This is a temporary post for collecting data. Not for posting and not for publishing. Saved only as readable for the editors. Not clickable and not downloadable.
মুক্তিযুদ্ধে টাঙ্গাইল
তপন কুমার দে
দক্ষিণ টাঙ্গাইলের উপনির্বাচনও শামসুল হকের ঐতিহাসিক বিজয়
১৯৪৯ সালের ২৬শে এপ্রিল টাঙ্গাইল-এ পূর্ব বাংলার প্রথম উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। খাজা নাজিমুদ্দিন তখন পূর্ব বাংলার মূখ্যমন্ত্রী। নির্বাচনে ক্ষমতাসীন মুসলীম লীগ সরকারের দলীয় প্রার্থী ছিলেন টাঙ্গাইলের প্রখ্যাত জমিদার খুররম খান পন্নী আর উদীয়মান তরুণ যুবনেতা শামসুল হক ছিলেন ওয়ার্কার্স ক্যাম্পের প্রার্থী। এ দু’জন ছাড়াও প্রার্থী ছিলেন আমির আলী খাঁ মােক্তার এবং আব্দুল জলিল এম.এ। এই নির্বাচনী এলাকা ছিল দক্ষিণ টাঙ্গাইলের তিনটি থানা নিয়ে গঠিত। থানা তিনটি নাগর পুর, মির্জাপুর ও বাসাইল। তিনটি থানাই ছিল জমিদারদের জমিদারীর অন্তর্ভূক্ত। এলাকার প্রায় সমস্ত কৃষকই ছিল জমিদারদের প্রজা। তকালে প্রজারা জমিদারদের অত্যন্ত ভয় করতাে। প্রজাদের উপর জমিদারদের ছিল মারাত্মক প্রভাব। তখনও জমিদারী প্রথা বিদ্যমান ছিল। জমিদারদের প্রজারা মহা মনীষী মনে করতাে। যদি কোন সময় জমিদার তার জমিদারী এলাকার প্রজাদের মাঝে যেতেন তাহলে তখন সেখানে এক আনন্দের ঢেউ বইত। জমিদারকে প্রজাদের মাঝে পেয়ে যেন তারা আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়তাে। প্রজারা বিভিন্ন প্রকার মূল্যবান উপহার সামগ্রী দিয়ে জমিদারকে বরণ করতে বা সম্মান প্রদর্শন করতাে। জমিদারকে প্রজারা টাকা দিয়ে মালা বানিয়ে গলায় পরিয়ে দিতাে। এমনি অবস্থায় জমিদার পুত্রের বিরুদ্ধে প্রার্থী। হন কৃষক প্রজার সন্তান যুব নেতা শামসুল হক। এ ছিল তৎকালে এক অস্বাভাবিক ব্যাপার । মুসলিম লীগ দলীয় প্রার্থী খুররাম খান পন্নী নিজে ছিলেন জমিদার। তার ছিল অগাধ ধন সম্পদ। আবার সরকারী দলের প্রার্থী সরকারও প্রচুর অর্থ ব্যয় করে তার নির্বাচনে । জমিদারী প্রভাব এবং সরকারী প্রভাবের সামনে একজন কৃষক সন্তান-এর পক্ষে বিজয় অর্জন করা ছিল সত্যি এক ঐতিহাসিক বিষয়। যদিও শামসুল হক কৃষক সন্তান ছিলেন, কিন্তু তার প্রভাবের পাল্লাই ভারী হয়ে পড়ে। কৃষক সন্তানের প্রতি কৃষক প্রজার কি দরদ ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় শামসুল হক আর খুররাম খান পন্নীর নির্বাচনে। নির্বাচন পরিচালনার জন্যে ঢাকা হতে যে সমস্ত নেতারা আসেন তাদের মধ্যে ছিলেন খন্দকার মােস্তাক আহম্মেদ, কামরুদ্দিন আহম্মেদ, মােহাম্মদ আসলাম, মােহাম্মদ আউয়াল, শওকত আলী, আজিজ আহম্মেদ, সামসুজ্জোহা সহ আরাে অনেকে। ঢাকার বাহির হতে বিশেষ করে ময়মনসিংহ, জামালপুর, শেরপুর হতে প্রচুর মুসলীম লীগ বিরােধী কর্মীরা শামসুল হকের পক্ষে, নির্বাচনী প্রচরণা চালানাের জন্যে টাঙ্গাইলে আসেন। এই সময় শেখ মুজিবুর রহমান জেলে বন্দী ছিলেন। তিনি বন্দী অবস্থায়ই তার সমর্থকদের নিদের্শ দেন শামসুল হকের নির্বাচনে কাজ করার জন্য। শেখ মুজিবুর রহমান-এর নির্দেশে দেশের বিভিন্ন স্থান হতে ব্যাপক যুবক নির্বাচনী প্রচারণার জন্যে টাঙ্গাইলে আসে। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু ছাত্র শামসুল হকের পক্ষে নির্বাচনী তৎপরতা চালানাের জন্যে টাঙ্গাইল আসে। বিভিন্ন স্থানের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা ও কর্মীদের সমাবেশ দেখে
১২
টাঙ্গাইলবাসী ব্যাপক সাহস আর উৎসাহ উদ্দীপনা পায়। নির্বাচনে টাঙ্গাইলের নেতৃস্থানীয়দের মধ্যে সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন জনাব হযরত আলী ও বদিউজ্জামান খাঁ। নির্বাচন পরিচালনার জন্যে তখনকার দিনেও কম বেশী টাকার প্রয়ােজন ছিল। তার উপর আবার জমিদার ও ক্ষমতাসীন দলের বিপক্ষে। প্রথম দিকে অর্থের অভাব দেখা দিলেও পরে আর টাকার তেমন অভাব হয়নি। যখন শামসুল হকের নির্বাচনে অংশগ্রহণের কথা প্রচার হয়ে পড়ে তখন বিভিন্ন স্থান হতে বিভিন্ন ব্যক্তি টাকা নিয়ে এগিয়ে আসেন তাকে সাহায্য করার জন্যে। শামসুল হক যখন নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে নাম ঘােষণা দেন তখন তার পকেটে ছিল মাত্র চৌদ্দ পয়সা। কিন্তু নির্বাচনী তৎপরতা শুরু হওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই নারায়ণগঞ্জের আলমাস সাহেব তার এলাকা হতে পাঁচশত টাকা পাঠান। চেম্বার অব কর্মাসের সাখাওয়াত হােসেন পাঠান পঞ্চাশ টাকা, আতাউর রহমান খান পঞ্চাশ টাকা, কাদের সর্দার এক শত পঞ্চাশ টাকা দেন। আরাে কিছু কর্মীদের টাকা নিয়ে সর্বমােট তেরশ’ টাকার তহবিল গঠন করা হয়। খুররম খান পন্নীর টাকার কাছে এই তেরশ’ টাকা ছিল অত্যন্ত নগণ্য। কিন্তু তা সত্ত্বেও নির্বাচনের ক্ষেত্রে টাকার তেমন অভাব দেখা দেয়নি। বহু প্রেসের মালিক শামসুল হকের পক্ষে নির্বাচনী বিজ্ঞাপন ছাপিয়ে দেওয়ার জন্যে এগিয়ে আসেন। তারা বলেন শামসুল হকের বিজ্ঞাপন ছাপানাের জন্যে কোন প্রকার টাকা পয়সার প্রয়ােজন হবে না। শুধু মাত্র কাগজের দাম দিলেই চলবে। অনেক প্রেস মালিকরা আবার কাগজের দামও নিতেন না। কয়েক দিনের মধ্যে হাজার হাজার বিজ্ঞাপন ছাপানাে হলাে। নির্বাচনের সাত আট দিন আগে হতেই পূর্ব বাংলার বিভিন্ন জেলা হতে এক টাকা, দুই টাকা, পাঁচ টাকা, দশ টাকা করে সাহায্য আসতে লাগলাে । এমনকি অনেক মেয়ে নিজেদের কানের রিং, হাতের চুড়ি প্রভৃতি পাঠাতে শুরু করে। তাদের অনুরােধ ছিল এগুলাে বিক্রি করে নির্বাচনের খরচ চালাতে । সবচেয়ে মজার ব্যাপার ঘটে খুররম খান পন্নীর স্ত্রীও শামসুল হককে তার নির্বাচনের জন্যে টাকা সাহায্য দেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। কিন্তু শামসুল হক, পন্নী সাহেবের স্ত্রীর টাকা নিতে অস্বীকৃতি জানান। নির্বাচনে শামসুল হকের জন্যে যেমনি টাকা পয়সা নিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তি এগিয়ে আসেন, তেমনি নির্বাচনী কাজ করার জন্যে এলাকার ব্যাপক কর্মী বাহিনী এগিয়ে আসে উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে । তখনকার দিনে শামসুল হকের নির্বাচনে যে ব্যাপক কর্মী বাহিনী গড়ে উঠেছিল তা অন্য কোন ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব ছিল না। খুররম খান পন্নীদের প্রতিষ্ঠিত করটিয়া সাদত কলেজের বহু ছাত্রসহ এলাকার বিভিন্ন স্কুলের বহু ছাত্র শামসুল হকের নির্বাচনে অক্লান্ত পরিশ্রম করে। এই সমস্ত ছাত্ররা সারা দিন না খেয়ে, পায়ে হেটে নির্বাচনী এলাকার বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচন্ডভাবে সরকার বিরােধী প্রচারণা চালায়। সরকারী দলের সভা সমাবেশে দলে দলে যােগদান করে বহু সভা সমাবেশকে বিরােধী দলের সভা সমাবেশে পরিণত করে। এ ধরণের কয়েকটি জনসভায় শামসুল হক প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমীনসহ অন্যান্যদের উপস্থিতিতে সরকারের বিভিন্ন বিষয়ে চ্যালেঞ্জ করেন এবং তাদের গণবিরােধী নীতিমালার তীব্র সমলােচনা করেন ও সরকারের বিরুদ্ধে প্রচন্ড বিক্ষোভের সৃষ্টি করেন। নাগরপুরের একটি জনসভায় শামসুল হক সাহেব বক্তব্য রাখেন। এই জনসভাটি ছিল মূলত মুসলিম লীগ দলীয় প্রার্থী খুররম খান পন্নীর। পন্নী সাহেবের জনসভায় পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমীনসহ পাঁচজন মন্ত্রী ও এলাকার বেশ কিছু নেতা উপস্থিত ছিলেন। নূরুল আমীন সাহেব ছিলেন সভার সভাপতি। সভা অনুষ্ঠানের বেশ কয়েকদিন আগে থেকে মাইক যােগে ব্যাপক প্রচার করার ফলে জনসভায় প্রচুর জনসমাবেশ ঘটে। সভা যথা সময়ে শুরু হয়। খুররম খান পন্নী ও মন্ত্রী
১৩
বাহাদুররা বক্তব্য শেষ করেছেন। এবার বক্তব্য রাখার পালা সভার সভাপতি পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমীনের । তিনি যখন বক্তব্য শুরু করেছেন এমন সময় সভাস্থলে শামসুল হক সাইকেল যােগে বেশ কয়েক জন কর্মী সঙ্গে নিয়ে উপস্থিত হন। তাঁকে দেখামাত্র সভার লােকজন শামসুল হক জিন্দাবাদ ধ্বনি দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। তারা চিৎকার করে বলতে থাকে যে, এখনি আমরা শামসুল হকের ভাষণ শুনবাে। নূরুল আমীনসহ অন্যান্য মন্ত্রীরা জনতাকে শান্ত করার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করেন। কিন্তু জনতা তাদের কথা না শুনে আরাে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। অসংখ্য জনতা যখন সভাস্থলে মারাত্মক বিশৃংখলার সৃষ্টি করছে ঠিক সেই সময় শামসুল হক সভামঞ্চে উঠেন এবং জনতাকে শান্ত হওয়ার অনুরােধ করেন। জনতা শামসুল হকের অনুরােধ করা মাত্র শান্ত হয়ে বসে। এরপর শামসুল হক তার বক্তব্য রাখা শুরু করেন। শামসুল হকের বক্তব্য শুরু করা দেখে নূরুল আমীন ও পন্নী সাহেবসহ সমস্ত সরকার দলীয় লােকজন তাড়াতাড়ি করে সভাস্থান ত্যাগ করেন। সরকারী দলের মন্ত্রী বাহাদুররা চলে গেলেও কিন্তু সাধারণ মানুষ একজনও চলে গেল না। তারা আরাে শামসুল হকের বক্তব্য শােনার জন্য ধৈর্য্য ধরে শান্তভাবে বসে পড়ে। তারপর এই জনসভায় শামসুল হক প্রায় দুই ঘন্টা সময় বক্তব্য রাখেন। সরকার পক্ষের লােকেরা এরপর বাশাইলে একটি জনসভার আয়ােজন করে। এই জনসভাটি ছিল সমস্ত জনসভার চেয়ে বড় আকারের একটি জনসভা। এই বাশাইলেই খুররম খান পন্নীর বাড়ী। তার বাড়ীর অতি নিকটে বলেই সম্ভত জনসভায় প্রচুর লােকের সমাবেশ ঘটে। এই সভায় নূরুল আমীন ও খুররম খান পন্নীসহ পাঁচ-সাতজন মন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন। সভার কাজ যথা সময়ে শুরু হয়। সভায় বেশ কয়েকজন বক্তব্য রাখেন এবং নূরুল আমীন ও পন্নী সাহেব বক্তব্য রাখার বাকী আছেন। এমন সময় শামসুল হক দুই জন কর্মীসহ সভা স্থলের অদূরে মাঠের এক কোণে এসে দাঁড়ান। শামসুল হক আসামাত্র জনতার দৃষ্টিতে পড়ে যান। তাকে দেখা মাত্রই জনতার মাঝে আলােচনা শুরু হয়ে যায়। ঐ আমাদের শামসুল হক আসছেন। তারপর ধ্বনি উঠতে থাকে শামসুল হক জিন্দাবাদ। প্রায় দেখতে দেখতে সামান্য সময়ের মধ্যে জনতা সভা ভেঙ্গে শামসুল হককে চারিদিকে ঘিরে ধরে। তখন নূরুল আমীন জনতাকে শান্ত হয়ে সভাস্থলে বসার অনুরােধ করেন। কিন্তু তার অনুরােধের প্রতি কর্ণপাত না করে সভাস্থল খালি করে সমস্ত জনতা শামসুল হকের কাছে ভিড় জমায়। এ সময় জনৈক কর্মী নূরুল আমীনের সামনে থেকে মাইক টান দিয়ে সরিয়ে আনেন। তখন মুসলিম লীগের এক কর্মী ঐ কর্মীকে আক্রমণ করে। সঙ্গে সঙ্গে শত শত লােক এসে মুসলিম লীগের ঐ আক্রমণকারী কর্মীকে মারপিট করে টেনে হিচড়ে মাঠে নামিয়ে আনে। অবস্থা বেগতিক দেখে নূরুল আমীন ও পন্নী সাহেব তাড়াতাড়ি করে সভাস্থল ত্যাগ করেন। তারপর শামসুল হক সেখানে বক্তব্য রাখেন। তার বক্তব্যে মুসলিম লীগ সরকারের সকল প্রকার দুর্নীতি ও ষড়যন্ত্রের প্রতিরােধ করে বাঙ্গালীর ন্যায্য পাওনা আদায়ের জন্যে তাকে ভােট দেওয়ার অনুরােধ করেন। শামসুল হকের বক্তব্য শুনার পর সভার লােকজন মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে তুলার শপথ নেয়। তারা মুসলিম লীগ প্রার্থী খুররম খান পন্নীকে ভােট না দিয়ে তাকে ভােট দেওয়ার প্রতিশ্রুতি প্রদান করে। সরকারী দলের লােকজন বা মন্ত্রী বাহদুররা শুধুমাত্র এ দু’স্থানেই অপমাণিত হয়নি। তারা যেখানেই জনসভা বা নির্বাচনী প্রচার চালাতে গেছেন সেখানেই জনসাধারণের নিকট নাস্তানাবুদ হয়েছেন। একদিন নূরুল আমীন কয়েকজন মন্ত্রী ও পন্নীকে নিয়ে টাঙ্গাইল শহরের এক বাসায়, এলাকার বেশ কিছু নেতৃস্থানীয় লােকজনের সঙ্গে নির্বাচন বিষয়ে আলাপ আলােচনা করছিলেন। এমন সময় কিছু সংখ্যক যুবক নূরুল আমীনের গাড়িটা উল্টিয়ে ফেলে দেয়। শামসুল হক এ সময়ে টাঙ্গাইল শহরে
১৪
ছিলেন না। তিনি নির্বাচনী প্রচারে শহরের বাইরে ছিলেন। নির্বাচনী আলাপ আলােচনা শেষ করে নূরুল আমীন সাহেব যখন সরকারী লােকজনের সাহায্যে গাড়ি তুলে চলে যাচ্ছেন তখন তার গাড়িটা শামসুল হকের নির্বাচনী অফিসের কাছে আসামাত্র গাড়ির সামনে গরুর গাড়ি দিয়ে গতিরােধ করে একদল জনতা। সামান্য সময়ের মধ্যে শত শত লােকজন এসে রাস্তা বন্ধ করে দেয়। নূরুল আমীন সাহেব গাড়ি নিয়ে পিছিয়ে যাবেন সে উপায়ও নেই। ইতিমধ্যে বদিউজ্জামান খাঁ এই জনসমাবেশে বক্তব্য রাখতে শুরু করেন। তিনি তার বক্তব্যে মুসলিম লীগ সরকারের প্রচন্ড সমালােচনা করেন এবং সরকারের সকল প্রকার দুর্নীতি অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে জনতাকে প্রতিরােধ গড়ে তােলার অনুরােধ করেন। বক্তব্যের এক পর্যায়ে তিনি নূরুল আমীনকে চ্যালেঞ্জ করে বলেন, নিয়ে আসেন যেন আপনার খুররম খান পন্নীকে, নির্বাচনী বৈতরনী পার করে আমরাও দেখিয়ে দেব। এইভাবে প্রায় এক ঘন্টা সময় বক্তব্য শুনাননার পর নূরুল আমীন ও অন্যান্য মন্ত্রীদের ছেড়ে দেয়া হয়। শামসুল হক নির্বাচনী প্রচারণার জন্যে যেখানেই যেতেন সেখানেই প্রচুর লােকের সমাবেশ হতাে। তাকে দেখার জন্যে লােকজন এসে তার চারপাশে ভীড় জমাতাে। লােকজন একে অপরকে জিজ্ঞাসা করত, শামসুল হক, কোন শামসুল হক? মাইঠানের শামসুল হক? আমাদের কৃষকের সন্তান শামসুল হক? জনতা শামসুল হকের কাছে এসে বলতাে তাদের কাছে আর কষ্ট করে ভােট চাওয়ার জন্যে আসতে হবে না। তারা শামসুল হককেই ভােট দিবে। এমনও অনেক সময় দেখা গেছে শামসুল হক নির্বাচনী প্রচার কার্য শেষ করে ফিরছেন, দেখা গেল শত শত লােক হারিকেন ও কুপি হাতে রাস্তার ধারে বসে আছে শামসুল হককে দেখার জন্য। তারা তাকে দেখার জন্য অনেক সময় রাস্তায় বসে থাকতাে। শামসুল হকের প্রতি এলাকার জনসাধারণের ছিল অত্যন্ত দরদ। তার যে কোন বিপদে সর্বস্তরের জনসাধারণ সহযােগিতা করার জন্য সর্বদা ব্যস্ত থাকতাে। তারা যেনাে শামসুল হককে একটু সাহায্য করে নিজেদের অত্যন্ত ধন্য মনে করতাে। একবার শামসুল হকের জীপ গাড়ি কাঁচা রাস্তার ধারে পড়ে যায়। দেখামাত্র আশেপাশের ক্ষেত খামারের কর্মরত কৃষকরা দৌড়ে আসে গাড়ি রাস্তায় তােলার জন্যে। কোন লােকজনকে এ কাজের জন্যে শামসুল হকের ডাকার প্রয়ােজন হয়নি। কারণ বলার আগেই তার গাড়ি তােলা শেষ হয়ে যায়। ঐ জীপ গাড়িটিও ছিল তার এক বন্ধুর দেয়া। এলাকার রাস্তাঘাট অধিকাংশ কাঁচা থাকায় অনেক সময় সরকারী পক্ষের বা জমিদার পুত্র খুররম খান পন্নীর গাড়িও রাস্তায় আটকা পড়তাে। তখন রাস্তার ধারে গাড়ি আটক দেখে জনসাধারণ দৌড়ে আসতাে। কিন্তু যখন দেখতাে গাড়ি সরকার পক্ষের তখন তারা যেভাবে আসততা সেইভাবেই চলে যেতাে। অনুরােধ করা সত্ত্বেও সরকারী দলের লােকজনদের গাড়ি তােলার কাজে কোন প্রকার সাহায্য না করে আরও চেষ্টা করতাে গাড়ি যাতে উঠাতে না পারে। শামসুল হকের এতাে জনপ্রিয়তার কারণেই ঐ নির্বাচনে বিজয় অর্জন করা সম্ভব হয়েছিল। তার প্রতি জনসাধারনের অগাধ ভালবাসা ছিল বলেই সরকার দলের সকল প্রকার অপপ্রচার ও ভয়ভীতি উপেক্ষা করে তারা তাকে ভােট দিয়েছে। এই নির্বাচনের সময় পূর্ব বাংলার মূখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন নিজে পুলিশের আইজিকে সঙ্গে নিয়ে টাঙ্গাইল এসে ক্ষমতার প্রভাব খাটান। প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমীনও আরাে পাঁচ-সাত জন মন্ত্রী নিয়ে প্রশাসনের উপর প্রচন্ডভাবে প্রভাব খাটান। তবুও জনসাধারণ এবং ভােটারদের পক্ষে আনা সম্ভব হয়নি। সরকারী দল বিভিন্নভাবে অর্থ সম্পদের লােভও অনেককে দেখিয়েছেন। কিন্তু কোন প্রকার লােভনীয় ফাঁদে এলাকার ভােটাররা পা বাড়ায়নি। ভয়ভীতি লােভ লালসা দেখানাের পাশাপাশি তারা বিভিন্ন ধরনের অপপ্রচার চালান অশিক্ষিত জনসাধারণকে ধোঁকা
১৫
দেওয়ার জন্যে। সরকার বিভিন্ন স্থান হতে কাঠ মােল্লাদের ভাড়া করে এনে ধর্মের দোহাই দিয়ে জনসাধারণের নিকট থেকে ভােট আদায় করার চেষ্টা করে। মােল্লা সাহেবরা অশিক্ষিত লােকজনদের বুঝান শামসুল হককে ভােট দেওয়া মানে কাফেরকে ভােট দেওয়া। শামসুল হক বিধর্মী, তাকে ভােট দেওয়া মানে বিধর্মীকে ভােট দেওয়া। সে ইসলামের দুশমন। কাজেই তাকে ভােট দেওয়া উচিত হবে না। শামসুল হক ভারতের দালাল। তাকে ভােট দিলে পূর্ব পাকিস্তানকে হিন্দুস্তানে পরিণত করবে। পাকিস্তান রক্ষার দায়িত্ব প্রতিটি মুসলমানের। আর সেই পাকিস্তান রক্ষার প্রশ্নে মুসলিম লীগের প্রার্থী খুররম খান পন্নীকে সাইকেল মার্কায় ভােট দিতে হবে। এ ধরনের বক্তব্য শুধু মাত্র কাঠ মােল্লারাই দিত না, বিভিন্ন স্থানে সভাসমাবেশে স্বয়ং খাজা নাজিমুদ্দিন ও নূরুল আমিনসহ মন্ত্রীরাও দিতেন। সভাসমাবেশে বক্তব্য দেওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন পত্র পত্রিকায়ও সরকারের পক্ষে এবং শামসুল হকের বিপক্ষে প্রচন্ড অপপ্রচার চালাননা হয়।
সকল প্রকার ভয়ভীতি লােভ লালসা এবং অপপ্রচারের পরও দক্ষিণ টাঙ্গাইলবাসী ব্যাপক ভােটের ব্যবধানে শামসুল হককে বিজয়ী করে এবং প্রখ্যাত জমিদার খুররম খান পন্নীকে পরাজিত করে। করটিয়ার জমিদার পরিবারের প্রার্থীকে একমাত্র শামসুল হকের পক্ষেই পরাজিত করা সম্ভব হয়েছিল।
১৯৪৯ সালের ২৬শে এপ্রিলের নির্বাচনে শামসুল হকের বিজয় অর্জন ও মুসলিম লীগ প্রার্থী খুররম খান পন্নীর পরাজয় বরণ করা ছিল তৎকালীন পাকিস্তানের রাজনৈতিক অঙ্গনে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এই নির্বাচনে মুসলীম লীগের পরাজয় একদিকে লীগ সরকারকে ভাবিয়ে তুলে। অন্যদিকে লীগ বিরােধী শক্তিকে আন্দোলন করার মারাত্মক উৎসাহ উদ্দীপনা সৃষ্টি করে। পন্নী সাহেবের পরাজয় শুধু মাত্র তার নিজের পরাজয় ছিল না। এ পরাজয় ছিল মুসলিম লীগ মন্ত্রী পরিষদের। আবার নির্বাচনে শামসুল হকের বিজয় শুধুমাত্র তার নিজের বিজয় ছিল না। এ বিজয় ছিল মুসলীম লীগ বিরােধী প্রগতিশীল শক্তির। এ বিজয় ছিল বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী শক্তির বিজয়। ১৯৪৯ সালের ২৬শে এপ্রিলের নির্বাচন ও ভাষা আন্দোলনে এদেশের নিপীড়িত, শােষিত, বঞ্চিত মানুষ যেমনি একদিকে নিজেদের আত্মশক্তি সম্পর্কে সচেতন হতে পেরেছিল অন্যদিকে লীগ সরকারের পক্ষে তাদের দুর্বলতাও ধরা পড়েছিল। যে কোন বিচারেই এ বিজয় ছিল এক ঐতিহাসিক আলােড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা। এ বিজয় সম্পর্কে মুসলিম লীগ সরকার নিয়ন্ত্রিত পত্রিকা দৈনিক আজাদের ভাষা প্রনিধানযােগ্য। আজাদের সম্পাদকীয়তে বলা হয়—টাঙ্গাইল-এর পরাজয়কে এক প্রকান্ড বিপদ সংকেত বলে সকলকে আজ গ্রহণ করতে হবে। মুসলীম লীগের বিরুদ্ধে উত্তোলিত বিদ্রোহের পতাকা একদিন সমগ্র পাকিস্তানকে আচ্ছন্ন করবে কিনা, লীগ এবং পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হবে কিনা, বিধ্বংস হবে কিনা একথাও হয়তাে এখন থেকেই চিন্তা করতে হবে।
১৯৪৯ সালের ২৬শে এপ্রিল-এর নির্বাচনের বিজয়কে কেন্দ্র করেই পরবর্তীতে এদেশের বিরােধী শক্তি সংগঠিতভাবে আত্মপ্রকাশ করে এবং বিজয়ী বীর শামসুল হকের নেতৃত্বেই তৎকালীন পাকিস্তানের সর্বপ্রথম বিরােধী রাজনৈতিক দল আওয়ামী মুসলীম লীগ গঠিত হয়, যা আজ আওয়ামী লীগ নামে পরিচিত। ১৯৪৯ সালে এদেশে আওয়ামী মুসলীম লীগের প্রতিষ্ঠা না হলে বাংলার স্বাধীনতা অর্জন করা সম্ভব হতাে না। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা এবং তার দীর্ঘদিনের বহু আন্দোলন সংগ্রাম আর রক্ত দানের মাধ্যমেই ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামের ফসল, স্বাধীন দেশের জন্ম হয়েছে। জন্ম হয়েছে একটি স্বাধীন জাতির। জন্ম হয়েছে মহান স্বাধীন বাংলাদেশের।
১৬
একথা বললে মনে হয় ভুল হবে না যে, মহান স্বাধীনতা সগ্রামের শুভ সূচনা হয়েছিল ১৯৪৯ সালের ২৬শে এপ্রিলের দক্ষিণ টাঙ্গাইলের উপনির্বাচনে, শামসুল হকের বিজয়কে কেন্দ্র করেই। অর্থাৎ আমরা ১৯৭১ সালে যে স্বাধীনতা অর্জন করেছি, তার ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল ১৯৪৯ সালের দক্ষিণ টাঙ্গাইলের উপনির্বাচনে।
শামসুল হকের নির্বাচনােত্তর বিভিন্ন স্থানে সম্বর্ধনা
১৯৪৯ সালের ২৬শে এপ্রিল নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত নির্বাচনে যুবনেতা শামসুল হক বিপুল ভােটের ব্যবধানে মুসলিম লীগ দলীয় প্রার্থী খুররম খান পন্নীকে পরাজিত করেন। শামসুল হকের বিজয়কে কেন্দ্র করে শুধুমাত্র টাঙ্গাইল নয়, ঢাকায়ও বিজয় উৎসব শুরু হয়। আর এই বিজয় উৎসব পালন করা হয় বিভিন্ন স্থানে শামসুল হককে সম্বর্ধনা দিয়ে। এই সমস্ত সম্বর্ধনার মধ্যে সবচেয়ে বিশাল আকারের ছিল ঢাকার সম্বর্ধনা এবং তার নিজ গ্রাম টেউরিয়ার সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানটি। ২৬শে এপ্রিল নির্বাচনের কয়েকদিন পর এই সম্বর্ধনা সভাতে হাজার হাজার লােকের সমাবেশ ঘটে। পল্লী গ্রামে ঐ ধরনের বিরাট সমাবেশ হওয়া অত্যন্ত অস্বাভাবিক ব্যাপার। সম্বর্ধনা সভাতে শামসুল হক দীর্ঘ সময় বক্তব্য রাখেন। তিনি বক্তব্যের প্রথমেই জনসাধারণকে অভিনন্দন জানান তাকে ভােট দেওয়ার জন্য। তিনি নির্বাচনে সকল স্তরের কর্মী ও সমর্থকদের অক্লান্ত কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকারের জন্য ভূয়সী প্রশংসা করেন। তিনি তার বক্তব্যে উল্লেখ করেন যে পাকিস্তানী শাসকদের বৈষম্যমূলক শাসন ও শােষনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক দলের প্রয়ােজন। কারণ মুসলীম লীগ সরকার বাংলার মানুষকে শাসন করবে, শােষণ করবে। বাংলার মানুষের উন্নয়নের জন্য কোন কাজ করবে না। তারা বাংলার মানুষের উন্নয়নের জন্য কোন কাজ করবে না তারা বাংলার মানুষকে পঙ্গু করে ছাড়বে। কাজেই মুসলীম লীগ সরকারের শাসন ও শােষণের হাত হতে বাঁচার তাগিদেই আজ আমাদের সংগঠিত হতে হবে। আর আমাদের সংগঠিত হওয়ার প্রশ্নেই রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তুলতে হবে। শামসুল হক আরাে বলেন, হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর সঙ্গে আমার আলাপ আলােচনা হয়েছে এবং তাকে সভাপতি করে আমরা একটি নতুন রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তুলবাে। তার সুদীর্ঘ বক্তব্য শুনার পর জনমনে মুসলীম লীগ বিরােধী নতুন রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়। এখান থেকেই নতুন রাজনৈতিক দল গড়ে তুললে যে এদেশের গণমানুষের সমর্থন পাওয়া যাবে তার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। নতুন রাজনৈতিক সংগঠন গড়ার ব্যাপারে জনমনে উৎসাহ উদ্দীপনা দেখে শামসুল হকেরও প্রচন্ড আত্মবিশ্বাস জাগে। এদিক দিয়ে বিচার করে বলা চলে বিরােধী দল গঠনের পিছনে টেউরিয়া গ্রামের সম্বর্ধনার যথেষ্ট গুরুত্ব আছে। বিজয়ী শামসুল হককে ১৯৪৯ সালের ৮ই মে ঢাকায় সর্বস্তরের মানুষের পক্ষ থেকে এক বিরাট সম্বর্ধনা দেওয়া হয়। এই সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানটি ছিল একটি ঐতিহাসিক সম্বর্ধনা সভা। সম্বর্ধনার দিন ঢাকা শহর এক উৎসবের নগরীতে পরিণত হয়েছিল। চারদিক থেকে মিছিল করে খুব ভাের হতেই হাজার হাজার মানুষ ভীড় জমাতে থাকে। শামসুল হক বেলা ১১টার সময় ঢাকা স্টেশনে পৌঁছলে তাঁকে হাজার হাজার মানুষ বিপুল সম্বর্ধনা প্রদান করে। স্টেশনে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে হাজার হাজার মানুষের কষ্ঠে ‘আল্লাহু আকবর’ ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ, শামসুল হক জিন্দাবাদ,’ ধ্বনিতে আকাশ বাতাসকে
১৭
কাঁপিয়ে তুলে। ধ্বনির সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের বাদ্যযন্ত্রের আওয়াজ ও বােমা পটকার আওয়াজ ঢাকা শহরের পরিবেশকে মুখরিত করে তুলে। স্টেশনেই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং নাগরিকদের পক্ষ হতে শামসুল হককে পুষ্পমাল্য প্রদান করা হয়। এরপর সুশােভিত মােটর গাড়ীতে শামসুল হককে নিয়ে এক বিশাল মিছিল, সম্বর্ধনার স্থান ভিক্টোরিয়া পার্কে উপস্থিত হয়। মিছিলের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন শওকত আলী, কামরুদ্দীন আহম্মেদ, আতাউর রহমান খান, আলী আমজাদ খানসহ আরাে অনেকে। এত বড় মিছিল ঢাকাবাসী অতীতে আর দেখেনি বলে অনেকের ধারণা। বেলা একটার সময় সম্বর্ধনার কাজ যথারীতি শুরু করা হয়। সভার সভাপতির আসন গ্রহণ করেন ইয়ার মােহাম্মদ সাহেব। সভাপতির আসন গ্রহণের পর পূর্ব বাংলা চেম্বার অব ফেডারেশনের সদস্য খন্দকার মুস্তাক আহম্মেদ, ঢাকা সেন্ট্রাল ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক জনাব শামসুল হকসহ আরাে কয়েকজন ঢাকার গণ্যমাণ্য ব্যক্তি বক্তব্য রাখেন। সর্বশেষে বক্তব্য রাখেন নবনির্বাচিত বিজয়ী বীর জনাব শামসুল হক। তিনি যখন ভাষণ দেওয়ার জন্য মাইকের সামনে দাঁড়ান তখন বিপুল করতালি আর শামসুল হক জিন্দাবাদ’ ধ্বনিতে সম্বর্ধনার স্থানকে প্রকম্পিত করে তুলে। তিনি এই সম্বর্ধনা সভায় প্রায় দেড় ঘন্টা ব্যাপী বক্তব্য রাখেন। তিনি মুসলিম লীগ সরকারের সকল প্রকার বৈষম্য মূলক শাসন নীতি তুলে ধরেন। সম্বর্ধনা সভায় শপথ নিয়ে তিনি বলেন, ‘শােষিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত, মানুষের দাবি আইন পরিষদে তুলে ধরাই আমার প্রধান দায়িত্ব। আমি বিশ্বাস করি এ ব্যাপারে আমার কষ্ঠে শক্তির অভাব হবে না। শামসুল হক বক্তৃতার উপসংহারে বলেন, দেশে আজ যে অসংখ্য সমস্যা দেখা দিয়েছে তার কোনটা থেকে কোনটা বিচ্ছিন্ন নয়। এই সমস্ত সমস্যার সমাধান করতে হবে কিন্তু সবার আগে নজর দিতে হবে পল্লীর কোটি কোটি ভূখা, বঞ্চিত চাষী ভাইদের দিকে। কারণ সমাজের প্রাণ তারা। শামসুল হক তার বক্তব্যে এখানেও বলেন পাকিস্তানী মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে হলে আমাদের নতুন রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর সেই রাজনৈতিক দলের মাধ্যমেই বাংলার মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাতে হবে। শামসুল হকের এ সম্বর্ধনা সভাটিও মুসলিম লীগ সরকার বানচাল করার চেষ্টা করেন। সরকার পক্ষ থেকে টাকা দিয়ে, মাজেদ সরদার নামক একজন গুন্ডাকে সম্বর্ধনা সভা পন্ড করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই সংবাদ পাওয়ার পর শওকত আলী, কামরুদ্দীন আহম্মেদ, আতাউর রহমান খান, ক্যাপ্টেন শাহাজাহানের সঙ্গে দেখা করেন এবং পরিস্থিতি সম্পর্কে আলাপ আলােচনা করেন। পরে লতিফুর রহমানের প্রচেষ্টায় মাজেদ সরদাররা আর সম্বর্ধনা সভা পন্ড করতে যাওয়ার সাহস পায়নি। পরবর্তীতে মাজেদ সরদার স্বীকার করেছেন মুসলিম লীগ সরকারের পক্ষ থেকে তাকে সম্বর্ধনা সভা পন্ড করার জন্য টাকা দেওয়া হয়েছিল।
পাকিস্তান সরকারের ষড়যন্দ্রে শামসুল হকের
সদস্যপদ বাতিল
নির্বাচিত হওয়া সত্ত্বেও কিন্তু শামসুল হককে পূর্ব বাংলা ব্যবস্থাপক সভায় আসন গ্রহণ করতে দেয়া হয়নি। মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর মতাে তার বিরুদ্ধেও একটি নির্বাচনী মামলা দায়ের করা হয়। পূর্ব পাকিস্তান সরকার বিচারপতি আমিনউদ্দিন আহমেদ, এনায়েতুর রহমান এবং
১৮
শহরউদ্দিনকে নিয়ে একটি বিশেষ ট্রাইবুনাল গঠন করেন এবং সেই ট্রাইবুনালের উপর নির্বাচনী মামলাটি পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। ট্রাইবুনাল তাদের প্রথম বৈঠকেই স্থির করেন যে, মামলাটির নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচিত প্রতিনিধি শামসুল হক ব্যবস্থাপক সভায় আসন গ্রহণ করতে পারবেন না। একটি নির্বাচনী ইস্তাহারকে ভিত্তি করে দক্ষিণ টাঙ্গাইল নির্বাচনে বিজয়ী শামসুল হকের বিরুদ্ধে মামলাটি দায়ের করা হয়। মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী আসাম থেকে চলে এসে টাঙ্গাইল শহরের দক্ষিণ পশ্চিম দিকে অতি নিকট গ্রাম সন্তোষে বসবাস শুরু করেন এবং টাঙ্গাইলে থেকেই পূর্বপাকিস্তান ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন। সেই নির্বাচন বাতিল হবার পর বন্ধু-বান্ধব ও মুরিদদের সঙ্গে দেখা করার জন্য তিনি আসাম প্রদেশের ধুবরী শহরে উপস্থিত হলে আসাম সরকার মার্চ মাসের মাঝামাঝি তাকে গ্রেপ্তার করে। টাঙ্গাইলের উপনির্বাচনের সময় মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ধুবরী জেলে অবস্থান করছিলেন। হযরত আলী নামের শামসুল হকের একজন সহকর্মী সেখানে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর সঙ্গে দেখা করে শামসুল হকের সপক্ষে একটি ইস্তাহারে তার স্বাক্ষর নিয়ে আসেন। নির্বাচনী প্রচারণার কাজে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর স্বাক্ষরযুক্ত সেই ইস্তাহার বিলি করা শুরু হলে কামরুদ্দিন আহমেদ তৎক্ষণাৎ সেগুলি বিলি বন্ধ করার নির্দেশ দিয়ে ছাপা ইস্তাহারগুলি নষ্ট করে দেন। কিন্তু তার আগেই বেশ কিছু সংখ্যক ইস্তাহার নির্বাচনী এলাকায় বিলি হয়ে গিয়েছিল। ইস্তাহারটিতে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর স্বাক্ষরের ফ্যাক্সিমিলি পর্যন্ত ব্লক করে দেয়া হয়েছিল। ইস্তাহারটির বিলি বন্ধ করার নির্দেশ সত্ত্বেও তার কপি মুসলিম লীগ কর্মী ও সরকারের পক্ষের লােকদের হস্তগত হয়। এবং নির্বাচনী ফলাফল ঘােষিত হবার পর এই মর্মে তারা শামসুল হকের নির্বাচনী বাতিলের আবেদন করে যে, নির্বাচনে তিনি মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর স্বাক্ষর জাল করে জয় লাভের উদ্দেশ্যে অসৎ পন্থা অবলম্বন করেছেন। তারা আরাে বলে যে, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর স্বাক্ষরযুক্ত ইস্তাহার যখন জেল কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অনুমােদিত হয়নি তখন সেই ইস্তাহার যে নিতান্তই জাল সেই বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। এই নির্বাচনী মামলা ১৯৫০ সাল পর্যন্ত চলে এবং হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী ট্রাইবুনালের সামনে শামসুল হকের পক্ষে সেই মামলা পরিচালনার উদ্দেশ্যে ঢাকা আসেন। সেই সময় ১৯শে জুলাই ১৯৫০ সালে পূর্বপাকিস্তান প্রাদেশিক সরকারের নির্দেশে স্বরাষ্ট্র দপ্তরের সেক্রেটারী তাকে জানান যে, ঢায় অবস্থান কালে তাকে নিজের কার্যাবলী ইলেকশান ট্রাইবুনালের ব্যাপারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাতে হবে। ঢাকা শহরের বাইরে তিনি অন্য কোন স্থানে যেতে অথবা কোন জনসভায় বক্তৃতা দান করতে পারবেন না। ট্রাইবুনালের কাজ শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে ২৮শে জুলাইয়ের মধ্যে তাকে পূর্বপাকিস্তান পরিত্যাগ করতে হবে এবং সরকারের এইসব নির্দেশ অমাণ্য করলে তাকে গ্রেপ্তার করারও প্রয়ােজন হতে পারে। প্রাদেশিক সরকারের এই নির্দেশ পাবার পর হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী সংবাদপত্র প্রতিনিধিদের বলেন যে, তিনি পাকিস্তানের উন্নতি ও মঙ্গল কামনা করেন এবং পূর্ব পাকিস্তান সরকার গণতন্ত্রের মূলনীতিকে কেন যে উপেক্ষা করে চলেছেন তার কারণ উপলব্ধি করতে তিনি অক্ষম। এক বৎসরের বেশি সময় কাল টাঙ্গাইল নির্বাচনী মামলা চলার পর তার রায় বের হয় এবং শামসুল হকের নির্বাচনকে ট্রাইবুনাল বাতিল ঘােষণা করেন।
১৯
আওয়ামী লীগের গােড়াপত্তনও শামসুল হক
বাংলাদেশের বর্তমানে প্রধান রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। আজ থেকে প্রায় ৫০ বৎসর পূর্বে এই দলের প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৪৯ সালের ২৩শে জুন। প্রতিষ্ঠাকালে দলটির নাম ছিল আওয়ামী মুসলিমলীগ। পরবর্তীতে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ নামে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। মুসলিম শব্দটি বাদ দেওয়া হয় দলটিকে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তােলার জন্য। সুদীর্ঘ দিন ধরে বহু আন্দোলন আর সংগ্রামের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানটি আজ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ নামে তার অস্তিত্ব ধরে আছে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পরই এদেশের কতিপয় প্রগতিশীল দেশ প্রেমিক রাজনৈতিক নেতা নতুন রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠার চিন্তা ভাবনা করেন। কারণ ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বাংলার মানুষের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয়নি। সুদীর্ঘদিনের আন্দোলনের পর ইংরেজ রাজত্বের অবসান হলেও বাংলার মানুষের ভাগ্যে পরাধীনতার গ্লানি রয়েই গেল। ইংরেজ বিদায়ের পর পশ্চিমা মুসলিম লীগ নেতারা বাংলার মানুষের প্রতি চরম বৈষম্যমূলক শাসন নীতি প্রনয়ন করে। তারা বাংলার মানুষকে ঔপনিবেশিক কায়দায় শাসন ও শােষণ করতে শুরু করে। শুধু শাসন আর শােষণ করেই ক্ষান্ত থাকেনি পশ্চিমা শাসক তারা বাংলার মানুষকে চিরদিনের জন্য দাসে পরিণত করে রাখার ষড়যন্ত্র শুরু করে। পশ্চিমা শাসক গােষ্ঠীরা আরাে চেষ্টা চালায় বাংলার মানুষকে পঙ্গু করে রাখার জন্য। তাই পাকিস্তানীদের হাত থেকে জাতিকে মুক্ত করার চিন্তা চেতনা নিয়ে এবং তাদের হীনচক্রান্তের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে তােলার জন্য এদেশের সচেতন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ নতুন রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠার প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করেন। নতুন রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠার প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করেও নেতৃবৃন্দ তেমন অগ্রসর হতে পারেননি প্রথম দিকে। কিন্তু ১৯৪৯ সালের ২৬শে এপ্রিলের দক্ষিণ টাঙ্গাইলের উপনির্বাচনে মুসলিম লীগ বিরােধী প্রার্থী তরুণ যুবনেতা শামসুল হকের বিজয়, নতুন রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠার তৎপরতাকে তরান্বিত করে। এই নির্বাচন প্রমাণ করে দেয় বাংলার মানুষ পশ্চিমা শাসকদের বিরুদ্ধে অনেক সচেতন। তারা এখন মুসলিম লীগের সরকারকে প্রত্যাখান করতে চায়। তাই বাংলার মানুষকে সঠিকভাবে নেতৃত্ব দিতে পারলে তারা পশ্চিমা শাসকদের বর্জন করবে। বাংলার মানুষকে সঠিকভাবে নেতৃত্ব দেয়ার প্রয়ােজনে নতুন রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৪৯ সালের ২৩শে ও ২৪শে জুন মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশের সম্মেলন ডাকা হয়। এই অংশ মূলতঃ শহীদ হাসিম পন্থী বলে পরিচিত ছিল। শহীদ হাসিম পন্থীদের নেতৃত্বে ছিলেন যুবনেতা শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, শওকত আলী ও আমজাদ হােসেন খান সাহেব, ওসমান ও খন্দকার মােস্তাক আহমেদ। সম্মেলনের তারিখ নির্ধারিত করা হলেও স্থান নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। কারণ মুসলিম লীগ সরকারের হুমকির ভয়ে ঢাকা শহরে কোথাও কোন ব্যক্তি সম্মেলনের জায়গা দিতে সহজে রাজী হয়নি। শেষ পর্যন্ত এই ঝুকিপূর্ণ দায়িত্বটি পালন করেন কে. এম. বশীর। তিনি তাঁর নিজ বাসভবন রােজ গার্ডেনের হল কামরায় সম্মেলন অনুষ্ঠান করার অনুমতি দানের সৎসাহস দেখান। তিনি মুসলিম লীগ সরকারের এবং তাঁর গুন্ডা পান্ডাদের ভয় ভীতিকে উপেক্ষা করে এগিয়ে না আসলে সেদিন সম্মেলন করা সম্ভব হত না। এই সময়ে ঢাকা শহরের কোন লােকজন সহজে মুসলিম লীগ সরকারের ভয়ভীতিকে উপেক্ষা করে সম্মেলনে
২০
সহযােগিতা করতে বা সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করতে সাহস পায়নি। এমনি একটি সময়ে সম্মেলনের জায়গা দিয়ে কে. এম. বশীর যে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেন তা জাতির ইতিহাসে চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ১৯৪৯ সালের ২৩শে জুন যথারীতি রােজ গার্ডেনের হল কামরায় সম্মেলন শুরু হয়। সম্মেলনে সভাপতির আসন গ্রহণ করেন জনাব আতাউর রহমান খান। সম্মেলনে প্রথম মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী তার লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন। সম্মেলনে সারা দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে প্রায় ২৫০ হইতে ৩০০ জনের মত প্রতিনিধি অংশ গ্রহণ করেন। সন্মেলনে বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের মধ্যে ছিলেন বগুড়ার মােহম্মদ আলী, কুষ্টিয়ার ডাঃ আব্দুল মােত্তালেব খালেক, কুমিল্লার তােফাজ্জল আলী, ও খন্দকার মােস্তাক আহমেদ, ঢাকার আতাউর রহমান খান, ইয়ার মােহম্মদ খান ও কামরুদ্দিন আহমদ, নােয়াখালীর আব্দুল জব্বার খন্দকার, পাবনার এম, মনসুর আলী ও নারায়নগঞ্জের খান সাহেব ওসমান আলী, রংপুরের খয়রাত হােসেন, টাঙ্গাইলের শামসুল হক, ফরিদপুরের মােল্লা জালাল উদ্দিন ও শেখ মুজিবুর রহমান, দিনাজপুরের রহিম উদ্দিন উকিল ও দারিরুল ইসলাম। আরাে উপস্থিতদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিলেন আনােয়ারা খাতুন, আলী আহমদ খান, ফজলুল কাদের চৌধুরী, শামসুদ্দিন আহমদ, আলী আমজাদ খান, মওলানা মুহম্মদ আরিফ চৌধুরী, মওলানা শামসুল হক, মওলানা এয়াকুব চৌধুরী ও ঢাকার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী প্রভিন্সিয়াল লাইব্রেরীর মালিক আব্দুর রশীদ প্রমূখ। শেরে বাংলা আবুল কাসেম ফজলুল হকও এই সন্মেলনের প্রথম অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন এবং সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন। পরে অবশ্য তিনি আর এই সম্মেলনে যাননি। উপস্থিত সদস্যদের মধ্যে থেকে বগুড়ার মােহম্মদ আলীকে বার্মার রাষ্ট্রদূত করে পাঠান এবং ডাঃ মালেক ও তােফাজ্জল আলীকে মুসলিমলীগ সরকার মন্ত্রী নিযুক্ত করেন। এমনিভাবে সরকার আরাে অনেককে বহু লােভনীয় পদ দেখান। কিন্তু তাতেও সরকারের পক্ষে আর তেমন কোন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিকে আদর্শ ত্যাগ করাতে পারেনি। সন্মেলনের প্রস্তুতি চলাকালে মাওলনা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ১৫০ মােগলটুলীতে অবস্থান করেন। ২০ শে জুন খবর পাওয়া যায় যে, সন্মেলনের আগে সরকার মাওলনা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীকে গ্রেপ্তার করবে। এই খবর পাওয়ার পর খন্দকার মােস্তাক আহমেদ, কাজী বশীরের সঙ্গে আলাপ করে শওকত আলীর সহযােগিতায় সেই রাত্রেই মাওলনা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর গায়ে একটা কম্বল জড়িয়ে ঘােড়ার গাড়ীতে করে তাকে রোজ গার্ডেন হলে পৌছে দেন এবং সন্মেলন শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনি সেখানেই থাকেন। সেদিনের সম্মেলনে সুদীর্ঘ আলাপ আলােচনার পর পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব গৃহিত হয়। এছাড়া এই সম্মেলনে আরাে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় যে প্রত্যেক প্রাপ্ত বয়স্ক নর নারীকে সংগঠনের সদস্য করা হবে এবং তার জন্য চাঁদা দেওয়ার প্রয়ােজন হবে না। এই সম্মেলনে আরাে কতগুলি প্রস্তাব গৃহিত হয়। সেগুলির মধ্যে বিশেষ উল্লেখযােগ্য ছিল বিনা খেসারতে অবিলম্বে জমিদারী প্রথার উচ্ছেদ, প্রাপ্ত বয়স্কদের ভােটাধিকারের ভিত্তিতে সাধারণ নির্বাচন, মন্ত্রী সভার বিভিন্ন কাজের জন্য বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করা, কারাবন্দী ছাত্র নেতাদের মুক্তি, ছাত্রদের উপর থেকে শাস্তিমূলক আদেশ প্রত্যাহার করা। অবিলম্বে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তন, বিক্রয়কর প্রত্যাহার। এছাড়া খাদ্য পরিস্থিতি সম্পর্কে একটি বিশেষ প্রস্তাবে দাবী করা হয় যে, খাদ্য সংকট দূর করার জন্য অবিলম্বে সরকারী উদ্যোগে একটি সর্বদলীয় খাদ্য সন্মেলন আহবান করা, প্রাদেশিক
২১
জেলা মহকুমা ও ইউনিয়নে খাদ্য পরামর্শদাতা কমিটি গঠন করা এবং অবিলম্বে খাদ্য সগ্রহ অভিযান শুরু করা হােক, নেভী সম্পর্কে যেসব সরকারী অন্যায় ও অবিচার অনুষ্ঠিত হচ্ছিল সেগুলাের প্রতিকারের জন্যেও বিশেষভাবে দাবী জানানাে হয়। ২৩ শে জুন তারিখের অধিবেশনের শেষ পর্যায়ে সাংগঠনিক কমিটির গঠন নিয়ে আলােচনা করা হয়। এই আলােচনায় মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, প্রতি জেলা বা প্রতি প্রতিষ্ঠান থেকে একজন করে প্রতিনিধি নিয়ে কমিটি করার প্রস্তাব করেন। কিন্তু তার এই প্রস্তাবের বিরােধীতা করেন অনেকেই। তারা বলেন প্রতি জেলা বা প্রতিষ্ঠান থেকে একজন করে প্রতিনিধি নিয়ে কমিটি করলে সে কমিটি অনেক বড় হবে, তার মাধ্যমে কোন সাংগঠনিক কাজই করা সম্ভব হবে না। এ সমস্ত আলােচনার পর সন্মেলনের সবাই মাওলনা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীকে অনুরােধ করেন তিনি যেন নিজে আধ ঘন্টার মধ্যে কমিটির নাম ঘােষণা করেন। সবার অনুরােধে মওলনা ভাসানী ৪০ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করেন। সেই কমিটিতে মাওলনা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী সভাপতি, শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক, শেখ মজিবুর রহমান ও খন্দকার মােস্তাক আহমদকে যুগ্মসম্পাদক হিসেবে রাখা হয়। মাওলনা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর সেই কমিটি, সম্মেলনে সর্ব সম্মতিক্রমে অনুমােদিত হয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ২ বৎসর হবার আগেই নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের পিছনে টাঙ্গাইলের দুই কৃতি সন্তান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। সেদিনের সম্মেলনের জন্য যদি টাঙ্গাইলের নির্বাচনের বিজয়ী বীর শামসুল হক এবং মাওলনা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী উদ্যোগ এবং সক্রিয়ভাবে নেতৃত্ব না দিতেন তাহলে সেদিন হয়তাে আওয়ামী মুসলিমলীগ বা পরবর্তী কালের আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হত না।
শামসুল হকের প্রস্তাব এবং আওয়ামী মুসলিম লীগের
প্রথম ম্যানিফেস্টো
পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলনে বিবেচনার জন্য শামসুল হক মূলবাদী’ নামে একটি ছাপা পুস্তিকায় লিপিবদ্ধ তাঁর বক্তব্য পাঠ করেন। এই মূলবাদীই সম্মেলনের পর সামান্য পরিবর্তীত অবস্থায় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের প্রথম খসরা ম্যানিফেস্টো রূপে প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়। পুস্তিকাটির মুখবন্ধের প্রারম্ভে তিনি বলেন : ইংরেজী ১৯৪৯ সনের ২৩শে ও ২৪শে জুন তারিখে ঢাকায় অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলন মনে করে যে, সর্বকালের সর্বযুগের সর্ব দেশের যুগ প্রবর্তক ঘটনাবলীর ন্যায় লাহাের প্রস্তাবও একটা নতুন ইতিহাসের সৃষ্টি করিয়াছে। বিরুদ্ধ পরিবেশে মানবের দেহ, মন ও মস্তিষ্কের উন্নতি ও পূর্ণ বিকাশ সম্ভব নয়। মানুষ পরিবেশের দাস একথা আধুনিক বৈজ্ঞানিকগনও স্বীকার করেন। বিরুদ্ধ পরিবেশে পূর্ণ ইসলামিক মনােভাব এবং সমাজ বিধান গড়িয়া তােলা সম্ভব নয়। ভারতের মুসলমানগণ বহু শতাব্দীর সঞ্চিত অভিজ্ঞতা হইতে এই মহা সত্য উপলব্ধি করিয়াই বিরুদ্ধ পরিবেশ বা দারুল হরবের পরিবর্তে ইসলামিক পরিবেশ বা দারুল ইসলাম কায়েম করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হইয়াছিল। কিন্তু পাকিস্তান ইসলামিক রাষ্ট্র হইলেও শুধু মুসলমানের রাষ্ট্র বা শুধু
২২
মুসলমানের জন্য প্রতিষ্ঠিত করিবার এবং পাশ্চাত্য সভ্যতা ও শিক্ষা প্রভাবান্বিত ইসলাম বিরােধ সাম্রাজ্যবাদী, ধনতান্ত্রিক ও আত্মকেন্দ্রিক পরিবেশ গড়িয়া তুলিবার ইচ্ছা তাহাদের ছিল না।’ শামসুল হকের লিখিত মূলবাদীতে স্রষ্টা ও সৃষ্টির কর্তব্য সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে ? রব বা সৃষ্টির হিসাবেই সৃষ্টির, বিশেষ করিয়া সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব মানুষের সাথে আল্লাহর সবচাইতে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। বস্তুতঃ রব বা স্রষ্টা পালন বা পােষন কর্তা হিসাবে বিশ্ব ও সৃষ্টিকে ধাপের পর ধাপ, স্তরের পর স্তর, পরিবর্তনের পর পরিবর্তনের ভিতর দিয়া কতকগুলি স্থায়ী ও সাধারণ ক্রমবিকাশ ও ক্রমােন্নতির নিয়ম অনুসারে এক অবস্থা হইতে অপর অবস্থার ভিতর দিয়া ধীরে ধীরে কিন্তু সুনিশ্চিতরূপে চরম সুখ শান্তি ও পূর্ণতা প্রাপ্তির দিকে আগাইয়া নিবেন। ইসলামের দৃষ্টি ভঙ্গীতে আল্লাহ শুধু মুসলমানদের নয়, জাতি ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে সমগ্র মানবের । রবই আল্লাহর সত্যিকারের পরিচয়। রব হিসাবে রবুবিয়াত বা বিশ্ব পালনই তার প্রথম ও প্রধান কাজ। সুতরাং দুনিয়ার উপর আল্লাহর খলিফা বা প্রতিভু হিসাবে মানব এবং খেলাফত হিসাবে রাষ্ট্রের প্রথম ও প্রধান কাজ ও কর্তব্য হইল আল্লাহর উপায় ও পদ্ধতি অনুসারে বিশ্ব পালন করা এবং জাতি ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের সামগ্রিক সুখ শান্তি,উন্নতি, কল্যান ও পূর্ণ বিকাশের জন্য চেষ্টা,সাধনা ও সগ্রাম করা। শামসুল হক মুসলিম লীগ সম্পর্কে পুস্তিকাটিতে বলেনঃ নিখিল ভারত মুসলিম লীগ কখনও দল বিশেষের প্রতিষ্ঠান ছিল না। ইহা ছিল ভারত উপমহাদেশের মুসলিম জনগনের জাতীয় প্লাটফর্ম বা মঞ্চ। ইহার উদ্দেশ্য পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পাকিস্তানের মূলনীতি গুলিকে কার্যকরী করিয়া তুলিতে হইলে প্রয়ােজন নতুন চিন্তাধারার নতুন নেতৃত্ব এবং নতুন সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নীতি ও কর্মসূচী এবং মুসলিম লীগকে মুসলিম জনগনের সত্যিকার জাতীয় প্লাটফর্ম বা মঞ্চ হিসাবে গড়িয়া তােলা। কিন্তু দুঃখের বিষয় বর্তমান পকেট লীগ নেতৃবৃন্দ উপরােক্ত কর্মপন্থা অনুসরণ না করিয়া তাহাদের নিজেদের কায়েমী স্বার্থ এবং কর্মপন্থা অনুসরণ করিয়া নিজেদের কায়েমী স্বার্থ এবং প্রতিক্রিয়াশীল নেতৃত্ব বজার রাখার জন্য লীগের মর্যাদা ও জনপ্রিয়তা ধ্বংস করিয়া চলিয়াছেন। এই উদ্দেশ্যেই তাহারা মুসলিম লীগকে দল বিশেষের প্রতিষ্ঠান করিয়া ফেলিয়াছেন। শুধু তাহাই নয় মানবের প্রতি আশীর্বাদ স্বরূপ ইসলামকেও ব্যক্তি, দল ও শ্রেনী বিশেষের স্বার্থসিদ্ধির জন্য এবং অসাধুভাবে কাজে লাগান হইতেছে। কোন পাকিস্তান প্রেমিক এমনি কি মুসলিম লীগের ঝানু কর্মীগণ পর্যন্ত নীতি ও কর্মসূচী সম্পর্কে কোনরূপ প্রশ্ন উথাপন করিতে অথবা প্রস্তাব করিতে পারে না। কেহ যদি এইরূপ করিবার চেষ্টা করে তাহা হইলে তাহাদিগকে পাকিস্তানের শত্রু বলিয়া আখ্যায়িত করা হয়। মূলবাদী’ তে উত্থাপিত প্রস্তাব গুলিতে বয়স্কদের ভােটাধিকার, ব্যক্তি স্বাধীনতা, আইনের চোখে সমতা, ধর্মের স্বাধীনতা, সংখ্যালঘুদের ন্যায্য অধিকার, কাজ করার অধিকার, স্বাস্থ্যের অধিকার, নারীর অধিকার ছাড়াও ইসলামী রাষ্ট্র এবং কৃষি পুনর্গঠন ও শিল্পের বিকাশ ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য।
ইসলামী রাষ্ট্রের রূপ সম্পর্কে তাতে বলা হয়ঃ
১। পাকিস্তানী খেলাফত অথবা ইউনিয়ন অব পাকিস্তান রিপাবলিক, ব্রিটিশ কমন ওয়েলথের বাহিরে একটি সার্বভৌম ইসলামী রাষ্ট্র হইবে।
২। পাকিস্তানের ইউনিট গুলিকে আত্মনিয়ন্ত্রণের পূর্ণ অধিকার দিতে হইবে।
২৩
৩। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব আল্লাহর প্রতিভু হিসাবে জনগনের উপর ন্যস্ত থাকিবে।
৪। গণতন্ত্র হইবে নীতিতে ইসলামী গণতান্ত্রিক ও আকারে রিপাবলিকান।
কৃষিপুনর্গঠন প্রস্তাবে বলা হয়ঃ
১। জমিদারী প্রথা ও জমির উপর অন্যান্য কায়েমী স্বার্থ বিনা খেসারতে উচ্ছেদ করিতে হইবে।
২। সমস্ত কর্ষিত ও কৃষি উপযােগী অকর্ষিত জমি কৃষকদের মধ্যে সমভাবে বন্টন করিয়া দিতে হইবে।
৩। তাড়াতাড়ি অর্ডিনেন্স জারী করিয়া তেভাগা দাবী মানিয়া লইতে হইবে।
৪। রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে সমবায় ও যৌথ কৃষি প্রথা প্রতিষ্ঠা করিতে হইবে।
৫। নিম্ন লিখিত বিষয়ে কৃষকদের অবিলম্বে সাহায্য করিতে হইবেঃ
(ক) সেচ ব্যবস্থার সুবিধা ও সার প্রস্তুতের পরিকল্পনা।
(খ) উন্নত ধরনের বীজ ও বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি।
(গ) সহজ ঋণ দান ও কৃষি ঋণ হইতে মুক্তি।
(ঘ) ভূমি করের উচ্ছেদ না হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ভূমিকর শতকরা পঞ্চাশ ভাগ কমান।
(ঙ) ভূমি করের পরিবর্তে কৃষি আয়কর বসানাে ।
(চ) খাদ্য শস্য প্রভৃতি জাতীয় ফসলের সর্বনিম্ন ও সর্ব উর্ধ্ব দর নির্ধারণ করিয়া দিতে হইবে এবং পাটের দর বাধিয়া দিতে হইবে।
(ছ) খাদ্য শস্যের ব্যবসা সরকারের হাতে একচেটিয়া থাকা উচিত। পাট ব্যবসা ও বুনানীর লাইসেন্স রহিত করিতে হইবে।
(জ) সকল রকমের সমিতিগুলিকে সাহায্য ও উৎসাহ দিতে হইবে।
৬। কালে সমস্ত ভূমিকে রাষ্ট্রের জাতীয় সম্পত্তিতে পরিণত করিতে হইবে এবং সরকারের অধিনায়কত্ব ও তত্ত্বাবধানে যৌথ ও সমবায় কৃষি প্রথা খুলিতে হইবে। দেশীয় শিল্পকে নানা বিপদের হাত থেকে রক্ষা করার উদ্দেশ্য মূলদাবীতে নিম্নলিখিত কর্মসূচীর উল্লেখ করা হয়ঃ
১। প্রাথমিক শিল্প গুলিকে জাতীয় সম্পত্তিতে পরিণত করিতে হইবে যেমন ক্ষুদ্র শিল্প, ব্যাংক, বীমা যানবাহন। বিদ্যুৎ সরবরাহ পরিকল্পনার ভেতর দিয়ে সরাসরি রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে আনিতে হইবে।
২। পাট ও চা শিল্পকে জাতীয় সম্পত্তিতে পরিণত করিতে হইবে এবং পাট ও চা ব্যবসা সরকারের হাতে একচেটিয়া থাকিবে।
৩। কুটির শিল্পগুলিকে সুবিন্যস্ত পরিকল্পনার ভিতর দিয়া বিশেষ ভাবে সাহায্য ও উৎসাহ দান করিতে হইবে।
৪। বিল-হাওর ও নদীর উপর হইতে কায়েমী স্বার্থ তুলিয়া দিয়া সরকারের কর্তৃত্বাধীনে মৎসজীবিদের মাঝে যৌথ উপায়ে বন্টন করিয়া দিতে হইবে এবং সুপরিকল্পিতভাবে বৈজ্ঞানিক
২৪
উপায়ে মৎস্য চাষ ও মৎস্য ব্যবসার পত্তন করিতে হইবে। ফিসারী বিভাগের দ্রুত উন্নত ধরনের গবেষনাগার খুলিতে হইবে।
৫। শিল্প ও ব্যবসায়ে ব্যাক্তিগত একচেটিয়া অধিকার থাকিবে না।
৬। ব্রিটিশের নিকট হইতে ষ্টার্লিং পাওনা অবিলম্বে আদায় করিতে হইবে। এবং তাহা দ্বারা যন্ত্রপাতি ক্রয় করিতে হইবে ও প্রতিষ্ঠান গড়িয়া তুলিতে হইবে।
৭। দেশের আভ্যন্তরীন ও বৈদেশিক ব্যবসাকে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত করিবার ভার রাষ্ট্রকে গ্রহণ করিতে হইবে।
৮। সমস্ত ব্রিটিশ ও বৈদেশিক ব্যবসাকে জাতীয় সম্পত্তিতে পরিণত করিতে হইবে।
৯। শিল্পে বৈদেশিক মূলধন খাটানাে বন্ধ করিতে হইবে।
১০। শিল্পে মুনাফার হার আইন করিয়া বাধিয়া দিতে হইবে।
শামসুল হক ‘মূলবাদী’তে সর্বশেষ নিম্নোক্ত আহ্বান জানানঃ
মানবতার চূড়ান্ত মুক্তি সংগ্রাম যাতে বিলম্বিত না হয়, সেজন্য জনতাকে তাহাদের ব্যক্তিগত ও দলগত বিভেদ বিসর্জন দিয়ে এক কাতারে সমবেত হতে মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলন আবেদন জানাইতেছে। সাম্রাজ্যবাদী সরীসৃপের ফোস ফোস শব্দ আজ সমাজের সর্বত্র শােনা যাইতেছে। সেই ফেঁস ফোঁস শব্দই যেন এ যুগের সংগীত । আমাদের কওমী প্রতিষ্ঠান এই সরীসৃপদের বিরুদ্ধে সগ্রাম চালাইয়া তাহাদের বিষদাঁত উৎপাটন করিতে বদ্ধ পরিকর। হযরত আবুবকর সিদ্দিকী (সঃ) বলিয়াছিলেন যদি আমি ঠিক থাকি, তবে আমাকে অনুসরণ কর,আর যদি আমি ভ্রান্ত হই, আমাকে সংশােধন কর। সেই অমর আদর্শকে সামনে ধরিয়াই কওমী প্রতিষ্ঠান সমস্ত দেশবাসীকে সমতলে আগাইয়া আসিতে আহ্বান জানাইতেছে, আসুন আমরা কোটি কোটি নর-নারীর সমবেত চেষ্টার গন-আজাদ হাসিল করিয়া এবার পূর্ব পাকিস্তানকে সুখী, সমৃদ্ধ ও গণতান্ত্রিক ভিত্তিতে গড়িয়া তুলি।
ভাষা আন্দোলন
ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে টাঙ্গাইলের এক বিশেষত্ব লক্ষ্য করা যায়। এ আন্দোলনে নেতৃস্থানীয় জাতীয় নেতাদের মধ্যে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, যুব নেতা শামসুল হক ও ছাত্রনেতা শামসুল আলমের বাড়ী টাঙ্গাইল। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে টাঙ্গাইলের কৃতিসন্তান ধনবাড়ির জমিদার সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরীর অবদানও কম নয়। তিনি বৃটিশ শাসনামলে যখন উর্দুভাষী মুসলমান নেতারা উর্দুকে ভারতের রাষ্ট্রভাষা দাবী করেন তখন তার বিরােধীতা করে বলেন, ‘ভারতের ভাষা যাই হােক বাংলার সরকারী ভাষা বাংলাই হবে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ভাষা আন্দোলন সৃষ্টি হলে তার শুরু থেকেই নেতৃত্ব দেন টাঙ্গাইলের কৃতিসন্তান মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, যুব নেতা শামসুল হক ও ছাত্র নেতা শামসুল আলম। ভাষা আন্দোলনের সূচনা থেকেই রাজধানী ঢাকার সংগে যােগসূত্র রেখে টাংগাইলের সংগ্রামী জনতা এখানেও আন্দোলন গড়ে তােলে। ১৯৪৮ সালের ৮ই মার্চ যুব নেতা শামসুল হক টাঙ্গাইলে আসেন এবং এক আলােচনা সভায় ভাষা
২৫
আন্দোলন সম্পর্কে সুদীর্ঘ সময় বক্তব্য রাখেন। উক্ত আলােচনা সভার স্থান নির্ধারন করা হয়েছিল শিবনাথ উচ্চবিদ্যালয়ের পূর্ব পার্শ্বে বর্তমান শিশু সদনের স্থানে। এখানে ছিল তৎকালে মুসলিম ছাত্রাবাস। এই আলােচনা সভায়, ১১ই মার্চ টাঙ্গাইলের বহু গণ্যমান্য ব্যক্তিসহ বহু স্কুল কলেজের ছাত্র উপস্থিত ছিলেন। গণ্যমান্য ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন করটিয়ার নুরুল হুদা, বদিউজ্জামান খান, ফজলুর রহমান খান কায়সার, শামসুল ইসলাম সিদ্দীকী প্রমুখ। বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতা তকালের বিন্দু বাসিনী উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেনীর ছাত্র মির্জা তােফাজ্জল হােসেন মুকুলের নেতৃত্বে বিন্দুবাসিনী স্কুলের প্রায় শতাধিক ছাত্র আলােচনা সভায় উপস্থিত ছিল। যুবনেতা শামসুল হকের বক্তব্য শােনার পর টাঙ্গাইলের ছাত্র সমাজ ও শিক্ষিত সচেতন মানুষের মনে রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়। ঐ সভায় বসেই টাঙ্গাইলের ছাত্র সমাজ ও নেতৃস্থানীয় কতিপয় ব্যক্তি ১৯৪৮ সালে ১১ ই মার্চ রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদ সারা দেশ ব্যাপী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয়। টাঙ্গাইলে সফল ভাবে ধর্মঘট পালনের জন্য করটিয়ার নূরুলহুদা মিছিল নিয়ে শহরে আসার দায়িত্ব নেয় এবং টাঙ্গাইল শহরের স্কুলের ছাত্রদের নিয়ে মিছিলে আসার দায়িত্ব দেয়া হয় বিন্দুবাসিনী উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেনীর ছাত্র মির্জা তােফাজ্জল হােসেন মুকুলকে। ছাত্র সমাজের ব্যাপক প্রস্তুতি দেখে ধর্মঘট যাতে না হতে পারে তার জন্য সরকার প্রচেষ্টা চালায়। ১০ ই মার্চ অনেক ছাত্রনেতা কর্মীদের বাড়িতে পুলিশ হানা দেয় এবং আলী আকবর খান খােকা, সৈয়দ আব্দুল মতিন ও ফজলুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে। ১১ই মার্চ যাতে স্কুলের ছাত্ররা মিছিলে না আসতে পারে তার জন্য প্রশাসন ১০ টার আগেই টাঙ্গাইল শহরের সব স্কুল ছুটি ঘােষণা করে। প্রশাসনের ছুটি ঘােষণাকে উপেক্ষা করে মির্জা তােফাজ্জল হােসেন মুকুলের নেতৃত্বে বিন্দুবাসিনী স্কুল সহ বিভিন্ন স্কুলের বেশ কিছু সংখ্যক ছাত্র ধর্মঘটের মিছিলে অংশ গ্রহণের জন্য উপস্থিত থাকে। সকাল ১১ টার সময় নূরুল হুদার নেতৃত্বে করটিয়া কলেজ থেকে ছাত্রদের একটি বিশাল মিছিল পায়ে হেঁটে টাঙ্গাইল শহরের পূর্বপ্রান্তে আশেকপুর পৌছলে পুলিশ মিছিলে প্রচন্ডভাবে লাঠিচার্জ করে। পুলিশের লাঠিচার্জ সত্ত্বেও ছাত্ররা মিছিলটি নিয়ে বেতকা হয়ে শহরে প্রবেশ করে। মিছিল শহরে প্রবেশ করার পর মির্জা তােফাজ্জল হােসেনের নেতৃত্বে শহরের স্কুলের বহু ছাত্র মিছিলে যােগদান করে। স্কুলের ছাত্রদের মিছিলে যােগদান করার পর মিছিলটি অত্যন্ত বেগবান হয়। মিছিলটি বেলা দুইটার সময় যখন এস, ডি, ওর বাসার কাছে চাররাস্তা মােড়ে আসে, পুলিশ তখন ছত্রভঙ্গ করার জন্য মিছিলে লাঠিচার্জ করে। পুলিশ মিছিল থেকে বদিউজ্জামান খান, কমিউনিষ্ট পার্টির নারায়ন বিশ্বাস, উপেন মালাকারকে গ্রেপ্তার করে। পুলিশের লাঠির আঘাতে নূরুলহুদা মারত্মকভাবে আহত হন। ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসের পর থেকে ১৯৫২ সালের জানুয়ারী মাস পর্যন্ত টাঙ্গাইলে ভাষা আন্দোলনের কোন তৎপরতা ছিলনা। কিন্তু ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের প্রথম দিক থেকেই টাঙ্গাইলের ভাষা সৈনিকরা সােচ্চার হয়ে উঠে। তারা রাজধানী ঢাকার সঙ্গে তাল মিলিয়ে টাঙ্গাইলে কর্মসূচী গ্রহণ করে। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী ঢাকার ছাত্রদের উপর পুলিশ গুলি বর্ষণ করলে তার প্রতিবাদে সারা দেশের মত আন্দোলনকে টাঙ্গাইলে শক্তিশালী করার জন্য ফেব্রুয়ারী মাসের প্রথম থেকেই টাঙ্গাইলের বিভিন্ন স্থানে আলােচনা সভা ও বৈঠকের মাধ্যমে ভাষার দাবীকে জোরদার করার জন্য জনমত গড়ে তােলে। ভাষা আন্দোলন পরিচালনার জন্য তহবিল সংগ্রহ করা হয়। এই তহবিলের অর্থ আদায় করার জন্য দুই পয়সা মূল্যের কুপন ছাপানাে হয়। কুপনে স্বাক্ষর করেন সৈয়দ
২৬
নূরুল হুদা ও বদিউজ্জামান খান। কুপন নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে অর্থ আদায় করেন মির্জা তােফাজ্জল হােসেন মুকুল, ফজলুর রহমান খান কায়সার, আলী আকবর খান খােকা, বদিউজ্জামান, রমিনুজ্জামান রহিজ প্রমুখ। ২২শে ফেব্রুয়ারী টাঙ্গাইলের ভাষা সৈনিকরা সফলভাবে তাদের কর্মসূচী পালন করে। ২২শে ফেব্রুয়ারীর প্রতিবাদ মিছিল ও প্রতিবাদ সভায় যারা সক্রিয় ভাবে অংশ গ্রহণ করেন বা নেতৃত্ব দেন তাদের মধ্যে ছিলেন নূরুল হুদা, বদিউজ্জামান খান, ফজলুর রহমান খান কায়সার, খান আব্দুস সালাম, মির্জা তােফাজ্জল হােসেন মুকুল, শামসুদ্দীন সিদ্দিকী প্রমুখ। ভাষা আন্দোলনে টাঙ্গাইলের বেশ কয়েকজন ছাত্রীও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। তাদের মধ্যে ছিলেন বিশিষ্ট চিকিৎসক ডাঃ নাজমুল শাকেরের মেয়ে রুবী, আরাে ছিলেন সুফিয়া বেগম, জোস্না বেগম, ঝরনা, মহেড়ার ডাক্তার সৈয়দ সাহেবের মেয়ে ছালেহা । ছালেহা ২২শে ফেব্রুয়ারী কুমুদিনী কলেজের উচু দেয়াল টপকিয়ে মিছিলে অংশগ্রহণ করে। ভাষা আন্দোলনে টাঙ্গাইলের যে সমস্ত রাজনৈতিক ব্যক্তিরা সহযােগিতা করতেন তাদের মধ্যে ছিলেন হাতেম আলী খান, খােদা বকস্ মােক্তার সুধাংশু সাহা । খােদা বকস্ মােক্তার আন্দোলন পরিচালনার জন্য উদার হস্তে বহু টাকা দিয়েছেন। ১৯৫২ সালের একুশ’ স্মরণে টাঙ্গাইলের ভাষা সৈনিকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শহীদ মিনার তৈরি করেন। এই শহীদ মিনার তৈরি করার ক্ষেত্রে যাদের সক্রিয় ভূমিকা ছিল তাদের মধ্যে ছিলেন শামসুর রহমান খান শাজাহান, মির্জা তােফাজ্জল হােসেন মুকুল, আলী আকবর খান খােকা, রমিনুজ্জামান রহিজ, বদিউজ্জামান খান প্রমুখ। শহীদ মিনার তৈরী করার জন্য খােদা বক্স মােক্তারের বাসা থেকে সিমেন্ট আনেন আলী আকবর খান খোকা । বিন্দুবাসিনী স্কুলের মাঠ থেকে রাতে ইট, বালু আনেন মির্জা তােফাজ্জল হােসেন মুকুল, রকিনুজ্জামান রহিজ, বদিউজ্জামান, বুলবুল খান মাহবুব প্রমুখ। শহীদ মিনারের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন হাবিবুর রহমান। তখন তিনি করটিয়া কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে সহসভাপতি পদের প্রার্থী ছিলেন। শহীদ মিনার নির্মাণ করেন মেহের রাজ এবং ভিত্তি প্রস্তর খােদাই করেন হৃষিকেশ পােদ্দার। দুজনের কেউই, তাদের কাজের জন্য কোন পারিশ্রমিক নেননি। এভাবে নির্মিত হয় টাঙ্গাইলে ভাষা সৈনিকদের স্মরণে শহীদ মিনার। প্রথম নির্মিত শহীদ মিনার ১৯৫৮ সালে আইয়ুবের সামরিক শাসনের সময় ভেঙ্গে ফেলা হয়। ১৯৬১ সালে টাঙ্গাইলের ভাষা সৈনিকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আবার শহীদ মিনার তৈরী করেন এবং শহীদ দিবস পালন করেন। এই শহীদ মিনার সামরিক সরকার ভেঙ্গে ফেলে, যা ১৯৬৩ সালে পুণরায় নির্মান করা হয়। ১৯৬৩ সালে নির্মিত শহীদ মিনার ১৯৭১ সালে হানাদার বাহিনী ভেঙ্গে ফেলে। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে পুণরায় শহীদ মিনার তৈরী করা হয়, যা আজও অপরিমেয় ত্যাগের মহিমায় উজ্জ্বল ভাস্বর হয়ে টিকে আছে।
ভাষা আন্দোলন ও সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী
ভাষার প্রশ্নে বাংলার বিরুদ্ধে উর্দু ভাষীরা শুধুমাত্র পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরই ষড়যন্ত্র করেনি তারা বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে বৃটিশ শাসনামল থেকেই। ১৯২১ সালের ওহাবী আন্দোলনে সারা ভারতের নেতৃস্থানীয় মুসলমানদের ভারতের রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার জন্য যখন বৃটিশ সরকারকে চাপ দেন তখন ধনবাড়ির জমিদার সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী লিখিত ভাবে বৃটিশ সরকারকে জানান
২৭
যে, ভারতের রাষ্ট্রভাষা যাই হউক না কেন বাংলার রাষ্ট্রভাষা বাংলা করতে হবে। এর পর থেকে তিনি ধনবাড়িতে পহেলা বৈশাখী মেলার আয়ােজন করেন। আজ পর্যন্তও মেলা নিয়মিত অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বাংলা ভাষা, বাঙ্গালি মুসলমানদের মাতৃভাষা। এ ভাষা আমাদের জাতীয় ভাষা। এ ধরনের কথা সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরীর আগে আর কোন অভিজাত মুসলমান এমন দৃঢ় কণ্ঠে ঘােষণা করেননি। বাংলা ভাষা হিন্দু প্রভাবিত ভাষা বলে মুসলমানদের নিকট বর্জনীয় এ যুক্তিকে তিনি কোন সময়ই আমল দেননি। বরং মুসলমানদের পুণর্জাগরনের প্রয়ােজনেই টাঙ্গাইলের এই কৃতি সন্তান বাংলা ভাষার মুসলিম লেখক সৃষ্টির নিমিত্তে শিক্ষিত মুসলমানদের নানা ভাবে অনুপ্রেরণা যােগাতেন। ‘সুধাকর গােষ্ঠী সাপ্তাহিক ‘সুধাকর’ পত্রিকার মাধ্যমে একাজে আত্মনিয়ােগ করেছিল । টাঙ্গাইলের সুপন্ডিত রিয়াজউদ্দীন আল- মাশহাদী এই পত্রিকার লেখক ছিলেন। এই পত্রিকার মাধ্যমে বাঙ্গালী মুসলমানগণ অতীত ঐতিহ্য, ধর্মীয় মহিমা ও তত্ত্ব কথা সম্পর্কে অবগত হয়ে নবজাগরণের অনুপ্রেরনা পেয়েছিল । সুধাকর’ পত্রিকাটি পরবর্তীতে বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় সৈয়দ নওয়াব আলী পত্রিকাটি পুণঃপ্রকাশের জন্য এগিয়ে আসেন করটিয়ার জমিদার পন্নী পরিবার ও সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরীর অর্থনৈতিক সহযােগিতায় পত্রিকাটি ‘মিহির ও সুধাকর’ নামে কলিকাতায় তার নিজস্ব ছাপাখানা থেকে প্রকাশ হয়ে আবার বহুকাল চলেছিল। এই পত্রিকার উদ্ভব থেকেই মুসলমানদের সাহিত্য যাত্রা শুরু হয়।
সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী বাংলা ভাষা সম্পর্কে রংপুরে এক মুসলিম শিক্ষা সম্মেলনে বক্তব্য রাখার সময় বলেন, বাঙ্গালী মুসলমানদের পক্ষে উর্দু ও ফার্সী দু’টি ভাষার প্রয়ােজন নেই। কোন জাতিকে অপর ভাষা মাতৃ ভাষা রূপে গ্রহণ করতে বাধ্য করা হলে তাদের জাতীয়তা একেবারে নষ্ট করা হয়” । তিনি আরাে বলেন, নির্মানেরা ইংল্যাণ্ড জয় করে সেখানে আরবী প্রচলন করতে সক্ষম হয়নি। মােগল সম্রাটরা তাদের অতি প্রিয় ভাষা ত্যাগ করে, যে জাতির মধ্যে বাস করতেন তাদের ভাষাই গ্রহণ করেছিলেন। বাংলা ভাষা সম্পর্কে উক্ত সম্মেলনে সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে উক্তি করেন। তার বক্তব্য সে সময় থেকেই বাঙালী জাতিকে মাতৃভাষার প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল করে। যে শ্রদ্ধাবোেধই বাঙালি জাতিকে তার মাতৃভাষাকে রাষ্টীয় ভাবে প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন গড়ে তােলার অনুপ্রেরণা যােগায়।
ভাষা আন্দোলন ও ভাষা সৈনিক শামসুল আলম
মহান ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে শামসুল আলমের ভূমিকা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। ভাষা আন্দোলনের শুরু থেকেই শামসুল আলম সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।
১৯৪৭ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র ছিলেন এবং হল ইউনিয়নের সমাজসেবা বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। ছাত্র অবস্থায়ই শামসুল আলম তমদুন মজলিশের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। যে কয়েকটি সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান ভাষার দাবীতে আন্দোলন গড়ে তােলে তার মধ্যে তমদুন মজলিশ অন্যতম। এই তমদুন মজলিশের মাধ্যমে শামসুল আলম ভাষা আন্দোলন পরিচালনার ক্ষেত্রে অত্যন্ত দক্ষ নেতৃত্বের পরিচয় দেন। যার জন্য তিনি সর্বদলীয় রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক নির্বাচিত হন। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক নিযুক্ত হবার পর তিনি ভাষা আন্দোলনকে গতিশীল করার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। যে কয়েকজন নেতা বা কর্মীর
২৮
অপরিমেয় পরিশ্রমে ভাষা আন্দোলন শক্তিশালী হয় তার মধ্যে অন্যতম ছিলেন ভাষা সৈনিক শামসুল আলম। তিনি ভাষার প্রশ্নে গড়ে উঠা প্রায় প্রতিটি সভা, সমাবেশ ও মিছিলে অগ্রণী ভূমিকা রাখতেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মূখ্য মন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন ও সর্বদলীয় রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদের মধ্যে যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় তাতে সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে শামসুল আলম স্বাক্ষর করেন। তিনি পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর সংগে ভাষার প্রশ্নে যে আলােচনা অনুষ্ঠিত হয় তাতেও অন্যান্যদের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। একজন সচেতন ছাত্রনেতা হিসাবে বাঙ্গালির স্বকীয়তা, স্বাতন্ত্র্য, নিজস্ব ভাষা ও কৃষ্টির প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন সর্বদা সজাগ। পাকিস্তান সরকার ষড়যন্ত্র করে উর্দুর সঙ্গে বাংলা মিশ্রণ করার প্রচেষ্টা চালায়। প্রতিদিনই ঢাকা কেন্দ্র থেকে সংবাদ পাঠের সময় বাংলা ও উর্দুর মিশ্রণ করা হত। একদিন সন্ধ্যায় রেডিওতে প্রচারিত বাংলা উর্দু মিশ্রণে পঠিত একটি সংবাদ শুনে শামসুল আলম ব্যথিত হয়ে পড়েন। প্রচারিত সংবাদের প্রতিবাদ করার জন্য তিনি বেশকয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রকে সঙ্গে নিয়ে রেডিও অফিসে গিয়ে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সৈয়দ আলী আহসানের সঙ্গে দেখা করে বাংলা সংবাদ পরিবেশনে উর্দুর সংমিশ্রণের বিরুদ্ধে জোর প্রতিবাদ জানান এবং বাংলার সঙ্গে উর্দু মিশ্রণ করে সংবাদ পরিবেশন বন্ধ করার দাবী করেন। তৎকালীন পাকিস্তান বেতার প্রধান জেড. এ. বােখারী বঙ্কিম-শরতের বাংলা ভাষা ব্যবহারে অস্বীকৃতি জানালে শামসুল আলম সহ নেতৃবৃন্দ নজরুল-গােলাম-মােস্তফার বাংলা ভাষায় সংবাদ পরিবেশন করার দাবী জানান। সদ্য পাকিস্তানের রেলওয়ে টিকেট, টাকার নােট ও অন্যান্য কাগজ পত্রে বাংলা ভাষার কোন স্থান ছিলনা। পাকিস্তান সরকারের এ ধরণের ষড়যন্ত্র ও বৈষম্যমূলক আচরনের জন্য সংগ্রামী ছাত্র সমাজ তল্কালীন শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানের বাড়ি ঘেরাও করে। ঐ ঘেরাও কর্মসূচিতে নেতৃস্থানীয়দের মধ্যে শামসুল আলম ছিলেন অন্যতম। ১৯৪৮ সালের জানুয়ারীতে পাকিস্তান গণ পরিষদে বাবু ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দুর সংগে বাংলাকে গণপরিষদের ভাষা হিসাবে গ্রহণ করার জন্য দাবী করেন। বাংলা ভাষাকে গণ-পরিষদের অন্যতম ভাষা হিসাবে গ্রহণ করার দাবী অগ্রাহ্য করায় ঢাকায় ছাত্র, রাজনৈতিক ও শিক্ষিত মহলে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবীকে অগ্রাহ্য করার প্রতিবাদে ছাত্র সমাজ ১৯৪৮ সালের ২৬ শে ফেব্রুয়ারী ঢাকার সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালন করে। বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক প্রতিবাদ সভায় পাকিস্তান সরকারের ভাষার প্রশ্নে ষড়যন্ত্রের তীব্র প্রতিবাদ জানানাে হয়। ঐ দিনের প্রতিবাদ সভা ও ধর্মঘট পালনে শামসুল আলম অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ক্ষমতাসীন মুসলিমলীগ সরকারের বাংলাভাষা বিরােধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তােলার জন্য ২রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফজলুল হক হলের এক সভায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। শামসুল আলমকেই এই সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সগ্রাম পরিষদের আহবায়ক নিযুক্ত করা হয়। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদে যে সমস্ত প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন প্রতিনিধিত্ব করে সেগুলি হল, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, তমদুন মজলিশ, গণ-আজাদী লীগ, বিভিন্ন হলের প্রতিনিধি ও ইনসাফ, জিন্দেগী ও দেশের দাবী প্রক্রিয়ার প্রতিনিধিবৃন্দ। ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চ সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ দেশ ব্যাপী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রধর্মঘটের ডাক দেয়। দেশব্যাপী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পুরােপুরি ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। ঐদিন সরকার বিভিন্ন স্থানে ভাষা আন্দোলনকারীদের উপর পুলিশী নির্যাতন চালায়। ছাত্রদের উপর পুলিশের নির্যাতনের প্রতিবাদে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ১৫ই মা পুণরায় সাধারণ ধর্মঘট পালনের ডাক দেয়। ইতিমধ্যে খাজা নাজিমুদ্দীন রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সংগে আপােষ আলােচনার প্রস্তাব পাঠান। শামসুল আলম সহ সংগ্রাম পরিষদের নেতৃস্থানীয় কয়েকজন
২৯
খাজা নাজিমুদ্দীনের সরকারী বাসভবন বর্ধমান হাউসে রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে আলােচনায় মিলিত হন। আলােচনার পর খাজা নাজিমুদ্দীন রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের দাবী দাওয়া মেনে নেয়। অবশেষে উভয় পক্ষ চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেন। সরকার পক্ষে খাজা নাজিমুদ্দীন আর রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে স্বাক্ষর করেন শামসুল আলম। চুক্তি পত্রের দাবীর মধ্যে ছিল গ্রেপ্তারকৃত রাজবন্দীদের মুক্তি দিতে হবে। চুক্তি মােতাবেক ঐদিন সন্ধ্যায় ১১ই মার্চ গ্রেপ্তারকৃত শেখ মুজিবুর রহমান ও শামসুল হক সহ সবাইকে সরকার মুক্তি দেয়। চুক্তিপত্রের দাবীতে আরাে ছিল পুলিশী নির্যাতনের ও অত্যাচারের তদন্ত করতে হবে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা প্রদানের সুপারিশ সম্বলিত প্রাদেশিক পরিষদের গৃহীত একটি প্রস্তাব কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে পাঠাতে হবে । আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী নেতা কর্মীদের বিরুদ্ধে কোন প্রকার দমন নীতি প্রয়ােগ না করা, সংবাদ পত্রের স্বাধীনতা প্রদান। পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল কায়েদে আজম মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসেন। তিনি ভাষার প্রশ্নে রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দের সংগে আলাপ আলােচনা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। জিন্নার সংগে আলাপ আলােচনার জন্য তঙ্কালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের উপসচিব মিঃ ডি. কে, পাওয়ার সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক শামসুল আলমের নিকট পত্র পাঠান। পত্র পেয়ে শামসুল আলম সংগ্রাম পরিষদের অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সংগে পরামর্শ করেন এবং জিন্নাহর সঙ্গে দেখা করতে বা আলােচনা করতে যান। আলােচনায় ২১ সদস্য বিশিষ্ট প্রতিনিধি দল যান। জিন্নাহ সাহেব মিন্টু রােডে তঙ্কালীন প্রধান সচিব আজিজ আহম্মেদের বাসায় অবস্থান করছিলেন। প্রতিনিধি দল সেখানেই আলােচনার জন্য যান। যাবার আগে প্রতিনিধি দল রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে বিভিন্ন দাবী সম্বলিত একটি স্মারকলিপি সঙ্গে নিয়ে যান। যাতে কোন প্রকার রাষ্ট্র বিরােধী কথা বা : বী দাওয়া ছিল না। জিন্নাহ সাহেবের অনুমতিক্রমে স্মারকলিপি পাঠ করতে শুরু করেন কামরুদ্দীন হেব। স্মারকলিপির ৩ পৃষ্ঠা পাঠ করার পর জিন্নাহ সাহেব ক্রুদ্ধ কণ্ঠে স্মারকলিপি পাঠ করতে নিষেধ করেন। প্রতিনিধি দলের আর কোন বক্তব্য না শুনে জিন্নাহ সাহেব একতরফা ভাবে তাদের ভারতের দালাল বলে গালি দেন। তিনি একরাষ্ট্র, এক ধর্ম, এক ভাষার কথা বললে তার সামনেই সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ প্রতিবাদ জানান। প্রতিনিধি দলের অন্যতম যুবনেতা শামসুল হক অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে তাদের ন্যায্য দাবী নিয়ে জিন্নাহ সাহেবের সঙ্গে তর্ক করেন। ছাত্র নেতাদের প্রশ্নবাণে জিন্নাহ সাহেব অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে আলােচনা সভা পরিত্যাগ করার হুমকি দেন। জিন্নাহ সাহেব গােয়ার্তুমি করে তার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ নিয়মতান্ত্রিকভাবে তাদের সংগ্রাম চালিয়ে যাবেন বলে জিন্নাহ সাহেবকে শুনিয়ে আসেন। জিন্নাহর গােয়ার্তুমি ও গােড়ামি নাজিমুদ্দীন ও নুরুল আমীনের অনুসরণ করাই ভাষা আন্দোলনকে ভয়াবহ পরিণতির দিকে ঠেলে দেয়। পরবর্তীতে তার আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারী। ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে জনাব শামসুল আলম যে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন বাঙ্গালি জাতি তা চিরদিন শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে । ভাষা সৈনিক শামসুল আলম ১৯২৬ সালে টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইল থানার পীরান্দী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ছিল রেজয় করিম আহমদ। তিনি নিজ গ্রামে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন এবং জামালপুর সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৪১ সালে প্রবেশিকা পাশ করেন। তিনি স্কুলে শিক্ষাকালীন সময়ে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হন এবং তৎকালীন ভারতীয় মুসলিম ছাত্রনেতা জনাব আব্দুল ওয়াসেকের সংস্পর্শে আসেন। জনাব শামসুল আলম ১৯৪৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে
৩০
অর্থনীতিতে বি.এ. অনার্স এবং ১৯৪৮ সালে এম.এ. পাশ করে কেন্দ্রীয় সরকারের চাকুরীতে প্রবেশ করেন। তিনি ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের জন্য ১৯৯০ সালে প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম স্বর্ণপদক লাভ করেন।
ভাষা আন্দোলন ও শামসুল হক
১৯৪৭ সালের ৭ই সেপ্টেম্বর শামসুল হকের উদ্যোগে গণতান্ত্রিক যুবলীগের দাবীনামায় প্রস্তাব রাখা হয় যে, পাকিস্তান কর্মী সম্মেলন প্রস্তাব করিতেছে যে, বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন ও আইন আদালতের ভাষা করা হােক। সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা কি হইবে তৎসম্পর্কে আলাপ আলােচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার জনগণের উপর ছাড়িয়া দেওয়া হউক এবং জনগণের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলিয়া গৃহীত হউক, এরপর ১৯৪৮ সনের ১০ই মার্চ ফজলুল হক হলের সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের যে সভা বসে, সেখানেও শামসুল হক পরের দিনের কর্মসূচীকে সামনে রেখে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখেন। উক্ত সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ছাত্ররা বিক্ষোভ প্রদর্শনসহ, শহরের গুরুত্বপূর্ণ এলাকাসমূহে পিকেটিং করে । ছাত্ররা সেক্রেটারীয়েটের সম্মুখে অফিস বর্জন করার জন্য শ্লোগান দিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, খালেক নেওয়াজ খান, অলি আহাদ প্রমুখ সেক্রেটারীয়েটের ১নং গেটে পিকেটিংয়ে অংশগ্রহণ করেন। এই সময় কর্তব্যরত পুলিশের সাথে শামসুল হকের তীব্র বাদানুবাদ হয়। ফলে ছাত্ররা পুলিশী হামলার সম্মুখীন হয়ে লাঠিচার্জ ও নির্যাতনের শিকার হন। সেখানে শামসুল হক সহ অনান্য সহযােগীদের গ্রেফতারপূর্বক কোতোয়ালী থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেদিন শােভা যাত্রা, বিক্ষোভ মিছিল, ছাত্রদের পিকেটিং এবং পুলিশের লাঠিচার্জের ফলে ঢাকা শহর বিক্ষোভের নগরীতে পরিণত হয় এবং ফজলুল হক সহ কমপক্ষে প্রায় ৫০ জন আহত হন। এই গ্রেফতার ও পুলিশী নির্যাতনের প্রতিবাদে ১২ হতে ১৫ই মার্চ প্রতিবাদ সভা ও ধর্মঘট অব্যাহত রাখার প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী নাজিমউদ্দীনের বাসভবনে মুসলিম লীগ সংসদীয় দলের সভা শুরু হলে ছাত্ররা প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন বর্ধমান হাউজের সম্মুখেও রাত ৯টা পর্যন্ত বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন এবং ১১ই মার্চের গ্রেফতারকৃত নেতাদের নিঃশর্ত মুক্তি দাবী পূর্বক রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রবর্তনের দাবী জানান। ছাত্রদের প্রচণ্ড চাপের মুখে প্রধানমন্ত্রী নাজিমউদ্দীন ছাত্র সগ্রাম পরিষদের সাথে বিনাশর্তে ৭ দফা চুক্তি সম্পাদন করতে বাধ্য হন। এই চুক্তিপত্রে সরকার পক্ষে নাজিম উদ্দিন এবং সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে শামসুল আলম স্বাক্ষর প্রদান করেন। চুক্তির শর্ত মােতাবেক ১৫ই মার্চ সন্ধ্যায় শামসুল হক সহ অন্যান্য নেতা গােলাম মাহবুব, শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ প্রমুখ কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন। নেতৃবৃন্দের জেল থেকে ছাড়া পাবার পরের দিন ১৬ই মার্চ নির্ধারিত কর্মসূচী অনুযায়ী শেখ মুজিবুর রহমান এক ছাত্র জনসভায় হঠাৎ উত্তেজনাকর বক্তৃতা প্রদানের পর কর্মসূচীর অন্তর্ভূক্ত মিছিল ও বিক্ষোভ না থাকলেও তিনি বিপুল পরিমাণ ছাত্রকে নিয়ে পরিষদ ভবনে মিটিং চলাকালীন সময়ে বিভিন্ন শ্লোগানে পরিষদ ভবন ঘিরে বিক্ষোভ প্রদর্শন সন্ধ্যা পর্যন্ত অব্যাহত রাখেন। ফলে অধিবেশন শেষ হবার ৩ ঘন্টা পরেও স্পীকার, ডেপুটি স্পীকার সহ মন্ত্রীবর্গ ঘেরাও অবস্থার শিকার হন।
৩১
অবস্থার চরম অবণতি ঘটলে ম্যাজিষ্ট্রেট রহমতুল্লাহ, শামসুল হককে পাঁচ মিনিটের মধ্যে পরিষদ ভবন ত্যাগ করার কঠোর নির্দেশ দেন। শামসুল হক বিপুল সংখ্যক ছাত্রকে সরিয়ে নিতে আরাে বেশি সময়ের প্রয়ােজন বলে উল্লেখ করলেই তাদের উপর এলােপাথাড়ি পুলিশের লাঠিচার্জসহ নির্যাতন নেমে আসে। বন্দুকের ফাঁকা গুলি ও কাঁদানে গ্যাস ইত্যাদিতে আক্রান্ত হয়ে প্রায় ১৯ জনের মত আহত হয়, ফলে ১৭ই মার্চ ঢাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে সরকারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে ধর্মঘট পালিত হয়। বেলা ১২-৩০ মিনিটে নাজিমউদ্দীন আহম্মেদের সভাপতিত্বে যে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয় তাতে শামসুল হক প্রধান বক্তা হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখেন। ১৯ শে মার্চ মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় আসেন। ২১ শে মার্চ ঢাকায় রমনা রেসকোর্স ময়দানে তার সম্মানে আয়ােজিত নাগরিক সম্বর্ধনায়, বক্তব্যের এক পর্যায়ে বলেন, “উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা”। জিন্নাহর মুখের কথা শেষ হবার সাথে সথে শামসুল হক নাে’, ‘নাে’ বলে চিৎকার করে দাঁড়িয়ে পড়লে তার সাথে সাথে আরাে অনেকে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করেন। পরে নাগরিক সম্বর্ধনা শেষে ওখানে দাড়িয়েই শামসুল হক উপস্থিত জনগণের উদ্দেশ্যে কায়েদে আজমের ভাষা বিষয়ক ঘােষণার নিন্দা জ্ঞাপন করে প্রতিবাদী বক্তব্য প্রদান করেন। এরপরে ২৪ শে মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ভাষণ দিতে গিয়ে জিন্নাহ আবার উল্লেখ করেন, “এটা আমার বিশ্বাস, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু হওয়া উচিত”। এখানেও ‘নাে’, ‘না’ ধ্বনি উচ্চারিত হলে অসাধারণ তিক্ষ্ণ মেধাসম্পন্ন ব্যক্তিত্বের অধিকারী জিন্নাহ তার বক্তব্যের আবারাে প্রতিবাদ হবার প্রেক্ষিতে সমস্যার গুরুত্ব উপলব্ধি করে প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বলেন, “প্রাদেশিক রাষ্ট্রভাষা প্রদেশবাসিই স্থির করবে”। এরপর তিনি ঐদিন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের প্রতিনিধিদের সাথে সন্ধ্যে ৬-৩০ মিনিটে সাক্ষাতকারে মিলিত হন। এই সময়ে কর্ম পরিষদের সদস্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন শামসুল হক, কমরউদ্দিন আহম্মেদ, আবুল কাশেম, তাজউদ্দিন আহম্মেদ, মােহাম্মদ তােয়াহা, সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রমুখ। এই সাক্ষাৎকারটি সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এবং এর বর্ণনা বেশ কয়েকটি বই এর পাতায় এবং লেখায় বিস্তারিতভাবে স্থান পেয়েছে। বাংলাদেশ প্রেস ইন্সটিটিউটের মহাপরিচালক, তৎকালীন সাপ্তাহিক ‘সৈনিক’ পত্রিকার অন্যতম সম্পাদক এনামুল হক তার এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “আমরা যে কাজ করতাম, আন্দোলন করতাম, ছাত্র সমাজের সে আন্দোলনে ব্রেইন বলতে যা বুঝায়, তা ছিলেন শামসুল হক।” জিন্নাহ’র সাথে সাক্ষাত্তার চলাকালে শামসুল হকের সাথে বিভিন্ন প্রসঙ্গে বেশ তর্কবিতর্কের সৃষ্টি হয় এবং রাষ্ট্র ভাষা কর্ম পরিষদের পক্ষ থেকে তাঁকে একটি স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। এই সময়ে স্মারকলিপির ১,২,৩ অনুচ্ছেদ পড়ার সাথে সাথে জিন্নাহ উত্তেজিত হয়ে উঠেন, এবং কর্কশ ভাষায় বলেন ঃ Stop all these nonsense. Look gentlemen, I called you to hear me and not to hear on. (ভাষা আন্দোলন ও সাতচল্লিশ থেকে বায়ান্ন জিন্নাহ বলেন, একধর্ম, এক ধর্মগ্রন্থ, একরাষ্ট্র সুতরাং দেশ ও জাতির সংহতির জন্যে ভাষাও এক হওয়া দরকার। শামসুল হক এই কথার প্রতিবাদ করলে জিন্নাহর সাথে তাঁর বিতর্কের সূচনা হয় এবং জিন্নাহ রাগান্বিত স্বরে শামসুল হককে উদ্দেশ্য করে বলেন, You are the man who always create trouble. I remember that you created trouble convention also along with moulana Hasrat Moulana Abdul
৩২
Hamid Khan Bhashasni and abul Hashi? [সূত্র ঃ ভাষা আন্দোলন : সাতচল্লিশ থেকে বায়ান্নঃ মােস্তফা কামাল/ সাক্ষাৎকার শামসুল আলম।] তবুও শামসুল হক হাল ছেড়ে দেননি, অসীম সাহস এবং অনমনীয় মনােভাব দেখিয়ে স্থিরচিত্তে জিন্নাহকে যুক্তি প্রদর্শন করে বলেছিলেন, “আপনার ডাকে দেশ স্বাধীন করার জন্যে আমরা লেখাপড়াসহ সবকিছু বিসর্জন দিয়ে পাকিস্তান আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়েছিলাম, সুতরাং দেশের ব্যাপারে, দেশের রাষ্ট্রভাষার ব্যাপারে আমাদের বক্তব্য রয়েছে।” জিন্নাহ্ প্রত্যুত্তরে অনেক কিছুই বলেছিলেন কিন্তু শামসুল হক ভাষার ব্যাপারে কখনাে আপােষ রক্ষায় রাজী হন নাই। বিদায়, নেওয়ার সময় তিনি জিন্নাহকে লক্ষ্য করে দীপ্ত প্রত্যয়ে বলেছিলেন, “প্রিয় কায়েদে আজম, আমাদের একটি দাবী ঃ তা হলাে, পাকিস্তানের বৃহত্তর জনগণের মায়ের ভাষাকে রাষ্ট্ৰীয় জীবনে সসম্মানে প্রতিষ্ঠা করা। পৃথিবীর এমন কোন শক্তিই নাই, সে যত বড়ই হােক না কেন, আমাদের এই ন্যায় সংগত এবং প্রাণের দাবীকে অগ্রাহ্য করে তা দাবিয়ে রাখে।” ১৯৪৯ সালের ১১ই অক্টোবরে লিয়াকত আলী খান ঢাকায় এলে মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে মিটিং ও মিছিলের মাধ্যমে বাংলাভাষার আন্দোলন জোরদার করা হলে শামসুল হক, মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। এক বছর পর শামসুল হক জেল থেকে বের হয়ে এসে সর্বদলীয় ভিত্তিতে বাংলাভাষার দাবীতে সংগ্রাম শুরু করেন। প্রতিটি সংগঠন থেকে সদস্য নিয়ে ৪০ জনের একটি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। এই সংগ্রাম কমিটি বাংলাভাষা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে বজশপথ সংকল্প ব্যক্ত করে। এ আন্দোলনকে জনপ্রিয় এবং পরিচালনার অর্থ সম্প্রহের জন্যে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” দাবী সম্বলিত ব্যাজ বিক্রিসহ ১১ই এবং ১৩ই ফেব্রুয়ারী পতাকা দিবস পালন করা হয়। রাষ্ট্রভাষা সগ্রামের তৎপরতাকে লক্ষ্য করে ঢাকাতে ১৪৪ ধারা জাী করা হয়। ফলে ১৯৫২ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারী, ৯৪ নবাবপুর আওয়ামী মুসলিম লীগ কার্যালয়ে সন্ধ্যায় এক সভা আহবান করা হয়। সভায় মূল আলােচ্য বিষয় থাকে ২১শে ফেব্রুয়ারী ১৪৪ ধারা ভাংগা হবে কিনা? সভায় দেশের সার্বিক পরিস্থিতির উপর আলােকপাত করে আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক তিনটি কারণ উল্লেখ করে ১৪৪ ধারা না ভাঙ্গার পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করেন। সভায় উপস্থিত অধিকাংশ সদস্য তাকে সমর্থন করলেও অলি আহাদ ও আব্দুল মতিন ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার পক্ষে জোরালাে যুক্তি রাখেন। পরে স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার জন্যে প্রস্তাবটি ভােটে দেয়া হয়। আবুল হাশিম, শামসুল হক, কমরউদ্দিন, খয়রাত হােসেন, কাজী গােলাম মাহবুব, খালেক নেওয়াজ খান, মির্জা গােলাম হাফিজসহ ১১জন ১৪৪ ধারা না ভাঙ্গার পক্ষে রায় দেন এবং অলি আহাদ, আব্দুল মতিন, গাজীউল হক, গােলাম মাওলা এই ৪ জন ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। মােহাম্মদ তােয়াহা ভােটদানে বিরত থাকেন। ফলে বৈঠকের সিদ্ধান্ত পরদিন ছাত্ৰজনসভায় জানিয়ে দেয়ার জন্য শামসুল হকের উপর দায়িত্ব অর্পিত হয়। ২০ তারিখ থেকেই পােষ্টার, ফেস্টুন, ব্যানারে ঢাকা শহর রক্তিম বর্ণমালার সগ্রামী চেহারায় সাজিয়ে তােলা হয়। ২১শে ফেব্রুয়ারী রাতে ১১টার সময় ঢাকা হলের পুকুরের পূর্বধারের সিঁড়ির উপর কতিপয় ছাত্রনেতা সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সিদ্ধান্তকে উপেক্ষা করে ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার জন্যে ঐক্যমতে পৌঁছেন। ছাত্ররা কলাভবনের সামনে একে একে সমবেত হতে থাকে। বেলা বাড়ার সাথে সাথে রাস্তাতেও খাকী হাফ-প্যান্ট পরা পুলিশের দল সারিবদ্ধভাবে এসে দাঁড়ায়। তারা কাউকে রেরুতে দেবে না,
৩৩
পরিষদ ভবনেও যেতে দেবে না, ১৪৪ ধারা কোনক্রমেই ভাঙ্গতে দেবেনা। কিন্তু ছাত্ররা তা মানবে না। এমন সময় শামসুল হক কালাে শেরওয়ানী এবং মাথায় জিন্নাহ ক্যাপ পরে আসেন এবং গাজীউল হকের সভাপতিত্বে আমতলায় তখন এক জরুরী সভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সভায় শামসুল হক সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সগ্রাম পরিষদের সিদ্ধান্তকে জানানাের জন্যে বক্তব্য রাখেন এবং বলেন, “১৪৪ ধারা ভাঙ্গা ঠিক হবে না।… নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পথেই আমাদের এগুনাে উচিত। কিন্তু শামসুল হকের এ কথা কারাে মনোঃপূত হলাে না এবং ছাত্ররা এ ধরণের প্রস্তাব শােনার জন্য মানসিক ভাবেও প্রস্তুত ছিল না। ছাত্ররা হৈ চৈ করে নানান প্রশ্ন শুরু করলাে। উত্তেজিত অবস্থায় হাসান হাফিজুর রহমান এক সময় চিৎকার করে শামসুল হককে Traitor বলে তার মাথার জিন্নাহ ক্যাপ দূরে ছুড়ে মারেন এবং বলেন, You have no right to speak, get out, এমন পরিস্থিতিতেও শামসুল হক বিচলিত হননি। অসীম ধৈৰ্য্য ও মনােবল দিয়ে তিনি পরিস্থিতির মােকাবিলা করেছেন। অতঃপর অধিকাংশ ছাত্রের মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যেই সিদ্ধান্ত হয়, ১৪৪ ধারা ভাঙ্গতে হবে। তখন সভার সভাপতি গাজীউল হক তার সমাপ্তি ভাষণে ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার সিদ্ধান্তের কথা ঘােষণা করেন। এমন পরিস্থিতিতে পরবর্তীতে শামসুল হককে নিয়ে কিছু বিতর্কের সৃষ্টি হয়। কিছু মানুষের সন্দেহ নিরসনের জন্য গাজীউল হক বলেছেন, “একথা সত্যি যে, জনাব শামসুল হক ১৪৪ ধারা না ভাঙ্গার জন্যে বক্তব্য রেখেছিলেন, কিন্তু যখন ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার সিদ্ধান্ত হলাে তখন তিনিই বলেন ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার সিদ্ধান্তের সাথে আমিও একমত আছি।” আব্দুল মতিন এক সাক্ষাৎকারে এ প্রসঙ্গে বলেছেন, “১৪৪ ধারা ভাঙ্গার সিদ্ধান্তের পর শামসুল হক আমাদের সাথে একাত্মতা ঘােষণা করেন। কারণ ১৪৪ ধারা না ভাঙ্গার মতামতটি শামসুল হকের নিজস্ব মত ছিলনা। তা ছিল, সর্বদলীয় সিদ্ধান্ত। এখানে শামসুল হক কেবলমাত্র মুখপাত্র ছিলেন। কিন্তু ছাত্ররা যখন ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার পক্ষে রায় ঘােষণা করেছেন তখন তিনিও বলেছিলেন, “এই রায় আমি মেনে নিলাম এবং সগ্রামের সাথে নিজেকে সংযুক্ত করলাম।” তারপর ১০ জন গ্রুপ করে ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার জন্যে ছাত্ররা রাস্তায় বের হয়। বিভিন্ন শ্লোগান সহকারে ছাত্ররা দলে দলে এগুতে থাকে, ১৪৪ ধারা ভাঙ্গতে থাকে। এতে ছাত্ররা পুলিশের হামলার সম্মুখীন হয়। লাঠিচার্জ, টিয়ার গ্যাস, ফাঁকা গুলিসহ পুলিশ ছাত্রদের বেদম মারপিট আরম্ভ করে। ক্রমান্বয়ে এলাকাটি যুদ্ধক্ষেত্রের রূপ ধারণ করে। অনেক নেতা-কর্মী এই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ত্যাগ করেন। কিন্তু শামসুল হক পরিস্থিতির ভয়াবহতা আঁচ করে, ছাত্রদেরকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়ে চলে যেতে পারলেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় গাজীউল হকের পাশেই তিনি দাঁড়িয়ে রইলেন। অতঃপর যা হবার তাই হলাে। অনেকেরই তা জানার কথা। বেলা ৩-১০ মিঃ। এই সময় ঘটে গেল ঢাকার বুকে নারকীয় ঘটনা। পুলিশ কোনরূপ পূর্ব সংকেত ছাড়াই মেডিকেল কলেজ হােষ্টেলের উল্টো দিকের দোকানের পিছন হতে জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট কোরাইশীর নির্দেশে গুলি চালায়। এতে আবুল বরকত, জব্বার, রফিক, সালাম ও সালাউদ্দিন শহীদ হন। আহতদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৯৬ জনের মত। তাছাড়া পুলিশ অনেক লাশ গুম করে। পরবর্তীতে হাফিজউদ্দিন লিখেন, “প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় যে, ১৪৪ ধারা ভাংগার পক্ষে যারা বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছিলেন, ঐতিহাসিক ২১শে ফেব্রুয়ারীর বিয়ােগান্তক ঘটনার পর তাদের
৩৪
অনেকেই গা ঢাকা দিয়েছিলেন। জনাব শামসুল হককে দেখেছি প্রায় উন্মাদের মত ছুটাছুটি করে ছাত্রদের নিয়ে আহতদের জন্যে হাসপাতালে যেতে । ভাষা আন্দোলনে শামসুল হকের এ ভূমিকা চির ভাস্বর হয়ে থাকবে”। সেদিনের সেই মর্মান্তিক ঘটনা সম্পর্কে অলি আহাদ এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ….. “সদ্য সংঘটিত মর্মান্তিক ও নৃশংস হত্যাকান্ডে আমরা উভয়েই [ শামসুল হক ও অলি আহাদ) মর্মাহত। হৃদয় বিদারক পরিস্থিতি আমাদের বাকশক্তি হরণ করে নিয়েছিল। প্রকৃতিস্থ হবার পর আমরা অত্যন্ত ধীরে ধীরে ও শান্ত কণ্ঠে উদ্ভূত পরিস্থিতি মূল্যায়ণে নিবিষ্ট হলাম”। এসব ঘটনাই ভাষা আন্দোলনে জনাব শামসুল হকের অবদানকে অম্লান করে রেখেছে। এরপর পুলিশ ব্যাপক ধরপাকড়, নিপীড়ন আরম্ভ করলে স্বাভাবিকভাবেই আন্দোলনে কিছুটা ভাটা পড়ে।
১৯শে মার্চ শামসুল হক গ্রেফতার হন। ২৫শে মার্চ তৎকালীন সাপ্তাহিক ইত্তেফাক শামসুল হকের গ্রেফতারের সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে বলা হয়, “পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক বিগত ১৯শে মার্চ বুধবার বেলা ১২ ঘটিকার সময় ঢাকা জেলা ম্যাজিষ্ট্রেটের নিকট হাজির হন। তাহাকে গ্রেফতার করিয়া ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে প্রেরণ করা হইয়াছে। গ্রেফতারের প্রাক্কালে জনাব হক বলেন, ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ছাত্র, যুবক ও জনসাধারণের মিলিত আন্দোলন। ইহা তাহাদের বাঁচিবার আন্দোলন। এই আন্দোলনের পিছনে কাহারাে উস্কানী নাই কিংবা কোন কুচক্রী ইহার সুযােগ লইতেছে, এই অভিযােগও সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। … সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করিতে হইলে বহু জুলুম ও হয়রানী সহ্য করিতে হইবে। কিন্তু সত্যের জয় অবধারিত।” কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের যে, শামসুল হকের সেই ভবিষ্যতবাণী শুধুই বাস্তবে পরিণত হয়নি, ভাষা আন্দোলনের ত্যাগ ও তিতিক্ষার পথ বেয়েই আমরা পৃথিবীর মানচিত্রে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের সংযােজন করেছি, যা সমকালীন ইতিহাসে একটি বিস্ময়, কিন্তু সেই সিংহশাবক আমাদের মাঝে আজ নেই। একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের পতনে তিনি কালে হারিয়ে গেছেন তার প্রিয় দেশবাসীর কাছ থেকে।
৫৪ সালের নির্বাচন
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগ বিরােধী যুক্তফ্রন্টের তৎপরতায় টাঙ্গাইলের অত্যন্ত প্রশংসনীয় ভূমিকা বাংলার ইতিহাসে চিরস্মরনীয় হয়ে থাকবে। এই নির্বাচনে টাঙ্গাইলের দুই কৃতি সন্তান জাতীয় নেতৃত্বে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। যুব নেতা শামসুল হকের প্রচেষ্টায় আওয়ামী লীগ যুক্তফ্রন্টের শরিক দল হিসাবে যােগদান করে। শামসুল হক তখন অসুস্থ ছিলেন। তিনি জানতে পারলেন ময়মনসিংহের অলকা সিনেমাহলে আওয়ামী লীগের অধিবেশন চলছে এবং আওয়ামী লীগ যুক্তফ্রন্টে যাবে কি যাবে না এ নিয়ে অধিবেশনে বিরােধ দেখা দিয়েছে। শামসুল হক তৎক্ষনাৎ টাঙ্গাইল থেকে ময়মনসিংহ ছুটে যান। অনেকটা অযাচিত ভাবেই তিনি মঞ্চে উঠে যুক্তফ্রন্ট হওয়া উচিৎ এই মর্মে বক্তব্য রাখেন। তার বক্তব্য অনুযারী অধিবেশনে নীতি নির্ধারণ করে যুক্তফ্রন্ট গঠন করা হয়। যুক্তফ্রন্ট গঠন করার পর মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী দেশের এক প্রান্ত থেকে
৩৫
অপর প্রান্ত পর্যন্ত উল্কার মত ছুটে বেরিয়েছেন। তার কর্মতৎপরতা ও যােগ্য নেতৃত্বের জন্য ঐ ফ্রন্টের নাম হয় হক-ভাসানী-সােহরাওয়ার্দীর যুক্তফ্রন্ট। যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে তাদের কর্মসূচী প্রনয়ন করা হয় ২১ দফার ভিত্তিতে। টাঙ্গাইলে মুসলীম লীগ বিরােধী যুক্তফ্রন্টের ব্যাপক সাড়া জাগে। নির্বাচনে টাঙ্গাইলে প্রতিটি আসনেই যুক্তফ্রন্ট মনােনীত প্রার্থীরা ব্যাপক ভােটের ব্যবধানে মুসলিম লীগ প্রার্থীদের পরাজিত করে। যুক্তফ্রন্টের প্রচার অভিযানের প্রথম দিকেই টাঙ্গাইল পার্ক ময়দানে এক বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত জনসভায় সভাপতির আসন গ্রহণ করেন মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। সভা পরিচালনা করেন হাফিজউদ্দিন। সভায় বক্তব্য রাখেন হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম, শামসুল হক, আবুল মনসুর আহম্মেদ, আতাউর রহমান খান, শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ। সভার সকল প্রকার ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিলেন মির্জা তােফাজ্জল হােসেন মুকুল। জাতীয় নেতৃবৃন্দ তাদের বক্তব্যে মুসলিম লীগ সরকারের সকল প্রকার বৈষম্যমূলক নীতির সমালােচনা করে ২১দফার ভিত্তিতে নৌকা মার্কায় ভােট দেওয়ার আহবান জানান। এই নির্বাচনী প্রচার অভিযানে টাঙ্গাইলের আর কোন জনসভায় জাতীয় নেতৃবৃন্দ আসেনি। স্থানীয় নেতৃবৃন্দ তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে সারা টাঙ্গাইলে যুক্তফ্রন্টের পক্ষে ব্যাপক সমর্থন আদায় করে। যে সকল স্থানীয় নেতৃবৃন্দ টাংগাইলের প্রতিটি এলাকায় সভাসমাবেশ করতে যান তাদের মধ্যে ছিলেন মােহাম্মদ আলী, হাফিজউদ্দিন, মির্জা তােফাজ্জল হােসেন মুকুল,শামসুর রহমান খান শাজাহান, হাতেম আলী খান, খােদা বক্স মােক্তার প্রমুখ। সারা দেশের মত টাঙ্গাইলেও যখন যুক্তফ্রন্টের পক্ষে ব্যাপক জনজোয়ার সৃষ্টি হয় তখন মুসলীম লীগ সরকার মারাত্মক ভাবে দমননীতি চালায়। সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের এক মাস আগেই মির্জা তােফাজ্জল হােসেন মুকুল ও ফজলুর রহমান কায়সারকে গ্রেফতার করে এবং নির্বাচনের পর যুক্তফ্রন্ট সরকার তাদের মুক্তি দেয়। শামসুর রহমান খান শাজাহান, হাফিজউদ্দিন, রমিনুজ্জামান রইজ এর বিরুদ্ধে সরকার গ্রেপ্তারী পরােয়ানা জারী করে। নির্বাচনের সময় বিভিন্ন স্থানে মুসলিম লীগ সরকার যুক্তফ্রন্টের সভাসমাবেশ ভাঙ্গার চেষ্টা চালায়। ভুয়াপুরের শিয়াল খােলে যুক্তফ্রন্টের একটি নির্বাচনী সভা ভেঙ্গে দেয়। মুসলিম লীগ সরকারের সকল প্রকার ভয়ভীতিকে উপেক্ষা করে যেমনি যুক্তফ্রন্টের নেতা কর্মীরা নির্বাচনী প্রচার চালায় তেমনি তাদের প্রচারে জনগন যুক্তফ্রন্টের প্রতি সমর্থন নিয়ে ব্যাপক ভাবে এগিয়ে আসে। সাধারণ মানুষ সেদিন সরকারের ভয়ভীতি ও লােভ লালসাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। প্রত্যাখ্যান করে মুসলিম লীগ সরকারের সকল প্রকার অপপ্রচারকে। মুসলিম লীগের মন্ত্রীরা, নেতারা, কর্মীরা ধর্মের দোহাই দিয়ে ভােট চাইতে আসত। তারা বলত নৌকা মার্কায় ভােট দেওয়া মানে বিধর্মীকে ভােট দেওয়া। নৌকা মার্কায় ভােট দেওয়া আর ইসলামের বিরুদ্ধে ভােট দেওয়া একই কথা। নৌকা মার্কায় ভােট দিলে দেশ হিন্দুস্তানে পরিণত হবে। যুক্তফ্রন্ট নেতৃবৃন্দ হিন্দুস্তানের দালাল। কিন্তু মুসলিম লীগ সরকারের সকল প্রকার মিথ্যা অপপ্রচারকে উপেক্ষা করে টাঙ্গাইলের জনগণ যুক্তফ্রন্টের নৌকা মার্কায় ভােট দিয়ে মুসলীম লীগ প্রার্থীদের ব্যাপক ভােটের ব্যবধানে পরাজিত করে। সেদিন যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসাবে যারা বিজয় অর্জন করেন তারা হলেন মধুপুরে অধ্যাপক আজহারুল ইসলাম, গােপালপুরে হাতেম আলী খান, ঘাটাইলে আহমদ আলী খান, কালিহাতীতে আমীর আলী খান, টাঙ্গাইলে খােদা বক্স মােক্তার, মির্জাপুরে এডভােকেট জমির উদ্দীন, নাগরপুরে এল, আর. খান। টাঙ্গাইলের সব কয়টি আসনে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থীরা ব্যাপক ভােটের ব্যবধানে বিজয়ী হন। বিজয়ী প্রার্থীদের মধ্যে একমাত্র এল.আর.
৩৬
খান ছিলেন কৃষক-প্রজা পার্টির আর সবাই ছিলেন আওয়ামী লীগের নেতা। নির্বাচনে বিজয় অর্জনের পর শেরে বাংলা আবুল কাসেম ফজলুল হকের নেতৃত্বে প্রাদেশিক মন্ত্রী পরিষদ গঠিত হয়। ১৯৫৪ সালের মুসলিম লীগ বিরােধী যুক্তফ্রন্টের অন্তর্ভুক্ত রাজনৈতিক দলগুলি ছিল মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগ, শেরে বাংলা আবুল কাসেম ফজলুল হকের কৃষক শ্রমিক পার্টি, নেজামে ইসলাম পার্টি, কমিউনিস্ট পার্টি ও খেলাফতে রাব্বানী পার্টি। যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা ছিল নিম্নরূপঃ
(১) বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা হবে।
(২) বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারী ও সমস্ত খাজনা আদায়কারী স্বত্ব উচ্ছেদ ও রহিত করে ভূমিহীন কৃষকের মধ্যে উদ্বৃত্ত জমি বিতরণ করা হবে এবং উচ্চ হারের খাজনা ন্যায় সংগতভাবে হ্রাস করা হবে এবং সার্টিফিকেটযােগে খাজনা আদায়ের প্রথা রহিত করা হবে।
(৩) পাট ব্যবসাকে জাতীয়করণ করে পূর্ববংগ সরকারের প্রত্যক্ষ পরিচালনাধীনে এনে পাট চাষীদের পাটের মূল্য দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে এবং লীগ মন্ত্রীসভার আমলের পাট কেলেংকারী তদন্ত করে সংশ্লিষ্ট সকলের শাস্তির ব্যবস্থা ও তাদের অসদুপায়ে অর্জিত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে।
(৪) কৃষি উন্নতির জন্য সমবায় কৃষি ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হবে ও সরকারী সাহায্যে সকল প্রকার কুটির ও হস্তশিল্পের উন্নতি সাধন করা হবে।
(৫) পূর্ব বংগকে লবণ শিল্পে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার জন্য সমুদ্র উপকূলে কুটির শিল্পের ও বৃহৎ শিল্পের লবণ তৈরীর কারখানা স্থাপন করা হবে এবং মুসলিম লীগ মন্ত্রীসভার আমলের লবণের কেলেংকারী সম্পর্কে তদন্ত করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের শাস্তির ব্যবস্থা ও তাদের অসদুপায়ে অর্জিত যাবতীয় অর্থ। বাজেয়াপ্ত করা হবে।
(৬) শিল্প ও কারিগর শ্রেণীর গরীব মােহাজেরদের কাজের আশু ব্যবস্থা করে তাদের পুণর্বসতির ব্যবস্থা করা হবে।
(৭) খাল খনন ও সেচের ব্যবস্থা করে দেশকে বন্যা এবং দুর্ভিক্ষের কবল থেকে রক্ষা করা হবে।
(৮) পূর্ব বংগকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে শিল্পায়িত ও কৃষিকে আধুনিক যুযযাপযােগী করে শিল্প ও খাদ্যে দেশকে স্বাবলম্বী করা হবে এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংঘের মূলনীতি অনুসারে শ্রমিকদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক এবং সকল প্রকার অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা হবে।
(৯) দেশের সর্বত্র একযােগে প্রাথমিক ও অবৈতনিক বাধ্যতামূলক শিক্ষা প্রবর্তন এবং শিক্ষকদের ন্যায়সংগত বেতন ও ভাতার ব্যবস্থা করা হবে।
(১০) শিক্ষা ব্যবস্থার আমুল সংস্কারের মাধ্যমে শিক্ষাকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে কার্যকর করে কেবলমাত্র মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা দানের ব্যবস্থা করা হবে এবং সরকারী ও বেসরকারী বিদ্যালয়সমূহের বর্তমান ভেদাভেদ উঠিয়ে দিয়ে সকল বিদ্যালয়সমূহকে সরকারী সাহায্যপুষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হবে এবং শিক্ষকদের উপযুক্ত বেতন ও ভাতার ব্যবস্থা করা হবে।
৩৭
(১১) ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আইন প্রভৃতি প্রতিক্রিয়াশীল কানুন বাতিল ও রহিত করে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে উচ্চ শিক্ষাকে সস্তা ও সহজলভ্য করা হবে এবং ছাত্রাবাসের অল্পব্যয়সাধ্য ও সুবিধাজনক বন্দোবস্ত করা হবে।
(১২) শাসন ব্যয় সর্বাত্মকভাবে হ্রাস করা হবে এবং তদুদ্দেশে উচ্চ বেতন ভােগীদের বেতন কমিয়ে ও নিম্ন বেতনভােগীদের বেতন বৃদ্ধি করে তাদের আয়ের একটি সুসংগত সামঞ্জস্য বিধান করা হবে। যুক্তফ্রন্টের কোন মন্ত্রী এক হাজারের বেশী বেতন গ্রহণ করবেন না।
(১৩) দুনীতি ও স্বজনপ্রীতি, ঘুষ-রিশওয়াত বন্ধ করে কার্যকর ব্যবস্থা করা হবে এবং এতদুদ্দেশ্যে সমস্ত সরকারী ও বেসরকারী পদাধিকারী ব্যবসায়ীর ১৯৪০ সাল হতে বর্তমান সময় পর্যন্ত সময়ের আয়-ব্যয়ের হিসাব-নিকাশ নেওয়া হবে এবং সন্তোষজনক কৈফিয়ত দিতে না পারলে তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে।
(১৪) জননিরাপত্তা আইন ও অর্ডিন্যান্স প্রভৃতি কালা-কানুন রদ ও রহিত করে বিনা বিচারে আটক বন্দীকে মুক্তি দেওয়া হবে ও রাষ্ট্রদ্রোহীতার অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের প্রকাশ্য আদালতে বিচার করা হবে এবং সংবাদপত্র ও সভা সমিতি করার অধিকার অবাধ ও নিরংকুশ করা হবে।
(১৫) বিচার বিভাগকে শাসন বিভাগ হতে পৃথক করা হবে।
(১৬) যুক্তফ্রন্টের প্রধানমন্ত্রী বর্ধমান হাউসের পরিবর্তে অপেক্ষাকৃত কম বিলাসবহুল বাড়িতে বাসস্থান নির্দিষ্ট করবেন এবং বর্ধমান হাউসকে আপাতত ছাত্রাবাস ও পরে বাংলা ভাষার গবেষণাগারে পরিণত করা হবে।
(১৭) বাংলা রাষ্ট্রভাষার দাবীতে যারা মুসলিম লীগ সরকারের পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়েছেন, তাদের পবিত্র স্মৃতিচিহ্ন স্বরূপ ঘটনাস্থলে একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করা হবে এবং তাদের। পরিবারবর্গকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে।
(১৮) ২১শে ফেব্রুয়ারীকে শহীদ দিবস ঘােষণা করে উহাকে সরকারী ছুটির দিন ঘােষণা করা হবে।
(১৯) লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ব বংগকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রদান ও সার্বভৌম করা হবে এবং দেশরক্ষা, পররাষ্ট্র ও মুদ্রা ব্যতীত আর সমস্ত বিষয় পূর্ববংগ সরকারের হাতে আনা হবে। দেশরক্ষা বিভাগের স্থল বাহিনীর হেডকোয়ার্টার পশ্চিম পাকিস্তানে ও নৌবাহিনীর হেডকোয়ার্টার পূর্ব পাকিস্তানে স্থাপন করা হবে এবং পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র নির্মাণ কারখানা স্থাপন করে পূর্ব পাকিস্তানকে আত্মরক্ষায় স্বয়ংসম্পূর্ণ করা হবে। আনসার বাহিনীকে সশস্ত্র বাহিনীতে পরিণত করা হবে।
(২০) যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রীসভা কোন অজুহাতেই আইন পরিষদের আয়ু বাড়াবে না। আইন পরিষদের আয়ু শেষ হবার ছয় মাস পূর্বেই মন্ত্রীসভা পদত্যাগ করে নির্বাচন কমিশনের মারফত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করবেন।
(২১) যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রীসভার আমলে যখন যে আসন শূন্য হবে, তিন মাসের মধ্যে তা পূরণের জন্য উপনির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবে এবং পরপর তিনটি উপনির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের মনােনীত প্রার্থী পরাজিত হলে মন্ত্রীসভা স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করবেন।
৩৮
ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলন ও মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসনিী
১৯৫৭ সালের ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলন তৎকালীন পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি উল্লেখযােগ্য ঘটনা। এই সম্মেলনের মধ্য দিয়েই পাকিস্তানের প্রধান বিরােধী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের প্রথম ভাংগন শুরু হয়। তাই ভাঙ্গনের মাধ্যমেই মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) নামে আরাে একটি নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটে। ১৯৫৬ সালের ১২ই সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের আওয়ামী লীগের প্রধান হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী কেন্দ্রীয় প্রধানমন্ত্রীর আসন গ্রহণ করার পরই দলের মধ্যে তীব্র মতবিরােধ দেখা দেয়। আঞ্চলিক স্বায়ত্ত্বশাসন ও পররাষ্ট্র নীতিতে এবং ২১ দফা বাস্তবায়নের বিষয় নিয়েই মূলত: বিরােধ ছিল আওয়ামী লীগের। ১৯৫৩, ১৯৫৫, ১৯৫৬ সালে অনুষ্ঠিত অধিবেশনের মাধ্যমে স্বায়ত্তশাসনের পাশাপাশি পররাষ্ট্রনীতির দাবী তুলে ধরা হয়েছে। আওয়ামী লীগ দলীয় কর্মসূচি হিসাবে স্বায়ত্ত্বশাসনের যে দাবী নিয়ে সােচ্চার ছিল শহীদ সােহরাওয়াদী প্রধানমন্ত্রী হবার পর পররাষ্ট্র ও স্বায়ত্ত্বশাসনের ব্যাপারে যে কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন তা ছিল সংগঠনের কর্মসূচি পরিপন্থী। শহীদ সােহরাওয়ার্দীর সঙ্গে মওলানা ভাসানীর বিরােধ দেখা দেয় আঞ্চলিক স্বায়ত্ত্বশাসন, পররাষ্ট্রনীতি ও ২১ দফা বাস্তবায়ন নিয়ে। মওলানা ভাসানী বিভিন্ন সভা সমিতিতে প্রধানমন্ত্রীর নীতি ও কার্যকলাপের তীব্র সমালােচনা শুরু করেন। ১৯৫৭ সালের ১৪ ই সেপ্টেম্বর পল্টনের জনসভায় দলের ঘােষিত নীতি ও কর্মসূচির ভিত্তিতে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্ত্বশাসন সহ ২১ দফা বাস্তবায়ন এবং স্বাধীন ও জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি প্রতিষ্ঠার দাবী প্রস্তাব আকারে গৃহিত হয়। ঐ জনসভায় সভাপতির ভাষণে মওলানা ভাসানী যে বক্তব্য প্রদান করেন তা ছিল বিরােধী দলীয় নেতার মত। ভাসানীর বক্তব্য প্রধানমন্ত্রী শহীদ সােহরাওয়ার্দীকে ক্ষিপ্ত করে তােলে। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার মাত্র তিন দিনের মধ্যে আয়ােজিত জনসভায় শহীদ সােহরাওয়ার্দী যে বক্তব্য রাখেন তা ছিল আওয়ামী লীগের ঘােষিত কর্মসূচির প্রকাশ্য বিরােধিতা। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার মাত্র ৬ মাস আগে ১৯৫৬ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের ২৬ তারিখে স্বায়ত্ত্বশাসনের বিধানবিহীন শাসনতন্ত্র রচনার প্রতিবাদে সােহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে গণপরিষদের সদস্যরা অধিবেশন হতে বেরিয়ে আসে। ৬ মাস পরে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর স্বায়ত্তশাসন বিহীন শাসনতন্ত্রের প্রশংসা করে বক্তব্য দেয়া আওয়ামী লীগ কর্মীদের এবং জনসাধারণের মনে মারাত্মক ক্ষোভের সৃষ্টি করে। আওয়ামী লীগ-এর সভাপতি মওলানা ভাসানীর বক্তব্যের সমালােচনা করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শহীদ সােহরাওয়ার্দী যে ভাষণ দেন তাতে ভাসানী সাহেবকে বিভিন্ন ধরণের হুমকি ও কটুক্তি করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শহীদ সাহেব ও ভাসানীর বিরােধের অন্যতম কারণ ছিল পররাষ্ট্রনীতির বিষয়। আওয়ামী লীগ বিদেশী প্রভাবমুক্ত সাধারণ রাষ্ট্র হিসাবে পাকিস্তানের প্রগতিশীলদের সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতি গ্রহণের দাবী করে। কিন্তু পাক সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে সামরিক চুক্তি ও যুদ্ধজোটে অংশগ্রহণ করে। ১৯৫৪ সালের ১৯শে মে পাক-মার্কিন পারস্পরিক প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরের পর পাকিস্তান একই বছর ১০ই সেপ্টেম্বর গঠিত সিয়্যাটোতে যােগদান করে। ১৯৫৫ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে পাকিস্তান যযাগদান করে বাগদাদ চুক্তিতে। চুক্তিগুলাে সম্পাদিত হওয়ার পর হতেই ভাসানীসহ স্বায়ত্ত্বশাসনের
৩৯
জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতির দাবীদারগণ বিরােধিতা করে আন্দোলন গড়ে তােলার চেষ্টা করে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর শহীদ সাহেব ঐ সমস্ত চুক্তির পক্ষ অবলম্বন করে সাম্রাজ্যবাদী পররাষ্ট্রনীতির রক্ষক ও প্রবক্তা সাজেন। সাম্রাজ্যবাদী পররাষ্ট্রনীতিকে কেন্দ্র করে ভাসানী ও
শহীদ সাহেবের বিরােধ তীব্র আকার ধারণ করে ১৯৫৬ সালের অক্টোবর মাসে। এই সময়ে বৃটেন এবং ইসরাইল সুয়েজ খাল প্রশ্নে মিশরের উপর মিলিতভাবে আক্রমণ চালালে মওলানা ভাসানীর ডাকে পাকিস্তানে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে ওঠে। ১৯৫৬ সালের ৯ই নভেম্বর সারা পূর্ব পাকিস্তানে সুয়েজ বস ও হরতাল পালিত হয় এবং পশ্চিম পাকিস্তানেও আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। ভাসানী সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী আন্দোলন গড়ে তুললেও প্রধানমন্ত্রী শহীদ সােহরাওয়ার্দী সাম্রাজ্যবাদী শক্তির কাছ থেকে সরে আসেননি। প্রধানমন্ত্রী শহীদ সাহেবের ভূমিকায় মিশরের রাষ্ট্র প্রধান নাসের এত বেশী ক্ষুব্ধ হন যে, সুয়েজ খালের তীরে জাতিসংঘ বাহিনীতে তিনি পাকিস্তানী সৈন্য গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শহীদ সাহেবের মিসর সফরের আগ্রহকেও তিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। সরকারের সাম্রাজ্যবাদমুখী পররাষ্ট্রনীতির বিরুদ্ধে তার নিজের দলে নেতৃত্ব প্রদান করায় ক্ষিপ্ত হয়ে প্রধানমন্ত্রী সাহীদ সাহেব অচিরেই আন্দোলন কারীদের বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা নেন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের ধারণ সম্পাদক শামছুল হক ওসমানিকে তিনি অপসারণ করলে পশ্চিম পাকিস্তানে সংগঠন খন্ডিত হয়ে পড়ে। পূর্ব পাকিস্তানেরও দলীয় নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযানকালে প্রধানমন্ত্রী শহীদ সােহরাওয়ার্দী ভাসানীকে ভারতের অর্থপ্রাপ্ত দালাল বলে অভিহিত করেন। বিভিন্ন ভাষণে শহীদ সাহেব বলেন তিনি ভাসানীর মত পাকিস্তানের ভাঙ্গন বা ভারতের অঙ্গরাজ্য বানানাের নৃত্যে অংশগ্রহণ করতে রাজী নন। তিনি আরাে বলেন ভাসানী সম্পর্কিত যে সমস্ত দলিল পত্র আছে তা প্রকাশ করলে জনসাধারণই ভাসানীর বিচার করবে। প্রধানমন্ত্রী ক্রমাগতভাবে ভাসানীর ওপর বিভিন্ন ক্রিমণাত্মক কার্যকলাপ শুরু করে। ১৯৫৬ সালের ৯ই ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ হালের এক সমাবেশে ভাষণদানকালে প্রধানমন্ত্রী শহীদ সােহরাওয়ার্দী তার বিখাত জেরো থিউরী পস্থাপিত করে বলেছিলেন, মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্কের অর্থ হল একটি শূন্যের সাথে কয়েকটি শুন্যের যােগফল আরাে একটি শূন্য। ১৯৫৬ সালের ডিসেম্বর মাসের ১৩ তারিখে প্রধানমন্ত্রী শহীদ সাহেবের বক্তব্যের সমালােচনা করে মওলানা ভাসানী বলেল, আওয়ামী লীগের ঘােষিত কর্মসূচি ও তি পরিবর্তনের অধিকার একমাত্র দলীয় কাউন্সিল সভারই আছে, কোন ব্যক্তি বিশেষের নেই। এই অবস্থার প্রেক্ষিতে মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন আহ্বান করেন। এই কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৫৭ সালের ৭ ও ৮ই ফেব্রুয়ারী, টাঙ্গাইল শহরের দক্ষিণ প্রান্তে কাগমারী নামক স্থানে। কাগমারীতে কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় বলে এটা কাগমারী সম্মেলন মে সমধিক পরিচিত। আওয়ামী লীগের সম্মেলনে রাজনৈতিক অধিবেশনের পাশাপাশি মওলানা সানী বিরাট আকারের যে সপ্তাহব্যাপী কৃষি শিল্প প্রদর্শনী ও সাংস্কৃতিক সম্মেলনের আয়ােজন রেছিলেন তা ছিল এক অভূতপূর্ব ঘটনা। সে কালের প্রেক্ষিতে প্রাদেশিক নয় , জাতীয় নয়, একটি ন্তির্জাতিক সম্মেলনের আয়ােজন, তাও আবার ঢাকায় নয় কাগমারীর মত একটি অজপাড়াগায়ে নুষ্ঠিত হয়। এটা ছিল তঙ্কালীন সময়ের জন্য একটি দুঃসাহসিক ব্যাপার। অতি অল্প সময়ের চারে এবং প্রস্তুতিতে কাগমারী সম্মেলন সুষ্ঠুভাবে সুসম্পন্ন হয়েছিল। এই সম্মেলন প্রদেশের ধিকার আন্দোলনের ক্ষেত্রে এক জোয়ার সৃষ্টি করেছিল, যে জোয়ারে কেপে উঠেছিল এদেশের ষক ও শােষক গােষ্ঠী।
৪০
টাঙ্গাইল শহর হতে দু মাইল দুরে কাগমারীতে এই সম্মেলনের স্থান করা হয়েছিল। প্রস্তুতি পরিষদের সদস্যগণ ছাড়াও অসংখ্য প্রগতিশীল তরুণ কর্মীরা সম্মেলনকে সাফল্য মন্ডিত করে তােলার জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছিল। সম্মেলন স্থলে মওলানা ভাসানী প্যান্ডেল নির্মান এবং আস্থায়ী বাসস্থানে কর্মী ও অতিথিদের খাবারের ব্যবস্থা করেন। টাঙ্গাইল শহর হতে কাগমারী পর্যন্ত দুইমাইল দীর্ঘ রাস্তাতে ৫১ টি তােরণ নির্মান করেন। হযরত মােহাম্মদ তােরণ,আবুবকর তােরণ, হযরত ওমর,হযরত ওসমান, হযরত আলী, আব্দুল কাদের জিলানী,হযরত ঈমান গাজ্জলি, হযরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী, হযরত রাবেয়া তাপসী, মওলানা শওকত আলী, মওলানা মােহাম্মদ আলী, মওলানা হাসরত মােহানী, মওলানা আজাদ সােবহানী, মহাকবি ইকবাল, মােহাম্মদ আলি জিন্নাহ, ডঃ মােহাম্মদ শহীদুল্লাহ ও মসনদ-ঈ আলী ঈশা খা, হযরত পীর শাহজাহাজামান, স্যার সলিমুল্লাহ, শহীদ তিতুমীর, দুদুমিয়া, হাজী শরিয়ত উল্লাহ, হাজী মােহাম্মদ মােহসীন, আমীর আলী, স্যার সৈয়দ আহম্মদ খান, স্যার জাহিদ সােহরাওয়ার্দী, মহামতি লেনিন, চেয়ারম্যান মাওসেতুঙ, মহাত্মাগান্ধী, ব্যারিস্টার চিত্ত রঞ্জন দাস, নেতাজী সুভাস চন্দ্র বসু, ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়, জহর লাল নেহেরু, কাজী নজরুল ইসলাম, মহামতি স্টালিন, শেলী, বায়রন, রুমী, ঈমাম আবু হানিফা, ওয়ার্ডসওয়ার্থ সহ আরাে অনেকের নামেই তােরণ নির্মান হয়। সর্বপ্রথম এবং সর্বশেষ তােরণ ছিল কায়েদ-ঈ-আজম তােরণ। সম্মেলনস্থল ছিল অত্যন্ত জাকজমকপূর্ণ। কমরেড মেহেদির ভাষায় সম্মেলনের সাত দিন প্রাদেশিক রাজধানী, ঢাকার পরিবর্তে মনে হয় কাগামারীতে স্থানান্তর করা হয়েছে। তৎকালীন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধান মন্ত্রী শহীদ সােহরাওয়ার্দী ও পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক মন্ত্রীপ্রধান আতাউর রহমানসহ বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এবং প্রায় সমস্ত প্রাদেশিক মন্ত্রীসহ বহু গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ সম্মেলনে উপস্থিত হয়েছিলেন। অনেক মন্ত্রীই তাবুতে বসে তাদের কাজ করেছেন। ছনের ঘর তােলা হয়েছিল। ঘরগুলােতে দূর দূরান্ত হতে আগত ডেলিকেটদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ডেলিগেট বা প্রতিনিধি ছাড়াও প্রায় কয়েক লক্ষ লােকের সমাবেশ হয়েছিল। লক্ষ লক্ষ লােকের থাকা, খাওয়া, পানি ও পায়খানার যে সুন্দর ব্যবস্থা করা হয়েছিল তা সত্যিই আশ্চর্যজনক। সেখানে বিদ্যুতায়িত করা হয়েছিল। টেলিফোন, টেলিগ্রাম, সেক্রেটারী অফিস সহ বহু অফিস রুম ছিল অস্থায়ী ভাবে। চিকিৎসার ব্যবস্থাও ছিল সেখানে। মাটি খনন করে সুন্দর চুলা তৈরি করা হয়েছিল। একাধারে ৬ দিন ৬ রাত চুলার আগুন নেভেনি। এক স্থানে হাজার হাজার মাটির বাসন জমা রাখা হয়েছিল। মানুষ ইচ্ছামত বাসন নিয়ে ভাতের স্থান হতে ভাত নিয়ে যেতাে ডালের নৌকার দিকে। ডাল রান্না করে বড় বড় নৌকায় ভর্তি করে রাখা হয়েছিল। কাজেই বড় বড় ছাতা নিয়ে কর্মীরা প্রতিটি নৌকার কাছে দাড়িয়ে থাকত। ভাতের বাসন নিয়ে কেউ এলেই কর্মীরা এক থালা ভাত ও ডাল দিয়ে দিত। খাওয়া শেষে বাসনটা পরিস্কার করে যথা স্থানে রেখে দিত। সম্মেলনে লক্ষ লক্ষ লােকের সমাবেশ হলেও সেখানে কোন প্রকার হৈ হুল্লোড় ছিল না। সবাই যেন চলছে একটি নির্দিষ্ট নিয়মে। এত বড় বিশাল জনসভা ও বিশাল সম্মেলন, সুন্দর এবং সুষ্ঠুভাবে হতে পেরেছিল মওলানা ভাসানীর সুব্যবস্থার কারণেই। কাগমারী সম্মেলনে অবিস্মরণীর বিষয় ছিল সম্মেলনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বা সাংস্কৃতিক অধিবেশন। এ অনুষ্ঠানটি বাঙ্গালি জাতির ইতিহাসে একটি মাইল ফলক হিসাবে চিহ্নিত। সাংস্কৃতিকসম্মেলন শুরু হয় ৮ই ফেব্রুয়ারীতে এবং ৯১০ তারিখ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়। এই অধিবেশন ডঃ কাজী মােতাহার হােসেনের সভাপতিত্বে শুরু হয়। আধিবেশন উদ্বোধন করেন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় প্রধানমন্ত্রী জনাব
৪১
হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী। এ দুই দিনের অধিবেশনে শুধুমাত্র দেশই নয়, বহু বিদেশী ব্যক্তি উপস্থিত ও অংশগ্রহণ করেছিল। বিদেশীদের মধ্যে যারা সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন তাদের মধ্যে ছিলেন মিশরের হাসান হাসবী,কানাডার ডঃ চার্লস. জে. এডামস, ইংল্যান্ডের ডক্টর এফ. এইচ. কওসন, আমেরিকার জোভড গার্থ, ভারতের হুমায়ুন কবীর,কাজী আব্দুল ওদুদ, তারা শংকর বন্দোপাধ্যায়, নরেন্দ্র দেব, প্রবােধ কুমার স্যান্নাল,রাধারানী দেবী,মিসেস সােফিয়া ওয়াহিদা। পশ্চিম পাকিস্তান হতে আসেন মওলানা আব্দুল কাদের, মাদাম আজুরীসহ আরাে কয়েকজন। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় অধিকাংশ জাতীয় সাহিত্যিক, কবি, ইতিহাসবিদ, লেখক, শিল্পী, গায়ক উপস্থিত ছিলেন। উপস্থিত পূর্ব পাকিস্তানের বিশিষ্ট কবি সাহিত্যিক শিক্ষাবিদও বুদ্ধিজীবিদের মধ্যে ছিলেন ডঃ মােঃ শহীদুল্লাহ, ডঃ কুদরত-ই-খুদা, ডঃ মুহাম্মদ এনামুল হক, ডা মােহাম্মদ হােসেন, ডঃ গােবিন্দ চন্দ্র দেব, ডঃ আখলাকুর রহমান, ডঃ মােহাম্মদ ওসমান গনি, ডঃ নুরুল ইসলাম , ডঃ এ বি এম হালিম, ডঃ শামছুউদ্দিন আহম্মেদ, ডঃ এম এ নন্দী, বেগম শামছুন নাহার মাহমুদ, ডি পি আই আব্দুল হাকিম, অধ্যাপক ওসমান গনি, শওকত ওসমান, বি. এম. আব্বাস, মিসেস কুমকুম বেগম প্রমুখ। উপস্থিত কবি সাহিত্যিক গণ প্রায় প্রতিদিনই এ অনুষ্ঠানে প্রবন্ধ পাঠ ও কবিতা পাঠ করেন। প্রতিদিন সন্ধ্যার পরে সংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের গান শুরু হত । গানের অনুষ্ঠানে অংশ নিতেন রমেশ শীল, তাসের আলী, মােসলেম, রাম সিং, মজিদ মিয়া, সুখেন্দ্র চক্রবর্তী, আব্বাস উদ্দিন, বেদারুদ্দিন, সােহরাব হােসেনসহ আরাে অনেকে। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন এলাকা হতে আঞ্চলিক শিল্পীর দল উপস্থিত ছিল। চট্টগ্রাম, সিলেট, কুমিল্লা, রংপুর কুষ্টিয়া যশাের ময়মনসিংহ হতে শিল্পীদের মধ্যে ছিল লালন শাহ দল, লীগ, লাঠি তরবারী, রামদা খেলার দল, সরদার বাড়ী খেলার দল প্রভৃতি। পশ্চিম পাকিস্তান হতে লােকনৃত্য দল লাজুরী ও তার দলসহ বহু একক শিল্পী ও গায়ক গায়িকা উপস্থিত হয়েছিলেন। এই সাংস্কৃতিক অধিবেশন প্রমাণ করে দেয়। মওলানা ভাসানীই ছিলেন তৎকালীন সময়ের পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র নেতা যিনি সংস্কৃতিকে রাজনীতি থেকে আলাদা করে দেখেননি। আমৃত্যু তিনি শিক্ষা ও সংস্কৃতির জন্য সংগ্রাম করে গেছেন। সম্মেলনের রাজনৈতিক অধিবেশনে ৭ ই ফেব্রুয়ারী মওলানা ভাসানী সভাপতির ভাষণ দেন। মওলানা ভাসানী তার বক্তব্যে মুসলিম লীগের কঠোর সমালােচনা যেমন করেন, তেমনি তার নিজের দলের সমালােচনা ও করেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর হতে ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত যে অন্যায় অবিচার জুলুম করেছে পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণের ওপর তার খতিয়ান তিনি তুলে ধরেন। অপরদিকে তার নিজের দল আওয়ামী লীগের ভুল ত্রুটির সমালােচনা করেন। ঐ সময়ে পূর্ব পাকিস্তানে আতাউর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের প্রাদেশিক মন্ত্রীসভা ক্ষমতায় ছিল। ভাসানী তার বক্তব্যে ২১ দফা দাবী বাস্তবায়ন, আঞ্চলিক স্বায়ত্ত্বশাসন ও জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতির পক্ষে জোর বক্তব্য রাখেন এবং সরকারী সাম্রাজ্যবাদী পররাষ্ট্রনীতির তীব্র সমালােচনা ও বিরােধিতা করেন। তিনি তার ভাষণে পাকিস্তানী কেন্দ্রীয় প্রধানমন্ত্রী শহীদ সাহেবের তীব্র সমালােচনা করেন। ভাসানী বলেন, অবিলম্বে সকল সামরিক চুক্তি ও যুদ্ধ জোট বাতিল করতে হবে। মওলানা ভাসানী ঐ সম্মেলনে আরাে বলেন পাকিস্তান সরকার যদি ২১ দফার ভিত্তিতে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্ত্বশাসন ও জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ না করে তাহলে পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানকে আসসালামু আলাইকুম জানাবে। তিনি দেশবাসীকে ২১দফার ভিত্তিতে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্ত্বশাসন ও জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতির জন্য আন্দোলন গড়ে তােলার ডাক দেন। ভাসানী ঐ সম্মেলনে আরাে বফোন, দলের কোন নেতা একই সঙ্গে মন্ত্রী এবং সম্পাদকের পদ দখল করে রাখতে পারবে না। অনেকেই
৪২
ধারণা, এই বক্তব্য ছিল শেখ মুজিবকে সম্পাদকের পদ হতে সরানাের চেষ্টা করা। কারণ শেখ মুজিব ঐ সময়ে দলের সম্পাদক ও শিল্প মন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন। সম্মেলনে ভাসানীর বক্তব্য ছিল পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর চিন্তা চেতনার পরিপন্থী। কাজেই এই বক্তব্যকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের ক্ষমতাসীন অনেকের মনের ভিতরেই মারাত্মক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। ভাসানীর বক্তব্যকে কেন্দ্র করে শেখ মুজিব মন্ত্রীত্বের পদে পদাঘাত করে রাজনৈতিক মহলকে স্তম্ভিত করে কাগমারিতেই আতাউর রহমানের মন্ত্রী সভা হতে পদত্যাগ করেন। শেখ মুজিব বলেন মন্ত্রীত্ব হতে আমার কাছে আওয়ামী লীগের সম্পাদকের দায়িত্ব অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। দলীয় স্বার্থে মন্ত্রীত্ব থেকে পদত্যাগ করার ঘটনা অন্তত পূর্ব পাকিস্তানে এক অভূতপূর্ব ঘটনা।কিন্তু শেখ মুজিব নিজেই অগ্রণী হয়ে মন্ত্রীত্ব থেকে পদত্যাগ করলেন। সম্মেলনে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী তার বক্তব্যে মওলানা ভাসানীর জবাব দেন তার পররাষ্ট্রনীতির পক্ষে যুক্তি দেন এবং ভাসানীকে তীব্রভাবে সমালােচনা করেন। তিনি তার বক্তব্যে ভাসানী সম্পর্কে কটুক্তি করতেও কোন প্রকার দ্বিধাবােধ করেননি। তিনি আরাে তার বক্তব্যে ভাসানীকে হুমকির ভাষায়ও ধমক দেবার চেষ্টা করেন। আঞ্চলিকতা ও স্বতন্ত্র হওয়ার মনােভাবের সমালােচনা করে স্বায়ত্তশাসনের দাবীকে ভিত্তিহীন আখ্যা দিয়ে বলেন, শাসনতন্ত্রে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য শতকরা ৯৮ ভাগ স্বায়ত্ত্বশাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। পররাষ্ট্রনীতির সমালােচনার জবাবে প্রধানমন্ত্রী শহীদ সাহেব বলেন,সময় ও অবস্থার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে । তিনি আবার তার জিরাে থিউরী উপস্থাপন করে বলেন, মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্কের অর্থ হল একটি শূন্যের সঙ্গে কয়েকটি শূন্যের যােগফল আরাে একটি শূন্য। কাগমারী সম্মেলনে মওলানা ভাসানীর বক্তব্য মারাত্মকভাবে সমালােচিত হয়। বিশেষ করে আসসালামু আলাইকুম এর উচ্চারণ পাকিস্তানের সর্বত্র প্রচন্ড আলােড়ন তুলেছিল। ভাসানী প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী লীগের পত্রিকা ইত্তেফাক এবং মুসলিম লীগের দৈনিক আজাদ একই ধরনের অশােভন ভাষায় তাকে আক্রমণ চালিয়েছে। পত্রিকার সমালােচনার পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলও তার তীব্র সমালােচনা করে। ভারতীয় দালাল,ভারতীয় অনুচর, বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতাকারী হিসাবে অভিহিত করে এবং রাষ্ট্রদ্রোহীতার অভিযােগে মওলানা ভাসানীর বিচারের দাবীতে সােচ্চার হয়েছিলেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা, এমনকি আওয়ামী লীগের এক বিরাট অংশ। অন্যান্য দলের মধ্যে অন্যতম ছিল কেন্দ্রীয় সরকারে আওয়ামী লীগের সাথে ক্ষমতার অংশীদার রিপাবলিকান পার্টি রিপাবলিকান পার্টির সুপার ভাইজার কাউন্সিলের সদস্য মওলানা জহির কাসমী ১৯৫৭ সালের ৯ই ফেব্রুয়ারী করাচীতে এক বিবৃতিতে বলেন, পশ্চিমপাকিস্তান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের শােষনের অভিযােগ তুলে মওলানা ভাসানী বিচ্ছিন্নতার যে ঈঙ্গিত দিয়েছেন তা পাকিস্তানের সংহতির পরিষ্কার বিরুদ্ধাচরন এবং দন্ডবিধির ১২৩ধারার অধীনে শাস্তিযােগ্য অপরাধ। এই ধবংসত্মক প্রবনতার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আহবান জানিয়ে মওলানা জহির কাসমী বলেন মওলানা ভাসানী এবং তার সহকর্মীদের চেয়ে পাকিস্তান অনেক বড়। নিজামই ইসলাম পার্টির সভাপতি মওলানা আতাহার আলী এম পি তার বিবৃতিতে বলেন, জনাব ভাসানী পাকিস্তানের দুই অংশের বিরােধ ও তিক্ততার প্রচারণা চালিয়ে ও পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান এজলাসি জমহুরিয়া ভাগ হয়ে যাওয়ার ভয় দেখিয়েই ক্ষান্ত হননি, লেনিন গেট, গান্ধী গেট, সুভাষ গেট প্রমুখের নামে তােরণ নির্মান করে পাকিস্তানকে কি করে গড়ে তুলতে চান তার প্রমাণ
৪৩
দিয়েছেন। পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতির ওপর আঘাত করে এধরনের উক্তি যে কোন মহল থেকেই চালানাে হােক না কেন তা প্রতিরােধ করার ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আমি পাকিস্তানকে অনুরােধ জানাচ্ছি। মাওলানা ভাসানী দলের আভ্যন্তরীন সংঘাত ও বিরােধ মিটানাের যে উদ্দেশ্য নিয়ে কাগমারী সম্মেলনের আহবান করেছিলেন আওয়ামী লীগের ক্ষমতাসীনরা তাকে ব্যর্থ করে দিয়েছিলেন। ভাসানী বিরােধী প্রবল অভিযানের সুযােগে সম্মেলনের প্রস্তাব সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর বক্তব্য রাখার মধ্য দিয়ে তারা নতুন পর্যায়ের সংঘাতের সৃষ্টি করেছিল। করাচীতে আওয়ামী লীগ ও রিপাবলিক পার্টির এক যৌথ সভাতে ১৯৫৭সালের ৯ই ফেব্রুয়ারী প্রধানমন্ত্রী শহীদ সােহরাওয়ার্দী বলেন, সমবেত কাউন্সিলারদের মধ্যে শতকরা ১৮জন তার পররাষ্ট্রনীতির অনুমােদন করেছেন। তিনি আরাে বলেন,পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে সম্মেলনে নতুন কোন প্রস্তাব উত্থাপিত হয়নি। এরপর ১৫ ফেব্রুয়ারী অন্য এক বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রী শহীদ বলেন দলের বিধান অনুযায়ী পূর্ববর্তী অধিবেশনের কার্যবিবরনীকে নিশ্চিত করতে হবে। আর সেজন্যই কাগমারীতে বিগত অধিবেশনের কার্যবিবরনীকে বহাল রাখা হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের মূখ্য মন্ত্রী আতাউর রহমান খান ১০ই ফেব্রুয়ারী এক বিবৃতিতে বলেন যে নতুন প্রস্তাব গ্রহণ বা পূর্বতন প্রস্তাবের সংশােধন এর কোনটিই সত্য নয়। সুনির্দিষ্ট ভাবে সত্য কথাটি বলতে গিয়ে তিনি বলেন, কাগমারী সম্মেলনে ১৯৫৬ সালের ১৯-২০শে মের গৃহীত পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কিত প্রস্তাবই বহাল রাখা হয়ছে। প্রকৃত পক্ষে সম্মেলনের আগের দিন ৬ই ফেব্রুয়ারী রাতে অনুষ্ঠিত ওয়াকিং কমিটির সভায় প্রধানমন্ত্রী শহীদ সাহেবের সমর্থকরা পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে কোন প্রস্তাব বহাল রাখার বিরােধিতা করায় ৭ তারিখের অধিবেশনে ভাষণ দানকালে মওলানা ভাসানী নিজেই প্রস্তাবটি উত্থাপন করেছিলেন এবং করতালী ও সামাজ্যবাদ বিরােধী শ্লোগানের মধ্য দিয়ে সমবেত প্রতিনিধিরা প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিলেন সৈনিক সংবাদ ও পাকিস্তান অবজারভার সহ দেশী বিদেশী সংবাদ পত্রগুলােতে বিষয়টি প্রকাশিত হয়েছিল। তাছাড়া শহীদ সাহেব ও আতাউর রহমান খানও তাদের বিবৃতিতে স্বীকার করেন যে পূর্বের অধিবেশনের প্রস্তাব ও কার্যবিবরনীকেই কাগমারীতে নিশ্চিত ও অনুমােদন করে বহাল রাখা হয়েছে।১৯৫৬ সালের ১৯-২০শে মে অনুষ্ঠিত এই পূর্ববর্তী অধিবেশনে সংরক্ষিত প্রথম ও দ্বিতীয় প্রস্তাবে সকল প্রকার সামরিক চুক্তি ও যুদ্ধজোট বাতিলের দাবী জানিয়ে বলা হয়েছিল যে, এর ফলে বিশেষ করে বাগদাদ চুক্তির কারণে পাকিস্তান মুসলিম বিশ্বের সহানুভূতি হারিয়েছে। প্রস্তাবে বলা হয় কোন বৈদেশিক লেজুর হিসেবে না থেকে আমাদের স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নীতির অনুসারী হতে হবে এবং আমরা বিশ্বাস করি কেবল এই নীতিই পাকিস্তানকে পৃথিবীর বুকে শ্রদ্ধাশালী ও শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে পারে। আওয়ামী লীগের কাগমারী সম্মেলনের পর পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্ত্বশাসন ও পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে আওয়ামী লীগ দ্রুতগতিতে ভাঙ্গনের পথে এগিয়ে যেতে থাকে। দল ভাঙ্গনের পিছনে প্রধানমন্ত্রী শহীদ সােহরাওয়ার্দী অগ্রনী ভূমিকা নিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের ভাঙ্গনের পর মওলানা ভাসানী তার অনুসারীদের নিয়ে ১৯৫৭ সালের ২৫ শে জুলাই পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠন করেন। তিনি মৃত্যু পর্যন্ত এই ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সঙ্গেই যুক্ত ছিলেন।
৪৪
‘৬২ সনের শিক্ষা কমিশন রিপাের্ট বিরােধী আন্দোলন
১৯৬২ সালের শুরুতেই আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। ২৪শে জানুয়ারি বিরােধী দলীয় নেতাদের নিয়ে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী আতাউর রহমান খানের বাসভবনে এক বৈঠক করেন। কেন্দ্রীয় সরকার তখনই তাকে গ্রেফতার করতে চাইলেও আজম খানের বিরােধীতার কারণে তা সম্ভব হয়নি। পরে ৩১শে জানুয়ারি করাচীতে তাকে গ্রেফতার করা হয়। সােহরাওয়ার্দীর গ্রেপ্তারের ব্যাপারটিকে কেন্দ্র করে ছাত্ররা সংগঠিতভাবে প্রতিবাদ জানায়। ১লা ফেব্রুয়ারী ঢাকায় ছাত্ররা মিছিলের মাধ্যমে সামরিক আইন ভঙ্গ করে। ২রা ফেব্রুয়ারী ছাত্ররা ধর্মঘট পালন করে। ৪ঠা ফেব্রুয়ারী আইয়ুবের মন্ত্রী কাজী কাদের ছাত্রদের হাতে লাঞ্ছিত হয়। ঢাকায় ব্যাপক আন্দোলন গড়ে উঠলে সরকার বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘােষণা করে। এরপর ৭ই ফেব্রুয়ারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ ঢাকা শহরের বিভিন্নস্থানে সভা, শশাভাযাত্রা মিছিল হয়। পুলিশ বিভিন্নস্থানে সভাসমাবেশে লাঠিচার্জ ও কাঁদুনে গ্যাস ব্যবহার করে । বেশ কয়েকটি স্থানে ছাত্র পুলিশ সংঘর্ষ হয়। এদিন পুলিশ ১২৮জনকে গ্রেফতার করে এবং ২৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। সামরিক আইনের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে সভাসমাবেশ করার অপরাধে আইয়ুব সরকার শেখ মুজিবুর রহমান, আবুল মনসুর আহম্মেদ সহ বহু জাতীয় নেতাকে গ্রেপ্তার করে। এসময় দেশব্যাপী আইয়ুবের ছবি ভাঙ্গা ও পােড়ানাে হয়। ২১শে ফেব্রুয়ারী শহীদ দিবসকে কেন্দ্র করে ছাত্রসমাজ দেশব্যাপী ব্যাপক সামরিক আইন বিরােধী আন্দোলনের বিস্তার ঘটায়। ঐদিন সারাদেশে প্রভাত ফেরিও বিক্ষোভ মিছিল হয়। দেশের অন্যান্য স্থানের মত ঐদিন টাঙ্গাইলের ছাত্র জনতা প্রভাত ফেরির মিছিলের মাধ্যমে সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। টাঙ্গাইলের আওয়মী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতৃত্বে বিশাল প্রভাতফেরি শহর প্রদক্ষিণ করে। মিছিলের অগ্রভাগে ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা খােদা বক্স, মােক্তার হাফিজউদ্দিন, শামসুর রহমান খান শাহাজাহান, মির্জা তােফাজ্জল হােসেন মুকুল এবং ছাত্র নেতাদের মধ্যে ছিলেন ফজলুর রহমান ফারুক, ফজলুল করিম মিঠু, আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী। ১৯৬২ সালের ১৬ ই জুন আইয়ুবের নতুন শাসনতন্ত্র ও শিক্ষা নীতির বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ছাত্রসভা হয়। উক্ত সভায় সভাপতিত্ব করেন ডাকসুর জি, এস, এনায়েতুর রহমান। সভায় বক্তব্য রাখেন কাজী জাফর আহমেদ,শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন, আবুল হাসনাত, জগন্নাথ কলেজের ভি. পি. আব্দুল আলীম। সভায় টাঙ্গাইলের পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখেন ফজলুর রহমান খান ফারুক। সভাশেষে কেন্দ্রীয় ছাত্রনেতাদের সঙ্গে টাঙ্গাইলের ছাত্রনেতৃবৃন্দ এক বৈঠকে মিলিত হন মধুর ক্যান্টিনে। বৈঠকে কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে আলােচনায় অংশ নেন ডাকসুর জি. এস. এনায়েতুর রহমান, সিরাজুল আলম খান, কাজী জাফর আহমেদ, শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন,আবুল হাসনাত, টাঙ্গাইলের নেতৃবৃন্দের মধ্যে আলােচনায় অংশ নেন ফজলুর রহমান খান ফারুক, আল মুজাহিদী, মিজানুর রহমান খান, খন্দকার সফিউজ্জামান, নুরনবী। টাঙ্গাইলের নেতৃবৃন্দ কিভাবে আন্দোলন গড়ে তােলা যায় সেই বিষয় নিয়ে মূলতঃ কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে পরামর্শ করেন। কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের পরামর্শ অনুযায়ী টাঙ্গাইলের ছাত্রনেতৃবৃন্দ আন্দোলন গড়ে তােলার জন্য ব্যাপক তৎপরতা শুরু করেন। ১৯৬২ সালের ১৯শে জুলাই ছাত্রসগ্রাম পরিষদ প্রদেশব্যাপী ছাত্রধর্মঘটের ডাক দেয়। কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নির্দেশে টাঙ্গাইলের ছাত্র সমাজ অত্যন্ত সফল ছাত্রধর্মঘট পালন করে।
৪৫
টাঙ্গাইলের প্রতিটি থানায় প্রতিটি স্কুল-কলেজের ছাত্ররা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ধর্মঘট পালন করে। ঐদিন টাঙ্গাইল শহরে ছাত্রদের বিশাল শােভাযাত্রা শহরের বিভিন্ন রাজপথ প্রদক্ষিণ করে। মিছিলে নেতৃত্ব দেন ফজলুর রহমান খান, মিজানুর রহমান খান ও খন্দকার বদিউজ্জামান। ধর্মঘটের পর টাঙ্গাইলের ছাত্রনেতৃবৃন্দ টাঙ্গাইলের প্রতিটি থানার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ব্যাপকভাবে আইয়ুব বিরােধী ও শিক্ষা কমিশন বিরােধী প্রচারণা চালান। ১৮ই আগষ্ট প্রদেশব্যাপী কেন্দ্রীয় ছাত্রসগ্রাম পরিষদ ছাত্রধর্মঘটের আহ্বান জানায়। কেন্দ্রীস ঘােষণার শােভাযাত্রা করে। ছাত্রধর্মঘট ও শােভাযাত্রা সফল করার ক্ষেত্রে যে সমস্ত ছাত্রনেতারা উল্লেখযােগ্য ভূমিকা রাখেন তাদের মধ্যে ছিলেন ফজলুর রহমান খান ফারুক, মিজানুর রহমান খান, খন্দকার সফিজদ্দিন ও আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী। ১৯৬২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ছাত্ররা “ জাতীয় শিক্ষা কমিশন রিপাের্ট বাতিলের দাবীতে ব্যাপক আন্দোলনের কর্মসূচী ঘােষণা করে। ছাত্রদের আন্দোলন দমন করার লক্ষ্যে সরকার ৯ই সেপ্টেম্বর ১৪৪ ধারা জারি করে শােভাযাত্রা, সভা-সমাবেশ মিছিল নিষিদ্ধ ঘােষণা করে। ১০ই সেপ্টেম্বর ঢাকায় ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিটিং মিছিল শুরু করলে পুলিশ ১০ জনকে গ্রেপ্তার করে। কয়েক হাজার ছাত্র -ছাত্রী ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে ঢাকা শহরে মিছিল বের করে। পুলিশ ছাত্রনেতাদের মধ্যে আবুল হাসনাত, শাহ মােয়াজ্জেম,আবু হেনা, আব্দুর রহিম আজাদ, কাজী জাফর আহম্মদ ও সিরাজুল আলম খান প্রমুখকে গ্রেপ্তার করে। এর ফলে আন্দোলন আরাে তীব্র গতিশীল হয়ে পড়ে। কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ ঘােষণা দেয় ১৭ই সেপ্টেম্বরের মধ্যে শিক্ষা কমিশন রিপাের্ট বাতিল না করলে ঐদিন প্রদেশ ব্যাপী হরতাল হবে। ছাত্রদের আন্দোলনের চাপে সরকারের মন্ত্রী ফজলুল কাদের চৌধুরী ১৬ই সেপ্টেম্বর ঘােষণা দেন, শিক্ষা কমিশন রিপাের্ট বিবেচনা করা হবে। কিন্তু ১৭ই সেপ্টেম্বর ছাত্ররা তাদের হরতালের কর্মসূচী ঠিক রাখে। ১৭ই সেপ্টেম্বর ঢাকাসহ সারা দেশে ছাত্রদের উপর পুলিশ ব্যাপক লাঠিচার্জ ও গুলী চালায়। পুলিশের গুলীতে ঢাকায় নিহত হয় বাবুল, ওয়াজিউল্লাহ ও মােস্তফা। ঢাকায় আহত হয় ৫২। প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে আরাে আহত হয় ২৫৩ জন। পুলিশ গ্রেপ্তার করে ১০৫৯ জনকে। দুপুর ১২ টায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সামরিক বাহিনীর জোয়ানদের নামানাে হয়। এদিন ছাত্ররা ব্যাপক বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। ছাত্রদের আহবানে টাঙ্গাইলের সর্বত্র স্বতস্ফূর্ত হরতাল পালিত হয়। হরতাল চলাকালীন সময়ে ছাত্ররা টাঙ্গাইলে বিশাল বিক্ষোভ মিছিল বের করে। মিছিল শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে বিন্দুবাসিনী উচ্চ বালক বিদ্যালয়ের সামনে ছাত্র জনসভা করে। সভায় বক্তব্য রাখেন ফজলুর রহমান খান ফারুক, ফজলুল করিম মিঠু। বিক্ষোভ মিছিলে উষা-সাহার নেতৃত্বে কুমুদিনী কলেজের বহু ছাত্রীরাও অংশগ্রহণ করেন।
১৭ই সেপ্টেম্বর সরকারী দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে সারাদেশের মত টাঙ্গাইলের ছাত্র সমাজও ১৮ই সেপ্টেম্বর বিক্ষোভ মিছিল বের করে। এদিন করটিয়া কলেজ থেকে ছাত্রদের বিরাট মিছিল টাঙ্গাইল শহরে আসে। মিছিলের নেতৃত্বে ছিলেন ফজলুর রহমান খান ফারুক, ফজলুল করিম মিঠু, গােলাম সরােয়ার। উষা সাহার নেতৃত্বে এদিনও কুমুদিনী কলেজ থেকে ছাত্রীদের একটি মিছিল আসে। এই বিক্ষোভ মিছিলের নেতৃত্ব দেয়ার জন্য ফজলুর রহমান খান ফারুক, ফজলুল করিম মিঠু ও সৈয়দ আব্দুল মতিনের বিরুদ্ধে সরকার হুলিয়া জারী করে এবং সৈয়দ আব্দুল মতিনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে।
৪৬
শিক্ষা কমিশন রিপোের্ট বিরােধী আন্দোলনে ছাত্রদেরকে যে সমস্ত রাজনৈতিক দল ও নেতৃবৃন্দ সাহায্য করেন তাদের মধ্যে ছিলেন আওয়ামীলীগের আব্দুল মান্নান, বদিউজ্জামান খান, মির্জা তােফাজ্জল হােসেন মুকুল ও শামসুর রহমান খান, শাহজাহান কমিউনিষ্ট পাটির নারায়ন বিশ্বাস ও উপেন মালাকার।
৬৪ সনের ছাত্র আন্দোলন এবং ফজলুর রহমান খান ফারুক, ফজলুল করিম মিঠু, আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী, আতিকুর রহমান সালু
ও এস. এম. রেজার করটিয়া কলেজ থেকে বহিস্কার আদেশ
১৯৬৪ সালের মার্চ মাসের শেষদিকে টাঙ্গাইলের ছাত্র আন্দোলন অত্যন্ত জঙ্গী আকার ধারণ করে। ২৯শে মার্চ আওয়ামী লীগ সহ কয়েকটি বিরােধী দল প্রদেশ ব্যাপী প্রতিবাদ দিবসের ডাক দেয়। কেন্দ্রীয় কর্মসূচী পালনের নির্দেশ মােতাবেক জেলা আওয়ামীলীগ ও তার সহযােগী সংগঠন যথারীতি টাঙ্গাইলে প্রতিবাদ দিবস পালন করে। ঐ দিনই সরকার ঢাকায় কেন্দ্রীয় ছাত্রনেতা রাশেদখান মেনন, হায়দার আকবর খান রনাে, রেজা আলী, গিয়াস উদ্দীন কামাল, শাহমােয়াজ্জেম হােসেন, কেএম. ওবায়দুর রহমান, সিরাজুল আলম খান, এ. কে. বদরুল হক এবং আউয়ুব রেজা চৌধুরী সহ আরাে অনেকের নামে গ্রেপ্তারী পরােয়ানা জারী করে। সরকার শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় ছাত্রনেতাদের উপরই দমনপীড়ন নীতি প্রয়ােগ করেনি, দেশের বিভিন্ন স্থানেও ব্যাপক দমন পীড়ন চালায়। এ সময় টাঙ্গাইলের ছাত্রনেতা ও সরকারের ব্যাপক দমন নীতির শিকার হয়। ৩০শে মার্চের হরতাল পালন ও নেতৃত্বদানের জন্য ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় পরিষদের সদস্য ফজলুর রহমান খান ফারুক, টাঙ্গাইলের ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী, ছাত্রনেতা ফজলুল করিম মিঠু, আতিকুর রহমান সালু, এস. এম. রেজাকে করটিয়া কলেজ থেকে বহিষ্কার করে। এই বহিষ্কার আদেশকে কেন্দ্র করে টাঙ্গাইলের ছাত্র আন্দোলন ব্যাপক জঙ্গী আকার ধারণ করে। ছাত্রসমাজ সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল কলেজ কর্তৃপক্ষের অন্যায় বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করার জন্য দাবী জানায়। যে মুহূর্তে ছাত্রনেতাদের বহিষ্কারাদেশ নিয়ে টাঙ্গাইলে ব্যাপক তুলকালাম চলছে ঠিক সেই মুহূর্তে সরকার কেন্দ্রীয় ছাত্রনেতা ফজলুর রহমান খান ফারুক এবং শ্রমিক নেতা আব্দুল মতিনকে গ্রেপ্তার করে। এতে অগ্নিতে মৃতাহুতি দেয়ার মত আন্দোলন আরাে তীব্র আকার ধারণ করে। নেতৃদ্বয়কে গ্রেপ্তার করে টাঙ্গাইল থানায় আনলে উত্তেজিত ছাত্রজনতা তাদের মুক্তির জন্য থানা ঘেরাও করে। ঐদিনই পুলিশ প্রথম টাঙ্গাইলে উত্তেজিত ছাত্রজনতার উপর লাঠি চার্জ ও কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করে। ভয়ে পুলিশ, নেতৃবৃন্দকে টাঙ্গাইলে রাখার সাহস না পেয়ে তাদেরকে ময়মনসিংহ জেলা কারাগারে পাঠায়। ফজলুর রহমান খান ফারুক ও সৈয়দ আব্দুল মতিনের গ্রেপ্তারের কয়েকদিন পরে পুলিশ গ্রেপ্তার করে ছাত্রনেতা ফজলুল করিম মিঠু, আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী, আতিকুর রহমান সালু, এস. এম. রেজাসহ আরাে কয়েকজনকে। প্রায় ৬ মাস বন্দী থাকার পর ছাত্রনেতৃবৃন্দ মুক্তি পান।
৪৭
জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর করটিয়া কলেজের বহিষ্কারাদেশের বিরুদ্ধে বহিষ্কৃত নেতৃবৃন্দ হাইকোর্টে রিট করেন। এই রিট পরিচালনা করেন প্রখ্যাত আইনবিদ সবিতা রঞ্জন পাল। রিট করে বহিষ্কৃত ছাত্রনেতৃবৃন্দ ডিগ্রী লাভ করেন। যদিও কলেজ কর্তৃপক্ষ আগেই আতিকুর রহমান সালুর বহিষ্কার আদেশ প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। জেল থেকে মুক্তি এবং করটিয়া কলেজ কর্তৃপক্ষের বহিষ্কারাদেশের বিরুদ্ধে ডিগ্রী পাওয়ার পর টাঙ্গাইলের ছাত্র নেতৃবৃন্দ নব উদ্যম নিয়ে আবার আন্দোলন গড়ে তােলার জন্য তৎপরতা চালান। এ সময়ে টাঙ্গাইলের ছাত্রনেতৃবৃন্দ দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক চিত্র জনসাধারণের সামনে তুলে ধরার জন্য এক সুধী সম্মেলনের আয়ােজন করে। সম্মেলনে অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন বিচারপতি ইব্রাহীম, কবি সুফিয়া কামাল ও তােফাজ্জল হােসেন মানিক মিয়া। তাদের বক্তব্যে দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থার চিত্র তুলে ধরেন। সম্মেলন করার অপরাধে সরকার ছাত্রনেতা ফজলুর রহমান খান ফারুক, আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী ও আতিকুর রহমান সালুর নামে গ্রেপ্তারী পরােয়ানা জারী করে। এই গ্রেপ্তারী পরােয়ানা জারীর বিরুদ্ধে আদালতে জামিনের জন্য আবেদন করেন আতাউর রহমান খান ও তােফাজ্জল হােসেন মানিক মিয়া। তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত ছাত্রনেতাদের গ্রেপ্তারী পরােয়ানা তুলে নিতে বাধ্য হয়। ১৯৬৪ সালের টাঙ্গাইলের ছাত্র আন্দোলনের আরেক উল্লেখযােগ্য ঘটনা ছিল, শহরের সমস্ত দোকান ও বহু অফিস থেকে আইয়ুব খানের ছবি ভেঙ্গে ফেলে বা পুড়িয়ে ফেলে আইয়ুবের কুকীর্তিতে উত্তেজিত ছাত্রজনতা, টাঙ্গাইল শহরের নিরালার মােড়ে আইয়ুব খানের প্রতিকৃতি তৈরী করে তার মলদ্বারে (মার্গ) বাঁশ দিয়ে দাঁড় করে তাদের ক্রোধ নিবারন করে। এ ঘটনায় নেতৃত্ব দেয়ার দায়ে সরকার ছাত্রনেতা ফজলুর রহমান ফারুক, আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী, বুলবুল খান মাহবুব, মওদুদ খান মজনু ও মােহাম্মদ আলীর নামে গ্রেপ্তারী পরােয়ানা জারী করে এবং তাদের ধরিয়ে দেয়ার জন্য ৫০ টাকা পুরস্কার ঘােষণা করে। এই গ্রেপ্তারী পরােয়ানা জারীর বিরুদ্ধে আদালতে জামিনের আবেদন করেন ড. আলীম আল রাজী। তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত ছাত্রনেতৃবৃন্দের জামিনের ব্যবস্থা করে এবং গ্রেপ্তারী পরােয়ানা প্রত্যাহার করে নেয়। ১৯৬৪ সালের অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময় প্রদেশব্যাপী রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রচারণা শুরু হয়। এই প্রচারণায় টাঙ্গাইলের ছাত্র সংগঠন ও রাজনৈতিক সংগঠন ব্যাপক তৎপরতা পরিচালনা করেন।
৬৫ সনের নির্বাচনে আফাজউদ্দীন ফকিরও
ডঃ আলীম আল রাজীর বিজয়।
১৯৬৫ সালের ২রা জানুয়ারি ও ২১শে মার্চ তৎকালীন পাকিস্তানে রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত নির্বাচনে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি হিসাবে বিজয়ী হন ফিল্ড মার্শাল আগা মাে: আইয়ুব খান। রাষ্ট্রপতি হিসাবে আইয়ুব খান নির্বাচিত হলেও তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে প্রচণ্ড প্রতিদ্বন্দিতার সম্মুখীন হন। পাকিস্তানের পশ্চিমাংশে বিপুল পরিমাণ ভােট পেলেও পূর্ব পাকিস্তানে সামান্য কিছু ভােটের পার্থক্য হয় বিরােধী দলীয় প্রার্থীনী মিস ফাতেমা জিন্নাহর সঙ্গে।
৪৮
পাকিস্তানের পশ্চিমাংশে আইয়ুব খান ভােট পান ২৮৯২৭ আর মিস জিন্নাহ পান ১০৭২০। অপরদিকে পূর্ব পাকিস্তানে আইয়ুব খান ভােট পান ২০৭২০ আর মিস ফাতেমা জিন্নাহ পান ১৮০৮০ ভােট। ১৯৬৫ সালের ২রা জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে সর্বদলীয় প্রার্থী দাড় করার জন্য ১৯৬৪ সালের ২৩শে জুলাই খাজা নাজিমুদ্দীনের বাসভবনে সকল বিরােধী দলের বৈঠক হয়। উক্ত বৈঠকে উপস্থিত দলগুলাের মধ্যে ছিল আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম পার্টি, কাউন্সিল মুসলিম লীগ ন্যাশনাল আওয়ামীলীগের সময়ে নয় দফার ভিত্তিতে আইয়ুব বিরােধী সম্মিলিত বিরােধী জোট গঠন করা হয়। নয় দফা দাবীর মধ্যে ছিলঃ ১. গণতান্ত্রিক শাসন কায়েম, ২. মৌলিক অধিকার, ৩. প্রত্যক্ষ নির্বাচন, ৪. জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের উপর আইন প্রণয়ন ও বাজেট প্রণয়নের পূর্ণ ক্ষমতা-ফেডারেল পার্লামেন্টারি পদ্ধতির শাসন, ৫. রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা হ্রাস ৬. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, ৭. সীমান্ত প্রদেশের উন্নয়ন, ৮. রাজনৈতিক দলসমূহের উপর থেকে বিধিনিষেধ প্রত্যাহার, ৯. সকল রাজবন্দীদের মুক্তি। সকল রাজনৈতিক দলের উপর থেকে বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করার ফলে কমিউনিষ্ট পার্টি প্রকাশ্যে রাজনীতি করার সুযােগ পায়। এভাবেই সকল বিরােধী দল ন্যূনতম কর্মসূচীর ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হয়। বিরােধী জোট গঠিত হওয়ার পর ১৯৬৪ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর জোটের নেতৃবৃন্দ করাচীর লাবাম হাউসে মিস জিন্নাহর সঙ্গে বৈঠক করেন। বিরােধী জোটের নেতৃবৃন্দ বিকাল ৫টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত মিস জিন্নাহর সঙ্গে আলােচনা করেন। আলােচনায় মিস জিন্নাহ জোটের প্রার্থী হতে রাজী হন। আলােচনায় বিরােধী জোটের পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান, খাজা নাজিমুদ্দিন, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, চৌধুরী মােহাম্মদ আলী ও নওয়াব জাদা নসুরুল্লাহ খান। মিস জিন্নাহ প্রার্থী হওয়ার পর ১৯৬৪ সালের ১লা অক্টোবর থেকে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেন। পশ্চিম পাকিস্তানে নির্বাচনী প্রচার অভিযান শেষ করে ১৫ই অক্টোবর পূর্ব পাকিস্তানে নির্বাচনী প্রচার অভিযান শুরু করেন। ঐদিন ঢাকায় মিস জিন্নাহকে বিরােধী জোটের পক্ষ থেকে অভূতপূর্ব সম্বর্ধনা দেয়া হয়। ১৭ই অক্টোবর বন্দর নগরী চট্টগ্রামে এক ঐতিহাসিক জনসভা করেন। ফাতেমা জিন্নাহর আগমনে জনতার ব্যাপক ভীড়ের কারণে ১৩৪ জন লােক আহত হয়। উক্ত জনসভায় ভাষণ দেন মিস জিন্নাহ সহ শেখ মুজিবুর রহমান, আজম খান, আবুল কাশেম, ফরিদ আহমদ ও মওলানা ভাসানী। ১৮ই অক্টোবর মিস জিন্নাহ যশাের ও খুলনায় দুইটি জনসভা করেন। ১৯শে অক্টোবর রাজশাহী ও ঈশরদীতে দুইটি জনসভা করেন। কয়েকটি স্থানে জনসভা করার পর প্রদেশব্যাপী জিন্নাহর প্রচারণা ঝড়ের গতিতে এগিয়ে চলে। এই নির্বাচনে সারা বাংলার মত টাঙ্গাইলে ব্যাপক নির্বাচনী প্রচারণা শুরু হয়। ২১শে অক্টোবর ময়মনসিংহে মিস জিন্নাহ জনসভা করেন। উক্ত জনসভা সফল করার পিছনে টাঙ্গাইলের রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তারা কয়েকদিন আগে থেকেই জনসভাকে সফল করার জন্য ময়মনসিংহ গিয়ে হাজির হন। বিশেষ করে আব্দুল মান্নান, শামসুর রহমান খান শাহজাহান, মির্জা তােফাজ্জল হােসেন মুকুল ও হাতেম আলী তালুকদার অক্লান্ত পরিশ্রম করেন ঐ জনসভাকে সফল করার জন্য। এছাড়া সারা টাঙ্গাইলে মিস জিন্নাহর পক্ষে ব্যাপক নির্বাচনী প্রচারণা অভিযান চালিয়ে আইয়ুব বিরােধী শক্তিকে অত্যন্ত গতিশীল করা হয়। ঐ সময় টাঙ্গাইলে ১১শ বিডি সদস্য ছিল। ভােটের সময় নেতৃবৃন্দ ভােটারদের বাড়ি বাড়ি যেতেন। এই সময়
৪৯
নির্বাচনী প্রচার অভিযানে যারা সক্রিয়ভাবে নেতৃত্ব দেন তাদের মধ্যে ছিলেন আওয়ামীলীগের আব্দুল মান্নান, শামসুর রহমান খান, শাহজাহান, মির্জা, তােফাজ্জল হােসেন মুকুল, ফজলুর রহমান খান ফারুক, কমিউনিষ্ট পাটির নারায়ন বিশ্বাস, উপেন মালাকার ও খন্দকার আব্দুল বাকী। ছাত্রনেতাদের মধ্যে ছিলেন পার্টির নেতাদের মধ্যে ছিলেন আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী, আল মুজাহিদি। ন্যাশানাল আওয়ামী পার্টির নেতাদের মধ্যে ছিলেন আব্দুর রহমান, হামিদুল হক মােহন, হাতেম খান, বুলবুল খান মাহবুব। বিরােধী দলের ব্যাপক প্রচারণার কারণেই টাঙ্গাইলে আইয়ুব খান মিস জিন্নাহর চেয়ে সামান্য কয়েকটি ভােট বেশি পান। সারা দেশের মধ্যে যে কয়েকটি অঞ্চলে মিস জিন্নাহ ব্যাপক পরিমাণে ভােট পান তার মধ্যে অন্যতম ছিল টাঙ্গাইল। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে আইয়ুব খান সামান্য কয়েকটি ভােট বেশি পেলেও এ বৎসরই ২১শে মার্চের জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে আইয়ুব খানের প্রার্থীরা টাঙ্গাইলে ব্যাপক ভােটের ব্যবধানে পরাজিত হন। সারা বাংলায় জাতীয় পরিষদের আসন ছিল ৭৫টি। তার মধ্যে টাঙ্গাইলের আসন সংখ্যা ছিল ২টি। এই দুইটি আসনেই সরকার বিরােধী প্রার্থী আফাজ উদ্দীন ফকির ও ড, আলীম আল রাজী বিজয় অর্জন করেন। এই নির্বাচনে উত্তর টাঙ্গাইল ও দক্ষিণ টাঙ্গাইল দুইটি আসন ছিল। উত্তর টাঙ্গাইল আসনে ছিল গােপালপুর, ভূয়াপুর, ঘাটাইল, কালিহাতী ও বাসাইল থানা। দক্ষিণ টাঙ্গাইলে ছিল টাঙ্গাইল সদর, নাগরপুর ও মির্জাপুর। উত্তর টাঙ্গাইলে স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন আফাজ উদ্দীন ফকির, মুসলিম লীগের প্রার্থী ছিলেন এডভােকেট আব্দুল হাই, আওয়ামীলীগের প্রার্থী ছিলেন মটু মিয়া। দক্ষিণ টাঙ্গাইলে স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন ড. আলীম আল রাজী, মুসলিম লীগের প্রার্থী ছিলেন আজগর খান। আইয়ুব খান তার দলীয় প্রার্থীদের বিজয়ী করার জন্য প্রচুর অর্থ ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে। টাঙ্গাইলের ভােটারগণ আইয়ুবের টাকার প্রতি ও ক্ষমতার প্রতি কোন প্রকার লােভ না করে তারা সরকার বিরােধী প্রার্থীদের ভােট দেয়। আইয়ুব খান ভােটারদের শুধুমাত্র লােভই দেখায়নি, তিনি ও তার প্রশাসন ভােটারদের ভয় এবং ভীতি প্রদর্শন করে। সমস্ত কিছুকে উপেক্ষা করে টাঙ্গাইলের ভােটাররা আইয়ুবের বিপক্ষে রায় দেয়। আফাজ উদ্দীন ফকির ও ড. আলীম আল রাজী বিজয়ী হওয়ার পর সরকারসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদেরকে দলে ভেড়ানাের চেষ্টা করে। কিন্তু বিজয়ী দুইজন জাতীয় পরিষদ সদস্য ভােটারদের রায়ের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে, কোন প্রকার লােভ লালসার বশবর্তী হয়ে অন্য দলে যাননি। শুধুমাত্র নিজেরাই স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নিয়ে থামেননি, অন্যান্য স্বতন্ত্র জাতীয় পরিষদ সদস্যরা যাতে অন্য কোন দলে না যেতে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেন। এক্ষেত্রে আফাজ উদ্দীন ফকিরের ভূমিকা ছিল খুবই সাহসিকতাপূর্ণ । আইয়ুব খান যখন তাদের দলে ভেড়াতে পারলেন না, তখন স্বতন্ত্র সদস্যদের দলে নেওয়ার জন্য এগিয়ে আসেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। তিনি স্বতন্ত্র সদস্যদের নিয়ে হােটেল ইন্টারকনে বৈঠক করেন। উক্ত বৈঠকে আফাজ উদ্দীন ফকীর, ড. আলীম আল রাজী সহ স্বতন্ত্র সব সদস্যই ছিলেন। বৈঠকে আলােচনার এক পর্যায়ে কোন কোন সদস্য ভুট্টোর দলে যাওয়ার চিন্তা ভাবনা করেন। তখন উত্তর টাঙ্গাইল আসন থেকে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্য আফাজ উদ্দীন ফকির বলেন, ভােটাররা আপনাদেরকে স্বতন্ত্র হিসাবে ভােট দিয়েছে, এখন যদি আপনারা কোন দলে যান তাহলে ভােটারদের সঙ্গে বেঈমানি করা হবে। কাজেই আপনারা স্বতন্ত্রই থেকে যান। স্বতন্ত্র সদস্যবৃন্দ নির্বাচিত হওয়ার পর তারা তাদের স্বতন্ত্র অস্তিত্বকে বজায় রেখে নিজেদেরকে ভােটারদের কাতারে রাখতে সক্ষম হয়েছেন।
৫০
৬৯-এর ছাত্র গণ আন্দোলন
১৯৬৬ সালে ৬ দফা ও ১৯৬৭ সালে ১১ দফার ভিত্তিতে বাঙালি জাতি স্বাধিকারের দাবীতে সারা বাংলায় যে দুর্বার ছাত্র গণআন্দোলন গড়ে তুলে, টাঙ্গাইলের সংগ্রামী জনতার অগ্রগামী অংশ সেই আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। বাঙ্গালীজাতির আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার এই আন্দোলনে স্থানীয়ভাবে টাঙ্গাইলে যে সমস্ত ছাত্রনেতৃবৃন্দ ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেন তাদের মধ্যে ছিলেন আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী, আব্দুল কাদের সিদ্দিকী, আলী আজগর খান দাউদ, খন্দকর আব্দুল বাতেন, আনােয়ার বক্স, শামীম আল মামুন, আবু মােহাম্মদ এনায়েত করিম, আলমগীর খান মেনু, মােয়াজ্জেম হােসেন খান, আব্দুর রাজ্জাক, আনােয়ারুল আলম শহীদ, খালেকুজ্জামান খান (লাবু), মােহাম্মদ সােহরাওয়ার্দী, আফতাবউজ্জামান খান ফিরােজ, হামিদুল হক মােহন, আতিকুর রহমান সালু, এস. এম. রেজা, বুলবুল খান মাহবুব, মাে: তাজউদ্দীন, আব্দুর রহমান সুরুজ, খন্দকার আশফাকুর রহমান জহির প্রমুখ । ১৯৬৮ সালের শেষ দিক থেকেই টাঙ্গইলের ছাত্র আন্দোলনের গতি বৃদ্ধি পেতে থাকে। কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের কর্মসূচী অনুসরণ করে টাঙ্গাইলের ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকে। ১৯৬৭ সালের ৪ঠা জানুয়ারি সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ যৌথভাবে ঐতিহাসিক ১১দফা দাবি পেশ করে দেশ ও জাতির সমস্যার সার্বিক সমাধানের লক্ষ্যে। সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের ১১ দফায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৬ দফা অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ঐদিন ছাত্রলীগ তার প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে ১১ দফার ঘােষণা দেয়। ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের উভয় গ্রুপ বিরােধী দলগুলােকে সমন্বিত ভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার জন্য আহবান জানায়। ১১ দফা ঘােষণায় স্বাক্ষর দেন ৬৯এর ছাত্র আন্দোলনের স্থপতি ডাকসুর ভিপি তােফাযেল আহম্মদ ও জি. এস. নাজিম কামরান চৌধুরী, ছাত্রলীগের পক্ষে আব্দুর রউফ ও খালেদ মােহাম্মদ আলী, ছাত্র ইউনিয়ন মতিয়া গ্রুপের সাইফুদ্দীন আহম্মদ মানিক ও শামসুদ্দোহা। ৫ই জানুয়ারি সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ ১১ দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনার জন্য আন্দোলনের আহবান জানায়। কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে ১৯৬৯ সালের ৭ই জানুয়ারি টাঙ্গাইলের ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ বিক্ষোভ মিছিল বের করে। এই বিক্ষোভ মিছিলটি ভিক্টোরিয়া রােড ধরে পুরাতন বাসষ্ট্যান্ড হয়ে ময়মনসিংহ রােড দিয়ে উত্তর দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় বাসষ্ট্যান্ডে মিছিলটি ই. পি. আর. <হিনীর গাড়ীর সম্মুখে পড়ে। এতে মিছিলে মারাত্মক উত্তেজনার সৃষ্টি হয় । ই. পি. আর. বাহিনীর সদস্যরা মিছিলে আক্রমণ করার চেষ্টা করে। এমন সময় মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ময়মনসিংহ থেকে এসে নামেন। তিনি নেমেই ই. পি. আর. বাহিনীর ভাবসাব দেখেই তাদের দিকে তাকিয়ে ধমক দেন। তাঁর ধমকে ই. পি. আর. দের গাড়ী চলে যায়। এখান থেকেই মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ছাত্রদের মিছিলে অংশগ্রহণ করেন। ভাসানী মিছিলে অংশগ্রহণ করাতে হঠাৎ করেই মিছিলটি বিশাল আকার ধারণ করে। এই বিক্ষোভ মিছিল শেষে, বিন্দু বাসিনী স্কুল মাঠে এক বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। জনসভাটি অনির্ধারিত হলেও তা একটি বিশাল জনসভায় পরিণত হয়। জনসভাটি দু’টি কারণেই হঠাৎ করে বিশাল আকার ধারণ করে। কারণ দু’টির একটি তখনকার রাজনৈতিক জোয়ার, অন্যটি ভাসানীর উপস্থিতি। এই জনসভাটি ৬৯-এর ছাত্র গণ আন্দোলনের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র টাঙ্গাইলেই নয় সারা বাংলার আন্দোলনে এক নতুন গতি সৃষ্টি করে। বিশাল জনসভায়
৫১
মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে হুংকার দিয়ে আইয়ূব খানকে হুশিয়ার করে বলেন, অতিসত্বর আগরতলা মামলা তুলে নিতে হবে এবং সকল প্রকার জুলুম নির্যাতন বন্ধ করতে হবে, নচেৎ পরিস্থিতি ভয়ানক হবে। তিনি উপস্থিত ছাত্র জনতাকে উদ্দেশ্য করে আরাে বলেন, দাবী আদায় না হওয়া পর্যন্ত যে কোন ত্যাগের বিনিময়ে আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে এবং বাঙ্গালীর বাঁচার অধিকার আদায় করতে হবে। তিনি বক্তব্যে পাকিস্তানীদের সকল প্রকার শােষণ, শাসন, নীপিড়ন-নির্যাতন ও বাঙ্গালীদের প্রতি পশ্চিমাদের বৈষম্যমূলক নীতির বিশদ ব্যাখ্যা দেন। এই বক্তব্য শােনার পর ছাত্র জনতার মনে মারাত্মক বিদ্রোহী মনােভাবের সৃষ্টি হয়, যা’ আন্দোলনকে ব্যাপক শক্তিশালী করে তােলে। এই সভায় আরাে ভাষণ দেন ছাত্রনেতা আনােয়ার বক্স, শামীম আল মামুন, আতিকুর রহমান সা ও হামিদুল হক মােহন। ছাত্রনেতৃবৃন্দ তাদের ভাষণে ১১ দফার ব্যাখ্যা দেন। সভায় সভাপতিত্ব করেন ছাত্রনেতা আলী আজগর খান দাউদ, সভাপতির ভাষণে তিনি ছাত্রজনতাকে সকল প্রকার দমন-পীড়নকে উপেক্ষা করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আহবান জানান। বিশাল জনসভায় উত্তেজিত ছাত্রজনতাকে সামাল দেয়ার জন্য আলী আজগর খান দাউদ হঠাৎ করে মাইকের সামনে এসে ভাসানীর কণ্ঠ অনুসরণ করে খামােশ বলে চিৎকার দেন। এতে অনেকটা কাজ হয়। ছাত্রজনতা শান্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু মানুষ যখন জানতে পারল ভাসানী নয়, আলী আজগর খান দাউদ খামােশ বলে চিৎকর দিয়েছে তখন জনসভায় হাসির রােল পড়ে যায়। কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১৭ই জানুয়ারি সারা বাংলায় ৬ দফা ও ১১ দফার ভিত্তিতে সভা সমিতি ও বিক্ষোভ মিছিলের কর্মসূচী ঘােষণা করে। এসময় সারা বাংলায় ১৪৪ ধারা জারী করা হয়। আগেই সামরিক সরকার প্রধান আইয়ুব খান হুশিয়ার করে দেয় যে, “দেশে ১৪৪ ধারা জারী আছে। কাজেই ছাত্রসগ্রাম পরিষদ ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে ঢাকাসহ বাংলার বিভিন্ন স্থানে সভাসমাবেস ও বিক্ষোভ মিছিল বের করে। মিছিল বের করলে পুলিশ ও ই, পি, আর, বাহিনীর সদস্যরা ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে ব্যাপকভাবে লাঠিচার্জ করে ও কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করে। তাতে শত শত ছাত্র-জনতা আহত হয় এবং বহু লােককে ঐদিন পুলিশ গ্রেপ্তার করে। ঐদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে পুলিশ আর ছাত্রদের মধ্যে প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়। এ সংঘর্ষ অতিদ্রুত সারা ঢাকা শহরে ছড়িয়ে পড়ে। দুপুর ১২টার পর ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে খন্ডযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অসংখ্য মিছিল এসে বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে উপস্থিত হয়। তখন বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ছিল আইয়ুব শাহীর পুলিশ আর ই. পি. আর. বাহিনীর দ্বারা ঘেরাও করা। এমনি অবস্থায় কলাভবনে অনুষ্ঠিত হয় এক ঐতিহাসিক ছাত্র-স্থপতি ডাকসুর ভি. পি. তােফায়েল আহম্মদ। সভায় ১৮ই জানুয়ারি ঢাকায় ছাত্র ধর্মঘট এবং ১লা ফেব্রুয়ারি সারা বাংলায় ১১ দফার সমর্থনে ধর্মঘটের কর্মসূচী ঘােষণা করা হয়। ১৯৬৯ সালের ১৮ই জানুয়ারি পুলিশ ঢাকায় ছাত্রদের উপর ব্যাপক লাঠিচার্জ ও মারপিট চালায়। বহু ছাত্রকে গ্রেপ্তার করে। এর প্রতিবাদে কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ ১৯শে জানুয়ারি আবার ছাত্রধর্মঘট আহবান করে। এদিনও ঢাকায় পুলিশ ছাত্রদের উপর মারাত্মকভাবে আক্রমণ চালায়। এর প্রতিবাদে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ ২০শে জানুয়ারি আবার বিক্ষোভ মিছিল বের করে। মিছিলে পুলিশ গুলী চালালে গুলিতে ছাত্রনেতা আসাদ শহীদ হন । আসাদের মৃত্যুতে ছাত্র আন্দোলন সহিংসতার আকার ধারণ করে। আসাদের মৃত্যুর প্রতিবাদে ২১শে জানুয়ারি ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ সারা বাংলায় হরতালের ডাক দেয় এবং এই হরতালকে আওয়ামীলীগ সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সমর্থন করে। ২১ শে জানুয়ারি সারা বাংলায়
৫২
স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল পালিত হলেও বিভিন্ন স্থানে ছাত্র ও পুলিশদের সঙ্গে সংঘর্ষের মত ঘটনা ঘটে। এদিন সারা টাঙ্গাইলে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও অফিস আদালতসহ সর্বত্র হরতাল পালিত হয়। হরতাল শেষে বিকেলে ছাত্রসগ্রাম পরিষদ টাঙ্গাইল শহরে বিশাল বিক্ষোভ মিছিল বের করে। মিছিল শেষে স্থানীয় শহীদমিনার প্রাঙ্গনে এক বিশাল ছাত্র-গণ জমায়েত অনুষ্ঠিত হয়। এতে ভাষণ দেন আলী আজগর খান দাউদ, হামিদুল হক মােহন, আতিকুর রহমান সালু, আনােয়ার বক্স প্রমুখ। ২১শে জানুয়ারির দমন পীড়নের প্রতিবাদে ছাত্রসগ্রাম পরিষদ ২৪শে জানুয়ারি সারা বাংলায় আবার হরতালের কর্মসূচী ঘােষণা করে। ঐদিন সরকার ঢাকায় ২৪ ঘন্টার জন্য কার্ফ জারি করে এবং রাস্তায় সেনাবাহিনী নামায়। ঢাকা শহরে সকাল থেকেই খণ্ড খণ্ড মিছিল বের হয় এবং পুলিশের সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষ হয়। দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয় কলাভবনে যেমনি লক্ষ লক্ষ ছাত্র-ছাত্রীর সমাবেশ ঘটে তেমনি পল্টনে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক, কৃষকসহ সর্বস্তরের লােকের সমাবেশ ঘটে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্র-ছাত্রীদের মিছিল পল্টনের সমাবেশের সঙ্গে একত্রিত হয়। সমাবেশ শেষে লক্ষ লক্ষ মানুষের মিছিল শুরু হয়। এই বিশাল মিছিল এক পর্যায়ে উত্তেজিত হয়ে সহিংস আকার ধারণ করে। মিছিলের লােকজন সরকার সমর্থিত কয়েকটি পত্রিকা অফিস পুড়িয়ে দেয়। মিছিলের উপর পুলিশ গুলী চালালে মতিউর, রুস্তম, মকবুল সহ অনেকেই মৃত্যুবরণ করে এবং বহু লােক আহত হয়। এর প্রতিবাদে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ ২৫শে জানুয়ারি দেশব্যাপী হরতার ও শােক দিবসের কর্মসূচি ঘােষণা করে। কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের আহবানে সারাদেশের মত টাঙ্গাইলের ছাত্রসগ্রাম পরিষদও হরতাল এবং শােক দিবস পালন করে। সকাল থেকেই টাঙ্গাইল শহরের প্রতিটি দোকানে এবং স্কুলে কালােপতাকা উত্তোলন করা হয়। সফল ছাত্র-ছাত্রীদের কালাে ব্যাজ ধারণ এবং ছাত্র ও রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের উদ্যোগে সর্বস্তরের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে কালােব্যাজ ধারণ করে। এদিন দুপুরে টাঙ্গাইল শহরে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের ও রাজনৈতিক সংগঠনের যৌথ শােক মিছিল বের করা হয়। হরতাল শেষে বিকালে শহীদ মিনারে বিরাট বিক্ষোভ সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং সভাশেষে বিক্ষোভ মিছিল টাঙ্গাইল শহরের বিভিন্ন রােড প্রদক্ষিণ করে। ২৫শে জানুয়ারি হরতাল ও শােক দিবসের কর্মসূচী পালনে ঢাকা সহ বিভিন্ন স্থানে পুলিশ ও ই. পি. আর. বাহিনীর সদস্যরা বাধা দেয় এবং বেশ কয়েক স্থানে গুলি চালালে তাতে বহু ছাত্র ও রাজনৈতিক কর্মী আহত হয়। অনেক নেতাকর্মীকে এদিন গ্রেপ্তার করা হয়। এর প্রতিবাদে এবং আইয়ুব শাহীর পতন ও বঙ্গবন্ধু সহ সকল রাজবন্দীদের মুক্তি এবং আগরতলা মামলা প্রত্যাহারের দাবীতে ৫ই ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ হরতালের আহ্বান জানায়। এই হরতাল পালন করার সময় ছাত্রদের বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশ ও ই. পি. আর. বাহিনীর গুলীতে টাঙ্গাইলে মৃত্যুবরণ করে বিশ্বনাথ। আরাে বেশ কয়েকজন আহত হয় পুলিশের গুলীতে। জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে টাঙ্গাইলে পুলিশ অধিকাংশ রাজনৈতিক নেতা ও ছাত্রনেতা কর্মীদের নামে গ্রেপ্তারী পরােয়ানা জারি করে এবং অনেককেই গ্রেপ্তার করে। পুলিশ ৫ই ফেব্রুয়ারির আগেই টাঙ্গাইলে গ্রেপ্তার করে করটিয়া কলেজের ভি. পি. খন্দকার আব্দুল বাতেন, জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আনােয়ার বক্স ও জেলা আওয়ামীলীগ সম্পাদক শামীম আল মামুন। গ্রেপ্তারী পরােয়ানাসহ সকল প্রকার দমন পীড়নকে উপেক্ষা করে টাঙ্গাইলের ছাত্র সমাজ ৫ই ফেব্রুয়ারি বিক্ষোভ মিছিল বের করার মধ্য দিয়ে টাঙ্গাইলসহ সারা বাংলার রাজনৈতিক আন্দোলনে এক ঐতিহাসিক কৃতিত্বের পরিচয় দেয়, যা ১৯৬৯ সালের ছাত্র-গণআন্দোলনের ইতিহাসে
৫৩
চিরস্মরনীয় হয়ে থাকবে। ঐদিন বেলা ১২টার দিকে এক বিশাল ছাত্রমিছিল টাঙ্গাইল শহরের পূর্বপ্রান্তের আশেকপুর সি. ও. অফিসের সম্মুখ থেকে শুরু হয়। মিছিলটি মূলত করটিয়া কলেজের ছাত্রদের নেতৃত্বে শুরু হয়। সকাল থেকেই করটিয়া কলেজের মাঠে পাশপাশের বিভিন্ন স্কুল থেকে বহু ছাত্র এসে উপস্থিত হয়। সকাল ১১টার পর থেকেই করটিয়া কলেজ থেকে বহু ছাত্র খণ্ড খণ্ড মিছিল করে পায়ে হেঁটে টাঙ্গাইলের দিকে আসতে থাকে। আবার অনেকেই ট্রাক বাস যােগে টাঙ্গাইল এসে পৌছে। তবে ছাত্রদের অধিকাংশই পায়ে হেঁটে ৬ মাইল রাস্তা অতিক্রম করে টাঙ্গাইল আসে। সেদিনের মিছিলে নেতৃত্বদানকারীদের মধ্যে ছিলেন শাহজাহান সিরাজ, আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী, আলী আজগর খান দাউদ, হামিদুল হক মােহন, সােরহাব আলী খান আরজু , খালেকুজ্জামান খান লাবু, আলমগীর খান মেনু, মােয়াজ্জেম হােসেন খান, আবু হােম্মদ এনায়েত করিম, আব্দুস সামাদ, আতিকুর রহমান সালু, এস. এম. রেজা, বুলবুল খান মাহবুব, আজিজুর রহমান দুলাল, মকবুল হােসেন, মীর শামসুল হক, মহির উদ্দিন মেহের, আবু আহম্মেদ, আফতাবুজ্জামান ফিরােজ, আনােয়ারুল আলম শহীদ, মিহির সাহা, মহসিনুজ্জামান জিন্না প্রমুখ। বিক্ষোভ মিছিলটি সি. ও. অফিস থেকে শুরু করার সময় পুলিশ আক্রমন চালানাের চেষ্টা করে কিন্তু বিশাল মিছিলের কারণে পুলিশ আক্রমন করতে সাহস পায়নি। মিছিল যতই শহরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে ততই বিভিন্ন স্থান থেকে ছাত্রদের যােগদান করাতে মিছিল ক্রমশ আরাে বিশাল আকার ধারণ করে। মিছিলটি যখন ভিক্টোরিয়া রােড ধরে পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়ে রওশন সিনেমা হলের একটু পূর্ব দিকে এসে পৌঁছে তখন পুলিশ মিছিলে আক্রমণ চালায়। পুলিশ আক্রমন চালালে তার প্রতি আক্রমনে ছাত্ররা ইট, পাটকেল এবং লাকড়ি নিয়ে পুলিশের উপর আক্রমন চালায়। এখানে ছাত্রদের আক্রমনের মুখে পুলিশ পিছু হটতে বাধ্য হয়। কারণ একদিকে চাত্রদের সংখ্যা ছিল পুলিশের চেয়ে কয়েকশত গুণ বেশি। অপরদিকে ছাত্ররা আরাে সুবিধাজনক ছিল বর্তমান ল’ কলেজের সামনেই ছিল ঘােড়ার গাড়ির ষ্টেশন। আর ঐ ষ্টেশনে ছিল প্রচুর আম গাছের লাকরি যা ছাত্ররা লাঠি হিসাবে ব্যবহার করতে পেরেছে এবং এই লাকড়ি ছাত্রদের অস্ত্র হিসবে পুলিশকে হঠাতে যথেষ্ট সাহায্য করে। পুলিশকে পিছু হঠিয়ে ছাত্রদের মিছিল আবার পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়। এই সময় অত্যন্ত সাহসিকতাপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন আলী আজগর খান দাউদ, সােরহাব আলী খান আরজু ও খালেকুজ্জামান খান লাবু। এদের সাহসিকতাপূর্ণ নেতৃত্বে মিছিলটি নিরালার মােড়ে আসলে মওলানা মােহাম্মদ আলী কলেজের ছাত্রদের আরাে একটি বড় মিছিল এসে মিলিত হয় এতে মিছিলের বিশালত্ব আরাে বৃদ্ধি পায়। মিছিলটি নিরালার মােড় হয়ে উত্তর দিকে জেল রােড ধরে অগ্রসর ডাকবাংলার সামনে মিছিলের উপর পুলিশ ও ই, পি, আর বাহিনী যৌথভাবে আক্রমন চালায়। সরকারী বাহিনীর গুলি আর কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপের ফলে ছাত্রদের মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। এসময় আবার ছাত্রনেতৃবৃন্দ ছত্রভঙ্গ মিছিলকে সংগঠিত করে মিছিলটি সরকার বাহিনীর সন্ত্রাসের মধ্যে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে খালেকুজ্জামান খান লাবু, আলী আজগর খান দাউদ, সােরহাব আলী খান আরজু, এস. এম. রেজা, আব্দুস সামাদ। বিশেষ করে খালেকুজ্জামান খান লাবু এবং আব্দুস সামাদের দরাজ কণ্ঠের শ্লোগান মিছিলকে একত্রিত করতে অত্যন্ত সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে। মিছিল পুনরায় সংগঠিত হয়ে নিড়ালার মাের হয়ে সদর রােড ধরে মসজিদ রােড দিয়ে কালীবাড়ি রােড দিয়ে উত্তর দিকে অগ্রসর হলে পুলিশ ও ই, পি, আর, বাহিনী যৌথভাবে আক্রমন চালায়। সরকারী বাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে ছাত্রদের মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। এই সময় পুলিশের গুলীতে আদালত পাড়ার কালীবাড়ি রােডের বিশ্বনাথসহ বেশ কয়েকজন আহত হয়। বিশ্বনাথ পরে
৫৪
মৃত্যুবরণ করে। এবার মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়ার পর আর মিছিল একত্রিত বা সংগঠিত হতে পারেনি। ইতিমধ্যে পুলিশ শাহজাহান সিরাজ ও আব্দুস সামাদকে গ্রেপ্তার করে। বেতকা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আলহাজ্ব ইমদাদুল হকের প্রচেষ্টায় শাহজাহান সিরাজ ও আব্দুস সামাদ মুক্তি পায় এবং ইমদাদুল হক নেতৃদ্বয়কে তার গাড়িতে তুলে নিজের বাসায় নিয়ে আসেন। অনুরূপ ভাবে পুলিশের হাত থেকে রেহাই পান আলী আজগর খান দাউদ। তকে যখন পুলিশ আদালত পাড়াস্থ অজিত হােমের বাসার নিকট ঘেরাও করে ফেলে তখন তিনি তুলা মােক্তারের সহযােগীতায় বেঁচে যান। ৫ই ফেব্রুয়ারির ঘটনার পর সারা টাঙ্গাইলের প্রত্যন্ত অঞ্চলে আন্দোলনের ব্যাপকতা বৃদ্ধি পায়। এরপর ছাত্রগণ আন্দোলন এমনি ব্যাপক আকার ধারণ করে যে, প্রশাসন তখন অচল হয়ে পড়ে । প্রশাসন অচল হয়ে পড়লে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ, বলা চলে, প্রশাসনকে নিজেদের হাতে তুলে নেয়। বিশেষ করে চোর, ডাকাতসহ সমাজ বিরােধীদের বিচার করার দায়িত্ব তার সঙ্গে ইউনিয়ন পরিষদের পরিচালনার দায়িত্ব ছাত্রদের হাতে তুলে দেয়। এবং বহু চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের শাস্তি দেয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ। টাংগাইলের চোর ডাকাতসহ সমাজ বিরােধীদের নির্মূল করার প্রথম অভিযান শুরু হয় করটিয়া কলেজের নিকটবর্তী খারজানা গ্রাম থেকে। এই গ্রামে বেশ কিছু লােক চুরি, ডাকাতিসহ সমাজ বিরােধী কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত ছিল। তাদের দাপটে এলাকার মানুষ সর্বদা জানমালসহ নিরাপত্তার অভাব বােধ করত। কিন্তু প্রশাসনের কাছে তাদের বিরুদ্ধে অভিযােগ করে কোন প্রকার বিচার পায়নি। কারণ পুলিশের সঙ্গে ঐ সমস্ত সমাজ-বিরােধীদের ভাল সম্পর্ক ছিল। কাজেই এবার সুযােগ পেয়ে এলাকার মানুষ ছাত্র সগ্রাম পরিষদের নিকট ঐ সমস্ত সমাজ বিরােধীদের বিরুদ্ধে অভিযোেগ জানায়। অভিযােগ পাওয়ার পর ছাত্রসগ্রাম পরিষদের নির্দেশে কলেজের ছাত্ররা ঐ গ্রামে আক্রমণ চালায়। ছাত্ররা সমাজবিরােধীদের অধিকাংশ বাড়িঘর ভেঙ্গে দেয় এবং অনেক বাড়িতে অগ্নি সংযােগ করে। অনেককেই মারপিট করে ছেড়ে দেয়। এই ঘটনার পর শুরু হয় টাঙ্গাইলের বিভিন্ন স্থানে সমাজ বিরােধীদের নির্মূল অভিযান। বিশেষ করে টাঙ্গাইলের পশ্চিম এলাকাতে এবং মির্জাপুরের বহুড়িয়াতে যে ঘটনা ঘটে তা সারা দেশের মানুষের কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে পড়ে। এর পরই দেশব্যাপী শুরু হয় টাঙ্গাইলের চর এলাকার মত সমাজ বিরােধী নিধন অভিযান।
‘৬৯-এর পশ্চিম টাঙ্গাইল
১৯৬৯ সালের ছাত্র গণআন্দোলনে টাঙ্গাইল জেলার পশ্চিম এলাকা অর্থাৎ ধলেশ্বরী ও যমুনা বিধৌত চরাঞ্চল। চরাঞ্চলে আন্দোলন শুরু হলে তার প্রথম ঢেউ লাগে আশপাশের বিভিন্ন জেলাতে। বিশেষ করে জামালপুর, শেরপুর, ময়মনসিংহ, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, বগুড়া। পর্যায়ক্রমে এই আন্দোলন সারা বাংলার গ্রাম পর্যায় বিস্তার লাভ করে। এই আন্দোলন মূলত যতটুকু না ছিল সরকার বিরােধী তার চেয়ে বেশি ছিল সমাজ বিরােধী দুষ্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে। চরাঞ্চলে ব্যাপক জঙ্গী আন্দোলন গড়ে উঠার পিছনে কারণ ছিল ঐ অঞ্চলের সমাজবিরােধী দুষ্কৃতিকারীদের একচ্ছত্র আধিপত্য। ঐ অঞ্চল ছিল চোর-ডাকাত ও সমাজবিরােধীদের স্বর্গরাজ্য। বিশেষ করে গরু চোরদের ছিল প্রচণ্ড অত্যাচার। তাদের অত্যাচারে টাঙ্গাইলের চর এলাকাসহ আশপাশের বিরাট এলাকার কৃষকদের তখন সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল গরু চুরির বিষয়টি। গরু চোরের অত্যাচারে অধিকাংশ কৃষকই রাতের বেলায় গরুর
৫৫
গােয়াল ঘরে রাত্রি যাপন করত, যাতে গরু চুরি করে নিতে না পারে। হাজার হাজার কৃষক পরিবারকে গরু চোররা পঙ্গু করে দিয়েছে। সাধারণ মানুষ গরু চোরের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়েও কিছু করতে পারেনি। কারণ প্রশাসন এবং এলাকার প্রভাবশালী অনেকের সঙ্গেই চোরদের ভাল সম্পর্ক ছিল। তারা কিছু লাভের বিনিময়ে চোরদের সহায়তা করত। যার জন্য চোরদের ধরেও কিছু করা যেত না। একদিকে থানা পুলিশের হাতে তুলে দিলে তারা টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দিত। অন্য দিকে এলাকার প্রভাবশালীদের জন্য স্থানীয়ভাবে কোন প্রকার বিচার করা সম্ভব হয়নি। এর ফলে এলাকার চোরদের ছিল ব্যাপক দাপট ও সাহস। কোন কৃষক চুরি যাওয়া গরুর খোঁজে গেলে তাকে ধরে মারপিট করে ছেড়ে দিত চোরেরা। অনেক গরুর মালিককে গরু জবাই করে জোর করে খাইয়ে দিত। আবার টাকার বিনিময়ে চুরি করা কিছু কিছু গরু ছেড়ে দিত। কোন প্রকার বিচার বা শাস্তি দেয়ার মত ব্যবস্থা না থাকাতে কৃষক নিজের গরু চোরদের টাকা দিয়ে ফিরিয়ে আনত । এর জন্য বহু কৃষককে গরু আনতে নিজেই সর্বশান্ত হয়েছে। দীর্ঘদিনের ক্ষোভ বিক্ষোভ এবার প্রকাশ করার সুযােগ পায় কৃষক সমাজ। কারণ এলাকার ছাত্রসমাজ সরকার বিরােধী আন্দোলনের পাশাপাশি কৃষকদের রক্ষা করার জন্য এগিয়ে আসে, চোর ডাকাতসহ সকল প্রকার সমাজ বিরােধীদের দমন করার জন্য। সেই সুযােগে কৃষক শ্রেণী ও ছাত্র সমাজের সঙ্গে মিলিতভাবে আন্দোলন গড়ে তােলার জন্য সংগঠিত হয়। কৃষকসহ সকলস্তরের জনতার সাহায্যে ছাত্রসমাজ এলাকায় গঠন করে সংগ্রাম পরিষদ। আর এই সংগ্রাম পরিষদই চোর-ডাকাতসহ সমাজ বিরােধীদের দমনের জন্য ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তুলে এবং চোর-ডাকাত ও সমাজ-বিরােধীদের বিচার করে শাস্তি দেয়ার ব্যবস্থা করে। প্রথমদিকে চোরদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্থানে সভাসমাবেশ করে। তারপর তাদের বাড়ি ঘেরাও করে ধরে এনে সভাসমাবেশে হাজির করা হয় এবং বিচার করে শাস্তি দেয়া হয়। শাস্তি স্বরূপ কিছু মারপিট এবং অর্থদণ্ড করা হয়। আবার অনেক চোরকে বাড়িঘর ভেঙ্গে দিয়ে এলাকা ত্যাগের নির্দেশ দেয়া হয়। সগ্রাম পরিষদের এ ধরণের কার্যকলাপ সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং সমর্থন পেতে থাকে। এই সময় সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে যারা ছিলেন বা ছাত্র গণআন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেন তাদের মধ্যে ছিলেন আব্দুস সাত্তার চাকলাদার, আকরাম হােসাইন, আব্দুস সালাম চাকলাদার, ইঞ্জিনিয়ার আব্দুস সবুর, আব্দুর রাজ্জাক, ইঞ্জিনিয়ার আবুল হােসেন, দেলবর হােসেন আনছারী, মাে: মহিউদ্দীন, মােঃ সােরহাব হােসেন, মােঃ হাফিজ উদ্দীন, মােঃ সুকুম উদ্দিন, মােঃ বছির, ইঞ্জিনিয়ার আশরাফ, মােঃ শাহজাহান, মােঃ আলী আরদুস, হযরত আলী, মােঃ আতােয়ার মাষ্টার, মােঃ ফজলুর রহমান, আব্দুর জব্বার সিদ্দিকী, মােঃ শাহজাহান খান, মােঃ শুকুর মােল্লা, আবু সাঈদ মাষ্টার, মােঃ সাখাওয়াত হােসেন, মােঃ শাহজাহান মিয়া, মােকাদ্দেস আল মামুন, আবুল হােসেন ও আবুল হাসান প্রমুখ । ছাত্রনেতাদের যে সমস্ত বয়স্ক ব্যক্তিবর্গ সহযােগীতা করে তাদের মধ্যে ছিলেন আলহাজ্ব মােঃ হাবিবুর রহমান মৌলভী। তিনি ছাত্র গণআন্দোলনের সূচনাতেই সক্রিয়ভবে নেতৃত্ব দেন। আরাে বয়স্কদের মদ্যে উল্লেখযােগ্য ছিলেন গণি চাকলাদার, আব্দুর রহমান ও গান্দি সরকার। আন্দোলন শুরু হয় মূলত হুগড়া থেকে-আলহাজ্ব মৌঃ মােঃ হাবিবুর রহমান ও তার পুত্র আকরাম হােসেনের নেতৃত্বে। তিনি ঐ সময়ে হুগড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। এলাকার শান্তি রক্ষার ক্ষেত্রে তিনি বহু আগে থেকেই তৎপর ছিলেন। একজন শিক্ষিত সব্যক্তি হিসেবে দুষ্টের দমন শিষ্ঠের পালনের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন সর্বদা সােচ্চার। শােনা যায় বহু আগে এলাকার সন্ত্রাস সৃষ্টিকারী, সাধারণ মানুষের জীবন যাত্রার বিঘ্ন সৃষ্টিকারী কুখ্যাত ডাকাত কসিমুদ্দিনকে নিজে হাতে
৫৬
ধরে পুলিশের হাতে তুলে দেন। এজন্য সরকার তাকে পুরস্কৃত করেন। কারণ কসিমুদ্দিনকে পুলিশ ধরার সাহস পায়নি। আর সেই কসিমুদ্দিনকে ধরে দেন মৌঃ মােঃ হাবিবুর রহমান। তিনি ছিলেন হবৃটিশ আমলের কলিকাতা থেকে বি. এ. ডিগ্রী প্রাপ্ত উচ্চ শিক্ষিত। ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি মৌঃ মােঃ হাবিবুর রহমান এলাকায় চোর ডাকাত ও সমাজবিরােধীদের দমনের জন্য নিজ বাড়িতে এক সভা ডাকেন। উক্ত সভায় টাঙ্গাইলের পশ্চিম অঞ্চল, পাবনা, সিরাজগঞ্জের ব্যাপক এলাকার বহু চেয়ারম্যান উপস্থিত হন। বৈঠকে চোর ডাকাত দমনের জন্য বিভিন্ন এলাকার চেয়ারম্যানদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয় যার সভাপতি ছিলেন মৌঃ মােঃ হাবিবুর রহমান। বৈঠকে হাজার হাজার সাধারণ মানুষের আগমনে এক বিরাট জনসভায় পরিণত হয়। সভাচলাকালীন সময়ে আকরাম হােসেন উপস্থিত হন। তিনি তখন করটিয়া সাদত কলেজের সম্মান দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। সভায় উপস্থিত হয়ে আকরাম হােসেন জ্বালাময়ী ভাষায় বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন চোরডাকাতদের বিচার করার আগে আপনারা নিজে ভাল হন। কারণ আপনাদের মধ্যে অনেক চেয়ারম্যান আছে যারা চোরদের সহযােগিতা করে বা চোরদের সঙ্গে চুরির মাল ভাগাভাগি করে নেন। সভায় আকরাম হােসাইন তার বক্তব্যে জনসাধারণকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আপনারা আগামী দিন সকাল দশটায় আমাদের বাড়িতে আসবেন। পরের দিন পাবনা, সিরাজগঞ্জ ও টাঙ্গাইলের বিভিন্ন স্থান থেকে হাজার হাজার জনসাধারণ যথা সময়ে উপস্থিত হয়। চোরদের যাতে দমন এবং বিচার করা না হয় তার জন্য চোরের সরদার আহসান এবং মগড়া মৌঃ মােঃ হাবিবুর রহমানের বাড়িতে যান হুমকী দিতে। আহসান এবং মগড়া বীরের বেশেই গিয়ে হাজির হন ঐ বাড়িতে। আহসান মাথায় জিন্না ক্যাপ পড়ে এবং মগড়া সাইকেল নিয়ে যান। চোরদের সরদার হিসেবে দুজনেই সাহেব সেজে যান। ঐ এলাকায় চোরদের মধ্যে ভাল সাহেবী ভাব দেখা গেছে। গরু চোর হলেও পােশাক আশাক ছিল সাহেবী। অনেককেই দেখা যেতাে বিকেল বেলা দামী লুঙ্গী ও দামী পাঞ্জাবী পড়ে, গায়ে দামী সাল প্যাচিয়ে, গায়ে পামসু জুতা পরে হাতে ছাতা নিয়ে রাস্তায় বের হত জমিদারী ভাব ধরে। মানুষ বলে চোরের মার বড় গলা। তার বাস্তব প্রমাণ দেখা গেছে চরের বিভিন্ন স্থানে। • সাহেবী ভাব নিয়ে চোরদের সরদার আহসান এবং মগড়া দাপটের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করে। সাধারণ মানুষ প্রথমদিকে কিছুটা ভয় পায় ওদের সাহস দেখে। কারণ দুজনেরই সাহেবী পােশাক আশাক, তাছাড়া দুজনেই খুবই সুন্দর আদমী ছিলেন। বিশেষ করে আহসান ছিলেন বিশাল দেহের অধিকারী। আলাপ আলােচনার সুযােগে এক পর্যায়ে জনতা আহসান এবং মগড়াকে আটকিয়ে ফেলে। এসময় মৌঃ মােঃ হাবিবুর রহমান বাড়িতে ছিলেন না। তিনি তখন বেড়ানাকালিয়াতে গেছেন। চাউলের নৌকার নিরাপত্তা জনিত কাজে। কারণ সরকার নৌকায় চাউল আনার সময় যাতে কোন চোর ডাকাত ক্ষতি করতে না পারে তার জন্য কিছু সংখ্যক চেয়ারম্যানকে দায়িত্ব দেন। বিশেষ করে যাদের পাশকৃতবন্দুক আছে। এই দায়িত্ব নিয়ে মৌঃ মােঃ হাবিবুর রহমান সেখানে যান। তিনি বাড়িতে না থাকাতে উপস্থিত জনতার কেউ কেউ চোরদের আটকিয়ে রাখার কথা বলেন তার আগমনের সময় পর্যন্ত। কিন্তু উত্তেজিত জনতা তা রাখতে রাজী ছিলেন না। বিক্ষুদ্ধ জনতা তাড়াতাড়ি চোরের দুই সর্দারকে হত্যা করার জন্য ব্যস্ত। প্রথমে গামছা দিয়ে ঘরের খুটির সঙ্গে আটকিয়ে রাখে। পরে শ্বাসরুদ্ধ করে দুজনকেই হত্যা করে। হত্যার পর উত্তেজিত জনতা ওদের মৃত দেহ টুকরা টুকরা করে ফেলে। ঐদিন হুগড়ার আরফান চোর সহ আরাে তিনজন চোরকে জনতা
৫৭
শাস্তি দেয় এবং বেশ কিছু চোরদের বাড়িঘর ভেঙ্গে দেয়। এই ঘটনার পর এলাকায় চোরদের মনে ভয়ের সৃষ্টি হয়। অপরদিকে ছাত্র-জনতার মনে ব্যাপক সাহস ও উৎসাহ উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়। চোরদের হত্যার পরে আবার সমস্ত জনতাকে একত্রিত করে সেখানে আকরাম হােসেনসহ বেশ কয়েকজন বক্তব্য রাখেন। বক্তব্যে আকরাম হােসেন পরের দিন দশটার সময় সবাইকে যথাস্থানে আসার জন্য অনুরােধ করেন। পরের দিন অর্থাৎ ১৯৬৯ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি সকালে হাজার হাজার মানুষ এসে হাজির হয়। লােকজন একত্রিত হওয়ার পর সেখানে আকরাম হােসেন সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন। তিনি তার বক্তব্যে জনতাকে নির্দেশ দেন চোর ডাকাতসহ সমাজ বিরােধীদের না মেরে একত্রিত করতে। বক্তব্য শেষে জনতা কাতুলী ইউনিয়নের দিকে অগ্রসর হয়। এই কাতুলী ইউনিয়নই ছিল চোর ডাকাতসহ সকল সমাজ বিরােধীদের বড় দূর্গ। উত্তেজিত ছাত্রজনতার বিশাল মিছিল কাতুলীর বাগবাড়িতে সমবেত জনতার সঙ্গে একত্রিত হয়। বাগবাড়িতে সকাল আটটার সময় থেকেই হাজার হাজার ছাত্র জনতা এসে উপস্থিত হতে থাকে। কাতুলীর ইউনিয়ন ছাত্র সগ্রাম পরিষদ ঐ স্থানেই এলাকার ছাত্র জনতাকে একত্রিত হওয়ার নির্দেশ দিয়ে ছিলেন। আর সেই নির্দেশ মােতাবেকই যথা সময়ে এসে হাজির হয় হাজার হাজার জনতা। কাতুলীর বাগবাড়ি থেকেই শুরু হয় উত্তেজিত হাজার হাজার ছাত্র জনতার বিশাল মিছিল। ঐ মিছিলে প্রায় সত্তর আশি হাজারের মত লােক ছিল। মিছিল কিছু দূর অগ্রসর হওয়ার পর উত্তেজিত ছাত্র জনতা চোর ডাকাত ও সামাজ বিরােধীদের বাড়িঘরের উপর আক্রমন করে। তারা বাড়িতে যে সমস্ত চোর ডাকাত পায় তাদের হত্যা করে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। উত্তেজিত ছাত্র জনতা কয়েকশত বাড়ি ঘর পুড়িয়ে দিয়ে চোরকে ছাত্রজনতা হত্যা করে। সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরা এবং ছাত্র জনতাকে আরাে সুসংগঠিত করার জন্য কাতুল্লী ইউনিয়ন ছাত্র সগ্রাম পরিষদ ১৯৬৯ সালের ১৫ ই ফেব্রুয়ারি রােজ শুক্রবার বিকেল বেলার বাগবাড়িতে এক জনসভার আয়ােজন করে। উক্ত জনসভার প্রস্তুতিকালে সকাল বেলার দিকে এলাকায় সংবাদ রটে যায় যে, স্থলের চরের রাফাদানি সম্প্রদায় এর লােকজন হানাফিদের আক্রমণ করার জন্য প্রস্ততি নিচ্ছে। ঐ সংবাদ পাওয়ার পর সগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ হুশিয়ার করে দেন এটা কোন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ব্যাপার নয়। এখানে কোন ধরনের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধানাে চলবে না ধর্মের দোহাই দিয়ে। যদি কোন ব্যক্তি কোন প্রকার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার চেষ্টা করে তবে তাকে রেহাই দেয়া হবে না। ঐ সংবাদ উদ্দেশ্যমূলক ভাবেই কিছু সংখ্যক সমাজ বিরােধী ব্যক্তি প্রচার করে ঘটনাকে অন্যদিকে প্রবাহিত করা এবং জনসভাকে পণ্ড করার জন্য। সভা যথারীতি বিকেলে বাগবাড়ির মাঠে শুরু হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন কাতুলীর ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি আব্দুস সাত্তার চাকলাদার। বক্তব্য রাখেন জেলা ছাত্র সগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ এবং স্থানীয় নেতা আব্দুস সালাম চাকলাদার ও আব্দুর রাজ্জাক। সভায় দুপুরের পর থেকেই বিশাল বিশাল মিছিল আসতে শুরু করে। প্রত্যেক মিছিলেই প্রায় দুই চারজন করে চোর ধরে আনে। ঐ দিন বিভিন্ন এলাকায়ে বেশ কিজু বাড়িঘরে অগ্নিসংযােগ এবং বেশ কয়েকজন চোর ডাকাতকে উত্তেজিত ছাত্র জনতা হত্যা করে। উত্তেজিত ছাত্র জনতা যে সমস্ত চোর ডাকাতকে হত্যা করে তাদের অনেকের আত্মীয় এবং বিপুল সংখ্যক দালাল প্রকৃতির লােকজন জেলা পুলিশ প্রশাসনসহ থানায় সংবাদ দেয় এবং অভিযােগ করে। অভিযােগ এবং সংবাদ পাওয়ার পর ১৯৬৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি এস.ডি. ও. সাহেব এবং এ.ডি.পি. ও সাহেব সঙ্গে পঁচিশ ত্রিশজন পুলিশ নিয়ে গুগড়া ইউনিয়ন ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতা আকরাম হােসেনের বাড়িতে যান। পুলিশ দেখে এলাকার ছাত্রজনতা একত্রিত হয় এবং উত্তেজিত
৫৮
হয়ে ওঠে। আকরাম হােসেন ও তার পিতা মৌঃ মােঃ হাবিবুর রহমান উত্তেজিত জনতাকে শান্ত করে পুলিশের সঙ্গে কথা বলেন। আলােচনার পর পুলিশ প্রশাসন এলাকার শান্তি শৃংখলা রক্ষার দায়িত্ব স্থানীয় ছাত্র নেতাদের উপর ছেড়ে দেন। একই সঙ্গে জনতার চাপে পুলিশ প্রশাসন বলেন যে সমস্ত ঘটনা ঘটেছে তারজন্য আর কোন ধরনের মামলা মকদ্দমা হবে না এবং কাউকে গ্রেফতার করা হবে না । কিন্তু পুলিশ গুগড়া থেকে কাতুলীর দিকে রওনা দেয়। ১৬ই ফেব্রুয়ারি ভােরেই কাতুলীর ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ সংবাদ পান এলাকায় পুলিশ আসছে। সংবাদ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছাত্র নেতৃবৃন্দ ছাত্রজনতাকে একত্রিত করে পুলিশের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে তােলার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ছাত্র নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন জন বিভিন্ন দায়িত্ব নিয়ে বিভিন্ন স্থানে যান। ঐ দিন ছিল কাতুলী ইউনিয়নের তােরাবগঞ্জের হাট। এই হাটের জনতাকে সংগঠিত করার জন্য দায়িত্ব দেন ছাত্রনেতা আব্দুস সালাম ও আব্দুস ছবুর। তারা মাইকের সাহায্যে এলাকায় পুলিশ আসার কথা প্রচার করে এবং জনতাকে প্রস্তুত হওয়ার জন্য অনুরােধ জানায়। অন্যদিকে ছাত্রনেতা আব্দুস সাত্তার চাকলাদার ও মােঃ রুস্তম আলীকে সঙ্গে নিয়ে গুগড়ার ছাত্রনেতা আকরাম হােসেনকে সংবাদ দিতে যান। পুলিশের আগমন বার্তা পেয়ে দ্রুত গতিতে হাজার হাজার ছাত্রজনতা একত্রিত হয়ে পলিশের বিরুদ্ধে শ্লোগান দিতে থাকে। পুলিশ চোরদের আত্মীয় স্বজনদের সাহায্যে কাতুল্লী ইউনিয়নের আলােকদিয়া ও রশীদপুর থেকে বেশ কয়েকটি মৃতদেহ তুলে নিয়ে আসে। তারা লাশ নিয়ে টাঙ্গাইলের দিকে আসতে চেষ্টা করে। উত্তেজিত হাজার হাজার জনতা এসময় টাঙ্গাইল আসার পথে চাড়াবাড়ি মৌজার বিপরীত দিকে ধলেশ্বরী নদীর পশ্চিম তীরে চৌবাড়িয়াতে পুলিশের সামনে প্রতিরােধ সৃষ্টি করে। এখানে প্রায় চল্লিশ পঞ্চাশ হাজার মানুষের সমাবেশ ঘটে। পুলিশের সঙ্গে লাশ নিয়ে যে সমস্ত চোরদের আত্মীয় স্বজন এসেছিল তারা জনতার প্রতিরােধ দেখে ভয় পেয়ে লাশ ফেলে চলে যায়। উত্তেজিত ছাত্রজনতা পুলিশের নিকট থেকে লাশ ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। প্রথম দিকে পুলিশ প্রয়ােগ করে জনতাকে ছাত্র ভঙ্গ করার হুমকী দেয়। কিন্তু হাজার হাজার জঙ্গী জনতার বিশাল সমাবেশ দেখে অবাঙ্গালী এম. ডি. ও. সাহেব শক্তি প্রয়ােগ না করে জনতাকে বুঝিয়ে লাশ টাঙ্গাইল নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। উত্তেজিত জনতার উদ্দেশ্যে করুণ সুরে বলেন আমাদের নিকট থেকে যদি লাশ রেখে দেন তবে আমাদের চাকুরী থাকবে না । উত্তেজিত জনতা এম. ডি. ও সাহেবের কথা শুনতে রাজী নয়। তাদের দাবী একটাই লাশ নিয়ে যাওয়া যাবে না। যদি আমাদের দাবীকে উপেক্ষা করে লাশ নিতে চান তবে পরিস্থিতি খুবই খারাপ হবে। শেষ পর্যন্ত ছাত্র জনতার চাপের মুখে পরাজয় স্বীকার করে এস.ডি.ও সাহেব লাশ রেখে চলে আসেন। সেই সঙ্গে প্রতিশ্রুতি দেন যে এই ঘটনার জন্য কোন প্রকার মামলা মকদ্দমা হবে না। এই প্রতিরােধে নেতৃত্বদানকারীদের মধ্যে ছিলেন আব্দুস ছাত্তার চাকলাদার, আকরাম হােসেন, আব্দুস ছালাম চাকলাদার, আব্দুর রাজ্জাক ইঞ্জিনিয়ার আব্দুস সবুর মােঃ রুস্তম আলী, ইঞ্জিনিয়ার আবুল হােসেন, ইঞ্জিনিয়ার আশরাফ, মােঃ সাদের আলী, আব্দুস সামাদ মােঃ শাহজাহান মিয়া প্রমুখ। এস.ডি. ও সাহেব এবং এ. ডি. পি.ও সাহেব টাংগাইল এসেই লাশ ছিনিয়ে নেয়া, হত্যা অগ্নি সংযােগ, লুটপাটসহ বিভিন্ন অভিযােগ করে ছাত্রসগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দসহ এলাকার বহু লােককে আসামী করে মামলা দায়ের করেন। মামলা দায়ের করেও প্রথমদিকে পুলিশ কোন আসামী ধরতে যায়নি। কিন্তু ১৯৬৯ সালের ২৫ শে মার্চ আইয়ুবের বিদায়ের পর ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা দখল করে সামরিক আইন জারী করে সকল প্রকার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড করে বন্ধ করে দেন। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ হওয়ার পর রাজনৈতিক অঙ্গনে সাময়িক কালের জন্য সুস্থিরতা দেখা দেয়। যার জন্য
৫৯
দেশব্যাপী ছাত্র আন্দোলন ঝিমিয়ে পড়ে। এই সুযােগে নিহত চোরের আত্মীয় স্বজনরা আসামী ধরার জন্য যােগাযােগ করে। এতে পুলিশ প্রশাসন আবার সােচ্চার হয় এবং আসামীদের গ্রেপ্তারের জন্য ঝটিকা অভিযান চালান। কয়েকদিন ঝটিকা অভিযান চালিয়ে পুলিশ চার পাঁচশত ধরে আনে। ধরে আনার পর অনেককেই অমানুষিক নির্যাতন করে। হত্যা অগ্নিসংযােগ লুণ্ঠন কাজসহ কয়েকটি মামলায় শেষ পর্যন্ত পুলিশ আশি জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে। পুলিশ চার্জশিট দাখিল করলেও বাদী পক্ষের কেউ সাক্ষ্য দিলনা। এবং এস. ডি.ও সাহেব নিজেও সাক্ষ্যতে যা বললেন তা অনেকটা আসামীর পক্ষে। তিনি বলেন ঘটনা কে ঘটিয়েছে তা সুনির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়। কাজেই আদালত দুইজনকে শাস্তি দিয়ে বাকী সবাইকে খালাস দেন। শাস্তি প্রাপ্তরা হলেন রুস্তম আলী ও কোরবান আলী। এ দুজনই ছিল অত্যন্ত নিরীহ প্রকৃতির। মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে ও এলাকার মানুষ ব্যাপক ঐক্যের পরিচয় দিয়েছে। কয়েকটি ইউনিয়নের প্রতিটি বাড়ি থেকে চাঁদা দিয়ে মামলা পরিচালনার খরচ যােগাড় করা হয়। যাদের নগদ টাকা পয়সা দেওয়ার ক্ষমতা ছিল না তারা ধান ,পাট, বিভিন্ন শষ্য দিয়ে সাহায্য করেন যা বিক্রি করে টাকা এনে মামলা পরিচালনা করা হয়। মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রখ্যাত আইনজীবী ড. রাজী অত্যন্ত প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখেন। ১৯৬৯ সালের ছাত্ৰগন আন্দোলনে টাঙ্গাইলের পশ্চিম অঞ্চল বা চরাঞ্চলের ছাত্র গন আন্দোলন। ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। এই আন্দোলন শুরু হওয়ার পর তার কেউ দেশের বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে পড়ে।
৬৯ এর নাগরপুর
.
টাংগাইল জেলার অন্যান্য থানার মত নাগরপুর থানায়ও ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি মাসের শেষদিকে ছাত্র আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করে। কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও জেলা সংগ্রাম পরিষদের ডাকা প্রতিটি কর্মসূচি সফলভাবে পালন করে নাগরপুর থানা সংগ্রাম পরিষদ।সগ্রাম পরিষদের আহ্বানের প্রতিটি ধর্মঘট, প্রতিবাদ, ও বিক্ষোভ দিবস থানা ছাত্রসগ্রাম পরিষদ সফলভাবে পালন করে বিক্ষোভ ধর্মঘট, সভা সমাবেশ ও মিছিল করার পাশাপাশি থানার সর্বত্র সগ্রাম পরিষদের ১১ দফা ও আওয়ামীলীগের ৬ দফা ব্যাপক ভাবে প্রচার করে। সরকার বিরােধী আন্দোলনকে শক্তিশালী করার জন্য থানার প্রতিটি স্কুল কলেজ, ইউনিয়ন ও গ্রামে গ্রামে গঠন করে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। এই সময়ে থানা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের যারা বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন তাদের মধ্যে ছিলেন ছাত্রনেতা বাবু নারায়ন সাহা, মােঃ সিরাজুল ইসলাম, গৌতম চক্রবর্তী মােঃ তাজউদ্দীন, আল কামাল মােহাম্মদ আলী জিন্না, আফতাব হােসেন আরজু, আতিকুর রহমান কয়েদ আলী, প্রমুখ। এই সময়ে নাগরপুর থানা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদকে আন্দোলন শক্তিশালী করে তােলার জন্য সহযােগিতা করেন থানা আওয়ামী লীগ নেতা মােঃ সেতাব আলী এডভােকেট ও জকিমুদ্দীন খান। সারা দেশের মত ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমদিকেই নাগরপুরে সামরিক শাসন বিরােধী আন্দোলন চরম আকার ধারণ করে। মিছিল, মিটিং প্রতিদিনই হতে থাকে নাগরপুরে। এমনি অবস্থায় ১৯৬৯ সালের ৭ই ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলীতে টাঙ্গাইল শহরে শহীদ হন বিশ্বনাথ কর্মকার । বিশ্বনাথের মৃত্যুর পর সারা টাঙ্গাইলে সরকার বিরােধী আন্দোলন ব্যাপক জঙ্গীত্ব লাভ করে। সারা টাঙ্গাইল পরিণত হয় বিক্ষোভের বারুদগাথা । আন্দোলনের ব্যাপকতার কারণে টাঙ্গাইল শহর পরিণত
৬০
হয় সভাসমাবেশের শহর। আর তার বাতাস লাগে নাগরপুর থানায়ও। প্রতিনিয়ত যখন মিছিল আর সভাসমাবেশ, ধর্মঘট চলছে ঠিক তখন পাক সামরিক সরকার ঘটিয়ে বসে নির্মম নিষ্ঠুর হত্যাকান্ড। আর এই হত্যার শিকার হন তথাকথিত আগরতলা মামলার আসামী সার্জেন্ট জহুরুল হক। সার্জেন্ট জহুরুল হকের মৃত্যুতে দেশব্যাপী আন্দোলন আরাে ব্যাপক জঙ্গী আকার ধারণ করে। সার্জেন্ট জহুরুল হকের মৃত্যুতে কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদ ও বিরােধী দল আওয়ামীলীগ দেশব্যাপী শােক দিবস পালনের আহবান জানান। সারা দেশের মত নাগরপুরের ছাত্রসগ্রাম পরিষদও শশাক দিবস পালনের কর্মসূচি ঘােষনা করে। শােক দিবসের কর্মসূচি হিসাবে সর্বত্র কালাে পতাকা উত্তোলন ও কালাে ব্যাজ ধারণ এবং অফিস আদালত স্কুল কলেজ সব বন্ধ রাখা হয়। থানার সর্বত্র যথারীতি সগ্রাম পরিষদের কর্মসূচি পালন হতে থাকে। কিন্তু থানার রেভিনিউ সি.ও. তার অফিস খােলা রাখে। এ সংবাদ পাওয়ার পর সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ সি. ও. সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে যান। নেতৃবৃন্দ সি.ও. সাহেবকে বিনয়ের সাথে অনুরােধ করে তার অফিসে কালাে পতাকা উত্তোলনের এবং পায়ের জুতা খুলতে বলে। কিন্তু সি. ও. সাহেব ছাত্রনেতাদের অনুরােধ রক্ষা করতে রাজী হন নি। এ বিষয়টি নিয়ে ছাত্রনেতাদের সঙ্গে কথাকাটাকাটি হয় এবং এক পর্যায়ে সি. ও. সাহেব বন্দুক বের করে গুলি করার হুমকি দেন। এতে ছাত্রনেতারা সি.ও. সাহেবের অফিস থেকে চলে এসে অফিস এবং বাড়ির মাঝখানে অবস্থান নেয়। সি.ও. সাহেব বাসায় যাওয়ার সময় সেখানে ঘূত্রনেতাদের সঙ্গে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে ধস্তাধস্তি হয়। ধস্তাধস্তির করণে সি. ও. সাহেব সংগ্রাম পরিষদের উল্লেখযােগ্য কয়েকজন নেতাকে আসামী করে মামলা দায়ের করেন। আসামীদের মধ্যে ছিলেন ছাত্রনেতা গৌতম চক্রবর্তী ও আতিকুর রহমান কয়েদ আলী। এই মামলার প্রতিবাদে নাগরপুর থানা সগ্রাম পরিষদ সারা থানায় প্রতিবাদ দিবস ও স্কুল কলেজে ধর্মঘটের ডাক দেন। প্রতিবাদ দিবসের কর্মসূচিকে সফল করার জন্য থানার সারা এলাকায় সকল স্কুল কলেজের ছাত্ররা প্রতিবাদ মিছিল নিয়ে নাগরপুর থানা সদরে উপস্থিত হয়। উপস্থিত হাজার হাজার ছাত্ররা প্রতিবাদ মিছিল নিয়ে সি. ও. সাহেবের বিরুদ্ধে শ্লোগান দিয়ে নাগরপুর বাজার প্রদক্ষিণ করতে থাকে। মিছিলের সংবাদ পেয়ে সি.ও. সাহেব ডাক্তার ভূপেনশ্বর চক্রবর্তীর ঔষধের দোকানে আশ্রয় নেন। এ সংবাদ পাওয়ার পর ছাত্রজনতা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে ঐ ঔষধের দোকানের দিকেই অগ্রসর হয়। বিক্ষোভ মিছিল ঔষধের দোকানের দিকে আসতে দেখে সি. ও. সাহেবকে রেখেই ঔষধের দোকান বন্ধ করে দেন দোকানের মালিক ডাক্তার ভূপেনেশ্বর চক্রবর্তী। দোকান বন্ধ দেখে মিছিলটি সরে যাচ্ছিলাে। এমন সময় সি. ও. সাহেব পিছনের দরজা দিয়ে বাহির হয়ে থানার দিকে দৌড় দেন। থানার দিকে যাওয়ার সময় তিনি ছাত্রজনতার দৃষ্টিতে পড়ে যান। তাকে দেখে বিক্ষোভকারীরা তার দিকে দ্রুতগতিতে এগিয়ে যায় এবং যদুনাথ স্কুলের পশ্চিম পাশে উত্তেজিত জনতা তাকে ধরে ফেলে। সি. ও. সাহেবকে ধরার পর বিক্ষোভকারীরা এলােপাথাড়ি কিলঘুষি মারতে থাকে। হাজার হাজার বিক্ষোভকারীর মধ্যে থেকে কে যেন সি.ও. সাহেবকে ছুরিকাঘাত করে। সঙ্গে সঙ্গে সি.ও. সাহেব রাস্তার উপর পড়ে যায়। সংবাদ পাওয়ার পর কলেজ ও স্কুলের শিক্ষকরা দ্রুতগতিতে ঘটনাস্থলে আসেন এবং তাকে চিকিৎসার জন্য বাজারে এক ডাক্তারখানায় নিয়ে যান। ডাক্তার খানায়ই সি.ও. সাহেব মৃত্যুবরণ করে। ১৯৬৯ সালের ছাত্রগণ আন্দোলনে সম্ভবত উচ্চপদস্থ একজনই সরকারী কর্মচারী ছাত্রজনতার রুদ্ররােষের মধ্যে পড়ে মৃত্যুবরণ করেন। এই মৃত্যুকে কেন্দ্র করে পাকিস্তান সরকার নাগরপুর থানা সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ সহ বেশ কয়েকজন নিরীহ লােককে আসামী করে মামলা দায়ের করে। ছাত্রনেতাদের মধ্যে আসামী দেয়া হয় মােঃ মজিবর রহমান, গৌতম চক্রবর্তী, আতিকুর রহমান,
৬১
কয়েদ আলী, নিখিল বিশ্বাস, সুবল সাহা, আব্দুস সামাদ, মুরাদ আলী ও ভূপেনেশ্বর চক্রবর্তী সহ ২১ জনকে। এই মামলাটি ১৯৬৯ সালের আন্দোলনের একটি বহুল আলােচিত মামলা। এই মামলার সাক্ষী করা হয় মােঃ শাহজাহান, মােঃ ফজলুল হক ও আলাল উদ্দীনকে। মামলার আসামীদের গ্রেপ্তারের জন্য সরকার নাগরপুরে ব্যাপক পুলিশি তৎপরতা চালিয়ে অধিকাংশ আসামীদের গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে ছিলেন ছাত্রনেতা গৌতম চক্রবর্তী, আতিকুর রহমান কয়েদ আলী, নিখিল বিশ্বাস, সুবল সাহা, আলী হােসেন, মজিবর রহমান ও ডাক্তার ভূপেনেশ্বর সহ বেশ কয়েকজন। গ্রেপ্তারের পর বিচার শুরু হয়। বিচার করার ব্যবস্থা হয় বিশেষ সামরিক আদালতে। বিচার ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর শুরু হয় এবং ১৯৭১ সালের সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত চলে। কিন্তু বিচারকার্য সামরিক আদালত শেষ করে যেতে পারেনি বা রায় দিতে পারেনি। গােপনসূত্রে প্রকাশ পাওয়া যায় যে আসামীদের একজনের মৃত্যুদণ্ড শাস্তি হওয়ার কথা ছিল। আর এ মৃত্যুদণ্ডের জন্য রাষ্ট্রপতির অনুমােদনের প্রয়ােজন ছিল। কিন্তু দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে রাষ্ট্রপতির অনুমােদন আনা যায়নি। অনুমােদন আনার আগেই সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হয় । যার জন্য মামলার রায় হয়নি বা বিচার হয়নি। স্বাধীনতার পরে স্বৈরাচারী ও সামরিক শাসক মেজর জিয়ার শাসনামলে আবার সেই মামলা নতুন করে চালু করা হয় এবং এরশাদের সামরিক শাসনামলে ঐ মামলার বিচার হয় ময়মনসিংহের বিশেষ সামরিক আদালতে। বিচারে বেশ কয়েকজন আসামীকে শাস্তি দেয়া হয়। শাস্তিপ্রাপ্তদের মধ্যে মজিবর রহমানের যাবৎ জীবন জেল হয়। গৌতম চক্রবর্তী ও আতিকুর রহমান কয়েদ আলীর জরিমানা সহ দশ বৎসর জেল হয়। অন্যান্যদের আটবৎসর করে জেল হয়। মামলাটি একটি রাজনৈতিক মামালা এবং বাঙ্গালীর স্বাধীকার আন্দোলনের মামলার অবদান বিবেচনা করে রাষ্ট্রপতি এরশাদ আসামীদের শাস্তি মওকুফ করে দেন ছয় মাস পরে ।
৬৯ এর মির্জাপুরের আড়াইপাড়া
১৯৬৯ সালের ছাত্র আন্দোলনের আরেকটি দুর্গ গড়ে উঠেছিল টাঙ্গাইল জেলাধীন মির্জাপুর থানার বহুরিরা ইউনিয়নের আড়াইপাড়া গ্রামে। সেদনি আড়াইপাড়ার বীরজনতা যে জঙ্গী আন্দোলন গড়ে তুলেছিল তার তুলনা সারা প্রদেশের হাতে গােনা আর হয়তাে দুই-চারটি গ্রামে মিলতে পারে। বহুবিয়া আড়াইাড়ার ছাত্রজনতা জাতির চরম ক্রান্তিলগ্নে এগিয়ে আসে দেশ মাতৃকার মুক্তির প্রশ্নে পল্লী গ্রামের মানুষ হয়ে বহুরিয়া আড়াইপাড়ার ছাত্ৰজতা আইয়ুব শাহীর সামরিক শাসন ও এলাকার সমাজবিরােধীদের বিরুদ্ধে যে জঙ্গী ঐক্য গড়ে তুলেছিল তা রাজধানী শহর অথবা জেলা শহরের আন্দোলনের চেয়ে কম শক্তিশালী ছিল না। সারা দেশব্যাপী যখন আইয়ুব বিরােধী ব্যাপক আন্দোলন চলছে তখন বহুরিয়া আড়াইপাড়ার ছাত্রসমাজ এলাকায় ছাত্র আন্দোলন গড়ে তােলার তৎপরতা চালায়। ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিকেই বহুরিয়া আড়াইপাড়ার ছাত্রসমাজ এলাকায় মিছিল মিটিং সভা সমাবেশ করে জনসাধারনকে সংগঠিত করতে থাকে। কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের আহবানে দেশের বিভিন্ন স্তানের মত বহুরিয়া আড়াই পাড়ার ছাত্র যুবকদের নেতৃত্বে এলাকার জনসাধারনকে সঙ্গে নিয়ে গঠন করে সংগ্রাম পরিষদ। কেন্দ্রীয় সগ্রাম পরিষদের সকল কর্মসূচি যথাযথভাবে পালন করে বহুরিয়া আড়াইপাড়া
৬২
সংগ্রাম পরিষদ। কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদের রাজনৈতিক কর্মসূচির কথা বলার পাশাপাশি এলাকার সমাজ বিরােধীদের দমন করার জন্য সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে এলাকার চোর ডাকাত,গ্রাম্য টাউট , দুনীতিবাজ, দালালদের বিচার করে শাস্তি দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। কারন ঐ সময় সারা দেশের মত মির্জাপুর থানা প্রশাসন ও চোর ডাকাত ও সমাজ বিরােধীদে কোন প্রকার দমন মূলক বা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়নি। বরং থানা অনেক সময় চোর ডাকাত বা সমাজ বিরােধীদের সাহায্য করত বিভিন্ন অপকর্মে। যার জন্য বহুরিয়া -আড়াইপাড়া গ্রামের চোর-ডাকাতরা অত্র এলাকায় লুঠতরাজের জগত প্রতিষ্ঠা করে ফেলে। এলাকার প্রতিটি মানুষ তখন জান-মালের নিরাপত্তার মারাত্মক অভাবে পড়ে যায়। তখন মানুষের শান্তি বিধানের জন্য এগিয়ে আসে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ। সমাজ বিরােধীদের শান্তি দিতে গিয়ে সগ্রাম পরিষদের কর্মীদের ও নেতাদের মারাত্মক ঝুঁকি নিতে হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে সমাজ বিরােধীদের সাহায্য করায় তাদের প্রচণ্ড দাপট ছিল। অপর দিকে চোর ডাকাতদের কিছু না করে আন্দোলনকারী সংগ্রাম পরিষদের উপর সরকার চালায় দমনমূলক কর্যক্রম। কিন্ত এলাকার সর্বসাধারনের ব্যাপক সমর্থনে সংগ্রাম পরিষদ সমস্ত বাধাকে উপেক্ষা করে কাজ চালিয়ে যেতে থাকে। সংগ্রাম পরিষদ সবচেয়ে বেশি তৎপরতা চালায় আড়াইপাড়া ইউনিয়নের বহুরিয়া গ্রামে। এই গ্রামে প্রায় দুই হাজার লােকের অধিকাংশই ছিল চোর-ডাকাত। তারা দীর্ঘদিন ধরে এলাকার মানুষের মধ্যে এক দূর্বিসহ জীবন বােধের সৃষ্টি করে। প্রতিনিয়ত চুরি আর ডাকাতির কারণে জনজীবন হয়ে ওঠে অতিষ্ঠ। দীর্ঘদিন চোর ডাকাতের অত্যাচারে এলাকার মানুষের ভিতর মারাত্মক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। কারণ তারা সরকারের নিকট থেকে কোন প্রকার সাহায্য পায়নি। এবার তারা সংগ্রাম পরিষদের কার্যক্রমে বুক বেধে আসে সাহায্য করার জন্য। সাধারন মানুষের ব্যাপক সহযােগীতায় আড়াই পাড়ার সমাজবিরােধীদের বিচার করা হয়। বিচারে শাস্তি দেয়া হয়, চোর ডাকাতদের স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে তা সগ্রাম পরিষদের অধীনে আনা হয়। শাস্তি কার্যকরী করার জন্য দোষী ব্যক্তিদের বাড়িঘর ভেঙ্গে নিলামে বিক্রয়ের ব্যবস্থা করা হয়। আন্দোলনের পরবর্তী সর্মসূচী সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহনের জন্য ১৯৬৯ সালের ২৬ শে মার্চ বহুরিয়া গ্রামের সংগ্রাম পরিষদ এক জনসভার আয়ােজন করে। উক্ত জনসভায় ঢাকা থেকে সংগ্রাম পরিষদের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ ও জেলা নেতৃবৃন্দের উপস্থিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ১৯৬৯ সালের ২৫ শে মার্চ ইয়াহিয়া খান আবার সামরিক শাসন জারি করায় ঐ জনসভা আর হতে পারেনি। সামরিক আইন ও জরুরি অবস্থা ঘােষনা করে সামরিক জান্তা দেশব্যাপী দমন পীড়ন চালাতে শুরু করে। যার ফলে আন্দোলন কিছুটা ঝিমিয়ে পড়ে। এই সুযােগে এলাকার সমাজ বিরােধী বা চোরডাকাতদের লােকজন মির্জাপুর থানায় মামলা দায়ের করে। এই মামলায় অধিকাংশ ছাত্রনেতাসহ প্রায় দুইশত লােককে আসামী করা হয়। আসামীদের মধ্যে এলাকার উল্লেকযােগ্য ছাত্রনেতৃবৃন্দ ছিলেন আব্দুর রাজ্জাক,মােঃ সােরহাব হােসেন, মােঃ আব্দুর রহিম, বাবু গনেশ চন্দ্র সূত্রধর, আব্দুর রহমান জঙ্গু , মােঃ দেলােয়ার হােসেন, আব্দুল বারেক, মােঃ কায়কোবাদ হােসেন, মােঃ শামসুল আলম, মােঃ মােয়াজ্জেম হােসেন প্রমূখ। মামলার আসামীদের গ্রেপ্তারের অজুহাতে এলাকায় ব্যাপক পুলিশী নির্যাতন শুরু করে সরকার। টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসক সাহেবের নির্দেশে জনৈক ম্যাজিষ্ট্রেট এক প্লাটুন ই,পি, আর ,ও বিপুল সংখ্যাক পুলিশ নিয়ে, আড়াইপাড়া পরিদর্শনে আসেন। ঘটনাস্থল পরিদশর্নে এসে সমাজবিরােধীদের পরামর্শে সংগ্রাম পরিষদের কোষাধ্যক্ষ মােঃ দেলােয়ার হােসেনের বাড়ীতে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে এলাকার হাজার হাজার জনতা ছুটে আসে। কয়েক মিনিটের মধ্যে প্রায় বিশ ত্রিশ হাজার লােক উপস্থিত হয়।
৬৩
যাদের অধিকাংশের হাতেই ছিল সাধারন অস্ত্রশস্ত্র । উপস্থিত জনতা ঘটনা দেখে এবং পুলিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে শ্লোগান দিতে থাকে অবস্থা বেগতিক দেখে ম্যাজিস্ট্রেট গুলি র নির্দেশ দেন। নির্দেশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গুলি বর্ষন শুরু হয়। সরকারের টেটোরা বাহিনীর গুলীর প্রতিউত্তরে জঙ্গী জনতা তাদের হাতের সাধারন অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সরকারী বাহিনীর উপর ঝাপিয়ে পড়ে। বেশ কিছু সময় চলে সরকারী বাহিনীর গুলি বর্ষন। সরকারী বাহিনীর প্রচন্ড গুলীর মুখে বিদ্রোহী জনতা শেষ পর্যন্ত দৌড়াদৌড়ি করে চলে যায়। ইতিমধ্যে অনেক আহত হয়েছে গুলীতে এবং মৃত্যুবরণ করে কয়েক জন। সেদিন ঘাতক বাহিনীর গুলি তে শহীদ হন সপ্তম শ্রেনীর ছাত্র কামারপাড়া গ্রামের আব্দুল হালিম ওরফে বাবু। আরাে শহীদ হন হাড়িয়া গ্রামের বীর সন্তান মঞ্জুর উদ্দিন। পুলিশের নির্মম নির্যাতনে হাজত খানায় শহীদ হন মােস্তফা কামাল। উক্ত ঘটনাকে কেন্দ্র করে সরকার আবার মামলা দায়ের করে সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দসহ এলাকার বহু সাধারণ মানুষের নামে। বহুড়িয়া আড়াইপাড়ার ছাত্ৰগন আন্দোলনে যারা অগ্রনী ভূমিকা পালন করেন তাদের মধ্যে ছিলেন আব্দুর রাজ্জাক, মােঃ সােরহাব হােসেন, মােঃ আব্দুর রহিম, বাবু গনেশ চন্দ্র সূত্রধর, আব্দুর রহমান জঙ্গু মােঃ দেলােয়ার হােসেন, আব্দুল বারেক, মােঃ কায়কোবাদ হােসেন মােঃ শামসুল আলম, মােঃ মােয়াজ্জেম হােসেন প্রমূখ।
৭০ সনের সাধারণ নির্বাচন
১৯৭০ সালের ৭ই ডিসেম্বর জাতীয় পরিষদের এবং ১৭ই ডিসেম্বর প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। দক্ষিণ বাংলার সাগর উপকূলের বেশ কয়েকটি আসনে নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড়ের কারণে নির্বাচণ অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭১ সালের ১৭ই জানুয়ারি । টাঙ্গাইল সদর আসনের একজন প্রার্থীর মৃত্যুর কারণে এই আসনের নির্বাচনও ১৯৭১ সালের ১৭ই জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু শেষ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন করে। জাতীয় পরিষদের পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা বিজয় অর্জন করে এবং প্রাদেশিক পরিষদের পূর্বপাকিস্তানের ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৮৮টি আসনে আওয়ামীলীগ দলীয় প্রার্থীরা বিজয় অর্জন করে। দীর্ঘ ২৩ বছরের পশ্চিমা শাসন ও শােষণের হাত থেকে বাঙ্গালী জাতির মুক্তি লাভের অদম্য আকাংখার বহিঃ প্রকাশ হচ্ছে এই নির্বাচনী ফলাফল। এই নির্বাচনের ফলাফল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন। কেননা এই নির্বাচনে বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ বঙ্গবন্ধুর ৬ দফার প্রতি ম্যান্ডেট দান করে। মুলতঃ জাতীয় পরিষদের ৩০০টি আসনের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য নির্ধারিত ১৬২টি আসন এবং পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য ছিল ১৩৮টি আসন। পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের ১৬২টি আসনের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ বিজয় অর্জণ করে ১৬০টি আসনে এবং বাকী দুইটির একটি আসনে বিজয় অর্জুন করে একজন নির্দলীয় প্রাথী ও অপর আর একটি আসনে বিজয় অর্জণ করে পি.ভি. পি নেতা ময়মনসিংহের নূরুল আমীন। মহিলাদের ৭টি আসন নিয়ে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামীলীগ ১৬৭টি আসনের অধিকারী এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭০ সালের জাতীয় পরিষদ এবং প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনী ফলাফল বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের ভীত রচনা করে।
৬৪
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে টাঙ্গাইলবাসী বাংলার আর অন্যান্য জেলার মত বঙ্গবন্ধু ৬ দফার প্রতি ব্যাপক সমর্থণ জানিয়ে নৌকা মার্কায় ভােট প্রদান কর। এই নির্বাচনে সারা জেলার জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের প্রতিটি আসনে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থীরা ব্যাপক ভােটের ব্যাবধানে বিজয় অর্জণ করে। টাঙ্গাইলের প্রতিটি আসনে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থীদের নিকট মুসলিম লীগ সহ অন্যান্য দলের প্রার্থীরা সবাই জামানত হারায়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে সরকার একদিকে ভয়ভীতি ও অর্থের লােভ দেখায়, অন্যদিকে বিভিন্ন প্রকার মিথ্যা প্রচার চালায়। টাঙ্গাইলের সগ্রামী জনতা সমস্ত মিথ্যাচারকে উপেক্ষা করে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থীদের নৌকা মার্কায় ভােট দেয়। ধর্মের দোহাই দিয়ে দ্বিজাতি তত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান নামক কৃত্রিম রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠা হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই শাসক গােষ্ঠী এ দেশের মানুষের উপর ধর্মের দোহাই এবং হিন্দুস্থান বিরােধী মুখরােচক স্লোগান দিয়ে বাঙ্গালী জাতিকে শাসন ও শােষন করে। আর এই শাসন শােষণের বিরুদ্ধে যখনই বাংলার মানুষ প্রতিবাদ করার চেষ্টা করে তখনই ধর্মরক্ষা ও ভারতের ভয় দেখিয়ে বাংলার মানুষকে বােকা বানানাের প্রচেষ্টা চালায়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে সারা বাংলাব্যাপী যেরকম ধর্মের দোহাই ও ভারতের ভয় দেখানাে হয় একইভাবে টাঙ্গাইল বাসীকেও ধর্মের নামে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা চালানাে হয়। মুসলিম লীগ সরকার আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালায় যে শেখ মুজিবুর রহমানসহ তার দলের নেতারা ভারতের দালাল। তার দলকে ভােট দিলে পূর্ব পাকিস্তান হিন্দুস্থানে পরিণত হবে। তারা আরাে বলে আওয়ামী লীগ বিধর্মীদের দল। এই দলের প্রার্থীদের ভােট দিলে দেশের ইসলাম বিপন্ন হবে। সেদিন সরকারের দলের লােকেরা শ্লোগান দিতে ‘জয় বাংলা, জয় হিন্দ, লুঙ্গি খুইয়া ধুতি পিন’। মুসলিমলীগ সরকারের এ ধরনের মিথ্যা প্রচারের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু যেমনি সারা দেশ বাসীকে চচেতন করে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন তেমনি টাঙ্গাইল বাসীকেও সচেতন করে তুলেন। নির্বাচনী প্রচারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭০ সালের প্রথম দিক থেকেই দেশের এক প্রাপ্ত থেকে আর এক প্রান্তে উল্কার বেশে ঘুরে বেড়ান। তিনি নির্বাচনী প্রচার অভিযানে টাঙ্গাইলের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের কর্মসূচি ব্যাখ্যা করেন এবং পাকিস্তানীদের শােষণ ও শাসনের চিত্র তুলে ধরেণ । বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭০ সালের পহেলা ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইল পার্ক ময়দানে জেলা আওয়ামী লীগের উদ্দ্যেগে আয়ােজিত এক ঐতিহাসিক জনসভায় ভাষণ দেন। তিনি তার ভাষনে সেদিন আওয়ামী লীগের ৬ দফার ভিত্তিতে নৌকা মার্কায় ভােট দেওয়ার আহবান জানান। বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান সরকারের সকল প্রকার চক্রান্তের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখার জন্য টাঙ্গাইল বাসির প্রতি অনুরােধ করেন। সুদীর্ঘ সময় ব্যাপী বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য, শােনায় টাঙ্গাইল বাসির মনে আওয়ামী লীগের প্রতি বিপুল সাড়া জাগে । উক্ত জনসভায় আরাে বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, খন্দকার মােস্তাক আহমদসহ আরাে অনেকে। সভায় সবাপতিত্ব করেন নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক এবং টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল মান্নান। সভা পরিচালনা করেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক শামসুর রহমান খান শাজাহান এবং মানপত্র পাঠ করেন মির্জা তােফাজ্জল হােসেন মুকুল। সভায় বঙ্গবন্ধুকে টাঙ্গাইল বাসীর পক্ষ থেকে জেলার মানচিত্র উপহার দেওয়া হয়।
৬৫
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টাঙ্গাইলের নাগরপুর যদুনাথ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠেও একটি জনসভা করেন ১৯৭০ সালের প্রায় শেষের দিকে। এই সভায়ও তিনি ৬ দফার ভিত্তিতে নৌকা মার্কায় ভােট দেওয়ার আহবান জানান। সভায় আরাে বক্তব্য রাখেন তাজ উদ্দিন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, আব্দুল মান্নান, ব্যারিষ্টার শওকত আলি খান, শামসুর রহমান খান শাহাজন ও মির্জা তােফা হােসেন মুকুল। সভায় সভাপতির আসন গ্রহণ করেন সেতাব আলী মােক্তার । নাগরপুর যাওয়ার পথে টাঙ্গাইল এলাসিন রােডের হিঙ্গানগর গ্রামে লৌহজঙ্গনদীর পুলের দক্ষিণ প্রান্তে এক পথ সভায় বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেন এবং সেখানে গরীব জন সাধারণের ভিতর কাপড় বিতরণ করেন। বঙ্গবন্ধুকে হিঙ্গানগর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে মানপত্র উপহার দেন বাবু যতিন দে। প্রধান শিক্ষক ফনি ভুষননন্দীর নেতৃত্বে স্কুলের ছাত্রদের একটি বিরাট মিছিল লৌহজনদীর পুলের দক্ষিণ প্রান্তে আসে। শেখ মুজিবুর রহমান টাঙ্গাইলের ঘাটাইল এবং গােপালপুর থানায় একই দিনে দুইটি নির্বাচনী সভা করেন। সভাগুলিতে আরাে বক্তব্য রাখেন জনাব আব্দুল মান্নান, শামসুর রহমান খান শাজাহান, মির্জা তােফাজ্জল হােসেন মুকুল, হাতেম আলী তালুকদার, বদিউজ্জামান খান। টাঙ্গাইল ও গােপালপুরে জনসভার দিন ঢাকা থেকে আসার পথে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মির্জাপুরে একটি পথসভা করেন। যা একটি বিশাল জনসভায় পরিণত হয়েছিল। সভায় বঙ্গবন্ধু ছাড়া আরাে বক্তব্য রাখেন জনাব আব্দুল মান্নান, ব্যারিষ্টার শওকত আলী খান ও ফজলুর রহমান খান ফারুক। এই কয়েকটি বড় জনসভা ছাড়াও টাঙ্গাইলের বিভিন্ন স্থানে বহু নির্বাচনী জনসভা করা হয়। এই সমস্ত জনসভার প্রায় অধিকাংশতেই কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ও জেলা সভাপতি আব্দুল মান্নান বক্তব্য রাখতেন। সভাগুলিতে আরাে বক্তব্য রাখতেন শামসুর রহমান খান শাজাহান, মির্জা তােফাজ্জল হােসেন মুকুল, বদিউজ্জামান খান, আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী প্রমুখ। ছাত্র নেতাদের মধ্যে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে প্রচার অভিযানে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন তাদের মধ্যে ছিলেন শাহজাহান সিরাজ, খন্দকার আব্দুল বাতেন, আলমগীর খান মেনু, আবু মােহাম্মদ এনায়েত করিম, আব্দুল কাদের সিদ্দিকী, আলী আসগর খান দাউদ প্রমুখ। ১৯৭০ সালের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দলীয় বিজয়ী প্রার্থীরা হলেন আব্দুল মান্নান, ব্যারিষ্টার শওকত আলী খান, শামসুর রহমান খান শাজাহান, মির্জা তােফাজ্জল হােসেন মুকুল, বদিউ জ্জামান খান, হাতেম আলী তালুকদার, আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী, আব্দুল বাসেত সিদ্দিকী, ডাঃ শেখ নিজামুল ইসলাম, ফজলুর রহমান খান ফারুক, সেতাব আলী মােক্তার, ইনছান আলী মােক্তার, শামসুদ্দিন আহমদ বালু মিয়া, অধ্যক্ষ হুমায়ুন খালিদ।
একাত্তরের অসহযােগ আন্দোলন
১৯৭০ সালের নির্বাচনে টাঙ্গাইলের প্রতিটি আসনে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থীরা নৌকা মার্কায় বিপুল ভােটে একচেটিয়া বিজয় অর্জন করে। এরপর শুরু হয় ইয়াহিয়া খানের ক্ষমতা হস্তান্তরের টালবাহানামূলক খেলা। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশের অন্যান্য অঞ্চল বা এলাকার মতাে টাঙ্গাইলেও ছড়িয়ে পড়ে তীব্র উত্তেজনা । দিনরাত চলতে থাকে বিক্ষোভ মিছিল। টাঙ্গাইল জেলা শহর পরিণত হয় বিক্ষোভের শহরে। এই বিক্ষোভে অংশ গ্রহণ করে সর্বস্তরের সংগ্রামী জনতা।
৬৬
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পরই সারা দেশব্যাপী শুরু হয় অহিংস-অসহযােগ আন্দোলন। বাংলার মানুষের মারাত্মক অসহযােগ আন্দোলনের ফলে অচল হয়ে পড়ে সরকারের সকল প্রশাসন যন্ত্র । পাকিস্তানী সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুর সাথে দফায় দফায় আলােচনার নামে বাঙ্গালি জাতিকে করে প্রতারিত । আর ইয়াহিয়ার এই প্রতারণামূলক তৎপরতা বাংলার মানুষের বুঝতে দেরি হয়নি। তাই বাংলার সংগ্রামী জনতা গ্রামে-গঞ্জে, পাড়ায়পাড়ায় সগ্রাম পরিষদ গঠন করে। বঙ্গবন্ধুর ডাকে উজ্জীবিত হয়ে সারা দেশের মত টাঙ্গাইলেও শুরু হয় প্রতিরােধের প্রস্তুতি। প্রতিরােধের প্রস্তুতি হিসাবে কেন্দ্রিয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ডাকে টাঙ্গাইলেও গঠন করা হয়, জয়বাংলা বাহিনী। তৎকালীন জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আবু মােহাম্মদ এনায়েত করিম ও জেলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক আব্দুল কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে ও সাংগঠনিক প্রচেষ্টায় প্রায় চার-পাঁচশ যুবক কাগমারী মওলানা মােহাম্মদ আলী কলেজের মাঠে সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে শুরু করে। কলেজের ক্যাডেট শিক্ষকদের সাহায্যে এন.সি.সি. সদস্যদের ডামি রাইফেল দিয়েই প্রায় একমাস ব্যাপী প্রশিক্ষণ চলে। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর ঢাকায় অতর্কিত আক্রমণ এবং নিরীহ জনসাধারণকে নির্বিচারে হত্যাকান্ডের খবর রাতেই টাঙ্গাইলে এসে পৌছায়। এই খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শহরের অলিগলি থেকে বেরিয়ে আসে বিক্ষোভ মিছিল। এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মারাত্মক যুদ্ধ প্রস্তুতির জন্য বিভিন্ন দলের নেতাদের নিয়ে ২৬শে মার্চ সকালে আদালত পাড়াস্থ এডভােকেট নূরুল ইসলাম সাহেবের বাসায় জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য এডভােকেট মির্জা তােফাজ্জল হােসেন মুকুলের আহবানে এক সর্বদলীয় সভা বসে। এই সভায় সর্ব সম্মতিক্রমে গঠিত হয় টাঙ্গাইল জেলা স্বাধীন বাংলা গণমুক্তি পরিষদ। জনাব বদিউজ্জামান খান চেয়ারম্যান ও জনাব আব্দুল লতিফ সিদ্দীকী এই পরিষদের আহবায়ক নির্বাচিত হয়। পরিষদের অন্যান্য সদস্য ছিলেন সৈয়দ আব্দুল মতিন, আল মুজাহিদি, নইম উদ্দিন আহম্মদ, এডভােকেট নূরুল ইসলাম, হাবিবুর রহমান খান, হবি মিঞা, শামসুর রহমান খান শাজাহান, ফজলুর রহমান খান ফারুক, আলী আকবর খান খােকা, হামিদুল হক মােহন ও বীরেন্দ্র কুমার সাহা। তঙ্কালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের যুগ্ম অর্থসচিব খন্দকার আসাদুজ্জামানকে পরিষদের উপদেষ্টা নিযুক্ত করা হয়। এই পরিষদকেই হাইকমান্ড নামে অভিহিত করা হতাে। হাইকমান্ড আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীকে সশস্ত্র বে ণবাহিনীর কমান্ডার-ইন-চীফ এবং আনােয়ারুল আলম শহীদ ও আবু মােহাম্মদ এনায়েত্ করিমকে। ডেপুটি কমান্ডার-ইন-চীফ পদে নিযুক্ত করেন। হাইকমান্ড মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণের পাশাপাশি জেলার সকল প্রকার প্রশাসনিক দায়িত্বও গ্রহণ করে। হানাদার বাহিনী টাঙ্গাইল দখল করার আগ পর্যন্ত অত্যন্ত দক্ষতার সাথে টাঙ্গাইল জেলার প্রশাসনিক কাজ পরিচালনা করে। মানুষের জানমালের নিরাপত্তার পাশাপাশি শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার ব্যবস্থা করে হাইকমান্ড। বিশেষ করে এই সময়ে পশ্চিমা বিহারীদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে হাইকমান্ড অত্যন্ত প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করে। মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকেই ঢাকাসহ এদেশের বিভিন্ন স্থানে সরকারের পুলিশ বাহিনী স্বাধীনতাকামী বাঙ্গালিদের উপর গুলি চালায়। পুলিশ সেনাবাহিনীর চেয়ে বহুগুণে উগ্রমূর্তি ধারণ করে ঢাকা, রংপুর, ঈশ্বরদী, পাবনা, কুষ্টিয়া, সৈয়দপুরসহ বিভিন্নস্থানে বিহারী রিফুজিরা বাঙ্গালি নিধনে মেতে উঠে। এই সমস্ত বিহারীদের অধিকাংশই ছিল ১৯৪৭ সালের পর ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে আগত মােহাজের । বিহারীরা মােহাজের রিফুজি হওয়ার সত্ত্বেও পাকিস্তান সরকারের সহযােগিতার কারণে
৬৭
হাজার হাজার বছর ধরে বসবাসরত বাঙ্গালির চেয়ে তাদের দাপট ছিল অনেক বেশী । বিহারীদের নির্মম হত্যাকান্ডের ফলে ঢাকার মীরপুর, মােহাম্মদপুর, রংপুর, সৈয়দপুরসহ বেশ কয়েকটি স্থানে বাঙ্গালিরা তাদের বাপদাদার ভিটাবাড়ি থেকে বিতাড়িত হতে থাকে। বিহারীরা যদিও বাঙ্গালিদের উপর হত্যাকান্ড, বাড়িঘর লুটপাট করতে শুরু করে তবুও বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে কোন স্থানে বাঙ্গালিরা বিহারীদের উপর আক্রমণ করতে যায়নি। বরং বাঙ্গালিরা ভ্রাতৃপ্রতিম মনােভাব নিয়ে বহুস্থানে নিরীহ বিহারীদের জান-মাল রক্ষা ও নিরাপত্তার দায়িত্ব গ্রহণ করে। সারা দেশে যেমন বিহারীদের জান-মাল রক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করে আওয়ামী লীগ, ছাত্র লীগের কর্মীরা তেমনি টাঙ্গাইলের বিহারীদের জানমালের রক্ষার জন্য অত্যন্ত প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করে। কোন কোন স্থানে সাধারণ জনতা বিহারীদের উপর আক্রমণ করার প্রচেষ্টা চালালেও আওয়ামী নেতা কর্মীদের হস্তক্ষেপে তা হতে পারেনি। এমন একটি ঘটনা ঘটে মির্জাপুরের গােড়াইতে। এখানে কটন মিলে প্রায় পাঁচশত বিহারী শ্রমিক ছিল। তারা মার্চের প্রথম দিক থেকেই অত্র এলাকার মানুষের উপর অত্যাচার শুরু করে। ২৫শে মার্চের পরে এলাকার বাঙ্গালি শ্রমিকরা বিহারীদের উপর আক্রমণ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। এ সময় মির্জাপুরের জাতীয় পরিষদ সদ্য ব্যারিষ্টার শওকত আলী খান ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য ফজলুর রহমান খান ফারুক দ্রুতগতিতে গােড়াই যান এবং গােড়াই বিহারীদের উপর কোন প্রকার আক্রমণ বা তাদের কোন প্রকার ক্ষতি করতে বিক্ষুব্ধ জনতাকে নিষেধ করেন। আরাে একটি ঘটনা ঘটে টাঙ্গাইলের দক্ষিণে ছিলিমপুর বাজারে। এখানে বেশ কয়েকশ’ ঘর বিহারী রিফুজি বসবাস করত। তারাও এলাকার বাঙ্গালিদের উপর অত্যাচার করে। যার জন্য এখানেও ২৫শে মার্চের পর এলাকার বাঙ্গালি জনসাধারণ তাদের উপর আক্রমণের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। এ সময় হিঙ্গানগর স্কুলের সামনে জনসভা করতে যান মির্জা তােফাজ্জল হােসেন মুকুল। তিনি তার বক্তব্যে হুশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেন, “বিহারীদের কোন প্রকার ক্ষতি আপনারা করবেন না । যদি আপনারা বিহারীদের কোন ক্ষতি করেন তাহলে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অমাণ্য করা হবে। মুকুল সাহেবের বক্তব্যের পর যদিও এলাকার বাঙ্গালিরা বিহারীদের কোন ক্ষতি করেনি কিন্তু বিহারীরা টাঙ্গাইলে পাকিস্তানী খুনী সামরিক জান্তা প্রবেশ করার পর বাঙ্গালি নিধনে মেতে উঠে। হানাদার খুনীদের সাথে একত্রিত হয়ে তারা সারা জেলাব্যাপী নয়টি মাস বাঙ্গালিদের হত্যা, বাড়িঘর লটুপাট, বাঙ্গালি মেয়েদের ধর্ষণ করে। বাঙ্গালিরা ধর্মীয় এবং মানবিক চেতনার কারণে যদিও সর্বদা বিহারীদের সঙ্গে ভ্রাতৃপ্রতিম সম্পর্ক রাখার চেষ্টা করত, কিন্তু বিহারীরা সুযােগ পেলেই বাঙ্গালিদের ক্ষতি করতে কোন দ্বিধা করেনি। এই ছিল পশ্চিমা বিহারীদের স্বাভাবিক চরিত্র। এ সময়ে টাঙ্গাইলের নেতৃবৃন্দ একটি প্রশংসনীয় কাজ করেন ঢাকা থেকে বিতাড়িত লােকজনদের সেবা যত্ন ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে। ২৫শে মার্চের পর মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য ঢাকা শহরবাসী যেভাবে পারে পালিয়ে আসে। গাড়ী-ঘােড়া বন্ধের কারণে বিতাড়িত লােকজন নারী, শিশু, বৃদ্ধ নিয়ে পায়ে হেঁটেই ঢাকা থেকে সরে পড়ে। এসব বিতাড়িত লােকজন সঙ্গে আনতে পারেনি টাকা-পয়সা, কাপড়-চোপড়সহ কোন প্রয়ােজনীয় জিনিস পত্র । অত্যন্ত অসহায় অবস্থায় সেদিন ঢাকাবাসীকে জীবন রক্ষার জন্য আসতে হয় গ্রামের দিকে। দিনের পর দিন মানুষ পায়ে হেঁটে অসুস্থ হয়ে পড়ে রাস্তাতেই অনেকে মৃত্যুবরণ করে। এমনি অবস্থায় ঢাকা থেকে বিতাড়িত লােকজনদের বিভিন্ন ধরনের সহযােগিতার জন্য মির্জাপুরে ক্যাম্প করা হয়। এখানে হাজার হাজার বিতাড়িত লােকজনদের খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। অসুস্থদের চিকিৎসা ও ঔষধ পত্রের ব্যবস্থা করা হয়। এমন
৬৮
বহু লােকজন ছিল যাদের পরনে কাপড় ছিল না তাদের কাপড়ের ব্যবস্থা করা হয়। অনেকেই টাকাপয়সা দেয়া হয়েছে গাড়ি ভাড়ার জন্য। মির্জাপুরের এই ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনায় নেতৃত্বদেন ব্যারিষ্টার শওকত আলী খান, ফজলুর রহমান খান ফারুক, আবুল হােসেন, একাব্বর হােসেন, সরকার হিতেশ চন্দ্র পুলক প্রমুখ। টাঙ্গাইলের প্রতিরােধ আন্দোলন খুব দ্রুত গতিতে সশস্ত্র আকার ধারণ করে । ২৭শে মার্চ ভােরে সার্কিট হাউজে অভিযান চালিয়ে প্রথম জয় বাংলা বাহিনীর যুদ্ধ শুরু হয়। এই দুঃসাহসিক অভিযানে নেতৃত্ব দেন বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী। তাকে সহযােগিতা করে মনি ঘােষ, আব্দুল ছবুর খানসহ আরাে বেশি কিছু টাঙ্গাইলের সাহসী যুবক। টাঙ্গাইল সার্কিট হাউসে ১৩ই মার্চ থেকে বেঙ্গল রেজিমেন্টের ১৫০ জনের একটি কোম্পানী অবস্থান করছিল। এখানে দুই জন পাঞ্জাবী অফিসার ছিল। এ দুইজনই পরে বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যদের হাতে নিহত হয়। বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকীর দুঃসাহসিক প্রচেষ্টায় বেঙ্গল রেজিমেন্টের কোম্পানীটি মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে একাত্মতা ঘােষণা করে। বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যরা সুবেদার জিয়াউল হকের নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে এবং পবিত্র কোরান শরীফ স্পর্শ করে শপথ বাক্য পাঠ করে। সৈন্যদের শপথ বাক্য পাঠ করান সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী। এরপর মনিঘােষ, সবুর খানকে সঙ্গে নিয়ে সার্কিট হাউজ থেকে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের বিজয় পতাকা উড়িয়ে দেয়। এই অভিযানের সফলতার ফলে কাদের সিদ্দিকী টাঙ্গাইলের সকল স্তরের মানুষের শ্রদ্ধা ও আস্থা অর্জন করেন। এতে বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকীর আত্মপ্রত্যয় বেড়ে যায় শতগুণে। জনগণের মনে সৃষ্টি হয় বিপুল উৎসাহ আর উদ্দীপনা। ইতিমধ্যে মেজর জেনারেল শফিউল্লাহর নেতৃত্বে বেঙ্গল রেজিমেন্টের একদল সৈনিক জয়দেবপুর থেকে টাঙ্গাইল এসে মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গে একাত্মতা ঘােষণা করে। কিন্তু পরদিনই তারা টাঙ্গাইল ছেড়ে ময়মনসিংহ চলে যায়। এতে টাঙ্গাইলের মুক্তিযােদ্ধারা কিছুটা হতাশ হয়ে পড়ে। সে হতাশা ছিল সাময়িক। হতাশ হয়ে টাঙ্গাইলের মুক্তিযােদ্ধারা বসে থাকেনি। তারা শুরু করে নতুন প্রস্তুতি। ঢাকা দিক থেকে সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে টাঙ্গাইলকে রক্ষার জন্য ঢাকা টাঙ্গাইল সড়কের বহু স্থানে গাছ কেটে ও অন্যান্যভাবে ব্যারিকেড তৈরী করে। দারুণ উদ্বেগের মধ্যে টাঙ্গাইলবাসীর দিন কাটতে থাকে। এমনি সময় ৩১শে মার্চ খন্দকার আসাদুজ্জামানের প্রচেষ্টায় টাঙ্গাইল পুলিশ লাইন ও ময়মনসিংহ থেকে ই.পি.আর.দের একটি দল টাঙ্গাইলের মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে একাত্মতা ঘােষণা করে। পহেলা এপ্রিল ঢাকা টাঙ্গাইল সড়কে নাটিয়াপাড়াতে প্রথম প্রতিরােধ ঘাটি স্থাপন করে মুক্তিযােদ্ধারা। এরপর ২রা এপ্রিল গােড়ান সটিয়াচড়াতে মুক্তিযােদ্ধারা অবস্থান গ্রহণ করে। এখানেই ১৯৭১ সালের ৩রা এপ্রিল টাঙ্গাইলের মুক্তিযােদ্ধারা পাকহানাদার বাহিনীর সাথে প্রথম মুখােমুখি প্রতিরােধ যুদ্ধ করে।
প্রথম প্রতিরােধযুদ্ধ-গােড়ান সাটিয়াচড়া
১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘােষণা করলেন “এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”
৬৯
এই ঘােষণাতেই প্রকারান্তরে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘােষণা দেন। তিনি সেদিন বাঙ্গালি জাতিকে নির্দেশ দেন, “যার যা আছে, তাই নিয়ে ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তােল।” নেতার নির্দেশিত পথ ধরেই সারা বাংলার প্রতিটি শহরে, বন্দরে, গ্রামে-গঞ্জে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য সামরিক প্রশিক্ষণ। এই প্রশিক্ষণের মাধ্যমেই বাংলার ছাত্র, শ্রমিক, কৃষকসহ সর্বস্তরের মানুষ সংগঠিত হতে থাকে। সারা বাংলার অন্যান্য স্থানের মত টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুর থানার গােড়ান-সাটিয়াচড়া গ্রামের বীর সন্তানরাও সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি ও সংগঠিত হতে থাকে। তারা মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময় থেকেই সেনাবাহিনীর সদস্য মােশারফ হােসেন বাবুর নেতৃত্বে সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করে। ২৫শে মার্চের রাতে ঢাকায় হানাদার বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞের সংবাদ পাওয়ার পর গােড়ান-সাটিয়াচড়া গ্রামের বীর সন্তানরা প্রস্তুতি নিতে শুরু করে, হানাদার বাহিনীকে টাঙ্গাইল যাওয়ার সময় প্রতিরােধ করার জন্য। হানাদারদের প্রতিরােধের জন্য গােড়ান সাটিয়াচড়া থেকে গােড়াই পর্যন্ত ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে গাছ কেটে ফেলে ও সড়কের মাটি সরিয়ে বাধার সৃষ্টি করে। বাধা সৃষ্টির পাশাপাশি ঢাকা-টাঙ্গাইল সড়কের পাকুল্লা থেকে ধল্লা পর্যন্ত সড়কের দুই পাশে বাংকার করে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নেয়। এই প্রস্তুতি পর্বে যারা অত্যন্ত সাহসিকতাপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তাদের মধ্যে ছিলেন ফজলুর রহমান খান ফারুক, একাব্বর হােসেন, সরকার হিতেশ চন্দ্র পূলক, মীর দৌলত হােসেন বিদ্যুৎ, মীর এনায়েত হােসেন মন্টু, মাখন মিঞা, ছানা মিয়া, ননী মিয়া, বাকী মিয়া, জি.এম. সুলতান, আব্দুল লতিফ, রতন, পরেশ, জমারত হােসেন, গাজী লুৎফর, গৌড় চন্দ্র সাহা, দুলাল, বেল্লাল, বায়জিদ, নাছির, ওয়াজেদ, শাজাহান, দুদু, আলম, ফারুক, বাদশা মিয়া, মানিক, মােবারক, মােজাফফর সরকার, আবুল হােসেন, মাছ মিয়া, খন্দকার আল-মহসিন, হানিফ মিয়া, ডাল্লা মিয়া, ভবানি বাবু, অতুল পােদ্দার, মনি, তালেব, শহীদ, নূরু, বাবুল, জয়নাল, সিদ্দিকী, ফজলু, তমসের মাষ্টার, খালেক চাচা, লেবু চাচা, মুকুল, আতােয়ার, জয়নাল মাষ্টার, নয়া মিয়া, নঈম উদ্দীন, মিয়াজ উদ্দীন, খালেক মিয়া প্রমুখ। গােড়ান সাটিয়াচড়াতে যখন হানাদার প্রতিরােধের জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি চলছে ঠিক তখনই টাঙ্গাইল থেকে একদল ই.পি.আর. বাহিনীর সদস্য এসে হাজির হয়। তারা সঙ্গে বেশ কিছু অস্ত্রশস্ত্র ও গােলাবারুদ নিয়ে আসে। এই ই.পি.আর-এর সদস্যদের ময়মনসিংহ থেকে নিয়ে আসেন খন্দকার আসাদুজ্জামান। ই.পি.আর, বাহিনীর সদস্যরা এবং টাংগাইলের মুক্তিযােদ্ধারা সমন্বিতভাবে ৩১শে মার্চ টাঙ্গাইল থেকে ঢাকা অভিযানের জন্য অগ্রসর হয়। তারা টাঙ্গাইল থেকে বেশ কিছুদূর অগ্রসর হয়ে নাটিয়া পাড়াতে অবস্থান গ্রহণ করে। নাটিয়াপাড়া থেকে ই.পি.আর. ও মুক্তিযােদ্ধারা ২রা এপ্রিল গােড়ান সাটিয়াচড়াতে উপস্থিত হয় এবং এখানে স্থানীয় মুক্তিযযাদ্ধাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে সম্মিলিতভাবে হানাদারদের প্রতিরােধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে। এই সময়ে মুক্তিযােদ্ধাদের সার্বিক সহযােগিতার জন্য টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ অত্যন্ত প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেন । বিশেষ করে খন্দকার আসাদুজ্জামান, বদিউজ্জামান খান, আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী, শ্রমিক নেতা হাবিবুর রহমান, হবি মিয়া, সৈয়দ আব্দুল মতিন, ছাত্রনেতা আব্দুল কাদের সিদ্দিকী, আল মুজাহিদি ও জেলা প্রশাসক এবং পুলিশ সুপার। গােড়ান সাটিয়াচড়াতে অবস্থান নিয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের একটি অংশ একটু সামনে ধল্লা থাকেন এবং পিছনে নাটিয়া পাড়াতে কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে একটি অংশ অবস্থান নিয়ে থাকেন। নাটিয়া পাড়া
৭০
থেকে ধল্লা পর্যন্ত সড়কের দুই ধারেই মুক্তিযােদ্ধারা বাংকার করে তাতে অবস্থান গ্রহণ করে। মুক্তিযােদ্ধাদের মূলত প্রধান ও শক্তিশালী অবস্থান থাকে গােড়ান-সাটিয়াচড়াতে। এখানে নেতৃত্বে থাকেন ই.পি.আর. বাহিনীর আব্দুল আজিজ ও আব্দুল খালেক। এ সময়ে মুক্তিযোেদ্ধাদের প্রতি অত্যন্ত দরদের সঙ্গে তদারকি এবং খোঁজ খবর নেন খন্দকার আসাদুজ্জামান ও আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী। বিশেষ করে যাতে মুক্তিযােদ্ধাদের খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে কোন প্রকার কষ্ট না হয়, তার জন্য জেলা নেতৃবৃন্দ গােড়ান-সাটিয়াচড়াতে মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য গাড়ীতে করে খাদ্য সামগ্রী নিয়ে আসেন খন্দকার আসাদুজ্জামান ও আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী। তাদের আনা খাদ্য সামগ্রী খেয়ে রাতে ঘুমাতে যান মুক্তিযােদ্ধারা।
১৯৭১ সালের ৩রা এপ্রিল শনিবার ভাের পাঁচটার সময় মুক্তিযােদ্ধাদের কানে ভেসে আসে গাড়ীর শব্দ। তখনও অনেক মুক্তিযােদ্ধা ঘুমিয়ে ছিল। গাড়ীর শব্দ শােনার সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযােদ্ধাদের সবাই প্রস্তুতি নেন হাতের অস্ত্র নিয়ে হানাদারদের প্রতিরােধের জন্য। প্রস্তুতি পর্ব শেষ হওয়ার আগেই হানাদারদের বিশাল গাড়ীর বহর মুক্তিযােদ্ধাদের অতি সামনে এসে যায়। এই গাড়ীর বহরে প্রায় দেড় দুইশর মত গাড়ী ছিল এবং সামনে ছিল কয়েকটি লাল ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ী। আর গাড়ীর বহরের উপরে ছিল বেশ কয়েকটি হেলিকপ্টার ও জেট বিমান। হানাদার বাহিনীর গাড়ীর বহর অতি নিকটে আসাতে ধল্লায় অবস্থানরত মুক্তিযােদ্ধারা আক্রমণ করার সাহস না পেয়ে একটু পিছনে এসে গােড়ান সাটিয়াচড়ার মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গে অবস্থান গ্রহণ করে। হানাদারদের গাড়ীর বহর যখন গােড়ান সাটিয়াচড়াতে অবস্থান গ্রহণকারী মুক্তিযােদের মাত্র ৬০/৭০ গজ সামনে এসে যায় তখন সড়কের বা পাশ থেকে গর্জে উঠে ই.পি.আর. বাহিনীর নায়েক সুবেদার আব্দুল আজিজের লাইট মেশিন গান। তার সঙ্গে সঙ্গেই আরাে গর্জে উঠে সড়কের দুই পাশ থেকে ৫০/৬০টি রাইফেল, ৬টি এল.এম.জি, ও ৩টি রকেট লাঞ্চার এবং ৩টি দুই ইঞ্চি মর্টার। হঠাৎ আক্রান্ত হয়ে হানাদাররা প্রথমে দিশেহারা হয়ে পড়ে। তারা ভাবতেই পারেনি এমনভাবে আক্রান্ত হতে পারে। আর আক্রান্ত হয়েই তারা টের পায় এটা বেঙ্গল রেজিমেন্টের জোয়ানদের আক্রমণ। মাত্র ৬০/৭০ গজ দূর থেকে আক্রান্ত হলে যা হবার হানাদারদের তাই হল। হানাদারদের পাল্টা আক্রমণ হানতে প্রায় ৩/৪ মিনিট লেগে যায়। এর মধ্যে সৈন্য বােঝাই সামনের প্রায় ১০/১২টি গাড়ী হুমড়ি খেয়ে নীচে পড়ে যায়। গাড়ী থেকে লাফিয়ে উঠে হানাদার সৈন্যরা অবস্থান নিতে গেলে মুক্তিযােদ্ধারা তাদের উপর গুলিবর্ষণ করে। মুক্তিযােদ্ধাদের গুলি ছিল পাখী শিকারের মত তাক করা। মুক্তিযােদ্ধারা সড়কের দুই পাশেই অবস্থান নিয়েছিল। কাজেই সড়ক আড়াল করে যুদ্ধ করার কোন সুযােগ হানাদারদের ছিল না। হানাদারদের যে ২৫/৩০টি গাড়ী মুক্তিযােদ্ধাদের মাঝে এসে পড়েছিল তার প্রায় অধিকাংশই ধ্বংস হয়ে যায়। এখানে হানাদারদের প্রায় ৩৫০ জনের মত নিহত হয় এবং প্রায় ২০০ জনের মত আহত হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় একই স্থানে হানাদারদের এত ব্যাপক সংখ্যক নিহত হওয়ার নজির আর কমই আছে। গােড়ান সাটিয়াচড়ার যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধারা যে বীরত্বের পরিচয় দিয়েছে তার দ্বিতীয় কোন নজীর হয়তাে মিলবে না। এই যুদ্ধে বিশেষ করে ই.পি.আর. বাহিনীর সদস্যরা জীবনের মায়া করেনি। তারা মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য যেন জীবন দিতেই এসেছিল। এক পর্যায়ে গােড়ানের দিকে অবস্থানগ্রহণকারী হাবিলদার আব্দুল খালেকের এল.এম.জি. নষ্ট হয়ে যায়। যুদ্ধ শুরু হলে আওয়ামী লীগ নেতা ফজলুর রহমান খান ফারুক, হাবিলদার আব্দুল খালেকের পিছনে অবস্থান গ্রহণ করেন। এল.এম.জি. নষ্ট হয়ে গেলে হাবিলদার আব্দুল খালেক,
৭১
ফজলুর রহমান খান ফারুককে সেখান থেকে চলে যেতে বলেন। তখন ফজলুর রহমান খান ফারুক বলেন, আমি চলে গেলে আপনি কিভাবে যাবেন।’ তখন হাবিলদার আব্দুল খালেক একজন খাটি দেশ প্রেমিকের মত উত্তর দেন, আপনি চলে যান, আপনি একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি, আপনার জীবনের মূল্য অনেক, আর আপনার কোন ট্রেনিং নেই, আমি একটা ব্যবস্থা করতে পারবােই। ফজলুর রহমান ফারুক হাবিলদার আব্দুল খালেকের নিকট থেকে ১০০ গজ দূরেও যেতে পারেননি তার আগেই হানাদারদের মেশিনগানের একঝাক গুলি এসে হাবিলদার আব্দুল খালেকের বুক ঝাঝরা করে দেয়। তার নিষ্প্রাণ দেহ বিকল এল.এম.জি’র উপর লুটিয়ে পড়ল। বাংলা মাকে ভালােবেসে নিজের রক্ত দিয়ে তিনি স্বাধীনতাকামীদের প্রতি অনুপ্রেরণার এক জ্বলন্ত স্বাক্ষর রেখে গেলেন । শত শহীদের সঙ্গে আব্দুল খালেকের নামও ইতিহাসের পাতায় সােনালী অক্ষরে চিরদিনের জন্য লেখা থাকবে। হানাদার সৈন্যরা প্রথমদিকে প্রচন্ড মার খেয়ে পরবর্তীতে ব্যাপক শক্তি নিয়ে মুক্তি সেনাদের উপর আঘাত হানে। তাদের আক্রমণের সামনে মুক্তিযােদ্ধাদের আর বেশি সময় প্রতিরােধ ব্যবস্থাকে ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। কারণ হানাদারদের বিভিন্ন ধরনের অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র অন্যদিকে মুক্তিযােদ্ধাদের বেশ কয়েকটি অস্ত্র জাম হয়ে যায়, যা পরে আর সচল করা সম্ভব হয়নি। এরপর আবার মুক্তিযােদ্ধাদের গুলি শেষ হয়ে যায়। অনেকেরই বিশ্বাস মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে যদি গােলাবারুদ ও অস্ত্রশস্ত্র থাকতাে তাহলে কোনক্রমেই তারা পিছপা হত না। একদিকে গােলাবারুদ ও অস্ত্রশস্ত্রের অভাব অন্যদিকে হানাদারদের ৭২ এম.এম.আর, এবং ১২০ এম.এম. কামান থেকে তীব্রবেগে গােলাবর্ষণ, একই সঙ্গে হেলিকপ্টার থেকে গােলাবর্ষণ মুক্তিযােদ্ধাদের বাংকার গুড়িয়ে দেয়। যার জন্য মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থান ত্যাগ করে সরে পড়তে হয়। গােড়ান-সাটিয়াচড়ার যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। এই যুদ্ধে ২৪-২৫ জন ই.পি.আর. বাহিনীর সদস্যসহ প্রায় ৩০/৩৫জন মুক্তিযােদ্ধা শহীদ হন। শহীদ মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে ছিলেন ফরিদপুরের ই,পি আরের সদস্য আব্দুল গফুর। বগুড়ার ই,পি,আরের হাবিলদার আব্দুল খালেক,গােড়ানের আবুল কাশেম, ছাত্রনেতা জুমায়াত হােসেন, জাহাঙ্গর ও দুদুর নাম উল্লেখযােগ্য। এখানে আর যে সমস্ত ই,পি, আরের সদস্য শহীদ হন আজ পর্যন্ত তাদের নাম বা পরিচয় পাওয়া যায়নি। তাদের পরিবারের লােকজন এই গৌরবময় বীরত্বের কাহিনী হয়তাে আজো জানেনা। সাড়ে সাতঘন্টা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর মুক্তিযােদ্ধারা যখন অবস্থান ত্যাগ করে চলে যান তখন হানাদার সৈন্যরা গােড়ান সাটিয়াচড়া গ্রাম দুটিতে প্রবেশ করে এক পৈশাচিক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। তারা নারী, পুরুষ, শিশু বৃদ্ধ যাকে সামনে পেয়েছে তাকেই গুলী করে অথবা বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করেছে। হানাদার সৈন্যদের হাতে সেদিন গােড়ান সাটিয়াচড়া গ্রামের শতাধিক ব্যক্তি শহীদ হন। হানাদার সৈন্যরা লােকজন হত্যা করে যে ভাবে গ্রাম দু’টিতে ফেলে রেখেছিল সে দৃশ্যের কথা শুনলে যে কোন মানুষের মনই শিউরে উঠবে। মৃতদেহগুলাে এমনভাবে ফেলে রেখেছিল যা অনেকটা ঝড়ে গাছতলায় আম পড়ে থাকার মত । সেদিন যারা শহীদ হন তাদের মধ্যে ছিলেন এস,এম, জিল্লুর রহমান, সৈয়দা মেহেরুন নেছা সুকী, এস, এম, আফজাল হােসেন, এস, এম, তােফাজ্জল হােসেন, এম, এম, মুস্তানাজিদুল হক শাহীন, মােঃ পান্না শিকদার, মােঃ আজমত আলী, আবুল কাশেম আলী, মােঃ নূরউদ্দিন, মােঃ শরীফ উদ্দিন, মােঃ জাহাঙ্গীর হােসেন, মােঃ নূরুল ইসলাম লেবু, গাজী শামসুল আলম, মােঃ মজিবর রহমান, নূরজাহান খানম, মােঃ নাজমুল আলম, বেগম করিমন নেছা,
৭২
বেগম আমেনা খাতুন, বেগম কোহিনূর আক্তার, বেগম মছিরন নেছা, মােঃ আবুল হােসেন, মােঃ ইব্রাহীম মিয়া, মােঃ আব্দুর রায়হান, লেবু মিয়া, মােঃ আব্দুল হক মিয়া, মােঃ হাবিবুর রহমান, মােঃ জিয়াউর রহমান, মােঃ জাহাঙ্গীর আলম মানিক, মােঃ শাহ আলম, মােঃ নঈম বক্স, আলহাজ মৌঃ খন্দকার আব্দুল হাকিম, বেগম লাল ভানু, নাছিরন বেওয়া, ইঞ্জিনিয়ার সৈয়দ নূরুর রহমান জাহাঙ্গীরসহ আরাে অনেকে। এখানেই সেদিন শহীদ হন রংপুরের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ভিখু চৌধুরী এবং তার স্ত্রী বেগম মিলি চৌধুরী। হানাদার বাহিনীর সৈন্যরা গােড়ান সাটিয়াচড়াতে যে নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে নিরস্ত্র নিরীহ জনতাকে হত্যা করেছে তা শােনার পর যেকোন মানুষের মন শিউরে উঠবে। খুনীরা সেদিন শুধু গুলি আর বেয়নেট চার্জ করেই মানুষকে হত্যা করেনি, সেদিন ওরা মানুষকে জীবিত অবস্থায় আগুন দিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করেছে। ১৮ জন ই.পি. আর বাহিনীর সদস্য সহ ৩০ জনকে একই ঘরে জীবিত অবস্থায় আগুন দিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করেছে। একই গর্তে আত্মগােপনকারী ১৫ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে। হানাদার সৈন্যরা গােড়ান সাটিয়াচড়াতে যাদের হত্যা করে তাদের লাশ কোন প্রকার ধর্মীয় এবং সামাজিক বিধি বিধান ছাড়াই মাটি চাপা দেয়া হয়। একই গর্তে কয়েকজন করেও মাটি চাপা দেয়া হয়। হানাদাররা গ্রাম দু’টির অধিকাংশ বাড়ীঘর পুড়িয়ে ধ্বংস করে দেয়। গ্রাম দুটি হয়ে পড়ে জনমানবহীন বিরান মরুভূমি। ই.পি.আর. বাহিনীর সদস্যদের সহ গােড়ান-সাটিয়াচড়ায় শহীদ বীর সন্তানদের কবর ধারণ করে আছে গােড়ান গ্রামের মাটি। কবরের ফলকে কারও নাম উত্তীর্ণ করা নেই। গােড়ান গ্রামের গণকবর আজ পরিণত হয়েছে চারণ ভূমিতে। সরকার বা কোন রাজনৈতিক দল বা মুক্তিযােদ্ধাদের পক্ষ থেকেও কবরগুলাে রক্ষণাবেক্ষনের কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। সরকারের পক্ষ থেকে শহীদ পরিবারগুলাে কোন প্রকার সাহায্য পায়নি। কোন কোন পরিবারের নামে সাহায্য বরাদ্দ করা হলেও তা প্রাপকের হাতে পৌছেনি। শহীদ পরিবারগুলাে আজ স্বাধীন বাংলাদেশে অবহেলিত, উপেক্ষিত মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের শহীদ বীর সেনানীরা। শহীদ পরিবারগুলাে কারও সহযােগিতা চায়নি। তারা চায় মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের মহান আদর্শের বাস্তবায়ন, শহীদ পরিবাররা চায় শহীদদের স্বপ্নের বাস্তবায়ন।
এলাঙ্গার জমিদার বাড়িতে অগ্নিসংযােগ ও লুটতরাজ
বিচারপতি দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য একজন দেশ বরেণ্য ব্যক্তিত্ব। আইনবিদ হিসাবে অগাধ পান্ডিত্যের অধিকারী হওয়ার ফলে আইন পেশায় যথেষ্ট সুনাম ও প্রচুর টাকা রােজগার করেও তিনি ছিলেন কিছুটা ব্যতিক্রম চরিত্রের মানুষ। তিনি এক সময়ে ছিলেন রাজনৈতিক অঙ্গনে একজন একনিষ্ঠ সক্রিয় নেতৃত্বের অধিকারী। বিশেষ করে বৃটিশ বিরােধী আন্দোলনে তিনি অত্যন্ত প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরও তিনি কিছুদিন রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। যার জন্য পাকিস্তান সরকার তাকে প্রায় দুই বৎসর রাজবন্দী হিসাবে কারাগারে বন্দী রাখেন। আইনজীবী হিসাবে অত্যন্ত ব্যস্ত থাকার কারণে পরে তিনি আর রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করতে পারেননি। যদিও তিনি রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে জড়িত থাকতে পারেননি তবু ১৯৬৯ সালে গণআন্দোলন ও ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে যথাসাধ্য কাজ করার চেষ্টা করেন। তিনি এ সময়ে কোন কোন রাজনৈতিক নেতা ও রাজনৈতিক দলকে মাঝে মধ্যেই অর্থ দিয়ে সাহায্য সহযােগিতা করেছেন। তিনি এক সময়ে যেমনি রাজনৈতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে দেশ ও দশের সেবা করার চেষ্টা
৭৩
করেছেন তেমনি পরবর্তীতে আইনজীবি হিসাবে দেশবাসীর সেবা করার পাশাপাশি অনেক গুলি সমাজ সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থেকে আর্তমানবতার সেবায় সর্বদা নিয়ােজিত থাকার চেষ্টা করেন। তিনি নিজ গ্রামে স্বর্গীয় মাতার নামে জিতেন্দ্ৰবালা উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন নিজ উদ্যোগে ও নিজ অর্থে। এলাকায় সগ্রামী শামসুল হকের স্মৃতিরক্ষার্থে শামসুল হক মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায়ও তার রয়েছে অসামান্য অবদান। এছাড়া আরাে বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নিজেকে জড়িত রেখেছেন। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ কালাে রাতে সৌভাগ্যক্রমে হানাদার বাহিনীর আক্রমণ থেকে রক্ষা পান বিচারপতি দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য। স্থানীয় রাজাকার ও ঘাতকদের সাহায্যে ২৭শে মার্চ রাতে তার বাসভবনে হানাদার বাহিনীর আক্রমণ করার আগমুহূর্তে প্রতিবেশীদের সহযােগিতায় বাইরে এসে তিনি কোনক্রমে প্রাণে রক্ষা পান। কিন্তু হানাদার সৈন্যরা ও তাদের সহযােগির তাঁর ঘর বাড়ি লুট করে টাকা-পয়সা ও মূল্যবান জিনিসপত্র সব কিছু নিয়ে যায়। বিচারপতি দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য বাসা থেকে বের হয়ে এসে প্রথমে তার বন্ধু অবসর প্রাপ্ত বিচারপতি ইমাম হােসেন চৌধুরীর বাসায় উঠেন। এখানে দুইদিন আত্মগােপন করে গৃহবন্দী অবস্থায় থাকার পর প্রখ্যাত আইনবিদ ডঃ আলীম আল রাজী তাকে তার নিজ বাসভবনে নিয়ে যান। এখানে তিনি প্রায় দুই মাসের মতাে গৃহবন্দী অবস্থায় আত্মগােপন করে থাকার পর এক বন্ধুর সহযােগিতায় নিজের গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার প্রচেষ্টা চালান। রাজধানী ঢাকা শহর থেকে প্রায় সত্তর মাইল দূরে টাঙ্গাইল জেলার কালিহাতী থানার এলাঙ্গা গ্রামের প্রখ্যাত জমিদার বাড়ি তার জন্মস্থান। ঢাকায় অবস্থান করেই তিনি সংবাদ পান ঐ এলাকায় মুক্তিযােদ্ধারা সংগঠিত হয়ে দেশের মুক্তির জন্য কাজ করে যাচ্ছে। মুক্তিযােদ্ধারা তাকে স্বপরিবারে নিজ এলাকায় যাওয়ার জন্য অনুরােধ জানিয়েছে । কিন্তু তাঁকে তারা সাবধান করে দিয়েছে যে তিনি যেন নিজের বাড়িতে না গিয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ন্ত্রিত পাশের কোন গ্রামে অবস্থান নেন। কারণ তাঁর বাড়ির উপর টাঙ্গাইল জেলা শহরে অবস্থিত হানাদার সৈন্যদের অশুভ দৃষ্টি রয়েছে। হানাদার সৈন্যরা মাঝে মধ্যে রণসাজে সজ্জিত হয়ে মুক্তিযােদ্ধা বা তাদের সমর্থকদের খুঁজে সন্দেহজনক স্থানে হানা দিয়ে লুটতরাজ করে এবং অনেক লােককে তুলে নিয়ে যায়। যাকে তুলে নিয়ে যায়, তাকে আর পরে পাওয়া যায়নি। যদিও পাওয়া যায় কাউকে, তবে তা মৃত অবস্থায়। বিচারপতি দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য মে মাসের শেষ দিকে একদিন স্বপরিবার ঢাকা ছেড়ে রওনা হলেন নিজ গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে। তখন তাঁর ছােট পরিবারে ছিল স্ত্রী চিত্রাদেবী, নাবালক দুই পুত্র ও এক কন্যা। বর্তমানে পুত্রদের একজন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ডঃ দেবন্দ্রিয় ভট্টাচার্য, অপরজন আমেরিকার কালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত ডঃ দেবদর্শী ভট্টাচার্য, কন্যা দেবলিনা রায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এস.সি. পাশ করে কলিকাতার অশােক হলের একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীর পদার্থ বিদ্যার শিক্ষিকা । বিচারপতি দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য নিজ বাড়িতে না গিয়ে পাশের বাসী গ্রামের তাঁর শুভনুধ্যায়ী কুশুকুমার সেনের বাড়িতে উঠেন। এই গ্রামে এসেই তিনি দেখতে পান এলাকার ছাত্র যুবকরা সংগঠিত হয়ে মুক্তিবাহিনী গড়ে তুলেছে এবং দেশকে হানাদার মুক্ত করার জন্য তারা সর্বদা ব্যস্ত। তাদের মনে তিনি লক্ষ্য করলেন প্রচন্ড উৎসাহ উদ্দীপনা। তারা অত্যন্ত সাহসিকতা নিয়ে এলাকাকে গড়ে তুলেছে মুক্তিযােদ্ধাদের দুর্গ। আর এই মুক্তিযােদ্ধাদের সংগঠিত করে মুক্তিযুদ্ধের জন্য তারা কৃতিত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তাদের মধ্যে আছেন ডা: হাছেন আলী, নজরুল ইসলাম, আব্দুল হাকিম তালুকদার, নূরুল ইসলাম, মকবুল হােসেন, জয়নাল,
৭৪
তারেজ উদ্দিন, মিয়া উল্লা, আমান উল্লা, শুকুর মামুদ প্রমুখ। মুক্তিযােদ্ধারা এলাকায় স্বাধীনভাবে চলাফেরা করছে এবং তাদের নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা করেছে। পাকিস্তানী হানাদার সৈন্যদের সমর্থকরা গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে হানাদারদের নিকট অবস্থান নিয়েছে। ২৫শে মার্চের পর দেশে শাসন ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে। যার জন্য গ্রামে চোর ডাকাতের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা লাভ করে। কিন্তু মুক্তিযােদ্ধারা তা কঠোর হস্তে দমন করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছে। ঢাকায় প্রায় দুই মাস গৃহবন্দী জীবন যাপন করার পর নিজ এলাকায় এসে তার মনে হয় তিনি যেন স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্ত বাতাসের নিঃশ্বাস গ্রহণ করেছেন। এ গ্রামের সঙ্গে যানবাহন চলাচলের উপযােগী কোন সড়ক যােগাযােগ নেই। এর পাশ দিয়ে একটি ক্ষীনতােয়া নদী বয়ে গেছে। বর্ষার ফলে তা অনেকটা স্ফীত হয়ে উঠেছে। শহরে অবস্থানকারী হানাদার সৈন্যদের পক্ষে যানবাহন যােগে এ গ্রামে আসা সম্ভব নয়। এ গ্রামে আসতে হলে প্রায় এক মাইল রাস্তা পায়ে হেটে আসতে হবে। কুশু কুমার সেন এলাকার একজন বিশিষ্ট জোতদার। তিনি জমিজিরাত দেখা শুনা নিয়েই মূলত সব সময় ব্যস্ত থাকেন। প্রথম দিকে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে তার তেমন কোন সম্পর্ক ছিল না। পরে ঐ পরিবারের দুই যুবক মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করাতে বাড়ির লােকজন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্ত সমর্থক হয়ে পড়ে। তার বাড়ি ধীরে ধীরে বহু মুক্তিযােদ্ধা ও তাদের সমর্থকদের আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়। বিচারপতি দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য কুশু কুমার সেনের বাড়িতে যথেষ্ট গােপনীয়তার সঙ্গে আশ্রয় নিলেও তার আগমন বার্তা ঐ এলাকায় প্রচারিত হতে খুব বেশী সময় লাগেনি। তার নিজ গ্রাম ও অন্যান্য গ্রাম থেকে দলে দলে লােকজন দেখা করতে আসতে শুরু করে। বিচারপতি দেবেশে চন্দ্র ভট্টাচার্য তাঁর নিজ গ্রামে এবং পাশ্ববর্তী অন্যান্য গ্রামে কয়েকটি জনসেবা মূলক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে এলাকায় তিনি ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয়। বিশেষ করে নিজ গ্রামে স্বর্গীয় মাতার স্মৃতি রক্ষার্থে জিতেন্দ্র বালা উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় নামে একটি স্মরণিকা নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করায় তাঁর সুনাম সুখ্যাতি অনেকটা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিচারপতি দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য নিয়মিত রেডিওতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রসহ বিদেশী বেতারের সংবাদ শুনতেন। কাজেই মুক্তিযযাদ্ধারা এবং এলাকার বহু লােকজন আসতাে তাঁর নিকট সংবাদ শুনার জন্য। এলাকার লােকজন অধিকাংশই আসতাে দেশের ভবিষ্যত অবস্থা কি হবে তা জানার জন্য এবং অনেকেই আসতাে কোন কোন স্থানে হানাদারদের অত্যাচারের কাহিনী জানানাের জন্য। গ্রামের এই সগ্রামী পরিবেশের মধ্যে ধীরে ধীরে খানিকটা নিজের অজ্ঞাতে বিচারপতি দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য মহাশয়ের অনেক খানি মানসিক পরিবর্তন হচ্ছিল। ঢাকায় অবস্থান কালে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ ও ২৫শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘােষণায় বাঙ্গালীদের পক্ষ থেকে তিনি যে সাড়া লক্ষ্য করেছিলেন তাতে তিনি অনেক খানি অনুপ্রেরণা পান। কিন্তু সশস্ত্রযুদ্ধে নিরস্ত্র বাঙ্গালীর অবস্থা কি হবে সে সম্পর্কে তাঁর ছিল প্রচুর সন্দেহ। কিন্তু গ্রামে এসে মুক্তিযােদ্ধাদের সংগঠিত শক্তির ভাব দেখে তিনি ক্রমশই বিজয়ের সম্ভবনা দেখেন। একদিন সকাল বেলায় বিচারপতি দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য কুশু কুমার সেনের বাড়ির পুকুরের পাড়ে বাহিরের ঘরে বসে ঐ গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক হরিচরণ বাবু এবং শহরের কলেজের ছাত্র নজরুলের সঙ্গে যুদ্ধের ফলে স্কুল কলেজের যে অবস্থা হয়েছে-সে সম্পর্কে আলাপ আলােচনা করছিলেন। এমন সময় সেখানে একজন ভদ্রলােক এসে উপস্থিত হলেন। তাঁর মুখখানি কালাে দাঁড়ি গােফে ঢাকা। মাথায় লাল রংয়ের ফেজ টুপি। গায়ে জামা ও জোরওয়াল পরা। হরিচরণ বাবু পরিচয় করিয়ে দিলেন তিনি জিতেন্দ্র বালা উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের মৌলভী শিক্ষক। কয়েক মাইল দূরে এক গ্রামে তাঁর বাড়ি। নাম তার কেরামত উল্লা
৭৫
মিয়া। এলাঙ্গা গ্রামের এক কৃষকের বাড়ি থেকে তিনি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। মৌলভী সাহেব বললেন, ‘বাবু আমি আপনার সঙ্গে পরিচিত হতে এসেছি। আমি আপনার প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়ে কাজ করি। অথচ আপনার সঙ্গে আমার পরিচয় হবার সৌভাগ্য হয়নি। বিচারপতি দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে আপ্যায়ন করে মৌলভী সাহেবকে একটি চেয়ারে বসালেন। মৌলভী সাহেব চেয়ারে বসে বললেন, দেখুন আজকে কিন্তু আমি একটি আরজি নিয়ে আপনার নিকট এসেছি। গত ১লা মার্চ থেকে বিদ্যালয়টি বন্ধ আছে; ছাত্র শিক্ষক কেউই বিদ্যালয়ে যায় না। এদিকে আমার বেতনও বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে অনাহারে দিন কাটাতে হচ্ছে। আপনি হলেন বিদ্যালয়ের মালিক, তাই দয়া প্রার্থী হয়ে আপনার নিকট এসেছি’। বিচারপতি দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য বললেন, ঠিক আছে। আমি প্রধান শিক্ষিকার সঙ্গে আলােচনা করে সমস্ত অবস্থা জেনে কোন ব্যবস্থা করা যায় কিনা তার চেষ্টা করব। মৌলভী সাহেব অত্যন্ত নম্রতার সঙ্গে ছালাম জানিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। ঐদিন বিকালে বিচারপতি দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য কয়েকজন সঙ্গীসহ নদীর তীরের রাস্তা ধরে তাঁর দৈনন্দিন বৈকালিক ভ্রমণ শুরু করেছিলেন। ঠিক এই সময় ঐ গ্রামের এক যুবক দ্রুত ছুটে এসে তাকে অত্যন্ত খুশির সঙ্গে জানায় মৌলভীর ফাঁসির হুকুম হয়ে গেছে। এবার আর তার রক্ষা নেই। এ সংবাদ শুনে বিচারপতি দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য যেন আকাশ থেকে পড়লেন। জিজ্ঞাসা করলেন মৌলভীর ফাঁসির হুকুম? আমি যে কিছুই বুঝতে পারছি না। ঐ যুবক বলল, ‘আমি সব কথা বলতে পারব না। তবে নজরুল ভাই এদিকে আসছে আপনাকে সব কথা জানাতে। অল্পক্ষণের মধ্যেই মুক্তিযােদ্ধা নজরুল চলে এলেন তাঁর নিকট। তিনি অত্যন্ত হতভম্ব হয়ে গেছেন। তাঁর কাছে যেন সবই একটা রহস্য মনে হচ্ছে। কোর্ট কাছারিতাে দূরে শহরে। এত তাড়াতাড়ি কোর্টের হুকুম এল কি করে? তাছাড়া কি অপরাধ ঐ মৌলভী সাহেবের। সকাল বেলায় মৌলভী সাহেবের সঙ্গে আলাপ করে বিচারপতি দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য তাঁর প্রতি অনেক খানি সহানুভূতিশীল হয়েছিলেন। তাকে দেখে তাে কোন অপরাধী বলে তার মনে হয়নি। এসব কথা চিন্তা করতে করতে বিচারপতি দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য সবাইকে নিয়ে স্কুল ঘরের বারান্দায় এসে উঠলেন । ভিতর থেকে একখানি চেয়ার ও দু’খানি বেঞ্চ বের করে দিলে সবাই তাতে বসলেন। সেখানে বসে বীর মুক্তিযােদ্ধা নজরুল ইসলাম যে সব কথা বলল, তার সারাংশ হল : মৌলভী কেরামত উল্লা মিয়া একজন রাজাকার এবং হানাদারদের সক্রিয় তাবেদার। সে এ গ্রামে এসেছিল মুক্তিযােদ্ধাদের আস্তানার খোঁজ খবর ও আপনার অবস্থান সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য । মৌলভী সাইকেল যােগে এ গ্রামে প্রবেশ করেছে। তাতেই সাধারণের মনে সন্দেহ হয়। কারণ সামরিক বাহিনীর নির্দেশ ছিল এলাকার সাধারণ মানুষের সাইকেলে চড়া দন্ডনিয়। মৌলভী কোন সাহসে সাইকেলে চড়ে কয়েক মাইল রাস্তা পাড়ি দেয়। মুক্তিযােদ্ধাদের শিবিরে সংবাদ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তারা সর্তকতার সঙ্গে মৌলভীর যাতায়াতের পথে তীক্ষ দৃষ্টি রাখছিল। বিচারপতি দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য মহাশয়ের সঙ্গে আলাপ করে বের হওয়ার পরপরই তাকে ধরে নিয়ে এই গ্রামের মুক্তিযােদ্ধা হাছেন আলীর বাড়িতে গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছে। মধ্য রাতে মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তরে পাঠানাে হবে। সদর দপ্তর এই গ্রাম থেকে সাত মাইল দূরে সখীপুরে অবস্থিত । সদর দপ্তরে পৌছলেই তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে। এসব শুনে বিচারপতি দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। দূর পল্লীতে রাজাকারদের আগমন তাকে অনেকখানি ভীত চকিত করে তুলেছে। তিনি তার তিন সঙ্গীর মধ্যে
৭৬
খানিকটা দ্বিধাদ্বন্দ্বের ভাব লক্ষ্য করলেন। এর মধ্যে শিক্ষক আব্দুল গফুর বিচারপতি দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য মহাশয়ের নিকট এসে অত্যন্ত মৃদুস্বরে বললেন, এ হল একজনের জীবন মরনের কথা। শুধু ছেলেদের ওপর এ বিষয় ছেড়ে দেওয়া ঠিক হবে না। তারপর মুক্তিযােদ্ধা নজরুলের দিকে তাকিয়ে বললেন, দেখ নজরুল তােমাদের সমস্যার কথা শুনলাম। কিন্তু মৌলভী সাহেব আমাদের সবার অত্যন্ত পরিচিত ব্যক্তি। বেশ কিছু দিন ধরে আমরা এক সঙ্গে জিতেন্দ্র বালা উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করি। তার স্বভাব চরিত্র সম্পর্কে যতটুকু জানতে পেরেছি, রাজাকারদের জঘন্য কাজের সঙ্গে তার একেবারেই মিল নেই। শুধু সন্দেহ বশে একজনের জীবন নাশ করা মােটেই সঙ্গত হবে না । উত্তরে মুক্তিযােদ্ধা নজরুল বলেন, আমরা শুধু সন্দেহের বশে তাকে সদর দপ্তরে পাঠাচ্ছি না। তাঁর অপরাধের অভ্রান্ত প্রমাণ আমাদের কাছে আছে। এ সময় অপর শিক্ষক মলয় ভূষণ বললেন, নজরুল তােমরা মৌলভী সাহেবের সঙ্গে একেবারেই পরিচিত নও। অথচ আমাদের তার সঙ্গে মেশার অনেক সুযােগ হয়েছে। তাই আমরা তাকে ভালভাবেই জানি। তাঁর কোমল হৃদয়ের জন্য আমরা তাকে দরদী মৌলভী’ বলে ডাকি। আব্দুল গফুর তখন বলে উঠলেন মৌলভী সাহেবের দরদী মৌলভী’ নাম মিছেমিছি নয়, এর পিছনে একটি বাস্তব ঘটনা রয়েছে। প্রায় বৎসর দুই আগে একদিন খুব জোরে বৃষ্টি নেমেছিল। মেয়েদের স্কুলটি তখন চলছিল। হঠাৎ লক্ষ্য করা গেল, শিক্ষকদের বসবার ঘরের ঠিক সামনে একটি ছােট ছাগলের বাচ্চা বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে খুব চিৎকার করছে। মৌলভী সাহেব আর থাকতে পারলেন না, ছুটে বাইরে গিয়ে বৃষ্টিতে ভিজে ক্রন্দনরত ছাগলের বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে তিনি স্কুলে ঘরের মধ্যে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন। তাঁর দরুদী হৃদয়ের পরিচয় পেয়েই তাকে ঐ আখ্যা দেওয়া হয়। মৌলভী সাহেবকে যদি মুক্তিযােদ্ধাদের সদর দপ্তরে পাঠানাে হয়, তবে মৌলভী সাহেবের মৃত্যু অনিবার্য । মৌলভী সাহেবের দু’জন সহকর্মীর কাছ থেকে তাঁর যে প্রশংসার কথা শুনলেন তাতে বিচারপতি দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য মহাশয়ের মনে হলাে যে, মৌলভী সাহেবের বিরুদ্ধে যে অভিযােগ এসেছে তা যুক্তি দিয়ে পরীক্ষা করে দেখা একটি মানবিক দায়িত্ব। তাই তিনি মুক্তিযােদ্ধা নজরুলকে জিজ্ঞাসা করলেন মৌলভী সাহেব যে রাজাকার তার কি প্রমাণ তােমরা পেয়েছাে? নজরুল বলল সে সব আমি কিছু বলতে পারবাে না। তবে হাছেন আলী ভাই সব বলতে পারবেন। বিচারপতি দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য হাছেন আলীকে ভালভাবে জানেন। হাছেন আলীকে ডেকে আনার জন্য তিনি নজরুলকে পাঠালেন। কিছুক্ষণ পরেই হাছেন আলী এসে উপস্থিত হয় তার সহযােদ্ধা মিয়া উল্লাকে সঙ্গে নিয়ে। হাছেন আলী প্রথম কথা বলল ঃ কাকাবাবু আমি আপনাদের কথা শুনেছি। মৌলভীকে গৃহবন্দী করে সদর দপ্তরে পাঠানাের সিদ্ধান্ত এমনি নেওয়া হয়নি। এর পিছনে অনেক প্রমাণ আছে বলেই এরূপ সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এর উত্তরে বিচারপতি দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য বলেন, দেখ হাছেন আলী তােমরা তােমাদের জীবন উৎসর্গ করে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করে যাচ্ছ। তােমাদের চিন্তা ভাবনা ও কাজের ওপর আমাদের সম্পূর্ণ বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা আছে। আমাদেরও কর্তব্য তােমাদের সাহায্য করা। কিন্তু আজ যখন আমাদের একজনের জীবন নাশের প্রশ্ন আসে, তখন আর একটি মানবিক দায়িত্ববােধের প্রশ্নও আমাদের সামনে এসে যায়। তাই এ সম্পর্কে কিছুটা আলােচনার জন্যই তােমাকে ডেকেছি। মুক্তিযােদ্ধা হাছেন আলী বলল, কাকাবাবু আপনাদের উৎকণ্ঠার কথা আমরা বুঝতে পেরেছি। আমরা অনেক ভেবেচিন্তে প্রমাণের ওপর নির্ভর করেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তারপর তিনি বললেন, মৌলভী যে হানাদার বাহিনীর সহযােগি তার প্রথম প্রমাণ হল, সে তার নিজ গ্রাম থেকে সাইকেল চালিয়ে এই গ্রামে এসেছে। এখানে আসতে তাকে বড় সড়কও পাড়ি দিতে হয়েছে, সে সড়ক দিয়ে সর্বক্ষণ হানাদার সৈন্যরা
৭৭
টহল দিচ্ছে। সাইকেল চালানাে হানাদার সৈন্যদের নিষেধ আছে। তা সত্ত্বেও হানাদারদের লােকজন ছাড়া আর কারও পক্ষে সাইকেল চালিয়ে বড় সড়ক অতিক্রম করা সম্ভব নয়। বিচারপতি দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য বললেন, এ সম্পর্কে মৌলভীকে কি তােমরা কিছু জিজ্ঞাসা করেছ? মুক্তিযােদ্ধা হাছেন আলী বলল, অবশ্যই জিজ্ঞাসা করেছি। কিন্তু ধূর্ত মৌলভী বলল, বড় সড়কে এসে সে এক জানাশােনা ট্রাকওয়ালার সাক্ষাত পায় এবং সেই নাকি অনুগ্রহ করে তাকে বড় সড়ক পার করে দেয়। একথা একেবারেই বিশ্বাসযােগ্য নয়। মুক্তিযােদ্ধা হাছেন আলীর কথায় তার সন্দেহের নিরাসন হল না। তিনি তাকে পুণরায় জিজ্ঞাসা করলেন, তাঁর বিরুদ্ধে আর কোন প্রমাণ তােমাদের কাছে আছে? হাছেন আলী উত্তরে বলল, নিশ্চয়ই এই দেখুন প্রত্যক্ষ প্রমাণ। এই বলে সে পকেট থেকে ছােট ছােট বইয়ের মত একটি খাতা বের করল এবং ঐ খাতার কয়েকটি পাতা উল্টিয়ে একটি পাতা বিচার পতি দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য মহাশয়ের সামনে তুলে ধরল। তিনি দেখলেন সেই পাতায় পরপর কয়েকটি নাম লেখা আছে এবং তালিকায় দ্বিতীয় নামটি হল মৌলভী কেরামত উল্লা মিয়া, গ্রাম বাশবাড়ি, জিতেন্দ্ৰবালা উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের মৌলভী শিক্ষক। হাছেন আলী বলল, এই তালিকাটি ধরে এই সব রাজাকারদের খুঁজে বেড়াচ্ছি। এরপর বিচারপতি দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য বললেন, তােমার লেখা তালিকাতে নাম লেখা থাকলেই তাঁর বিরুদ্ধে অভিযােগ প্রমাণ হয় না। এবার তুমি বল, এই নাম তুমি কিভাবে সংগ্রহ করেছে। মুক্তিযােদ্ধা হাছেন আলী বলল, এই নাম পেয়েছি এমন একজনের কাছ থেকে সে হলাে মৌলভী সাহেবের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় এবং সে মৌলভীর সমস্ত কাজ কর্মের খোঁজ-খবর রাখে। তার নাম জমির উদ্দিন। সে সম্পর্কে মৌলভীর ভাই পাে হয় এবং একই গ্রামে তাদের বসবাস। বিচারপতি দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য বললেন, জমির মৌলভীর ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হয়েও মুক্তিযােদ্ধাদের নিকট মৌলভীর বিরুদ্ধে এত বড় অভিযােগ করল। জমিরউদ্দিন কি মুক্তিযােদ্ধা? মুক্তিযােদ্ধা হাছেন আলী বলল, না জমির উদ্দিন মুক্তিযােদ্ধা নয়। ঐ গ্রামে কোন মুক্তিযােদ্ধা নেই। মৌলভীর সঙ্গে জমিজিরাত নিয়ে অবশ্য জমির উদ্দিনের পরিবারের মামলা মােকদ্দমা আছে। কিন্তু আমরা তাকে অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করে বুঝতে পেরেছি যে সে সত্য কথাই বলেছে। এ সময় শিক্ষক মলয় বাবু বললেন, দেখা যাচ্ছে মামলা মােকাদ্দমা নিয়ে দুজনের মধ্যে বেশ বিরােধ রয়েছে। বিদ্বেষ বশে যে জমির উদ্দিন মৌলভীর বিরুদ্ধে এই মিথ্যা কাহিনী প্রচার করেনি তার কিছু নিশ্চয়তা আছে? বিচারপতি মহাশয় বললেন, তােমরা কি জমির উদ্দিন ছাড়া আর কারও কাছ থেকে মৌলভীর বিরুদ্ধে এত বড় অভিযােগ শুনেছাে? হাছেন আলী বলল, কাকাবাবু একথা ঠিক জমিরউদ্দিন ছাড়া আর কারও কাছ থেকে মৌলভীর বিশ্বাসঘাতকতার প্রমাণ আমাদের কাছে আসেনি। তবে আমরা জমিরউদ্দিনের কথা যথেষ্ট যাচাই করেই গ্রহণ করেছি। অবশ্য শেষ সিদ্ধান্তের প্রক্রিয়া সদর দপ্তরের নেতার মৌলভীকে কাল ভােরেই সেখানে পাঠিয়ে দিচ্ছি। হাছেন আলীর কথা শুনামাত্র শিক্ষক গফুর সাহেব বলে উঠলেন, সর্বনাশ। সদর দপ্তরে পাঠালে মৌলভীর আর বাঁচার আশা নেই। আমরা জানি রাজাকারের অপবাদ যার বিরুদ্ধে আছে তার সম্পর্কে সদর দপ্তরের নেতৃত্ব অত্যন্ত কঠোর। রাজাকারের অভিযােগে মৌলভীকে সদর দপ্তরে পাঠালে তাঁর পরিবারের সবার অনাথ হওয়া ছাড়া উপায় নেই। পরস্পরের বাদানুবাদ শুনে বিচারপতি দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য মহাশয় দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। তিনি বললেন, দেখ হাছেন আলী তােমাদের উপর আমাদের যথেষ্ট বিশ্বাস আছে। তােমরা জনগণের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে রয়েছে। কিন্তু শুধু একজনের কথার উপর ঐরূপ ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড দেওয়া আমার কাছে উচিত বলে মনে হয় না। বিশেষ করে সেই একজনের সঙ্গে যখন মৌলভীর আগে থেকেই বিরােধ রয়েছে। এই কথা শুনার পর হাছেন আলী বলল,
৭৮
আমাদের এক বড় ভাই আছেন তিনি আমাদের শিবিরে রয়েছেন। আমি তাকে আপনার কাছে এখানেই নিয়ে আসছি। তার কথা অনুসারে শেষ সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এই বলে হাছেন আলী তাঁর শিবিরের দিকে অগ্রসর হয়। কিছুক্ষণ পর হাছেন আলী বিশিষ্ট মুক্তিযােদ্ধা আব্দুল হাকিম তালুকদারকে সঙ্গে নিয়ে কুশু কুমার সেনের বাড়িতে উপস্থিত হয়। হাছেন আলী এসেই বলল, ইনিই আমাদের বড় ভাই। ইনি যে সিদ্ধান্ত দিবেন তাই আমাদের কাছে অবশ্য পালনীয় আইন। ইনি সমস্ত ঘটনা জানেন। বিচারপতি দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য আব্দুল হাকিম তালুকদারকে লক্ষ্য করে বললেন, দেখ আজ যদি আদালতে মৌলভীর বিচার হত তাহলে সে বেনিফিট অব ডাউট দাবী করতে পারতেন। আজ যদি তােমরা মৌলভী সাহেবকে দোষী হওয়া সত্বেও তাকে ছেড়ে দাও তাহলে তােমাদের যুদ্ধ ব্যবস্থা কিছুটা ক্ষতিগ্রস্থ হবে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। একজন সহযােগিকে সরিয়ে দিয়ে শত্রু পক্ষকে যতটুকু হীনবল করতে চেয়েছিলে তা করতে পারলে না, আর যদি নির্দোষ হওয়া সত্বেও মৌলভীকে জীবন নাশ করা হয় তাহলে একজন নির্দোষ ব্যক্তির অকাল মৃত্যুতে সমাজ কিছুটা ক্ষতিগ্রস্থ তাে হবেই। তাছাড়া মৌলভীর উপর নির্ভরশীল তাঁর পরিবারের লােকজন একেবারে অনাথ হয়ে পড়বে। এই অবস্থায় দ্বিতীয় বিকল্পটি এড়িয়ে যাওয়াই কি আমাদের পক্ষে উচিত হবে না । বিচারপতি দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য মহাশয়ের কথার উত্তরে যুক্তিযােদ্ধা আব্দুল হাকিম তালুকদার বললেন, এ সম্পর্কে আর একটি দিক বিবেচনা করার আছে। মৌলভী যদি সত্যিই হানাদারদের দোসর হয়ে থাকে তবে সে ফিরে গিয়ে অবশ্যই তার প্রভুদের কাছে এখানকার সব খবর জানাবে। সে বিশেষ করে আপনার অনুসন্ধান এবং মুক্তিযােদ্ধাদের খোজ খবর নিতে এসেছিল। কাজেই মৌলভীর মুক্তি দেওয়া মানে এ গ্রামের উপর হানাদারদের আক্রমণ সুনিশ্চিত করা। আর সে আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য হবেন আপনি এবার বিচারপতি দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য বললেন, ঠিকই বলেছাে। আমি সেটাও ভেবেছি। তবে আমার মনে হয় এ সমস্যার একটি মানবিক দিকও রয়েছে, মৌলভী বুঝতে পেরেছেন যে তিনি মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে বন্দী এবং তাকে সদর দপ্তরে পাঠানাে হবে আর সেখানে পাঠানাে হলে তার মৃতুদন্ড অবশ্যই কার্যকর করবে। এরকম অবস্থায় যদি সে গ্রামবাসীদের মধ্যস্থতায় মুক্তিপায় তবে সে নিশ্চই বুঝতে পারবে যে গ্রামবাসীরা তার জীবনদাতা। সে যদি সত্যিই একজন রাজাকার হয়ে থাকে তবু তার মন থেকে সব রকম মানবতা বােধ একেবারে মুছে গেছে এরকম মনে করার কি কোন কারণ আছে? আমার তাে মনে হয় তার যদিও সামান্য মাত্রার এতটুকু মানবিক বােধ থেকে থাকে তবে সে গ্রামবাসীর দয়ার কথা ভুলতে পারবে না। তাদের এই দয়ার ঋন তিনি চিরকৃতজ্ঞ থেকে পরিশােধ করার চেষ্টা করবেন। বিচারপতি দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য মহাশয়ের এই কথার পর উপস্থিত জনতার মধ্যে সমর্থক গুঞ্জন শােনা গেল। এই সময় হাছেন আলী আব্দুল হাকিম তালুকদারকে ডেকে বাহিরে নিয়ে গেল। যাবার সময় বিচারপতি মহাশয়কে বলে গেল কাকাবাবু আমরা এখনই আসছি। কিছুক্ষণ পরেই আবার তারা দুজনে সেখানে ফিরে এল। আব্দুল হাকিম তালুকদার বিচারপতি দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য মহাশয়কে লক্ষ্য করে কললেন, সমস্ত অবস্থা বিবেচনা করে আমরা আপনার কথা মেনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এ সিদ্ধান্তটি কিছুটা ঝুকিপূর্ণ হবে। কিন্তু আমাদের আপনাদের নিয়েই চলতে হবে। তার পরও আপনার মত একজন মহান ব্যক্তির মতামতের প্রতি রয়েছে আমাদের গভীর শ্রদ্ধা। কাজেই আপনার অভিমত আমাদের অবশ্যই শ্রদ্ধার সঙ্গে মানতে হবে। আপনার অভিমত উপেক্ষা করা আমাদের উচিৎ হবে না। আমরা সন্মিলিত ভাবে আপনার সিদ্ধান্তই মেনে নিলাম। তবে এখন থেকে আপনাদের সবার অনেক হুশিয়ার থাকতে হবে। আমরা মৌলভীকে এখনই ছেড়ে দিচ্ছি। তবে
৭৯
এতরাতে ওর নিজের বাড়িতে যাওয়া সম্ভব হবে না। যে বাড়িতে থেকে তিনি শিক্ষতা করেন আমরা তাকে আজ রাতে সেখানেই পৌছে দিচ্ছি। এরপর আব্দুল হাকিম তালুকদার হাছেন আলীকে নিয়ে সেখানে থেকে চলে গেলেন। বিচারপতি দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য সহ অন্যান্য যারা সেখানে উপস্থিত ছিলেন তারা সকলেই একটি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। পরদিন সকালে সবাই শুনল, গভীর রাতে গ্রামের কয়েকজন তরুণ ছেলে মৌলভীকে তাঁর সাইকেল সহ পাশের গ্রামের যে বাড়িতে থেকে সে শিক্ষকতা করত সেখানেই পৌছে দিয়েছে এবং মৌলভী নাকি গ্রামের সকলকে শুকরিয়া জানিয়েছে। এর তিনদিন পর বিচারপতি দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য কুশুকুমার সেনের বাইরের ঘরে বসে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংবাদ শুনার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। সেখানে গ্রামের বেশ কয়েকজন বয়স্ক ব্যক্তি ও কয়েকজন তরুন যুবক উপস্থিত ছিলেন। এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে বিচার পতি দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য মহাশয়ের গ্রামের বাড়ির পাহারাদার তালেব আলী ঘরের ভিতরে প্রবেশ করে। ঢুকেই সে বলল, আমাদের গ্রামের তারুমিয়া আজকে মৌলভীকে দেখে এসেছে। সে রাজাকারদের সঙ্গে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। তালেব আলীর কথার সঙ্গে সঙ্গে যেন সেই ঘরে একটি বজ্রপাত হল। সবাই আতংকে গেল। বিচারপতি দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য তখন ধীরে ধীরে বললেন, ছেলেদের কথাই ঠিক ছিল। আমাদের কথাই ভুল হয়ে গেছে। কিন্ত ভেঙ্গে পড়লে চলবেনা। আমাদের সকল অবস্থার জন্যই প্রস্তুত থাকতে হবে। তিনি তখন একজন যুবককে পাঠালেন মুক্তিযােদ্ধা হাছেন আলীকে ডেকে আনার জন্য। বেশ কিছুক্ষণ পর হাছেন আলী এসে উপস্থিত হলেন। তাঁর সঙ্গে ছিল নূরুল ইসলাম নামে আর একজন মুক্তিযােদ্ধা। রাত তখন অনেক হয়েছে। হাছেন আলী বলল: কাকাবাবু আমি খবর শুনেছি। আমাদের জন্য বিশেষ কিছু চিন্তা করার নেই। কারণ আমরা এ ধরনের অবস্থার জন্য সব সময়ই প্রস্তুত আছি। চিন্তা হল আপনার ও আপনার পরিবারের লােকজনদের জন্য। আমার ধারণা হচ্ছে ওরা যে কোন সময় এ গ্রামে হানা দিতে পারে। আপনার জন্য নদীর ওপর পারের একটি গ্রামে সে রকম একটি জায়গা দেখে রেখেছি। মুক্তি যােদ্ধা হাছেন আলীর সঙ্গী নূরুল ইসলাম বলল,এই রাজাকাররা গুপ্তচরের কাজ করেছে। ওরাই রাস্তা দেখিয়ে হানাদার সৈন্যদের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাচ্ছে মুক্তিযােদ্ধা ও তাদের সহযােগিদের ধরে আনার জন্য। হানাদার সৈন্যরা যে গ্রামে হানা দেয় সে গ্রামের যুবক যুবতীদের রক্ষা নেই। ওরা লুট পাট করে মানুষের সব নিয়ে যায় আর যাওয়ার সময় মানুষের ঘরবাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দেয়। তাই এগ্রামের মানুষের সতর্ক থাকতে হবে। মুক্তিযােদ্ধা হাছেন তখন সবাইকে আশ্বাস দিয়ে বলল; সৌভাগ্যের কথা বর্ষার পানি এসে যাওয়ায় আমাদের নদীটার আয়তন অনেকটা বেড়ে গেছে এবং গ্রামের অনেক জায়গায় এ মাঠে পানি ঢুকেছে। পাক হানাদার সৈন্যরা পানিকে খুব ভয় পায়। তাই ওরা সব সময় পানি ভরা জায়গা এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। আমাদের গ্রামে এবং অপর গ্রামে বেশ কয়েকটি নৌকা আছে। ওদের খবর দেওয়া আছে। প্রয়ােজনবােধে ঐসব নৌকা উদ্ধার কাজে ব্যবহার করা হবে। আগামী দিন ভােরে আমরা বিচারপতি দেবেশ চন্দ্র ভষ্টাচার্য মহাশয়কে স্বপরিবারে নদীর অপর পারে একটি গ্রামে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করছি। আর কাল ভাের থেকে নদীর ঘাটে কয়েকটি নৌকা বাধা থাকবে সব সময়ই। হানাদার সৈন্যরা এ গ্রামে আঘাত হানলে গ্রামের সবাইকে সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। সারারাত বিচারপতি দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য মহাশয়ের পরিবারের সকলের জিনিসপত্র গােছ গাছ করে ভাের বেলায় ঘাটে বাধা নৌকায় উঠলেন। বেশ কিছুক্ষণ নৌকা চালানাের পর মাঝিরা নৌকাটি নদীর অপর পারের একঘাটে ভিড়ালাে। মাঝিদের নির্দেশে বিচারপতি দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য
৮০
স্বপরিবারে সেই ঘাটে নেমে পড়লেন। মাঝিরা অপর পারের গ্রামের এক বাড়িতে উঠল তাদের নিয়ে। তারা গৃহস্বামীকে ডেকে তার হাতে হাছেন আলীর লেখা একটি চিঠি দিল। গৃহস্বামী ঐ গ্রামের একজন বড় জোতদার। তিনি চিঠি পড়ামাত্র বিচারপতি মহাশয়কে অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে বাড়ির ভিতরে নিয়ে গেলেন। বাড়ির ভিতরে গিয়ে ঘরে বসে বিচারপতিবাবু গৃহস্বামীর সঙ্গে আলাপ আলােচনা করছিলেন এমন সময় সেখানে এসে উপস্থিত হয় মুক্তিযােদ্ধা নজরুল। সে হাসতে হাসতে বলল; কাকাবাবু মৌলভী আপনার দেনা পরিশােধ করে গেছে। অর্থাৎ আমরা যা ধারণা করেছিলাম তাই হয়েছে। আপনার চলে আসার পর গ্রামে হানাদার সৈন্যরা আসে। তারা প্রথমে কুণ্ড সেনের বাড়ি তারপর হাছেন আলীর বাড়িতে এবং পরে আপনার বাড়িতে যায়। তারা প্রতিটি বাড়িতে লুটপাট করে সব নিয়ে যায় এবং ঘরে আগুন দেয়। হানাদার সৈন্যরা চলে যাওয়ার পর গ্রামের লােকজন আপনার বাড়ির আগুন নিভানাের চেষ্টা করে। কিন্তু তখন সব শেষ। তাই বলছিলাম কাকাবাবু, আপনি মানবতার প্রশ্নে মৌলভীর জীবন রক্ষা করলেন আর মৌলভী তার প্রতিদানে আপনার এবং গ্রামের সব শেষ করল। মুক্তিযােদ্ধা নজরুলের কথা শুনে বিচারপতি দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য মহাশয় নির্বাক হয়ে বাহিরের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
কাদেরিয়া বাহিনী
১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী মুক্তিবাহিনীর কর্তৃত্বের বাইরেও আরাে অনেকগুলাে বাহিনী গড়ে উঠেছিল। এ সব বাহিনীর মধ্যে ছিল কাদেরিয়া বাহিনী, বাতেন বাহিনী, সিরাজগঞ্জের লতিফ মির্জার বাহিনী, ফরিদপুরের হেমায়েত বাহিনী, ঝিনাইদহের আকবর বাহিনী, পিরােজপুরের রফিক বাহিনী। বাংলাদেশের ভেতরে ভারতের বা প্রবাসী সরকারের সাহায্য ছাড়াই এই সমস্ত বাহিনী গড়ে উঠে এবং বহু রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে অংশগ্রহণ করে। এই বাহিনীর মধ্যে কাদেরিয়া বাহিনী সবচেয়ে বেশী সংখ্যক সংঘর্ষে অংশগ্রহণ করে। এই বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল ১৭ হাজারেরও বেশী। এদের সহযােগী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সংখ্যা ছিল ৭২ হাজারেরও বেশী। কাদেরিয়া বাহিনীর যুদ্ধ ক্ষেত্র ছিল ৫টি সেক্টরে বিভক্ত। ৫টি সেক্টরের ছিল ৫টি সদর দফতর। ৯৭টি কোম্পানীতে বিভক্ত ছিল কাদেরিয়া বাহিনীর সদস্যরা। কোম্পানীগুলােরও ছিল পৃথক পৃথক সদর দফতর। দপ্তরগুলাে ছিল ভ্রাম্যমান। এছাড়া সবার ওপরে ছিল একটি সর্বোচ্চ সদর দফতর। এখানে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী কোনদিনই যেতে পারেনি। কাদেরিয়া বাহিনী টাঙ্গাইল, জামালপুর, ময়মনসিংহ ও সিরাজগঞ্জের কিছু অংশসহ প্রায় ১৫ শ বর্গমাইল এলাকা মুক্ত রাখতে সক্ষম হয়েছিল। বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম ছিলেন এই বাহিনীর প্রধান। তার নামানুসারে এই বাহিনীর নাম হয় কাদেরিয়া বাহিনী। বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের আগে আওয়ামী লীগ কিংবা ছাত্রলীগের কোন জাতীয় পর্যায়ের নেতা ছিলেন না। তিনি স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরুর সময় ছিলেন টাঙ্গাইল জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মাত্র। স্বাধীনতার আগে তার দেশব্যাপী কোন পরিচিতি ছিল না। দীর্ঘদেহী এই যুবক তার যুদ্ধ কৌশল, যুদ্ধনীতি, দক্ষতা ও
৮১
যােগ্যতা দিয়ে বিশাল বাহিনী গড়ে তােলেন। সে বাহিনীর সমস্ত কিছুই ছিল নিজস্ব শক্তি ও সমর্থের প্রতি নির্ভরশীল। ভারতীয় বা প্রবাসী সরকারের কোন প্রকার সাহায্য সহযােগিতা ছাড়াই দেশের ভেতরে অবস্থান করে বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী এই বাহিনী গড়ে তুলেন। ১৯৭১ সালের ৩রা এপ্রিল পাক-হানাদার বাহিনী টাঙ্গাইল শহরে প্রবেশ করে। হানাদার বাহিনীর সঙ্গে টাঙ্গাইল শহর হতে ১২ মাইল দক্ষিণে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে গােড়ান-সাটিয়াচড়া নামক স্থানে ইপিআর ও মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাক হানাদার বাহিনীর সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষে পাক বাহিনীকে পরাজিত করতে না পারলেও তাদের প্রচুর জীবনহানি ঘটে। যুদ্ধে যখন ইপিআর ও মুক্তিবাহিনীরা টিকতে না পেরে সরে পড়ে তখন পাক হানাদার বাহিনী দ্রুত গতিতে টাঙ্গাইল শহরে প্রবেশ করে গােড়ান-সাটিয়াচড়া হতে পাক হানাদার বাহিনী টাঙ্গাইলের দিকে অগ্রসর হবার সংবাদ শুনে প্রায় সমস্ত নেতাই শহর ত্যাগ করে ভারতের দিকে চলে যায়। টাঙ্গাইলের পতনের পর বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকীও শহর ত্যাগ করেন। তিনি চলে যাবার সময় দুটি গাড়ীতে কিছু পেট্রোল, খাদ্যদ্রব্য ও কাপড়চোপড় নিয়ে টাঙ্গাইলের পাহাড়ী এলাকাতে যান। পাহাড়ী এলাকাকে মূল কেন্দ্র করে সেখান হতে বিভিন্ন স্থানে যােগাযােগ করেন। এখান থেকেই তিনি ময়মনসিংহ হালুয়াঘাটের সঙ্গে যােগাযােগ করে তার বাহিনী গড়ে তােলার কাজে অগ্রসর হন। ১৯৭১ সালের ১৯শে এপ্রিল কালিহাতি ইপিআর বাহিনীর সঙ্গে পাক বাহিনীর প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়। যদিও এখানে সংঘর্ষে ইপিআর বাহিনীকে পিছু হটতে হয়, তবুও এখানে পাক হানাদারদের একজন মেজরসহ প্রচুর জীবনহানি ঘটে। কালিহাতি ও গােরান-সাটিয়াচড়ার যুদ্ধে কাদের সিদ্দিকী সরাসরি অংশগ্রহণ করেননি। কিন্তু এই দুটি সংঘর্ষের কাছাকাছি থাকাতে তার প্রচুর অভিজ্ঞতা হয় যুদ্ধ সম্পর্কে। এই অভিজ্ঞতাকেই ভরসা করে তিনি ১৯৭১ সালের ২১শে এপ্রিল বের হন সংগঠন গড়ে তােলার জন্য। কাঁধে একটি গুলীশূন্য কাটাগান নিয়ে পাহাড়ী এলাকার বহু জায়গা সফর করেন। অধিকাংশ সময়ে তিনি প্রায় একা একা বিভিন্ন স্থান সফর করেন। হঠাৎ করে কোন সময় হয়তাে দু’ একজন সাথী-সঙ্গী জুটে যেত। ঘুম নেই, খাওয়া নেই, বিশ্রাম নেই, জীবন বাজি রেখে তিনি সংগঠন করার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। এ সময় অনেকেই তাকে উপহাস করেছে। আবার অনেকে উৎসাহ দিয়েছে, সাহস দিয়েছে, সমর্থন দিয়েছে। কিন্তু তাদের সংখ্যা খুবই কম। ঠিক এমন সময় হানাদার বাহিনী ঘােষণা করে কাদের সিদ্দিকীকে জীবিত অথবা মৃত অবস্থায় ধরে দিতে পারলে এক লাখ টাকা পুরস্কার দেয়া হবে। বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী ঐ ঘােষণাকে পরােয়া না করে উল্কার বেগে ছুটে চলেছেন এক স্থান থেকে আর এক স্থানে। কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী গঠিত হচ্ছে-এ সংবাদ শুনে দলে ছাত্র, যুবক, শ্রমিক স্বাধীনতা সগ্রামে অংশগ্রহণের জন্যে এগিয়ে আসেন। সংগৃহীত হতে থাকে অস্ত্র । তিনি তা একে একে তুল দিতে লাগলেন তার দলের যােদ্ধাদের হাতে। দেখতে দেখতে কাদেরিয়া বাহিনী দেশের ভেতরে বিশাল এক বাহিনীতে পরিণত হয়। বাহিনীর প্রধান বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী পাকিস্তানী হানাদারদের কাছে হয়ে উঠেন আতঙ্ক ও শংকার প্রতিচ্ছবি, আর স্বাধীনতাকামী মানুষের কাছে হয়ে উঠেন অভয়দাতা ও ত্রাণকর্তা। বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে হানাদারদের সঙ্গে প্রথম যুদ্ধ সংগঠিত হয় ১৯৭১ সালের ২২শে মে কালিহাতি থানার চারান গ্রামে। এই যুদ্ধ প্রায় ৪০ মিনিট স্থায়ী হয়। যুদ্ধে ১৫ জন খান সেনা নিহত ও অনেক আহত হয়। কাদেরিয়া বাহিনীর পক্ষে কোন হতাহত হয়নি। এখানে দুজন গ্রামবাসী শহীদ হন। যুদ্ধে খান সেনারা পিছু হটে
৮২
সরে পড়ে। এই দিনের প্রথম যুদ্ধেই কাদেরিয়া বাহিনীর বিজয় ছিল গুরুত্বপূর্ণ। কারণ যুদ্ধে বিজয়ের ফলে সাধারণ মানুষের মনে ব্যাপক সমর্থন জাগে এবং যােদ্ধাদের মনেও ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা বাড়ে। চারান যুদ্ধের পর কাদেরিয়া বাহিনী পর্যায় ক্রমে আরাে শক্তিশালী হতে থাকে এবং একের পর এক বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন যুদ্ধে পাক বাহিনীকে ব্যাপক আঘাত হানে। দিনের পর দিন কাদেরিয়া বাহিনীর আঘাতের প্রচণ্ডতা যতই বাড়তে থাকে পাক-হানাদার বাহিনীর মনে এই বাহিনী সম্পর্কে ভীতির পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। কাদেরিয়া বাহিনীর সকল যুদ্ধের মধ্যে সবচেয়ে কৃতিত্বপূর্ণ যুদ্ধ ছিল মাটিকাটার জাহাজমারা। মাটিকাটার জাহাজমারার যুদ্ধ শুধুমাত্র কাদেরিয়া বাহিনীরই নয়, সমগ্র দেশের সমস্ত যুদ্ধের মধ্যে ছিল একটি ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ। যুদ্ধে পাকিস্তানী সৈন্যদের যেমনি ব্যাপক ক্ষতি হয় তেমনি কাদেরিয়া বাহিনীর সৈন্যদের প্রচুর লাভ হয়। কারণ জাহাজে প্রায় ২১ কোটি টাকার অস্ত্রশস্ত্র ছিল যা সবই খােয়া যায় হানাদারদের নিকট হতে। আর খােয়া যাওয়া অধিকাংশ অস্ত্রই কাদেরিয়া বাহিনীর হাতে চলে আসে। এই অস্ত্র কাদেরিয়া বাহিনীর হাতে চলে আসতে কাদেরিয়া বাহিনীর ব্যাপক শক্তিশালী হয়। হানাদারদের হাতের অস্ত্র পাওয়ার পর কাদেরিয়া বাহিনীর জোয়ানরা কয়েকগুণ উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে হানাদারদের ওপর বিভিন্ন স্থানে ঝাপিয়ে পড়ে। কাদেরিয়া বাহিনীর আক্রমণে এক সময় পাক বাহিনীর সৈন্যরা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। কাদেরিয়া বাহিনীকে হানাদার বাহিনী তাদের যমদূত মনে করতাে। কাদেরিয়া বাহিনী আরাে বেশ কয়েকটি ভয়াবহ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। এসব যুদ্ধের মধ্যে ছিল পাথরঘাটার যুদ্ধ, মাকড়াই যুদ্ধ, ধলাপাড়া যুদ্ধ, কামটার যুদ্ধ ! টাঙ্গাইল জেলার বিভিন্ন থানাসহ জেলা সদর মুক্ত করার কৃতিত্ব কাদেরিয়া বাহিনীর। এই বাহিনীর সদস্যরা টাঙ্গাইল শহর মুক্ত করার পর রাজধানী ঢাকাকে মুক্ত করার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ভারতীয় সমর বিদদের পরিকল্পনা ছিল আখাউড়া-আশুগঞ্জ ভৈরব হয়ে রাজধানী ঢাকা মুক্ত করার। এই পরিকল্পনার উপর ভিত্তি করেই মিত্র বাহিনী ভারী অস্ত্রশস্ত্র সহ এদিক দিয়ে ঢাকা আক্রমণের জন্য অগ্রসর হয়। কিন্তু পাক হানাদার বাহিনীর প্রচণ্ড বাধার কারণে মিত্র বাহিনীর এই পথে ঢাকা দখল করা সম্ভব হয়নি। অপরদিকে কাদেরিয়া বাহিনীর বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধের ফলে তারা জামালপুর এবং ময়মনসিংহ শহরের সামান্য দূর হতে ঢাকার অতি নিকট পর্যন্ত প্রায় শতাধিক মাইল ঢাকা রােড মুক্ত রাখতে সক্ষম হয়েছিল। যার জন্য ভারতীয় মিত্র বাহিনীকে জামালপুর ও ময়মনসিংহে যুদ্ধ করার পর ঢাকা পর্যন্ত আসতে কোন যুদ্ধ করতে হয়নি। কাদেরিয়া বাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণের কারণে ঢাকার অতি নিকট ৩০/৪০ মাইলের মধ্যে হানাদার বাহিনী অত্যন্ত ভীতি জনক অবস্থায় ছিল। কাদেরিয়া বাহিনীর কৃতিত্বপূর্ণ আরাে দুটি কাজ ছিল। তার একটি হল ভারতীয় মিত্র সৈন্যদের প্যারাসুট দিয়ে সৈন্য নামানাের জন্য একটি মুক্ত এলাকা তৈরি করা। কাদেরিয়া বাহিনীর সদস্যরা এ কাজটি অত্যন্ত সফলভাবে করে। তারা টাঙ্গাইল শহরের অতি নিকটেই পুংলি নামক স্থানে মিত্র সৈন্যদের নামার ক্ষেত্র তৈরী করে এবং এখানে ১৯৭১ সালের ১১ই ডিসেম্বর ভারতীয় মিত্র সৈন্যরা উড়ােজাহাজ দিয়ে প্যারাসুট থেকে নামে। অন্য আরাে একটি কঠিন কাজ করে কাদেরিয়া বাহিনীর প্রধান বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী। তা হলাে ভরতীয় বাহিনীর এ দেশে প্রবেশ করার যুদ্ধ পথ মাফিক মানচিত্র তৈরি করে দেয়া। যুদ্ধ পরিচালনার জন্য মানচিত্র একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই মানচিত্রের ওপর ভিত্তি করেই ভারতীয় সৈন্যরা তাদের বিমান বহর নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। ১৯৭১ সালের ১১ই ডিসেম্বর টাঙ্গাইল মুক্ত করার পর ১২ই ডিসেম্বর ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে যৌথভাবে কাদেরিয়া বাহিনী ঢাকা অভিযানে অংশগ্রহণ করে। ঢাকা টাঙ্গাইল রােড ছিল অত্যন্ত বিপজ্জনক। কারণ রােডের বহু স্থানে মাইন পুতে রাখা হয়েছিল কাদেরিয়া বাহিনী
৮৩
পক্ষ হতে। যাতে করে হানাদাররা ঢাকা যাবার পথে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেই মাইন উদ্ধার করে রােড পরিষ্কার করার দায়িত্ব কাদেরিয়া বাহিনী গ্রহণ করে এবং দ্রুতগতিতে মাইন সরিয়ে রােড পরিষ্কার করে। রােড পরিষ্কার হবার পর যৌথবাহিনীর ঢাকার অতি নিকট পর্যন্ত আসতে কোন বেগ পেতে হয়নি। কাদেরিয়া বাহিনী আরাে একটি প্রশংসনীয় কাজ করে। সেটা হলাে ভারতীয় বাহিনীর পাঁচ হাজার সৈন্যের একদিনের খাবার ব্যবস্থা করা। ভারতীয় সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা জেনারেল নাগরাসহ অন্যরাও কাদেরিয়া বাহিনীর কাজের প্রশংসা করেন। তারা যুদ্ধের বিভিন্ন কৌশল নিয়ে কাদেরিয়া বাহিনীর সঙ্গে পরামর্শ করতেন। কাদেরিয়া বাহিনীর প্রধান বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকীর কৌশল অবলম্বন করেই ভারতীয় বাহিনী ঢাকা মুক্ত করে। ঢাকা মুক্ত করার সময় কাদের সিদ্দিকী উপস্থিত ছিলেন। কাদেরিয়া বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী দেশের ভেতর অবস্থান করে এই বাহিনী প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি তার বাহিনীর জন্যে বলা চলে মুজিবনগর সরকারের তেমন কোন প্রকার সাহায্য নেননি। আগস্ট মাসের শেষের দিকে প্রবাসী সরকার সামান্য কিছু সাহায্য পাঠান। যা ছিল কাদেরিয়া বাহিনীর জন্য অতি সামান্য। এই বিশাল বাহিনী বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকীর একক প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠে এবং পরিচালিত হয়। এই বাহিনীকে একটি নিয়মিত বাহিনীর মত করে গড়ে তুলেন বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী। নিয়মিত সেনা বাহিনীর মত সব নিয়ম কানুন চালু ছিল এই বাহিনীতে যা কঠোরভাবে পালন করার ব্যবস্থা ছিল। কাদেরিয়া বাহিনীকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য কয়েকটি প্রশাসনিক ভাগে ভাগ করা হয়েছিল। যেমন সামরিক বিভাগ, বেসামরিক বিভাগ, বেতার বিভাগ, টেলিফোন বিভাগ, যােগাযােগ বিভাগ, জনসংযােগ বিভাগ, বিচার ও কারিগরি বিভাগ, খাদ্য ও স্বাস্থ্য বিভাগ, চিকিৎসা বিভাগ, প্রতিরক্ষা বিভাগ। কাদেরিয়া বাহিনীর শুধু মাত্র বিমান ছাড়া প্রায় সকল প্রকার আধুনিক যুদ্ধের উপকরণ ছিল। এই বাহিনীতে যেমন ব্যাপক পরিমানে যুদ্ধের অস্ত্রশস্ত্র ছিল তেমনি যােদ্ধাদের মনােভাবকে সতেজ রাখার জন্যে রনাঙ্গণ নামে একটি মুখপত্র প্রকাশ করা হতাে নিয়মিতভাবে। এছাড়া নিয়মিত জনসভা, আলােচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হত। কাদেরিয়া বাহিনীর প্রতিষ্ঠাকাল হতে অস্ত্র হস্তান্তরের দিন পর্যন্ত যে সমস্ত ব্যক্তিরা সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন তাদের সবার নাম উল্লেখ করা সম্ভব নয়। নেতৃস্থানীয়দের মধ্যে ছিলেন কোম্পানী কমান্ডার ও সহকারী কোম্পানী কমান্ডার বৃন্দ। এদের মধ্যে ছিলেন ব্রিগেডিয়ার ফজলুর রহমান, মানিরুল ইসলাম, শওকত মােমেন, শাহজাহান, লােকমান হােসেন, হাবিবুর রহমান, আব্দুল গফুর, লবিবুর রহমান, আব্দুস ছবুর খান, সরােয়ার, হুমায়ুন বাঙ্গাল, আব্দুল খালেক, সাইদুর রহমান, আনােয়ার হােসেন, বকুল, ফজলুল হক, খােরশেদ আলম, ইদ্রিস, নবী নেওয়াজ, আফসার উদ্দিন, হাবিবুল হক খান বেনু, মােকাদ্দেছ, ইউনুস, আরজু, হবি, বায়জিদ, চান মিঞা, মােহাম্মদ আলী, মাইনুদ্দিন, রেজাউল করীম, ফেরদৌস আলম রঞ্জু, এন এ খান আজাদ, লুঙ্কর রহমান, হাকিম, হাবিব, আনিছুর রহমান ও লুৎফর রহমান প্রমুখ উল্লেখযােগ্য। কাদেরিয়া বাহিনীর বেসামরিক দপ্তরে যারা নেতৃত্ব দিতেন তারা হলেন বেসামরিক প্রধান আনােয়ার আলম শহীদ, হামিদুল হক, আমজাদ মাস্টার, ফারুক, মাহবুবু সাদিক, মাহবুব হাসান, আলী আজগর খান দাউদ, সােহরাব আলী খান আরজু, সােহরাওয়ার্দী, রাঙ্গা, খলিলুর রহমান, আব্দুর রাজ্জাক, সানু, আবদুল মান্নান, বর্মন, আবদুল্লাহ ও লাল মােহনের নাম উল্লেখযােগ্য।
৮৪
ভারতের সঙ্গে বা প্রবাসী সরকারের সঙ্গে বিশেষ সময় যােগাযােগ রক্ষা করতেন এবং বহু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে কাদেরিয়া বাহিনীর বিশেষ ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিলেন নূরুল ইসলাম ও নুরুন্নবী। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা তাদের দায়িত্ব পালন করতেন। টাঙ্গাইল শহরে যারা সবসময় হানাদারদের ভীতি সৃষ্টির জন্যে গ্রেনেড ও বােমা ফাটাতাে তারা হল বাকু, আবুল কালাম ও মিনু। বাকু মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন। কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে যারা সর্বদা থাকতেন তাদের মধ্যে ছিলেন আব্দুস ছবুর খান, সাইদুর রহমান, মকবুল হােসেন খােকা, রজু, দুলাল, আবদুল্লাহ, ফজলু, আবদুল হাকিম, শামসু, আবদুল কুদ্দস, আমজাদ, কাশেম, মাসুদ, রফিক, জাহাঙ্গীর প্রমুখের নাম উল্লেখযােগ্য। এছাড়া পাকিস্তান হতে পলাতক সেনাবাহিনীর সদস্য গেরিলা রবিউল প্রায় সবসময় কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে থাকতেন। বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে সবসময় কয়েকজন সাংস্কৃতিক কর্মী ও কবি সাহিত্যিক থাকতেন। তাদের মধ্যে ছিলেন নাট্যকার মামুনুর রশীদ, কবি রফিক আজাদ, বিশিষ্ট ছাত্রনেতা ও প্রখ্যাত লেখক বুলবুল খান মাহবুব ও মাহবুব সাদিক। কাদেরিয়া বাহিনীর হাতে কয়েক হাজার খান সেনা ও রাজাকার নিহত হয়। এই বাহিনীর শহীদ যােদ্ধার সংখ্যা ৩১ জন। ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা সগ্রামে কাদেরিয়া বাহিনী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভূমিকা রাখে। যতদিন বাঙ্গালি ও বাঙ্গালি জাতি থাকবে ততদিন কাদেরিয়া বাহিনীর কৃতিত্বপূর্ণ ভূমিকা জাতি স্মরণ করবে।
পাকিনী হানাদার বাহিনীর অস্ত্র বোঝাই জাহাজ
কাদেরিয়া বাহিনীর দখলে
১৯৭১ সালের আগষ্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে পাকিস্তানী সামরিক জান্তা মুক্তিযোেদ্ধাদের চিরতরে ধ্বংস করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহণ করে। রংপুর, সৈয়দপুর, সহ উত্তর বঙ্গে সীমান্ত এলাকার বিভিন্ন স্থানে অস্ত্র সরবরাহ করার প্রয়ােজন দেখা দেওয়ায় তারা নারায়ণগঞ্জ থেকে খুব বড় রকমের অস্ত্রের চালান পাঠানাের সিদ্ধান্ত নেয়। অত্যন্ত গােপনে প্রস্তুতি গ্রহণ করে, যথেষ্ট নিরাপত্তার মধ্যে সকলের অজান্তে ছােট বড় ৭টি জাহাজে ২১ কোটি টাকার ভারী ও হালকা অস্ত্র, গােলাবারুদ এবং এক ব্যাটেলিয়ান সৈন্য তােলা হলাে। পাকহানাদার বাহিনীর ধারণা এই অস্ত্র উত্তর বঙ্গের সীমান্ত এলাকায় পাঠাতে পারলে উত্তর বঙ্গের মুক্তিযােদ্ধাদের ধ্বংস করা সহজ হবে। চারিদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে হানাদার বাহিনীর জাহাজ বহর উত্তর দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করে। যে ভাবে জাহাজ বহর এগিয়ে আসতে থাকে তাতে কোন ভাবেই খবর ফাঁস হওয়ার সম্ভবনা ছিলনা। সব কয়টি জাহাজের চারিদিকে বিভিন্ন আধুনিক মারাত্মক অস্ত্র তাক করে হানাদার সৈন্যরা অতন্দ্র প্রহরীর মত মােতায়েন থাকে। জাহাজ বহর ছােট বড় নদী অতিক্রম করে আসছে ধীরে ধীরে। কোন প্রয়ােজনে, কোন জাহাজ নদীর পাড়ে কোথাও নােঙ্গর করেনি। ১৯৭১ সালের ১২ আগস্ট জাহাজ বহরটি ধলেশ্বরী নদীর পাড়ে সিরাজকান্দি ঘাটে নােঙ্গর করে। জাহাজগুলির তিনটি আকারে ছিল বিরাট এবং দুইটি সযত্নে ত্রিপাল দিয়ে মােড়ানাে। জাহাজের বহর দেখে অনেকেই ভাবলেন হানাদার বাহিনী সম্ভবতঃ ভুয়াপুরে ব্যাপক হামলা চালানাের জন্য এসেছে। কিন্তু জাহাজের মধ্যে সৈন্যদের তৎপরতার অভাব দেখে অনেকে অনুমাণ করলেন ওদের গন্তব্য স্থান
৮৫
হয়ত অন্য কোথাও। এখানে হয়তাে বিশ্রামের জন্য নােঙ্গর করেছে। সিরাজকান্দি ঘাটে বিশাল জাহাজের বহর দেখে এলাকার মানুষ অনেকেই বাড়ী ঘর ছাড়তে শুরু করে। নদী পাহাড়া ও খোঁজ খবর রাখার দায়িত্ব ছিল কাদেরিয়া বাহিনীর বিশিষ্ট যােদ্ধা মেজর হাবিবের উপর। সে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ওদের উদ্দেশ্য যাই হােক তথ্য সম্প্রহের প্রয়ােজন। যদিও কাজটি রীতিমত দুঃসাহসিক। তবুও তথ্য সগ্রহ করতে হবে। কারণ কাদেরিয়া বাহিনীর প্রধান বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকীর পরিষ্কার নির্দেশ ওদের খতম করতে হবে। মেজর হাবিব ডাকলেন তার গেরিলা যােদ্ধাদের। তাকে সহযােগিতা করার জন্য এগিয়ে আসেন বেশ কয়েকজন কমাভাে যােদ্ধা। তাদের মধ্যে ছিল মােতাহার হােসেন, সিরাজুল হক, গােলাম নবী, সামাদ লামা, রেজাউল করিম, লুৎফর রহমান, ছােট ফজলু, জামশেদ আলী, জগতপুরা চরের আলী আকবর, ছালাম প্রমুখ। প্রথমে মেজর হাবিব, মােতাহার, জিয়াও জামশেদকে নিয়ে জেলের বেশে বের হন। তার পরনে ছিড়া লুঙ্গি মাথায় গামছা, কাধে ঝাঁকি জাল। অন্যান্যদের কাছেও মাছ ধরার যন্ত্রপাতি। জেলের বেশধারী মুক্তিযােদ্ধারা স্বাভাবিক ভাবে জাহাজের কাছে আসতেই তিন জন খান সেনা ও একজন পাক সমর্থক বাঙ্গালি সৈনিকের স্পিডবোেট নদীর পাড়ে এসে চমচম, খাসী মুরগীর খবরাখবর জিজ্ঞাসা করল। জেলের বেশধারী মুক্তিযােদ্ধারা পােড়া বাড়ীতে চমচম এবং সস্তায় খাসি মুরগী ভাল চাল অন্যান্য প্রয়ােজনীয় জিনিসপত্র পাওয়া যায় বলে হানাদারদের জানাল। কথার মাঝে বেশ কিছু তথ্য নিয়ে জেলেবেশী মেজর হাবিব ও তার সঙ্গীরা নিজেদের ক্যাম্পে ফিরে আসে। মেজর হাবিবের সহিত তথ্য যথেষ্ঠ নয়। আরাে তথ্যের প্রয়ােজন তাই মােতাহার হােসেন, জিয়া, ছােট ফজলু ও জামসেদকে আবার পাঠানাে হল। তারা স্থানীয় জনসাধারণের সঙ্গে যােগাযোেগ করল। মেজর হাবিব ইতিমধ্যে কয়েকটি স্থানে স্বেচ্ছাসেবক মােতায়েন করেন। তারা দেখে দুটি বড় বড় জাহাজ ও দুটি ছােট জাহাজ পাশাপাশি বাধা রয়েছে। জাহাজ ঘাটের কাছের বাসিন্দা মানিক মিয়া অনেক খবর জানালেন এবং প্রয়ােজন হলে তিনি আরও খবর জানাবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিলেন। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রচুর পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র ও গােলাবারুদের কোন জাহাজে কি আছে ইত্যাদি সমস্ত খবরই মুক্তিযােদ্ধারা সগ্রহ করতে সমর্থ হলাে। আরাে তথ্যের প্রয়ােজন তাই মােতাহার হােসেন, জিয়া, ছােট ফজলু ও জামসেদকে আবার পাঠান হল। তারা স্থানীয় জনসাধারণের সঙ্গে যােগাযােগ করল। খবরা-খবর সংগ্রহের পরে মেজর হাবিব দ্রুত আক্রমণে র জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। তিনি প্রস্তুতি হিসাবে সিরাজ কান্দি থেকে কিছুটা উত্তরে মাটিকাটা গ্রামের স্বেচ্ছাসেবকদের তৈরী হওয়ার নির্দেশ পাঠান। জামসেদ, মােতাহার মিয়া, ভােলার সঙ্গে পরামর্শ করে মেজর হাবিব বিভিন্ন স্থানে এমবুশ বসাবার ব্যবস্থা করেন। ১০ই আগস্ট রেজউল করিম একটি শক্তিশালী দল নিয়ে মাটিকাটা গ্রামে এসে অবস্থান নিলেন। ভূয়াপুরের চার পাশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আরও জোরদার করা হলাে। রাতের আধারে নদীর পাশের রাস্তা ধরে মেজর হাবিব দুশমনদের অবস্থানের কাছে গিয়ে তাদের গতিবিধি লক্ষ্য করেন। ১১ই আগষ্ট সকালে মেজর হাবিব আবার কিছু দুর পিছিয়ে আসেন। একটু পরে একজন স্বেচ্ছাসেবক দৌড়ে এসে জানায় জাহাজ গুলি উত্তরদিকে যাত্রা শুরু করেছে। সংবাদ পেয়ে মেজর হাবিব মুক্তিযোেদ্ধাদের তাড়াতাড়ি যার যার অবস্থানে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দিলেন। প্রতিটি মুহূর্তে মুক্তিযােদ্ধারা অসীম ধৈর্য, সাহস ও দৃঢ়তা নিয়ে নিজ নিজ অবস্থানে আত্মগােপন করে সুযােগের অপেক্ষায় থাকে। সকাল ৯ টায় দেখলেন জাহাজগুলি আর অগ্রসর হচ্ছে না। জাহাজগুলি অগ্রসর না হলেও হঠাত দেখা গেল ছােট একটি জাহাজ পানি মাপতে মাপতে উত্তরে সিরাজ গঞ্জের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এর একটু পরেই আবার দেখা যায় বড় জাহাজ বহরও ধীরে ধীরে উত্তর দিকে অগ্রসর হচ্ছে। মেজর হাবিব উত্তর-দক্ষিণ দিকের মুক্তিযােদ্ধাদের নির্দেশ দিলেন ‘অবস্থানে দৃঢ়ভাবে বসে থাক কেউ উত্তেজিত হবেনা। শক্রর শক্তি আমাদের চেয়ে অনেক
৮৬
বেশী। ঠান্ডা মাথায় বুদ্ধি খাটিয়ে ওদের খতম করতে হবে। আমি গুলি ছােড়ার সঙ্গে সঙ্গে তােমরা এক সঙ্গে শত্রুর উপর মরণাঘাত হানবে।’ সকালে রীতিমত নির্দেশ দিয়ে কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে সে বুকে হেঁটে কিছুটা এগিয়ে গেল। তাদের কাছে দুটি এল এম জি, একটি দুই ইঞ্চি মর্টার ও কয়েকটি চাইনিজ ও বৃটিশ রাইফেল। দলের অন্যান্যদের কাছে চারটি বৃটিশ এল, এম, জি, দুটি দুই ইঞ্চি মর্টার ও একটি বৃটিশ রকেট লাঞ্চার। ১২ই আগষ্ট বেলা এগারটায় হানাদারদের জাহাজগুলি আবার এগিয়ে চলল। মুক্তিযােদ্ধাদের সামনে দিয়ে অতিক্রম করল ছােট আকারের দুটি জাহাজ। মুক্তি যােদ্ধারা যে পাড়ে অবস্থান নিয়েছে জাহাজ বহরও ঠিক সেই পাড় ঘেষে এগিয়ে যাচ্ছে। কারণ পূর্ব পাড়ে পানির গভীরতা বেশী। মাঝখানে অনেকটা জায়গা জুড়ে চর আর চর। দুটি জাহাজ চলে গেল কিন্তু মেজর হাবিব কোন নির্দেশ দিলেন না । এবার কাছাকাছি এলাে ত্রিপল দিয়ে মােড়ানাে বিশাল দুটি জাহাজ। একটি এস, ইউ ইঞ্জিনিয়ার্স এল. সি. ও আর অন্যটি এসটি রাজন। জাহাজ দুটির দুপাশে দুটি মেশিন গান নিয়ে খান সেনারা বসে আছে। জাহাজ দুটি মুক্তিযােদ্ধাদের গুলির আওতায় আসতেই মেজর হাবিবের এল. এম. জি. গর্জে উঠে। সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য মুক্তি যােদ্ধাদের মর্টার, এল. এম. জি ও রাইফেল থেকে প্রচণ্ডবেগে গুলি বর্ষণ শুরু হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের এম.এ. শেষ বর্ষের ছাত্র রেজাউল করিম অব্যর্থ নিশানায় পর পর দশ বারটি দুই ইঞ্চি মর্টারের গােলা বর্ষণ করে । ডান পাশ থেকে মঞ্জু পনের বিশটি রকেট সেল নিক্ষেপ করে। রকেট সেলের আঘাতে জাহাজের সারেংদের কেবিন ও নীচতালায় খান সেনাদের অবস্থান ঝাঝড়া হয়ে পড়ে। মুক্তিযােদ্ধদের প্রচণ্ড আঘাতে জাহাজের হানাদারদের অফিসার চিৎকার করে উঠে, শত্রুরা কামান দাগছে। তােমরা তাড়াতাড়ি সরে পড়, জাহাজে আগুন ধরে যেতে পারে। আক্রান্ত জাহাজ দুটিকে অন্য কোন জাহাজ আর সাহায্য না করে যার যার মত তাড়াতাড়ি পালাতে চেষ্টা করে। আক্রান্ত জাহাজ দুটি গােলার আঘাতে তেমন ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থান থেকে পাঁচ ছয়শ গজ দুরে পশ্চিম দিকে নদীর বুকে বালুর চরে আটকে পড়ে। চৌদ্দ পনের জন হানাদার সৈন্য গােলার সঙ্গে সঙ্গেই মৃত্যু বরণ করে। বাকীরা জাহাজে একটু দেরি না করে তিন চারটি ছােট ছােট স্পীড বাের্ট নিয়ে জাহাজের পশ্চিম দিকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। সকল হানাদার জাহাজ থেকে পালিয়ে যেতে পারলেও জাহাজে দুইজন নাবিক ছাদের উপর দাঁড়িয়ে বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করে নদীতে ঝাপিয়ে পড়ে। এরপর আরাে একজন বাচাও বাঁচাও বলে জোরে চীৎকার দিয়ে নদীতে পড়ে যায়। মুক্তিযােদ্ধারা তখন গােলা-গুলি বন্ধ করে দিয়েছে। জাহাজের দিক থেকেও কোন গােলা গুলি আসছেনা। মেজর হাবিব নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়াদের তােলার জন্য মাটিকাটার স্বেচ্ছাসেবক কমাণ্ডার হাসানকে নির্দেশ দেন। হাসান একটি ছােট নৌকা নিয়ে জাহাজের প্রায় দুই মাইল ভাটি থেকে তাদের তুলে নিয়ে আসে। পানি থেকে তােলার পর ওদের প্রাথমিক চিকিৎসা করে সুস্থ করে তোেলা হয়। সুস্থ হওয়ার পর ওরা জানায় গােলার আঘাতে সারেংয়ের কেবিন ভেঙ্গে গেছে এবং পনের বিশজন হানাদার সৈন্য নিহত হয়েছে। জাহাজে একজন হানাদার সৈন্যও নেই। প্রায় এক কোম্পানী সৈন্য ছিল ঐ জাহাজে, কিন্তু তারা নিহতদের রেখে পালিয়ে গেছে। তারা আরাে জানায় জাহাজে অনেক গােলাবারুদ ও অস্ত্র শস্ত্র আছে। এই সব অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে ফুলছড়িঘাটে নামিয়ে রংপুর, সৈয়দ পুর, সহ উত্তর বঙ্গের বিভিন্ন সীমান্তে এলাকায় নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। সব শেষে সারেং বলেন আপনারা
৮৭
তাড়াতাড়ি জাহাজে গিয়ে মাল খালাস করুন। ওরা সিরাজগঞ্জ টাঙ্গাইল ও ঢাকায় সাহায্য চেয়ে বারবার বেতার বার্তা পাঠাতে চেষ্টা করেছে । পিছনের জাহাজগুলি তাে একটু পরেই ওদের ঘাঁটিতে আক্রমণের খবর পৌছে দিবে। সারেংয়ের কথা শুনার পর তাকে সঙ্গে নিয়ে জামশেদ, জিয়া ও সামাদ গামা একটি ছােট নৌকায় উঠে জাহাজের নিকট যায়। তারা জাহাজের উপর উঠে দেখে জাহাজের ভিতরে বেশ কিছু হানাদারদের মৃতদেহ পড়ে আছে। মুক্তিযােদ্ধাদের জাহাজের যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চারদিক থেকে বহু লােক এসে জাহাজে উঠতে শুরু করে। জাহাজে ভর্তি অস্ত্রশস্ত্র দেখে মুক্তিযােদ্ধা ও সাধারণ মানুষ অবাক হয়ে যায়। জাহাজে প্রচুর বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র শস্ত্র আর গােলা বারুদ। জাহাজ দখলের এক ঘন্টার মধ্যে জাহাজের মালামাল খালাস করা শুরু হয়ে যায়। বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনার সঙ্গে মুক্তিযােদ্ধা ও স্বেচ্ছাসেবকরা বাক্সের পর বাক্স নামিয়ে নিচ্ছে। মেজর হাবিব জাহাজের এমাথা থেকে ওমাথা, একতলা থেকে দোতলা, দোতলা থেকে তেতলা, দৌড়া দৌড়ি করে সব কিছু তদারকি করেছে। ছয় ঘন্টা ধরে অস্ত্র ও গােলা বারুদের বাক্স খালাস করা হয়। তবুও জাহাজের পুরাে মালামাল নামানাে সম্ভব হলাে না। প্রায় ষাট ভাগ অস্ত্র ও গােলাবারুদ জাহাজে রয়ে গেল।
মেজর হাবিব রাত দশটার সময় জাহাজে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। আগুন ধরিয়ে দেওয়ার পর জাহাজের অবশিষ্ট অস্ত্র শস্ত্র ও গােলাবারুদ প্রচণ্ড শব্দে ফাটতে লাগল। জাহাজের লগবুক ও মুভমেন্ট কভারের হিসাবে জাহাজে একলক্ষ বিশ হাজার বাক্সে ২১ কোটি টাকার নানা ধরনের চাইনিজ, বৃটিশ ও আমেরিকান অস্ত্র শস্ত্র ছিল। জাহাজের নেতৃত্বে ছিল ক্যাপ্টেন আমানুল্লাহ ও লেঃ আতাউল্লাহ। ক্যাপ্টেন আমানুল্লাহ প্রাণে বেঁচে গেলেও সহকারী কমান্ডার আতাউল্লাহ ও সুবেদার রহিম খান মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণে মারা যায়। মাটিকাটার যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধাদের তিনজন শহীদ ও সাতজন আহত হয়। জাহাজ ধ্বংস ও দখল করার পরদিন ১৩ই আগষ্ট পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী চার দিক থেকে ভূয়াপুর আক্রমণ করে। হানাদার বাহিনীর ৪৭তম ব্রিগেড দাক্ষিণ দিক থেকে এলেঙ্গা ও পালিমা হয়ে, ৫১ কমান্ডাে ব্রিগেড কাছাকাছি এলাকা দিয়ে এগিয়ে আসে। ঘাটাইল, কালিহাতী এবং গােপালপুর থেকে নদী পথ ধরে আর একটি দল ভূয়াপুরের দিকে আক্রমণ পরিচালনা করে। সিরাজগঞ্জ থেকে হানাদার বাহিনী নদী পথে মাটি কাটায় আক্রমণ করলে মেজর হাবিব ও গফুর কোম্পানী তা প্রতিহত করেন। কালিহাতী থেকে নদী পথে আসা হানাদার বাহিনীর দলটিকে নূরুল ইসলামের কোম্পানী প্রতিহত করে। গােপালপুর থেকে অগ্রসর হওয়ার পথে হুমায়ুন কোম্পানী প্রচণ্ড বাধা দেয়। এলেঙ্গা ভূয়াপুর পথে এগিয়ে আসা হানাদারদের দলটিকে প্রতিহত করে কাদেরিয়া বাহিনীর সদস্যরা। বিভিন্ন ভাবে হানাদার বাহিনী যখন ভূয়াপুরে প্রবেশ করতে পারলােনা তখন আকাশ পথে প্রচণ্ড বেগে আক্রমণ চালায়। অপর দিকে সিরাজগঞ্জ থেকে দূর পাল্লার কামান দিয়ে গােলা বর্ষণ করতে থাকে। এ সময় ভূয়াপুরে কাদেরিয়া বাহিনীর উপর হানাদার বাহিনীর আক্রমণে নেতৃত্ব দেন লেঃ জেনারেল নিয়াজী। হানাদার বাহিনীর বিমান আক্রমণের মুখে কাদেরিয়া বাহিনীর পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব হলাে না। হানাদারদের প্রচণ্ড আক্রমণের চাপে কাদেরিয়া বাহিনী সাময়িক সময়ের জন্য পিছনে সরে পড়তে বাধ্য হন।
৮৮
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের ভয়াবহ এবং গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধগুলির মধ্যে মাটিকাটার জাহাজ দখল করা ছিল অন্যতম। মাটি কাটার জাহাজ দখল যুদ্ধ বিশেষ স্মরণীয় এবং গুরুত্বের দাবীদার। কারণ এই যুদ্ধে হানাদার বাহিনী সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অন্যদিকে এই যুদ্ধে যে প্রচুর পরিমাণ অস্ত্র শস্ত্র কাদেরিয়া বাহিনীর দখলে আসে তা এই বাহিনীকে শতগুণ শক্তিশালী করে তুলে।
কাদেরিয়া বাহিনীর আঁড়াশী আক্রমণ ও
হানাদার মুক্ত টাঙ্গাইল
১৯৭১ সাল। ৩রা এপ্রিল শনিবার। দিনটি টাঙ্গাইলের জন্য একটি বিভীষিকাময় দিন। এই দিনই পাকহানাদার বাহিনী টাঙ্গাইল দখল করে। টাঙ্গাইলের বিপ্লবী মুক্তিযােদ্ধারা হানাদারদের সহজে টাঙ্গাইল প্রবেশ করতে দেয়নি। টাঙ্গাইল জেলা সদর থেকে ১২ মাইল দক্ষিণে গােরান সাটিয়াচড়া নামক গ্রামে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে হানাদারদের প্রতিরােধ করার জন্য আক্রমণ করে। এ আক্রমণে যদিও মুক্তিযােদ্ধারা শেষ পর্যন্ত টিকতে পারেনি তবু প্রায় তিনশ জনের মত পাকহানাদারকে হত্যা করে এবং শতাধিক হানাদার আহত হয়। অপরদিকে মুক্তিযােদ্ধাদের পক্ষে ইপিআরের হাবিলদার খালেকসহ প্রায় ২০/২৫ জন শহীদ এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়। এখানে দুই পক্ষের গুলিতে কয়েকশ সাধারণ মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে। যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধারা পিছু হটলে হানাদার জল্লাদরা ক্ষিপ্রগতিতে টাঙ্গাইল জেলা শহরের দিকে এগিয়ে আসে। আসার সময় গােড়ান সাটিয়াচড়া থেকে টাঙ্গাইল শহর পর্যন্ত ১২ মাইল রাস্তার দুই ধারের সমস্ত গ্রাম আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয় এবং সামনে নারী, পুরুষ, বৃদ্ধ, শিশু যাকে পেয়েছে তাকেই গুলি করে এবং বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করে। টাঙ্গাইলে প্রবেশ করেই বহু বাড়িতে অগ্নি সংযােগ করে এবং বহু লােককে গুলি করে হত্যা করে। এই দিন হত্যা করে টাঙ্গাইল শহরের ছাত্র নেতা সানােয়ার হােসেন অনুকে ও তার পিতা সাহাব উদ্দিনকে এবং আব্দুল কুদ্সসহ আরাে অনেককে। পাকবাহিনী টাঙ্গাইল প্রবেশ করেই পরদিন অগ্রসর হয় টাঙ্গাইলের দক্ষিণে নাগরপুরের দিকে এবং যাবার পথে এলাসিন নামক স্থানে চালায় এক হত্যাযজ্ঞ। এইদিন এখানে হত্যা করে প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ জোগেন বাবু সহ প্রায় ১০ জন বাঙ্গালি সন্তানকে। আর অগ্নিসংযােগ করে শতশত বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। এমনিভাবেই হানাদার দস্যুরা টাঙ্গাইল জেলার বিভিন্ন স্থানে ব্যাপকভাবে হত্যা, অগ্নিসংযােগ, নারী নির্যাতন ও লুটতরাজ চালায়। জল্লাদদের হাত থেকে নারী, পুরুষ, বৃদ্ধ এমনকি কোলের শিশু পর্যন্ত রেহাই পায়নি। পাক হানাদারদের টাঙ্গাইলের হত্যাকান্ড হার মানিয়েছে মধ্য যুগের চেঙ্গিস খা, হালাকু খা, তৈমুর জংঘের হত্যাযজ্ঞকে। স্নান করে দিয়েছে আধুনিক যুগের হিটলার, মুসােলিনী, চিয়াংকাইশেকের হত্যাকান্ডকে, ভিয়েতনামের মাহলাই আর পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকান্ডকে। টাঙ্গাইলের দামাল সন্তানরা কিছু দিনের মধ্যেই গড়ে তুলে এক বিশাল মুক্তিবাহিনী। এই বাহিনী আব্দুল কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে গঠিত হয় বলে কাদেরিয়া বাহিনী নামে পরিচিতি লাভ করে। কাদেরিয়া বাহিনীর প্রধান আব্দুল কাদের সিদ্দিকী সুদক্ষ ও যােগ্য নেতৃত্ব এবং অসম সাহসিকতার জন্য বঙ্গবীর এবং বাঘা সিদ্দিকী হিসাবে খ্যাতি লাভ করেন। কাদেরিয়া বাহিনীর উপর্যপুরি গেরিলা আক্রমণে হানাদার জল্লাদদের প্রচুর জীবনহানি ঘটে। জল্লাদবাহিনী কাদেরিয়া বাহিনীকে যমদূতের
৮৯
মত ভয় পেত। কাদেরিয়া বাহিনী জুলাই মাসের প্রথম থেকেই হানাদারদের উপর গেরিলা আক্রমণ প্রচণ্ডভাবে বৃদ্ধি করে, যার জন্য হানাদারদের বিচরণ অনেকটা কমে আসে। বিশেষ করে ১২ই আগস্ট মঙ্গলবার যমুনা নদীতে পাকহানাদারদের অস্ত্র বােঝাই বিশাল জাহাজ বহর আক্রমণ ও দখল করে। এ আক্রমণে হানাদারদের প্রায় ৩০/৪০ জনকে জীবন দিতে হয় এবং প্রায় ২১ কোটি টাকার অস্ত্রশস্ত্র ক্ষতিগ্রস্থ হয়। অধিকাংশ অস্ত্রশস্ত্রই কাদেরিয়া বাহিনীর দখলে চলে আসে। এই সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র মূলত মার্কিন ও চীনের তৈরি আধুনিক মারণাস্ত্র ছিল। হানাদারদের অস্ত্র হাতে আসার পর কাদেরিয়া বাহিনী আরাে ব্যাপক শক্তিশালী হয়ে উঠে। এই সময় কাদেরিয়া বাহিনী এবং বাহিনীর প্রধান আব্দুল কাদের সিদ্দিকীর নাম শােনামাত্র হানাদারদের কাপুনি উঠে যেত। অক্টোবর মাসের প্রথমে পাক হানাদার বাহিনী তাদের মনােবল হারিয়ে ফেলে। কারণ, কাদেরিয়া বাহিনীর সাথে প্রতিটি যুদ্ধে দিনের পর দিন মার খেতে খেতে তাদের বিপুলসংখ্যক জীবনহানি ঘটে। অন্যদিকে তাদের প্রচুর অস্ত্রও কাদেরিয়া বাহিনীর হাতে চলে যায়। এমনিভাবে পাক হানাদাররা দিনের পর দিন দুর্বল হতে থাকে, অপরদিকে কাদেরিয়া বাহিনী শক্তি অর্জন করতে থাকে। কাদেরিয়া বাহিনী নভেম্বর মাসের শেষ দিকে ব্যাপক শক্তিশালী হয়। এই সময় কাদেরিয়া বাহিনীতে প্রায় ১৭ হাজার সশস্ত্র যােদ্ধা, ৭০ হাজার স্বেচ্ছাসেবক কর্মী এবং বিপুল পরিমাণ অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র সংগৃহীত হয়। এসময় কাদেরিয়া বাহিনী হানাদারদের শক্তি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয়। তারা জানতে পারে যুদ্ধ করার মত তেমন সাহস বা শক্তি হানাদারদের নেই। ৬ই ডিসেম্বর সােমবার ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ায় কাদেরিয়া বাহিনীর মনােবল কয়েকগুণ বৃদ্ধি পায়। কাদেরিয়া বাহিনীর প্রধান আব্দুল কাদের সিদ্দিকী ৬ই ডিসেম্বর সােমবার ভারত কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের খবর পাবার সঙ্গে সঙ্গে তার বাহিনীর সদস্যদের জরুরী ভিত্তিতে ডাকেন। ৭ই ডিসেম্বর মঙ্গলবার বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী তার বাহিনীর কমান্ডারদের নিয়ে এক সভা করেন টাঙ্গাইল জেলার ভূয়াপুর থানার নিকরাইল নামক এক গ্রামে। এখান থেকেই ৫ হাজার মুক্তিযােদ্ধাকে ত্রিশটি কোম্পানীতে বিভক্ত করে টাঙ্গাইলের বিভিন্ন থানাতে এবং জেলা সদরে চরম আক্রমণ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। ত্রিশটি কোম্পানীকে পাঁচটি মূল দলে ভাগ করে একেক দলের একেক দিকে অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দেয়া হয়। ৫টি দলের প্রধান ছিলেন যে পাঁচজন তারা হলেন (১) মেজর হাবিবুর রহমান, (২) মেজর আব্দুল হাকিম, (৩) মেজর আনিছুর রহমান, (৪) ক্যাপ্টেন আব্দুস ছবুর খান, (৫) ফজলুল হক ও গােলাম মােস্তফা। মেজর হাবিবুর রহমান দায়িত্ব নিলেন টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ পাকা সড়ক দখল করবার, মেজর হাকিম ঘাটাইল থানা, মেজর আনিছ বাহাদুরাবাদ ও জগন্নাথগঞ্জঘাট এবং বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী নিজে গােপালপুর থানা দখল করার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ক্যাপ্টেন ফজলুর রহমান, মেজর মঈনুদ্দিন, ক্যাপ্টেন নিয়ত আলী, মেজর লােকমান হােসেন, মেজর মােকাদ্দেস আলী ও মেজর মতিয়ার রহমান টাঙ্গাইল শহরের আশেপাশে অবস্থান গ্রহণ ও আক্রমণ করার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। টাঙ্গাইল শহর থেকে ঢাকা সড়কে বিভিন্ন স্থানে হানাদারদের উপর আক্রমণের দায়িত্ব নেন ক্যাপ্টেন শামছুল হক, ক্যাপ্টেন সুলেমান, ক্যাপ্টেন গাজী লুঙ্কর রহমান, ক্যাপ্টেন আলম, ক্যাপ্টেন আজাদ কামাল এবং ক্যাপ্টেন সুলতান। দায়িত্ব বন্টন করার পর বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী দুই হাজার মুক্তিযােদ্ধার বিশাল দলটি নিয়ে ৮ই ডিসেম্বর গােপালপুর থানা আক্রমণের জন্য অগ্রসর হন। মেজর আনিছ তার দল নিয়ে বাহাদুরাবাদ ও জগন্নাথগঞ্জ আক্রমণের জন্য অগ্রসর হন। ইতিমধ্যে জামালপুর থেকে ভারতীয় মিত্র
৯০
বাহিনীর প্রধান আব্দুল কাদের সিদ্দিকীর কাছে সাহায্য চেয়ে সংবাদ পাঠান। কারণ কয়েক দিন যাবৎ জামালপুরে মিত্র বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর যৌথ আক্রমণে হানাদারদের পরাজিত করা সম্ভব হচ্ছিল না । কাজেই কাদেরিয়া বাহিনীকে দক্ষিণ দিক থেকে জামালপুর আক্রমণের জন্য সাহায্য চাওয়া হয়। বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকীও সংবাদ পাওয়া মাত্র জামালপুরের দিকে অগ্রসর হন। মেজর আনিছকেও তার বাহিনী নিয়ে জামালপুরের দিকে অগ্রসর হতে বলা হয়। কাদের সিদ্দিকী তার বাহিনী নিয়ে ৮ই ডিসেম্বর ভােরে জামালপুরের দিকে অগ্রসর হন। এখান থেকে কাদের সিদ্দিকী আনিছের বাহিনীসহ মধুপুরের দিকে অগ্রসর হয়। কিছুদুর আসার পর মেজর আনিছের দলটি দুইটি ভাগে বিভক্ত হয়ে এক দল মধুপুরে, আর এক দল গােপালপুর আক্রমণের জন্য অগ্রসর হয়। ৯ই ডিসেম্বর সন্ধ্যায় আনিছের বাহিনীর নিকট মধুপুর হানাদারদের পতন ঘটে। কিন্তু আনিছের অপর বাহিনী গােপালপুরে দীর্ঘ সময় যুদ্ধ করেও হানাদারদের পরাজিত করতে ব্যর্থ হয়। বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী তার বাহিনী নিয়ে এসময়ে ঘাটাইল দখল করার জন্য মেজর হাকিমের দলের সাথে একত্রিত হন। মেজর হাবিব এবং মেজর মােস্তফাকে দুই দিক থেকে ঘাটাইল থানা আক্রমণের জন্য কাদের সিদ্দিকী নির্দেশ দেন। কাদের সিদ্দিকীর নির্দেশ মােতাবেক মেজর মােস্তাফা এক কোম্পানী মুক্তিযােদ্ধা নিয়ে ঘাটাইল থানার দুই তিন মাইল দক্ষিণে কালিদাস পাড়াপুল আক্রমণ করার জন্য চলে যান এবং মেজর হাবিব ঘাটাইল থানা সদর থেকে এক মাইল উত্তরে বানিয়াপাড়া পুল দখল করার জন্য অগ্রসর হন। সিদ্ধান্ত হয়, ৯ই ডিসেম্বর ভাের চারটার দিকে মেজর হাবিব ও মেজর মােস্তফা তাদের আক্রমণ পরিচালনা করবে। আর কাদের সিদ্দিকী তার বাহিনী নিয়ে ভাের পাঁচটার আগেই ঘাটাইল আক্রমণ করবে। সিদ্ধান্ত মােতাবেক ভাের চারটায় মেজর হাবিব ও মেজর মােস্তফা তাদের আক্রমণ পরিচালনা করেন। মেজর হাবিবকে তার লক্ষ্যস্থল দখল করতে তেমন বেগ পেতে হয়নি। সামান্য কয়েক রাউন্ড গুলি ছােড়ার পর সেতুর উপর অবস্থানরত ৩০/৪০ জন রাজাকার আত্মসমর্পন করে। রাজাকারদের আত্মসমর্পনের পর তাদের অস্ত্রশস্ত্র কাদেরিয়া বাহিনীর দখলে আসে। এরপর মেজর হাবিব বনিয়াপাড়া সেতু ধ্বংস ও দখল করেন এবং তার বাহিনী নিয়ে ঘাটাইল থানা আক্রমণ করেন। মেজর মােস্তফা ও মেজর হাকিম যার যার দল নিয়ে ঘাটাইল থানা আক্রমণ করেন। তিন দিক থেকে মর্টার ও কামানের প্রচণ্ড গুলির ফলে হানাদারদের অবস্থান চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যায়। এই আক্রমণে প্রায় শতাধিক হানাদার বন্দী হয় এবং ২৫/৩০ জন খান সেনা নিহত হয়। ঘাটাইল থানা এই দিন কাদেরিয়া বাহিনী দখল করলেও আবার কিছু সময়ের জন্য তাদের পিছু হটতে হয়। কারণ ইতিমধ্যেই ১০ই ডিসেম্বর শুক্রবার জামালপুর ও ময়মনসিংহ থেকে বিতাড়িত পাক হানাদার বাহিনীর প্রায় চারশ গাড়ীর একটি বহর টাঙ্গাইলের দিকে অগ্রসর হয়। এই বিশাল বহর দেখে ঘাটাইল সদর থেকে কাদেরিয়া বাহিনী সরে পড়ে। মেজর হাবিবের ধ্বংস করে দেয়া বানিয়াপাড়া সেতুর কাছে এসে হানাদাররা ব্যাপকভাবে মেশিনগানের গুলি চালায়। বিশাল পাক বহিনীর সঙ্গে স্থল পথে কাদেরিয়া বাহিনী সংঘর্ষ না করে মিত্র বাহিনীর সাহায্যে বিমান হামলার ব্যবস্থা করে। কাদের সিদ্দিকীর অনুরােধে দুপুর তিনটার সময় ভারতীয় বিমান বাহিনীর তিনটি মিগ২১ ঘাটাইল এবং গােপালপুর আক্রমণ করে। ভারতীয় বিমান বাহিনীর হামলায় গােপালপুরে হানাদারদের পতন ঘটে এবং প্রায় ৩০০/৪০০ পাক হানাদার কাদেরিয়া বাহিনীর হাতে বন্দী হয়। আর গাড়ীর বহরের বাকী অনেকেই বিভিন্নভাবে টাঙ্গাইলের দিকে অগ্রসর হয়। কিন্তু ঘাটাইলময়মনসিংহ সড়কের বিভিন্ন স্থানে কাদেরিয়া বাহিনীর উপর্যুপরি আঘাতে হানাদারদের অসংখ্য সদস্যের জীবনহানি ঘটে। ইতিমধ্যে ১০ই ডিসেম্বর শনিবার ভারতীয় ছত্ৰী সেনারা বিমান থেকে
৯১
প্যারাসুটে টাঙ্গাইল শহর থেকে মাত্র ৫/৬ মাইল উত্তরে পুংলি নামক স্থানে নামে। এখানে ছত্রী সেনাদের এমনভাবে প্যারাসুটের মাধ্যমে নামানাে হয় যে তারা একেবারে পাক হানাদারদের মাথার উপর পরে। কারণ উত্তর দিক থেকে পলাতক হানাদার বাহিনীর সদস্যরা জীবন রক্ষার জন্য টাঙ্গাইলের দিকে ছুটে আসা দলটির সাথে তখন পুংলি সেতুর উপর ছিল। কাজেই ভারতীয় বাহিনীর সৈন্যরা নেমে আর বিশ্রাম করার সুযােগ পেল না। মাটিতে নেমেই পাক হানাদারদের আক্রমণের জবাব দিতে হয় তাদের। মিত্র বাহিনীর গুলিতে ৪০০ জন পাক হানাদার নিহত হয় এবং মিত্র বাহিনীরও ৬ জন বীর সেনানী শহীদ হন। এখানে প্রায় সারারাত মিত্র বাহিনীও মুক্তি বাহিনীর সাথে হানাদারদের গুলি বিনিময় হয়েছিল। পরদিন ১১ই ডিসেম্বর কাদেরিয়া বাহিনীর প্রধান বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী তার বিশাল বাহিনী নিয়ে মধুপুর, গােপালপুর, টাঙ্গাইল ও কালীহাতী থানা মুক্ত করে টাঙ্গাইল শহরের দিকে অগ্রসর হন। পুংলি সেতুর কিছুটা উত্তরে শােলাকুরাতে উপস্থিত হলে শােলাকুরা এবং ইছাপুরে বেশ কিছুসংখ্যক পাক সৈন্যকে বিশ্রাম নিতে দেখেন। তাদের সঙ্গে কাদেরিয়া বাহিনীর প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে পাক হানাদাররা কাদেরিয়া বাহিনীকে প্রচণ্ডভাবে বাঁধা দেয়। কাদেরিয়া বাহিনী কামান ও ৩ইঞ্চি মর্টারের সাহায্যে গুলি করেও তেমন সুবিধা করতে পারেনি। এরপর মিত্র বাহিনীর নিকট বিমানের সাহায্য চাওয়া হয়। সকাল নয়টার দিকে ভারতীয় মিত্র বাহিনীর বিমান বাহিনী শােলাকুরা ইছাপুরে হানাদারদের উপর প্রচণ্ড ভাবে বিমান হামলা চালায়। এ হামলার ৩/৪শ জন পাক সেনা নিহত হয় এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়। এখান থেকে পাক বাহিনীকে পরাজিত করে কাদেরিয়া বাহিনী দক্ষিণ দিকে এগিয়ে এসে পুংলি সেতুর নিকট মিত্র বাহিনীর সঙ্গে একত্রিত হয়। পুংলি থেকে মিত্র এবং কাদেরিয়া বাহিনী সম্মিলিতভাবে টাঙ্গাইলের দিকে অগ্রসর হয়। অন্যদিকে ১১ই ডিসেম্বর শনিবার ভাের থেকেই কাদেরিয়া বাহিনীর কর্ণেল ফজলুর রহমান, মেজর মঈনুদ্দিন, ক্যাপ্টেন নিয়ত আলী, ক্যাপ্টেন করিম পশ্চিম ও দক্ষিণ দিক থেকে টাঙ্গাইল শহর আক্রমণ করে এবং পূর্ব দিক থেকে মেজর লােকমান, মেজর মতিয়ার, মেজর মােকাদ্দেস প্রচণ্ডভাবে আক্রমণ চালায়। মেজর লােকমান ভাের পাঁচটা থেকেই ঘারিন্দায় ৩ ইঞ্চি মর্টার বসিয়ে জেলাসদরের উপর অবিরাম গুলি বর্ষণ করে। কাদেরিয়া বাহিনীর সাহসী আক্রমণের মুখে ১১ই ডিসেম্বর সকাল থেকে হানাদার বাহিনীর দস্যুরা টাঙ্গাইল থেকে পালাতে থাকে। এদিন সকাল ১১টার দিকে কর্ণেল ফজলু তার বিশাল বাহিনী নিয়ে টাঙ্গাইল শহরের দক্ষিণে এর পুরান অংশ দখল করে নেয়। কর্ণেল ফজলু টাঙ্গাইল শহরে প্রবেশ করে ৪/৫শ পাক হানাদার ও রাজাকার, বদর বাহিনীর দস্যুদের বন্দী করে। বিকেল পাঁচটার দিকে বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী ক্যাপ্টেন সবুর, মেজর মােস্তফাসহ বিশাল বাহিনী নিয়ে পুংলি থেকে টাঙ্গাইল শহরের দিকে অগ্রসর হয়। কাদের সিদ্দিকী যে সময় টাঙ্গাইল শহরে প্রবেশ করেন তখন শহরের নতুন অংশে পাক হানাদারদের অবস্থান ছিল বেশ শক্তিশালী। কাদের সিদ্দিকী তার বাহিনী নিয়ে শহরের কাছে দেওলা নামক স্থানে উপস্থিত হলে জেলা সদর হতে পাক হানাদাররা প্রচণ্ড ভাবে মেশিনগান দিয়ে গুলিবর্ষণ শুরু করে। হানাদার বাহিনীর আকস্মিক হামলায় কাদেরিয়া বাহিনী দিশেহারা হয়ে পড়ে। কিন্তু বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী স্বয়ং যেখানে উপস্থিত সেখানে মুক্তিযােদ্ধাদের পিছপা হবার কথা না। তিনি অতি দ্রুত তার বাহিনীকে প্রস্তুত করে হানাদারদের বিরুদ্ধে পাল্টা আক্রমণ চালান। কাদেরিয়া বাহিনীর কামান, মর্টার আর মেশিনগানের প্রচণ্ড গুলিতে হানাদাররা ১০ মিনিটের মধ্যে পরাজয় বরণ করে। ১১ই ডিসেম্বর শনিবার সন্ধ্যা সাতটার দিকে কাদের সিদ্দিকী জেলা সদরে প্রবেশ করেন এবং তার নিকট এক হাজারেরও বেশি হানাদার সৈন্য আত্মসমর্পন করে। এই ৩ মসমর্পনের মাধ্যমে মুক্তি পেল
৯২
টাঙ্গাইলের মাটি, মানুষ নামের কলংক পাকিস্তানী হানাদার শাসক এবং তাদের সহযােগি এদেশীয় নরপিশাচ রাজাকার, আলবদর, আল শামস্, জামায়াতে ইসলামির কবল থেকে। হানাদার মুক্ত হবার সংবাদ আর কাদের সিদ্দিকী ও মিত্র বাহিনীর কমান্ডার নাগরার আগমন বার্তা বাতাসের গতিতে টাঙ্গাইলবাসীর নিকট পৌছে যায়। সংবাদ পাওয়া মাত্র নারী পুরুষ শিশু বৃদ্ধ, জয়বাংলা’ শ্লোগান দিয়ে আকাশ বাতাস কাপিয়ে তােলে। বিজয়ের আনন্দে টাঙ্গাইলবাসী হয়ে উঠে আনন্দে আত্মহারা। তাই তারা আজও ১১ই ডিসেম্বরকে টাঙ্গাইল মুক্তি দিবস হিসেবে উদযাপন করে।
ঢাকা অভিযানে কাদেরিয়া বাহিনী
১৯৭১ সালের ১১ই ডিসেম্বর টাঙ্গাইল হানাদারমুক্ত হয়। ঐদিন রাতেই কাদেরিয়া বাহিনীর সদস্যরা ঢাকা টাঙ্গাইল সড়কের পুতে রাখা এন্টি ট্যাংক মাইন অপসারণ করতে শুরু করে। প্রচন্ড ঝুকি নিয়ে মাইন অপসরণে যারা নেতৃত্ব দেন তারা হলেন ক্যাপ্টেন বায়েজিদ, ক্যাপ্টেন সােলেমান, ক্যাপ্টেন শামসুল হক, ক্যাপ্টেন গাজী লুৎফর রহমান ও ক্যাপ্টেন নায়েক আলম। মাইন অপসরণ করতে কাদেরিয়া বাহিনীর দুজন সদস্য মারাত্মকভাবে আহত হয়। ঢাকা-টাঙ্গাইল সড়ক বিপদমুক্ত হবার পর ১২ই ডিসেম্বর ভারতীয় মিত্র বাহিনী এবং কাদেরিয়া বাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত যৌথ বাহিনী ঢাকা অভিযানের জন্য অগ্রসর হয়। যৌথ বাহিনী বিনা বাধায় সকাল আটটায় মির্জাপুর এবং বেলা বারােটায় কালিয়াকৈর উপস্থিত হয়। ১২ই ডিসেম্বর যৌথবাহিনী সারাদিন কালিয়াকৈরে অবস্থান করে। ১৩ই ডিসেম্বর ব্রিগেডিয়ার ক্রের নেতৃত্বে যৌথ বাহিনীর পাঁচ হাজার সদস্য কড়াতে উপস্থিত হন। ইতিমধ্যে ব্রিগেডিয়ার সনসিংহের নেতৃত্বে তার বাহিনী হালুয়াঘাট, ফুলপুর, ময়মনসিংহ মুক্ত করে টাঙ্গাইল এসে উপস্থিত হয় ১৩ ডিসেম্বর। সামান্য শ্রিাম নেয়ার পর রাত দশটায ব্রিগেডিয়ার সনসিংহ কলিয়াকৈর উপস্থিত হন। ১৩ই ডিসেম্বর রাত ৯টার সময় জেনারেল নাগরা টাঙ্গাইল উপস্থিত হন। তিনি ব্রিগেডিয়ার সানসিংহ, ব্রিগেডিয়ার জুের ও বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকীকে নিয়ে ঢাকা অভিযানের পরিকল্পনার জন্য আলােচনায় বসেন। জেনারেল নাগরা আলােচনার শুরুতেই কাদেরিয়া বাহিনীর ভূয়সী প্রশংসা করে বারবার ধন্যবাদ জানান। তিনি আন্তরিকভাবে বলেন, কাদেরিয়া বাহিনীর সদস্যরা যদি বিনা বাধায় অতটা পথ পাড়ি দিতে সাহায্য না করতেন তাহলে আমাদের বাহিনী দীর্ঘপথ যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়তাে। পথেই আমাদের অনেক শক্তি ক্ষয় হয়ে যেতাে। ১৪ই ডিসেম্বর সকালে মৌচাকের নিকটে ৩১ জন খানসেনাসহ হানাদার বাহিনীর ব্রিগেডিয়ার কাদের খান যৌথ বাহিনীর নিকট বন্দী হন। খানসেনাসহ কাদের খানকে কয়েকদিন কাদেরিয়া বাহিনীর হেফাজতে রাখা হয়। ব্রিগেডিয়ার ক্লের নেতৃত্বের যৌথ বাহিনীকে কড়ায় হানাদার বাহিনীর সঙ্গে প্রচণ্ড যুদ্ধ করতে হয়। কড়া নদীর দক্ষিণ পাশে হানাদারদের অত্যন্ত শক্তিশালী অবস্থান ছিল। এখানে ঢাকা থেকে এক ব্যাটালিয়ান পাক সেনা আগেই অবস্থান নিয়ে বসেছিল। এরমধ্যে আবার ময়মনসিংহ, জামালপুর ও টাঙ্গাইল থেকে পলায়নপর হাজার দুই সৈন্য কড়া পর্যন্ত এসে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে আরাে শক্তিশালী করে তােলে। ১৪ই ডিসেম্বর যৌথ বাহিনীর সঙ্গে হানাদার বাহিনীর এক মরণপণ যুদ্ধ হল। ব্রিগেডিয়ার ক্লের হাতে ভারী অস্ত্র না থাকায় প্রথমদিকে যৌথ বাহিনী তেমন সুবিধা করতে পারছিলনা। ব্রিগেডিয়ার ক্লের এই যুদ্ধে তেমন একটা ক্ষয়-ক্ষতির শিকার হতে রাজী ছিলেন না। তিনি সম্মুখ যুদ্ধে বেশী জোর না দিয়ে তার বাহিনীকে
৯৩
ডাইনে বায়ে ভাগ করে দিয়ে স্থানীয় জনগণের সাহায্যে ছােট ছােট নৌকায় প্রায় অর্ধেক সৈন্যকে নদী পার করে দিতে সক্ষম হন। নৌকা সগ্রহ ও নদী পারাপারের ব্যপারে কাদেরিয়া বাহিনী অত্যন্ত প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করে। এই যুদ্ধে ভারতীয় বাহিনীর মধ্যে একটা আবেগ প্রবণ ভাব দেখা যায়। প্রচন্ড যুদ্ধের আশংকায় সম্মুখ যুদ্ধে কাদেরিয়া বাহিনীর সদস্যদের যেতে দিতে চাইছিলেন না। কাদেরিয়া বাহিনীর সদস্যদের প্রতি মিত্র বাহিনীর অনুরােধ, আপনার এখন পিছনে থাকুন। পিছনে থেকে সাহায্য করুন। আমরা আগে ওদের সঙ্গে সামনা-সামনি লড়ে দেখি কত শক্তি রাখে। যদিও কাদেরিয়া বাহিনীর সদস্যরা সব সময় মিত্র বাহিনীর অনুরােধ রক্ষা করেনি। তারা প্রায় সর্বদা মিত্র বাহিনীর সঙ্গে থেকেছে। এমনকি অনেক স্থানে কাদেরিয়া বাহিনীর জোয়ানরা ডাইনে বায়ে পাশ কাটিয়ে মিত্র বাহিনীর আগে চলে গেছে। তাদের এটা করার সুযােগও ছিল। কারণ রাস্তা-ঘাট, গ্রামগঞ্জ, হাট-বাজার সবই ছিল তাদের পরিচিত। ব্রিগেডিয়ার ক্লের অর্ধেক সৈন্য নদী পার করে দু’পাশ দিয়ে হানাদারদের ওপর ঝাপিয়ে পড়ার নির্দেশ দিলেন। যৌথ বাহিনীর আক্রমণে হানাদাররা টিকে থাকতে না পেরে কড়া থেকে পিছনের দিকে সরে গিয়ে জয়দেবপুরের দক্ষিণে রােড বাজারে অবস্থান করে। যৌথ বাহিনী হানাদারদের পিছু ধাওয়া না করে ঐদিন কড়াতেই ঘাঁটি গাড়ে। ব্রিগেডিয়ার কে সঙ্গে যােগদানের জন্য ৬ হাজার কাদেরিয়া বাহিনীর সদস্য টাঙ্গাইল থেকে ঢাকার দিকে অগ্রসর হয়। কাদেরিয়া বাহিনীর সদস্যরা চান্দারার নিকট এসে যৌথ বাহিনীর সঙ্গে একত্রিত হয়। ১৫ই ডিসেম্বর ব্রিগেডিয়ার কে যখন কড়ায় অবস্থান করছিলেন তখন ব্রিগেডিয়ার সানসিংহ নবীনগরসাভার রাস্তা ধরে ঢাকার দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। ব্রিগেডিয়ার সানসিং তার বাহিনী নিয়ে ঢাকাআরিচা সড়কের নবীনগর এসে উপস্থিত হন। নবীনগর এসে ঢাকার দিকে অগ্রসর হবার সময় সানসিংহের বাহিনী সাভার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্বদিকে হানাদারদের প্রচন্ড বাধার সম্মুখীন হয়। ব্রিগেডিয়ার সানসিংহের অস্ত্র বল ও সৈন্য বল বেশি হওয়া সত্ত্বেও হানাদারদের সঙ্গে লড়াইয়ে প্রথমদিকে তাকে হিমশিম খেতে হয়। কারণ পাক হানাদারবাহিনীর জোয়ানরা মরনপণ যুদ্ধ শুরু করে, তারা পিছপা হতে মােটেই রাজী ছিল না। ব্রিগেডিয়ার মানসিংহও ছাড়ার পাত্র ছিলেন না। তিনি শেষ পর্যায়ে তার সৈন্যদের ডানে-বাঁয়ে অগ্রসর করে চারদিক দিয়ে আঘাত হানার নির্দেশ দিলেন। এবার যৌথবাহিনী চারদিক দিয়ে আঘাত হানে হানাদারদের উপর। এসময় ব্রিগেডিয়ার সানসিংহের সঙ্গে তিন হাজার সৈন্য ছিল। যৌথবাহিনীর সৈন্যরা চারদিক দিয়ে তাদের ঘোওয়ের স্থান আস্তে আস্তে ছােট করে আনতে লাগলেন। রাত তিনটার সময় চরম অবস্থার সৃষ্টি হল। যৌথ বাহিনীর সৈন্যরা হানাদারদের ঘাঁটির পঞ্চাশ গজের মধ্যে পৌছে যায়। হানাদারদের সত্তর-আশিটি লাশ যৌথবাহিনীর হাতে এসে গেছে। তবুও হানাদাররা আত্মসমর্পন করতে রাজী না। এ সময় ব্রিগেডিয়ার মানসিংহ হানাদারদের ঘাটির মাত্র একশ গজ দূরে দুতিন ফুট উচু দেওয়ালের উপর দাঁড়িয়ে চিৎকার করেন ডাইনে যাও, বয়ে যাও, দেখ ডান পাশের বাংকার থেকে হানাদার সৈন্যরা গুলী ছুড়ছে। পেছনে দশ বারাে জন ভাগছে, ধর ওদের। এই ধরনের নানা নির্দেশ দিচ্ছিলেন। হানাদার সৈন্যদের গুলী সানসিংহ বাবাজীর আশে পাশে এসে পড়ছিল। ব্রিগেডিয়ার বা বাজীর দেওয়ালের উপর দাঁড়িয়ে নির্দেশ দেয়া কাদেরিয়া বাহিনীর ছােট এক মুক্তিযােদ্ধা অনেকক্ষণ ধরে অবাক বিস্ময়ে দেখছিল। গুলী এদিক ওদিক পড়ছে অথচ বাবাজীর গায়ে লাগছে না দেখে বাবাজীর নিকট এসে তাকে এক হেঁচকা টানে নীচে নামিয়ে অবাক বিস্ময়ে কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘এই বাবাজী আপ কেয়া হােতা হ্যায়?’ বাবাজী প্রাণ খােলা হাসি হেসে ছােট্ট মুক্তিযােদ্ধাটিকে জড়িয়ে ধরে বললেন, না আমি ভূত না তবে গুলি ফেরানাের মন্ত্র জানি।’ ব্রিগেডিয়ার বাবাজীর কথায় ছােট্ট
৯৪
মুক্তিযােদ্ধাটির বিশ্বাস হলাে। সে বাবাজীকে জোরে টেনে ধরে আরাে আশ্চর্য হয়ে বললাে, এই জন্যই তাে অনেকক্ষণ ধরে দেখছি আপনার গায়ে একটা গুলিও লাগছে না। রাত সাড়ে তিনটায় সাভারের হানাদারদের ঘাটির পতন ঘটে। এখানে হানাদারদের একশ চল্লিশ জন নিহত এবং একশ সত্তর জন আহত হয়। যৌথ বাহিনীর পক্ষে বারজন নিহত ও পাঁচজন আহত হয়। বারজন নিহতের মধ্যে দশজনই ছিল ভারতীয় বাহিনীর আর বাকী দু’জন কাদেরিয়া বাহিনীর। কড়ার মত এ যুদ্ধেও ভারতীয় বাহিনী কাদেরিয়া বাহিনীর সদস্যদের আগে যেতে দিতে চায়নি। কাদেরিয়া বাহিনীর বা মুক্তিযােদ্ধাদের পিছনে রাখা কোন কৌশল বা কোন উচ্চ নেতৃত্বের নির্দেশও ছিল না। যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়মিত সৈন্যরা অল্প বয়সী মুক্তিযােদ্ধাদের স্নেহ-মমতা আর ভালবাসার টানে শত্রুর সামনে আগে যেতে নিষেধ করেছে। ব্রিগেডিয়ার সানসিংহ মুক্তিযােদ্ধাদের নিকট বাবাজী বলেই পরিচিত ছিলাে। ভারতীয় সামরিক অফিসারদের মধ্যে হয়তাে তিনি মুক্তিযােদ্ধাদের নিকট সবচেয়ে বেশি প্রিয় ছিলেন। মুক্তিযােদ্ধাদের এমন কোন সৈন্য নেই যে সানসিংহের নাম শুনেই নাই বা তাকে জানে না। ভারতীয় সমরবিশ রদরা ঢাকা দখলের জন্য দায়িত্ব দিয়েছিলেন লেঃ জেনারেল সাগত সিংকে। লেঃ জেনারেল সাগত সিং ঢাকা আক্রমণের জন্য আখাউড়া-আশুগঞ্জ-ভৈরব পথে অগ্রসর হন। এই পথে ঢাকার দূরত্ব ছিল মাত্র আশি-নব্বই মাইলের মত। সাগত সিং ঢাকা আসার ত্রিশ-চল্লিশ ঘন্টা আগেই জেনারেল নাগরার নেতৃত্বে যৌথ বাহিনী ঢাকার উপকণ্ঠে উপস্থিত হয়। এই বাহিনীকে প্রায় দুইশত মাইল রাস্তা অতিক্রম করে আসতে হয়েছে। কারণ জামালপুর-টাঙ্গাইল অথবা ময়মনসিংহটাঙ্গাইল হয়ে ঢাকার দূরত্ব দু’শ মাইলের বেশী। উত্তর দিক থেকে অর্থাৎ জামালপুর-টাঙ্গাইল পথ ধরে অতি তাড়াতাড়ি ঢাকার উপকণ্ঠে পৌছার কারণ ছিল কাদেরিয়া বাহিনীর সফলতা। কাদেরিয়া বাহিনীর সদস্যরা ঢাকার মাত্র বিশ-পঁচিশ মাইল উত্তর থেকে জামালপুর-ময়মনসিং রাস্তার প্রায় ষাট মাইল রাস্তা মিত্রবাহিনী আসার আগেই মুক্ত করে ফেলেছিল। কাদেরিয়া বাহিনীর আক্রমণে হানাদার বাহিনীর তেমন একটা সংখ্যা জামালপুর, ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল থেকে ঢাকায় আসতে পারেনি। জামালপুর, ময়মনসিংহ থেকে পালিয়ে আসা সাত হাজার এবং টাঙ্গাইলের তিন হাজার হানাদার বাহিনীকে কাদেরিয়া বাহিনী বন্দী করে। এই রাস্তা দিয়ে মাত্র দুই হাজার হানাদার ঢাকায় পৌছাতে সক্ষম হয়। যারা ঢাকায় পিছিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল তাদের অবস্থা ছিল অত্যন্ত করুন। তাদের পক্ষে আর সহজে যুদ্ধ করার মনমানসিকতা ছিল না। দীর্ঘ কয়েকদিন যাবৎ বহু রাস্তা পায়ে হেঁটে, তারপর আবার না খাওয়া অবস্থা। অনেকের ভাগ্যেই প্রায় এক সপ্তাহ যাবৎ খাওয়া জোটেনি। রাস্তায় পানিটুকু পর্যন্ত পায়নি তারা খাওয়ার জন্য। হানাদারদের কাছে প্রচুর অর্থ ছিল । কিন্তু তারা অর্থ দিয়েও কোন কিছু ক্রয় করতে পারেনি। এ সময় তাদের জীবনীশক্তি বাঁচিয়ে রাখার জন্য রাস্তার ধারের পঁচা পানি খেতে হয়েছে। খেতে হয়েছে শিশির বিন্দু। ব্রিগেডিয়ার কাদের খান যখন কালিয়াকৈরে অবস্থান করছিলেন তখন কয়েকদিন যাবৎ তার ভাগ্যে কোন খাবার জোটেনি। এমনি সময় একজন সৈন্য গাছের একটি ডাল ভেঙ্গে এনে নিয়ে বলল, স্যার এটা চিবান পানি পিপাসা কমবে। আমি চিবিয়েছি।’ কাদেরিয়া বাহিনীকে মিত্র বাহিনীর বার হাজার সৈন্যের এক দিনের খাবার ব্যবস্থা করতে হয় । ১৫ই ডিসেম্বর জেনারেল নাগরা বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকীকে বলেন, আমাদের আগামী দিনের খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ যুদ্ধক্ষেত্রে খাবার তৈরী করা কঠিন। তাই আব্দুল কাদের সিদ্দিকী মিত্র বাহিনীর খাবার ব্যবস্থা করতে রাজী হন। তিনি তার বাহিনীকে খাবার তৈরী করার
৯৫
নির্দেশ দেন। নির্দেশ পাওয়া মাত্র কাদেরিয়া বাহিনীর সৈন্যরা নাস্তা তৈরির কাজ শুরু করে দেয়। রাতেই তারা বার হাজার সৈন্যের একবারের নাস্তা তৈরি করে ফেলে। বিশ হাজার আটার রুটি, বিশ হাজার পরােটা, ত্রিশ-পয়ত্রিশ হাজার পাউরুটি, বিরাট বিরাট দশ ডেকচি বুটের ডাল, বড় বড় আটবেনয় ডেকচি খাসির মাংস, সতের ডেকচি সবজিসহ নাস্তা প্রস্তুত করা হয়। এছাড়া জারিকেনে চা পাঠানাের ব্যবস্থা করা হলাে। এই নাস্তা তৈরী করতে যারা বিশেষ দায়িত্ব পালন করেন তারা হলেন কর্ণেল ফজলু, ক্যাপ্টেন নিয়ত আলী, ক্যাপ্টেন খােরশেদ আলম, মােয়াজ্জেম হােসেন, হবি মিঞা ও মেজর আলী হােসেন। এদের নেতৃত্বে প্রায় দু’শত কাদেরিয়া বাহিনীর সদস্য নাস্তা তৈরির কাজে অংশগ্রহণ করে। ভাের পাঁচটার মধ্যে নাস্তা সার্কিট হাউস মাঠে নিয়ে যাওয়া হয়। বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকীও নাস্তা আনার সঙ্গে সঙ্গেই উপস্থিত হন। ভাের ছয়টার সময় ময়মনসিংহ থেকে একটি হেলিকপ্টার এসে টাঙ্গাইল সার্কিট হাউসের মাঠে নামে। হেলিকপ্টার নামার সঙ্গে সঙ্গে নাস্তা তােলার কাজ শুরু হয়। তাড়াতাড়ি করে প্রায় অর্ধেক নাস্তা হেলিকপ্টারে তুলে দেয়া হয়। নাস্তা তােলার পর মেজর জেনারেল নাগরা এবং কাদের সিদ্দিকী হেলিকপ্টারে উঠেন। ভাের সাড়ে ছ’টার সময় নাস্তা নিয়ে হেলিকপ্টার কড্ডার মৌচাক স্কাউট প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের পাশে অবতরণ করে। এখানেই ব্রিগেডিয়ার ক্লের তার অস্থায়ী সদর দপ্তর স্থাপন করেছিলেন। তিনি দৌড়ে এসে খুব উত্তেজিত ভাবে নাগরাকে বললেন, ‘নিয়াজী খুব সম্ভবত আত্মসমর্পন করবে। আমাদের বেতারে বেশ কয়েকবার ওদের কথাবার্তা ধরা পড়েছে। আমার দিকে গতকাল বিকেল থেকে ওদের কোন তৎপরতা নেই। তবে সানসিংহের দিকে গুলি বন্ধ হয়েছে। এখানে নাস্তা নামিয়ে দিয়ে নাগরা ব্রিগেডিয়ার ক্লেরকে নিয়ে ব্রিগেডিয়ার সানসিংহের দিকে চলে গেলেন। সাভার মীরপুরের মাঝামাঝি রাস্তার বাকে হেলিকপ্টার নামানাে হয়। এখানে নাস্তা নামিয়ে দিয়ে আবার নাস্তার জন্য টাঙ্গাইলের দিকে হেলিকপ্টার রওয়ানা হয়। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী ও ব্রিগেডিয়ার ক্লেরকে সঙ্গে নিয়ে মেজর জেনারেল নাগরা রাস্তার একটি সেতুর উপর দাঁড়ান। সেতু থেকে মীরপুরের দূরত্ব মাত্র দেড়-দুই মাইল। এই সেতু থেকে নাগরা, ব্রিগেডিয়ার ক্লের, ব্রিগেডিয়ার সানসিংহ ও বঙ্গবীর আব্দুর কাদের সিদ্দিকীকে নিয়ে ঢাকার দিকে পায়ে হেঁটে এগিয়ে যেতে থাকেন। কিছুদূর এগিয়ে যাবার পর আবার ছােট একটি সেতু সামনে পড়ে। সেতুর উপর গিয়ে নাগরা তার সঙ্গীদের নিয়ে দাঁড়ান। নাগরা সেতুর উপর যাওয়ার পর দেখেন বামদিক থেকে চার পাঁচজন লােক দৌড়ে আসছে। প্রথমে তাদের চেনা না গেলেও কাছে আসার পর দেখা যায় তারা কাদেরিয়া বাহিনীর লােক। চারজনের মধ্যে ছিলেন ক্যাপ্টেন আব্দুল ছবুর খান ও মেজর মােস্তফা। তারা দৌড়ে এসে মেজর জেনারেল নাগরাকে সংবাদ দেয় যে, আমরা চার কোম্পানী প্রায় এক হাজার কাদেরিয়া বাহিনীর যােদ্ধারা মীরপুরে পৌছে গেছি। পিছন দিকে যাতে আপনারা গুলি না ছােড়েন, তাই সংবাদ দিতে এসেছি। এ সংবাদ শােনার পর নাগরা যৌথবাহিনীকে অতি দ্রুত মীরপুর সেতুর নিকট যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। কারণ, কাদেরিয়া বাহিনী একেবারে মীরপুর সেতুর কাছে পৌছে গেছে। তাই মীরপুর সেতুর কাছে যাওয়া খুবই জরুরী। মীরপুর সেতুর দিকে কাদেরিয়া বাহিনীর সৈন্যদের শক্তি বৃদ্ধির জন্য তাড়াতাড়ি এগিয়ে যাওয়া উচিত। সকাল-আটটার সময় রাজধানী ঢাকার প্রান্ত সীমান্তে পৌঁছে যান জেনারেল নাগরা ও তার বাহিনী। ঢাকা-মীরপুর রাস্তার হেমায়েতপুর সেতুর উপর দাঁড়িয়ে মেজর জেনারেল নাগরা এক টুকরাে কাগজ নিয়ে জীপের বনেটে রেখে হানাদার বাহিনীর প্রধান নিয়াজীকে আত্মসমর্পনের জন্য পত্র লেখেন।
৯৬
কাদেরিয়া বাহিনীর একজন ও মিত্র বাহিনীর তিনজন-এই চারজন নাগরা কর্তৃক লিখিত পত্র নিয়ে সাদা পতাকা না থাকায় গাড়িতে সাদা জামা উড়িয়ে হানাদারদের দিকে ছুটে যান। আত্মসমর্পনের বার্তা নিয়ে চারজন সাহসী যােদ্ধা যখন চলে যান তখন মেজর জেনারেল নাগরা ও কাদের সিদ্দিকীসহ আরাে বেশ কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তা আমিন বাজার স্কুলের পাশের সেতুতে এগিয়ে যান। পত্র বাহক চার সাহসী যােদ্ধা নাগরার পত্র নিয়ে নিয়াজীর কাছে পৌছে দেয়ার পর নিয়াজী আত্মসমর্পন করতে রাজী বলে জানিয়ে দেয়। বিনা যুদ্ধে নিয়াজী আত্মসমর্পনে রাজী আছে’ এ সংবাদ নিয়ে অতি আনন্দের সঙ্গে যখন নিজেদের সেনাপতির নিকট আসছিলেন ঠিক তখনই ভুলবশতঃ যৌথ বাহিনীর একঝাক মেশিনগানের গুলী ঐসব বাহকদের গাড়ী দুটিকে উড়িয়ে দেয়। এ ভুল হবার কারণ ছিল ঐ পত্র বাহকরা অতি আনন্দে আত্মহারা হয়ে সাদা জামাটি আর গাড়িতে উড়ায়নি। গাড়িতে কোন প্রকার সাদা পতাকা না থাকাতে যৌথ বাহিনী মনে করেছিল গাড়ি দুটি হানাদারদের। তাই তারা গাড়ির উপর গুলি বর্ষণ করে। গুলিতে গাড়ীর তিনজন আরােহী সঙ্গে সঙ্গেই মৃত্যুবরণ করে। একজন জীবিত আছে তবে তার অবস্থা খুবই খারাপ। যৌথ বাহিনী যখন জানতে পারে গাড়ী দুটি তাদের তখন তাড়াতাড়ি গাড়ীর কাছে গিয়ে দেখে সত্যিই তাদের গাড়ী। সবাই এ দৃশ্য দেখে হতবাক হয়ে যায়। জীবিত সৈন্যটি গাড়ীর চালক। সেই সংবাদ দেয় যে, নিয়াজী আত্মসমর্পন করতে রাজী হয়েছে। দ্রুত গতিতে আহত ও নিহতদের গাড়ী হতে সরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হয়। হেলিকপ্টারে আহত ও নিহতদের তুলে দেয়া হয়। মির্জাপুর হাসপাতালে তাদের আনা হল চিকিৎসার জন্য। হেলিকপ্টারে মির্জাপুরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেবার একটু পরেই হানাদারদের পক্ষ থেকে মেজর জামসেদ আসেন আত্মসমর্পনের প্রথম পর্ব সারতে। মেজর জেনারেল নাগরা, ব্রিগেডিয়ার সানসিংহ, ব্রিগেডিয়ার ক্লের ও বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকীকে হানাদার বাহিনীর পক্ষ থেকে মেজর জেনারেল জামসেদ সামরিক অভিবাদন জানান এবং নাগরার সামনে এসে মেজর জেনারেল জামসেদ তার কোমর থেকে রিভলভার বের করে প্রসারিত দুই হাত নাগরার সামনে বাড়িয়ে দেন। মেজর জেনারেল নাগরা রিভলভারের ছয়টি গুলী বের করে আবার রিভলভারটি জামসেদের হাতে তুলে দিলেন। এরপর জামসেদ আগের মত দুই হাত প্রসারিত করে তার সামরিক টুপিটি নাগরার হাতে অর্পন করে। মেজর জেনারেল নাগরা টুপিটি নিয়ে বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকীর হাতে তুলে দেন। জামসেদ তার গাড়ির জেনারেল পতাকাটি তুলে এনে নাগরার হাতে দেয়। নাগরা এ পতাকাটি সানসিংহের হাতে তুলে দেন। জামসেদ সবশেষে তার কোমরের বেল্টটি খুলে নাগরার হাতে তুলে দেয়। নাগরা বেল্টটি নিয়ে ব্রিগেডিয়ার ক্লের হাতে তুলে দেন। তিনি বেল্টটি সামরিকভাবে ব্যবহারের জন্য আবার জামসেদকে ফিরিয়ে দেন। মেজর জেনারেল নাগরার গাড়ীতে মেজর জেনারেল জামসেদের গাড়ীর ফ্ল্যাগ উড়ানাে হয়। ঐ গাড়িতেই যৌথবাহিনীর সমর নায়কগণ হানাদারদের সদর দপ্তরে যাওয়ার জন্য রওয়ানা দেন। গাড়ীতে সামনের আসনে বসেন জামসেদ, পিছনের আসনে বসেন মেজর জেনারেল নাগরা, ব্রিগেডিয়ার ক্লের, ব্রিগেডিয়ার সানসিংহ ও কাদেরিয়া বাহিনীর প্রধান বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী। যৌথ বাহিনীর পতাকা উড়িয়ে গাড়িটি সকাল দশটা পাঁচ মিনিটে নিয়াজীর ১৪তম ডিভিশন সদর দপ্তরের সামনে এসে দাঁড়ালাে। নিয়াজীর এডিসি এসে যৌথ বাহিনীর সমরনায়কদের অফিসের ভেতরে নিয়ে বসার ব্যবস্থা করে। সকাল দশটা দশ মিনিট। নিয়াজী তার অফিস ঘরে এলাে। অফিসে ঢুকে তার চেয়ারের পাশে দাঁড়িয়ে বিজয়ী
৯৭
সেনাপতিদের সামরিক অভিবাদন জানান। আত্মসমর্পন করার জন্য নাগরা নিয়াজীকে ধন্যবাদ জানান এবং তাকে বুদ্ধিমান সেনাপতি হিসেবে অভিহিত করে ভূয়সী প্রশংসা করেন। তারপর জেনারেল নিয়াজীর ছেলে মেয়ের কথা জিজ্ঞাসা করেন। মেজর জেনারেল নাগরা ও লেঃ জেনারেল নিয়াজ। বৃটিশ আর্মিতে একসঙ্গে কমিশন পাওয়ার পর একই একাডেমিতে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিলেন। পাকিস্তান আর্মিতে থাকায় নিয়াজী লেঃ জেনারেল হয়েছে। নাগরা ভারতীয় আর্মিতে থাকায় এখনও মেজর জেনারেল । ধন্যবাদ ও পারিবারিক কথা শেষ করে নাগরা নিয়াজীকে তার সাথীদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। প্রথমে ব্রিগেডিয়ার সানসিংহ বাবাজী, তারপর ব্রিগেডিয়ার ক্লের এবং সর্বশেষ পরিচয় করিয়ে দেন বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকীকে। তার পরিচয় জানাতে গিয়ে মেজর জেনারেল নাগরা বলেন, ইনিই এখন মুক্তিবাহিনীর একমাত্র প্রতিনিধি। ইনিই তােমার বন্ধু সেই বিখ্যাত কাদের সিদ্দিকী। কাদের সিদ্দিকী নামটা শােনার পর নিয়াজী হাত এগিয়ে দিল কাদের সিদ্দিকীর দিকে। নিয়াজী উঠে দাঁড়ানাের সঙ্গে সঙ্গে কাদের সিদ্দিকীও উঠে দাঁড়ান কিন্তু নিয়াজী হাত বাড়িয়ে দিলেও কাদের সিদ্দিকী তার হাত বাড়িয়ে দেননি। বেশ কিছু সময় নিয়াজী হাত বাড়িয়ে রাখার পর ব্যাপারটি বুঝে নাগরা কাদের সিদ্দিকীকে বলেন, আপনি কি করছেন হাত মিলান। আপনার সামনে পরাজিত সেনাপতি। পরাজিতের সাথে হাত না মিলানাে বীরত্বের অবমাননা। নাগরার কথায় নিয়াজীর সঙ্গে বেশ কিছু সময় পর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী হাত মিলান। তিনি আগে হাত মিলাতে চাননি। যে সেনানায়ক এদেশের লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে, লাখ লাখ বােনের ইজ্জত নষ্ট করেছে তার হাতের সঙ্গে হাত মিলানাে কাদের সিদ্দিকীর পক্ষে সহজে মেনে নেয়া সম্ভব ছিল না। নিয়াজীর সঙ্গে প্রয়ােজনীয় কথাবার্তা হলাে। স্থির হলাে আত্মসমর্পনের অনুষ্ঠানে মিত্রবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লেঃ জেনারেল আবােরা স্বয়ং উপস্থিত হবেন। বিকেল সাড়ে চারটায় আরােরা উপস্থিত হলে ঢাকায় সােহরাওয়ার্দী উদ্যানেই আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পন পর্ব শেষ হবে। কারণ ওখান থেকেই বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বাঙ্গালির উদ্দেশ্যে স্বাধীনতার ঘােষণা দিয়েছিলেন। নিয়াজীর রাজী না হয়ে উপায় ছিল না। পরাজিতদের বিজয়ীর শর্ত মানতেই হয়। নিয়াজীকেও মানতে হলাে। নিয়াজীর দপ্তর থেকেই যৌথ বাহিনীর হাই কমান্ডের কাছে সব ধরনের খবর পাঠানাে হল।
‘নিয়াজীর আত্মসমর্পন অনুষ্ঠানে কাদেরিয়া বাহিনী
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান হানাদার বাহিনী সেনাপতি লেঃ জেনারেল আমীর আব্দুল্লাহ নিয়াজী যৌথ বাহিনীর নিকট আত্মসমর্পন করেন। আত্মসমর্পন অনুষ্ঠানে কাদেরিয়া বাহিনী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিজয়ী সেনাপতি জগজিৎ সিং অরােরাকে তেঁজগাও বিমান বন্দরে অভিনন্দন জানান থেকে শুরু করে সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে আত্মসমর্পন অনুষ্ঠানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাদেরিয়া বাহিনীর সৈন্যরা বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করে। ১৬ই ডিসেম্বর বিকেল চারটা থেকে ভারতীয় বাহিনীর পূবাঞ্চলীয় প্রধান জগজিৎ সিং অরােরাকে স্বাগত অভিনন্দন জানানাের জন্য কাদেরিয়া বাহিনীর প্রধান বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী তেঁজগাও বিমান বন্দরে উপস্থিত হন। সেখানে আরাে উপস্থিত ছিলেন বিজয়ী বাহিনীর মেজর জেনারেল স্বালত, মেজর জেনারেল নাগরা, ব্রিগেডিয়ার সান সিং বাবাজী ও মুক্তি বাহিনীর মেজর হায়দার এবং ফ্লাইট লে: আবু ইউসুফ। আরােরাকে অভিনন্দন জানানাের জন্য পরাজিত পাকিস্তানী বাহিনীর পক্ষ থেকে উপস্থিত থাকেন লেঃ জেনারেল নিয়াজী,
৯৮
মেজর জেনারেল রাওয়ারমান আলী ও মেজর জেনারেল জামসেদ। বিকেল চারটা চল্লিশ মিনিটে পচিশ ছাব্বিশটি ভারতীয় চৈতক হেলিকপ্টারের বহর নিয়ে জগজিত সিং আরােরা তেজগাও বিমান বন্দরে অবতরণ করেন। প্রথমে আরােরাকে স্বাগত অভিনন্দন জানান পরাজিত পাক হানাদার বাহিনীর সেনাপতি নিয়াজী। এর পর বিজয়ী বাহিনীর মেজর জেনারেল নাগরা, মেজর জেনারেল সালত সিং, ব্রিগেডিয়ার ক্লের, ব্রিগেডিয়ার সান সিং বাবাজী ও কাদেরিয়া বাহিনীর প্রধান বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী, জগজিৎ সিং অরােরাকে স্বাগত অভিনন্দন জানান। লে: জেনারেল জগজিৎ সিং অরােরার সঙ্গে কলিকাতা থেকে প্রায় পঞ্চাশ ষাট জন দেশী বিদেশী সাংবাদিক আসেন। তাছাড়াও ভারতীয় কাগো বিমানে করে আগেই আরাে বেশ কিছু বিদেশী সাংবাদিক ঢাকায় এসে হাজির হয়েছিলেন। আরােরার সঙ্গে তার স্ত্রী ও বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর উপপ্রধান এয়ার কমান্ডার এ. ক. খােন্দকার আসেন। বিমান বন্দরে বেশি সময় দেরী না করে আরােরাকে তাড়াতাড়ি সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিয়ে যাওয়ার জন্য রওনা দেওয়া হয়। নিয়াজীর গাড়ীতেই আরােরা বিমান বন্দর থেকে সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে আসেন। বিকেল পাচটা ৫ মিনিটে পাকিস্তানী পরাজিত সেনাপতি নিয়াজী সই দিলেন আত্মসমপর্ন দলিল এ সেই দলিল গ্রহণ করে, বিজয়ী বাহিনীর সেনাপতি জগজিত সিং আরােরাও সই করেন। পরে পরাজিত পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর অন্যান্য অফিসাররাও আত্মসমর্পন দলিলে সই করেন। পরে ঐ সমস্ত আত্মসমর্পন দলিল গ্রহণ করে সই দেন উপস্থিত ভারতীয় জেনারেলরা এবং মুক্তি বাহিনীর পক্ষে সই দেন কাদেরিয়া বাহিনীর প্রধান বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী। পরাজিত পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সেনাপতি আমীর আব্দুল্লাহ নিয়াজী আত্মসমর্পন দলিলে সই করেন হাত কাঁপা অবস্থায়। তার হাত কাঁপার কারণে হাতের কলমের কালিও ঝরতে চায়নি। নিয়াজীর মুখ ছিল বিষন্নতায় ভরা। তার চোখের কোণা বেয়ে পড়ছিল প্রচুর পানি। নিয়াজীর আত্মসমর্পন দলিলে সই করার পরেই শতাধিক পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর অফিসার ও শতাধিক সৈন্য আত্মসর্পনের প্রতীক হিসাবে তাদের অস্ত্র মাটিতে নামিয়ে রাখে। আত্মসমর্পন অনুষ্ঠানে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করেন কাদেরিয়া বাহিনীর ছয় হাজার মুক্তিযােদ্ধা এবং মেজর জেনারেল নাগরার দুই ব্রিগেড সৈন্য। আত্মসমর্পন অনুষ্ঠানের নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করা অত্যন্ত কঠিন কাজ ছিল। কারণ তখন কাদেরিয়া বাহিনীর ছয়হাজার মুক্তিযােদ্ধা ছাড়া ঢাকায় আর মুক্তিযােদ্ধা প্রবেশ করতে পারেনি। যদিও ছােট একটি মুক্তিযােদ্ধার দল নারায়ণগঞ্জ হয়ে ঢাকায় প্রবেশ করেছিল, কিন্তু তারা সবেমাত্র পুরান ঢাকায় উপস্থিত হয়েছিল। কাজেই শুধু মাত্র কাদেরিয়া বাহিনী এবং ভারতীয় মিত্র বাহিনীর দুই ব্রিগেড সৈন্যেরপক্ষ্যে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করা ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। কারণ তখন যৌথবাহিনীর চেয়ে হানাদার বাহিনীর সংখ্যা ছিল অনেক অনেক গুনে বেশী। যৌথ বাহিনীর ধারণা ছিল ঢাকায় হানাদারদের সংখ্যা বিশ পচিশ হাজারের বেশী হবেনা । কিন্তু ঢাকা পতনের পর দেখা গেল হানাদারদের সংখ্যা প্রায় পঞ্চাশ ষাট হাজার, অপরদিকে যৌথ বাহিনীর সংখ্যা সবনিয়ে বিশ হাজারেরও কম। এমন চরম অবস্থায় যেকোন সময় পরিস্থিতি ভিন্ন আকার ধারণ করতে পারে। এ চিন্তায় যৌথ বাহিনীর সমর নায়কদের অনেকটা চিন্তিত করে তােলে। আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পন পর্ব শেষ হওয়ার পর জগজিত সিং আরােরা সােজা ১৪তম ডিভিশনের হেড কোয়ার্টারে চলে গেলেন। তার সঙ্গে মেজর জেনারেল সালত সিং, মেজর জেনারেল নাগরা ব্রিগেডিয়ার ক্লের ব্রিগেডিয়ার সান সিং ও কাদেরিয়া বাহিনীর প্রধান বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকীও
৯৯
যান। কিছু সময় সেখানে আরােরার সঙ্গে আলাপ আলােচনা করে বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী বেরিয়ে পড়েন বেগম মুজিবের সঙ্গে দেখা করার জন্য ৩২নং রােডের বাড়ীর দিকে। বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে উপস্থিত হয়ে তিনি জানতে পারেন বেগম মুজিব এ বাসায় থাকেন না। তিনি থাকেন ১৯ নং রােডের একটি বাসায়। বাসার সামনে আসলে বাসা হতে হানাদার বাহিনীর খুনীরা গুলিবর্ষণ করে। তখন ঐ বাসায় পাহারারত হানাদার সৈন্যরা আত্মসমর্পন করেনি। তারা নয়াজীর আত্মসমর্পন মানতে রাজী নয়। হানাদারদের গুলির পর আর বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকীর ঐ বাসায় প্রবেশ করা সম্ভব হয়নি এবং বেগম মুজিবের সঙ্গে দেখা করাও সম্ভব হয়নি।
হানাদারমুক্ত ঢাকায় কাদেরিয়া বাহিনীর
ঐতিহাসিক জনসভা
১৯৭১ সালের ১৬ ই ডিসেম্বর বাংলার পবিত্র মাটি মুক্ত হয় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর কবল থেকে। হানাদার বাহিনীর কবল থেকে ঢাকা শহর মুক্ত হবার দুই দিন পর ১৯৭১ সালের ১৮ই ডিসেম্বর পল্টন ময়দানে কাদেরিয়া বাহিনীর এক বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ঐ জনসভা ছিল মুক্ত ঢাকায় স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম বাঙ্গালিদের জনসভা। ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পন এর পর ঢাকা শহরের শান্তি শৃংখলা ও জনসেবা, জানমালের সকল প্রকার নিরাপত্তার দায়িত্ব গ্রহণ করে কাদেরিয়া বাহিনী। কাদেরিয়া বাহিনীর প্রধান বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী ১৬ ডি: রাতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন জনসভা করে ঢাকাবাসীকে আইন শৃংখলা রক্ষার ব্যাপারে এবং স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসাবে তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে অবহিত করতে হবে। সিদ্ধান্ত মােতাবেক ১৮ই ডিসেম্বর বিকালে ঢাকার পল্টন ময়দানে এক জনসভা করার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে শুরু করেন। ১৭ই ডিসেম্বর দুপুর থেকে কাদেরিয়া বাহিনীর উদ্দ্যোগে ঢাকার পল্টনে জনসভার প্রচার কাজ শুরু হয় এ জনসভার প্রচার কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সৈয়দ নূরু ফারুক আহম্মেদ, দাউদ খান, মােয়াজ্জেম হােসেন খান, আজিজ বাঙ্গাল, শওকত হােসেন, শাজাহান সােহরাওয়ার্দী এবং কাদেরিয়া বাহিনীর প্রচার বিভাগের আরাে বেশ কয়েকজন। ১৯৭১ সালের ১৮ই ডিসেম্বর দুপুরে বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী স্বাধীন বাংলার ঢাকার পল্টনে প্রথম জনসভা করতে টাঙ্গাইল থেকে রওনা হন। এই সময়ে তার সঙ্গে ছিলেন গণ পরিষদ সদস্য জনাব আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী, জনাব বাসেত সিদ্দিকী, অধ্যক্ষ হুমায়ুন খালিদ এবং কাদেরিয়া বাহিনীর বেসামরিক প্রধান আনােয়ার উল আলম শহীদ সহ আরাে অনেকে। বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দীকী টাঙ্গাইল থেকে ঢাকা গিয়ে প্রথম বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে উপস্থিত হন। সেখানে তিনি বেগম মুজিব, বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা, দুই পুত্র শেখ জামাল ও শেখ রাসেল, বঙ্গবন্ধুর নাতি জয়ও পরিবারে অন্যান্যদের সঙ্গে দেখা করেন। বেগম মুজিব আনন্দে আত্মহারা হয়ে বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকীকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে ডুকরে কেঁদে বললেন তােমরা বঙ্গবন্ধুকে ফিরিয়ে আন। আব্দুল কাদের সিদ্দিকী বেগম মুজিবকে ওয়াদা দেন: স্বাধীন বাংলায় বঙ্গবন্ধুকে আনবােই। বিশ্বের কোন শক্তি নেই বঙ্গবন্ধুকে বন্দী করে রাখতে পারে। এই কঠিন ওয়াদা দিয়ে আব্দুল কাদের সিদ্দিকী বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ পুত্র রাসেলকে কোলে তুলে নেন। গণপরিষদ সদস্য আব্দুল
১০০
লতিফ সিদ্দিকী, বাসেত সিদ্দিকী, অধ্যক্ষ হুমায়ুন খালিদ ও কাদেরিয়া বাহিনীর বেসামরিক প্রধান আনােয়ার উল আলম শহীদ সহ অন্যান্য মুক্তিযােদ্ধারা বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সকলের সঙ্গে আলাপ আলােচনা করেন। বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা বারবার কাদের সিদ্দিকী কে বলেন ‘ভাই বাবাকে ফিরিয়ে আনুন। আপনাদের দেখে কত খুশি লাগছে, বাবা উপস্থিত থাকলে আজকের এই খুশী আরাে ভাল করে অনুভব করতে পারতাম’। শেখ জামালকে সঙ্গে নিয়ে বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী পনের বিশটি গাড়ী নিয়ে পল্টনের দিকে রওনা হন। তিনি যখন গাড়ী নিয়ে সচিবালয়ের পাশ দিয়ে পল্টনের দিকে অগ্রসর হচ্ছেন ঠিক সেই সময় দেখেন বাম পাশ দিয়ে দুইটি গাড়ী যাচ্ছে এবং সেই গাড়ী থেকে চিৎকার শােনা যাচ্ছে। নারী কন্ঠের চিৎকার শুনে কাদের সিদ্দিকীর সন্দেহ জাগে। কি ব্যাপার সন্দেহ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি তার বাহিনীর লােকদের নির্দেশ দেন গাড়ীটিকে আটক করতে। নির্দেশ পাওয়া মাত্র কাদেরিয়া বাহিনীর সদস্যরা গাড়ী দুইটিকে আটক করে। একটি গাড়ী থেকে তের চৌদ্দ বছর বয়সের দুইটি মেয়ে ও চারজন যুবক কাদেরিয়া বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। মেয়ে দুইটির কাছ থেকে কাদেরিয়া বাহিনীর সদস্যরা জানতে পারে ঐ মেয়েদের বাড়ী মগবাজারের নিকট, তাদের জোর করে ধরে আনা হয়েছে। তাদের বাবাকেও লুটেরা হাত পা মুখ বেধে গাড়ীর পিছনে বনেটের ভিতরে ভরে রেখেছেন। কাদেরিয়া বাহিনীর সদস্যরা দৌড়ে গিয়ে গাড়ীর পিছনের বনেট খুলে সত্যিই একজন পূর্ণ বয়স্ক লােককে আধমরা অবস্থায় বের করে নিয়ে এলাে। লােকটি একজন অবাঙ্গালী মটোর মেকানিক। ছয়জন দুষ্কৃতিকারী তাকে তার বাড়ী থেকে দুই মেয়ে সহ ৫০ হাজার টাকা নিয়ে তারই গাড়ীতে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল। তাকে হয়তাে একটু পরেই দুষ্কৃতিকারী হত্যা করতাে এবং মেয়ে দুইটির ইজ্জত নষ্ট করতাে। কাদেরিয়া বাহিনীর সদস্যরা এই অন্যায় কিছুতেই সহ্য করতে পারবেনা। দৃষ্কৃতিকারীরা যে অবাঙ্গালী লােকটিকে ধরে এনেছে তিনি অবাঙ্গালী হলেও তার প্রতি ন্যায় বিচার না করে উপায় নেই। হাতে তেমন সময় ছিলনা। তাই চারজন দৃষ্কৃতিকারীকে পিঠ মােরা দিয়ে বেধে পল্টন ময়দানে নিয়ে যান। বন্দী দুস্কৃতিকারীদের গাড়ী সহ কাদেরিয়া বাহিনীর প্রধান বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকীর গাড়ীটি পল্টনের প্রধান গেট দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে। স্টেডিয়ামের নিকট দিয়ে কাদের সিদ্দিকী গাড়ী থেকে নামলেন। আনােয়ার উল আলম শহীদকে সঙ্গে নিয়ে তিনি মঞ্চে উঠলেন। এর পর গণপরিষদ সদস্য আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী, বাসেত সিদ্দিকী অধ্যক্ষ হুমায়ুন খালিদও মঞ্চে উঠে বসেন। সভায় প্রচুর লােকের সমাবেশ হয়েছে। সভার উপস্থিত মানুষ সম্পর্কে পরের দিন অথাৎ ১৯ শে ডিসেম্বর বিভিন্ন পত্র পত্রিকা বিভিন্ন সংখ্যা উল্লেখ করেন। কোন কোন পত্রিকায় উল্লেখ করা হয় ঐ জনসভায় তিনলাখ মানুষের সমাবেশ হয়েছিল। আবার কোন কোন পত্রিকার মতে জনসভায় দুই লাখ মানুষের সমাবেশ হয়েছিল। মঞ্চে বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকীর বাম পাশেই আসন গ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় পুত্র শেখ জামাল এবং ডানদিকে আসন গ্রহণ করেন কাদেরিয়া বাহিনীর বেসামরিক প্রধান আনােয়ার উল আলম শহীদ। পবিত্র কোরান তেলাওয়াত ও গীতাপাঠের মাধ্যমে সভার কাজ শুরু করা হলাে। সভা পরিচালনা করেন আনােয়ারুল আলম শহীদ। সভায় বক্তব্য রাখেন গণপরিষদ সদস্য আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী, আব্দুল বাসেত সিদ্দিকী, অধ্যক্ষ হুমায়ুন খালিদ। সবার শেষে বক্তব্য রাখেন কাদেরিয়া বাহিনীর প্রধান বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী।
১০১
স্বাধীন বাংলার ঢাকায় প্রথম জনসভায় গণপরিষদ সদস্য আব্দুল বাসেত সিদ্দিকী তার বক্তব্যে বলেন লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনের বিনিময়ে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছি। কিন্তু আমার দুঃখ আজ আমাদের বঙ্গবন্ধু উপস্থিত নেই। আমরা কাদেরিয়া বাহিনীর সদস্যরা শপথ নিচ্ছি যত দিন সাড়ে সাত কোটি মানুষের নেতা বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করতে না পারবাে ততােদিন আমরা অশ্রু ত্যাগ করবনা। হুমায়ুন খালিদ তার বক্তব্যে বলেন ‘সাড়ে সাত কোটি মানুষ শহীদ হবে তবুও বঙ্গবন্ধুকে ফিরিয়ে আনবে।’ লতিফ সিদ্দিকী তার বক্তব্যে বলেন ‘পল্টনেই সকল সংগ্রামের ডাক উঠেছে। সােহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের আহবান সার্থক হয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের প্রধান মন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর আন্তরিক সমর্থন অতুলনীয় সমবেদনা ও সহযােগিতা ভারতের মহান জনগনের মহৎ আত্মত্যাগ ও রক্তের দামে মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্যের সেতু বন্ধন রচনা করলেন যে মিত্র বাহিনী আমি তাদের সকলকে আমার সশ্রদ্ধ সালাম জানাই। তিনি আরাে বলেন ২৫ শে ডিসেম্বরের মধ্যে বঙ্গবন্ধু কে স্বসম্মানে মুক্তি না দিলে কাদেরিয়া বাহিনী পশ্চিম পাকিস্তান আক্রমণ করবে।’ সভার প্রধান বক্তা বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী তার বক্তব্যে বলেন আমরা দীর্ঘ নয় মাস হানাদার বাহিনীর সঙ্গে অবিরাম অবিচ্ছিন্ন মরণ জয়ী যুদ্ধ করে স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য কে ছিনিয়ে এনেছি। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের নয়নের মণি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু এখনাে হানাদারদের কারাগারে বন্দী। বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত না করা পর্যন্ত স্বাধীনতার পূর্ণস্বাদ আমরা অনুভব করতে পারবােনা। বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় পুত্র শেখ জামাল আমার পাশেই বসা আছে। প্রতিটি মুক্তিযােদ্ধা প্রতিটি স্বাধীনতা কার্মী বাঙ্গালির মতই পিতার অনুপস্থিতিতে সে আজ শােকাহত।’ বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকীর বক্তব্যের এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউয়ের দিক থেকে কয়েকটি গুলি এসে সভা মঞ্চের উপরে লেগে পান্ডেলের কিছু অংশ ছিটকে বেরিয়ে গেল। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বক্তব্যের প্রসঙ্গে কঠোর ভাবে বললেন কারা সভার স্থলে গুলি ছুড়েছে তাদের আমরা বুঝি। হুশিয়ার করে দিচ্ছি কারাে লুটের রাজত্ব কায়েম করতে হাজার হাজার মুক্তিযােদ্ধা ও লক্ষ লক্ষ মানুষ জীবন দেয়নি। আর একটি গুলি যদি এদিকে আসে এবং সেই গুলিতে কারাে সামান্য ক্ষতি হয়, তাহলে যারা গুলি ছুড়ছে তাদের আমরা আস্ত রাখবােনা। উড়িয়ে দেব। বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকীর এই হুশিয়ার করে দেওয়ার পর গুলি থেমে গেল। আবার স্বাভাবিক ভাবে সভার কাজ শুরু হলাে। তিনি আবার বক্তব্যের প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে পূর্বের প্রসঙ্গে ফিরে আসলেন। তিনি তার বক্তব্যে আরাে বলেন, আমাদের সংগ্রাম ছিল হানাদারদের কামানের মুখ থেকে লাখ লাখ মা বােন ও ভাইকে রক্ষা করা। বাংলাদেশ হানাদার মুক্ত করা। যে কাজ শেষ হয়েছে। এখন আমাদের কাজ বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কে পাকিস্তানের কারাগার ভেঙ্গে বের করে আনা। ইয়াহিয়ার জেনারেলদের মনে রাখা উচিত বাংলার মুক্তি বাহিনী কোন ট্রেনিং নিয়ে যুদ্ধ শেখেনি। তােমাদের সাথে যুদ্ধ করেই তারা যুদ্ধ শিখেছে। তােমরা এখনাে আমাদের নেতাকে বন্দী করে রেখেছ। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনককে বন্দী করে রাখার অধিকার তােমাদের নেই। মুক্তি বাহিনীর অধিকার আছে যে কোন ত্যাগের বিনিময়ে তাদের নেতাকে মুক্ত করে আনার। ঘাতকরা মনে রেখাে, আগামী ৩১ শে ডিসেম্বরের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তেঁজগাও বিমান বন্দরে স্বসম্মানে পৌছে দিয়ে না গেলে আমরা পাকিস্তান আক্রমণ করবাে এবং বিশ্বের মানচিত্র থেকে পাকিস্তানের নাম নিশানা মুছে দেব। তিনি মুক্তি যােদ্ধাদের স্মরণ করে দেন পিতাহীন স্বাধীনতা অর্থহীন। তাই জীবন দিয়ে, সর্বস্ব দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে ফিরিয়ে এনে স্বাধীনতা অর্থবহ করতে হবে। তােমরা প্রস্তুত হও। তিনি আরাে বলেন ভাইয়েরা বােনেরা, মুক্তি বাহিনী এমন
১০২
বাংলাদেশ গড়তে চায় যেখানে ধনী দরিদ্রের কোন প্রকার ভেদাভেদ থাকবেনা। আর এই সােনার বাংলা গড়ার জন্য যে বাধা আসবে তা আমরা সর্বশক্তি দিয়ে রুখবাে। বাংলাদেশের বিপ্লবী সরকার যে পর্যন্ত ঢাকায় না আসবে সে সময় পর্যন্ত যা যেমন আছে সেই ভাবেই থাকবে। কোন নড়াচড়া করা চলবেনা। আইন কারাে হাতে তুলে নিলে মুক্তি বাহিনী তা বরদাস্ত কেনা। আপনারা সাহসের সঙ্গে সব কিছুর মােকাবিলা করুন। আমি বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষকে সালাম জানাচ্ছি। মুক্তি যােদ্ধাদের হাতে শুধু মাত্র অস্ত্রই ছিলনা ছিল জনগনের সক্রিয় সহযােগিতা ও আশীর্বাদ। বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী আরাে বলেন, মুক্তিযােদ্ধা ভাইয়েরা, কোন বিজাতীয় দখলদার শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ও জয় লাভ করলেই মুক্তিযােদ্ধাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য শেষ হয়ে যায়না। শেষ হয়ে যেতে পারে না। আমাদের সামনে আরাে বড় যুদ্ধ রয়েছে। সেখানে আমাদের হাতের এ অঞ্জ কোন কাজে দিবেনা, হানাদার মুক্ত স্বাধীন দেশ গড়তে আমাদেরকে দ্বিগুন উৎসাহে ঝাপিয়ে পড়তে হবে, অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হবে। আন্তরিকতা, দেশ প্রেম ও নিরলস কর্মশক্তিই হবে আমাদের আগামী দিনের হাতিয়ার। নিষ্ঠা, সততা, ন্যায়পরায়নতা, সুই সংগঠন ও সুই সুসংগঠিত কম ছাড়া কোন জাতি উন্নতি করতে পারেনা। আমরা যে ওয়াদা দিয়ে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলাম সেই ওয়াদা এক মুহূর্তের জন্য ভুলে গেলে চলবেনা। ভুখা নাঙ্গা সাড়ে সাত কোটি মানুষের মৌলিক অধিকার অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করে তাদের মুখে হাসি ফুটাতে না পারলে আমাদের এত রক্তে দামে অর্জিত স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ ব্যর্থ হয়ে যাবে। লক্ষ লক্ষ শহীদের আত্মা আমাদের ক্ষমা করবে না। বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী সভার জনতাকে উদ্দেশ্য করে আরাে বলেন, তাই ও বােনেরা আপনারা কি শান্তি শৃঙখলা ভঙ্গকারীদের সহ্য কেন ? আপনারা কি লুটেরাদের প্রশ্রয় দেবেন? লক্ষ কণ্ঠে জনতা উত্তর দিল নানা নানা। তিনি তখন বললেন আমরা যখন জনসভায় আসছিলাম তখন এই চারজন দুষ্কৃতিকারী দুইটি মেয়ে ও পঞ্চাশ হাজার টাকা লুট করে এদের বাবাকে বেধে নিয়ে যাচ্ছিল। সেই সময় দুষ্কৃতিকারীরা আমাদের হাতে পড়ে। এইযে আমাদের হাতে দুস্কৃতিকারীদের লুট করা পঞ্চাশ হাজার টাকা, আপনারা বলুন এদের কি করা উচিৎ? আপনারা এদের কি করতে চান? জনতা তখন সমস্বরে উচ্চ কণ্ঠে বলে উঠল নারী হরণকারী লুটেরাদের আমরা মৃত্যু দন্ড চাই। হাজার হাজার লােক চিক্কার করে বললেন ওদের গুলি করে মারা হউক। এবার কাদের সিদ্দিকী বল্লেন আপনাদের নির্দেশ মুক্তি বাহিনী অবশ্যই পালন করবে। এই চার দুষ্কৃতিকারীকে সভাশেষে সভাস্থলে চারটি গুলি ও বেনেট চার্জ করে মৃত্যু দন্ড কার্যকর করা হবে। আমি আবার আপনাদের সালাম জানাই। মুক্তিযুদ্ধের সকল শহীদদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি ও আহতদের আশু সুস্থতা কামনা করছি। প্রতিটি বীর মুক্তিযােদ্ধা স্বেচ্ছাবেক ও জনগনকে আমি সালাম অভিন্দন ও ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি। আমরা ওয়াদা সুছি অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীন বাংলার মুক্ত মাটিতে ফিরিয়ে আনবােই আনবাে। আপনারা মুক্তিবাহিনী ও কাদেরিয়া বাহিনীর সফলতা কামনা করে আল্লাহর দরবারে দোয়া করুন। বঙ্গবন্ধুর মুক্তি কামনা করে আল্লাহর দরবারে মােনাজাত করুন। আপনারা আমাকে দোয়া করুন যেন লােভ লালসা ও বিপদের মুখে মাথা উঁচু করে লড়ে যেতে পারি। আল্লাহ আপনাদের সহায় হউন। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, জয় হিন্দ। ইন্দিরা মুজিব জিন্দাবাদ, ভারত বাংলা মৈত্রী দীর্ঘজীবি হউক, জয় যৌথ বাহিনী।
১০৩
বক্তব্যের শেষে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি কামনা করে মােনাজাত করা হয়। মােনাজাত শেষে জাতীয় সঙ্গীতের, মাধ্যমে সভার কার্য শেষ করা হয়। সভাশেষে সভামঞ্চের উত্তরে চারজন দৃষ্কৃতি কারীর প্রত্যেককে একটি করে গুলিকরে ও বেয়বেট চার্জ করে মুত্যু দন্ড কার্যকরী করা হল। সভাস্থলে দেশ বিদেশের রেডিও টেলিভিশন ও সংবাদ পত্রের শতাধিক সংবাদিক উপস্থিত ছিল। তাদের ক্যামেরায় মুত্যুদন্ড কার্যকরী করার দৃশ্যের ছবি তুলে নিল। সভাশেষে সাংবাদিকরা বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকীকে ধরলেন। তাদের নানা প্রশ্ন মুক্তি যােদ্ধারা কিভাবে লড়লাে কেন পাকিস্তানিরা হারলাে। বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি না দিলে মুক্তি বাহিনী কি ঠিকই পাকিস্তান আক্রমণ করবে? যে চারজনকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হল তারা কি সত্যিই মুত্যুদন্ড পাবার মত অপরাধ করেছিল? এমনি অনেক প্রশ্নের মধ্যে ১৮ ই ডিসেম্বর পল্টন ময়দানে স্বাধীন বাংলায় লােকটিকে তার দুই মেয়ে ও পঞ্চাশ হাজার টাকাসহ বাড়ীতে পাঠিয়ে দিয়ে তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়।
বাতেন বাহিনী
১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে বাতেন বাহিনী অত্যন্ত বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাহিনীর প্রধান ও প্রতিষ্ঠাতা খন্দকার আব্দুল বাতেনের নাম অনুসারে এই বাহিনী ইতিহাসের পাতায় বাতেন বাহিনী নামে খ্যাতি লাভ করে। বাতেন বাহিনী হানাদার বাহিনীর সঙ্গে বহু যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। অজস্র হানাদার সৈন্য ও তাদের সহযােগিদের নিধন করে। দক্ষিণ টাঙ্গাইলের কনােরা গ্রামকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠলেও এই বাহিনীর যুদ্ধক্ষেত্র ছিল সমগ্র দক্ষিণ টাঙ্গাইল সহ ঢাকা জেলার কিছু অংশ; গাজীপুর জেলার কিছু অংশ, মানিকগঞ্জ জেলার উত্তর অঞ্চল এবং পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলার ব্যাপক অংশ। বাতেন বাহিনীর উল্লেখযোেগ্য যুদ্ধের মধ্যে ছিল মানিকগঞ্জ জেলার সিঙ্গাইর থানা আক্রমণ,দৌলতপুর থানা আক্রমণ ঘিওর থানা দফল সাটুরিয়া থানা দুই বার আক্রমণ চৌহালী অভিযান, নাগরপুর থানা মুক্ত করা, ধল্লার ব্রিজ আক্রমণ, মানিকগঞ্জের জাব্রাব্রিজের নিকট হানাদারদের গান বােট আক্রমণ ও মাসকাউলিয়াল রাজাকার নিধন। বাতেন বাহিনীতে সাড়ে তিন হাজার সশস্ত্র যােদ্ধা ছিল। একুশটি কোম্পানীর সমম্বয়ে বাতেন বাহিনী গঠিত ছিল । এই বাহিনীতে তেষট্টিটি প্লাটুন এবং একশতটি সেকশন ছিল। বাহিনীর কোম্পানী কমান্ডারগণ ছিলেন মেজর আবু তাহের, নায়েক হুমায়ুন কবীর খান,নায়েক আব্দুস সামাদ, নায়েক সিরাজুল হক খান, নায়েক ওয়াজেদ আলী খান, নায়েক আবুল খায়ের, সুবেদার আলমগীর, মােঃ দেলােয়ার হােসেন হারিজ, মােঃ হুমায়ুন কবীর খান, মােঃ ইন্তাজ আলী, মােঃ আব্দুস সামাদ, মােঃ ওয়াজেদ আলী খান, মােঃ আব্দুর রশীদ, মােঃ বেলাল হোেসন, মােঃ নূরুল ইসলাম, আমিনুর রহমান খান, মােঃ আফজাল হােসেন, মােঃ আল্লাদ খান, মােঃ জাহাঙ্গীর হােসেন, মােঃ আবু কায়সার ও মােঃ কফিল উদ্দিন। সুবেদার মেজর আব্দুল বারী ছিলেন বাতেন বাহিনীর ফিল্ড কমান্ডার। এই বাহিনীর তিনটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ছিলঃ (১) মানিকগঞ্জ জেলার সাটুরিয়া থানার অন্তর্গত তিল্লী গ্রাম, (২) টাঙ্গাইল জেলার দেলদুয়ার থানার অন্তর্গত লাউহাটি (৩) টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর থানার অন্তর্গত শাহজানির চর।
১০৪
বাতেন বাহিনীর যােদ্ধাদের সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য সামরিক প্রশিক্ষণ বিভাগ ছিল। এই বিভাগের দায়িত্ব যারা পালন করেন বা যােদ্ধাদের যারা সামরিক প্রশিক্ষণ দেন তারা হলেন-সুবেদার মেজর আবু তাহের, সুবেদার আব্দুল বারী,নায়েক ওয়াজেদ আলী খান, নায়েক আবুল খায়ের ও সুবেদার আলমগীর। বাতেন বাহিনীর কোয়ার্টার মাষ্টার ছিলেন খন্দকার আব্দুল করিম। বাতেন বাহিনীর বেসামরিক প্রশাসন পরিচালনার জন্য একটি বিভাগ ছিল। এই বিভাগ বেসামরিক বিভাগ নামে পরিচিত ছিল। বেসামরিক বিভাগের কাজ ছিল মুক্ত এলাকায় বেসামরিক শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা ও জনগণের জানমালের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা এবং সশস্ত্র যােদ্ধাদের সঙ্গে বিভিন্ন ভাবে সহযােগিতা করা। বেসামরিক বিভাগের প্রধান ছিলেন অধ্যাপক আলী আকবর খান ডলার। এই বিভাগের সচিব ছিলেন মহিদুর রহমান খান আলমগীর। বেসামরিক বিভাগকে প্রশাসনিক সুবিধার জন্য আবার কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যেমনঃ
(১) নিরাপত্তা বিভাগ,
(২) খাদ্য বিভাগ,
(৩) অর্থ বিভাগ,
(৪) বিচার ও গনসংযােগ বিভাগ,
(৫) রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ বিভাগ।
(১) নিরাপত্তা বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন,উপেন্দ্রনাথ সরকার বি, এস,সি, খন্দকার আব্দুস ছালাম, মীর শামসুল আলম শাহজাদা, আমিনুল ইসলাম খান, মােঃ সহিদুল ইসলাম, আব্দুল আলীম খান সেলিম, শহিদুল হক খান মল্লিক, মােঃ সুলতান উদ্দিন আহম্মেদ, খালেদ খান যুবরাজ, মােঃ ইউনুস খান, মােঃ শামসুল আলম, মােঃ মেজবা উদ্দিন নয়ন, মােঃ আব্দুল গফুর খান , মােঃ নুরুল ইসলাম, এস এম শামসুল হুদা, মােঃ আজগর আলী, খন্দকার ফজলুল হক, মােঃ খলিলুর রহমান, আব্দুর রশীদ, মােঃ রােস্তম আলী, মােঃ মানিক, মােঃ শাহজাহান, মােঃ রেজাউল বারী খান, খন্দকার এজাজ রসুল (জানু), মােঃ হাসমত আলী খান, মােঃ রফিকুল ইসলাম খান, আব্দুল হাসেম খান ঠান্ডা, অধ্যাপক আলী হাসান, মােঃ সাইদুল ইসলাম খান, মােঃ শাহজাহান মাষ্টার, মােঃ শাহজাহান (গ্যান্ডা), বাবু বৈষ্ণব বিশ্বাস, মােঃ আলী জিন্না, মােঃ আফতাব হােসেন আরজু, খন্দকার লুৎফর রহমান মিন্টু, শ্রী গৌর চন্দ্র সাহা, মােঃ বেনজির আহমেদ, আল মাসুদ, আব্দুল করিম খান, আমিনুর রহমান খান (মজিবর), মােঃ শাহজাহান খান (ওয়ারবেলস), মােঃ বজলুর রহমান খান (সাবু), মােঃ শরিফ উদ্দিন, মােঃ আফতাব উদ্দিন, বাবু নূপুর পােদ্দার, আনন্দ মােহন দাস, মােঃ জোসন আলী, ডঃ মােঃ শাহজাহান।
(২) খাদ্য বিভাগ- এই বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন অরুন কুমার বােস (বরুন) ও আব্দুর রাজ্জাক খান।
(৩) অর্থ বিভাগ-এই বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন খন্দকার আব্দুস সালাম ও আব্দুর রৌফ। (৪) বিচার-ও গণসংযােগ বিভাগ-এই বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন খন্দকার আব্দুস ছালাম, মীর শামসুল আলম, শাহজাদা ও মােঃ সুলতান উদ্দিন আহম্মেদ।
(৫) রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ বিভাগ-এই বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন অধ্যাপক আলী আকবর খান ডলার, খন্দকার আব্দুস ছালাম, মীর শামসুল আলম শাহজাদা, বাবু উপেন্দ্রনাথ সরকার বি, এস, সি, অধ্যাপক আলী হাসান, মহিদুর রহমান খান আলমগীর, অধ্যাপক আশরাফ উদ্দিন খান ছিলেন রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ বিভাগের উপদেষ্টা। বেসামরিক বিভাগের নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন মােঃ দেলােয়ার হােসেন খান চারু ও মােঃ সেলিম খান।
১০৫
যুদ্ধক্ষেত্রের আহত বা অসুস্থ যােদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য বাতেন বাহিনীর ভ্রাম্যমান হাসপাতাল ছিল । ভ্রাম্যমান হাসপাতালের চিকিৎসকের দায়িত্বে ছিলেন-বেঙ্গল রেজিমেন্টের চিকিৎসক ডাঃ জহিরুল ইসলাম এবং তার সহকারী ছিলেন ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজের ডাক্তার বসন্ত কুমার সাহা ও সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া চিকিৎসা কেন্দ্রের চিকিৎসক ডাক্তার নিখিল চন্দ্র সাহা, হাসপাতালের সেবিকা হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন আঙ্গুরী রানী সরকার। বাতেন বাহিনী নিজস্ব এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের যুদ্ধ সহ বিভিন্ন প্রকারের সংবাদ আদান প্রদানের জন্য অগ্নি শিখা নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করত। খন্দকার আব্দুল বাতেন ছিলেন স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুতে একজন তুখােড় ছাত্রনেতা। ঐ সময়ে তিনি টাঙ্গাইল জেলা ছাত্রলীগের একাংশের সভাপতি এবং বন্দের আলীগড় নামে খ্যত সাদত বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ ছাত্র সংসদের সহ সভাপতি। তিনি ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের প্রথম দিক থেকেই টাঙ্গাইল জেলার বিভিন্ন স্থানে স্বাধীনতার পক্ষে প্রচার চালান। জেলার বিভিন্ন থানায় বিভিন্ন কলেজে জয় বাংলা বাহিনী, জয় বাংলা ক্যাপ ও স্বাধীনতার ইস্তেহার প্রচার করেন খন্দকার আব্দুল বাতেন। তার সেই ভূমিকা তখন উপলব্ধি না করে তার কার্যক্রমকে অনেকেই উপহাস করেছে। অনেকেই তার কাজে বাধা সৃষ্টি করেছে। কিন্তু সকল প্রকার প্রতিকুলতা ও বাঁধাকে উপেক্ষা করে খন্দকার আব্দুল বাতেন স্বাধীনতার সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাবার প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। ১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চ সকালে ই.পি.আর বাহিনীর ওয়ারলেস কর্তৃক ট্রান্সমিট করা বঙ্গবন্ধুর শেষ বার্তা এস.এম. রহমান নামে খন্দকার আব্দুল বাতেনের হস্তগত হয়। সেই বার্তা পাওয়ার পর তিনি নতুন উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে বন্দে আলিগড় নামে খ্যত সাদত বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ সহ জেলার বিভিন্ন থানায় মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালের ৩রা এপ্রিল হানাদার বাহিনীর টাঙ্গাইল শহরে প্রবেশ করার পর খন্দকার আব্দুল বাতেন জেলার বিভিন্ন স্থানে মুক্তিবাহিনী গড়ে তােলার জন্য জীবনকে বাজী রেখে ঝড়ের গতিতে তৎপরতা চালান। এক পর্যায়ে তিনি তার নিজ গ্রাম টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর থানার অন্তর্গত কনােড়া গ্রামে যান।
গ্রামে এসেই খন্দকার আব্দুল বাতেন তরুণ তাজা যুবক এবং অস্ত্রের সন্ধানে বের হন। তাঁর বেমুক্তিবাহিনী গড়ে তােলার সংবাদ পেয়ে গ্রামের বেশ কিছু তরুণ-যুবক প্রচন্ড উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে এগিয়ে আসেন। এই সমস্ত যুবকদের মধ্যে ছিলেন-আবুল কালাম আজাদ (শাহজাহান), মােঃ দেলােয়ার হােসেন হারিজ, আফতাব হােসেন আরজু, মােঃ আলী জিন্না, উপেন্দ্রনাথ সরকার বি, এস,সি, খন্দকার আব্দুস ছালাম, খন্দকার আব্দুল করিম, মেজবা উদ্দিন নয়ন, আব্দুর রশিদ, ওয়াজেদ আলী, আব্দুল মান্নান ফিরােজ, মীর শামসুল আলম শাহজাদা, মােঃ শাহজাহান ওরফে গ্যাভা, মীর জাহাঙ্গীর, মীর কায়সার, মােঃ বেলাল হােসেন, মােঃ জাহাঙ্গীর আলম, মােঃ আব্দুল কদুছ। খন্দকার আব্দুল বাতেনের মুক্তিযােদ্ধাদের সংগঠিত করার সংবাদ পেয়ে এগিয়ে আসেন টাঙ্গাইল জেলার দেলদুয়ার থানার লাউহাটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আততায়ার রহমান খান ওরফে কামাল খান। বাঙ্গালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামকে শক্তিশালী করার জন্য আতােয়ার রহমান খান ওরফে কামাল খান খন্দকার আব্দুল বাতেনকে ম্যাগজিন ছাড়া চারটি রাইফেলের সন্ধান দেন। ঐ রাইফেল চারটি লাউহাটির পার্শ্ববর্তী গ্রাম তারুটিয়ার এক ডােবায় পাট পচা পানির নীচ থেকে
১০৬
খন্দকার আব্দুল বাতেন তার সঙ্গীদের নিয়ে তুলে আনেন। ম্যাগজিন ছাড়া চারটি রাইফেল আর এলাকার কয়েকজন দুঃসাহসী যুবককে নিয়ে খন্দকার আব্দুল বাতেন শুরু করেন মুক্তিবাহিনী গড়ে তােলার কাজ। তার মুক্তিবাহিনী গড়ে তােলার সংবাদ অতিদ্রুত বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। খন্দকার আব্দুল বাতেনের মুক্তিবাহিনী সংগঠিত করার সংবাদ পাবার পর বিভিন্ন স্থান থেকে বহু দুঃসাহসী যুবক তার সংগঠনে যােগদান করার জন্য ছুটে আসে। যেমনি-বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, স্কুলের ছাত্র আসতে শুরু করে, তেমনি আসতে শুরু করে কৃষক শ্রমিক সহ সাধারণ যুবক। এর পাশাপাশি আসতে থাকে বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্য,ই, পি, আর বাহিনীর সদস্য, পুলিশের ও আনসার বাহিনীর সদস্যবৃন্দ। তাদের অনেকেই সঙ্গে নিয়ে আসে বিভিন্ন ধরনের আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র। খন্দকার আব্দুল বাতেনের মুক্তিবাহিনীর গড়ে তােলার সংবাদ পেয়ে টাঙ্গাইল জেলার দেলুয়ার থানার গজিয়া বাড়ি গ্রামের দুঃসাহসী যুবক ফজলুল হক মল্লিক একটি চায়নিজ এল, এম.জি সহ কিছু অস্ত্রশস্ত্র ও বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্য আনােয়ার হােসেন এবং নিজ গ্রামের ইসমাইল হােসেন ঠান্ডু সহ বেশ কিছু যুবকদের সঙ্গে নিয়ে বাতেন বাহিনীতে যােগদান করেন। আরাে আসেন টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুর থানার পাকুল্লা গ্রামের বেঙ্গল রেজিমেন্টের সুবেদার আব্দুল বারী, নায়েক আজহারুল ইসলাম ও ল্যান্স নায়েক মজিবর রহমান তালুকদার মন্টু। এ সমস্ত বেঙ্গল রেজিমেন্টের জোয়ানরা বেশ কিছু চাইনিজ রাইফেল, গােলাবারুদ ও অনেকগুলি গ্রেনেড সঙ্গে নিয়ে আসেন। এ ধরণের বিভিন্ন শ্রেণীর যুবকদের যােগদান করার ফলে বাতেন বাহিনী ক্রমশই শক্তিশালী বাহিনীতে পরিণত হতে শুরু করে। বাতেন বাহিনীকে আরাে শক্তিশালী করে তুলার জন্য এগিয়ে আসেন অধ্যাপক আলী আকবর খান ডলার। তিনি তার সঙ্গে মহিদুর রহমান খানসহ আরাে বহু সংখ্যক যুবককে নিয়ে আসেন। এর ফলে বাতেন বাহিনীতে অসংখ্য যুবকের ভীড় জমে যায়। একদিকে বিস্নি স্থান থেকে যুবকদের আগমন, অন্যদিকে বেঙ্গল রেজিমেন্টের ও ইপিআর, পুলিশের অস্ত্রশস্ত্রসহ আগমনে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই খন্দকার আব্দুল বাতেন এক বিশাল বাহিনী গড়ে তুলতে সক্ষম হন। মাত্র চারটি রাইফেল আর কয়েকজন যুবককে নিয়ে বিশাল বাহিনী গড়ে তােলার পিছনে ছিল খন্দকার আব্দুল বাতেনের একনিষ্ঠতা ও দক্ষ নেতৃত্ব। তিনি প্রবাসী সরকার বা ভারতীয় সরকারের সহযােগিতা ছাড়াই নিজের শক্তি, সামর্থ্য ও যােগ্যতা দিয়ে এই বিশাল বাহিনী গড়ে তােলেন। এই বাহিনীকে বলা চলে, ভারতীয় সরকার ও প্রবাসী সরকার কোন প্রকার সহযােগিতা করেনি। খন্দকার আব্দুল বাতেন তার বাহিনীকে শক্তিশালী করেন বিভিন্ন স্থান থেকে হানাদার বাহিনীর অস্ত্রশস্ত্র ও গােলাবারুদ ছিনিয়ে এনে। খন্দকার আব্দুল বাতেন ১৯৭১ সালের মে মাসের প্রথম দিক থেকেই হানাদার বাহিনীর উপর আক্রমণ পরিচালনা শুরু করেন। মে মাসের চার তারিখে খন্দকার আব্দুল বাতেন তার বাহিনী নিয়ে মানিকগঞ্জ জেলার সিঙ্গাইর থানা আক্রমণ করেন। এই আক্রমণটি বাতেন বাহিনীর একটি উল্লেখযােগ্য যুদ্ধ ছিল। পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুসারে সিঙ্গাইর থানা আক্রমণের সিদ্ধান্ত কার্যকরী করার জন্য বাহিনীর প্রধান খন্দকার আব্দুল বাতেন নৌকা যােগে তার বাহিনী নিয়ে সিঙ্গাইর প্রবেশ করেন। তার সঙ্গে ছিলেন সুবেদার আব্দুল বারী, আবুল কালাম আজাদ (শাহজাহান), মােঃ দেলােয়ার হােসেন হারিজ, মােঃ ফজলুল হক মল্লিক, আব্দুর রশীদ, মােঃ আলী জিন্না, আবতাব হােসেন আরজু, নায়েক আব্দুস সামাদ, হরমুজ আলী বি.এস.সি, নায়েক আজহারুল ইসলাম, নায়েক হুমায়ুন, নায়েক আলাউদ্দিন, নায়েক সিরাজুল হক, ই.পি.আর বাহিনীর সদস্য বাবুল চৌধুরীসহ আরাে অনেকে। ঝড়
১০৭
বৃষ্টির রাত্রে ১১টার সময় আক্রমণ করা হয়। খন্দকার আব্দুল বাতেন ও সুবেদার আব্দুল বারির নেতৃত্বে বাতেন বাহিনীর দুটি দল সিঙ্গাইর থানা আক্রমণ করে। বাহিনীর প্রধান খন্দকার আব্দুল বাতেন তার হাতের চায়নিজ স্টেনগান দিয়ে গুলি ছুঁড়ে আক্রমণের সূচনা করেন। অধিনায়কের গুলি ঘোড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাহিনীর সমস্ত যােদ্ধাদের অস্ত্র থেকে গুলি বর্ষণ হতে থাকে। দ্বিমুখী আক্রমণের চাপে হানাদার বাহিনীর সৈন্যরা ও তাদের সহযােগী পুলিশের সদস্যরা দিশেহারা হয়ে পড়ে। এখানে বাতেন বাহিনীর সঙ্গে হানাদার বাহিনীর দু’ঘন্টা যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে হানাদারদের প্রচুর জীবনহানি ঘটে। যুদ্ধের এক পর্যায়ে হানাদার সৈন্যরা প্রচুর মৃতদেহ, অস্ত্র ও গােলাবারুদ রেখে পালিয়ে যায়। হানাদার সৈন্যদের পালিয়ে যাবার পর সিঙ্গাইর খানা বাতেন বাহিনীর দখলে আসে। দখল করার পর সেখান থেকে বাতেন বাহিনী প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ও গােলাবারুদ উদ্ধার করে। এই যুদ্ধে বাতেন বাহিনীর পক্ষে তেমন কোন ক্ষতি হয়নি। তবে যুদ্ধে ভাগ্যের জোরে অল্পের জন্য জীবন নিয়ে ফিরে আসতে পেরেছেন মােঃ ফজলুল হক মল্লিক। কারণ তিনি যখন গুলি ছুঁড়ে ক্রলিং করে থানার উপকণ্ঠে উপস্থিত হন তখন পিছন থেকে একটি গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়। যা বিস্ফোরিত হবার মাত্র কয়েক মুহূর্ত আগে তিনি দূরে চলে যান। সিঙ্গাইর থানা পতনের পর ভোঁর ছয়টার দিকে দুইটি সার জেট জঙ্গী বিমান স্থানা আক্রমণকারী বাতেন বাহিনীর উপর দিয়ে উড়ে যায়। প্রথমে বাতেন বাহিনীর যােদ্ধারা মনে করেন বিমান দুইটি আর হয়তাে ফিরে আসবে না। কিন্তু দেখা গেল বিমান দুইটি উপর দিয়ে বারবার ক্রাইভ দেয়া শুরু করল। বিমানের উড়া দেখে সুবেদার আব্দুল বারী বিমান দুটিকে গুলি করার জন্য বাহিনীর প্রধান খন্দকার আব্দুল বাতেনের নিকট অনুমতি চায়। অধিনায়কের অনুমতি পেয়ে সুবেদার আব্দুল বারী ও নায়েক আজহার জি খ্রি দিয়ে বিমান দুটিকে গুলি করে। জি খ্রিগুলির মুখে বিমান দুটি অতি দ্রুত স্থান ত্যাগ করে চলে যায়। সিঙ্গাইর থানা আক্রমণ করে সফলতা অর্জন করা বাতেন বাহিনীর যােদ্ধাদের মনে উৎসাহ এবং উদ্দিপ্না ব্যাপকভাবে বেড়ে যায় হানাদার নিধনে। বাতেন বাহিনীর আরো একটি উল্লেখযােগ্য যুদ্ধ ছিল মানিকগঞ্জ জেলার দৌলতপুর থানা আক্রমণ। ১৯৭১ সালের ১৭ই যে ৰন্দকার আব্দুল বাতেনের নেতৃত্বে রাত দুইটার সময় বাতেন বাহিনীর দুঃসাহসী যােদ্ধারা দৌলতপুর থানা আক্রমণ করে। হানাদার বাহিনীর মিলিশিয়া ও পুলিশ বাহিনীর লােকজন দৌলতপুর থানা প্রতিরক্ষার কাজে নিয়োজিত ছিল। তিন ঘন্টা ব্যাপী প্রচন্ড সংঘর্ষ হবার পর হানাদার বাহিনীর খুনীরা তাঁর লাশ ও অস্ত্রশস্ত্রসহ গােলাবারুদ ফেলে পালিয়ে যায়। দৌলতপুর থানায়ু উত্তোলিত হয় স্বাধীনতার পতা। পতাকা উত্তোলন করেন বাহিনীর প্রধান খন্দকার আব্দুল বাতেন। বাতেন বাহিনীর যােদ্ধারা ১৮ই মে বিকেল তিনটার সময় দৌলতপুর থানা ত্যাগ করে চলে আসে। কারণ তাদের যুদ্ধের কৌশল ছিল শত্রুকে আঘাত করে সরে পরা। বাতেন বাহিনীর যােদ্ধারা ১৯৭১ সালের মে মাসের শেষের দিকে সিরাজগঞ্জ জেলার চৌহালী থানা আক্রমণ করে। বাহিনীর প্রধান সংবাদ পান চৌহালি থানার একটি গ্রামে ১৫ পেটি চায়নিজ এল.এম.জি. এবং রাইফেলের গুলি আছে। সংবাদ পাবার পর বাহিনীর প্রধান বড় একটি ছিপ নৌকায় তার বাহিনীর বেশ কিছু দুর্ধর্ষ যােদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে চৌহালির দিকে যাত্রা করেন। ঝড় বৃষ্টির প্রচন্ড তান্ডবের মধ্যে ধলেশ্বরী পাড়ি দিয়ে যমুনা নদী দিয়ে চৌহালি থানার উপকণ্ঠে উপস্থিত হন। ছিপ নৌকাটি থানার অতি সন্নিকটে রেখে বাহিনীর ২০ জন যােদ্ধাকে গুলি উদ্ধার করার জন্য পাঠানাে হয়। অধিনায়ক সহ মাত্র ৫ জন যােদ্ধা বৃষ্টির মধ্যে নৌকায় অবস্থান করে। হঠাৎ আকাশের
১০৮
বিদ্যুৎ চমকানাের আলােয় বীর যােদ্ধাদের চোখে পড়ে চৌহালি থানা। তারা দেখতে পায় মাত্র ৫০ গজ দূরেই চৌহালি থানা। থানার এত কাছে সকলে নিজেদের বিপদ হতে পারে ভেবে দূরে সরে যাবার চিন্তা ভাবনা করে, কিন্তু তাও যাওয়া সম্ভব নয়। কারণ অন্য যােদ্ধাদের ফেলে দূরে যাওয়া যেমন সম্ভব নয় তেমনি প্রাকৃতিক কারণে মাত্র চারজনের পক্ষে ঐ ছিপ নৌকা চালিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। এ অবস্থায় অধিনায়ক থানার হানাদার বাহিনীর অবস্থান সম্পর্কে খোঁজ খবর নেওয়ার জন্য চিন্তা করেন এবং নায়েক আজাহারকে নির্দেশ দেন থানার খোজ খবর আনার জন্য। নায়েক আজাহার অধিনায়কের নির্দেশ মােতাবেক ক্রলিং করে থানার ভিতরে যান। তিনি সেখানে দেখতে পান দুটি বাংকার থানার সামনে। তা বৃষ্টির পানিতে সয়লাব হয়ে গেছে। কোন সেন্ট্রি নেই। থানায় অবস্থানরত সমস্ত হানাদার সৈন্যরা ঘুমানাে । থানার অবস্থা দেখে এসে নায়েক আজাহার অধিনায়কের নিকট তা বর্ণনা করেন। অধিনায়ক থানার অবস্থা শুনে এ ধরনের সূবর্ণ সুযােগ হাত ছাড়া হতে দিতে রাজী নন। কাজেই তিনি মাত্র চারটি অস্ত্র নিয়ে এবং চারজন যােদ্ধা নিয়ে থানা আক্রমণের জন্য অগ্রসর হন। চারজন দুঃসাহসী যােদ্ধা ক্রলিং করে সেন্ট্রি শূন্য বাংকার অতিক্রম করে থানার মূল দালানের বারান্দায় উপস্থিত হন। সেখানে দেখতে পান অস্ত্র হাতে দু’জন সেন্ট্রি ঘুমাচ্ছে। এই অবস্থা দেখে ঘুমানাে সেন্ট্রি দুজনের মুখ চেপে ধরে সরিয়ে আনেন। বন্দী দুই সেন্ট্রির নিকট শুনেন থানার ভিতর সবাই ঘুমানাে। এই বিবরণ শােনার পর হানাদার নিধনে উন্মাদ হয়ে অধিনায়কের নেতৃত্বে বাতেন বাহিনীর দুঃসাহসী যােদ্ধারা নিদ্রিত হানাদারদের কক্ষে প্রবেশ করে। হানাদার বাহিনীর বিভাের ঘুমানাের সুযােগে বাতেন বাহিনীর যােদ্ধারা সেখান থেকে স্ট্রংরুমে প্রবেশ করে ১১টি জি.খ্রি. এবং ১২টি থ্রি, ও, খ্রি. মার্কফোরসহ প্রচুর গােলাবারুদ দখল করে নেন। অস্ত্রশস্ত্র ও গােলাবারুদসহ বিজয়ী বেশে খন্দকার আব্দুল বাতেন তার সহযােদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে ছিপ নৌকায় ফিরে আসেন। নৌকায় উঠার পর নৌকা নিয়ে যমুনার উজান বেয়ে উত্তর দিকে অগ্রসর হতে থাকে। তাদের আশংকা গুলির সন্ধানে যাওয়া যােদ্ধাদের নাগাল পাওয়া যাবে কিনা? প্রায় মাইল খানেক এগিয়ে যাবার পর টর্চের সিগন্যাল দেওয়া হয়। সিগন্যাল পাবার ১০ মিনিটের মধ্যেই ২০ জন যােদ্ধা গুলির পেটিসহ নৌকায় উপস্থিত হন। তার কয়েক মিনিট পরেই চৌহালি থানা থেকে হানাদার বাহিনীর সদস্যরা প্রচন্ড বেগে গুলি বর্ষণ করতে শুরু করে। হানাদার সৈন্যদের একটি দল থানার বাইরের একটি গ্রামে নারী ধর্ষণসহ লুটপাট করতে গিয়েছিল। ঘাতকদের এই দলটি থানায় এসেই গুলিবর্ষণ করতে শুরু করে। হানাদারদের গুলির ভিতর দিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাতেন বাহিনীর যােদ্ধারা যমুনা নদী পাড়ি দেন। মাত্র ৪টি রাইফেল নিয়ে চারজন যােদ্ধার পক্ষে একটি থানা আক্রমণ শুধু আত্মঘাতীই নয়, এ অভিযান হানাদার নিধনের উন্মাদের সুস্পষ্ট কার্যক্রম। এ অভিযান ছিল যুদ্ধের সকল রীতিনীতি ও কৌশল বহির্ভূত। এ এক অবিশ্বাস্য এবং অসম্ভব ঘটনা। অথচ চরম সত্য হল চারটি জি.থ্রিসহ চারজন দুঃসাহসী যােদ্ধার দ্বারা চৌহালি থানা আক্রান্ত। শত্রুরা বিভাের ঘুমের মাঝে হতচকিত। অস্ত্রশস্ত্র গােলাবারুদ চারজন বীর যােদ্ধার দখলে। বাতেন বাহিনীর কৃতিত্বপূর্ণ অভিযানগুলাের মধ্যে অন্যতম ছিল মানিকগঞ্জ জেলার ঘিউর থানা দখল। ১৯৭১ সালের মে মাসের শেষের দিকে এ অভিযানটি পরিচালিত হয়। ঘিউর থানা অভিযান ছিল প্রকৃতপক্ষেই যুদ্ধের গেরিলা কৌশল। বাহিনীর প্রধান খন্দকার আব্দুল বাতেন একমাল্লা চালিত একটি ছােট নৌকা নিয়ে ৫/৬ জন সাহসী সঙ্গীসহ ঘিউর থানার বিভিন্ন স্থানে গণসংযােগ ও অস্ত্রশস্ত্রের সন্ধান এবং ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে হানাদার সৈন্যদের অবস্থান ও আনাগােনা সম্পর্কে খোঁজ খবর নিতে যান। ঘিউর থানার অবস্থান, থানায় শত্রুপক্ষের শক্তি, হানাদার বাহিনীর অস্ত্রশস্ত্রের
১০৯
প্রকৃতি, জনগণের মানসিকতা এবং যােগাযােগের অনুকূল পরিবেশ লক্ষ্য করে খন্দকার আব্দুল বাতেন ঘিউর থানা আক্রমণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য দু’টি কোম্পানীকে ডেকে পাঠান। আক্রমণের দিনটি ছিল ঘিউর হাটের দিন। হাটে প্রচুর ছাগল, ভেড়া বেচাকেনার জন্য আনা হয়। বাতেন বাহিনীর অধিনায়ক খন্দকার আব্দুল বাতেন ছদ্মবেশে হাটে উপস্থিত হন থানার বাংকারগুলাের অবস্থা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং শত্রুর সংখ্যা নিজে প্রত্যক্ষ করেন। হাটে ছাগল ভেড়ার সংখ্যা দেখে অধিনায়কের মাথায় নতুন ধরনের রণকৌশলের আবির্ভাব হয়। সন্ধ্যার আগেই আগত দুই কোম্পানী থেকে ১৫ জন করে ৩০ জনের আক্রমণকারী পার্টি গঠন করেন। বাহিনীর অধিনায়ক আব্দুল বাতেনের নেতৃত্বে শর্ট আর্মসে সজ্জিত উক্ত ৩০ জনের আক্রমণকারী দল তরকারীর ঝাকা মাথায় নিয়ে হাটে প্রবেশ করেন। তার আগে ছাগল ভেড়ার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বাহিনীর প্রধানের আলােচনা হয়। দেশ ও জাতির মুক্তির প্রশ্নে তারা বাতেন বাহিনীকে যে কোন ধরনের সহযােগিতা করতে রাজী হয়। সন্ধ্যা সমাগত। এমন সময় একদল ছাগল ভেড়া নিয়ে থানার দিকে অগ্রসর হয় সেই তরকারীর ঝাকা মাথায় নেয়া বীর যােদ্ধারা। রণকৌশলের কারণে ছাগল ভেড়ার দলকে থানার ভিতরে প্রবেশ করানাে হয়। তাতে থানার নিরাপত্তা ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। থানার নিরাপত্তা কাজে নিয়ােজিত সেন্ট্রিরা ছাগল ভেড়া প্রবেশে দিশেহারা হয়ে পড়ে। ছাগল ভেড়া ফিরিয়ে আনার অভিনয় করে থানায় প্রবেশ করে ঝাকা-মাথায় বাতেন বাহিনীর দুঃসাহসী যােদ্ধারা। তার পরের ইতিহাস অত্যন্ত চমকপ্রদ। বিনা গুলিতে বিনা রক্তপাতে ঘিউর থানা বাতেন বাহিনীর দখলে আসে। এখানে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ও গােলা বারুদ বাতেন বাহিনীর হস্তগত হয়। যা পরবর্তীতে বাতেন বাহিনীকে ব্যাপক শক্তিশালী করে তােলে। অভিযান শেষে ছাগল-ভেড়া একত্রিত করে ব্যবসায়ীদের পৌছে দেয়া হয়। সন্ধ্যার আধারে তখন হাট চলছিল। হাটে বেচা-কেনায় জনতা ব্যস্ত তারা জানতে পারল না আধঘন্টার মধ্যে বাতেন বাহিনীর যােদ্ধারা থানা দখল করে নিয়েছে। হাটের বেচা কেনার ও স্বাভাবিক জীবন যাত্রায় যাতে বিঘ্ন সৃষ্টি না হয় তার জন্য “জয় বাংলা ” বা “শেখ মুজিব” শ্লোগান দেয়া হয়নি। ছাগল-ভেড়া মালিকদের নিকট পৌছে দিয়ে চিড়া মুড়ি গুড়ের ব্যবস্থা করে বাতেন বাহিনীর বীর যােদ্ধারা বিজয়ী বেশে দূরে অবস্থিত নৌকাগুলিতে আরােহণ করে। ছিপ নৌকা বাইছ দিয়ে তারা রওনা হয় তাদের হেডকোয়ার্টারের দিকে। ঢাকা টাঙ্গাইল মহাসড়কের মির্জাপুর থানার ধল্লাব্রীজ অভিযান ছিল বাতেন বাহিনীর একটি দুঃসাহসিক অভিযান। এ ব্রীজে পাহারার কাজে নিয়ােজিত ছিল রাজাকার বাহিনীর ২০ জন সদস্য। তারা ব্রীজের দুপাশে ১০ জন করে অবস্থান করত। এ সড়ক দিয়ে প্রতিনিয়ত হানাদার বাহিনীর ট্রাক, জীপ ঢাকা থেকে টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, জামালপুর, শেরপুর সহ বিভিন্ন স্থানে আসা যাওয়া করত । ব্রিজের পাহারাদার রাজাকাররা নীরিহ পথচারীদের ও আশ পাশের গ্রামের লােকদের অত্যাচার, নির্যাতন করত এবং তাদের সর্বস্ব লুট করত। এ ধরনের অভিযােগ শােনার পর বাতেন বাহিনীর প্রধান খন্দকার আব্দুল বাতেন ধল্লা ব্রিজ আক্রমণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। অভিযান পরিচালনার জন্য ব্রিজের খুটিনাটি বিবরণ সহ বিস্তারিত তথ্যাবলী সংগ্রহ করেন। তার প্রেক্ষিতে খন্দকার আব্দুল বাতেন একটি ছিপ নৌকায় ২৫ জন সহযােদ্ধা সঙ্গে নিয়ে ধল্লা ব্রিজের কাছেই এক পাট ক্ষেতে অবতরণ করেন। নৌকায় ৫ জন রেখে বাকী ২০ জনকে সঙ্গে নিয়ে ব্রিজের দিকে অগ্রসর হন আব্দুল বাতেন। ২০ জনের সবাই ছিল শর্ট আর্মসে সুসজ্জিত। তারা যুদ্ধের কৌশল হিসাবে সবাই হাজী সাহেবদের পােষাক পরেন। ব্রিজের কাছাকাছি পৌছানাের একটু আগেই হানাদার বাহিনীর দুটি ট্রাক টাঙ্গাইলের দিকে চলে যায়। পরিকল্পনা অনুসারে অধিনায়কের নেতৃত্বে দশ জনের একটি দল
১১০
অগ্রগামী হয়ে যায়। দশ গজ পিছন থেকে অনুসরণ করে অপর দশ জনের দলটি। অগ্রগামী দশ জন ব্রিজের দক্ষিণ পাশের প্রান্ত সীমায় অবস্থানত দশ জন রাজাকারকে আকস্মিকভাবে আক্রমণ করে তাদের অস্ত্রশস্ত্র ছিনিয়ে নেয় এবং হাত মুখ বেঁধে ফেলে । পিছনের অনুসরনকারী দলের দশজন ব্রিজের উত্তর পাশের রাজাকারদের উপর আক্রমণ চালিয়ে তাদের অস্ত্রশস্ত্র ছিনিয়ে নেয় এবং বন্দী করে। ৫ মিনিটের মধ্যে ২০ জন রাজাকার বন্দী করে বাতেন বাহিনীর বীর যােদ্ধারা ছিপ নৌকা নিয়ে দ্রুতগতিতে সরে পরে। কিছুদূর সরে যাবার পর ব্রিজের নিকট থেকে প্রচণ্ড বেগে গুলিবর্ষণ করতে থাকে হানাদার সৈন্যরা। সম্ভবত ব্রিজের কাছে কোন লােকের পাঠানাে সংবাদ পেয়ে চাকা অথবা টাঙ্গাইল থেকে এসে হানাদার সৈন্যরা গুনী বর্ষণ করে। কিছুদূর যাবার পর বন্দী রাজাকারদের জবানবন্দী নেয়া হয়। স্বাধীনতাকামী মুক্তিসেনাদের এবং বাঙ্গালি জাতির স্বাধীনতার বিরুদ্ধে এই রাজাকারগণ আর কোন ভূমিকা গ্রহণ প্রবে না। এ প্রতিশ্রুতিতে ওদের মুক্তি দেয়া হয়। অবশ্য কিছু উত্তম মধ্যমও এর সাথে যােগ হয়। অশিক্ষিত অধম বাঙ্গালির সন্তান টাকার লােভে রাজাকার বাহিনীতে যােগদান করে। তাদের স্ত্রী-পুত্র সহ পরিবার আছে। এ মানবিক চিন্তাই তাদের মুক্তির কারণ। ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে হানাদারদের অবিরাম উপস্থিতি, ধল্লা ব্রিজের অবস্থান ও পারিপার্শ্বিকতা ভেবে ব্রিজ আক্র ছিল অত্যন্ত কঠিন অভিযান। ঢাকা আরিচা মহাসড়কে মানিকগঞ্জ জেলার জাব্রা ব্রিজের নিকট হানাদারদের পানবােট ধ্বংস করা ছিল বাতেন বাহিনীর কৃতিত্বপূর্ণ আক্রমণ। গােলাবারুদের অভাবে বাহিনীর ৬২টি চাইনিজ রাইফেল এবং ১৫টি এল, এম, জি, প্রায় অকেজো হয়ে পড়ে। সে সময়ে বাহিনীর সােয়েন্দা দপ্তরের মাধ্যমে অধিনায়ক খন্দকার আব্দুল বাতেন সংবাদ পান যে, মানিকগঞ্জের জাব্রা ব্রিজের উত্তরে এক গ্রামে ১৭ পেটি চাইনিজ গুলি আছে। সেই গুলির সন্ধান এবং উদ্ধার করার লক্ষ্যে অধিনায়ক আব্দুল বাতেন দুই কোম্পানি যােদ্ধা সহ ঐ এলাকার দিকে অস্ব হন। কোম্পানী কমান্ডার ছিলেন নায়েক আব্দুস সামাদ ও নায়েক আজাহার। বহু কষ্টে বহু পথ ঘাট অতিক্রম করে মানিকগঞ্জের সেই গ্রামে উপস্থিত হন বাতেন বাহিনীর দুঃসাহসী যােদ্ধারা। সৌজস্য বশত ১৭ পেটি গুলিই পাওয়া যায় সেখানে। ফলে জীবন ফিরে পায় ৬২টি চাইনিজ রাইফেল এবং ১৫টি চাইনিজ এল, এম. জি. ওখানে আরাে অতিরিক্ত পাওয়া যায় একশ তাজা গ্রেনেড । ঐ সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র পাবার পর বাতেন বাহিনীর যােদ্ধারা যখন স্থান ত্যাগ করার প্রস্তুতি নেয়, তখন চার পাশ থেকে বিভিন্ন গ্রামের লােকজন এসে ভীড় করে। জনতা সংবাদ দেয় যে প্রতি সপ্তাহে একটি করে গানবােট অস্ত্রশস্ত্র ও গােলাবারুদ নিয়ে উত্তর দিকে যায়। যাবার সময় গানবােটটি জাব্রা ব্রিজের ৩/৪ মাইল উত্তরে একটি নির্দিষ্ট হাটে থামায়। হানাদার সৈন্যরা গানবােট থেকে নেমে নদীর পশ্চিম তীরের বিভিন্ন গ্রামে আক্রমণ চালায়। তারা ঐ সমস্ত গ্রামে হত্যা লুট-পাট-অগ্নিসংযােগ ও নারী ধর্ষণ করে। ইতিমধ্যে হানাদার সৈন্যরা ঐ এলাকা থেকে ১৫/২০ জন যুবতী মেয়েকে পানবােটে ভুলে নিয়ে যায়। এ ফলে অত্র এলাকায় স্বজনহারার বেদনা ও যুবতী কন্যা অপহরণজনিত আর্তনাদে আকাশ-বাতাস-ভারী করে তােলে। স্থানীয় জনসাধারণ বাতেন বাহিনীর কাছে বারবার দাবী করতে থাকে আপনারা এ অত্যাচার ঝেকে আমাদের মুক্তি দিন। জনতার আকুল দাবীর মুখে খন্দকার আব্দুল বাতেন বিষয়টি সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা ও প্রতিরােধের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সিদ্ধান্ত নেন। অকূলস্থে যাবার পর দেখা গেল পাল মশাইদের হাড়ি পাতিল তৈরি করার এটেল মাটির চিবি সারি সারি ভাবে সাজানাে আছে। নদীটিও সে স্থানে একটু সংকীর্ণ ছিল। কোম্পানী কমান্ডারদের সঙ্গে পরামর্শ করে আক্রমণের কৌশল ঠিক করেন বাহিনীর অধিনায়ক। মাটির ঢিবিগুলি নদীর ঘাট থেকে দুইশত গজ দূরে অবস্থিত ছিল। সেখানেই বাংকার
১১১
করে পজিশন নেন বাতেন বাহিনীর যােদ্ধারা। প্রথম দিকে যেভাবে পজিশন নেয়, সেভাবে হানাদার সৈন্যদের ঘায়েল করা কঠিন হবে ভেবে কোম্পানী কমান্ডারদ্বয় বাহিনীর অধিনায়কের সঙ্গে পরামর্শ করে দুই কোম্পানীকে নদীর দুই তীরে পজিশন নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সিদ্ধান্ত কার্যকরী করার জন্য ঘন অন্ধকারে নৌকা যােগে নদীর পূর্ব-তীরে নায়েক আব্দুস সামাদের নেতৃত্বে এক কোম্পানী পাঠানাে হয়। সিগন্যাল কর্মপদ্ধতি এবং শক্ৰদ্বারা আক্রান্ত হলে অথবা কোম্পানী প্রত্যাহার করার প্রয়ােজন দেখা দিলে নদীর দুই তীরের কোম্পানী কোথায় একত্রিত হবে তার পয়েন্ট নির্ধারণ করে দেয়া হয়। এর পর বাতেন বাহিনীর যােদ্ধারা হানাদার সৈন্যের আগমণের জন্য প্রতীক্ষায় বসে থাকে। রাত দুটার সময় যােদ্ধারা গ্রামবাসীদের দেওয়া খাদ্য গ্রহণ করে ক্ষুধা নিবারণ করে। রাত চলে গেল দিন এল । কিন্তু হানাদারদের গানবােটের কোন খোঁজ পাওয়া গেল না। গানবোটের কোন খোঁজ না পেয়ে যখন বাতেন বাহিনীর বীর যােদ্ধারা স্থান ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তখন গ্রামবাসীরা আরাে এক রাত থাকার অনুরােধ করে। ইতিমধ্যে যােদ্ধারা খাদ্যগ্রহণ করে। আবারও প্রতীক্ষায় থাকে কোন সময় আসবে হানাদারদের গানবােট, কোন সময় গর্জে উঠবে হানাদার নিধনে বাতেন বাহিনীর যােদ্ধাদের মারাণাস্ত্রগুলি। রাত দুটোর সময় একজন স্কাউট পাঁচ ব্যাটারী টর্চের আলােয় সংকেত প্রদান করে গানবােট আসছে। কিছুক্ষণ পরে দেখা যায় গানবােটটি আসছে জাব্রা ব্রিজের নিচ দিয়ে। স্বভাবতঃ অপর পাড়ে সিগন্যাল চলে যায় প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য। রাত তিনটার সময় গানবােটটি বাতেন বাহিনীর অবস্থানের ৪/৫ শত গজ দূরে ঘাটের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ঘাট থেকে মাত্র ৫০ গজ দূরে থাকতে গর্জে উঠে বাতেন বাহিনীর যােদ্ধাদের মারাণাস্ত্রগুলি। তার ফলে গানবােট থেকে হানাদার সৈন্যরা প্রচণ্ড ভাবে গুলি বর্ষণ করতে শুরু করে বাতেন বাহিনীর যােদ্ধাদের উপর। প্রথম দিকে বাতেন বাহিনীর গুলিতে গানবােটের কোন প্রকার ক্ষতি না হওয়াতে বাহিনীর অধিনায়ক বাধ্য হয়ে গুলি ছোঁড়ার কৌশল পরিবর্তন করে। গানবােটের ফোকাস হােলে এবং চেইনে গুলি বর্ষণের নির্দেশ দেন। নির্দেশ মত যােছারা গুলী ছেড়া শুরু করে। এবার কাজ হল, গুলিতে গানবােটের হালের চেইন ছিড়ে যায়। গানবােটটি নদীর পূর্বপার্শের দিকে অগ্রসর হয়। স্রোতের টানে গানবােটটি একটু ভাটির দিকে চলে যায়। তার পরক্ষণেই ওপারে অবস্থানরত কোম্পানী গুলী ছুঁড়তে থাকে। রাত চারটার সময় স্কাউটের সংকেত পাওয়া যায় হানাদারদের গানবােট জব্রা ব্রিজের পাশ থেকে উত্তর দিকে অগ্রসর হচ্ছে। বাতেন বাহিনীর গুলির আঘাতে গানবোটটি আর বেশী দুর সর হতে পারেনি। কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর গানবােটটি নদীর এক কিনারায় পড়ে যায়। এই আক্রমণে গানবােটের প্রচুর ক্ষতি হয়। হানাদারদের ৩৮ জন নিহত হয় এবং ৫জন মারাত্মকভাবে আহত হয়। টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর থানার ঘাসকাউনিয়া গ্রামে রাজাকার নিধন অভিযান বাতেন বাহিনীর একটি দুঃসাহসিক অভিযান ছিল। এই অভিযানটি ১৯৭১ সালের ২৮শে জুন পরিচালিত হয়। বাতেন বাহিনীর দুঃসাহসী বীর মুক্তিযােদ্ধা মােঃ ফজলুল হক মল্লিক ঐ অভিযানটি পরিচালনা করেন। তার দূরদর্শীতার কারণে অভিযানটি সফলভাবে পরিচালিত হয়। এদিন পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশ্যে এক বেতার ভাষণ দেন। ঘাস কাউলিয়া ছিল রাজাকার বাহিনীর অন্যতম প্রভাবশালী নেতা অধ্যাপক আব্দুল খালেকের এক ঘনিষ্ট সহকর্মীর সন্ত্রাসী কার্যকলাপের কেন্দ্রস্থল। তার হত্যা, লুটপাট ও নারী ধর্ষণের ফলে এলাকার মানুষ অতিষ্ট হয়ে উঠে। ঘাতকদের ধ্বংস যজ্ঞের সংবাদ পেয়ে বাতেন বাহিনীর অধিনায়ক খন্দকার আব্দুল বাতেন ও সুবেদার বারী, মােঃ ফজলুল হক মল্লিককে ঐ এলাকার রাজাকারদের দমন করার নির্দেশ দেন। অধিনায়কের
১১২
নির্দেশ মােতাবেক বীর মুক্তিযােদ্ধা মােঃ ফজলুল হক মল্লিক অভিযান পরিচালনার জন্য এক অভিনব রণকৌশল উদ্ভাবন করেন। তিনি রণকৌশল অনুসারে ১৯৭১ সালের ২৮শে জুন সােমবার প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। কারণ ঐদিন জেনারেল ইয়াহিয়ার বেতার ভাষণ শুনে রাজাকারদের পরবর্তী কর্মসূচী নিয়ে আলাপ আলােচনার জন্য এক সভা ডাকে ঘাস কাউলিয়া মাদ্রাসা ও স্কুল প্রাঙ্গণে। রাজাকারদের আলােচনা সভার সংবাদ পেয়ে অনেককে একত্রে পাবার জন্য ফজলুল হক মল্লিক অভিযান পরিচালনায় ঐদিন ধার্য করেন। রণকৌশল হিসাবে অভিযানকারীদল বরযাত্রী বেশে রাজাকারদের সভাস্থলের নিকট যাবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বর সাজেন অভিযানকারী দলের অধিনায়ক দুঃসাহসী মুক্তিযােদ্ধা মােঃ ফজলুল হক মল্লিক নিজেই। তিনি পিতার জীবদ্দশায় রেখে যাওয়া মাসেলাইস লুঙ্গী এবং একটি পাঞ্জাবী পরেন। সঙ্গে নেন কাপড় দিয়ে মােড়ানাে একটি বেয়নেট। একজন সঙ্গে নিয়ে দুইজন অগ্রসর হন লক্ষ্যস্থলের দিকে। অন্যদের নির্দেশ দেন তাকে অনুসরণ করে পিছনে পিছনে যেতে। কিছুদুর যাবার পর পরিচিত এক বাড়ি থেকে জিন্নাহ টুপী, রুমাল ও স্পঞ্জ সংগ্রহ করে প্রকৃত বরের বেশ ধারণ করে নৌকা যােগে সঙ্গীদের নিয়ে সভাস্থলে উপস্থিত হন। তিনি সভাস্থলে পৌছার সঙ্গে সঙ্গে মাদ্রাসার সামনে বসা ২৭/২৮ জন লােকের মধ্য থেকে ২/৩ জন এসে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। তখন ফজলুল হক মল্লিক তাদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, আমার বাবা মারা যাওয়ায় বৃদ্ধা মা আমাকে বিয়ে করানাের ইচ্ছা প্রকাশ করাতে এই বিপদের দিনেও আমি বিয়ে করতে বাধ্য হচ্ছি। তিনি আরাে বলেন, আমরা দু’জন আগে এসেছি, আমার চাচা ও অন্যান্য আত্মীয় স্বজন পিছনে আসছে মিষ্টি নিয়ে। সেই সঙ্গে তিনি পূর্ব পরিচিত ঐ এলাকার একজন কাজীর নামও বলেন। কেউ কেউ ইতস্তত করলেও রাজাকারদের মধ্যে বসা অনেকেই উৎসাহী হয়ে বলে উঠে এতদিন পর বিয়ের মিষ্টি খাব এতে আবার চিন্তার কারণ কি? এরপর দুজনকে অভ্যর্থনা জানিয়ে সভার মাঝে নিয়ে রসালাে আলাপ করতে থাকে। ইতিমধ্যে মাগরেবের আযান হয়ে যায়। আযানের সময় হলে বীর মুক্তিযােদ্ধা মােঃ ফজলুল হক মল্লিকও নামাজ পড়তে যান। কিন্তু ছুন্নাত নামাজ আদায়ের পর শেষ রাকাতে তাঁর বেয়নেটের কাপড় খুলে লুঙ্গী ছিড়ে গেলে নফল পড়া বাদ দিয়ে তিনি নামাজ শেষ করে আসেন। এর মধ্যে অন্ধকার হয়ে যায়। ইতিমধ্যে ইয়াহিয়া খানের ভাষণ শােনার জন্য একটি ঘরে রাজাকারদের অনেকেই একত্রিত হয়েছে। উপস্থিত রাজাকারদের অনেকেই ইয়াহিয়ার ভাষণ শােনার জন্য ফজলুল হক মল্লিককে অনুরােধ করে। রাজাকারদের অনুরােধে তিনি ভাষণ শােনার জন্য রেডিওর কাছে নিয়ে দাঁড়ান। কিন্তু একজন তাকে হাত ধরে টান দিয়ে বসানাের সময় আবার বেয়নেটের আঘাতে লুঙ্গী ছিড়ে যাওয়ার ফলে তিনি দাঁড়িয়ে যান এবং ধীরে ধীরে আবার বসেন। সঙ্গের অপর সঙ্গী পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুসারে বাইরের মাঠে অবস্থান করছিল। হঠাৎ গুলির শব্দ শুনে ফজলুল হক মল্লিক বেয়নেট বের করে নড়াচড়া করতে নিষেধ করে সবাইকে আত্মসমর্পন করতে বলেন। ইতিমধ্যে তার পাশে দাঁড়ানাে এক যুবকের পিঠে গুলী লাগায় তিনি সতর্ক হয়ে লাইং পজিশনে যান এবং অবস্থা বেগতিক দেখে ক্রলিং করে মাঠের মাঝখানে গিয়ে উচ্চস্বরে গুলি বন্ধ করার জন্য সংকেত উচ্চারণ করেন। গুলী বন্ধ হতে হতে ৬/৭ জন মারা যায়। আক্রমণ শুরু এবং বন্ধ করার সাংকেতিক শব্দ ছিল চাঁদ ও ফুল। ভুলবশতঃ অভিযান পরিচালনাকারী দলের যােগাযােগ অসম্পূর্ণ রেখে গুলি বর্ষণ শুরু করে। ঘটনাস্থলে ফজলুল হক মল্লিক অল্পের জন্য মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পান। পরে তিনি গুলী বর্ষণকারী দলের নেতার উপর চটে যান এবং তাকে ভৎর্সনা করেন। মারাত্মক ভুলের জন্য হাইকমান্ডের নিকট বিশেষ করে সুবেদার আব্দুল বারীর নিকট গুলি বর্ষণকারী দলের নেতাকে শাস্তি পেতে হয়েছিল। এই
১১৩
অভিযানের দুঃসাহসিকতার জন্য বীর মুক্তিযােদ্ধা মােঃ ফজলুল হক মল্লিক বাতেন বাহিনীতে ব্যাপক পরিচিতি ও প্রশংসা অর্জন করেন। যাকে উদ্দেশ্য করে ঐ অভিযান পরিচালনা করা হয়েছিল হানাদারদের সেই সহচর পালিয়ে যাবার সময় গুলিতে মৃত্যুবরণ করে। এরপর ঐ এলাকায় রাজাকার ও শান্তিবাহিনীর কোন প্রকার তৎপরতা ছিল না। বাতেন বাহিনীর সাটুরিয়া আক্রমণ ও দখল ছিল অত্যন্ত বীরত্বপূর্ণ ও প্রশংসনীয় অভিযান। এই থানার বাতেন বাহিনীর বীর সেনারা দু’বার অভিযান পরিচালনা করে এবং দু’বারই হানাদার সৈন্যদের থানা হতে বিতাড়িত করে। প্রথমবার অভিযান পরিচালনা করে থানা দখল করে সরে আসলেও দ্বিতীয় বার অভিযান চালিয়ে থানা দখল করে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে এনে সেখানে অবস্থান করেন। ১৯৭১ সালের ১৪ই আগস্ট বাতেন বাহিনীর দুঃসাহসী যােদ্ধারা সাটুরিয়া থানা প্রথমবার আক্রমণ করে দখল করে। এখানে হানাদারদের সঙ্গে বাতেন বাহিনীর এক রক্তক্ষয়ী ভয়াবহ সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষে হানাদারদের প্রচুর জীবনহানি ঘটে । এখানে বাতেন বাহিনী হানাদারদের রেখে যাওয়া প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ও গােলাবারুদ দখল করে নেয়। যা তাদেরকে পরবর্তীতে অত্যন্ত শক্তিশালী করে তােলে। ১৪ই আগষ্ট ছিল পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস। বাতেন বাহিনীর অধিনায়ক খন্দকার আব্দুল বাতেনের জিদ জাগে পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে সাটুরিয়া থানা দখল করে সেখানে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করতে হবে। সেই লক্ষ্যে খন্দকার আব্দুল বাতেন নাগরপুর থানার পাকুটিয়াতে উপস্থিত হন। ১৯৭১ সালের ১১ ই আগষ্ট। তিনি বাহিনীর দুঃসাহসী যােদ্ধা পীর সাহেব ইয়াকুব ভাইকে ছদ্মবেশে তরকারীর ঝাকা মাথায় দিয়ে সাটুরিয়া পাঠান। তার ফলে সংগৃহীত হয় সঠিক তথ্যাবলী । ১৩ ই আগষ্ট কোম্পানী নং ৭, কোম্পানী নং ১১, কোম্পানী নং ১৭-এই তিন কোম্পানী সঙ্গে নিয়ে বাহিনীর অধিনায়ক খন্দকার আব্দুল বাতেন পাকুটিয়ার পাশে এক মুক্ত স্থানে একত্রিত হন। তিন কোম্পানীর দায়িত্ব দেওয়া হয় তিন দুঃসাহসী কোম্পানী কমান্ডারকে। কারারিং কোম্পানীর দায়িত্ব দেওয়া হয় মীর কায়ছারকে। ১৩ই আগষ্ট রাত ১০ টার সময় উক্ত তিন কোম্পানীর যােদ্ধা নিয়ে অধিনায়ক খন্দকার আব্দুল বাতেন সাটুরিয়া থানা অভিযানের জন্য অগ্রসর হন। অত্যন্ত ঝড়বৃষ্টির মধ্যে সমস্ত প্রাকৃতিক প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করে নৌকা যােগে খন্দকার আব্দুল বাতেন তার বাহিনী। নিয়ে সাটুরিয়া থানার উপকণ্ঠে উপস্থিত হন। পরিকল্পনা অনুসারে প্রথম কোম্পানীর সার্বিক দায়িত্ব গ্রহণ করেন অধিনায়ক স্বয়ং। থানার কাছাকাছি পৌঁছে বাতেন বাহিনীর দূরদর্শী যােদ্ধারা পরিকল্পনা মাফিক পজিশন গ্রহণ করেন। ঝড়-বৃষ্টির অন্ধকার রাতে অধিনায়ক তার হাতের চায়নিজ স্টেনগান দিয়ে গুলি ছুড়ে আক্রমণের সূচনা করেন। অধিনায়কের গুলির সঙ্গে সমস্ত যােদ্ধাদের অস্ত্র থেকে একবারে প্রচন্ড বেগে গুলিবর্ষণ হতে থাকে। থানায় অবস্থানরত হানাদার বাহিনীর সদস্যরাও প্রচন্ডবেগে গুলি ছুঁড়তে থাকে। এক পর্যায়ে থানার পশ্চিম পার্শ্বের দুটি বাংকার বাতেন বাহিনীর দখলে আসে। বাংকারে অবস্থানরত ৫ জন হানাদার সৈন্য মৃত্যুবরণ করে এবং অবশিষ্ট সৈন্যরা ভিতরের দিকে পালিয়ে যায়। এরপর শুরু হয় আক্রমণের দ্বিতীয় পর্যায়। বাংকার থেকে ভিতরের দিকে গুলিবর্ষণ শুরু করে বাতেন বাহিনীর বীর যােদ্ধারা। দ্বিতীয় বাংকারে পজিশন গ্রহণ করেন অধিনায়ক নিজেই এবং কোম্পানী কমান্ডার নায়েক আব্দুস সামাদ। অধিনায়ক মাথা উঁচু করে ভিতরের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছিলেন, ঠিক সেই সময় ভেতর থেকে হানাদারদের গুলি এসে তাঁর মাথার ক্যাপ এফোড় ওফোড় হয়ে যায়। মাথা নিচু করে অধিনায়ক দেখেন তার মাথার ক্যাপের
১১৪
আগে পিছনে ছিদ্র হয়ে গেছে। অধিনায়ক কোম্পানী কমান্ডারকে বলেন, কোথা থেকে গুলি আসে তা পর্যবেক্ষণ করে দেখতে হবে। পর্যবেক্ষণ করে কোম্পানী কমান্ডার বলেন, বালুর বস্তার আড়ালে রয়েছে হানাদার সৈন্য। অধিনায়ক বলেন, টুপিটা হাতে নিয়ে এমনভাবে উঁচু করবাে যাতে শত্রুরা মনে করে এটাই আমার মাথা। আর গুলী করলে টুপিটা নিচে নামিয়ে ফেলবাে। অমনি আপনি টার্গেট করে গুলী করবেন। ওদের হত্যা করতেই হবে। পরিকল্পনা অনুসারে অধিনায়ক টুপি শশা করতে শুরু করেন। কিছুক্ষণ পরেই গুলির শব্দের সঙ্গে সঙ্গে ক্যাপসহ হাত নামিয়ে ফেলেন। গুলির উৎসমুখে গুলি চালায় কোম্পানী কমান্ডার নায়েক আব্দুস সামাদ। তার পরক্ষণেই ইয়া আলী বলে চিৎকার করে বালীর বস্তার উপর দিয়ে এসে ধপ করে পড়ে যায় এক দশাসই হানাদার সৈন্য। এই কাজের পুরষ্কার হিসাবে অধিনায়ক খন্দকার আব্দুল বাতেন তাঁর ছিদ্র টুপিটা কোম্পানী কমান্ডার আব্দুস সামাদের মাথায় পরিয়ে দেন এবং তাঁর পিঠ চাপড়িয়ে সাব্বাস বলেন। কিছুক্ষণ পর কোম্পানী কমান্ডারের নিকট প্রথম কোম্পানীর দায়িত্ব অর্পণ করেন অধিনায়ক, এরপর শাহজানির চরের দূরদর্শী যােদ্ধা সিদ্দিক হােসেন বি.এস.সিকে সঙ্গে নিয়ে খন্দকার আব্দুল বাতেন পাট পচা পানির ডােবা সাতরিয়ে দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হন। অস্ত্রসহ ক্রলিং করতে করতে দুজনেরই হাতের চামড়া উঠে যায়। সেই অবস্থায় থানার দক্ষিণ দিকের প্রবাহমান খালের ধারে দু’জনেই উপস্থিত হন। সেখানে নিরাপদ স্থান থেকে লক্ষ্য করেন খালের পূর্ব পাড়ের কাবারিং কোম্পানী সঠিক দায়িত্ব পালন করছে না। যে টার্গেটে গুলি করার কথা তা হচ্ছে না। দু’জনেই খাল সাতরিয়ে পূর্ব পাড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। হানাদারদের প্রচন্ড গুলির মধ্যে দিয়ে জীবনকে বাজী রেখে দু’জনে সাতরিয়ে খালের পূর্ব পাড়ে উপস্থিত হন। অধিনায়ক এবার কাবারিং কোম্পানীকে নির্দেশ দেন থানার দালানের জানালার ভিতর লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়তে। নির্দেশ মােতাবেক কাবারিং কোম্পানী গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। এতে কাজ হয়। কিছুক্ষন পর থানায় অবস্থিত হানাদার সৈন্যরা লাঠির মাথায় সাদা কাপড় বেঁধে আত্মসমর্পনের সিগন্যাল দেয়। সেই সিগন্যাল পেয়ে কাবারিং কোম্পানীকে নির্দেশ দেন। গুলিবর্ষণ অব্যাহত রাখতে। অধিনায়ক মাত্র ১৬ জন যােদ্ধা সঙ্গে নিয়ে খাল সাতরিয়ে পশ্চিম পাড়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। পশ্চিম পাড়ে উপস্থিত হয়ে সেখানে রাখা গােল কাঠের স্তুপের আড়ালে আশ্রয় গ্রহণ করেন বাতেন বাহিনীর যােদ্ধারা। সেই গােল কাঠের স্তুপের আড়াল থেকে অধিনায়ক কাবারিং কোম্পানীকে গুলি ছোড়ার নির্দেশ দেন। কিছুক্ষণ পর হানাদার সৈন্যরা আবার সাদা জামা লাঠিতে তুলে আত্মসমর্পনের সিগন্যাল দেয়। সিদ্দিক হােসেন বি.এস.সি’র সঙ্গে পরামর্শ করে অধিনায়ক ১৬ জন যােদ্ধাকে সঙ্গে নিয়ে মাথা নিচু করে দ্রুত গতিতে পৌছে যায় হানাদারদের পাকা দালানে । হানাদার সৈন্যের এক দশাসই মিলিশিয়ার সামনে পড়ে যান অধিনায়ক খন্দকার আব্দুল বাতেন। হানাদার সেনা তার হাতের চাইনিজ রাইফেল দিয়ে অধিনায়কের বুক বরাবর গুলি করে। ট্রিগার টিপার সঙ্গে সঙ্গে অধিনায়ক তার হাতের স্টেনগান দিয়ে শত্রুর উপর আক্রমণ করে। শত্রুর রাইফেলের গুলি অধিনায়কের বগলের তলা দিয়ে বের হয়ে যায়। তার পরই অধিনায়কের চাইনিজ স্টেনের গুলিতে হানাদার সৈন্যের মৃত্যু ঘটে। তারপরের ইতিহাস শত্রু নিধনের ইতিহাস। শত্রুর আত্মসমর্পনের ইতিহাস। ১৪ই আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে সাটুরিয়া থানা দখল করে সেখানে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন বাতেন বাহিনীর প্রধান খন্দকার আব্দুল বাতেন। সাটুরিয়ায় সর্বস্তরের মানুষ বাতেন বাহিনীকে অভিনন্দন জানায়। বিপন্ন নিরস্ত্র মানুষের খাদ্যের সংস্থানের জন্য বাতেন বাহিনী সাটুরিয়া খাদ্য গুদাম খুলে দেয়। হাজার হাজার জনতা খাদ্য শষ্য
১১৫
তাদের ঘরে নিয়ে যায়। বেলা দুইটার সময় বাতেন বাহিনী সাটুরিয়া থানা ত্যাগ করে বিজয়ী বেশে লাউহাটির দিকে অগ্রসর হয়। বাতেন বাহিনীর বীর যােদ্ধারা ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে মানিকগঞ্জ জেলার সাটুরিয়া থানা দ্বিতীয়বার আক্রমণ করে। এই আক্রমণের নেতৃত্ব দেন বাতেন বাহিনীর দূরদর্শী যােদ্ধা সুবেদার মেজর আবু তাহের । রাত্রি তিনটার সময় বাতেন বাহিনীর বীর যােদ্ধারা সাটুরিয়া থানা আক্রমণ করে থানার তিন দিক থেকে । সুবেদার মেজর আবু তাহের এক্সপ্লোসিভ ব্রাষ্ট করে আক্রমণের সূচনা করেন। তার এক্সপ্লোসিভ ব্রাষ্ট করার সঙ্গে সঙ্গে বাতেন বাহিনীর দুঃসাহসী পাঁচশত যােদ্ধার হাতের অস্ত্র গর্জে উঠে হানাদার সৈন্যদের নিধনে। প্রায় দু’ঘন্টা প্রচন্ড যুদ্ধ হবার পর সূর্যের আলাে দেখা যায়। দিনের আলাে দেখা দেবার সঙ্গে সঙ্গে অত্র এলাকার হাজার হাজার সাধারণ মানুষ ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান দিয়ে হানাদার সৈন্যদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে। তাদের হাতে অস্ত্র ছিল সাধারণ গ্রাম্য অস্ত্র-দাও, ফালা, বল্লম, সুরকী, লাঠি, খন্তা, কুড়াল-অর্থাৎ যার যা ছিল বাড়ীতে তাই নিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়ে হানাদার নিধনে। এই যুদ্ধটি ছিল একটি জনযুদ্ধ। সত্যিকার অর্থেই সেদিনের সাধারণ মানুষ যে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিল তার প্রমাণ হয়ত দুই/চারটি আছে কিনা সন্দেহ। সে সমস্ত মানুষের ছিল না কোন প্রকার সামরিক প্রশিক্ষণ ছিল না কোন প্রকার যুদ্ধের অস্ত্রশস্ত্র। শুধুমাত্র তাদের যুদ্ধের অস্ত্র ছিল স্বাধীনতার মূলমন্ত্র। তাদের মনে ছিল বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের সেই ঐতিহাসিক ভাষণের নির্দেশ, তােমাদের যার যা আছে তা নিয়েই প্রস্তুতি গ্রহণ কর’। সাটুরিয়ার বীর জনতা সেদিন শুধুমাত্র প্রস্তুতিই গ্রহণ করেনি তারা সেদিন হানাদার নিধনে উন্মাদ হয়ে পড়ে। তারা সেদিন প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত বাতেন বাহিনীর সশস্ত্র যােদ্ধাদের পিছনে ফেলে হানাদারদের উপর আঘাত হানে। সেদিন সাটুরিয়ায় মানুষ জীবনের প্রতি কোন প্রকার মমতা করেনি। তারা সেদিন পরিবারের লােকজনের কথা ভাবেনি। সেদিন তারা স্বাধীনতা লাভের আশা নিয়ে হানাদার নিধনে ঝাপিয়ে পড়ে। এলাকার মানুষ আরও কৃতিত্ব দেখায় এই ভয়াবহ যুদ্ধের মধ্যেই ব্যবস্থা করে বাতেন বাহিনীর যােদ্ধাদের সকালের নাস্তার। যুদ্ধের ময়দানেই বীর যােদ্ধারা সকালের নাস্তা খেয়ে নেয়। বাতেন বাহিনীর যােদ্ধারা যুদ্ধের কৌশল হিসাবে পাঁচ মিনিট গুলি করে গুলি করা বন্ধ রাখে। পাঁচ মিনিট গুলি করলে হানাদার সৈন্যরা ৪০/৫০ মিনিট এক টানা গুলি করত। এই কৌশল গ্রহণ করা হয় অল্প গুলি খরচ করে হানাদাদের বেশী গুলি খরচ করানাে। যাতে তাড়াতাড়ি হানাদারদের গুলি শেষ হয়ে যায়। যুদ্ধের এই কৌশলটি ভাল ফল দেয়। তাড়াতাড়ি গুলি করে হানাদার সৈন্যরা এক পর্যায়ে তাদের গুলি শেষ করে ফেলে। প্রায় আট ঘন্টা প্রচন্ড যুদ্ধের পর হানাদার সৈন্যরা বহু লাশ, অস্ত্রশস্ত্র ও বিভিন্ন প্রকার মালপত্র রেখে পালিয়ে যায়। সাটুরিয়ার এই যুদ্ধে বাতেন বাহিনীর বীর যােদ্ধা জিয়ারত হােসেন হানাদার বাহিনীর গুলিতে শহীদ হন। হানাদার সৈন্যরা পালিয়ে গেলেও তৎক্ষণাৎ বাতেন বাহিনীর যােদ্ধারা থানার দালানে উপস্থিত হয়নি। কারণ তাদের ধারণা ছিল যদি আবার ব্যাপক শক্তি নিয়ে তারা থানায় আসে তাহলে তাদেরকে গেরিলাভাবে আক্রমণ করে নিধন করতে হবে। তাই তারা তাদের পজিশনে কিছু সময় অপেক্ষা করে। দুপুরের খাওয়া খেয়ে নেয় যুদ্ধের ময়দানেই। গ্রামের মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়েই বাতেন বাহিনীর বীর যােদ্ধাদের খাবারের ব্যবস্থা করেন। বেশ সময় অপেক্ষা করার পর যখন হানাদার সৈন্যদের দেখা গেল না তখন বাতেন বাহিনীর যােদ্ধারা থানার হেডকোয়ার্টারের দখল নেয়। সাটুরিয়া থানা দখল করার পর সেখানে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন বাতেন বাহিনীর বেসামরিক প্রধান অধ্যাপক আলী আকবর খান ডলার। পতাকা উত্তোলনের সময় অধ্যাপক আলী আকবর খান ডলার স্থানীয় জনগণের উদ্দেশ্যে সংক্ষিপ্ত
১১৬
ভাষণ দেন। তিনি তার ভাষণে সাটুরিয়াকে জিয়ারত নগর ঘােষণা করেন। ঐ দিনই সাটুরিয়ার অফিস, দোকানসহ বিভিন্ন ঘর-বাড়ীর সাইনবাের্ড নামিয়ে জিয়ারত নগর লেখা শুরু করে দেয়। স্বাধীনতার বেশ কিছুদিন পরেও সাটুরিয়া জিয়ারত নগর হিসাবে পরিচিত ছিল। কিন্তু আজ আর কেউ শহীদ জিয়ারতের নামের স্মরণে সেই জিয়ারত নগর নাম স্মরণ করে না। ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসের শেষের দিকে টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর থানা দখল বাতেন বাহিনীর একটি ঐতিহাসিক অভিযান। ঐদিন বাতেন বাহিনীর বীর যােদ্ধারা নাগরপুর থানার চারদিক থেকে প্রচন্ড গতিতে আক্রমণ করে। এই যুদ্ধের নেতৃত্ব দেন সুবেদার মেজর আবু তাহের ও সুবেদার আব্দুল বারী। দীর্ঘ সময় সংঘর্ষের পরে হানাদার সৈন্যরা পালিয়ে যায়। প্রথম দিকে হানাদার বাহিনীর প্রচন্ড আক্রমণ ও কপ্টার দিয়ে গুলি করার ফলে বাতেন বাহিনীর যােদ্ধারা কোনঠাসা হয়ে পড়ে। কিন্তু কয়েকজন দূরদর্শী যােদ্ধার অসীম সাহসীকতাপূর্ণ আক্রমণ এবং গুলিবর্ষণের ফলে হানাদার কপ্টার চলে যেতে বাধ্য হয়। কপ্টার চলে যাবার পর হানাদার সৈন্যরা পালিয়ে যায়। যাবার সময় তারা রেখে যায় বহু নিহত ও আহত সৈন্যদের। হানাদার বাহিনীর সৈন্যরা পালিয়ে যাবার পর বাতেন বাহিনীর যােদ্ধারা নাগরপুর দখল করে নেয়। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে হানাদার বাহিনীর সঙ্গে বাতেন বাহিনীর একটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়, টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর থানার কনােড়া গ্রামে। হানাদার বাহিনীর সৈন্যরা টাঙ্গাইল থেকে পালিয়ে যাবার পথে টাঙ্গাইল জেলা সদরের প্রায় ১৫ মাইল দক্ষিণে কনােড়া গ্রামে হানাদার সৈন্যরা পৌঁছলে সেখানে বাতেন বাহিনীর বীর যােদ্ধারা আক্রমণ করে। হানাদারদের সঙ্গে এখানে বাতেন বাহিনীর এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংগঠিত হয়। এই যুদ্ধে বাতেন বাহিনীর বীর যােদ্ধা আব্দুর রব হানাদারদের গুলিতে শহীদ হন এবং সুবেদার মেজর আবু তাহের হানাদার সৈন্যদের গুলিতে মারাত্মকভাবে আহত হন। কনােড়ার যুদ্ধে হানাদারদের প্রচুর জীবনহানি ঘটে। যুদ্ধের এক পর্যায়ে গভীর রাতে বহু লাশ ও অস্ত্রশস্ত্র ফেলে হানাদার সৈন্যরা ঢাকার দিকে পালিয়ে যায়। ১৯৭১ সালের রমজান মাসে বাতেন বাহিনীর একটি দুর্ঘটনা ঘটে। এই দুর্ঘটনায় শহীদ হন বাতেন বাহিনীর বীর মুক্তিযোেদ্ধা আব্দুল বাতেন। দুর্ঘটনাটি ঘটে মানিকগঞ্জ জেলার ঘিউর থানার নিরালি গ্রামের এক বাড়িতে। সেদিন ঐ বাড়িতে বাতেন বাহিনীর বীর যােদ্ধাদের ইফতার খাওয়ার দাওয়াত ছিল। ইফতার করে যখন সবাই নামাজ পড়ছিল তখন জনৈক যযাদ্ধার পায়ের আঘাতে রাইফেলের মিস ফায়ার হয়। এই ফায়ারের গুলি আব্দুল বাতেনসহ আরাে কয়েকজনের দেহে লাগে। আহতদের মধ্যে আব্দুল বাতেন সবচেয়ে বেশী মারাত্মক আহত হন। এই আব্দুল বাতেন যােদ্ধাদের ইফতার পরিবেশন করে খাওয়ার ব্যবস্থা করছিলেন এমন সময় তার দেহে গুলির আঘাত লাগে। দুর্ঘটনা ঘটে যাবার সঙ্গে সঙ্গে হেডকোয়ার্টারে সংবাদ পাঠানাে হয়। সংবাদ পেয়ে দ্রুতগতিতে বাতেন বাহিনীর দুঃসাহসী যােদ্ধা মেজবা উদ্দিন নয়ন, ডাঃ জহিরুল ইসলাম ও কছিমুদ্দিনকে সঙ্গে নিয়ে ঘটনা স্থলে আসেন। সেখানে আসার পর মেজবা উদ্দিন নয়নের সঙ্গী কছিমুদ্দীন আহত বাতেনের রক্ত দেখে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। ডাঃ জহিরুল ইসলাম আপ্রাণ চেষ্টা করেও আহত বাতেনকে বাঁচাতে পারেনি। বাতেন বাহিনীর আরাে একজন বীর যােদ্ধা নাগরপুর থানার পাকুটিয়ার ক্যাম্পে রাইফেলের মিস ফায়ারের কারণে মৃত্যুবরণ করেন। ঐ বীর যােদ্ধা ক্যাম্পে অস্ত্র পরিষ্কার করার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। ভুলবশতঃ মিস ফায়ার হয়ে সামাদ নামক ঐ বীর যােদ্ধা মৃত্যুবরণ করেন।
১১৭
বাতেন বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা ও অধিনায়ক খন্দকার আব্দুল বাতেন তার অনুপস্থিতিতে বাহিনী পরিচালনার দায়িত্ব দেন আবুল কালাম আজাদ (শাহজাহান), মােঃ দেলােয়ার হােসেন হারিজ ও আব্দুর রশীদের উপর । খন্দকার আব্দুল বাতেন মুক্তিযুদ্ধের প্রয়ােজনে মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে যােগাযােগ করার জন্য ভারত যান তখন বাহিনীর পরিচালনার দায়িত্ব নেন আবুল কালাম আজাদ (শাহজাহান)।
মুজিব বাহিনীর মোঃ ফজলুল হক মল্লিক
১৯৭১সালের ৭ই মার্চ বাঙ্গালী জাতির ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিন। ঐদিন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিশাল জনসমুদ্রে এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। তার সেদিনের ভাষণে বাঙ্গালী জাতির হাজার হাজার বছরের লালিত স্বপ্নের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ঐ ভাষণে তিনি প্রকারান্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করেন। ভাষণের শেষ পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তুলুন। আমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকুন। রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরাে দেবাে। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বাে, ইনশাল্লাহ্। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বঙ্গবন্ধুর এই ঐতিহাসিক ভাষণ শােনার সৌভাগ্য হয়েছিল আরাে অনেকের মত বীর মুক্তিযােদ্ধা ফজলুল হক মল্লিকের। তিনি সভা মঞ্চের মাত্র ২০/২৫ গজ সামনে বসা ছিলেন। ২২ বছর বয়সের টগবগে যুবক ফজলুল হক মল্লিক বঙ্গবন্ধুর ঐ ঘােষণা শােনার পর চিৎকার দিয়ে উঠেন, ‘বীর বাঙ্গালী অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর। বাশের লাঠি তৈরি কর বাংলাদেশ স্বাধীন কর। জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু।’ বঙ্গবন্ধুর এই ঘােষণা তার সংগ্রামী চেতনাকে আরাে শানিত করে তুলে। ৭ই মার্চের ভাষণ শুনে জঙ্গী মনােভাব নিয়ে ফজলুল হক মল্লিক তার জন্মস্থান টাঙ্গাইল জেলার দেলদুয়ার থানার গজিয়া বাড়ী গ্রামে যান। সেখানে গিয়ে তিনি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথ ধরে এলাকায় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কর্মীদের নিয়ে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তােলার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ফজলুল হক মল্লিক এলাকায় সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তােলার পাশাপাশি মিটিং মিছিলের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে স্বাধীনতা সগ্রামের জন্য প্রস্তুত থাকার অনুরােধ জানান। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে হানাদার বাহিনীর ঢাকা আক্রমণ ও ধ্বংসযজ্ঞের সংবাদ পাবার পর রাজনৈতিক পরিস্থিতি বুঝতে পেরে সঙ্গীদের তিনি সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত করে তােলেন। ‘৭১ সালের ৩ এপ্রিল সাটিয়াচড়া গােড়ানে সংঘটিত হয় হানাদার বাহিনীর সাথে মুক্তি বাহিনীর প্রচন্ড লড়াই। এই সংঘর্ষের সংবাদ পেয়ে তিনি তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে মুক্তি বাহিনী গড়ে তােলার জন্য তৎপরতা চালাতে থাকেন। ইতিমধ্যে বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকীর মুক্তিবাহিনী গঠনের সংবাদ পান। এই সংবাদ পেয়ে ‘৭১ সালের ৭ই এপ্রিল তিনি বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে যােগাযােগের জন্য টাঙ্গাইল জেলার বাসাইল থানার ফতেপুর গ্রামে যান। সেখানে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীকে না পেয়ে সখিপুর থানার হতেয়া রাজবাড়ী যান। সেখানেও তাকে না পেয়ে বাড়ী ফিরে আসেন। এ সময়ে তার সঙ্গীদের মধ্যে ছিলেন লুৎফর রহমান লেবু, এবাদত আলী খান, হারুন আল-মামুন হিরু, আজিজুল
১১৮
হক, হাবিবুর রহমান মানিক, হযরত আলী ও আবুল হােসেন। ব্যর্থ হয়েও ফজলুল হক মল্লিক বসে থাকেননি। তিনি এলাকায় এসে নিজের উদ্যোগেই মুক্তি বাহিনী গঠন এবং অস্ত্র সংগ্রহের জন্য তৎপর হন। ১৪ই এপ্রিল অস্ত্র সংগ্রহের জন্য তাঁর পার্শ্ববর্তী গ্রাম সরাতৈলের আব্দুস ছবুরের বাড়ীতে অভিযান চালান। এই অভিযানে তার সঙ্গে ছিলেন ইসমাইল হােসেন ঠান্ডু, বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্য আনােয়ার হােসেন, ফজলুল, আজিজসহ প্রায়৩০/৩৫ জন। ছবুরের বাড়ীতে তাঁর সঙ্গে ফজলুল হক মল্লিকের সঙ্গীদের খন্ড যুদ্ধ হয়। যুদ্ধের এক পর্যায়ে ছবুর আহত হয়ে পড়ে। তার ফেলে যাওয়া। রাইফেলটি ফজলুল হক মল্লিক নিয়ে আসেন। পরে তিনি অত্যন্ত সাহসী ও উৎসাহী হয়ে উঠেন মুক্তিবাহিনী গড়ে তােলার জন্য। ইতিমধ্যে তিনি সংবাদ পান টাঙ্গাইলের পশ্চিমে চর এলাকার খুশাই বার বয়লা, রশিদপুর ও বেলতা গ্রামের কোন একটি পাট ক্ষেতে বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন সদস্য একটি এল এমজি রেখে সরে পড়েছেন। এই সংবাদ পেয়ে তিনি তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে ঐ এল এমজি উদ্ধার করার জন্য অভিযান চালান। অনেক খােজাখুজির পর বেলতা গ্রামের একটি পাটক্ষেত থেকে ঐ এল এমজি উদ্ধার করেন। বীর মুক্তিযোেদ্ধা ফজলুল হক মল্লিক, ইসমাইল হােসেন ঠান্ডু ও বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্য আনােয়ার হােসেন সহ আরাে বেশ কিছু যুবককে সঙ্গে নিয়ে বাতেন বাহিনীতে যােগদান করেন। এ সময় তিনি সঙ্গে নিয়ে যান উদ্ধার করা এল, এম, জি সহ বেশ কিছু অস্ত্রশস্ত্র । তিনি বাতেন বাহিনীতে যােগদান করে কয়েকটি যুদ্ধে অত্যন্ত সাহসিকতাপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। যা পূর্ববর্তী অধ্যায় বাতেন বাহিনীতে উল্লেখ করা হয়েছে। ১৯৭১ সালের জুলাই মাসের শেষ দিকে বীর মুক্তিযােদ্ধা ফজলুল হক মল্পিক উন্নততর সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে যান। অত্যন্ত কষ্ট করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আখাউড়া হয়ে তিনি ভারতের আগরতলায় পৌছান। সেখান থেকে ত্রিপুরার গােকুলনগর যান। এখানে জঙ্গল পরিষ্কার করে মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। এই ক্যাম্পে আলফা, চার্লি,ব্রেভাে ও ডালডা নামে কোম্পানীর মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এখানেই ফজলুল হক মল্লিককে ব্রেভাে কোম্পানীর ৬ নং প্লাটুনের কমান্ডার নিয়ােগ করা হয়। কমান্ডার নিয়ােগের পর গােকুলনগর ক্যাম্পেই কয়েকদিন গ্রেনেড চার্জ করাসহ বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। কয়েকদিন প্রশিক্ষণ দেয়ার পর ফজলুল হক মল্লিককে এিপুরা রাজ্যের কলেজ টিলা পাঠানাে হয় এবং সেখানে তাকে মুজিব বাহিনীর সিনিয়র গ্রুপে প্রশিক্ষণের জন্য পাঞ্জাবের দেরাদুন পাঠানাে হয়। কলেজ টিলা থেকে রাশিয়ার কার্গো বিমানে প্রথমে দার্জিলিং এবং পরে সেখান থেকে অন্য বিমানে শাহরাস্থি পাঠানাে হয়। শাহরাস্থি থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ডাবল ইঞ্জিন বিশিষ্ট ট্রাক যােগে প্রায় দুইশ মাইল অতিক্রম করে দেরাদুন পাঠানাে হয়। ফজলুল হক মল্লিক সেখানে মুজিব বাহিনীর অষ্টম ব্যাচে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। হাসানুল হক ইনু, আফম মাহবুবুল হক, শরীফ নুরুল আম্বিয়া প্রমুখ মুক্তিযােদ্ধা এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর মন মােহনসিং, নেপালী সেনা প্রমুখ ওখানে মুজিব বাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণ দিবেন। এক্সপ্লোসিভ থেকে আরম্ভ করে রাইফেল, এল এমজি, মর্টার, এয়ার ক্রফট ধ্বংসী কামান চালানােসহ বিভিন্ন উচ্চ মানের অস্ত্র ব্যবহারের প্রশিক্ষণে দেয়া হয়। ২৮ দিনের প্রশিক্ষণের কথা থাকলেও ঐ ক্যাম্পে ৪২দিন প্রশিক্ষণ দেয়া যায়। প্রশিক্ষণ গ্রহণের সময় মুজিব বাহিনীর সদস্যদের অত্যন্ত কষ্ট ভােগ করতে হয়েছে। প্রশিক্ষণের সময় মাঝে মাঝে রাজনৈতিক বক্তব্য শােনানাে হতাে। রাজনৈতিক বক্তব্য রাখতেন মুজিব বাহিনীর প্রভাবশালী সংগঠকদের মধ্যে
১১৯
শেখ ফজলুল হক মনি, আব্দুর রাজ্জাক, তােফায়ল আহম্মদ, হাসানুল হক ইনুসহ অন্যান্য। প্রশিক্ষণ শেষে গােহাটির ঘেড়া পাড়া বেইজ ক্যাম্পে পাঠানাে হয় ফজলুল হক মল্লিক সহ ঐ ব্যাচের সবাইকে। খেড়াপাড়া যাবার পর সেখানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন কর্মকর্তা জিজ্ঞাসা করেন ৭২ ঘন্টার মধ্যে আত্মহুতির বিনিময়ে ঢাকা শহরে গ্রেনেড চার্জ করতে হবে। এই আত্মাহুতির জন্য আপনারা কে কে প্রস্তুত আছেন। যারা প্রস্তুত আছেন তারা হাত তুলুন। বীর মুক্তিযােদ্ধা ফজলুল হক মল্লিক সবার আগে হাত তােলেন এবং পরে আরাে বেশ কয়েকজন হাত তােলেন। এই সাহসিকতা দেখে মুজিব বাহিনীর অন্যতম সংগঠক আব্দুর রাজ্জাক ফজলুল হক মল্লিকের ভূয়সী প্রশংসা করেন। এখানে যারা হাত তুলেন তাদের গােয়েন্দা বিভাগের জন্য নিয়ােগ করে গৌহাটি সহ বিভিন্ন স্থানে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। ঐ সমস্ত স্থানে প্রশিক্ষক হিসাবে কাজ করেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর মিঃ মেনন, মিঃ খােরনা সহ আরাে কয়েকজন। প্রশিক্ষণ দেয়া হত অত্যন্ত গােপনীয় ভাবে ও সতর্কতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের। কৌশল শিখা বা আরাে প্রশিক্ষণ দেয়া হতাে ওয়ার্ড ব্যবহার, ছদ্ম নাম ও বহুবেশ ধারন,তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতি নির্ণয়, শত্রুকে চিহ্নিত করন এবং শত্রুকে ফাঁকি দিয়ে কাজ উদ্ধরে, দেশের বিভিন্ন অবস্থানে যােগসূত্র স্থাপন, যােগাযােগ সতর্কীকরন ইত্যাদি। বােমা তৈরি, বােমা ফাটানাে, অস্ত্র বহন করা অস্ত্র রাখা সহ বিভিন্ন ধরনের সামরিক নীতিমালা সম্পর্কেও প্রশিক্ষণ দিতেন। প্রশিক্ষণ দেয়ার সময় ভারতের সেনা কর্মকর্তা মিঃখােরানা একেক দিন একেক ধরনের পােশাক পরে আসতেন। তিনি কোনদিন ধুতি ও শার্ট পরে হিন্দু সেজে আসতেন আবার কোনদিন পায়জামা পাঞ্জাবি পরে মুসলমান সেজে আসতেন আবার কোনদিন শিখদের পােশাক পরে শিখ সেজে আসতেন। মিঃ খােরানা প্রশিক্ষণ দেয়ার সময় মাঝে মাঝে গল্প বলতেন। যার মধ্যে যুদ্ধের কৌশল সম্পর্কে শিক্ষার অনেক কিছু থাকতাে। বীর মুক্তিযােদ্ধা ফজলুল হক মল্লিক বিভিন্ন সামরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে আন্তর্জাতিক মান সম্পন্ন সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়ে মানকের চর ও বাহাদুরাবাদ ঘাট দিয়ে নৌকাযােগে তার সঙ্গী সাথীদের নিয়ে টাঙ্গাইল প্রবেশ করেন। ভারত থেকে আসার সময় তিনি বেশ কিছু অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আসেন। টাঙ্গাইল প্রবেশ করে কিছুসংখ্যক সাহসী যুবককে মুজিব বাহিনীর জন্য নির্বাচিত করে তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। টাঙ্গাইল জেলার আশেপাশে আরাে কয়েকটি জেলায় মুজিব বাহিনীর তৎপরতা ও সংগঠিত করার কার্যক্রম পরিচালনা করেন ফজলুল হক মল্লিক। বিশেষ করে সিরাজগঞ্জ পাবনা, জামালপুর, ময়মনসিংহ, শেরপুরের বিস্তীর্ন অঞ্চলে। সমস্ত বাংলাদেশকে মুজিব বাহিনীর চারজন সংগঠকের জন্য চার ভাগে বিভক্ত করা হয়। এই চারজন ছিলেন শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক ও তােফায়েল আহম্মদ। আব্দুর রাজ্জাকের দায়িত্বপ্রাপ্ত এলাকার অংশ বিশেষে ফজলুল হক মল্লিক মুজিব বাহিনী তৎপরতা চালান। তার সহযােদ্ধাদের মধ্যে ছিলেন আনােয়ার হােসেন চুনু, জয়নাল, শরিফ, রােকন, আজিজ, ওসমান প্রমূখ। ফজলুল হক মল্লিককে মুজিব বাহিনীর কার্যক্রম পরিচালনা করতে অত্যন্ত সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়েছে। কারণ তার এলাকায় কাদেরিয়া বাহিনী ও বাতেন বাহিনীর যােদ্ধাদের মধ্যে সুসম্পর্কের মাধ্যমে কার্যপরিচালনার জন্য তিনি সব সময় সচেষ্ট থাকতেন। মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে তিনি বাতেন বাহিনীর অন্যতম সংগঠক ও দূরদর্শী যােদ্ধা থাকায় বাহিনীর লােকজনের সাথে তার ভাল সম্পর্ক ছিল। তিনি কাদেরিয়া বাহিনীর যােদ্ধাদের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তােলার জন্য সচেষ্ট থাকতেন। ফজলুল হক মল্লিক ‘দেয়াল চান’ ছদ্মনাম ধারন করে প্রায় ৩/৪ শ যুবককে বিভিন্ন ক্যাডারে প্রশিক্ষণ দিয়ে শক্তিশালী ভাবে তৎপরতা চালাতে শুরু করেন। তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে বিভিন্ন স্থানের অবস্থা ও
১২০
সেখানে শক্রর অবস্থান সম্পর্কে ভারতীয় বাহিনীর নিকট সংবাদ পাঠান। ফজলুল হক মল্লিক শুধুমাত্র ১৯৭১ সালের সশস্ত্র যুদ্ধেই অংশগ্রহণ করেননি ১৯৬৬ সালে নবম শ্রেনীর ছাত্রাবস্থায় রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রবেশ করে ১৯৬৯সালের ছাত্র -গন আন্দোলনে এবং ৭০ সালের সাধারন নির্বাচনে তার এলাকায় প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেন। এমনিভাবে বীর মুক্তিযােদ্ধা ফজলুল হক মল্লিক বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অত্যন্ত দুঃসাহসী ও বীরত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করেন। যা জাতির ইতিহাসে চিরদিনের জন্য লেখা থাকবে। বাঙ্গালী গবেষনা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার জন্য ফজলুল হক মল্লিক আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এই কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাকে পদে পদে বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। কিন্তু তিনি দমে যাওয়ার পাত্র নন। মুক্তিযুদ্ধে যেমন বিজয়ী হয়েছেন বাঙ্গালী গবেষনা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও তিনি বিজয়ী হতে চান।
কামালপুর -হালুয়াঘাট সেক্টরে ইঞ্জিনিয়ার আবুল হোসেন
ইঞ্জিয়ার আবুল হােসেন একজন বিশিষ্ট মুক্তিযােদ্ধা। তিনি ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে অত্যন্ত প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে তার সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ন যুদ্ধের কথা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। ইঞ্জিনিয়ার আবুল হােসেন এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে টাঙ্গাইলের চর অঞ্চলের ১৭৫জন যুবককে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণের জন্য ভারতে যান। সেখানে তুরার রওশন আরা ক্যাম্পে বিগ্রেডিয়ার সানসিং বাবাজির তত্ত্ববিধানে সামরিক প্রশিক্ষন শেষে ইঞ্জিয়ার আবুল হােসেন তার সহযােদ্ধাদের নিয়ে কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বাধীন ১১ নং সেক্টরের অধীনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তার সঙ্গীদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় মুক্তিযােদ্ধা ছিলেন টাঙ্গাইল শহরস্থ থানাপাড়ার মােঃ শাহজাহান মিয়া, দিঘুলিয়ার আলী, আনাহহালার কোরবান আলী, পাথরাইলের ময়েজ বি. এস. সি, কুচিয়ামুড়ির আব্দুল জলিল। কুকুয়ার মােকাদ্দেস আলমামুন, দেলদুয়ারের সানােয়ার হােসেন, রুপসীযাত্রার সেলিম, চক গােপালের রফিকুল ইসলাম রফিক। ইঞ্জিনিয়ার আবুল হােসেন শেরপুর জালালপুর, হালুয়াঘাট ও ময়মনসিংহ অঞ্চলের ১১ নং সেক্টরের অধীনে অনেকগুলি যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। তিনি সতের আঠারটি যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। এই সমস্ত যুদ্ধের মধ্যে বেশ কয়েকটি ছিল অত্যন্ত ভয়াবহ যুদ্ধ। কামালপুর, ভায়াডাঙ্গা, হালুয়াঘাট যুদ্ধ ছিল ইঞ্জিনিয়ার আবুল হােসেনের নেতৃত্বাধীন যােদ্ধাদের মারত্মক ভয়াবহ ও স্মরনীয় যুদ্ধ। শেরপুর জেলার শ্রীবর্দী থানাধীন ভায়াডাঙ্গা গ্রামে মুক্তিযোেদ্ধাদের সঙ্গে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে ইঞ্জিনিয়ার আবুল হােসেনের নেতৃত্বাধীন তিন জন মুক্তিযােদ্ধা শহীদ হন। ভায়াডাঙ্গা যুদ্ধে শহীদ মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে ছিলেন মােঃ আবু তাহের, আবুল গনি ও অপর জনের নাম জানা যায়নি। এই যুদ্ধে মােঃ আবু তাহের অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করে শেষ পর্যন্ত হানাদার বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে মৃত্যুবরন করেন। মােঃ আবু তাহের এই যুদ্ধে এল, এম, জির ব্রাস ফায়ারের সাহায্যে হানাদার সৈন্যদের বেশ কিছু সময়ের জন্য প্রতিরােধ করে রেখে অন্যান্য মুক্তিযোেদ্ধাদের নিরাপদ স্থানে চলে যাবার ব্যবস্থা করে দেন। একজন মুক্তিযােদ্ধা হানাদারদের গুলীতে আহত হলে তাকে আবু তাহের এবং আব্দুল গনি কাঁধে করে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাবার চেষ্টা
১২১
করেন। আহত মুক্তিযােদ্ধাকে কাঁধে নিয়ে তারা নিরাপদ স্থান হিসেবে একটি বাড়িতে ঢােকে। তারা বাড়িতে ঢােকার সঙ্গে সঙ্গেই দেখতে পায় ঐ বাড়িতে রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর বহু লােকজন অবস্থান নিয়ে আছে। এই বাড়িতে উঠে মােঃ আবু তাহের ও আব্দুল গনি আহত মুক্তিযােদ্ধা সহ রাজাকারদের হাতে ধরা পড়েন। রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর সদস্যরা ধৃত তিনজন মুক্তিযােদ্ধাকে পাকিস্তানী পাঞ্জাবী সৈন্যদের হাতে তুলে দেয়। পাকিস্তানী পাঞ্জাবী সৈন্যরা ধৃত তিনজন মুক্তিযােদ্ধাকে বারবার পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ শ্লোগান দিতে বললেও তারা দেয়নি। বরং তারা আরাে বীরত্বের সঙ্গে। জয় বাংলা’ শ্লোগান দেয়। বহুবার চেষ্টা করেও যখন পাঞ্জবীরা ঐ তিন জন বীর হমুক্তিযােদ্ধাকে দিয়ে পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ শ্লোগান দিতে ব্যর্থ হয়। তখন তারা আহত মুক্তিযােদ্ধাসহ মােঃ আবু তাহের ও আব্দুল গনিকে নির্মমভাবে হত্যা করে। পাঞ্জাবী সৈন্যরা চলে যাবার পর এলাকার সাধারণ মানুষ শহীদ তিন মুক্তিযােদ্ধাকে দাফন করে। আজও শ্রীবর্দীতে ঐ তিনবীর মুক্তিযােদ্ধার শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ দাঁড়িয়ে আছে। পরবর্তীতে মুক্তিযােদ্ধারা ঘাতক রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর সদস্যদের ধরে নিয়ে চরম শাস্তি দেয় এবং হত্যা করে। ইঞ্জিনিয়ার আবুল হােসেন কামালপুরের যুদ্ধে অত্যন্ত সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করেন। কামালপুর যুদ্ধটি ছিল সারা দেশের সমস্ত যুদ্ধগুলির মধ্যে একটি ভয়াবহ যুদ্ধ। এই যুদ্ধ বেশ কয়েকদিন ব্যপী চলে। এতে হানাদারদের যেমন জীবনহানি ঘটে তেমনি মুক্তিযােদ্ধাদের পক্ষেও বেশ জীবনহানি ঘটে। এই যুদ্ধের সময় ১১ নং সেক্টরে কমান্ডার কর্ণেল তাহের আহত হন। কর্ণেল তাহের তিন চার জন সঙ্গীকে নিয়ে কামালপুরের ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীদের দক্ষিণ দিকে রেকি করে পাকিস্তানী হানাদারদের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হবার জন্য বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় যাত্রা শুরু করেন। তিনি যখন বাংলাদেশ সীমান্তে প্রবেশ করেন তখন একটি এন্টি পার্সনাল মাইন তার পায়ের চাপে ব্রাষ্ট হয়। ঐ মাইনের আঘাতে কর্ণেল তাহেরের একটি পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। উল্লেখ্য যে বাংলাদেশের সমস্ত সীমান্ত এলাকা ব্যাপী পাকিস্তানী হানাদার সৈন্যরা এন্টি পার্সনাল মাইন ও ট্যাংক বিধ্বংসী মাইন বসিয়ে রেখেছিল। আর এ ধরনের হানাদারদের বসানাে একটি এন্টি পার্সনাল মাইন কর্ণেল তাহের ভুলবশত স্পর্শ করেন। ইঞ্জিনিয়ার আবুল হােসেন যুদ্ধরত অবস্থায় ঐ স্থানেই ছিলেন। তিনি ঐ রনাঙ্গণে একটি বিশেষ দায়িত্বে ছিলেন। কর্ণেল তাহেরের অবস্থা দেখার সঙ্গে সঙ্গে তার চিকিৎসার জন্য ভারতীয় বিগ্রেডিয়ার সান সিং বাবাজিকে অনুরােধ করেন। বিগ্রেডিয়ার সানসিং বাবাজি তাড়াতাড়ি কর্ণেল তাহেরের নিকট আসেন এবং তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। সানসিং বাবাজির প্রচেষ্টায় অতি দ্রুত গতিতে কর্ণেল তাহেরকে হেলিকপ্টারে করে চিকিৎসার জন্য ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়। কামালপুর রণাঙ্গণ থেকে ইঞ্জিনিয়ার আবুল হােসেনকে হালুয়াঘাটে পাকিস্তানী হানাদারদের উপর আক্রমণ করার জন্য দায়িত্ব দেয়া হয়। এখানে ভারতীয় ৬ষ্ঠ বিহার ব্যাটেলিয়নকে ভালুর পাহাড় দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করার জন্য রাস্তার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেন। কারণ হানাদার বাহিনীর সৈন্যরা বাংলাদেশ সীমান্তে বহু এন্টি পার্সনাল মাইন এবং ট্যাংক বিধ্বংসী মাইন বসিয়ে রাখে। এই সমস্ত মাইন অপসারণ করে রাস্তাকে বিপদ মুক্ত করে দেয় ইঞ্জিনিয়ার আবুল হােসেন ও তার সহযােদ্ধারা। মাইন অপসারণ করার সময় একজন মুক্তিযােদ্ধা শহীদ হন। মাইনগুলি তুলে একটি বাড়িতে অনেকগুলি একত্রিত করে রাখা হয়েছিল এবং এ মাইন পাহাড়া দেয়ার জন্য কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধাকে নিয়ােজিত করা হয়। হঠাৎ একটি মাইন ব্রাষ্ট হয়ে একজন মুক্তিযােদ্ধা মৃত্যুবরণ করে,
১২২
যার বাড়ী ছিল টাঙ্গাইলে। ইঞ্জিনিয়ার আবুল হােসেন তার সহযােদ্ধাদের নিয়ে অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে জীবনকে বাজী রেখে সমস্ত মাইন অপসারণ করে বিপদমুক্ত রাস্তা দিয়ে ভারতীয় সৈন্যদের হালুয়াঘাট আক্রমণ করার ক্ষেত্র তৈরী করে দেন। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের পাঁচ/ছয় তারিখে ভারতীয় বাহিনীর ৬ষ্ঠ বিহার ব্যাটলিয়ানের সৈন্যরা হালুয়াঘাট আক্রমণ করে এবং এখানে হানাদারদের সঙ্গে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। ভারতীয় বাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমনে হানাদার বাহিনীর তেমন কোন ক্ষতি করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত বিমান আক্রমণ চালানাে হয়। কয়েকবার বিমান হামলার পর হানাদার সৈন্যরা হালুয়াঘাট ত্যাগ করে। হালুয়াঘাট যুদ্ধে ৬ষ্ঠ বিহার ব্যাটেলিয়নের সঙ্গে ইঞ্জিনিয়ার আবুল হােসেন তার সহযােদ্ধাদের নিয়ে অত্যন্ত শক্তিশালী ভূমিকা রাখেন। হালুয়াঘাট হানাদার মুক্ত করার পর ইঞ্জিনিয়ার আবুল হােসেন তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে ভারতীয় মিত্র। সৈন্যদের সঙ্গে ময়মনসিংহের দিকে অগ্রসর হন। ময়মনসিংহ আসার পথে ফুলপুর মুক্ত করার পর যৌথবাহিনী ময়মনসিংহ শহর আক্রমণ করে। এখানে হানাদারদের সঙ্গে যৌথ বাহিনীর প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে হানাদারদের পতন ঘটে। ফুলপুর মুক্ত করার পর যৌথবাহিনী ময়মনসিংহ শহর আক্রমণ করে। এখানে হানাদারদের সঙ্গে যৌথবাহিনীর প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে হানাদারদের পক্ষে ব্যাপক জীবনহানী ঘটে এবং একজন কর্ণেল ও বেশ কয়েকজন অফিসার সহ ৫৫১ জন আত্মসমর্পণ করে। ময়মনসিংহের যুদ্ধে ইঞ্জিনিয়ার আবুল হােসেন তার সহকর্মীদের নিয়ে অত্যন্ত প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করে। ১১ই ডিসেম্বর ময়মনসিংহ মুক্ত করার পর ব্রিগেডিয়ার সানসিং বাবাজী ইঞ্জিনিয়ার আবুল হােসেনকে এখানকার আইন শৃংঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব দেন। তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ময়মনসিংহের আইন শৃংখলা রক্ষার দায়িত্ব পালন করেন। ইঞ্জিনিয়ার আবুল হােসেনের যুদ্ধে সাহসিকতাপূর্ণ অংশগ্রহণ ও তার আচার আচরণের জন্য মুক্তি বাহিনীর সেনাপতি জেনারেল এম.এ.জি. ওসমানি এবং ভারতীয় সেনাকর্মকর্তা বিগ্রেডিয়ার সানসিং বাবাজীর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসেন। জেনারেল ওসমানি মাঝে মধ্যেই রণাঙ্গন পরিদর্শনে যেতেন। তিনি ইঞ্জিনিয়ার আবুল হােসেনকে পেলেই তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে আলাপ-আলােচনা করতেন। এক এক আলােচনার সময় ইঞ্জিনিয়ার আবুল হােসেন জেনারেল ওসমানিকে প্রশ্ন করেনHow many children of you? Toc Galicia Boyalfa 1669 -I have eight children. Frist Bengal Regiment, Sceond Bengal Regiment, Third Bengal Regiment, Fourth Bengal Regiment, Fifth Bengal Regiment, Sixth Bengal Regiment, Seventh Bengal Regiment and Eighth Bengal Regiment. জেনারেল এম, এ, জি, ওসমানির উত্তর প্রমাণ করে তিনি একজন খাঁটি দেশ প্রেমিক সেনানায়ক ছিলেন। সেনাবাহিনীর প্রতিটি সৈন্যকে যে কতটুকু আপন ভাবতেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় তার ঐ উত্তরে। তিনি মুক্তিযােদ্ধাদেরকে সত্যিই নিজ সন্তান তুল্য মনে করতেন। ইঞ্জিনিয়ার আবুল হােসেন শুধুমাত্র একা মুক্তিযুদ্ধেই সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেননি, তিনি ১৯৬৯ সালের ছাত্রগণ আন্দোলনেও অত্যন্ত প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেন। তিনি দশম শ্রেণীতে অধ্যায়নরত অবস্থায় ছাত্র গণআন্দোলনে অংশ গ্রহণ করেন। ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলন সারা দেশের মধ্যে সবচেয়ে জঙ্গী আকার ধারণ করে টাঙ্গাইলে। রাজধানী ঢাকার বাইরে দেশের অন্য কোন জেলায় এত ব্যাপক শক্তিশালী ও জঙ্গী আন্দোলন গড়ে উঠেনি। এসময় টাঙ্গাইল জেলার পশ্চিম এলাকাতে ডাকাত, গরু চোর ও সমাজবিরােধীদের দমন করার আন্দোলন সৃষ্টি হয়। এই
১২৩
আন্দোলনে আনুমানিক ৬৭ জন চোর-ডাকাতকে হত্যা করা হয়। এমন পরিস্থিতিতে ১৯৬৯ সালের মার্চ মাসে আইয়ুব শাহী ইয়াহিয়ার নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরের মাত্র কয়েকদিন আগে টাঙ্গাইলের তৎকালীন অবাঙ্গালী মহকুমা প্রশাসক জনাব আব্দুল্লা আল মেমন এর নেতৃত্বে পুলিশ ও ই. পি. আর এর এক বিশাল বাহিনী পশ্চিম টাঙ্গাইল গমন করে গণ আন্দোলনে নিহত দুস্কৃতিকারীদের বেশ কয়েকজনের মৃত দেহ তুলে যখন টাঙ্গাইল শহরের দিকে রওনা হন, তখন তিনি ছাত্র নেতা ও ১০/১২ হাজার জনসাধারণের বিশাল বাহিনী নিয়ে ধলেশ্বরী নদীর পাড়ে তাদের গতিপথ রুদ্ধ করে দাঁড়ান। এখানে প্রায় এক ঘন্টা বাক বিতন্ডার পর মহকুমা প্রশাসক পরিস্থিতির ভয়াবহতা উপলব্ধি করে উক্ত লাশ ছাত্র-জনতার নিকট হস্তান্তর করে টাঙ্গাইল চলে আসেন। এরপর ১৯৬৯ সালের ২৫ শে মার্চ আইয়ুব খান সেনা বহিনীর প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করায় সামরিক শাসন জারী হলে সারা পশ্চিম টাঙ্গাইলে ব্যাপক ধরপাকর শুরু হয়। ছাত্র জনতার অনেকেই গ্রেপ্তার হন। মুক্তিযুদ্ধ ও রাজনীতি বিষয়ে ইঞ্জিনিয়ার আবুল হােসেন কতগুলাে মূল্যবান বই লেখেন। তার রচিত বইগুলাের মধ্যে বাংলাদেশের রাজনীতি (১৭৫৭-১৯৯২), উপমহাদেশের রাজনীতি, বিশ্ব রাজনীতি, বিশ্ব শান্তির সন্ধানে – উল্লেখযােগ্য।
ব্যারিষ্টারশওকত আলী খান
ব্যারিষ্টার শওকত আলী খান ১৯৭১ সালে ছিলেন মির্জাপুর-নাগরপুর এলাকা থেকে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ দলীয় একজন জাতীয় সংসদ সদস্য। যে কয়েকজন মুষ্টিমেয় বুদ্ধিজীবী জনপ্রতিনিধি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন, ব্যারিষ্টার শওকত আলী খান ছিলেন তাদেরই একজন। বর্তমানে তিনি সুপ্রিম কোর্টের একজন প্রবীন আইনজীবি ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য। ১৯৭১ সালের ২৩শে মার্চ রাতে ব্যারিষ্টার শওকত আলী খান বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে যান। সেখানে আলােচনার পর বঙ্গবন্ধু তাকে নিজ এলাকায় যাওয়ার নির্দেশ দেন। তিনি তাকে বলেন, চট্টগ্রামে গন্ডগােল শুরু হয়ে গিয়েছে কাজেই তােমরা এখন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও। ১৯৭১ সালের ২৪শে মার্চ ব্যারিষ্টার শওকত আলী খান তার নিজ গ্রাম লাউহাটিতে চলে আসেন। ঐদিন বিকেলেই তিনি এক জনসভা ডাকেন। সেই জনসভাতে তিনি জনসাধারণকে জানান যে চট্টগ্রামে যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে। পাকিস্তানীরা বাঙ্গালীদের উপর বিভিন্ন স্থানে আক্রমণ করেছে। যুদ্ধ অবশ্যাম্ভাবী। ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর গ্রেপ্তার এবং তার স্বাধীনতা ঘােষণার কথা শুনে তিনি লাউহাটি থেকে মির্জাপুর চলে যান। তারপর সেখান থেকে তিনি ঘাটাইল পাহাড় অঞ্চলে কয়েকদিন অবস্থান করেন। সেখানে তিনি বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে ঘুরে লােকজনদের সঙ্গে দেখা করেন এবং তাদের মনােবল দৃঢ় রাখার জন্য তাদেরকে সাহস দেন। আগস্ট মাসের শেষের দিকে ব্যারিষ্টার শওকত আলী খান একখানা নৌকা নিয়ে মহেন্দ্র গঞ্জের মাইনারচর যান। সেখানে সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়ে গেরিলা বাহিনীর একটি কোম্পানীসহ দেশের ভিতরে আসেন। তিনি মির্জাপুর নাগরপুর সহ বিভিন্ন স্থানে তার কোম্পানীর যােদ্ধাদের নিয়ে অবস্থান করেন। দেশের ভিতরে থাকলেও তিনি মাঝে মাঝে ভারতের মহেন্দ্র গঞ্জে
১২৪
যেতেন। তিনি তিবার সেক্টরের সদর দপ্তরে যান এবং এক কোম্পানী করে মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ে আসেন। ব্যারিষ্টার শওকত আলী খানের মুক্তিযুদ্ধ কালীন সময়ের সব চেয়ে স্মরণীয় ঘটনা ছিল কর্ণেল তাহেরের আহত হওয়ার ঘটনাটি। সেদিন তিনি কর্ণেল তাহেরের সঙ্গে ঐ রণাঙ্গনে উপস্থিত ছিলেন। কর্ণেল তাহেরের সঙ্গে যুদ্ধের সম্মুখ ভাগের দিকে কিছুদূর যাবার পর তাকে আর বেশি দূর যেতে দিলেন না কর্ণেল তাহের। তিনি তাকে একটি নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থানের পরামর্শ দিয়ে তার অন্য কয়েকজন সাথী নিয়ে আক্রমণ চালানাের জন্য দেশের ভিতরে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কিছুদূর যাবার পর হঠাৎ একটি মাইন ব্রাস্ট হয়ে তার পায়ের এক অংশ দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তিনি সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে পড়ে যান। তার সাথীরা তাকে তাড়াতাড়ি পিছনের দিকে নিয়ে গেলেন। ক্যাম্পের ফিল্ড হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসার পর তাঁকে হেলিকপ্টারে নৌহাটি হাসপাতালে পাঠানাে হয়। ব্যারিষ্টার শওকত আলী খান যখন মহেন্দ্র গঞ্জে যেতেন তখন সেখানেও তিনি মুক্তিযােদ্ধাদের সংগঠিত করার জন্য অত্যন্ত তৎপর থাকতেন। তিনি বিভিন্ন ক্যাম্প নিজেই পরিদর্শনে যেতেন এবং বিভিন্ন স্থানে অন্যান্য নেতাদের সঙ্গে নিয়েও যেতেন। প্রবাসী সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামরুজ্জামানকে সঙ্গে নিয়ে একটি ক্যাম্প পরিদর্শনে যান। ঐ ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন মেজর জিয়া। তিনি তাকে অনুরােধ করেন কামরুজ্জামানকে কোন রকমে সম্মত করে তাদের ক্যাম্প পরিদর্শনে আনার জন্য। ব্যারিষ্টার শওকত আলী খানের অনুরােধে কামরুজ্জামান একদিন ক্যাম্প পদির্শনে আসেন। তার পরিদর্শন মুক্তিযযাদ্ধাদের অনেকটা উৎসাহ উদ্দীপনা যােগাতে সাহায্য করে। এই ক্যাম্প পরিদর্শনে আরাে আসেন- শামসুর রহমান খান, হাতেম আলী তালুকদার ও মির্জা তােফাজ্জাল হােসেন মুকুলসহ আরাে দু-চারজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। এই ক্যাম্পের একটু দূরে তুরাতে বেশ কয়েকজন জনপ্রতিনিধি থাকতেন তারাও মাঝে মাঝে ক্যাম্প পরিদর্শনে আসতেন। ব্যারিষ্টার শওকত আলী খানের আত্মবিশ্বাস ছিল যে তিনি যুদ্ধের কাজেই বেশি সহযােগিতা করতে পারবেন। তাছাড়া তার মনের মধ্যে একটি প্রতিক্রিয়াও কাজ করছিল যে এই যুদ্ধ বার বার হবে না। কাজেই এই যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য তিনি উৎসাহী ছিলেন। তিনি আরাে ভেবেছিলেন যে বাইরে যাবার জন্য কিংবা মুজিব নগর সরকারের কাছাকাছি থেকে কাজ করার জন্য অনেককেই পাওয়া যাবে। কিন্তু জাতীয় পরিষদ সদস্য কিংবা অন্য কোন বুদ্ধিজীবিকে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করতে পাওয়া যাবে না। কাজেই তিনি তখন মনে করলেন বুদ্ধিজীবিদেরও অস্ত্র হাতে যুদ্ধ ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষভাবে এগিয়ে আসা উচিৎ। এই দৃষ্টি ভঙ্গীতেই তিনি অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন। ব্যারিস্টার শওকত আলীর মত আর মাত্র হাতে গােনা সামান্য কয়েকজন বুদ্ধিজীবি অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন। এসব বুদ্ধিজীবিদের মধ্যে ছিলেন শ্রী সুরঞ্জিৎ সেন গুপ্ত, জেনারেল আব্দুল রব, ক্যাপ্টেন সুজাত আলী এবং আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী প্রমূখ।
কুমিল্লায় শহীদ এ, কে, এম, শামসুল হক খান সি. এস. পি.
১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে যে ক’জন উচ্চ পদস্থ বেসামরিক কর্মকর্তা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন তাদের মধ্যে এ, কে, এম, শামসুল হক খান অন্যতম। স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুতেই তিনি পাক
১২৫
সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে তােলার মত সাহসিকতাপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেন। তার নেতৃত্বে কুমিল্লায় হানাদার প্রতিরােধ তৎপরতা শুরু হয় ৭১ সালের মার্চ মাসের প্রথম দিকে। ঐ সময় তিনি ছিলেন কুমিল্লার জেলা প্রশাসক। এ, কে, এম, শামসুল হক খান ‘৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ঘােষণার পর কুমিল্লার রাজনৈতিক নেতা, কর্মীদের সঙ্গে যােগাযােগ করে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে পরামর্শ করতে শুরু করেন। তিনি কুমিল্লার মুক্তিকামী জনতাকে সংগঠিত হওয়ার জন্য সকল প্রকার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন। রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের ডেকে নিয়ে বলেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য সর্বক্ষণ তিনি তাদের সঙ্গে থাকবেন। মার্চ মাসের প্রথম দিকেই এ, কে, এম, শামসুল হক খান চাঁদপুরের সরকারী কর্মকর্তাদের এক সমাবেশে ভাষণকালে বলেন, আমাদের দেশমাতৃকার জন্য সংগ্রাম করার সময় এসেছে। আমাদের ত্যাগের সময় এসেছে। যদিও আমরা এ চরম ত্যাগের ফল ভােগ করতে পারবাে না; কিন্তু আমাদের ভবিষ্যত বংশধরদের জন্য স্বর্ণদ্বার খুলে দেবে। একজন উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মচারীর পক্ষে এ ধরণের বক্তব্য রাখা তখন কত যে কঠিন কাজ, তা একটু ভাবলেই বুঝা যায়। ঐ ধরনের বক্তব্য রাখা তখন সবার পক্ষেই সম্ভব ছিল
। এ বক্তব্যেই প্রমাণ মেলে তিনি কতটুকু সাহসী ও দূরদর্শী ছিলেন এবং দেশমাতৃকার প্রতি তার কত দরদ ছিল। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ১০ তারিখ থেকেই এ, কে, এম, শামসুল হক খান, এস পি মুন্সি কবীর উদ্দীন, ডঃ সাত্তার, অধ্যাপক খােরশেদ আলম এমসিএ, মিঃ আহমেদ আলী এমসিএ সহ স্থানীয় নেতাদের নিয়ে পাকিস্তানী হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে তােলার নকশা তৈরি করেন। তিনি পরিকল্পনামাফিক অত্যন্ত শক্তিশালী প্রতিরােধ ব্যবস্থা গড়ে তােলার জন্য শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তােলার প্রতি মনােযােগ দেন। তার অক্লান্ত পরিশ্রমে কুমিল্লার রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের সমন্বয়ে এক জঙ্গী প্রতিরােধ ব্যবস্থা গড়ে উঠে। তিনি কুমিল্লার মাটিতে গড়ে তােলেন এক সাহসী দূরদর্শী মুক্তিযােদ্ধাদের সংগঠন। এ কে এম শামসুল হক খান বঙ্গবন্ধুর ভাষণকে। অনুসরণ করে কুমিল্লায় হানাদারদের রেশন ও পেট্রোল বন্ধ করে দেন। এতে হানাদার সৈন্যরা তার প্রতি মারাত্মকভাবে ক্ষেপে যায়। কুমিল্লা সেনানিবাসের বিগ্রেড কমান্ডার ইকবাল শফি পুলিশের অস্ত্রশস্ত্র ও গােলাবারুদ দখল করতে গেলে এ কে এম শামসুল হক খান স্টোরের চাবি না দেয়ার জন্য এসপি কবির উদ্দিনকে নির্দেশ দেন। তার এ ধরনের কার্যক্রম প্রমাণ করে যে, তিনি ছিলেন একজন দূরদর্শী সংগঠক। তিনি চাকরি ও জীবনের মায়া ত্যাগ করে সার্বক্ষণিক মুক্তিযােদ্ধাদের সংগঠিত করার কাজে নিজেকে নিয়ােজিত রেখেছেন। দেশের জন্য জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কোন আপােষ তিনি করেননি। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের পর অনেকে যখন দেশ ত্যাগ করে সীমান্তের ওপারে চলে যান তখন তাকে অনেকেই সঙ্গে নিতে চেয়েছেন। কিন্তু তিনি যাননি। তিনি তখন বলতেন আমি কুমিল্লা ত্যাগ করলে এখানে হানাদারদের প্রতিরােধ করবে কে? আমাকে এখানে থেকেই প্রতিরােধ গড়ে তুলতে হবে হানাদারদের বিরুদ্ধে। ২৬শে মার্চ কুমিল্লা শহরে কার্টু ঘােষণা করে হানাদার সৈন্যরা এবং ঐদিনই এ কে এম শামসুল হক খানকে জেলা সার্কিট হাউজ থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে আসে। একই সাথে নিয়ে যায় কুমিল্লার এসপি কবীর উদ্দীনকে। আর এই গ্রেফতার অভিযানের নেতৃত্ব দেন হানাদার মেজর আগা ও ক্যাপ্টেন বােখারী। ডিসি ও এসপি গ্রেফতারের পর কয়েকদিন কুমিল্লা সেনানিবাসে রাখে। তারপর ১লা এপ্রিল তাদেরকে ঢাকায় পাঠায়। এ কে এম শামসুল হক খানের গ্রেফতার হবার সংবাদ পাবার পর আত্মীয় -স্বজন তাকে বিভিন্ন স্থানে খোঁজ করতে থাকেন। ঢাকায় আসার সংবাদ পেয়ে তার ভগ্নীপতি মােঃ নায়ীম খান নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিভিন্নভাবে বিভিন্নস্থানে তাঁকে খোঁজ করতে থাকেন। এ সময় তিনি
১২৬
পরস্পরের কাছে সংবাদ পান যে টাকার বিনিময়ে হানাদারদের নিকট থেকে বন্দী অনেকেই মুক্তি পাচ্ছে। এ ধরনের সংবাদ পাবার পর তিনি খিলগাঁও যান। সেখানে ঘাতকদের একজন সহযােগি বলেন ১০ হাজার টাকা দিলে এ, কে, এম, শামসুল হক খানকে ফিরিয়ে দেয়া হবে। একথা শােনার পর তিনি ১০ হাজার টাকা নিয়ে যান ঘাতকদের ঐ সহযােগির কাছে। তখন সে বলে, টাকা দিলে তাকে মীরপুর ১০ নং সেকশন থেকে এনে দেয়া হবে। মােঃ নায়ীম খান তখন বলেন, আমি টাকা দিতে পারি যদি আমাকে প্রমাণ দেখাতে পারেন যে আপনাদের কাছে সে আছে। তখন ঘাতকদের সহযােগি বলে তাহলে ৫ হাজার টাকা দিলে তার ছবি দিব আপনাকে। এরপর নায়ীম খান ঘাতকদের সহযােগির নিকট ৫ হাজার টাকা দেন। টাকা দেয়ার পর ঘাতকদের সহযােগি বলে ছবি পরে দেয়া হবে। সাত আট দিন পর ঘাতকদের ঐ সহযােগি এ, কে, এম, শামসুল হক খানের একটি ছবি এনে দেয় নায়ীম খানের নিকট। এ ছবিটি ঘাতকরা সংগ্রহ করে সচিবালয়ে সংরক্ষিত এ, কে, এম, শামসুল হক খানের ফাইল থেকে। ঘাতকরা এ, কে, এম, শামসুল হক খানকে হত্যা করার পরেও চক্রান্তমূলকভাবে তার আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিতে আসে। কোথায় হত্যা করেছে হানাদার সৈন্যরা এ কে এম শামসুল হক খানকে, কোথায় তার মৃতদেহ সমাধিস্থ করা হয়েছে তার কোন প্রকার অনুসন্ধান তার আত্মীয়-স্বজনরা পায়নি। আজো তার ভাই বােন সহ আত্মীয়-স্বজনরা খুঁজে বেড়ায় এ কে এম শামসুল হক খানকে। তারা খুঁজে বেড়ায় শামসুল হক খানের কবর। তারা পায়নি তার পরনের কাপড় চোপড়ের কোন প্রকার চিহ্ন। মুক্তিযােদ্ধা এ, কে, এম, শামসুল হক খান রেখে গেছেন স্ত্রী এক পুত্ৰ উসমান হক খান ও মেয়ে উসমা হক খানকে। তার খোঁজ না পেলেও পরিবারের লােকজন বা সন্তানদের সান্ত্বনা শামসুল হক খান একজন বীর মুক্তিযােদ্ধা ছিলেন। তার শ্রমের বিনিময়ে, রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। আর সেই স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসাবে তারা আজ গর্বিত। শামসুল হকের সন্তানরা পিতাকে না পেয়েও শান্তি পাবে, যদি তার বাবার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়। যদি বাস্তবায়িত হয় ৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের চিন্তা-চেতনা । এ কে এম শামসুল হক খান জন্মগ্রহণ করেন টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর থানার অন্তর্গত পাকুটিয়া ইউনিয়নের আখতাড়াইল গ্রামে। তার পিতার নাম হাসান খান এবং মাতার নাম মাসুদা খানম। তিনি ছিলেন পিতা মাতার পাঁচ সন্তানের মধ্যে প্রথম। পিতা-মাতা তাই আদর করে তার নাম রাখেন রওশন’ অর্থাৎ জ্যোতি। তার অন্যান্য ভাই-বােনদের নাম ছিল এ কে এম ফজলুল হক খান, আজিজুল হক খান, এ কে এম আজাহারুল হক খান, সুফিয়া খানম ও জোহরা খানম। তিনি ছাত্র জীবনে অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। তিনি লেখাপড়া শুরু করেন আখতাড়াইল প্রাইমারী স্কুলে। বৃত্তি নিয়ে তিনি পাবনার শাহজাদপুর সরকারী স্কুলে ভর্তি হন। সেখানে কিছুদিন লেখাপড়া করার পর ঢাকার আরমানিটোলা সরকারী স্কুলে ভর্তি হন এবং এখান থেকেই কৃতিত্বের সঙ্গে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৫২ সালে ঢাকা কলেজের ছাত্র ছিলেন। তাই ভাষা আন্দোলনে শামসুল হক খান সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূগােল শাস্ত্রে এম এ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয় হন। তিনি ছাত্র জীবন থেকেই রাজনৈতিক কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৫৭ – ৫৮ সালে ফজলুল হক মুসলিম হল ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। লেখাপড়া শেষ করে শামসুল হক খান প্রথমে কিছুদিনের জন্য রাজশাহী সরকারী কলেজে অধ্যাপনা করেন। অধ্যাপনা করা অবস্থায়ই তিনি পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দেন। প্রথম পরীক্ষায় তাঁকে জুনিয়র সিভিল সার্ভিস পদে নিয়ােগ করা হয়। কিন্তু তাতে তিনি সন্তুষ্ট না হয়ে পুণরায় পরীক্ষা দেন এবং
১২৭
এবার সিভিল সার্ভিসে কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। বাঙ্গালী হওয়ার অপরাধে তাকে করাচীতে মেডিকেল পরীক্ষায় অযােগ্য ঘােষণা করা হয়। মেডিকেল পরীক্ষার বিরুদ্ধে আপীল করে তিনি ডিগ্রি লাভ করেন এবং সিভিল সার্ভিসের যােগদান করেন। শামসুল হক খান ১৯৬২-৬৩ সালে লাহাের সিভিল সার্ভিসের প্রশিক্ষণে যােগ দেন। ১৯৬৪ সালে রাজশাহীতে সহকারী কমিশনার হিসেবে যােগদান করেন। ১৯৬৫ সালে তিনি হবিগঞ্জে এডিসি এবং ১৯৭০ সালে কুমিল্লাতে জেলা প্রশাসক হিসেবে যােগদান করেন।
উত্তরবঙ্গে শহীদ কর্ণেল এ. কে. সামসুদ্দীন সি. এস. পি
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে যে কয়জন উচ্চপদস্থ বেসামরিক কর্মকর্তা অসীম সাহসিকতার সঙ্গে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধ করে মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের মধ্যে শহীদ কর্ণেল এ, কে, শামসুদ্দিন অন্যতম। তিনি মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করে দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অত্যন্ত প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে তাঁর নাম চিরদিনের জন্য সােনালী অক্ষরে লেখা থাকবে। শহীদ কর্ণেল এ, কে, শামসুদ্দিন মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে সিরাজগঞ্জের এস.ডি. ও ছিলেন। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের অসহযােগ আন্দোলন থেকেই তিনি মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। তাঁর নেতৃত্বে এবং প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে সিরাজগঞ্জকে কেন্দ্র করে উত্তর বঙ্গের কয়েকটি জেলার মুক্তিযােদ্ধারা সংগঠিত হয়। শহীদ কর্ণেল এ, কে, শামসুদ্দিনের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে সিরাজগঞ্জ, পাবনা, বগুড়া ও রংপুরের কিছু এলাকা সহ উত্তর বঙ্গের মুক্তিযােদ্ধারা তাড়াতাড়ি একটি শক্তিশালী সশস্ত্র বাহিনীতে পরিণত হয়। বেতার যােগাযােগের মাধ্যমে তিনি হানাদার বাহিনীর অবস্থান সম্পর্কে সার্বক্ষণিক খােজখবর রাখতেন। তাঁর নিজের বাসাকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য একটি দূর্গ হিসাবে গড়ে তুলেন। এই বাসার চারিদিকে বাংকার তৈরি করে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সৃষ্টি করেন। এই বাসাই ছিল অত্র এলাকার মুক্তিযােদ্ধাদের হেডকোয়ার্টার। এখানে বসেই সারা এলাকার মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গে যােগাযােগ এবং সংগঠিত করার কাজ পরিচালনা করা হয়। বাংকার গুলিতে সর্বক্ষণ বেঙ্গল রেজিমেন্টের, ই. পি. আর ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা অবস্থান নিয়ে শত্রুর অপেক্ষায় থাকতেন। বাসার একদিকে স্বাধীন বাংলার পতাকা, অন্যদিকে কালাে পতাকা সার্বক্ষণিক উত্তোলিত থাকত। নিজের কাছে সবসময় ওয়ার লেস রাখতেন। মুক্তিযােদ্ধাদের মন চাঙ্গা রাখার জন্য তিনি সিনেমা প্রদর্শনের ব্যবস্থা করেন। অস্ত্রশস্ত্র ও গােলাবারুদ সংগ্রহ করার জন্য তিনি বিভিন্ন স্থানে ছুটে বেড়িয়েছেন। তাঁর জানা ছিল যুদ্ধ পরিচালনা করতে হলে প্রচুর অস্ত্রের প্রয়ােজন তাই যে ভাবেই হােক অস্ত্রশস্ত্র ও গােলাবারুদ সংগ্রহ করতে হবে। তিনি প্রথমে তার নিজের নিয়ন্ত্রিত সিরাজগঞ্জের পুলিশ ও আনসারদের অস্ত্রশস্ত্র ও গােলাবারুদ নিয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের সংগঠিত করতে শুরু করেন। এরপর রাজশাহী, বগুড়া, রংপুর ও পাবনা থেকে বেশ কিছু বেঙ্গল রেজিমেন্টের ও ই.পি. আর বাহিনীর সদস্যরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যােগদান করাতে তাঁর বাহিনী কিছু অস্ত্রশস্ত্র লাভ করে। এর পরে তিনি টাঙ্গাইলের মুক্তিযােদ্ধাদের নিকট থেকে ৫০টি রাইফেল নেন তার বাহিনীর জন্য। দিনের পর দিন মুক্তিযােদ্ধাদের সংখ্যা বৃদ্ধি হওয়াতে ব্যাপক অস্ত্রশস্ত্র ও গােলাবারুদের প্রয়ােজন দেখা দেয়। তিনি অস্ত্রশস্ত্র ও গােলাবারুদ সগ্রহের জন্য সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে চলে যান। সেখানে থেকে বেশ কিছু আধুনিক অস্ত্র ও গােলাবারুদ নিয়ে আসেন।
১২৮
ভারত থেকে ফিরে এলেন? —তখন তিনি উত্তর দিতেন আমি যদি এলাকায় থাকি তবে সিরাজগঞ্জের ১৪ লক্ষ লােকের অবস্থা কি হবে? সিরাজগঞ্জের সর্বস্তরের মানুষ তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে জঙ্গী মনােভাব নিয়ে শত্রুর উপর আঘাত হানার জন্য তৎপর হয়ে উঠে। ১৯৭১ সালের ৮ই এপ্রিল হানাদার সৈন্যরা আরিচা হয়ে পাবনা আসার জন্য ঢাকা থেকে রওনা হয়েছে। এ সংবাদ পাওয়ার পর শহীদ কর্ণেল এ. কে. শামসুদ্দিন মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ে হানাদারদের প্রতিরােধের জন্য বাঘাবাড়ির ঘাটে উপস্থিত হন। এখানে তাঁর নেতৃত্বে হানাদারদের সঙ্গে মুক্তিযােদ্ধাদের প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে বেশ কিছু হানাদার সৈন্য নিহত হয় এবং বহু হানাদার সৈন্য আহত হয়। সংঘর্ষের এক পর্যায়ে মুক্তিযােদ্ধারা টিকতে না পেরে পিছপা হয়। পাবনার কালীনাথপুরের নারিকেল বাগানে হানাদার সৈন্যদের সঙ্গে মুক্তিযােদ্ধারা প্রচণ্ড রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এই সংঘর্ষে মুক্তিযােদ্ধাদের নেতৃত্ব দেন শহীদ কর্ণেল এ. কে. শামসুদ্দিন। এই সংঘর্ষে হানাদার সৈন্যরা প্রচুর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৯৭১ সালের ২৪শে এপ্রিল শহীদ কর্ণেল এ. কে. শামসুদ্দিনের নেতৃত্বে বাঘাবাড়ীর ঘাটে হানাদারদের এক সামরিক দলবলের উপর মুক্তিযােদ্ধারা হআক্রমণ করে। এই আক্রমণে হানাদারদের প্রচুর জীবনহানি ঘটে। এখান থেকে হানাদার সৈন্যরা এক পর্যায়ে পালিয়ে যায়। ১৯৭১ সালের ২৬শে এপ্রিল হানাদার সৈন্যরা ট্রেনযােগে ঈশ্বরদী থেকে সিরাজগঞ্জের দিকে অগ্রসর হয়। ঈশ্বরদী থেকে হানাদার বাহিনীর ট্রেন উল্লাপাড়ার আটিনা ব্রিজের উপর আসলে সেখানে মুক্তিযােদ্ধারা প্রতিরােধ করার চেষ্টা করে শহীদ কর্ণেল এ.কে. শামসুদ্দিনের নেতৃত্বে। মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতিরােধ আক্রমণে এখানে হানাদারদের প্রচুর জীবন হানি ঘটে ও বহু। খানসেনা আহত হয়। ঐদিন হানাদার সৈন্যদের পক্ষে সিরাজগঞ্জে আসা সম্ভব হয়নি। পরে যখন হানাদার সৈন্যরা সিরাজগঞ্জে আসে তখনও মুক্তিযােদ্ধারা প্রতিরােধ করার চেষ্টা করে। কিন্তু হানাদার সৈন্যদের শক্তির সামনে মুক্তিযােদ্ধাদের পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব হয়নি। সিরাজগঞ্জে হানাদার সৈন্যরা প্রবেশ করায় শহীদ কর্ণেল এ. কে. শামসুদ্দিন মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ে গ্রামের দিকে ছড়িয়ে পড়ে। তিনি একজন বেসামরিক সরকারী কর্মকর্তা হয়েও মুক্তিযােদ্ধাদের সংগঠিত এবং হানাদারদের বিতাড়নের জন্য সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাদের মত সার্বক্ষণিক যুদ্ধক্ষেত্রে অবস্থান করেন। তিনি উচ্চ পদস্থ সরকারী কর্মকর্তা হয়েও জীবনের সকল সুখ আরাম আয়েশকে হারাম করে অত্যন্ত কষ্টের মধ্যে জীবন কাটাতে শুরু করেন। কাজের ব্যস্ততার জন্য তাঁর পক্ষে নিয়মিতভাবে খাওয়া দাওয়া করা সম্ভব হয়নি। তিনি এই সময়ে নিজের দেহের কোন প্রকার যত্ন নেওয়ার সময় পাননি। যার জন্য তাঁর চুল এবং দাড়ি লম্বা হয়ে ঝাকরা বাবরি হয়েছিল। তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম ও সাহসী নেতৃত্বের জন্য এবং মুক্তিযােদ্ধাদের সাংগঠনিক তৎপরতার কারণে অত্র এলাকার জনসাধারণ তাকে কর্ণেল উপধীতে ভূষিত করেন। এরপর তিনি এলাকার মুক্তিযােদ্ধা সহ জনগণের নিকট কর্ণেল এ. কে. শামসুদ্দিন নামে পরিচিতি লাভ করেন। শহীদ কর্ণেল এ, কে, শামসুদ্দিন ছিলেন অত্যন্ত দৃঢ় প্রত্যয়ী মুক্তিযােদ্ধা। তাঁর দলের প্রত্যেক মুক্তিযােদ্ধাকেই বলতেন দেশ স্বাধীন হবেই। হানাদার সৈন্যরা কয়জনকে মারতে পারবে। নির্ভীক এই মুক্তিযােদ্ধা কোন সময় নিজের নিরাপত্তার কথা ভাবেনি। ভাবেনি অসহায় পিতামাতার ও ভাই বােনদের কথা ভাবেননি কোন সময় নবপরিনীতা অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর কথা, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মায়ের অসুখের কথা, শুনে সিরাজগঞ্জ থেকে ব্যাকুল প্রাণে ছুটে আসেন মায়ের সাথে দেখা করতে। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের হানাদার বাহিনীর আক্রমণের সংবাদ পাওয়ার পর তিনি অত্যন্ত উদ্ভ্রান্ত
১২৯
হয়ে পড়েছিলেন এবং তাৎক্ষণিকভাবে তিনি বৃদ্ধ মা-বাবা ও ভাইবােনদেরকে বিশেষ দূতের মারফত ফলমূলও খাবারের প্যাকেট সহ সান্তনার বাণী পাঠান। মায়ের মনকে সান্তনা দেওয়ার জন্য ওয়ারলেসের মাধ্যমে মায়ের সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন। মাকে তিনি সান্তনা দিয়ে বলতেন, “আমি কোন সময় বিপথে পরিচালিত হতে পারি না, দেশের নিরীহ মানুষের হত্যাকারী হানাদার সৈন্যদের প্রতিহত করার জন্য আমি নিয়ােজিত আছি। যুদ্ধরত থাকা অবস্থায় মায়ের সাক্ষাৎ লাভের প্রবল আকাংক্ষাকে তিনি উপেক্ষা করতে পারেননি তাই ক্ষনিকের জন্য মাকে দেখার জন্য ছুটে আসেন। মায়ের সঙ্গে দেখা করে ব্লাডপ্রেসারের রুগী মাকে তিনি কিছু ঔষধ ও নগদ টাকা প্রদান করে মায়ের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করে ফিরে এসেছিলেন সিরাজগঞ্জে। মুক্তিযুদ্ধের অন্তরালে তিনি নবপরিণীতা বধূকে ভুলে থাকলেও অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর আহবানে তিনি সাড়া দিয়েছিলেন এক পর্যায়ে। দীর্ঘদিন একটানা মুক্তিযুদ্ধে আবদ্ধ থাকার পর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর একান্ত অনুরােধে তিনি ঢাকা আসেন। কিন্তু নিয়তির নিমর্ম পরিহাস ও উত্তর বঙ্গের মুক্তিযােদ্ধাদের, তথা সারা দেশের মুক্তিপাগল মানুষের চরম দুর্ভাগ্য যে, ঢাকায় অবস্থান কালে তিনি হানাদার বাহিনীর চরদের চক্ষুর অন্তরালে থাকতে পারেননি। সারাক্ষণ অনুসরণকারী চররা অবশেষে ১৯৭১ সালের ১৭ই মে বীর মুক্তিযােদ্ধা শামসুদ্দিনকে ধরে ফেলে। শােনা যায় ঐ ধরার পিছনে তার আত্মীয় শফিউল আজমের হাত ছিল। শফিউল আজম ছিল তৎকালীন ইয়াহিয়া সরকারের সচিবালয়ের প্রভাবশালী সচিব। শহীদ কর্ণেল এ. কে, শামসুদ্দিনকে ধরার পরে হানাদার সৈন্যরা অত্যন্ত নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করে। তাকে ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে হানাদার সৈন্যরা যে অমানুষিক নির্যাতন তাঁর উপর চালায় তা ভাবতে গেলে ও দেহ শিউরে ওঠে। মেজর সরজদারাজের ব্র্যাক পাটি হিংস্র কুকুরের মত তার দেহের মাংস টেনে যেন খেয়েছিল। তার মাথায় চুল টেনে তুলে ফেলেছিল খুনীরা। তার দেহের বিভিন্ন অঙ্গ কেটে দেহ থেকে বিছিন্ন করে ফেলে হানাদার সৈন্যরা। কয়েকদিন এই ভাবে অত্যাচার করে ১৯৭১ সালের ১৯ শে মে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। ঐ দিনই বনানী সামরিক গােরস্থানে সামরিক পাহাড়ায় শহীদ কর্ণেল এ. কে. শামসুদ্দিনকে আত্মীয় পরিজনের অনুপস্থিতিতে সমাধিস্থ করা হয়েছিল। দেশ আজ স্বাধীন। কিন্তু মুক্তিযােদ্ধা শামসুদ্দিন আজ পিতা মাতার কাছে নেই। আছে তাঁর উত্তরাধীকার এ. কে. সালাউদ্দিন। এই সালাউদ্দিনকে তাঁর পিতা শহীদ মুক্তিযােদ্ধা শামসুদ্দিন দেখে যেতে পারেননি। কারণ তাঁর জন্ম হয় ১৯৭১ সালের ১৪ই অক্টোবর পিতার মৃত্যুর কয়েকমাস পড়ে। সালাউদ্দিন তাঁর পিতাকে হারিয়ে শান্তি পায় দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ হয়েছে। আর তার শহীদ পিতার রক্তের বিনিময়ে আজ দেশ স্বাধীন। সালাউদ্দিন দেশের সুনাগরিক হতে চায় । চায় মহান মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নের বাস্তবায়ন। সে দেশ ও জাতির নিকট কোন সাহায্যে সহযােগিতা সুযােগ সুবিধা চায়না। চায় মুক্তিযুদ্ধের এবং শহীদ পিতার স্বপ্নের বাস্তবায়ন। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ কর্ণেল এ. কে. শামসুদ্দিনের নেতৃত্ব ছিল অত্যন্ত সক্রিয় এবং কৃতিত্বপূর্ণ। তিনি বাংকারে অবস্থান করে হানাদারদের বিরুদ্ধে দিনরাত যুদ্ধ করেছেন। যুদ্ধ পরিচালনায় অস্ত্র হাতে তিনি উত্তর বঙ্গের এক প্রান্তর থেকে অন্য প্রান্তরে ঘুরে বেড়িয়েছেন। তাঁর সঙ্গে সর্বশেষ টেলিফোনে যােগাযােগ করে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন তুমি সবচেয়ে ব্যাকওয়ার্ড এলাকার এস. জিও বলে তােমাকে উত্তর বঙ্গের কমান্ড নিতে হবে। বঙ্গবন্ধুর সেই নির্দেশ তিনি পালন করেছিলেন অক্ষরে অক্ষরে, উত্তর বঙ্গের প্রতিটি এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের জালী শুনিয়ে ও সম্মুখ সমরে অংশ গ্রহণ করে ।
১৩০
একাত্তরের ভাসনিী
১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল খান ভাসানীর অবদান অসীম। তিনি মনেপ্রাণে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক ছিলেন। ১৯৬৯ সালের ছাত্র গণ-আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার, বঙ্গবন্ধুর নি:শর্ত মুক্তি, আইয়ুব খানের পদত্যাগ, সত্তুরের সাধারণ নির্বাচন, স্বাধীনতার আন্দোলন ও অসহযােগ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বুঝতে পারেন যে, দেশ ও জাতির নেতৃত্ব এখন তারই হাতে গড়া রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের হাতে এবং তার এককালীন স্নেহ-ভাজন শিষ্য শেখ মুজিবের জনপ্রিয়তা এখন শীর্ষে রয়েছে। এজন্যই তিনি ১৯৭১ সালের ৯ই মার্চ ঢাকার পল্টনে এক জনসভায় ভাষণ দেয়ার সময় বলেন, ইয়াহিয়া সাহেব অনেক হয়েছে আর নয় । তিক্ততা বাড়িয়ে আর লাভ নেই। লাকুম দ্বীনুকুম অলইয়াদ্বীন’ [তােমার ধর্ম তােমার আমার ধর্ম আমার নিয়মে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা স্বীকার করে নাও। মওলানা ভাসানী আরাে বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশ মত আগামী ২৫ তারিখের মধ্যে কোন কিছু না করা হলে আমি শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে মিলে ১৯৫২ সালের মতাে তুমুল গণ-আন্দোলন শুরু করব। মওলানা ভাসানী বাংলাদেশের স্বাধীনতা স্বীকারের জন্য পাকিস্তানের সামরিক প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের প্রতি আহবান জানিয়ে বলেন, পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হবে। পাকিস্তান অখন্ড থাকবে না। অখন্ড রাখবেও না। ইয়াহিয়া তােমার বাপেরও ক্ষমতা নেই, ঠেকায়। যদি পশ্চিম পাকিস্তানের ভালাে চাও তাহলে কালই বাংলার স্বাধীনতা স্বীকার করে নাও। মজলুম জননেতা তার স্বভাবসুলভ কণ্ঠে বলেন জালেমের সঙ্গে কোন সহযােগিতা নাই। যে জুলুম করে সে যেমন পাপী আর যে জুলুম সহ্য করে সেও তেমনি পাপী। কামানের সেলকে বাঙ্গালী ভয় করে না। বাঙ্গালীর হাতে দা কুড়াল, তীর ধনুক, খন্তা, বল্লম আছে। আমি সহিংশায় বিশ্বাস করিনা। আল্লাহ্ ও তার রসুল এই শিক্ষা দেননি। মওলানা ভাসানী তুমুল করতালী ও হর্ষধ্বনীর মধ্যে আরাে বলেন, কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করেছেন মুজিবুর রহমান আপােষ করতে পারেন। খামাখা কেউ মুজিবকে অবিশ্বাস করবেন না। শেখ মুজিবকে আমি খুব ভাল করে চিনি। তাকে আমি রাজনীতিতে হাতে খড়ি দিয়েছি। আমি শেখ মুজিবকে আমার তিন পুত্রের চেয়েও বেশি ভালবাসি। আমি আমার রাজনৈতিক জীবনে বিভিন্ন সংগঠনের সভাপতি হিসেবে ৩১ জন জেনারেল সেক্রেটারীর সঙ্গে কাজ করেছি। তাদের মধ্যে শেখ মু জবুর রহমানই ছিল শ্রেষ্ঠ সেক্রেটারী । উক্ত জনসভায় আরাে ভাষণ দেন আতাউর রহমান খান। তিনি তাঁর ভাষণে বলেন, বঙ্গবন্ধু আপনি সংখ্যা গরিষ্ঠ দলের নেতা। আপনি স্বাধীন বাংলার জাতীয় সরকার ঘােষণা করুন। আপনার হাতে ক্ষমতা না হস্তান্তরের ষড়যন্ত্র চলছে। উক্ত জনসভায় ভাষণ দিতে যাবার আগে আওয়ামী লীগের প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী এবং তার দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির কেন্দ্রীয় নেতাদের আলােচনা সভা হয়। প্রায় আড়াই ঘন্টা ব্যাপী আলােচনা সভায় বঙ্গবন্ধু ও মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর মধ্যে দেশের সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতির ও তার পরিপ্রেক্ষিতে করণীয় বিষয় নিয়ে আলােচনা হয়। ঐদিন তিনি পল্টনের জনসভায় ভাষণ দেয়ার উদ্দেশ্যে সকালে টাঙ্গাইলের সন্তোষ হতে ঢাকা আসেন। ঢাকায় পৌঁছার পরই বঙ্গবন্ধু তাকে টেলিফোন করেন। টেলিফোনে দুই নেতার আলােচনার পর আওয়ামীলীগ ও ন্যাপের কেন্দ্রীয় নেতাদের নিয়ে এই বৈঠক হয়।
১৩১
মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ১৯৭১ সালের মার্চের প্রথম দিক থেকেই দেশব্যাপী ব্যাপকভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ও স্বাধীনতার পক্ষে প্রচারকার্য চালান। তিনি ১৯৭১ সালের ১১ই মার্চ টাঙ্গাইলের বিন্দুবাসিনী স্কুল ময়দানে এক জনসভায় ভাষণ দেন। তিনি সেখানে বঙ্গবন্ধুর ঘােষিত স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রতি পূর্ণ সমর্থন ঘােষনা করেন আর সমর্থকদের উদ্দেশ্যে বলেন,শেখ মুজিবুর রহমান সাতকোটি বাঙ্গালীর নেতা তাঁর নির্দেশ পালন করুন। লক্ষ্য অর্জনের জন্য সবাই একসাথে ঐক্যবদ্ধ ভাবে সংগ্রাম করুন। এ মুহূর্তে রাজনৈতিক দলগুলাের মধ্যে কোন রকম বিভেদ থাকা উচিৎ নয়। জনগন এখন নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। ১৯৭১ সালের ১২ ই মার্চ ময়মনসিংহের এক জনসভায় ন্যাপ প্রধান মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী সাত কোটি বাঙ্গালীর মুক্তি সম্রামে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রতি তাঁর সমর্থন পুণর্ব্যক্ত করে বলেন, আমি জানি শেখ মুজিবুর রহমান কখনােই জনগনের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে না। আপনারা শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি ভরসা রাখুন। মওলানা ভাসানী পশ্চিম পাকিস্তানী প্রতিক্রিয়াশীল নেতাদের উদ্দেশ্যে জনসভায় বলেন, আল্লাহর ওয়াস্তে আপনারা বাঙ্গালীদের ব্যাপারে নাক গলাবেন না। ১৯৭১ সালের ১৬ই মার্চ ময়মনসিংহে অপর আরেক জনসভায় ভাষণ দেওয়ার সময় তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পদ অলংকৃত করবার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি আহবান জানান। ন্যাপ প্রধান বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর ও পশ্চিম পাকিস্তানে জুলফিকার আলী ভুট্টোর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার প্রতি আহবান জানান। ১৭ই মার্চ সন্ধ্যায় চট্টগ্রামে স্থানীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী বলেন, পূর্ববাংলার সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গলী এখন স্বাধীনতার প্রশ্নের ঐক্যবদ্ধ। তিনি আরাে বলেন, আমার ৮৯ বছরে অতীতের সবকটি আন্দোলনের সাথে আমি জড়িত ছিলাম। কিন্তু একটি সার্বজনীন দাবিতে জনগণের মধ্যে বর্তমান সময়ের মতাে একতা ও সহযােগিতা আমি এর আগে আর কখনাে দেখেনি। মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী সাংবাদিকদের কাছে বলেন, পাকিস্তানের সম্পদ ও সময়ের হিসাব এবং জনসংখ্যার ভিত্তিতে দেশের দুই অংশের মধ্যে এই সম্পদ ভাগ বাটোয়ারার উদ্দেশ্যে কেন্দ্রে একটি অন্তবর্তী সরকার গঠনের জন্য প্রেসিডেন্টের উচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে আহবান জানানাে। ২১শে মার্চ মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী চট্টগ্রামের পােলাে গ্রাউন্ডের এক বিশাল জনসভায় ঘােষণা করেন, আলােচনায় ফল হবে না। এদেশের হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি থেকে চাপরাশী পর্যন্ত যখন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে মানে না, তখন শেখ মুজিবুর রহমানকে অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠনের সুযােগ দেওয়া উচিত। তবে এ সরকার পাকিস্তান শাসন করার জন্য নয়। কেবল পশ্চিম পাকিস্তানের কাছ থেকে পূর্ব বাংলার পাওনা আদায়ের জন্য গঠিত হবে। মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে শাসন ও সংবিধান প্রণয়নের সমস্ত দায়িত্ব অর্পনের জন্য প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের প্রতি আহবান জানিয়ে আরাে বলেন, বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ আজ তাদের মুক্তি সংগ্রামে শেখ মুজিবের পিছনে কাতার বন্দী। জেনারেল ইয়াহিয়ার বুদ্ধিমানের মতাে কাজ হবে শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়ে সরে পড়া।’ পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক গােষ্ঠীর উদ্দেশ্যে তিনি আরাে বলেন, ‘ইসলামের ভাওতা দিয়ে আর আমাদের শাসন করাে না। আমাদের ও তােমাদের ধর্ম এক হলেও ভাষা, সংস্কৃতি, বেশভুষা প্রভৃতিতে আমরা একটি পৃথক জাতি।’ তিনি আরাে বলেন, পূর্ববাংলার
১৩২
মানুষ দেশকে স্বাধীন করার জন্য সমুদ্রের তরঙ্গের মতাে আজ জেগেছে। নিজেদের মুক্তি আন্দোলনে তারা যে ঐক্য দেখিয়েছে দুনিয়ার ইতিহাসে তার কোন তুলনা নেই। আমরা এদেশকে স্বাধীন করবােই। ১৯৭১ সালের ২৩শে মার্চ ন্যাপ ভাসানী স্বাধীন পূর্ববঙ্গ দিবস পালন করে। এ উপলক্ষ্যে ন্যাপের উদ্যেগে পল্টন ময়দানে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত জনসভায় ন্যাপ প্রধান মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর ভাষণ দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু তিনি অসুস্থতার জন্য জনসভায় আসতে পারেননি। জনসভা উপলক্ষ্যে মওলানা ভাসানী সন্তোষ থেকে একটি বাণী পাঠান। বাণীতে তিনি স্বাধীন ও সার্বভৌম পূর্ব বাংলাকে সরল মনে স্বীকার করে নেবার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানী নেতাদের প্রতি আহবান জানান। জনসভায় প্রধান বক্তার ভাষণে ন্যাপ নেতা মশিয়ুর রহমান যাদুমিয়া বলেন, শেখ মুজিবুর রহমান ৭ই মার্চ রেসকোর্সে ঘােষণা করেছেন, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ আমরা স্বাধীন হয়ে গেছি। এ স্বাধীনতাকে আজ আমাদের রক্ষা করতেই হবে। তিনি আরাে বলেন, পাকিস্তানের পতাকা আজ কোথাও নেই। আজ একদিকে সামরিক সরকার, অন্যদিকে আওয়ামী লীগ নির্দেশ জারি করেছেন। জনগণ আওয়ামী লীগের নির্দেশই মেনে চলেছে। সমস্ত সরকারী কর্মচারী এ নির্দেশ পালন করেছে। ন্যাপ নেতা স্বাধীনতা রক্ষার জন্যে সকল বামপন্থীদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে এগিয়ে আসার আহবান জানিয়ে বলেন, জননেতা শেখ মুজিবুর রহমান কিছুতেই বাঙ্গালীদের স্বার্থ ক্ষুদ্ধ করতে কিংবা বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারেন না। ন্যাপের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত পরিষ্কার অর্থাৎ আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ২০ তারিখে আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুস সামাদ আজাদের বাসায় মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ও বঙ্গবন্ধুর বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। বৈঠকে সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও কর্মসূচী নিয়ে আলােচনা করার কথা ছিল। সেই মােতাবেক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সন্ধ্যায় আব্দুস সামাদ আজাদের বাসায় এসে অপেক্ষা করতে থাকেন। বঙ্গবন্ধু অপেক্ষা করলেও মওলানা ভাসানী উপস্থিত হতে পারেননি। তার লেখা চিঠি নিয়ে রাত দশটার সময় উপস্থিত হন ফজলুল সাত্তার ও এম. এ. জলিল। তাদের কাছে মওলানা ভাসানী আব্দুস সামাদ আজাদের উদ্দেশ্যে ঐ চিঠি লিখে পাঠান। ভাসানী এই চিঠিতে লিখেন টাঙ্গাইল চলে গেলাম তুমি এসে দেখা করাে। মুজিবকে বলবে সাক্ষাতে আলােচনার সুযােগ হলে ভালাে। তবে সে যেভাবে চলছে তার বাইরে যেন না যায় সে ব্যাপারে হুশিয়ার করে দেন। শেখ মুজিবের অনুমতি সাপেক্ষে ২৪শে মার্চ আব্দুস সামাদ আজাদ টাঙ্গাইল রওয়ানা হয়ে যান। মওলানাকে দেবার জন্য শেখ মুজিব দশ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। কিন্তু টাঙ্গাইল পৌছে দেখা গেল মওলানা টাঙ্গাইল নেই। সেদিন সকালে সন্তোষ থেকে নৌকায় চড়ে তিনি সিরাজগঞ্জের দিকে চলে যান। সম্ভবত মওলানা ভাসানী সেনাবাহিনীর অঘঘাষিত আক্রমণের কথা জানতে পেরেছিলেন আর তাই তিনি সন্তোষ ছেড়ে চলে যান। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের তিন তারিখে পাকিস্তানী হানাদার সৈন্যরা টাঙ্গাইল প্রবেশ করে। ঐ দিনই হানাদার সৈন্যরা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর সন্তোষের বাড়ী ঘর ও সহায় সম্পত্তি ধ্বংস করে। এই ধ্বংসলীলা দেখে তিনি যমুনা নদীতে নৌকার মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করলেন। এ সময় ন্যাপ ভাসানী সহ বামপন্থী দলগুলাের নেতৃবৃন্দ নিজেদের মধ্যে যােগাযােগ হারিয়ে ফেলেন। মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী সিরাজগঞ্জের রুশপন্থী ন্যাপ নেতা সাইফুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে
১৩৩
নৌকায় চড়ে যমুনা নদী পথে আসামের ধুবড়ী সীমান্তে উপস্থিত হন। শেষ পর্যন্ত মওলানা ভাসানী নৌকাযােগে তার যৌবনের রাজনীতির কেন্দ্র আসামে গিয়ে হাজির হন। এখানে গােয়ালপাড়া জেলার শিশুমারীতে তিনি আশ্রয় লাভ করেন। ভারত বিভাগের আগে মওলানা ভাসানী দীর্ঘকাল আসাম ছিলেন এবং আসাম মুসলীম লীগের সভাপতি ছিলেন। তখন আসামের তরুণ আইনজীবী মইনুল হক কিছু কিছু দিনের জন্য আসাম মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৭১ সালে সেই মইনুল হক চৌধুরী ছিলেন ভারতের কংগ্রেস ইন্দিরা মন্ত্রী সভার সদস্য। কার্য উপলক্ষ্যে ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মইনুল হক চৌধুরী গােয়ালপাড়ার শিশুমারীতে এলে মওলানা ভাসানীর সঙ্গে তার দেখা হয়। এবং সেখানে তাদের মধ্যে আলাপ আলােচনা হয়। এর অল্প দিন পরেই মওলানা ভাসানীকে কোলকাতায় নিয়ে আসা হয়। কোলকাতার পার্ক স্ট্রীটের কোহিনূর ম্যানশনের পাঁচ তলায় একটি ফ্লাটে নিরাপত্তার জন্য তার থাকার ব্যবস্থা করা হয়। ১৯৭১ সালের এপ্রিলের শেষের দিকে কোহিনূর ম্যানশনে মওলানা ভাসানীর সঙ্গে মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রীদের বৈঠক হয়। এরপর মে মাসের শেষ দিকে কোলকাতায় চীনাপন্থী কয়েকটি বামপন্থী দলের সমর্থকদের কয়েকদিন ব্যাপী বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। কোলকাতার বেলঘাটায় কমরেড বরদা চক্রবর্তীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সমস্ত বামপন্থীদের বৈঠকে মওলানা ভাসানীকে চেয়ারম্যান করে বাংলাদেশ মুক্তি সমন্বয় কমিটি গঠনের কথা ঘােষণা করা হয়। আশ্চর্যজনক হলেও এ কথা সত্যি যে মওলানা ভাসানী স্বয়ং কোলকাতায় উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও বামপন্থীদের কোন আলােচনা সভায় বা বৈঠকে যাননি। এমননি তিনি তার দলের সাধারণ সম্পাদক মশিয়ুর রহমান যাদুমিয়ার সঙ্গে দেখা করেননি। যাদুমিয়া মওলানা ভাসানীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাইলে মওলানা ভাসানী সাক্ষাৎ দান করতে অস্বীকার করেন। মওলানা ভাসানী তার যুদ্ধকালীন সময়ের সেক্রেটারী সাইফুল ইসলামকে বলেন যে, যাদু মিয়া যাদু জানে। মওলানাকে পূর্ব পাকিস্তানে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য যাদু মিয়া কোলকাতায় এসেছেন। সুতরাং যাদু মিয়ার সঙ্গে দেখা করা যাবে না বিস্তারিত কারণ জানতে চাইলে মওলানা ভাসানী আরাে জানান যে যাদু মিয়ারা মওলানা ভাসানীকে ভারতে আসতে দিতে চায়নি। ওরা তাকে চীনে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। চীনা দূতাবাসের লােকজন মওলানা ভাসানীর সঙ্গে তিনবার দেখা করেছিল। তারা বলেছিল হয় পাকিস্তানকে সমর্থন করুন আর তা যদি না করুন চুপচাপ থাকুন। পূর্ব পাকিস্তানে থাকা অসুবিধা বােধ করলে চীনে চলে যেতে পারেন। মওলানা তাদের স্পষ্ট করেই বলেন যে চীন পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রাম স্বীকার করেনা, সেখানে যাওয়া কেমন করে সম্ভব? স্বাধীনতার লড়াই যে দেশের মাটিতে থেকে করা সম্ভব সেই দেশেই যাবাে। এর পর এক বামপন্থী নেতা মওলানাকে বার্মায় নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব করেন। মওলানা ভাসানীর উদ্দেশ্য ছিল লন্ডনে গিয়ে স্বাধীনতার জন্য লড়াই চালিয়ে যাওয়া। বস্তুত এই স্বপ্ন বুকে নিয়েই তিনি যমুনার নৌকা ভাসিয়েছিলেন। মশিয়ুর রহমান যাদুমিয়া মওলানা ভাসানীর সঙ্গে দেখা করতে না পেরে সবার চোখে ধুলাে দিয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে আসেন এবং পাকিস্তানী নরঘাতকদের সঙ্গে হাত মেলান। যাদু মিয়া পাকিস্তানী সরকারের মন্ত্রী হবার অভিলাষ প্রকাশ করেন। কিন্তু তাকে মন্ত্রী পরিষদে গ্রহণ না করায় ব্যর্থ মনে তিনি ফিরে আসেন। মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী যাদু মিয়াকে ন্যাপ থেকে বহিষ্কার করেন। এখানে উল্লেখ্য যে মশিয়ুব রহমান যাদুমিয়া কোলকাতায় উপস্থিত হয়ে মুজিব নগর সরকারে মন্ত্রী পরিষদের সদস্য হওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছিলেন।
১৩৪
১৯৭১ সালের মে মাসের শেষের দিকে তার পুরাতন মুরিদদের সঙ্গে দেখা করার জন্য আসামের চর যাবার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু ভাসানী চর যাবার পথে কুচবিহারের পুনজিবাড়ীতে পৌছার পর অসুস্থ হয়ে পরেন। তার অসুখ গুরুতর আকার ধারণ করলে তাকে চিকিৎসার জন্য বিমান যােগে জুন মাসে দিল্লীতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে মওলানা ভাসানীকে দেরাদুনের শৈত্যাবাসে পাঠানাে হয় । তিনি যখন দেরাদুনে অবস্থান করছিলেন তখন মুজিব নগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহম্মদ তার কাছে এক জরুরী বার্তা পাঠান। বার্তায় বলা হলাে যে একদিকে আওয়ামী লীগ মন্ত্রী পরিষদ সম্প্রসারণের জন্য প্রচন্ড চাপ দিচ্ছে, অন্যদিকে ন্যাপ মােজাফফর কমরেড মনি সিংহের কম্যুনিষ্ট পার্টি আর মনােরঞ্জন ধরের কংগ্রেস থেকে তাদেরকে মন্ত্রী পরিষদে নেয়ার মাধ্যমে সর্বদলীয় মন্ত্রী পরিষদ গঠন করা হােক, এদের যুক্তি হচ্ছে সমগ্র জাতি যেখানে মুক্তিযুদ্ধে জড়িত সেখানে মুজিবনগর মন্ত্রী পরিষদ শুধুমাত্র আওয়ামীলীগের দলীয় সদস্যদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখাটা অন্যায়। বার্তায় আরাে বলা ছিল যে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বর্তমান অবস্থায় একবার মন্ত্রীপরিষদ সম্প্রসারণের কাজ শুরু হলে এর সমাপ্তিকরা মুশকিল হয়ে দাঁড়াবে এবং এক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ মুক্তিযুদ্ধের চেয়ে পার্লামেন্টারী রাজনীতিতে বেশী জড়িত হয়ে পড়বেন। প্রধান মন্ত্রী তাজউদ্দিন আহম্মদ তাঁর বার্তার বর্ষীয়ান নেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর সহযােগিতা কামনা করে তাকে অবিলম্বে কোলকাতায় আসার জরুরী অনুরােধ জানান। মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগের রাজনীতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন। তিনি আরাে জানতেন যে প্রগতিশীল রাজনৈতিক চরিত্রের প্রধান মন্ত্রী তাজউদ্দিন আহম্মদের প্রতি আওয়ামী লীগ পার্লমেন্টারী পার্টির সংখ্যাগুরু অংশের সমর্থন নেই সুতরাং একবার মুজিবনগর সরকারে মন্ত্রীসভা সম্প্রসারণ অথবা পুনর্গঠনের কাজ শুরু হলে উপদলীয় বিরােধ মারাত্মক আকার ধারণ করবে এবং তা মুক্তিযুদ্ধের জন্য সব চেয়ে বেশি ক্ষতিকর হবে। ভাসানী সাহেব পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুভব করে পূর্ণ সুস্থ হওয়ার আগেই সাইফুল ইসলামকে সঙ্গে বেকরে কলকাতায় আগমন করেন। আওয়ামী লীগের আভ্যন্তরীন বিরােধের ফলে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন যখন বিপদগ্রস্ত এবং মুক্তিযুদ্ধ বিরােধী ষড়যন্ত্র যখন তুঙ্গে তখন মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী তাজউদ্দিনের পাশে এসে দাড়ান এবং ইতিহাসের এই ক্রান্তিলগ্নে মুজিবনগর সরকারকে সকল চক্রান্ত থেকে রক্ষা করার সময়ােপযােগী ভূমিকা পালন করেন। সত্তরের নির্বাচনে পরাজিত ন্যাপ, কমুনিষ্ট পার্টি , কংগ্রেস ও অন্যান্য বামপন্থী দলগুলাে যখন সর্বদলীয় সরকার গঠনের জন্য চাপ প্রয়ােগ করে তখন মওলানা ভাসানী এর বিরােধিতা করে এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেন। মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী কলকাতায় আসার দিন দুয়েক পরে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক সকল রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের নিয়ে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকে মওলানা ভাসানী সভাপতিত্ব করেন এবং প্রায় একঘন্টা সময়ব্যাপী বক্তৃতা করে সমস্ত পরিস্থিতির ব্যাখ্যা দান করেন। তিনি পরিষ্কার ভাবে বলেন, ‘সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কাছে অন্যান্য সমস্ত পার্টির প্রার্থীরা পরাজিত হয়েছে বলে সঙ্গত কারণেই এসব নেতাদের নিয়ে সর্বদলীয় মন্ত্রীসভা গঠন সম্ভব নয়। হারুপার্টির দল তােমাদের লজ্জা হওয়া উচিৎ। ইলেকশনে হারার পর এখন আবার মুজিবনগরে বসে মন্ত্রী হবার স্বপ্ন দেখাে। বুকে সাহস থাকে তাে লড়াই এর ময়দানে যাও। পােলপানগাে পাশে দাঁড়ায়ে লড়াই করাে। এই বৈঠকে মওলানা ভাসানীর প্রস্তাব অনুসারে মুজিবনগর সরকারের নীতি নির্ধারন সংক্রান্ত একটা সর্বদলীয় উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয়। অবশ্য মওলানা সাহেব এই প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু
১৩৫
১৯৭১ সালের মে মাসের শেষের দিকে তার পুরাতন মুরিদদের সঙ্গে দেখা করার জন্য আসামের চর যাবার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু ভাসানী চর যাবার পথে কুচবিহারের পুনজিবাড়ীতে পৌছার পর অসুস্থ হয়ে পরেন। তার অসুখ গুরুতর আকার ধারণ করলে তাকে চিকিৎসার জন্য বিমান যােগে জুন মাসে দিল্লীতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে মওলানা ভাসানীকে দেরাদুনের শৈত্যাবাসে পাঠানাে হয় । তিনি যখন দেরাদুনে অবস্থান করছিলেন তখন মুজিব নগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহম্মদ তার কাছে এক জরুরী বার্তা পাঠান। বার্তায় বলা হলাে যে একদিকে আওয়ামী লীগ মন্ত্রী পরিষদ সম্প্রসারণের জন্য প্রচন্ড চাপ দিচ্ছে, অন্যদিকে ন্যাপ মােজাফফর কমরেড মনি সিংহের কম্যুনিষ্ট পার্টি আর মনােরঞ্জন ধরের কংগ্রেস থেকে তাদেরকে মন্ত্রী পরিষদে নেয়ার মাধ্যমে সর্বদলীয় মন্ত্রী পরিষদ গঠন করা হােক, এদের যুক্তি হচ্ছে সমগ্র জাতি যেখানে মুক্তিযুদ্ধে জড়িত সেখানে মুজিবনগর মন্ত্রী পরিষদ শুধুমাত্র আওয়ামীলীগের দলীয় সদস্যদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখাটা অন্যায়। বার্তায় আরাে বলা ছিল যে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বর্তমান অবস্থায় একবার মন্ত্রীপরিষদ সম্প্রসারণের কাজ শুরু হলে এর সমাপ্তিকরা মুশকিল হয়ে দাঁড়াবে এবং এক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ মুক্তিযুদ্ধের চেয়ে পার্লামেন্টারী রাজনীতিতে বেশী জড়িত হয়ে পড়বেন। প্রধান মন্ত্রী তাজউদ্দিন আহম্মদ তাঁর বার্তার বর্ষীয়ান নেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর সহযােগিতা কামনা করে তাকে অবিলম্বে কোলকাতায় আসার জরুরী অনুরােধ জানান। মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগের রাজনীতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন। তিনি আরাে জানতেন যে প্রগতিশীল রাজনৈতিক চরিত্রের প্রধান মন্ত্রী তাজউদ্দিন আহম্মদের প্রতি আওয়ামী লীগ পার্লমেন্টারী পার্টির সংখ্যাগুরু অংশের সমর্থন নেই সুতরাং একবার মুজিবনগর সরকারে মন্ত্রীসভা সম্প্রসারণ অথবা পুনর্গঠনের কাজ শুরু হলে উপদলীয় বিরােধ মারাত্মক আকার ধারণ করবে এবং তা মুক্তিযুদ্ধের জন্য সব চেয়ে বেশি ক্ষতিকর হবে। ভাসানী সাহেব পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুভব করে পূর্ণ সুস্থ হওয়ার আগেই সাইফুল ইসলামকে সঙ্গে বেকরে কলকাতায় আগমন করেন। আওয়ামী লীগের আভ্যন্তরীন বিরােধের ফলে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন যখন বিপদগ্রস্ত এবং মুক্তিযুদ্ধ বিরােধী ষড়যন্ত্র যখন তুঙ্গে তখন মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী তাজউদ্দিনের পাশে এসে দাড়ান এবং ইতিহাসের এই ক্রান্তিলগ্নে মুজিবনগর সরকারকে সকল চক্রান্ত থেকে রক্ষা করার সময়ােপযােগী ভূমিকা পালন করেন। সত্তরের নির্বাচনে পরাজিত ন্যাপ, কমুনিষ্ট পার্টি , কংগ্রেস ও অন্যান্য বামপন্থী দলগুলাে যখন সর্বদলীয় সরকার গঠনের জন্য চাপ প্রয়ােগ করে তখন মওলানা ভাসানী এর বিরােধিতা করে এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেন। মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী কলকাতায় আসার দিন দুয়েক পরে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক সকল রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের নিয়ে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকে মওলানা ভাসানী সভাপতিত্ব করেন এবং প্রায় একঘন্টা সময়ব্যাপী বক্তৃতা করে সমস্ত পরিস্থিতির ব্যাখ্যা দান করেন। তিনি পরিষ্কার ভাবে বলেন, ‘সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কাছে অন্যান্য সমস্ত পার্টির প্রার্থীরা পরাজিত হয়েছে বলে সঙ্গত কারণেই এসব নেতাদের নিয়ে সর্বদলীয় মন্ত্রীসভা গঠন সম্ভব নয়। হারুপার্টির দল তােমাদের লজ্জা হওয়া উচিৎ। ইলেকশনে হারার পর এখন আবার মুজিবনগরে বসে মন্ত্রী হবার স্বপ্ন দেখাে। বুকে সাহস থাকে তাে লড়াই এর ময়দানে যাও। পােলপানগাে পাশে দাঁড়ায়ে লড়াই করাে। এই বৈঠকে মওলানা ভাসানীর প্রস্তাব অনুসারে মুজিবনগর সরকারের নীতি নির্ধারন সংক্রান্ত একটা সর্বদলীয় উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয়। অবশ্য মওলানা সাহেব এই প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু
১৩৬
১৯৭১ সালের মে মাসের শেষের দিকে তার পুরাতন মুরিদদের সঙ্গে দেখা করার জন্য আসামের চর যাবার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু ভাসানী চর যাবার পথে কুচবিহারের পুনজিবাড়ীতে পৌছার পর অসুস্থ হয়ে পরেন। তার অসুখ গুরুতর আকার ধারণ করলে তাকে চিকিৎসার জন্য বিমান যােগে জুন মাসে দিল্লীতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে মওলানা ভাসানীকে দেরাদুনের শৈত্যাবাসে পাঠানাে হয় । তিনি যখন দেরাদুনে অবস্থান করছিলেন তখন মুজিব নগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহম্মদ তার কাছে এক জরুরী বার্তা পাঠান। বার্তায় বলা হলাে যে একদিকে আওয়ামী লীগ মন্ত্রী পরিষদ সম্প্রসারণের জন্য প্রচন্ড চাপ দিচ্ছে, অন্যদিকে ন্যাপ মােজাফফর কমরেড মনি সিংহের কম্যুনিষ্ট পার্টি আর মনােরঞ্জন ধরের কংগ্রেস থেকে তাদেরকে মন্ত্রী পরিষদে নেয়ার মাধ্যমে সর্বদলীয় মন্ত্রী পরিষদ গঠন করা হােক, এদের যুক্তি হচ্ছে সমগ্র জাতি যেখানে মুক্তিযুদ্ধে জড়িত সেখানে মুজিবনগর মন্ত্রী পরিষদ শুধুমাত্র আওয়ামীলীগের দলীয় সদস্যদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখাটা অন্যায়। বার্তায় আরাে বলা ছিল যে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বর্তমান অবস্থায় একবার মন্ত্রীপরিষদ সম্প্রসারণের কাজ শুরু হলে এর সমাপ্তিকরা মুশকিল হয়ে দাঁড়াবে এবং এক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ মুক্তিযুদ্ধের চেয়ে পার্লামেন্টারী রাজনীতিতে বেশী জড়িত হয়ে পড়বেন। প্রধান মন্ত্রী তাজউদ্দিন আহম্মদ তাঁর বার্তার বর্ষীয়ান নেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর সহযােগিতা কামনা করে তাকে অবিলম্বে কোলকাতায় আসার জরুরী অনুরােধ জানান। মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগের রাজনীতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন। তিনি আরাে জানতেন যে প্রগতিশীল রাজনৈতিক চরিত্রের প্রধান মন্ত্রী তাজউদ্দিন আহম্মদের প্রতি আওয়ামী লীগ পার্লমেন্টারী পার্টির সংখ্যাগুরু অংশের সমর্থন নেই সুতরাং একবার মুজিবনগর সরকারে মন্ত্রীসভা সম্প্রসারণ অথবা পুনর্গঠনের কাজ শুরু হলে উপদলীয় বিরােধ মারাত্মক আকার ধারণ করবে এবং তা মুক্তিযুদ্ধের জন্য সব চেয়ে বেশি ক্ষতিকর হবে। ভাসানী সাহেব পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুভব করে পূর্ণ সুস্থ হওয়ার আগেই সাইফুল ইসলামকে সঙ্গে বেকরে কলকাতায় আগমন করেন। আওয়ামী লীগের আভ্যন্তরীন বিরােধের ফলে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন যখন বিপদগ্রস্ত এবং মুক্তিযুদ্ধ বিরােধী ষড়যন্ত্র যখন তুঙ্গে তখন মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী তাজউদ্দিনের পাশে এসে দাড়ান এবং ইতিহাসের এই ক্রান্তিলগ্নে মুজিবনগর সরকারকে সকল চক্রান্ত থেকে রক্ষা করার সময়ােপযােগী ভূমিকা পালন করেন। সত্তরের নির্বাচনে পরাজিত ন্যাপ, কমুনিষ্ট পার্টি , কংগ্রেস ও অন্যান্য বামপন্থী দলগুলাে যখন সর্বদলীয় সরকার গঠনের জন্য চাপ প্রয়ােগ করে তখন মওলানা ভাসানী এর বিরােধিতা করে এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেন। মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী কলকাতায় আসার দিন দুয়েক পরে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক সকল রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের নিয়ে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকে মওলানা ভাসানী সভাপতিত্ব করেন এবং প্রায় একঘন্টা সময়ব্যাপী বক্তৃতা করে সমস্ত পরিস্থিতির ব্যাখ্যা দান করেন। তিনি পরিষ্কার ভাবে বলেন, ‘সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কাছে অন্যান্য সমস্ত পার্টির প্রার্থীরা পরাজিত হয়েছে বলে সঙ্গত কারণেই এসব নেতাদের নিয়ে সর্বদলীয় মন্ত্রীসভা গঠন সম্ভব নয়। হারুপার্টির দল তােমাদের লজ্জা হওয়া উচিৎ। ইলেকশনে হারার পর এখন আবার মুজিবনগরে বসে মন্ত্রী হবার স্বপ্ন দেখাে। বুকে সাহস থাকে তাে লড়াই এর ময়দানে যাও। পােলপানগাে পাশে দাঁড়ায়ে লড়াই করাে। এই বৈঠকে মওলানা ভাসানীর প্রস্তাব অনুসারে মুজিবনগর সরকারের নীতি নির্ধারন সংক্রান্ত একটা সর্বদলীয় উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয়। অবশ্য মওলানা সাহেব এই প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু
১৩৭
বিকেলেই লন্ডন আসেন। সেখানে বাঙালিদের সাথে দেখা করেন। এছাড়াও তিনি ইতিমধ্যে পররাষ্ট্র দপ্তরের দু’জন কর্মকর্তার সঙ্গে যােগাযােগ করেন। লন্ডনে অবস্থানরত বাঙালীরা তার উপস্থিতি এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সমর্থনের সংবাদ পাবার পর অত্যন্ত আনন্দিত হন। তারা তার সঙ্গে মােগাযােগ করে আন্দোলন গড়ে তােলার পরামর্শ চান এবং তাকে আন্দোলনে নেতৃত্বদানের জন্য অনুরােধ করেন। এসব বাঙ্গালীর মধ্যে ছিলেন ডা. আব্দুল হাকিম, ডা. মােশারফ হােসেন, ডা. জাফর উল্লাহ চৌধুরী প্রমুখ। ৩০শে মার্চ বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি এবং সেন্ট ক্যাথারিন কলেজের অধ্যক্ষ লর্ড এ্যালেন বুলকের সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেন। তিনি আরাে দেখা করেন কমনওয়েলথ ইউনিভারসিটি এ্যাসােসিয়েশনের জেনারেল স্যারহিউ স্ত্রীংগারের সঙ্গে। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর আলােচনা অনুরােধের কারণে স্যার হিউ স্ত্রীংগার ইয়াহিয়া খানের নিকট তারবার্তা পাঠান বাংলাদেশের হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করার জন্য। তিনি আন্তর্জাতিক জুরিন্স কমিশনের সাধারণ সম্পাদককে বাংলাদেশে হত্যাযজ্ঞ বন্ধ ও বঙ্গবন্ধুর জীবন রক্ষার জন্য পাকিস্তানীর সরকার প্রধানকে চাপ প্রয়ােগের জন্য টেলিফোনে অনুরােধ করেন। তার অনুরােধে আন্তর্জাতিক জুরি কমিশনের সাধারণ সম্পাদক বাংলাদেশে হত্যাকাণ্ড বন্ধ ও বঙ্গবন্ধুর জীবন রক্ষার জন্য ইয়াহিয়া খানকে অনুরােধ করেন। ১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বৃটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন। তিনি বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের কারণ ব্যাখ্যা করে বুঝান এবং বাংলাদেশে পাক সামরিক জান্তার হত্যাযজ্ঞ বন্ধ সহ বঙ্গবন্ধুর জীবনরক্ষা ও মুক্তির ব্যবস্থা করার অনুরােধ করেন। ২১শে এপ্রিল মুজিবনগর সরকার বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে বহির্বিশ্বের দূত হিসেবে নিয়ােগ করেন। এই নিয়ােগ পাবার পর লন্ডনকে কেন্দ্র করে বিশ্বজনমত সংগঠন ও প্রবাসী বাঙালিদের ঐক্যবদ্ধ করার জন্য ইউরােপ আমেরিকা সহ বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে তিনি উল্কার মত ঘুরে বেড়ান। বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে যুক্তরাজ্য ছাড়া ও আমেরিকা, পশ্চিম জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, নরওয়ে, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক সহ বিভিন্ন দেশে যান এবং সেসব দেশের সরকার প্রধান ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশের অবস্থা ব্যাখ্যা করেন। তিনি একদিকে বিভিন্ন রাষ্ট্রপ্রধান ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের নিকট বাংলাদেশের পরিস্থিতি তুলে ধরেন অন্যদিকে প্রবাসী বাঙালিদের সংগঠিত করার জন্য বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন স্থানে বহু সভা সমাবেশ ও শােভাযাত্রা করেন। ১৯৭১ সালের ২৪শে এপ্রিল শনিবার কভেনট্টি শহরের একটি মিলনায়তনে এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে যুক্তরাজ্যে অবস্থিত বাঙালিদের বিভিন্ন এ্যাকশন কমিটির পক্ষ থেকে ১২৫ জন প্রতিনিধি ও ২৫জন পর্যবেক্ষক যােগদান করেন। সকল কমিটির পক্ষ থেকে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে সম্মেলনে সভাপতির আসন গ্রহণ করার জন্য অনুরােধ করা হয়। তিনি সভাপতির আসন গ্রহণ না করে মিসেস লুলু বিলকিস বানুর নাম সভানেত্রী হিসাবে প্রস্তাব করেন। সম্মেলনের শুরুতেই বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী সকল দল ও সকল এ্যাকশন কমিটির সমর্থনপুষ্ট ও সকলের বিশ্বাস ভাজন একটি কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের জন্য আবেদন জানান। কভেনট্রির সম্মেলনকে তিনি ঐতিহাসিক সম্মেলন বলে আখ্যায়িত করেন। তার প্রস্তাবিত কেন্দ্রিয় কমিটির সদস্যদের নামের তালিকা তৈরি
১৩৮
করার ব্যাপারে প্রথমে অচলাবস্থা দেখা দেয়। বহু আলাপ-আলােচনা করার পর বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর পরামর্শে “এ্যাকশন কমিটি ফর দি পিপলস্ রিপাবলিক অব বাংলাদেশ ইন দি ইউকে” নামক একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব গৃহীত হয়। সংগঠনের কার্য পরিচালনার জন্য পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট কমিটিতে ছিলেন আজিজুল হক ভূইয়া, কবীর চৌধুরী, মনােয়ার হােসেন, শেখ আব্দুল মান্নান, শামসুর রহমান। ষ্টিয়ারিং কমিটির প্রথম সভাতে একজন আহবায়ক নিয়ােগ করা হবে বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। অপর এক প্রস্তাবে যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় গঠিত এ্যাকশন কমিটিগুলিকে কেন্দ্রীয় কমিটির শাখার মর্যাদা দেয়া হয়। কেন্দ্রীয় এ্যাকশন কমিটির চেয়ারম্যানের পদ গ্রহণের জন্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে অনুরােধ করা হয়। বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে তাঁর পক্ষে কোন পদ গ্রহণ করা উচিৎ হবে না বলে তিনি সিদ্ধান্ত জানান। এরপর সম্মেলনে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় কেন্দ্রীয় কমিটি তার সঙ্গে পরামর্শ করে কাজ করবে। মিসেস লুলু বিলকিস বানুর সভানেত্রীত্বে স্টিয়ারিং কমিটির প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয় ২১ নম্বর রােমিলি স্ট্রীটে। এই সভায় বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী তার বক্তব্যে অবিলম্বে একটি অফিস স্থাপনের প্রয়ােজনের কথা উল্লেখ করেন। ১৯৭১ সালের ৩রা মে পূর্ব লন্ডনের ১১ নম্বর গােরিংস্ট্রীটে স্টিয়ারিং কমিটির অফিস উদ্বোধন করা হয। সেদিন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর উপস্থিতিতে নতুন অফিসে স্টিয়ারিং কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় শামসুল আলম চৌধুরীকে অফিস সেক্রেটারীর দায়িত্ব দেয়া হয়। নতুন অফিসের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন উপলক্ষে সমবেত বাঙ্গালীদের উদ্দেশ্যে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বলেন, মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর দ্বি-জাতি তত্ত্ব মৃত্যুবরণ করেছে। বাংলাদেশ আজ একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র। বাংলাদেশের নিপীড়িত মানুষ আত্মনিয়ন্ত্রনের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবীতে সগ্রাম করছে। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে খতম না করা পর্যন্ত এই সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে। পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনী কর্তৃক অতর্কিত আক্রমণের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, পূর্ব বাংলায় পরিচালিত গণহত্যা কিছুতেই পাকিস্তানের ঘরােয়া ব্যানার হতে পারে না। জাতি সংঘ ও ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অব জুরিষ্টস এই গণহত্যা সম্পর্কে তদন্ত করে অপরাধীদের উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। মে মাসের প্রথম দিকেই বাংলাদেশ সরকার বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে আমেরিকায় গিয়ে জাতিসংঘে নিয়ােজিত বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি দল ও আমেরিকার জনগণকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ সম্পর্কে অবহিত করার জন্য অনুরােধ করেন। তিনি অনুরােধ পত্র পাবার পর অবিলম্বে ভিসার জন্য লন্ডনস্থ আমেরিকান দূতাবাসে গিয়ে কনসাল জেনারেলের নিকট দরখাস্ত পেশ করেন। এর কয়েকদিন পর আমেরিকার নিকসন সরকার কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরােধিতা সম্পর্কিত সংবাদ প্রকাশিত হয়। কাজেই আমেরিকান ভিসা পাওয়া সম্পর্কে বিচারপতি চৌধুরীর সন্দেহ ছিল। তিনি তিন মাসের ভিসার জন্য আবেদন করেছিলেন কিন্তু কনসাল জেনারেল তাঁকে ১৯৭১ সালের ৬ই মে থেকে ১৯৭৫ সালের ৬ই মে পর্যন্ত ৪ বৎসরের ভিসা মঞ্জুর করেন। চার বৎসরের মধ্যে যতবার খুশি আমেরিকায় যাওয়ার অনুমতি ভুলক্রমে দেওয়া হয়েছে কিনা জানতে চাইলে কনসাল জেনারেল বলেন, “না ভুল করে নয় ইচ্ছা করেই দিয়েছি। একবার গেলেই আপনার দেশ স্বাধীন হয়ে যাবে সেটা ভাবিনি। দেখুন জাষ্টিস চৌধুরী ব্যাপারটা হচ্ছে এই আপনি আমাদের দেশে যাচ্ছেন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রচারকাজ চালাতে। পাকিস্তান আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র। তাদের আমরা অসন্তুষ্ট
১৩৯
করতে পারি না। সেরকম চিঠি পেলে পাকিস্তানকে আমরা জানিয়ে দেব যে আর আপনাকে ভিসা দেয়া হবে না। অল্পদিনের ভিসা দিলে আবার আপনি ভিসার জন্য আসবেন, তাই আমরা ঠিক করলাম, আপনাকে চার বৎসরের ভিসা দেব। তাহলে পাকিস্তান ও আপনারা দুপক্ষই আমাদের শান্তিতে থাকতে দেবেন।” দেশ স্বাধীন হবার পর বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী সরকারী সূত্রে জানতে পেরেছিলেন, পাক সরকার আমেরিকান সরকারকে তার ভিসা বাতিল এবং তাকে আমেরিকা ত্যাগ করতে বাধ্য করার জন্য লিখেছিল । আমেরিকান সরকার অবশ্য তাতে সম্মত হয়নি। ভিসা পাবার সঙ্গে সঙ্গে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর পক্ষে আমেরিকা যাওয়া সম্ভব হয়নি। কারণ ১৪ই মে বৃটিশ পার্লামেন্টের হাউস অব কমন্স-এ বাংলাদেশ সম্পর্কে আলােচনার দিন ধার্য করা হয়েছিল। বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে পার্লামেন্টের সদস্যদের অবহিত করার জন্য তার লন্ডনে অবস্থান করা জরুরি প্রয়ােজন বলে তিনি তার আমেরিকা সফর সাময়িকভাবে স্থগিত রাখেন। প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ আব্দুর রহমান খানের পুত্র শিকাগাে প্রবাসী আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন বাঙ্গালী স্থপতি ফজলুর রহমান খান মে মাসের প্রথম সপ্তাহে লন্ডন আসেন। ৬ই মে স্থানীয় ক্ল্যারিজেস হােটেলে তাঁর সঙ্গে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর দেখা হয়। তিনি ফজলুর রহমান খানের সঙ্গে তার আমেরিকা সফর সম্পর্কে পরামর্শ করেন। ৮ই মে গােরিং স্ট্রীটের অফিসে যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন এ্যাকশন কমিটির প্রায় একশজন প্রেসিডেন্ট ও সেক্রেটারীর এক জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয় । স্টিয়ারিং কমিটি গঠিত হওয়ার পর এই সভা সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য বলে বিবেচিত হয়। সভায় সর্বসম্মতিক্রমে বাংলাদেশ আন্দোলনের অর্থনৈতিক সাহায্যের জন্য “বাংলাদেশ ফান্ড” নামক একটি তহবিল গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। তহবিল পরিচালনার জন্য “বাের্ড অব ট্রাস্টি” গঠনের ব্যাপারে জটিলতা দেখা দেয়। প্রথমে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী “বাের্ড অব ট্রাস্টি”-র সদস্য হতে রাজী হননি। বহু আলাপ-আলােচনার পর তিনি এই “বাের্ড অব ট্রাস্টি”-র সদস্য পদ গ্রহণে সম্মতি দেন। তাকে সহ তিন সদস্য বিশিষ্ট “বাের্ড অব ট্রস্টি” গঠন করা হয়। অপর দুই সদস্য ছিলেন, ডােনাল চেসওয়ার্থ ও শ্রমিক দলীয় পার্লামেন্ট সদস্য জন স্টোনহাউস। বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি না পাওয়াতে কোন ব্যাংক “বাংলাদেশ ফান্ড” নামে কোন একাউন্ট খুলতে রাজী হয়নি। অনেক চেষ্টার পর হ্যাণ্ডব্রোজ ব্যাংক নামক একটি মার্চেন্ট ব্যাংক একাউন্ট খুলতে রাজী হয়। কিছুদিন পর হ্যাব্রোজ ব্যাংক একাউন্ট বন্ধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বহু চেষ্টার পর “বাের্ড অব ট্রাস্টির সদস্যগণ ন্যাশনাল ওয়েষ্ট মিনিষ্টার ব্যাংকে নতুন একটা একাউন্ট খুলতে সক্ষম হয়। “বাংলাদেশ ফান্ড” নামক তহবিল হতে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী তার নিজ খরচের জন্য কোন অর্থ গ্রহণ করেননি। স্টিয়ারিং কমিটি গঠিত হওয়ার পর জনসভায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সমর্থনে ভাষণ দানের জন্য ইংল্যান্ডের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে অনুরােধ জানানাে হয়। ৯ই মে সকালে ব্রাডফোর্ডে এবং বিকাল বেলায় বার্মিংহামে জনসভার আয়ােজন করে। দুটি সভাতেই বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী প্রধান বক্তা হিসাবে বক্তব্য রাখেন। মে মাসের প্রথম দিকে শ্রমিকদলীয় পার্লামেন্টের সদস্য ব্রুস ডগলাস্ ম্যান বাংলাদেশ সমস্যা সম্পর্কে হাউস অব কমনস-এ যে ব্যাক্তিগত প্রস্তাব পেশ করেন সে সম্পর্কে ১৪ই মে সরকার ও বিরােধী দলের সম্মতিক্রমে এক বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। বিতর্ক অনুষ্ঠিত হবার আগেই বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বৃটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রী স্যার আলেক ডগলাস্ হিউমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং বঙ্গবন্ধুর বিচার
১৪০
প্রসঙ্গে আলাপ-আলােচনা করেন। তার আলােচনার উত্তরে স্যার আলেক বলেন “বঙ্গবন্ধুর বিচার এবং স্বাস্থ্য সম্পর্কে কোন উদ্বেগের কারণ নেই বলে পাকিস্তান সরকার বৃটিশ সরকারকে জানিয়েছে।” পাক সরকারের বক্তব্য বিশ্বাস না করে ইসলামাবাদে অবস্থিত বৃটিশ হাইকমিশনের মাধ্যমে প্রকৃত খবর সংগ্রহের জন্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী পররাষ্ট্র মন্ত্রীকে অনুরােধ করেন। স্যার আলেক বলেন, “বঙ্গবন্ধুর মুক্তি ও বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধির সঙ্গে আলােচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের উদ্দেশ্যে পাক সরকারকে রাজী হওয়ার জন্য বৃটিশ সরকার চেষ্টা চালিয়ে যাবে”। প্রায় তিনশ পার্লামেন্ট সদস্য মি. ডগলাস-ম্যানের প্রস্তাবটি সমর্থন করেন। সমর্থন কারীদের মধ্যে পিটার শাের, মাইকেল বার্নস, ফ্রাংক এ্যালান, হিউ ফ্রেজার, ফ্রেড এভান্স, এব্রু ফাউণ্ড, রেজ ফ্রিসন, হিউজেনকিন্স, জন সিলকিনু, রবার্ট প্যারি, জনস্টোন হাউস, ইয়ারমিকাডাে, স্যার জেরাল্ড নেবারােওর নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখযােগ্য। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ১৯৭১ সালের ১৬ই মে লেস্টার সফরে যান। সেখানে তিনি একটি জনসভায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন। জনসভায় আরাে বক্তব্য রাখেন লন্ডনস্থ বাংলাদেশ মেডিকেল এসােসিয়েশনের সভাপতি আব্দুল হাকিম, জাফরুল্লাহ চৌধুরী, মিসেস জগলুল পাশা এবং স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য শামসুর রহমান, শেখ আব্দুল মান্নান। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী তার ভাষণ লেস্টারের সকল বাঙালিকে একত্রিত হয়ে দেশের স্বাধীনতার জন্য কাজ করার অনুরােধ জানান। জনসভা শেষে লেস্টারের সকল নেতৃ স্থানীয় ব্যক্তিদের নিয়ে বিচারপতি বৈঠকে বসেন। উক্ত বৈঠক ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সেখানে একজন নেতৃস্থানীয় সদস্যকে কেন্দ্র করে নিজেদের মধ্যে তীব্র গন্ডগােল চলছিল। তিনি বৈঠকে সবাইকে একত্রিত করে আলাপ আলােচনার মধ্যে নিজেদের গভূগােল নিষ্পত্তি করে দেন। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর লেস্টারের সভা করার পিছনে লন্ডনস্থ বাংলাদেশ মেডিকেল এসােসিয়েশনের সভাপতি ডাঃ আব্দুল হাকিমের অত্যন্ত প্রশংসনীয় ভূমিকা আছে। ১৫ই মে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়েন। অসুস্থতার সংবাদ পেয়ে ডাঃ আব্দুল হাকিম দ্রুত তাঁর কাছে যান এবং চিকিৎসা করেন। তার সফল চিকিৎসার জন্য বিচারপতি চৌধুরী তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠেন এবং লেস্টারে সভা করতে যেতে সক্ষম হন। লেস্টারে যাবার সময় তিনি সঙ্গে ডাঃ আব্দুল হাকিমকে নিয়ে যান। তিনি তাঁর নিকট থেকে লন্ডনে কাজ করার জন্য বিভিন্নভাবে সহযােগিতা পেয়েছেন। ডাঃ আব্দুল হাকিম ছিলেন একনিষ্ঠ ও একজন কর্মঠ ব্যক্তি। তিনি লন্ডনে বাংলাদেশ মেডিকেল এসােসিয়েশন করে তার মাধ্যমে ২৫শে মার্চের পর থেকেই মুক্তিযুদ্ধের কাজ শুরু করেন। এই মেডিকেল এসােসিয়েশন মুক্তিযুদ্ধের জন্য লন্ডনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আর এই এসােসিয়েশনের সভাপতি ছিলেন ডাঃ আব্দুল হাকিম তিনি অত্যন্ত ধীরস্থির এবং নিষ্ঠাবান ব্যক্তি ছিলেন। ২২শে মে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ব্লোচলী ও অক্সফোর্ড শহরে বাঙ্গালিদের দুটি জনসভায় বক্তব্য রাখেন। অক্সফোর্ডের জনসভায় তিনি বলেন, “বাংলাদেশ সরকার পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে আপােষ করতে পারে বলে যে গুজব ছড়ানাে হয়েছে তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। বাংলাদেশের সরকার দেশ সম্পূর্ণ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত সগ্রাম চালিয়ে যেতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ”। পরদিন বিচারপতি চৌধুরী শেখ আব্দুল মান্নানকে সঙ্গে নিয়ে স্কটল্যান্ড যান। গ্লাসগাে বিমান বন্দরে স্থানীয় এ্যাকশন কমিটির সদস্যরা তাদের অভ্যর্থনা জানান। স্থানীয় একটি হলে অনুষ্ঠিত এক বিরাট জনসভায় তারা দুজনে বক্তব্য রাখেন। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী তার বক্তব্যে বাংলাদেশের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন কি করে স্বাধীনতা সংগ্রামে পরিণত হয় তা ব্যাখ্যা করেন।
১৪১
২৪শে মে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী এনামুল হককে সঙ্গে নিয়ে আমেরিকা সফরের জন্য রওনা হন। নিউইয়র্ক বন্দরে এ. এইচ. মামুদ আলী প্রায় দু’শ বাঙ্গালি নিয়ে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে অভ্যর্থনা জানান। ২১শে এপ্রিল তিনি নিউইয়র্কে নিয়ােজিত পাকিস্তানী ভাইস কনসল পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘােষণা করেন। হােটেলে পৌছাবার পর আবু সাঈদ চৌধুরী বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে স্থানীয় বাঙ্গালিদের অবহিত করার পর ভবিষ্যত কর্মপন্থা সম্পর্কে তার ধারণা ব্যাখ্যা করেন। দুপুর রাত পর্যন্ত আলােচনার পর ঠিক হলাে বিভিন্ন দল বিভিন্ন দিনে ওয়াশিংটন গিয়ে সিনেটর ও কংগ্রেস ম্যানদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পটভূমিকা ব্যাখ্যা করে তাদের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করবে। ওয়াশিংটনে বিশ্ব ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে নিয়ােজিত এ. এম. এ. মুহিত ও আমেরিকার পাকিস্তানী দূতাবাসে কর্মরত হারুন উর রশীদ বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করেন। তারা যথাসময়ে অন্যান্য বাঙালি কুটনীতিবিদদের সঙ্গে নিয়ে একত্রে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘােষণা করবেন বলে জানান। ১লা আগষ্ট তারা তাদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আনুগত্য ঘােষণা করেন। ২৫শে মে শিকাগাে থেকে স্থপতি ফজলুর রহমান খান বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করেন। তার সঙ্গে বিচারপতি চৌধুরীর বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে বিস্তারিত আলােচনা হয়। আমেরিকার বিভিন্ন শহর থেকে মি. খানের উদ্যোগ প্রেরিত বাঙ্গালী প্রতিনিধিদল ওয়াশিংটনে গিয়ে সিনেটর ও কংগ্রেসম্যানদের সঙ্গে বাংলাদেশ সম্পর্কে আলােচনা করেন। এর ফলে নিকসন প্রশাসনের বৈরি মনােভাব উপেক্ষা করে আমেরিকার জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিকট বাংলাদেশের জনগণের আবেদন পৌছে দেওয়া সম্ভব হয়। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, এনামুল হক ও মামুদ আলীকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিদিন জরুরি ভিত্তিতে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। কয়েকদিনের মধ্যেই তিনি নরওয়ে, সুইডেন, মিশর, ইরাক, ইরান, জর্ডান, সিরিয়া, লিবিয়া, আলজেরিয়া, সৌদি আরব, ফিলিপাইন ও আয়ারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি রাষ্ট্রদূতদের বলেন বাংলাদেশের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম। নরওয়ের রাষ্ট্রদূত মি. হামব্রো তখন জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভাপতি ছিলেন। তিনি রেড ক্রসের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। তিনি সহানুভূতির সঙ্গে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলেন। সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূত রােদীর সঙ্গে আলােচনার সময় বিচারপতি চৌধুরী রােকেয়া হলে পাক বাহিনীর নারী নির্যাতন এবং দেশব্যাপী গণহত্যার কথা উল্লেখ করেন। রােদী বাদশা ফয়সলের ব্যক্তিগত বন্ধু ছিলেন। তিনি পাকিস্তানী সৈন্য কর্তৃক নিপিড়নের কথা বাদশা ফয়সলের আসন্ন ওয়াশিংটন সফরকালে তাকে জানাবেন বলে কথা দেন। বিচারপতি চৌধুরী তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ভারতের প্ররােচনার ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়েছে বলে যে প্রচার চালানাে হচ্ছে তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। এবং সমস্ত বাঙ্গালি স্বাধীনতার সমর্থক। এই কথাগুলি বাদশা ফয়সালকে জানানাের জন্য তিনি রােদীকে অনুরােধ করেন। তাছাড়া বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য তিনি রােদীর মারফত বাদশা ফয়সালের নিকট আবেদন জানান। নিউইয়র্ক পৌছাবার পরদিন মামুদ আলী বিচারপতি চৌধুরীকে জাতিসংঘে অবস্থিত আন্তর্জাতিক প্রেসক্লাবের প্রেসিডেন্ট ডা. যােগেন্দ্র কুমার ব্যানার্জির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। ডা. ব্যানার্জি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ও মামুদ আলীকে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে অবস্থিত তার অফিসে নিয়ে যান। তিনি সেদিনই কয়েকজন আমেরিকান ও ইউরােপিয়ান সাংবাদিকদের সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দেন। নিউইয়র্ক টাইমস-এর সংবাদদাতা বিচারপতি চৌধুরীর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন।
১৪২
নিউইয়র্কে অবস্থানকালে বিচারপতি চৌধুরী জাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনারেল উথান্টের সঙ্গে যােগাযােগ করার চেষ্টা করেন। তার অফিস থেকে বলা হয় নির্যাতিত বাঙ্গালির সাহায্যের জন্য তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কিন্তু বিচারপতি চৌধুরীর পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার ফলে জাতিসংঘের মানবিক অধিকার কমিশনের প্রাক্তন সদস্যদের সঙ্গে উথান্টের সাক্ষাতের ব্যাপারে ‘প্রটোকল সম্পর্কিত সমস্যা দেখা দিতে পারে। তবে বিচারপতি চৌধুরী রাজী হলে জাতিসংঘের একজন উচ্চ পদস্থ অফিসার তার সঙ্গে দেখা করতে পারেন। এই প্রস্তাব অনুযায়ী ওয়ার্ল্ড কাউন্সিল ফর রিলিজিয়াস এ্যাণ্ড পীসের জেনারেল সেক্রেটারী হােমার জ্যাকের অফিসে বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে উথান্টের প্রতিনিধি সাক্ষাত করে বাংলাদেশের অবস্থা সম্পর্কে অবহিত হন। বিচারপতি চৌধুরী তাকে বলেন, জাতিসংঘ কর্তৃক জনগণের ন্যায্য দাবী মেনে নিয়ে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেওয়া পর্যন্ত এই এলাকায় শান্তি ফিরে আসবে না। বঙ্গবন্ধুর মুক্তির ব্যানারে সেক্রেটারী জেনারেলের সাহায্যের জন্যও তিনি আবেদন জানান। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ফোর্ড ফাউণ্ডেশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গেও কয়েকবার দেখা করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য পাকিস্তানী দূতাবাস ফোর্ড ফাউন্ডেশনের বৃত্তিপ্রাপ্ত বাঙ্গালি ছাত্রদের বৃত্তি কেটে দেয়ার চেষ্টা করে। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গে আলােচনার পর তারা একটি সাময়িক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এর ফলে বৃত্তিভােগী বাঙ্গালি ছাত্রদের বৃত্তির টাকা সরাসরি তাদের ঠিকানায় পাঠানাের ব্যবস্থা করা হয়। ২৯শে মে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী আমেরিকা সফর করে লন্ডনে ফিরে আসেন। ৩০শে মে তিনি ম্যানচেষ্টারে এক বিরাট জনসভায় ভাষণ দেন। ম্যানচেস্টারে যাওয়ার আগে তিনি গােরিং স্ট্রীটের অফিসে গিয়ে প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের নিকট বিদেশ থেকে অস্ত্র সরবরাহ সম্পর্কে একটি জরুরি চিঠি লিখে স্টিয়ারিং কমিটির আহবায়ক আজিজুল হক ভূইয়ার মারফত পাঠাবার ব্যবস্থা করেন। ১৯৭১ সালের ৬ই জুন লন্ডন এ্যাকশান কমিটির উদ্যোগে পূর্ব লন্ডনে একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় পূর্ব লন্ডনে বসবাসকারী বাঙ্গালিরা এবং বেশ কিছু সংখ্যক ইংরেজ যােগদান করেন। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী এই সভায় তার বক্তব্যে প্রবাসী বাঙ্গালিদের মধ্যে একতার প্রয়ােজনীয়তা ব্যাখ্যা করেন। স্বাধীনতা সগ্রামের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের অপপ্রচারের তীব্র সমালােচনা করে তিনি বলেন, “জয় আমাদের সুনিশ্চিত”। পাকিস্তানের আর্থিক সাহায্যে কয়েকজন বাংলাভাষী কুলাংগার ‘মুক্তি’ নামক একটি বাংলা সাপ্তাহিকের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালায়। এদের মধ্যে আবুল হায়াতের নাম উল্লেখযােগ্য। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সে ভারতীয় হিন্দুদের মুসলমান বিরােধী ষড়যন্ত্র বলে দাবী করে। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর বিরুদ্ধে সে মিথ্যা ও মানহানিকর প্রচার চালায়। উক্ত পত্রিকার কয়েকটি কপি সংগ্রহ করে দেশপ্রেমিক বাঙ্গালিরা সভামঞ্চের সামনে আনুষ্ঠানিকভাবে অগ্নিসংযােগ করেন। ১১ই জুন লন্ডনের ‘উইকএন্ড’ টেলিভিশনে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে জোড়ালাে বক্তব্য রাখেন। বক্তব্যের আগে তাকে সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালির প্রতিনিধি হিসাবে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে বিরােধী মত প্রকাশের জন্য টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ টোরী দলীয় পাকামেই সদস্য জন বিগস্ -ডিভিসনকে আমন্ত্রণ জানান। তিনি পাকিস্তানের গােড়া সমর্থক ছিলেন। মি. বিগ-ডিভিসন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে বহু প্রশ্ন করেন । তিনি অত্যন্ত
১৪৩
সঙ্গে সব প্রশ্নের উত্তর দেন। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ১২ই জুন লন্ডনের উত্তরে অবস্থিত সেন্ট অবান্স শহরে এক বিশাল জনসভায় ভাষণ দেন। ১৩ই জুন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী লাউসের এক সভায় ভাষণ দেন। সেখানে বিরাট এক হলে ঐ এলাকার বাঙ্গালিরা ছাড়াও বহু ইংরেজ সভায় উপস্থিত হন। সভায় আরাে ভাষণ দেন লন্ডনস্থ বাংলাদেশ মেডিকেল এসােসিয়েশনের সভাপতি ডা. আব্দুল হাকিম, জাফরুল্লাহ চৌধুরী, অধ্যাপক কবির জাকারিয়া চৌধুরী ও শেখ আব্দুল মান্নান। পরদিন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী লাউসে এক বিরাট জনসমাবেশের প্রধান বক্তা . সাবে বক্তব্য রাখেন। তিনি তাঁর বক্তব্যে বলেন, দেশকে হানাদার মুক্ত করে এবং স্বাধীনতার পতাকা উচ্চে তুলে ধরে বাংলাদেশের বীর শহীদদের প্রতি সত্যিকারের শ্রদ্ধা নিবেদন করতে হবে। সভায় আরাে বক্তব্য রাখেন শেখ আব্দুল মান্নান, অধ্যাপক কবীর উদ্দিন সহ বেশ কয়েকজন। বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য লাভের উদ্দেশ্যে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি শােভাযাত্রার আয়ােজন করা হয়। বৃটেনে বিভিন্ন এলাকা থেকে বহু বাঙ্গালি কোচযােগে এসে, লন্ডনে শােভাযাত্রায় যােগ দেন। শােভা যাত্রাটি হােয়াইট হলে এসে শেষ হয়। পরদিন শােভাযাত্রার ছবি লন্ডনের বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৭ ই জুন বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর কূটনৈতিক পরিচয় পত্রে স্বাক্ষর করেন। এই পরিচয় পত্রে বিচারপতি চৌধুরীকে যুক্তরাজ্যে হাই কমিশনার হিসাবে নিয়ােগের কথা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘােষণা করা হয়। এই পরিচয় পত্র রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের সরকারী বাসভবন, বাকিংহাম প্যালেসে পেশ করা হয়। যথাসময়ে পরিচয় পত্র প্রাপ্তি স্বীকার করে বাকিংহাম প্যালেস থেকে বিচারপতি চৌধুরীর নিকট একটি পত্র পাঠানাে হয়। এই পত্রের মাধ্যমে প্রকারান্তরে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া হয় বলে ওয়াকিবহাল মহল মনে করেন। ২০শে জুন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ওয়েলসের প্রধান শহর কর্ডিফের এক বিশাল জনসভায় ভাষণ দেন। তিনি তার ভাষণে বলেন, এবারের স্বাধীনতা হবে গণমানুষের স্বাধীনতা এবং জনগণের প্রতিনিধিরা দেশ শাষণ করবেন। বাংলাদেশে হানাদার বাহিনীর ধ্বংসলীলা তুলে ধরে তিনি আরাে বলেন, হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে বাঙ্গালিদের আর দমিয়ে রাখতে পারবে না পাকিস্তান সরকার। পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের আপােষের গুজব ছড়ানাে হচ্ছে তা ভিত্তিহীন বলে তিনি ঘােষণা করেন। জনসভায় অন্যান্য বক্তারা ছিলেন সুলতান শরীফ, ও শেখ আব্দুল মান্নান। ২১শে জুন বিচারপতি চৌধুরী শেখ আব্দুল মান্নানকে সঙ্গে নিয়ে হল্যান্ড সফরে যান। তিনি সেখানে ২২শে জুন পার্লামেন্ট ভবনে গিয়ে কয়েকজন পার্লমেন্ট সদস্যের সাহায্যে স্পীকারের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। বিকেল বেলায় পার্লামেন্টের একটি কমিটি রুমে তিনি বৈদেশিক বিষয় সম্পর্কিত সাবকমিটির সদস্যদের সঙ্গে মিলিত হন। তারা দু ঘন্টার বেশি সময় ধরে বিচারপতি চৌধুরীকে নানা প্রশ্ন করেন। তিনি তাদের প্রশ্নের জবাব দেন অত্যন্ত যুক্তিসংগতভাবে। তার আলােচনার পর সাব কমিটির চেয়ারম্যান বলেন, “পাকিস্তানী সৈন্যরা বাংলাদেশে যে নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে তারপর বাংলাদেশ পাকিস্তানের সংগে থাকতে পারে না” তিনি আরও বলেন, “বাংলাদেশের সগ্রামকে তারা আদর্শগত ভাবে সমর্থন জানাবে”। সাব কমিটির সংগে আলােচনার সময় বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে ছিলেন সুনীল কুমার লাহিড়ী, জহিরুদ্দীন এবং রাজিউল হাসান রঞ্জু। পরদিন লন্ডনে ফিরে আসার আগে বিচারপতি চৌধুরী একটি সাংবাদিক সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন। এই সম্মেলনের রিপাের্ট ও
১৪৪
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী সরকার শরন সিং বৃটেন সফরে আসেন। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের নির্দেশে জুন মাসের শেষের দিকে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী তার সঙ্গে দেখা করেন। শরন সিং বিচার পতি চৌধুরীকে বলেন, বিভিন্ন দেশ সফরকালে কোন বিপদের সম্মুখীন হলে ভারতীয় দূতাবাসের সঙ্গে যােগাযােগ করবেন। আলােচনার এক পর্যায়ে বিচারপতি চৌধুরী বলেন, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য অস্ত্র পাঠাবার ব্যাপারে ভারত সরকারে অনুমতি চেয়েছেন। অনুমতি না পাওয়ার জন্য অস্ত্র পাঠান সম্ভব হচ্ছে না বলে প্রবাসী বাঙ্গালিদের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে। মি. শরন সিং বলেন, বিদেশ থেকে অস্ত্র না পাঠালেও মুক্তিযােদ্ধারা অস্ত্র পাচ্ছে। তবে লন্ডন থেকে অস্ত্র পাঠানাের ব্যবস্থা করা হবে জরুরিভাবে। ১৯৭১ সালের ১০ই জুলাই বেডফোর্ড শহরের একটি পাবলিক হলে বাঙ্গালিরা এক বিরাট জনসভার আয়ােজন করে। উক্ত জনসভায় প্রধান অতিথি হিসাবে বক্তব্য রাখেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। জনসভাটি পণ্ড করার জন্য পাকিস্তানীরা চেষ্টা করে। তারা সভা শুরুর আগেই হলের চারিদিক থেকে ঘিরে রাখে এবং বাধা দেবার প্রচেষ্টা চালায়। গণ্ডগােল এড়ানাের জন্য বৃটিশ সরকার হলের সামনে পুলিশ মােতায়েন করে। পাকিস্থানীদের সকল প্রকার ভয়ভীতি উপেক্ষা করে বিচারপতি চৌধুরী দৃঢ় মনােভাব নিয়ে অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে সভার কাজ চালিয়ে যান। তিনি তার বক্তব্যে কঠোর ভাষায় পাকিস্তানীদের হীন ষড়যন্ত্রের নিন্দা করেন । তিনি আরাে বলেন পাকিস্তানীদের এই ধরনের হঠকারিতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম আরাে লাভবান হবে এতে কোন সন্দেহ নেই। সভায় আরাে বক্তব্য রাখেন অধ্যাপক কবীর ও শেখ আব্দুল মান্নান। জুলাই মাসের মাঝামাঝি আমেরিকার কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট লন্ডন আসেন তাদের সম্মানার্থে কমনওয়েলথ ইউনিভারসিটিজ এ্যাসােসিয়েশনের সেক্রেটারী জেনারেল স্যার হিউ স্পিংগার একটি ভােজসভার আয়ােজন করে। বৃটেনের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইসচ্যান্সেলর এই ভােজসভায় যােগদান করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগঠিত হত্যাকান্ড সম্পর্কে আলােচনার সুযােগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে স্যার হিউ স্পিংগার বিচারপতি চৌধুরীকে বিশেষভাবে অনুরােধ করেন। এই সুযােগে বিচারপতি চৌধুরী ভােজসভায় বক্তব্য রাখেন। তিনি তার বক্তব্যে অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ সারা বাংলার হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংস লীলার বিবরণ তুলে ধরেন। ২৬ শে জুলাই হাউস অব কমনসহ এর হাইকোট রুমে স্বাধীন বাংলাদেশের ৮টি ডাক টিকেট প্রকাশ করার উপলক্ষ্যে এক অনুষ্ঠানের আয়ােজন করা হয়। বৃটিশ পার্লামেন্টের সকল দলের নেতৃস্থানীয় সদস্য এবং ৪০ জন সাংবাদিক ও বৃটেনের সাবেক পােষ্টমাষ্টার জেনারেল (মন্ত্রী) জনস্টোনহাউস পিটার শেরেও উপস্থিত ছিলেন। উক্ত অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের বিশেষ প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন এবং বক্তব্য রাখেন। তিনি তার বক্তব্যে
১৪৫
বলেন ডাক টিকিট গুলাের জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিলাভ বাংলাদেশের জন্য একটি উল্লেখযােগ্য পদক্ষেপ বলে গণ্য করা হবে। তিনি আরাে বলেন আগষ্ট মাস শেষ হবার আগেই বৃটেনে বাংলাদেশের দূতাবাস স্থাপন করা হবে। বাংলাদেশ এখন একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। পাকিস্থানী হানাদারদের তাড়িয়ে দিয়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়াই বাঙ্গালিদের একমাত্র কর্তব্য। বঙ্গবন্ধুর বিচার সম্পর্কে ইয়াহিয়া খানের সাম্প্রতিক ঘােষণার উল্লেখ করে বিচারপতি চৌধুরী বলেন, এই ঘােষণা অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে বাঙ্গালি জাতি পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে আরাে অধিকতর ঐক্য গড়ে তুলবে। এই হীন উদ্যোগের জন্য তিনি বিশ্বে শান্তিকামী জনগনও বিভিন্ন দেশের সরকারের নিকট আকুল আবেদন জানান। পাকিস্তান কমন ওয়েলথ ত্যাগ করতে পারে বলে যে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে তার উল্লেখ করে বিচারপতি চৌধুরী বলেন, কমন ওয়েলথের বাকী দেশগুলি তা সানন্দে মেনে নিয়ে বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্রকে সাদর অভ্যর্থনা জানাতেপারে।
আগষ্ট মাসের প্রথম দিকে পাকিস্তানের সামরিক আদালতে বঙ্গবন্ধুর বিচার শুরু হবে বলে খবর পাওয়ার পর বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবি সন ম্যাকব্রাইড়কে ইসলামাবাদ পাঠাবার ব্যাবস্থা করেন। লন্ডনের বার্নার্ড শেরিডান সলিসিটার্স নামক প্রতিষ্ঠানের একজন অভিজ্ঞ সলিসিটারও তার সঙ্গে যান। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময় এই প্রতিষ্ঠানের “ব্ৰীফ ” গ্রহণ করে শ্রমিক পার্লামেন্ট সদস্য স্যার টমাস উইলিয়ামস্ কিউ সি বঙ্গবন্ধুর পক্ষ সমর্থন করার জন্য ঢাকা এসেছিলেন। মি. ম্যাক ব্রাইডকে পাঠাবার আগে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী এ সম্পর্কে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সঙ্গে টেলিফোনে আলাপ করেন। তিনি বলেন কাজ হােক বা না হােক বঙ্গবন্ধুর জন্য সব রকম চেষ্টাই করতে হবে তাতে যত খরচই হােক। ২৪ শে জুলাই মিঃ ম্যাকব্রাইড় ইসলামাবাদে পৌছে কয়েকজন উচ্চ পদস্থ সরকারী কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করেন। ইয়াহিয়া খান নিজে দেখা করতে অস্বীকার করেন কাজেই বাধ্য হয়ে তিনি ইয়াহিয়ার আইন বিয়য়ক উপদেষ্টা কর্নেলিয়সের সঙ্গে দেখা করেন। কর্নেলিয়ান বলেন, কোন বিদেশী আইনজীবিকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া এবং তার পক্ষ সমর্থন করতে দেওয়া হবে না। ইয়াহিয়া খানের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রুদ্ধদ্বার কক্ষে বঙ্গবন্ধুর বিচার অনুষ্ঠিত হবে এবং তারপক্ষ সমর্থন করার জন্য একজন পাকিস্তানী আইনজীবি নিয়ােগ করা হবে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে এই প্রথম বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে দেখা করার চেষ্টা করা হয়। গ্রেপ্তারের পর থেকে তাকে নির্জন কারাকক্ষে বন্দী করে রাখা হয়। কয়েকদিন পর লন্ডন ফিরে এসে মি. ম্যাকব্রাইড বঙ্গবন্ধুর পক্ষ সমর্থন করার সুযােগ না পাবার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে বিবৃতি দেন । জুলাই মাসের শেষ দিকে বৃটিশ সরকার বাংলাদেশে ব্যবহার করার জন্য কয়েকটি মােটর বােট পাকিস্তানকে সরবরাহ করার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এই সংবাদ পাওয়া মাত্র বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী পররাষ্ট্র দপ্তরে গিয়ে ইয়ান সাদার ল্যান্ডের সঙ্গে দেখা করেন। মি. সাদার ল্যান্ড সংবাদের সত্যতা স্বীকার করে বলেন, মােটর বােটগুলি সামরিকবাহিনী কর্তৃক ব্যবহার করা হবেনা বলে শর্ত আরােপ করা হয়েছে। বিচারপতি চৌধুরী বলেন: মােটর বােটগুলি পাওয়ার পর পাকিস্তানী সৈন্যরা বাংলাদেশের নদীপথ দিয়ে অভ্যন্তরের গ্রামাঞ্চলে গিয়ে গণহত্যা ও লুণ্ঠনের জন্য অবশ্যই ব্যবহার করবে। তার এই আশংকার প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষনের জন্য তিনি স্যার আলােকের সঙ্গে সাক্ষতের ব্যবস্থা করার জন্য অনুরােধ করেন। ইতিমধ্যে জনস্টোনহাউস,পিটার শাের এক, আরাে কয়েকজন পার্লামেন্ট সদস্য বৃটিশ সরকারের উপরােক্ত সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করার দাবী জানান। পররাষ্ট্র দপ্তরের সঙ্গে এ বিষয়ে তারা আলােচনা করে। স্যার
১৪৬
আলেকের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় বিচারপতি চৌধুরীকে তিনি বলেন বাংলাদেশের পক্ষে গ্রহণযােগ্য কোন রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত কোন মােটরবােট পাকিস্তান সরকারকে সরবরাহ করা হবে না। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ১৯৭১ সালের ১লা আগষ্ট রবিবার লন্ডনের ট্রাফালগার স্কোয়ারের এক ঐতিহাসিক জনসভায় বক্তব্য রাখেন। তার সেদিনের বক্তব্য পাকিস্তানী সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ ও স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের জন্য বিশ্বজনমতকে প্রচণ্ডভাবে প্রভাবিত করে। সভায় বক্তব্যে তিনি বলেন, মুজিবনগর সরকার পাকিস্তানের সঙ্গে আপােষ রফা করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে বলে মিথ্যা প্রচারনা চালানাে হচ্ছে। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে বানচাল করার জন্য পাকিস্তানীরা এই গুজব ছড়াচ্ছে। তিনি এব্যাপারে প্রধান মন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের সঙ্গে টেলিফোনে আলাপ করেছেন। এই গুজব ভিত্তিহীন বলে প্রধান মন্ত্রী তাকে জানিয়েছেন। পাকিস্তানের এই মিথ্যা প্রচারনা দ্বারা বিভ্রান্ত না হওয়ার জন্য বিচারপতি চৌধুরী আহবান জানান। এই প্রসঙ্গে তিনি আরাে বলেন, বাংলাদেশকে হানাদার মুক্ত করাই মুজিবনগর সরকারের একমাত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য। বিচারপতি চৌধুরী বক্তব্য রাখার সময় অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে ঘােষণা করেন, বাংলাদেশ কখনও তার স্বাধীনতা সংগ্রামের পথ থেকে বিচ্যুত হবে না। বাংলাদেশের পবিত্র মাটি থেকে হানাদার বাহিনীকে সম্পূর্নভাবে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত আমাদের আপােষহীন, বিরামহীন সংগ্রাম চলবে। এই সগ্রাম সাড়েসাত কোটি বাঙ্গালীর সগ্রাম। হাজার হাজার কন্ঠ “জয় বাংলা শ্লোগানের মাধ্যমে বিচারপতি আত্মবিশ্বাসের প্রমাণ পেয়ে বিচারপতি অত্যন্ত আনন্দিত হন। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইরিশ আইনজীবী গন ম্যাকগাইড বঙ্গবন্ধুর পক্ষ সমর্থন করার উদ্দেশ্যে তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে পাকিস্তান থেকে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছেন বলে বিচারপতি চৌধুরী তার বক্তব্যে যখন প্রকাশ করেন, তখন “শেম শেম” বলে উপস্থিত জনতা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা প্রকাশ করেন। বিচারপতি চৌধুরী অবিলম্বে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবী এবং স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের জন্য বিশ্বের গনতান্ত্রিক দেশসমূহের প্রতি আহবান জানান। তিনি বাংলাদেশে নির্মমভাবে নির্বিচারে ব্যাপক হত্যার মাধ্যমে গণহত্যা সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক কনভেনশন” ভঙ্গের ফলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জাতি সংঘের অধিনস্থ সিকিউরিটি কাউন্সিলের নিকট দাবী করেন। জনসভায় বক্তব্য রাখার সময় বিচারপতি চৌধুরী মুজিবনগর সরকারের তিনটি নির্দেশের কথা উল্লেখ করেন। প্রথম নির্দেশ অনুযায়ী অতি তাড়াতাড়ি লন্ডনে একটি হাইকমিশন স্থাপন করা হবে বলে তিনি ঘােষণা করেন। দ্বিতীয় নির্দেশ অনুযায়ী পাকিস্তানী ইন্টারন্যাশনাল এয়ারওয়েজের বিমানে ভ্রমণ না করার জন্য বাংলাদেশের নাগরিকদের প্রতি তিনি আহবান জানান। তৃতীয় নির্দেশ অনুযায়ী পাকিস্তানী সরকারী কর্মচারী হিসাবে পাকিস্তান ও বিদেশে নিয়ােজিত বাঙ্গালিদের পদত্যাগ করে মুজিবনগর সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের আহবান জানান। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর বক্তৃতার পর অপ্রত্যাশিতভাবে লন্ডনস্থ পাকিস্তান হাই কমিশানে নিয়ােজিত দ্বিতীয় সেক্রেটারী মহিউদ্দিন আহমদ বক্তৃতা দেওয়ার জন্য এগিয়ে আসেন। সমবেত জনতার হর্ষধ্বনির মধ্যে মি. আহমদ পাকিস্তানের চাকুরী থেকে ইস্তফা দিয়ে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার দাবীকে তিনি উপেক্ষা করতে পারেননি। একটি স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসাবে তিনি বেঁচে থাকতে চান। তার বক্তব্য সমবেত জনতার মধ্যে বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার সৃষ্টি করে।
১৪৭
কর্মরত পাকিস্তানী কূটনীতিকদের মধ্যে মহিউদ্দীন আহম্মদই সর্ব প্রথম পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করেন। ১০ই এপ্রিল বিচারপতি চৌধুরী তার সঙ্গে বি, বি, সি, -র বুস হাউসের অফিসে আলােচনা করে তাকে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের কথা উল্লেখ করেন। আলােচনার এক পর্যায়ে তিনি বিচারপতি চৌধুরীর নিকট বাংলাদেশের প্রতি সমর্থন আছে বলে মত প্রকাশ করেন। ট্রাফলগার স্কোয়ারের সভায় যােগদানের জন্য রওয়ানা হবার কিছু সময় আগে মি. মহিউদ্দিন আহমদ টেলিফোনে বিচারপতি চৌধুরীকে বলেন, তিনি বাংলাদেশ সরকারের আনুগত্য প্রকাশ করতে প্রস্তুত। বিচারপতি চৌধুরী তাকে সপরিবারে তার বাসায় আসার জন্য বলেন। সেখান থেকে তারা দুজনে একত্রে সরাসরি ট্যাফালগার স্কোয়ারের জনসভায় আসেন। সভায় আরাে বক্তব্য রাখেন লর্ড ব্রকওয়ে, অশােকমেন, পিটারশাের, রেজ জন্টিস্ ব্রুম ডগল্যাস,বেগম লুলু বিলকিস বানু ও গাউস খান। জনসভাটি অনুষ্ঠিত হয় পল কনেটের নেতৃত্বে গঠিত এ্যাকশান বাংলাদেশের উদ্যোগে। সভায় বৃটেনের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রায় বিশ হাজারের ও বেশি বাঙ্গালি যােগদান করে। শতাধিক বাংলাদেশ এ্যাকশান কমিটির সদস্যদের লন্ডনে নিয়ে আসার জন্য কমিটি বহু কোচ ভাড়া করে। একমাত্র বামিংহাম থেকে ৭০টি কোচ লন্ডনে আসে বাঙ্গালিদের নিয়ে। ইতিপূর্বে বৃটেনে বাঙ্গালিরা এর চেয়ে বড় কোন সমাবেশ করতে পারেনি। এই সভার প্রচার কাজ চলে বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই সারা বৃটেন ব্যাপী সভার প্রচারের জন্য ৩০ শে জুলাই তারিখের “দিগার্ডিয়ান পত্রিকায় “পূর্ববঙ্গ গণহত্যা” শীর্ষক অর্ধ পৃষ্ঠাব্যাপী একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়। ঢাকা শহরের রাস্তায় তিনটি মৃতদেহের একটি ছবির নীচে লেখা রয়েছে, এই ছবিটি আপনার ছেলে-মেয়েদের দেখান এবং তাদের সঙ্গে জনসভায় যােগ দিন। এ্যাকশান বাংলাদেশের উদ্যোগে প্রকাশিত এই বিজ্ঞাপনে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীসহ অন্যান্য বক্তাদের নাম দেওয়া হয়েছিল। জুলাই মাসের প্রথম দিকে পাকিস্তানের জেলে বঙ্গবন্ধুকে নির্যাতনের গুজব শােনার পর বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী এমন্যাস্টি ইন্টারন্যাশনালের সেক্রেটারী জেনারেল মার্টিন এ্যানাসের সাহায্য প্রার্থনা করেন। মিঃ এ্যানাস বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন সম্পর্কে সহানুভূতিশীল ছিলেন। বিচারপতি চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর মুক্তির ব্যাপারে সাহায্য করার জন্য এ্যামনেষ্টি ইন্টারন্যাশনাল ও আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটির নিকট আনুষ্ঠানিক ভাবে দরখাস্ত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। মার্টিন এ্যানালসের পরামর্শ অনুযায়ী তিনি মাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রধান ও “ডীন” এবং রেডক্রস সংক্রান্ত জেনেভা কনভেনশান ও আনুসংগিক আইন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড্রেপারকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক রেডক্রসের নিকট দরখাস্ত পেশ করার জন্য ব্যারিস্টার হিসাবে নিয়ােগ করেন। ৫ই আগস্ট অধ্যাপক ড্রেপারকে সঙ্গে নিয়ে বিচারপতি চৌধুরী জেনেভা পৌছেন। অধ্যাপক ড্রেপার আনুষ্ঠানিক ভাবে রেডক্রসের উচ্চপদ মর্যাদা সম্পন্ন অফিসারদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তার ব্যাপারে আলােচনা করেন এবং তার সম্পর্কে সঠিক সংবাদ সংগ্রহের জন্য অনুরােধ জানান। আন্তর্জাতিক রেডক্রসের কর্তৃপক্ষ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করবে এবং ফলাফল যথাসময়ে জানাবেন বলে আশ্বাস দেন। তারা যদি পাকিস্তানী জেলে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাত করতে পারেন তাহলে গৌরবান্বিত বােধ করবেন বলে উল্লেখ করেন। অধ্যাপক ড্রেপারকে বিমানবন্দরে বিদায় দিয়ে বিচারপতি চৌধুরী জেনেভায় ফিরে এসে ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অব জুরিস্ট এর অফিসে গিয়ে সেক্রেটারী জেনারেল নীল ম্যাকডার মেটের সঙ্গে দেখা করেন। বৃটিশ সরকারের সাবেক মন্ত্রী মি. ম্যাকডার মেট অত্যন্ত মনােযােগ দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস
১৪৮
ও বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে বিচারপতি চৌধুরীর বক্তব্য শােনেন। তিনি বিচারপতি চৌধুরীকে সর্বপ্রকার সাহায্যের আশ্বাস দেন। বাংলাদেশে হত্যাযজ্ঞ শুরু হবার পর তিনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের নিকট উদ্বেগ প্রকাশ করে একটি বার্তা পাঠিয়েছিলেন। মি. ম্যাকডার মেটের অফিস থেকে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ওয়াল্ড ইউনিভারসিটি সার্ভিসেস এর অফিসে গিয়ে সেক্রেটারী জেনারেল চিদামবরা পাথানের সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলােচনা করেন। ৬ই আগস্ট লন্ডন ফিরে আসার আগে বিচারপতি চৌধুরী সুইস পার্লামেন্টের প্রভাবশালী সদস্য জা জিগলার এবং কয়েকজন সাংবাদিকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করেন। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর দক্ষ কর্মতৎপরতার ফলে ইউরােপ সহ বিভিন্ন স্থানে বঙ্গবন্ধুর বিচারের ব্যাপারে প্রতিবাদের ঝড় উঠে। তার প্রচেষ্টায়ই বৃটিশ পার্লামেন্টের সরকারী দল এবং বিরােধী দলের ২৭০ জন এম,পি বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দাবী করে। এদিকে ভারতীয় পালামেন্টের ৪৬৭ জন সদস্য আগষ্ট মাসের প্রথমদিকে জাতি সংঘের সেক্রেটারী জেনারেল উথান্টের নিকট বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবী করে একটি স্মারকলিপি পেশ করেন। বঙ্গবন্ধুর বিচারের প্রতিবাদে ১১ ই আগস্ট লন্ডনের হাইডপার্কে এক বিরাট জনসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। বৃটেনের বিভিন্ন স্থান থেকে কোচযােগে বাঙ্গালিরা দলে দলে এই জনসমাবেশে যােগদান করেন। এই সভায় বক্তৃতাকালে বিচারপতি চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবী করে বলেন, নিরাপত্তাহীন কিংবা কোন প্রকার ক্ষতি হলে বাঙ্গালি জাতি কোনদিন পাকিস্তানীদের ক্ষমা করবেনা। ক্ষমা শব্দটি বাঙ্গালি জাতি চিরদিনের জন্য ভুলে যাবে” সভাশেষে একটি বিশাল শােভাযাত্রা আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে বিভিন্ন রােড ঘুরে ১০ নং ডাউনিং স্ট্রীটে অবস্থিত বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের সামনে উপস্থিত হয়। শােভাযাত্রায় অংশগ্রহনকারীরা “শেখ মুজিবের মুক্তি চাই” “বিচার প্রহসন বন্ধকর” “গনহত্যা বন্ধ কর” ইত্যাদি শ্লোগান দেন। পিটার শাের, মাইকেল বার্নস , ব্রস ডগলাসম্যান,জনস্টোন হাউস এবং আরাে কয়েকজন পার্লামেন্ট সদস্য শশাভাযাত্রার প্রথম সারিতে বিচারপতি চৌধুরীর সাথে ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্থ হীথের সরকারী দপ্তরে নিয়ােজিত একজন অফিসারের হাতে একটি স্মারকলিপি দিয়ে বলেন, শেখ মুজিব একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি তার বিচার করার অধিকার কারও নেই। গােপন বিচার একেবারেই সভ্যতার বহির্ভূত। এই প্রহসন বন্ধ এবং বঙ্গবন্ধুর অবিলম্বে মুক্তির জন্য বৃটিশ সরকার পাকিস্তানী সামরিক জান্তার উপর প্রভাব বিস্তার করবেন এটাই আমাদের আশা। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ১৯৭১ সালের ১৭ই আগস্ট জেনেভায় এক সাংবাদিক সম্মেলন করেন। এই সাংবাদিক সম্মেলনের ব্যবস্থা করেন সুইজারল্যান্ডের সমাজতান্ত্রিক দলীয় পালামেন্ট সদস্য জো জিগলার। সম্মেলনটি পাকিস্তানীরা বানচাল করার আপ্রাণ চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। সম্মেলন করার জন্য আরাে সহযােগিতা করেন সুইজারল্যান্ডের বিশিষ্ট নাগরিক মাদাম লা পঁ্যা ও তার কয়েকজন সহকর্মী। সাংবাদিক সম্মেলনে বিচারপতি চৌধুরী বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসও যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর বিচার প্রহসন সম্পর্কেও সাংবাদিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ১৮ই আগস্ট বিচারপতি চৌধুরী জেনেভার লীডও রেডক্রস এবং ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব রেড ক্রসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করে বঙ্গবন্ধুর জীবনের নিরাপত্তার জন্য তাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার জন্য অনুরােধ জানান। ১৯৭১ সালের ২৭শে আগস্ট বাংলাদেশের স্বাধীনতা সগ্রামের ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক দিন। এইদিন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী লন্ডনের ২৪
১৪৯
কেমব্রিজ গার্ডেনের বাংলাদেশের মিশন উদ্বোধন করেন বহু বিদেশী গণ্যমান্য অতিথি ও সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে । তিনি বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে মিশনের উদ্বোধন ঘােষণা করেন। পতাকা উত্তোলন করার পর বিচারপতি চৌধুরী তার বক্তব্যে বলেন, লন্ডন থেকেই বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনের সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষা করা হবে এবং লন্ডনই হবে বহির্বিশ্বে বাংলদেশ আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র। বিচারপতি চৌধুরী তার বক্তব্যে আরাে বলেন, আমাদের প্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্বের নির্ভীক ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞ নেতাদের মধ্যে অন্যতম। তাকে বেআইনী ভাবে বন্দী করে রাখা হয়েছে। তার বিচার অনুষ্ঠান অবীরােচিত কাজ। তার যদি কোন ক্ষতি হয় তাহলে সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালি কোন দিনই তা ক্ষমা করবে না। শেখ মুজিব একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি ও রাষ্ট্রপ্রধান। তার বিচার করার অধিকার অন্য কোন দেশের নেই। আমি অবিলম্বে তার মুক্তি দাবী করি” তিনি আরাে বলেন “হানাদারদের বাংলার মাটি থেকে তাড়িয়ে দিয়ে আমরা একটি সুখী ও সমৃদ্ধশালী দেশ গড়ে তুলবাে। এদেশে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা সাম্য ও মৈত্রীর ভিত্তিতে সমান মানবাধিকার ভােগ করবেন। বিচারপতি চৌধুরী শেখ মুজিবের মুক্তির নিশ্চয়তার বিধান ও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জনগন ও সরকারের নিকট আবেদন করেন। মিশন উদ্বোধন এবং বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর বক্তব্যের পর বৃটিশ পার্লামেন্টের কয়েকজন সদস্য বাংলাদেশের সর্বাঙ্গীন সাফল্য কামনা করে বক্তব্য রাখেন। মুজিবনগর সরকার ইতি পূর্বেই বিচারপতি চৌধুরীকে বৃটেনে বাংলাদেশ সরকারের হাই কমিশনার নিয়ােগ দান করে কুটনৈতিক পরিচয়-পত্র প্রেরণ করে। পরিচয় পত্রে স্বাক্ষর করেন অস্থায়ী রাষ্ট্র প্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম। দূতাবাস স্থাপিত হবার পর বর্হিবিশ্বে বাংলাদেশ আন্দোলন দ্রুতগতিতে শক্তিশালী হতে থাকে। এই দূতাবাস বাংলার স্বাধীনতা যুদ্ধকে অনেকটা গতিশীল করতে সক্ষম হয়। আর এই দূতাবাস প্রতিষ্ঠার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ১লা সেপ্টেম্বর লন্ডন থেকে নরওয়ের রাজধানী অসলাে যান। বিমানবন্দরে তাকে অভ্যর্থনা জানান ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হামিদুল ইসলাম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রফিকুজ্জামান সহ ৬/৭জন বাঙ্গালি। মাত্র ৬/৭ জন অসলােবাসী বাঙ্গালির কর্ম তৎপরতার ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন বিভিন্ন মহলের দৃষ্টি আকর্ষন করে। এই সাক্ষাঙ্কারের মাধ্যমে তিনি নরওয়ের অধিবাসীদের নিকট বাংলাদেশের পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করার সুযােগ লাভ করেন। সেদিন বিকেলেই সাক্ষাতকার প্রচারিত হয়। পরদিন ২রা সেপ্টেম্বর বিচারপতি চৌধুরী নরওয়ের প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দেখা করেন। তিনি সুপ্রীমকোর্টের সকল বিচারপতিদের সঙ্গে বিচারপতি চৌধুরীর পরিচয় করিয়ে দেন। তারা জানতাে বাংলাদেশ কেন পাকিস্তান হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীনতা অর্জন করতে চায়। বিচারপতি চৌধুরী সংক্ষেপে বাঙ্গালি জাতি কেন স্বাধীনতা চায় তার কারণ ব্যাখ্যা করেন। বিচারপতি চৌধুরীর বক্তব্য শােনার পর তারা বাঙ্গালি জাতির প্রতি সহানুভূতি জানিয়ে আন্দোলনের সাফল্য কামনা করেন। সেদিন দুপুরে বিচারপতি চৌধুরী অসলাে রােটারী ক্লাবে অতিথি হিসাবে যােগদান করেন। রােটারী ক্লাবের সভা শুরুর আগে তিনি একটি সংক্ষিপ্ত ভাষণে “সংগ্রামী বাংলার দৃঢ় প্রত্যয়ের বাণী” সদস্যদের নিকট পৌছে দেন। এরপর বিচারপতি চৌধুরী নরওয়ের পার্লামেন্ট ভবনে গিয়ে পার্লামেন্টের আন্তর্জাতিক কমিটির সদস্যদের সঙ্গে বাংলাদেশ সম্পর্কে আলােচনা করেন। পার্লামেন্ট ভবন থেকে বের হয়ে অসলাে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ডীন এর সঙ্গে দেখা করেন। তিনি একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অধ্যাপক। কিছুদিন আগে মুজিবনগর সরকার বাংলাদেশে গণহত্যা সংগঠনের অপরাধে পাকিস্তানের বিচার
১৫০
কেমব্রিজ গার্ডেনের বাংলাদেশের মিশন উদ্বোধন করেন বহু বিদেশী গণ্যমান্য অতিথি ও সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে । তিনি বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে মিশনের উদ্বোধন ঘােষণা করেন। পতাকা উত্তোলন করার পর বিচারপতি চৌধুরী তার বক্তব্যে বলেন, লন্ডন থেকেই বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনের সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষা করা হবে এবং লন্ডনই হবে বহির্বিশ্বে বাংলদেশ আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র। বিচারপতি চৌধুরী তার বক্তব্যে আরাে বলেন, আমাদের প্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্বের নির্ভীক ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞ নেতাদের মধ্যে অন্যতম। তাকে বেআইনী ভাবে বন্দী করে রাখা হয়েছে। তার বিচার অনুষ্ঠান অবীরােচিত কাজ। তার যদি কোন ক্ষতি হয় তাহলে সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালি কোন দিনই তা ক্ষমা করবে না। শেখ মুজিব একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি ও রাষ্ট্রপ্রধান। তার বিচার করার অধিকার অন্য কোন দেশের নেই। আমি অবিলম্বে তার মুক্তি দাবী করি” তিনি আরাে বলেন “হানাদারদের বাংলার মাটি থেকে তাড়িয়ে দিয়ে আমরা একটি সুখী ও সমৃদ্ধশালী দেশ গড়ে তুলবাে। এদেশে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা সাম্য ও মৈত্রীর ভিত্তিতে সমান মানবাধিকার ভােগ করবেন। বিচারপতি চৌধুরী শেখ মুজিবের মুক্তির নিশ্চয়তার বিধান ও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জনগন ও সরকারের নিকট আবেদন করেন। মিশন উদ্বোধন এবং বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর বক্তব্যের পর বৃটিশ পার্লামেন্টের কয়েকজন সদস্য বাংলাদেশের সর্বাঙ্গীন সাফল্য কামনা করে বক্তব্য রাখেন। মুজিবনগর সরকার ইতি পূর্বেই বিচারপতি চৌধুরীকে বৃটেনে বাংলাদেশ সরকারের হাই কমিশনার নিয়ােগ দান করে কুটনৈতিক পরিচয়-পত্র প্রেরণ করে। পরিচয় পত্রে স্বাক্ষর করেন অস্থায়ী রাষ্ট্র প্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম। দূতাবাস স্থাপিত হবার পর বর্হিবিশ্বে বাংলাদেশ আন্দোলন দ্রুতগতিতে শক্তিশালী হতে থাকে। এই দূতাবাস বাংলার স্বাধীনতা যুদ্ধকে অনেকটা গতিশীল করতে সক্ষম হয়। আর এই দূতাবাস প্রতিষ্ঠার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ১লা সেপ্টেম্বর লন্ডন থেকে নরওয়ের রাজধানী অসলাে যান। বিমানবন্দরে তাকে অভ্যর্থনা জানান ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হামিদুল ইসলাম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রফিকুজ্জামান সহ ৬/৭জন বাঙ্গালি। মাত্র ৬/৭ জন অসলােবাসী বাঙ্গালির কর্ম তৎপরতার ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন বিভিন্ন মহলের দৃষ্টি আকর্ষন করে। এই সাক্ষাঙ্কারের মাধ্যমে তিনি নরওয়ের অধিবাসীদের নিকট বাংলাদেশের পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করার সুযােগ লাভ করেন। সেদিন বিকেলেই সাক্ষাতকার প্রচারিত হয়। পরদিন ২রা সেপ্টেম্বর বিচারপতি চৌধুরী নরওয়ের প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দেখা করেন। তিনি সুপ্রীমকোর্টের সকল বিচারপতিদের সঙ্গে বিচারপতি চৌধুরীর পরিচয় করিয়ে দেন। তারা জানতাে বাংলাদেশ কেন পাকিস্তান হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীনতা অর্জন করতে চায়। বিচারপতি চৌধুরী সংক্ষেপে বাঙ্গালি জাতি কেন স্বাধীনতা চায় তার কারণ ব্যাখ্যা করেন। বিচারপতি চৌধুরীর বক্তব্য শােনার পর তারা বাঙ্গালি জাতির প্রতি সহানুভূতি জানিয়ে আন্দোলনের সাফল্য কামনা করেন। সেদিন দুপুরে বিচারপতি চৌধুরী অসলাে রােটারী ক্লাবে অতিথি হিসাবে যােগদান করেন। রােটারী ক্লাবের সভা শুরুর আগে তিনি একটি সংক্ষিপ্ত ভাষণে “সংগ্রামী বাংলার দৃঢ় প্রত্যয়ের বাণী” সদস্যদের নিকট পৌছে দেন। এরপর বিচারপতি চৌধুরী নরওয়ের পার্লামেন্ট ভবনে গিয়ে পার্লামেন্টের আন্তর্জাতিক কমিটির সদস্যদের সঙ্গে বাংলাদেশ সম্পর্কে আলােচনা করেন। পার্লামেন্ট ভবন থেকে বের হয়ে অসলাে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ডীন এর সঙ্গে দেখা করেন। তিনি একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অধ্যাপক। কিছুদিন আগে মুজিবনগর সরকার বাংলাদেশে গণহত্যা সংগঠনের অপরাধে পাকিস্তানের বিচার
১৫১
খ্যাতনামা সাংবাদিক এবং এক্সপ্রেসেন ইভিনিং ডেইলি পত্রিকার সম্পাদক টমাস হ্যামবাগের সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশ সম্পর্কে আলােচনা করেন। তিনি বাংলাদেশকে সমর্থন করবেন বলে বিচারপতি চৌধুরীকে আশ্বাস দেন। ৯ই সেপ্টেম্বর সকালে বিচারপতি চৌধুরী “সেভেন্সকা ডাগ ব্লাডেট” পত্রিকার সাংবাদিক শাে কার্লসনকে সাক্ষাৎকার দেন। বিকেলে তিনি একটি জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনে বাংলাদেশ সম্পর্কে ব্যাখ্যা করেন। সুইডেনের প্রায় সমস্ত পত্রিকার প্রতিনিধি এই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। ১০ই সেপ্টেম্বর বিচারপতি চৌধুরী “ক্র্যাক্ট ব্লাডেট” পত্রিকার খ্যাতনামা সাংবাদিক ফ্রেডারিকসেনের সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশ সম্পর্কে আলােচনা করেন। তার আলােচনা শােনার পর ফ্রেডারিকসেন স্থানীয় বাংলাদেশ এ্যাকশান কমিটির সঙ্গে একত্রে কাজ করার জন্য রাজী হন। সুইডেন ত্যাগ করার আগে বিচারপতি চৌধুরী আব্দুর রাজ্জাককে সুইডেনে বাংলাদেশের প্রতিনিধি নিযুক্ত করার জন্য মুজিবনগর সরকারকে পত্র যােগে অনুরােধ জানান। ১৩ই সেপ্টেম্বর সকালে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বিমান যােগে সুইডেন থেকে ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিংকি পৌছান। হেলসিংকিতে নিয়ােজিত বৃটিশ কনসাল জেনারেল রয়ফা বিমান বন্দরে বিচারপতি চৌধুরীকে অভ্যর্থনা জানান। আলােচনাকালে মিঃ ফকস বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তার কথা জানতে চান। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের জেলে নিঃসঙ্গ জীবন কাটাতে বাধ্য হয়েছেন শুনে তিনি অত্যন্ত দুঃখিত হন। বিকেলে মিঃ ফকস বিচারপতি চৌধুরীকে রেলওয়ে স্টেশনের নিকট তার হােটেলে পৌঁছে দেন। হােটেলে জিনিসপত্র রেখে তিনি সরাসরি বিশ্বশান্তি পরিষদের সেক্রেটারী জেনারেল রমেশ চন্দ্রের সঙ্গে দেখা করেন। রমেশ চন্দ্র বলেন, হেলসিংকিতে অবস্থানকালে বিচারপতি চৌধুরী তার অফিস, টেলিফোন ও টেলেকস ব্যবহার করতে পারেন। পরদিন সকালে বিচারপতি চৌধুরী ফিনিস টেলিভিশনে এক সাক্ষাৎকার দেন। সাক্ষাৎকারে তিনি বাংলাদেশের পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেন। বিকেলে স্থানীয় ছাত্রদের এক সভায় বিচারপতি চৌধুরী ভাষণ দেন। তার পর পার্লামেন্ট ভবনে গিয়ে কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে বাংলাদেশ সম্পর্কে আলােচনা করেন। এদের মধ্যে একজন কয়েকদিনের মধ্যে ফিনল্যান্ডের প্রতিনিধি হিসাবে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যােগ দেবেন। তিনি ফিনল্যান্ড সরকারকে বাংলাদেশের সংগ্রাম সম্পর্কে অবহিত করা এবং জাতিসংঘে বাংলাদেশকে সমর্থন করবে বলে আশ্বাস দেন। এরপর পররাষ্ট্র দপ্তরের জনৈক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বিচারপতি চৌধুরীকে অভ্যর্থনা জানান। তিনি বিচারপতি চৌধুরীকে বলেন, বাংলাদেশ সম্পর্কে ফিনল্যান্ড সরকার সজাগ রয়েছে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে বাংলাদেশ নিঃসন্দেহে ফিনল্যান্ডের সহযােগিতা আশা করতে পারে। সন্ধ্যায় হেলসিংকি ত্যাগ করার আগে বিচারপতি চৌধুরী ফিনল্যান্ডের বিখ্যাত সংবাদপত্র “সুয়ােম্যান সােসিয়ালি ডেমােক্রাত” এর সম্পাদক এবং সুপ্রীম কোর্টের জজ ও মানবাধিকার কমিশনের সদস্য ভ্যাটিয়াে সারিরাের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। তারা বাংলাদেশ আন্দোলনকে যথা সম্ভব সাহায্যদানের আশ্বাস দেন। ১৪ই সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনে পৌঁছেন। বিমানবন্দরে মতিউর রহমান এবং লিয়াকত হােসেনসহ বেশকয়েকজন বাঙ্গালি কর্মী তাকে অভ্যর্থনা জানান। বাংলাদেশ আন্দোলনের উৎসাহী সমর্থক মিমি ক্রিস্টিয়ানসেন নামক একজন বয়ােবৃদ্ধ ডেনিশ মহিলার বাড়িতে বিচারপতি চৌধুরীর থাকার ব্যবস্থা করা হয়। পরদিন সকালে বিচারপতি চৌধুরী ডেনমার্কের বহুল প্রচারিত সংবাদ “ইনফরমেশান” অফিসে গিয়ে সম্পাদক
১৫২
নিটেলসেনের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি ইতিমধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন জানিয়ে কয়েকটি সম্পাদকীয় নিবন্ধ লিখেছেন। বিচারপতি চৌধুরীকে তিনি বলেন বাংলাদেশের জনগন পাকিস্তানকে প্রত্যাখ্যান করেছে একথা ডেনমার্ক উপলব্ধি করে। এরপর বিচারপতি চৌধুরী পার্লামেন্ট ভবনে গিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলভুক্ত সদস্যদের সঙ্গে বাংলাদেশ সম্পর্কে আলােচনা করেন। তারা বাংলাদেশের আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেন এবং সাধ্যমত সাহায্য করবেন বলে আশ্বাস দেন। পার্লামেন্ট ভবন থেকে বিচারপতি চৌধুরী টিভি স্টেশানে যান। সাক্ষাৎকার যিনি পরিচালনা করছিলেন তিনি রেকডিং শুরু হবার আগে বিচারপতি চৌধুরীকে বলেন, পাকিস্তান সরকার ডেনমার্কের একজন অস্ত্র ব্যবসায়ীকে অস্ত্র সরবরাহের অনুরােধ জানিয়েছে। সাক্ষাৎকারকালে এসম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করার উদ্দেশ্যে ডেনিশ সরকারের নিকট আবেদন জানাবার জন্য তিনি বিচারপতি চৌধুরীকে পরামর্শ দেন। সাক্ষাৎকার কালে অস্ত্র সরবরাহ সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে বিচারপতি চৌধুরী বলেন, গণতন্ত্রে অটল বিশ্বাসী ডেনমার্ক কখনও পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর গণহত্যার জন্য অস্ত্র সরবরাহ করবে না বলে তিনি আশা করেন। পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করা হলে নারী নির্যাতন, শিশু হত্যা এবং যেসব নির্দেশ মানুষের প্রাণহানী করা হবে তার জন্য দায়ী থাকবে অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ। স্থানীয় বাংলাদেশ এ্যাকশান কমিটি টি ভি সাক্ষাঙ্কারের ব্যাবস্থা করেছিলেন। এ্যাকশান কমিটির আহবায়িকা বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ কিস্টন ওয়েস্টগার্ড। কোপেনহাগেনে তার অফিসে বঙ্গবন্ধুর ছবি ঝুলানাে রয়েছে। গণ্যমান্য লােকজনদের সঙ্গে বিচারপতি চৌধুরীকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য তিনি সেদিন রাতে তার বাসভবনে একটা সান্ধ্য অনুষ্ঠানের আয়ােজন করেছিলেন। টি ভি স্টেশান থেকে বিচারপতি চৌধুরী পুণরায় পার্লামেন্ট ভবনে গিয়ে স্পীকারের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি বাংলাদেশ আন্দোলনের সাফল্য কামনা করেন। বিচারপতি চৌধুরীর আলােচনার পর বৈদেশিক কমিটির সভাপতি বিয়েল আলুসেন বাংলাদেশেকে সর্ব প্রকার সাহায্য দানের আশ্বাস দেন। তারা বিচারপতি চৌধুরীর বক্তব্য শােনার পর পাকিস্তানকে অস্ত্র দেয়ার জন্য ডেনমার্কের সমস্ত অস্ত্র কোম্পানীকে নিষেধ করেন। ১৬ই সেপ্টেম্বর বিচারপতি চৌধুরী জাতিসংঘের আসন্ন অধিবেশনে যােগদানের জন্য ডেনিশ প্রতিনিধিদলের নেতার সঙ্গে দেখা করেন। তিনি জাতিসংঘের অন্যান্য দেশের প্রতিনিধিদের নিকট বাংলাদেশের পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করবেন এবং বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনে সাহায্য করবেন বলে বিচারপতি চৌধুরীকে আশ্বাস দেন। বেলা প্রায় ১১ টার সময় ডেনমার্কের প্রভাব শালী পত্রিকা “পলিকেন” এর খ্যাতনামা সম্পদক জ ডানাপ বিচারপতি চৌধুরীর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। সেদিন বিকেলে স্থানীয় এ্যাকশান কমিটি ও কয়েকজন উৎসাহী বাঙ্গালির উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে বিচারপতি চৌধুরী বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে বক্তব্য রাখেন। ডেনমার্কের অধিকাংশ প্রভাবশালী পত্রিকার প্রতিনিধি সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। বক্তব্য রাখার শুরুতেই বিচারপতি চৌধুরী বলেন, আদর্শগতভাবে এই সংগ্রাম ভৌগলিক সীমারেখা অতিক্রম করে সকল দেশের সকল মানুষের সগ্রামে পরিণত হয়েছে। এই সগ্রামে ডেনিশ জনগন সক্রিয় সাহায্য দান করবেন বলে তিনি আশা করেন। সাংবাদিক সম্মেলনে বিচারপতি চৌধুরীকে জনৈক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন বাংলাদেশ সরকার ইজরাইলের নিকট থেকে সাহায্য গ্রহণ করেছে বলে সাংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এ সম্পর্কে আপনার অভিমত কি? প্রশ্নের উত্তরে বিচারপতি চৌধুরী বলেন এই মিথ্যা প্রচারের জন্য পাকিস্তান দায়ী। বাংলাদেশ সরকারকে মুসলিম দেশগুলির নিকট হেয় প্রতিপন্ন করাই তাদের উদ্দেশ্য। তাদের এই হীন কারসাজি ব্যর্থ হবে। সত্য চিরকালই জয়লাভ করে। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে
১৫৩
১৬ সদস্য বিশিষ্ট প্রতিনিধি দল জাতিসংঘের অধিবেশনে যােগদানের জন্য ২৩শে সেপ্টেম্বর নিউইয়র্ক পৌছে। প্রতিনিধি দলের অন্যান্য সদস্যবৃন্দ ছিলেন আব্দুস সামাদ আজাদ, এম আর সিদ্দিকী, সৈয়দ আব্দুস সুলতান, ডাঃ মফিজ চৌধুরী, সিরাজুল হক, ডাঃ আসহাবুল হক, ফনিভূষণ মজুমদার,ফকির শাহাবউদ্দিন, অধ্যাপক মুজাফফর আহমদ, ডাঃ এ আর মল্লিক, অধ্যাপক রেহমান সােবহান, এ, এফ, এম, আবুল ফতেহ, খুররম খানপন্নী, সৈয়দ আনােয়ারুল করিম, এ. এম. এ. মুহিত, এইচ. এম. মাহমুদ আলী। অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ মন্ত্রী সভার অনুমােদন ক্রমে এই প্রতিনিধি দল গঠন করেন। জাতিসংঘের সদস্যদেশ গুলির প্রতিনিধিদের নিকট বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করার গুরুদায়িত্ব তাদের উপর ন্যাস্ত করা হয়। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে জাতিসংঘে প্রেরিত প্রতিনিধিদল জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলির প্রায় শতাধিক দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলােচনা করেন। এই সফরের সময় বিচারপতি চৌধুরী নিউইয়র্কে বিভিন্ন টেলিভিশনে প্রায় ২৫টি সাক্ষাৎকার দেন। তিনি প্রতিনিধিদলের সদস্যদের বিভিন্ন দলে ভাগ করে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের দূতাবাসের সঙ্গে যােগাযােগ ও আলােচনা করতে পাঠান। বিচারপতি চৌধুরী প্রতিদিন একবার করে জাতি সংঘ ভবনে যান। ভারতে প্রখ্যাত সাংবাদিক ডঃ জেনে ব্যানার্জীর সহযােগিতায় বিচারপতি চৌধুরী জাতিসংঘের সমিতি ব্যবহার করেন। এখান থেকেই বিচারপতি চৌধুরী তাদের কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে ঘন ঘন বার্তা পাঠিয়ে সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং তাজউদ্দিনকে অবহিত করেন। বিচারপতি চৌধুরীর আলােচনার পর জাতি সংঘের বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশ আন্দোলন সম্পর্কে সত্য ঘটনা জানতে পারেন এবং তারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য দানের আশ্বাস দেন। বিশেষ করে ল্যাটিন আমেরিকা আফ্রিকা ও এশিয়ার প্রতিনিধিরা বাংলাদেশের আন্দোলন সম্পর্কে সহানুভূতি প্রকাশ করেন। কেউ কেউ সরাসরি সমর্থন জ্ঞাপন করেন স্বীকৃতির প্রশ্নে সবাই বলেন, বাংলাদেশ সরকার দেশের অভ্যন্তরে থেকে নির্বিঘ্নে কাজ করছে বলে তারা নিশ্চিত হতে চান। ভারত স্বীকৃতি না দেওয়া পর্যন্ত সে সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয় বলে তারা অভিমত প্রকাশ করেন। কোন কোন দেশের প্রতিনিধি সরাসরি ভাবে বলেন, ভারতের স্বীকৃতির পরই শুধু এ ব্যাপারে বিবেচনা করা যেতে পারে। বিভিন্ন দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ও অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে বাংলাদেশ সম্পর্কে আলাপ করার সুযােগ দেওয়ার জন্য বহু প্রতিনিধিদলের নেতা বিচারপতি চৌধুরীকে তাদের সরকারী প্রীতি অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ করেন। মুসলিম দেশের রাষ্ট্রদূতদের মধ্যে কেউ কেউ স্বীকার করেন, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের ব্যাপারে তাদের মনে সংশয় বয়েছে। এর উত্তরে বিচারপতি চৌধুরী বলেন, পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক নীতি ও ২৫ শে মার্চের হত্যাযজ্ঞের ফলে বর্তমান পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এই অসহনীয় পরিস্থিতিতে ঐক্যবদ্ধ বাঙ্গালি জাতি বঙ্গবন্ধুর ডাকে পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনের জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়। ৬ দফা দাবী এক দফার অর্থাৎ স্বাধীনতার দাবীতে রূপান্তরিত হয়। এজন্য ভারতকে দায়ী করা চলে না । ১৯৭১ সালের পহেলা অক্টোবর বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী নিউইয়র্কে জাতিসংঘ ভবনের বিপরীত দিকে অবস্থিত চার্চ সেন্টারের একটি বড় হলঘরে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের আদর্শ ও উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করেন। হলঘরটি ভাড়া করার ব্যাপারে সহায়তা করেন ওয়ার্ল্ডকনফারেন্স অব রিলিজিয়ান ফর পীস্ এর জেনারেল সেক্রেটারী হােমার জ্যাক। বিভিন্ন দেশের
১৫৪
বহু সাংবাদিক এই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। সম্মেলনে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী তার বক্তব্যে পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে বাঙ্গালিদের প্রতি পাক সরকারের সফল বৈষম্যমূলক শাসন ও শােষনের খতিয়ান তুলে ধরে ২৫ শে মার্চের হত্যাকান্ডসহ তার পরবর্তী ঘটনা বিস্তারিত ভাবে ব্যাখ্যা করেন। তিনি রণাঙ্গনের বিবরণ দিয়ে বলেন“ বঙ্গালিদের জয়যাত্রা চলছে প্রতিটি রণক্ষেত্রে। চলাচলের রাস্তা হয়েছে বন্ধ। জাহাজ হয়েছে নিমজ্জিত। ইয়াহিয়া খানের প্রশাসন আজ ভগ্নপ্রায়। আমাদের যুদ্ধরত সগ্রামী ভাইদের জানাই সশ্রদ্ধ সালাম। তিনি আরাে বলেন, বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান তিনটি পূর্বশর্তের উপর নির্ভরশীল। যথা (১) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দান, (২) অবিলম্বে এবং বিনাশর্তে গণতান্ত্রিক পন্থায় নির্বাচিত বাংলাদেশের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তিদান এবং (৩) ইয়াহিয়া খানের হানাদার সৈন্যদের বাংলার মাটি থেকে অবিলম্বে প্রত্যাহার । তিনি পাকিস্তান ও বাংলাদেশের ভিন্নতার উল্লেখ করে বলেন, “ বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে এক হাজার মাইলেরও বেশি দূরে অবস্থিত। আমাদের ভাষা, আচার-ব্যবহার, আদর্শ এবং সংস্কৃতি ভিন্ন। অতএব জাতি সংঘের সংজ্ঞা অনুযায়ী আমরা একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন জাতি। প্রত্যেক জাতির আত্ম নিয়ন্ত্রণের অধিকার জাতি সংঘের সানদে ঘঘাষিত হয়েছে। একটি স্বতন্ত্র জাতি রূপে সেই ধারা অনুসারে বাঙ্গালি জাতি স্বাধীনতা ঘােষণা করেছে। ইয়াহিয়া খানের নিষ্ঠুর নিপীড়নের বিরুদ্ধে আমাদের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসা জাতি সংঘের অবশ্য কর্তব্য। বিচারপতি চৌধুরী আরাে বলেন আমরা গণহত্যা বন্ধের উদ্দেশ্যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আবেদন জানাই। আমরা বিশ্বাস করি জাতিসংঘ বাংলাদেশে মানবাধিকার লংঘন, ঔপনিবেশিকতা ও সামাজিক বৈষম্যের অবসান ঘটাবে। আমাদের স্বাধীতা সংগ্রামের জয় সুনিশ্চিত। তিনি আরাে বলেন, আমরা আশা করি অদূর ভবিষ্যতে বিশ্বের রাষ্ট্রসমূহ আমাদের স্বীকৃতি দেবে এবং জাতি সংঘের সদস্য হিসাবে আমরা বিশ্বসংস্থায় যােগদান করব” বিচারপতি চৌধুরীর সাংবাদিক সম্মেলনের বিবরণ আমেরিকা ও অন্যান্যদেশের সংবাদপত্র, রেডিও টেলিভিশনে প্রচারিত হয়। এ সম্মেলনের বিবরণ প্রচারিত হওয়ার পর আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়ে ভাষণ দেওয়ার জন্য প্রবাসী বাঙ্গালিদের নিকট থেকে বহু আমন্ত্রণ পান। জরুরি কাজের জন্য তাকে কিছু দিনের জন্য লন্ডনে ফিরতে হয়েছিল বলে এসব আমন্ত্রণ গ্রহণ করা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। বলা বহুল্য এই সম্মেলনটি সাফল্যমন্ডিত হয়েছিল। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত প্রতিনিধিদলের সদস্যদের মধ্যে ছিলেন একটি রাজনৈতিক দলের সভাপতি , সংসদে নির্বাচিত আটজন সদস্য, দুজন রাষ্ট্রদূত,দুজন ভাইস চ্যান্সেলার একজন বিশিষ্ট্য অর্থনীতিবিদ এবং কয়েকজন অভিজ্ঞ কূটনীতিবিদ। তারা সহজেই সম্মেলনে যােগদানকারীর শ্রদ্ধা অর্জন করেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ইউরােপের বিভিন্নদেশ সফর করে ২৯শে অক্টোবর ভিয়েনা থেকে লন্ডন আসেন। মিসেস গান্ধী লন্ডনে আসার কয়েক ঘন্টা পর বাংলাদেশ মিশনের প্রধান এবং মুজিবনগর সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করেন। বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে মিসেস ইন্দিরা গান্ধী কথা বলেন। বিচারপতি চৌধুরীর ফ্রান্স,হল্যান্ড,ডেনমার্ক, সুইডেন, ফিনল্যান্ড ও সুইজারল্যান্ড সফরের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তিনি জানতে চান। বিচারপতি চৌধুরী বলেন, বিভিন্ন দেশের সরকার ও জনগন বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের ব্যাপারে তারা বলেন, ভারত কর্তৃক স্বীকৃতি দানের উপর তাদের সিদ্ধান্ত নির্ভর করছে। আবেগ পূর্ণ স্বরে তিনি আরাে বলেন, মিসেস গান্ধীর পিতা বেঁচে থাকলে তিনি শুধুমাত্র উদ্বাস্তদের আশ্রয় দিয়েই ক্ষান্ত থাকতেন না। অবশ্য এর প্রতিদান দেয়ার মত বিচারপতি চৌধুরীর কিছুই নেই। তবে স্বাধীন
১৫৫
ও সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিবেশী ভারতের বন্ধু রাষ্ট্রের ভূমিকা গ্রহণ করবে। অক্টোবর মাসের শেষ দিকে বিচারপতি চৌধুরী পাকিস্তানের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত আব্দুল মােমেনকে সঙ্গে নিয়ে লন্ডনের একটি হােটেলে মরিশাসের কৃষি মন্ত্রী স্যার আব্দুর রাজ্জাকের সঙ্গে দ্বিতীয় বার দেখা করেন। কয়েকদিন আগে বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে তার প্রথমবার দেখা হয়। তখন তিনি বলেন, পাকিস্তানের অংগ ছেদের ব্যাপারে তিনি সম্মতি দিতে পারেন না। দ্বিতীয় বার দেখা করার সময় বিচারপতি চৌধুরী মিঃ মােমেনকে কথা বলার সুযােগ দেন। তিনি মরিশাস কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের ব্যাপারে সমর্থন দানের জন্য আব্দুর রাজ্জাককে অনুরােধ করেন। তার বক্তব্য শােনার পর আব্দুর রাজ্জাক বলেন, পাকিস্তান ভেঙ্গে দেয়া ঠিক হবে না অতীতের অন্যায় ক্ষমা করে নতুন পরিবেশ সৃষ্টির জন্য এগিয়ে যেতে হবে। মরিশসের প্রধানমন্ত্রী স্যার সিউসাগর রামগােলাম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের পক্ষপাতী ছিলেন। তার দলের মুসলমান সদস্যদের বিরােধিতার ফলে তা সম্ভব হয়নি। নভেম্বর মাসের শেষের দিকে বিচারপতি চৌধুরী লন্ডন থেকে আমেরিকা সফরে যান। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী তিনি স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলােচনা করার জন্য হার্ড নিউইয়র্ক সিটি, কলম্বিয়া, হােয়াস্ট্রা ও ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় এবং ম্যাসাটুসেটস্ ইনস্টিটিউট অব টেকনােলজি ও হার্ভার্ড স্কুল অব ল সফর করেন। বিচারপতি এইসব প্রতিষ্ঠান গুলিতে বাংলাদেশ আন্দোলনের সমর্থকদের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত জনাকীর্ণ সভায় বক্তৃতা করেন। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সফর করার পর বিচারপতি চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে নিউইয়র্ক থেকে ট্রেনযােগে ওয়াশিংটন সফরে যান। পরদিন বিচারপতি চৌধুরীর নেতৃত্বে প্রতিনিধিদলের সদস্যগণ সিনেটার এডওয়ার্ড কেনেডি ও সিনেটার স্যাকসবীসহ কয়েকজন সিনেটার এবং কংগ্রেসম্যান গ্যালাখারের সঙ্গে বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে আলােচনা করেন। ওয়াশিংটনে নিয়ােজিত বাংলা দেশের রাষ্ট্রদূত এম. এম. আর. সিদ্দিকী প্রতিনিধিদলের সম্মানার্থে একটি সান্ধ্য অনুষ্ঠানের আয়ােজন করেন। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও প্রতিনিধিরা এই অনুষ্ঠানে যােগদান করেন। মুসলিম দেশগুলির মধ্যে দুএকটি দেশের দূতাবাস ছাড়া অন্যসব দূতাবাসের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী আমেরিকান স্টেটাডিনার্ড মেন্টে অফিসার মিঃ কনসটেবলের সঙ্গেও বাংলাদেশ সম্পর্কে আলােচনা করেন। আলােচনা কালে মিঃ কনসূটেবল বলেন, পাকিস্তান সরকার ও মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধিদের সমবায়ে একটি গােলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত। এই বৈঠকে শেখ মুজিবের যােগদান সম্পর্কে বিচারপতি চৌধুরীর এক প্রশ্নের উত্তরে মিঃ কনসটেবল বলেন, এপর্যায়ে শেখ মুজিব পরবর্তী আলােচনায় যােগদান করতে পারবেন। বিচারপতি চৌধুরী তৎক্ষনাৎ তার আসন থেকে উঠে ফেলট হ্যাট ও ওভারকোর্ট হাতে তুলে নিয়ে বলেন, শেখ মুজিব ছাড়া অন্য কারাে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশ সম্পর্কে আলােচনা করার অধিকার নাই। এই মন্তব্যের সঙ্গে আলােচনারও অবসান হয়। আমেরিকার প্রেসিডেন্টের বাসভবন হােয়াইট হাউসের নিকটবর্তী লাফায়েত পার্কে একদল তরুণতরুণী ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী বাংলাদেশের বাস্তুত্যাগীদের দুদর্শ সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য শরনার্থী শিবিরের অনুরূপ একটি শিবির স্থাপন করে। লুঙ্গী, গেঞ্জী পরা আমেরিকান তরুণ তরুণীরা এই শিবিরের বিরাটাকার কার্ডবাের্ড দিয়ে নির্মিত পাইপের ভিতর আশ্রয় গ্রহণ করে বাস্তুত্যাগীদের করুণ অবস্থার প্রতিফলন করতে সক্ষম হয়। বিচারপতি চৌধুরী এই শিবির পরিদর্শন করেন। এই সময়ে অনেকগুলি সংবাদপত্র টি ভি ও রেডিওর কয়েকজন প্রতিনিধি ও প্রেস ফটো গ্রাফার উপস্থিত
১৫৬
ছিলেন, সাংবাদিকদের নিকট উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে আমেরিকান তরুণ তরুণীরা বাংলাদেশের নিপিড়ীত জনগণের সঙ্গে তাদের সংহতি ঘােষণার কথা বলেন। বিচারপতি চৌধুরী এখানে তার বক্তব্যে আমেরিকান তরুণ তরুনীদের ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। এই উদ্দীপনাময় অনুষ্ঠান বিচারপতি চৌধুরীকে অনুপ্রাণিত করে। আমেরিকান টেলিভিশনে এক সাক্ষাৎকার কালে বিচারপতি চৌধুরীকে প্রশ্ন করা হয়, আমেরিকান সরকার কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া হবে বলে কি তিনি আশা করেন? উত্তরে তিনি বলেন, নিকসন সরকার বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল নয়। কিন্তু আমেরিকান জনগন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন করে। অতএব আমেরিকান সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হবে। আমেরিকান জনগনের বিভিন্ন প্রমাণ হিসাবে তিনি বিভিন্ন জনাকীর্ণ সভায় তার বক্তব্য রাখার কথা উল্লেখ করেন। অপর আর একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে জনৈক সাংবাদিক বলেন, ভারতের সাহায্যে সংগ্রাম শুরু করার ফলে স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশ ভারতের একটি অধীনস্ত রাজ্যে পরিণত হতে পারে বলে অনেকে আশংকা করেন। এর উত্তরে বিচারপতি চৌধুরী পাল্টা প্রশ্ন করেন, গত মহাযুদ্ধে নাৎসী কবল মুক্ত হবার পর ফরাসী দেশ কি মিত্রপক্ষের অধীনস্ত রাজ্যে পরিণত হয়েছে। তিনি অত্যন্ত দৃঢ়কণ্ঠে বলেন,ভারত বন্ধু ও সাহায্য কারী দেশ হিসাবে এগিয়ে এসেছে। স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ বাংলাদেশ ভারতের বন্ধু রাষ্ট্র হিসাবে পরিগণিত হবে। তিনি আরাে বলেন, ভারত কিংবা আর কোন রাষ্ট্রের অধীনস্ত মর্যাদা বাংলাদেশের নিকট কখনও গ্রহণযােগ্য হবে না। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের শুরু থেকেই ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর সাহায্যে মুক্তিযযাদ্ধারা প্রতিটি যুদ্ধে বিজয় অর্জন করে। শুরু হয় জয়যাত্রা। তখনই নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশন আহবান করা হয়। বাংলাদেশে কাশ্মিরের মত অচলাবস্থা সৃষ্ট্রির জন্য পাকিস্তান ও তার সমর্থকরা নিরাপত্তা পরিষদের হস্তক্ষেপ কামনা করে। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী তার সহকর্মীদের নিয়ে দিবারাত্রি অক্লান্ত পরিশ্রম করে এর বিরুদ্ধে বিশ্ব জনমত গড়ে তােলেন, পরিষদের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করে যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন না করার জন্য তিনি অনুরােধ জানান। এরমধ্যে ভারতীয় পররাষ্ট্রসচিব সরদার শরন সিং বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে আলােচনার জন্য বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করেন। আলােচনার সময় মিঃ শরন সিং বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে বিচারপতি চৌধুরীর তার ঘনিষ্ঠ সহযােগিতা একান্ত প্রয়ােজন। অতএব জাতি সংঘের সদর দপ্তরে তাদের একযােগে কাজ করা উচিৎ। বিচারপতি চৌধুরী বলেন ভারত কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার ফলে এব্যাপারে তিনি একমত। এরপর থেকে ভারতীর প্রতিনিধিদল সবসময় বিচারপতি চৌধুরীর পরমর্শ গ্রহণ করেন। নিরপত্তা পরিষদে বাংলাদেশ সম্পর্কে আলােচনা শুরু হবার পর মুজিবনগর সরকারের বক্তব্য পেশ করার জন্য বিচারতি চৌধুরীর পরিষদের চেয়ারম্যানের নিকট একটি আবেদন পত্র পেশ করেন। ভারতীয় প্রতিনিধিদলের মাধ্যমে এই আবেদন পত্র পেশ করা হয়। বিচারপতি চৌধুরীকে অনুমতিদানের জন্য ভারতীয় প্রতিনিধি দল জোরালাে দাবী জানান। জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃতি দেওয়ার আগে কোন একটি সরকারের প্রতিনিধিকে পরিষদের অধিবেশনে যােগ দিয়ে তাদের বক্তব্য পেশ করতে দেওয়া উচিৎ হবে কিনা সে সম্পর্কে দীর্ঘ আলােচনা অনুষ্ঠিত হয়। এ বিষয়ের উপর দু বার দেওয়া হয়। উভয় ক্ষেত্রে অধিকাংশ দেশ বিচারপতি চৌধুরীকে বক্তব্য পেশ করার প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেন। দুবার “ভিটো প্রয়ােগ করে চীন প্রস্তাবটি নাকোচ করে দেয়। বৃটেন ও আমেরিকা প্রস্তাবটিরপ্রতি তুলনামূলকভাবে সহাভূতি প্রদর্শন করে। বিচারপতি চৌধুরী
১৫৭
মাহমুদ আলীকে সঙ্গে নিয়ে জাতি সংঘের আমেরিকান প্রতিনিধি দলের নেতা জর্জ বুশের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি অত্যন্ত মনােযােগ সহকারে তার বক্তব্য শােনালেন। বাংলাদেশ সম্পর্কে আলােচনা কালে বিচারপতি চৌধুরী বলেল, বাংলাদেশ আন্দোলন বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন নয়। বাঙ্গালিরা। স্বাধীনতা সংগ্রামে নিয়ােজিত রয়েছে। তিনি আমেরিকান সংবিধানের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, আমেরিকান সংবিধানের চতুর্দশ সংশােধনীতে নাগরিকদের সম অধিকার ভােগের দাবী স্বীকৃত রয়েছে। বাঙ্গালির সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত। তাদের দাবী মেনে নেয়ার পরিবর্তে পাকিস্তানী সামরিক জান্তা নির্যাতনের পথ বেছে নিয়েছে। মিঃ বুশ সমস্যা সমাধানের জন্য কোন প্রস্তাব না করে বর্তমান পরিস্থিতির জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন,অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান হলে তিনি খুশী হবেন। বিচারপতি চৌধুরী এ ব্যাপারে সাহায্য করার জন্য তাকে অনুরােধ করেন। মিঃ বুশ এই অনুরােধ সম্পর্কে তার মনােভাব প্রকাশ না করে মৌনভাব অবলম্বন করে। জাতিসংঘ কর্তৃক যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব আলােচনা কালে এক বিবৃতির মাধ্যমে বিচারপতি চৌধুরী বাংলাদেশের ব্যাপারে জাতি সংঘের ভূমিকা সম্পর্কে মুজিবনগর সরকারের বক্তব্য ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন ,বাংলাদেশের জনগনকে যখন নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছিল তখন জাতিসংঘ নিস্ক্রিয় ছিল। হানাদার সৈন্যদের পরাজিত করে বাংলাদেশ যখন সাফল্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন জাতিসংঘ কর্তৃক যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। এই প্রস্তাব গৃহীত হলে পাকিস্তান লাভবান হবে এবং বাংলার মানুষ অবর্ণনীয় দুর্দশার সম্মুখীন হবে। এর ফলে মূল সমস্যার সমাধান হবে না। বাঙ্গালির জয় অনিবার্য। চূড়ান্ত জয়লাভ না হওয়া পর্যন্ত তাদের সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে বলে মুজিবনগর সরকারের পক্ষ থেকে তিনি ঘােষণা করেন। ১৬ ডিসেম্বর নিউইয়র্কে অবস্থানকালে বিচারপতি চৌধুরী যৌথ বাহিনীর নিকট হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পনের সংবাদ পান। বাংলাদেশ আন্দোলনের প্রতি সমর্থনকারী আমেরিকার বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ধন্যবাদ জ্ঞাপনের জন্য আরাে। কয়েকদিন অবস্থানের পর তিনি তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে লন্ডনে আসেন ২২শে ডিসেম্বর। লন্ডনে আসার পর বিচারপতি চৌধুরী বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের তারবার্তা পান। এই তারবার্তায় তাকে অবিলম্বে দেশে ফিরার জন্য অনুরােধ জানান হয়। বিচারপতি চৌধুরী স্বাধীনতা সম্রামে অংশগ্রহণকারী প্রবাসী বাঙ্গালি ও সমর্থনকারী বৃটিশ নাগরিকদের অশেষ ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন এবং কয়েকটি সাংগঠনিক কাজ শেষ করে ১৯৭২ সালের ৬ই জানুয়ারি লন্ডন ত্যাগ করেন এবং ১৯৭২ সালের ৮ই জানুয়ারী ঢাকা পৌছান।
বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ১৯২১ সালের ৩১ শে জানুয়ারি টাঙ্গাইল জেলার কালীহাতী থানার নাগবাড়ি গ্রামে এক সুপরিচিত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম আব্দুল হামিদ চৌধুরী। তিনি তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের স্বীকার ছিলেন। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তার বাল্য শিক্ষা শুরু হয় টাঙ্গাইল শহরের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। বিন্দুবাসিনী হাইস্কুলে কিছুদিন লেখাপড়ার পর ময়মনসিংহে স্কুল জীবনের লেখাপড়া শেষ করেন। এখান হতে ম্যাট্রিক পাস করার পর উচ্চ শিক্ষার জন্য কলকাতা যান। সেখানে প্রেসিডেন্সী কলেজ হতে বি,এ পাশ করেন। কলকাতা প্রেসিডেন্সী কলেজে ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদকও তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন। পরে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ইতিহাসে এম. এ. এবং বি. এল, ডিগ্রী লাভ করেন।
১৫৮
১৯৪৭ সালে লন্ডনের লিংকন্সই হতে ব্যারিষ্টারী পাস করেন। ব্যারিষ্টারী পাশ করার পর তিনি হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর সহকারী হিসাবে আইন পেশায় যােগদান করেন। অতি অল্প দিনেই তিনি আইন পেশায় সুখ্যাতি অর্জন করেন। ১৯৬০ হতে ১৯৬১ সালে তিনি ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের এ্যাডভভাকেট জেনারেল । ১৯৬১ সাল হতে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বাের্ডের সভাপতি। ১৯৬৯ সালে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিযুক্ত হন। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জাতি সংঘের মানবাধিকার কমিশনের অধিবেশনে যােগ দিতে জেনেভা যান। সেখানে জানুয়ারি মাসে দেশের রাষ্ট্রপতি হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বর মাসে রাষ্ট্রপতির পদ হতে পদত্যাগ করেন। ১৯৮৫ সালে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের সভাপতি নিযুক্ত হন। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯৮৭ সালের ২ আগস্ট তিনি লন্ডনে মৃত্যুবরণ করেন।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ও আব্দুল মান্নান
মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে আব্দুল মান্নানের নাম অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র পরিচালনার মাধ্যমে তিনি ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা সগ্রামে অত্যন্ত কৃতিত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বাংলার পবিত্র মাটি থেকে পাকিস্তানী জল্লাদবাহিনী বিতাড়িত করার জন্য সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের পাশাপাশি যে যুদ্ধ মুক্তিযােদ্ধাদের উৎসাহ, উদ্দীপনা ও সাহস যুগিয়েছে, যুগিয়েছে সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালিকে অনুপ্রেরণা এবং হানাদার জল্লাদ বাহিনীকে সর্বক্ষণ রেখেছে ভীত সন্ত্রস্ত তা হলাে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ। আর এই মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ পরিচালনা করে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে পাক সরকারের দখলকৃত এলাকার ৬টা বেতার কেন্দ্র থেকে অবিরাম প্রচন্ডভাবে মুক্তিযােদ্ধা ও বাঙ্গালি জাতির বিরুদ্ধে ভয়াবহভাবে মিথ্যাচার এবং অপপ্রচার চালানাে হয়েছে। তার বিরুদ্ধে জবাব দেওয়া হয়েছে একমাত্র বেতার কেন্দ্র থেকে। এই বেতার কেন্দ্রই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের পরিচালক আব্দুল মান্নান তৎকালীন সময়ে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ছিলেন। বর্তমানে তিনি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি মন্ডলীর অন্যতম সদস্য। পাকিস্তানী হানাদারবাহিনী বাঙ্গালির নিধনযজ্ঞে মেতে উঠলে তখন দেশবাসী খুনীদের হাত থেকে বাঁচার জন্য ব্যাপকভাবে দেশত্যাগ করতে থাকে। আব্দুল মান্নান অত্যন্ত কষ্ট করে ময়মনসিংহ হয়ে সৈয়দ নজরুল ইসলামের সঙ্গে ভারতে উপস্থিত হন। ভারতের ঢালু পাহাড়ে তাজউদ্দিনের সঙ্গে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও আব্দুল মান্নানের দেখা হয়। এখান থেকে নজরুল ইসলাম ও আব্দুল মান্নান তাজউদ্দিনের সঙ্গে কলকাতায় যান। কলকাতায় উপস্থিত হয়েই নেতৃবৃন্দ ১৭ই এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথ তলায় প্রবাসী সরকারের শপথ অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। প্রস্তুতি পর্বে জনাব আব্দুল মান্নান বিশেষ দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৬ই এপ্রিল কলকাতা প্রেস ক্লাবে যান সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ জানাতে। তিনি তাদেরকে বলেন, আগামীকাল স্বাধীন বাংলাদেশে নবগঠিত সরকারের শপথ অনুষ্ঠান হবে। সেখানে আপনাদের আমন্ত্রণ জানাতে নবগঠিত সরকারের পক্ষ থেকে আমাকে পাঠানাে হয়েছে। বিশেষ কারণে শপথ অনুষ্ঠানের স্থানের নাম আপনাদের কাছে বলা হল না। আপনাদের ভােরে আমরা এখান থেকে নিয়ে যাব। আপনারা যথারীতি ক্লাবে সবাই একত্রিত হবেন।’ ১৭ই এপ্রিল ভােরে জনাব আব্দুল মান্নান ব্যারিস্টার
১৫৯
আমিরুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে কলকাতা প্রেস ক্লাবে যান এবং সেখান থেকে প্রায় ৫০/৬০টি গাড়িতে করে দেশী বিদেশী কয়েকশ সাংবাদিক নিয়ে বেলা ১১টার দিকে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথ তলায় উপস্থিত হন। দেশী-বিদেশী সাংবাদিক এবং হাজার হাজার লােকের উপস্থিতিতে ঘােষণা করা হল স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সনদপত্র এবং শপথ অনুষ্ঠান হল প্রবাসী সরকারের। শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন আব্দুল মান্নান। অনুষ্ঠানে স্বাধীন বাংলার সনদ পাঠ করেন দিনাজপুরের অধ্যাপক ইউনুস আলী। প্রবাসী সরকারের মন্ত্রী পরিষদের সদস্যদের শপথ বাক্য পাঠ করান অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহম্মেদ এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেন এবং বক্তব্য রাখেন। প্রবাসী সরকারের শপথ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিশ্ববাসী জানতে পারে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের অস্তিত্বের কথা। ১৯৭১ সালের ১৭ই এপ্রিলের শপথ অনুষ্ঠান হওয়ার পর প্রবাসী সরকার কাজ শুরু করে। ১৯শে এপ্রিল প্রবাসী সরকারের মন্ত্রী পরিষদের বৈঠকে আব্দুল মান্নানকে মন্ত্রীর পদমর্যাদায়, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয়। দায়িত্ব পাবার পর আব্দুল মান্নান ও এম আর আক্তার বেমুকুলসহ বেশ কয়েকজনকে নিয়ে কাজ শুরু করেন। ভারতীয় কর্মকর্তারা বেতার কেন্দ্রের কাজ করার জন্য ভারতীয় শিল্পী ও কর্মীদের রাখার প্রস্তাব দেন। কিন্তু আব্দুল মান্নান ভারতীয় কর্মকর্তাদের প্রস্তাব দৃঢ়তার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করে বলেন-আমাদের বেতার কেন্দ্রে আমাদের শিল্পী বা কর্মীরাই কাজ করবে। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন ও অন্যান্য মন্ত্রীদের সঙ্গে পরামর্শ করে আমিনুল হক বাদশা, এম আর আক্তার মুকুল ও টি এইচ সিকদারসহ বেশ কয়েকজনকে তাড়াতাড়ি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র চালু করার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দেন। তিনি প্রয়ােজনীয় যন্ত্রপাতি সংগ্রহের আশ্বাস দেন। পরের দিন অর্থাৎ ২৪ শে মে দুপুরে মাত্র দুটি রেকর্ডিং মেশিন ও একটি মাইক্রোফোন নিয়ে কাজ শুরু করা হয়। অত্যন্ত অসুবিধার মধ্য দিয়ে কাজ শুরু করা হয়। একদিকে জায়গার অভাব অন্যদিকে যন্ত্রপাতির অভাব। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহম্মেদ কেরানীগঞ্জের সার্কুলার রােডের যে বাড়িতে থাকতেন তার পাশেই একটি ছােট কামরায় প্রথম কাজ শুরু হয়। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রথমদিকে কোন সাউন্ড প্রুফ রেকর্ডিং স্টুডিও ছিল না। ছিল না ইঞ্জিনিয়ার বা টেকনিক্যাল অপারেটর। রেকর্ডিং স্টুডিও না থাকাতে কক্ষটির চারদিকের দেয়ালে বিছানার চাদর ও কাপড় ঝুলিয়ে দরজা ও জানালার ছিদ্রগুলাে বন্ধ করে রেকর্ডিং স্টুডিও বানানাে হয়। এখানেই দুটি ভাঙ্গা টেপ রেকর্ডার রাখা হয়। এই রেকর্ডিং কক্ষটি ছিল অত্যন্ত ছােট। এর মধ্যেই বেতারকেন্দ্র চালুর সমস্ত প্রস্তুতি অতি কষ্টে গ্রহণ করা হয়। প্রস্তুতি গ্রহণ শেষে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় ২৫শে মে বিদ্রোহী কবি নজরুলের জন্মদিন উপলক্ষ্যে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান চালু করা হবে। সিদ্ধান্ত মােতাবেক ২৫শে মে কলকাতার ২৫ মাইল দূরে ৫০ কিলােওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের যাত্রা শুরু হল। প্রথম দিনে কোরান তেলাওয়াত ও বক্তৃতাসহ মাত্র ১০ মিনিটের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অস্তিত্বের প্রকাশ ঘটে। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে অনুষ্ঠানের পরিধি বেড়ে যায় এবং এখান থেকেই দৈনিক ১০ ঘন্টা পর্যন্ত অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়েছে। এই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ছিল মুক্তিযােদ্ধাদের অনুপ্রেরণার অন্যতম উৎস। আর এই বেতার কেন্দ্রের পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন আব্দুল মান্নান। তার দক্ষতা এবং যােগ্যতার কারণেই একটি
১৬০
মাত্র বেতার কেন্দ্র দিয়ে পাকিস্তানী সরকারের ৬টি বেতার কেন্দ্রের মিথ্যাচার ও অপপ্রচারের জবাব দেয়া সম্ভব হয়েছে। আব্দুল মান্নান স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য বিভিন্ন বিভাগ বা দপ্তর সৃষ্টি করে বিভিন্ন জনের উপর দায়িত্ব দেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নীতি নির্ধারণ, মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষা, অর্থ সংগ্রহ এবং কর্মচারী নিয়ােগের ব্যাপারে পরামর্শদাতা হিসাবে সহযােগিতা করার জন্য তথ্য সচিব নিয়ােগ করেন আনােয়ারুল হক খানকে, ডিরেক্টর জেনারেল নিয়ােগ করেন এম আর আক্তার মুকুলকে। এরপর কাজের সুবিধার জন্যই প্রশাসনিক বিভাগ সৃষ্টি করেন। প্রশাসনিক বিভাগে যারা দায়িত্ব পালন করেন তারা হলেন ফজলুল হক ভূঁইয়া, অনিল মিত্র, আশরাফ উদ্দিন, কালিদাস রায়, মহিউদ্দিন আহমেদ ও আনােয়ারুল আবেদীন সহ আরাে অনেকে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান উপস্থাপনা ছিল অত্যন্ত গতিশীল ও আকর্ষণীয়। অনুষ্ঠান উপস্থাপনায় যারা নিয়ােজিত ছিলেন তারা হলেন আশরাফুর রহমান খান, টি এইচ সিকদার, মােস্তফা আনােয়ার, আশারাফুল আলম, শহীদুল ইসলাম, বাবুল, আবু ইউনুস, মােতাহার হােসেন, মােহসীন রেজা প্রমুখ। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ব্যবস্থাপনার জন্য যাদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল তারা অত্যন্ত একনিষ্ঠতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে বেতার কেন্দ্রকে অত্যন্ত শক্তিশালী ও গতিশীল করে তুলেন। এসব কর্মীবৃন্দ হলেন-আশরাফুল রহমান, মেজবা উদ্দিন, বেলাল উদ্দিন, আলমগীর, টি এইচ সিকদার, তাহের সুলতান, আবদুল্লাহ আল ফারুক, আলী যাকের, আশরাফুল, জাহিদ সিদ্দিকী, শহীদুল ইসলাম, এ কে শামসুদ্দিন ও আবু ইউসুফ। বার্তা বিভাগে যারা কাজ করতেন তাদের মধ্যে ছিলেন কামাল লােহানী, মামুন, এ কে এম জালাল উদ্দিন, সুব্রত বড়ুয়া, মৃনাল, আবুল কাসেম সন্দ্বীপ, রনজিৎ পাল, চৌধুরী হাসান ইসলাম, আলী রেজা, চৌধুরী রায়, নূরুল ইসলাম, শহীদুল ইসলাম, বাবুল আক্তার, আশরাফুল আলম, পারভীন হােসেন, জরীন আহম্মেদ ও ফিরােজ ইফতেখার। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রকৌশল বিভাগে যারা দায়িত্ব পালন করেন তারা হলেন সৈয়দ আব্দুস শাকের, রাশেদুল হােসেন, আমিনুর রহমান, শারফুজ্জামান, প্রনব রায়, রেজাউল করিম ও হাবিবুল্লাহ চৌধুরী। ধর্মীয় অনুষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্বে যারা ছিলেন তারা হলেন, পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত অনুবাদে মৌলানা নূরুল ইসলাম জেহাদী, মৌলানা খায়রুল ইসলাম যশােরী ও মৌলানা ওবায়দুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী, হাবিবুর রহমান। গীতা পাঠে অংশ নিতেন বিনয় কুমার মন্ডল ও জ্ঞানেন্দ্র বিশ্বাস। পবিত্র ত্রিপিটক পাঠ করেন রণধির বড়ুয়া এবং পবিত্র বাইবেল পাঠ করেন ডেভিড প্রণব দাশ। যন্ত্রসঙ্গীতে ছিলেনঃ- সুজেয় শ্যাম, কালাচাদ ঘােষ, গােপী বল্লব বিশ্বাস, হরেন্দ্র চন্দ্র লাহিড়ী, সুব্রত দত্ত, বাবুল দত্ত, অবিনাশ শীল, সুনিল গােস্বামী, তড়িৎ হােসেন খান, দিলীপ দাস গুপ্ত, দিলীপ ঘােষ, জুলু খান, রুসু খান, বাসুদেব দাশ, সমীর চন্দ্র, শতদল সেনসহ আরাে অনেকে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যে সমস্ত নাট্য কর্মী নাট্যানুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতেন তাদের মধ্যে ছিলেনঃ আব্দুল জবার খান, নারায়ণ ঘােষ, কল্যাণ মিত্র, মামুনুর রশীদ, রানেশ কুশরী, হাসান ইমাম, রাজু আহম্মেদ, তােফাজ্জল হােসেন, সুভাষ দত্ত, খান আতাউর রহমান, মাধুরী চট্টোপাধ্যায়,
১৬১
সুমিতা দেবী, নাজমুল হুদা মিঠু, ফিরােজ ইফতেখার, প্রসনজিত বােস, অমিতাভ বসু, জহুরুল হক, ইফতেখারুল আলম, বুলবুল, মহালন বীশ, করুণা রায়, গােলাম রব্বানী, মাসুদ নবী, অমিতা বাবু, সৈয়দ দীপেন, লায়লা হাসান, মুক্তি মহান বীশ, নন্দিতা চট্টোপাধ্যায়, রাশেদুল রহমান, কাজী তামান্না, দিলীপ চক্রবর্তী, দিলীপ বােস, বাদল রহমান, মাজহারুল হক, আসাবুদ্দীন খান, মদন শাহ খান মহিবুর, পূর্ণেন্দ্র সাহা, তােফাজ্জল হােসেন, আসলাম পারভেজ, উম্মে কুলসুম, সুফিয়া খাতুন, তাজিন শাহানাজ মুর্শিদ, দিলশাদ বেগম, ইয়ার মােহাম্মদ, সৈয়দ মােহাম্মদ চাঁদ সহ আরাে অনেকে। একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালি ও মুক্তিযােদ্ধাদের মনােবল এবং প্রেরণা সঞ্চারের জন্য গানের ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয়। যারা গান অথবা কবিতা লিখেছেন তাদের মধ্যে ছিলেনঃ- সিকান্দার আবু জাফর, আব্দুল গাফফার চৌধুরী, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, আসাদ চৌধুরী, টি এইচ সিকদার, সারওয়ার জাহান, মাহবুব তালুকদার, শহীদুল ইসলাম, বেলাল মােহাম্মদ, আবুল কাশেম সন্দ্বীপ, মুস্তাফিজুর রহমান, মােহাম্মদ শাহ বাঙ্গালি, প্রণদিত বড়ুয়া, এস এম আব্দুল গনি বােখারী, মিজানুর রহমান চৌধুরী, নওজেশ হােসেন, গণেশ ভৌমিক, মাকসুদ আলী সাই, সবুজ চক্রবর্তী, বিপ্লব দাস, বিপ্রদাশ বড়ুয়া, রফিক নওশাদ, অধ্যাপক অমিত রায় চৌধুরী, মােঃ রফিকুল ইসলাম, প্রণব চৌধুরী, অরুণ তালুকদার, নাসিম চৌধুরী, কাজী রেজা প্রমুখ। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে সঙ্গীত রচনায় ছিলেনঃ- গাজী মাজহারুল আনােয়ার, গৌর প্রসন্ন মজুমদার, আব্দুল লতিফ, ফজল এ খােদা, গােবিন্দ হাওলাদার, নঈম নওহর, সলিল চৌধুরী, শ্যামল দাস গুপ্ত, ডঃ মােঃ মনিরুজ্জামান, কবি আজিজুর রহমান, হাফিজুর রহমান। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গীত পরিচালনা করেন অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সমর দাস। তার সঙ্গীত পরিচালনা ছিল অত্যন্ত প্রশংসনীয়। সঙ্গীত পরিচালনা ও কণ্ঠদানে আরাে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেনঃ- আব্দুল জব্বার, অজিত রায়, আপেল মাহমুদ, রথীন্দ্রনাথ রায়, মান্না হক, এম এ মান্নান। পুঁথি পাঠে অংশ নেনঃ মােহাম্মদ শাহ বাঙ্গালি । আবৃত্তিতে অতিথি শিল্পী হিসেবে অংশগ্রহণ করেনঃ বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুলের জ্যেষ্ঠ পুত্র কাজী সব্যসাচী। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে যারা আবৃতি ও গান করতেন তাদের মধ্যে ছিলেন ঃ মজিব বিন হক, নিখিল রঞ্জন দাস, শাহ আলী, সানজিদা খাতুন, কল্যানী ঘােষ, অনুপ কুমার ভট্টাচার্য, মনজুর আহম্মেদ, কাদেরী কিবরিয়া, সুবল দাস, হরলাল রায়, এস এম এ গনি বােখারী, শাহীন মাহমুদ, অনিল চন্দ্র দে, অরুপ রতন চৌধুরী, মাের্শেদ আলী, শেফালী ঘােষ, হেনা বেগম, মাফিজ আব্দুর, সম্পা রায়, মালা খান, রুপা খান, মাধুরী আচার্য্য, নমিতা ঘােষ, ইন্দ্ৰোমােহন রাজবংশী, আবু নওশের, রমা ভৌমিক, মনােয়ার হােসেন, অজয় কিশাের রায়, কামাল উদ্দিন, ইকবাল আহম্মেদ, রঞ্জন ঘটক, তােরাব আলী শাহ, লায়লা জামান, বুলবুল মাহলপশ্রীশ, এম এ খালেক, মাকসুদ আলী সাঁই, ফকির আলমগীর, মলয় ঘােষ, মনজুলা দাস গুপ্ত, সুব্রত সেন গুপ্ত, উমা চৌধুরী, মােশাররফ হােসেন, ঝর্ণা ব্যানার্জী, দীপা ব্যানার্জী, সুকুমার বিশ্বাস, অরুণবাবু, প্রবাল চৌধুরী, তােরাব আলী, রফিকুল আলম, কল্যাণ মিত্র, মঞ্জুশ্রী নিয়ােগী, লীনা দাশ, সকিনা বেগম, রেজওয়ানুল হক, অনিল বসু, লীনা, কনা, মহিউদ্দিন খােকা, রিজিয়া সাইফুদ্দীন, রেহানা বেগম, মিহির নন্দী, অমিতা সেনগুপ্ত, ভক্তি রায়, অর্চনা বসু, মােস্তফা ভানুজ, সাধন সরকার, মুজিবর রহমান, মিনু রায়, রিতা চ্যাটার্জী, শান্তি মুখার্জী, জীবন কৃষ্ণ দাস, শিব শংকর রায়, সৈয়দ আলমগীর, ভারতী ঘােষ, শেফালী ঘােষ, স্যান্যাল, মদন মােহন
১৬২
দাস, শহীদ হাসান, অরুণা সাহা, জয়ন্তী ভুইয়া, কুইন, মাহাজিন, মৃনাল, সাফাউন নবী, প্রদীপ ঘােষ, মিহির কর্মকার, শক্তি শিখা দাস, মিহির লালা, গীতশ্রী সেন, গৌরাঙ্গ সরকার, প্রবাল চন্দ্র ঘােষ, শহীদুর রহমান, কাঞ্চন তালুকদার, মুকুল চৌধুরী, মলিনা দাস, জরিনা আহম্মেদ, ইন্দু-বিকাশ রায়, বাসু দেব, পরিতােষ শীল, মিতালী মুখার্জী, মলয় গাঙ্গুলী, তপন ভট্টাচার্য, চিত্ত রঞ্জন ভূঁইয়া, মুক্তি মহালন বীশ, মিহির নন্দী, সামুনাল চৌধুরী, আফরােজা মামুন সহ আরাে অনেকে। সঙ্গীত পরিচালনার কাজে যে দুজন ব্যক্তি সমর দাসকে সহযােগিতা করেন তারা ছিলেনঃ কাজী হাবিবুদ্দীন, রঙ্গলাল দেব চৌধুরী। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রকে গতিশীল করে তুলার জন্য আব্দুল মান্নানের প্রচেষ্টায় দেশবরেণ্য বহু বুদ্ধিজীবীরা নিয়মিত ও অনিয়মিত অনুষ্ঠানের সিরিজে অংশগ্রহণ করেন। নিয়মিত বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ছিলেনঃ সৈয়দ আহসান আলী, ডঃ মাযহারুল ইসলাম, অধ্যাপক আব্দুল হাফিজ, সাংবাদিক রনেশ দাস গুপ্ত, ফয়েজ আহম্মদ, সাদেকিন, আমির হােসেন, এডভােকেট গাজিউল হক, সলিমুল্লাহ, মাহবুব তালুকদার, আব্দুর রাজ্জাক চৌধুরী, বদরুল হাসান, মােহাম্মদ মুসা, নাজিম চৌধুরী সহ আরাে অনেকে। সিরিজ অনুষ্ঠানে অনিয়মিতভাবে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ছিলেনঃ ডাঃ মুজাফফর আহম্মেদ চৌধুরী, ডঃ এ আর মল্লিক, ডঃ আনিসুজ্জামান, ব্যারিষ্টার মওদুদ আহম্মদ, ডঃ বেলায়েত হােসেন, ডঃ এ জি সামাদ, ডঃ অজয় রায়, ডাঃ মাহমুদ শাহ কোরেশী, ডাঃ এ কে এম আমিনুল ইসলাম, জহির রায়হান, সাংবাদিক সন্তোষ গুপ্ত, অধ্যাপক অমিত রায় চৌধুরী, অধ্যাপক নরেন বিশ্বাস, জাহাঙ্গীর আলম, ডাক্তার নুরুন নাহার জহুর, আইভি রহমান, কুলসুম আজাদ, নুরজাহান মাজহার, মুশতারি শফী, মাহমুদা খাতুন, বাসনা গুণ, দিপ্তী লােহানী, রেবা আক্তার, জলি জাহানারা, দীপা ব্যানার্জী, সুকুমার, শওকত আজিজ, পারভীন আক্তার, দিলীপ কুমার ধর, বুলবুল ওসমান, আবদুল জলিল, আবুল মনজুর সহ আরাে অনেকে।
১৯৭১ সালের জুলাই মাস থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধ যেমনি ব্যাপক আকার ধারণ করে তেমনি এসময় থেকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রেও জঙ্গী অনুষ্ঠান চলতে থাকে ব্যাপকভাবে। ইতিমধ্যে বেতার কেন্দ্রের পরিচালক আব্দুল মান্নান তার প্রচেষ্টায় সকল প্রকার শিল্পী, কুশলী, কর্মী সগ্রহ করে একটি সম্পূর্ণ বেতার কেন্দ্রে রূপ দেন। যুদ্ধমান অবস্থায় প্রবাসের মাটিতে অবস্থান করে প্রয়ােজনীয় সংখ্যক জনবল সগ্রহ করা ছিল অত্যন্ত অস্বাভাবিক ব্যাপার। এ ধরনের অস্বাভাবিক কাজকে স্বাভাবিক করা সম্ভব হয়েছে আব্দুল মান্নান সাহেবের একাগ্রতা, ঐকান্তিকতা ও অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে। এই বেতার কেন্দ্র পরিচালনা করতে আব্দুল মান্নানকে বহু বাধা-বিপত্তি ও প্রতিকুলতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। প্রবাসী সরকার প্রতিষ্ঠা হওয়ায় যেমনি একটি কুচক্রী মহল স্বাধীনতা সংগ্রামকে নির্মূল করার ষড়যন্ত্রে মেতে উঠে, তেমনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র পচিালনার ক্ষেত্রেও একটি কুচক্রী মহল বিভিন্ন ধরনের চক্রান্ত শুরু করে। মার্কিন অর্থে পুষ্ট বুদ্ধিজীবীদের চক্রান্তে জুলাই মাসের শেষের দিকে বেতার কর্মীরা ধর্মঘট করে। এই ধর্মঘট শুধুমাত্র আব্দুল মান্নানের মতাে দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ব্যক্তির কারণেই অতি দ্রুত নিষ্পত্তি ঘটে। একাত্তরের জুলাই মাস থেকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র এমন কতগুলাে অনুষ্ঠান শুরু করে যা বাঙ্গালির মনে জাগরণ সৃষ্টি করে। এই সময়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নিয়মিত অনুষ্ঠান সিরিজে অন্যতম প্রধান আকর্ষণ ছিল প্রতিনিধির কণ্ঠ। প্রতিনিধির কণ্ঠে নিয়মিতভাবে প্রবাসী সরকারের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের ভাষণ প্রচার করা হত। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী
১৬৩
রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহম্মেদ, অর্থমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণ প্রচারিত হত। আরাে যাদের বক্তব্য প্রচারিত হত তারা হলেন মুক্তি বাহিনীর প্রধান সেনাপতি কর্ণেল আতাউল গণি ওসমানি, আব্দুল মান্নান, জিলুর রহমান, আবদুল মালেক উকিল, মিজানুর রহমান, অধ্যাপক ইউসুফ আলী, সৈয়দ সুলতান, মােহাম্মদ খালেদ, বেগম বদরুননেসা আহমেদ, নুরুল হক, অধ্যক্ষ হান খালিদ, শামসুর রহমান খান শাহজাহান, অধ্যাপক আবু সাঈদ, শামসুদ্দিন মােল্লা, মােস্তাফিজুর রহমান, মনসুর আহম্মেদ, শাখাওয়াত উল্লাহ, ডাক্তার সাইদুর রহমান ও নাজিদিন। ছাত্র নেতাদের মধ্যে যাদের ভাষা প্রচারিত হত তারা হলেন নুরে আলম সিদিকী, শাহজাহান সিরাজ, আ স ম আব্দুর রব, আব্দুল কুদুস মাখন, এম এ রেজাসহ আরো অনেকে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র নেতৃবৃন্দের প্রচারিত ভাষণ সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালি ও মুক্তিযােদ্ধাদের মনে সঞ্চার করেছিল আশার আলাে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত এম আর আকার মুকুলের প্রমপত্র পাঠ ছিল উদ্দীপনামূলক ও জাগরণী অনুষ্ঠান। এই ব্যঙ্গাত্মক অনুষ্ঠানটি বাঙ্গালিদের সেই দুদিনে দুঃসময়ে মনে হাসির উদ্রেক সৃষ্টি কত। লিখতেন এবং পাঠ কতেন এম আর আক্তার মুকুল। আর এই অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করেছিলেন আব্দুল মান্নান। সমপত্র গড়া আরাে বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠান নিয়মিত প্রচারিত হত। এ সমস্ত অনুষ্ঠানের মধ্যে ছিল অশিখি, রক্ত সাগৰ, বিশ্ব জনমত, দর্পন প্রভৃতি। যার মহান নেতৃত্ব পরিকল্পনা এবং পথ নির্দেশনা স্বাধীন বাংলা বেতার কর্মীদের দিয়েছে জঙ্গী অনুষ্ঠান প্রচারে সঠিক অনুপ্রেরণা, তিনি ছিলেন যুদ্ধকালীন অস্থালী বিপ্লবী সরকারের প্রেস, তথ্য, বেতার ও ফিল এর ভারপ্রাপ্ত এম এন এ আব্দুল মান্নান। বেতার কেন্দ্রের শিল্পী,কী সবার কাছে একটি পরিচিত নাম মান্নান ভাই, নামটি ছিল সবার কাছে অতি প্রিয়। প্রবাসী সরকারের ৫০ কিলােওয়াট শক্তিসম্পন্ন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে পরিচালনার সার্বিক দায়িত্ব ন্যাস্ত ছিল তার উপর। যুদ্ধকালীন এই প্রতিষ্ঠানকে যদি উল মহাসদ্র টহলরত একখানা কবীর সঙ্গে তুলনা করা হয় এবং যদি বলা হয় স্বাধীন বাংলা বেতার কে এক একজন শব্দ সৈনিক এবং তথ্য প্রেস, বেতার ও ফি-এ একজন কর্মী ছিলেন এই তরীর নাবিক, তবে নিঃসন্দেহে আব্দুল মান্নান ছিলেন এরই সুযােগ্য কাভারী। আব্দুল মান্নানের কাছ থেকে সেদিনের উত্তাল মহাসদ্র অভিযানে বেতার কেন্দ্রের শিল্পী কর্মীরা পেয়েছে সার্বক্ষণিক অনুপ্রেরণা এবং পথ নির্দেশ বেতার কেন্দ্র পরিচালনার ক্ষেত্রে অনেকেই বিভিন্ন ভাবে সহযােগিতা করেছে। তবে এদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ভূমিকা রাখেন বঙ্গবন্ধুর অকালীন প্রেস সেক্রেটারী আমিনুল হক বাদ। বলার অপেক্ষা রাখেনা যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এই বেতার কেন্দ্রের শব্দ সৈনিকা সাড়ে সাত কোটি মুক্তিকামী স্বাধীনতা প্রিয় বাঙ্গালির মনােবলকে অক্ষুন্ন রেখেছে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ক্ষুরধার প্রচার মুক্তিযুদ্ধকে করেছে গতিশীল । এগিয়ে নিতে সর্বাত্মকভাবে সাহায্য করেছে মুক্তিযুদ্ধের গতিকে। এই বেতার কের প্রতিটি শব্দ ইথার ভেদ করে বেরিয়ে এসেছে এক একটি বুলেট হয়ে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইউনিট গুলাে এবং শত্রু কবলিত এলাকার সঙ্গে যােগসূত্র বজায় রেখেছে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। এ বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণার বার্তা প্রথম প্রচারিত হওয়ার এক ঘন্টাকালের মধ্যে বিবিসি এবং
১৬৪
ভয়েস অব আমেরিকাসহ বিশ্বের বহু বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সংবাদ বিশ্ববাসীর কাছে ছড়িয়ে পড়ে। সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালি যখন পাকিস্তানী খুনী বাহিনীর কবলে পড়ে মৃত্যুর দিন গুনছিল ঠিক তখনি প্রতিষ্ঠা লাভ করে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। এই বেতার কেন্দ্র দীর্ঘ নয় মাস ধরে অমিত তেজ ও তেজস্বিনী ভাষা আর দৃপ্ত কণ্ঠে জঙ্গী অনুষ্ঠান প্রচারের মাধ্যমে বাংলা ও বাঙ্গালির অতন্দ্র প্রহরী মুক্তিযােদ্ধাদের সার্বক্ষণিক অনুপ্রেরণা দিয়ে, শক্তি দিয়ে, সাহস দিয়ে, দিশেহারা মুক্তিকামী বাঙ্গালিকে বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিয়েছে। বিশ্বের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে এত বড় অবদান আর কোন বেতার কেন্দ্র রাখতে পেরেছে কিনা তা আমাদের জানা নেই। সত্যি সত্যি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালির অগ্রদূত হিসেবে এ দেশের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। আর এই কৃতিত্বের একক দাবীদার আব্দুল মান্নান।
মুজিবনগর সরকারের অর্থসচিব খন্দকার আসাদুজ্জামান
বাংলার স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে খন্দকার আসাদুজ্জামান একটি অবিস্মরণীয় নাম। স্বাধীনতা যুদ্ধে অত্যন্ত কৃতিত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন তিনি। তার বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা জাতি চিরদিন স্মরণ করবে। সরকারী উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত থেকেও খন্দকার আসাদুজ্জামান মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহন করেছেন। মুজিবনগর সরকারের অর্থসচিবের দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে স্বাধীনতা যুদ্ধকে এগিয়ে নিয়ে যেতে আপ্রাণ চেষ্টা চালান। রাষ্ট্রের প্রশাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে অর্থবিভাগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ।এই বিভাগের মাধ্যমেই রাষ্ট্রের সমস্ত প্রশাসনিক বিভাগকে সচল রাখা হয়। আর এ ধরনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের দায়িত্ব পালন করেন খন্দকার আসাদুজ্জামান। তাও আবার প্রবাসের মাটিতে, যার নেই কোন অর্থ কড়ি। বিদেশের মাটিতে বসে তহবিলহীন অবস্থায় অর্থমন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের সমস্ত দিক সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হয়েছে খন্দকার আসাদুজ্জামানের দক্ষতা এবং একনিষ্ঠতার জন্য। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিলের আগে স্বাধীন বাংলাদেশের কোন সংগঠিত সরকার ছিল না। কাজেই কোন মন্ত্রণালয় থাকার প্রশ্নই আসে না। সরকার গঠন এবং অভিষেক অনুষ্ঠানের পর বৈধ সরকারের কাজ শুরু হয়। যেহেতু একটি সরকারের প্রাণকেন্দ্র সচিবলায় সেহেতু দ্রুত সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। সচিবালয় প্রতিষ্ঠা হবার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের বৈধতা বৃদ্ধি পায় এবং সচিবালয় চালুর ফলে মুজিবনগর সরকারের কর্মকান্ড দ্রুতগতিতে চলতে থাকে। শূন্য হাতে শুরু করলেও মুজিবনগর সরকারের হাতে বেশ কিছু পরিমাণ মুদ্রা জমা হয়। ব্যাংক কর্মকর্তা ও সংগ্রামী জনতা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ব্যাংক ট্রেজারী থেকে এই মুদ্রা নিয়ে আসে। এই সমস্ত জমাকৃত মুদ্রা থেকেই মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে কিছুদিন কর্মকর্তাদের সামান্য কিছু কিছু বেতন দেয়া হতাে। শুধু মাত্র যারা মুজিবনগর সরকারে কর্মরত ছিলেন তাদেরই বেতন দেয়া হত না, যারা পূর্বপাকিস্তানে সরকারী চাকরীতে নিয়ােজিত ছিলেন অথচ মুজিবনগরে সরকারী চাকরীতে নিয়ােজিত নেই তাদেরকেও বেতনের অর্ধেক, ভাতা হিসেবে দেয়া হত। কিন্তু পাকিস্তান সরকার একশ ও পাঁচশ টাকার নােট অচল ঘােষণা করায় মুজিবনগর সরকারের কাছে জমাকৃত প্রচুর নােট
১৬৫
অকেজো হয়। ইতিমধ্যে কোলকাতায় অবস্থিত পাকিস্তান মিশনের প্রধান হােসেন আলী বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করেন এবং তিনি হাইকমিশনের সাত লাখ টাকা মুজিবনগর সরকারের নিকট হস্তান্তর করেন। সে টাকা অর্থ মন্ত্রণালয়ে জমা হয়। অর্থ-মন্ত্রণালয়ের প্রধান কাজ ছিল সরকারী অর্থের হিসাব রক্ষা করা এবং সরকারী অর্থের অডিট করা। মুজিবনগর সরকারের প্রধান কাজ ছিল দুটি। (১) যুদ্ধ করা। (২) শরণার্থীদের দেখাশােনা করা। অর্থমন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ছিল ভারতীয় সরকারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষা করে শরণার্থীদের জন্য সাহায্যের ব্যবস্থা করা। এই সাহায্য ছিল প্রধানতঃ ভারতীয়। কিন্তু রিলিফ ক্যাম্পগুলাে ছিল আওয়ামী লীগ নেতাদের হাতে। মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায় ছিল মুক্তিযযাদ্ধাদের গড়ে তােলা। যুবকদের প্রশিক্ষণ দান ছিল এই কর্মসূচীর প্রধান অংশ। এর জন্য অনেকগুলাে যুব শিবির খােলা হয়। এই সমস্ত শিবিরের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য যুব নিয়ন্ত্রণ বাের্ড’ গঠন করা হয়। লাখ লাখ যুবক বিভিন্ন যুব শিবিরে এসে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। ভারতীয় সরকার মুক্তিযোেদ্ধাদের সমস্ত খরচ বহন করলেও যুব শিবিরের ব্যয় তারা বহন করত না। কাজেই এই শিবিরগুলােকে মুজিবনগর সরকারের অর্থে চালাননা হাত। শিবির এলাকা থেকে চাঁদা সংগ্রহ করতাে। কিন্তু সমস্ত খরচ ফাইনানসিয়াল’ রুল অনুযায়ী হত। একটি প্রতিষ্ঠিত সরকার যে নিয়মে তার টাকা বরাদ্দ ও খরচ করে, মুজিবনগর সরকারের অর্থমন্ত্রণালয়ও সেই ভাবেই করতাে। সরকারী কর্মচারীদের বেতন এই মন্ত্রণালয় হতেই দেয়া হত এবং কর্মচারীদের সর্বোচ্চ বেতন ছিল পাঁচশ টাকা। যুদ্ধের খরচের ব্যাপারে সরাসরি সিদ্ধান্ত নিত মন্ত্রী পরিষদ। এটি মন্ত্রণালয়ের বিষয় ছিলাে না। জেনারেল এডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিল গঠন ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এই আঞ্চলিক প্রশাসন এলাকাগুলাে যেমন সেই এলাকার সমস্ত দায়িত্ব বহন করতাে তেমনি এদের প্রায় সমস্ত অর্থ যােগানের দায়িত্ব ছিল অর্থ মন্ত্রণালয়ের। নগণ্য টাকা দিয়ে খন্দকার আসাদুজ্জামান, মুজিবনগর সরকারের অর্থ সচিবের দায়িত্ব যে রকম সুষ্ঠুভাবে পালন করেছিলেন তা নিষ্ঠার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত থাকবে। মুজিবনগর সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয় কিছু কিছু এলাকায় সীমিতভাবে ব্যবসা বাণিজ্য চালু রাখার ব্যবস্থা করে। এর একটি কারণ ছিল হানাদারদের জানানাে যে মুক্তিযােদ্ধারা ক্রমে ক্রমে প্রশাসন দখল করে নিচ্ছে। এছাড়া বেসরকারী কোন সংগঠনে বা কোন দলের হাতে ক্ষমতা যাতে না যায় তার জন্যও পদক্ষেপ নেয়া হয়। অর্থ সগ্রহের জন্য জেনারেল এডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিলগুলােকে কিছুটা স্বাধীনতা দেয়া হত। এই সঙ্গে এটাও লক্ষ্য রাখা হত যে, অন্য কোন সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান যেন চাঁদা আদায়ের অভিযান না চালায়। কেবল মাত্র তাদের চাঁদা আদায়ের অধিকার ছিল এবং তারাই সে অর্থ সঠিকভাবে ব্যবহার করবে। দেশের যে সব এলাকায় বিচ্ছিন্নভাবে মুক্ত ছিল সেখানেও মুক্তিযােদ্ধারা চাঁদা আদায় করত। চাঁদা আদায় করা হত আন্তরিকতার সঙ্গে। সাধারণ মানুষ মুক্তিযুদ্ধের জন্য চাঁদা দিতে নিজেরাই এগিয়ে এসেছে। জেনারেল এডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিল তাদের পূর্ণ স্বাধীনতা ভােগ করত। কেউ স্বাধীনভাবে কাজ করতে না পারলে তাদের জন্য অসুবিধার সম্মুখীন হতে হত। প্রায় সব ধরণের সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার তাদের ছিল। মুজিবনগর সরকার পরিচালনা করা হতাে নিজের শক্তি ও সামর্থের উপর। মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে ভারত সরকারের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত আনুষ্ঠানিক এবং
১৬৬
প্রয়ােজনভিত্তিক। সরাসরি কোন প্রকার যােগাযােগ সহজে হত না। লিয়াজোঁ অফিসারের মাধ্যমে মুজিবনগর সরকারের কাজ সম্পন্ন হয় এবং প্রয়ােজনীয় তথ্য আদান-প্রদান করা হত। মুক্তিযুদ্ধে সহস্র সৈন্যদের বা যােদ্ধাদের কার্যক্রমের পাশাপাশি বেসামরিক প্রশাসনিক কর্মকর্তারা একটি সক্রিয় সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য সচেষ্ট ছিলেন যাতে প্রয়োজনের সময় দেশের জন্য একটি কার্যকরী সরকার তৎক্ষণাৎ চালু করা যায়। সমস্ত টাকা পয়সা আদান প্রদান করা হত চেকে মাধ্যমে। মুজিবনগর সরকাৱেৰ অধীনে প্রায় এক হাজারের বেশি কর্মকর্তা ছিল। তাদের টাকা পয়সা বিশেষ ব্যবস্থার মাধ্যমে ব্যাংকেও রাখা হত। এই মুজিবনগর সরকারের অধীনে অর্থ মন্ত্রণালয় ১৯৭২ সালের বাজেট প্রস্তুত করে রাখেন যা আর পরবর্তীতে প্রয়োজন হয়নি। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে যে পরিমাণ অর্থ জমা ছিল তা দিয়ে দুবছর চালানাে যেতাে। এরপর হয়তাে নতুন অর্থ সংগ্রহের প্রয়ােজন হত। অর্থ মন্ত্রণালয়ের এই সফলতার জন্য অনেকটা কৃতিত্বের দাবীদার খন্দকার আসাদুজ্জামান।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি খন্দকার আসাদুজ্জামান কিছু দিন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বিশেষ কারণেই ই প্ৰালয় প্রতিষ্ঠা অত্যন্ত জরুরী হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের অভ্যন্তর থেকে সংবাদ আনা এবং তা মন্ত্রীপরিষদের নিকট পেশ করা, বিদেশে মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধি পাঠানাের ব্যাপারে তরকার ও অন্যান্য বিদেশী সরকারের সঙ্গে যােপাযােগ সৃষ্টি করার প্রয়ােজনীয়তা দেখা দিল। মুজিবনগর সরকার ইতিমধ্যে বহির্বিতে জানিয়ে দিয়েছেন যে, বাংলাদেশের যে কোন জায়গায় বিদেশীদের যেতে হলে মুজিবনগর সরকারের কাছ থেকে ভিসা নিতে হবে এবং এই উদ্দেশ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি ইমিগ্রেশন এবং পাসপাের্ট অফিসও খােলা হল। তার সমস্ত দায়িত্ব পালন করার জন্য খন্দকার আসাদুজ্জামানকে অর্থ সচিবের পাশাপাশি সবি নিযুক্ত করা হয়। তাকে সাহায্য করার জন্য উপসচিব হিসাবে নিযুক্ত করেন মােঃ কামরুজ্জামান চৌধুরীকে। শ্ৰী জ্ঞানরঞ্জন সাহা, শ্রী ডি কে নাথ, গােলাম আকবরসহ বেশ কয়েকজনকে আন্ডার সেক্রেটারী হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। পরিস্থিতি সম্পর্কে সাপ্তাহিক, পাক্ষিক এবং দৈনিক বিবরণী দ্বীপরিষদের নিকট পেশ করা হতে লাগল। ইন্টেলিজেন্স রিপাের্ট এবং সঙ্গে বুদ্ধিমত্তা এবং আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিবরণীও যেতে লাগল। এই মন্ত্রণালয়ের কর্মচারীর সংখ্যা ছিল প্রায় চারশর মত। খন্দকার আসাদুজ্জামানের পক্ষে এক সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ দুটি মন্ত্রণালয়ের দামিতার সুভাবে পরিচালনা করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। তাই তখন এম এ খালেককে স্বরাষ্ট্র সচিবের পদে নিয়ােগ দান করা হয়। খন্দকার আসাদুজামান শুধু মুজিবনগর সরকারের অর্থ সচিবের দায়িত্ব পালনের মাধ্যমেই মুক্তিযুদ্ধে তার ভূমিকা সীমাবদ্ধ রাখেননি। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নেই অংশগ্রহণ করে মুক্তিযােদ্ধাদের সুসংগঠিত এবং হানাদারদের তিনি বিভিন্ন স্থানে প্রতিরােধের ব্যবস্থা করেন। যুদ্ধ শুরু হবার আগে তিনি ছিলেন রাজশাহী জেলা প্রশাসক। ১৯৭১ সালে বিভাগের যুগ্মসচিব হিসেবে নিয়ােগ করা হয়। তিনি বদলি হয়ে ঢাকা এসে সার্কিট হাউজে উঠেন এবং দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে খােজ খবর নিতে থাকেন। ১৯৭১ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারী কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পরিষদ ভেঙ্গে দেয়ার পর তার মনে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা হয়। এতে তিনি বুঝতে পারেন দেশের অবস্থা খুবই খারাপের দিকে চলে যাচ্ছে। সংসদ অধিবেশন স্থগিত করে দেয়ায় তিনি তখন নিশ্চিত হন যে, রাজনৈতিক দুর্যোপ অতি নিকটে। এই সময় যে
১৬৭
গণআন্দোলন হয় তাতে দেশের সর্বস্তরের লােক কোন না কোনভাবে ভূমিকা পালন করতেন। খন্দকার আসাদুজ্জামানও একজন সচেতন নাগরিক এবং একটি রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান হিসেবে এ মুহূর্তে কি ধরণের ভূমিকা রাখতে পারবেন তা ভাবতে থাকেন। পরিস্থিতি ক্রমশই জটিলতার দিকে ধাবিত হতে দেখে তিনি আরাে কিছু সরকারী কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি বৈঠক করেন। এই বৈঠক হয় সালাউদ্দিন সাহেবের বাসায়। উক্ত বেঠকে উপস্থিত ছিলেন সালাউদ্দিন, মুজিবুল হক সহ আরাে বেশ কয়েকজন সি এসপি অফিসার। বৈঠকে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে ব্যাপক আলােচনা করা হয়। ঢাকা, জয়দেবপুর, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সৈন্যরা গুলি করে মানুষ হত্যা করে এবং এমডি সােয়াতে অস্ত্র আনাতে পাকিস্তানী সরকারের কুমতলব সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠে। এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে খন্দকার আসাদুজ্জামান ১৯৭১ সালের ২৩শে মার্চ তার গ্রামের বাড়ী টাঙ্গাইল চলে যান। সেখানে গিয়ে তিনি আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করেন। ২৪শে মার্চ তার শ্যলিকা ঢাকা ছেড়ে আসে এবং তাকে জানায় যে, ঢাকা একটি যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। ২৫শে মার্চ আলােচনা ভেঙ্গে যায়। ২৬শে মার্চ তিনি টাঙ্গাইল বসেই ঢাকার বিভিন্ন ঘটনার সংবাদ জানতে পারেন। সংবাদ পাওয়ার পর ২৬শে মার্চ সকালেই তিনি টাঙ্গাইলের সকল রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে আলােচনায় বসেন এবং আগামী দিনের কর্মসূচী সম্পর্কে প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। ঐ দিনই টাঙ্গাইল জেলা সর্বদলীয় সগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। আর এই সগ্রাম পরিষদের পরামর্শদাতা হিসেবে খন্দকার আসাদুজ্জামানকে উপদেষ্টা নির্বাচিত করা হয়। সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হওয়ার পর টাঙ্গাইলের মুক্তিযােদ্ধাদের সংগঠিত করার কাজ অত্যন্ত দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলে। খন্দকার আসাদুজ্জামান এলাকার মুক্তিযােদ্ধাদের দুটি ভাগে বিভক্ত করার পরামর্শ দেন। যাদের সামরিক প্রশিক্ষণ আছে তাদের এক দিকে, অন্যদিকে প্রশিক্ষণবিহীনদের। এই প্রশিক্ষণবিহীনদের তাড়াতাড়ি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে বলেন। ইতিমধ্যে টাঙ্গাইলের পুলিশ ও আনসারদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য আহবান জানাননা হয়। এই আহবানে সাড়া দিয়ে টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক ও পুলিশের এস পি সহ বহু পুলিশ ও আনসার মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য এগিয়ে আসে। খন্দকার আসাদুজ্জামানের লিখিত আদেশের পর জেলা ট্রেজারী হতে সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র মুক্তিযোেদ্ধাদের হাতে তুলে দেন। তিনি এলাকার সর্বোচ্চ কর্মকর্তা হিসেবে ট্রেজারীর দায়িত্বে নিয়ােজিত অফিসারকে ঐ আদেশ দেন। মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে অস্ত্রশস্ত্র জমা হবার সংবাদ পাবার পর টাঙ্গাইলের জনতার মধ্যে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য প্রতিযােগিতা শুরু হয়ে যায়। হাজার হাজার ছাত্র যুব সংগ্রাম পরিষদের অফিসের সামনে ভিড় জমাতে শুরু করে যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য। মুক্তিযােদ্ধাদের সংখ্যাবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে শিবির খােলার ব্যবস্থা করা হয়। এই সমস্ত শিবিরে মুক্তিযােদ্ধাদের সামরিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। সামরিক প্রশিক্ষণের নেতৃত্ব দেন বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী ও আবু মােহাম্মদ এনায়েত করীম। তার বেশ কিছুদিন আগে থেকেই মওলানা মােহাম্মদ আলী কলেজ মাঠে টাঙ্গাইলের ছাত্র যুবকদের সামরিক প্রশিক্ষণ দিচ্ছিলেন। মুক্তিযােদ্ধাদের সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে সমস্যা দেখা দেয় অস্ত্রের। যে পরিমাণ মুক্তিযােদ্ধার সংখ্যা বাড়তে থাকে দিনের পর দিন, কিন্তু সেই পরিমাণ অস্ত্র টাঙ্গাইল পরিষদের হাতে নেই। নেতৃবৃন্দ অস্ত্রের সন্ধানে বাইরে যান। এর মধ্যে সংবাদ পাওয়া যায় জেলা সদরে বেঙ্গল
১৬৮
রেজিমেন্টের বেশ কিছু সৈন্য আছে এবং তাদের কাছে অস্ত্রশস্ত্রও আছে। সংবাদ পাবার পর তাদের সঙ্গে যােগাযােগ করা হলে বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙ্গালি সৈন্যরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের আশ্বাস দেন। তারা বলেন যে, তাদের উপর একটা ভূয়া আক্রমণ করলে তারা মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গে চলে আসবে। এমন অবস্থার মধ্যে বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে বেঙ্গল রেজিমেন্টের উপর আক্রমণ করার সঙ্গে সঙ্গেই বাঙ্গালি রেজিমেন্টের সৈন্যরা আত্মসমর্পন করে মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে যােগদান করে। আর পাঞ্জাবী অফিসারদের বন্দী করে পরবর্তীতে তাদের হত্যা করা হয়। এ সময়ে মেজর শফীউল্লাহ জয়দেবপুর থেকে বাঙ্গালি সৈন্যদের নিয়ে বের হয়ে আসেন। তিনি টাঙ্গাইল আসার পর বেশী সময় এখানে না থেকে ময়মনসিংহের দিকে চলে যান। শফীউল্লাহকে পাবার পর টাঙ্গাইলের মুক্তিযযাদ্ধাদের মধ্যে প্রচণ্ড উৎসাহ উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়। কিন্তু তিনি তার সৈন্য নিয়ে ময়মনসিংহের দিকে অগ্রসর হলে টাঙ্গাইলের মুক্তিযােদ্ধাদের মনে কিছুটা হতাশা দেখা দেয়। হতাশাজনক অবস্থার মধ্যে মুক্তিযােদ্ধাদের শক্তিশালী করে তােলার জন্য খন্দকার আসাদুজ্জামান ঝড়ের বেগে বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ান, অস্ত্র এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যােদ্ধাদের জন্য ময়মনসিংহ যান। সেখানে তিনি আওয়ামী লীগ নেতা রফিক উদ্দিন ভূইয়া, সৈয়দ আব্দুস সুলতানসহ বেশ কয়েকজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির সঙ্গে বৈঠক করেন জেলা প্রশাসকের বাসায়। তখন ময়মনসিংহের সরকারী কর্মকর্তা ছিলেন হাসান আহমদ ও সিরাজ উল্লাহ। এই আলােচনা সভায় খন্দকার আসাদুজ্জামান টাঙ্গাইলের পরিস্থিতি সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেন। তিনি আলােচনা করে ময়মনসিংহ থেকে কিছু ইপিআর নিয়ে আসেন। ইপিআর বাহিনীর জোয়ানদের সঙ্গে নিয়ে আসাদুজ্জামান টাঙ্গাইল পৌছলে সেখানকার মুক্তিযােদ্ধাদের সাহস আবার ফিরে আসে। সিরাজগঞ্জ থেকে সেখানকার এসডিও এ কে শামসুদ্দিন আসেন টাঙ্গাইলে কিছু অস্ত্রের জন্য। তিনি টাঙ্গাইলের নেতৃবৃন্দকে জানান, তার এলাকার জনগণ মুক্তিযুদ্ধের জন্য ব্যাপকভাবে সংগঠিত হচ্ছে কিন্তু তাদের অস্ত্রের খুবই অভাব। তার আলােচনার পরিপ্রেক্ষিতে সগ্রাম পরিষদকে ৫০টি অস্ত্র সিরাজগঞ্জের জন্য দেয়ার নির্দেশ দেন। ইপিআরদের সঙ্গে নিয়ে খন্দকার আসাদুজ্জামান টাঙ্গাইল থেকে ঢাকার দিকে এগিয়ে মির্জাপুর যান। সেখানে জাতীয় পরিষদ সদস্য ব্যারিষ্টার শওকত আলী খান ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য ফজলুর রহমান খান ফারুকসহ স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলাপ আলােচনা করেন। এখানে আলােচনার পর সিদ্ধান্ত নেয়া হয় হানাদারদের প্রতিরােধ করতে হবে মির্জাপুরে যে কোন স্থানে। সিদ্ধান্ত নেয়া হয় মির্জাপুর হাসপাতাল ও ভারতেশ্বরী হােমসের মেয়েদের ছুটি দিয়ে বাড়িতে পাঠানাের। এর কয়েকদিন আগে থেকেই মির্জাপুরের মুক্তিযােদ্ধারা বিভিন্ন স্থানে প্রতিরােধের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে থাকেন। এর সঙ্গে টাঙ্গাইলের মুক্তিযােদ্ধারাও এগিয়ে এসে অংশগ্রহণ করে। হানাদারদের প্রতিরাধের জন্য চূড়ান্ত প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয় মির্জাপুর থানার গােড়ান সাটিয়াচড়া নামক স্থানে। স্থানটি টাঙ্গাইল জেলা সদর থেকে ১২ মাইল দক্ষিণে এবং ঢাকা থেকে ৪৮ মাইল উত্তরে। এখানে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের দুপাশে বাংকার করা হয়। ইপিআর সৈন্যরা গােড়ান সাটিয়াচড়াতে তাদের আস্তানা গেড়ে হানাদারদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। স্থানীয় এবং টাঙ্গাইলের মুক্তিযােদ্ধারা বিভিন্ন ভাবে সহযােগিতা করতে থাকে। ১৯৭১ সালের ৩রা এপ্রিল গােড়ান সাটিয়াচড়াতে হানাদারদের সঙ্গে মুক্তিযােদ্ধাদের প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে প্রায় সাড়ে তিনশ হানাদার নিহত হয় এবং বহু আহত হয়। এখানে মুক্তিযােদ্ধারা প্রচণ্ড ক্ষগ্রিস্ত
১৬৯
হয়। ইপিআরসহ প্রায় ৩০ জনের মত মুক্তিযােদ্ধা শহীদ হয় এবং প্রায় শতাধিক গ্রামবাসীকে হত্যা করা হয়। সাড়ে সাত ঘন্টা যুদ্ধ করার পর মুক্তিযােদ্ধাদের গােলাবারুদ শেষ হয়ে যায় এবং বেশ কয়েকটি অস্ত্র নষ্ট হয়ে যায়, যার জন্য তারা পিছু হটতে বাধ্য হন। পাক সৈন্যরা দ্রুত গতিতে টাঙ্গাইলের দিকে অগ্রসর হয়। বিনা বাধায় হানাদার বাহিনী টাঙ্গাইল শহরে প্রবেশ করে। হানাদাররা আসার পথে গােড়ান সাটিয়াচড়া থেকে টাঙ্গাইল পর্যন্ত ১২ মাইল রাস্তার দুই পাশের সমস্ত গ্রাম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয় এবং বহু মানুষ হত্যা করে টাঙ্গাইল শহরে প্রবেশ করে। গােড়ান সাটিয়াচড়ার যুদ্ধে আসাদুজ্জামান অত্যন্ত সাহসিকতা পূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি ২রা এপ্রিল থেকেই ইপিআরদের খাওয়া দাওয়াসহ সকল প্রকার দেখাশােনায় ব্যস্ত থাকেন। সৈন্যদের যাতে কোন প্রকার অসুবিধা না হয় তার জন্য তিনি ছিলেন অত্যন্ত সজাগ। যুদ্ধ শুরু হলে তিনি নিজেই অন্যান্য সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের সঙ্গে গিয়ে অস্ত্রশস্ত্র যুদ্ধক্ষেত্রে পৌছে দেয়ার ব্যবস্থা করেন। বেসামরিক বিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হয়েও সেদিন তিনি একজন সশস্ত্র সৈনিকের মত যুদ্ধক্ষেত্রের তদারকি করেছেন। হানাদার সৈন্যরা টাঙ্গাইল শহরে প্রবেশ করার পর সগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে শহর থেকে গ্রামে চলে যান। শহরে প্রবেশ করেই হানাদার সৈন্যরা খন্দকার আসাদুজ্জামানের বাড়িটি ডিনামাইট দিয়ে গুড়িয়ে দেয় এবং তার খোঁজে তার শশুর বাড়ি ও মামার বাড়িতে যায়। খন্দকার আসাদুজ্জামান টাঙ্গাইল শহর থেকে তার নিজ এলাকা গােপালপুরে চলে যান এবং সেখানে মুক্তিযােদ্ধাদের সংগঠিত করতে থাকেন। গােপালপুরে হানাদার সৈন্যরা প্রবেশ করেই খন্দকার আসাদুজ্জামানের খোঁজ করে এবং তাকে ধরার জন্য তৎপরতা চালায়। হানাদার সৈন্যদের গােপালপুরে পৌছার সংবাদ পাবার পর আসাদুজ্জামান খাওয়া হতে উঠে বাড়ির পেছন দিক দিয়ে বের হয়ে যান। বাড়ি হতে বের হয়ে তিনি বহু কষ্টে ১৫ মাইল রাস্তা পায়ে হেঁটে যমুনা নদী পাড়ি দিয়ে সিরাজগঞ্জে উপস্থিত হন। তিনি এখানে এসে মুক্তিযােদ্ধাদের সংগঠিত করার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন। শুধুমাত্র সিরাজগঞ্জই না, বগুড়া-রংপুর সহ উত্তরবঙ্গের মুক্তিযােদ্ধাদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে খন্দকার আসাদুজ্জামানের অত্যন্ত প্রশংসনীয় ভূমিকা আছে। তাকে সঙ্গে পেয়ে সিরাজগঞ্জ, পাবনা, বগুড়ার মুক্তিযােদ্ধারা প্রতিরােধ ব্যবস্থা আরাে শক্তিশালী করে তুলেন। সিরাজগঞ্জে পৌছেই তিনি সংবাদ পান যে, তার পৈতৃক বাড়ি ধ্বংস করে দিয়েছে হানাদার বাহিনীরা। সিরাজগঞ্জ, পাবনা, বগুড়ার পতন হওয়ার পর খন্দকার আসাদুজ্জামান তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে অত্যন্ত অমানবিক কষ্ট করে জয়পুরহাট এবং হিলি হয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে পৌছান। পশ্চিমবঙ্গে পৌছে তিনি মালদহ জেলার ডিসি’র সঙ্গে দেখা করেন এবং সেখানেই সংবাদ পান আরাে কিছু নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ভারতে আসছেন। এখান থেকে তিনি কলকাতা যান এবং সেখানে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ ও কামরুজ্জামানের সঙ্গে দেখা করেন। তাদের সঙ্গে দেখা করে সরকার গঠনের ব্যাপারে আলাপ-আলােচনা করেন। আলােচনার পর নেতৃবৃন্দ খন্দকার আসাদুজ্জামান ও নূরুল কাদের খানকে একটি সরকারের কাঠামাে তৈরি করার দায়িত্ব দেন। সরকার গঠনের ক্ষেত্রে খন্দকার আসাদুজ্জামান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের অপরাধে পাক সরকার খন্দকার আসাদুজ্জামানকে ১৪ বছরের সশ্রম কারাদন্ড প্রদান করে। তার সঙ্গে আরাে ১২ জন সি. এস. পি. অফিসারের বিচার করে একই
১৭০
মেয়াদের কারাদণ্ড প্রদান করে। সঙ্গে সঙ্গে দণ্ডিত অফিসারদের সম্পত্তির ৫০ ভাগ বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দেন। মুক্তিযুদ্ধে খন্দকার আসাদুজ্জামানের গৌরবােজ্জ্বল ভূমিকা স্বাধীনতা সগ্রামের ইতিহাসে সােনালী অক্ষরে চিরদিনের জন্য লেখা থাকবে।
ইন্দোনেশিয়ায় আবুল ফজল শামসুজ্জামান
বীর মুক্তিযােদ্ধা আবুল ফজল শামসুজ্জামান ১৯৭১ সালে ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তায় পাকিস্তান দূতাবাসের বাণিজ্য প্রতিনিধি ছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বিদেশের মাটিতে অবস্থান করে তিনি অত্যন্ত প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেন। তিনি ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ বিকেলে বাঙ্গালিদের উপর পশ্চিমা হানাদার বাহিনীর আক্রমণের সংবাদ পান। হানাদারদের ধ্বংসযজ্ঞের সংবাদ পাওয়ার পর তিনি অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে পড়েন। ২৭শে মার্চ বার্মার জাতীয় দিবসের উৎসব অনুষ্ঠানে জাকার্তায় বার্মার দূতাবাসে যান। সেখানে তাকে বার্মার এ্যামবাসেডর মং মং সহ অন্যান্য দেশের বেশ কয়েকজন রাষ্ট্রদূত বা কর্মকর্তা হানাদারদের হত্যাযজ্ঞের নিন্দা করেন এবং বাঙ্গালিদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেন। বিদেশী কূটনীতিকদের সহানুভূতি দেখে তিনি সােচ্চার হয়ে উঠেন। হানাদারদের হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠভাবে প্রতিরােধ গড়ে তােলার সাহস পান। ইতিমধ্যেই তিনি সংবাদ পান বাঙ্গালিরা স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু করেছে। এ সংবাদ পাওয়ার পর তিনি আনন্দে উল্লসিত হয়ে উঠেন। আবুল ফজল শামসুজ্জামান এবার তার সহকর্মীদের নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করার জন্য নিজের বাসায় এক বৈঠক করেন। উক্ত বৈঠকে উপস্থিত হন তার সেকশনের সিদ্দিক আহমেদ ও একরাম আলী, প্রেস সেকশনের নূরুল ইসলাম, ডিফেন্স সেকশনের রুহুল আমিন, আইপেকের সানাউল্লা, এবং প্রেস কাউন্সিলের আবেদীন। আইপেকের সেক্রেটারী জেনরেল এম. এ. আজিজ বৈঠকে আসেননি। তিনি বাঙ্গালিদের চেয়ে পাকিস্তানীদের সঙ্গে বেশি মেলামেশা করতেন। বৈঠকে সানাউল্লাহ সজোরে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য মতামত প্রকাশ করেন। নূরুল ইসলাম ও নূরুল আমিন মতামত প্রকাশ করে বলেন, প্রকাশ্যে না হলেও গােপনে আমাদের কাজ করতে হবে। একরাম আলী ও সিদ্দিক আহমদ দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। যুদ্ধের কৌশল ব্যাখ্যা করে বক্তব্য রাখেন আবেদীন। তিনি বলেন এ যুদ্ধে বাঙ্গালির জয় অসম্ভব। আমেরিকা, চীন পাকিস্তানকে সমর্থন করবে। রাশিয়া মৌখিক সমর্থন দিলেও সক্রিয়ভাবে সাহায্য করবে না। ভারত, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তেমন সাহায্য করতে পারবে না। কারণ সে নিজেই নানা সমস্যায় জর্জরিত। বাঙ্গালির জন্য এ যুদ্ধ আত্মঘাতী হবে। এর উত্তরে আবুল ফজল শামসুজ্জামান বলেন, যুদ্ধ শুরু হয়েছে। এখন আর আপােষ সম্ভব নয়। পিছালে জাতি হিসাবে আমাদের ধ্বংস অনিবার্য। বাঁচতে চাইলে সংগ্রাম করতে হবে। তাছাড়া বাংলাদেশকে স্বাধীন বলে ঘােষণা দেয়া হয়েছে। আজ হােক কাল হােক, দশ বছর পরে হােক, একশত বছর পরে তােক বাংলাদেশ স্বাধীন না হয়ে পারে না। ব্যক্তিগত ভাবে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারি। আমি বাণিজ্য বিভাগে সার্ভিসে আছি। এখান থেকে বেলগ্রেডে বদলি করা হবে বলে চিঠি পেয়েছি। আমাকে কাউন্সিলর করার জোর রিকমন্ডেশন গেছে। ধাপে ধাপে উপরে যাবাে, একদেশ থেকে অন্যদেশে যাবাে, এ নিশ্চিত চাকরী হয়তাে আমার থাকবে । হয়তাে আপনাদেরও থাকবে না। তাই বলে সত্যকে অস্বীকার করলে চলবে না। জাতি হিসাবে
১৭১
আমাদের কর্তব্য অবহেলা করা অন্যায় হবে। আবুল ফজল শামসুজ্জামানের বক্তব্য শােনার পর আবেদীন আর কিছু বলেননি। উৎসাহিত হয়ে সমর্থন জানালেন সানাউল্লাহ, নূরুল ইসলাম ও রুহুল আমিন। এদের নিয়েই পরে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করার জন্য “আমার দল” নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। আবুল ফজল শামসুজ্জামান ঐ বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেন প্রথম কাজ করতে হবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে এবং হানাদার পাকবাহিনীর বিপক্ষে প্রচারণা চালানাে। তাই তিনি পরদিন “ইজ-ইসলাম ডেড?” নামে একটি নিবন্ধ লেখেন। আর এ নিবন্ধ টাইপ করার দায়িত্ব নেন সানাউল্লাহ্। টাইপ করার পর নিবন্ধটি বেনামীতে জাকার্তা টাইমস এ পাঠান এবং প্রকাশ করার জন্য সম্পাদককে অনুরােধ জানান। ১৯৭১ সালের ১৫ই এপ্রিল জাকার্তা টাইমস্-এ ফলাও করে ছাপানাে হয় “ইজ ইসলাম ডেড?” ইংরেজী জানা অধিকাংশ ইন্দোনেশিয়ান এবং প্রতিটি বিদেশী কাগজটা পড়েন। সেই কাগজে হানাদারদের হত্যাযজ্ঞ, নারী-ধর্ষণ, ইসলাম বিরােধী কর্মকাণ্ডের কথা ফলাও করে ছাপানাে হয়েছে। এতে পাকিস্তানীদের মাথা হেট হয়ে যায়। হৈ চৈ পড়ে যায় দূতাবাসের পাকিস্তানীদের মধ্যে। এ ধরণের একটি কাজ করতে পেরে আবুল ফজল শামসুজ্জামান অনেকটা উৎসাহিত হন। লেখাটায় যুক্তি ছিল, তার চেয়ে বেশি ছিল আবেগ ও উচ্ছ্বাস, আর পাকিস্তানীদের অন্যায় কাজের বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিবাদ। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশ ডকুমেন্টস’-এর ৪৩৫ পৃষ্ঠায় ইজ ইসলাম ডেড থেকে কিছু অংশ “স্টপ দিজ জেনােসাইড” শিরােনামে ছাপা হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযযাদ্ধাদের পক্ষে তৎপরতা প্রকাশ হলে বিপদ হতে পারে ভেবে আবুল ফজল শামসুজ্জামান তার সহকর্মীদের নিয়ে অত্যন্ত গােপনে কাজ করে যান। তিনি টাইপ রাইটার কিনে লেখা টাইপ করে ইন্দোনেশিয়ায় বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশের জন্য পাঠাতেন। অধিকাংশ লেখা ছাপানাে হতাে জাকার্তা টাইমস্ ও ইন্দোনেশিয়ান অবজারভার-এ। পত্রিকায় প্রচার প্রকাশের সঙ্গে তিনি আরাে বেশ কিছু কাজ করেন মুক্তিযােদ্ধের পক্ষে। এর মধ্যে ছিল ইন্দোনেশিয়ার প্রভাবশালী মুসলিম নেতাদেরকে অবস্থা জানানাে। পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে ইন্দোনেশিয়ান সরকারের বিশেষ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। স্থানীয় সরকারী মহলের অনেকে বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল থাকলেও তারা চাইতেন সেখানে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কোন পরিস্থিতি সৃষ্টি হােক। সচেতন সাংবাদিকরা মােটামুটি সত্য ঘটনা প্রকাশ করতেন। তবে পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ব্যবধান কতটুকু তা তারা জানতেন না । মুসলিম নেতাদের কাছে পাকিস্তানী নেতাদের বক্তব্য বেশী গ্রহণযােগ্য হতাে। তারা বিশ্বাস করতাে বাংলার মানুষ স্বাধীনতা চায় না। ভারতীয় হিন্দুরা তাদের উস্কানি দিচ্ছে পাকিস্তান থেকে আলাদা হতে। সাধারণ মানুষ সংবাদপত্র পড়ে পাকিস্তানীদের হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে জ্ঞাত হয়ে পাকিস্তানীদের ঘৃণা করতে শুরু করে এবং তারা বাংলার মানুষের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচারণা চালানােই ছিল “আমার দলের প্রধান উদ্দেশ্য। এই “আমার দলের সদস্য সংখ্যা ছিল মাত্র তিনজন। এরা হলেন আবুল ফজল শামসুজ্জামান, সানাউল্লাহ ও সিদ্দিক আহমেদ। গােপনে কাজ করতে হতাে বলে তিনজনেরই ‘কোড নাম রাখা হয়। আবুল ফজল শামসুজ্জামানের কোড নাম রাখা হয় কামাল। ভারতীয় দূতাবাসের সঙ্গে যােগাযােগ করে কাজ করার সুবিধার্থে কমলগুপ্ত’ নামও ব্যবহার করেন। সানাউল্লাহর নাম রাখা হয় সুফী এবং সিদ্দিক আহমেদের নাম রাখা হয় রুমী। কাজ পরিচালনার জন্য কাজকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে একেকজন একেক বিভাগের দায়িত্ব নেন। আবুল ফজল শামসুজ্জামান দায়িত্ব গ্রহণ করেন সকল
১৭২
কাজের পরিকল্পনা, সমন্বয়, কলকাতাস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনের সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষা করার। তিনি আরাে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন দলীয় প্রধানের। সানাউল্লাহ জনসংযােগের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সিদ্দিক আহমেদ গ্রহণ করেন প্রচারের দায়িত্ব। কাজ চলার কিছুদিন পরে “আমার দলে” যােগদান করেন রুহুল আমিন, নূরুল ইসলাম, এবং আব্দুল হালিম। রুহুল আমিনের নাম রাখা হয় সাফারী । নূরুল ইসলামের নাম রাখা হয় সালাম এবং আব্দুল হালিম সরকারের নাম রাখা হয় রুহানি। স্থানীয় বাঙ্গালিদের মধ্যে মাহমুদ হােসেন “আমার দলে” সাহায্য করতে শুরু করেন একপর্যায়ে। তিনি ছিলেন একজন কন্ট্রাক্টর। তার সাহায্যে জাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনারেল এবং আরাে কয়েকজন বিশ্ব নেতার কাছে বাঙ্গালিদের দূরাবস্থার কথা জানানাে হয় আমার দলের পক্ষ থেকে। সেই সঙ্গে তাদের কাছে বাংলাদেশের সাহায্যের জন্যও অনুরােধ করা হয়। প্রবাসী সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের নিকট তার সাহায্যেই প্রথম যােগাযোেগ করা হয়। এরপর থেকে মাহমুদ হােসেনের মাধ্যমেই বেশ কিছুদিন প্রবাসী সরকারের সঙ্গে যােগাযােগ চলে। তার ও ‘কোড নাম রাখা হয় আনসার। পরবর্তীতে আমার দলে যােগদান করেন সেকেন্ড সেক্রেটারী মােস্তাফা ফারুক মুহাম্মদ। তাদের দুজনের কোড’ নাম রাখা হয় নতুন ও বদর। মাঝে মাঝেই আমার দলের’ কার্যক্রম চিঠির মাধ্যমে কলকাতাস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনে জানানাে হতাে। মাহমুদ হােসেনের মাধ্যমে প্রবাসী সরকারের বিভিন্ন চিঠিপত্র আমার দলের নিকট পৌছাত। সেই সঙ্গে প্রবাসী সরকারের প্রচার পত্রও পাওয়া যেত। এসমস্ত প্রচারপত্র ইন্দোনেশিয়ার বিভিন্ন পত্রিকায় পাঠানাে হতাে প্রকাশের জন্য এবং ইন্দোনেশিয়ায় বিশিষ্ট নেতাদের নিকটও ঐ সমস্ত প্রচার পত্র পাঠানাে হতাে। ইন্দোনেশিয়ার অত্যন্ত শক্তিশালী রাজনৈতিক দল ছিল তখন মাসজুমি পার্টি। আর এ দলের নেতা ছিলেন মুহম্মদ নাসের। তার নিকটও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রচারপত্র পাঠানাে হতাে। মাসজুমি পার্টি রাজনৈতিক গুরুত্বের প্রতিষ্ঠান ছিল। বাংলাদেশের ভয়াবহ অবস্থার সংবাদ টাইমস, নিউজউইক, ফারইষ্টার্ন ইকনমিক রিভিউ প্রভৃতি ম্যাগাজিনে স্থানীয় প্রতিটি সংবাদপত্রে এবং রেডিও টেলিভিশনে প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়। কিন্তু মাসজুমি পার্টির গােড়া মুসলমান নেতারা সে সংবাদ বিশ্বাস করছিল না। তাদের বিশ্বাস বাঙ্গালিদের বিরুদ্ধে হত্যাযজ্ঞ হিন্দুদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানী মুসলমানদের জেহাদ। এদের ভ্রান্ত ধারণা দূর করতে হলে পাকিস্তানের পটভূমি থেকে শুরু করে বাঙ্গালিদের প্রতি পাকিস্তানীদের অর্থনৈতিক শােষন, শাসন ও নিপীড়নের বিশেষভাবে ব্যাখ্যা করা প্রয়ােজন। প্রবাসী সরকারের পক্ষ থেকে যে পরিমাণ প্রচার পত্র পাওয়া যেত তা ছিল সামান্য। তাই আমার দলের ব্যাপক প্রচার পত্রের প্রয়ােজন মেটানাের জন্য নিজেরাই বিভিন্ন প্রকার প্রচার পত্র তৈরী করেন। বাংলার অবস্থা ইন্দোনেশিয়ানদের বুঝানাের জন্য পাকিস্তান-ইটস বার্থ অ্যান্ড ডেথ” নামে একটি লেখা ছাপানাে হয়। এই লেখাটি ইন্দোনেশিয়ায় মানুষের মনে পশ্চিম পাকিস্তানীদের অপকর্ম সম্পর্কে মারাত্মক দাগ কাটে। এছাড়াও আরও বেশ কয়েকটি লেখা পত্রিকাতে ছাপানাে হয়, এবং তা মাসজুমি পার্টির নেতাদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। এ সমস্ত প্রকাশিত লেখা কলকাতাস্থ বাংলাদেশ মিশনে পাঠানাে হতাে। ১৯৭১ সালের ১৫ই মে এবং ১৬ই ডিসেম্বর প্রকাশিত দু’ টি লেখা ইন্দোনেশিয়ায় মুসলমানদের মধ্যে মারাত্মক আলােড়ন সৃষ্টি করে। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর “দ্যা ডেথ অব ওল্ড পাকিস্তান অ্যান্ড দ্যা ইমারজেন্স অব বাংলাদেশ” নামে একটি লেখা ছাপানাে হয়। এর কপি ইন্দোনেশিয়ায় বিভিন্ন মহলে পাঠানাে হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল ইন্দোশিয়ার সরকার যেন বাংলাদেশ সম্পর্কে জানতে পেরে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জন্য কাজ করতে গিয়ে আমার দলকে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে।
১৭৩
ভালভাবে প্রচার কাজ চালানাের জন্য অফিসের প্রয়ােজন হয়েছে। আরাে প্রয়ােজন হয়েছে টাইপ রাইটার, ডুপ্লিকেটিং মেশিন, কাগজপত্র ইত্যাদি। আমার দলের সমস্যার কথা বিভিন্নভাবে কলকাতাস্থ বাংলাদেশ মিশনে জানানাে হয়েছে তারা অর্থের সম্পর্কে কিছু বলেনি। তখন আবুল ফজল শামসুজ্জামান ও আর সহকর্মীরা নিজেদের মধ্যে থেকে চাঁদা তুলে এবং মুক্তিযুদ্ধ সমর্থক বাঙ্গালিদের নিকট থেকে চাঁদা তােলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। নিজেদের মধ্যে থেকে চাঁদা তুলে তারা ফান্ড গঠন করেন। ফান্ডে মােট চাদা উঠে ৬১০ ডলার। এর মধ্যে আবুল ফজল শামসুজ্জমান দেন ২৯২ ডলার, সিদ্দিক আহমেদ দেন ৯৮ ডলার, আব্দুল হালিম সরকার দেন ৪৬ ডলার, রুহল আমিন দেন ৪১ ডলার, মাহমুদ হােসেন ৩৪ ডলার এবং আব্দুল মালেক দেন ৫ ডলার। শেষের দিকে মােস্তফা ফারুক মুহম্মদ আমার দলে যােগ দেন এবং ৮৫ ডলার চাঁদা দেন। আমার দলের ফান্ড থেকে কলকাতাস্থ বাংলাদেশের মিশনে কিছু অর্থ পাঠান। ফান্ডের অর্থের বেশ কিছু খরচ হয় ডাক ও তারের জন্য। আবুল ফজল শামসুজ্জামান আমার দলের পক্ষ থেকে মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য পাঠান। আমার দলের কাজের জন্য সিদ্দিক আহমদ একটি টাইপ রাইটার কিনেছিলেন এবং নূরুল ইসলাম একটি ডুপ্লিকেটিং মেশিন যােগাড় করেছিলেন। এ সমস্ত যন্ত্রপাতি পরে বাংলাদেশের দূতাবাসকে দেয়া হয়। পাকিস্তান সরকারের পদত্যাগ করে স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের পর কয়েকজন কর্মচারীকে ঔষধপত্র ও চিকিৎসার জন্য আমার দলের ফান্ড থেকে অর্থ সাহায্য করেন। ফান্ডের অর্থ সিদ্দিক আহমেদের নিকট জমা থাকতাে এবং তার মাধ্যমে খরচ করা হতাে। বাঙ্গালির বহু আকাংখিত স্বাধীনতা অনেক রক্তের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর সত্যে পরিণত হলাে। ১৭ ই ডিসেম্বর জাকার্তায় তার খবর পৌছলাে। খবর পাওয়ার পর আনন্দ বেদানায় আবুল ফজল শামসুজ্জামান ও তার সহকর্মীরা আপ্লুত হয়ে পড়েন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আবুল ফজল শামসুজ্জামান তার সঙ্গীদের নিয়ে পরবর্তী কর্মসূচী সম্পর্কে ভাবতে থাকেন। তিনি টেলিফোনে কলকাতার সঙ্গে যােগাযযাগ করতে চেষ্টা করেন, কিন্তু বহু চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। অভিনন্দন জানিয়ে ও উপদেশ চেয়ে কলকাতাস্থ মিশনের নিকট টেলিগ্রাম পাঠান। আবুল ফজল শামসুজ্জামান ও তার সহকর্মীদের দুঃখ তারা কেন দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে ডিফেক্ট করতে পারেনি। তবে এর জন্য তারা নিজেরা দায়ী নন, দায়ী কলকাতাস্থ মিশনের নিরবতাই। এরপর আবুল ফজল শামসুজ্জামান, তার সাথীদের নিয়ে ডিফেক্ট করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তার ইচ্ছা তারা ১২ জন এবং পরিবারের সদস্যসহ মােট ৫৩ জন লােক একসাথে ডিফেক্ট করবেন। যাতে বিশ্বব্যাপী একটি সাড়া পড়ে যায়। যেমন পড়েছিল যখন কলকাতা, দিল্লী, লন্ডন, ওয়াশিংটনে বাঙ্গালি অফিসাররা ডিফেক্ট করেছিলেন। দুই তিন জন বাঙ্গালির মনােভাব ঠিক ছিলনা বলে তখন তাদের পক্ষে ডিফেক্ট করা সম্ভব হয়নি। ১৯৭১ সালের ১৮ই ডিসেম্বর শনিবার সকাল বেলায় মােস্তফা ফারুক মুহম্মদ হঠাৎ আবুল ফজল শামসুজ্জামানের বাসায় উপস্থিত। এসেই আবুল ফজল শামসুজ্জামানকে বলেন আজই আমাদের ডিফেক্ট করতে হবে। কারণ দুই একদিনের মধ্যেই কুয়ালালমপুর থেকে মি,কে, কে, পন্নী এসে জাকার্তায় উপস্থিত হবেন। তিনি আসার আগেই আমাদেরকে ডিফেক্ট করতে বলেছেন। এর উত্তরে আবুল ফজল শামসুজ্জামান বলেন কারও ভয়ে আমরা কাজ করিনি, এখন আর করবাে না। কাজেই ডিফেক্ট করবাে বিশ্বকে জানিয়েই। চোরের মত ভয়ে ভয়ে ডিফেক্ট করবাে না । এমনিভাবে আলাপ আলােচনার পর আবুল ফজল শামসুজ্জামান ও তার সহকর্মীরা ১৯৭১ সালের
১৭৪
২০শে ডিসেম্বর সােমবার তার বাসায় প্রেস কনফারেন্স করে, তারা সবাই ডিফেক্ট করবে। প্রেস কনফারেন্সে বক্তব্য রাখার দায়িত্ব গ্রহণ করেন আবুল ফজল শামসুজ্জামান। প্রেস কনফারেন্সের আধ ঘন্টা আগে মিডিয়ার লােকজনদের ফোনে আমন্ত্রণ জানান। সবাইকে গােপনীয়তা পালন করতে বলা হলাে । ভাল পােশাক পরে সপরিবারে সবাইকে সাড়ে বারটার মধ্যে আবুল ফজল শামসুজ্জামানের বাসায় আসতে বলা হলাে। বারােটার দিক থেকেই একজন একজন করে বাঙ্গালি পরিবার আবুল ফজল শামসুজ্জামানের বাসায় আসতে শুরু করে। তার বাসাটা ছিল বড়। একটার দিকে সকল বাঙ্গালি পরিবারের লােকজনেরা এসে উপস্থিত হয়। স্থানীয় প্রেস ও বিদেশী মিডিয়ার প্রতিনিধিরাও একটার আগেই এসে উপস্থিত হলেন। প্রেস কনফারেন্সে সবাই উপস্থিত হওয়ার পর আবুল ফজল শামসুজ্জামান তার বক্তব্য শুরু করেন। তিনি বক্তব্যে বলেন, অনেক রক্তের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ সম্পূর্ণ স্বাধীন হয়েছে। স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে আমরা বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করি। আজ এই প্রেস কনফারেন্সে জাকার্তা সরকারের প্রতি আমাদের আনুগত্য ঘােষণা করছি এই সঙ্গে আমরা পাকিস্তান সরকার ও পাকিস্তান দূতাবাসের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করছি। ততদিন পর্যন্ত আমরা রাজনৈতিক আশ্রয় ও নিরাপত্তা কামনা করছি। তার বক্তব্যের পর উপস্থিত প্রতিটি বাঙ্গালি আলাদাভাবে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘােষণা করলেন। এরপর জাতীয় সঙ্গীত আমার সােনার বাংলা আমি তােমায় ভালােবাসি’, গাওয়া হলাে এবং জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হলাে। সেই ভাব গম্ভীর মুহুর্তে শুধু বাঙ্গালিরাই নয় মিডিয়ার প্রতিনিধিরাও অভিভূত হয়ে পড়লেন। সেদিনই বিকাল চারটার সময় বি, বি. সি. থেকে প্রচার করা হলাে জাকার্তায় পাকিস্তান দূতবাসের সকল বাঙ্গলি একত্রে মি. শামসুজ্জামানের নেতৃত্বে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছেন। এরপর ভয়েস অব আমেরিকা ও অল ইন্ডিয়া রেডিও থেকেও সংবাদটা প্রচার করা হলাে। আনুগত্য প্রকাশের পরের দিন অর্থাৎ ২১ শে ডিসেম্বর ভােরে পাকিস্তান সরকার আবুল ফজল শামসুজ্জামানের বাসায় সামরিক বাহিনীর লােক পাঠিয়ে তাকে গৃহবন্দী করে। তিনি ঘুম থেকে উঠেই শুনেন তার গৃহবন্দীর সংবাদ কিছুক্ষণের মধ্যেই এ সংবাদ তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে পড়লাে। সকাল দশটার পর থেকে তার বন্ধুবান্ধব, প্রতিটি মিডিয়ার লােকজন, ভারতের রাষ্ট্রদূত মি. এন. বি মেনন এবং নিরােদ সিং রায় তাকে দেখতে এলেন। রাষ্ট্রদূত মেনন ছাড়া আর কাউকে সিপাহীরা ভিতরে যেতে দেয়নি তাকে দেখার জন্য। গেটের ভিতর থেকে অন্যদের সংগে তিনি কথা বলেন। তার প্রতিবেশীরা অনেকেই তার জন্য ফুল পাঠায়। কেউ কেউ ফল পাঠালেন। ইন্দোনেশিয়ার প্রখ্যাত সাংবাদিক মােখতার লুবিঘও একদিন ফল নিয়ে দেখতে এসেছিলেন। সেদিন বিকেলেই বি. বি.সি, অল ইন্ডিয়া রেডিও এবং ভয়েস অব আমেরিকা সহ বিভিন্ন বেতার কেন্দ্র ঐ সংবাদ প্রচার করে। আফগান অ্যামব্যাসেডর যিনি তখন চিফ অব দ্যা ডিপ্লোমেটিক কোর এবং ভারতীয় রাষ্ট্রদূত তার গৃহবন্দীর ব্যাপারে ফরেন অফিসের কাছে জোর প্রতিবাদ জানান এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মালেকের সাথে কথা বলেন। চারদিন পর আবুল ফজল শামসুজ্জামান গৃহবন্দী দশা থেকে মুক্তি লাভ করেন। মুক্তি পাওয়ার পর তিনি স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ও নেতৃবৃন্দের সাথে সাক্ষাত করেন যাতে করে ইন্দোনেশিয়া সরকার অবিলবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদান করে তার জন্য তাদের সহযােগিতা ও সমর্থন কামনা করেন। ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদম মালিক, মাসজুমি নেতা মােহাম্মদ নাসের ও শরফুদ্দীন প্রবীরানেগারা যে সব দেশ স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে তাঁদের রাষ্ট্রদূত এবং আরাে অনেকের সঙ্গে তিনি দেখা করেন । আবুল ফজল শামসুজ্জামান অধিকাংশ স্থানেই সাথীদের নিয়ে
১৭৫
যেতেন। কিন্তু মােহাম্মদ নাসের ও শরফুদ্দিন প্রবীরানেগারার সঙ্গে সস্ত্রীক দেখা করেন। মােহাম্মদ নাসের তাকে বলেন, স্বাধীন না হয়ে আপনারা ভারতের একটি প্রদেশ হলেই তাে পারতেন। ঘন্টাখানেক তর্ক তর্কির পর তিনি বলেন, তর্কস্থলে যাই বলি, বাংলাদেশের প্রতি আমাদের সমর্থন আছে। সুমাত্রার নির্ভীক নেতা শরফুদ্দিন প্রবীরানেগারা তখন মুসলিম চ্যাম্বার অব কমার্সের প্রেসিডেন্ট। তিনি বহুবার আবুল ফজল শামসুজ্জামানের বাসায় সন্ত্ৰীক গেছেন। বিশেষ সম্পর্কের কারণেই তিনি বাংলাদেশকে সমর্থন করেন। গােপন কাজ শেষ করে তিনি হাইকমিশনার হােসেন আলীর নিকট আমার দলের শেষ বিবরণী দিয়ে পত্র পাঠান। এই পত্রে তিনি দলের কার্যকলাপ ও বিভিন্ন সদস্যের ব্যক্তিগত অবদানের কথা উল্লেখ করেন। জাকার্তা টাইমস্ ইন্দোনেশিয়ান অবজারভার, ইন্দোনেশিয়ান রায়া মিনার, হারাপান, কম্পাস ইত্যাদি পত্রিকা নিরপেক্ষ ভাবে বাংলাদেশের কথা প্রচার করেন এবং বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের স্বপক্ষে সম্পাদকীয় লিখেন। অনেক ছাত্র, চিন্তাশীল ব্যক্তি, সাংবাদিক যেমন মােখতার লুবিস, আরিফ বুড়িমাস, প্রিনসেল, হরিয়াদি প্রমুখ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের জন্য ইন্দোশিয়ান সরকারের উপর চাপ দেন। আবুল ফজল শামসুজ্জামানের পত্র পাওয়ার পর তার উত্তরে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে হােসেন আলী ‘আমার দলের’ অবদানের প্রশংসা করে ১৯৭২ সালের ১৫ ই ফেব্রুয়ারী চিঠি পাঠান। এই চিঠিতে আরাে উল্লেখ ছিল বাংলাদেশ সরকারের তার অবদানের স্বীকৃতি দেয়ার আশ্বাস। চিঠি পাওয়ার পর আবুল ফজল শামসুজ্জামান অত্যন্ত আনন্দিত হন।
মুক্তিযুদ্ধের আরাে কয়েকজন বীর সেনানী
মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র সংগ্রামের পাশাপাশি বেসামরিক ক্ষেত্রে টাঙ্গাইলের বেশ কয়েকজন কৃতি সন্তান উল্লেখযােগ্য অবদান রাখেন। দেশের ভিতরে যখন তরুণ মুক্তিযােদ্ধারা অস্ত্র হাতে নিয়ে হানাদার বাহিনীর সঙ্গে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লিপ্ত তখন রাজনৈতিক নেতা বুদ্ধিজীবী শিক্ষক, আইনজীবী ডাক্তার, সরকারী কর্মচারী এবং অন্যান্য শ্রেণীর ও পেশার বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ তাদের মেধা, বুদ্ধি এম, সাহস ও সাংগঠনিক প্রতিভার দ্বারা স্বাধীনতা আন্দোলনের পক্ষে কাজ করেছেন, দেশে এবং দেশের বাইরে জনমত সৃষ্টি করেছেন, আন্দোলনকে সফল করার জন্য কৃতিত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। সশস্ত্র সগ্রামের মতাে বেসামরিক ক্ষেত্রেও টাঙ্গাইল বাসীর ভূমিকা ছিল নেতৃস্থানীয় ও প্রশংসনীয়। এক্ষেত্রে টাঙ্গাইলের যে সমস্ত কৃতি সন্তানরা উল্লেযােগ্য ভূমিকা রেখেছেন, তাদের মধ্যে ছিলেন- শামসুর রহমান খান শাজাহান, এম. এন. এ, হাতেম আলী তালুকদার, এম, এন, এ, আব্দুল বাসেদ সিদ্দিকী এম. পি. এ, হুমায়ুন খালিদ এম. পি.এ, বদিউজ্জামান খান এম.পি. পি, ডাঃ নিজামুল ইসলাম এম.পি. এ, ইনসান আলী এডঃ এম .পি. এ. সেতাব আলী খান, এম. পি. এ. মির্জা তােফাজ্জল হােসেন মুকুল, এম. পি. এ, ফজলুর রহমান খান ফারুক, এম. পি. এ. অধ্যাপক অরুন প্রকাশ নিয়ােগী, অধ্যাপক সুবল চন্দ্র ঘােষ, এডভােকেট কামাক্ষানাথ সেন, প্রখ্যাত নাট্যকার মামুনুর রশীদ প্রমুখ। এদের মধ্যে শামসুর রহমান খান এম. এন. এ মুজিবনগর সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। মুজিবনগর সরকারের পক্ষে ২ নং আঞ্চলিক প্রশাসন পরিচালনা করেন তিনি। ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল জেলা এ আঞ্চলিক প্রশাসনের অধীনে ছিল এবং এই অঞ্চলের সকল নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য উক্ত ২ নং আঞ্চলিক প্রশাসনিক পরিষদের সদস্য
১৭৬
ছিলেন। শামসুর রহমান খান শাজাহান এই পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। মুজিবনগর সরকারের অধীনে ভারতে সামরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ প্রদানের ক্ষেত্রেও তিনি গুরুত্বপূর্ন দায়িত্বপালন করেন। তার একনিষ্ঠতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন, বাঙ্গালি জাতির ইতিহাসে চিরস্মরণীর হয়ে থাকবে। আব্দুল বাতেন সিদ্দিকী এম.পি. এ টাঙ্গাইলের মুক্তিযুদ্ধের এক বীর সেনানী। তিনি দেশের ভিতরে থেকেই মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে অত্যন্ত দুঃসাহসিক ভূমিকা পালন করেন। অস্ত্র হাতে তুলে না নিলেও তিনি মুক্তিযযাদ্ধাদের নানাভাবে সাহায্য করেছেন। বিশেষ করে কাদেরিয়া বাহিনী। গঠনের ক্ষেত্রে এবং কাদেরিয়া বাহিনী ও বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকীকে তিনি বিশেষভাবে সহযােগিতা করেন ।ধলাপাড়া হাসপাতালে রিলিফ ক্যাম্প প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সহযােগিতা, অস্ত্র সংগ্রহের জন্য ভারত গমন এবং নিয়ে আসা, মুক্তিযুদ্ধে তাঁর কৃতিত্বপূর্ণ অবদান। আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী এম.পি. এ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় নাম। তিনি মুক্তিযুদ্ধে অত্যন্ত দুঃসাহসিকতা এবং কৃতিত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁর নেতৃত্বেই টাঙ্গাইলে প্রথম মুক্তিবাহিনী গঠনের কার্যক্রম শুরু হয়। তিনি নিজে অনেক স্থানে অস্ত্র হাতে মুক্তি যােদ্ধাদের সঙ্গে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। দেশের ভিতরে থেকে মুক্তিযােদ্ধাদের সংগঠিত এবং হানাদার নিধনের ক্ষেত্রে সাহসিকতাপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন তেমনি ভারতে বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযােদ্ধাদের সংগঠিত করা তাদের অস্ত্রশস্ত্র ও থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। বিশেষ করে যুব শিবিরে ঘুরে ঘুরে যুবকদের এনে মুক্তি বাহিনীতে ভর্তি করানাে তার উল্লেখযােগ্য অবদান। যুবশিবিরে তার জ্বালাময়ী ভাষণ যুবকদের মুক্তিযুদ্ধে যােগদানের জন্য উৎসাহী করে তুলত। তিনি মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণ শিবিরে রাজনৈতিক বক্তব্য দিতেন। যা মুক্তিযােদ্ধাদের মনে জাগাতে সাহস আর উদ্দীপনা। মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্রে আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীর কৃতিত্বপূর্ণ অবদান জাতি চিরদিন স্মরণ করবে। মির্জা তােফাজ্জল হােসেন মুকুল এম,পি,এ, ফজলুর রহমান খান ফারুক এম. পি.এ মানকার চরে যুবশিবির পরিচালনা করেন । ডাঃ নিজামুল ইসলাম দেশের ভিতরে অবস্থান করেই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এডঃ কামাক্ষানাথ সেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের একজন একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন এবং মুজিবনগর সরকার থেকে প্রকাশিত ‘জয় বাংলা পত্রিকার সাংবাদিকতার সঙ্গে সক্রিয় ভাবে যুক্ত ছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর টাঙ্গাইল আগমন ও ঐতিহাসিক জনসভা
২৪ শে জানুয়ারী ১৯৭২ সাল। টাঙ্গাইলের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিন। ১৯৭২ সালের এই দিনে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখমুজিবুর রহমান টাঙ্গাইলের পবিত্র মাটিতে আসেন। এ কারণে দিনটি টাঙ্গাইলের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই দিনটিকে টাঙ্গাইলবাসী কোনদিনই ভুলতে পারবে না । স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত সন্ধিক্ষণে ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ গভীর রাতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে তার ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাসা থেকে গ্রেফতার করে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে কারাগারে বন্দী করে রাখে। তারপর
১৭৭
পাক সরকার রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযােগে বঙ্গবন্ধুর বিচার করার ষড়যন্ত্র করে । প্রহসন মূলক এই বিচারের নামে তারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার অপপ্রয়াস চালায়। এই পরিকল্পনা তারা পূর্বেই করে রেখেছিল। বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী করে রাখা হয়েছিল। সেই কারাগারের পার্শ্বে তার মৃতদেহ দাফনের জন্যে কবর খােড়া হয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তানী সামরিক জান্তা বিশ্ব জনমতের চাপের মুখে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার সাহস দেখায়নি। বন্দীশালা থেকে ১৯৭২ সালের ৮ ই জানুয়ারী মুক্তি পেয়ে লন্ডন দিল্লী হয়ে ১৯৭২-সালেই ১০ই জানুয়ারী স্বাধীন স্বদেশভূমিতে প্রত্যাবর্তন করেন বঙ্গবন্ধু। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ১৪ দিন পর ১৯৭২ সালের ২৪ শে জানুয়ারী তিনি টাঙ্গাইলের মাটিতে আসেন। বঙ্গবন্ধুর পদার্পনে টাঙ্গাইলবাসীর হৃদয়ে যে নজিরবিহীন আনন্দের সৃষ্টি হয়েছিল সে ঐতিহাসিক ঘটনা টাঙ্গাইলের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। এর মাত্র ৩৮ দিন আগে পাকিস্তানী খুনী, জল্লাদ হানাদার বাহিনী শােচনীয় পরাজয় বরণ করে যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পন করে। ত্রিশ লাখ শহীদের পবিত্র রক্তে বিধৌত মুক্ত বাংলার মাটি তখন স্বাধীনতার তরুন ধারায় রক্তিম কিরণে উদ্ভাসিত। আমাদের ইতিহাসের সেই অবিস্মরণীয় মাহেন্দ্রক্ষণে স্বাধীনতা সগ্রামের মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আসেন মুক্ত টাঙ্গাইলের পবিত্র মাটিতে। মহান নেতাকে বীরােচিত সম্বর্ধনা জানাতে এবং এক নজর দেখার জন্য আসা নারী, পুরুষ, শিশু -বৃদ্ধ নির্বিশেষে লাখ লাখ মানুষে টাঙ্গাইল শহর ভরে যায় । আগের দিন সারারাত টাঙ্গাইল শহরের কোন লােকের চোখে ঘুম ছিল না। দিনের মতই রাস্তায় হাজার হাজার মানুষ আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠেছিল। মুক্তিযােদ্ধারা ফাকা গুলি ছুড়ে শীতের রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে দিয়েছে। শহরের পাড়ায় পাড়ায় মাইকে ও টেপ রেকর্ডারে বাজতে থাকে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা উদ্দীপনার গানগুলাে। রাতভর শহর অভিমুখে আসতে থাকে জেলার বিভিন্ন অঞ্চলের মুক্তিযােদ্ধা, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর মিছিল। মুক্তিযােদ্ধা, স্বেচ্ছাসেবক ও মুজিব ভক্ত সাধারণ মানুষের জয়বাংলা, জয়বঙ্গবন্ধু’ শ্লোগানে মুখর হয়ে উঠেছিল টাঙ্গাইলের আকাশ বাতাস। বঙ্গবন্ধুর আগমণ বার্তায় টাঙ্গাইলবাসীর আনন্দ বুঝি আর ধরে না। এই প্রিয়। ব্যক্তিকে ঘিরেই তাে বাঙ্গালির এত রক্ত দান, এত ত্যাগ, সংগ্রাম। দারিদ্র ক্ষুধা-বঞ্চনার শিকার অসচেতন, অসংগঠিত বাঙ্গালি জাতিকে বঙ্গবন্ধুই তাে নিজে জীবনের সব সুখ স্বাচ্ছন্দ বিসর্জন দিয়ে প্রতিবাদের ভাষা দিয়েছেন, প্রতিরােধের শক্তি যুগিয়েছেন। স্বাধীনতা প্রিয় মুক্তিপাগল বাঙ্গালিকে স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত করেছিলেন। স্পন্দনশীল ভরাট ওই কষ্ঠের বাণী, বাঙ্গালি বেদবাক্যের মত শুনেছে কতবার। বাংলার মানুষ জানে মুজিব তাদের দাবী ও অধিকারের প্রশ্নে কোনদিন আপােষ করেনি। শত জেল জুলুম, নির্যাতনের মুখেও কোনদিন বাঙ্গালির স্বাধীকার, স্বাধীনতার দাবীর সঙ্গে তিনি বিশ্বাসঘাতকতা করেন নি। বারবার জেলে গিয়েছেন, নিগৃহীত হয়েছেন কিন্তু সমস্ত ভয়ভীতিকে উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধু ছিলেন দূর্ভেদ্য পাহাড়ের মত অটল। ভরা জোয়ারে বঙ্গবন্ধুর নৌকা হয়েছে উথাল পাতাল কিন্তু মাঝি হাল ছাড়েনি। বঙ্গবন্ধুকে কি করে ভুলবে বাঙ্গালিরা, তিনি যে তাদের জন্য দুঃসাধ্য সাধন করেছেন, নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েছেন বারবার। ২৬শে মার্চের সে ভয়াল রাতে আক্রান্ত বাংলার মানুষ জানতােনা বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছেন কি মরে গেছেন। প্রথম দিকেতাে গুজব ছড়ায় মুজিবকে পাক বাহিনী ঐ রাতেই হত্যা করেছে। বাংলার ঘরে ঘরে তখন সে কি বুকফাটা আহাজারি আর বিলাপ। বিশ্বের আর কোথাও কোন দিন এই অবস্থা দেখা যায়নি। সেদিন সৃষ্টি কর্তার কাছে বাংলার বহু নারী-পুরুষ করজোরে প্রার্থনা করেছে বঙ্গবন্ধু যেন বেঁচে থাকেন।
১৭৮
সেই মানুষ আসছেন টাঙ্গাইলের মাটিতে। রাত গড়িয়ে ভাের হতে না হতেই লাখ লাখ মানুষের ঢল টাঙ্গাইল শহরে বিশাল জনসমুদ্রে পরিণত হয়। বঙ্গবন্ধুর আগমণ বার্তা শুনে টাঙ্গাইলের সব এলাকা থেকে আসে লাখ লাখ মানুষের মিছিল। প্রতিটি মিছিল শােভাযাত্রাতে ঢাক-ঢােলসহ বিভিন্ন ধরনের বাদ্যযন্ত্র। টাঙ্গাইল শহরের প্রান্ত থেকে জেলার শেষ সীমা পর্যন্ত ২৬ মাইল রাস্তার দু’ধারে অসংখ্য মানুষ লাইন করে দাড়িয়ে থাকে তাদের প্রিয় নেতাকে একটু দেখার জন্য। এই ২৬ মাইল রাস্তার মধ্যে কয়েকশ তােরণ নির্মাণ করা হয়। সকাল ৮টা থেকে জেলা আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ও মুক্তিযােদ্ধানেতৃবৃন্দ উপস্থিত হতে থাকেন। এখানে সবাই অপেক্ষা করতে থাকেন বঙ্গবন্ধুর আগমণের প্রতীক্ষায়। অবশেষে দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে সকাল দশটায় শতাধিক গাড়ীর বহর নিয়ে বঙ্গবন্ধুর গাড়ীটি গােড়াই স্বাগত তােরণের সামনে এসে হাজির হয়। এখানে বঙ্গবন্ধুকে টাঙ্গাইল বাসীর পক্ষ থেকে অভিবাদন জানান শামসুর রহমান খান শাহজাহান, হাতেম আলী তালুকদার, বেহুমায়ুন খালিদ, আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী, ফজলুর রহমান খান ফারুক, বাসেত সিদ্দিকী ও কাদেরিয়া বাহিনীর প্রধান আব্দুল কাদের সিদ্দিকী। গােড়াই থেকে ৪০/৫০টি মােটর সাইকেল বঙ্গবন্ধুর সামনের গাড়িকে এস্কট করে টাঙ্গাইলের দিকে অগ্রসর হয়। সকাল ১১টার দিকে বঙ্গবন্ধু টাঙ্গাইল শহরে শিবনাথ উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে উপস্থিত হন। এখানে তাকে মুক্তিযােদ্ধাদের পক্ষ থেকে সশস্ত্র অভিবাদন জানানাে হয়। অভিবাদন অনুষ্ঠান শেষে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যাওয়া হয় বিন্দুবাসিনী সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে। এই মাঠে কাদেরিয়া বাহিনী বঙ্গবন্ধুর কাছে তাদের অস্ত্র হস্তান্তর করে। এ পর্ব শেষ করে বঙ্গবন্ধু টাঙ্গাইলের পুলিশ প্যারেড ময়দানে মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের শহীদদের স্মৃতির প্রতীক নতুন শহীদ মিনারের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। এরপর বঙ্গবন্ধু শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে দুই মিনিট নিরবতা পালন করেন। এখান থেকে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যাওয়া হয় ওয়াপদা ডাকবাংলােয়। সেখানে বঙ্গবন্ধু স্নান করে দুপুরের খাবার খেতে যান সার্কিট হাউজে। এখানে খাবার শেষে বঙ্গবন্ধু জনসভায় ভাষণ দেয়ার জন্য রওনা হন। ২৪শে জানুয়ারী ১৯৭২ সাল। বেলা দুটা ত্রিশ মিনিটে টাঙ্গাইলের ইতিহাসে সর্বকালের সর্ববৃহৎ । জনসভায় উপস্থিত হলেন বঙ্গবন্ধু । এই জনসভার স্থান করা হয়েছিল টাঙ্গাইল পার্ক ময়দানে। আজকের স্টেডিয়াম ও পার্ক বাজারসহ বিশাল এলাকা ছিল সেদিনের পার্ক ময়দান। প্রায় এক মাইলের মত দৈর্ঘ্য এবং আধ মাইলের মত প্রস্থ। কোথায়ও তিল ধারণের জায়গা ছিল না। শুধু মানুষ আর মানুষ। পার্কের চারদিকের ঘরবাড়ী ও ছাদ এবং গাছের ডালে অসংখ্য মানুষ বসে আছে। সভাস্থলে জনগণের শ্লোগানে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হয়ে উঠছে। সেদিনের মানুষের কণ্ঠে শ্লোগান ছিল ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ । বঙ্গবন্ধু দীর্ঘ জীবী হউন। বঙ্গবন্ধু জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ।’ বঙ্গবন্ধু সভামঞ্চে আসার পর কোরান ও গীতা পাঠের পর সভার কাজ আরম্ভ হয়। এই ঐতিহাসিক জনসভায় সভাপতির আসন গ্রহণ করেন জনাব আব্দুল মান্নান। সভা পরিচালনা করেন আনােয়ার-উল-আলম শহীদ। জেলা আওয়ামীলীগের পক্ষ থেকে জনাব মির্জা তােফাজ্জল হােসেন মুকুল এবং মুক্তি বাহিনীর পক্ষ থেকে জনাব আনােয়ার-উল-আলম শহীদ মানপত্র পাঠ করেন। মানপত্র পাঠের পর আব্দুল মান্নান সভাপতির ভাষণ দেন। মান্নান সাহেবের ভাষণের পর ভাষণ দেন আব্দুল কাদের সিদ্দিকী । কাদের সিদ্দিকী তার ভাষণে বলেন, “মুক্তিযােদ্ধা ভাইয়েরা আমরা আজ বঙ্গবন্ধুর হাতে অস্ত্র জমা দিয়েছি। বঙ্গবন্ধু আমাদের নেতা। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে অস্ত্র হাতে নিয়েছিলাম। তার আদেশে অস্ত্র ত্যাগ করলাম। এর অর্থ এই নয়, যে জনতা আমাদের নয় মাস সাহায্য করেছেন, বাচিয়ে
১৭৯
রেখেছেন, তাদের থেকে আমরা দূরে সরে গেলাম। যুদ্ধের সময় আমার আশা ছিল স্বাধীন বাংলায় আমাদের অস্ত্রগুলাে দিয়ে লাঙ্গল, কোদাল, হাতুড়ি, কাস্তে, দা বানাবাে। জানিনা আমার সেই আশা সফল হবে কিনা। বঙ্গবন্ধু আপনার কাছে আমার অনুরােধ সকল অস্ত্রের লােহা গলিয়ে লাঙ্গল, কোদাল, গাইতী, শাবল তৈরি করুন। মুক্তিযােদ্ধা ও দেশবাসীকে আমি কথা দিচ্ছি মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি যুদ্ধে যেমন আমি পিছিয়ে থাকিনি, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশ গড়ার সংগ্রামেও আমি পিছিয়ে থাকবাে না। আপনাদের সঙ্গে একই কাতারে একই সারিতে দাড়াবাে । আপনারা আমাকে নির্লোভ থাকার দোয়া করবেন। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু। কাদের সিদ্দিকীর ভাষণের পর তিনিই বঙ্গবন্ধুকে ভাষণ দানের জন্যে অনুরােধ করেন। বঙ্গবন্ধু এবার মাইকের সামনে আসেন ভাষণ দানের জন্যে। তার নাম ঘােষণার সঙ্গে সঙ্গেই সমস্ত জনতা শ্লোগান। আর করতালিতে কাঁপিয়ে তুলে পার্ক ময়দান। বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে মুক্তিযােদ্ধাদের সালাম জানান। সালাম জানান টাঙ্গাইলের বীর জনতাকে। তিনি তার বক্তব্যের শুরুতেই বলেন, টাঙ্গাইলের মানুষ যা করেছে তার তুলনা হয় না। তাই আমি সবার আগে আপনাদের সম্মান জানাতে এসেছি। আমি আমার গ্রামের বাড়ি যাইনি। আমি আপনাদের টাঙ্গাইল এসেছি। আপনারা যা করেছেন মুক্তিযােদ্ধা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী যা করেছে, সেই জন্যই আপনাদের সম্মান করা উচিত। টাঙ্গাইলের জন্য আমার গর্ব হয়। বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে আরাে বলেন, মুক্তিযােদ্ধা ভাইয়েরা আমি তােমাদের তিন বছর কিছু দিতে পারবনা। তিনি মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশ্ন করেন, আরাে তিন বছর যুদ্ধ চললে তােমরা যুদ্ধ করতে?’ মুক্তিযােদ্ধা ও জনতা সমস্বরে চিৎকার করে ফেটে পড়ল, করতাম। তাহলে মনে কর যুদ্ধ চলছে। তিন বছর যুদ্ধ চলবে। সেই যুদ্ধ দেশ গড়ার যুদ্ধ। অস্ত্র হবে লাঙ্গল, কোদাল। বঙ্গবন্ধু সেদিন সরকারী কর্মচারীদের হুশিয়ার করে দিয়ে বলেছিলেন স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি, ঘুষ খাওয়া চলবে না । দুনীতিবাজ কর্মচারীদের একজনকেও চাকরিতে বহাল রাখা হবে না। বঙ্গবন্ধু জনতাকে উদ্দেশ্য করে আরাে বলেন, আমরা সংগ্রাম করেই জয়ী হয়েছি, আমরা সংগ্রাম করেই জয়ী হব। কোন অন্যায় করিনি তাই হার মানব না। জয় বাংলা, জয় মুক্তিবাহিনী। এবারের সংগ্রাম দেশ গড়ার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম।’ ২৪শে জানুয়ারী এলেই মনে পড়ে ১৯৭২ সালের সেই ঐতিহাসিক ২৪শে জানুয়ারীর বঙ্গবন্ধুর টাঙ্গাইল পদার্পন ও তার ভাষণের কথা। তিনি সেদিন বলেছিলেন, তােমাদের তিন বছর আমি কিছু দিতে পারব না।’ কিন্তু মুজিব বাঙ্গালিকে তিন বছর অনেক কিছুই দিয়েছেন যা অনেকের পক্ষেই সম্ভব হত না। তিনি জাতিকে অল্পদিনের মধ্যেই দিয়েছিলেন একটি সংবিধান। বঙ্গবন্ধু বাঙ্গালিকে এনে দিয়েছিলেন ১৩৯ দেশের স্বীকৃতি। হার্ডিঞ্জ ও ভৈরব সেতুসহ ৫৬৭টি সেতু তিনি মেরামত ও নির্মাণ করেছিলেন। তিনি মেরামত করেন ১৮৫১টি রেলওয়ে-ওয়াগন ও যাত্রীবাহী বগি, ৪৬০টি বাস, ৬০৫টি নৌ যান এবং ৩টি বিমান চালু করেন। বঙ্গবন্ধুর আমলেই অচল বন্দরগুলাে চালু করা হয়। তিনি ৫৮০টি শিল্প প্রতিষ্ঠানকে উৎপাদনশীল করে লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের কাজের ব্যবস্থা করেন। তার আমলেই পাক আমলের ধ্বংসপ্রাপ্ত ব্যাপক বীমা চালু করেন। বঙ্গবন্ধুই ফারাক্কার মাধ্যমে ৪৪ হাজার কিউসেক পানি আনেন যা আজ পর্যন্ত কোন সরকারের পক্ষে সম্ভব হয়নি। বঙ্গবন্ধুর সরকারই সেনাবাহিনী, বিডিআর পুলিশ বাহিনীকে পুণর্গঠন করেন। তার আমলেই স্থাপিত হয় মিলিটারী একাডেমী, কয়েকটি পুলিশ একাডেমী ও ইসলামী ফাউন্ডেশন। বঙ্গবন্ধুর আমলেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সরকারী কর্মচারী করা হয়, করা হয় হাজার হাজার মুক্তিযােদ্ধাদের চাকরীর
১৮০
ব্যবস্থা, পঙ্গু মুক্তিযোেদ্ধাদের পুনর্বাসন ও শহীদ পরিবারদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হয় মুজিব সরকারকেই। কিন্তু সাফল্যের খাতায় এতসব অসংখ্য দৃষ্টান্ত থাকার পরও বিশেষ একটি মহল আজ বঙ্গবন্ধুর কোন কৃতিত্বই নাকি দেখেন না। তারা শুধু বঙ্গবন্ধুর ব্যর্থতার কথাই বলেন। এতেই তারা ক্ষান্ত নন। তারা বলতে চান স্বাধীনতা সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর অবদান নাকি তেমন কিছুই নেই। এজন্যেই হয়তাে মহাবীর আলেকজান্ডার বলেছিলেন কি বিচিত্র এই দেশ সেলুকাস! তাও মেনে নেয়া যেত যদি ১৯৭৫ সালের পরবর্তী-সরকারগুলাে দেশে শান্তির জোয়ার বইয়ে দিতে পারতাে। মুজিব হত্যার পর গত ২১ বছর যাবৎ দেশবাসীর দুঃখ কষ্ট শুধু দিন দিন বাড়ছে। গরীব আরাে গরীব হয়েছে। ভূমিহীনদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বেকারের সংখ্যা প্রচণ্ডভাবে বেড়ে চলেছে, শিল্প কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, শ্রমিকের কাজ বন্ধ হচ্ছে। শিল্পপতিরা আজ পারছে না শিল্পকারখানা চালাতে । খাদ্য দ্রব্যের মূল্য প্রচণ্ড ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আজ রণক্ষেত্রে পরিণত হচ্ছে, শিক্ষা ব্যবস্থা ক্রমশই পঙ্গু হতে চলেছে। আর তারাই যখন বঙ্গবন্ধুর সমালােচনা করে তখন হাসি পায়। আজ শুধু একথাই বলার সময় এসেছে। সত্য কোনদিন চাপা থাকে না। থাকলেও তা দীর্ঘদিন স্থায়ী হয় না। এক সময় না একসময় সত্য বেরিয়ে আসেই। আজ যারা বঙ্গবন্ধুর সমালােচনায় ব্যস্ত সময়ে তারা সত্য উপলব্ধি করতে পারবেন। আর মানুষকে বেশীদিন অপব্যাখ্যা ও ভুল বুঝানাে যাবে না। মানুষ আজ আগের চেয়ে অনেক বেশী সচেতন। কিছু মানুষকে সব সময়ের জন্য অথবা সকল মানুষকে কিছু সময়ের জন্য বােকা বানানাে যায়, কিন্তু সকল মানুষকে সকল সময়ের জন্য বােকা বানানাে যায় না । ইতিহাস একদিন ঠিকই বঙ্গবন্ধুকে মূল্যায়ণ করবে। দেশবাসীও একদিন বুঝতে পারবেন বঙ্গবন্ধু আমাদের জন্যে সত্যি কি করেছেন। কিন্তু সেই হারানাে নেতাকে আর আমরা কোনদিন ফিরে পাবাে না। তাই তার ঋণ শােধ করতে হলে তার আদর্শকে লালন করতে হবে। তার আদর্শকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কোন নেতাই চিরঞ্জীব বা অমর নয়। তাদের অমরত্ব তাদের আদর্শেই নিহিত থাকে। অতএব বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে লালন ও প্রতিষ্ঠা করেই আমরা তাকে স্মরণীয় এবং বরণীয় করে রাখতে চাই।