This is a temporary post for collecting data. Not for posting and not for publishing. Saved only as readable for the editors. Not clickable and not downloadable.
মুক্তিযুদ্ধে যুক্তরাজ্যে বাঙালির অবদান
শেখ আবদুল মান্নান
১. পূর্বাভাষ
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের আগেই আমরা প্রবাসী বাঙালীরা একটা আকস্মিক পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। পশ্চিম পাকিস্তানভিত্তিক শাসকবর্গের দুরভিসন্ধি সম্বন্ধে আমাদের মনে কোনাে সন্দেহ ছিল না। পূর্ববর্তী বছরের ডিসেম্বর মাস থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত বেসামরিক বিমান ও জাহাজে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বহু সৈন্য নিয়ে এসে পূর্ব বঙ্গ আক্রমণের প্রস্তুতি আমরা লক্ষ্য করেছি। ৭ই ডিসেম্বর (১৯৭০) এবং ১০ই জানুয়ারী (১৯৭১) তারিখে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সমগ্র পাকিস্তানে সংখ্যাধিক্য লাভ করে। পশ্চিম পাকিস্তান-ভিত্তিক পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো জনগণের রায় মেনে নিতে অস্বীকার করেন। রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনের উদ্দেশ্যে ১২ই জানুয়ারী ইয়াহিয়া-মুজিব আলােচনা অনুষ্ঠিত হয়। ১৪ই জানুয়ারী জেনারেল ইয়াহিয়া খান ঢাকা ত্যাগ করেন। ১৭ই জানুয়ারী তিনি সিন্ধু প্রদেশের লারকানায় ভুট্টোর বাড়িতে এক গােপন বৈঠকে মিলিত হন। ১লা মার্চ নবনির্বাচিত গণপরিষদের অধিবেশন শুরু হওয়ার কথা ছিল। ভুট্টো এই অধিবেশন “বয়কট করবেন বলে ঘােষণা করেন। ৩রা মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া প্রস্তাবিত অধিবেশন বাতিল বলে ঘােষণা করেন।
৭ই মার্চ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে বিক্ষুব্ধ ছাত্র ও যুবকরা চেশাম প্রেসে অবস্থিত পাকিস্তানী ছাত্রাবাসের দেওয়াল থেকে মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর ছবি নামিয়ে পায়ের তলায় পিষে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে। ছাত্রাবাসে অনুষ্ঠিত সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পাকিস্তান হাই কমিশনের সামনের লাউডস স্কোয়ারে ক্রমাগত বিক্ষোভ প্রদর্শনের জন্য বহু ছাত্র ও যুবক জমায়েত হয়। পাকিস্তান ডেমােক্রেটিক ফ্রন্টের যুক্তরাজ্য শাখার সদস্য এবং যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সদস্য ও সমর্থকরা এই বিক্ষোডে অংশগ্রহণ করে। আমি ডেমােক্রেটিক ফ্রন্টের সদস্যদের নেতৃত্ব দান করি।
এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে, পাকিস্তান-বিরােধী আন্দোলনে যােগদানের ব্যাপারে পিকিংপন্থী বাঙালীদের মধ্যে উৎসাহের অভাব ছিল। ৭ই
১৩
রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সােহরাওয়ার্দী উদ্যান) অনুষ্ঠিত গণসমাবেশে পূর্ণ স্বাধীনতা ঘােষণা না করে শেখ মুজিব বিশ্বাসঘাতকতা করেন বলে তারা মনে করে। (১)
৮ই মার্চ জেনারেল টিক্কা খান পূর্ব পাকিস্তানের নতুন গভর্ণর নিয়ােজিত হন। ৯ই মার্চ প্রধান বিচারপতি বি এ সিদ্দিকী টিক্কা খানের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে অস্বীকার করেন। লন্ডনের “দি টাইমস” ও “দি গার্ডিয়ান” পত্রিকায় এই সংবাদ প্রকাশিত হয়। সঙ্কট ক্রমেই ঘনীভূত হতে থাকে। ইয়াহিয়া খান ঢাকায় আসেন ১৫ই মার্চ। ভূট্টো আসেন ২১শে মার্চ। ঢাকায় ইয়াহিয়া ও ভূট্টো-বিরােধী বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। এই অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে বিদেশী সামরিক ও বেসামরিক বিমান ভারতের উপর দিয়ে সরাসরি পূর্ব পাকিস্তানে উড়ে যাওয়াকে নিষিদ্ধ বলে ঘােষণা করা হয় ।
২২শে মার্চ শেখ মুজিব ও ভূট্টো এক বৈঠকে মিলিত হন। এই বৈঠক চলাকালে ইয়াহিয়ার পক্ষ থেকে বলা হয়, গণ পরিষদের প্রারম্ভিক অধিবেশনের তারিখ ২৫শে মার্চ থেকে পিছিয়ে দেওয়া হবে। যুক্তরাজ্য-প্রবাসী ছাত্রদের সংগঠন “বেঙ্গল স্টুডেন্টস্ এ্যাকশান কমিটি” ও তাদের সমর্থকরা ২৩শে মার্চ তারিখে “দি টাইমস্”-এ প্রকাশিত এক বিজ্ঞাপনে বাংলার জনগণের সঙ্গে তাদের সংহতি ঘােষণা করে। সেদিন পূর্ব বাংলায় আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবসের পরিবর্তে প্রতিরােধ দিবস পালন করে।
২৫শে মার্চ সন্ধ্যার আগে করাচী থেকে প্রেরিত “দি টাইমস” ও “ দি গার্ডিয়ান”-এর সংবাদদাতাদের খবরে বলা হয়, ইয়াহিয়ার সঙ্গে শেখ মুজিবের আলােচনা ব্যর্থ হয়েছে। সেই রাত্রে ইয়াহিয়া খান ঢাকা থেকে গােপনে করাচীর পথে রওয়ানা হন। ভুট্টো তাকে অনুসরণ করেন।
পাকিস্তানের অভিসন্ধি অনুমান করা কষ্টকর ছিল না। মার্চ মাসের প্রথম থেকেই আমরা এ সম্বন্ধে সচেতন ছিলাম। বাংলাদেশের আসন্ন মুক্তি সংগ্রামে আমাদের অংশগ্রহণ করতে হবে, এ সম্পর্কেও আমরা নিশ্চিত ছিলাম। সংগ্রাম শুরু হলে আমরা কি করতে পারি, সে সম্পর্কে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলােচনা করি।
২৫শে মার্চ রাত্রের অন্ধকারে বর্বর পাকিস্তান-বাহিনী অসহায় বাঙালী নারী, পুরুষ ও শিশুদের নির্বিচারে আক্রমণ করে হত্যাযজ্ঞের সূচনা করে। এর অব্যবহিতপরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘােষণার মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি সার্বভৌম । জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে যুক্তরাজ্যের বাঙালীদের মধ্যে নানা ব্যাপারে মতভেদ ছিল। কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে তা’ আত্মকলহে পর্যবসিত হয়। আমরা
১৪
নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-ঝাটি করেছি নেতৃত্ব নিয়ে, কর্মসূচী নিয়ে, আদর্শ নিয়ে। কিন্তু ২৫শে মার্চের পর এসব নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। জাতির এই সন্ধিক্ষণে আমরা, প্রবাসী বাঙালীরা সমগ্র ইউরােপে এক হয়ে যাই। মুক্তিযুদ্ধ-প্রচেষ্টাকে আপ্রাণ সমর্থন দানের দৃঢ় শপথ গ্রহণ করে আমরা মেনে নিয়েছি—আমরা এক জাতি, এক নতুন রাষ্ট্রের অধিকারী, একজনই আমাদের নেতা। মুক্তি সংগ্রামই আমাদের জীবনের মূল সংগ্রাম।
সবাই আমাদের সঙ্গে ছিলেন, একথা বলা ঠিক হবে না। আব্বাস আলী (ব্যারিস্টার), আজহার আলী, আবদুল হামিদ, আবদুল হক, আবুল হায়াত—এরা বাঙালী হয়েও পাকিস্তান হাই কমিশনের সঙ্গে কাজ করেছেন। পাকিস্তান রক্ষাকল্পে তারা পাকিস্তান সরকারের সাথে তখন পুরােপুরি সহযােগিতা করেছেন এবং এখনও করছেন বলে আমি বিশ্বাস করি। তাদের পক্ষে ব্রিটিশ এম পি-দের মধ্যে যারা মুখর ছিলেন, তাদের মধ্যে একজন হচ্ছেন বিগ ডেভিডসন (বর্তমানে প্রয়াত) এবং অন্যজন মিস্ জিল নাইট (বর্তমানে ডেইম জিল)। জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে পাকিস্তান সরকারের আমন্ত্রণক্রমে রক্ষণশীল দলীয় সদস্য জিল নাইট আরাে দু’জন পার্লামেন্ট সদস্যসহ পাকিস্তান সফরে যান। ১৪ই জুন “দি ডেইলি টেলিগ্রাফ”- এ প্রকাশিত এক তারবার্তায় মিসেস নাইট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারের কথ, উল্লেখ করে বলেন, নির্বাচনে জয়লাভ করে শেখ মুজিব পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তান থেকে পৃথক করার চেষ্টা করেন। ২৫শে মার্চের আগে তিনি ও তাঁর সহকর্মীরা বহু লােককে হত্যা করেন। শেখ মুজিবের সেনাবাহিনী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ও প্রত্যেক পাকিস্তানী সৈন্যকে হত্যা করার পরিকল্পনা করেছিল বলে পাকিস্তানের কর্তৃপক্ষ বিশ্বাস করে। এই পরিকল্পনা বানচাল করার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনী তড়িৎগতিতে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য হয়।
২৫শে মার্চের পর ব্রিটেনের বাঙালী সমাজের প্রতিক্রিয়া বর্ণনা করার আগে ছাত্র ও যুব সমাজের প্রস্তুতিপর্ব সম্পর্কে কিছু বলা প্রয়ােজন। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের আগে বিভিন্ন রাজনৈতিক লভুক্ত ছাত্র ও যুবকরা বাংলাদেশ আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ও ভবিষ্যৎ কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে আলােচনার জন্য কয়েকটি বৈঠকে অংশ গ্রহণ করে। কিন্তু একমত না হওয়ায় তখন পর্যন্ত সর্বদলীয় এ্যাকশান কমিটি গঠন করা সম্ভব হয়নি। ৭ই মার্চের পর ছাত্রদের অভ্যন্তরীণ গােলযােগ মিটিয়ে এক পথ ও মতে পৌছানাের উদ্দেশ্যে আমরা কয়েকটি সভার আয়ােজন করি। এর অধিকাংশই চেশাম প্রেসে পাকিস্তান স্টুডেন্টস্ হােস্টেলে অনুষ্ঠিত হয়। শেষ পর্যন্ত আমাদের সিদ্ধান্ত হলাে আমাদের মধ্যে আদর্শগত পার্থক্য যদি
১৫
থেকেও থাকে, তা হলেও মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা অর্জন সম্পর্কে আমাদের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।
তৎকালীন বামপন্থী আন্দোলনের দু’টি ধারার মধ্যে একটি মস্কোপন্থী এবং অন্যটি চীনাপন্থী হিসেবে পরিচিত ছিল। মস্কোপন্থীরা বঙ্গবন্ধুর ৬-দফার পক্ষে এবং চীনাপন্থীরা বিপক্ষে ছিলেন। উভয় পক্ষই উপরােক্ত সভায় যােগ দেন। ৬দফার সঙ্গে যারা একমত, তাদের মধ্যে ছিলেন সাইদুর রহমান মিয়া (বর্তমানে প্রয়াত), শ্যামাপ্রসাদ ঘােষ, নিখিলেশ চক্রবর্তী ও হাবীবুর রহমান। ৬-দফার যারা | বিরােধিতা করেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন জিয়াউদ্দিন মাহমুদ, লুৎফর রহমান শাজাহান এবং আরাে অনেকে।
উপরােক্ত সভায় জিয়াউদ্দিন মাহমুদ বলেন, আমাদের সংগঠনের নাম হবে “স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদ”। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের মধ্য থেকে সুলতান মাহমুদ শরীফ বলেন, আমাদের নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে আমরা এখনও পর্যন্ত “ক্লিয়ারেন্স” পাইনি। স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদ” নাম গ্রহণের ব্যাপারে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। সভায় উত্থাপিত এক প্রস্তাবে বলা হয়, নাম সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে শােভাযাত্রা, অনশন-ধর্মঘট ও বিক্ষোভ অনুষ্ঠান, স্মারকলিপি পেশ, সাপ্তাহিক বুলেটিন, পুস্তিকা ও প্রচারপত্র প্রকাশ এবং বিলি করার ব্যাপারে যখনই ডাক দেওয়া হবে, তখনই সবাই তাতে অংশ গ্রহণ করবেন। এই প্রস্তাব গ্রহণ করে সবাই এক সঙ্গে কাজ করবেন বলে অঙ্গীকার করেন।
এর পর আমাদের সঙ্গে যােগ দেন বাঙালীঅধ্যুষিত পূর্ব লন্ডনের নেতৃবৃন্দ ও জনসাধারণ। আওয়ামী লীগের তখন দুটি শাখা ছিল। একটি যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ, গাউস খান যার প্রেসিডেন্ট এবং অন্যটি লডন আওয়ামী লীগ, মিনহাজউদ্দিন যার প্রেসিডেন্ট। গাউস খানের সঙ্গে যারা কাজ করেছেন তাদের মধ্যে ছিলেন তৈয়েবুর রহমান ও ম্যাঞ্চেস্টারের হাজী আবদুল মতিন। মিনহাজউদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত লন্ডন আওয়ামী লীগ খুব শক্তিশালী ছিল। তার সঙ্গে ছিলেন দিলশাদ রেস্তোরার মালিক মতিউর রহমান চৌধুরী (মােতালিব চৌধুরীর পুত্র), মিম্বর আলী, শামসুর রহমান, সুলতান মাহমুদ শরীফ এবং আরাে অনেকে। মি: শরীফ স্টুডেন্টস এ্যাকশান কমিটিরও সদস্য ছিলেন। গণসংযােগের ব্যাপারে লন্ডন আওয়ামী লীগের প্রাধান্য ছিল। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন সমাজে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি। সাধারণ ব্যবসা-বাণিজ্য এবং রেস্তোরাঁ ব্যবসায় তারা ছিলেন অগ্রগণ্য। আওয়ামী লীগ দু’ভাগে বিভক্ত হলেও স্বাধীনতা আন্দোলনের ক্ষেত্রে তাদের পার্থক্য জনসাধারণের দৃষ্টিতে ধরা পড়েনি। তারা নিজেরাও এ সম্পর্কে প্রকাশ্যে উচ্চবাচ্য করেননি।
১৬
১৪ই মার্চ যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের উদ্যোগে লন্ডনের হাইড পার্কে একটি গণসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ব্রিটেনের বহু শহর থেকে দশ হাজারেরও বেশী বাঙালী এই সমাবেশে যােগদান করে। সভা শেষে বিক্ষোভকারী একটি দল গাউস খানের নেতৃত্বে লাউডস স্কোয়ারে অবস্থিত পাকিস্তান হাই কমিশানে গিয়ে পূর্ব বাংলার দাবি সম্বলিত একটি স্মারকলিপি পেশ করে। এই সমাবেশের পর সারা দেশে বাঙালীদের কর্মতৎপরতা বৃদ্ধি পায়। কয়েক দিনের মধ্যে তারা প্রায় ১৫টি শহরে “এ্যাকশান কমিটি গঠন করে। এই শহরগুলির মধ্যে ছিল লন্ডন, বার্মিংহাম, লীড়স, ব্র্যাডফোর্ড ও মাঞ্চেস্টার। ২৫শে মার্চের পর বিভিন্ন পেশাজীবী এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে উৎসাহী ব্যক্তিরাও নিজস্ব প্রতিষ্ঠান গড়ে তােলেন। এদের মধ্যে ছিল বাংলাদেশ স্টুডেন্টস এ্যাকশান কমিটি, বাংলাদেশ উইমেন এ্যাসােসিয়েশান, বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যাসােসিয়েশান, এ্যাকশান বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ কালচারাল এ্যাসােসিয়েশান। স্বতঃস্ফূর্তভাবে গঠিত বাংলাদেশ এ্যাকশান কমিটিগুলি তখন একটি কেন্দ্রীয় কমিটির নেতৃত্বের জন্য অপেক্ষমাণ ছিল।
স্বাধীনতা সংগ্রামে আমাদের কর্তব্য কী হবে, সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য বিদেশে আমরা কী করতে পারি—এ সম্পর্কে আলােচনার জন্য আমরা ৭ই মার্চ থেকে ২৫শে মার্চের মধ্যে লন্ডনের বিভিন্ন এলাকায় অনেকগুলি সভায় মিলিত হই। বিভিন্ন এ্যাকশান কমিটির প্রতিনিধি এবং উৎসাহী ব্যক্তিরা এসব সভায় যােগ দেন। আলাপ-আলােচনার পর যে প্রস্তাবগুলি গ্রহণযােগ্য বলে বিবেচিত হয়, তার মধ্যে ছিল মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে সরাসরি যােগাযোেগ স্থাপন, বিশ্বজনমত বাংলাদেশের পক্ষে নিয়ে আসার জন্য বিভিন্ন দেশে প্রতিনিধি প্রেরণ, বৈদেশিক সরকারসমূহের কাছে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলার স্বীকৃতি দাবি, পাকিস্তান সৈন্যবাহিনী কর্তৃক নির্বিচারে নরহত্যার চিত্র বিদেশের কাছে তুলে ধরা, হত্যাযজ্ঞ বদ্ধ করার জন্য জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ দাবি, মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য প্রয়ােজনীয় অস্ত্র প্রেরণ এবং “মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধিদের বিদেশে পাঠাবার জন্য অর্থ সংগ্রহ।
হাইবারী হিল-এ অবস্থিত পূর্ব পাকিস্তান হাউস, গাউস খানের “এলাহাবাদ” রেস্তোরাঁ, মতিউর রহমান চৌধুরীর “দিলশাদ” রেস্তোরাঁ, ফোর্ডহাম স্ট্রীট, পাকিস্তান ওয়েলফেয়ার এ্যাসােসিয়েশনের অফিস এবং ছাত্রদের বিভিন্ন আস্তানায় উল্লিখিত সভাগুলি অনুষ্ঠিত হয়। সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তগুলি সম্পর্কে আমরা সবাই একমত হওয়ার চেষ্টা করেছি।
লন্ডনে যখন আমরা মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলাম, তখন বার্মিংহামে দু’টো কমিটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে একটি তােজাম্মেল হকের
১৭
(টনি হক নামে পরিচিত) নেতৃত্বে গড়ে ওঠে। অন্যটির নেতৃত্বে ছিলেন জগলুল পাশা (প্রেসিডেন্ট) ও আজিজুল হক ভূঁইয়া (সেক্রেটারী)। এই প্রভাবশালী কমিটির সঙ্গে জড়িত ছিলেন আফরােজ মিয়া (বর্তমানে প্রয়াত), ইসরাইল মিয়া এবং আরাে অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি। হাজী আবদুল মতিনের নেতৃত্বে ম্যাঞ্চেস্টারে যে কমিটি গঠিত হয় তা খুবই শক্তিশালী ছিল। ব্রাডফোর্ড, গ্লাসগাে, পাের্টসমাথ শেফিল্ড, লুটন এবং ব্রাইটনেও স্বতঃস্ফূর্তভাবে কমিটি গড়ে ওঠে।
বিভিন্ন এ্যাকশান কমিটির সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষা করে যৌথ নেতৃত্বদানের উদ্দেশ্যে একটি বৃহত্তর প্রতিষ্ঠান গঠনের জন্য ২৯শে মার্চ লন্ডনের পােল্যান্ড স্ট্রীটে অবস্থিত “মহাঋষি” রেস্তোরাঁয় একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। গাউস খান এই সভায় সভাপতিত্ব করেন। মফঃস্বলের নেতৃবৃন্দের অনেকেই আসতে পারেননি, কিন্তু বৃহত্তর লন্ডনের প্রায় সব কমিটির প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।(২) সভায় আলাপ-আলােচনার পর “কাউন্সিল ফর দি পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ ইন ইউ কে” নামের একটি প্রতিষ্ঠান গঠন সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন শহরে সংগঠিত এ্যাকশান কমিটিগুলিকে অনুমােদন দানের ক্ষমতা কাউন্সিলকে দেওয়া হয়। কার্যকারী পরিষদ হিসাবে ১১জন নির্বাচিত সদস্য এবং ব্র্যাডফোর্ড, শেফিল্ড, ব্লাসগাে, বার্মিংহাম, ম্যাঞ্চেস্টার প্রভৃতি শহরে সংগঠিত এ্যাকশান কমিটির দশজন প্রতিনিধি নিয়ে একটি কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়। গাউস খান ও “কোহিনূর” রেস্তোরার মালিক আবদুল হামিদ যথাক্রমে কমিটির প্রেসিডেন্ট ও কোষাধ্যক্ষ নির্বাচিত হন। আমি কেন্দ্রীয় কমিটির জেনারেল সেক্রেটারী নির্বাচিত হই। উইন্ডমিল স্ট্রীটে অবস্থিত “লাক্ষ্ণৌ রেস্তোরার মালিক শওকত আলী দু’টি রুম বিনা ভাড়ায় কমিটির অফিস হিসাবে ব্যবহারের জন্য দেন। তা ছাড়া তিনি অফিসের কাজে বিনা খরচে একটি টেলিফোন ব্যবহার করারও অনুমতি দেন।
অবিলম্বে আমরা লন্ডনের বাইরের কমিটিগুলির সঙ্গে যােগাযােগের দায়িত্ব গ্রহণ করি। ব্যারিস্টার শাখাওয়াত হােসেন কভেন্ট্রি ও বার্মিংহামসহ মিল্যান্ডসের বিভিন্ন শহরে যান। আমি ইংল্যান্ডের দক্ষিণ-পূর্ব এলাকা এবং লন্ডনের চারপাশের শহরে যেসব কমিটি ছিল, তাদের সঙ্গে যােগাযােগ করি। গাউস খান নিজে ল্যাঙ্কাশায়ার ও ইয়র্কশায়ারসহ উত্তরাঞ্চলের কমিটিগুলির সঙ্গে যােগাযােগের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। প্রয়ােজন হলে সদস্য-সংখ্যা বাড়িয়ে কিংবা আমরা কেউ কেউ পদত্যাগ করে হলেও মফঃস্বল শহরের নেতৃবৃন্দকে কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্থান করে দেব, এই অঙ্গীকারে আমরা আবদ্ধ হই।
শীঘ্রই সাংগঠনিক ব্যাপারে অপ্রত্যাশিত এক সমস্যা দেখা দেয়। যুক্তরাজ্যের প্রায় প্রত্যেকটি এ্যাকশান কমিটি কেন্দ্রীয় কমিটির নেতৃত্ব মেনে নিয়ে অনুমােদন
১৮
গ্রহণ করে; কিন্তু দক্ষিণ লন্ডনে বি এইচ তালুকদারের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি অনুমােদন গ্রহণের বিরােধিতা করে। থােম হাই স্ট্রীটে অবস্থিত কুলাউড়া” রেস্তোরার মালিক মি: তালুকদার গাউস খানের নেতৃত্ব মেনে নিতে রাজি হননি। আলাপ-আলােচনার মাধ্যমে তাঁর মত পরিবর্তন করার জন্য কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে ব্যারিস্টার শাখাওয়াত হােসেন, আমীর আলী, শামসুল মাের্শেদসহ (বর্তমানে পররাষ্ট্র দপ্তরে কর্মরত) আমরা পাঁচজন তাঁর বাড়িতে (কুলাউড়া রেস্তোরার ওপরের তলায়) যাই। আমরা রাত ১২টা পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে কথা বলি। আলােচনাকালে তাঁর সহকর্মীদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন নূরুল হক চৌধুরী (বিচারপতি চৌধুরীর আত্মীয়), সােহেল ইবনে আজিজ এবং আরাে কয়েকজন। তিনি তার সিদ্ধান্তে অনড় থাকেন। কিছুতেই তিনি গাউস খানের নেতৃত্ব মেনে নিতে রাজি হলেন না।(৩)
বার্মিংহামের দুটি কমিটি কেন্দ্রীয় কমিটির কর্তৃত্ব মেনে নেওয়া সত্ত্বেও গাউস খানের নেতৃত্ব মেনে নিতে রাজি হয়নি। এই দু’টি কমিটির মধ্যে জগলুল পাশার নেতৃত্বে পরিচালিত কমিটি সদস্য-সংখ্যার বিচারে লন্ডনের পর দ্বিতীয় স্থান দখল করে। স্বাধীনতা আন্দোলন সম্পর্কিত কার্যকলাপে উভয় কমিটি কেন্দ্রীয় কমিটির সঙ্গে পূর্ণ সহযােগিতা করে।
লন্ডনের অন্যান্য কমিটি কোনাে কোনাে ব্যাপারে কেন্দ্রীয় কমিটির সঙ্গে দ্বিমত পােষণ করে। গাউস খান ও আমি পূর্ব লন্ডনে গি েসিরাজুল হক, ফখরুদ্দিন, মতিউর রহমান চৌধুরী, মিম্বর আলী, শামসুর রহমান এবং অন্যান্য নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করে বললাম, আমাদের আত্ম-কলহের সময় এখন নেই; কাজ করার সময় এখন। তারা বললেন, আপনারা কাজ চালিয়ে যান। আমরা, যখনই ডাক আসবে, বৃহত্তর কমিটির সঙ্গে কাজ করবাে। আমরা আশা করবাে, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য-তালিকা আপনারা “ফাইনাল” করবেন। কমিটিতে যাদের প্রতিনিধিত্ব নেই, তাদের প্রতিনিধি নিতে হবে। আপাততঃ আপনাদের ডাকে যত শশাভাযাত্রা, বিক্ষোভ-মিছিল এবং জনসভা হবে, তাতে আমরা যােগ দেব; আপনাদের প্রচারপত্র, দেওয়ালপত্র ও পুস্তিকা বিলি করার ব্যাপারেও আমরা সাহায্য করবে।
ইতােমধ্যে আমরা বৃহত্তর কমিটির পক্ষ থেকে একটি নির্দেশনামার মাধ্যমে স্থানীয় এ্যাকশান কমিটিগুলিকে জানিয়ে দিলাম, তারা যেন অবিলম্বে স্থানীয় অধিবাসী এবং এম পি-দের সঙ্গে যােগাযােগ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার অনুকূলে তাদের সমর্থন আদায় এবং প্রয়ােজনবােধে শশাভাযাত্রা ও বিক্ষোভমিছিলের আয়ােজন করে।
১৯
২. বিচারপতি চৌধুরীর লন্ডন আগমন
১৮ই ফ্রেব্রুয়ারী (১৯৭১) বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী (তিনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন) জাতি সংঘের মানবাধিকার কমিশানের অধিবেশনে যােগ দেওয়ার জন্য জেনেভায় আসেন। মার্চ মাসের মাঝামাঝি তিনি ঢাকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে উদ্বেগজনক খবর পান। দ্বিতীয় সপ্তাহের শেষ দিকে জেনেভার একটি পত্রিকা থেকে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দু’জন ছাত্র নিহত হওয়ার সংবাদ পান। এর প্রতিবাদে তিনি ১৫ই মার্চ তারিখে প্রাদেশিক শিক্ষা সচিবকে লিখিত এক পত্রে জানান, “আমার নিরস্ত্র ছাত্রদের উপর গুলি চালনার পর আমার ভাইস-চ্যান্সলার থাকার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই।”
২৬শে মার্চ সকালবেলা বি বি সি-র মাধ্যমে ঢাকার সঙ্গে বহির্বিশ্বের সব যােগাযোেগ ছিন্ন হওয়ার খবর শুনে বিচারপতি চৌধুরী অনুমান করলেন, বাংলাদেশে গুরুতর কিছু একটা ঘটেছে। তিনি অত্যন্ত অস্বস্তি বােধ করলেন। সে দিনের অধিবেশনে গিয়ে তিনি বি বি সি-র খবরের কথা উল্লেখ করে কমিশনের চেয়ারম্যানের অনুমতি নিয়ে লন্ডনে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত প্রকাশ করেন। বিচারপতির পরিবারের অন্য সদস্যরা তার জন্য লন্ডনে অপেক্ষা করছিলেন।
লন্ডন বিমানবন্দরে বিচারপতি চৌধুরীর বড় ছেলে আবুল হাসান চৌধুরী (বর্তমানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্টেট মিনিস্টার) এবং পাকিস্তান হাই কমিশানে। নিয়ােজিত বাঙালী অফিসার হাবীবুর রহমান তাকে অভ্যর্থনা জানান। দক্ষিণ লন্ডনের ব্যালহাম এলাকায় গসবার্টন রােডের একটি ভাড়াটে বাড়িতে তিনি উঠলেন। আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) এবং বিভিন্ন বামপন্থী দলের নেতা ও কর্মীরা তার সঙ্গে দেখা করে তাদের কার্যকলাপ ব্যাখ্যা করেন। এদের মধ্যে ছিলেন সুলতান মাহমুদ শরীফ, মিনহাজউদ্দিন এবং বি এইচ তালুকদার। মাওপন্থী দলের কোনাে নেতা কিংবা কর্মী বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করেননি।
১০ই এপ্রিল বিচারপতি চৌধুরী বি বি সি-র সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে অত্যন্ত আবেগপূর্ণ ভাষায় পাকিস্তান সৈন্যবাহিনী কর্তৃক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও
২০
শিক্ষক হত্যার কথা বর্ণনা করেন। এই হত্যাকাণ্ডের কথা তিনি বিশ্ববাসীকে জানাবেন এবং দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত দেশে ফিরবেন না বলে প্রতিজ্ঞা করেন। ভারতীয় সংবাদপত্রে এই সাক্ষাৎকারের বিবরণ পড়ে “মুজিবনগর”-এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা সবাই অত্যন্ত খুশী হন। তাজউদ্দিন আহমদ বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে যােগাযােগ করার জন্য ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামকে নির্দেশ দেন। ১২ই এপ্রিল তিনি বিচারপতির সঙ্গে যােগাযােগ করেন (৪) আমিরুল ইসলাম বিচারপতি চৌধুরীকে বলেন, বাংলাদেশের যে-সব নেতৃবৃন্দ ভারতে এসেছেন তারা শীঘ্রই প্রবাসী সরকার গঠন করবেন এবং তাজউদ্দিন আহমদ প্রধানমন্ত্রী হবেন। তিনি বিচারপতি চৌধুরীকে বিশেষ প্রতিনিধি পদে নিয়ােগ করতে চান। তার সম্মতি নেওয়ার জন্য আমিরুল ইসলামকে দায়িত্ব দেওয়া। হয়েছে।
বিচারপতি চৌধুরী বলেন, “আপনাদের সঙ্গে কোনােরূপ যােগাযােগ না হলেও আমি স্বাধীনতা আন্দোলনে ব্যক্তিগতভাবে কাজ করে যাচ্ছি। আমি ধন্যবাদের সঙ্গে বিশেষ প্রতিনিধিরূপে কাজ করার সম্মতি জানাচ্ছি।”
আমিরুল ইসলাম বলেন, মন্ত্রীসভা শীঘ্রই শপথ গ্রহণ করবে এবং তার পরই বিচারপতি চৌধুরীর নিয়ােগপত্র পাঠিয়ে দেওয়া হবে। ১৭ই এপ্রিল মুজিবনগর”এ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ২১শে এপ্রিল বিচারপতি চৌধুরীর নিয়ােগপত্রে অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম স্বাক্ষরদান করেন। এই নিয়ােগপত্র সঙ্গে নিয়ে লন্ডন-প্রবাসী বাঙালী ব্যবসায়ী রকিবউদ্দিন ২৩শে এপ্রিল কলকাতা থেকে লন্ডন পৌঁছান।
বিচারপতি চৌধুরী কাউন্সিল ফর দি পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ ইন ইউ কে গঠনের সংবাদ পেয়েছিলেন। তিনি আমাদের সঙ্গে যােগাযােগের চেষ্টা করছিলেন। গাউস খানের অনুরােধক্রমে আমি বিচারপতি চৌধুরীকে টেলিফোন করে তাকে আমাদের সংগঠনের নেতৃত্ব গ্রহণ করার অনুরােধ জানাই। কাউন্সিলের সাফল্য কামনা করে বিচারপতি চৌধুরী বলেন, তিনি বিশেষ কোনাে দল বা প্রতিষ্ঠানে যােগ দেবেন না।
১৬ই এপ্রিল হলওয়ে এলাকায় ব্যারিস্টার রুহুল আমিনের বাড়িতে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকে কাউন্সিল ফর দি পিপল্স-রিপাবলিক অব বাংলাদেশ ইন ইউ কে-র প্রেসিডেন্ট হিসাবে গাউস খান, সেক্রেটারি হিসাবে আমি নিজে, শাখাওয়াত হােসেন, জাকারিয়া খান চৌধুরী, আমীর আলী, শামসুল মুর্শেদ, শামসুল হুদা হারুণ, আবদুল হামিদ এবং আরাে কয়েকজন উপস্থিত ছিলেন। এই বৈঠকে বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে গাউস খানের প্রথম সাক্ষাৎ হয়।
২১
বিচারপতি চৌধুরী জানতে চান, আমাদের আন্দোলন কত দূর এগিয়েছে, দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে আমরা সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল কি-না, আমাদের কি প্রােগাম, ” আমরা কেন বিভিন্ন দলে বিভক্ত, আমরা কেন এক হতে পারি না, ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব প্রশ্নের জবাব আমরা ধীরে ধীরে সেখানে দিই।
আলােচনাকালে যে-কথাগুলাে আমি বিশেষভাবে বলেছি, তা হচ্ছে, এই আন্দোলনে আমরা এ-যাবৎ যে ভূমিকা পালন করেছি, তা পুরােপুরি সফল না হনেও একে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব যদি সবাই এগিয়ে আসেন এবং বিচারপতি চৌধুরীও আমাদের সঙ্গে যােগ দেন। গাউস খান বলেন, আন্দোলনের স্বার্থে প্রয়ােজন হলে তিনি পদত্যাগ করবেন। বিচারপতি চৌধুরী প্রেসিডেন্ট পদ গ্রহণে রাজী হলে তিনি বিনা দ্বিধায় তাঁর সঙ্গে কাজ করবেন। বিচারপতি চৌধুরীর পক্ষে কোনাে প্রতিষ্ঠানে যােগ দেওয়া কেন সম্ভব নয়, তা’ তিনি ব্যাখ্যা করেন এবং স্বাধীনতা আন্দোলন সম্পর্কিত কার্যাবলীর সমন্বয় সাধনের উদ্দেশ্যে একটি কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের আবেদন জানান। রাত্রি দু’টো পর্যন্ত আলােচনার পরও কমিটির কাঠামাে তৈরি করা সম্ভব হয়নি। পরদিন আবার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকে বিচারপতি চৌধুরী বলেন, কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের ব্যাপারে একমত না হলে তিনি আর ঘরােয়া বৈঠকে যােগদান করবেন না। তা সত্ত্বেও সেদিন কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি।
এখানে আমার কিছু ব্যক্তিগত কথা আছে। আমার মনে প্রশ্ন ছিল—একটি বিত্তবান পরিবারের মানুষ, যিনি শৈশব থেকেই সমৃদ্ধির মধ্যে একটা বিশেষ পরিবেশে মানুষ হয়েছেন, একটা বিশেষ রাজনীতিতে বিশ্বাস করেছেন এবং তার পিতাও সেই রাজনীতি করেছেন, হঠাৎ করে তাকে আমরা কিভাবে আমাদের মুক্তি-আন্দোলনে যােগদান করবেন বলে আশা করতে পারি! তার রাজনৈতিক বিশ্বাস এবং আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের পটভূমির পরিপ্রেক্ষিতে তিনি কতটুকু কাজ করতে পারবেন, সে সম্বন্ধেও আমার মনে প্রশ্ন ছিল। এই পরিবেশ থেকে এসে তিনি কোনাে গণআন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে পারবেন বলে আমি ভাবতেও পারিনি। আমরা ইউরােপ ও আমেরিকার বুদ্ধিজীবী, চিন্তাবিদ, শিক্ষাবিদ এবং রাজনীতিবিদদের কাছে যে-সব কাগজপত্র পাঠিয়েছি, তার মধ্যে বলা হয়েছে—বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর আমাদের মাতৃভূমি থেকে আমরা চিরদিনের জন্য দারিদ্র্য, শােষণ ও লাঞ্ছনার অবসান ঘটাবাে। জরাজীর্ণ সমাজের পরিবর্তে সুন্দর, গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক-সমাজ প্রতিষ্ঠা করবে। সে সমাজে ধনীর স্বার্থ রক্ষা ও গরিবদের শশাষণের পরিবর্তে জাতীয় মর্যাদাবােধ সম্পদে আত্মসচেতন একটি জাতি ও শশাষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে। গণতন্ত্র হবে
২২
গণমুক্তির হাতিয়ার। ৬-দফার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আমরা আমাদের প্রােগ্রাম তৈরি করেছি এবং পৃথিবীর বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীরা তার প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছেন। বিচারপতি চৌধুরী কি তার সাথে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারবেন! এ নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি। তার নিরাপদ পরিবেশ থেকে এসে তিনি বিদেশের রাস্তাঘাটে অসহায় অবস্থায়, এতাে স্বার্থত্যাগ করে এগােতে পারবেন বলে আমি তখন বিশ্বাস করিনি। কিন্তু ধীরে ধীরে আমি তার মানসিকতা বুঝতে পেরেছি।
অনেকে দাবি কবেছেন তারাই বিচারপতি চৌধুরীকে স্বাধীনতা আন্দোলনে নামিয়েছিলেন। এই দাবি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন এবং উদ্দেশ্যপ্রণােদিত বলে আমি মনে করি। কারণ, তিনি নিজের মনে অঙ্ক কষেছেন। দেশের পরিস্থিতি তখন কোথায়, সে সম্বন্ধে মনে মনে বিশ্লেষণ করে তিনি সিদ্ধান্তে পৌছান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হত্যার সংবাদ তার মনে একটা বিরাট রেখাপাত এবং গভীর বেদনার সৃষ্টি করে। ছাত্রদের নির্বিচারে হত্যা করার পর তিনি শুধু সংবাদমাধ্যম থেকেই পাননি, ব্যক্তিগত সত্রেও বিস্তারিত বিবরণ পেয়েছেন। তখনই তিনি সিদ্ধান্ত করেন, স্বাধীনতা ছাড়া আমাদের আর কোনাে পথ নেই, কোনাে দেওয়া-নেওয়ার প্রশ্ন নেই, কোনাে আপস নেই, পাকিস্তানের মৃত্যু হয়েছে। কখন উনি আমাদের সঙ্গে আসবেন, কি ভাবে আসবেন, সে সম্বন্ধে তখনও তার মনে কিছু দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল, এটি সত্যি। কিন্তু তিনি নিজেই মনে মনে স্থির-সিদ্ধান্ত করেছিলেন, সম্পূর্ণভাবে স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত তিনি দেশে ফিরবেন না।
বিচারপতি চৌধুরী পরে আমাকে বলেন, এক বিয়ের বাড়িতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার দেখা হয়। একটি সােফা”-য় তিনি বসেছিলেন। বঙ্গবন্ধু এসে তার পাশে বসেন এবং তাঁর (বিচারপতি) কাঁধে হাত রেখে বললেন, “চৌধুরী সাহেব, বড় একটা কাজ করতে হবে আপনাকে। এক বৃহত্তর কাজের জন্য আপনি প্রস্তুত হন। অনেক, অনেক কাজ আপনার জন্য আছে।” বিচারপতি চৌধুরী আমাকে বলেন, “তখন তাে আমি বুঝতে পারিনি; আর নিয়তি এমনই হলাে, আমি যখন বাইরে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজে যাই, বাইরে আছি, বিদেশে আছি, তখন এই বিরাট প্রলয়কাণ্ড, এই অমানুষিক অত্যাচার, এই নরহত্যা, এই ছাত্রহত্যা। এটা তাে বঙ্গবন্ধু আমার কাধে হাত রেখে বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘চৌধুরী সাহেব, আপনাকে অনেক, অনেক কাজ করতে হবে। এটা কি করে এমনভাবে সম্ভব হলাে, তার এই অনুরােধ পরবর্তীকালে বাস্তবে পরিণত হলাে আমার মনের বেদনা এবং দেশাত্মবােধের মাধ্যমে! বঙ্গবন্ধু কী চেয়েছিলেন, এখন আমি বুঝতে পারলাম। কিন্তু এটা কী করে সম্ভব হলাে—আমি বিদেশে থাকবাে এবং আমার উপর একটা দায়িত্ব আসবে। সে উত্তর আমি খুঁজে পাই না।”
২৩
আমাদের সঙ্গে কাজ করার আগে একটা প্রশ্ন হয় তাে বিচারপতি চৌধুরীকে উতলা করেছে। ব্যক্তিগত সম্পত্তি, পিতার স্মৃতি এবং বাড়িঘরসহ বিরাট সম্পত্তির এধিকারী ছিলেন তিনি। সম্পত্তি এবং সম্মান—দুটোই হারাবার আশঙ্কায় তিনি উদ্বিগ্ন ছিলেন। কিন্তু নিজের সঙ্গে নিজেই বােঝাপড়া করে তিনি স্থির করেন, তার আর কোনাে পথ নেই; সর্বস্ব যদি ধূলিসাৎ হয়ে যায়, জীবনও যদি চলে যায়, তবুও আর কোনাে রাস্তা তাঁর সামনে খােলা নেই।
বঙ্গবন্ধুকে (তখনও সম্মানসূচক বঙ্গবন্ধু নামটি বহুল প্রচলিত নয়) আমরা কখনাে নেতা বলেছি, কখনাে শেখ মুজিব বলেছি; কিন্তু বিচারপতি চৌধুরী কোনাে দিন ব্যক্তিগত আলাপ-আলােচনায় কিংবা প্রকাশ্য সভায় বঙ্গবন্ধু ছাড়া কথা বলেননি। সেন্ট্রাল কমিটির সদস্যদের কেউ যখনই বঙ্গবন্ধুর সমালােচনা করতে চেয়েছেন কিংবা আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব মানতে ইতস্তত করেছেন, তখনই তিনি আমার সামনেই বলেছেন, “আপনারা কি এটা অস্বীকার করতে চান—-জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের যিনি একচ্ছত্র অধিপতি, তিনি আওয়ামী লীগের প্রধান; একথাটা আপনারা ভুলে যাবেন না।”
স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বিচারপতি চৌধুরীর প্রকৃত মনােভাব কি আমরা জানতে পেরেছি? এ সম্পর্কে অনেকের মনে প্রশ্ন ছিল। আমি বলবাে, তার মনােভাব আমরা জেনেছি; তার কাছ থেকেই জানার সুযােগ আমার হয়েছে।
‘মুজিবনগর সরকারের নির্দেশ ছিল—পূর্ণক্ষমতাপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত (Ambassador Plenipotentiary) হিসাবে বহির্বিশ্বের আন্দোলনে বিচারপতি চৌধুরী নেতৃত্ব দেবেন। দু’টি জরুরী দায়িত্ব তাঁকে দেওয়া হয়। প্রথমতঃ বাংলাদেশের জীবনমরণ সংগ্রামকে বাঙালী জাতির মুক্তি আন্দোলন হিসাবে তাকে তুলে ধরতে হবে। দ্বিতীয়তঃ বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের আহ্বান অনুযায়ী আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে প্রবাসী বাঙালীদের যে যেখানে আছেন, সেখানেই কাজ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে কাজ করার কথা বিচারপতি চৌধুরী কখনও বলেননি। দুর্ভাগ্যবশতঃ যুক্তরাজ্যে আন্দোলনের নেতৃত্ব এককভাবে আওয়ামী লীগের হাতে থাকেনি; অন্যের সঙ্গে সম্মান্বিত হয়ে থেকেছে। যেমন : বাংলাদেশ স্টুডেন্টস্ এ্যাকশান কমিটির ১১জন সদস্যের মধ্যে ৮জনই আওয়ামী লীগ দলভুক্ত ছিলেন না। পরবর্তীকালে এ্যাকশান কমিটিগুলির কার্যকলাপের সমন্বয় সাধনের জন্য গঠিত স্টিয়ারিং কমিটির পাচজন সদস্যের মধ্যে একমাত্র আজিজুল হক ভূংস আওয়ামী লীগ মনােভাবাপন্ন ছিলেন। আমি নিজে আওয়ামী লীগের আদি 4″ একজন সাধারণ কর্মী হওয়া সত্তেও পঞ্চাশের দশকে আমার রাজনে চিন্তাধারার পরিবর্তনের জন্য দূরে সরে যাই; কিন্তু বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামা লাসঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক কখনও শিথিল হয়নি।
২৪
যাই হােক, মােদ্দা কথা হচ্ছে–“মুজিবনগর” থেকে বিচারপতি চৌধুরী একটি সুচিন্তিত নির্দেশ পেয়েছেন। এই নির্দেশে বলা হয়, বাংলাদেশের যুদ্ধ আওয়ামী লীগের যুদ্ধ নয়, বাঙালী জাতির যুদ্ধ। বাংলাদেশের জনগণ জাতীয় মুক্তি অর্জনের জন্য লড়াই করছে এবং তারা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। তাদের এই বাণী সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়াই হবে বিচারপতি চৌধুরীর প্রধান কর্তব্য। এই বাণীর কথা তিনি কখনও ভােলেননি।
বিচারপতি চৌধুরী মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ এবং অন্যান্য সদস্যের সঙ্গে টেলিফোনে আলাপ করেন। তাঁরা বলেন, বহির্বিশ্বে স্বাধীনতার আন্দোলন যেন দলীয় রাজনীতির গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকে। কিন্তু তাকে স্মরণ রাখতে হবে, আওয়ামী লীগ ৬-দফা দিয়েছে, স্বাধীনতা ঘােষণা করেছে এবং স্বাধীনতা ঘােষণার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে। কাজেই তার প্রাধান্য থাকবেই কিন্তু বহির্বিশ্বে জাতীয় ঐক্যের কথা জোর দিয়ে বলতে হবে।
২৫
৩. কভেন্ট্রি সম্মেলন
যুক্তরাজ্যে স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কিত কার্যকলাপের সমন্বয় সাধনের ব্যাপারে এ্যাকশন কমিটিগুলির কর্তব্য নির্ধারণের জন্য এপ্রিল মাসের তৃতীয় সপ্তাহে পূর্ব লন্ডনের আর্টিলারী প্যাসেজে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা মতিউর রহমান চৌধুরী (দিলশাদ রেস্তোরাঁর মালিক) হলের ব্যয়ভার বহন করেন। বিভিন্ন এ্যাকশান কমিটির প্রতিনিধিরা এই বৈঠকে যােগ দেন। পর পর তিন রাত আলােচনার পর ২৩শে এপ্রিল তারিখের বৈঠকে কভেন্ট্রি। শহরে পরদিন (২৪শে এপ্রিল) এ্যাকশান কমিটির প্রতিনিধিদের এক সম্মেলন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এই সম্মেলনে এ্যাকশান কমিটিগুলিকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য একটি কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হবে বলে ঘােষণা দেয়া হয়। ২৩শে এপ্রিল তারিখের বৈঠকে কাউন্সিল ফর দি পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ ইন ইউ কে-র সভাপতি গাউস খানসহ কেন্দ্রীয় কমিটির ১১জন সদস্য পদত্যাগের কথা ঘােষণা করেন। যুক্তরাজ্যের প্রত্যেকটি এ্যাকশান কমিটির প্রতিনিধিদের এই সম্মেলনে যােগদানের আমন্ত্রণ জানান হয়। সভার উদ্যোক্তারা বিচারপতি চৌধুরীকে সম্মেলনে উপস্থিত থাকার জন্য সনির্বন্ধ অনুরােধ জানান।
কভেন্ট্রি সম্মেলনের আয়ােজন করার দায়িত্ব যারা নিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন হাজী আবদুল মতিন (ম্যাঞ্চেস্টার), দবীরউদ্দিন (লুটন), শামসুর রহমান। (পূর্ব লন্ডন), আজিজুল হক ভূঁইয়া (বার্মিংহাম), মনােয়ার হােসেন (ইয়র্কশায়ার) এবং এ এম তরফদার (ব্র্যাডফোর্ড)। আমিও তাদের সঙ্গে ছিলাম।
বৃহত্তর লন্ডনের ১৪টি কমিটির ১৪জন প্রতিনিধি এবং নেতৃস্থানীয়দের মধ্যে গাউস খান, মিনহাজউদ্দিন, তৈয়বুর রহমান, আজিজুর রহমান, ব্যারিস্টাম শাখাওয়াত হােসেন, জিয়াউদ্দিন মাহমুদ, জাকারিয়া খান চৌধুরী এবং মাৎ রহমান চৌধুরীসহ আমরা একটি কোচযােগে ২৪শে এপ্রিল (শনিবার) ক পৌছালাম। স্থানীয় একটি মিলনায়তনে সম্মেলনের কাজ শুরু হয়। এই সমে বিভিন্ন এ্যাকশান কমিটির পক্ষ থেকে ১২৫জন প্রতিনিধি ও ২৫জন পর্যবে যােগদান করেন। সকল দলের পক্ষ থেকে বিচারপতি চৌধুরীকে সম্মেলনে
২৬
সভাপতিত্ব করার অনুরােধ জানান হয়। তিনি তাতে রাজী না হয়ে মিসেস লুল বিলকিস বানুর নাম সভানেত্রী হিসাবে প্রস্তাব করেন। মিসেস বানু উইমেন্স এ্যাকশান কমিটির প্রতিনিধি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন। বিচারপতির প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।
সভার কাজ শুরু হওয়ার পর বিচারপতি চৌধুরীর জন্য “মুজিবনগর সরকার প্রদত্ত নিয়ােগপত্র পড়ে শােনানাে হয় । “মুজিবনগর সরকারের পক্ষ থেকে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী রকিবউদ্দিন পত্রখানি আনুষ্ঠানিকভাবে তার হাতে তুলে দেন। বিচারপতি চৌধুরী তার উদ্বোধনী বক্তৃতায় সকল দলের সমর্থনপুষ্ট ও সকলের বিশ্বাসভাজন একটি কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের জন্য আবেদন জানান।
প্রস্তাবিত কেন্দ্রীয় এ্যাকশান কমিটির সদস্যদের নামের তালিকা তৈরি করার ব্যাপারে অচলাবস্থা দেখা দেয়। বহু আলাপ-আলােচনার পর “এ্যাকশান কমিটি ফর দি পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ ইন ইউ কে” নামের একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব গৃহীত হয়। সংগঠনের কার্য পরিচালনার জন্য পাঁচ-সদস্যবিশিষ্ট একটি স্টিয়ারিং কমিটি গঠন করা হয়। স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য হিসাবে (১) আজিজুল হক ভূঁইয়া, (২) কবীর চৌধুরী, (৩) মনােয়ার হােসেন, (৪) শেখ আবদুল মান্নান ও (৫) শামসুর রহমানের নাম ঘােষণা করা হয়। এই পাঁচজনের ওপর আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া এবং বৃহত্তর কমিটি গঠনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তাছাড়া স্টিয়ারিং কমিটির প্রথম বৈঠকে একজন আহ্বায়ক নিয়ােগ করা হবে বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। অপর এক প্রস্তাবে যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় সংগঠিত এ্যাকশান কমিটিগুলিকে কেন্দ্রীয় কমিটির শাখার মর্যাদা দেওয়া হয়।
কেন্দ্রীয় এ্যাকশান কমিটির চেয়ারম্যান হওয়ার জন্য বিচারপতি চৌধুরীকে অনুরােধ জানান হয়। “মুজিবনগর সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি হিসাবে অন্য কোনও পদ গ্রহণ করা তাঁর পক্ষে অনুচিত হবে বলে তিনি অভিমত প্রকাশ করেন। তার ফলে সম্মেলনে স্থির করা হয়, কেন্দ্রীয় কমিটি তার সঙ্গে পরামর্শ করে কাজ করবে।
কভেন্ট্রি সম্মেলনে শুধু আওয়ামী লীগ ও ডেমােক্রেটিক ফ্রন্টের নেতা ও কর্মীরা যােগ দিয়েছিলেন তা নয়। সাধারণভাবে বামপন্থী হিসাবে পরিচিত রাজনৈতিক কর্মীরাও সম্মেলনে যােগ দেন। এদের মধ্যে ছিলেন জিয়াউদ্দিন মাহমুদ, জগলুল হােসেন, ব্যারিস্টার লুৎফুর রহমান শাজাহান, আবু মূসা, মেসবাহউদ্দিন ও ব্যারিস্টার শাখাওয়াত হােসেন। বামপন্থীদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন মাওপন্থী। এদের মধ্যে জিয়াউদ্দিন মাহমুদ ছিলেন স্পষ্টভাষী ।
২৭
সম্মেলেনে উত্থাপিত প্রস্তাবগুলি সম্পর্কে আলােচনাকালে শাখাওয়াত হােসেন ভিন্ন মত প্রকাশ করেন। তার বক্তব্য তিনি বেশ জোরালাে ভাষায় প্রকাশ করেন। কিন্তু তার মতামত গৃহীত হয়নি। কডেন্ট্রি থেকে ফিরে এসে শাখাওয়াত হােসেন। ছাড়া অন্যান্য বামপন্থী নেতা সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাবাবলীর পক্ষে থাকেননি। নিজেদের আদর্শ অনুযায়ী পৃথক সংগঠনের মাধ্যমে তারা মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তাদের ভিন্ন প্রচারণা চালাতে থাকেন।
কাউন্সিল ফর দি পিপল’স রিপাবলিক অব বাংলাদেশ ইন ইউ কে” গঠিত হওয়ার পর ২২ নম্বর উইন্ডমিল স্ট্রীটে আমরা একটি সাংবাদিক সম্মেলনের জয়েন করি। গাউস খান ও অন্য নেতৃবৃন্দকে আমি সাংবাদিকদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেই। “ওয়াকার্স প্রেস” (কিংবা “স্যোস্যালিস্ট প্রেস”) থেকে একজন সাংবাদিক জানতে চান, উপস্থিত নেতৃবৃন্দের মধ্যে কেউ কমিউনিস্ট কিংবা মক্সীয় মতবাদে বিশ্বাস করেন কি-না। তখন জিয়াউদ্দিন মাহমুদ হাত উচু করে বলেন, তিনি মার্ক্সসিস্ট-লেনিনিস্ট এবং মাও সেতুং-এর চিন্তাধারার প্রতি আস্থাশীল। এই উপলক্ষে প্রদত্ত এক দীর্ঘ বক্তৃতায় তিনি দীর্ঘস্থায়ী গেরিলাযুদ্ধের মাধ্যমে কি ভাবে দেশের মুক্তি আসবে, তা ব্যাখ্যা করে বলেন, সেই মুক্তিই হবে আসল মুক্তি, অন্যের উপর নির্ভরশীল মুক্তি নয়। সম্প্রসারণবাদী” ভারত এবং সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী” রাশিয়ার সেখানে কোনাে প্রভাব থাকবে না। আমরা সম্পূর্ণ মুক্ত হবে।
কভেন্ট্রি সম্মেলন থেকে কোচযােগে লন্ডনে ফিরে আসার পথে আমি কাউন্সিল ফর দি পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ ইন ইউ কে ভেঙ্গে দিয়ে লন্ডন এলাকার জন্য কেন্দ্রীয় এ্যাকশান কমিটির একটি শাখা গঠনের প্রস্তাব করি। এই প্রস্তাব অনুযায়ী ২৬শে এপ্রিল পূর্ব লন্ডনের হ্যাসেল স্ট্রীটে হাফেজ মনির হােসেনের দোকানে একটি সভার আয়ােজন করা হয়। এই সভায় উপস্থিত ছিলেন শামসুর রহমান (সভাপতি), জিলুর রহমান, আমীর আলী, ড: নূরুল হােসেন, মিনহাজউদ্দিন এবং আরাে অনেকে। নেতৃস্থানীয় একজন প্রস্তাবিত লন্ডন কমিটির সভাপতি হিসাবে মিনহাজউদ্দিনকে নির্বাচনের অনুরােধ জানান। আমি প্রেসিডেন্ট ও সেক্রেটারী হিসাবে যথাক্রমে গাউস খান ও ব্যারিস্টার শাখাওয়াত হােসেনের নাম প্রস্তাব করি। তারা দু’জনেই অনুপস্থিত ছিলেন। বিস্তারিত আলােচনার পরও আমার প্রস্তাব সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। তখন মিনহাজউদ্দিন একা বিরাট ব্যক্তিত্ব এবং আত্মত্যাগের পরিচয় দেন। তিনি গাউস খান সম্পর্কে আমল প্রস্তাব মেনে নেন। সাখাওয়াত হােসেন সম্পর্কে আমার প্রস্তাবও সবাই মেনে নেন। পাউস খান খুশি হননি; তিনি আশা করছিলেন প্রস্তাবিত কেন্দ্রীয় এ্যাকশান
২৮
কমিটিতে তার স্থান হবে। শেষ পর্যন্ত তিনি লন্ডন কমিটির প্রেসিডেন্ট পদ গ্রহণ করতে রাজী হন। কমিটির অফিস হিসাবে ব্যবহার করার জন্য ৫৮ নম্বর বেরিক স্ট্রীটে একটি রুমও তিনি দিয়েছিলেন।
এই শাখা কমিটি “লন্ডন এ্যাকশান কমিটি ফর দি পিপলস রিপাবলিক অব। বাংলাদেশ” নাম গ্রহণ করে। আমীর আলীর সম্পাদনায় কমিটির মুখপত্র হিসাবে “জয় বাংলা” শীর্ষক একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার ৪টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়।
কিছুকাল পর লন্ডন কমিটি একটি সংবিধান প্রণয়ন করে গ্রেটার লন্ডন কমিটি নাম গ্রহণ করে। গঠনতন্ত্র প্রণয়নের পর বিভিন্ন কারণে কমিটির সদস্যদের মধ্যে উৎসাহের অভাব দেখা দেয়। সাখাওয়াত হােসেন সেক্রেটারী পদ থেকে ইস্তফা দেন। আমীর আলীও কমিটির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন।
স্টিয়ারিং কমিটির প্রথম বৈঠকের জন্য ২১ নম্বর রােমেলি স্ট্রীটে অবস্থিত একটি রেস্তোরার বেসমেন্ট পাওয়া যাবে বলে তাসাদ্দক আহমদ আমাদের জানালেন। কভেন্টি সম্মেলনের সভানেত্রী সুলু বিলকিস বানুকে আমাদের প্রথম বৈঠকে সভানেত্রী হিসাবে কাজ করার জন্য আমি আমন্ত্রণ জানালাম। ম্যাঞ্চেস্টার থেকে কবীর চৌধুরী (বর্তমানে ড: কবীর চৌধুরী), ব্র্যাডফোর্ড থেকে মনােয়ার হােসেন, বার্মিংহাম থেকে আজিজুল হক ভূঁইয়া এবং লন্ডন থেকে শামসুর রহমান ও আমি বৈঠকে যােগদান করি। বিচারপতি চৌধুরীর উপস্থিতিতে বৈঠক শুরু হয়। বৈঠক শেষে বিচারপতি বলেন, একটি রেস্তোরার বেসমেন্টে বৈঠক করে আমাদের আলাপ-আলােচনা এবং সিদ্ধান্ত গােপন রাখা সম্ভব হবে না। শীঘ্রই নিরাপদ পরিবেশে একটি অফিসের ব্যবস্থা করতে হবে।
৩০শে এপ্রিল আমার রাসেল স্ট্রীটের বাড়িতে স্টিয়ারিং কমিটির দ্বিতীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বিচারপতি চৌধুরীর উপস্থিতিতে এই বৈঠকে আমাদের কর্তব্য, কর্মপদ্ধতি ও কৌশল সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। কবীর চৌধুরী কমিটির আহ্বায়ক হিসাবে নিয়ােগের জন্য আমার নাম প্রস্তাব করেন। বাকী সদস্যরা তাকে সমর্থন করেন। আমি বললাম, “কাজটা আমাকে দেন, কিন্তু নামটা আমাকে দেবেন না। আমি আমার সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন ছিলাম। তাই আমার চেয়ে অল্পবয়স্ক কাউকে আহ্বায়ক নিয়ােগ করার অনুরােধ জানালাম। বিচারপতি চৌধুরী অনেকক্ষণ ধরে আমাকে বােঝাবার চেষ্টা করলেন। শেষে বললেন, “আপনি অভিজ্ঞ, আপনি রাজনীতি করেছেন, বাকী চারজন রাজনীতি করেননি। অতএব, আপনার এই দায়িত্ব নেওয়া উচিত। তাকে আমি বুঝিয়ে বললাম, কাজটা যদি আমি করি, নামটা আমি নিতে চাই না। আমি অঙ্গীকার করছি, কাজ আমি করবাে। তখন আজিজুল হক ভূঁইয়াকে আমরা আহ্বায়ক নিয়ােগ করি।
২৯
হােসেনের পরিবর্তে আমাদের বৈঠকে যােগদানের আমন্ত্রণ জানাই। তিনি বৈঠকে উপস্থিত হতে না পারলেও আমাদের সঙ্গে সরাসরি যােগাযােগ রাখবেন বলে ঠিক হলাে। ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি আমাদের সঙ্গে কাজ করেছেন। অনুরূপভাবে মননায়ার হােসেনও ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষা করেছেন এবং কোচভর্তি লােকজন নিয়ে এসে আমাদের বিক্ষোভ-মিছিল ও জনসভায় যােগ দিয়েছেন। পঁচিশ বছর পর আজ আমি জোর দিয়ে বলতে চাই, আমার বিশ্বাস সেদিন যেমন ছিল। আজও তাই আছে। মনােয়ার সাহেব কোনাে তারবার্তা পাঠাননি এবং বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ও পাকিস্তানের পক্ষে কোনাে কথাই বলেননি।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার অব্যবহিত পর আমাদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা লন্ডনস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের সঙ্গে যােগাযােগ স্থাপন করেন। স্টুডেন্টস এ্যাকশান কমিটির পক্ষ থেকে সুলতান মাহমুদ শরীফ এবং আরাে কয়েকজন ভারতীয় হাই কমিশনার আপা পন্থের সঙ্গে দেখা করেন। লন্ডন আওয়ামী লীগের সভাপতি মিনহাজউদ্দিনের সঙ্গে ভারতীয় হাই কমিশানের ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ ছিল। মূলতঃ তারই প্রচেষ্টায় তিনজন ছাত্রনেতাকে আপা পন্থের সৌজন্যে ভারতে পাঠানাে সম্ভব হয়। ৭ই এপ্রিল সুলতান মাহমুদ শরীফ, মােহাম্মদ হােসেন মঞ্জু ও মাহমুদ হােসেন লন্ডন থেকে কলকাতা রওয়ানা হন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, পাকিস্তানী নির্যাতন ও মুক্তিযােদ্ধাদের অসীম সাহস ও বীরত্বপূর্ণ তৎপরতা সম্পর্কিত তিনটি প্রামাণ্য চলচ্চিত্র সঙ্গে নিয়ে তারা প্রায় তিন মাস পর লন্ডনে ফিরে আসেন।
পরবর্তীকালে আপা পন্থের সঙ্গে গাউস খানের সরাসরি যােগাযােগ স্থাপিত হয়। তার সঙ্গে গাউস খানের সাক্ষাৎকালে তৈয়েবুর রহমান, ম্যাঞ্চেস্টারের হাজী আবদুল মতিন এবং বার্মিংহামের এ কে এম হক উপস্থিত ছিলেন।
৩১
৪. বিভিন্ন এ্যাকশান কমিটি
২৮শে মার্চ পশ্চিম লন্ডনের ১০৩ নম্বর লেডবেরী রােডে মিসেস জেবুন্নিসা বসের বাড়িতে বাঙালী মহিলাদের সমাবেশে মিসেস বক্স ও মিসেস সূল বিলকিস বানুর উদ্যোগে বাংলাদেশ মহিলা সমিতি (এ্যাকশান কমিটি) গঠিত হয়। মিসেস ব সর্বসম্মতিক্রমে প্রেসিডেন্ট মনােনীত হন। ফেরদৌস রহমান, আনােয়ারা জাহান ও মুন্নি রহমান জনসংযােগের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সমিতির উৎসাহী সমর্থক ও নেত্রীদের মধ্যে আরাে ছিলেন মিসেস সােফিয়া রহমান, জেবুন্নেসা খায়ের ও ড: হালিমা আলম।
মহিলারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাদের সমিতি গড়ে তােলেন। তাদের মধ্যে কেউ ছিলেন গৃহবধূ, কেউ শিক্ষক কিংবা ছাত্রী, কেউ বা অফিস-কর্মচারী। বাংলাদেশে গণহত্যার প্রতিবাদে তারা রাস্তায় নেমে এলেন। দীর্ঘ নয়-মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধকালে বিভিন্ন কর্মকান্ডের মাধ্যমে তারা সাহস ও কর্তব্যপরায়ণতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। তাঁরা স্টিয়ারিং কমিটির পক্ষ থেকে প্রচারপত্র বিলি করেছেন, দেওয়ালপত্র ও প্ল্যাকার্ড লিখেছেন এবং বাংলাদেশের পতাকা তৈরি করেছেন। বিভিন্ন সভা, শােভাযাত্রা এবং বিক্ষোভেও তাঁরা যােগদান করেন। সমিতির উদ্যোগে একটি শােভাযাত্রা “সেভ দি চিলড্রেন ফান্ড”-এর অফিসে গিয়ে ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারী শিশুদের দুর্বিসহ জীবনযাপন ও হৃদয়বিদারক মৃত্যুর বিবরণ দেয় এবং একটি স্মারকলিপি পেশ করে। ৪ঠা জুন মিসেস বখসের নেত্রীত্বে প্রায় দু’শ মহিলা ও শিশু সেন্ট জেমস পার্ক থেকে মিছিল করে ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রীটে গিয়ে। প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথের নিকট একটি স্মারকলিপি পেশ করে। এই স্মারকলিপিতে ইয়াহিয়া সরকারকে সাহায্যদান অব্যাহত রাখার ব্রিট্রিশ সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করার অনুরােধ জানানাে হয়। লুল বিলকিস বানু অক্লান্তভাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেন। তিনি বিভিন্ন শিক্ষাবিদ ও পার্লামেন্ট সদস্যদেশ সঙ্গে দেখা করে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করেন। তাছাড়া “ওয়ার ওয়ান্ট” ও “ক্রিশ্চিয়ান এইড়”-এর কার্যালয়ে গিয়ে বাংলাদেশের নির্য গণমানুষের জন্য সাহায্যেরও আবেদন জানিয়েছেন।
৩২
এই উপলক্ষে একটি দুঃখজনক ঘটনার কথা উল্লেখ করতেই হবে। বাংলাদেশ মহিলা সমিতি তিন হাজার পাউন্ড সংগ্রহ করে বিচারপতি চৌধুরীর হাতে তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এই অর্থ কীভাবে ব্যয় করা হবে, সে সম্বন্ধে তিনি নিজেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন।
জুন মাসের মাঝামাঝি জাতীয় শ্রমিক লীগের সভাপতি মােহাম্মদ শাজাহান ও সাধারণ সম্পাদক আবদুল মান্নান বাংলাদেশের স্বাধীনতার অনুকূলে ব্রিটিশ শ্রমিক আন্দোলনের সমর্থন লাভের উদ্দেশ্যে লন্ডন সফরে আসেন। তারা বিচারপতি চৌধুরীকে বলেন, যুদ্ধক্ষেত্রে রাতের অন্ধকারে ব্যবহার করার উদ্দেশ্যে ইনফ্রা-রেড লাইট নিয়ে যাওয়ার জন্য জেনারেল ওসমানী বিশেষভাবে তাদের অনুরােধ করেন। শীঘ্রই তারা সুইটজারল্যান্ডে যাবেন। সেখান থেকে দেশে ফেরার সময় তাঁরা ইফ্রা-রেড লাইট নিয়ে যাবেন। মহিলা সমিতি সংগৃহীত অর্থ তাদের হাতে দেওয়া হলে তারা তার সদ্ব্যবহার করবেন। অনেক চিন্তা-ভাবনা করে মহিলা সমিতির নেত্রী বিচারপতি চৌধুরীকে বললেন, চেক তাঁর হাতেই দেওয়া হবে এবং তিনি তা আওয়ামী লীগের এম পি আবদুল মান্নানের হাতে তুলে দেবেন। নির্দিষ্ট দিনে বিচারপতি চৌধুরী দেশের বাইরে যেতে বাধ্য হন। তিনি টেলিফোন করে মহিলা সমিতির নেত্রীকে বললেন, তার পক্ষ থেকে শেখ আবদুল মান্নান চেকটি গ্রহণ করে মােহাম্মদ শাজাহান ও আবদুল মান্নানকে দেবেন। নির্দিষ্ট দিনে বিকেল তিনটার সময় লন্ডনের সাউথফিল্ডে মিসেস ফেরদৌস রহমানের বাড়িতে গিয়ে আমি চেখানি গ্রহণ করে সেখানেই মান্নান সাহেবের কাছে তা হস্তান্তর করি। কথা ছিল, তারা ইনফ্রা-রেড লাইট কেনার রসিদ আমার কাছে পাঠাবেন। স্টিয়ারিং কমিটি কিংবা সরাসরি মহিলা সমিতির কাছেও তাঁরা রসিদ পাঠাতে পারেন। এই রসিদ কখনও আমার কিংবা মহিলা সমিতির হাতে পৌঁছায়নি। আবদুল মান্নানের সততা সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করে মিসেস বস আমাকে বার বার বলেছেন, “মান্নান ভাই, রসিদটা তাে এখনও পেলাম না। শেষ পর্যন্ত রসিদ পাওয়া যায়নি। ইনফ্রা-রেড লাইট জেনারেল ওসমানী ও তাঁর মুক্তিযযাদ্ধাদের হাতে পৌছেছিলাে কি-না, তা যাচাই করা সম্ভব হয়নি। মহিলা সমিতির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চেকনি হস্তান্তর করা হলেও আমি তার সঙ্গে জড়িত ছিলাম বলে এই দুঃখজনক ঘটনার কথা এখনও আমি ভুলতে পারিনি।
* * * * * * *
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বাঙালী ছাত্রদের সর্বদলীয় এক বিরাট সভায় বিস্তারিত আলােচনার পর ১১-সদস্যবিশিষ্ট বাংলাদেশ স্টুডেন্টস এ্যাকশান কমিটি ইনৃ গ্রেট ব্রিটেন গঠন করা হয়। মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে প্রচারণা চালাবার জন্য ছাত্র
৩৩
এ্যাকশান কমিটিকে হল ভাড়া করা, খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া এবং প্রচারপত্র ও পুস্তিকা প্রকাশের ব্যয় বাবদ প্রয়ােজনীয় অর্থ স্টিয়ারিং কমিটির তহবিল থেকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
৭ই মার্চ যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ আয়ােজিত এক প্রতিবাদ-মিছিলে হাজার হাজার বাঙালী মানুষের সঙ্গে ছাত্ররাও যােগ দেয়। আন্দোলনের প্রথম দিকে তারা দলে দলে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাসবভন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সসাভিয়েত ইউনিয়ন, চীন, ভারত, শ্রীলঙ্কা ও বার্মার দূতাবাসে বার বার গিয়ে স্মারকলিপি ও আবেদনপত্র পেশ করে। তা ছাড়া বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও জাতি সংঘের নিকট প্রেরিত তারবার্তায় বাংলাদেশে পাকিস্তান সৈন্যবাহিনীর গণহত্যাঅভিযানের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। | বাংলাদেশে পাকিস্তানী হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে এবং বাংলাদেশকে কূটনৈতিক স্বীকৃতিদানের দাবিতে বাঙালী ছাত্র শামসুদ্দিন চৌধুরী (মানিক) এবং তাঁর সহকর্মী আফরােজ আফগান ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের নিকটবর্তী রাস্তার ফুটপাথে ২৫শে মার্চ থেকে অনশন শুরু করেন। কয়েক দিন পর শ্রমিক দলীয় পার্লামেন্ট সদস্য পিটার শের-এর অনুরােধে শামসুদ্দিন চৌধুরী ও তার সহকর্মী অনশন ভঙ্গ করেন।
লন্ডনে সর্বপ্রথম অনুষ্ঠিত যে-সভায় বিচারপতি চৌধুরী ও শ্রমিক দলীয় পার্লামেন্ট সদস্য জন স্টোনহাউস বক্তৃতা করেন, সেই সভা ছাত্রদের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয়। পাকিস্তানী ক্রিকেট ‘ মের বিরুদ্ধেও ছাত্ররা বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।
ছাত্র এ্যাকশান কমিটির প্রতিনিধিরা বুডাপেস্টে অনুষ্ঠিত বিশ্ব-শান্তি সম্মেলন ও হল্যান্ডে গঠিত ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশ-এর আমন্ত্রণে এক সাংবাদিক সম্মেলনে যােগদান করে। পারীতে অনুষ্ঠিত ইন্টার-পার্লামেন্টারী ইউনিয়ান-এর সম্মেলন এবং রুমানিয়ায় বিজ্ঞান ও বিশ্ব শান্তি সম্পর্কে অনুষ্ঠিত “পাগওয়াস” সম্মেলনে “লবী” করার জন্যও ছাত্র-প্রতিনিধিদল পাঠানাে হয় ।
ছাত্র এ্যাকশান কমিটির উদ্যোগে লন্ডনের দৈনিক সংবাদপত্রগুলিতে বাংলাদেশ সম্পর্কে মােট চারটি বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়। ২৩শে মার্চ “দি টাইমস”-এ, ২৭শে মার্চ ও ২০শে জুলাই “দি গার্ডিয়ান”-এ এবং ১৬ই অগাস্ট “দি টাইমস”-এ বিজ্ঞাপনগুলি প্রকাশিত হয়। জুলাই মাসের তৃতীয় সপ্তাহে আমেরিকান বার এ্যাসােসিয়েশনের বার্ষিক সম্মেলন লন্ডনে অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেদ যােগদানকারী সদস্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার উদ্দেশ্যে ছাত্র এ্যাকশান কমি একটি খোলা চিঠি” ২০শে জুলাই “দি গার্ডিয়ান পত্রিকায় অর্ধ-পৃষ্ঠাব্যাপা বিজ্ঞাপন হিসাবে প্রকাশের ব্যবস্থা করে। এই খােলা চিঠি”-তে এ্যাসােসিয়ে
৩৪
শানের সদস্যদের লক্ষ্য করে বলা হয়, আইনজীবী হিসাবে আইন ভঙ্গ করা সম্পর্কে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হচ্ছে। তাছাড়া আমেরিকান নাগরিক হিসাবে তারা। বাঙালীদের দুঃখ-দুর্দশা ও নির্যাতনের খবর প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে অবহিত করে এই অমানিশার অবসান ঘটাতে পারেন। ১৬ই অগাস্টের বিজ্ঞাপনে পাকিস্তানের কারাগারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের গােপন বিচারের প্রহসন সম্পর্কেও বিশ্বজনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়।
* * * * * * *
মুক্তিযােদ্ধাদের সরাসরি সাহায্য দানের উদ্দেশ্যে বাঙালী ডাক্তাররা বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যাসােসিয়েশান গঠন করেন। এ ব্যাপারে যারা উদ্যোগ গ্রহণ করেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন ড: জাফরুল্লাহ চৌধুরী, ড: হাকিম, ড: জোয়ারদার, ডা: আহমেদ এবং ড: কাজী। এই প্রতিষ্ঠানটি অত্যন্ত কর্মতৎপর, সতর্ক এবং বিবেকবুদ্ধিসম্পন্ন বলে পরিগণিত হয়।
ড: জাফরুল্লাহ চৌধুরী, ড: মােশাররফ হােসেন জোয়ারদার এবং তাদের আরাে কয়েকজন সহকর্মী গােরিং স্ট্রীটে স্টিয়ারিং কমিটির অফিসে এসে জানতে চান, আমাদের কোনাে আর্থিক সঙ্কট আছে কি-না। আমরা বললাম, আর্থিক সঙ্কটের জন্য আমরা বিচারপতি চৌধুরীকে আমেরিকা পাঠাতে পারছি না। তারা বললেন, বিচারপতির বিমান-ভাড়া তারাই দেবেন। মেডিক্যাল এ্যাসােসিয়েশনের সৌজন্যে বিচারপতি চৌধুরীর প্রথম আমেরিকা সফরের ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়। স্বাধীনতা আন্দোলন কালে তাঁর বিদেশ সফরের খরচ স্টিয়ারিং কমিটির তহবিল থেকে নেওয়ার প্রয়ােজন হয়নি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাঙালীরা প্রয়ােজনীয় অর্থের ব্যবস্থা করেছেন।
* * * * * * *
সংস্কৃতি ক্ষেত্রেও আমাদের কর্মতৎপরতা বজায় ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় ব্রিটেনে দু’টি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গঠিত হয়। তার মধ্যে একটি হলাে মােহাম্মদ। আলীর উদ্যোগে গঠিত “বাংলাদেশ কালচারল এ্যাসােসিয়েশান”। এরা। রাজনৈতিকভাবে আমাদের সাহায্য করেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশে শিল্প ও সাহিত্যের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তারা চিন্তা-ভাবনা করেছেন।
“বাংলাদেশ গণসংস্কৃতি সংসদ” নামে পরিচিত অন্য প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা হিলেন এনামুল হক (পরবর্তীকালে উ: এনামুল হক)। তিনি তখন ফোর্ড ফাউন্ডেশনের বৃত্তি নিয়ে ডক্টরেট ডিগ্রির জন্য অক্সফোর্ডে গবেষণারত ছিলেন। ১৮ই ও ১৯শে সেপ্টেম্বার লন্ডনের কনওয়ে হলে গণসংস্কৃতি সংসদের উদ্যোগে “অস্ত্র হাতে তুলে নাও” শীর্ষক একটি নৃত্যনাট্য মঞ্চস্থ হয়। সংসদের প্রতিষ্ঠাতা
৩৫
সভাপতি নৃত্যনাট্যটি রচনা করেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের এই বিপ্লবী আলেখ্য দর্শকদের হৃদয় স্পর্শ করে। বিচারপতি চৌধুরী এই অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন। মিসেস গান্ধীর লন্ডন সফরকালে তাকে সংবর্ধনা জানাবার জন্য আয়ােজিত একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপলক্ষেও নৃত্যনাট্যটি মঞ্চস্থ করা হয়। মুন্নি রহমান সংসদের সম্পাদিকার দায়িত্ব পালন করেন।
পরবর্তী কালে গণসংস্কৃতি সংসদ আয়ােজিত অনুষ্ঠানের ব্যয় নির্বাহের ব্যাপারে কিছুটা তিক্ততা সৃষ্টি হয়। বিচারপতি চৌধুরীর নির্দেশ ছিল বাঙালী জনসাধারণের কাছ থেকে স্থানীয়ভাবে চাঁদা সংগ্রহ করে অনুষ্ঠানের ব্যয় নির্বাহ। করতে হবে; সেন্ট্রাল কমিটি থেকে অর্থ সাহায্য দেওয়া যাবে না। তা সত্ত্বেও আমরা স্টিয়ারিং কমিটির তহবিল থেকে সংসদের তিনটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের খরচ বহন করি ।
* * * * * * * *
এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি বাংলাদেশ স্টুডেন্টস এ্যাকশান কমিটিসহ আটটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা “এ্যাকশান বাংলাদেশ ক্লিয়ারিং হাউস” নামের একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। পূর্ব বঙ্গ থেকে অবিলম্বে পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনী প্রত্যাহার এবং বাস্তুহারা বাঙালীদের সাহায্যদানের জন্য প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ তাদের মূল উদ্দেশ্য বলে ঘােষণা করা হয়।
২০শে এপ্রিল বাংলাদেশ আন্দোলনকে প্রত্যক্ষ সাহায্যদানের কর্মসূচী তৈরি করার জন্য “পীস নিউজ” পত্রিকার অফিসে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকের উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছিলেন পল কনেট, মিস ম্যারিয়েটা প্রােকোপে ও “পীস নিউজ”-এর সম্পাদক। বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের প্রতিনিধি হিসাবে শামসুদ্দিন চৌধুরী (মানিক) ও খােন্দকার মােশাররফ এই বৈঠকে যােগ দেন। কর্মসূচী সম্পর্কে বিস্তারিত আলাপ-আলােচনার পর “এ্যাকশান বাংলাদেশ নামের একটি সংস্থা গঠন করা হয়। পল কনেটের নেতৃত্বে ম্যারিয়েটা এই সংস্থার সচিবের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।(৫)
১৯৭১ সালে লন্ডনে বাংলাদেশ আন্দোলনের সমর্থনে অনুষ্ঠিত সভা ও মিছিলে পল কনেট ও ম্যারিয়েটার যােগদান অবধারিত ছিল। পার্লামেন্টে “লবী,” মার্কিন দূতাবাস কিংবা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের সামনে বিক্ষোভ-মিছিল ও অন্যান্য অনুষ্ঠানে হাজির থাকার ব্যাপারে তারা কর্তব্যনিষ্ঠার পরিচয় দেন। তারা উভয়েই প্রবাসী বাঙালীদের শ্রদ্ধা অর্জন করেন।
পল কনেটের উদ্যোগে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে “দি টাইমস এ দু’টি এবং “দি গার্ডিয়ান”-এ দু’টি বড় আকারের বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। স্টিয়ারিং
৩৬
কমিটি এই বিজ্ঞাপনের ব্যয়ভার বহন করে। মে মাসের ১৩ই তারিখে “দি টাইমস”-এ “এ্যাকশান বাংলাদেশ”-এর নামে প্রকাশিত বিজ্ঞাপনে পূর্ব বঙ্গে পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনীর নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞের কথা উল্লেখ করে পশ্চিম পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক সাহায্যদান বন্ধের জন্য ব্রিটিশ সরকারের কাছে জোরালাে দাবি জানানাে হয়। বিজ্ঞাপনে উল্লিখিত বক্তব্যের সমর্থনে ১২জন পার্লামেন্ট সদস্যসহ বিভিন্ন পেশায় নিয়ােজিত মােট ২০৪জন গণ্যমান্য ব্যক্তির নাম প্রকাশ করা হয়।
১১ই জুন তারিখে “দি গার্ডিয়ান”-এ প্রকাশিত এক বিজ্ঞাপনে ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারী বাঙালীদের সাহায্যদানের আবেদন জানিয়ে বলা হয়, বাংলাদেশের দুর্ভোগ কারাে “অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়। এ সমস্যা আমাদের সকলের। পল কনেটের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত সাহায্য-সংস্থা “অপারেশান ওমেগা”-র নামে এই বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়।
৩০শে জুন তারিখে “দি টাইমস্”-এ প্রকাশিত পুরাে-পৃষ্ঠাব্যাপী এক বিজ্ঞাপনে পূর্ব বঙ্গে সংঘটিত গণহত্যা” সম্পর্কে সিকিউরিটি কাউন্সিল কর্তৃক পদক্ষেপ গ্রহণ এবং স্বাধীন বাংলাদেশকে কূটনৈতিক স্বীকৃতিদানের দাবি জানান হয়। উপরােক্ত মর্মে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে উত্থাপিত প্রস্তাবের প্রতি সমর্থনদানকারী ১১জন প্রিভিকাউন্সিলার ও ৩০জনেরও বেশি প্রাক্তন মন্ত্রীসহ দুশ’জনেরও বেশি সদস্যের নাম এই বিজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয় ।
৩০শে জুলাই তারিখে “দি গার্ডিয়ান”-এ প্রকাশিত অর্ধ-পৃষ্ঠাব্যাপী এক বিজ্ঞাপনে পূর্ব বঙ্গে সংঘটিত গণহত্যার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে দু’দিন পরে একটি গণসমাবেশে যােগদানের জন্য আহ্বান জানানাে হয়। পাকিস্তানের অত্যাচারী সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের জন্য বিশ্ব-জনমতকে প্রভাবিত করার উদ্দেশ্যে ১লা অগাস্ট (রবিবার) লন্ডনের ট্রাফালগার স্কোয়ারে এই গণসমাবেশের আয়ােজন করা হয়।
ট্রাফালগার স্কোয়ারে অনুষ্ঠিত গণসমাবেশের একটি আকর্ষণ ছিল “অপারেশান ওমেগা”-র উদ্যোগে গঠিত “ইন্টারন্যাশনাল পীস্ টীম” এবং তাদের কর্মসূচীর বাস্তবায়ন। পাকিস্তানীদের আক্রমণের ফলে আহত ও ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ওষধপত্র ও অন্যান্য সাহায্যসামগ্রী নিয়ে পল কনেটের স্ত্রী এবং আরাে একজন মহিলা একটি ভ্যানযােগে ট্র্যাফালগার স্কোয়ার থেকে বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন।
১৭ই অগাস্ট “পীস টীম”-এর ৮জন ব্রিটিশ ও ৩জন আমেরিকান কর্মী আহত ও ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ঔষধপত্র ও অন্যান্য সাহায্য সামগ্রী নিয়ে পেত্রাপােল পার
৩৭
হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সৈন্যরা তাদের গ্রেপ্তার করে জেলখানায় আটক রাখে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাঁরা মুক্তিলাভ করেন। (দি টাইমস, ১৮ই অগাস্ট, ১৯৭১)
* * * * *
বিভিন্ন শহরে বাংলাদেশ এ্যাকশান কমিটি গঠন করে যারা স্বাধীনতা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন হাজী আবদুল মতিন (ম্যাঞ্চেস্টার), ড: মােজাম্মেল হক (গ্লাসগাে), বােবহানউদ্দিন (লুটন), নবীরউদ্দিন (সেন্ট অলবান্স), নূর মােহাম্মদ খান (লেস্টার), আজিজুল হক ভূঁইয়া, জগলুল পাশা, আফরােজ মিয়া, ইজরাইল মিয়া ও তােজাম্মেল (টনি) হক (বার্মিংহাম), ড: মাের্শেদ তালুকদার, ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক, শাখাওয়াত হােসেন, তােসাক আহমদ ও আতাউর রহমান (পশ্চিম লন্ডনের বেজওয়াটার কমিটি), এস এম আইউব (উত্তর লন্ডন), সৈয়দ আবু আহসান ও কায়সারুল ইসলাম (দক্ষিণ-পশ্চিম লন্ডনের ব্যালহাম কমিটি), মিম্বর আলী, শামসুর রহমান, মতিউর রহমান চৌধুরী, ফখরুদ্দিন, সিরাজুল হক, জিল্লুল হক ও তৈয়েবুর রহমান (পূর্ব লন্ডনের বিভিন্ন কমিটি)।
স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য কবীর চৌধুরীকে সমগ্র ল্যাঙ্কাশায়ার অঞ্চলের কমিটিগুলিকে সংঘবদ্ধ করে তাদের কার্যক্রমের সমন্বয় সাধনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এডিনবরা ও গ্লাসগাে অঞ্চলের বাঙালীদের, বিশেষ করে সরকারী বৃত্তিপ্রাপ্ত ডাক্তারদের, দেশের কাজে উদ্বুদ্ধ করার ব্যাপারে ড: মােজাম্মেল হক প্রশংসাসূচক ভূমিকা পালন করেন। লেস্টারে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় বিচারপতি চৌধুরী, শামসুর রহমান ও আমার উপস্থিতিতে ঘােষণা করা হয়-বাঙালী ডাক্তার আকরাম সায়ীদ পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করছেন। ড: সায়ীদ সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন। তিনি সেখানে দাঁড়িয়ে বলেন, তার বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা চালানাে হচ্ছে; তিনি বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করছেন।
৩৮
৫. স্টিয়ারিং কমিটির অফিস ও বাংলাদেশ দূতাবাস
নিরাপদ পরিবেশে স্টিয়ারিং কমিটির অফিস স্থাপনের জন্য আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। মে মাসের প্রথম দিকে ড: মােশাররফ হােসেন জোয়ারদার ও হারুণ-অর-রশীদ আমার বাড়িতে আসেন। তারা বললেন, বহির্বিশ্বের সঙ্গে পূর্ব বাংলার রপ্তানী-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে হেন্ডন এ্যাকশান কমিটির প্রেসিডেন্ট হারুণ-অর-রশীদের পাট-ব্যবসাও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। পূর্ব লন্ডনের ১১ নম্বর গােরিং স্ট্রীটে অবস্থিত দোতলা দালানে তাঁর অফিস তিনি আর চালাতে পারছেন না। তার অফিসে তিনটি টেলিফোন, টেবিল, টাইপ-রাইটার এবং অফিসের জন্য প্রয়ােজনীয় অন্যান্য সব জিনিস রয়েছে। স্টিয়রিং কমিটির জন্য অফিসটি নেয়া হলে তিনি যে-ভাড়া দিচ্ছেন, তাই দিতে হবে।
হেন্ডন এ্যাকশান কমিটির প্রেসিডেন্ট হিসাবে হারুন-অর-রশীদের নাম আমার জানা ছিল, কিন্তু ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল না। ড: জোয়ারদার বললেন, তাদের উভয়ের বাড়ি যশােহর জেলায় এবং রশীদ সাহেব সম্পর্কে চিন্তার কোনাে কারণ নেই। আমি বিচারপতি চৌধুরীকে টেলিফোন করলাম। তিনি বললেন, সব কিছু পরীক্ষা করে যদি দেখেন, অফিসটি পুরােপুরি আমাদের অধিকারে থাকবে এবং নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে না, তা হলেই আমরা ভাড়া নেব। ৩রা মে গােরিংটে স্টিয়ারিং কমিটির অফিস খােলা হয়।
গােরিং স্ট্রীট পূর্ব লন্ডনের হাউন্ডস ডি ও লিভারপুল স্ট্রীটের পাশে অবস্থিত। লন্ডনের অধিকাংশ বাঙালী এই এলাকায় বসবাস করে। কাজেই আমরা আমাদের স্বদেশবাসীদের দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিলাম। গাউস খান গােরিং স্ট্রীটে অফিস খােলার পক্ষপাতী ছিলেন না। তিনি এই অফিসকে “বালাখানা” আখ্যা দিয়েছিলেন। সােহাে এলাকায় তার এলাহবাদ রেস্তোরা”-র ওপরের তলায় স্টিয়ারিং কমিটির জন্য বিনা ভাড়ায় অফিস-ঘর এবং একটি টেলিফোন দেওয়ার প্রস্তাব তিনি করেছিলেন। তার প্রস্তাব গৃহীত না হওয়ায় তিনি মনঃক্ষুন্ন হয়েছিলেন।
৩৯
মে মাসে স্টিয়ারিং কমিটির অফিস ভাড়া নেওয়ার কিছু কাল পর আমরা হারুন-অর-রশীদের কাছ থেকে একখানি চিঠি পাই। চিঠিখানি খুলনা থেকে তার মীর নামে লেখা হয়েছে। তিনি নিজেও সেদিন গােরিং স্ট্রীটের অফিসে আসেন। আমাদের সামনে এসে তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। চিঠিতে বলা হয়েছে, তাঁর ১৪, বছর বয়সী ভাইকে পাকিস্তানী সৈন্যরা ধরে নিয়ে প্রথমে নির্মমভাবে মারধর করেছে, তারপর কান দুটো কেটে ফেলেছে এবং সবশেষে গাছে ঝুলিয়ে তার চোখ দুটো সাঁড়াসি দিয়ে তুলে নিয়েছে। অবিলম্বে এই চিঠির ইংরেজী অনুবাদ করে আমি জাকারিয়া খান চৌধুরীসহ কয়েকজন সহকর্মীকে নিয়ে পার্লামেন্ট ভবনে যাই, শ্রমিক দলের সদস্য জন স্টোনহাউসের সঙ্গে দেখা করে চিঠিখানি অবিলম্বে স্পীকারের হাতে পৌছে দেওয়ার জন্য অনুরােধ করলাম। বাংলাদেশের নিরপরাধ মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করার এই জঘন্য চিত্র পার্লামেন্টের সদস্যদের কাছে পৌছে দেওয়ার ফলে আমরা তাদের অকুণ্ঠ সাহায্য ও সহানুভূতি পেয়েছিলাম ।
এই প্রসঙ্গে আরও একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করতে হয়। হারুন-অররশীদের বড় ভাই আওয়ামী লীগের আদি যুগে (অর্থাৎ আওয়ামী মুসলিম লীগের যুগে) বঙ্গবন্ধুর নিকটবর্তী কর্মীদের একজন ছিলেন। তিনি একদিন এদেশে এসে হাজির হলেন। আমাদের কাছে খবর পাঠালেন, তিনি একদিন বাংলাদেশ থেকে পাট রপ্তানী করার একটা রাস্তা খুলে দেবেন। আমরা যদি ভারতের মাধ্যমে পাট চালান দেওয়ার ব্যাপারে তাদের সম্মতি আদায় করতে পারি, তাহলে যে টাকা পাওয়া যাবে, তা’দিয়ে মুক্তিবাহিনীর জন্য অস্ত্র ক্রয় এবং ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারীদের দুরবস্থার খানিকটা লাঘব করা সম্ভব হবে। আমরা হারুণঅর-রশীদের অনুরােধে তার বাড়িতে এক গােপন বৈঠকে মিলিত হই। বিচারপতি চৌধুরী এবং শাখাওয়াত হােসেন প্রথমে এই বৈঠকে যােগ দিতে অস্বীকার করেন। তিনি প্রশ্ন করেন, এই ভদ্রলােক কি করে পাসপাের্ট জোগাড় করলেন এবং দেশ থেকে বেরিয়ে আসার অনুমতি পেলেন? তার রাজনৈতিক আনুগত্য সম্পর্কে আমরা খোঁজ নিয়েছি কি? শেষ পর্যন্ত বিচারপতি চৌধুরী, লন্ডন কমিটির সেক্রেটারী হিসাবে শাখাওয়াত হােসেন এবং স্টিয়ারিং কমিটির পক্ষ থেকে শামসুর রহমান ও আমি বৈঠকে যােগদান করি। হারুন-অর-রশীদের ভাই বাংলাদেশের বিরাট একটি মানচিত্র তুলে ধরে আমাদের দেখালেন—মুক্তিবাহিনীর সৈন্যরা কোণ কোন এলাকায় অবস্থান নিয়েছে। তিনি মানচিত্রটি যে-ভাবে তুলে ধরলেন, বাচনভঙ্গী ও কথাবার্তা—সব কিছু লক্ষ্য করে আমরা সন্দেহ করলাম, আমাদের পক্ষের লােক নন। তার প্রস্তাব আমরা ভেবে দেখবাে-এই আস্থা
৪০
আমরা চলে আসি। পরদিন স্টিয়ারিং কমিটির এক বৈঠকে আমরা সিদ্ধান্ত করলাম, তার সঙ্গে আমাদের কোনও সম্পর্ক রাখা চলবে না। হারুন-অর-রশীদকে ডেকে আমরা বললাম, আপনার অফিস ভাড়া দিয়েছেন বলে আমরা আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবাে। আপনার সঙ্গে আমাদের থাকবে বাড়ির মালিকের ও ভাড়াটের সম্পর্ক, এর বেশি কিছু নয়। আপনি হেন্ডন কমিটিতে আছেন, তা আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু আমরা আপনার ভাইয়ের সঙ্গে আর সাক্ষাৎ করবাে না ।
হারুণ-অর-রশীদের ভাই যখন দেশে ফিরে গেলেন, তখন বিচারপতি চৌধুরীর টাঙ্গাইলের বাড়ি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হলাে, তার হিন্দু ম্যানেজারকে হত্যা করা হলাে এবং তার বহু সম্পত্তি নির্বিচারে নষ্ট করা হলাে। বিচারপতি চৌধুরী এ ব্যাপারে আমাকে ব্যক্তিগতভাবে কখনও ক্ষমা করেননি। কারণ, তিনি মনে করেছিলেন এই ভুলটা আমিই করেছি। আমি নিজের পক্ষ থেকে শুধু একথা বলতে চাই, সেদিনকার জাতীয় দুর্যোগ কালে যারাই আমাদের সাহায্য করতে চেয়েছে, তাকেই বিশ্বাস করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সবাই আমাদের পক্ষে থাকেননি। এটা হলাে চলার পথের ভুল। সে ভুলের জন্য আমি দুঃখিত।
গােরিং স্ট্রীটের অফিস মুক্তিযুদ্ধকালে বহুমুখী দায়িত্ব পালন করে। যে-সব বাঙালীকে পাকিস্তানী জাহাজ থেকে সমুদ্রের পানিতে ফেলে দেওয়া হয় এবং পি আই এ থেকে যারা বিতাড়িত হন, তাদের কেউ কেউ এই অফিসে দিনের বেলা কাজ করতেন এবং রাত্রে ঘুমাতেন। এখান থেকেই স্টিয়ারিং কমিটির মুখপত্র বাংলাদেশ টু-ডে” প্রকাশিত হয়।
অবিলম্বে আমরা স্টিয়ারিং কমিটির জন্য একজন পুরাে-সময়ের বেতনভােগী কর্মচারী নিয়ােগ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। তিনি দেশাত্মবােধে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশের জন্য কাজ করবেন, কিন্তু তার জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা আমাদের করতে হবে। দু’জনকে আমরা “ইন্টারভিউ”-র জন্য মনােনীত করি। এদের মধ্যে একজন ছিলেন বার্মিংহাম এ্যাকশান কমিটির মনােনীত প্রার্থী। তিনি ছিলেন উচ্চশিক্ষিত, অত্যন্ত দক্ষ এবং বুদ্ধিমান বাঙালী হিন্দু। পেশাগতভাবে তিনি ছিলেন চার্টার্ড একাউন্টেস্ট। বার্মিংহাম থেকে আজিজুল হক ভূঁইয়া তাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসেন। লন্ডন থেকে আমরা যাকে মনােনীত করেছিলাম, তিনি ছিলেন শামসুল আলম চৌধুরী। তিনি এম এ পাশ করেছেন এবং “ইনার টেম্পল”-এ অধ্যয়নরত আইনের ছাত্র। বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে ৩০শে মার্চ তিনি লন্ডনে পৌছান। ২৬শে মার্চ পাকিস্তানী হত্যাকাণ্ডের সময় তিনি ধানমন্ডী এলাকায় বঙ্গবন্ধুর বাড়ির কাছে। তার এক বন্ধুর বাড়িতে ছিলেন। লন্ডনের সংবাদপত্রের সঙ্গে সাক্ষাৎকারকালে
৪১
তিনি পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনীর বাঙালীনিধন অভিযানকে গণহত্যা বলে উল্লেখ করে কয়েকটি নৃশংস হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ দেন। তার সঙ্গে আলাপ-আলােচনার পর আমরা নিশ্চিত হলাম, তিনি বাংলাদেশের কাজে আত্মনিয়ােগ করার জন্য মানসিকভাবে সম্পূর্ণভাবে তৈরি। আমি তাকে যক্তিগতভাবে জানতাম। এক সময় আমি যখন পাকিস্তান স্টাডি সার্কেলের জেনারেল সেক্রেটারী ছিলাম, তখন তিনি তার এক্সিকিউটিভ কমিটির সদস্য ছিলেন। বাংলাদেশের সেই দুর্দিনে তাঁকে আমি সম্পূর্ণ নিবেদিত-প্রাণ হিসাবে গ্রহণ করেছিলাম এবং সেকথা আজও বিশ্বাস করি।
উপরোক্ত দু’জন প্রার্থীকে নিয়ে শেষ পর্যন্ত একটি অনাকাঙিক্ষত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়–আজিজুল হক সাহেবের মনােনীত প্রার্থীকে, নাকি আমার মনােনীত প্রার্থীকে নেওয়া হবে। বিচারপতি চৌধুরী বলেন, এখানে আপনাদের তাে ব্যক্তিগত কোনাে প্রার্থী নেই; আপনি লন্ডন থেকে একজনকে জানেন, উনি বার্মিংহাম থেকে একজনকে জানেন। কাজেই আপনারা এখানে পক্ষ নেবেন না; নিরপেক্ষভাবে আসুন। স্টিয়ারিং কমিটির অন্যান্য সদস্য বললেন, বার্মিংহামের প্রার্থী বেশি পারদর্শী, বুদ্ধিমান এবং পেশাদার চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট। পক্ষান্তরে একথাও সত্য, পাকিস্তান হাই কমিশান আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে ভারতীয় উদে গে পরিচালিত আন্দোলন বলে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। কাজেই আমরা যদি আমাদের অফিসে একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বীকে নিয়ােগ করি, তাহলে তাদের মিথ্যা প্রচারণা চালাতে সুবিধা হবে। আমরা কি এই মিথ্যা প্রচারণা চালাবার সুযোেগ দেবাে? শেষ পর্যন্ত আমরা শামসুল আলম চৌধুরীকে নিয়ােগ করেছিলাম। তখন আমরা বুঝিনি; কিন্তু আজ আমরা বুঝি, এই ভুলটা আমাদেরই ছিল। আজ পঁচিশ বছর পরে আমি মনে করি, এটা ছিল আমার জীবনের সব চেয়ে মারাত্মক ভুল। শামসুল আলম সাহেবকে আমরা অন্য কাজে লাগাতে পারতাম; তার বিদ্যা-বুদ্ধি ও যােগ্যতা ছিল। তিনিও কিছু মনে করতেন না। ভুল যুক্তি অনুসরণ করে আমরা পরাজিত হয়েছি। বাংলাদেশের মানুষ হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ ও খ্রীস্টান এদের মধ্যে যদি আমরা বিভেদ সৃষ্টি করি, তাহলে আমাদের “সেকুলারিজম আকাশকুসুম মাত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা অর্থহীন। আজ অত্যন্ত অনুশােচনার সঙ্গে স্বীকার করছি, উল্লিখিত সিদ্ধান্ত নিয়ে আমরা “জুজু”-র ভয়ের কাছে পরাজয় মেনে নিয়েছিলাম।
স্টিয়ারিং কমিটির প্রধান দুটো দায়িত্ব ছিল : (১) প্রবাসে স্বাধীনতা আন্দোল” চালিয়ে যাওয়া এবং (২) বিভিন্ন এ্যাকশান কমিটিগুলিকে সংঘবদ্ধ করার উদ্দেশ্যে একটি প্রতিনিধিত্বমূলক কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা। আমাদের প্রথম দায়িত্ব
৪২
সাফল্যজনকভাবে আমরা পালন করেছি। কিন্তু দ্বিতীয় দায়িত্ব পালনে আমরা সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছি। এ জন্য বিচারপতি চৌধুরী বিরূপ সমালােচনার সম্মুখীন হন। তিনি ছিলেন আমাদের উপদেষ্টা। স্টিয়ারিং কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আমিও ব্যক্তিগতভাবে সমালােচিত হয়েছি। কেউ কেউ এজন্য আমাকে দায়ী করেছেন। কেন আমরা ব্যর্থ হয়েছি, সে সম্পর্কে একটি ব্যাখ্যা দেওয়া প্রয়ােজন। বিভিন্ন দল ও মতের সমর্থকরা বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে বার বার দেখা করে অবিলম্বে কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করার জন্য দাবি জানাচ্ছিলেন। তাদের চিন্তাধারা এবং উদ্দেশ্যের বিভিন্নতা সম্মিলিত আন্দোলনের পরিপন্থী হবে বলে বিচারপতি চৌধুরী আশঙ্কা করেন। কেন্দ্রীয় কমিটির মধ্যে অবশ্যম্ভাবী আত্ম-কলহের ফলে আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়বে বলে তিনি বিশ্বাস করতেন। উনি যেন দিব্য-দৃষ্টিতে দেখেন, বিভিন্ন মতাবলম্বীদের নিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হলে আমরা যে এক জাতি, আমাদের একটাই দাবি—স্বাধীনতা, তা থাকবে না।
এখানে আমি এযাবৎ অপ্রকাশিত একটি তথ্য প্রকাশ করবাে। আমরা স্টিয়ারিং কমিটির পাঁচজন সদস্য কাজের সুবিধার জন্য আঞ্চলিক নেতাদের নিয়ে বৈঠক করেছি। এই অঞ্চলগুলি ছিল: (১) ইয়র্কশায়ার ও ব্রিটেনের উত্তরাঞ্চল, (২) ল্যাঙ্কাশায়ার (৩) মিডুল্যান্ডস এবং (৪) লন্ডন ও দক্ষিণ-পূর্ব ইংল্যান্ড। এই চার অঞ্চলের চারজন নেতা এবং তাদের প্রত্যেকের একজন সহকর্মী স্টিয়ারিং কমিটির অফিসে অনুষ্ঠিত একাধিক বৈঠকে যােগ দিয়েছেন। আঞ্চলিক নেতাদের মধ্যে ছিলেন এ এম তরফদার, হাজী আবদুল মতিন, জগলুল পাশা ও গাউস খান। কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন সম্পর্কে আমরা একমত হতে পারিনি। লন্ডন এলাকার নেতৃবৃন্দ আরও ৬জন আঞ্চলিক প্রতিনিধি নিয়ে স্টিয়ারিং কমিটি পুনর্গঠনের পক্ষে ছিলেন। কিন্তু অন্যান্য অঞ্চলের নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন এ্যাকশান কমিটির সম্মেলন আহ্বান করে নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের পক্ষপাতী ছিলেন।
স্টিয়ারিং কমিটির উপদেষ্টা হিসাবে বিচারপতি চৌধুরীর কাছে আমি কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন সম্পর্কে একটি স্মারকলিপি পেশ করি। এই স্মারকলিপি নিয়ে একদিন সন্ধ্যাবেলা আমি যখন কটনে বিচারপতির বাড়িতে যাই, তখন আমার সঙ্গে ছিলেন ড: জোয়ার। স্মারকলিপি পড়ে তিনি (বিচারপতি) নীরব থাকলেন। আমাদের জন্য চা-নাস্তা এলাে। রাত এগিয়ে চললাে। প্রায় ১২টার সময় তিনি বললেন, আমার প্রস্তাব মেনে নেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়।
আমি দু’টো প্রস্তাব করেছিলাম। প্রথম প্রস্তাব হলাে: গােরিং স্ট্রীটে আঞ্চলিক কমিটির পরবর্তী বৈঠকে কেন্দ্রীয় কমিটির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হােক। দ্বিতীয় প্রস্তাব
৪৩
হলাে: স্টিয়ারিং কমিটির পাঁচজন সদস্য এবং আরাে দু’জন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিকে নিয়ে বর্ধিত স্টিয়ারিং কমিটি গঠন করা হােক। ছ’জন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির নামও আমি উল্লেখ করেছিলাম।
বিচারপতি চৌধুরী যখন আমার প্রস্তাব গ্রহণ করতে রাজী হলেন না, তখন আমি বললাম, কভেন্ট্রি সম্মেলনে নির্বাচিত হওয়ার পর কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের দায়িত্ব আমি পালন করবে বলে অঙ্গীকার করেছিলাম। তা পূরণ করা না হলে স্টিয়ারিং কমিটিতে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। বিচারপতি বললেন, আপনি যদি না থাকতে পারেন, তা হলে তাে আমিও থাকতে পারি না। আপনি কেন “রিজাইন” করবেন, আমার “ রেজিগনেশানটা আমি দিয়ে দিচ্ছি। আমি দিব্যদৃষ্টিতে দেখছি, আপনি যাদের নামের তালিকা দিয়েছেন, তাদের কো-অপ্ট” করার সঙ্গে সঙ্গে চারদিকে অসুবিধার সৃষ্টি হবে এবং কিছুতেই আপনাদের একতা আর থাকবে না। আর আমি কোনাে কাজেই লাগবাে না। কাজেই আপনি যদি “রিজাইন” করতে চান তাে করেন; আমার “রিজিগনেশান”টাও নিয়ে যান।
ড: জোয়াদার বললেন, স্যার, আপনি তাে নেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত আছেন, কাজেই আপনাকে কেউ প্রশ্ন করবে না; কিন্তু এই লােকটার কি হবে?
বিচারপতি চৌধুরী বললেন, বহুলােক তাে মৃত্যু বরণ করেছে, নির্মমভাবে সঙ্গীন দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তাদের হত্যা করা হয়েছে, অনেকের লাশও খুঁজে পাওয়া যায়নি। উনি যদি দেশকে ভালােবাসেন, তবে উনিও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবেন। আমি যদি মরে যাই, আমাকে যদি কেউ মেরে ফেলে, তার জন্য আমি প্রস্তুত; কিন্তু আমি এই বিড়ম্বনা ডেকে আনতে পারবাে না। প্যান্ডােরা’-র বাক্স একবার খুলে দেওয়া হলে আর বন্ধ করা যাবে না। আপনারা প্যান্ডােরা”-র বাক্স খুলে দেবেন, এটা হবে না।
তিনি আরও বললেন, ইউরােপ ও আমেরিকার যে-সব দেশে তিনি গিয়েছেন, সেখানে দেখেছেন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালী একতাবদ্ধ হয়ে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। তিনি বিভিন্ন দেশের নেতৃবৃন্দ এবং বহু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সলারদের সঙ্গে দেখা করেছেন। আন্দোলনের একটা “ইমেজ(ভাবমূর্তি) তিনি গড়ে তুলেছেন এবং এই আন্দোলন চালিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব বলে তিনি মনে করেন। ড: জোয়ারদারের পীড়াপীড়িতে তিনি বললেন, তার এ মুজিবনগর সরকারের যে নির্দেশ রয়েছে, সে সম্পর্কে তিনি তাদের সঙ্গে পা আলাপ করবেন।
“মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে বিচারপতির আলােচনার ফলাফল আমার জানা নেই। তবে আমি অনুমান করি, তারা বলেছেন যুক্তরাজ্যে আন্দোলনের কাঠামো
৪৪
কি ধরনের হবে, সে সম্পর্কে তারা নির্দেশ দিতে পারেন না। কিন্তু বিচারপতি বহির্বিশ্বে যে নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন, সেই “ইমেজ” যেন নষ্ট না হয় (৬)
দু’দিন পর বিচারপতি চৌধুরী আমাকে তাঁর বাড়িতে ডাকলেন। তিনি বললেন, এখানে যদি গােলমাল সৃষ্টি হয়, তাহলে আমাদের শত্রুপক্ষ তার সুযােগ গ্রহণ করবে। আমাদের আন্দোলনে ভাঙ্গন সৃষ্টির জন্য তারা অপেক্ষা করছে। আপনারা পাঁচজন (স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য) যদি একতাবদ্ধ থাকেন, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব স্বীকার করেন, “মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্ব মেনে নেন, তা হলে ভবিষ্যতের ইতিহাসে আপনার চরিত্র হননের কোনাে ভয় নেই, এ নিশ্চয়তা আমি দিতে পারি।
কিন্তু বাস্তবে ফলাফলটা আমার জন্য ছিল অবাঞ্ছিত। যারা প্রস্তাবিত সেন্ট্রাল কমিটির মাধ্যমে নেতৃত্ব লাভের সুযােগ থেকে বঞ্চিত হলেন, তারা বিচারপতি চৌধুরীকে নয়, আমাকে শত্রু হিসাবে ধরে নিলেন। তারা ভাবলেন, আমি বিচারপতির ঘনিষ্ঠ সহকর্মী এবং আমার পরামর্শ অনুযায়ী, তাদের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে অংশগ্রহণের সুযােগ দেওয়া হয়নি। আন্দোলনের কাজকর্ম উপলক্ষে গাউস ধানের সঙ্গে আমার চমৎকার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। একে অপরের প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধাবােধ ছিল। কিন্তু তা নষ্ট হয়ে গেল।
আমি চার মাস যাবৎ গােরিং স্ত্রীটের কাজ সেরে এলাহবাদ রেস্তোরায় গিয়ে গাউস খানকে সারা দিনের কার্যবিবরণী দিয়ে বাড়ি ফিরছি। মিনহাজ সাহেবের সঙ্গেও আমি অনুরূপভাবে কথা বলেছি। পূর্ব লন্ডনের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে একাধিকবার “দিলশাদ রেস্তোরা”-য় একত্রিত হয়ে আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি ব্যাখ্যা করেছি এবং কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হবে বলে আশ্বাস দিয়ে বলেছি, আপাততঃ আমরা বিচারপতির নেতৃত্বে কাজ চালিয়ে যাবাে।
১৯৭১ সালের মাঝামাঝি থেকে আমার এককালীন সহকর্মীরা আমাকে ধিক্কার দিয়েছেন, তিরস্কার করেছেন, লাঞ্ছিত করেছেন এবং সর্বগ্রাসী ক্ষমতা কুক্ষিগত করার অপরাধে অপরাধী বলে সাব্যস্ত করেছেন। আমি জেনে-শুনে সব সহ্য করেছি। অনেক সময় সহ্য করতে না পেরে আমি বিচারপতি চৌধুরীকে বলেছি, পরিস্থিতি আমার কাছে অসহনীয় হয়ে পড়েছে। তিনি আমাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, আপনি তাে এখনও জীবিত রয়েছেন; যারা মারা গিয়েছেন, তাদের কথা ভেবে দেশের জন্য কাজ করে যান।
এখানে আমার ব্যক্তিগতভাবে হতবুদ্ধি হওয়ার এক ঘটনার কথা আমি উল্লেখ করতে চাই। স্টিয়ারিং কমিটি গঠিত হওয়ার কিছুকাল পর হােবাের্ন টিউব স্টেশানের উল্টো দিকে একটি চার্চ হলে লন্ডনের কর্মীদের এক সভা ডাকা হয়।
৪৫
শামসুর রহমান সেই সভায় যেতে রাজী হননি। তিনি সভা বয়কট করেন। তৈয়েবুর রহমান সভা পরিচালনা করেন। স্টিয়ারিং কমিটির প্রতিনিধি হিসাবে আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম। সভায় বক্তৃতা উপলক্ষে আমি বলেছিলাম,ধনতন্ত্রের কাঠামাে থেকে দেশকে মুক্ত করে দারিদ্র্যের যন্ত্রণা থেকে মানুষকে মুক্ত করতে হবে। আমি ভেবেছিলাম, বঙ্গবন্ধুর দাবিগুলির মধ্যে সমাজতন্ত্র অন্যতম-—এ কথা সবার জানা আছে। তার সমর্থনে কথা বলার জন্য আওয়ামী লীগের উপস্থিত নেতৃবৃন্দ আমার ওপর ক্ষেপে গেলেন এবং বললেন, এই “লাল মিয়া”-দের বাংলাদেশে রাজত্ব করতে দেওয়া হবে না। অথচ “লাল মিয়া”দের কোনাে কথাই আমি বলিনি। আমি বলেছি, একটি দারিদ্যমুক্ত দেশের কথা, যেখানে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে, যেখানে গণতন্ত্রের মাধ্যমে দেশ পরিচালিত , হবে, যেখানে সাধারণ মানুষের দুঃখ-বেদনার কথা তুলে ধরতে হবে এবং তা মােচনের ব্যবস্থা করতে হবে। আমার এই সহজ-সরল বক্তব্য আমার বিরুদ্ধে কাজ করে এবং দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা চালানাে হয়।
১৯৭২ সালের জানুয়ারী মাসে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডনে এসে ক্ল্যারিজেস হােটেলে অবস্থান করেন। ভােরবেলা যখন আমি হােটেলে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাই, তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন গাউস খান, তাসাদুক আহমদ এবং আমাদের হাই কমিশনের অফিসারবৃন্দ। আমি বঙ্গবন্ধুর রুমে ঢুকতেই তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠে আমাকে জড়িয়ে ধরেন। আমাদের উভয়ের চোখে তখন পানি। এই দৃশ্য সবাই দেখেছেন। তা সত্ত্বেও পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুর কাছে আমার বিরুদ্ধে নানা মিথ্যা ও বিদ্বেষমূলক কথা বলা হয়েছে। এমনও বলা হয়েছে, আমি নাকি তার শত্রু। বিশ্বস্ত সূত্রে এসব খবর আমি পেয়েছি। আমার মনে একটা তীব্র বেদনা জমা হয়ে রয়েছে। বেদনা এই জন্য যে, আমি মন্ত্রীত্ব চাইনি, রাষ্ট্রদূত হতে চাইনি, ব্যবসা-বাণিজ্য করতে চাইনি, রিফিউজিদের বাড়ি দখল করতে চাইনি, কোনাে চাকুরি চাইনি, কিছুই চাইনি। একটা সুযােগ আমার জীবনে এসেছিল, সেই সুযােগ গ্রহণ করে আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি।
কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের অঙ্গীকার আমি রক্ষা করতে পারিনি। কিন্থ বিচারপতি চৌধুরী উপদেষ্টা হিসাবে যে উপদেশ দিয়েছেন, তা’ চরিতার্থ হয়েছে। আমার মনে হয়, নেতৃত্ব না পেয়ে যারা অসন্তুষ্ট হয়েছেন, তারাও পরবর্তকিালে বুঝতে পেরেছেন, বিচারপতির সিদ্ধান্তই সঠিক ছিল।
১৯৭১ সালের ১লা অগাস্ট লন্ডনের ট্যাফালগার স্কোয়ারে এ্যাকশান বাংলাদেশের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত গণসমাবেশে বক্ততা প্রসঙ্গে বিচারপতি চৌধুরী
৪৬
বলেন, “মুজিবনগর সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী অবিলম্বে লন্ডনে একটি কূটনৈতিক মিশান স্থাপন করা হবে। | জাকারিয়া খান চৌধুরী খবর নিয়ে এলেন, লন্ডনের বেজওয়াটার এলাকায় নটিংহিল গেইটের নিকট ২৪ নম্বর পেমব্রিজ গার্ডেনে অবস্থিত বাড়িতে কূটনৈতিক মিশানের জন্য জায়গা পাওয়া যেতে পারে। এই বাড়িতে তখন টক-এই নামের প্রতিষ্ঠান পরিচালিত একটি আন্তর্জাতিক হােস্টেল ছিল। ডােনান্ড চেওয়ার্থ এই হােস্টেলের ওয়ার্ডেন পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তিনি “ওয়ার অন ওয়ান্ট”-এর চেয়ারম্যান হিসাবে কয়েকবার ভারত সফরে গিয়ে শরণার্থী শিবিরে দেশত্যাগী বাঙালীদের দুর্দশা স্বচক্ষে দেখে এসেছেন। বিচারপতি চৌধুরী, জাকারিয়া খান চৌধুরী ও আমি ডােনান্ড চেওয়ার্থের সঙ্গে দেখা করলাম। মি: চেওয়ার্থ বললেন, গ্রাউন্ড ফ্লোরের রুমগুলি অল্প-ভাড়ায় মিশানের জন্য দেওয়ার ব্যবস্থা তিনি করতে পারেন। আমরা তার প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়ে চলে আসার পর ড: জোয়ারদারের মাধ্যমে বাঙালী শিল্পপতি জহিরুল ইসলামকে খবরটা জানানাে হয় । স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম থেকেই মি: ইসলাম বিচারপতির সঙ্গে যােগাযােগ করে অকুণ্ঠ সমর্থন এবং আর্থিক সহায়তার অঙ্গীকার করেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত জহিরুল ইসলাম বাংলাদেশ মিশানের ব্যায় নির্বাহের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এ কথাটা অনেকেই জানেন না। (৭)
২৭শে অগাস্ট মুজিবনগর সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি হিসাবে বিচারপতি চৌধুরী প্রায় তিন শ’ বাঙালী এবং বহু বিদেশী সাংবাদিকের উপস্থিতিতে বাংলাদেশ মিশানের উদ্বোধন করেন। ভারতের বাইরে লন্ডনেই প্রথম বাংলাদেশ মিশান প্রতিষ্ঠিত হয়।
দূতাবাসের সামনে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের পর বিচারপতি চৌধুরী বলেন, লন্ডন থেকেই বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনের সঙ্গে সংযােগ রক্ষা করা হবে এবং লন্ডনই হবে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ আন্দোলনের প্রধান। কেন্দ্র।
তিনি আরও বলেন, সবচেয়ে জরুরী যে-কথাটি মনে রাখা দরকার তা’ হলাে- পাকিস্তানের মৃত্যু হয়েছে। এর ফলে দু’টি দেশের জন্ম হয়েছে। ইতিপূর্বে পূর্ব পাকিস্তান নামে পরিচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশটি এখন স্বাধীন বাংলাদেশে পরিণত হয়েছে। পূর্ববর্তী অবস্থায় আর ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়—একথা কখনও ভুলে যাওয়া চলবে না।
দূতাবাস স্থাপিত হওয়ার পর সরকারী অফিসারগণ ২৪ নম্বর পেমব্রিজ গার্ডেন্সে এবং বেসরকারী কর্মীরা ১১ নম্বর গােরিং স্ট্রীটের অফিসে কাজ করবেন। বলে বিচারপতি চৌধুরী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। গােরিং স্ট্রীটের কর্মীরা সাংগঠনিক ও প্রচারকার্য এবং পেমব্রিজ গার্ডেন্সের অফিসাররা কুটনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
৪৭
৬. পাকিস্তান-সমর্থক ও মাওপন্থী বাঙালী
১৯৭১ সালে যুক্তরাজ্যে বাঙালীর সংখ্যা ছিল ৬০/৭০ হাজার। এর মধ্যে মাত্র হাজার খানেক মানুষ পাকিস্তানকে সমর্থন করেছে। কিন্তু পাকিস্তানের পক্ষে যারা প্রকাশ্যে রাস্তায় বেরিয়ে এসেছে তাদের সংখ্যা দু’ডজনের বেশি ছিল না। অনেকেই তখন দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে “ফেন্স”-এর (বেড়ার) উপর বসে ছিল। তারা ভেবেছিল, পাকিস্তান থেকে যেতে পারে, স্বাধীনতা যুদ্ধ সফল-ও হতে পারে। শেষ পর্যন্ত যে-পক্ষ জয়ী হবে, সেদিকে তারা ঝাপিয়ে পড়বে। ঠিক তাই হলাে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর তারা কোলাবােরেটার” ও ঘাতকদের সমন্বয়ে গঠিত তথাকথিত সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বণিক হলাে, ধনী হলাে। কিন্তু যে চাকরিজীবী স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থনদানের জন্য চাকরি হারাল, পুরাে সপ্তাহের মাইনে মুক্তিযুদ্ধ তহবিলে দান করেছে, মাস যাবৎ সময় মত বাড়িতে ফিরতে পারেনি, পরিবার-পরিজনের খোঁজখবর নিতে পারেনি, দেশের জন্য অপরিসীম আত্মত্যাগ করেছে, তাদের সম্পর্কে স্বাধীনতার পর কেউ খোজখবর করেনি। ইতােমধ্যে গাউস খান, হাজী আবদুল মতিন, তৈয়েবুর রহমান, মােতালেব চৌধুরী, মিনহাজউদ্দিন, বি এইচ তালুকদার, জগলুল পাশা, মননায়ার হােসেন এবং আরাে অনেক নেতৃস্থানীয় প্রবাসী বাঙালী ইহলােক ত্যাগ করেছেন। তাঁদের স্মৃতির প্রতি যথােপযুক্ত সম্মান জাতির পক্ষ থেকে প্রদর্শন করা হয়নি। এরা দেশকে ভালবেসে দেশের পক্ষে কাজ করেছেন; তার জন্য কোনোও পুরস্কার আশা করেননি। কিন্তু আমি মনে করি, এদের প্রতি মুক্তিযুদ্ধের-পক্ষের সরকারের একটা নৈতিক দায়িত্ব রয়েছে।
বাঙালী হয়েও মুক্তিযুদ্ধ কালে যারা আমাদের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কাজ করেছে তাদের মধ্যে আবুল হায়াতের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। তার দেশে বাড়ি বৃহত্তর সিলেট জেলায়। এ দেশে বসবাসকারী বাঙালীদের অধিকাংশে এই অঞ্চল থেকে এসেছেন। তাদের মধ্যে তিনি বাংলাদেশ-বিরােধী প্রচারণা চালান। বাংলাদেশের মুক্তি-সংগ্রামকে “গৃহযুদ্ধ” আখ্যা দিয়ে ধামাচাপা দেওয়া সম্ভব হবে না বলে বুঝতে পেরে পাকিস্তান সরকার একটি বাংলা পত্রিকার মাধ্যমে মুক্তি
৪৮
বিরােধী প্রচারণা চালাবার জন্য আবুল হায়াতের সম্পাদনায় “মুক্তি” নামের একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশের ব্যবস্থা করে।
১৫ই অগাস্ট লন্ডনের ট্রাফালগার স্কোয়ারে পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের অজুহাতে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ-বিরােধী একটি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এই সমাবেশের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন আবুল হায়াত। ১৬ই অগাস্ট “দি গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত এক রিপাের্টে বলা হয়, দু’ সপ্তাহ আগে ট্রাফালগার স্কোয়ারে বাংলাদেশের সমর্থক বাঙালীদের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত গণসমাবেশের পাল্টা জবাব হিসাবে পাকিস্তান সলিডারিটি ফ্রন্ট এই সমাবেশের আয়ােজন করে। এপ্রিল মাসে আবুল হায়াতের নেতৃত্বে বার্মিংহামে প্রতিষ্ঠানটি জন্মলাভ করে। পূর্ব বঙ্গে গণহত্যা সংঘটনের অভিযােগ অস্বীকার করে পাকিস্তান হাই কমিশান প্রকাশিত একটি প্রচারপত্র এই সমাবেশে বিলি করা হয়।
১৯শে অগাস্ট “দি গার্ডিয়ান”-এ প্রকাশিত এক চিঠিতে এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ভিক্টর জি কিয়ারনান বলেন, বহু সংখ্যক পশ্চিম পাকিস্তানী তাদের বর্বর সরকার এবং পূর্ব বঙ্গে তাদের সামরিকবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত পাশবিক অত্যাচারের সমর্থনে ১৫ই অগাস্ট লন্ডনে যে সমাবেশের আয়ােজন করে, তার সংবাদ অবগত হয়ে তিনি অস্বস্তি বােধ করেন। তিনি আরও বলেন, ব্রিটেন নবাগতদের জাতীয় জীবনের অংশ হিসাবে গ্রহণ করার জন্য সচেষ্ট রয়েছে। এর বিনিময়ে তাদের মনােভাব কিছুটা পরিবর্তিত হবে বলে ব্রিটেন আশা করে। ব্রিটেনপ্রবাসী পাকিস্তানীরা এমন এক দেশ থেকে এসেছে যে-দেশের জনজীবন সভ্যতার মানদণ্ড দিয়ে যাচাই করা চলে না এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের মান অত্যন্ত নীচু। ১৫ই অগাস্টের সমাবেশ থেকে মনে হয়, অংশগ্রহণকারীদের অধিকাংশই রাজনৈতিক দৃষ্টিহীনতা, গোড়ামি এবং নিন্দনীয় নেতৃত্বের মনােভাব সঙ্গে নিয়ে এসেছে। এসব তাদের নিজের দেশে রেখে আসা উচিত ছিল।
২৩শে অগাস্ট উল্লিখিত পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবাদপত্রে আবুল হায়াত নিজেকে পূর্ব পাকিস্তানী হিসাবে পরিচয় দিয়ে সমাবেশে অংশগ্রহণকারীদের অধিকাংশই “পূর্ব বঙ্গের” নাগরিক বলে দাবি করেন।
১০ই অক্টোবর “দি সানডে টাইমস”-এ প্রকাশিত এক সংবাদ বিশ্লেষণে লন্ডনস্থ পাকিস্তান হাই কমিশনের একটি গােপন দলিলের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, ৩রা অগাস্ট “দি টাইমস”-এ প্রকাশিত বাংলাদেশ-বিরােধী একটি বিজ্ঞাপনের ব্যয়ভার পাকিস্তান সরকার বহন করে। এই বিজ্ঞাপনের উদ্যোক্তা তথাকথিত পাকিস্তান সলিডারিটি ফ্রন্ট। পাকিস্তান হাই কমিশানে নিয়ােজিত প্রেস কাউন্সেলার
৪৯
আবদুল কাইউম সরকারী তহবিল থেকে ২,৬৪০ পাউন্ড ব্যক্তিগত নামে গ্রহণ করে সলিডারিটি ফ্রন্টের প্রতিনিধির হাতে তুলে দেন। “দি সানডে টাইমস”-এ গােপন দলিলটির “ফ্যাক্সিমিলি” প্রকাশিত হয় ।
যুক্তরাজ্যে গোঁড়া পাকিস্তানপন্থী বাঙালীদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় ছিলেন ব্যারিস্টার আব্বাস আলী। তিনি ইংল্যান্ডে আইনের ছাত্র হিসাবে বিচারপতি চৌধুরীর সমসাময়িক ছিলেন। ভারত বিভাগের আগে বিচারপতি চৌধুরী যখন আসেন, তার আগেই আব্বাস আলী এদেশে আসেন। লন্ডনে অবস্থান কালে তাঁকে দেখাশােনা করার অনুরােধ জানিয়ে বিচারপতির পিতা আব্বাস আলীকে চিঠি লেখেন। লন্ডনে অবস্থান কালে তাঁর সৌজন্যের কথা স্মরণ করে বিচারপতি চৌধুরী আব্বাস আলীর কাছে ঋণী বােধ করেন। আব্বাস আলীর মৃত্যু পর্যন্ত তিনি তার সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষা করেন।
সত্তরের দশকের শেষ দিকে আব্বাস আলী গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ছিলেন। বিচারপতি চৌধুরী তাকে দেখতে যান। তিনি তখন মৃত্যুশয্যায় । আব্বাস আলী বিচারপতি চৌধুরীর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন এবং কথা বলতে রাজী হলেন না। বিচারপতি আন্তরিক কষ্ঠে বিনয়ের সঙ্গে বলেন, আমি তােমাকে মুক্তিবাহিনীর প্রতিনিধি হিসাবে নয়, বন্ধু হিসাবে দেখতে এসেছি। পাকিস্তান তােমার দেশ; বাংলাদেশ আমার দেশ! তুমি অতীতে আমার সঙ্গে যে সৌজন্যমূলক ব্যবহার করেছ তার জন্য আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে এসেছি। কিন্তু আব্বাস আলী কোনও কথা বললেন না।
মৃত্যুর পূর্বে আব্বাস আলী নির্দেশ রেখে যান, তাকে যেন পাকিস্তানে কবর দেওয়া হয়। তার মৃত্যুর পর পাকিস্তান সরকারের উদ্যোগে মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ-র কবরের পাশে যথারীতি মর্যাদার সঙ্গে তাকে কবর দেওয়া হয়। জিন্নাহ সাহেবের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ও যােগাযােগ খুব বেশি ছিল বলে মনে হয় না । দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অবসানে জিন্নাহ সাহেব রাউন্ড টেবিল কনফারেন্সে যােগদানের জন্য মুসলীম লীগের নেতা হিসাবে লন্ডনে আসেন। তিনি যখন বিমানবন্দরে পৌছান, তখন মুসলীম লীগের পতাকা হাতে নিয়ে আব্বাস আলী বিমানের দিকে দৌড়ে যান। ব্রিটিশ লেখক হেক্টার বলিথাে রচিত জিন্নাহ সাহেবের জীবনীগ্রন্থে এই ঘটনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। পাকিস্তানের জাতির জনকের নামের সঙ্গে তার নাম উল্লেখ করা হয়েছে বলে আব্বাস আলী গর্ব বােধ করতেন।
* * * * *
জুলাই মাসের প্রথম দিকে পাকিস্তান সরকারের উদ্যোগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড: সৈয়দ সাজ্জাদ হােসাইন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
৫০
ইতিহাস বিভাগের রীডার ড: মােহর আলী বাংলাদেশের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাবার জন্য লন্ডনে আসেন। ৭ই জুলাই (১৯৭১) “দি টাইমস”-এর চিঠিপত্র কলামে প্রকাশিত এক দীর্ঘ চিঠিতে তারা দাবি করেন, ২৫শে মার্চ কিংবা তারপর চট্টগ্রাম কিংবা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনাে শিক্ষককে পাকিস্তান সৈন্যবাহিনী ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করেনি। ২৫শে মার্চ দিবাগত রাত্রে ইকবাল হল ও জগন্নাথ হলের আশপাশে সশস্ত্র সংঘর্ষের ফলে ৯জন শিক্ষক মারা যান। আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী হল দু’টি ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকা সামরিক আক্রমণের ঘাঁটি হিসাবে ব্যবহার না করলে এই “দুঃখজনক ঘটনা এড়ানাে যেতাে। তাদের। “ব্যক্তিগত বন্ধু” অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা গুলির আঘাতে আহত হয়ে হাসপাতালে গিয়ে তিন দিন পর মারা যাওয়ার আগে তাঁর বন্ধুদের নাকি বলেছিলেন, আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাসেবীরা তাঁর বাড়িতে না ঢুকলে তিনি (পাকিস্তানী) সৈন্যবাহিনীর আক্রমণ এড়াতে পারতেন।
লন্ডনের রয়াল গার্ডেন হােটেল থেকে যুক্তভাবে লিখিত এই চিঠিতে তারা আরও বলেন, এপ্রিল মাসের গােড়ার দিক থেকে ১৩ই তারিখে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক রাজশাহী দখল না করা পর্যন্ত আওয়ামী লীগের প্রতি আস্থাহীন অধ্যাপকদের হত্যা করার জন্য বার বার চেষ্টা করা হয়। অবাঙালী অধ্যাপকদের তখন গৃহবন্দী করে রাখা হয়। পাকিস্তান সৈন্যবাহিনী এই “অরাজকতা” দমন না। করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু অবাঙালী অধ্যাপকের মৃত্যু অবধারিত ছিল বলে তারা বিশ্বাস করেন ।(৮)
দেশপ্রেমিক বাঙালীরা ইউরােপ, আমেরিকা ও যুক্তরাজ্যে সাজ্জাদ হােসাইন ও মােহর আলী পরিবেশিত নির্জলা মিথ্যার প্রতিবাদ জানিয়ে প্রকৃত সত্য তুলে ধরতে সক্ষম হন। ১৬ই অগাস্ট “দি টাইমস”-এ প্রকাশিত এক চিঠিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক এম হােসেন এবং বাংলার অধ্যাপক এম ইসলাম বলেন, ১৩ই এপ্রিল রাজশাহী দখল করার পর পাকিস্তান সেনাবাহিনী গণিতশাস্ত্র বিভাগের হাবিবুর রহমান ও ভাষাতত্ত্ব বিভাগের এস আর সমাদ্দারকে তাদের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। ড: সাজ্জাদ হােসাইন তখনও পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় অবস্থিত উপাচার্যের বাসভবনে বসবাস করছিলেন। এই হত্যাকাণ্ডের খবর তার অজানা থাকার কথা নয়। তাঁরা আরও বলেন, শহরগুলি (রাজশাহী ও চট্টগ্রাম) মুক্তিবাহিনীর হাতে থাকার সময় কোনও উর্দুভাষী অধ্যাপককে হত্যা করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে মিথ্যা প্রচারণা চালাবার জন্য পাকিস্তানের সামরিক চক্র বেসরকারীভাবে যাদের বিদেশে পাঠায়, তাদের মধ্যে
৫১
ছিলেন হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর কন্যা বেগম আখতার সােলায়মান। তিনি তাঁর স্বামী এস সােলায়মানের সঙ্গে ২০শে জুলাই লন্ডনে এসে হাজির হন। তাঁর বক্তব্য ছিল; স্বাধীন ও সার্বভৌম পাকিস্তানে যে-যুদ্ধের কথা বলা হচ্ছে তা গৃহযুদ্ধ এবং পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। ঢাকায় গণহত্যা সম্পর্কে ভারতীয় প্রচারণা ভিত্তিহীন। | পূর্ব বঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যাকে সমর্থন করে বেগম সােলায়মান জুন মাসে একটি বিবৃতি দেন। এই বিবৃতিতে তিনি দাবি করেন, তাঁর পিতা (শহীদ সােহরাওয়ার্দী) জীবিত থাকলে মুক্তিযুদ্ধের বিরােধিতা করতেন।
লন্ডনে এসে বেগম সােলায়মান ও তার স্বামী প্রবাসী বাঙালীদের মধ্যে পাকিস্তান-সমর্থক হিসাবে পরিচিত ব্যারিস্টার আব্বাস আলী, আজহার আলী, আফজল হামিদ, মি: হক এবং আরাে কয়েকজনের সঙ্গে যােগাযােগ করেন। “মুক্তি” পত্রিকার সম্পাদক আবুল হায়াত তাঁদের সঙ্গে ঘােরাফেরা করে। কয়েকজন পাকিস্তান-সমর্থক পার্লামেন্ট সদস্যদের সঙ্গেও তারা দেখা করেন। এদের মধ্যে ছিলেন পাকিস্তান কাউন্সিলের চেয়ারম্যান বিগ ডেভিডসন এবং মিসেস জিল নাইট (বর্তমানে ডেইম নাইট)। তবে বাঙালী মহলে বেগম সােলায়মান সুবিধা করতে পারেননি। দেশপ্রেমিক বাঙালীরা তাকে আমল দেননি।
তার লন্ডন সফরকালে বি বি সি-র উর্দু সার্ভিস প্রচারিত এক সাক্ষাৎকারে বেগম সােলায়মান বলেন, বিদেশ সফরের জন্য তিনি পাকিস্তান সরকারের নিকট থেকে কোনাে টাকা গ্রহণ করেননি। লন্ডনের সাপ্তাহিক “জনমত” পত্রিকার ১২ই সেপ্টেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত একটি দলিল অনুযায়ী, যুক্তরাজ্য সফরকালে বেগম সােলায়মান ও তাঁর স্বামী মি: সােলায়মানকে ২০শে জুলাই থেকে ৪ সপ্তাহের জন্য দৈনিক সাড়ে-সাত পাউন্ড হিসাবে মােট ৪শ ২০ পাউন্ড ভাতা হিসাবে দেওয়া হয়। পাকিস্তান হাই কমিশনের চ্যান্সেরী” বিভাগের প্রধান অফিসার বখতিয়ার আলী ২রা অগাস্ট এই দলিলে স্বাক্ষর করেন।
হঠাৎ রাত ১১টার সময় বেগম সােলায়মান আমাকে টেলিফোন করেন। আমি অবাক হলাম, সােহরাওয়ার্দী সাহেবের কন্যা আমার টেলিফোন নাম্বার কোথায় পেলেন এবং কেনই-বা আমার খোঁজ করছেন। আমি বললাম, আমি কি আপনাকে চিনি? তিনি বললেন, মুজিব ভাইয়ের বাড়িতে আপনাকে আমি দেখেছি। তিনি তারিখ ও বছর উল্লেখ করলেন। আমি তার সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা স্মরণ করতে পারলাম না। বললাম: হাউ কেন আই হেলপ ইউ?”
তিনি সােজা বাংলায় বললেন: “মান্নাই ভাই, জেনােসাইড’ (গণহত্যা) হয়ান, অফিসার হত্যা করা হয়নি, সব ভারতীয় প্রােপাগান্ডা’। বর্ডারে কিছু সংখ্যক
৫২
‘রিফিউজি’ মরেছে; ওরা তাদের লাশ দেখিয়ে দিয়েছে। আর ইউনিভার্সিটির ওখানে ওরা কয়েকজন ছাত্র মেরে তাদের ফটো বাইরের দুনিয়ায় পাঠিয়ে দিয়েছে।”
আমি বললাম: “আপনি তাে অনেক কিছুই জানেন; নিহত প্রফেসারদের নাম সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে; তারা কি তা হলে বেঁচে আছেন? আপনি কি তাঁদের সঙ্গে কথাবার্তা বলেছেন? তারা জীবিত কি মৃত–সে সম্বন্ধে খােজ নিয়েছেন? | বেগম সােলায়মান বললেন, “আমি কি করে যাবাে?”
আমি বললাম, আপনার জন্য তাে পূর্ব পাকিস্তানে যাওয়ার ব্যাপারে কোনও বাধা নেই। গিয়ে নিজের চোখে দেখে আসুন। খোঁজখবর না নিয়ে এখানে এসে বিচারপতি চৌধুরীকে টেলিফোন করবেন না। তিনি (বিচারপতি) পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং সরকারী কর্তৃপক্ষকে সমূলে উত্তত করে বাংলাদেশকে সম্পূর্ণ স্বাধীন করার ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আপনাকে কোনও রকম সাহায্য তিনি করতে পারবেন না।”
আমি পরে জেনেছি, বেগম সােলায়মান বরিশালের আবদুল হক-এর (একাউন্টেন্ট) বাড়িতে ছিলেন। সেখান থেকেই তিনি আমাকে টেলিফোন করেন।
পরদিন বেগম সােলায়মানের সঙ্গে টেলিফোনে আলাপের কথা বিচারপতি চৌধুরীকে বললাম। সব শুনে তিনি বললেন, সােহরাওয়ার্দী সাহেবের ছেলে এদেশে আছেন। তার সন্ধান কে আনতে পারবে?
বেশ কিছুকাল পর খবর পেলাম, স্ট্রাটফোর্ড-আপন-এভনে অবস্থিত “কাশ্মীর রেস্তোরা”-র মালিক আরব আলীর সঙ্গে সােহরাওয়ার্দী সাহেবের পুত্র রাশেদ সােহরাওয়ার্দীর আলাপ-পরিচয় রয়েছে। রয়াল সেক্সপীয়ার থিয়েটার কোম্পানীর সদস্য হিসাবে তিনি তখন স্ট্যাটফোর্ডে থাকতেন। আরিফ আলীর রেস্তোরাঁয় খেতে এসে তিনি তার সঙ্গে কথাবার্তা বলেন।
আরিফ আলী বললেন, তিনি রাশেদ সােহরাওয়ার্দীকে লন্ডনে নিয়ে। আসবেন। অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে নিজের গাড়িতে করে তিনি তাঁকে স্টিয়ারিং কমিটির অফিসে নিয়ে এলেন। বিচারপতি চৌধুরী রাশেদ সােহরাওয়ার্দীকে বললেন, “মি: সােহরাওয়ার্দী, আপনার পিতা আমাকে স্নেহ করতেন। তিনি বাংলাদেশকে ভালবাসতেন। বাঙালীদের স্বার্থ রক্ষার ব্যাপারে তিনি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন। এর জন্য তাকে অনেক দুর্ভোগ সহ্য করতে হয়েছে। আপনি কি মনে করেন, বাংলাদেশে নিজের লােকজনের প্রতি আপনার কিছু বর্তব্য আছে?”
৫৩
রাশেদ সােহরাওয়ার্দী বললেন, “হ্যা, আমার কিছু করণীয় আছে বলে আমি মনে করি। কিন্তু আমি কি করতে পারি?”
বিচারপতি বলেন, “আপনি যদি বাংলাদেশকে সমর্থন করেন তা হলে বেগম সােলায়মানের বিবৃতির প্রতিবাদ করতে পারেন।”
মি: সােহরাওয়ার্দী বললেন, তিনি অবশ্যই বাংলাদেশকে সমর্থন করেন। তবে তিনি চান বাংলাদেশ একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হবে।
বিচারপতি বললেন, বাংলাদেশ আপনার নিজের দেশ; আপনি কি চান, তা’ আপনি স্থির করুন। বঙ্গবন্ধুর ছ’দফার মধ্যে একটি হলাে সমাজতন্ত্র—এ কথা ভুলবেন না। এই যুক্তি মেনে নিয়ে মি: সােহরাওয়ার্দী “মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের কাছে একটি পত্র লেখেন। এই পত্রের বক্তব্য সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়।
৭ই অক্টোবর তারিখে লিখিত পত্রে রাশেদ সােহরাওয়ার্দী বলেন:
“পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্যবাহিনীর উদ্যোগে গণহত্যা শুরু হওয়ার সংবাদ পাওয়ার পর থেকে আমি বাংলাদেশের জনগণের প্রতি সহানুভূতিশীল এবং তাদের মুক্তিসংগ্রামের দৃঢ় সমর্থক। রাজনীতিতে জড়িত না থাকায় আমি ব্যক্তিগতভাবে বিবৃতি দেওয়ার প্রয়ােজন বােধ করিনি। আমাদের পরিবারের একজন সদস্য তাঁর বিবৃতির মাধ্যমে আমার প্রিয় পিতা হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করেছেন বলে বুঝতে পারার পর আমার বক্তব্য পেশ করা অবশ্য বর্তব্য বলে আমি মনে করি।
“আমি পরিষ্কারভাবে বলতে চাই, মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণের বিজয় আমি কামনা করি। গত ২৪ বছর যাবৎ পশ্চিম পাকিস্তান তাদের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে শােষণ করে এবং রাজনীতি ক্ষেত্রে কর্তৃত্বাধীনে রাখে। পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্যবাহিনী গণহত্যা এবং অন্যান্য জঘন্য অপরাধজনক কর্মকাণ্ড শুরু করার পর তারা অস্ত্র হাতে নিতে বাধ্য হয়েছে।
‘মুক্তিবাহিনীর বীর যােদ্ধারা আক্রমণকারী সৈন্যদের উৎখাত করে পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করবে, এ সম্বন্ধে আমি নিঃসন্দেহ।
“আমি আশা করি অদূর ভবিষ্যতে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশে গিয়ে দেখবাে- বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী এবং রাজনৈতিক দলের সমর্থকরা শান্তি ও সম্প্রীতিমূলক পরিবেশে জীবনযাপন করছে।
“বাংলাদেশ সরকারকে আমি অভিনন্দন জানাচ্ছি। এই সরকারের সদস্যবৃন্দের সবাই আমার পিতার সহকর্মী এবং স্নেহের পাত্র ছিলেন।” (৯)
* * * * *
আমি পাকিস্তান স্টাডি সার্কেলের জেনারেল সেক্রেটারী থাকা কালে আবদুল হামিদ তার সদস্য ছিলেন। তিনি ডেবেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে তার অবস্থানের
৫৪
কথা আমার জানা নেই। এক দিন রাত্রে টেলিফোন করে তিনি আমাকে বললেন, দেশটা তাে জ্বলে-পুড়ে ছারখার হয়ে গেল; আত্মীয় স্বজনহারা শিশু ও অসহায়দের কান্না আর সহ্য করা যায় না। দেশের জন্য কাজ করতে হবে। তিনি একটি উপায় খুঁজে পেয়েছেন। তারা বিদেশী জাহাজের মাধ্যমে মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য অস্ত্র পাঠাবেন। সুন্দরবনে তাদের একটা সেল” তৈরি হয়েছে। সেখানে তারা অস্ত্র পাঠাতে পারেন। আমরা এ-ব্যাপারে তাদের সাহায্য করতে পারবাে কিনা, তিনি জানতে চান।
আমি জানতাম, মি: মােল্লা, আবদুল হামিদ, আজহার আলী, আব্বাস আলী এবং আরাে অনেকে বিভিন্ন ধরনের বাংলাদেশ-বিরােধী প্রচারণা ছাড়াও নানা দুরভিসন্ধি নিয়ে কাজ করেন। আমি মি: হামিদকে বললাম, আপনি যদি জাহাজে পাঠাবার ব্যবস্থা করতে পারেন, তাহলে আপনাকে অত্র পৌছে দেওয়ার ব্যাপারে আমি যতদূর পারি সাহায্য করবে। আর সুন্দরবনে কোথায় আপনাদের “সেল” তা আমাকে জানান। তারপর আপনারা অস্ত্র পাবেন।
মূলতঃ মি: হামিদের উদ্দেশ্য ছিল, অস্ত্র পাঠানাে সম্পর্কে আমাদের পরিকল্পনা জানতে পারলে তার খবর পাকিস্তান হাই কমিশানে পৌছে দিয়ে পুরস্কার লাভ করা। আমি এই ফাঁদে পা দিইনি।
* * * * *
বাংলাদেশ থেকে মুক্তিযুদ্ধ-বিরােধী প্রচারণা চালাবার জন্য পাকিস্তান সরকার যাদের পাঠায়, তাদের মধ্যে ছিলেন পাকিস্তান অবজারভার”-এর (বর্তমান ‘বাংলাদেশ অবজারভার) মালিক হামিদুল হক চৌধুরী এবং তৎকালীন গণতন্ত্রী দলের নেতা মাহমুদ আলী। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জুলফিকার আলী ভুট্টো মাহমুদ আলীকে দালালির পুরস্কার-স্বরূপ মন্ত্রী পদে নিয়ােগ করেন।
অগাস্ট মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে হামিদুল হক চৌধুরী ইউরােপের কয়েকটি দেশ সফর করে লন্ডনে পৌছান। ইতােমধ্যে মাহমুদ আলীও লন্ডনে পৌছান। তাঁরা উভয়ে বেজওয়াটার এলাকায় রয়াল ল্যাঙ্কাস্টার হােটেলে ওঠেন। পাকিস্তান সরকার তাঁদের ব্যয়ভার বহন করে। তাদের ভাতাদান সম্পর্কিত দলিলের ফ্যাক্সিমিলি” লন্ডনের সাপ্তাহিক জনমত” পত্রিকার ৫ই সেপ্টেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত হয়।
মি: চৌধুরী ও মি: আলী লন্ডনে মাত্র কয়েক দিন অবস্থান করেন। কয়েকটি বাঙালী রেস্তোরাঁয় গিয়ে তাঁরা ঘরােয়া আলাপ-আলােচনা কালে ভারতের তথাকথিত দুরভিসন্ধির কথা উল্লেখ করেন। তারা দাবি করেন, ১৯৪৭ সালে ভারত দেশ-বিভাগ মেন নেয়নি। তাই পাকিস্তানকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে তারা আওয়ামী লীগকে সমর্থন করছে। ব্যারিস্টার আব্বাস আলী এবং আরও কয়েকজন পাকিস্তানপন্থী বাঙালী তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
৫৫
ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্র দপ্তর থেকে মি: চৌধুরী ও মি: আলীকে বলা হয়, জনসভায় বক্তৃতাদান করা হলে তাদের নিরাপত্তা বিপন্ন হতে পারে। তার ফলে তারা : জনসভায় বক্তৃতাদনের পরিকল্পনা ত্যাগ করে আমেরিকায় চলে যান।
হামিদুল হক চৌধুরী ও মাহমুদ আলী পূর্ব বঙ্গে পাকিস্তানী হত্যাযজ্ঞ অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে গঠিত তথাকথিত শান্তি কমিটির সক্রিয় সদস্য ছিলেন।
* * *
স্টিয়ারিং কমিটি গঠিত হওয়ার পর লন্ডনের রেড লায়ন স্কোয়ারে অবস্থিত কনওয়ে হলে জিয়াউদ্দিন মাহমুদ পরিচালিত একটি জনসভায় লন্ডন এ্যাকশান কমিটির সেক্রেটারী হিসাবে ব্যারিস্টার শাখাওয়াত হােসেন এবং স্টিয়ারিং কমিটির পক্ষ থেকে আমি যােগদান করি। জিয়াউদ্দিন তার বক্তৃতায় দাবি করেন, তিনি ঢাকা জেলে তাজউদ্দিন আহমদের সঙ্গে একই সেলে বন্দী ছিলেন। তাজউদ্দিন সাহেবের তিনি ভূয়সী প্রশংসা করেন। কিন্তু বিচারপতি চৌধুরীকে তিনি চিত্রিত করেন একজন ভূস্বামী ও সামন্ততান্ত্রিক মনােবৃত্তিসম্পন্ন ব্যক্তি হিসাবে। বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনে তার নেতৃত্বদানের যােগ্যতা সম্বন্ধেও জিয়াউদ্দিন প্রশ্ন করেন। জগলুল হােসেন, ব্যারিস্টার লুৎফর রহমান শাজাহান এবং আরও কয়েকজন বক্তৃতা করেন। এদের মধ্যে কেউ কেউ ভােলাখুলিভাবেই নিজেদের নকশালপন্থী বলে দাবি করেন। মুন্নি রহমানও এই সভায় উপস্থিত ছিলেন।
বক্তৃতা প্রসঙ্গে আমি বলেছি, “মুজিবনগর সরকার যাকে প্রতিনিধি হিসাবে নিয়ােগ করেছেন, তাঁকে বাদ দিয়ে যদি অন্য কাউকে আমরা আমাদের বিপ্লবের নেতা নির্বাচন করি, তা হলে সে ব্যক্তিটি কে হতে পারেন, তা জানা দরকার। আপনারা এমন একজনের নামােল্লেখ করুন, যিনি দলমত নির্বিশেষে সব বাঙালীর নেতৃত্বদানের উপযুক্ত ব্যক্তি। এ প্রশ্ন আমি আওয়ামী লীগ ও চীনাপন্থীদের। করেছি। এ সম্পর্কে একমত হতে না পারলে বহির্বিশ্বে আমাদের যে কলঙ্কময় চিত্র প্রতিফলিত হবে, তার ফলাফল কি হবে, আমি তা জানতে চেয়েছি। তারা আমার প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারেননি।
যুক্তরাজ্যের মাওপন্থীরা আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে সরে গিয়ে নিজেদের আদর্শ অনুযায়ী কর্মপন্থা নির্ধারণ করে পৃথকভাবে কাজ করেন। (১০)
৫৬
৭. জনসভা ও বিক্ষোভ মিছিল
৪ঠা এপ্রিল (রবিবার) আমাদের জীবনের একটি স্মরণীয় দিন। বাংলাদেশ স্টুডেন্টস এ্যাকশান কমিটির উদ্যোগে সেদিন দুপুরবেলা হাইড পার্কে বাংলাদেশের সমর্থনে একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। আমি সেখানে কাউন্সিল ফর দি পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বক্তৃতা করি। সেখান থেকে একটি বিক্ষোভ-মিছিল নিয়ে আমরা ট্রাফালগার স্কোয়ারে যাই। কাউন্সিল ফর দি পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশের উদ্যোগে এখানেও একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। গাউস খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সভার কার্য পরিচালনা করেন বি এইচ তালুকদার। সভায় বক্তাদের মধ্যে ছিলেন সুলতান মাহমুদ শরীফ, হাজী আবদুল মতিন ও শাখাওয়াত হােসেন। কাউন্সিলের জেনারেল সেক্রেটারী হিসাবে আমিও বক্তৃতা করি। সভার পর আমরা ডাউনিং স্ট্রীটে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে গিয়ে একটি স্মারকলিপি পেশ করি।
সেদিন সন্ধ্যায় উত্তর লন্ডনের হ্যামস্টেড টাউন হলে শ্রমিক দলের প্রভাবশালী সদস্য জন এনালস-এর সভাপতিত্বে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। পূর্ব বঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নৃশংস সামরিক অভিযানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাবার জন্য এই সভার আয়ােজন করা হয়। আমরা দলবদ্ধ হয়ে এই সভায় যােগদান করি। সভায় বক্তাদের মধ্যে ছিলেন পরাধীনতার বিরুদ্ধে আজীবন সংগ্রামকারী। লর্ড ব্রকওয়ে, শ্রমিক দলীয় পার্লামেন্ট সদস্য পিটার শাের (বর্তমানে লর্ড শাের), ছাত্রনেতা তারিক আলী, লন্ডন আওয়ামী লীগের পক্ষে সুলতান মাহমুদ শরীফ, “বাংলাদেশ নিউজলেটার”-এর সম্পাদক ফরিদ এস জাফরী ও মহিলা সমিতির লুলু বিলকিস বানু।
লর্ড ব্রকওয়ে পূর্ব বাংলার ব্যাপারে জাতি সংঘের হস্তক্ষেপ দাবি করেন এবং পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীকে কোনও প্রকার সাহায্য না দেওয়ার জন্য শ্রীলঙ্কার প্রতি আবেদন জানান। পিটার শাের পূর্ব বাংলায় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে মেনে নিতে অস্বীকার করেন। তারিক আলী বাংলাদেশের সংগ্রামকে ভিয়েতনামের সংগ্রামের সঙ্গে তুলনা করে বলেন, এই
৫৭
আন্দোলনের ফলে লক্ষ লক্ষ বাঙালীর মুক্তি আসবে, শােষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠিত যাবে এবং এই উপমহাদেশে সমাজতন্ত্রের বীজ বপন করা হবে। | তারিক আলীর বক্তৃতার পর লন্ডন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে কথা বলতে গিয়ে সুলতান মাহমুদ শরীফ বলেন, আমরা সর্বহারার রাজনীতির সঙ্গে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ জড়িয়ে ফেলতে চাই না। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ আমরাই করবে আমরা অন্যের কোনাে সাহায্য চাই না। তিনি পূর্ববর্তী বক্ত্যর সঙ্গে একমত নন বলে উল্লেখ করেন।
শ্রোতাদের অনেকেই সুলতান শরীফের বক্তব্যের প্রতিবাদ করেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, উলিখিত বক্তব্য পেশ করে শরীফ সাহেব তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল করেন। বাংলাদেশের আদর্শের মধ্যে রয়েছে ধর্মনিরপেক্ষত্য ও সমাজতন্ত্র। বঙ্গবন্ধু তার ভিত্তি গড়ে দিয়েছিলেন। এই দুই আদর্শকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ হতে পারে না। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক বন্ধুরা, যারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সহায়ক হবেন, আমাদের দুঃখ-বেদনার কথা বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরে সাহায্যের আবেদন জানাবেন, তাদের তিনি জানিয়ে দিলেন– আমাদের মুক্তিযুদ্ধে আমরা অন্যের কোনাে সাহায্য চাই না, আমরা নিজেরাই আমাদের দেশকে মুক্ত করবে। আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি হিসাবে কথাগুলি বলা তার পক্ষে সমীচীন হয়নি।
স্টিয়ারিং কমিটি গঠিত হওয়ার পর বাংলাদেশ আন্দোলন সম্পর্কে বক্তৃতাদানের জন্য ইংল্যান্ডের বিভিন্ন এলাকা থেকে বিচারপতি চৌধুরীকে আমন্ত্রণ জানান হয়। জনসংযােগের কর্মতালিকা অনুযায়ী প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয় ব্র্যাডফোর্ডে। ১ই মে সকালবেলা স্থানীয় আহ্বায়ক কমিটি এই সভার আয়ােজন করে। একটি অনাকীর্ণ হলে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত “আমার সােনার বাংলা, আমি তােমায় ভালবাসি” দিয়ে সভার কাজ শুরু হয়।
স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমি বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করে বিচারপতি চৌধুরী। বলেন: “বন্দী হওয়ার পূর্ব মুহুর্তে বাংলার নেতা স্বাধীনতা ঘােষণা করে সমগ্র বাঙালী জাতির আশা ও আকাঙ্ক্ষা্ই প্রতিধ্বনি করেছেন। তিনি বিচারপিত) মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধি হিসাবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাম আদর্শ ব্যাখ্যা করেন। সমগ্র জনতা “জয় বাংলা”, “শেখ মুজিবের মুক্তি চাই ইত্যাদি শ্যেন দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তাদের অকুণ্ঠ সমর্থন ঘােষণা করে।
ব্র্যাডফোর্ড থেকে বিচারপতি চৌধুরী ও আমি বার্মিংহাম পৌছাই। আমাদের সঙ্গে ছিলেন বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যাসােসিয়েশনের ড: মােশাররফ হোসেন
৫৮
তরফদার। বিকেলবেলা অনুষ্ঠিত সভায় বার্মিংহাম এ্যাকশন কমিটির পক্ষ থেকে জগলুল পাশা এবং স্টিয়ারিং কমিটির পক্ষ থেকে আমার বক্তৃতার পর বিচারপতি চৌধুরী প্রধান বক্তা হিসাবে তার বক্তব্য পেশ করেন।
বিচারপতি চৌধুরী বলেন, “পঁচিশে মার্চের স্তব্ধ অন্ধকারে নির্মম হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে এক নবজাগ্রত জাতির জয়যাত্রা শুরু হয়েছে। সেই ন্যায়যুদ্ধে আপনারা সকলেই যােগদান করেছেন। আপনাদের সঙ্গে একজন নগণ্য বাঙালী হিসাবে আমিও এসে দাঁড়িয়েছি। আমরা চেয়েছিলাম সমান অধিকার, এগিয়ে চলেছিলাম নিয়মতান্ত্রিক পথে। সেই সময় প্রতারণার দ্বারা সময় হরণ করে পাকিস্তান থেকে সৈন্য এনে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে শ্যামল বাংলার বুকে মা-বােনের ইজ্জৎ হরণ, লুণ্ঠন আর গণহত্যার জন্য । “
৩০শে মে প্রবীণ বাঙালী নেতা হাজী আবদুল মতিনের উদ্যোগে ম্যাঞ্চেস্টারে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য কবীর চৌধুরী এবং স্থানীয় বাঙালী ছাত্রদের নেতা মহীউদ্দিন আহমদ সভা অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সহায়তা করেন। বিরাট হলটিতে তিল ধারণের স্থান ছিল না। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের বক্তৃতার ক্যাসেট বাজিয়ে সভার কাজ শুরু হয়। এই ঐতিহাসিক ভাষণ শ্রোতাদের ওপর এক অবর্ণনীয় প্রভাব বিস্তার করে। বিচারপতি চৌধুরী তার বক্তৃতায় ২৫শে মার্চের রাত থেকে ৩০শে মে পর্যন্ত সংঘটিত ঘটনাগুলির বিবরণ দেন। তাঁর সাম্প্রতিক আমেরিকা সফরের কথা উল্লেখ করে তিনি আমেরিকা-প্রবাসী বাঙালীদের সংগঠন ও কর্মতৎপরতার বিবরণ দেন। শ্রোতারা “জয় বাংলা” ও “শেখ মুজিবের মুক্তি চাই” স্লোগান দিয়ে বাঙালীর মুক্তিসংগ্রামের সঙ্গে একাত্মতা ঘােষণা করেন।
শেফিল্ড এ্যাকশান কমিটির উদ্যোগে ৫ই জুন স্থানীয় টাউন হল-এ একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। শেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র প্রীতিশ মজুমদার সভা অনুষ্ঠানের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এই সভায় যােগ দেওয়ার জন্য বিচারপতি চৌধুরীকে নিয়ে আমি এবং আরাে কয়েকজন সহকর্মী লন্ডন থেকে শেফিল্ড রওয়ানা হই।
হল-এ ঢােকার আগে প্রীতিশ মজুমদার ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে বিচারপতি চৌধুরীকে বলেন, স্যার, আপনাকে একটা দুঃসংবাদ দিতে হচ্ছে। আমরা তাে সভা করতে পারছি না। কারণ ওরা (পাকিস্তানীরা) হল-এর মধ্যে ঢুকেছে এবং চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে। স্টিয়ারিং কমিটির সকল সদস্য, জাকারিয়া খান চৌধুরী, ডঃ জোয়ারদার ও শেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফ্র্যাঙ্ক গার্লিং তখন উপস্থিত নি। আমরা বললাম, হল-এ আমরা ঢুকবাে এবং সভা হবেই। যে-কোনও
৫৯
পরিস্থিতির মােকাবিলা করার জন্য আমরা তৈরি আছি। হল-এ ঢােকার সময় বিরােধী-পক্ষ গােলমাল সৃষ্টির চেষ্টা করে। তারা দু’তিন টুকরাে পাথর ছুঁড়ে মারে। এবং ব্যারিকেড় তৈরি করে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে। আমরা “ব্যারিকেড ভেঙ্গে হল-এ ঢুকে পড়ি এবং বিচারপতি চৌধুরী বক্তৃতা করেন। পুলিশ দক্ষতার সঙ্গে শৃঙ্খলা বজায় রাখে।
প্রধান অতিথির বক্তৃতায় বিচারপতি চৌধুরী বলেন, “আমরা একটি পবিত্র সাধনায় লিপ্ত। বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করে সেখানে সংসদীয় গণতন্ত্র স্থাপনে আমরা দৃঢ়সঙ্কল্প। ব্রিটেনের মতােই নির্বাচিত প্রতিনিধিবৃন্দ জনগণের ইচ্ছানুযায়ী। দেশ শাসন করবেন। মানুষের মৌলিক অধিকার স্বীকৃত হবে; সংবাদপত্র ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে মানুষের মনে নিরাপত্তাবােধ স্থায়ী করতে হবে। সেই মহৎ জীবনের লক্ষ্যে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে দৃঢ় পদক্ষেপে।” ।
সভায় বক্তাদের মধ্যে ছিলেন অধ্যাপক ফ্র্যাঙ্ক গার্লিং, আফরােজ চৌধুরী ও কবীর চৌধুরী । আমিও এই সভায় বক্তৃতা করি। সুরাইয়া খানম নজরুল ইসলামের “বিদ্রোহী কবিতা আবৃত্তি করেন। বহু ইংরেজ ও ভারতীয় শ্রোতা সভায় উপস্থিত ছিলেন। সম্ভাব্য অপ্রীতিকর পরিস্থিতি আয়ত্তে রাখার জন্য প্রায় দুশ ইউনিফর্মপরিহিত পুলিশ পাকিস্তানীদের প্রতি নজর রাখে।
স্টিয়ারিং কমিটি গঠিত হওয়ার পর ২৭শে জুন বার্মিংহামের দ্বিতীয় জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ডিগবেথ হল-এ অনুষ্ঠিত এই সভায় বিচারপতি চৌধুরী স্বাধীনতা সংগ্রামের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করে ২৫শে মার্চের পর সংঘটিত তাৎপর্যপূর্ণ। ঘটনাগুলি বর্ণনা করেন। বাংলাদেশ সংগ্রামের ঐতিহাসিক ও আদর্শগত দিক সম্পর্কেও তিনি বিশদ ব্যাখ্যা দেন। অন্যান্য বক্তার মধ্যে ছিলেন শ্রমিক দলীয় পার্লামেন্ট সদস্য জুলিয়াস সিলভারম্যান ও ব্রুস ডগলাস্-ম্যান।
এখানে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করতে হয়। বার্মিংহামের সভায় বিপুল জনসমাগম হয়। এর সুযােগ নিয়ে আমার এক প্রাক্তন সহকর্মী তাঁর দলের মুখপত্র ‘গণযুদ্ধ” বিক্রি করার চেষ্টা করেন। এক কালে আমরা যখন বামপন্থী হিসাবে পাকিস্তান ডেমােক্রেটিক ফ্রন্টের সঙ্গে জড়িত ছিলাম, তখন মেসবাহউদ্দিন আমার সহকর্মী ছিলেন। ডেমােক্রেটিক ফ্রন্ট তখনও দ্বিধা-বিভক্ত হয়নি। পরবর্তীকালে আমরা যারা ছ’দফা সমর্থন করি, তারা মঙ্কো-পন্থী এবং যারা তার বিরােধিতা করেন তারা চীনপন্থী হিসাবে পরিচিত হন। চীনপন্থী মেসবাহউদ্দিন তাদেশ পত্রিকা বিক্রি করার উদ্দেশ্যে হলের বাইরে এসে দাঁড়ান। আমার সহকর্মী আজিজুল হক ভূইয়া একটা নির্বুদ্ধিতার কাজ করেন। তিনি মাইক্রোফোনের সামনে দাম বলেন, ভাইসব, এই হল-এর বাইরে চীনের এক চর আমাদের সভা স্যাবােচাখ
৬০
করার জন্য দাড়িয়ে আছে। সে পত্রিকা বিক্রি করছে। ঘােষণা শােনার পর জনতা মেসবাহউদ্দিনকে ঘিরে ফেলে উত্তম-মধ্যম দেওয়ার উপক্রম করে। আমি ছুটে গিয়ে তাঁকে জনতার হাত থেকে মুক্ত করে হল-এর মধ্যে নিয়ে এসে বিচারপতি চৌধুরীর পাশে চুপচাপ বসে থাকার জন্য বললাম। সভা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাঁর নিরাপত্তার ব্যবস্থা আমরা করেছি। সভা শেষে তিনি ভীড়ের মধ্য দিয়ে সটকে পড়েন। তাঁকে মারমুখাে জনতার হাত থেকে রক্ষা করে আমি গর্ববােধ করিনি। প্রাক্তন সহকর্মীকে বিপদ থেকে বাঁচাননা আমার বর্তব্য বলে আমি মনে করেছি।
১৮ই জুলাই (রবিবার) স্টিয়ারিং কমিটির উদ্যোগে লন্ডনস্থ চীনা দূতাবাসের সামনে একটি বিক্ষোভ এবং দূতাবাস থেকে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন পর্যন্ত মিছিলের আয়ােজন করা হয়। বিক্ষোভ ও মিছিলে যােগদান করার জন্য ব্রিটেনের বিভিন্ন এলাকা থেকে বিপুল সংখ্যক বাঙালী কোচযােগে লন্ডনে আসেন। জগলুল পাশার নেতৃত্বে বিরাট একটি দল বার্মিংহাম থেকে এসে বিক্ষোভ ও মিছিলে যােগ দেয়। টনি হকও কয়েকটি কোচ-ভর্তি করে বাঙালীদের নিয়ে এসে এদের সঙ্গে যােগ দেন।
বিক্ষোভ অনুষ্ঠানের আগে লন্ডন কমিটির সেক্রেটারী ব্যারিস্টার শাখাওয়াত হােসেন এসে বলেন, স্টিয়ারিং কমিটির উদ্যোগে কেন্দ্রীয় এ্যাকশান কমিটি গঠিত হওয়ার ফলে বিক্ষোভকারীদের মধ্যে মারামারি হবে। গাউস খান পরিচালিত লন্ডন কমিটির সমর্থকরা বিক্ষোভ ও মিছিল বানচাল করার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। কাজেই এই বিক্ষোভ ও মিছিল বন্ধ করতে হবে। বিচারপতি চৌধুরী এবং স্টিয়ারিং কমিটির সকল সদস্য তাকে বলেন, বিক্ষোভ ও মিছিল অনুষ্ঠিত হবেই এবং সেখানে কোনও গােলমাল হবে না। স্টিয়ারিং কমিটি দিন-রাত পরিশ্রম করে শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভ অনুষ্ঠান করে। এ-ব্যাপারে শামসুর রহমান, মিম্বর আলী ও মতিউর রহমান চৌধুরী সহায়তা করেন। বিক্ষোভ শেষে দূতাবাসে একটি স্মারকলিপি পেশ করা হয়। স্বারকলিপিতে বলা হয়, চীনের মহান নেতা মাও সেতুং এবং প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাইয়ের প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা রয়েছে। আমরা আশা করি চীনের জণগণ কোনাে দিন ভুল করবে না। পাকিস্তান তাদের বন্ধু রাষ্ট্র- এই অজুহাতে তারা যদি পাকিস্তানকে সমর্থন করেন, তা হলে ইতিহাসের চোখে তারা দোষী বলে সাব্যস্ত হবেন।
দূতাবাস এলাকা থেকে মিছিল সহকারে আমরা ডাউনিং স্ট্রীটে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে গিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের আবেদন জানিয়ে একটি স্মারকলিপি পেশ করি।
৬১
পাকিস্তানী সামরিক চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের জন্য বিশ্বজনমতকে প্রভাবিত করার উদ্দেশ্যে ১লা অগাস্ট (রবিবার) লন্ডনের ট্রাফালগার স্কোয়ারে একটি বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। পল কনেটের নেতৃত্বে গঠিত এ্যাকশান বাংলাদেশের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এই জনসমাবেশে ব্রিটেনের বিভিন্ন এলাকা থেকে বিশ হাজারেরও বেশি বাঙালী যােগ দেয়। শতাধিক বাংলাদেশ এ্যাকশন কমিটির সদস্যদের লভনে নিয়ে আসার জন্য বহু কোচ ভাড়া করা হয়। একমাত্র বার্মিংহাম থেকেই ৭০টি কোচ লন্ডনে আসে।
জনসমাবেশে বক্তৃতাদান কালে বিচারপতি চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশ কখনও তার স্বাধীনতা সংগ্রামের পথ থেকে বিচ্যুত হবে না।তিনি আরাে বলেন, “বাংলাদেশের পূত-পবিত্র ভূমি থেকে হানাদার পাক-বাহিনীকে সম্পূর্ণ বিতাড়িত
করা পর্যন্ত আমাদের আপসহীন, বিরামহীন সংগ্রাম চলবে। এই সংগ্রাম সাড়েসাত কোটি বাঙালীর সংগ্রাম।” হাজার হাজার কন্ঠ “জয় বাংলা স্লোগানের মাধ্যমে বিচারপতি চৌধুরীর উদ্দীপনাময় ঘােষণাকে সমর্থন জানায়।
‘মুজিবনগর সরকার পাকিস্তানের সঙ্গে আপস-রফা করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে বলে যে-মিথ্যা প্রচারণা চালানাে হচ্ছে, তার উল্লেখ করে বিচারপতি চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে বানচাল করার জন্য শত্রুপক্ষ এই গুজব ছড়াচ্ছে। এই গুজব ভিত্তিহীন বলে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ তাকে জানিয়েছেন।
বিচারপতি চৌধুরী আরও বলেন, পূর্ব বঙ্গে নির্বিচারে হত্যার মাধ্যমে গণহত্যা সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক কনভেনৃশান” ভঙ্গের জন্য পাকিস্তানের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা সিকিউরিটি কাউন্সিলের কর্তব্য।
তিনি অবিলম্বে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান এবং বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দাবি করার জন্য বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশসমূহের প্রতি আহ্বান জানান।
সভায় বক্তাদের মধ্যে ছিলেন লর্ড ব্রকওয়ে, পিটার শাের, রেজ প্রেন্টিস, ব্রুস ডগলাস-ম্যান, লর্ড গিফোর্ড, পল কনেট ও বেগম লুলু বিলকিস বানু।
পাকিস্তানী কারাগারে বঙ্গবন্ধুর বিচার অনুষ্ঠানের প্রতিবাদে ১১ই অগাস্ট লন্ডনের হাইড পার্কে একটি প্রতিবাদ সভা আহ্বান করা হয়। আগের দিন রাত্রিবেল্য প্রস্তাবিত সভা ও শােভাযাত্রা সম্পর্কে আলােচনা করার জন্য এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় । এই বৈঠকে স্টিয়ারিং কমিটির পক্ষ থেকে আমরা তিনজন-শামসুর রহমান, আজিজুল হক ভূঁইয়া ও আমি— উপস্থিত ছিলাম। প্রথমােক্ত দু’জন বলেন, যা’ শােভনীয় এবং সবাই যা মেনে নেবেন, আমরা তাই করবাে। আমি বললাম, আমাদের সামনে জীবন-মরণ সমস্যা। পাকিস্তানী সামরিক-চক্র যদি বঙ্গবন্ধুকে
৬২
এই দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে পারে, তা হলে আমাদের আন্দোলন স্তিমিত হবে এবং আমরা নিরাশ হয়ে পড়বাে। নেতৃত্বহীন জাতি লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হতে বাধ্য। প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী বিক্ষোভ-মিছিল শেষে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে স্মারকলিপি পেশ করে আমরা বাড়িতে ফিরলাম, আর ওদিকে পাকিস্তানী সামরিক-চক্র বঙ্গবন্ধুকে যদি ফাঁসিতে ঝােলায়, তাহলে স্বাধীনতার জন্য আমাদের সর্ব উৎসর্গ করার অঙ্গীকার অর্থহীন হয়ে পড়বে। আমার বক্তব্য সম্পর্কে প্রথমে মৃদু তর্ক এবং পরে গুরুতর মতবিরােধ দেখা দেয়। আমি তখন বললাম, পাকিস্তান হাই কমিশনের সামনে বিক্ষাভ প্রদর্শন করে আমরা যদি গ্রেপ্তার হয়ে যাই এবং কেউ যদি আহত হন, কিংবা কাউকে এদেশ থেকে বহিষ্কার করা হয়, তাহলে ডাউনিং স্ট্রীটে স্মারকলিপি পেশ করার তুলনায় আমরা অনেক বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম
বিচারপতি চৌধুরী আমার প্রস্তাব সম্পর্কে সবার মতামত জানতে চাইলেন। শুধু ব্যারিস্টার শাখাওয়াত হােসেন ও আমাদের অফিস সেক্রেটারী শামসুল আলম চৌধুরী আমার প্রস্তাব সমর্থন করলেন। বিচারপতি তখন বললেন, “আমি যদি স্টিয়ারিং কমিটির উপদেষ্টা হিসাবে থাকি, তাহলে আগামীকাল পাকিস্তান হাই কমিশনের সামনে গিয়ে শহীদ হয়ে বঙ্গবন্ধুকে আমরা বাচাতে পারবাে, এটা আমি বিশ্বাস করি না। বঙ্গবন্ধুকে আমরা বাঁচাতে পারবাে আমরা নিজেরা বেঁচে থেকে, মানুষের দরজায় ধাক্কা দিয়ে, মানুষের বুদ্ধি-বিবেচনার কাছে আমাদের দাবি পৌছে দিয়ে।”
আমরা শেষ পর্যন্ত তার পরামর্শ মেনে নিলাম। তিনি আমাদের উপদেষ্টা; তাঁর উপদেশ আমরা গ্রহণ করতে বাধ্য। পরদিন হাইড পার্কের সভায় আমরা একত্র হই। | বিচারপতি চৌধুরী তার বক্তৃতায় বলেন, “বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তাহানি কিংবা কোনও প্রকার ক্ষতি হলে বাঙালী জাতি কোনও দিন পাকিস্তানকে ক্ষমা করতে পারবে না। ক্ষমা শব্দটি বাঙালী চিরদিনের মতাে ভুলে যাবে। পাকিস্তানী কারাগারে বঙ্গবন্ধুর গােপন বিচারের ব্যাপারে অবিলম্বে হস্তক্ষেপ করার জন্য তিনি সােভিয়েত ইউনিয়ন, আমেরিকা ও চীনের নেতৃবৃন্দের নিকট আবেদন জানান।
স্টিয়ারিং কমিটির পক্ষ থেকে আমি ও আজিজুল হক ভূঁইয়া এবং শাখাওয়াত হােসেনসহ আঞ্চলিক কমিটিগুলির কয়েকজন নেতা সভায় বক্তৃতা করেন। এই সভায় পাকিস্তান হাই কমিশনে অফিসার পদে নিয়ােজিত লুৎফুল মতিন, ফজলুল হক চৌধুরী এবং আরাে কয়েকজন পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘােষণা করেন।
৬৩
(মূল বইয়ে ৬৪ নম্বর পৃষ্ঠা অস্পষ্ঠ)
সভার শেষে এক শোভাযাত্রা পিকডিলিসহ বিভিন্ন রাস্তা পরিক্রমণের পর বলৈ ৰাম ভবনে হােয়। পিটার শাের, মাইকেল বার্নস, স কলস মান, ন মেটস এবং আরাে কয়েকজন পার্লামেন্ট সদস শেষ সাধিতে বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে ছিলেন।
এল এডওয়ার্ড হী-এর সরকারী দপ্তরের জনৈক অফিসারের হাতে এটি যলিপি দিয়ে বিচারপতি চৌধুরী বলেন, শেখ মুজিব একটি স্বাধীন ও সাৰচৌম দেশে রাষ্ট্রপতি। তাঁর বিচার করার অধিকার কারও নেই। গােপন বির ইে সভ্যতা বহির্ভূত । এই প্রহসন বন্ধ করা ও শেখ মুজিবের
নিয়ে মুক্তি না ব্রিটিশ সরকার পাকিস্তানের স্বৈরাচারী সরকারের ওপর বৰ বিস্তার করবে, এটাই আমাদের আশা।
পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ১৫ই আগষ্ট লন্ডনের ট্যাফালগার তােরে বাংলাদেশ-বিরােধ একটি জনসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এই সমাবেশে
কেন পনপন্থী বাঙালী যােগদান করেন। এদের মধ্যে ছিলেন আবুল হায়াত (তি সম্পাদক), আজহার আলী, আবদুল হামিদ এবং পাবনা জেলার আরও দুজন : বেগম আখতার সােলায়মান এই সভায় বক্তৃতা করেন। বাকরনে পত্র মুক্তি” পত্রিকায় তার বক্তৃতার বিবরণ প্রকাশিত হয়। লন্ডন থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশ নিউজলেটার”-এ এই জনসমাবেশকে “অদ্ভুত সার্কাস বলে অভিহিত করা হয় ।
২৯শে অগাষ্ট লন্ডন থেকে ২০/২৫ মাইল দূরবর্তী লুটন শহরে বাঙালীরা একটি জনসহর আয়ােজন করে। বিচারপতি চৌধুরী জরুরী কাজে ব্যস্ত ছিলেন বলে সভায় যােগ দিতে পারেননি। তার পক্ষ থেকে স্টিয়ারিং কমিটির সদস্যবৃন্দ। উপস্থিত থাকবেন বলে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আমি ছাড়া অন্য কোনও সদস্য সেখানে উপস্থিত থাকতে পারেননি। জাকারিয়া খান চৌধুরী ও আমি সভাস্থলে উপস্থিত হয়ে দেখলাম, ৫০০ থেকে ৭০০ জনের মত আমাদের সভায় হাজির হয়েছেন। তাদের ঘিরে রেখেছে এক থেকে দেড়-হাজার পাকিস্তানী । তারা বাঙালী নেতৃবৃন্দকে আক্রমণ করবে বলে ঘােষণা করে। দু’শ থেকে তিন শ পুলিশম্যান সেখানে উপস্থিত ছিলেন। আমি সভাস্থলে পৌছানাে মাত্রই একজন পুলিশ অফিসার এসে আমাকে বললেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে সভা অনুষ্ঠান “
ৰু কন্য আমি আপনাকে অনুরােধ জানাচ্ছি। তিনি আরও বললেন, এখানে বাঙালী ও পাব্বিানীদের মধ্যে সংঘর্ষ হােক, আমরা তা চাই না।
আমি বললাম, আপনাদের অনুমতি নিয়েই স্থানীয় বাঙালীরা এই সভায় আয়ােজন করেছেন। এই সভা আজ এখানেই অনুষ্ঠিত হবে। আমরা কোন
৬৪
আইন ভঙ্গ করছি না। এখানে কাউকে—এমন কি পাকিস্তানীদেরও–আমরা আক্রমণ করবাে না। আমাদের মুক্তিযােদ্ধারা যুদ্ধক্ষেত্রে লড়াই করছে। পাকিস্তানীদের আমরা পরামর্শ দেবে-খবরেরকাগজ পড়া এবং টেলিভিশন দেখার জন্য। তা হলেই তারা বাংলাদেশে পাকিস্তানী সৈন্যদের কার্যকলাপের কথা জানতে পারবে। আমরা তাদের সৈন্যদের কার্যকলাপের প্রতিবাদ জানাবার জন্যই এখানে এসেছি। কেউ আমাদের বাধা দিতে পারবে না।
শেষ পর্যন্ত আমরা শান্তিপূর্ণভাবে সভার কাজ সম্পূর্ণ করতে পেরেছিলাম।
৬৫
৮. মুক্তিযুদ্ধকালে প্রকাশিত পত্র-পত্রিকা
মুক্তিযুদ্ধ কালে লন্ডনের বাংলা সাপ্তাহিক জনমত এর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গৌরবজনক। ১৯৬৯ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয় । পত্রিকাটির প্রধান সম্পাদক ওয়ালী আশরাফ, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক আনিস আহমদ এবং আরাে অনেকে যারা এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তারা আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন। ব্রিটেনে বসবাসকারী বাঙালী যাঁরা ইংরেজী জানেন না, তাঁদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সংবাদ পৌছে দেওয়া ছাড়াও পাকিস্তানপন্থী বাঙালী এবং বাংলাদেশ-বিরােধী পাকিস্তানীদের অপপ্রচারের পাল্টা জবাব এবং তাদের গােপন তথ্য ফাঁস করে দিয়ে পত্রিকাটি আমাদের সংগ্রামে সহায়তা করে। “জনমত-এর অবদান অতুলনীয়।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পাকিস্তান সরকার “জনমত” থেকে বিজ্ঞাপন প্রত্যাহার করে। ফলে পত্রিকাটি আর্থিক সঙ্কটের সম্মুখীন হয়। তখন ওয়ালী আশরাফ স্টিয়ারিং কমিটির অফিসে এসে বিচারপতি চৌধুরীকে বলেন, অর্থাভাবে পত্রিকাটি তিনি আর চালাতে পারছেন না। পত্রিকা চালাবার খরচ স্টিয়ারিং কমিটিকে দিতে হবে। বিচারপতি বলেন, আমি চিন্তা-ভাবনা করে দেখবাে, আর্থিক সাহায্য দেওয়ার মতাে সঙ্গতি আমাদের আছে কিনা। এর কিছু কাল পর ওয়ালী আশরাফ স্টিয়ারিং কমিটির সকল সদস্যের উপস্থিতিতে আর্থিক সাহায্যের কথা পুনরায় উত্থাপন করেন। বিচারপতি চৌধুরী আমাদের মাধ্যমে তাকে জানান, নিয়মিতভাবে আর্থিক সাহায্য দেওয়া সম্ভব হবে না; তবে মাঝে মাঝে কিছু সাহায্য দেওয়া সম্ভব হবে। বিচারপতি আরও জানান, পত্রিকাটিকে সাহায্য করার জন্য কয়েকজনকে তিনি অনুরােধ জানাবেন। ওয়ালী আশরাফ মনে করলেন, আমার পরামর্শ অনুযায়ী “জনমত”. কে আর্থিক সাহায্য দেওয়া হলাে না। তিনি আশাতার শত্রু বলে ধরে নিলেন।
১৯৬৮-৬৯ সালে আমি “মশাল” নামের একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সঙ্গে জড়িত ছিলাম। পত্রিকাটি বামপন্থী চিন্তাধারার বাহক ছিল। “শিখা” নামে একটি পত্রিকার প্রথম দুটি সংখ্যা ওয়ালী আশরাফ সম্পাদনা করেন। তার সঙ্গে
৬৬
মতের মিল না হওয়ায় পত্রিকাটির মালিক আমার সঙ্গে যােগাযােগ করেন এবং আমি সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করি। আমার ভূলের মধ্যে এটুকুই ছিল যে, ওয়ালী আশরাফ পদত্যাগ করার পর আমি যে সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করেছি, সেকথা তাকে বলিনি। তিনি ধরে নিয়েছিলেন, আমি তাঁকে সম্পাদকের পদ থেকে বঞ্চিত করেছি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হওয়ার পর লন্ডন থেকে পাকিস্তান সলিডারিটি ফ্রন্টের মুখপত্র হিসাবে “মুক্তি” নামের একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন পাকিস্তানপন্থী বাঙালী আবুল হায়াত। উভয় প্রতিষ্ঠানের জন্য পাকিস্তান সরকার প্রয়ােজনীয় অর্থ সরবরাহ করে। পত্রিকাটির মাধ্যমে আবুল হায়াত বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরােধিতা অব্যাহত রাখেন। ধর্মকে তিনি ব্যবহার করেন অস্ত্র হিসাবে । মুক্তিযুদ্ধকে তিনি ভারতীয় হিন্দুদের মুসলমান-বিরােধী ষড়যন্ত্র বলে প্রচার করেন। বিচারপতি চৌধুরীর বিরুদ্ধে তিনি জঘন্য মিথ্যা ও মানহানিকর প্রচারণা চালান। মুক্তি পত্রিকায় কখনও কখনও ইংরেজীতে সংবাদ ও মন্তব্য প্রকাশিত হয়। ইংরেজী লেখাগুলি পাকিস্তান হাই কমিশান থেকে সরবরাহ করা হতাে।
৬ই জুন লন্ডন এ্যাকশান কমিটির উদ্যোগে পূর্ব লন্ডনের গ্র্যান্ড প্যালেস হলএ বাংলাদেশ আন্দোলনের সমর্থনে একটি বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় বিচারপতি চৌধুরী, গাউস খান, শামসুর রহমান এবং অন্যান্য নেতা উপস্থিত ছিলেন। আবুল হায়াত ও তার সহকর্মীরা সাপ্তাহিক “মুক্তি” বিক্রি করার জন্য সভাস্থলে এসে হাজির হন। দেশপ্রেমিক বাঙালীরা তার দুরভিসদ্ধি সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। তারা পত্রিকাটির কয়েকটি কপি সংগ্রহ করে হল-এর মধ্যে নিয়ে আসেন। বিচারপতি চৌধুরী নিজের হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে পত্রিকাটির কপিগুলি ম্যাচের-কাঠি জ্বালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেন।
চীনাপন্থী বাঙালীরা আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে সরে গিয়ে নিজেদের আদর্শ ও কর্মপন্থা অনুযায়ী কাজ করেন। তাদের মুখপত্র হিসাবে গণযুদ্ধ” শীর্ষক একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকার সম্পাদকীয় বাের্ডের সদস্যদের মধ্যে ছিলেন জিয়াউদ্দিন মাহমুদ, মেসবাহউদ্দিন, জগলুল হােসেন ও ব্যারিস্টার লুৎফর রহমান শাজাহান। আমাদের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত জনসভায় তাঁরা “গণযুদ্ধ” বিক্রির চেষ্টা করেছেন। পত্রিকা বিক্রি করতে গিয়ে তারা অনেক জায়গায় স্বাধীনতা সংগ্রামে নিবেদিত কর্মীদের হাতে নাজেহালও হয়েছেন।
“গণযুদ্ধ” পত্রিকার পরিচালকরা মনে করতেন, মুক্তিযুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হবে পূর্বাহ্নে সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার কাঠামাে তৈরি করতে হবে এবং মার্ক্সসিজম
৬৭
লেনিনিজম ও চারু মজুমদারের দর্শন-ভিত্তিক রাষ্ট্র গঠন করতে হবে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে যিনি প্রেরণা জুগিয়েছেন, যিনি বাঙালীকে সচেতন করেছেন, বাঙালীর পাশে এসে দুর্দিনে দাড়িয়েছেন, সারা-জীবনের সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশকে পৃথিবীর মানচিত্রে প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হয়েছেন, সেই বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবর রহমানকে তারা নেতা হিসাবে স্বীকার করেননি। চারু মজুমদারই তাদের নেতা। বলা বাহুল্য, “গণযুদ্ধ” পত্রিকার প্রচারণা মুষ্টিমেয় মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি এবং স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কিত সংবাদ প্রচারের উদ্দেশ্যে তাসাদুক আহমদ, রােজমেরী আহমদ এবং আবদুল মতিনের উদ্যোগে এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে একটি ইংরেজী “নিউজলেটার” প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটি এপ্রিল মাসে সাপ্তাহিক, মে মাসে পাক্ষিক এবং জুন মাস থেকে মাসিক হিসাবে প্রকাশিত হয়। তৃতীয় সংখ্যার পর নাম পরিবর্তন করে “বাংলাদেশ” এবং ষষ্ঠ সংখ্যা থেকে বাংলাদেশ নিউজলেটার” নামে পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়।
“বাংলাদেশ নিউজলেটার”-এ প্রবাসী বাঙালীদের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিবরণ, “মুজিবনগর সরকারের কার্যক্রম, মুক্তিবাহিনীর সামরিক তৎপরতা, বাংলাদেশ আন্দোলনে বিদেশী সমর্থকদের অবদান, বিদেশী সংবাদপত্রে প্রকাশিত বাংলাদেশ সম্পর্কিত খবর ও সম্পাদকীয় মন্তব্য প্রকাশ করা হয়। যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন শহরে সংগ্রামরত বাঙালী, তাদের সমর্থক, পার্লামেন্ট সদস্য, সরকারী অফিসারদের কাছে এবং বিদেশী দূতাবাসে পৌছে দেওয়া ছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউ জিল্যান্ড, ভারত ও পশ্চিম ইউরােপের দেশগুলিতে পত্রিকাটি নিয়মিতভাবে পাঠানাে হয়।
এয়ার-কমােডাের এম কে জানজুয়া ও বিখ্যাত সাংবাদিক ফরিদ এস জাফরী বাংলাদেশ নিউজলেটার”-এর সাথে জড়িত ছিলেন। পত্রিকাটির পরিচালকবৃন্দ আমাদের সঙ্গে সব সময় যােগাযােগ রেখেছেন, পরামর্শ দিয়েছেন এবং আমাদের সভা ও বিক্ষোভ-মিছিলে অংশগ্রহণ করেছেন।
২৩শে জুন বিচারপতি চৌধুরী হল্যান্ড থেকে লন্ডনে ফিরে আসার পর একা সাপ্তাহিক ইংরেজী পত্রিকা প্রকাশের প্রয়ােজনীয়তা সম্পর্কে আলাপ-আলােচনা করার জন্য যাদের আমন্ত্রণ জানানাে হয়েছিল, তাদের মধ্যে ছিলেন ড: কবীরউদ্দিন আহমদ (নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার), জিয়াউদ্দিন মাহমুদ (“গণযুদ্ধ” পত্রিকার ভূমিকা তখনও প্রকট হয়নি), আমীর আলী, সুরাইয়া খানম, শিল্পী আবদুর রউফ ও মহীউদ্দিন আহমদ চৌধুরী। বিচারপতি চৌধুরী বলে, স্টিয়ারিং কমিটির কাজ; এতে তিনি হস্তক্ষেপ করবেন না। তিনি সভায় উপস্থিত
৬৮
ছিলেন, কিন্তু আলােচনায় অংশগ্রহণ করেননি। আমার সহকর্মীদের অনুরােধে আমি এই সভায় সভাপতিত্ব করি ।
পত্রিকার উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করার পর আদর্শগত প্রশ্নে জিয়াউদ্দিন মাহমুদ ও ড: কবীরউদ্দিন আহমদের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়। জিয়াউদ্দিন লেনিনের একটি উক্তি উদ্ধৃত করে বলেন, আপনাদের চিন্তাধারা শিশুসুলভ। বিস্তারিত আলােচনার পর বাংলাদেশ টু-ডে” শীর্ষক একটি পত্রিকা প্রকাশের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। আমীর আলী ও মহীউদ্দিন আহমদ চৌধুরী পত্রিকাটি প্রকাশের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১লা অগাষ্ট পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়।
স্টিয়ারিং কমিটির উদ্যোগে আফরােজ চৌধুরীর সম্পাদনায় “বাংলাদেশ সংবাদ পরিক্রমা” শীর্ষক একটি বুলেটিনও প্রকাশিত হয়।
৬৯
৯. তিনজন কূটনীতিবিদ
১০ই এপ্রিল লন্ডনের অভউই এলাকায় অবস্থিত বুশ হাউসে বি বি সি’র বৈদেশিক সার্ভিসের বাংলা বিভাগ বিচারপতি চৌধুরীর সাক্ষাৎকার প্রচার করে। সিরাজুর রহমান ও শ্যামল লােধ এই সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। সাক্ষাৎকারের পর তিনি বৃশ হাউস থেকে বেরিয়ে আসার সময় তৎকালীন পাকিস্তানী দূতাবাসের সেকেন্ড সেক্রেটারী মহীউদ্দিন আহমদকে তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। মহীউদ্দিন তাকে বলেন, “স্যার, আমি আপনার নির্দেশের অপেক্ষায় রয়েছি। আপনারা ডাকলেই আমাকে পাবেন। লন্ডনে তখনও প্রবাসী সরকারের কুটনৈতিক অফিস স্থাপিত হয়নি বলে বিচারপতি তাঁকে হাই কমিশান থেকে পদত্যাগ করে বাংলাদেশ আন্দোলনে যােগ দেওয়ার কথা সেই মুহূর্তে বলেননি।
মহীউদ্দিন আহমদ স্বেচ্ছায় আমাদের সঙ্গে যােগাযােগ করেছেন। পাকিস্তান দূতাবাসের চাকরি ছেড়ে দেওয়ার পর তাঁর থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হবে—এ ধরনের কোনও প্রতিশ্রুতি আমরা তাঁকে দিইনি। আমরা তাকে শুধু বলেছি, গােপনীয়তা রক্ষা করুন। পাকিস্তান হাই কমিশানে আপনার থাকার প্রয়ােজন আছে। আপনি উতলা হবেন না; দেশের জন্য কাজ করে যান। সে জন্যই। আপনাকে আপাততঃ ওখানে থাকতে হবে। দেশের ডাকে সাড়া দিয়ে মহীউদ্দিন অজানা পথে পা বাড়াবার জন্য তৈরি ছিলেন। কিন্তু তাঁর কাছে পথ অজানা ছিল।
বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ছিল তাঁর মানসপটে। ৭ই মার্চের ঘােষণা তাঁর দেশপ্রেমকে উদ্দীপ্ত করেছে।
১লা অগাষ্ট এ্যাকশান বাংলাদেশের উদ্যোগে লন্ডনের ট্রাফালগার স্কোয়ারে অনুষ্ঠিত জনসভায় বিচারপতি চৌধুরীর বক্ততার পর অপ্রত্যাশিতভাবে মহাভান্দন আহমদ বক্তৃতা দেওয়ার জন্য এগিয়ে আসেন। তিনি বলেন, পাকিস্তানের চাকা ছেড়ে দিয়ে বাংলাদেশের জন্য কাজ করবেন বলে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইতােমধ্যে তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করেছেন। জনতার বিপুল হর্ষধ্বনির মধ্যে তিনি আবেগজড়িত কণ্ঠে বলেন, “আমি একটি স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হতে চাই।” তিনি আরও বলেন, পূর্ব বঙ্গে গণহত্যা হয়নি’
৭০
বলে পাকিস্তান সরকার যে প্রচারণা চালাচ্ছে, তা মিথ্যার বেসাতি ছাড়া আর কিছুই নয়।
ট্র্যাফালগার স্কোয়ারের সভায় যােগদানের জন্য রওয়ানা হওয়ার আগে বিচারপতি চৌধুরী মহীউদ্দিন আহমদের টেলিফোন কল” পান। মহীউদ্দিন তাকে বলেন, তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে প্রস্তুত। বিচারপতি তাকে সপরিবারে তার বাড়িতে আসার জন্য বলেন। সেখান থেকে তারা দু’জনে সরাসরি ট্রাফালগার স্কোয়ারে যান। পরদিন “দি টাইমস ও দি গার্ডিয়ান পত্রিকায় গুরুত্বসহকারে সভার সংবাদ প্রকাশিত হয়। প্রথমােক্ত পত্রিকায় পাকিস্তান সরকারকে উপেক্ষা করে মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে মহীউদ্দিনের বক্তৃতাদানের ছবি প্রকাশিত হয়। ভারতের বাইরে নিয়ােজিত বাঙালী কূটনৈতিক অফিসারদের মধ্যে মহীউদ্দিন আহমদ সর্বপ্রথম পাকিস্তান দূতাবাস থেকে পদত্যাগ করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন।
২১শে অগাস্ট (শনিবার) সকালবেলা ইরাকে নিয়ােজিত পাকিস্তানী রাষ্ট্রদূত আবুল ফতেহ টেলিফোনযােগে বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে যােগাযােগ করেন। তিনি ইরাক থেকে গােপনে লন্ডনে চলে এসেছেন। এখান থেকে তিনি বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করবেন বলে বিচারপতি চৌধুরীকে জানান।
সেদিন বিকেলবেলা স্টিয়ারিং কমিটির অফিসে অনুষ্ঠিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে মি: ফতেহ বাংলাদেশের পক্ষে যােগদানের সিদ্ধান্ত ঘােষণা করেন। তিনি বলেন, সামরিক আদালতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার শুরু হওয়ার পর তিনি পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ইরাকের রাজধানী বাগদাদ ত্যাগ করার দিন তিনি দূতাবাস থেকে বেরিয়ে সরাসরি ব্যাঙ্কে গিয়ে দূতাবাসের একাউন্ট থেকে পঁচিশ হাজার পাউন্ড তুলে ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের সহায়তায় সেই অর্থ “মুজিবনগর সরকারের কাছে পাঠাবার ব্যবস্থা করেন। তারপর সপরিবারে ট্যাক্সিযােগে ছশ মাইল পথ পাড়ি দিয়ে কুয়েত থেকে বিমানযােগে লন্ডনের পথে রওয়ানা হন। অগাস্ট মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রায় ২০জন বাঙালী কূটনৈতিক অফিসার পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে বাংলাদেশের পক্ষে যােগ দেন। তাঁদের মধ্যে মি: ফতেহ সবচেয়ে উচ্চপদস্থ অফিসার ছিলেন।
বিচারপতি চৌধুরী তার স্মৃতিকথা “প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলিতে লিখেছেন, কিছুকাল পর ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে তাঁকে বলা হয়, পাকিস্তান হাই কমিশান মি: ফতেহ-র বিরুদ্ধে এক অভিযোেগ পেশ করেছে। ইরাকের ব্যাঙ্ক থেকে পাকিস্তান সরকারের অর্থ তুলে নিয়ে আসার অভিযােগে মি: ফতেহ-কে
৭১
পাকিস্তান সরকারের হস্তে অর্পণ করার সরাসরি অনুরােধ আসার সম্ভাবনা রয়েছে বলে পররাষ্ট্র দপ্তর আশঙ্কা প্রকাশ করে। মি: ফতেহ বাংলাদেশ সরকারের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার উদ্দেশ্য “মুজিবনগর” যাওয়ার কথা ভাবছিলেন। পাকিস্তান সরকারের মতলব টের পাওয়ার পর অবিলম্বে তাঁর “মুজিবনগর”-এ চলে যাওয়া বাঞ্ছনীয় বলে বিবেচিত হয়।
মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হয়, তখন রেজাউল করিম ছিলেন লন্ডনস্থ পাকিস্তানী দূতাবাসে নিয়ােজিত পলিটিক্যাল কাউন্সেলার। বাঙালী অফিসারদের মধ্যে তিনি ছিলেন বয়ােজ্যেষ্ঠ এবং উচ্চতম পদের অধিকারী। স্বভাবতঃই আমরা আশা করেছিলাম তিনি স্বতঃপ্রণােদিত হয়ে বাংলাদেশের এই দুর্দিনে এগিয়ে আসবেন। তিনি আসেননি; আমরা তাঁর কাছে গিয়েছি। আমাদের প্রতিনিধি তাঁর সঙ্গে যােগাযােগ করেছেন। তিনি না’-ও বলেননি, “হ্যা”-ও বলেননি। তারপর লুলু বিলকিস বানু তাঁর সঙ্গে যােগাযােগ করেন। তাঁর সঙ্গে রেজাউল করিমের আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল। তাঁর প্রচেষ্টা সাফল্য লাভ করে। করিম সাহেব বিচারপতি চৌধুরীর মাধ্যমে আমাকে জানান, তিনি যে ফ্ল্যাটে থাকেন, তা ছেড়ে দেওয়া তাঁর পক্ষে কঠিন হবে। যদি ছেড়ে দিতেই হয়, তাহলে পাকিস্তান হাই কমিশানের পদমর্যাদার সমতুল্য সুযােগ-সুবিধা তাকে দিতে হবে। তার মানসম্মানের প্রশ্ন আছে। তাঁর “সারভেন্ট” থাকা দরকার । গাড়ি আছে, গাড়ি থাকা দরকার। কত টাকা হলে তিনি জীবনধারণ করতে পারবেন, তাও তিনি জানান। স্টিয়ারিং কমিটির বৈঠকে এ নিয়ে আলােচনা হয়। সদস্যদের অধিকাংশই বলেন, যে-কোন মূল্যেই হােক, তাকে আমাদের পাওয়া দরকার। আমি এতে মনঃক্ষুন্ন। হয়েছি। বলেছি, আমাদের পক্ষে আসার জন্য যে-কোনাে মূল্য দিতে আমরা তৈরি নই। তিনি যদি আমাদের পক্ষে আসতে চান, তবে তিনি আসতে পারেন।
আমার মনে হয়, মুজিবনগর সরকার বিচারপতি চৌধুরীকে বলেছিলেনরেজাউল করিমের “ডিফেকশান” আমাদের জন্য প্রয়ােজন। প্রসঙ্গত: মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ আক্রমণ করার পর পাকিস্তান হাই কমিশন তাকে মিসরে পাঠিয়েছিল পাকিস্তানের পক্ষে ওকালতি করার জন্য। তার মিসরে যাওয়ার ব্যাপারটা আমাদের কাছে “মড়ার ওপর খাড়ার ঘা” বলে মনে হয়েছিল। এ কথা ভেবে আমি ব্যক্তিগতভাবে কথনও তাঁর “ডিফেকশান”-এর প্রতি আকৃষ্ট হইনি।
সে যাই হােক, অক্টোবর মাসে রেজাউল করিম যখন আমাদের পক্ষে যাে দেওয়ার কথা ঘােষণা করেন, তখন তার মন খানিকটা নরমও হয়েছে। যে দাবি-দাওয়া তিনি করেছিলেন, তার সবগুলি পূরণ করা সম্ভব হয়নি। তবে বিচারপতি
৭২
যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা পালন করা হয়।(১১) আমি মনে করি, যারা ভবিষ্যৎ সম্পর্কে শঙ্কিত, দেশ স্বাধীন হবে কি হবে না, আমি কোন্ দিকে থাকবাে, আমার অবস্থা কি হবে, আমার পদোন্নতি হবে কিনা, যদি বাংলাদেশ না হয়, তা হলে আমার কি হবে—এই সব দ্বিধা-দ্বন্দ্বে যারা ক্ষতবিক্ষত, তারা “ডিফেক্ট” না করলেই ভালাে করতেন।
রেজাউল করিম যখন আসলেন তখন আমরা ২৪ নম্বর পেমব্রিজ গার্ডেনে বাংলাদেশ মিশানের অফিস খুলেছি। বিচারপতি চৌধুরী ছিলেন হাই কমিশনার এবং বিশেষ ক্ষমতাপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত। রেজাউল করিম সিনিয়র অফিসার হিসাবে যেকাজ করেছেন, তা ছিল প্রশংসনীয়। বিচারপতির অনুপস্থিতিতে তিনি টেলিভিশন সাক্ষাৎকার কালে পাকিস্তানের সমর্থক ব্যারিস্টার আব্বাস আলীকে যেভাবে যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য দিয়ে মােকাবিলা করেন, তা’ নিঃসন্দেহে আমাদের আন্দোলনের সহায়ক হয়েছে। সে জন্য আমি মনে করি, যার যা প্রাপ্য তাকে তা দেওয়া উচিত। যদি পূর্ববর্তী সময়ের সন্দেহ পরবর্তী সময়ের ভালাে কাজের মাধ্যমে দূর করা সম্ভব হয়, তাহলে তিনি মাপ পেয়ে গেছেন। ইতিহাস এ সম্বন্ধে শেষ কথা বলবে ।
১০. লন্ডনে ভারতীয় নেতা ও নেত্রীবৃন্দ
মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে ভারতীয় সােস্যালিস্ট পার্টির নেত্রী মিসেস অরুণা আসফ আলী মস্কো থেকে ফেরার পথে লন্ডনে আসেন। তিনি বরিশাল জেলায় জনুগ্রহণ করেন। তাঁর স্বামী আসফ আলী ভারতীয় কংগ্রেসের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ছিলেন। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। মিসেস আসফ। আলী বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের উৎসাহী সমর্থক ছিলেন। মুজিবনগর” সরকারের পক্ষে দেশে ও বিদেশে জনমত গড়ে তােলার জন্য তিনি সর্বশক্তি নিয়ােগ করেন।
অরুণা আস আলীন জন্য যেসভার আয়ােজন করা হবে, তার দায়িত্ব কে নেবেন এবং কোথায় সভা অনুষ্ঠিত হবে, সে সম্বন্ধে প্রশ্ন ওঠে। বিচারপতি চৌধুরী নির্দেশ দিয়েছিলেন, এসব সভা স্থানীয় কমিটিগুলির দায়িত্বে অনুষ্ঠিত হবে। স্টিয়ারিং কমিটির সদস্যদের মধ্যে একজন এ সভায় উপস্থিত থাকবেন। লন্ডন কমিটির প্রেসিডেন্ট গাউস ধান সভা অনুষ্ঠানের দায়িত্ব গ্রহণে আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু বি এইচ তালুকদার মিসেস আসফ আলীর লন্ডন সফরকালীন কর্মসূচী তদারককারী “লিঙ্ক ফোরাম গ্রুপ”-এর সম্মতি নিয়ে রেড লায়ন স্কোয়ারের কনওয়ে হল ভাড়ার ব্যবস্থা করে সভা পরিচালনা করবেন বলে জানালেন। গাউস খান অনিচ্ছা সত্ত্বেও তার প্রস্তাবে রাজী হন। কারাে সঙ্গে আলােচনা না করে নিজের দায়িত্বে মি: তালুকদার এই সভার আয়ােজন করা সত্ত্বেও আমরা সবাইকে বলেছি, আমাদের মধ্যে যে বিভেদ নেই, একথা আমরা মিসেস আসফ আলীর কাছে প্রমাণ করতে চাই। কাজেই ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে আমরা সবাই তাঁর সভায় যাবাে। বিচারপতির নির্দেশ অনুযায়ী স্টিয়ারিং কমিটির পক্ষ থেকে আমি সেই সভায় উপস্থিত থেকেছি।
কনওয়ে হলের সভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে মিসেস আসফ আলী বলেন, ভারতের জনগণ বাংলাদেশের সংগ্রামকে জাতীয় বিপ্লব বলে মনে করে; কারণ বাংলাদেশের জনগণ একযােগে বিদ্রোহ ঘােষণা করেছে। দল ও মত নির্বিশেষে ভারতের জনগণ বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র বলে মেনে নিয়েছে। মস্কো ও বার্লিনে
৭৪
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সমর্থন ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে তিনি মনে করেন।
তিনি আরও বলেন, অন্য কোনাে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে জড়িয়ে পড়ার ইচ্ছা ভারত সরকার এবং ভারতবাসীদের নেই। ভারতের প্রতিবেশী রাষ্ট্রে নির্যাতন, নরহত্যা ও ধর্ষণ অব্যাহত রয়েছে, একথা বিশ্ববাসী জানে না। কিন্তু ভারতবাসীরা তার খবর রাখে। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ না করে তিনি ঘরে বসে থাকতে পারেননি। তাই তিনি স্বেচ্ছায় বেরিয়ে পড়েছেন বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যা সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে সচেতন করার প্রতিজ্ঞা নিয়ে। যেখানেই তিনি যাবেন, সেখানেই বাংলাদেশের মর্মবাণী তিনি পৌছে দেবেন বলে আশ্বাস দেন।
লর্ড ব্রকওয়ের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সভায় জন স্টোনহাউস (এম পি), ব্রুস ডগলাস-ম্যান (এম পি), সুরাইয়া খানম (স্টুডেন্টস্ এ্যাকশান কমিটি), ব্যারিস্টার শাখাওয়াত হােসেন, বি এইচ তালুকদার, পল কনেট ও ফরিদ এস জাফরী (সম্পাদক, বাংলাদেশ নিউজলেটার) বক্তৃতা করেন।
মি: ডগলাসম্যান বলেন, পাকিস্তানকে আন্তর্জাতিক সাহায্যদান বন্ধ করার জন্য আন্দোলনের মাধ্যমে বিশ্ব ব্যাঙ্ক ও পাশ্চাত্যের দেশগুলিকে রাজী করাতে হবে।
মি: স্টোনহাউস বলেন, জাতি সংঘের সনদে জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার স্বীকৃত। এই সনদ অনুযায়ী বাংলাদেশের দাবি ন্যায়সঙ্গত ।
লর্ড ব্রকওয়ে বলেন, ইহুদীদের হত্যা করার ফলে তার মনে হিটলারের বিরুদ্ধে যে ঘৃণার উদ্রেক হয়েছিল, ঠিক সেই পরিমাণ ঘৃণা তিনি পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে অনুভব করেন। পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশের সরকার এবং ব্রিটিশ সরকার যদি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে, তা হলে পূর্ব বঙ্গে পাকিস্তানী শাসনকে নিন্দা না করে তাদের কোনাে উপায় নেই।
বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনের উদ্দেশ্যে ভারতীয় সর্বোদয় আন্দোলনের নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ কায়রাে, বােম, হেলসিঙ্কি, পারী ও মস্কো সফরের পর ২রা জুন লন্ডনে পৌছান। তাঁর সফর কালে তিনি বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের জন্য বিভিন্ন দেশের নিকট আবেদন জানান।
পল কনেট ও ম্যারিয়েটার উদ্যোগে এ্যাকশান বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অনুষ্ঠিত এক সভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে মি: নারায়ণ বলেন, বাংলাদেশ চিরস্থায়ী হবে। বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দ জেনারেল ইয়াহিয়া খান কিংবা বাংলাদেশে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পশ্চিম পাকিস্তানের কোনাে ব্যক্তির সঙ্গে বাক্য-বিনিময় কিংবা করমর্দন করতেও রাজী নন।” তিনি আরও বলেন, “আমি শান্তিবাদী, কিন্তু ইয়াহিয়া খানের নিষ্ঠুর সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙালীদের সশস্ত্র প্রতিরােধের নিন্দা করতে আমি রাজী নই। যুদ্ধের জন্য ভারতের তৈরি হওয়া উচিত।” (“বাংলাদেশ নিউজলেটার, লন্ডন, ২১ শে জুন, ১৯৭১)।
৭৫
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে তিনজন পার্লামেন্ট সদস্য এই সভায় বক্তৃতা করেন। তাঁরা হলেন জন স্টোনহাউস, পিটার শাের ও মাইকেল বার্নস। তাঁদের বক্তৃতার পর বিচারপতি চৌধুরী সবাইকে ধন্যবাদ। জানান।
৪ঠা জুন ডি ভ্যালেরা হােটেলে জয়প্রকাশ নারায়ণকে লন্ডন এ্যাকশান কমিটির পক্ষ থেকে এক চা-চক্রে আপ্যায়ন করা হয়। এই অনুষ্ঠানে গাউস খান সভাপতিত্ব করেন। স্টিয়ারিং কমিটির প্রতিনিধি হিসাবে যােগ দিয়ে আমি অনুষ্ঠান পরিচালনা করি এবং জয়প্রকাশ নারায়ণকে উপস্থিত ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। বিচারপতি চৌধুরী এই অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। তিনি বলেন, ভারতীয় উপমহাদেশের এই মহান নেতা জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে আমাদের সকলের মঙ্গলকামী । তিনি আমাদের দাবি বিশ্ববাসীর কাছে পৌছে দেওয়ার মহান দায়িত্ব নিয়ে এসেছেন। তাঁর কাছে আমরা চিরকাল ঋণী থাকবাে।
ভারতীয় আইন-বিশেষজ্ঞ ও পরবর্তীকালে আইনমন্ত্রী অশােক সেন ব্রিটেনের বিভিন্ন শহরে অনুষ্ঠিত জনসভায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পক্ষে বক্তৃতা করেন। তিনি বিচারপতি চৌধুরীর ব্যক্তিগত বন্ধু ছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি ভারতের আইন দপ্তরের মন্ত্রীপদে অধিষ্ঠিত হন।
২৭শে জুন বার্মিংহামে অনুষ্ঠিত এক বিরাট জনসভায় মি: সেন প্রধান বক্তা হিসাবে আমন্ত্রিত হন। বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের জন্য ১লা অগাস্ট লন্ডনের ট্রাফালগার স্কোয়ারে অনুষ্ঠিত জনসভায়ও তিনি বক্তৃতা করেন। বক্তৃতা প্রসঙ্গে তিনি বাঙালীদের সংগ্রাম ও একনিষ্ঠ দেশপ্রেমের কথা গর্বের সঙ্গে উল্লেখ করেন।
অগাস্ট মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ভারতের প্রাক্তন দেশরক্ষা মন্ত্রী ও যুক্তরাজ্যে তাদের প্রাক্তন হাই কমিশনার মি: কৃষ্ণমেনন ৪/৫ দিনের জন্য লন্ডন সফরে আসেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতীয় মনােভাব দৃঢ়তার সঙ্গে ব্যক্ত করাই ছিল তার সফরের উদ্দেশ্য। তিনি তখন ভারতীয় লােকসভার স্বতন্ত্র সদস্য। প্রবাসী ভারতীয় সাংবাদিক ডাঃ তারাপদ বসু তাঁকে দেখাশােনা করার দায়িত্ব পালন করেন । (১২)
বিচারপতি চৌধুরী ডরচেস্টার হােটেলে গিয়ে মি: কৃষ্ণমেননের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাঁরা পুরাে বিকেল জুড়ে বাংলাদেশ পরিস্থিতি এবং বঙ্গবন্ধুর বিচারপ্রহসন সম্পর্কে আলােচনা করে কাটান।
১২ই অগাস্ট ভ: বসু মিঃ কৃষ্ণমেননের সঙ্গে আমাদের সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করে দেন। আমরা যারা তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম, তার মধ্যে ছিলেন ব্যারিস্টার শাখাওয়াত হােসেন, জাকারিয়া খান চৌধুরী, শামসুর রহমান এবং আজিজুল হক ভূঁইয়া।
৭৬
ড: বসু আমাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পর মি: কৃষ্ণমেনন বলেন, তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে একজন বিজ্ঞ ব্যক্তি নন। আমাদের নেতা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার ব্যক্তিগত আলাপ-পরিচয় নেই। পাকিস্তানের রাজনীতি কখনও তাকে আকৃষ্ট করেনি। তবে এটা তিনি বুঝতে পেরেছেন, আমাদের নেতা জাতিকে সংগ্রামের জন্য তৈরি করে গিয়েছেন। আমাদের দেশে যে অত্যাচারনির্যাতন চালানাে হচ্ছে, তার যেটুকু তিনি দেখেছেন এবং খবরের কাগজে যে বিবরণ পড়েছেন, তা তিনি বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরবেন। তিনি যে-সব দেশে যাবেন, সে-সব দেশে আমাদের পক্ষ হয়ে তিনি কথা বলবেন। আমরা তাঁকে বললাম, পাকিস্তান সৈন্যবাহিনী প্রথম দিকে গণহত্যা চালায়। তারপর তারা আমাদের বুদ্ধিজীবীদের, বিশেষ করে সাংবাদিক, অধ্যাপক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারদের বেছে বেছে হত্যা করছে। এ কথাটা বিদেশে প্রচার করার জন্য তাকে আমরা অনুরােধ করি। আমরা কয়েকজন নিহত বুদ্ধিজীবীর নামােল্লেখ করলাম। তিনি নামগুলি লিখে নিলেন।
১৩ই অগাস্ট মি: কৃষ্ণমেনন কমনওয়েলথ ইনস্টিটিউটের প্রেক্ষাগৃহে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় বক্তৃতা করেন। সভা শেষে ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী বাঙালীদের দুঃখ-দুর্দশা সম্পর্কে একটি চলচ্চিত্র প্রদর্শন করা হয়। এ সম্পর্কে মন্তব্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, নিজের চোখে তিনি যা দেখেছেন, তা’ আরও করুণ ও হৃদয়বিদারক।
১৪ই অগাস্ট মি: কৃষ্ণমেনন লন্ডনের ফিট্জরয় স্কোয়ারে অবস্থিত ভারতীয় ছাত্রদের আবাস মহাত্মা গান্ধী হল এবং রেড লায়ন স্কোয়ারের কনওয়ে ইল-এ অনুষ্ঠিত দু’টি পৃথক সভায় বাংলাদেশ সম্পর্কে বক্তৃতা করেন। উভয় সভায় বিচারপতি চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন। কনওয়ে হলের সভায় তিনি মিঃ কৃষ্ণমেননকে “মুজিবনগর সরকারের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানান।
যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট গাউস খান মি: কৃষ্ণমেননের সম্মানার্থে একটি ঘরােয়া ভােজসভার আয়ােজন করেন। বিচারপতি চৌধুরী ও স্টিয়ারিং কমিটির নেতৃবৃন্দ এবং কয়েকজন বিশিষ্ট কর্মীকে আমন্ত্রণ জানানাে হয়েছিল। তিনি ধৈর্য ধরে সবার বক্তব্য শােনেন এবং যথাসম্ভব সাহায্যের আশ্বাস দেন।
অগাস্ট মাসের শেষ দিকে ভারতের মেঘালয় প্রদেশের প্রভাবশালী এম পি রাণী মঞ্জুলা দেবী লন্ডনে আসেন। লন্ডনের ইডিয়া ক্লাবে তার সঙ্গে আমাদের সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা হয়। ২৬শে অগাস্ট আমি, আজিজুল হক ভূঁইয়া, জাকারিয়া খান চৌধুরী, ব্যারিস্টার শাখাওয়াত হােসেন এবং আরাে দু’জন তার সঙ্গে দেখা করি।
৭৭
যা দেবী পূর্ব বঙ্গের বাত্যাগীদের নিয়ে কী ধরণের সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন, তারা কী ভাবে এক কাপড়ে দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে, কী ভাবে তার অনাহারে ও বিনা চিকিৎসায় রয়েছে, তার বিস্তারিত বিবরণ দেন। তিনি বলেন, শরণার্থীদের সমস্যা সমাধানের জন্য একটি আন্তর্জাতিক আপীল নিয়ে তিনি বিদেশ সফরে বেরিয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, মেঘালয়ে আশ্রয় গ্রহণকারীদের অবস্থা অত্যন্ত মর্মান্তিক। স্থানীয় অবস্থাপন্ন ব্যক্তিদের সাহায্য গ্রহণ করে তিনি তাদের জন্য খাবার সরবরাহের ব্যবস্থা করেছেন। কলকাতায় যারা আশ্রয় গ্রহণ করেছে, তাদের সমস্যা সহজেই বিদেশী টেলিভিশন-সাংবাদিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মেঘালয়ে আশ্রয় গ্রহণকারীরা সংবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে পেছনে পড়ে থাকে। আমরা হাসতে হাসতে বললাম, মেঘের আড়ালে পড়লে তাে আর কিছুই দেখা যায় না। আমাদের শরণার্থীর মেঘের আড়ালে পড়েছে। অনেক হাসা-হাসির পর তিনি বললেন, “না, অন্ধকারে ওরা থাকবে না। তাদের জন্য আমি জীবন পণ করেছি। আমি কাজ করবে। তাই আমি আন্তর্জাতিক সফরে বেরিয়েছি। আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন, আমি আমার কাজ করে যাবাে। রাণী মঞ্জুলা দেবীর অবদান বাঙালী কোনাে দিনও ভুলতে পারবে না। | বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশের সরকারী মনােভাব যাচাই করার জন্য অক্টোবর মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী সফরে বের হন। ২৯শে অক্টোবর (শুক্রবার) তিনি অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা থেকে লন্ডনে এসে পৌছান। কয়েক ঘন্টা পর বাংলাদেশ মিশানের প্রধান এবং “মুজিবনগর সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ক্লারিজেস হােটেলে গিয়ে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। লন্ডনস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের উদ্যোগে এই সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করা হয়।
মিসেস গান্ধীর সঙ্গে এর আগে বিচারপতি চৌধুরীর সাক্ষাৎ হয়নি। তিনি বিচারপতির সঙ্গে পুরনাে বন্ধুর মতাে কথা বলতে শুরু করেন। পশ্চিম ইউরােপে বিচারপতির সাম্প্রতিক সফরের অভিজ্ঞতার কথা তিনি জানতে চান।
বিচারপতি চৌধুরী বলেন, বিভিন্ন দেশের সরকার ও জনগণ বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল। বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের ব্যাপারে তারা বলেন, ভারতের স্বীকৃতিদানের ওপর তাদের সিদ্ধান্ত নির্ভর করছে। বিচারপতি আবেগপূর্ণ কণ্ঠে আরাে বলেন, মিসেস গান্ধীর শ্রদ্ধেয় পিতা বেঁচে থাকলে তিনি শুধু বাস্তুত্যাগীদের আশ্রয় দিয়েই ক্ষান্ত হতেন না। অবশ্যি তার প্রতিদানে দেওয়ার মতাে কিছুই বিচারপতি চৌধুরীর নেই। বাংলাদেশ কখনও ভারতের করদ রাজ্যে
৭৮
পরিণত হবে না। তবে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ তার নিকট-প্রতিবেশী ভারতের বন্ধু-রাষ্ট্রের ভূমিকা গ্রহণ করবে। এই বন্ধুত্বের কোনাে মূল্য আছে কিনা, তা’ ভারতের বিচার্য বিষয়।
ধৈর্য ধরে তাঁর বক্তব্য শােনার পর মিসেস গান্ধী অমায়িকভাবে বলেন, বন্ধুত্বের কথা বলে বিচারপতি সৌজন্য প্রকাশ করেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণ এ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করা পর্যন্ত অপেক্ষা করাই বাঞ্ছনীয় বলে তিনি মনে করেন। প্রতিদান সম্পর্কে বিচারপতি চৌধুরীর উক্তির উল্লেখ করে তিনি বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে তিনি একটি মাত্র প্রতিদান আশা করেন– তা হলাে, গণতন্ত্র। পার্শ্ববর্তী দেশে তিনি সামারিক শাসন দেখতে চান না।
যথা সময়ে বিনা দ্বিধায় বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদান করা হবে বলে মিসেস গান্ধী উল্লিখিত সাক্ষাৎকার কালে বিচারপতি চৌধুরীকে আশ্বাস দেন। (১৩)
মিসেস গান্ধী ব্রিটেন-প্রবাসী বাঙালীদের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করতে রাজী হন। স্টিয়ারিং কমিটির উদ্যোগে তাকে সংবর্ধনা জানাবার আয়ােজন করা হয় । বিচারপতি চৌধুরী প্রত্যেকটি এ্যাকশান কমিটি থেকে প্রতিনিধি পাঠাবার নির্দেশ দেন। প্রবাসী বাঙালীদের মনে নানা প্রশ্ন ছিল। তারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে ভারতের মনােভাব, কখন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া হবে ইত্যাদি বিষয়ে তার বক্তব্য শােনার জন্য অত্যন্ত আগ্রহান্বিত ছিলেন।
এই সংবর্ধনা উপলক্ষে বিভিন্ন বক্তা আমাদের দাবিদাওয়া তুলে ধরেন এবং আশা-আকাঙক্ষা ব্যাখ্যা করেন। মিসেস গান্ধীর বক্তৃতা ছিল উদ্দীপনাময় ও আশাব্যঞ্জক। এমন পাণ্ডিত্যপূর্ণ এবং সমবেদনামূলক বক্তৃতা আমার জীবনে খুব কমই শুনেছি।
মিসেস গান্ধী বলেন, আমরা তােমাদের সঙ্গে আছি— পাকিস্তানের শত্রু বলে নয়, তােমাদের মুক্ত করবাে বলে নয়। বহু শতাব্দী ধরে আমরা এক সঙ্গে বসবাস করছি। আমরা দেশ-বিভাগ মেনে নিয়েছিলাম, সুখে শান্তিতে থাকবাে, এই আশায়। কিন্তু আমাদের ভাগ্যে সেটা হয়নি। আমরা দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়েছি; এই দ্বন্ধ আত্মঘাতী । আমি পাকিস্তানের কোনাে শত্রু নই। কিন্তু যেহেতু পাকিস্তান যাদের নিজস্ব জনগণ বলে দাবি করেন, তাদের নিধন করছে, নিশ্চিহ্ন করার এক হীন ষড়যন্ত্র করেছে, সেই জন্য আমি মনে করি—প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসাবে আমাদের একটি দায়িত্ব রয়েছে এই অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে জগদ্বাসীকে তা জানানাে এবং নিপীড়িতদের প্রত্যক্ষ সাহায্যদান আমাদের অবশ্য কর্তব্য। আমি তােমাদের নিশ্চয়তা দিচ্ছি, তােমাদের দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত আমাদের প্রতিশ্রুতির কোনােটাই ভঙ্গ করবে না। শরণার্থীদের সর্ব প্রকারের সাহায্য আমরা
৭৯
দেব। প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসাবে আমাদের পক্ষে যা কিছু করা সম্ভব তা আমরা করবাে। তােমরা জেনে রাখ, আমরা বৃহৎ ও শক্তিমান রাষ্ট্রর ঔদ্ধত্য নিয়ে তােমাদের ওপর কর্তৃত্ব খাটাতে আসবাে না। আমরা তােমাদের দেশ স্বাধীন করার জন্য ডাক দিইনি। তােমাদের ভাগ্য তােমরা নিয়ন্ত্রণ করবে। আমরা শুধু আমাদের দায়িত্ব পালন করে যাবাে।
বিচারপতি চৌধুরী তার বক্তৃতায় শরণার্থীদের আশ্রয় এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সাহায্য ও সহযােগিতাদানের জন্য মিসেস গান্ধীকে আন্তরিক ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।
অসুস্থতার জন্য আমি এই অনুষ্ঠানে হাজির থাকতে পারিনি। আজিজুল হক ভূইয়া মিসেস গান্ধীর রেকর্ড-করা বক্তৃতার “টেইপ” আমার বাড়িতে পৌছে দেন।
অনুষ্ঠানের শেষ পর্বে বাংলাদেশ পিপলস কালচারল সােসায়েটির উদ্যোগে এনামুল হকের অস্ত্র হাতে তুলে নাও” শীর্ষক একটি নৃত্যনাট্য পরিবেশন করা হয়।
৮০
১১. মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য অস্ত্র সরবরাহ
কাউন্সিল ফর দি পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ ইন্ ইউ কে-র ১১জন সদস্যের মধ্যে একজন ছিলেন একরামুল হক। তিনি কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট (গাউস খান), জেনারেল সেক্রেটারী (শেখ আবদুল মান্নান), ট্রেজারার (আবদুল হামিদ) এবং অন্যান্য সদস্যের সঙ্গে কোনাে আলাপ-আলােচনা না করেই এক সাংবাদিক সম্মেলন আহ্বান করেন। এই সম্মেলনে তিনি বলেন, আমরা শীঘ্রই অস্ত্র ক্রয় করার উদ্যোগ নিচ্ছি। “দি টাইমস পত্রিকায় এই সংবাদ প্রকাশিত হয়। এর ফলে “স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড” (পুলিশ ও গােয়েন্দা দপ্তর) সচকিত হয় এবং আমরা এক ব্রিতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হই। বিচারপতি চৌধুরীকে এর জন্য কৈফিয়ৎ দিতে হয়েছিল। তারা জানতে চেয়েছে, অস্ত্র ক্রয় করা সম্পর্কে আমরা নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছ কিনা, না কি তা’ আকাশ-কুসুম কল্পনা মাত্র।
মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য অস্ত্র ক্রয় করার কথা সম্ভবতঃ আমাদের নেতাদের মুখ থেকেই বেরিয়েছিল । যত দূর মনে পড়ে, জাকারিয়া খান চৌধুরী কোনাে এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, আলজেরিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় ফ্রান্স থেকে হাজার হাজার আলজেরিয়ান তাদের দেশে অস্ত্র পাঠায়। আমরাও সেইভাবে অস্ত্র পাঠাতে পারি।
অস্ত্র পাঠাবার কথা যারা প্রকাশ্যে বলেছেন, তারা ভেবে দেখেননি—ভারতের অনুমতি নিয়ে, নাকি বিনা অনুমতিতে তা’ পাঠানাে হবে, কোথা দিয়ে কি করে পাঠানাে হবে, অস্ত্র পাঠানাে আদৌ প্রয়ােজন কিনা। তা ছাড়া প্রকাশ্য সাংবাদিক সম্মেলনে এধরনের স্পর্শকাতর বিষয় উত্থাপন করা নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক, এ কথা উৎসাহী ব্যক্তিরা নিশ্চয় বুঝতে পারেননি।
পূর্ব লন্ডনের গ্র্যান্ড প্যালেস হলু-এ ৬ই জুন তারিখে লন্ডন এ্যাকশান কমিটির উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এক জনসভায়ও একটি বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। সেই সভায় আমি যখন বক্তৃতা দেওয়ার জন্য দাঁড়ালাম, তখন এক যুবক–রফিকুল ইসলাম মিয়া (বর্তমানে বি এন পি নেতা)-বাধা দিয়ে বলেন, “আমি শেখ মান্নানকে জিজ্ঞেস করতে চাই, আপনারা অস্ত্র পাঠাবার ব্যাপারে এ পর্যন্ত কি
৮১
করেছেন?” মনে রাখতে হবে, এই সময় স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড, পাকিস্তান দূতাবাস এবং ভারতীয় দূতাবাসের পরিচিত ও অপরিচিত প্রতিনিধি এবং জনসাধারণ অর্থাৎ আমাদের শক্ত ও মিত্রদের অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। এ ধরনের সভায় তিনি আমার কাছ থেকে যে মারাত্মক কথাটা শুনতে চান, তা হলাে—আমরা অস্ত্র পাঠাচ্ছি। আমি তাকে বললাম, এ ব্যাপারে আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইলে সভার পরে আমার সঙ্গে দেখা করবেন। তবুও তিনি চীৎকার করে একই প্রশ্ন করতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত সভাপতি গাউস খান তাঁকে থামতে বাধ্য করেন।
আমাদের আপন লােক, যারা অনিচ্ছাকৃতভাবে স্বাধীনতা আন্দোলনের ক্ষতি করেছেন, তাঁদের কথাও বলা দরকার। এদের মধ্যে একজন হলেন হােসেন আলী। তিনি কলকাতায় পাকিস্তানের ডেপুটি হাই কমিশনারের পদ ত্যাগ করে বাংলাদেশের পক্ষে যােগ দেন। তিনি এদেশে বসবাসকারী ব্যক্তি বিশেষের কাছে পৃথকভাবে চিঠি লিখে অবিলম্বে টাকা এবং অন্যান্য সাহায্য পাঠাবার অনুরােধ জানান। অথচ এসব চিঠি লেখার কোনাে “অথরিটি” (আইনসম্মত অধিকার) তার ছিল না। এসব চিঠি আমাদের আন্দোলনের ক্ষতি করেছে বলে আমি মনে করি।
জেনারেল আতাউল গণি ওসমানীও একটা ভুল করেছেন। তিনি তাঁর আত্মীয়-স্বজন ও অনুসারীদের কাছে সরাসরি চিঠি লিখে টাকা ও অস্ত্র পাঠাবার জন্য অনুরােধ করেন। তিনি বলেন, আমাদের মুক্তিযােদ্ধারা সাপের কামড়ে মারা যাচ্ছে; তাদের গায়ে কাপড় নেই। আর তােমরা ওখানে বসে কিছুই করছ না। এসব চিঠি পেয়ে মানুষ বিচলিত হয়েছে। তারা আমাদের কাছে এসেছে এসব চিঠি নিয়ে। লাক্ষ্ণৌ রেস্তোরাঁ”-র মালিক শাখাওয়াত আলী এ ধরনের একটা চিঠি পেয়েছিলেন বলে আমার মনে পড়ে। ড: নূর হােসেনও একটা চিঠি পেয়েছিলেন। তিনি যাদের কাছে চিঠি লিখেছেন, তাদের বেশির ভাগ পূর্ব লন্ডনের অধিবাসী । আমি নিজে দু’টো চিঠি পড়েছি। একটা চিঠিতে তিনি লিখেছেন, ভারতীয়রা যে-অস্ত্র দিচ্ছে তা’ প্রয়ােজনের তুলনায় যথেষ্ট নয়। আর একটা চিঠিতে তিনি লেজার বীম অপারেটেড” অস্ত্র পাঠাবার কথা বলেছেন। অথচ এ ধরনের অস্ত্র ক্রয়ের জন্য অর্থ সংগ্রহ করা প্রবাসী বাঙালীদের পক্ষে অসম্ভব ছিল। তা ছাড়া ভারতের অনুমতি ছাড়া এ ধরনের অস্ত্র পাঠাবার সমস্যার কথা তিনি ভেবে দেখেছেন বলে মনে হয় না। বিচারপতি চৌধুরীর কর্তৃত্ব এবং বাংলাদেশ মিশানের অস্তিত্ব অস্বীকার করে এই চিঠিগুলি এখানে পৌছায়। এর ফলে সৃষ্ট সমস্যা। সমাধানের জন্য আমাদের অনেক সময় ব্যয় করতে হয়েছে।
পরবর্তীকালে আমাদের অনুরােধ অনুযায়ী মুজিবনগর সরকার এই মর্মে নির্দেশ জারী করে যে, প্রবাসী বাঙালীদের কাছে ব্যক্তিগতভাবে কেউ সাহায্য
৮২
চাইবেন না। জেনারেল ওসমানীও এইভাবে সাহায্য চাইবেন না বলে আশা প্রকাশ করা হয়। উল্লিখিত নির্দেশ লিখিতভাবে জারী করা হয় ।
কাউন্সিল ফর দি পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ ইন ইউ কে গঠিত হওয়ার পর গাউস খান আমাকে বলেন, ভারতীয় হাই কমিশনের সঙ্গে আমাদের যােগাযােগ করা উচিত। আমি তাকে বললাম, আমাদের পক্ষের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা ইতােমধ্যে তাদের সঙ্গে যােগাযােগ স্থাপন করেছেন। প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসাবে তারা নিপীড়িত শরণার্থীদের সাহায্য করবে, এটাই আমরা আশা করি। তাছাড়া বাংলাদেশ স্বাধীন হলে তাদের শত্রু পাকিস্তান দূর্বল হবে। নিজেদের স্বার্থেই তারা আমাদের সাহায্য করবে। অতএব, তারা আমন্ত্রণ না জানানাে পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করবাে।
পরবর্তীকালে ভারতীয় হাই কমিশনারের সঙ্গে আমার যােগাযোেগ হলে তিনি জানান, তাদের একজন অফিসার (ফার্স্ট সেক্রেটারী) আমাদের সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষা করবেন। তিনিই আমাদের জানাবেন, তাঁরা আমাদের সাহায্য করছেন কিনা এবং আমরা তাদের কি সাহায্য দিতে পারি। আমার যতদূর মনে পড়ে, এই অফিসারের নাম ছিল আই সিং।ট্রাফালগার স্কোয়ারের পার্শ্ববর্তী একটি রেস্তোরার ওপরের তলায় আমি ও আজিজুল হক ভূঁইয়া তার সঙ্গে দেখা করি। তাকে আমরা বললাম, ভারত সরকারের কাছে আমরা দাবি করি-মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে। আমাদের অস্ত্র পাঠাবার ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের সংগ্রামী জনগণকে আমরা সাহায্য করতে চাই। তাদের হাতে কিছু অস্ত্র পৌছে দেওয়ার জন্য আমরা অর্থ সংগ্রহ করছি। একই জায়গায় দুটো বৈঠকের পর আমার নিজের ব্যস্ততার জন্য আমি আর তার সঙ্গে দেখা করিনি। আমার ধারণা হলাে, আমাদের বন্ধু-দেশ প্রয়ােজনীয় অস্ত্র সরবরাহ করবে। কিন্তু তারা আমাদের অস্ত্র সরবরাহের অনুমতি মঞ্জুর করবে না । আজিজুল হক ভূইয়াকে আমি বললাম, আপনি আলােচনা চালিয়ে যান। দেখুন, তারা যদি কিছু অস্ত্র প্রতীক স্বরূপ পাঠাবার অনুমতি দেয়, তাহলে লােকজনকে আমরা বলতে পারবাে, আমাদের অস্ত্র যাচ্ছে। স্টিয়ারিং কমিটির পক্ষ থেকে আমরা আর কোনও সাহায্য ভারতীয় হাই কমিশনের কাছে চাইনি।
২১শে জুন ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রী সরদার শরণ সিং ও ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রী স্যার আলেক ডগলাস-হিউম বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রায় ঘন্টা যাবৎ আলােচনা করেন। ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তরে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকের পর এক যুক্ত বিবৃতিতে বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তান সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান অধিবাসীদের নিকট গ্রহণযোেগ্য হতে হবে। বৈঠকের পর এক সাংবাদিক সম্মেলনে শরণ সিং বলেন, ভারতের জন্য বৈদেশিক সাহায্য চাওয়ার উদ্দেশ্যে তিনি লন্ডনে আসেননি।
৮৩
পাকিস্তানকে বৈদেশিক সাহায্যদান স্থগিত রাখার জন্য অনুরােধ জানানাে তার সফরের মূল উদ্দেশ্য। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পশ্চিম ইউরােপের কয়েকটি দেশের সান্ত্রী কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বাংলাদেশ সমস্যা সম্পর্কে মত বিনিময়ের পর শরণ সিং লন্ডনে আনে।
প্রধান তাজউদ্দিন আহমদের নির্দেশ অনুযায়ী বিচারপতি চৌধুরী শরণ সং-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এই সাক্ষাৎকালে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত আপা পন্থ উপস্থিত ছিলেন । শরণ সিং বলেন, বিভিন্ন দেশ সফরকালে বিচারপতি চৌধুরী যদি বিপদগ্রস্ত হন, তাহলে তিনি যেন ভারতীয় দূতাবাসের সঙ্গে যােগাযােগ। কতে দ্বিধা না করেন।
কথা প্রসঙ্গে বিচারপতি চৌধুরী বলেন, মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য অস্ত্র পাঠাবার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ ভারত সরকারের অনুমতি চেয়েছেন। অনুমতি না পাওয়ার জন্য অস্ত্র পাঠানাে সম্ভব হচ্ছে না বলে প্রবাসী বাঙালীদের মধ্যে হতাল দেখা দিয়েছে। শরণ সিং বলেন, বিদেশ থেকে অস্ত্র না পাঠালেও মুক্তিযােদ্ধারা প্রয়োজনীয় অস্ত্র পাচ্ছেন। তবে লন্ডন থেকে অস্ত্র পাঠাবার অনুমতি দেওয়ার আগে কয়েকটি নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সে জন্যই অনুমতিদানে বিলম্ব হচ্ছে ।
অমর স্টিয়ারিং কমিটির সদস্যরা অন্যান্য নেতাকে সঙ্গে নিয়ে ভারতীয় হাই কমিশনারের বাড়িতে শরণ সিং-এর সঙ্গে অস্ত্র পাঠাবার ব্যাপারে আলােচনা করার জন্য এক বৈঠকে মিলিত হই । আমরা তাকে ভারতের সীমানা পার হয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে অস্ত্র পাঠাবার ব্যবস্থা করার অনুরােধ জানাই। তিনি বললেন, প্রথম কথা হলাে–কত অস্ত্র আপনারা ক্রয় করতে পারবেন এবং কি পরিমাণ অর্থ আপনার সংগ্রহ করেছেন? তাছাড়া অস্ত্র কার হাতে যাবে? কোন কোম্পানীর জাহাজে অস্ত্র পাঠাবেন? এ মুহুর্তে অস্ত্র দেওয়ার ব্যাপারে কোনাে । প্রস্তুতি নেই। আমরা এখনাে বাংলাদেশকে কৃটনৈতিক স্বীকৃতি দিইনি। এর চেয়েও কি ভালাে হয় না— আপনাদের চাহিদা অনুযায়ী আমরা যদি বিনা মূল্যে অস্ত্র সরবরাহ করি? আপনারা তাে স্বাধীনতাই চান। আপনাদের মুক্তিযােদ্ধারা যুদ্ধ করুক, আর আপনারা অস্ত্র ক্রয়ের জন্য সংগৃহীত অর্থ ভবিষ্যতের বাংলাদেশ সরকারের জন্য জমা রাখুন।
আমি স্বীকার করছি, তখন আমি মনঃক্ষুন্ন হয়েছিলাম। পরে ভেবে দেখেছি, ভারত আমাদের তিন দিকে ঘিরে রয়েছে। বার্মা আমাদের বন্ধু দেশ নয়। আমরা একটা জাহাজ ভাড়া করে অস্ত্র নিয়ে গেলে কোথায় তা’ নামাবার ব্যবস্থা করবাে? চট্টগ্রামে, খুলনায়, নাকি বরিশালে? গােপনে অস্ত্র পাঠাবার খবর প্রকাশিত হয়ে
৮৪
পড়লে অস্ত্রের আন্তর্জাতিক চোরাচালানের অভিযােগ উঠতে পারে। অনেক ভেবেচিন্তে আমি মেনে নিলাম—শরণ সিং যে কথাগুলাে বলেছেন, তা যুক্তিসঙ্গত।
শরণ সিং-এর কথা যুক্তিসঙ্গত হলেও আমাদের অস্ত্র পাঠাবার ব্যাপারে জনমনে সন্দেহের সৃষ্টি হয়। তারা মনে করে, অস্ত্র ক্রয়ের জন্য অর্থ সংগ্রহ করা সত্ত্বেও অস্ত্র পাঠানাে হচ্ছে না। এ নিয়ে আমাদের মধ্যে অনেক বাক-বিতণ্ডা হয়েছে। পাকিস্তান হাই কমিশান অস্ত্র পাঠাবার ব্যাপারে আমাদের তথাকথিত ব্যর্থতাকে উপলক্ষ্য করে বিচারপতি চৌধুরীর বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা চালায় এবং জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে।
আমি একটা ভুল করেছিলাম। এই ভুলের জন্য বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে আমার বেশ কয়েক দিন কথাবার্তা বন্ধ ছিল। আমাদের বৃহত্তর বরিশাল জেলার মােহাম্মদ মহসীন মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক ছিলেন। তিনি একদিন আমাকে বললেন, “রিমােট কন্ট্রোল” বােমা তৈরি ও বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে এমন একটি “সাের্স”. এর সন্ধান তিনি পেয়েছেন। ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী ও অন্যান্য জায়গায় যেখানে পাকিস্তানী সামরিক ঘাঁটি আছে, সেখানে “রিমােট কন্ট্রোল বােমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আমরা তাদের ঘায়েল করতে পারবে এবং তারা মানসিকভাবে দুর্বল হবে। আমি সঙ্গে সঙ্গে স্টিয়ারিং কমিটির অন্য সদস্যদের একথা জানালাম। কবীর চৌধুরীর সঙ্গে যােগাযােগ করা সম্ভব হয়নি। শামসুর রহমান, আজিজুল হক। ভূঁইয়া এবং আমি এ সম্পর্কে আলােচনা করার জন্য আমার বাড়িতে এক বৈঠকে মিলিত হলাম। আললাচনার পর আমরা মহসীন সাহেবকে বললাম, একটি নির্দিষ্ট। তারিখে আমাদের পরিচিত এক রেস্তোরায় তার সঙ্গে আমাদের দেখা হবে। সেই তারিখে মহসীন সাহেব দু’জন ইংরেজকে সঙ্গে নিয়ে হাজির হলেন তাঁরা।
আমাদের বােঝালেন, এই বােমা এত হাল্কা হবে যে, ভারতের অনুমতি ছাড়াই সঙ্গে করে সহজেই নিয়ে যাওয়া যাবে। সীমান্ত এলাকায় পৌছে বােমাগুলি মুক্তিবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হলে তারা নির্বিঘ্নে তা প্ল্যান্ট” করতে পারবে। তারা গােপনে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বােমার কার্যকারিতা প্রমাণ করবেন বলে আমাদের আশ্বাস দিলেন। আমি বিস্ফোরণ দেখতে রাজী হলাম। ঠিক হলাে– আমার সঙ্গে যাবেন আজিজুল হক ভূঁইয়া, মেডিক্যাল এ্যাসােসিয়েশনের ড: জোয়ারদার ও মােহাম্মদ মহসীন। লন্ডন থেকে বেশ দূরে চেলতেনহাম-এর পাহাড়ে যেখানে জনবসতি নেই সেখানে বােমা প্যান্ট করা হবে। আমরা দূর থেকে রিমােট কন্ট্রোল”-এর মাধ্যমে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ফলাফল দেখবাে। নির্দিষ্ট দিনে আমরা রাত তিনটার সময় রওয়ানা হলাম। সেই দু’জন ইংরেজ একটি ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে পৃথক গাড়িতে পূর্ব-নির্দিষ্ট পয়েন্ট”-এ আমাদের সঙ্গে যােগাযােগ করেন। “রিমােট
৮৫
কন্ট্রোল ব্যবহার করে আমরা পাহাড়ের মধ্যে “প্ল্যান্ট” করা তিনটি বােমা বিষ্ণোরণ ঘটালাম। দূর থেকে বােমার শব্দ শুনে আমরা নিশ্চিত হলাম, শত্রুকে ঘায়েল এবং মানসিকভাবে দুর্বল করার জন্য এই বােমা আমাদের জন্য প্রয়ােজন।
এর দুদিন পর স্টিয়ারিং কমিটির অফিসে একটি রুমের দরজা বন্ধ করে দিয়ে আমাদের এই পরিকল্পনার কথা বিচারপতি চৌধুরীকে অবহিত করি। আমি নিজেই এই কথা ব্যক্ত করি। তখনকার দৃশ্য দেখার মতাে নয়। তিনি আমাকে বার বার বললেন, “আপনি এই কাজের মধ্যে গেলেন! আপনাকে আমি এই ভাবে বিশ্বাস করি। এত মানুষ আপনাকে ভালােবাসে। আপনি এদেশের সরকারের আতিথেয়তাকে এই ভাবে নস্যাৎ করছেন। আপনি কি আশা করেন, ভারত সরকার আপনার স্যুটকেস-বােঝাই করা বােমা মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে পৌছে দেবে? আপনারা যদি এই দুটো সাদা মানুষকে নিয়ে রওয়ানা হন, তাহলে (ভারতীয়) ইন্টেলিজেন্স ডিপার্টমেন্ট’ প্রশ্ন করবে। বন্ধু-রাষ্ট্র বলে যে-দেশকে স্বীকার করে নিয়েছেন, তাদের বিনা অনুমতিতে এ কাজ করা কি ঠিক হবে? এই সময় আপনি কেন অপচয় করলেন?”
আমার প্রস্তাব শােনার পর বিচারপতি চৌধুরী আমার প্রতি রাগ করেন, বরং মানসিকভাবে কষ্ট পেয়েছেন। আমার দ্বারা এরকম একটা কাজ সম্ভব, তা তিনি ভাবতে পারেননি। এই ঘটনার পর বেশ কয়েক দিন মােটামুটিভাবে আমাদের কথাবার্তা বন্ধ ছিল। তিনি এ রকম মনােভাব প্রকাশ করবেন, সে কথা আমি কল্পনাও করতে পারিনি। এই প্রসঙ্গে আমি বলবাে, আমাদের এই বেপরােয়া মনােভাবের জন্য জেনারেল ওসমানীর চিঠিগুলিই দায়ী।
৮৬
১২. বিদেশে প্রতিনিধি প্রেরণ
বিদেশে বিভিন্ন উপলক্ষে বাংলাদেশের পক্ষের কথা বলার জন্য আমরা প্রতিনিধি পাঠিয়েছি। স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হওয়ার কিছুকাল পর সিরিয়ার রাজধানী দামাসকাস-এ জোট-নিরপেক্ষ দেশগুলির এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। আমরা ইংল্যান্ডের ব্রুনেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়ার লেকচারার ড: কবীরউদ্দিন আহমদকে পাঠাবাে বলে স্থির করি। অর্থনীতিবিদ ড: আহমদ পাকিস্তান আমলে Unhappu East Pakistan শীর্ষক একটি বই লিখে খ্যাতি অর্জন করেন। তাকে পাঠাবার প্রস্তাব তিনি আগ্রহের সঙ্গে গ্রহণ করেন। কিন্তু আমরা খবর পেলাম, আমাদের কোনও প্রতিনিধি যদি জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে যান, তাহলে তাঁকে নির্মূল করা হবে। এই খবর পাওয়ার পর ড: আহমদ তাঁর স্ত্রী ও একমাত্র শিশু সন্তানকে নিয়ে বিমান-টিকেট সংগ্রহ করার জন্য আমার বাড়িতে আসেন। তিনি বললেন, মান্নান সাহেব, আমি চলে যাচ্ছি, আমার স্ত্রী ও বাচ্চা থাকলাে। আমি যদি আর ফিরে না আসি, তাহলে আপনাদের দায়িত্ব হবে ওদের বাংলাদেশের মাটিতে পৌছে দেওয়া। ওরা যেন স্বাধীন বাংলায় ফিরে যেতে পারে। ড: আহমদ তার দায়িত্ব পালন করে নির্বিঘ্নে ফিরে এসেছিলেন।
আমরা হল্যান্ডে পাঠিয়েছিলাম আমাদের বাংলাদেশেরই এক সন্তান নিখিলেশ ভট্টাচার্যকে। জার্মানীর কোল শহরে তিনি বসবাস করতেন। তিনি জানালেন তার যাতায়াতের সব খরচ তিনি বহন করবেন; তাকে কি করতে হবে, তা-ই শুধু বলতে হবে। দুর্ভাগ্যবশতঃ হল্যান্ডের রাজধানী দি হেগ-এ এক সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি নিহত হন।
জুন মাসের শেষ দিকে পারীতে পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক সাহায্যদানের উদ্দেশ্যে গঠিত ১১-সদস্য বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের (এইড় কনসরসিয়াম) এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকে “লবী করার জন্য লন্ডন থেকে এ্যাকশান বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদের প্রতিনিধিরা পারী সফর করেন। পারী থেকে ২১শে জুন তারিখে প্রাপ্ত সংবাদে বলা হয়, এই কসরসিয়াম পূর্ব বাংলা সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান না হওয়া পর্যন্ত নতুন সাহায্যদানের প্রস্তাব
৮৭
সম্পর্কিত আলােচনা স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। আমাদের প্রতিনিধিদলের প্রচেষ্টা সাফল্য লাভ করায় আমরা গর্ব বােধ করি।
২১শে জুন বিচারপতি চৌধুরী হল্যান্ড সফরে যান। তার সঙ্গে ছিলেন জাতীয় শ্রমিক লীগের জেনারেল সেক্রেটারী ও আওয়ামী লীগ দলভুক্ত সংসদ সদস্য আব্দুল মান্নান। ইংল্যান্ড থেকে রওয়ানা হওয়ার দু’দিন আগে হল্যান্ড থেকে একটি টেলিভিশন টীম লন্ডনে এসে বিচারপতি চৌধুরীর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে। ২০শে জুন এই সাক্ষাৎকার প্রচারিত হয়। পরদিন বিকেলবেলা বিমানযােগে তিনি আমস্টারডাম পৌছান। বিমানবন্দরের ভি আই পি রুমে সংবাদপত্র, রেডিয়াে ও টেলিভিশনের সাংবাদিকরা তাঁর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। বিমানবন্দর থেকে হােটেলে পৌছানাের পর দুজন পার্লামেন্ট সদস্য তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাঁদের সঙ্গে তিনি বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে আলােচনা করেন।
২২শে জুন বিচারপতি তার সঙ্গীদের নিয়ে পার্লামেন্ট ভবনে যান। কয়েকজন পার্লামেন্ট সদস্যের সহায়তায় তিনি স্পীকারের সঙ্গে সৌজন্যমূলক সাক্ষাৎকার মিলিত হন। বিকেলবেলা পার্লামেন্টের একটি কমিটি রুমে বৈদেশিক-ব্যাপার সম্পর্কিত সাব-কমিটির সদস্যদের সঙ্গে মিলিত হন। তারা দু’ঘন্টারও অধিক সময় ধরে বিচারপতি চৌধুরীকে নানা প্রশ্ন করেন। প্রশ্নোত্তরের পর সাব-কমিটির চেয়ারম্যান বলেন, বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে আলােচনার পর তারা বুঝতে পেরেছেন—বাংলাদেশের মাটিতে পাক সেনাবাহিনীর বর্বর হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশ পাকিস্তানের সঙ্গে থাকতে পারে না। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের সংগ্রামকে তারা আদর্শগতভাবে সমর্থন জানাবেন। আলােচনা কালে বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে ছিলেন রাজিউল হাসান রঞ্জু, সুনীল কুমার লাহিড়ী ও জহীরউদ্দিন।
অগাস্ট মাসের শেষ দিকে রুমানিয়ায় “ বিজ্ঞান ও বিশ্বশান্তি” শীর্ষক একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ছাত্রনেতা মােহাম্মদ হােসেন মঞ্জুকে সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী প্রতিনিধিদের সঙ্গে যােগযােগ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে তাঁদের অবহিত করার উদ্দেশ্যে রুমানিয়ায় যাওয়ার জন্য বিচারপতি চৌধুরী মনােনীত করেন। বাংলাদেশ সম্পর্কিত প্রচারপুস্তক নিয়ে তিনি ৩০শে অগাস্ট রুমানিয়া পৌছান।
ভারতীয় প্রতিনিধিদলের নেতা সারাভাইয়ের সঙ্গে দেখা করে মােহাম্মদ হােসেন মঞ্জু তাঁর কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে আলােচনা করেন। ভারতীয় দলের অন্য দু’জন সদস্য—শিশির গুপ্ত ও হােসেন জাহির—তাকে অন্যান্য দেশের কয়েকজন প্রতিনিধির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলের সদস্য জেরা স্মিথের সঙ্গে দেখা করে পাকিস্তানে সমরাস্ত্র প্রেরণ বন্ধ করার জন্য
৮৮
অনুরােধ জানান। এরপর তিনি সােভিয়েত প্রতিনিধি দলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তারা বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতি জানিয়ে যথাসাধ্য সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন।
সুইডেনের স্বনামখ্যাত অধ্যাপক এ্যালভেন সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। বাংলাদেশ সম্পর্কিত দলিলপত্র এবং বিচারপতি চৌধুরীর চিঠি নিয়ে মােহাম্মদ হােসেন মঞ্জু তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি পরের দিন সম্মেলনের মূল অধিবেশনে বাংলাদেশের প্রসঙ্গ উত্থাপন করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন। (বিচারপতি চৌধুরীর স্মৃতিকথা, “প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি” ।
* * * * * *
আমরা বিচারপতি চৌধুরীকে ফ্রান্স, সুইটজারল্যান্ড, নরওয়ে, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক, হল্যান্ড প্রভৃতি দেশে পাঠিয়েছি। আমেরিকায় তিনি দু’বার গিয়েছেন। তিনি সঙ্গী নির্বাচন করার দায়িত্ব আমাদের দিয়েছেন। ব্যারিস্টার শামসুল মাের্শেদ-কে (বর্তমানে বাংলাদেশ ফরেন সার্ভিসে কর্মরত) আমরা তাঁর সফরসঙ্গী হিসাবে ইউরােপে পাঠাই। মাত্র একবার তিনি নিজেই তার সফরসঙ্গী নির্বাচন করেন। আমীর আলী ও রাজিউল হাসান রঞ্জুকে (বর্তমানে ব্রিটেনে
এ্যাসিস্ট্যান্ট হাই কমিশনার পদে নিয়ােজিত) তিনি তাঁর সফরসঙ্গী করার প্রস্তাব | স্টিয়ারিং কমিটির নিকট পেশ করেন। তিনি সানুনয় অনুরােধ করেন, আমরা যেন তার প্রস্তাবে রাজী হই।
লন্ডন আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি হিসাবে সুলতান মাহমুদ শরীফ গােরিং স্ট্রীটের অফিসে এসে বলেন, মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হচ্ছে আওয়ামী লীগের নামে, আর আপনারা লােক পাঠাচ্ছেন অন্যান্য দল থেকে। এ অধিকারটা আপনাদের কে দিয়েছে? আমি তখন উপস্থিত ছিলাম। তাই আমাকেই জবাব দিতে হলাে। আমি তাকে বুঝিয়ে বললাম, ভাই, দেশ আমাদের জন্য বড়, ব্যক্তির চেয়েও বড়। এরা ততা ইতিহাস-বিখ্যাত হওয়ার জন্য যাচ্ছে না। উপযুক্ত ব্যক্তি বিবেচনায় তাদের পাঠানাে হচ্ছে। তিনি বললেন, আপনি কি আওয়ামী লীগের কোনাে উপযুক্ত লােক পান না? আমি তাকে বললাম, আওয়ামী লীগার হিসাবে এ ধরনের লােক আমি পাইনি। ড: শামসুল হুদা হারুন এখানে আছেন; তিনি কোন্ দলের সঙ্গে জড়িত তা আমার জানা নেই। কাজেই তাকে পাঠানাে হয়নি।
পরে আমি মিনহাজ সাহেবকে বলেছি; ভাই, দেখুন, আমি আওয়ামী লীগের লােক নই; বিচারপতি চৌধুরীও নন। তাসাদ্দক আহমদও আওয়ামী লীগার নন। এই ভাবে আমি ২০টি এ্যাকশন কমিটির নাম বললাম, যাদের প্রেসিডেন্ট এবং সেক্রেটারীদের কেউই আওয়ামী লীগার নন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শুধু আওয়ামী লীগের নেতা নন; তিনি সমগ্র জাতির নেতা। ছাত্রদের মধ্যে যারা বৃত্তি নিয়ে
৮৯
এসেছেন, তাদের মধ্যে অনেকেই স্বভাবতঃই পাকিস্তান সরকারের পক্ষের লােক। যারা নিজের উদ্যোগে লেখাপড়া করছেন, তাঁরা কোনও পার্টির সদস্য হিসাবে আসেননি। কলকারখানা ও রেস্তোরার হাজার হাজার কর্মী দেশে কোনও রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। তারা বঙ্গবন্ধুর ডাক শােনার পর জাতির দুর্দিনে পথে নেমে এসেছেন আমাদের সঙ্গে। কাজেই বঙ্গবন্ধুকে শুধু আওয়ামী লীগের নেতা হিসাবে বিবেচনা করা যুক্তিসঙ্গত হবে না।
আমি আরও বললাম, ছাত্র এ্যাকশন কমিটির দিকে লক্ষ্য করুন। মােহাম্মদ হােসেন মঞ্জ, বুলবুল, শামসুদ্দীন চৌধুরী (মানিক) আওয়ামী লীগার নন। খােন্দকার মােশাররফ হােসেন, নজরুল ইসলাম এবং জয়নাল আবেদীনও আওয়ামী লীগার নন। কিন্তু তারা সবাই আওয়ামী লীগের সঙ্গে কাজ করছেন। কারণ, আওয়ামী লীগার নেতা বাংলাদেশের জনগণের নেতা। কাজেই আমরা যদি দলীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করি, তা হলে আমাদের পক্ষে কাজ করা কঠিন হবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে এমন কোনও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিনি, যা’ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যেতে পারে। যদি গিয়ে থাকে, তবে সজ্ঞানে যায়নি। পাকিস্তান ক্রিকেট টীমের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ এবং পারীতে “এইড় কসরসিয়াম”-এর বৈঠক, লেবার পার্টিও টোরী দলের সম্মেলনে যারা “লবী” করার জন্য গিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই আওয়ামী লীগের সমর্থক ছিলেন। বহির্বিশ্বে যারা আমাদের প্রতিনিধি হিসাবে গিয়েছেন, তাঁদের শিক্ষাগত যােগ্যতা এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি অবিচলিত সমর্থনের কথা বিবেচনা করেই মনােনীত করা হয়।
* * * * * *
১লা সেপ্টেম্বর বিচারপতি চৌধুরী লন্ডন থেকে নরওয়ের রাজধানী অসলাে। পৌছান। তার সফরসঙ্গী ছিলেন রাজিউল হাসান রঞ্জু। বিমানবন্দরে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হামিদুল ইসলাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রফিকুজ্জামানসহ ৬/৭ জন বাঙালী তাদের অভ্যর্থনা জানান।
স্থানীয় বাঙালীদের প্রচেষ্টার ফলে স্থানীয় টিভি বিচারপতি চৌধুরীর দীর্ঘ সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে। এই সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে তিনি নরওয়ের অধিবাসীদের নিকট স্বাধীনতা আন্দোলনের সারমর্ম ব্যাখ্যা করার সুযােগ লাভ করেন। সে দিন বিকেলবেলা এই সাক্ষাৎকার প্রচারিত হয়।
২রা সেপ্টেম্বর বেলা এগারােটার সময় বিচারপতি চৌধুরী নরওয়ের প্রধান বিচারপতি পিয়ের অন্ড-এর কফি পানের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য সুপ্রীম কোর্টের সব বিচারপতিদের আমন্ত্রণ জানান হয়েছিল। তাঁরা জানতে চাইলেন, বাংলাদেশ কেন পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীনতা অর্জন
৯০
করতে চায়। বিচারপতি চৌধুরী তাঁদের কাছে স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করেন।
সেদিন দুপুরবেলা রােটারী ক্লাবের সভায় অতিথি হিসাবে যােগ দিয়ে সভা শুরু হওয়ার আগে বিচারপতি চৌধুরী এক সংক্ষিপ্ত ভাষণে “সংগ্রামী বাংলার দৃঢ় প্রত্যয়ের বাণী” সদস্যদের কাছে পৌঁছে দেন। রােটারী ক্লাবের সভার পর নরওয়ের পার্লামেন্ট ভবনে গিয়ে পার্লামেন্টের আন্তর্জাতিক কমিটির সদস্যদের। সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতার দাবি সম্পর্কে আলােচনা করেন। এরপর তিনি অসলাে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ডীন-এর সঙ্গে দেখা করেন। কিছুকাল আগে মুজিবনগর সরকার গণহত্যা” সম্পর্কে প্রামাণ্য রিপাের্ট প্রণয়নের। উদ্দেশ্যে একটি আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনাল গঠনের জন্য বিচারপতি চৌধুরীকে ব্যবস্থা করার অনুরােধ জানায়। তিনি আইন বিভাগের ডীন-কে প্রস্তাবিত ট্রাইবুনালের সদস্যপদ গ্রহণ করার অনুরােধ জানান। তিনি (আইন বিভাগের ডীন) এই প্রস্তাবে রাজী হন। কিন্তু ট্রাইবুনাল গঠিত হওয়ার আগেই বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে।
৩রা সেপ্টেম্বর বিকেলবেলা বিচারপতি চৌধুরী অস্লাের মেয়রের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানান। সেদিন বিকেলবেলা নরওয়ের পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী স্টলটেনবার্গ বিচারপতি চৌধুরীকে আনুষ্ঠানিকভাবে সাদর অভ্যর্থনা জানান। মি: স্টলটেনবার্গ বলেন, স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশসমূহের পররাষ্ট্র মন্ত্রীদের আসন্ন সম্মেলনে নরওয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন জানিয়ে বিবৃতি পেশ করবে।
৬ই সেপ্টেম্বর সকালবেলা এক সাংবাদিক সম্মেলনে বিচারপতি চৌধুরী বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের উদ্দেশ্য ও বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পেশ করেন। পরদিন নরওয়ের সবগুলি সংবাদপত্রে তাঁর বক্তব্য গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হয়। সন্ধ্যাবেলা অসলাে বিশ্ববিদ্যালয়ের মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এক ছাত্র-সমাবেশে আমন্ত্রিত হয়ে বিচারপতি চৌধুরী বক্তৃতা করেন। নরওয়ের একজন বিখ্যাত শিল্পীর আঁকা একটি ব্যঙ্গচিত্র ছাত্র ইউনিয়ান পােস্টার হিসাবে ব্যবহার। করে। এই ব্যঙ্গচিত্রে ইয়াহিয়া খানকে নরহত্যাকারী দৈত্যরূপে চিত্রিত করা হয়। সমবেত ছাত্ররা বিচারপতি চৌধুরীকে উষ্ণ অভিনন্দন জানিয়ে বাংলাদেশ আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করে। (বিচারপতি চৌধুরীর স্মৃতিকথা, “প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি”।)
৭ই সেপ্টেম্বর বিচারপতি চৌধুরী অসলাে থেকে সুইডেনের রাজধানী স্টকহােম রওয়ানা হন। সুইডেনে নিয়ােজিত পাকিস্তানের প্রাক্তন কূটনৈতিক
৯১
অফিসার আবদুর রাজ্জাক বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তিনি “মুজিবনগর সরকারের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করেন।
স্টকহােমে পৌছানাের দু’ঘন্টা পর বিচারপতি চৌধুরী নােবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক গুণার মীরডালের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বাংলাদেশ আন্দোলনের আদর্শ ও উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করার পর বিচারপতি চৌধুরী অধ্যাপক মীরডালকে স্থানীয় বাংলাদেশ এ্যাকশান কমিটির চেয়ারম্যানের পদ গ্রহণ করার জন্য অনুরােধ করেন। তিনি সানন্দে রাজী হন। সেদিন বিকেলবেলা আবুদর রাজ্জাক ও রাজিউল হাসান রঞ্জুকে সঙ্গে নিয়ে বিচারপতি চৌধুরী সুইডিস সােস্যালিস্ট ডেমােক্রেটিক পার্টির সেক্রেটারী-জেনারেল স্টেন্ এ্যাভারসেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে বিচারপতি চৌধুরীর ব্যাখ্যা শােনার পর মি: এ্যান্ডারসেন বলেন, তার পার্টির সমর্থন জানিয়ে শুধু একটি প্রস্তাব পাশ করিয়ে তিনি সন্তুষ্ট হবেন না। বাংলাদেশকে সত্যিকারের সাহায্য করতে হলে মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য অস্ত্র সরবরাহ করতে হবে। তাদের পার্টির মাধ্যমে অস্ত্র সরবরাহের চেষ্টা করবেন বলে তিনি আশ্বাস দেন। এরপর বিচারপতি চৌধুরী পররাষ্ট্র মন্ত্রী ক্যালবার্গ এবং প্রধানমন্ত্রীর প্রিন্সিপাল সেক্রেটারী পিয়ের শশারীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। প্রধানমন্ত্রী তখন সুইডেনে ছিলেন না।
৮ই সেপ্টেম্বর সকালবেলা বিচারপতি চৌধুরী সুপ্রীম কোর্টের অস্থায়ী প্রধান বিচারপতি মিসেস ইনগ্রিড় গার্ডেওয়াইমারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বিকেলবেলা তিনি সুইডিস পার্লামেন্ট হাউসে গিয়ে লিবারেল পার্টির চীফ হুইপ ইয়ান স্টিফেনসেনের সঙ্গে বাংলাদেশ সংগ্রাম সম্পর্কে আলােচনা করেন। তার পার্টি বাংলাদেশকে সমর্থন করবে বলে তিনি আশ্বাস দেন। অতঃপর বিচারপতি চৌধুরী সুইডেনের খ্যাতনামা সাংবাদিক এবং এক্সপ্রেসেন ইভনিং ডেইলী” পত্রিকার সম্পাদক টমাস হামানবার্গের সঙ্গে বাংলাদেশ আন্দোলন সম্পর্কে আলােচনা করেন। তিনি বাংলাদেশকে সমর্থন করবেন বলে বিচারপতি চৌধুরীকে আশ্বাস দেন।
৯ই সেপ্টেম্বর সকালবেলা “সভেনেস্কা ডাগ ব্লডেট” বিচারপতি চৌধুরীর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে। বিকেলবেলা একটি জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বাংলাদেশ পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেন। সুইডেনের প্রত্যেকটি উল্লেখযােগ্য পত্রিকার প্রতিনিধি এই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।
১০ই সেপ্টেম্বর বিচারপতি চৌধুরী এ্যাফট ব্লডেট” পত্রিকার খ্যাতনামা সাংবাদিক ফ্রেডারিকসেনের সঙ্গে বাংলাদেশ আন্দোলন সম্পর্কে আলােচনা করেন। তিনি স্থানীয় বাংলাদেশ এ্যাকশান কমিটির সঙ্গে একযােগে কাজ করবেন বলে আশ্বাস দেন।
৯২
সইডেন ত্যাগ করার আগে বিচারপতি চৌধুরী আবদুর রাজ্জাককে সুইডেনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করার দায়িত্ব অর্পণের জন্য মুজিবনগর সরকারকে পত্রযােগে অনুরােধ জানান।
১৩ই সেপ্টেম্বর সকালবেলা বিমানযােগে বিচারপতি চৌধুরী সুইডেন থেকে ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিঙ্কিতে পৌছান। তাঁর সঙ্গে ছিলেন রাজিউল হাসান রঞ্জ। হেলসিঙ্কিতে নিয়ােজিত ব্রিটিশ কাল রয় ফক্স বিমানবন্দরে বিচারপতি চৌধুরীকে অভ্যর্থনা জানান। বিকেলবেলা তিনি বিশ্ব শান্তি পরিষদের সেক্রেটারীজেনারেল রমেশ চন্দের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। রমেশ চন্দ তাঁর সহকর্মীদের সঙ্গে বিচারপতি চৌধুরীকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পর তার অফিসে বসেই হেলসিঙ্কির কর্মসূচী তৈরি করা হয় ।
পরদিন সকালবেলা বিচারপতি চৌধুরীর হােটেলে এসে ফিনিস টেলিভিশন তাঁর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে। বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরদানকালে তিনি বাংলাদেশের মুক্তি-সংগ্রামের উদ্দেশ্য ও বর্তমান পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেন। বিকেলবেলা স্থানীয় ছাত্রদের এক সভায় তিনি বক্তৃতা করেন। তারপর পার্লামেন্ট ভবনে গিয়ে কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে বাংলাদেশ সম্পর্কে আলােচনা করেন। এদের মধ্যে একজনের কয়েক দিনের মধ্যেই ফিনল্যান্ডের প্রতিনিধি হিসাবে জাতি সংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যােগ দেবার কথা। তিনি ফিনল্যান্ড সরকারকে বাংলাদেশের সংগ্রাম সম্পর্কে অবহিত করা এবং জাতি সংঘে বাংলাদেশকে সমর্থন করার আশ্বাস দেন। এরপর পররাষ্ট্র দপ্তরের জনৈক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বিচারপতি চৌধুরীকে অভ্যর্থনা জানান। তিনি বিচারপতিকে বলেন, বাংলাদেশ আন্দোলনের ব্যাপকতা ও গুরুত্ব সম্পর্কে ফিল্যান্ড সরকার সজাগ রয়েছে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে বাংলাদেশ নিঃসন্দেহে ফিনল্যান্ডের সাহায্য আশা করতে পারে। সন্ধ্যাবেলা হেলসিঙ্কি ত্যাগ করার আগে বিচারপতি চৌধুরী ফিনল্যান্ডের বিখ্যাত সংবাদপত্র “সুয়ােম্যান সােসিয়ালী ডেমােক্রাত”-এর সম্পাদক এবং সুপ্রীম কোর্টের জজ ও মানবাধিকার কমিশনের সদস্য ভ্যাটিসারিয়াের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাঁরা বাংলাদেশ আন্দোলনকে যথাসম্ভব সাহায্যদানের আশ্বাস দেন। (বিচারপতি চৌধুরীর স্মৃতিকথা, “প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি”।)
১৪ই সেপ্টেম্বর সন্ধ্যাবেলা বিচারপতি চৌধুরী ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহাগেন পৌছান। বিমানবন্দরে মতিউর রহমান এবং লিয়াকত হােসেনসহ কয়েকজন বাঙালী কর্মী তাকে অভ্যর্থনা জানান। বাংলাদেশ আন্দোলনের উৎসাহী ‘৭ মাম ক্রিশ্চিয়ানসেন নামের এক বয়ােরদ্ধা ডেনিস মহিলার বাড়িতে বিচারপতি চৌধুরী ও রাজিউল হাসান রঞ্জর থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
৯৩
পরদিন সকালবেলা বিচারপতি চৌধুরী ডেনমার্কের বহুল প্রচারিত সংবাদপত্র “ইনফরমেশান অফিসে গিয়ে সম্পাদক নিয়েলসেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ইতােমধ্যে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন করে কয়েকটি সম্পাদকীয় নিবন্ধ লিখেছেন। তিনি বিচারপতি চৌধুরীকে বলেন, বাংলাদেশের জনগণ পাকিস্তানকে প্রত্যাখ্যান করেছে—একথা ডেনমার্কবাসী উপলব্ধি করে। এরপর তিনি পার্লামেন্ট ভবনে গিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সদস্যদের সঙ্গে বাংলাদেশ সম্পর্কে আলােচনা করেন। পার্লামেন্ট ভবন থেকে তিনি টি-ভি স্টেশানে যান। সাক্ষাৎকার যিনি পরিচালনা করছিলেন তিনি রেকর্ডিং শুরু হওয়ার আগে বিচারপতিকে বলেন, পাকিস্তান সরকার ডেনমার্কের এক অস্ত্র ব্যবসায়ীকে অস্ত্র সরবরাহের অনুরােধ জানিয়েছে। সাক্ষাৎকার কালে এ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করার উদ্দেশ্যে ডেনিস সরকারের কাছে আবেদন জানাবার জন্য তিনি বিচারপতি চৌধুরীকে পরামর্শ দেন। সাক্ষাৎকার কালে অস্ত্র সরবরাহ সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তরে বিচারপতি চৌধুরী বলেন, গণতন্ত্রে অটল বিশ্বাসী ডেনমার্ক কখনও পাকিস্তান হানাদার-বাহিনীর স্বৈরশাসন চিরস্থায়ী। করার উদ্দেশ্যে অস্ত্র সরবরাহ করবে না বলে তিনি আশা করেন। স্থানীয় বাংলাদেশ এ্যাকশান কমিটি টিভি সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করেছিল। এ্যাকশান কমিটির আহ্বায়িকা কিস্টেন ওয়েস্টগার্ড একজন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ। ২৫শে মার্চ তিনি ঢাকায় উপস্থিত ছিলেন। সে দিনের হত্যাকাণ্ড তিনি নিজের চোখে দেখেছেন। টিভি স্টেশান থেকে বিচারপতি চৌধুরী পুনরায় পার্লামেন্ট ভবনে গিয়ে স্পীকার এবং বৈদেশিক কমিটির সদস্যদের সঙ্গে পৃথকভাবে সাক্ষাৎ করেন। বৈদেশিক কমিটির সভাপতি কিয়েল অসেন বাংলাদেশকে সর্বপ্রকার সাহায্যদানের আশ্বাস দেন। এঁদের সমবেত চেষ্টার ফলে পাকিস্তানকে অস্ত্র। সরবরাহ করার জন্য যে কয়েকটি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান চুক্তি সম্পাদন করেছিল, তারা যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে।
১৬ই ডিসেম্বার বিচারপতি চৌধুরী জাতি সংঘের আসন্ন অধিবেশনে যােগদানের জন্য মনােনীত ডেনিস প্রতিনিধি দলের নেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি জাতি সংঘে অন্যান্য দেশের প্রতিনিধিদের নিকট বাংলাদেশ পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করবেন এবং আন্দোলনের পক্ষে জনমত গঠনে সহায়তা করবেন বলে বিচারপতি চৌধুরীকে আশ্বাস দেন। সেদিন বিকেলবেলা স্থানীয় এ্যকশান কমিটি ও কয়েকজন উৎসাহী বাঙালীর উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে বিচারপতি চৌধুরী বাংলাদেশ আন্দোলন সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। সন্ধ্যাবেলা তিনি কোপেনহাগেন থেকে বিমানযােগে লন্ডনের পথে রওয়ানা হন।
৯৪
১৩. ব্রিটিশ এম পি-দের সমর্থন
পূর্ব বঙ্গে গণহত্যা শুরু হওয়ার পর সর্বপ্রথম যে জনসভায় ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য এবং ইংরেজ বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক কর্মীরা যােগদান করেন, তা হলাে হ্যামড়ে টাউন হল-এ অনুষ্ঠিত সভা। ৪ঠা এপ্রিল তারিখে অনুষ্ঠিত এই সভায় যারা সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন লর্ড ব্রকওয়ে, জন এ্যানালস এবং দু’জন শ্রমিকদলীয় পার্লামেন্ট সদস্য—পিটার শাের ও মাইকেল বার্নস। এই সভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে মাইকেল বার্নাস বলেন, শরণার্থীদের সাহায্যদানের ব্যাপারে। সময় অপচয় করার আগেই পূর্ব বঙ্গ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান বাঞ্ছনীয়। | ৬ই এপ্রিল সকালবেলা জানা গেল, ৫ই এপ্রিল দিবাগত রাত্রে কয়েকজন পার্লামেন্ট সদস্য পূর্ব বঙ্গে গৃহযুদ্ধ বন্ধ করার উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকারকে প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরােধ জানিয়ে পার্লামেন্টে একটি জরুরী প্রস্তাব পেশ করেছেন। এদের মধ্যে ক্রস ডগলাস-ম্যান, ফ্রাঙ্ক জাড়, নাইজেল ফিশার, এরিক হেফার এবং জন পার্ডোর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। বিকেলবেলা পররাষ্ট্র মন্ত্রী স্যার আলেক ডগলাস্ হিউম পার্লামেন্টে পূর্ব বঙ্গ সমস্যা সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য পেশ করবেন। ৬ই তারিখের মধ্যে ১৬০জনেরও বেশি পার্লামেন্ট সদস্য এই প্রস্তাব সমর্থন করেন।
স্যার আলেকের বক্তব্য বাংলাদেশ আন্দোলনের সমর্থকদের কিছুটা নিরাশ করে। তিনি বলেন, রাজনৈতিক মতবিরােধ আলাপ-আলােচনার মাধ্যমে দূর করা বাঞ্ছনীয় বলে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ইতঃপূর্বে জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে জানিয়েছেন। আলােচনা ভেঙ্গে যাওয়ার পর সামরিক বলপ্রয়ােগ করার জন্য তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন এবং সংঘাত বন্ধ করে পুনরায় আলােচনা শুরু করার আবেদন জানান।
শ্রমিক দলের পক্ষ থেকে ডেনিস হীলি পূর্ব বাংলার জনসাধারণের কথা মনে রেখে শান্তিপূর্ণভাবে রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে পাকিস্তান সরকারের ওপর চাপ প্রয়ােগ করার জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রীর মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকারের কাছে অনুরােধ জানান।
৯৫
(মূল বইয়ের ৯৬ নম্বর পৃষ্ঠা অস্পষ্ট)
পর্যবসিত হবে। এর ফলে লক্ষ লক্ষ লােক খাদ্যাভাবে, মহামারী ও বুলেটের আঘাতে মৃত্যু বরণ করবে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ব্রিটেনের যে প্রভাব রয়েছে, তা প্রয়ােগ করে পাকিস্তানকে তাদের সৈন্যবাহিনী প্রত্যাহার করতে বাধ্য করা ব্রিটিশ সরকারের কর্তব্য।
তিনি আশা করেন, বিশ্ব ব্যাঙ্ক ও আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল থেকে পাকিস্তানকে সাহায্যদান বন্ধ রাখার জন্য ব্রিটিশ সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। ইতােমধ্যে পাকিস্তানের অর্থনীতিতে গুরুতর সঙ্কট দেখা দিয়েছে। যুদ্ধ বাবদ পাকিস্তানকে দৈনিক দশ লক্ষ পাউন্ড খরচ করতে হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে যুদ্ধের অবসান ঘােষণা না করা পর্যন্ত পাকিস্তানকে কোনও প্রকার সাহায্য না দেওয়ার জন্য তিনি ব্রিটিশ সরকারের কাছে দাবি জানান।
বৈদেশিক উন্নয়ন দপ্তরের মন্ত্রী রিচার্ড উড় বলেন, পূর্ব বঙ্গে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা চালাতে হবে। কিন্তু বৈদেশিক সাহায্যদান বন্ধ রেখে সমস্যার সমাধান সম্ভব নয় বলে তিনি মনে করেন।
তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবকে পূর্ব বঙ্গে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে যে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, তা যাচাই করা সম্ভব হয়নি। সর্বশেষ সংবাদে প্রকাশ, তাঁকে পশ্চিম পাকিস্তানে বন্দী করে রাখা হয়েছে এবং সম্ভবতঃ তাঁর বিচারের ব্যবস্থা করা হবে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীহ্ ব্যক্তিগতভাবে গােপন আলােচনা করেছেন বলে মি; উড় প্রকাশ করেন। আলােচনা কালে মি: হীহ্ পূর্ব বাংলা সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের পরামর্শ দেন।
শ্রমিক দলের নেতৃস্থানীয় সদস্য ডেনিস হীলি বলেন, পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবের বিচারের ব্যবস্থা করবে না বলে তিনি আশা করেন। যদি তা করা হয়, তা’ হলে পূর্ব বঙ্গ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। জনগণের। আশা-আকাঙক্ষা অনুযায়ী শীঘ্রই রাজনৈতিক সমাধানের উদ্যোগ যদি গ্রহণ না করা হয়, তা হলে ভারত ও পাকিস্তানের প্রত্যক্ষ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা। রয়েছে। ইতােমধ্যে রাশিয়া ও চীন যথাক্রমে ভারত ও পাকিস্তানের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেছে। এই পরিস্থিতিতে সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শান্তি ব্যাহত হওয়ার বাস্তব সম্ভাবনা রয়েছে।
উদারনৈতিক দলের সদস্য জন পার্ডো বলেন, বাংলাদেশ সমস্যার ব্যাপারে ব্রিটেন, কমনওয়েলথ ও জাতি সংঘ নিজেদের হীনবল বলে প্রমাণ করেছে। মনােবলের অভাবে তারা নৈতিক চাপ প্রদানে ব্যর্থ হয়েছে।
৯৮
শ্রমিক দলীয় সদস্য মি: স্টোনহাউস বলেন, পূর্ব বঙ্গের জনগণ পূর্ণ স্বাধীনতা চায় কিনা, তা যাচাই করার জন্য জাতি সংঘের তত্ত্বাবধানে পূর্ব বঙ্গে একটি গণভােট গ্রহণ করা উচিত। এক হাজার মাইল দূরে অবস্থিত পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষে সাড়ে-সাত কোটি বাঙালীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে পূর্ব বঙ্গে তাদের শাসন চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব বলে তিনি মন্তব্য করেন।
আলােচনার উপসংহারে মি: উড় বলেন, পূর্ব বঙ্গে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে ব্রিটিশ সরকার পাকিস্তান সরকারকে সাহায্য করবে। কিন্তু উন্নয়ন সাহায্য বন্ধ করে পূর্ব বঙ্গ সমস্যা সমাধানের জন্য পাকিস্তানের ওপর চাপ প্রয়ােগ করার ব্যাপারে ব্রিটিশ সরকার রাজী নয়। তা সত্ত্বেও তিনি মি: ডগলাস-ম্যান এর প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভােট দেওয়ার জন্য পরামর্শ দিচ্ছেন না। কারণ, তা অন্যায় হবে বলে তিনি মনে করেন।
শেষ পর্যন্ত সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাবটি গৃহীত হয় ।(১৪)
৯ই জুন পার্লামেন্টের অধিবেশন কালে মিসেস জুডিথ হার্ট বাংলাদেশের জন্য বরাদ্দ ২০ লক্ষ পাউন্ড অপর্যাপ্ত বলে মন্তব্য করেন। শ্রমিক দলের পক্ষ থেকে তিনি আর্থিক সাহায্যের পরিমাণ বৃদ্ধি করার দাবি জানান। বিরােধীদলের নেতা হ্যান্ড উইলসন বাংলাদেশ পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনা করে অবিলম্বে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান। তিনি বাংলাদেশের হত্যাযজ্ঞকে গত মহাযুদ্ধের পর সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা বলে উল্লেখ করেন।
বিরােধীদলের দাবি মেনে নিয়ে পররাষ্ট্র সচিব স্যার আলেক ডগলাস-হিউম ১০ই জুন পার্লামেন্টে পাকিস্তান সম্পর্কে বিশেষ বিতর্ক অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত ঘােষণা করেন। চার-ঘন্টাব্যাপী বিতর্ক কালে স্যার আলেক বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের প্রয়ােজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন। শেষ পর্যন্ত তিনি শরণার্থীদের সাহায্য বাবদ ব্রিটিশ সরকারের দান সীমাবদ্ধ থাকবে না বলে আশ্বাস দেন। বিতর্কে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ছিলেন মিসেস জুডিথ হার্ট, জন স্টোনহাউস, পিটার শাের, ক্রস ডগলাসূ-ম্যান, রিচার্ড উড়, ডেভিড লেইন ও জর্জ টসন।
১৫ই জুন ১২০জন শ্রমিক দলীয় সদস্য ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি প্রস্তাব পেশ করেন। এই প্রস্তাবে পূর্ব বঙ্গে গণহত্যা সংঘটনের জন্য পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও সামরিক নেতৃবৃন্দকে দায়ী করা হয়। ডাক ও তার
যােগ দপ্তরের প্রাক্তন মন্ত্রী জন স্টোনহাউস উথাপিত এই প্রস্তাব সমর্থন করে যারা দস্তবত দেন তাদের মধ্যে দুজন প্রিভি কাউন্সিলার, শ্রমিক দলের চেয়ারম্যান ২য়ান মিকার্ডো এবং কার্যকরী পরিষদের তিনজন সদস্য ছিলেন। কয়েক দিনের মধ্যে প্রস্তাবটি তিন শ’র বেশি পার্লামেন্ট সদস্যের সমর্থন লাভ করে।
৯৯
এক সাংবাদিক সাক্ষাৎকারে মি: স্টোনহাউস বলেন: “জেনােসাইড তেনশান”-এ স্বাক্ষরকারী দেশ হিসাবে ব্রিটেন গণতন্ত্রের প্রশ্ন উত্থাপন করে পাকিস্তান ও তার নেতৃবৃন্দকে গণহত্যার জন্য দায়ী বলে ঘােষণা করার দাবি জানাতে পারে। (“দি টাইমস্” ও “দি গার্ডিয়ান, ১৬ই জুন, ১৯৭১)
পার্লামেন্টে উত্থাপিত অপর এক প্রস্তাবে বলা হয়, পূর্ব বঙ্গে উপযুক্ত রাজনৈতিক কাঠামাে গঠিত না হওয়া পর্যন্ত পাকিস্তানকে বৈদেশিক সাহায্যদান স্থগিত রাখা বাঞ্চনীয়। দুশ’ পঞ্চাশজনেরও বেশি পার্লামেন্ট সদস্য প্রস্তাবটি সমর্থন করেন।
২১শে জুন একটি সর্বদলীয় পার্লামেন্টারী প্রতিনিধিদল ভারত ও পূর্ব বঙ্গ সফরের উদেশ্যে লন্ডন ত্যাগ করেন। বিরােধীদলের নেতা হ্যারল্ড উইলসন ও শ্রমিক দলীয় দস্য পিটার শাের-এর উদ্যোগে এই প্রতিনিধিদল পাঠানাে সম্ভব হয়। এদের মধ্যে ছিলেন টোরী দলের জেমস্ র্যামডেন ও টোবী জ্যাসেল এবং শ্রমিক দলের তার বটমলী ও রেজ প্রেন্টিস্।
মি: বটলী ও তাঁর সহকর্মীরা পূর্ব বঙ্গে চার দিন সফরের পর ২৮শে জুন কলকাতা পৌছান। সেখান থেকে বনগাও গিয়ে কয়েকটি শরণার্থী শিবির ও স্থানীয় হাসপাতালের কলেরা ওয়ার্ড পরিদর্শন করেন। কংক্রিটের নােংরা মেঝের ওপর বিভিন্ন বয়সের কলেরা-রােগী এবং দরজার কাছে একটি ছােট মেয়ের বিবস্ত্র মৃতদেহ তারা দেখতে পান।
স্থানীয় জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পার্লামেন্ট সদস্যদের বলেন, গত দু’তিন দিন যাবৎ দৈনিক প্রায় ৯০ হাজার লােক বনগাঁও এলাকায় সীমান্ত পার হয়ে পশ্চিম বাংলায় আশ্রয় গ্রহণ করছে। ইতােমধ্যে ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারীদের সংখ্যা ৫৪ লক্ষে দাঁড়িয়েছে বলে অনুমান করা হয়।
টোবী জ্যাসেল কলকাতায় প্রদত্ত এক বিবৃতিতে বলেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্ব বঙ্গে হিন্দু অধ্যুষিত বহু গ্রাম নির্বিচারে ধ্বংস করেছে। এ সম্বন্ধে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।
রেজ প্রেন্টিস্ দিল্লীতে সাংবাদিকদের সঙ্গে পূর্ব বঙ্গ সমস্যা সম্পর্কে আলাপ কালে বলেন, কেবল রাজনৈতিক সমাধানের মাধ্যমেই শান্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব । পূর্ব বঙ্গ থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলােচনা করে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। (“দি টাইমস” ২রা জুলাই, ১৯৭১)
ভারতীয় পার্লামেন্ট সদস্য ও সাংবাদিকদের এক সভায় বক্তৃতাদান কালে মি: বটমূলী পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টকে সাবধান করে দিয়ে বলেন, পূর্ব বঙ্গে আরও
১০০
একটি ভিয়েতনাম” সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। পূর্ব বঙ্গ সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য উদ্যোগী না হলে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট তার ফলাফলের জন্য দায়ী থাকবেন বলে তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যাকে বিশ্বের একটি চরম দুঃখজনক ঘটনা বলে উল্লেখ করে মি: বটমূলী বলেন, লন্ডনে ফিরে গিয়ে পূর্ব বঙ্গ সফর কালে তিনি স্বচক্ষে যা দেখেছেন, তার যথাযথ বিবরণ তাঁর পার্লামেন্টারী সহকর্মীদের নিকট পেশ করবেন। (“দি গার্ডিয়ান” ২রা জুলাই, ১৯৭১)
পার্লামেন্টারী প্রতিনিধিদলের বক্তব্য ব্রিটেনের রেডিয়াে, টি-ভি ও সংবাদপত্রের মাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। ৫ই জুলাই ইসলামাবাদে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাই কমিশনারের নিকট প্রদত্ত এক কূটনৈতিক পত্রে পাকিস্তান সরকার ব্রিটিশ পার্লামেন্ট, সংবাদপত্র এবং বি বি সি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা চালাচ্ছে বলে অভিযােগ করে। এই কূটনৈতিক পত্র ব্রিটেন উপেক্ষা করে বলে ওয়াকেবহাল মহল মনে করেন।
স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের দাবিতে ১লা অগাস্ট লন্ডনের ট্রাফালগার স্কোয়ারে এক বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বক্তৃতাদানকারীদের মধ্যে ছিলেন লর্ড ব্রকওয়ে, পিটার শাের, রেজ প্রেন্টিস, ক্ৰ ডগলাস-ম্যান,জন স্টোন হাউস এবং লর্ড ও লেডী গিফোর্ড।
জনসভায় বক্তৃতা উপলক্ষে জন স্টোনহাউস, এম পি বলেন, বাংলাদেশে পাকিস্তানী হত্যাযজ্ঞ হিটলারের আমলে সংঘটিত ঘটনার মতই ভয়াবহ। কিছুদিন আগে তিনি কলকাতা ও পশ্চিম বঙ্গের বিভিন্ন এলাকায় শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করে দুর্গতদের অবস্থা নিজের চোখে দেখে এসেছেন।
পাকিস্তান সরকারের কারাগারে বঙ্গবন্ধুর বিচার প্রহসনের কথা উল্লেখ করে মি: স্টোনহাউস বলেন, “মুজিবনগর সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী বঙ্গবন্ধুর পক্ষ সমর্থন করার জন্য আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সন্ ম্যাকব্রাইড জনৈক সলিসিটারকে সঙ্গে নিয়ে পাকিস্তানে গিয়েছিলেন। কিন্তু পাকিস্তান সরকার তাকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষ সমর্থন করার অনুমতি দিতে অস্বীকার করে। এমন কি বিচারকক্ষে উপস্থিত থাকার আবেদনও প্রত্যাখ্যান করা হয়। | বঙ্গবন্ধুর পক্ষ সমর্থন করার জন্য পাকিস্তান সরকার বিচারপতি চৌধুরীকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে বলে মি: স্টোনহাউস জানতে পেরেছেন বলে প্রকাশ করেন। এই আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করার জন্য তিনি বিচারপতি চৌধুরীকে অনুরােধ জানিয়েছেন। পাকিস্তানে তার শারীরিক নিরাপত্তা বিপন্ন হবে বলে মি: স্টোনহাউস আশঙ্কা প্রকাশ করেন। তিনি অবিলম্বে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দাবি করেন।
১০১
লর্ড ব্রকওয়ে বলেন, বাংলাদেশ সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে সিকিউরিটি কাউন্সিলের জরুরী বৈঠক অনুষ্ঠানের জন্য ব্রিটিশ সরকারের আহ্বান জানানাে উচিত। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধের আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, অবিলম্বে আলােচনার মাধ্যমে এই সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান বাঞ্ছনীয়। এ ব্যাপারে তিনি বৃহৎ শক্তিবর্গের নিষ্ক্রিয়তার সমালােচনা করেন।
রেজ প্রেন্টিস্ এম পি বলেন, বাংলাদেশকে অবিলম্বে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন করবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
২রা সেপ্টেম্বর এক সাংবাদিক সাক্ষাৎকারে ব্রিটিশ শ্রমিকদলের প্রভাবশালী পার্লামেন্ট সদস্য পিটার শাের (বর্তমানে লর্ড শাের) বলেন, পাকিস্তানকে উন্নয়ন কণ এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক সাহায্যদান বন্ধ রাখার জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রী স্যার আলেক ডগলাস্-হিউম-এর নিকট তিনি একটি প্রস্তাব পেশ করেছেন।
মি: শাের দিলী ও পশ্চিম পাকিস্তানে এক-সপ্তাহ-কাল সফর শেষে সম্প্রতি লভনে ফিরে এসেছেন। বিশপ ট্রেভর হাডলস্টোনের সঙ্গে যুক্তভাবে তিনি এই প্রস্তাব পেশ করেছেন। পূর্ব বঙ্গের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছে বলে স্বীকার করতে বাধ্য করার উদ্দেশ্যে এই প্রস্তাব পেশ করা হয়।
মি: শাের আরও বলেন, পাকিস্তান দু’ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছে এই কঠোর সত্য স্বীকার করতে হবে। পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময় উভয় অংশের মধ্যে ভৌগােলিক দূরত্ব ছিল এক হাজার মাইল। বর্তমানে উভয় অংশের রাজনৈতিক লক্ষ্যের মধ্যেও সমপরিমাণ দূরত্ব বিরাজমান। ইতঃপূর্বে বিদ্যমান বন্ধন চুরমার হয়ে গিয়েছে। (“দি টাইমস, ৩রা সেপ্টেম্বর, ১৯৭১)
৭ই অক্টোবর ব্রাইটনে অনুষ্ঠিত শ্রমিকদলের বার্ষিক সম্মেলনে গৃহীত এক প্রস্তাবে বাংলাদেশের শােকাবহ পরিস্থিতির জন্য পাকিস্তান সরকারকে দায়ী করা হয় । কার্যকরী পরিষদের পক্ষ থেকে পার্লামেন্ট সদস্য ও শ্রমিকদলের চেয়ারম্যান ইয়ান মিকার্ডো এই প্রস্তাব পেশ করেন।
জাতি সংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে অবিলম্বে আলােচনা অনুষ্ঠানের ব্যাপারে উদ্যোগী হওয়ার জন্য শ্রমিক দল ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানায়। প্রস্তাবের সমর্থনে জুডিপ্ হার্ট, ক্ৰস্ ডগলাস-ম্যান, জন স্টোনহাউস এবং আরও কয়েকজন সদস্য বক্তৃতা করেন।
মিসেস হার্ট বলেন, বাংলাদেশে দুর্গতদের জন্য খাদ্য বিতরণের দায়িত্ব পাকিস্তান সৈন্যবাহিনীর পরিবর্তে জাতি সংঘের ওপর ন্যস্ত করতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশ সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য রাজনৈতিক সমাধান অপরিহার্য। তিনি
১০২
আরও বলেন, শেখ মুজিব ও অন্যান্য আওয়ামী লীগ নেতাকে মুক্তি দিয়ে তাদের সঙ্গে আলােচনার মাধ্যমেই বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান সব। (দি গার্ডিয়ান” ও “দি টাইমস্ ৮ই অক্টোবর, ১৯৭১)
ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিকে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ও পিপলস ডেমােক্রেটিক ফ্রন্ট অব বাংলাদেশের উদ্যোগে লন্ডনে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় বাংলাদেশ ও ভারতের বিরুদ্ধে সামরিক আক্রমণ পরিচালনার জন্য পাকিস্তানের সামরিক চক্রের তীব্র নিন্দা করা হয়।
এই সভায় বক্তৃতা উপলক্ষে লর্ড ব্রকওয়ে বলেন, এই যুদ্ধের জন্য সােভিয়েত ইউনিয়ন ছাড়া অন্যান্য বৃহৎ শক্তি বিশেষভাবে দায়ী। পূর্ব বঙ্গে সামরিক আক্রমণ চালিয়ে গণহত্যা শুরু করার পর তারা নিষ্ক্রিয় থাকার নীতি গ্রহণ করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের অধিকার মেনে নিয়ে বিদ্যমান সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের দাবি উত্থাপন করে সর্বাত্মক যুদ্ধজনিত বিপর্যয় এড়ানাে বৃহৎ শক্তিবর্গ ও জাতি সংঘের পক্ষে সম্ভব ছিল।
বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্ত এলাকা থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করার দাবি সম্বলিত একটি প্রস্তাব সভায় সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। (“মর্নিং স্টার, ৬ই ডিসেম্বর, ১৯৭১)
৬ই ডিসেম্বর ব্রিটিশ পার্লামেন্টের অধিবেশনে টোরীদলীয় সদস্য ডানকান্ স্যান্ড সিকিউরিটি কাউন্সিলে সােভিয়েত ইউনিয়ানের “ডিটো” প্রয়ােগ সম্পর্কে সমালােচনা করেন। শ্রমিকদলীয় সদস্যগণ তাঁর সােভিয়েত-বিরােধী মন্তব্যের তীব্র সমালােচনা করেন। এদের মধ্যে ক্রন্ স্টোনহাউসের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। সিকিউরিটি কাউন্সিলে উথাপিত মার্কিন প্রস্তাব সমর্থন করতে অস্বীকার করার জন্য তিনি ব্রিটিশ সরকারের প্রশংসা করেন। (“মনিং স্টার,”
ডিসেম্বর, ১৯৭১)
১৪. নেকটাই, ব্যাজ, পতাকা, ডাকটিকেট ও
বাংলাদেশ ফান্ড
স্টিয়ারিং কমিটি গঠিত হওয়ার কিছুকাল পর যুক্তরাজ্যের বাঙালীরা স্বাধীনতা আন্দোলনের সমর্থনসূচক ব্যাজ, নেকটাই, টি-শার্ট, বাংলাদেশের পতাকা এবং বিভিন্ন রকমের প্রতীক সম্বলিত জিনিসপত্র বিক্রি করতে শুরু করে। এদের মধ্যে কেউ কেউ ব্যক্তিগত স্বার্থে অর্থাৎ নিজের পকেট ভারী করার জন্য স্বাধীনতা আন্দোলনের সুযােগ গ্রহণ করে। তা ছাড়া কোনাে কোনাে জিনিসের ডিজাইন ছিল নিম্ন মানের এবং দাম রাখা হয়েছিল অত্যধিক। এই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি স্টিয়ারিং কমিটির দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে দীর্ঘ আলােচনার পর আমরা এই সিদ্ধান্তে পৌছাই-প্রবাসী বাঙালীদের স্বাধীনতা আন্দোলন সম্পর্কে সচেতন করার জন্য রুচিসম্মত ব্যাজ, নেকটাই, পতাকা ইত্যাদি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিতে হবে। স্টিয়ারিং কমিটির অনুমােদন ছাড়া কোনাে জিনিস বাজারে ছাড়া হলে তানা কেনার জন্য আমরা জনসাধারণকে অনুরােধ করলাম। ইতােমধ্যে বাজারে যেসব জিনিস পাওয়া যাচ্ছিল তার মধ্যে কয়েকটি ব্যাজ ও নেকটাই বিক্রি করার জন্য অনুমােদন দেওয়া হয়। অন্য কয়েকটি ব্যাজ ও রেকগনাইজ বাংলাদেশে” লেখা টি-শার্ট বিক্রি বন্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হয়।
বিভিন্ন এ্যাকশান কমিটির উদ্যোগে অনুষ্ঠিত জনসভায় যােগদানকারী প্রবাসী বাঙালী এবং সহানুভূতিসম্পন্ন ইংরেজ বাংলাদেশ আন্দোলনের সমর্থনসূচক জিনিসপত্র অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে সংগ্রহ করেন। ২৭শে জুন বার্মিংহামে অনুষ্ঠিত জনসভা উপলক্ষে স্থানীয় এ্যাকশান কমিটি সভাগৃহের এক দিকে কয়েকটি ছােট হােট দোকান খােলেন। এই দোকানগুলিতে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ সরকারের মনােগ্রাম” সম্বলিত নেকটাই, কাফলিঙ্ক ইত্যাদি বিক্রি করা হয়।
ব্রিটেনের প্রাক্তন পােস্টমাস্টার-জেনারেল (মন্ত্রী) জন স্টোনহাউস বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থীদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ এবং বাংলাদেশ সরকারের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে পরামর্শের জন্য ব্রিটিশ দাতব্য প্রতিষ্ঠান “ওয়ার অন ওয়ান্ট”-এর পক্ষ থেকে
১০৮
কয়েকবার “মুজিবনগর” সফর করেন। সেখানে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ ও অন্যান্য মন্ত্রীর সঙ্গে আলােচনা কালে বাংলাদেশের ডাকটিকেট প্রকাশনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এই ব্যাপারে জন স্টোনহাউস সরাসরি মুজিবনগর”-এর নির্দেশ অনুযায়ী তার দায়িত্ব পালন করেন।
২৬ শে জুলাই হাউস অব কমন্স-এর হারকোর্ট রুমে স্বাধীন বাংলাদেশের ৮টি ডাকটিকেট প্রকাশনা উপলক্ষে একটি অনুষ্ঠানের আয়ােজন করা হয়। পার্লামেন্টের সকল দলের নেতৃস্থানীয় সদস্য এবং প্রায় ৪০জন সাংবাদিকের উপস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি বিচারপতি চৌধুরী সদ্য প্রকাশিত ডাকটিকেটগুলি প্রদর্শন করেন।
দশ-পয়সার টিকেটে বাংলাদেশের মানচিত্র এবং পাঁচ-পয়সার টিকেটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি ব্যবহার করা হয়। বাঙালী গ্রাফিক-শিল্পী বিমান মল্লিক ডাকটিকেটগুলির নক্সা তৈরি করেন। বিদেশে চিঠিপত্র পাঠাবার জন্য ভারত সরকার টিকেটগুলি ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছেন বলে উদ্যোক্তারা প্রকাশ করেন। ২৯শে জুলাই থেকে ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, দূর প্রাচ্য এবং বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চলে টিকেটগুলি পাওয়া যাবে বলে তারা জানান। এ কথা বিনা দ্বিধায় বলা চলে, জন স্টোনহাউস উদ্যোগ গ্রহণ না করলে স্বাধীনতা সংগ্রাম কালে বাংলাদেশের ডাকটিকেট প্রকাশ করা সম্ভব হতাে না।
জন স্টোনহাউস, পিটার শাের, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দলীয় পরিষদ সদস্য আবদুল মান্নান এবং অন্যান্যের উপস্থিতিতে বিচারপতি চৌধুরী বলেন, ডাকটিকেটগুলির জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ বাংলাদেশের জন্য একটি উল্লেখযােগ্য পদক্ষেপ বলে গণ্য করা হবে।
বাংলাদেশ নামটি কি এক শব্দ, নাকি দু’শব্দ-বিশিষ্ট——এ সম্পর্কে একটি এতিহাসিক তথ্য উল্লেখ করা প্রয়ােজন। লন্ডনে প্রকাশিত ডাকটিকেটে বাংলাদেশ পাম দু’শব্দ হিসাবে দেখান হয়েছে। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর কিংবা অক্টোবর মাসে বাংলাদেশ নিজউলেটার”-এর প্রতিষ্ঠাতা তাসাদ্দুক আহমদ মুজিবনগর সকারের নিকট থেকে একটি ইংরেজী বুলেটিন পান। এই বুলেটিনের শীর্ষে ইংরেজিতে বাংলাদেশ নামটি “বাংলা” ও “দেশ” আলাদা করে ছাপানাে ছিল। তাসাদ্দুক সাহেব চিঠি লিখে তাদের জানালেন—দয়েচল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড প্রভৃতি দেশের নামের মতাে বাংলাদেশ নামটি এক শব্দ হওয়া উচিত।এই যুক্তি গৃহীত হওয়ার পর তাসাদুক সাহেব লন্ডনের দি টাইমস প্ত্রিকায় চিঠি লিখে বললেন, Bangla ও Desh শব্দ দুটি একসঙ্গে Bangladesh হিসাবে মজিবনগর সরকারের দলিলপত্রে ব্যবহার করা হচ্ছে।
১০৫
এ চিঠির সঙ্গে তিনি মুজিবনগর সরকারের লেটারহেড”-এর “ফ্যাক্সিমিলি” পাঠিয়েছিলেন। দি টাইমস.এ তাসাদ্দুক সাহেবের চিঠি প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদপত্রে বাংলাদেশ নামটি এক শব্দ হিসাবে গ্রহণ করা হয়।
৮ই মে গোরিং স্ট্রীটের অফিসে সমগ্র যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন এ্যাকশান কমিটির প্রেসিডেন্ট ও সেক্রেটারীদের এক জরুরী সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সর্বসম্মতিক্রমে বাংলাদেশ আন্দোলন পরিচালনার জন্য “বাংলাদেশ ফান্ড” নামের একটি তহবিল গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় । তহবিল পরিচালনার জন্য “ বাের্ড অব ট্রাস্টি” গঠনের ব্যাপারে জটিলতা দেখা দেয়। বিচারপতি চৌধুরী প্রথমে “বাের্ড অব ট্রাস্টি”-র দস্য হতে রাজী হননি। দীর্ঘ আলাপ-আলােচনার পর বিচারপতি চৌধুরী, ডেনান্ড চেস্ওয়ার্থ (“ওয়ার অন্ ওয়ান্ট”-এর চেয়ারম্যান) ও শ্রমিক দলীয় পর্নমেন্ট সদস্য জন স্টোনহাউসকে সদস্য মনােনীত করে “বাের্ড অব ট্রাস্টি” গঠন করা হয় তখন সিদ্ধান্ত করা হয়, ফান্ডের জন্য প্রাপ্ত অর্থ ব্যাঙ্কে জমা দেওয়া হবে এবং এজন মতাে বিচারপতি চৌধুরী ও অন্য একজন সদস্যের দস্তখতে “চেক” মধ্য থেকে অর্থ তুলতে হবে। অর্থাৎ বিচারপতি চৌধুরীর দস্তখত চেকে থাকতেই হবে।
বাংলাদেশ তখনও পর্যন্ত স্বাধীন দেশ হিসাবে স্বীকৃতি না পাওয়ার ফলে কেনও ব্যাংক “বাংলাদেশ ফান্ড” নামে একাউন্ট খুলতে রাজী হয়নি। অনেক চেষ্টার পর হ্যামরােজ ব্যাঙ্ক নামের একটি মার্চেন্ট ব্যাঙ্ক একাউন্ট খুলতে রাজী হয়। কিছুকাল পর হ্যামরােজ ব্যাঙ্ক একাউন্টটি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বহু চেষ্টার পর বাের্ড অব ট্রাস্টি”-র সদস্যগণ ন্যাশনাল ওয়েস্টমিনস্টার ব্যাঙ্কে নতুন একাউন্ট খুলতে সক্ষম হন। বিচারপতি চৌধুরী তার স্মৃতিকথায় বলেন, পাকিস্তান দূতাবাসের প্রতিবাদের ফলে হ্যামরােজ ব্যাঙ্ক একাউন্ট বন্ধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল বলে তিনি পরবর্তীকালে জানতে পেরেছিলেন।
১৮ই মে এক্সিটার এ্যাকশান কমিটির প্রতিনিধিরা স্টিয়ারিং কমিটির অফিসে এসে নগদ পাঁচ হাজার পাউন্ড জমা দেন। পরের দিন তা’ “বাংলাদেশ ফান্ড”-এর একাউন্টে জমা দেওয়ার জন্য বিচারপতি চৌধুরী নির্দেশ দেন। এ যাবৎ এটাই ছিল সব চেয়ে বড় অঙ্কের চাঁদা। কিছুকাল পর বার্মিংহাম এ্যাকশান কমিটি নগদ ২৫ হাজার পাউন্ড বিচারপতি চৌধুরী ও আমার হাতে তুলে দেন। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ অবিলম্বে ব্যাঙ্কে জমা দেওয়া হয়।
যুদ্ধে ক্ষত্তি বাঙালীদের সাহায্যদান, মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য অস্ত্র ক্রয় এবং আনুষঙ্গিক ব্যয় নির্বাহের জন্য বাংলাদেশ এ্যাকশান কমিটিগুলির মাধ্যমে সংগৃহাত অর্থ বাংলাদেশ ফান্ড”-এ জমা হয়। তাছাড়া ইউরােপের বিভিন্ন দেশ ও
১০৬
মধ্যপ্রাচ্যে বসবাসকারী বাঙালীরা যে-অর্থ পাঠিয়েছেন, তাও বাংলাদেশ ফান্ড”এ জমা দেওয়া হয়। মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধিদের আমেরিকা ও ইউরােপের বিভিন্ন দেশে যাওয়ার পথে লন্ডনে অবস্থানের খরচ “বাংলাদেশ ফান্ড থেকে নেওয়া হয়। স্টিয়ারিং কমিটির সদস্যবৃন্দ এবং বাংলাদেশ ফান্ড”-এর টাবিন্দ, বিশেষ করে বিচারপতি চৌধুরী নিজে, ব্যক্তিগত খরচ বাবদ কোনও অর্থ গ্রহণ করেননি।
১৯৭২ সালের ২রা জানুয়ারী লন্ডনের হাইড পার্কে স্টিয়ারিং কমিটির উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় বিচারপতি চৌধুরী স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী প্রবাসী বাঙালী ও সমর্থনদানকারী ব্রিটিশ নাগরিকদের ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। এই উপলক্ষে তিনি “বাংলাদেশ ফাভ”-এর জন্য সংগৃহীত অর্থের সংক্ষিপ্ত বিবরণ পেশ করেন। তিনি বলেন, “আপনাদের প্রতিটি পাই-পয়সার হিসাব দেওয়া হবে।” ব্যক্তি বিশেষ এবং বিভিন্ন এ্যাকশান কমিটি সংগৃহীত অর্থের একটি বিরাট অংশ “বাংলাদেশ ফান্ড”-এ জমা দেওয়া হয়নি বলে তিনি প্রকাশ করেন। এই অর্থ শীঘ্রই জমা দেওয়ার জন্য তিনি অনুরােধ জানান।
আমার জানা মতে দু’টো এ্যাকশান কমিটি তাদের সংগৃহীত অর্থ “বাংলাদেশ ফান্ড”-এ জমা দেয়নি। এই দু’টো কমিটির মধ্যে একটি হচ্ছে হেভন কমিটি। অন্যটি হচ্ছে গাউস খানের নেতৃত্বে এলাহবাদ রেস্তোরকে কেন্দ্র করে গঠিত লন্ডন কমিটি। বৃহত্তর লন্ডন এলাকার ১৪টি এ্যাকশান কমিটি নিয়ে লন্ডন সেন্ট্রাল কমিটি গঠিত হয়েছিল। হেডন কমিটি ও লন্ডন কমিটি লন্ডন কেন্দ্রীয় কমিটির অঙ্গীভূত ছিল। কেন্দ্রীয় কমিটির প্রেসিডেন্ট ও সেক্রেটারী ছিলেন যথাক্রমে গাউস খান ও ব্যারিস্টার শাখাওয়াত হােসেন।
আমরা যখন স্টিয়ারিং কমিটির অফিস থেকে চাঁদা আদায়ের বই “ইসু করি তখন ১৪টি কমিটির প্রত্যেকটিকে বলা হয়েছিল—গাউস খানের কাছ থেকে এই বইগুলি পাওয়া যাবে। প্রথমে এই ব্যবস্থা কার্যকর হয়। কিন্তু ৩/৪ সপ্তাহের মধ্যে ১৩টি কমিটি লন্ডন কমিটির বিরুদ্ধে চলে যায়। তাদের প্রতিনিধিরা সরাসরি বিচারপতি চৌধুরীর কাছে গিয়ে বলেন, তাঁরা গাউস খানের কাছ থেকে চাঁদার বই। নেবেন না। গাউস খানের সঙ্গে তাদের কোনও সম্পর্ক নেই। বিচারপতি চৌধুরী অনেক চেষ্টা করেও এই সমস্যার সমাধান করতে পারেননি। বাংলাদেশ পার্লামেন্ট পদস্য ফণীভূষণ মজুমদারের সাহায্যও আমরা নিয়েছি। তাকে ও সুলতান মাহমুদ ‘মাকে আমার বাড়িতে আমন্ত্রণ জানিয়ে সমস্যা সমাধান করার অনুরােধ
শাহ। তাঁদের সঙ্গে অন্যরাও আসেন। কিন্তু কিছুতেই তারা গাউস খানের নেতৃত্ব নিতে রাজী হলেন না। তারা স্থির করলেন, তাদের ১৩টি কমিটি মিলে কনওয়ে ল-এ এক সভা আহ্বান করা হবে ।
১০৭
কনওয়ে হল-এর সভায় স্টিয়ারিং কমিটির পক্ষ থেকে শামসুর রহমান, কবার চৌধুরী ও আমার উপস্থিত থাকার কথা ছিল। কিন্তু শামসুর রহমান ও কবীর চৌধুরী সভায় উপস্থিত হতে পারেননি। ফণীভূষণ মজুমদার এই সভায় উপস্থিত ছিলেন। এই সভায় সভাপতিত্ব করার জন্য তিনি আমাকে রাজী করান। সভায় অনেক কথাই হলাে, কিন্তু দু’পক্ষের মধ্যে মিলনের কথা আসেনি। ফণীবাবুর বক্তৃতা সবাই আগ্রহের সঙ্গে শুনলেন, কিন্তু আমাদের এখানকার সমস্যার সমাধান হলাে না। ফল দাঁড়ালাে এই-লন্ডন কেন্দ্রীয় কমিটির কাছ থেকে যে একশ’ বই দেওয়া হয়েছিল, তা দিয়ে কত পাউড তারা তুলেছিলেন সে কথা আমাদের জানানাে হয়নি এবং বাংলাদেশ ফাভ”-এ কোনও অর্থ তারা জমা দেননি। পরবর্তীকালে ১৪টি কমিটির মধ্যে ১২টি কমিটি তাদের সংগৃহীত চাঁদা ফান্ড-এ জমা দিয়েছিল। সৈয়দ আবদুস সুলতান যখন হাই কমিশনার হয়ে লন্ডনে আসেন, তখন আমি তাকে জানিয়েছিলাম, লন্ডন এ্যাকশান কমিটি ও হেন্ডন এ্যাকশান কমিটি তাদের সংগৃহীত চাঁদা জমা দেয়নি। আমি মনে করি কমপক্ষে দু’লক্ষ পাউন্ড তাদের কাছে জমা ছিল। গাউস খানের সঙ্গে সাক্ষাতের পর সৈয়দ সুলতান আমাকে টেলিফোনে জানান, তাঁদের সংগৃহীত অর্থ শীঘ্রই জমা দেওয়া হবে বলে তাঁকে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।
হেন্ডন এ্যাকশান কমিটির প্রেসিডেন্ট ও সেক্রেটারী ছিলেন যথাক্রমে আবদুল মােমেন ও হারুন-অর-রশীদ। তাদের সংগৃহীত অর্থ জমা দেওয়ার জন্য আমি ব্যক্তিগতভাবে অনুরােধ করেছি। তাদের কাছে ২০ থেকে ৪০ হাজার পাউন্ড ছিল বলে আমি অনুমান করি। তারা বলেছেন, আমরা এই অর্থ বাংলাদেশ সরকারকে দেবাে না। প্রতি বছর গরীব ও মেধাবী ছাত্রদের বৃত্তি দিয়ে বাংলাদেশ থেকে নিয়ে এসে আমরা তাদের উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা করবাে। আমি যত দূর জানি, আজ পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে কোনাে ছাত্রও আসেনি; টাকাও তারা দেননি।
স্টিয়ারিং কমিটি নিয়ােজিত চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট কাজী মুজিবুর রহমান বিনা বেতনে আমাদের জন্য কাজ করেছেন। তিনি ও লুৎফুল মতিন আমাদের এ্যাকাউন্টস বিভাগের দায়িত্বে নিয়ােজিত ছিলেন। তারা বাংলাদেশ সরকারের কাছে যে ফাইনাল একাউন্ট” পেশ করেন, তাতে হেভন ও লন্ডন কমিটি সংগৃহীত অর্থের কোনও উল্লেখ ছিল না।
১৯৮৬ সালের ৩০শে অগাস্ট লন্ডনে প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে বিচারপতি চৌধুরী বলেন, প্রায় এক বছর যাবৎ তাগাদা দিয়ে চাঁদা সংগ্রহকারী এ্যাকশান কমিটিগুলি ও ব্যক্তিবিশেষের কাছ থেকে এক লক্ষেরও কিছু বেশি পাউন্ড আদাম কর পুব হয় । কেন্দ্রীয় ফান্ডে মােট ৪ লাখ ১২ হাজার ৮৩ পাউন্ড জমা হয়। তার
১০৮
মধ্যে ৩ লাখ ৭৮ হাজার ৮৭১ পাউন্ড বাংলাদেশ সরকারের নিকট হস্তান্তর করা হয়। বাংলাদেশ ফান্ডের বাের্ড অব ট্রাস্টি নয় মাসের আন্দোলনে মােট ১১ হাজার ৪৩০ পাউন্ড ব্যয় করেন। সংগ্রাম পরিচালনার জন্য স্টিয়ারিং কমিটি মোট ২১ সাজার ৭৮২ পাউন্ড ব্যয় করে। ১৯৭২ সালের ৩০শে সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ফান্ডের অডিট রিপাের্ট এবং হিসাব বাংলাদেশ সরকারের প্রেসে ছাপানাে হয় (বিজিপি-৭২-৭৩-৩১৯৫ ডি-১ এম)। লন্ডনস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে কমিটিগুলিকে রিপাের্টের কপি পাঠানাে হয় ।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ ফান্ড কর্তৃক সংগৃহীত অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে গুজব ছড়ানাে হয়। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্য জেমস জনসন এ সম্পর্কে তদন্ত করার জন্য ব্রিটিশ সলিসিটার-জেনারেল পিটার আর্চারকে অনুরােধ করেন। ১৯৭৬ সালের ৫ই নভেম্বর মি: জনসনের কাছে লিখিত এক পত্রে মি: আর্চার বলেন, পুলিশ এ সম্পর্কে তদন্ত করে অভিযােগ ভিত্তিহীন বলে সিদ্ধান্ত করে। ডাইরেক্টার অব পাবলিক প্রসিকিউশন এই সিদ্ধান্তের কথা বিচারপতি চৌধুরীকে জানিয়েছেন। মি: আর্চারও ডাইরেক্টার অব পাবলিক প্রসিকিউশানের সঙ্গে একমত হন।
ব্রিটিশ বাের্ড অব ট্রেড গঠিত একটি তদন্ত কমিটিও ফান্ডের হিসাবপত্র পরীক্ষা করে। ১৯৭৭ সালের ৩১শে মার্চ তারিখে লিখিত এক রিপাের্টে বলা হয়, জন স্টোনহাউস কিংবা আর কেউ বাংলাদেশ ফান্ডের অর্থ আত্মসাৎ করেননি। (“স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রবাসী বাঙালী, আবদুল মতিন, পৃঃ ২১৫)
১০৯
১৫. স্টিয়ারিং কমিটির সর্বশেষ জনসভা
১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে বিচারপতি চৌধুরী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন। ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় দিবসের খবর তিনি সেখানেই পান। আমরা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে স্বাগত জানাবার জন্য লন্ডনের হাইড পার্কে স্টিয়ারিং কমিটির উদ্যোগে এক জনসভা অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা গ্রহণ করি। বিচারপতি চৌধুরী আমাকে টেলিফোন করে বলেন, সভার তারিখ ২রা জানুয়ারী (১৯৭২) ঠিক করা হলে তিনি তার আগেই পৌছে যাবেন। তিনি আরও বলেন, স্টিয়ারিং কমিটির সদস্যদের নামে ব্রিটেনের সব এ্যাকশান কমিটির পক্ষ থেকে এই সভা আহ্বান করতে হবে। তিনি নির্দেশ দিলেন, জন স্টোনহাউস ও পিটার শােরসহ ব্রিটিশ পার্লামেন্টের যে-সব সদস্য আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থন করেছেন, তাদের সবাইকে সাদর আমন্ত্রণ জানাতে হবে।
আমি স্টিয়ারিং কমিটির সভায় বিচারপতির নির্দেশ উল্লেখ করে সভা আয়ােজন সম্পর্কিত ব্যাপারে আমার সহকর্মীদের সাহায্য চাইলাম। স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য আজিজুল হক ভূঁইয়া পূর্ব লন্ডনের সভায় আসেননি। আমি ও শামসুর রহমান স্টিয়ারিং কমিটির অন্যতম সদস্য কবীর চৌধুরীর সঙ্গে বার্মিংহামে। যােগাযােগ করে বলেছি, স্টিয়ারিং কমিটির এটাই হবে সর্বশেষ জনসভা এবং এর সাফল্যের জন্য তাঁকে সর্বশক্তি নিয়ােগ করতে হবে। আমাদের সংগ্রামের অংশীদার বাঙালীদের নিয়ে জনসভায় যােগদানের জন্য তাকে অনুরােধ করলাম।
২রা জানুয়ারী লন্ডনে আবহাওয়া ছিল দুর্যোগপূর্ণ । শীতকালের বৃষ্টি এবং তার সঙ্গে উত্তরের কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়ার মধ্যে ভােলা ময়দানে সভা অনুষ্ঠান অসম্ভব বলে মনে হয়েছিল। তা সত্ত্বেও ব্রিটেনের বিভিন্ন এলাকা থেকে কোচযােগে ৭/৮ হাজার উৎসাহী বাঙালী বিজয়ের আনন্দে শরীক হওয়ার উদ্দেশ্যে হাইড পাকে জমায়েত হয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা দাড়িয়ে সভা শুরু হওয়ার জন্য অপেক্ষা করেন। জন স্টোনহাউস, পিটার শাের এবং এ্যাকশান বাংলাদেশের পল কনেটের প্রতিনিধি হিসাবে মিস ম্যারিয়েটা প্রকোপে এবং আরাে কয়েকজন ব্রিটিশ সমথ সভায় উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশ নিউজলেটার”-এর পক্ষ থেকে তাসাদ্দুক
১১০
আহমদ, বাংলাদেশ গণ-সংস্কৃতি সংসদের প্রতিষ্ঠাতা এনামুল হক (পরবর্তীকালে ড. এনামুল হক) এবং বিভিন্ন এ্যাকশান কমিটির প্রেসিডেন্ট ও সেক্রেটারীরাও উপস্থিত ছিলেন।
এই সভায় আমার সভাপতিত্ব করার সৌভাগ্য হয়েছিল। আমি উপস্থিতঅনুপস্থিত ইংরেজ, ওয়েলসের অধিবাসী, স্কটল্যান্ডের মানুষ এবং ইউরােপের বিভিন্ন দেশের যে-সব বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতি-সচেতন ব্যক্তি আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সাহায্য করেছেন, তাঁদের সবাইকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করি। তাছাড়া আমাদের মুক্তিযুদ্ধ কালে জয়প্রকাশ নারায়ণ, কৃষ্ণমেনন, অরুণা আসফ আলী, রাণী মলা দেৰী, অশােক সেন এবং আরও অনেকে যারা আমাদের প্রতিবেশী বন্ধু রাষ্ট্র থেকে বিদেশে এসে আমাদের পক্ষে কাজ করেছেন, তাদের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি।
এরপর বিচারপতি চৌধুরী তার বক্তৃতা শুরু করেন। তিনি জাতি সঙেঘ কিভাবে কাজ করেছেন, কিভাবে বাঙালীর স্বপ্ন সার্থক হলাে, কি ভাবে তারা ত্যাগ স্বীকার করেছে, আমাদের ভবিষ্যৎ কেন উজ্জ্বল হবে—সে সম্পর্কে আবেগপূর্ণ ভাষায় বক্তৃতা করেন।
তিনি বলেন: “কমনওয়েলথ-এর প্রধান হিসাবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যাপারে ব্রিটেনের বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে।”
তিনি আরও বলেন: “সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে গঠিত নতুন বাংলাদেশে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ ও খৃস্টান ধর্মাবলম্বী এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলভুক্ত ব্যক্তিরা শান্তিতে বসবাস করবে। বাংলাদেশ সভ্য জাতি হিসাবে গর্ব বােধ করে। বাঙালীরা পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনীর মতাে বর্বর অত্যাচারের নীতি অনুসরণ করবে না। কিন্তু যারা গণহত্যা সম্পর্কিত জেনেভা কনৃডেনশান লঙঘন করেছে, তাদের বিচার করা হবে।”
বিচারপতি চৌধুরী বলেন; “স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ফিরে না আসা পর্যন্ত বাঙালীরা তার মুক্তির দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাবে।” (“মনিং স্টার”, ৩রা জানুয়ারী, ১৯৭২)।
বাঙালীদের স্বাধীনতার পক্ষে দেশে-বিদেশে যারা কাজ করেছেন এবং আমাদের আদর্শকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য যারা আমাদের সঙ্গে সহযােগিতা করেছেন, তাদের সবাইকে বিচারপতি চৌধুরী ধন্যবাদ জানান। দেশের প্রতি ভালবাসা, সাহস ও জীবনদানের প্রতিযােগিতা, আত্মত্যাগ, আত্মসুখ বিসর্জন এবং নিঃস্বার্থপরায়ণতা, সহযােগিতা ও সহমর্মিতা প্রতিষ্ঠা করে প্রবাসী বাঙালীরা যে
১১১
দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তার জন্য তিনি তাদের প্রতি বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
অতঃপর স্থানীয় নেতৃবৃন্দ বক্তৃতা করেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন শ্রমিক দলের প্রাক্তন মন্ত্রী জন স্টোনহাউস, মহিলা সমিতির বেগম শামসুন্নাহার, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মােহাম্মদ হােসেন মঞ্জু, জাকারিয়া খান চৌধুরী, এ্যাকশান বাংলাদেশের ম্যারিয়েটা প্রকোপে, স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য শামসুর রহমান এবং বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যাসােসিয়েশনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ড: হাকিম।
মিস প্রকোপে অত্যন্ত আবেগপূর্ণ ভাষায় বক্তৃতা করেন। তাঁর জীবনে এই প্রথম বার কথা বলার সময় তিনি কাঁদছিলেন। কিছুক্ষণ পর তিনি আমার কাঁধে হাত দিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে বলেন, আপনাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম সফল হয়েছে দেখে আমরা বিদেশী, যারা বাংলাদেশকে সাহায্য করেছি, তারা আপনাদের কাছ থেকে অনেক কিছু প্রত্যাশা করবাে। দেশ গড়ার কাজে সর্বশক্তি নিয়ােগ করুন।।
বাংলাদেশ গণসংস্কৃতি সংসদের একটি দেশাত্মবােধক গান দিয়ে সভার কাজ শেষ হয়।
* * * *
৬ই জানুয়ারী (১৯৭২) সন্ধ্যাবেলা বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের অনুরােধ অনুযায়ী লন্ডন থেকে বিমানযােগে ঢাকা রওয়ানা হন। কলকাতা হয়ে ৮ই জানুয়ারী তিনি ঢাকায় পৌছান। ১২ই জানুয়ারী তিনি গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন।
১১২
১৬. যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের ভূমিকা
১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রাম কালে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের ভূমিকা সম্পর্কে আলােচনা করার সময় মনে রাখতে হবে, আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব তখন দ্বিধা-বিভক্ত ছিল। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট ছিলেন গাউস খান। লন্ডন আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট ছিলেন মিনহাজউদ্দিন এবং অন্য নেতৃবৃন্দের মধ্য ছিলেন সুলতান মাহমুদ শরীফ ও মতিউর রহমান চৌধুরী।
১৯৬৯ সালে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করার পর শেখ মুজিবুর রহমান জেল থেকে মুক্তিলাভ করেন। তাঁকে সংবর্ধনা জানাবার জন্য ঢাকার সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত এক গণসমাবেশে সংগ্রামী ছাত্রদের পক্ষ থেকে তাকে “বঙ্গবন্ধু” উপাধি দেওয়া হয়। ২৬শে অক্টোবর তিনি লন্ডনে আসেন। এই উপলক্ষে প্রবাসী বাঙালীরা একটি অভ্যর্থনা কমিটি গঠন করে। এই কমিটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন গাউস খান। ৬ই নভেম্বর বঙ্গবন্ধু লন্ডন ত্যাগ করার কিছুকাল পর গাউস খানের নেতৃত্বে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ গঠিত হয়।
১৯৭১ সালে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ১৪ই মার্চ (রবিবার) গাউস খানের সভাপতিত্বে লন্ডনের হাইড পার্কে একটি গণসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। মফঃস্বলের বহু শহর থেকে ১০ হাজারেরও বেশি বাঙালী এই সমাবেশে যােগদান করে। হাইড পার্ক থেকে গাউস খানের নেতৃত্বে একটি বিক্ষোভ-মিছিল লাউডস স্কোয়ারে অবস্থিত পাকিস্তান হাই কমিশানে গিয়ে পূর্ব বাংলার দাবি সংবলিত একটি স্মারকলিপি পেশ করে। এর আগে লন্ডনে বাঙ্গালীদের এত বড় সমাবেশ আর দেখা যায়নি। (“বাংলাদেশ নিউজলেটার, লন্ডন, ৩০শে মার্চ ১৯৭১)।
২৬শে মার্চ গাউস ধানের উদ্যোগে লন্ডনের বেসিক স্ট্রীটে অবস্থিত তার বাদ রেস্তোরার ওপরের তলার অফিসে একটি জরুরী বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে আলােচনার পর অবিলম্বে পাকিস্তান হাই কমিশনের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এই বৈঠকে
১১৩
যােগদানকারীদের মধ্যে ছিলেন আতউর রহমান খান, তাসাক আহমদ, হাজী নিসার আলী, একরামুল হক, আবুল বাসার ও মােহাম্মদ ইসহাক।
সেদিন সন্ধ্যার দিকে পাকিস্তান হাই কমিশনের সামনে প্রায় তিন শ’ বাঙালী ছাত্র ও জনসাধারণ তুমুল বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। এক পর্যায়ে তারা হাই কমিশান দখলের চেষ্টা করে। রাত্রি প্রায় ৯টার দিকে উত্তেজিত ছাত্র ও যুবক এবং পুলিশের মধ্যে সংঘটিত সংঘর্ষের এক পর্যায়ে মােহাম্মদ ইসহাক ও শফিকুল হকসহ মােট ৮ জনকে গ্রেন্তার করা হয়। পরদিন ৩জনের বিরুদ্ধে পুলিশ মামলা দায়ের করে। ১লা জুন মার্লবারা স্ট্রীট কোর্টে অনুষ্ঠিত বিচারে মি: ইসহাককে ছ’সপ্তাহের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। গাউস খান এই মামলার ব্যয়ভার বহন করেন।
উল্লিখিত বিক্ষোভে লন্ডন আওয়ামী লীগের সভাপতি মিনহাজউদ্দিনও যােগদান করেন। পাকিস্তান ডেমােক্রেটিক ফ্রন্টের নেতা হিসাবে আমিও বিক্ষোভে যােগদান করি। প্রায় এক শ জন ছাত্র ও সাধারণ মানুষ সারা রাত হাই কমিশনের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন।। (“দি গার্ডিয়ান,” ২৭শে মার্চ, ১৯৭১)
২৬শে মার্চ বাংলাদেশে পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনীর সশস্ত্র আক্রমণের প্রতিবাদে ২৮শে মার্চ যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের উদ্যোগে লন্ডনের ট্রাফালগার স্কোয়ারে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সমর্থকরা এই সভায় যােগদান করেন। বার্মিংহাম, মাঞ্চেস্টার, কভেন্ট্রি, লুটন ও অন্যান্য শহর থেকে কোচ ও ট্রেনযােগে কয়েক হাজার বাঙালী এই সভায় যােগদানের জন্য আসেন। সভায় বিভিন্ন বক্তা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন করেন এবং বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলির প্রতি আবেদন জানান। গাউস খান ট্রাফালগার স্কোয়ারে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন।
যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন শহরে সংগঠিত শতাধিক বাংলাদেশ এ্যাকশান কমিটিকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য একটি কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের উদ্দেশ্যে ২৪শে এপ্রিল কভেন্ট্রি শহরে একটি প্রতিনিধি-সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে যুক্তরাজ্যে। আওয়ামী লীগেরে ভূমিকা সম্পর্কে কিছুটা অস্পষ্টতা রয়েছে বলে মনে হয়। স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রধান শক্তি ও বঙ্গবন্ধুর পার্টি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুক্তরাজ্য শাখা এই সম্মেলনে বিশেষ ভূমিকা পালন করবে বলে অনেকেই আশী। করেছিলেন। এখানে মনে রাখা দরকার, এ্যাকশান কমিটিগুলির প্রেসিডেন্ট ও সেক্রেটারীদের মধ্যে আওয়ামী লীগারদের সংখ্যা ছিল নগণ্য। তা ছাড়া প্রবাস বাঙালীরা মনে করেন, দলমত নির্বিশেষে বাঙালী জনসাধারণ পাকিস্তানী হানাদাম বাহিনীর বিরুদ্ধে জীবনমরণ সংগ্রামে নিয়ােজিত রয়েছে। অতএব, স্বাধা।
১১৪
সংগ্রাম শুধু আওয়ামী লীগের সংগ্রাম নয়। তারা অবশ্য মেনে নিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে এবং “মুজিবনগর সরকারের উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হচ্ছে। কভেন্ট্রি সম্মেলনে গঠিত স্টিয়ারিং কমিটির ৫জন সদস্যের মধ্যে একজনও আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি ছিলেন না। তার কারণ, সদস্যরা বিভিন্ন এলাকার এ্যাকশান কমিটিগুলির প্রতিনিধি হিসাবে নির্বাচিত হন।
স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম থেকেই গাউস খান বিচারপতি চৌধুরীকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করার পক্ষপাতী ছিলেন। মার্চ মাসে গাউস খানের নেতৃত্বে “কাউন্সিল ফর দি পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ ইন ইউ কে” গঠিত হয়। এপ্রিল মাসে তার অনুরােধক্রমে আমি বিচারপতি চৌধুরীকে টেলিফোন করে কাউন্সিলের নেতৃত্ব গ্রহণের আমন্ত্রণ জানাই। তিনি তখন কোনও দল বা প্রতিষ্ঠানে যােগ দেবেন না বলে জানান।
স্টিয়ারিং কমিটিকে পূর্ণাঙ্গ সাংগঠনিক রূপ দেওয়ার জন্য যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের প্রচেষ্টা সফল না হওয়া সত্ত্বেও নীতিগতভাবে কমিটির বিরােধিতা না করে গাউস খান ও তার সহকর্মীরা তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী নিজস্ব পন্থায় আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন ।(১৫) তারা টেলিফোন ও প্রচারপত্রের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ কর্মীদের স্থানীয় পার্লামেন্ট সদস্যদের সঙ্গে যােগাযােগ করে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের জন্য ব্রিটিশ সরকারকে চাপ দেওয়ার নির্দেশ দেন।
১২ই ডিসেম্বর লন্ডনের হাইড পার্কে হাজার হাজার প্রবাসী বাঙালীর এক গণসমাবেশে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি দাবি করা হয়। এই সমাবেশ স্টিয়ারিং কমিটির উদ্যোগে আহূত হয় এবং এ্যাকশান কমিটিগুলির পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগ কার্যক্রম পরিচালনা করে। ব্রিটেনের বিভিন্ন শহর থেকে দলে দলে প্রবাসী বাঙালীরা কোচযােগে লন্ডনে এসে এই সমাবেশে যােগদান করেন। সমাবেশে বক্তাদের মধ্যে ছিলেন বাংলাদেশ মশনের ভারপ্রাপ্ত প্রধান কর্মকর্তা রেজাউল করিম, শ্রমিক দলীয় পার্লামেন্ট সদস্য পিটার শাের ও জন স্টোনহাউস এবং বাংলাদেশ থেকে আগত আওয়ামী লীগ নেতা আসাবুল হক । (সাপ্তাহিক জনমত, ১৯শে ডিসেম্বর, ১৯৭১)
হাইড পার্ক থেকে প্রবাসী বাঙালীরা বিরাট মিছিল সহকারে ১০ নম্বর ডাউনিং ( ২াশ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে পৌছায়। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের ডেন্ট গাউস খানের নেতত্বে একটি প্রতিনিধিদল ভেতরে গিয়ে বাংলাদেশকে দানের অনুরােধ সংবলিত একটি স্মারকলিপি পেশ করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির ব্যাপারে সাহায্য করার জন্যও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ জানানো হয়। “দি গার্ডিয়ান”-এ প্রকাশিত রিপাের্টে এই মিছিলকে ‘ডিক্টরী প্যারেড” (বিজয় মিছিল) বলে অভিহিত করা হয় ।
১১৫
১৭. বিচারপতি চৌধুরীর অবদান
আমি আমার সারা জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে বলতে পারি, ১৯৭১ সালে। বাংলাদেশের দুর্দিনে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী দেশকে ভালােবেসে জাতির পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। স্বাধীনতা আন্দোলনে তিনি ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। লন্ডনে তার আগমন ছিল আমাদের জন্য এক পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার। বিভিন্ন দল ও মতের সমর্থক এবং ব্যক্তি বিশেষের অনুসারী হিসাবে প্রবাসী বাঙালীদের কখনও একতাবদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। নেতৃত্ব নিয়ে কোন্দলের ফলে তারা স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিকে সংঘবদ্ধ হওয়ার সুযােগদানে অনিচ্ছুক ছিল। তথাকথিত বামপন্থীদের কেউ কেউ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব মেনে নিতে অস্বীকার করে। তারা স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃবৃন্দের শ্রেণীগত অবস্থান সম্পর্কে চুলচেরা বিচারে লিপ্ত হয়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্ভব নয় বলে তারা বিশ্বাস করে। অতএব, পৃথকভাবে তারা নিজস্ব প্রােগ্রাম অনুযায়ী তাদের কার্যক্রম নির্ধারণ করে। আন্দোলনের প্রথম দিকে ব্রিটেনের বিভিন্ন এ্যাকশান কমিটির সমন্বয়ে কাউন্সিল ফর দি পিপলস্ রিপাবলিক অব বাংলাদেশ ইন ইউ কে প্রতিষ্ঠান হিসাবে দুর্বল ছিল। স্বাধীনতা সংগ্রামের স্বরূপ সম্পর্কে মতানৈক্যের ফলে সংঘবদ্ধ। হয়ে কাজ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি।
বিচারপতি চৌধুরী কখনও দু’টো জিনিস থেকে বিচ্ছিন্ন হননি বঙ্গবন্ধু তাঁর নেতা এবং বাংলাদেশ তার স্বদেশ। নমাস-স্থায়ী মুক্তিযুদ্ধ কালে বিচারপতি চৌধুরী। যেখানেই গিয়েছেন, সেখানেই তিনি বক্তৃতা, বিবৃতি এবং সংবাদপত্র ও টিভি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালিত হচ্ছে। তিনি আরও বলেছেন, রাজনৈতিক সত্তা হিসাবে পাকিস্তান মৃত; . পাকিস্তানের সঙ্গে কোনও আপস হতে পারে না; স্বাধীনতা বাঙালীদের জন্মগত অধিকার।
আমাদের বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলি একটি অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্যে ছিল। তাদের প্রশ্ন ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিযুদ্ধের নেতা কিনা, মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় তিনি সর্বাধিনায়ক কিনা এবং তাঁর নেতৃত্বে স্বাধীনতা ঘােষণা
১১৬
করা হয়েছে কিনা। এসব প্রশ্ন সম্পর্কে বিচারপতি চৌধুরীর মনে কোনও দ্বিধা-দ্বন্দ – না। অথচ বামপন্থী দলগুলির মধ্যে যারা স্বাধীনতা যুদ্ধ করবে, দীর্ঘ মেয়াদী গেরিলাযুদ্ধের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র কায়েম করবে, তাদের চিন্তায় ও কর্মপন্থায় বঙ্গবন্ধু ছিলেন সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। তারা ভুলে যায়, ছ’-দফা কোন পার্টি দিয়েছিল। ছ’-দফার ভিত্তিতে নির্বাচনে জয়লাভের পর পাকিস্তানীরা বাঙালীদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরিত করতে অস্বীকার করায় স্বাধীনতায় যুদ্ধ ঘােষণা করা হয়। কাজেই স্বাধীনতা-যুদ্ধ বঙ্গবন্ধুর নামেই পরিচালিত, এটাই স্বাভাবিক।
বিচারপতি চৌধুরী নিজেকে বাঙালী বলে পরিচয় দিয়ে গর্ববােধ করতেন। ১৯৭১ সালের ৬ই এপ্রিল ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সলার লর্ড জেমস ও ১৫জন অধ্যাপকের সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন সম্পর্কে আলােচনা কালে তিনি বলেন: “আমাদের সম-অধিকারের দাবি আজ স্বাধীনতার দাবিতে রূপান্তরিত হয়েছে। আজ আমরা স্বাধীনতা অর্জনের জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। জীবনে কখনও রাজনীতির সঙ্গে আমার সম্পর্কে ছিল না। কিন্তু একজন আত্মসম্মানবােধসম্পন্ন বাঙালী হিসাবে আমি এই সংগ্রামে যােগদান করেছি। (বিচারপতি চৌধুরীর স্মৃতিকথা, “মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি।”)
বাংলাদেশ হাই কোর্টের বিচারপতি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইসচ্যান্সলার হিসাবে বিচারপতি চৌধুরী পাশ্চাত্যের যে কোনাে দেশের বিদ্যোৎসমাজে সম্মানীয় অতিথির মর্যাদায় অভ্যর্থনালাভের অধিকারী ছিলেন। বাস্তবেও তাই হয়েছে। তাঁর পাণ্ডিত্য, কর্তব্যপরায়ণতা এবং আদর্শের প্রতি একনিষ্ঠতা সহজেই দেশ-বিদেশের রাজনীতিবিদ এবং রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের সশ্রদ্ধ দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ১৯৭১ সালে বহির্বিশ্বে স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্বদানের জন্য প্রবাসী বাঙালীদের মধ্যে তার চাইতে যােগ্যতর কেউ ছিলেন না। তাঁর রাজনৈতিক চন্তাধারা সম্পর্কে কারাে কারাে মনে সন্দেহ থাকলেও তিনি স্বল্প কালের মধ্যেই আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা হিসাবে পরিগণিত হন। তাঁর প্রতি মুজিবনগর সরকারের অবিচলিত আস্থা এ ব্যাপারে সহায়ক হয়।
বাংলাদেশের ৪-রাষ্ট্রীয়-আদর্শের মধ্যে একটি ছিলাে সমাজতন্ত্র। বিচারপতি এর কাছে সমাজতন্ত্র কি গ্রহণযােগ্য ছিল? এ সম্পর্কে কেউ কেউ প্রশ্ন করেন। তিনি শিশুকাল থেকে একটি অবস্থাপন্ন পরিবারে সমৃদ্ধির মধ্যে মানুষ হয়েছেন। আমি তখন ভাবতেও পারিনি—তিনি এই পরিবেশ থেকে এসে একটা গণআন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে পারবেন। আমিও তাকে এই প্রশ্ন করেছি। তিনি বলেছেন: দেশবাসী যেটা চায় সেটাই হবে। আপনারা যদি সমাজতন্ত্র প্রাতষ্ঠা করতে পারেন-করুন। আমি তাে আর রাজনীতিতে থাকবাে না। আমি আমার
১১৭
বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যাবাে। তিনি বার বার বলেছেন, কোনও দিন তিনি রাজনীতিতে ছিলেন না এবং ভবিষ্যতেও থাকবেন না। কাজেই উল্লিখিত প্রশ্ন অবান্তর। আমি বলবাে, বিচারপতি চৌধুরীর নির্ভেজাল মন ছিল, দেশাত্মবােধ ছিল এবং তিনি আওয়ামী লীগের প্রতি সহানুভূতিশীল ও বঙ্গবন্ধুর অনুসারী ছিলেন।
মে মাসে জাতি সঙেঘ “লবী” করার উদ্দেশ্যে বিচারপতি চৌধুরীর যুক্তরাষ্ট্র সফরকে কেন্দ্র করে কিছু ভুল বােঝাবুঝির সম্ভাবনা দেখা দেয়। তিনি লন্ডনে ফিরে আসার পর বেজওয়াটার এ্যাকশান কমিটি ইস্ট-ওয়েস্ট রেস্তোরায় একটি বৈঠক আহ্বান করে। এই বৈঠকে যােগদান করার জন্য তাকে আমন্ত্রণ জানানাে হয়। আজিজুল হক ভূইয়া ও আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম। বিচারপতি চৌধুরীকে প্রশ্ন করা হয়— হেনরী কিসিংগার ও পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ যুদ্ধের পরিবর্তে আলােচনার মাধ্যমে মীমাংসার যে চেষ্টা চালাচ্ছে, সে ব্যাপারে জড়িত হওয়ার জন্য তিনি আমেরিকায় গিয়েছেন কিনা। তিনি বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলেন, আপনারা আমাকে পাঠিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের কথা বহির্বিশ্বে জানিয়ে দেওয়ার জন্য। আমেরিকার তরফ থেকে কিংবা জাতি সংঘের কাছ থেকে আমার কাছে প্রস্তাব আসতে পারে; কিন্তু তার মানে এই নয়, আমাদের স্বাধীনতার ব্যাপারে আমরা কোনও রকমের আপসমীমাংসা করছি। আমি যখন জাতি সঘে গিয়েছি তখন বিভিন্ন মহল থেকে নানা রকম চাপ দেওয়া হয়েছে। আমার নির্দেশে এসব ব্যাপারে কোনও অগ্রগতি হয়নি। আমাদের পূর্ণ স্বাধীনতা পাকিস্তান যদি মেনে নেয়, বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দেয়, তা হলে আমি সম্মতি জানাবাে। এই ম্যাডেট” (আইনসঙ্গত আদেশ) “মুজিবনগর সরকার আমাকে দিয়েছে। কাজেই কোনও রাষ্ট্র যদি এগিয়ে আসে এবং আমরা কোনও আলােচনায় যাই, সেটা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরােধিতা বলে ধরে নেওয়া অন্যায় হবে।
এ সময় একটা গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। পাকিস্তান নাকি শ্রীলঙ্কার মাধ্যমে একটা প্রস্তাব দিয়েছিল—আপস-আলােচনার মাধ্যমে মীমাংসা হলে বিচারপতি চৌধুরীকে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট করা হবে। এ ধরনের প্রস্তাব আমি ভিত্তিহীন বলে মনে করি। বিচারপতি চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী হিসাবে আমি জানি, স্বাধীনতা অর্জনের দুর্গম পথে তিনি অত্যন্ত সাহসের সঙ্গে এগিয়েছেন। “মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে তিনি ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ রক্ষা করেন। পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া আর কোনও বিকল্প তাঁর কাছে গ্রহণযােগ্য ছিল না। মুক্তিযােদ্ধাদের মনােবল ভেঙে দেওয়ার জন্যই তার বিরুদ্ধে এই মিথ্যা প্রচারণা চালানাে হয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর অবদান বাঙালী জাতি চিরকাল কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করবে, এ সম্বন্ধে আমার কোনও সন্দেহ নেই।
১১৮
১৮. লন্ডনে বঙ্গবন্ধুঃ জানুয়ারী, ১৯৭২
পাকিস্তানী কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ১৯৭২ সালের ৮ই জানুয়ারী (শনিবার) লন্ডনের হিথরাে বিমানবন্দরে এসে পৌছান। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড থেকে পুলিশ অফিসার পিটার ল্যাংলী টেলিফোন করে বললেন, তােমাদের বঙ্গবন্ধু তাে এখানে। কথাটা আমি বিশ্বাস করতে পারিনি। বঙ্গবন্ধুর কারামুক্তির জন্য আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু তিনি হঠাৎ লন্ডনে এসে হাজির হবেন, তা আমি কল্পনাও করতে পারিনি। মি: ল্যাংলীর সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ ছিল। ব্রিটিশ সরকারের নির্দেশক্রমে আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম থেকেই তিনি বিচারপতি চৌধুরীর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা সম্পর্কে সাহায্য ও পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বললেন, বঙ্গবন্ধু মে-ফেয়ার এলাকায় ক্ল্যারিজে হােটেলে উঠেছেন। তার সঙ্গে দেখা করতে হলে এখুনি আসতে হবে। তার সফরসূচী মি: ল্যাংগীর জানা নেই। তবে বঙ্গবন্ধু শীঘ্রই লন্ডন থেকে চলে যাবেন বলে তিনি অনুমান করেন।
আমি এক মুহূর্তও বিলম্ব না করে স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য আজিজুল হক ভূইয়া, বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যাসােসিয়েশনের ড: হাকিম, স্টিয়ারিং কমিটি নিয়ােজিত চার্টার্ড একাউন্টেন্ট কাজী মুজিবুর রহমান ও বেজওয়াটার কমিটির আলী নেওয়াজকে এক গাড়িতে তুলে নিয়ে ক্লারিজেস হােটেলে হাজির হলাম। আমার আগেই যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট গাউস খান, লন্ডন আওয়ামী গের প্রেসিডেন্ট মিনহাজউদ্দিন এবং বাংলাদেশ নিউজলেটার”-এর প্রতিষ্ঠাতা তাসাদ্দুক আহমদ পৌছে গিয়েছেন। বাংলাদেশ মিশানের অফিসাররাও সেখানে ছিলেন। আমি বঙ্গবন্ধুর রুমে ঢুকতেই তিনি দু’হাত বাড়িয়ে সােফা ছেড়ে আমার দিকে এগিয়ে আসলেন। তার সঙ্গে কোলাকুলি করার সময় আমার চোখে পানি এসেছিল। তিনি আমাদের মধ্যে ফিরে আসবেন এবং তাঁকে জীবিত দেখবে, সে কথা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। এই আবেগময় মুহূর্ত আমার জীবনের এক পরম সম্পদ। কিছুটা প্রকৃতিস্থ হওয়ার পর তিনি আমার কানে কানে বললেন, আমার
১১৯
সম্ভবতঃ কালই চলে যাওয়া হতে পারে। তােমরা এখানে যা কিছু করেছ, তার কিছু কিছু আমি শুনেছি, বাকীটা দেশে আসাে—পরে শুনবাে। আমাদের কথাবার্তার মধ্যে হঠাৎ করে টেলিফোন আসলাে ভারত থেকে—মিসেস ইন্দিরা গান্ধী টেলিফোন লাইনে অপেক্ষা করছেন। তিনি বললেন, “তােমরা ওদিকে থাকো, আমি ফোনে কথা বলি।” উনি খানিকক্ষণ কথা বলার পর দেখলাম তাঁর হাসিখুশি মুখ । কিছুক্ষণের মধ্যেই লেবার পার্টির নেতা (পরবর্তীকালের প্রধান মন্ত্রী) হ্যারল্ড উইলসন এসে হাজির হলেন। তিনি “শুড় মর্নিং, মি: প্রেসিডেন্ট” বলে বঙ্গবন্ধুকে সম্ভাষণ জানালেন। আমরা আবার রুম ত্যাগ করলে বঙ্গবন্ধু তার সঙ্গে কথা বললেন। মি: উইলসন বিদায় নেওয়ার পর আমরা আবার তার রুমে গেলাম । ইতােমধ্যে ভারতীয় হাই কমিশনার আপা পন্থ এসে হাজির হলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে ব্রিটিশ টিভি সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট এসে বঙ্গবন্ধুর কাছে সবিনয়ে নিজের পরিচয় দিলেন। বঙ্গবন্ধু বললেন, “ তােমার নাম আমি জানি। আমি কি করতে পারি বল।” উনি বললেন, “বিশেষ কিছুই নয়, শুধু একটা ইন্টারভিউ আমাকে দিতে হবে। আপনি যদি অনুমতি দেন, বি বি সি টেলিভিশন তৈরি রয়েছে; ক্যামেরা ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি আপনার রুমেই নিয়ে আসা হবে।” বঙ্গবন্ধু হেসে বললেন ব্রিটিশ টেলিভিশনের জন্য আমি ইন্টারভিউ দেবাে, কিন্তু তার জন্য তােমাকে বাংলাদেশে আসতে হবে। আমার প্রথম ইন্টারভিউ হবে বাংলাদেশের সাংবাদিকদের জন্য। আমি কথা দিচ্ছি, বিদেশী সাংবাদিকদের মধ্যে তােমাকেই আমি প্রথম ইন্টারভিউ দেবাে।”
হােটেলের বাইরে রাস্তার দৃশ্য বর্ণনা করা আমার পক্ষে অসম্ভব। গত দশএগারাে মাস যাবৎ স্বাধীনতা আন্দোলনে জড়িত থাকার ফলে পরিশ্রান্ত বাঙালীরা দলে দলে এসে হােটেল ঘিরে ফেলেছে। মুহুর্মুহঃ “জয় বঙ্গবন্ধু,” “জয় বাংলা” স্লোগান দিয়ে তারা আকাশ-বাতাস মুখরিত করে তােলে। হােটেলের বাইরে যেদিকে তাকানাে যায়, সেদিকেই অগণিত লােক। দেখেই বােঝা যায় , বঙ্গবন্ধুর শরীর অত্যন্ত দুর্বল। তা সত্ত্বেও তিনি জানালার পর্দা সরিয়ে জনতার উদ্দেশ্যে হাত নেড়ে অভিনন্দন জানাচ্ছেন। তার গায়ে শক্তি নেই; তিনি থর থর করে কাঁপছেন। তাঁর সঙ্গীদের কেউ কেউ বললেন, আপনি তাে পড়ে যাবেন। তিনি কারাে কথা শুনলেন না। জানালা থেকে ফিরে এসে কয়েক মিনিট বসে আবার জানালায় ফিরে গিয়ে তিনি হাত তুলে সবাইকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন।
আমি বললাম: “মুজিব ভাই, আপনি তাে এদের সবাইকে খুশি করতে পারবেন না; আপনি পরিশ্রান্ত হয়ে পড়বেন। অন্যান্য শহরে তাে আরাে ভীর হবে।”
১২০
তিনি বললেন, “আমার তাে এখন সময় হবে না। যারা এসেছে তাদের সঙ্গে আমাকে দেখা করতে দাও। আমাকে অন্ততঃ হাতটা তুলতে দাও। ওরাই তাে দলটাকে স্বাধীন করেছে। তিনি আবেগে অভিভূত হয়ে হােটেলের ওপরের তলার জানালায় দাড়িয়ে দর্শনপ্রাথী জনতার উদ্দেশে কথা বললেন । দর্শনপ্রার্থীরা হয় তাে তার কথা শুনতে পায়নি। এই ভাবে তিনি জনতার সঙ্গে ভাব বিনিময় করলেন।
স্থানীয় নেতৃবৃন্দের অনেকেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে আসলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন জাকারিয়া খান চৌধুরী, স্টিয়ারিং কমিটির সেক্রেটারী শামসুল আলম চৌধুরী এবং ফেডারেল ইনসিওরেন্স কোম্পানীর ম্যানেজিং ডাইরেক্টার গােলাম মাওলা। শিল্পপতি জহিরুল ইসলামের পক্ষ থেকে তার এক ভাইও দেখা করতে আসেন। বঙ্গবন্ধুকে এক নজর দেখার জন্য শীতের মধ্যে সারাদিন জনতা হােটেলের বাইরে অপেক্ষমাণ ছিল।
দুপুরের দিকে বঙ্গবন্ধু এক সাংবাদিক সম্মেলনে তার বক্তব্য পেশ করেন। দেশ-বিদেশের রেডিয়াে, টি-ভি ও সংবাদপত্রের প্রতিনিধিরা তার বক্তব্য শােনার জন্য উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করছিলেন। ক্ল্যারিজেস হােটেলের লাউঞ্জে সাংবাদিকরা ছাড়াও বহু নেতৃস্থানীয় বাঙালী তার পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
প্রশ্নোত্তরের আগেই একটি লিখিত বিবৃতি সাংবাদিকদের দেওয়া হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সাবলীলভাবে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেন। তিনি বার বার আমার জনগণ” (My people) এবং “আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ” (our epic liberation war) শব্দগুলি ব্যবহার করেন। মিয়াওয়ালী জেলে তাকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র এবং তার “সেল”-এর পাশে কবর খােড়ার কথা তিনি সংক্ষেপে বর্ণনা করেন। মুহূর্তে মুহুর্তে কারা-প্রহরীরা এসে তাকে জীবনের ভয় দেখিয়েছে, সে কথাও তিনি উল্লেখ করলেন। সবাই অবাকবিস্ময়ে তাঁর কথা শােনেন। প্রসঙ্গক্রমেই তিনি বললেন, “এক মুহুর্তের জন্যও আমি বাংলাদেশের কথা ভুলিনি। আমি আমার নিজের জন্য প্রাণ-ধারণ করছিলাম না। আমি জানতাম, তারা আমাকে হত্যা করবে। আমি তােমাদের সঙ্গে এখানে দেখা হওয়ার সুযােগ পাবাে না, কিন্তু আমার জনগণ মুক্তি অর্জন করবে। আমাকে যদি তারা হত্যাও করে তা’ হলেও আমার জনগণ মুক্তি অর্জন করবে, এ সম্বন্ধে কখনও আমার মনে কোনও সন্দেহ ছিল না।(১৬)
বঙ্গবন্ধু লন্ডনে পৌছানাের পর বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে যারা তাকে অবহিত করেছেন, তাদের মধ্যে ছিলেন লন্ডনে বাংলাদেশ মিশনের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রেজাউল করিম, গাউস খান, মিনহাজউদ্দিন,
‘১২১
তাসাদ্দুক আহমদ, জাকারিয়া খান চৌধুরী ও গােলাম মাওলা । তা ছাড়া তিনি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথ, বিরােধী দলের নেতা হ্যারল্ড উইলসন, শ্রমিক দলীয় পার্লামেন্ট সদস্য পিটার শাের এবং আরও কয়েকজনের সঙ্গে বাংলাদেশ সম্পর্কে একান্তে আলােচনা করেন। ক্যারিজেস হােটেলে ছােটখাট গােপন আলােচনার সময় তিনি সবাইকে রুমের বাইরে যাওয়ার জন্য অনুরােধ করেছেন, কিংবা অন্য রুমে গিয়ে কথা বলেছেন।
সাংবাদিক সম্মেলনের পর বহুলােকের ভীড়ের মধ্য থেকে বঙ্গবন্ধুকে লক্ষ্য করে একজন বললেন: “ডাই, যুদ্ধ-বিগ্রহের শেষে আমাদের উপমহাদেশেই বসবাস করতে হবে। কাজেই পাকিস্তানের সঙ্গে একটা সহযােগিতার ডাব রেখে আমাদের চলতে হবে, চলা উচিত।”
বঙ্গবন্ধু বললেন, “পাকিস্তানের সঙ্গে কোনও আপস হতে পারে না। আমাদের স্বাধীনতা সম্পর্কে দর কষাকষির কথাই ওঠে না। আমরা পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করেছি। পাকিস্তান আমার কাছে অন্য যেকোন একটি দেশের মতাে। ২৫শে মার্চ (১৯৭১) পাকিস্তান একটি জাতি হিসাবে মৃত্যু বরণ করেছে এবং আমার জনগণ বীরের মতাে যুদ্ধ করেছে। তারা তাদের সর্বস্ব বিসর্জন দিয়েছে। আমি কখনও তাদের অসম্মান করবো না; এমন কি আমার জীবন দিয়ে হলেও আমি এই প্রতিশ্রুতি পালন করবাে” (১৭)
রাত্রিবেলা মিনহাজউদ্দিন আমাকে বললেন, “বঙ্গবন্ধু তাে কাল চলে যাবেন। আজ আবার যদি তার সঙ্গে দেখা করতে না যান, তাহলে আর কথা বলার সুযােগ পাবেন না । আসুন, আজ আবার তার সঙ্গে দেখা করতে যাই।” সেই রাত্রে আবার বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। তিনি বললেন: “এখন এখানে সময় নষ্ট করবে কেন। আজ বাড়ি চলে যাও। কাল সকালে আমার প্লেন যাবে। এদের এয়ারফোর্সের প্লেন আমাকে পৌছে দেবে। আমি তােমাকে সঙ্গে করে এয়ারপাের্টে নিয়ে যাবাে। সেখানে কথা হবে।” পরদিন সকালবেলা আমি যখন হােটেলে পৌছাই, তখন আমার সঙ্গে ছিলেন স্টিয়ারিং কমিটির কনভেনার আজিজুল হক ভূইয়া, আমাদের একাউন্টেন্ট কাজী মুজিবুর রহমান ও স্বাধীনতা সংগ্রামের একনিষ্ঠ সমর্থক নেওয়াজ সাহেব। আমি বললাম: “মুজিব ভাই, আমার সঙ্গে এর রয়েছেন। তিনি বললেন: “ওদের নিয়ে চল।” স্কটল্যান্ড ইয়াডের আপত্তি সত্ত্বেও দ্বিতীয় গাড়িতে তিনি আমাদের জন্য জায়গা করে দিলেন।
ক্ল্যারিজেস হােটেল থেকে গাড়ি যখন রওয়ানা হচ্ছিলাে, তখন হােটেলে বাইরের ভাঁড়ের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর পূর্ব পরিচিত একজন পাকিস্তানী ছিলেন। তিিন এসেছিলেন বঙ্গবন্ধুকে ‘ব্রীফ” করার জন্য নয়, আবেদন পেশ করার উদ্দেশ্যে।
১২২
তিনি গাড়ির দরজা টেনে ধরে বললেন, “ Mujib, don’t forget, I and you belong to Pakistan.” (মুজিব, তুমি ও আমি পাকিস্তানী, এ কথা ভুলে যাবে না), তখন আমাদের পক্ষের একটি ছেলে তাকে টেনে সরিয়ে দিতে বাধ্য হলাে।
এয়ারপাের্টে পৌছানাের পর বঙ্গবন্ধু যে ভি আই পি রুমে বসেছিলেন, সেখানে আমিও বসার সুযোেগ পেয়েছিলাম। আমি আধ-ঘন্টা সময় পেয়েছিলাম। সত্যি কথা বলতে কি, সেদিন আমি কোনও প্রশ্নই তাকে করতে পারিনি। কোনও গুরুত্বপূর্ণ কথাও বলতে পারিনি। ক্ল্যারিজেস হােটেলে লক্ষ্য করেছি, বহু লােক বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীনতা আন্দোলন কালে তারা কি করেছেন, তার বিবরণ দিচ্ছেন। আমি কি করেছি, সে সম্পর্কে একটি কথাও আমার মুখ থেকে বের হলাে না। শুধু এটুকু বলেছি: “মুজিব ভাই, বাঙালী কিন্তু আপনার ডাকে সাড়া দিয়েছে এবং এখানে যারা সাড়া দিয়েছে, তারা অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছে। এ ব্যাপারে তাদের কোনও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিল না।”
এয়ারপাের্টে অবস্থান কালে আজিজুল হক ভূঁইয়া,কাজী মুজিবুর রহমান এবং নেওয়াজ সাহেব আমাকে বললেন, বঙ্গবন্ধুকে একটা কথা বলতে হবে—তিনি তাে। জানেন, অনেক রক্তক্ষয়ের পর দেশ স্বাধীন হয়েছে। এখন দেশে এমন একটা সরকার গঠন করা যায় কিনা যেখানে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সর্বদলীয় সরকার গঠিত হবে। আমি তাদের কথাটা এভাবে বলিনি। মিনিটখানেক সময় নিয়ে আমি সংক্ষেপে তাকে বললাম, শাহ আজিজুর রহমানসহ সব কোলাবােরেটার” এবং আল-বদর ও আল-শামস-এর যে-সব কর্মী ঘরে ঘরে ঢুকে বাঙালীদের নিধন করেছে, বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে মিরপুরের বধ্যভূমিতে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে, তাদের সবাইকে বাদ দিয়ে এমন একটা সরকার গঠন করা যায় কিনা, যেখানে আওয়ামী লীগারদের সংখ্যা হবে শতকরা ৯৯ ভাগ এবং বাকি এক ভাগ হবে অন্যান্য যারা স্বাধীনতা যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন। এই সরকার গঠিত হবে আপনার নেতৃত্বে।
বঙ্গবন্ধু আমাদের বললেন, “৭ই ডিসেম্বর ও ১০ ই জানুয়ারী নির্বাচন হয়েছে, নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৬৭টি আসন পেয়ে সারা দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা জীবিত আছে, তারা যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে, তারা সরকার গঠন করবে। কিন্তু তােমরা যদি চাও অন্যরাও সরকারে যােগ দেবে, তাহলে সেই সুযোেগ আমি দেবাে। ইলেকশান করা হােক, তােমরা দেশে আস, দেশের জন্য কাজ কর। আমাকে তােমরা ছেড়ে দাও, সরকার ওরাই গঠন করবে। আমি যেয়ে বাগিয়ার নদীতে ছাতা মাথায় দিয়ে মাছ ধরবাে।
১২৩
তােমরা একটা স্বাধীন দেশে এখন বসবাস করছে। এর পর তােমাদের আর কিছু আমার দেওয়ার নেই। আমি জীবনের দীর্ঘ ১১টি বছর জেল খেটে, আমার পুত্রকন্যাকে অবহেলা করে, নিজের ঘর-সংসার বাদ দিয়ে, দেশের কাজ করেছি। এখন তােমরা কিছুটা কর। তােমরা অনেক সুযােগ পাবে এবং আমি তােমাদের সেই সুযােগ দেব, অঙ্গীকার করছি। কিন্তু এই মুহূর্তে যারা গণনির্বাচিত প্রতিনিধি, তারাই সরকার পরিচালনা করবে।”
হিথরাে বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে বিদায় দেওয়ার সময় আমার চোখে পানি আসেনি। আমি তখন মনে মনে ভাবছিলাম—যে জাতি তার জন্য, তার ডাকে, তার কথায় অবলীলাক্রমে জীবন দিল, ইজ্জত দিল, মান-সম্মান দিল, সব অত্যাচার সহ্য করলাে, তার কাছে তিনি ফিরে যাচ্ছেন, কোলের সন্তান কোলে ফিরে যাচ্ছেন, আর হাজার হাজার মানুষ যারা এতিম হয়েছে, নির্যাতিত হয়েছে, তারা তাঁকে ফিরে পাবে। এটাই আমার সান্ত্বনা ।
১২৪
টীকা ও ব্যাখ্যা
(১) ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ (রবিবার) ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বকণ্ঠে ঘােষণা করেন: “প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলুন এবং আমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকুন। রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরাে দেব। এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বাে, ইনশাআল্লাহ। এবারের সগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।”
(২) সভায় যােগদানকারীদের মধ্যে ছিলেন শেখ আবদুল মান্নান, আতাউর রহমান খান, হাজী নিসার আলী, মােহাম্মদ ইসহাক, আমীর আলী, তৈয়েবুর রহমান, শেখ মােহাম্মদ আইয়ুব, শামসুল হুদা হারুণ, শামসুল মাের্শেদ, সাখাওয়াত হােসেন, জগলুল পাশা, শওকত আলী, আবদুল হামিদ, একরামুল হক, নিখিলেশ চক্রবর্তী, ড: কবীরউদ্দিন আহমদ, আরব আলী, হাজী আবদুল মতিন (ম্যাঞ্চেস্টার), মিনহাজউদ্দিন, মতিউর রহমান চৌধুরী, শামসুর রহমান, সিরাজুল হক, জিল্লুর হক, শ্যামাপ্রসাদ ঘােষ ও সাঈদুর রহমান মিয়া।
(৩) ঐেথাম কমিটির কর্মীবৃন্দ বার্মিংহাম, ম্যাঞ্চেস্টার ইত্যাদি অঞ্চলে গিয়ে অন্যান্য বাঙালীর সঙ্গে যােগাযােগ স্থাপন করেন। তাদের নিজস্ব একটি ফান্ড ছিল । ফান্ডের ট্রাস্টিদের মধ্যে ছিলেন রিচার্ড ক্রসম্যান (পরবর্তীকালে শ্রমিকদলীয় মন্ত্রী), লর্ড গিফোর্ড ও বিশপ ট্রেডার হাডলস্টোন।
নূরুল হক চৌধুরী রচিত “বাংলাদেশ ফাইটস ফর ফ্রিডাম” শীর্ষক একটি ইংরেজী পুস্তিকা এই কমিটি প্রকাশ করে। বিচারপতি চৌধুরী এর ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে নুরুল হক চৌধুরী এই কমিটির সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করে বাংলাদেশ টেলিফোন এ্যান্ড পােস্টাল ক্যাম্পেইন” নামের একটি সংস্থা গঠন করে একজন কর্মীকে সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে প্রচারকার্য চালান।
(৪) ১০ই কিংবা ১১ই এপ্রিল লন্ডনের জেরার্ড স্ট্রীটে অবস্থিত গঙ্গা রেস্তোরার মালিক তাসাদ্দক আহমদের সঙ্গে টেলিফোনে আলাপকালে ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম বলেন, “মুজিবনগর সরকার বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে যােগাযােগ করতেচায়। এ ব্যাপারে তিনি তাসাক আহমদের সাহায্য চান। ১২ই এপ্রিল দুপুরবেলা তাঁকে টেলিফোন করা হবে বলে জানানাে হয়। আমীর আলীর মারফত এই সংবাদ বিচারপতি চৌধুরীকে পৌছে দেওয়া হয়। যথাসময়ে গঙ্গা রেস্তোরাঁয় এই কল” পাওয়া গেলে তা বিচারপতির বাসস্থানের টেলিফোনে ট্রান্সফার করার জন্য টেলিফোন এক্সচেঞ্জকে নির্দেশ দেওয়া হয়।
(৫) স্বাধীনতা অর্জনের পর ম্যারিয়েটা প্রােকোপে বাংলাদেশে যান। অল্প কিছুকাল অবস্থানের পর তিনি লন্ডনে ফিরে আসেন। তার কিছুকাল পর তিনি বাথটাবের পানিতে চৈতন্য হারিয়ে মৃত্যু বরণ করেন।
(৬) বিচারপতি চৌধুরী তার স্মৃতিকথায় বলেছেন: “২৫শে এপ্রিল কভেন্ট্রির সভায় কেন্দ্রীয়) এ্যাকশান কমিটির স্টিয়ারিং কমিটি গঠিত হয়। কথা ছিল কিছুদিন পরে নিয়মিত নির্বাচনের দ্বারা এ্যাকশান কমিটি গঠিত হবে। সেই এ্যাকশান কমিটির নির্বাচন অনেকেই কামনা করছিলেন। পঁচিশে এপ্রিল থেকে ২রা জুলাই পর্যন্ত স্টিয়ারিং কমিটি যেভাবে কাজ করে এসেছে তাতে আন্দোলন সুসংহত হয়েছে। আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম যে, নির্বাচন অনুষ্ঠান আমাদের সংহতি ও ঐক্যে ফাটল ধরাতে পারে। তাই আমি উপলব্ধি করলাম যে, এ কারণে কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের ব্যাপারটিকে আপাতত স্থগিত রাখা দরকার। … যারা নির্বাচনের জনা উন্মুখ হয়েছিলেন তাদেরকে আমি জাতীয় স্বার্থে নির্বাচন আরাে কিছুদিন স্থগিত রাখতে অনুরােধ করলে তারা সম্মত হন।” (“মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি,” ইউনিভার্সিটি প্রেস, ঢাকা, ১৯)
১২৫
(৭) মুকিং কালে বালী শিল্পপতি জহরুল ইসলাম লন্ডনে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ মিশানের ব্যয় নির্বাহের জন্য প্রতি কিস্তিতে দু’হাজার পাউন্ড দান করেন। নিঃশর্ত পান হিসাবে প্রদত্ত এই অর্থ ড: এম এইচ জোয়ারদারের মাধ্যমে বাংলাদেশ মিশানের ফাইনাল ও একাউন্টস বিভাগে জমা দেওয়া হয়। নিরাপত্তার খাতিরে অর্থ প্রদানকারীর নাম সুবেদ আলী বলে রসিদে উল্লেখ করা হয়। ১৯৭১ সালের ৩১শে অগাস্ট তারিখে প্রদত্ত দু’নম্বর রসিদের ফ্যামিলি এই বইয়ের শেষে প্রকাশ করা হলাে।
(৮) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩০জন বাঙালী অধ্যাপক এবং দুজন বাঙালী অফিসারের একটি তালিকা তৈরি করে ড: সৈয়দ সাজ্জাদ হােসাইন সামরিক হেড কোয়ার্টার্সে দাখিল করেন। তালিকায় অধ্যাপকদের চারটি শ্রেণীতে বিভক্ত করে চার ধরনের শাস্তি হিসাবে (১) হত্যা, (২) কারাদণ্ড, (৩) চাকরি থেকে বহিষ্কার এবং (৪) ধরে নিয়ে প্রহার করার সুপারিশ করা হয়। দণ্ডপ্রাপ্ত অধ্যাপকদের অনেকেই আল-বদর বাহিনীর হাতে নিহত অথবা নির্যাতিত হন। | রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রণয়ণ সমাপ্ত হওয়ার পর প্রদেশিক গভর্নর-জেনারেল টিক্কা খানের নির্দেশে সাজ্জাদ হােসাইন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং প্রদেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা-সংস্কার কমিটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। (“একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায়?” দ্বিতীয় সংস্করণ, পৃ: ৮৪, ১৫৭, ১৮২)
(৯) London, 7 October, 1971.
My sympathies and full support were with the liberation movement of the people of Bangladesh as soon as I learnt of the genocide committed by the army of West Pakistan. Not being in politics I did not think a statement from me personally was necessary. But since it has become apparent that the image and memory of my beloved father, Huseyn Shaheed Suhrawardy, are being sought to be tarnished by one member of my Immediate family delate by her recent statements, I felt It Incumbent upon me to speak out.
I would like to express in unequivocal terms that I wish the liberation movement of the people of Bangladesh all success. They have been economically exploited and politically dominated by West Pakistan for the past twentyfour years and they have now been forced to take up arms to resist the genocide and other heinous crimes that have been and are being perpetrated by the West Pakistan army.
I have no doubt in my mind that the brave freedom fighters will succeed in achieving full Independence by ejecung tbe invading army.
I eagerly look forward to going to Bangladesh in the near future to see that in an independent, sovereign republic, people of all faiths and political affiliations are living in peace and harmony..
I also convey my greetings to the Government of Bangladesh, the members of which were all colleagues of my father and who were great objects of his afflection.
Rashid Suhrawardy.
(১০) মাওপন্থীরা দাবি করেন, ১৯৭১ সালে তাদের সংগ্রামের উদ্দেশ্য ছিল-পাকিস্তান সৈন্য নিধন এবং বাংলাদেশে নকশাল আন্দোলন প্রসারিত করা। তাদের নেতা মােহাম তোমাহা দাবি করেন, মুক্তিযুদ্ধ কালে তার দল “দুমুখী যুদ্ধ কৌশল গ্রহণ করে। একদিকে পাব্বিানী সৈন্যবাহিনী এবং অন্য দিকে আওয়ামী লীগ সমর্থক মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে
১২৬
যায়। পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর মধ্যে কোন্ পক্ষ তাদের মূল শত্রু ছিল, তা পরিষ্কার করে তােয়াহা কখনও বলেননি। (“বাংলাদেশ : দি আনফিজিসড় রেলিউশান, লরেন্স লিন্টজ, জেড় প্রেস, লন্ডন, পৃ: ২২)
(১১) ৮ই অক্টোবর “দি গার্ডিয়ান”-এর কূটনৈতিক সংবাদদাতা প্রদত্ত এক সংবাদে বলা হয়, লন্ডনস্থ পাকিস্তান হাইকমিশনে নিয়ােজিত “পলিটিক্যাল কাউন্সেলার রেজাউল করিম পদত্যাগ করে বাংলাদেশের পক্ষে যােগদান করেছেন।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার কয়েক বছর আগে রেজাউল করিমের সঙ্গে পাকিস্তান অবজারভার”-এর লন্ডন সংবাদদাতা আবদুল মতিনের সঙ্গে পরিচয় হয়। জুন মাসের প্রথম দিকে তাসাদ্দক আহমদের সঙ্গে পরামর্শ করে মি: করিমকে বাংলাদেশের পক্ষে যােগদানের জন্য তিনি অনুরোধ জানান। অধ্যাপক রেহমান সােবহান মাত্র দিন কয়েক আগে লন্ডনে এসেছেন।
মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে তিনি ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। তার সঙ্গে তাসাক আহমদের যােগাযােপ ছিল। তিনি আবদুল মতিনকে বলেন, রেজাউল করিম যদি বাংলাদেশের পক্ষে যোগদান করতে রাজী হন, তাহলে অধ্যাপক রেহমান সােবহানের সঙ্গে যােগাযােগ করিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব তিনি গ্রহণ করবেন।
এক দিন সন্ধ্যাবেলা পশ্চিম লন্ডনের হল্যান্ড পার্ক টিউব স্টেশানের নির্জন পরিবেশে মি: করিম আবদুল মতিনের সঙ্গে দেখা করতে রাজী হন। নিকটবর্তী একটি জনমানবহীন একটি রাস্তার এক পাশে পার্ক করা গাড়িতে বসে আবদুল মতিন বললেন, তিনি যদি বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করতে রাজী হন, তা হলে মুজিবনগর সরকারের একজন প্রতিনিধির সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা হবে। কয়েক দিন পর টেলিফোনযোগে তার সম্মতিসূচক উত্তর পাওয়ার পর একটি নির্দিষ্ট তারিখে অধ্যাপক রেহমান সােবহানের সঙ্গে তার সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা হয়।
কিছুদিন পর অধ্যাপক রেহমান সােবহানের সঙ্গে যােগাযােগ করে তাসাদ্দক আহমদ আবদুল মতিনকে জানান, মি: করিম বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করতে রাজী হয়েছেন। আরও চার মাস অপেক্ষা করার পর তিনি তার পদত্যাগ ঘােষণা করেন। ইতিমধ্যে ৪০০ জনেরও বেশি বাঙালী অফিসার পাকিস্তানের বিভিন্ন দূতাবাস থেকে পদত্যাগ করে বাংলাদেশের পক্ষে যােগ দিয়েছেন।
১৯৮৬ সালে লন্ডনে এক সাক্ষাৎকার কালে বিচারপতি চৌধুরী আবদুল মতিনকে বলেন, ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে পৃল বিলকিস বানু রেজাউল করিমকে নিয়ে তার সঙ্গে দেখা করেন। তখন আশা করা হয়েছিল, ১লা অগাস্ট ট্রাফালগার স্কোয়ারে আয়ােজিত গণসমাবেশে মি: করিম বাংলাদেশের পক্ষে যােগদানের সিদ্ধান্ত ঘােষণা করবেন। -“স্বাধীনতা সগ্রামের প্রবাসী বাঙালী, আবদুল মতিন, র্যাডিকাল এশিয়া পাবলিকেশান্স, পৃ: ১৬৪)।
(১২) ড: তারাপদ বসু বাঙালীদের প্রকৃত বন্ধু ছিলেন। তিনি বিভিন্ন সময়ে নানাভাবে আমাদের সহায়তা করেছেন। বিদেশ সফররত ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গেও তিনি আমাদের যােগাযােগ করিয়ে দিয়েছেন।’ সত্তেও কেউ কেউ তাকে সন্দেহের চোখে দেখতেন। আমাদের কাছে খবর এলাে, ড: বসু একজন ভারতীয় গুপ্তচর। আমরা বললাম, তাহলে ধরে নিতে হবে ভারতীয় হাই কমিশনের সবাই তাদের দেশের গুপ্তচর। কিন্তু ভারত আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সহযােগী দেশ। অতএব, তাদের গুপ্তচরদের সম্বন্ধে অযথা শঙ্কিত হওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, ড: বসু একটা ভুল করেছিলেন। কয়েকজন বাঙালী বুদ্ধিজীবী তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যান। এদের মধ্যে ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার মােশাররফ হােসেন মুস্তাজির। ১৯৬৩ সালে কমনওয়েলথ রুলারশীপ নিয়ে তিনি এদেশে আসেন। অর্থনীতি বিষয়ে তিনি পারদর্শী ছিলেন। কিছুক্ষণ আলাপ-আলােচনার পর ড: বসু বলেন, “এই তাে, আপনাদের মতাে লােকই আমরা চাই। মুস্তাজির সাহেব ধরে নিলেন, ডঃ বসু পাকিস্তান ভাঙার জন্য তার মতাে মীর জাফরদের প্রয়ােজন বলে ইঙ্গিত করেছেন।
(১৩) “I told her (Mrs. Indira Gandhi) that the Governments and the peoples’ of the various countries (or Western Europe) were full of sympathy for us. On the question of recognition, they had told me that recognition would be possible only when Indla recognised Bangladesh. I also said with some emotion: “Had your revered father been alive, he could not have remained satisfied by merely giving shelter to the refugees.” Her pensive mood gave me full opportunity to express my
১২৭
sentiments. I added : “After all, I have noting to offer by way of reward. Bangladesh will never be a vassal kingdom of India but a free and sovereign Bangladesh will be a friend of the close neighbour India, If that is of any value.”
In recalling these words. I am struck by their Irrelevance. But I was then in a rebellious mood. It was the propaganda of Pakistan I was denying everywhere. She did not give even the appearance of irritation. She watched my agaitated mood with a flicker of a smile. calm, quiet and gazing at the carpet almost with shyness. Then she gently said : ” Justice Choudhury, it is kind of you to have mentioned friendship. I think even that should be left to the people of Bangladesh to decide when they are free.” She proceeded to say: “You have spoken about reward : the only reward I would expect from a free Bangladesh is democracy. I do not like military rule in a neighbouring country.”
– “The Birth of Bangladesh” by Mr. Justice Abu Sayeed Choudhury, incorporated in an anthology entitled “Indira Gandhi Statesmen. Scholars, Scientists and Friends Remember,” published by Indira Gandhi Memorial Trust, New Delhi, October, 1985.
(১৪) That this House, deeply concerned by the killing and destruction which has taken place in East Pakistan, and the possible shortage of food later this year, calls upon Her Majesty’s Govemment to use their influence to secure an end to the strife, the admission of United Nations or other international relief organisations, and the achievement of political settlement which will respect the democratic rights of the people of Pakistan.
– Hansard No.-142, 14 May, 1971.
(১৫) ১৯৭১ সালের অগাস্ট মাসে লন্ডনের কওয়ে হল-এ অনুষ্ঠিত শাখা সমিতির (স্থানীয় এ্যাকশান কমিটি) প্রতিনিধিদের এক সম্মেলনে বিচারপতি চৌধুরী কেন্দ্রীয় এ্যাকশান কমিটির নির্বাচন স্থগিত রাখার কারণ ব্যাখ্যা করেন। প্রতিনিধিরা তাঁর আবেদনে সাড়া দিয়েছিলেন বলে তিনি তাঁর স্মৃতিকথায় উল্লেখ করেন।
(১৬) বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য স্মৃতি থেকে উদ্ধার করার চেষ্টা করেছি। তিনি বলেছিলেন : “At no moment of my life Bangladesh was absent from my mind. And I did not live for myself. I knew they would kill me. I would not get an opportunity to see you and meet you here, but my people would be free. I never had any doubt that even if they kill me, my people will be free.”
(১৭) বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য স্মৃতি থেকে উদ্ধার করার চেষ্টা করেছি। তিনি আরাে বলেছিলেন : “No reconciliation with Pakistan and no point in bargains” respect of our independence. It is complete. Pakistan simply another country to me. Pakistan died as a nation”. March (1971) and my people fought the war heroically. ” have sacrificed everything they had. I will never, never.” dishonour them, even at the cost of my life.”
১২৮