This is a temporary post for collecting data. Not for posting and not for publishing. Saved only as readable for the editors. Not clickable and not downloadable.
মুক্তিযুদ্ধে বিলাত প্রবাসীদের অবদান
ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন
প্রবাসীদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার উন্মেষ
১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিলাত-প্রবাসী বাংলাদেশীরা আন্তর্জাতিক প্রচারের ক্ষেত্রে ও দেশে মুক্তিযােদ্ধাদের উৎসাহদানের কাজে এক প্রশংসনীয় ভূমিকা রেখেছেন। বিভিন্ন পেশায় নিয়ােজিত বিলাত-প্রবাসী বাংলাদেশীরা দলমত নির্বিশেষে দেশমাতৃকার ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য ও সহযােগিতা করার এই চেতনা প্রবাসীদের মধ্যে একদিনে সৃষ্টি হয়নি। দেশের জনগণের মতােই প্রবাসী বাংলাদেশীরা তৎকালীন পাকিস্তানী শাসক ও শােষকের হাত থেকে মুক্ত হওয়ার দীর্ঘ সংগ্রামে জড়িত ছিলেন। মূলত দেশের রাজনৈতিক মেরুকরণ ও আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিদেশে অবস্থানরত নাগরিকদের মধ্যে সমভাবে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল। বিলাত-প্রবাসী বাংলাদেশীদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার যে উন্মেষ ঘটেছিল তার কারণ সমূহ পর্যালােচনা করতে হলে প্রথমেই বিলাতে প্রবাসীদের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আলােচনা করা প্রয়ােজন। বিলাতে তকালে যে সকল প্রবাসী বাংলাদেশী বসবাস করতেন তাদেরকে মােটামুটি চার ভাগে বিভক্ত করা যায়। যথা : ছাত্র, শ্রমিক, ব্যবসায়ী ও চাকুরীজীবী সম্প্রদায় । মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিলাতের আন্দোলনে ও প্রচার কার্যে যে সকল মহিলা নেত্রী ও কর্মী অবদান রেখেছিলেন তারা বেশির ভাগই ছিলেন গৃহিনী এবং মুষ্টিমেয় সংখ্যায় ছাত্রী ও চাকুরীজীবী। মুক্তিযুদ্ধকালে বিলাতে বসবাসকারী ছাত্রদের মধ্যে অনেকেই ষাটের দশকে তকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন ছাত্র আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী ছিলেন এবং সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী প্রাপ্ত ছিলেন। ছাত্রদের মধ্যে কেউ কেউ দেশের পড়াশােনা সমাপ্ত করে বিভিন্ন পেশায় যােগদান করে বৃত্তি লাভ করে বিলাতে ছাত্র হিসেবে গিয়েছিলেন অথবা স্নাতক অথবা স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভের পর সরাসরি উচ্চতর শিক্ষা লাভের জন্য বিলাতে গমন করেছিলেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র রাজনীতিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন এমন কয়েকজন প্রাক্তন ছাত্রনেতৃবৃন্দ তখন বিলাতে অধ্যয়নরত ছিলেন। বিশেষ করে ষাটের দশকের শেষের দিকে যারা বিলাত গিয়েছেন তাদের মধ্যে বেশির ভাগই ছিলেন পাকিস্তানী স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে স্বায়ত্ত্বশাসনের পক্ষের রাজনৈতিক ভাবধারার অধিকারী। ফলে বিলাত প্রবাসী ছাত্রদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রকট ছিল। তাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ফলে বিলাত প্রবাসী সকল স্তরের নাগরিকদের মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের আকাংক্ষা প্রবল ও সােচ্চার ছিল।
বিলাতে প্রবাসী বাংলাদেশীদের মধ্যে শ্রমিক শ্রেণীই ছিল সর্বাধিক সংখ্যক । বিলাতে যখন শিল্প বিপ্লব সংগঠিত হচ্ছিল, তখন বিদেশী শ্রমিকদের বিলাতে প্রবেশে উৎসাহিত করা হয়েছিল। তখন থেকেই বাঙ্গালীরা বিলাতে বসবাস শুরু করে। এদের মধ্যে শিল্প কলকারখানা ও বিভিন্ন কঠিন কাজেই বেশির ভাগ লােকদের নিয়ােগ করা হতাে। শ্রমিক শ্রেণীর রাজনৈতিক চর্চা করার সময় ও সুযােগ না থাকা সত্ত্বেও তকালিন পূর্ব পাকিস্তানে বৈষম্য, উনসত্তরের গণ আন্দোলন, আগরতলা মামলা, রাজনৈতিক অবস্থা, ১৯৭০ সালে ঘূর্ণিঝড় ও জলােচ্ছাসের সময়ে পাকিস্তানী শাসকদের বিমাতাসুলভ ব্যবহার এবং সর্বোপরি ১৯৭১ সালে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের উপেক্ষা করে জাতীয় পরিষদের বৈঠক স্থগিত করার বিষয়সমূহ বাংলাদেশী শ্রমিকদের মধ্যে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণ মানুষের উপর শােষণ, নির্যাতন ও অবহেলা এতই প্রকট ছিল যে, বিলাত প্রবাসী বাঙ্গালী শ্রমিকরা অত্যন্ত বিক্ষুব্ধ ছিল এবং স্বাধিকারের প্রশ্নে দেশের শ্রমিকদের সাথে একাত্ম ছিল। বিলাতে প্রবাসী বাঙ্গালীদের মধ্যে প্রভাবশালী শ্রেণী হিসাবে ব্যবসায়ী গােষ্ঠী বসবাস করতাে। যারা এক সময় চাকুরী বা অন্য পেশায় ছিলেন তাদের মধ্যে পরিশ্রমী, উৎসাহী, কর্মঠ ও অপেক্ষাকৃত বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা ব্যবসা ও বাণিজে মনােনিবেশ করেন। বাংলাদেশী ব্যবসায়ীদের মধ্যে বেশির ভাগই রেষ্টুরেন্ট ব্যবসা পরিচালনা করতেন। সামান্য কিছু সংখ্যক ব্যবসায়ী গ্রোসারী ও ছােটখাট গার্মেন্টসের মালিক ছিলেন। ছাত্রদের পরই ছােট ছােট ব্যবসায়ীদের মধ্য থেকে বিলাতে প্রবাসী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সৃষ্টি হয়েছিল। ছাত্রদের পরই এই ব্যবসায়ী গােষ্ঠী রাজনৈতিকভাবে সচেতন ও সক্রিয় গ্রুপ হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ পূর্ব কাল থেকেই বিলাতে আত্মপ্রকাশ করে। এছাড়া কিছু কিছু শিক্ষিত চাকুরীজীবী ব্যক্তিত্বও রাজনৈতিক অঙ্গনে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। তাদের মধ্যে অনেকেই ছাত্র জীবনের ইতি করে চাকুরী গ্রহণ করেছিলেন। তাই তাদের রাজনৈতিক চেতনা ও দেশের প্রতি দায়িত্ববােধ তাদেরকে স্বাধিকার ও স্বায়ত্তশাসনের দাবীর আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করেছিল। বিলাতে বসবাসকারী ব্যবসায়ীরা প্রভাবশালী হলেও বিলাতে বসবাসকারী ছাত্ররা স্বাভাবিক কারণেই রাজনৈতিকভাবে বেশি সচেতন ছিল।
পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীকার ও স্বাধীনতার জন্য বিলাতে ষাট দশকেই ছাত্ররা সােচ্চার ছিলেন। তৎকালে ছাত্র, ব্যবসায়ী ও সমাজকর্মীদের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের অস্তিত্বের প্রতিক “পূর্ব পাকিস্তান হাউজ”। “পূর্ব পাকিস্তান হাউজ” শুধু একটি বাড়ি ছিলনা—এই স্বতন্ত্র ‘হাউজ’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে যে চেতনার সৃষ্টি করেছিল তার ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধে বিলাতের আন্দোলনে প্রবাসী ছাত্রদের অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ সম্ভব হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তান হাউজ প্রতিষ্ঠায় যারা ভূমিকা রেখেছিলেন তারা সকলেই স্বাধীন বাংলাদেশে স্ব স্ব ক্ষেত্রে খ্যাতি অর্জন করেছে। পাকিস্তান হাউজে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান ভিত্তিক যুক্তরাজ্যস্থ পাকিস্তান ছাত্র ফেডারেশনে বাঙ্গালী ছাত্ররা নেতৃত্ব গ্রহণ করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের আশা-আকাংখা ও স্বায়ত্তশাসনের দাবির পক্ষে কথা বলার চেষ্টা করে। ষাটের দশকে বেশ কয়েকজন বাঙ্গালী। ছাত্র পাকিস্তান ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতিসহ বিভিন্ন পদে নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিলেন কিন্তু। পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায় সঙ্গত দাবির পক্ষে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। সে কারণে বাঙ্গালী ছাত্ররা আলাদাভাবে পাকিস্তান যুব সমিতির প্রতিষ্ঠা করে এবং সকল বাঙ্গালী ছাত্র নেতৃবৃন্দ এই ব্যানারে ঐক্যবদ্ধ হয়। যুক্তরাজ্যে বসবাসকারী মহিলাদের মধ্যে বেশির ভাগ হাউজ ওয়াইফ (গৃহিনী) থাকায় মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে তেমন উল্লেখযােগ্য কোন মহিলা সংগঠন গড়ে ওঠেনি। কিন্তু তাদের মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রত্যাশা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রবল। ছিল। তাই মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই মহিলারা সংগঠিত হয়। মহিলাদের সংগঠিত করার ব্যাপারে যারা বিশেষভাবে ভূমিকা রেখেছিলেন তাদের মধ্যে জেবুন্নেছা বস্তৃত, আনােয়ারা জাহান, লুলু বিলকিস বানু, মুন্নী সাহজাহান, জেবুন্নেছা খায়ের, ফেরদৌস রহমান, ডাঃ হালিমা আলম, সুরাইয়া বেগম, রাজিয়া চৌধুরী, রাবেয়া ভূইয়া, সুফিয়া রহমান, মনােয়ারা বেগম ও বার্মিংহামের বদরুন্নেছা পাশা এর নাম উল্লেখযােগ্য। তৎকালে বিলাতে প্রবাসী চিকিৎসকরা শিক্ষিত সমাজের মধ্যে বেশ সংগঠিত ছিল।
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সময় থেকেই বিলাতে বসবাসকারী চিকিৎসকরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবদান রাখার জন্য লন্ডন ভিত্তিক ও বিভিন্ন শহরে ‘বাংলাদেশ মেডিকেল এ্যাসােসিয়েশন’ প্রতিষ্ঠা করে। চিকিৎসকদের সংগঠিত করার ব্যাপারে যারা অবদান রেখেছিলেন তাদের মধ্যে ডাঃ মােশাররফ হােসেন জোয়ার্দার, ডাঃ এ. টি. এম. জাফরুল্লা চৌধুরী, ডাঃ আবদুল হাকিম, ডাঃ সামসুল আলম, ডাঃ মঞ্জুর মাের্শেদ তালুকদার, ডাঃ কাজী ও ডাঃ আহম্মদ এর নাম উল্লেখযােগ্য ষাটের দশকে যেমনিভাবে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ছাত্র সংগঠন, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ স্বায়ত্তশাসনের দাবির প্রতি সােচ্চার ছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লাভ করছিলেন ঠিক তেমনিভাবে বিলাতে প্রবাসীরা বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে একই লক্ষ্যে প্রস্তুতি গ্রহণ করছিলেন। এই কারণে ষাটের দশকে বিলাতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ভিত্তিক দল সংগঠিত হতে দেখা যায়। যে সকল রাজনৈতিক দল সক্রিয়ভাবে আত্মপ্রকাশ করে তার মধ্যে আওয়ামী লীগ ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। মুক্তিযুদ্ধের পূর্বকালে মরহুম গউস খান, মিনহাজ উদ্দিন, তৈয়বুর রহমান, মরহুম বি, এইচ, তালুকদার, সুলতান মাহমুদ শরীফ, হাজী আবদুল মতিন, সামসুর রহমান, মতিউর রহমান, মিম্বর আলী, আতাউর রহমান, সৈয়দ আবুল আহসান, আহম্মদ হােসেন জোয়ার্দার, ইসহাক প্রমূখ সমাজকর্মী ও ব্যবসায়ী বিলাতে আওয়ামী লীগ গঠনে উদ্যোগ গ্রহণ করেন এবং আওয়ামী লীগ সংগঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। আইয়ুব বিরােধী আন্দোলন ও স্বায়ত্তশাসনের দাবির প্রতি বিলাত প্রবাসী বাঙালীরা বেশ আকৃষ্ট হয়েছিলেন এবং আওয়ামী লীগে যােগদান করে বিভিন্ন কর্মসূচী বাস্তাবায়নের মাধ্যমে বিদেশে আইয়ুব বিরােধী জনমত সৃষ্টি করতে ভূমিকা রেখেছিলেন।
আইয়ুব বিরােধী আন্দোলনে বিলাত প্রবাসীদের কাছে মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নাম সংগ্রামের অগ্নিমশাল হিসেবে চিহ্নিত ছিল। মওলানা ভাসানীর প্রতিষ্ঠিত দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ও সেই কারণে বিলাত প্রবাসীদের আকৃষ্ট করেছিল এবং বিলাতের বিভিন্ন শহরে বিস্তার লাভ করেছিল। মওলানা ভাসানীর ন্যাপ বিলাতে সংগঠিত করার ব্যাপারে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের প্রাক্তন কর্মীরা বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করে। সমাজকর্মী শেখ আবদুল মান্নান, আবদুস সবুর, ডাঃ তালুকদার, সাইদুর রহমান (বর্তমান বার এট ল), শ্যামাপ্রসাদ ঘােষ (ডাকসুর প্রাক্তন ভি. পি.), নিখিলেশ। চক্রবর্তী, এম, এহিয়া (বার এট ল) প্রমুখ ন্যাপ সংগঠনে উল্লেখযােগ্য ভূমিকা রাখেন। ষাটের দশকে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বিলাত ভ্রমণে যান এবং বাঙ্গালী অধ্যুষিত শহরগুলােতে বিভিন্ন সভায় বক্তব্য রাখেন। মওলানা ভাসানীর বিলাত ভ্রমণের ফলে বিলাতে ন্যাপের সাংগঠনিক তৎপরতা বিস্তৃতি লাভ করে। অবশ্য পরবর্তী কালে ন্যাপ দ্বিধাবিভক্ত হওয়ার পর তার প্রতিক্রিয়া বিলাতের ন্যাপেও বিস্তার লাভ করে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ন্যাপ বিভক্ত হওয়ার ফলে তার প্রতিক্রিয়ায় বিলাতের ন্যাপে বিভক্তি আসে। মােজাফফর পন্থী ন্যাপ খায়রুল হুদা, মাহমুদ এ. রউফ, ডাঃ নুরুল আলম ও হাবিবুর হরমানের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে চলাকালে বিলাতের আন্দোলনে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে অংশ গ্রহণ করে অবদান রাখে। আওয়ামী লীগ ও ন্যাপ ছাড়াও বিলাত প্রবাসী বাঙালীদের মধ্যে প্রগতিশীল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবী কিছু কমী সক্রিয় ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধোত্তর বিভিন্ন সংগ্রামে উপরােক্ত প্রগতিশীল কর্মীরাও সক্রিয় ভাবে অংশ গ্রহণ করেছিল। তাদের ভূমিকাকেও ছােট করে দেখার অবকাশ নেই। প্রগতিশীল যে সকল কর্মী দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক বিবর্তনের কাজ করছিলেন তাদের মধ্যে তাসাদুক হােসেন, ব্যারিষ্টার সাখাওয়াত হােসেন, ব্যারিষ্টার জিয়াউদ্দিন মাহমুদ, ব্যারিষ্টার লুৎফুর রহমান সাহজাহানের নাম উল্লেখযােগ্য। তাসাদুক হােসেন এককালীন পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন। তিনি লন্ডনের কেন্দ্রবিন্দুতে গঙ্গা রেষ্টুরেন্টের মালিক ছিলেন।
এই গঙ্গা রেষ্টুরেন্ট বিলাত প্রবাসী প্রগতিশীল কর্মীদের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। বর্তমানে এই গঙ্গা রেষ্টুরেন্টের অস্তিত্ব আর নেই। বিলাতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও গ্রুপগুলাের কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র ছিল লন্ডন। তবে বার্মিংহাম, মানচেস্টার, লীডস, ব্রাডফোর্ড, মিডলসেক্স, লুটন, সাউথহল, গ্লাসগাে, লেষ্টার, সেন্ট অলবন্স, কভেন্ট্রি, পাের্টসমাউথ, টিপটন, সাউথ হল, ওল্ডহাম ও ইয়র্কশায়ার এর যে সকল অঞ্চলে বাঙালীরা বসবাস করতেন সে সকল অঞ্চলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের আঞ্চলিক কমিটি সংগঠিত হয়েছিল। এছাড়া পেশাগত কিছু সংগঠন স্বাধিকারের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আত্ম প্রকাশ করে। বিভিন্ন শহরে শ্রমিক কল্যাণ পরিষদ বা সমিতি নামে অগণিত সংগঠন জন্ম লাভ করে ষাটের দশকে। বিভিন্ন শহর ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভিত্তিক বাঙালী যুব সংগঠন ও ছাত্র সংগঠন স্বাধিকার আন্দোলনের শপথে আত্মপ্রকাশ করে। এই সকল কর্মকাণ্ডের ও সংগঠনের মাধ্যমে কিছু আঞ্চলিক নেতৃত্বে গড়ে উঠে। তাদের মধ্যে বার্মিংহামের জগলুল পাশা, আজিজুল হক ভূইয়া, তােজাম্মেল হক (টনি হক), আফরােজ মিয়া, ইসরাইল মিয়া; মাঞ্চেষ্টারের হাজী আবদুল মতিন; ইয়র্কশায়ারের মনােয়ার হােসেন, ব্রাডফোর্ডের আবদুল মুসাব্বির তরফদার ও শারাফত আলী, লুটনের দবির উদ্দিন ও বােরহান উদ্দিন, সেন্ট অলবনূসের আবদুল হাই; গ্লোসগাে এর ডাঃ মােজাম্মেল হক, ডাঃ রফিউদ্দিন ও কাজী এনামুল হক; লীডস্ এর মিয়া মােঃ মুস্তাফিজুর রহমান, খায়রুল বাশার, মােঃ নুরুদ্দোহা ও ডাঃ ফজলুল করিম; নর্থহাম্পটনের এ. এইচ. চৌধুরী, বি, মিয়া ও ইস্রাইল আলী; লেষ্টারের নূর মােহাম্মদ খান; ল্যাংকেশায়ারের কবীর চৌধুরী; কভেন্ট্রি এর সামসুল হুদা চৌধুরী ও মতছিম আলী; টিপটনের আলতাফুর রহমান চৌধুরী ও আসব আলী, সাউথ হলের আবদুস সালাম চৌধুরী ও এম. ইউ. আহসান এবং ইয়র্কশায়ারের জহিরুল হক এর নাম উল্লেখযােগ্য। ষাটের দশকে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি পর্বে লন্ডন ভিত্তিক বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ এবং আঞ্চলিক সংগঠনে নেতৃবৃন্দই ১৯৭১ সনে মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় ফ্রন্ট বলে খ্যাত বিলাত আন্দোলনের নেতৃত্বের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়।
পাকিস্তান ছাত্র ফেডারেশন
১৯৭১ সালে বিলাতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে প্রচার কার্যে প্রবাসী ছাত্ররা বিশেষ অবদান রেখেছিলেন। ষাটের দশকে বাঙালি ছাত্ররা পাকিস্তান ছাত্র ফেডারেশন এবং এলাকাভিত্তিক বিভিন্ন ছাত্র সমিতির মাধ্যমে সংগঠিত হতে থাকে। লন্ডনের ‘পাকিস্তান হাউজে অবস্থিত পাকিস্তান ছাত্র ফেডারেশন যুক্তরাজ্য ভিত্তিক একটি ছাত্র সংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। এই ছাত্র ফেডারেশনে নেতৃত্ব গ্রহণের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন ও বাঙালিদের স্বাধিকার আদায়ের দাবি জোরদার করার লক্ষ্যে বাঙালি ছাত্ররা বিলাতে ঐক্যবদ্ধ হয়। বাঙালি ছাত্রদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় পাকিস্তান ছাত্র ফেডারেশনে মাহমুদুর রহমান, আমিরুল ইসলাম, শরফুল ইসলাম খান, সুবেদ আলী টিপু ও একরামুল হক প্রমুখ প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্বে পাকিস্তান জাতীয় সংসদের বৈঠক বাতিল ঘােষণার প্রতিবাদ করার জন্য পাকিস্তান ছাত্র ফেডারেশনের এক সভায় পাকিস্তান ছাত্র ফেডারেশনের নেতৃত্বের সাথে বাঙালি সদস্যদের মতবিরােধ হয়। পাকিস্তানের অখণ্ডতা ও সংহতির জন্য জেনারেল ইয়াহিয়া কর্তৃক গৃহিত পদক্ষেপকে নিন্দার প্রস্তাব নিয়ে মতবিরােধ হয় এবং অপ্রীতিকর ঘটনায় পাকিস্তান ছাত্র ফেডারেশনের সভা পণ্ড হয়ে যায়। পাকিস্তান ছাত্র ফেডারেশনের তত্ত্বালীন সভাপতি বাঙালি (একরামুল হক) হওয়া স্বত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি ফেডারেশনের মাধ্যমে উত্থাপন করা সম্ভব হয় নাই। তার ফলশ্রুতিতে বাঙালি ছাত্রদের অংশ গ্রহণে পাকিস্তান ছাত্র ফেডারেশনের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যায় ।
এতদ্উদ্দেশ্যে পাকিস্তান যুব সমিতি নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে তাতে শুধুমাত্র বাঙালি ছাত্র ও যুবকদের সদস্য করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এই উদ্যোগে যারা অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন তাদের মধ্যে মােহাম্মদ হােসেন মঞ্জু, সুলতান মাহমুদ শরীফ, এ, কে, নজরুল ইসলাম, আহমেদ হােসেন জোয়ার্দার, এ. টি. এম, ওয়ালী আশরাফ, মনজুর মাের্শেদ, সামসুল আলম চৌধুরী, জিয়াউদ্দিন মাহমুদ, লুৎফর রহমান সাহজাহান, আখতার ইমাম, শফিউদ্দিন মাহমুদ বুলবুল, সামসুল আবেদীন, আনিছ আহম্মদ, শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ও লেখকের নাম বিশেষ উল্লেখযােগ্য । উপরােক্ত সংগঠনের উদ্যোক্তা সদস্যদের পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতি বিরােধী বিচ্ছিন্নতাবাদী চক্র বলে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। প্রবাসী ছাত্রদের মধ্যে পাকিস্তান বিরােধী তথা জাতীয়তাবাদী শক্তির মেরুকরণ শুরু হয় মূলত পাকিস্তান ছাত্র ফেডারেশনের নির্বাচনকে উপলক্ষ করে। বিলাত প্রবাসী বাঙালি ছাত্রদের মধ্যে একটি ক্ষুদ্র অংশ অবশ্য পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। তাদের অংশ পাকিস্তান যুব ফেডারেশনের সাথে ঐক্যমত পােষণ করেননি, বরং পাকিস্তানী ছাত্রদের সমঝােতা করে পাকিস্তান ছাত্র ফেডারেশনের নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। এই আপােসকামী ব্যক্তিবর্গের মধ্যে বেশির ভাগই তৎকালীন সরকার সমর্থিত ছাত্র সংগঠন এন এস এফ এর কর্মী ও সমর্থক ছিলেন।
পূর্ব পাকিস্তান হাউজ
ষাটের দশকে পাকিস্তান হাউজে অবস্থিত ছাত্র ফেডারেশনে বিভেদকে কেন্দ্র করে এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে শােষণ ও নির্যাতনের প্রশ্নের বাঙালি ছাত্রদের সাথে পাকিস্তানী ছাত্রদের বিরােধ তীব্র হয়। জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ বাঙালি ব্যবসায়ী ও সমাজকর্মীদের সহযােগিতায় উত্তর লন্ডনে ১৯৬৪ ইং সনে ৯১নং হাইবারী হীলে পূর্ব পাকিস্তান হাউজ’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। পাকিস্তানী দূতাবাসের নানা হুমকি ও দেশদ্রোহিতার অভিযােগকে উপেক্ষা। করে ষাটের দশকে পূর্ব পাকিস্তান হাউজ’ প্রতিষ্ঠা বিলাতের প্রবাসী বাঙালিদের কাছে একটি উল্লেখযােগ্য ঘটনা। পাকিস্তানীরা এই হাউজ’ প্রতিষ্ঠাকে নিছক একটি বাড়ি ক্রয় হিসেবে মেনে নিতে পারেনি। তাদের দৃষ্টিতে এই আলাদা হাউজ’ প্রতিষ্ঠাকে পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতি বিনষ্ট করে আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কর্মসূচীর অংশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে পূর্ব পাকিস্তান হাউজ’ পশ্চিম লন্ডনে অবস্থিত পাকিস্তান হাউজের’ বিকল্প এবং বাঙালিদের আলাদা অস্তিত্বের প্রমাণ স্বরূপ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। এই উদ্যোগের সাথে জড়িত ব্যক্তিবর্গের নানা নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছিল এবং পরবর্তিকালে মুক্তিযুদ্ধকালে পূর্ব পাকিস্তান হাউজ’ ও তার সাথে জড়িত ব্যক্তিবর্গ বিশেষ ভূমিকা রাখতে সমর্থ হয়েছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধিকারের সংগ্রামে এবং জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষের ক্ষেত্রে বিলাত প্রবাসীদের কাছে “পূর্ব পাকিস্তান হাউজ” একটি আলাদা অস্তিত্বের প্রতিক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল। “পূর্ব পাকিস্তান হাউজ” প্রতিষ্ঠার পিছনে যে চেতনা কাজ করেছিল তা ছিল স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়। ১৯৬২ সনের দিকে প্রতিষ্ঠিত “উত্তর সূরী” নামক এক সংগঠনের একদল প্রগতিশীল ছাত্র পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে পাকিস্তানের অব্যাহতভাবে শােষণ, বঞ্চনা ও নির্যাতন থেকে পরিত্রাণের জন্য স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় গ্রহণ করে ।
খােলাখুলিভাবে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার কথা প্রথম পূর্ব পাকিস্তান হাউজ” এর পক্ষ থেকে ঘােষণা করা হয় । “পূর্ব পাকিস্তান হাউজ” প্রথমে একটি সংগঠন হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬২ সালের শেষ দিকে এই প্রতিষ্ঠান থেকে “Unhappy East Pakistan” শিরােনামে একটি বুকলেট প্রকাশ করা হয় যার মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্য, শােষণ ও নির্যাতনের কথা প্রকাশ করা হয়। পরবর্তি সময়ে লন্ডনে বসবাসকারী ব্যবসায়ী, রেষ্টুরেন্ট মালিক ও সমাজকর্মীদের যৌথ প্রয়াসে উত্তর লন্ডনের হাইবারী হীলে “পূর্ব পাকিস্তান হাউজ” এক নামে একটি বাড়ি ক্রয় করা হয়। তাৎপর্য পূর্ণ “পূর্ব পাকিস্তান হাউজ” আন্দোলনের সাথে তকালে লন্ডনে উচ্চ শিক্ষার জন্য অবস্থানকারী ছাত্রদের মধ্যে ড, কবির উদ্দিন আহম্মদ, ব্যারিষ্টার মওদুদ আহম্মদ, জাকারিয়া খান চৌধুরী, আমীর আলী, শফিক রেহমান, মিসেস আলেয়া রহমান, আবেদ হাসান, ব্যারিষ্টার আবদুর রশিদ, ব্যারিষ্টার আবুল খায়ের, আলমগীর কবির, ব্যারিষ্টার সাখাওয়াত হােসেন, ব্যারিষ্টার লুৎফর রহমান সাহাজাহান, ফজলে লােহানী, আবুল মনসুর, মেসবাহউদ্দিন, ড. মনােয়ার হােসেন, ড. বেলায়েত হােসেন, ব্যারিষ্টার আমিরুল ইসলাম, ফজলে আলী এবং আবিদ হােসেন প্রমুখ নেতৃবৃন্দ সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। লন্ডনের যে সকল ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক ও সমাজসেবী “পূর্ব পাকিস্তান হাউজ” এর জন্য বাড়ি ক্রয়ে আর্থিক সহযােগিতা করেছিলেন তাদের মধ্যে গউস খান, নেছার আলী, মােতালেব মিয়া, শফি আহম্মদ ও তৈয়বর রহমানের নাম উল্লেখযােগ্য।
বাংলা পত্রিকা
ষাটের দশকে প্রবাসীদের মধ্যে আরাে একটি উল্লেখযােগ্য জাতীয়তাবাদী চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটে লন্ডনে একটি বাংলা পত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে। তৎকালে আইয়ুব বিরােধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পক্ষে মতামত প্রকাশ ও প্রচারের উদ্দেশ্যে লন্ডনের বালহাম এলাকার ২নং টেম্পারলি রােড থেকে ‘জনমত’ নামে একটি পরিপূর্ণ সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ লাভ করে। এককালীন ছাত্র ইউনিয়ন নেতা, ভাসানীপন্থী রাজনৈতিক কর্মী এবং বাংলাদেশ সংসদের সাবেক এম, পি মরহুম এ. টি. এম. ওয়ালী আশরাফ জনমত’ পত্রিকাটি প্রকাশ ও সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাকে সহযােগিতা করেন জনমতের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক আনিস আহমেদ। তাদের উভয়ের আন্তরিক প্রচেষ্টা ও দেশপ্রেমিক জাতীয়বাদী প্রবাসী বাঙালিদের সহযােগিতায় অতি অল্প সময়ের মধ্যে ‘জনমত জনপ্রিয়তা লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ পূর্বকালে বিলাতে প্রবাসীদের মধ্যে পূর্ব বাংলার জনগণের দূরবস্থা, বঞ্চনা ও পাকিস্তানের শােষক গােষ্ঠীর অপকর্ম প্রচার এবং জাতীয়তাবাদী চেতনায় শুধুদ্ধকরণের কাজে জনমত’ বিশেষ অবদান রাখতে সমর্থ হয়। জনমত’ ১৯৭১ সালে পশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পাকিস্তানের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে পি, আই, এ-সহ পাকিস্তান দূতাবাসের প্রদত্ত সকল বিজ্ঞাপন প্রত্যাখ্যান করে স্বাধীন বাংলাদেশের মুখপত্র হিসেবে ভূমিকা রাখতে শুরু করে। ইতােপূর্বে অবশ্য কিছু অনিয়মিত প্রচারপত্র ও বুলেটিন স্বাধিকারের স্বপক্ষে প্রচার কার্যে অংশগ্রহণ করে। তবে নিয়মিতভাবে মুক্তিযােদ্ধাদের খবরাখবর পরিবেশন ও স্বাধীনতার স্বপক্ষে বিভিন্ন লেখনীর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রবাসী বাঙালিদের প্রেরণা জোগাতে জনমত’-এর ঐতিহাসিক ভূমিকা অনস্বীকার্য। নিয়মিত বাংলা সাপ্তাহিক “জনমত” ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কয়েকটি অনিয়মিত বাংলা পত্রিকা লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয়। ১৯৬৯ সালে ‘মশাল’ নামে। একটি সাপ্তাহিক বামপন্থি চিন্তার বাহক হিসাবে অনিয়মিতভাবে প্রকাশিত হয়। ‘মশাল’ এর সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন শেখ আব্দুল মান্নান। ‘শিখা’ নামে আরেকটি বাংলা সাপ্তাহিক অনিয়মিতভাবে প্রকাশ লাভ করে। এই পত্রিকার দুটি সংখ্যা সম্পাদনা করেন জনমত’ এর সম্পাদক এ, টি, এম, ওয়ালী আশরাফ এবং পরবর্তিতে সম্পাদনার দায়িত্ব নেন শেখ আবদুল মান্নান।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে চীন পন্থিদের মুখপত্র হিসাবে গণযুদ্ধ’ নামে একটি সাপ্তাহিক অনিয়মিভাবে প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকার সম্পাদনা মণ্ডলির সদস্য ছিলেন জিয়াউদ্দিন মাহমুদ, মেসবাহ উদ্দিন, জগলুল হােসেন এবং ব্যারিষ্টার লুৎফর রহমান সাহজাহান। মুক্তিযুদ্ধের মূল ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দীর্ঘ মেয়াদি সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে মুক্তিযুদ্ধ প্রবাহিত করা (ভিয়েৎনামের ধারায়) ছিল ‘গণযুদ্ধ’ এর মূল বক্তব্য। ষ্টিয়ারিং কমিটি এর উদ্যোগে আফরােজ আফগান চৌধুরীর সম্পাদনায় বাংলাদেশ সংবাদ পরিক্রমা’; পূর্ব বাংলা পাবলিকেশন এন্ড প্রিন্টিং কোম্পানী লিঃ এর পক্ষে ডাইরেক্টর এম. এ. রাজ্জাকের তত্ত্বাবধানেও একরামুল হকের সম্পাদনায় সাপ্তাহিক বাংলাদেশ’ এবং বাংলাদেশ। জনগণতান্ত্রিক ফ্রন্টের উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধ” নামে পাক্ষিক পত্রিকা অনিয়মিতভাবে প্রকাশিত হয়। এই সকল পত্রিকা তাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ সমর্থন ও উৎসাহ প্রদানে ভূমিকা রাখে। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাঙালিদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি এবং পাকিস্তানের অখণ্ডতাকে সমর্থন করে আবুল হায়াত নামে এক বাঙালির সম্পাদনায় মুক্তি’ নামে একটি অনিয়মিত পত্রিকাও লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয়। পূর্ব লন্ডনের গ্রান্ড প্যালেস হলের সামনে “লন্ডন এ্যাকশন কমিটি আয়ােজিত জনসভায় বিচারপতি চৌধুরীর। সামনেই মুক্তি’ পত্রিকায় অগ্নি সংযােগ করে প্রতিবাদ করা হয় । ঊনসত্তরের ছাত্র গণআন্দোলন ও আইনজীবী প্রেরণ ষাটের দশকের শেষ দিকে যখন স্বাধিকারের আন্দোলন তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানে তীব্র আকার ধারণ করে তখন তার হাওয়া স্বাভাবিকভাবেই সুদূর বিলাতেও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল। উনসত্তরের ছাত্র গণ আন্দোলনের সময়ে বিলাত প্রবাসী বাঙ্গালীরা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র-জনতার সাথে একাত্মতা ঘােষণা করে বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করেছিলেন।
জনমত গঠনে পাকিস্তান দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। পূর্ব বাংলার জনগণের উপর পাকিস্তানী শাসক গােষ্ঠীর ২৪ বছরের জবরদস্তি শাসনের ফলাফল ও তার প্রতিক্রিয়া তুলে ধরে লিফলেট ও প্রচারপত্র বিলির কার্যক্রম গ্রহণ করে জনমত সৃষ্টির পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছিল। স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনের নেতা শেখ মুজিবর রহমানকে যখন পাকিস্তান সরকার তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান আসামী হিসেবে গ্রেফতার করে তখন বিলাত প্রবাসীদের মধ্যে তুমুল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল। বিলাত প্রবাসী বাঙালিরা এই ষড়যন্ত্র মামলার প্রতিবাদে বিক্ষোভের আয়ােজন করে এবং মামলা পরিচালনার জন্য বিলাত থেকে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী প্রেরণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। বিলাত প্রবাসীরা চাঁদা সংগ্রহ করে প্রখ্যাত একজন “কুইনস কাউন্সিলর”কে শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ সমর্থনের জন্য ঢাকায় প্রেরণ করেছিলেন। তৎকালীন সরকার সেই বৃটিশ আইনজীবীকে নির্বিঘ্নে কর্তব্য পালনে নানা রকমের বাধা সৃষ্টি করেছিলেন এবং বেশি দিন ঢাকায় থাকতে দেননি। এই আইনজীবীর আগমন বিচারের প্রক্রিয়ায় কতটুকু শুভ প্রভাব বিস্তার করেছিল তা স্পষ্ট করে বলা না গেলেও তথাকথিত বিচার চলা সময়ে পূর্ব পাকিস্তানে তখন যে আন্দোলন চলছিল তার গতি বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে বিপুল প্রেরণা সৃষ্টি করেছিল। জনগণের তীব্র আন্দোলনের মুখে তথাকথিত মামলার প্রধান বিচারককে পালিয়ে প্রাণে বাঁচতে হয়েছিল এবং পাকিস্তান সরকার আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করে শেখ মুজিবর রহমানকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছিল। ঊনসত্তরের ছাত্র-গণ আন্দোলন বিলাত প্রবাসীদের এই অবদান ক্ষুদ্র হলেও তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। একজন আইনজীবী প্রেরণ করে দেশের জনগণের মধ্যে আন্দোলনের উৎসাহ সৃষ্টির সাফল্য থেকে বিলাতের প্রবাসীরা দেশের প্রতি তাদের দায়িত্ববােধের এবং দেশের দুর্দিনে জনগণের পাশে দাঁড়ানাের যে আত্মবিশ্বাস ও শিক্ষা লাভ করেছিল তা পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধকালে জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে।
সত্তরের জলােচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড়
১৯৭০ সালে প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়ে যখন পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের দুর্গত জনগণের প্রতি চরম অবহেলা প্রদর্শন করে বিমাতা সুলত মনােভাবের পরিচয় দিলেন তখন বিলাত প্রবাসী বাঙালিরা তা ফলাও করে প্রচার করেছিল। লন্ডনের রাস্তায় বাঙালিরা সাহায্যের হাত পেতে বিশ্ব দরবারে পাকিস্তানী শাসকদের আসল চেহারা উন্মােচন করে দিতে সাহায্য করেছিল। বিভিন্ন সাহায্যসংস্থা ও দুতাবাসসমূহে বাঙালিরা লবিং’ করে পাকিস্তানের প্রশাসনের অবহেলার কথা তুলে ধরতে সমর্থ হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পাকিস্তান শাসকগােষ্ঠীর এহেন মনােবৃত্তির পরিচয় বৃটিশ সাংবাদিকদের মধ্যে প্রচার করে তাদেরকে বাঙালিদের প্রতি সংবেদনশীল করে গড়ে তুলতে নানা প্রচারপত্র সহ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। এই কাজে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন বি, বি, সি, বাংলা বিভাগের কর্মকর্তাবৃন্দ। তাদের মধ্যে সিরাজুর রহমান, প্রয়াত শ্যামল লােধ, কমল বােস, এ, টি, এম। ওয়ালী আশরাফ সহ বিলাতে অধ্যয়নরত কিছু ছাত্র বিশেষ ভূমিকা রাখতে সমর্থ হয়েছিল। সাংবাদিকদের সংবেদনশীল মনােভাবের ফলে ১৯৭০ এর-ঘূর্ণিঝড় ও জলােচ্ছাসের সময় বিলাতের পত্র পত্রিকা পাকিস্তান প্রশাসনের সমালােচনা মুখর ছিল যার ফলে বৃটিশ জনমত বাঙালিদের পক্ষে সৃষ্টি হয়েছিল। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠী এই আন্দোলনকে ‘বায়াফ্রার’ মতাে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন বলে চিত্রায়িত করতে চেষ্টা চালায়। কিন্তু বৃটিশ। সাংবাদিকদের সহানুভূতি এবং বৃটিশ জনমত বাঙালিদের পক্ষে থাকায় মুক্তিযুদ্ধকালে বৃটিশ। পত্রপত্রিকা বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্বজনমত সৃষ্টিতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশের মুক্তি। সংগ্রামে বিশ্ব প্রচারকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত লন্ডনের সংবাদপত্রকে প্রভাবান্বিত করার ক্ষেত্রে বিলাত প্রবাসীদের ভূমিকা বিশেষ কৃতিত্বের দাবিদার।
মুক্তিযুদ্ধপূর্ব সময়ে প্রবাসীদের প্রস্তুতি
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রাক্কালে দেশে যে প্রতিরােধ ও অসহযােগ আন্দোলন চলছিল তার প্রতিক্রিয়া সুদূর বিলাতে সৃষ্টি হয়েছিল। বিলাতে বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চলে পাকিস্তানের সংসদ অধিবেশন আহ্বানের টালবাহানার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মিছিল ও মিটিং এর আয়ােজন করা হয়েছিল। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও পেশাজীবী সংগঠন থেকে পাকিস্তান দূতাবাসে মেমােরেন্ডাম প্রদান ও বিক্ষোভ প্রদর্শন করে বিলাত প্রবাসীদের মনােভাব ব্যক্ত করা হয়েছিল। তৎকালীন পাকিস্তান পার্লামেন্টে (National Assembly) বাঙালিদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় জেনারেল ইয়াহিয়া খান সংসদ আহ্বান না করে সংসদ বাতিলের যে ষড়যন্ত্র করছিল তা প্রবাসী সচেতন বাঙালিরা উপলব্ধি করতে পেরেছিল। এই ষড়যন্ত্র প্রতিহত করা এবং ষড়যন্ত্রের নীলনক্সা বিশ্বজনমতের কাছে তুলে ধরার জন্য বিলাতে বিভিন্ন শহরে বিশেষ করে লন্ডনে পাকিস্তান দূতাবাসকে কেন্দ্র করে আন্দোলন গড়ে ওঠে। এ ক্ষেত্রে বিলাতে যে কয়টি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠিত ছিল তার মধ্যে আওয়ামী লীগ, ন্যাপ ও প্রবাসী ছাত্ররা বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল। আন্দোলনের এই পর্যায়ে একটি বিশেষ দিক লক্ষণীয় ছিল যে, পাকিস্তানের কিছু বুদ্ধিজীবী, ও রাজনৈতিক সচেতন ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রাক্কালে সংসদ অধিবেশন আহ্বান এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের কাছে পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবিতে বিলাতে বাঙালিদের সাথে একাত্মতা ঘােষণা করে আন্দোলনে অংশ গ্রহণ। করেছিলেন। বিলাতের বিভিন্ন অরাজনৈতিক মানবতাবাদী সংগঠন সমূহ পাকিস্তানের রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে সেমিনার সিম্পােজিয়ামের আয়ােজন করে সমস্যার সঠিক সমাধান খুঁজতে চেষ্টা করেছিল। কমনওয়েলথ সােসাইটি, বিভিন্ন চার্চ এবং বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের সংসদ সমূহ পাকিস্তানের রাজনৈতিক সমস্যা একটি ন্যায় সংগত সমাধান চেয়েছিলেন। এমনি একটি সেমিনার আয়ােজন করেছিল লন্ডনের ইম্পােরিয়েল কলেজ ছাত্র সংসদের ডিবেটিং সােসাইটি। উক্ত সেমিনারে পূর্ব পাকিস্তানের পক্ষ সমর্থন ও পাকিস্তানের অবস্থান। ব্যাখ্যা করে বক্তব্য রাখার জন্যও বক্তা নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল। পাকিস্তানের অবস্থান ব্যাখ্যা করতে আলােচক হিসেবে এসেছিলেন পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক কলিম সিদ্দিকী। তিনি লন্ডন থেকে প্রকাশিত বহুল প্রচারিত ইংরেজি দৈনিক দি গার্ডিয়ানে কর্মরত একজন। সাংবাদিক ছিলেন। সাংবাদিকতার মান আন্তর্জাতিক পর্যায়ে না হলে একজন পাকিস্তানী হয়ে ইংরেজী দৈনিকে কলাম লেখার সুযােগ লাভ করতেন না। সাংবাদিক কলিম সিদ্দিকী উন্ন সেমিনারে শশী বিদেশী সঞ্চণ শ্রাতাকে বিস্মিত করে দিয়ে পূর্ব পাকিও-র দাবির এ জোর সমর্থন দিলেন।
তিনি তার বক্তব্যে বললেন যে, ‘আজ পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষমতাশালীদের প্রয়ােজন সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব পাকিস্তানের ভাইদের কাছে হাত জোড় করে মিনতি করা যাতে তারা পশ্চিম পাকিস্তানকে বাদ দিয়ে না দেন।’ জনসংখ্যার ক্ষেত্রে সংখ্যালঘু হয়ে সারাজীবন সম্পদের সিংহভাগ ভােগ করা সম্ভব হবে তা যদি পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠী মনে করে থাকেন তাহলে তারা বােকার স্বর্গে বসবাস করছেন বলেও কলিম সিদ্দিকী উক্ত সেমিনারে মন্তব্য করেছিলেন। উক্ত সেমিনারে ঐ কলেজের তৎকালীন ছাত্র হিসেবে একজন বক্তা হিসেবে উপস্থিত থাকার আমার সুযােগ হয়েছিল। পাকিস্তান। দূতাবাসের কর্তা ব্যক্তিদের সামনে এ ধরনের বক্তব্য রাখার জন্য নাকি কলিম সিদ্দিকীকে অনেক খেসারত দিতে হয়েছিল। তাকে ছাড়াও পশ্চিম পাকিস্তানী বেশ কিছু বুদ্ধিজীবী ও ছাত্র ১৯৭০ এর শেষ দিকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের পক্ষ সমর্থন করেছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখযােগ্য যে, তাদের মধ্যে কলিম সিদ্দিকী ১৯৭০ সালের ২৪ নভেম্বর গার্ডিয়ানে স্বনামে। ‘পূর্ব পাকিস্তানে স্বাধীনতার জ্বর (ফিভার)’ এই শিরােনামে কলাম লিখেছিলেন। উপরােক্ত একটি ঘটনা থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে, পাকিস্তানের তৎকালীন শাসকগােষ্ঠী, সামরিক জান্তা ও ইয়াহিয়া খানের পাকিস্তানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার পরের পদক্ষেপ সমূহকে পশ্চিম পাকিস্তানের অনেকেই সঠিক মনে করেননি। বেশি বাড়াবাড়ি করলে যে ফলাফল ভয়াবহ হতে পারে সে ব্যাপারে অনেক প্রবাসী পাকিস্তানী বক্তৃতা, বিবৃতি ও লিখনীর মাধ্যমে পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক জান্তাকে সাবধান করেও দিয়েছিলেন। পাকিস্তানে তা প্রকাশ করা সম্ভব না হলেও বিলাত প্রবাসী বহু পাকিস্তানী তা উপলব্ধি করেছিলেন এবং প্রকাশ করেছিলেন। কলিম সিদ্দিকী এক পর্যায়ে ১৯৭০ সালের ২৫ নভেম্বরের গার্ডিয়ানে ইয়াহিয়ার চলে যাওয়া উচিৎ’ শিরােনামে কলাম লিখেও পাকিস্তানকে রক্ষা করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে যখন জাতীয় পরিষদ আহ্বানের প্রশ্নে দেশে চরম উত্তেজনা এবং পূর্ব পাকিস্তানে দূর্বার প্রতিরােধ আন্দোলন চলছিল তখন লন্ডনের বাঙালি।
ছাত্রদের চাপে জাতীয় পরিষদ আহ্বানের প্রশ্নে পাকিস্তান ছাত্র ফেডারেশনের একটি সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। পাকিস্তান ছাত্র ফেডারেশনের নেতৃত্বে ছিলেন পাকিস্তানের অখণ্ডতায়। বিশ্বাসী আপােসকামী বাঙালি ছাত্রনেতা একরামুল হক। সভা চলাকালে অন্য একজন বাঙালি ছাত্রনেতা এককালীন পূর্ব পাকিস্তানের ‘এন, এস, এফ’ নামক ছাত্র সংগঠনের নেতা এবং ফজলুল হক হলের এককালীন সহ-সভাপতি আনােয়ার আনসারী খান পাকিস্তানের প্রেসিডে ইয়াহিয়া খানের কাছে লেখা একটি মেমােরেণ্ডাম পাঠ করে তা ফেডারেশন থেকে অনুমােদন প্রার্থনা করলেন। এই পর্যায়ে স্বাধিকার আন্দোলনের স্বপক্ষের তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে উপস্থিত প্রায় সকল সদস্য এই মেমােরেন্ডাম প্রেরণকে কামার বাড়ীতে কোরান পাঠে সামিল’ হিসেবে মন্তব্য করে সভা ত্যাগ করেন। সভাটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল লন্ডনের পাকিস্তান হাউজের হজমেন্ট নিং কক্ষে। সভ৷ কক্ষ ত্যাগ করার ব্যাপারে যায়। অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন তারাই পরবর্তীকালে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে পাকিস্তান হাউজে বসেই বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেছিলেন। ফেব্রুয়ারীর এই বিভক্তি করণকে কেন্দ্র করে একাধিকবার পাকিস্তান হাউজে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। এক পর্যায়ে বিদ্রোহী গ্রুপের একজন নেতা মােহাম্মদ হােসেন মঞ্জুকে আক্রমণও করেছিল। দেশে ছাত্ররা যখন অস্ত্র নিয়ে ট্রেনিং দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিল তখন সুদূর লন্ডনেও বাঙালি ছাত্রদের সাথে পাকিস্তানী ছাত্রদের দ্বন্দ্ব ও সঙ্কট তীব্র থেকে তীব্রতর আকার ধারণ করছিল । | ১৯৭১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে বিলাত প্রবাসীদের মধ্যে শহীদ দিবস পালনের আয়ােজন ও আকার ছিল রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণের ব্যাপারে পশ্চিম পাকিস্তানীদের কোন উৎসাহ স্বাভাবিকভাবেই থাকার কথা নয়। কিন্তু তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জনসাধারণ লন্ডনের পাকিস্তান ভবন, পূর্ব পাকিস্তান ভবন ও পূর্ব লন্ডনের কমিউনিটি হল সহ বিলাতের বিভিন্ন শহরে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে মহান শহীদ দিবস পালন করেন। এই আয়ােজনের মধ্যদিয়ে বিলাত প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার পূর্ণ বহিঃপ্রকাশ ঘটে এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য মানসিক প্রস্তুতির একটি পূর্ণ সুযােগ লাভ করে। এই উপলক্ষে আয়ােজিত বিভিন্ন সভা ও সেমিনারে বিলাতে অবস্থানরত বাঙালি বুদ্ধিজীবী, ছাত্রনেতা, রাজনৈতিক কর্মী স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রস্তুতি গ্রহণ করার কথা প্রকাশ্যে প্রচার করেন এবং সাধারণ বাঙালি জনসাধারণকে স্বাধীনতার প্রয়ােজনীয়তার কথা বিশ্লেষণ করেন।
বাঙালিদের মধ্যে একটি ছােট অংশ এ সকল বক্তব্য ও প্রচারণাকে পাকিস্তানের সংহতি বিরােধী বলে মনে করতেন এবং জাতীয়তাবাদী গ্রুপ থেকে অনেক দূরে অবস্থান করতেন। পরবর্তীকালে এই গ্রুপ ব্যারিস্টার আব্বাস আলীর নেতৃত্বে বিলাতে মুক্তিযুদ্ধের বিরােধী কর্মকাণ্ডে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারির শেষ দিক তৎকালীন পাকিস্তানের জাতীয় সংসদ ভেঙ্গে দেবেন বলে যে আশঙ্কা বা রাজনৈতিক ভবিষ্যদ্বাণী প্রচারিত ছিল তা লন্ডনের পত্র পত্রিকায় ফলাও করে প্রকাশিত হচ্ছিল। প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যেও তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল। ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ তারিখে লন্ডন আওয়ামী লীগের উদ্যোগে হাইডপার্ক। স্পীকার্স কর্ণারে পাকিস্তানের জাতীয় সংসদ ভেঙ্গে দেয়ার ষড়যন্ত্রের বিরােধিতা করার জন্য এক জনসভা আয়ােজন করা হয়েছিল। যদিও উক্ত প্রতিবাদ সভা লন্ডন আওয়ামী লীগ আহ্বান করেছিল কিন্তু ইস্যুটি এতই তাৎপর্যপূর্ণ ছিল যে লন্ডন প্রবাসী বাঙালিদের বিভিন্ন দল ও গােষ্ঠী সভায় যােগদান করে তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিল। লন্ডনে অধ্যয়নরত বাঙালি ছাত্রদের তখনাে কোন স্বতন্ত্র সংগঠন গড়ে ওঠেনি। তবুও লন্ডন আওয়ামী লীগ আহুত সভায় ছাত্ররা ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করেছিল। লন্ডন আওয়ামী লীগের সভাপতি মিনহাজ উদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে উক্ত সভায় বক্তব্য রাখেন লন্ডন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সুলতান মাহমুদ শরিফ, দপ্তর সম্পাদক ইসহাক ও ছাত্রনেতা মােহাম্মদ হােসেন মঞ্জু সহ যুব ও শ্রমিক নেতৃবৃন্দ।
বক্তার জনসভায় পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানবে জাতীয় সংসদ ভেঙ্গে দিলে তার ভয়াবহ পরিণতির কথা স্মরণ করিয়ে প্রবাসী বাঙালিদেরকে যে কোন ত্যাগ স্বীকার করার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণের আহ্বান জানান। সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের কাছে পাকিস্তানের ক্ষমতা হস্তান্তর করা না হলে প্রয়ােজনে স্বাধীনতা ঘােষণা করা হবে বলেও কোন কোন বক্তা ইংগিত প্রদান করেন। এখানে প্রসঙ্গত উল্লেখযােগ্য যে, ২৮ ফেব্রুয়ারির জনসভায় দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জন্য যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ যােগদান করেনি। ইতােপূর্বে নেতৃত্বের প্রশ্নে বিলাতের আওয়ামী লীগ তিন ভাগে বিভক্ত ছিল । গাউস খান। | (মরহুম) ও তৈয়বুর রহমানের নেতৃত্বে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ নামে একটি গ্রুপ কাজ করছিল। তাদের নেতৃত্বের প্রতি চ্যালেঞ্জ করে মিনহাজ উদ্দিনের নেতৃত্বে আর একটি গ্রুপ। লন্ডন আওয়ামী লীগের নামে একটি পৃথক সংগঠন পরিচালনা করছিলেন। লন্ডন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন যথাক্রমে মিনহাজ উদ্দিন আহমেদ ও মাহমুদ। সুলতান শরিফ। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে বিশ্বাসী আরও একটি ছােট গ্রুপ তাদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে ‘ওভারসীজ আওয়ামী লীগের ব্যানারে কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। বি এইচ তালুকদার ও আহম্মদ হােসেন জোয়ারদার যথাক্রমে ওভারসীজ আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। বিলাতের আওয়ামী লীগ তিন গ্রুপে বিভক্ত থাকায় পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধকালে বিলাতের কর্মকাণ্ডকে প্রথমদিকে সমন্বয় করা কষ্টকর হয়ে পড়েছিল। এই অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণেই মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে লন্ডনের মুভমেন্টে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব লাভ করতে সমর্থ হয়নি। আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে লন্ডন আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের বাংলাদেশের সাথে অধিকতর যােগাযােগ এবং নেতৃত্বের যােগ্যতা থাকা সত্ত্বেও অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে একক নেতৃত্ব গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। এর ফলে ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে কভেন্ট্রিতে সম্মেলনের মাধ্যমে গঠিত কেন্দ্রীয় স্টিয়ারিং কমিটির সদস্যদের মধ্যে। আওয়ামী লীগের কোন গ্রুপের নেতাই স্থান পাননি।
পকিস্তানের জাতীয় পতাকা ভস্মীভূত
পাকিস্তানের জাতীয় সংসদ ভেঙ্গে দেয়ার ব্যাপার যখন চূড়ান্ত তখন তার প্রতিবাদে ও প্রতিরােধের উদ্দেশ্যে লন্ডনে বসবাসকারী প্রবাসী বাঙালিরা ১ মার্চ থেকে ৭ মার্চ (১৯৭১) পর্যন্ত একটানা আন্দোলন কর্মসূচী ঘােষণা করে। কর্মসূচীর মধ্যে ১ মার্চ থেকে লন্ডনস্থ পাকিস্তান দূতাবাসের সামনে লাগাতার তৎপরতা (Vigilance), অবস্থান ধর্মঘট ও বিক্ষোভ প্রদর্শন অব্যাহত রাখা হয়। ইয়াহিয়া খান হঠাৎ করে জাতীয় পরিষদ বসার তারিখ স্থগিত করে দেবার খবর লন্ডনে পৌছার সঙ্গে সঙ্গে হাজার হাজার ছাত্র, যুবক, চাকুরীজীবী সই রাজনৈতিক কর্মী ৫ মার্চ, ১৯৭১ তারিখে পাকিস্তান দূতাবাসের সামনে সমবেত হয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। প্রকৃতপক্ষে ৫ মার্চ তারিখে বিলাতে বসবাসকারী বাঙালিদের সাথে পাকিস্তান। দূতাবাসের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায় । সমবেত জনতা সেদিন সঙ্গত কারণেই অত্যন্ত বিক্ষুব্ধ ও উত্তেজিত ছিল । ৫ মার্চ তারিখে প্রথমবারের মতাে বিক্ষুব্ধ বাঙালিরা দূতাবাসে স্থাপিত পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা নামিয়ে তা ভস্মিভূত করে। আন্দোলনের এই পর্যায়ে বিলাত প্রবাসী ছাত্ররা এবং লন্ডন আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে একটি অংশ এই পর্যায়ে কোন অগ্রীম পদক্ষেপ, স্বাধীনতার কথা বলা, দূতাবাসে বিক্ষোভ বা পতাকা ভস্মিভূত করার মতাে কঠিন পদক্ষেপ গ্রহণের ব্যাপারে দ্বিমত পােষণ করেছিলেন। তাই এই পর্যায়ে বিলাতের আন্দোলন সৃষ্টিতে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের তেমন উৎসাহ ছিল না।
৭ই মার্চে হাইডপার্কে জনসভা। ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য
৭ মার্চের জনসভার সাথে সামঞ্জস্য রেখে ৭ মার্চ, ১৯৭১ সালে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ লন্ডনের ঐতিহাসিক হাইডপার্ক স্পীকার্স কর্ণারে এক জনসভার আয়ােজন করে। লন্ডন আওয়ামী লীগ, ছাত্র সংগঠন, শ্রমিক সংগঠন সহ হাজার হাজার বাঙালি উক্ত জনসভায় যােগদান করেন। বার্মিংহাম, ম্যানচেষ্টার সহ বিভিন্ন শহর থেকেও বাঙালিরা হাইডপার্ক কর্ণারে সমবেত হয়ে বাঙালিদের দাবির প্রতি একাত্মতা ঘােষণা করেন। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সভাপতি গাউস খানের (মরহুম) সভাপতিত্বে উক্ত জনসভায় বেশির ভাগ বক্তা বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা ঘােষণা করেন। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের। নেতারা অবশ্য এ ব্যাপারে মুখ বন্ধ রাখেন এবং সভার প্রস্তাবাবলীতে স্বাধীনতার ঘােষণার বিষয় অস্পষ্ট রাখেন। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের নেতাদের বক্তব্য ছিল যে, সেদিন ঢাকায়। শেখ মুজির স্বাধীনতা ঘােষণা না করে একটি আপােষ ফর্মুলা দেবেন। অতএব, লন্ডনে। স্বাধীনতা ঘােষণা করলে তা আত্মঘাতি হবে। এমনি একটি দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে হাইডপার্ক-এর। জনসভা শেষ হয়। ১৯৭১ সনের ৭ মার্চ হাইড-পার্ক স্পীকার্স কর্ণারে যে উল্লেখযােগ্য ঘটনা ঘটে তা হলাে। বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন। যুক্তরাজ্যস্থ আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের মধ্যে দ্বিধা থাকা। সত্ত্বেও লন্ডন আওয়ামী লীগ ও ছাত্র নেতৃবৃন্দের উদ্যোগে হাইডপার্কের সমাবেশে। বাংলাদেশের একটি কাল্পনিক পতাকা উত্তোলন করা হয়। লন্ডনের বিপ্লবী কর্মীদের মধ্যে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ পতাকা কি হতে পারে তার একটা অস্পষ্ট ধারণা বিরাজমান ছিল। সবুজ, লাল ও সােনালী রংয়ের সমন্বয়ে বাংলাদেশের পতাকা শােভা পাবে এমন একটা ধারণার উপর ভিত্তি করে সেদিনের পতাকাটি ডিজাইন করা হয়েছিল যার পটভূমিতে ছিল। সবুজ রং এবং মাঝে লাল সূর্য ও তার অভ্যন্তরে ছয় পাতা বিশিষ্ট একটি সােনালী পাট গাছ। সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা চির সবুজ বাংলাদেশের প্রতীক হিসেবে পতাকার পটভূমিতে সবুজ রং এবং একটি রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে লাল সূর্য লন্ডনে উত্তোলিত বাংলাদেশের পতাকায় স্থান পেয়েছিল। লাল সূর্যের মধ্যভাগে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে বাংলাদেশের সােনালী আঁশ-পাট এবং ৬ দফা আন্দোলনের প্রতীক হিসেবে পাটের ছয়টি সােনালী পাতা উক্ত পতাকায় সন্নিবেশিত করা হয়েছিল। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, পরবর্তীকালে ২৫ মার্চের পর বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণার প্রেক্ষাপটে মুজিবনগর সরকার কর্তৃক মুজিবনগরে উত্তোলিত পতাকার গঠন বিলাতে প্রকাশিত হওয়ার পর উক্ত পতাকার গঠন পরিবর্তন করা হয়।
স্বাধীনতা ঘােষণা পূর্ব পর্যন্ত বিলাতের বাঙালিদের মধ্যে যে গ্রুপট সবচাইতে সােচ্চার। ছিলেন তারা হলেন প্রগতিশীল ছাত্র কমী, লন্ডন আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ, ইয়থ। ফেডারেশন, পূর্ব পাকিস্তান লিবারেশন ফ্রন্টের কর্মী ও নেতৃবৃন্দ। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর। উপরােক্ত সংগঠনের কর্মী ও নেতারাই বিভিন্ন এ্যাকশন কমিটি সমূহের নেতৃত্ব প্রদান করেছিলেন। স্বাধীনতার ও স্বায়ত্ত্বশাসনের পক্ষে বাঙালিদের মুখপত্র হিসেবে জাতীয়তাবাদী সাপ্তাহিক পত্রিকা “জনমত ও পূর্ব পাকিস্তানের লিবারেশন ফ্রন্টের মুখপত্র ‘বিদ্রোহী বাংলা এর মাধ্যমে আন্দোলনের খবরাখবর প্রবাসীদের মধ্যে প্রচার লাভ করত। | ১ মার্চ থেকে ৭ মার্চের লাগাতার আন্দোলনের এক পর্যায়ে বাঙালি ছাত্রদের চাপে ‘পাকিস্তান স্টুডেন্ট ফেডারেশন’ পাকিস্তান হাই কমিশনের সামনে একটি জনসভা আহ্বান করতে বাধ্য হয়। ইতােপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, পাকিস্তানের সংহতিতে বিশ্বাসী একটি আপােসকামী বাঙালি গ্রুপের নেতা একরামুল হক তখন উক্ত ফেডারেশনের সভাপতি ছিলেন। একরামুল হক, আনােয়ার আনসারী খান, মনােয়ার হােসেন প্রমুখ নেতৃবৃন্দ পাকিস্তানী ছাত্রদের সাথে বিদ্রোহী ও বিক্ষোভকারী বাঙালি ছাত্র নেতৃবৃন্দের আপােস করার চেষ্টা করেন। কিন্তু বাঙালিদের তুমুল বিক্ষোভের মুখে কোন প্রকার আপােস ফর্মুলায় উপনীত হওয়া বা যৌথ কোন মেমােরেন্ডাম প্রদান করা সম্ভব হয়নি। বরং বাঙালি বিপ্লবী ছাত্র নেতারা যখন বাংলায় বক্তব্য শুরু করেন তখন সভা হাতাহাতি ও ধস্তাধস্তির মধ্য দিয়ে ভেঙ্গে যায়। এক পর্যায়ে পশ্চিম পাকিস্তানের ছাত্রদের আক্রমণে ইয়থ ফেডারেশনের নেতা শামসুল আলম আহত হন। উক্ত ঘটনার পর পাকিস্তান দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ আরাে তীব্র আকার ধারণ করে। লন্ডন ও আশেপাশের বসবাসকারী বাঙালি ছাত্র, শ্রমিক ও কর্মচারীরা বিক্ষোভে এসে যােগদান করতে শুরু করে। তখন বিলাতে পাকিস্তানের হাই কমিশনার ছিলেন সালমান আলী। তিনি এক পর্যায়ে কড়া পুলিশ প্রহবায় সমবেত বিক্ষোভকারীদের কাছে পাকিস্তানের পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু তুমুল বিক্ষোভ ও ঘৃণার মুখে সালমান আলীর সেই চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছিল।
সালমান আলীর সামনেই বাঙালি ছাত্ররা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কুশপুত্তলিকায় অগ্নি সংযােগ করে স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে শ্লোগান দেয়। বৃটিশ পুলিশের তা নিয়ন্ত্রণ করতে হিমসিম খেতে হয়েছিল। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ লন্ডনের হাইওপার্কে জনসমাবেশ, স্বাধীনতা ঘােষণা ও বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন ছাড়াও পাকিস্তান স্টুডেন্ট হাউজে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার শপথে “বেঙ্গল স্টুডেন্ট এ্যাকশন কমিটি গঠন করা হয়। বাংলাদেশে স্বাধীনতা ঘােষণার পর বিলাতে বহু সংগ্রাম পরিষদ গড়ে উঠেছিল কিন্তু ‘বেঙ্গল স্টুডেন্টস এ্যাকশন কমিটি’ স্বাধীনতা ঘােষণার পূর্বেই গঠিত প্রথম একটি সংগ্রাম কমিটি। পরবর্তীকালে অবশ্য এই সংগ্রাম কমিটির নামে কিছুটা রদবদল করে বাংলাদেশ স্টুডেন্টস এ্যাকশন কমিটি ইন ইউকে রাখা হয়েছিল। ৭ মার্চে পাকিস্তান স্টুডেন্টস হাউজে অনুষ্ঠিত সভায় সভাপতিত্ব করেন ছাত্রনেতা মােহাম্মদ হােসেন মঞ্জু । উক্ত সভায় সর্বসম্মতিক্রমে “বেঙ্গল স্টুডেন্টস এ্যাকশন কমিটি গঠন ও তার ১১ জন সদস্য মনােনয়ন দানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। প্রাথমিক এই ১১ জন সদস্যের মধ্যে ছিলেন মােহাম্মদ হােসেন মঞ্জু (বর্তমান লন্ডনের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ও সমাজকর্মী), খন্দকার মােশাররফ হােসেন (এই গ্রন্থের লেখক), এ কে নজরুল ইসলাম (লন্ডনে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী), এ টি এম ওয়ালী আশরাফ (বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের সাবেক সদস্য), সুলতান মাহমুদ শরীফ (বাংলাদেশে ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ), শফিউদ্দিন মাহমুদ বুলবুল (ব্যারিষ্টার), সামসউদ্দিন আহম্মদ চৌধুরী মানিক (ব্যারিষ্টার), জিয়াউদ্দিন মাহমুদ (ব্যারিষ্টার ও বৃটেনে শিক্ষকতা পেশায় নিয়ােজিত), লুৎফর রহমান সাহজাহান (ব্যারিষ্টার ও বাংলাদেশে আইনজীবী), আখতার ইমাম (ব্যারিষ্টার ও বাংলাদেশে আইনজীবী) ও কামরুল ইসলাম (বর্তমান অবস্থান জানা নেই)। ‘বেঙ্গল স্টুডেন্টস এ্যাকশন কমিটি’ দেশে স্বাধীনতা ঘােষণার পর বাংলাদেশ স্টুডেন্টস এ্যাকশন কমিটি’ নাম গ্রহণ করে এবং কমিটিকে সম্প্রসারিত করে ২১ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি করা হয়। কমিটির কর্মকাণ্ড সমন্বয় ও সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য তিনজন আহ্বায়ক নির্বাচিত করা হয়। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেন যথাক্রমে মােহাম্মদ হােসেন মঞ্জু, খন্দকার মােশাররফ হােসেন (লেখক) ও এ. কে. এম. নজরুল ইসলাম। স্বাধীনতা ঘােষণার পর কিছুদিনের মধ্যে মােহাম্মদ হােসেন মঞ্জু স্বাধীনতা যুদ্ধে আরাে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করার উদ্দেশ্যে মুজিবনগর গমন করায় আমার (লেখক) উপরই ছাত্র সংগ্রামের আহ্বায়কের দায়িত্ব অর্পিত হয় এবং মুক্তিযুদ্ধের বেশির ভাগ সময়ই এই দায়িত্ব পালন করতে হয়। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ অফিস হাই হবাের্ণের ৩৫ নং গ্যামেজেজ বিল্ডিং এ স্থাপন করা হয়। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সক্রিয় সদস্য ও তৃতীয় আহ্বায়ক এ. কে. নজরুল ইসলাম তার ব্যবসার অফিসটি সম্পূর্ণভাবে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদকে হস্তান্তর করেন। মুক্তিযুদ্ধের পুরাে সময় এই অফিস থেকে বহু গুরুত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধ কালে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কর্মকাণ্ড ও গুরুত্ব সম্পর্কে মুজিবনগর সরকারের তৎকালীন বৈদেশিক প্রতিনিধি ও বাংলাদেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি মরহুম বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী তার লিখিত প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি’ শীর্ষক গ্রন্থে বহুবার অত্যন্ত জোরালােভাবে উল্লেখ করেছেন। ৭ মার্চ উত্তর লন্ডনের হাইবারী হীলে অবস্থিত পূর্ব পাকিস্তান হাউজে’ এক সমাবেশ | অনুষ্ঠিত হয়। এই সমাবেশ আহ্বানের উদ্যোগ গ্রহণ করেন তৎকালে পূর্ব পাকিস্তান হাউজ’ | এর সেক্রেটারী আমীর আলী। এই সমাবেশে ছাত্র, চাকুরীজীবী ও রাজনৈতিক নেতা সহ বিভিন্ন পেশার মানুষ উপস্থিত ছিলেন। উক্ত সমাবেশ থেকে সর্বসম্মতভাবে পূর্ববঙ্গের স্বাধীনতা ঘােষণার প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। প্রস্তাবের কিছু অংশ উল্লেখ করা প্রয়ােজন যাতে felett f507 The panjabi answer to the popular Bangalee mandate (given by the electorate in the General Election) has been a bloodbath. And so things have come to snch a hcad that nothing short of complete Independence can satisfy the Bangalees. Hence the revolution. We, the overseas Bangalees, express our fullest solidarity with our fighting and slaying brothers back home. A free Bengal will exact retribution for their blood. And as the same blood flows through our veins, we also raise our voices in unison with them and say “Victory for Bengal, Longlive Revolution.” ঢাকায় ৭ মার্চ স্বাধীনতার ঘােষণা দেয়া না হলেও হাইড পার্ক স্পীকার্স কর্ণারের সভায় স্বাধীনতার ঘােষণা ও বাংলাদেশের পতাকা (কাল্পনিক) উত্তোলন এবং পূর্ব পাকিস্তান হাউজে’ অনুষ্ঠিত সমাবেশের স্বাধীনতা ঘােষণার । প্রস্তাব একই চেতনার বহিঃপ্রকাশ। ১৪ মার্চ যুক্তরাজ্যস্থ আওয়ামী লীগের উদ্যোগে পাকিস্তান জাতীয় সংসদ ভেঙ্গে দেয়ার । প্রতিবাদে, পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা বন্ধ এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা। হস্তান্তরের দাবিতে লন্ডনের হাইডপার্ক স্পীকার্স কর্ণারে এক বিরাট জনসভার আয়ােজন করা হয়। বিভিন্ন শহর থেকে কোচ ও ট্রেন যােগে সমাবেশে যােগ দেয়ার জন্য হাজার হাজার। বাঙালি হাইড পার্কে সমবেত হয়। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সভাপতি গাউস খান। সমাবেশ শেষে প্রায় ১০ হাজার বাঙালির এক বিরাট মিছিল লাউন্ডস। স্কোয়ারে অবস্থিত পাকিস্তান হাইকমিশনে পূর্ব বাংলার দাবি সম্বলিত একটি স্মারকলিপি পেশ করে।
মার্চের শেষ সপ্তাহের তৎপরতা
দেশের জনগণের জন্য ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহ যেমনি বিভীষিকাময় ও দুঃস্বপ্নের ছিল তেমনি বিলাত প্রবাসীদের মধ্যে ছিল উত্তেজনা ও উৎকণ্ঠা মিশ্রিত প্রতিক্রিয়া। দেশের অভ্যন্তরে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মধ্যে যে আলােচনা চলছিল তা প্রবাসীরা খুব আগ্রহ সহকারে লক্ষ্য করছিল। প্রতিদিন অফিস বা কারখানার কাজ শেষ করে লন্ডনের বাঙালিরা ছুটে আসতেন পাকিস্তান দূতাবাসের সামনে। ইতােপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, তৎকালে প্রতিদিন বিকেলে পাকিস্তান দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ ও সমাবেশের আয়ােজন করা হতাে। প্রবাসী বাঙালিরা দু’টো উদ্দেশ্যে প্রতিদিন দূতাবাসের সামনে হাজির হতেন। তার মধ্যে একটি হচ্ছে বাঙালিদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা এবং অপরটি হচ্ছে দেশে আলােচনার অগ্রগতি কতটুকু হচ্ছে তার সর্বশেষ খবর নেয়া। সকল প্রবাসী বাঙালি স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিল যে, পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এক অনিবার্য সংঘাতের দিকেই যাচ্ছে। একদিকে পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনী আর অন্য দিকে নিরস্ত্র বাঙালি। তাই সকল প্রবাসীদের চোখে মুখে উৎকণ্ঠা, অনিবার্য ভবিষ্যত ও দেশের আপনজনের নিরাপত্তার চিন্তা সকলকে আপুত করে রেখেছিল। ২০ মার্চ, ১৯৭১ ইং সন্ধ্যায় পাকিস্তান ছাত্রাবাসে প্রবাসী বাঙালিদের এক সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভার প্রথম অংশে সভাপতিত্ব করেন সামসুল আবেদীন এবং দ্বিতীয় অংশে সভাপতিত্ব করেন শেখ আবদুল মান্নান। পূর্ববঙ্গে সম্ভাব্য দীর্ঘ মেয়াদি আন্দোলনে যুক্তরাজ্যে প্রবাসীদের যথাযথ ভূমিকা পালনের উদ্দেশ্যে একটি সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠনের উদ্দেশ্য নিয়ে এই সাধারণ সভা আহ্বান করা হয়। সভায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ ছাড়াও পেশাজীবী সংগঠনের মধ্যে যুক্তরাজ্যস্থ বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এবং বাংলাদেশ মেডিকেল এসােসিয়েশনের নেতৃবৃন্দ ব্যক্তব্য রাখেন। পূর্ববঙ্গে সর্বশেষ পরিস্থিতি এবং সংগ্রামের ধারা সম্পর্কে বক্তাগণ মতামত ব্যক্ত করেন। বেশির ভাগ নেতৃবৃন্দই তড়িগরি করে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠনের বিষয়ে দ্বিমত পােষণ করেন এবং পরিশেষে এই সভায় সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়নি। প্রসঙ্গত উল্লেখযােগ্য, সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের প্রস্তাব আর কখনো বাস্তবায়িত হয় নি।
ইতােপূর্বে ২১ মার্চ, ১৯৭১ তারিখে বেঙ্গল স্টুডেন্টস এ্যাকশন কমিটি এক সভায় মিলিত হয়ে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠনের একটি উদ্যোগ গ্রহণ করে। ঘটনা প্রবাহ এত দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছিল যে বিলাতের প্রবাসীরা উপলব্ধি করছিলেন একটি অবিসম্ভাব্য দীর্ঘমেয়াদী সংগ্রামকে সমন্বয় সাধনের জন্য একটি কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব প্রয়ােজন। কিন্তু সেদিনের সভায় এই সংগ্রাম পরিষদের নামকরণের বিষয়ে মতপার্থক্য সৃষ্টি হওয়ায় সর্বদলীয় কোন কমিটি গঠন করা সম্ভব হয়নি। সভায় প্রগতিশীল ছাত্রনেতা জিয়াউদ্দিন মাহমুদ (বর্তমানে ব্যারিষ্টার) নেতৃত্বাধীন একটি গ্রুপ সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের নাম “এ্যাকশন কমিটি ফর ইনডিপেন্ডেন্ট ইষ্ট বেঙ্গল” রাখার পক্ষে মত পােষণ করেন। সভায় সভাপতি বেঙ্গল স্টুডেন্টস এ্যাকশন কমিটির মােহাম্মদ হােসেন মঞ্জু এ ব্যাপারে একটি সমঝােতার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। এই ঘটনার ক্রমধারার পরবর্তিকালে মুক্তিযুদ্ধ কালে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও গােষ্ঠী মিলে একটি সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি গঠন করা সম্ভব হয় নি। | ২৫ মার্চের পূর্বে স্বাধীনতার জন্য একমাত্র ছাত্র সংগ্রাম পরিষদই সকল কর্মকাণ্ডের সমন্বয় করার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। তাই সিদ্ধান্ত ছিল যে, ছাত্র সংগ্রামের আহূত সভায় সকল দল ও গােষ্ঠীর প্রতিনিধি যােগদান করবেন এবং মতামত পেশ করতে পারবেন। ২১ মার্চের সভায় সর্বদলীয় কমিটি গঠন সম্ভব না হলেও নিম্নলিখিত কয়েকটি বিষয়ে ঐকমত্য প্রকাশ করা হয়। এগুলাের মধ্যে ছিল ? (১) প্রবাসী প্রতিটি বাঙালির দেশে টাকা প্রেরণ বন্ধ রাখতে হবে। (২) পশ্চিম পাকিস্তানীদের সাথে সকল প্রকার সম্পর্কচ্ছেদ করতে হবে। (৩) পাকিস্তানের দূতাবাসের সাথে সকল প্রকার সহযােগিতা এবং তাদের সকল নির্দেশ প্রত্যাখ্যান করতে হবে। (৪) পাকিস্তান সরকারের স্কলারশীপসহ সকল প্রকার সুযােগ সুবিধা প্রত্যাখ্যান করতে হবে। এই সকল নির্দেশনামা লন্ডনে প্রকাশিত সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘জনমতের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে সাপ্তাহিক জনমত’ পত্রিকা পরবর্তি সপ্তাহ থেকে পাকিস্তান সরকারের প্রদত্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন (পি. আই. এ. সহ) প্রত্যাখ্যান করে নজির সৃষ্টি করেছিল। ২৬শে মার্চ সকাল থেকেই বি. বি. সি (বাংলা বিভাগ) ও অন্যান্য সূত্র থেকে অসমর্থিত খবর আসতে থাকে যে, ২৫ মার্চ গভীর রাত্রে ঢাকাসহ পূর্ববঙ্গে’ এক জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়েছে। এই দিনের সকালের পত্রিকা স্পষ্ট কোন তথ্য দিতে না পারলেও বৈকালিক পত্রিকা সমূহ হত্যাযজ্ঞের বিবরণ প্রকাশ করে। এই সামরিক অভিযানে কত লােককে হত্যা করা হয়েছে, নেতারা কে কি অবস্থায় আছে, প্রবাসীদের আপনজনদের কার কি অবস্থা এই সকল প্রশ্ন ভেবে প্রবাসী বাঙালিরা এক বিরাট উৎকণ্ঠা ও শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে দিনটি অতিবাহিত করে।
রাজনৈতিক সচেতন ও স্বাধীনতাকামী প্রবাসীদের সবচাইতে বড় উৎকণ্ঠা ছিল স্বাধীনতা ঘােষণার বিষয়। আমরা তখনাে স্বাধীনতা ঘােষণার কোন স্পষ্ট খবর জানতে পারিনি। ২৬ মার্চের গভীর রাতে বি, বি, সি, বাংলা বিভাগের সূত্র থেকে জানতে পারা গেল যে, চট্টগ্রাম থেকে মেজর জিয়াউর রহমান নামে এক সেনা অফিসার স্বাধীনতা ঘােষণা করেছে এবং ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ই, পি, আর, পুলিশ ও আনসারসহ সকল জনগণকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে প্রতিহত করার জন্য মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে আহ্বান জানিয়েছে। চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত উপরােক্ত স্বাধীনতার ঘােষণা ভারতের পূর্বাঞ্চলের সীমান্ত শহর আগরতলা থেকে মনিটর করা হয় বলে সূত্র জানায়। সূত্র থেকে আরাে জানা যায় যে, চট্টগ্রাম রেডিও থেকে পূর্ববঙ্গের প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চট্টগ্রামে মুক্তিবাহিনীর সাথে আছেন। অপর দিকে ২৫ রাতেই গ্রেফতার করা হয়েছিল বলেও বিভিন্ন অসমর্থিত খবর থেকে জানা গিয়েছিল। বিলাতের পত্রপত্রিকায় ২৭ মার্চে পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের কথা ফলাও করে প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই প্রবাসী বাঙালিরা পাকিস্তান দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। কোন প্রকার পূর্ব ঘােষিত প্রােগ্রাম ছাড়াই হাজার হাজার লন্ডন প্রবাসী পাকিস্তান দূতাবাসের সামনে হাজির হয়। বিক্ষুব্ধ বাঙালি জনতা পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞের নিন্দা, ইয়াহিয়ার পতন কামনা ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপক্ষে শ্লোগান তােলেন। নিরীহ, নিরস্ত্র ও ঘুমন্ত বাঙালিদের নির্বিচারে হত্যা করায় প্রবাসীদের মধ্যে যে ঘৃণা ও ক্ষোভ সৃষ্টি। হয়েছিল তা চরম বিক্ষোভের রূপ লাভ করে। লন্ডন পুলিশ এই তীব্র বিক্ষোভকে আয়ত্তে আনার জন্য লন্ডন আওয়ামী লীগ নেতা ইসহাক ও পূর্ব লন্ডনের নেতা সিরাজুল হককে গ্রেফতার করতে বাধ্য হয়। এই স্বতঃস্ফুর্ত সমাবেশ কোন সংগঠনের আহ্বানে অনুষ্ঠিত হয় নি। তবে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ আন্দোলনে এতকাল সক্রিয় থাকায় ছাত্র সংগ্রামের নেতারা এই স্বতঃস্ফূর্ত সমাবেশে নেতৃত্ব দেন। এই সমাবেশে (২৭ মার্চ, ১৯৭১) আওয়ামী লীগের সকল গ্রুপের নেতা কর্মীসহ সকল দল ও মতের কর্মীরা উপস্থিত ছিলেন। প্রতিক্রিয়া প্রকাশকালে সকল নেতারা ঐকমত্য প্রকাশ করেন যে, এর পর থেকে বাঙালিদের কোন বিক্ষোভ বা প্রতিবাদ পাকিস্তান দূতাবাসের সামনে অনুষ্ঠান করার কোন অর্থই হয় না। এই মর্মে ২৮ মার্চ তারিখে (রােববার) পাকিস্তানীদের বর্বরতার প্রতিবাদে এবং বাংলাদেশের সমর্থনে এক সমাবেশ অনুষ্ঠানের স্থান হিসেবে পূর্ব লন্ডনের কথা ঘােষণা করা হয়।
এই ঘােষণার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তান দূতাবাসের সামনের সমাবেশের সমাপ্তি করে প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তান দূতাবাস তথা পাকিস্তান সরকারের সাথে লন্ডন প্রবাসী বাঙালিদের সকল সম্পর্ক ছিন্ন করা হয়। এই ঘটনার পর দীর্ঘ নয় মাস প্রবাসী বাঙালিরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার সমর্থনে বহু আন্দোলন, বহু সমাবেশ ও শােভাযাত্রা অনুষ্ঠিত করেছে কিন্তু ২৭ মার্চের পর পাকিস্তান দূতাবাসে বা সেই পথে বাঙালিদের শােভাযাত্রা আর কখনাে যায়নি। ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ পূর্ব লন্ডনের উইন্ড মিল স্ট্রীটে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সাথে একাত্ম ঘােষণার লক্ষ্যে বাঙালিদের এক বিশাল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এই সমাবেশের প্রকৃতি ছিল সর্বদলীয় । দেশের সর্বশেষ পরিস্থিতি এবং স্বাধীনতা ঘােষণার প্রেক্ষাপটে অবাসাদের কর্তব্য সম্পর্কে জানার জন্য কোন প্রকার প্রচার ছাড়াই হাজার হাজার বাঙালি জনতা পূর্ব লন্ডনে সমবেত হয়। সভায় ছাত্র যুবক ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সমবেত সকলকে মুক্তিযুদ্ধের মানসিক প্রস্তুতি ও সার্বিক সর্মথনের জন্য আহবান জানান। ২৭ মার্চ তারিখের পরবর্তিকালে লন্ডন আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর লন্ডন আগমন একটি উল্লেখযােগ্য ঘটনা। তিনি জেনেভায় অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের সম্মেলন পরিত্যাগ করে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদ করেন। এই পর্যায়ের ব্যক্তিত্বের মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিনেই প্রতিবাদ ও পক্ষ পরিবর্তন নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। ২৭ মার্চের গার্ডিয়ানে বেঙ্গল স্টুডেন্ট এ্যাকশন কমিটি “Recognise Bangladesh” শিরােনামে একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশ করে বিশ্ববাসীকে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি ও সমর্থন দানের আহ্বান জানান। ২৮ মার্চ তারিখে বেঙ্গল স্টুডেন্ট এ্যাকশন কমিটি স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে প্রচারকার্য পরিচালনার উদ্দেশ্যে “ফ্যাক্টসীট” নামে একটি প্রচারপত্র প্রথম প্রকাশ করেন। এই ফ্যাক্টসীট’ পরবর্তিকালে মুক্তিযুদ্ধের খবরা খবর দেশী বিদেশী পত্র পত্রিকা ও কূটনৈতিক ব্যক্তিবর্গের মধ্যে প্রচার কার্যে বিশেষ অবদান রেখেছে। বাঙালি অধ্যুষিত এলাকা হিসেবে লন্ডনের পর বার্মিংহামের স্থান। স্বাধীনতা ঘােষণা ও ২৫ মার্চের কালাে রাত্রির প্রতিক্রিয়া লন্ডনের মতাে বার্মিংহামেও সৃষ্টি করেছে। এতদউপলক্ষে বার্মিংহামের স্মলহীথ পার্কে এক সমাবেশের আয়ােজন করা হয়। উক্ত সমাবেশে জগলুল পাশা, তােজাম্মেল হক, আজিজুল হক ভূইয়া প্রমুখ নেতা বক্তব্য রাখেন। স্মলহীথ পার্কের সমাবেশের এক পর্যায়ে পাকিস্তানীদের হাতে একজন বাঙালি ছুরিকাহত হন এবং এই ঘটনায় জড়িত সন্দেহে ১ জন পাকিস্তানী গ্রেফতার হয়।
২৮ মার্চ, ১৯৭১ সালে লন্ডন ও বার্মিংহামসহ বিলাতের বিভিন্ন শহরে প্রবাসী বাঙালিরা সভা, সমাবেশ ও শােভাযাত্রার মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বিশ্বজনমত সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ লাগাতার আন্দোলনের কর্মসূচী গ্রহণ করে। এ সপ্তাহের প্রধান কর্মসূচী ছিল বাংলাদেশকে স্বীকৃতি ও সমর্থন দানের দাবিতে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের সম্মুখে বাঙালি ছাত্রদের অনশন ধর্মঘট। ১০নং ডাইনিং স্ট্রিটের সামনে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের শামসুদ্দিন আহম্মদ চৌধুরী মানিক (ব্যারিষ্টার) এবং আফরােজ আফগান চৌধুরী (বর্তমান হবিগঞ্জে আইনজীবী এবং বিএনপির নেতা) ২৯ মার্চ অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। এই সময়ে বৃটিশ পার্লামেন্টের অধিবেশন চলছিল। ১০নং ডাউনিং স্ট্রীট পার্লামেন্ট ভবনের কাছে অবস্থিত থাকায় পার্লামেন্টের অভ্যন্তরে অনশন ধর্মঘটের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছিল। পাকিস্তান ধ্বংস হউক” “ইয়াহিয়া খানের পতন হউক” “বাংলাদেশ-দীর্ঘজীবী হউক”, “এগিয়ে যাও মুক্তি সেনা” ইত্যাদি ইংরেজীতে লিখিত শ্লোগান সম্বলিত ব্যানার ও পােষ্টারসহ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের শত শত কর্মী অনশনকারীদের সাথে অবস্থান গ্রহণ করে। ২৮ মার্চ থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত এই অনশন ধর্মঘট অব্যাহত থাকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যে আন্দোলন দ্রুত সৃষ্টি হয়েছে তার সমন্বয় করার জন্য তখনাে কোন অফিস বা কেন্দ্র স্থাপন করা সম্ভব হয়নি। তাই ১০ নং ডাউনিং স্ট্রীটের অনশন ধর্মঘট স্থানটি ২৮ থেকে ৩১ মার্চ এই চার দিন আন্দোলনের কেন্দ্র বিন্দুতে পরিণত হয়েছিল। সারাদিন শত শত বাঙালি ভিড় জমাতাে অনশন ধর্মঘট স্থানে। সন্ধ্যায় অফিস ও কলকারখানা ছুটির পর এ ভিড় বাড়তাে। শত শত বাঙালি জনতা ছুটে আসত অনশনকারীদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করতে। ২৮ থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত প্রত্যেক দিন বৃটিশ পার্লামেন্ট সদস্যদের কাছে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ছাত্রনেতারা ধর্ণা (লবিং) দেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করেন। এই প্রাথমিক প্রচেষ্টায় প্রথমে গুটি কয়েক বৃটিশ এমপি অনশন ধর্মঘটকারী ছাত্রদের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করতে ধর্মঘট স্থানে আসেন। তাদের মধ্যে পিটার শাের ও ডগলাস ম্যান এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। এই সপ্তাহে বৃটিশ পত্র পত্রিকায় বাংলাদেশের সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের খবরাখবরের সাথে লন্ডনের বাঙালিদের প্রতিক্রিয়া ও অনশন ধর্মঘট সম্পর্কে খবর প্রকাশিত হয়। | ইতােমধ্যে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী জেনেভা থেকে লন্ডনে এসে পৌঁছেছেন। তিনি কয়েকজন ছাত্রনেতাকে সঙ্গে নিয়ে অনশন ধর্মঘট স্থানে এসে বাঙালিদের সংগ্রামে একাত্মতা প্রকাশ করেন।
অনশন ধর্মঘট চলার সময়ে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথ প্রত্যহ অনশনকারীদের সামনে দিয়ে যাতায়াত করলেও কূটনৈতিক কারণে নিজে অনশনকারীদের দেখতে আসেননি। তবে প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের কর্মকর্তারা অনশনকারীদের খোঁজ খবর রাখতেন এবং সমবেদনা প্রকাশ করতেন। ৩১ মার্চ তারিখে অনশনকারীদের স্বাস্থ্যের যখন চরম অবনতি হয় তখন বৃটিশ পার্লামেন্টে বিরােধী দলীয় প্রভাবশালী এমপি এবং উইলসন কেবিনেটের প্রাক্তন অর্থনৈতিক মন্ত্রী পিটার শাের এর অনুরােধ ও আশ্বাসের প্রেক্ষিতে অনশন ভঙ্গ করা হয়। পিটার শাের বাঙালিদের সংগ্রামের প্রতি অত্যন্ত সহানুভূতিশীল ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালের নয় মাস লন্ডনে তিনি বাঙালিদের সাথে একাত্ম হয়ে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ২৮ মার্চ লন্ডনের ট্রাফেলগার স্কোয়ারে যুক্তরাজ্যস্থ আওয়ামী লীগের উদ্যোগে এক বিরাট জনসভা আয়ােজন করা হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন যুক্তরাজ্যস্থ আওয়ামী লীগের | সভাপতি গউস খান। বাৰ্ছিংহাম, মাঞ্চেষ্টার, লুটন সহ বিভিন্ন শহর থেকে বাঙালিরা সভায় যােগদান করে। বিভিন্ন বক্তা পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যার নিন্দা ও প্রতিবাদ করে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করে। সভাশেষে | ট্রাফেলগার স্কোয়ারে সভামঞ্চে সভার সভাপতি গউস খান বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। এদিকে একই দিনে উত্তর লন্ডনস্থ হাইবারী হীলে অবস্থিত “পূর্ব-পাকিস্তান হাউজ” এ ছাত্র, পেশাজীবী ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এক সভায় মিলিত হন। ছাত্রদের গৃহিত কর্মসূচী পালনে কোন কোন রাজনৈতিক দলের অনিহা থাকলেও ছাত্রদের কর্মসূচীর প্রতি সহানুভূতি [প্রকাশের পক্ষে মতামত ব্যক্ত করা হয়। একই দিনে সন্ধ্যায় পূর্ব লন্ডনের আর্টিলারী প্যাসেজে আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের কর্মপন্থা তৈরীর জন্য পৃথক সভার আয়ােজন করে। পূর্ব পাকিস্তান হাউজে’ অনুষ্ঠিত সভায় শেখ আবদুল মান্নানের নেতৃত্বে ৫ জনের প্রতিনিধি দল পূর্ব লন্ডনের আর্টিলারী প্যাসেজের সভায় প্রেরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় । সভা শেষে ‘পূর্ব পাকিস্তান হাউজে আনুষ্ঠানিক ভাবে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। ২৯ মার্চ লন্ডনের পােলান্ড স্ট্রীটে অবস্থিত ‘মহাঋষি’ রেষ্টুরেন্টে বিভিন্ন শহরে এবং এলাকায় প্রতিষ্ঠিত সংগ্রাম পরিষদ সমূহের সমন্বয় সাধনের লক্ষে একটি কেন্দ্রীয় সমন্বয় কমিটি গঠনের উদ্দেশ্যে এক সভার আয়ােজন করা হয়। সভায় বিভিন্ন শহর এবং এলাকার নেতৃবৃন্দ যােগদান করেন। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সভাপতি গউস খানের সভাপতিত্বে এই সভায় সর্বসম্মতভাবে “কাউন্সিল ফর দি পিপলস রিপাবলিক অফ বাংলাদেশ ইন হউ, কে.” নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় ।
এই সংগঠনের সভাপতি নিয়ােজিত হন গউস খান এবং শেখ আবদুল মান্নান ও আবদুল হামিদকে যথাক্রমে সেক্রেটারী ও কোষাধ্যক্ষের দায়িত্ব দেয়া হয়। সংগঠনের কার্যকরী কমিটিতে ১১ জন নির্বাচিত সদস্য এবং ব্রাডফোর্ড, শেফিল্ড, গ্লাসগাে, বাহিংহাম, ম্যাঞ্চেস্টার প্রভৃতি শহরের সংগ্রাম কমিটি থেকে ১০ জনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। নির্বাচিত ১১ জন সদস্যের মধ্যে ব্যারিষ্টার শাখাওয়াত হােসেন, আমীর আলী ও সামসুল মাের্শেদ এর নাম উল্লেখযােগ্য। কাউন্সিলের কার্যালয়ের জন্য উইন্ডমিল স্ট্রীটে অবস্থিত ‘লাক্ষ্মেী’ রেষ্টুরেন্টের মালিক শওকত আলী রেষ্টুরেন্টের ২টি কক্ষ বিনাভাড়ায় প্রদান করেন। যে মহান উদ্দেশ্য নিয়ে এই সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল তা বেশি দূর অগ্রসর হতে পারেনি। ২৪ এপ্রিল কভেন্ট্রি সম্মেলনের মাধ্যমে “স্টিয়ারিং কমিটি গঠিত হওয়ার পর কাউন্সিল ফর দি পিপলস রিপাবলিক অফ বাংলাদেশ’ এর উদ্যোক্তারাই এই সংগঠন বিলুপ্ত করে দেন। ৩১ মার্চ ‘দি গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত এক পত্রে পাকিস্তানের নাগরিক তারেক আলী, হামজা আলাভী, মােহাম্মদ আখতার ও নাছিম বাজওয়া পশ্চিম পাকিস্তান সােসালিষ্টদের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের যৌক্তিক মুক্তি সংগ্রামকে সমর্থন জানান এবং এই পরিস্থিতির জন্য ভূট্টোকে দায়ী করেন। একই দিনে ‘দি গার্ডিয়ান’এ অপর এক পত্রে পাকিস্তানের নাগরিক। এয়ার কমােডর (অবঃ) মােহাম্মদ খান জানজুয়া, কর্ণেল (অবঃ) ইনায়েত হাসান ও ফরিদ জাফরি পূর্ব বাংলার সংখ্যাগরিষ্ট দলের দাবি মেনে নেয়ার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্ধকে আহ্বান জানান। পরবর্তি কালে জানা যায়, বাংলাদেশকে সমর্থন জানানাের জন্য উপরােক্ত ব্যক্তিবর্গকে জুলফিকার আলী ভুট্টো ও মওদুদী দেশদ্রোহী বলে আক্ষায়িত করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালে লন্ডন আন্দোলনের এক উল্লেখযােগ্য ও তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হলাে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর লন্ডনে আন্দোলনে যােগদান। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের সম্মেলনে যােগদানের জন্য জেনেভায় অবস্থান করছিলেন। ২৫ মার্চের কালাে রাত্রে বাংলাদেশে হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে মানবাধিকার যেভাবে লংঘন করা হয়েছে তার বর্ণনা। দিয়ে সম্মেলনে বক্তব্য রেখে বিচারপতি চৌধুরী সম্মেলন পরিত্যাগ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে জেনেভা থেকেই তিনি উপাচার্য পদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং লন্ডনে চলে আসেন। তিনি লন্ডনে এসে বালহাম এলাকায় উঠেন।
বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর লন্ডনে আগমন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে তার ইতিবাচক মনােবৃত্তির খবর লন্ডনে ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, ডাক্তার সমিতির সদস্যবৃন্দসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সমাজ কর্মীরা তাঁর সাথে সাক্ষাত করে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে জনপ্রিয় করার লক্ষ্যে আন্দোলন জোরদার করার প্রয়ােজনীয়তার কথা বলেন। বিচারপতি চৌধুরী এ ব্যাপারে ঐকমত্য প্রকাশ করে আন্দোলনে শরিক হওয়ার প্রত্যয় ঘােষণা করেন। বিলাতে অবস্থানরত বাঙালিদের মধ্যে তখন একতার অভাব ছিল। যে কয়টি রাজনৈতিক দল বিদ্যমান ছিল তাও প্রকৃতপক্ষে জনপ্রিয় নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত ছিল না। ইতােপূর্বে ২১ মার্চ তারিখে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠনের প্রচেষ্টায় সফল হয়নি। এমনকি আওয়ামী লীগও নেতৃত্বের প্রশ্নে তিন ভাগে বিভক্ত ছিল। এমতাবস্থায়, প্রবাসী বাঙালিদের সচেতন অংশ লন্ডন আন্দোলনের এই পর্যায়ে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সক্রিয় অংশ গ্রহণের প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করেন। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী লন্ডনে এসেই তার ব্যক্তিগত উদ্যোগে এবং অতীত পরিচয়ের সূত্র ধরে বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তি ও সংস্থার সাথে যােগাযােগ স্থাপন করেন এবং বাংলাদেশে যে হত্যাযজ্ঞ হচ্ছে তা অবহিত করেন। তিনি ২৭ মার্চে প্রথমেই বৃটিশ পররাষ্ট্র দফতরের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বিভাগের প্রধান ইয়ান সাদারল্যান্ড এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিব নিকোলাস ব্যারিংটনের সাথে যােগাযােগ করেন। বৃটিশ সরকারের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আলেক ডগলাস হিউম মার্চের শেষ সপ্তাহে লন্ডনের বাইরে স্কটল্যান্ডে ছুটি যাপন করছিলেন। ছুটি যাপন শেষে লন্ডনে এসে স্যার আলেক ডগলাস হিউম এপ্রিল মাসের ১০ তারিখ বিচারপতি চৌধুরীকে সাক্ষাত দান করেন এবং বাংলাদেশের ব্যাপারে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেন। তিনি বাংলাদেশের হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করার লক্ষ্যে কূটনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন বলে বিচারপতি চৌধুরীকে বলেন। একই দিনে বিবিসি বাংলা বিভাগের তরফ থেকে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর একটি সাক্ষাৎকার প্রচার করা হয় এবং এর মাধ্যমে বিচারপতি চৌধুরীর লন্ডন আন্দোলনে অংশ গ্রহণের খবর দেশে ও বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়া মার্চের শেষ সপ্তাহে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য লড জেমস, কমনওয়েলথ সেক্রেটারিয়েটের সচিব উইলিয়াম পিটার্স, ইন্টারন্যাল কমিশন অব জুরিসটস এর মহাসচিব ম্যাক গরমেট এবং ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির (রক্ষণশীল দল) কমনওয়েলথ বিষয়ক সচিব প্রফেসর জেনকিন সহ বহু প্রভাবশালী ব্যক্তি ও সংস্থার সাথে যােগাযােগ করে বাংলাদেশে মুক্তি সংগ্রামের কথা বলেন। মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহে বিচারপতি চৌধুরী তার নিজস্ব উদ্যোগে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের পক্ষে কাজ শুরু করে নিঃসন্দেহে সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। তাই পরবর্তিকালে মুক্তিযুদ্ধ কালে লন্ডন আন্দোলনের সমন্বয় সাধন ও নেতৃত্বে কোন সংকটের সৃষ্টি হয়নি। বিচারপতি চৌধুরীর অবদান সম্পর্কে অধ্যায়-উনত্রিশ’ এ আলাদাভাবে আলােচনা করা হয়েছে।
এপ্রিল মাসের তৎপরতা
১৯৭১ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত লন্ডনে প্রতিবাদ প্রতিরােধের সকল কর্মতৎপরতার কেন্দ্র ছিল ১০ নং ডাউনিং স্ট্রীটে অনুষ্ঠিত অনশন ধর্মঘটকে কেন্দ্র করে। মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে প্রচারণার জন্য তখনও তেমন কোন সংগঠন গড়ে ওঠেনি। ইতােপূর্বে যে তিনটি পেশাভিত্তিক সংগঠন গড়ে উঠেছিল সেগুলাে হচ্ছে বেঙ্গল স্টুডেন্টস এ্যাকশন কমিটি, বেঙ্গল উইমেন্স এসােসিয়েশন ইন গ্রেট বৃটেন এবং ডক্টরস এসােসিয়েশন ইন ইউ. কে। ডক্টরস সমিতির কতিপয় নেতা খুবই সক্রিয় থাকা সত্ত্বেও সংখ্যায় কম থাকায় তাদের পক্ষে স্বতন্ত্র কোন প্রােগ্রাম ঘােষণা সম্ভব না হলেও প্রতিটি প্রােগ্রামে তারা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিল। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে যে দু’টি উল্লেখযােগ্য প্রােগ্রাম ঘােষণা করা হয় তার একটি বেঙ্গল স্টুডেন্টস এ্যাকশন কমিটি ও অপরটি বেঙ্গল উইমেনস এসােসিয়েশন ঘােষণা করে। | ৩ এপ্রিল, ১৯৭১ তারিখ শনিবার বেঙ্গল মহিলা সমিতির আহ্বানে লন্ডনের ঐতিহাসিক ট্রাফেলগার স্কোয়ারে প্রবাসী বাঙালি মহিলাদের এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন প্লেকার্ড, পােষ্টার ও ব্যানার সহকারে শত শত বাঙালি মহিলা ও শিশু ট্রাফেলগার স্কোয়ারের সমাবেশে যােগদান করে। এই সমাবেশকে সফল করার জন্য বেঙ্গল স্টুডেন্টস এ্যাকশনের সদস্যরা সক্রিয়ভাবে সহযােগিতা করে। মহিলাদের এই সংগঠনটি লন্ডনে বসবাসকারী কয়েকজন উদ্যোগী ও দেশপ্রেমিক বাঙালি মহিলার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় অল্প সময়ের মধ্যে গড়ে উঠেছিল। বাঙালি মহিলাদের মধ্যে যারা অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন তাঁদের মধ্যে জেবুন্নেছা বখত (সভানেত্রী), আনােয়ারা জাহান (সাধারণ সম্পাদিকা), জেবুন্নেছা খায়ের, মুন্নী। শাহজাহান, ফেরদৌস রহমান, নােরা শরীফ, সুরাইয়া ইসলাম, সেলিনা মােল্লা, রাজিয়া চৌধুরী, সুরাইয়া বেগম, লুলু বিলকিস বানু, রেবেকা আশরাফ, সাহেদা খাতুন, বিলকিস আক্তার হােসেন (লেখকের স্ত্রী) প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। উল্লেখিত মহিলারা ইতােপূর্বে বাঙালী প্রবাসীদের মধ্যে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে কর্মতৎপরতা পরিচালনা করে সকলের কাছে পরিচিত ছিল।
এদের মধ্যে জেনুন্নেছা বখত সকলের শ্রদ্ধেয়া এবং বয়সের কারণে মাতৃতুল্যা ছিলেন। তিনি বিলাত গমনের পূর্বে ব্যক্তিগত জীবনে শিক্ষয়িত্রী থাকায় লন্ডন প্রবাসী অনেক মহিলা তার ছাত্রী ছিলেন। জেবুন্নেছা বখতের ব্যক্তিত্ব এবং আনােয়ারা জাহানের পরিশ্রম ও কর্মচাঞ্চল্যের ফলে খুব অল্প সময়ের মধ্যে ৩ এপ্রিলের মহিলা সমাবেশ অত্যন্ত সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছিল। মহিলাদের প্লেকার্ডে ও পােষ্টারে ইয়াহিয়া খানের, পতন হউক, পাকিস্তানের ধ্বংস হউক” শ্লোগান লেখা ছিল। বিভিন শ্লোগানে মুখর একটি শােভাযাত্রা সমাবেশ শেষে ট্রাফেলগার স্কোয়ার থেকে বের করা হয় । মিছিলটি প্রথমে ১০ নং ডাউনিং স্ট্রীটে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে একটি মেমােরেন্ডাম এবং পরে আমেরিকান দূতাবাসে একটি মেমােরেন্ডাম প্রদান করে হাইডপার্ক স্পীকার্স কর্ণারে শেষ হয়। মিছিল সমাপ্তিতে মহিলা সমিতির নেতৃবৃন্দ স্বাধীনতা সংগ্রামে সর্বাত্মক সহযােগিতা ও সাহায্য করার দৃপ্ত শপথ গ্রহণ করে। জেবুন্নেছা বখত ও আনােয়ারা জাহানের নেতৃত্বে মহিলা সমিতি মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে লন্ডনে অনুষ্ঠিত প্রতিটি কর্মসূচীতে উল্লেখযােগ্য ভূমিকা রেখেছিল। | ১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল, রােববারে বেঙ্গল স্টুডেন্ট এ্যাকশন কমিটি হাইড-পার্ক স্পীকার্স কর্ণারে এক বিরাট সমাবেশের আয়ােজন করে। লন্ডনে প্রকাশিত সাপ্তাহিক জনমত এবং লিফলেটের মাধ্যমে সমাবেশের কথা বাঙালিদের মধ্যে প্রচার করা হয়। তখন লন্ডনে। লিফলেট ছাপানাে খুব কষ্টকর ছিল। লন্ডনে তখন কোন বাংলা প্রেস না থাকায় হাতে লিখে তা ছাপানাে হতাে অথবা ফটোকপি করে বিলি করা হতাে। দেশে স্বাধীনতা ঘােষণার পর নির্ধারিত এই সমাবেশে লন্ডন ও তার পার্শ্ববতী শহরের বসবাসকারী সর্বস্তরের বাঙালিরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে যােগদান করে। এই সমাবেশের আকার ও চরিত্র দেখে প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে বিপুল প্রেরণা ও উৎসাহ সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশে পাকিস্তানীদের হত্যাযজ্ঞের খবর বিলাতের পত্রপত্রিকায় প্রতিদিন প্রকাশ হওয়ায় প্রবাসী বাঙালিরা অত্যন্ত বিক্ষুব্ধ ছিল। তাই ৪ এপ্রিলের হাইডপার্কের সমাবেশ অত্যন্ত জংগী রূপ ধারণ করে। বিক্ষুব্ধ জনতা পাকিস্তানের পতন’ “ইয়াহিয়া খানের ধ্বংস” “বাংলাদেশকে সমর্থন দাও” “মুক্তিযােদ্ধারা এগিয়ে যাও” ইত্যাদি শ্লোগানে হাইডপার্ক মুখরিত করে তােলে। সাপ্তাহিক ছুটির দিনের হাইডপার্কে স্থানীয় জনগণের বেশ ভিড় ছিল।
বাংলাদেশের সম্পর্কে জানার জন্য তাদের ভিড়ও বৃদ্ধি পায় । হাইডপার্ক স্পীকার্স কর্ণারে মুক্ত বক্তব্য প্রদানের এক ঐতিহ্য রয়েছে। যে কোন মত ও বিশ্বাসের ব্যক্তি এবং সংস্থা এখানে নির্ভয়ে বক্তব্য রাখতে পারেন। আমাদের দেশের মতাে কোন বক্তৃতা মঞ্চ তৈরী করা হয় না। সিড়ি সম্বলিত উঁচু প্লাটফরম ভাড়া পাওয়া যায় যেখানে দাড়িয়ে বক্তা তার বক্তৃতা প্রদান করেন। এই ধরনের বক্তৃতা ষ্ট্যান্ড স্থাপন করে ছাত্র সংগ্রামের মােহাম্মদ হােসেন মঞ্জুর সভাপতিত্বে এক বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় ছাত্র সংগ্রামের পক্ষ থেকে আমি ও ওয়ালী আশরাফ, মহিলা সমিতির পক্ষে জেবুন্নেছা বখত, ডাক্তার সমিতির পক্ষে ডাঃ তালুকদার ও লন্ডন আওয়ামী লীগের পক্ষে সুলতান মাহমুদ শরীফসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখেন। সভা শেষে এক বিরাট শশাভাযাত্রা হাইডপাক থেকে রওনা হয়ে শহরের বিভিন্ন রাস্তা প্রদক্ষিণ করে ট্রাফেলগার স্কোয়ারে গিয়ে শেষ হয়। ৪ এপ্রিলের এই সমাবেশ ও শশাভাযাত্রা থেকে একটি তাৎপর্যপূর্ণ শ্লোগান আত্মপ্রকাশ করে তা RCT: “Not a penny not a gun to Tikka-Bhutto-Yahya Khan. পরবর্তীকালে এই শ্লোগান আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে বিলাতের বাঙালীদের মধ্যে বেশ প্রচলিত ও জনপ্রিয় হয়েছিল। ট্রাফেলগার স্কোয়ারে শােভাযাত্রা সমাপ্ত করে বাংলাদেশের আন্দোলনের পক্ষ থেকে ভারতীয় দূতাবাস ও সােভিয়েট দূতাবাসে প্রতিনিধি প্রেরণ করা হয়। প্রতিনিধিরা ভারতীয় পার্লামেন্টে ৩১ মার্চে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বাংলাদেশের পক্ষ সমর্থন করে প্রস্তাব গ্রহণ এবং বাংলাদেশকে সােভিয়েট প্রেসিডেন্ট পােদগর্নির সমর্থন দানের জন্য তাদের স্ব-স্ব রাষ্ট্রদূতদের মাধ্যমে ভারত ও রাশিয়াকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। একই দিনে অর্থাৎ ৪ এপ্রিল রােববার সন্ধ্যা ৭ টায় হ্যামষ্টিড হলে স্থানীয় সাংবাদিকদের উদ্যোগে একটি “ব্রিফিং সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভাটি বিলাতে সাংবাদিকদের বাংলাদেশের প্রতি সংবেদনশীল করতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। উক্ত সভায় বৃটিশ সাংবাদিকবৃন্দ ছাড়াও শ্রমিকদলীয় বৃটিশ এম পি ও প্রাক্তন মন্ত্রী পিটার শাের এবং লর্ড ব্রুকওয়ে বাংলাদেশের পক্ষে বক্তব্য রাখেন। | ১৯৭১ সালের এপ্রিল লণ্ডনের প্রবাসী বাঙালি পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর বাঙালি নিধন অভিযানের প্রতিবাদে এবং স্বাধীনতার দাবিতে এক নজীরবিহীন কর্মসূচী পালন করে। লন্ডনের বাঙালি রেষ্টুরেন্ট মালিক সমিতির সিদ্ধান্তক্রমে বাঙালি মালিকনাধীন লন্ডনের সকল রেষ্টুরেন্ট ৪ এপ্রিল সারা দিন (সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত) বন্ধ রাখেন। রেষ্টুরেন্টগুলাে বন্ধ রাখার কারণসমূহ পােষ্টার আকারে বন্ধ রেষ্টুরেন্টের দরজায় ঝুলিয়ে রাখা হয়। এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে বিলাত প্রবাসী বাঙালীরা এ্যাকশন কর্মসূচীর সাথে সাথে বিভিন্ন দূতাবাস, বৃটিশ পার্লামেন্টের সদস্য এবং রাজনৈতিক দলের কাছে প্রতিনিধি প্রেরণ। করে বাংলাদেশকে সমর্থন করার আবেদন জানান।
এই সকল প্রতিনিধি দলে স্টুডেন্টস। এ্যাকশন কমিটি, মহিলা সমিতি, ডাক্তার সমিতির সদস্যসহ বাঙালি রাজনৈতিক দলের। নেতৃবৃন্দ বিশেষ ভূমিকা রাখেন। প্রতিদিন কোন না কোনাে দেশের দূতাবাস অথবা বৃটিশ এমপি বা ব্যক্তিত্বের সাথে দেখা করে বাংলাদেশের পক্ষে প্রচারণা চালান হয়। | ইতােপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এই সকল যােগাযােগ ও লবিং এর ফলে শ্রমিক। দলীয় বৃটিশ এমপি ও প্রাক্তন মন্ত্রী পিটার শাের শ্রমিক দলীয় এমপি ডগলাসম্যান এবং লর্ড ব্রকওয়ে বাংলাদেশের পক্ষ সমর্থন করে আন্দোলনকে সহযােগিতা শুরু করেছেন। উল্লেখিত ব্যক্তিবর্গের মাধ্যমে বৃটিশ পার্লামেন্টে বাংলাদেশ সম্পর্কিত সর্বশেষ অবস্থার উপর। বক্তব্য রাখার জন্য বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আলেক ডগলাস হিউমের উপর চাপ সৃষ্টির সকল। প্রকার কূটনৈতিক পন্থা গ্রহণ করা হয়। শ্রমিক দলীয় এমপিদের সাথে লিবারেল-পার্টি এমপিরাও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতি চাপ সৃষ্টি করেন। গত সপ্তাহে “পাকিস্তানে’ হত্যাযজ্ঞ বন্ধ। করার ব্যাপারে বৃটিশ পার্লামেন্টে অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়। এই মর্মে লন্ডন থেকে । প্রকাশিত গার্ডিয়ান পত্রিকায় কিটলী এক কলামে বৃটিশ সরকারকে গড়িমসি করার অভিযােগ করেন (গার্ডিয়ান, ৩/৪/৭১)। তার ভাষায় চার মাস পূর্বে “পূর্ব পাকিস্তানে” ঘূর্ণিঝড় ও জলােচ্ছ্বাসের অব্যবহিত পরে সর্বপ্রথমে যেখানে বৃটিশ সাহায্য পৌছেছিল সেখানে বৃটিশ সরকার পূর্ব পাকিস্তানে হত্যাযজ্ঞের সময়ে নিশ্ৰুপ থাকা প্রশ্নাতীত নয় (গার্ডিয়ান, এপ্রিল, ১৯৭১)। চাপের মুখে স্যার আলেক ডগলাস হিউম “পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক অবস্থা সংকটজনক” আখ্যায়িত করে বৃটিশ সরকারের উৎকণ্ঠার কথা জানিয়ে ৫ এপ্রিল, সােমবার পার্লামেন্টে একটি বক্তব্য পেশ করেন। | ইতােমধ্যে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টি, বিরােধী লেবার পার্টি ও লিবারেল পার্টি মােট ১৬০ জন এমপি এর দস্তখতে বৃটিশ পার্লামেন্টে “পূর্ব পাকিস্তানে” রক্তপাত বন্ধ করার লক্ষ্যে একটি নােটিশ প্রদান করা হয়। এমতাবস্থায়, বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী একটি নাটকীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
খুবই অল্প সময়ের নােটিশে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতকে পার্লামেন্টে স্যার। আলেক ডগলাস হিউমের অফিসে ডেকে পাঠান। পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত সালমান আলী ৬ এপ্রিল বিকালে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাত করেন (গার্ডিয়ান, ৭ এপ্রিল ‘৭১)। এ অল্প সময়ের নােটিশে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে পাঠানাের মাধ্যমে বাংলাদেশে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের জন্য বৃটিশ সরকারের উৎকণ্ঠার মনােভাব প্রকাশিত হয়। জানা যায়, বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে পাকিস্তান সরকারকে “পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক অভিযান পরিহার করে রাজনৈতিক সমাধান করার পরামর্শ দিয়েছিলেন এবং পাকিস্তানের রাজনৈতিক অবস্থায় বৃটিশ সরকার ও জনগণের মনােভাবের কথা উল্লেখ করেছিলেন। ১৬০ জন এমপি এর উথাপিত প্রস্তাবে বাংলাদেশে রক্তপাত ছাড়াও ভবিষ্যতে খাদ্যাভাবকে প্রাধান্য দেয়া। হয়েছিল। সামরিক অভিযানের কারণে চাষাবাদের ক্ষয়ক্ষতি ও খাদ্য সরবরাহে বিঘ্ন ঘটায়। বৃটিশ এমপিরা বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষের আশংকা করে বিশ্ববাসীর এ ব্যাপারে পূর্বাহ্নেই পদক্ষেপ গ্রহণ করার কথা ব্যক্ত করেছিলেন। বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদক্ষেপ এবং ১৬০ জন সর্বদলীয় বৃটিশ এমপি এর পার্লামেন্টে প্রস্তাব উত্থাপন বিলাতে প্রবাসী বাঙালীদের কর্মতৎপরতা বিরাট উৎসাহ সৃষ্টি করেছিল। এপ্রিল-এর প্রথম সপ্তাহেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আর একটি উল্লেখযােগ্য। কূটনৈতিক সাফল্য লাভ হয় ৪ এপ্রিল প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার প্রতি পূর্ব পাকিস্তানের রক্তপাত বন্ধ করার জন্য সােভিয়েট প্রেসিডেন্ট পােদগর্নির আহ্বান জানানাের মাধ্যমে। সােভিয়েট সংবাদ সংস্থা তাস পরিবেশিত খবরে প্রকাশ হয় যে, প্রেসিডেন্ট পােদগনি পূর্ব পাকিস্তানে রক্তপাত বন্ধ এবং বিষয়টির শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন। প্রেসিডেন্ট পােদগর্নির আহ্বানে আরাে বলা হয় যে, একটি রাজনৈতিক সমাধানে জনগণের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী ব্যবহার করা নিন্দনীয় এবং এই জন্য সােভিয়েট জনগণ উদ্বিগ্ন। প্রেসিডেন্ট পােদগর্নির এই আহ্বানকে কূটনৈতিকভাবে একটি ব্যতিক্রমধর্মী পদক্ষেপ হিসেবে বৃটিশ পত্র পত্রিকা মন্তব্য করে। ‘বায়াফ্রা’ সমস্যাকে রাশিয়া বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন চিহ্নিত করে তার পক্ষ সমর্থন করেনি।
কিন্তু পাকিস্তানের এই রাজনৈতিক সংকটের সময়ে সােভিয়েট প্রেসিডেন্টের এই প্রতিক্রিয়া সারা বিশ্বে একটা আলােড়নের সৃষ্টি করে। প্রেসিডেন্ট পােদগর্নি তার প্রেরিত বার্তায় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টকে আরাে জানায় যে, সােভিয়েট সরকার এখনাে বিশ্বাস করে যে, পাকিস্তান’ সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধান সম্ভব এবং একথা বলা তার দায়িত্ব বলে তিনি মনে করেন। ৫ এপ্রিল লন্ডনের পত্র পত্রিকায় এই খবরটি গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হলে প্রবাসী বাঙালীদের মধ্যে উৎসাহের সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশ আন্দোলনের পক্ষ থেকে একটি প্রতিনিধি দল লণ্ডনস্থ সােভিয়েট দূতাবাসে গমন করে রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে সােভিয়েট প্রেসিডেন্টকে উপরােক্ত পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। বাংলাদেশের জনগণের সংগ্রামের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ ও সমর্থন দান করে ভারতীয় পার্লামেন্ট যে সর্বসম্মত প্রস্তাব গ্রহণ করে তা ১ এপ্রিল, ১৯৭১ সালের বৃটিশ পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। লন্ডনসহ বিলাতের প্রতিটি শহরে বাঙালীরা যখন বাংলাদেশের প্রতি সমর্থন দানের জন্য পথে পথে শােভাযাত্রা করছে ও বিভিন্ন দূতাবাসের দ্বারে দ্বারে ধর্ণা (লবিং) দিচ্ছে। তখন ভারতের এই সমর্থন বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতা ঘােষণা যে শুধুমাত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন নয় তার স্বপক্ষে যুক্তি হিসেবে ভারতের সমর্থন এক বিরাট ভূমিকা। রেখেছে। এপ্রিলের প্রথম দিকে সারা বিশ্ব বাংলাদেশের প্রকৃত ঘটনা সম্পর্কে কিছুটা বিভ্রান্তির মধ্যে ছিল। একদিকে পাকিস্তানের মিথ্যা প্রচারণা আর অন্য দিকে নিকট অতীতে ‘বায়াফ্রা’ সংগ্রামের ব্যর্থতা কূটনৈতিক মহলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণার যথার্থতা ও সফলতা সম্পর্কে অনেকেই সন্দিহান ছিল। এই ক্রান্তিলগ্নে ভারতীয় পার্লামেন্টে সর্বসম্মত সমর্থন ও পরবর্তীকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বক্তব্য এক বিরাট কূটনৈতিক অবদান রেখেছে। লন্ডনে বাঙালীদের একটি প্রতিনিধিদল ভারতের দূতাবাসে গমন করে এই সমর্থন ও সহানুভূতির জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী, সরকার ও জনগণের প্রতি প্রবাসী বাঙালীদের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।
এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে প্রবাসী বাঙালীদের পরিষদ সমূহের লবিং, জনমত সৃষ্টি ও যােগাযোেগ প্রােগ্রামের আর একটি সাফল্য অর্জিত হয় বাংলাদেশের প্রতি বৃটিশ লিবারেল পাটির সমর্থন দানের মাধ্যমে। বৃটিশ লিবারেল পাটি তাদের দলীয় কাউন্সিলে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকটে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে এবং রক্তপাত বন্ধ করার জন্য কমনওয়েলথের একজন প্রবীণ সদস্য হিসেবে বৃটেনকে কূটনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য আহ্বান জানায়। লিবারেল পার্টির গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয় যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের দাবির প্রেক্ষিতে ঘােষণা করা হয়েছে এবং তাকে দমন করার জন্য পাকিস্তানের সেনাবাহিনী নির্বিচারে বেসামরিক জনগণকে হত্যা করছে। পূর্ব পাকিস্তানের এই হত্যাযজ্ঞে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে চিহ্নিত করে বৃটেন বসে থাকতে পারে না। বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করে এবং রক্তপাত বন্ধ করার জন্য বৃটিশ সরকারের কূটনৈতিক হস্তক্ষেপ কামনা করে ১৬০ জন বৃটিশ পার্লামেন্ট সদস্যদের দস্তখত সম্বলিত প্রস্তাব উপস্থাপনের ব্যাপারে লন্ডনের নর্থ কেনসিংটন থেকে নির্বাচিত শ্রমিক দলীয় এমপি ব্রুস ডগলাস ম্যান বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে নিছক বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন বিবেচনায় বায়াফ্রা সমস্যার সময়ে নাইজেরিয়ার ফেডারেল সরকারের প্রতি যেভাবে বৃটিশ সরকার সমর্থন দিয়েছিলেন সেই দৃষ্টিভঙ্গির সমার্থক মনে করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আলেক ডগলাস হিউম বাংলাদেশের ব্যাপারে একটু শীতল ছিলেন। ক্রস ডগলাস ম্যান “পূর্ব পাকিস্তানে রক্তপাত বন্ধ করার লক্ষ্যে পাকিস্তানের প্রতি যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানান এবং তা কার্যকর করার জন্য কমনওয়েলথ কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টির জন্য বৃটিশ পার্লামেন্টে দাবি উত্থাপন করেন। ব্রুস ডগলাস ম্যানের এই প্রস্তাবকে সমর্থন করে ৪ এপ্রিল, ১৯৭১ তারিখের মধ্যে যে সকল মাননীয় এম, পি, দস্তখত করেন তাঁরা হলেন ফ্রড লি (প্রাক্তন কলনিয়েল সেক্রেটারী). মিসেস জুডিথ হাট (প্রাক্তন ওভারসিজ উন্নয়ন মন্ত্রী), ফ্রাঙ্ক জাড (পার্লামেন্টারী প্রাইভেট সেক্রেটারী টু লীডার অব অপজিশন), নাইজেল ফিসার (প্রাক্তন কমনওয়েলথ আন্ডার সেক্রেটারী), জন পারডাে (নর্থ করণওয়াল। থেকে লিবারেল পার্টির এম, পি,) এরিক হেফার (ওয়ালটন থেকে লেবার পার্টি এম, পি.)।
নিকোলাস স্কট (দক্ষিণ প্যাডিংন্টন থেকে নির্বাচিত কনজারভেটিভ দলীয় এম, পি,) হিউজ ফ্রেজার (ষ্টাফোর্ড এড ষ্টোন থেকে কনজারভেটিভ দলীয় এম. পি.) উইলিয়াম বেনিয়ন (বাকিংহাম থেকে কনজারভেটিভ দলীয় এমপি) এবং ক্রিসটার ব্রুকলব্যাংক ফাইলার (কিংগস লীন থেকে কনজারভেটিভ এম. পি.)। ৪ এপ্রিল-এর মধ্যে উপরােক্ত ১১ জন বিশিষ্ট বৃটিশ এম, পি, বাংলাদেশের জনগণের পক্ষে এগিয়ে এসেছিলেন তা প্রবাসী বাঙালীদের জন্য এক আশাতীত সাফল্য ছিল। জনমত সৃষ্টির অব্যাহত প্রয়াস এবং নেপথ্যে থেকে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর কূটনৈতিক যােগাযোেগ এ ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রেখেছে। ১১ জন মাননীয় এম, পি, এর এই উদ্যোগের ফলেই পরবর্তিকালে এই প্রস্তাবে দস্তখতকারী এম. পি.-এর সংখ্যা ১৬০ জনে উন্নীত হয়েছিল। সর্বদলীয় ১৬০ জন এম. পি. কে বাংলাদেশের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ করা বা একাত্মতা প্রকাশ করায় বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাধ্য হয়েই যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য পাকিস্তানকে চাপ সৃষ্টি করেছিলেন। বৃটেনে তখন কনজারভেটিভ পার্টি ক্ষমতায় ছিলেন। বৃটিশ কমনওয়েলথ সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অত্যন্ত রক্ষণশীল। কিন্তু বৃটিশ জনমত এবং ১৬০ জন। সর্বদলীয় মাননীয় এম. পি. দের বাংলাদেশের ইস্যুকে সমর্থনের ফলেই রক্ষণশীল হয়েও কনজারভেটিভ সরকার ও তার প্রধান মিঃ হিথ বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে যখন পাকিস্তানের কারাগারে গােপনে বিচার করে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করছিল তখন তার নিরাপত্তার জন্য বৃটিশ সরকার বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল। পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা বন্ধ করার জন্য বৃটিশ পার্লামেন্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল, ইয়াহিয়া খানকে বুঝানাের জন্য পার্লামেন্টারী প্রতিনিধি প্রেরণ করেছিল। এবং সর্বশেষ ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়ের পর ত্বরিৎ গতিতে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। বৃটিশ পার্লামেন্ট এবং বৃটিশ সরকারের বাংলাদেশের প্রতি দুর্বলতার (কূটনৈতিক) জন পাকিস্তান সরকার বিক্ষুব্ধ ছিল যার পরিণামে পাকিস্তান কমনওয়েলথ থেকে বের হয়ে গিয়েছিল। প্রসংগত উল্লেখযােগ্য যে, পাকিস্তান পুনরায় কমনওয়েলথে যােগদান করেছে। এপ্রিল মাসটিতে বৃটেনের বাঙালীদের আন্দোলন ও লবিং এর সকল কেন্দ্রবিন্দু ছিল বৃটিশ পার্লামেন্ট। ৫ এপ্রিল স্যার আলেক ডগলাস হিউম বৃটিশ পার্লামেন্টে একটি দায়সারা বিবৃতি প্রদান করেন। এর পর খৃষ্টানদের ধর্মীয় দুটি ইষ্টারের জন্য পার্লামেন্ট কিছু দিনের জন্য স্থগিত হয়। ইষ্টারের বন্ধের পর ১৯ এপ্রিল পুনরায় পার্লামেন্ট বসার দিনে বাংলাদেশ মহিলা সংগ্রাম কমিটি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সহযােগিতায় পার্লামেন্টের সামনে বিক্ষোভ ও সমাবেশের আয়ােজন করে। পার্লামেন্টের সামনে শত শত মহিলা ও ছাত্র-ছাত্রীরা বাংলাদেশের গণহত্যা বন্ধ করার লক্ষ্যে বৃটিশ পার্লামেন্টকে কূটনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি সম্বলিত প্লেকার্ড ও ব্যানার বহন করে।
৪ এপ্রিল, রবিবার বিকাল ৩.০০ টায় “কাউন্সিল ফর দি পিপলস রিপাবলিক অফ বাংলাদেশ ইন ইউ, কে” এর উদ্যোগে লন্ডনের ট্রাফেলগার স্কোয়ারে এক বিরাট জনসভার। আয়ােজন করা হয়। বাঙালীদের সকল রেষ্টুরেন্ট বন্ধ করে লন্ডনে বসবাসকারী বিপুল পরিমাণ বাঙালী উক্ত জনসভায় যােগদান করে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের হাইড পার্ক স্পীকার্স কর্ণারে। দুপুরের সমাবেশের শেষে মিছিল সহকারে ট্রাফেলগীর স্কোয়ারের জনসভায় যােগ দেয়। প্রায়। দশ সহস্র জনতার উপস্থিতিতে ট্রাফেলগার স্কোয়ার পূর্ণ হয়ে যায়। এই সভায় সভাপতিত্ব করেন ‘কাউন্সিল’ এর সভাপতি গউস খান এবং সভা পরিচালনা করেন বি. এইচ, তালুকদার। সভায় বক্তব্য রাখেন কাউন্সিল’ এর সাধারণ সম্পাদক শেখ আবদুল মান্নান, ব্যারিষ্টার শাখাওয়াত হােসেন, সুলতান মােহাম্মদ শরিফ, মাঞ্চেষ্টারের আবদুল মতিন এবং ছাত্র সংগ্রামের এ, জেড. মােহাম্মদ হােসেন মঞ্জু। একই দিনে (৪ এপ্রিল) সন্ধ্যা বেলায় পূর্ব বঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বর্বরতা গণহত্যার প্রতিবাদে লন্ডনের ‘হ্যাম্পস্টেড টাইন হলে এক সুধী সমাবেশ আয়ােজন করা হয়। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন শ্রমিক দলীয় । (Labour Party) প্রভাবশালী নেতা জন এনালস। সভায় যারা বক্তব্য রাখেন তাদের মধ্যে অন্যতম লর্ড ক্লকওয়ে, শ্রমিকদলীয় এম. পি. পিটার শাের, মাইকেল বার্নস্, পাকিস্তানী। ছাত্রনেতা তারেক আলী, নিউজ লেটার’ এর সম্পাদক ফরিদ জাফরী (পাকিস্তানী নাগরিক), বাঙালীদের মধ্য থেকে শেখ আবদুল মান্নান, লুলু বিলকিস বানু, সুলতান মাহমুদ শরীফ প্রমুখ। সভায় বক্তাগণ পূর্ববঙ্গে পাকিস্তানের গণহত্যা ও নিরস্ত্র বাঙালীদের আক্রমণের বিষয়ে। জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ কামনা করেন। পিটার শাের এবং মাইকেল বার্নস্ পূর্ববাংলার সংগ্রামকে সমর্থন করে পাকিস্তান কর্তৃক গণহত্যা বন্ধ করার জন্য বৃটিশ সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
পাকিস্তানের নাগরিক তারেক আলী ও ফরিদ জাফরী পূর্ব বাংলার ন্যায্য সংগ্রামকে সমর্থন করেন। ৪ এপ্রিল লন্ডনের বাইরে অন্যান্য শহরে বিক্ষোভ ও সমাবেশ। অনুষ্ঠিত হয়। ব্রাডফোর্ড শহরে ব্রাডফোর্ড টেক্সটাইল হলে বাঙালীদের এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন আফরুজ বখত এবং বক্তব্য রাখেন মনােয়ার হােসেন, জহির উদ্দিন, আবুল বাশার, করম আলী আহম্মদ, আবদুল মালিক, মাহমুদুল হক, মকসুদ আলী এবং মিসেস সৈয়দা তাহেরা । ১০ এপ্রিল বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আলেক ডগলাসহিউম এর সাথে সাক্ষাৎ করে পাকিস্তান সরকারের পরিচালিত গণহত্যা, সংখ্যাগরিষ্ট দলের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমি ব্যাখ্যা করে বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধ এবং শেখ মুজিবের মুক্তির জন্য তাঁর হস্তক্ষেপ কামনা করেন। বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা মি, সাদারল্যান্ড এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীর একান্ত সচিব মি. ব্যারিংটন। বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে আলােচনার সময় তারা দু’জন উপস্থিত ছিলেন। বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিচারপতি চৌধুরীকে আন্তরিকতার সাথে গ্রহণ করেন এবং যথাসাধ্য সহযােগিতার আশ্বাস দেন। বিচারপতি চৌধুরী পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বের হয়ে সরাসরি বুশ হাউজে বি. বি. সি. এর বাংলা বিভাগে গমন করেন এবং বাংলা অনুষ্ঠানের জন্য সাক্ষাৎকার প্রদান করেন। বিচারপতি চৌধুরী তার সাক্ষাৎকারে আবেগ জড়িত কণ্ঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্র হত্যার তীব্র নিন্দা করেন। তিনি দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত দেশে না ফিরে বিশ্বে পাকিস্তানী সামরিক সরকারের বর্বরতার কথা জানাবেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জনমত সৃষ্টির জন্য আত্মনিয়ােগ করার দৃঢ় প্রত্যয় ঘােষণা করেন। তিনি একই দিনে দি ডেইলি গ্রেলিগ্রাফ’ এর রিপাের্টার পিটার গিল এর সাথে একটি সাক্ষাক্তার দেন। এর দু’টি সাক্ষাৎকার প্রদানের মাধ্যমে বিচারপতি চৌধুরী সরাসরি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পূর্ণ সময়ে বিলাতে বাঙালীদের নেতৃত্ব দেন ও বিলাতসহ ইউরােপআমেরিকায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ব্যাপক প্রচারণা পরিচালনা করেন।
লন্ডনে বসবাসকারী বাঙালীরা বিভিন্ন কমিটি ও সংগ্রাম পরিষদের মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনার সমন্বয় সাধনে বেশ সমস্যা সৃষ্টি হওয়ায় মুজিবনগর সরকারের সাথে প্রত্যক্ষ যােগাযােগ স্থাপন প্রয়ােজন হয়ে পরে। তাই লন্ডন মুভমেন্টের পক্ষ থেকে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের প্রথম আহ্বায়ক মােহাম্মদ হােসেন মঞ্জু ও লন্ডন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সুলতান মাহমুদ শরিফ মুজিবনগর সরকারের সাথে যােগাযােগ স্থাপনের জন্য এবং মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে কলকাতা গমনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। লন্ডন আওয়ামী লীগ সভাপতি মিনহাজ উদ্দিন আহমদ উপরােক্ত বিষয়ে সহযােগিতা করেন। বিলাতে প্রবাসীদের শুভেচ্ছা ও সমর্থনের টোকেন হিসেবে মােহাম্মদ হােসেন মঞ্জু ও সুলতান মাহমুদ শরিফ ১২ এপ্রিল কলকাতার উদ্দেশ্যে লন্ডন ত্যাগ করেন। বিলাতের আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে মুজিবনগরের সরকারের সাথে তাদের যােগাযােগ পরবর্তিকালে মুজিবনগরের সাথে বিলাতের কর্মকাণ্ডের সমন্বয় সাধনে সুফল এনে দিয়েছিল। ১৬ এপ্রিল লন্ডনের হলওয়ে এলাকায় ব্যারিষ্টার রুহুল আমীনের বাসভবনে “কাউন্সিল ফর দি পিপলস্ রিপারলিক অফ বাংলাদেশ ইন ইউ. কে” এর কার্যনির্বাহী কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন কাউন্সিলের সভাপতি গউস খান। বিচারপতি চৌধুরী। সহ কাউন্সিলের কার্যকরী কমিটির সাধারণ সম্পাদক শেখ আবদুল মান্নান, সদস্য ব্যারিষ্টার শাখাওয়াত হােসেন, জাকারিয়া খান চৌধুরী, আমীর আলী, সামসুল মাের্শেদ, শামসুল হুদা হারুন, আবদুল হামিদ প্রমুখ নেতৃবর্গ সভায় উপস্থিত ছিলেন। উক্ত সভায় বিচারপতি চৌধুরীকে এই কমিটির সভাপতির দায়িত্ব নিয়ে বাঙালীদের নেতৃত্ব প্রদানের জন্য সর্বসম্মত অনুরােধ জানানাে হয়। গউস খান এই কমিটির সভাপতির পদত্যাগ করার ঘােষণা করেন। বিচারপতি চৌধুরী সকলকে আশ্বস্ত করে বলেন, একটি কমিটির সভাপতির দায়িত্ব না নিয়ে তিনি আরাে বৃহত্তর পরিসরে কাজ করতে চান এবং এই মর্মে তার বিভিন্ন পরিকল্পনার কথা বলে কমিটির সদস্যদের সাথে একাগ্রচিত্তে কাজ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। | ১৮ এপ্রিল, রােববার বিকালে বাংলাদেশ এ্যাকশন কমিটি” এর উদ্যোগে ট্রাফেলগার স্কোয়ারে এক বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। বক্তাগণ নব গঠিত মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য অভিনন্দন জানিয়ে বাংলাদেশ সরকারকে অকুণ্ঠ সমর্থনের ঘােষণা করেন।
সভায় পাকিস্তান ক্রিকেট দলের বৃটেন সফর বাতিল করার জন্য বৃটিশ কর্তৃপক্ষকে আহ্বান জানান হয়। সভাশেষে এক বিরাট মিছিল ১০নং ডাইনিং স্ট্রীটে প্রধানমন্ত্রী বাসভবনের সামনে সমবেত হয় এবং নবগঠিত বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি জানানাের দাবি সম্বলিত একটি স্মারকলিপি প্রধানমন্ত্রীর বরাবরে পেশ করা হয়। | একই দিনে (১৮ এপ্রিল) বৃটিশ পার্লামেন্টের প্রভাবশালী শ্রমিক দলীয় এম, পি, ব্রুস ডগলাস ম্যানের নেতৃত্বে “জাষ্টিস্ ফর ইষ্ট পাকিস্তান” নামে একটি সংগঠন বাংলাদেশের সমর্থক বৃটিশ এম, পি, ও বিশিষ্ট নাগরিকদের সমন্বয়ে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এই কমিটির পক্ষ থেকে পরের দিন (১৯ এপ্রিল) ব্রুস ডগলাস-ম্যান এম, পি, বাংলাদেশ থেকে আগত। শরণার্থীদের অবস্থা এবং পূর্ববঙ্গের পরিস্থিতি দেখার জন্য কলকাতা গমন করেন। | ১৮ এপ্রিল যুক্তরাজ্যস্থ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কার্যকরী কমিটির সভা আমার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বক্তব্য রাখেন এ-টি, এম ওয়ালী আশরাফ, এ, কে, নজরুল ইসলাম, লুৎফর রহমান সাহজাহান, সামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, শফিউদ্দিন মাহমুদ বুলবুল প্রমুখ ছাত্র নেতৃবৃন্দ। সভায় নিম্নলিখিত বিষয়ে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় ঃ (ক) পাকিস্তান ক্রিকেট দলের আসন্ন বৃটেন সফরের প্রতিবাদ; (খ) ২৪ এপ্রিল বিকাল ৪.০০ টায় পাকিস্তান ক্রিকেট টীমের হিথরাে বিমান বন্দরে অবতরনের সময়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন; (গ) ক্রিকেট টীমের সফরের বিরুদ্ধে কর্মসূচী গ্রহণে ইয়ং লিবারেল পার্টির পিটার হেইনসহ অন্যান্য সংগ্রাম পরিষদের সাথে যােগাযােগে স্থাপন; (ঘ) ক্রিকেট খেলার জন্য নির্ধারিত মাঠের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শনের কর্মসূচী গ্রহণ এবং (ঙ) মহান মে দিবসে মিছিল সহকারে ট্রাফেলগার স্কোয়ারে শ্রমিক সমাবেশে যােগ দান। এপ্রিল মাসে বাংলাদেশের জনগণের রক্তে যখন প্রতিনিয়ত দেশের মাটি রঞ্জিত হচ্ছে, পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনীর বর্বরতার জন্য সারা বিশ্ব যখন প্রতিবাদ মুখর তখন হৃত সম্মান পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা হিসেবে পাকিস্তান তাদের ক্রিকেট টীমকে বৃটেনে শুভেচ্ছা সফরে প্রেরণ। করে। বিলাতের বাঙালীরা এই শুভেচ্ছা সফরকে নিছক ক্রিকেট খেলা হিসেবে মেনে নিতে। পারেনি। বিলাতে ইতােমধ্যে প্রতিষ্ঠিত সংগ্রাম পরিষদ সমূহ এই মর্মে সিদ্ধান্ত নেয় যে, ইয়াহিয়ার রক্তরঞ্জিত হাতকে শুভেচ্ছার হাতে পরিণত করার এই ক্রিকেট খেলার কূটনৈতিক পদক্ষেপকে প্রতিহত করতে হবে। ইতােপূর্বে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী সরকারের বিরােধিতা ও নিন্দা জ্ঞাপনের মাধ্যম হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকা প্রেরিত ক্রিকেট টীমকে বিলাতে বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল।
বাংলাদেশে গণহত্যাকে ধামাচাপা দেয়ার লক্ষ্যে পাকিস্তান ক্রিকেটকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার প্রতিবাদে বিলাতে বিভিন্ন কার্যক্রম। গ্রহণ করা হয়। প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে বেঙ্গল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ২৩ এপ্রিল ৭১ তারিখে ২৬৪ নং দি ট্রান্ড, লন্ডন ডব্লিউ, সি-২ এর অবস্থিত ‘চার্লস ডিকেনসে’ এক সাংবাদিক সম্মেলনের আয়ােজন করে। সাংবাদিক সম্মেলনে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে সাপ্তাহিক জনমতের তৎকালীন সম্পাদক এ টি এম ওয়ালী আশরাফ লিখিত বক্তব্য পেশ করেন। সাংবাদিক সম্মেলনে পাকিস্তানের এই ক্রিকেট টীমের সফরকে রাজনৈতিক চাল হিসেবে আখ্যায়িত করে তাদের এই হীন প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করার প্রত্যয় ঘােষণা করা হয়। সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে বিলাতের সকল সংগ্রাম পরিষদ সমূহকে এই ক্রিকেট সফর প্রতিহত করার আহ্বান জানানাে হয়। | ২১ এপ্রিল থেকে ২৩ এপ্রিল পরপর তিনরাত “কাউন্সিল ফর দি পিপল্স রিপাবলিক অফ বাংলাদেশ ইন ইউকে” এর কার্যকরী কমিটীর সভা পূর্ব লন্ডনের আটিলারী প্যাসেজের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিটি সভায় সভাপতিত্ব করেন কাউন্সিল’ এর সভাপতি গউস খান। সভায় কাউন্সিল’ এর সাধারণ সম্পাদক শেখ আবদুল মান্নান সহ প্রায় সকল সদস্যই উপস্থিত ছিলেন। এই গুরুত্ব পূর্ণ তিন রাতের সভায় প্রধান আলােচ্য বিষয় ছিল ইতােমধ্যে আহুত কভেন্ট্রি সম্মেলনে করণীয় কৌশল ও প্রাথমিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ। বিভিন্ন শহরে প্রতিষ্ঠিত সংগ্রাম পরিষদগুলাের মধ্যে সমন্বয় এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কেন্দ্রীয় ভাবে বিলাতে আরাে কার্যকর ভূমিকা গ্রহণের লক্ষ্যে কভেন্ট্রি সম্মেলনে একটি কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের ব্যাপারে। সভায় সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়। কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের সকল প্রতিবন্ধকতা ও সংশয় মুক্ত করার লক্ষ্যে কাউন্সিল’ এর সভাপতিসহ সকল সদস্য পদত্যাগ করার ঘােষণা প্রদান করেন। ২৪ এপ্রিল কভেন্ট্রি সম্মেলনে ‘স্টিয়ারিং কমিটি গঠন যুক্তরাজ্যে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্দোলন, আন্তর্জাতিক প্রচার, কূটনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা এবং বিশ্বজনমত সৃষ্টিতে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালনে একটি স্মরণীয় ঘটনা হিসাবে চিহ্নিত হয়ে আছে। সেই গুরুত্ব উপলব্ধি থেকেই কভেন্ট্রি সম্মেলন সম্পর্কে একটি আলাদা অধ্যায়ে (অধ্যায়-পাপ আলােচনা করা হয়েছে।
২৫ এপ্রিল বৃটেনে বামপন্থীদের সংগঠন “স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদ” এর উদ্যোগে লন্ডনের রেড লায়ন স্কোয়ারে অবস্থিত কনওয়ে হলে’ প্রবাসী বামপন্থীদের একটি সম্মিলিত সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন জিয়াউদ্দিন মাহমুদ এবং বক্তব্য রাখেন লুৎফর রহমান সাহজাহান, নিখিলেশ চক্রবর্তি, এরশাদ আলী, গৌরাঙ্গ সাহা, সামসুল আলম, মুস্তাফিজ উদ্দিন আহম্মদ, হাবিবুর রহমান ও আবদুল হক প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। বক্তাগণ দেশের মুক্তির জন্য ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের উপর গুরুত্ব দিয়ে ভিয়েত্রম সংগ্রামের’ আদলে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য মতামত ব্যক্ত করেন। কোন কোন বক্তা বিপ্লবের মাধ্যমে দেশকে মুক্ত করার পক্ষে অভিমত প্রকাশ করলে বিপ্লবের ব্যাখ্যা নিয়ে সভায় মতানৈক্যের সৃষ্টি হয়। | ২৬ এপ্রিল পূর্ব লন্ডনের হ্যাসেল স্ট্রীটে “কাউন্সিল ফর দি পিপলস রিপাবলিক অফ বাংলাদেশ ইন, ইউ, কে,” বিলুপ্ত হওয়ায় লন্ডন ভিত্তিক একটি সংগ্রাম পরিষদ গঠন করার জন্য এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন শামসুর রহমান। সভায় অন্যান্যদের। মধ্যে বক্তব্য রাখেন মিনহাজউদ্দিন, শেখ আবদুল মান্নান, জিল্লুর রহমান, আমীর আলী এবং ডাঃ নুরুল হােসেন প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। সভায় লন্ডন ভিত্তিক সংগ্রামের কর্মকাণ্ডকে জোরদার করার জন্য লন্ডন এ্যাকশন কমিটি ফর দি পিপলস রিপাবলিক অফ বাংলাদেশ” নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। উক্ত কমিটির সভাপতি ও সেক্রেটারী হিসাবে সভায় অনুপস্থিত গউস খান ও ব্যারিষ্টার শাখাওয়াত হােসেনকে দায়িত্ব প্রদান করা হয়। সভায় আর এক প্রস্তাবে ‘জয়বাংলা’ নামে একটি বাংলা সাপ্তাহিক প্রকাশের সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়। আমীর আলীর সম্পাদনায় ‘জয়বাংলা’ এর ৪টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। কিন্তু ব্যারিষ্টার শাখাওয়াত হােসেনের সেক্রেটারী পদত্যাগ ও আমীর আলীর কমিটির সাথে সম্পর্কচ্ছেদ সহ কমিটির সদস্যদের অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং অসহযােগিতার কারণে লন্ডন এ্যাকশন। কমিটি নিষ্ক্রিয় হয়ে যায় ও ‘জয়বাংলা’ এর প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। ২৭ এপ্রিল লন্ডনে পাকিস্তান হাইকমিশনের বাঙালী শিক্ষা কর্মকর্তা হাবিবুর রহমানকে বাংলাদেশ আন্দোলনের সাথে সক্রিয় থাকার অভিযােগে বিনা নােটিশে বরখাস্ত করা হয়। হাবিবুর রহমান পরবর্তি কালে বাংলাদেশ দূতাবাসে’ যােগদান করে আন্দোলনে সার্বক্ষণিক কাজ করেন। ২৮ এপ্রিল লন্ডনের মে-ফেয়ার এলাকায় অবস্থিত ইংলিশ স্পিকিং এসােসিয়েশনে আয়ােজিত পাকিস্তান ক্রিকেট টীমের সম্বর্ধনা সভায় বাধা দিতে হাজার হাজার বাঙালী সেখানে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। পুলিশ বিক্ষোভকারীদের নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়ে এক পর্যায়ে ২৬ জন বিক্ষোভকারীকে গ্রেফতার করে। বৃটেনে পাকিস্তান ক্রিকেট টীমের সফরের বিরুদ্ধে গৃহিত বিভিন্ন কর্মসূচী সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলােচনা করা হয়েছে গ্রন্থের তেত্রিশ অধ্যায়ে।
মে মাসে প্রবাসীদের তৎপরতা
শ্রমিক আন্দোলনের অতীব গুরুত্বপূর্ণ দিন ১ মে তারিখে আমেরিকার শিকাগাে শহরের শ্রমিকদের আত্মত্যাগকে স্মরণ করার জন্যে লন্ডনের ট্রাফেলগার স্কোয়ারে প্রতি বছর নিয়মিতভাবে অনুষ্ঠিত হয় এক বিরাট শ্রমিক-জন সমাবেশ। এর আয়ােজনে থাকেন বৃটেনের সকল শ্রমিক সংগঠন ও লেবার দলীয় নেতৃবৃন্দ। এ বিশাল সমাবেশে বাংলাদেশের ইস্যুর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের কথা চিন্তা করে বাংলাদেশের ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও মহিলা সমিতি উক্ত সমাবেশে দলগতভাবে বাংলাদেশের ব্যানার ও বাংলাদেশের দাবিতে ফেটুন সহ অংশ গ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। লন্ডন সংগ্রাম পরিষদ, কাউন্সিল ফর লিবারেশন অব বাংলাদেশ ও ষ্টিয়ারিং কমিটি এই কার্যক্রমে ঐকমত্য পােষণ করেন। | লন্ডনে প্রকাশিত জনমত পত্রিকা ও লিফলেটের মাধ্যমে লন্ডন ও আশপাশের শহরের সকল বাঙালীকে হাইড পার্ক স্পীকার্স কর্ণারে সমবেত হয়ে মে দিবস প্যারেডে অংশগ্রহণ এবং স্ট্রাফেলগার স্কোয়ারের সমাবেশে যােগদানের আহ্বান জানানাে হয় । ঘােষিত কাৰ্যসূচী মােতাবেক শত শত বাঙালী হাইড পার্কে সমবেত হয়ে বাংলাদেশের পতাকা, ব্যানার ও ফেটুন বহন করে অক্সফোর্ড স্ট্রীট দিয়ে শােভাযাত্রা করে ট্রাফেলগার স্কোয়ারে গমন করে। বাংলাদেশের সংগ্রামী ও নির্যাতিত জনগণের পক্ষে বিরাট শােভাযাত্রা দেখে মে দিবসের উদ্যোক্তরা আনন্দিত হন এবং উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে মাইকে ঘােষণার মাধ্যমে একাত্মতা ঘােষণা করা হয়। সমাবেশটিতে বিলাতের প্রগতিশীল শ্রমিক শ্রেণীর সকল নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। ইতােপূর্বে উপস্থিত নেতৃবৃন্দের অনেকেই ব্যক্তিতভাবে পার্লামেন্টে বা তাদের দলীয় সভায় বাংলাদেশের প্রতি তাদের সহানুভূতি ব্যক্ত করেছেন। উদ্যোক্তাদের মধ্য থেকে উপস্থিত বাংলাদেশের আন্দোলনের পক্ষ থেকে সমাবেশে বক্তব্য রাখার আহ্বান জানানাে হয়। এ ধরনের ঘােষণা আমাদের কাছে সম্পূর্ণভাবে অবিশ্বাস্য ছিল। নির্ধারিত বক্তার অতিরিক্ত একটি বিদেশী মুক্তিকামী জাতির পক্ষে বক্তব্য রাখার সুযোেগ প্রদান একটি ব্যতিক্রমধর্মী পদক্ষেপ ছিল।
এই পদক্ষেপের মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিকামী নিরস্ত্র জনগণের প্রতি সমাবেশের একনিষ্ঠ সমর্থন ও সহানুভূতি প্রকাশ পেয়েছিল। বাংলাদেশ ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ ও মহিলা সমিতির উপস্থিত নেতৃবৃন্দ তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিয়ে ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদের কর্মী সুরাইয়া খানমকে বক্তব্য রাখার জন্য মনােনীত করেন। সুরাইয়া খানম ইংরেজি বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রীর জন্য বিলাতে অধ্যায়নরতা ছিলেন। তিনি পরবর্তীকালে কিছুদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে শিক্ষকতা করেছেন। তিনি বাংলাদেশে সংঘটিত নৃশংস হত্যাকাণ্ড ও মহিলাদের উপর জঘন্য নির্যাতনের কথা উপস্থিত সমাবেশে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেন। সমাবেশের পক্ষ থেকে হাজারাে জনতা সেদিন ইংরেজি ভি” চিহ্ন দেখিয়ে বাংলাদেশের বিজয় কামনা করেছিলেন। স্টিয়ারিং কমিটির সিদ্ধান্ত মােতাবেক পূর্ব লন্ডনের ১১নং গােরিং স্ট্রীটে ষ্টিয়ারিং কমিটির অফিস ভাড়া করা হয়। উক্ত অফিসটি বাঙালী পাট ব্যবসায়ী হারুন অর রশিদ সাহেবের অফিস ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাট ব্যবসা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় হারুন অর রশিদের পাঁচ কক্ষ বিশিষ্ট অফিস প্রয়ােজন ছিল না। অফিসের টেলিফোন ও আসবাবপত্র সহ অপেক্ষাকৃত কম ভাড়ায় অফিসটি পেয়ে যাওয়ায় স্টিয়ারিং কমিটির একটি ঠিকানা অতি সহজেই মিলে যায়। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ৩ মে ১১নং গােরিং স্ট্রীটে ষ্টিয়ারিং কমিটির কার্যালয়ের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। এর পর থেকে ডিসেম্বরে বিজয় অর্জন পর্যন্ত স্টিয়ারিং কমিটির উক্ত অফিস প্রবাসী বাঙালীদের যুদ্ধকালীন আন্দোলনের কেন্দ্র বিন্দুতে পরিণত হয়। | ৭ মে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের অপপ্রচারের প্রতিবাদে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন। ৮ মে ষ্টিয়ারিং কমিটির ১১ নং গােরিং স্ট্রীটের কার্যালয়ে ষ্টিয়ারিং কমিটির এক সভা বিচারপতি চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বিলাতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণের জন্য ফাণ্ডের প্রয়োজনীয়তার কথা বিবেচনা ও আলােচনা করা হয়। ফান্ড সংগ্রহ ও পরিচালনার ব্যাপারে স্বচ্ছতার গুরুত্ব সম্পর্কে সকলেই আলােকপাত করেন এবং সর্বসম্মতিক্রমে বাংলাদেশ ফান্ড” নামে একটি কেন্দ্রীয় তহবিল গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। বাংলাদেশ ফাণ্ড, সম্পর্কে ছাব্বিশ অধ্যায়ে বিস্তারিত আলােচনা করা হয়েছে।
বৃটেনে পাকিস্তান ক্রিকেট টীমের সফরের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জন্য পূর্বঘােষিত কর্মসূচী মােতাবেক ৮ মে লন্ডনের উত্তরে অবস্থিত নর্থ হাম্পটন শহরের ক্রিকেট গ্রাউন্ডে পাকিস্তান ও বৃটেনের খেলার দিনে মাঠের বাইরে প্রায় দুই হাজার বাঙালী বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। বিক্ষোভকারীদের হাতে ‘পাকিস্তান নিপাত যাক’, ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’; মুক্তিযযাদ্ধারা এগিয়ে চল’ সহ বিভিন্ন শ্লোগান সম্বলিত প্ল্যাকার্ড শােভা পায়। | ৯ মে সকাল ১০.০০ টায় ব্রাডফোর্ড সগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে একজনসভা আয়ােজন করা হয়। বৃটেনে বাঙালীদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে শাণিত করা এবং প্রচারের উদ্দেশ্যে যুক্তরাজ্যে জনসংযােগের অংশ হিসাবে ব্রাডফোর্ডে প্রথম সভা অনুষ্ঠিত। সভায় প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। লন্ডন থেকে তার সাথে সফরসঙ্গি ছিলেন স্টিয়ারিং কমিটির শেখ আবদুল মান্নান, লন্ডন সংগ্রাম কমিটির জাকারিয়া খান চৌধুরী এবং মেডিকেল এ্যাসােসিয়েশনের ডাঃ মােশাররফ হােসেন জোয়ার্দার। সভা আয়ােজনে যারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তাদের মধ্যে মুসাব্বির তরফদার, এ. কে. এম. এনায়েতউল্লা, আবদুস সােবাহান মাষ্টার, আবদুল কাদের, মাহমুদুল হক ও মীর্জী লুৎফর রহমান প্রমুখ নেতৃবৃন্দের নাম উল্লেখযােগ্য। বিচারপতি চৌধুরী সভায় বাংলাদেশের জনা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের স্বপক্ষে বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে। ব্রাডফার্ডের বাঙালীদের উৎসাহ দান ও সংগ্রামের জন্য অনুপ্রাণিত করেন। ৯ মে বিকাল ৪ টায় বার্মিংহামে একটি স্থানীয় হলে বার্মিংহাম সংগ্রাম কমিটির উদ্যোগে এক বিশাল জনসভার আয়ােজন করা হয়। বিচারপতি চৌধুরী ব্রাডফোর্ড থেকে সরাসরি ডাঃ মােশাররফ হােসেন জোয়ার্দারের গাড়ীতে শেখ আবদুল মান্নান ও জাকারিয়া খান চৌধুরীকে সঙ্গে নিয়ে বার্মিংহাম সভা স্থলে পৌছেন। লন্ডনের পর অধিক বাঙালীদের বসবাস বার্মিংহামে। তাই বামিংহামের জনসভাটি ছিল জনাকীর্ণ । সভায় সভাপতিত্ব করেন বার্মিংহাম সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক জগলুল পাশা। সভায় বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ছাড়াও বক্তব্য রাখেন শেখ আবদুল মান্নান ও বার্মিংহামের স্থানীয় নেতৃবৃন্দ। বিচারপতি চৌধুরী বার্মিংহামের বাঙালীদের মনােবল দৃঢ় করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা কেউ রুখতে পারবে না।
মে মাসের কর্মতৎপরতার মধ্যে আরেকটি উল্লেখযােগ্য ঘটনা বৃটিশ পার্লামেন্ট ভবনের সামনে এবং চর্তুপাশে অবস্থান ধর্মঘট। বৃটিশ পার্লামেন্টে ৪ এপ্রিল নর্থ কেনসিংগটন থেকে নির্বাচিত শ্রমিক দলীয়-এম পি ব্রুস ডগলাস ম্যানের উপস্থাপিত প্রস্তাবের পূর্ণ আলােচনার জন্য ১৩ এবং ১৪ মে নির্ধারণ করা হয়। সংগ্রাম পরিষদ সমূহ বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের বৈদেশিক মুখপাত্র বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সাথে পরামর্শক্রমে ১৩ এবং ১৪ মে বৃটিশ এম পিদের দৃষ্টি আকর্ষণ এবং বাংলাদেশকে সমর্থন দানের আবেদন জানানাের কর্মসূচী গ্রহণ করে। ১৩ মে সন্ধ্যার অধিবেশনে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ উত্থাপন হওয়ার সম্ভাবনার কথা বিবেচনা করে পার্লামেন্ট ভবনের চর্তুপার্শ্বে মােমবাতি (Candle Light) জ্বালিয়ে বেষ্টনী স্থাপন করে অবস্থান গ্রহণের কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়। ব্যতিক্রমধর্মী এই কর্মসূচীতে লণ্ডন ও আশেপাশের শহর থেকে বাঙালী ছাত্র, শ্রমিক, মহিলা ও চাকুরিজীবী সহ সকল স্তরের মানুষের সমাবেশ ঘটে। অংশগ্রহণকারী প্রত্যেকেই বড় আকারের মােমবাতি সঙ্গে নিয়ে আসেন। সংগ্রাম পরিষদ থেকেও মােমবাতি সরবরাহ করা হয়। সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত পার্লামেন্টের চর্তুপার্শ্বে টেমস নদীর পাড় ঘেষে প্রজ্বলিত মােমবাতির বেষ্টনী এক নয়নমধুর দৃশ্যের অবতারণা করে। পার্লামেন্টের মাননীয় এম পি, সাংবাদিক ও উৎসাহী দর্শক এই নতুন ধরনের শান্তিপূর্ণ দৃষ্টি আকর্ষণকারী কর্মসূচীকে প্রশংসা করেন। বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল এবং প্রস্তাবে সমর্থনকারী ১৬০ জন মাননীয় এম পি এর মধ্যে অনেকেই অবস্থানকারীদেরকে বাংলাদেশের প্রতি সমর্থনের আশ্বাস প্রদান করেন। মােমবাতি বেষ্টনী। সৃষ্টি করে বৃটিশ এমপিদের প্রতি বাংলাদেশের সমর্থনের প্রােগ্রামে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও মহিলা সমিতির সদস্য ও সদস্যারা বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করে। ১৩ মে দুপুর থেকে ১৪ মে বিকেল পর্যন্ত ২৬ ঘণ্টা ‘হাউস অফ কমন্স’ এর সামনে দক্ষিণ ওয়েলস বাংলাদেশ এ্যাকশন কমিটি বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বৃটিশ এম, পি, দের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য অনশন ধর্মঘট পালন করে। অনশনে অংশ গ্রহণ করেন আবদুল হানান, এম. জেড. মিয়া, মােহাম্মদ ফিরােজ, আবদুল হালিম ও আবদুস শহীদ প্রমুখ। কর্মীবৃন্দ। ১৬ মে কভেন্ট্রিতে স্থানীয় সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে এক সভার আয়ােজন করা হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন সামসুল হুদা চৌধুরী এবং বিগত কয়েকমাসের কাজের বিবরণী পাঠ করেন মতছিম আলী। কভেন্ট্রির বাঙালীদের যার যার অবস্থান থেকে। ঐক্যবদ্ধভাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচার কার্য পরিচালনার জন্য সভায় বক্তাগণ মতামত ব্যক্ত করেন।
১৪ মে বৃটিশ পার্লামেন্টে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে আলােচনা অব্যাহত থাকে। পূর্ব ঘােষিত প্রােগ্রাম মােতাবেক ১৪ মে পালামেন্টের সামনে সকাল ১১টা থেকে পুনরায় অবস্থান ধর্মঘট শুরু হয়। বিভিন্ন ব্যানার ও প্লেকার্ড নিয়ে শত শত বাঙালী কর্মী পার্লামেন্টের সামনে অবস্থান। গ্রহণ করে। ঐদিন বেলা ১টায় পার্লামেন্টে মধ্যাহ্ন ভােজের বিরতির পূর্বে ব্রুস ডগলাস ম্যানের উত্থাপিত প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। প্রস্তাবে বলা হয় যে, এই হাউজ পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞের জন্য গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং ভবিষ্যতে খাদ্যের মারাত্মক ঘাটতির আশংকা করছে। এই হাউজ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের এই দুর্দশা লাঘব, জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাকে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের গণতান্ত্রিক রায়ের ভিত্তিতে একটি রাজনৈতিক সমাধান অর্জনের জন্য বৃটিশ সরকারের প্রভাব ব্যবহারের জন্য আহ্বান জানাচ্ছে। প্রস্তাবের এক অংশে পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে উল্লেখ করে বলা হয় যে, এ পর্যন্ত কোন কোন হিবে দশ লাখ (এক মিলিয়ন) এর মত বাঙালীকে হত্যা করা হয়েছে। এই জঘন্য হত্যাকাণ্ড এবং তার ফলে যে ঘৃণার সৃষ্টি হয়েছে তাতে এক ও অভিন্ন দেশ হিসেবে পাকিস্তানের মৃত্যু ঘটেছে। প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর পার্লামেন্ট ভবন থেকে জন ষ্টোন হাউজ ও বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী সমাবেশ স্থলে উপস্থিত হন এবং সমবেত জনগণ পার্লামেন্ট ফটকে এক স্বতঃস্ফূর্ত সভা অনুষ্ঠানের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। কিন্তু পুলিশের বাধার মুখে সমবেত জনতা মিছিল করে সেখান থেকে হাউড পার্কে গমন করে। হাইড পার্কে আমার (লেখক) সভাপতিত্বে এক স্বতঃস্ফূর্ত সভায় বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী এবং বৃটিশ এম পি জন ষ্টোনহাউজ বৃটিশ পার্লামেন্টে এই প্রস্তাব সর্বসম্মতিতে গৃহিত হওয়াকে বাংলাদেশের প্রথম আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক বিজয় বলে অভিহিত করেন। এখানে উল্লেখযােগ্য যে, বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনের কাজে যােগ দেয়ার পর হাইডপার্কের এই স্বতঃস্ফূর্ত জনসভায় প্রথমবারের মতাে জনসম্মুখে বক্তব্য রাখেন। কূটনৈতিক, বুদ্ধিজীবী ও আইনজীবী মহলে বিচারপতি চৌধুরী বহু তৎপরতা চালিয়ে গেলেও কোন জনসভায় ইতােপূর্বে কোন বক্তব্য রাখেননি। ১৯৭১ সালের মে মাসের প্রথম দুই সপ্তাহ বিলাত প্রবাসীদের তৎপরতার কেন্দ্র বিন্দু ছিল বৃটিশ পার্লামেন্ট।
হাউজ অব কমন্স [House of Commons) বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিমূলক প্রস্তাব গ্রহণ করলে এবং পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দকৃত সাহায্য হ্রাস করলে বিশ্বজনমত বাংলাদেশের প্রতি দৃষ্টি দেবে এই প্রত্যাশায় বিলাতের প্রবাসীরা ক্রস ডগলাসম্যানের উত্থাপিত প্রস্তাবের ইস্যুটিকে অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে গ্রহণ করে। পার্লামেন্ট ভবনের সামনে অবস্থান ধর্মঘটসহ বিভিন্ন প্রােগ্রাম ছাড়াও বৃটিশ এম, পিদেরকে এলাকা ভিত্তিক যােগাযােগ স্থাপন ও ধর্না (Lobbing) দেয়ার কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থা অবহিত করার উদ্দেশ্যে দুটি আবেদনপত্র বৃটিশ এম, পিদের কাছে বিতরণ করা হয়। প্রথম প্রচারপত্রটি “An appeal to the Members of the British House of Commons” শিরােনামে বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ প্রকাশ করে। উক্ত প্রচারপত্রে বাংলাদেশের নির্যাতিত জনগণের সমর্থন ইতােমধ্যে যে সকল সম্মানিত বৃটিশ এম পি এগিয়ে এসেছিলেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে ‘গণতন্ত্রের মা’ নামে পরিচিত বৃটিশ পার্লামেন্টের সকল সম্মানিত সদস্যকে গণতন্ত্রের সংগ্রামে লিপ্ত বাংলাদেশের জনগণকে সমর্থন দানের জন্য আবেদন জানানাে হয়। ৫ এপ্রিল পার্লামেন্টে প্রদত্ত বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আলেক ডগলাস হিউমের বক্তব্যকে খণ্ডন করে আবেদনপত্রে বলা হয় যে, মাননীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশের প্রকৃত অবস্থা এবং এতদসংক্রান্ত বৃটিশ জনগণের মনােভাব সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারেননি। প্রচারপত্রে ৬ এপ্রিলে ‘দি গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় প্রকাশিত বৃটিশ জনগণের মনােভাবের কথা উল্লেখ করা হয়। দি গার্ডিয়ানে প্রকাশিত বৃটিশ জনগণের মনােভাবের পরিচয় হিসেবে প্রতিবেদনের অংশ এখানে উদ্ধৃত করা হলাে “The Foreign and Commonwealth office still seems to believe the fact that a foreign Government is diplomatically recognised is more important than blood on its hands. Sir Alec Douglas Home had the opportunity yesterday to declare Britain’s support for democracy in East Pakistan. He wasted it.” (The Guardian. 6th April, 1971) আবেদনপত্রে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণার প্রেক্ষাপট ও যৌক্তিকতা বিশ্লেষণ করে গণতন্ত্রের ধারক মাননীয় বৃটিশ এমপিদেরকে বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের পক্ষ সমর্থন করার আকুল আহ্বান জানানাে হয়। | এই উদ্দেশ্যে বৃটেনের বাংলাদেশ সংগ্রাম পরিষদসমূহের পক্ষ থেকে “One more appeal to the conscience of the mother of Parliaments” নামে অপর একটি আবেদনপত্র প্রত্যেক মাননীয় বৃটিশ এম পিদের কাছে পৌছে দেয়া হয়। চার পৃষ্ঠাব্যাপী এই আবেদনপত্রটি একটি দলিল হিসেবে বিলি করা হয়।
এই আবেদনপত্রে। বাংলাদেশ আন্দোলনের পটভূমি, ২৫ মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হত্যা, ধর্ষণ ও ধ্বংসযজ্ঞের সংক্ষিপ্ত বিবরণ, রিলিফ ক্যাম্পগুলাের করুণ অবস্থা, মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতি এবং বাংলাদেশের জনগণের প্রত্যয়ের কথা তুলে ধরা হয়। এই প্রচারপত্রে পাকিস্তানের হত্যাকারী সরকারকে বৃটেন কর্তৃক প্রদত্ত সাহায্য বন্ধ করে দেয়ার জন্য বৃটিশ সরকারের প্রতি চাপ সৃষ্টির জন্য বৃটিশ এমপিদের কাছে বিশেষভাবে আবেদন জানানাে হয়। যক্তি হিসেবে উল্লেখ করা হয় যে, পাকিস্তান বৈদেশিক সাহায্য না পেলে বাংলাদেশে নিরস্ত্র বাঙালিদের হত্যা করার জন্য পরিচালিত যুদ্ধের বাজেট হ্রাস পাবে এবং তার ফলে বাংলাদেশের মুক্তি ত্বরান্বিত হবে। বৃটেন ‘পাকিস্তান সাহায্য কনসরসিয়ামের’ শক্তিশালী সদস্য হিসেবে সাহায্য বন্ধের মাধ্যমে ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞের অবসান হতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়। উপরােক্ত কার্যক্রম অত্যন্ত কার্যকরী হওয়ার ফলে বৃটিশ হাউস অব কমনসে উত্থাপিত ক্রস ডগলাস ম্যানের প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর তৃতীয় মাসে বৃটিশ পার্লামেন্টে বাংলাদেশের পক্ষে প্রস্তাব গ্রহণ প্রবাসীদের তৎপরতার ফলে সম্ভব হয়েছিল এবং তার ফলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি লাভ করেছিল। | মে মাসের ১৩ থেকে ১৬ তারিখে পূর্ব ইউরােপের হাঙ্গেরীর রাজধানী বুদ্যাপেষ্ট শহরে। চতুর্থ বিশ্ব শান্তি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। মুজিবনগর অস্থায়ী সরকার উক্ত সম্মেলনে প্রতিনিধি প্রেরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সম্মেলনে বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিনিধি গ্রহণ ও প্রতিনিধি দলের যাবতীয় ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব লন্ডন আন্দোলনের ষ্টিয়ারিং কমিটির উপর ন্যস্ত করা হয়। মুজিবনগর সরকারের পক্ষ থেকে উক্ত সম্মেলনে প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব প্রদানের জন্যে সিলেট থেকে নির্বাচিত তৎকালীন এমএনএ ও বাংলাদেশ সরকারের ভ্রাম্যমান প্রতিনিধি আবদুস সামাদকে মনােনীত করা হয় । প্রতিনিধি দলের অন্যান্য সদস্য ছিলেন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির যুগ্ম সচিব দেওয়ান মাহবুব আলী এবং বিলাতের আন্দোলনের পক্ষে এটিএম ওয়ালী আশরাফ। চতুর্থ বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে ১২৪টি দেশের আট শতাধিক সদস্য যােগদান করেন। সম্মেলনে বাংলাদেশের সগ্রামরত জনগণের পক্ষে প্রতিনিধি দলের নেতা আবদুস সামাদ বক্তব্য রাখেন। উক্ত সম্মেলনে এক প্রস্তাবে বাংলাদেশে সংঘটিত হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করা হয় এবং স্বাধীনতাকামী বাংলাদেশের জনগণের সংগ্রামের প্রতি একাত্মতা ঘােষণা করা হয়।
উল্লেখ্য যে, হাঙ্গেরীতে অনুষ্ঠিত এই শান্তি সম্মেলনে বাংলাদেশের স্বীকৃতি স্বরূপ সম্মানজনক ‘ল্যাম্ৰাকিস’ (LAMBRAKIS) পদকে ভূমিত করা হয়। | বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে পাকিস্তান সরকার বিশ্বজনমতকে বিভ্রান্ত করার জন্য আন্তর্জাতিক পত্র-পত্রিকায় বানােয়াট খবরা-খবর প্রচারের ব্যবস্থা করে। এই অপপ্রচারকে প্রতিহত করার জন্য এ মাসে বিলাতের বিভিন্ন সগ্রাম কমিটি প্রচারপত্র প্রকাশ। করে সঠিক পরিস্থিতি উপস্থাপনের প্রচেষ্টা গ্রহণ করে। বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এ মাসে তাদের নিয়মিত ফ্যাক্টশীটের ৯ নং সংস্করণ প্রকাশ করে। নর্থ ও নর্থ ওয়েষ্ট লন্ডন সংগ্রাম কমিটি ৩৩ নং ডাগমুর রােড, লন্ডন-নর্থ ২২ ঠিকানা থেকে বাংলাদেশ টু-ডে’ শিরােনামে ৫ মে একটি প্রচারপত্র প্রকাশ করে এবং প্রভাবশালী মহলে বিতরণ করে। উক্ত প্রচারপত্রে ইয়াহিয়া খানের মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে এবং বাংলাদেশের সমর্থনে সােচ্চার হওয়ার অন্য বিশ্ববাসীর কাছে আবেদন জানানাে হয় । ৬মে ১৫নং এলডন স্ট্রীটে, গ্লাসগো-সিত ঠিকানা থেকে স্কটল্যান্ডস্থ বাংলাদেশ এসােসিয়েশন অপর একটি প্রচারপত্র প্রকাশ করে। এই বইপত্রে বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে বৃটিশ সাংবাদিকদের প্রতি বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনের আবেদন জানানাে হয়। ৮ মে ৬৮/এ, ষ্টোের হাই রােড, লন্ডন-এন ডব্লিউ ঠিকানা থেকে গ্রেট বৃটেনস্থ সংগ্রাম পরিষদ বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে বটি সাংবাদিকদের প্রতি বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনের আবেদন জানানাে হয়। ৮ মে ৬৮ ষ্টেথাম হাই রােড, লন্ডন-এর ডব্লিউ ১৬ ঠিকানা থেকে গ্রেট বৃটেনস্থ বাংলাদেশ সংগ্রাম পরিষদ অপর একটি প্রচারপত্র প্রকাশ করে। উক্ত প্রচারপত্রটি একটি ছােট পুস্তিকাকারে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর একটি মুখবন্ধসহ প্রকাশ করা হয়। এমনিভাবে এ মাসে বিলাতের বিভিন্ন সগ্রাম কমিটি বহু প্রচারপত্র প্রকাশ করে পাকিস্তানের অপপ্রচারের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্বজনমত সৃষ্টির কাজে তৎপরতা অব্যাহত রাখে।
বৃটেনের ২০৬ জন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী, পার্লামেন্ট সদস্য ও প্রখ্যাত ব্যক্তিবর্গের দস্তখত সম্বলিত একটি বিজ্ঞাপন ১৩ মে ‘মি টাইম্স’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। বিজ্ঞাপনে ‘পূর্ব বাংলায় সংঘটিত হতাযজ্ঞ ও ধ্বংসের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে পাকিস্তানকে সাহায্য বন্ধ করে দেয়ার জন্য বৃটিশ সরকারকে আহ্বান জানানাে হয়। ১২ মে ল্যাংকাশায়ার ও পার্শ্ববর্তী এলাকার সগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ পার্লামেন্টের সদস্যদের কাছে বাংলাদেশকে সমর্থনের জন্য একখানি আবেদনপত্র বিলি করেন। মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে লন্ডনের কনওয়ে হলে লিংক ফোরামের উদ্যোগে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। জনসভায় ভারতের প্রখ্যাতনেত্রী। মিসেস অরুণা আসফ আলী, বৃটিশ এম, পি, জন ষ্টোন হাউজ, ব্রুস ডগলাসম্যান, এ্যাকশন বাংলাদেশ এর পল কনেষ্ট, পাকিস্তানের বিশিষ্ট সাংবাদিক ফরিদ জাফরী এবং বাংলাদেশের পক্ষে বি এইচ, তালুকদার ও সাখাওয়াত হােসেন (ব্যারিষ্টার) বক্তৃতা করেন। সভায়। সভাপতিত্ব করেন লর্ড ব্রকওয়ে। ২২ মে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ব্লেচলি ও অক্সফোর্ড শহরে এবং ২৩ মে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগাে শহরে জনসভায় বক্তব্য রাখেন। উপরােক্ত সভায় বিচারপতি চৌধুরীর সফর সঙ্গী হিসাবে ষ্টিয়ারীং কমিটির সদস্য শেখ আবদুল মান্নানও বক্তব্য রাখেন। আমেরিকায় বাংলাদেশের পক্ষে যে সকল সংগ্রাম পরিষদ কাজ করছিলেন তাদের সাথে সংযােগ এবং আমেরিকান সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে যােগাযােগ স্থাপনের উদ্দেশ্যে বিচারপিত আবু সাঈদ চৌধুরী ২৪ মে নিউইয়র্কের উদ্দেশ্যে লন্ডন ত্যাগ করেন। তিনি ২৯ মে লন্ডনে প্রত্যাবর্তন করেন। ৩০ মে মানচেষ্টারে আবদুল মতিনের সভাপতিত্বে এক জনসভা বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী প্রধান অতিথি হিসাবে বক্তব্য রাখেন। সভায় অন্যন্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য শেখ আবদুল মান্নান ও কবীর চৌধুরী এবং স্থানীয় নেতৃবৃন্দ। ৩০ মে বৃটেনের বাঙালীদের মুখপত্র ‘জনমত’ পত্রিকায় যুক্তরাজ্যস্থ বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে আমার একটি বিবৃতি প্রকাশিত হয়। বিবৃতিতে যুক্তরালে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে অধ্যয়নরত সকল বাঙালী ছাত্র-ছাত্রীদের বাংলাদেশ সমিতি” গঠনের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান হয়। মুক্তিযুদ্ধের “” প্রতিষ্ঠানে প্রচারণা চালানাের মাধ্যমে আন্দোলনে অংশগ্রহণ এবং লন্ডনে স্থাপিত ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদের সাথে যােগাযােগ রক্ষা করার জন্য অনুরােধ জানানাে হয়। গ্রহণ এবং লন্ডনে স্থাপিত যুক্তরাজ্যস্থ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সাথে যোগাযোগ করার জন্য অনুরোধ করা হয়।
জুন মাসের তৎপরতা
জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর সীমান্ত অতিক্রম এবং সীমান্তে স্থাপিত রিলিফ ক্যাম্পগুলাের করুণ অবস্থার বিবরণ বৃটেনসহ আন্তর্জাতিক পত্র-পত্রিকার শিরােনামে স্থান লাভ করে। এপ্রিল ও মে মাসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সমর্থনে এবং হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে সমাবেশ শােভাযাত্রাসহ বিভিন্ন প্রচারের গুরুত্ব জুন মাসে বিশ্ব জনমতের কাছে অর্থবহ হয়ে ওঠে এবং সারা দুনিয়ার শান্তিপ্রিয় মানুষ বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে পুনরায় গুরুত্ব আরােপ করে। রিলিফ ক্যাম্পগুলােতে স্থানাভাব, খাদ্যের অভাব ও কলেরার প্রাদুর্ভাব বিশ্ব জনমতকে উদ্বিগ্ন করে। তােলে। | ৪ জুন লন্ডনের রেডলায়ন স্কোয়ারে অবস্থিত কনওয়ে হলে’ যুক্তরাজ্যস্থ বাংলাদেশ ছাত্র। সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে আমার (লেখক) সভাপতিত্বে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। জনসভায় প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ সরকারের বৈদেশিক প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। সভায় বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ‘মুজিব নগর থেকে আগত রেহমান সােবহান, সদ্য বাংলাদেশ থেকে আগত জনমত পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক আনিস আহম্মদ, এ্যাকশন বাংলাদেশ এর নেতা পল কনেট এবং ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে এ. টি. এম. ওয়ালী আশরাফ প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। রেহমান সােবহান বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে অর্থনৈতিক যুক্তি প্রদান করে দীর্ঘ বক্তব্য। রাখেন। আনিস আহম্মদ ঢাকা থেকে প্রত্যাবর্তন করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ঢাকার সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে সভাকে অবহিত করেন। সভায় বক্তাগণ বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিলাতের কর্মকাণ্ড আরাে জোরদার করার সংকল্প ব্যক্ত করে। বিচারপতি চৌধুরী বিলাতের আন্দোলনকে শক্তিশালী করার জন্য বিলাতে অধ্যয়নরত বাঙালী ছাত্র সমাজকে ঐক্যবদ্ধভাবে সামনের কাতারে থেকে ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান। বাংলাদেশ মহিলা সমিতি ৪ জুন পাকিস্তানকে সাহায্য বন্ধ ও বাংলাদেশকে সমর্থন দানের দাবিতে প্রবাসী বাঙালি মহিলা ও শিশুদের সমন্বয়ে লন্ডনে একটি মিছিলের আয়ােজন করে। মিসেস জেবুন্নেছা বখত ও আনােয়ারা জাহানের নেতৃত্বে সেন্ট জেমস পার্ক থেকে শুরু করে মিছিলটি ডাইনিং স্ট্রীটে এসে সমাপ্ত হয়। ৫ জুন শেফিল্ড শহরে শেফিল্ড এ্যাকশন।
কমিটির উদ্যোগে এক জনসভার আয়ােজন করা হয়। উক্ত জনসভায় বিচারপতি আবু সাঈদ একাধুরা প্রধান অতিথি এবং শেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ফ্র্যাংক গার্লিং, ষ্টিয়ারিং কমিটির শেখ আবদুল মান্নান ও কবীর চৌধুরী বিশেষ অতিথি হিসাবে বক্তব্য রাখেন। ৬ জুন লন্ডন এ্যাকশন কমিটির উদ্যোগে পূর্ব লন্ডনে এক জনসভায় বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সর্বশেষ পরিস্থিতির উপর বক্তব্য রাখেন। সভাটি পূর্ব লন্ডনের গ্রান্ড প্যালেস হলে ‘লন্ডন এ্যাকশন কমিটি’ এর সভাপতি গউস খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। সভায় অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন তৈয়বুর রহমান ও জাকারিয়া খান চৌধুরী প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। সভায় বিচারপতি চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত “বাংলাদেশ ফান্ড” এর প্রতি পূর্ণ। সমর্থন জ্ঞাপন করা হয়। | বৃটিশ পার্লামেন্টে পাকিস্তান পরিস্থিতি’ ও শরণার্থী সমস্যা পুনরায় আলােচনার জন্যে স্থান পায়। ৮ জুন লেবার পার্টির আন্তর্জাতিক কমিটি পাকিস্তানকে বৃটেনের সাহায্য হ্রাসের জন্যে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে। লেবার পার্টির এমপি এবং প্রাক্তন বৈদেশিক উন্নয়নমন্ত্রী মিসেস জুডিথ হার্ট উক্ত প্রস্তাব উত্থাপন করেন এবং লেবার পার্টির অন্য এমপি মিসেস বারবারা কেসল প্রস্তাবটি সমর্থন করেন। উক্ত প্রস্তাবটি বৃটিশ বৈদেশিক উন্নয়নমন্ত্রী রিচার্ড উডের কাছে মিসেস জুডিথ হার্ট ও পিটার শাের আনুষ্ঠানিকভাবে পেশ করেন। একই দিনে বৃটিশ পার্লামেন্টে রক্ষণশীল দলীয় এমপি (সরকার দলীয়) বয়েড কার্পেন্টার যুদ্ধবিধ্বস্ত পূর্ব পাকিস্তান থেকে শরণার্থীদের সীমান্ত অতিক্রম ও রিলিফ ক্যাম্পসমূহের অবস্থার উপরে একটি দৃষ্টি আকর্ষণী প্রস্তাব উত্থাপন করেন। এই পর্যায়ে বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আলেক ডগলাস হিউম পার্লামেন্টে পাকিস্তান পরিস্থিতির উপর একটি বিবৃতি প্রদান করন। তাঁর এবারের বিবৃতি এপ্রিলে প্রদত্ত বিবৃতি থেকে অনেক নরম সুরের এবং বাংলাদেশের নির্যাতিত জনগণের প্রতি সহানুভূতিশীল বলে প্রতীয়মান হয়। তিনি পার্লামেন্টকে অবহিত করেন যে, পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর বর্বরতার ভয়ে ভীত হয়েই লক্ষ-লক্ষ শরণার্থী তাদের ভিটেমাটি ছেড়ে রিলিফ ক্যাম্পে আশ্রয় নিচ্ছে।
তিনি বিবৃতিতে বলেন যে, “They were afraid of intolerable suppressive action by the Pakistan Army, and only a political settlement would get them back to their homes.” (The Guardian, June 9, 1971) স্যার আলেক ডগলাস হিউম “পূর্ব পাকিস্তানে” ভবিষ্যতে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করে বলেন যে, পাকিস্তানের উচিত জাতিসংঘের সহযােগিতা নিয়ে খাদ্য পরিস্থিতির ত্বরিত মােকাবিলা করা। উদ্বাস্তু সমস্যা আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার প্রতি হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করে বিষয়টি বৃটিশ পার্লামেন্টে পূর্ন আলােচনার জন্য গৃহীত হয়। প্রথম দিনের (৮ জুন, ১৯৭১) আলােচনায় বিরােধী দলীয় সংসদ নেতা ও প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মিঃ উইলসন শরণার্থী সমস্যাকে অত্যন্ত উদ্বেগজনক আখ্যায়িত করে মন্তব্য করেন যে, “—the worst human tragedy the world has known since the war, apart from war self.” বিরােধী দলীয় এমপি এবং প্রাক্তন বৈদেশিক উন্নয়নমন্ত্রী মিসেস জুডিথ হার্ট বলেন যে, বাঙালীদের বিষয়টি আর পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে বিবেচনার অবকাশ নেই। পার্লামেন্টের ভাষায় ‘পাকিস্তান পরিস্থিতি ও উদ্বাস্তু সমস্যা নিয়ে পার্লামেন্টে দ্বিতীয় দিনে (৯ জন) আলােচনা অব্যাহত থাকে। ৯ জুনে স্যার আলেক ডগলাস হিউম ছাড়াও বক্তব্য রাখেন মিসেস জুডিথ হার্ট (লেবার পাটি), জর্জ থমসন (লেবার পার্টি), রিচার্ড উড (কন্সাৰ্বভেটিভ পার্টি) প্রমুখ বৃটিশ এমপিবৃন্দ। ৯ জুন পার্লামেন্টে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্ব জনমতের সহানুভূতি বৃদ্ধির আভাস পরিলক্ষিত হয়। তিনি পার্লামেন্টে পরিষ্কার ভাষায় বলেন যে, “Peace will not return to East Pakistan unul civil governmnt has been restored…… Otherwise the danger of war could be very real and would convert what is already a tragedy into a catastrophe” (The Guardian, June 10. 1971). | ১১ জুন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও তার ভবিষ্যত সম্পর্কে লন্ডনের “উইক এন্ড টেলিভিশন” একটি আলােচনা অনুষ্ঠান প্রচার করে। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের পক্ষ সমর্থনের জন্য বাংলাদেশ সরকারের বৈদেশিক প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে এবং পাকিস্তানের পক্ষ সমর্থনের জন্য কনজারভেটিভ পার্টি” এর এম. পি. জন বিগস্ ডেভিসনকে আমন্ত্রণ জানানাে হয়। অনুষ্ঠানে বিচারপতি চৌধুরী বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জোরালাে যুক্তিপ্রদর্শন করে বাঙালীদের উপর পাকিস্তানের শােষণ, নির্যাতন ও বৈষম্যের কথা তুলে ধরে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত করেন।
১২ ও ১৩ জুন লন্ডনে “ইন্টারন্যাশনাল। ইউনিয়ন অফ সােসালিষ্ট ইয়থস্” এর সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে বাংলাদেশের পক্ষে লবিং করা এবং প্রতিনিধিদের বাংলাদেশ সম্পর্কে অবহিত করার জন্য ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে লুঙ্কর রহমান সাহজাহান, আকতার ইমাম, শফিউদ্দিন আহম্মদ বুলবুল, এ. কে. নজরুল ইসলাম, এম, এইচ, প্রামানিক ও মজিবুল হক অংশগ্রহণ করেন। সম্মেলনে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করে একটি প্রস্তাব গৃহিত হয়। ১৩ জুন লন্ডনের ‘জনমত’ পত্রিকায় যুক্তরাজ্যস্থ বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে আহবায়ক (২) হিসাবে আমার একটি বিবৃতি গুরুত্ব সহকারে ছাপানাে হয়। বিবৃতিতে পাকিস্তানের রক্ত রঞ্জিত ও হত্যাকারী ভাবমূর্তিকে উন্নত করার উদ্দেশ্যে পাকিস্তান ক্রিকেট ডামের বৃটেন সফরের প্রতিবাদ করার জন্য ১৯ জুন শনিবার বেলা ১.০০ টায় হাইডপার্ক কাস কণীরে আহুত ছাত্র জনসভাকে সাফল্যমণ্ডিত করার জন্য সকলের কাছে আহ্বান সানাে হয়। একই দিন (১৩ জুন) লন্ডনের ৩২নং ওন্ড কম্পটোন স্ট্রীটে “বাংলাদেশ ওয়ারক্রস সােসাইটি” এর এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন সােসাইটির সম্পাদক আবদুল্লা ফারুক । সভায় বক্তব্য রাখেন এরশাদ আলী, ডাঃ মােকলেসুর রহমান এবং ডাঃ সােবহান প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। ১৩ জুন লন্ডনের বহুল প্রচারিত টেলিভিশন ‘আই, টি, ভি’ সন্ধ্যায় ‘ম্যান ইন দি নিউজ’ নামক এক প্রােগ্রামে বিচারপতি চৌধুরীর এক সাক্ষাৎকার প্রচার করে। সাক্ষাৎকারে বিচারপতি চৌধুরী পাকিস্তান পূর্ববঙ্গে’ যে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে তা গােপন করার অভিযােগ করে বলেন, বাংলাদেশ এখন একটি বাস্তবতা। বড় বড় শহর ছাড়া বাংলাদেশের উপর পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর কোন নিয়ন্ত্রণ নেই । বাংলাদেশকে স্বীকৃতি জানানাের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশ যত দ্রুত স্বাধীন। হবে তত শীঘ্র এই গণহত্যার অবসান হবে। ১২ জুন সেন্ট অবন্স শহরে এ্যাকশন কমিটির উদ্যোগে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। জনসভায় বিচাপতি আবু সাঈদ চৌধুরী প্রধান অতিথি হিসাবে বক্তব্য রাখেন। সভায় শেখ আবদুল মান্নান ও আমি বিচারপতি চৌধুরীর সাথে উপস্থিত ছিলাম। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ১৩ জুন লীডস শহরে লীডস বাংলাদেশ এসােসিয়েশন এবং লীডস লিবারেশন ফ্রন্টের যৌথ উদ্যোগে আয়ােজিত জনসভায় বক্তব্য রাখেন।
১৩ জুন পাকিস্তানকে সাহায্য বন্ধের দাবিতে লন্ডনে যুব সংঘের উদ্যোগে মিছিলের আয়ােজন করা হয়। মিছিলটি হাইডপার্ক থেকে শুরু করে পিকাডিলি, পার্ক লেইন, ডাইনিং স্ট্রীট প্রদক্ষিণ করে ট্রাফেলগার স্কোয়ারে গিয়ে শেষ হয়। ১৪ জুন অপর একটি মিছিল বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে হােয়াইট হলে এসে সমাপ্ত হয়। পাকিস্তানকে সাহায্য বন্ধের দাবিতে এবং সফররত পাকিস্তান ক্রিকেট খেলার প্রতিবাদে বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১৯ জুন বিকেল ১টায় লন্ডনের হাইড-পার্ক স্পীকার্স কর্ণারে এক বিশাল সমাবেশের আয়ােজন করে। আমার সভাপতিত্ব সমাবেশে প্রধান অতিথি ও বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন যথাক্রমে বাংলাদেশ সরকারের বৈদেশিক প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ও বৃটিশ এমপি পিটার শাের। এছাড়া বৃটিশ ‘ইয়ং লিবারেল পার্টির সভাপতি পিটার হেইন, ছাত্র-সংগ্রামের পক্ষ থেকে এ জেড মােহাম্মদ হােসেন মঞ্জু ও সুলতান শরিফ এবং বৃটেন সফররত বাংলাদেশের নির্বাচিত এম এন এ, আবুদল মান্নান। (শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক) ও শ্রমিক লীগ সভাপতি মােহাম্মদ শাহজাহান সমাবেশে বক্তব্য রাখেন। সমাবেশে বিভিন্ন বক্তাগণ বিশ্বের শান্তিপ্রিয় গণতন্ত্রকামী সকল সরকার ও জনগণের কাছে পাকিস্তানকে সাহায্য বন্ধ করে দেয়ার আবেদন জানান। বক্তাগণ পাকিস্তানকে সাহায্য করাকে বাংলাদেশে গণহত্যাকে সরাসরি সাহায্য করার শামিল বলে অভিহিত করেন। সমাবেশ শেষে একটি বিরাট মিছিল স্পীকার্স কর্ণার থেকে অক্সফোর্ড স্ট্রীট, পাের্টম্যান স্ট্রীট ও গ্লোসটার প্লেস হয়ে লর্ডস ক্রিকেট মাঠের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে সেন্ট জন উড রােডে সমাপ্ত হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখযােগ্য যে, লর্ডস ক্রিকেট মাঠে তখন। সফরকারী পাকিস্তান ক্রিকেট দলের খেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছিল।
২০ জুন ওয়েলসের প্রধান শহর কার্ডিফে স্থানীয় সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বিচারপতি চৌধুরী প্রধান অতিথি হিসাবে যােগদান করেন। তার সফরসঙ্গী ছিলেন শেখ আবদুল মান্নান। সভায় বিচারপতি চৌধুরী বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতি ও বিশ্বব্যাপী প্রচার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। এছাড়া তিনি পাকিস্তানের সাথে। বাংলাদেশের একটি আপােষরফা হচ্ছে বলে যে অপপ্রচার ও গুজব ছড়ানাে হচ্ছে তার তীব্র প্রতিবাদ করেন এবং মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হবে বলে দৃঢ় প্রত্যয়ের কথা ঘােষণা করেন। ১৯৭১-৭২ আর্থিক বছরের জন্য পাকিস্তানকে নতুন সাহায্য বরাদ্দ করার প্রাথমিক বিবেচনার জন্য বিশ্ব ব্যাংকের ‘পাকিস্তান সাহায্য কনসরসিয়াম’ (Aid to Pakistan Consortium)-এর সভা ২১ জুন প্যারিসে আহবান করা হয়। পশ্চিমের শিল্পোন্নত। দেশসমূহ ও প্রাচ্যের জাপানের সমন্বয়ে ১১ জাতির অর্থনৈতিক জোট পাকিস্তানকে আসন্ন জুলাই মাসের আনুষ্ঠানিক সভায় অর্থ বরাদ্দ করা হবে কিনা তার আলােচনার জন্য দাতা দেশগুলাের প্রতিনিধিরা প্যারিসে ২১ জুন সমবেত হন। বিলাতের প্রবাসী সংগ্রাম পরিষদসমূহ পাকিস্তানকে সাহায্য বন্ধ করার আন্দোলনকে জোরদার করার জন্য উক্ত সভাস্থলে বিক্ষোভ প্রদর্শন ও ধর্ণা (Lobbing] দেয়ার জন্য লন্ডন ও বার্মিংহাম থেকে বাঙালীদের একটি বড় গ্রুপ প্রেরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। পাকিস্তান সাহায্য কনসরসিয়াম এর সভাটি বাংলাদেশের। মুক্তি সংগ্রামের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে নিয়ামক ভূমিকা পালন করবে বলে উক্ত কার্যক্রমকে খুবই গুরুত্ব দেয়া হয়। লন্ডন ও বার্মিংহাম থেকে প্রায় দেড় শতাধিক বাঙালী প্যারিস গমন করে। এবং ২১ জুন বিশ্ব ব্যাংকের অফিসের সামনে বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড ও ব্যানারসহ অবস্থান ও বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। প্যারিসে তৎকালে বাঙালীদের উল্লেখযােগ্য তেমন কোন বসবাস না থাকায় বিক্ষোভ প্রদর্শনের জন্য লন্ডন ও বার্মিংহাম থেকে বাঙালীরা প্যারিস গমন করে। প্যারিসে বিশ্বব্যাংক অফিসের সামনে বিক্ষোভের সময়ে যে সকল প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করা হয় তার বক্তব্য ছিল “Foreign aid for Pakistan means genocide for Bangladesh”: “Economic aid to Pakistan is tantamount to Financing massere in Bangladesh” Not a penny, not a gun to Tikka, Bhutto, Yahaya Khan” ইত্যাদি। পাকিস্তানকে সাহায্য বন্ধের দাবিতে এছাড়াও দাতা দেশগুলাের প্রতি ষ্টিয়ারিং কমিটির মেমােরেন্ডাম প্রদান ও কূটনৈতিক কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়।
প্যারিসের কনসরসিয়াম সভায় বিশ্ব ব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়ার তৎকালীন পরিচালক পিটার কারগিলের রিপাের্ট বিবেচনা করা হয় এবং পাকিস্তানকে সাহায্য বরাদ্দের জন্য জুলাই মাসের আনুষ্ঠানিক সভা বাতিলের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। বৃটেন ও আমেরিকাসহ ১১ জাতির প্রতিনিধিবৃন্দ পাকিস্তানে একটি রাজনৈতিক সমাধান না হওয়া পর্যন্ত নতুন কোন সাহায্য বরাদ্দ করা হবে না বলে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কনসরটিয়াম সভায় পাকিস্তানকে সাহায্য বন্ধের সিদ্ধান্ত পাকিস্তানের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি ও মনস্তাত্ত্বিক পরাজয় এবং বাংলাদেশের জন্য এক বিরাট নৈতিক বিজয় ঘােষণা করে। এর ফলে দেশে ও বিদেশে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ প্রাথমিক সাফল্য অর্জন করে এবং কূটনৈতিকভাবে বাংলাদেশের অস্তিত্ব সারা বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত হয়। ২১ জুন বাংলাদেশের অপর একটি কূটনৈতিক বিজয় অর্জিত হয় সফররত ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং এবং বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আলেক ডগলাস হিউম এর যুক্ত বিবৃতি প্রকাশের মাধ্যমে। ২২ জুন লন্ডনের পত্র-পত্রিকায় উক্ত যুক্ত বিবৃতি প্রকাশিত হয়। বিবৃতিতে বাংলাদেশ ইস্যুতে বৃটিশ সরকারের মনােভাবের পরিবর্তন করে পাকিস্তানে বিরােধ নিস্পত্তির জন্য পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের কাছে গ্রহণযােগ্য রাজনৈতিক সমাধানের কথা। ব্যক্ত করা হয়। বিবৃতিতে বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া উদ্বাস্তুদের করুণ অবস্থা ও তাদের দেশে প্রত্যাবর্তনের পরিবেশ সৃষ্টির বিষয় গুরুত্ব লাভ করে। প্রায় ৬ মিলিয়ন উদ্বাস্তুর দেশে প্রত্যাবর্তনের পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে বিবৃতিতে বলা হয় যে, “It was recognised that this would only be possible if they were assured of a secure future…. Sir Alec Douglas Home and Mr. Swaran Singh agreed that a political solution must be found which would be acceptable to the people of East Pakistan”. (The Guardian. June. 22, 1971)। উক্ত ইশতেহারের মর্মবাণীতে বাঙালীদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রতি প্রকারান্তরে সমর্থন ঘােষিত হয় এবং বাঙালীদের মুক্তিযুদ্ধ আরাে জোরদার বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত গণহত্যার প্রতিবাদে ইন্টারন্যাশনাল ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশ’ নামে লন্ডনে প্রতিষ্ঠিত একটি আন্তর্জাতিক সংগঠনের উদ্যোগে ২৫ জুন লন্ডনের কনওয়ে হলে এক জনসভার আয়ােজন করা হয়। লন্ডনে বসবাসকারী কিছু উদ্যোগী বাঙালি আইনজীবী ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কিছু কর্মীর সহযােগিতায় আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গ।
বাংলাদেশের নির্যাতিত জনগণের পক্ষে বিশ্ব জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে উক্ত সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন। ইন্টারন্যাশনাল ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশ’ এর জনসভায় সভানেত্রীত্ব করেন নেতা গিফোর্ড। উক্ত সভায় বক্তব্য রাখেন কুইনস কাউন্সিলর জন প্লাটুস-মিল, ভারতের প্রাক্তন আইনমন্ত্রী ব্যারিষ্টার অশােক সেন, বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, লর্ড গিফোর্ড (বার এট’ল) এবং ব্যারিষ্টার সাখাওয়াৎ হােসেন প্রমুখ আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবীবৃন্দ। সভায় তকমে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যা কনভেনশন আহ্বানের জন্য একটি প্রস্তুতি কমিটি গঠন করা হয়। কনভেনশনের মাধ্যমে বাংলাদেশে সংঘটিত নার আন্তর্জাতিক তদন্ত ও দোষী ব্যক্তিদের বিচার অনুষ্ঠানের জন্য একটি আন্তর্জাতিক “যুদ্ধ অপরাধ ট্রাইবুনাল (War Crime Tribunal)” গঠনের জন্য জাতিসংঘের কাছে। অনুরােধ জানানাের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ২৬ জুন লন্ডনের বেইজওয়াটার এলাকার “বাংলাদেশ এ্যাকশন কমিটি” এর উদ্যোগে স্থানীয় হলে এক জনসভার আয়ােজন করা হয়। জনাকীর্ণ এই জনসভায় বাঙালি ছাড়াও অনেক স্থানীয় ইরেজ উপস্থিত ছিলেন। মনজুর মাের্শেদ তালুকদারের সভাপতিত্বে এই। জনসভায় প্রধান অতিথি হিসাবে বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরী এবং বিশেষ অতিথি হিসাবে শ্রমিকদলীয় এম, পি, পিটার শাের উপস্থিত ছিলেন। আরাে বক্তব্য রাখেন শেখ আবদুল মান্নান। বিচারপতি চৌধুরী তার বক্তব্যে দেশে ও বিলাত প্রবাসে বাঙালীদের মধ্যে গত তিন মাসে যে ঐক্য ও প্রত্যয়ের সৃষ্টি হয়েছে তাতে বাংলাদেশের বিজয় সুনিশ্চিত বলে আশা পােষণ করেন। পিটার শাের তাঁর বক্তব্যে বাংলাদেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত প্রত্যেক বাঙালীর মতাে তার সর্বাত্মক সহযােগিতা ও সমর্থন অব্যাহত থাকবে বলে ঘােষণা করেন। ২৭শে জুন পাকিস্তানকে সাহায্য বন্ধ ও বাংলাদেশকে সমর্থনের দাবিতে বার্মিংহামের ডিগবেথ হলে বার্মিংহামের বিভিন্ন সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে এক বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সভায় বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ছাড়াও এম. পি. ব্রুস ডগলাস ম্যান এবং স্থানীয় এম পি, জুলিয়াস সিলভারম্যান বক্তব্য রাখেন।
২৮ জুন লন্ডনের রেড লায়ন স্কোয়ারে অবস্থিত কনওয়ে হলে বৃটেনের বিভিন্ন অঞ্চলের সগ্রাম পরিষদ সমূহের প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। বিলাতে কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠনে যে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছিল (অধ্যায়। এশে বিস্তারিত আলােচনা করা হয়েছে) তার ব্যাখ্যা প্রদান করে বিচারপতি আবু সাঈদ। চোধুরা কেন্দ্রীয় কমিটির নির্বাচন স্থগিত করার সিদ্ধান্ত সম্মেলনকে অবহিত করেন। ২৮ জুন রাতে ওয়েলসের কার্ডিফ সমুদ্র বন্দরে পাকিস্তান শিপিং করপােরেশনের এমভি “ধুলা নামক জাহাজ থেকে ১৫ জন বাঙালি অফিসার ও কর্মচারী ইঞ্জিনিয়ার একেএম । “” হুদার নেতৃত্বে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বৃটিশ কর্তৃপক্ষের কাছে আত্মসমর্পণ। করে। এক সাংবাদিক সম্মেলনে তারা বাংলাদেশের বিপ্লবী সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে এবং এমভি কর্ণফুলীসহ সকল জাহাজে বাঙালীদের প্রতি পাকিস্তানীদের নির্যাতন ও দুর্ব্যবহারের চিত্র তুলে ধরেন। তাদের পক্ষে নূরুল হুদা জানান যে, ২৫ মার্চের কালাে রাত্রিতে এমভি কর্ণফুলী চট্টগ্রাম বন্দরে অবস্থান করছিল। তিনি ২৪ মার্চ চট্টগ্রাম বন্দরে এমভি সােয়াতে সংঘটিত হত্যাকান্ড ও নির্যাতনের বিবরণ এবং চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পাকিস্তান থেকে অস্ত্র ও গােলাবারুদ আমদানির বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করেন। একজন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে তিনি জানান যে, এমভি সােয়াতের সকল বাঙালি অফিসার ও কর্মচারীদেরকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে। নূরুল হুদা বাংলাদেশে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করার চাপ সৃষ্টির জন্য বিশ্ব বিবেকের কাছে আবেদন জানান। বৃটিশ সরকার পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগকারী ১৫ জন অফিসার ও কর্মচারীদের যুদ্ধ বন্ধ হওয়া পর্যন্ত বৃটেনে অবস্থানের অনুমতি প্রদান করেন।
জুলাই মাসের তৎপরতা
পল কনেটের নেতৃত্বে “এ্যাকশন বাংলাদেশ” সরাসরি বাংলাদেশে সাহায্য প্রেরণ করার উদ্দেশ্যে ‘ওপারেশন ওমেগা-১’ এর পীস টীম’ সংগঠিত করে একটি ব্যতিক্রমধর্মী কার্যক্রম গ্রহণ করে। সাহায্য সামগ্রী সহ সাবেক বৃটিশ পুলিশ মার্ক ডুরানের নেতৃত্বে ৪ সদস্য বিশিষ্ট টীম ১ জুলাই লন্ডনের ট্রাফেলগার স্কোয়ার থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের উদেশ্যে যাত্রা করে। এ সময় বিভিন্ন সংগ্রাম পরিষদের কর্মী ও মহিলাসহ প্রায় ৩ শতাধিক বাঙালী পীস টীম’কে বিদায় সম্বর্ধনা দেয়। এ ধরনের দুঃসাহসিক ও প্রতীকি কর্মসূচী গ্রহণ করার জন্য’এ্যাকশন বাংলাদেশ’ এর বৃটিশ কর্মীদের অভিনন্দন জানানাে হয় এবং তাদের সফলতা কামনা করা হয়। ইতােপূর্বে বৃটিশ পার্লামেন্টে পূর্ববঙ্গের পরিস্থিতি নিয়ে বিতর্ক শেষে পরিস্থিতি সরজমিনে দেখার জন্য যে পার্লামেন্টারী প্রতিনিধি দল প্রেরণ করা হয়েছিল সেই সদস্যগণ ভারত ও পূর্ববঙ্গ সফর করে ফিরে এসে লন্ডনে ৪ জুলাই এক সাংবাদিক সম্মেলনের আয়ােজন করে। প্রতিনিধি দলের নেতা রেজ প্রেন্টিস বলেন, ‘পূর্ববঙ্গের সমস্যার একটি রাজনৈতিক সমাধান পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক করতে পারে। পাকিস্তান জোড় করে পূর্ববঙ্গ’কে তাদের সাথে রাখতে পারবে না বলেও তিনি মন্তব্য করেন। তাই ইয়াহিয়া খানের উচিৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নেতা শেখ মুজিবকে মুক্তি দিয়ে তার সাথে আলােচনা করে সমস্যার সমাধান করা। তিনি এ ব্যাপারে ইয়াহিয়া খানের উপর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টিরও দাবি করেন। প্রতিনিধি দলের অপর এক কনজারভেটিভ পার্টির এম. পি. টোবি জ্যাসেল বলেন, “পূর্ববঙ্গে পাকিস্তানের বর্বোরােচিত আক্রমণে গ্রামের পর গ্রাম ধ্বংস হয়ে গিয়েছে, তাদের আক্রমণ থেকে নারী ও শিশুরা পর্যন্ত রক্ষা পায় নি এবং হত্যাকাণ্ড থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য লক্ষ লক্ষ মানুষ ভারতে পালিয়ে যাচ্ছে। পার্লামেন্টারী দলের পর্যবেক্ষণ ও মন্তব্য লন্ডনের পত্র-পত্রিকা, রেডিও, টেলিভিশনে প্রচারিত হয়। এই প্রেক্ষাপটে বৃটিশ ওভারসীজ মন্ত্রী মিসেস জীল নাইট প্রতিনিধিদলের পর্যবেক্ষণ রিপাের্ট উল্লেখ করে ইয়াহিয়া খানের কাছে প্রেরিত এক পত্রে তার উদ্বেগের কথা জানান। জুলাই মাসের ৫ তারিখে স্কটল্যান্ডের এবারডিন (Aberdeen) শহরে বৃটিশ খনি শ্রমিক ইউনিয়ন সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। শ্রমিক রাজনীতি তথা বৃটেনের রাজনৈতিক অঙ্গনে খান শ্রমিক ইউনিয়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করে।
তাই বিলাতে বাম সংগঠক কমিটিসমূহ ৫ জুলাইয়ের সম্মেলনে বাংলাদেশের পক্ষে প্রচার কার্য। “মচালনা ও তাদের সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে কার্যক্রম গ্রহণ করে। এবারডিন ও তার আশে ২৪ ” পাশের শহরের বাঙালীরা সম্মেলন স্থলে অবস্থান গ্রহণ করে এবং লন্ডন থেকে প্রতিনিধি প্রেরণের ব্যবস্থা করা হয়। বাংলাদেশের শ্রমিকদের উপরে যে অকথ্য অত্যাচার ও হত্যায় চলছিল তার চিত্র সম্বলিত পােষ্টার ও ব্যানারসহ শত শত বাঙালি সম্মেলন স্থলে অবস্থান গ্রহণ করে। বাঙালি প্রতিনিধিরা বাংলাদেশের সংঘটিত হত্যাযঞ্জের বিবরণ, মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতি ও বৃটিশ শ্রমিকদের সমর্থনের আবেদন সম্বলিত প্রচারপত্র খনি শ্রমিক প্রতিনিধিদের মধ্যে। বিতরণ করেন। উক্ত সম্মেলনে বাংলাদেশ পরিস্থিতি গুরুত্বের সাথে আলােচিত হয় এবং নির্যাতিত জনগণের পক্ষে প্রস্তাব গৃহীত হয়। সম্মেলনে বৃটিশ খনি শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক লরেন্স ডেলী (Lawrence Daly) “পূর্ব পাকিস্তান” পরিস্থিতির উপর প্রস্তাব উত্থাপন করেন। প্রস্তাবে “পূর্ব পাকিস্তান” পরিস্থিতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে সংকটের সুষ্ঠু সমাধানের জন্য ফলপ্রসূ আলােচনার উপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়। প্রস্তানে বলা হয় যে, “পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের স্বাধীন মতামত প্রকাশ করেছে এবং সেই মতামতকে উপেক্ষা করে নিরীহ বাঙালীদের উপর পাকিস্তানের পরিচালিত হত্যাযজ্ঞ ও নির্যাতন নিন্দনীয় অপরাধ।” প্রস্তাবে “পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের নির্বাচিত নেতা শেখ মুজিবর রহমানসহ হাজার হাজার কারাবন্দীর মুক্তি এবং পাকিস্তানে বাঙালীদের কাছে গ্রহণযােগ্য একটি বেসামরিক সরকার গঠনের দাবি উত্থাপিত হয়। প্রস্তাবের অপর অংশে পাকিস্তান সংকটের গ্রহণযােগ্য সমাধান ও পাকিস্তান সরকারের পরিচালিত সামরিক অভিযান বন্ধ করার জন্য। বৃটিশ সরকারের কূটনৈতিক হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়। বৃটেনসহ ইউরােপের বিভিন্ন দেশের শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রচার ও তাদের সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে কার্যক্রম পরিচালনার জন্য মুজিবনগর সরকারের পক্ষ থেকে তৎকালীন এমএনএ শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মান্নান, শ্রমিক লীগের সভাপতি মােহাম্মদ শাহজাহান মধ্য জুন থেকেই লন্ডনে অবস্থান করছিলেন।
বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতি এবং বিলাতে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের সাথে দেশ থেকে আগত শ্রমিক নেতৃবন্দের মত বিনিময়ের উদ্দেশ্যে লন্ডন ডব্লিউ সি-১ এর ২৫ নং রেডলায়ন কোয়ারে অবাঞ্ছত কনওয়ে হলে যুক্তরাজ্যস্থ বাংলাদেশ ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদের উদে আমার সভাপতিত্বে ৩ জুলাই এক জনসভার আয়ােজন করা হয়। সভায় সফররত নেতাদ্বয় ছাড়াও লন্ডনের বিভিন্ন সংগ্রাম কমিটি ও ষ্টিয়ারিং কমিটির নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখেন সভায় মুক্তিযুদ্ধের সর্বশেষ পরিস্থিতি পর্যালােচনা করা হয় এবং দেশকে মুক্ত না যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার শপথ পুনর্ব্যক্ত করা হয়। জুলাই মাসে বাংলাদেশের উদ্বাস্তু সমস্যা আন্তর্জাতিক সমস্যার আকার ধার বিলাতে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক কমিটিসমূহ উদ্বাস্তুদের করুণ অবস্থা ও তালে মানবিক আবেদন জানিয়ে বিভিন্ন দূতাবাস ও আন্তর্জাতিক সংস্থায় প্রচারপত্র বি করা হয়। সভায় সফররত শ্রমিক। দেশকে মুক্ত না করা পর্যন্ত যার আকার ধারণ করে। তাদের রক্ষা করার স্থায় প্রচারপত্র বিতরণ করে। ৬ জুলাইয়ে প্রকাশিত ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদের মুখপত্র “ফ্যাক্টসীট-১৪” এ উদ্বাস্তু সমস্যা পরিদর্শনের জন্য গ্রেরিত আমেরিকার প্রতিনিধিদলের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে বিশ্ব বিবেককে জাগ্রত করার প্রয়াস গ্রহণ করে। উদ্বাস্তু সমস্যা পরিদর্শনের জন্য প্রেরিত ৫ সদস্যবিশিষ্ট প্রতিনিধি দলের অন্যতম সদস্য আমেরিকার ষ্টেট ডিপার্টমেন্টের সাবেক সহকারী সেক্রেটারী এ. বি. ডিউক সাংবাদিকদের বলেন যে, Refugee problem is the greatest crisis since World war-11 Their plight is tragic beyond description. মধ্য জুনে উদ্বাস্তু সমস্যা সম্পর্কে জাতিসংঘের রিলিফ কমিশনার পাকিস্তানের নাগরিক প্রিন্স সদরুদ্দিন আগাখানের বিতর্কিত মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে প্রকৃত অবস্থা তদন্তের জন্য আমেরিকার সরকার উল্লেখিত ৫-সদস্যের প্রতিনিধি দল ভারতের সীমান্তে অবস্থিত শিবিরগুলােতে প্রেরণ করে। বৃটিশ পার্লামেন্ট মাননীয় এম. পি আর্থার বটমলির নেতৃত্বে শরণার্থীদের প্রকৃত অবস্থা জানার জন্য একটি প্রতিনিধি দল প্রেরণ করেন। পাশ্চাত্যের সকল পর্যবেক্ষকদের রিপাের্ট ও বক্তব্যে উদ্বাস্তু সমস্যা সংক্রান্ত প্রিন্স সদরুদ্দিনের জুন মাসের আশাবাদী “Optimisitic “মন্তব্য” did not see why the Refugees should not be able to return home in time” প্রকৃতপক্ষে পক্ষপাতদুষ্ট বলে প্রমাণিত হয়। বিশ্বজনমতকে বিভ্রান্ত করার জন্য পাকিস্তান সরকার “পূর্ব পাকিস্তানে” স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজমান এবং উদ্বাস্তুরা দেশে ফিরে যাচ্ছে বলে দাবি করে মিথ্যা প্রচার চালায়। পাকিস্তানের এই মিথ্যাচারের মুখােশ উন্মােচিত হয় ১৪ জুলাই তারিখে “দি টাইমস’-এ প্রকাশিত বিশ্ব। ব্যাংকের একটি রিপাের্টের মাধ্যমে। দি টাইমস পত্রিকা বিশ্বব্যাংকের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের সদস্য হেনড্রিক ভ্যানডার হেইজডােনে (Hendrick Van Dey Heijden) এর।
রিপাের্ট প্রকাশ করে। বিশ্ব ব্যাংকের এই মিশন ৩ থেকে ৬ জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চলের যশাের, কুষ্টিয়া, খুলনা, চালনা ও মংলা ইত্যাদি শহর সরেজমিনে তদন্ত করে। উক্ত রিপাের্ট প্রস্তুত করে। রিপাের্টটি “Bank report on Bengal destruction” শিরােনামে বাংলাদেশে সংঘটিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসের বিস্তারিত ‘হসাব প্রকাশ করে। রিপাের্ট উল্লেখিত শহরগুলাের ধ্বংসের বিবরণ প্রদান করতে গিয়ে। কুষ্টিয়া শহর সম্পর্কে উল্লেখ করা হয় যে, …Ninety percent of the houses, shops, banks and other buildings were totally destroyed. The City looked like a second world war German town having undergone strategic bombing attacks (The Times. July 14, 1971)” তােপূবে বৃটিশ পার্লামেন্ট সদস্যদের প্রতিনিধি দলের নেতা আর্থার বটমলি (Arthur Ottomly) বাংলাদেশের শরণার্থী শিবির পরিদর্শন শেষে দেশে ফিরে অনুরূপ রিপােট। শ করেন। পাকিস্তানের পরিস্থিতি সম্পর্কে বিশ্বব্যাংকের রিপাের্ট ও বটমলির বক্তব্যের টাইমস পত্রিকা “The terror that পাদকীয় প্রকাশ করে। এই সম্পাদকীয়তে পরিপ্রেক্ষিতে ১৪ জুলাই লন্ডন থেকে প্রকাশিত দি টাইমস পত্রিকা “The perpetuates terror” শিরােনামে এক সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। এই সম্প মন্তব্য করা হয় যে, “As the evidence accumulates from East Paki almost all hopes for plitical compromise seen to be vanishing The evidence also confirms how false is the picture of events offers by the Pakistan Government in Islamabad. এমনিভাবে পাকিস্তানের অপপ্রচার মিথ্যা প্রমাণিত করে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের প্রকৃত অবস্থা আত্মপ্রকাশ করে এবং মুক্তিযুদ্ধের বিশ্বজনমতের সমর্থন বৃদ্ধি লাভ করে। বিলাতে পাকিস্তান ক্রিকেট টীমের সফরের প্রতিবাদে গৃহিত কর্মসূচীর অংশ হিসাবে ৮ এবং ১০ জুলাই লীড়সের হেডিংলী ক্রিকেট গ্রাউন্ডের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশের আয়ােজন করা হয়। সফরের এই পর্যায়ে ইংল্যান্ড ও পাকিস্তানের তৃতীয় টেস্ট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। খেলার প্রথম দিন (৮ জুলাই) এবং শেষ দিন (১০ জুলাই) লীড় সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে এবং পাকিস্তানীদের বর্বরতা ও গণহত্যার বিরুদ্ধে বিভিন্ন শ্লোগান ও ব্যানার হাতে ক্রিকেট টীমের সফরের প্রতিবাদ জানানাে হয়।
১০ জুলাই ব্রেডফোর্ড শহরে সংগ্রাম পরিষদ আয়ােজিত এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। জনসভায় প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী এবং বিশেষ অতিথি হিসাবে স্টিয়ারিং কমিটি শেখ আবদুল মান্নান ও কবীর চৌধুরী সভায় বক্তব্য রাখেন। | ১৬ জুলাই কেন্দ্রীয় স্টিয়ারিং কমিটির উদ্যোগে লন্ডনে বিক্ষোভ মিছিলের আয়ােজন করা হয়। মিছিল করে লন্ডনস্থ চীনা দূতাবাসে এবং ১০ নং ডাইনিং স্ট্রীটে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর কাছে। বাংলাদেশকে সমর্থন দানের আবেদন জানিয়ে স্মারকলিপি প্রদান করা হয় । ১৮ জুলাই, রবিবার ষ্টিয়ারিং কমিটির উদ্যোগে লন্ডনের হাইড পার্ক স্পীকার্স কর্ণারে পাকিস্তানকে আমেরিকা ও চীনের সাহায্য প্রদানের প্রতিবাদে এক সমাবেশের আয়ােজন করা হয়। কভেন্ট্রি সম্মেলনে গৃহিত সিদ্ধান্ত মােতাবেক কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন না করায় এই কর্মসূচী গ্রহণে কিছুটা ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হলেও সমাবেশ সফল ভাবে অনুষ্ঠিত হয়। | বৃটেনের বিভিন্ন শহর থেকে বিপুল সংখ্যক বাঙালি সমাবেশে যােগ দেয়। প্রায় ১০ হাজা | বাঙালি বিক্ষোভ মিছিল প্রথমে চীনা দূতাবাসে এবং পরে আমেরিকান দূতাবাসে গমন ” স্মারকলিপি পেশ করে। উভয় স্মারকলিপিতে গণহত্যাকারী পাকিস্তানকে সাহায্য বণ | বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের আহ্বান জানানাে হয়। বিক্ষোভ মিছিলটি ১০নং ডাইনিং এ গিয়ে সমাপ্ত হয় এবং সেখানে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর কাছে অপর একটি স্মারকলিপি ”জুলাই মাসের তৃতীয় সপ্তাহে আমেরিকার আইনজীবীদের বাৎসরিক সম্মেল অনুষ্ঠিত হয়। দেড় হাজারের মতাে আমেরিকার আইনজীবী তখন লন্ডনে অবস্থা সুযোগে তাদের কাছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচারকার্য পরিচালনার জ কমিটি, ছাত্র সংগ্রাম কমিটি ও লন্ডনস্থ অন্যান্য সংগ্রাম কমিটি কার্যক্রম অবাৎসরিক সম্মেলন লন্ডনে ” লন্ডনে অবস্থান করার পরিচালনার জন্য ষ্টিয়ারিং কার্যক্রম গ্রহণ করে।
বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বৃহৎ শক্তিগুলাের মধ্যে আমেরিকার সরকার পাকিস্তান সরকারকে সমর্থন অব্যাহত রেখেছিল। পাকিস্তানের অখণ্ডতা ও ইয়াহিয়া খানের বাঙালী নিধন কার্যক্রমকে আমেরিকার সমর্থন প্রদানের ফলে বাংলাদেশের পক্ষে কূটনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা খুবই কষ্টকর ছিল। তাই বার বার বিলাতে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকরা আমেরিকান দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন, মেমােরেন্ডাম প্রদান, অনশন ধর্মঘট ইত্যাদি কার্যক্রমের মাধ্যমে আমেরিকার সরকারের মনােবৃত্তি পরিবর্তনের প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছে। আমেরিকার আইনজীবীদের সম্মেলন লন্ডনে অনুষ্ঠান একটি ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনা। এই ব্যতিক্রমধর্মী অনুষ্ঠানের সুযােগ নিয়ে আমেরিকার বিশিষ্ট নাগরিকদের মধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের যৌক্তিকতা ও পরিস্থিতি ব্যাখ্যা এবং প্রচারের ব্যাপক কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়। আমেরিকার জনগণের মতামতের উপর নির্ভর করে আমেরিকার সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন হয় এই বিবেচনায় আমেরিকা থেকে আগত আইনজীবীদের কাছে মেমােরেন্ডাম, চিঠি ও পত্রিকার মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের প্রতি সমর্থনের জন্য আবেদন জানানাে হয়। ১৪ জুলাই বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এবং এ্যাকশন বাংলাদেশ যৌথভাবে আমেরিকান বার এসােসিয়েশনের সকল সদস্যের কাছে একটি পত্র প্রেরণ করে। পত্রে পাকিস্তানের কর্তৃপক্ষ কি নির্মমভাবে জাতিসংঘের “Genocide Convention” এর নীতিকে লংঘন করে হত্যাযজ্ঞ ও নির্যাতন চালাচ্ছে তার বিবরণ দেয়া হয়। পত্রে ১৩ ও ২০ জুন এবং ১১ জুলাই তারিখে ‘সানডে টাইমসে প্রকাশিত রিপাের্টের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করে বলা হয় যে, ঐ সকল রিপাের্টে বর্ণিত ঘটনার মাধ্যমে উক্ত কনভেনশনের সংশ্লিষ্ট ধারা (Ila. IIb. Ile) সমূহ পরিষ্কারভাবে লংঘন হয়েছে। তাই গণতান্ত্রিক একটি দেশের মুক্তবুদ্ধি সম্পন্ন আইনজীবীদের কাছে আইন ও মানবাধিকার লংঘনের বিরুদ্ধে সােচ্চার হওয়ার। অনুরােধ জানানাে হয়। সর্বশেষ আবেদন জানানাে হয় যে… “We urge you, therefore, individually and collectively to approach your Government to bring this matter before the U. N. without further delay.”
উল্লেখ্য যে, এই পত্রে বাংলাদেশে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ জাতিসংঘের মানবাধিকার আইন ও ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষার জন্য সংশ্লিষ্ট ধারাসমূহ লংঘিত হওয়ায় জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়। ১৯ জুলাই বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ বৈদেশিক প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ। চৌধুরী আমেরিকার বার এসােসিয়েশনের সকল সদস্যকে অপর একটি পত্র প্রেরণ করেন। পত্রে সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী আমেরিকার আইনজীবীদেরকে “আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় নিবেদিতপ্রাণ আখ্যায়িত করে পত্রে উল্লেখ করা হয় যে, পাকিস্তানের সেনাবাহিনী বাংলাদেশে স্বের প্রকৃত সকল আইনকে লংঘন করেছে এবং শান্তিপ্রিয় বাংলাদেশের জনগণের উপর রেখেছে। পত্রে আরাে বলা হয় যে, দশের স্বাধীনতার ঘােষণা করেছে। তাই নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞের এক নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। পত্রে আরাে বলা জনগণের ভােটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘােষণা গণতান্ত্রিক মূল্যবােধ ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের জনগণের সংগ্রামের পাশে দাড়ানাের জন্য আমিেরকার আইনজীবাদের আহ্বান জানানাে হয়। আবেদনের a… বলা হয় যে, “The Government of Bangladesh fervently hopes that you will urge upon the government of the world including your own government to recognise the independent Government of Bangladesh and stop all supply of arms and economic aid to the Government of West Pakistan and demand release of Shaikh Majibur Rahman and all other political prisoners and thus pave the way for establishment of the Rule of law in East Bengal, now Bangladesh. উপরােক্ত পত্রের সাথে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিকা ব্যাখ্যার উদ্দেশ্যে ইতিমধ্যে 2017-18 “Conflict in East Pakistan-background and prospect.” “The murder of people and” “Why Bangladesh.” ইত্যাদি পুস্তিকাসমূহ। প্রত্যেক আইনজীবীকে হােটেলের কক্ষে পৌছে দেয়া হয়। এ ব্যাপারে সক্রিয়ভাবে। সহযােগিতা করেন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সদস্যবৃন্দ। সম্মেলন স্থল থেকে প্রত্যেক প্রতিনিধির হােটেল কক্ষ ও নাম সংগ্রাহ করে প্রত্যেককে উপরােক্ত কাগজপত্র পৌছে দেয়া। হয়।
এখানে উল্লেখযােগ্য যে, আমেরিকান বার এসােসিয়েশনের এই ব্যতিক্রমধর্মী সম্মেলনে রিপাবলিকান ও ডেমােক্রেটিক পার্টির নেতৃবৃন্দ সিনেটে ও প্রতিনিধি পরিষদের সম্মানিত সদস্যবৃন্দ এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী অংশগ্রহণ করেছিলেন। লন্ডনে বসে আমেরিকার প্রায় দেড় হাজার বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বকে যােগাযােগ এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে লবিং করা বিশ্বজনমত সৃষ্টিতে খুবই কার্যকরী পদক্ষেপ ও ফলপ্রসূ অবদান রেখেছিল। এছাড়া বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ আমেরিকার আইনজীবীদের বাংলাদেশের পরিস্থিতির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের উদ্দেশ্যে ২০ জুলাই ‘দি গার্ডিয়ান পত্রিকায় অর্ধপৃষ্ঠাব্যাপ একটি বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে “An open letter to the Delegates of a American Bar Association from the people of Bangladesh একটি খােলা চিঠি প্রকাশ করে। উক্ত খােলা চিঠির উপরিভাগে বাংলাদেশ সরকামে* প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবর রহমানের একটি হাস্যোজ্জ্বল ছবি শােভা পায়। খােলা শুরুতেই এই চিঠির উদ্দেশ্য বর্ণনা করতে গিয়ে উল্লেখ করা হয় যে, “We W” you because you are lawyers and laws are being broken, you are Americans and America can do a great deal to the suffering and because you are a body powerful enough শাভা পায়। খােলা চিঠির being broken; because reat deal to end our erful enough to get his message through to President Nixon.”উক্ত খােলা চিঠিতে বাংলাদেশে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ ও নির্যাতনের বিবরণ প্রদান করা হয় এবং এতদসংক্রান্ত পাশ্চাত্যের পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত রিপাের্টের উল্লেখ করা হয় । খােলা চিঠিতে বাংলাদেশের হত্যাযজ্ঞকে। জাতিসংঘের মানবাধিকার ও জেনােসাইড কনভেনশনে গৃহীত নীতিমালার ন্যাক্কারজনক লংঘন বলে অভিহিত করে তার প্রতিকারের জন্য মুক্তিবুদ্ধিসম্পন্ন আমেরিকার আইনজীবীদের প্রতি আহ্বান জানানাে হয়। উক্ত খােলা চিঠিতে আমেরিকান বার এসােসিয়েশনের সম্মানিত সদস্যদের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কাছে নিম্নলিখিত বিষয়ে আবেদন জানানাে হয় ?
(ক) আমেরিকা কর্তৃক পাকিস্তানকে প্রদত্ত সকল সামরিক সহযােগিতা বন্ধ করা। | (খ) বাংলাদেশ থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের পূর্বে পাকিস্তানকে নতুন কোন আর্থিক সাহায্য মঞ্জুর না করা।
(গ) বাংলাদেশের নির্বাচিত নেতা শেখ মুজিবের মুক্তির জন্য পাকিস্তান সরকারের প্রতি চাপ সৃষ্টি।
(ঘ) স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান।
(ঙ) বাংলাদেশে সংঘটিত সন্ত্রাস ও হত্যাকান্ড আন্তর্জাতিক শান্তির প্রতি হুমকি ও জেনােসাইড কনভেশনের লংঘন হওয়ায় উক্ত বিষয় জাতিসংঘের স্বস্তি পরিষদে উত্থাপন।
উক্ত বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রকাশিত খােলা চিঠিতে বাংলাদেশকে সমর্থনের জন্য বিশ্বের শান্তিপ্রিয় সকল জনগণকেও আহ্বান জানানাে হয়। | ২৬ জুলাই বৃটিশ পার্লমেন্টের হারকোর্ট রুমে এক অনাড়ম্ভর অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের ৮টি ডাকটিকেট প্রকাশ করা হয়। বৃটিশ এম, পি, এবং সাবেক পােষ্ট মাষ্টার জেনারেল জন স্টোন হাউজ ডাকটিকেট মুদ্রণ, প্রকাশ ও প্রচারের সকল উদ্যোগ গ্রহণ করেন। বৃটিশ পার্লামেন্টের উভয় দিকের প্রভাবশালী এম. পি বৃন্দ ও সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ডাকটিকিটগুলাে সকলকে দেখান। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের গণপরিষদ সদস্য ও শ্রমিক নেতা আঃ মান্নান (মরহুম) উপস্থিত ছিলেন। ডাক টিকেট গুলাের ডিজাইন তৈরি করেন বাঙালি গ্রাফিক শিল্পী বিমান মল্লিক।
আগস্ট মাসের প্রথম দিকে সামরিক আদালতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গােপন বিচার শুরু হবে মর্মে বিলাতের পত্র পত্রিকার খবর প্রকাশিত হয়। বিলাত প্রবাসী বাঙালীরা এই খবরে উদ্বিগ্ন হয়ে বিলাত থেকে আইনজীবী প্রেরণের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। বিচারপতি সাধুরা নােবেল শান্তি পুরস্কার প্রাপ্ত এবং আয়ারল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী আন্তর্জাতিক যাতি সম্পন্ন আইনজীবী শশার ম্যাকব্রাইডকে ইসলামাবাদে গিয়ে শেখ মুজিবের পক্ষ পমথনের অনুরােধ জানান। শাের ম্যাকব্রাইড বিচারপতি চৌধুরীর প্রস্তাব সানন্দে গ্রহণ করেন এবং বার্নার্ড শেরিডেন সলিসিটার ফার্মের একজন সলিসিটার সহ জুলাই মাসের শেষ দিকে সলামাবাদে গমন করেন। তিনি একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন আইনজীবী হওয়ার কারণে তার পাকিস্তান গমনের খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হয় । মি, ম্যাকব্রাইড ইসলামাবাদে সরকারী উধ্বতন কর্মকর্তা ছাড়াও ইয়াহিয়া খানের আইন উপদেষ্টার সাথে সাক্ষাৎ করেন। তাকে শেখ মুজিবের সাথে দেখা করতে দেয়া হয়নি এবং ইয়াহিয়া খানও তাঁকে সাক্ষাদানের ব্যাপারে অস্বীকৃতি জানায়। তাকে আরাে জানানাে হয় যে, কোন বিদেশী আইনজীবীকে শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ সমর্থন করার সুযােগ দেয়া হবে না। বিফল মনােরথে লন্ডন প্রত্যাবর্তন করে মি. ম্যাকব্রাইড এক বিবৃতিতে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রহসনের বিচারের পাকিস্তানী দুরভিসন্ধির বিষয়ে আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। | ৩১ জুলাই পাের্টসমাউথে স্থানীয় সংগ্রাম পরিষদ এবং পাের্টমাইথে ইংরেজ সমর্থকদের যৌথ উদ্যোগে এক জনসভার আয়ােজন করা হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রফেসর ক্ৰমলী এবং প্রধান অতিথি ছিলেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। বক্তব্য রাখেন পাের্টসমাউথ থেকে নির্বাচিত এম, পি, ফ্রাংক জ্যাড, স্থানীয় নেতা আবদুর রাজ্জাক চৌধুরী এবং লন্ডনে থেকে বিচারপতি চৌধুরীর সফর সঙ্গী সুলতান মাহমুদ শরিফ, জাকারিয়া খান চৌধুরী ও সামসুল আলম চৌধুরী। প্রধান অতিথির ভাষণে বিচারপতি চৌধুরী শেখ মুজিবুর রহমানকে গােপনে প্রহসনমূলক বিচারের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং তার মুক্তি দাবি করেন। ফ্রাংক জ্যাড তার বক্তব্যে শেখ মুজিবুর রহমানের গােপন বিচারের জন্য নিন্দা প্রকাশ করেন এবং তার মুক্তির জন্য আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টির উপর গুরুত্ব প্রদান করেন।
আগস্ট মাসের প্রথম দিনে লন্ডনের ট্রাফেলগার স্কোয়ারে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের দাবিতে এক ব্যতিক্রমধর্মী ও গুরুত্বপূর্ণ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এতদিন যত সভা-সমাবেশ হয়েছে তা বাঙালীদের দ্বারা পরিচালিত বিভিন্ন সগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু ১ আগস্টের সমাবেশ আয়ােজন করে লন্ডন এন ডব্লিউ-১ এর ৩৪ নং ষ্টাটফোর্ড ভিলাস্থ এ্যাকশন বাংলাদেশ’ নামে একটি স্থানীয় সংগঠন। বৃটিশ যুব নেতা পল কনেটের নেতৃত্বে। এবং বৃটিশ এমপি, সমাজকর্মী ও আইনজীবী সমন্বয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে উক্ত সংগঠনটি লন্ডনে প্রতিষ্ঠা করা হয় । ট্রাফালগার স্কোয়ারের এই সমাবেশ আয়ােজনে কেন্দ্রীয়। স্টিয়ারিং কমিটি, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও মহিলা সমিতি এ্যাকশন বাংলাদেশকে সহযােগিতা করে। সমাবেশ উপলক্ষে একটি পােস্টার ছাপানাে হয় এবং তা শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে লাগানাে হয়। পােস্টারে STOP GENOCIDE’ এবং ‘RECOGNISE BANGLADESH RALLY’ শিরােনামে ১ আগস্ট বিকাল ২ টায় ট্রাফেলগার স্কোয়ারের র্যালীতে যােগদানের আহ্বান জানানাে হয়। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের দাবিতে একটি বৃটিশ সংগঠনের সমাবেশ আয়ােজন এবং মিছিল সহকারে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর কাছে। স্মারকলিপি পেশ বিদেশে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে এক উল্লেখযােগ্য অবদান রেখেছে। ১ আগস্টের এই সমাবেশে বিভিন্ন স্তরের বৃটিশ খ্যাতনামা ব্যক্তিত্বের বাংলাদেশের সমর্থন জ্ঞাপন ছাড়াও পাকিস্তান দূতাবাসের একজন দ্বিতীয় সচিব পাকিস্তান সরকারের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে ঘােষণা প্রদান সমাবেশটিকে আরাে গুরুত্বপূর্ণ করে তােলে। _ ট্রাফেলগার স্কোয়ারের র্যালীতে বৃটিশ নেতৃবৃন্দের মধ্যে ইতােমধ্যে বাংলাদেশ ও তার সীমান্ত পরিদর্শনকারী রেজ প্রেনটিস (এমপি), জন ষ্টোনহাউজ (এমপি) এবং রেভারেন্ড কেনিয়ন রাইট (কভেন্ট্রি ক্যাথড্রেলের আরাবান ষ্ট্যাডিজের পরিচালক) তাঁদের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বক্তব্য রাখেন। তাঁরা বাংলাদেশে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ ও রিলিফ ক্যাম্পগুলাের রুণ অবস্থার কথা সমাবেশে ব্যক্ত করেন। বৃটিশ নেতৃবৃন্দের মধ্যে আরাে বক্তব্য রাখেন লডকওয়ে, কুইনস কাউন্সিলর ও প্রখ্যাত আইনজীবী টম উইলিয়াম (আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আইনজীবী) মঞ্চ ও চিত্রনাট্য শিল্পী ডেভিড কসপ, চার্চ মিশনারী সােসাইটির যুব পরিচালক রেভারেন্ড রজার ক্রসথওয়েইট, বিশিষ্ট সমাজকর্মী লেডী গিফোর্ড, কেমিক্যাল মস ইউনিয়নের মহাসচিব বব এডওয়ার্ড (এম পি), ইয়ং লিবারেল পার্টির রাজনৈতিক ” চেয়ারম্যান সায়মন হেড্রিচ এবং এ্যাকশন বাংলাদেশ’-এর পক্ষে পল কনেট। “”শের উদ্যোক্তা ও অংশগ্রহণকারীদের ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে বাংলাদেশের পক্ষে বক্তব্য।
রাখেন বাংলাদেশ সরকারের বৈদেশিক প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী এবং মহিলানেত্রী মিসেস লুলু বিলকিস বানু। সমাবেশে সকল বক্তা বাংলাদেশে হত্যাযজ্ঞ নয়. বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের দাবি উত্থাপন করেন। | উক্ত সভায় লন্ডনস্থ পাকিস্তান দূতাবাসের দ্বিতীয় সচিব বাঙালি কূটনীতিবিদ মহিউটি আহমেদ হত্যাকারী পাকিস্তান সরকারের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের কথা প্রকাশ্যে ঘােষণা করেন। এভাবে পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার দৃষ্টান্ত সৃষ্টি হওয়ায় বৃটেনে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সংগঠকদের মধ্যে বিপুল উদ্দীপনার সৃষ্টি হয় এবং আন্দোলন আরাে জোরদার হয়। পরবর্তীকালে দেখা যায় যে, মহিউদ্দিন আহমদের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে বিভিন্ন দূতাবাস থেকে বাঙালি কূটনীতিবিদরা পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ সমর্থন করেন। সমাবেশ শেষে এক বিরাট মিছিল ১০নং ডাইনিং স্ট্রীটে গমন করে এবং বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের কাছে একটি স্মারকলিপি প্রদান করে। স্মারকলিপিতে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি এবং বাংলাদেশে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করার জন্য বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর কাছে কয়েকটি প্রস্তাব পেশ করা হয়। প্রস্তাবগুলাে ছিল নিম্নরূপঃ (ক) বাংলাদেশে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ জাতিসংঘের জেনােসাইড কনভেনশনের সংশ্লিষ্ট ধারা লংঘন বিধায় বিষয়টি জাতিসংঘের স্বস্তি পরিষদে উত্থাপনের জন্য বৃটিশ সরকারকে প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের অনুরােধ; (খ) পাকিস্তানে সামরিক অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করার জন্য আমেরিকার সরকারের প্রতি চাপ প্রয়ােগ করা; (গ) বাংলাদেশের বিপ্লবী সরকারকে স্বীকৃতি প্রদান করা এবং (ঘ) বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের জন্য পাকিস্তানের উপর বৃটিশ সরকারের কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টি। স্মারকলিপির সাথে ১১ জন প্রিভি কাউন্সিলর ও ৩০ জন প্রাক্তনমন্ত্রীসহ ২০০ জন এম পি স্বাক্ষরিত বৃটিশ পার্লামেন্টে যে প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছিল। তার একটি কপি সংযযাজন করা হয়। ৫ আগস্ট বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রধান ও রেডক্রস সংক্রান্ত জেনেভা কনভেনশন’-এর বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড্রেপারকে সঙ্গে নিয়ে জেনেভা গমন করেন। বাংলাদেশ সরকারের প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য জেনেভায় অবস্থিত আন্তর্জাতিক রেডক্রসের হেডকোয়ার্টারে আনুষ্ঠানিক ভাবে আবেদন সে। করার জন্য অধ্যাপক ড্রেপারকে ব্যারিষ্টার নিয়ােগ করা হয়। বিচারপতি চৌধুরী ও অধ্যা ড্রেপার আন্তর্জাতিক রেডক্রসের উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের সাথে দেখা করে আনুষ্ঠানিক দর। পেশ এবং শেখ মুজিবুর রহমানের নিরাপত্তা ও মুক্তির জন্য রেডক্রসকে যথাযথ ?” পালনের অনুরােধ করেন। জেনেভায় অবস্থানকালে বিচারপতি চৌধুরী ইন্টারন্য কমিশন অফ জুরিষ্টস’ এর সেক্রেটারী জেনারেল নীল ম্যাকডারমেটের সাথেও সাক্ষাৎ করেন।
ইতােমধ্যে লন্ডনস্থ পাকিস্তান হাই কমিশনের হিসাব পরিচালক লুৎফুল মতিন। লাদেশ সরকারের সাবেক যুগ্মসচিব), শিক্ষা অফিসার হাবিবুর রহমান এবং বার্মিংহামস্থ পাকিস্তানের লেবার অফিসের কর্মকর্তা ফজলুল হক পাকিস্তান সরকারের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে বাংলাদেশ সংগ্রামে অংশগ্রহণের কথা ঘােষণা করেন। বাংলাদেশ ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ ১ আগস্টের সমাবেশে পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক ছিন্নকারী দ্বিতীয় সচিব মহিউদ্দিন আহম্মদসহ উপরােক্ত কর্মকর্তাদের সংবর্ধনা প্রদানের জন্য লন্ডনের রেড লায়ন স্কোয়ারস্থ কনওয়ে হলে ৮ আগস্ট এক জনসভার আয়ােজন করে। উক্ত গণসংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের অপর আহ্বায়ক এ জেড এম মােহাম্মদ হােসেন মঞ্জু। পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক ছিন্নকারী কর্মকর্তাদের ছাড়াও উক্ত গণসংবর্ধনায় বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ সরকারের বৈদেশিক প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। এই সমাবেশে পাকিস্তান সরকারের চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের তৎকালীন ডেপুটি ডাইরেক্টর লন্ডনে উচ্চ শিক্ষার জন্য অবস্থানরত আবদুর রউফ পাকিস্তান সরকারের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের কথা ঘােষণা করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখযােগ্য যে, মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভ থেকে আবদুর রউফ বৃটেনে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে আসছিলেন। তিনি বিভিন্ন সংগ্রাম কমিটি পােষ্টার ও প্রচারপত্র লেখায় সহযােগিতা ছাড়াও প্রথমে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ এবং পরে কেন্দ্রীয় ষ্টিয়ারিং কমিটি থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশ সংবাদ পরিক্রমা’ নামক সংবাদ বুলেটিন সম্পাদনা করতেন। উক্ত গণসংবর্ধনায় বিভিন্ন বক্তা পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক ছিন্নকারী অফিসারদের দেশপ্রেম ও সাহসিকতার প্রশংসা করেন। এবং তাদের অংশগ্রহণে দেশে মুক্তিযুদ্ধ আরাে শক্তি সঞ্চয় করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। কনওয়ে হলে একই দিনে বাংলাদেশ মহিলা সমিতির উদ্যোগে একটি মিনাবাজারের আয়ােজন করা হয়। মিনাবাজার উদ্বোধন করেন বিচারপতি চৌধুরী ও মিসেস চৌধুরী। সন্ধ্যায় বাংলাদেশ গণসংস্কৃতি সংসদ এক মনােজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপহার দেন।
আগষ্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে বৃটিশ পত্রিকায় বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ও গ্রেফতারকৃত নেতা শেখ মুজিবর রহমানের গােপন বিচার শুরু হওয়ার খবর প্রকাশিত হয়। এ খবর প্রকাশের সাথে সাথে বৃটেনের বিভিন্ন সংগ্রাম পরিষদ সমূহ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনপ্রতিনিধিদের নির্বাচিত নেতার বিরুদ্ধে গােপন বিচারের প্রতিবাদে সভা, শােভাযাত্রা ও প্রচারপত্র প্রকাশ। করে। সামরিক আদলতে গােপনে শেখ মুজিবর রহমানের বিচারের ষড়যন্ত্র-এর বিরুদ্ধে বিশ্ব-জনমত সৃষ্টি ও তার প্রতিবাদ করার জন্য ১১নং গােরিং স্ট্রীটে অবস্থিত কেন্দ্রীয় স্টিয়ারিং কমিটির পক্ষ থেকে ১১ আগস্ট বেলা ২টার হাইড-পার্ক স্পীকার্স কর্ণারে এক গণসমাবেশের আয়ােজন করা হয়। সভায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবর মানের জীবনের নিরাপত্তা বিধানের জন্য গণতান্ত্রিক সকল দেশের সরকার ও জনগণের এই আহ্বান জানানাে হয়। সভায় বৃটিশ সরকারকে এ ব্যাপারে কূটনৈতিক পদক্ষেপ। শহণের অনুরােধ জানানাে হয়। হাইড-পার্কের এই গণসমাবেশে সভাপতিত্ব করেন ষ্টিয়ারিং কমিটির আহ্বায়ক আজিজুল হক ভূইয়া এবং প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিল বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। সমাবেশে বক্তব্য রাখেন বৃটিশ এম, পি, পিটার মশা মাইকেল বার্নস, ব্রুস ডগলাস-ম্যান, জন স্টোন হাউজ, রেজ প্রেন্টিস ও লর্গ গিফোর্ড প্রম বাংলাদেশের সমর্থক বৃটিশ নাগরিকবৃন্দ। এছাড়াও বিভিন্ন সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে বক্তত রাখেন গউস খান, শেখ আবদুল মান্নান, ব্যারিষ্টার সাখাওয়াত হােসেন এবং লুলু বিলকিস বান প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। সমাবেশ শেষে বিচারপতি চৌধুরী ও বৃটিশ এম, পিদের নেতৃত্বে একটি মিছিল ১০ নং ডাউনিং স্ট্রীটে গমন করে এবং বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর কাছে শেখ মজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে গােপন বিচার বন্ধ ও তার মুক্তির দাবি জানিয়ে একটি স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। | ১৫ আগস্ট লন্ডনের আমেরিকান দূতাবাসের সামনে ‘এ্যাকশন বাংলাদেশ’ এর কর্মীরা। এক ব্যক্তিক্রম ধর্মী কার্যক্রম গ্রহণ করে। সেদিন ট্রাফেলগার স্কোয়ারে ইয়াহিয়া খানের সমর্থনে “পাকিস্তান সলিডারিটি ফ্রন্ট” এর উদ্যোগে বাংলাদেশ বিরােধী এক জনসমাবেশের আয়ােজন করা হয়েছিল। এই জনসভার প্রতিবাদে আমেরিকান দূতাবাসের সামনের রাস্তায় “এ্যাকশন বাংলাদেশ” এর কর্মীরা হত্যা অভিনয় প্রদর্শন করে বাংলাদেশে পাকিস্তানী হত্যাকান্ডের একটি প্রতিকি চিত্র আমেরিকান দূতাবাস ও পথচারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
কয়েকজন শাড়ী পরিহিতা নারী রাস্তার ফুটপাথে শুয়ে পরে এবং তাদের উপর তিন গাড়ী বােঝাই পাকিস্তানী সামরিক পােষাক পরিহিত সৈন্য নির্বিচারে গুলি করার অভিনয় করে একটি নাটকীয় দৃশ্যের উপস্থাপনা করে। ১৬ আগস্ট মর্ণিং ষ্টার পত্রিকায় এই হত্যা অভিনয়ের সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ১৭ আগস্ট “ওপারেশন ওমেগা” এর পীস টীমের ৮ জন বৃটিশ ও ৩ জন আমেরিকান স্বেচ্ছাসেবক বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বেনাপােল চেকপােষ্ট। অতিক্রম করার পর পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদেরকে গ্রেফতার করে। ১ আগস্ট ট্রাফেলগার। স্কোয়ার থেকে ওপারেশন ওমেগা’ এর এই পীস টীম বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা। হয়েছিল। স্বেচ্ছাসেবকদের মধ্যে ওপারেশন ওমেগা’ এর প্রতিষ্ঠাতা পল কনেটের স্ত্রী আইলীন কনেট ছিলেন। গ্রেফতারকৃত স্বেচ্ছাসেবকদেরকে ২৬ ঘণ্টা আটক রেখে পাকিস্তান। সেনাবাহিনী তাদেরকে পশ্চিমবঙ্গে ফেরত পাঠিয়ে দেয়। আগস্ট মাসের প্রথম দিকে পাকিস্তান সরকারের সাথে কিছুসংখ্যক কূটনৈতিক ও কর্মকর্তা সম্পর্ক ছিন্ন করায় বিলাতের বাঙালীদের মধ্যে বিপুল সাড়া লক্ষ্য করা যায়। বিলাতের বিভিন্ন শহরের আঞ্চলিক কমিটিসমূহ সম্পর্ক ছিন্নকারী ব্যক্তিদের দেশপ্রেম ও সাহসিকতার জন্য সংবর্ধনা আয়ােজন করে। এমনি একটি সংবর্ধনা অনুষ্ঠিত হয় ১৫ আ ব্রাডফোর্ড শহরের তকদীর রেষ্টুরেন্টে। বাংলাদেশ এ্যাকশন কমিটি, ইয়র্কশায়ার শাখা। সংবর্ধনা সভার আয়ােজন করে। উক্ত অনুষ্ঠানে সম্পর্কছিন্নকারীদের পক্ষ থেকে মাই আহমেদ (২য় সচিব), লুৎফুল মতিন (হিসাব পরিচালক), ফজলুল হক চৌধুরা (অফিসার), মহিউদ্দিন চৌধুরী (পি এই এর কর্মকর্তা) এবং নূরুল হুদা (কণফুণ জর ক্যাপ্টেন) উপস্থিত ছিলেন। উপরােক্ত ব্যক্তিদের সংবর্ধনা জানিয়ে বক্তব্য রাখেন টিয়ারিং কমিটির সদস্য শেখ আবদুল মান্নান এবং ইয়ার্কশায়ার কমিটির কর্মকর্তাবৃন্দ ।
গ্রেফতারকৃত বাংলাদেশের নেতা ও বাংলাদেশের সরকারের প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবর তমানের পাকিস্তানে গােপন বিচারের বিরুদ্ধে বিশ্বজনমত সৃষ্টি করার জন্য বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ বৃটিশ পত্র-পত্রিকায় একটি বড় ধরনের বিজ্ঞাপন প্রদানের ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ বিজ্ঞাপন প্রদানের উদ্দেশ্যে আর্থিক সহযােগিতা দানের জন্য বিলাতের বিভিন্ন সংগ্রাম পরিষদসমূহের কাছে আহ্বান জানিয়ে পত্র দেন। এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে ৬৩টি কমিটি সহযােগিতা করতে সম্মতি জানায়। ৬৩টি কমিটির নামসহ ১৬ আগস্টের দি টাইমস পত্রিকায় একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়। বিজ্ঞাপনে যে শিরােনাম শােভা পায় তা হলাে ঃ “Wake up world-please act immediately to stop camera trialSecure release of the President of the Peoples Republic of | Bangladesh. বিজ্ঞাপনে সংক্ষেপে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি এবং ২৫ মার্চ থেকে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের একটি বিবরণ প্রদান করা হয়। বিজ্ঞাপনে শেখ মুজিবর রহমানের গােপন বিচারের প্রচেষ্টাকে ন্যাক্কারজনক দুরভিসন্ধি আখ্যায়িত করে এই বিচার বাংলাদেশের সকল জনগণের বিরুদ্ধে বিচার অনুষ্ঠানের শামিল বলে উল্লেখ করা হয়। এতে | বিশ্ব বিবেকের কাছে প্রশ্ন রাখা হয় যে, “Can the world really afford to watch | such an outrageous act of vengeance?” পরিশেষে বিজ্ঞাপনে বাংলাদেশের | নির্যাতিত স্বাধীনতাকামী জনগণের পক্ষে দাবি জানানাে হয় যে “We demand that the British Government, the Uniled Nations and the people of the World put a stop to this trial of Shaikh Mujibur Rahman and secure his release.” | বৃটিশ সংবাদপত্রের একাংশ প্রকাশিত পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে শান্তি আলােচনার | খবরের তীব্র প্রতিবাদ করে ১৯ আগস্ট বাংলাদেশ সরকারের বৈদেশিক প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী একটি বিবৃতি প্রদান করেন। বিবৃতিতে তিনি নিম্নে প্রদত্ত দাবিগুলাে মেনে ” নেয়া পর্যন্ত পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের কোন প্রকার শান্তি আলােচনা বা সমঝােতার কান প্রশ্নই ওঠেনা বলে দৃঢ়ভাবে ব্যক্ত করেন। দাবিগুলাে ছিল ঃ (১) পাকিস্তান সরকার তৃক বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব স্বীকার করা, (২) বেআইনীভাবে পাকিস্তানে আটক
প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবর রহমানকে মুক্তিদান, (৩) “দেশের পবিত্র মাটি থেকে পাকিস্তানের প্রতিটি হানাদার সৈন্য প্রত্যাহার । তিনি স্ততে আরাে বলেন যে, বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতার প্রশ্নে কোন আপােষ বাঙালি মেনে নিবেন না। বিলাতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনের যাবতীয় খরচ প্রবাসী বাঙালীদের ও সাহায্য থেকে বহন করা হতাে। মুক্তিযুদ্ধে সহযােগিতার জন্য প্রবাসী বাঙালীরা উৎসাহ প্রকাশ করে যে, ‘বাংলাদেশ ফান্ড’ নামে হামজ ব্যাংকে ইতিপূর্বে যে এত খােলা হয়েছিল তা প্রবাসীদের চাহিদা মেটাতে অসমর্থ হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায়, স্টিয়ারি কমিটি ও বাংলাদেশ ফান্ড’ এর ট্রাষ্টি বাের্ডের সিদ্ধান্তক্রমে ন্যাশনাল ওয়েষ্টমিনিষ্টার বাংলায় অপর একটি একউন্ট খােলা হয় এবং তা ষ্টিয়ারিং কমিটির বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ১৯ আগস্ট প্রচার করা হয়। লন্ডন এস ডব্লিউ-১ এর ৬নং টথিল স্ট্রীটস্থ ন্যাশনাল ওয়েস্টমিনিষ্টার ব্যাংকের ব্রাঞ্চে (ব্যাংক কোর্ড ৬০-৪০-০৩) একাউন্ট নম্বর ০০৭৭২২ এর মাধ্যমে এই নতুন একাউন্ট পরিচালনা করা হয়। ২৭ আগস্ট বিলাতে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠকদের এক স্মরণীয় দিন। এই দিনে ভারতের বাইরে বাংলাদেশের একমাত্র মিশন স্থাপন করা হয়। লন্ডনের নটিংহিল গেইটে অবস্থিত ২৪নং প্রেমব্রিজ গার্ডেনে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে বাংলাদেশ সরকারের বৈদেশিক প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বাংলাদেশের দূতাবাসের উদ্বোধন করেন। মুজিবনগর সরকার বিশ্বে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কার্যক্রম পরিচালনা ও সমন্বয় সাধন করার উদ্দেশ্যে লন্ডনে এই মিশন স্থাপনের অনুমােদন দান করেন। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে লন্ডনের মিশনের প্রধান নিয়ােগ করা হয়। ২৭ আগস্ট মিশন উদ্বোধনের দিনে বিচারপতি চৌধুরীর সাথে পাকিস্তান সরকারের সাথে সম্পর্ক ছিন্নকারী কূটনৈতিক ও কর্মচারীদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ইরাক থেকে আগত রাষ্ট্রদূত আবুল ফতেহ, মহিউদ্দিন আহমেদ (দ্বিতীয় সচিব, লন্ডন দূতাবাস), লুৎফুল মতিন (হিসাব পরিচালক, লন্ডন দূতাবাস), ফজলুল হক চৌধুরী (লেবার এটাচি), আবদুর রউফ (চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা বিভাগের ডেপুটি ডাইরেক্টর), মহিউদ্দিন চৌধুরী (পি আই এ কর্মকর্তা), নূরুল হুদা ও আবদুল সালাম। উপরােক্ত কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে লন্ডনে মিশনের কার্যক্রমের শুভ সূচনা হয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিলাতের বিভিন্ন সংগ্রাম পরিষদের কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর বিপারপতি চৌধুরী এক সাংবাদিক সম্মেলনে ভাষণ দেন। লন্ডনই বাংলাদেশ মিশন উদ্বোধনের খবর ছবিসহ বৃটিশ পত্র-পত্রিকায় ২৮ আগস্ট ছাপানাে হয়। এই মিশন পরিচালনায় বৃটিশ সরকারের পক্ষ থেকে কোন প্রকার বাধা বা বিপত্তি সৃষ্টি হয়নি।
লন্ডন মিশনটি যে ভবনে স্থাপিত হয় তা মূলত ওয়ার আন ওয়ান্টের ডনান্ড চেসও ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। উক্ত ভবনের বিদ্যুৎ ও পানি বিল পরিশােধ’ ছাড়া অন্য কোন ভাড়া বা রেন্ট দিতে হতাে না। ২৪ নং প্রেমব্রিজ গার্ডেন্সের বিল্ডিংটি আ উপযােগী করার মেরামত ও আসবাবপত্র ক্রয় বিলাতে বসবাসকারী বাঙালীদের আ৷” সাহায্যে সম্ভব হয়। মিশনের দৈনন্দিন কাজের সুবিধার্থে কয়েকজন প্রবাসী বাঙালী আসবাবপত্র দান টকিতে বসবাসকারী নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি ৬০০ পাউন্ড খরচ করে এক আসবাবপত্র দান করেন। খরচ করে একটি ফটো মন মেশিন ও একটি ডুপ্লিকেটিং মেশিন মিশনকে দান করেন। এমনিভাবে মাসুদ মিয়া, হর মিয়া, আবুদল মতিন, আবদুল মালেক, আটক মিয়া ও আবদুল বাসিত মিলিতভাবে কটি ফাইল কেবিনেট দান করেন। ডনাল্ড চেসওয়ার্থের ব্যবস্থাপনায় এবং প্রবাসীদের ও সহযােগিতায় লন্ডন মিশন এ পর্যায়ে কাজ শুরু করে। বিচারপতি আবু সাঈদ ধরী থেকে জানা যায় যে, পরবর্তিকালে মিশন পরিচালনার জন্য পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসা জনৈক বাঙালি ধনাঢ্য ব্যক্তি সুবেদ আলী ছদ্মনামে যথেষ্ট সাহায্য প্রদান করেছেন। লন্ডন মিশনকে বৃটিশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেননি। কিন্তু বাঙালীদের কাছে এই মিশনটি দূতাবাসের মর্যাদার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। প্রসংগত উল্লেখযােগ্য যে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বহুদিন পর্যন্ত ২৪ নং প্রেমব্রিজ গার্ডেন্স মিশনটি বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক দূতাবাস হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। বর্তমানে উক্ত ভবনটিকে বাংলাদেশ সেন্টার’ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ২১ আগস্ট ইরাকে পাকিস্তানের বাঙালি রাষ্ট্রদূত আবুল ফতেহ পাকিস্তানের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। ইরাক থেকে আবুল ফতেহ গােপনে লন্ডনে চলে আসেন এবং ১১ নং গােরিং স্ট্রীটে আয়ােজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে বিচারপতি চৌধুরী আবুল ফতেহকে সাংবাদিকদের কাছে পরিচয় করিয়ে দেন। ঐ সময় পর্যন্ত যে সকল বাঙালি কূটনৈতিকবৃন্দ পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন তাদের মধ্যে আবুল ফতেহ রাষ্ট্রদূত পর্যায়ের প্রথম কর্মকর্তা। ২৯ আগস্ট লন্ডনের অদুরে লুটন শহরে এক জনসভা স্থানীয় সংগ্রাম কমিটির উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয়। সভায় প্রধান অতিথি হিসাবে বিচারপতি চৌধুরী এবং অন্যদের মধ্যে শেখ আবদুল মান্নান ও জাকারিয়া খান চৌধুরী বক্তব্য রাখেন। পাকিস্তানী নাগরিকরা এই সভা ভণ্ডুলের চেষ্টা করে কিন্তু বৃটিশ পুলিশের হস্তক্ষেপে সভাটি শান্তিপূর্ণ ভাবে সমাপ্ত হয়।
সেপ্টেম্বর মাসের তৎপরতা
সেপ্টেম্বর মাসে বিলাতে একটি কেন্দ্রীয় সংগ্রাম কমিটির গঠন, তার কাঠামাে ও প্রতিনিধিত্ব ইত্যাদি সম্পর্কে ষ্টিয়ারিং কমিটি বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে। কভেন্ট্রিতে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে যে স্টিয়ারিং কমিটি গঠন করা হয়েছিল তার মূল উদ্দেশ্য ছিল একটি কেন্দ্রীয় সম্মেলনের মাধ্যমে বিলাতে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠন ও অন্যান্য কর্মকান্ড পরিচালনার জন্য একটি কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা। কিন্তু কমিটির গঠনতন্ত্র, পরিচালনা কমিটি এবং আঞ্চলিক প্রতিনিধিত্বের প্রশ্নে বিভিন্ন আঞ্চলিক কমিটির মধ্যে মতানৈক্য সৃষ্টি হওয়ায় অবশেষে উক্ত কমিটি গঠন সম্ভব হয়নি। স্টিয়ারিং কমিটিই কেন্দ্রীয় কমিটির পদমর্যাদায় কাজ চালিয়ে যায়। এ মাসের উল্লেখযােগ্য অংশ কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন প্রক্রিয়ায় ব্যয় করা হয়। ১ থেকে ১০ সেপ্টেম্বর ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে আন্তর্জাতিক পার্লামেন্টারী ইউনিয়নের বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন দেশের পার্লামেন্টের স্পীকারদের নেতৃত্বে প্রায় সাত শত জন সংসদ সদস্য সম্মেলনে অংশ গ্রহণ করে। পৃথিবীর প্রায় সকল দেশের পার্লামেন্টের প্রতিনিধিদের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বর্বরতা, গণহত্যা এবং শরণার্থী শিবিরের করুণ অবস্থা ইত্যাদির বিষয়ে অবগত করার সুযােগ গ্রহণ করার জন্য যুক্তরাজ্যস্থ ছাত্র সংগ্রাম কমিটি একটি প্রতিনিধিদল প্যারিসে প্রেরণ করে। ছাত্র প্রতিনিধিরা প্যারিসে অবস্থানরত বাঙালীদের সঙ্গে নিয়ে সম্মেলনের যােগদানকারীদের কাছে বিচারপতি চৌধুরী একটি পত্র, হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের লিখিত একটি বুকলেট, বিশ্বব্যাংকের রিপাের্ট এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর একটি গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতাসহ বিভিন্ন কাগজপত্র বিলি করে। ছাত্র প্রতিনিধিরা বিভিন্নদেশের সংসদ সদস্যদের সাথে দেখা করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে যুক্তি প্রদান করেন এবং মুক্তিযুদ্ধের ব্যাখ্যা দেন। সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করে একটি প্রস্তাব গৃহিত হয়। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল এই প্রস্তাব বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্বজনমত সৃষ্টিতে বিরাট অবদান রেখে ২ সেপেট স্বর ওয়েলসের কার্ডিফ শহরে বাংলাদেশ আন্দোলনের ইংরেজ সমর্থকদেম সমন্বয়ে সলিডারিটি’ নামে একটি সংগঠন আত্মপ্রকাশ করে।
এই সংগঠনে বৃটেনের শ্রম। দল, ওয়েলস জাতীয়তাবাদী দল, কমিউনিষ্ট পার্টি, ইয়ং কনজারভেটিভ ও ক্রিশ্চিয়ান এই প্রতিনিধিবৃন্দ সম্পৃক্ত ছিলেন। সলিডারিটি’ প্রতিষ্ঠার দিনে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাংলাগে ন্যায্য মুক্তিযুদ্ধের প্রতি একাত্মতা প্রকাশ, শেখ মুজিবের মুক্তি ও গণহত্যা বকে জানানাে হয়। ৫ সেপ্টেম্বর ওল্ডহাম বাংলাদেশ সমিতির উদ্যোগে স্থানীয় কো-অপারাে গণহত্যা বন্ধের দাবি এক বিরাট জনসভার আয়ােজন করা হয়। মকসুদ আলীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সভায় প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ থেকে আগত এম, পি, তারুজ্জামান চৌধুরী। সভায় বক্তব্য রাখেন আজিজুল হক ভূইয়া, অধ্যাপক কবীর হােসেন, আবদুল মতিন ও ডাঃ জামান প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। প্রধান অতিথির ভাষণে আকতারুজ্জামান বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে সভাকে অবহিত করে দেশ মুক্ত করার জন্য মুক্তিযােদ্ধাদের দৃঢ় মনােবলের কথা ব্যক্ত করেন। একই দিনে (৫ সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশ সীমান্তে পেত্রাপােল চেকপােষ্ট দিয়ে ‘অপারেশন ওমেগা’ এর ৪ জন সদস্য দুর্গতদের জন্য সাহায্য সামগ্রি নিয়ে পায়ে হেঁটে বাংলাদেশে দ্বিতীয়বার প্রবেশ করেন। পাকিস্তানের সৈন্যরা তাদেরকে গ্রেফতার করে যশাের জেলে প্রেরণ করে। তাদের অন্য তিন সদস্য অন্যপথে বাংলাদেশে প্রবেশ করলে তাদেরকে গ্রেফতার করে পশ্চিমবঙ্গে ফেরত পাঠিয়ে দেয়। যশাের কারাগারে বন্দি ক্রিশ্চিয়ান গ্রান্ট, চেন ক্রো, জয়েস কোলওয়েল এবং ড্যান দু এর মুক্তির দাবিতে লন্ডনে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সামনে ডেনিসাে পাইল ৯ দিন যাবৎ অনশন ধর্মঘট পালন করে। ঢাকায় অবস্থিত বৃটিশ হাইকমিশনের হস্তক্ষেপে ‘ওপারেশন ওমেগা’ এর চার স্বেচ্ছাসেবক কে যশাের জেল থেকে মুক্ত করে লন্ডন ফেরত পাঠানাে ১০ সেপ্টেম্বর বৃটেনের গােয়েন্দা প্রতিষ্ঠান “স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড” এর কর্মকর্তা পিটার লাংলী স্টিয়ারিং কমিটির কার্যালয়ে এসে কর্মকর্তাদের সাথে অফিসের নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়ে আলােচনা করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখযােগ্য যে, এর কয়েকদিন পূর্বে পাকিস্তানী কোন একটি মহল ১১নং গােরিং স্ট্রীটের অফিসের নিচতলায় বােমা বিস্ফোরণ ঘটায় যার ফলে অফিসের দরজা-জানালার ক্ষতি হয়। এই ঘটনার প্রেক্ষাপটেই ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের ঘটনা আর না ঘটে তার নিরাপত্তার বিভিন্ন দিক আলােচনার করে গােরিং স্ট্রীটে পুলিশ টহল বৃদ্ধিসহ অন্যান্য নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত আর কখনাে ষ্টিয়ারিং কমিটির অফিসে আর কোন অঘটন ঘটে নাই।
১১ সেপ্টেম্বর ইয়র্কশায়ার আঞ্চলিক সংগ্রাম কমিটির উদ্যোগে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। জনসভায় প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের এম. পি. এ. আকতারুজ্জামান চৌধুরী মনােয়ার হােসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় বক্তব্য রাখেন “শগুল হক চৌধুরী, জগলুল পাশা, তৈয়বুর রহমান, মােকাদ্দার বখত, নূরুল ইসলাম, * ডান ও মকসুদ আলী প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। সভায় প্রধান অতিথি বাংলাদেশে কাদের বীরত্ব ও দৃঢ়তার কথা উল্লেখ করে স্বাধীনতা লাভের নিশ্চয়তার আশ্বাস দিয়ে সভায় উপস্থিত সবাইকে উজ্জীবিত করেন। ‘তে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠকদের মধ্যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এত স্বল্প সময়ে শেষ হবে। মশা ছিল না। তাই দীর্ঘমেয়াদী আন্দোলন পরিচালনার জন্য অর্থ সংগ্রহ করার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। এমনি একটি পদক্ষেপ গ্রহণ করেন বাংলাদেশ পিপলস ইন গ্রেট বৃটেন” নামে একটি সংগঠন। প্রবাসী বাঙালীরা চাদা প্রদানের মাধ্যমে তহবিলে অর্থ জোগান দেয়া ছাড়াও আঞ্চলিকভাবে চ্যারিটি শাে ও প্রদর্শনী আ মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহের প্রচেষ্টা চালায়। ১২ সেপ্টেম্বর উক্ত সংগঠনের উদ্যোগে টটেনহাম কোর্ট রােডস্থ “লা-কন্টিনেন্টাল সিনেমা হলে বাংলাদেশ ফাণ্ডের সাহায্যার্থে = চ্যারিটি শাে অনুষ্ঠিত হয়। চ্যারিটি শাে-এর সংগৃহাত অথ বাংলাদেশ ফাণ্ডে জমা দেয়া হয় বলে উদ্যোক্তরা ঘােষণা দেন। ১৩ সেপ্টেম্বর থেকে ১৬ সেপ্টেম্বর ট্রাফেলগার স্কোয়ারের সন্নিকটে “সেন্ট মার্টিনস ইন দি ফিল্ড” নামক গীর্জায় কমিটি ফর ক্রিশ্চিয়ান এ্যাকশন’ এর চেয়ারম্যান ক্যানন কলিন্স এর উদ্যোগে বাংলাদেশের সংগ্রামের স্বপক্ষে একটি প্রদর্শনী ও ৪টি আলােচনা সভার আয়ােজন করা হয়। চার দিনের আলােচনা সভায় প্রত্যেক দিন একজন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী মল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন এবং অন্যান্যরা আলােচনায় অংশগ্রহণ করেন। প্রত্যেকটি প্রবন্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, পাকিস্তানের হত্যাযজ্ঞ এবং মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়। ১৩ সেপ্টেম্বরে আলােচনা সভার উদ্যোক্তা ক্যানন কলিন্স, ১৪ সেপ্টেম্বরে জন গ্রিগ, ১৫ সেপ্টেম্বরে বিশিষ্ট সাংবাদিক মার্টিন এ্যাডনী এবং ১৬ সেপ্টেম্বর বিশিষ্ট সাংবাদিক ও পাকিস্তানের নাগরিক ফরিদ জাফরী মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। ১৬ সেপ্টেম্বর বৃটিশ কমিউনিষ্ট পার্টির আঞ্চলিক শাখার উদ্যোগে “মিচামে” বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বৃটিশ কমিউনিষ্ট পার্টির স্থানীয় নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশের সংগ্রামকে সমর্থন করে বক্তব্য রাখেন। উক্ত জনসভায় আমন্ত্রণক্রমে কেন্দ্রীয় স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য শেখ আবদুল মান্নান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমি ব্যাখ্যা করে বক্তব্য রাখেন। ১৬ সেপ্টেম্বর বৃটেনের লিবারেল পার্টির সম্মেলন ইংল্যান্ডের স্কারবারা শহরে অনুষ্ঠিত হয়।
লিবারেল পার্টি ইতােমধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষ সমর্থনকারী দল হিসাবে পরিচিতি ছিল। বৃটিশ পার্লামেন্টে লেবার পার্টির এম, পি, দের সাথে লিবারেল পার্টির এম, পি, রা বাংলাদেশের পক্ষে ভূমিকা রেখে আসছে। সম্মেলনের প্রথম দিনে লিবারেল পার্টির এম. পি. জন পারডাে তার উত্থাপিত এক প্রস্তাবে ‘পূর্ববঙ্গ থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রত্যাহার ও অবিলম্বে শেখ মুজিবের মুক্তি দাবি করেন। এই দাবি আ” পাকিস্তান সরকার মেনে না নিলে বৃটিশ সরকারকে একটি কমনওয়েলথ সম্মেলন অ করে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি জানানাের জন্য বৃটিশ সরকারের কাছে তিনি প্রস্তাব পেশ কম” ১৮ সেপ্টেম্বর সম্মেলনের সমাপ্তি দিবসে পার্টি প্রধান জেরেমি থর্প তার বক্তব্যে বাংলা” আন্দোলনের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করেন এবং আন্দোলনকারীদের সার্বিক সহণে আশ্বাস প্রদান করেন। বাংলাদেশের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠা ? সরকারকে ভূমিকা গ্রহণের জন্যও তিনি আহ্বান জানান। আমাদের সার্বিক সহযােগিতার ১৮ সেপ্টেম্বর ইপসুইজে বৃটিশ স্থানীয় নাগরিক ও প্রবাসী বাঙালীদের এক যৌথ জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত জনসভায় স্থানীয় বৃটিশ সমাজকর্মী ও সিনিয়র নাগরিকরা বাংলাদেশের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়ে বক্তব্য রাখেন। স্থানীয় নেতবৃন্দ ছাড়াও বাঙালীদের পক্ষে বক্তব্য রাখেন ড. কবির চৌধুরী ও আবদুল হক। সভার শেষে সমবেত জনতা এক মিছিল সহকারে শহরের গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা প্রদক্ষিণ করে। এভাবে বিলাতের বিভিন্ন শহরে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকরা বৃটিশ জনগণকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি আকৃষ্ট করে এবং সমর্থন আদায় করার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে শুধুমাত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন হিসেবে বিদেশীদের কাছে মনে হলেও ধীরে ধীরে স্বাধীনতা যুদ্ধের গুরুত্ব ও তার যথার্থতা বৃটিশ জনগণকে আকৃষ্ট করতে সমর্থ হয়। বাংলাদেশ গণসংস্কৃতি সংসদ ১৮ ও ১৯ সেপ্টেম্বর (শনি ও রবিবার) লন্ডনের কনওয়ে হলে দুই দিনব্যাপী এক সম্মেলন এবং মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক নৃত্যনাট্য ও গীতি বিচিত্রার আয়ােজন করে। বিলাতে প্রবাসী বাঙালীদের মধ্যে দেশীয় সংস্কৃতির প্রচার ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে উপরােক্ত সাংস্কৃতিক সম্মেলন ও নৃত্যনাট্যের আয়ােজন করা হয়।
উক্ত সম্মেলন উদ্বোধন করেন বাংলাদেশ সরকারের বৈদেশিক প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। সম্মেলন গণসংস্কৃতি সংসদের সভাপতি ড. এনামুল হকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে সদ্য বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাগত বৃটিশ এম পি পিটার শাের বাংলাদেশের সর্বশেষ পরিস্থিতির উপর বক্তব্য রাখেন। বাঙালি নেতৃবৃন্দ ছাড়াও সিংহলের (বর্তমান শ্রীলংকা) বিরােধী দলীয় নেতা নওরতনও উক্ত সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন। উভয় দিনেই গণসংস্কৃতি সংসদের সভাপতি ড. এনামুল হকের রচিত মুক্তযুদ্ধ ভিত্তিক নৃত্যনাট্য অস্ত্র হাতে তুলে নাও” মঞ্চস্থ হয়। উক্ত নৃত্যনাট্যের মূল ভূমিকায় অংশ গ্রহণ করেন মিসেস মঞ্জু হাফিজ ও আবদুল রউফ প্রমুখ নৃত্য শিল্পীবৃন্দ। ২৩ সেপ্টেম্বর বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ১৬ সদস্য প্রতিনিধিদলের নেতা হিসাবে বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে কাজ করার জন্য লন্ডন থেকে নিউইয়র্ক গমন করেন। প্রতিনিধিদলের মধ্যে জাতীয় সংসদ সদস্য আবদুস সামাদ, মুস্তাফিজুর রহমান সিদ্দিকী (এম. আর. সিদ্দিকী), সৈয়দ আবদুস সুলতান, ড. মফিজ উদ্দিন, সেরাজুল হক, প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ডাঃ আসাবুল। হক, ফনি ভূষন মজুমদার, ফকির শাহাবুদ্দিন; ন্যাপ সভাপতি অধ্যাপক মােজাফফর আহম্মদ; আম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. আজিজুর রহমান মল্লিক; অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান। “শ কূটনীতিবিদ রাষ্ট্রদূত এ, এফ, এম, আবুল ফাত্তাহ, রাষ্ট্রদূত খুররম খান পন্নী, সৈয়দ মারুল করিম, এ, এম. এ. মুহিত এবং এ. এইচ, মাহমুদ আলী অন্তর্ভূক্ত ছিলেন। বদলের সদস্যগণ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ চলাকালে বিভিন্ন সময়ে লন্ডনে যাত্রা বিরতি করে নিউইয়র্ক গমন করেন। ২৬ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের ছয় মাস পূতি দিবস যথাযােগ্য গুরুত্বের সাথে বিলাতের বিভিন্ন সংগ্রাম পরিষদসমূহ পালন করে। এ উপলক্ষে কেন্দ্রীয় স্টিয়ারিং কমিটির সহযােগিতায় যুক্তরাজ্যস্থ বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ২৬ সেপ্টেম্বরে লন্ডনের হাইড wers স্পীকার্স কর্ণারে এক জনসভার আয়ােজন করে। উক্ত জনসভায় সভাপতিত্ব করেন জাত সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে অপর আহ্বায়ক মােহাম্মদ হােসেন মঞ্জু। সভায় বিভিন্ন সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দ ছাড়াও বক্তব্য রাখেন সদ্য বাংলাদেশ থেকে আগত বাংলাদেশ সরকারের ভ্রাম্যমাণ প্রতিনিধি সিলেট থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য আবদুস সামাদ, সংসদ সদস্য। সিরাজুল হক এবং সংসদ সদস্য ফণীভূষণ মজুমদার। প্রসংগত উল্লেখযােগ্য যে, উক্ত সংসদ সদস্যরা জাতিসংঘে লবিং করার জন্য নিউইয়র্ক গমনের পথে তখন লন্ডনে অবস্থান করছিলেন। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী জাতিসংঘে প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশে ইতােপূর্বে নিউইয়র্ক গমন করায় ছয় মাস পূর্তি অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারেননি।
মুক্তিযুদ্ধের ছয় মাস পূর্তি উপলক্ষে ২৬ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ একটি সমীক্ষা প্রকাশ করে। উক্ত সমীক্ষায় মুক্তিযুদ্ধের ছয় মাসের সাফল্য উল্লেখ করে মুক্তি অর্জনের আশাবাদ ব্যক্ত করে বলা হয় যে, “While the agonies and indignities of the people of Bangladesh may have already exceded those of vietnam, the war in Bangladesh may not last as long as the current phase of vietnam war. The patriotic and partisans of Bangladesh must therefore view the immediate future with considerable hope” এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধ পূর্তি উপলক্ষে লন্ডন থেকে প্রকাশিত বাংলা। সাপ্তাহিক ও মুক্তিযুদ্ধের মুখপত্র “সাপ্তাহিক জনমত” বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে। ২৭ সেপ্টেম্বর লন্ডনের রেড লায়ন স্কোয়ারে অবস্থিত ‘কনওয়ে হলে ‘ যুক্তরাজ্যস্থ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ মােজাফফর) এর উদ্যোগে ন্যাপ সভাপতি অধ্যাপক মােজাফফর আহম্মদকে সম্বর্ধনা প্রদানের জন্য এক সভার আয়ােজন করা হয়। অধ্যাপক মােজাফফর আহম্মদ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশ সরকারে প্রতিনিধিদলের। সদস্য হিসাবে যােগদানের জন্য নিউইয়র্কের পথে লন্ডনে যাত্রা বিরতি করেন। খায়রুল হুদার সভাপতিত্বে এই সভায় বক্তব্য রাখেন ডাঃ নুরুল আলম, মাহমুদ এ. রউফ, ডাঃ মনজুর আহম্মদ ও কায়সারুল ইসলাম প্রমুখ ন্যাপ নেতৃবৃন্দ। অধ্যাপক মােজাফফর আহম্মদ সভা বলেন, বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে নেতৃবৃন্দের মধ্যে কোন মত বিরােধ বা বিভেদ নাহ। তিনি বিভিন্ন অপপ্রচারকে নাকচ করে দিয়ে বলেন, সকল প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলো যেথভাবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করছে। মুক্তিবাহিনীতে বামপন্থী বা বিশেষ কোন দলে সমর্থকদের অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে না বলে যে অপপ্রচার করা হচ্ছে তাও সঠিক নয় বলে মন্তব্য করেন। ৩০ সেপ্টেম্বর ওয়েলস্ এর কার্ডিফ শহরে ‘টেম্পল অফ পীস’ এ ইংরেজ সমর্থকদের একটি প্রতিষ্ঠান “এইড টু বাংলাদেশ” এর উদ্যোগে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় প্রধান বক্তা আলফ্রেড ইভানুস এম, পি, তার বক্তব্যে শীঘ্র বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। বাংলাদেশে গণহত্যা পরিচালনার জন্য ইয়াহিয়া খানের বিচার দাবি করে বৃটিশ পার্লামেন্টে তিনি প্রস্তাব উত্থাপন করবেন বলে উপস্থিত সবাইকে আশ্বাস প্রদান করেন। সভায় কনজারভেটিভ পাটির এম, পি, মাইকেল রবার্ট বাংলাদেশের মানুষের জন্য সাহায্যের হাত বাড়ানাের জন্য ওয়েল্স বাসীকে আহ্বান জানান। সভায় আরাে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ দূতাবাসের মহিউদ্দিন জায়গীরদার, এবং ‘বাংলাদেশ নিউজ লেটার’ এর সম্পাদক ফরিদ জাফরী। সভায় লেবার পার্টি, কমিউনিষ্ট পার্টি, ওয়েল্স ন্যাশনালিষ্ট পার্টি, ওয়েল্স ইয়ং কনজারভেটিভ পার্টির নেতা ও কর্মীবৃন্দ যােগদান করেন।
অক্টোবর মাসের তৎপরতা
অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে লন্ডনস্থ পাকিস্তান দূতাবাস থেকে আর একটি উল্লেখযােগ্য পক্ষত্যাগ (defection)-এর ঘটনা ঘটে। লন্ডনস্থ পাকিস্তান দূতাবাসের কাউন্সিলর বাঙালি কূটনীতিবিদ রেজাউল করিম ৭ অক্টোবর তারিখে পাকিস্তান সরকারের সাথে সকল প্রকার সম্পর্ক ছিন্ন করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। তি বিবৃতিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে বিশ্বের সকর শান্তিপ্রিয় গণতানিত সরকার ও জনগণকে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি ও সমর্থনের আবেদন জানান। রেজাউল করিম। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করার প্রত্যয় ঘােষণা করেন এবং লন্ডনস্থ বাংলাদেশ মিশনে যােগদান করেন। একই দিনে (৭ অক্টোবর, ১৯৭১ ইং) পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর একমাত্র পুত্র রাশেদ সােহরাওয়ার্দী লন্ডনে এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের আশাবাদ ব্যক্ত করেন। ইতােপূর্বে পাকিস্তান সরকারের অপপ্রচারের অংশ হিসেবে, শহীদ সােহরাওয়ার্দীর এক নিকট বংশধরকে দিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এক বিবৃতি প্রদান করা হয়েছিল। রাশেদ সােহরাওয়ার্দী তার বক্তব্যে তাদের পরিবারের অন্য এক সদস্যের বক্তব্যকে তার পিতা হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর ভাবমূর্তি নষ্ট করার প্রচেষ্টা বলে আখ্যায়িত করে বলেন যে তার পিতার আদর্শের পথ ধরে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলছে। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন যে, “I have no doubt in my mind that the brave freedom fighters will succeed in achieving full Independence by ejecting the invading army.” রাশেদ সােহরাওয়ার্দীর বিবৃতিটি বাংলাদেশ মিশনের প্রেস এবং পাবলিসিটি ডিভিশন থেকেও প্রচার করা হয়। অক্টোবর মাসের প্রথম দিকে বৃটিশ লেবার পাটির বাৎসরিক সম্মেলন ব্রাইটনে অনুষ্ঠিত হয়। পার্লামেন্টের অভ্যন্তরে এবং বাইরে লেবার পাটি ইতােপূর্বে বাংলাদেশের পক্ষে জোরালাে সমর্থন করে আসছে। এই দলের এমিপ পিটার শাের, জন ষ্টোনহাউজ, ব্রুস ডগলাস ম্যান, ইয়ান মিকার্ডোসহ বহু পার্লামেন্ট সদস বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করে আসছিলেন। লেবার পার্টির সকল সদস্যকে বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল ও সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে বাংলাদেশ আন্দোলনের পশ থেকে লেবার পাটি সম্মেলনে প্রচারকার্য পরিচালনার জন্য স্টিয়ারিং কমিটির আহ্বায়” আজিজুল হক ভুইয়ার নেতৃত্বে এক প্রতিনিধি দল ব্রাইটনে গমন করে ।
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রতিনিধি দল সম্মেলনের উপস্থিত নেতৃবৃন্দের মধ্যে লাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে প্রকাশিত বিভিন্ন পুস্তিকা ও প্রচারপত্র বিলি করেন এবং মালনের বাইরে একটি সভার আয়ােজন করেন। সম্মেলনে পাকিস্তান’ ইস্যু আলােচনার জন্য স্থান লাভ করে এবং বাংলাদেশের মুক্তিকামী জনগণের পক্ষে ইতিবাচক প্রস্তাবাবলী গহীত হয়। ইতােপূর্বে বৃটিশ লেবার পাটির ন্যাশনাল এক্সিকিউটিভ কমিটি (NEC)-এ গৃহীত ৮ জুন, ১৯৭১ ইং তারিখের প্রস্তাব অনুমােদন ও আলােচনার জন্য সম্মেলনে পেশ করা হয় । সম্মেলনে বিভিন্ন বক্তা ‘পাকিস্তান সংকটের পটভূমি, বাংলাদেশে গণহত্যা এবং বাংলাদেশের জনগণের দুর্দশার বিস্তারিত বিবরণ প্রদান করেন। বক্তারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং ‘পাকিস্তান সংকটের একটি রাজনৈতিক সমাধানের প্রতি গুরুত্ব প্রদান করেন এবং এই সংকট সৃষ্টির জন্য পাকিস্তানকে সম্পূর্ণভাবে দায়ী করেন। সম্মেলনে সর্বসম্মত এক প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্রস্তাবের এক অংশে বলা হয় যে, “Conference expresses its horror and concern at the terrible human tragedy now taking place in Bengal. It belives that the Pakistan Government must take full responsibility for the terrible suffering endured by the people of East Bengal and conference condemns the Government of Pakistan for its total unjustified use of Military force against the people and democratically elected leaders of East Bengal.” | ব্রাইটনে অনুষ্ঠিত লেবার পার্টি সম্মেলনের প্রস্তাবে শরণার্থী সমস্যা, পাকিস্তানের সাহায্য প্রদান বন্ধ রাখাসহ রাজনৈতিক সমাধানের বিষয়সমূহ স্থান পায়। পাকিস্তানকে সাহায্য প্রদান সংক্রান্ত প্রস্তাবে বলা হয় যে, “Without a satisfactory political solution, long term aid to Pakistan would mean sudsidising a discredited military regime. Conference, therefore, urges all countries and in particular the members of the Pakistan Aid Consortium to wtihhold all but urgent humanitarian aid until a satisfactory political solution has been agreed to by the people of East | Bengal” এছাড়া পাকিস্তান সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের পূর্বশর্ত হিসেবে পূর্ববঙ্গ থেকে সামরিক বাহিনী প্রত্যাহার ও শেখ মুজিবর রহমানসহ বাঙালি নেতাদের মুক্তিদানকে উল্লেখ করে প্রস্তাবে বলা হয় যে, বিশ্বশান্তি রক্ষার খাতিরে পাকিস্তান সংকটের রাজনৈতিক সমাধান হওয়া বাঞ্ছনীয়।
১০ অক্টোবর লন্ডনের এক হােটেলের হলরুমে যুক্তরাজ্যস্থ আওয়ামী লীগের উদ্যোগে। এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন আবদুল মান্নান এবং প্রধান অতিথি ২সাবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ সরকারের রাজনৈতিক উপদেষ্টা আবদুস সামাদ এম. এন. অ.। তিনি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে যােগ দিয়ে প্রত্যাবর্তনের পথে লন্ডনে যাত্রা বিরতি করেন। সমাবেশে যুক্তরাজ্যস্থ আওয়ামী লীগের সভাপতি গউস খান মানপত্র পাঠ করে সমাবেশে বক্তব্য রাখেন বৃটিশ এম, পি, পিটার শশার, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পা তৈয়বুর রহমান ও সিরাজুল হক প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। প্রধান অতিথির ভাষণে আবদুস সামাদ জাতিসংঘে বিশ্বনেতাদের সাথে মতবিনিময় করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বাস্তবতাকে তলে ধরার বিষয়ে সমাবেশকে অবহিত করেন। ১২ অক্টোবর বৃটেনের লিবারেল পার্টির যন সংগঠন “ইয়ং লিবারেল্স” বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর কাছে একপত্রে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি। জানানাের জন্য দাবি করেন। অক্টোবর মাসে সরকার দলীয় বৃটিশ কনজারভেটিভ পার্টির সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। কনজারভেটিভ পার্টিরও মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকের রক্ষণশীল মনােবৃত্তি পরিবর্তন করে পরবর্তীকালে বাংলাদেশের ইস্যুর প্রতি বেশ সহানুভূতিশীল মনােবৃত্তি গ্রহণ করে। তাই লেবার পার্টি সম্মেলনের অনুরূপ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে প্রচার কার্য পরিচালনার জন্য ষ্টিয়ারিং কমিটির পক্ষ থেকে জাকারিয়া চৌধুরী ও সুরাইয়া খানম, ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের শামসুদ্দিন চৌধুরী (মানিক) ও আবদুল হাই এবং বার্মিংহাম সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে জগলুল পাশা, জহুর আলী ও ইসমাইল আজাদ সমন্বয়ে একটি প্রতিনিধি দল কনজারভেটিভ সম্মেলনে। প্রেরণ করা হয়। প্রতিনিধি দল সম্মেলনে যােগদানকারী ডেলিগেট ও নেতৃবৃন্দের মধ্যে বিভিন্ন পুস্তিকা ও প্রচারপত্র বিলি করেন। অক্টোবর মাসের গােড়ার দিকে ইউনাইটেড এ্যাকশনবাংলাদেশ’ (United Action Bangladesh) নামে একটি সংগঠন বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্যে সাহায্য সংগ্রহের জন্য একটি রিলিফ ফান্ড প্রতিষ্ঠা করে। ১২ অক্টোবর ইউনাইটেড এ্যাকশন-বাংলাদেশ’ এর বিজ্ঞপ্তিতে একটি আবেদন প্রচার করা হয়। আবেদনপত্রে বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরগুলাের করুণ কাহিনী ও বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত বিবরণ তুলে ধরে তাদের রক্ষার জন্য সকল বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও প্রতিষ্ঠানে রিলিফ ফান্ড প্রতিষ্ঠা করে সাহায্য সংগ্রহের জন্য আহবান জানান হয়।
এই ফান্ড পরিচালনার জন্য স্টেপনির বিশপ রেভারেন্ড ট্রেভার হাডলস্টন, লেডী গিফোর্ড, বৃটিশ এমপি রিচার্ড ক্রসম্যান এবং এসআই আজিজকে নিয়ে একটি ট্রাষ্ট বাের্ড গঠন করা হয় এবং ন্যাশনাল ওয়েষ্ট মিনিষ্টার ব্যাকের ৪৩ নং কিংগসওয়ে শাখায় (AC. No-01533118) একাট একাউন্ট খােলা হয়। ইতােপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী অন্যতম দল বিলাতের আওয়ামী লীগের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব ও মতানৈক্যের ফলে বিলাতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দলের প্রাধান্য ছিল সামান্য। এ অবস্থা নিরসনের জন্য সফরত বাংলাদেশ সরকারের তৎকালীন রাজনৈতিক উপদেষ্টা ও ভ্ৰমামাণ দূত এবং সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল সামাদ (এম, এন, এ) এ মাসে পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। মুজিবনগর সরকারের যে সকল নেতা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচারকার্য পরিচালনার জন্য এ পর্যন্ত বিলাত ভ্রমণ করেছেন তা প্রত্যেকেই আওয়ামী লীগের এ দুর্বলতাকে লক্ষ্য করেছেন এবং তার অবসানে আছেন। বিলাতের আওয়ামী লীগের মধ্যে যে তিনটি বিবদমান গ্রুপের অস্তিত্ব ছিল তার। তিটির নেতৃত্বে ছিলেন সিলেট থেকে আগত নেতা গউস খান, মিনজাহ উদ্দিন ও বি, এইচ তালুকদার। আবদুস সামাদ সিলেটের অধিবাসী হওয়ায় বিলাতের আওয়ামী লীগকে ঐক্যবদ্ধ করার দায়িত্ব তার উপর প্রদান করা হয়। প্রথমিক পদক্ষেপ হিসাবে তিনি সকল গ্রুপকে একত্রিত করে লন্ডনের একটি অস্থায়ী কমিটি গঠনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এতদউদ্দেশ্যে ১৩ অক্টোবর সকল গ্রুপের নেতা ও কর্মী সমন্বয়ে এক কর্মী সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন আবদুস সামাদ (এম, এন, এ)। তিনি লন্ডন আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ করার উপর গুরুত্ব আরােপ করে বক্তব্য রাখেন। উক্ত কর্মী সমাবেশে সকলের পরামর্শ মােতাবেক নিম্নরূপভাবে একটি অস্থায়ী লন্ডন কমিটি গঠন করা হয়। সভাপতি আলহাজ্ব আব্দুল মান্নান, সহ-সভাপতি মিনহাজ উদ্দিন আহমেদ, ইসমাইল মিয়া, মােহাম্মদ ইসহাক, সাধারণ সম্পাদক মােহাম্মদ আবুল বশর, সাংগঠনিক সম্পাদক সুলতান মাহমুদ।
শরিফ, জনসংযােগ সম্পাদক জিলুল হক, সামাজিক সম্পাদক মিম্বর আলী, শ্রম সম্পাদক শাহ সিরাজুল হক, বহিরাগত সম্পর্কিত সম্পাদক আবদুর রকীব, মহিলা সম্পাদক হেলেন তালুকদার, দফতর সম্পাদক এম এ হাকিম, কোষাধ্যক্ষ-মজির উদ্দিন, কার্যকরী কমিটির সদস্যদের মধ্যে গউস খান, বিএইচ তালুকদার, শামসুর রহমান, তৈয়বুর রহমান, মােহাম্মদ একরাম হােসেন এবং মঈন উদ্দিনের নাম উল্লেখযােগ্য। বিলাতের বিবদমান তিনটি গ্রুপের লন্ডনে অবস্থানরত প্রভাবশালী নেতাদের সকলকেই উক্ত কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হলেও পূর্ববর্তী কমিটিসমূহ (যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ, ওভারসীজ আওয়ামী লীগ ও লন্ডন আওয়ামী লীগ) সম্পূর্ণবাবে নিষ্ক্রিয় করা সম্ভব হয়নি। অতএব আবদুস সামাদের একত্রিকরণের পদক্ষেপ গ্রহণ সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের মধ্যে প্রকৃত ঐক্য স্থাপিত হয়নি। | বিলাতের বিভিন্ন শহরের বাঙালীদেরকে মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করা এবং প্রেরণা সৃষ্টির লক্ষ্যে বাংলাদেশ গণসংস্কৃতি সংসদ কর্তৃক প্রযােজিত স্বাধীনতা সংগ্রামের বিপ্লবী আলেখ্য “অস্ত্র হাতে তুলে নাও” নৃত্যনাট্য ও দেশাত্মবােধক সঙ্গীত পরিবেশনার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। ১৬ অক্টোবরে এমনি একটি অনুষ্ঠান ল্যাংকাশায়ার ও পার্শ্ববর্তী এলাকার বাংলাদেশ এসােসিয়েশন ম্যাঞ্চেস্টারের ফ্রি ট্রেড হলে আয়ােজন করে। বাংলাদেশ গণসংস্কৃতি সংসদের শিল্পীবৃন্দ উক্ত “নুষ্ঠান পরিবেশনা করেন এবং নৃত্য নাট্যের মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে প্রবাসীদের মনে মূর্ত করে তােলেন। ১৭ অক্টোবর গ্রেটবৃটেনস্থ মহিলা সমিতির উদ্যোগে ২১ নং পেমব্রীজ গার্ডেন্সে “লশে শান্তি প্রতিষ্ঠা, মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের রুহের মাগফেরাত এবং দখলদার বাহিনীর বাংলাদেশের মুক্তির জন্য এক মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। মিলাদ মাহফিলে সভানেত্রী জেবুন্নেছা বখত, সাধারণ সম্পাদিকা আনােয়ারা জাহান, মুন্নী শাহজাহান, জেবুন্নেছা খায়ের সহ মহিলা সমিতির নেতৃবৃন্দ ও কর্মী বােনেরা উপস্থিত ছিলেন । দিনে (১৭ অক্টোবর) ওয়েল্স এর পেনাৰ্থ শহরে—“গ্লোবাল এন্ড সােসাল ইস্যজ” এ উদ্যোগে বাংলাদেশে বিরাজমান পরিস্থিতির উপর এক আলােচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন গ্রুপের নেতা মি, গ্রিফিথুস। ২৪ অক্টোবর লন্ডনে ১৭টি সংগ্রাম পরিষদ, প্রতিনিধি সভায় বৃহত্তর লন্ডন এলাকার কার্যক্রমকে সমন্বয় করার লক্ষে “ইউনাইটে। বাংলাদেশ এ্যাকশন কমিটি গঠন করা হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন আবদুস সামাদ .. সভায় সর্বসম্মত প্রস্তাবে আহম্মদ হােসেন জোয়ারদারকে আহ্বায়ক করে একটি কমিটি গঠন। করা হয়।
এই সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা লাভের ছয় সপ্তাহের মধ্যে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যাওয়ায় এই সংগঠনের তেমন কোন কর্মকান্ড পরিচালনার সুযােগ হয় নি। অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী বিলাতে সফরে যান। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ও তার প্রেক্ষিতে উদ্ভুত শরণার্থী পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের সাথে আলােচনা কার্যক্রমের অংশ হিসাবে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর এ সফর প্রবাসীদের কাছে। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। মিসেস ইন্দিরা গান্ধী লন্ডন অবস্থানকালে বাংলাদেশের প্রবাসীদের দেশের জন্য উৎকণ্ঠা ও স্বাধীনতার জন্য দৃঢ়তা প্রকাশের উদ্দেশ্যে বিলাতের বিভিন্ন সগ্রাম কমিটিসমূহ কার্যক্রম গ্রহণ করে। ২৯ অক্টোবরে স্টিয়ারিং কমিটির পক্ষ থেকে এক প্রতিনিধি দল মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর সাথে দেখা করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তার সাহায্য ও সমর্থনের জন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন এবং একটি পত্র হস্তান্তর করেন। উক্ত পত্রে। বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ না করা পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যাও্যার প্রত্যয় ঘােষণা করে বলা হয় যে, “We do fervently hope that as Prime Minister of the Country closest to our land, you will be pleased to take a forthright step and your Government will immediately recognise the government of the People’s Republic of Bangladesh.” লন্ডনে মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর সফর উপলক্ষে তার লন্ডন অবস্থানকালে ৩০ অক্টোবরে ষ্টিয়ারিং কমিটির উদ্যোগে বাংলাদেশের স্বীকৃতির দাবিতে হাইড-পার্ক স্পীকার্স কর্ণারে এক বিরাট সমাবেশ ও গণমিছিলের আয়ােজন করা হয়। উক্ত সভায় সভাপতিত্ব করেন স্টিয়ারিং কমিটির আহ্বায়ক আজিজুল হক ভূঞা এবং প্রধান বক্তা হিসাবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি ও ষ্টিয়ারিং কমিটির উপদেষ্টা বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। সমাবেশে বক্তব্য রাখেন আঞ্চলিক কমিটির পক্ষ থেকে গউস খান (লন্ডন), কবির চৌধুরী। (ইয়র্কশায়ার), আবদুল মতিন (ম্যানচেষ্টার), জগলুল পাশা (বার্মিংহাম) এবং বি এ তালকুদার, রাষ্ট্রদূত এ মােমেন, ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী, মিসেস জেবুন্নেছা বল বাংলাদেশ মিশনের পক্ষ থেকে রেজাউল করিমসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ বক্তাগণ বাংলা মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সরকার ও জনগণের সমর্থন এবং উদ্বাস্তুদের প্রতি সহানুভূতির ও ভারতের প্রধানমনন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীকে ধন্যবাদ জানিয়ে বাংলাদেশ সরকারকে যথাশ্রীঘ্র একতি দানের জন্য আহ্বান জানান। সমাবেশ শেষে এক বিরাট গণমিছিল হাইড-পার্ক স্পীকার্স কর্ণার থেকে শুরু করে ফ্রক টিস্থ ক্লারিজেস হােটেলের সম্মুখ দিয়ে হ্যানােভার স্কোয়ারে গিয়ে সমাপ্ত হয়।
প্রসঙ্গত উলেখযােগ্য যে, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী লন্ডনে সফরকালে ক্লারিজেস হােটেলে অবস্থান করছিলেন। একই দিনে (৩০ অক্টোবর) ক্লাপহামের হেনরি থরনটন স্কুলে বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে বৃটেনে বসবাসকারী বাঙালি ছাত্রদের এক কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়। সকাল ১০টায় এই ছাত্র সম্মেলনের উদ্বোধন করেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। সম্মেলনের বিস্তারিত বিবরণ অধ্যায় একত্রিশ তে আলােচনা করা হয়েছে। প্রবাসী সংগ্রাম পরিষদসমূহ ছাড়াও আরাে দু’টি আন্তর্জাতিক সংগঠন অক্টোবর মাসে লন্ডনে বাংলাদেশের পক্ষে কর্মকান্ড শুরু করে। তার মধ্যে সর্বদলীয় পালামেন্টারী সদস্যদের সমন্বয়ে “Justice for East Bengal” নামে একটি সংগঠন এবং সচেতন নাগরিকদের সমন্বয়ে “Bangladesh Freedom Movement Overseas” নামে অপর একটি সংগঠন আত্মপ্রকাশ করে। শেষােক্ত কমিটির নেতৃত্ব প্রদান করেন মেথােডিটি চার্চের রেভারেণ্ড ডেভিড মেসন।
অক্টোবর মাসের তৎপরতা
অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে লন্ডনস্থ পাকিস্তান দূতাবাস থেকে আর একটি উল্লেখযােগ্য পক্ষত্যাগ (defection)-এর ঘটনা ঘটে। লন্ডনস্থ পাকিস্তান দূতাবাসের কাউন্সিলর বাঙালি কূটনীতিবিদ রেজাউল করিম ৭ অক্টোবর তারিখে পাকিস্তান সরকারের সাথে সকল প্রকার সম্পর্ক ছিন্ন করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। তি বিবৃতিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে বিশ্বের সকর শান্তিপ্রিয় গণতানিত সরকার ও জনগণকে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি ও সমর্থনের আবেদন জানান। রেজাউল করিম। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করার প্রত্যয় ঘােষণা করেন এবং লন্ডনস্থ বাংলাদেশ মিশনে যােগদান করেন। একই দিনে (৭ অক্টোবর, ১৯৭১ ইং) পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর একমাত্র পুত্র রাশেদ সােহরাওয়ার্দী লন্ডনে এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের আশাবাদ ব্যক্ত করেন। ইতােপূর্বে পাকিস্তান সরকারের অপপ্রচারের অংশ হিসেবে, শহীদ সােহরাওয়ার্দীর এক নিকট বংশধরকে দিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এক বিবৃতি প্রদান করা হয়েছিল। রাশেদ সােহরাওয়ার্দী তার বক্তব্যে তাদের পরিবারের অন্য এক সদস্যের বক্তব্যকে তার পিতা হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর ভাবমূর্তি নষ্ট করার প্রচেষ্টা বলে আখ্যায়িত করে বলেন যে তার পিতার আদর্শের পথ ধরে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলছে। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন যে, “I have no doubt in my mind that the brave freedom fighters will succeed in achieving full Independence by ejecting the invading army.” রাশেদ সােহরাওয়ার্দীর বিবৃতিটি বাংলাদেশ মিশনের প্রেস এবং পাবলিসিটি ডিভিশন থেকেও প্রচার করা হয়। অক্টোবর মাসের প্রথম দিকে বৃটিশ লেবার পাটির বাৎসরিক সম্মেলন ব্রাইটনে অনুষ্ঠিত হয়। পার্লামেন্টের অভ্যন্তরে এবং বাইরে লেবার পাটি ইতােপূর্বে বাংলাদেশের পক্ষে জোরালাে সমর্থন করে আসছে। এই দলের এমিপ পিটার শাের, জন ষ্টোনহাউজ, ব্রুস ডগলাস ম্যান, ইয়ান মিকার্ডোসহ বহু পার্লামেন্ট সদস বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করে আসছিলেন। লেবার পার্টির সকল সদস্যকে বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল ও সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে বাংলাদেশ আন্দোলনের পশ থেকে লেবার পাটি সম্মেলনে প্রচারকার্য পরিচালনার জন্য স্টিয়ারিং কমিটির আহ্বায়” আজিজুল হক ভুইয়ার নেতৃত্বে এক প্রতিনিধি দল ব্রাইটনে গমন করে ।
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রতিনিধি দল সম্মেলনের উপস্থিত নেতৃবৃন্দের মধ্যে লাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে প্রকাশিত বিভিন্ন পুস্তিকা ও প্রচারপত্র বিলি করেন এবং মালনের বাইরে একটি সভার আয়ােজন করেন। সম্মেলনে পাকিস্তান’ ইস্যু আলােচনার জন্য স্থান লাভ করে এবং বাংলাদেশের মুক্তিকামী জনগণের পক্ষে ইতিবাচক প্রস্তাবাবলী গহীত হয়। ইতােপূর্বে বৃটিশ লেবার পাটির ন্যাশনাল এক্সিকিউটিভ কমিটি (NEC)-এ গৃহীত ৮ জুন, ১৯৭১ ইং তারিখের প্রস্তাব অনুমােদন ও আলােচনার জন্য সম্মেলনে পেশ করা হয় । সম্মেলনে বিভিন্ন বক্তা ‘পাকিস্তান সংকটের পটভূমি, বাংলাদেশে গণহত্যা এবং বাংলাদেশের জনগণের দুর্দশার বিস্তারিত বিবরণ প্রদান করেন। বক্তারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং ‘পাকিস্তান সংকটের একটি রাজনৈতিক সমাধানের প্রতি গুরুত্ব প্রদান করেন এবং এই সংকট সৃষ্টির জন্য পাকিস্তানকে সম্পূর্ণভাবে দায়ী করেন। সম্মেলনে সর্বসম্মত এক প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্রস্তাবের এক অংশে বলা হয় যে, “Conference expresses its horror and concern at the terrible human tragedy now taking place in Bengal. It belives that the Pakistan Government must take full responsibility for the terrible suffering endured by the people of East Bengal and conference condemns the Government of Pakistan for its total unjustified use of Military force against the people and democratically elected leaders of East Bengal.” | ব্রাইটনে অনুষ্ঠিত লেবার পার্টি সম্মেলনের প্রস্তাবে শরণার্থী সমস্যা, পাকিস্তানের সাহায্য প্রদান বন্ধ রাখাসহ রাজনৈতিক সমাধানের বিষয়সমূহ স্থান পায়। পাকিস্তানকে সাহায্য প্রদান সংক্রান্ত প্রস্তাবে বলা হয় যে, “Without a satisfactory political solution, long term aid to Pakistan would mean sudsidising a discredited military regime. Conference, therefore, urges all countries and in particular the members of the Pakistan Aid Consortium to wtihhold all but urgent humanitarian aid until a satisfactory political solution has been agreed to by the people of East | Bengal” এছাড়া পাকিস্তান সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের পূর্বশর্ত হিসেবে পূর্ববঙ্গ থেকে সামরিক বাহিনী প্রত্যাহার ও শেখ মুজিবর রহমানসহ বাঙালি নেতাদের মুক্তিদানকে উল্লেখ করে প্রস্তাবে বলা হয় যে, বিশ্বশান্তি রক্ষার খাতিরে পাকিস্তান সংকটের রাজনৈতিক সমাধান হওয়া বাঞ্ছনীয়।
১০ অক্টোবর লন্ডনের এক হােটেলের হলরুমে যুক্তরাজ্যস্থ আওয়ামী লীগের উদ্যোগে। এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন আবদুল মান্নান এবং প্রধান অতিথি ২সাবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ সরকারের রাজনৈতিক উপদেষ্টা আবদুস সামাদ এম. এন. অ.। তিনি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে যােগ দিয়ে প্রত্যাবর্তনের পথে লন্ডনে যাত্রা বিরতি করেন। সমাবেশে যুক্তরাজ্যস্থ আওয়ামী লীগের সভাপতি গউস খান মানপত্র পাঠ করে সমাবেশে বক্তব্য রাখেন বৃটিশ এম, পি, পিটার শশার, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পা তৈয়বুর রহমান ও সিরাজুল হক প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। প্রধান অতিথির ভাষণে আবদুস সামাদ জাতিসংঘে বিশ্বনেতাদের সাথে মতবিনিময় করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বাস্তবতাকে তলে ধরার বিষয়ে সমাবেশকে অবহিত করেন। ১২ অক্টোবর বৃটেনের লিবারেল পার্টির যন সংগঠন “ইয়ং লিবারেল্স” বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর কাছে একপত্রে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি। জানানাের জন্য দাবি করেন। অক্টোবর মাসে সরকার দলীয় বৃটিশ কনজারভেটিভ পার্টির সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। কনজারভেটিভ পার্টিরও মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকের রক্ষণশীল মনােবৃত্তি পরিবর্তন করে পরবর্তীকালে বাংলাদেশের ইস্যুর প্রতি বেশ সহানুভূতিশীল মনােবৃত্তি গ্রহণ করে। তাই লেবার পার্টি সম্মেলনের অনুরূপ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে প্রচার কার্য পরিচালনার জন্য ষ্টিয়ারিং কমিটির পক্ষ থেকে জাকারিয়া চৌধুরী ও সুরাইয়া খানম, ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের শামসুদ্দিন চৌধুরী (মানিক) ও আবদুল হাই এবং বার্মিংহাম সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে জগলুল পাশা, জহুর আলী ও ইসমাইল আজাদ সমন্বয়ে একটি প্রতিনিধি দল কনজারভেটিভ সম্মেলনে। প্রেরণ করা হয়। প্রতিনিধি দল সম্মেলনে যােগদানকারী ডেলিগেট ও নেতৃবৃন্দের মধ্যে বিভিন্ন পুস্তিকা ও প্রচারপত্র বিলি করেন। অক্টোবর মাসের গােড়ার দিকে ইউনাইটেড এ্যাকশনবাংলাদেশ’ (United Action Bangladesh) নামে একটি সংগঠন বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্যে সাহায্য সংগ্রহের জন্য একটি রিলিফ ফান্ড প্রতিষ্ঠা করে। ১২ অক্টোবর ইউনাইটেড এ্যাকশন-বাংলাদেশ’ এর বিজ্ঞপ্তিতে একটি আবেদন প্রচার করা হয়। আবেদনপত্রে বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরগুলাের করুণ কাহিনী ও বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত বিবরণ তুলে ধরে তাদের রক্ষার জন্য সকল বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও প্রতিষ্ঠানে রিলিফ ফান্ড প্রতিষ্ঠা করে সাহায্য সংগ্রহের জন্য আহবান জানান হয়।
এই ফান্ড পরিচালনার জন্য স্টেপনির বিশপ রেভারেন্ড ট্রেভার হাডলস্টন, লেডী গিফোর্ড, বৃটিশ এমপি রিচার্ড ক্রসম্যান এবং এসআই আজিজকে নিয়ে একটি ট্রাষ্ট বাের্ড গঠন করা হয় এবং ন্যাশনাল ওয়েষ্ট মিনিষ্টার ব্যাকের ৪৩ নং কিংগসওয়ে শাখায় (AC. No-01533118) একাট একাউন্ট খােলা হয়। ইতােপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী অন্যতম দল বিলাতের আওয়ামী লীগের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব ও মতানৈক্যের ফলে বিলাতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দলের প্রাধান্য ছিল সামান্য। এ অবস্থা নিরসনের জন্য সফরত বাংলাদেশ সরকারের তৎকালীন রাজনৈতিক উপদেষ্টা ও ভ্ৰমামাণ দূত এবং সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল সামাদ (এম, এন, এ) এ মাসে পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। মুজিবনগর সরকারের যে সকল নেতা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচারকার্য পরিচালনার জন্য এ পর্যন্ত বিলাত ভ্রমণ করেছেন তা প্রত্যেকেই আওয়ামী লীগের এ দুর্বলতাকে লক্ষ্য করেছেন এবং তার অবসানে আছেন। বিলাতের আওয়ামী লীগের মধ্যে যে তিনটি বিবদমান গ্রুপের অস্তিত্ব ছিল তার। তিটির নেতৃত্বে ছিলেন সিলেট থেকে আগত নেতা গউস খান, মিনজাহ উদ্দিন ও বি, এইচ তালুকদার। আবদুস সামাদ সিলেটের অধিবাসী হওয়ায় বিলাতের আওয়ামী লীগকে ঐক্যবদ্ধ করার দায়িত্ব তার উপর প্রদান করা হয়। প্রথমিক পদক্ষেপ হিসাবে তিনি সকল গ্রুপকে একত্রিত করে লন্ডনের একটি অস্থায়ী কমিটি গঠনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এতদউদ্দেশ্যে ১৩ অক্টোবর সকল গ্রুপের নেতা ও কর্মী সমন্বয়ে এক কর্মী সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন আবদুস সামাদ (এম, এন, এ)। তিনি লন্ডন আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ করার উপর গুরুত্ব আরােপ করে বক্তব্য রাখেন। উক্ত কর্মী সমাবেশে সকলের পরামর্শ মােতাবেক নিম্নরূপভাবে একটি অস্থায়ী লন্ডন কমিটি গঠন করা হয়। সভাপতি আলহাজ্ব আব্দুল মান্নান, সহ-সভাপতি মিনহাজ উদ্দিন আহমেদ, ইসমাইল মিয়া, মােহাম্মদ ইসহাক, সাধারণ সম্পাদক মােহাম্মদ আবুল বশর, সাংগঠনিক সম্পাদক সুলতান মাহমুদ।
শরিফ, জনসংযােগ সম্পাদক জিলুল হক, সামাজিক সম্পাদক মিম্বর আলী, শ্রম সম্পাদক শাহ সিরাজুল হক, বহিরাগত সম্পর্কিত সম্পাদক আবদুর রকীব, মহিলা সম্পাদক হেলেন তালুকদার, দফতর সম্পাদক এম এ হাকিম, কোষাধ্যক্ষ-মজির উদ্দিন, কার্যকরী কমিটির সদস্যদের মধ্যে গউস খান, বিএইচ তালুকদার, শামসুর রহমান, তৈয়বুর রহমান, মােহাম্মদ একরাম হােসেন এবং মঈন উদ্দিনের নাম উল্লেখযােগ্য। বিলাতের বিবদমান তিনটি গ্রুপের লন্ডনে অবস্থানরত প্রভাবশালী নেতাদের সকলকেই উক্ত কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হলেও পূর্ববর্তী কমিটিসমূহ (যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ, ওভারসীজ আওয়ামী লীগ ও লন্ডন আওয়ামী লীগ) সম্পূর্ণবাবে নিষ্ক্রিয় করা সম্ভব হয়নি। অতএব আবদুস সামাদের একত্রিকরণের পদক্ষেপ গ্রহণ সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের মধ্যে প্রকৃত ঐক্য স্থাপিত হয়নি। | বিলাতের বিভিন্ন শহরের বাঙালীদেরকে মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করা এবং প্রেরণা সৃষ্টির লক্ষ্যে বাংলাদেশ গণসংস্কৃতি সংসদ কর্তৃক প্রযােজিত স্বাধীনতা সংগ্রামের বিপ্লবী আলেখ্য “অস্ত্র হাতে তুলে নাও” নৃত্যনাট্য ও দেশাত্মবােধক সঙ্গীত পরিবেশনার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। ১৬ অক্টোবরে এমনি একটি অনুষ্ঠান ল্যাংকাশায়ার ও পার্শ্ববর্তী এলাকার বাংলাদেশ এসােসিয়েশন ম্যাঞ্চেস্টারের ফ্রি ট্রেড হলে আয়ােজন করে। বাংলাদেশ গণসংস্কৃতি সংসদের শিল্পীবৃন্দ উক্ত “নুষ্ঠান পরিবেশনা করেন এবং নৃত্য নাট্যের মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে প্রবাসীদের মনে মূর্ত করে তােলেন। ১৭ অক্টোবর গ্রেটবৃটেনস্থ মহিলা সমিতির উদ্যোগে ২১ নং পেমব্রীজ গার্ডেন্সে “লশে শান্তি প্রতিষ্ঠা, মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের রুহের মাগফেরাত এবং দখলদার বাহিনীর বাংলাদেশের মুক্তির জন্য এক মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। মিলাদ মাহফিলে সভানেত্রী জেবুন্নেছা বখত, সাধারণ সম্পাদিকা আনােয়ারা জাহান, মুন্নী শাহজাহান, জেবুন্নেছা খায়ের সহ মহিলা সমিতির নেতৃবৃন্দ ও কর্মী বােনেরা উপস্থিত ছিলেন । দিনে (১৭ অক্টোবর) ওয়েল্স এর পেনাৰ্থ শহরে—“গ্লোবাল এন্ড সােসাল ইস্যজ” এ উদ্যোগে বাংলাদেশে বিরাজমান পরিস্থিতির উপর এক আলােচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন গ্রুপের নেতা মি, গ্রিফিথুস। ২৪ অক্টোবর লন্ডনে ১৭টি সংগ্রাম পরিষদ, প্রতিনিধি সভায় বৃহত্তর লন্ডন এলাকার কার্যক্রমকে সমন্বয় করার লক্ষে “ইউনাইটে। বাংলাদেশ এ্যাকশন কমিটি গঠন করা হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন আবদুস সামাদ .. সভায় সর্বসম্মত প্রস্তাবে আহম্মদ হােসেন জোয়ারদারকে আহ্বায়ক করে একটি কমিটি গঠন। করা হয়।
এই সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা লাভের ছয় সপ্তাহের মধ্যে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যাওয়ায় এই সংগঠনের তেমন কোন কর্মকান্ড পরিচালনার সুযােগ হয় নি। অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী বিলাতে সফরে যান। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ও তার প্রেক্ষিতে উদ্ভুত শরণার্থী পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের সাথে আলােচনা কার্যক্রমের অংশ হিসাবে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর এ সফর প্রবাসীদের কাছে। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। মিসেস ইন্দিরা গান্ধী লন্ডন অবস্থানকালে বাংলাদেশের প্রবাসীদের দেশের জন্য উৎকণ্ঠা ও স্বাধীনতার জন্য দৃঢ়তা প্রকাশের উদ্দেশ্যে বিলাতের বিভিন্ন সগ্রাম কমিটিসমূহ কার্যক্রম গ্রহণ করে। ২৯ অক্টোবরে স্টিয়ারিং কমিটির পক্ষ থেকে এক প্রতিনিধি দল মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর সাথে দেখা করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তার সাহায্য ও সমর্থনের জন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন এবং একটি পত্র হস্তান্তর করেন। উক্ত পত্রে। বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ না করা পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যাও্যার প্রত্যয় ঘােষণা করে বলা হয় যে, “We do fervently hope that as Prime Minister of the Country closest to our land, you will be pleased to take a forthright step and your Government will immediately recognise the government of the People’s Republic of Bangladesh.” লন্ডনে মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর সফর উপলক্ষে তার লন্ডন অবস্থানকালে ৩০ অক্টোবরে ষ্টিয়ারিং কমিটির উদ্যোগে বাংলাদেশের স্বীকৃতির দাবিতে হাইড-পার্ক স্পীকার্স কর্ণারে এক বিরাট সমাবেশ ও গণমিছিলের আয়ােজন করা হয়। উক্ত সভায় সভাপতিত্ব করেন স্টিয়ারিং কমিটির আহ্বায়ক আজিজুল হক ভূঞা এবং প্রধান বক্তা হিসাবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি ও ষ্টিয়ারিং কমিটির উপদেষ্টা বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। সমাবেশে বক্তব্য রাখেন আঞ্চলিক কমিটির পক্ষ থেকে গউস খান (লন্ডন), কবির চৌধুরী। (ইয়র্কশায়ার), আবদুল মতিন (ম্যানচেষ্টার), জগলুল পাশা (বার্মিংহাম) এবং বি এ তালকুদার, রাষ্ট্রদূত এ মােমেন, ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী, মিসেস জেবুন্নেছা বল বাংলাদেশ মিশনের পক্ষ থেকে রেজাউল করিমসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ বক্তাগণ বাংলা মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সরকার ও জনগণের সমর্থন এবং উদ্বাস্তুদের প্রতি সহানুভূতির ও ভারতের প্রধানমনন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীকে ধন্যবাদ জানিয়ে বাংলাদেশ সরকারকে যথাশ্রীঘ্র একতি দানের জন্য আহ্বান জানান। সমাবেশ শেষে এক বিরাট গণমিছিল হাইড-পার্ক স্পীকার্স কর্ণার থেকে শুরু করে ফ্রক টিস্থ ক্লারিজেস হােটেলের সম্মুখ দিয়ে হ্যানােভার স্কোয়ারে গিয়ে সমাপ্ত হয়।
প্রসঙ্গত উলেখযােগ্য যে, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী লন্ডনে সফরকালে ক্লারিজেস হােটেলে অবস্থান করছিলেন। একই দিনে (৩০ অক্টোবর) ক্লাপহামের হেনরি থরনটন স্কুলে বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে বৃটেনে বসবাসকারী বাঙালি ছাত্রদের এক কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়। সকাল ১০টায় এই ছাত্র সম্মেলনের উদ্বোধন করেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। সম্মেলনের বিস্তারিত বিবরণ অধ্যায় একত্রিশ তে আলােচনা করা হয়েছে। প্রবাসী সংগ্রাম পরিষদসমূহ ছাড়াও আরাে দু’টি আন্তর্জাতিক সংগঠন অক্টোবর মাসে লন্ডনে বাংলাদেশের পক্ষে কর্মকান্ড শুরু করে। তার মধ্যে সর্বদলীয় পালামেন্টারী সদস্যদের সমন্বয়ে “Justice for East Bengal” নামে একটি সংগঠন এবং সচেতন নাগরিকদের সমন্বয়ে “Bangladesh Freedom Movement Overseas” নামে অপর একটি সংগঠন আত্মপ্রকাশ করে। শেষােক্ত কমিটির নেতৃত্ব প্রদান করেন মেথােডিটি চার্চের রেভারেণ্ড ডেভিড মেসন।
নভেম্বর মাসের তৎপরতা
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর পাশ্চাত্যের দেশগুলাে সফর ও লন্ডনে প্রকাশিত পত্র-পত্রিকার রিপাের্ট ও মন্তব্য থেকে বাংলাদেশ সমস্যার একটা ত্বরিত সমাধানের আভাস স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ৩১ অক্টোবর, ১৯৭১ তারিখে লন্ডনের কনিসিয়াম থিয়েটার হলে ইন্ডিয়া লীগ আয়ােজিত এক সভায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন যে, 1 feel that I am sitting on top of a volcano, and I honestly don’t know if it is going to erupt.” (The Times, Nov. 1. 1971). তিনি শরণার্থী সমস্যা এবং বাংলাদেশের সর্বশেষ পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে উপরােক্ত মন্তব্য করেন। তিনি বলেন যে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যে নির্যাতন হত্যাযজ্ঞ চলছে তা সভ্যতার ইতিহাসে বিরল। ভারত মানবিক কারণে তার পূর্ব সীমান্ত খােলা রেখেছে এবং শত উস্কানির মুখেও শান্ত থাকতে চেষ্টা করছে। ভারতের এই ধৈর্যধারণ বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনয়নে ব্যর্থ হয়েছে এবং পরিস্থিতি আরাে জটিল আকার ধারণ করেছে। তিনি সভায় মন্তব্য করেন যে, ভারত এভাবে আর নীরব দর্শকের ভূমিকায় বসে থাকতে পারেনা, বরং ভারত বাংলাদেশের সমস্যার ত্বরিত সমাধান চায়। এছাড়া মিসেস গান্ধী ৯ নভেম্বর প্যারিসে এবং ১০ নভেম্বর বনে সাংবাদিকদের কাছে ভারতের সীমান্তে পাকিস্তানের সৈন্য সমাবেশ এবং সীমান্ত উত্তেজনার কথা বলেন। এ প্রসঙ্গে তিনি সাংবাদিকদের বলেন যে, ভারত যুদ্ধ চায়। , তবে তার সীমান্ত রক্ষার্থে ভারত সব সময়ই প্রস্তুত রয়েছে। | মিসেস গান্ধীর বিভিন্ন রাষ্ট্র সফর ও সফরকালে বিভিন্ন মন্তব্য এবং উভয় দেশের সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, বাংলাদেশের সমস্যা সমাধানে একটা। সামরিক পদক্ষেপ অনিবার্য। এছাড়া বাংলাদেশের সীমান্তে ও অভ্যন্তরে মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা বৃদ্ধি এবং মুক্তি বাহিনীর আক্রমণকে ভারতীয় সৈন্য বাহিনীর আক্রমণ বলে পাকিস্তানের অভিযােগ ইত্যাদি ঘটনা থেকেও বাংলাদেশের মুক্তি অর্জনে অত্যাসন্ন সামরিক অভিযানের আভাস স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মধ্য নভেম্বর থেকেই বাংলাদেশ সীমান্তে ভারত ও পাকিস্তান সৈন্যদের আক্রমণ ও পাল্টা আক্রমণের অভিযোেগ আন্তর্জাতিক পত্র-পত্রিকায় স্থান লাভ করতে থাকে। ২৩ নভেম্বর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানে জরুরা আইন এবং যুদ্ধাবস্থা ঘােষণা করেন। একই দিনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গাথা। বিভিন্ন সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানদের সাথে মিলিত হয়ে সতর্কাবস্থায় থাকার নির্দেশ দেন।
এ সকল প্রস্তুতি থেকে বাংলাদেশ ইস্যুকে নিয়ে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সম্ভাবনা কূটলে মহলে ব্যাপক আলােচিত হয় এবং পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। আন্তর্জাতিক সে দেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট পরিবর্তন লাভ করে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ গুরুত্ব লাভ এমনি পরিস্থিতিতে বিলাতের প্রবাসী বাঙালীরা তাদের আন্দোলনের পূর্ববর্তী ধারা হত রাখে। ষ্টিয়ারিং কমিটি তাদের মুখপত্র ‘বাংলাদেশ সংবাদ পরিক্রমা’ ও ‘বাংলাদেশ ২.ডে’ এর মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মুক্তিযােদ্ধাদের বীরত্ব কাহিনী ও তাদের সাফল্য চার করতে থাকে এবং সর্বশেষ পরিস্থিতি অবহিত করতে থাকে। বিভিন্ন শহরে সভা ও শােভাযাত্রার মাধ্যমে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের দাবি পুনরায় সােচ্চার হয়। বাংলাদেশকে স্বীকতি দানের পূবে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ ঘােষণা হয়ে গেলে বাংলাদেশ ইস্যু ধামাচাপা পড়ে। যাবে এই সন্দেহে অনেক প্রবাসী শঙ্কিত ছিল। তাই, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ অবস্থার মধ্যেও প্রবাসী বাঙালীরা তাদের স্বীকৃতি দানের পূর্ববর্তী দাবির প্রতি সােচ্চার থাকে। ৬ নভেম্বর “ইউনাটেড এ্যাকশন বাংলাদেশ’ এর উদ্যোগে রেড লায়ন স্কোয়ারে অবস্থিত ‘কনওয়ে হলে’ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের দাবিতে এক জনসভার আয়ােজন করা হয়। সংগঠনের সভাপতি এস, এই, আজিজের সভাপতিত্বে জনসভায় প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। সভায় বক্তব্য রাখেন বৃটিশ এম. পি. পিটার শাের, বাংলাদেশ থেকে আগত এম. এন. এ. ড. মফিজউদ্দিন, রাষ্ট্রদূত এ. মােমিন, বিশিষ্ট বৃটিশ সমাজকর্মী লেডী গিফোর্ড, এ্যাকশন বাংলাদেশ’ এর মিস লীন বিলী এবং লন্ডনস্থ বাংলাদেশ মিশনের রেজাউল করিম। বক্তাগণ অবিলম্বে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের জন্য বিশ্বের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সরকার ও জনগণের কাছে আবেদন জানান। প্রধান অতিথির ভাষণে বিচারপতি চৌধুরী জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশে প্রতিনিধি দলের কর্মতৎপরতা ও বিশ্ব নেতাদের বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতির কথা উল্লেখ করে বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা এখন শুধু সময়ের ব্যাপার। অতিশীঘ্রই আমাদের বীর মুক্তিযােদ্ধারা বাংলাদেশের সর্বত্র বিজয়ের পতাকা উড্ডীন করতে পারবেন বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
৭ নভেম্বর (রবিবার) লন্ডনের উত্তর-পশ্চিম এলাকায় কেন্টিশ টাউনে অবস্থিত “লেডী মার্গারেট চার্চ হলে দক্ষিণ ইংল্যান্ড আঞ্চলিক সংগ্রাম কমিটি সমূহের প্রতিনিধিদের এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন ষ্টিয়ারিং কমিটির আহবায়ক আজিজুল হক ভূইয়া। উক্ত সম্মেলনে বিভিন্ন বক্তা বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সর্বশেষ পরিস্থিতি এবং প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিভিন্ন প্রচারণা ও অন্যান্য কার্যক্রম গ্রহণে সাংগঠনিক অবস্থা পযালােচনা করেন। বিভিন্ন সংগ্রাম পরিষদের সাথে যােগাযােগ রক্ষা ও সমন্বয়ের লক্ষ্যে এমাহাম্মদ আইউবকে আহবায়ক করে একটি সমন্বয় কমিটি’ গঠিন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। কিন্তু পরবর্তি ৫ সপ্তাহের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের সমাপ্তি এবং স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা হওয়ায় উপরােক্ত সমন্বয় কমিটির কোন কর্মসূচী গ্রহণের সুযােগ হয় নাই। ১২ নভেম্বর পাের্টস ‘মাউথ বাংলাদেশ সংগ্রাম পরিষদ’ এবং “পােটস মাউথ লটেকনিক ছাত্র ইউনিয়ন” এর যৌথ উদ্যোগে পলিটেকনিক ছাত্র ইউনিয়ন হলে বাংলাদেশের সমর্থনে এক সমাবেশের আয়ােজন করা হয়। সমাবেশে সভাপতিতক পলিটেকনিক ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি কীথ গার্ডনার। সভায় বাংলাদেশের মুক্তি সমর্থন করে বক্তব্য রাখেন প্রফেসর রজার ব্রুমলী, গাও ল্যান্ড, বি, এস, চাডার এ রাজ্জাক খান এবং সি, হােসেন প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। সভার প্রস্তাবে বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী ও বিনােটা দলীয় নেতাকে নিরবতা ভঙ্গ করে বাংলাদেশকে সমর্থনের আহ্বান জানানাে হয় । ১৯ নভেম্বর ম্যাঞ্চেষ্টার বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে বিশ্ববিদায় মিলনায়তনে বাংলাদেশের সমর্থনে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন অফ স্টুডেন্টস (NUS) এর আঞ্চলিক সভাপতি জেফ হ্যানিম, বাংলাদেশের ছাত্রদের পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখেন কবীর আহম্মদ। সভার প্রস্তাবে বলা হয়, পর্ণ স্বাধীনতাই হচ্ছে বাংলাদেশের সমস্যার একমাত্র সমাধান। বৃটেনের তথাকথিত নিরপেক্ষতা ত্যাগ করে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের জন্য বৃটিশ সরকারের কাছে আহ্বান জানানাে হয়। একই দিন (১৯ নভেম্বর) কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়ন এক সভা আহ্বান করে। সভায় সভাপতিত্ব করেন কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-ইউনিয়নের সভাপতি ওয়ার উইক। অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন সাবেকমন্ত্রী টেড বােলেন, সাবেক এম. পি, গুয়েভার এভেন্স এবং বাঙালীদের পক্ষে ডাঃ নুরুল হােসেন প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। সভায় বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী প্রত্যাহার এবং পূর্ব বঙ্গের’ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দানের জন্য দাবি করা হয়।
বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ যেমনি সাফল্যের পথে অগ্রসর হচ্ছিল তেমনি আন্তর্জাতিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের স্বীকৃতি এবং কূটনৈতিক সাফল্য অর্জিত হচ্ছিল। ষ্টিয়ারিং কমিটি প্রকাশিত বাংলাদেশ সংবাদ পরিক্রমা’ ১২ নভেম্বর তারিখে বিশ্বের বিভিন্ন রাজধানীতে পাকিস্তান সরকারের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে বাঙালি কূটনীতিকদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অংশগ্রহণের খবর পরিবেশন করে। সুইজারল্যাণ্ডের জেনেভস্থ পাকিস্তান দূতাবাসের বাঙালি দ্বিতীয় সচিব জনাব ওয়ালিউর রহমান পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে সুইজারল্যাণ্ডে রাজনৈতিক আশ্রয় লাভ করেন। এছাড়া নেপালের পাকিস্তান দূতাবাসের দ্বিতীয় সচিব মুস্তাফিজুর রহমান, কায়রাের হেড অফ চেলারী ফজলুল করিম, টোকিও দূতাবাসের প্রেস এটাচি এসএম মাসউদ এবং টোকিও দূতাবাসের তৃতীয় সচিব আবদুর রহিম পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যােগদান করেন। এসকল সম্পর্কচ্ছেদের ঘটনা বিলবে হলেও গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত বহন করেছে। বাংলাদেশে আর যে পাকিস্তানের শাসন চালানাে সম্ভব নয় তার নগ্ন প্রকাশ উপরােক্ত সম্পর্কছিন্ন’ (Defection) ঘটনার মাধ্যমে আন্তজাতিকতা প্রচার লাভ করে। ২৭ নভেম্বর ইউনাইটেড এ্যাকশন কমিটির উদ্যোগে কনওয়ে হলে স একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন ৮৬ বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য এ, আর, মল্লিক। তিনি জাতিসংঘে বাংলাদেশ প্রাদলের সদস্য হিসেবে নিউইয়র্ক গমনের পথে লন্ডনে অবস্থান করছিলেন। ইতােপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বাংলাদেশ: সাঈদ চৌধুরীর বাংলাদেশ সরকার বিলাতের স্টিয়ারিং কমিটির উপদেষ্টা বিচারপতি আবু ধরীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বাংলাদেশের চার কার্য পরিচালনার জন্য প্রেরণ করে। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ইতােমধ্যে নিউইয়র্ক গমন করেন। ড. মল্লিক মুক্তিযুদ্ধের সর্বশেষ পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে দেশের মুক্তি অত্যাসন্ন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। ২৭ নভেম্বর আমার সভাপতিত্বে যুক্তরাজ্যে ছাত্রলীগ গঠনের জন্য এক সভা অনুষ্ঠিত সভায় সর্বসম্মতিক্রমে সৈয়দ মােকাররম আলীকে আহ্বায়ক এবং মােঃ মমতাজ উদ্দিন, যাত্রী ওয়াহিদ উদ্দিন আলমগীর, সৈয়দ মােজাম্মেল আলী ও মিসেস খালেদা মান্নান কে যুগ আহ্বায়ক মনােনীত করে একটি আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। ৩০ নভেম্বর যুক্তরাজ্যস্থ আওয়ামী লীগের উদ্যোগে বৃটিশ পালামেন্টের গ্রান্ড কমিটি রুমে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। যুক্তরাজ্যস্থ আওয়ামী লীগের সভাপতি গউস খানের সভপতিত্বে সভায় বক্তব্য রাখেন বৃটিশ এম. পি. পিটার শাের, রেজিনান্ড প্রেনটিস, ব্রুস ডগলাস-ম্যান ও জুলিয়াস সিলভার ম্যান এবং বাংলাদেশ দূতাবাসের রেজাউল করিম প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। সভায় বক্তাগণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি এবং বাংলাদেশকে স্বীকৃতির দাবি জানান।
ডিসেম্বর মাসের তৎপরতা
বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী শরণার্থী সমস্যার স্থায়ী সমাws, লক্ষ্যে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ সম্ভাবনা নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে স্পষ্ট হয়ে ও… নভেম্বরে পাকিস্তানে জরুরী অবস্থা ঘােষণা এবং একই দিনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইনি। গান্ধীর বিশেষ কেবিনেট সভা আহ্বান ও সার্ভিস প্রধানদের সভায় সতর্ক থাকায় আহ্বান বিলাত প্রবাসীদের কাছে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ ঘােষণার প্রস্তুতি বলে প্রতীয়মান হয় । নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকেই পাকিস্তান ও ভারত সীমান্তে ছােট-খাট-সংঘর্ষ ও সৈন। মােতায়েনের খবর আন্তর্জাতিক পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা। সংগ্রামের প্রেক্ষপটে একটি যুদ্ধ আশংকায় পত্র-পত্রিকা নানা মন্তব্য প্রকাশ করে। বিশ্ব। জনমত যুদ্ধকে পরিহার করে শান্তিপূর্ণ পন্থায় বাংলাদেশ ও শরণার্থী সমস্যা সমাধানের পক্ষ অবলম্বন করে বাংলাদেশ সীমান্তে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণকে পাকিস্তান ভারতীয় অনুপ্রবেশ বলে বারবারই আখ্যায়িত করেছে এবং মুক্তিবাহিনীকে আক্রমণের নামে ভারতীয় সীমান্ত লংঘনের বহু ঘটনা পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ২৪ নভেম্বর দি ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় ভারতীয় মন্ত্রী ভি সি শুকলার বরাত দিয়ে পূর্বাঞ্চলীয় বয়রা সীমান্তে পাকিস্তানের তিনটি জেট বিমান ভূপাতিত করার খবর প্রকাশ করে। পাকিস্তান ঘটনাকে ভারতের অঘােষিত যুদ্ধ বলে অভিযােগ করে। ভারতের পার্লামেন্টে শুকলা পাকিস্তানের বৈমানিক। ফ্লাইট লেফটেন্টে পারভেজ মেহেদী ও ফ্লাইং অফিসার খালিদ আহমদকে উক্ত বিমান যুদ্ধে আটক করার কথা বলেন। এ সকল ঘটনা থেকে পাশ্চাত্যের কূটনৈতিক মহল ভারত। পাকিস্তানের মধ্যে একটি যুদ্ধের সম্ভাবনা অনিবার্য মনে করেন। আমেরিকা এ যুদ্ধ বাধার ব্যাপারে ভারতকে প্রধানত দায়ী করে ৬ ডিসেম্বর আমেরিকা কর্তৃক ভারতে প্রদত্ত সাহায্যের এক-তৃতীয়াংশ (৮৭৬ মিলিয়ন ডলার) স্থগিত করার ঘােষণা প্রদান করে। এর ফলে প্রবাসী বাঙলীরা অত্যন্ত বিক্ষুব্ধ হয়। বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধ করার জন্য পাকিস্তানের উপর যে অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টির কথা ছিল তা উল্টো ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হলাে। | বিলাত প্রবাসী বাঙালীরা ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিকে বিভিন্ন সংগ্রাম পরিষদের মাধ্যমে বিভিন্ন দূতাবাসে গিয়ে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের আবেদন জানান। ৬ ডিসেম্বরে ভারত কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের খবর লন্ডনের সকল পত্র-পত্রিকায় গুরুত্ব সহ প্রকাশিত হয়।
উক্ত স্বীকৃতির খবরে বিলাতে প্রবাসী বাঙালীদের মধ্যে আনন্দের জোয়ার এ যায়। যাদের কাছে বাংলাদেশের মুক্তি সম্পর্কে দ্বিধা ছিল তাদের কাছেও বাংলাদেশর” স্বাধীনতা লাভ অনিবার্য হয় পাকিস্তান ভারতের সাথে । অঘােষিত শক্রতা প্রকাশ ছড়িয়ে পড়ল। প্রবাসী বাঙাল লাভ অনিবার্য হয়ে গেল। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর উক্ত স্বীকৃতি ঘােষণার সাথে সাথে ভারতের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে । এই ঘােষণার ফলে এতদিনের ; শত্রুতা প্রকাশ্য যুদ্ধের রূপ লাভ করলাে। ভারত-পাকিস্তানের সীমান্তেও যুদ্ধ ডল। প্রবাসী বাঙালীরা প্রতিদিন যুদ্ধের অগ্রগতি পত্র-পত্রিকা ও রেডিও-টেলিভিশনে গুরুত্বের সাথে লক্ষ্য রেখে বিলাতে বিভিন্ন প্রচার কার্য অব্যাহত রাখে। ডিসেম্বর লন্ডনের রেড লায়ন স্কোয়ারে অবস্থিত কনওয়ে হলে’ যুক্তরাজ্যস্থ ন্যাপ ফফর) এবং ‘পিপল্স ডেমােক্রেটিক ফ্রন্ট যৌথভাবে এক সমাবেশের আয়ােজন করে। সমাবেশে সভাপিতত্ব করেন যুক্তরাজ্যস্থ ন্যাপ (মােজাফফর) এর সভাপতি খায়রুল দা। সভায় অতিথি বক্তা হিসাবে বক্তব্য রাখেন লর্ড ক্লকওয়ে, বৃটিশ কমিনিষ্ট পটির জ্যাক এদিস, ‘মর্নিংষ্টার’ পত্রিকার সহকারী সম্পদক উইলিয়াম ওয়েলরাইট এবং ন্যাপ (মােজাফফর) নেতা ডাঃ নুরুল আলম প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। সভায় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য বামপন্থী চিন্তাধারায় জাতীয় মুক্তি ফ্রন্ট গঠনের প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ইতােমধ্যে বাংলাদেশের বিশাল অংশ মুক্তিযােদ্ধাদের দখলে, মুক্তিযােদ্ধাদের অগ্রযাত্রা যখন অব্যাহত, মুক্তিযুদ্ধে যখন বিজয়ের প্রহর গুনছে—তখন লন্ডনে ‘জাতীয় মুক্তি ফ্রন্ট’ গঠন একটি অযৌক্তিক প্রয়াস হিসাবে গণ্য হয়। ৬ ডিসেম্বর বার্মিংহাম বাংলাদেশ সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে এক বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয় । জগলুল পাশার সভাপতিত্বে বিভিন্ন বক্তা বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতিতে সন্তোষ প্রকাশ করে বাংলাদেশকে ভারতের স্বীকৃতি দানের জন্য ভারত সরকারকে অভিনন্দন জানান। ৭ ডিসেম্বর ম্যাঞ্চেষ্টার বাংলাদেশ এসােসিয়েশন স্থানীয় একটি হলে সমাবেশের আয়ােজন করে। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন এম. এ. মতিন। সভায় বক্তব্য রাখেন মাঞ্চেষ্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি জেফ হ্যারিস এবং বাঙালী নেতা লতিফ আহম্মদ, মকসুদ আলী ও কবীর চৌধুরী প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। বক্তারা বাংলাদেশে মুক্তিযােদ্ধাদের সাফল্যের বিভিন্ন ঘটনা উল্লেখ করে অনতিবিলম্বে বাংলাদেশ দখলদার মুক্ত হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
১০ ডিসেম্বর বাংলাদেশ মহিলা সমিতির আয়ােজনে লন্ডনের হাইড পার্ক স্পীকার্স কণীরে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের দাবিতে এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। মহিলা সমিতির সভানেত্রী জেবুন্নেছা বখতের সভাপতিত্বে সমাবেশে বক্তব্য রাখেন বৃটিশ এম. পি. ব্রুস লাস-ম্যান, ষ্টিয়ারিং কমিটির শেখ আবদুল মান্নান, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে আমি (ক), মহিলা সমিতির লুলু বিলকিছ বানু, আনােয়ারা খানম, রাবেয়া ভূইয়া, ফেরদৌস ” ৬ মনােয়ারা রহমান প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। সভায় বক্তাগণ বাংলাদেশের নিশ্চিত বিজয় “শপকে মন্তব্য করে বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধাদের অভিনন্দন জানান। সমাবেশ শেষে শট বিরাট মিছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার দূতাবাস সমূহে পশকে স্বীকৃতি দানের দাবি সম্বলিত স্মারকলিপি প্রদান করে। মিছিলটি ১০ নং ডাউনিং স্ট্রীটে গিয়ে সমাপ্ত হয় এবং সেখানেও একই দাবি সম্বলিত স্মারকলিপি বটি প্রধানমন্ত্রীর সমীপে পেশ করে। একই দিনে (১০ ডিসেম্বর) “ইউনাইটেড এয়া বাংলাদেশ” পূর্ব লন্ডনের টয়েনবি হলে একটি জনসভার আয়ােজন করে। সভায় সভাপতি করেন আবদুস সামাদ খান এবং বক্তব্য রাখেন স্টিয়ারিং কমিটির শেখ আবদল বাংলাদেশ দূতাবাসের দ্বিতীয় সচিব মহিউদ্দিন আহম্মদ এবং সংগঠনের নেতা এস এম আজিজ, নর চৌধুরী ও ওমর ফারুক চৌধুরী প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। সভায় বক্তাগণ শীঘ্রই স্বাধীন .. সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশ পৃথিবীর মানচিত্রে প্রতিষ্ঠিত হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। ভারতের পরপর ভুটান বাংলাদেশের সার্বভৌম সরকারকে স্বীকৃতি দান করলেও আমি কোন দেশ স্বীকৃতি ঘােষণা করেনি। তাই এদিকে বিশ্ব জনমতকে আকর্ষণ করার জন্য। বিলাতের সগ্রাম পরিষদসমূহের কেন্দ্রীয় ষ্টিয়ারিং কমিটি ১২ ডিসেম্বরে বাংলাদেশের স্বীকতি। ও শেখ মুজিবর রহমানের মুক্তির দাবিতে হাইডপার্ক স্পীকার্স কর্নারে এক সমাবেশ ও মিছিলের আয়ােজন করে। এই মর্মে প্রচারপত্র ও পত্রিকার মাধ্যমে ঘােষণা দানের পর গ্রেট বৃটেন আওয়ামী লীগও একই দিনে একই সময়ে এবং একই স্থানে অনুরূপ সামবেশ ও মিছিলের কথা ঘােষণা দেন। ইতােপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছিল যে, আওয়ামী লীগের অন্তর্দ্বন্দ্ব ও দ্বিধার ফলে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে প্রতিষ্ঠিত ষ্টিয়ারিং কমিটির নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের অবস্থান ছিলনা। তাই নেতৃত্বের প্রশ্নে ষ্টিয়ারিং কমিটির সাথে আওয়ামী লীগের ঠাণ্ডা লড়াই অব্যাহত ছিল। স্বাধীনতার উষালগ্নে ঠান্ডা লড়াইয়ের নগ্ন প্রকাশ লাভ করল।
ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রবাসী বাংলাদেশীরা নিজেদেরকে স্বাধীন বলেই মনে করত। ১২ ডিসেম্বরের সমাবেশ ও মিছিলকে কেন্দ্র করে প্রবাসী বাঙালীদের এতদিনের সংঘবদ্ধ দুর্বার আন্দোলনের মাধ্যমে অর্জিত সাফল্য ম্লান হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। এ সময়ে ষ্টিয়ারিং কমিটির উপদেষ্টা ও বিলাতে বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বাংলাদেশের পক্ষে প্রচার কার্য পরিচালনার জন্য জাতিসংঘে (নিউইয়র্কে অবস্থান করছিলেন। তাই লন্ডনে উপরােক্ত পরিস্থিতিতে মধ্যস্থতা করার জন্য বিচারপতি চৌধুরীর টেলিফোন নির্দেশ মােতাবেক স্টিয়ারিং কমিটির নেতৃবৃন্দ আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের সাথে সমঝােতা সভা অনুষ্ঠান করেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ হাইড-পার্ক স্পীকার্স কর্ণারে তাদের সভা অনুষ্ঠানের ব্যাপারে অনড় থাকায় বিচারপতি চৌধুরীর নির্দেশে ষ্টিয়ারিং কমিটি নেতৃবৃন্দ সমাবেশ অনুষ্ঠান থেকে বিরত থাকেন এবং তাতে যােগদান করেন। | ১২ ডিসেম্বরের সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সভাপতি গভ খান। হাইড-পার্কের উক্ত সভায় বক্তাগণ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান ও বাংলাদেশে প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবব রহমানের মুক্তি দাবি করেন। সমাবেশ শেষে এক বিরাট মি স্বীকৃতির বিভিন্ন শ্লোগানসহ ১০ নং-ডাউনিং স্ট্রীটে গমন করে এবং তথায় বৃটিশ প্রধান কাছে উল্লেখিত দাবিসমূহ সম্বলিত একটি স্মারকলিপি প্রদান করেন।
১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশের কাংক্ষিত স্বাধীনতা লাভের দিনে ঢাকায় পাকিস্তান নায়কের আত্মসমর্পণের খবর লন্ডনের বৈকালিক পত্রিকাসমূহে শিরােনাম লাভ করে। সময়ের ব্যবধানে লন্ডনের বৈকালিক পত্রিকাসমূহে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সূর্য ওঠার প্রথম প্রহরে বিস্তারিত ঘটনা প্রকাশিত হয়। লন্ডনসহ বিলাতের সকল শহরের লীরা ১৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় সর্বত্র স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিজয় উৎসব অনুষ্ঠান করেন। লন্ডনের গার স্কোয়ারে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সন্ধ্যার সময় হাজার হাজার বাঙালি একত্রিত হয়ে বিজয় বের মাধ্যমে দীর্ঘ দশমাসের স্বাধীনতা যুদ্ধ কালের উৎকণ্ঠা ও প্রত্যাশার শুভ সমাপ্তি লাষণা করে। একই দিনে পূর্ব নির্ধারিতভাবে লিংক ফেরাম’ আয়ােজিত বাংলাদেশের সমর্থনে লন্ডনের কনওয়ে হলে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সভা যদিও বাংলাদেশের স্বীকৃতির দাবিতে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে উক্ত সভা বিজয় সভায় রূপান্তরিত হয়। উক্ত সভায় ভারতীয় হাই কমিশনার অপা পান্ত এবং বাংলাদেশ মিশনের রেজাউল করিম উপস্থিত ছিলেন। স্বতঃস্ফূর্ত বিজয় উৎসব অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ২৫ মার্চের কালাে রাত্রিতে যে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয়েছিল তার শুভ সমাপ্তি হলাে, ১৬ ডিসেম্বরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের মাধ্যমে।
বিলাতের পত্র পত্রিকার ভূমিকা (মার্চ ‘৭১)
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বজনমত সৃষ্টির ক্ষেত্রে বিলাতের পত্র-পত্রিকার অবদান ছিল অপরিসীম। বিলাতের প্রচার মাধ্যমকে বাংলাদেশের জনগণের প্রতি সহানুভূতিশীল করে তােলার জন্য প্রবাসী বাঙালীদের অব্যাহত প্রচেষ্টা ও বিভিন্ন কার্যক্রম। বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। বিলাতের সাংবাদিকদের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বিলাতে প্রবাসীদের সমাবেশ, শােভাযাত্রা, নিউজ বুলেটিন ও পুস্তিকা প্রকাশ ইত্যাদি পদক্ষেপ উল্লেখযােগ্য। এ ছাড়া বিলাতের রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী মহলে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি ব্যাখ্যা ও অগ্রগতি অবহিত রাখার কার্যক্রমও বিলাতের সংবাদপত্রগুলাের উপর প্রভাব সৃষ্টি করেছে। বিভিন্ন সময়ে বৃটিশ এম, পি’দের বাংলাদেশ ও সীমান্ত এলাকা পরিদর্শনের ব্যবস্থা গ্রহণ এবং বিলাতের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণের ফলে বাংলাদেশ ইস্যু বৃটিশ সাংবাদিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ ও গুরুত্ব প্রদানে সাহায্য করেছে। যুক্তরাজ্যস্থ বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, বি, বি, সি এর বাংলা বিভাগের সিরাজুর রহমান, শ্যামল লােধ (প্রয়াত), কমল বােস, জনমত পত্রিকার সম্পাদক এ, টি, এম ওয়ালী আশরাফ (বাংলাদেশ সংসদে সাবেক এম, পি) এবং স্টিয়ারিং কমিটির আবদুর রউফ ও মহিউদ্দিন চৌধুরীসহ একটি বিশেষ গ্রুপ লন্ডনের সাংবাদিকদের সাথে সাবক্ষণিক যােগাযােগ রক্ষা করতেন। এ ব্যাপারে বৃটিশ সাংবাদিক সায়মন ড্রিংগ, পিটার হেজেলহা, বৃটিশ পত্রিকায় কর্মরত পাকিস্তানী সাংবাদিক এনথনি মাসকারেনহাস, কলিম সিদ্দিকী এবং ভারতীয় সাংবাদিক ধরম পালসহ লন্ডনে কর্মরত বেশ কিছু সাংবাদিক সহযােগিতা করেন। | বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্ব থেকেই বৃটিশ পত্র-পত্রিকা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের প্রতি পাকিস্তান সরকারের অবহেলা ও একপেশে নীতির ফলে বাঙালীদের ক্ষোভ এবং পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়ার সম্ভাবনার আভাস দিয়ে প্রতিবেদন এ করেছে। ১৯৭০ এর নভেম্বরের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলােচ্ছ্বাসের পর তৎকালা” পাকিস্তানের উপকূলীয় অঞ্চলে পাকিস্তান সরকারের রিলিফ কার্যক্রমে ব্যর্থতা ও অবহে বিষয়ে বৃটিশ পত্র-পত্রিকায় বিরূপ সমালােচনা হয়েছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, “, প্রলংকরী জলােচ্ছ্বাসের পর উপকূলীয় অঞ্চলে পাকিস্তান সরকারের সাহায্য পােহ বৃটিশ সাহায্য জাহাজ পৌঁছেছিল। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের এই মহাবিপদে পাকিস্তানের ইয়াহিয়া সরকারের চরম অবহেলা বাঙালীদের মধ্যে বিরূপ প্রাতা রের সাহায্য পৌছার পূর্বে এই মহাবিপদের দিনে ধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি।
করেছিল এবং পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় উদ্বুদ্ধ করেছিল। এমনি সময়ে লন্ডন থেকে প্রকাশিত দি গার্ডিয়ান পত্রিকার কলামিস্ট পাকিস্তানী সাংবাদিক কলিম সিদ্দীকী ১৯৭০ সানের ২৪ নভেম্বরের সংখ্যায় “Independence fever in Pakistan” শিরােনামে একটি বাস্তবমুখী কলাম প্রকাশ করেন। উক্ত কলামে কালানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর বক্তব্যের উল্লেখ করে বাঙালীদের স্বাধীনতার প্রতি ঝুঁকে পড়ার বাস্তব চিত্র তুরে ধরা হয়। পাকিস্তানী নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও কলিম সিদ্দিকী বাংলাদেশের প্রকৃত অবস্থা সাহসের সাথে প্রকাশ করে সৎ ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার পরিচয় দিয়েছেন। এ ধরনের কলাম লিখার জন্য কলিম সিদ্দীকি পাকিস্তান হাই কমিশন এবং পাকিস্তানী প্রবাসীদের ভর্ৎসনার পাত্র হয়েছিলেন। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে কলিম সিদ্দিকীর ভবিষ্যৎ বাণীই সত্যি প্রমাণিত হয়েছিল। পাকিস্তান সরকারের সকল অবহেলা ও নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড়ের তাজা অভিজ্ঞতার আলােকে ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাঙালীদের রায় মূলত কলিম সিদ্দিকীর “স্বাধীনতার আভাস বা ইংগিত হিসাবে প্রকাশিত হয়। ১৯৭০ ইং সনের ৭ ডিসেম্বরের দি গার্ডিয়ান পত্রিকায় ‘Ivory tower power” শিরােনামে এক সাব এডিটরিয়েল কলামে পিটার প্রেসটন পাকিস্তানের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কঠিন বাস্তবতাকে বিশ্লেষণ করেন। গণতান্ত্রিক রায়কে উপযুক্ত মূল্যায়ন করা না হলে বা বাঙালীদের স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে উপেক্ষা করা হলে পাকিস্তানে একটা সাংঘাতিক বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে বলে উক্ত উপসম্পাদকীয়কে উল্লেখ করা হয়। পিটার প্রেসটন উক্ত উপসম্পাদকীয়ের এক স্থানে উল্লেখ করেন যে, the cry of Bengal sounds like a united cry of hunger and deprivation” কিন্তু ইতিহাসের নির্মম সত্য এই যে, যা পিটার প্রেসটনের কাছে। পরিষ্কার ছিল তা পাকিস্তানের শাসকদের বােধগম্য হয় নি। এই “United cry” কে। চ্ছিন্নতাবাদী পাকিস্তানের শত্রুদের গন্ডগােল আখ্যায়িত করে পাকিস্তানের শাসকরা দিবান্দ্রিাতে বিভাের ছিলেন। | ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরবর্তী ড্রামা বাংলাদেশের সকলের ততে রয়েছে। বিলাতের পত্র-পত্রিকা ডিসেম্বর থেকে ১৯৭১ সনের ২৫ মার্চের ঘটনাবলী ” গুরুত্ব সহকারে পরিবেশন করে। পাকিস্তানের সামরিক নেতাদের একটু ভুলে যে শপথয় হতে পারে তা পুনঃ পুনঃ স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। কিন্তু তাতে পাকিস্তানের সক শাসিকদের কোন উপলব্ধি বা শুভবুদ্ধি সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়নি। ২৫ মার্চের কালাে গত সংঘটিত হওয়ার পর সময়ের ব্যবধান ও ২৬ মার্চ ঢাকার সাথে বিশ্বের সকল বন্ধ থাকায় ২৭ মার্চ বিলাতের সকল পত্র-পত্রিকায় বাংলাদেশের মর্মান্তিক ঘটনা ” লাভ করে। বিলাতের রক্ষণশীল পত্রিকা হিসাবে পরিচিত ‘দি টাইমস’ পত্রিকার গম এবং তৎসঙ্গে একই দিনে প্রকাশিত “War clouds over Pakistan”
রাত্রি যথারীতি সংঘটিত হওয়ার পর সময় শিরােনাম লাভ করে শিরােনাম এবং নামের সম্পাদকীয় বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যা ও স্বাধীনতা যুদ্ধের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন অবদান রেখেছে। একই দিনে লন্ডনের আর একটি রক্ষণশীল পত্রিকা দি টেলিগ afoche Calella “Jinnah’s dream of unity dissolves শিরােনামে বাংলাদেশের ঘটনাবলীর বিবরণ পেশ করেন। গণতান্ত্রিক ও উদার “দি গার্ডিয়ান” ২৭ মার্চে “The tragedy in Pakistan” শিরােনামে একটি সম্পাদন প্রকাশ করেন। এই সম্পাদকীয়তে বলা হয় যে, The immediate outcome tal be a bloody reaffirmation of the east’s worst suspicious of the west’s intenstions… All of Pakistan’s leading politicians have contributed to the slow-burning fuse on this tragedy. The pity is that President Yahya Khan could not see his way to accept Bengal separate identity and to crystallise it in some blood saving form.” বাংলাদেশে স্বাধীনতার ঘােষণার অব্যবহিত পরে অর্থাৎ ২৭ ও ২৮ মার্চের বিলাতের সংবাদপত্রসমূহে বাংলাদেশে স্বাধীনতার ঘােষণার খবর প্রাধান্য লাভ করে। ২৫ মার্চের কালাে রাত্রে বাংলাদেশে যে গণহত্যা ও ধ্বংসলীলা ঘটেছে তা তখনাে বিশ্বের মানুষের কাছে পরিষ্কার হয়নি। ২৭ ও ২৮ মার্চের খবরা-খবর ভারতের দিল্লী থেকে পাঠানাে খবরের উপর ভিত্তি করে প্রকাশিত হয়। ঢাকায় ২৫ মার্চ রাত্র থেকে সান্ধ্য আইন বলবৎ থাকায় এবং সাংবাদিকদের হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আবদ্ধ করে রাখায় ঢাকা থেকে কোন সাংবাদিক কোন খবর পরিবেশন করতে পারেনি। পূর্ব পাকিস্তানে’ গৃহযুদ্ধ, তুমুল যুদ্ধ চলছে, পাকিস্তানী ট্যাংক বিদ্রোহীদের দমনে ব্যবহার করা হচ্ছে ইত্যাদি খবরা-খবর ইতােমধ্যে প্রকাশিত হলেও প্রকৃত অবস্থা তখনাে অন্ধকারে ছিল। ২৮ মার্চে সানডে টাইমসে ডেভিড হােলডেন “The second flood in East Pakistan” শিরােনামে এক বিশ্লেষণাত্মক দীর্ঘ প্রবন্ধে বাংলাদেশে ভয়াবহ অবস্থার কথা বিস্তারিত আলােচনা করেন এবং পাকিস্তানের পুনঃ একত্রীকরণের সম্ভাবনাকে নাকচ করে দেন। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে সংঘটিত জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের তথ্য প্রকাশ শুরু হয় ২৯ মার্চ থেকে।
২৯ মার্চ দি গার্ডিয়ান পত্রিকায়। পাকিস্তান থেকে প্রত্যাগত সাংবাদিক মার্টিন এ্যাডনি তিনটি পৃথক রিপাের্ট প্রকাশ করেন। তার প্রতিবেদনগুলাের শিরােনাম ছিল ঃ (১) Curfew eased as army moPP + rebellion () Rocket attack on the campus 47 (0) Troops Use shot first tactics” উপরােক্ত তিনটি প্রতিবেদনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হত্যা প্রাথমিক রিপাের্ট প্রকাশিত হওয়ার পর বিশ্বজনমত স্তম্ভিত হয়ে যায়। মার্টিন এ্যাডনি অশJI” সাংবাদিকদের সাথে তৎকালীন হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আবদ্ধ থেকে ২৪ ঘন্টা থেকে বের হয়ে যেতে সক্ষম হন। পাকিস্তান সামরিক জান্তা ২৫ মার্চের কালাে ” ঘণ্টা পর সকল বিদেশী সাংবাদিকদের দেশ থেকে বের করে দেয় হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আবদ্ধ অবস্থায় থেকে তিনি যতটুকু উপলব্ধি করেছেন এবং খবরা-খবর বছিলেন তার ভিত্তিতে রচিত হয়েছিল উপরােক্ত তিনটি প্রতিবেদন। মার্টিন এ্যাডনি এর এক স্থানে লিখেছেন যে, “Dacca was still burning when I and or foreign journalists left it nearly 24 hours after the Army an its military assault on an almost unarmed population” | ২৮ মার্চ লন্ডন থেকে প্রকাশিত রবিবারের পত্রিকা “দি অবজারভার’ এ ‘পূর্ববঙ্গ’ পরিস্থিতি নিয়ে একটি সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়। সম্পাদকীয় মন্তব্যে বলা হয়, পূর্ববঙ্গে সামরিক বল প্রয়ােগ করে পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষা করা সম্ভব হবে না। বরং এই বল। প্রয়ােগ দেশটিকে গৃহ যুদ্ধের দিকে নিয়ে যাবে। শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রদ্রোহী’ ঘােষণা করে জেনারেল ইয়াহিয়া খান মারাত্মক ভুল করেছে বলেও সম্পাদকীয়তে মন্তব্য করা হয়। ২৯ মার্চ ‘দি টাইম্স’ পত্রিকায় কলকাতা থেকে তাদের প্রতিনিধি পিটার হেজেলহার্সট প্রেরিত এক সংবাদে পূর্ব পাকিস্তানে বল প্রয়ােগের সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য জুলফিকার আলী ভুট্টো সামরিক বাহিনীকেও পাকিস্তান সরকারকে ধন্যবাদ জানান এবং আল্লাহ পাকিস্তানকে রক্ষা করেছে বলে মন্তব্য করেন। দি টাইম্স’ পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের এক অংশে বলা। “Thanks Allah, Pakistan is at last saved, he (Bhutto) said, as the tanks and guns rolled into Bengal. But the dream of Mr. Jinnah, the first Governor-General of Pakistan, of a Country united by the bond of Islam has vanished into thin air. Mr. Bhutto’s new Pakistan will be kept together with rifle and bayonets.”
লন্ডন থেকে প্রকাশিত বৈকালিক দৈনিক ইভিনিং স্ট্যান্ডার্ড’ পত্রিকা এসােসিয়েটেড প্রেসের ফটো সাংবাদিক মাইকেল লরেন্স এর বরাতে “The Pakistan Death horror” শিরােনামে এক পূর্ণ পাতা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। মাইকেল লরেন্স ও অন্যান্য বিদেশী সাংবাদিকদের সাথে ঢাকায় আবদ্ধ থেকে বেরিয়ে যেতে সমর্থ হন এবং কিছু হক নােট ও গােপনে তােলা কিছু ছবি নিয়ে যেতে সমর্থ হন। ২৯ মার্চ তারিখ থেকে। লাদেশে সংঘটিত প্রকৃত তথ্য বিশ্ববাসী জানতে শুরু করে। বাংলাদেশের ঘটনাবলী। ব কাছে তুলে ধরার ব্যাপারে বৃটিশ অপর এক সাংবাদিক সাইমন ড্রিংগ বিশেষ ভূমিকা। “রেছেন। তিনিও অন্যান্য সাংবাদিকদের সাথে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হােটেলে আবদ্ধ * পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর সালিক যখন ২৬ মার্চ (শুক্রবার) বিকাল ৫-৩০ মিঃ ৯ ৩০ জন সাংবাদিককে জোর করে হােটেল থেকে এয়ারপাের্টে নিয়ে যান তখন ” হােটেলে আত্মগােপন করে থাকেন। ২৫ মার্চের কালাে রাত্রির ২৪ ঘন্টা পরে। ‘রের মতাে সান্ধ্য আইন শিথিল করা হয় তখন ড্রিংগ গােপনে ঢাকার বিভিন্ন অংশ। বিদেশী প্রায় ৩০ জন সাংবাদিক সায়মন ড্রিংগ হােটেলে আত্মগােপন যে প্রথম বারের মতাে সান্ধ ঘরে দেখেন এবং পরবতী সুযােগে ঢাকা থেকে ব্যাংককে চলে যান। প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ ব্যাংকক থেকে লন্ডনে প্রেরণ করেন এবং তা দি ডেইলী টেলিকায় পত্রিকায় “Tanks crush revolt in Pakistan” শিরােনামে প্রকাশিত হয়। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, পুলিশ লাইন ও পুরানাে ঢাকার হিন্দু প্রধান এলাকাসহ ঢাকায় সংঘটিত ধ্বংসযজ্ঞের বিস্তারিত বিবরণ উক্ত প্রতিবেদনে প্রকাশ করেন। সায়মন ড্রিংগের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের আন্দোলনের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রেফতার হওয়ার খবর চুড়ান্তভাবে জানা যায়। ইতােপূবে শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে বিভিন্ন ভিন্নধর্মী খবর পরিবেশন করা হয়েছিল। সায়মন ড্রিংগের প্রাথমিক রিপাের্টে জানা যায়। যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঢাকা আক্রমণের জন্য ১ ব্যাটেলিয়ন আমর্ড, ১ ব্যাটেলিয়ন আর্টিলারী এবং ১ ব্যাটেলিয়ন ইনফ্যান্ট্রি (সর্বমােট ৩ ব্যাটেলিয়ন) সৈন্য ব্যবহার করেছে। সায়মন ড্রিংগ তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন যে, “In the name of God and a united Pakistan, Dhaka is today a crushed and frightened city. After 24 hours of ruthless, cold blooded shelling by the Pakistan army, as many as 7000 people are dead, large areas have been levelled…”
| দি টাইমস পত্রিকা ৩০ মার্চ এসােসিয়েটেড প্রেসের ফটো সাংবাদিক মাইকেল লরেন্সের বরাত দিয়ে “At Dhaka University the burning bodies of students still lay in dormitory beds… A mass grave had been hastily covered…” শিরােনামে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে প্রথম পাতায় হেড লাইন। প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ঢাকায় সামরিককর্তাদের চক্ষুকে ফাকি দিয়ে যে কয়জন সাংবাদিক ঢাকার ধ্বংসলীলা দেখার সুযােগ করে নিয়েছিলেন মিঃ লরেন্স তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন। দি টাইম্স ছাড়াও ইভিনিং স্ট্যাণ্ডার্ডসহ অন্যান্য পত্রিকা মাইকেল লরেন্সর প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ প্রকাশ করে এবং তার তােলা ঢাকার ছবি ছাপিয়ে বাংলাদেশের প্রকৃত অবস্থা বিশ্ব বিবেকে কাছে তুলে ধরে। তার প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেন যে, “Touring the son burning areas of fighting on Saturday and Sunday, it was obvious that the city had been taken without warning: | বাংলাদেশে স্বাধীনতা ঘােষণার পর বিশ্বজনমতের যে এক অংশ স্বাধীনতা ঘােষ বাঙালীদের বাড়াবাড়ি বা বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন মনে করেছিলেন সে অংশ ও ২ ৩ খবরা-খবরে স্বাধীনতা ঘােষণার যৌক্তিকতাকে স্বীকার করতে বাধ্য ২ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টিতে লন্ডন থেকে প্রকাশিত এ পত্রিকার ভূমিকা বিশেষ অবদান রেখেছে। ঢাকা থেকে প্রত্যাগত বৃটিশ সাংবাদিকদের প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ প্রকাশ বাংলাদেশে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের প্রকৃত চিত্র আংশিকভাবে হলেও বৃটিশ জশন রেছিলেন সে অংশ ও ২৯ এবং ৩০ গুতে লন্ডন থেকে প্রকাশিত এ কয়েকদিনের দশার বিবরণ প্রকাশিত হওয়ার পর বৃটিশ জনমনে বিরাট পতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। ২৮ ও ২৯ মার্চ এবং এপ্রিলের প্রথম দিকে লন্ডন থেকে প্রকাশিত কয়েকটি আন্তর্জাতিক পত্রিকার সম্পাদকীয়সমূহে উক্ত প্রতিক্রিয়ার প্রতিফলন ঘটে । উপরােক্ত সম্পাদকীয়সমূহে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ভবিষ্যৎ আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া এবং পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের কর্তব্যের প্রতি ইঙ্গিত নির্দেশ করে মন্তব্য করা হয়। সুদুর লন্ডন থেকে সাংবাদিকরা যে ভবিষ্যতবাণী করতে সমর্থ হয়েছিলেন বা পাকিস্তান সংকটে যে বাস্তব সমাধান চিন্তা করতে পেরেছিলেন তা পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের পক্ষে চিন্তা করা সম্ভব হয়নি।
২৮ মার্চ, ১৯৭১ইং তারিখে ‘সানডে টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় ‘The victim শিরােনামে প্রকাশিত এক সম্পাদকীয়তে বলা হয় যে, “What ever happens, the old Pakistan is dead. The rulers are trying to deny that fact by arms, but the attempt cannot be other than tragic folly.” লন্ডন থেকে প্রকাশিত রক্ষণশীল এই পত্রিকায় ২৫ মার্চের কালাে রাতের ঘটনার পর তিন দিনের মধ্যে উপরােক্ত মন্তব্য কি পরিমাণ বাস্তব ছিল তা পরবর্তীকালে প্রমাণিত হয়েছিল। ‘দি সানডে টেলিগ্রাফে’ উপরােক্ত সম্পাদকীয়তে বায়াফ্রার গৃহযুদ্ধ এবং ভিয়েতনামে আমেরিকার বর্বরতাকে উল্লেখ করে পূর্ব পাকিস্তানের গৃহযুদ্ধকে আরাে ভয়াবহ ও ব্যতিক্রমধর্মী বলে আখ্যয়িত করা হয়। ‘দি সানডে টেলিগ্রাফের মন্তব্যকে অনুধাবন করে অর্থাৎ পুরানাে পাকিস্তানের যে মৃত্যু ঘটেছে তাকে মেনে নিয়ে পাকিস্তানের শাসক গােষ্ঠী যদি শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ খুঁজতেন তা হলে হয়তাে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে এত রক্তপাত ঘটাতাে না। ২৯ মার্চ ‘দি টাইমস’ পত্রিকায় The watching Neighbours’ শিরােনামের এক। সম্পাদকীয়তে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আর একটি বিশেষ দিক বিশ্ব জনমতের কাছে তুলে ধরা হয়। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মতামতকে পদদলিত করে একটি জনগােষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্র পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত কিভাবে গ্রহণ করতে পারে তার আভাস উক্ত সম্পাদকীয়তে দেয়া হয়। সম্পাদকীয়-এর এক অংশে উল্লেখ করা হয় যে, *”Undeniably all the emotions of the partition of 1947 are Tevived by the dispute that is now being fought over. And in this context India’s involvement can begin with the natural Bengali ympathies of such a politically volatile city as Calcutta. There is much encouragement also for champions of anti Pakistani mument to get into action.” বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে ভারত এবং চীন ভাবে মূল্যায়ন করবেন তা সম্পাদকীয়তে বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষণ করা হয়। বিশেষ করে লাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতীয় প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে ২৯ মার্চে রক্ষণশীল পত্রিকা দি স পত্রিকা যে মন্তব্য করেছিল তা পরবর্তীতে অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবে রূপ লাভ
করেছিল। একথা ঐতিহাসিকভাবে সত্য যে, ১৯৪৭ সনে ভারত বিভক্তিকরণ ভারতে বহু নেতা মেনে নিতে পারেননি এবং শক্তিশালী পাকিস্তানও অনেকের কাম্য চিন এমতাবস্থায়, পাকিস্তানের এক অংশ অস্ত্রের বলে বলীয়ান হয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ তা নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার প্রক্রিয়ায় ভারত নিপ থাকবেন এটা আশা করা (পাকিস্তান প অবাস্তব তা যুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার চতুর্থ দিনেই ‘দি টাইমস পত্রিকার সম্পাদকী দেয়া হয়েছিল; কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সত্য যে, পাকিস্তান তখন সকল যুক্তি জনমতকে উপেক্ষা করে দীর্ঘ নয় মাস বাংলাদেশে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যায়। | ‘দি টাইমসের সম্পাদকীয়তে বাংলাদেশ পরিস্থিতিতে চীনের দৃষ্টিভঙ্গি পর্যালােচনা করা হয়। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ যদি দীর্ঘমেয়াদী গেরিলা যুদ্ধের রূপ লাভ করে তখন চীন বিপ্লবীদের সমর্থন দান করলে বাংলাদেশের সাথে সাথে পশ্চিমবঙ্গও ভারতের হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে বলেও উক্ত সম্পাদকীয়তে সন্দেহ পােষণ করা হয়। এ ক্ষেত্রেও যে ভারতের সমূহ বিপদ রয়েছে তা উল্লেখ করে বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে ভারতীয় নেতাদের অত্যন্ত সতর্ক পদক্ষেপ গ্রহণের সুপারিশ করা হয়। ভারতের পরবর্তী পদক্ষেপসমূহ থেকে প্রমাণিত। হয় যে, ভারতের নেতারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদী রূপ লাভের বিপদ সম্পর্কে সম্পূর্ণ সজাগ ছিলেন। ২৯ মার্চ রাওয়ালপিণ্ডি থেকে ‘দি গার্ডিয়ান পত্রিকার সম্পাদক পিটার প্রেস্টন প্রেরীত এক প্রতিবেদনে জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে একজন নির্বোধ সৈনিক আক্ষায়িত করে পূর্ববঙ্গে ভয়ংকর পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য তাকে দায়ী করেন। প্রতিবেদনের একটি অংশে তিনি লিখেন— “For who else would allow a national election to find a leader, chat to that leader openly for three weeks of wheelerdealing, then within minutes and wihout any fundamental change of situation, accuse him of treason’ and order in the machine gunners? It is the act of a mindless sergeant major.” | ৩১ মার্চ লন্ডনে থেকে প্রকাশিত উদারপন্থি “দি গার্ডিয়ান” পত্রিকায় পূর্ববঙ্গ পরিস্থিতি নিয়ে একটি সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়। সম্পাদকীয়তে মন্তব্য করা হয়, ঢাকায় জঘন্যতম। হত্যাকান্ড মানব জাতি ও মানবতা বিরােধী অপরাধ। এই জঘন্য অপরাধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানাের ব্যাপারে কারােই ইতস্ততঃ করা উচিৎ নয়। সম্পাদকীয় মন্তব্যের এক স্থানে উল্পে। 24 “….Henceforth, the country must be regarded as a particularly brutal and insensitive military dictatorship elected political leadership in prison, its majority obliterated by decree…. The fate of Dacca is an arrogan against humanity and human aspirations, no one shou mealy-mouth by.”
বিলাতের পত্র পত্রিকার ভূমিকা (এপ্রিল ‘৭১)
টেনের মধ্যমপন্থী পত্রিকা দি গার্ডিয়ান’ ৩ এপ্রিল, ১৯৭১ ইং তারিখে বাংলাদেশের পরিস্থিতির উপর “A time to speak out” শিরােনামে এক সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। সম্পাদকীয়তে বাংলাদেশ পরিস্থিতিকে এশিয়ার রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আখ্যায়িত করে বলা হয় যে, “The East Pakistan crisis is not what it was, even a few days ago. Then it was a disastrous, bloodied mess: now it begins to stain the political map of Asia” Stiftca tacts মন্তব্য থেকে বুঝা যায় যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুধুমাত্র আর পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় নেই বরং তা আন্তর্জাতিক রূপ লাভ করেছে। উক্ত সম্পাদকীয়তে আরাে বলা হয় যে, পাকিস্তানের ৭০,০০০ সৈন্যের পক্ষে শহরে আওয়ামী লীগ নেতা, কর্মী, ছাত্র ও যুবকদের হত্যা করা সম্ভব হলেও ৭৫ মিলিয়ন (সাড়ে সাত কোটি) জনগণকে পদানত করা সম্ভব হবে । যে জাতীয় ঐক্যের জন্য পূর্ব পাকিস্তানে জনগণের মতামতকে উপেক্ষা করে হত্যাযজ্ঞ চালানাে হচ্ছে সে জাতীয় ঐক্যের যে চিরতরে মৃত্যু ঘটেছে তা উল্লেখ করে সম্পাদকীয়তে বলা হয় যে, “That a junta of western generals and wild western foot soliders, have ripped apart this mandate in the cause of a national unity which is now, certainly dead for ever. Atrocities can not yoke two lands together.” ৩ এপ্রিলে প্রকাশিত দি গার্ডিয়ানের উপরােক্ত সম্পাদকীয় মন্তব্যে যে ভবিষ্যদ্বাণী করা । হয়েছিল তা প্রবাসী বাঙালীদের কাছে অত্যন্ত বাস্তব মনে হলেও পাকিস্তানের সামরিক জান্তা তা উপলব্ধি করতে পারেনি। নির্যাতন, সন্ত্রাস ও হত্যা পাকিস্তানের দুই অংশকে একত্রিত করতে পারেনি। উক্ত সম্পাদকীয়তে পাকিস্তানের নৃংশংসতা ও হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করা এবং ভালাদের ন্যায্য দাবির সমর্থনে বিশ্বজনমত বিশেষ করে পাকিস্তানের বিবেকসম্পন্ন। “কে এখনই সােচ্চার হওয়ার আহ্বান জানানাে হয়। বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে পাকিস্তানের অপপ্রচার সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার অল্প কিছু দিনের মধ্যেই লন্ডন থেকে ‘ বিলাতের পত্রপত্রিকার দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্বজনমতকে বাংলাদেশের পক্ষে প্রভাবিত। করেছে। সংঘটিত রক্তপাতের খবর ও আপ্রল মাসের প্রথম সপ্তাহে বিলাতের সকল পত্র-পত্রিকায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। মক্তপাতের খবর গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হয়। রবিবারের সাপ্তাহিক পত্রিকাগুলাে।
সপ্তাহের সংগৃহিত সকল খবরের সমন্বয়ে বাংলাদেশের পরিস্থিতির উপর ব ও সম্পাদকীয় মন্তব্য প্রকাশ করে। ৪ এপ্রিল দি সানডে টেলিগ্রাফ’ প লােশাকের “Pakistan’s path to blood shed” এবং কলিন স্মীথর p. bainboo stick Army” শিরােনামে দুটো প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। যথাক্রমে কলিকাতা এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরের যশাের শহর থেকে পাঠানাে হয় । লােশাক মার্চ মাসের শেষের দিকে ইয়াহিয়া-শেখ মুজিব আলােচনা চলাকালে ঢাকা করছিলেন এবং ঘটনাপ্রবাহ কি ভাবে একটি যুদ্ধের দিকে মােড় নিচ্ছিল তা অব করছিলেন। প্রহসনমূলক আলােচনার নাটক, বাঙালীদের অসহযােগ আন্দোলন, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রস্তুতি ও নিরস্ত্র বাঙালীদের জাতীয়তাবাদী চেতনার অভিব্যক্তি ইত্যাদি বিষয়সমূহ পর্যালােচনা করে পাকিস্তানে একটি বড় ধরনের রক্তপাতের সূচনা হয়েছে বলে ডেভিড লােশক মন্তব্য করেন। তার প্রবন্ধ উল্লেখ করেন যে, ২৫ মার্চ রাতের আক্রমণ বাঙালীদের কাছে অপ্রত্যাশিত মনে হলেও তা প্রকৃতপক্ষে পরিকল্পিত আক্রমণ ছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই। পাকিস্তান পরিস্থিতির শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য ১১ দিন যাবৎ শীর্ষ আলােচনা ও প্রতিদিনই অগ্রগতির খবর পরিবেশন করায় বাঙালীরা এধরনের আক্রমণের কথা চিন্তা করতে পারেনি। অন্যদিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা সম্পর্কে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে, In addition, the army had a carefullylaid contingency plan. Its intelligence network had thoroughly infiltrated the Awami League. The Army had lists of hundreds of key party workers to round up. It had a schedule of targets in Dacca. Thus it was only a matter of hours before the Army was able to eliminate physically the essence of the Awamy League.” প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে, প্রথম দিকে পাকিস্তানের সুসজ্জিত সেনাবাহিনী তাদের হত্যাযজ্ঞের অভিযানে শহর ভিত্তিক সাফল্য অর্জন করলেও সারা দেশের বিক্ষুব্ধ জনতাকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। ইতােমধ্যে স্থানে স্থানে প্রতিরােধ ও প্রতিশােধ কার্যক্রম শুরু হয়েছে এবং পশ্চিম পাকিস্তানী বেসামরিক নাগরিক ও সেনাবাহিনীর সহযােগী ব্যক্তিদের যর চ9থামসহ বিভিন্ন শহরে বাঙালি মুক্তিযােদ্ধারা হত্যা করছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
ডেভিড লােশাক বামপন্থি শক্তি অস্ত্র জোগাড় করে এই পরিস্থিতিতে একা বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটানাের উদ্দেশ্যে সশস্ত্র সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়ে রক্তপাত আরাে বৃক্ষ করবে বলেও তার প্রতিবেদনে আশংকা প্রকাশ করেন। ‘দি সানডে টেলিগ্রাফে’ অপর এক প্রতিবেদনে কলিন স্মীথ অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত ‘গলার মােকাবেলায় নিরস্ত্র বাঙালি মুক্তিযােদ্ধাদের অসম সাহসিকতা ও দেশপ্রেমের মূল্যায়ন করেন। তিনি ২৫ মার্চের পরবর্তী সময়ে মুক্তিযােদ্ধারা স্থানে পানারক আতরােধ গড়ে তুলছে তা গেরিলা যুদ্ধ শুরু হওয়ার অন্তবর্তকিালীন ব্যবস্থা হিসেবে আখ্যায়িত করেন। অবিশ্বাস্য হলেও বাঙালীরা যে প্রথমে বাঁশের লাঠি নিয়ে প্রতিরােধ রচনা করেছিলেন তার উল্লেখ কর। civilian volunteers of anything more than এর উল্লেখ করতে গিয়ে প্রতিবেদনের এক অংশে বলা হয় যে, “Few of the volunteers of the Bengali National Liberation Army-have ing more than single-barrelled shotguns. Most have sharpened bamboo sticks.” কলিন স্মীথ সে সময়ে ( বের পরিস্থিতি ও বাঙালীদের প্রতিরােধ সংগ্রামের বিস্তারিত বিবরণ এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে মুক্তিযােদ্ধাদের কয়েকটি খণ্ড যুদ্ধের চিত্র তুলে ধরেন। বাঙালীদের সাহসের প্রশংসা করে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে, “Undoubtedly the Bengalis, the despised clerking box wallas, the same people the London skin-heads were beating up in the East End, have put up a much stiffer resistance than the worrior Punjabis and Beluchis expected.” কলিন শ্মীথের উপরােক্ত মন্তব্য থেকে স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে, বিদেশী সাংবাদিকদের দৃষ্টিতে বাঙালীরা কেরানীকূল বাক্সওয়ালা-তাদের পক্ষে যুদ্ধ করা এক অবিশ্বাস্য ব্যাপার। প্রতিবেদনে সে সময় কালে (১৯৭০-৭১) লন্ডনে মাথা কামনাে (skinhead) কিছু উচ্ছংখল যুবক পূর্ব লন্ডনে বাঙালীদের উপর যে আক্রমণ পরিচালনা করেছিল তার উল্লেখ রয়েছে।
এ সকল যুবকরা এক পাওয়েলের (এম, পি) বর্ণবাদী আদর্শের অনুসারী হিসাবে বিদেশীদের উপর আক্রমণ চালাতাে। লন্ডনে বসবাসকারী প্রবাসী বাঙালীরা সবচেয়ে নিরীহ প্রকৃতির মানুষ হিসাবে পরিচিত থাকায় তাদেরকে উক্ত বর্ণবাদী আক্রমণের টার্গেট করা হতাে। কলিন স্মীথ উদাহরণ হিসেবে এ ধরনের নিরীহ বাঙালীরাও যে বাধ্য হয়ে অস্ত্র ধরেছে এবং সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করছে তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে স্কীন হেডদের কথা উল্লেখ করেছেন। লন্ডন থেকে প্রকাশিত রবিবারের অপর একটি পত্রিকা ‘দি সানডে টাইমস’ ৪ এপ্রিল, The slaughter in East Pakistan” শিরােনামে একটি সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। সম্পাদকীয়তে বাংলাদেশে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডকে সত্যায়িত করে বলা হয় যে, “By now the picture is a little more clear and a great deal more gruesome. whough first hand reports from Dacca itself and from some of the major towns have come in to confirm that what is appening is far worse than what might have been expected in a war of East Pakistanis resisting the forces of the central ment in their demand for independence.” সম্পাদকীয়তে বিবদমান। “কস্তান সেনাবাহিনী বনাম মুক্তিযােদ্ধা, বাঙালী ও অবাঙালী, সেনাবাহিনীর সহযােগী যােদ্ধাদের সহযােগী এবং সাম্প্রদায়িক প্রতিপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে রক্তপাত দিন দিন বনাম মুক্তিযােদ্ধাদের সহযােগী বৃদ্ধি পাবে বলে মন্তব্য করা হয়। উভয় পক্ষের অনমনীয় মনােভাব ও , শান্তিপূর্ণ পথ পরিহারের ফলে সংকট আরাে জটিল হবে এবং আলােচনার আর কোন পথই খােলা থাকবে না বলেও সম্পাদকীয়তে আশংকা প্রকাশ করা হয়। সর্বশেষ মন্তব্য উল্লেখ করা হয় যে, . “At some point the dialogue between the Government and the leaders of East Pakistan must be resumed. The sooner the better, indging by the horrors of the past few days. 96 কিছুদিনের হত্যাযজ্ঞ দেখে দি সানডে টাইমস যে সংলাপের প্রত্যাশা করেছিলেন তা বাস্তবে রূপলাভ করেনি। বরং এক সাগর রক্ত পাড় হয়ে বাঙালীরা তাদের ইন্সিত লক্ষ্য স্বাধীনতার সূর্যকে ছিনিয়ে এনেছিল।
৬ এপ্রিল ‘দি গার্ডিয়ান পত্রিকায় পূর্ব বঙ্গে’ হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আলেক ডগলাস হিউমের পার্লামেন্টে প্রদত্ত বিবৃতির পরিপ্রেক্ষিতে একটি সম্পাদকীয় ছাপা হয়। শ্রমিক দলীয় এম. পি. ব্রুস ডগলাস-ম্যান, ফ্রাংকজ্যাড, নাইজেল ফিচার এবং লিবারেল পার্টির এম, পি, জন পারডাে ‘পূর্ববঙ্গে গৃহযুদ্ধ বন্ধ করার লক্ষ্যে বৃটিশ সরকারকে হস্তক্ষেপের জন্য এক প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। প্রস্তাব ১৬০ জনের বেশি এম, পি, সমর্থন করেন। এই প্রস্তাবের প্রেক্ষিতেই স্যার আলেক ডগলাস-হিউম পার্লামেন্টকে জানান যে, বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী এই সমস্যা আলাপ-আলােচনার মাধ্যমে সমাধানের জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি তার বক্তব্যে পূর্ববঙ্গে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে। কোন মন্তব্য না করায় শ্রমিকদলীয় এম, পি, ডেনীস হীলি পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে সমালােচনা করে বৃটিশ সরকারকে পাকিস্তান সরকারের উপর শান্তি স্থাপনের জন্য চাপ প্রয়ােগের অনুরােধ করেন। স্যার আলেক ডগলাস-হিউমের বক্তব্যে ‘পূর্ববঙ্গের গণতন্ত্রের প্রতি সমর্থন না করায় সম্পাদকীয়তে উল্লেখ করেন Sir Alec Douglas-Home had the opportunity to declare Britain’s support for democracy in East Pakistan. He wasted it. The Presideut Yahya Khan did not want Shaikh Mujib to assume the powers that his people had voted him. So the President reached for his gun. What is happening in East Pakistan is unjustified military oppression. Until Sir Alec can bring himself to say so he should stop making statement.” এপ্রিল মাসের প্রথম ও দ্বিতীয় সপ্তাহব্যাপী বিলাতে পত্র-পত্রিকায় প্রত্যক্ষদর্শীর উদ্ধৃতি দিয়ে বাংলাদেশে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের খবর পরিবেশন অব্যাহত থাকে। লন্ডন যে প্রকাশিত দি গার্ডিয়ান, পত্রিকায় ৭ এপ্রিল তারিখে মার্টিন উলাকোট “Refugees flee murder in East Pakistan” শিরােনামে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেন প্রতিবেদনে বন্দর নগরী চট্টগ্রাম থেকে পালিয়ে কলিকাতার অবতরণকারী ১১৯ জন রােপিয়ান ও আমেরিকান শরণার্থীর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ও সাক্ষাৎকারের বিবরণ দেয়া হয়। কলিকাতা থেকে প্রেরিত উক্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন যে, উল্লেখিত ১১৯ জন বিদেশী নাগরিকের মধ্যে ৩৩ জন বৃটিশ নাগরিক, তাদের অভিজ্ঞতার বিবরণ প্রদান করেন। বিপার্টের এক অংশে চট্টগ্রামের পরিস্থিতি বর্ণনা করে উল্লেখ করা হয় যে, Chittagong, e second city of East Pakistan, is shattered wrek after two weeks of fighting, killing and looting, with bodies still lying in the streets and a large arca burnt out, refugees from the port city said here today. 199 Europeans and Americans, including 33 British, gave horrifing accounts of killing and atrocities by both sides and by criminal elements. বিদেশী যে সকল ব্যক্তি আটক পড়েছিল তাদেরকে উদ্ধার করে ‘Clan McNair’ নামক কার্গো জাহাজ কলিকাতা পাের্টে নিয়ে যায়।
বিদেশীদের বিবরণীতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রাথমিক দিকের পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণা করা যায় যে, চট্টগ্রামে উভয় পক্ষেই আক্রমণ ও পাল্টা আক্রমণ চলে। শরণার্থীদের মতে চট্টগ্রাম শহর তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সম্পূর্ণ দখলে ছিল। বিবরণীতে বলা হয় যে, “All agreed that Chittagong was now firmly under army control although, as one said, with much of its puplation gone and with no services, it is now a dead city.” লন্ডন থেকে ৭ এপ্রিল তারিখে প্রকাশিত ‘দি টাইমস’ পত্রিকায় পিটার হেজেলহার্ট অপর এক প্রতিবেদনে কলিকাতায় আগত শরণার্থীদের বরাত দিয়ে “British refugees from Chittagong flee of murder by both sides” নামে অনুরূপ বিবরণ প্রকাশ করেন। প্রতিবেদনের একটি অংশে উল্লেখ করা হয় যে, ‘The Pakistan Army has embarked on a programme of genocide and troops are moving through the city’s streets. gunning down every Bengali they see.” বিদেশী নাগরিকদের উপরােক্ত মন্তব্য থেকে স্পষ্ট অনুমান করা যায় যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাঙালীদের উপর কি পরিমাণ বর্বর ও নৃশংস হত্যাকাণ্ড পরিচালনা করেছিল। বিলাতের বাঙালীরা এ পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যে সকল অভিযােগ থাপন করেছিল তা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার খবর প্রকাশের মাধ্যমে আস্তে আস্তে প্রমাণিত হয় এবং বাঙালীদের ইস্যুর সমর্থনে বিশ্ব জনমত সৃষ্টি হয়। ১১ এপ্রিল তারিখে “দি সানডে টাইমস” নিকোলাস টমালিন বাংলাদেশের উত্তর সীমান্ত মদিনাজপুর থেকে প্রেরিত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। প্রতিবেদনে পাকিস্তান বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে যে হত্যাকাণ্ড পরিচালনা করেছিল “তারিত বিবরণ উক্ত রিপাের্টে প্রদান করা হয়। বাংলাদেশের পরিস্থিতি বিশেষ করে জপুরের অবস্থা আলােচনা করতে গিয়ে মিঃ টমালিন উল্লেখ করেন যে, “By the Time these words are in print the town of Dinajpur in Free Bangladesh will almost certainly be overwhelmed by West Pakistani troops and Sgt-Major Abdur Rab, its Chief Defender will probably be dead” উক্ত প্রতিবেদনে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের মে প্রদত্ত সামরিক নির্দেশ উল্লেখ করে বলা হয় যে, বাংলাদেশে হত্যাযজ্ঞ পরিচালনার পূর্ব সিদ্ধান্ত সম্পর্কে স্পষ্ট প্রমাণ উক্ত নিদেশ থেকে পাওয়া যায়। রেডিওতে। প্রচারিত নির্দেশে বলা হয় যে, “Official orders from President Yahya Khan’s high command that opposition be crushed by slaughtering indiscriminately destroying indiscriminately and above all, by killing all military, civil and intellectual leaders, উপরােক্ত রেডিও নির্দেশ থেকে আর প্রমাণের অপেক্ষা রাখেনা যে, পাকিস্তান বাংলাদেশের। মুক্তিযুদ্ধকে স্তব্ধ করে দেয়ার জন্য নির্বিচারে হত্যা, ধ্বংস ও নির্যাতন পরিচালনা করেছিল। মিঃ টমালিন প্রতিবেদনের এক অংশে তার নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে উল্লেখ । করেন যে “We have seen the massacres with our own eyes and that radio message appears to prove the deliberate intention.” | মিঃ টমালিন উক্ত প্রতিবেদনে পাকিস্তান কর্তৃক প্রচারিত মিথ্যা রটনা বিরুদ্ধে কিছু তথ্য পরিবেশন করেন।
ইতােপূর্বে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা অপপ্রচার চালায় যে, দিনাজপুর শহরে ভারতীয় সৈন্য ও ভারতীয় অস্ত্র দিয়ে বাঙালীদের সমর্থন দেয়া হচ্ছে। এই অপপ্রচারের প্রতিবাদ করে মিঃ টমালিন উল্লেখ করেন যে, তিনি যখন দিনাজপুরসহ সীমান্ত এলাকা পরিদর্শন করেন তখন তিনি বাঙালী মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে পুলিশ ও বিডিআর এর ব্যবহৃত হালকা রাইফেল দেখতে পান। ছয় ডিভিশন ভারতীয় সৈন্যের সীমান্তে অবস্থানের পাকিস্তানী অপপ্রচারকে প্রত্যাখ্যান করে তিনি উল্লেখ করেন যে, “As for Pakistani reports that six Indian divistions are threatening the border, these are nonsense.” মিঃ টমালিন বাঙালীদের শৌর্য ও বীরত্ব সম্পর্কে ভূয়সী প্রশংসা করে সার্জেন্ট মেজর আব্দুর রবের বীরত্বের বিবরণ প্রদান করেন। স্বাধীনতার জন্য একাগ্রতা, জাতীয়তাবােধের প্রেরণা ও হত্যাযজ্ঞের প্রতিশােধ গ্রহণের শপথে বলীয়ান বাঙালি যুবকদের স্তব্ধ করা সম্ভব হবে না বলে প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়। সার্জেন্ট মেজর রবের মতাে বীর মুক্তিযােদ্ধা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করলে মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতিহত করা সম্ভব হবে না বলেও প্রতিবেদনে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নৃশংস হামলা ও তার ফলে সৃষ্ণ পারাহাততে সীমান্ত শরণার্থীদের ভিড় সম্পর্কে বিভিন্ন প্রতিবেদন এপ্রিল মাসের তৃতা চতুথ সপ্তাহে বিলাতের পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১২ এপ্রিল তারিখে ‘দি গার্ডিয়ান পত্রিকায় “Border area under Pakistani pressure” শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অগ্রযাত্রা এবং মুক্তিযােদ্ধাদের পিছু হটার বিবরণ প্রকাশিত হয়। উক্ত প্রতিবেদনের সাথে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক আটক বাংলাদেশের নেতা শেখ সজিবর রহমানের একটি ছবি ছাপানাে হয়। ২৫ মার্চের কালাে রাত্রিতে ৩২ নং ধানমণ্ডিস্থ বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে ইসলামাবাদে নিয়ে যাওয়ার পথে করাচী বিমান বন্দরে পুলিশ বেষ্টিত অবস্থায় শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি প্রকাশ করা হয়। এর ফলে প্রবাসী বাঙালীদের মধ্যে কিছুটা হতাশা পরিলক্ষিত হয়। ইতােপূর্বে শেখ মুজিবের গ্রেফতারের বিষয়ে প্রবাসীদের মধ্যে যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ছিল তা এই ছবি প্রকাশের পর পরিষ্কার হয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভে শেখ মুজিবের আত্মগােপনের খবরে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এবং প্রবাসীদের মধ্যে যে আশার সঞ্চার করেছিল তা স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা স্তিমিত হয়ে যায়।
‘দি টাইমস’ পত্রিকায় ১৩ এবং ১৪ এপ্রিল তারিখে এসােসিয়েটেড প্রেসের সংবাদদাতা ডেনিস নিলড (Dennis Neeld) এর বরাত দিয়ে যথাক্রমে “Thousands still fleeing frightened Dacca” 47: “Dacca city of fear” FICTTRICT 1 প্রতিবেদনে এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ের ঢাকার অবস্থা এবং দেশত্যাগের ভয়াবহতা সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশিত হয়। ডেনিস নিড পাকিস্তান সরকারের বিধি-নিষেধ উপেক্ষা করে ভারত সীমান্ত দিয়ে ঢাকায় গিয়ে সব কিছু দেখে ঢাকা থেকে গােপনে উপরােক্ত প্রতিবেদনসমূহ প্রেরণ করেন। ১৩ তারিখে প্রকাশিত প্রতিবেদনে মিঃ নিলড কূটনৈতিক এক সূত্র উল্লেখপূর্বক শুধুমাত্র ঢাকা শহরে দুই সপ্তাহে ৬০০০ জনের মৃত্যুর হিসাব প্রদান করেন। প্রতিবেদনে আরাে বলা হয় যে, ঢাকা শহরকে খুব ভীত সন্ত্রম্ভ একটি আত্মসমর্পণকারী শহর। বলে মনে হয়। ঢাকা শহরের তখনকার পরিস্থিতির বিবরণ দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয় ”The crack of rifle shots still punctuates the night as troops round up Awami League officials, intellectuals and other prominant Bengalis. This is gestapo rule, one western diplomate commented. The army has committed mass murder.” 417313 বাড়িঘর ছেড়ে যে যে অবস্থায় পারছে ঢাকা ত্যাগ করছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। ১৭ এপ্রিল ‘দি টাইমস’ পত্রিকায় “East Bengal rebel Hg, falls after jet rad” শিরােনামে প্রথম পাতায় গুরুত্ব সহকারে একটি প্রতিবেদন ও একটি সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সীমান্ত শহর কুষ্টিয়া দখলের বিবরণ এবং শরণার্থী সমস্যা সম্পর্কে বিস্তারিত আলােচনা করা হয়। কুষ্টিয়া দখলকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জেট বিমান কিভাবে নির্বিচারে বেসামরিক এলাকায় বােমাবর্ষণ করে তার “ম আতবেদনে উল্লেখ করা হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধাদের পিছু হটার সাথে সাথে যায় শরণার্থী সংখ্যা বৃদ্ধিতে প্রতিবেদন ও সম্পাদকীয়তে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। নে ভারতীয় সরকারী সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে ইতােমধ্যে ১০০,০০০ শরণার্থীর ভারতীয় সীমান্ত অতিক্রমের একটি হিসাব প্রদান করে বলা হয় যে, “Offier . “Officials in Calcuttad India so far. Makeorder and the resugees are Government. এ reported that 100.000 refugees mps have been set up on the border and the refug being provided with food paid for by Government. সম্পাদকীয়তে এ হারে শরণার্থী ভারতীয় সীমান্ত অতিক্রম কর তক সমস্যা হিসাবে চিহ্নিত করে তার স্থায়ী সমাধানে শান্তির প্রতি হুমকি হবে বলে আশাংকা করা হয়। মেহেরপুরের (বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অবস্থিত) কাছাকাছি কোন এক স্থান cor.. এপ্রিলে মার্টিন ওলাকোট (Martin Woollacott) প্রেরিত একটি প্রতিবেদনে “Bangladesh troops flee into India” শিরােনামে ১৯ এপ্রিল ‘দি গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
এই প্রতিবেদনে সীমান্ত শহর চূড়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর কিভাবে | পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হস্তগত হয়েছিল তার বিবরণ প্রকাশ করা হয়। এ অঞ্চলে প্রতিরােধকারী মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে পাকিস্তানীদের অভিযান ছিল সর্বাত্মক। সীমান্ত থেকে | ৩০০ গজ দূরে অবস্থিত মেহেরপুরের একটি গ্রামে বাংলাদেশের অস্থায়ী বিপ্লবী সরকারের আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘােষণার পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তৎপরতা এত অঞ্চলে বহুগুণ | বৃদ্ধি পায়। ১৭ এপ্রিল স্বাধীনতা ঘােষণা হওয়ার পরের দিন বস্তুতপক্ষে বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধারা মেহেরপুর থেকে পিছু হটে সীমান্তে আশ্রয় গ্রহণ করে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদন লেখার দিনে (১৮ এপ্রিল) প্রায় বিনা বাধায় পাকিস্তান বাহিনী মেহেরপুর দখল করে নেয়। পাকিস্তান এয়ার ফোর্সের জঙ্গী বিমানের সহযােগিতায় মুক্তিযােদ্ধাদের সৃষ্ঠ প্রাথমিক প্রতিরােধ ভেঙে পড়ে এবং বাঙালি বেসামরিক জনগণের উপর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অত্যাচার ও আক্রোশ আরাে বৃদ্ধি পায়। নিরীহ জনগণ পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে জীবনের ভয়ে হাজার হাজারে সীমান্তের অপর পারে পালিয়ে যেতে শুরু করে। ইতােমধ্যে ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী ১০০,০০০ শরণার্থীর সাথে প্রতি মুহূর্তে হাজারাে শরণার্থী যােগ হয়ে সমস্যা আরাে তীব্রতর আকারে ধারণ করে। এই পর্যায়ে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ থেকে দৃষ্টি পরিবর্তিত হয়ে বিশ্বজনমতের দৃষ্টি শরণার্থী শিবিরের প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে একটি নতুন প্রেক্ষপট সৃষ্টি হয়। | ‘দি গার্ডিয়ান’ পত্রিকা ১৪ এপ্রিল “Rhetoric and Reality” শিরােনামে সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। তিন সপ্তাহ ব্যাপী রক্তপাতের মাধ্যমে পাকিস্তান পারই অবস্থায় উপনীত হয়েছে তার মূল্যায়ন করা হয় এই সম্পাদকীয়তে। আপাতত প সেনা বাহিনী বিজয়ী মনে হলেও বাংলাদেশের সুদূর প্রসারী সংগ্রাম এবং হত অবিশ্বাস ও অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতিকে কাটিয়ে উঠা যে পাকিস্তানের পক্ষে সম্ভব Reality” শিরােনামে একটি র মাধ্যমে পাকিস্তান পরিস্থিতি কোন কায়তে। আপাতত পাকিস্তানের র সংগ্রাম এবং হত্যাকাণ্ডের ফলে গানের পক্ষে সম্ভব হবে না তাও।
সম্পাদকীয়তে সন্দেহ করা হয়। ইয়াহিয়া খানের রণনীতি ভুল হিসাবের ফসল উল্লেখ করে বলা হয় যে, বাঙালীদের মাথা কেটে (হত্যা করে) জাতীয়তাবাদী চেতনার ধ্বংস করা যে অসম্ভব তা ইয়াহিয়া খান ধারণা করেনি। সম্পাদকীয় এর এক পর্যায়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা কে বায়ফ্রা এর বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের সাথে তুলনা করা সমীচীন নয় বলে মন্তব্য করা হয় যে, ‘The Bangladesh affair is not a second Biafra or the fruits of more interminable wrangling hetween Delhi and Rawalpindi. It rose simply when a well conducted, peaceful elections produced a result the army could not stand.
১৬ এপ্রিল লন্ডন থেকে প্রকাশিত প্রগতিশীল সাপ্তাহিক ‘নিউ ষ্ট্যাটসম্যান’ পত্রিকায় একটি দীর্ঘ সম্পাদকীয় “The blood of Bangladesh” প্রকাশিত হয়। সম্পাদকীয়ের শুরুতে মন্তব্য করা হয় যে, If blood is the price of a people’s right to Independence. Bangladesh has over paid, দীর্ঘ সম্পাদকীয়তে। বাংলাদেশের জনগণের আত্মাহুতি ও নির্যাতনের বিবরণ উল্লেখ করে এই যুদ্ধকে গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর যুদ্ধ হিসাবে মূল্যায়ন করা হয়। এই সংগ্রামে তৃতীয় বিশ্বকে বাংলাদেশের পক্ষে আরাে সােচ্চার হওয়ার প্রয়ােজনীয়তা সম্পর্কে তাগিদ দেয়া হয়। সম্পাদকীয়তে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের জিওপলিটিকেল কারণসমূহ বিশ্লেষণ করে। বায়াফ্রার বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের সাথে তুলনা না করার জন্য উল্লেখ করা হয়। পাকিস্তান সৃষ্টির সময়ে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের ভূমিকা সমালােচনা করে উল্লেখ করা হয় যে, Pakistan was a state created from above for reasons of Political expediency. So the lesson in simple, if a hard one that such structures cannot survive. How much human misery must be endured before that fact is accepted. উপরােক্ত সম্পাদকীয় ছাড়াও ১৬ এপ্রিল সীমান্ত অতিক্রম করে সিলেটের অভ্যন্তর থেকে ডেভিড লােশাক (David Loshak) কর্তৃক প্রেরিত সংবাদ “Slaughter goes on as East Pakistan fights for | life” শিরােনামে দি সানডে টেলিগ্রাফে প্রকাশিত হয়। এই সংবাদে মুক্তিযুদ্ধে উভয় পক্ষের ক্ষয়ক্ষতি, মুক্তিফৌজের মরণপণ সংগ্রাম এবং সাধারণ জনগণের দুর্ভোগের কথা। বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হয়। দি সানডে টেলিগ্রাফ পত্রিকায় একই দিনে সায়মন ড্রিংগ প্রেরিত অপর এক সংবাদ ‘Sheikh’s supporters failed to prepare for amed resistance” শিরােনামে প্রকাশিত হয়। পাকিস্তানের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে প্রথম যে বৃটিশ সাংবাদিক কলিন শীথ কলকাতা থেকে ঢাকায় গিয়ে সরজমিনে প্রত্যক্ষ করে প্রত্যাবর্তন করে কলকাতা থেকে সংবাদ প্রেরণ করেন তা ‘দি অবজারভার পত্রিকায় ১৮ এপ্রিল প্রকাশিত হয়। এই সংবাদে পাকিস্তানী সেন্যদের বর্বরতা এবং মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতিরােধ সংগ্রামের বিভিন্ন দিক বিস্তারিতভাবে স্থান। লাভ করে।
ডেভিড লােশাক এক পর্যায়ে মন্তব্য করেন যে, “I am s now on President Yahya will hold his Eastern province force and that his rule will be harassed by continual re however, ill organised and futile it may be. The Bengalis never froget or forgive the happenings of the past few w উপরােক্ত মন্তব্য থেকে স্পষ্টভাবেই মুক্তিযােদ্ধাদের দৃঢ়তা ও ইয়াহিয়া খানের ব সম্পর্কে অনুমান করা যায়। ১৮ এপ্রিল ‘দি সানডে টাইমস’ পত্রিকায় প্রম “Pakistan: A time to speak out” শিরােনামে সম্পাদকীয়তে বাংলাদেশে সং মর্মান্তিক ও জঘন্য ঘটনাবলীর উল্লেখ করে বৃটিশ সরকারকে এখনই সােচ্চার হওয়ার সময় হয়েছে বলে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়। সম্পাদকীয়তে এক অংশে উল্লেখ করা হয় যে , time has come, it is indeed overdue, for the British Government publicily to express its disgust, in for stronger terms than it has yet done, at the course of events in East Pakistan” | ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় ২০ এপ্রিল প্রকাশিত এক সংবাদে শেখ মুজিবুর রহমান ও তার সহকর্মীদের বিচারের জন্য ইসলামাবাদে একটি বিশেষ ট্রাইবুনাল গঠনের খবর পরিবেশন করা হয়। সংবাদে শেখ মুজিবকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যায়িত করে তাকে ভারতের সাথে পাকিস্তান বিরােধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার অভিযােগ অভিযুক্ত করা হয়। ২৪ এপ্রিল “দি টাইমস” পত্রিকায় পশ্চিমবংগের নক্সাল পন্থীরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে “সাম্রাজ্যবাদীদের ষড়যন্ত্র” বলে আখ্যায়িত করে মুক্তি সংগ্রামের বিরােধিতা করছে বলে এক খবর প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশের উগ্র মাওপন্থী নেতা মােহাম্মদ তােয়াহাও পাকিস্তানের শাসক ইয়াহিয়া খানের বিরােধিতা পরিহার করেছেন বলেও উক্ত খবরে উল্লেখ করা হয়। উক্ত খবরে বিলাতে অবস্থানরত তােয়াহা পন্থীদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখযােগ্য যে, বিলাত প্রবাসী চীনপন্থী কমিউনিষ্ট নেতারা ইতােমধ্যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। বাংলাদেশে পাকিস্তানীদের বর্বরতা ও হত্যাযজ্ঞের বিবরণ সাপ্তাহিক ‘নিউজ উইক’ পত্রিকায় ২৬ এপ্রিল তারিখে প্রকাশিত হয়। উক্ত বিবরণের সাথে করাচী বিমান বন্দরে বন্দী অবস্থায় গৃহীত শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি ছাপানাে হয়।
বিলাতের পত্র পত্রিকার ভূমিকা (মে ‘৭১)
বিলাত সফরে আগত পাকিস্তানী ক্রিকেট টিমের বিরুদ্ধে যুক্তরাজ্যস্থ বাংলাদেশ স্টুডেন্ট একশন কমিটিসহ প্রবাসী বিভিন্ন এ্যাকশন কমিটিসমূহের বিক্ষোভের কর্মসূচী গ্রহণের প্রেক্ষাপটে ১ মে তারিখে ‘দি গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। নিবন্ধে আশংকা করা হয় যে, প্রবাসীদের বিক্ষোভের কারণে যদি ক্রিকেট খেলায় বিঘ্ন ঘটে তাহলে বাংলাদেশের প্রতি বৃটিশ ক্রীড়ামােদী জনগােষ্ঠীর সহানুভূতি ও সমর্থন হারাতে পারে। তবে নিবন্ধে একথাও স্বীকার করা হয় যে, বাংলাদেশের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের সংগ্রামকে পদদলিত করার জন্য পাকিস্তানী সামরিক শাসকদের বর্বরতার বিরুদ্ধে বৃটেন ও আমেরিকাসহ বিশ্ববাসী যদি নিচুপ থাকেন তাহলে প্রবাসী বাঙালীদের পক্ষে বিক্ষোভ প্রদর্শন করা ছাড়া বিকল্প কিছু নেই। ১ মে দি টাইমস’ পত্রিকায় জুলফিকার আলী ভুট্টোর বরাত দিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধের আশংকা প্রকাশ করে এক সংবাদ প্রকাশিত হয়। এই সংবাদে আরাে জানা যায় যে, মিঃ ভুট্টো উক্ত সম্ভাব্য যুদ্ধে চীন পাকিস্তানের পক্ষে থাকবে বলে এক বিবৃতিতে দাবি করেছেন। | বৃটেনের বামপন্থী পত্রিকা “মর্নিং সান” ৪ এপ্রিলে প্রকাশিত খবরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ কমিউনিষ্ট পার্টির সমর্থনের কথা প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশ কমিউনিষ্ট পাটি বিশ্বের সকল গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল ও সমাজতান্ত্রিক দেশ সমূহের কাছে বাংলাদেশকে সমর্থনের আবেদন জানিয়েছেন বলে উক্ত খবরে উল্লেখ করা হয়। বাংলাদেশের ছয়টি প্রভাবশালী ট্রেড ইউনিয়ন সমবায়ে গঠিত বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র এবং বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নও বাংলাদেশকে সমর্থনের জন্য বিশ্ববাসীকে আহ্বান জানিয়েছেন বলেও উক্ত সংবাদে জানা যায়। এর ফলে বৃটেনে প্রবাসী প্রগতিশীল কর্মীদের মধ্যে ইতোপূর্বে প্রকাশিত | খবরে যে ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছিল তার অবসান হয়। বার্মিংহামের কাছে এজবাষ্টন ক্রিকেট মাঠে অনুষ্ঠিত ক্রিকেট খেলায় পাকিস্তান ক্রিকেট | টিমের বিরুদ্ধে প্রবাসী বাঙালীদের বিক্ষোভ প্রদর্শনের খবর ‘মর্নিং সান’ পত্রিকায় ৬ মে ফলাওভাবে প্রকাশিত হয়। ৬ মে তারিখে “দি গার্ডিয়ান পত্রিকায় পাকিস্তান ইন্টেলিজেন্স সাভিসের ডি, জি, মেজর জেনারেল মােহাম্মদ আকবর খানের বরাত দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান বেঁচে আছেন এবং সুস্থ আছেন বলে খবর প্রকাশিত হয়। লন্ডন থেকে প্রকাশিত সান্ধ্য দৈনিক “The Evening standard” পত্রিকায় ৬ মে “Time শিরােনামের এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে মন্তব্য করা হয় যে, “This is not a it is virtually a war between two nations, clumsily unite 1947 and now quite clearly imcompatible.”
৭ মে ‘দি গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় “The world’s latest refugees” শিরােনামে এক প্রবন্ধে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে শরণার্থী সমস্যার কথা বিশ্ববিবেকের কা ধরা হয়। পাকিস্তানী সেনা বাহিনীর বর্বরতার ফলে যে বিপুল পরিমাণ শরণার্থী ভারতে প্রবেশ করছে তার ভয়াবহতা সম্পর্কে এই প্রবন্ধে বিস্তারিতভাবে আলােচনা করা হয় । | ‘দি অবজারভার পত্রিকা ৯ মে শরণার্থী সমস্যা সম্পর্কে এক নিবন্ধে এ পর্যন্ত যে বিপুল পরিমাণ শরণার্থী ভারতে প্রবেশ করেছে তাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করতে ভারত যে ব্রিতকর অবস্থায় পড়েছে তার আলােচনা করা হয়। এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে শরণার্থীদের সংখ্যা ৫০ লক্ষে দাঁড়াবে বলে নিবন্ধে আশংকা প্রকাশ করা হয় এবং এ ব্যাপারে আঞ্চলিক শান্তি ভঙ্গের সম্ভাবনার কথাও উল্লেখ করা হয়। ১৩ মে ‘দি গার্ডিয়ান পত্রিকা “The silent conscience” শিরােনামে এক সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশ করে। অবশেষে পরের দিন (১৪ মে) বৃটিশ পার্লামেন্টে বাংলাদেশ সম্পর্কে আলােচনা হবে এই প্রেক্ষাপটে উক্ত সম্পাদকীয় নিবন্ধে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞের মুখে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরুদ্ধে বৃটিশ পার্লামেন্টের এম, পি, দের কাছ থেকে বৃটিশ জনগণ ও বিশ্ব বিবেক কি প্রত্যাশা করে তা বিস্তারিত আলােচনা করা হয়। নিবন্ধে এক অংশে বলা হয় যে How many died. Millions, says the Bangla propagandists. Perhaps 15000 say Yahya’s spokesmen. But crucially even fifteen thousand corpses is an absurd price to pay for keeping the two distant giants of Pakistan in miserable liaison.” নিবন্ধে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয় যে, পাকিস্তানের ধারণার অপমৃত্যু হয়েছে-বাংলাদেশের স্বাধীনতা এখন সময়ের ব্যাপার। ক্ষয়ক্ষতি ও হত্যাকাণ্ড এড়ানাের উদ্দেশ্যে সমস্যার সমাধানের জন্য পাকিস্তানের সেনা শাসনকে বৃটেন যত দ্রুত বাধ্য করতে পারবে ততই মঙ্গল হবে।
নিবন্ধে এক পর্যায়ে উল্লেখ করা হয় যে, “How should a Government which belives in freedon act in these circumstances? It should not hide behind the diplomatic niceties of “internal matter”. It should have an open view.” এ পর্যায়ে বৃটিশ পার্লামেন্টের সদস্যদের এবং সরকারের কি কি করণীয় রয়েছে তাও বিস্তারিত আলােচনা করা হয়। বাংলাদেশ সংক্রান্ত পালামেন্ট ডিবেটকে সামনে রেখে ১৩ মে ‘দি টাইমসূ’ পত্রিকায়। নাটনের ২০৬ জন বৃদ্ধিজীবী, পালামেন্ট সদস্য ও অন্যান্য বিশিষ্ট নাগরিকের স্বাক্ষর সম্বলিত নষ্ঠ ব্যাপি একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়। এই বিজ্ঞাপনে পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর যাযজ্ঞের প্রতি বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বাংলাদেশ থেকে দখলদার পাকিস্তানী সেনাবাহিনী প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত পাকিস্তানকে কোন প্রকার সাহায্য প্রদান থেকে বিরত থাকার জন্য বৃটিশ সরকারের প্রতি আবেদন জানানাে হয়। ১৫ মে “দি টাইমস পত্রিকায় বনগা থেকে পিটার হেজেলহার্সটস (Peter Hazelhurst) কর্তৃক প্রেরিত একটি সংবাদ “Unbelivable misery” শিরােনামে প্রকাশিত হয়। উক্ত সংবাদে বিপুল সংখ্যক শরণার্থীর ভারতে প্রবেশের খবর প্রাধান্য পায়। খবরে বলা হয় যে ইতােমধ্যে প্রায় ২০ লাখ শরণার্থী বনগা এলাকায় রয়েছে। শরণার্থীদের। মাথা গুজবার মত কোন স্থান নেই বলে উল্লেখ করে তাদের সীমাহীন দুর্ভোগের কথা। বিস্তারিতভাবে আলােচনা করা হয়।
বিলাতের পত্রপত্রিকার ভূমিকা জুন ৭১
বাংলাদেশ ইস্যুর আন্তর্জাতিক প্রচারের ক্ষেত্রে জুন মাস বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। বিলাতে পত্রপত্রিকায় বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের ফলে সৃষ্ট শরণার্থী সমস্যা সংবাদের শিরােনাম স করে। প্রায় সকল সংবাদপত্রের ব্যানার হেডলাইন ও সম্পাদকীয়তে স্থান পায় বাংলাদে ইস্যু। ‘দি টাইমস্’ পত্রিকা ১ জুন “Bengal’s suffering millions” শিরােনামে এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বর্বর হত্যাযজ্ঞ থেকে ভারতে পালিয়ে আসা লত লক্ষ শরণার্থীর সীমাহীন দুর্ভোগের কথা আলােচনা করা হয়। শরণার্থীদের বাঁচানাের জন্য আন্তর্জাতিক সাহায্যের প্রয়ােজনীয়তা সম্পর্কেও সম্পাদকীয়তে তাগিদ দেয়া হয়। বাংলাদেশে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব ও শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে পাকিস্তান যে দাবি করেছে তা যে ভিত্তিহীন তার প্রমাণ ভারতে পালিয়ে আসা লক্ষ লক্ষ শরণার্থী । সম্পাদকীয় নিবন্ধে মন্তব্য করা হয় যে, “The evidence of refugees does not confirm the claim made by the army authorities in East Pakistan that order has been restored and that life is returning to normal.” ৪ জুন “দি টাইমস্ পত্রিকার প্রথম পাতার ব্যানার হেডলাইন ৬ কলামে “Drug | supplies runing out as 5,000 refugees die of cholera.” সংবাদটি প্রেরণ করেন পিটার হেজেলহার্সট পশ্চিমবঙ্গের কৃষ্ণনগর থেকে। এই প্রবন্ধে শরণার্থীদের বাসস্থানের অপ্রতুলতা, খাদ্যের অভাব ও রােগ ব্যাধির ভয়াবহতা সম্পর্কে বিশ্বের শান্তিকামী | মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। রক্ষণশীল পত্রিকা দি টেলিগ্রাফ’ ৫ জুন কলিকাতা থেকে | ইয়ান ওয়ার্ড কর্তৃক প্রেরিত একই ধরনের খবর “Cholera-out of control | শিরােনামে প্রকাশ করে। | ৮ জুন ‘দি গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় বাংলাদেশ ইস্যু ও শরণার্থী সমস্যা নিয়ে কয়েকটি প্রবন্ধ | ও সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশ করে। The better way to help” শিরােনামে সম্পাদকীয় |নিবন্ধে বাংলাদেশ থেকে ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী শরণার্থীদের রক্ষা করতে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলাে যে ব্যর্থ হয়েছে তার সমালােচনা করা হয়। সম্পাদকীয়তে | প্রথমেই মন্তব্য করা হয় যে, “The world community should be ashamed at how slow it is to learn. “এই নিবন্ধে ইয়াহিয়া খানকে বাংলাদেশে তাম জিঘন্যতম হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করতে বাধ্য করার জন্য জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে হস্তক্ষেপ করার জন্য আহ্বান জানান হয়।
‘দি গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় একই দিনে সাইমন উইনচেষ্টার coffro “Ferry to freedom or death” 428 “Aid demands beyond . শিরােনামে প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। এই সকল প্রবন্ধ থেকে এটাই স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, লাদেশে মুক্তিযুদ্ধ তার আঞ্চলিক সীমানা অতিক্রম করে আন্তর্জাতিক সমস্যা হিসাবে। হ্নিত হয়েছে। শ্রমিক দলীয় সংসদ সদস্য জন ষ্টোনহাউজ ৮ জুন ‘দি টাইমস’ পত্রিকায় প্রকাশিত এক পত্রে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যা বন্ধের জন্য জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে হস্তক্ষেপ এবং বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের জন্য আহ্বান জানান। | ‘দি গার্ডিয়ান পত্রিকা ৯ জুন “Relief bottleneck threatens aid”; “Guerrillas raids add to border chaos” 998 “Armed police move to stop refugee clash” শিরােনামে তিনটি সংবাদ নিবন্ধ এবং “Refugees fear of Pakistan army” শিরােনামে একটি উপ-সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। উপ-সম্পাদকীয়তে গত ৮ জুন পার্লামেন্টে বৃটিশ পরবাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আলেক ডগলাস হিউম এর সত্য ভাষণের জন্য প্রশংসা করা হয়। স্যার আলেক পার্লামেন্টে এক বিবৃতিতে শরণার্থী সমস্যা সম্পর্কে মন্তব্য করেন যে ‘They were afraid of untolerable suppressive action by the Pakistan army, and only a political settlement would get them back to their homes.” স্যার আলেক এর মন্তব্য থেকে এ কথা স্পষ্ট যে রক্ষণশীল বৃটিশ সরকারের মনােভাব পূর্বের অবস্থান থেকে পরিবর্তন হয়েছে। বৃটিশ পার্লামেন্টে ১০ জুন চারঘন্টাব্যাপী পাকিস্তান, বাংলাদেশ সংক্রান্ত বিতর্কে স্যার আলেক। ডগলাস হিউম বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের প্রয়ােজনীয়তার প্রতি যে গুরুত্ব। প্রদান করেছে তার সমর্থন করে ১১ জুন “দি ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশ করে। ‘দি টাইমস্’ পত্রিকায় ১২ জুন এক সংবাদ নিবন্ধে বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জঘন্যতম গণহত্যা এবং হিন্দুদেরকে নির্বিচারে হত্যার এক মর্মস্পর্শী বিবরণ ছাপানাে হয়। ১২ জুন ‘দি গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় বৃটিশ এম. পি. টেড় লেড়বিটার পাকিস্তান হাইকমিশন কতৃক বাংলাদেশ আন্দোলন সম্পর্কে মিথ্যা, বানােয়াট ও অর্থহীন সংবাদ সম্বলিত প্রচারপত্র প্রকাশ করায় বিরক্ত হয়ে তার প্রতিবাদ করে পাকিস্তান হাই কমিশনার সালমান আলীকে যে পত্র দেন তা সংবাদ আকারে প্রকাশিত হয়। টেড় লেড়বিটার তার পত্রে লিখেন যে, পাকিস্তানের সামরিক সরকার পূর্ব বঙ্গে’ যেভাবে গণহত্যা, অগ্নিসংযােগ ও লকারের মতাে জঘন্য অপরাধ করছে তা শতাব্দির ঘৃনিত কাজ হিসাবে গণ্য হবে।
বাংলাদেশের ঘটনাবলী যে কিভাবে বৃটিশ এম, পি, সহ সুধী সমাজকে বিচলিত করেছিল তা মি. লেড়বিটারের পত্রে প্রতিফলিত হয়েছে। ১৩ জুন ‘দি সানডে টাইমস্ পত্রিকায় এনথােনী মাসকারেনহাস এর সাড়া জা দীর্ঘ প্রবন্ধ ‘Genocide’ শিরােনামে প্রকাশিত হয়। মাসকারেনহাস এই প্রবন্ধ লিখে পরিচয় দিয়েছে তা প্রশংসনীয়। তিনি ভারত বিভাগের পূর্বে গােয়ার অধিবাসী একতে ভারত বিভাগের পর তিনি পাকিস্তানের স্থায়ী বাসিন্দা হন এবং পাকিস্তানী পাস নাগরিক ছিলেন। তিনি পাকিস্তান থেকে প্রকাশিত ‘মর্নিং নিউজ’ পত্রিকার সহকারী সত ও লন্ডনের “দি সানডে টাইমসের প্রতিনিধি ছিলেন। বাংলাদেশে গণহত্যা সংঘটিত হওয়া পর এপ্রিল মাসে তিনি বাংলাদেশ সফর করেন এবং পিরস্থতি সরজমিনে প্রত্যক্ষ করেন। পাকিস্তানে ফিরে এসে তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে তিনি তার রিপোের্ট পাকিস্তানের সরকারের ইচ্ছা মাফিক প্রকাশ করবেন না, যদি রিপাের্ট ছাপাতেই হয় তাহলে প্র পূর্ণ রিপাের্ট প্রকাশ করবেন। প্রকৃত রিপাের্ট পাকিস্তানে প্রকাশ করা সম্ভব হবে না বলে তিনি সম্পূর্ণ রিপাের্ট নিয়ে লন্ডনে উপস্থিত হন। তিনি জানতেন যে, এই রিপাের্ট প্রকাশের a তাকে আর পাকিস্তানে ফিরে যেতে দেয়া হবে না। তাই “দি সানডে টাইমসের’ কর্তপক্ষের সাথে কথা বলে তিনি পুনরায় পাকিস্তানে ফিরে গিয়ে তার স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে তার বাড়ীসহ সকল সম্পত্তি পরিত্যাগ করে লন্ডনে পালিয়ে আসেন। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে লন্ডনে ফিরে আসার পর এই প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। ‘Genocide’ রিপাের্ট প্রকাশের সূচনাতে “দি সানডে টাইমস্’ পত্রিকার প্রথম পাতায় মন্তব্য করা হয় যে, ‘West Pakistanis Army has been systematically massacaring thousands of civilians in East Pakistan since end of march. This is the horrifying reality behind the news blackout imposed by President Yahya Khan’s Government since end of march. This is the reason why more than five million refugees have streamed out of East Pakistan into India, risking cholera and famine. ম্যাসকারেনহাসের দীর্ঘ এই রিপাের্ট বিশ্ব বিবেককে নাড়া দিয়েছিল এবং বাংলাদেশের। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বজনমত সৃষ্টিতে বিরাট ভূমিকা রেখেছিল।
১৪ জুন ‘দি টাইমস্’ পত্রিকায় “Death of a Citizen” এবং “Dwindling flow of refugees suggests West Bangal border has been sealed off” শিরােনামে দু’টি সংবাদ নিবন্ধে বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বর্বরতা এবং শরণার্থী সমস্যা আলােচনা করা হয় এবং বিশ্ব বিবেকের কাছে তুলে ধরা হয়। একই দিনে দি গাডিয়ান’ পত্রিকায় এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে বাংলাদেশে হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করার জন্য হয়াহিয়া খানের উপর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টির প্রয়ােজনীয়তার উপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়। সম্পাদকীয়তে মন্তব্য করা হয় যে, ”The chief weapon in the Internatic community’s hands is economic–not the descredited threat of sanctions, but rather the threat that credit will be withheld an istan’s means of exchange dry up. ১৬ জুন ‘দি গার্ডিয়ান পত্রিকায় A 360019 als “Soothing words scan Bangali refugees” মে যে খবর প্রকাশিত হয় তাতে প্রবাসী বাংলাদেশী জনগণের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি বথী সংক্রান্ত জাতিসংঘের হাই কমিশনার প্রিন্স সদরুদ্দিন খান বনগাঁও এলাকার র পরিদর্শনের পর মন্তব্য করেন যে he regarded the situation in East bekistan as optimistic and that he did not see why the refugees should not be able to return home in time. 1919 Ach for সদরুদ্দিনের এই ধরনের মনােবৃত্তির সমালােচনা করা হয়। একই দিনে ‘দি গার্ডিয়ান পত্রিকায় “Pakistan-guilty of genocide” শিরােনামে অপর একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। প্রিন্স সদরুদ্দিনের উপরােক্ত মন্তব্যে বিশ্বজনমতও স্তম্ভিত হয় এবং সমালােচনা মুখর। হয়। ১৭ জুন দি গার্ডিয়ান পত্রিকায় বাংলাদেশের শরণার্থী ও জাতিসংঘের ভূমিকা নিয়ে। একটি সম্পাদকীয় “The UN could be bolder” শিরােনামে প্রকাশিত হয়। সম্পাদকীয়তে মন্তব্য করা হয় যে “Prince Sadruddins words have added the burden of despair to the refugees trials of flight, disease and. hunger.” শরণার্থীদের সাহায্যে এগিয়ে আসার জন্য জাতিসংঘকে আরাে দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সম্পাদকীয়তে মত প্রকাশ করা হয়। একই দিনে “দি গার্ডিয়ান’ পত্রিকার মার্টিন ওলাকোট প্রেরিত খবরে পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশগুলাের কঠিন মনােভাবের কথা প্রকাশিত হয়। ২২ জুন লন্ডন থেকে প্রকাশিত সকল পত্রিকা প্যারিসে অনুষ্ঠিত ১১ জাতি সমন্বয়ে গঠিত পাকিস্তান এইড কনসােরসিয়ামের সভায় পাকিস্তানকে নতুন সাহায্য বন্ধের সিদ্ধান্তের খবর ফলাওভাবে প্রচার করা হয়। ২১ জুনে অনুষ্ঠিত প্যারিস সভায় সিদ্ধান্ত হয় যে, বাংলাদেশ সমস্যার একটি রাজনৈতিক সমাধান না হলে পাকিস্তানকে আর কোন নতুন সাহায্য দেয়া হবে না। গার্ডিয়ান পত্রিকায় ২২ জুনে প্রকাশিত উক্ত খবরের সাথে লন্ডন এবং বার্মিংহাম থেকে প্রেরিত ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও ‘এ্যাকশন বাংলাদেশ সহ বিভিন্ন সংগ্রাম। পরিষদের সদস্যদের সভা স্থলের কাছে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যে লবিং এবং বিক্ষোভ হয় তাও প্রচার করা হয়। ২২ জুন লন্ডনের পত্র পত্রিকায় বাংলাদেশের জন্য অপর একটি ইতিবাচক। আনন্দের খবর প্রকাশিত হয়।
২১ জুনে ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরন সিং এবং বৃটিশ। পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আলেক ডগলাস হিউম এর মধ্যে অনুষ্ঠিত সভার পর এক যুক্ত বিবৃতিতে এই প্রথম বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বৃটিশ সরকারের পরােক্ষ সমর্থন মনােভাব একশত হয়। যুক্তবিবৃতিতে বলা হয় যে, পাকিস্তানে সৃষ্ট সমস্যার এমন সমাধান হতে হবে যা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের কাছে গ্রহণযােগ্য হবে। দীর্ঘদিনের লবিং, ধর্না, মিছিল শােভাযাত্রা অনুষ্ঠানের পর রক্ষণশীল বৃটিশ সরকারের এই পরিবর্তিত মনােভাব আন্দোলনরত সকল প্রবাসীদের মনে অনুপ্রেরণা ও আশাবাদ সৃষ্টি করে। | ২৩ জুন ‘দি গার্ডিয়ান পত্রিকায় শরণার্থী সংক্রান্ত জাতিসংঘের হাই কমিশনার সদরুদ্দিন আগাখান জাতিসংঘের মহাসচিব মিঃ উথানটের কাছে যে রিপাের্ট দেন তা, লাভ করে। এই রিপাের্ট একপেশে বলে সমালােচিত হয়। ২৪ জুন পত্রিকায় প্যাটিক ৪ এবং ক্রিষ্টিন ইয়েড যৌথভাবে “Big squeeze is on Yahya Khan” শিরােনামে একটি সংবাদ নিবন্ধে ‘পাকিস্তান সমস্যার’ একটি গ্রহণযােগ্য রাজনৈতিক সমাধান না, পর্যন্ত বৃটেন পাকিস্তানকে কোন সাহায্য দেবেন না বলে যে ঘােষণা বৃটিশ পররাই গতকল্য পার্লামেন্টে দিয়েছেন তা প্রকাশ করে। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সাথে সাথে পাকিস্তানে অস্ত্র বিক্রয়ের ব্যাপারে আমেরিকা যে নিষেধাজ্ঞা আরােপ করেছিল তা উপেক্ষা করে ২টি জাহাজ ভতি অস্ত্র নিউইয়র্ক পােট থেকে ছেড়ে এসেছে বলে এক খবৰ ২৫ জুন ‘দি টাইমস্’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। | ২৯ জুন “দি গার্ডিয়ান পত্রিকায় মার্টিন ওলাকোট পাকিস্তানে বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের পরিকল্পনার বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল ইস্যুকে ধামাচাপা দেয়ার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের এই পরিকল্পনা বিদ্যমান পরিস্থিতির কোন উল্লেখযােগ্য পরিবর্তন যে হবে না তা উল্লেখ করে ‘দি গার্ডিয়ানে’ একই দিনে সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। ৩০ জুন ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় মিস ক্লেয়ার হােলিংওয়ার্থ প্রেরিত প্রতিবেদনে বাংলাদেশের উপর ইয়াহিয়া খানের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার নতুন পরিকল্পনাকে নস্যাত করার জন্য মুক্তিযােদ্ধাদের ঢাকা শহরের কেন্দ্রবিন্দু আক্রমণের খবর প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বৃটিশ সমর্থক “এ্যাকশন বাংলাদেশ” এর উদ্যোগে ৩০ জুন ‘দি টাইম্স’ পত্রিকায় বাংলাদেশে। অনুষ্ঠিত গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং বাংলাদেশকে স্বীকৃতির দাবি সম্বলিত এক পূর্ণ পৃষ্ঠা ব্যাপী বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়। বৃটিশ পার্লামেন্টে ১৫ জুন বাংলাদেশের সমর্থক সংসদ সদস্যগণ যে প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন, প্রায় ২০০ জনের বেশি এম, পি এর নাম সহ তার পূর্ণ বিবরণ উক্ত বিজ্ঞাপনে ছাপানাে হয় ।
বিলাতে পত্র পত্রিকার ভূমিকা জুলাই ‘৭১
জুলাই দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় বৃটিশ পার্লামেন্টে শ্রমিক দলীয় সদস্য আর্থার উলীর নেতৃত্বে প্রেরিত বৃটিশ পার্লামেন্টারী প্রতিনিধি দলের ভারতে শরণার্থী শিবির এবং বাংলাদেশের কিছু এলাকা পরিদর্শনের খবর প্রকাশ হয়। প্রতিনিধি দলের সদস্য টোবী মাসেল প্রদত্ত বিবৃতির উদ্ধৃতি দিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নির্বিচারে হত্যা, ধ্বংস ও নশংসতার বিবরণ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। একই দিনে দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’ অপর এক সংবাদ প্রতিবেদনে কানাডা কতৃক পাকিস্তান বিমান বাহিনীর জন্য খুচরা যন্ত্রাংশ সরবরাহ লাইসেন্স বাতিলের খবর প্রকাশিত হয়। এর ফলে পাকিস্তানী জাহাজ ‘পদ্মা’ মন্ট্রিয়েলের বন্দর থেকে খালি ফিরে গিয়েছে বলেও খবরে উল্লেখ করা হয়। ২ জুলাই ‘দি টাইমস্’ পত্রিকায় বৃটিশ পার্লামেন্টারী প্রতিনিধি দলের সদস্য রেজিনাল্ড প্রেন্টিস, এম, পি, এক বিবৃতিতে বাংলাদেশে সৃষ্ট সমস্যা নিরসন শুধুমাত্র রাজনৈতিকভাবেই সম্ভব বলে মন্তব্য করেন। একই দিনে ‘দি গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রতিনিধি দলের নেতা আর্থার বটমলী এমপির বক্তব্য প্রকাশিত হয়। তিনি মন্তব্য করেন যে, পূর্ববঙ্গ সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান না হলে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান তার পরিণতির জন্য দায়ী হবেন। পূর্ব বঙ্গে আরও একটি ভিয়েতনাম সৃষ্টি হওয়ার আশংকার কথাও তিনি দৃঢ়ভাবে উল্লেখ করেন। পূর্ববঙ্গ সফরের বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে মিঃ বটমূলী বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক অনুষ্ঠিত গণহত্যাকে বিশ্বের একটি চরম লজ্জাজনক ঘটনা বলে অভিহিত করেন। | ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকা ৩ জুলাই তারিখে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চল কমাণ্ডের প্রধান জেনারেল ফরমান আলী খানের একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশ করে। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেন বৃটিশ সাংবাদিক মিস্ ক্লেয়ার হােলিংওয়ার্থ। জেনারেল খান সাক্ষাৎকারে সীমিতভাবে হলেও বাংলাদেশে মুক্তিবাহিনীর অস্তিত্ব স্বীকার করে মুক্তিবাহিনীকে ধ্বংস করার জন্য হত্যা, ধ্বংস ও নির্যাতনের কথা উল্লেখ করেন। ৫ জুলাই ‘দি টাইমস্ একা গন্ধিী পীস ফাউন্ডেশন এর সভাপতি ভারতের সর্বশ্রদ্ধেয় নেতা জয় প্রকাশ নারায়ণের এক বিবৃতি প্রকাশ করে। বিবৃতিতে মিঃ নারায়ণ মন্তব্য করেন যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের এমন এক পর্যায় এসেছে যখন কার্যকরী ব্যবস্থা’ গ্রহণ এখন প্রয়ােজন। তিনি বাংলাদেশের মুক্তযােদ্ধাদের জন্য ভারী সমরাস্ত্র পর্যাপ্ত সরবরাহের জন্য সকল মহলের কাছে আবেদন “ম। ৬ জুলাই ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় ঢাকা থেকে মিস ক্লেয়ার হােলিংয়ার্থের
একটি সংবাদ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নাজক পরিস্থিতির উল্লেখ করে মন্তব্য করা হয় যে, ইয়াহিয়া খান যদি অতি আপােষ রফা না করেন তা হলে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হবে তা কেউ রুখতে, প্রতিবেদনে আরাে বলা হয় যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে এদেশের জনগণ সমর্থন করে বিধায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন শুধু সময়ের ব্যাপার। লাই দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় “Pakistan’s only way out” শিরােনামে মন্তব্যে বলা হয় যে, শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিয়ে পূর্বকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এতদঅঞ্চলে শান্তি পুনঃস্থাপন করা যায়। সম্পাদকীয়তে আরাে উন্ন, হয় যে, পূর্ববঙ্গে’ পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ ও অত্যাচার কারাে ক গ্রহণযােগ্য হতে পারে না এবং এর কোন ভবিষ্যত নেই। প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয় “It is unacceptable also to the International community, both on grounds of morality and because it most gravely endangers world peace and stability. Nor can one believe that this misguided policy of President Yahya’s would be acceptable to him or to the people of West Pakistan if they would realistically and honestly consider both the depressing results achieved so far and the prospects of continued blood shed increasing chaos and final disaster in the future.” একই দিনে দি টাইমসূ’ পত্রিকায় ফ্রান্স কর্তৃক পাকিস্তানের জন্য সামরিক অস্ত্র সরবরাহ নিষিদ্ধ এবং তৎসংক্রান্ত সকল চুক্তি বাতিলের খবর প্রচারিত হয়। উপরােক্ত সম্পাদকীয় এবং সংবাদ প্রতিবেদন প্রবাসীদের মধ্যে বিপুল প্রেরণা ও উৎসাহের সৃষ্টি করে এবং ধীরে ধীরে পাকিস্তান যে আন্তর্জাতিক সমর্থন হারাচ্ছে তা স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়। ‘দি গার্ডিয়ান’ পত্রিকা ৮ জুলাই “166m needed for refugees” শিরােনামে এক সংবাদ সমীক্ষা প্রকাশ করে। সংবাদে ভারতের অভ্যন্তরে শরণার্থীদের সংখ্যা ৬০ লক্ষের উর্ধ্বে হবে বলে উল্লেখ করে জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক হাই কমিশনারের মুখপাত্র ষ্ট্যানলি রাইট বলেন যে, এই বিশাল জনগােষ্ঠীকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে প্রায় ১৬৬ মিলিয়ন পাউণ্ড ষ্টার্লিং এর সমপরিমাণ অর্থের প্রয়ােজন হবে। ৯ জুলাই ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় বেনাপােল সীমান্ত এলাকা থেকে মিসেস ক্লেয়ার হােলিংওয়ার্থের প্রেরিত এক সংবাদ প্রতিবেদন “War spirit grows on trigger happy Pakistan border” শিরােনামে প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে পাকিস্তান ভারত সীমান্ত এলাকায় উত্তেজনা ও যুদ্ধ প্রস্তুতি আবহাওয়ার কথা উল্লেখ করে শান্তি রক্ষা জন্য জাতিসংঘ শান্তি বাহিনীর উপস্থিতির প্রয়ােজনীয়তার উপর গুরুত্ব আরােপ করা হয়।
১১ জুলাই বৃটেনের জনপ্রিয় সাপ্তাহিক “দি সানডে টাইমস্ পত্রিকায় “A regime 5 thugs and bigots” শিরােনামে মুরে সায়েল (Mury Sayle) একটি দীর্ঘ প্রতিবেল” প্রকাশ করেন। প্রতিবে অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা ও হত্যাযজ্ঞ, নির্যাতন, পাকিস্তানী বর্বর সেনাবাড়ি নির্যাতনের সীমা অতর্কিত প্রতিবেদক বাংরাদেশের অভ্যন্তরে খুলনা, মংলা, সাতক্ষীরা ও বেনাপােল ভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করে বাংলাদেশের জনগণের উপর পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর নির্যাতন ও অত্যাচারের এক করুণ চিত্র এই দীর্ঘ প্রতিবেদনে তুলে ধরেন। বর্বর সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত গণহত্যা ধিকৃত হিটলার মুসুলিনীর অত্যাচার ও নের সীমা অতিক্রম করেছে বলে এই প্রতিবেদনে উল্লেখ করে মন্তব্য করা হয় যে, The pacification methods used on the North-West frontier by British Army a long ago, burning villages and gunning down inhabitants are bad enough when imported into heavily lated and peaceful place like East Pakistan. The roduction of the political methods of Hitler and Mussolini the British Arm even less defensible.” দি টাইমস্ পত্রিকা ১৪ জুলাই বাংলাদেশের ধ্বংসযজ্ঞ সম্পর্কে বিশ্ব ব্যাংক একটি রিপাের্ট প্রকাশ করে। ১৩ জুলাই দি নিউইয়র্ক টাইমস্ পত্রিকা বিশ্বব্যাংকের এই গােপন বিপাের্টটি প্রকাশ করে, যা ১৪ জুলাই লন্ডন থেকে পুনঃ প্রকাশ করা হয়। ব্যাংক কর্তৃক প্রেরিত প্রতিনিধি হেন্দ্রিক ভেনডার হেইজেন (Hendrick Vander Heijden) বাংলাদেশে পশ্চিমাঞ্চলের যশাের, খুলনা, কুষ্টিয়া চালনা ও মংলা পাের্ট এবং তৎসংলগ্ন এলাকা সরেজমিনে পরিদর্শন (৩ জুন থেকে ৬ জুন, ‘৭১) করে ব্যাংকে যে গােপন রিপাের্ট। পেশ করেন তা প্রকাশিত হয়। রিপাের্টে বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চলে পাকিস্তান কর্তৃক পরিচালিত গণহত্যা ও ধ্বংসের বিবরণ দেয়া হয়। রিপাের্টের এক অংশে কুষ্টিয়ার বিবরণ দিতে গিয়ে বলা হয় যে, Ninety percent of the houses, shops, banks and other buildings were totally destroyed. The city looked like a Second world war Germam town having undergone strategic bombing attacks. People were sitting around dazed. When we moved around, every one Hed. It was like the morning after a nuclear attack” এমনিভাবে অন্যান্য এলাকার ধ্বংসযজ্ঞের বিবরণ উপরােক্ত রিপাের্ট উল্লেখ করা হয়। পরবর্তীকালে বিশ্বব্যাংক ও দাতা দেশসমূহ যে পাকিস্তানকে সাহায্য দান স্থগিত করেছিল তার জন্য উপরােক্ত রিপাের্টটি বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল। ১৪ জুলাই ‘দি টাইমস্ পত্রিকায় ‘The terror that perpetuates terror” রােনামে এক সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। সম্পাদকীয় মন্তব্যে বলা হয় যে, বৃটিশ মেন্টারী প্রতিনিধি দলের প্রতিবেদন ও বিশ্ব ব্যাংক মিশনের রিপাের্ট থেকে এটা স্পষ্ট যে, “তান সেনাবাহিনী শক্তি প্রয়ােগ ও ভয় দেখিয়ে সন্ত্রাসের মাধ্যমে পূর্ববঙ্গকে তাদের এল রেখেছে। উপরােক্ত তথ্যাদি থেকে এখন প্রমাণিত হচ্ছে যে, পাকিস্তান সরকার এ এ সব তথ্যাদি সরবরাহ করেছে তা সব ভুল। পূর্ববঙ্গের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নিয়ন্ত্রণে রেখেছে।
প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে যে সন্ত্রাস ও শক্তি প্রয়ােগের মাধ্যমে দাবিয়ে রাখা যাবে সম্পাদকীয়তে মন্তব্য করা হয়। ফাইনান্সিয়াল টাইমস্ পত্রিকায় ১৯ জুলাই বৃটিশ সাংবাদিক নেভিল ম্যাক্সওয়েল এ গহীত পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশ করে। সাক প্রেসিডেন্ট খান রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযােগে শেখ মুজিবুর রহমানকে সামরিক আদালতে করা হবে বলে জানান। তিনি আরাে বলেন যে, ভারত পূর্ব বঙ্গের’ ব্যাপারে যদি বাড়াবাড়ি করে তাহলে তিনি ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করবেন এবং সে ক্ষেতে পাকিস্তান বন্ধুহীন থাকবে না। লন্ডনে অনুষ্ঠিত আমেরিয়ার বার এসােসিয়েশনের বার্ষিক সম্মেলনকে সামনে রেখে যুক্তরাজ্য বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ২০ জুলাই ‘দি গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় অর্ধপষ্ঠান বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে একটি খােলা চিঠি” প্রকাশ করে। খােলা চিঠিতে পাকিস্তান সেনাবাটি কর্তৃক বাংলাদেশে পরিচালিত গণহত্যার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলা হয় যে, পাকিস্তানের সামরিক সরকার জাতিসংঘের জেনােসাইড কনভেনশন’ এর দ্বিতীয় ধারার ক খ ও গ উপধারা লংঘন করেছে। তাই আইনজীবী হিসাবে আইনভঙ্গকারী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তাদেরকে সােচ্চার হওয়ার জন্য আবেদন জানানাে হয়। বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতনের বিষয়ে প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে অবহিত করে নিম্নোক্ত দাবিসমূহের প্রতি আমেরিকার আইনজীবীদের সক্রিয় সমর্থন কামনা করা হয়। “খােলা চিঠিতে যে সকল দাবি উত্থাপন করা হয় তার মধ্যে (ক) বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান; (খ) পাকিস্তানকে সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধ করা; (গ) গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত বাংলাদেশের নেতা শেখ মুজিবের মুক্তি এবং (ঘ) জেনােসাইড কনভেনশন লংঘন ও বিশ্বশান্তি বিপন্ন করার ব্যাপারে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপন দাবিসমূহ উল্লেখযােগ্য। ২৩ জুলাই ‘দি টাইমস্ পত্রিকায় তাদের সংবাদদাতা প্রেরিত এক সংবাদে গেরিলা মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে ২০,০০০ পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হওয়ার দাবি করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানী সংবাদদাতার সাথে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে উপরােক্ত তথ্য প্রকাশ করেন। মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাঞ্চল কমান্ডের অন্যান্য কমান্ডারদের সাথে সাক্ষাৎ করেও সংবাদদাতা উল্লেখিত তথ্যের সমর্থন পান বলে সংবাদ প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন।
২৫ জুলাই ‘সানডে টাইমস্’ পত্রিকায় পিটার গীল প্রেরিত সংবাদ “Still no end to Bengal Pight” শিরােনামে বাংলাদেশ থেকে ভারতে আগত শরণার্থীদের দুঃখ দুদশম কথা বিস্তারিতভাবে প্রকাশিত হয়। প্রাণের ভয়ে সর্বস্ব হারিয়ে, লক্ষ লক্ষ হিন্দু-মুসলমান শরণার্থীদের অব্যাহত আগমন এবং শরণার্থীদের ক্রমবর্ধমান সংখ্যার ফলে সৃষ্ট ভয়াবহ অবস্থার কথাও সংবাদ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। ২৫ জুলাই ‘দি অবজাভার প অপর এক খবরে চীনের নীতি সমর্থক মাওপন্থী ভারতের নক্সালপন্থীদের এক বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে ধনিক শ্রেণীর আন্দোলন বলে আখ্যায়িত করে পাকিস্তানকে সমর্থনের কথা প্রকাশিতহয়। নক্সালপন্থী এই গ্রুপের নেতা অসীম চ্যাটার্জীর সাথে রী পার্টির চেয়ারম্যান চারু মজুমদারের এ বিষয়ে মতভেদের কথাও সংবাদ সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়। ২৮ জুলাই ‘দি গার্ডিয়ান পত্রিকায় “The plight of Bengal” শিরােনামে একটি কীয় নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। সম্পাদকীয়তে মন্তব্য করা হয় যে, ভারতের অভ্যন্তরে দেশের শরণার্থী সমস্যা এতই প্রকট হয়েছে যার ফলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কক ও ভীত শরণার্থীদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে বাধ্য হবেন নতুবা পাকিস্তানের ঘােষণা করতে বাধ্য হবেন। সম্পাদকীয়তে আশংকা করা হয় যে, শুধুমাত্র টনৈতিক পদক্ষেপের মাধ্যমে শরণার্থীদের ফেরত পাঠানাে বা যুদ্ধের সম্ভাবনা পরিহার করা সম্ভব হবে না। সমস্যা সমাধানের কয়েকটি পদক্ষেপের সুপারিশ করে সম্পাদকীয়তে বলা হয় যে, “It may be that nothing, no diplomatic intervention, can roverse this humaliting and disastrous side. But a few dramatic gestures would help. First the release of Sheikh Mujibur Rahman and his installation in Dhaka. Secondly, concerted action by the Security Council. Thirdly, clear warning to Yahya that he will remain, economically and moraly, beyond the pall until his Punjabi troops fly home to the Punjab.” ৩০ জুলাই দি গার্ডিয়ান পত্রিকায় এ্যাকশন বাংলাদেশ এর উদ্যোগে আয়ােজিত ১ আগষ্টের ট্রাফেলগার স্কোয়ারের জনসমাবেশে যােগদানের আবেদন জানিয়ে পূর্ব বঙ্গে গণহত্যা” শিরােনামে অর্ধপৃষ্ঠা ব্যাপী একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়। সিনেটর ইউজিন ম্যাকার্থী এর বাংলাদেশকে সমর্থন দানের খবর প্রচারিত হয়। ৩১ জুলাই ‘দি টাইমস্ পত্রিকায় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের এক সাংবাদিক সাক্ষাৎকারের বরাত দিয়ে এক সংবাদ সমীক্ষায় বলা হয় যে, যে সকল দেশ পাকিস্তানকে সাহায্য প্রদান স্থগিত করেছে। তারা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দূরভিসন্ধিমূলক আচরণ করছে বলে ইয়াহিয়া খান অভিযােগ করেছেন। উক্ত সাক্ষাৎকারে ইয়াহিয়া খান ভারতের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘােষণার হুমকি প্রদান করেন। একই দিনে “দি ইকনমিষ্ট” পত্রিকায় “Time is running out” শিরােনামে একটি সংবাদ প্রতিবেদন প্রকাশ পায়। প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। মুক্তযুদ্ধ ও ভারতে শরণার্থী সমস্যা নিয়ে আলােচনা করা হয় এবং তার ভয়াবহ পরিণতির আশংকার কথা উল্লেখ করা হয়।
বিলাতের পত্রপত্রিকার ভূমিকা (আগস্ট ‘৭১)
বিলাতে বহুল প্রচারিত পত্রিকা ‘দি সানডে টাইমস’ ১ আগস্ট মুরে সাইল (M, Syel) এর একটি দীর্ঘ নিবন্ধ প্রকাশ করে। নিবন্ধে বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়েছে তার কোন আপােষ সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করা হয়। পূর্ববঙ্গ” পরিধি সম্পর্কে পাকিস্তান যে পরিমাণ অবাস্তব ও মিথ্যা প্রচারণা চালাচ্ছে তাতে পাকিতা ভিয়েতনামের মতাে এক ভয়াবহ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে বলে প্রবন্ধে আশংকা করা হয়। বাংলাদেশে মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে পাকিস্তানী সেনাদের হতাহতের সংখ্যা যে দিন দিন বছি পাচ্ছে তার ইঙ্গিত হিসাবে পাকিস্তানী আহত সৈন্যদের বিমানযােগে ঢাকা থেকে করাচী। প্রেরণের বিবরণ উক্ত নিবন্ধে প্রকাশিত হয়। পূর্ব বঙ্গের সামরিক হাসপাতালগুলােতে স্থান সংকুলান না হওয়ায় আহত সৈন্যদের করাচী স্থানান্তর করা হচ্ছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। একই দিনে ‘সানডে টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় ইয়াহিয়া খানের ঢাকা গমনের ঘােষণা ও ঢাকায় সংঘটিত যুদ্ধের কিছু বিবরণ প্রকাশিত হয়। ২ আগস্ট ‘দি টাইমস্ পত্রিকায় ওয়াশিংটনে পাকিস্তানী দূতাবাসে কর্মরত ইকনমিক কাউন্সিলর বাঙালি কর্মকর্তা এ. এম, মুহিতের বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের খবর প্রকাশিত হয়। একই দিনে দি টাইমস্ সহ বিলাতের প্রায় সকল পত্রপত্রিকায় ১ আগস্টে ট্রাফেলগার স্কোয়ারে এ্যাকশন বাংলাদেশ কর্তৃক আয়ােজিত জনসভার খবর প্রকাশিত হয়। ট্রাফেলগার স্কোয়ারের জনসভায় ঘােষণার মাধ্যমে লন্ডনের পাকিস্তান দূতাবাসের দ্বিতীয় সচিব বাঙালি কর্মকর্তা মহিউদ্দিনের বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের খবরটি উক্ত পত্রিকায় প্রাধান্য পায়। ৩ আগস্ট ‘দি টাইমস্’ পত্রিকায় পাকিস্তানে বন্দী ও বিচারাধীন বাংলাদেশের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি দাবি করে বৃটিশ পার্লামেন্টে এক প্রস্তাব পেশ করার খবর প্রকাশিত হয়। গত ১৫ জুন বৃটিশ পার্লামেন্টে বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধের দাবিতে যে প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল তার পরবর্তী পদক্ষেপ হিসাবে এই প্রস্তাব পেশ করা হয়। পিটার শাের, এডওয়ার্ড ডুকান, আর্নেষ্ট মারপল্স, জন ষ্টোনহাউজ এবং মাইকেল স্টুয়ার্ট উপরােক্ত উদ্যোগের জন্য বিশেষ ভূমিকা পালন করেন বলে সংবাদে উল্লেখ করা হয়। ৫ আগষ্ট “দি গার্ডিয়ান’ পত্রিকা আমেরিকার প্রতিনিধি পরিষদে বাংলাদেশের প্রাত সহানুভূতিপূর্ণ একটি প্রস্তাব গ্রহণের খবর প্রকাশ করে সংবাদে বলা হয় যে, বাংলাদে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ বন্ধ এবং শরণার্থীরা ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত পাকিস্তানকে আমেরিকার সাহায্য দান স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত আমেরিকার প্রতিনিধি পরিষদে গৃহীত হয়। ৬ আগস্ট ‘দি টাইমস এবং এবং দি গার্ডিয়ান পাকিস্তান কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশের পরিস্থিতি একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করে। উক্ত শ্বেতপত্রে ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশে সংঘটিত ঘটনাবলীর অতিরঞ্জিত ও মিথ্যা বিবরণ দিয়ে সকল ঘটনার জন্য য়ামী লীগকে এবং ভারতকে দায়ী করা হয়। ৭ আগস্ট ‘দি টাইমস্’ পত্রিকায় পিটার হেজেলহার্সট এক সংবাদ সমীক্ষায় এ পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধের সম্ভাবনার ইঙ্গিত প্রদান করেন। ভারত ও রাশিয়ার মধ্যে কয়েকটি রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক পদক্ষেপ উল্লেখ করে তিনি সােভিয়েত মন্ত্রী মিঃ গ্রোমিকোর অপ্রত্যাশিত দিল্লী সফরকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মন্তব্য মিস ক্লেয়ার হােলিংয়ার্থ প্রেরিত সংবাদ, মন্তব্য করা হয়। ৭ আগস্ট “দি ভারত ও পাকিস্তানের মতে গৃহীত কয়েকটি রাজনৈ পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিঃ ঘােমিয়ে করেন। – আগস্ট ‘দি সানডে টাইমস্’ পত্রিকায় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের একটি সাক্ষাৎকার ছাপানাে হয়। সাক্ষাৎকারে ইয়াহিয়া খান বৃটেনের বিরুদ্ধে ভারত প্রীতি ও পাকিস্তানের প্রধান সমালােচক হিসাবে অভিযােগ করে পাকিস্তানের কমনওয়েলথ ত্যাগের কারণ ব্যাখ্যা করেন। তিনি বৃটিশ সাংবাদিকদেরও কঠোর সমালােচনা করেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের উপরােক্ত বক্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বটেনের পত্রপত্রিকা বৃটিশ জনগণ ও সরকারকে বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল ও সমর্থকে পরিণত করতে কি পরিমাণ ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছিল।
‘দি গার্ডিয়ান পত্রিকা ৯ আগস্টে এক সম্পাদকীয় মন্তব্য সম্প্রতি ওয়াশিংটন ও নিউ ইয়র্কে পাকিস্তানী দূতাবাস ও মিশনে কর্মরত ১৫ জন কূটনৈতিক কর্মকর্তার একযােগে পদত্যাগের ঘটনাকে ইয়াহিয়া খানের জন্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় বলে উল্লেখ করা হয়। সম্পাদকীয় তে এক পর্যায়ে উল্লেখ করা হয় যে, Nothing is likely to persuade him yet if anything still can, it ought to be the dignified resignations of East Pakistani diplomats. The group that had resigned in Washington and New York is only the most dramatic group to have gone. Others have gone singly. More will undoubtedly go. Theirs is a powerful witness. Diplomats are normally among the last people to resign. When it happens it commands attention.” | ১০ আগস্ট লন্ডন থেকে প্রকাশিত প্রায় সকল পত্রিকায় পাকিস্তানে গঠিত একটি সামরিক পলিতে শেখ মুজিবুর রহমানের গােপন বিচার শুরু হওয়ার খবর প্রকাশিত হয়। এই *তে ১০ আগষ্ট “দি গার্ডিয়ান পত্রিকায় এক সম্পাদকীয় মন্তব্যে বলা হয় যে, এই শমূলক বিচার অনুষ্ঠানের ফলে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধানের যে একটা ক্ষীণ সম্ভাবনা ছিল তারও অপমৃত্যু হলাে। এই বিচার অনষ্ঠা ইয়াহিয়া খানের একটি অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত বলে অভিহিত করে সম্পাদকীয়তে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী বলে আশংকা করা হয় । সম্পাদকীয়তে মত করা হয় যে, “So also does Yahya Khan’s incredible decision to star the secret military trial of Sheikh Mujibur Rahman this we India and Pakistan are running out of all options but Open conflict fast.” | ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় ১২ আগস্টে মিস, ক্লেয়ার হােলিংওয়ার্থ পরিবেশিত খবরে ঢাকার কেন্দ্র বিন্দুতে অবস্থিত হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে পরিচালিত মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণের বিবরণ দেয়া হয়। শেখ মুজিবুর রহমানের গােপন বিচার অনুষ্ঠানের প্রতিবাদে এই আক্রমণ পরিচালিত হয়েছে বলে খবরে উল্লেখ করা হয়। একই দিনে ‘দি টাইমস পত্রিকায় সম্পাদকীয় নিবন্ধে শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন রক্ষার জন্য সকল সংশ্লিষ্ট মহলকে জোরালাে পদক্ষেপ গ্রহণের আবেদন জানান। সম্পাদকীয়তে এই প্রহসনমূলক গােপন বিচারের তীব্র নিন্দা জানানাে হয় এবং পাকিস্তানের জন্য এটা অত্যন্ত লজ্জাকর বলে অভিহিত করা হয়।
১৩ আগস্ট ‘দি টাইমস্’ পত্রিকায় শ্রমিকদলীয় এম, পি, টমাস উইলিয়াস এর একটি। পত্র গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ করে। পত্রে টমাস উইলয়াস বলেন, সামরিক আদালতে শেখ মুজিবের গােপন বিচারের সময় তার বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আনীত অভিযােগগুলাে যােগ করার খবরে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তাছাড়া এই গােপন বিচারে শেখ মুজিবের পক্ষ সমর্থনের জন্য পাকিস্তানী আইনজীবী ছাড়া অন্য কাউকে সুযােগ না দেয়ার সিদ্ধান্তে এটা পরিষ্কার যে শেখ মুজিব ন্যায় বিচার পাবেন না বলে তিনি মন্তব্য করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখযােগ্য যে, টমাস উইলিয়ামস্ ১৯৬৯ সনে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবের পক্ষ সমর্থনের জন্য ঢাকায় গিয়েছিলেন। একই দিন (১৩ আগস্ট) “দি ডেইলী টেলিগ্রাফ পত্রিকার জাতিসংঘ সংবাদদাতা প্রেরিত এক খবরে বলা হয়, শেখ মুজিবের সামরিক আদালতে গােপন বিচার এবং নিরাপত্তার বিষয়ে জাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনারেল উথান্ট পর্দার অন্তরালে পাকিস্তান সামরিক শাসকদের সাথে যােগাযােগ রাখছেন এবং সক্রিয় আছেন। ১৫ আগস্ট ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় শেখ মুজিবের গােপন বিচার প্রসঙ্গে সম্পাদকীয় মন্তব্যে বলা হয় যে, গত ডিসেম্বরের নির্বাচনে বিপুল ভােটাধিক্যে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ নেতার প্রতি ইয়াহিয়া খানের এ হেন আচরণে তিক্ততা আরাে বৃদ্ধি হবে এবং করুণ পরিণতির দিকে দ্রুত ধাবিত হবে। ১৫ আগস্ট ‘দি অবজারভার পত্রিকায় একই বিষয় সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয় যে, বাংলাদেশের নেতা শেখ মুজিবের গােপন বিচার প্রসে মাধ্যমে বাংলাদেশে পাকিস্তানী নির্যাতন নীতির প্রমাণ পাওয়া যায়। সম্পাদকীয়তে ইয়াহিয়া খানকে হুশিয়ারি করে বলা হয় যে, তার এই ভুল পদক্ষেপের ফলে এক সুদূরপ্রসারী বিপর্যয় সবে এবং ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সম্ভাবনা দেখা দিবে। গস্ট লন্ডনের রবিবারের পত্রিকা “সানডে টেলিগ্রাফ” এ প্রকাশিত এক খবরে না যায় যে, জনৈক ব্রিগেডিয়ারের নেতৃত্বে তিন সদস্য বিশিষ্ট বিশেষ সামরিক আদালত | শহরে একটি সার্কিট হাউজে শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার শুরু করেছে।
গােপনে বিচারকার্য পরিচালনা করার কারণে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে আনীত অভিযােগ। সমূহের বিবরণ জানা যায়নি বলেও সংবাদে উল্লেখ করা হয়। যুক্তরাজ্যস্থ বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ আরাে ৬৮টি সংগ্রাম পরিষদের সমর্থন পুষ্ট হয়ে ১৬ আগস্ট দি ঢাইমস পত্রিকায় একটি অপৃষ্ঠা ব্যাপী বিজ্ঞাপন প্রকাশ করে। বিজ্ঞাপনে জনগণতান্ত্রিক বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি দাবি করা হয়। বিজ্ঞাপনে বাংলাদেশে পরিচালিত পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর গণহত্যা এবং সামরিক আদালতে শেখ মুজিবের গােপন বিচার সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্যাদি প্রকাশ করা হয়। ২১ আগস্ট “দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় সামরিক আদালতে শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ সমর্থনের জন্য পাকিস্তানের আইনজীবী এ, কে, ব্রোহী রাজী হয়েছেন বলে খবর পরিবেশিত হয় । ‘দি সানডে টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় ক্যানাডার টরেন্টোতে অনুষ্ঠিত দক্ষিণ এশিয়া সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাবাবলী ২২ আগস্ট প্রকাশ লাভ করে। উল্লেখিত সম্মেলনে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই উপমহাদেশে সৃষ্ট সমস্যার একমাত্র স্থায়ী সমাধান হবে বলে মত প্রকাশ করা হয়। ২৮ আগস্ট ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’ সহ অন্যান্য পত্রিকায় লন্ডনের বেইজ ওয়াটার এলাকায় ২৪ নং পেমৃব্রিজ গার্ডেনে বাংলাদেশ মিশনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের খবর পরিবেশন করা হয় । | ৩০ আগস্ট ‘দি গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় “Washington and Bangladesh” শিরােনামে একটি সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশে বিরাজমান পরিস্থিতির জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে দায়ী করে মানবাধিকার লংঘনের অভিযােগ এনে এমতাবস্থায় ওয়াশিংটনের করণীয় সম্পর্কে সম্পাদকীয়তে মন্তব্য করা হয়। গত ডিসেম্বরে যে অঞ্চলে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হয়েছে সেখানে ক্রমবর্ধমান সংঘর্ষ, হত্যা, ধর্ষণ ও দুর্ভিক্ষের মতাে এক ভয়াবহ অবস্থা চলছে। এ হেন পরিস্থিতিতে বৃটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রী স্যার এ্যালেক ডগলাস হিউমকে ওয়াশিংটন সফর করে প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে বাংলাদেশের প্রকৃত অবস্থা এবং বৃটেনের মনােভাবের কথা অবহিত করার জন্য সম্পাদকীয়তে পরামর্শ দেয়া হয়।
বিলাতের পত্র পত্রিকার ভূমিকা সেপ্টেম্বর ‘৭১
১ সেপ্টেম্বর ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় মিস ক্লেয়ার হােলিংওয়ার্থ প্রেরিত সংবা নিবন্ধে পূর্ববঙ্গের গভর্নর ও সামরিক প্রশাসক লেঃ জেঃ টিক্কা খানকে বাদ দিয়ে গভ, পদে ডাঃ এ. এম. মালিককে এবং সামরিক প্রশাসক পদে লেঃ জেঃ নিয়াজীকে নিয়ে খবর পরিবেশন করে মন্তব্য করা হয় যে, টিক্কা খানের অপসারণে আপাতত ‘পূর্ববঙ্গের জনগণ খুশি হবেন। নিবন্ধে আরাে উল্লেখ করা হয় যে, ডাঃ মালিক বাঙালি হলেও তিনি পাকিস্তানী সামরিক কমান্ডার দালাল হিসেবে চিহ্নিত হবেন। “দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’ একই। দিনে অপর এক খবরে পাকিস্তান মিশনসমূহে কর্মরত বাঙালি কূটনৈতিকদেরকে পদত্যাগ করতে বৃটেন উৎসাহ দিচ্ছে বলে অভিযােগ করা হয়। খবরে আরাে উল্লেখ করা হয় যে, লন্ডনে বাংলাদেশ মিশন স্থাপনের বিষয় পাকিস্তানের প্রতিবাদের যে ব্যাখ্যা বৃটেন প্রদান। করেছে তা পাকিস্তানের কাছে গ্রহণযােগ্য নয়। | ৩ সেপ্টেম্বর ‘দি টাইমস্’ পত্রিকায় বৃটিশ শ্রমিক দলীয় প্রভাবশালী এম, পি ও সাবেক মন্ত্রী পিটার শাের এর একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। মিঃ শশার সপ্তাহব্যাপী পশ্চিম পাকিস্তান ও ভারত সফর শেষে লন্ডনে ফিরে সাক্ষাৎকার দেন। তিনি পাকিস্তানকে সকল প্রকার বৃটিশ ঋণ ও অর্থনৈতিক সহযােগিতা বন্ধ করে দেয়ার জন্য বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার। আলেক ডগলাস হিউমের কাছে প্রস্তাব করেন। তিনি এই প্রস্তাবে যুক্তি হিসাবে বলেন যে, ‘পূর্ববঙ্গ পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে এবং পাকিস্তান দু’ভাগ হয়ে গিয়েছে। এই কঠিন সত্যকে গ্রহণ করতে হবে। একই দিনে ‘দি গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় পাকিস্তান দূতাবাসসমূহে কর্মরত বাঙালীরা যাতে পদত্যাগ করে বাংলাদেশের পক্ষে যােগ দিতে না পারে তার পদক্ষেপ হিসাবে পাকিস্তান দূতাবাসে কর্মরত অফিসারদের পাসপাের্ট জমা দেয়ার নিদেশের খবর প্রকাশিত হয়। এর ফলে পাকিস্তানের দুর্বলতা আন্তর্জাতিকভাবে প্রকাশ লাভ করে। ১০ সেপ্টেম্বর “দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় জুলফিকার আলীকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিয়ােগের দাবির সমালােচনা করে একটি সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়। মাচ মাসে ইয়াহিয়া-মুজিব আলােচনা ব্যর্থ হওয়ার জন্য ভুট্টোকে দায়ী করে সম্পাদকীয়তে মন্তব্য কম। হয় যে, সমগ্র পাকিস্তানের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যেখানে ভূট্টোর দল পেয়েছে ৮৫টি ৭ আর শেখ মুজিবের দল পেয়েছে ১৬২টি সেখানে ভুট্টোকে প্রধানমন্ত্রী নিয়ােগের দাবি স যুক্তিহীন। সম্পাদকীয়তে আরাে বলা হয় যে, পূর্ববঙ্গের স্বায়ত্তশাসনের দাবি মে ইয়াহিয়া খানের উচিত শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে একটা আপােষ ফরমুলায় উপনীত হওয়া।
একই দিনে শিরােনামে একটি সংবাদ নিন একই দিনে ‘নিউ ষ্ট্যাটসম্যান’ পত্রিকায় “Bangladesh must be freed” মে একটি সংবাদ নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। নিবন্ধের শুরুতেই উল্লেখ করা হয় যে, “At heart of the great crisis in Bengal is the breakup of this state of Pakistan. What Jinnah created with his fanatical resolve in 1947 has now been irrevocably destroyed by the stupidity of Yahya Khan and the ferocity of his generals. ১১ সেপ্টেম্বর ‘দি টাইমস্’ পত্রিকায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে পরামর্শ দানের জন্য পাচ দল সমন্বয়ে ‘কনসালটেটিভ কমিটি গঠনের খবর পরিবেশিত হয়। বিপ্লবী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনকে কমিটির আহ্বায়ক করে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী (ন্যাপ ভাসানী পন্থী), মনি সিং (বাংলাদেশ কমিউনিষ্ট পার্টি), মনােরঞ্জন ধর (বাংলাদেশ ন্যাশনাল কংগ্রেস), অধ্যাপক মুজাফফর আহম্মদ (মুজাফফর পন্থী ন্যাপ), খন্দকার মােস্তাক আহম্মদ (বিপ্লবী সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের দুইজনসহ আট সদস্য বিশিষ্ট কনসালটেটিভ কমিটি গঠিত হয়। এই খবরে প্রবাসীদের মধ্যে ঐক্য আরাে সুদৃঢ় হয় এবং মুক্তিযুদ্ধে সহযােগিতা ও সমর্থনের উৎসাহ বৃদ্ধি পায়। ১৪ সেপ্টেম্বর ‘দি গার্ডিয়ান পত্রিকায় কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারী এসােসিয়েশন’ এর সম্মেলনের উত্থাপিত বাংলাদেশ সম্পর্কিত খবর প্রকাশিত হয়। সম্মেলনের প্রথম দিনে (১৩ সেপ্টেম্বর) বৃটেনের সাবেক মন্ত্রী আর্থার বটমূলী পূর্ববঙ্গে পাকিস্তান সামরিক সরকারের বল প্রয়ােগ ও হত্যাযজ্ঞ পরিচালনার জন্য নিন্দা জানিয়ে সংখ্যাগরিষ্ট দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তির দাবি করেন। সংবাদে আরাে জানা যায় যে, ভারতীয় লােকসভার স্পীকার মি, ধিলন তার বক্তৃতায় পূর্ব বঙ্গের সমস্যা ভারত ও পাকিস্তানের যুদ্ধের পরিবর্তে পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্য যুদ্ধ বলে সম্মেলনে মন্তব্য। করেন। | ১৪ সেপ্টেম্বর ‘দি টাইমস্ পত্রিকায় ফিলিপাইনে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত বাঙালি কূটনীতিবিদ খুররম খান পন্নী এবং নাইজেরিয়ার পাকিস্তান হাই কমিশনের চ্যান্সেরীর কর্মকর্তা মহিউদ্দিন জায়গীরদারের পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে বাংলাদেশের পক্ষে যােগদানের খবর প্রকাশিত হয়। খবরে মন্তব্য করা হয় যে, এ পর্যন্ত প্রায় ৪০ জন কূটনীতিবিদ বাংলাদেশে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর পরিচালিত গণহত্যা ও নির্যাতনের প্রতিবাদে পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে বাংলাদেশের পক্ষে যােগদান করেছে। একই দিনে ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় মিস ক্লেয়ার হােলিংওয়ার্থ একটি বিশ্লেষণ মূলক প্রবন্ধে “খ করেন যে, মস্কো-দিল্লী মৈত্রী চুক্তির সম্ভাব্য ফলাফলের কথা চিন্তা করে পাকিস্তানের মারক সরকার উদ্বিগ্নবলে মনে হচ্ছে। এই সংকট আরাে ঘনীভূত হলে পাকিস্তান চীনের সাহায্য পাবে কিনা প্রবন্ধে সে ব্যাপারে সন্দেহ পােষণ করা হয়।
১৫ সেপ্টেম্বর ‘ইভিনিং স্টান্ডার্ড’ পত্রিকার খবরে প্রকাশ, ইরানের শহn পরিস্থিতির ব্যাপারে পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে as পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি শেখ মুজিবকে অনতিবিলম্বে মুক্তি দানের আহ্বান । “পূর্ববঙ্গের সমস্যা সমাধানে পাকিস্তান ও ভারতের সাথে মধ্যস্থতা করার প্রস্তাব সংবাদে আরাে বলা হয়, ইরানের শাহ এর যমজ বােন প্রিন্সেস আশরাফ পাহলভি । শাহ এর পক্ষে উপরােক্ত বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। তিনি ইতােমধ্যে পিত মস্কো সফর শেষে ১৫ সেপ্টেম্বর রাতে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথের সঙ্গে নৈশভােতে মিলিত হবেন এবং পূর্ব বঙ্গের সমস্যা সমাধানের বিষয়ে কথা বলবেন বলেও সং উল্লেখ করা হয়। ১৮ সেপ্টেম্বর দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় ফরাসী বামপন্থী রাজনীতিবিদ, প্রখ্যাত সাহিত্যিক, মুক্তিযােদ্ধা, জেনারেল দ্যা গলের মন্ত্রী সভার সদস্য ৬৯ বছর বয়স্ক আদ্রে মালরাে এর এক চাঞ্চল্যকর বিবৃতি প্রকাশিত হয়। বিবৃতিতে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ সমর্থন করে যুক্তি প্রদর্শন করেন এবং পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে যােগ দেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তিনি আরাে বলেন যে, পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার জন্য রওয়ানা হওয়ার তারিখ শ্রীঘ্রই ঘােষণা করা হবে। “দি টাইমস্ পত্রিকায় ১৭ সেপ্টেম্বর তারিখে ইংল্যান্ডের স্কারবারাতে অনুষ্ঠিত লিবারেল পার্টির সম্মেলনে পার্টির নেতা পার্লামেন্ট সদস্য জন পারডাে কর্তৃক বাংলাদেশ সংগ্রামকে সমর্থন করে যে প্রস্তাব উত্থাপন। করা হয় তার বিবরণ প্রকাশিত হয়। প্রস্তাবে বলা হয় যে, অবিলম্বে পূর্ববঙ্গ থেকে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করতে হবে। অন্যথায় বৃটিশ সরকার কর্তৃক একটি কমনওয়েলথ সম্মেলন আহ্বান করে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে হবে। ১৮ সেপ্টেম্বর দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় “অপারেশ ওমেগা” কর্তৃক পীস টিমের বাংলাদেশে প্রবেশকালে গ্রেফতারকৃত সদস্যদের মুক্তির খবর পরিবেশন করা হয়। | ২০ সেপ্টেম্বর মনিং ষ্টার’ পত্রিকায় ভারতে অবস্থানরত বাংলাদেশের শরণার্থীদের সাহায্যার্থে লন্ডনের ওভাল ক্রিকেট ময়দানে আয়ােজিত পপ উৎসবের খবর প্রচারিত হয়। খবরে বলা হয় যে, পপ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের সমর্থনকারী প্রায় ৩৩ হাজার তরুণ তরুণী যােগদান করেছে। টিকিট বিক্রির আয় থেকে ১৫ হাজার ২শ’ পাউন্ড শরণার্থীদের সাহায্যে প্রেরণ করা হবে বলেও সংবাদে উল্লেখ করা হয়।
২৪ সেপ্টেম্বর “দি গার্ডিয়ান পত্রিকায় বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আলেক ডগলাস্ হিউমের হাউস অব কমনসে ভাষনের বরাত দিয়ে একটি সংবাদ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে যােগদানকালে তি” মহাসচিব এবং বিভিন্ন দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রীদের সাথে আলােচনাকালে পাকিস্তানে পংকজনক পরিস্থিতি এবং পূর্ববঙ্গ’ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের উপর বিশেস অr আরােপ করবেন বলে পার্লামেন্টে তিনি আশ্বাস দেন। ২৭ সেপ্টেম্বর দি গার্ডিয়ান পাত্রণ পাকিস্তানেও বাংলাদেশের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তিদাবি করার খবর মহমানের মুক্তিদাবি করার খবর পরিবেশিত হয়। ২৬ সেপ্টেম্বর করাচীতে করাচীতে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির কাউন্সিল অধিবেশনে উপরােক্ত দাবি উত্থাপন করা হয়। ২৯ সেপ্টেম্বর “দি টাইমস্’ পত্রিকায় মস্কো সংবাদদাতা ডেভিড বােনাভিয়া প্রেরিত কোসিগিন বৈঠকের বিবরণ প্রকাশ করা হয়। ক্রেমলিন প্রাসাদে সফররত ভারতের সনমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সম্মানে আয়ােজিত মধ্যাহ্ন ভােজ সভায় বক্তৃতায় সােভিয়েত ধানমন্ত্রী কোসিগিন বলেন, পূর্ববঙ্গে পাকিস্তানের পরিচালিত নৃশংশ কর্মকাণ্ড কোনক্রমেই সমর্থনযােগ্য হতে পারে না। তিনি পূর্ববঙ্গের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে সমুন্নত রেখে অবিলম্বে পূর্ববঙ্গের সমস্যার একটি রাজনৈতিক সমাধানের প্রতি গুরুত্ব প্রদান করেন। ৩০ সেপ্টেম্বর ‘দি টাইমস্ পত্রিকায় পূর্বের দিনে জাতি সংঘের সাধারণ পরিষদে প্রদত্ত বটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আলেক ডগলাস হিউমের বক্তৃতার উল্লেখ করে এক সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। সম্পাদকীয়তে মন্তব্য করা হয় যে, একমাত্র আওয়ামী লীগের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ আলােচনার মাধ্যমেই নিজের দেশ থেকে পালিয়ে আসা লক্ষ লক্ষ শরণার্থীদের শালীনতাপূর্ণ জীবনে ফিরিয়ে নেয়া সম্ভব। আওয়ামী লীগ গত নির্বাচনে পূর্ববঙ্গের’ জনগণের স্বাভাবিক মুখপাত্র হিসাবে প্রমাণিত হয়েছে। এ আলােচনা মার্চ মাসের আলােচনার পরিবেশ থেকে অবশ্য ভিন্নতর হতে হবে এবং পাকিস্তানে কারারুদ্ধ বিচারাধীন শেখ মুজিবকে মুক্ত মানুষ হিসাবে আলােচনায় উপস্থিত থাকার সুযােগ থাকতে হবে। সম্পাদকীয়তে উল্লেখ করা 2761″ It would enter fresh negotiations in a very different mood from that of last march. At the same time Shaikh Mujib must be associated in freedom with such negotiations. Of course an acknowledgement of these necessities would reopen the question of future relations of East and West Pakistan. That can not be evated…….
বিলাতের পত্রপত্রিকার ভূমিকা অক্টোবর ৭১
“দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’ পত্রিকা ১ অক্টোবরের সংখ্যায় ডেভিড লােশাক প্রেরিত এক সংবাদ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মুক্তিযােদ্ধা গেরিলা পরিচালিত চোরাগুপ্তা আক্রমণের বিবরণ দিয়ে বলা হয় যে, মুক্তিযােদ্ধারা আমেরিকা, চীন। রাশিয়া, বৃটেন ও ফ্রান্সের তৈরি বিভিন্ন অস্ত্র ব্যবহার করছে। ২ অক্টোবর ‘দি গার্ডিয়ান পত্রিকায় পাকিস্তানে সৃষ্ট সমস্যার অবসান না হওয়া পর্যন্ত পশ্চিমা দেশগুলাে প্যারিসে এইজ পাকিস্তান কনসােরসিয়াম’ এর সভায় পাকিস্তানকে সাহায্যদান বন্ধের যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল তা অপরিবর্তিত রাখার কথা প্রকাশিত হয়। ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ব্যাংকের সভার বরাত দিয়ে উপরােক্ত খবর পরিবেশিত হয়। এর ফলে বিশ্ববাসীর কাছে পাকিস্তানের অবস্থা আরাে নাজুক হয়। ৪ অক্টোবর ‘মর্নিং স্টার’ পত্রিকায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মস্কো সফরের বিষয় গুরুত্বসহকারে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। মস্কো সফরে মিসেস গান্ধী ‘পূর্ববঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যা ও নির্যাতন পরিচালনার ফলে বাংলাদেশ থেকে যে পরিমাণ শরণার্থী ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেছে তাতে ভারতের সামাজিক ও নিরাপত্তার প্রতি হুমকি হিসাবে চিহ্নিত করে সােভিয়েত নেতৃবৃন্ধকে বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল করতে সমর্থ হন। মস্কো থেকে প্রকাশিত যুক্ত বিবৃতিতে বাংলাদেশের প্রকৃত পরিস্থিতি উল্লেখ করে সােভিয়েত ইউনিয়নের গভীর উপলব্ধির কথা প্রতিফলিত হওয়ায় বাংলাদেশ সরকার যুক্ত বিবৃতিকে অভিনন্দন জানান বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। ৬ অক্টোবর ‘দি গার্ডিয়ান বাংলাদেশ থেকে ভারতে আগত শরণার্থীদের করুণ অবস্থার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে এক সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশ করে। সম্পাদকীয়তে শরণার্থী শিবিরগুলিকে পাকিস্তানের ধ্বংসাবশেষ হিসাবে আখ্যায়িত করে আমেরিকা কর্তৃক পাকিস্তানে সমরাস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত রাখার নিন্দা করা হয়। ৮ অক্টোবর ‘দি গার্ডিয়ান পত্রিকায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ত্রাণকার্য পরিচালনাকালে অপারেশন ওমেগা’ এর আরাে দু’জন কর্মীকে গ্রেফতারের খবর প্রকাশিত হয়। ৮ অক্টোবরে “ইভিনিং স্ট্যান্ডার্ড” পত্রিকায় অপর খবরে বাংলাদেশ থেকে শরণার্থী আগমনের হার পুনরায় বৃদ্ধি পাওয়ার কথা বলা হয়। শরণার্থী বৃদ্ধির কারণ হিসাবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সামরিক কর্মকাণ্ড এবং দুর্ভিক্ষাবহানে দায়ী করা হয়।
১০ অক্টোবর “দি সানডে টাইমস’ পত্রিকা পাকিস্তান হাই কমিশনের একটি গােপন লিলের ফ্যাসিমিলি প্রকাশ করে। জনেক বাঙালি আবদুল হাই ‘পাকিস্তান সলিডারিটি ফ্রন্ট মে পাকিস্তানের কর্মকাণ্ড পরিচালনায় পাকিস্তান হাই কমিশন যে তাকে অর্থ দিচ্ছে তা গাপন দলিল থেকে প্রমাণিত হয়। ১৫ অক্টোবর ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় পূর্ব সানের সাবেক গভর্নর পাকিস্তানপন্থী হিসাবে পরিচিত আবদুল মোনেম খানকে হত্যার এবর প্রকাশ করে। সাংবাদদাতা ডেভিড লােশাক প্রেরিত খবরে জানা যায় যে, দু’জন গেরিলা মােনেম খানের বাড়িতে প্রবেশ করে তাকে অতর্কিতে গুলি করে হত্যা করে। ‘ওয়ার অন ওয়ান্ট’ এবং ‘অক্সফাম’ এর উদ্যোগে ১৯ অক্টোবর ‘দি টাইমস’ পত্রিকায় ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী বাংলাদেশের শরণার্থীদের করুণ অবস্থার প্রতি বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণের লক্ষ্যে অর্ধ পৃষ্ঠাব্যাপী একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়। বিজ্ঞাপনে দুর্গতদের সাহায্য ছাড়াও পূর্ববঙ্গের রাজনৈতিক সমাধানের জন্য সকল মহলকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানানাে হয়। বিজ্ঞাপনে একটি কুপন ছাপানাে হয় এবং বাংলাদেশকে সমর্থনের নিদর্শন হিসাবে এই কুপন পূরণ করে নিজ নিজ এলাকার সংসদ সদস্যদের কাছে প্রেরণের জন্য পাঠকদের অনুরােধ জানানাে হয়। ২১ অক্টোবর ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় যুগােশ্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটোর চারদিন ব্যাপী ভারত সফরের পর প্রেসিডেন্ট টিটো ও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর এক যুক্ত বিবৃতি প্রকাশিত হয়। বিবৃতিতে পূর্ববঙ্গের সমস্যা সমাধানে আওয়ামী নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি অবশ্য প্রয়ােজনীয় বলে মন্তব্য করা হয়। বিবৃতিতে পাকিস্তানকে সাবধান করে দিয়ে বলা হয় যে, বাংলাদেশের জনগণের মতামতকে উপেক্ষা করা হলে পরিস্থিতি আরাে ভয়াবহ হতে পারে। ২৫ অক্টোবর ‘দি গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় ভারতে প্রধানমন্ত্রীর বিদেশ সফরের পূর্বে বেতার ভাষণের বরাত দিয়ে এক সংবাদ সমীক্ষা প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশ পরিস্থিতি ও শরণার্থী সমস্যা এমন এক পর্যায়ে উপনীত হয়েছে যার ফলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস গান্ধী বিভিন্ন দেশের নেতৃবৃন্দের মতামত গ্রহণ করা প্রয়ােজন হয়ে পড়েছে বলে সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়। ২৫ অক্টোবর ‘দি টাইমস্’ পত্রিকায় পিটার হেজেলহাস্ট প্রেরিত সংবাদ নিবন্ধে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস গান্ধীর তিন সপ্তাহ ব্যাপী বেলজিয়াম, অষ্ট্রিয়া, ফ্রান্স, বৃটেন, পশ্চিম জার্মানী এবং আমেরিকা সফরের মূল উদ্দেশ্য সম্পর্কে আলােকপাত করা হয়। নিবন্ধে বলা হয় যে, পূর্ববঙ্গে সৃষ্ট সমস্যা মূলত পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরিণ ব্যাপার এবং প্রায় ৯০ লক্ষ শরণার্থী ভারতের অর্থনীতির প্রতি যে বিরাট হুমকি সে বিষয়ে সি গান্ধী পশ্চিমা নেতাদের বুঝাতে চেষ্টা করবেন। এসকল সমস্যার সমাধানের বিষয়ে। * যে আন্তরিক এবং সর্বাত্মক গুরুত্ত্ব আরােপ করছে তা প্রধানমন্ত্রীর দীর্ঘ সফরে প্রতীয়মান হয় ।
২৬ অক্টোবর ‘দি গার্ডিয়ান পত্রিকায় মাটিন ওরাকোট এর ঢাকা থেকে প্রেরিত এs বিশ্লেষণমূলক নিবন্ধ “Waiting for the war to start” শিরােনামে প্রকাশি নিবন্ধে বলা হয় যে, বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনী । থেকে সম্ভাব্য যুদ্ধের সকল প্রস্তুতির লক্ষণ প্রতীয়মান হয়। নিবন্ধে আরাে উ যে, ভারত সীমান্তে ভারতের সৈন্যবাহিনী ইতােমধ্যে মােতায়েন করা হত কূটনৈতিক মহলের ধারণা। বাংলাদেশ সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য একটি যুদ্ধ অনিন। উল্লেখ করে নিবন্ধের উপসংহারে উল্লেখ করা হয় যে, There is less optimism, about the avoidance of war in the longer term with m believing that ultimately only conventional military light bring a permanent solution.” ২৮ অক্টোবর ‘দি টাইমস’ পত্রিকায় সােভিয়েট ইউনিয়নের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিকোলাই ফিরুবিন এর ভারত সফর শেষে দু’দেশের প্রতিনিধিদের প্রদত্ত যৌথ বিবৃতি প্রকাশিত হয়। বিবৃতিতে ভারত-সােভিয়েত মৈত্রী চুক্তির ৯নং ধারায় ভারত বা সােভিয়েট ইউনিয়ন ততীয় দেশ কর্তৃক আক্রান্ত হলে উভয় দেশ পরস্পরকে সামরিক সাহায্য দানের যে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত আছে তা বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত ঘােষণা করা হয়। এই ঘােষণার ফলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে উপমহাদেশে যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে যার পরিণতি একটি অবিসম্ভাবী যুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তার স্পষ্ট ইঙ্গিত বহন করে। | ২৯ অক্টোবর ‘দি টাইমস্’ পত্রিকায় পাক-ভারত উপমহাদেশে উত্তেজনাময় পরিবেশ সম্পর্কে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস গান্ধীর যুক্তি সমর্থন করে এক সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশিত হয় । নিবন্ধে মিসেস গান্ধীর বরাত দিয়ে বলা হয় যে, সমস্যার একটি রাজনৈতিক সমাধানের মাধ্যমে পূর্ববঙ্গ থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে শরণার্থীদের তাদের নিজের দেশে ফিরে যাওয়ার পরিবেশ সৃষ্টি করেই কেবলমাত্র উপমহাদেশে সৃষ্ট উত্তেজনা নিরসন সম্ভব। ৯০ লক্ষ শরণার্থীকে আশ্রয় দিতে বাধ্য হয়ে ভারত যে এক ভয়াবহ রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক চাপে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে রয়েছে তাও নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়। ইয়াহিয়া খান মূল সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে পূর্ববঙ্গে’ যে অকার্যকর পুতুল বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে তার কঠিন সমালােচনা করা হয়। ৩০ অক্টোবর “দি ইকোনােমিষ্ট” এবং “দি টাইমস” পত্রিকা ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গন্ধিীর লন্ডন সফরের উপর খবর ও বিশ্লেষণ ধর্মী প্রবন্ধ প্রকাশ করে।
“দি ইকোনােমিষ্ট পত্রিকার বিশ্লেষণে মন্তব্য করা হয় যে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী তিন সপ্তাহ ব্যাপী পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশে সফর করে সরকার প্রধানদেরকে ভারত-সােভিয়েত মৈত্রী চুক্তি সম্পর্কে ব্যাখ্যা, বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থী সমস্যা এবং পূর্ববঙ্গের সমস্যার স্থায়ী সমাধানে নে মুজিবকে মুক্তিসহ পূর্ববঙ্গ থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের জন্য পাকিস্তানকে চাপ সৃষ্টি লক্ষ্যে দৃষ্টি আকর্ষণ করবেন। ‘দি টাইমস” পত্রিকায় এক খবরে রিয়াল ইনষ্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল এ্যাফেয়স ‘ এর সদস্যদের উদ্দেশ্যে মিসেস গান্ধীর বক্তব্যে পূর্ববঙ্গের এর সমাধান একমাত্র পূর্ববঙ্গের নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই করতে পারেন বলে মন্তব্য | আর তা করতে হলে শেখ মুজিবের মুক্তি অপরিহার্য বলে তিনি মন্তব্য করেন। ১ অক্টোবর “দি সানডে টাইমস্ পত্রিকায় বাংলাদেশে মুক্তিযােদ্ধাদের বীরােচিত গুণ এবং প্রতিরােধের একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে ঢাকা থেকে প্রাপ্ত বর বরাত দিয়ে বলা হয় যে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মুক্তিবাহিনীর নেতৃত্বে প্রায় ১ লাখ গেরিলাযােদ্ধা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সক্রিয় সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত রয়েছে। প্রতিবেদনে গেরিলাদের আক্রমণে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্ষয়ক্ষতিরও একটি পরিসংখ্যান প্রকাশিত হয়। ‘দি অবজারভার’ পত্রিকায় একই দিনে সফররত ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস গান্ধী ও বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথের আলােচনার সংবাদ প্রকাশিত হয় । মিসেস গান্ধী। উপরােক্ত বৈঠকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং উপমহাদেশের সংকটে ভারতের নীতির প্রতি। বৃটেনের সমর্থন কামনা করেন।
বিলাতের পত্র পত্রিকার ভূমিকা নভেম্বর ‘৭১
১ নভেম্বর ‘দি টাইমস্’ পত্রিকায় সফররত ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস গান্ধীর সম্মানে ইন্ডিয়া লীগ আয়ােজিত সভায় তার বক্তৃতার বরাত দিয়ে বলা হয় যে, ৯০ লক্ষ শরণার্থী রক্ষণাবেক্ষণ ও সীমান্ত পরিস্থিতি এক ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি করেছে। মিসেস গান্ধী অবস্থাকে আগ্নেয়গিরির সাথে তুলনা করে বলেন যে তার বিস্ফোরণ যে কোন সময় ঘটতে পারে। দি ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় একই দিনে ডেভিড লােশাক প্রেরিত এক সংবাদ সমীক্ষায় একের পর এক পাকিস্তান সরকারের হঠকারি সিদ্ধান্তের ফলে বাংলাদেশ সমস্যা নিয়ে পাকিস্তান যে একটি চরম সংকটে নিপতিত হয়েছে তার বিস্তারিত আলােচনা করা হয়। ৩ নভেম্বর ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় ঢাকা থেকে মিস ক্লেয়ার হােলিংওয়ার্থ কর্তৃক প্রেরিত বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গেরিলা মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতিরােধ ও আক্রমণের ফলে পাকিস্তানী ক্ষয়ক্ষতির প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। খবরে বলা হয় যে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রায় ৪০ হাজার মুক্তিযােদ্ধা গেরিলা আক্রমণ চালিয়ে পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনীকে ব্রিত অবস্থায় রেখেছে। শহর অঞ্চলেই মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণে গড়ে ২০ জন পাকিস্তানী সৈন্য হতাহত হচ্ছে এবং জনসমর্থনের কারণে মুক্তিযােদ্ধাদের ক্ষমতা প্রতিদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে বলেও খবরে মন্তব্য করা হয়। ৪ নভেম্বর একই পত্রিকায় ঢাকা থেকে প্রেরিত খবরে মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণে সিদ্ধিরগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৪টি ইউনিটের মধ্যে ৩টি ইউনিট বিধ্বস্ত হওয়ার সংবাদ প্রচারিত হয়। মুক্তিযােদ্ধারা পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ইউনিফরম পরিধান করে ছদ্মবেশে এই দুর্দান্ত আক্রমণ পরিচালনা করে। বিদ্যুৎ কেন্দ্র বিধ্বস্ত হওয়ায় ঢাকা ও আশেপাশের শিল্প এলাকা অকেজো হয়ে যায়। এই খবরে প্রবাসীদের মধ্যে বিপুল উৎসাহের সৃষ্টি করে এবং মুক্তিযােদ্ধাদের কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ‘দি টাইমস্ পত্রিকায় ৮ নভেম্বর তারিখে উপমহাদেশে উত্তেজনা এবং মিসেস গান্ধী ও মিঃ ভুট্টোর আন্তর্জাতিক সফরের মূল্যায়ন করে একটি সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। নিবন্ধে বলা হয়, মিসেস গান্ধী তার সফরকালে বাংলাদেশ সমস্যার বিষয়ে আন্তর্জাতিক সহানুভূতি লাভ করেছে বলে প্রতিয়মান হয়। পক্ষান্তরে মিঃ ভুট্টো চীন সফর শেষে পাকিস্তানের সরাসরি সমর্থনে চীনের কোন সরকারী বিবৃতি আদায় করতে ব্যর্থ হওয়ায় উপমহাদেশের সংকটে পাকিস্তানের কূটনৈতিক বিপর্যয়ের কথা তুলে ধরা হয়।
৯ নভেম্বর দি গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় উপমহাদেশে সৃষ্ট ঘটনা প্রবাহ ইয়াহিয়া খানের বিরুদ্ধে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করে একটি সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। নিবন্ধে উল্লেখ করা হয় যে পাকিস্তানের সেনাপতিদের একগুয়েমি ও নির্বুদ্ধিতার জন্য তারা আজ ধ্বংসের শেষ উপনীত হয়েছে এখন আলােচনার মাধ্যমে ক্ষয়ক্ষতি এড়িয়ে বিদায় নিতে হবে। নতুবা যুদ্ধ ঘোষণা করে পরাজিত হতে হবে। বাংলাদেশ সমস্যা এমন এক যার ফলে পাকিস্তানের কাছে বিকল্প তেমন কিছু আর অবশিষ্ট নাই বলে পর্যায়ে এসেছে যার ফলে পাকিস্তা সম্পাদকীয়তে মন্তব্য করা হয়। | ৯ নভেম্বর ‘দি ডেইলি নভেম্বর “দি ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় বাংলাদেশে পাকিস্তানী আগ্রাসনের সর্বশেষ সুতি নিয়ে একটি সম্পদকীয় ছাপা হয়। সম্পাদকীয় মন্তব্যে বলা হয়, ইয়াহিয়া খান আন্তর্জাতিকভাবে ক্রমশ একা হয়ে যাচ্ছে। তাই ইয়াহিয়া খানের উচিৎ শেখ মুজিবকে মুক্তি দিয়ে তার সাথে একটি রাজনৈতিক সমাধানের নতুন প্রচেষ্টা চালানাে। পূর্ববঙ্গে প্রতিনিয়ত যেভাবে মুক্তিযােদ্ধাদের অগ্রযাত্রা অব্যাহত আছে তাকে অন্যখাতে প্রবাহিত করার জন্য। পাকিস্তান হয়তাে কাশ্মীর সমস্যাকে সামনে এনে সেই ফ্রন্টে যুদ্ধ ঘােষণা করতে পারে। কিন্ত তার সম্ভাবনা ও ক্ষীন হয়ে গেছে মি, ভূট্টোর ব্যর্থ চীন সফরের পর। সম্পাদকীয়ের এক অংশে বলা হয়েছে— Fortunately. it looks as though Mr. Bhutto’s mission to Peking has failed to produce any chinese undertaking to provide diversionary relief on India’s northern frontier in such an event, as china did before. Unlike last time. India has now mutual defence pact with Russia against attacks by third parties.•••••” রক্ষণশীল পত্রিকা নামে পরিচিত দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’ তাদের সম্পাদকীয় মন্তব্যে যে ভবিষ্যতবানী করেছিল তার যথার্থতা প্রমাণিত হলাে ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে। ভারত ও পাকিস্তান পূর্বাঞ্চলে যুদ্ধ ঘােষণা করলে পাকিস্তানের পক্ষে কাশীর বা পাঞ্জাব ফ্রন্টে যুদ্ধ সম্প্রসার করা সম্ভব হয় নাই।
১১ নভেম্বর ‘দি টাইমস্’ পত্রিকায় ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধের পূর্বাভাস হিসাবে নােয়াখালী জেলার বেলুনিয়া এলাকায় সীমান্ত যুদ্ধে ১০২ জন ভারতীয় সৈন্য নিহত হয়েছে বলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দাবির খবর প্রকাশিত হয়। সংবাদে বলা হয় যে, উভয় সীমান্তে ভারত ও পাকিস্তান সৈন্য সমাবেশ জোরদার করছে এবং যে কোন সময় পূর্ণ যুদ্ধ ঘােষণা হতে পরে। ১২ নভেম্বর দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’ পত্রিকার সংবাদদাতা ক্লেয়ার হােলিংওয়ার্থ কর্তৃক পাকা থেকে প্রেরিত খবরে ঢাকার জি. পি, ও, এর কাছে মুক্তিযােদ্ধারা একটি শক্তিশালী। বােমা বিস্ফোরণের মাধ্যমে হতাহত ও ব্যাপক ক্ষতি সাধন করা হয়েছে বলে প্রকাশিত হয়। পন্ডন থেকে প্রকাশিত পত্রিকা সমূহে এই মাসব্যাপী বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এবং সামান্ত এলাকায় মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণ ও প্রতি আক্রমণের খবরা খবর প্রাধান্য পায়। ৩ নভেম্বর “দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’ তাদের প্রতিনিধি মিস ক্লেয়ার হােলিংওয়ার্থ কর্তৃক কে প্রেরিত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে বলা হয় যে, ইয়াহিয়া খান। ” “তানকে টিকিয়ে রাখতে সর্বশেষ প্রচেষ্টা হিসাবে “পূর্ব পাকিস্তানে” ১২ থেকে ২৩ ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় সংসদের উপ-নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘােষণা দেন। প্রতি উল্লেখ করা হয়, উপনির্বাচনের পর মুসলিম লীগ নেতা নূরুল আমীনকে পাট প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়ােজিত করা হবে এবং মন্ত্রীসভায় বাঙালীদের প্রাধান্য থাকবে বলে দেয়া হয়। ইয়াহিয়া খানের এই চাল কোন ফলপ্রসু পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে গত বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধা ও জনগণের কাছে আরেকটি ষড়যন্ত্র বলে প্রতীয়মান হত মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণের মাত্রা আরাে বৃদ্ধি পায় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় নভেম্বর “দি সানডে টেলিগ্রাফ পত্রিকায় ঢাকা থেকে প্রেরিত এক সংবাদ বিবরণীত যায়, পূর্ববঙ্গে সফররত জাতিসংঘের এ্যাসিসটেন্ট সেক্রেটারী জেনারেল মার্ক হেনরী তার সফর সংক্ষিপ্ত করে বাংলাদেশের পরিস্থিতি সেক্রেটারী জেনারেল উ থান্টকে জানানাের জন্য নিউইয়র্ক ফিরে গিয়েছেন। খবরে বলা হয়, পূর্ববঙ্গে’ যে সকল বিস্তীর্ণ এলাকা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে নাই সে সব এলাকায় জাতিসংঘের ত্রাণসামগ্রী বিতরণ সম্ভব নয় বলেই মি. হেনরি ঢাকা ত্যাগ করেন। একই দিন (১৪ নভেম্বর) “দি অবজারভার” পত্রিকায় ঢাকা থেকে প্রেরিত খবরে মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণের বিবরণ প্রকাশিত হয়। পত্রিকায় বলা হয় মুক্তিযােদ্ধারা লিপেট মাইন’ ব্যবহারে করে জাতিসংঘের চিহ্নধারী একটি খাদ্যশষ্য বহনকারী জাহাজকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
১৫ নভেম্বর “দি ডেইলি টেলিগ্রাফ” এর বিশেষ সংবাদদাতা মিস ক্লেয়ার হােলিংওয়ার্থ বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চল থেকে প্রেরিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয় যে, মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে আধুনিক অস্ত্র ও গোলাবারুদের অভাব থাকলেও তাদের মনােবল শক্ত এবং তাদের মধ্যে মাতৃভূমি স্বাধীন করার দৃঢ় প্রত্যয়, উৎসাহ ও উদ্দীপনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। প্রতিবেদনে আরাে বলা হয়, ঢাকার আশে পাশে হাজার হাজার মুক্তিযােদ্ধা অবস্থান নিয়েছে এবং আগামী এক মাসের মধ্যে ঢাকা আক্রমণের ব্যাপারে প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে মুক্তিযােদ্ধারা সংবাদদাতাকে অবহিত করেন। একই দিন (১৫ নভেম্বর) দি টাইমস’ পত্রিকার এক খববে জানা যায় যে, চালনা বন্দরের কাছে “সিটি অফ সেন্ট অলবান্স” নামের একটি মালবাহী জাহাজ মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দু’টি গানবােট ব্যবহার করে মুক্তিযােদ্ধারা জাহাজের উপর গােলা নিক্ষেপ করে বলে সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে সংবাদ পরিবেশন করা হয়। এই খবরে প্রতীয়মান হয় যে, মুক্তিযােদ্ধারা স্থল ও জলপথে চতুর্মুখী আক্রমণের জন্য শক্তি অর্জন করে চূড়ান্ত আঘাতের জন্য প্রস্তুত রয়েছে। ১৫ নভেম্বর ‘দি টাইমস্ এর সংবাদদাতা পিটার হেজেলহাষ্ট্র ভারত পাকিস্তানের যুদ্ধের সম্ভাবনার বিষয় একটি বিশ্লেষণ মূলক প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। নিবন্ধে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস গান্ধীর বরাত দিয়ে বলা হয় যে, পূর্ববঙ্গ সমস্যা সমাধানের বিষয় আন্তর্জাতিক নেতৃবৃন্দ কিছু দিনের মধ্যে ব্যর্থ হলে ভারতে জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ভারত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য হবে। এই ইংগিতের মাধ্যমে স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে তার শীঘ্রই দেশে জরুরী অবস্থা ঘােষণা করে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘােষণার সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন
বিলাতের পত্র পত্রিকার ভূমিকা ডিসেম্বর ৭১
১ ডিসেম্বর ‘দি টাইমস’ পত্রিকায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ৩০ নভেম্বরে রাজ্য পরিষদে প্রদত্ত বক্তৃতার গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশের সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া অন্য কোন বিকল্প নাই বলে তিনি সরকারের মনােভাবের কথা উল্লেখ করেন। মিসেস গান্ধী আরাে বলেন, পাকিস্তান যদি শান্তির পক্ষে হয় তা হলে ইয়াহিয়া খান বাংলাদেশ থেকে তার সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করতে হবে। ঐ রাতেই এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে ভারতের দেশরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম বলেন, আত্মরক্ষার প্রয়ােজনে ভারতীয় সৈন্যবাহিনীকে পূর্ববঙ্গে প্রবেশ করে পাকিস্তান সেনা বাহিনীকে মােকাবেলা করার অনুমতি দেয়া হয়েছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। ১ ডিসেম্বর ‘দি গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় ম্যাম ডীন কর্তৃক প্রেরিত এক খবরে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে জাতিসংঘে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের কর্মতৎপরতার বিবরণ প্রকাশিত হয়। খবরে বলা হয় যে, প্রতিনিধি দল প্রায় ১০০টি দেশের প্রতিনিধিদের সাথে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশে মুক্তিযােদ্ধাদের সাফল্য, বাংলাদেশের স্বাধীনতার বাস্তবতা এবং বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের বিষয়ে ব্যাখ্যা প্রদান করেন। ২ ডিসেম্বর জাতিসংঘ থেকে ‘দি গার্ডিয়ান’ পত্রিকার সংবাদদাতা ম্যাকম্ ডীন প্রেরিত প্রতিবেদনে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতা বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর একটি বিবৃতি প্রকাশিত হয়। বিচারপতি চৌধুরী বলেন, মার্চ মাসে যখন ইয়াহিয়া খান পূর্ববঙ্গে’ গণহত্যা পরিচালনা করছিল তখন জাতিসংঘ ঐ জঘন্য অপরাধকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরিণ ব্যাপার বলে কোন আমলে আনে নি। আর এখন যখন বাংলাদেশে মুক্তিযােদ্ধারা পাকিস্তান সেনা বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে সফলতা লাভ করছে তখন জাতিসংঘের পক্ষে পূর্বের মতাে নিষ্ক্রিয়। থাকাই উচিৎ। তিনি বিবৃতিতে আরাে বলেন, বাংলাদেশ অতি শীঘ্র স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। হিসাবে আত্মপ্রকাশ করবে এবং অনেক দেশের স্বীকৃতি লাভ করবে। তাই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের এই চূড়ান্ত বিজয়ের সময়ে জাতিসংঘের কোন পদক্ষেপ গ্রহণযােগ্য হবে না। প্রসঙ্গত উল্লেখযােগ্য যে, এ সময়ে বিচারপতি চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বদানের জন্য জাতিসংঘে অবস্থান করছিলেন।
৩ ডিসেম্বর ‘দি টাইমসূ’ পত্রিকায় “India’s tactics in East Pakistan” শিরোনামে একটি সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। নিবন্ধে বলা হয় যে, ভারতের অভ্যন্তরে “বাংলাদেশের শরণার্থীদের ভার বহন করতে ভারত যে ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন অনেক কম ক্ষতির ঝুকি নিয়ে যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন করে শরণার্থী দেশে প্রত্যাবর্তন করতে পারলে উপমহাদেশে শান্তি ফিরে আসবে যুদ্ধ – উপায় হিসাবে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রামের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়- No war avoided if the rulers of on the wall and give has yet begain. he insists, and war can be avoided if the Pakistan will read the writings on the wall and pendence to the peole of Bangladesh in accordance with their wishes” একই দিনে দি টাইমস্ পত্রিকায় কলিকাতা থেকে সা পরিবেশিত মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণ এবং ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় বলা হয় যে, মুক্তিযােদ্ধাদের পর্যাপ্ত ট্রেনিং না থাকায় পাকিস্তানী নিয়মিত সেনাবাহিনীর সাত কুলিয়ে উঠতে পারছেনা এবং বিপুল ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। ক্ষয়ক্ষতি সতে মুক্তিবাহিনী কর্তৃক সীমান্ত এলাকায় কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখলের খবরও এই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। ৪ ডিসেম্বর বিলাতের সকল পত্রিকায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস গান্ধী ভারতে জরুরী অবস্থা ঘােষণা করে জাতির উদ্দেশ্যে যে বেতার ভাষণ প্রদান করেন তার বিবরণ প্রকাশিত হয় । মিসেস গান্ধী বলেন যে, পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে পূর্ণ যুদ্ধ ঘােষণা করেছে এবং দেশে যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে। ৪ ডিসেম্বর ‘দি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় পাকিস্তানে জুলফিকার আলী ভূট্টোর ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি সম্বলিত একটি খবর প্রকাশিত হয় । মিঃ ভূট্টো এক জনসভায় ভারতীয় আক্রমণ প্রতিহত করতে ব্যর্থ হওয়ায় ইয়াহিয়া খানকে ক্ষমতা ত্যাগ করে তার কাছে পূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর করার দাবি করেন। ৫ ডিসেম্বর “দি সানডে টাইমস্’ পত্রিকায় এনথােনি মাসকারেনহাস “Why they went te, war” শিরােনামে একটি বিশ্লেষণাত্মক প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। বিশ্বের বড় বড় শক্তিশালী দেশগুলাের দীর্ঘ দিনের নীরবতা এবং ভারতে শরণার্থী প্রবেশের ফলে সৃষ্ট কি পারশাণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপের ফলে শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ প্রয়ােজন হলে তার বিশ্লেষণ *রে ভারতের পক্ষে এছাড়া যে কোন বিকল্প ছিল না তা প্রবন্ধে মন্তব্য করা হয়। প্রববাে শুরুতেই উল্লেখ করা হয় যে, ‘The hard truth of the matter is that to was reluctantly forced to the conclusion that there could solution to the refugee problem other than war. Eight looking to the International Community for help disappointing.” একই দিনে ‘দি সানডে টাইমস্’ পত্রিকায় চলে slaughter” শিরােনামে একটি সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। সপ বন্ধ করার উপর গুরুত্ব দিয়ে মন্তব্য করা হয় যে, এখনও যদি পু মুজিবকে মুক্তি দিয়ে তার দাবি মেনে পূর্ববঙ্গে স্বায়ত্তশাসন এ বন্ধ হতে পারে।
৬ ডিসেম্বর “দি টাইমস’ পত্রিকার এক প্রতিবেদনে জানা যায় যে, মুক্তিযােদ্ধাদের যােগিতায় ভারতের সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হিসাবে আক্ষায়িত করে যুদ্ধ বিরতির জন্য একটি প্রস্তাব জাতিসংঘের সিকিউরিটি কাউন্সিলে উথাপন করে। প্রতিবেদনে বলা হয়, সিকিউরিটি কাউন্সিলের সদস্যদেশগুলাের মধ্যে ১১টি নে প্রস্তাবের পক্ষে, সােভিয়েট ইউনিয়ন ও পােলান্ড প্রস্তাবের বিপক্ষে এবং বৃটেন ও ফ্রান্স ভােট দানে বিরত থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাব পরিশেষে সােভিয়েত ইউনিয়নের ভিটো’ প্রয়ােগের ফলে কার্যকর করা সম্ভব হয় নাই । ৬ ডিসেম্বরে ‘দি ডেহলি টেলিগ্রাফ পত্রিকার এক খবরে বলা হয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের ব্যাপকতা দেখে উদ্বেগ প্রকাশ করে যুদ্ধের জন্য ভারতকে দায়ী করে। যুদ্ধের গুরুত্ব উপলব্ধি করে মার্কিন সেক্রেটারী অফ স্টেট উইলিয়াম রজার্স বিদেশ সফর বাতিল করেন এবং প্রেসিডেন্ট নিক্সনের নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা ড. হেনরি কিসিংগারের নেতৃত্বে একটি এ্যাকশন গ্রুপ সার্বক্ষণিক পরিস্থিতি মনিটরিং করে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। ৭ ডিসেম্বর ‘দি টাইমস্ দি গার্ডিয়ান’ এবং ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’ সহ সকল পত্র পত্রিকায় ভারত কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের খবর ব্যানার শিরােনামে প্রকাশিত হয়। এই স্বীকৃতি দানের সাথে সাথে বাংলাদেশ যে পৃথিবীর মানচিত্রে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম নতুন রাষ্ট্র সৃষ্টি হলাে তার বাস্তবতা সম্পর্কে সকল পত্র পত্রিকা মন্তব্য করে বলা হয় যে, অল্প দিনের মধ্যে বাংলাদেশকে আরাে অনেক দেশ স্বীকৃতি দেবে। এই দিনের পত্র পত্রিকায় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে ক্ষয়ক্ষতি, মুক্তিযােদ্ধাদের অগ্রযাত্রা এবং যুদ্ধরত প্রতিপক্ষের পরস্পর বিরােধী দাবি সমূহের বিবরণ প্রকাশিত হয়। ৭ ডিসেম্বর বিলাতের সকল পত্র পত্রিকায় এই দিনটিকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন হিসাবে চিহ্নিত করে সম্পাদকীয় প্রবন্ধ প্রকাশ করে। ৭ ডিসেম্বর ‘দি টাইমস’ পত্রিকায় “The deadlock at the UN” শিরােনামে এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বন্ধ করতে ব্যর্থ হওয়ায় তীব্র সমালােচনা করা হয়। সম্পাদকীয় এর শুরুতেই মন্তব্য করা হয় “The United Nations Security council seems as powerless as ever to stop a war that nobody wants except the combatants. True, it is great power division that has brought the deadlock in New Youk as it did in the Past. একই দিনে ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় সম্পাদকীয় নিবন্ধে ভারত কর্তৃক ‘লাদেশকে স্বীকৃতি দানের যৌক্তিকতাকে সমর্থন করে বলা হয় যে, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে। রেই রাশিয়া এবং পূর্ব ইউরােপের কয়েকটি দেশ ভারতকে অনুসরণ করবে। সম্পাদকীয় শব্দে এক পর্যায়ে মন্তব্য করা হয় “Given Indias policy and the stage ” has been reached on the ground in East Pakistan the decision had indeed become logical.
এবং সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান কামনা করেন। পিটার শাের বলেন যে ত সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান হতে হলে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত নেতা । অপরিহার্য। মিঃ ডগলাসম্যান পাকিস্তানের যুদ্ধ বন্ধ করার লক্ষ্যে হাউজে উ যে প্রস্তাব তৈরি করেছেন তাতে এ পর্যন্ত হাউজের উভয়পক্ষের ১০০ জন সদ করেছেন বলে হাউজকে অবহিত করেন। তিনি তার বক্তব্যে এক পর্যায়ে প্রশ্ন : Right Hon. Gentleman aware ol the widespread Iccling Pakistan, after the events of the last few weeks, can never be country” তিনি পাকিস্তানে’ এই অন্তর্ঘাতি যুদ্ধ বন্ধ করার লক্ষ্যে বৃটিশ সরকারকে সকল প্রকার প্রভাব ও প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার অনুরােধ করেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রী উপসংহারে বলেন যে, উপরােক্ত প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। পিটার শাের বলেন যে, উদ্ভুত পরিস্থিতিতে ভাবে নির্বাচিত নেতা শেখ মুজিবের মুক্তি বার লক্ষ্যে হাউজ উথাপনের জন্য ১০০ জন সদস্য স্বাক্ষর ঘর বক্তব্যে এক পর্যায়ে প্রশ্ন রাখেন “Is of the widespread feeling that ‘পূর্ববঙ্গে গণহত্যা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য (২০ এপ্রিল, ‘৭১)
বৃটিশ পার্লামেন্টে বিরােধী দলীয় মাননীয় নেতা হ্যারল্ড উইলসনের পূর্ববঙ্গ’ পরিস্থিতি সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথ বলেন, যথাসময়ে পূর্ববঙ্গের পরিস্থিতি সম্পর্কে হাউজকে অবহিত করা হবে। বিরােধী দলীয় নেতা মি, উইলসন পূর্ব বাংলায়’ গণহত্যা সম্পর্কে সঠিক তথ্য সংগ্রহের জন্য একটি পরিদর্শন দল প্রেরণের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে পরামর্শ দেন। একই প্রসঙ্গে লিবারেল পার্টির সদস্য ডেভিড স্টীলের এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পূর্ব বাংলায় একটি রাজনৈতিক সমাধান ও সংঘর্ষের অবসানের উপযুক্ত পন্থা অবলম্বনের জন্য বৃটিশ সরকার স্বচেষ্ট ও সক্রিয় আছে। শ্রমিক দলের সদস্য ও বাংলাদেশের কট্টর সমর্থক এম, পি, পিটার শাের পূর্ববঙ্গে পাকিস্তানের সামরিক সরকারের গৃহিত দমননীতি পরিহারের জন্য পাকিস্তানের সামরিক সরকারের উপর চাপ সৃষ্টির লক্ষ্যে বৃটিশ সরকারের নীতি নির্ধারনের জন্য পার্লামেন্টে জরুরী ও পূর্ণাঙ্গ আলােচনা অনুষ্ঠানের জন্য। দাবি জানান। শ্রমিক দলীয় অপর এক সদস্য উইলিয়াম হ্যামিলটন প্রশ্নোত্তর পর্বে আলােচনায় অংশগ্রহণ করে পূর্ব বাংলায় পাকিস্তান সামরিক সরকার পরিচালিত গণহত্যার প্রতিবাদ ও নিন্দা জ্ঞাপনের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান। পাকিস্তানকে সাহায্য প্রদান সংক্রান্ত বির্তক (২৬ এপ্রিল, ‘৭১) ২৬ এপ্রিল, ১৯৭১ হাউজ অব কমনস-এ পাকিস্তানে ভবিষ্যতে বৃটিশ সাহায্য প্রদান সংক্রান্ত বিষয়ে মাননীয় এম, পি মিঃ প্রেনটিস এক প্রশ্ন উত্থাপন করেন। প্রশ্নের জ” বৈদেশিক উন্নয়ন বিষয়ক মন্ত্রী রিচার্ড উড বলেন, আগামী জুলাই মাসে অনুষ্ঠিতব্য এ ন্য দাতা দেশ ও সংস্থার সাথে আলােচনা করে এবং পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তবে পূর্ব পাকিতা প্রকল্পে কাজ চলছে সে সকল প্রজেক্টে যাতে সাহায্য অব্যাহত থাকে তাও ল বলে তিনি আশ্বাস দেন। পাকিস্তানে বৃটিশ সাহায্য সংক্রান্ত বিতর্ক হবে। তবে ‘পূর্ব পাকিস্তানে’ যে সকল অব্যাহত থাকে তাও লক্ষ্য রাখা হবে হায্য সংক্রান্ত বিতর্কে প্রেনটিস্ ছাড়াও উইলকিনসন, পিটার শোর, মিঃ বাস প্রমুখ সম্মানিত এম, পি, বৃন্দ অংশ গ্রহণ করেন। মিঃ বার্নস এর এক প্রশ্নের জবাবে বৃটিশ পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ বিষয়ক মন্ত্রী স্যার আলেক ডগলাস হিউম হাউজকে জানান যে, পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহ পরিস্থিতি তিনি পর্যালোচনা করেছেন।
১৯৬৭ইং সনের পর ছােট খাট মেরামত এর চুক্তি ব্যতিরেকে বৃটেনের সাথে তেমন কোন উল্লেখযোগ্য অস্ত্র সরবরাহের চুক্তি হয়নি বলেও তিনি হাউজকে অবহিত করেন। বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য ও আলােচনা (৪ মে, ‘৭১) | ৪ মে, ১৯৭১ সনে হাউজ অব কমনস্ এ বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী মাননীয় এডওয়ার্ড হাথ “পাকিস্তান’ এর রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী শরণার্থী সমস্যা সংক্রান্ত বিষয়ে প্রথম বারের মতাে বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন, পাকিস্তানের বর্তমান নাজুক পরিস্থিতির একটি রাজনৈতিক সমাধানের কথা পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নিজেই ব্যক্ত করেছেন। আমরা আশা করি, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এই মর্মে বাস্তব পদক্ষেপ নেবেন। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের বিশেষ দূত আরশাদ হােসেনের সাথে গত সপ্তাহের তাঁর বৈঠক অনুষ্ঠানের কথা তিনি পার্লামেন্টকে অবহিত করে মিঃ হীথ বলেন যে, পাকিস্তানে সাহায্য প্রদানের পূর্বঘােষিত নীতি এখনও অনুসরণ করা হবে। শরণার্থী সমস্যার বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী হাউজকে জানান যে, আমাদের সর্বশেষ খবর মােতাবেক পূর্ব পাকিস্তান থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৬০,০০০ শরণার্থী ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেছে এবং প্রতিদিন প্রায় ২০,০০০ শরণার্থী ভারতে প্রবেশ করছে। শরণার্থীদের ক্যাম্পে সাহায্য প্রেরণের বিষয়ে সরকার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থার সাথে যােগাযােগ রাখছেন বলেও তিনি হাউজকে অবহিত করেন। পূর্ব পাকিস্তান’ এর এহেন দুর্যোগ মুহূর্তে বৃটিশ জনগণ ও সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন যে, At the same time, there is a deep feeling in this country and the house about the problems which exist. This was shown in the different situation which arose when part of East Pakistan was hit by the hurricane and there was an upsurge of voluntary effort which amazed the world, as I known from my own contacts. There is similarly today a very deep feeling about the situation. I think it is quite natural that many in this country and the House would want to help. হাউজে প্রশ্ন উত্থাপন ও আলােচনায় অংশগ্রহণ করেন মাইকেল বার্নস, পিটার শাের, হিউজ ফ্রেজার, জন ম্যানডেলসন, বিগ্স ডেভিডসন এবং মি. ডালিয়েল প্রমুখ সম্মানিত এম. পি. বৃন্দ।
‘পূর্ব পাকিস্তান’ পরিস্থিতিতে পাকিস্তান’ পরিস্থিতিতে প্রস্তাব উত্থাপন ও সাধারণ আলােচনা (১৪ মে, ১৯৭১) ১৪ মে, ১৯৭১ তারিখে বৃটিশ পার্লামেন্টে পূর্ব পাকিস্তান’ এর পরিস্থিতি সংক্রান্ত প্রস্তাব উথাপন এবং সাধারণ আলােচনার জন্য পূর্ব থেকেই দিন ধার্য করা হয়েছিল। নির্ধারিত এই দিনে সকাল ১১-০৫ মিনিটে লন্ডনের কেনসিংগটন নর্থ থেকে নির্বাচিত শ্রমিক দলীয় এম, পি রুস ডগলাস ম্যান পর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসের ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতি সম্পর্কে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন। প্রস্তাবে বলা হয় যে, “That the House, deeply concerned by the killing and destruction which has taken place in East Pakistan, and the possible threat of food shortages later this year calls upon Her majestys Government to use their influence to secure on end to the strise, the admission of United Nations or other international relief orgamsations and the achievenient of political settlement which will respect the democratic rights of the people of Pakistan. তিনি ইতােপূর্বে যে ৩০০ এম পি এর স্বাক্ষর যুক্ত প্রস্তাবটি জমা দিয়েছিলেন (প্রস্তাব নং-৫০৯)। বর্তমান প্রস্তাবটি তার চেয়ে সামান্য পরিবর্তিত অবস্থায় উথাপনের কথা হাউজকে অবহিত করে বলেন যে, একটি প্রস্তাবে ৩০০ জন সম্মানীত এম. পি. এর সমর্থন পার্লামেন্টে এক নজিরবিহীন ঘটনা। এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহে জন ষ্টোন হাউজ ও তার বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় শরণার্থী শিবির এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কিছু এলাকা পরিদর্শনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে ব্রুস ডগলাস ম্যান বলেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর পরিচালিত জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডে এ পর্যন্ত প্রায় ১ লক্ষ বাঙালি প্রাণ হারিয়েছে (পাকিস্তানের সরকারী হিসাবে ১৫০০০) এবং প্রাণভয়ে ইতিমধ্যে প্রায় ২০ লক্ষ লােক ভারতে পালিয়ে এসেছে। তিনি।
রণার্থী শিবিরগুলাের করুণ অবস্থা এবং খাদ্য সংকটের কথা হাউজকে অবহিত করে বলেন। যে, অনতিবিলম্বে আন্তর্জাতিক ত্রাণ তৎপরতা শুরু না হলে সেখানে দুর্ভিক্ষে লক্ষ লক্ষ লােক। মৃত্যুবরণ করবে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নির্মমতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বক্তৃতায় এক AICI COTT “Time and again we were told the same story: troops of the West Pakistan military Authorities had entered the village, which had not been defended, had shot the men in the fields and killed the women and children and then, having killed a great number of people from the village, had burnt it down and . উগলাস ম্যান তার দীর্ঘ ২২ মিনিটের বক্তব্যে পাকিস্তানের জন্ম ইতিহাস, পূর্ব। “কস্তানের দীর্ঘ দিনের বঞ্চনা ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের ফলে সৃষ্ট অবিশ্বাস এবং গত
করে চলছে। তিনি পাকিস্তানের অর্থনৈতিক পুর্নগঠনে সাহায্য প্রদান সংৰ পরবর্তি পর্যায়ে বিবেচনা করা হবে বলেও হাউজকে অবহিত করেন। এই পর্যায়ে আলাে অংশ গ্রহণ করেন ডেনিস হীলি, গ্রেভি জেনার, জর্জ কানিংহাম, স্যার এফ কেনে জাড এবং মিসেস জুডিথ হার্ট প্রমুখ সম্মানিত এম. পি. বৃন্দ। ত্রাণ সাহায্য সংক্রান্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিবৃতি (৮ জুন, ৭১) ‘পাকিস্তান’ এর সর্বশেষ পরিস্থিতি, ত্রাণ কার্যক্রম এবং বৃটেনের ত্রাণ সাহায্য প্রেরণ সম্পর্কে ৮ জুন বৃটিশ পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ বিষয়ক মন্ত্রী আলেক ডগলাস হিউম হাউজে বিবৃতি প্রদান করেন। স্পীকারের অনুমতি নিয়ে বিবৃতির শুরুতে হাউজকে অবহিত করেন 61, “Since the House debated the situation in Pakistan, there has been a serious deterioration of now of refugee from East Pakistan to India. The number is now estimated as upwards of 4 million” তিনি বিবৃতিতে বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তান পরিস্থিতির ভয়াবহতার কথা চিন্তা করে তিনি সিয়াটো সভায় যােগদানের জন্য লন্ডনে অবস্থান কালে আমেরিকার পররাষ্ট্র মন্ত্রীর সাথে এ বিষয়ে আলােচনা করে জাতিসংঘকে পর্যাপ্ত ত্রাণ সাহায্য প্রেরণের উদ্যোগ গ্রহণের জন্য যৌথ ভাবে অনুরােধ করেছিলাম। জাতিসংঘের মহাসচিব উথানট ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী ‘পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীদের সাহায্যের জন্য যে আবেদন করেছিল তাতে প্রথমই বৃটিশ সরকারের পক্ষ থেকে ১০ লাখ পাউন্ড এবং আরাে ৭ লক্ষ ৫০ হাজার পাউন্ডেশ খাদ্য সামগ্রী প্রদান করা হয়েছে বলে তিনি হাউজকে অবহিত করেন। জাতিসংঘ তাদের ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনায় যাতে অর্থকষ্টের সম্মুখীন না হন তার ব্যাপারে বৃটিশ সরকার সর্বাত্মক সহযােগিতা প্রদানের আশ্বাস দিয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। এছাড়া, ইতােমধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের শরণাথাদের সাহায্যে বৃটিশ বেসরকারী ত্রাণ সংস্থাগুলাে যে সব পদক্ষেপ গ্রহণ করে তাতে বৃটিশ সরকার যে সকল সহযােগিতা ও অর্থ সাহায্য প্রদান করেছে তার বিবরণ তিনি বিবৃতিতে উল্লেখ করেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিবৃতির পর হাউজ অব কমসের বিরােধী দলীয় নেতা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড উইলসন বক্তব্য রাখেন। মিঃ উইলসন পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড দ্বিতীয় মাহযুদ্ধের পর জঘন্যতম ট্র্যাজিডি আখ্যায়িত করে বলেন, “Is the Right Hol Gentleman aware that the whole House and. I believe, al constituents throughout the country regard this in ter sheer scale as the worst human tragedy that the w known since the war, apart from war itself?”
মিঃ উলসন ছাড়াও মিসেস জুডিথ হার্টি, বয়েড কার্পেন্টার, মাইকেল স্টুয়াট, সাল, স্যার এইচ. লেগে বােকী, ডগলাস ম্যান, স্যার এফ. বেনেট, আলত্রে tragedy that the world has * এফ. বেনেট, আলফ্রেড মরিস, স্যার
সম্পর্কে মি. হিউম বলেন; our aim is to play our full part wilh th International community in bringing an end to suffering and the return of normal conditions to this troubled part of the subcontinent, including making it possible for the return of the refugees to their homes. মাননীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রীর বিবৃতির পর মিঃ হিলী, মিঃ ব্রেইন, জন স্টোনহাউজ, মিঃ পারদো, বিগস ডেভিসন, মিঃ পেগেট, মিঃ মলী এবং মিসেস জুডিথ হার্ট প্রমুখ সম্মানীত এম. পি. বৃন্দ মন্ত্রীকে বিভিন্ন প্রশ্ন করেন এবং আলােচনায় অংশ গ্রহণ করেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ৪ নভেম্বরে প্রদত্ত বিবৃতি বৃটিশ পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ মন্ত্রী সম্প্রতি বৃটেনে সফররত ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী ও তার বৈঠকের বিষয় এবং পূর্ব বাংলার সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে ৪ নভেম্বর হাউজে বিবৃতি প্রধান করেন। তিনি পূর্ব বঙ্গের জরুরী অবস্থার প্রেক্ষিতে বৃটিশ সরকার কর্তৃক গৃহীত প্রদান দু’টি নীতির প্রতি হাউজের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন যে, প্রথম নীতি হলাে ত্রাণ সাহায্য প্রদান। এ পর্যন্ত বৃটিশ সরকার শরণার্থীদের সাহায্যার্থে ভারতকে মােট ১৫ মিলিয়ন (১৫০ লাখ) পাউন্ড এবং পূর্ব পাকিস্তানকে ২ মিলিয়ন (২০ লাখ) পাউন্ড সাহায্য প্রদান করেছে বলে তিনি হাউজকে জানান। বৃটিশ সরকারের দ্বিতীয় নীতি উপমহাদেশে যুদ্ধ পরিস্থিতিতে উভয় পক্ষকে যথাসম্ভব যুদ্ধ থেকে নিবৃত করার প্রয়াস সম্পর্কে তিনি হাউজকে অবহিত করেন। উপমহাদেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি যে পরিমাণ জটিল আকার ধারণ করেছে তার শান্তিপূর্ণ সমাধানকল্পে ভারত-পাকিস্তান আলােচনার প্রয়ােজনীয়তা সম্পর্কে মিঃ হিউম গুরুত্ব আরােপ করেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ৬ ডিসেম্বরে প্রদত্ত বিবৃতি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হওয়ায় বৃটিশ সরকার এবং হাউজের সকল সদস্যের উদ্বিগ্ন হওয়ার বিষয়ে ৬ ডিসেম্বর আলেক ডগলাস হিউম হাউজে সংক্ষিপ্ত বিবৃতি প্রদান করেন। তিনি বলেন যে, ৩ ডিসেম্বরে প্রথম আক্রমণ ও প্রতি আক্রমনের রিপাের্ট প্রাপ্তির পরপরই বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে যুদ্ধ যথার আবেদন জানিয়েছেন। তিনি হাউজে বলেন “In spite of our efforts and those of other powers. India and Pakistan have been to the Calamity of war. Our immediate concern must now be to try to the lighting and to contribute to a sane and civilised solution that takes account of the wishes of the peoples affected.”
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ১৩ ডিসেম্বরে প্রদত্ত বিবৃতি
বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভ ও যুদ্ধের অবসানের প্রাককালে বৃটিশ পার্লামেলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ১৩ ডিসেম্বর তারিখে বিবৃতি প্রদান করেন। বাংলাদেশে মার্চ মাসে হওয়ার পর থেকে উপমহাদেশের পরিস্থিতি এবং তাদের ভাষায় পূর্ব পাতি বিষয়ে বৃটিশ পার্লামেন্টে যে সকল বক্তৃতা বিবৃতি আলােচনা অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১. ২ বিবৃতি ছিল তার সর্বশেষ ঘটনা। বিবৃতিতে মিঃ হিউম উপমহাদেশে যুদ্ধের দিন পরিস্থিতির ক্রমাবনতির কথা উল্লেখ করে বলেন, “The hostilities between India and Pakistan continue. Indian forces have advanced deep into East Pakistan, have captured the town of Jessore and have now virtually surrounded Dacca. Fighting is also continuing on the border between India and West Pakistan particularly in the chhamb area where Pakistani forces have penetrated into Indian territory.” যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে পরস্পর বিরােধী তথ্যাদি উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন যে, পরিস্থিতি যতই বিয়ােগান্ত হােক না কেন উপমহাদেশে যুদ্ধ বিরতি এবং শান্তি প্রতিষ্ঠায় বৃটিশ সরকারের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
যুক্তরাজ্যস্থ বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ
৭ মার্চ হাউডপার্ক স্পীকার্স কর্নারে ছাত্র গণসমাবেশ ও শােভাযাত্রা শেষে পাকিস্তান স্টুডেন্টস হােস্টেলে অনুষ্ঠিত বাঙালী ছাত্রদের এক সভায় আনুষ্ঠানিকভাবে “বেঙ্গল স্টুডেন্টস এ্যাকশন কমিটি গঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন পাকিস্তান ছাত্র ফেডারেশনে জাতীয়তাবাদী গ্রুপের ছাত্র নেতা মােহাম্মদ হােসেন মঞ্জু। সভায় সর্বসম্মতভাবে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ জন সদস্য নির্বাচিত হয়। ১১ সদস্য বিশিষ্ট এই কমিটির ছাত্র নেতৃবৃন্দ ছিলেন। সর্বজনাব মােহাম্মদ হােসেন মঞ্জু, খন্দকার মােশাররফ হােসেন (গ্রন্থের লেখক), নজরুল। ইসলাম, এ. টি, এম, ওয়ালী আশরাফ, সুলতান মাহমুদ শরীফ, শফিউদ্দিন মাহমুদ বুলবুল, সামসুদ্দিন আহম্মদ চৌধুরী মানিক, জিয়াউদ্দিন মাহমুদ, লুঙ্কর রহমান সাহজাহান, আখতার ইমাম ও কামরুল ইসলাম। | বাংলাদেশে স্বাধীনতা ঘােষণার পর “বেঙ্গল স্টুডেন্টস এ্যাকশন কমিটি” এর নাম। পরিবর্তন করে যুক্তরাজ্যস্থ বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ” বা “বাংলাদেশ স্টুডেন্টস এ্যাকশন কমিটি ইন ইউকে” রাখা হয় এবং কমিটিকে সম্প্রসারিত করে ২১ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি ঘােষণা করা হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আন্তর্জাতিক প্রচারণা ও জনমত সৃষ্টির কাজে বিশেষ ভূমিকা গ্রহণের লক্ষ্যে কমিটির কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য তিন জন আহ্বায়ক নিযুক্ত হন। যথাক্রমে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেন মােহাম্মদ হােসেন মঞ্জু, আমি নিজে এবং নজরুল ইসলাম। স্বাধীনতা ঘােষণার অব্যবহিত পরে ১২ এপ্রিল তারিখে মােহাম্মদ হােসেন মঞ্জু ও সুলতান মাহমুদ শরীফ মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশ। গ্রহণ এবং মুজিবনগর সরকারের সাথে যােগাযােগে স্থাপনের উদ্দেশ্যে কলিকাতা গমন। করে। মােহাম্মদ হােসেন মঞ্জুর অনুপস্থিতিতে আমার উপর বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সকল কর্মকাণ্ড পরিচালনায় দায়িত্ব অর্পিত হয়। অপর আহ্বায়ক (৩) নজরুল ইসলাম ৩৫নং হােবনে গ্যামেজেজ বিল্ডিং-এ তার নিজস্ব অফিসটিকে বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আফস হিসাবে ব্যবহারের জন্য ছেড়ে দেন এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সম্পূর্ণ সময়ে উপরােক্ত “প থেকে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সকল কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এ সম পরিষদ বাংলাদেশের স্বপক্ষে বহু গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পাদন করেছে যার বিবরণ হল বান্ন অনুচ্ছেদে স্থান পেয়েছে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের গুরুত্ব ও কর্মকাণ্ড সম্পকে অশর সরকারের তৎকালীন বৈদেশিক প্রতিনিধি, স্টিয়ারিং কমিটির উপদেষ্টা ও সাবেক জাত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী তাঁর “প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি” গ্রন্থে এবং বিশিষ্ট
উপরােক্ত কার্যক্রম অত্যন্ত সফলতার সাথে পরিচালনা করা যাদের অক্লান্ত ও আন্তরিক পরিশ্রমের ফলে সম্ভব হয়েছে তাদের সকলের নাম স্মরণেও নেই এবং উল্লেখ করাও সম্ভব নয়। তবুও যাদের নাম উল্লেখ করতেই হয় তারা হলেন মােহাম্মদ হােসেন মঞ্জু, এ, কে, নজরুল ইসলাম, এ, টি, এম ওয়ালী আশরাফ, সুলতান মাহমুদ শরীফ, সামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, শফিউদ্দিন মাহমুদ বুলবুল, জিয়াউদ্দিন মাহমুদ, লুৎফর রহমান শাহজাহান, আফরোজ আফগান চৌধুরী, এম. ইয়াহিয়া, মাহমুদ আবদুর রউফ, শ্যামা প্রসাদ ঘােষ, আনিস আহম্মদ, আখতার ইমাম, এ. কে. এম সামসুল আলম, এম, মজিবুল হক, ফজলে রাব্বি খান, নজরুল আলম, মমতাজ উদ্দিন, রাজিয়া চৌধুরী, এম, আই চৌধুরী, জাকিউদ্দিন আহম্মদ, আবদুস সামাদ বাংলাদেশ, সামসুল আবেদীন, রফিকুল ইসলাম মিয়া, আবদুল্লাহ ফারুক, সৈয়দ মােজাম্মেল আলী, মােঃ আবুল হাশেম, আমিনুল হক, খলিফা এ. মালিক, সৈয়দ মােজাম্মেল আলী, মােঃ আবুল হাশেম, এম, নূরুল আবছার, এম, এম, মুস্তাফিজুর রহমান, রফিকুল হক ভুইয়া, আহম্মদ হােসেন জোয়ারদার, আখতার ফেরদৌস লাকী, সৈয়দ মােকাররম আলী, বেগম আজিজা এমাদ, রাবেয়া ভূইয়া, সুরাইয়া খানম, এ. এম চৌধুরী। মঞ্জু, সৈয়দ ফজলে এলাহী এবং সৈয়দ সফিউল্লা প্রমুখ ছাত্র নেতৃবৃন্দ।
কভেন্ট্রি সম্মেলন ও স্টিয়ারিং কমিটি
১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে বিলাতে বিভিন্ন এলাকা ভিত্তিক সংগ্রাম পরিষদ গঠন ও কর্মসূচী প্রণয়নের স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া প্রবাসী বাঙালীদের এক গৌরবের ইতিহাস। প্রতি শহরে ও এলাকায় স্ব-স্ব উদ্যোগে সংগ্রাম কমিটি গঠনের মাধ্যমে প্রবাসী বাঙালীরা তাদের দেশ ও জাতির প্রতি দায়িত্ববােধ ও দেশপ্রেমের পরিচয় দিয়েছিল। দেশের রাজনৈতিক অবস্থা ও পাকিস্তানীদের জঘন্য গণহত্যার প্রতিক্রিয়া হিসেবে প্রত্যেক বাঙালী অত্যন্ত ভাবপ্রবণ ও বিক্ষুব্ধ ছিলেন। তাই কোন পরিকল্পনা ও বৃহত্তর যােগাযােগের তােয়াক্কা না করে প্রায় প্রত্যেক শহরেই একাধিক সংগ্রাম কমিটি গড়ে উঠেছিল । বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই একস্থানে একাধিক সংগঠন কোন প্রতিযােগিতা বা বিরােধের ফলে আত্মপ্রকাশ করেনি বরং দেশের দুর্দিনে সামান্য হলেও অবদান রাখার মহৎ উদ্দেশ্যেই গড়ে উঠেছিল। তবে প্রতিযােগিতা বা বিরােধের কারণে লন্ডনসহ কয়েকটি বড় শহরে বহু সংগ্রাম পরিষদ আত্মপ্রকাশ করে। যার ফলে পরবর্তিতে সংগ্রামের কর্মসূচী গ্রহণে অহেতুক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। লন্ডন ছিল বিলাতে বাংলাদেশ সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দু। লন্ডন শহরে বেশ কয়েকটি সংগ্রাম পরিষদ গড়ে ওঠে রাজনৈতিক ও ব্যক্তির প্রতিযােগিতার ফলশ্রুতিতে । গউস খানের নেতৃত্বে পরিচালিত যুক্তরাজ্যস্থ আওয়ামী লীগের উদ্যোগে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই লন্ডনে “কাউন্সিল ফর লিবারেশন অব বাংলাদেশ” নামে একটি সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয় । মিনহাজ উদ্দিন আহমদের নেতৃত্বাধীন লন্ডন আওয়ামী লীগ এবং বি, এইচ, তালুকদারের নেতৃত্বে পরিচালিত ওভারসীজ আওয়ামী লীগের উদ্যোগে আরাে দু’টি সংগ্রাম পরিষদ আত্মপ্রকাশ করে। এমনিভাবে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী পন্থী ন্যাপ, অধ্যাপক মােজাফফর আহমেদ পন্থী ন্যাপ ও অন্যান্য বামপন্থী দলগুলাে আলাদা আলাদা কমিটি গঠন করে কাজ শুরু করে। পেশাভিত্তিক সংগঠন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, ডাক্তার সমিতি ও মহিলা সমিতি হতােমধ্যে বহু কর্মসূচী এককভাবে বা যৌথভাবে যােগাযােগের মাধ্যমে গ্রহণ করেছিল। রাজনীতির সাথে জড়িত নন এমন বহু সমাজসেবী ব্যক্তিরাও এলাকা ভিত্তিক বাংলাদেশ এ্যাকশন কমিটি, বাংলাদেশ ওয়ার্কাস সমিতি, বাংলাদেশ যুব সংঘ, বাংলাদেশ সারভাইভাল কমিটি, বাংলাদেশ রিলিফ কমিটি, বাংলাদেশ গণ সংহতি, (মৌলভীবাজার) জনসেবা সমিতি ইত্যাদি নামে বহু কমিটি গঠন করে বাংলাদেশের পক্ষে কাজ শুরু করে। এমনও দেখা গিয়েছে যে, একই ঠিকানায় দুই কমিটি কাজ করেছে। উদাহরণস্বরূপ ৫৮ ” বারউইক স্ট্রীট, লন্ডন ডব্লিউ-১ এর ঠিকানায় কাউন্সিল ফর দি পিপলস রিপাবালিক অব
বাংলাদেশ” “লন্ডন এ্যাকশন কমিটি নামে দুইটি সংগ্রাম পরিষদ বাংলাদেশের পক্ষে
ভ করেছে। লন্ডন ছাড়াও বার্মিংহাম, ম্যানচেষ্টার ও ব্র্যাডফোর্ডে এভাবে বহু স্বতঃস্ফূর্ত সংগ্রাম কমিটি আত্মপ্রকাশ করে। | স্বতঃস্ফূর্তভাবে এত কমিটি আত্মপ্রকাশের মাধ্যমে প্রবাসী বাঙালীদের মধ্যে আত্মসচেতনতা, দেশপ্রেম ও প্রত্যয়ের বহিঃপ্রকাশ ঘটলেও বিলাতের সংগ্রামকে একটি সনির্দিষ্ট লক্ষ্যে পরিচালিত করা ও সমন্বয়ের ক্ষেত্রে বেশ বিভ্রাটের সৃষ্টি হয়। এই বিভ্রাটের। ফলে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বাংলাদেশের পক্ষে যােগ দিয়েও কোন কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারছিলেন না। তাই মধ্য এপ্রিলেই সংগ্রাম পরিষদের নেতা ও কর্মীরা উপলব্ধি করলেন যে, সকল সংগ্রাম কমিটিকে সমন্বয় সাধনের জন্য একটি কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা প্রয়ােজন। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সাথে পরামর্শক্রমে কভেন্ট্রি নামক একটি ছােট শহরে ইতােমধ্যে গড়ে ওঠা সকল সংগ্রাম পরিষদের প্রতিনিধি ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের এক সম্মেলন আহ্বানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
২৪ এপ্রিল অনুষ্ঠিত কভেন্ট্রি সম্মেলন বিলাতের বাঙালীদের মুক্তিযুদ্ধে অবদানের এক মাইল ফলক। এত দ্রুত গড়ে ওঠা সংগ্রাম পরিষদগুলােকে সমন্বয় করার জন্য একটি। কেন্দ্রীয় সংগঠন গঠন কঠিন বিষয় হলেও কভেন্ট্রি সম্মেলনের মাধ্যমে তা সম্ভব হয়েছিল। বিলাত প্রবাসী বাঙালীরা কোন একক রাজনৈতিক সংগঠনকে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত। করতে প্রস্তুত ছিলেন না। তাই উক্ত সম্মেলনটিকে অরাজনৈতিক ও সার্বজনীন চরিত্র দেয়ার উদ্দেশ্যে বিলাতে উচ্চ শিক্ষায় অধ্যয়নরত বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অংগনে বিশিষ্ট মহিলা মিসেস লুলু বিলকিস বানুকে সভায় সভাপতিত্ব করার জন্য অনুরােধ করা হয়। তিনি কোন রাজনৈতিক দল বা সংগ্রাম পরিষদের সদস্য ছিলেন না। উক্ত সম্মেলনে প্রধান অতিথি। হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। তিনি ইতােমধ্যে মুজিবনগর সরকারের বৈদেশিক বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে নিয়ােগ লাভ করেছিলেন। নিয়ােগপত্রটি মুজিবনগর সরকার সিলেটবাসী লন্ডনে বসবাসকারী সমাজকর্মী ও আওয়ামী লীগ নেতা। আবদুর রকিবের মাধ্যমে প্রেরণ করেন। সম্মেলনে তিনি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নিয়ােগপত্রটি পাঠ করে শােনান। কভেন্ট্রি সম্মেলনে বিলাতের প্রায় সকল শহরের সংগ্রাম পরিষদের প্রতিনিধিরা যােগদান করেন। সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরী, গউস খান, মিনহাজ উদ্দিন, আজিজুল হক ভূঁইয়া, শেখ আবদুল মান্নান, মহিলা পােতর পক্ষে মিসেস জেবুন্নেসা বখত ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে আহ্বায়ক খন্দকার ‘মাশাররফ হােসেন (লেখক) প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। কভেন্ট্রির এই প্রতিনিধি সম্মেলনে নিম্নলিখিত প্রস্তাবাবলি গৃহীত হয়। . (ক) গ্রেট বৃটেনে কেন্দ্রীয়ভাবে একটি সমিতি গঠন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল এবং এই নামকরণ হবে “Action Committee for the People’s Republic of Bangladesh in U.K.
শক্তিশালী কমিটি গঠন করা হল এবং
(খ) অদ্যকার সভায় পাঁচজন সদস্য বিশিষ্ট একটি শক্তিশালী কমিটি গঠন ক উক্ত কমিটির নাম হবে “Steering Committee of the Action Commi উক্ত কমিটিকে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার সর্বক্ষমতার সম্পূর্ণ অধিকার দেয়া হল ।
| (গ) এই সভায় আরও সিদ্ধান্ত হলাে যে, “Steering Committee” কে । প্রয়ােজনবােধে আরাে সদস্য বাড়াবার ক্ষমতা দেয়া হলাে।
(ঘ) এই কমিটির যে পাঁচজন সদস্য মনােনয়ন দান করা হলাে তারা হলেন?
(১) আজিজুল হক ভুইয়া (২) কবীর চৌধুরী (3) মনােয়ার হােসেন (৪) শেখ আবদুল মান্নান (৫) শামসুর রহমান।
(ঙ) এই পাঁচজনের প্রথম সভার অধিবেশন অদ্যকার সভার সভানেত্রী লুলু বিলকিস বানুর আহ্বানে অনুষ্ঠিত হবে এবং এ সভায় একজন আহ্বায়ক নিযুক্ত করা হবে।
(চ) বর্তমানে গ্রেট বৃটেনে যত কমিটি আছে সে সকল কমিটি এই কমিটির শাখা রূপে কাজ করবে।
উক্ত সভায় আরাে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, বালাদেশ সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী স্টিয়ারিং কমিটির উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। এছাড়া বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, বাংলাদেশ মহিলা সমিতি ও বাংলাদেশ মেডিকেল সমিতি স্টিয়ারিং কমিটির সকল কর্মকান্ডে আমন্ত্রিত সদস্য হিসেবে অংশগ্রহণ করবেন। | কভেন্ট্রি সম্মেলনের সিদ্ধান্ত মােতাবেক স্টিয়ারিং কমিটির প্রথম সভায় আজিজুল হক ভূঁইয়াকে ষ্টিয়ারিং কমিটির আহ্বায়ক মনােনয়ন করা হয়। বৃটেনের বাঙালীদের সকল সংগ্রাম কমিটির কর্মকাণ্ডের সুষ্ঠু সমন্বয়ের জন্য পূর্ব লন্ডনের ১১ নং গােরিং স্ট্রীটে “ষ্টিয়ারিং কমিটি ফর দি লিবারেশন অব বাংলাদেশ” এর স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি অফিস স্থাপন করা হয়। লন্ডন প্রবাসীদের বিশেষ করে পূর্ব লন্ডনের বাঙালীদের সহযােগিতা ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় উক্ত অফিসটি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাঙালী প্রবাসীদের সকল কর্মকাণ্ডের একটি কেন্দ্র বিন্দুতে পরিণত হয়েছিল। | কেন্দ্রীয় কমিটির মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত স্টিয়ারিং কমিটি নিম্নলিখিত সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করে কাজ শুরু করে ঃ (ক) বিলাতে গড়ে ওঠা সংগ্রাম কমিটিসমূহের সমন্বয় সাধন করা। (খ) দেশমাতৃকার স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধরত মুক্তিযােদ্ধাদের মানসিক শক্তি ও অন্যান্য সামগ্রী যােগান দান এবং বাংলাদেশের নির্যাতিত জনগণকে সাহায্য প্রেরণ । (গ) দখলদার পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর কবল থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য বিদেশে কার্যক্রম গ্রহণ করা। (খ) বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপক্ষে জনমত সৃষ্টি করার জন্য বিদেশে সভা ও সমাবেশ আ০ করা। (ঙ) বাংলাদেশের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠার স্বপক্ষে বক্তব্য পেশ ও প্রচার কার্য পরিচালনার জন্য বিভিন্ন দেশে প্রতিনিধি প্রেরণ করা। (চ) বিভিন্ন সংগ্রাম কা সংগৃহিত অর্থের সমন্বয় সাধন ও হিসাব সংরক্ষণ করা।
উক্ত কমিটির আহবায়ক আজিজুল হক ভূঁইয়া কমিটির কার্যক্রম সার্বক্ষণিকভাবে আরিচালনার উদ্দেশ্যে বার্মিংহাম থেকে লন্ডনে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেন । টিয়ারিং কমিটির অপর সক্রিয় সদস্য শেখ আবদুল মান্নান বৃটিশ সিভিল সার্ভিসে চাকরিরত ছিলেন। চাকরিরত থাকা সত্ত্বেও শেখ আবদুল মান্নান সংগ্রামের সকল কর্মকাণ্ডের প্রায় সার্বক্ষণিকভাবে কাজ করেছেন। শামসুর রহমান পূর্ব লন্ডনের অধিবাসী ছিলেন এবং তিনি কমিটির কার্যক্রমে উল্লেখযােগ্য অবদান রেখেছেন। কবির চৌধুরী এবং মনােয়ার হােসেন লন্ডনের বাইরে বসবাস করার ফলে আন্দোলনের সকল কর্মসূচীতে উপস্থিত থাকতে পারতেন না। কোন অজ্ঞাত কারণে পরবর্তীকালে ষ্টিয়ারিং কমিটির সদস্যপদ থেকে মনােয়ার হােসেনের নাম বাদ পড়ে যায়। | ষ্টিয়ারিং কমিটির অফিস স্থাপনের পর সংগ্রামের কর্মসূচী এবং বাংলাদেশ সরকারের বৈদেশিক প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর কার্যক্রম বৃদ্ধি পাওয়ার প্রেক্ষাপটে ষ্টিয়ারিং কমিটিতে কয়েকজন সার্বক্ষণিক কর্মী নিয়ােজিত হন। তাদের মধ্যে শিল্পী আবদুর রউফ, মহিউদ্দিন চৌধুরী এবং শামসুল আলম চৌধুরীর নাম বিশেষ উল্লেখযােগ্য । শিল্পী আবদুর রউফ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্ব থেকেই উচ্চ শিক্ষার্থে লন্ডনে অবস্থান করছিলেন। তিনি তৎকালীন পাকিস্তানে কেন্দ্রীয় তথ্য ও চলচ্চিত্র বিভাগের উপ-পরিচালক ছিলেন এবং পরবর্তিকালে তিনি বাংলাদেশে জাতীয় চলচ্চিত্র উন্নয়ন ইনষ্টিটিউট, চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর (ডি এফ পি) ও অর্কাইভের পরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। শিল্পী হিসেবে আবদুর রউফের উপর দায়িত্ব ছিল ষ্টিয়ারিং কমিটির প্রচার, আঁকা-জোকা, লিফলেট লেখা ও প্রকাশ করা। জনাব রউফ ষ্টিয়ারিং কমিটি ছাড়াও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, গণসংস্কৃতি সংসদ ও বাংলাদেশ মহিলা সমিতির বিভিন্ন প্রচারপত্র ও পােষ্টার তৈরি ও প্রকাশনায় সহযােগিতা করেছেন। মহিউদ্দিন চৌধুরী পি আই এ এর একজন কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পি, আই, এ পরিত্যাগ করে বাংলাদেশের আন্দোলনে যােগদান করেন এবং ষ্টিয়ারিং কমিটিতে সার্বক্ষণিকভাবে নিয়ােজিত হন। শামসুল আলম চৌধুরী বার এট ল’ পড়ার জন্য লন্ডনে অবস্থান করছিলেন। তিনি ষ্টিয়ারিং কমিটি এবং বাংলাদেশ সরকারের বৈদেশিক প্রতিনিধি বিচারপতি চৌধুরীকে সাহায্য করার জন্য সার্বক্ষণিকভাবে নিয়ােজিত ছিলেন। এখানে উল্লেখযােগ্য যে, বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বাংলাদেশ সরকারের বৈদেশিক প্রতিনিধির অফিস হিসেবে ১১ নং গােরিং স্ট্রীটস্থ অফিসটিকেই ব্যবহার করতেন। তিনি মুজিবনগর সরকারের বৈদেশিক প্রতিনিধি ও ষ্টিয়ারিং কমিটির উপদেষ্টা হিসেবে যুগপথভাবে এই অফিসে বসে কাজ করতেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের স্বপক্ষে প্রচার এবং বাংলাদেশকে স্বীকৃতির বিশ্বজনমত স্টর জন্য বিলাতের অন্যান্য সংগ্রাম কমিটির পাশাপাশি স্টিয়ারিং কমিটিও সমাবেশ, হাত্রা এবং লবিং কার্যক্রম পরিচালনা করেন। এছাড়া ষ্টিয়রিং কমিটি মুজিবনগর “মর সাথে যােগাযােগ রক্ষা এবং বিলাতের আন্দোলনের রূপরেখা প্রণয়ন, নির্দেশ জারি এবং পরামর্শ প্রদানের দায়িত্ব পালন করে। মুজিবনগর থেকে প্রেরিত প্রতিনিধিদের দেশে প্রেরণ এবং যােগাযােগ স্থাপন করার ব্যাপারেও ষ্টিয়ারিং কমিটি দায়িত্ব পালন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতি ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করে বিলাতের বাঙালী মুক্তিযুদ্ধের সাথে সম্পৃক্ত রাখার উদ্দেশ্যে ষ্টিয়ারিং কমিটি ইংরেজী ভাষায় “বাংলাদেশ এবং বাংলা ভাষায় সংবাদ পরিক্রমা” নামে দু’টি সংবাদ সাময়িকী প্রকাশ করে। উ পত্রিকাসমূহ বাংলাদেশ সরকারের এবং ষ্টিয়ারিং কমিটির মুখপত্র হিসেবে বিলাতে বাঙালীদের কাছে খবরাখবর পরিবেশন করে।
কভেন্ট্রি সম্মেলন ও স্টিয়ারিং কমিটি
১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে বিলাতে বিভিন্ন এলাকা ভিত্তিক সংগ্রাম পরিষদ গঠন ও কর্মসূচী প্রণয়নের স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া প্রবাসী বাঙালীদের এক গৌরবের ইতিহাস। প্রতি শহরে ও এলাকায় স্ব-স্ব উদ্যোগে সংগ্রাম কমিটি গঠনের মাধ্যমে প্রবাসী বাঙালীরা তাদের দেশ ও জাতির প্রতি দায়িত্ববােধ ও দেশপ্রেমের পরিচয় দিয়েছিল। দেশের রাজনৈতিক অবস্থা ও পাকিস্তানীদের জঘন্য গণহত্যার প্রতিক্রিয়া হিসেবে প্রত্যেক বাঙালী অত্যন্ত ভাবপ্রবণ ও বিক্ষুব্ধ ছিলেন। তাই কোন পরিকল্পনা ও বৃহত্তর যােগাযােগের তােয়াক্কা না করে প্রায় প্রত্যেক শহরেই একাধিক সংগ্রাম কমিটি গড়ে উঠেছিল । বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই একস্থানে একাধিক সংগঠন কোন প্রতিযােগিতা বা বিরােধের ফলে আত্মপ্রকাশ করেনি বরং দেশের দুর্দিনে সামান্য হলেও অবদান রাখার মহৎ উদ্দেশ্যেই গড়ে উঠেছিল। তবে প্রতিযােগিতা বা বিরােধের কারণে লন্ডনসহ কয়েকটি বড় শহরে বহু সংগ্রাম পরিষদ আত্মপ্রকাশ করে। যার ফলে পরবর্তিতে সংগ্রামের কর্মসূচী গ্রহণে অহেতুক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। লন্ডন ছিল বিলাতে বাংলাদেশ সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দু। লন্ডন শহরে বেশ কয়েকটি সংগ্রাম পরিষদ গড়ে ওঠে রাজনৈতিক ও ব্যক্তির প্রতিযােগিতার ফলশ্রুতিতে । গউস খানের নেতৃত্বে পরিচালিত যুক্তরাজ্যস্থ আওয়ামী লীগের উদ্যোগে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই লন্ডনে “কাউন্সিল ফর লিবারেশন অব বাংলাদেশ” নামে একটি সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয় । মিনহাজ উদ্দিন আহমদের নেতৃত্বাধীন লন্ডন আওয়ামী লীগ এবং বি, এইচ, তালুকদারের নেতৃত্বে পরিচালিত ওভারসীজ আওয়ামী লীগের উদ্যোগে আরাে দু’টি সংগ্রাম পরিষদ আত্মপ্রকাশ করে। এমনিভাবে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী পন্থী ন্যাপ, অধ্যাপক মােজাফফর আহমেদ পন্থী ন্যাপ ও অন্যান্য বামপন্থী দলগুলাে আলাদা আলাদা কমিটি গঠন করে কাজ শুরু করে। পেশাভিত্তিক সংগঠন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, ডাক্তার সমিতি ও মহিলা সমিতি হতােমধ্যে বহু কর্মসূচী এককভাবে বা যৌথভাবে যােগাযােগের মাধ্যমে গ্রহণ করেছিল। রাজনীতির সাথে জড়িত নন এমন বহু সমাজসেবী ব্যক্তিরাও এলাকা ভিত্তিক বাংলাদেশ এ্যাকশন কমিটি, বাংলাদেশ ওয়ার্কাস সমিতি, বাংলাদেশ যুব সংঘ, বাংলাদেশ সারভাইভাল কমিটি, বাংলাদেশ রিলিফ কমিটি, বাংলাদেশ গণ সংহতি, (মৌলভীবাজার) জনসেবা সমিতি ইত্যাদি নামে বহু কমিটি গঠন করে বাংলাদেশের পক্ষে কাজ শুরু করে।
এমনও দেখা গিয়েছে যে, একই ঠিকানায় দুই কমিটি কাজ করেছে। উদাহরণস্বরূপ ৫৮ ” বারউইক স্ট্রীট, লন্ডন ডব্লিউ-১ এর ঠিকানায় কাউন্সিল ফর দি পিপলস রিপাবালিক অব বাংলাদেশ” “লন্ডন এ্যাকশন কমিটি নামে দুইটি সংগ্রাম পরিষদ বাংলাদেশের পক্ষে ভয় করেছে। লন্ডন ছাড়াও বার্মিংহাম, ম্যানচেষ্টার ও ব্র্যাডফোর্ডে এভাবে বহু স্বতঃস্ফূর্ত সংগ্রাম কমিটি আত্মপ্রকাশ করে। স্বতঃস্ফূর্তভাবে এত কমিটি আত্মপ্রকাশের মাধ্যমে প্রবাসী বাঙালীদের মধ্যে আত্মসচেতনতা, দেশপ্রেম ও প্রত্যয়ের বহিঃপ্রকাশ ঘটলেও বিলাতের সংগ্রামকে একটি সনির্দিষ্ট লক্ষ্যে পরিচালিত করা ও সমন্বয়ের ক্ষেত্রে বেশ বিভ্রাটের সৃষ্টি হয়। এই বিভ্রাটের। ফলে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বাংলাদেশের পক্ষে যােগ দিয়েও কোন কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারছিলেন না। তাই মধ্য এপ্রিলেই সংগ্রাম পরিষদের নেতা ও কর্মীরা উপলব্ধি করলেন যে, সকল সংগ্রাম কমিটিকে সমন্বয় সাধনের জন্য একটি কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা প্রয়ােজন। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সাথে পরামর্শক্রমে কভেন্ট্রি নামক একটি ছােট শহরে ইতােমধ্যে গড়ে ওঠা সকল সংগ্রাম পরিষদের প্রতিনিধি ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের এক সম্মেলন আহ্বানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ২৪ এপ্রিল অনুষ্ঠিত কভেন্ট্রি সম্মেলন বিলাতের বাঙালীদের মুক্তিযুদ্ধে অবদানের এক মাইল ফলক। এত দ্রুত গড়ে ওঠা সংগ্রাম পরিষদগুলােকে সমন্বয় করার জন্য একটি। কেন্দ্রীয় সংগঠন গঠন কঠিন বিষয় হলেও কভেন্ট্রি সম্মেলনের মাধ্যমে তা সম্ভব হয়েছিল। বিলাত প্রবাসী বাঙালীরা কোন একক রাজনৈতিক সংগঠনকে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত। করতে প্রস্তুত ছিলেন না। তাই উক্ত সম্মেলনটিকে অরাজনৈতিক ও সার্বজনীন চরিত্র দেয়ার উদ্দেশ্যে বিলাতে উচ্চ শিক্ষায় অধ্যয়নরত বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অংগনে বিশিষ্ট মহিলা মিসেস লুলু বিলকিস বানুকে সভায় সভাপতিত্ব করার জন্য অনুরােধ করা হয়। তিনি কোন রাজনৈতিক দল বা সংগ্রাম পরিষদের সদস্য ছিলেন না। উক্ত সম্মেলনে প্রধান অতিথি। হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। তিনি ইতােমধ্যে মুজিবনগর সরকারের বৈদেশিক বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে নিয়ােগ লাভ করেছিলেন। নিয়ােগপত্রটি মুজিবনগর সরকার সিলেটবাসী লন্ডনে বসবাসকারী সমাজকর্মী ও আওয়ামী লীগ নেতা। আবদুর রকিবের মাধ্যমে প্রেরণ করেন। সম্মেলনে তিনি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নিয়ােগপত্রটি পাঠ করে শােনান। কভেন্ট্রি সম্মেলনে বিলাতের প্রায় সকল শহরের সংগ্রাম পরিষদের প্রতিনিধিরা যােগদান করেন। সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরী, গউস খান, মিনহাজ উদ্দিন, আজিজুল হক ভূঁইয়া, শেখ আবদুল মান্নান, মহিলা পােতর পক্ষে মিসেস জেবুন্নেসা বখত ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে আহ্বায়ক খন্দকার ‘মাশাররফ হােসেন (লেখক) প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। কভেন্ট্রির এই প্রতিনিধি সম্মেলনে নিম্নলিখিত প্রস্তাবাবলি গৃহীত হয়। . (ক) গ্রেট বৃটেনে কেন্দ্রীয়ভাবে একটি সমিতি গঠন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল এবং এই নামকরণ হবে “Action Committee for the People’s Republic of Bangladesh in U.K.
শক্তিশালী কমিটি গঠন করা হল এবং
(খ) অদ্যকার সভায় পাঁচজন সদস্য বিশিষ্ট একটি শক্তিশালী কমিটি গঠন ক উক্ত কমিটির নাম হবে “Steering Committee of the Action Commi উক্ত কমিটিকে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার সর্বক্ষমতার সম্পূর্ণ অধিকার দেয়া হল ।
(গ) এই সভায় আরও সিদ্ধান্ত হলাে যে, “Steering Committee” কে । প্রয়ােজনবােধে আরাে সদস্য বাড়াবার ক্ষমতা দেয়া হলাে।
(ঘ) এই কমিটির যে পাঁচজন সদস্য মনােনয়ন দান করা হলাে তারা হলেন?
(১) আজিজুল হক ভুইয়া (২) কবীর চৌধুরী (3) মনােয়ার হােসেন (৪) শেখ আবদুল মান্নান (৫) শামসুর রহমান।
(ঙ) এই পাঁচজনের প্রথম সভার অধিবেশন অদ্যকার সভার সভানেত্রী লুলু বিলকিস বানুর আহ্বানে অনুষ্ঠিত হবে এবং এ সভায় একজন আহ্বায়ক নিযুক্ত করা হবে।
(চ) বর্তমানে গ্রেট বৃটেনে যত কমিটি আছে সে সকল কমিটি এই কমিটির শাখা রূপে কাজ করবে।
উক্ত সভায় আরাে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, বালাদেশ সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী স্টিয়ারিং কমিটির উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। এছাড়া বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, বাংলাদেশ মহিলা সমিতি ও বাংলাদেশ মেডিকেল সমিতি স্টিয়ারিং কমিটির সকল কর্মকান্ডে আমন্ত্রিত সদস্য হিসেবে অংশগ্রহণ করবেন। কভেন্ট্রি সম্মেলনের সিদ্ধান্ত মােতাবেক স্টিয়ারিং কমিটির প্রথম সভায় আজিজুল হক ভূঁইয়াকে ষ্টিয়ারিং কমিটির আহ্বায়ক মনােনয়ন করা হয়। বৃটেনের বাঙালীদের সকল সংগ্রাম কমিটির কর্মকাণ্ডের সুষ্ঠু সমন্বয়ের জন্য পূর্ব লন্ডনের ১১ নং গােরিং স্ট্রীটে “ষ্টিয়ারিং কমিটি ফর দি লিবারেশন অব বাংলাদেশ” এর স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি অফিস স্থাপন করা হয়। লন্ডন প্রবাসীদের বিশেষ করে পূর্ব লন্ডনের বাঙালীদের সহযােগিতা ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় উক্ত অফিসটি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাঙালী প্রবাসীদের সকল কর্মকাণ্ডের একটি কেন্দ্র বিন্দুতে পরিণত হয়েছিল। | কেন্দ্রীয় কমিটির মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত স্টিয়ারিং কমিটি নিম্নলিখিত সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করে কাজ শুরু করে ঃ (ক) বিলাতে গড়ে ওঠা সংগ্রাম কমিটিসমূহের সমন্বয় সাধন করা। (খ) দেশমাতৃকার স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধরত মুক্তিযােদ্ধাদের মানসিক শক্তি ও অন্যান্য সামগ্রী যােগান দান এবং বাংলাদেশের নির্যাতিত জনগণকে সাহায্য প্রেরণ । (গ) দখলদার পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর কবল থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য বিদেশে কার্যক্রম গ্রহণ করা। (খ) বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপক্ষে জনমত সৃষ্টি করার জন্য বিদেশে সভা ও সমাবেশ আ০ করা। (ঙ) বাংলাদেশের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠার স্বপক্ষে বক্তব্য পেশ ও প্রচার কার্য পরিচালনার জন্য বিভিন্ন দেশে প্রতিনিধি প্রেরণ করা। (চ) বিভিন্ন সংগ্রাম কা সংগৃহিত অর্থের সমন্বয় সাধন ও হিসাব সংরক্ষণ করা।
উক্ত কমিটির আহবায়ক আজিজুল হক ভূঁইয়া কমিটির কার্যক্রম সার্বক্ষণিকভাবে আরিচালনার উদ্দেশ্যে বার্মিংহাম থেকে লন্ডনে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেন । টিয়ারিং কমিটির অপর সক্রিয় সদস্য শেখ আবদুল মান্নান বৃটিশ সিভিল সার্ভিসে চাকরিরত ছিলেন। চাকরিরত থাকা সত্ত্বেও শেখ আবদুল মান্নান সংগ্রামের সকল কর্মকাণ্ডের প্রায় সার্বক্ষণিকভাবে কাজ করেছেন। শামসুর রহমান পূর্ব লন্ডনের অধিবাসী ছিলেন এবং তিনি কমিটির কার্যক্রমে উল্লেখযােগ্য অবদান রেখেছেন। কবির চৌধুরী এবং মনােয়ার হােসেন লন্ডনের বাইরে বসবাস করার ফলে আন্দোলনের সকল কর্মসূচীতে উপস্থিত থাকতে পারতেন না। কোন অজ্ঞাত কারণে পরবর্তীকালে ষ্টিয়ারিং কমিটির সদস্যপদ থেকে মনােয়ার হােসেনের নাম বাদ পড়ে যায়। | ষ্টিয়ারিং কমিটির অফিস স্থাপনের পর সংগ্রামের কর্মসূচী এবং বাংলাদেশ সরকারের বৈদেশিক প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর কার্যক্রম বৃদ্ধি পাওয়ার প্রেক্ষাপটে ষ্টিয়ারিং কমিটিতে কয়েকজন সার্বক্ষণিক কর্মী নিয়ােজিত হন। তাদের মধ্যে শিল্পী আবদুর রউফ, মহিউদ্দিন চৌধুরী এবং শামসুল আলম চৌধুরীর নাম বিশেষ উল্লেখযােগ্য । শিল্পী আবদুর রউফ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্ব থেকেই উচ্চ শিক্ষার্থে লন্ডনে অবস্থান করছিলেন। তিনি তৎকালীন পাকিস্তানে কেন্দ্রীয় তথ্য ও চলচ্চিত্র বিভাগের উপ-পরিচালক ছিলেন এবং পরবর্তিকালে তিনি বাংলাদেশে জাতীয় চলচ্চিত্র উন্নয়ন ইনষ্টিটিউট, চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর (ডি এফ পি) ও অর্কাইভের পরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। শিল্পী হিসেবে আবদুর রউফের উপর দায়িত্ব ছিল ষ্টিয়ারিং কমিটির প্রচার, আঁকা-জোকা, লিফলেট লেখা ও প্রকাশ করা। জনাব রউফ ষ্টিয়ারিং কমিটি ছাড়াও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, গণসংস্কৃতি সংসদ ও বাংলাদেশ মহিলা সমিতির বিভিন্ন প্রচারপত্র ও পােষ্টার তৈরি ও প্রকাশনায় সহযােগিতা করেছেন। মহিউদ্দিন চৌধুরী পি আই এ এর একজন কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পি, আই, এ পরিত্যাগ করে বাংলাদেশের আন্দোলনে যােগদান করেন এবং ষ্টিয়ারিং কমিটিতে সার্বক্ষণিকভাবে নিয়ােজিত হন। শামসুল আলম চৌধুরী বার এট ল’ পড়ার জন্য লন্ডনে অবস্থান করছিলেন। তিনি ষ্টিয়ারিং কমিটি এবং বাংলাদেশ সরকারের বৈদেশিক প্রতিনিধি বিচারপতি চৌধুরীকে সাহায্য করার জন্য সার্বক্ষণিকভাবে নিয়ােজিত ছিলেন। এখানে উল্লেখযােগ্য যে, বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বাংলাদেশ সরকারের বৈদেশিক প্রতিনিধির অফিস হিসেবে ১১ নং গােরিং স্ট্রীটস্থ অফিসটিকেই ব্যবহার করতেন। তিনি মুজিবনগর সরকারের বৈদেশিক প্রতিনিধি ও ষ্টিয়ারিং কমিটির উপদেষ্টা হিসেবে যুগপথভাবে এই অফিসে বসে কাজ করতেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের স্বপক্ষে প্রচার এবং বাংলাদেশকে স্বীকৃতির বিশ্বজনমত স্টর জন্য বিলাতের অন্যান্য সংগ্রাম কমিটির পাশাপাশি স্টিয়ারিং কমিটিও সমাবেশ, হাত্রা এবং লবিং কার্যক্রম পরিচালনা করেন। এছাড়া ষ্টিয়রিং কমিটি মুজিবনগর “মর সাথে যােগাযােগ রক্ষা এবং বিলাতের আন্দোলনের রূপরেখা প্রণয়ন, নির্দেশ জারি এবং পরামর্শ প্রদানের দায়িত্ব পালন করে। মুজিবনগর থেকে প্রেরিত প্রতিনিধিদের দেশে প্রেরণ এবং যােগাযােগ স্থাপন করার ব্যাপারেও ষ্টিয়ারিং কমিটি দায়িত্ব পালন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতি ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করে বিলাতের বাঙালী মুক্তিযুদ্ধের সাথে সম্পৃক্ত রাখার উদ্দেশ্যে ষ্টিয়ারিং কমিটি ইংরেজী ভাষায় “বাংলাদেশ এবং বাংলা ভাষায় সংবাদ পরিক্রমা” নামে দু’টি সংবাদ সাময়িকী প্রকাশ করে। উ পত্রিকাসমূহ বাংলাদেশ সরকারের এবং ষ্টিয়ারিং কমিটির মুখপত্র হিসেবে বিলাতে বাঙালীদের কাছে খবরাখবর পরিবেশন করে।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে বিলাত প্রবাসীদের অবদান – ড খন্দকার মোশাররফ হোসেন
বাংলাদেশ ফান্ড
বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সাথে সাথেই বিলাতের প্রবাসীরা বিভিন্ন শহরে নিজস্ব উদ্যোগে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচারকার্য পরিচালনার পাশাপাশি অর্থ। সংগ্রহ শুরু করে। সময়ের অভাবে বা পেশাগত কারণে যারা সংগ্রাম পরিষদের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত হতে সমর্থ হয়নি তারা সংগ্রাম পরিষদ পরিচালনার জন্য অর্থ দিয়ে অংশগ্রহণ করাকে তাদের পবিত্র দায়িত্ব মনে করেছে। তাই শুরু থেকেই সংগ্রাম পরিষদসমূহকে কোন আর্থিক সমস্যার মােকাবিলা করতে হয়নি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে বিদেশে প্রচার ও সংগৃহীত অর্থ সুচারুভাবে পরিচালনা ও সমন্বয় সাধনের লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় কমিটির সাথে সাথে একটি কেন্দ্রীয় ফান্ড সৃষ্টির প্রয়ােজনীয়তা দেখা দেয়। এই দায়িত্ব স্বাভাবিকভাবেই কেন্দ্রীয় স্টিয়ারিং উপর অর্পিত হয়। | এপ্রিল মাসে কভেন্ট্রিতে সম্মেলনের মাধ্যমে ষ্টিয়ারিং কমিটি গঠনের অব্যবহিত পরেই ষ্টিয়ারিং কমিটি এক সভায় “বাংলাদেশ ফান্ড” নামে একটি কেন্দ্রীয় ফান্ড গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সভায় উক্ত ফান্ড গঠনের দু’টি লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয় ঃ (ক) ষ্টিয়ারিং কমিটির মাধ্যমে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের জন্য অর্থ সংগ্রহের সমুদয় ব্যবস্থা গ্রহণ এবং সকল সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক সংগৃহীত অর্থের সমন্বয় সাধন করা। (খ) ফান্ডের অর্থ মুক্তিসংগ্রামের স্বার্থে একটি ট্রাষ্টি বাের্ডের মাধ্যমে ট্রাস্টি বাের্ড যেভাবে ভাল মনে করেন সেভাবে সময়ের চাহিদাকে লক্ষ্য রেখে খরচের ব্যবস্থা করা। উপরােক্ত দুটো উদ্দেশ্য সামনে নিয়ে প্রথমে হাজ ব্যাংকে এবং পরে ন্যাশনাল ওয়েষ্ট মিনিষ্টার ব্যাংকে “বাংলাদেশ ফাণ্ডের দুটো একাউন্ট খােলা হয় । এই মর্মে বিলাতে প্রবাসী বাঙালীদেরকে প্রচারপত্র ও পত্রিকা মাধ্যমে অবহিত করা হয়। | বাংলাদেশ ফান্ডের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার জন্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, জন ষ্টোন হাউজ এবং ডােনাল্ড চেসওয়ার্থকে সদস্য নিয়ােগ করে একটি ট্রাষ্টি বাের্ড গঠন। করা হয় । ট্রাষ্টি বাের্ডের তিন সদস্যের মধ্যে ষ্টিয়ারিং কমিটির উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ সরকারের বৈদেশিক প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বাঙালীদের পক্ষ থেকে বাের্ডে প্রাতনিধিত্ব করেন। অপর দুই সদস্যের মধ্যে জন ষ্টোন হাউজ একজন লেবার দলীয় । প্রভাবশালী এম. পি ও প্রাক্তন মন্ত্রী ছিলেন এবং ইতােপূর্বে বাংলাদেশের পক্ষে পার্লামেন্টে ও বাহিরে ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। ডােনাল্ড চেসওয়ার্থ বৃটেনের প্রতিষ্ঠিত ‘ওয়ার অন্ ওয়ান্ট’। নামে একটি এন, জি ও, এর নেতৃত্বে ছিলেন এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ইতােমধ্যে
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে বিলাত প্রবাসীদের অবদান – ড খন্দকার মোশাররফ হোসেন
লন্ডনে বাংলাদেশ দূতাবাস স্থাপন
মুজিবনগর সরকার বহির্বিশ্বে কূটনৈতিক যােগাযােগ স্থাপনের সুবিধার জন্য কলকাতার বাইরে একটি দূতাবাস প্রতিষ্ঠার প্রয়ােজনীয়তার কথা লন্ডনে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে অবহিত করেন। বিচারপতি চৌধুরী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহম্মদ কে এক পত্রে লন্ডনে দূতাবাস স্থাপনের ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেন। বৃটেনে রক্ষণশীল দল (Conservative Party) ক্ষমতা থাকলেও বাংলাদেশ আন্দোলনের প্রতি সরকার বেশ সহানুভূতিশীল ও নমনীয় ছিল। বিরােধী দল (শ্রমিক দল) এর এম. পি. দের ছিল বাংলাদেশের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন। এই সকল বিবেচনায় বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ দূতাবাস স্থাপনের উপযুক্ত স্থান হিসাবে লন্ডনই সব দিক থেকে সুবিধাজনক বলে বিবেচিত হয়। ইতােপূর্বে স্টিয়ারিং কমিটির গােরিং স্ট্রীটের অফিসে বিচারপতি চৌধুরীসহ পাকিস্তানের সাথে সম্পর্কচ্ছেদকারী কূটনৈতিক কর্মকর্তাবৃন্দ বিলাতে আন্দোলনের সমন্বয়, প্রচার ও কূটনৈতিক যােগাযােগ সহ সকল কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতেন। কোন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সাথে বিচারপতি চৌধুরী সাক্ষাৎ প্রদান করতে চাইলে স্টিয়ারিং কমিটি অফিস উপযুক্ত ছিলনা। ষ্টিয়ারিং কমিটির অফিসটি মূলতঃ রাজনৈতিক কর্মকান্ডের অফিস হওয়ায় বিচারপতি চৌধুরী বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন বেমানান মনে হতাে। এমতাবস্থায়, লন্ডনে বাংলাদেশ দূতাবাস স্থাপন অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল। বিচারপতি চৌধুরী এই বাস্তবতাকে সামনে রেখে মুজিবনগর সরকার থেকে অনুমতি নিয়েই ১ আগস্টে এ্যাকশন বাংলাদেশ’ আয়ােজিত ট্রাফেলগার স্কোয়ারের জনসভায় লন্ডনে বাংলাদেশ দূতাবাস স্থাপনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। ভাগ্য সুপ্রসন্ন যে, যখন দূতাবাস স্থাপনের জন্য উপযুক্ত এলাকায় অফিস খোঁজ করা হচ্ছিল, তখন জাকারিয়া খান চৌধুরী পশ্চিম পডনের বেইজওয়াটার এলাকায় নটিংহীল গেইটের কাছে ২৪, পপত্ৰীজ গার্ডেনে ডোনাল্ড সওয়ার্থের তত্ত্বাবধানে একটি বাড়ির গ্রাইন্ড ফ্লোর পাওয়ার সম্ভাবনার কথা বিচারপতি ‘পুরাকে অবহিত করেন। ইতােমধ্যে ডােনাল্ড চেসওয়ার্থের নাম বহু স্থানে উল্লেখ করা গেছে। তিনি ‘ওয়ার অন ওয়ান্ট’ এর চেয়ারম্যান এবং বাঙালীদের একজন সাচ্চা সমথক সাবে সকলের কাছে পরিচিত। পেমত্রীজ গার্ডেনের উল্লেখিত বাড়িতে টক-এইচ’ নামে * পাতিষ্ঠানের পরিচালিত ইন্টারন্যাশনাল হােষ্টেলের তিনি ওয়ার্ডেনের দায়িত্বে ছিলেন। ” চেসওয়ার্থের কথা জানতে পেরে বিচারপতি চৌধুরী, শেখ আবদুল মান্নান ও
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে বিলাত প্রবাসীদের অবদান – ড খন্দকার মোশাররফ হোসেন
বৃটিশ এম. পি. ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের অবদান
পাকিস্তানের নির্বাচিত পার্লামেন্ট বাতিল, সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ রহমানকে গ্রেফতার এবং ২৫ মার্চ রাত থেকে বাংলাদেশে পাকিস্তান সামরিক না জঘন্যতম গণহত্যা পরিচালনার পর থেকে বৃটিশ এম, পি, ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ পাকিস ঘূন্য কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ এবং বাঙালীদের প্রতি সমর্থনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসেন মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বিলাতে বাংলাদেশ আন্দোলনে সমর্থন এবং বৃটিশ হাউজ অফ কমনসে (বৃটিশ পার্লামেন্টে) পার্লামেন্ট সদস্যদের ভূমিকা বাংলাদেশে মুক্তিযােদ্ধাদের কলেজে অনুপ্রাণিত এবং বিলাতে আন্দোলনরত বাঙালীদের করেছে উৎসাহিত । বৃটিশ পার্লামেন্টে বিরােধী দল-শ্রমিক দল (Labour Party) এর নেতা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড উইলসন এবং পার্টির চেয়ারম্যান ইয়ান মিকার্ডোসহ প্রায় সকল এম, পি, বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ সমর্থন করেন। লিবারেল পাটির সকল এম. পি. বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নেন। কিছুসংখ্যক সরকার দলীয় রক্ষণশীল দল (Conservative Party) এর এম. পি. বৃন্দও পাকিস্তান সামরিক সরকারের বর্বরতার সমালােচনা এবং বাঙালীদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের পক্ষে কথা বলেছেন। এছাড়া বিশিষ্ট বৃটিশ বুদ্ধিজীবী, অধ্যাপক ও বিশেষ করে সাংবাদিকদের বাংলাদেশকে সমর্থন করে বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ, প্রচার কাজে অংশগ্রহণ এবং মূল্যবান লিখনীর মাধ্যমে বিশ্ব জনমত সৃষ্টিতে অবদান রেখেছেন। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সময় থেকে প্রবাসী বাঙালীদের কাছে অতিপ্রিয় একটি নাম পূর্ব লন্ডনের ষ্টেপনি থেকে নির্বাচিত শ্রমিক দলীয় এম. পি. পিটার শাের। তিনি পার্লামেন্টে এবং পার্লামেন্টের বাইরে বাঙালীদের প্রতিনিধির মতাে বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে প্রবাসীদের প্রশংসা অর্জন করেছিলেন। বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাহিনীর গণহত্যার প্রতিবাদে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্দ্যোগে ২৮ মার্চ থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত ১০ নং জাহান স্ট্রীটের সামনে যে অনশন ধর্মঘট চলছিল সে স্থানে পিটার শাের অন্য একজন এম. পি. ব্রুস ডগলাস-ম্যান সহ উপস্থিত হয়ে অনশনকারী ছাত্রদের প্রতি সমবেদেনা প্রকাশ করেন। ধর্মঘটস্থলে এসে তিনি পূর্ববঙ্গে’ সংঘটিত গণহত্যার নিন্দা করেন এবং বাঙ্গালীদের ন্যায্য দাবির পক্ষে অবস্থান গ্রহণের কথা বলে তিনি বাঙালীদের সমর্থক একজন এম. পি. হিল। আত্মপ্রকাশ করেন। ৪ এপ্রিল ‘হ্যামস্টেড টাইন হলে’ পূর্ববঙ্গে গণহত্যার প্রতি গণসমাবেশে বক্তব্য রাখার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বৃটেনের বাঙালীদের আলো” আনুষ্ঠানিকভাবে সম্পৃক্ত হন। এরপর থেকে লন্ডনে এমন কোন জনসমাবেশ ২৯ “”) যেখানে পিটার শাের এর সক্রিয় উপস্থিতি ছিল না। যত ব্যস্ততাই থাকুক না কেন বাংলাদেশ
বিলাতের সংবাদপত্রগুলাে বরাবরই পূর্ববঙ্গের’ জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের পক্ষ সমর্থন করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধকে অনুপ্রাণিত করেছে। লন্ডন কে প্রকাশিত পত্র-পত্রিকার ইতিবাচক ভূমিকার জন্য বিলাতের এবং সারা বিশ্বের জনমত বাংলাদেশের পক্ষে প্রভাবান্বিত হয়েছে । এই সকল পত্রিকার সাংবাদিকবৃন্দ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পূর্ববঙ্গ থেকে বস্তুনিষ্ঠ খবর পরিবেশন করে বাংলাদেশের জনগণের পক্ষে বিশাল অবদান রেখেছেন। বিশ্ব জনমত সৃষ্টিতে বৃটেনের পত্র-পত্রিকা এবং তাদের সাংবাদিকদের ভূমিকার কথা গ্রন্থের ১০টি অধ্যায়ে বিস্তারিতভাবে আলােচনা করা হয়েছে। তারপরও যে কয়েকজন স্বনামধন্য সাংবাদিকদের নাম উল্লেখ না করলে কৃপনতা করা হবে তাঁরা হলেন “দি সানডে টাইমস” এর এথেনী মাসকারেনহাস, ডেভিড হােল্ডেন, কলিন স্মীথ, নিকোলাস টমালিন, মুরে সায়েল; “দি ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকার সায়মন ড্রিংগ (পরবর্তিতে দি টাইমস), ডেভিড লােশাক, মিস ক্লেয়ার হােলিংওয়ার্থ, কেনেথ ক্লার্ক, ‘দি গার্ডিয়ান’ পত্রিকার পিটার প্রেসটন (সম্পাদক), মার্টিন এ্যাডনি, মার্টিন ওলাকোট, সায়মন উইনচেষ্টার, লরেন স্টার্ন; ‘দি টাইমস’ পত্রিকার পিটার হেজেল হাট; ‘এসেসিয়েটেড প্রেস’ এর ডেনিস নিৰ্ড ও ফটো সাংবাদিক মাইকেল লরেন্স; ‘দি অবজারভার’ পত্রিকার কলিন স্মীথ এবং বি,বি,সি বাংলা বিভাগের সিরাজুর রহমান, শ্যামল লােধ ও কমলবােস প্রমুখের নাম উল্লেখযােগ্য।
বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর অবদান
বাংলাদেশে মুক্তযুদ্ধ চলাকালে বিলাতে প্রবাসী বাঙালীদের কাছে একজন স দেশপ্রেমিক, অকুতােভয় নির্ভিক সৈনিক এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিলাতে আন্দোলনে ঐক্যের প্রতিক যে নামটি প্রবাসীদের উজ্জীবিত করেছে তিনি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচনের পর সংসদ অধিবেশন নিয়ে তালবাহানা এবং তকালীন পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নির্যাতন যখন অব্যাহত তখন লন্ডনে বহু বিভক্ত দলউপদলের কোন্দলের ফলে বিলাতের আন্দোলনে কাংখিত সমন্বয় করা সম্ভব হচ্ছিল না। সকল দল ও উপদলকে একত্রিত করে একটি সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদ গঠনের একটি প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এমতাবস্থায়, যখন পাকিস্তান পার্লামেন্ট বাতিল, সংখ্যাগরিষ্ট দলের নেতা শেখ মুজিবর রহমানকে গ্রেফতার এবং চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়ার স্বাধীনতা ঘােষণা করে বাংলাদেশ সর্বাত্মক মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ, সেই ক্রান্তিলগ্নে বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, বাংলাদেশ মহিলা সমিতি ও বাংলাদেশ মেডিকেল এ্যাসােসিয়েশন সমন্বয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশে গণহত্যার প্রতিবাদে এবং স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে সমর্থনের দাবিতে বেশ কিছু কার্যক্রম গ্রহণ করে। রাজনৈতিক দলগুলাে মধ্যে সমন্বয়ের অভাব এবং বিশেষ করে আওয়ামী লীগের বিভক্তির ফলে কোন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বা ঐক্যবদ্ধ কোন প্রয়াস গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছিল না। লন্ডনে বিভিন্ন এলাকা ভিত্তিক এবং লন্ডনের বাইরে শহর ভিত্তিক সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে বাঙালীরা বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করছিল। ঠিক এমনি এক সংকটময় মুহূর্তে বিলাতের প্রবাসী বাঙালীদের আশীর্বাদ রূপে লন্ডনে আগমন করলেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। বাংলাদেশের জনগণের আশা-আকাংখার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও কর্তব্যবােধে উদ্বুদ্ধ হয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বর্বরতা এবং বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার প্রতিবাদে তিনি স্বেচ্ছায় জেনেভা থেকে লন্ডনে এসে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করার প্রত্যয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তাঁর প্রবল আত্মবিশ্বাস, বাঙালীদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের প্রতি অকুণ্ঠ সমথন এবং বাঙালীদের প্রতি প্রদর্শিত চরম বৈষম্যের প্রতিবাদে বিদ্রোহী মনের অধিকারী বিচারপিত চৌধুরী সহায় সম্বলহীন অবস্থায় লন্ডনে এই কঠিন ও ঝুকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে সম হন। তার একাগ্রতা, দেশপ্রেম ও কঠোর পরিশ্রমে অতি দ্রুত বিবদমান ও বিশৃংখল সংগ্রাম পরিষদ’ সমূহকে সমন্বয় করে এবং রাজনৈতিক দল ও উপদলের বিশ্বাস অর্জন করে। আত্মপ্রকাশ করেন বিলাতে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনের আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে প্রাণ হিসাবে।
১৯২১ সালের ৩১ জানুয়ারি মাসে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী টাঙ্গাইলের এক সম্ভ্রান্ত এ সপরিচিত পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতা আবদুল হামিদ চৌধুরী পূর্বপাকিস্তান আইন পরিষদের স্পীকার ছিলেন। আবু সাঈদ চৌধুরী বাল্যকাল থেকেই মেধাবী ছাত্র হিসাবে বিচিত ছিলেন এবং পাঠ্য পুস্তক ছাড়াও অন্যান্য বই পড়ার প্রতি তার আগ্রহ ছিল। তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বি. এ. পাশ করেন। তিনি ১৯৩৯ ইং সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। আবু সাঈদ চৌধুরী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস বিষয়ে এম, এ, এবং বি, এল. ডিগ্রী লাভ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়য়ে অধ্যয়কালে তিনি নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এর দায়িত্ব পালন করেন এবং রূপায়ন’ নামে একটি সাহিত্যপত্র সম্পাদনা করেন। তিনি ১৯৪৭ সালে লন্ডনের লিংকনস্-ইন’ থেকে ব্যারিষ্টারী (বার-এট-ল) পাস করেন। লন্ডনে অধ্যয়নকালে তিনি নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের বৃটেন শাখার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ব্যারিষ্টার আবু সাঈদ চৌধুরী দেশে ফিরে প্রথমে শহীদ সােহরাওয়ার্দীর জুনিয়র হিসাবে। এবং পরবর্তিতে স্বতন্ত্রভাবে আইন পেশায় আত্মনিয়ােগ করেন। আইন পেশায় তাঁর মেধা ও একাগ্রতার স্বীকৃতি হিসাবে ১৯৬০-৬১ সালের জন্য তাঁকে পুর্ব-পাকিস্তানের এডভােকেট জেনারেল পদে নিযুক্ত করা হয়। ব্যারিষ্টার চৌধুরী ১৯৬১ সালে ঢাকা হাইকোর্টে বিচারপতি হিসাবে নিয়ােগ লাভ করেন। তিনি ১৯৬৩-৬৪ সময়কালের জন্য অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসাবে কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বাের্ডের সভাপতির পদে নিয়ােজিত ছিলেন। ১৯৬৯ ইং সালে ব্যাংককে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় বিশ্ব বিচারক সম্মেলন’ এবং ‘আইনের মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্পর্কিত চতুর্থ বিশ্ব সম্মেলনে পাকিস্তানের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব করেন। ১৯৬৯ ইং সালে ছাত্র-গণ আন্দোলন সফল হওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য প্রফেসর | ওসমান গণি উপাচার্যের পদ ত্যাগ করেন। এমনি একটি ক্রান্তিকালে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়ােগ দান করা হয়। তিনি উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করে অতি দ্রুত তার মেধা ও আন্তরিকতা দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষকদের মন জয় করতে সমর্থ হন।
১৯৭১ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি চৌধুরী জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের শবেশনে যােগদানের জন্য জেনেভা গমন করেন। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের আধবেশন চলাকালে মার্চ মাসে ঢাকা থেকে পরিবেশিত বিভিন্ন খবরে তিনি উদ্বিগ্ন ও কথার মধ্যে দিন কাটাচ্ছিলেন। মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে পত্রিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুইজন ২/এ হত্যার খবর পান। এই ঘটনার পর ১৫ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র হত্যায় প্রতিবাদে লাশক শিক্ষা সচিবের কাছে জেনেভস্থ পাকিস্তান দূতাবাসের মাধ্যমে উপাচার্যের পদত্যাগ * পত্র প্রেরণ করেন। ২৬ মার্চ ঢাকার সাথে সকল যােগাযােগ বন্ধ এবং বাংলাদেশে “ম কিছু ঘটেছে বলে তিনি বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম থেকে জানতে পারেন। এমতাবস্থায়,
বিশ্বব্যাপী এই বর্বরতার কথা বলবেন বলে প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। বি. বি. সি, বাংলা অনুষ্ঠানে একই দিনে (১০ এপ্রিল) সাক্ষাৎকারটি গুরুত্ব সহকারে প্রচার করে। কলকাতার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় বিচারপতি চৌধুরীর বি. বি. সি. এর সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ করে। এভাবেই ১০ এপ্রিল বিচারপতি চৌধুরী প্রকাশ্যে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে তার সম্পৃক্ততা ঘােষণা করেন। ইতােমধ্যে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে বিলাতে প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন সংগ্রাম পরিষদের সমন্বয়ে বিলাতের আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করার জন্য অনুরােধ জানানাে হয় । কিন্তু এরই মধ্যে মুজিবনগর থেকে বিচারপতি চৌধুরীকে বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি নিয়ােগের খবর জানানাে হয়। বিচারপতি চৌধুরীকে পাকিস্তান হাইকমিশন থেকে নানা ভাবে ভয়-ভীতি প্রদর্শন করা হয়। যার প্রেক্ষিতে তার বাসস্থান পরিবর্তন করতে হয় । এক পর্যায়ে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের কর্মকর্তারা বিচারপতি চৌধুরীকে বিশেষ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেন। ২৪ এপ্রিল কভেন্ট্রিতে যুক্তরাজ্যস্থ সকল সংগ্রাম কমিটির প্রতিনিধিদের একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে বিচারপতি চৌধুরী উপস্থিত হন। প্রতিনিধিদের সকলে তাকে সম্মেলনের সভাপতিত্ব করার জন্য এবং প্রস্তাবিত কমিটির নেতৃত্ব গ্রহণের জন্য অনুরােধ করেন। বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি হিসাবে সম্মেলনে সভাপতিত্ব করা। বা কোন কমিটির নেতৃত্ব নেয়া সমীচীন হবে না বলে যুক্তি দিয়ে প্রতিনিধিদের অনুরােধ রক্ষায় অপরাগতার কথা সকলকে অবহিত করেন। ইতােমধ্যে মুজিবনগর থেকে লন্ডন প্রবাসী রকিবউদ্দিনের মাধ্যমে প্রেরীত বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি হিসাবে নিয়ােগদান পত্র সম্মেলনে পাঠ করে শােনান হয়।
ঐতিহাসিক কভেন্ট্রি সম্মেলনে কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা সম্ভব না হলেও স্টিয়ারিং কমিটি” গঠন করা হয় এবং বিচারপতি চৌধুরীকে এই কমিটির উপদেষ্টা নির্বাচন করা হয়। ১১ নং গােরিং স্ট্রীটে অফিস স্থাপন করে দেশ মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত বিচারপতি চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে ও পরিচালনায় স্টিয়ারিং কমিটি যুক্তরাজ্যে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচার ও সংগ্রাম কমিটি সমূহের মধ্যে সমন্বয়ের কাজ অত্যন্ত সফলতার সাথে পরিচালনা করে। বাংলাদেশ সরকারের অনুমতি গ্রহণ করে বিচারপতি চৌধুরী বহিবিশ্বে কূটনৈতিক গাযােগ স্থাপনের লক্ষ্যে লন্ডনে বাংলাদেশ দূতাবাস স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। “ওয়ার অন ওয়ান্ট” এর ডােনাল্ড চেসওয়ার্থের সহযােগিতায় ২৪ নং পেব্রীজ গার্ডেনে ২৭ ৮ বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে লন্ডনে বাংলাদেশ দূতাবাসের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন লন। বিচারপতি চৌধুরীর নির্দেশ মােতাবেক পাকিস্তান সরকারের সাথে সম্পর্কছিন্নকারী লা কূটনৈতিক কর্মকর্তারা বাংলাদেশ দূতাবাসের যাবতীয় কর্মকান্ড পরিচালনা করেন। চারপতি চৌধুরী প্রত্যহ সকালে ষ্টিয়ারিং কমিটির গােরিং স্ট্রীটের অফিসে এবং অপরাহে স্ত্ৰীজ গার্ডেনে বাংলাদেশ দূতাবাসে অফিস করেন।
করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাব পাসে বাধা সৃষ্টি করেন। এ সময় বিচারপতি ২ কূটনৈতিক কর্মকান্ড এবং তার উপস্থিতিতে বাংলাদেশের স্বার্থ বিরােধী প্রস্তাবের সােভিয়েত ইউনিয়ন সহ অনেক দেশ অবস্থান গ্রহণ করেছিল। বিচারপতি চৌধুরী নিউই অবস্থান কালেই বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হয় এবং স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে আw. করে। ট্রাফেলগার স্কোয়ারে ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় উৎসব বিচারপতি চৌধনী অনুপস্থিতিতেই অনুষ্ঠিত হয়। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী লন্ডনে প্রত্যাবর্তন করেন ২৪ ডিসেম্বর। স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বাগত জানানাে এবং প্রবাসী বাঙালী ও বৃটিশ জনগণকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থনের জন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে ২ জানুয়ারি হাইড পার্ক স্পীকার্স কর্ণায়ে ষ্টিয়ারিং কমিটির সর্বশেষ জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বিচারপতি চৌধুরী পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশে সন্তোষ প্রকাশ করে বিলাতের আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত সকলকে ধন্যবাদ জানান। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের জরুরী তারবার্তা পেয়ে বিচারপতি চৌধুরী ৬ জানুয়ারি, ‘৭২ বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে লন্ডন ত্যাগ করেন এবং ১৮ জানুয়ারি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন। ১৯৭৩ সালে ২৪ ডিসেম্বর তিনি রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ করেন। ১৯৭৩ এর পর বিচারপতি চৌধুরী বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯৮৫ সালে তিনি জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। বিচারপতি চৌধুরী একজন অরাজনৈতিক ব্যক্তি হিসাবে ১৯৭১ এর ২৬ মার্চ লন্ডনে এসে একজন বিজ্ঞ রাজনীতিবিদের মতাে লন্ডনে বাংলাদেশ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে বহিবিশ্বে সুনাম অর্জন করেন। তার স্বীকৃতিতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রপতির পদলাভ করেন। যে লন্ডন থেকে বিচারপতি চৌধুরীর উত্থান সেই লন্ডনে এসেই তিনি ১৯৮৭ ইং সালের ২ আগস্ট একটি আন্ডারগ্রাইন্ড স্টেশনে নিঃসঙ্গ অবস্থায় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে এই পৃথিবী থেকে চির বিদায় নিয়ে চলে গেলেন (ইন্নালিল্লাহে……)।
|কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন প্রচেষ্টা
কভেন্ট্রি সম্মেলনের সিদ্ধান্ত মােতাবেক স্টিয়ারিং কমিটি বিলাতের বাঙালীদের সংগঠিত সংগ্রাম কমিটি সমূহকে সমন্বয় সাধন করে একটি কেন্দ্রীয় পরিষদ গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। ১৯৭১ সালের ৩০ জুলাই স্টিয়ারিং কমিটির উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সাথে কিছু বাঙালী নেতার এক আনুষ্ঠানিক সভায় কেন্দ্রীয় পরিষদ গঠনের উদ্দেশ্যে একটি কনভেনশন কমিটি গঠনের সুপারিশ করা হয়। উক্ত সভায় বিভিন্ন আঞ্চলিক সংগ্রাম কমিটি সমূহের ৪টি বৃহৎ জোন থেকে ৪ জন এবং ষ্টিয়ারিং কমিটি থেকে ২ জন প্রতিনিধি নিয়ে ৬ জনের একটি কনভেনশন কমিটি গঠনের ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। | ৩০ জুলাই আনুষ্ঠানিক সভার আলােচনার প্রেক্ষাপটে ৬ আগস্ট তারিখে ষ্টিয়ারিং কমিটির এক সভা উপরােক্ত বিষয়ে আলােচনার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে মিলিত হন এবং একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় পরিষদ গঠনের উপর গুরুত্ব আরােপ করা হয়। এই মর্মে অনুমােদন লাভের জন্য ষ্টিয়ারিং কমিটির শেখ আবদুল মান্নান, শাসসুর রহমান ও কবির চৌধুরী। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সাথে সাক্ষাত করেন। ফলপ্রসূ আলােচনার প্রেক্ষাপটে ষ্টিয়ারিং কমিটি ১২ আগস্ট পুনরায় মিলিত হয়ে পূর্ব প্রস্তাব মােতাবেক শেখ আবদুল মান্নান ও আজিজুল হক ভূইয়াকে ষ্টিয়ারিং কমিটির প্রতিনিধি হিসেবে কনভেনশন কমিটিতে মনােনয়ন দান করা হয়। এই সভায় ষ্টিয়ারিং কমিটির শেখ আবদুল মান্নান, শামসুর রহমান ও আজিজুল হক ভূঁইয়া উপস্থিত ছিলেন। | বিলাতের বাঙালি অধ্যুষিত এলাকাকে চারটি অঞ্চলে বিভক্ত করা হয়। যথা ঃ (ক) সাউথ ইংল্যান্ড, (খ) মিডল্যান্ড; (গ) ল্যাংকেশায়ার এবং (ঘ) ইয়র্কশায়ার ও পার্শ্ববর্তী এলাকা। ৩০ জুলাইয়ে গৃহীত সিদ্ধান্ত মােতাবেক চারটি অঞ্চল থেকে গউস খান (লন্ডন), আবুদল মতিন (ম্যানচেষ্টার), আরব আলী (ট্রাটফোর্ড আপন এ্যাভন) এবং এ এম তরফদারকে কনভেনশন কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। | এই অন্তর্ভুক্তি উল্লেখিত অঞ্চলগুলােতে গড়ে ওঠা নেতৃত্ব থেকে কোন নীতিমালার ওতে মনােনীত করা হয়নি। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন অঞ্চলে সংগ্রামের মকাণ্ডে যারা অগ্রগামী পরিচিত ব্যক্তিত্ব ছিলেন তাদের মধ্য থেকে কনভেনশন কমিটিতে ইক্ত করা হয়। এই অন্তর্ভুক্তি নিয়ে অবশ্য পরবর্তিকালে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল। এ পর্যন্ত তো ছয়জন ছাড়াও কেন্দ্রীয় পরিষদের গঠনতন্ত্র প্রণয়নে সাহায্য করার জন্য কনভেনশন
উক্ত সম্মেলন অনুষ্ঠানের আয়ােজন করা হয়। কেন্দ্রীয় সগ্রাম পরিষদের কর্মকর্তা ও কার্যকরী কমিটি নির্বাচন পরিচালনার জন্য ব্যারিষ্টার আমীন, ব্যারিষ্টার ফেরদৌস, ডাক্তার হারুন, ডাক্তার সিরাজদৌল্লা ও গনেশ চন্দ্র দে-কে সদস্য করে একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়। কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠনের সকল প্রকার সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও প্রতিনিধি প্রেরণের বিষয়ে মতানৈক্য সৃষ্টি হওয়ায় শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের বৈদেশিক মুখপাত্র বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর পরামর্শ মােতাবেক ৭ নভেম্বর-এ অনুষ্ঠিতব্য কেন্দ্রীয় সম্মেলন স্থগিত করা হয়। যে সকল ক্ষেত্রে প্রতিনিধি মনােনয়নে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে তা নিরসনের জন্য কনভেনশন কমিটি প্রচেষ্টা চালান। ইতিমধ্যে মাস গড়িয়ে ডিসেম্বর এসে গেলে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের মােড় ত্বরিৎ গতিতে ইতিবাচক পরিণতির দিকে এগিয়ে যায় এবং বিলাতের আন্দোলনে সমন্বয় করার যে তাগিদ ছিল তার প্রয়ােজনীয়তা ফুরিয়ে যায়। ২৪ মার্চে কভেন্ট্রি সম্মেলনে কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠনের যে প্রত্যয় ব্যক্ত করা তা আর কখনাে বাস্তবায়িত হয় নি।
উক্ত সম্মেলন অনুষ্ঠানের আয়ােজন করা হয়। কেন্দ্রীয় সগ্রাম পরিষদের কর্মকর্তা ও কার্যকরী কমিটি নির্বাচন পরিচালনার জন্য ব্যারিষ্টার আমীন, ব্যারিষ্টার ফেরদৌস, ডাক্তার হারুন, ডাক্তার সিরাজদৌল্লা ও গনেশ চন্দ্র দে-কে সদস্য করে একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়। কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠনের সকল প্রকার সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও প্রতিনিধি প্রেরণের বিষয়ে মতানৈক্য সৃষ্টি হওয়ায় শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের বৈদেশিক মুখপাত্র বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর পরামর্শ মােতাবেক ৭ নভেম্বর-এ অনুষ্ঠিতব্য কেন্দ্রীয় সম্মেলন স্থগিত করা হয়। যে সকল ক্ষেত্রে প্রতিনিধি মনােনয়নে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে তা নিরসনের জন্য কনভেনশন কমিটি প্রচেষ্টা চালান। ইতিমধ্যে মাস গড়িয়ে ডিসেম্বর এসে গেলে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের মােড় ত্বরিৎ গতিতে ইতিবাচক পরিণতির দিকে এগিয়ে যায় এবং বিলাতের আন্দোলনে সমন্বয় করার যে তাগিদ ছিল তার প্রয়ােজনীয়তা ফুরিয়ে যায়। ২৪ মার্চে কভেন্ট্রি সম্মেলনে কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠনের যে প্রত্যয় ব্যক্ত করা তা আর কখনাে বাস্তবায়িত হয় নি।
বিলাতে প্রথম জাতীয় ছাত্র সম্মেলন।
সংগ্রাম পরিষদসমূহের কেন্দ্রীয় সম্মেলন অনুষ্ঠান প্রচেষ্টার পাশাপাশি যুক্তরাজ্য বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ লন্ডনে একটি জাতীয় ছাত্র সম্মেলন অনুষ্ঠানের কর্মসূচী গ্রহণ করে । পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, আঞ্চলিক প্রতিনিধি প্রেরণ সংক্রান্ত মতানৈক্যের কারণে সংগ্রাম পরিষদসমূহের কেন্দ্রীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। লন্ডনসহ বিভিন্ন শহরে ছাত্ররা অন্যান্য সংগ্রাম কমিটির সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত থাকায় বিলাতে আন্দোলন সংগঠন, সমন্বয় ও নেতৃত্ব দানের ব্যাপারে ছাত্র সম্মেলন অনুষ্ঠানের উপর বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হয়। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ লন্ডন এস ডব্লিউ-৪ এর ক্লাপহাম কমনস্থ (সাউসাইড) হেনরী থরন্টন স্কুল মিলনায়তনে ১৯৭১ সালের ৩০ অক্টোবরে উক্ত ছাত্র সম্মেলনের আয়ােজন করে। উক্ত জাতীয় ছাত্র সম্মেলন অনুষ্ঠানের জন্য ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভায় একটি সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি গঠন করা হয়। আমাকে (লেখক) এই কমিটির আহ্বায়ক এবং এ টি এম ওয়ালী আশরাফ (বাংলাদেশ পার্লামেন্ট সাবেক এম পি), এম আলতাফ হােসেন (বার এট ল), এ রেজা খান (বার এট ল), ড. হুজ্জত আলী প্রামানিক (বর্তমান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক) এবং মাজেদ সওদাগর (বর্তমান লন্ডনে ব্যবসায়ী) প্রমুখকে সদস্য মনােনীত করা হয়। ছাত্র সম্মেলন উপলক্ষে একটি স্মরণিকা প্রকাশ করা হয়। লারকুলা লিমিটেড স্মরণিকাটি মুদ্রণের কাজ সম্পাদন করে। স্মরণিকায় বাংলাদেশের বিপ্লবী সরকারের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবর রহমানের বক্তৃতার উদ্ধৃতি, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের বাণী, পররাষ্ট্র ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী খন্দকার মােস্তাক আহমদের বাণী ও মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কর্ণেল এম এ জি ওসমানীর বাণী ছাপানাে হয়। মুজির নগর থেকে প্রেরিত প্রতিটি বাণীতে দেশকে মুক্ত করার দৃপ্ত অঙ্গিকার, মুক্তিযুদ্ধকালে বিলাতে প্রবাসী বাঙালি ছাত্রদের ভূমিকার প্রশংসা ও সম্মেলনের সফলতা কামনা করা হয়। ইংরেজীতে মুদ্রিত এই স্মরণিকায় শেখ মুজিবর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের বক্তৃতার মধ্য থেকে “এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম…” অংশটি, উদ্ধৃতি হিসেবে স্থান পায়। এ ছাড়া মার্চ মাস থেকে শুরু করে তৎপরতা, বিভিন্ন প্রতিনিধি প্রেরণ, প্রচারপত্র ও পুস্তিকা প্রকাশ সংক্রান্ত একটি সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদন স্মরণিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। স্মরণিকা আমাদের সংগ্রাম’ (Our Struggle) শিরােনামে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণার প্রেক্ষাপট, মুক্তিযুদ্ধের যৌক্তিকতা ও অগ্রগতি সম্পর্কে একটি প্রবন্ধ মুদ্রিত করা হয়।
বাংলাদেশ গণ-সংস্কৃতি সংসদ
মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে সমাবেশ, শােভাযাত্রা, লবিং ও সভা ইত্যাদি আয়ােজনের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রবাসী বাঙালীদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া এবং বিশ্ব জনমতকে প্রভাবিত করার সুমহান লক্ষ্যে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠার প্রয়ােজনীয়তা দেখা দেয় মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় থেকেই। এই তাগিদে সাড়া দিয়ে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও যুক্তরাজ্যস্থ বাংলাদেশ মহিলা সমিতির কিছু উৎসাহী নেতা ও কর্মী বিলাত-প্রবাসী লেখক, কবি, শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীকে সংগঠিত করে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠার। উদ্যোগ গ্রহণ করেন। সেই সময়ে লন্ডনে উচ্চ শিক্ষার্থে অবস্থানকারী তৎকালীন ঢাকা। মিউজিয়ামের পরিচালক ও বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী এনামুল হক এই উদ্যোগের সাথে সম্পৃক্ত হন। লন্ডন ডব্লিউ-সি-১ এ অবস্থিত টেভিস্টক প্লেসের ৫৯ নং সেমুর হাউজে মিসেস মুন্নী রহমানের বাসভবনে উক্ত সাংস্কৃতিক সংস্থা গঠনের উদ্যোগে এক সভা আহ্বান করা হয়। উক্ত সভায় সর্বসম্মতিক্রমে বাংলাদেশ গণসংস্কৃতি সংসদ (Bangladesh Peoples’ Cultural Society) নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিষ্ঠা এবং তার কার্যালয় হিসেবে ৫৯ নং সেমুর হাউসে মিসেস মুন্নী রহমানের বাসভবনকে ব্যবহারের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। | বাংলাদেশ গণ-সংস্কৃতি সংসদের সকল কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন সংসদের সাধারণ সম্পাদিকা এবং মহিলা সমিতির নেত্রী মিসেস মুন্নী রহমান। অপরিসীম সাংগঠনিক দক্ষতার অধিকারী বিলাতের বাঙালি মহিলাদের নেতৃত্বদানকারী সদাহাস্যময় সকলের মুন্নী আপা আজ আর আমাদের মাঝে বেঁচে নেই। তিনি লন্ডনে এক সড়ক দুর্ঘটনায় ইন্তেকাল করেছেন। (ইন্না লিল্লাহে …….. রাজেউন)। মিসেস মুন্নী রহমানের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ গণসংস্কৃতি সংসদ মুক্তিযুদ্ধকালে বিলাতের প্রবাসীদের সংগঠিত করার ব্যাপারে এবং প্রেরণা যােগাতে এক বিশেষ অবদান রেখেছিলেন। তিনি যুক্তরাজ্যস্থ বাংলাদেশ মহিলা সমিতির সকল কর্মকাণ্ডেও চালিকা শক্তি হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তার স্বামী বিশিষ্ট আইনজীবী ও তৎকালীন লন্ডনের প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতা ব্যারিষ্টার লুৎফর রহমান। শাহজাহান এর সার্বক্ষণিক উৎসাহে মিসেস মুন্নী রহমান মুক্তিযুদ্ধ সময়ের নয় মাস অক্লান্ত শ্রম করে একজন প্রবাসী মুক্তিযুদ্ধ সংগঠক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। লস মুন্নী রহমান স্বাধীনতা উত্তরকালে লন্ডনে সাংস্কৃতিক ও সামাজিক আন্দোলনে নেতৃত্ব মছেন এবং তিনি লন্ডনে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ সেন্টারের দায়িত্ব বহুদিন যাবৎ অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে পরিচালনা করেন। তার অকাল মৃত্যুতে বিলাতের প্রবাসীরা তাদের বলিষ্ঠ সংগঠককে হারিয়েছে।
৫৯ নং সেমুর হাউজের সভায় বাংলাদেশ গণ-সংস্কৃতি সংসদের পরিচালনার । এনামুল হককে (জাতীয় যাদুঘরের সাবেক মহাপরিচালক) সভাপতি ও মিসেস মন রহমানকে সাধারণ সম্পাদিকা নির্বাচিত করে গঠিত ১৯ সদস্যবিশিষ্ট সংসদের অপর সদস্যরা ছিলেনঃ সহ-সভাপতি (৩ জন) শফিকুর রহমান, ফজলে লােহানী (বিশিষ্ট টিভি ব্যক্তিত এ মরহুম) ও শহিদুদ দাহার (নরথাপন), যুগ্ম সচিব (২ জন) মাহমুদ হাসান ও জাকিউদ্দিন আহম্মদ, সাংগঠনিক সম্পাদক-বুলবুল মাহমুদ (বর্তমানে ব্যারিষ্টার ও বৃটিশ সিভিল সার্ভিসে কর্মরত); কোষাধ্যক্ষ-আনিস আহম্মদ (লন্ডনে প্রকাশিত সাপ্তাহিক জনমতের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও বর্তমানে সম্পাদক); সদস্যবৃন্দ-লুলু বিলকিস বানু, জেবুন্নেসা খায়ের। আহমদ হােসেন জোয়ারদার, আবদুর রউফ (শিল্পী ও বাংলাদেশ ফিল্ম এন্ড আর্কাইভের ও চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর ডি এফ পির সাবেক পরিচালক), এম, এ রউফ (বর্তমানে লন্ডনে চাটার্ড একাউন্টটেন্ট), মেসবাহ উদ্দিন আহমেদ, এ কে এম, নজরুল ইসলাম (লন্ডনে বিশিষ্ট ব্যাবসায়ী), এ রাজ্জাক সৈয়দ, জিয়াউর রহমান খান (বর্তমানে ব্যরিষ্টার ও সংসদ সদস্য) এবং ড. হুজ্জত আলী প্রামানিক (বর্তমানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক)। ১৯৭১ সালের জুন মাসে প্রচারিত বাংলাদেশ গণ-সংস্কৃতি সংসদের এক প্রতিবেদনে উক্ত সংসদের উদ্দেশ্য ও কার্যাবলীর বিবরণ প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনে জানা যায় যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন, বাংলাদেশের ঐতিহ্যমণ্ডিত সংস্কৃতি বিদেশে প্রচার ও পৃথিবীর সকল স্বাধীনতাকামী জনগােষ্ঠীর সাথে সম্পর্ক স্থাপনের উদ্দেশ্যে এই সংসদ গঠন করা হয়। এই সংগঠন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রবাসী জনগণের মধ্যে মনােবল সৃষ্টি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশ এবং বাংলাদেশের নিজস্ব সংস্কৃতি রক্ষার অঙ্গিকার করে। উপরােক্ত উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গণ-সংস্কৃতি সংসদ বিভিন্ন সেমিনার, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, নৃত্যনাট্য প্রচার ও বিভিন্ন প্রদর্শনীর আয়ােজন করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করে। বাংলাদেশ গণ-সংস্কৃতি সংসদ প্রযােজিত অনুষ্ঠানাদির মধ্যে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের বিপ্লবী আলেখ্য “অস্ত্র হাতে তুলে নাও” নামক নৃত্যনাট্য বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। লন্ডন, মাচেষ্টার, বার্মিংহাম সহ বিলাতে বিভিন্ন শহরে আমন্ত্রণক্রমে ভক্ত নৃত্যনাট্যটি মঞ্চায়িত করা হয় এবং প্রবাসী মুক্তিকামী জনগণের প্রশংসা লাভ করে।
অত্র হাতে তুলে নাও” নৃত্যনাট্যটি রচনা ও সুরারােপ করেন বাংলাদেশ গণ-সংস্কৃতি সংসদের সভাপতি এনামুল হক। আগস্ট মাসে রচিত নৃত্যনাট্যটি প্রথম লন্ডনে মঞ্চায়িত হয় সে। মাসে। নৃত্যনাট্যটি পরিচালনা ও সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন মিসেস মুন্নী রহমান ও মি মঞ্জু হাফিজ। নৃত্যনাট্যের কিষাণ ও কিষাণীর মুখ্য নৃত্যাভিনয়ে অংশ গ্রহণ করেন যথা
পাকিস্তান ক্রিকেট দলের সফর বিরােধী আন্দোলন
পাকিস্তান ক্রিকেট টীমের সফরের প্রতিবাদ ও বাধা সৃষ্টির বিষয়ে সহযােগিতার জন্য ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ দক্ষিণ-আফ্রিকার বর্ণবাদী ক্রিকেট টীমের বৃটেন সফরের বিরুদ্ধে নেতত প্রদানকারী নেতা যুব ইউনিয়নের সভাপতি পিটার হেইনের সাথে যােগাযােগ স্থাপন করে। ঘােষিত প্রােগ্রাম মােতাবেক ২৪ এপ্রিল, ১৯৭১ বিকেল ৪টায় পাকিস্তান ক্রিকেট টীমের লন্ডন অবতরণের কথা ছিল। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও এ্যাকশন বাংলাদেশসহ বিভিন্ন সংগ্রাম পরিষদ পাকিস্তান ক্রিকেট টীমের আগমনের প্রতিবাদে হিথরাে বিমান বন্দরে সমাবেশ ও বিক্ষোভের আয়ােজন করে। ধারণা করা হয় যে, বিমান বন্দরে অপ্রীতিকর ঘটনাকে এড়ানাের উদ্দেশ্যে পাকিস্তান তাদের টীমের আগমন তারিখ স্থগিত ঘােষণা করে। লন্ডনে ক্রিকেট সফরের বিরুদ্ধে আয়ােজিত ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের প্রেস কনফারেন্স এবং পাকিস্তান ক্রিকেট টীমের আগমন স্থগিত করার খবর বৃটিশ পত্র-পত্রিকায় একই দিনে প্রকাশিত হয়। বাধাবিপত্তি এড়ানাের উদ্দেশ্যে পাকিস্তান টীম গােপনে তাদের আগমনের তারিখ নির্ধারণ করে। কিন্তু বিশ্বস্ত সূত্রে খবর পেয়ে পাকিস্তান ক্রিকেট টীমের আগমনে বাধা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ যথাযােগ্য কর্মসূচী গ্রহণ করে। পূর্ব নির্ধারিত তারিখের পরিবর্তে ২৭ এপ্রিল সকালে পাকিস্তান ক্রিকেট টীমের লন্ডন অবতরণের পরিবর্তিত সময়সূচী বাঙালীদের যে কোন পদক্ষেপকে এড়ানাের জন্য নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু বাঙালীদের চেতনা তখন এতই প্রখর ছিল যে, শীতের সকালের আমেজকে পরিহার করে প্রত্যুষেই শত-শত বাঙালি পাকিস্তান টীমের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রকাশ করার জন্য হিথরাে বিমান বন্দরে উপস্থিত হন। বিলাতের পত্র-পত্রিকা পাকিস্তান ক্রিকেট টীমের বৃটেন সফর বিরােধী প্রবাসী বাঙালালে প্রতিরােধ কর্মসূচীর খবর প্রকাশ করায় পাকিস্তান দূতাবাস বৃটিশ কর্তৃপক্ষের সহযােগিতায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করে।
এয়ারপাের্টের আগমন পথে একটি অপ্রীতিকর ঘটনা এড়ানাের জন্য এয়ারপােটের ভেতর থেকেই গাড়ীতে করে পেছনের পথ দিয়ে পাকা” টমিকে শহরে নিয়ে যাওয়া হয়। এ খবর যখন অপেক্ষমান বিক্ষোভকারীরা জানতে তখন বিক্ষুব্ধ বাঙালীরা হিথরাে বিমান বন্দরে অবস্থিত পি. আই. এ’ এর কাউন্টার করে তা তছনছ করে দেয়। বিক্ষোভকারীদের ফাঁক দিয়ে তুমুল বিক্ষোভের পাকিস্তান ক্রিকেট টীমের আগমনের খবর বৃটিশ পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। আহ, এ’ এর কাউন্টার আক্রমণ। ইমুল বিক্ষোভের মধ্য দিয়ে পর্ব নির্ধারিত ২৪ এপ্রিলের পরিবর্তে ২৮ এপ্রিল পাকিস্তান ক্রিকেট টীমের সম্মানে a স্পীকিং ইউনিয়নের উদ্যোগে এক সংবর্ধনার আয়ােজন করা হয়। ইতােপূর্বে ছাত্র শাম পরিষদ হত্যাকারী পাকিস্তানের টমিকে মানবতার কারণে সংবর্ধনা না দেয়ার অনুরোধ করেছিল। কিন্তু সেই অনুরােধ উপেক্ষা করে ইংলিশ স্পীকিং ইউনিয়ন তাদের নির্ধারিত সংবর্ধনা বাকলী স্কোয়ারের কাছে ২৭ নং চার্লস স্ট্রীটে আয়ােজন করে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এবং এ্যাকশন বাংলাদেশ এর যৌথ উদ্যোগে চার্লস স্ট্রীটে ইউনিয়ন অফিসের সামনে সন্ধ্যা ৬ টায় পাকিস্তান ক্রিকেট টীমের বিরুদ্ধে এক বিক্ষোভ সমাবেশের আয়ােজন করা হয়। লন্ডনের শত শত বাঙালি এবং এ্যাকশন বাংলাদেশের স্থানীয় সদস্যরা বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড ও ফেস্টুন নিয়ে সংবর্ধনায় গমনের গেটে অবস্থান গ্রহণ করে। প্ল্যাকার্ডে বাংলাদেশে হত্যাযজ্ঞ বন্ধ কর’ ইয়াহিয়া খান ধ্বংস হােক ক্রিকেট রাজনীতি বন্ধ কর” এবং “বাংলাদেশের। মুক্তিযােদ্ধারা এগিয়ে চল” ইত্যাদি শ্লোগান লিখিত ছিল। নির্ধারিত সময়ে পাকিস্তান ক্রিকেট টীম সংবর্ধনা স্থলে উপস্থিত হলে বিক্ষোভকারীদের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়। বৃটিশ পুলিশ পাকিস্তান টীমকে সংবর্ধনা স্থল থেকে দূরে একটি ছােট স্কোয়ারে অপেক্ষা করতে বলেন। এসময় বিক্ষোভকারীরা পুলিশের বেস্টনী অতিক্রম করে পাকিস্তান ক্রিকেট টীমকে আক্রমণের চেষ্টা চালায়। বিক্ষোভকারীদের সাথে পুলিশের ধস্তাধস্তিতে বিশৃংখলা সৃষ্টি হয় এবং এই পর্যায়ে বিক্ষোভকারীদের মধ্য থেকে মিস সুরাইয়া খানম ও মিসেস রাজিয়া চৌধুরী পুলিশের বেস্টনী অতিক্রম করে ছুটে গিয়ে পাকিস্তান ক্রিকেট টীমের অধিনায়ককে নাজেহাল করে। পুলিশের হস্তক্ষেপে সুরাইয়া খানম ও রাজিয়া চৌধুরীকে নিবৃত্ত করা হয় । বিক্ষোভের মারমুখী চরিত্র দেখে পুলিশ কর্তৃপক্ষ সংবর্ধনা স্থলে মহিলা পুলিশসহ আরাে অধিক পুলিশ ডেকে পাঠান। সংবর্ধনা স্থলের গেট থেকে বিক্ষোভকারীদের সরিয়ে দেয়ার জন্য পুলিশ ব্যাটন চার্জ করেও সফল হতে পারেনি।
অতঃপর পাকিস্তান ক্রিকেট টীমের খেলােয়াড়দেরকে ছােট ছােট গ্রুপে ভাগ করে পুলিশ ঘেরাও (কর্ডন) করে তাদেরকে গেট দিয়ে প্রবেশ করতে সাহায্য করে। এসময় পুলিশ ও বিক্ষোভকারীদের মধ্যে ধস্তাধস্তিতে বিশংখলা সৃষ্টি হয় এবং তার ফলে কয়েকজন খেলােয়াড় বিক্ষোভকারীদের হাতে নাজেহাল হয়। সংবর্ধনায় নিমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক নাসিম আহমেদ (পরবর্তিকালে ভুট্টো সরকারের মন্ত্রী) সংবধনা স্থলে পৌছলে বিক্ষোভকারীদের হাতে চরমভাবে লাঞ্ছিত হন। প্রসঙ্গত উল্লেখযােগ্য যে, নাসিম আহমেদ বিভিন্ন বুদ্ধিজীবী মহলে বাংলাদেশের গণহত্যাকে সমর্থন করে পাকিস্তান “রের পক্ষে বক্তৃতা ও বিবৃতি দিয়ে বাঙালীদের কাছে অত্যন্ত বিরাগভাজন ব্যক্তি হিসাবে। পরিচিত ছিলেন। লশের সাথে সংঘর্ষ, পুলিশের ব্যাটন চার্জ ও পাকিস্তানী খেলােয়াড়দের সংবর্ধনা স্থলে যশে বাধাদানকালে বিভিন্ন সময়ে বিক্ষোভকারীদের মধ্য থেকে মােট ৩৫ জনকে পুলিশ তার করে। পর্যায়ক্রমে গ্রেফতার করা হলেও বিক্ষোভকারীরা পিছপা হয়নি এবং তারকে বরণ করে নিয়ে বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করেছে। গ্রেফতারকৃত ৩৫ জনকে পরের দিন অর্থাৎ ২৯ এপ্রিল কোর্টে হাজির করা হয়। গ্রেফতারকৃতরা সকলেই কৃতকর্মের কথা স্বীকার করে বিবৃতিতে বলেন যে, যখন পাকিস্তানের সেনাবাহিনী বাংলাদেশে গs পরিচালনা করছে তখন ক্রিকেট টীমকে পাঠিয়ে পাকিস্তান বিশ্বজনমতকে অন্য এ প্রবাহিত করতে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। তাই বিক্ষোভকারীরা বিশ্বকে পাকিস্তান সরকারের হত্যাকারী পরিচয়কে তুলে ধরার জন্যই বিক্ষোভ করেছে এবং পুলিশের গ্রেফতারকে মেনে নিয়েছে। গ্রেফতারকৃতরা আরাে জানায় যে, তারা বৃটিশ আইন অমান্য করার উদ্দেশ্যে না বরং জাতীয়তাবাদী চেতনায় অনুপ্রাণিত হয়ে রাজনৈতিক কারণে পাকিস্তানীদের প্রতি ঘণ প্রকাশের লক্ষ্যে বিক্ষোভে জংগী রূপ ধারণ করেছিল। অতঃপর কোর্টের বিজ্ঞ বিচারক গ্রেফতারকৃতদের দেশপ্রেমিক স্বীকাররােক্তিতে খুশি হয়ে প্রত্যেককে নামমাত্র ৫ পাউন্ড জরিমানা আদায় করে মুক্তি দানের আদেশ প্রদান করেন। ২৮ এপ্রিলে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান ক্রিকেট সফর বিরােধী বিক্ষোভের ছবি এবং মন্তব্যসহ খবরাখবর বৃটিশ পত্র-পত্রিকায় প্রথম পাতায় প্রকাশিত হয় (দি টাইমস, ২৯-৩-৭১)। ২৫ মার্চের পর পর্যায়ক্রমে কয়েকদিন বাংলাদেশের খবর পত্র-পত্রিকায় স্থান পাওয়ার পর প্রবাসী বাঙালীরা ২৯ এপ্রিল পুনরায় বাংলাদেশের ইস্যুকে বৃটিশ পত্র-পত্রিকায় প্রথম পাতায় স্থান করে দেয়। বিলাতে ইতিমধ্যে সংগঠিত বিভিন্ন সংগ্রাম পরিষদ পাকিস্তানের ক্রিকেট সফরের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তােলার জন্য সমন্বিত কর্মসূচী গ্রহণ করে।
বৃটেনের বিভিন্ন শহরে পাকিস্তান ক্রিকেট দল যেন নির্বিবাদে বা বাধাহীনভাবে খেলতে না পারে তার জন্য প্রত্যেক খেলার দিনে মাঠের বাইরে বিক্ষোভ ও কালাে পতাকা প্রদর্শন এবং মাঠের ভেতরে প্রতিরােধ সৃষ্টি করার কৌশল গ্রহণ করা হয়। প্রথম শুভেচ্ছামূলক খেলাটি অনুষ্ঠিত হয় ১ মে, বিলাতের একটি ছােট শহর উরসেস্টারে। উক্ত শহরে বাঙালি বসবাসকারীদের সংখ্যা নগণ্য। হওয়ার কারণেই সম্ভবত প্রথম শুভেচ্ছা খেলাটি এই শহরে আয়ােজন করা হয়। বাস্তব অবস্থার প্রেক্ষিতে বিলাতের বাঙালি আন্দোলনরত সংগঠনসমূহ উরসেসটারে বিক্ষোভ প্রদর্শনের জন্য লন্ডন ও বার্মিংহাম থেকে দলে দলে উরসেসটারে গমনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। খেলার দিনে উরসেসটারে তুমুল প্রতিবাদ ও বিক্ষাভের মুখে পাকিস্তান ক্রিকেট দলকে খেলা শুরু করতে হয়। প্রথম দিনে এই খেলায় বিক্ষোভের কর্মসূচী দু’ভাগে নেয়া হয়। সমবেত বাঙালি বিক্ষোভকারীদের একটি দল মাঠের বাইরে সর্বক্ষণ বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকেন এবং পাকিস্তানের হত্যাযজ্ঞের ও বর্বরতার কাহিনী সম্বলিত লিফলেট দর্শকদের মনে বিতরণ করেন। অপর একটি দল টিকেট ক্রয় করে মাঠের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে এবং পকেটে কালাে পতাকা ও কম দামের ক্রিকেট বল নিয়ে দর্শকদের গ্যালারিতে অবস্থান অ করে। পাকিস্তান দল প্রথমেই ব্যাট করতে নামলে তাদের বিরুদ্ধে কালাে পতাকা প্রদ করা হয়। পাকিস্তানের ওপেনিং ব্যাটসম্যানকে লক্ষ্য করে যখন প্রথম বলটি ছোড়া হয় তখন শত শত ক্রিকেট বল গ্যালারী থেকে মাঠে প্রবেশ করে এমতাবস্থায়, কিছু সময়ের জন্য। খেলা স্থগিত করতে বাধ্য হয়। মাঠের অভ্যন্তরে অধিক সংখ্যক পুলিশের ব্যবস্থা করে খেলা পরিচালনা করা হলেও বেশ কয়েকবার খেলা বাধার সম্মুখীন হয়। প্রতিবাদ ও বিক্ষোভে এই নবতর ভাষা বিলাতের পত্রিকায় ফলাও করে প্রকাশিত হয়।
৩ জুন, ১৯৭১ইং তারিখ থেকে বার্মিংহামের এজবাষ্টনে পাকিস্তানের ক্রিকেট টেষ্ট খেলা শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে নির্ধারিত সময়ের প্রায় ৫ সপ্তাহ পূর্বে পাকিস্তান টীমকে প্রেরণ করে বিভিন্ন শহরে শুভেচ্ছা খেলার আয়ােজন করে বিলাতে জনমতকে পাকিস্তানের গণহত্যা’ থেকে অন্য খাতে পরিচালনা করার এক কূটনৈতিক কৌশল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তাই পাকিস্তানের এই কূটকৌশলকে প্রতিহত করার লক্ষ্যে প্রবাসী বাঙালীরা পাকিস্তান ক্রিকেট সফরকে প্রতিবাদ ও সর্বত্র নাজেহাল করার পদক্ষেপ গ্রহণ করে। বার্মিংহামের এসবেষ্টনে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান ক্রিকেট দলের প্রথম টেষ্ট খেলা উপলক্ষে হত্যাকারী পাকিস্তান দলের সফরের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ প্রদর্শনের জন্য ৫ জুন, ১৯৭১ তারিখে বার্মিংহামে এক সমাবেশ ও গণমিছিলের আয়ােজন করা হয়। বার্মিংহামের। এডওয়ার্ড রােডে “ক্যালথােৰ্প পার্ক” এর সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন বার্মিংহামের বাংলাদেশ সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি জগলুল পাশা। ইতােপূর্বে কেন্দ্রীয় স্টিয়ারিং কমিটির আহ্বায়ক আজিজুল হক ভূইয়া এবং ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক খন্দকার মােশাররফ হােসেন (লেখক) উক্ত সমাবেশে ও গণমিছিলে যােগদানের জন্য লন্ডন ও বার্মিংহামের আশেপাশের শহরের বাঙালীদের কাছে আহ্বান জানান। লন্ডনসহ বিভিন্ন শহর থেকে উক্ত সমাবেশে হাজার হাজার বাঙালি যােগদান করেন এবং সমাবেশ শেষে বিরাট গণমিছিল। এ্যাসবেষ্টন ক্রিকেট মাঠের চতুর্দিকে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।
ক্রিকেট খেলাকে কেন্দ্র করে বাঙালীদের বিক্ষোভ ও সমাবেশ বার্মিংহামের জনগণের মধ্যে বিরাট প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এর ফলে বার্মিংহামের লর্ড মেয়র এ্যালডারম্যান ভিক্টর চারটন প্রথম টেষ্ট খেলার ব্যাটটিতে উভয় দলের অধিনায়কদের অটোগ্রাফ নিয়ে তা নিলামে বিক্রি করে তার অর্থ বাঙালি উদ্বাস্তু শিবিরে ‘কলেরা রিলিফ ফাণ্ডে’ প্রেরণের এক মহৎ উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এই মহান উদ্যোগে সাড়া দিয়ে বৃটিশ ক্রিকেট দলের অধিনায়ক অটোগ্রাফি প্রদান করেন। কিন্তু পাকিস্তান দূতাবাসের নিষেধাজ্ঞার কারণে পাকিস্তান ক্রিকেট দলের অধিনায়ক অটোগ্রাফ দিতে অস্বীকৃতি জানায়। অগত্যা এক দলের অটোগ্রাফ নিয়েই ব্যাটটি নিলামে দেয়া হয় এবং তার থেকে সংগৃহিত অর্থ বাঙালীদের সাহায্যার্থে রিলিফ ফাণ্ডে প্রেরণ করা হয়। এই ঘটনায় পাকিস্তানীদের হীনমনােবৃত্তির জন্য বিলাতের পত্র-পত্রিকা “ম সমালোচনা করে। ইয়ং লিবারেল দলের রাজনৈতিক ভাইস চেয়ারম্যান সাইমন ২৬৮ উপরােক্ত ঘটনার মন্তব্য করতে গিয়ে পাবিস্তানের কর্তৃপক্ষকে হীনমানসিকতাপূর্ণ। অমানবিক আখ্যায়িত করে বলেন যে, উক্ত সফরের বিরােধিতা করে বাঙালীরা যে নিয়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছে তা যথার্থ ও যুক্তিযুক্ত। (দি গার্ডিয়ান, ৯-৬-১৯৭১)। পাকিস্তান ক্রিকেট দলের অপর উল্লেখযােগ্য টেষ্ট খেলা অনুষ্ঠিত হয় লন্ডনে । লন্ড টেষ্ট খেলার প্রতিবাদ জানানাের জন্য বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও কেন্দ্রীয় স্টিয়ারি কমিটির যৌথ উদ্যোগে ১৯ জুন, ১৯৭১ তারিখে হাইড পার্ক স্পীকার্স কর্ণারে জনসভা, বিক্ষোভ মিছিলের আয়ােজন করা হয়। সমাবেশে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশের ভ্রাম্যমান বৈদেশিক প্রতিনিধি ও কেন্দ্রীয় স্টিয়ারিং কমিটির উপদেষ্টা বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, বৃটিশ এম, পি, ও প্রাক্তন মন্ত্রী পিটার শাের, ইয়ং লিবারেল দলের সভাপতি পিটার হেইন, বিলাতে সফররত মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধি এম, এন, এ, আবদুল মান্নান, | শ্রমিক লীগের মােহাম্মদ শাহজাহান এবং বিভিন্ন সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ। সমাবেশ শেষে একটি বিরাট বিক্ষোভ মিছিল শহরের গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা প্রদক্ষিণ করে। এছাড়া লন্ডনের টেস্ট খেলার বিরােধিতা করে লর্ডস ক্রিকেট মাঠের সামনে গউস খানের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত কাউন্সিল ফর লিবারেশন অব বাংলাদেশ” এর উদ্যোগে এক | বিক্ষোভ মিছিলের আয়ােজন করা হয়। মিছিলে নেতৃত্ব দেন গউস খান, তৈয়বুর রহমান ও আতাউর রহমান খান প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। ২৬ জুন, ১৯৭১ তারিখে মানচেষ্টারে অনুষ্ঠিত লাংকাশায়ারের বিরুদ্ধে পাকিস্তান ক্রিকেট দলের অপর এক খেলার দিনে ম্যানচেষ্টার সংগ্রাম পরিষদ অনুরূপ বিক্ষোভ মিছিলের আয়ােজন করে। বাঙালীরা ম্যানচেষ্টার শহর কেন্দ্র থেকে মিছিল করে ওলড ট্রাফোর্ড ক্রিকেট মাঠে সমবেত হয় এবং ক্রিকেট দলের সফরের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। এমনিভাবে বিলাত সফরকালে পাকিস্তান টীম সর্বত্র বাধার সম্মুখীন হয় এবং বাঙালীরা পাকিস্তানের রক্তমাখা চেহারা তুলে ধরতে সমর্থন হন।