You dont have javascript enabled! Please enable it! Draft - সংগ্রামের নোটবুক

This is a temporary post for collecting data. Not for posting and not for publishing. Saved only as readable for the editors. Not clickable and not downloadable.

যুদ্ধাপরাধ দেশে দেশে
ঊর্মি রহমান

যুদ্ধাপরাধ-শুরুর কথা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে পর্যন্ত যুদ্ধাপরাধের সঠিক সংজ্ঞা নির্ধারিত হয়নি। কাজটা সেরকম সহজ ছিল না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তিনটি শ্রেণী নির্ধারণ করা হয়, যা সর্বজনগ্রাহ্য হয়। এক, শাস্তির বিরুদ্ধে অপরাধ- কোন আগ্রাসী যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়া এবং যুদ্ধ শুরু করা; দুই. যুদ্ধাপরাধ, যাকে সনাতনী যুদ্ধাপরাধ নামে অভিহিত করা হয়। এর মধ্যে পড়ছে হত্যা, অন্যায় আচরণ এবং দখলীকৃত ভূমি থেকে বেসামরিক নাগরিকদের উৎখাত করা বা দেশত্যাগে বাধ্য করা; এবং তিন, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ যুদ্ধের আগে বা যুদ্ধ চলাকালে যে কোন বেসামরিক নাগরিকের বিরুদ্ধে। রাজনৈতিক, বর্ণবাদী কিংবা ধর্মীয় নির্যাতন। মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’- এই বাকভঙ্গিটি এই অর্থ বহন করে যে, ব্যাপক আকারে নৃশংস কিছু ঘটেছে। এই বাকভঙ্গিটির জন্ম ১৯০৭ সালে ‘হেগ কনভেনশনের সময়। ১৯৪৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্য মিত্রশক্তিগুলাে প্রধান যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তির জন্য চুক্তি করে। নূরেমবার্গে বসে, যাতে বলা হয়: মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ: যুদ্ধের সময় বা পরে, বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে হত্যা, নিশ্চিহ্ন করা, দাসত্ব, ডিপাের্টেশন বা ফেরত পাঠানাে এবং অন্য অমানবিক আচরণঃ অথবা রাজনৈতিক, জাতি বা বর্ণ, ধর্মীয় কারণে নির্যাতন, মৃত্যুদণ্ড বা অন্য কোন অপরাধ, সেটা কোন দেশের অভ্যন্তরীণ আইনে লক্ষ্মন হােক বা না হােক, ট্রাইবুনালের আওতায় সেটা অপরাধ বলে গণ্য করা হবে। নূরেমবার্গ চার্টার (Nuremberg Charter)-এ প্রথম মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধকে আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় আনা হয়। কিছুটা হলেও ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’ গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধকে অংশত আবৃত করেছে। কিন্তু মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধকে এই অর্থে গণহত্যা থেকে আলাদা করা যায় যে, সেটা ১৯৪৮ সালের ‘জেনােসাইড কনভেনশনে বর্ণিত “সম্পূর্ণ বা আংশিক ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে কিছু নয়, বরং সেটা নির্দিষ্ট গােষ্ঠীকে লক্ষ্য করে সংঘটিত হতে পারে এবং কোন নীতির ব্যাপক ও সুসংবদ্ধ লঘন হতে পারে। তাছাড়া মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ

যুদ্ধাপরাধ থেকে এজন্য পৃথক যে সেটা শুধু যুদ্ধের সময় সংঘটিত কোন কিছু নয়, শান্তিকালীন সময়ও ঘটে থাকতে পারে। যুগ যুগ ধরে সনাতনী যুদ্ধাপরাধের জন্য, যুদ্ধ সংক্রান্ত আইন ও নিয়ম ভঙ্গের জন্য ব্যক্তিবর্গের বিচার ও দণ্ড হয়েছে। তারও আগে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর একটি প্রাথমিক শান্তি সম্মেলনে একটি কমিশন গঠন করা হয়, যার দায়িত্ব ছিল “যুদ্ধের ব্যাপারে দায়ীদের তদন্ত করা। জার্মানির কাইজার দ্বিতীয় উইলিয়ামের বিচার করা সম্ভব হয়নি, কারণ নেদারল্যাণ্ডস্ তাঁকে ডিপাের্ট করতে বা ফেরত পাঠাতে অসম্মতি জানায়। ১৮৬৩ সালে মার্কিন রাষ্ট্রপতি আব্রাহাম লিংকন ‘যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর সরকারের জন্য একটি নির্দেশনামা জারি করেন যাতে দখলদার সেনাবাহিনীর সদস্য এবং ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে আগে করা কোন অপরাধের জন্য জবাবদিহি করতে হবে বলে বলা হয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ভার্সাই চুক্তির সাথে সম্পৃক্ত মিত্রশক্তি, ১৯১৯ সালে একটি কমিশন গঠন করে যার দায়িত্ব ছিল যুদ্ধাপরাধ তদন্ত করা। আর এই কমিশন প্রয়ােগযােগ্য আইন হিসেবে ১৯০৭ সালের হেগ কনভেনশনের ওপর নির্ভর করে। কমিশন দেখতে পায়, জার্মানরা ছাড়াও “মানবিক আইনের বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটিত করেছে তুর্কিরা। তারা যুদ্ধের সময় আর্মেনিয়ানদের হত্যা করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এবং জাপান এ ধরনের আচরণকে অপরাধের আওতায় আনার বিরােধিতা করে। তাদের যুক্তি ছিল মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ নির্দিষ্ট সংস্কৃতির নয়, নৈতিকতার লক্ষ্মন। গােটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জুড়েই নাৎসীদের শাস্তি দেবার ব্যাপারে মিত্রবাহিনী। বদ্ধপরিকর থেকেছে। ভিন্ন ভিন্ন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে এ ব্যাপারে। ১৯৪৩ সালে মস্কো ঘােষণায় স্বাক্ষর করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, গ্রেট ব্রিটেন ও সােভিয়েত ইউনিয়ন।
১৯৪৫ সালে ‘পটসড্যাম’ ঘােষণায় স্বাক্ষর করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, গ্রেট ব্রিটেন ও চীন, পরে সােভিয়েত ইউনিয়নও তাতে সমর্থন জানায়। যুদ্ধশেষে ১৯৪৫ সালেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, গ্রেট ব্রিটেন ও সােভিয়েত ইউনিয়ন এবং ফ্রান্সের অস্থায়ী সরকার লন্ডন ঘােষণায় স্বাক্ষর করে। যুদ্ধশেষে মিত্রবাহিনীর হাতে বন্দী হারমান গােয়েরিং (Hermann Goering)-এর হাতে যখন তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযােগ সম্বলিত বিবৃতি তুলে দেওয়া হয়, তখন তিনি তার মার্জিনে লিখেছিলেন,”বিজয়ীরা সবসময়ই বিচারক হবে এবং অভিযুক্তকে পরাভূত করবে।” কাজটা বিচারকদের জন্যও সহজ ছিল না। মাসের পর মাস বিজয়ী শক্তিগুলাে, কার বিচার করা হবে এবং কী। অভিযােগে, সেসব নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করেছে। যুদ্ধ চলাকালেই এ ভাবনা তাঁদের মনে এসেছিল যে যদি মিত্রশক্তি জয়ী হয়, তাহলে অ্যাডল্ফ হিটলার ও অন্য জার্মান নেতৃত্বকে নিয়ে কী করা হবে। ব্রিটিশ নেতা উইনস্টন চার্চিল চেয়েছিলেন, কোন বিচার করেই যুদ্ধাপরাধীদের গুলি করে হত্যা করতে । সিনিয়র সেনা অফিসারদের বলা হয়েছিল বন্দীদের পরিচিতি নিশ্চিত করে ছয় ঘন্টার মধ্যেই তাদের ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলি করে হত্যা করার। একটি দীর্ঘ তালিকা তৈরি করা হয়, কিন্তু তাতে তাদের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট অভিযােগ চিহ্নিত ছিল না। ১৯৪২ সালে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রী অ্যান্টনি ইডেন বলেন, এসব ব্যক্তির অপরাধ এত বেশি যে তারা কোন জুডিশিয়াল ব্যবস্থার মধ্যে পড়ে না। এই প্রস্তাবে অবশ্য মার্কিন বা সােভিয়েত নেতারা সন্তুষ্ট ছিলেন না। তারা কোন আনুষ্ঠানিক আইনী প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে চেয়েছিলেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট-এর মৃত্যুর পর ১৯৪৫ সালে হ্যারি ট্রুম্যান যখন প্রেসিডেন্ট হন, তিনি এ ব্যাপারে জোর দেন যে, শত্রুপক্ষের নেতাদের পশ্চিমী অনুশীলন অনুযায়ী বিচার করা হবে, যাতে স্পষ্ট ও নির্দিষ্ট অভিযােগ থাকতে হবে এবং তাদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযােগ থাকতে হবে। এরপর যখন যখন ব্রিটিশ, আমেরিকান ও রুশ শক্তি মিলিত হয়, তখন জার্মানির পরাজয়ের পর তাদের বন্দী নেতা ও সৈনিকদের বিচার করার জন্য একটি সামরিক ট্রাইবুনাল গঠিত হয়। এই বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘ ছয়মাস আলাপ-আলােচনা, তর্ক-বিতর্ক চলে। কারণ এরকম কোন নজির বিজয়ী শক্তিগুলাের কাছে ছিল না।তার আগে, শতাব্দীর গােড়ার দিকে যুদ্ধাপরাধের সংজ্ঞায় নির্দিষ্ট অপরাধের কথা ছিল, যেমন যুদ্ধবন্দীদের হত্যা বা জিম্মিদের গুলি করে মেরে ফেলা। সেটা করা হত তাৎক্ষণিকভাবে, সাধারণত জুনিয়র অফিসার ও সাধারণ সৈনিকদের। মিত্রশক্তি যে ট্রাইবুনালের কথা ভেবেছিলেন, তাতে আগ্রাসী যুদ্ধ শুরু করা, সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন এবং ১৮৪৫ সালে আন্তর্জাতিকভাবে যাকে মানবতার প্রতি অপরাধ বলে চিহ্নিত করে ও স্বীকৃতি দেয়, সেগুলাে অন্তর্ভুক্ত থেকেছে। শেষ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সামরিক ট্রাইবুনাল। গঠিত হল ৮ই আগস্ট। যেসব অপরাধ অন্তর্ভুক্ত থাকবে, সে ব্যাপারে সমঝােতা হল এবং বড় ধরনের যুদ্ধাপরাধ হিসেবে শাস্তির বিরুদ্ধে অপরাধ, আগ্রাসী যুদ্ধ শুরু করার ষড়যন্ত্র, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ গৃহীত হল । সেই সাথে জাতি-বর্ণের কারণে কোন জনগােষ্ঠীকে ইচ্ছাকৃত হত্যাও এতে অন্তর্ভুক্ত করা হল। দূরপ্রাচ্যের জন্য যে আন্তর্জাতিক সামরিক ট্রাইবুনাল গঠিত হয়, সেটা নাৎসীদের বিচারের মতই ছিল। তবে এটা নির্ধারণ করা হয় যে, অভিযুক্তের সরকারি অবস্থানকে গণনায় ধরা হবে। ১৯৪৬ সালের ৩রা মে টোকিওতে শুরু হওয়া এই বিচার ইংরেজি ও জাপানি ভাষায় অনুষ্ঠিত হয় এবং এতে প্রতিনিধিত্ব করে ১১টি দেশ আর এর বিচার প্রক্রিয়া চলে দুই বছর। এতে ২৫ জনের ফাসী হয়, ১৬ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ২ জনকে কিছুটা কম দণ্ড দেওয়া হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে ন্যুরেমবার্গ ট্রাইবুনালের পর একটি চুক্তিতে বলা হয়, সমস্ত আগ্রাসী যুদ্ধকে অবৈধ ঘােষণা করা হবে এবং এটি যিনি সূচনা করবেন সেটা হবে তার ব্যক্তিগত অপরাধ। জার্মানিসহ এতে প্রায় সব দেশই স্বাক্ষর করে। অনেক যুদ্ধাপরাধী নানা কারণে বিচারের মুখােমুখী হয় না। তার মধ্যে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব, কার্যকর প্রক্রিয়ার অভাব, জোরালাে প্রমাণের অভাব অথবা অন্য কোন ব্যবহারিক কারণ থাকতে পারে। কিছু কিছু যুদ্ধাপরাধের বিচার দৃষ্টান্ত হয়ে আছে । যেমন ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসীদের আন্তর্জাতিক বিচার যা ‘ন্যুরেমবার্গ মামলা’ নামে পরিচিত এবং ১৯৪৬ সালে জার্মান ও জাপানি নেতাদের বিচার যা ‘টোকিও মামলা’ নামে পরিচিত। যুদ্ধাপরাধীর বিচার সম্পর্কে ১৯০৭ সালে গঠিত হেগ কনভেনশন সমস্ত ‘সভ্য দেশ স্বীকৃতি দিয়েছে এবং যুদ্ধেও আইন ও নিয়ম বলে মেনে নিয়েছে। এতে যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের সংজ্ঞা দেওয়া হয়। তার পরে প্রথম যে আন্তর্জাতিক সংঘর্ষ হয়েছে, সেটা হল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। এতে শত্রু সৈনিকের ওপর বিষাক্ত গ্যাস নিক্ষেপ করা হয়। এটা করে জার্মানি এবং পরে অন্যরাও তা ব্যবহার করে এবং এভাবে যুদ্ধেও নিয়ম লঙ্ঘন করে। ১৯১৯-২০ সালে তুর্কিরা আর্মেনীয় নাগরিকদের হত্যার নির্দেশ দেয়। হয় তাদের সাথে সাথে গণহত্যার মাধ্যমে মেরে ফেলে; কিংবা তাদের সিরিয়াতে ফেরত পাঠিয়ে তারপর হত্যা করা হয়।এখানেও যুদ্ধের নিয়ম বা সভ্য জগতের কোন নীতি মেনে চলা হয়নি। প্রায় ১০ লক্ষ। আর্মেনীয় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। অটোমান সাম্রাজ্যের উত্তরসূরী তুরস্ক প্রজাতন্ত্র এই ঘটনার ব্যাপারে ‘গণহত্যা’ শব্দটি স্বীকার করে না। রাজনৈতিক পুনর্বিন্যাসের কারণে যা ঘটেছে, সেটাও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, যার ব্যাপারে হয়ত সে সময় লােকজন ততটা সচেতন ছিল না । এই পুনর্বিন্যাসের জন্য বহু জাতিগত গােষ্ঠীকে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধ এক জায়গা থেকে অন্যত্র সরিয়ে ফেলা হয়।

জাপান নানকিং শহরে হামলা চালায় এবং নানকিং-এর যুদ্ধ নামে পরিচিত সংঘর্ষের পর জাপানিরা কোনরকম প্রতিরােধ ছাড়াই ঐ শহরে প্রবেশ করে। সেটা ছিল ১৯৩৭ সালের ১৩ই ডিসেম্বর আর তারপর ১৯৩৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত ব্যাপক যুদ্ধাপরাধ তারা ঘটিয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে গণ ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নি সংযােগ এবং বেসরকারি নাগরিক ও যুদ্ধবন্দীদের নির্বিচার হত্যাকাণ্ড। এই হত্যার সংখ্যাকে ১৫০,০০০ থেকে ৩০০,০০০ বলে মনে করা হতাে। ইদানীংকালে মার্কিন সরকারি দলিলে নানকিং-এর পতন হবার আগে পর্যন্ত, শহরের বাইরে আরাে ৫০০,০০০ মৃত্যুও কথা জানা গেছে। সাম্প্রতিক সময়ের ইতিহাসে জার্মানি আর জাপানকেই সবচেয়ে বড় যুদ্ধাপরাধী দেশ’ বলে বিবেচনা করা হয়। নাৎসীদের জাতি-বিদ্বেষ তার মধ্যে অন্যতম। ইহুদীসহ অন্য জাতিগত গােষ্ঠীকে নির্মূল করার প্রচেষ্টা, জার্মানির সােভিয়েত ইউনিয়ন হামলা, ইউরােপের অধিকাংশ দখল এবং অন্যদিকে জাপানের মাঞ্চুরিয়া ও ফিলিপাইন দখল, চীনের ওপর হামলা- এসবই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মােট বেসামরিক নাগরিকদের মৃত্যুর অর্ধাংশের মূলে রয়েছে। এই দু’টি জাতিই নিষ্ঠুর এবং তাদের হাতে বন্দীদের প্রতি নির্মম, বর্বর আচরণ করার জন্য কুখ্যাত। মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধে নাৎসীরা প্রায় দুই লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছিল, যারা সরাসরি যুদ্ধের সাথে জড়িত ছিল না। তাদের হাতে নিহত ইহুদীদের সঠিক সংখ্যা হয়ত কখনােই জানা যাবে না, কিন্তু এই সংখ্যা ৫০ থেকে ৬০ লক্ষ বলে অনুমান করা হয়। গােটা ইউরােপ এই নির্মমতার শিকার হলেও সবচেয়ে বেশি ঘটেছে রাশিয়া এবং পােল্যান্ডে। যুদ্ধাপরাধের কারণে ২৪ জন নাৎসী নেতার বিচার হয় বার্লিনের প্রথম অধিবেশনে, ১৯৪৫ সালের ১৮ অক্টোবর।
এর পরের বিচারকার্যটি অনুষ্ঠিত হয় জার্মানির ন্যরেমবার্গে। নুরেমবার্গ মামলা নামে বিখ্যাত এই বিচারকার্যটি চারটি ভাষায়। পরিচালিত হয় এবং ১০ মাস সময় ধরে চলে। এতে বিবাদীদের মধ্যে একজন আত্মহত্যা করে, একজন শারীরিকভাবে বিচারে অংশ নেবার জন্য অনুপযােগী বলে বিবেচিত হয়। বাকি ২২ জনের মধ্যে ৩ জনকে অব্যহতি দেওয়া হয়, ১২ জনের ফাঁসি হয়, ৩ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয় এবং চারজনকে ১০ থেকে ২০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। সে সময় মিত্রবাহিনীকে নানা রকমের সিদ্ধান্ত নিতে হয়, যা খুব সহজ ছিল না। স্টালিন সম্পর্কে পশ্চিমা নেতাদের সন্দেহ ছিল। কিন্তু মিত্রশক্তির অংশীদার হিসেবে তারা নিশ্ৰুপ থাকেন।
সে সময় লন্ডন, ওয়ারস এবং রটারডামের বােমাবর্ষণকে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে না ধরার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কারণ তারা নিজেরাও এ ধরনের ধ্বংসাত্মক বােমা বর্ষণের জন্য দায়ী ছিল। ইতালীয় ফ্যাসিস্ট নেতাদের বিচার না করার ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তাদের বিচার পরে ইতালীয় আদালতে করা হয়। আবার দেখা গেছে নাৎসী বাহিনীর বড় বড় নেতাদের ছেড়ে দিয়ে। ছােট-খাটোদের ওপর মনােনিবেশ করা হয়, যারা হয়ত হিটলারের সাথে ছিল, কিন্তু যুদ্ধ সম্পর্কিত পররাষ্ট্রনীতিতে তাদের কোন ভূমিকা ছিল না। অন্যদিকে অ্যাডল্ফ হিটলার, হাইনরিখ হিমলার ও জোসেফ গােয়েবল আত্মহত্যা করে বিচার এড়িয়ে যেতে সক্ষম হয়। তখন একমাত্র গােয়েরিং ছাড়া আর কারাে বিচার করা সম্ভব হয়নি।
তবে যুদ্ধাপরাধ সম্পর্কে মােটামুটি একটা ধারণা সে সময় হয় আর তারই ভিত্তিতে পরবর্তীকালে অসংখ্য যুদ্ধের সময় যারা মানবতার বিরুদ্ধে অন্যায় আচরণ করেছে, তাদের বিচার করা সম্ভব হয়। কোন যুদ্ধ-বিবাদ এড়ানাে সম্ভব হয়নি। মানুষের প্রতি মানুষের অন্যায়-অবিচার বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। যুদ্ধের ধরন পাল্টেছে। শুধু দেশে দেশে নয়, আগ্রাসনের জন্য নয়, আদর্শিক কারণেও মানুষ যুদ্ধ-বিগ্রহে জড়িয়ে পড়েছে। তবু যুদ্ধাপরাধ সম্পর্কে একটা পরিষ্কার ধারণা করা গেছে আর যুদ্ধাপরাধীর বিচার করা গেছে। আর সেটা সর্বত্র করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা ও দণ্ড দেবার প্রচণ্ড দাবি নির্যাতিত জনগােষ্ঠী বা তাদের উত্তরসূরিরা জিইয়ে রেখেছে। আর আশা করেছে, একদিন যুদ্ধাপরাধীর বিচার হবেই।
১৯
আফগানিস্তান
আফগানিস্তানকে একটি হতভাগ্য দেশ বললে অত্যুক্তি করা হবে না। আফগানিস্তান বিভিন্ন বিদেশী শক্তির মধ্যে দড়ি টানাটানির শিকার হয়েছে, যার অবসান এখনাে ঘটেনি। প্রথমে যখন আফগানিস্তানের মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী সরকারকে মুজাহেদিনদের বিরুদ্ধে সহায়তা করার নামে সােভিয়েত ইউনিয়ন সেখানে গিয়ে দখল নেয়, তখন আবার মুজাহেদিনদের সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসে অনেক দেশ। এ ব্যাপারে সৌদী আরব, পাকিস্তান, মিশরের মত আরাে কিছু ইসলামী দেশের পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের নাম করা যায়। ১৯৭৯ সালের ডিসেম্বর মাসে অল্প কিছু সােভিয়েত সেনাদলের সেখানে যাওয়া থেকে যে দখলদারীর শুরু, তার অবসান ঘটে ১৯৮৯ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে। সােভিয়েত নেতা লিওনিদ ব্রেজনেভ শুরু করেন আর শেষ করেন মিখাইল গরবাচফ। এরপর ১৯৯২ সালে কাবুলে দখল নেয় পশ্চিমের সাহায্যপুষ্ট মুজাহেদিনরা। এরপর শুরু হয় ইসলামী মৌলবাদী দলগুলাের মধ্যে গােষ্ঠী দ্বন্দ্ব। ১৯৯৬ সালে ধর্মান্ধ তালেবান দেশের ৯০% অংশ দখল করে। আল-কায়েদার ঘাঁটি হয় আফগানিস্তান। সেখানকার সাধারণ মানুষ প্রায় সমস্ত অধিকার হারায়। আল-কায়েদা নিউ ইয়র্কের টুইন টাওয়ার ও পেন্টাগনে হামলা চালায়, নিহত হয় হাজার তিনেক সাধারণ নিরীহ মানুষ। ২০০১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে হামলা চালায়। প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ বলেন, “ওরা সন্ত্রাসীদের (আমাদের) হাতে তুলে দেবে অথবা তাদের ভাগ্যও একই হবে।” তিনি আরাে বলেন, “সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই আল-কায়েদাকে দিয়ে শুরু হলেও তাতেই সেটা শেষ হবে না।” উল্লেখ্য, ১১ই সেপ্টেম্বর যে ১৯ জন আত্মঘাতী সন্ত্রাসী বিমান। হাইজ্যাক করে নিউ ইয়র্কে হামলা চালিয়েছিল, তাদের মধ্যে একজনও আফগান ছিল। ১৫ জন ছিল সৌদী, দু’জন যুক্ত আরব আমীরতন্ত্রের, একজন মিশরের এবং একজন লেবাননের। এদের কেউ-ই আফগানিস্তানে থাকতাে না। তারা পাশ্চাত্যের শহরগুলােতেই বসবাস করতাে আর সেখানেই তারা প্রশিক্ষণ পেয়েছিল। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ মার্কিন নেতৃত্বাধীন আফগান হামলা অনুমােদন করেনি। তবে আবার এরকম বিতর্কও রয়েছে যে সে অধিকার নিরাপত্তা পরিষদের আছে কিনা। কারণ এসব হামলা ৫১ নং ধারায় বর্ণিত আত্মরক্ষার্থে মিলিত উদ্যোগ, নাকি শুধুমাত্রই আগ্রাসী হামলা- এই প্রশ্নগুলাে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। বুশ সরকারের তরফে এটা ‘যুদ্ধ ছিল না, যুদ্ধের ঘোষণাও দেওয়া হয়নি। কারণ তাদের কাছে তালেবানরা সন্ত্রাসী, সৈনিক নয়। ফলে তারা জেনিভা কনভেনশনের প্রতিরক্ষা পাবার

যােগ্য নয়। তবে এ হামলা শুধু তালেবানদের ঘাঁটিতে সীমাবদ্ধ থাকেনি, ছড়িয়ে পড়েছে আফগানিস্তানের সর্বত্র। যদিও একই সাথে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে ক্ষুধার্ত ও কষ্টভােগ করছে আফগানিস্তানের যেসব পুরুষ, নারী ও শিশু তাদের মধ্যে খাদ্য, ওষুধ ও অন্য সরবরাহ আকাশপথে ফেলে দেওয়া হবে। নভেম্বর মাস নাগাদ কাবুল থেকে তালেবানরা হটে যেতে বাধ্য হয় এবং কাবুল নেটো বাহিনী ও তাদের সমর্থনপুষ্ট উত্তরাঞ্চলীয় জোটের দখলে আসে। তার পরের মাসে তালেবানরা তাদের শক্ত ঘাঁটি কান্দাহার থেকেও সরে যেতে বাধ্য হয়। প্রধান তালেবান নেতারা পাকিস্তানে আশ্রয় নিয়েছে বলে মনে করা হয়। এই সময়ের রাজনৈতিক সংকট মােকাবেলার উদ্দেশ্যে জাতিসংঘ জার্মানির বন শহরে এক সম্মেলন ডাকে যাতে তালেবান ছাড়া অন্য সংশ্লিষ্ট গােষ্ঠী ও সরকার উপস্থিত ছিল। এই সম্মেলনে আফগান অন্তর্বর্তীকালীন কর্তৃপক্ষ গঠিত হয়, যারা আফগানিস্তান শাসন করবে। ২০০১ সালের নভেম্বর মাসে জাতিসংঘ। নিরাপত্তা পরিষদে আফগানিস্তানকে সন্ত্রাসবাদ ছড়িয়ে দেবার ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করার জন্য এবং ওসামা বিন লাদেন, আল-কায়েদা ও তাদের অন্য সহযােগীদের আশ্রয় দেবার জন্য তালেবানদের নিন্দা করে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়।

এদিকে ফাঁস হয়ে যাওয়া মার্কিন রিপাের্টে যুদ্ধের শিকার যারা, তাদের কথা বলা হয়, যাদের কথা পশ্চিমের গণমাধ্যমে আসেনি আর যাদের কথা ভুলে যাওয়া হয়েছে। এতে ১৪০টি বিস্মৃত ঘটনার কথা বলা হয়েছে যাতে শিশুসহ আফগান বেসামরিক নাগরিক বিমান হামলা, বিশেষ বাহিনীর তৎপরতায় এবং কোয়ালিশন বাহিনী আত্মঘাতী বােমারু মনে করে গুলি বর্ষণ করায় নিহত হয়েছে। বেসামরিক সাধারণ নাগরিকদের এ ধরনের হামলার শিকার হওয়া শুধু সেই সময় নয়, কিছুদিন আগে পর্যন্ত ঘটেছে। ২০১০ সালের জুলাই মাসের এক রিপাের্টে বলা হয়, আফগানিস্তানে তিন শ’য়ের বেশি ব্রিটিশ সৈন্য নিহত হয়েছে। এদের অনেকে সবে কৈশাের ছাড়িয়েছিল এবং কেউ কেউ যুদ্ধে গিয়েছিল কোন দেশপ্রেম, কর্তব্য বা আদর্শের কারণে নয়, বেকার জীবন থেকে মুক্তি পাবার জন্য। তার চেয়ে বড় কথা হল, আফগানিস্তানে এখন যুদ্ধ চলছে না এবং সেখানে তথাকথিত ‘গণতান্ত্রিক সরকার’ ক্ষমতায় আছে। কিন্তু একথা সত্য যে, ২০০১ সাল থেকে এ পর্যন্ত হাজার হাজার আফগান নিরপরাধ মানুষ ধর্মান্ধ গােষ্ঠীগুলাের বিদ্রোহ এবং বিদেশী হামলার শিকার হয়ে প্রাণ দিয়েছে। এছাড়াও আছে নিজ ভূমি থেকে উৎখাত হয়ে ক্যাম্পে থাকা, ক্ষুধা, রােগ, ঠাণ্ডা আবহাওয়া অথবা তীব্র তাপমাত্রা, চিকিৎসার অভাব, আইন-শৃঙ্খলার অভাব ইত্যাদি নানা কারণে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। এ সবকিছুর মূলে কিন্তু রয়েছে যুদ্ধ। ২০০৭ সালের মে মাসে আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই এ ব্যাপারে সামরিক কমান্ডারদের সতর্ক করে দেন। বেসামরিক নাগরিকদের এই মৃত্যুর সঠিক উপাত্ত পাওয়া সহজ নয়। তবে কিছু নিরপেক্ষ সংগঠন যে তথ্য সংগ্রহ করেছে সেগুলাে এখানে লিপিবদ্ধ করা হল: ডিফেন্স অলটারনেটিভ সম্পর্কিত প্রকল্পে এরকম আনুমানিক হিসেব দেওয়া হয়েছে যে, ২০০১ সালের ৭ই অক্টোবর থেকে ২০০২ সালের ১লা জানুয়ারি পর্যন্ত মার্কিন বিমান থেকে বােমা বর্ষণের ফলে সরাসরি নিহত হয়েছে ১,০০০-১,৩০০ বেসামরিক নাগরিক।
২০০২ সালে জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে ৩,২০০ আফগান মারা গেছে। খাদ্যাভাবে, নানা রকমে রােগ-ব্যাধিতে অথবা যুদ্ধক্ষেত্রে আহত হবার ফলে। লস এঞ্জেলেস টাইমস অনুসন্ধান করে জেনেছে, ২০০১ সালের অক্টোবর থেকে ২০০২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পাঁচ মাসে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং পাকিস্তানের সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী বােমা বর্ষণের ফলে ১,০৬৭ থেকে ১,২০১ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে। ২০০২ সালে ব্রিটেনের দি গার্ডিয়ান সংবাদপত্রের এক সমীক্ষায় জানা গেছে, ২০০১ সালে ২০ হাজারের মত আফগান নাগরিক প্রাথমিক মার্কিন বিমান হামলা ও ভূমি আক্রমণের পরােক্ষ কারণে নিহত হয়েছে। নিউ হ্যাম্পশায়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মার্ক ডব্লিউ হ্যারল্ড অনুমান করেছেন, ২০০১ সালের অক্টোবর থেকে ২০০৩ সালের জুন পর্যন্ত ২০ মাসে মার্কিন নেতৃত্বধীন বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছে ৩,১০০ থেকে ৩,৬০০ বেসামরিক আফগান নাগরিক। হিউম্যান রাইটস্ ওয়াচ-এর অনুমান, ২০০৬ সালে মার্কিন ও নেটো বাহিনীর হামলায় কমপক্ষে ২৩০ জন আফগান নাগরিক নিহত হয়েছে। বিমান হামলায় ১১৬ জন এবং ১১৪ জন মারা গেছে ভূমি থেকে ছোড়া গুলি বর্ষণে। এই সংগঠন জানিয়েছে, একই কালে বিভিন্ন আফগান বিদ্রোহী বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছে ৬৯৯ জন বেসামরিক নাগরিক। হিউম্যান রাইটস্ ওয়াচ-এর আর এক হিসেবে জানা গেছে, ২০০৬ সালে সশস্ত্র সংঘর্ষের কারণে ৯২৯ জন আফগান নাগরিক মারা গেছে। সামগ্রিকভাবে তাদের অনুমান আফগান বেসামরিক নাগরিক এবং চরমপন্থী মিলিয়ে নিহতের সংখ্যা ৪,৪০০, যা ২০০৫ সালের সংখ্যার দ্বিগুণ। আফগানিস্তানে জাতিসংঘের সহায়ক মিশনের অনুমান, ২০০৭ সালে সরকার বিরােধী গােষ্ঠীগুলাের হাতে ৭০০ আফগান নাগরিক নিহত হয়েছে, যা মােট সংখ্যার ৪৬%।
‘আফগান ইন্ডিপেন্ডেন্ট হিউম্যান রাইটস কমিশন হিসেব দিয়েছে, ২০০৮ সালে সশস্ত্র সংঘর্ষের ফলে ১,৮০০ জন আফগান নাগরিক নিহত হয়েছে। মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছে ৮০০ আর উগ্রবাদীদের হাতে নিহত হয়েছে এক হাজার। একই সময় আফগানিস্তানে জাতিসংঘের সহায়ক মিশনের হিসেব হচ্ছে, সশস্ত্র সংঘর্ষের কারণে নিহত হয়েছে ২,১১৮ নাগরিক এবং তারা এটিকে ২০০১ সালের পর সর্বোচ্চ সংখ্যা বলে জানিয়েছে। আন্তর্জাতিক বাহিনীর নেতৃত্বাধীন বাহিনীর হাতে মারা গেছে ৮২৮ জন। আর সরকার বিরােধী শক্তির হাতে মারা গেছে ১,১৬০ জন নাগরিক। আফগানিস্তানে জাতিসংঘের সহায়ক মিশনের হিসেব অনুযায়ী আরাে জানা গেছে, মার্কিন নেতৃত্বাধীন যুদ্ধে ২০১০ সালের প্রথমার্ধে ১,২৭১ জন নাগরিক নিহত হয়েছে। একই সময়ে আন্তর্জাতিক বাহিনীর নেতৃত্বাধীন বাহিনীর হাতে মারা গেছে ২২৩ জন। আর সরকার বিরােধী শক্তির হাতে মারা গেছে ৯২০ জন নাগরিক। এসবই হচ্ছে অল্প কিছু উপাত্ত, যা বিভিন্ন সংগঠন সংগ্রহ করেছে। এসবগুলাে মিলিয়ে মােটামুটি যে সামগ্রিক হিসেব পাওয়া যাচ্ছে, তা হলে মার্কিন নেতৃত্বাধীন যুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে মৃত্যুর সংখ্যা ১৪,৪৪৩-৩৪,২৪০ জন। একই সময়ে আন্তর্জাতিক বাহিনীর নেতৃত্বাধীন বাহিনীর হাতে প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে মারা গেছে ৮,৯৯১-২৮,৫৮৩। আর সরকার বিরােধী শক্তির হাতে মারা গেছে ৪,৯৪৯-৬,৪৯৯ জন নাগরিক। অ্যাসােসিয়েটেড প্রেসের হিসেব অনুযায়ী ২০০৫ সালে ১,৭০০ মানুষ মারা গেছে। তাদের মধ্যে যেমন বেসামরিক নাগরিক আছে, তেমনি আছে উগ্রবাদী ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য। ২০০৪ সালের ডিসেম্বর ও ২০০৫ সালের মে মাসে আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে হামিদ কারজাই’র নির্বাচনের সময় ৬০০ পুলিশ নিহত হয়। এ পর্যন্ত যত সমীক্ষা হয়েছে, তার মধ্যে নিউ হ্যাম্পশায়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মার্ক ডব্লিউ, হ্যারল্ড-এর আফগান বেসামরিক নাগরিকদের হতাহতের হিসেবকে সবচেয়ে ব্যাপক বলা চলে। তিনি ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এই পরিসংখ্যান দেন, মার্কিনি ও নেটো (NATO) সামরিক শক্তির যুদ্ধে ৫,৭০০ থেকে ৬,৫০০ নাগরিক নিহত হয়েছে। তবে সেই সাথে তিনি একথাও জোর দিয়ে বলেন যে, এটা একেবারে ন্যূনতম হিসাব এবং সম্ভবত কম করেই বলা হয়েছে, কারণ এই হিসেবের মধ্যে এগুলাে অন্তর্ভুক্ত নেই: | ২০০১-২০০২ সালের প্রাথমিক সামরিক তৎপরতার সময় স্থানচ্যুত আফগান, যারা শরণার্থী শিবির বা অন্য কোথাও আশ্রয় নিয়েছে এবং যাদের ভাগ্যে খাদ্য-ওষুধ ইত্যাদি খুব কম কিংবা কোন সরবরাহই জোটেনি। পার্বত্য এলাকায় মার্কিনি-নেটো বাহিনীর বােমা বর্ষণে যেসব বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে, যাদের সম্পর্কে কোন খবর বাইরে এসে পৌছায়নি। সেসব নাগরিক যারা সাথে সাথে মারা যায়নি, কিন্তু গুরুতরভাবে আহত হয়েছে। এবং পরে মারা গেছে।

কাবুলে অবস্থিত একটি সংগঠন, আফগানিস্তান রাইটস্ মনিটর’ হিসেব করেছে যে, ২০০৮ সালে ৩,৯১৭ জন বেসামরিক নাগরিক মারা গেছে, আহত হয়েছে ৬,৮০০ আর এক লক্ষ ২০ হাজারকে নিজেদের বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। তাদের হিসাব, উগ্রবাদীরা ২,৩০০ মানুষকে হত্যা করেছে, যার মধ্যে ৯৩০ জন আত্মঘাতী বােমা হামলায় মারা গেছে। মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনী হত্যা করেছে। ১,৬২০ জন নাগরিককে, তার মধ্যে ১,১০০ জন মারা গেছে মার্কিন নেতৃত্বাধীন নেটো বাহিনীর হাতে আর ৫২০ জন আফগান সামরিক বাহিনীর হাতে। অস্ট্রেলিয়ায় আফগানিস্তানের রাষ্ট্রদূত আমারুল্লাহ জায়হুন-এর মতে, ২০০৮ সালে এক হাজার আফগান নাগরিক মারা গেছে। গারদেজ-এর কাছে খাতাবা গ্রামের একটি বাড়িতে মার্কিন ও আফগান বিশেষ বাহিনী জোর করে ঢুকে দু’জন গর্ভবতী নারী, এক কিশােরী, একজন পুলিশ অফিসার ও তার ভাইসহ ১২ জনকে হত্যা করে। নেটো প্রথমে বলেছিল যে, তাদের বাহিনী। সেখানে যাবার কয়েক ঘণ্টা আগেই ঐ দু’জন নারীর মৃত্যু হয়েছিল। পরে তারা এ দায়িত্ব স্বীকার করে নেয়। টাইমস সাময়িকীকে আফগান তদন্তকারীরা জানিয়েছে যে, মার্কিন বাহিনী নিহত নারীদের শরীর থেকে বুলেট বের করে নিয়ে অ্যালকোহল দিয়ে তাদের ক্ষত পরিষ্কার করে তাদের ঊর্ধ্বতন অফিসারদের কাছে মিথ্যা কথা বলে। এদিকে নেটোর আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা সহায়ক বাহিনীর মতে এ একই সময় মাত্র দু’শ’য়ের কিছু বেশি বেসামরিক আফগান নাগরিক মারা গেছে আর সেটাও বিদেশী বাহিনী বলে ভুল করে! নেটো মুখপাত্র জেমস অ্যাপাথুরাই (James) বলেছেন, ২০০৮ সালে ৯৭ জন নাগরিক আন্তর্জাতিক নিরাপত্র সহায়ক বাহিনীর হাতে মারা গেছে আর ৯৮৭ জন মারা গেছে উগ্রবাদীদের হাতে।
তার বাইরে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনীর হাতে নিহতদের কথা তিনি উল্লেখ করেননি। আফগানিস্তানে জাতিসংঘের সহায়ক মিশন তাদের মধ্যবর্তী সময়ের রিপাের্টে জানিয়েছে, যারা সরাসরি যুদ্ধের সাথে জড়িত নয়, যদি সেরকম এক বা একাধিক নিহত ব্যক্তি সম্পকে লক্ষ্যযােগ্য সন্দেহ থেকেও থাকে, এ ধরনের মৃত্যু বেসামরিক নাগরিকদের হতাহতের হিসেবের বাইরে থেকে যাচ্ছে। সেজন্য, এরকম লক্ষ্যযােগ্য সম্ভাবনা রয়ে গেছে যে আফগানিস্তানে জাতিসংঘের সহায়ক মিশন বেসামরিক লােকজনের হতাহতের যে সামগ্রিক সংখ্যা জানাচ্ছে, তা কমিয়ে বলা হয়েছে। আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই বার বার তার দেশে বিদেশী সামরিক বাহিনীর কাছে বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা করা থেকে বিরত থাকার আবেদন জানিয়েছেন। ২০০২ সালের জুলাই মাসে এক বিয়ের অনুষ্ঠানে বােমাবর্ষণ করে। মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনী ৪৪ জনকে মেরে ফেলে, যাদের মধ্যে অনেক নারী ও শিশু ছিল। হামিদ কারজাই তখন তাদের আরাে সতর্কতার সাথে কাজ করার অনুরােধ জানান। তিনি বলেন, “আমরা এতে অসন্তুষ্ট। আমরা আর কোন আফগান নাগরিকের হতাহতের ঘটনা ঘটতে দেখতে চাই না। এরকম ঘটনা আর যেন না ঘটে। আমি এখন থেকে বলছি যে, এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে সবকিছুর ব্যাপারে আমেরিকান ও আফগানিস্তানের কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সমম্বয় থাকতে হবে। আমি একথা আমেরিকাকে জানিয়ে দিয়েছি।” মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনী তখন জানিয়েছিল, তারা খবর পেয়েছিল, সেখানে উগ্রবাদীরা লুকিয়ে ছিল। এই ঘটনায় বিশ্বব্যাপী নিন্দা-মন্দের ঢেউ উঠলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ সমবেদনা জানান। কিন্তু আফগান উর্ধতন কর্মকর্তারা এ ব্যাপারে তীব্র ক্ষোভ ব্যক্ত করেন যে জর্জ বুশ প্রেসিডেন্ট কারজাইকে টেলিফোন করে সমবেদনা জানাবার জন্য পাঁচদিন সময় নেন এবং মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ডােনাল্ড র্যামসফেল্ড কোন অনুতাপ দেখাননি বা এই ভুলের জন্য ক্ষমা চাননি। হামিদ কারজাই গুয়ান্তামাে বে’তে সন্ত্রাসী সন্দেহে আটক আফগান নাগরিকদের ফিরিয়ে দেবারও দাবি জানান। পরবর্তী সময়ে তিনি তাঁর দেশে সামরিক তৎপরতার ওপর আরাে বেশি নিয়ন্ত্রণ চেয়েছিলেন যা তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশ প্রত্যাখ্যান করেন।

২০০৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই বলেন, আমার মনে হয় না আফগানিস্তানে আর সামরিক তৎপরতার প্রয়ােজন আছে। বিমান শক্তির ব্যবহার এমন কিছু যা এখন আর কার্যকর হবে না, কারণ আমরা সামনে এগিয়ে গিয়েছি। কোয়ালিশন বাহিনীর কারাে উচিত নয় আফগান সরকারের অনুমতি ছাড়া কোন আফগান বাড়িতে যাওয়া। ২০০৬ সালের ডিসেম্বর মাসে চোখে অশ্রু নিয়ে আফগান প্রেসিডেন্ট বােমা বর্ষণে। নিহত শিশুদের জন্য শােক প্রকাশ করেন। তিনি যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট সন্ত্রাসবাদের কথাও বলেন। তিনি বলেন, “এই নির্মমতা সহ্যের বাইরে”। তিনি স্বীকার করেন, আফগানিস্তান সরকার কোয়ালিশন বাহিনীর ‘শিশু হত্যা বন্ধ করাতে পারবে না। ২০০৭ সালে মে মাসে মার্কিন বাহিনীর তীব্র বােমা বর্ষণে নারী ও শিশুসহ ৪০ থেকে ৬০ জন আফগান নাগরিক নিহত ও ৫০ জনের মত আহত হলে আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই বিদেশী জেনারেল ও কূটনীতিকদের ডেকে পাঠিয়ে তাঁর দীর্ঘদিনের অভিযােগের কথা আবারও জানান। ঐ ঘটনায় ১০০টির মত আফগান বাড়ি ধ্বংস| গােটা আফগানিস্তান জুড়ে নিরীহ গ্রামবাসী বা সাধারণ নাগরিকদের হত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। তারা শুধু যে মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক বাহিনী অথবা বিদেশী শক্তির হাতে নিহতদের ব্যাপারে প্রতিবাদ জানিয়েছে, তা নয়, এ প্রতিবাদ ছিল উগ্রবাদীদের বিরুদ্ধেও, কারণ তাদের হাতেও প্রচুর নিরীহ সাধারণ। মানুষ মারা গেছে বা নির্যাতিত হয়েছে। কিন্তু তাতে কোন কিছুর কোন পরিবর্তন হয়নি। এই দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে এবং তথাকথিত গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে আফগান নাগরিকরা শুধু প্রাণই দেয়নি, তারা তাদের ঘরবাড়ি, জীবিকা, সম্পদ ইত্যাদি সমস্তই হারিয়েছে। পরবর্তী সময়ে কিছু মার্কিন সেনাকে আফগানিস্তানে যুদ্ধাপরাধের জন্য বিচারের সম্মুখীন হতে হয়েছে। ১২ জন সৈনিক বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা করে সেটা ধামাচাপা দেবার ব্যাপারে অপরাধী প্রমাণিত হয়। সিএনএন (CNN) টেলিভিশন চ্যানেলের এক খবরে প্রকাশ, ৫ম ব্রিগেড ও ২য় ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের ৫ জন সৈনিক হত্যা গােপন করা; আফগান বেসামরিক নাগরিকদের মারধাের করা, যাতে তারা তদন্তকারীদের সামনে মুখ না খােলে; মৃত আফগানদের দেহ ক্ষতবিক্ষত করা ইত্যাদি অপরাধে দণ্ডিত হয়েছে।
আরাে সাতজন দণ্ডিত হয় হত্যা ধামাচাপা দেওয়া ও মাদকের ব্যবহার সংক্রান্ত অপরাধে। যুক্তরাজ্যের গার্ডিয়ান সংবাদপত্রে এক নিবন্ধের শিরােনাম দেওয়া হয়, “মার্কিন সৈনিকরা ক্রীড়া হিসেবে আফগান বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা করে এবং পুরস্কার তাদের আঙুল সংগ্রহ করে। প্রথম পাঁচজন অপরাধীর একজন অ্যাডাম উইনফিল্ড-এর পিতা ক্রিস্টোফার উইনফিল্ড অ্যাসােসিয়েটেড প্রেসকে জানান যে, তিনি বার বার সেনাবাহিনীকে এসব ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছেন। প্রথম হত্যাকাণ্ডের পর তাঁর পুত্র তাকে ফেসবুকে লিখেছিল, “আমি জানি না কি করা উচিত কিন্তু আমাকে এটা গােপন রাখতে হবে।” পরে সে ইন্টারনেট চ্যাট-এ বিস্তারিতভাবে এ তথ্য জানায় যে তার ইউনিটের সদস্যরা কিছু নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করেছে। পরে তার আইনজীবী বলেন, উইনফিল্ডকে একজন নাগরিককে গুলি করতে বলা হয়, কিন্তু সে ইচ্ছা করে নিশানা ভুল করে। এই ঘটনা সম্পর্কে আর একটি সংবাদপত্র লেখে, ক্রিস্টোফার উইনফিল্ডের সতর্কবাণী সেনাবাহিনী অগ্রাহ্য করে। তিনি ব্যাকুলভাবে তাঁর সন্তানকে বাঁচাবার চেষ্টা করছিলেন। এসব নিয়ে পেন্টাগন উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে যে, এর ফলে বিশ্বময় তাদের সৈনিকদের ভাবমূর্তির ক্ষতি হবে। নিউ স্টেটসম্যান সাময়িকীর সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, যদি ধরে নেওয়া হয় এসব হত্যাকাণ্ডের অধিকাংশ ইচ্ছাকৃত নয়। বেসামরিক নাগরিকরা কোয়ালিশন বাহিনীর লক্ষ্য ছিল না। তালেবানরা অন্ততপক্ষে সাত হাজার বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করেছে। তারপরও কথা থেকে যায়। আফগানরা পশ্চিমা শক্তির এই হামলা ও দখলদারী আহ্বান করেনি। তারা যুদ্ধও চায়নি। সঠিক হােক বা হােক, তারা এরকম মনে করতে পারে যে পাশ্চাত্য এসব মৃত্যুর জন্য দায়ী।
একটি প্রাদেশিক শহরের একজন মার্কিনি অফিসারের এক ফাঁস হয়ে যাওয়া রিপাের্টে এরকম জানা গেছে যে, আফগান জনগণের সাধারণ অভিমত হচ্ছে, বর্তমান আফগান সরকার তালেবানদের চেয়েও খারাপ। হয়ত জনসাধারণের স্মৃতি সবসময়ই দুর্বল ও স্বল্পস্থায়ী বলে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালের কথা তারা ভুলে গেছে। কিন্তু অব্যাহত বিদেশী দখলদারী ও একটি দুর্নীতিপরায়ণ আফগান সরকারের প্রতি সশস্ত্র সমর্থন ধর্মান্ধ গােষ্ঠীগুলােকে শক্তিশালী করছে। তারা নিজেদের মুক্তিদাতা বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করছে, যা তারা সােভিয়েত দখলদারীর সময় করেছিল। কোয়ালিশন বাহিনী বিশেষ করে ব্রিটিশ সরকারের এই যুক্তিও ততটা জোরালাে প্রমাণিত হয়নি যে, আফগানিস্তানে কোয়ালিশন বাহিনীর উপস্থিতি যুক্তরাজ্যে সন্ত্রাস প্রতিরােধ করবে । ব্রিটেনে সংঘটিত চিলকট তদন্তে সাবেক এমআই৫ (MI5) প্রধান এলিজা ম্যানিংহ্যাম-বুলার (Eliza Manning Buller) বলেন, ইরাক ও আফগানিস্তানে আমাদের জড়িত হওয়া …তরুণসমাজের একটি গােটা প্রজন্মকে কট্টরবাদী করে তুলেছে, যাদের মধ্যে অনেকেই ব্রিটিশ নাগরিক। তারা এটাকে ইসলামের ওপর হামলা হিসেবে দেখেছে। তার ফলে এমআই৫’ র কাছে প্রচুর সন্ত্রাসবাদী হামলার খবর আসে, যার উৎপত্তি ব্রিটেনেই।
২৯
বাংলাদেশ
দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে যখন ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান সৃষ্টি হল, তখন সেটা বিদায়ী ব্রিটিশ শাসকদের রাজনৈতিক চাল এবং কিছু রাজনীতিকের স্বার্থসিদ্ধি বড় হয়ে দেখা দিলেও বাঙালি মুসলমানেরও তাতে সায় ছিল। তাদের অনেকেই খুশি হয়েছিল। ভেবেছিল তাদের নিজের আপন দেশ হলাে, এবার তারা আর পরের গােলামি করবে। ইংরেজদের যেমন নয়, তেমনি হিন্দু জমিদারদেরও নয়। কিন্তু অন্যদিকে আবার একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে পাক-ভারত উপমহাদেশের স্বাধীনতা অগুনতি সাধারণ মানুষের কাছে শুধুমাত্র দেশভাগের বেদনা ছাড়া আর কিছু বয়ে আনেনি। বাঙালি এবং সেই সাথে পাঞ্জাবীরা সবসময় ১৯৪৭ সালকে ‘স্বাধীনতার সময় না বলে ‘পাটিশন’ বলেই উল্লেখ করে। যে বাঙালি মুসলমান পাকিস্তান তথা পূর্ব পাকিস্তানকে নিজবাসভূমি বলে আনন্দে উদ্বেল হয়েছিল, তাদের সে স্বপ্নভঙ্গ হতে বেশি সময় লাগেনি। তারা টের পেলাে যে, তাদের জীবনে শুধু শাসকের পরিবর্তন ঘটেছে, তার বেশি কিছু নয়। তারা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তান ব্রিটিশদের বদলে পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশে পরিণত হয়েছে। পশ্চিমী আধিপত্যের প্রথম নগ্ন প্রকাশ ছিল বাংলা ভাষার ওপর আক্রমণ। সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির দেশে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার চক্রান্তকে নস্যাৎ করতে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঙালি। ভাষা আন্দোলন শুরু হয় গােটা পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে আর ১৯৫২ সালে রক্ত দিয়ে সেই চক্রান্ত রুখে দেয়। সেই থেকে শুরু দিন বদলের পালা’ যা পরিণতি পায় ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার মাধ্যমে রক্ত ও অশ্রুর মধ্যে দিয়ে জন্ম নেয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ ২৫শে মার্চ রাতে বাংলার ঘুমন্ত ভূখণ্ডের ওপর ঝাপিয়ে পড়েছিল পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী, হত্যা করেছিল অনেক নিরীহ নিস্পাপ বাঙালিকে। এই হত্যাযজ্ঞ চলে দীর্ঘ নয়মাস ধরে যেতে যেতে শেষ ছােবল দিয়ে গেছে তারা। ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসা। ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করার আগে বাঙালি কিছু বিশ্বাসঘাতক দালালের সাহায্যে বেছে বেছে বাংলার কৃতি সন্তানদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছে। তারপর সুদীর্ঘ সময় পার হয়ে গেছে, প্রায় চার দশক হতে চলেছে, আজও সেইসব যুদ্ধাপরাধীর বিচার হয়নি। আজ অনেক মানুষ চোখে অশ্রু আর আগুন নিয়ে বেঁচে আছে । যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও দণ্ড না হলে সে অশ্রু মুছবে না, সে আগুন নিভবে না

বাংলাদেশের ক্ষমতায় যারাই এসেছে, তাদের কেউ-ই যুদ্ধাপরাধীর বিচার করেনি। আওয়ামী লীগ সরকার এর আগেও ক্ষমতায় এসেছে এবং পূর্ণাঙ্গ মেয়াদে ক্ষমতায় থেকেছে, কিন্তু যুদ্ধাপরাধীর বিচার হয়নি। এবার প্রথম একটি সম্ভাবনা দেখা গিয়েছে। দেশ যুদ্ধাপরাধীর বিচার চায়। এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তার ম্যানিফেস্টোতে এই দাবি মেনে নেবার অঙ্গীকার করেছিল। ২০০৯ সালের ২৯শে জানুয়ারি বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ যুদ্ধাপরাধীর বিচারের ব্যাপারে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে। একই বছর ২৫শে মার্চ সরকার ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম (ট্রাইবুনাল) অ্যাক্ট ১৯৭৩’ অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধীর বিচারের সিদ্ধান্ত নেয়। তবে এই ট্রাইবুনালের আকার আকৃতি কী হবে, সেসব নিয়ে কিছু সমস্যা, কিছু প্রশ্ন দেখা দেয়। তাছাড়া ১৯৭৩-এ বেসামরিক অপরাধীদের বিচারের বিধান ছিল না। ১৯৭৩ সালের ৬ই মে বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশ কোলাবােরেটরস্ (স্পেশাল ট্রাইবুনালস) অর্ডার’ ১৯৭২-এর অধীনে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সাধারণ ক্ষমা ঘােষণা করে। ১৯৭৩ সালের ৩০শে নভেম্বর একই আইনের আওতায় অভিযুক্ত গুরুতর অপরাধীদের প্রতি দ্বিতীয় ক্ষমা ঘােষণা করা হয়। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এসব ক্ষমা ঘােষণা করেছিলেন। ১৯৭৫ সালের ৩১শে ডিসেম্বর বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর বাংলাদেশ কোলাবােরেটরস্ (স্পেশাল ট্রাইবুনাল) অর্ডার, ১৯৭২ বাতিল করা হয়। এই আইনের অধীনে যেসব মামলা ম্যাজিস্ট্রেট বা অন্য আদালতে ছিল কিংবা যে তদন্ত চলছিল, সমস্তই বাতিল হয়ে যায়। সাধারণ ক্ষমার সময় আটক ৩৭ হাজার যুদ্ধাপরাধীর মধ্যে ২৬ হাজারকে মুক্তি দেওয়া হয়। যে ১১,০০০ অভিযুক্ত তারপরও আটক ছিল, তাদের ১৯৭৫ সালে মুক্তি দেওয়া হয়। তবে সে সময় ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস্ (ট্রাইবুনালস্) অ্যাক্ট ১৯৭৩ বাতিল করা হয়নি। এই আইনে ছিল, “যে কোন ব্যক্তি, তার জাতীয়তা ভেদে, যে কোন সশস্ত্র, প্রতিরক্ষা বা সহায়ক বাহিনীর সদস্য হিসেবে, এই আইন প্রণয়নের সময় বা তার আগে বাংলাদেশের ভেতরে কোন অপরাধ করে থাকলে একটি ট্রাইবুনালের ক্ষমতা রয়েছে তাদের বিচার করার।” এখানে সহায়ক বাহিনীর সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, সশস্ত্র বাহিনীর অভিযান চালানাে, প্রশাসন, স্ট্যাটিক বা অন্য কারণে তাদের নিয়ন্ত্রণে যে শক্তি রয়েছে। এর মধ্যে বেসামরিক নাগরিকরা পড়ছে কিনা সেটা স্পষ্ট নয়। সেজন্য অনেকে মনে করেছে আইনে সংশােধন আনা দরকার।
১৯৭৩ সালের ৩রা ডিসেম্বর জাতীয় সংসদের সাধারণ অধিবেশনে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয় যাতে জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত দেশগুলাের দায়বদ্ধতা মেনে নিয়ে। যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য অপরাধীকে গ্রেফতার ও শাস্তির কথা বলা ছিল। অন্য দেশে যেমন জাতিসংঘ যুদ্ধাপরাধীর বিচারে এগিয়ে গেছে অথবা ট্রাইবুনাল গঠনে সাহায্য করেছে, এই সুদীর্ঘ সময়ে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সেটা করা হয়নি। কিন্তু জাতিসংঘের সাহায্য ছাড়াই সরকার চাইলে এবং বিচারের জন্য যথাযথ আইন থাকলে এ বিচার করা সম্ভব। ১৯৭৩ সালে সরকার পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সদস্যদের ১৯৫ জনের একটি তালিকা করে যারা গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অপরাধী। তাদের বিরুদ্ধে বিচারকাজ পরিচালনার জন্য আইনজীবীদের একটি প্যানেলও গঠন করা হয়। কিন্তু ১৯৭২ সালে জেনিভা। কনভেনশনের শর্ত অনুযায়ী পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীদের ভারত সরকারের হাতে তুলে দিতে হয়। এরপর ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান ত্রিপক্ষীয় একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে এবং ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীসহ সকল যুদ্ধবন্দীকে ভারত সরকার।
পাকিস্তান সরকারের কাছে ফিরিয়ে দেয়। সে সময় এরকম কথা শােনা গিয়েছিল যে, পাকিস্তান সরকার তাদের বিচার করবে। পাকিস্তান সরকার এ ব্যাপারে কিছু করেনি। এমনকি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে যে সামরিক অভিযান চালিয়ে তারা অনেক মানুষকে হত্যা করেছে, সে সম্পর্কে পাকিস্তানের সাধারণ নাগরিকদের সরকার তাে জানায়ইনি, সংবাদমাধ্যমগুলােও চুপ থেকেছে। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন সাধারণ ক্ষমা ঘােষণা করেন, তখন পাকিস্তানীদের দোসররা মুক্তি পায়, যদিও হত্যা বা ধর্ষণে দায়ে অভিযুক্তরা ছাড়া পায়নি। তদানীন্তন পাকিস্তানী প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলি ভুট্টো বিচারপতি হামুদুর রহমানের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিশন বসান। কিন্তু তার উদ্দেশ্য ছিল কোন্ পরিস্থিতিতে ইস্টার্ন কমান্ড আত্মসমর্পণ করেছে সেটা অনুসন্ধান করা। তবে পাকিস্তানে এক শ্রেণীর মানুষ এই বিষয় সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ রিপাের্ট দাবি করে এবং বাংলাদেশ সরকারের কাছে ক্ষমা চাইবার জন্য চাপ দেয়। ২০০০ সালের আগস্ট মাসে জয়েন্ট কমিটি ফর পিপলস্ রাইটস্’ নামে একটি সংগঠন একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে যাতে বলা হয়, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী সেনাবাহিনী যে বর্বর হামলা চালায়, তার জন্য পাকিস্তানকে বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। পাকিস্তান তাতে ভ্রুক্ষেপ না করলেও কিছু প্রগতিশীল মানুষ আজও এ দাবি অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে একাত্তরের ঘাতক দালালদের বিচারের দাবি জানিয়ে এসেছে বাংলাদেশের মানুষ বিভিন্ন সংগঠন, ব্যক্তিবর্গ, শহীদ মুক্তিযােদ্ধার পরিবার এই দাবিতে সােচ্চার হয়েছে। ১৯৯১ এবং ১৯৯৬ সালে গণতান্ত্রিক নির্বাচনে বেসামরিক সরকার গঠিত হলে এই দাবি আরাে জোরালাে হয়। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গঠিত হয় ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’। জাহানারা ইমাম শুধু মুক্তিযােদ্ধা আপন সন্তান রুমিকেই হারাননি, তিনি যুদ্ধকালে তাঁর স্বামীকেও হারিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি ক্যান্সার রােগে আক্রান্ত হন। কিন্তু সেটা তাকে তার লক্ষ্য, তাঁর। কাজ থেকে বিরত রাখতে পারেননি। তিনি যতদিন বেঁচে ছিলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মুখােমুখি আনার জন্য লড়ে গেছেন। গণআদালতে যুদ্ধাপরাধীর বিচারও করা। হয়। তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে গােটা দেশ এগিয়ে এসেছিল। ১৯৮৪ সালে গঠিত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশ কেন্দ্র, যার সভাপতি ছিলেন কর্নেল নূরুজ্জামান আর সাধারণ সম্পাদক শাহরিয়ার কবির। ইতােমধ্যে বাংলাদেশে স্বাধীনতা বিরােধীরা সংঘবদ্ধ হচ্ছিল এবং সমাজে নিজেদের আবার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার চেষ্টায় লিপ্ত ছিল। ১৯৯১ সালের ডিসেম্বর মাসে জামাতে ইসলামীর আমীর হিসেবে পাকিস্তানী নাগরিক এবং একাত্তরের ঘাতক গােলাম আযমের নাম ঘােষণা করা হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি বিশ্বাসী প্রগতিশীল মানুষ এতে ক্ষুব্ধ ও ক্রুদ্ধ হয়। তারা এই বিষয়টাকে চ্যালেঞ্জ না জানিয়ে ছেড়ে দিতে রাজি ছিল না। তখন স্বাধীনতাবিরােধীদের বিচারের প্রশ্নটা সবার মনে আবারও জেগে ওঠে।
কর্নেল নূরুজ্জামান ও শাহরিয়ার কবিরের সাথে যােগ দেয় মুক্তিযুদ্ধের দেশপ্রেমিক সংগঠন ও ব্যক্তিবর্গ। সবাই একাত্তরের ঘাতকদের ব্যাপারে সােচ্চার হয়ে ওঠে। অতঃপর নব্বই দশকের গােড়ার দিকেই জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’ আত্মপ্রকাশ করে স্বাধীনতা বিরােধীদের ব্যাপারে বিচারের দাবী তােলে। কিন্তু তৎকালীন সরকার একাত্তরের ঘাতক দালালদের বিচারের দাবি অগ্রাহ্য করলে নির্মূল কমিটি এই বিচারের দায়িত্ব নেয়। গণআদালত গঠিত হয় ২৬শে মার্চ সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে। তাদের ডাকে এগিয়ে আসে বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক মানুষ। প্রায় পাঁচ লক্ষ মানুষের উপস্থিতিতে গণআদালতে গােলাম আযমের বিচার করা হয়। তার অপরাধের মধ্যে আছে পাকিস্তানী বাহিনীর গণহত্যা, জনপদ ধ্বংস, ধর্ষণ ইত্যাদি কাজে সহায়তা করা, শান্তিবাহিনী, আল-বদর, আল-শামস গঠন করা এবং নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করার পরিকল্পনা ও তাদের হত্যা করা। এ ছাড়াও দেশ স্বাধীন হবার পর বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা। তার অপরাধকে মৃত্যুদণ্ডযােগ্য অপরাধ ঘােষণা করে সরকারের প্রতি আবেদন জানানাে হয়। সেটা কার্যকর করার। কিন্তু সরকার বরং গােলাম আযমকে রক্ষা করতে বেশি আগ্রহী ছিল। জাহানারা ইমামসহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে গণআদালত গঠন করার অপরাধে দেশদ্রোহিতার মামলা করা হয়।

গণআদালতের সদস্য ছিলেন জাহানারা ইমাম, গাজীউল হক, ড. আহমদ শরীফ, স্থপতি মজহারুল ইসলাম, ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, ফয়েজ আহমদ, কবীর চৌধুরী, কলিম শরাফী, মওলানা আব্দুল আওয়াল, কর্নেল নূরুজ্জামান, ব্যারিস্টার শওকত আলি খান এবং কর্নেল আবু ওসমান চৌধুরী। মামলায় অভিযােগকারীর পক্ষের কৌসুলি ছিলেন অ্যাডভােকেটবৃন্দ জেড আই পান্না, শামসুদ্দিন বাবুল, উম্মে কুলসুম রেখা আর অভিযুক্তকর পক্ষে গণআদালত অ্যাডভােকেট মােহাম্মদ নজরুল ইসলামকে নিযুক্ত করে। এই মামলার রায় ছিল: “বাংলাদেশের গণমানুষের পক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. বােরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, কবি শামসুল হক, ড. আনিসুজ্জামানের উত্থাপিত অভিযােগের ভিত্তিতে অত্র গণআদালতে এই মােকদ্দমার সূত্রপাত: অভিযােগের বিবরণে প্রকাশ, জনাব গােলাম আযম, পিতা মরহুম মওলানা গােলাম কবির একজন পাকিস্তানী নাগরিক। বহুদিন ধরে অবৈধভাবে বাংলাদেশে, ঢাকা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের অন্তর্গত মগবাজার এলাকায় ১১৯ কাজী অফিস লেনে অবস্থানরত। গােলাম আযম ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত বাংলাদেশে হানাদার তথা দখলদার বাহিনীকে সর্বতােভাবে প্রত্যক্ষ পরােক্ষভাবে ত্রিশ লক্ষ নিরীহ নিরস্ত্র নারী, পুরুষ ও শিশু হত্যা এবং দুই লক্ষ নারী অপহরণ ও ধর্ষণে সহায়তা করে যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরােধী অপরাধ করেছেন।
উক্ত সময়ে তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে শান্তি কমিটি, আল-বদর, আল-শামস গঠন করে তাদের এবং তার অনুগত রাজাকার বাহিনী দিয়ে সাহায্য করে পাকিস্তানী বাহিনী কর্তৃক দুই লক্ষ নারীকে অপহরণ, ধর্ষণ, শ্লীলতাহানিতে প্ররােচিত করে হীন অপরাধ সংগঠন করিয়েছেন, উক্ত সময়ে তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে তার অনুগত আল-বদর, আল-শামস এবং রাজাকার বাহিনীকে নির্দেশ দিয়ে ব্যাপক গণহত্যা সংঘটিত করিয়েছেন এবং হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীকে উস্কানি, প্ররােচনা এবং সাহায্য দান করেছেন এবং তার উক্ত কাজের ফলে বাংলাদেশের ত্রিশ লক্ষ নারী, পুরুষ ও শিশু নিহত হয়েছে, উক্ত সময়ে গােলাম আযম তার গঠিত ও অনুগত আল-বদর, আল-শামস ও শান্তি কমিটি দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে লিপ্ত মুক্তিযােদ্ধাদের নিরীহ পরিবার পরিজনের উপর সশস্ত্র ধ্বংসযজ্ঞ অভিযান পরিচালনা করে, উক্ত সময়ে অভিযুক্ত গােলাম আযম বাংলাদেশের নাগরিকদের মধ্যে বিদ্বেষ ও সহিংসতা ছড়ানাের লক্ষ্যে ধর্মের বিকৃত ব্যাখ্যা প্রদান করে ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে ধর্মের নামে লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করে এবং এই দেশের শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রসমূহ ধ্বংস করার অপচেষ্টায় লিপ্ত করেছে এবং আজো এই দেশের শিল্প-সংস্কৃতিকে বিকৃত করা এবং শিক্ষা, শিল্প ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রসমূহ ধ্বংস করার অপচেষ্টায় লিপ্ত করেছে, অভিযুক্ত গােলাম আযম ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে পাকিস্তানের এজেন্ট হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটি গঠন করে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান না করার জন্য বিদেশী দেশসমূহকে প্ররােচিত করে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়, অভিযুক্ত গােলাম আযম বিদেশী নাগরিক হয়ে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে বাংলাদেশের সংবিধান বিরােধী ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রচার চালিয়ে মানবতাবিরােধী অপরাধ করেছে। ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চের পর অভিযুক্ত গােলাম আযম তার নিজস্ব অনুগত বাহিনী আল-বদর, আল-শামস এবং রাজাকার বাহিনী। দিয়ে লুটতরাজ এবং নিরস্ত্র নিরীহ মানুষের ঘরে অগ্নিসংযােগ করে অসংখ্য জনপদ ধ্বংস করেছে, ১৯৭১ সালের নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবিদের অপহরণ ও হত্যা করে মানবতাবিরােধী জঘন্য অপরাধ সংঘটন করে। উপরােক্ত অপরাধের ভিত্তিতে অভিযুক্ত গােলাম আযমের বিরুদ্ধে ১২(বার)টি সুনির্দিষ্ট অভিযােগ রচনা করা হয়।
গণআদালতের বিচার আত্মপক্ষ সমর্থন করতে অনুপস্থিত থাকায় ন্যায় বিচারের জন্য অভিযুক্ত গােলাম আযমের পক্ষে এডভােকেট মােঃ নজরুল ইসলামকে গণআদালত কৌসুলি নিযুক্ত করেন এবং গােলাম আযমের পক্ষে নিযুক্ত কৌসুলিকে অভিযােগসমূহ পাঠ করে শােনান। অভিযুক্ত গােলাম আযমের পক্ষে নিযুক্ত কৌসুলি তার মক্কেল গােলাম আযমকে নির্দোষ বলে দাবি করেন। গণআদালত এই মামলায় ১৫ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য নেয়। এক নম্বর সাক্ষী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান তাঁর লিখিত জবানবন্দীতে বলেন, অভিযুক্ত গােলাম আযম ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর প্রতিটি অন্যায়, বেআইনি, অমানবিক ও নিষ্ঠুর কাজকে প্রকাশ্যে সমর্থন করেছেন এবং মুক্তিযােদ্ধাদের দেশদ্রোহী বলে আখ্যায়িত করার প্ররােচনা দিয়েছিলেন এবং তার প্ররােচনায় দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের আল বদর এবং আল শামস বাহিনী হত্যা করে। ড. আনিসুজ্জামান তার সাক্ষ্যে আরাে বলেন, অভিযুক্ত গােলাম আযম ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭৮ সালের ১০ জুলাই পর্যন্ত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সশরীরে উপস্থিত থেকে বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে মুদ্রিত ও প্রকাশিত প্রচারপত্র ও প্রবন্ধের মাধ্যমে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে দুর্বল, সহায়হীন, বিচ্ছিন্ন ও বিনষ্ট করার ষড়যন্ত্র করেছে। ড. আনিসুজ্জামান এসব কাগজপত্র দলিল হিসেবে আদালতে দাখিল করেন। দ্বিতীয় সাক্ষী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. বােরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর তার লিখিত জবানবন্দীতে বলেন, গােলাম আযম পূর্ব পাকিস্তানে জামাতে ইসলামীর আমীর হিসেবে হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীকে হত্যা, নারীধর্ষণ, লুণ্ঠন এবং জনপদ ধ্বংসের কাজে সহায়তা করেছে। ড. জাহাঙ্গীর তার বক্তব্যের সমর্থনে বিভিন্ন সংবাদপত্র আদালতে পেশ করেন। ফরিয়াদির পক্ষে তিন নম্বর সাক্ষী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ের শিক্ষক ড. মেঘনা গুহঠাকুরতা পূর্বোক্ত দু’জন সাক্ষীর বক্তব্যকে পুরােপুরি সমর্থন করেন। চতুর্থ সাক্ষী ঔপন্যাসিক, কবি ও নাট্যকার সৈয়দ শামসুল হক প্রথম ও দ্বিতীয় সাক্ষীকে পুরােপুরি সমর্থন করে বলেন, গােলাম আযম মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশের দীর্ঘ ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে সক্রিয় ছিল। গােলাম আযম পাকিস্তানী বাহিনীর সাথে সক্রিয় সহযােগিতা করে, মদদ দান করে বাঙালি জাতিকে সব অর্থে নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে নীল নকশা প্রণয়ন করে।’

সৈয়দ শামসুল হক আরাে বলেন, গােলাম আযম বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের যে ধর্মবিশ্বাস সেই ইসলামের বিকৃত ব্যাখ্যা করেছে। মুক্তিযােদ্ধা ও স্বাধীনতাকামী মানুষের ওপর অমানুষিক নির্যাতন করেছে এবং লাখ লাখ মানুষের প্রাণ হরণ করেছে। সৈয়দ শামসুল হক গােলাম আযমের কার্যকলাপকে হিটলারে নাৎসী বাহিনীর অমানবিক পৈশাচিক কার্যকলাপের সাথে তুলনা করে বুদ্ধিজীবী হত্যার জন্য তাকে দায়ী করেন। সাংবাদিক ও লেখক শাহরিয়ার কবির তাঁর জবানবন্দীতে গােলাম আযমের বিরুদ্ধে ফ্যাসিবাদ ও নাৎসীদের অনুসরণ করার অভিযােগ করেন। তিনি বলেন, গােলাম আযমের নেতৃত্বে জামাতে ইসলামী ফ্যাসিবাদী দর্শনের অনুসারী হয়ে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে ব্যাপক গণহত্যা চালিয়েছে। পাকিস্তানী সামরিক জান্তাকে নানাভাবে প্ররােচিত করে গণহত্যাযজ্ঞ ঘটিয়েছে। লেখিকা মুশতারী শফি পূর্বের সাক্ষীদের বক্তব্যকে সমর্থন করেন। প্রকৌশলী ফজলুর রহমানের পুত্র অপর সাক্ষী সাইদুর রহমান জানান, ১৯৭১ সালের ১৫ই এপ্রিল পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এবং গােলাম আযমের জামায়াতে ইসলামের দলীয় লােকজন তাঁর বাবা, মা এবং তিন বড় ভাইকে গুলি করে ও বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করে।
বিখ্যাত সাংবাদিক শহীদুল্লাহ কায়সারের পুত্র অমিতাভ কায়সার তার জবানবন্দীতে বলেন, ডিসেম্বর মাসের ১৪ তারিখে গােলাম আযমের নেতৃত্বে পরিচালিত আল-বদর বাহিনীর সদস্য এবিএম খালেক মজুমদার এবং আরাে কয়েকজন সশস্ত্র আল-বদর শহীদুল্লাহ কায়সারকে বাড়ি থেকে হত্যার উদ্দেশ্যে বলপূর্বক অপহরণ করে নিয়ে যায়। পিতার অপহরণ এবং হত্যার জন্য অমিতাভ কায়সার গােলাম আযমকে এবং তার নেতৃত্বে গঠিত আল-বদর ও জামায়াতে ইসলামী দলকে দায়ী করেন। অন্যতম সাক্ষী হামিদা বানু তার জবানবন্দীতে বলেন, গােলাম আযমের পূর্ণ সমর্থন ও সহযােগিতায় এই দেশের দুই লক্ষ নারীকে অপহরণ ও ধর্ষণ ও শ্লীলতাহানি করে। সাক্ষী মওলানা ইয়াহিয়া মাহমুদ পবিত্র ইসলাম ধর্মের বিকৃত ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য গােলাম আযম এবং তাঁর দল জামায়াতে ইসলামীকে দায়ী করেন। তিনি, এই দেশে গণহত্যা, মুক্তিযােদ্ধা হত্যা এবং অগ্নিসংযােগ, জনপদ ধ্বংসের জন্য গােলাম আযমকে অভিযুক্ত করেন এবং আলেম সমাজের পক্ষ থেকে তার। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবী করেন। নাট্যশিল্পী আলী যাকের বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা করার জন্য। গােলাম আযমকে দায়ী করে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলির সাথে গােলাম আযমের গােপন বৈঠকের আলােকচিত্র পেশ করেন।
ড. মুশতাক হােসেন একাত্তরের যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের ডাক্তারদের হত্যা। করার জন্য গােলাম আযম সহায়তা করেছে বলে সাক্ষ্য দেন। গণআদালত পর্যবেক্ষণ করতে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক দল এসেছিলেন। গণআদালতে অভিযুক্ত গােলাম আযমের বিরুদ্ধে দাখিল করা সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে তাকে দোষী সাব্যস্ত করে বলা হয় তার অপরাধ মৃত্যুদণ্ডযােগ্য। কিন্তু গণআদালতের পক্ষে দণ্ডাদেশ কার্যকর করা সম্ভব নয় বলে গােলাম আযমের বিরুদ্ধে। উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি অনুরােধ জানানাে হয়। সে অনুরােধ বা আহ্বানে কর্ণপাত করেনি তদানীন্তন বিএনপি সরকার। আওয়ামী লীগ। ক্ষমতায় এলে এই রায় কার্যকর হবে ভেবে দলের নেত্রী শেখ হাসিনাকে পাশে ডেকে নেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম, মঞ্চে তাঁকে সামনে এগিয়ে দেন। শেখ হাসিনা। সে সময় যুদ্ধাপরাধীর বিচারের অঙ্গীকার করেন। কিন্তু সরকারবিরােধী আন্দোলনের পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেও সে সময় কিছুই হয়নি। সাম্প্রতিক নির্বাচনে বিপুল জয়ের অন্যতম কারণ নির্বাচনী ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধীর বিচারের অঙ্গীকার বলে। অনেকেই মনে করেন। এই দাবির পক্ষে বর্তমান প্রজন্ম সােচ্চার, যাদের জন্ম ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের অনেক পরে এবং তারাই বিপুল সংখ্যায় আওয়ামী লীগকে ভােট দিয়েছে। এছাড়াও সে সময়ের গণআদালতের অন্যতম বিচারক ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বর্তমানে ক্ষমতাসীন সরকারের আইনমন্ত্রী। তাই জনগণের আশা চার দশক পর এবার হয়ত বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে। গত বেশ অনেক বছর ধরেই বিভিন্ন সংগঠন গণহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া মানুষ, ধর্ষিত নারী এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের শিকার ব্যক্তিদের কাছ থেকে তথ্য ও ইতিহাস সংগ্রহ ও লিপিবদ্ধ, নথিবদ্ধ করেছে।
এ ব্যাপারে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। ১৯৯৬ সালের ২২শে মার্চ প্রতিষ্ঠিত এই জাদুঘর মুক্তিযুদ্ধের বীরগাঁথা, ইতিহাস, অলিখিত কাহিনী সংগ্রহ করেছে। সর্বশেষ তথ্যে জানা গেছে, এই জাদুঘরের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সাথে সম্পৃক্ত ১৪০০০টি জিনিস আছে যার মধ্যে আলােকচিত্র, দলিলপত্র, সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবারখবর এবং সেই সাথে। মুক্তিযােদ্ধাদের ব্যবহৃত নানা জিনিস অন্তর্ভুক্ত আছে। কিন্তু স্থানাভাবে মাত্র ১৩০০০টি জিনিস প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে। উল্লেখ্য, একটি ট্রাস্টি কর্তৃক পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর বর্তমানে ভাড়াটে বাড়িতে রয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে নিজস্ব ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা আছে। ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাহায্যে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। ঢাকায় দু’টি বধ্যভূমি খনন করেছে যেখানে ১৯৭১ সালের বর্বর গণহত্যার শিকার বাঙালির দেহাবশেষ পাওয়া গেছে। ‘দি ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি যুদ্ধাপরাধ সম্পর্কে উপাত্ত সংগ্রহ করেছে। এই সংগঠনের আহ্বায়ক ড. এম এ হাসান তার ভাই সেলিমকে খুঁজতে গিয়ে বধ্যভূমি আবিষ্কার করেন। আবিষ্কার করেন নির্মম, ভয়াবহ, নৃশংস অত্যাচারের চিহ্ন নিয়ে পড়ে থাকা বাঙালির দেহাবশেষ। সেটা ছিল ১৯৭২ সালের ৩০শে জানুয়ারী। এভাবে বাংলাদেশে বহু বধ্যভূমি খুঁজে পায় বাংলাদেশের মানুষ । তিনি নিশ্ৰুপ বসে থাকতে পরেননি, গড়ে তুলেছেন এই সংগঠন, ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস্ ফাইন্ডিং কমিটি। এই কমিটির কাজ গণহত্যার ব্যাপারে তদন্ত করা, সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করা এবং সরকারের ওপর যুদ্ধাপরাধীর বিচারের ব্যাপারে চাপ সৃষ্টি করা। গত দুই দশকের বেশি সময় ধরে তারা এসব সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করছেন। এ কাজ করার জন্য তার জীবনের ওপর হুমকি এসেছে। ড. হাসান জানিয়েছেন, তার কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নেই। তিনি শুধু চান, যারা অপরাধ করেছে, তাদের শাস্তি হােক। এই সংগঠন ১,৭৭৫ জনের একটি তালিকা সরকারকে দিয়েছে যারা ১৯৭১ সালে। মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। এই সংগঠনের অহ্বায়ক ড. এম এ হাসান প্রধান যুদ্ধাপরাধ তদন্তকারী অফিসারের হাতে এই তালিকা তুলে। দেন। এই তালিকায় পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর ৩৬৯ জন অফিসার, ৮৫২ জন। রাজাকার, ৬৪ জন আল-বদর, ১২৮ জন ‘শান্তি কমিটির সদস্য এবং ৭৮ জন বিহারীর নাম আছে।
এই সংগঠন দাবি করে তারা এ ব্যাপারে দলিলপত্র পেয়েছে এবং তারা প্রভাবশালী পেশাজীবী ও রাজনীতিকদের ব্যাপারে অনুসন্ধান করে জেনেছে যে তারা এসব অপরাধ পরিকল্পনার পেছনে ছিল আর যুদ্ধাপরাধও করেছে। তারা যাদের নাম করেছে তাদের মধ্যে খাজা খায়েরউদ্দিন, এ কিউ এম শফিকুল ইসলাম, গােলাম আযম, মাহমুদ আলি সিদ্দিক আহমেদ, আবুল কাশেম, মােহন মিয়া, আবদুল মতিন, মৌলানা সৈয়দ মােহাম্মদ মাসুম, গােলাম সরােয়ার, পীর হােসেন উদ্দিন, প্রয়াত আব্বাস আলি খান, আব্দুল কাদের মােল্লা, ফজলুল কাদের চৌধুরী, আলী আহসান মােহাম্মদ মুজাহিদ প্রমুখের নাম উল্লেখযােগ্য। ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস্ ফাইন্ডিং কমিটির আহ্বায়ক ড, এম এ হাসান বলেন, ‘আমাদের মধ্যে এখনাে (১৯৭১’এর যুদ্ধে) ক্ষতিগ্রস্ত, নৃশংসতা প্রত্যক্ষ করেছেন এমন অনেকে বেঁচে আছেন।’ তিনি জানান, এ ব্যাপারে দলিলপত্র রয়েছে। ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের মত সংগঠনও কিছু কাজ করেছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্র নির্যাতিত নারী। এবং সেইসব নারীর মৌখিক ইতিহাস তুলে এনেছে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ যাদের জীবনে কোন-না-কোনভাবে বেদনা ও যন্ত্রণার কারণ হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার অনেক মানুষ, প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষে যারা মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেছেন, তাদের অনেকে এখনাে বেঁচে আছেন এবং তাদের স্মৃতি এখনাে উজ্জ্বল। আরাে দেরী করলে হয়ত ইতিহাসের অনেক পাতাই হারিয়ে যাবে, কালের গহ্বরে তলিয়ে যাবে। ব্যক্তিগতভাবে কেউ কেউ এ ধরনের মামলা করেছেন। শহীদ অধ্যাপক গিয়াসুদ্দিনের তাঁর ভগ্নি অধ্যাপক ফরিদা বানু অধ্যাপক গিয়াসুদ্দিনকে অন্যান্য বুদ্ধিজীবীর সাথে অপহরণ ও হত্যার দায়ে চৌধুরী মইনুদ্দিন, আশরাফুজ্জামান ও অন্যদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। এরকম অভিযােগ রয়েছে যে, জামায়াতে
৪০

ইসলামীর নেতৃস্থানীয় সদস্য চৌধুরী মঈনুদ্দিন ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে বুদ্ধিজীবী হত্যার ব্যাপারে যে অভিযান চালানাে হয়, তার অধিনায়ক ছিল। তদন্তে যা পাওয়া গেছে, তা স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড ঢাকাস্থ ব্রিটিশ হাই কমিশনের কাছে জমা দিয়েছে বাংলাদেশ সরকারের কাছে হস্তান্তর করার জন্য। উল্লেখ্য, চৌধুরী মঈনুদ্দিন লন্ডনে বসবাস করে। মাগুরাতেও এ ধরনের একটি মামলা দায়ের করা হয়, করেন মুক্তিযােদ্ধা হাশেম মােল্লার কন্যা খাদিজা খাতুন ১০ জন রাজাকারের বিরুদ্ধে এই মামলা করেন, কিন্তু সে মামলার কিছু হয়নি। ১৯৭১ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর জামাতে ইসলামীর মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম-এ আল-বদরের নেতা মতিউর রহমান নিজামী বলেছিল, তাদের সবাইকে ইসলামী দেশের সৈনিকের ভূমিকা পালন করতে হবে এবং যারা পাকিস্তান ও ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত আছে, তাদের হত্যা করতে হবে। সেটাই তারা সে সময় করেছে। নয় মাসের যুদ্ধ চলাকালে তাে করেছেই, যুদ্ধ শেষে বাংলাদেশ স্বাধীন করার মাত্র দুই দিন আগে এই আল-বদর, আল-শামস সদস্য রাজাকাররা দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের অপহরণ করে নির্মমভাবে হত্যা করে। এমনকি দেশ স্বাধীন হবার পর গােলাম আযমসহ কেউ কেউ পাকিস্তানে পালিয়ে গেলেও বাকিরা অন্তর্ঘাতমূলক কার্যক্রম চালিয়ে যায়। সে সময় দৈনিক আজাদ লিখেছিল, “আল-বদর ও জামায়াতের পান্ডারা গা ঢাকা দিয়ে নাশকতামূলক তৎপরতা চালাচ্ছে, স্বাধীনতার বিপদ এখনাে কাটেনি।” ইসলামী ঐক্যজোটের নেতা মেজবাহুর রহীম চৌধুরী ১৯৭১ সালে ইসলামী ছাত্র। সংগঠনের সদস্য ছিলেন। তাকে আল-বদরে যােগ দেবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল বলে তিনি জানান। তিনি এক সংবাদ সম্মেলন ডেকে ১৫ জন পাকিস্তানী দালালের নাম প্রকাশ করেন এবং জানান তার কাছে তাদের বিরুদ্ধে যথেষ্ট প্রমাণ আছে। এসব নামের মধ্যে মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মােহাম্মদ মুজাহিদ, মােহাম্মদ কামরুজ্জামান, চৌধুরী মঈনুদ্দিন প্রমুখের নাম উল্লেখযােগ্য। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলাে আল-বদর সদস্য চৌধুরী মঈনুদ্দিনের পালিয়ে যাবার সংবাদ ছেপেছিল। এখন মঈনুদ্দিন লন্ডনে বসবাস করে, শুধু তা-ই নয়, সেখানে সে বেশ প্রভাবশালী মুসলমান নেতা হিসেবে বহাল তবিয়তে আছে। ব্রিটেনের চ্যানেল ফোর টেলিভিশন ‘ডিসপ্যাচেস’ নামের অনুষ্ঠানে চৌধুরী মঈনুদ্দিনসহ তিনজন প্রবাসী বাংলাদেশী যুদ্ধাপরাধী বলে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে নিয়ে একটি প্রামাণ্য ছবি দেখিয়েছিল ১৯৯৫ সালের ৩রা মে । ওয়ার ক্রাইম ফাইলস নামে এই ছবিটি টোয়েন্টি টোয়েন্টির পক্ষে প্রযােজনা করেছেন গীতা সাহগল, পরিচালনা করেছেন হাওয়ার্ড ব্র্যাডবার্ন এবং রিপাের্টার হিসেবে সহযােগিতা করেন। ডেভিড বার্গম্যান। আর চ্যানেল ফোর-এর পক্ষে কমিশনিং এডিটর ছিলেন ডেভিড

লয়েড। তিনজন অভিযুক্ত ব্যক্তি হচ্ছে চৌধুরী মইনুদ্দিন, আবু সাইদ ও লুৎফর রহমান, যারা সে সময় ব্রিটিশ নাগরিক হিসেবে নিশ্চিন্তে বিলেতে বসবাস করছিল। ছবিতে সাক্ষাত্তারের ভিত্তিতে দেখানাে হয় কিভাবে তারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালি বুদ্ধিজীবী হত্যাসহ নানা রকম বাঙালিদের স্বার্থবিরােধী কার্যকলাপে নিযুক্ত ছিল। প্রামাণ্য ছবিটিতে যুক্তি-প্রমাণসহ বলা হয়, জেনিভা কনভেনশন অনুযায়ী মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য ব্রিটেনের যুদ্ধাপরাধ সংক্রান্ত আইন অনুযায়ী তাদের বিচার হতে পারে। নয় মাসের দীর্ঘ গবেষণার ফসল ছিল এই ছবি। এতে শহীদ | বুদ্ধিজীবীদের পরিবারের সদস্য, রাজনীতিক, সাংবাদিক এবং দেশের সাধারণ নাগরিকদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয় । ঢাকা, সিলেট, ফেনী ইত্যাদি নানা জায়গায় গিয়ে গীতা ও ডেভিড লােকজনের সাথে কথা বলেন। ড. মাের্তজা ও সিরাজুদ্দিন | হােসেনের স্ত্রী, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার কন্যা মেঘনা গুহঠাকুরতা, ড. আনিসুজ্জামান, ড. কামাল হােসেন, এনাতুল্লাহ খান, আতিকুর রহমান, আতাউস সামাদ প্রমুখের সাথে তারা কথা বলেন। এছাড়াও এ তিনজন অভিযুক্তদের নির্যাতন, হত্যা ইত্যাদির চাক্ষুষ সাক্ষী ব্যক্তিদের সাথেও তারা কথা বলেন। সে সময় ব্রিটেনের পার্লামেন্টের ওয়ার ক্রাইম গ্রুপের ভাইস চেয়ার ছিলেন লর্ড আর্চার, তাঁর সাক্ষাৎকারও এই ছবিতে আছে।
এই তিনজন ব্যক্তি সে সময় ব্রিটেনের নানা ধরনের ইসলামী সংগঠনের সাথে জড়িত ছিল। এছাড়াও তারা কাউন্সিলগুলাের সাথেও জড়িত ছিল। ‘মুসলিম কাউন্সিল অব ব্রিটেন’ প্রতিষ্ঠার পেছনে এদের একজনের হাত রয়েছে। এরা সকলেই মৌলবাদী। তৎপরতা চালিয়ে গেছে। ছবিটিতে এদের সাক্ষাৎকার নেবারও চেষ্টা করা হয়। কিন্তু। একজন দরজা-ই খােলেনি। বাকি দু’জন অভিযােগ অস্বীকার করেছে। এই ছবিটি দেখে সে সময় ব্রিটেনে বেশ তােলপাড় ওঠে। ছবির প্রিভিউতে উপস্থিত ছিলেন পূর্ব লন্ডনের সে সময়ের এমপি এবং বাঙালিদের বন্ধু বলে পরিচিত পিটার শাের, প্রজন্ম একাত্তরের পক্ষ থেকে মেঘনা গুহঠাকুরতা, যুক্তরাজ্য ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সদস্য সুনাহর আলি প্রমুখ। পিটার শাের বলেন, মানবতার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের কোন ক্ষমা নেই। ছবিটি দেখাবার পর শােনা গিয়েছিল স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড বিলেত প্রবাসী বাংলাদেশী যুদ্ধাপরাধীদের ব্যাপারে তদন্ত শুরু করেছে। এ বিষয়ে। অবজার্ভার পত্রিকায় ডেভিড কনেট (David Connett) -এর এক প্রতিবেদনে সেকথা বলা হয়। বলা হয়, চৌধুরী মঈনুদ্দিনের ব্যাপারে একটি ফাইল খােলা হয়েছে। এই ছবিটি প্রচারের পর পরই যুক্তরাজ্য ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের কাছে। সাক্ষ্য প্রমাণ দাখিল করে। আনসার আহমদউল্লাহর নেতৃত্বে ১৯৯৫ সালের ডিসেম্বর। মাসে এসব স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের কাছে দেওয়া হয়। এসব সংগ্রহ করেছিল মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী বাহিনী ও তাদের দোসর আল বদর-আল, আল-শামস বাহিনীর হাতে নিহত বুদ্ধিজীবীদের সন্তানদের নিয়ে গঠিত সংগঠন প্রজন্ম একাত্তর’ । সাতটি সাক্ষ্যপ্রমাণ শপথ নিয়ে এফিডেবিট করে পাঠানাে হয়। এতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এনামুল হকের সাক্ষ্য রয়েছে যাতে তিনি বলেছেন, তিনি ১৯৭১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর চৌধুরী মঈনুদ্দিনকে তাঁর বাবা সিরাজুল হক খানকে ধরে নিয়ে যেতে দেখেছেন।
তিনি ছাড়াও যাদের সাক্ষ্যপ্রমাণ অন্তর্ভুক্ত ছিল তারা হলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, আতিকুর। রহমান, দুলু রহমান, ডলি চৌধুরী, মুশতাকুর রহমান ও আতাউস সামাদ। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের ওয়ার ক্রাইম ইউনিটের ডিটেকটিভ সার্জেন্ট অ্যান্ড্রু উইডেটের হাতে এসব তুলে দেওয়া হয়। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, ওয়ার ক্রাইম ফাইলস ছবিটি দেখবার পর এত তাড়াতাড়ি এসব সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়াটা উৎসাহব্যঞ্জক। তখন তিনি বলেন এই বিষয়টা পররাষ্ট্র দফতরের কাছে সুপারিশ করে পাঠানাে হয়েছে। ডিটেকটিভ সার্জেন্ট অ্যান্ড্রু উইডেট তখন জানিয়েছিলেন, এ ধরনের অনুরােধ তারা প্রথম পেয়েছেন এবং অ্যান্টি টেররিজম অ্যাক্ট-এর মত এই বিষয়টার ব্যাপারেও তাঁরা পররাষ্ট্র দফতরের। অনুমতি ছাড়া কিছু করতে পারেন না। এছাড়াও চৌধুরী মঈনুদ্দিন চ্যানেল ফোর-এর বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেবার হুমকি দেবার পর চ্যানেল ফোর এই প্রামাণ্য ছবিটি আর পুনঃপ্রচার না করার সিদ্ধান্ত নেয়। সে সময় লন্ডন বার অব টাওয়ার হ্যামলেটস্ (Bar of Tower Hamlets)-এর শিক্ষা বিভাগের কো-অপ্ট করা সদস্য ছিল অন্যতম অভিযুক্ত আবু সাঈদ। এই প্রামাণ্য ছবিটি দেখার পর টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলও তদন্ত করে দেখার কথা জানায়। চৌধুরী মঈনুদ্দিন ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস-এর সাথে জড়িত ছিল সে সময়। এরপরে সে জড়িত হয় পূর্ব লন্ডন মসজিদ এবং লন্ডন মুসলিম সেন্টারের সাথে। চ্যানেল ফোর এই প্রামাণ্য ছবিটি দেখাবার পর এর সমর্থনে পূর্ব লন্ডনে একাধিক সভা অনুষ্ঠিত হয়। যুক্তরাজ্য ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি আয়ােজিত এক সভায় গীতা সাহগল এবং ডেভিড বার্গম্যানও উপস্থিত ছিলেন। সে সভা ভণ্ডুল করার চেষ্টা করে কিছু সংখ্যক মৌলবাদী। কিন্তু স্থানীয় পুলিশের হস্তক্ষেপে সেটা সম্ভব হয়নি। বিলেতের বাঙালি নারীরাও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে আলাদা সভা করে। এর আগে জাতিসংঘের ট্রাইবুনাল সাবেক যুগােস্লাভিয়া এবং রুয়ান্ডাতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে নজির স্থাপন করেছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলাের মধ্যে বাংলাদেশই প্রথম ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার জন্য ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টের রােম সংবিধিবদ্ধ আইনে স্বাক্ষর করে। ১৯৯৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশ এতে স্বাক্ষর করে। যারা এই বিচার চায় না বা যারা মুক্তিযুদ্ধও চেতনার বিপক্ষে, তাদের অনেকে বলার চেষ্টা করেছে যে, এতদিন পর বিচার করার সম্ভব নয়। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার নাৎসীদের এখনাে খুঁজে বের করে তাদের বিচার করা হচ্ছে আর বাংলাদেশের ঘটনা তাে মাত্র চার দশকের পুরনাে।
২০০৭ সালের ৩১শে অক্টোবর মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডারস্ ফোরাম জানায়, ১৯৭১ সালে যুদ্ধাপরাধীরা ৫৩ ধরনের অপরাধ সংঘটিত করেছে। এর মধ্যে গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, ১৯৪৯ সালের জেনিভা কনভেনশনের গুরুতর লঙ্ঘন রয়েছে। যারা সরাসরি এগুলাে করেছে, তারা তাে বটেই, যারা এসব অপরাধে ইন্ধন জুগিয়েছে, সহায়তা করেছে, তাদেরও বিচার হওয়া উচিত। মুক্তিযুদ্ধের যে ক’জন সেক্টর কমান্ডার জীবিত আছেন, তাদের সমন্বয়ে ২০০৭ সালে গঠিত হয়েছে এই ‘সেক্টর কমান্ডারস্ ফোরাম’। এঁদের মধ্যে আছেন মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহ বীরােত্তম, লেফটেন্যান্ট জেনারেল মীর শওকত আলি বীরােত্তম, লেফটেন্যান্ট কর্নেল কাজী নূরুজ্জামান বীরােত্তম, মেজর রফিক বীরােত্তম এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবু ওসমান। এদের নেতৃত্বে আছেন মুক্তিযুদ্ধের সময় ডেপুটি চিফ অব স্টাফ এয়ার ভাইস মার্শাল একে খন্দকার বীরােত্তম। তাঁদের একমাত্র দাবি যুদ্ধাপরাধীর বিচার। তারা মনে করেন, যুদ্ধাপরাধীর বিচার ছাড়া ন্যায্য সমাজ গড়ে তােলা সম্ভব নয়। সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম গঠনের পর মুক্তিযােদ্ধা ও সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে প্রচুর সাড়া পেয়েছেন তাঁরা। এর সাথে জড়িত হয়েছেন অনেকে। সামরিক ও বেসামরিক মুক্তিযােদ্ধা ছাড়াও অন্য পেশার মানুষও তাদের সমর্থন জানিয়েছে। ২০০৮ সালে তারা এই দাবির পক্ষে স্বাক্ষর সংগ্রহ করেন। তারা সরকারের ওপর চাপ অব্যাহত রেখেছেন।
সাক্ষ্য-প্রমাণ সংক্রান্ত বিষয়ে, ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইবুনালস্) অ্যাক্ট ১৯৭৩ বলছে, একটি ট্রাইবুনাল সাক্ষ্য-প্রমাণের প্রয়ােগগত নিয়মকানুননের দ্বারা সীমিত থাকবে না; এবং যতটা ব্যাপকভাবে সম্ভব ত্বরান্বিত ও অ-প্রয়ােগগত পদ্ধতি গ্রহণ ও কার্যকর করবে এবং সংবাদপত্রে, সাময়িক পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত খবরাখবর ও আলােকচিত্র, চলচ্চিত্রায়িত ও টেপে ধারণকৃত যাবতীয় তথ্য এবং তার সামনে পেশ করা অন্যান্য এমন সব উপকরণ যা তার কাছে সত্যতা প্রমাণের কাজে মূল্যবান বিবেচিত হবে, সাক্ষ্য-প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা অনুমােদন করতে পারে । এই অ্যাক্ট বা বিধির সাক্ষ্য-প্রমাণ সংক্রান্ত নিয়মকানুন বলছে, একটি ট্রাইবুনাল একজন ম্যাজিস্ট্রেট অথবা একজন তদন্তকারী কর্মকর্তার দ্বারা নথিভুক্ত করা যে কোন বিবৃতি, যা এমন কোন ব্যক্তির দ্বারা প্রদত্ত যে বিচারের সময়ে মৃত অথবা যাকে উপস্থিত করতে হলে বিচারকার্য এমনভাবে বিলম্বিত কিংবা ব্যায়সাধ্য। হয়ে পড়তে পারে যা ট্রাইবুনালের বিবেচনা যুক্তিসঙ্গত নয়, তাকে সাক্ষ্য-প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করতে পারে। সাধারণভাবে সকলের জানা ঘটনাবলীর বিষয়ে কোন প্রমাণ ট্রাইবুনালের দরকার হবে না, তবে বিধানতান্ত্রিক বিচারে ট্রাইবুনাল তাদের বিবেচনা করবে।” আরাে বলা হয়েছে, একটি ট্রাইবুনাল আনুষ্ঠানিক সরকারী দলিলপত্র এবং জাতিসংঘের ও তার বিভিন্ন সহযােগী সংস্থার অথবা সরকার-বহির্ভূত সংগঠনসমূহসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংগঠনের প্রতিবেদন বিধানতান্ত্রিক বিচারে বিবেচনা করবে। সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি মােহাম্মদ গােলাম রাব্বানী জানিয়েছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য প্রয়ােজনীয় দলিল ও অন্যান্য কাগজপত্র স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছেই আছে, যা যথেষ্ট। তবে সেসব কাগজপত্র প্রায় ৪০ বছরের পুরনাে বলে সেগুলােকে এভিডেন্স অ্যাক্ট অনুযায়ী প্রাচীন দলিল বলে গণ্য করতে হবে। বাংলাদেশ সরকার একটি ট্রাইবুনাল গঠন করে একদল তদন্তকারী নিয়ােগ করেছে। এছাড়াও একদল কৌসুলিকে নিযুক্ত করা হয়েছে যারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রক্রিয়া শুরু করবেন।
আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বে তিন-সদস্যের ট্রাইবুনাল, সাত-সদস্যের তদন্তকারী সংস্থা এবং ১২-সদস্যের কৌসুলি দল নিয়ােগের কথা ঘােষণা করেন। কেঁৗসুলি দলের নেতৃত্ব দেবেন সিনিয়র আইনজীবী গােলাম আরিফ টিপু। এই বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইবুনাল) অ্যাক্ট, ১৯৭৩ অনুযায়ী হবে বলেও জানা যায়। আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, এই সংস্থা যে কোন অপরাধের অভিযােগের ব্যাপারে তদন্ত করবে, যা মানবতার বিরুদ্ধে সংঘটিত হয়েছে- গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, অগ্নিকাণ্ড, লুটপাট, ধর্ষণ ও ১৯৭১
৪৫
সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় জোর করে লােকজনকে দেশত্যাগে বাধ্য করা। এগুলাে দলিলপত্র, দেশে ও বিদেশে প্রকাশিত সংবাদপত্রের প্রতিবেদন এবং অন্য যেসব প্রমাণাদি পাওয়া যাবে, তার ওপর ভিত্তি করে করা হবে। তিনি আরাে জানান, পাকিস্তান ছাড়া অন্যান্য দেশ এই উদ্যোগকে সমর্থন জানিয়েছে। তিনি একথা স্বীকার করেন যে এই বিচারের দীর্ঘসূত্রতা ঘটতে পারে আর আন্তর্জাতিক মান রাখার জন্যই সেটা ঘটতে পারে। সরকার প্রথম পর্যায়ে ২৫ জনের তালিকা করেছে যা সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের তৈরি ৫০ জনের তালিকার মধ্যে রয়েছে। ট্রাইবুনাল প্রধান জানিয়েছে কোন নিরপরাধ ব্যক্তিকে এই মামলায় জড়ানাে হবে না।

বর্তমান জাতীয় সংসদে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস্ (ট্রাইবুনালস) অ্যাক্ট’ ২০০৯ পেশ করেন। এতে ১৯৭৩ সালের আইনে কিছু সংশােধনী রয়েছে যাতে একে যুগােপযােগী, ন্যায্য, নিরপেক্ষ ও বিশ্বব্যাপী গ্রহণযােগ্য করা যায়। উল্লেখ্য যে, আন্তর্জাতিক আইনে মৃত্যুদণ্ডের প্রতি অনুমােদন নেই। সেটা গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ অথবা শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধই হােক কেন- কোন ক্ষেত্রেই নেই। কেউ কেউ বলছেন, যুদ্ধাপরাধের সংজ্ঞা চতুর্থ জেনিভা কনভেনশনের ১৪৭ নং ধারার সাথে মিলিয়ে করতে হবে। এর ভেতরে যে কোন গােষ্ঠীর প্রতি বর্ণ, জাতি, ধর্মীয় কারণে নির্যাতনের বিষয়টা অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে। যে কোন ধরনের নির্যাতন, ধর্ষণ, যৌন দাসত্ব, বেশ্যাবৃত্তিতে বাধ্য করা, দেশত্যাগে বাধ্য করা ইত্যাদি সমস্তই অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে। আন্তর্জাতিক অপরাধ। (ট্রাইবুনাল) আইন ১৯৭৩-এর ৮(১) ধারা অনুযায়ী একটি তদন্ত সংস্থা গঠন করা হয়। প্রথমদিকে বিভিন্ন জেলায় কিছু চুনােপুটি রাজাকার-আল-বদর সদস্যকে গ্রেফতার করায় বাংলাদেশের মানুষ হতাশ হয়ে পড়ে। অনেকে মনে করে নির্বাচনী ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধীর বিচারের অঙ্গীকার করাতে আওয়ামী লীগ সরকার লােক দেখানাে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
পরে অবশ্য জামায়াতে ইসলামী দলের নেতা আলী আহসান মােহাম্মদ মুজাহিদ ও মতিউর রহমান নিজামীসহ অনেককে গ্রেফতার করা হয়। তাতে অনেকের মনে আশার আলাে জেগে ওঠে যে হয়ত এবার সত্যিই যুদ্ধাপরাধীর বিচার হবে। সাধারণ মানুষের দীর্ঘকালের দাবি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কিন্তু সেই সাথে অনেকে মনে করেন, এই বিচার যেন ন্যায্য ও স্বচ্ছ এবং আন্তর্জাতিক মানের হয়। মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ এবং গণহত্যা হচ্ছে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী সবচেয়ে গুরুতর অপরাধ। এসব অপরাধের জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলাে এধরনের অপরাধ প্রতিরােধে, মানবিক অধিকার রক্ষায় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য জরুরি বিধান। আর সময় এর জন্য কোন বাধা নয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অনেক বছর পর আজও চরম অপরাধী নাৎসীদের খুঁজে খুঁজে তাদের বিচারের মুখােমুখী আনা হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের তাে মাত্র চার দশকের মত সময় অতিবাহিত হয়েছে। বাংলাদেশের একটি সংবাদপত্রে লেখা বক্তব্য অনেকেরই মনের কথা, “এই বিচার অবশেষে আমাদের দরজা বন্ধ করে দিতে দেবে আমাদের আর অনন্তকাল ধরে অতীতের লড়াই লড়ে যেতে হবে না।’ অসমাপ্ত যুদ্ধ শেষে বাংলাদেশের মানুষ ঘরে ফিরতে পারবে।
৪৭

বসনিয়া
বসনিয়াতে ১৯৯২-১৯৯৫ সালে যে যুদ্ধ হয়, সে সময় জাতিগত গােষ্ঠীকে নির্মূল করার। ঘটনা ঘটে। এছাড়াও স্রেবারনিৎজা’য় ১৯৯৫ সালে সার্ব বাহিনী গণহত্যার অপরাধে অভিযুক্ত হন। অল্প কয়েকজন আইনজ্ঞসহ বেশ কিছু কর্তৃপক্ষ জোর দিয়ে বলেন, যুদ্ধকালীন সার্ব বাহিনীর কার্যকলাপ গণহত্যার সামিল। এর মধ্যে ছিল জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত একটি সুপারিশ ও জার্মান আদালতে চারজনের বিচার। তাঁরা দোষী সাব্যস্ত হন, তবে এই বিচারকার্যে গণহত্যার ব্যাপক ব্যাখ্যাকে হিসেবে ধরা হয়, আন্তর্জাতিক আদালতে ব্যবহৃত ব্যাখ্যা নয়। ২০০৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যাতে বলা হয়, সার্বিয়ানদের আগ্রাসী ও জাতিগত গােষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করার নীতি গণহত্যার সামিল।’ সাবেক যুগােস্লাভিয়ার জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ সংক্রান্ত ট্রাইবুনাল (ICTY) এবং আন্তর্জাতিক কোর্ট অব জাস্টিস (Court of Justice) এই রায় দিয়েছেন যে, গণহত্যা হিসেবে চিহ্নিত হবার জন্য কোন সুরক্ষিত গােষ্ঠীর শারীরিক ও জৈবিক ধ্বংস হতে হবে এবং সেরকম ধ্বংসের ইচ্ছা থাকতে হবে। আজ পর্যন্ত এই দু’টি বিচার বিভাগ একমাত্র স্রেবারনিৎজার, নির্বিচার হত্যাকে গণহত্যা হিসেবে রায় দিয়েছে। যুগােস্লাভিয়ার জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ সংক্রান্ত ট্রাইবুনাল ২০০১ সালে মেনে নেয় যে স্রেবারনিৎজায় গণহত্যা ঘটেছে । কৌসুলি বনাম ক্রিসটি মামলায় সর্বসম্মতিক্রমে। বলা হয় যে ১৯৯৫ সালে সেখানে গণহত্যা ঘটেছিল। হেগ শহরে অবস্থিত সাবেক যুগােস্লাভিয়ার জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ সংক্রান্ত ট্রাইবুনালের আপীল চেম্বার সেটা মেনে নেয়। বসনিয়ান মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্যে তারা এই নির্বিচার হত্যাকাণ্ড চালায়, যা গণহত্যা হিসেবে গৃহীত হয়। সেখানে ৪০ হাজার বসনিয়ান মুসলমানের বাস ছিল।
তাদের মধ্যে বয়স্ক ও তরুণ, উভয় শ্রেণীর পুরুষদের কাছ থেকে তাদের ব্যক্তিগত সমস্ত কিছু ও পরিচিতিমূলক সবকিছু কেড়ে নিয়ে তাদের ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করা হয়। তবে এককভাবে অনেকেই যুদ্ধাপরাধের অভিযােগে অভিযুক্ত হয়েছে, অন্তত ৩০ জন। অধিকাংশই অবশ্য দণ্ডকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে করে অথবা আপীল করে পার পেয়ে গেছে। একমাত্র রাদিম্লভ ক্রিসটিচ আন্তর্জাতিক আদালতে গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত হয়েছেন। এছাড়াও আরাে চারজন জার্মান আদালতে গণহত্যায় অংশ নেবার দায়ে অভিযুক্ত হয়েছে। তাদের মধ্যে একজন নিকোলা ইয়ােরগিচ মানবাধিকার সংক্রান্ত ইউরােপীয় আদালতে আপিল করেছে।

২০০৮ সালের জুলাই মাসে বসনিয়া ও হারজেগােভিনার রাষ্ট্রীয় আদালতে মিলেঙ্কো ত্রিফানােভিচ, ব্রানাে দজিনিচ, আলেকসান্দার রাতেদানােভিচ, মিলােস স্তুপার, স্লোবােদান ইয়াকোভরিয়েভিচ ব্রারিনস্লাভ মেদান ও পিতার মিত্রোভিচ স্রেবারনিৎজার গণহত্যার জন্য বিচারের মুখােমুখি হন। বর্তমানে একই আদালতে সাবেক সার্ব নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য মিলােরাদ ত্রিবিচ বিচারাধীন আছেন। যারা বসনিয়ার যুদ্ধেও অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত বা অভিযুক্ত হয়েছে তাদের মধ্যে সবচেয়ে উধর্বতন হচ্ছে সার্বিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট স্লোবােদান মিলােসেভিচ (Slobodan Milosevic)। তাকে আন্তর্জাতিক অপরাধ সংক্রান্ত ট্রাইবুনালের সামনে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়। কিন্তু বিচার চলাকালীন তিনি মারা যান। তাঁর বিরুদ্ধে কোন রায় দেওয়া হয়নি। রাদোভান কারাজিচ ও র্যাটকো মিলাডিচ-এর বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরােয়ানা জারি করা হয়। কারজিচ বেলগ্রেডে ২০০৮ সালের ২১শে জুলাই গ্রেফতার হন ও তাঁকে এ বছরেরই ৩০শে জুলাই হেগ শহরে চালান করে দেওয়া হয়। কিন্তু মিলাডিচকে আজ পর্যন্ত ধরা যায়নি। রাদোভান কারাজিচ ১৯৯৬ থেকে পলাতক ছিলেন। ২০০৫ সালে বসনিয়ার সার্ব নেতারা তাঁকে আত্মসমর্পণ করতে বলেন। তাঁরা বলেন, তিনি যতদিন পলাতক। থাকবেন, ততদিন বসনিয়া এবং সার্বিয়া অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিকভাবে এগিয়ে যেতে পারবে না। সে বছরই তাকে আটক করার এক ব্যর্থ প্রচেষ্টায় নেটো বাহিনী তার পুত্র আলেকসান্দার কারাজিচ বা সাশাকে গ্রেফতার করে এবং ১০ দিন পর তাকে ছেড়ে দেয়। সে সময় তার স্ত্রী লিলিয়ানাও তাঁকে আত্মসমর্পণ করার আহ্বান জানান। তবে তিনি পরে জানান, প্রচণ্ড চাপের মুখে তাকে এই আহ্বান জানাতে হয়েছিল। কারাজিচ অলটারনেটিভ মেডিসিন প্র্যাকটিস করার নামে লম্বা দাড়ি ও চুল গজিয়ে আত্মগােপন করে ছিলেন। তাঁর চুলে একটা পনিটেইল থাকতাে এবং তিনি নাম নিয়েছিলেন ড্রাগান, ডেভিড দাবিচ।
তিনি মেডিকেল সম্মেলনে হাজার হাজার মানুষের সামনে ভাষণ দেন। এমনকি তার নিজের একটি ওয়েবসাইটও ছিল। একবার, ২০০৭ সালের মে মাসে ভিয়েনাতে পুলিশ তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে একটি অসম্পর্কিত হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে। কিন্তু তখন তার আঙুলের ছাপ নেওয়া হয়নি বা আরাে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি। তিনি ক্রোএশিয়ান পাসপাের্টধারী এক ব্যক্তি হিসেবে অত্যন্ত শান্তভাবে অস্ট্রিয়ান পুলিশের প্রশ্নের জবাব দেন। শেষ পর্যন্ত তিনি এই ঘটনার এক বছর পর বেলগ্রেড-এ ধরা পড়েন। তাকে ধরার জন্য যে অর্থ পুরস্কার হিসেবে ঘােষণা। করা হয়েছিল, সেটা কেউ দাবি করেনি। জান গেছে, স্থানীয় লােকজন তাকে সন্দেহ করে এবং ধরিয়ে দেয়। তিনি ধরা পড়েন ২০০৮ সালের জুলাই মাসের ২১ তারিখ। তাঁর বিরুদ্ধে যেসব অভিযােগ আছে, সেগুলাে হচ্ছে: • মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের পাঁচ দফা হত্যা, রাজনৈতিক-জাতিগত বর্ণ সম্পর্কিত-ধর্মীয় কারণে নির্যাতন, অমানবিক আচরণ, জোর করে অন্যত্র স্থানান্তর ইত্যাদি। যুদ্ধ-আইনের তিন দফা লঙ্ঘন হত্যা, বেসামরিক নাগরিকদের মধ্যে বেআইনীভাবে ভীতির সঞ্চার করা, জিম্মি করা; জেনিভা কনভেনশন লঙ্ন; • বেআইনীভাবে ধর্মীয় অথবা জাতীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে বেসামরিক নাগরিকদের স্থানান্তর করা; স্রেবারনিৎজার নির্বিচার গণহত্যা।

তাঁকে হেগ শহরে যুগােস্লাভিয়ার জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ সংক্রান্ত ট্রাইবুনালের হাতে তুলে দেওয়া হয়। তিনি ট্রাইবুনালে বিচারপতি আলফনস্ অরি-র সামনে উপস্থিত হন, কিন্তু জানান যে তিনি তাঁর জীবনের জন্য ভীত আছেন। তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে এবং তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বসনিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বিরুদ্ধে অভিযােগ জানান। তিনি বিচার বয়কট করার হুমকি দিলে মামলা স্থগিত রাখা হয়। ২০০৯ সালের নভেম্বর মাসে তিনি এই ট্রাইবুনালের বৈধতা ও আইনগত যােগ্যতা। নিয়ে প্রশ্ন তােলেন। এরপর ২০১০ সালের মার্চ মাসে তিনি আবার কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আত্মপক্ষ সমর্থন করেন। নিজেকে তিনি এমন একজন কমিউনিস্ট বিরােধী নেতা হিসেবে চিত্রিত করেন যাকে ভুল বােঝা হয়েছিল। হেগ শহরে যুগােস্লাভিয়ার জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ সংক্রান্ত ট্রাইবুনালের সামনে বুলেট প্রুফ কাঁচের আড়াল থেকে ৬৪ বছর বয়সী যুদ্ধাপরাধী রাদোভান কারাজিচ (Radovan Karadic) আত্মপক্ষ সমর্থন করেন চার ঘণ্টা ধরে। তিনি বলেন, “আমরা যা করিনি তার জন্য ওরা আমাদের দণ্ড দেবার চেষ্টা করছে।’ তিনি বলেন, সার্বরা কোন কিছুর জন্য দায়ী নয়। তিনি বলেন, সার্বরা মুসলমানদের পাশাপাশি বাস করতে চেয়েছে, তাদের অধীনে নয়। সারাইয়েভভাতে বসনিয়ার মুসলমানরাই নিজেদের লােকজনকে মেরেছে বলে অভিযােগ করে বলেন, এটা করে তারা বসনিয়ার সার্বদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ চেয়েছিল কিন্তু আত্মপক্ষ সমর্থন করার সময় তিনি তার বিরুদ্ধে ১১ দফা রণ-অভিযােগের কোন। সদুত্তর দিতে ব্যর্থ হন। আন্তর্জাতিক কোর্ট অব জাস্টিস-এর প্রেসিডেন্ট রােজালিন হিগিনস্ (Rosalyn Higgins) উল্লেখ করেন যে, বসনিয়া ও হারজেগােভিনায় যে গণহত্যা এবং যুদ্ধাপরাধের ঘটনা ঘটেছে তার অনেক সাক্ষ্য-প্রমাণ আছে। তার মধ্যে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড, ধর্ষণ, নির্যাতন, ক্যাপ ও আটক কেন্দ্রে জোর করে পাঠিয়ে দেওয়া রয়েছে।
আন্তর্জাতিক কোর্ট অব জাস্টিসের এসব বিষয়ে কিছু করার এক্তিয়ার নেই। কারণ এই কেস সীমিত আইনগত অর্থে বিশেষভাবে গণহত্যা নিয়ে কাজ করছে, ব্যাপক অর্থে নয়”। তার ওপর এই আদালত দেখেছে সার্বিয়া গণহত্যা ঘটায়নি কিংবা গণহত্যার ষড়যন্ত্র করেনি” অথবা “গণহত্যায় উস্কানি দেয়নি। তবে আন্তর্জাতিক কোর্ট অব জাস্টিস দেখেছে সার্বিয়া তাদের ক্ষমতা অনুযায়ী স্রেবারনিৎজার গণহত্যা রােধ করতে ব্যর্থ হয়েছে। এছাড়াও সার্বিয়া র্যাটকো। মলাডিচকে হেগ শহরে আন্তর্জাতিক কোর্ট অব জাস্টিসের কাছে সােপর্দ করতে ব্যর্থ হয়েছে। ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক কোর্ট অব জাস্টিস চিহ্নিত সমস্ত ব্যক্তিবর্গকে হস্তান্তর করতে হবে যারা সার্বিয়ায় এক্তিয়ারে বসবাস করে।

জার্মানির ডুসলডর্ফ (Disseldorf)-এর অবস্থিত উচ্চতর আঞ্চলিক আদালত ১৯৯৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বসনিয়ান সার্ব নেতা নিকোলা জরগিচ-এর বিরুদ্ধে একটি গণহত্যা সংক্রান্ত অভিযােগের রায় হস্তান্তর করে তাকে গণহত্যার সাথে জড়িত থাকার দায়ে চারটি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। মানবাধিকার সংক্রান্ত। ইউরােপীয় কোর্ট জরগিচের আপীলের আবেদন নাকচ করে দেয়। যদিও ওই আদালত বলে জার্মান আদালত তাদের অভ্যন্তরীণ আইন অনুযায়ী বিচার করেছে। তারা গণহত্যাকে ব্যাপক অর্থে নিয়েছে যাকে আন্তর্জাতিক আদালতগুলাে প্রত্যাখ্যান করে। যদিও কিছু কিছু পণ্ডিত মনে করেন, জার্মান গণহত্যা আইনের উচিত গণহত্যাকে কোন সুরক্ষিত গােষ্ঠীর শারীরিক-জৈবিক ধ্বংস হিসেবে ব্যাখ্যা করা, কিন্তু অনেকেই আবার মনে করেন, আক্ষরিক অর্থে কোন গােষ্ঠীর ধ্বংস, সামাজিক একক হিসেবে তাদের ধ্বংস শারীরিক-জৈবিক ধ্বংসের চেয়ে অনেক বড়, অনেক ব্যাপক। সাবেক যুগােস্লাভিয়ার জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ সংক্রান্ত ট্রাইবুনাল ২০০০ সালের ১৪ জানুয়ারি একটি এ ধরনের মামলার সময় রায় দেয় যে, বসনিয়ার মুসলমানদের এলাকা থেকে বিতাড়িত করার বিষয়টা ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কারণে নির্যাতন, কিন্তু গণহত্যা নয়। মানবাধিকার সংক্রান্ত ইউরােপীয় আদালতও একথা মেনে নিয়ে বলে, এই এথনিক ক্লেনজিং বা জাতিগতভাবে কোন গােষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করার বিষয়টা যা সার্ব বাহিনী বসনিয়া ও হারজেগােভিনার মুসলমানদের সাথে করেছে, সেটা গণহত্যার পর্যায়ে পড়ে না। ইউরােপীয় পার্লামেন্ট একটি রেজোলিউশন পাশ করে ইউরােপীয় ইউনিয়নকে স্রেবারনিৎজার গণহত্যার স্মরণে ১১ই জানুয়ারি দিনটি পালন করতে বলে। বিপুল ভােটে এই রেজোলিউশনে পাশ করে।
১৯৯৫ সালে ৮ হাজারের বেশি পুরুষ ও ১৫ বছর বয়সী কিশােরদের হত্যা করা হয়। ২০১০ সালের ১১ই জুলাই ১৫তম বার্ষিকী উপলক্ষ্যে শ্রেবারনিৎজার গণহত্যায় নিহতদের স্মরণ করা হয়, তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানাে হয়। জাতিসংঘের প্রতিরক্ষায় থাকার শহরটিতে সার্ব বাহিনী এই গণহত্যা। চালায়। তবে এই সংখ্যা মােট নিহতদের মাত্র ১০ ভাগের এক ভাগ। গণকবর থেকে। খুঁড়ে বের করা ৭৭৫টি কফিন নতুন করে সমাধিস্থ করা হয়। তাদের চিহ্নিত করা হয় ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে। এই অনুষ্ঠানে অবশ্য জাতিসংঘের পক্ষ থেকে কেউ আসেনি, তবে সার্বিয়ার প্রেসিডেন্ট বরিস টাডিচ উপস্থিত ছিলেন। তিনি জানান, তিনি। পুনর্মিলনের চেষ্টায় সেখানে আসেন এবং ঐ এলাকার জাতিগুলাের মধ্যে বিশ্বাস ও সমঝােতা গড়ে তুলতে চান। অনেকে তাঁকে সাবাস জানালেও কেউ কেউ উচ্চস্বরে জানতে চান, ‘মিলাডিচ কোথায়?’ সার্ব প্রেসিডেন্ট কথা দেন, যে কোন মূল্যে তারা। যুদ্ধাপরাধীদের গ্রেফতার করবেন । স্রেবারনিজার বিধবাদের প্রতিনিধি কার্ড হােটিচ সার্ব প্রেসিডেন্টকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, “আমরা আপনাকে শান্তির সাথে গ্রহণ করছি ।” বসনিয়ায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত চার্লস ইংলিশ মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার একটি বাণী পড়ে শােনান যাতে তিনি এই গণহত্যাকে “আমাদের সবার। বিবেকে একটি দাগ” বলে অভিহিত করেছেন। যাদের পুনরায় সমাধিস্থ করা হয়, তাঁদের মধ্যে ৭৭৫ জন মুসলমান, মাত্র একজন খ্রিষ্টান একমাত্র ক্রস চিহ্নিত কবরটি রুডল্ফ হেরেন-এর। তার মা বলেছেন, তার পুত্র এঁদের সবার সাথে মারা গেছেন, তাদের সবার সাথেই তিনি চিরন্দ্রিায় শায়িত থাকবেন।
গণহত্যা সম্পর্কে বসনিয়ান ও সার্ব, উভয়পক্ষের মধ্যে মতবিরােধ রয়েছে। ওপরে উল্লিখিত অনুষ্ঠানেও বসনিয়ার সার্বরা আসেনি, বরং সেই একই দিন কারাজিচের সার্ব ডেমােক্র্যাটিক দল তাকে সম্মানিত করেছে। বসনিয়ানরা মনে করে। স্রেবারনিৎজাতে যা ঘটেছে, সেটা একটি অংশ মাত্র, সার্বরা সেখানে ব্যাপকভাবে গণহত্যা ঘটিয়েছে। যদিও সাবেক যুগােস্লাভিয়ার জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ সংক্রান্ত। ট্রাইবুনালের বিচারকদের সার্ব সেনাবাহিনীর যুদ্ধকালীন সভার বিবরণী দেখার সুযােগ ছিল, কিন্তু তাঁরা সার্বিয়ার এই যুক্তি মেনে নিয়েছিলেন যে, এতে সার্বিয়ার জাতীয় নিরাপত্তা ক্ষুন্ন হবে। আন্তর্জাতিক কোর্ট অব জাস্টিসও সার্বিয়ার কাছ থেকে সরাসরি। দলিলপত্র দেখার জন্য পরােয়ানা জারি করতে পারতাে। কিন্তু তারাও সেটা করেনি। বরং সাবেক যুগােস্লাভিয়ার জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ সংক্রান্ত ট্রাইবুনালের মামলার সময় প্রকাশ করা কাগজপত্র দেখে কাজ চালিয়েছে। এতে অবশ্য আন্তর্জাতিক কোর্ট। অব জাস্টিসের দুজন বিচারক তীব্র ভাষায় এর সমালােচনা করেন। তাদের একজন নিউইয়র্ক টাইমস-এ লেখেন যে, সাবেক যুগােস্লাভিয়ার জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ। সংক্রান্ত ট্রাইবুনালের কাছে এসব দলিলপত্র হস্তান্তর করার সময় আইনজীবীরা বলেন, বেলগ্রেডের একটি দল ট্রাইবুনালের কাছের একটি এক চিঠিতে এবং কৌসুলি ও বিচারকদের সাথে তাদের বৈঠকেও একথা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে, সেগুলােকে যেন এমনভাবে সংশােধন করা হয় যাতে আন্তর্জাতিক কোর্ট অব জাস্টিসের কাছে। সার্বিয়ার কেসের কোন ক্ষতি না হয়। সাবেক যুগােস্লাভিয়ার জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ। সংক্রান্ত ট্রাইবুনাল সেটা জানতে এবং আন্তর্জাতিক কোর্ট অব জাস্টিসের প্রেসিডেন্ট। রােজালিন হিগিনস্ এ ব্যাপারে কোন মন্তব্য করতে অসম্মতি জানান যে, কেন সমস্ত রেকর্ড দেখতে চাইবার জন্য পরােয়ানা জারি করা হয়নি। ওয়াশিংটনের আমেরিকান। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের একজন শিক্ষক বলেন, কেন সমস্ত দলিলপত্র দেখতে চাওয়া। হয়নি? সেগুলাে নিষিদ্ধ না করা হলে হয়ত মামলার গতি অন্যদিকে যেতাে।
৫৪
কম্বােডিয়া
১৮৭৫ সালের এপ্রিল মাসে যখন খেমার রুজ (Khmer Rouge) বাহিনী বিজয়ীর বেশে কম্বােডিয়ার রাজধানী নমপেনে ঢােকে, তখন সে দেশের সাধারণ মানুষ সােল্লাসে তাদের স্বাগত জানায়। তাদের পাথরের মত মুখ দেখেও শঙ্কিত হয়নি কম্বােডিয়ার মানুষ, আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠেছিল। কিন্তু গৃহযুদ্ধের অবসানে যে আনন্দ তারা অনুভব করেছিল, সেটা মুছতে সময় লাগেনি। খেমার রুজ বাহিনী সবাইকে রাজধানী ছেড়ে চলে যেতে নির্দেশ দেয়। তাদের বলা হয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নমপেনের ওপর বােমাবর্ষণ করতে যাচ্ছে। আসল ঘটনা ছিল তাদের গ্রামে পাঠিয়ে দেওয়া। সমাজতন্ত্র সম্পর্কে যে ভুল ধারণা খেমার রুজ লালন করছিল, তারই এই। সিদ্ধান্ত। তারা একমাত্র কৃষকদেরই সমাজতন্ত্রের প্রতিভূ হিসেবে দেখেছে। নাগরিক জীবনের অর্থ হচ্ছে পুঁজিবাদের কাছে আত্মসমর্পণ করা। সবাইকে তাই নগরজীবন ছেড়ে গ্রামে গিয়ে চাষবাস করতে হয়েছে। ধর্ম, অর্থ, ব্যক্তি মালিকানা, পারিবারিক সম্পর্ক, সমস্ত ভেঙ্গে দিতে চেয়েছে খেমার রুজ। তারা বলেছিল, কম্বােডিয়ার ২০০০ বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্যের অবসান ঘটলাে। ১৯৭৫ সালের এপ্রিল মাস হচ্ছে ‘শূন্য’ (০) বছর। সেটাই নতুন কম্বােডিয়া বা গণতান্ত্রিক কাপুচিয়ার সূচনা এর পরের চার বছরের ইতিহাস ভয়াবহ, বেদনাদায়ক ও করুণ। ‘কিলিং ফিল্ডস’ নামে পরিচিত। অনেকগুলাে জায়গা তার স্বাক্ষর বহন করছে, যেখানে গণকবর রয়েছে। প্রচুর সংখ্যক মানুষকে আপাতত কোন কারণ ছাড়াই হত্যা করা হয়েছে। তাদের অনেককে নিজের কবর নিজেকেই খুঁড়তে হয়েছে। অন্তত ২ লক্ষ মানুষকে খেমার রুজ বাহিনী হত্যা করেছে। কম্বােডিয়ার সাংবাদিক ডিথ প্রান খেমার রুজের হাত থেকে পালাতে সক্ষম হন এবং তিনি কিলিং ফিল্ডস নামে একটি বই লেখেন, যা অবলম্বনে পরে রােল্যান্ড জফে (Roland Joffe) একই নামে ছবি তৈরি করেন। খেমার রুজ বাহিনী যে সাবেক সরকার বা বিদেশী কোন দেশের সাথে সংযােগ আছে বলে সন্দেহভাজন লােকজনকে গ্রেফতার করে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে তা নয়, পেশাজীবী ও বুদ্ধিজীবীদেরও হত্যা করেছে। তাদের নির্যাতনের শিকার হয়েছে জাতিগতভাবে ভিয়েতনামী, থাই, চীনা, মুসলমান, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ ভিক্ষু প্রমুখ।
কম্বােডিয়ার জনগােষ্ঠীর ১৫% সংখ্যালঘু। কিন্তু খেমার রুজ স্ট্যান্ডিং কমিটিতে কিছু ভিয়েতনামী ও টীনা থাকাতে তারা সংখ্যালঘুর ওপর অত্যাচার করছে এমন কথাও বলা যায়নি। যুদ্ধোত্তর দেশের অন্য সমস্যার সাথে মিশেছে রাজনৈতিক দমননীতি। তার ফলে অনেক মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। ১৯৭৫-১৯৭৯ সাল পর্যন্ত খেমার রুজের শাসনামলে কত মানুষ মারা যায়, সে সম্পর্কে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমীক্ষায় এই সংখ্যাকে আনুমানিক ১৭ লক্ষ জানিয়ে মন্তব্য করা হয়, কম্বােডিয়ার গণহত্যা হচ্ছে

“গত শতাব্দীর অন্যতম শােচনীয় মানবিক ট্রাজেডি”। কম্বােডিয়ার ডকুমেন্টেশন সেন্টারের গবেষক ক্রেগ এচেসন মনে করেন গণহত্যায় নিহতের সংখ্যা বিশ থেকে পঁচিশ লক্ষ। খেমার রুজ সরকারের বিচার বিভাগীয় পদ্ধতি অনুযায়ী লােকজনকে তাদের “অপরাধের জন্য হুঁশিয়ারি পাঠানাে হতাে। এসব অপরাধের মধ্যে আছে। বিপ্লব-পূর্ব জীবনে কোন ধরনের খােলা-বাজার-তৎপরতা, সরকার, কোন মিশনারী, বিদেশী সংস্থা ইত্যাদির সাথে সম্পর্ক। দু’টি হুঁশিয়ারি পাবার অর্থ হচ্ছে প্রায় মৃত্যু। গােলাগুলি খরচ বাঁচাবার জন্য জীবন্ত কবর দেওয়া, বিষ, ধারালাে বাঁশের লাঠি ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে বাচ্চাদের গাছের গুড়িতে ছুড়ে মেরে হত্যা করা হয়, যাতে তারা বড় হয়ে তারা তাদের বাবা-মায়ের হত্যার প্রতিশােধ নিতে না পারে।
১৯৯৭ সালে কম্বােডিয়া সরকার জাতিসংঘের কাছে গণহত্যা ট্রাইবুনাল গঠনের ব্যাপারে সাহায্য চায় । তবে সেই আদালতের রূপরেখা, কাঠামাে কী হবে সেটা ঠিক করতে ৯ বছর কেটে গেছে। ২০০৬ সালে বিচারকরা শপথ নেন। জাতিসংঘের পৃষ্ঠপােষকতায় গঠিত এই যুদ্ধাপরাধ সংক্রান্ত ট্রাইবুনাল, যুদ্ধাপরাধের শিকার নিরীহ অসহায় মানুষকে তাদের কথা বলার সুযােগ করে দিয়েছে। সেই সাথে বিলম্বিত বিচারকে ত্বরান্বিত করার প্রচেষ্টা নেওয়া হয়। ২০১০ সালের গােড়ার দিকে আদালত সিদ্ধান্ত নেয় যে, দুজন আইনজীবীর মাধ্যমে সমস্ত বাদীর প্রতিনিধিত্ব করা হবে। তাদের একজন কম্বােডিয়ান, অন্যজন আন্তর্জাতিক। এটি এক্সট্রাঅর্ডিনারি চেম্বারস্ ইন দি কোর্টস অব কম্বােডিয়া’ নামে পরিচিত। ট্রাইবুনাল একটি ‘সিভিল পাটি’ ব্যবস্থা গঠন করে যার লক্ষ্য বিশেষজ্ঞ নন, এমন লােকজনকে একটি আনুষ্ঠানিক ভূমিকা পালন করার সুযােগ করে দেওয়া যাতে সাক্ষ্য, সন্দেহভাজনকে প্রশ্ন করা এবং ক্ষতিপূরণ দাবি করা সম্ভব হয়। চার হাজারের বেশি মানুষ আবেদন জানায় এবং ২০০৯ সালের শেষ নাগাদ তাদের মধ্যে ২৫০ জনের দাবি গ্রহণ করা হয়। এই ট্রাইবুনালে পাঁচজনের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযােগ আনা হয়। কম্বােডিয়ায় জাতিসংঘের পৃষ্ঠপােষকতায় যুদ্ধাপরাধ সংক্রান্ত ট্রাইবুনালে একজন কারা প্রধান কেইন গুয়াক ঈভ বা ডুখ (Duch) অপরাধী প্রমাণিত হয়েছে। তাকে ১৯৯৯ সালে আচমকা খুঁজে পেয়েছেন একজন ব্রিটিশ আলােকচিত্রীসাংবাদিক। তার বিচার শেষ হয়েছে ২০১০ সালের জুলাই মাসে। সাতষট্টি বছর বয়সী এই যুদ্ধাপরাধীর ৩৫ বছরের কারাদণ্ড হয়েছে। ডুখ টুয়ল স্লেঙ্গ কারাগারে হাজার হাজার নারী ও শিশুর ওপর নির্যাতন এবং হত্যার বিষয়টা তদারকি করার কথা। স্বীকার করে ক্ষমা চেয়েছেন।
তবে তিনি বলেছেন শুধুমাত্র ঊর্ধ্বতন অফিসারদের আদেশ পালন করছিলাে। তিনি মুক্তি চাওয়াতে আদালতে উপস্থিত সকলে স্তম্ভিত হয়। অবশ্য তার পুরাে ৩৫ বছরের কারাদণ্ড হবে না। তাকে অবৈধভাবে আটক রাখার জন্য ৫ বছরের এবং কারাগারে আটক থাকার জন্য ১১ বছরের কারাদণ্ড মওকুফ করা হয়েছে। পাঁচজন বিচারপতির এক প্যানেল তার অপরাধকে নৃশংস বলে বর্ণনা করেন। রাজধানী নমপেনের বাইরে এই আদালতের রায় শােনার জন্য অনেক মানুষ জড়াে হয়েছিল। তাদের মধ্যে যারা জীবিত, তারা সেসব নির্মম অত্যাচারের কাহিনী আদালতে বর্ণনা করেন। খেমার রুজ প্রধান পল পট ১৯৯৮ সালে মারা যান। সাবেক গণিতের শিক্ষক কেইন গুয়াক ঈভ বন্দীদের কাছ থেকে স্বীকারােক্তি আদায়ের জন্য তাদের নখ উপড়ে ফেলতেন ও তাদের বৈদ্যুতিক শক দিতেন। ডুখ আবার নিষ্ঠার সাথে তার নিজের কৃতকর্মের সমস্ত রেকর্ড রেখেছেন। এক মেমােতে জানা গেছে ডুখকে একজন কারারক্ষী যখন জিজ্ঞাসা করেন, ছয়জন বালককে কী করা হবে? তখন ডুখের জবাব ছিল, তাদের প্রত্যেককে হত্যা করাে।”
এই টুয়ল স্লেঙ্গ-এ এখন একটি জাদুঘর করা হয়েছে যেখানে এই গণহত্যার স্মৃতিকে জীবিত রাখা হয়েছে। চুয়াঙ্গ এক-এর গণকবর ঘিরে স্মৃতিসৌধ ও পার্ক গড়ে তােলা হয়েছে। অনেক গণকবর এখনাে দৃশ্যমান। সবগুলাে এখনাে খোঁড়া হয়নি। সেখানে অনেক মানুষের জীবন্ত সমাধি হয়েছিল। এখনাে বেশি বৃষ্টিপাত হলে মাটির ওপর হাড় কিংবা ছিন্নভিন্ন কাপড় উঠে আসে। টুয়ল স্লেঙ্গ কারাগারে ১৭, ০০০ কম্বােডীয় মারা যায়, বেচে ছিল মাত্র ১২ জন। তাদের মধ্যে তিনজন এখনাে বেচে আছে। কম্বােডিয়ার সাধারণ মানুষের দুর্ভাগ্যের পেছনে মূল কলকাঠি যিনি নেড়েছিল, সেই পল পট ১৯৯৮ সালে মারা যান। তবে তার ডেপুটি নয়ন চিয়া অভিযুক্ত হয়েছে। আরাে অভিযুক্ত হয়েছে সাবেক প্রেসিডেন্ট খিউ সাফান, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী লেং স্যারি ও তার স্ত্রী লেং থিরিথ। এরা ২০০৭ সাল থেকে আটক রয়েছে। এদের সকলেই বয়ােবৃদ্ধ। খিউ সাফানের বয়স ৭৯, নুয়ন চিয়ার বয়স ৮৪, লেং স্যারির বয়স ৮৪ এবং যুদ্ধাপরাধের জন্য অভিযুক্ত একমাত্র কম্বােডিয়ান নারী সাবেক সমাজকল্যাণ মন্ত্রী লেং থিরিথের বয়স ৭৮ বছর। এই চার নেতাই অভিযােগ প্রত্যাখ্যান করেছেন। সেপ্টেম্বর ২০১০-এ কম্বােডিয়ার জাতিসংঘ সমর্থিত ট্রাইবুনাল জানিয়েছে যে, ২০১৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে এই চার নেতার বিচারকাজ শুরু হবে বলে আশা করা যায়।
৫৮
ইরাক
ইরাকের যুদ্ধাপরাধের বিবরণ লিপিবদ্ধ করা সহজ নয়, যেমনটা আফগানিস্তানের। এই দু’টি দেশেরই ভাগ্যাহত মানুষ একই সাথে দখলদার বাহিনী এবং দেশের ভেতরে। কর্মরত সশস্ত্র গােষ্ঠীগুলাের শিকারে পরিণত হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে হামলার ঘটনা শুধু যে ২০০৩ সালে ঘটেছে তা নয় । উপসাগর যুদ্ধের সময় ইরাকের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধাপরাধ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক ওয়ার ক্রাইম ট্রাইবুনাল জানায়, মার্কিন বিমান রাস্তায় বােমাবর্ষণ করে যার ফলে ষাট মাইল জুড়ে দুই হাজারের বেশি পুড়ে যাওয়া গাড়ির কাঠামাে এবং হাজার মানুষের অঙ্গার হয়ে যাওয়া মৃতদেহ পাওয়া যায়। দ্রুত জ্বলতে থাকা মানুষের শরীর ন্যাপাম, ফসফরাস ও সেরকম কিছু ব্যবহারের ইঙ্গিত দেয়। উল্লেখ্য ১৯৭৭ সালের জেনিভা প্রােটোকলে এসবই নিষিদ্ধ ঘােষিত হয়। জাতিসংঘ প্রস্তাব ৬৬০ মেনে নিয়ে সাদ্দাম হােসেন যখন কুয়েত থেকে সেনা প্রত্যাহারের কথা ঘােষণা করেন, তারপরই এই হামলা হয়। এটি ১৯৪৯ সালের জেনিভা কনভেনশনের সাধারণ ধারা ৩-এর লঙ্ঘন। যারা মারা গেছে তাদের। অনেকেই ফিলিস্তিনি ও কুয়েতী বেসামরিক নাগরিক বলে অনুমান করা হচ্ছে যারা যুদ্ধের ভয়াবহতা এড়াতে পালাবার চেষ্টা করছিল। এই তদন্ত কমিশন গঠন করেন। লিন্ডন বি, জনসনের সময়কার অ্যাটর্নি জেনারেল র্যামসি ক্লার্ক। তিনি নিউ ইয়র্কে ১৯৯১ সালের ১১ মে ওয়ার ক্রাইম ট্রাইবুনালের তদন্ত কমিশনের শুনানীর সময় এটি প্রকাশ করেন। এই কমিশন গঠনের কথা শুনে বিশ্বের নানা জায়গা থেকে অনেকেই এসে যােগ দেন এবং যেখানে যেখানে সম্ভব হয়েছে, সেখানে অন্য কমিশনের। রিপাের্টকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই শুনানীর সময় বিধ্বস্ত জনপদ, দগ্ধ মৃতদেহ, হাসপাতালে অসুস্থ, আহত, পুষ্টিহীন শিশুদের ছবি দেখানাে হয়। র্যামসি ক্লার্ক পদ্ধতিগতভাবে অবকাঠামাে ধ্বংসের কথা লিপিবদ্ধ করেন পরে যা সমর্থন করে আরাে রিপাের্ট বের হয় যার মধ্যে জাতিসংঘের নিজস্ব তদন্ত দলও রয়েছে। এই ট্রাইবুনালের আভযুক্তরা হচ্ছেন জর্জ বুশ, ড্যান কোয়েইল, জেমস বেকার, রিচার্ড চেনি, উইলিয়ম ওয়েবস্টার, কলিন পাওয়েল, জেনারেল নরমান সােয়রজকফ প্রমুখ। তাদের বিরুদ্ধে অভিযােগ শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক আইন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান লঙ্ন। এই তদন্ত শেষে সুপারশি করা হয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যাতে ভবিষ্যতে ইরাক, লিবিয়া, কিউবা, হাইতি, উত্তর কোরিয়া বা ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে কোন আগ্রাসী ব্যবস্থা না নেয়, সেজন্য জোরালােভাবে জনসাধারণকে ব্যবস্থা নিতে হবে। এছাড়াও বেসামরিক ও সামরিক উভয় মানুষের ওপরই হামলা চালাবার জন্য কোন সামরিক প্রযুক্তি ব্যবহারের নিন্দা করা হয়।

এরপর ২০০৩ সালে মার্কিন ও ব্রিটিশ বাহিনীর নেতৃত্বে ইরাক দখলের মধ্যে দিয়ে যার শুরু তার অবসান আজও ঘটেনি। ইরাক সরকারই ২০০৭ সালে ডিসেম্বর মাসে জানিয়েছে দেশের ৫০ লক্ষ শিশু অনাথ হয়েছে, যা ইরাকের গােটা শিশু জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক। ইরাকের সাইকিয়াট্রিক সােসাইটি এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা উত্তর বাগদাদের প্রাথমিক স্কুলের ১০ হাজার ছাত্র/ছাত্রীর মধ্যে এক সমীক্ষা চালায়। তাতে জানা গেছে, ইরাকের ৭০% শিশু মানসিক আঘাতের ফলে স্নায়ুরােগে ভুগছে। একজন ইরাকি মনস্তত্ত্ববিদের মতে, এদের অনেকেই আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে পারে। ইরাকের সংঘর্ষের বলি ইরাকের সাধারণ মানুষ সম্পর্কে নিচে একটি ছকে বিভিন্ন সংস্থার হিসেব দেওয়া হলাে:

ইরাক যুদ্ধ ও দখলদারীত্বের হতাহতের সংখ্যা বিভিন্ন সূত্রমতে বিভিন্ন রকমের পাওয়া গেছে। সঠিক তথ্য পাওয়া দুষ্কর। অনেককে তাড়াহুড়াে করে কবর দেওয়া হয়েছে। অনেকে নিখোঁজ যারা বেঁচে আছে কিনা জানা যায়নি। এদের খবর সরকারি হিসেবে যেমন নেই, তেমনি গণমাধ্যমেও আসেনি। এই সংখ্যাই কয়েক হাজার হবে। যে পরিসংখ্যান পাওয়া যায় সেটা সম্পর্কেও প্রচুর বিতর্ক আছে। ইরাকি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে যে হিসেব রয়েছে সেটা মূলত হাসপাতাল ও মর্গ থেকে দেওয়া মৃত্যুর সার্টিফিকেটের ওপর নির্ভর করে পাওয়া। ২০০৫ সালের জানুয়ারি থেকে ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এই সংখ্যা হচ্ছে ৮৭,২১৫। তার আগের দু’বছরের কোন। হিসেব পাওয়া যায়নি। তবে অ্যাসােসিয়েটেড প্রেস জানিয়েছে প্রথম দু’বছরে হতাহতের সংখ্যা ১১০,৬০০। জাতিসংঘ জানিয়েছে, ২০০৬ সালে সহিংসতার ফলে ৩৪,৪৫২ ইরাকি নাগরিকের মৃত্যু ঘটেছে। এই হিসাব মর্গ, হাসপাতাল ও পৌর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য থেকে সংগৃহীত। ২০০৫ সালের ডিসেম্বর মাসে স্বয়ং মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ বলেছিলেন, ৩০ হাজার ইরাকি মারা গেছে। হােয়াইট হাউজের মুখপাত্র জানান, এটি একটি বেসরকারী হিসেব যা সংবাদ মাধ্যমের খবরের। ওপর ভিত্তি করে পাওয়া। জাতিসংঘ ল্যান্সেট ২০০৬ সালের জুন মাসে বাড়ি বাড়ি গিয়ে করা জরিপে ৬৫৪,৯৬৫টি বাড়তি মৃত্যুর হিসেব পায়। এতে সহিংস ঘটনায় মৃত্যুর পাশাপাশি সহিংস নয়, এমন মৃত্যুর হিসেবও রয়েছে।
এর মধ্যে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, অবকাঠামাে ভেঙ্গে পড়া, স্বাস্থ্য সেবার অভাবও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। সহিংস হত্যার মধ্যে ৩১% ঘটেছে কোয়ালিশন বাহিনীর হাতে, ২৪% অন্যদের হাতে এবং ৪৬% অজানা। সহিংস ঘটনার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত আছে গুলি বর্ষণ, গাড়ি বােমা, অন্য বিস্ফোরণ, বিমান হামলা ইত্যাদি। রয়টারের খবরে জানা গেছে, কর্মরত অবস্থায় ১৩৬ জন সাংবাদিক এবং সাহায্য সংস্থার কর্মী মারা গেছে। ইরাক যুদ্ধ ও পরবর্তী সময়ে মার্কিন সামরিক বাহিনীর অনেক সদস্য মারা গেছে। ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাস নাগাদ ৪,৩৭৯ জন মারা গেছে। কোয়ালিশন বাহিনীর ৪,৫৬৮ জন মারা গেছে যার মধ্যে বিরােধী পক্ষের গুলি বর্ষণে মারা গেছে ৩,৬৬২ জন। বহুজাতিক যে কোয়ালিশন বাহিনী, তাতে ব্রিটেন ও আমেরিকা ছাড়াও ইউরােপ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, সাবেক সােভিয়েতভুক্ত দেশগুলাের সদস্য রয়েছে। এমনকি যেসব ঠিকাদার ইরাকে কাজের জন্য গিয়েছে বা সেখানে যারা কাজ করে, তারাও এই সংঘর্ষের কারণে মৃত্যু থেকে রেহাই পায়নি। ২০০৬ সালের নভেম্বর মাসে জাতিসংঘের শরণার্থী সংক্রান্ত হাই কমিশন এক হিসেবে জানিয়েছে, ১৮ লক্ষ ইরাকি প্রতিবেশী দেশগুলােতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে এবং দেশের ভেতরেরই গৃহহীন ও বাস্তুচ্যুত ইরাকির সংখ্যা ১৬ লক্ষ। এছাড়াও প্রতি মাসে প্রায় এক লক্ষ ইরাকি সিরিয়া ও জর্ডানে পালিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে।

ইরাক যুদ্ধের আগে আফগানিস্তানে মার্কিন জেনারেল টমি ফ্যাঙ্ক বলেছিলেন, “আমরা মৃতদেহ গণনা করি না। কিন্তু তিনি ইরাক যুদ্ধ শুরু হবার পর জানিয়েছিলেন যে, এপ্রিল ২০০৩-এ ৩০ হাজার ইরাকি হতাহত হয়েছে। এই সংখ্যা জানা যায় বিখ্যাত সাংবাদিক বব উডওয়ার্ডের সাথে তকালীন মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ডােনাল্ড র্যামসফেল্ডের এক সাক্ষাৎকারে। সে বছরেরই অক্টোবর মাসে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস-এর কেম্ব্রিজের কমনওয়েলথ ইন্সটিটিউট প্রতিরক্ষা বিকল্প সংক্রান্ত এক প্রকল্পের সমীক্ষায় জানা গেছে, ২০০৩ সালের ইরাক যুদ্ধে ৭,৬০০ থেকে ১০,৮০০ ইরাকি যােদ্ধা মারা গেছে। একই সমীক্ষা জানায়, ৩,২০০ মানুষ মারা গেছে যারা যােদ্ধা নয় বা যুদ্ধে সরাসরি অংশ নেয়নি। ইরাক যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ইরাকি বেসামরিক নাগরিকরা। তবে এই সংখ্যা নিয়ে তীব্র বিতর্ক রয়েছে। যুদ্ধের সাথে সরাসরি জড়িতদের কাছ থেকে বেসামরিক নাগরিকদের সংখ্যাকে পৃথক করাটাও সহজসাধ্য নয়। ২০০৩ সালের মার্চ থেকে এপ্রিল মাসের যুদ্ধে ১,২৫২ জন বেসামরিক নাগরিক মারা গেছে আর ৫,১০৩ জন আহত হয়েছে বলে জানিয়েছিল আবু ধাবী টেলিভিশন। ইরাকি রাজনৈতিক দল পিপলস্ কিফা ২০০৩ সালের মার্চ থেকে জুন মাসে করা এক জরিপে জানিয়েছে, ৩৬,৫৩৩ নাগরিক মারা গেছে। তারা এই জরিপ ইরাকের অ-কুদী এলাকায় করে। এই তথ্য প্রথম প্রকাশিত হয় ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের অবসরপ্রাপ্ত রিপাের্টার জুড ওয়ানিস্কির (Jude Wanniski) ওয়েবসাইটে। পরে আল-জাজিরা এটি জানায় তবে এই সমীক্ষা সম্পর্কে বলা হয়েছে এর পদ্ধতি খুব একটা জোরালাে ছিল না। যুক্তরাজ্য/যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক নিরেপক্ষ গােষ্ঠী ইরাকি বডি কাউন্ট পরবর্তীতে এক রিপােটে বলেছে, ৭,২৯৯ বেসামরিক নাগরিক প্রধানত মার্কিন বিমান ও স্থল বাহিনীর হামলায় নিহত হয়েছে। এই গােষ্ঠী অবশ্য ইরাকে দখলদার বাহিনীর পাশাপাশি বিদ্রোহী দলগুলাের হামলা ও নির্যাতনের কথাও বলেছে। তারা মনে করে, দখলদার বাহিনীর দায়িত্ব সব ধরনের মৃত্যু ও নির্যাতন রােধ করা। নিচে বেসামরিক নাগরিকদের। মৃত্যু সম্পর্কে ইরাকি বডি কাউন্ট-এর কিছু পরিসংখ্যান দেওয়া হলাে:

২০০৬ সালের জুন মাসে লস এঞ্জেলেস টাইমস এক নিবন্ধে লেখে, “যুদ্ধে ইরাকি মৃত্যুর সংখ্যা ৫০,০০০ ছাড়িয়ে গেছে। সংবাদপত্রটি জানায় এদের অধিকাংশ বেসামরিক নাগরিক, তবে কিছু নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য এবং চরমপন্থী বিদ্রোহীও থাকতে পারে। সংবাদপত্রটি এসব মৃত্যু রেকর্ড করার অভাব ও বিশৃঙ্খলার কথাও জানায়। যুদ্ধশেষে প্রথমদিকে সেভাবে কোন সরকারও ছিল না। তাদের সূত্র সম্পর্কে বলা হয়, ২০০৩ সালে ইরাকি মর্গে ৩০,২০৪টি মৃতদেহ এসেছিল, যদিও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায় তাদের গণনায় এ সংখ্যা ১৮,৯৩৩। এসব মৃত্যুর কারণ সামরিক সংঘর্ষ এবং সন্ত্রাসী হামলা। এর মধ্যে অবশ্য বাগদাদের বাইরের মৃত্যুকে হিসেবে ধরা হয়নি। ২০০৪ সালের মে মাসে অ্যাসােসিয়েটেড প্রেস এক জরিপ সম্পন্ন করে তাদের ফলাফলে বলা হয়, ৫৬ লক্ষ মানুষের শহর বাগদাদে ৪,২৭৯ জন ১২ মাসে নিহত হয়েছে।

মৃত যারা তারা সব কিছুর উর্ধ্বে। কিন্তু যারা পড়ে আছে তাদের বেদনা-যন্ত্রণার তুলনা হয় না। সত্যি কথা বলতে কি, তারাই আসল ‘ক্যাজুয়লিটিজ অব ওয়ার’ । ইরাক যুদ্ধ তৈরি করেছে বিপুল সংখ্যক মানসিক রােগী। সৃষ্টি করেছে– সৈনিকদের মধ্যে যেমন, তেমনি সাধারণ নাগরিকদেরও। ২০০৭ সালের মার্চ মাসে টাইম সাময়িকী এক সমীক্ষার বরাত দিয়ে লিখেছে, ইরাক ও আফগানিস্তান থেকে ফিরে আসা সৈনিকদের মধ্যে ১০৩,৭৮৮ জনের মানসিক রােগ বা মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা রয়েছে বলে জানা গেছে। প্রচুর আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। এছাড়াও ইরাকি নাগরিকদের মধ্যে এই সমস্যা রয়েছে বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে। মানসিক এবং ভীতিজনিত সমস্যা অনেক শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধিকে ব্যাহত করছে। ইরাক যুদ্ধ বর্তমান সময়ের বিশ্ব রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলেছে। নিন্দার ঢেউ উঠেছে। বিশেষ করে ব্রিটেনের নির্বাচনেও তার প্রতিফলন দেখা গেছে। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যারিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক নীতি সংক্রান্ত কর্মসূচীর এক জরিপে দেখা গেছে, প্রেসিডেন্ট বুশের সমর্থকদের ৭০% শতাংশ বিশ্বাস করে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে পরিষ্কার প্রমাণ ছিল যে সাদ্দাম হােসেন আল-কায়েদার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছেন।
এসব সমর্থকদের এক তৃতীয়াংশ মনে করে, সাদ্দামের কাছে গণবিধ্বংসী অস্ত্র (ওয়েপন অব মাস ডেস্ট্রাকশন) ছিল এবং এক তৃতীয়াংশের বেশি মনে করে বিশ্ব জনমত ইরাকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন হামলাকে সমর্থন করে। অন্যদিকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করে যে একেবারে পার পেয়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্র বা কোয়ালিশন বাহিনী, সেটা বলা যাবে না। ২০০৪ সালে গােড়ার দিকে নির্যাতনের এক ভয়াবহ চিত্র জনসমক্ষে আসে যা ঘটেছে আবু গারিব নামে এক কারাগারে। শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতন, শেষােক্তটির মধ্যে ধর্ষণও সমকামিতা ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এর জন্য দায়ী মার্কিন সেনাবাহিনী ও অতিরিক্ত মার্কিন সরকারি সংস্থা। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরকে ১৭ জন সৈনিক ও অফিসারকে কর্তব্য থেকে সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়। আরাে ১১ জনের বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযােগ দায়ের করা হয়। তাদের কোর্ট মার্শাল হয়, তারা অপমানিত হয়ে চাকুরিচ্যুত হয় এবং সামরিক কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়। কমান্ডিং অফিসার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জ্যানিস কারপিনস্কির কর্নেল পদে পদাবনতি হয়। ইরাকে যতটা যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, তার সবটুকু প্রকাশ হয়নি, তার সবটার বিচার হয়নি। যুদ্ধের অবসান ঘটলেও ইরাক সমস্যার সমাধান হয়নি। ইরাকের সাধারণ মানুষের দুর্ভাগ্য তারা এখনাে দু’ধারি। তরবারির মাঝখানে বসবাস করছে।
৬৫

ইসরায়েল-ফিলিস্তিন
বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন সমস্যা এবং যুদ্ধাপরাধ সম্ভবত সংঘটিত হয়েছে আরবইসরায়েল সংঘর্ষের ফলে বলা যায় প্রায় এক শতাব্দী কেটে গেছে কিন্তু এই সংকটের অবসান তাে দূরের কথা, এর কোন সমাধানের চিহ্ন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। কেউ কেউ মনে করে এই সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে ১৯৪৮ সালে আধুনিক ইসরায়েল রাষ্ট্র স্থাপনের পর থেকে। ঐ অঞ্চলকে ইহুদীরা মনে করে ঐতিহাসিকভাবে তাদের নিজভূমি আর আরবরা মনে করে সেটা ফিলিস্তিনিদের জায়গা, সে তারা মুসলমান, খ্রিষ্টান, দ্রজ বা অন্য কেউ হােক। অটোমান সাম্রাজ্য ধ্বসে পড়ার পর থেকে এই সংঘর্ষ রাজনৈতিক ও জাতীয়তাবাদী সংঘর্ষ হিসেবে শুরু হয় এবং বছরের পর বছর কেটে যাবার পর সেটা এখন ফিলিস্তিনি-ইসরায়েল সংকটে এসে পড়েছে। তবে বাকি আরব দেশগুলােও সরে যায়নি। নির্দিষ্ট অঞ্চল নিয়ে তাদের সমস্যাও অব্যাহত আছে। এর মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে ফিলিস্তিনি লিবারেশন অর্গানাইজেশন বা পিএলও (PLO) । মঞ্চে এসেছে হামাস, ফাতাহ- নানা গােষ্ঠী। স্বাক্ষর হয়েছে অনেক শান্তিচুক্তি আর অস্ত্র-বিরতি। কিন্তু ঐ অঞ্চলের সাধারণ মানুষের ভাগ্যে কোন পরিবর্তন আসেনি। প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি, হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। শুধুমাত্র মানবিক হতাহতের ঘটনার কথা যদি উল্লেখ করতে হয়, তাহলে দেখা যাবে ১৯৪৫ থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত এই সংখ্যা ৯২,০০০, যার মধ্যে ৭৪,০০০ সামরিক আর ১৮,০০০ বেসামরিক নাগরিক। ১৯৫০ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত ৫১,০০০ হতাহতের ঘটনা ঘটেছে যার মধ্যে ৩৫,০০০ আরব আর ১৬,০০০ ইহুদী। এটি নির্দিষ্ট সময়ের হিসেব। এই সংঘর্ষের সময়কাল ও ব্যাপ্তি। এত বেশি যে স্বল্প পরিসরে সেটা লিপিবদ্ধ করা সম্ভব নয়। তাই এই পরিচ্ছেদে সামান্য কিছু ঘটনার উল্লেখমাত্র করা হল। ২০০৬ সালে যখন প্যালেস্টাইনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলাে, তখন তাকে পশ্চিমের অনেকেই সঠিকভাবে গণতন্ত্রের প্রতিফলন বলে দেখেছিল।
কিন্তু মার্কিন ও ইসরায়েল সরকার গাজার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরােধ সৃষ্টি করল। তার ফলে ঐ অঞ্চলে অর্থনৈতিক ও মানবিক সংকট শুরু হল। হামাস ও ইসরায়েল পরস্পরের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে লিপ্ত থাকছে, তার ফল ভােগ করছে সাধারণ মানুষ। কিন্তু ২০০৮ সালের: ক্রিস্টমাসের দিন সার্কিরন সমর্থনে ইসরায়েল গাজায় এক গণহত্যা চালায় যাতে নিহত হয় ১,৩০০ ফিলিস্তিনি যার মধ্যে ৩৫০ জন শিশু রয়েছে। এছাড়াও আই ৩ ৫,৫০০ নাগরিক। ইসরায়েল আবাসিক এলাকায় গােলাবর্ষণ করছে এবং ফ পরিবারকে মানবিক ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে বলে অভিযােগ উঠেছে।জাতিসংঘের কর্মকর্তা ও মানবাধিকার সংস্থাগুলাের কাছে যুদ্ধাপরাধের ৩৭৭। ব্যাপারে ক্রমবর্ধমান দাবি উঠছে। জাতিসংঘের একটি স্কুল, যা শরণার্থী শিবিরে পরিণত হয়েছিল, সেখানে গােলাবর্ষণ হলে ৪০ জন মারা যায়। পদ্ধতিগতভাবে মানবাধিকার সংক্রান্ত আইন ভঙ্গ করছে এই অভিযােগের তদন্তের দাবি জোরালাে হয়েছে। কিছু মানবাধিকার সংগঠন অভিযােগ ক1,৫০, ইসরায়েলী নেতৃত্ব বেসামরিক নাগরিকদের ভাগ্যে যা-ই ঘটুক না কেন, সামরিক ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে রাখবার নির্দেশ দিয়েছে। গাজায় জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শাণ। সংস্থার প্রধান জন গিন্স বলেছেন, “আমরা রায় দেবার জন্য কারাে সাথে গলা মেলাতে চাই না, কিন্তু যে কোন এবং প্রতিটি ঘটনার তদন্ত হওয়া দরকার, যেখানেই আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গের ব্যাপারে উদ্বেগ আছে।”

ইসরায়েলী সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে এসব অভিযােগ রয়েছে: বেসামরিক এলাকায় শক্তিশালী গােলাবর্ষণ, যেখানে সেনাবাহিনী জানে যে, ব্যাপক সংখ্যায় নিরপরাধ নাগরিক হতাহতের ঘটনা ঘটবে; ফসফরাস বােমার মত নিষিদ্ধ ঘােষিত অস্ত্র ব্যবহার; • ফিলিস্তিনি পরিবারকে মানবিক ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা; মেডিকেল উপকরণ ও স্থাপনার ওপর হামলা, যার মধ্যে ১২ জন অ্যাম্বুলেন্স কর্মীর হত্যা। উল্লেখ্য, অ্যাম্বুলন্স পরিষ্কারভাবে চিহ্নিত করা ছিল; • প্রচুর সংখ্যক পুলিশকে হত্যা করা যাদের কোন সামরিক ভূমিকা ছিল না। ইসরায়েলী সেনাবাহিনী একটি ফিলিস্তিনি পরিবারকে একটি ভবনে সরিয়ে নিয়ে গােলাবর্ষণ করলে ৩০ জন মারা যায় এবং শিশুরা চার দিন ধরে তাদের মৃত মায়ের দেহ আকড়ে পড়ে থাকে, কারণ ইসরায়েলী বাহিনী উদ্ধারকর্মীদের আসতে বাধা দেয়। এই ঘটনায় আন্তর্জাতিক রেড ক্রস প্রকাশ্যে এর তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রতি যুদ্ধাপরাধের ব্যাপারে একটি তদন্ত কমিশন গঠনের আহ্বান জানায়। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে। আবাসিক এলাকার সড়কে গােলাবর্ষণ করে ব্যাপক এলাকায় ধ্বংস সাধন করা যুদ্ধাপরাধেরই প্রমাণ। ইসরায়েলে অ্যামনেস্টির তদন্তকারী প্রতিনিধি ডনাতেলা রােভেরা (Donatelo Rovera) বলেন, সেখানে বেপরােয়া ও মাত্রাহীন এবং কোন কোন ক্ষেত্রে নির্বিচার শক্তির ব্যবহার করা হয়েছে। সেখানে অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে যা ঘন বসতিপূর্ণ এলাকায় করা উচিত ছিল না, কারণ জানা কথাই তাতে বেসামরিক নাগরিকদের হতাহতের ঘটনা ঘটবে। তিনি বলেন, ইসরায়েলীরা যে ফিলিস্তিনি পরিবারকে মানবিক ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে তার অনেক প্রমাণ আছে। তারা কোন একটি বাড়িতে প্রবেশ করে পরিবারের সদস্যদের একটি ঘরে তালাবদ্ধ করে রাখে। তারপর সেই বাড়িকে সামরিক ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে সেখানে থেকে গুলিবর্ষণ করে। রােভেরা বলেন, বহু বছর ধরে ইসরায়েলী বাহিনীর মধ্যে এই চর্চা চলে আসছে, এখন তারা সেটা গাজাতে করছে।
দু’টি প্রথম সারির ইসরায়েলী মানবাধিকার সংগঠনও দেশের অ্যাটর্নি। জেনারেলের কাছে এই অভিযােগ তদন্ত করার দাবি জানায়। তাদের একটি অ্যাটর্নি জেনারেলের কাছে লিখিতভাবে অনুরােধ জানায় যেন তিনি এই কথিত ঘটনার তদন্ত করেন, যার মধ্যে যেন এটাও থাকে যে, সামরিক বাহিনী কিভাবে তাদের হামলার লক্ষ্য নির্ধারণ করে। একটি কুচকাওয়াজের সময় ইসরায়েলী বাহিনীর গুলিবর্ষণে পুলিশ মারা গেছে। এই সংগঠন এই ঘটনার তদন্তের অনুরােধ জানিয়ে বলে, এসব বৈধ সামরিক লক্ষ্য নয় এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের পরিপন্থী। কিন্তু মার্কিন সমর্থনে এর আগেও ইসরায়েল এ ধরনের তদন্ত রােধ করাতে এই ঘটনার ব্যাপারেও কিছু হবে বলে ইসরায়েলের সমালােচকরা আশা করে না। জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদ এর আগেও যুদ্ধাপরাধের তদন্ত করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু ইসরায়েল সেটা প্রতিরােধ করেছে। কারাে কারাে ধারণা জাতিসংঘ। নিরাপত্তা পরিষদ এ ধরনের কোন তদন্ত কমিশন গঠন করলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার। বিরুদ্ধে ভােট দেবে, এমনকি ব্রিটেনও সেটা করতে পারে। ইসরায়েল ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টে স্বাক্ষর না করায় এটা তাদেরও আওতার বাইরে ইসারয়েলী সামরিক বাহিনী অবশ্য এসব অভিযােগ অস্বীকার করে বলেছে তারা মনে করে না। তারা কোন আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করেছে।

নিরীহ নাগরিক বা আবাসিক এলাকার ওপর হামলা ইসরায়েলের জন্য নতুন কিছু নয়, যেমন নতুন নয় সাহায্য সংস্থা বা সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসা মানুষের ওপর হামলা। ১৯৬৭ সালের ৮ই জুন একটি তথ্য সংগ্রহকারী মার্কিন জাহাজের ওপর। ন্যাপাম ও মেশিনগানের গুলি বর্ষণ করে। তাতে ৩৪ জন মার্কিন নাবিক নিহত হয় আর আহত হয় ১৭২ জন। ঐ জাহাজে স্পষ্টভাবে মার্কিন পতাকা উড়তে দেখা গিয়েছিল। ভুল হবার কোন সুযােগ ছিল না। ইসরায়েলী বিমান জাহাজের অ্যান্টেনা লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ে যাতে জীবিত নাবিকরা রেডিও’র মাধ্যমে সাহায্য চাইতে না পারে। সে সময় লিন্ডন বি. জনসনের সরকার এই ঘটনাকে ধামা চাপা দেয়। জীবিত নাবিকরা যাতে ইসরায়েলের এই হামলার কথা ফাঁস করে দিতে না পারে, সেজন্য তাদের কোর্ট মার্শালের হুমকি দেওয়া হয়। ইসরায়েল যা বলেছে মার্কিন কর্তৃপক্ষও সে কথাই বার বার বলে- চিনতে না পেরে ইসরায়েল এই ভুল করেছে! পরে অনেক সামরিক নেতাই এই ধামাচাপা দেওয়া মিথ্যাকে প্রত্যাখ্যান করেন। তার ৪৩ বছর পর ২০১০ সালের ৩১শে মে তারিখ ইসরায়েলী যুদ্ধজাহাজ, হেলিকপ্টার গানশীপ এবং কমান্ডােরা আরেকটি জাহাজের ওপর হামলা চালায় যা মানবিক সাহায্য নিয়ে গাজা যাচ্ছিল এবং সেটা ইসরায়েলের জলসীমায় নয়, আন্তর্জাতিক জলসীমায় ছিল। এই জাহাজটি যাত্রা করার আগে তুর্কি কর্তৃপক্ষ ভালভাবে সেটা পরীক্ষা করে দেখেছে যে তাতে সাহায্য সামগ্রী ছাড়া কিছু নেই। কোন অস্ত্র সেখানে লুকিয়ে রাখা হয়নি। ইসরায়েলী সেই হামলায় ১৯ জন নিহত এবং আরাে অনেকে আহত হয়। ইসরায়েলী হত্যাকারীরা জাহাজের সমস্ত ক্যামেরা, ভিডিও, টেপ রেকর্ডারসহ সমস্ত দলিলপত্র নষ্ট করে দেয় যা প্রমাণ করতে পারতাে, রান্নাঘরের ছুরি এবং ছড়ি ছাড়া জাহাজে আর কোন অস্ত্র ছিল না। বিশ্বব্যাপী এই ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদের তুফান উঠলেও ইসরায়েলের তাতে কিছু আসে-যায়নি। কারণ তাদের পেছনে রয়েছে মার্কিন প্রশাসন। ইসরায়েল বলে চলেছে, জাহাজে অস্ত্র ছিল এবং তারা শুধু হামলা প্রতিরােধ করেছে। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইতিহাস সৃষ্টি করে কৃষ্ণাঙ্গ বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় বসলেও ৪৩ বছরে কোন পরিবর্তন আসেনি। এবারও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের সমালােচনা করতে রাজি নয়। হােয়াইট হাউজের একজন মুখপাত্র শুধু বলেছেন, “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জীবনহানী ও জঞমের জন্য গভীরভাবে দুঃখ প্রকাশ করছে এবং বর্তমানে এই ট্রাজেডীকে ঘিরে যে পরিস্থিতি, সেটা বােঝার চেষ্টা করছে।”
এখানে উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে, হােয়াইট হাউজে ইহুদীবাদী লবী অত্যন্ত শক্তিশালী।
৭০

জাপান
জাপানের সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের সময় জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযােগ ওঠে। অষ্টাদশ শতকের শেষভাগে এর শুরু আর শেষ হয় ১৯৪৫ সালে জাপানের সামরিক পরাজয়ের মধ্যে দিয়ে। এগুলাে জাপানি সেনাবাহিনী এবং সম্রাট হিরােহিতাের সময় তার সহযােগীদের হাতে ঘটেছে। এটাকে কেউ কেউ এশিয়ান হলােকস্ট’ও বলে থাকে। জাপানের রাজকীয় সেনা ও নৌবাহিনী প্রচুর বেসামরিক নাগরিক এবং যুদ্ধবন্দীর হত্যার জন্য দায়ী বলে অনেক ইতিহাসবিদের অভিমত | চীন দখলের সময়ও জাপান নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে। জাপান জেনিভা কনভেনশনে স্বাক্ষর করেনি, কিন্তু তাদের অপরাধ জাপানের আইনের আওতায় পড়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানি বাহিনী যেসব নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে, সেসব জাপানি সামরিক আইনের পরিপন্থী এবং এসব যুদ্ধাপরাধীদের কোর্ট মার্শাল হবার কথা। জাপান ১৮৯৯ এবং ১৯০৭ সালে হেগ কনভেনশনে স্বাক্ষর করে। কিন্তু সেটাও লঙ্তি হয় যখন জাপান রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করে, যুদ্ধবন্দীদের রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়। এছাড়া জাপান পটসডাম ঘােষণার শর্ত মেনে নিয়েছিল ১৯৪৫ সালে। জাপানের আইনে তাদের অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করেনি যারা ১৯৪৫-পরবর্তী ট্রাইবুনালে অপরাধী বলে সাব্যস্ত হয়েছে। যদিও জাপান বিচার এবং ১৯৫২ সালের স্যানফ্রান্সিসকো চুক্তি মেনে নেয়, কিন্তু জাপান এসব ট্রাইবুনালের আইনগত বৈধতা মেনে নেয়নি। জাপানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো অ্যাবে বলেছেন, জাপান টোকিও ট্রাইবুনাল মেনে নিয়েছে যুদ্ধাবসানের একটি শর্ত হিসেবে। এর সঙ্গে জাপানের অভ্যন্তরীণ আইনের কোন সম্পর্ক নেই। তার অর্থ দাড়ালাে এসব ট্রাইবুনালে যারা দোষী সাব্যস্ত হয়েছে, তারা জাপানের আইনে অপরাধী নয়। অবশ্য জাপানের যুদ্ধাপরাধ যে শুধু জাপানি জাতিগত ব্যক্তিবর্গ দ্বারা সংঘটিত হয়েছে, তা নয়।
যেসব এশিয়া-প্যাসিফিক দেশ জাপান দখল করেছে, সেখানকার কিছু মানুষ তাদের সহযােগিতা করেছে, যেমনটা ঘটেছিলাে বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে। বিংশ শতকের প্রথমার্ধে জাপান যখন কোরিয়া ও ফরমােজাকে (তাইওয়ান) জাপান সাম্রাজ্যের অঙ্গীভূত করে, তখন সেসব দেশের নাগরিকদের সাথে এ নিয়ে কোন শলাপরামর্শ করা হয়নি। সশস্ত্র বিক্ষোভ দানা বেধে ওঠে এবং সে সময় হয়ত যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হয়ে থাকতে পারে। উনিশ শ’ ত্রিশের শেষভাগে জাপানের গােপন পুলিশ বাহিনীর হাতে নির্যাতিত-নিগৃহীত হয়েছে প্রতিবাদী জাপানি নাগরিক। এই বাহিনী ছিল নাৎসী জার্মানীর গেস্টাপাে বাহিনীর মত। টোকিও ট্রাইবুনালের তদন্তের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, জাপানের দখলকৃত এশিয়ান দেশগুলােতে যুদ্ধবন্দীর মৃত্যুর হার ২৭.১% ।

হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক আর. জে. রামেল (R.J. Rummel)-এর মতে, ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৫ সালের মধ্যে জাপানি সেনাবাহিনী ৩০ লক্ষ থেকে ১ কোটি মানুষকে হত্যা করেছে যার মধ্যে রয়েছে চীনা, ইন্দোনিশিয়ান, কোরিয়ান, ফিলিপিনাে ইত্যাদি। দূরপ্রাচ্যের আন্তর্জাতিক সামরিক ট্রাইবুনালে তদন্তে জানা গেছে, জাপানি সেনাবাহিনী ৩ লক্ষ বেসামরিক নাগরিক ও যুদ্ধবন্দীকে নির্বিচারে হত্যা করেছে, যা নানকিং হত্যাযজ্ঞ’ নামে পরিচিত। একই ধরনের ঘটনা ঘটে চ্যাঙ্গচিয়াও হত্যাযজ্ঞে। এছাড়া ম্যানিলা হত্যাযজ্ঞে ফিলিপাইনে ১ লক্ষ বেসামরিক নাগরিক মারা গেছে। সুক চিঙ্গ হত্যাযজ্ঞে সিঙ্গাপুরের ২৫ থেকে ৫০ হাজার চীনাকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়। এরকম ঘটনা আরাে অনেক রয়েছে। ইতিহাসবিদ মিৎসুওশি হিসেতা জানিয়েছেন, ১৯৪২-১৯৪৫ সালের মধ্যে ২৭ লক্ষ চীনাকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়, যার নির্দেশ দিয়েছিলেন স্বয়ং সম্রাট হিরােহিতাে, “সবাইকে হত্যা করাে, সবাইকে পুড়িয়ে দাও, সবাইকে লুটপাট করাে।”
বিশেষ জাপানি সামরিক ইউনিট চীনে বেসামরিক নাগরিক ও যুদ্ধবন্দীদের ওপর অমানুষিক, বর্বর ও নৃশংস পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম ছিল ইউনিট ৭৩১ যার নেতৃত্বে ছিল শিরাে ইশি। এই ইউনিট অ্যানেসথিসিয়া না দিয়ে এসব হতভাগ্য মানুষের অঙ্গচ্ছেদ করেছে এবং সেসবকে কাজে লাগিয়েছে জৈবিক অস্ত্র পরীক্ষা করার জন্য। একটি সূত্রমতে জানা গেছে, শুধুমাত্র ইউনিট ৭৩১ এভাবে তিন হাজার মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েছে। ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চ মিত্রবাহিনী বেশ কয়েকজন চিকিৎসকের বিচার করে। তাদের বিরুদ্ধে নরমাংস খাবার অভিযােগ ছিল, সেটাতে তারা নির্দোষ প্রমাণিত হলেও ২৩ জন বিরুদ্ধে জ্ঞান থাকাকালে অঙ্গচ্ছেদের অভিযােগের ব্যাপারে দোষী সাব্যস্ত ও দণ্ডিত হয়। এসব অভিযুক্তরা নরমাংস খাবার অভিযােগ থেকে রেহাই পেলেও এশিয়া-প্যাসিফিকের বিভিন্ন অংশে যে জাপানি সৈনিকরা এই অপরাধ সংঘটিত করেছে, তা তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে। কখনাে কখনাে তারা জীবিত যুদ্ধবন্দীর শরীর থেকে অংশ কেটে নিয়েছে। ভারতীয় বংশােদ্ভূত যুদ্ধবন্দী ল্যান্স নায়েক হাতেম আলি সাক্ষ্য দিয়ে জানান, নিউ গিনিতে ‘জাপানিরা বন্দীদের বাছাই করতে শুরু করে এবং প্রতিদিন একজন করে বন্দীকে বাইরে নিয়ে যাওয়া হতাে। তাদের হত্যা করে সৈনিকরা খেয়ে নিতাে। আমি ব্যক্তিগতভাবে এটা দেখেছি এবং এই জায়গায় জাপানিরা প্রায় ১০০ জনকে এভাবে খেয়েছে।’ জাপানের যুদ্ধাপরাধের মধ্যে জোর করে শ্রম দিতে বাধ্য করা আর নারীদের যৌন দাসত্বে বাধ্য করা অন্তর্ভুক্ত আছে। এসব বাণিজ্যিক দেহব্যবসার অংশ ছিল না। একে বলা হতাে ‘কমঅর্ট স্টেশন যেখানে নারীরা থাকতাে। তাদের সাথে যেটা করা হতাে সেটা ছিল ধর্ষণ ও নির্যাতন। একজন সাবেক সৈনিক ইয়াসুজি কানেকো স্বীকার করেছে, সেসব নারীরা আর্তনাদ করতাে, কিন্তু আমাদের কিছু আসতাে-যেতাে না যে তারা বেঁচে আছে, না মরে গেছে। আমার ছিলাম সম্রাটের সৈনিক। সামরিক বেশ্যালয় হােক অথবা গ্রামে, আমরা কোন দ্বিধা ছাড়াই ধর্ষণ করেছি।’ জাপান সরকারের চোখে যুদ্ধাপরাধ সংক্রান্ত আইনগত ও নৈতিক অবস্থান ভিন্ন। ভিন্ন। সেজন্য তারা কোন আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করেনি বলে দাবি জানাবার পাশাপাশি একথা মেনে নেয় যে, জাপানি সেনাবাহিনী মানুষের নির্যাতন ও কষ্টের কারণ হয়েছিল । ১৯৯৫ সালের আগস্ট মাসে জাপানি প্রধানমন্ত্রী তােমিচি মুরাইয়ামা বলেন, ‘জাপান তার ঔপনিবেশিক শাসনও আগ্রাসনের মাধ্যমে অনেক দেশে বিশেষ করে এশিয়ান দেশগুলােতে প্রচুর ক্ষয়-ক্ষতি ও মানুষের কষ্টের কারণ হয়েছে।’ সেজন্য তারা গভীর অনুশােচনা বােধ করছেন এবং আন্তরিকভাবে ক্ষমা চাইছেন। কিন্তু এসব অপরাধের শিকার মৃত ব্যক্তিবর্গের পরিবার এবং জীবিত অনেক মানুষের কাছে এই ক্ষমা প্রার্থনা যথেষ্ট নয়। তারা প্রতিটি ঘটনার জন্য জাপানের কাছ থেকে অনুতাপ ও ক্ষমা প্রার্থনা আশা করেছেন, যা আজও পাওয়া যায়নি।
৭৩

কোরিয়া
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে যে যুদ্ধাপরাধ সংক্রান্ত ট্রাইবুনাল গঠন করা হয়, তাতে যুদ্ধাপরাধীদের তিনটি শ্রেণী বিন্যাস করা হয়। প্রথম শ্রেণীতে ছিল, শান্তির বিরুদ্ধে যারা অপরাধ করেছে, তারা দ্বিতীয় শ্রেণীতে, সাধারণ যুদ্ধাপরাধ যারা করেছে, যেমন যুদ্ধবন্দীদের ওপর নির্যাতন আর তৃতীয় ও শেষােক্ত শ্রেণীতে ছিল সেইসব যুদ্ধাপরাধী যারা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছে। প্রথম শ্রেণীতে ছিল নেতারা যারা যুদ্ধের সূচনা করেছে আর দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণীতে অফিসার ও সৈনিকরা। মানুষকে রক্ষা করার জন্য যেসব আইন-কানুন আছে, এরা তাকে লঙ্ঘন করেছে। যুদ্ধশেষে যে ৫,৭০০ জন এই শেষােক্ত দুই শ্রেণীতে দণ্ডিত হয়েছে, তাদের মধ্যে ১৪৮ জন ছিল কোরিয়ান, যাদের মধ্যে অনেককে জাপানিরা অপহরণ করে নিয়ে গিয়ে যুদ্ধবন্দীদের তদারকির কাজে লাগায়। এদের অনেকের ব্যাপারেই কেউ কিছু করতে পারেনি, কারণ জাপান জোর দিয়ে বলে তারা জাপানি নাগরিক, ফলে জাপানের আইনে তাদের শাস্তি ভােগ করতে হবে। আবার তারা মুক্তি পাবার পর সেই জাপানই তাদের নাগরিকত্ব দিতে অসম্মতি জানায়। অন্যদিকে কোরিয়া তাদের প্রত্যাখ্যান করে এই বলে যে তারা জাপানের দালালী করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সােভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে দেশটার প্রশাসন ভাগ হয়ে যায়। সেটা করার সময় কোরিয়াবাসীদের সাথে আলােচনা করা হয়নি বা তাদের মতামত নেওয়া হয়নি। এর পর একদিকে জাতিসংঘ অন্যদিকে সােভিয়েত ইউনিয়ন আর চীনের সমর্থনে কোরিয়ানদের মধ্যে যুদ্ধ লেগে যায়। তারপরের দীর্ঘ ইতিহাস কোরিয়ানদের সাথে কোরিয়ানদের সংঘর্ষের, কোরিয়ানদের নিজেদের মধ্যে অবিশ্বাসের, যার অবসান আজও ঘটেনি। ১৯৫০ সালের জুলাই মাসে তায়েজন কারাগার থেকে ১৮০০ বেসামরিক রাজনৈতিক বন্দীদের সরানাে হয়, যাদের কমিউনিস্টদের প্রতি সহানুভূতি আছে বলে মনে করা হয়। তাদের অনেককে হত্যা করা হয়। মার্কিন বাহিনীর নির্দেশে এ কাজ

দক্ষিণ কোরিয়ার পুলিশ করেছিল। বিভিন্ন জায়গায় মার্কিন বাহিনী বা তাদের অধীনস্ত দক্ষিণ কোরিয়ার প্যারামিলিটারী বাহিনী গণহত্যা চালিয়েছে। কোরিয়ান গ্রামবাসীদের ওপর ১৯৫১ সালে হালকা বিমানের সাহায্যে জৈবিক ও রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করা হয়। এসব রাসায়নিক স্প্রে করে মানুষের মধ্যে ছিটিয়ে দেবার ফলে তাদের চামড়া কালাে হয়ে যায় আর তাদের অনেকে মারা যায়। কেউ কেউ অভ্যন্তরীণ রক্তপাতজনিত জ্বরে মারা যায়। রেললাইনের টানেলে শত শত মৃতদেহ পাওয়া গেছে। ১৯৪৫ থেকে ১৯৫৩ সালের মধ্যে যেসব নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটে, সেগুলাে কোরিয়ান সাধারণ নাগরিক ৫০ বছর ধরে প্রকাশ করতে পারেনি তাদের ওপর নতুন করে নির্যাতন হতে পারে, এমনকি তাদের হত্যা করা হতে পারে এই ভয়ে। ফলে এখনাে এসব কাহিনী বেরিয়ে আসছে। আশির দশকে জেনারেল চুন দুহােয়ান এক কূ’র মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে এবং সামরিক শাসন জারী করে। গােটা কোরিয়া জুড়ে প্রতিবাদের ঢেউ ওঠে। কোয়াঙ্গজুতে সবচেয়ে তীব্র বিক্ষোভ হয়। সেখানে মার্কিন সামরিক কর্মকর্তাদের সহযােগিতায় ২৫০০ জন মানুষকে হত্যা করা হয়। সেটা ঘটে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের শাসনামলে, যার পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল মানবাধিকার । দক্ষিণ কোরিয়াতে “আর একটি ইরান যাতে না হয়, সেজন্য সেখানে কঠোর হাতে বিক্ষোভ দমন করার নির্দেশ দেওয়া হয়। উল্লেখ্য, তার ঠিক আগে ইরানের শাহকে হঠিয়ে সেখানে ইসলামী শাসনতন্ত্র কায়েম হয়েছিল। দুই কোরিয়ার একত্রিকরণের স্বপ্ন যারা দেখেছিল এবং এ ব্যাপারে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিল, এরকম দু’জন ছাত্রের ওপর এফবিআইয়ের সহযােগিতায় কোরিয়ান এজেন্টরা নজর রাখে আর সেটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়ে। তারা এবং আরাে ২০ জনের মত ছাত্র দেশে ফিরলে প্রথম তাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় পরে তাদের কারাদণ্ড হয়। উনত্রিশজন কমিউনিস্ট’ সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে চোখ বেঁধে খুটির সাথে বাধা হয়, তাঁদের বুকে বুলস্ আই সেঁটে দেওয়া হয়। তারপর তাদের গুলি করে হত্যা করে দক্ষিণ কোরিয়ার পুলিশ বাহিনীর ফায়ারিং স্কোয়াড। ১৯৫০ সালের এই ঘটনাটি ঘটে। সউল-এর ১০ মাইল উত্তরপূর্বের একটি জায়গায়। এই নির্বিচার হত্যা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে ছয়জন মার্কিন সেনা অফিসার।

যেসব সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে তা থেকে এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, কোরিয়াতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে যে যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হয়েছে তার হােতা ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র । হয় তারা সরাসরি এসব করেছে অথবা তাদের সমর্থন অনুমােদন নিয়ে কোরিয়ার পুলিশ বাহিনী করেছে। ১৯৪৫ সালের ১৫ই আগস্ট

কোরিয়া
জাপানের আত্মসমর্পণের পর সােভিয়েত ইউনিয়নের অনুমােদন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র কোরিয়াকে ভাগ করার সিদ্ধান্ত নেয়। তারপর থেকে যে ভয়ের শাসন তারা জারি রাখে তা শেষ পর্যন্ত গৃহযুদ্ধের মুখে নিয়ে ফেলে কোরিয়াকে। তথাকথিত পুলিশী ব্যবস্থায় মৃত্যু ঘটে প্রায় ৫০ লক্ষ মানুষের। মার্কিন সমর্থনে সেখানে সামরিক একনায়কতন্ত্র চলে। কোরিয়ার সার্বভৌমত্ব ধরে রাখার কোন উপায় সেখানে ছিল না। কমিউনিজমকে দূর করার নামে সেখানে ভিন্নমতাবলম্বীদের দমন করার হয়। একে অনেকে বিশ শতকের সবচেয়ে নিষ্ঠুরতম ট্রাজেডী বলে অভিহিত করেছেন। পরবর্তী সময়ে ‘টুথ কমিশন’ এবং ভেটারেনস্ ফর পীস্ (Veterans for Peace) নামের সংগঠন এ সংক্রান্ত ট্রাইবুনালকে সাহায্য করে এসব তথ্য প্রকাশ করতে আর সেই সাথে ন্যায়বিচারের পথে এগিয়ে যেতে। তবে কোরিয়ার ভাগ্য এখনাে অনিশ্চিত। এখনাে দুই কোরিয়ার মধ্যে অবিশ্বাস ও বৈরি মনােভাব বিরাজ করছে। দুই দেশের সরকার-নীতিতে বিস্তর পার্থক্য। তার ফলে তাদের মধ্যে সংঘর্ষ-পাল্টা সংঘর্ষ চলছে। এর অবসান যতদিন পর্যন্ত না হবে, ততদিন কোরিয়ার সাধারণ মানুষের জীবনে শান্তি নেমে আসার কোন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।
লাইবেরিয়া
লাইবেরিয়ান গৃহযুদ্ধকে একটি ভয়াবহ ঘটনা বলে বর্ণনা করা যায়, যেখানে আইনের কোন স্থান ছিল না। আইন মানুষকে রক্ষা করতে পারেনি। সময়কাল ১৯৯০ থেকে ১৯৯৭ সাল। তবে সেটা একদিনে হয়নি। বহু বছরের রাজনৈতিক সংকটের ফলে শেষ ছােবল হিসেবে এসেছে এই গৃহযুদ্ধ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শীতল যুদ্ধের সহযাত্রী লাইবেরিয়াতে যখন সামরিক নেতা স্যামুয়েল কে, ডাে অভ্যুত্থান ঘটায়, তখন তাকে তারা সমর্থন দেয়। এরপরের ইতিহাস দুনীতি ও একনায়কতন্ত্রের। যখন গৃহযুদ্ধ শুরু হয়, তখন আইন নীরব থেকেছে। এমনকি ১৯৯৪ সালের গণহত্যার পরও আইনের। শাসনের প্রসঙ্গ ওঠেনি। চার্লস টেইলরের নেতৃত্বে বিদ্রোহী বাহিনী রাজধানী মনরােভিয়ার দিকে যত এগিয়ে এসেছে, ততই সরকারি প্রশাসন ধসে পড়েছে। সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করে। আর ডাে’র ট্রাইবাল গােষ্ঠী অন্য ট্রাইবের সদস্যদের হত্যা করতে শুরু করে। সবচেয়ে ভয়াবহ গণহত্যার ঘটনা ঘটে ১৯৯০ সালের ২৭শে জুলাই, মনরােভিয়ার সেন্ট পিটারস গীর্জায়। একদল সৈনিক প্রথমে সেখানে এসে যাবতীয় খাদ্যসামগ্রী লুট করে। আর যে নারীর কাছে ভাড়ারের চাবী ছিল, তাকে তারা ধর্ষণের পর হত্যা করে। তারপর শ’ দুই সৈনিক ফিরে এসে প্রথমে একটি বালককে কেটে ফেলে। তারপর এভাবে তারা বহু মানুষকে কেটে ফেলে হত্যা করে। সে রাতে ছয় শ’ মানুষ মারা যায়। গীর্জার দরজায় কিন্তু বড় একটি রেড ক্রস পতাকা ছিল। এই গণহত্যার হােতা মাইকেল টিলি এর আগেও অনেক হিংস্র, বীভৎস ঘটনা ঘটিয়েছে। তার কিছুই হয়নি, বরং সরকার তাকে রক্ষা করেছে। এটা আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী। লাইবেরিয়াতে যা ঘটেছে তার জন্য উভয়পক্ষই দায়ী। শুধুমাত্র লাইবেরিয়ানদের নয়, নাইজেরিয়ানদের হত্যা করা হয়, যাতে তারা হস্তক্ষেপ না করে এবং শান্তিরক্ষী বাহিনী না পাঠায়। সম্ভবত একই কারণে ৯ জন নান্ বা সন্ন্যাসিনীকে হত্যা করা হয়।
প্রিন্স জনসন নামে আরেক নেতা তার আইএনপিএফএল (INPFL) বাহিনীকে নির্দেশ দেয় ৪৮ জন বিদেশীকে জিম্মি করে রাখতে, উদ্দেশ্য বিশ্বের নজর লাইবেরিয়ার দিকে ফেরানাে। এটা জেনিভা কনভেনশন লঙ্ঘন তাে বটেই, কিন্তু জনসন অন্য যেসব অপরাধ করেছে, তার তুলনায় এটা কিছুই নয়। এই ব্যক্তিই ডাে’কে আটক করে তার ওপর নির্যাতন চালিয়ে তাকে হত্যা করে। সে নিহত প্রেসিডেন্টের কান কেটে সেটা ভক্ষণ করে এবং সেটা ফিল্ম করা হয় । রুয়ান্ডার গণহত্যার পর ট্রাইবুনাল গঠন করে অপরাধীদের বিচার করার যে আশা ছিল, তা সর্বাংশে সফল হয়নি। এখনাে অনেককে বিচারের অধীনে আনা হয়নি। এমনকি তাদের একজন এখনাে মনরােভিয়ার প্রেসিডেন্টের প্রাসাদেই অবস্থান করছে।

লাইবেরিয়া ভিন্ন কারণে কিছুদিন আগে সংবাদ মাধ্যমের শিরােনামে এসেছে। নেদারল্যান্ডসের হেগ শহরে যুদ্ধাপরাধের বিচারে লাইবেরিয়ান নেতা চার্লস টেইলর। সিয়েরা লিয়ন-এর গৃহযুদ্ধের তহবিল দান করার জন্য লাইবেরিয়ার খনিজ সম্পদ হিরাকে ব্যবহার করেছে কিনা, এমন একটি কথা উঠেছে আর এতে ফেসে গেছেন। গ্ল্যামার জগতের একজন খ্যাতনামা ফ্যাশন মডেল ন্যাওমী ক্যাম্পবেল। চার্লস টেইলর নানাভাবে এসব হিরা দেশের বাইরে পাঠিয়েছে এবং ন্যাওমী ক্যাম্পবেল হিরা, বহনকারীদের অন্যতম বলে ধরা পড়েছেন। ১৯৯৭ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার তদানীন্তন। প্রেসিডেন্ট নেলসন ম্যান্ডেলার বাড়িতে তাঁর দেওয়া চ্যারিটি ভােজে যােগ দিতে গিয়ে ন্যাওমীর সাথে চার্লস টেইলরের সাক্ষাৎ হয়। চার্লস ন্যাওমীকে না-কাটা হিরা উপহার। দেন। ন্যাওমী প্রথমে বলেন, তিনি এ ব্যাপারে কিছুই জানেন না এবং তিনি চার্লস টেইলরের বা লাইবেরিয়ার নামও কখনাে শােনেনি। এসব হিরাকে ‘ব্লাড ডায়মন্ড’ বা রক্তাক্ত হিরা বলে অভিহিত করা হয়েছে। এ শব্দটিও কখনাে শােনেননি বলে জানান। ন্যাওমী ক্যাম্পবেল। তিনি সেসব পাথর নেলসন ম্যান্ডেলার শিশু তহবিলের। পরিচালক জেরেমী র্যাটক্লিফ দেন বলে জানান। কিন্তু ঐ দাতব্য সংস্থা সেকথা অস্বীকার করেছে। কৌসুলিরাও সেটা মেনে নিতে পারেননি, কারণ ঐ ভােজসভায় উপস্থিত অপর অতিথি অভিনেত্রী মিয়া ফ্যারাে জানান, ন্যাওমী হিরা উপহার গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য চার্লস টেইলরের বিরুদ্ধে ধর্ষণ, হত্যা, শিশু সৈনিকদের নিযুক্ত করা এবং যৌনদাস রাখার অভিযােগ উঠেছে।
৮০

রুয়ান্ডা
১৯৯৪ সালের এপ্রিল থেকে জুন মাসের মধ্যে মাত্র ১০০ দিনে ৮ লক্ষ রুয়ান্ডাবাসী। নিহত হয়। কুড়ি লক্ষ জায়ের (Zaire) বা বর্তমান কঙ্গোতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। এদের অধিকাংশ ছিল টুটসি সম্প্রদায়ের আর যারা এই গণহত্যায় অংশ নেয় তাদের অধিকাংশ ছিল হুটু সম্প্রদায়ের মানুষ। ঐ বছর ৬ই এপ্রিল তারিখে রুয়ান্ডার প্রেসিডেন্ট হুটু সম্প্রদায়ভুক্ত জুভেনাল হাবিয়ারিমানা (Juvenal Habyarimana)-র বিমানকে গুলি করে নামানাে হয়েছিল। তার সাথে বুরুন্ডির প্রেসিডেন্টও নিহত হন। তার জন্য বর্তমান প্রেসিডেন্ট পল কাগামে অভিযুক্ত হন। সে সময় তিনি টুটসি বিদ্রোহী দলের নেতা ছিলেন। তিনি এ অভিযোেগ তীব্রভাবে প্রত্যাখ্যান করেন এবং বলেন, সেটা ছিল হুটু চরমপন্থীদের কাজ। কাজটা যে-ই করে থাক না কেন, মুহূর্তের মধ্যে আগুন ছড়িয়ে পড়ল গােটা দেশে এবং সেটা জুন মাস পর্যন্ত নিভলাে না, হিংসাত্মক অভিযান শুরু হয়ে গেল। এটা মনে করা ঠিক হবে না যে, শুধু প্রেসিডেন্টের মৃত্যু এই সহিংস তাণ্ডবের মূলে রয়েছে। এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনা সবসময়ই ছিল, সেই ঔপনিবেশিক আমল থেকেই সংখ্যাগরিষ্ঠ হুটু আর সংখ্যালঘু টুটসিদের মধ্যে বৈরিতা দানা পাকায়। বেলজিয়াম ঔপনিবেশিক শক্তি জাতিগত পরিচয় অনুযায়ী হুটু ও টুটসিদের ভিন্ন ভিন্ন পরিচয়পত্র দিয়েছিল। শুধু তাই নয়, বেলজিয়ানরা মনে করতাে টুটসিরা হুটুদের চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান। সেজন্য তারা সব রকম সুযােগ-সুবিধা ভােগ করে থাকে। অথচ এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে অমিলের চেয়ে মিলই বেশি। তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি এক টুটসিরা দীর্ঘাঙ্গী ও ক্ষীণাঙ্গী হয়। কেউ কেউ মনে করে তাদের পূর্বপুরুষ ইথিওপিয়ার বাসিন্দা ছিল । তাই হুটুরা যখন তাদের হত্যা করে নদীতে ভাসিয়ে দেয়, তখন বলে, তাদের ইথিওপিয়ার ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। হুটুরা পরে নিজেদের শক্তি গড়ে তােলে। ১৯৬২ সালে ঔপনিবেশিক প্রভুরা চলে গেলে হুটুরা তাদের জায়গা নেয়। পরবর্তী সময়ে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি ঘটে। প্রেসিডেন্ট হাবিয়ারিমানা জনপ্রিয়তা হারাতে শুরু করেন। অন্যদিকে উগান্ডা শরণার্থী শিবিরের টুটসিরা ‘রুয়ান্ডান প্যাট্রিয়টিক ফ্রন্ট’ নামে সংগঠন গড়ে তােলে, যার নেতা ছিলেন কাগামে । তাদের লক্ষ্য ছিল হাবিয়ারিমানাকে উৎখাত করা ও স্বদেশে প্রত্যাবর্তন সমস্যা চলতে থাকে, এক পর্যায়ে একটি শান্তিচুক্তিও স্বাক্ষরিত হয় তদানীন্তন সরকার ও রুয়ান্ডান প্যাট্রিয়টিক ফ্রন্ট-এর মধ্যে। কিন্তু বিমানকে গুলি করে নামানাের পর শুরু হয় প্রতিহিংসার পালা। বিরােধী রাজনৈতিক নেতাদের হত্যা করে প্রেসিডেন্টের রক্ষীদল। নির্বিচারে হত্যা করতে শুরু করে টুটসি ও ভিন্ন মতাবলম্বী হুটুদের। প্রথমে সামরিক বাহিনী এই কাজ শুরু করে থাকলেও পরে অন্যরা যােগ দেয়। বেতারে প্রচারণা চালানাে হয়। সেনা ও পুলিশ বাহিনী সাধারণ নাগরিকদের যােগ দিতে উৎসাহ দেয়। এরকমও অভিযােগ রয়েছে যে কোন হুটু বেসামরিক নাগরিককে তাদের টুটসি প্রতিবেশীকে হত্যা করতে বাধ্য করা হয়। একাজে উৎসাহ দেবার জন্য হত্যাকারীদের অর্থ ও খাদ্য উৎকোচ দেওয়া হয়। এমনও বলা হয় যেসব টুটসিকে তারা হত্যা করবে, তাদের জমি তাদের হয়ে যাবে। এরপর জুলাই মাসে রুয়ান্ডান প্যাট্রিয়টিক ফ্রন্ট রাজধানী কিগালি দখল করে ও অস্ত্রবিরতি ঘােষণা করে। এই সময় হুটুরা কঙ্গোতে পালিয়ে যায়।

রুয়ান্ডায় গুরুতর যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হয়েছে, এটা মেনে নিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডার যুদ্ধাপরাধ সংক্রান্ত একটি ট্রাইবুনাল গঠন করে, যা ‘দি ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল ট্রাইবুনাল ফর রুয়ান্ডা’ নামে পরিচিত। এর লক্ষ্য রুয়ান্ডার গণহত্যার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচার করা। এছাড়া যারা আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেছে, তাদেরও এই বিচারের আওতায় আনা ছিল উদ্দেশ্য। এই ট্রাইবুনালের আওতায় পড়ছে গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং যুদ্ধাপরাধ । এগুলাে জেনিভা কনভেনশনের তিন নং সাধারণ ধারা ও অতিরিক্ত প্রটোকলও লজ্জন বলে বাখ্যা করা হয় রুয়ান্ডায় নারী ধর্ষণের ভয়াবহ চিত্র পাওয়া গেছে। টুটসি নারীদের ধর্ষণ করে মেরে ফেলা হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে মারার আগে তাদের অঙ্গচ্ছেদ করা হয়। যুদ্ধের অন্যতম অস্ত্র ধর্ষণ। বিজয়ী আগ্রাসী বাহিনীর কাছে এটা অনেকটা পুরস্কারের মত। কিন্তু রুয়ান্ডার ট্রাইবুনালের একজন বিচারপতি মনে করিয়ে দেন যে, ধর্ষণ যুদ্ধাপরাধ। রুয়ান্ডায় ১৯৯৪ সালের গণহত্যায় ইন্ধন জোগাবার অপরাধে টেলিভিশন চ্যানেলের কর্মকর্তা ফার্দিনান্দ নাহিমানা ও জা বসকো বারাইয়াগিজার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। এছাড়া একটি সংবাদপত্রের সম্পাদক হাসান এনগেজেও দণ্ডিত হয়। পরে অবশ্য আপীলের মাধ্যমে তাদের দণ্ড ৩০-৩৫ সালে কমিয়ে আনা হয়। এই ট্রাইবুনাল প্রথম পর্যায়ে ৫০টির মত বিচার সম্পন্ন করেছে এবং ২৯ জন অভিযুক্ত ব্যক্তিকে দণ্ড দিয়েছে। অভিযুক্তদের মধ্যে অনেকে এখনাে পলাতক রয়েছে, তাদের কেউ কেউ মৃত বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। প্রথমে ঠিক করা হয়েছিল যে, ২০১০ সালের মধ্যে সমস্ত বিচার শেষ করতে হবে, পরে সেটা বাস্তব নয় বলে মনে করা হয়। এখনাে বিচার চলছে।
৮৩

ভিয়েতনাম
সাম্প্রতিক ইতিহাসের অন্যতম দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ ঘটে ভিয়েতনামে ১৯৫৯ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত। ফ্রান্স ভিয়েতনামে উপনিবেশ গড়েছিল ১৮৫৯ সাল থেকে, সে সময় এই দেশের নাম হয় ‘ফ্রেঞ্চ ইন্দোচীন আর এতে ভিয়েতনাম ছাড়াও অন্তর্ভুক্ত ছিল কম্বােডিয়া। পরে লাওসকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়। ১৯৪১ সালে গঠিত হয় ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট পার্টি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফরাসিরা এই উপনিবেশ পরিচালনা করলেও মূল শক্তি ছিল জাপানের হাতে। এরপর যুদ্ধশেষে জাপানিদের পরাজয়ের সুযােগ নিয়ে কমিউনিস্ট পাটি পরিচালিত ভিয়েতমিন্ ক্ষমতা দখল করে ‘আগস্ট বিপ্লবের মাধ্যমে। আর এতে। অধিকাংশ জনগণ সমর্থন দেয়। তাদের নেতা হাে চি মিন স্বাধীন গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র ভিয়েতনামের ঘােষণা দেন। তবে মিত্রশক্তি অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য আর সােভিয়েত ইউনিয়ন সিদ্ধান্ত নেয়, বৃটিশ বাহিনী দক্ষিণ ভিয়েতনামে দখল নেবে আর চীন বাহিনী উত্তরে প্রবেশ করবে। এদিকে জাপানের হাতে ‘গৃহবন্দী’ ফরাসিরা আবার শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে এবং তারা ১৯৪৬ সালে ভিয়েতমিকে রাজধানী হ্যানয় থেকে উৎখাত করে। সঙ্গে সঙ্গে ভিয়েতমিন্ গেরিলা যুদ্ধ শুরু করে। ১৯৫০ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন ভিয়েতমিন-এর গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র ভিয়েতনামকে স্বীকৃতি দেয়। আর অ-কমিউনিস্ট দেশগুলাে সায়গনের ভিয়েতনাম রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেয়। আর তাদের ধারণা হয় কমিউনিস্টরা ক্রমে ইন্দোচীনে দখল বাড়াচ্ছে। তবে তখনাে সীমানা তত কঠোর ছিল না। দিয়েন বিয়েন ফু’র যুদ্ধের পর অবশেষে ইন্দোচীনে ফরাসিদের প্রভাবের অবসান ঘটলাে। ১৯৫৪ সালে ফরাসি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে এবং জেনিভা সম্মেলনে ভিয়েতনামের সাথে সাথে কম্বােডিয়া এবং লাওসকে স্বাধীন রাষ্ট্র ঘােষণা করা হয়। জেনিভা চুক্তিতে ভিয়েতনামের ভাগাভাগিকে সাময়িক বলে ধরা হয় আর সেটা নির্বাচন পর্যন্ত।
ভিয়েতনামে সারা দেশে নির্বাচন হবার কথা ছিল কিন্তু দক্ষিণ ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট তাতে বাধা দেন, তাঁর ধারণা ছিল কমিউনিস্টরা জয়ী হবে। এদিকে কমিউনিস্ট নির্যাতন সম্পর্কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রচারণা ও প্ররােচনায় বহু মানুষ উত্তর থেকে দক্ষিণে চলে যায়, যাদের মধ্যে প্রচুর সংখ্যক ক্যাথলিক ধর্মাবলম্বী ছিল। উত্তরে ততদিনে ভিয়েতমিন্ সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন করেছে এবং ভূমি সংস্কার শুরু হয়ে গেছে। এভাবে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলাের কারণে একটি দেশ তাদের জনগণের মতামতের তােয়াক্কা না করে দু’ভাগ হয়ে যায়

ভিয়েতনাম যুদ্ধ শুধু ভিয়েতনামে নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যতটা প্রভাব ফেলেছিল, ততটা আর কোন সংঘর্ষ বা ঘটনা ততটা প্রভাব ফেলতে পারেনি। মার্কিন বাহিনীর নির্যাতনের কথা খােদ মার্কিনিরা স্বীকার করেছে, সেসব খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছে। যেসব দলিলপত্র ‘ইউনাইটেড স্টেটস্ ন্যাশনাল আর্কাইভস্ অ্যান্ড রেকর্ডস। wwufacut’ (United States National Archives Records Administration) এর কাছে আছে, তাতে ‘মাই লাই’ গণহত্যাকে বাদ দিয়েই ৩২০টি ঘটনার কথা। লিপিবদ্ধ করা আছে। এছাড়াও আরাে ৫০০ ঘটনার কথা এই রেকর্ডে রয়েছে, যা। তদন্তকারীরা প্রমাণ করতে পারেননি। এসব ঘটনার মধ্যে আছে, ১৯৬৭ থেকে ১৯৭১ সালের মধ্যে নির্বিচার হত্যার শিকার হয়েছে কমপক্ষে ১৩৭ জন বেসামরিক নাগরিক। অন্য আটাত্তরটি হামলায় ৫৭ জন নিহত, ৫৬ জন আহত এবং ১৫ জনের ওপর যৌন নির্যাতন চালানাে হয়। মার্কিন সেনাবাহিনীর আটক বেসামরিক নাগরিক এবং যুদ্ধবন্দীদের ওপর মুষ্ঠি, লাথি, ব্যাট, পানি ও বৈদ্যুতিক শক-এর সাহায্যে নির্যাতন চালানাের ১৪১টি ঘটনা রয়েছে। এগুলাে শুধু সেনাবাহিনীর রিপােট। তার বাইরে যেগুলাে আছে, সেগুলাে আলাদা। এক ভাষ্যকারের মতে, যুদ্ধাপরাধ ছিল দৈনন্দিন ঘটনা, যার মধ্যে আছে বেসামরিক এলাকায় রকেট হামলা, বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা, নারী ধর্ষণ ইত্যাদি। একটি স্কুলের ওপর মর্টার হামলায় ২৩ জন শিশু নিহত হয়। আর আহত হয় আরাে ৪০ জন। ওহাইয়াে-ভিত্তিক এক সংবাদপত্রের রিপাের্টে জানা গেছে, ১৯৭১ সালে সেনাবাহিনী একটি সাড়ে চার বছরব্যাপী তদন্ত শুরু করে যাতে মার্কিন সেনাদের যুদ্ধবন্দীর ওপর নির্যাতন, বেসামরিক নারীদের ধর্ষণ, মৃতদেহ ক্ষতবিক্ষত করা, নয় থেকে একশ’জনের বেশি নিরস্ত্র নাগরিককে হত্যা ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত। এই সেনা। তদন্তের ফলাফল হচ্ছে, ১৮ জন মার্কিন সৈনিক এ ধরনের কাজের সাথে জড়িত ছিল। তবে লক্ষ্যযােগ্য হচ্ছে, এদের একজনেরও কোর্ট মার্শাল হয়নি। তার ওপর ছয়জনকে সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করার সুযােগ করে দেওয়া হয়, যাতে তারা এ ব্যাপারে শাস্তি এড়িয়ে যেতে পারে। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র নিক টার্স, যিনি ভিয়েতনাম যুদ্ধে মার্কিন যুদ্ধাপরাধ সম্পর্কে গবেষণা করছিলেন, তিনি জানান যা। ঘটেছে, এটা তার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশমাত্র।
ঐ সংবাদপত্র আরাে কিছু ঘটনার কথা। লিপিবদ্ধ করেছে: ১৯৬৬ সালের নভেম্বর মাসে চতুর্থ পদাতিক বাহিনীর একজন অফিসার একজন মৃত ভিয়েতনামীর কান কেটে তার জিপের অ্যান্টনার সাথে স্যুভেনির হিসেবে লাগিয়ে রাখে। ১৯৬৭ সালের আগস্ট মাসে ১৯৬তম পদাতিক ব্রিগেডের একজন সৈনিক একটি ১৩ বছর বয়সী ভিয়েতনামী শিশুকে ধর্ষণ করে। তার মাত্র ৭ মাস ১৬ দিনের সাজা। হয়, ‘শিশুর প্রতি অশালীন আচরণ করার জন্য ১৯৬৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে একজন সার্জেন্ট দুটি শিশুকে গুলি করে হত্যা করে। একজনের মাথায় খুব কাছে থেকে গুলি করে। ১৯৭০ সালে তার কোর্ট মার্শালে সে দোষী বলে স্বীকারােক্তি দেয়। তার ব্যাপারে রায় ছিল সে পূর্বপরিকল্পিত নয়, এমন হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। তার কোন সাজা হয়নি। এ ধরনের বহু ঘটনা আছে যার সবগুলাে প্রকাশও পায়নি। সে সময়ের বেসরকারি বা অলিখিত বিশ্বাস ছিল, যা কিছু নড়াচড়া করবে, তাকেই গুলি করতে হবে। একজন মার্কিন সৈনিক স্বীকার করেছে যে, তাদের দলে অধিকাংশই ভিয়েতনামীদের মানুষ মনে করতাে না। সব যুদ্ধেই নির্যাতন, ভয়াবহতা, নিমর্মতা থাকে, কিন্তু ভিয়েতনাম যুদ্ধে সেসব যুদ্ধের অংশ ছিল না। যুদ্ধের প্রয়ােজনে ছিল না। হয়ত এসব নির্মমতা ব্যক্তির ওপর নির্ভর করে, তার চরিত্রের ক্রুরতার ওপর নির্ভর করে। কিন্তু ভিয়েতনাম যুদ্ধে তার পরিমাণ এত বেশি ছিল যে সেটা ব্যক্তিকে ছাড়িয়ে সমষ্টিতে পরিণত হয়। এখানে উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে, ভিয়েতনামীদের পক্ষেও নির্মম নির্যাতনের অভিযােগ ছিল। দুটি ক্ষেত্রেই তার শিকার হয়েছে সাধারণ বেসামরিক নাগরিক।

ভিয়েতনামে বিশেষ করে মার্কিন চরম নির্মমতার সাক্ষী হয়ে আছে মাই লাই গণহত্যা। ১৯৬৮ সালের ১৬ই মার্চ তারিখটি যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের পাতায় একটি কৃষ্ণ দিবস হয়ে থাকবে। সে সময় মার্কিনিদের কাছে খবর আসে ঐ এলাকায়, অর্থাৎ ঐ গ্রাম ও তার আশপাশের এলাকায় ভিয়েত কং গেরিলা বাহিনী তৎপর। একদল মার্কিন সেনা সেখানে গিয়ে ৪০০-৫০০ নিরস্ত্র, বেসামরিক ভিয়েতনামীকে নির্বিচারে হত্যা করে। এদের মধ্যে অধিকাংশ ছিল নারী, এ ছাড়াও ছিল শিশু ও বৃদ্ধ। কেউ বাদ যায়নি। সেই সাথে যৌন নির্যাতন ও অন্য নির্মম আচরণের কথাও পরে জানা। যায়। কিছু মৃতদেহকে ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় পাওয়া যায়। একই সময় মাই লাই’র কাছে কো লাই’তে ৯০ থেকে ১০০ জনকে হত্যা করা হয়। প্রথমে বলা হয় ১২৮ জনকে হত্যা করে মার্কিন সেনা ঐ অঞ্চলে জয়ী হয়েছে। পরে যখন প্রত্যক্ষদর্শীরা এই ঘটনার ব্যাপকতার কথা জানায়, তখন একটি অনানুষ্ঠানিক তদন্ত কমিটি গঠন করে এটাকে ধামাচাপা দেবার চেষ্টা চলে। বলা হয় সেটা ছিল ভিয়েত কংদের প্রচারণা। এত মানুষ মারা যায়নি। এভাবেই হয়ত ঘটনাটা চাপা পড়ে যেতাে। কিন্তু ১৯৬৯ সালের ২রা এপ্রিল সেনাবাহিনীরই একজন সদস্য, রন রিডেনহাওয়ার (Ron Ridenhour) যিনি এই ঘটনা প্রত্যক্ষ করেন, তিনি। ওয়াশিংটনের তিরিশজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে চিঠি লিখে এই ঘটনার ভয়াবহতার কথা জানান। এসব ব্যক্তির মধ্যে ছিলেন খােদ প্রেসিডেন্ট নিক্সন, সেক্রেটারী অব ডিফেন্স, জয়েন্ট চিফ অব স্টাফের চেয়ারম্যান এবং কয়েকজন কংগ্রেস সদস্য। যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ মাধ্যম এবং সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে এ নিয়ে তােলপাড় শুরু হয়। তারপরে বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের নিন্দা-মন্দ শুরু হবার পর শেষ পর্যন্ত সে বছরেরই নভেম্বর মাসে একটি নিরপেক্ষ তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়। তদন্তে যেসব কারণ বেরিয়ে আসে, তা। হল অনভিজ্ঞ নেতৃত্ব, ধোঁয়াটে নির্দেশ, কোন অপারেশন চলাকালীন নিয়ন্ত্রণের অভাব ইত্যাদি। এর সাথে যুক্ত হয়েছে কুরতা, ভিয়েতনামীদের প্রতি বর্ণবাদী মনােভাব। ইত্যাদি। তবে মাই লাই গণহত্যার সময় সমস্ত মার্কিন সৈনিক যে অমানবিক আচরণ করেছে তা নয়। কেউ কেউ হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করেছে। কেউ কেউ গুলি করতে অসম্মতি জানিয়েছে। হেলিকপ্টারের পাইলট হিউ সি টমসন ওপর থেকে সব দেখতে পেয়ে গুলি ছুঁড়তে থাকা সৈনিক ও পলায়নরত গ্রামবাসীর মাঝখানে এসে হেলিপ্টার অবতরণ করেন।
তিনি তাঁর ক্রুদের সৈনিকদের দিকে বন্দুক তাক করে থাকতে বলেন, ততক্ষণ তিনি রেডিও’তে সহায়তা চান এবং বাঙ্কারে আশ্রয় নেওয়া নারী ও শিশুদের পালাতে সাহায্য করেন। পরে অনেক সৈনিক এই ঘটনার কথা চিঠি লিখে জানায়। কিন্তু এরকম তিনজনের বিরুদ্ধে মার্কিন কংগ্রেস সদস্যদের অনেকে বিষােদার করে। তাঁরা ঘৃণাপূর্ণ চিঠি এবং তাঁদের জীবনের ওপর হুমকির মুখােমুখী হন। ঐ ঘটনার প্রায় ৩০ বছর পর, ১৯৯৮ সালে তাদের প্রচেষ্টাকে সম্মান জানানাে হয় । হিউ সি টমসন ও তার ক্রুরাও পদক পান। তদন্তে সবার বিরুদ্ধে প্রমাণ পাওয়া না গেলেও ঐ প্লাটুনের ২৫ জন অফিসার দণ্ডিত হয় এবং প্লাটুনের নেতা লেফটেন্যান্ট উইলিয়ম ক্যালি অপরাধী সাব্যস্ত হয় ও তার কারাদণ্ড হয়।
৮৮
জেনিভা কনভেশন
যাকে আমরা আজ জেনিভা কনভেনশন নামে জানি, তা হল চারটি ট্রিটি’ বা চুক্তি এবং তিনটি অতিরিক্ত প্রােটোকল’ বা আচরণবিধি সমন্বয়ে গঠিত যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত বা নিপীড়িতদের প্রতি মানবিক আচরণ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আইন। এখানে মনে রাখতে হবে কনভেনশনের যে সনাতনী অর্থ, বিভিন্ন ব্যক্তি বা দলের সম্মিলন, সেটা এখানে খাটে না। এখানে কনভেনশন অর্থ হচ্ছে চুক্তি। এই চুক্তিমালায় বহুবচনের বদলে একবচনে ‘জেনিভা। কনভেনশন’ আখ্যা দেওয়া হলে তা ১৯৪৯ সালে সম্পাদিত বিভিন্ন চুক্তিকে বােঝায়। এগুলাে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে আলাপ-আলােচনার মাধ্যমে নির্ধারিত এবং যাদের সঙ্গে প্রথম তিনটি চুক্তির সর্বাধুনিক ভাষ্য এবং চতুর্থ একটি চুক্তি যােগ করা হয়েছিল। কনভেনশনের ভাষা ব্যাপক অর্থবহ এবং এর বিভিন্ন আর্টিকল’ বা ধারায় কোন সামরিক সংঘর্ষের সময় আটক ব্যক্তিদের মৌলিক অধিকারগুলাের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে এবং যুদ্ধের এলাকার মধ্যে ও তার আশপাশে অবস্থিত বা বসবাসকারী বেসামরিক ব্যক্তিদের সুরক্ষাবিধানের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। উল্লেখ্য, জেনিভা কনভেনশনে অস্ত্রের ব্যবহার। অন্তর্ভুক্ত নেই কারণ সেটি আছে ১৮৯৯ ও ১৯০৭ সালের হেগ কনভেনশন এবং জেনিভা প্রােটোকলে। ১৯৪৯ সালের জেনিভা কনভেনশন অনুমােদন করে স্বাক্ষর করেছে ১৯৪টি দেশ, সম্পূর্ণ অথবা আংশিক। বর্তমান সময়ে যুদ্ধের ধরন ও রীতি অনেকাংশে পাল্টে গেছে। কিন্তু আজও জেনিভা কনভেনশন যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্তদের রক্ষা করার ব্যাপারে প্রহরীর মত সজাগ। জেনিভা কনভেনশনে বলা হয়েছে: “সুরক্ষাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের সমস্ত ক্ষেত্রে ও পরিবেশে, এই অধিকার রয়েছে যে তাদের সকলের দেহের, তাঁদের সম্মানের, তাদের পারিবারিক অধিকারসমূহের, তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচরণের এবং তাদের সমস্ত অভ্যাস, প্রথা ও রীতিনীতির প্রতি যথাযােগ্য সম্মান প্রদর্শন করা হবে।
সব সময়েই তাদের প্রতি মানবিক আচরণ করা হবে এবং বিশেষ করে সমস্ত ধরনের সহিংস কার্যকলাপের অথবা হুমকির বিরুদ্ধে এবং যে কোন ধরনের অসম্মানের ও প্রকাশ্য কৌতূহলের বিরুদ্ধে তারা সুরক্ষিত থাকবেন। বিশেষভাবে নারীরা তাদের মর্যাদার প্রতি কোন রকম হামলার, সুনির্দিষ্টভাবে ধর্ষণ, বাধ্যতামূলক বেশ্যাবৃত্তি অথবা যে কোন ধরনের ইতর বা অশ্লীল হামলার বিরুদ্ধে সুরক্ষিত থাকবেন। সমস্ত সুরক্ষিত ব্যক্তি, তাদের স্বাস্থ্যগত অবস্থা, বয়স ও লিঙ্গের ক্ষেত্রে গৃহীত বিভিন্ন ব্যবস্থা নির্বিশেষে, যুদ্ধে বা সংঘর্ষে লিপ্ত যে কোন পক্ষের নিয়ন্ত্রণাধীন থাকাকালে সেই পক্ষের কাছ থেকে একই ধরনের আচরণ লাভ করার অধিকারী হবেন এবং সুনির্দিষ্টভাবে, জাতি বা বর্ণ, ধর্ম অথবা রাজনৈতিক মতামতের ভিত্তিতে তাদের। প্রতি কোনরকম বৈষম্যমূলক আচরণ করা হবে না। তবে যুদ্ধে বা সংঘর্ষে লিপ্ত। বিভিন্ন পক্ষ সমস্ত সুরক্ষিত ব্যক্তির ক্ষেত্রে এমন ধরনের নিয়ন্ত্রণমূলক অথবা নিরাপত্তাবিধানকারী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে যা যুদ্ধের ফলস্বরূপ প্রয়ােজনীয় বিবেচিত হতে পারে।”-ধারা ২৭, চতুর্থ জেনিভা কনভেনশন। জেনিভা কনভেনশন বিভিন্ন ভাগে ভাগে গড়ে উঠেছে। এর সূচনা ১৮৬২ সালে। হেনরি ডুন্যান্ট তার যুদ্ধের সময়কার ভয়াবহ স্মৃতিকথা লিখতে গিয়ে, যুদ্ধের সময় একটি স্থায়ী মানবিক সহায়তা এবং বিভিন্ন সরকারের মধ্যে এ সংক্রান্ত চুক্তির কথা উল্লেখ করেন। তাঁর প্রথম প্রস্তাবকে ভিত্তি করেই গড়ে ওঠে রেড ক্রস আর দ্বিতীয়টি জন্ম দেয় প্রথম জেনিভা কনভেনশনের। পরবর্তীকালে হেনরি ডুনান্ট ১৯০১ সালে অপর একজনের সাথে নােবেল শান্তি পুরস্কার পান। প্রথম চুক্তির ১০টি ধারা প্রথমে বারােটি দেশ কর্তৃক গৃহীত হয়। ১৮৬৪ সালে। তবে সেটি অনুমােদন করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অনেক সময় নেয়। শেষ পর্যন্ত প্রচারণা-আন্দোলনের তােড়ে ১৮৮২ সালে সেটি অনুমােদন করে স্বাক্ষর করে যুক্তরাষ্ট্র। দ্বিতীয় চুক্তিটি হয় ১৯০৬ সালে।
এটি নির্দিষ্ট করে সমুদ্রে কর্মরত সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের উদ্দেশ্য করে তৈরি করা হয়। তৃতীয় চুক্তিটি যুদ্ধবন্দীদের রক্ষা করার জন্য প্রথম গৃহীত হয়। ১৯২৯ সালে। চতুর্থ চুক্তির পেছনে কারণ ছিল বিখ্যাত নূরেমবার্গ মামলার যুদ্ধাপরাধীরা আর সেটি প্রথম গৃহীত হয় ১৯৪৯ সালে। এটি আগের সবগুলাে চুক্তিকে একীভূত করে নেয়। তার সাথে যুক্ত হয় আরাে কিছু নতুন শর্ত, যা প্রােটোকল’ বা আচরণবিধি নামে পরিচিত এবং যার মধ্যে যুদ্ধকালে বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষা অন্যতম। কিন্তু সেখানেই শেষ নয়। কালের আবর্তনে এই কনভেনশনকে অনেক সময়ই অসম্পূর্ণ মনে করে তাতে যুক্ত করা হয়েছে আরাে শর্ত। সেটি করা হয়েছে ১৯৭৭ সালে, এমনকি ২০০৫ সালের মত সাম্প্রতিক সময়ে, যখন রেড ক্রসের জায়গা নিয়েছে রেড ক্রিস্টাল। রেড ক্রস’-এর ব্যাপারে আপত্তি জানায় ইসলাম-প্রধান দেশগুলাে। জেনিভা কনভেনশনের লক্ষ্য সশস্ত্র সংগ্রাম চলাকালে নিম্নোক্ত লােকজনকে রক্ষা করা: ১. যুদ্ধে আহত ও অসুস্থ যােদ্ধা। ২. যুদ্ধবন্দী ৩. বেসামরিক নাগরিক। ৪. মেডিকেল ও ধর্মীয় ব্যক্তিবর্গ। প্রথম জেনিভা কনভেনশন যুদ্ধক্ষেত্রে সশস্ত্র বাহিনীর আহত ও অসুস্থ ব্যক্তিবর্গের অবস্থার উন্নতিকল্পে গৃহীত হয় ১৮৬৪ সালে। দ্বিতীয় জেনিভা কনভেনশন সমুদ্রের যুদ্ধে সশস্ত্র বাহিনীর আহত, অসুস্থ, জাহাজডুবির শিকার ব্যক্তিবর্গের অবস্থার উন্নতিকল্পে গৃহীত হয় ১৯০৬ সালে। তৃতীয় জেনিভা কনভেনশন যুদ্ধবন্দীদের প্রতি আচরণের ব্যাপারে সম্পর্কিত, গৃহীত হয় ১৯২৯ সালে। চতুর্থ জেনিভা কনভেনশন বেসামরিক নাগরিকদের রক্ষা করার ব্যাপারে সম্পর্কিত, গৃহীত হয় ১৯৪৯ সালে। এতে আগের তিনটি চুক্তিকে একত্রিত করা হয় এবং এটিই মূলত জেনিভা কনভেনশন নামে পরিচিত ও গৃহীত। এ সমস্ত একসাথে জেনিভা কনভেনশন নামে পরিচিত হলেও পরে আরাে সংশােধনী আনা হয় বা জেনিভা কনভেনশনকে ঢেলে সাজানাে হয়, যাকে বলা হচ্ছে প্রােটোকল। তাতে যা অন্তর্ভুক্ত করা হয় সেগুলাে হচ্ছে: ১৯৭৭ সালে-আন্তর্জাতিক সশস্ত্র সংগ্রামের শিকার লােকজনকে রক্ষা করা। ১৯৭৭ সালে আন্তর্জাতিক নয়, এমন সশস্ত্র সংগ্রামের শিকার লােকজনকে রক্ষা করা। ২০০৫ সালে-মেডিকেল সেবার ব্যাপারে অতিরিক্ত বিশেষ প্রতীক চিহ্ন গ্রহণ করা। মনে রাখা দরকার, জেনিভা কনভেনশন সবার ক্ষেত্রে প্রযােজ্য নয়, শুধু সেইসব জাতি বা রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে প্রযােজ্য যারা এই চুক্তি অনুমােদন করে তাতে স্বাক্ষর করেছে। যারা জেনিভা কনভেনশনে স্বাক্ষর করবে, সেই দেশগুলােকে এসব অপরাধের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি দেবার জন্য আইন প্রণয়ন ও তার প্রয়ােগ করতে হবে। অপরাধীদের। জাতীয়তা যা-ই হােক না কেন এবং অপরাধ যেখানেই সংঘটিত হয়ে থাক না কেন, তাদের বিচারের আওতায় আনা ও শাস্তি দেবার ব্যাপারে এসব রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা আছে ।