You dont have javascript enabled! Please enable it! Draft - সংগ্রামের নোটবুক

This is a temporary post for collecting data. Not for posting and not for publishing. Saved only as readable for the editors. Not clickable and not downloadable.

পাকিস্তানের প্রাসাদ ষড়যন্ত্র
কুদরতুল্লাহ শেহাবের ডায়েরী

ভূমিকা

কুদরতুল্লাহ্ শেহাব মূলতঃ কাশ্মিরী। এ সুবাদেই, সম্ভবতঃ ওকে আজাদ কাশ্মীরের সেক্রেটারী জেনারেল করা হয়েছিলাে। জানা যায়, সার সৈয়দের বংশােদ্ভুত তার পিতা আবদুল্লাহ সাহেব একদা গিলগিটের গভর্ণর ছিলেন। শেহাব উপনিবেশিক শাসনকে মনে-প্রাণে ঘৃণা করতেন বলে আই,সি,এস, চাকুরীতে যােগদানের মাত্র দশ মাস পরেই ইস্তেফা দিয়েছিলেন। কিন্তু তা গৃহীত হয়নি। বৃটিশ আমলের গােধুলি লগ্ন থেকে অখন্ড পাকিস্তানের আর এক গােধুলি লগ্ন পর্যন্ত, মহকুমা-হাকিম-জেলা প্রশাসক থেকে শুরু করে সচিব পর্যন্ত বহু গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। চাপের মুখে, সুদীর্ঘ নয় বছর, মদ্যপ, অবসাঙ্গ, অহংকারী, ক্ষমতালােলুপ, বদমেজাজী গভর্ণর জেনারেল গােলাম মােহাম্মদের সচিব ছিলেন, যে সময়টিকে ইনি নরকবাস বলে উল্লেখ করেছেন। এ গুরুত্বপূর্ণ পদটিতেও ইনি ইস্তফা দিয়েছিলেন কিন্তু রেহাই পাননি। পাকিস্তানের প্রথম প্রেসিডেন্ট প্রায় অনুরূপ চরিত্রের ইস্কান্দার মির্জাও তৎপর, সুযােগ সন্ধানী ছিলেন। স্বনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খানের আমলেও, ইনি একই পদে বহাল ছিলেন। দেশকে কিভাবে এরা গণতন্ত্রের পথ থেকে এক নায়কতন্ত্র ও সামরিক শাসনের পথে চালিত করেছেন, অব্যক্ত দুঃখের সঙ্গে, কুদরতুল্লাহ্ শেহাব বিস্ফারিত নেত্রে লক্ষ করেছেন। এ সময়েও ইনি এ পদে ইস্তফা দিয়েছিলেন, কিন্তু কামিয়াব হতে পারেননি। ইস্কান্দার মির্জার আমলে তিন বছরে চারবার মন্ত্রিসভা রদবদল হয়েছিলাে। ইয়াহিয়ার আমলে শুধু ইস্তেফা নয়, কুদরতুল্লাহ্ দেশ ত্যাগ করেন সপরিবারে। এ জন্যে তার পেনশন ইত্যাদির প্রশ্নটি স্থগিত ছিলাে তিন বছর।
কুদরতুল্লাহ শেহাব শুধু ডাকসাইটে আই,সি,এস অফিসারই ছিলেন না, একজন আঁদরেল উর্দু লেখকও বটে। তার কোন কোন লেখা উর্দু সাহিত্যের অমর সৃষ্টি। তার ‘মা’ গল্প সম্পর্কে অনেকেই সুবিদিত।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ছিয়াত্তরের মন্বন্তরে বাংলাদেশে অনাহারে অগণিত মানুষ অকালে প্রাণ হারাচ্ছিলাে। তখন এ দরদী মানুষটি স্বয়ং তদবির করে ত্রাণ দপ্তরের আন্ডার সেক্রেটারী হয়ে আসেন বাংলাদেশে। কিন্তু ওঁকে পাঠিয়ে দেয়া হয় মেদিনীপুরে মহকুমা-হাকিম হিসাবে। গােটা যুদ্ধে যত না মানুষ মারা গিয়েছে বাংলাদেশে, তারচে বেশী মারা গিয়েছে খাদ্যাভাবে। অথচ খাদ্য গুদামে মজুদ ছিলাে প্রচুর খাদ্য। বাংলাদেশের দ্বারদেশে উপস্থিত আজাদ হিন্দ ফৌজ বাংলার মাটিতে প্রবেশের সাথে সাথেই গুদামজাত খাদ্য জ্বালিয়ে দেয়া হবে, এ ছিলাে বৃটিশের পােড়ামাটি নীতি। কুদরতুল্লাহ্ সরকারী গুদামের তালা ভেঙ্গে অনাহারী মানুষের মধ্যে খাদ্যদানা বিলিয়ে দেন, যে জন্যে ওঁকে দারুণভাবে অপমানিত ও লাঞ্ছিত হতে হয়। একই সময়ে আর এক দুঃসাহসী আই,সি,এস, অফিসার নেত্রেকোনার তৎকালীন মহকুমা-হাকি আখতার হামিদ খানও চাকুরী ছেড়ে নিজের উদ্দেশ্যে কামিয়াব হন। তাঁর জনসেবা সম্পর্কে অনেকেই জানেন।
চাকুরি জীবনের তঁার এ তিক্ত ও বিচিত্র অভিজ্ঞতা কুদরতুল্লাহ শেহাব তাঁর প্রকান্ড ‘শেহাবনামা (১২০০ পৃষ্ঠা) গ্রন্থে মর্মস্পর্শী ভাষায় বিবৃত করেছেন। স্মরণকালে পন্ডিত নেহরু ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে লিখিত মিঃ মাথানির বইটিও প্রায় একই ধাচের।
এদিকে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সওদাগরী আমলাতন্ত্র ইংল্যান্ডের আমলাতন্ত্র থেকে স্বতন্ত্র ছিলাে। কোম্পানীর আমলাদের অর্থ লােলুপতা, অর্থ আত্মসাৎ, মদ্যপান, জুয়া খেলা, যৌনতা ইত্যাদি ছিলাে সাধারণ বৈশিষ্ট্য। সিপাহী বিপ্লবের পর বেগতিক দেখে স্বয়ং বৃটিশ সরকার সরাসরি এদেশের শাসনভার গ্রহণ করে। সওদাগরী আমলাতন্ত্রই ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস, কিন্তু খাচিয়ত-এ ছিল তথৈবচ। দেশী মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রী ছিলেন শ্বেতাঙ্গ সচিবদের হাতের পুতুল। ১৯১৫-৪৫ পর্যন্ত আই,সি,এস-এর ভারতীয় অনুপাত ছিলাে ১৫%। এরাও ছিল আবার কায়েমী স্বার্থবাদীভুক্ত, যাদের স্বার্থ ও বৃটিশ স্বার্থ অভিন্ন, কিছু ব্যতিক্রম বতিরেকে। প্রথম দিকে মনােনয়নে ভারতীয় সিভিল সার্ভিসে লোেক নিয়ােগ করা হতাে। পরে, প্রতিযােগিতামূলক পরীক্ষার ব্যবস্থা হয়।
১৬৩ জন বৃটিশ ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের নিম্নস্থ কিছু আমলা নিয়ে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের পত্তন। এর মধ্যে সচিব পর্যায়ের কেউ ছিলেন না। যুগসচিব ও উপ-সচিবের সংখ্যা ছিলাে মাত্র ৭। ১০ বছরের বেশী অভিজ্ঞতা খুবকম অফিসারেই ছিলাে। সচিবালয়ের অভিজ্ঞতা ছিলাে মাত্র ৮ জনের। ৬০% আমলার বয়েস ছিলাে ৩৫-এর নীচে, কিছু ব্যতিক্রম ব্যতিরেকে ৪০-এর উপর কারও বয়েস ছিলাে না। অভিজ্ঞ বৃটিশ আমলারা ছিলেন প্রশাসনের নায়ক। ফলে, স্বাধীনতার পরেও পাকিস্তানে সওদাগরী তথা বৃটিশ আমলাতন্ত্র একই ধারায় চলতে থাকে। জিন্নাহ, মন্ত্রীদের চেয়ে আমলাদের উপর ভরসা করতেন বেশী। ফলে, পাকিস্তানে আমলাতন্ত্র হয়ে উঠে লাগাম ছাড়া ঘােড়া, যার উত্তরাধিকারী বালাদেশও। গােলাম মােহাম্মদ থেকে ইয়াহিয়া খান পর্যন্ত, এমনকি পরেও পাকিস্তান শাসিত হয়েছে কতিপয় মদ্যপ, অহংকারী, ক্ষমতালােলুপ আমলাদের দ্বারা, যে জন্যে পন্ডিত নেহরু পাকিস্তান সরকারকে ‘দপ্তরী সরকার’ আখ্যায়িত করেছিলেন। এই নীতিহীন নেতৃত্ব ইসলামের নামে মানুষকে বুদ করে রেখেছিলাে, অথচ ইসলামের সাথে এঁদের দূরবর্তী সম্পর্কও ছিলাে না। এরা দেশ শাসনের চেয়ে কোদলী মেয়েদের মতাে লড়াই করেছিলেন। কুদরতুল্লাহ এ প্রাসাদ-ষড়যন্ত্রের প্রত্যক্ষ সাক্ষী। তার এ সাক্ষী বিধৃত হয়ে আছে শেহাবনামায়, অনুদিত শেহাবনামা মূল গ্রন্থের কয়েকটি নির্ধারিত অধ্যায় মাত্র। এ থেকেই মূল লেখকের শক্তিমত্তার পরিচয় পাওয়া যায়, তাছাড়া জানা যায় পাকিস্তানের প্রাসাদ-কোন্দলের চিত্তাকর্ষক কাহিনী, যার কুফলের ভাগ আমরাও পেয়েছি। আমাদের বাস্তবতাকে বুঝার জন্য প্রত্যেকেরই এ পুস্তক পাঠ করা সমীচিন।
—ডাঃ আলি নওয়াজ ১৮০/সি, আরামবাগ, ঢাকা

গভর্ণর জেনারেল গােলাম মােহাম্মদ

১৯৫৪ সালের ২৭শে অক্টোবর একটি মিটিং-এ যােগদানের জন্য আমি লাহাের থেকে করাচী যাই। মিটিং শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কেবিনেট সেক্রেটারী মিঃ আজিজ আহমদ টেলিফোনে আমাকে তার সঙ্গে দেখা করার জন্য ডাকলেন। আমি তার কার্যালয়ে গেলে তিনি জানালেন, গভর্ণর জেনারেল মিঃ গােলাম মােহাম্মদ আমাকে তলব করেছেন। আমি যেন এখনই গভর্ণর জেনারেল হাউসে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করি।
গােলাম মােহাম্মদ সাহেবের সঙ্গে আমার কোন পরিচয় ছিল না। মিঃ আজিজ আহমদের কাছে আমাকে তলব করার কারণ জানতে চাইলে তিনি সম্পূর্ণ অজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। গােলাম মােহাম্মদ সাহেবের এক ভাই লাহােরে শিল্পকারখানা স্থাপনের অনুমতি চেয়ে দরখাস্ত করেছিলেন। বললাম, এ ব্যাপারে কোন কথা বলার বা নির্দেশ দেয়ার জন্য আমাকে ডেকে থাকতে পারেন। কিন্তু মিঃ আজিজ আহমদ সে প্রসঙ্গেও কিছু জানেন না বলে জানালেন। তবে আমাকে সাবধান করে দিয়ে বললেন, ‘মিঃ গােলাম মােহাম্মদ রুক্ষ প্রকৃতির লােক। তার সঙ্গে কথা বলার সময় সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করবে।’
আমি গভর্ণর জেনারেল হাউসে গিয়ে উপস্থিত হলাম। একজন এ,ডি,সি আমাকে দোতলায় নিয়ে গেল। গালিচার ওপর সােফা। সামনে গােল টেবিলের ওপর ফুলের তােড়া। গভর্ণর জেনারেল নীল রঙের স্যুট পরে একটি ‘ইজি চেয়ারে বসে আছেন। কোটের কলারে তাজা গােলাপ ফুল, মাথায় কালাে জিন্নাহ টুপি এবং হাতে সিগারেট। তার পাশের চেয়ারে বসে আছেন প্রাইভেট সেক্রেটারী মিস্ রূথ। দেখতে সুন্দর, আধা মার্কিন-আধা সুইস। মিস রূথকে দেখে আমি মনে মনে মিঃ গােলাম মােহাম্মদের পছন্দের তারিফ না করে পারলাম না।
এ,ডি,সি, আমার পরিচয় দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে দু’জনই দৃষ্টি গাঢ় করে আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত নিরীক্ষণ করে লি। তারপর মিঃ গােলাম মােহাম্মদ আমাকে হাতের ইশারায় বসতে বললেন। কিছুক্ষণ আশ্চর্য নীরবতার পর তিনি বাচ্চা ছেলের মতাে গো-গো করে কিছু বলতে লাগলেন এবং অনেক্ষণ একইভাবে কথা বললেন, যার বিন্দুবিসর্গ কিছুই আমার বােধগম্য হল না। তিনি কোন ভাষায় কথা বললেন, তাও আমার বােধগম্য হল না। মিস্ রূথ বােঝালেন- “হিজ এন্সলেন্সি বলছেন যে তিনি আপনাকে গভর্ণর জেনারেলের সেক্রেটারীর পদে নিযুক্ত করেছেন। এটা খুবই সম্মানজনক চাকরি। তিনি আশা করছেন, আপনি তার আস্থা ও সন্তুষ্টি অর্জনে সচেষ্ট হবেন। তিনি আদেশ করছেন, আপনি এখনই নিচে গিয়ে আপনার দায়িত্ব গ্রহণ

করবেন।
শুনে আমার পায়ের তলার মাটি সরে গেল। সরাসরি অস্বীকার করা সম্ভব হলাে না; আমি, একটি আপত্তি দাঁড় করার চেষ্টা করলাম। আমি পাঞ্জাব সরকারের শিল্প পরিচালকের দায়িত্বে নিয়ােজিত। প্রাদেশিক সরকারের বিমুক্তি ব্যতিরেকে নতুন দায়িত্ব গ্রহণ করাটা খুবই অনিয়মের কাজ হবে।
মিঃ গােলাম মােহাম্মদ রেগে গেলেন। তার চেহারা লাল হয়ে উঠল। পূর্বের মতাে কিছুক্ষণ ‘গোঁ-গোঁ করে থামলেন। মিস্ রূথ বুঝিয়ে বললেন-‘হিজ এক্সলেন্সি বলছেন, পাঞ্জাব সরকার জাহান্নামে যাক,আর যে অনিয়মের কথা আপনি তুলেছেন, সে অনিয়মও আপনাকে সহ জাহান্নামে যাক। পাঞ্জাবের চীফ মিনিস্টার মালিক ফিরােজ খান নুন ঘটনাক্রমে নীচেই আছেন। তাকে এখনই ডাকা হচ্ছে। তিনি আপনাকে বিমুক্ত করে দেবেন এবং আপনি সঙ্গে সঙ্গে দায়িত্ব গ্রহণ করবেন।’
আপত্তিতে কোন কাজ হল না দেখে আমি আরেকটি অজুহাত পেশ করলাম,-জনাব, আমার বৃদ্ধা মা লাহােরে রয়েছেন। তাকে এবং মালপত্র আনার জন্য দায়িত্ব গ্রহণের আগে একবার লাহাের যেতে চাই।’
এবারে মিঃ গােলাম মােহাম্মদ রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে চেয়ারের হাতল ধরে চীৎকার করতে লাগলেন। মুখ থেকে ফেনা বেরুতে লাগল। মিস্ রূথ বললেন, স্যার আপনার ওপর ভীষণ রেগে আছেন। বলেছেন, আপনি বেশী তর্ক করেন। যদি এই অভ্যাস ত্যাগ করেন তবে আপনাকে পস্তাতে হবে।’
এ সময় একজন এ,ডি,সি, মিঃ ফিরােজ খান নুনকে নিয়ে কক্ষে প্রকাশ করলেন। গভর্ণর জেনারেল, তাকে লক্ষ্য করে কিছু অস্পষ্ট কথাবার্তা এবং মিস্ ক্লথের বিশ্লেষণের পর মিঃ নুন আমাকে বললেন, এটা খুবই সম্মানজনক পােস্টিং আপনাকে মােবারকবাদ জানাচ্ছি। আপনি এই মুহূর্তে দায়িত্ব নিয়ে নিন; আনুষ্ঠানিকতার কাজ পরে করবেন।’ আমি কিছু একটা বলতে চাইলে তিনি চোখের ইশারায় থামিয়ে দিলেন। এভাবেই পরবর্তী নয় বছরের জন্য আমি এই ‘জিন-পুরিতে’ (বায়তুল জিন) আবদ্ধ হয়ে পড়লাম।
নিচে নেমে আমি মিঃ এ,জি, রেজার কামরায় গেলাম, তিনি তখন গভর্ণর জেনারেলের সেক্রেটারী। সম্ভবতঃ তিনি তখনও জানেন না যে, তাকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে এবং তার জায়গায় আমাকে নিযুক্ত করা হয়েছে। একথা তিনি আমার কাছ থেকেই প্রথম শুনলেন বলে মনে হল। আমি ১৯৫৪ সালের নভেম্বরে যথারীতি দায়িত্ব গ্রহণ করলাম এবং যার সঙ্গে দিন-রাত কাজ করতে হবে সেই ব্যক্তিটিকে নীরবে পর্যালােচনা করার চেষ্টা করতে লাগলাম।
মিঃ গােলাম মােহাম্মদ দীর্ঘকাল ধরে প্যারালাইসিসের রােগী। পঙ্গুত্ব ছাড়াও সব
১০
সময় উচ্চ রক্তচাপে ভুগতেন। দু’এক কদম ছাড়া তিনি নিজে নিজে চলাফেরা করতে অক্ষম ছিলেন। হুইল চেয়ারে বসে গভর্ণর হাউসের লনে চক্কর লাগাতেন। হাতে কম্পনের রােগ ছিল বলে কোন রকমে দস্তখত দেয়া ছাড়া আর কিছু লিখতে পারতেন না। প্যারালাইসিসের প্রভাবে তার ভাষাও এমন আড়ষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে সকলের পক্ষে তা বুঝে ওঠা সম্ভব হত না। শারীরিক বৈকল্যের পাশাপাশি তিনি মানসিক বিকারের শিকার ছিলেন। থেমে থেমে কাজ করা কিংবা কাজের সময় ঘন ঘন বিরতি দেয়া তার ম্যানিয়া ছিল। কখনাে তার মস্তিষ্ক যথেষ্ট পরিচ্ছন্ন ও তেজোদীপ্ত থাকত এবং যে কোন বিষয় বিদ্যগতিতে উপলব্ধি করতে পারতেন। আবার কখনাে তা ফিউজ বালের মতাে ঘােলাটে হয়ে যেত; সে সময় প্রায় বাচ্চাদের মতাে আচরণ করতেন। এই গরম, এই ঠান্ডা, এই নরম, এই শক্ত। কখনাে সখনাে প্রায় পাগলের মতাে আচরণ করতেন। ভয় দেখাবার জন্য কিংবা খেলাচ্ছলে উপস্থিত লােকদের প্রতি শেয়াল তাড়াবার ভাব-ভঙ্গি প্রদর্শন করতেন। তার একটি প্রিয় অভ্যাস ছিল, নিজের ওপর মেকি ক্রোধ আরােপ করে জোরে জোরে চীৎকার করে কথা বলা। এ রকম অবস্থায় রক্তচাপ বেড়ে যেত এবং তিনি আস্তে আস্তে বেহুশ হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়তেন।
কর্নেল সরােয়ার ও ডাঃ হাফিজ আক্তার গভর্ণর জেনারেলের ব্যক্তিগত চিকিৎসক ছিলেন। ডাঃ হাফিজ খুব ভােরে একবার তার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতেন। বেরিয়ে আসার। সময় তার চেহারা দেখে ও প্রশ্ন করে আমি বুঝে নিতাম, আজকের দিনটি আমার কেমন যাবে। সে অনুযায়ী আমি নিজেকে প্রস্তুত করে নিতাম।
গােলাম মােহাম্মদের চরিত্রে কোন আদর্শ ছিল না। ক্ষমতার প্রতি অসম্ভব লােত ও নারী সঙ্গ লালসা-এ দুটি ছিল তার চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য। এই লক্ষ্যে তিনি ধােকাবাজি, ধান্ধালি, ষড়যন্ত্র, মিথ্যাচার-সব রকম অস্ত্র প্রয়ােগে পারঙ্গম ছিলেন। তার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের মন্ত্রীসভায় যারা কাজ করেছেন, তারা সব কিছুই জানতেন। এতদসত্বেও, কেন যে তাঁকে রােগ শয্যা থেকে তুলে নিয়ে পাকিস্তানের গভর্ণর জেনারেলের চেয়ারে বসানাে হয়েছিল, তার কারণ এখনও অনুদঘাটিত। তবে এ কথা ঠিক যে, সেই ভুলের মাশুলই পাকিস্তান অদ্যাবধি দিয়ে যাচ্ছে।
এই বিকলাঙ্গ, অক্ষম ও অহংকারী ব্যক্তিটি এমন মাটি দিয়ে তৈরী ছিল না, যে গভর্ণর জেনারেলের শাসনতান্ত্রিক সিংহাসনে শান্ত-শিষ্টতাবে চুপচাপ বসে থাকবে। দেড় বছরের মাথায়, ১৯৫৩ সালের এপ্রিলে, কলমের এক খোচায় তিনি খাজা নাজিমউদ্দিনকে প্রধানমন্ত্রীর গদি থেকে সরিয়ে দিলেন। কয়েকদিন আগেই তার পেশকৃত বাজেট জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভােটে পাস হয়েছিল। গভর্ণর জেনারেলের এই কার্যক্রম প্রথমবারের মতাে পাকিস্তানে গণতন্ত্রের ভিত্তির অপূরণীয়
১১
ক্ষতি সাধন করল। মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির উচিত ছিল, এই স্বৈরতান্ত্রিক কার্যক্রমের নিন্দা করা এবং খাজা নাজিমউদ্দিনের নেতৃত্বের ওপর আস্থা পুনর্ব্যক্ত করা। কিন্তু তাদের পতন শুরু হয়ে গিয়েছিল। তারা ভিজা বেড়ালের মতাে গভর্ণর জেনারেল-এর নিযুক্ত নতুন প্রধানমন্ত্রী বগুড়ার মােহাম্মদ আলীকে নিজেদের নেতা মেনে নিল। কয়েক মাস পর ১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ২৩৭টি মুসলিম আসনের মধ্যে মুসলিম লীগ মাত্র ১০টি আসনে জয়লাভ করতে সক্ষম হয়। ২২৩টি আসনে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করে এবং বাকী আসন পায় অন্যান্য দল। পূর্ব পাকিস্তান থেকে দাবী ওঠে, কেন্দ্রীয় আইন পরিষদ ভেঙ্গে দিয়ে নতুন নির্বাচন করতে হবে। পূর্ব পাকিস্তানে মুসলিম লীগের ভরাডুবি দেখে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ নির্বাচনের নামে ভয় পেয়ে গেলেন। তারা বেশী ভয় করলেন গােলাম মােহাম্মদকে। তিনি আইন সভা ভেঙ্গে দিয়ে নতুন নির্বাচন ঘােষণা করে দিতে পারেন। খাজা নাজিমউদ্দিনের অবৈধ অপসারণের কথাও এখন তারা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে শুরু করেন। তারা তলে তলে গভর্ণর জেনারেলের ক্ষমতা খর্ব করার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৫৪ সালের ২১শে সেপ্টেম্বর কেন্দ্রীয় আইন সভা গভর্ণর জেনারেলের আইন ও মন্ত্রীসভা বরখাস্ত করার ক্ষমতা রদ করে প্রস্তাব পাস করে। তাদের এই পদক্ষেপ যথার্থ ছিল, কিন্তু যে পদ্ধতি অবলম্বন করা হয় তা ছিল হাস্যম্পদ। এসেম্বলির সদস্যরা পঙ্গু গােলাম মােহাম্মদকে এতই ভয় পেতেন যে, সংশােধনী প্রস্তাবটি পাস করার ব্যাপারে তারা অতি গােপনীয়তা ও চোরের সতর্কতা অবলম্বন করেন। প্রস্তাবের মুদ্রিত কপি সদস্যদের মধ্যে বিতরণ না করে রাতের আঁধারে এসেম্বলি হাউসের আলমারিতে রেখে দেয়া হয়। পরের দিন নির্ধারিত সময়ের এক ঘন্টা আগে এসেম্বলির সভা ডেকে ১০ মিনিটের মধ্যে সংশােধনী প্রস্তাব পাস করে নেয়া হয়। এই প্রস্তাব অনুযায়ী গভর্ণর জেনারেলকে এসেম্বলির খেয়াল-খুশীর ওপর নির্ভরশীল ঠুটো জগন্নাথ-এ পরিণত করা হয়। ৩৩ দিন পর গােলাম মােহাম্মদ এর দাঁতভাঙ্গা জবাব দিলেন। ২৪শে অক্টোবর তিনি সারা দেশে ‘জরুরী অবস্থা জারি করে এসেম্বলি এবং মন্ত্রীসভা বাতিল ঘােষণা করলেন। বগুড়ার মােহাম্মদ আলীকে প্রধানমন্ত্রী করে নিজের পছন্দ মতাে নতুন এক মন্ত্রীসভা গঠন করলেন। ফলে গণতন্ত্রের অবশিষ্ট সম্ভাবনাটুকুও সমূলে বিদূরীত হল এবং আইনের শাসনের ওপর ব্যক্তি কেন্দ্রিক স্বৈরশাসনের জগদ্দল পাথর চেপে বসল।
আইনের শাসন হচ্ছে ব্যক্তি চরিত্রের মর্যাদার চাদরের মতাে। একবার তাতে ছিদ্র সৃষ্টি হলে, সেই ছিদ্র ক্রমান্বয়ে আরাে বহু ছিদ্রের জন্ম দেয় এবং তা মানুষের রিফু করার ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। রাজনীতির অঙ্গন মূলতঃ একটি বাগান। যদি সঠিক পরিচর্যা অব্যাহত থাকে, তবে ফুল ও কাটা আনুপাতিক হারে জন্মায়; অন্যথায় কেবল জঙ্গলে
১২
পরিণত হয়।
গােলাম মােহাম্মদ নিজের শক্তিতে চলতে-ফিরতে পারতেন না। কোন কিছু লিখতে পারতেন না। এমনকি,তার কথাবার্তাও কেউ সহজে বুঝতে পারত না। এতদসত্ত্বেও, কিসের বলে তিনি সারাদেশে ‘জরুরী অবস্থা ঘােষণা করলেন? ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান তার যে খাদ্য মানুষের বিকাশ বিঘ্নিত করে’ (যিস রিজিক সে আতি হে পরওয়াজ মে কোহি) শীর্ষক গ্রন্থে লিখেছেন , ‘জরুরী অবস্থা’ ঘােষণার আগে তিনি প্রধানমন্ত্রী বগুড়ার মােহাম্মদ আলী, চৌধুরী মােহাম্মদ আলী ও ইস্কান্দার মির্জার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন। সেখানে প্রধানমন্ত্রী গভর্ণর জেনারেলের তারবার্তা পেলেন, দেশে ফিরে আসার জন্য। সবাই দেশে ফেরার জন্য লন্ডনে আসল। করাচীগামী কোন বিমান না থাকায় একটি বিমান চার্টার করা হল। এর পরের ঘটনা আইয়ুব খানের ভাষায় এ রকম –
লন্ডন এয়ারপাের্টে গভর্ণর জেনারেল টেলিফোনে আমাকে ডাকলেন। তার কথা আমি কিছু বুঝতে পারছিলাম না। আমি টেলিফোন ইস্কান্দার মির্জাকে দিলাম। অবশ্য আমি এটুকু বুঝতে পেরেছিলাম, গভর্ণর জেনারেল আমাকে এই মুহূর্তে পাকিস্তানে ফিরে আসতে বলেছেন। অন্যদের ব্যাপারে তার কোন আগ্রহ নেই।……..
ইস্কান্দার মির্জা, চৌধুরী মােহাম্মদ আলী এবং আমি গভর্ণর জেনারেলের প্রাসাদে পৌছলাম। তিনি দোতলায় নিজের কামরায় সটান শয্যাশায়ী ছিলেন। রক্তচাপ বেড়ে গেছে, রাগে গরগর করছেন এবং মুখ দিয়ে কেবল গালাগালী উচ্চারিত হচ্ছে। চৌধুরী মােহাম্মদ আলী সাহস করে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, খেলেন এক ধমক। তারপর ইস্কান্দার মির্জা কিছু বলতে গিয়ে ধমক খেয়ে থেমে গেলেন। আমি বিনীতভাবে বললাম, প্রধানমন্ত্রীকে আর একটি সুযােগ দেয়া হােক। তিনি ঘাড় বাকিয়ে বলে উঠলেন, যাও, যাও, দূর হয়ে যাও।’ আমাদের এক প্রকার তাড়িয়ে দিতে চাইলেন তিনি।
আমরা একজনের পেছনে আরেকজন, এভাবে ঘর থেকে বেরুতে লাগলাম। সবার আগে ইস্কান্দার মির্জা, তার পেছনে চৌধুরী মােহাম্মদ আলী, তার পেছনে আমি। আমি বাইরে পা রাখতে যাচ্ছিলাম, ঠিক সে মুহূর্তে মিস রূথ আমার কোটের আস্তিন টেনে ধরলেন। আমি পেছনে ফিরে নতুন এক মানুষের চেহারা দেখতে পেলাম। সেই অসুস্থ বৃদ্ধ গভর্ণর জেনারেল, যিনি এতক্ষণ রাগে গরগর করছিলেন, খিল খিল করে হাসছেন। চোখের ইশারায় আমাকে কাছে ডেকে নিয়ে বসতে বললেন। তাকিয়ার নিচে থেকে
১৩
দুটো দলিল বের করলেন; এর একটিতে লেখা ছিল –
‘আমি গােলাম মােহাম্মদ, (পাকিস্তানের গভর্ণর জেনারেল) অমুক অমুক কারণে অমুক অমুক ক্ষমতা জেনারেল আইয়ুব খানের ওপর ন্যস্ত করছি এবং তিন মাসের মধ্যে শাসনতন্ত্র তৈরী করার জন্য নির্দেশ দিচ্ছি।’
আমি মনে মনে বললাম, আট বছর পর্যন্ত তাে আপনার কোন হুশ ছিল না, আর এখন আমাকে বলছেন, তিন মাসে আইন বানিয়ে দিতে। অন্য দলিলে লেখা ছিলঃ
‘আমি এই দায়িত্ব গ্রহণ করলাম। নিচে আমার নাম (স্বাক্ষরের জায়গাসহ)।
দলিল দুটো পড়ে আমার মন ‘না’ ‘না’ বলে চীৎকার করে উঠল। আমি তাকে বললাম, ‘জনাব, আপনি তাড়াহুড়া করছেন, এতে দেশের ভীষণ ক্ষতি হয়ে যাবে। আমি সামরিক বাহিনীকে সংগঠিত করার কাজে নিয়ােজিত আছি। আমাদের দুশমন ভারতকে আমরা যতই বােঝাই, তারা যেন আমাদের দুশমন না ভাবে, ততই তারা আমাদের পরম দুশমন ভেবে তৃপ্তি পাচ্ছে। আমি বরং আমার পেশায় নিযুক্ত থেকেই দেশের বেশী উপকার করতে চাই।’
উত্তরে তিনি অকথ্য গালি-গালাজের এক পিচকারি ছুঁড়ে মারলেন। অবশ্য তিনি একথা বুঝতে পারলেন যে, আমি তার তড়িঘড়ি কাজে সায় দেব না।’
যে কমান্ডার-ইন-চীফ গভর্ণর জেনারেলের মুখের ওপর এ রকম কড়া কড়া কথা বলতে পারেন, তাঁর তাে গভর্ণর জেনারেলকে অগণতান্ত্রিক কাজ করা থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেয়াই কর্তব্য ছিল। কিন্তু আইয়ুব খান তা কখনই করেননি। বরং ‘জরুরী অবস্থা’ ঘােষিত হলে নতুন মন্ত্রীসভায় (কমান্ডার-ইন-চীফ পদে বহাল থেকেই দেশ রক্ষা মন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ইস্কান্দার মির্জা গ্রহণ করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব। বস্তুতঃ এই দুই ব্যক্তিই গােলাম মােহাম্মদের বড় পৃষ্ঠপােষক ছিলেন। এ সেই শক্তি, যার বলে গােলাম মােহাম্মদ একের পর এক অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন।
একবার করাচী মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন গভর্ণর জেনারেলের এক সংবর্ধনার আয়ােজন করে। নির্ধারিত সময়ের কয়েক ঘন্টা আগে গােয়েন্দা বিভাগের একটি রিপাের্ট আমার কাছে আসে। রিপাের্টে বলা হয়, গভর্ণর জেনারেল যখন কর্পোরেশনে যাবেন, তখন পথে তার বিরুদ্ধে শ্লোগান এবং মিছিল হতে পারে। আমি সঙ্গে সঙ্গে রিপাের্টটি নিয়ে তার কাছে গেলাম। শুনে তিনি ভয় পেয়ে গেলেন। বললেন, ‘রিপাের্টটি নিয়ে আইয়ুব খান ও ইস্কান্দার মির্জাকে দেখাও এবং তাদের বলাে যে কর্পোরেশনে যাওয়ার সময় তারা দু’জন আমার গাড়ীতে থাকবে।’ আমি প্রথমে ইস্কান্দার মির্জার কাছে গেলাম। তিনি সবকিছু দেখে শুনে বললেন, ‘বুড়া ভয় পেয়েছে, চলাে আইয়ুব খানের কাছে যাই।’ সেখানে পৌঁছে ইস্কান্দার মির্জা আইয়ুব খানের সঙ্গে কিছুক্ষণ কানাঘুষা
১৪
করলেন তারপর রিপাের্টের পাশে লিখলেন-‘আমি গভর্ণর জেনারেলকে পরিপূর্ণ আশ্বাস দিচ্ছি যে, পরিস্থিতি আমাদের আয়ত্তে। তিনি নিশ্চিন্তে কর্পোরেশনে যেতে পারেন, পথে কোনাে অসুবিধা হবে না।’
মিঃ গােলাম মােহাম্মদ সহ আমরা কর্পোরেশনের দিকে যাত্রা করলাম। আমাদের গাড়ীর সামনে পেছনে এত বিপুল পরিমাণ সশস্ত্র পুলিশের গাড়ী শােভাযাত্রা করে চলতে লাগল যে, মনেই হল না, আমরা কোনাে সংবর্ধনা সভায় যােগদান করতে যাচ্ছি। সমস্ত রাস্তা একেবারে জন মানবশূন্য। রাস্তা এতখানি নিরাপদ দেখে গােলাম মােহাম্মদ সিংহের মতাে সাহসী হয়ে উঠলেন। আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, কোথায় গেল আমার বিরুদ্ধে মিছিলকারীরা? আমি পুলিশী ব্যবস্থার তারিফ করলে তিনি তাদের একচোট নিয়ে বললেন, “আমি কাউকে ভয় করি না। আমার সামনে কেউ এলে, আমি তার ঠ্যাং ভেঙে দেব। আমার বিরুদ্ধে কেউ শ্লোগান দিলে আমি তার মুখে থুথু দিয়ে দেব। তুমি বড় ভীরু। সকাল থেকে বলছ, রাস্তায় এই হবে সেই হবে। এখন কি দেখলে? গােলাম মােহাম্মদের সামনে কে দাঁড়াবে? থুক্।’ এই বলে তিনি গাড়ির মধ্যেই থুথু ফেললেন।
এরপর বেশ কয়েকদিন তিনি চায়ের টেবিলে আমার ‘ভীরুতা’ নিয়ে ঠাট্টা মশক। করেছেন। একদিন বলেই ফেললেন- “আচ্ছা বলতাে, সেদিন তুমি ভয়ে পেশাব করন তাে?’ আমি সহজভাবে উত্তর দিলাম, ‘না, সেদিন আমি কোন প্রকার ভয়ই পাইনি।’ তিনি একটু দম নিলেন, তারপর রেগেমেগে বললেন, তাহলে তুমি বলতে চাচ্ছ, আমি মিথ্যা বলছি।’ আমাকে নিশ্ৰুপ দেখে আরাে রেগে গেলেন। বললেন, -“আজকাল দুই টাকার সরকারী অফিসার রাষ্ট্র প্রধানের মুখের ওপর তাকে মিথ্যক বলছে। এর জন্য কঠিন শাস্তি ভােগ করতে হবে। তিনি বলে চলেছেন, আমরা যার যার ঘরে ফিরে এলাম।
কিছুক্ষণ পর মিস্ রূথ আমার কামরায় এলেন এবং আমাকে বােঝাতে চাইলেন যে, এতে রাগ করার কিছু নেই। এটা গভর্ণর জেনারেলের এক ধরনের অত্যাস। তাঁর কথা শেষ না হতেই ‘হুইল চেয়ারে বসে স্বয়ং গভর্ণর জেনারেল আমার কামরার সামনে এসে আমাকে চায়ের আমন্ত্রণ জানালেন।
মিঃ গােলাম মােহাম্মদ কখনও একথা স্বীকার করতেন না যে, তাঁর ভাষা অস্পষ্ট এবং তা অনেকেরই বােধগম্য নয়। একবার এক জয়েন্ট সেক্রেটারী তার মিনিষ্টারের সঙ্গে গােলাম মােহাম্মদের কাছে আসলেন। গােলাম মােহাম্মদের কোনাে কথাই জয়েন্ট সেক্রেটারী বুঝতে পারলেন না। গােলাম মােহাম্মদ তাকে ধমক দিয়ে বললেন, ‘কালা নাকি?’ তিনি জান বাঁচাবার জন্য তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, ‘জ্বি হ্যা, আজকাল কানে
১৫
একটু অসুবিধা অনুভব করছি। আর যায় কোথায়? গােলাম মােহাম্মদ ডিস্পেন্সারি থেকে কম্পাউন্ডার ডাকালেন। সেখানেই জয়েন্ট সেক্রেটারীর কানের মধ্যে পিচকারি ঢুকিয়ে তার কান পরিষ্কার করিয়ে দিলেন।
একবার ঈদ উপলক্ষে গােলাম মােহাম্মদের খায়েশ হল, তিনি স্বকণ্ঠে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন এবং রেডিওতে তা সরাসরি ব্রডকাস্ট করা হবে। রেডিও পাকিস্তানের মহাপরিচালক জেড, এ, বােখারী প্রমাদ গুনলেন। তিনি ঠিক করলেন, ভাষণের রেকর্ড ব্রডকাস্ট করার আগে তাকে শুনিয়ে দিলেই তিনি ঠিক বুঝতে পারবেন, এটা ব্রডকাস্ট করার মতাে নয়। বােখারী সাহেব বহু যত্নে গভর্ণর জেনারেলের ভাষণ রেকর্ড করলেন। তারপর তাকে বললেন, “স্যার, ভাষণটি কি আপনি আগে একবার শুনবেন?’ তিনি বললেন, অবশ্যই রেকর্ডিং-এর টেপ চালু হলে খরখর, গরগর, গাে-গো ইত্যাকার শব্দ করে তার কণ্ঠস্বর এমনভাবে বাজতে লাগল, যেন ফাটা পাইপ দিয়ে অনেক গ্যাস এক সঙ্গে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। অর্ধেক টেপ শােনার পর গােলাম মােহাম্মদ ঘব থেকে বেরিয়ে গেলেন। বােখারীর ওপর তার সে কি রাগ। কি রকম আনাড়ি ডাইরেক্টর জেনারেল একটা বক্তৃতা পর্যন্ত শুদ্ধভাবে রেকর্ড করতে জানে না। সেদিন বােখারীকে আমরা বহু কষ্টে নিরাপদে ঘর থেকে বের করে নিয়ে আসতে পেরেছিলাম।
মিশরের প্রেসিডেন্ট জামাল আবদুন নাসের কোনাে এক সফরে করাচীতে এক রাত যাত্রা বিরতি করেছিলেন। গভর্ণর জেনারেলের বাড়িতে তাঁকে ডিনার দেওয়া হল। ডিনারের আগে তাদের দু’জনের ইংরেজী কথােপকথন ছিল এই রকম-
মিঃ গােঃ মােঃ- গত বছর আমি খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম।
মিঃ জাঃ নাঃ- (কিছু বুঝতে পারলেন না; ভাবলেন কুশল জিজ্ঞেস করছেন) ইয়েস, গুড, ভেরি গুড।
মিঃ গােঃ মােঃ- প্রায় মৃত্যুর মুখে পড়েছিলাম, বলা যায়। মিঃ জাঃ নাঃ-ইয়েস, ইউর এসিলেন্সি, গুড-তেরি গুড।
ইতিমধ্যে আমাদের একজন কর্মচারী সেখানে পৌঁছে যায় এবং সে দোভাষীর কাজ শুরু করায় পরিস্থিতি বেশী দূর গড়াতে পারেনি।
গােলাম মােহাম্মদ তােষামােদ পছন্দ করতেন। তার পাশে সব সময় তােষামােদকারীদের ভীড় লেগেই থাকত। একবার গাড়ি করে শহর দিয়ে যাওয়ার সময় দেখা গেল একটি মসজিদ থেকে মুসল্লীরা নামাজ পড়ে বেরুচ্ছে। একজন তােষামােদকারী সেদিকে গােলাম মােহাম্মদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল, হুজুরের বদৌলতে আজকাল মসজিদে মুসুল্লী বেড়ে গেছে। আপনার আমলের আগে এত নামাজী
১৬
কখনও দেখা যায়নি। সবই আপনার বরকতে, হুজুর।
একবার গােলাম মােহাম্মদ নিমােনিয়ায় আক্রান্ত হলে এক ভদ্রলােক হন্তদন্ত হয়ে একটি রূপার তস্তরি হাতে নিয়ে আমার কামরায় প্রবেশ করল। তস্তরির ওপর বকরি জবাই করার একটি ছুরি সাদা রেশমি কাপড়ে ঢাকা। আমাকে সে অনুরােধ করল, অনুগ্রহ করে, আমি যেন ছুরির হাতলে গভর্ণর জেনারেলের হাতের স্পর্শ এনে দেই। এই ছুরি দিয়ে সে বকরি জবাই করে তার রােগ মুক্তির জন্য সদকা করবে। আমি দোতলায় গিয়ে গভর্ণর জেনারেলকে একথা বললে তিনি সানন্দে তার দুহাত দিয়ে ছুরিটা ছুঁয়ে দিলেন। আমি বললাম, স্যারের অনুমতি পেলে লােকটার সঙ্গে ডেপুটি সেক্রেটারীকে পাঠাতে চাই, যাতে সকা ছুরির স্পর্শেই শেষ না হয়। বকরিও একটা জবাই হয়। বললেন, ‘হ্যা’ তাতাে অবশ্যই।’ ফিরে গিয়ে সেই ভদ্রলােককে বললাম, বকরি জবাই করার সময় আমাদের ডেপুটি সেক্রেটারী আপনার সঙ্গে থাকবেন-গভর্ণর জেনারেলের প্রতিনিধি হিসাবে। শুনে তার মুখ কাল হয়ে গেল এবং তারপর আর কোন উচ্চবাচ্য করে আস্তে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
তােষামােদকারী ছিলেন প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীবর্গ, কমান্ডার-ইন-চীফ, অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা-সবাই। এরা কেউ কখনাে গােলাম মােহাম্মদের কথার বিরােধিতা করেনি-যতই অযৌক্তিক-অগণতান্ত্রিক হােক না কেন, গােলাম মােহাম্মদের হার সঙ্গে এরা হ্যা মিলিয়েছেন নির্দ্বিধায়। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে যুক্ত ফ্রন্টের বিপুল বিজয় পূর্ব পাকিস্তানে নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। মওলানা ভাসানী কাগমারি সম্মেলনে পশ্চিম পাকিস্তানকে ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলার হুমকি দেন। এর বিপরীতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা কাঠের পুতুলের ভূমিকা ছাড়া আর কিছুই পালন করেনি। গােলাম মােহাম্মদের সভাপতিত্বে প্রায় নিত্য-নিত্য মন্ত্রীসভার বৈঠক বসছে। এর কোনাে বৈঠকেই পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তিত পরিস্থিতি নিয়ে আলােচনা-পর্যালােচনা হয়নি। পূর্ব পাকিস্তানীদের রাজনৈতিক ক্ষোভের মােকাবেলা করার কোন যােগ্যতাই কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার ছিল না। তাদের যােগ্যতার চাবিকাঠি ছিল ৯২-ক ধারায় নিহিত। প্রাদেশিক সরকার যদি পছন্দমতাে কাজ না করে, দাও তাকে বরখাস্ত করাে তারপর সেখানে জারি কর গভর্ণরের শাসন।
এরমধ্যে দু’জন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভায় যােগদান করেন। একজন সীমান্তের বিখ্যাত কংগ্রেস নেতা ডাঃ খান সাহেব ও হােসাইন শহীদ সােহরাওয়ার্দী। ইস্কান্দার মির্জার সাথে ডাঃ খান সাহেবের ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব ছিল। ইস্কান্দার মির্জা যখন পেশােয়ারে ডেপুটি কমিশনার ছিলেন, তখন থেকে এই বন্ধুত্ব। শােনা যায়, কংগ্রেস নেতারা একবার মিছিল বের করলে ইস্কান্দার মির্জা বাঁধা দেয়ার জন্য পুলিশ না ডেকে,
১৭
রাস্তার মােড়ে মােড়ে তাদের স্বাগত জানানাের ব্যবস্থা করেছিলেন। প্রত্যেক মােড়ে ঠান্ডা শরবতের ব্যবস্থা করলেন। গরমের দিন, কংগ্রেসীরা শরবতের ওপর লাফিয়ে পড়ল। শরবতের সঙ্গে মেশানাে ছিল পায়খানার বেগ সৃষ্টিকারী ওষুধ। মুহূর্তের মধ্যে হাজার হাজার লােকের মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল।
সােহরাওয়ার্দি সাহেব আইন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছিলেন, কিন্তু তার লক্ষ্য ছিল প্রধানমন্ত্রীত্ব। প্রধানমন্ত্রী বগুড়ার মােহাম্মদ আলীকে তিনি দুচোখে দেখতে পারতেন না। অবশ্য তখন যে ধরনের শাসন ব্যবস্থা চালু ছিল, তাতে গভর্ণর জেনারেলকে খুশী রাখতে পারলেই কেল্লা ফতে আর সে জন্য তিনি চেষ্টার ত্রুটি করতেন না। ছবি তােলা তার একটি প্রিয় শখ ছিল। বিভিন্ন ঘরােয়া অনুষ্ঠানে গভর্ণর জেনারেলের ছবি তােলার ক্ষেত্রে তিনি নিজেকে দৃশ্যমান করে রাখতে সচেষ্ট থাকতেন। গভর্ণর জেনারেলের বাড়িতে তার ঘন ঘন যাতায়াত ছিল। সব যাতায়াতের উদ্দশ্য শুধু গােলাম মােহাম্মদের সঙ্গে সাক্ষাৎ নয়, মিস রূপের কামরায় বসে দীর্ঘক্ষণ গল্প করাও এসব যাতায়াতের লক্ষ্য ছিল। বাতাসে ভেসে খবরটি গােলাম মােহাম্মদের কান পর্যন্ত পৌঁছলে তিনি আমাকে ডেকে এর কৈফিয়ৎ তলব করলেন- এই সােহরাওয়ার্দী মিস্ ক্লথের কামরায় এসে বসে বসে এতক্ষণ কী করে? তাকে বলে দিও, এরপর সেখানে দেখা গেলে আমি তার ঠ্যাং ভেঙ্গে দেব।’ সােহরাওয়ার্দী সাহেবের সঙ্গে বাংলার মন্বন্তর কালে আমার পরিচয় হয়েছিল। আমি তার কাছে গিয়ে ঘটনা বললাম। এরপর থেকে তিনি এ ব্যাপারে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করতেন।
মিঃ গােলাম মােহাম্মদ শারীরিক শক্তি ফিরে পাওয়ার জন্য লাখনৌ থেকে একজন হেকিম আনালেন। হেকিম সাহেব অন্ধ ছিলেন এবং তার বয়স ছিল একশ’ পাচ বছর। ১০ বছরের একটি ছেলেও তার সঙ্গে আসলাে। এই ছেলেটি হেকিম সাহেবের পঁচানব্বই বছর বয়সে জন্মলাভ করে; সেজন্য নিজের যােগ্যতার জীবন্ত সার্টিফিকেট হিসাবে তিনি ছেলেটিকে সঙ্গে সঙ্গে রাখতেন। হেকিম সাহেবের আসার সাথে সাথে গভর্ণর জেনারেল হাউসের এক অংশ তিবি দাওয়াখানায় পরিণত হল। গাছের ছাল-বাকল, ডালপালা সব আসতে লাগল। সারাদিন হামান দিস্তা চলতে লাগল। কয়েকবার তিনি শয়ে শয়ে জীবিত ও স্বাস্থ্যবান পাখির ফরমাশ দেন। হায়দ্রাবাদের কমিশনারের মাধ্যমে বহু কষ্টে সেগুলাে সগ্রহ করা হয়। মগজ দিয়ে কোন ঔষধ হয়তাে তৈরী করেছেন, কিন্তু মাংসের কাবাব বানিয়ে তা নিজেই খেয়েছেন। একবার তিনি বকরির এমন একটি বাচ্চা চাইলেন, যেটি জন্মের পর এখনাে চোখ খােলেনি। শহরের বিভিন্ন বকরিখানায় লােক লাগিয়ে সে রকম বাচ্চা যােগাড় করে দেয়া হল। বাচ্চার মগজ ও মাংস দিয়ে শক্তিবর্ধক কুস্তা বানানাে হল। গােলাম মােহাম্মদ বেশ আনন্দের সঙ্গে সেগুলাে খেলেন। তার শক্তি বাড়ল কি
১৮
বাড়ল না, বােঝা গেল না। কিন্তু রক্তচাপে যে দারুণভাবে বেড়ে গেল, সেটা স্পষ্ট বােঝা গেল। একদিন তিনি হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। কর্নেল (পরে বিগেডিয়ার) ডাক্তার সরােয়ার তাঁকে দেখেশুনে আমাকে বললেন, গভর্ণর জেনারেলের জীবনের আশা খুবই ক্ষীণ। সবাইকে জানিয়ে দিন, যদি শেষ দেখা দেখতে চায় তবে এখনি যেন চলে আসে। দেখতে দেখতে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীবর্গ, কর্মচারীবৃন্দ সবাই এসে উপস্থিত। ইস্কান্দার মির্জা ও আইয়ুব খান সামরিক উর্দি পরা ছিলেন। তারা বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে বিদায়ী ‘স্যালুট জানালেন। আইয়ুব খান গভর্ণর জেনারেলের প্রশংসায় একটি শ্লোক আওড়ালেন। দেখাদেখি দু’একজন মন্ত্রীও সংক্ষিপ্ত শােক-বক্তৃতা ঝাড়লেন। হঠাৎ অক্সিজেন পাইপ একটু কেঁপে উঠল; প্রথমে একটি হাত এবং পরে দ্বিতীয় হাত একটু নড়ে উঠল। কর্নেল সরােয়ার আনন্দের সঙ্গে ঘােষণা দিলেন, গভর্ণর জেনারেল জ্ঞান ফিরে পাচ্ছেন। শােনামাত্র পুরাে কেবিনেট পড়ি কি মরি করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। জ্ঞান ফিরে পেয়ে গােলাম মােহাম্মদ কর্মচারীদের এক এক জনকে ডেকে ডেকে জানতে চাইলেন, তার অজ্ঞান অবস্থায় কে কত খুশী ছিল, আর কে কত চিন্তিত ছিল?
গােলাম মােহাম্মদের শারীরিক অবস্থা ক্রমান্বয়ে আরাে খারাপ হয়ে পড়ল। বিছানা থেকে তিনি আর উঠতে পারছিলেন না। তাকে চিকিৎসার জন্য সুইজারল্যান্ডের জুরিখে পাঠানাে হল। সেখানেও তার স্বাস্থ্যের বিশেষ কোনাে পরিবর্তন হলাে না; বরং মানসিক অবস্থার আরাে অবনতি ঘটলাে। করাচী ফিরে আসলেন তিনি। প্রতিদিন ভােরে স্যুট-কোট পরে কেবিনেট রুমে আসতেন। ব্যক্তিগত কর্মচারীদের জড় করে তাদের মন্ত্রীসভা গঠন করতেন, দপ্তর বন্টন করতেন, শপথ বাক্য পাঠ করাতেন, তারপর ঘন্টার পর ঘন্টা মিটিং চালাতেন।
একদিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ইস্কান্দার মির্জার পি,এস, আমাকে টেলিফোন করে বললেন, মির্জা সাহেব আমাকে সন্ধ্যায় তার বাসায় চায়ের দাওয়াত দিয়েছেন। সেখানে পৌঁছে দেখি, আইয়ুব খান, চৌধুরী মােহাম্মদ আলী, কর্নেল সরােয়ার আগে থেকেই উপস্থিত আছেন। আমাদের কথাবার্তা ছিল এ রকম ঃ
ইস্কান্দার মির্জা ঃ গভর্ণর জেনারেলের স্বাস্থ্য সম্পর্কে যে খবর পাচ্ছি, তাতে তার পূর্ণ বিশ্রাম নেয়া প্রয়ােজন।
আইয়ুব খান ঃ প্রশ্ন হচ্ছে স্বেচ্ছায় তিনি পদত্যাগ করতে রাজী হবেন কিনা?
আমি ঃ তাকে বুঝিয়ে বললে রাজী হতেও পারেন।
ইঃ মিঃ আমরা শুনেছি তােমাকে খুব বিশ্বাস করেন। তুমি যে কাগজ সামনে ধর, তাতেই সই করে দেন।
১৯
আমিঃ না , ঠিক তা নয়; বরং মিস্ রূথ এবং ডেপুটি সেক্রেটারী ফররুখ আমিনকে বেশী বিশ্বাস করেন।
ইঃ মিঃ বাদ দাও সে কথা। তুমি এ ব্যাপারে কি সাহায্য করতে পার?
আমি ঃ পদত্যাগের ব্যাপারে আমাদের না টানাই ভাল। এ দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়া যায় অথবা গভর্ণর জেনারেলের পরিবারের কাউকে।
আমার প্রস্তাব তাদের মনঃপুত হল না বুঝতে পারলাম। মিটিং ভেঙে গেল। কয়েক সপ্তাহ পর গােলাম মােহাম্মদের পদত্যাগের বিষয়টি মীমাংসা হয়ে গেল। তিনি প্রথমে ছুটি নিলেন, তারপর পদত্যাগ করলেন।
আমাকে অনেক সময় প্রশ্ন করা হয়েছে, -গােলাম মােহাম্মদ নেশাগ্রস্ত ছিল, চলতে ফিরতে পারত না, বলতে লিখতে পারত -তারপরও রীতিমত শান-শওকতের সাথে রাজত্ব করেছেন-এর আসল রহস্য কোথায়?
এ প্রশ্নের দুটো জবাব আছে। একটি, গােলাম মােহাম্মদের শক্তির উৎস ও রাজনীতিবিদদের দুর্বলতা। দ্বিতীয়টি- ইস্কান্দার মির্জা ও আইয়ুব খানের পৃষ্ঠপােষকতা, যা দৃষ্টিগােচর হয়না এমন কালিতে লিখত। এ দু’জন ক্ষমতালােভী ব্যক্তির নিজ নিজ উচ্চাভিলাষ ছিল। এরা নিজেদের কার্যসিদ্ধের জন্য গােলাম মােহাম্মদের মতাে অথর্ব, অহংকারী এবং স্বৈরাচারীকে সামনে রেখে তারা নিজেদের প্রস্তুত করে নিয়েছিল।
২০

ইস্কান্দার মির্জা ঃ উত্থান ও পতন

১৯৫৫ সালের আগস্টে মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা গভর্ণর জেনারেলের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। নতুন গভর্ণর জেনারেল যাতে তার পছন্দমতাে নতুন সেক্রেটারী নিয়ােগ করতে পারেন, সেজন্য আমি আমার দায়িত্ব অর্পণের রিপাের্ট যথারীতি তার কাছে পাঠিয়ে দিই। রিপাের্টটি হাতে নিয়ে তিনি সােজা আমার কামরায় চলে আসেন এবং বলেন, “আমি চাই, তুমি এখানেই কাজ করতে থাক।’
তার সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে প্রথম দিকে দারুণ অসুবিধা সৃষ্টি হল। এতদিন আমরা গভর্ণর জেনারেলের কথা বা কণ্ঠধ্বনি না শুনে তার ঠোটের নড়াচড়া বা ভঙ্গি দেখেই কাজ করতে অভ্যস্ত ছিলাম। এখন সম্পূর্ণ উল্টো হয়ে গেল। দু’তিনবার এ রকম অবস্থার সৃষ্টি হল যে, তিনি যখন কোনাে কথা বলা শুরু করেছেন, আমি অভ্যাসবশতঃ এক দৃষ্টে তার ঠোটের দিকে তাকিয়ে থেকেছি। আর তিনি, মুখে কিছু লেগে রয়েছে মনে করে পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছে নিতেন। প্রতিবারই এ রকম ঘটনা ঘটতে দেখে, আমি বিনীতিভাবে আসল ব্যাপারটি তাকে খুলে বললাম। শুনে তিনি অনেকক্ষণ ধরে হাসলেন; তারপর বললেন, তাতে কি হয়েছে? চিন্তার কোন কারণ নেই, আস্তে আস্তে স্বাভাবিক কণ্ঠধ্বনি শুনতে শুনতে তােমাদের অভ্যাস হয়ে যাবে।’
বেগম নাহিদ মির্জার প্রবেশের পর গভর্ণর জেনারেল হাউসের চেহারা পাল্টে গেল। তিনি ছিলেন অত্যন্ত পরিচ্ছন্নতা প্রিয়, আচরণবাদী ও ফ্যাশন দুরস্ত ইরানী মহিলা। ঘর-দোরের সাজ-গােছ এবং সৌন্দর্য রক্ষার প্রতি তার ছিল সীমাহীন আগ্রহ। একদিন আমার অফিস রুমে ঢুকে জিজ্ঞাসা করলেন, এই রুমের নতুন সাজ-সজ্জা আপনার পছন্দ হয়েছে কি?
আমাকে অবাক হয়ে এদিক-ওদিক তাকাতে দেখে ততােধিক অবাক হয়ে তিনি বললেন, “আপনি কি সত্যি সত্যি এই রুমে কোনাে পরিবর্তন লক্ষ্য করেন নি? আমি লজ্জিত হয়ে মাথা নিচু করলাম, কারণ আমি কোন পরিবর্তন লক্ষ্য করিনি। তিনি কপালে হাত ঠেকিয়ে বলতে লাগলেন, ‘ভাল করে দেখুন তাে,পুরনাে ছিন্নভিন্ন পর্দার জায়গায় কি সুন্দর নতুন পর্দা লাগানাে হয়েছে, পর্দার রঙের সঙ্গে মিল করে সােফার কাপড়ও বদলানাে হয়েছে। দরজার দুই দিকে ফুলের টব, জানালার পাশে তাজা ফুলসহ ফুলদানি আর খুঁটির সঙ্গে লটকে থাকা আপনার ময়লা কোটটিও ড্রাইওয়াশ করিয়ে প্লাষ্টিক কভারে ঢেকে টানিয়ে রাখা হয়েছে। আমি লজ্জিত হয়ে আমার সৌন্দর্যবােধের অভাবের জন্য মাফ চাইলাম। তিনি মুচকি হেসে বললেন ‘এই অপরাধ ক্ষমার যােগ্য নয়, তবে একটি কাজ করে দিলে ক্ষমা করে দিতে পারি।
২১
– “আপনি আদেশ দিন, আমি যথাসাধ্য পালন করতে প্রস্তুত।’
– ‘মিস রূথকে গভর্ণর জেনারেল হাউস থেকে বিদায় করে দিন।
এ রকম একটি অপ্রত্যাশিত আদেশ শুনে আমি হকচকিয়ে গেলাম। তিনি বলতে থাকলেন, এটা সাধারণ কান্ডজ্ঞানের কথা, এখান থেকে ওর বিদায় নিতে যত দেরি হবে, কেলেংকারির আশংকা তত বেশি থাকবে। আপনি এই দপ্তরের ইনচার্জ, যত শীঘ্র সম্ভব ওকে সরিয়ে দিন। দেখবেন, আমার নাম যেন বলবেন না।’
মিস্ রূথ অসম্ভব অনুভূতিপ্রবণ ও দূরদর্শী মেয়ে। গভর্ণর জেনারেল হাউসের নতুন পরিবর্তন দৃশ্যমান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার নারীসত্তা তাকে সাবধান করে বলে দিয়েছে, এখন আর তার এখানে থাকা সম্ভব নয়। ফলে আমার ইঙ্গিত মাত্র পেয়েই সে ইস্তেফা দেয় এবং এর কয়েকদিন পরেই পাকিস্তান ছেড়ে চলে যায়।
ইস্কান্দার মির্জা ও নাহিদ মির্জা গভর্ণর জেনারেল হাউসে আসার পর থেকে দাওয়াত আর পার্টি লেগেই থাকত। কখনাে ডিনার, কখনাে ড্যান্স, কখনাে বা মুন-লাইট পিকনিক। এর ওপর আবার নানা কায়দার অনুষ্ঠান রাত আটটা/সাড়ে আটটা থেকে দেড়টা-দুটো পর্যন্ত চলতে থাকত। মহিলাদের জন্য এটা ছিল ফ্যাশন শাের মতাে, যেখানে সৌন্দর্য ও পােশাকের প্রদর্শনী করা হত। তাছাড়া বেগম নাহিদ মির্জার বিশেষ তত্ত্বাবধানে তৈরী ইরানী পােলাও, কাবাব এবং কোপ্তাও বড় আকর্ষণীয় হত। মদ পান করে বেহুশ হয়ে পড়ে থাকা একটি সাধারণ দৃশ্য ছিল। অবশ্য ইস্কান্দার মির্জা নিজে হুশ হারাতেন না, অন্যদের তামাশা উপভােগ করতেন। একদিন তিনি এক সুন্দরী মহিলার আঁচল ধরে তার শাড়ীর প্রশংসা করছিলেন; বেগম মির্জা যেন ছোঁ মেরে সেখানে এসে উপস্থিত হলেন। মহিলাকে লক্ষ্য করে বললেন, “আমার স্বামীর সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করার চেষ্টা করবেন না।’ তওবা, তা আমি কি করলাম? উনি তাে আমার শাড়ীর প্রশংসা করেছেন শুধু-মহিলা চট করে জবাব দিলেন। নাহিদ মির্জা বললেন, ‘এরকমই আমার সঙ্গে সম্পর্ক হওয়ার আগে উনি কিন্তু এভাবেই আমার শাড়ির প্রশংসা করেছিলেন। নাহিদ মির্জা ইস্কান্দার মির্জার দ্বিতীয় স্ত্রী। প্রথমে পাকিস্তানস্থ ইরানী এ্যাম্বেসির মিলিটারী সেক্রেটারীর সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছিল। তার কাছ থেকে তালাক নিয়ে তিনি ইস্কান্দার মির্জাকে বিয়ে করেন। মির্জা সাহেব তখন পাকিস্তানের দেশরক্ষা সচিব।
ইস্কান্দার মির্জার কাজ করার পদ্ধতি ছিল সুশৃংখল। প্রতিদিন সকাল আটটা থেকে দুপুর একটা পর্যন্ত তিনি এক নাগাড়ে অফিসে বসে থাকতেন। রােজকার ফাইল রােজই ছেড়ে দিতেন। ১টার সময় চলে যাওয়ার পথে আমার জানালার পাশে কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়াতেন, বলতেন-‘কোন জরুরী কাজ বাকী নেই তাে?’ সন্ধ্যায় আমাকে সরকারী কাজে কখনাে ডাকতেন না। এই রুটিনের মাত্র একদিন ব্যত্যয় ঘটেছিল। একদিন রাত
২২
দশটার সময় দেখি, আমার বাসার সামনে গভর্ণর জেনারেল হাউসের গাড়ি এসে উপস্থিত। গাড়ী থেকে নামল করাচীর এক নামজাদা শেঠ। সে নেশাগ্রস্ত ছিল। গভর্ণর জেনারেলের হাতের লেখা একটি স্লিপ আমাকে দিয়ে সে বলল যে, তিনি আমাকে দেখা করতে বলেছেন। স্লিপে আমার প্রতি আদেশ ছিল, আমি যেন বাহককে আমদানী-রপ্তানির প্রধান নিয়ন্ত্রকের কাছ থেকে ২৫টি শিভার্লেট কার আমদানী করার লাইসেন্স পাইয়ে দিই। দস্তখতের নিচে সেদিনের তারিখ ছিল এবং আদেশ দানের সময় লেখা ছিল রাত নয়টা। আমি শেঠকে সঙ্গে নিয়ে গভর্ণর জেনারেল হাউসে গিয়ে ইস্কান্দার মির্জার সঙ্গে দেখা করি, তিনি আমাকে ভিন্ন কামরায় নিয়ে গিয়ে বললেন, ‘এই শেঠ সারা সন্ধ্যা আমাকে জ্বালাতন করে মেরেছে। আমিও তার হাত থেকে বাঁচার জন্য ঐ হাস্যাস্পদ আদেশনামাটি লিখে দিয়েছি। নীচে সময় লিখেছি এজন্য যে, যাতে তুমি বুঝতে পার, এটা সরকারী আদেশ নয়, মদের টেবিলে বসে লেখা আদেশ। এবার তাকে তােমার অফিসে নিয়ে গিয়ে আচ্ছা করে ধমকাও এবং তার সামনেই কাগজটি ছিড়ে ফেল। আর মনে রেখাে, এ রকম রাত ৮টার পরে লেখা কোনাে কাগজ যদি ভবিষ্যতে পাও, নির্দিধায় সঙ্গে সঙ্গে ছিড়ে ফেলবে।’
ইস্কান্দার মির্জা গভর্ণর জেনারেল হওয়ার তিন দিন পর সােহরাওয়ার্দী সাহেব এক সন্ধ্যায় আমাকে টেলিফোন করে জানতে চাইলেন, প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তার শপথ গ্রহণের তারিখ নির্ধারিত হয়েছে কিনা। এ ব্যাপারে আমার কিছুই জানা ছিল না। সে কথা বলতেই তিনি উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন “তুমি কি রকম সেক্রেটারী? সিদ্ধান্ত তাে হয়েই গেছে-কেবল তারিখ ঠিক করা বাকী। তুমি এখনই গভর্ণর জেনারেলের কাছে যাও, শপথের দিন-তারিখ-ক্ষণ জেনে নিয়ে আমাকে জানাও আমি অপেক্ষা করছি।’
অগত্যা গভর্ণর জেনারেলের কাছে গিয়ে আমি বিষয়টি জানতে চাইলাম। তিনি ব্রিজ খেলছিলেন। আমার কথা শুনে খুব জোরে জোরে হাসলেন। বন্ধুদের লক্ষ্য করে বললেন, “ওহেতােমরা কি শুনেছ? সােহরাওয়ার্দী উজিরে আযম হওয়ার তারিখ জানতে চাচ্ছে। সবাই মিলে একচোট হাসাহাসি হল। এরপর ইস্কান্দার মির্জা আমাকে বললেন, “আমার হয়ে তুমি তাকে জানিয়ে দাও, শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান আগামী পরশু অনুষ্ঠিত হচ্ছে এবং চৌধুরী মােহাম্মদ আলী প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন। আমি সােজা সােহরাওয়ার্দী সাহেবের বাসায় চলে গেলাম। খবরটি বলার পর, বিভিন্ন কথায় মনে হল, তার সঙ্গে পাকাপাকি কথা হয়েছিল। পরিবর্তনের কথা শুনে তিনি মনক্ষুন্ন হলেন। আমার সামনে শুধু এইটুকু উচ্চারণ করলেন ‘আচ্ছা, আবার সেই প্রাসাদ ষড়যন্ত্র!
১৯৫৫ সালের ১১ই আগস্ট চৌধুরী মােহাম্মদ আলী প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ
২৩
করেন। শেরেবাংলা এ, কে, ফজলুল হক এই প্রথম বারের মতাে কোন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভায় অন্তর্ভূক্ত হন। কিছুদিন আগে তাকে গাদ্দার, দেশের শত্রু আখ্যা দেয়া হয়েছিল আর এখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। চৌধুরী মােহাম্মদ আলী দায়িত্ব গ্রহণের দু’মাসের মধ্যেই পশ্চিম পাকিস্তানকে ‘এক ইউনিটে পরিণত করার কাজ সমাপ্ত করেন এবং ১৯৫৫ সালের ১৪ই অক্টোবর তারিখে পশ্চিম পাকিস্তান যথারীতি একটি মাত্র প্রদেশে রূপান্তরিত হয়।
প্রধানমন্ত্রী হিসাবে চৌধুরী মােহাম্মদ আলীর প্রধান কৃতিত্ব ১৯৫৬ সালের শাসন। লিয়াকত আলী খান থেকে শুরু করে অদ্যাবধি কোন প্রধানমন্ত্রী পূর্ণাঙ্গ শাসনতন্ত্র প্রদান করতে সক্ষম হননি। চৌধুরী মােহাম্মদ আলী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পাঁচ মাসের মাথায় খসড়া শাসনতন্ত্র পেশ করেন। ২৪৫ ধারা সম্বলিত খসড়া শাসনতন্ত্রের ওপর আইনসভায় ৬৭০টি সংশােধনী প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। পূর্ব পাকিস্তানে এর বিরুদ্ধে মিছিল, হরতাল সহ প্রতিরােধ দিবস পালিত হয়। মওলানা ভাসানী পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার হুমকি দেন। আইনসভার অধিবেশনে আওয়ামী লীগ নেতা আবুল মনসুর আহমেদ পরিষ্কার ভাষায় ঘােষণা করেন যে, ধর্মবােধ এবং একসঙ্গে স্বাধীনতা আন্দোলন করা ছাড়া পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে আর কোন মিল নেই। দুটো দুই দেশ এবং দুই জাতি। সােহরাওয়ার্দী সাহেবও এর তীব্র বিরােধিতা করেন, কিন্তু ভােটাভুটির সময় ওয়াকআউট করেন। কিছুদিন পর, এই শাসনতন্ত্রের অধীনেই তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং দ্বিধা-দ্বন্দহীন চিত্তে ঘােষণা করেন-শাসনতন্ত্রে পূর্ব পাকিস্তানের শতকরা আটানব্বই ভাগ দাবী-দাওয়া মেনে নেয়া হয়েছে।
খসড়া শাসনতন্ত্র ১৯৫৬ সালের ২৩শে মার্চ পাস হয়। এর অধীনে চৌধুরী মােহাম্মদ আলী প্রথম প্রধানমন্ত্রী ও ইস্কান্দার মির্জা ইসলামী প্রজান্ত্রী পাকিস্তানের প্রথম প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত হন। নতুন শাসনতন্ত্র ছিল ইসলাম ও গণতন্ত্রের সহায়ক আর তার রক্ষক নিযুক্ত হলেন এমন এক ব্যক্তি যার সঙ্গে দুই জিনিসের দূরবর্তী সম্পর্কও ছিল না।
প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ইস্কান্দার মির্জা নতুন শাসনতন্ত্রকে নানাভাবে অকার্যকর করার কাজে সর্বশক্তি নিয়ােগ করেন। তিনি ভাঙ্গা-গড়ার কাজে ওস্তাদ ছিলেন। প্রথমেই তার বন্ধু পশ্চিম পাকিস্তানের মূখ্যমন্ত্রী ডাঃ খান সাহেব ও গভর্ণর মুশতাক আহমদ গুরমানিকে দিয়ে নতুন রাজনৈতিক দল রিপাবলিকান পার্টির জন্ম দেন। এ কাজে তিনি এতই ব্যস্ত হয়ে পড়েন যে, সরকারী ফাইলে সই দিতে পর্যন্ত সময় পেতেন না। এতদিনকার নিয়ম ভঙ্গ করে তিনি দিনের বেলা অল্পক্ষণের জন্য মাত্র অফিসে আসতেন এবং দাড়িয়ে দাঁড়িয়ে জরুরী ফাইলে সই দিয়ে চলে যেতেন। কখনাে কখনাে ফাইলের ফিতা না খুলেই কাগজ টেনে সই করে চলে যেতেন। পার্টি তৈরী হয়ে যাওয়ার পর তিনি যেন যাদুর কাঠি হাতে
২৪
পেয়ে গেলেন। যখন যাকে খুশী ক্ষমতায় বসাতেন, যাকে খুশী বাদ দিতেন। শাসনতন্ত্র প্রবর্তিত হওয়ার ১৩ মাস পরে চৌধুরী মােহাম্মদ আলীকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দেন। রিপাবলিকান পার্টির সমর্থনে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রে মন্ত্রীসভা গঠন করে-হােসাইন শহীদ সােহরাওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। এর ১৩ মাস পরে রিপাবলিকান পার্টি সমর্থন প্রত্যাহার করলে কোয়ালিশন মন্ত্রীসভা ভেঙ্গে যায়। আই, আই, চুন্দ্রিগড়ের নেতৃত্বে চার দলের কোয়ালিশন মন্ত্রীসভা গঠন করা হয় এবং বহু কষ্টে তা দুই মাস স্থায়ী হয়। সবশেষে মালিক ফিরােজ খান নুনের নেতৃত্বে ছয় পার্টির কোয়ালিশনে মন্ত্রীসভা গঠিত হয় এবং নয় মাসের মতাে তা স্থায়ী থাকে।
নতুন শাসনতন্ত্রের অধীনে তিন বছরে চার-চারটি মন্ত্রীসভা গঠিত হয়, মােট ১১টি রাজনৈতিক দল এতে অংশগ্রহণ করে এবং রিপাবলিকান পার্টি সবকটিতেই অন্তর্ভূক্ত থাকে। এসব ভাঙা-গড়ায় নেপথ্যে থেকে কলকাঠি নেড়েছেন ইস্কান্দার মির্জা স্বয়ং। তিনি তিনটি জিনিস প্রমাণ করতে চাচ্ছিলেন-
এক, নতুন শাসনতন্ত্র কাজের উপযুক্ত নয়;
দুই, দেশ পরিচালনায় যােগ্য কোন রাজনৈতিক নেতা নেই; এবং
তিন দেশের উতয় অংশের আস্থাভাজন কোন একক রাজনৈতিক দল নেই।
তিন বছরে তিনি উপরিউক্ত তিনটি বিষয় প্রমাণ করে ছেড়েছেন। উক্ত সময়ে দেশের সবকটি বড় রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এসেছে, প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ নেতা ক্ষমতায় আরােহণ করেছেন, কিন্তু হয় ব্যর্থ হয়েছেন,নয়তাে ব্যর্থ করে দেয়া হয়েছে। তিনি গণতান্ত্রিক বিধি-বিধানকে ভয় পেতেন। তাই সাংবিধানিক শাসনের পরিবর্তে একনায়কতান্ত্রিক শাসন প্রবর্তনের পথ খুঁজছিলেন।
ইস্কান্দার মির্জা ব্যক্তিগতভাবে বাদশাহী ঠাট-বাটে বিশ্বাসী ছিলেন। রাজা-বাদশাহদের শাসন প্রণালী ও জীবন পদ্ধতি দেখে তিনি মুগ্ধ হয়ে যেতেন।
একবার তিনি সরকারী সফরে আফগানিস্তান গিয়েছিলেন, আমিও তার অন্যতম সঙ্গী ছিলাম। বাদশাহ জহির শাহ এর সরকারী দাওয়াতে গিয়ে দেখি টেবিলে দুই ধরনের ব্যবস্থা-ইংলিশ এবং আফগানী। আমি ভাবলাম, অতিথিদের পছন্দ অনুসারে হয় ইংলিশ, না হয় আফগানী খাবার পরিবেশন করা হবে। কিন্তু দেখা গেল ছয় রকমের ইংরেজী খাবার পরিবেশন করার পর আবার দশ রকমের আফগানী থানা পরিবেশন করা হল। অধিকাংশ মেহমান উভয় প্রকার খানার যথাসাধ্য সদ্ব্যবহার করল। খাওয়া-দাওয়ার পর বাদশাহ সকল মেহমানদের নিয়ে সংলগ্ন বাগানে প্রবেশ করলেন। সেখানে প্রায় পাঁচ-ছয়শ’ গণ্যমান্য নাগরিক পাকিস্তানী প্রেসিডেন্টকে সংবর্ধনা জানানাের জন্য দেড়-দু’ঘন্টা আগ থেকে উপস্থিত রয়েছেন। সেখানেও দেখলাম,
২৫
টেবিলে থরে-বিথরে নানা সুস্বাদু খাবার সাজানাে রয়েছে। বাদশাহী নিমন্ত্রণের এই দৃশ্য ইস্কান্দার মির্জাকে এতই মুগ্ধ করেছিল যে, দেশে ফেরার পর তিনি বহুবার আমার কাছে সেই স্মৃতি রােমন্থন করেছেন।
ইরানের রেজা শাহ পাহলবী ইস্কান্দার মির্জার প্রিয় ব্যক্তি ছিলেন। বেগম নাহিদ মির্জাকে সঙ্গে নিয়ে তিনি কয়েকবার ইরান সফর করেন। এসব সফরে নাহিদ মির্জা মনে মনে রাণী সুরাইয়ার সঙ্গে উত্তম পােশাক ও সৌন্দর্যের প্রতিযােগিতায় অবতীর্ণ হতেন। রেজা শাহের তখনাে কোন সন্তান ছিল না। প্রতিটি অনুষ্ঠানে তার চার পাশে প্রিয়দর্শিনী ললনারা ঘুরঘুর করতাে এবং রাণী সুরাইয়াকে এড়িয়ে তার মনােযােগ আকর্ষণ করার চেষ্টা করত। বাদশাহ ‘বু ফিল্মের’ ভারী ভক্ত ছিলেন এবং ইউরােপ-আমেরিকার নামী-দামী নাইট ক্লাবগুলােতে তার অবাধ যাতায়াত ছিল। এক সন্ধ্যায় তিনি দেড় ঘন্টা ধরে তার সেসব অভিজ্ঞতার কথা ইস্কান্দার মির্জার কাছে বর্ণনা করে শেষে মন্তব্য করেন, কোন সমাজের উন্নতি ও অগ্রগতি পরিমাপের সঠিক মাপকাঠি হচ্ছে, সে সমাজ কতখানি যৌন-স্বাধীনতা ভােগ করে। তার সরকারী ডিনারগুলি হত জমকাল এবং আড়ম্বরপূর্ণ। প্রতিটি ডিনারের সময় অর্ধডজন সামরিক, অফিসার মর্যাদাসূচক তমগা খচিত উর্দি পরে বাদশাহের সিংহাসনের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকত। এক দিনে ডিনারের পর বেগম মির্জা আমাকে বললেন, ‘শাহের পেছনে দন্ডায়মান লােকদের মধ্যে দু’জন জেনারেল র্যাঙ্কের সামরিক অফিসারও ছিলেন; অথচ অন্যদিকে করাচীতে ক্যাপ্টেন, মেজর র্যাঙ্কের এডিসিরাও আমাদের সঙ্গে খাবার টেবিলে বসে। আপনি এ বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করে দেখবেন।’
আরেকবার নাহিদ মির্জা সহ প্রেসিডেন্ট স্পেন সফরে যান। সেখানে যে জিনিসটি তাদের মুগ্ধ করে তা কর্ডোভার মসজিদ নয় বরং জেনারেল ফ্রাঙ্কোর একনায়কী শাসন ব্যবস্থা। জেনারেল ফ্রাঙ্কোর শাসন প্রণালীর কথা দীর্ঘদিন পর্যন্ত তাদের উভয়ের স্মৃতিতে জাগরূক ছিল। সি,এস,পি অফিসারদের ট্রেনিং-এর জন্য যেসব দেশে পাঠানাে হত, তার তালিকায় স্পেনকে অন্তর্ভূক্ত করার জন্যও প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রীকে পরামর্শ দিয়েছিলেন।
১৯৫৮ সালের জুন মাসের প্রথম দিককার কথা। আমি আমার অফিসে বসে কাজ করছিলাম। নিয়মমতাে একটার দিকে প্রেসিডেন্ট আমার জানালার পাশে এসে কোন জরুরী ফাইল বাকি আছে কিনা জিজ্ঞাসা করলেন। আমি না সূচক জবাব দেওয়ায় তিনি তার বাসভবনের দিকে চলে গেলেন। অল্পক্ষণ পরেই খুব দ্রুত পায়ে হেঁটে এসে আমার কামরায় প্রবেশ করলেন। একটি জরুরী কাজ ভুলে গিয়েছি’ বলেই প্রেসিডেন্টের প্যাড থেকে একটি কাগজ ছিড়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী ফিরােজ খান নুনকে একটি নােট লিখলেন আমাদের যৌথ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী স্থল বাহিনী প্রধান হিসাবে আইয়ুব খানের
২৬
চাকরির মেয়াদ দু’বছর বাড়িয়ে দেয়ার সরকারী আদেশ অবিলম্বে জারি করে দিন। কাগজটি আমার কাছে দিয়ে বললেন, আমি নিজে গিয়ে যেন কাগজটি তাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।’ এই ছােট্ট কাগজই পাকিস্তানের ইতিহাসের মােড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল।
১৯৫৮ সাল থেকেই ইস্কান্দার মির্জার প্রেসিডেন্ট পদের ওপর নির্বাচনের খড়গ ঝুলতে থাকল। নির্বাচন ১৯৫৭ সালের নভেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। ‘কিন্তু নানা টালবাহানা করে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত পিছিয়ে দেয়া হয়েছিল। তারপর আরাে অজুহাত খাড়া করে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত পিছিয়ে দেয়া হয়। নতুন শাসনতন্ত্র অনুযায়ী, নির্বাচন হলে ইস্কান্দার মির্জাকে প্রেসিডেন্ট পদ থকে সরে দাড়াতে হবে অথবা তাকে নির্বাচনে জিতে আসতে হবে। দুটোর কোনটাই তিনি চান না। কাজেই কোন নির্বাচনই যাতে অনুষ্ঠিত না হয়, সে রকম পরিস্থিতি সৃষ্টির ষড়যন্ত্রে উঠেপড়ে লেগে গেলেন। প্রথমেই ডাঃ খান সাহেবকে দিয়ে প্রস্তাব দেওয়ালেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রেসিডেন্টের নেতৃত্বে ‘বিপ্লবী কাউন্সিল গঠন করা প্রয়ােজন। এই মর্মে বিভিন্ন শহরে পােস্টার লাগানাে হল।
কালাতের ‘খানে আযম মীর আহমদ ইয়ার খান তার ‘বেলুচিস্তানের অভ্যন্তরে নামক বইতে লিখেছেন যে, ইস্কান্দার মির্জা তাঁর সঙ্গে ওয়াদা করেছিলেন, যে ৫০ লাখ টাকা নির্বাচনী খরচ দিলে তিনি কালাতকে এক ইউনিটের আওতার বাইরে রাখবেন। ভাওয়ালপুর ও খায়েরপুর থেকেও অনুরূপভাবে টাকা চেয়েছিলেন। তাঁর বিবরণ থেকে আরাে জানা যায় যে, তিনি পরিকল্পনা করেছিলেন, মার্শাল ল’ জারি করে ভুপালের নবাবকে প্রধানমন্ত্রী বানিয়ে, নিজে প্রেসিডেন্টের গদিতে বসে থেকে আরামে দেশ শাসন করবেন। ইস্কান্দার মির্জা যখন এসব প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন, তখন দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত নির্বাচনী হাওয়া গরম হতে হতে প্রায় তুঙ্গে উঠেছিল। গণতন্ত্রের ধারা এ রকমই-যতই নির্বাচনের তারিখ ঘনিয়ে আসতে থাকে, ততই রাজনৈতিক তৎপরতা বাড়তে থাকে। খান আবদুল কাইউম খানের নেতৃত্বে বড় বড় মিছিল-মিটিং করে মুসলিম লীগ সারা পশ্চিম পাকিস্তানকে কাপিয়ে তুলল। পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক অঙ্গনও উত্তপ্ত হয়ে উঠল। সেখানে একটি দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাও ঘটে গেল। প্রাদেশিক পরিষদের ডেপুটি স্পিকার পরিষদের অভ্যন্তরে মারামারিতে আঘাত পেয়ে মারা যান। এ ঘটনা খুবই লজ্জাজনক এবং নিন্দনীয়, কিন্তু গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ইতিহাসে অভিনব নয়। পৃথিবীর সভ্য জাতিগুলাের গণতান্ত্রিক সগ্রামের ইতিহাসে অনুরূপ ঘটনা সুলভ। কিন্তু গণতন্ত্রের নামে সন্ত্রস্ত ইস্কান্দার মির্জা উক্ত ঘটনাকে গণতান্ত্রিক বিধি-বিধানের কবর রচনার মােক্ষম হাতিয়ার হিসাবে গণ্য করলেন।
২৭
১৯৫৮ সালের ২২শে সেপ্টেম্বর। ইস্কান্দার মির্জা একটার সময় অফিস থেকে যাওয়ার পথে আমার জানালার পাশে না দাঁড়িয়ে, আমাকে বাইরে ডেকে নিয়ে গেলেন। তার হাতে শাসনতন্ত্রের একটি কপি। সেদিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন, ‘এই বাজে বইটি তুমি পড়েছ?’ আমার উত্তরের অপেক্ষা না করে তিনি সংবিধানকে গালি দিতে দিতে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠছিলেন। বক্তব্য অসমাপ্ত রেখেই সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে বাসভবনের ভেতরে প্রবেশ করলেন। আমি ফিরে আসছিলাম। পবিত্র শাসনতন্ত্র সম্পর্কে তাঁর ‘বাজে বই’ মন্তব্যটি আমার কানে তখনাে বেজে চলেছে। হঠাৎ মনে হল সিঁড়িগুলি কাপছে-নীচের সিড়ি যেন ওপরের দিকে উঠতে চাচ্ছে। আমি দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে পড়লাম। একজন নিরাপত্তা কর্মী দৌড়ে এসে আমাকে কর্নেল ডাক্তার সরােয়ারের কাছে নিয়ে গেল। তিনি নীচেই ছিলেন। আমাকে জিন্নাহ হাসপাতালে ভর্তি করে দেওয়া হল। দু’দিন পর সুস্থ হয়ে অফিসে টেলিফোন করে কাজ-কাম সম্পর্কে জানতে চাইলে, আমার এক কর্মচারী জানাল যে, এই দু’দিন প্রেসিডেন্ট অফিসে আসেননি, ফাইল জমে রয়েছে। তিনি আইয়ুব খানের সঙ্গে মিটিং-এর পর মিটিং করে চলেছেন। সেদিন ছিল ৭ই অক্টোবর, ১৯৫৮। রাত শেষে একজন কর্মচাবী আমাকে প্রেসিডেন্ট হাউস থেকে টেলিফোনে জানাল যে, এইমাত্র সারাদেশে মার্শাল ল’ জারি করা হয়েছে। শাসনতন্ত্র, কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক মন্ত্রীসভা সমূহ বাতিল করা হয়েছে এবং আইয়ুব খানকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিযুক্ত করা হয়েছে।
৮ই অক্টোবর তােরে প্রেসিডেন্ট হাউসে গিয়ে দেখি, ইস্কান্দার মির্জা আহত পাখির মতাে ছটফট করছেন। যে শাসনতন্ত্রের বলে তিনি প্রেসিডেন্ট পদে আসীন ছিলেন, সেই শাসনতন্ত্রকেই তিনি বাতিল করে দিয়েছেন। সামরিক বাহিনীর আইন বিশেষজ্ঞরা পরিষ্কার রায় দিয়ে দিয়েছেন যে, শাসনতন্ত্র বাতিলের সঙ্গে সঙ্গে প্রেসিডেন্টের পদও বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এখন দেশের একমাত্র শাসক সামরিক আইন প্রশাসক।
মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা নিজের অবস্থান ঠিক রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। কয়েকজন সিভিল অফিসারের যােগসাজশে করাচীর শ্রমিকদের দিয়ে একটি মিছিল বের করে প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে, তার প্রতি জন সমর্থন রয়েছে। সামরিক বাহিনীতে ভাঙ্গন ধরাবার লক্ষ্যে বিমান বাহিনীর এয়ার কমােডর মকবুল রবকে দিয়ে কয়েকজন জেনারেলকে গ্রেফতার করার চেষ্টাও তিনি করেছিলেন। কিন্তু তার পেছনে কোন সাংবিধানিক ভিত্তি না থাকায় তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। মার্শাল ল’তে শাসন ক্ষমতা সেই ব্যক্তির হাতে থাকে, যার হাতে থাকে সামরিক ক্ষমতা। সেই ক্ষমতা ছিল আইয়ুব খানের হাতে। ফলে ঠিক বিশ দিনের মাথায় একদল সৈন্য প্রেসিডেন্ট-প্রাসাদ ঘিরে ফেলে। অস্ত্রসস্ত্রে সজ্জিত হয়ে তিনজন জেনারেল এবং একজন ব্রিগেডিয়ার ইস্কান্দার
২৮
মির্জার কাছে যায়। প্রেসিডেন্টের চেয়ার থেকে নামিয়ে তাকে প্রথমে কোয়েটা, তারপরে সােজা লন্ডনে পাঠিয়ে দেয়।
গণতন্ত্র ধ্বংসের যে কাজ গােলাম মােহাম্মদ শুরু করেছিলেন, ইস্কান্দার মির্জা তাকে পরিপূর্ণতা দিলেন। ১৯৫৮ সালে শাসনতন্ত্র বাতিল করার কোন অনিবার্য কারণ বিদ্যমান ছিল না। এই শাসনতন্ত্রের অধীনে কোন নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হয়নি যে, এটাকে অনুপযুক্ত আখ্যা দেয়া যেতে পারে। কেবল নির্বাচন-ভীতির কারণে এবং ব্যক্তিগত স্বার্থ সংরক্ষণের আকাঙক্ষায় তিনি শাসন বাতিল করে সামরিক শাসনের রাস্তা পরিষ্কার করে দিয়েছিলেন। আইয়ুব খান গত চার বছর ধরে এই সন্ধিক্ষণটির জন্যেই অপেক্ষা করছিলেন। মার্শাল ল’ জারি করে তিনি সর্বপ্রথম ইস্কান্দার মির্জাকেই এক চোখ ও দুই কানসহ বের করে দিলেন এবং পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী দেশ শাসন করতে লাগলেন। পরিকল্পনাটি তিনি ১৯৫৪ সালের ১৪ই অক্টোবর রাতে লন্ডনের ডর্চেস্টার হােটেলে বসে প্রণয়ন করেছিলেন। পরবর্তী দশ বছর তিনি প্রায় হুবহু সেই পরিকল্পনা মেনে চলেন।
২৯

মহা শক্তিধর ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের পতনের জন্য কোনাে একটি মাত্র ঘটনা দায়ী নয়। বরং বলা সমীচীন অনেকগুলাে ঘটনার সম্মিলিত ফলশ্রুতি তার পতনের আসল কারণ। ১৯৬৯ সালে তার পতনের কয়েক বছর আগে থেকেই পতনের ঘুণপােকা আইয়ুব খানের ক্ষমতা-বৃক্ষকে ভেতরে ভেতরে কুরে কুরে খাচ্ছিল। কিন্তু ক্ষমতার মদমত্তে বিভাের থাকায় তিনি তা কখনই টের পাননি।
ক্ষমতাবান ব্যক্তির পতন সর্বপ্রথম তার নিজের মধ্যেই শুরু হয়। আইয়ুব খানের মধ্যে এর উদ্ভব কখন ঘটে, তা সঠিক বলা যাবে না। ১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে ভারতের মাদ্রাজ থেকে এক ভদ্রলােক পাকিস্তানে আসে। সে তার জীবনের শেষ দিনগুলাে মক্কা-মদিনায় কাটাবার আকাংক্ষায় সৌদী আরব যাচ্ছিল। মাদ্রাজ থেকে বেশ কয়েকটি চিঠি লিখে সে জানিয়েছিল যে, সৌদি আরবের পথে পাকিস্তানে কয়েকদিন অবস্থান কালে সে প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের সাথে সাক্ষাৎ করতে আগ্রহী। তার দাবী ছিল সে ভাগ্য গণনার একজন বিশারদ এবং আইয়ুব খানকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভবিষ্যৎবাণী শােনাতে ইচ্ছুক। তার বয়স একশ’ বছরের উপরে। বার্ধক্যপীড়িত শ্রবণশক্তি রহিত এই বৃদ্ধকে আইয়ুব খান আধা ঘন্টা ধৈর্যপূর্ণ সাক্ষাৎকার দেন। বৃদ্ধের কথাবার্তার আগা-মাথা খুব একটা ছিল না। তবে একটা কথা স্পষ্ট বােঝা গেল, আইয়ুব খান পাকিস্তানে আট অথবা নয় বছর রাজত্ব করবেন।
ভদ্র বৃদ্ধ লােক চলে যাওয়ার পর আইয়ুব খান আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, এই বুড়া কিসব বাজে কথা বলছিল যে, আমি নাকি আট-ন’বছর পাকিস্তান শাসন করব। সেকি জানে যে নতুন শাসনতন্ত্র অনুযায়ী আমার প্রেসিডেন্ট থাকার মেয়াদ আর মাত্র দু’বছর বাকি। এরপর নতুন করে পার্লামেন্ট নির্বাচন হবে, নতুন ভােটারও হবে। নতুন ভােটাররা হয়ত নতুন প্রেসিডেন্টও নির্বাচন করতে চাইবে।
আমার ধারণা, শুভবুদ্ধি ও সরল বিশ্বাস থেকেই আইয়ুব খান এ উক্তি করেছেন। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই, দেখতে দেখতে ব্যক্তিস্বার্থ ও রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ শুভবুদ্ধির স্থান দখল করে নেয়। ১৯৬৪ সালের মে মাসে নিজের ক্ষমতা পাকাপােক্ত করার লক্ষ্যে শাসনতন্ত্রের ২য় সংশােধনী পেশ করলেন। শাসনতন্ত্রের ধারা অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পূর্বেই জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদসমূহের নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে। কিন্তু ২য় সংশােধনীতে তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কে আগে নিয়ে এলেন। জাতীয় পরিষদে তুমুল প্রতিবাদ হল। সংশােধনী পাসের জন্য প্রয়ােজনীয় সংখ্যক সদস্যের সমর্থন লাভ দুষ্কর হয়ে পড়ল। ভয়ভীতি, ধােকাবাজি আর প্রলােভনের আশ্রয় নিয়ে আইয়ুব খান বিরােধী
৩০
দলের আট জন সদস্যকে দল ত্যাগে বাধ্য করে নিজের দলে ভিড়িয়ে নিলেন। ‘রাজনৈতিক দল আচরণ বিধি’ তে একটি ধারা ছিল-জাতীয় বা প্রাদেশিক পরিষদের কোন নির্বাচিত সদস্য দল ত্যাগ করলে তার সদস্যপদ বাতিল হয়ে যাবে এবং ঐ সীটে তাকে পুনরায় নির্বাচনে লড়তে হবে। আটজন দলত্যাগী সদস্যের বেলায় এ ধরনের কোন কার্যক্রম গ্রহণ করা হল না। শাসনতন্ত্রের ২য় সংশােধনীর ফলে এটা দিবালােকের মতাে সুস্পষ্ট হয়ে উঠল যে, আইয়ুব খান আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যে কোনাে মূল্যে জয়লাভ করতে বদ্ধপরিকর।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারাভিযান জোরেশােরে শুরু হয়ে গেল। দেশের খ্যাতনামা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ঐক্যবদ্ধভাবে আইয়ুব খানের বিরােধিতার সিদ্ধান্ত নিলেন। খাজা নাজিমউদ্দিন, মিয়া মমতাজ মােঃ দৌলতানা, শেখ মুজিবুর রহমান, মওলানা ভাসানী, খান আবদুল ওয়ালি খান, চৌধুরী মােহাম্মদ আলী ও মাওলানা মওদুদী প্রমুখের নেতৃত্বাধীন কাউন্সিল মুসলিম লীগ, আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, নেমে ইসলাম ও জামায়াতে ইসলামী জোটবদ্ধ হয়ে ‘কম্বাইন্ড অপােজিশন পার্টি (COP) গঠন করল। এঁদের একমাত্র উদ্দেশ্য আইয়ুব খানকে পরাজিত করা।
এই উদ্দেশ্যকে সফল করার জন্য প্রথম কাজ ছিল সম্মিলিত বিরােধী দলের পক্ষে, আইয়ুব খানের সমকক্ষ একজন প্রার্থী মনােনীত করা। দুটি নাম বিবেচনায় এল। একটি কায়েদে আযমের বােন মিস ফাতেমা জিন্নাহ এবং দ্বিতীয়টি, পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক গভর্ণর জেনারেল আযম খান। আযম খান পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে সমান জনপ্রিয় ছিলেন। যদি সম্মিলিত বিরােধী দল আযম খানকে তাদের পক্ষে প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী মনােনীত করত, তবে আইয়ুব খানের নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া কঠিন হত। পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো এ ব্যাপারে দারুণ এক চাল চাললেন।
ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির একজন প্রভাবশালী নেতা জনাব মশিউর রহমান (যাদু মিয়া)-এর সাথে ভুট্টোর ছিল গভীর সম্পর্ক। মওলানা ভাসানীর ‘ডান হাত’ বলে কথিত মশিউর রহমান ছিলেন তাঁর পানাহারের সঙ্গী। জাতীয় পর্যায়ে তেমন খ্যাতির অধিকারী না হলেও রাজনীতির বাজারে বেচা-কেনা কিংবা দর কষাকষির কৌশল তিনি জানতেন। শােনা যায়, ভুট্টো তাকে পাঁচ লাখ টাকার বিনিময়ে কিনে ফেলেন। মশিউর রহমানের চাপে মওলানা ভাসানী সম্মিলিত বিরােধী দলের ওপর এই শর্ত আরােপ করলেন যে, এমন কোন ব্যক্তিকে বিরােধী দলের পক্ষে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী মনােনীত করা যাবে না, যিনি কোন না কোন ভাবে সামরিক সরকারের সাথে সম্পর্কযুক্ত ছিলেন। আযম খান এক সময়ে সামরিক সরকারের অন্যতম স্তম্ভ ছিলেন। কাজেই মওলানা ভাসানীর শর্তের কারণে তার নাম আপনা-আপনি খারিজ হয়ে গেল।
৩১
মশিউর রহমান ভুট্টোর জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করলেন। সম্মিলিত বিরােধী দল আইন বিশারদদের পরামর্শক্রমে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের প্রেসিডেন্ট পদের প্রার্থীতার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করার গােপন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল। কেননা, বেতনভুক্ত ফিল্ড মার্শাল হিসাবে তিনি আইনতঃ কোনাে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারেন না। মশিউর রহমান আগে-ভাগে ভুট্টোর কাছে এই তথ্য ফাস করে দিলেন। আইয়ুব খান বিরােধী দলের মামলা করার আগেই ফিল্ড মার্শাল নিযুক্তির আইনগত দিক পেছনের তারিখ থেকে কার্যকারিতা দিয়ে সংশােধন করিয়ে নিলেন।
আইয়ুব খান তার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পথের সকল বাধা দূর করার জন্য ন্যায়-অন্যায় যে কোন পন্থা অবলম্বন করলেন এবং পতনের দিকে ধাপে ধাপে এগিয়ে যেতে থাকলেন। ব্যক্তি স্বার্থে ধর্মকে ব্যবহার করতেও তিনি দ্বিধা করেননি। প্রথমে একজন বিখ্যাত পীর ঘােষণা করলেন, তিনি আধ্যাত্মিক শক্তি বলে জানতে পেরেছেন যে, আল্লাহতায়ালা সম্মিলিত বিরােধী দলের ওপর সন্তুষ্ট নন। এরপর কয়েকজন আলেম ফতােয়া দিলেন, ইসলাম নারীর রাষ্ট্রপ্রধান হওয়া সমর্থন করে না।
নির্বাচনী প্রচারে আইয়ুব খান কনভেনশন মুসলিম লীগের তহবিল উন্মুক্ত করে দিলেন। শিল্পপতি-ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নির্বাচনী তহবিলে বাধ্যতামূলকভাবে চাদা আদায় করা হল। ভােটারদের প্রভাবিত করার জন্য সারাদেশে টাকার বন্যা বইয়ে দেওয়া হল। পাকিস্তানের ইতিহাসে নির্বাচন উপলক্ষে এ রকম টাকার খেলা কখনাে দেখা যায়নি। নােংরা রাজনীতিকে পরিচ্ছন্ন করার শ্লোগান নিয়ে, সামরিক উর্দি পরে তিনি ক্ষমতায় আরােহণ করেছিলেন। আর এখন নিজেই রাজনৈতিক দল গঠন করে রাজনীতি ও নির্বাচনের নােংরা খেলায় মেতে উঠেছেন।
সারাদেশে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হল। ১৯৬৫ সালের ৩রা জানুয়ারী ফলাফল ঘঘাষিত হলে দেখা গেল আইয়ুব খান পেয়েছেন ৪৯,৬৪৭ ভােট ও মিস্ জিন্নাহ পেয়েছেন ২৮.৩৪৫ ভােট। নির্বাচনী লড়াইয়ে বিজয়ী হওয়া সত্ত্বেও আইয়ুব খানের এখন আর সে ভাবমূর্তি বিদ্যমান নেই, যা নিয়ে তিনি ক্ষমতায় এসেছিলেন।
ঢাকা ও করাচীর বেশীরভাগ ভােটার আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে ভােট দেয়। আইয়ুব-পুত্র গওহর আইয়ুব করাচীর ভােটারদের শায়েস্তা করার এক ভয়ংকর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। হাজারা জেলা থেকে দলে দলে পাঠানদের করাচীতে আনা হল। বিরাট এক বিজয় মিছিল বের করা হল। রিক্সায়, বাসে, জীপে চড়ে পাঠানরা মিছিলে শরীক হল। লিয়াকতাবাদসহ কয়েক স্থানে মিছিলের লােকদের সাথে করাচীর মােহাজেরদের ছােটখাট সংঘর্ষ বাধে। এর প্রতিশােধ নিতে পাঠানরা রাতের অন্ধকারে লিয়াকতাবাদে সন্ত্রাসের তান্ডব লীলায় মেতে ওঠে। মােহাজেরদের বস্তিতে আগুন লাগিয়ে দেয়।
৩২
পরবর্তী কয়েকদিন সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে করাচীর জীবনযাত্রা সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। গান্ধারা ইন্ডাস্ট্রিজ কেলেংকারির পর লিয়াকতাবাদ হত্যাকান্ডের এ ঘটনা আইয়ুব খানের নতুন পর্যায়ের শাসনামলকে মসিলিপ্ত করে তুললেও, গওহর আইয়ুব ক্রমান্বয়ে করাচীর রাজনীতিতে গভীরভাবে জড়িয়ে পড়ে। সবকিছু দেখেশুনে এ রকম ধারণার জন্ম হয় যে, আইয়ুব খান স্বনামধন্য পুত্রকে তার স্থলাভিষিক্ত করার জন্য তৈরী করেছেন এবং এই ধারণা আরাে বদ্ধমূল হয়, যখন এর কিছুদিন পরেই গওহর আইয়বকে করাচী মুসলিম লীগ সমন্বয় কমিটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত করা হয়। কিন্তু আইয়ুব খান তখনাে জানতেন না, করাচীর জনগণ তার পুত্রকে তখন শুধু ঘৃণার চোখে দেখছে। রমযান মাসের প্রথম জুমায় করাচীর মেমন মসজিদে গওহর আইয়ুব বক্তৃতা দেয়ার চেষ্টা করলে সমবেত মুসুল্লীরা তাৎক্ষণিকভাবে তাকে বাধা দেয়। হৈচৈ মারামারির মধ্যে পুলিশের সহায়তায় মসজিদ থেকে কোন রকমে সে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।
এর আগে করাচীতে আরেকটি কলংকজনক ঘটনা সংঘটিত হয়। মিস ফাতেমা জিন্নাহর মৃত্যুর পর তার জানাজায় করাচীতে লক্ষ লােকের সমাবেশ ঘটে। মিছিলের একাংশ যখন সরকার বিরােধী রূপ ধারণ করে এবং ‘আইয়ুব খান মুর্দাবাদ’ শ্লোগান দেয়, তখন পুলিশ মিছিলে বাধা দান করে। লাঠিচার্জ, কঁাদনে গ্যাস ছাড়াও পুলিশ গুলী বর্ষণ করে। হতাহতের সংখ্যা কখনই জানানাে হয়নি। কিন্তু একথা সত্য যে, প্রবাহিত রক্তের ধারায় আইয়ুব খানের পতনের ছবিও মূর্ত হয়ে ওঠে।
১৯৬৭ সালের ডিসেম্বর মাসে আইয়ুব খান পূর্ব পাকিস্তান সফর করেন। সফর উপলক্ষে আমিও ঢাকা গিয়েছিলাম। শুনতে পেলাম, আইয়ুব খানকে হত্যা করার একটি ষড়যন্ত্র ধরা পড়ায় তার নিরাপত্তা ব্যবস্থা কয়েকগুণ জোরদার করা হয়েছে। আইয়ুব খানের ইচ্ছানুযায়ী আমি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের বিশিষ্ট অধ্যাপকবৃন্দের সঙ্গে তার একটি সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করি। জাতীয় নিরাপত্তা ও সংহতি বিষয়ে তিনি তাদের সাথে মতবিনিময় করতে আগ্রহী। দিন ক্ষণ মােতাবেক অধ্যাপকবৃন্দ প্রেসিডেন্ট হাউসের প্রশস্ত হল ঘরে এসে সমবেত হয়েছেন। আমি প্রেসিডেন্টকে আনার জন্য তার ড্রয়িং রুমে ঢুকেই তাজ্জব বনে গেলাম। একটি সােফায় বসে আইয়ুব খান গভর্ণর মােননম খানের সঙ্গে নিরিবিলি আলাপ করছেন। একদিকে কয়েকজন প্রভাবশালী মন্ত্রী পরস্পর কানাঘুষায় নিরত। অন্যদিকে, সিভিল ও মিলিটারী ইন্টেলিজেন্সের দু’তিন জন বড় কর্মকর্তা ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখেই প্রেসিডেন্ট বললেন, এই সভাটা কি মুলতবি করা যায় না? আমি বললাম, বেশ কয়েকজন অধ্যাপক দূর-দূরান্ত থেকে এসেছেন। আজ সন্ধ্যায় এবং আগামীকাল
৩৩
সকালে চলে যাবেন বলে তারা অগ্রিম টিকিট কিনেছেন। সভাটি না হলে তারা দারুণভাবে নিরাশ হবেন।’ তিনি বললেন, “যদি তাই হয়, তবে আমি কয়েক মিনিটের জন্য আসছি; বেশী কথা বলার সময় নেই। বাকি তর্ক-বিতর্ক নিজেরা চালিয়ে যাবে।’
সভায় উপস্থিত হয়ে আইয়ুব খান অতি সংক্ষেপে দু’একটি কথা বলে মােনেম খানের সঙ্গে গাড়িতে গভর্ণর হাউসে চলে গেলেন। সেই রাতে গভর্ণর হাউসে প্রেসিডেন্টের সম্মানে একটি ভােজসভা অনুষ্ঠিত হয়। অভ্যাগতদের সকলের চেহারাই বিষন্নতায় পরিকীর্ণ। স্বাভাবিক নিয়ম ভঙ্গ করে আইয়ুব খান প্রায় দু’ঘন্টা দেরিতে ভােজসভায় উপস্থিত হলেন। পরে জানতে পেরেছি, সেই দিনই সকালে তাকে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অবহিত করা হয় এবং সারাদিন, ভােজসভায় আসার আগ পর্যন্ত, ষড়যন্ত্রের অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণে তিনি ব্যস্ত ছিলেন।
১৯৬৮ সালের জানুয়ারীতে “আগরতলা ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সরকারী ঘােষণা জারি করা হয় এবং শেখ মুজিবুর রহমানসহ মােট ২৯ জনকে এই ষড়যন্ত্রের দায়ে অভিযুক্ত করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে এই অভিযােগ আনা হয় যে, ঢাকায় ভারতীয় কূটনৈতিক মিশনের ফার্স্ট সেক্রেটারী পি, এন, ওঝার নেতৃত্বে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। এই উদ্দেশ্যে তারা ভারতের আগরতলায় একটি কেন্দ্র স্থাপন করে বিচ্ছিন্নতা আন্দোলনকে রাজনৈতিক, সামরিক ও নাশকতামূলক সহায়তা দান করছে। অবশ্য শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা আন্দোলনের জন্য ১৯৬৬ সালের মে মাস থেকেই কারাবন্দী ছিলেন।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার শুনানির জন্য পাকিস্তানের সাবেক চীফ জাষ্টিস মিঃ এস, এ, রহমানকে প্রধান করে একটি স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। মামলার শুনানি খােলা আদালতে অনুষ্ঠিত হওয়ায়, পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তিত নাম, নতুন পতাকা, নতুন জাতীয় সঙ্গীত ইত্যাদি যাবতীয় বিষয় বিস্তারিতভাবে জনসমক্ষে প্রচারিত হয় এবং পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিচ্ছন্নতাবাদীদের হক না হক অভিযােগগুলিও সংবাদপত্রের পাতায় প্রকাশিত হওয়ার বিরল সুযােগ লাভ করে। ফলে একদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের ঘৃণা বাড়তে থাকে এবং অন্যদিকে আন্দোলনকারীদের বিশেষতঃ শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের প্রতি পূর্ব পাকিস্তানী আপামর জনগণের আস্থা তুঙ্গে ওঠে। ষড়যন্ত্র মামলাটি বাস্তব সাক্ষী-সাবুদ ও তথ্যভিত্তিক ছিল, কিন্তু পত্র-পত্রিকার প্রচারণা এর বাস্তবতাকে কেবল ধূলিস্যাৎ করে দেয়নি, এর বিরুদ্ধে জনগণকে বিক্ষুব্ধ করে তােলে। বিক্ষুব্ধ জনতার উত্তাল তরঙ্গে টালমাটাল ঢাকার রাস্তা খুব অল্প সময়ের মধ্যে রূপান্তরিত হয় গণঅভুথানে। বিক্ষুব্ধ জনতার একাংশ এক পর্যায়ে ট্রাইব্যুনাল-প্রধান এস, এ, রহমানের আবাসস্থল, রাস্ট্রীয় অতিথি ভবন ও হােটেল
৩৪
আরজুতে হামলা করে বসে। এস, এ, রহমান একজন বিশ্বস্থ বাঙালি কর্মচারীর পক্ষে আত্মগােপন করে কোন রকমে প্রাণে বেঁচে যান এবং পরে ফাইলপত্র ছেড়ে-ছুঁড়ে বিমানে লাহাের পালিয়ে যান।
২৯শে জানুয়ারী জর্দানের বাদশাহ হােসেন পাকিস্তান সফরে আসেন। রাওয়ালপিন্ডির হােটেল ইন্টারকনে তার সম্মানে ভােজসভার আয়ােজন করা হয়। আইয়ুব খান হােটেলে পৌঁছে হল ঘরের পরিবর্তে সরাসরি বার-এ প্রবেশ করেন এবং গ্লাস ভর্তি হুইস্কি (পানি না মিলিয়েই) এক দমে গটগট পান করে ফেলেন। এরপর এ রকম আরাে কয়েক গ্লাস পান করে তিনি ভােজসভায় উপস্থিত হন। খাওয়ার পর পূর্বে তৈরী করা ভাষণ পাঠ করবার সময় তার কণ্ঠস্বর জড়িয়ে যেতে লাগল এবং এমনকি পড়তে পড়তে তিনি দু’পাতা করে উল্টে যেতে লাগলেন। কোন রকম ভুল সংশােধন ছাড়াই তিনি পড়া শেষ করলেন এবং সরাসরি প্রেসিডেন্ট হাউসে চলে গেলেন।
সেই রাতেই তার প্রচন্ড হার্ট এ্যাটাক হল। আইয়ুব খানের অসুস্থতার খবর পাওয়া মাত্র সেনাপ্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খান এবং দেশ রক্ষাকারী মন্ত্রী এডমিরাল এ, আর, খান প্রেসিডেন্ট হাউসের নিয়ন্ত্রণভার নিজেদের হাতে তুলে নেন। প্রধান ফটক বন্ধ করে দেওয়া হল এবং গার্ডদের নির্দেশ দেয়া হল, কয়েকজন বিশেষ সামরিক কর্মকর্তা ব্যতিরেকে অন্য কাউকে যেন প্রবেশ করতে দেয়া না হয়। পরের দিন সকাল ৮টায় সিনিয়র মন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিনের সঙ্গে প্রেসিডেন্টের সাক্ষাৎকার পূর্বেই নির্ধারিত ছিল। গাড়িতে পতাকা উড়িয়ে ঠিক পৌনে আট টায় তিনি প্রেসিডেন্ট হাউসের সদর দরজায় পৌঁছলে তাকে সেখানেই বাধা দেয়া হয়। প্রেসিডেন্ট হাউসের একজন ড্রাইভার মাহফুজ আলী সকালে আমার কাছে এসে জানান, সারারাত প্রেসিডেন্ট হাউসের ভেতরে এক ধরনের কেয়ামত-সদৃশ অবস্থা বিরাজ করেছে। বেগম আইয়ুব ও সকল ছেলে-মেয়ে নিদারুণ আশংকায় নিদ্রাহীন রাত কাটিয়েছে। দফায় দফায় ডাক্তারদের আসা-যাওয়া, যন্ত্রপাতি আনা-নেয়া এবং কিছুক্ষণ পরপর ইয়াহিয়া খান ও এ, আর, খানের বাইরে এসে কানাঘুষা করা ইত্যকার ঘটনার মধ্যে আমরা কিছুই বুঝতে পারছিলাম না যে, আইয়ুব খান জীবিত আছে না মৃত, নাকি তাকে মেরে ফেলা হয়েছে। একথা শুনে আমি তৎক্ষণাৎ তথ্য সচিব আলতাফ গওহরের কাছে গেলাম। দেখলাম তিনিও অন্য সকলের মতাে পুরােপুরি অন্ধকারে রয়েছেন।
ক্রমে এটা পরিষ্কার হয়ে উঠল যে, আইয়ুব খান কঠিন পীড়ায় আক্রান্ত হয়েছেন, তবে কোন ধরনের রােগ, তা নিয়ে জনমনে নানা জল্পনা-কল্পনা চলতে লাগল। এর মধ্যে একটি মেডিক্যাল বুলেটিন প্রকাশ করা হল, কিন্তু জনগণ তা বিশ্বাস করল না। গুজবের বাজার গরম হয়ে উঠল। প্রত্যেকেই নিজের নিজের পছন্দ মতাে গুজব তৈরী
৩৫
করে ছড়িয়ে দিতে লাগল। ইয়াহিয়া খান আইয়ুব খানের সঙ্গে বাইরের জগতের যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিলেন। টেলিফোন ও বেতার যােগাযােগ বন্ধ ছিল এবং বাইরের কোন সিভিলিয়ানকে প্রেসিডেন্ট হাউসের দেয়াল পর্যন্ত স্পর্শ করতে দেয়া হয়নি। অসুস্থতার সাত/আট দিন পর্যন্ত ইয়াহিয়া খান আইয়ুব খানের কাছাকাছি এমনভাবে ঘেঁসে রইলেন যে, তার শরীর ঠান্ডা হয়ে আসামাত্র যেন শেয়ালের মতাে লাশের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারেন।
আস্তে আস্তে আইয়ুব খান আকস্মিক মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে উঠলেন, কিন্তু এরপরও ছয় সপ্তাহ শয্যাশায়ী ছিলেন এবং প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালনে অক্ষম ছিলেন। এ দীর্ঘ সময়ে আইয়ুব খানের নামে ইয়াহিয়া খানই দেশ পরিচালনা করেছেন। জাতীয় পরিষদের স্পিকার আবদুল জব্বার খানকে কেউ জিজ্ঞাসা পর্যন্ত করেনি, সাহেব আপনার মুখে কয়টি দাঁত আছে? অথচ শাসনতন্ত্রের ধারা অনুযায়ী তাঁরই দায়িত্ব পালনের কথা। সম্ভবতঃ ইয়াহিয়া খানের ভয়ে আইয়ুব খান এ ব্যাপারে মুখ খােলেননি। | তখন সমগ্র দেশব্যাপী উন্নয়ন দশকের’ উৎসব উদযাপিত হচ্ছিল। একদিকে সমস্ত অফিস, আদালত, কল-কারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য, স্কুল-কলেজ সর্বত্র সরকারী উদ্যোগে উন্নয়নের ঢােল বাজানাে হচ্ছিল, অন্যদিকে চাল, ডাল, আটা চিনিসহ নিত্যপ্রয়ােজনীয় দ্রব্যাদির মূল্য হু হু করে বেড়ে যাচ্ছিল। এর প্রতিবাদে করাচীতে একদিনের পূর্ণ হরতাল পালিত হয় এবং কেন্দ্রীয় বাণিজ্যমন্ত্রী নবাব আবদুল গফুর খান হােতিকে ‘চিনি চোর’ আখ্যা দিয়ে তার পদত্যাগ দাবী করা হয়। ঢাকায় প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাদদেশে নরকংকাল টানিয়ে ‘উন্নয়ন দশক’কে ব্যঙ্গ ও প্রত্যাখ্যান করা হয়।
পদত্যাগকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো আগে থেকেই সুযােগের অপেক্ষা করছিলেন। তিনি দেখলেন, লােহা গরম হয়েছে, অমনি হাতুড়ি দিয়ে আঘাত দিতে শুরু করলেন। মেজর জেনারেল পীরজাদাসহ সেনা সদরের কিছু অফিসার ভুট্টোকে আশ্বাস দিলেন যে, তিনি যদি আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন, তাহলে তারা তার পেছনে থাকবেন। সুতরাং ১৯৬৮ সালের ২৮শে ডিসেম্বর ভুট্টো হায়দ্রাবাদের এক জনসভায় ঘােষণা করলেন, আইয়ুব খানকে ক্ষমতাচ্যুত না করে তিনি ঘরে ফিরবেন না। ভুট্টো পশ্চিম পাকিস্তানের একচ্ছত্র নেতা হয়ে উঠলেন। প্রতিবাদে-প্রতিরােধে, ধর্মঘটে-হরতালে বিরােধী আন্দোলন তুঙ্গে উঠল। রাওয়ালপিন্ডির পলিটেকনিক কলেজের কাছে ছাত্রদের উপর পুলিশের গুলি বর্ষণে আবদুল হামিদ নামক এক ছাত্র ঘটনাস্থলে নিহত হয়। বিদ্যুৎগতিতে ভুট্টো সেখানে উপস্থিত হয়ে তার লাশ নিয়ে বিশাল মিছিলের আয়ােজন করেন। রাওয়ালপিন্ডি থেকে আবদুল হামিদের গ্রামের বাড়ী পর্যন্ত (৬০/৭০)
৩৬
মাইলের যেখান দিয়েই মিছিল অতিক্রম করছিল, সেখান থেকেই আইয়ুবের নাম-নিশানা মুছে ফেলা হয়। পরের দিন রাওয়ালপিন্ডির আরেকটি শােক মিছিলে গুলি বর্ষণের ফলে আরাে দু’ব্যক্তি নিহত হয়। গণপ্রতিবাদের মুখে শান্তি রক্ষায়, পুলিশের সাথে সেনাবাহিনী অংশগ্রহণ করে। কিন্তু ইয়াহিয়া খান ও পীরজাদার নির্দেশে সেনাবাহিনী আন্দোলনকারীদের উপর শক্তি প্রয়ােগে বিরত থাকে। সরকার ভুট্টো ও ধান আবদুল ওয়ালি খানকে গ্রেফতার করল। কিন্তু তাতে আন্দোলন -ঘেরাও -পােড়াও -জ্বালাও বেড়ে গেল। পুলিশের সাথে জনতার সংঘর্ষ চলতেই থাকল। এক পর্যায়ে পুলিশ মসজিদে আশ্রয় গ্রহণকারী জনতাকে বেদম প্রহার করে মসজিদকে রক্তাক্ত ও সেখানে রক্ষিত কোরআনের অবমাননা করল। এরই মধ্যে খারিয়ান পুলিশ স্টেশনের ‘খানম কাহিনী’ প্রকাশিত হয়ে পড়ে। খানম ষােল বছরের এক যুবতী। একটি হত্যাকান্ডের জিজ্ঞাসাবাদের ছুতায় মা-বাপ, ভাই-বােনদের সঙ্গে তাকে পুলিশ স্টেশনে আনা হয়। রাত্রে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য অন্য কামরায় নিয়ে গিয়ে সারারাত ধর্ষণ করে ফেলে রাখা হয়। ভােরে তাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেলে পুলিশ জানায়, সে আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু মেডিক্যাল রিপাের্টে ধরা পড়ে যে, তাকে ধর্ষণ করা হয়েছে এবং গলা টিপে হত্যা করা হয়েছে। এই খবর আইয়ুব শাহীর ভিতকে নড়বড়ে করে তােলে।
পূর্ব পাকিস্তানেও আইয়ুব-বিরােধী আন্দোলন চরম রূপ ধারণ করল। সর্বত্র মিটিং-মিছিল, প্রতিবাদ-প্রতিরােধ সমানে চলছে। প্রথমে সেখানে এই খবর ছড়িয়ে পড়ে যে, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার একজন আসামী সার্জেন্ট জহুরুল হককে বন্দী অবস্থায় সৈন্যরা গুলি করে হত্যা করেছে। সে জেল থেকে পালাবার চেষ্টা করছিল বলে প্রচার করা হলেও কেউ তা বিশ্বাস করেনি। খবর ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে ঢাকা প্রতিবাদের শহরে রূপান্তরিত হয়ে যায়। বিক্ষুব্ধ জনতা দু’জন মন্ত্রীর বাড়ীতে আগুন ধরিয়ে দেয়। ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান বিচারপতির ভবনে (রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে) হামলা করে বসে। খুলনায় কেন্দ্রীয় মন্ত্রী খান আবদুস সবুর খানের বাড়ীতে আগুন লাগিয়ে দেয় এবং এরপর রাজনীতিতে সেই ঘটনাটি ঘটে যা আইয়ুব শাহীর শেষ তক্তাটিও ওলট-পালট করে দেয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা প্রতিবাদ মিছিল বের করে প্রধান ফটক পর্যন্ত পৌঁছলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর জনপ্রিয় অধ্যাপক ডঃ শামসুদ্দোহা সেখানে তাদের বাধা দেন। তিনি ছাত্রদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বিরত রাখার চেষ্টা করছিলেন। হঠাৎ একজন সিপাই বেয়নেটের আগায় তাকে আটকে ফেলল এবং মারতে মারতে তাকে সেখানেই হত্যা করল। ডঃ শামসুদ্দোহার নৃশংস হত্যাকান্ড পূর্ব পাকিস্তানে জ্বলন্ত আগুনে ঘৃতাহুতির মত কাজ করলাে। ছাত্র-জনতা, পুলিশ ও
৩৭
সৈন্যদের ১৪৪ ধারা আর কারফিউ ভভুল করে দিল। শহর, বন্দর, গ্রাম, সর্বত্র আইয়ুবপন্থীদের উপর হামলা শুরু হল। জনতা ‘মৌলিক গণতন্ত্রের সদস্যদের মেরে মেরে তাদের অফিস পুড়িয়ে দিতে লাগল। অনেকে ইস্তেফা দিয়ে জান বাঁচাতে চেষ্টা করল।
সেনা সদর থেকে ইয়াহিয়া খান ও পীরজাদা আইয়ুব খানকে বললেন, ‘অতিসত্বর রাজনৈতিক নেতাদের ডেকে তাদের দাবী-দাওয়া শুনুন এবং তাদের সাথে সমঝােতায় আসুন। অন্যথায় পরিস্থিতি আয়ত্বের বাইরে চলে যাবে।’
একটি জরুরী ফাইল নিয়ে আইয়ুব খানের কাছে গেলে তিনি আমাকে বললেন, তােমার তাে মনে আছে, এই সেনা অফিসাররা ১৯৬২ সালে আমাকে শাসনতন্ত্র না দেওয়ার জন্য খুবই চাপ দিয়েছিল। রাজনীতিবিদদের ধারে না গিয়ে মার্শাল ল’ চালু রেখে আরামসে রাজত্ব করতে বলেছিল। আজ সাত বছর পর এরাই বলছে, রাজনীতিবিদদের সামলাতে।’
-আপনি কী ভাবছেন?
-তাববার জন্য আর বাকী কী আছে? এখন তাে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময়।
আইয়ুব খান রাওয়ালপিন্ডিতে রাজনৈতিক নেতাদের গােলটেবিল বৈঠক ডাকলেন। ডেমক্র্যাটিক একশন কমিটি (ডাক)-এর আহবায়ক নবাবজাদা নসরুল্লাহ খানকে অন্যান্য নেতৃবৃন্দসহ ১৭ই ফেব্রুয়ারী বৈঠকে উপস্থিত থাকার আমন্ত্রণ জানালেন। নবাবজাদা শর্ত আরােপ করলেন, বৈঠকে বসার আগে ‘ইমার্জেন্সি মিটিং-মিছিলের উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে হবে এবং বন্দী রাজনৈতিক নেতা-কর্মী এবং ছাত্রদের মুক্তি দিতে হবে। আইয়ুব খান শর্ত মেনে নিলেন। পূর্ব পাকিস্তানকে খুশী করার জন্য তিন বছর যাবৎ বন্ধ দৈনিক ইত্তেফাকের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিলেন। সেই সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানকেও প্যারলে গােলটেবিল বৈঠকে যােগদান করার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন।
শেখ মুজিব আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন। তাকে নিয়ে রাওয়ালপিন্ডি যাওয়ার জন্য একটি বিশেষ বিমান এয়ারপাের্টে প্রস্তুত রাখা হল, কিন্তু ইয়াহিয়া খান ও পীরাজাদা বৈঠক ভণ্ডুল করার লক্ষ্যে ঢাকার সেনা অফিসারদের মাধ্যমে কি কলকাঠি নাড়লেন যে, শেখ মুজিবুর রহমান প্যারলে রাওয়ালপিন্ডি যেতে অস্বীকার করে বসলেন। তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন যে, বন্দী অবস্থায় তিনি কোন আলােচনায় বসতে রাজী নন। আইয়ুব খান সঙ্গে সঙ্গে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের ঘােষণা দেন ও শেখ মুজিবসহ অন্যান্য অভিযুক্তরা মুক্তি লাভ করে। নতুন পরিস্থিতিতে গােলটেবিল বৈঠকের তারিখ ২৬শে ফেব্রুয়ারী, ১৯৬৯ ধার্য করা হয়। বৈঠকে ‘ডাক’ নেতারা ছাড়াও শেখ মুজিবুর রহমান ও
৩৮
এয়ার ভাইস মার্শাল (অবঃ) আসগর খান যােগদান করেন। মওলানা ভাসানী ও জুলফিকার আলী ভুট্টো যােগদান করবেন না বলে আগেই ঘােষণা দিয়েছিলেন। প্রাথমিক আলােচনার পর বৈঠক ১০ই মার্চ পর্যন্ত মুলতবি করা হয়। উপস্থিত নেতৃবৃন্দ আইয়ুব খানের সঙ্গে একটা সমঝােতামূলক সিদ্ধান্তে পৌঁছতে যথেষ্ট আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু সমঝােতামূলক আলােচনা বা সিদ্ধান্তের আসল চাবি ছিল শেখ মুজিবের হাতে। তাকে রাজী করাবার জন্য বৃদ্ধ ফিল্ড মার্শাল আপ্রাণ চেষ্টা করেন। মােনেম খানের পরিবর্তে শেখ মুজিবের অনুমােদিত ডঃ এম, এন, হুদাকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর এবং শেখ মুজিবের বন্ধু শিল্পপতি ইউসুফ হারুনকে জেনারেল মুসার পরিবর্তে পশ্চিম পাকিস্তানের গভর্ণর নিযুক্ত করা হল। পার্লামেন্টারি শাসন ব্যবস্থা এবং প্রাপ্ত বয়স্ক ভােটাধিকারের ভিত্তিতে শেখ মুজিব পরবর্তী গােলটেবিল বৈঠকে আইয়ুব খানের সঙ্গে সমঝােতায় উপনীত হবেন বলে ধারণা করা গিয়েছিল। কিন্তু সেনা সদর সব ভণ্ডুল করে দিল। ইয়াহিয়া খান ও জেনারেল পীরজাদা গােপন সূত্রে শেখ মুজিবের কাছে এই বার্তা পৌঁছে দিল যে, আইয়ুবের হাতে এখন আর কোন ক্ষমতা অবশিষ্ট নেই। ক্ষমতা চাইলে আমাদের সঙ্গে আসতে হবে। ১০ই মার্চ দ্বিতীয় বার গােলটেবিল বৈঠক শুরু হলে, দেখা গেল শেখ মুজিবুর রহমান কোন প্রকার আলােচনা না করে, ব্রিফ কেস খুলে এক বান্ডিল কাগজ বের করে পড়তে লাগলেন। পড়া শেষ করে তিনি বললেন যে, কেবল আমার উপস্থাপিত এই প্রস্তাবগুলাে মেনে নিলেই দেশে শান্তি-শৃংখলা ফিরে আসতে পারে। এই প্রস্তাবগুলিই তার ছয় দফা প্রস্তাব বলে খ্যাত। শেখ মুজিবের ‘ছয় দফা প্রস্তাব পাঠের পরই বৈঠক ভেঙ্গে যায়।
সমগ্র পাকিস্তানে আন্দোলন আগের চেয়ে কয়েকগুণ বেড়ে গেল। প্রতিদিনই মারপিট, হত্যা, ভাংচুর, ঘেরাও-জ্বালাও চলতে লাগল। সেই সঙ্গে পেশাজীবীদের দাবী-দাওয়া ও ধর্মঘট নতুন মাত্রা যােগ করল। ন্যাশনাল ব্যাংকের ম্যানেজিং ডিরেক্টরকে হেড অফিসে আটকে রেখে ব্যাংকের কর্মচারীরা নিজেদের দাবী-দাওয়া আদায় করে নিল। পি, আই, ডি, সি, সহ সব মিল-কারখানায় ঘেরাও অভিযান এবং দাবী আদায়ের হিড়িক পড়ে গেল। দেশের আর্থিক ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ল। করাচী ‘স্টক এক্সচেঞ্জ’ বন্ধ হয়ে গেল। পূর্ব পাকিস্তানে আদমজি জুটমিল এবং পাকিস্তান টোবাকো কোম্পানী শ্রমিকরা দখল করে নিল।
আইয়ুব খান মন্ত্রীসভার বৈঠক ডাকলেন। সভায় সেনাবাহিনী প্রধান ইয়াহিয়া খানকেও আমন্ত্রণ জানানাে হল। আইয়ুব খান সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখার পর প্রস্তাব করলেন- বর্তমান পরিস্থিতিতে শান্তি স্থাপনের একমাত্র পথ হচ্ছে ‘মার্শাল ল’ জারি করা। সকলেই ইয়াহিয়া খানের দিকে তাকিয়ে রইলাে। ইয়াহিয়া খানের মতামত
৩৯
চাওয়া হলে তিনি বললেন, এ ব্যাপারে আমি প্রেসিডেন্টের সাথে একাকি কথা বলব।’ মন্ত্রীসভার বৈঠক ভেঙ্গে গেল। | আইয়ুব খানের সঙ্গে ইয়াহিয়া খানের একাকি কি কথা হল, তা কেউ জানতে পারেনি। তবে সাক্ষ্য-প্রমাণ থেকে ধারণা করা হয় যে, ইয়াহিয়া খান নিচের শর্তে ‘মার্শাল ল’ জারি করতে রাজী হয়েছেন।
১। কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক এসেম্বলিসমূহ ভেঙ্গে দিতে হবে।
২। প্রাদেশিক গভর্ণর ও মন্ত্রীসভা বরখাস্ত করতে হবে।
৩। ১৯৬২ সালের শাসনন্ত্র বাতিল করতে হবে।
ইয়াহিয়া খানের উদ্দেশ্য আইয়ুব খানের বুঝতে কিছুই বাকী রইল না। অর্থাৎ চীফ মার্শাল ল’ এ্যাডমিনিস্ট্রেটর হয়ে প্রেসিডেন্টের গদিতে বসতে চান তিনি। আইয়ুব খান তার সব শর্ত মেনে নিলেন। এর মধ্যে শােনা গেল, পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত বিশেষ বিমানে ওয়াশিংটন গেছেন। ক্ষমতার হাত বদলে আমেরিকার অনুমােদনের জন্য হয়তাে। কিন্তু কার্যতঃ তাই সত্য হল। রাষ্ট্রদূত ফিরে আসার সাথে সাথেই ২৫শে মার্চ প্রেসিডেন্টের গদি উল্টে গেল। সকাল দশটায় প্রেসিডেন্ট হাউসে আইয়ুব খান তার শেষ ভাষণ রেডিও-টিভির জন্য রেকর্ড করলেন। সে সময় ইয়াহিয়া খান মাথা নিচু করে মলিন মুখে বসে রইলেন। কিন্তু ভাষণের টেপ যখনই হাতে আসে, তার চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠে। আনন্দে আত্মহারা হয়ে ‘ঝুমতে ঝামতে’ তিনি কমান্ডার-ইন-চীফ হাউসে গিয়ে উপস্থিত হলেন। কয়েকজন ঘনিষ্ঠ শরাবী বন্ধুকে ডেকে পাঠালেন, এবং সেই সঙ্গে আনা হল মিস সুন্দরী। শরাবের পর শরাব চলতে লাগল এবং গভীর রাত পর্যন্ত ‘হায় জামাললা’, ‘হায় জামালাে’ রব করতে করতে ফুর্তি চললাে।
আইয়ুব খান নিঃসন্দেহে উজ্জ্বল এবং ভরাট ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। কিন্তু পতনের সময়ে খানিকটা ম্লান ও ফাপা হয়ে পড়েছিলেন। ব্যক্তিগতভাবে তিনি সভ্যতা, ন্যায় বিচার ও ঔদার্যের পূজারী ছিলেন। তাঁর অন্তরে দেশপ্রেমের শিখা ছিল সদা অনির্বাণ। পাকিস্তান তার শাসনামলেই বিদেশে সর্বাধিক সম্মান লাভ করে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বিচারেও তার শাসনামলকে ‘সােনালী আমল’ বলা হয়ে থাকে।
রাজনৈতিক কূটচালে তিনি অসফল। তিন সশস্ত্র বাহিনী দীর্ঘদিন তার সাথে থাকলেও শেষ দিকে তারই লালিত-অনুগৃহীত শীর্ষ স্থানীয় কয়েকজন অফিসার তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে। ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে কিংবা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়ে তিনি ইসলামাবাদে নীরব জীবনযাপন করেন। ঈদের মাঠে নামাজ পড়তে গেলে তখনাে অসংখ্য মানুষ তার হাতে হাত মেলাবার জন্য ভীড় জমায়। ট্যাক্সিতে, বাসে, ছােট ছােট দোকানে তখনাে তার ছবি চোখে পড়ে।
৪০

মন্বন্তর, লর্ডওয়াভেল নন্দীগ্রাম ও সােহরাওয়ার্দী

একবার আমি এক বন্ধুকে আনার জন্য সাসারাম রেল স্টেশনে গিয়েছিলাম। কলকাতা থেকে যে ট্রেনটি আসল, তা নানা শ্রেণীর যাত্রীতে ঠাসা ছিল। প্রথম, দ্বিতীয় ও ইন্টারক্লাসে ছিল মারওয়াড়ী শেঠদের ভীড়। এরা নিজেদের মালামাল বড় বড় ট্রাকে ভরে নিয়ে জাপানী বিমান হামলার ভয়ে কলকাতা ছেড়ে যাচ্ছিল। অন্য কামরাগুলিতে ক্ষুধার্ত আদম সন্তানেরা, টিকটিকির মতাে, একজন আর একজনের সঙ্গে লাগালাগি করে বসা ছিল। অসংখ্য হাড্ডিসার বাচ্চা-কাচ্চা জানালার পাশে উদাস চোখে মাথা গলিয়ে রেখেছে। এদের ঠোটের ওপর রুটির মতাে পাতলা আবরণ জমে আছে। ক্ষুধা-তৃষ্ণার যন্ত্রণায় এদের চেহারাগুলাে বিবর্ণ হয়ে আছে। আধা পােড়া ডালপালার ছাল-বাকল যেমন কুঞ্চিত হয়ে যায়, এদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও তেমনি শীর্ণ হয়ে গেছে।
এরা দূর-দূরান্তের শ্যামল গ্রাম ছেড়ে এক মুঠো অন্নের জন্য প্রথমে কলকাতা এসেছিল এবং সেখানে নিরাশ হয়ে এখন তারা নিজেরাই জানে না কোথায় যাচ্ছে, কার কাছে যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে।
সারা বাংলা এক ভয়ংকর দুর্ভিক্ষের করাল গ্রাসে হাবুডুবু খাচ্ছে। অনাহারে মৃত্যুর সংখ্যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মৃত্যুর সংখ্যার চাইতে বেশী। এই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ঘূর্ণিঝড় ওসামুদ্রিক প্রাবন। পশ্চিম বাংলার কয়েক মাইল উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ, গরু, মহিষ ইত্যাদি সেই প্লাবনে খড়-কুটার মতাে ভাসতে ভাসতে সমুদ্রের তলদেশে নিক্ষিপ্ত হয়েছে।
বন্যা-বিধ্বস্ত ও দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের করুণ চিত্র ও সংবাদ প্রতিদিন এতই ভীতিপ্রদ হয়ে উঠতে লাগল যে, সাসারামের অফিসে বসে আরামে অফিসারগিরি করা আমার কাছে বিরাট অপরাধ বলে মনে হল। অনেক ভেবেচিন্তে আমি পাটনা চলে গেলাম এবং গভর্ণর ও চীফ সেক্রেটারীর কাছে ত্রাণ কাজে বাংলায় যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে দরখাস্ত করলাম। প্রথমে তারা বেশ কিছুক্ষণ বুঝিয়ে-সুঝিয়ে আমাকে নিরস্ত করতে চাইলেন। তারা আমাকে বােঝাতে চাইলেন-আমি দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ সাবডিভিশনের চার্জে আছি, সরকার আমার কাজে সন্তুষ্ট, আমার চাকরি জীবনে উন্নতির জন্যে এখানেই নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করা আমার জন্য উত্তম। কিন্তু আমি যখন তাদের বােঝাতে সক্ষম হলাম যে, সত্যি সত্যি এখানকার কাজ থেকে আমার মন উঠে গেছে তখন তারা রাজী হয়ে গেলেন। সেই দিনই আমার চাকরি সাময়িকভাবে বাংলা সরকারের হাতে ন্যস্ত করে এক সরকারী ফরমান জারি করা হয়।
কলকাতায় হাওড়া স্টেশনে নেমে আমি তাজ্জব হয়ে গেলাম, চারদিকে ফুর্তির ফোয়ারা বইছে যেন। জ্যোৎস্নায় উদ্ভাসিত প্রশস্ত সড়কের দুই পাশে এবং বাজারে
৪১
বিচিত্র পণ্যসম্ভারে সজ্জিত দোকানগুলি স্বপ্নের জগত বলে মনে হল। বাংলার বর্ণিল ললনারা সর্পিল কবরী দুলিয়ে জোড়ায় জোড়ায় কেনা কাটায় মত্ত। লােকেরা ট্যাক্সিতে, ট্রামে, বাসে, রিক্সায় এবং হেঁটে নিরুদ্বিগ্ন আনন্দে যাতায়াত করছে। একদল নিজেদের নিয়ে মত্ত, অন্যদল অন্য কাজে ব্যস্ত। এদের চলার পথের চারপাশে-সামনে, পেছনে, ডানে, বামে; সড়কে, ফুটপাতে ও গলির ভেতরে-ক্ষুধার যন্ত্রণায় অসংখ্য হতভাগা মানুষ পােকা-মাকড়ের মতাে যে ছটফট করছে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে, তা তাদের চোখেই পড়ছে না। বিপরীতমুখী দুটি জীবন-ধারা এভাবে পাশাপাশি নিজগতিতে বয়ে চলেছে-কেউ কারাে নাগাল পায় না, যেমন আগের চিঠিকে পরের চিঠি কখনই ধরতে পারে না।
বাংলার মন্বন্তরের জন্য মূলতঃ প্রাকৃতিক দুর্যোগের চাইতে সরকারী অদূরদর্শিতা, উদাসীনতা ও অব্যবস্থা বেশী দায়ী ছিল। সে সময় জাপান দূরপ্রাচ্যে একটার পর একটা দেশ জয় করে আসাম সীমান্ত দিয়ে ভারত আক্রমণের পায়তারা করছিল। কলকাতা ও মাদ্রাজে ইতিপূর্বেই বােমা হামলা হয়েছে। এদিকে এরকম একটি গুজব ছড়িয়ে পড়েছে যে, সমুদ্র পথে জাপানী পঞ্চম বাহিনীর গােয়েন্দারা বাংলার উপকূলে অবতরণ করেছে। ১৯৪২-এর ‘ভারত ছাড়’ (Quit India) আন্দোলনের পর বৃটিশ সরকারও সন্দিগ্ধ হয়ে ওঠে, জাপান প্রকৃতই ভারত আক্রমণ করে বসলে ভারতীয় জনগণ কোন্ পক্ষ নেবে বিশেষ করে বাংলার ব্যাপারে তাদের সন্দেহটা ছিল একটু বেশী। কারণ, সুভাষ চন্দ্র বসুর ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ তখন বালায় খুবই প্রভাবশালী ছিল।
এ রকম পরিস্থিতিতে বৃটিশ সরকার (Scorch Earth Policy) ‘পােড়া মাটি নীতি গ্রহণ করল। এ নীতির অধীনে সারা বাংলা বড় বড় শস্য সহকারী দালাল নিয়ােগ করা হয়। তারা শহরে-বন্দরে-গ্রামে গুদাম খুলে ধান-চালসহ সমস্ত ফসলাদি সস্তায় খরিদ করে গুদামজাত করতে লাগল। কিছু দিনের মধ্যেই দেশের যাবতীয় ফসল এদের গুদামে তালাবদ্ধ হল। এসব ফসল প্রধানতঃ সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং মিলিটারীদের জরুরী প্রয়ােজন মেটাবার জন্য সংগৃহীত হয়েছে। এ ব্যাপারে নির্দেশ ছিল, জাপানী সৈন্যদের ভারত ভূখন্ডে মার্চ করার সাথে সাথে সংরক্ষিত ফসলাদি আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে দিতে হবে, যাতে এগুলাে তারা ব্যবহার করতে না পারে।
দালালদের ক্রয় সীমার বাইরে যা কিছু ফসলাদি বাকী ছিল তা জমিদার, ব্যবসায়ী ও ধনী লােকেরা ব্যক্তিগত গুদামে আটকে রাখে। বলতে গেলে, কৃষক ও জনসাধারনের হাতে খাদ্যশস্য বলতে কিছুই আর অবশিষ্ট রইল না। তরি-তরকারিসহ সব জিনিসের দাম হুহু করে বাড়তে লাগল।
প্রথম প্রথম গরীব গ্রামবাসী শাকপাতা খেয়ে জীবন ধারণের চেষ্টা করল। ক্রমান্বয়ে
৪২
গাছের ছাল বাকল, লতাপাতা খেতে শুরু করল। রােগে-শােকে-ক্ষুধায় পুরুষদের কোমর বাঁকা হয়ে গেল, নারীদের স্তন শুকিয়ে গেল এবং বাচ্চাদের শরীরের মাংস পাঁজরে লেপ্টে গেল এবং পেট বেলুনের মতাে ফুলে উঠল। উপায়ন্তর না দেখে কংকালসার মানুষেরা নিজেদের ঝুপড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল। রাস্তায় নেমে তারা দেখল, হাজারাে বুভুক্ষু কঙ্কাল তাদের আগে-পিছে এগিয়ে চলেছে-এদের মধ্যে, নারী, পুরুষ ছােট ছেলে ও মেয়ে সবই আছে। কেউ তরপাচ্ছে, কেউ চলতে চলতে ঢলে পড়ছে মৃত্যুর হিমশীতল কোলে যারা এগুতে পারছে তারা কোন রকমে এগিয়ে চলেছে। খাদ্য-মরীচিকা তাদের একটি স্বপ্নপুরীর দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। তাদের সকলের বিশ্বাস, কলকাতা সকল দুঃখ-দুর্দশানাশিনী। সেখানে আকাশচুম্বী প্রাসাদ আছে, রঙ-বেরঙের দোকান আছে, স্বাস্থ্যবান শেঠ আছে, কুকুরের ক্ষুধা নিবারণের জন্য মাংস আছে, পােষা বেড়ালের জন্য দুধ আছে, তাছাড়া কিছু ধানচাল তাে থাকতেই পারে। রাস্তার দু’পাশে প্রসাদগুলাের দরজায় চালের বস্তা সারি সারি পড়ে থাকাও বিচিত্র নয়, যা তাদেরই অপেক্ষায় প্রহর গুণছে।
এই ধারণার বশবর্তী হয়ে বুভুক্ষ মানুষের ঢল নেমেছে কলকাতায়। যতই এগিয়ে যাচ্ছে, বাঁচার আকাঙ্খা ততই তীব্রতর হচ্ছে। মুহূর্তে কলকাতার অলি-গলিতে ক্ষুধার্তের আর্তনাদ প্রতিধ্বনিত হল-ও, মা! চাউল, ও বাবা! ভাত; হে বাবু….., কিন্তু মা কোথায়? বাবা কে? দরজার সামনে রাখা চালের বস্তাগুলিই বা কোথায় গেল? দরজায় তাে শুধু দারােয়ান চোখে পড়ছে, সড়কে কেবল ট্যাক্সি আর মােটর গাড়ি। ক্ষুধার্ত লােকগুলি আসার পথে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়েছে, কিন্তু কলকাতা পৌঁছে এখন জীবনের সাথে লড়তে শুরু করল। দলে দলে নালায়-নর্দমায় নেমে পড়ল এবং কলাই, মটরশুটি, কপি ইত্যাদি তরি-তরকারির খােসা ও বর্জিত আবর্জনা খেতে লাগল। করপােরেশনের ময়লা আবর্জনার গাড়ির উপর হুমড়ি খেয়ে পড়তে লাগল। কার আগে কে খাবে এ নিয়ে পরস্পর যুদ্ধে লিপ্ত হয় এবং দুর্বল হতে হতে এক সময় রাস্তায় পড়ে যেত। লাল পাগড়িওয়ালা সিপাই এসে তাদের টেনে টেনে রাস্তার এক পাশে ফেলে রাখত যাতে গাড়ি চলাচলের বিঘ্ন না ঘটে।
সূর্য ডুবার সাথে সাথে হাওড়া ব্রীজের দু’পাশে ক্ষুধার্ত নারী-পুরুষ ও ছেলে-মেয়েদের মেলা বসে যেত। ছােট ছােট বাচ্চাদের গলার সঙ্গে ঝুলিয়ে মায়েরা সারিবদ্ধভাবে সুদীর্ঘ পুলটির দু’পাশে এই এলাকায় দাঁড়িয়ে থাকত, যদি কোন ধনবান বা উদার ব্যক্তি তাদের বাচ্চাদের কেনে অথবা এমনিতেই নিয়ে যায়। কখনাে কখনাে কোন মা কলিজার টুকরা সন্তানকে শেষবারের মতাে বুকের সঙ্গে লাগিয়ে তারপর চোখ বন্ধ করে হুগলি নদীতে নিক্ষেপ করত। কখনাে কখনাে কোন মা বাচ্চাসহ
৪৩
নিজেই নদীতে লাফিয়ে পড়ে ইহলীলা সাঙ্গ করত। হুগলি নদীতে লঞ্চ, স্টীমার, বজরা ঠিক আগের মতােই চলতে থাকত এবং পুলের উপর দিয়ে দ্রুতগামী গাড়িগুলাের চলাচলেও কোন ব্যাঘাত ঘটত না। এভাবে বৃটিশ সরকারের রাজ্যে জাপানী হামলা ছাড়া এক-একটি রাত কেটে যেত।
স্পষ্টতই বােঝা যাচ্ছিল, বৃটিশ সরকারের কাছে বাংলার দুর্ভিক্ষ ভয়াবহতা তেমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়, তাদের যত দুশ্চিন্তার বিষয় ছিল জাপানী আক্রমণের আশংকা। আমি চীফ সেক্রেটারীর কাছে আমার উপস্থিতি জানাতে ‘রাইটার্স বিল্ডিং’-এ পৌছে দেখি এর ছাদের উপর দুটি বিমান-বিধ্বংসী কামান বসানাে রয়েছে এবং বােমা হামলা থেকে বাঁচার জন্য বারান্দা ও আঙিনার বিভিন্ন স্থানে বালির বস্তা দিয়ে বাঙ্কার তৈরী করা হয়েছে। সেক্রেটারীয়েট বিল্ডিং-এর চার পাশের কোথাও ক্ষুধার্ত মানুষের নামনিশানা পর্যন্ত নেই। সবচাইতে মজার ব্যাপার হল, সেক্রেটারিয়েটের ছােট ঘােট অন্ধকার কামরাগুলােতে বাবু নামধারী কালাে এবং অফিসার নামধারী সাদা লােকগুলাে স্বাস্থ্যবান গরদান কঁকিয়ে যে ফাইল নিরীক্ষণ করছিল, তার বিষয় চাল কিংবা দুর্ভিক্ষ নয়, প্লাবন কিংবা সাইক্লোন নয়, এমনকি সম্ভাব্য জাপানী হামলাও নয়।
আমি চীফ সেক্রেটারীর অফিসে পৌছলে একজন অফিসার পূর্বে টাইপকৃত আমার নিয়ােগপত্রটি হাতে দিলেন। আমাকে সেক্রেটারিয়েটের সিভিল সাপ্লাই বিভাগের আন্ডার সেক্রেটারী নিযুক্ত করা হয়েছে। আমি নিদারুণ হতাশ হয়ে পড়লাম। কারণ কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিং-এর ফাইলের পেট পূরণের জন্য আমি বিহার ছেড়ে বাংলায় আসিনি। ইংরেজ চীফ সেক্রেটারীর কাছ থেকে আমি সােজা চীফ মিনিষ্টার খাজা নাজিমউদ্দিন সাহেবের কাছে চলে গেলাম এবং বাংলার কোন দুর্ভিক্ষপীড়িত এলাকায় ত্রাণ ও পুনর্বাসন কাজে আমাকে নিয়ােগ করার জন্য আরজি পেশ করলাম।
খাজা সাহেব ব্যক্তিগতভাবে উন্নত চরিত্র, উচ্চবংশজাত একজন অতিশয় ভদ্রলোেক, কিন্তু রাষ্ট্রীয় কর্মে ছিলেন ঢিলেঢালা প্রকৃতির। আমার নিয়ােগপত্রটি পড়লেন, তারপর মাছম বাচ্চার মতাে মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, ‘চীফ সেক্রেটারী তাে তােমাকে পােষ্টিং দিয়ে দিয়েছেন, এখন আর কি করার আছে?
বিনীতভাবে বললাম, “সবই করার আছে, স্যার কেননা, আপনি প্রদেশের চীফ মিনিষ্টার।’ খাজা সাহেব বেশ কিছুক্ষণ ভেবে বললেন, “ঠিক আছে, বস। আমি চেষ্টা করে দেখি।’ মনে হল চীফ সেক্রেটারীকে তার কামরায় ডেকে পাঠাবেন। কিন্তু না, তিনি নিজে উঠলেন এবং সােজা চীফ সেক্রেটারীর কামরায় চলে গেলেন। দশ-বার মিনিট পর ফিরে এসে নিদারুণ অসহায়ের মতাে মাথা নেড়ে বললেন, ‘না, তিনি মানছেন না। তুমি দু-তিন মাস সেক্রেটারিয়েটে কাজ কর, তারপর তােমাকে কোন দুর্গত এলাকায়
৪৪
পাঠাবার ব্যবস্থা করব।’
খাজা নাজিমউদ্দিন সাহেবের ভদ্রতা এবং যুগপৎ তার অসহায়ত্ব আমার অন্তরে গভীর রেখাপাত করে। তাঁর সাথে আমার পূর্ব পরিচয় ছিল না এবং আমার ব্যাপারে তার কাছে কেউ সুপারিশও করেনি। অপরিচিত একজন জুনিয়র অফিসারের কথা এমন মনোেযােগ দিয়ে শােনা এবং তারপর সে বিষয়ে কথা বলার জন্য সেক্রেটারীর কক্ষে যাওয়া সব চীফ মিনিষ্টারের কাজ নয়। আবার, বিমুখ হওয়ার পর আগের মতােই চুপচাপ, বিনা বাক্যব্যয়ে, নিজ কক্ষে ফিরে আসাও প্রত্যেক চীফ মিনিষ্টারের স্বভাব নয়।
সব কিছু দেখে-শুনে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, সেক্রেটারিয়েটে বসে বসে সময় নষ্ট করার চাইতে পূর্বের কর্মস্থল বিহারে ফিরে যাওয়াই আমার জন্য উত্তম। আমি আমার এই সিদ্ধান্ত এবং নাজিমউদ্দিন সাহেবকে তার ভদ্রতার জন্য কৃতজ্ঞতা জানাতে সেদিনই সন্ধ্যায় তার থিয়েটার রােডের বাসায় গেলাম। চীফ মিনিষ্টারের বাড়ীতে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থার কোন লক্ষণ দেখলাম না। কেবল কাঠের বেঞ্চিতে দু’জন সিপাই লাঠিতে ঠেস দিয়ে ঝিমুচ্ছিল। আমি কে, কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি-এসব কোন কথাই এরা আমাকে জিজ্ঞেস করল না। ভেতরে ঢােকার পর একজন অফিসার/কর্মচারী আমাকে খাজা সাহেবের ঘরের দিকে নিয়ে গেল। জোছনা বিধৌত খােলা বারান্দায় তিনি চেয়ারে বসেছিলেন, পাশে খাজা শাহাবুদ্দিন ও হোেসইন শহীদ সােহরাওয়ার্দী। এঁরা দুজনই তখন মন্ত্রী। সােহরাওয়ার্দী সাহেব ছিলেন সিভিল সাপ্লাই বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত।
আমার বক্তব্য শােনার পর সােহরাওয়ার্দী সাহেব আমাকে কিছু সওয়াল-জওয়াব করলেন, তারপর চীফ মিনিষ্টারকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘একদিকে তাে প্রতিনিয়ত শুনছি, রিলিফের কাজের জন্য কোন অফিসার পাওয়া যাচ্ছে না, অন্যদিকে দেখছি, কোন অফিসার স্বেচ্ছাপ্রনােদিত হয়ে সে কাজ করতে চাইলে তাকে সেক্রেটারিয়েটে আটকে রাখা হয়। আমি মনে করি একে এখনই তামলুক পাঠিয়ে দেওয়া উচিত। সেখানে এই মুহূর্তে একজন মুসলমান এসডিও’র খুবই প্রয়ােজন।’ চীফ মিনিষ্টার তার গােলগাল মাথা দুলিয়ে বললেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে, আমিও তাই ভাবছি।’ তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলেন, “তুমি আমাকে খুবই অপ্রস্তুত করলে হে। কাল সকালেই সােহরাওয়ার্দী সাহেবের অফিসে চলে যেও; তিনি চীফ সেক্রেটারীকে বলে তােমার নতুন নিয়ােগপত্রের ব্যবস্থা করে দেবেন। সােহরাওয়ার্দী সাহেব একটু মুচকি হাসলেন এবং সেদিনের জন্য তখনই আমাদের সাক্ষাৎকার শেষ হল।
৪৫
পরদিন অফিস খােলার সাথে সাথে সােহরাওয়ার্দী সাহেবের কামরায় গিয়ে উপস্থিত হলাম। তিনি এলেন বেলা ১১টার দিকে। প্রথমে আমাকে চিনতেই পারলেন না এবং সম্পূর্ণ অস্বীকার করে বসলেন। কিন্তু আমি গত রাতের কথাবার্তার প্রসঙ্গ বর্ণনা করার পর তিনি আমাকে বসতে বললেন। প্রায় ঘন্টা খানেক ধরে তিনি বিভিন্ন কাগজপত্র-ফাইল ইত্যাদি দেখতে থাকলেন এবং একটার পর একটা টেলিফোন রিসিভ করতে থাকলেন। হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে এক রকম আশ্চর্যান্বিত ভঙ্গিতে বললেন, ‘ও হঁ্যা আপনি কি কাজ নিয়ে…….এসেছিলেন, কি কাজ, বলুন?’ আমি নতুন করে চীফ মিনিষ্টারের বাসার সাক্ষাৎকারের ঘটনা বলতে শুরু করলে তার স্মরণ হয়। কাগজ-কলম হাতে নিয়ে আমার নাম জিজ্ঞেস করলেন। আমি একদমে আমার পুরা নাম বলে ফেললাম। তিনি খানিকটা বিরক্তির সুরে বললেন, ‘পাথর ছুঁড়ছেন কেন? ধীরে ধীরে বানান করে করে বলুন।
আমি আমার পুরা নাম ইংরেজিতে বানান করে বলতে লাগলাম, ‘কিউ-ইউ-ডি-আর-এ-টি-কুদরাত……’
সােহ্রাওয়ার্দী সাহেব হাত থেকে কলম ফেলে দিলেন। বললেন, ‘ভুল, একেবারে ভুল। কিউ’র পর সব সময়ই দুটো স্বরধ্বনি হবে। তুমি দুটি ‘ইউ’ ব্যবহার করতে পার অথবা ‘কিউ’ বাদ দিয়ে শুধু ‘ইউ’ থেকেই নামটা শুরু করতে পার (উদরাত…)।
ইংরেজী ভাষার সূক্ষ্ম ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের পর তিনি ইংরেজ চীফ সেক্রেটারীর টেলিফোন নম্বর ঘােরালেন। গম্ভীর কণ্ঠে এবং আদেশসূচক ভঙ্গিতে ইংরেজীতে বললেন, ‘বিহার থেকে ডেপুটেশনে আসা কিউ-ইউ-শেহাব আমার কাছে বসা আছে। চীফ মিনিষ্টারের অনুমােদনক্রমে আজই আমি তাকে তামলুক পাঠাচ্ছি।’
চীফ সেক্রেটারী সম্ভবতঃ কোন প্রকার প্রতিবাদ করতে চাইছিলেন, কিন্তু সােহরাওয়ার্দী সাহেব কণ্ঠস্বর চড়া করে বললেন, ‘ননা, নাে, এই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত। নিয়ােগপত্র এখানে পাঠিয়ে দিন, এখনই; আমি অপেক্ষা করছি।’
এই বিরল রাজকীয় আদেশ জারি করে সােহরাওয়ার্দী সাহেব নিজের কোট খুলে , চেয়ারে রাখলেন, টাই’র নড় ঢিলা করলেন, তারপর রিভলভিং চেয়ারে বসে প্রথমে একটি ইংরেজী গানের কিছু শব্দ গুণ গুণ করে গাইলেন এবং পরক্ষণেই তামলুকের ঐতিহাসিক গুরুত্ব সম্পর্কে বক্তৃতা শুরু করে দিলেন। চীনা পরিব্রাজক হিউ-এন-সাঙ তার ভ্রমণ কাহিনীতে তামলুককে তাম্রলিপ্তি বলে উল্লেখ করেছেন। এক সময় এখানে ‘বেদ’ পড়াবার বড় বড় পাঠশালা ছিল, এখনও কিছু কিছু লােকের কাছে সেখানে সংস্কৃতে রচিত প্রাচীন ও দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থাদি রক্ষিত আছে। ওয়ারেন হেস্টিংস ও লর্ড ক্লাইভ বৃটিশ মিউজিয়ামের জন্য এসব দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থাদি সংগ্রহ করার জন্য জোর প্রচেষ্টা চালিয়েও সম্পূর্ণ
৪৬
সফল হননি।
সােহরাওয়ার্দী সাহেবের বিজ্ঞজনােচিত বক্তৃতার মাঝেই স্বরাষ্ট্র বিভাগের এক ইংরেজ আন্ডার সেক্রেটারী দরজায় নক করে ভেতরে প্রবেশ করল। আমার নিয়ােগপত্রটি সােহরাওয়ার্দী সাহেবের হাতে দিয়ে আমার দিকে ক্রোধমিশ্রিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সে চলে গেল। তামলুক কলকাতা থেকে পঞ্চাশ মাইল দূরবর্তী মেদিনীপুরের একটি মহকুমা। মেদিনীপুর জেলা ছিল সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের ঘাঁটি। এখানে সন্ত্রাসীদের হাতে তিন-তিন জন ইংরেজ কালেক্টর পরপর নিহত হয়। এবারে জলােচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড় ও দুর্ভিক্ষে এই জেলার উপকূলীয় দুটি মহকুমা ‘কোন্টাই’ ও ‘তালুক’-একেবারে পর্যদস্ত হয়ে পড়ে।
তমলুকের সমুদ্র উপকূলীয় একটি এলাকার নাম নন্দীগ্রাম। ঘূর্ণিঝড় শুরু হলে পর্বতসমান উঁচু সামুদ্রিক প্লাবন নন্দীগ্রামের দেড়শ’ বর্গমাইল ঘনবসতি এলাকা বিলীন করে দেয়। বর্তমানে পুরাে এলাকাটি একটি পুঁতিগন্ধময় জলাশয়ে পরিণত হয়েছে। নর-নারীর মাথার খুলি, গবাদি পশুর কংকাল, মরা-পঁচা বড় বড় মাছ ছাড়াও এখন একটি নানা জাত-বেজাতের সাপের আস্তানা। কলকাতার একটি কোম্পানী জীবিত সাপের ব্যবসা করত, তাদের কয়েকজন প্রতিনিধি ইতিমধ্যেই এখানে এসে পৌঁছেছে। এরা মূলতঃ বিষধর সাপ ধরে ধরে ইউরােপ-আমেরিকা রপ্তানি করত। সাপ ধরার নানা কলা-কৌশল জানা থাকলেও তারা লেংটিপরা, জটাধারী, একজন যােগীকে নিজেদের দলে রথিত। এই যােগী শুকনা লাকড়ি দিয়ে আগুনের কুন্ডলি বানিয়ে তার মধ্যে ধূপ ছিটিয়ে দিত আর নিজে পাশে বসে বসে মালা জপত। তার সামনে মানুষের মাথার দুটি খুলি একটায় দুধ আর একটায় দেশী চোলাই মদ। মদ সে নিজে পান করত আর মন্ত্রপড়া দুধ নানা জায়গায় ছিটিয়ে দিত। এই দুধের উপর সাপেরা মাছির মতাে ঝাপিয়ে পড়ত এবং তা এঁকে কিংবা জিভে লাগিয়ে বেঁহুশ হয়ে যেত। কোম্পানীর লােকেরা এরপর নিজেদের পছন্দ মতাে সাপ ধরে ধরে বাক্সবন্দী করত।
জলােচ্ছাস ও ঝড়-তুফান নন্দীগ্রামের বিরাট এক এলাকা দাবিয়ে দিয়ে তার নিচে থেকে সাপগুলােকে যেমন বের করে এনেছে, তেমনি, দুর্ভিক্ষপীড়িত অন্যান্য এলাকার মানুষগুলােকে করে তুলেছে সাপের মতই হিংস্র। মানুষের মনের যাবতীয় লােভ-লালসা, স্বার্থপরতা, নােংরামি, নিষ্ঠুরতা ও হিংস্রতা নির্লজ্জভাবে প্রকাশ পেতে লাগল। একদিকে, কারাে কারাে ঘরে সকাল-সন্ধ্যা ভাত রান্না হত, মাছ ভাজা হত, সালুন তৈরী হত, চা, নাস্তা, দুধের ক্ষীরও বাদ যেত না, অন্যদিকে তাদের সামনে, পেছনে, ডানে-বাঁয়ে অসংখ্য ঝুপড়িতে সপ্তাহকে-সপ্তাহ, মাসকে মাস বাতি জ্বলত না, চুলাও জ্বলত না। এসব কুটিরের অধিবাসীরা হয় সকলেই মারা গেছে অথবা অর্ধমৃত
৪৭
অবস্থায় শুয়ে শুয়ে কাতরাচ্ছে। কোন কোন ঘরে হয়ত দু-একটি লাশ বিনা দাফন কাফন এখনাে পড়ে রয়েছে, আবার কোন কোন ঘরে মুমূর্ষ হাড্ডিসার মানব সন্তান দরজার চৌকাঠে মাথা ঠেকিয়ে পাশের বাড়ি থেকে আসা সদ্য রান্নাকৃত ভাতের গন্ধ নাকে নিতে নিতে অসহায়ের মতাে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু অনাহারের মৃত্যু বড়ই কঠিন, অনাহারীকে কষ্ট না দিয়ে সহজে আসে না।
যত রকমের মৃত্যু আছে, ক্ষুধা-তৃষ্ণার মৃত্যু তার মধ্যে সবচাইতে ভয়ংকর ও যন্ত্রণাদায়ক। এতে, প্রাণবায়ুতে এক নিমিষে মানবের দেহ ত্যাগ করে না। দিনের পর দিন জীবন-বারির প্রতিটি ফোটা একের পর এক শুকোতে থাকে। আগুনের পাশে চুল ধরলে যেমন দুমড়ে মুচড়ে বটে যায়, ক্ষুধার জ্বালায় মানুষের শরীরের প্রত্যঙ্গগুলিও তেমনি চুপসে গিয়ে বটতে শুরু করে, হাড়ি-চামড়ার সঙ্গে লেপ্টে যায়। চোখ কোটরাগত হয়, কিন্তু কণ্ঠের কাছে প্রাণ তখনাে ধুকতে থাকে। শরীর সম্পূর্ণ নিষ্প্রাণ হলেও মস্তিষ্কের অনুভূতি তখনাে বিদ্যমান থাকে। শেষ নিশ্বাস ত্যাগের আগ পর্যন্ত মস্তিষ্কের কোন কোন কোটরে এই আকাঙ্খা টিমটিম করতে থাকে যে, এই বুঝি প্রতিবেশীর ঘর থেকে কেউ ভাতের থালা নিয়ে এগিয়ে আসছে, কিংবা অদৃশ্য লােক থেকে কোন পথচারী দুধের পেয়ালা হাতে উপস্থিত হবে।
রাহীল খন্দকার নিজের ঝুপড়িতে, দরজার কাছে নিস্তেজ পড়ে থেকে, এ রকম আশা-নিরাশার দোলাচলে দুলতে দুলতে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। কোন প্রতিবেশী বা পথচারী ভাতের থালা বা দুধের পেয়ালা নিয়ে এগিয়ে এল না। অবশ্য ফরাসী এম্বুলেন্স ইউনিট-এর একটি সাহায্যকারী দল সেখানে এসে উপস্থিত হল। গুঁড়া দুধের টিন, গ্লুকোজের কৌটা, বিস্কুটের প্যাকেট আর ভিটামিন ট্যাবলেট নিয়ে তাদের জীপটি একটু দুরে গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে ছিল। রিচার্ড সাইমন্ড মাথায় ম্যানিলা হ্যাট এবং চোখে সানগ্লাস লাগিয়ে রাহীল খন্দকারের ঝুঁপড়ির পেছনে হাঁটু গেড়ে বসে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে মৎস্য শিকারীর একনিষ্ঠতা নিয়ে কি যেন নিরীক্ষণ করছিল। একটি নারকেল গাছের আড়াল থেকে মিস্ বেষ্কার্ট বাইনাকুলার দিয়ে এক দৃষ্টে ঝুপড়ির দিকে তাকাচ্ছিল। তাদের দলের তৃতীয় এক ব্যক্তি অতি সন্তর্পণে আরাে একটু এগিয়ে বিভিন্ন ধরনের ক্যামেরার সাহায্যে খটাখট ছবি তুলে নিচ্ছিল।
রাহীল খন্দকার তখনাে ঝুঁপড়ির দরজার মুখে সাড়া-শব্দহীন নিঃসাড়-নিষ্প্রণের মতাে পড়ে রয়েছে। এখনাে সে মরেনি চোখের নিচে মােটামােটা অশ্রুর ফেঁাটা মােমের মতাে জমে রয়েছে। একটি শেয়াল তার পা কামড়ে ধরে এদিক সেদিক নাড়া-চাড়ার চেষ্টা করছে। শেয়ালের মুখ থেকে টেনে পা সরিয়ে নেওয়ার শক্তি রাহীলের হাঁটুতে অবশিষ্ট ছিল না। এই করুণ ও বিরল দৃশ্য মার্কিন ফটোগ্রাফার আর কোথায় পাবে? ঠিক
৪৮
এই সময় আমি সেখানে গিয়ে উপস্থিত হলাম। আমার জীপের আওয়াজ পেয়ে শেয়ালটি দৌড়ে পালিয়ে গেল। বিদেশী লােকগুলাে দারুণভাবে মনােক্ষুন্ন হল। অনেকক্ষণ তারা পরস্পর কি যেন বিড়বিড় করতে থাকল।
আন্তর্জাতিক রেড ক্রসের টীমও সময় সময় তামলুকে আসত। তবে তাদের কার্যক্রম লঙ্গরখানা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল। সরকার তামলুকে আটটি লঙ্গরখানা খুলেছিল। রেড ক্রসের পক্ষ থেকে এগুলােতে পর্যাপ্ত পরিমাণ বিস্কুট, ভিটামিন, সাবান ও তেল সরবরাহ করা হত। লঙ্গরখানার সুপারভাইজার এসব দ্রব্যাদি শহরের বড় বড় দোকানে বিক্রি করে দিত। লঙ্গরখানার রেজিস্টার-আশ্রিতদের সংখ্যা দু’তিন গুণ বাড়িয়ে দেখানাে হত। বাড়তি রেশন কালাে বাজারে বিক্রি করা হত। চা-চিনি-দুধ দৈনিক হিসাবে পাওয়া যেত। কিন্তু এগুলাে কেবল সে দিনই বন্টন করা হত, যেদিন কোন অফিসার পরিদর্শনে আসত।
লঙ্গরখানায় আশ্রয় লাভের জন্য ক্ষুধা-দারিদ্র্য কোন শর্ত ছিল না। সর্বপ্রথম এলাকার কোন মােড়ল, জমিদার বা সম্মানিত কোন ব্যক্তির কাছ থেকে নিজের নাম, পিতার নাম, পরিবারের সদস্য সংখ্যা, স্থায়ী ঠিকানা, স্বভাব-চরিত্র ও রাজনৈতিক সংস্রবহীনতা সম্পর্কে একটি সার্টিফিকেট জোগাড় করতে হত। তারপর সার্কেল অফিসারকে দিয়ে সেটাকে সত্যায়িত করিয়ে নিতে হত। এই দুটো ঘাট পার হওয়া সকলের জন্য সহজ ছিল না। কিন্তু যে পরিবারের তাগড়া পুরুষ ছিল কিংবা পছন্দসই চেহারার নারী তারা অনায়াসে পার হয়ে আসত। লঙ্গরখানায়, বাচ্চারা আর বুড়ারা ঘন্টার পর ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকত। সুপারভাইজার, স্টোর কিপার, একাউন্ট্যান্ট, বাবুর্চি, পিওন, চাপরাসি-সবাই নিজ নিজ ক্ষমতা অনুযায়ী যুবতী মেয়েদের সন্তুষ্টি লাতের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ত। কেউ কেউ গােপনে সুগন্ধি সাবান, কেউ দুধের কৌটা, কেউ বিস্কুটের প্যাকেট, আবার কেউ ভিটামিন ট্যাবলেট মেয়েদের হাতে গুঁজে দিয়ে ইহজীবন সার্থক করত। লঙ্গরখানা হােক কিংবা হােক রাহীল খন্দকারের আস্তানা-সর্বত্রই ক্ষুধার্ত মানুষের দেহ, প্রাণ ও লিঙ্গের একই রেট ছিল।
একদিন আমি একটি লঙ্গরখানা পরিদর্শনে গেলাম। দেখতে পেলাম চৌদ্দ-পনের বছরের একটি সুন্দরী মেয়ে মৃতপ্রায় তার মাকে কোলে নিয়ে সবার কাছ থেকে দূর এক জায়গায় বসে রয়েছে। মেয়েটির নাম নুরজাহান। যদি তার হাতে দুটো কবুতর থাকত এবং শাহজাদা সেলিম তাকে দেখে ফেলত, তবে সে লঙ্গরখানার পরিবর্তে, মাথায় তাজ পরে মােঘল প্রাসাদ পর্যন্ত পৌঁছে যেত এবং রাণী উপাধি লাভ করত। লঙ্গরখানার কর্মচারীদের দিকে তাকিয়ে মনে হল, তারা মেয়েটির ক্ষুধার্ত মায়ের মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছিল। বৃদ্ধার মুখ থেকে লালা পড়তে দেখে আমি মা ও মেয়েকে জীপে
৪৯
তুলে নিলাম এবং নিকটস্থ কোলঘাট গ্রামে নিয়ে গেলাম। সেখানে হাজী আবদুর রহমান নামে একজন মুসলিম জমিদার বাস করতেন। সে জনসেবায় নিবেদিত প্রাণ হিসাবে তার যথেষ্ট সুখ্যাতি ছিল। বিভিন্ন ত্রাণ তহবিলে তিনি অকাতরে দান করতেন। বয়স সত্তরের উপর। আমি তাকে এই বিপন্ন মা-বেটিকে আশ্রয় দেয়ার প্রস্তাব করলে তিনি সানন্দে রাজী হয়ে গেলেন। বেচারী মা দিন কয়েকের মধ্যেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল এবং খবর পাওয়া গেল, এর চল্লিশ দিনের মাথায় হাজী সাহেব নুরজাহানকে ফি সাবিলিল্লাহ বিয়ে করেছেন। তিনি যদি এই পূণ্যের কাজটি করতে বিলম্ব করতেন, তবে তার কয়েক ছেলের মধ্যে কে আগে এই সওয়াবের কাজটি সমাধা করতে পারবে, তা নিয়ে কুরুক্ষেত্র হয়ে যেত।
লঙ্গরখানা ছাড়াও, দুর্গত মানুষদের সাহায্যের জন্য সরকার তামলুকের উপকূলে ছয়-সাতটি বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু করে। বাঁধ নির্মাণ প্রসঙ্গে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযােগ আসতে লাগল। একদিন আমি সাইকেলে চড়ে সবচাইতে বড় বাধটি পরিদর্শন করার জন্য গােপনে বাঁধ নির্মাণের স্থানে চলে গেলাম। সেখানে বাধের কোন নাম-নিশানা পর্যন্ত দেখতে পেলাম না। কোন শ্রমিককেও কাজ করতে দেখলাম না। অবশ্য ঠিকাদারের পাশে পি-ডার-ডি’র কয়েকজন কর্মচারীকে বসা দেখলাম। শ্রমিকদের মাস্টার রােলে সেই তারিখে দেড়শ’ শ্রমিকের টিপসই দেওয়ার কাজে নিয়ােজিত রয়েছে। অন্যান্য বাধ সম্পর্কেও এ ধরনের অভিযােগের-গুজবে বাজার গরম ছিল।
এর মধ্যে সেনাবাহিনীর একজন অফিসার কর্নেল মুথ হঠাৎ তামলুকে এসে উপস্থিত। তার সঙ্গে রয়েছে দু’জন সি,আই,ডি ইনস্পেক্টর। ইনস্পেক্টর দু’জন রেস্ট হাউসে উঠল আর কর্নেল স্মথকে আমার মেহমান করে বাংলােয় নিয়ে এলাম। এরা তিন জন প্রতিদিন সকালে জীপ নিয়ে বেরিয়ে যেত এবং সন্ধ্যায় ফিরে আসত। একদিন কর্নেল সাহেব অত্যন্ত গােপনে আমাকে জানালেন যে ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেল দুর্ভিক্ষপীড়িত এলাকা সফরে আসছেন। আগামীকাল দুপুর সাড়ে বারটা নাগাদ তার বিমান নন্দীগ্রামে এসে পৌছবে। এই সফরের ব্যবস্থাপনার সকল দায়-দায়িত্ব সামরিক বাহিনীর বিভাগীয় সদর দপ্তরের উপর ন্যস্ত। অবশ্য আগামীকাল আপনাকে আমি আমার জীপে করে নন্দীগ্রামে নিয়ে যাব, যাতে ভাইসরয়ের পরিদর্শনের সময় আপনিও সেখানে উপস্থিত থাকতে পারেন।
সেই রাতে আমার বাংলােয় আমি এক রকম নজরবন্দী অবস্থায় কাটালাম। সি,আই,ডি ইন্সপেক্টর দু’জনও রেস্ট হাউস থেকে আমার এখানে এসে উপস্থিত হয়েছে। কোন কথাবার্তা ছাড়াই আমার বাংলাের নিয়ন্ত্রণ তারা নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছে।
৫০
আমার ও আমার কর্মচারীদের গতিবিধির উপর এক অঘােষিত ও অদৃশ্য নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে বুঝতে পারলাম। আমরা বাইরের কারাে সঙ্গে এবং বাইরের কেউ আমাদের সঙ্গে যােগাযােগ করতে পারল না। সম্ভবতঃ ভাইসরয়ের সফরকে গােপন রাখাই এই সতর্কতার উদ্দেশ্য।
পরদিন নন্দীগ্রামে পৌছে দেখি সেখানকার চেহারাই পাল্টে গেছে। সামরিক বাহিনীর ট্রাকগুলি সারে সারে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বৃটিশ সৈন্যদের বিরাট এক বাহিনী পজিশন নিয়ে নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়ােজিত রয়েছে। ঠিক সাড়ে বারটায় তাইসরয়ের ডাকোটা বিমান নন্দীগ্রামে অবতরণ করল। তার সঙ্গে রয়েছে বাংলার গভর্ণর রােদর ফোর্ড এবং তিনজন সামরিক অফিসার। তাঁরা সর্বপ্রথম কামান ও মেশিনগানের আড়াল থেকে নন্দীগ্রামের বিধ্বস্ত বিরান এলাকা পরিদর্শন করলেন, জলাশয়ে মানুষের মাথার খুলি এবং গবাদি পশুর কংকাল দেখলেন। তারপর কাছাকাছি অবস্থিত একটি লঙ্গরখানা দেখতে গেলেন। লঙ্গরখানাটি কিছুক্ষণ পূর্বেই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়েছে। কয়েকটি ছােট ছেলেমেয়ে ভাইসরয়কে ফুলের তােড়া উপহার দিল। লঙ্গরখানার সুপারভাইজার সেদিনের থানার নমুনা প্রদর্শন করল, যার মধ্যে রয়েছে ভাত, মাছ ও দই। খাদ্য দ্রব্যের মজুদ দেখানাে হল। কয়েকজন বৃদ্ধা মহিলা হাতজোড় করে ভাইসরয়কে সালাম করল এবং তাকে গরীবের মা-বাপ’ বলে দোয়া করল। এরপর খাদ্যশস্য সহকারী এজেন্ট ভাইসরয়কে অবহিত করল যে, তামলুক সাবডিভিশনের বিভিন্ন গুদামে এক লাখ বিশ হাজার মন ধান মজুদ আছে। লাঞ্চের সময় হওয়ায় তারা সবাই ডাকোটার কাছে চলে গেল। একজন অফিসার বিমান থেকে একটি বড় সড় পিকনিক বাক্স বের করল, নারকেল গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে তারা ডিম, চিকেন রােস্ট, শুয়রের মাংসের স্যান্ডউইচ, পেস্ট্রি খেল এবং তারপর ঠান্ডা বিয়ার পান করল। একজন অফিসার খানিকটা বিরক্তির সাথেই আমাকে একটি ডিম ও পেস্ট্রি খেতে বলল। আমি রমজানের রােজা ছিলাম বিধায় ক্ষমা চেয়ে নিলাম।
লাঞ্চ শেষে ভাইসরয় রেওয়াজ অনুযায়ী আমার কাছে জানতে চাইলেন, জনগণের কল্যাণে আমার কোন প্রস্তাব আছে কিনা। আমি সুবর্ণ সুযােগ মনে করে বললাম, আমার সাবডিভিশনে এজেন্টের গুদামে যে সােয়া লাখ মন ধান মজুদ রয়েছে তার অন্তত অর্ধেক ক্ষুধার্ত জনগণের মধ্যে খয়রাতি সাহায্য হিসাবে বন্টন করা হােক। প্রস্তাব শুনে ভাইসরয়ের সঙ্গীদের মুখ কালাে হয়ে গেল-গভর্ণর ফোর্ড তীক্ষ্ণ বাঁকা চোখে আমার দিকে তাকালেন। ভাইসরয় নিজে শুষ্ক-শীতল চোখে নীরবে তাকিয়ে রইলেন। অন্যান্য অফিসাররা একধাপ এগিয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য এবং ক্রোধের ভঙ্গিতে ঘাড় উঁচু করে দাঁড়ালেন। এরপর ভাইসরয় ও তার দলবল তামলুক থেকে বিদায় নিয়ে
৫১
চলে গেলেন।
কয়েক মাস পর হঠাৎ আরেকটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিল। সামুদ্রিক জলােচ্ছাসে তামলুকের দুই নদীর মাঝে অবস্থিত আট-দশ গ্রামের একটি এলাকা প্লাবিত হল। ঘর-বাড়ী বিধ্বস্ত হল। মানুষ না খেয়ে মরতে শুরু করল। নদীর স্রোত প্রবল থাকায় বাইরে থেকে রসদ পৌছানাে গেল না। সেই এলাকার একটি গুদামে আট হাজার মণ ধান মজুদ ছিল। আমি প্রাদেশিক সরকারের কাছে কিছু পরিমাণ ধান দুর্গতদের মধ্যে বিতরণের অনুমতি চেয়ে টেলিগ্রামের পর টেলিগ্রাম করলাম। কিন্তু কোন উত্তর পাওয়া গেল না। একদিন গুদামের আশপাশে দু’জন মহিলা এবং তিনটি বাচ্চার লাশ পাওয়া গেল। আমি আর অপেক্ষা না করে কংগ্রেস, মুসলিম লীগ ওফরওয়ার্ড ব্লক থেকে একজন করে প্রতিনিধি নিয়ে পুলিশের সহায়তায় গুদামের তালা ভেঙ্গে ফেললাম এবং অর্ধেক ধান তাদের মাধ্যমে বন্টন করলাম।
উক্ত কমিটিতে আমি ইচ্ছা করেই হিন্দু মহাসভার প্রতিনিধি রাখিনি। মহাসভা নেতা শ্যামা প্রসাদ মুখার্জি এতে ক্ষিপ্ত হয়ে কলকাতার পত্রিকাগুলিতে আমার বিরুদ্ধে কড়া বিবৃতি দিলেন।
গুদামের এজেন্ট মেদনীপুর কোর্টে আমার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করল। প্রাদেশিক চীফ সেক্রেটারী আমার উপর সরকারের অবিশ্বাস, অসন্তোষ ও অনাস্থার কথা জানিয়ে চিঠি দিলেন এবং আমার চাকরি বিহার সরকারের কাছে ফেরত দেওয়া হল। বিহারের চীফ সেক্রেটারী আমাকে টেলিগ্রাম মারফত জানিয়ে দিলেন, আমার চাকরি (সম্ভবতঃ শাস্তিস্বরূপ) বিহারের পরিবর্তে উড়িষ্যা সরকারের কাছে ন্যস্ত করা হয়েছে।
মেদিনীপুরের পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে ও তত্ত্বাবধানে রাতের মধ্যেই তামলুক থেকে আমার বিদায় অতি গােপনীয়তার সঙ্গে সমাধা করা হল ঠিক যেমন লর্ড ওয়াভেল কয়েকদিন পূর্বে তামলুক সফরে এসেছিলেন। পরদিন সকালে কংগ্রেস, মুসলিম লীগ, ফরওয়ার্ড ব্লকের কর্মীরা আমার বদলির আদেশের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করল। আমাকে রাত্রেই পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে জেনে তারা বাংলােয় হামলা করে বসল। দোহাই দিয়ে নিজেদের কাছে রেখে বাকী মালামাল কয়েকদিন পর আমার কাছে উড়িষ্যায় পাঠিয়ে দিল।
৫২

ডেপুটি কমিশনারের ডায়রী
কয়েকটি সাক্ষাৎকার

‘যারা ডেপুটি কমিশনারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চান, তারা সােমবার ও বৃহস্পতিবার সকাল নয়টা থেকে ১২টা পর্যন্ত বিনা বাধায় চলে আসতে পারেন।’
‘বিনা উদ্দেশ্যের সাক্ষাৎপ্রার্থী এবং সুপারিশ শিকারী ব্যক্তিগণ দয়া করে আসবেন না।’
ডেপুটি কমিশনার হিসেবে আমি প্রথমেই উক্ত দুটি বিজ্ঞপ্তি আমার কার্যালয়ের সামনে টানিয়ে দিই। আমার বিজ্ঞপ্তির সরল- সােজা অর্থ অনেকেই বুঝতে পারেনি বলে মনে হল। কারণ প্রথম প্রথম যারা সাক্ষাৎ করতে এসেছিল, তাদের অধিকাংশই পেশাদার সাক্ষাৎপ্রার্থী ও সুপারিশ প্রত্যাশী ছিল। ক্রমান্বয়ে অবস্থার পরিবর্তন হয়। আস্তে আস্তে শহরের প্রকৃত সমস্যাগ্রস্ত লােকজন আসতে শুরু করে। তারপর শহরতলী ও কাছাকাছি গ্রামের লােকজন এবং শেষ পর্যন্ত দূর-দূরান্ত থেকে প্রায় সব শ্রেণীর মানুষ সাক্ষাতের জন্য আসতে লাগল। প্রথম দিকে এদের সংখ্যা ছিল পনের-বিশ-এর মতাে। দু’মাসের মধ্যে এই সংখ্যা একশ’ এবং আরও কিছুদিন পর তা বাড়তে বাড়তে তিন-চারশ’র মতাে হয়ে গেল।
প্রথমে দু’জন ক্লার্ক একটি রেজিস্টারে সাক্ষাৎপ্রার্থীদের নাম-ধাম লিখে নিত, তারপর সে অনুযায়ী তাদের ডাকা হত। এই দীর্ঘ সাক্ষাৎ গ্রহণ আমার জন্য ধৈর্য্যের পরাকাষ্ঠা বলে প্রতিভাত হল। কিন্তু, সত্যি বলতে গেলে সাক্ষাৎকারের সেই অবিস্মরণীয় দিনগুলিই আমার সমগ্র চাকরি জীবনের আসল সম্পদ।
এমনিতেই একজন ডেপুটি কমিশনারের পক্ষে যথাসাধ্য নিয়মনিষ্ঠ জীবন যাপন করা অপরিহার্য। জনগণের সঙ্গে তার সরাসরি সম্পর্কের সুযােগও লেগে থাকে। এদের মধ্যে যেমন আছেন ম্যাজিস্ট্রেট, নাজির, পেশকার, তহশিলদার, পাটওয়ারী প্রমুখ সরকারী কর্মচারী তেমনি আছেন উকিল ও মােক্তার। আরেক শ্রেণীর লােকও রয়েছেন, যারা ডেপুটি কমিশনারের প্রাণ ভাজা ভাজা করে ছাড়েন। তাছাড়া আছে শহরের ‘এলিট’-গণ্যমান্য লােক, আর গ্রামের ‘শাসক’-জমিদারগণ। এরা আসেন নানা তদবীর আর সুপারিশ নিয়ে, যার বেশির ভাগই বৈধ বা ন্যায্য নয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এরা নির্ধারিত তারিখ সােমবার বা বৃহস্পতিবারে আসেন না, কেননা, সেটা তাদের জন্য শােভন বা মর্যাদার উপযােগী নয়।
একবার গ্রাম থেকে এক বড় জমিদার আমার সাথে দেখা করতে এলেন। বিশ হাজার একরের ওপর তার জমি। জেলা সদরেও বেশ কয়েকটি চমৎকার বাংলাে
৫৩
রয়েছে তাঁর। মাসে দু’একবার তিনি জেলা প্রশাসকের সাথে দেখা করার জন্য পঞ্চাশ-ষাট মাইল দূর থেকে শহরে আসেন। সে সময় তার সাথে আসে পাইক, পেয়াদা, আর্দালি ও কর্মচারীদের বিরাট এক বাহিনী। শিকার করা আর কুকুর পালা তার প্রিয় খেলা। তাঁর নাচ-গান ও নারী সংসর্গ প্রিয়তা ‘আলিফ লায়লা’র কাহিনীর সাথে তুলনীয়। তাঁর বাংলাের সামনে সারি সারি ঘােড়া, কুকুর, বন্দুক আর লােক-লস্কর দেখে মনে হবে, কোন মােগল শাহজাদা বিদ্রোহী হয়ে রাজধানী দখল করতে যাচ্ছে।
এরা নিজেদের এলাকায় কেবল জমিদারিই করত না, আইন-শৃংখলা ও বিচার-আচারসহ জীবন্যাত্রার প্রায় সবকিছু নিয়ন্ত্রণও করত। এদের অনুমােদন ছাড়া মামলা-মকদ্দমা থানায় গ্রহণ করা হত না। কোন দরখাস্ত এদের সুপারিশ ছাড়া সামনে এগুত না। এক কথায়, সরকারী আমলা ও জনগণের মাঝে এই জমিদাররা ছিল চীনের প্রাচীরের মতাে। আমি প্রচলিত নিয়ম ভঙ্গ করে যখন এই প্রাচীর ভেদ করে জনগণের সঙ্গে কিছুটা সরাসরি সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা চালালাম, তখন এরা বিচলিত হয়ে পড়ল। কেউ কেউ বললে ‘অপ্রাপ্ত বয়স্ক যুবক, অভিজ্ঞতা কম। দু’চার দিনেই আমাদের সামনে মুখ থুবড়ে পড়ে যেতে বাধ্য হবে। অন্য দু’একজন এই বলে হুমকিও দিল, ‘আমরাও মাটির ঢেলা নই। তাঁর এই তালসুলভ ব্যবস্থাকে এক ফুৎকারে মাকড়সার জালের মতাে ছিন্ন ভিন্ন করে ছাড়ব।
আমি কিন্তু আমার কাজ নির্ভয়ে আগের মতােই চালিয়ে যেতে লাগলাম। গ্রামের সাক্ষাৎপ্রার্থীর সংখ্যা এতই বেড়ে গেল যে, এক সুযােগসন্ধানী লােক ‘সাক্ষাৎপ্রার্থীর হােটেল’ নামে একটি হােটেল খুলে দিল। দূরের লােকদের অনেকেরই শহরে পৌঁছতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে যেত। তারা ঐ হােটেলে রাত কাটিয়ে খুব ভােরে রেজিস্টারে নাম লেখাত। আমি প্রত্যেকের সমস্যার কথা শুনে আর একটি রেজিস্টারে লিখে নিতাম এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে ডেকে সাথে সাথে সমাধানের ব্যবস্থা করতাম। যদি মহকুমা বা থানা পর্যায়ের কোন অফিসারের রিপাের্ট কোন দরখাস্তের ব্যাপারে প্রয়ােজনীয় মনে করতাম, তবে দরখাস্তের ওপর সাক্ষাতের পরবর্তী তারিখ লিখে দিতাম। যথাসময়ে সংশ্লিষ্ট অফিসারের রিপাের্ট সগ্রহ করে পরবর্তী তারিখে ফয়সালা করে দিতাম। কখনাে-কখনাে কোন দরখাস্তকারীকে সঙ্গে নিয়ে সরাসরি তার এলাকায় চলে যেতাম এবং সংশ্লিষ্ট অফিসারের সঙ্গে পরামর্শক্রমে সমস্যার সমাধান দিয়ে দিতাম। কিছু কিছু লােক এমন সব ব্যক্তিগত নালিশ নিয়ে হাজির হত, যার সমাধান আমার হাতে ছিল না। যেমন ঃ
* এক পতিতা নালিশ করল যে, তার প্রতিবেশী রাতের বেলা অর্ধ নগ্ন হয়ে সকলের সামনে হাটাচলা করে এতে তাদের ভদ্রপাড়ার সুনাম ক্ষুন্ন হচ্ছে।
* এক বুড়ি বলল, তার পুত্রবধু তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করছে।
৫৪
* একদিন আরেক বুড়ি কেঁদে কেঁদে বলল, তার কিছু জমি আছে। জমির ওপর নামজারি করতে গেলে পাটওয়ারি ঘুষ ছাড়া কিছুতেই নামজারির কাজ করে দিতে রাজি হয় না। তিন চার বছর ধরে সে কয়েক রকমের অফিসে যােরাঘুরি করেছে, কিন্তু কেউই তার কথা শােনে না। তার এত টাকা নেই যে ঘুষ দিতে পারে। আমি বুড়িকে সঙ্গে নিয়ে ঝং শহর থেকে ষাট মাইল রাস্তা পাড়ি দিয়ে সেই পাটওয়ারিকে গিয়ে ধরলাম। ডেপুটি কমিশনারকে নিজেদের গ্রামে দেখতে পেয়ে লােক জমা হয়ে গেল। পাটওয়ারি ঝটপট যুজদান দিয়ে ঢাকা এক খন্ড কোরান শরীফ মাথায় তুলে বলল, ‘হুজুর এই বুড়ি ডাহা মিথ্যে কথা বলছে, আমি কোন ঘুষ চাইনি। কোরান ছুঁয়ে বলছি, ভীড় থেকে এক যুবক বলল, “স্যার, যুজদানটিও একবার খুলে দেখতে পারেন।’
আমি যুজদানটি খুললাম। ওমা! কোরান শরীফ নয়, তার অফিসেরই একটি রেজিস্টার। এরপর পাটওয়ারি আমার আদেশ মতাে আরেকটি রেজিস্টার এনে বুড়ির নামজারির কাগজপত্র প্রস্তুত করে দেয়।
আমি বুড়িকে বললাম, “বুড়ি মা, তােমার কাজ হয়ে গেছে, এখন খুশী তাে? সে আমার কথা বিশ্বাস করল না। আমার আর্দালির কাছে জিজ্ঞাসা করল, “সত্যিই আমার কাজ হয়ে গেছে?’ আর্দালি হ্যা সূচক জবাব দিলে বুড়ির আনন্দ আর ধরে না, চোখ থেকে আনন্দাশ্রু গড়িয়ে পড়তে শুরু করে। তার দুই আঁচলের কোণে কিছু রেজকি পয়সা বাঁধা ছিল। গুণে গুণে ঠিক মােল আনা হাতের মুঠোয় করে, কেউ যাতে দেখতে না পায় এমন ভঙ্গিতে আমার পকেটে খুঁজে দিল। এই সরল ঘুষদান পদ্ধতির গুরুত্ব অনুধাবন করে আমার কান্না পেল।
এই ‘ষােল আনা পয়সাই আমার সারা চাকরি জীবনের একমাত্র ‘ঘুষ’ যা আমি গ্রহণ করেছি। পর্বতসমান স্বর্ণও এর কাছে তুচ্ছ। সেই ‘ষােলা আনা’ আমি এখনাে সযত্নে রক্ষা করে চলেছি। আমি মনে করি, এই সেই পবিত্র উপহার যা আমার সারা জীবন আনন্দে পূর্ণ করে রেখেছে।
* একবার রহমত এলাহি নামে, প্রাইমারি স্কুলের একজন শিক্ষক আমার কাছে এলেন। তিনি কয়েক মাস পরেই চাকরি থেকে অবসর নেবেন। তিনটি যুবতী মেয়ে রয়েছে তার। থাকার জন্য নিজের কোন ঘরবাড়ী নেই। পেনশনও খুবই কম পাবেন। অবসর জীবনে কোথায় থাকবেন, মেয়েদের কিভাবে বিয়ে দেবেন, ভরণ-পােষণই বা কিভাবে চালাবেন-এসব দুশ্চিন্তা তাকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলল। এই অবস্থায় তিনি কয়েক মাস ধরে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ে কান্নাকাটি করে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ জানালেন। একটু এগিয়ে এসে আমার কানে কানে বললেন, কয়েকদিন আগে স্বপ্নে আমি রসুলে করিমের (দঃ) মােলাকাত লাভ করি। তিনি আমাকে আদেশ করেছেন যে,
৫৫
ঝং শহরে গিয়ে আমি যেন ডেপুটি কমিশনারকে আমার দুশ্চিন্তার কথা জানাই।
শুনে আমি ভাবলাম, লােকটি মিথ্যা স্বপ্নের কথা বলে আমার ধর্মীয় অনুভূতিকে ‘ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টা করছে। আমার চেহারায় সন্দেহের ভাবভঙ্গি দেখে তিনি আবার বলতে লাগলেন, ‘জনাব, আমি মিথ্যা বলছি না। মিথ্যাই যদি বলব, তবে আল্লাহর নামেই বলতাম, রসুল (দঃ)-এর নামে বলব কেন? আপনি কি সেই আপ্ত বাক্যটি শােনেননি,-আল্লাহর নামে অজ্ঞান হও, আর রসুলের নামে সাবধান হও।’
আমার সন্দেহ পুরােপুরি না ঘুচলেও, তিন সপ্তাহ পরে তাকে আবার আমার সঙ্গে দেখা করার কথা বলে বিদায় দিলাম। ইতিমধ্যে গােপন সূত্রের মাধ্যমে আমি তার স্বভাব-চরিত্র সম্পর্কে অনুসন্ধান করে জানতে পারলাম, তিনি একজন সত্যবাদী, চরিত্রবান ও ধার্মিক ব্যক্তি বলে সুপরিচিত। তার পারিবারিক অবস্থাও তার বর্ণনার অনুরূপ। সেকালে প্রাদেশিক সরকার কিছুদিনের জন্য সরকারের অনাবাদী খাস জমি বন্টনের দায়িত্ব ডেপুটি কমিশনারদের ওপর ন্যস্ত করেছিলেন। আমি ল্যান্ড অফিসারকে ডেকে অনতিবিলম্বে চাষাবাদের আওতায় আনা যায় এমন চার কোন বিশিষ্ট এক খন্ড জমি খুঁজে বের করার কথা বললাম। তিনি আমার কোন আত্মীয় ভেবে একেবারে সড়কের কাছাকাছি একখন্ড আধা-আবাদী খাস জমি রহমত এলাহির নামে এ্যালটমেন্ট দিয়ে কাগজপত্র আমার হাতে দিলেন। তিন সপ্তাহ পর রহমত এলাহি পুনরায় এলে এই কাগজপত্র আমি তার হাতে দিই এবং ল্যান্ড অফিসারের কাছ থেকে দখল নিতে বলি।
প্রায় নয় বছর পর, আমি যখন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের সচিব ও করাচীতে কর্মরত, তখন আমার নামে মােটা ১টি রেজিস্ট্রি চিঠি আসে। খুলে দেখি রহমত এলাহির চিঠি। তিনি লিখেছেন, ঐ জমি চাষাবাদ করে তিনি তিন-তিনটি মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন, থাকার জন্য জমি কিনে সেখানে বাড়ি করেছেন, গত বছর স্বামী-স্ত্রী দু’জন হজ্ব করে এসেছেন। এখন তিনি খুব ভালভাবে জীবন যাপন করছেন, সরকারের খাস জমিটি তার আর দরকার নেই। অন্য কোন অভাবগ্রস্ত লােকের নামে বন্দোবস্ত দেয়ার সুবিধার্থে এই চিঠির সঙ্গেই জমির সমুদয় কাগজপত্র পাঠানাে হল।
চিঠিটি পড়ার পর অনেকক্ষণ ধরে আমার মুখ দিয়ে কোন কথাই সরল না।
* এক পতিতা একদিন আমার কাছে অভিযােগ করল, যে-বাড়িটিতে সে বার বছর ধরে আছে, মিউনিসিপ্যালিটির লােক এসে নােটিশ দিয়ে গেছে, সেটি ছেড়ে দেওয়ার জন্য।
কোন কারণ নিশ্চয়ই আছে।
– কোন কারণ নেই, সরকার-পানিপথের এক রিফিউজি’ সম্প্রতি আমাদের পাড়ায় এসে উঠেছে। সে মিউনিসিপ্যালিটিকে বলেছে, আমাকে উঠিয়ে না দিলে তার বিবি,
৫৬
বাল-বাচ্চার ওপর খারাপ প্রভাব পড়বে।
-বাড়িটা কার?
-আমার, সরকার। লালা শংকর দাস খুশী হয়ে আমাকে লিখে-পড়ে দিয়েছে।
-কাগজপত্র আছে?
-আছে, সরকার। বলেই সে কাগজের বান্ডিল খুলে দেখায়। তারপর বলে, ‘পাই পাই। করে আমি হজ্বে যাওয়ার জন্য টাকা জমা করেছি। লটারিতে নামও উঠেছে। আমি হজ্বে গেলেই, আমার অনুপস্থিতিতে রিফিউজিটা মিউনিসিপ্যালিটির যােগসাজশে আমাকে বাড়ি থেকে বেদখল করবে। হজ্র অফিসে হাজিরার তারিখ পড়েছে। এখন আমি যদি না যাই, গুণাহর ভাগী হবে কে?’
মেয়েটির কথা শুনে আমি তাজ্জব বনে গেলাম। একটি খারাপ চরিত্রের মেয়ে, সমাজে যার পতিতা বলে পরিচয়, হজে যাওয়ার জন্য ডাঙ্গার মাছের মতাে ছটফট করছে। আল্লাহ ও রসুলের কোনাে আইন তার হজ্বে যাওয়াকে বারণ করছে না, কিন্তু মিউনিসিপ্যালিটির আইন তার ঘর ছিনিয়ে নিতে পারে। তার ঘর চলে যাওয়ার ভয়ে সে হজে যেতে পারবেনা,যদি দশ জন নামাজী-মােত্তাকী হজে না যায়, তবে বেহেশতের আবাদি কমবে না, কিন্তু একজন বেশ্যা হজ্বে গিয়ে তওবা করে ফিরে আসলে দোযখের আগুন নিতে যাবে কেন?
আমি উঠে অন্য কামরায় গিয়ে টেলিফোনে এস,পি, সাহেবের সঙ্গে কথা বললাম। ফিরে এসে তাকে বললাম, তুমি অবশ্যই হছে যাবে। তােমার বাড়ীতে কেউ হাত দিতে পারবে না। তােমার অনুপস্থিতিতে পুলিশের লােক বাড়িটি পাহারা দেবে।
-‘খােদা সরকারকে শান্তিতে রাখুক’-বশিরন আমাকে দোয়া করল।
* একবার আবদুল্লাহ নামে এক সাক্ষাপ্রার্থী সালাম দিয়েই বলল যে, ‘শুনলাম, আপনার বাড়ি নাকি জম্মু, আমার বাড়িও এক সময়ে সেখানে ছিল। ব্যস, চলে এলাম- দেশী লােকের দেখা পাব, শহরও দেখা হবে। আমার আর অন্য কোন উদ্দেশ্য নেই। তাকে বসতে বললাম, তারপর নানা প্রশ্ন করে যা জানলাম তাতে আমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত কেঁপে উঠল।
জম্মুতে আবদুল্লাহ দালানের রঙ লাগাবার কাজ করত। তিনটি মেয়ে রেখে স্ত্রী হঠাৎ মারা যায়। নয় বছরের জোহরা, বার বছরের আতিয়া ও ষােল বছরের রাশেদা। ১৯৪৭ সালের অক্টোবরে মহারাজা হরি সিং যখন আমুর মুসলিম আবাদিগুলাে নিজের দখলে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিল, তখন মুসলিম পরিবারগুলােকে প্রথমে পুলিশ লাইনে এনে জড়াে করা হত। তারপর পাকিস্তানের শিয়ালকোট বর্ডারে নামিয়ে দেয়ার কথা বলে তাদের বাসে, ট্রাকে উঠিয়ে দেয়া হত। রাস্তায় রাষ্ট্রীয় সেবক সংঘের গুন্ডারা এবং শিখ
৫৭
হায়েনারা বাস ও ট্রাকগুলি থামিয়ে যুবতী মেয়েদের ছিনিয়ে নিত এবং যুবকদের হত্যা করত। বুড়াবুড়ি আর বাচ্চা-কাচ্চাদের পাকিস্তানে পাঠিয়ে দিত। এই খবর জম্মু শহরে সকলের মুখে মুখে ফিরতে ফিরতে আবদুল্লাহর কানেও এসে পৌঁছল। সে তার তিন মেয়ের কথা ভেবে পাগলের মতাে হয়ে গেল। সে একটি চরম পরিকল্পনা তৈরী করল। গােসল করে মসজিদে দু’রাকাত নামাজ পড়ে নিল। বাজার থেকে একটি ধারাল ছুরি কিনে আনল। মেয়েদের ডেকে ‘নারীর ইজ্জত’ বিষয়ে এবং ইবরাহীম (আঃ)-এর সুন্নত সম্পর্কে জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা দিল। জোহরা ও আতিয়া বাপের কথায় রাজী হয়ে যায়। তারা নববধূর মতাে সেজে হাসতে হাসতে দরজার চৌকাঠের ওপর মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। আবদুল্লাহ চোখ বন্ধ না করেই ছুরি দিয়ে পর পর দু’জনের মাথা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। দুর্ঘটনাক্রমে সেদিন আসমান থেকে কোন দুষা নেমে আসল না কাজেই জোহরা ও আতিয়াকে মরতে হল। তাদের তাজা রক্তস্রোতে আবদুল্লাহর মাটির কুটির ভাসতে লাগল। রক্তমাখা ছুরি হাতে নিয়ে আবদুল্লাহ এবার রাশেদাকে ডাকল। তার শরীর থর থর করে কাঁপছে। ধীর পদবিক্ষেপে এগিয়ে এসে সে বাপের পায়ের ওপর লুটিয়ে পড়ল। গর গর আওয়াজ করে কিসব বকছে সে। যদি সে কিছুমাত্র লেখাপড়া জানত, তবে বলতে পারত ‘আমি কোন পয়গম্বর কন্যা নই, আর তুমিও পয়গম্বর নও বাবা। কেননা, আমাদের ধর্ম অনেক আগেই পরিপূর্ণতা পেয়েছে। তাহলে তােমার এত কিসের গরজ পড়েছে, আমার মাথা কেটে সুন্নত পুরা করার?
রাশেদার গর গর আওয়াজ ও ‘আব্বা’ ‘আব্বা চিৎকার শুনে আবদুল্লাহর পাও কেঁপে উঠল। হাত থেকে ছুরি ফেলে দিল সে। রাশেদাকে কুশ্রী এক বুড়ির চেহারায় সাজিয়ে নিল। তারপর কালেমা আওড়াতে আওড়াতে তাকে নিয়ে ট্রাকে চড়ে বসল। ট্রাক তাদের বর্ডারে নামিয়ে দিতেই তারা কাটাতারের বেড়া ডিঙিয়ে পাকিস্তানে প্রবেশ করল। আর তখনই আবদুল্লাহর মনে পড়ে গেল জোহরা ও আতিয়ার কথা। রাশেদার গলা জড়িয়ে আবদুল্লাহ অনেকক্ষণ ধরে কাদল।
শিয়ালকোটের মােহাজের ক্যাম্পে আসার পর রাশেদার চুলের বেনী সাপের মতাে লকলক করতে লাগল। কালাে ডাগর দুটি চোখ ঝকমক করতে লাগল। কিছুদিনের মধ্যেই আবদুল্লাহ বুঝতে পারল, ঝকমকে এই সৌন্দর্য একদম ঝুটা, কীটদষ্ট,-আগের মতাে পবিত্র নয়। একদিন সে নিজের চোখেই দেখল, যে-ইজ্জত সে প্রাণ বাজি রেখে রাষ্ট্রীয় সেবক সংঘ ও শিখ গুন্ডাদের থাবা থেকে বাঁচিয়ে নিয়ে এসেছে, আল্লাহর রাজ্য পাকিস্তানে তা খােলা বাজারে বিক্রি হচ্ছে। রাশেদা এখন প্রায় রাত ১২টার দিকে ক্যাম্পে ফেরে। তার আঁচলে থাকে ফল, মিষ্টান্ন, রঙিন পােশাক, পাউডার, ক্রিম ইত্যাদি এবং নানা জিনিসের রঙ-বেরঙের প্যাকেট। মার খেতে খেতে দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়
৫৮
রাশেদার। মারতে মারতে আবদুল্লাহও এক সময় ক্লান্ত হয়ে পড়ে, রাশেদার গলা টিপে মারতে উদ্যত হয়। ঠিক তখনি তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে জম্মুর রক্তাক্ত চৌকাঠ-যেখানে পড়ে আছে জোহরা ও আতিয়ার খন্ডিত মাথা। রাশেদাকে ছেড়ে দিয়ে উঠে দাড়ায় আবদুল্লাহ। ক্যাম্পের এক প্রান্তে গিয়ে বাকী রাত বসে বসে কাদতে থাকে।
একদিন রাশেদা এক যুবকের হাত ধরে রাতের আঁধারে ক্যাম্প থেকে উধাও হয়ে যায় এবং আবদুল্লাহকে রােজকার যন্ত্রণা থেকে চিরতরে মুক্তি দেয়। আবদুল্লাহও ক্যাম্প ছেড়ে দেয়। প্রথমে গুজরাটে, তারপর লায়ালপুরে এবং শেষে এই ঝং-এ এসে বসবাস শুরু করে।
* ঝং-এ এসে খবর পেলাম সাদত হাসান মান্টো খুব অসুস্থ। তার সঙ্গে আমার পুরনাে বন্ধুত্ব ছিল। তাকে দেখার জন্য লাহােরে গেলাম। লিভারের রােগ, কোন ওষুধে কাজ হচ্ছে না; কারণ মদ পান করা থেকে বিরত হচ্ছেন না তিনি। ডাক্তার বলে দিয়েছেন, মুখের কাছে মদ না নিলে তার ওষুধে কাজ হবে। আমি বেগম মান্টোর অনুমতি নিয়ে তাকে আমার গাড়িতে করে ঝং-এ নিয়ে আসি। প্রথম দু’তিন দিন বেশ ফুর্তিতে কাটল। শহর ছেড়ে দূর গ্রামাঞ্চলে চলে যেতাম আমরা। রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে তিনি গােসলও করে নিতেন। কিন্তু চতুর্থ দিন তাঁর ‘মুড’ একেবারে বিগড়ে গেল। বিরক্তির সুরে বলতে লাগলেন-এটাকি কোনাে ঘর হল, না গ্রাম হল, কোন বান্ধব। নেই, না সাক্ষাৎপ্রার্থী; না আছে শােভা না সভা-তওবা, তওবা, একেবারে বেহুদা জায়গা।
– ‘আমি ওয়দা করলাম, আগামীকাল এমন এক জায়গায় নিয়ে যাব যেখানে আপনার ভাল লাগবে।’ তিনি চুপ থাকলেন। সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে দেখি ঘর খালি। আর্দালি বলল, মেহমান লাহাের চলে গেছেন। ঝং তার ভাল লাগবে কেন? তিনি তাে ফয়েজ আহমদ ফয়েজের এই চরণে বিশ্বাসীআসুক মেঘ, চলুক শরাব প্রাণ ভরে।
যা কিছু আজাব আসুক না তার পরে।
* ঝং-এর দুই জমিদারের কথা বলি। এদের একজন আমার অফিসে এসে একদিন সাক্ষাৎ করলেন। নিজে লেখাপড়া কিছুই জানে না, কিন্তু প্রথমেই শিক্ষার মহায্যের ওপর এক বক্তৃতা ঝাড়লেন। তারপর বিনীতভাবে বললেন, ‘জনাব অমুক গ্রামে একটি প্রাইমারি স্কুল স্থাপন করলে গ্রামবাসীর খুব উপকার হয়। আপনার যদি অনুমতি থাকে, তবে এই অধম স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য বিনামূল্যে জমি দান করতে প্রস্তুত। ঘর তৈরীর জন্য নগদ বিশ হাজার টাকা প্রদানসহ একজন শিক্ষকের বেতনও এই বান্দা বহন করবে।
৫৯
আমি প্রস্তাবটি গ্রহণ করলাম এবং পরে সময় মতাে তাকে খবর দেয়া হবে বলে বিদায় দিলাম। ঠিক এক সপ্তাহ পর আরেক জমিদার সাক্ষাৎ করতে এলেন। তিনি আমার রুমে ঢুকেই বলতে শুরু করলেন, “জনাব আমি এমন কি অপরাধ করেছি যে এতবড় শাস্তিটা দিচ্ছেন। এই বান্দাতাে সম্পূর্ণ নিররাধ।’
আমার হতবুদ্ধি হওয়ার পালা। বললাম, কি হয়েছে খুলে বলুন। তিনি বললেন ‘গত সপ্তাহে স্কুল প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব নিয়ে যে ব্যক্তি আপনার সঙ্গে দেখা করে গেছে, সে স্কুলটি আমার গ্রামে প্রতিষ্ঠা করবে, তার নিজের গ্রামে নয়। আমাদের দুজনের মধ্যে বংশ পরস্পরায় শত্রুতা চলে আসছে। আমরা একজন আরেকজনের গবাদি পশু, ফসলাদি চুরি করাই, ক্ষেতের ধান কেটে আনি, মানুষ হত্যা করাই। সে আমার সাথে কোন কিছুতেই না পেরে শেষে এই ফন্দি এঁটেছে। আমার গ্রামের ছেলেমেয়েদের রক্তে শিক্ষার বিষ ঢুকিয়ে আমাকে পরাজিত করতে চাচ্ছে।’
এবার বুদ্ধি লােপ পাওয়ার পালা। আমি তাকে বললাম, আপনি ইটের জবাব পাথর দিয়ে দিচ্ছেন না কেন? তিনি যে বােঝা কাঁধে নিয়েছেন, আপনিও সে রকম একটি বােঝ কাধে তুলে নিন-স্কুল প্রতিষ্ঠার ব্যয় বহন করুন। আমি কথা দিচ্ছি, তার গ্রামেও একটি স্কুল চালু করে দেব এবং একই সময়ে।’
বহুদিন গত হয়েছে, তাদের দুজনের কেউই আর ফিরে আসেননি। পরে শুনেছি, শিক্ষার বিষ উভয় গ্রামেই ঢুকে যাবে মনে করে তারা দু’জনে আপসে মিলে গিয়েছেন।
৬০

আই,সি,এস, থেকে ইস্তেফা

জেনারেল ইয়াহিয়া খানের ক্ষমতা লাভের পর পরিবর্তিত অপ্রিয় পরিস্থিতির কারণে আমি আই,সি,এস (সি,এস,পি)-এর চাকরি থেকে ইস্তেফা দিই। আমার চাকরির মেয়াদ তখনাে আট-নয় বছর বাকী ছিল। সিভিল সার্ভিসের চাকরি আমার প্রথম থেকেই ভাল লাগছিল না। এর আগেও তিন-তিনবার জীবনহীন, জীবনের রূপ-রস-গন্ধহীন এই চাকরির শিষমহল থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম; কিন্তু কামইয়াব হইনি।
প্রথমবারে যখন ইস্তফা দেই, তখন আমার আই,সি,এস-এর চাকরির বয়স দশ মাস। আমি বিহার প্রদেশের ভাগলপুর জেলায় এসিস্ট্যান্ট কমিশনার হিসেবে কর্মরত। তৃতীয় শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে বিচার-আচার পরিচালনা করা আর থানা-পুলিশের কাজ তদারকি করা ছিল আমার দায়িত্ব। আমার কোর্টে যেসব আসামী হাজির করা হত, তাদের অধিকাংশই রিকশা ও একা গাড়ী চালক, ফুটপাতের হকার এবং নিষিদ্ধ জায়গায় প্রস্রাবকারীর দল। আমার মনে হত, এরা খুবই নিরীহ এবং সামান্য অপরাধ বা অনিয়মের অভিযােগে এদের জবরদস্তি ধরে নিয়ে আসা হয়েছে। আমি এসব মােকাদ্দমায় বিশেষ গুরুত্ব দিতাম না। নাম কা ওয়াস্তে শুনানি করে কাউকে কাউকে অল্প-স্বল্প জরিমানা করে দিতাম, কাউকে কাউকে আদালত শেষ হওয়া পর্যন্ত আটকের আদেশ দিতাম এবং অধিকাংশকেই বিনা শাস্তিতে খালাস করে দিতাম। এতে কমিশনার ও সেশন জজ-দুজনেই আমার উপর নাখােশ হলেন এবং কয়েকবার তারা আমাকে লিখিতভাবে সাবধান করে দিলেন। অবশ্য থানা পরিদর্শন ও তদারকির কাজটি আমি যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে সমাধা করতাম এবং এ ব্যাপারে কমিশনার আমার উপর সন্তুষ্টই ছিলেন, কিন্তু এস,পি ছিলেন দারুণ খাপ্পা।
সে সময় সারা ভারতে ‘ভারত ছাড়’ (Quit India) আন্দোলন দানা বেঁধে উঠতে শুরু করেছে। ভাগলপুর জেলায় এই আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। কংগ্রেস নেতা ও কর্মীরা রেল লাইন, পুল, নৌকা, স্টিমার, ডাকঘর, টেলিগ্রাফ অফিল, ইতাদি আক্রমণ করে। কোথাও আগুন লাগিয়ে, কোথাও ভাংচুর করে একেবারে লন্ডভন্ড কাভ শুরু করে দেয়। প্রতিদিনই সন্ত্রাসী ঘটনার সংবাদ আসতে লাগল এবং একদিন সংবাদ আসল যে, সন্ত্রাসীরা একজন পুলিশ কনষ্টেবলকে হত্যা করে তার লাশ গাছের সঙ্গে টানিয়ে রেখেছে। সংবাদ পাওয়া মাত্র কমিশনার,কালেক্টর, ডি,আই,জি এবং এস,পি আমাকে আদেশ দিলেন ঘটনাস্থলে গিয়ে তদন্ত শেষে আসামীদের গ্রেফতার করে ভাগলপুরে নিয়ে আসতে।
আমি দফাদার রশিদ খানের নেতৃত্বে একদল সশস্ত্র ঘােড়সওয়ার পুলিশসহ
৬১
ঘটনাস্থলে যাই। পুলিশের এই দলটি ছিল পাঞ্জাব এবং সীমান্ত প্রদেশের মুসলমান দ্বারা গঠিত। হিন্দু-প্রধান এলাকার শান্তি-শৃংখলা রক্ষার ক্ষেত্রে ইংরেজরা এ ধরনের বাহিনী ব্যবহার করত। এ ব্যবস্থার মাধ্যমে তারা আম ছালা-দুটোর দামই ঠিকঠাক পেয়ে যেত। অর্থাৎ শান্তিও ফিরে আসত এবং হিন্দুদের মনে মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিংসাও জেগে উঠত।
গ্রামে পৌঁছে আমি তাবু খাটালাম তারপর স্থানীয় কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে যােগাযােগের চেষ্টা করলাম। সেখানকার এক স্থানীয় নেতা ছিলেন ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপ্রধান শ্রী রাজেন্দ্র প্রসাদের ছেলে। তিনি তার দলবলসহ আমার ক্যাম্পে আসলেন। প্রথমে তিনি স্বাধীনতার উপকারিতা সম্পর্কে বেশ কিছু বাছাবাছা উদ্ধৃতি আওড়ালেন। আমিও, সদ্য কলেজ পাস তরতাজা আই,সি,এস, অফিসার হিসাবে পরাধীনতার গ্লানি বিষয়ে দু’চার কথা না বলে পারলাম না। আমার বক্তব্য শুনে তারা যুগপৎ আনন্দিত ও বিস্মিত হল। তারা একবাক্যে বলতে লাগল যে, আই,সি,এস-এ আরাে অধিক সংখ্যায় আমার মতাে ধ্যান-ধারণার অফিসার থাকলে আজ হয়তাে কনষ্টেবল হত্যার প্রয়ােজনই হত না। আমি তাদের উদ্দেশ্যে বললাম, ‘হত্যাকারীকে চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হলে, আমার এই ধ্যান-ধারণার কোন মূল্য থাকবে না। কেননা সে অবস্থায় আমাকে প্রশাসন থেকে সরিয়ে দেওয়া হবে। তারা আমাকে সহায়তা করার আশ্বাস দিয়ে চলে গেল।
কিন্তু গ্রামে ফিরে গিয়ে রামানারায়ণ প্রসাদ দারুণ এক বােকামি করে বসল। আন্দোলন সম্পর্কে আমার সহানুভূতিশীল মনােভাবের কথা কংগ্রেস সমাবেশে প্রচার করে দিল-তাও বেশ বাড়িয়ে-চড়িয়ে। দেখতে দেখতে বিরাট এক মিছিল আমার ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হল। মিছিলের আগেভাগে দুটো হাতি, দশটি ঘােড়া, আর ঢােল-বাজনার পার্টিও রয়েছে। তারা কেবল ইংরেজের বিরুদ্ধেই শ্লোগান দিল না, আমাকে উদ্দেশ্য করে এ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার জিন্দাবাদ’ শ্লোগান দিল। ক্যাম্পের কাছে এসে মিছিলটি থেমে গেল। কয়েকজন যুবক এগিয়ে এসে মিছিলের লােকজনকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলার জন্য আমাকে পীড়াপীড়ি করল। একটি ছােট মেয়ে আমার গলায় গাঁদা ফুলের মালা পরিয়ে দিল। আমি বহু কষ্টে তাদের বােঝাতে সক্ষম হলাম যে, সরকারী চাকুরে হিসাবে মিছিলের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তারা পুনরায় শ্লোগান দিতে দিতে ঢােল বাজাতে বাজাতে চলে গেল।
এ খবর জেলা সদরে পৌছলে ঊর্ধ্বতন কর্তারা তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন। পরের দিন সকালে কালেক্টর, এস,পি, এবং সে সময় ভাগলপুরে উপস্থিত একজন ডি,আই,জি, (তিন জনই ইংরেজ) ওয়ারলেস ও মেশিনগানে সজ্জিত একটি জিপে চড়ে গ্রামে এসে পৌছলেন। তারা বার্মা শেলের পেট্রোল ভর্তি একটি ট্যাঙ্কারও নিয়ে এলেন। আমার সঙ্গে
৬২
কোন কথাবার্তা না বলে এবং আমার উপস্থিতি সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য ও উপেক্ষা করে তারা ক্যাম্পে প্রবেশ করলেন। তিনজনে মিলে পরামর্শ করতে লাগলেন যে পুরা গ্রামটি পেট্রোল দিয়ে জ্বালিয়ে দিতে হবে, পাশের গ্রামগুলাের ফসলও পুড়িয়ে দিতে হবে এবং এভাবেই ইংরেজদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার উচিত শাস্তি তারা হৃদয়ঙ্গম করতে সক্ষম হবে। তাদের এই ভয়ংকর সিদ্ধান্তের কথা শুনে আমি তাদের বিনীতভাবে স্মরণ করিয়ে দিলাম যে, আমিও এখানে উপস্থিত আছি এবং আলােচ্য বিষয়ে আমি আমার মতামত ব্যক্ত করতে আগ্রহী। শুনে ডি,আই,জি পিস্তলে হাত রেখে গর্জে উঠলেন, ‘শাট আপ, ইউ বাস্টার্ড-বেরিয়ে যাও, ওয়ারনা গুলী মার দুঙ্গা’ কালেক্টর এবং এস,পিও আমাকে অকথ্য ভাষায় গালি দিতে লাগলেন। আমি সেখানকার দায়িত্বে নিয়ােজিত ম্যাজিস্ট্রেট, আমার সঙ্গে আলােচনা না করে এখানে কোন পদক্ষেপ নেয়া যাবে না। আমি অটল রইলাম। এস,পি, উঠে এসে হঠাৎ আমার মুখে চড় মেরে বসলেন। সাথে সাথে আমিও তার গাল বরাবর পাল্টা চড় বসিয়ে দিলাম। ডি,আই,জি অগ্নিশর্মা হয়ে ছুটে এলেন। আমার পিঠে জোরে লাথি মেরে, কলার ধরে ঠেলে ধাক্কা মেরে ক্যাম্প থেকে বের করে দিলেন।
এভাবে ক্যাম্প থেকে বিতাড়িত হয়ে বাইরে এসে দফাদার রশিদ খানের সাথে পরামর্শ করলাম। আমরা দুজনে একমত হলাম যে, সরকারী দায়িত্ব পালন করা আমাদের কর্তব্য, কিন্তু একটি গ্রামের নিরীহ মানুষকে আগুনের হাত থেকে রক্ষা করাও আমাদের কম কর্তব্য নয়। যেই চিন্তা সেই কাজ। আমি উক্ত তিনজন অফিসারের নামে একটি হুকুমনামা লিখলাম।
‘যেহেতু আপনাদের উদ্দেশ্য এবং সিদ্ধান্ত মানবতা বিরােধী এবং সরকার ও রাষ্ট্রের স্বার্থের পরিপন্থী, সেইহেতু আমি, দায়িত্ব প্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে এই হুকুম জারি করছি যে, পরবর্তী হুকুম না পাওয়া পর্যন্ত আপনারা ক্যাম্পের ভেতরে অবস্থান করবেন। এই আদেশ অমান্য করে আপনারা বা আপনাদের কেউ বাইরে আসার চেষ্টা করলে তার ভয়াবহ পরিণামের জন্য আপনারা দায়ী থাকবেন।’
রশীদ খানের নেতৃত্বে সশস্ত্র ঘােড়সওয়ার পুলিশ ক্যাম্পের চারদিকে অবস্থান নিল। শেরখান নামে একজন পুলিশ কাঁধে রাইফেল রেখে হুকুমনামাটি নিয়ে ক্যাম্পে প্রবেশ করল এবং যথারীতি স্যালুট করে সেটি তাদের সামনে রেখে দু’কদম পিছিয়ে দরজায় এসে দাঁড়িয়ে পড়ল।
ক্যাম্পের ভিতরের বেশ কিছুক্ষণ অট্টহাসির ঝড় বয়ে গেল। বিক্ষুদ্ধ বিজাতীয় ভাষায় কিছু উচ্চমার্গীয় গালি বর্ষিত হল। তারপর কালেক্টর বাবু তার ইহুদী সুলত নাকটি পর্দার ফাক দিয়ে একটু খানি বের করে পরিস্থিতি আঁচ করেই একবারে চুপসে
৬৩
গেলেন। আমি জিপ থেকে তাদের বিয়ারের বােতল, গ্লাস, ওয়্যারলেস ইত্যাদি একজন সিপাহির মাধ্যমে ভেতরে পৌঁছে দিলাম। পেট্রোল ট্যাঙ্কারটি ভাগলপুরে ফেরত পাঠিয়ে দিলাম। ক্যাম্পের ভেতরে কবরের নিস্তব্ধতা বিরাজ করছিল। তারপর বিয়ারের বােতলের টুংটাং আওয়াজ এবং সেই সঙ্গে ওয়ারলেস সেটের কথাবার্তা শােনা গেল। ভাগলপুর পুলিশ লাইনের মাধ্যমে কালেক্টরের পক্ষ থেকে কমিশনারের কাছে বার্ত পাঠানাে হল। বার্তা পেয়েই কমিশনার নিজে একদল ইংরেজ সৈন্যসহ ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন।
এদিকে পুরাে খবরটি সংশ্লিষ্ট গ্রামসহ আশপাশের গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল। খবর কম, গুজব বেশী। কেউ বলল, ইংরেজ অফিসাররা আমাকে গুলি করে মেরে ফেলেছে; কেউ বলল, আমি একজন ইংরেজ অফিসারকে মেরে ফেলেছি এবং বাকী দুইজনকে গ্রেফতার করেছি। দেখতে দেখতে হাতি ও ঘােড়ার পিঠে চড়ে, গরুর গাড়িতে চড়ে এবং হেঁটে হেঁটে প্রায় আট-নয়শ’ লােক ক্যাম্পের কাছে এসে জমা হল।
কমিশনার গােখলে সেখানে পৌঁছেই উক্ত তিনজন অফিসারকে ইংরেজ সৈন্যের নিরাপত্তায় নিয়ে নিলেন এবং আমাকে বিদ্রোহী পুলিশসহ ভাগলপুরে উপস্থিত হওয়ার নির্দেশ দিলেন।
কমিশনার হেড কোয়ার্টারে পৌঁছেই পুলিশদের নিরস্ত্র করার আদেশ দিলেন। আমার বিরুদ্ধে অযােগ্যতা, আদেশ অমান্য করা, বিদ্রোহ এবং পুলিশকে বিদ্রোহী হওয়ার জন্য উস্কানী দেওয়া ইত্যাদি অভিযােগ সংবলিত চার্জশীট প্রদান করা হল। এর উত্তরে আমি আই,সি,এস-এর চাকরি থেকে ইস্তফা দিলাম।
দিনকয়েক পরেই বিহারের গভর্ণর আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমি তাকে সমস্ত ঘটনা বিস্তারিতভাবে বললাম। শুনে তিনি আমাকে ধন্যবাদ দিয়ে বললেন, ‘পরিস্থিতি আরাে মারাত্মক আকার ধারণ করার আগেই তুমি তাকে দৃঢ়তার সঙ্গে মােকাবিলা করেছ। তােমার ইস্তেফা দেওয়ার প্রয়ােজন নেই। নাও তােমার পদত্যাগ পত্র।
এরপর তার আদেশে আমি পুরাে ঘটনার একটি লিখিত বিবরণ তার কাছে জমা দেই। প্রায় আড়াই মাস পর একদিন হঠাৎ দিল্লীতে ভাইসরয়দের হােম সেক্রেটারীর সমীপে হাজির হওয়ার আদেশ পাই। হােম সেক্রেটারীর নাম স্যার রেজিনাল্ড ম্যাকলি-তার কাছে আমার বিরুদ্ধে বেশ কিছু রিপাের্ট জমা হয়েছিল। অবশ্য গভর্ণরের রিপোের্ট আমার পক্ষে ছিল। নির্দিষ্ট সময়ে আমি হােম সেক্রেটারীর দপ্তরে হাজির হওয়ার পর তিনি আমাকে প্রায় দশ মিনিট ধরে গালি-গালাজ করলেন। আমি কোন উত্তর দিচ্ছিনা দেখে চিৎকার করে বললেন, “তুমি মুখ খুলছনা কেন? তুমি কি বােবা?’ আমি বললাম ‘স্যার, আমার বক্তব্য গভর্ণর সাহেবের কাছে লিখিত আকারে পেশ করেছি। সেই সঙ্গে
৬৪
পদত্যাগ পত্রও। আপনি যদি চান, তবে লিখিত বিবরণ অথবা ইস্তেফা অথবা দুটোই আপনার কাছে পেশ করতে পারি।’
আমি বিনীতভাবে বললাম, “স্যার, আপনি আই,সি,এস-এর চূড়ার সিঁড়িতে অবস্থান করছেন, আর আমি প্রথম সিঁড়িতে। ঘটনাস্থলে যদি আমার জায়গায় আপনি হতেন, তবে দীর্ঘ অভিজ্ঞতার আলােকে আপনি কি পদক্ষেপ নিতেন?’ হােম সেক্রেটারী রিভলভিং চেয়ারে ঘুরতে লাগলেন এবং হেসে বললেন, ‘সম্ভবতঃ তুমি যে পদক্ষেপ নিয়েছ, তাই। তােমার সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল, কিন্তু পদ্ধতিতে ভুল হয়েছে। ঠিক আছে, যাও, ভবিষ্যতে সাবধান থেকো।
এরপর একবার ইস্কান্দার মির্জা এবং আরেকবার আইয়ুব খানের সময় ইস্তেফা দিয়েছিলাম কিন্তু কোনবারই তা গৃহীত হয়নি। জেনারেল ইয়াহিয়া ক্ষমতায় আসলেন, তখন চতুর্থবার আমার মাথায় সেই পাগলামি মাথাচাড়া দিয়ে উঠল এবং আমি সফলকাম হলাম।
ইয়াহিয়া খান আমার কাছে আগে থেকেই একজন অলক্ষুণে ব্যক্তি হিসেবে প্রতিভাত। আমি তাকে দুচোখে দেখতে পারতাম না। আমি তখন আজাদ কাশ্মীর সরকারের সেক্রেটারী জেনারেল। দালানকোঠা বিশেষ কিছু ছিল না, গাছতলায় বসে অফিস করতে হত। একদিন আমাদের কি একটা মিটিং চলছিল, হঠাৎ গােলগাল চেহারার এক লােক সামরিক জীপ থেকে নেমে আমাদের কাছে আসল। আমার নাকের কাছে ছড়ি ঘােরাতে ঘােরাতে বলল, এখানে কিসের তামাশা হচ্ছে?
আমি বললাম, এটা আজাদ জম্মু ও কাশ্মীর সরকারের সেক্রেটারিয়েট।’ একথা শুনে আগা মােহাম্মদ ইয়াহিয়া খান ঠাট্টার হাসি হাসতে হাসতে একটু দূরে গিয়ে গাছতলায় বসলেন। জীপ থেকে বিয়ারের বােতল বের করে পান করতে লাগলেন। রমজানের মাস ছিল। আমার কাশ্মীরি আর্দালি এটা দেখে চিৎকার করে উঠল ‘সাবধান সাহেব, বােতল ফেলে দাও, নইলে খুনাখুনি হয়ে যাবে।’ ইয়াহিয়া খান বােতলসহ জীপে উঠে দ্রুত নিষ্কান্ত হয়ে গেলেন।
আইয়ুব খানের পতনের পর ইয়াহিয়া খান যখন আনন্দে আত্মহারা হয়ে নাচগান ও পানের আসরে মশগুল, তখন জেনারেল পীরজাদা প্রেসিডেন্ট হাউস দখল করে নিজের আসনটি পাকাপােক্ত করে নিতে সচেষ্ট হলেন। আইয়ুব খানের মিলিটারি সেক্রেটারী থাকার সুবাদে তিনি প্রেসিডেন্ট হাউসের অলিগলি সম্পর্কে ওয়াকিফহাল ছিলেন। পাকিস্তানের ইতিহাসে একটি অলক্ষুণে আমল শুরু হল-যার বিসমিল্লাহতেই গলদ দেখা দিল। পীরজাদা এক আদেশে এডমিরাল এ, আর, খান, সৈয়দ ফিদা হােসাইন শাহ ও মিয়া আরশাদ হােসাইনকে এই তিনজনকে প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা নিয়ােগ
৬৫
করলেন। বিমান ও নৌবাহিনী প্রধানরা হন্তদন্ত হয়ে স্থলবাহিনী প্রধান ইয়াহিয়া খানের কাছে গেলেন। একটি জরুরী মিটিং করে তারা মার্শাল ল’র গনিমতের মাল নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে নিলেন। পীরজাদা আপ্রাণ চেষ্টা করেও ব্যর্থ হতে বাধ্য হলেন।
মার্শাল ল’ জারি হওয়ার পর দশ দিন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সেক্রেটারিয়েটের কাজ এক রকম বন্ধই ছিল। কারণ, সামরিক জান্তার নেতারা ঐ দশ দিন ক্ষমতা ভাগাভাগির লড়াইয়ে লিপ্ত ছিলেন। আমরা অফিসে যেতাম, গল্প-গুজব করতাম; সময় শেষ হলে বাড়ি ফিরে আসতাম। নতুন রাষ্ট্র প্রধানের সঙ্গে আমাদের একমাত্র যােগাযােগ ছিল সংবাদপত্র। এই দশ দিন মূলতঃ একটি অরাজক অবস্থা বিরাজমান ছিল।
জেনারেল পীরাজাদার দশ দিনের বাদশাহীর খবরাখবর সংবাদপত্রের পাতায় এ রকম ছিল।
O আজ অমুক অফিসের গেট সাতটা ১০ মিনিটে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
O বিলম্বে আসা অফিসারদের বােদে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে।
O আজ শহরের নর্দমাগুলােতে ফিনাইল ঢালা হয়েছে।
O আজ থেকে মশক নিধন অভিযান শুরু করা হয়েছে।
O আজ মিষ্টির দোকানে জাল টানাবার হুকুম দেওয়া হয়েছে।
O আজ এটা করা হয়েছে…………..।
O আজ সেটা করা হয়েছে…………….
অতঃপর (দশ দিন পর হঠাৎ একদিন আদেশ পেলাম, ‘আগামীকাল, ৪ঠা এপ্রিল সকাল দশটায় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও চীফ মার্শাল ল’ এডমিনিস্ট্রেটর আগা মােহাম্মদ ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট গেস্ট হাউসে কেন্দ্রীয় সচিববৃন্দ এবং অন্যান্য অফিসারদের সভায় ভাষণ দেবেন। সংশ্লিষ্ট সকলকে উপস্থিত থাকতে হবে।’
উদীয়মান সূর্যের পূজারী ব্যুরােক্রেসিতেও আছে। তারা এই আমন্ত্রণের অপেক্ষাতেই ওঁৎ পেতে ছিলেন। পরদিন সকাল পৌনে দশটায় প্রেসিডেন্ট গেস্ট হাউসে গিয়ে দেখি হল ঘর কানায় কানায় ভর্তি। সামনের সারিতে সামরিক কর্মকর্তারা বসে আছেন। এক কোণায় তিনজন সিনিয়র সচিব কোন মতে বসতে পেরেছেন। আমি পেছনে একটি খালি চেয়ার পেয়ে বসে পড়লাম। দশটা চল্লিশ মিনিটের সময় ইয়াহিয়া খান আগে আগে এবং পীরজাদা তার পেছনে পেছনে হল ঘরে প্রবেশ করলেন। কিছুক্ষণ নীরবতার পর ইয়াহিয়া খান মঞ্চে দাঁড়িয়ে তার গলায় কথা বলা কিংবা বলা যায়, ভাষণ দেওয়া শুরু করলেন।
‘তােমরা সিভিল সার্ভিসের লােকেরা বড় তােষামুদে প্রকৃতির। নতুন কেউ ক্ষমতায় আসলেই তার হাতে হঁা মেলাও। তােমরা নৈতিক সাহস বিবর্জিত। সঠিক মতামত
৬৬
প্রদানে বিরত থেকে তােষামােদ-খােমােদের মাধ্যমে নিজেদের আখের গােছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়। কিন্তু এখন সাবধান হয়ে যাও। আমি সাদাসিধা সিপাহী, তােমাদের ষড়যন্ত্রে ধরা দেবনা। আমার সঙ্গে সরল-সােজা, সহজ ও সত্য কথা বলতে হবে। ……..আমি অতিদ্রুত স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনব এবং তারপর ব্যারাকে প্রত্যাবর্তন করব। তােমরা সাবধানতার সঙ্গে নিজেদের দায়িত্ব পালন করবে, সাহসের সঙ্গে কাজ করবে এবং তােষামােদ ছেড়ে নির্ভয়ে মতামত পেশ করবে। কোন বিষয়ে জানতে চাইলে সরাসরি আমার কাছ থেকে জেনে নেবে।’
প্রায় পনের মিনিট এ রকম জ্ঞানগর্ভ বক্তব্য রাখার পর ইয়াহিয়া খান থেমে গেলেন। প্রত্যুত্তরে সিভিল সার্ভিসের প্রবীণতম সদস্য এম, এম, আহমেদ মুখ খুললেন। এতদিনকার দোষ-ক্রটি স্বীকার করে নিয়ে বললেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ্ দেশের উপর আল্লাহর রহমত নাজিল হয়েছে। আপনি হাল ধরেছেন, এখন সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। সিভিল সার্ভিসের পক্ষ থেকে আমরা আপনাকে পরিপূর্ণ সহযােগিতার আন্তরিক আশ্বাস দিচ্ছি। আরাে দু’একজন অফিসার অনুরূপ টেপ রেকর্ড বাজালেন। ইয়াহিয়া খান মাথা নেড়ে নেড়ে নব পর্যায়ের এই ভূরীয় তোেষামােদ বেশ উপভােগ করলেন। গর্বে আনন্দে তার চোখ-মুখ-সীনা স্ফীত হয়ে উঠল। গলায় ঝুলে থাকা ঢিলেঢালা চামড়ায় আনন্দ-শােনিত প্রবাহিত হল। কিছুক্ষণের জন্য আবার হল ঘরে নীরবতা নেমে এল।
আমি দাঁড়িয়ে এই নীরবতা ভাঙলাম। আমি ‘মিষ্টার চীফ মার্শাল ল’ এডমিনিস্ট্রেটর’ বলে সম্বােধন করতে ইয়াহিয়া খানের কান খাড়া হয়ে উঠল। মনে হল এ রকম সম্বােধন তিনি আশা করেননি। তিনি চোখ একবার উঠিয়ে আবার নামিয়ে আমাকে ভালাে করে দেখে নিলেন। সামনের সারির সমস্ত মাথা একবার করে পেছনের দিকে ঘুরল।।
‘মিঃ চীফ মার্শাল ল’ এডমিনিস্ট্রেটর, আমি শুধু সরকারী কর্মকর্তা হিসেবে নয় একজন শুভাকাংক্ষী হিসাবে দু-একটি কথা বলতে চাই।’
-“হ্যা, হঁা, বলুন। আমরাতাে আপনাদের বন্ধুই বটে, বলুন।’
-“স্যার, আপনি নির্ভয়ে মতামত প্রকাশের আদেশ করেছেন। আমি যা বলব, কোন
কিছু কমিয়ে বা বাড়িয়ে বলবনা-নিজের মতামত অকপটে পেশ করব মাত্র।
-‘হা’ বলুন, বলুন। – জনাব, এই গরীব দেশ বারবার মার্শাল ল’-এর ধকল সইতে পারবে না। সে
জন্য’। সামনের সারিতে গুঞ্জন শােনা গেল ‘সে জন্য কি’,
– সে জন্য কি? আমি বললাম, সে
৬৭
জন্য, যে কাজের দায়িত্ব নিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন, সেটি এখনই শুরু করে দিন। সামনের সারি থেকে আবারাে নানা রকম গুঞ্জন ভেসে আসল। -এটা কি রকম বক্তৃতা হচ্ছে?
-এটা কি কোন কথা হলাে?
– সব কাজই তাে শুরু করা হয়েছে।
ইয়াহিয়া খান এই গুঞ্জনকে সমর্থন করে আমাকে ধমকের সুরে বললেন, তুমি কি ঘুম থেকে উঠে সংবাদপত্র পড় না?’ আমি উত্তর দিলাম, ‘জি হঁ্যা, পড়ি। জরুরী ভিত্তিতে পড়ি। কেননা, আজকাল আপনাদের সঙ্গে আমাদের যােগাযােগের সূত্র তাে কেবল সংবাদপত্র।’
– “কি পড়? আমরা বেকার বসে আছি, কোন কাজ করিনা-এই খবর পড় নাকি?’
-না জনাব, সড়ক পরিষ্কার করা হচ্ছে, ফিনাইল ছিটানাে হচ্ছে, দোকানে জাল টানানাে হচ্ছে, অফিসে হাজিরা নেয়া হচ্ছে এবং -‘এবং কি? এগুলাে কি জরুরী কাজ নয়?’
– ‘অবশ্যই জরুরী, জনাব! তবে এর জন্য মার্শাল ল’র প্রয়ােজন কি? আপনি ঘােষণায় মার্শাল ল’র উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্পর্কে বলেছেন।’
আবার সেই সামনের সারির গুঞ্জন। আমি মিটিং-এর সৌন্দর্য নষ্ট করছি। সময় নষ্ট করছি। সামরিক সরকার তাে পুরােদমে কাজ করেই চলেছে-ইত্যাদি, ইত্যাদি। আমি পুনরায় ইয়াহিয়া খানকে উদ্দেশ্য করে বললাম‘স্যার, আমি কি আমার বক্তব্য শেষ করতে পারি? তিনি না শােনার ভান করে দাড়িয়ে গেলেন এবং বললেন, ‘চলুন চা খাওয়া যাক। চা পানের আগে ইয়াহিয়া খান আমাকে হাত ধরে এক কোণে নিয়ে গেলেন। বললেন,
‘ভাই আমরা কেবল রাস্তা সাফ করতেই আসিনি। অপেক্ষা কর। দেখবে, অনেক বড় বড় কাজ আমরা সমাধা করছি।’
-‘নিঃসন্দেহে আপনারা বড় বড় কাজ করবেন। কিন্তু আমার একটি আরজ আছে।
– ‘সেটা কি?’
– ‘আপনি তাে জানেন, ইংরেজ সেনাবাহিনীতে যারা রােমান হরফে সামান্য একটু উর্দু শিখেছিল, তাদের ভারত উপমহাদেশ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ মনে করা হতাে। এই মেজর জেনারেল পীরজাদা কিছুদিন আইয়ুব খানের মিলিটারি সেক্রেটারী ছিলেন। সে কারণে আপনি যেন তাকে পাকিস্তান বিষয়ে বিশেষজ্ঞ না তাবেন।’
ইয়াহিয়া খান বন বেড়ালের মতাে ফেঁস করে উঠলেন। ইতিমধ্যে পীরজাদাও সেখানে এসে হাজির হলেন। দুজনে মিলে আমাকে এক হাত নিলেন।
৬৮
পরদিন স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের মিঃ আলভি আমার বাসায় এলেন। মুরুব্বীয়ানা সুরে বললেন, ভাই এটা তুমি কি করলে? তােমার উপর বড় রকমের দায়িত্ব দেওয়া হবে বলে সব কিছু ঠিকঠাক হয়ে গেছে। পােস্টিংও ঠিক করা হয়েছে। কিন্তু তােমার বক্তব্যে ইয়াহিয়া খান ধরে নিয়েছে, তুমি সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে উস্কানীমূলক বক্তব্য রেখেছ। যাক এখনাে সময় আছে। দেখি আমি কি করতে পারি। আলভি সাহেবের কথাবার্তায় মনে হল, আমি পাকিস্তান সরকারের সচিব নই, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের একজন কর্মচারী। আমি তাকে বললাম, আমার চাকরি বা পােস্টিং নিয়ে আপনাকে খামাখা চিন্তা করতে হবে না। প্রাক্তন আই,সি,এস, এবং বর্তমানে সি,এস,পি, অফিসার হিসাবে এ ব্যাপারে আমি নিজেই সিদ্ধান্ত গ্রহণের যথেষ্ট যােগ্যতা রাখি।’
ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে, এরপর আমার দু’বার মুখখামুখি সাক্ষাৎ হয়। প্রতিবারই তাকে আমার পূর্বের তুলনায় অধিক ভীতিপ্রদ এবং অনভিপ্রেত মনে হয়েছে। সৌভাগ্যক্রমে সে সময় ইউনেস্কোর এক্সিকিউটিভ বাের্ডের সাধারণ সভার তারিখ পড়ে যায়। আমি স্বনামে ঐ বাের্ডের সদস্য ছিলাম। বাের্ডের সভায় যােগদানের জন্য আমি প্যারিস যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিলাম। জেনারেল পীরজাদা নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। আমি প্যারিস পৌঁছে গােপনে আমার স্ত্রী ইফফাত এবং পুত্র সাকিবকেও প্যারিস নিয়ে গেলাম। আর সেখান থেকেই ইয়াহিয়া খানের নামে আমার পদত্যাগ পত্র পাঠিয়ে দিলাম। পদত্যাগ গৃহীত হওয়াটিই স্বাভাবিক ছিল, কিন্তু তা হল না। ইয়াহিয়া খান অপেক্ষা করছিলেন, প্রথমে আমি তার কাছে আত্মসমর্পণ করব, তারপরে পদত্যাগ করব। নয় বছর চাকরি বাকী থাকতে আমি স্বেচ্ছায় ইস্তফা দিয়েছি। তার কাছে কোন কিছু দাবী করি নি। কাজেই তার বালসুলভ জেদের কাছে আমি আত্মসমর্পণ করতে রাজী হলাম না।
দীর্ঘ এক বছর ধরে অনেক দর কষাকষি, জেদাজেদির পর পদত্যাগ গৃহীত হল, কিন্তু আমার পেনশন তিন বছর আটকে রাখা হল। আমি যখন পেনশন পাওয়া শুরু করি, তখন ইয়াহিয়া খান আর পীরজাদা পাকিস্তানকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়ে প্রেসিডেন্ট হাউস থেকে পালিয়ে গেছে।
লন্ডনের শহরতলীতে আমরা একটি বাসা ভাড়া করে থাকতাম। প্রতিবছর প্যারিসে বাের্ডের মিটিং-এ যােগদানের জন্য কম খরচে লন্ডন থেকে পি,আই,এ, বিমানে যাতায়াত করতাম। একবার পিকাডেলি স্ট্রীটে টিকেট কেনার জন্য পি,আই,এ, অফিসে যাই, কাউন্টারে কর্মরত মহিলার পাশে তার এক এয়ার হােস্টেস বান্ধবীও উপবিষ্ট। আমার নাম শুনেই এয়ার হােস্টেস বলল, টিকেট পরে কিনবনে, আগে আমাকে এককাপ চা খাওয়ান। আপনার সঙ্গে আমার এই প্রথম সাক্ষাৎ। আমি দীর্ঘদিন
৬৯
আপনার স্ত্রী ইফফাতের সঙ্গে এক মহল্লায় থেকেছি।’ সে আমাকে কফি হাউসে নিয়ে গেল। সেখানে গিয়ে সে বলল, আমাকে বাজে চরিত্রের মেয়ে মনে করবেন না। আমি চা খেতে নয়, একটি জরুরী কথা জানাতে আপনাকে এখানে নিয়ে এসেছি। কিছুদিন আগে আর্মি ইসলামাবাদ-করাচীর ফ্লাইটে কর্মরত ছিলাম। সেই ফ্লাইটে ইয়াহিয়া খান এবং কিছু উর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা সফর করছিলেন। ইয়াহিয়া খান একজন অফিসারকে ধমকাচ্ছিলেন, “কেন সে এখনাে কুদরাতুল্লাহ শেহাবকে তার কাছে এনে হাজির করেনি। এই হুকুম তামিল করতে কোন গাফিলতি করা হলে তার চামড়া তুলে ফেলা হবে।” ইত্যাদি, ইত্যাদি। আমি বলি কি, ‘আপনি আর কখনাে পি,আই,এ’র বিমানে লন্ডন-প্যারিস যাতায়াত করার ঝুঁকি নেবেন না।’
মেয়েটি কিছুতেই তার নাম প্রকাশ করল না। বাড়ীতে গিয়ে আমি ইফফাতের কাছে তার চেহারার বর্ণনা দিয়ে জানতে চাইলে সে এমন কোন প্রতিবেশিনী বা বান্ধবীর কথা স্মরণ করতে পারল না। তারপর ‘রহমতের ফেরেশতা সেই মেয়েটিকে আমি আর কখনাে কোথাও দেখতে পাইনি।
আমাদের লন্ডনের গ্রামের কাছাকাছি একটি শহর ছিল। সেখানে কাপড় ধােলাই করার জন্য আমি একদিন লন্ড্রিতে ঢুকি। প্রতি সােমবার আমি ময়লা কাপড়-চোপড় নিয়ে সেখানে যেতাম। সেদিন দেখি বড় বড় মােচওয়ালা, জিন্নাহ ক্যাপ পরা একজন লম্বা-চওড়া গােছের পাকিস্তানী ফুটপাতের উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমাকে দেখেই জোরে জোরে গলা খাকারি দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করল, তারপর পাঞ্জাবী ভাষায় বলল, ‘আরে বােপর বাচ্চা, কাপড় জমা দিয়ে তাড়াতাড়ি বাইরে আয়, তাের সাথে জরুরী কথা আছে।’ লােকটি আমার সম্পূর্ণ অপরিচিত। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। সহসা সেই এয়ার হােষ্টেসের কথা মনে পড়ে গেল। লন্ড্রির মহিলা আমার পরিচিতা। তাকে বললাম, ‘বাইরের ঐ লােকটি আমার ক্ষতি করার জন্য এখানে এসেছে। তুমি পুলিশকে ফোন করে দাও।’
আমি লন্ড্রি থেকে বেরিয়ে তার কাছে যাওয়ার সাথে সাথেই সে আমাকে বগলদাবা করে ফেলল। আমি বললাম, তুমি কে?’ সে বলল,
-‘আমি নিজের পরিচয় মুখ দিয়ে দেই না, হাত ও পা দিয়ে দেই। তবে তােমাকে আমি বন্ধুর মতাে করে বলছি, তুমি এখন থেকে আমার দখলে। কারাে দিকে না তাকিয়ে কোন ইশারা না করে, আমি যা বলবাে সে অনুযায়ী চলবে। একটুও অন্যথা করবে না। আমাদের এক লােক তােমার ঘরে, আরেক লােক তােমার ছেলের জন্য স্কুলের গেটে আছে। আমি খুন-খারাবি করতে চাই না। তবে আমাকে নির্মম হতে বাধ্য করবে না।
-আমি প্রশ্ন করলাম “তুমি আমার কাছে আসলে কি চাও?’
৭০
-উত্তরে সে বলল তুমি আমার সঙ্গে এখনই ঘরে চলাে। পাসপাের্ট মালামাল নিয়ে আজ সন্ধ্যার ফ্লাইটে আমার সঙ্গে করাচী যেতে হবে।’
আমি কিছুক্ষণ থেমে থেকে তাকে বললাম, “রাজী আছি। কিন্তু এখানে তাে ট্যাক্সি পাওয়া যাবে না। দাড়াও, ফোন করে ট্যাক্সি আনাই’ বলেই আমি টেলিফোন করতে লন্ড্রিতে ঢুকলাম। সেও আমার পেছনে পেছনে লন্ড্রিতে ঢুকল। লন্ড্রির মহিলাকে আমার বাসার ঠিকানা দিয়ে একটি ট্যাক্সি আনিয়ে দিতে বললাম। সে ফোন করার পর আমাদের জানাল যে, পাঁচ-সাত মিনিটের মধ্যে ট্যাক্সি আসছে। আমরা বাইরে গিয়ে ফুটপাতে অপেক্ষা করছি, সে সময় পুলিশের একটি জীপ এসে লন্ড্রির সামনে থামল। একজন পুলিশ জীপ থেকে নেমে লন্ড্রিতে প্রবেশ করল। তাকে দেখেই পাকিস্তানী লােকটি বলে উঠল, ‘এই হারামীটি আবার কি করতে এখানে এসেছে?’ বললাম, ‘ময়লা কাপড়-চোপড় ধােলাইর ব্যাপার হয়তােবা।’ ইতিমধ্যে আমাদের ট্যাক্সি এসে যায়। আমরা ট্যাক্সিতে বাসায় যাই। গিয়ে দেখি সেখানেও সত্যি সত্যি জিন্নাহ ক্যাপ পরা মােচওয়ালা এক পাকিস্তানী আমার ঘরের মধ্যে বসে রয়েছে। ইফফাতের চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। সে বলল, ‘এদের আরেকজন সাকিবের স্কুলে গেছে। এই কথাবার্তার মধ্যে পুলিশের জীপটি আমাদের ঘরের সামনে এসে থামল। দু’জন পুলিশ ঘন্টা বাজাতে বাজাতে ঘরের মধ্যে ঢুকল। ইফফাতের কথা অনুযায়ী একজন পুলিশ তাকে নিয়ে সাকিবের স্কুলে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখানে পাহারারত পাকিস্তানীকে ধরে নিয়ে এল। একজন পুলিশ আমার ও ইফফাতের জবানবন্দী নিল। অন্য একজন পাকিস্তানীদের কাগজপত্র পরীক্ষা করল। তারপর তাদের জীপে তুলে নিয়ে চলে গেল।
ইংল্যান্ডে আমার তিন বছর অবস্থানে ভাল শিক্ষাপ্রদ হল। পাকিস্তান এ্যাম্বেসির অফিসাররা যখন জানল যে, আমি ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে ঝগড়া করে ইস্তেফা দিয়ে এখানে চলে এসেছি, তখন তারা আমার ছায়া থেকেও দূরে থাকতে সচেষ্ট হল। এদের প্রায় প্রত্যেকেই কোন না কোন সময় আমার কাছে সুপারিশের জন্য ধর্ণা দিয়েছিল এবং আমার দ্বারা উপকৃত হয়েছিল। এদের মধ্যে একজনকে আমি সাধারণ চাকরি থেকে প্রেসিডেন্ট হাউসের বড় পদে নিয়ে এসেছিলাম। তবে একজনের উদারতা, আতিথিয়তা, সাহসিকতা এবং আমার প্রতি তার শ্রদ্ধা-ভালবাসার প্রমাণ পেয়ে আমি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। তিনি এ্যাম্বেসীর সকলের বিরােধিতার মুখেও সর্বক্ষণ আমাকে সাহায্য-সহযােগিতা করেছেন। তিনি শিক্ষা কাউন্সিলার মিঃ তানভির আহমদ খান। পরবর্তী সময় তিনি বাংলাদেশে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত হয়েছিলেন।
৭১

শেহাবনামা থেকে টুকিটাকি
সিগারেট লাইটার

আমি তখন জম্মু ও আজাদ কাশীর সরকারের সেক্রেটারী জেনারেল। সর্দার আবদুর রব নিশতার ছাড়া পাকিস্তানের অন্য কোন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তখনাে কাশ্মীরে পদার্পণ করেননি। কিন্তু যুদ্ধবিরতি ঘােষণার সাথে সাথে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের কাশ্মীর সফরের যেন হিড়িক পড়ে যায়। দু’জন মন্ত্রীর এ রকম এক সফরের কথা আমার বিশেষভাবে মনে পড়ছে।
তারা যেখানেই যান, জনতা তাদের বিপুল সংবর্ধনা দিচ্ছে। এক সংবর্ধনা সভায় বৃদ্ধ এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বলল, “জনাব মন্ত্রী বাহাদুরগণ, কাশ্মীর একটি ছােট এলাকা, পাকিস্তান বিরাট দেশ। আপনাদের কথাবার্তায় মনে হচ্ছে, আপনারা প্রথমে কাশ্মীরের ওপর ইসলামী হুকুমতের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাবেন এবং পরে তা পাকিস্তানের জন্য উপযােগী হবে কিনা বিবেচনা করবেন।’
বৃদ্ধের এই কথা শােনামাত্র সভাস্থলে নিস্তব্ধতা নেমে আসে, কিন্তু তা অল্পক্ষণের জন্য। উক্ত মন্ত্রীদ্বয়ের একজন স্বতঃস্ফূর্তভাবে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত আবেগময় ভাষায় বক্তৃতা শুরু করে দেন। এক পর্যায়ে জোশের/আবেগের আতিশয্যে তিনি পকেট থেকে একটি লকেট জাতীয় জিনিস বের করে জনতাকে দেখিয়ে বললেন, ‘ভাইসব, আল্লাহর আইনকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে আমরা কারা? এই দেখুন, (হাত উঁচিয়ে লকেটটি নাড়তে নাড়তে) এটা হল আল্লাহর আইন, যা কিনা চৌদ্দশ’ বছর ধরে জারি রয়েছে। এই আইন মানা আমাদের সকলেরই নৈতিক ও ঈমানী কর্তব্য।
ফেরার পথে আমিও তাদের গাড়িতে বসলাম। এক মন্ত্রী আরেক মন্ত্রীকে বলছে, ‘ভাই, অতি চমৎকার বক্তৃতা ঝেড়েছ আজকে। কিন্তু এত সুন্দর ছােট কোরান শরীফটি পেলে কোথায়? তাজ কোম্পানীর না অন্য কারাে?’
শুনে বক্তা মন্ত্রী খিলখিল করে হেসে উঠলেন। বললেন, তােমার মাথা খারাপ হয়েছে, এটা কোরান শরীফ হতে যাবে কেন?’ লকেটটি বের করে বললেন, এটা তাে আমার সিগারেট লাইটার।’
উল্লিখিত দু’জন মন্ত্রীর একজন ছিলেন মালিক গােলাম মােহাম্মদ, অন্যজন নবাব মুশতাক আহমদ প্রমানী।

পাগড়ি
হজরত কেবলা মুরীদের গৌরব, ভক্তদের নেতা, তরিকতের সূর্য, মারেফাতের চন্দ্র জনাব মাখদুম জাদা গােলাম মুর্শিদ খান সাহেব
৭২
‘পীর, ল্যান্ডলর্ড এবং লীডার।
এটা কোন মাযারের ওপর খােদাই করা লেখা নয়, একজন জীবিত গদিনশিন পীরের নামফলক। তিনি পাকা রাস্তায় মাস্টার বাইয়ক, কাঁচা রাস্তায় শিভার্লেট এবং শিকার করার সময় জীপ ব্যবহার করেন। দশ-বার রকম উন্নত জাতের ঘােড়া পালেন আর তিন ডজনের মতাে অভিজাত কুকুরও পােষেণ।
‘দরগাহ শরীফ’ দেখতে একেবারেই সাদামাটা। কিন্তু বড় বড় শহরে তার নিজস্ব আলীশান দালান-কোঠা রয়েছে। গরমে তিনি মারি, কোয়েটা, এবােটাবাদ আর শীতে লাহাের, পেশওয়ার বা করাচীতে অবস্থান করে সংশ্লিষ্ট শহরবাসীদের ফয়েজ দান করেন। দরগাহ শরীফে প্রতিবছর কয়েকদিন ধরে বার্ষিক ওরস অনুষ্ঠিত হয়। এ রকম এক ওরসের শেষ দিনের ঘটনা ঃ –
আয়ােজনের ধুমধাম সম্পন্ন হয়েছে। লােবান-আগরবাতি জ্বালানাে হয়েছে। মেশক-আম্বর-কাফুরের সুগন্ধি ছড়ানাে হয়েছে। গােলাপ জল ছিটিয়ে দেয়া হয়েছে। পীর সাহেব নক্সাদার জুবা পরে গদীতে আসীন হয়েছেন; তার ঠিক চোখ বরাবর পাতলা পর্দার অন্তরালে ললনাদের মজলিস। গদীর বাঁদিকে জেলার অফিসারবৃন্দ, ডান দিকে উচ্চপর্যায়ের মুরীদ ও গণ্যমান্য শহরবাসী। মজলিসের এক কোণে রয়েছে দরবেশদের একটি দল। কাওয়ালী শুরু হলে তারা মাঝে মধ্যে বেহুঁশ হয়ে পড়বে। বেহুঁশ হয়ে পড়ার জন্য লাহাের থেকে তরিকতপন্থী কিছু যুবকও আমদানি করা হয়েছে। তাদের পরণে রয়েছে পাতলা মলমলের পাঞ্জাবী আর মাথায় বাঁকা মতাে বিশেষ এক ধরনের টুপি। সকলের মাঝে বসেছে নানা বাদ্যযন্ত্র, সাজ-সরঞ্জামসহ কাওয়ালী শিল্পীবৃন্দ। দূর-দূরান্ত থেকে আগত শতশত ভক্তবৃন্দ শিল্পীদের পেছনে অতি আদবের সাথে উপবিষ্ট।
কাওয়ালী শিল্পী হারমােনিয়াম আর তবলাতে সুর তাজতে শুরু করলেন। ফারসী কবি জামীর গজলের সুর। দরবেশরা হুঁশ হারিয়ে ফেলল, তরিকতপন্থী যুবকদের কেউ কেউ জমিনের সঙ্গে মাথা ঠুকতে লাগল। দেখাদেখি সাধারণ ভক্তরাও বাদ গেল না। কাওয়ালদের কথা ও সুর যখন চরমে ওঠে তখন কোন কোন দরবেশ হু-হক’ বলে চষ্কার করে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হয়। কেউ সটান শুয়ে পড়ে। এর মধ্যেই ভক্তবৃন্দ, যার যা সামর্থ্য, হুজুরের দরবারে নজরানা হিসাবে পেশ করতে থাকে। এক ছাত্র তার ফাউন্টেনপেনটিই পীর সাহেবকে দিয়ে দিল। আরেক শহুরে ভক্ত তার গায়ের কোটটি খুলে হুজুরের দরবারে পেশ করে দিল। পীর সাহেব এসব নজরানার ওপর নিজের হাত বুলিয়ে দেন আর তারপর সেগুলি কাওয়ালাদের সামনে রাখা হয়। মজলিস খুব জমজমাট হয়েছে; জামী, হাফিজ, খসরু, ইকবাল, খাজা ফরীদ সকলের
৭৩
গজলই গাওয়া হয়েছে।
রাত দেড়টার দিকে পীর সাহেব ডানে ও বামে তাকিয়ে অফিসার এবং গণ্যমান্য ব্যক্তিদের আরেকটি মজলিসে আমন্ত্রণ জানালেন এবং তারপরই কাওয়ালির মজলিস খতম হয়ে গেল।
এটি উঁচুস্তরের সাংস্কৃতিক মজলিস। দরগার পাশেই শামিয়ানা টানিয়ে তাবু ঘেরাও করে এই মজলিসের আয়ােজন করা হয়েছে। লাহাের, মুলতান ও লায়ালপুর থেকে আগত শিল্পীরা এখানে গাইবেন। এ মজলিস অফিসারদের খুশী করার জন্য এখানে সাধারণ মুরীদদের প্রবেশ নিষিদ্ধ।
তাবুতে প্রবেশ করেই পীর সাহেব সােনালী রঙের নক্সাদার জুবা খুলে ফেললেন। মাথার পাগড়িটিও খুলে বিশেষ এক খাদেমের কাছে দিলেন। খাদেম রূপার পাত্রে পাগড়িটি ধারণ করে বেরিয়ে গেল। এই পাগড়ি এখন কোথায় যাবে, কেউ জানে না। পাগড়ি একটি পবিত্র পােশাক। আউলিয়া কেরামদের উত্তরাধিকার। এর ফজিলত ও মর্যাদা সর্বজন স্বীকৃত। কিন্তু আলােচ্য এই পীর সাহেবের পাগড়িটি নিয়ে খাদেম এখন কোথায় গেল, কেউ তা জানে না। হয়তাে কর্মকার নবী বখশের বাড়িতে, নয়তাে রওশন দীন মিস্ত্রীর ঘরে কিংবা চেরাগ আলী চাষীর ঘরে পৌঁছেছে। খাদেম ঘরে এক চক্কর দিয়ে নীরবে বেরিয়ে আসবে। এই নীরবতাই ঘরের মালিককে ঘােষণা করবে ‘হে মালিক, হজরত কেবলা তােমার ঘরে অবস্থান করে তােমার স্ত্রী ও কন্যাদের ফয়েজ দান করার জন্য নির্বাচন করেছেন। এখন তুমি যদি চাও, তােমার ওপর খােদার রহমত নাজিল হােক, তােমার ক্ষেতে ফসল বেশী ফলুক, তােমার ঘর আগুন লেগে পুড়ে না যাক, তােমার গবাদি পশু গুম হয়ে না যাক, তবে খােশ-খুশী, রাজী হয়ে যাও।’ “মালিক আমার ঘরে পাগড়ি এসে গেছে। খােদার দোহাই, আমাকে বাঁচাও।।
সাকিনা বেগম
পিতা-গােলাম মােহাম্মদ
সাকিন রহবানা। ……”
এই চিঠিটি একদিন ডাক মারফত আমার হস্তগত হয়। আমি একবার নয় দু’বার পড়লাম, কিছুই বুঝতে পারলাম না। আমি ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ অফিসার, অনেকের কাছে জিজ্ঞসা করে পাগড়ির রহস্য কিছুই উদ্ধার করতে পারলাম না। বিষয়টি শেষ পর্যন্ত দেখার উদ্দেশ্যে সেই রাতেই আমি গােপনে সাকিনা বেগমের ঠিকানায় গিয়ে হানা দিলাম। সাকিনা বেগম তাে বেঁচে গেল, কিন্তু পরিতাপের বিষয়, কুটিল পাগড়িটি আমি কখনাে ধরতে পারলাম না।
৭৪

ফাউন্টেন পেন
কাশ্মীরের মীর ওয়ায়েজ মােঃ ইউসুফ-এর কাছ থেকে আরেকজন ভন্ড পীরের একটি চমৎকার ঘটনা জানা গেছে।
এই পীর সাহেবের নিয়ম ছিল, তিনি বিভিন্ন রােগ-ব্যাধি ও বিপদগ্রস্তদের মুক্তির জন্য কিংবা বলা যায়, মুশকিল আসানের জন্য প্রতি বৃহস্পতিবারে তাবিজ লিখে দিতেন। প্রথম যখন ফাউন্টেনপেন বাজারে আসে, তখন তিনি এটাকে তার নিজের কেরামতির অন্তর্ভূক্ত করে নিলেন। বৃহস্পতিবার এলেই তিনি আগে থেকে দোয়াতের কালি ফেলে দিয়ে খালি দোয়াত সামনে রেখে দিতেন। অবশ্য কালি ভরা ফাউন্টেনপেনটিও একই জায়গায় রেখে দিতেন। দূর-দূরান্ত থেকে ভক্তেরা আসত এবং সাধ্যানুযায়ী নজরানা পেশ করে নিজের বা স্বজনের অসুবিধার কথা জ্ঞাপন করে তাবিজ চাইত। পীর সাহেব তাবিজ লেখার জন্য ফাউন্টেনপেনটি উঠিয়ে দোয়াতে ঢুকিয়ে বলতেন, “কি মুসিবত, কালি যে শেষ হয়ে গেছে। ঠিক আছে আগামী বৃহস্পতিবার আসেন। নিরাশ হয়ে ভক্ত যখন চলে যাবার জন্য ঘরের বাইরে বেরুতে, পীরের পূর্ব নির্ধারিত দালাল তাকে বুঝিয়ে দিত, কিভাবে হুজুরের কেরামতি শক্তিকে জাগাতে হয়। হুজুরের কেরামতি অসীম। নজরানা বাড়িয়ে দিলে খালি কলম থেকেও কালি বেরুতে পারে। ভক্ত ফিরে এসে দুই-তিন গুণ নজরানা পেশ করে অনুনয়-বিনয় করতে থাকে। হুজুর বলেন, “কি আপদ, তুমি দেখছি নাছােড়বান্দা। ঠিক আছে, আল্লাহ মালিক’ বলে তিনি কিছুক্ষণ ঠোট নাড়াচাড়া করে ফাউন্টেনপেনটিতে ফু দেন। তারপর খালি দোয়াতে কলম ঢুকিয়ে তাবিজ লেখা শেষ করেন। ভক্তের বিস্ময়ের সীমা থাকে। পকেট যে খালি, না হয় আরাে কিছু দিতেন।

ভি,আই,পি লাউঞ্জ
বিমান বন্দরের ভি,আই,পি, লাউঞ্জ হচ্ছে দেশের ব্রাহ্মণ শ্রেণীর লােকদের তাবৎ শূদ্রদের দৃষ্টি ও নাগালের বাইরে রাখার ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা। রাষ্ট্রপ্রধান কিংবা বিদেশী রাষ্ট্রীয় অতিথিদের ক্ষেত্রে এ ব্যবস্থার প্রয়ােজনীয়তা স্বীকার্য বটে, কিন্তু স্বাধীন দেশের মন্ত্রী, রাষ্ট্রদূত ও উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মচারীদের জন্য এটা লজ্জার বিষয়। তারা যদি সাধারণ লাউঞ্জ দিয়ে যাতায়াত করেন, তাতে এটা অবশ্যম্ভাবী নয় যে, অন্য যাত্রীদের সঙ্গে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে যেতে হবে এবং নিজেদের ব্রাহ্মণত্বের হানি ঘটবে। আসলে ভি,আই,পি অভিধা স্বাধীন দেশের অফিসারদের মন-মানসিকতা বিগড়ে দিয়েছে।
আমার তিরিশ বছরের সিভিল ব্যুরােক্রেসির চাকরি জীবনে মাত্র দু’একবার ভি,আই,পি, লাউঞ্জে গিয়েছি, তাও আমার পি,এ, অথবা পি,এস-এর পীড়াপীড়িতে।
৭৫
পি,এস-এর পীড়াপীড়িতে একবার আমি করাচীর ভি,আই,পি লাউঞ্জে গিয়ে বসলাম। প্রােটোকল অফিসার খাই-খাই করে দৌড়ে এলেন, বললেন, আপনি কি ভি,আই,পি? ভেরি ইম্পর্টেন্ট পারসন?’ প্রতিটি শব্দ যেন তিনি চিবিয়ে চিবিয়ে উচ্চারণ করলেন।
আমি দুষ্টুমি করে বললাম, না ভাই, আমি নিজেকে তেমন কিছু মনে করি না।’
– ‘তাহলে আপনি এখানে বসেছেন কেন? সাধারণ লাউঞ্জে চলে যান।’
আমি চলে যাওয়ার জন্য যখন প্রস্তুত হচ্ছি, ঠিক তখন আমার পি,এস, সেখানে এসে উপস্থিত। প্রােটোকল অফিসারের সঙ্গে তার কি কথা হল, জানিনা, সঙ্গে সঙ্গে উক্ত প্রটোকল অফিসার আমার কাছে এসে বললেন, স্যার আমি লজ্জিত। আমাকে ক্ষমা করুন। আপনি তাে স্যার, পরিচয় গােপন করেছেন। আমি বললাম, “আপনার লজ্জিত হওয়ার কি আছে; লজ্জিত হওয়া উচিত তাদের, যারা নিজেদের সত্যি সত্যি ভি,আই,পি, মনে করে।’
আমার কথা শুনে যুবক অফিসার বললেন, “স্যার, আপনি কোন্ দুনিয়ার কথা বলছেন? ভি,আই,পি তাে এখন আর তেমন গণ্যমান্যতার মধ্যে পড়ে না। এর উপরে আরও একটি ধাপ হয়েছে-তিতি,আই,পি (ভেরি ভেরি ইম্পর্ট্যান্ট পারসন)।
৭৬