You dont have javascript enabled! Please enable it! Draft - সংগ্রামের নোটবুক

This is a temporary post for collecting data. Not for posting and not for publishing. Saved only as readable for the editors. Not clickable and not downloadable.

পরাজিত পাকিস্তানী জেনারেলদের দৃষ্টিতে মুক্তিযুদ্ধ
মুনতাসীর মামুন

পাকিস্তানীদের দৃষ্টিতে পাকিস্তান ভাঙল কেন?
পাকিস্তান কেন ভেঙেছে বাঙালিদের তা নতুন করে বােঝাবার কিছু নেই। আমরা যারা বড় হয়েছি পাকিস্তানী আমলে তারা সেটি হাড়ে-হাড়ে জানি, হয়ত জানে না এ-প্রজন্ম। কিন্তু পাকিস্তানীরা কি জানে পাকিস্তান কেন ভেঙেছে? কারা। এর জন্য দায়ী? না, তেমনভাবে তারা জানে না। তাদের ধারণা এ-বিষয়ে তেমন। স্বচ্ছ নয়। এটি মনে হয়েছে সম্প্রতি পাকিস্তান সফর করে। প্রকাশক মহিউদ্দিন। আহমদ ও আমি সম্প্রতি দিন বিশেক পাকিস্তান সফর করেছি। কথা বলেছি। রাজনীতিবিদ, প্রাক্তন সামরিক-বেসামরিক আমলা, অধ্যাপক, সাংবাদিক, ছাত্রদের। সঙ্গে। তবে সঙ্গে সঙ্গে আমাদের এটাও মনে হয়েছে, এ-নিয়ে তাদের যে পূর্ব ধারণা ছিল, সেটি এখন ধীরে ধীরে বদলাচ্ছে। এর কারণ, পাকিস্তানের বর্তমান জাতিগত সমস্যা। তাছাড়া বিভিন্ন পর্যায়ে বাঙালি-পাকিস্তানীদের আলােচনা হচ্ছে। প্রযুক্তিগত উন্নতির কারণে পাকিস্তানীরা অনেক তথ্য জানছে। সম্প্রতি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের মন্তব্য এতে নতুন করে ইন্ধন যুগিয়েছে। বাঙালিদের। কাছে পাকিস্তানের মাফ চাওয়া উচিত—এ-বিষয়ে পত্রপত্রিকায় যে-বিতর্ক হচ্ছে তাতেও বিভিন্নভাবে উল্লেখ করা হচ্ছে পাকিস্তান ভাঙার কারণগুলাে। আমাদের সঙ্গে আলাপে বিভিন্ন জন এ-বিষয়গুলাে নিজেরাই তুলে ধরছেন এবং অনেক কথা। স্বীকার করছেন বা স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছেন। পাকিস্তানীদের দৃষ্টিতে পাকিস্তান। ভাঙার কারণগুলাে মােটামুটি কয়েক ভাগে ভাগ করা যেতে পারে
১. দুই প্রদেশের মধ্যে পার্থক্য
২. শাসকচক্রের দৃষ্টিভঙ্গি
৩. তাৎক্ষণিক কারণ।
এখানে উল্লেখ্য যে, এই প্রতিটি বিষয় অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। আমাদের কাছে। বিষয়গুলাে নতুন নয়, কিন্তু পাকিস্তানীদের কাছে বিষয়গুলাে নতুন। রাষ্ট্র এমনভাবে সাধারণের মনােজগতে আধিপত্য বিস্তার করেছিল যে, এ-বিষয়ে তারা। ভাবে নি। সেই আধিপত্য এখন প্রশ্নের সম্মুখীন এবং বিস্মিত হয়ে তারা দেখছে। যে, বাঙালি বা শেখ মুজিবুর রহমান নয়, তারাই পাকিস্তান ভাঙার জন্য দায়ী। এ-বিষয়টি তাদের ব্ৰিত করে তুলছে। ১৯৭১ সালে যা ঘটেছে তার জন্যও মনে। অপরাধবােধ জাগছে। হয়ত এ-কারণেই আমাদের সঙ্গে অনেকে খােলাখুলি কথা
বলেছেন, পত্রপত্রিকায়ও বিষয়গুলাে আলােচিত হচ্ছে। কেন্দ্রে যারা শাসন করেছে তারা কি পূর্ববাংলা বা পূর্বপাকিস্তানকে নিজেদের অংশ বলে মনে করেছে? না, করে নি। করলে হয়ত দু’দেশের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি হতাে না। মনােভঙ্গিও অন্যরকম হতাে। শুরু থেকেই পূর্বপাকিস্তানের প্রতি বিরূপ মনােভাবের সৃষ্টি করা হয়েছে এবং তা করেছে সরকারি প্রচারণা এবং সংবাদপত্র। সাংবাদিকরা বলেছেন, পশ্চিম পাকিস্তানের উর্দু প্রেস’ ডানপন্থী এবং সরকারমুখী। ফলে সাধারণের মধ্যে পূর্বপাকিস্তান সম্পর্কে কিছু ধারণার সৃষ্টি করা হয়েছিল। এ-পূর্ব ধারণা কী? পূর্ব ধারণা হলাে, পূর্বপাকিস্তানের বাঙালি ভারতীয় অর্থাৎ হিন্দু-প্রভাবান্বিত। তাই বাঙালিরা সমপর্যায়ের হতে পারে না। সমপর্যায়ের যেহেতু নয় সেহেতু তাদের প্রতি সমপর্যায়ের ব্যবহারও চলে না। মেজর জেনারেল তােজাম্মেল হােসেন মালিক (অব.) পঞ্চাশ ও ষাট দশকে ছিলেন পূর্বপাকিস্তানে। সম্প্রতি তাঁর আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন—নিরপেক্ষ যে-কোনাে পর্যবেক্ষকের চোখেই ধরা পড়ত যে, পশ্চিমপাকিস্তানীরা বাঙালিদের “নিগার’ হিসাবে মনে করত। বিশেষ করে সেনাবাহিনী। একটি ঘটনার তিনি উল্লেখ করেছেন। একবার এক সেনা অফিসার কুলাউড়া স্টেশনে চল্লিশ মিনিট ট্রেন থামিয়ে রেখেছিলেন। কারণ তিনি একটি মিটিংয়ে ছিলেন, কিন্তু তাকে যেতে হবে। সেই ট্রেনে। আমি যখন বাংলাদেশের আমলাতন্ত্রের ওপর গবেষণা করছিলাম তখন এক উচ্চপদস্থ আমলা আমাকে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেছিলেন। গুরমানি ছিলেন পাঞ্জাবের গবর্নর। তিনি একবার একজন উচ্চপদস্থ বাঙালি আমলাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “আচ্ছা, পূর্বপাকিস্তানে যে-সব রাজনীতিবিদ ও আমলা শাসন করছেন তারা সমাজের কোন স্তর থেকে এসেছেন?’ ভদ্রলােক উত্তর দিয়েছিলেন, ‘সাধারণ স্তর থেকে।’ গুরমানি তখন বলেছিলেন, ‘ইফ উই হ্যাভ টু লিভ উইথ পিপল অফ ডাস্ট ফ্রম ইস্ট পাকিস্তান, তাহলে তাে চলবে না।’ বেনজির ভুট্টোও কথাচ্ছলে আমাদের বলছিলেন, আসলেই বাঙালিদের সমভাবে দেখা হতাে না। তারা তখন বাস করতেন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয়মন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিনের বাসার কাছে। দু’পরিবারের মধ্যে যাতায়াত ছিল। বেনজির বলছেন, তারাও তখন বলতেন, তাঁদের প্রতি মর্যাদাপূর্ণ ব্যবহার করা হয় না। খালিদ মাহমুদ করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক। ১৯৬৩-৬৪-এর সময় ঢাকায় ছিলেন। তাদের পারিবারিক ব্যবসা ছিল এখানে। তিনি জানিয়েছেন, বাঙালিদের নিচু চোখে দেখা হতাে। তাদের প্রতি খারাপ ব্যবহার করা হতাে। এ-বছর প্রথমবারের মতাে পাকিস্তানে বাংলাদেশ হাইকমিশনে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন পালিত হয়েছিল। সেখানে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন প্রখ্যাত ঐতিহাসিক আহমেদ হাসান দানি। গত পনেরাে বছর ধরে আমি তাকে চিনি। কখনও তাকে ক্রুদ্ধ হতে দেখি নি। এই প্রথমবার দেখলাম আবেগ তাঁকে প্রভাবান্বিত করেছে। তিনি অভিযােগের সুরে বলছিলেন, পশ্চিমপাকিস্তানীরা সবসময় বাঙালিদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছে। আমি তার সাক্ষী। যেহেতু আমি পূর্বপাকিস্তানে ছিলাম, আমার প্রতিও খারাপ ব্যবহার করেছে। বাঙালিরা স্বাধীনতা চাইবে তাতে অবাক হওয়ার কী আছে? যেহেতু, পূর্বপাকিস্তানের মানুষ বাঙালি, সুতরাং তারা হিন্দু-ভাবাপন্ন। বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী হত্যার জন্য দায়ী রাও ফরমান আলি লিখেছেন এবং বলেছেন, হিন্দুরা পূর্বপাকিস্তানীদের মনে প্রভাব বিস্তার করেছিল। মে. জেনারেল উমর, যিনি ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা কাউন্সিলের সচিব ছিলেন, তারও সেই মত। হিন্দু-ভাবাপন্ন বলতে তারা বােঝাতে চেয়েছেন, ভারত দ্বারা প্রভাবান্বিত। পাকিস্তানের প্রচারমাধ্যম সবসময় ভারতকে প্রধান শত্রু বলে চিহ্নিত করেছে। সুতরাং লজিকটি হলাে এই যে, বাঙালিরা, যেহেতু হিন্দু-প্রভাবান্বিত সেহেতু তারা ভারতে বিশ্বাসী অর্থাৎ কম পাকিস্তানী, সেহেতু তারা শত্রু এবং এ-ধারণা এমনভাবে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে যে, অনেক স্বচ্ছ-চিন্তার মানুষও এ-প্রশ্নে দ্বিধান্বিত। বিষয়টি কেমন ‘ইন-বিল্ট’ তার একটি উদাহরণ দিচ্ছি। আমি আর মহিউদ্দিন আহমদ গিয়েছি জেনারেল নিয়াজির বাসায় তার সাক্ষাতকার নিতে। নিয়াজির দুই মেয়েও ছিলেন সেখানে। তারা একপর্যায়ে জিজ্ঞেস করলেন, আমরা মুসলমান কি না? মহিউদ্দিন ভাই একটু চটে উত্তর দিলেন ‘আমার নাম মহিউদ্দিন আহমদ। খানিক পর আমাকে দেখিয়ে নিয়াজির ছােটমেয়ে মহিউদ্দিন ভাইকে জিজ্ঞেস করলেন উনি কি হিন্দু?’ মহিউদ্দিন ভাই উত্তর দিলেন, তার নাম মুনতাসীর উদ্দিন খান মামুন’।
“ওহ, তিনি পাঠান!’
‘না’, গম্ভীরভাবে উত্তর দিলেন মহিউদ্দিন ভাই, তিনি মুঘল’। মর্যাদার দিক থেকে মুঘলরা ওপরে। এ-উত্তরে তারা খানিকটা চুপসে গেলেন।
এ-তাচ্ছিল্যের প্রতি ইঙ্গিত করে ব্রিগেডিয়ার এ আর সিদ্দিকী একটি মন্তব্য করেছেন। পাকিস্তান হওয়ার পর কায়েদে আজম প্রথম ঢাকা না গিয়ে করাচি এলেন কেন? তার তাে ঢাকা যাওয়া উচিত ছিল। কারণ পাকিস্তানের ৫৬ ভাগ মানুষ সেখানে বাস করতেন। মহিউদ্দিন আহমদ এবং আমি অনেককে জিজ্ঞেস করেছি, আচ্ছা, বাঙালিরা যদি হিন্দু-ভাবাপন্ন, ভারতীয় প্রভাবান্বিত হয় তাহলে এ-প্রশ্নগুলাের উত্তর দিন—মুসলিম লীগ হয়েছিল ঢাকায়; এ কে ফজলুল হক পাকিস্তান প্রস্তাব করেছিলেন যার স্মরণে নির্মিত হয়েছে ‘মিনার-ই-পাকিস্তান’। বাঙালিদের ভােটে পাকিস্তান এসেছে। তাহলে তারা হিন্দু/ভারত-ভাবাপন্ন হয় কিভাবে? বলা বাহুল্য, এর উত্তর তাদের পক্ষে দেয়া সম্ভব হয় নি। এর উত্তরে তারা আমতা-আমতা করেন। জেনারেল উমর বললেন (বা এখন তারা বলছেন), বাঙালিরা বহুত পেয়ারে, সাচ্চা মুসলমান।’ রাও ফরমান আলী ও নিয়াজির মতাে লােকও বললেন, বাঙালিদের মুসলমানত্ব বেশি। পশ্চিমপাকিস্তানীদের থেকে ধর্মে তারা বেশি মনােযােগী।

নিয়াজি ও তার দুই মেয়েকে আমি সিরিয়াসভাবে বললাম, আপনাদের এখানে এসে আমার খুব খারাপ লাগছে। আপনারা এত প্রাে-হিন্দু ও প্রাে-ইন্ডিয়ান, ডিসগাসটিং।’ মহিউদ্দিন ভাই অনেক কষ্টে গম্ভীর থাকলেন। তারা সিরিয়াসলি বললেন, কিভাবে?’ যেখানে যাই’, বললাম আমি ‘ভারতীয় গান, কাজল, পূজা ভাট—এদের পােস্টার, হিন্দি ভিডিয়াে।’ দুই মেয়ে তখন সমস্বরে বললেন, ‘না, না, সেটি তাে অন্য ব্যাপার’ ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু নিয়াজি গম্ভীরভাবে বললেন, আমি পাকিস্তানী গান শুনি না, হিন্দি গানও শুনি না। আমি ইংরেজি গান শুনি। জামাতে ইসলামের সহ-সভাপতি আবদুল গফুর বরং আমাদের প্রশ্নেরই প্রতিধ্বনি করেছেন অন্য অর্থে। তিনি বলেছেন, শেখ মুজিব মুসলমান, বাঙালিরাও মুসলমান। না হলে তারা পাকিস্তান চেয়েছিল কেন? আর মুজিব তাে ভারতের এজেন্ট ছিলেন না। ১৯৭১ সাল একদিনে হয় নি। এর পেছনে পুঞ্জীভূত অনেক কারণ ছিল— এ-কথা কম-বেশি অনেকে বলেছেন এবং লিখছেন। এম এইচ আসকারি পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রবন্ধে লিখেছেন—এটি ছিল দীর্ঘদিনের প্রক্রিয়া। ১৯৪৭ থেকে পাকিস্তানের প্রভাবশালী গােষ্ঠীরা এমন নীতি কার্যকর করেছে যা দুই অংশের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক পার্থক্য না ঘুচিয়ে বরং দূরত্ব সৃষ্টি করেছে। প্রতিটি সরকারের রুলিং এলিটস’রা এ-ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে, ‘Not much different from the murder plot in Agatha Christies Murder in the Orient Express’, পাকিস্তান মানবাধিকার কমিশনের প্রধান, সাংবাদিক আই এ রেহমানও একই মন্তব্য করেছেন। তিনি বলছেন, এই পার্থক্য ক্রমেই বাড়ছিল এবং শাসকরা। ধর্মের ধুয়া তুলে এ-পার্থক্য ঢাকতে চেয়েছিল।’ ভুট্টোর একসময়ের ঘনিষ্ঠ সহযােগী, প্রাক্তন ফেডারেল মন্ত্রী ড. মুবাশ্বির হাসান বলেছেন, এককথায় বলা যেতে পারে পাকিস্তানে ছিল একটি ইন্টার্নাল কলােনিয়াল সিস্টেম’। পূর্বপাকিস্তান ছিল কলােনি যার টাকাতে আমরা চলেছি। অধ্যাপক খালিদ মাহমুদ বললেন, শেখ মুজিব একবার ইসলামাবাদে এসেছিলেন। সেখানে বক্তৃতা দেয়ার সময় নিঃশ্বাস টেনে বলেছিলেন, পাটের গন্ধ পাচ্ছি। অর্থাৎ তিনি বলতে চেয়েছিলেন, ইসলামবাদ তৈরি হচ্ছে পূর্বপাকিস্তানের পাটের টাকায়। জেনারেল তােজাম্মেল লিখেছেন, পূর্বপাকিস্তানে গ্রাম-শহরের মানুষরা ছিল গরিব। যে-কোনাে উন্নয়নই হােক-না কেন টাকা-সম্পদ জমা হচ্ছিল কয়েকজনের হাতে। এদের মধ্যে পশ্চিমপাকিস্তানীরাও ছিল, যাদের ব্যবসা ছিল এখানে। পূর্বপাকিস্তানে। যা হয়েছে তার জন্য হিন্দুরা দায়ী এ-কথা বলার অর্থ নিজেদের ফাঁকি দেয়া। এমএ নকভি পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক, ১৯৭১ সালের ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে তিনি সে-সময় ‘ডন’ পত্রিকায় লেখা পাঠিয়েছিলেন। ‘ডন’ ছাপে নি। তখন তিনি ‘ডন’-এ লেখা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন পঞ্চাশের দশকে, বিদেশী অর্থনীতিবিদরা দুই প্রদেশে এক সমীক্ষা চালিয়ে বলেছিলেন, পশ্চিমপাকিস্তানে কৃষিখাতের সম্ভাবনা বেশি। সুতরাং পশ্চিমপাকিস্তানে কৃষিতে ও পূর্বপাকিস্তানে শিল্পে বিনিয়ােগ করা হােক। এ-নীতি গ্রহণ করা হয় নি। চৌধুরী মােহাম্মদ আলি আমার বন্ধু নাজিউল্লাহকে বলেছিল, পূর্বপাকিস্তানে কেন শিল্প স্থাপন করবে? এগুলাে চলে যাবে। দু’দেশের মধ্যে পার্থক্য কেমন ছিল সাক্ষাতকার যারা দিয়েছেন তারা বিভিন্ন উদাহরণের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। তারা একসময় পূর্বপাকিস্তানে কর্মরত ছিলেন। তারা এখন বলতে চাচ্ছেন, এই পার্থক্য নিরসনে তারা প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। প্রতিরক্ষার কথা ধরা যাক। জেনারেল উমর বলছেন, ষাটের দশকে তিনি। ছিলেন ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে। তখন পূর্বপাকিস্তানে কোনাে গােলন্দাজবাহিনী ছিল।
বিমানবহরে ছিল মাত্র ছয়টি এয়ারক্রাফট, একটি মর্টার ব্যাটারি। ছিল না কোনাে ট্যাংক রেজিমেন্ট। তখন বলা হতাে পূর্বপাকিস্তানের প্রতিরক্ষা পশ্চিমপাকিস্তানে ন্যস্ত। এটি ছিল একটি বােগাস থিউরি। জেনারেল তােজাম্মেলও একই কথা বলেছেন। আলতাফ গওহর তার সাক্ষাতকারে জানিয়েছেন, বাঙালিরা পশ্চিমপাকিস্তানী বা পশ্চিমপাকিস্তানের বিরুদ্ধে ছিল না। তারা কেন্দ্রের কিছু নীতির বিরুদ্ধে ছিল, যা ছিল যুক্তিযুক্ত। আইয়ুব খান বাঙালিদের দাবির ‘মেরিট’ বােঝেন নি। আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেন, বাঙালিদের সেনাবাহিনীতে নেয়া হচ্ছে না। উত্তরে তিনি বললেন, ব্রিটিশরা এই নীতি করেছে। আমি বললাম, গুর্খাদের তাহলে তারা সেনাবাহিনীতে কেন নিয়েছিল?’ অর্থাৎ আকৃতির দিক থেকে তাে খারাও খর্বকায় ছিল।
আলতাফ গওহর আরও বলেছেন, ‘বাঙালি অফিসারদের গুরুত্বপূর্ণ কোনাে পােস্টিং দেয়া হয় নি। কেন্দ্রে এ কে খান, হাফিজুর রহমান, জাস্টিস ইব্রাহিম জোরালােভাবে বাঙালিদের দাবি তুলে ধরেছিলেন। অন্যদিকে আইয়ুব খান যা শুনতে ভালােবাসতেন মােনেম খান, সবুর খান তা-ই বলতেন। যে তিন জন পূর্বপাকিস্তানীদের দাবি তুলে ধরছিলেন ১৯৬৩ সালে আইয়ুব খান তাদের মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেন।’ আলতাফ গওহর আরও জানাচ্ছেন, কেন্দ্র প্রদেশগুলাের অর্থনৈতিক অধিকার কেড়ে নিয়েছিল এবং পূর্বপাকিস্তানকে ক্রমান্বয়ে কেন্দ্রের ওপর নির্ভরশীল করে তােলা হচ্ছিল। পাটের আয় কেন্দ্রকে দেয়া হয়েছিল। নূরুল আমীন পর্যন্ত বলেছিলেন, এ কী, আমাদের ফকির করে দিচ্ছ। তােমাদের ওপর নির্ভর করে তুলছ। তার মতে, “Unfair distribution of national resources was at the root of this.” কামারউল ইসলাম আইসিএস অফিসার। ছিলেন পাকিস্তানের পরিকল্পনা কমিশনের সচিব ও ডেপুটি চেয়ারম্যান। তিনি বললেন, ‘দু’প্রদেশের মধ্যে পার্থক্য ছিল। বাঙালিদের প্রতিনিধিত্ব ছিল না কেন্দ্রে। এর যে চরম প্রতিক্রিয়া হবে তা বুঝতে পারি নি। পূর্বপাকিস্তান কখনও তার ‘শেয়ার’ পায় নি।’ এ-নীতি কারা প্রয়ােগ করেছিলেন? এয়ার ভাইস মার্শাল আসগর খান বলেছেন, শাসকচক্র ক্ষমতা চেয়েছিল, আমরা নিয়ন্ত্রিত হই সামন্ত শ্রেণী দ্বারা। মধ্যশ্রেণী ক্ষমতায় আসুক তা তারা চায় নি। এম এ নকভি বলেছেন, পূর্বপাকিস্তানে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বিলােপে। বজ্রপাতের মতাে কাজ করেছে। পশ্চিমপাকিস্তানী শাসকদের মনে হয়েছে, এরা সব বিপ্লবী। জমিদারদের হটিয়ে দিয়েছে। কারণ, পশ্চিম পাকিস্তানের সংসদসদস্যরা ছিল ভূস্বামী, নিজ জমিদারিতে যাদের ক্ষমতা ছিল অপ্রতিহত। এদের সহযােগী ছিল সামরিক ও বেসামরিক আমলাবৃন্দ যাদের অনেকে। আবার ছিলেন সামন্ত-পরিবারের অংশ। এই তিন গােষ্ঠী মিলে সৃষ্টি করেছিল। পশ্চিমপাকিস্তান তথা কেন্দ্রীয় শাসকচক্র। মেরাজ মােহাম্মদ ১৯৭১ সালে ছিলেন পিপিপি’র প্রভাবশালী তরুণ নেতা। তিনি বললেন, রুলিং এলিট ও আর্মি, সেকুলারিজম, অ্যান্টি ফিউডালিজম ও ডিলিশন অব পাওয়ার বরদাশতে রাজি ছিল না। জেনারেল ইয়াহিয়া যখন বলেছিলেন শেখ মুজিব পাকিস্তানের পিএম হবেন তখন ভুট্টো বলেছিলেন, তা হতে পারে না। এর অর্থ যে-ক’টি উপাদানকে শাসকচক্র ভয় করে মুজিব তাে তাদের পক্ষে। ব্রিগেডিয়ার এ আর সিদ্দিকী বলেছেন, “আর্মি সহানুভূতিশীল ছিল পশ্চিমপাকিস্তানের প্রতি আর ভুট্টো ছিলেন তাদের মুখপাত্র।’ পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ফারুক আহমেদ লেঘারি সামন্ত-পরিবারের এবং ছিলেন সিএসপি। বাংলাদেশে তিনি এসডিও এবং এডিসি হিসাবে কাজ করেছেন। তিনি বললেন, আমি তখন নিম্নপদের কর্মকর্তা ছিলাম। কিন্তু পাঞ্জাবি ও পশ্চিমপাকিস্তানী সিনিয়র ব্যুরােক্রাটদের দেখেছি বাঙালিদের হেয় চোখে দেখতেন। এমন ভাব করতেন যেন, পূর্বপাকিস্তানকে দয়া করে তারা কিছু দিচ্ছেন। এবং বাঙালিদের অসন্তোষের মূল কারণ ছিল এটি। রেহমান সােবহান ও অন্য অনেকের ফিলিং ছিল ইস্ট পাকিস্তানের ক্ষেত্রে ডিসক্রিমেনেট করা হচ্ছে।’ লেঘারি মনে করেন, এর সবটাই ঠিক নয় কিছুটা অতিরঞ্জন ছিল। সিএসপি অফিসার মাসুদ মুফতি ১৯৭১ সালে ছিলেন পূর্বপাকিস্তানের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব। যুদ্ধবন্দি হিসাবে ছিলেন ভারতে। পাকিস্তানের প্রাক্তন সচিব ও মন্ত্রী রােয়েদাদ খানের বাসায় তার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। এখন তিনি অবসরপ্রাপ্ত এবং কলামিস্ট—লেখক হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছেন। আলাপ চলাকালে তিনি বলেছিলেন, ‘আর্মি ফিউডাল এক্সিস যে-কোনাে উপায়ে আধিপত্য বজায় রাখতে চেয়েছিল এবং পূর্বপাকিস্তানকে তারা হুমকি মনে করেছিল। কারণ, বাঙালিরা রাজনৈতিকভাবে সচেতন ও উচ্চকণ্ঠ। ‘পশ্চিমপাকিস্তানীরা ঐতিহ্যগতভাবে সামন্তপ্রথার কারণে নমিত ও নির্যাতিত। সেনাবাহিনীকে বাঙালিরা বিচার করেছে “অবজেকটিভ সিটিজেন” হিসাবে।
পশ্চিমপাকিস্তানীরা ঐতিহ্যগতভাবে সেনাবাহিনীকে দেখেছে চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্র হিসাবে।’ এই ভয় বা হুমকির কথা প্রায় সবাই বলেছেন বিভিন্নভাবে। জামাতের আবদুল গফুর বলছেন, পূর্বপাকিস্তানীরা ছিল অধিক গণতন্ত্রমনা। পাশ্চমপাকিস্তানীরা ভেবেছে এদের নিয়ন্ত্রণে রাখা মুশকিল হবে। জেনারেল উমর বলেছেন, ‘১৯৭১ সালে পলিসি ডিকটেট করেছে কয়েকজন, সাধারণ মুসলমানরা নয়। পাকিস্তান গঠিত হয়েছিল রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে, ১৯৫৮ সালের মার্শাল ল’ দিয়ে আমরা সে-প্রক্রিয়াকে রুদ্ধ করলাম, যার পরিণামে পাকিস্তান ভেঙে গেল। এছাড়া, পূর্বপাকিস্তানের লােকজন ছিল শিক্ষিত, নৈতিকভাবে সচেতন। তারা ভেবেছে এভাবে দেশ চলতে পারে না। আর পশ্চিমপাকিস্তানে তাে ছিল সামন্তসংস্কৃতি। সুতরাং মার্শাল ল’ তে তাদের কোনাে তিক্রিয়া হয় নি। আসগর খানের মতে, পশ্চিমপাকিস্তানের ক্ষমতা যারা নিয়ন্ত্রণ করতেন তারা ভেবেছিলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ফিউডালিজম থাকবে না, সুতরাং ক্ষমতায় তাদের আসতে দেয়া যায় না। আহমদ সেলিম ইসলামাবাদে আমার সঙ্গে আলাপ করার সময় বলেছিলেন, ৭০-এর নির্বাচনের পর পশ্চিমপাকিস্তানের
মন্ত-প্রভুদের কয়েকজন প্রতিনিধি মুজিবের সঙ্গে দেখা করে এ-আশ্বাস ৭.৮য়েছিলেন যে, পশ্চিমপাকিস্তানের জমিদারদের বিরুদ্ধে কিছু করা হবে না। কিন্তু, বের সঙ্গে তারা আলােচনা করতে পারেন নি। বাঙালিরা সচেতন, শিক্ষিত, গণতন্ত্রমনা। তারা জমিদারদের মানে না। তারা আইয়ুব খানকে গদিচ্যুত করেছে। জিন্নাহ থাকাকালীন ভাষা আন্দোলন করেছে। ‘যারা ক্ষমতায় এলে কী হবে! অধ্যাপক মাহমুদ বলেছেন, ব্যাপারটা ছিল • রকম। বাংলাদেশ ১৭ বছর ধরে ‘এক্সপ্লয়েটেড’ হয়েছে। কিন্তু, এবার তারা ক্ষমতায় এলে আমরা (প, পাক) এক্সপ্লয়েটেড হব। অর্থাৎ ক্ষমতা থেকে তাদের নানাে যাবে না। সুতরাং তাদের আটকাও।’ শাসকচক্র প্রকাশ্যে এসব কথা বলতে পারছিল না। তখন তারা নতুন এক ওর উদ্ভব করে যা আমরা খুব একটা জানি না। সেটি হচ্ছে ‘লায়াবিলিটি তত্ত্ব’। অৎ পূর্বপাকিস্তান কোনাে সম্পদ নয়, সেটি না থাকলেই পাকিস্তান অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নতি হবে। পূর্বপাকিস্তান পশ্চিমপাকিস্তানের কাঁধে। শাঝাস্বরূপ। এ-কথা প্রায় সবাই বলেছেন। এ-তত্ত্বের উদ্ভব ষাটের দশকে। কামারউল ইসলাম বলেছেন, আইয়ুব খান, কালাবাগের আমির, পরিকল্পনা মিশনের এমএম আহমেদের মত ছিল, পূর্বপাকিস্তানের আর দরকার নেই। ম আহমদ এ-কারণে হিসাবনিকাশ করে দেখিয়েছিলেন পূর্বপাকিস্তান ছাড়াও পাকিস্তান চলবে। এটি এখন লায়াবিলিটি। সুতরাং তাদের আর কোনাে -লিটিক্যাল কনসেশন দেয়ার দরকার নেই। আব্দুল গফুরও প্রায় একই কথা

১৫

বলেছেন। এম এ নকভি স্পষ্টভাবে বলেছেন, ১৯৬৫-এর দিকে পরিকল্পনা কমিশনের পশ্চিমপাকিস্তানী সদস্য এবং ব্যুরােক্রেটরা বলেছিল পূর্বপাকিস্তান লায়াবিলিটি। “উই শুড ডি ইস্ট পাকিস্তান। কারণ, এদের জনসংখ্যা বেশি, সম্পদ কম। এরা ক্ষমতার প্রতি নতজানু নয়। এরা আমাদের নিয়ন্ত্রণ করবে তা হতে পারে না। ১৯৬৯ সালে আইয়ুব খানের পতনের পর এই তত্ত্ব পশ্চিমপাকিস্তানী এলিটদের প্রভাবিত করেছিল। ১৯৭০-এর নির্বাচনের ফলাফল তাদের বিমূঢ় করে দিয়েছিল এবং এ-পরিপ্রেক্ষিতে তৈরি হয়েছিল ১৯৭১ সালের পটভূমি যাকে বলা যেতে পারে তাৎক্ষণিক কারণ। আই. এ. রেহমান আলােচনাকালে আমাদের যা বলেছিলেন প্রবন্ধাকারেও তা লিখেছেন। তার মতে, ১৯৭০-এর নির্বাচনের পর পূর্বপাকিস্তানের বাঙালিদের ধারণা হয়েছিল, ন্যায্য অধিকার থেকে তাদের বঞ্চিত করা হচ্ছে। আর পশ্চিমপাকিস্তানীদের বিশ্বাস করানাে হয়েছিল যে, বাঙালিরা জাতীয় ঐক্যের ধারণা বােঝে না কারণ তারা তা চায় না। এখন যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে যাতে মনে করা যেতে পারে যে, পূর্বপাকিস্তানকে তারা আর পাকিস্তানের অংশ হিসাবে দেখতে চাচ্ছিল না, যুদ্ধ ছিল অজুহাত। বা যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে তারা তাদের উদ্দেশ্য আড়াল করতে চাইছিল। তার ভাষায় “Sufficient evidence is now available to show that the event of 1971 were the consequence of the states ruling coterie’s decision to write of the eastern half of the country as a war loss thus betraying the people of both the wings in different ways and in different measure.” মুফতি মাসুদ আমাকে কয়েকদিন আগে একটি প্রবন্ধ পাঠিয়েছেন। সেখানেও তিনি অনেক কারণ দেখিয়ে একই কথা উল্লেখ করেছেন। এর মধ্যে দু’টি কারণ উল্লেখ করা যেতে পারে ১. হামুদুর রহমান কমিশন কেন প্রকাশ করা হলাে না? ২. যারা এ-ঘটনার জন্য দায়ী তাদের কেন শাস্তি হলাে না? তাঁর মতে, পূর্বপাকিস্তান গেল কিন্তু অজুহাতটি ছিল, শক্তিশালী শত্রুর হাতে পরাজিত হয়েছে পাকিস্তান। তাহেরা মাজহার আলি বলেছেন, সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্র চেয়েছিল, বাংলাদেশ আর পাকিস্তানের অংশ হিসাবে না থাকুক। বড় গােলমেলে জায়গা। ১৯৭১ সালে তাদের ইচ্ছা পূরণ হলাে। আরেকটি বিকল্পও ছিল। আকারেইঙ্গিতে এ-কথা অনেকে বলতে চেয়েছেন, কিন্তু রফিরাজা তা স্পষ্ট করে বলেছেন। রফিরাজা ছিলেন ভুট্টোর অন্যতম সহযােগী। তাঁর মতে, পিপিপির সবাই ও আরও অনেকে ভেবেছিল, আর্মি। অ্যাকশন হলে পূর্বপাকিস্তান ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। “বেঙ্গলিজ কুড বি শর্টেড আউট।” আর একবার ঠাণ্ডা হলে আরও কয়েক যুগ তাদের দমিয়ে রাখা যাবে। তাহলে কে দায়ী পাকিস্তান ভাঙার জন্য? এ-সব বিস্তারিত কারণ বা

পটভূমিকার কথা না তুলে যদি প্রশ্ন করা যায় তা হলে দু’ধরনের উত্তর পাওয়া যাবে। আমরা যাদের সাক্ষাতকার নিয়েছি তারাও দু’ধরনের উত্তর দিয়েছেন। উত্তর হলাে—১. দু’পক্ষই দায়ী; ২. ইয়াহিয়া-ভুট্টো-মুজিব বা ভুট্টো-ইয়াহিয়া-মুজিব দায়ী। যাঁরা বলছেন, দু’পক্ষই দায়ী, তাঁদের মতে, পশ্চিমপাকিস্তান হয়ত বেশি দায়ী, তবে পূর্বপাকিস্তান এতটা বাড়াবাড়ি না করলেও পারত। দ্বিতীয় উত্তরটির পক্ষে অধিকাংশ মানুষ। সবাই ভুট্টো-ইয়াহিয়াকে এক-দুই নম্বরে স্থান দিয়েছেন। রফিরাজা বলেছেন, ভুট্টো ও ইয়াহিয়ার একধরনের সমঝােতা ছিল যা হয়ত অন্য কেউ জানত না। আবদুল গফুরও তিন জনকে দায়ী করেছেন। ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিকির উত্তরটা একটু আলাদা। তিনি বলছেন, বাংলাদেশ আলাদা হতে চায় নি। মেরাজ মােহাম্মদ বলছেন, পাকিস্তান ভাঙার জন্য ভুট্টো দায়ী। নিজেদের ফিউডাল সিস্টেমকে বাঁচাবার জন্য তিনি পাকিস্তান ভেঙেছিলেন। আলমদার রাজা যে রিট পিটিশন করেছেন তাতেও তিন জনকে দায়ী করেছেন। এঁদের অধিকাংশকে একটি প্রশ্ন করেছিলাম। সম্প্রতি পাকিস্তানে একটি নির্বাচন হয়েছে? হঁ্যা। নওয়াজ শরীফ জিতেছেন? হ্যা। তাহলে বেনজির ভুট্টো পার্লামেন্টে কেন গেলেন? তিনি কেন বলছেন না পার্লামেন্টে যাওয়ার আগে রেস্তরাঁয় বসে তার সঙ্গে আলাপ করতে হবে? উত্তর, না তা কী করে হয়! ঠিক আছে, বলি আমি! ১৯৭০ সালে সারাপাকিস্তানে একটা নির্বাচন হয়েছিল? হ্যা। আওয়ামী লীগ জিতেছিল? হ্যা। তাহলে ক্ষমতা তাকে হস্তান্তর করতে হবে? হ্যা। তবে আ. লীগ ৬ দফা চেয়েছিল যা পাকিস্তান ভাঙার সামিল। ঠিক আছে, বলি আমি, নির্বাচন হয়েছিল মার্শাল ল’ এবং এলএফও-এর অধীন? হ্যা। শাসকরা এটি জেনেও তাে আ. লীগকে বাধা দেয় নি। কোনাে উত্তর নেই। থাকার কথাও নয়। বুঝতে পারি, সম্পূর্ণ দায় নিজের ওপর নিতে অস্বস্তি লাগে তাই এ-উত্তর। বা ঐ যে সরকার প্রচারণা চালিয়েছিল তা-ই মাথায় গেঁথে গেছে। আর থাকে ভারত। পাকিস্তান ও বাংলাদেশের অনেকের কাছে তাে ভারত সবসময়ই সবকিছুর জন্য দায়ী। এ-ক্ষেত্রে মূল থিসিস হলাে, ভারত সবসময় পাকিস্তান ভাঙতে চেয়েছে। ইয়াহিয়া ভুট্টো সে-সুযােগ করে দিয়েছে। সাংবাদিক জেড এ সুলেরি লিখেছেন— নবনির্বাচিত গণপরিষদ পিপিপি বর্জন করার ফলে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয় ভারত তার সম্পূর্ণ সুযােগ নিয়েছে। পিপিপি চেয়েছে। বাঙালি সংখ্যাগরিষ্ঠতা থেকে মুক্ত হয়ে একাই সব ক্ষমতা ভােগ করতে, আর ভারত চেয়েছে পাকিস্তানের অঙ্গহানি ঘটাতে একটা বিশাল আঘাতের প্রস্তুতি নিতে যাতে করে মুসলমান জাতীয়তার কেন্দ্রবিন্দুটি গুড়িয়ে দেয়া যায়। তারপরে যা ঘটেছে তা ছিল ভীষণ চক্রান্তমূলক। যে ব্যক্তিটি পাকিস্তানের ভাঙনের জন্য প্রধানত দায়ী তাকেই অবশিষ্ট পাকিস্তানের প্রশাসনের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে এবং

চূড়ান্ত বিভ্রান্তিকর ব্যাপার হলাে এই যে, সেই ভয়ঙ্কর ট্রাজেডিকে আমাদের জাতীয় বিস্মৃতির অতলে কবর দেয়া হয়েছে, যেন-বা আমাদের সঙ্গে পূর্বপাকিস্তানের কখনােই কোনাে সম্পর্ক ছিল না।’ করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক খালিদ মাহমুদ কথাটাকে ঘুরিয়ে একটু অন্যভাবে বলেছেন। তাঁর মতে, যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান, ভারতের মধ্যে হয়ত একধরনের সমঝােতা ছিল যে, যুদ্ধটা হবে সীমিত আকারে এবং বাংলাদেশও মুক্তি পাবে। অনেকেই বলেছেন জাতিসংঘে পাকিস্তান কিন্তু বেশ দেরিতে গেছে এবং প্রস্তাব পেশ করতেও দেরি করেছে। তারা মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে চায় নি। কিন্তু পাকিস্তানীদের অনেকে আবার যে-বক্তব্য দিচ্ছেন বা লিখেছেন তাতে অজান্তেই একটি কথা বলছেন, যা ভারতকে দায়ী করার ব্যাপরাটি নাকচ করে দেয়। আমাদের অনেকে প্রশ্ন করেছেন, ১৯৭১ না হলে কি বাংলাদেশ থাকত পাকিস্তানের সঙ্গে? আমরা উত্তর দিয়েছি— না। তারা সেটি মেনে নিয়েছেন কারণ তারা সেটি জানতেন। জেনারেল তােজাম্মেল লিখেছেন, পঞ্চাশের দশকে তিনি যখন ঢাকায় তখন সদরি ইস্পাহানি তাকে বলেছিলেন, পাকিস্তানী শাসকদের ব্যবহারের প্যার্টান না বদলালে পাকিস্তান এক থাকবে না। তাঁর ভাষায়, “I still remember he often used to say that unless there was a greater social contact and fair dealings between East and West Pakistan, their union would not survive for long. West Pakistan should not treat East Pakistan as a colony. They must treat this part as a home land.” অধ্যাপক দানি বলেছেন, ১৯৬২ সালে তিনি যখন ঢাকা ত্যাগ করেন তখন উপাচার্য তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কেন আপনি চলে যাচ্ছেন? দানি বলেছেন, তিনি উপাচার্যকে জানিয়েছিলেন এখানকার অবস্থা দুঃখসহ করে তােলা হচ্ছে। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, পাকিস্তান ভেঙে যাবে। ড. মুবাশ্বির হাসান বলেছেন, বাংলাদেশের জন্ম ছিল অবশ্যম্ভাবী। অর্থাৎ পাকিস্তানীরা জানত, বাংলাদেশ হবে এবং এর কারণ তারা নিজেরাই। যে-কদিন থাকে তার থেকে যা পার লুটপাট করে নাও এবং ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত সে-কাজটিই তারা করে গেছে। আর আমরা নিতান্ত মুখের মতাে পাকিস্তানী আদর্শের কথা ভেবেছি এবং এখনও অনেকে তা ভাবে। কিন্তু পাকিস্তানের অনেকে আমাকে বলেছেন, যা আমাদের দেশের পাকিস্তানীদের বলতে চাই তােমরা স্বাধীন হয়ে বুদ্ধিমানের কাজ করেছ। ভালাে করেছ। এখন এগিয়ে যাও।’
১৮

পাকিস্তানীদের দৃষ্টিতে বাংলাদেশে গণহত্যা ও অন্যান্য প্রসঙ্গ
১৯৭১ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত কী ঘটেছিল বাংলাদেশে? যারা চল্লিশাের্ধ বা তার কাছাকাছি তারা তা জানেন। ১৯৭১ সালে সমগ্র বিশ্বও তা জানত। সে-সময় এমন কোনাে দেশ খুব কমই ছিল যেখানে হানাদার পাকিস্তানী। বাহিনীর অত্যাচার ও মুক্তিযােদ্ধাদের কথা ওঠে নি। কিন্তু মনে হয় জানত না একটি দেশ এবং এর অধিবাসীরা। সে-দেশটির নাম পাকিস্তান।
অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। কিন্তু যদি এ-ধারণা সত্যি হয় তাহলে আমাদের বুঝে নিতে হবে কী দৃষ্টিকোণ থেকে তারা বিচার করত বাঙালিদের। অর্থাৎ বাঙালিরা ধর্তব্যের মধ্যেই ছিল না। অবশ্য, আক্ষরিক অর্থে, এ-বক্তব্য গ্রহণ না করাই ভালাে। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান দখলে রাখার চেষ্টা করেছে এবং এ-জন্য যা যা করা দরকার তা-ই করেছে। কারণ, তাদের ভাষায়, তাদের দরকার ছিল মাটি, মানুষ নয়। আর এ-বিষয়টি তাদের দেশের কেউ জানে না, তা হতে পার না। এ-প্রসঙ্গে, ১৯৭১ সালের পাকিস্তানী নীতিনির্ধারকদের অনেকের সঙ্গে, সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি। এর সহজ সরল উত্তর পাওয়া যায় নি। উত্তরগুলাের ধরন এ-রকম-১, জানতাম কী হচ্ছে ২. কী ঘটছে তার কিছু কিছু জানতাম, সবটা নয় ৩. [জানতেন কিন্তু এখন বলছেন] কিছুই জানতাম না। সাম্প্রতিক পাকিস্তান সফরে যাদের সঙ্গে আলাপ করেছি তাদের অধিকাংশ অবশ্য বলেছেন, পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ জানতেন না ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে কী ঘটছে। নিতান্ত দায়িত্ববান ব্যক্তিরাও তা বলেছেন। এর কারণ কী? উত্তর হচ্ছে—১. রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রচার ২. সম্পূর্ণ সেন্সরশিপ। পাকিস্তানের উর্দু পত্র-পত্রিকাগুলাে সবসময় বাঙালিদের বিরুদ্ধে ছিল এবং পশ্চিমপাকিস্তানে অধিকাংশ সময় তারা বাঙালিদের নেতিবাচক চিত্র তুলে ধরেছে। শাঙালি এবং বঙ্গবন্ধুকে চিত্রায়িত করা হয়েছে একটি জাতি এবং একজন নেতা। হিসাবে যারা পাকিস্তান ভাঙতে চায়। এবং পাকিস্তান ভাঙার জন্য তারা ১৫-ভারতের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। পাকিস্তানে এ-ভাবনা ব্ল্যাশফেমির মতাে।

সুতরাং (১৯৭১ সালে সদরে আলা ইয়াহিয়া খান যা করছেন ঠিকই করছেন। কারণ, পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ বেড়ে উঠেছে সামন্ত পরিবেশে, মনের গড়ন তাদের একমুখী; রাষ্ট্র যা বলছে, তাদের ধারণা, তা-ই ঠিক। ২৫ মার্চের পর। গণমাধ্যম পূর্বপাকিস্তানে সংঘটিত নির্মম ঘটনাবলি ব্ল্যাক আউট করে দেয়। ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় জেনারেল নিয়াজির আত্মসমর্পণের চিত্র টেলিভিশনে দেখার পর তাদের মাথা খারাপ হয়ে যায়। আল্লাহর পর পাকিস্তানে যাদের দেখা হয়, সেই পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনী কিনা বাঙালি ও ভারতীয়দের কাছে হাঁটু গেড়ে বসেছে। তাদের মনোেজগতে এ-সংবাদ ও চিত্র প্রবল আঘাত হানে। দেশজুড়ে এর তীব্র প্রতিক্রিয়ার পর এ-চিত্র আর পাকিস্তানে কখনােও দেখানাে হয় নি। প্রশ্ন উঠতে পারে (১৯৭১ সালে মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত কি পাকিস্তানের। ‘মধ্যবিত্তের কাছে রেডিও বা ট্রানজিস্টার ছিল না। ছিল। তবে, পাকিস্তান ছাড়া অন্য কোনাে রেডিওতে তারা আগ্রহী ছিল না। আমাদের আরাে মনে রাখা দরকার, পাকিস্তান কওম নিয়ে বাঙালিরা যত চিন্তিত ছিল, পশ্চিমপাকিস্তানীরা কখনই তত চিন্তিত ছিল না। পাকিস্তান বলতে তারা পশ্চিমপাকিস্তানকেই বুঝত। পূর্বপাকিস্তানকে নয়। এ-বিষয়ে তাদের কোনাে দ্বিধা ছিল না দেখে পূর্বপাকিস্তানের ক্ষেত্রে তাদের নীতির কখনও পরিবর্তন হয় নি এবং ১৯৭১ সালে এ-দেশে নির্মম হত্যাকাণ্ড চালাতেও তাদের বাধে নি। আমরা দ্বিধাগ্রস্ত ছিলাম দেখে আমাদের ভুগতে হয়েছে, মাসুল দিতে হয়েছে। তৎকালীন হানাদারবাহিনীর জনসংযােগ পরিচালক ব্রিগেডিয়ার (অব.) এ আর সিদ্দিকির সঙ্গে আলাপ হচ্ছিল। করাচিতে। তিনি বলছিলেন, সরকার পূর্বপাকিস্তানের অবস্থা স্বাভাবিক তা প্রচারে বাগ্র ছিল এবং নিয়ত তা প্রচার করছিলও। ২৫ মার্চের ঘটনাবলির প্রতিক্রিয়া বিশ্বব্যাপী যে এত তীব্র হবে তা শাসকরা অনুধাবন করেন নি। সরকার একদিকে। বলছিল সব স্বাভাবিক এবং এ-খবরও দিচ্ছিল দুষ্কৃতকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষ হচ্ছে; [বা হয়েছে এবং তাদের দমন করা হচ্ছে। এ-প্রচারে যে-স্ববিরােধিতা ছিল। পশ্চিমপাকিস্তানে কেউ তা নিয়ে মাথা ঘামায় নি। গড়পড়তা পশ্চিমপাকিস্তানী বিশ্বাস করেছে; সেনাবাহিনী পূর্বপাকিস্তানে খাসা কাজ করছে এবং এ-কারণে নিয়ত তারা প্রশংসার যােগ্য। সদ্য প্রকাশিত তাঁর বইয়ে সিদ্দিকি এ-প্রসঙ্গে লিখেছেন—”Most people in the west wing sang hosannas to him and wished him all the luck and success in his mission. সিদ্দিকি ঐ গ্রন্থে আরাে উল্লেখ করেছেন, এভাবে ১৯৭১ সালে সেনাবাহিনীর ইমেজ হয়ে ওঠে দ্বিধাবিভক্ত। পাকিস্তানের একঅংশে সে বীর, অন্য অংশে। নিপীড়নের হাতিয়ার। তার ভাষায়, “psychologically, the soldier acquired a kind of schizophrenia by fighting against the people he was supposed to stand by and defend. Professionally, he suffered from doubt about his own ability to fight a counter insurgency operation for which he had

never been trained. In propoganda alone did he feel secure and vindicated.” প্রচারের এ-লাইনটি জেনারেল ইয়াহিয়া নিজেই শুরু করেছিলেন। তাঁর বক্তৃতায়, বাঙালি স্বাধীনতাকামীদের তিনি উল্লেখ করেছেন কাফের বলে। এর অর্থ পাকিস্তানী সেনা যুদ্ধ করছে ইসলামবিরােধী অর্থাৎ কাফেরদের সঙ্গে। পাকবাহিনী। হচ্ছে মুজাহিদ। মুজাহিদ হলাে সে, যে জিহাদে লিপ্ত। সুতরাং এসব মুজাহিদকে বন্দনা ছাড়া আর কী করা যাবে? যারা শিক্ষিত, সরকারের সঙ্গে নানাভাবে যুক্ত তারা কী বলেন? গণহত্যা শব্দটি কি তারা শুনেছেন? না, … হ্যা, পূর্বপাকিস্তানে সে-সময় কিছু একটা হচ্ছিল, হয়ত মারাও গেছে কিছু। কিন্তু বিহারি ও পাকিস্তানীদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। পাকিস্তান থেকে সে-সময় প্রকাশিত শ্বেতপত্রেও এ-বিষয়ে গুরুত্ব আরােপ করা হয়েছে। বাংলাদেশের ঘটনাবলির ব্যাপারে পাকিস্তানে যারা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। ছিলেন নীতিনির্ধারণে তারা এ-লাইনটি গ্রহণ করেছেন। সেটি হচ্ছে, পূর্বপাকিস্তানে মার্চ মাস থেকেই নির্বিচারে বিহারি এবং পাকিস্তানীদের হত্যা চলছিল। ফলে, পাকিস্তানী সৈন্যদের মাথা ঠিক ছিল না। তাদের ধারণা হচ্ছিল, তারা শত্ৰুপুরিতে বাস করছে। সুতরাং ২৫ মার্চ তারা হয়ত এক-আধটু বাড়াবাড়ি করেছে। আমরা তাদের অনেককে জিজ্ঞেস করেছি, এই নির্মম হত্যাকাণ্ড যদি চলেই থাকে তাহলে বিদেশী কোনাে পত্রিকায় কেন তা ছাপা হলাে না? তখন তাে বাংলাদেশ সরকার হয় নি। এ-প্রশ্নের জবাব তারা দিতে পারেন নি। কারণ, দেয়া সম্ভব নয়। কিন্তু গণহত্যার বিষয়টি আড়াল করার জন্য এ-লাইনেই প্রচার চলেছে এবং এখনও চলছে।
এদের অধিকাংশ যে-মিথ্যা বলছেন তা প্রমাণিত হচ্ছে অন্যভাবে। আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে তারা বই লিখছেন, সাক্ষাতকার দিচ্ছেন এবং সেখানে নানা কথা ফাঁস হয়ে যাচ্ছে যার দু’একটি বিবরণ দিচ্ছি। সুহায়েল লারি ও ইয়াসমিন লারি করাচিতে থাকেন। উচ্চবিত্ত পরিবার, লারি একজন গবেষক, বিদেশে পড়াশােনা করেছেন। করাচিতে এখন তারা হেরিটেজ ফাউন্ডেশন গঠন করে সিন্ধুর ঐতিহ্য রক্ষায় ব্রত। লারি বলছিলেন, “আসলে মনােভাবটা তখন কী রকম ছিল বলি। ড. মুবাশ্বির হাসান ছিলেন ভুট্টোর ঘনিষ্ঠ, ফেডারেল মন্ত্রী হয়েছিলেন তাঁর সময়ে। ২৫ মার্চ ভুট্টোর সঙ্গে ছিলেন তিনি ঢাকায়। ঢাকা থেকে ফেরার পর পর তার সঙ্গে আমার দেখা। জিজ্ঞেস করলাম, ব্যাপার কী কী হচ্ছে সেখানে? তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেন, ‘৪৭ সালে পাকিস্তানের জন্য লাখখানেক মরেছে এখনও না হয় মরবে, তাতে কী?” ড. মুবাশ্বির হাসানের সঙ্গে দেখা লাহােরে। তিনি ঐ-সময়কাল সম্পর্কে বললেন, “২৫ মার্চ কিছু একটা হবে বুঝতে পারছিলাম। ভাের চারটায় হােটেল

ইন্টারকন থেকে দেখলাম সেনাবাহিনী রাস্তায় বেরিয়ে এসেছে। আমি ভুট্টোকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কী হচ্ছে? তিনিও জানালা দিয়ে দেখলেন। পিপিপি’র আবদুর রহিম ছাড়া আমরা আর কেউ চাইনি আর্মি এ্যকশন হােক” [রহিম এখন মৃত)। তিনি আরাে বলেছেন, “পূর্বপাকিস্তানে যে-অন্যায় ব্যবহার করা হয়েছে দীর্ঘদিন তা জানতাম না। আমাদের মতাে লােকেরা কিছুই জানত না।” উল্লেখ্য ড, মুবাশ্বির ছিলেন পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী। সুহায়েলকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “১৯৭১ সালের ঘটনাবলি সম্পর্কে এখানে সাধারণ মানুষের কী ধারণা?” “সাধারণ মানুষ কিছুই জানত না।” “তারা কি বিবিসি বা ভােয়া শুনত না।” “খুব সম্ভব কেয়ার করত না। যা শুনত তা-ও বিশ্বাস করত না। ভাবত বিবিসি মিথ্যা বলছে। পিপল হ্যাড টোটালি ক্লোজড মাইন্ড।”
“আপনি জানতেন না?” “হ্যা, রেডিও শুনে কিছু কিছু আন্দাজ করছিলাম। তারপর অস্বস্তির সঙ্গে বললেন, “বিস্তারিত জানতাম না।” শিক্ষিত মানুষরা এ-প্রসঙ্গ এড়িয়ে যেতে চান। কারণ, তারপরই প্রশ্ন করি, প্রতিবাদ হয় নি কেন? সুতরাং এ-প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাওয়াই শ্রেয়। আমি সুহায়েলকেও জিজ্ঞেস করলাম, “কেউ কিছু বলল না?” “না।” উত্তর দিলেন সুহায়েল, “কেউ কিছু বলে নি। একমাত্র এয়ার ভাইস। মার্শাল আসগর খান ও আমেদ রাজা কাসুরিই প্রকাশ্যে যা কিছু বলেছেন।” জামাতের দ্বিতীয় ব্যক্তি অর্থাৎ ভাইস প্রেসিডেন্ট আবদুল গফুর কী বলেন? “২৫ মার্চ কী ঘটেছে তা আমরা শুনেছি। ভারত এবং অমুসলমানরা এ-ঘটনায় একটি ভূমিকা পালন করেছিল। ইন্ডিয়া বলেছিল, হাজারে হাজারে মরেছে। এটি বিশ্বাসযােগ্য হয় নি। তাঁর বক্তব্যটি কেমন গােলমেলে দেখুন। তাঁর বক্তব্য ধরলে বলতে হয়, ২৫ মার্চ ঘটনার জন্য মুজিব বা আ. লীগ কোনাে ফ্যাক্টর নয়। ইন্ডিয়াই হচ্ছে প্রধান। তা হলে কি শেখ মুজিব প্রক্সি দিচ্ছিলেন ইন্ডিয়ার হয়ে? জিজ্ঞেস করলাম তাকে, “শেখ সাহেব কি তাহলে ইন্ডিয়ান এজেন্ট?” এর দৃঢ় উত্তর“না।” তাহলে আবদুল গফুরের প্রথম বক্তব্যের সঙ্গে তাে আবার দ্বিতীয় বক্তব্য মেলে না। “১৪ ডিসেম্বরের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তাে জামাত জড়িত” বলি তাকে। “যদি বলেন” গফুর উত্তর দেন, “সেনাবাহিনীর সঙ্গে জামাত সহযােগিতা। করেছে তা বিশ্বাসযােগ্য, কিন্তু জামাত হত্যা করেছে তা বিশ্বাস করা যায় না।” করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহযােগী অধ্যাপক। খালেদ মাহমুদ কি জানতেন ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ কী ঘটেছিল? “জানি”, তাঁর সােজাসাপ্টা উত্তর। “মেহের ইন্ডাষ্ট্রির অর্ধেক মালিকানা ছিল

আমাদের। ঢাকায় আমাদের যেসব আত্মীয়স্বজন ব্যবসায় দেখাশােনা করতেন তারা পালিয়ে এসেছিলেন। কারখানাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।” একই বিভাগের চেয়ারপার্সন তালাত নাজারিয়াত যিনি ১৯৭১ সালে যােগ দিয়েছিলেন বিভাগে, বললেন, “পত্রিকায় ২৫ মার্চের পুরাে খবর পাওয়া যায় নি। দেখলাম, আ. লীগ নেতারা অ্যারেস্টেড। এটা আমাকে ক্ষুব্ধ করেছে। কিন্তু, রক্তপাতের বিষয়টি তখনও আমরা জানতে পারি নি। পরে বিভিন্ন রেডিও স্টেশন শুনে জোড়াতালি দিয়ে যতটুকু জানা যায় তা জেনেছি।”
সত্তর দশকের ছাত্রনেতা, পরবর্তীকালে পিপলস পার্টির নেতা, মেরাজ মােহাম্মদ খান বললেন “২৬ মার্চ ফিরেছেন ভুট্টো। এয়ারপোের্ট গেলাম রিসিভ করতে। প্লেন থেকে নেমে তিনি বললেন, থ্যাংক গড, পাকিস্তান ইজ সেভড। আমি মনেমনে বললাম, আল্লা মিয়ানে পাকিস্তানকে মার দিয়া। গেলাম ভুট্টোর সঙ্গে ক্লিফটনে তার বাসায়। বেগম ভুট্টো ওপর থেকে নামছিলেন। আমার সঙ্গে। দেখা হওয়ার পর বললেন, “পাকিস্তান থাকবে না। এরপর আর কীভাবে পাকিস্তান থাকবে?” মেরাজ বললেন, “পাঞ্জাব ছাড়া, সব অঞ্চলে এর প্রতিক্রিয়া খারাপ হয়েছে। পার্টির সম্পাদক জে, রহিম এ-বিষয়ে একটি পেপার তৈরি করেছিলেন যাতে পূর্বপাকিস্তানে সেনাবাহিনীর কাণ্ডকারখানায় সমালােচনা ছিল। ড. মুবাশ্বির হাসানের বাসায় বসেছিল পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক। সবার অগােচরে আমি রহিমের পেপারটি ফটোকপি করে বিতরণের ব্যবস্থা করি। ভুট্টো এতে প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ। হন।” মুবাশ্বির বলেছেন, পার্টির মধ্যে রহিমই একমাত্র সেনাবাহিনীর পক্ষে ছিলেন। হয়ত এরপরই পার্টিতে রহিমের ভাগ্যচক্রে শনি দেখা দেয়। ২৫ মার্চ ও তার পরবর্তী ঘটনাবলির সঙ্গে যে ক’জন প্রত্যক্ষভাবে জড়িত, যাদের সঙ্গে কথা বলেছি এবার তাদের প্রতিক্রিয়া বলি। এরা হলেন, জে, উমর, জে. রাও ফরমান আলি, জে, নিয়াজি, ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিকি ও রােয়েদাদ খান।
জে, উমর ছিলেন নিরাপত্তা কাউন্সিলের সচিব। ২৫ মার্চ ঢাকায় ছিলেন তিনি। ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে কয়েকবার এসেছেন ঢাকায়। করাচিতে তার বাসভবনে গেলাম দেখা করতে। আমাদের দেখে তিনি এমনভাবে অভ্যর্থনা জানালেন যাতে মনে হলাে তিনি হারানাে স্বজনদের খুঁজে পেয়েছেন। বললেন এই বাঙালি ভাইদের জন্য তিনি এতক্ষণ কোরান শরীফ পড়ছিলেন এবং কাঁদছিলেন। কী থেকে যে কী হয়ে গেল! জিজ্ঞেস করলাম, “২৫ মার্চ সম্পর্কে কিছু জানেন?” নিস্পাপ ভঙ্গিতে বললেন, “না”। “২৫ পরবর্তী ঘটনাবলি সম্পর্কে কিছু জানেন?” “আপনি নিরাপত্তা কাউন্সিলের সচিব ছিলেন। এবং আপনি আমাদের বিশ্বাস করতে বলছেন যে, কিছুই জানেন না।”

“আমি কাউন্সিলের সামান্য সদস্যসচিব ছিলাম। কাউন্সিলের কোনাে মিটিং-ই। ডাকা হতাে না, কোনাে ক্ষমতাও ছিল না।” রফি রাজা পিপিপি করতেন এবং ঘনিষ্ঠ ছিলেন ভুট্টোর। ২৫ মার্চ ভুট্টোর সঙ্গে ছিলেন ঢাকায়। করাচিতে তার বাসায় আলাপকালে এ-প্রসঙ্গ এল। তিনি বললেন, “উমর জানে না মানে? ঢাকা থেকে আমরা রওনা হয়েছি। প্লেনে ঢুকল সে একটা ভাব নিয়ে। ভুট্টো বা আমাকে চেনে বলে মনে হলাে না। কাউকে দেখেও দেখল। ঢাকায় কী হয়েছে সে জানে না?” আলতাফ গওহর ইসলামাবাদে তার বাসায় চা খেতে খেতে বললেন, “শােনেন, রােয়েদাদ এবং উমর প্রায় যেত ঢাকায়। ফিরে এসে, বিকেলে আমার বাসায় আড্ডা দিত। কী ঘটছে ঢাকায় তার বর্ণনা দিত। আপনারা রােয়েদাদকে আমার রেফারেন্স দিয়ে জিজ্ঞেস করবেন এ-কথা সত্য কি না?”
ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিকিও একই ধরনের মন্তব্য করেছেন। ২৫ মার্চের আগে এবং পরে জেনারেল উমরের সঙ্গে তার যােগাযােগ রাখতে হয়েছে। লিখেছেন তিনি, এবং বলেছেনও যে, উমর ছিলেন ইয়াহিয়ার প্রধান রাজনৈতিক উপদেষ্টা। ২৫ মার্চের ঠিক আগে, ঢাকার সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে সিদ্দিকিকে বলেছিলেন, তুমি কী ধরনের পাবলিক রিলেশনস ডিরেক্টর যে “Can’t even control these bastards.” জে. ফরমান আলি আত্মপক্ষ সমর্থন করে বই লিখেছেন ঢাকার ইউপিএল এর অনুবাদ প্রকাশ করেছে তার সঙ্গে সাক্ষাতকারে তাকে গণহত্যার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলাম। বললেন, “গণহত্যা? না, গণহত্যা হয় নি।” “আচ্ছা, মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মানুষ মারা গেছে?” “গেছে।” কত জন মারা যেতে পারে বলে আপনার ধারণা, ত্রিশ-চল্লিশ, পঞ্চাশ হাজার?” “হ্যা, তা হবে।” বলেই তিনি বুঝলেন ভুল হয়ে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলেন।
“জেনারেল,” বললাম আমি, “পঞ্চাশ হাজার লােক হত্যা গণহত্যা নয়?” কোনাে উত্তর নেই। জিজ্ঞেস করলাম, “১৪ ডিসেম্বরের ঘটনার জন্য তাে আপনিই দায়ী?” “এ-সম্পর্কে আমি আমার বইতে লিখেছি”, জানালেন তিনি। “সে বই আমি দেখেছি”, বলি আমি, “লিখেছেন, আপনি কিছুই জানেন না। কিন্তু ঢাকার পতনের পর গবর্নর হাউসে আপনার অফিসের টেবিলে বুদ্ধিজীবীদের তালিকা পাওয়া গেছে।” “আমার কাছে অনেকেই আসতেন। বলতেন, অমুকে এটা করছে তমুকে ওটা। করছে। তা আমি নাম টুকে রাখতাম। এইসব নামেরই তালিকা ছিল সেটি।”

আলতাফ গওহরের সঙ্গে যখন এ প্রসঙ্গে আলােচনা করছি তখন তিনি একটি ঘটনার উল্লেখ করলেন। তার এক বন্ধু এসে তাকে খবর দিয়েছিল, বাঙালি-হত্যার জন্য একটি তালিকা হয়েছে। তার এক বন্ধুর নামও সেখানে আছে। আলতাফ গওহর কি কিছু করতে পারবে? গওহর জানালেন, আমার এক পরিচিত যিনি ফরমানেরও পরিচিত তাকে বিষয়টা জানালাম এবং ফরমানের সঙ্গে দেখা করতে বললাম। সে ফরমানের সঙ্গে দেখা করে তালিকা থেকে নামটি বাদ দেয়ার অনুরােধ জানাল। “ফরমান ড্রয়ার থেকে একটি তালিকা বের করে নামটি কেটে দিলেন। সেই নামটি ছিল সানাউল হকের।” ইসলামাবাদে এয়ার মার্শাল আসগর খানের সঙ্গে আলাপ করতে গিয়েছিলাম। বললাম, ফরমান আলী বলছেন, ১৯৭১ সালে ঢাকায় কী হয়েছিল তা তিনি জানেন
। বলেই হেসে ফেললাম। আসগর খানও হেসে ফেললেন। তারপর মৃদুভাবে বললেন, “দ্যাট ইল ফেমড ম্যান। এখন সব ফিলােসফিক্যাল ও হাই আইডিয়ালের কথা বলছে।” নিয়াজির সঙ্গে কথা বলে মনে হলাে তিনি গণহত্যা বিষয়টিই বুঝছেন না। মানুষ মারা গেছে কি না সে-সম্পর্কেও জানেন না। খুব সম্ভব এ-ভাবটি লােক দেখানাে। কারণ, তাঁর আত্মজীবনীতে তিনি ২৫ মার্চের ঢাকা অভিযানকে হালাকু খানের অভিযানের সঙ্গে তুলনা করেছেন। ১৫ এপ্রিল ১৯৭১ সালে নিয়াজি ডিভিশনাল কমান্ডারদের একটি গােপনীয় চিঠি পাঠিয়েছিলেন। চিঠির মূল বক্তব্য ছিল, সৈন্যরা বিশৃঙ্খল পরিবেশের সৃষ্টি করছে। ধর্ষণ, লুট ও হত্যায় তারা ব্যস্ত। এ-অবস্থা চলতে থাকলে, তিনি জানিয়েছেন তাদের অর্থাৎ পাকিস্তানী] মহিলারাও আক্রান্ত হবে। এবং তার ভাষায় “It is not uncommon in history when a battle has been lost because troops were over indulgent in loot and rape.” নিয়াজির মেমাের প্রথম অংশটি অনুবাদ না করে মূল ভাষায়ই উদ্ধৃত করতে 6131 “Since my arrival, I have heard numerous reports of troops indulging in loot and arson, killing people at random and without reason in areas cleared of the anti state elements; of late there have been reports of rape and even the west pakistanis are not being spared; on 12 Apr. two west pakistani women were raped, and an attempt was made on two others.” নিয়াজি বােধহয় এই মেমাের কথা ভুলে গিয়েছিলেন। রােয়েদাদ খান ছিলেন তখন তথ্য সচিব এবং প্রভাবশালী। পরে মন্ত্রীও হয়েছিলেন। বাংলাদেশে কী ঘটছে তা বহির্বিশ্বে জানাবার ভার ছিল তার ওপর। ২৫ মার্চ তিনি ছিলেন ঢাকায়। ইসলামাবাদে তাঁর সঙ্গে দেখা করি। না। তিনি কিছুই জানেন না। “না, আমি জানি না কী হয়েছে। অন্তত রাত ১২টা থেকে ভাের ৪টা পর্যন্ত আমি কোনাে বন্দুকের আওয়াজ শুনি নি।”

২৫

“আপনি যেখানে ছিলেন,” বলি আমি, “সেই হােটেল ইন্টারকনের উল্টোদিকে ‘দি পিপল’ তখন জ্বলছিল।” কোনাে উত্তর নেই শুধু বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে থাকা ছাড়া। “জেনারেল উমর বলছিলেন,” আবারও যােগ করি, “রেডিওতে প্রথম ঘােষণাটা দিয়েছিলেন। আপনি।” “জেনারেল উমর ঠিক বলেন নি।” ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিকি ২৫ মার্চের ঘটনার উল্লেখ করে লিখেছেন, বিদেশী। সাংবাদিকদের বহিষ্কার করা হয় এবং ধরে নেয়া হয় পাকিস্তানের খারাপ ইমেজ তারাই সৃষ্টি করেছে এ-কারণে। কিন্তু, একদিক থেকে লিখেছেন তিনি, বহিষ্কার করে ভালােই হয়েছিল। কারণ, “Dacca, on March 26 and for several day to come, was virtually a media men’s paradise. It was the picture of death and desolation. Every dead body by the road side, every bombed out building, every barricade, every tank, truck and Jeep, was a story for the avaricious TV man and news photographer: and they missed nearly all that.” এরি মাঝে, জানাচ্ছেন তিনি, রােয়েদাদ খান ও তার লােকজন পাকিস্তানের ইমেজ সৃষ্টি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। রােয়েদাদ ‘দি গ্রেট বিট্রেয়াল’ নামে একটি ডকুমেন্টারিও তৈরি করে ফেললেন। এতে খরচ হয়েছিল সে-আমলে প্রায় দশ লক্ষ টাকা। আরবি, ফরাসি, উর্দু এবং ইংরেজি— এই চারটি ভাষায় ওটি ডাব করা হয়েছিল এবং প্রসেস করা হয়েছিল ব্রাসেলসে। এর মূল বক্তব্য ছিল—আওয়ামী লীগ-কর্তৃক অবাঙালিদের ওপর অত্যাচারের বিবরণ। মহাসমারােহে ইয়াহিয়া খানকে তা দেখানাে হলাে। কিন্তু ইয়াহিয়া তা রিলিজ করতে রাজি হলেন না। রােয়েদাদ বারবার ইয়াহিয়াকে এ-কথাই বােঝাতে চাইলেন যে, এই ফিল্মের উদ্দেশ্য- “Was to create guilt complex’ in the mind of the Bengalis. It was time they were faced with the grim evidence of their crimes.” ঢাকার শেষ পাকিস্তানী কমিশনার আলমদার রাজা পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে রিট পিটিশন করেছেন হামুদুর রহমান কমিশন প্রকাশের জন্য যাতে যারা দায়ী তাদের শাস্তি দেয়া যায়। আরজির ৫২ নং অনুচ্ছেদে তিনি বলেছেন যারা বড় ধরনের অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ছিল তাদের শাস্তি না দেয়াতে পাকিস্তান এখন বিশ্বের কাছে হাসির পাত্রে পরিণত হয়েছে। এবং এর ফল কী হয়েছে, “The internal effect of this has been such that the extra judicial and custodial killing have become a part of national tradition,” শেষােক্ত মন্তব্যটি তাৎপর্যপূর্ণ।
আলমদার রাজা বলছিলেন, তার রিট গ্রহণে গড়িমসি করা হচ্ছিল। তারপর আরজি পেশের সুযােগ পেলেন। এবং আরজির একপর্যায়ে পাকিস্তানী বাহিনীর

বর্বরতার উদাহরণ দিলেন। কয়েকজন সৈন্য একটি বাড়ি আক্রমণ করে কয়েকজনকে হত্যা করে। পরিবারের তরুণীটিকে বাঁচিয়ে রাখে ধর্ষণের জন্য। তরুণী মিনতি করে জানায়, সেও তাে পাকিস্তানী। তারপর বলে, সৈন্যরাও মুসলমান সেও মুসলমান। একজন মুসলমান আরেকজন মুসলমান নারীকে কিভাবে ধর্ষণ করে? সবশেষে সে কোরান শরিফটি নামিয়ে বিছানায় রেখে বলে, তাঁকে যদি কেউ ধর্ষণ করতে চায় তা হলে এই কোরান শরিফ সরিয়ে ধর্ষণ করতে হবে। সৈন্যরা তাই করেছিল। আলমদার বললেন, এই বিবরণ শুনে বিচারক অশ্রু সংবরণ করতে পারেন নি। বেনজির ভুট্টোকে এ-প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করে কোনাে সদুত্তর পাই নি। এবং জানলেও তার পক্ষে বলা যে সম্ভব নয় তা বুঝি। সুতরাং যারা নীতিনির্ধারণের সঙ্গে বা অন্যভাবে জড়িত ছিলেন ১৯৭১ সালের সঙ্গে, তারা মােটামুটি জানতেন পূর্বপাকিস্তানে কী ঘটছে। কিন্তু, তারা যদি বলেন, জানতেন, তা হলে তাদের আর অন্য কাঠগড়ায় না হােক সভ্যজগতের বা সভ্যতার মাপকাঠির সামনে দাঁড়াতে হয়। সঙ্গত কারণেই তারা তা চান না। যারা মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত তারাও যে একেবারে জানতেন না যে, তা নয়। জানতেন। তবে, এর বিস্তৃতি বা ভয়াবহতাটা হয়ত তারা জানতেন না। রফি রাজা এ-প্রসঙ্গে যে উক্তি করেছেন তা অনেক যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছে আমার কাছে। তিনি বলেছেন- “We didn’t know or we didn’t want to know, আপনি যেভাবেই নেন।” এম এ নকভি বললেন, “টিক্কা খান বলেছিলেন মাত্র তিন হাজার ধর্ষিত হয়েছে। আর এখন একে অন্যের ওপর দোষ চাপাচ্ছে।” এ-প্রসঙ্গে তিনি আরেকটি কথা বলেছেন যা আমাদেরও মনে আসে নি। সাধারণ মানুষ কতটুকু জানত ১৯৭১-এর প্রসঙ্গে? তিনি বললেন বলা হয়ে থাকে। পশ্চিম পাকিস্তানীরা পূর্বপাকিস্তানের অবস্থা জানত না। এটা মিথ্যা সরকারি প্রচারণা। সে-সময় কি ট্রানজিস্টর ছিল না? পাঞ্জাবি সৈন্যরা আগে কর্মস্থল থেকে পরিবার-পরিজনদের মাসে পাঠাত দুই-তিন শ’ টাকা। কিন্তু, ১৯৭১ সালে। পাঠিয়েছে পাঁচ-ছয়শ’ টাকা। এ-বাড়তি টাকা এল কোথেকে?” নিয়াজি এপ্রিলে তাঁর এক গােপন মেমােতে উল্লেখ করেছিলেন, শােনা যাচ্ছে ফেরত যাওয়া পরিবারগুলির সঙ্গে পশ্চিমপাকিস্তানের লুটের মাল ফেরত যাচ্ছে। শুধু তাই নয়,- “I gather that even officers have been suspected of indulging in this shameful activity and what is worse, that in spite of repeated instructions, comdos, have so far failed to curb this alarming state of indiscipline. I suspect that cos and osc units/sub-units are Protecting and shielding such criminals.” তবে, মূল কথা হলাে, গণহত্যা শব্দটি পাকিস্তানে কেউ উচ্চারণ করতে চায় না। কোনাে লিবারেলও না। স্বীকার। করতেও চায় না। কারণ গণহত্যার অর্থ দায়দায়িত্ব, অপরাধ এবং শাস্তি।

কিন্তু, ১৯৭১ সালের যুদ্ধের প্রকৃতি কী ছিল? বা কীভাবে দেখা হয়েছিল এটিকে? করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক বিভাগের কয়েকজন ছাত্রের সঙ্গে আলাপ হলাে— যাদের জন্ম ১৯৭১ সালের পর। স্বাভাবিকভাবেই তারা অনেক কিছু জানে
কিন্তু জানতে আগ্রহী। তারা জানাল, পাঠ্যবইয়ে যা লেখা আছে এখন সে-সম্পর্কে তাদের মনে প্রশ্ন জাগছে। এবং তাদের মনে হয়েছে, যা লেখা হয়েছে। তা সঠিক নয়। পাঠ্যবইয়ের মূল বক্তব্য, পাকিস্তান ভাঙার জন্য দায়ী শেখ মুজিব, ছয় দফা ও বাঙালি। হত্যাকাণ্ডের বিবরণ অবশ্য তারা তেমন জানে না। রাজা কাজেম লাহােরের খুবই সফল, ধনী আইনজীবী, কম্যুনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। রাজনীতিবিদদের সঙ্গে ওঠাবসা আছে। তিনি বললেন, “আমি বিশ্বাস করেছি শেখ মুজিব, মুক্তিবাহিনী ভুল পথে এগােচ্ছে। এটি পেটি বুর্জোয়া উত্থান, জনগণের বিপ্লব নয়।” তিনি জোর দিয়ে বললেন, “আমি পাকিস্তানের ব্রিফ নিয়ে বলছি না। কারণ, এরা আমাকে চারবার জেলে পাঠিয়েছে। আমি নিজের কথাই বলছি। তারপর যখন হত্যা, লুট, ধর্ষণের কাহিনী শুনলাম তখন I felt disturbed. I certainly did not support army but I was to remain in darkness. The ও অন্যান্যরা যখন ফিরে এল তখন আরাে বিস্তারিত শুনলাম। কিন্তু তখন, There was no room for opinion.” জামাতের ভাইস প্রেসিডেন্ট আবদুল গফুরও বললেন, “এটি জনগণের কোনাে উত্থান ছিল না।” ছয় দফাকেও অধিকাংশ মনে করেন, এটি ছিল পাকিস্তান বিভক্তির ম্যানিফেস্টো। আবার এ-কথাও বলেন, ভুট্টো বলেছিলেন, ৬ দফার মধ্যে সাড়ে পাঁচ দফা গ্রহণযােগ্য। কিন্তু বাকি অগ্রহণযােগ্য আধা দফা কী সে-সম্পর্কে সবাই নিচুপ। তবে, ছয় দফা সম্পর্কে পাকিস্তানের সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে অঞ্চল ভেদে ধারণা বদলাচ্ছে। মােহাজেররা, যারা এতদিন পাকিস্তান পাকিস্তান করে চেঁচিয়েছে। তারা বলছেন, এ-পাকিস্তান কোন পাকিস্তান? কারণ, এ-পাকিস্তান তাদের বিশ্বাস করে নি। এখনও করে না। বিশ্বব্যাংকের কনসালট্যান্ট একজন বিদুষী মহিলা এক পার্টিতে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছিলেন, “এরা বলছেন ১৯৭১ সম্পর্কে তারা জানতেন না। করাচিতে সৈন্যরা যে হত্যা করেছে তাও তারা বিশ্বাস করে না।” তিনি যে-পরিপ্রেক্ষিতে এ-মন্তব্য করছিলেন তা ইন্টারেস্টিং। ঐ পার্টিতেই স্থিতধি এক গবেষকের সঙ্গে আলাপ হচ্ছিল। তিনি মােহাজের নন। এবং তারা দু’জন বান্ধবী। মােহাজের নন সেই ভদ্রমহিলা বলছিলেন, “১৯৭১ সালে নিহত সৈন্যদের লাশ ফেরত আসছিল। এবং তখন আমরা অনুমান করছিলাম পূর্বপাকিস্তানে একটা ঝামেলা হচ্ছে। কিন্তু এর বিস্তৃতি বুঝতে পারি নি।” সদ্য সিভিল সার্ভিস পাস করা এক সিন্ধি যুবক আলাপকালে বলছিলেন,
“সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় এসেছিল— ৬ দফা কী আলােচনা কর। আমি জানি ৬ দফা কী— কিন্তু সেই প্রশ্নের উত্তর আমি দিই নি। কারণ, তা যদি পাঞ্জাবি পরীক্ষকের হাতে পড়ে তাহলে আমার উত্তর তার মনঃপূত না-ও হতে পারে।” সময়, স্থান এখন ৬ দফার তাৎপর্যও বদলে দিচ্ছে। তবে, রাজনীতিবিদরা ৬ দফা সম্পর্কে যে স্ট্যান্ডার্ড টেক্সট পেশ করেন তা বলেছেন বেনজির ভুট্টো। তিনি বলেন, “ছয় দফা গ্রহণের অর্থ ছিল ১৯৭১ সালে পাকিস্তানে বিভক্তি। এটি শুধু বাংলাদেশেরই নয়, ছিল পশ্চিমপাকিস্তানের অন্যান্য প্রদেশেরও স্বাধীনতার নামান্তর। সেজন্য আমরা ছয় দফা প্রতিরােধ করেছি। I feel that if the six points had been into place, Pakistan would not have existed as a state to-day.” মুক্তিযুদ্ধ শব্দটিকে এড়িয়ে চলে পাকিস্তানীরা। মুক্তিবাহিনী শব্দটিও। কারণ, ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকে তারা মনে করে ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ। পাকিস্তানীদের জন্য এটিই স্বাভাবিক। কারণ, বাঙালিদের কাছে তারা পরাজিত হয়েছে এটি মেনে নেয়া তাদের কাছে কষ্টকর। ব্যাপারটাকে তারা বােধহয় এভাবে দেখে। ভারত-পাকিস্তান পরস্পরের শত্রু। বেশ ক’টি যুদ্ধ তারা করেছে। এসব যুদ্ধে হারজিত আছে। সুতরাং ১৯৭১ সালে পাকিস্তান না-হয় ভারতীয়দের কাছেই পরাজিত হয়েছে। তবে, সামরিকজান্তার নীতির কারণে যে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানে বিদ্রোহ হবে এবং যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে হবে তা তারা জানত। মানসিকভাবেও প্রস্তুত ছিল। হলে ১৯৭০ সালের নবেম্বরে জেনারেল ইয়াকুব অপারেশন ব্রিজ পরিকল্পনা কেন করবেন? এবং সেটিই-বা কেন ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রূপান্তরিত হবে। অপারেশন সার্চ লাইটে? মার্চের পর-ই তারা পূর্বপাকিস্তানের আশা ত্যাগ করে, অন্তত সদর দফতর। ধারণাটা এমন ছিল, অপারেশন সার্চ লাইটে বাঙালিদের জারিজুরি সব থেমে যাবে। বাঙালি দমিত হলে তাে ব্যাপারটা চুকেই গেল। আর দি না থাকে তাহলে সেই অঞ্চলকে বাগে রাখা যাবে না। সুতরাং সে-পরিপ্রেক্ষিতে, পশ্চিমপাকিস্তানকে রক্ষা করাই হবে শ্রেয়। ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিকি এ-বিষয়ে একটি প্রশ্ন করেছেন যা যুক্তিযুক্ত। তাহলাে, পূর্বপাকিস্তানকে যদি ভারতের আগ্রাসন থেকে রক্ষা করতে হয় তা হলে পূর্বপাকিস্তানে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হলাে না কেন? জেনারেল নিয়াজিও এ-প্রশ্ন তুলেছেন। এ-পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানের তৎকালীন চিফ অফ জেনারেল স্টাফ লে. জে. গুলহাসানের একটি মেমোের কথা উল্লেখ করা যায়). “The main battle would be fought in the west (the Punjab). It was envisaged that the fate of East Pakistan would hinge upon what ever operation were undertaken in the west.” শুলহাসান লিখেছেন তার আত্মকাহিনীতে যে, পূর্বপাকিস্তানের কোনাে আশা
“সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় এসেছিল— ৬ দফা কী আলােচনা কর। আমি জানি ৬ দফা কী— কিন্তু সেই প্রশ্নের উত্তর আমি দিই নি। কারণ, তা যদি পাঞ্জাবি পরীক্ষকের হাতে পড়ে তাহলে আমার উত্তর তার মনঃপূত না-ও হতে পারে।” সময়, স্থান এখন ৬ দফার তাৎপর্যও বদলে দিচ্ছে। তবে, রাজনীতিবিদরা ৬ দফা সম্পর্কে যে স্ট্যান্ডার্ড টেক্সট পেশ করেন তা বলেছেন বেনজির ভুট্টো। তিনি বলেন, “ছয় দফা গ্রহণের অর্থ ছিল ১৯৭১ সালে পাকিস্তানে বিভক্তি। এটি শুধু বাংলাদেশেরই নয়, ছিল পশ্চিমপাকিস্তানের অন্যান্য প্রদেশেরও স্বাধীনতার নামান্তর। সেজন্য আমরা ছয় দফা প্রতিরােধ করেছি। I feel that if the six points had been into place, Pakistan would not have existed as a state to-day.” মুক্তিযুদ্ধ শব্দটিকে এড়িয়ে চলে পাকিস্তানীরা। মুক্তিবাহিনী শব্দটিও। কারণ, ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকে তারা মনে করে ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ। পাকিস্তানীদের জন্য এটিই স্বাভাবিক। কারণ, বাঙালিদের কাছে তারা পরাজিত হয়েছে এটি মেনে নেয়া তাদের কাছে কষ্টকর। ব্যাপারটাকে তারা বােধহয় এভাবে দেখে। ভারত-পাকিস্তান পরস্পরের শত্রু। বেশ ক’টি যুদ্ধ তারা করেছে। এসব যুদ্ধে হারজিত আছে। সুতরাং ১৯৭১ সালে পাকিস্তান না-হয় ভারতীয়দের কাছেই পরাজিত হয়েছে। তবে, সামরিকজান্তার নীতির কারণে যে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানে বিদ্রোহ হবে এবং যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে হবে তা তারা জানত। মানসিকভাবেও প্রস্তুত ছিল। হলে ১৯৭০ সালের নবেম্বরে জেনারেল ইয়াকুব অপারেশন ব্রিজ পরিকল্পনা কেন করবেন? এবং সেটিই-বা কেন ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রূপান্তরিত হবে। অপারেশন সার্চ লাইটে? মার্চের পর-ই তারা পূর্বপাকিস্তানের আশা ত্যাগ করে, অন্তত সদর দফতর। ধারণাটা এমন ছিল, অপারেশন সার্চ লাইটে বাঙালিদের জারিজুরি সব থেমে যাবে। বাঙালি দমিত হলে তাে ব্যাপারটা চুকেই গেল। আর দি না থাকে তাহলে সেই অঞ্চলকে বাগে রাখা যাবে না। সুতরাং সে-পরিপ্রেক্ষিতে, পশ্চিমপাকিস্তানকে রক্ষা করাই হবে শ্রেয়। ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিকি এ-বিষয়ে একটি প্রশ্ন করেছেন যা যুক্তিযুক্ত। তাহলাে, পূর্বপাকিস্তানকে যদি ভারতের আগ্রাসন থেকে রক্ষা করতে হয় তা হলে পূর্বপাকিস্তানে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হলাে না কেন? জেনারেল নিয়াজিও এ-প্রশ্ন তুলেছেন। এ-পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানের তৎকালীন চিফ অফ জেনারেল স্টাফ লে. জে. গুলহাসানের একটি মেমোের কথা উল্লেখ করা যায়). “The main battle would be fought in the west (the Punjab). It was envisaged that the fate of East Pakistan would hinge upon what ever operation were undertaken in the west.” শুলহাসান লিখেছেন তার আত্মকাহিনীতে যে, পূর্বপাকিস্তানের কোনাে আশা
৩০

হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানিয়েছেন যার সংকলন করলে বেশ মােটাসােটা একটি বই হবে। কিন্তু কেউ এর খবর জানে না। বিখ্যাত কবি হাবিব জালেবি হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করায় তাকে জেলে পােরা হয়। লাহােরের তাহেরা মজহার ও তার কয়েকজন সঙ্গী মিলে মিছিল করে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। ব্যক্তিগত প্রতিবাদও কিছু হয়েছে যা আমাদের জানা নেই। যেমন ড. তারিক রহমান। ১৯৭১ সালে ছিলেন সেনাবাহিনীর ক্যাডেট। তিনি কমিশন পাওয়ার পরপরই পদত্যাগ করেন। কোট মার্শাল হতাে তার। কিন্তু বাবা ব্রিগেডিয়ার হওয়ায় বেঁচে যান। এখন ইসলামাবাদের কায়দে আজম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছেন। তার সঙ্গেও আলাপ হয়েছিল ইসলামাবাদে। শান্ত কণ্ঠে। বলেছিলেন, এতে সাহসের কোনাে ব্যাপার নেই। মানবিকতার বাইরে আমি যেতে পারি না। তিনি আমাকে যা বলেছিলেন তাই সংহতভাবে লিখেছেন আহমদ সেলিমের একটি বইয়ের ভূমিকার উপসংহারে—“আসুন আমরা সবাই মিলে লিখি, কথা বলি, ছবি আঁকি- স্মরণ করি ১৯৭১ সালকে এর সকল নির্মম বাস্তবতাসমেত। আসুন আমরা ক্ষমা চাই মৃতদের কাছে। আসুন আমরা সচেষ্ট হই সমঝােতা ও ক্ষমা অর্জনে। এতে করে অতীত পাল্টে যাবে না তবে হয়ত ভবিষ্যৎ বদলাতে পারে। এটা সহায়তা করবে ভবিষ্যতের বাংলাদেশের সঙ্গে নিবিড় বন্ধন গড়তে এবং আরাে যা গুরুত্বপূর্ণ এটা আমাদের সাহায্য করবে আরেকটি বাংলাদেশ সৃষ্টি পরিহারে। বর্তমান পাকিস্তানে যে-সহিংসা ও বিচ্ছিন্নতাবাদী মনােভাব দেখা দিয়েছে তার পরপ্রেক্ষিতেই তিনি এ-মন্তব্য করেছেন। সাংবাদিক আই এ রেহমানের কথা আগে বলেছি। ঐ সময় যেমন, এখনও তিনিই কঠোর ভাষায় তাঁর বক্তব্য তুলে ধরছেন। আমাকে তিনি বলেছিলেন হিন্দু ও বৃটিশরা যে-পরিমাণ মুসলমান হত্যা করেছে আমরা মুসলমান হিসাবে তার থেকে বেশি মুসলমান হত্যা করেছি। কথাটি সত্য। কিন্তু এই সত্য বলার সাহস। আছে কয়জনের? আই এ রেহমান বলেন, “অনেকে বলেন ১৯৭১-এ কী হয়েছে এখানকার বাসিন্দারা তা জানত না। এগুলাে খােড়া যুক্তি। কমবেশি তারা জানত। কারণ otal Supported the massacre of their compatriots in the eastern wing. With a very few honourable exceptions, the West Pakistan population, led by politicians, academics, bureaucrats, and opinion makers, chose to back the senseless carnage, and there were many who fought over the spoils.”
তিনি আরাে বলেছেন, ১৯৭১ সালের যুদ্ধের যৌক্তিকতা দাঁড় করানাে অসম্ভব। ইসলামবাদের একটি চক্র অযথা এ-যুদ্ধ করেছে এটি জেনে যে, তারা হারবে। আসলে হারাটাই ছিল উদ্দেশ্য। “It was a betrayal of the officers and men of the Pakistan army in that they were deceived into giving their

lives for an issue, of which the adverse out come had already been determined by their supreme commander. And no justification could be advanced for the people. The rules of combat do not apply in this case.” এরই সূত্র ধরে দুয়েকজন বলেছেন, এ-সংঘর্ষের দরকার ছিল না। বললেই হতাে, আমাদের বনাবনি হচ্ছে না। আমরা আপােসে আলাদা হয়ে যাই। আজ অনেক ঘাত-প্রতিঘাত পেরােনাের পর এই চিন্তা হচ্ছে কিন্তু ২৫ বছর আগে এই চিন্তা কারও হয় নি। বাকি থাকে মুক্তিযুদ্ধের নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কথা। পাকিস্তানীরা। তাকে কীভাবে দেখে? ১৯৭১ সালে দেখেছে গাদ্দার হিসাবে। একটি উদাহরণ দিই, যে রােয়েদাদ খান এখন নিস্পাপ মুখে বললেন কিছুই জানেন না এবং শেখ মুজিবকে তিনি শ্রদ্ধা করেন; ১৯৭১-এ তিনি কী বলেছিলেন। ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিকি ঘটনাটি আমাকে বলেছিলেন এবং লিখেছেনও তার বইতে। ইয়াহিয়া তার। পরামর্শকদের সভায় প্রত্যেককে জিজ্ঞেস করেছিলেন, মুজিবকে বিনাবিচারে না। বিচার করে লটকানাে হবে। রােয়েদাদ বিনাবিচারে লটকানাের পক্ষপাতী ছিলেন। তারও আগে, শেখ মুজিবকে যখন পশ্চিমপাকিস্তানে নিয়ে আসা হয় বন্দি হিসাবে। তখন রােয়েদাদ প্রবলভাবে এ মত তুলে ধরেছিলেন যে, বন্দি মুজিবে102 র ছবি তুলে। পত্র-পত্রিকায় দেয়া হােক। রােয়েদাদের ভাষায়— “Let the world know that the bastards is in our hands.” আজ ২৫ বছর ধারণা খানিকটা বদলেছে। গাদ্দার’ এখন কেউ তাকে আমাদের সামনে বলেন নি, তবে পাকিস্তান ভাঙার জন্য তারা যে তিন জনকে দায়ী করেন তার মধ্যে তিনি একজন। তবে তার স্থান দেয়া হয় তিন নম্বরে। এক-দুই। নম্বর ভাগাভাগি করে নেন ভুট্টো এবং ইয়াহিয়া। বেনজির ভুট্টো পর্যন্ত জানালেন, বঙ্গবন্ধু তাকে স্নেহ করতেন। এবং কোনােরকম দ্বিধা না করেই তিনি বললেন, নীতির জন্য শেখ মুজিব মরতেও প্রস্তুত ছিলেন। তাই তাঁর মৃত্যু (হত্যা) আমাদের নাড়া দিয়েছিল গভীরভাবে। সবশেষে আই এ রেহমানের একটি মন্তব্য দিয়েই শেষ করি। উপমহাদেশের তিনটি রাষ্ট্রের মধ্যে মনান্তর ও বৈরী সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি যে-মন্তব্য করেছেন তা প্রণিধানযােগ্য। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়েছে এর তাৎপর্য অধিকাংশ মানুষ এখনও অনুভব করতে অক্ষম। তিনি বলছিলেন—“আমরা হিমালয়ের পুত্র। হিমালয় থাকবে না। আমরাও থাকব। এ-কথা মনে রেখেই আমাদের আচরণ করা উচিত।”
৩২

বাংলাদেশের কাছে পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়া না-চাওয়া
ঢাকায়, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পরিপ্রেক্ষিতে যে-মন্তব্য করেছিলেন, তা বাংলাদেশে তাে বটেই, পাকিস্তানেও প্রবল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। ঢাকায় তিনি শুধু বলেছিলেন, ১৯৭০ সালের নির্বাচনের রায় মেনে যদি আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হতাে তাহলে পাকিস্তানের ইতিহাস অন্যরকম হতাে। অর্থাৎ, রায় মানাটা উচিত ছিল। করাচিতে তিনি আরাে একধাপ এগিয়ে বলেছেন, যারা অপরাধী তাদের শাস্তি পেতে হবে। পূর্ব পাকিস্তান যাতে পশ্চিমপাকিস্তানের ওপর শাসন করতে না বাংলাদেশে অনেকে লিখেছেন, এ-মন্তব্যই যথেষ্ট নয়, ক্ষমা চাইতে হবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। কিন্তু, এটি আমরা ভেবে দেখিনি যে, নওয়াজ শরিফই একমাত্র পাকিস্তানী শাসক যিনি গত ২৮ বছরে ১৯৭১ সাল সম্পর্কে মন্তব্য করলেন। ভুল স্বীকার করলেন। পাকিস্তানে এ-বিষয়ে জনমত সৃষ্টির সূচনা করলেন।
সম্প্রতি পাকিস্তান সফরকালে এর প্রতিক্রিয়া লক্ষ করেছি। আমি করাচি, লাহাের, ইসলামাবাদ গেছি এবং সেখানে প্রায় চল্লিশ জনের সঙ্গে কথাবার্তা বলেছি। যাদের সঙ্গে আলাপ হয়েছে তাদের মধ্যে প্রাক্তন জেনারেল, মন্ত্রী, সচিব, ব্যবসায়ী, সাংবাদিক, অধ্যাপক, ছাত্র সবাই আছেন। এই প্রথম, বহুদিন পর দেখা যাচ্ছে, পাকিস্তানে ১৯৭০-৭১ সালের ঘটনাবলি নিয়ে আলােচনা শুরু হয়েছে এলিট মহলে। নেওয়াজ শরিফের মন্তব্যের পর পত্র-পত্রিকায় এ-নিয়ে লেখালেখি শুরু হয়েছে। পাঠকরা চিঠি লিখে পত্রিকায় তাদের মতামত জানাচ্ছেন। তবে, জন। প্রতিক্রিয়া বহুধাবিভক্ত। অনেকে যে নওয়াজ শরিফের বক্তব্যের মধ্যে রাজনীতি খুঁজে পাচ্ছেন না তা নয়। শরীফ যদি এ-বিষয়ে তদন্তের আদেশ দেন এ-নিয়ে খোচাখুঁচি করেন তাহলে অবশ্যই পাকিস্তান ভাঙার দায় আরাে অনেকের সঙ্গে ভুট্টোর ওপরও বর্তাবে। তা’হলে বেনজির ব্রিত বােধ করবেন, পিপলস পার্টির ওপরও একচোট নেয়া যাবে। উল্লেখ্য, এই বিতর্ক সম্পর্কে বেনজিরকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি প্রশ্নটি এড়িয়ে গেছেন। কথা উঠেছিল হামুদুর রহমান কমিশন নিয়েও যার উল্লেখ

শরিফও করেছেন। অনেকের ধারণা, কমিশনের রিপাের্ট প্রকাশিত হলে অনেক কিছু জানা যেত। কিন্তু, কমিশনের রিপাের্ট প্রকাশিত হয় নি এবং পাকিস্তানে একটি প্রচলিত ধারণা যে, রিপাের্টের কপি নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। বেনজির ভুট্টো বললেন, “আমার বাবার কাছে একটি রিপাের্ট ছিল। তাতে পরিষ্কারভাবে তাঁকে দায়দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। সামরিক শাসকরা যখন তাকে গ্রেফতার করে তখন কপিটিও নিয়ে যায়। তিনি আরাে বললেন, এখন যখন আবার তা নিয়ে কথা উঠছে তখন তা প্রকাশ করা উচিত। “আপনি যখন ক্ষমতায় ছিলেন, তখন করলেন না কেন?” জিজ্ঞেস করি আমি। “বাধা ছিল।” বেনজির ভুট্টো অবশ্য এটি বললেন না যে, তার যেমন বাধা ছিল কমিশন রিপাের্ট প্রকাশে, শরিফেরও তেমন বাধা থাকতে পারে। সে-বাধাটি হলাে সেনাবাহিনী। বলা হয়ে থাকে, আল্লাহ্ পাকিস্তান সৃষ্টি করেছেন। পাকিস্তানের ওপরে আল্লাহ্, নিচে মিলিটারি। এছাড়া আছে সামন্ত জমিদার ও আমলারা। তাই বলতে দ্বিধা নেই, নওয়াজ শরিফ যতটুকু বলেছেন, পাকিস্তানের পরিপ্রেক্ষিতে তাতে সাহসেরই পরিচয় দিয়েছেন। নেওয়াজ দু’টি বিষয় তুলে ধরেছেন। যে শাসকচক্র (অর্থাৎ সামন্ত, সামরিক-বেসামরিক আমলা) ১৯৭১ সালের সঙ্গে জড়িত ছিল এবং যাদের অনুসারিরা এখনও আছে তাদের তিনি প্রশ্নের সম্মুখীন করেছেন। তারা, এ-অধ্যায়টি পাকিস্তানের ইতিহাস থেকে মুছে ফেলতে চান। দ্বিতীয়: সাধারণ মানুষ এখন বুঝতে পারছে ১৯৭১ সালে কিছু একটা হয়েছিল। বলে রাখা ভালাে, পাকিস্তানে ব্যাপক আলােচনা করে মনে হয়েছে, অল্প কিছু ব্যক্তি ছাড়া বাংলাদেশে কী হয়েছে কেউ-ই তা জানত না। এটি অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে কিন্তু পুরােটা অসত্য নয়। পাকিস্তান গেলে, মানুষজনের সঙ্গে কথা বললে বােঝা যায়, রাষ্ট্র। কীভাবে মানুষকে দাস করে রাখতে পারে। শাসকরা যা বলে (অন্তত তখন), বােঝায় তাই তারা মেনে নেয়। ১৯৭১ সালে তাদের বলা হয়েছিল, পূর্বপাকিস্তানে যা ঘটছে তা একটি ভারতীয় অর্থাৎ হিন্দু-চক্রান্ত যার বিরুদ্ধে পাকিস্তানের মুসলমানরা লড়ছে। এটি তারা বিশ্বাস করেছিল এবং এ-নিয়ে কোনাে প্রশ্ন তারা করে নি। একদল বলছেন, যা আগেই উল্লেখ করেছি, শরিফ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে মন্তব্য করেছেন। হুসেইন হাক্কানি ‘দি নেশন’ পত্রিকায় লিখেছেন, প্রধানমন্ত্রী বিচ্ছিন্নভাবে ইতিহাসের ঘটনাবলি বিচার করছেন। তিনি একথা বলছেন, কারণ, তাকে তার ম্যান্ডেট রক্ষা করতে হবে যা এখন বৈধতার সম্মুখীন। এ বৈধতা এখন ক্রমাগত প্রশ্নের মুখােমুখি হচ্ছে। হ্যা, পূর্বপাকিস্তানের প্রতি অত্যাচার হয়েছিল কিন্তু, তার জন্য পশ্চিমপাকিস্তানের সমগ্র রাজনৈতিক নেতৃত্ব দায়ী যার মধ্যে

মুসলিম লীগও অন্তর্ভুক্ত। উল্লেখ্য, শরিফ মুসলিম লীগের নেতা। হাক্কানি অবশ্য স্বীকার করছেন, পশ্চিমপাকিস্তানের জনমত তখন দৃঢ়ভাবে সামরিক ব্যবস্থা সমর্থন করেছে। তার ভাষায়— “It can be argued that the application of force in Bengal was merely an extension of the dominant political way of thinking in West Pakistan. True, excess in the course of military action are, of course the responsibility of the military leaders.” অর্থাৎ তিনি আবার ভুট্টোকে আড়াল করে সামরিক চক্রকে দায়ী করছেন। হাক্কানি আরাে লিখেছেন, ভারতের ভূমিকার কথা শরিফ কেন ভুলে যাচ্ছেন? সমস্ত কাণ্ডটার জন্য তাে ভারতই দায়ী। সুতরাং, ক্ষমা চাওয়ার আগে এসব বিষয়ও বিবেচনা করতে হবে। এ-তত্ত্ব অনেকে স্বীকার করেন যে, অন্যায় করা হয়েছিল, সামরিকবাহিনী বাড়াবাড়ি করেছে— সবই ঠিক, কিন্তু দায়ী হচ্ছে ভারত। সামরিকবাহিনীর সঙ্গে যারা যুক্ত ছিলেন, স্বাভাবিকভাবেই তারা এখন আত্মপক্ষ সমর্থনে ব্যস্ত। সুতরাং, তারাও এখন যােগ দিচ্ছেন বিতর্কে। পাকিস্তান সরকারের কাশ্মীরবিষয়ক মন্ত্রী অবসরপ্রাপ্ত লে. জে. আবদুল মজিদ মানিক বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বক্তব্যে উম্মা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলছেন, এর কোনাে প্রশ্নই ওঠে না। অবশ্য, এ-কথাও বলছেন, তিনি এ-বক্তব্য রাখছেন সরকারি মন্ত্রী হিসেবে নয়, ব্যক্তি হিসেবে। ভারতের আগ্রাসনের কথা তিনিও উল্লেখ করেছেন। বলছেন, ভারতের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যারা জেহাদ করেছেন তাদের ‘গণহত্যার জন্য অভিযুক্ত করা তাদের দেশাত্মবােধের প্রতি-ই অপমান। বলেছেন তিনি, “I would request Dhaka not to touch this issue because it would not do any good to the relation between the two countries.”
এ-ভাষ্যের আরেকটি উপ-ভাষ্য আছে, সেটিও প্রতিফলিত হচ্ছে জনমতে। ড. এম. এ. সুফির লেখা “বাংলাদেশ মেরা দেশ” নামে গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসবে ১৮ মার্চ বলেছেন সিন্ধুর গভর্নর মঈনউদ্দিন হায়দার, সত্য জানা দরকার। বাংলাদেশ ছিল একটি স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র (“was a sovereign muslim state”) যা ভারতের উপনিবেশে পরিণত হয় নি। এটি দ্বিজাতি তত্ত্বের অভ্রান্ত প্রমাণ। করে। এখনও, তাঁর মতে, বাংলাদেশের মানুষ হিন্দু-ভারত থেকে মুসলিম পাকিস্তানকে কাছের মনে করে [এর প্রমাণ, তিনি বলেন নি, কিন্তু বলেছেন। কয়েকজন ঢাকায় ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট খেলার সময় পাকিস্তানী খেলােয়াড় ও দলকে নিয়ে উচ্ছাস)। সুতরাং, তার ভাষায় “If we (Pakistan) set out house in order, learn a lesson from the past mistakes, keep the present right and make positive head way in the future, the possibility of Islamabad and Dhaka getting closer to each other cannot be ruled out.” এ-তত্ত্ব এগিয়ে নেয়া পছন্দ করছেন অনেকে। কারণ, এর মধ্যে সূক্ষ্মভাবে

থাকছে, পাকিস্তান যে-ভুল করেছে তা স্বীকার করা এবং এ-বক্তব্য তুলে ধরা যে, বাংলাদেশ মুসলিম দেশ, সুতরাং হিন্দু-ভারতের বিরুদ্ধে মুসলমান পাকিস্তান-বাংলাদেশ এক হতে পারে। সাংবাদিক জেড, এ, সুলেরি যিনি সব সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘােষণার জন্য বিখ্যাত, ক্ষমাপ্রার্থনা সম্পর্কে লিখেছেন, “১৯৭১ সালের ট্রাজেডি সম্পর্কে। প্রধানমন্ত্রী নেওয়াজ শরিফের স্মরণ তাই ইতিহাসের প্রতি সর্বপ্রথম একটি সরকারি বােঝাপড়া, যার গুরুত্ব ও তাৎপর্য অতিরঞ্জিত করার জো নেই।” তিনি আরাে লিখেছেন “দি নিউজ ইন্টারন্যাশনাল’ পত্রিকায়—“এই অনুসন্ধানের কেন্দ্রীয় কথা। হলাে, আমাদের ভুলভ্রান্তিগুলাে চিহ্নিত করে এবং সেগুলাে শুধরে নিয়ে আমরা আমাদের বাংলাদেশের ভাইদেরকে আরাে কাছে টানব। ভারত আমাদের চারপাশে যে-বলয় শক্ত করে চেপে আনছে তা ভেঙে ফেলতে আমাদেরকে সাহায্য করবে। আমাদের এই সৌহার্দ্য।” বেনজির ভুট্টোও আমাদের সঙ্গে আলােচনায় প্রায় একই ধরণের কথা বলেছেন। সুলেরি আরাে বলেছেন, সুতরাং, “ভারতীয় হুমকির মুখে আমাদের জাতীয় সংহতির বৃহত্তর স্বার্থে বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাওয়া অতি সামান্য ব্যাপার।” সাধারণ পাঠকদের প্রতিক্রিয়া জানার মাপকাঠি হয় যদি চিঠিপত্র, তাহলে। বলব, সংবাদপত্রে এ-বিষয়ে যে-কটি চিঠি দেখেছি সেগুলির লেখকরা একবাক্যে। বলেছেন, মাপ চাওয়ার কোনাে প্রশ্ন ওঠে না। এর একটি কারণ হতে পারে, ১৯৭১ সাল সম্পর্কে তারা জানে না। যারা জানেন বা এখন জানছেন তারা মনেমনে স্বীকার করে নিচ্ছেন, আত্মগ্লানিতে হয়ত ভুগছেনও কিন্তু প্রকাশ্যে মাপ চাওয়ার ব্যাপারে নীরব। শুনেছি, যারা এখানে পাকিস্তানের পক্ষে লড়াই করেছিল পরবর্তীকালে তাদের অনেকে মানসিক বৈকল্য বা তীব্র ডিপ্রেশনের স্বীকার হয়েছে। বামপন্থিরাও পুরাে বিষয়টির বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানান কিন্তু ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্নে নীরব। হয়ত সমগ্র দেশে এ-নিয়ে বিতর্ক জোরদার হলে তারা মুখ খুলবেন। যারা ক্ষমা চাওয়ার বিরুদ্ধে, এবং যারা সমবেদনা প্রকাশ করেছেন আমাদের কাছে তারা কিন্তু আরেকটি বিষয়ও যােগ করেছেন। তা হলাে, পাকিস্তান ১৯৭১ সালের জন্য দায়ী, কিন্তু পূর্বপাকিস্তানও খানিকটা দায়ী। কেন, কিভাবে তা তারা বিশ্লেষণ করেন না কিন্তু বলেন, ভারত এর জন্য দায়ী। আসলে ৯৩ হাজার পাকিস্তানী সেনা আত্মসমর্পণ করেছিল এটা মেনে নেওয়া পাকিস্তানের এলিটদের পক্ষে কষ্টকর। লাহােরের ফ্রাইডে নিউজের’ বাম-ঘেঁষা সাংবাদিক খালেদ আহমদ বলছিলেন, বাংলাদেশ পাকিস্তানের সম্পর্ক ভালাে হতে পারে না কারণ পাকিস্তান এখনও সেই পরাজয়ের সঙ্গে ‘reconcile’ করতে পারে নি। ব্রিগেডিয়ার এ আর সিদ্দিকি ১৯৭১ সালে ছিলেন সেনাবাহিনীর জনসংযােগ অফিসার। তিনি এখন এ-বিষয়ে বেশ লেখালেখি করছেন। “পাকিস্তানের

মানুষদের এখন শান্তভাবে, “বিষয়টি নিয়ে পর্যালােচনা করা উচিত।” লিখেছেন তিনি। Are we pleading guilty to something simply by refusing to face it? If Bangladesh demands an apology from us, we might as well turn around and suggest a corporate basis for the consideration of such a demand.” কারণ, সত্য হলাে এ-সংকটের জন্য দু’পক্ষই দায়ী। পশ্চিমপাকিস্তানের দায় হয়ত একটু বেশি। পাকিস্তানের প্রাক্তন কেবিনেট সেক্রেটারি, ১৯৭১ সালে ঢাকায় সচিব হিসেবে যিনি কর্মরত ছিলেন সেই হাসান জহির এক সাক্ষাৎকারে আমাকে বলেছেন, “আমরা যথাযথ ব্যবহার করি নি, বাড়াবাড়ি হয়েছে। সে-পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষমা চাওয়ার ব্যাপারটা ঠিক আছে। কিন্তু, It too early to start this controvrsey.”।
এ সূত্র ধরেই অনেকে এখনই ক্ষমা চাওয়ার পরিবর্তে দক্ষিণ আফ্রিকার মতাে একটি টুথ কমিশন’ করার পক্ষপাতী। এ-বিষয়টি তুলে ধরেছেন, আইয়ুব খানের ঘনিষ্ঠ আমলা আলতাফ গওহর। ৮ ফেব্রুয়ারি ‘দি নেশন’-এ একটি প্রবন্ধ লিখেছেন এ-বিষয়ে। আমাদের সঙ্গে আলােচনাকালেও তিনি এ-বিষয়ে জোর দিয়েছেন। পাকিস্তানের প্রখ্যাত আইনজীবী এস এম জাফরও তা সমর্থন করেছেন। এস এম জাফরের মতে, তাহলে সবসময়ের জন্য ১৯৭১ সালের পটভূমিকা জানা। যাবে। আলতাফ গওহর বলছেন, এটা না করলে আমরা আমাদের বর্তমান বুঝতে পারব না এবং আমাদের জনমানুষের ভবিষ্যতকে যথার্থভাবে রূপ দিতে পারব না। ‘নেশন’ পত্রিকায়ই তিনি লিখেছেন, “Truth never hurts, it enables the nation by identifying those who acted against the people. The humiliating ceremony of surrender of the Pakistan Army in Dhaka shattered our national interests
পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি ড. নাসিম হাসান শাহ এবং সিন্ধুর গভর্নরও টুথ কমিশন স্থাপনের কথা বলেছেন। আমাদের সঙ্গে সাক্ষাৎকারেও অনেকে এর যৌক্তিকতা স্বীকার করেছেন। প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়ার পক্ষে প্রকাশ্যে বলাবলি করেছেন হাতে-গােনা কয়েকজন। এরও আবার দু’টি দিক আছে। কিছু বলছেন, যারা এর জন্য দায়ী। তাদের শাস্তি হতে হবে। অন্যরা বলছেন, ক্ষমা চাইতে হবে। দুটি বিষয় কিন্তু ভিন্ন। এদের কয়েকজন হলেন এয়ার মার্শাল আসগর খান, তাহেরা মাজহার আলি, আই এ রহমান এবং আহমদ সেলিম। ১৯৭১ সালেই এরা প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। আমরা যাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছি, তারা সবাই একবাক্যে বলেছেন, আসগর খানই একমাত্র রাজনীতিবিদ যিনি ঐ-সময় প্রকাশ্যে জনসভা করে সামরিক জান্তার কার্যকলাপকে নিন্দা করেছেন। এ-কারণে, তাকে ঢিল ছােড়া

হয়েছে; তাঁর জনসভা ভেঙে দেয়া হয়েছে। তাঁকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। তিনি তার বক্তব্য থেকে একচুলও সরেন নি। নেওয়াজ শরিফের বক্তব্য এবং জেনারেল নিয়াজির গ্রন্থটির পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেছেন “It is apparent that even after 27 years it will be a national mistake to gloss over the events of 1971 tragedy as has been done by General ‘Tiger’ Niazi ” আমাদের সঙ্গে সাক্ষাৎকারেও তিনি একই কথা বলেছেন এবং দাবি তুলেছেন ১৯৭১ সালের হােতাদের শাস্তি দিতে হবে। আলমদার রাজা আবেগপ্রবণ মানুষ। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন ঢাকার কমিশনার। আমরা রাও ফরমান আলির সাক্ষাৎকার নিয়েছি শুনে তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলেন। এখন তিনি আইনব্যবসা করেন। ১৯৯৭ সালে তিনি লাহাের হাইকোর্টে একটি রিট পিটিশন করেন। রিটে তিনি দাবি তুলেছিলেন ওয়ার কমিশন বা হামুদুর রহমান কমিশন রিপাের্ট প্রকাশ করার জন্য। তার দাবি, ২৫ বছর সরকারি নথিপত্র জাতীয় অভিলেখগারে পাঠানাের নিয়ম কিন্তু এ-সংক্রান্ত নথিপত্র এখনও পাঠানাে হয় নি। যারা দোষী তাদের শাস্তি দেয়া হয় নি। সুতরাং যারা দোষী তাদের অবিলম্বে শাস্তি দিতে হবে। তার আরজিটির কয়েকটি বয়ান উদ্ধৃত দিচ্ছি যেখানে প্রকাশ্যে হত্যা, ধর্ষণের কথা স্বীকার করা হয়েছে। এ-ধরণের নজিরও পাকিস্তানে কম। “g. That large scale extra judicial and custodial killings, looting raping was not stopped and the culprits were not punished.j. That the persons guilty of major crimes of vivisection of the country, surrender of the Eastern command, killing, raping and looting were protected and no action was taken against them.n. That there has been no accountability of those who have indulged in heinous crimes in 1971 and even the latest Ehtesab ordinance does not appy to these people although their crimes are mcuh greater in magnitude than the people whose Ehtesab is being done since 1985 under the Ehtasab ordinance.
o. That on an average about half a million people have lost their lives and Pakistans basic concept has been eroded. The wave of crimes let loose in East Pakistan still continues in Pakistan.” আলমদার রাজা বলছিলেন, তিনি যখন আদালতে ১৯৭১ সালের ঘটনাবলির বর্ণনা দিচ্ছিলেন তখন বিচারপতি বারবার বলছিলেন, “এটা কি সত্যি?’ তারপর পাকিস্তানী সৈন্য কর্তৃক এক তরুণী ধর্ষণের ঘটনা যখন তিনি বর্ণনা করছেন তখন বিচারকের চোখ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে। তিনি রিট পিটিশন গ্রহণ করেন। কিন্তু, রাজা জানালেন, একবছর হয়ে গেল, এর শুনানি আর হচ্ছে না। কেন হচ্ছে না তা ততা বােঝাই যাচ্ছে। ভুট্টোর অন্যতম সহযােগী, একসময়ের ফেডারেল মন্ত্রী ড. মুবাশ্বির হাসান
আমাদের বলেছেন, হ্যা, পাকিস্তানের ক্ষমাপ্রার্থনা করা উচিত। এ-ব্যাপারে সবসময় সােচ্চার সমাজকর্মী তাহেরা মাজহার আলি। ১৯৭১ সালে মার্চেই মাত্র কয়েকজন মহিলা নিয়ে রাজপথে তিনি বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছিলেন। আমাদের তিনি বলছিলেন, এসব মহিলারা তথাকথিত উচ্চবর্গ বা মধ্যবিত্তের নয়। নিম্নবর্গের। ইউপিএল-এর মহিউদ্দিন আহমদ বলছিলেন, বছর দুয়েক আগে পাকিস্তানে তারা একটি সাহিত্যসম্মেলনে এসেছিলেন। তখন তিনি, ড. সুলতানা জামান, কবীর চৌধুরী, এনায়েতুল্লাহ খান মিলে সভাপতিকে একটি স্মারকলিপি দিয়ে জানান, ১৯৭১ সালের ঘটনার জন্য পাকিস্তানের ক্ষমাপ্রার্থনা করা উচিত এ-রকম একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হােক। সভাপতি রাজি নন। তখন তাহেরা মাজহার আলি জোর করে মঞ্চে উঠে নিজের ও পাকিস্তানের তরফ থেকে ক্ষমাপ্রার্থনা করেন। তাহেরা বললেন, ১৯৭১ সালের ঘটনার প্রতিবাদ করায় ঐ-সময় অনেকেই আমাকে দেশদ্রোহী বলেছে। পাকিস্তান মানবাধিকার কমিশনের সভাপতি আই এ রেহমান পাকিস্তানের ক্ষমাপ্রার্থনার ব্যাপারে সােচ্চার। ১৯৭১ সালের ঘটনার প্রতিবাদে তিনি চাকুরি ত্যাগ করেন ও লাহাের থেকে নিজেরা পত্রিকা প্রকাশ শুরু করেন। নিউজলাইন। পত্রিকায় তাঁর একটি বিরাট প্রবন্ধ বেরিয়েছে এ-সম্পর্কে। লাহােরে তার অফিস-কক্ষে যখন আমরা এ-বিষয়ে আলােচনা করছি তখন এক মহিলা এলেন, বখতিয়ারি নাম। থাকেন করাচিতে। তিনি রেহমানকে তার প্রবন্ধের জন্য ধন্যবাদ জানাতে এসেছেন। আমাদের বললেন, ১৯৭১ সালে আমি ছিলাম সুখি এক গৃহবধূ। কিন্তু, যখন আমি এ-ঘটনা জানতে পারলাম তখন আমার জীবনের মােড় ঘুরে গেল। আমি নিম্নবর্গের মধ্যে কাজ শুরু করলাম ও একই সঙ্গে পড়াশােনা শুরু করলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নেয়ার পর তিনি এখন সমাজকর্মী। ঢাকা ঘুরে গেছেন। আই এ রেহমান দ্ব্যর্থহীন ভাবে আমাদের জানালেন, পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়া উচিত। বাঙালিদের জানমালের আক্রমণের কোনাে যৌক্তিকতা নেই। যুদ্ধের নীতির মধ্যে তা পড়ে না। যদি অল্প কয়েকজন মানুষও নিহত হয়ে থাকে বিনা কারণে, যদি একজন নারী ধর্ষিতা হয়ে থাকে, হত্যা করা হয়ে থাকে। কয়েকজন শিশুকে (যার কোনাে কারণ নেই) তা’হলেও পাকিস্তানের ক্ষমাপ্রার্থনা করা উচিত। তিনি খুব সুন্দর একটি মন্তব্য করেছেন এ পরিপ্রেক্ষিতে যা মূল ইংরেজিতেই উদ্ধৃত করছি- “If we sincerely believe that in 1971 a great tragedy befell us, then a catharsis of the same order is necessary for the restoration of our mental health and our perception of justice and equity. So long as we believe, and continue to teach our children, that we were not responsible for killing our own innocent people in Bengal, we will never be able to understand what actually happened.” আহমদ সেলিমের নাম আমাদের কাছে পরিচিত। তার সঙ্গেও দেখা হলাে

এবার ইসলামাবাদে। ১৯৭১ সালে ন্যাপের কর্মী হিসেবে তিনি প্রতিবাদ করে জেল খেটেছেন। পাকিস্তানের ক্ষমাপ্রার্থনার দাবিও তিনি করে আসছেন। এবার মনে হলাে তিনি একটু ক্ষুব্ধ। কারণ, বাংলাদেশে কয়েকবার আসায় বাংলাদেশের কয়েকজন নাকি সন্দেহপােষণ করেছে। তিনি বলছেন, বাংলাদেশের অনেকে পাকিস্তানের ক্ষমাপ্রার্থনার দাবি ও যারা দোষী তাদের শাস্তি দাবি করেছেন। এটি যৌক্তিক। কিন্তু, যদি প্রশ্ন করি, বাংলাদেশে যারা কোলাবরেটর বা যুদ্ধাপরাধী। তাদের বিষয়ে বাংলাদেশ কী করেছে? এ প্রশ্ন আমাকে আরাে কয়েকজন করেছেন। বলা বাহুল্য আমি তার উত্তর। দিতে পারি নি।
৪০

পরাজিত পাকিস্তানী জেনারেলদের দৃষ্টিতে মুক্তিযুদ্ধ
ইদানীং, পাকিস্তানী জেনারেলরা আত্মজীবনী রচনায় মন দিয়েছেন। গত, এক দশকে, এ-ধরনের বেশকিছু বই প্রকাশিত হয়েছে। এসব আত্মজীবনীতে, প্রসঙ্গক্রমে ১৯৭০-৭১-এর ঘটনাবলি এসেছে, কম আর বেশি। এসব বই লেখার উদ্দেশ্য বিবিধ, তবে দুটি উদ্দেশ্যের কথা বলা যায়- ১. পাকিস্তানে এখন। সেনাবাহিনীকে সৎ এবং ত্রাতারূপে তেমনভাবে বিবেচনা করা হয় না বরং পাকিস্তানের অবনতির জন্য সামরিক শাসনকে দায়ী করা হয়। ২. পাকিস্তান ভাঙার জন্য ইদানীং দায়ী করা হচ্ছে সেনাবাহিনীকে। শেষােক্ত দায়টিই তাদের কাছে বিব্রতকর। ইদানীং, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যা নিয়েও আলােচনা হচ্ছে এবং পরােক্ষভাবে হলেও সেনাকর্তাদের এ-জন্য দায়ী করা হচ্ছে। ১৯৭০-৭১ সালে যারা ক্ষমতায় ছিলেন এ-কারণে তারা আত্মপক্ষ সমর্থন করতে চাচ্ছেন। এ-ধরণের আত্মজীবনীগুলি পড়ে দেখেছি একধরনের ইতিহাসতত্ত্বের ফ্রেমওয়ার্ক সৃষ্টি করেছেন তারা যার আওতায় সবগুলি বই-ই লেখা হয়েছে। (দু’একটি ব্যতিক্রম হতে পারে)। আলাদা আলাদাভাবে পড়লে এ-বিষয়টি স্পষ্ট হবে না হয়ত। কিন্তু বেশকিছু বই একসঙ্গে পড়লে তা পরিস্কার হয়ে ওঠে। এ-ইতিহাসতত্ত্বের ভিত্তি গণতন্ত্র, সমাজ, রাষ্ট্র সম্পর্কে পাকিস্তানের সাধারণ মধ্যবিত্তের চিন্তাভাবনা। সম্প্রতি, আমার সুযােগ হয়েছিল পাকিস্তান সফর করার। সেখানে বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষের সঙ্গে কথা বলে আমার যে-ধারণা হয়েছিল তার সঙ্গে দেখছি জেনারেলদের চিন্তাভাবনা মিলে যাচ্ছে। ফলে, বলা যেতে পারে, এ-ইতিহাসতত্ত্ব বিচ্ছিন্ন কোনাে বিষয় নয়, পাকিস্তানের মধ্যবিত্তের দৃষ্টিভঙ্গিই। এ-তত্ত্ব নির্মাণে সাহায্য করেছে। তবে, যারা বামপন্থি তারা এর সঙ্গে একমত নন। জেনারেলদের আলােচনা, মনােভঙ্গি থেকে একট বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, পাকিস্তান বলতে মূলত তারা পশ্চিমপাকিস্তানকেই বুঝেছেন। পূর্বপাকিস্তান ছিল বাড়তি। সে-কারণে পূর্ববঙ্গ সম্পর্কে তাদের আলােচনার ধাঁচটা এরকমপূর্বপাকিস্তানের প্রতি অবিচার করা হয়েছে (পাঠকদের বােঝানাে যে লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি নির্মোহ) তবে যতটা বলা হয় ততটা নয়। তিনি পূর্বপাকিস্তানে (অর্থাৎ লেখক) যে-পদে ছিলেন সে-পদে থেকেই পূর্বপাকিস্তানের জন্য কাজ করতে
চেয়েছেন। অবিচারের কথা এখন নির্দ্বিধায় বলার কারণ, বিষয়টি বহুলভাবে আলােচিত এবং এখন আর তা গােপন করার উপায় নেই। গােপন করলে বরং তার আত্মকথন সম্পর্কে সন্দেহ জাগতে পারে। পাকিস্তানে গন্ডগােল বাধিয়েছে বাঙালিরা। এ-ধারণা অধিকাংশ পাকিস্তানীর। অনেকে এর বিশ্লেষণ করেছেন এভাবে যে, পশ্চিমে ছিল সামন্তবাদী কর্তৃত্ব, পূর্ব ছিল তা থেকে মুক্ত। পূর্বের মধ্যবিত্ত এ-ধরনের আধিপত্য মানতে রাজি হয় নি। বিরােধটা সেখান থেকে শুরু। পূর্বপাকিস্তানের মানুষ গণতন্ত্রের জন্য যেভাবে হাহাকার করেছে পশ্চিমে হাহাকার ততটা ছিল না। গণতন্ত্রের বিষয়টা পাকিস্তানের এলিট শাসকবর্গ কখনও পছন্দ করে নি। এ-বিষয়ে সাহায্য করেছে কিছু পূর্ব ধারণা। জেনারেলরা কেন, পাকিস্তানের খুব কম মানুষই এ-ধারণা থেকে মুক্ত। ধারণাটা হলাে বাঙালির মুসলমান নিয়ে সন্দেহ। যাদের নিয়ে আলােচনা করেছি তাদের অধিকাংশই আমার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, বাঙালির মুসলমানত্ব নিয়ে তাদের কোনাে সন্দেহ নেই। বাঙালিরা বেশি মুসলমান। কিন্তু, যখন তারা লিখছেন অজান্তেই পূর্ব ধারণায় আক্রান্ত হয়েছেন। ১৯৭১ সালে গণহত্যার সময়ও পাকিস্তানী সৈন্যদের মনে একই। ধারণা কাজ করছিল।
এ-ধারণা গড়তে সাহায্য করেছে পাকিস্তানীদের প্রচণ্ড ভারত ও হিন্দু-বিদ্বেষ। তারা দেখেছে পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের মধ্যে মিল বেশি এবং পূর্বপাকিস্তানে হিন্দু জনসংখ্যাও পশ্চিমপাকিস্তানের তুলনায় বেশি। তা ছাড়া, বাঙালিরা তেমনভাবে হিন্দু/ভারত-বিদ্বেষী নয় যেমনভাবে পাকিস্তানীরা বিদ্বেষী। সে-কারণে দেখি, যে-কথাটিতে কোনাে না কোনভাবে তারা গুরুত্ব দিয়েছেন আত্মজীবনীতে, তা হলাে বাঙালিদের মনমানসিকতা প্রভাবিত করেছিল হিন্দুরা। আর হিন্দুরা তাে ভারতীয়দেরই অংশ। ভারত, সবসময় পাকিস্তানের শত্রুতা করেছে, পাকিস্তানের বিনাশ চেয়েছে। কিন্তু শিক্ষকরা বাঙালি তরুণদের বিভ্রান্ত করেছে তাই পাকিস্তানী চেতনা বাঙালিদের মধ্যে কাজ করতে পারে নি। এবং সে-কারণে বাঙালিদের মন চলে গিয়েছিল বিচ্ছিন্নতার দিকে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাকে ভারত-প্রভাবিত ষড়যন্ত্র হিসেবে ধরা হয়েছে এমনকি কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে ছয় দফাকেও। তবে, বর্তমানে, ছয় দফাকে পাঞ্জাবীরা যেভাবে দেখে সিন্ধী, বালুচরা সেভাবে বিচার করছে না। কারণ, পাঞ্জাবীদের হাতে তারাও নিষ্পেষিত হচ্ছে। কিন্তু, জেনারেল বা এলিটরা সবসময় ছয় দফাকে বিচ্ছিন্নতাবাদের প্রতীক হিসেবেই দেখেছেন।
১৯৭১ সালের ঘটনাবলির বয়ান করেছেন তারা এভাবে- পূর্বপাকিস্তানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছিল। বিহারি ও পশ্চিমপাকিস্তানীরা আক্রান্ত ও নিহত হচ্ছিলেন। উপায়ন্তর না দেখে পরিস্থিতি আয়ত্তে আনার জন্য সেনাবাহিনীকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছিল। এ-ধরনের পরিস্থিতিতে দু’একটি

প্রাণহানি ঘটে, তবে, গণহত্যা-জাতীয় কিছু ঘটে নি। ভারত নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য আক্রমণ করেছিল পূর্বপাকিস্তান। জেনারেলরা কেউ-ই যৌথ কমান্ডের বিষয়টি স্বীকার করেন নি। পারতপক্ষে মুক্তিবাহিনীর উল্লেখ করেন নি। ভারতের সঙ্গে পরাজয়ের ব্যাপারটা তবুও স্বীকার করা যায় কিন্তু বাঙালিদের কাছে পরাজয়ের বিষয়টি পাকিস্তানীদের পক্ষে মেনে নেয়া সম্ভব নয়। পাকিস্তান যে ভেঙে গেল তার জন্য বাঙালিরা তাে দায়ী-ই, তবে, পাকিস্তানে। কেউ দায়ী হলে সে হচ্ছে ভুট্টো এবং ইয়াহিয়া। ইয়াহিয়া খান যেহেতু অসম্মানিত, মৃত এবং তার কোনাে রাজনৈতিক সাপাের্ট নেই, সেহেতু পাকিস্তান ভাঙার জন্য। তাকেই প্রধানত দায়ী করা হচ্ছে। এ-প্রসঙ্গেই আসে সেনাবাহিনীর কথা। জেনারেলরা সবাই সামরিক শাসনের বেনিফিশিয়ারি। তা সত্ত্বেও তাদের স্বীকার করতে হয়েছে সামরিক শাসন জনগণের জন্য মঙ্গল বয়ে আনে নি। কিন্তু, সামরিক শাসন কেন এল? কারণ, রাজনীতিবিদরা। প্রত্যেকে লিখেছেন, পাকিস্তানে সামরিক আইন জারি ও পাকিস্তান ভাঙার জন্য রাজনীতিবিদদের দায়ভারই বেশি। সেনাবাহিনী বরং পাকিস্তানের জন্য কিছু করার চেষ্টা করেছে। ক্ষমতা করায়ত্ত করার এবং তা অক্ষুন্ন রাখার জন্য সেনাবাহিনী ১৯৫০ থেকে একধরনের ইমেজ তৈরি করেছে যার বর্ণনা পাওয়া যাবে ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিকির। বইতে। প্রচারের কয়েকটি উপাদান ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন—
১. সেনাবাহিনী ঐক্য ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক। অর্থ : অন্য প্রতিষ্ঠানগুলি তা নয়।
২. সৈনিকরা সহজ, সরল, ধর্মভীরু। অর্থ : অন্যরা তা নয়।
৩, সৈনিকরা মুজাহিদ। তারা ইসলাম ধর্ম রক্ষায় বিশ্বাসী। কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে শহীদ হলে বেহেশত। অর্থ : অন্যরা ধর্মের রক্ষক নয়। ভারত। কাফের। সুতরাং সেনাবাহিনীকে সবসময় যিহাদী জোশে রাখা। বাংলাদেশে তারা গণহত্যা চালিয়েছিল এই কাফের নিধনের অজুহাতে। ৪, সেনাবাহিনী দেশ প্রেমিক। অর্থ : অন্যরা তেমন নয়। রাজনীতিবিদরা তাে। নয়ই কারণ তারা নিজের বা নিজদলের প্রতি বিশ্বস্ত।
৫. সৈনিকরা সৎ। অর্থ : অন্যরা দুর্নীতিপরায়ণ। ৬. সেনাবাহিনী কর্মদক্ষ। অর্থ : অন্যরা নয়।
সুতরাং, দেশ চালাবার অধিকারী সেনাবাহিনী। এ-কারণেই, পাকিস্তানে আর্মড ফোর্সেস ডে’ নামে একটি দিবস পালিত হতাে।
এ-থেকেই নির্মাণ করা যায় একটি নতুন প্রত্যয় ‘পাকিস্তান’। যেমন, আমরা খারাপ অর্থে বলি যে, সে পাকিস্তানী। এ-শব্দটি একটি মনােভঙ্গি। বাংলাদেশের সামরিক শাসকরাও এ-সংজ্ঞাটির বাস্তব রূপায়ণ করেছিলেন নিজের দেশে। এ-মনােভঙ্গির অর্থ দাঁড়ায়, আমলাতন্ত্র, বিশেষ করে সামরিক আমলাতন্ত্র-কর্তৃক সিভিল সমাজ ও রাজনীতিবিদদের ওপর আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা, অভ্যন্তরীণ

লুটের প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ এবং রাজনৈতিক প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ তা যেভাবেই হােক-না কেন। এ-কারণে দেখি, সামরিক বাহিনীর (তৎকালীন পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর অংশ) অনেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, বীরত্ব দেখিয়েছিলেন কিন্তু অন্তিমে ঐ মনােভঙ্গির বাইরে যেতে পারেন নি। কারণ, বেড়ে ওঠার বয়সে তারা প্রশিক্ষণ নিয়েছেন পাকিস্তানে, পাকিস্তানী প্রশিক্ষকের কাছে, যৌবনও কাটিয়েছেন সেখানে। বাংলাদেশে ক্ষমতা দখল করে, তারা সেই পাকিস্তানতত্ত্বও প্রচার করেছেন মাতৃভূমিতে। এটাই আমাদের ট্র্যাজেডি। এই পাকিস্তানী মন বা তত্ত্ব কিভাবে প্রভাবিত করেছিল আমাদের শাসক ও রাজনীতিবিদদের একাংশকে তার দুটি উদাহরণ দিই। জেনারেল জিয়াউর রহমান আইয়ুব খানের মতাে একই ভঙ্গিতে ক্ষমতা দখল করে হাঁ-না ভােট করেন। রাজনৈতিক দলগুলি বিলুপ্ত করেন, পরে তাদের রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে তাদের কাজের অনুমতি দেয়া হয়। শাসনতন্ত্রের মূলধারা পরিবর্তন করেন। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পায় সে-সব দেশ যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরােধিতা করেছিল। প্রচারমাধ্যম সম্পূর্ণ করায়ত্ত করে নিজের ও সেনাবাহিনীর ইমেজ বৃদ্ধিতে ব্যবহার। জেনারেল এরশাদ সেই ধারাকে আরাে পুষ্ট করলেন। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করলেন। সমাজকে সামরিকায়ণ করতে চাইলেন।
এদের সময় কয়েকটি নতুন বাক্য চালু করা হয় প্রচারমাধ্যমে যা পরবর্তীকালের রাজনীতিবিদরাও তােতাপাখির মতাে আওড়ে যাচ্ছেন। যেমন—
১. সেনাবাহিনী শৃঙ্খলা সার্বভৌমত্বের প্রতীক। অর্থ অন্যরা বিশৃঙ্খলা ও অধস্তনতার প্রতীক।
২. সেনাবাহিনীর উল্লেখ করলেই বলা হয়- এ স্মার্টলি ড্রেসড কনটিনজেন্ট। অর্থ সেনাবাহিনী স্মার্ট অন্যরা নয়। পৃথিবীতে পাকিস্তান ছাড়া বােধহয় আর কোথাও সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমে এ-ধরনের বাক্য উচ্চারিত হয় না।
৩, সৈনিকরা সরল, সৎ। উদাহরণ, প্রচারণায় জিয়ার ছেড়া গেঞ্জি ও ভাঙা স্যুটকেস-কে গুরুত্ব দেয়া। এরশাদের সাইকেল চালানাে। অর্থ : অন্যরা নয়।
৪. জঁকালােভাবে সেনা প্যারেড প্রদর্শন। সামরিক জাদুঘর নির্মাণ লক্ষ। করুন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর নয়। যদিও এ-সেনাবাহিনীর জন্ম মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে।
৫. রাজনীতিবিদরা সমস্ত কিছুর জন্য দায়ী। তারা দুর্নীতিবাজ।
এরা বা এদের অনুসারীরা কখনও পাকিস্তানকে দোষারােপ করেন নি, করেছেন ভারতকে (অর্থাৎ হিন্দু-ভারত)। বাংলাদেশের যাবতীয় দুর্দশার জন্য এরা দায়ী করেছেন আওয়ামী লীগকে (এর মধ্যে স্বাধীনতা অর্জনও অন্তর্ভুক্ত, কারণ আওয়ামী লীগ ছিল মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বকারী দল)। কারণ, তাদের মতে, আওয়ামী লীগ ভারতের এজেন্ট। এসব এজেন্ট ও হিন্দুরা ধর্মবিরােধী অর্থাৎ ইসলামবিরােধী। ইসলাম এদের চোখে সবসময় বিপন্ন, মনে হয়, ইসলামের ঠিকাদারি তারা।

নিয়েছিলেন। এ-পরিপ্রেক্ষিতে, তারা স্বাধীনতাবিরােধীদের পুনর্বাসন করেছিলেন। এসব প্রচারের আড়ালে তারা দেশের সম্পদ লুট করেছেন এবং বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় সেনাবাহিনীর সদস্যদের কাছে তা চুইয়ে পড়েছে। এভাবে সেনাবাহিনীকে তারা নিজেদের হাতে রেখেছেন। বিচারপতি কায়ানি বলেছিলেন, পাকিস্তানী সৈনিকরা বীর, তারা নিজেদের দেশ জয় করেছে। বেঁচে থাকলে হয়ত বলতেন, তারা নিজের দেশও ভেঙেছে। আমাদের শাসকরাও বীর। নিজের দেশ জয় করেছিলেন। কিন্তু, দেশের অস্তিত্ব বিনষ্ট করার আগেই বাংলাদেশের সজীব সিভিল সমাজ তাদের হটিয়ে দিতে পেরেছে। কিন্তু, সেই পাকিস্তানী তত্ত্ব, যা তারা পরিপুষ্ট করেছিল তার বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই করতে হয়েছে এবং এখনও। এ-পরিপ্রেক্ষিতে, আমি যে-কজন জেনারেলের বই আলােচনা করেছি তারা হলেন- ফজল মুকিম খান, আমির আবদুল্লাহ নিয়াজি, রাও ফরমান আলি, আসগর খান, গুল হাসান, তােজাম্মেল হােসেন মালিক ও এ আর সিদ্দিক। এছাড়া নিয়াজি ও ফরমান আলির সাক্ষাৎকার কিছু অংশও সংকলিত হলাে এই রচনার পরিপূরক হিসেবে। ১৯৭১-এর ঘটনাকেই গুরুত্ব দিয়ে যে-সব বই বেরিয়েছে তার মধ্যে মেজর জেনারেল ফজল মুকিম খানের বইটিই বােধহয় প্রথম। ১৯৭৩ সালে ইসলামাবাদ থেকে তাঁর লেখা পাকিস্তানস ক্রাইসিস ইন লিডারশিপ বইটি প্রকাশিত হয়েছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী-সম্পর্কিত বিভিন্ন বইতে ‘পাকিস্তানস ক্রাইসিস’ থেকে উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে বিদেশী যারা লিখেছেন। অনেকের মুখে সুখ্যাতিও শুনেছি বইটির। কিন্তু, ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ কোনােও দেশ থেকে বইটির কপি সংগ্রহ করতে পারি নি। কয়েকদিন আগে সাংবাদিক মতিউর রহমানের কাছ থেকে বইটির ফটোকপি সংগ্রহ করে সাগ্রহে পড়লাম। ২৭টি অধ্যায়ে বিভক্ত প্রায় তিনশাে পাতার বই ‘পাকিস্তানস ক্রাইসিস’ মূলত রচিত হয়েছে ১৯৬৯-১৯৭১-এই সময়টুকু নিয়ে। আর এ-কারণেই এটি আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। জেনারেল কেন বইটি লিখেছেন? ভূমিকায় তিনি জানাচ্ছেন, এই গ্রন্থ রচনার উদ্দেশ্য তাঁর ছিল না। ১৯৬৩ সালেই তাকে সাবধান করে দেয়া হয়েছিল যাতে তিনি ১৯৬৫ সালের যুদ্ধ নিয়ে না লেখেন। এর অর্থ, ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের বিপর্যয়ের বিশ্লেষণ হয়ত তিনি করেছিলেন যা কর্তৃপক্ষের পছন্দ হয় নি। সেই থেকে তিনি এসব করা থেকে নিজেকে বিরত রেখে সমাজকর্মে মনােনিবেশ করেছিলেন। কিন্তু, ১৯৭১ সালে আবার বিপর্যয়ের পর বন্ধুবান্ধবদের অনুরােধে তিনি এ-বইটি লিখেছেন।

ভূমিকার প্রথমে তিনি একটি উল্লেখযােগ্য মন্তব্য করেছেন। পাকিস্তানের বিপর্যয় হলাে কেন? কী বিপর্যয়, সেটি অবশ্য তিনি উল্লেখ না করলেও আমরা বুঝতে পারি, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভ ছিল পাকিস্তানের জন্য বিপর্যয়। অনেকে মনে করেন, আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের কারণে এ-বিপর্যয় হয়েছে। ফজল মুকিম এ-কথা মানতে রাজি নন। তার মতে, ষড়যন্ত্র যদি হয়েও থাকে তা হলে সেক্ষেত্রে দায়ভারটা পাকিস্তানের। নেতা ও মানুষরা ষড়যন্ত্রের ক্ষেত্র প্রস্তুত করলেই ষড়যন্ত্র হয়। ভারত ও রাশিয়া যদি পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্র করে থাকে তাহলে পাকিস্তানও তাদের সাহায্য করেছে। তাঁর মতে, “Our own lack of political wisdom and vision of history and our own indifference to what might be our national interest brought the disintegration.” এরপর তিনি মূল বিষয় গণহত্যা নিয়ে আলােচনা করেছেন। তার মতে, ভারত ও ভারত দ্বারা উৎসাহিত বিদেশী রিপাের্টে বাংলাদেশে হত্যা, লুট ও ধর্ষণের কথা বলা হয়েছে। এ-বিষয়টি অনালােচিত থাকুক তা তিনি বা কোনাে পাকিস্তানীরা চায় না। তবে, ভারত থেকে পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দিরা ফিরে এলে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা যাবে পাকিস্তানে যুদ্ধবন্দিরা ফিরে আসার আগে বইটি লেখা]। সৈনিকদের ওপর জেনারেলের এই অগাধ বিশ্বাসে বিস্মিত হতে হয়। তিনি কী ভাবে আশা করেছিলেন যারা হত্যা, ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত তারা তা স্বীকার করবে? ফজল মুকিম বলছেন, এ-বিষয়ে ভারতীয়রা যা প্রচার করে তাতে কান না। দেয়াই সমীচীন। পূর্বপাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক আগ্রাসনের আগে ভারত অন্যান্য প্রচারের জন্য ১২ মিলিয়ন পাউন্ড খরচ করেছে। তারা বারবার প্রচার করেছে ইসলামাবাদ ঢাকাকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে বঞ্চিত করেছে। ফজল মুকিম আশ্চর্য হয়েছেন যে, বিশ্ব প্রেস এই অতিরঞ্জন মেনে নিয়েছে। এবং এভাবে পাকিস্তান সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে ‘unjust impression’ গড়ে উঠেছে। পশ্চিমপাকিস্তানকে অভিযুক্ত করা হয়েছে বাঙালিদের ওপর গণহত্যা চালানাের জন্য। এভাবে- “objectivity, fairness and even reason went down before a thumping desire to punish and destroy Pakistan.” 16761119 খান ও অন্যান্য সমর-নায়কদের সমস্যাটা ছিল পাকিস্তানকেই তারা বিশ্ব ভাবতেন। আর ফজল মুকিম যদি তা না ভেবে থাকেন, তাহলে ধরে নিতে হবে সারাপৃথিবীর প্রেস মিথ্যাবাদী এবং টেলিভিশন বা বেতারে তখন প্রত্যক্ষদর্শীদের যে-রিপাের্ট প্রচারিত হয়েছে তা ছিল ভেলকিবাজি। এপর তিনি বিভিন্ন হিসাব দিয়ে দেখাবার চেষ্টা করেছেন যে, গণহত্যা ও গণধর্ষণের কাহিনী আসলে ঠিক নয়। এ-প্রসঙ্গে বলতে হয়, পাকিস্তানে এ-বিষয়ে যাদের সঙ্গেই আলাপ হয়েছে। তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ বলছেন, এসব বিষয় তারা জানেন না। এমনকি জেনালে নিয়াজি ও রাও ফরমানও তাই বলেছেন? বিষয়টি আমরা বুঝি। গণহত্যা হয়েছে

বললে ১৯৭১ সালের পাকিস্তানী রাজনীতিবিদ ও সমর-নায়কদের কাঠগড়ায় দাড়াতে হয়। আর এখানেই আমরা ইঙ্গিত পেয়ে যাই বাংলাদেশ সম্পর্কে তাঁর পূর্ব ধারণার। জেনারেল ফজল মুকিম খানের প্রথম অধ্যায়ের নাম ‘দুই যুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়’। এই সময়টুকু হচ্ছে ১৯৬৫ এবং ১৯৭১। দু’টি যুদ্ধকেই লেখক দেখেছেন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের আগ্রাসন হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধ হলাে, ‘পূর্বপাকিস্তানে ভারতীয় আগ্রাসন’। এ-অধ্যায়ের মূল প্রতিপাদ্য হলাে- শুরু থেকেই ভারত পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করতে চেয়েছে। এবং সবসময় সর্বক্ষেত্রে পাকিস্তানের ওপর চাপ অব্যাহত রেখেছে। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হয়েছে। কিন্তু ভারত ‘failed to achieve her aim, ended in a stalemate and brought no glory to the Indian Armed forces. Instead of gaining in stature, they suffered a further loss of face.” এই মন্তব্য সত্য হলে জিজ্ঞাস্য তাসখন্দ চুক্তি করতে কেন পাকিস্তান বাধ্য হয়েছিল? কেনই-বা ভুট্টো পরবর্তীকালে তাসখন্দ চুক্তিকে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছিলেন? ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে যে ক্রটিগুলি স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল, লেখকের ভাষায়, পাকিস্তান তা দূর করতে পারে নি, বরং পুরনাে ব্যবস্থাই অব্যাহত থেকেছে। লেখক অবশ্য একথা স্বীকার করতে দ্বিধা করেন নি যে, পাকিস্তান আন্দোলনে, বাঙালিরা ছিল অগ্রপথিক। যে-মুসলিম লীগ এই আন্দোলনের পুরােধা সেই মুসলিম লীগ গঠিত হয়েছিল ঢাকাতেই। কিন্তু, জিন্নাহ এবং লিয়াকতের মৃত্যুর পর যাদের কাজ ছিল বাস্তববাদী হয়ে ঠাণ্ডা মাথায় রাষ্ট্র পরিচালনা করা, ৩ারা তা পারেন নি। এরা কারা? এরা হলেন আবদুর রব নিশতার, সােহরাওয়ার্দী, আকরম খান ও তমিজউদ্দিন খান। লক্ষ্যণীয় যে, এদের অধিকাংশই বাঙালি এবং নদ-ক্ষমতায় এরা ছিলেন না। সুতরাং তারা রাষ্ট্র পরিচালনা করেন নি। যারা পরিচালনা করেছিল সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্র এবং তাদের প্রতিভূ ও সহযােগীদের কথা কিন্তু উল্লেখ করা হয় নি। অর্থাৎ তারা দায়ী নয়।
এ-অধ্যায়ে তিনি আরাে বলেছেন, ১৯৪৭-এর পর পাকিস্তানে সৃষ্টি হয়েছিল মন্ত শ্রেণীর এবং পূর্বপাকিস্তানে ক্লাসলেস সােসাইটি’র। পাকিস্তানের যেসব বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে আলাপ হয়েছে তারাও এ-কথা বলেছেন, তবে শ্রেণীহীন। মাজের কথা বলেন নি, বলেছেন পূর্ববাংলার উঠতি মধ্যবিত্ত শ্রেণীই ছিল প্রবল লং প্রভাবশালী। প্রাক-স্বাধীনতা (১৯৪৭) পর্বে, পশ্চিমপাকিস্তানীরা ছিল অনুগত সূরাং ব্রিটিশরা সবধরনের চাকুরিতে পশ্চিমপাকিস্তানীদের নিয়ােগ দিয়েছে। পূর্ণবাংলার মানুষদের আনুগত্য সম্পর্কে ব্রিটিশরা ছিল সন্দিহান ফলে, এ-অঞ্চলের
মানুষরা চাকুরি থেকে বঞ্চিত হয়েছে। ১৯৪৭-এর পর তাই দেখা যায় সরকারি চাকুরিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ হলাে পশ্চিমপাকিস্তানীরা। ঐতিহাসিকভাবেই পূর্ববাংলা ছিল “হিন্টারল্যান্ড’, এখানে শিল্প গড়ে ওঠে নি। ১৯৪৭-এর পর পূর্ববাংলা থেকে আধিপত্য বিস্তারকারী হিন্দু ব্যবসায়ী ও কারিগররা চলে যায়। পশ্চিমপাকিস্তানের ব্যবসায়ীরা তা কিনে নেয় বা নতুন শিল্প গড়ে তােলে। তা ছাড়া বাঙালিরা 19194 “showed certain prejudices against foreign capital and capitalists, particularly muslim.” সবাইকে তারা পশ্চিমপাকিস্তানী ভাবত কিন্তু তাদের অনেকেই ছিল বহিরাগত, পশ্চিমপাকিস্তানেও। অর্থাৎ, তিনি যা ইঙ্গিত করতে চেয়েছেন, তা হলাে মুসলমানদের বাঙালিরা পছন্দ করত না। পছন্দ করতে কাদের? হিন্দুদের। ফজল মুকিম বলছেন, ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পর পশ্চিমপাকিস্তান সম্পর্কে পূর্বপাকিস্তানের মােহ ভাঙল। এটি অবশ্য সত্য। তিনি লিখেছেন, প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আইয়ুব খানের কাছে হারলেন ফাতেমা জিন্নাহ এবং বাঙালিরা তখন বুঝল এই ব্যবস্থায় তারা রাজনৈতিক ক্ষমতা পাবে না। সেনাবাহিনী দু’অঞ্চলের মধ্যে সেতুবন্ধন গড়ে তুলতে পারত। কিন্তু, তখন দেখা গেল [পূর্বপাকিস্তান অরক্ষিত এবং ‘the feeling of uneasiness and loneliness produced by the war started taking root.” যে অসন্তোষ দানা বাধছিল কেন্দ্রীয় সরকার তা দূর করার কোনাে ব্যবস্থা নেয় নি। পাকিস্তানের ২৫ বছরের ইতিহাসে দু’টি অঞ্চলকে সত্যিকারভাবে একত্রিত করার কোনাে উদ্যোগ নেয়া হয় নি। বরং সরকারের অনেক নীতি দূরত্ব সৃষ্টি করেছে। কিন্তু এ-কারণে ফজল মুকিম কেন্দ্রীয় সরকারকে দোষারােপ করেন নি। তার মতে, “the Government case, therefore, went by default, so did that of the western wing. No literature and no white papers were cver issued, and the Government’s information media miserably failed. The great strides made in social and economic fields in _East Pakistan remained unappreciated.” এ-কারণেই, সৃষ্টি হলাে ৬ দফার। এরপর একটি ইন্টারেস্টিং তত্ত্বের অবতারণা করেছেন ফজল মুকিম খান। তার। মতে, শুরু থেকেই ভারতের নীতি ছিল দ্বি-মুখী। পশ্চিমপাকিস্তানের জন্য তার দ্বার ছিল রুদ্ধ, পূর্বপাকিস্তানের জন্য ছিল উন্মুক্ত। ১৯৪৭-এ নেহেরু-লিয়াকত চুক্তি বলে লােক-বদলের যে নীতি গৃহীত হয়েছিল পূর্বপাকিস্তানের ক্ষেত্রে তা প্রযােজ্য হয় নি। ফলে, পশ্চিমপাকিস্তানে ৮০% সম্পদ পশ্চিমপাকিস্তানী মুসলমানদের হাতে এলেও পূর্বাঞ্চলে সেসব সম্পদ রয়ে গেল হিন্দুদের হাতে এবং ক্রমান্বয়ে তারা তা পাচার করল ভারতে। প্রতি বছর পূর্বপাকিস্তান থেকে হিন্দুরা ৭৫০ থেকে ৮০০ মিলিয়ন টাকা স্মাগল করে বা অন্য উপায়ে নিয়ে যেত ভারতে। T শিক্ষার ক্ষেত্রেও ব্যবস্থাটি ছিল তাই। ১৯৪৭-এ পূর্ববঙ্গের ১২১০টি হাইস্কুল এবং ৬৭টি কলেজ চলত হিন্দুদের টাকায়। এসব প্রতিষ্ঠানে হিন্দু-শিক্ষকরা ভারতে

প্রকাশিত বইপত্রের মাধ্যমে শিক্ষা দিত যা ছিল ইন্ডিয়ান প্রপাগান্ডায় ভরা। ফলে, পাকিস্তানী কোনাে চেতনা পূর্ববঙ্গের তরুণ জেনারেশনের মধ্যে জাগে নি; পরিণামে ‘ইস্ট পাকিস্তানী মুসলিমস’রা রূপান্তরিত হলাে বাঙালিতে। এখানে লেখকের মন্তব্যটি দীর্ঘ হলেও উদ্ধৃত করতে চাই। কারণ, অধিকাংশ পাকিস্তানী এ-তত্ত্বে বিশ্বাস করে এবং পাঠকদের জন্য বাংলাদেশের স্বাধীনতার পটভূমিকা সম্পর্কে পাকিস্তানী তত্ত্বটি পরিস্কার হবে- “The Pakistan cause came to be connected with West Pakistan only. Thus the internal disenssions were being fostered to destroy Pakistan, and regional affinities were being encouraged and Pakistani patriotism downgraded. The seeds of the crisis between East and West Pakistan, sown by professors and teachers of the minority community, yielded a flourishing crop. In twenty-four years, the type of education imparted to them together with insistent Indian propaganda changed the East Pakistani Muslims to Bengalis. A considereable reaction of young East Pakistan was therefore the first to break away from Pakistan and it basis.”
শুধু তাই নয়, ১৯৬৫ থেকে ১৯৭০ এ-সময়টুকুতে দেখা যায় রাজনৈতিক ক্ষেত্রে হিন্দু-নেতারা অনুপস্থিত। তারা বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে বরং সাংস্কৃতিক ফ্রন্টে আত্মনিয়ােগ করে। সারা পূর্ববাংলায় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে ওঠে এবং পাকিস্তান-বিনাশী কর্মকাণ্ড শুরু হয়ে যায়। কিন্তু কেন হিন্দু-নেতারা অনুপস্থিত ছিলেন রাজনীতি ক্ষেত্রে? উত্তর দিতে হলে ফজল মুকিমকে বলতে হতাে, পাকিস্তান সরকার তাদের বিশ্বাসঘাতক’ হিসেবে মনে করত, তাদের দেশত্যাগে, আত্মগােপন করে থাকতে বাধ্য করা হয়েছিল। তবে, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সাংস্কৃতিককর্মীরা যে-অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন তা তার নজর এড়ায় নি। এ-বিষয়ে পাকিস্তানে তাে বটেই আমাদের এখানেও অনেকে উল্লেখ করা থেকে বিরত থাকেন।
এরপর এল আগরতলা মামলা। আইয়ুব খান বাধ্য হলেন ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়াতে। উপসংহারে তিনি যে-মন্তব্য করেছেন, তা বিশ্লেষণ করলে ফজল মুকিমের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে আরাে স্পষ্ট ধারণা হবে। তিনি বলছেন, স্বাধীনতার প্রথম দশকে রাজনৈতিক নেতাদের ‘misrule and misdeed’s এর কারণে আইয়ুবের উত্থান কিন্তু অন্তিমে তারাই সমর্থ হয় তাঁকে ধ্বংস করতে। প্রথম দশকে রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে মােহাম্মদ আলি জিন্নাহ, লিয়াকত আলি, নাজিমুদ্দিন প্রমুখ ছিলেন উল্লেখযােগ্য। অন্য কথায় প্রথম দশকের প্রথমার্ধে সিভিল সমাজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ ছিল। আমলাতন্ত্রের প্রভাবের কারণে তা পারা যায় নি এবং আমলাতন্ত্রের প্রতিভূ হিসেবেই আইয়ুব খান ক্ষমতায় এসেছিলেন। সিভিল সমাজের আধিপত্য যে জেনারেলের পছন্দ নয় তা বােঝাই যাচ্ছে। অবশ্য হবার

কথাও নয়। পাকিস্তানের সব জেনারেলের লেখা আত্মজীবনীতেই এ-কথা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। প্রায় সবাই তাদের বইয়ের উপসংহারে বলেছেন পাকিস্তানের বিপর্যয়ের জন্য রাজনীতিবিদরাই দায়ী। ১৯৬৯-৭১ এ-সময়কালটুকু কেমন ছিল? যেমনটি হয় সামরিক শাসনামলে তেমনই ছিল, লিখেছেন ফজল মুকিম। ক্ষমতায় ইয়াহিয়ার আরােহনের পর এক বৈঠকে সিএমএলএ-র প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার বলেছিলেন- গতবার সিভিলিয়ানরা ভুল করেছে, দোষ পড়েছে আমাদের। এইবার আমরা সব করব, ক্রেডিটও নেব। নতুন সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি ঠিক করেছিল সরকারের কর্মপদ্ধতি। অর্থাৎ এবার সামরিক আমলারা নির্দেশ দেবে, অন্য সবাই তা মানবে। ফজল মুকিম কিন্তু তারপর আবার বলছেন, তবে এটা বলাও ঠিক হবে না যে পুরােপুরি তা সামরিক শাসনই ছিল কারণ এর রুলস রেগুলেশন সামরিক প্রতিষ্ঠান দ্বারা প্রণীত হয় নি। বােঝা যাচ্ছে, সামরিক বাহিনী বা সামরিক প্রতিষ্ঠানকে তিনি কোনাে বিতর্কে জড়াতে চান না এবং সবার ওপরেই তাকে রাখতে চান, যে-কারণে ১৯৬৯-৭১-এর ঘটনাবলির জন্য দোষারােপ করেছেন ইয়াহিয়া খান ও তার ঘনিষ্ঠ 60-67, “It should not be mixed up with the HQ CMLA.” ফজল মুকিম লক্ষ করেছেন, ১৯৬৯ সালের পর থেকে পূর্বাঞ্চলে পশ্চিমপাকিস্তানীদের প্রতি ঘৃণা বাড়ছিল। পূর্ব ও পশ্চিমপাকিস্তানের অফিসারদের মধ্যে দূরত্বের সৃষ্টি হয়। পশ্চিমপাকিস্তানী ও সেনাবাহিনীকে একই চোখে দেখা হতাে এবং তাদের প্রতিও ঘৃণা বাড়ছিল। তিনি বুঝে উঠতে পারেন নি কেন এই ঘৃণা বাড়ছে? কারণ, সেনবাহিনী কি ১৯৭০ সালে ঘূর্ণিঝড় উপদ্রুত এলাকায় কাজ করে নি? এই ঘৃণা সেনাবাহিনীকেও অবাক করেছে। লেখকের মতে, পাকিস্তানী সেনাবাহিনী কখনও কোনাে রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তির প্রতি আনুগত্য দেখায় নি। তারা বৈধভাবে (শব্দটি লক্ষ করুন, বৈধ ভাবে) স্থাপিত কেন্দ্রীয় কর্তৃত্বের অধীনেই থেকেছে। ফজল মুকিমকে এ-প্রশ্নটি করা উচিত ছিল, সেনাবাহিনী যদি দেশের প্রতি অনুগতই হয় তাহলে সিভিল রুল উৎখাত করে কিভাবে তাদের প্রতিনিধি আইয়ুব বা ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় আসেন? সিভিল শাসন উৎখাত করা বৈধ কি? ফজল মুকিমরা এ-ধরনের মন্তব্য করেন এ-কারণে যে, তারা সেনা শাসনের বেনিফিসিয়ারি। সুতরাং, আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে, সরল চিত্তে তিনি এসব মন্তব্য করে গেছেন। আসলে, উৎখাতকার্য সেনা-কর্তৃক যে-বৈধ তা-ই তিনি তুলে ধরতে চেয়েছেন। ১৯৭০ সালে নির্বাচন হলাে। শেখ মুজিব নির্বাচনে জিতলেন। ইসলামাবাদের শাসকচক্র তা ভাবে নি। ফলে, তারা যে-চিন্তাভাবনা করে রেখেছিল নির্বাচন-পরবর্তী সময়ের জন্য তা পাল্টাতে হলাে। আওয়ামী লীগ কিন্তু সবকিছুর
৫০

জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এখানে তিনি একটি তথ্য দিয়েছেন যা কোথাও আগে বিস্তারিতভাবে উল্লিখিত হয় নি। তিনি লিখেছেন, আওয়ামী লীগের সামরিক পরামর্শক কর্নেল ওসমানী একটি বিস্তারিত পরিকল্পনা করেছিলেন শেখ মুজিবের সঙ্গে আলােচনা করে। এর তিনটি পর্যায় ছিল।
প্রথম পর্যায় : রাজনৈতিক আলােচনার মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়া, দুই অংশের মধ্যে বৈষম্য দূর করা এবং সময়-সুযােগ বুঝে স্বাধীনতা ঘােষণা করা।
দ্বিতীয় পর্যায় প্রথম পর্যায় ব্যর্থ হলে জোরপূর্বক ক্ষমতা দখল। এ-কারণে বাংলাদেশকে ৬টি সেক্টরে ভাগ করা হলাে— ঢাকা, ময়মনসিংহ এবং টাঙ্গাইল জেলা; চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা; কুমিল্লা, নােয়াখালি ও সিলেট জেলা; খুলনা যশাের বরিশাল জেলা; দিনাজপুর, রংপুর ও বগুড়া জেলা এবং রাজশাহী ও পাবনা জেলা। প্রতিটি সেক্টরের জন্য কমান্ডার ঠিক করা হলাে। কমান্ডাররা নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের মারফত কাজ করবেন। অস্ত্র যােগাড়ের ভার থাকবে গণপ্রতিনিধিদের ওপর। তৃতীয় পর্যায় প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায় ব্যর্থ হলে জনসাধারণ ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী যার যার জেলার বিপরীতে ভারতীয় ভূখণ্ডে চলে যাবে এবং যাবার সময় পােড়ামাটিনীতি গ্রহণ করবে। বস্তুত দেশ ত্যাগের উদ্দেশ্য হবে, বাংলাদেশ ইস্যুর আন্তর্জাতিককরণ। এরপর শুরু হবে প্রতিরােধ ও গেরিলাযুদ্ধ।
এ-ধরণের ইঙ্গিত আরাে অনেকে করেছেন। আমাদের দেশের অনেক রাজনৈতিক নেতা ও বুদ্ধিজীবী মনে করেন, যুদ্ধের জন্য আওয়ামী লীগ প্রস্তুত ছিল না। তারা পাকিস্তানের সঙ্গেই সবসময় থাকতে চেয়েছে। বাধ্য হয়ে যুদ্ধ করেছে। কিন্তু উপরােল্লিখিত তথ্য মেনে নিলে ঐ তত্ত্ব নাকচ হয়ে যায়।
লে, জে, ওয়াসিউদ্দিন এ-সময় রাওয়ালপিন্ডিতে অফিসার কুরিয়রের মাধ্যমে একটি সংবাদ পাঠিয়েছিলেন
১. পাকিস্তানের এক অংশ থেকে অন্য অংশে প্লেন যেতে ভারত বাধা দেবে।
২. ভারত পাকিস্তানের পশ্চিম সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করবে যাতে পূর্ব সীমান্তে পাকিস্তান বড় ধরনের সমাবেশ ঘটাতে না পারে।
ফজল মুকিমকে এসব তথ্য দিয়েছেন তিন জন বাঙালি অফিসার ব্রিগেডিয়ার এম আর মজুমদার, লে. কর্নেল এ এস বি ইয়াসিন ও সামছুল হাসান।
জল মুকিমের মতে, ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তৃত ছিল এবং কিছু সিনিয়র সিভিল ও পুলিশ অফিসারের তা জানা ছিল। পরে সেনাবাহিনীর পূর্বপাকিস্তানী অফিসারদের এ-বিষয়ে কনভিন্স করে এই পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত করে নেয়া হয়।
১৯৭১-এর গােড়ার দিকেও জেনারেল ইয়াহিয়া ঠিক করতে পারছিলেন না যে তিনি কী করবেন। বিভিন্ন মহলের চাপ ছিল তার ওপর। তাছাড়া ‘various intelligence agencies had a personal stake in ensuring that Mujib didnot ome to power.” অনেকেই পরামর্শ দিচ্ছিল বাঙালিদের ডান্ডা মেরে ঠাণ্ডা করে

দেয়ার জন্য।
জেনারেলের ভাষায় পরামর্শটি ছিল এ-রকম- “The killing of a few thousand would not be a high price for keeping the country together. Handing over power to Mujibur Rahman, a proved traitor, would be a blunder and history would never forgive Yahyah Khan for this.” পশ্চিমপাকিস্তানে বুদ্ধিজীবী ও নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে আলােচনাকালে অনেকে। এ-তথ্য সমর্থন করেছেন। ২৬ মার্চ পর্যন্ত কী ঘটেছিল, এরপর ফজল মুকিম তার বর্ণনা দিয়েছেন। বর্ণনাটি অন্য অনেক বইয়ের মতােই বা বলা যেতে অন্যান্য বইয়ের বিবরণের সূত্র ফজল মুকিমের এই বিবরণ কারণ তাঁর বইটিই প্রথম বেরিয়েছিল। ফজল মুকিমের এই বিবরণের মূল কথা হলাে— আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়ছিল, আওয়ামী লীগ সবাইকে উত্তেজিত করে তুলছিল, বিহারিদের হত্যা করা হচ্ছিল, সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক প্রচারণা চলছিল। আসলে কী ঘটেছিল তা আমাদের জেনারেলদের জানা। সুতরাং, এ-বিবরনের কতটুকু সত্য, কতটুকু অনুমাননির্ভর তা পাঠকের বুঝতে অসুবিধা হয় না। তবে, এখানে বিশেষভাবে একটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই। জেনারেলের এই দীর্ঘ বিবরণে জুলফিকার আলি ভুট্টোর উল্লেখ নেই, তার কর্মকাণ্ডের বিবরণ নেই, তিনি কিভাবে পরিস্থিতি ঘােলাটে করে তুললেন সে-সম্পর্কে কোনাে মন্তব্য নেই, সেনাবাহিনী কিভাবে ভুট্টোর সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করল সে-বিষয়েও কোনাে বক্তব্য নেই। ফজল মুকিমকে ভুট্টো সামরিক সচিব হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন।
ফজল মুকিম খানের বইয়ের পঞ্চম অধ্যায়টি ২৫ মার্চের ওপর। ২৫ মার্চের ঘটনার বিবরণ তিনি বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করেছেন। অন্যান্য জেনারেলদের বইতেও ২৫ মার্চের উল্লেখ আছে বিভিন্ন ভাবে। তবে, মনে হয়, অনেকের প্রধান অবলম্বন ছিল ফজল মুকিমের এই বর্ণনা। এ-বর্ণনারও কতটুকু সত্যি তা আমরা যারা ঢাকা ছিলাম তাদের পক্ষে বোেঝা সহজ। ফজল মুকিম লিখেছেন, ২৫ মার্চ রাতে, সেনাবাহিনী বিভিন্ন ধরনের বাধা দূর করে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে চেয়েছিল। তাদের ওপর নির্দেশ ছিল কেউ গুলি করলে গুলি করার বা প্রতিরােধ করলে তা ভেঙে দেয়ার। এবং বিরােধীদের মনে মনস্তাত্ত্বিক অভিঘাত সৃষ্টি ও রাস্তার জনতা হটাবার জন্য কিছুক্ষণ পর পর আকাশের দিকে গুলি ছােড়ার। শেখ মুজিব পালান নি। তাকে গ্রেফতার করা হয়। কেন পালান নি। তিনি? এ প্রশ্নের জবাবে, ঢাকার স্টেশন কমান্ডারকে শেখ মুজিব বলেছিলেন- ‘to save Pakistan’. ফজল মুকিম বর্ণিত একটি ঘটনার উল্লেখ করি। তিনি লিখেছেন, ইকবাল হল থেকে অনেক ভারতীয় অস্ত্র পাওয়া গিয়েছিল এবং উদ্ধার করা

হয়েছিল বেশ কিছু অবাঙালি মেয়েকে যাদের পতিতা হিসাবে সেখানে রাখা। হয়েছিল। এই অপারেশনে সেনাবাহিনীর পক্ষে মারা গিয়েছিল ৪ জন, ৯৭ জন সিভিলিয়ানকে হাসপাতালে নেয়া হয়েছিল। মৃতের সংখ্যা সরকারি হিসেবে ১৫০, অন্যান্য হিসেবে ৫০০ জন।
এ বর্ণনা পড়লে মনে হবে, সারাবিশ্বের পত্রপত্রিকা যা লিখেছে বা। সংবাদমাধ্যমে যা প্রচারিত হয়েছে তা ছিল মিথ্যা আর জেনারেল ফজল মুকিম খানের ভার্সানটিই সত্যি। আসলে, জেনারেলদের এ-ধরনের ধারণা পাকিস্তানের পতন ত্বরান্বিত করেছে।
ফজল মুকিমের ষষ্ঠ অধায়টি আমাকে বিস্মিত করেছে। এর শিরােনাম মুক্তিবাহিনী’। আপনাদের নিশ্চয় ১৯৭১-এর পাকিস্তানী প্রপাগান্ডার কথা মনে আছে যেখানে মুক্তিবাহিনী ছিল ‘দুষ্কৃতিকারী’। পাকিস্তানে মুক্তিবাহিনী তাই ছিল। জেনারেলরা যখন ১৯৭১-এর যুদ্ধের কথা লিখেছেন তখন পারতপক্ষে মুক্তিবাহিনী’ শব্দটির উল্লেখ করেন নি। জেনারেল নিয়াজির বইতে অবশ্য উল্লেখ। আছে মুক্তিবাহিনীর। কিন্তু, এভাবে অধ্যায়ের শিরােনাম কেউ দেন নি। এর একটি কারণ হয়ত হতে পারে যে, জেনারেল খান যুদ্ধের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না।
ফজল মুকিম অবশ্য অধ্যায়ের গােড়াতেই এ-কথা উল্লেখ করতে ভােলেন নি। যে, ভারতই মুক্তিবাহিনী গড়ে তুলেছে। মুক্তিবাহিনীতে কয়েকবার হতাশা দেখা গিয়েছিল কারণ পাকিস্তানী বাহিনীর বিক্রমের কাছে তারা বা ভারতীয় বাহিনীরা সুবিধা করতে পারছিল না। অনেকে ফেরৎও আসছিল। কিন্তু, পাকিস্তান সরকার। মুক্তিযােদ্ধাদের হতাশার সুযােগ নিতে পারে নি। এ-ধরনের মন্তব্য স্বাভাবিক। হিসেবেই ধরে নেয়া যেতে পারে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এ-অধ্যায়টিতে স্বাধীনতা। সংগ্রামে মুক্তিবাহিনীর অবদানটা তিনি চাপা দিয়ে রাখতে পারেন নি।
তিনি অবশ্য বলেছেন, ১৯৬৮-৬৯ সাল থেকেই সীমান্ত এলাকায় এ-ধরনের। অনেক বাহিনী গড়ে উঠেছিল, যেমন, রুশপন্থি জঙ্গী বাহিনী, চীনভক্ত মুক্তি কমিটি, আর্মি ফর লিবারেশন অফ ইস্ট বেঙ্গল, জাতীয় মুক্তি জোট। আমরাও আজকাল এ-ধরনের তথ্য পাচ্ছি যে, এক ধরনের নিউক্লিয়াস গড়ে উঠেছিল ষাটের দশকে। তবে, ফজল মুকিম যেভাবে বলছেন, সেভাবে নয় নিশ্চয়। তিনি জানিয়েছেন, ১৯৬৯ সালের ১১ মার্চ গােলটেবিল বৈঠক চলাকালীন আইয়ুব খান। বলেছিলেন মুজিবকে যে, ভারত থেকে কিছু লােক প্রবেশ করছে পূর্বপাকিস্তানে এবং সৃষ্টি করছে অস্থিতিশীলতার, তারা বন্দুক বিক্রি করছে ৪০ টাকায়। মুকিম যা। বলতে চেয়েছেন তা হলাে, এ-ধরনের কার্যক্রমের কারণে, মানসিকভাবেই অনেক বাঙালি প্রস্তুত ছিল, যে-কারণে মুক্তিবাহিনী গঠন করতে তেমন অসুবিধা হয় নি। লিখেছেন তিনি, পাকিস্তানে অনেকে মুক্তিবাহিনীকে খাটো করে ভারতীয় সেনা,

সীমানা-রক্ষা-বাহিনীকে ক্রেডিট দিতে চায়। ভারতও প্রথমে তাই করত, পরে দেখল যে, এরকম প্রচারে তারই ক্ষতি। তিনি বলতে চেয়েছেন, মুক্তিবাহিনীর কৃতিত্ব অস্বীকার করার উপায় নেই। লিখেই ফেলেছেন এক জায়গায় “Particularly the EBR had fought with skill, courage and fanaticism which should have surprised no one who knew these units.”
এরপরের চারটি অধ্যায়ের শিরােনাম হচ্ছে ডিফেন্স প্ল্যানস, ইন্ডিয়ান প্রিপারেশনস, স্টেট অফ দি আর্মি ইন নভেম্বর ১৯৭১। এসব অধ্যায়গুলি আমাদের বর্তমান আলােচনার সঙ্গে প্রাসঙ্গিক নয়। প্রায় জেনারেলদের এ-ধরনের আলােচনাগুলি গৎবাধা। আমাদের বিষয়ের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক উল্লিখিত শেষ অধ্যায়টি।
নভেম্বরে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী সম্পর্কে মতামত এই যে, এদের মনােবল। হ্রাস পাচ্ছিল, ছিল না সমন্বয়, ভুগছিল তা অনিশ্চয়তায়। এ-পরিপ্রেক্ষিতে তিনি। একটি হিসেব দিয়েছেন যা অন্য কারাে বইতে দেখি নি, হিসেবটি হলাে পাকিস্তানী সেনাদের মৃত্যুর হার। মার্চ-এপ্রিলে মৃত্যুর হার ছিল প্রতিদিন ১৫-এর নিচে। মে-জুন মাসে এ হার ছিল প্রতিদিন ৩ জন, জুলাই থেকে আবার মৃত্যুর হার বাড়তে থাকে এবং নভেম্বরে গিয়ে তা দাঁড়ায় ১০০ জনে।
সেনাবাহিনীর ওপর এর অভিঘাত ছিল প্রচণ্ড, ডিমরালাইজিং’। মুক্তিবাহিনীর। সঙ্গে সম্মুখ-সমর হচ্ছে না অথচ গেরিলা আক্রমণে মারা যাচ্ছে এটাতে তারা হতবিহ্বল হয়ে যাচ্ছিল এবং তা “adding to the strain on the proud army”
পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর পরাজয়ের অনেক কারণ তিনি বিশ্লেষণ করেছেন, এর মধ্যে সমন্বয়হীনতা এবং কিভাবে তা ক্ষতিকর হয়েছে ইত্যাদির বিবরণ দিয়েছেন। তবে একটি মন্তব্য তিনি করেছেন যা তার কাছে তেমন উল্লেখযােগ্য মনে হয় নি কিন্তু আমার কাছে হয়েছে। এবং পাকিস্তানীদের পরাজয়ের এটি অন্যতম কারণ বলে মনে হয়েছে। সেটি হলাে, দীর্ঘ সময় নিরাপত্তাহীনতার পরিবেশের কারণে ক্রমান্বয়ে সৈন্যরা বাধ্য হচ্ছিল এমন সব অঞ্চলে থাকতে যা সহজে রক্ষা করা যায়। তার ভাষায়- “They were getting fixed, with no manoeuvreability left to them. The feeling of being surrounded was creeping in as any laxity on their part was invariably punished by the Mukti Bahini.”
ভারত পূর্বপাকিস্তান আক্রমণ করল’ – বইয়ের একাদশ অধ্যায়ের। শিরােনাম। তারপর ‘ঢাকার পতন’। এ দুটি অধ্যায়ের বাঙালি পাঠকদের আকর্ষণ করার মতাে কোনাে বিত্তান্ত নেই। পরবর্তী তিনটি অধ্যায় পশ্চিমপাকিস্তানে যুদ্ধের যা আমাদের জন্য প্রাসঙ্গিক নয়। শেষ অধ্যায় ‘রিজনস ফর ডিবাকল’ বা

বিপর্যয়ের কারণটি বরং আমাদের জন্য প্রাসঙ্গিক। এটি লিখতে যে তাঁর ভালাে লাগে নি সেটা বােঝা যায় অধ্যায়ের শুরুর বাক্যটিতে- “Pakistan was not defeated; it was hamiliated, which is still worse.” এরপর বিস্তারিতভাবে বিপর্যয়ের কারণগুলি তিনি বর্ণনা করেছেন। এগুলি হলাে একটি কার্যকর শাসনতন্ত্র তৈরির ব্যর্থতা, শাসক ও শাসিতের মধ্যে দূরত্ব, জাতীয় বিষয়ে অনিশ্চয়তা, তথ্যমাধ্যম, কর্তৃক কিছু ব্যক্তি বা গােষ্ঠির জন্য প্রচারণা। আরাে আছে, যার মধ্যে উল্লেখযােগ্য প্রতিরক্ষা বিষয়টি জনমানসের অগােচরে রাখা এবং কারাে কাছে এদের দায়বদ্ধ না থাকা। এ-বিষয়টি সাধারণ সামরিক অফিসাররা অবসর গ্রহণের পর উল্লেখ করেন। তিনি আরাে উল্লেখ করেছেন, ১৯৭১ সালে সমস্ত ক্ষমতা সিএমএলএ-এর হাতে কেন্দ্রীভূত থাকাও বিপর্যয়ের মস্ত কারণ। পাকিস্তান ১৯৭১ সালে একটি যুদ্ধের মুখােমুখি হয়েছে কোনাে জাতীয় লক্ষ্য ছাড়া। শুধু তাই নয়, তার মতে, পূর্বপাকিস্তানে যুদ্ধটা হলাে শুধু ইয়াহিয়া খান ও তার উপদেষ্টাদের নির্বুদ্ধিতার কারণে সৃষ্ট রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার জন্য। ঢাকায় আত্মসমর্পণের কারণ হাইকমান্ডের এবং তাদের নিযুক্ত কমান্ডারদের অযােগ্যতা। এরপর পাকিস্তানের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা কিভাবে ঢেলে সাজানাে যায় তার উল্লেখ করেছেন তিনি। কিন্তু, এগুলি অর্জিত হবে কিভাবে? এগুলি অর্জিত হবে, তাঁর ভাষায়, “well defined and efficient political institutions for conducting the affairs of state.” এসব প্রতিষ্ঠান সৃষ্টির দায়িত্ব রাজনীতিবিদদের। ২৫ বছরের সৃষ্ট পটভূমিকার জন্য ১৯৭১ সালে পাকিস্তান ভেঙে গেল। এজন্য সবাই কম-বেশি দায়ী তবে বেশি দায়ী রাজনীতিবিদরা। সবকিছু ভুলে তাদের এখন ভালােভাবে দেশ শাসন করতে হবে। “They must ponder earnestly over what great damage they have already done to the country and get down to redemning their past mistake.”
ফজল মুকিম খানও শেষাবধি অন্যান্যদের মতাে এ-সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে পাকিস্তান ভাঙার জন্য রাজনীতিবিদরাই দায়ী এবং রাজনীতিবিদদের পরামর্শ দিয়েছেন। এই যে পরামর্শ দেয়ার এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলি গায়ের জোরে ভেঙে দেয়াই পাকিস্তানের পতনের কারণ, জেনারেলদের মাথায়ই তা ঢােকে নি। বা বুঝলেও নিজ স্বার্থে তা এজেন্ডার বাইরে রাখতে চান। জেনারেল ফজল মুকিম খানের বইটি তার আরাে একটি উদাহরণ।
b
জেনারেল নিয়াজির বই দি বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তান আলােচনার আগে, ব্যক্তি নিয়াজির সম্পর্কে খানিকটা ধারণা থাকলে তার বক্তব্য অনুধাবন করা সহজ হবে। সম্প্রতি গিয়েছিলাম পাকিস্তান এবং সেখানে জেনারেল নিয়াজি সম্পর্কে
৫৫

একজনের মুখেও কোনাে প্রশংসাবাক্য শুনি নি। প্রথমে মনে হয়েছিল, যেহেতু তিনি পরাজিত জেনারেল সেহেতু এ-ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি। কারণ পাকিস্তানীরা সবসময় নিজেদের শ্রেষ্ঠ সৈন্য ভেবে এসেছে, অথচ বাংলাদেশে তারা জীবনের প্রথম প্রচণ্ড মার খেয়েছে। এটি একেবারে লিবারেল পাকিস্তানীর পক্ষেও হজম করা মুশকিল। নিয়াজি সম্পর্কে সবার মত : তিনি বীর কোনাে যােদ্ধা নন, তিনি লম্পট, নিরেট অশ্লীল ইয়ার্কি মারতে দক্ষ ইত্যাদি। জামায়াতের ভাইস-প্রেসিডেন্ট তাে বলেই ফেললেন, “সে বেঁচে এল কেন?”
নিয়াজির সঙ্গে সাক্ষাত করে আমারও তাই মনে হয়েছে। লােকটি ক্লাউনের মতাে অবান্তর রসিকতা করে, দৃঢ়মূল কিছু পূর্ব ধারণা আছে এবং নিরেট। আসলে পাকিস্তান, তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানে যে নীলনক্সা কার্যকর করতে চেয়েছিল তার জন্য দরকার ছিল বােধহীন, নিরেট লােক। সে-কারণেই, সামরিক জান্তা, ১২ জনকে ডিঙিয়ে, নিয়াজিকে প্রমােশন দিয়ে ঢাকা পাঠিয়েছিল। নিয়াজির বােধশক্তির একটি উদাহরণ দেই। তিনি আমাদের বলছিলেন হাইকমান্ড তাকে বাধা না দিলে তিনি কলকাতা, গুজরানওয়ালা দখল করে কাশ্মীর নিয়ে নিতে পারতেন। এখন আপনারা মানচিত্রে দেখে নিন, কোথায় ঢাকা, কোথায় কলকাতা, কোথায় গুজরানওয়ালা আর কোথায় কাশ্মীর! নিয়াজির প্রকাশক অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস তাকে কী চোখে দেখেছে? এই প্রথম তারা লেখকের বক্তব্যের দায়দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করেছে। অর্থাৎ প্রকাশক জানে যে, নিয়াজিকে পাকিস্তানে কী দৃষ্টিতে দেখা হয়। কিন্তু বইটি তারা প্রকাশ করেছে ব্যবসায়িক কারণে এবং তা ভালাে বিক্রিও হচ্ছে। আমাদের লাভটি হয়েছে এই যে, বইটি নিয়ে প্রচণ্ড বির্তক হচ্ছে। এমনকি যারা গত ত্রিশ বছর চুপ ছিলেন তারাও মুখ খুলছেন। ফলে অনেক অজানা তথ্য জানা যাচ্ছে। নিয়াজি ভূমিকার গােড়াতেই নির্ধারণ করে দিয়েছেন, কারা ১৯৭১ সালের জন্য দায়ী। তিনি লিখেছেন যুদ্ধবন্দি হিসাবে, ১৯৭৪ সালে ভারত থেকে তিনি পাকিস্তান ফেরেন। ক্ষমতা তখন তাদের হাতে যাদের আগ্রাসী ভূমিকার জন্য পাকিস্তান দ্বিখণ্ডিত হয়েছে। “আমি যা ভয় পেয়েছিলাম, দেখি তা-ই ঘটছে,” লিখেছেন নিয়াজি, “পূর্বাঞ্চলের গ্যারিসনকে নন্দঘােষ করা হয়েছে। এটি করা। হচ্ছিল এ-কারণে যাতে পাকিস্তান ভাঙার জন্য যিনি দায়ী সেই ভুট্টোকে রক্ষা করা যায়।” নিয়াজি তখনই লিখতেন। কিন্তু পরিবেশ অনুকূল ছিল না। এমনকি জে, জিয়াউল হকের আমলেও। ভুট্টো থেকে জিয়া আমল পর্যন্ত যারা ক্ষমতায় ছিলেন। তাদের কেউই চাচ্ছিলেন না ১৯৭১ সাল সম্পর্কিত ‘সত্য’ কেউ জানুক। বরং তারা নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরানাের জন্য অন্য জেনারেলদের দিয়ে লেখাচ্ছিলেন। নিয়াজি জানাচ্ছেন, ক্রাইসিস ইন লিডারশিপের’ লেখক জেনারেল ফজল মুকিম খান বইটি লিখেছেন ভুট্টো ও জেনারেল টিক্কা খানের নির্দেশে। হতেও পারে।

কারণ ফজল মুকিমকে তখন সামরিক সচিবের পদটি দেয়া হয়েছিল। নিয়াজির মতে, বইটিতে তথ্য বিকৃত করা হয়েছে। উইটনেস টু সারেন্ডার-এর লেখক ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিক সালিক সম্পর্কেও তার মতামত একই রকম। নিয়াজি দুঃখ করে লিখেছেন, সালিক তার কমান্ডারের বিরুদ্ধে লিখেছেন, যে কমান্ডার না থাকলে বাঙালিরা তার গায়ের চামড়া তুলে নিত। উল্লেখ্য, সালিক ভুট্টো ও জিয়া আমলে, যুদ্ধবন্দি হওয়া সত্ত্বেও দ্রুত সব প্রমােশন পেয়েছিলেন। নিয়াজির মতে, সদর দফতর মেজর জেনারেল শওকত রিজাকে কমিশন করেছিল ১৯৭১ সালের যুদ্ধ সম্পর্কে লিখতে। রিজা লিখেছিলেন দি পাকিস্তান আর্মি ১৯৫৬-৭১। অদক্ষতা, কাপুরুষতা ইত্যাদির কারণে নিয়াজি তাঁকে ১৯৭১ সালে একটি ডিভিশনের কমান্ড থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন। নিয়াজির প্রশ্ন, রিজার পক্ষে কি তাহলে সঠিক ইতিহাস লেখা সম্ভব? সদর দফতর লে. জে. কামাল মতিনকে দিয়েও একটি বই। লিখিয়েছিল। মে. জেনারেল রাও ফরমান আলি লিখেছেন, হাউ পাকিস্তান গট ডিভাইডেড। নিয়াজির মতে, ফরমান আলির বইও মিথ্যার বেসাতি। ফরমান, তাঁর ভাষায়, পাঁচ জন গবর্নরের অধীনে চাকরি করতে পেরেছিলেন। তাঁর “Intrigue and manipulation”-এর মাধ্যমে। এ-বক্তব্যে যে যুক্তি একবারে নেই তা নয়। কারণ ১৯৭৪ সালে পাকিস্তানে ফেরার পর ফরমান উচ্চপদে আসীন ছিলেন। উল্লেখ্য যে, পাকিস্তানের সব জেনারেলই নানা কর্মকাণ্ড করেও পেনশন পাচ্ছেন। পেনশন থেকে একমাত্র বঞ্চিত করা হয়েছে জেনারেল নিয়াজিকে।
সুতরাং নিয়াজিকে অবশেষে কলম তুলে নিতে হয়েছে। তার মতে, ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর ভুট্টো অর্থনৈতিক উপদেষ্টা এম.এম. আহমেদ ও প্ল্যানিং কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান কামার উল ইসলামকে বলেছিলেন, হিসাব করে দেখতে যে, পূর্বপাকিস্তান ছাড়া পাকিস্তান টিকবে কি না। নিয়াজি যা বলতে চেয়েছেন, তা হলাে, ১৯৭১ একটি অজুহাত মাত্র, পাকিস্তানের শাসকবর্গ অনেক আগেই পূর্বপাকিস্তানকে ত্যাগ করতে চেয়েছিল। পাকিস্তানের প্রাক্তন উচ্চপদস্থ আমলাদের এ-বিষয়ে জিজ্ঞাসা করেছি, তারা এর সত্যতা স্বীকার করেছেন। কামার উল ইসলামকেও এ-বিষয়ে প্রশ্ন করেছিলাম। তিনি তা অস্বীকার করেন নি। বরং বলেছেন, ১৯৬৯ সালের পর থেকেই এ-ধরনের চিন্তাভাবনা হচ্ছিল। নিয়াজি আরও বলছেন, ভুট্টো বিরােধীদলের নেতা হওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। ক্ষমতায় যাওয়া তার পক্ষে তখন সম্ভব ছিল, যদি পূর্বপাকিস্তান স্বাধীনতা পায়। সে জন্যই তিনি তখন বলেছিলেন, ‘ইধার হাম উধার তুম’। এ-যুক্তিও আমি যাদের সঙ্গে আলাপ করেছি তারা অস্বীকার করেন নি। যুদ্ধ যখন তুঙ্গে তখন ইয়াহিয়া খান বলেছিলেন, “পূর্বপাকিস্তানের জন্য প্রার্থনা করা ছাড়া আমার আর করার কিছু নেই” এবং পূর্বাঞ্চলীয় গ্যরিসন যখন শেষপর্যন্ত লড়তে প্রস্তুত তখন তাকে আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়েছে। কারণ, তা না-হলে পশ্চিমপাকিস্তান আর টিকে থাকে না। এখানে একটু কিন্তু আছে। আত্মসমর্পণ করা ছাড়া নিয়াজির আর

কোনাে উপায় ছিল না। নিয়াজির মূল বক্তব্য যেটি, সেটি কিন্তু আজ পাকিস্তানে কেউ অস্বীকার করেন নি। বলা যেতে পারে, ভূমিকায় নিয়াজি যা বলেছেন তার। সত্যতা আছে। কারণ নিয়াজির সমসাময়িক যারা পাকিস্তানে বেঁচে আছেন তাঁরা। কেউ-ই এ-কথাগুলাে অস্বীকার করেন নি। তবে নিয়াজিই প্রথম যিনি প্রকাশ্যে। এ-কথাগুলাে স্পষ্ট করে বললেন। এজন্য কৃতিত্ব অবশ্যই তার প্রাপ্য। নিয়াজির বইয়ের প্রথম দুটি অধ্যায় তার বেড়ে ওঠা, সেনাবাহিনীতে যােগদান, ভারত। বিভক্তি, পূর্বপাকিস্তানে পােস্টিং এবং ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধ নিয়ে লেখা। “আমার নাম আমির আবদুল্লাহ নিয়াজি কিন্তু পরিচিত হয়ে উঠেছি টাইগার নিয়াজি। নামে।” এভাবে নিয়াজি শুরু করেছেন তার বাল্যজীবনের কথা। বংশ গরিমা ও নিজ বীরত্বের কথা উল্লেখ করেছেন। এ-বিষয়গুলাে তিনি বারবার উল্লেখ করতে ভােলেন না। আমাকে তিনি বলছিলেন, “আরে আমি গেরিলাদের (১৯৭১ সালে) ভয় পাব কেন? আমি ইন্দোনেশিয়ায় গেরিলাদের বিরুদ্ধে লড়েছি না? এ-কারণেই তাে ১৯৭১ সালে গেরিলারা আমার সঙ্গে সুবিধা করতে পারে নি।” নিয়াজি জানাচ্ছেন, জাপানিদের বিরুদ্ধে কোরিয়ায় যুদ্ধের সময় ব্রিগেডিয়ার ওয়ারেন তার এই (টাইগার) নামকরণ করেছিলেন। এই খেতাব’ ছাড়াও তিনি। পেয়েছেন মিলিটারি ক্রস, সিতারা-ই-খিদমত, সিতারা-ই-পাকিস্তান, বীরত্বের জন্য দুটি হিলাল-ই-জুরাত ও ২৪টি মেডেল। ১৯৫৭ সালে ঢাকায় ছিলেন এবং তাঁর। সাংগঠনিক প্রতিভা ও বীরত্বের কারণে ক্যান্টনমেন্টে একটি রাস্তার নামকরণ হয়েছিল ‘টাইগার রােড’। আইয়ুব আমলের প্রভাবশালী আমলা আলতাফ গওহর আমাদের বলেছিলেন এবং খবরের কাগজেও লিখেছেন, ‘টাইগার’ উপাধি পাওয়ার কারণটি অন্য। নিয়াজির সঙ্গে ক্যাডেট হিসাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এক ভারতীয় জেনারেল জানিয়েছেন, আর্মি মেসে নজর কাড়ার জন্য বেয়ারাদের নিয়াজি চিৎকার করে ডাকতেন ‘শেরা। সেজন্য তার নামকরণ করা হয় ‘টাইগার’ (পাঞ্জাবি ‘শেরার কাছাকাছি অর্থ)। কোনাে যুদ্ধের কারণে তিনি তা অর্জন করেন নি। আলতাফ গওহর বলেছিলেন, নিয়াজি বলছেন, পশ্চিমপাকিস্তানে তাঁকে। তারিক-বিন-জায়েদ উপাধি দেয়া হয়েছিল। কিন্তু কে কখন তাকে এই উপাধি। দিয়েছিল তা জানান নি। তিনি আরও বলছেন, ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের সময় আমি। জেনারেল নিয়াজির নাম-ই শুনি নি। ঘণ্টায় ঘণ্টায় এ-যুদ্ধ আমাকে পর্যবেক্ষণ। করতে হয়েছিল। হয়ত নিয়াজি তাঁর কাজ ভালােভাবেই করছিলেন যে-কারণে হিলাল-ই-জুরাত পেয়েছেন কিন্তু আইয়ুব খানের কোনাে ব্রিফিংয়ে তার নাম। উচ্চারিত হয় নি। পাকিস্তানে নিয়াজিই বােধহয় সর্বাধিক মেডেল ও উপাধি পাওয়া জেনারেল। নিয়াজি নিজেও তা বলছিলেন। হয়ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এবং পাক ভারত যুদ্ধে তিনি ভালাে লড়াইও করেছিলেন। না-হলে ক্রমাগত মেডেল পাওয়া যেত না। তবে একটি বিষয় বিবেচনায় রাখা উচিত। মেজর জেনারেল তােজাম্মেল হােসেন মালিক

তার আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছেন, পাক-ভারত যুদ্ধের সময় তার সেক্টরে যারা বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন এবং যাদের তিনি মেডেলের জন্য সুপারিশ করেছিলেন তাদের কাউকে মেডেল দেয়া হয় নি। সেনাবাহিনীতে এভাবে সুবিধাবাদী চক্র নিজেদের স্বার্থরক্ষা করে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে। লক্ষ করবেন বীর উত্তম, বীর প্রতীক ইত্যাদির সিংহভাগ পেয়েছে প্রাক্তন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সৈনিকরা, যারা মুক্তিযুদ্ধে যােগ দিয়েছিলেন। সাধারণ মানুষ পান নি। সেনাবাহিনীর সদস্য ছাড়া একজনকেও নাকি খুঁজে পাওয়া যায় নি। যাকে বীরশ্রেষ্ঠ দেয়া যায়। এভাবে বাংলাদেশের শুরুতে প্রাক্তন পাকিস্তানী সেনারা নিজেদের স্বার্থচক্র সৃষ্টি করেছিল।
১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন নিয়াজি যেখানে নিজের প্রত্যুৎপন্নতা ও বীরত্বের উল্লেখ আছে। তিনি জানিয়েছেন, শিয়ালকোটের যুদ্ধে জেনারেল আবরার জয়ী হয়েছিলেন, কিন্তু নাম কিনলেন জেনারেল টিক্কা খান কিছু না করেই। যুদ্ধ সম্পর্কে টিক্কা খান ভুল ধারণা দিয়েছিলেন এবং শাস্তির হাত থেকে অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছিলেন। মন্তব্য করেছেন নিয়াজি- “At times history is unkind. It creates giants out of pygmies and titans are not given their in due share.” নিজের কথা ভেবেই তিনি এ-মন্তব্য করেছেন। মনে রাখা দরকার, টিক্কা খানের সঙ্গে সম্পর্ক তার মধুর ছিল না। কমান্ডার হিসাবে টিক্কা খান একেবারে ব্যর্থ—এ-কথা নিয়াজি ছাড়া পাকিস্তানের কেউ কখনও বলেন নি। নিয়াজির বইয়ের তৃতীয় অধ্যায়টি আমাদের আলােচনার জন্য প্রাসঙ্গিক, যার নাম দিয়েছেন তিনি- “Events leading to secession.” পাকিস্তানে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান সম্পর্কে যে-ধারণা দেয়া হতাে বা যাকে বলা যেতে পারে স্ট্যান্ডার্ড টেক্সট’ তারই প্রতিফলন ঘটেছে এ-অধ্যায়ে। পাকিস্তানীদের অনেকের সঙ্গে কথা বলে আমারও তা মনে হয়েছে। এবং আরও মনে হয়েছে বামপন্থি ও নতুন প্রজন্ম এখন এই স্ট্যান্ডার্ড টেক্সট’ সম্পর্কে প্রশ্ন তুলছে। এ-অধ্যায়ে অন্যান্য জেনারেলের মতাে তিনিও পূর্ব ধারণা ব্যক্ত করেছেন। জেনারেল উমর ও জেনারেল ফরমান। আলিও তাদের সাক্ষাতকারে একই ধারণা ব্যক্ত করেছেন। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির সময়, জানাচ্ছেন নিয়াজি, পশ্চিমপাকিস্তান থেকে ধনী ও শিক্ষিত হিন্দুরা চলে গিয়েছিল। পূর্বপাকিস্তান থেকে যায় নি। এখানে মুসলমানরা যদিও ছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ কিন্তু ছিলেন অধস্তন। স্কুল-কলেজের অধিকাংশ শিক্ষক ছিলেন হিন্দু এবং পশ্চিমপাকিস্তানীদের তারা চিহ্নিত করেছিলেন সাম্রাজ্যবাদী, স্বৈরাচারী ও লুটেরা হিসাবে। তরুণমনকে তারা প্রভাবিত করেছিলেন এবং এভাবে রােপিত হয়েছিল অসন্তোষের বীজ।
এ-কারণেই পশ্চিমপাকিস্তানীরা সচেতনভাবেই প্যারিটি চেয়েছিল। কারণ তা না-হলে ক্ষমতা থাকত বাঙালিদের হাতে। সেই বাঙালিদের নিয়ন্ত্রণ করত কুড়ি
ভাগ হিন্দু। অর্থাৎ হিন্দুরাই পরােক্ষভাবে শাসন করত পাকিস্তান। এই হিন্দু-প্রভাব রদের জন্যই উদ্ভব হয়েছিল প্যারিটি ব্যবস্থার। এই ধারণা যে কতটা বন্ধমূল তার একটি উদাহরণ দিচ্ছি। নিয়াজির সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছি আমি এবং মহিউদ্দিন আহমদ। নিয়াজির সঙ্গে আছেন তাঁর দুই মেয়ে। প্রথমেই একজন জানতে চাইলেন। আমরা হিন্দু কি না! সাক্ষাতকার শেষে দু’জনই অনুনয় জানিয়ে বললেন, আমরা যেন ভারতকে ত্যাগ করে অন্য যে-কোনাে দেশকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করি। আমরা এ-প্রশ্নটিই রেখেছিলাম— আমরা যদি হিন্দু-প্রভাবান্বিতই হই তাহলে আমরা পাকিস্তান প্রস্তাব কেন করেছিলাম এবং পাকিস্তানের অংশই-বা কেন হয়েছিলাম? এ-প্রশ্নের জবাব নিয়াজি, ফরমান, উমর— কেউ-ই দিতে পারেন নি। দেয়া সম্ভবও নয়, কারণ ব্যাপারটি অবাস্তব। কিন্তু পাকিস্তানী মন বােঝার জন্য বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। নিয়াজি অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে জানাতে বাধ্য হয়েছেন যে, দু’প্রদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান হলেও এদের মধ্যে কোনাে মিল ছিল না। ভাষা, পােশাক-আশাক, খাদ্য-রুচি কোনাে কিছুতেই না। সাক্ষাতকার প্রদানকালে নিয়াজি বলেছেন ‘প্র্যাকটিসিং মুসলমান হিসাবে বাঙালি মুসলমানরা পাকিস্তানী থেকেও বেশি মুসলমান। সাচ্চা মুসলমান। অন্যান্য জেনারেলও তাই বলছেন। এভাবেই জেনারেলদের মনের পরস্পর বিরােধিতা প্রকাশিত হয়েছে।
এ-প্রসঙ্গে নিয়াজি আরও উল্লেখ করেছেন, পশ্চিমপাকিস্তান ছিল জমিদারদের ক্ষেত্র, যারা ছিল ক্ষমতাশালী ও সামন্তবাদী এবং কৃষকরা ছিল তাদের অধস্তন।
পূর্বপাকিস্তানে প্রভাবশালী ছিল শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী। বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক ও আইনজীবীদের প্রবল প্রভাব ছিল সাধারণ মানুষের ওপর। পাকিস্তানে যাদের সঙ্গে কথা বলেছি, এমনকি যারা সামন্ত পরিবারেরও তাঁরাও এ-কথা স্বীকার করেছেন।
পূর্বপাকিস্তানে যে-অসন্তোষের বীজ রােপিত হয়েছিল তা নিয়াজি অস্বীকার করেন নি। কিন্তু কেন, সে-বীজ রােপিত হয়েছিল সে কারণ বিশ্লেষণ তিনি করেন নি। তবে তার বিভিন্ন উক্তিতে মনে হয়, তিনি বা তারা কারণগুলাে জানতেন। যেমন, লিখেছেন তিনি, ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় পূর্বপাকিস্তান ছিল অরক্ষিত। ফলে, এ-অঞ্চলে অসন্তোষ তীব্র হয়ে ওঠে। তার ভাষায়— “The Bengalis were convinced more than ever before that they were being neglected. To a certain extent their anxieties were not unfounded.” তাঁর মতে, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা মিথ্যা ছিল না। হিন্দুরা ১৯৪৭ থেকেই ভারতীয় গােয়েন্দা সংস্থাকে সাহায্য করেছে। ১৯৬৯ সালে সেনাপতি ইয়াহিয়া খান, শেখ মুজিবকে উৎসাহ দিয়েছেন আন্দোলন চালিয়ে যাবার জন্য যাতে তিনি ক্ষমতা দখল করতে পারেন। তার এ-মন্তব্যের যথার্থতা যে নেই তা বলাই বাহুল্য।
১৯৭০ সালে ঘূর্ণিঝড়ের সময় পূর্বপাকিস্তানের গবর্নর এডমিরাল আহসান,
৬০

ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব থেকে কোনাে সাহায্য চেয়ে পান নি। ফলে, এ অসন্তোষ তীব্র হয়ে ওঠে। ইয়াকুব বরং একটি নিরাপত্তা পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন যার নাম ব্রিজ।’ নিবার্চনে আওয়ামী লীগ অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করে। নিয়াজি আমাদের বলেছেন, ফজলুল কাদের চৌধুরী, ফরিদ আহমদ প্রমুখ তাকে বলেছিলেন যে সামরিক সরকার যদি নির্বাচনে হস্তক্ষেপ না করত তা হলে অন্যান্য দল ৫০/৬০টি আসন পেত। এ-ধারণা পশ্চিমপাকিস্তানের অনেকেরই। কারণ তারা ভেবে পায় না, কীভাবে একটি দল পরিষদের (প্রায়) সব আসনে জয়লাভ করে? ভুট্টো এ ফলাফল মানতে অস্বীকার করেন। ১৯৭১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি গবর্নরদের এক বৈঠকে ইয়াকুবকে জানান হয় : যদি মুজিব ৬ দফা থেকে না সরেন তা হলে ‘ব্রিজ’ পরিকল্পনা যেন কার্যকর করা হয়, ইয়াকুব অনেক আগেই ‘বিদ্রোহ দমন করতে পারতেন কারণ, “All Yaqub faced was a rag-tag mob” এরপর ইয়াকুব গবর্নর হলেন এবং চারদিন পর পদত্যাগ করলেন। পাকিস্তানের বিপদের সময় তিনি পদত্যাগ করলেন বিবেকের দোহাই দিয়ে। কারণ, পাকিস্তানী ভাইদের ওপর তিনি গুলি চালাতে পারবেন না। কিন্তু এই অজুহাত ঠিক হতাে যদি আরও আগে বিবেকের তাড়নায় তিনি পদত্যাগ করতেন। এককথায় নিয়াজি ইয়াকুবকে চিত্রিত করেছেন চরম সুবিধাবাদী হিসাবে, যিনি নওয়াজ শরিফের পূর্ব পর্যন্ত প্রতিটি সরকার থেকেই সুবিধা নিয়েছেন।
সাহেবজাদা ইয়াকুবই বােধহয় ১৯৭১ সালের কুশীলবদের একজন যিনি গত ২৮ বছরে ১৯৭১ সাল সম্পর্কে কোনাে মন্তব্য করেন নি। নিয়াজির বই প্রকাশিত হওয়ার পর তিনি আলতাফ গওহরকে একটি চিঠি ও কিছু দলিলপত্র পাঠিয়েছিলেন আত্মপক্ষ সমর্থন করে। গওহর সেটি প্রবন্ধাকারে ছেপেছেন। আমি এবং মহিউদ্দিন আহমদ ইসলামাবাদে তার সঙ্গে দেখা করেছিলাম। তিনি আমাদের সঙ্গে ১৯৭১ সাল নিয়ে কিছুক্ষণ আলাপ করলেন। কিন্তু বললেন, এসব কিছুই ‘অব দ্য রেকর্ড”। অপারেশন ‘ব্লিঞ্জ’ নিয়ে কথা উঠতেই তিনি কিছু কাগজপত্র দিলেন যা। তিনি আলতাফ গওহরকেও পাঠিয়েছিলেন। গওহরকে তিনি লিখেছিলেন— “As you know, baseless and malicious charges are best treated with contempt.”
১৯৭১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্টের পিএসও লে.জে. পিরজাদাকে ইয়াকুব যে চিঠিটি দিয়েছিলেন তার কপিও দিলেন আমাদের।
জেনারেল ইয়াকুব বলছেন, ১৯৭০ সালের নবেম্বরে তিনি অপারেশন “ব্রিজ’-এর পরিকল্পনা করেন। তার ভাষ্য-অনুযায়ী এ-পরিকল্পনা করা হয়েছিল”……to meet the eventuality of an insurgencey and the total collaspe of law and order during the period of general elections in E. Pakistan in December 70. In this hypothetical situation, the mission was to restore order rapidly by the stringent enforcement of martial law, selective

arrest of anti-Pakistan elements, vigorous implementation of order to secure key points vital areas using minimum force. The object was to gain swift control to be able to meet external intervention.” তিনি জানাচ্ছেন, তার সময়ে অপারেশন ‘
ব্লিঞ্জ’ কার্যকর হয় নি কারণ তার আগেই তিনি পদত্যাগ করেছিলেন। পদত্যাগপত্র পেশ করেছিলেন তিনি ৫ মার্চ। এর কারণ আগে প্রকাশিত হয় নি দেখে মূল ভাষায় তা উদ্ধৃত করছি— “Only solution present crisis is a purely political one. Only President can take this far-reaching decision by reaching Dacca by 6th, which I have repeatedly recommended. Am convinced there is no military solution which can make sense in present situation. I am consequently unable to except responsibility for complementing a mission, namely a military solution, which would mean civil war and large scale killing unarmed civilians and would achieve no sane aim. It would have disastrous consequences. I therefore confirm tendering my resignation
উল্লেখ্য, জেনারেল ইয়াকুব সামরিক সমাধানের ফলাফল স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করেছিলেন। ফেব্রুয়ারিতে পিরজাদাকে তিনি লিখেছিলেন যে, পাকিস্তান ভেঙে যাবে এবং এর দায়দায়িত্ব বহন করবে কে? তিনি লিখেছিলেন
W. Pak leaders must make up their mind regarding the price” they are prepared to pay in the political and economic spheres for integration.
It should be our endeavour to place the responsibilty for their failure on their shoulders or at worst they- at least the W.Pak leaders must be made to share with us the responsibility for decisions which are bound to lead to disintegration under the most unfavourable and bitter circumstances.”
আলতাফ গওহর জানিয়েছেন, অপারেশন ব্লিজ’ কার্যকর করার বিরােধী ছিলেন আরেকজন সামরিক অফিসার—গ্রুপ ক্যাপ্টেন মাসুদ জাফর যাকে সবাই জানত মিট্টি মাসুদ নামে। ইয়াহিয়া ও অন্য অফিসারদের এক বৈঠকে ‘অপারেশন ব্রিজ’ কার্যকর করার বিষয় যখন আলােচনা হচ্ছিল মিট্টি মাসুদ তখন তার বিরােধিতা করে বলেন, এর ফলাফল খুব খারাপ হবে। যতদিন মিট্টি বিমানবাহিনীর দায়িত্বে ছিলেন ততদিন ‘অপারেশন ব্লিজ’-এ একটি বিমানও সাহায্য করেন নি। জেনারেল ইয়াকুব আলতাফ গওহরকে বলেছেন যে, মিট্টির মতাে এত সাহসী ও দৃঢ়চেতা লােক তিনি খুব কম দেখেছেন। আমাকেও পাকিস্তানে দু’একজন মিট্টির কথা বলেছেন। হুকুম তামিল না করার কারণে মিষ্টির। কোর্ট মার্শাল হয়। তিনি নাকি এখন থাকেন জার্মানিতে। সুতরাং নিয়াজি এ-পর্যায়ে যা বলছেন তা সঠিক নয় এবং এসব বক্তব্য তাঁর ধারণাপ্রসূত। অন্যদিকে জেনারেল ইয়াকুবের চিঠিপত্র থেকে বােঝা যাচ্ছে, পূর্বপাকিস্তানে

সামরিক অভিযান এবং হত্যাযজ্ঞের বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে পূর্বপরিকল্পিত, হঠাৎ করে তা উদ্ভূত হয় নি। নিয়াজি তারপর লিখেছেন, শাসনতান্ত্রিক সঙ্কট আরও জোরালাে হয়ে উঠলে ভুট্টো পশ্চিমপাকিস্তানে ঘােষণা করেছিলেন, হয় পূর্বপাকিস্তানকে স্বাধীনতা দাও, নয় তাে মুজিবকে গ্রেফতার করাে। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইয়াহিয়া গবর্নরদের নিয়ে বৈঠক করেন যেখানে জেনারেল ইয়াকুবও ছিলেন। সেখানেই সিদ্ধান্ত নেয়া হয় শেখ মুজিব যদি তাঁর অবস্থান থেকে না সরেন তাহলে সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
চলে এল ১৯৭১ সালের মার্চ মাস। এ-মাস সম্পর্কিত বিবরণে তিনি কিছু পূর্ব ধারণা ব্যক্ত করেছেন। সত্য-মিথ্যার মিশ্রণ ঘটিয়েছেন এবং টিক্কা খানের প্রতি বিরাগবশত কিছু সত্য বলেছেন।
নিয়াজি লিখছেন, ৭ মার্চ মুজিব অসহযােগ আন্দোলন শুরু করার পর আওয়ামী লীগ এমন সব নিষ্ঠুর ঘটনা ঘটিয়েছিল যা বর্ণনাতীত। বগুড়াতে ১৫০০০ অবাঙালিকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করা হয়েছিল। চট্টগ্রামে হাজার হাজার নারী-পুরুষকে হত্যা ও নারীধর্ষণ করা হয়েছিল। সিরাজগঞ্জে মহিলা ও শিশুদের ঘরে আটকে আগুন দেয়া হয়েছিল। বিহারি এবং পশ্চিমপাকিস্তানীরা ছিল এসব আক্রমণের লক্ষ্য। শুধু তাই নয়, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের যেসব পশ্চিম পাকিস্তানী অফিসার ছিল তাদের হত্যা করে তাদের স্ত্রীদের ধর্ষণ করা হয়েছে এবং উলঙ্গাবস্থায় বাঙালি অফিসারদের খাবার সার্ভ করতে বাধ্য করা হয়েছে। পরবর্তীকালে পাকিস্তানী সৈন্যদের নিষ্ঠুরতার যে-কাহিনী প্রচার করা হয়েছে তার উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে হেয় করে তােলা।
তৎকালীন কোনাে বিদেশী প্রচারমাধ্যমেও কিন্তু বাঙালিদের দ্বারা সংঘটিত এতবড় হত্যাযজ্ঞের কাহিনী প্রচারিত হয় নি। নিয়াজিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “তাহলে এই হত্যাযজ্ঞের বিবরণ আপনি জানলেন কিভাবে? আপনার সাের্স কী?” তিনি বােধহয় আগেই আঁচ করেছিলেন এ-ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন হবেন। তাই প্রশ্ন করার সঙ্গে সঙ্গে আমাকে একটি প্রবন্ধের ফটোকপি তুলে দিলেন। প্রবন্ধটি রাব্রুক উইলিয়ামসের লেখা ‘দ্য ইস্ট পাকিস্তান ট্র্যাজেডি’। তখন এর পাতা উল্টে দেখি নি। এখন দেখছি এই প্রবন্ধের উৎস পাকিস্তান সরকার-কর্তৃক প্রকাশিত শ্বেতপত্র। বিষয়টি সহজেই অনুমেয়। তা ছাড়া উইলিয়ামসের খানিকটা পরিচয় দিতে হয়। আইয়ুব খানের সামরিক শাসন জারির পর তাকে নিযুক্ত করা হয়েছিল এর পক্ষে লিখতে। তিনি প্রায় সময় পাকিস্তানের সামরিক সরকারের হয়ে ভাড়া খেটেছেন। ২৫ মার্চের পর, সামরিক জান্তা আবার তাকে ব্যবহার করেছিল। নিজেদের প্রচারের স্বার্থে। নিয়াজি এরপর লিখেছেন, টিক্কা খান পূর্বপাকিস্তানের গবর্নর হয়ে এলে

যথাযােগ্য অভ্যর্থনা পান নি। তিনি মুজিবের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু, মুজিব দেখা করেন নি, কারণ তখন তিনি ইয়াকুবের সঙ্গে নাকি নিয়মিত “wined and dined and played cards.” মার্চের সেই টালমাটাল দিনগুলােতে বঙ্গবন্ধুর এত সময় ছিল একথা কোনাে পাগলও বিশ্বাস করবে না।
২৫ মার্চ ঘটাবার জন্য টিক্কা খান আগে থেকেই সব ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। এ-ক্ষেত্রে টিক্কার সমালােচনা করতে গিয়ে তিনি সত্য লুকোতে পারেন নি। তবে, সত্য-মিথ্যা একাকার করে ফেলেছেন। লিখেছেন তিনি এবং বলেছেনও আমাদের যে, টিক্কা যে-ভুলটি করেছিলেন তা হলাে তিনি মুখােমুখি ছিলেন আরেকটি সেনাবাহিনীর নয় বরং অসন্তুষ্ট সশস্ত্র সিভিলিয়ানদের (সশস্ত্র শব্দটি মিথ্যা। এ-জন্য দরকার ছিল বুদ্ধি ও ধৈর্য্যের। তিনি বলছেন কর্নেল ওসমানীকে শেখ সাহেব দায়িত্ব দিয়েছিলেন সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যালােচনার। আর অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মজিদকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল প্রাক্তন সৈন্যদের সংগঠিত করার। ভারত থেকে অস্ত্র আসছিল এবং পুলিশ ও পূর্বপাকিস্তানী ভিন্ন মতাবলম্বীদের সশস্ত্র করা হয়েছিল। এক্ষেত্রে ভারতীয় সেনাবাহিনী সাহায্য করেছিল। ইতােমধ্যে হাজার হাজার ভারতীয় সেনা সিভিলিয়ান পােশাকে পূর্বপাকিস্তানে অনুপ্রবেশ করেছিল। শেষের মন্তব্যগুলাে যে সর্বৈব মিথ্যা তা বলাই বাহুল্য। যদি বাঙালিরা সশস্ত্র থাকত এবং হাজার হাজার ভারতীয় সেনা থাকত তা হলে কি পাকিস্তানী হানাদারবাহিনীর পক্ষে সম্ভব হতাে গণহত্যা চালানাে? এই সাধারণ লজিকটি লেখার সময় জেনারেল নিয়াজি খেয়াল করেন নি। এরপরেই তিনি কিন্তু বলছেন বাঙালি সৈন্যরা তখনও বিদ্রোহ করে নি। টিক্কা খানকে বলা হয়েছিল, বাঙালি সৈন্যদের নিরস্ত্র করতে ও রাজনৈতিক নেতাদের বন্দি করতে। কিন্তু টিক্কা কী করলেন-“General Tikka let loose everything at his disposal as if raiding an enemy and not dealing with his own misguided and misled people. The military action was a display of stark cruelty, more merciless than the massacre at Bukhara and Baghdad by Changez Khan and Halaku Khan and at Jalianwala Bagh by British General Dyer.” এই একটি সত্য কথনের মাধ্যমই নিয়াজি তার পূর্বেকার অনেক মিথ্যা মন্তব্য নাকচ করে দিয়েছেন। সত্য কথনের মুশকিল এটাই। নিয়াজি বললেন আমাকে, টিক্কার এই আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন রাও ফরমান আলি ও ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আবরার। জেনারেল ফরমান তার Glauco ficfecia, “Green land of East Pakistan will be painted red.”
ফরমান আলিকে এ-সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি বললেন, এ-কথা সত্যি নয়। হ্যা, আমি ডায়েরিতে তা লিখেছিলাম তবে তাঁর প্রেক্ষিত ছিল ভিন্ন। কাজী জাফর সে সময় তাঁর এক ভাষণে বলেছিলেন, লাল ঝাণ্ডা (অর্থাৎ সমাজতন্ত্র) দিয়ে পূর্ববাংলার সবুজ ঢেকে দেবেন। এটিই তিনি ডায়েরিতে টুকে রেখেছিলেন,

এ-মন্তব্য কি, বিশ্বাসযােগ্য? পাঠকই তা বিচার করবেন। টিক্কা খান, জানিয়েছেন নিয়াজি ২৫ মার্চের পর বিদেশী সাংবাদিকদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে আরেকটি ভুল করেছিলেন। এইসব সাংবাদিকরা এ-কারণে পরে সব বিবরণ বিকৃত করে প্রচার করে। ফলে পাকিস্তান ও তার সেনাবাহিনী সম্পর্কে খারাপ ধারণা তৈরি হয়। উল্লেখ্য, কয়েক মাস পরে পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশে যে অবস্থা স্বাভাবিক তা প্রমাণ করার জন্য নিজেদের পছন্দসই সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ করে ঢাকায় নিয়ে আসে। ফিরে গিয়ে সাংবাদিকরা কেউ পাকিস্তানের পক্ষে লেখেন নি। বরং অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস লিখলেন, তাঁর বিখ্যাত রিপাের্ট, ‘দ্য রেপ অব বাংলাদেশ’। অর্থাৎ, খারাপ ব্যবহারের কারণে নয়, যা ঘটেছিল সাংবাদিকরা তাই লিখেছিলেন।
১৯৭১ সালের ১১ এপ্রিল পূর্বপাকিস্তানের প্রশাসনে নতুন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলাে। টিক্কা খান হলেন গবর্নর ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক অর্থাৎ বেসামরিক প্রশাসনের প্রধান। তিনি রিপাের্ট করবেন প্রেসিডেন্টের কাছে এবং নিয়াজি সামরিক প্রশাসনের প্রধান। তিনি রিপাের্ট করবেন সেনাপতি জেনারেল আব্দুল হামিদ খানের কাছে। নিয়াজি লিখেছেন, ভুট্টো আমলে টিক্কা খান বলতে চেয়েছেন তিনি তার অধীনে কাজ করেছেন। এটি বিন্দুমাত্র সত্য নয়।
১০ চতুর্থ থেকে ত্রয়ােদশ অধ্যায় পর্যন্ত নিয়াজি পূর্বাঞ্চলের সেনাধ্যক্ষ হিসাবে তার নিয়ােগ, বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতির পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানী সেনা নিয়ােগ, মুক্তিবাহিনী, অপারেশন প্ল্যান, যুদ্ধ-বৃত্তান্ত, পাকিস্তানের পরাজয় ইতাদির বর্ণনা দিয়েছেন। নিয়াজি তার সামরিক পরিকল্পনার বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন। এর একটি কারণ, তিনি যে সমর বিশারদ এবং তার অফেনসিভ ও ডিফেনসিভ প্ল্যান যে ঠিক ছিল তা তুলে ধরা। শুধু তা-ই নয়, সদর দফতরে বাধা না দিলে এবং তাঁর পরিকল্পনা-অনুযায়ী কাজ করতে দিলে তিনি সফল হতেন। বিভিন্ন সামরিক পরিকল্পনার বিষয়ে সামরিক বিশেষজ্ঞরাই বলতে পারবেন এবং আশা করি তারা এ-বিষয়ে তাদের মতামত তুলে ধরবেন। আমরা এখানে শুধু আমাদের প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলােই উদ্ধৃত করব।
চতুর্থ অধ্যায়ের শুরুতেই নিয়াজি জানাচ্ছেন, টিক্কা খানকে যখন টুপসের কমান্ড থেকে সরিয়ে দেয়া হলাে তখনই টিক্কা খান শক্ত হলেন। কারণ যুদ্ধ চলাকালীন অবস্থায় কোনাে জেনারেলকে সরিয়ে দেয়া তার জন্য কলঙ্কজনক। টিক্কা খান জেনারেল হামিদকে অনুরােধ করেছিলেন, নিয়াজি যেন তাঁর অধীনে থেকে কাজ করেন। কিন্তু সে-অনুরােধ প্রত্যাখ্যাত হলাে। হামিদ টিক্কাকে Glaicena, “Tikka you were given a chance and you have bungled it up, how can I violate the principle of not to reinforce a failure?”
এ-পর্যায়ে নিয়াজি আবার সঠিক তথ্য তুলে ধরছেন। তিনি জানাচ্ছেন যে,
৬৫

পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ও প্রশাসন সম্পূর্ণভাবে স্থানীয় মানুষ ও বাঙালি কর্মচারীদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছিল। বাঙালিরা ঘৃণিত পশ্চিমপাকিস্তানীদের কোনােরকম সাহায্য না করতে বদ্ধপরিকর ছিল। “নিজের দেশেই আমরা অবাঞ্ছিত হয়ে পড়েছিলাম” লিখেছেন নিয়াজি। ঢাকা ছাড়া দেশের বাকি অংশ ছিল মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে যাদের মনের জোর ছিল আকাশ-ছোঁয়া এবং ছিল উদ্যম। এরপর নিয়াজি এক অদ্ভুত অভিযােগ করেছেন যা আসলেই তার মানসিক অবস্থা সম্পর্কে সন্দেহ জাগায়। তিনি লিখেছেন, পশ্চিমপাকিস্তানী সামরিক ও বেসামরিক লােকদের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তি করার জন্য ভারত সরকার অনেক নর্তকী, দেবদাসী। ও পতিতা প্রেরণ করেছিল। তারা পশ্চিমপাকিস্তানীদের ‘সিডিউস’ করতে পারে নি, কিন্তু বিপুলসংখ্যক পূর্বপাকিস্তানীকে বিপথে নিয়ে গিয়েছিল। ২৫/২৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে বেশ কিছু অবাঙালি মেয়ে উদ্ধার করা হয়েছিল যাদের রাখা হয়েছিল বেশ্যাবৃত্তির জন্য। মুক্তিবাহিনীর একজন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার শাহ বেগ সিং (ভারতীয় কমান্ডার) নিয়াজিকে বলেছিলেন, পূর্বপাকিস্তানে অনেক ভারতীয় মহিলা কাজ করেছে। সুতরাং নিয়াজির দৃঢ়বিশ্বাস পশ্চিমপাকিস্তানী সেনাবাহিনী, পুলিশ, সিভিলিয়ান যে বাঙালি মেয়েদের ধর্ষণ করেছে তা ভিত্তিহীন ও সঠিক নয়। যেখানে ইচ্ছুক এত ভারতীয় মহিলা আছে অনিচ্ছুক বাঙালি মেয়েদের ধর্ষণের প্রশ্নই আসে না। তা ছাড়া চারদিকে যখন, এ-রকম বিপদ তখন কেউ এ-ধরনের কাজ করে না বরং ধর্মভীরু হয়ে ওঠে। তা ছাড়া সৈন্যদের প্লাটুন (৩৬ জন) বা কোম্পানিতে (১২০ জন) থাকতে নির্দেশ দেয়া। হয়েছিল। সুতরাং তাদের পক্ষে একত্রে এসব কাজ করা সম্ভব নয়। কেউ একা বেরুবার সাহস করলেই মারা পড়ত। এ-ব্যাখ্যা গ্রহণযােগ্য কি না সে প্রশ্নই। অবান্তর। কারণ যেসব জেনারেল ১৯৭১ সালের সঙ্গে জড়িত তারাও বাঙালি রমণী ধর্ষণের পক্ষে এমন সাফাই গান নি। জেনারেল নিয়াজি বরং কী করেছিলেন (তার মেয়েঘটিত ব্যাপার) তার কিছু বিবরণ অন্যরা দিয়েছেন। জেনারেল ফরমানও বলেছেন। [অব দ্য রেকর্ড], আমি সেগুলাে এখানে উদ্ধৃত করা থেকে বিরত থাকলাম। নিয়াজি এসব অধ্যায়ে বারবার যা বলতে চেয়েছেন তা হলাে এই যে, তার সৈন্যসংখ্যা ছিল ৫০ হাজারের নিচে, ভৌগােলিক ও রাজনৈতিক পরিবেশ ছিল প্রতিকূল এবং আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ছিল না। তবুও মে মাসের মধ্যেই বিদ্রোহীদের হটিয়ে দিয়ে যখন তিনি অবস্থা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছিলেন তখন একটি রাজনৈতিক মীমাংসায় পৌছানাে যেত।
আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম এ-পরিপ্রেক্ষিতে, “কিভাবে?”
“কেন,” ভারিক্কি চালে উত্তর দিলেন তিনি, “আমার সঙ্গে রাজনৈতিক নেতারা যােগাযােগ করছিল।’
“কারা?”

“ফজলুল কাদের চৌধুরী, আব্দুস সবুর খান, মৌলবী ফরিদ আহমেদ, সিরাজুল হক প্রমুখ। তারা বলছিলেন, তাঁদের সঙ্গে আলাপ করে সরকার একটি রাজনৈতিক মীমাংসা করতে পারে।”
কেন্দ্রীয় সরকার বলেছিল এসব non-entity-র সঙ্গে আলাপ করে লাভ নেই। আলাপ করতে হবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। নিয়াজি অবশ্য এ-সামান্য ব্যাপারটি বুঝে উঠতে পারেন নি।
নিয়াজি লিখেছেন, ঐ সময় রাজনৈতিক মীমাংসা হলে আসাম জয় করে তিনি পৌছে যেতেন কলকাতায়। কারণ তখন পাকিস্তানীদের সঙ্গে নাগা বিদ্রোহী লাল ডেংগা, ফিজো ও চারু মজুমদারের সঙ্গে যােগাযােগ ছিল। এবং তারাও এতে সহায়তা করতেন। নিয়াজির এই যুদ্ধ পরিকল্পনা জেনারেল হামিদ সমর্থন করেছিলেন, কিন্তু রাজনীতির ব্যাপারে বলেছিলেন, এসব জটিল ব্যাপারে তােমার মাথা না ঘামানােই ভালাে।
ফলে নিয়াজিকে একাই যা করার করতে হয়েছে। কেন্দ্র থেকে তার জন্য কোনাে স্পষ্ট নির্দেশ ছিল না। বাংলাদেশের আবহাওয়া হানাদারবাহিনীর সহ্য হচ্ছিল না। অভাব ছিল তাদের কাপড়-জামার। রাজাকার-আলবদরবাহিনীগুলাে “harrassed” হচ্ছিল। এমজিও (মাস্টার জেনারেল অব অর্ডন্যান্স) একজন বাঙালি লে.জে, ওয়াসিউদ্দিনের কাছে অস্ত্রশস্ত্রের ব্যাপারে দরবার করতে গেলে নিয়াজির চিফ অব স্টাফকে গালিগালাজ করে তিনি বের করে দিয়েছিলেন এবং সাহায্য করতে রাজি হন নি। ফলে তাঁকে নানারকম ধোঁকাবাজি করে প্রমাণ করতে হচ্ছিল যে, তার অধীনে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত চারটি ডিভিশন আছে যাতে তারা একটু সমঝে চলে।
এ-প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের উত্তরে নিয়াজি আমাকে জানিয়েছেন যে, রাজাকারবাহিনী তাঁরই সৃষ্টি। এবং তার সেনাবাহিনী হ্রাস পেতে থাকায় তিনি ঐ ডিভিশন পূরণ করতেন রাজাকার দিয়ে। শেষােক্ত মন্তব্য খুব সম্ভব সত্য নয়। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈন্যরা অ্যামেচার রাজাকারদের নিয়ে একই পঙক্তিতে যুদ্ধ করবে, এটিই অবাস্তব। তবে নিয়াজি যেটি খেয়াল করেন নি সেটি হলাে এই যে, এই মন্তব্যের মাধ্যমে তিনি স্বীকার করে নিলেন যে, মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে পাকসেনারা নিয়মিত হত হচ্ছিল।
এরই মধ্যে ব্রিগেডিয়ার বাকের ইসলামাবাদ থেকে ফিরে নিয়াজিকে জানালেন যে, পূর্বপাকিস্তানের আশা কেন্দ্র ছেড়ে দিচ্ছে এবং পূর্বপাকিস্তানে সেনাবাহিনীকে scape goat করা হবে। তার অবস্থা যে কত খারাপ ছিল তা প্রমাণের জন্য তিনি এরপর ফজল মুকিম খানের বই থেকে দীর্ঘ বর্ণনা দিয়েছেন ভূমিকাতেই কিন্তু তিনি আবার ফজল মুকিম খান-কে নস্যাৎ করে দিয়েছেন। নিয়াজির অধীনে কোনাে নৌ বা বিমানবাহিনী ছিল না। ৩ ডিসেম্বর ভারতের সঙ্গে লড়াই শুরু হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত নিয়াজির হিসাব-অনুযায়ী প্রায় চার হাজার সৈন্য নিহত,

দু’হাজার আহত হয়েছিল যাদের পাঠাতে হয়েছিল পশ্চিমপাকিস্তান।
নিয়াজির সব যুক্তি মেনে নিলেও দেখা যাবে একটি বিষয়ের উত্তর মিলছে না। তা হলাে নব্বই হাজারের বেশি যুদ্ধবন্দি হলাে কিভাবে? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আর কোনাে যুদ্ধে এত বন্দি হয়েছে বলে জানা নেই।
ঢাকার পতন সম্পর্কে সবশেষে তিনি যা মন্তব্য করেছেন তা প্রণিধানযােগ্য। এতে বােঝা যায়, তার পরাজয়টা তিনি মানতে পারছেন না এবং এটিকে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক পরাজয় বলছেন যাকে ভারত বলছে সামরিক বিজয়। কিন্তু আসলে যে এটি ছিল পাকিস্তানের সামগ্রিক পরাজয়- এ-সত্যটা তিনি বুঝেও মানতে চান নি। তিনি লিখেছেন— “To capture Dhaka the Indians would have had to fight hard and suffer losses to destroy my force but to their good luck when our President realized that the Indians were not capable of defeating us he for ulterior motives, insisted on our surrender. Because he and Bhutto could only get power by our defeat and Indian victory and not by our victory or a cesasefire. All I can say is that our political and diplomatic defeat was claimed by the Indians as a military victory which it was not.”
আত্মসমর্পণের সময় যৌথ কমান্ডের মে. জেনারেল জ্যাকবকে নিয়াজি বলেছিলেন, যৌথ কমান্ডের কাছে তিনি আত্মসমর্পণ করবেন না। জ্যাকব বলেছিলেন, ‘টেক ইট অর লিভ ইট।’ নিয়াজির ভাষায় তাদের ব্ল্যাকমেল করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, আত্মসমর্পণের ধারাসমূহ না মানলে হােটেল ইন্টার কন্টিনেন্টাল মুক্তিবাহিনীর জন্য উন্মুক্ত করা দেয়া হবে।
এখানে একটু ব্যাখ্যা দরকার। পাকিস্তানে যাদের সঙ্গেই আলাপ হয়েছে তারাও বলেছেন, ১৯৭১ সালে যুদ্ধ হয়েছিল ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে। মুক্তিবাহিনীর কথা তারা উল্লেখই করেন না। বােঝা যায়, এটি তাদের আত্মশ্লাঘায় লাগে। এসব ছােটখাটো বাঙালি যাদের ধর্তব্যের মধ্যে আনা হয় নি, তারা কিনা ভারতীয় সাহায্যে আর্যদের হারিয়ে দিল। নিয়াজি কিন্তু তাঁর বইয়ে আগাগােড়া মুক্তিবাহিনীকে স্বীকার করেছেন, তাদের শৌর্যবীর্যের কথা প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে উল্লেখ করেছেন যা আর কোনাে জেনারেল করেন নি। কিন্তু যৌথ কমান্ড যার অংশ মুক্তিবাহিনী, তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে এটা তিনি মানতে পারেন নি। তাদের মূল দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, ভারতের কাছে হার মানা যায়, মুক্তিবাহিনীর কাছে নয়। নিয়াজির কাছে ছিল এটিই ট্রাডেজি। তবে আত্মসমর্পণের সময় তার সত্যিকার অনুভূতি তিনি প্রকাশ করেছেন। এখানে কোনাে চাতুরি করেন নি। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে রমনার সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তে তার সঙ্গে ছিলেন মে. জে. ফরমান আলি ও অ্যাডমিরাল শরিফ। নিয়াজির ভাষায়- “As I signed the document with trembling hands, sorrow rose from my heart to my eyes brimming

them with unshed tears of despair and frustration. Before the surrender ceremony, a french reporter came to me and said, How are you feeling tiger? I replied, “Depressed”.
এই দৃশ্যটি শুধু ১৬ ডিসেম্বর একবার পাকিস্তানী টেলিভিশনে দেখানাে। হয়েছিল। পাকিস্তানীরা জানিয়েছে, এতে এমন প্রবল প্রতিক্রিয়া হয়েছিল যে এ-দৃশ্য আর কখনও দেখানাে হয় নি। কারণ এই আত্মসমর্পণের সঙ্গেই। পাকিস্তানের সমস্ত দর্প, স্বপ্ন, ভবিষ্যৎ নস্যাত হয়ে গিয়েছিল।
নিয়াজিকে আমিও একই প্রশ্ন করেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, পাকিস্তানের। জন্য তাকে আত্মসর্মপণ করতে হয়েছে। লিখেছেন তিনি,
“I swallowed my pride and made the supreme sacrifice of reputation, honour and honour of my gallant troops in national interest.” পাকিস্তান কেন পরাজিত হলাে? নিয়াজি তা বর্ণনা করেছেন তার বইয়ের। ক্রয়ােদশ অধ্যায়ে যার শিরােনাম— “Engineered debacle.” অর্থাৎ পাকিস্তানের। ভাঙনের পিছে পাকিস্তানী শাসকচক্রের দীর্ঘমেয়াদী একধরনের ষড়যন্ত্র ছিল। এ-প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে, তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম তার বইয়ের নাম দি বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তান কেন? তিনি বলেছিলেন, কারণ পাকিস্তান বিট্রে। করেছিল। সুকৌশলে শাসকচক্র সেই পথ অনুসরণ করেছিল। আমরা যেসব। পাকিস্তানীর সঙ্গে আলাপ করেছি, এখন তারাও তা স্বীকার করেছেন। নিয়াজি তা। স্বীকার করেছেন এবং এ স্বীকারােক্তির মাধ্যমে তার বইয়ের প্রথম দিকে পূর্ব ধারণাবশত যেসব মন্তব্য করেছেন তা নস্যাত করে দিয়েছেন। সত্যের মুখােমুখি হয়ে সত্য তুলে ধরতে তিনি বাধ্য হয়েছেন। এছাড়া আত্মপক্ষ সমর্থনে তার অন্য। কোনাে উপায় ছিল না। তার ভাষায়- “However, it was a consistent policy of all rulers to deprive East Pakistanis of their legitimate right of participation in governance and decision making process of the country. The result of 1970 election could have kept Pakistan together if the democratic process of rule by the majority party had been adhered to.”
ঢাকার পতনের পর যুদ্ধবন্দি পূর্বপাকিস্তানের তৎকালীন মুখ্য সচিব মুজাফফর। আহমদ ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেছিলেন— এমএম আহমদের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলাে। এবং নিজের অজান্তে নিয়াজিও স্বীকার করেছেন তিনিও সেই দলের, কারণ। “জাতীয় স্বার্থে” তিনি আত্মসমর্পণ করেছিলেন। অর্থাৎ পশ্চিমপাকিস্তানের স্বার্থে। পূর্ব ও পশ্চিম মিলে যে পাকিস্তান ছিল তার স্বার্থে নয়। পাকিস্তানের পরাজয়ের জন্য নিয়াজি, জেনারেল ইয়াহিয়া তাে বটেই, এয়ার মার্শাল রহিম, লে. জে. গুল হাসান, টিক্কা খান, ফরমান আলিকে দায়ী করেছেন। আর.পি. সাহা ও তার পুত্রের হত্যার ব্যাপারে টিক্কার হাত ছিল বলে তিনি ইঙ্গিত করেছেন। ভুট্টোকেও দায়ী। করে লিখেছেন, ভুট্টো ছিলেন তাঁর মতে ষড়যন্ত্রে সেরা যিনি ব্যক্তিগত স্বার্থের কাছে।

রাষ্ট্রীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়েছিলেন। নিয়াজির ক্রোধ বেশি রাও ফরমান আলির ওপর। তার মতে, ফরমান শুধু সুবিধাবাদী ষড়যন্ত্রীই ছিলেন না, অর্থও আত্মসাত করেছিলেন। ফরমান তাকে বলেছিলেন পাকিস্তানে পাঠিয়ে দিতে, কারণ “Mukti Bahini would kill him for his alleged massacre of the Bengalis and intellectuals on the night of 15/16th December. It was a pathetic sight
to see him pale and almost on the verge of break-down.” fps Fus তখন তাকে বলেছিলেন, তার জানের বদলেও তিনি ফরমানকে মুক্তিবাহিনীর হাতে
তুলে দেবেন না এবং সে-কথা তিনি রেখেছিলেন। নিয়াজির বইয়ের পরিশিষ্টগুলাে গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে তৃতীয় পরিশিষ্টটি। ১৮ এপ্রিল ১৯৭১ সালে তিনি একটি চিঠি দিয়েছিলেন যার বিষয় ছিলযুদ্ধক্ষেত্রে শৃঙ্খলা। এ-চিঠিতে স্পষ্ট যে, পাকিস্তানী বাহিনী হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। অথচ পুরাে বইয়ে তিনি তা অস্বীকার করেছেন। নিয়াজির বইটি পাকিস্তানে কেউ পছন্দ করে নি। আলতাফ গওহর লিখেছেন TIG RET – “Is not a confession but a long unending whimper from cover to cover.” তার মতে, বইটি হলাে অপাঠ্য যার যােগ্য জায়গা ডাস্টবিন। এর কারণ, নিয়াজি হচ্ছেন পাকিস্তানের পরাজয়ের চুৰ্ণিত দম্ভের প্রতীক। আত্মসমর্পণের পর জেনারেল নিয়াজি পাকিস্তানীদের কাছে ‘বাঘ’ থেকে পরিণত হয়েছেন ‘বিড়াল’-এ। অন্য কথায় বলা যায় পাকিস্তানীদের গর্ব সেনাবাহিনী বাঘ’ থেকে পরিণত হয়েছিল ‘বিড়াল’-এ। এটি যে-কোনাে পাকিস্তানী তিনি যত লিবারেল-ই হন-না কেন, মেনে নেয়া কষ্টকর। কিন্তু বইটি সম্পূর্ণ অন্য কারণে আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। নিয়াজির দম্ভোক্তি, মিথ্যাচার বাদ দিলে আমরা এমন অনেক তথ্য পাই যা কোনাে পাকিস্তানী জেনারেল স্বীকার করতে চান নি। নিয়াজিও চান নি, কিন্তু নিজ স্বার্থে তাকে তা স্বীকার করতে হয়েছে। আলতাফ গওহরের বক্তব্য উল্টো করে বলা যায়, নিয়াজির মিথ্যাচার হলাে whimper আর যা স্বীকার করেছেন বাধ্য হয়ে তা হলাে confession.
সবশেষে বলব, নিয়াজির বই পড়ে এবং তার সঙ্গে আলাপ করে আমার মনে হয়েছে, নিয়াজি হলেন পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর (অধিকাংশের) মূর্ত প্রতীক। এরা নিরেট, রােবটের মতাে। দম্ভ তাদের প্রচুর এবং পাকিস্তানকেই তারা মনে করে বিশ্ব। পাকিস্তানী জেনারেলদের বুদ্ধিমান অংশ (মুষ্টিমেয়) এদের ব্যবহার করেছে সবসময়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ১৯৭১ সালে বুদ্ধিমান জেনারেলরা বুঝেছিলেন, অন্তিমে পূর্বপাকিস্তান স্বাধীন হবে। তাই তারা কেউ এখানে আসেন। নি এবং যারা ছিলেন তারাও চলে গিয়েছিলেন। পরাজয়ের দায়দায়িত্ব নিতে তারা রাজি ছিলেন না। নিয়াজিকে বলা মাত্রই তিনি এসেছেন এবং সদর্পে লুটেরা, হত্যাকারী, ধর্ষণকারী বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি যে যুদ্ধাপরাধী এই বােধও তার নেই। এখনও তিনি মনে করেন বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান, তাই
৭০

হয়ত একসময় কনফেডারেশন হবে। আবার এও মনে করেন, বাঙালিরা হিন্দু ভাবাপন্ন; রাজাকাররা তার মিত্র, একান্ত প্রিয়। নিজ সৈন্যরাও নয় যাদের সাহসের কথা বারবার তিনি উল্লেখ করেছেন। নিজ সৈন্যরা প্রিয় হলে বইটি তাদেরই উৎসর্গ করতেন, রাজাকারদের নয়। পাকিস্তানী জেনারেলদের মনােজগত বুঝতে হলে তাই নিয়াজির বইটি পাঠ করা দরকার।
জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজির সাক্ষাতকার প্র: তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের ঘটনাবলি সম্পর্কে আপনার সাধারণ ধারণার কথা বলবেন?
উ: পশ্চিমপাকিস্তানীদেরকে কখনও প্রকৃত সত্য বা বাস্তবতা কি তা জানান হয় নি। এর কারণ, যখন জেনারেল টিক্কা পূর্বপাকিস্তানে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন তখন তিনি বিদেশী সাংবাদিক, রিপাের্টার ও ক্যামেরাম্যানদেরকে হুঁশিয়ার করে দেন ও সেখান থেকে তাদেরকে অবমাননাকরভাবে বের করে দেন। এর পরিণতি হিসেবে ওরা আমাদের বিরুদ্ধে চলে যায়। আর সব বানােয়াট খবর প্রচার করতে ও ছাপাতে থাকে। তাদের ঐ সব কাহিনীর উপাদান জোগাড় করত ঐ সময় যেসব লােক পূর্বপাকিস্তান থেকে পালিয়ে শরণার্থী হিসেবে ভারতে যাচ্ছিল তাদের কাছ থেকে। তাদের কথার ওপরই নির্ভর করছিল বিদেশী তথ্যমাধ্যমগুলি। ভারতীয়রা বাংলাদেশ থেকে আসা লােকজনের মাথা ধােলাই করছিল আর ভারতীয়রা যা-ই বলুক বিদেশীরা তা লুফে নিচ্ছিল। ফলে যা হবার তাই হয়, প্রকৃত সত্য কখনও বেরিয়ে আসে নি। যাহােক, তখন পশ্চিমপাকিস্তানেও সামরিক আইন বলবৎ ছিল। তাই জনসাধারণও পূর্বে কি ঘটছে তা খুঁজে-পেতে জানার জন্য তেমন আগ্রহ বােধ করেন নি। আমি যখন দায়িত্বভার নিই তখন সরকার পরিস্থিতি বদলানাের চেষ্টা করেন। ইয়াহিয়া ও ভুট্টো চেষ্টা করেন বাংলাদেশে তাদের কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে। ভুট্টো ও ইয়াহিয়া চেয়েছিলেন পূর্বপাকিস্তানে তাদের নিজেদেরকে আরও বলিষ্ঠ, শক্তিশালী করে তুলতে ও পশ্চিমপাকিস্তনকে শাসন করতে। কাজেই পূর্ব পাকিস্তনে কী ঘটছে না ঘটছে তা তারা চাপা দিয়ে রেখেছিলেন। ফলে সাধারণ মানুষ পাশ্চাত্যের পত্রপত্রিকায় যা ছাপা হচ্ছিল তাতে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন। এর আরও একটা কারণ হলাে, দেশের কাগজপত্রেও তখন ঘটনা সম্পর্কে কিছুই প্রকাশ করা হচ্ছিল না।
প্র: জেনারেল আপনি এসব কথা বলছেন কারণ এখন আপনার এসব জানার সুযােগ হয়েছে। আপনি পরবর্তকিালে অন্তর্দৃষ্টি লাভ করেছেন। ভালাে কথা। কিন্তু আমরা জানতে চাই, তখন তাদের চিন্তা-ভাবনা কী ছিল? তখন কি আপনি এ-সব কথা জানতেন?
উ: না, জানতাম না, কারণ, আমি তখন আমার নিজের কাজ নিয়েই ব্যস্ত

ছিলাম। কিন্তু আমি পশ্চিমপাকিস্তানে ফিরে লক্ষ করি, ওখানকার জনসাধারণ আসল ঘটনা সম্পর্কে কিছুই জানে না, ওরা সব আমার কাছে নির্বোধসুলভ প্রশ্ন করছে। এর ফল হিসেবে সত্য-মিথ্যার আঁস্তাকুড়ে চাপা পড়ে থাকে, প্রহসন হয়ে ওঠে সবকিছু। কেউ-কেউ আসলে ঘটনা কী তা লেখেও, কেননা, কারা পাকিস্তান ভেঙেছে তা জানতে তারা আগ্রহী ছিলেন। এ-ভাঙনের নায়ক ভুট্টো, এ-ভাঙনের নায়ক মুজিব। তাই এই নির্মম, নিষ্ঠুর যুদ্ধ সম্পর্কে জানতে হলে বাইরের জগতের ওপর নির্ভর করা ছাড়া তখন উপায় ছিল না।
প্র: এই বাইরে, বিদেশীরা কারা?
উ: তারা হলাে, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, আফগানিস্তান ও ইসরাইল। এ-কারণেই তারা পাকিস্তানের অন্য প্রদেশগুলিতে নির্বাচনে লড়ে নি।
প্র: না, কথাটা ঠিক নয়। কেননা, আওয়ামী লীগ তাে পশ্চিমপাকিস্তানেও নির্বাচনে প্রার্থী দিয়েছে, লড়েছে।
উ: কিন্তু ওরা নির্বাচনে জেতে নি। ওরা তা চায়ওনি। প্র: আওয়ামী লীগের তাে নিখিল পাকিস্তানভিত্তিক দলীয় সংগঠন ছিল।
উ: ওরা ভােটের জন্য লােক খুঁজত বটে। তবে ভুট্টোর পার্টিই ছিল আধিপত্যশীল। আমি পাকিস্তানে ফেরার পর একটা দল গঠন করেছিলাম।
প্র: তা ঐ দলটির নাম কী ছিল?
উ: দলটির নাম মুজাহিদ… না ফেদাইন পার্টি। তবে সরকার এ-দল গঠনের অনুমতি দেয় নি।
প্র: কেন? কেন, এই অনুমােদন দেওয়া হলাে না?
উ: কেননা, ওটা আমার দল, তাই! আর জানেনই তাে ভূট্টোর সরকার আমার বিরুদ্ধে ছিল। আমাকে এ-ব্যাপারে অনেক আশ্বাস, অঙ্গীকার, প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল এই বলে যে দলীয় একটা টিকেট আমাকে দেওয়া হবে। অবশ্য নানা মহলে যেকথা প্রচলিত তা হলাে, টিকেট পাওয়ার জন্য কিছু লােকই থাকে যেখানেই যেতে চায় সেখানে যাবার টিকেট পেয়েও যায় তারা, পেয়ে যায় তা। আবশ্যিকভাবেই। কাজেই কিছু জিনিস আছে যার প্রতিবন্ধকতা কখনও সরে না। তারপর আমি এই বইটি লিখি। আমার প্রায় নিশ্চিত আশঙ্কা ছিল যে, বহু লােক আমার বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেবে। কেননা, আমার যা কিছু চোখে পড়েছে আমি তার সবকিছুই ফাস করে দিয়েছি কোনাে রাখঢাক করি নি। প্রকৃত সত্য কী তা ঘেঁকে তুলতে আমার ৫ থেকে ৬ বছর সময় লেগেছে গবেষণা-সমীক্ষায় আর তারপর যদি আমি বাস্তব প্রমাণসহকারে না বলি তাহলে আমার কথা কেউ বিশ্বাস করবে না কারণ আমি তাে ক্ষতিগ্রস্ত। আপনারা যা জানতে চাচ্ছেন তার সব বিষয়ই আমি আমার এই বইয়ে সন্নিবেশিত করেছি। আবার আমি গােড়ায় ফিরে যাই, মুজিব সমর্থকও ছিল, মুজিববিরােধীও ছিল। কাজেই সত্যিকার অর্থে তখন ভুট্টোই সরকার হিসেবে কাজ করছিলেন। তাঁর সমর্থকদের সেটিই ছিল কাম্য।

কিন্তু নেপথ্যের আসল ঘটনা তারা কখনও জানতে পারে নি। তবে আমি আপনাদের কাছে একটা বড় জিনিসের উল্লেখ করতে চাই সেটি হলাে আমাদের তখনকার পশ্চিমপাকিস্তানে অনেক দল-উপদল ছিল, মতভেদের অন্ত ছিল না পূর্বপাকিস্তানের ব্যাপারে। সেদিন আমরা আত্মসমর্পণ করেছিলাম। যে-সব। অফিসার আমার সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন তারা ছিল আমার ছাত্র। তারা আমাকে ভালাে করে চিনত। আমিও তাদের চিনতাম। এদের তিনজন অফিসার মেসে থাকত আর আমি তাদের খরচ যােগাতাম। একদিন চোর হানা দেয় তাদের সেই মেসে, তাদের সবকিছু লাপাত্তা হয়ে যায়। এরপর সংশ্লিষ্ট ঐ অফিসারটি যখন এখানে ছিল তখন তার স্ত্রী আমাদেরকে ঠাট্টা করে বলত, আরে এখানে তাে কোনাে রুশী নেই! আসলেও ঐ সময়টায় সবরকমের প্রচারণা, রটনা চলছিল তার কোনাে শেষ ছিল না। তা সে যা-ই হােক আমি এখনও ‘৭১-এর নিষ্ঠুরতার পক্ষপাতি নই। আমি এখানে তাে ফিরে এলাম। আমি এখন আপনাদেরকে এ-বিষয়ে কিছু উপকরণ দেব যা একজন ব্রিটিশ নাগরিকের প্রকাশনা যাতে পুর্বপাকিস্তানীরা কী নিষ্ঠুরতা চালিয়েছে তার বর্ণনা রয়েছে। আমি ধরুন সেখানে ছিলাম, আপনারা ওখানে ছিলেন। এখন আসা যাক, কিভাবে ঘটনা গড়িয়েছে। আপনাদের ওখানে। ৭০-এর মহাঘুর্ণিঝড় ও জলােচ্ছাসের দুর্যোগ ছিল দারুণ গুরুতর রকমের ঘটনা। ঐ সময রিয়ার অ্যাডমিরাল এ কে এম আহসান ছিলেন পূর্বপাকিস্তানের গভর্নর। সাহেবজাদা ইয়াকুব খান ছিলেন সামরিক আইন প্রশাসক ও সেনাধিনায়ক। আহসান ঐ সময় প্রথম দিকে ঘুর্ণিদুর্গতদের কাজে হেলিকপ্টার চেয়েছিলেন। সামরিক তরফে ক্ষমতাবান সাহেবজাদা ইয়াকুব সে-অনুরােধ রাখেন। নি। অথচ সে সহযােগিতা করা তার জন্যে ছিল নৈতিক কর্তব্য। এতে যা হলাে তাতে দেখা গেল পূর্বপাকিস্তানবাসীদের বিপদের দিনে তাদের সেই দুঃখকষ্টের অংশীদার তিনি হলেন না। এর পরে আরেকদল যারা এল, তাতেও অবস্থার তেমন রকমফের হলাে না, ভালাে কিছু হলাে না। আর এর ফলে ওখানকার মানুষের মনে একধরনের সংশয়-সন্দেহ জন্ম নিল। ওরা ভাবল, ‘আমাদের সঙ্কটের সময়ে ওরা আমাদের সাহায্যে এল না। তবে তারা যেসব মানুষকে দোষারােপ করতে চেয়েছে। তারা কোনাে সমষ্টি নয় আসলে একজন ব্যক্তিবিশেষ। কিন্তু একথাও সত্যি, তিনি তাে আসলে প্রতিনিধিত্ব করছিলেন কোনাে এক জনসমষ্টির। আর তাই ব্যাপারটা। চলে যায় পশ্চিমপাকিস্তানের বিরুদ্ধে। তবে সে-সময়ে সেনাবাহিনীতে দেশের দুই অংশের সমতা ছিল। ১২ ব্যাটালিয়ান সৈন্য ছিল পশ্চিম ও পূর্ব উভয় তরফে। আর উভয় দিকেই ছিল ১৩ জন করে ইউনিট অফিসার। তাই বিভেদের রেখাটি ঠিক এখানে তৈরি হয় নি। পূর্ব ও পশ্চিমপাকিস্তান উভয় অঞ্চলেই এইসব ইউনিট অফিসাররা ছিল। আর সে-কারণে একটা বৃহত্তর ধারণায় তখন সেনাবহিনীতে একটা শৃঙ্খলা ছিল। তবে আনুষ্ঠানিকতা-সংক্রান্ত নানা বিষয়ে পূর্বপাকিস্তানের কিছুটা হতাশা ছিল।

এরপর আসে নির্বাচন। সেই সময়ে ইয়াহিয়া ছিলেন প্রধান সেনাপতি। আমরা তাকে প্রধান সেনাপতি হিসেবে যেভাবেই জানি-না কেন, তিনি নিঃসন্দেহে স্বার্থপর ও লােভী ব্যক্তি ছিলেন। তিনি কোনাে-না-কোনােভাবে আইয়ুবকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেন ও মুজিবকে এমন সব কাজে উৎসাহিত করেন যাতে সামরিক আইন জারি করার অবকাশ ঘটবে না, ওটা করা হবে না যদি তাকে (ইয়াহিয়াকে) ক্ষমতা থেকে সরবার ব্যবস্থা না করা হয়। আর তাদের মধ্যে এই মর্মে একটা সমঝােতা ছিল যে, যদি মুজিব কথা দেন যে তিনি নির্বাচনে জয়ী হলে তারপরেও ইয়াহিয়া ক্ষমতায় থেকে যাবেন তাহলে ইয়াহিয়া আপনারা যাকে বলেন প্যারিটি ও এক ইউনিট ভাঙার সেই প্যারিটি ও এক ইউনিট ভাঙার পর পশ্চিমপাকিস্তান হয়ে ওঠে ৩৫%, পূর্বপাকিস্তানও ৩৫%, তারপর আমরা আবার এক ইউনিটের সুবাদে…
প্র: আমি তাে মনে করি, ভােটের বন্টনের ব্যাপারটি সবসময় ঘটে থাকে। জনসংখ্যা অনুপাতে …
উ: না, তবে প্যারিটির আওতায় ঠিক হয় হবে সমান সমান অনুপাতে; ৫০ আসন এখানে ৫০ আসন ওখানে… এভাবে। অন্যথায় যে-অঞ্চলে জনসংখ্যা বেশি। সেখানে ভােটও বেশি হওয়াই উচিৎ ছিল। তবে এ-ব্যবস্থার আগে এরকম একটা আশঙ্কা ছিল ও তার কারণও এরকম ছিল যে, পূর্বপাকিস্তানে একটি শিক্ষিত হিন্দু জনসম্প্রদায়ের অস্তিত্ব রয়েছে। যদি তারা সরকার গঠনে একটা বড়রকমের ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হয় তাহলে ঐ হিন্দুসম্প্রদায় সেখানে সরকারকে প্রভাবিত করতে পারবে।
প্র: তা পূর্বপাকিস্তানে হিন্দু সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা কত ছিল?
উ: ঐ সময়ে প্রায় এক কোটি। তারা ছিল সবাই শিক্ষিত। তারা সবাই ভালাে সরকারি পদে কায়েমি ছিল। ওদের মধ্যে অনেকে ছিল অধ্যাপক, শিক্ষক। ওদের প্রায় সকলেই ছিল শিক্ষক। এরকম অবস্থায় দেশের জন্য কোনাে শাসনতন্ত্র রচনা ও সেটি অনুমােদন করতে হলে সেক্ষেত্রে হিন্দুরা তাদের জোর প্রভাব ফেলবে। অন্তত এখানে তখন সে-ধারণাই কাজ করে।
প্র: কোথায় এ-ধারণা দেওয়া হয়? পশ্চিমপাকিস্তানে? উ: ঠিক তাই। প্র: সে হােক, তবে আপনি নিজেও কি সেই একই ধারণা পােষণ করেন?
উ: আরে না, না, আমি তাে একজন সৈনিক বৈ নই! আমার এসব নিয়ে কিছুই করার ছিল না। আমি সেভাবে বিষয়টি ভেবেও দেখি নি। আমাদের কালে আমরা প্রশিক্ষণ পেয়েছি তা ছিল ভিন্নপ্রকৃতির। আমাদের সেই প্রশিক্ষণের আওতায় আমাদের বলা হতাে: কি ঘটে-না-ঘটে তাতে তােমাদের মাথা ঘামাবার কিছুই নেই, তােমরা তােমাদের দেশ ও শাসনতন্ত্রের প্রতি বিশ্বস্ত। আমরা তাই প্রতিষ্ঠান ও শাসনতন্ত্রের প্রতি বিশ্বস্ত, ঘটনা যা-ই হােক তাতে আমাদের কিছু যায়-আসে না।

প্র: কোন প্রতিষ্ঠানের প্রতি আপনারা অনুগত?
উ: আমার ইউনিট, সেনাবাহিনী, প্রতিষ্ঠান ও শাসনতন্ত্রের প্রতি যার আওতায়। আমি এ-মর্মে শপথ নিয়েছি যে, আমি দেশের প্রতি বিশ্বস্ত থাকব, বিশ্বস্ত থাকব……..। সেই সময়ে আমরা অসামরিক লােকজন সম্পর্কে একটা শৃঙ্খলা মেনে চলতাম। কেউ বাইরে থেকে এলে, ও সে ব্যক্তি কোনাে রাজনীতিক হলে আমি তাকে সেনানিবাস এলাকায় প্রবেশের অনুমতি দিতাম না। এমনকি, আগন্তুক আমার বন্ধু হলেও তিনি যদি রাজনীতিতে লিপ্ত থাকতেন তাঁকেও আমি। ক্যান্টনমেন্টে প্রবেশের অনুমতি দেই নি। যাহােক ওখানে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে কারচুপি হয়। এ-বিষয়ে আমাকে জানান মৌলভী…।।
প্র: কোন নির্বাচনের কথা বলছেন আপনি? ১৯৭০-এর…।
উ: ১৯৭০-এর। একথা আমাকে বলেছেন ফজলুল কাদের চৌধুরী, মােনেম খান, মৌলভী ফরিদ আহমদ ও আরও বেশকিছু লােক যারা ছিলেন পাকিস্তানপন্থি। একটিমাত্র লােক এখানে সবকিছু ঘটানাের পরিকল্পনা করছে, সবকিছু করছে, তাকে থামানাে দরকার। এ-অবস্থায় সামরিক আইন প্রশাসন যদি বাংলাদেশে ঐ-সব লােককে নির্বাচনে আসতে না দিত আমরা নির্বাচনে বিভিন্ন নগর জনপদে ৫০ থেকে ৬০ টি আসনে জয়ী হতে পারি। ঐ সময়ে আমাদের হাতে ৫০/৬০টি আসন থাকলে মুজিবুর রহমান এরকম বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতেন না। আর সকল বিষয়ে তিনি এতখানি প্রভাব খাটাতেও পারতেন না। তবে সেক্ষেত্রেও সামরিক আইন-কর্তৃপক্ষকে নন্দঘােষ করা হয়। বলা হয়, এই কর্তৃপক্ষই তাকে নির্বাচনে আসতে দিয়েছে। এসবের আলােকে, পশ্চিমপাকিস্তানে নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হলেও পূর্বপাকিস্তানে তা হয় নি। আমি মনে করি, আপনাদের হয়ত মনে আছে যে, ফজলুল কাদের চৌধুরী… একজন মাননীয় ব্যক্তি, সবুর খান, মােনায়েম খান, টেকনাফের মৌলভী ফরিদ আহমদ… এরা সবাই ছিলেন পাকিস্তানপন্থি, তারা আমার কাছে আসতেন। সকলেই আসতেন। আপনারা হয়ত জানেন না যে, ময়মনসিংহে গিয়ে আমি বলতে গেলে জনতার মাঝে মিশে যাই। তাতে মানুষ বুঝতে পারে যে, আমি তাদের কোনাে ক্ষতি করছি
। আমি এভাবেই জনতার ভীড়ে মিশে যেতাম, তাতে আমার কোনাে বিপদ ঘটে নি। মুজিব নির্বাচনে জয়ী হবার পর ইয়াহিয়া পূর্বপাকিস্তানে আসেন। তিনি তখন বলতে থাকেন, শেখ মুজিবুর রহমান আমার ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী। তবে মুজিব জবাবে জানান, কিন্তু আপনি আমার প্রেসিডেন্ট নন। কেন?…আপনি তাে। অঙ্গীকার করেছিলেন! মুজিব তাঁকে সাফ জানিয়ে দেন, দেখুন, আমি একজন রাজনীতিবিদ। এর ফলে ইয়াহিয়ার স্বপ্ন চুরমার হয়ে যায়, তাঁর চৈতন্যোদয় ঘটে। তার ভাবখানা ছিল এই যে, আমি তার জন্য এক ইউনিট ভেঙেছি, প্যারিটি ভেঙেছি তারই কারণে, নির্বাচনে তিনি কী করছেন-না-করছেন তাতে ভ্রুক্ষেপও করি নি আর সেই তিনি কিনা এখন…! ইতিমধ্যে ভুট্টো যিনি পশ্চিমপাকিস্তানে
৭৫

৮২টি আসন পেয়েছিলেন তিনিও মুজিবের কাছে ছােটেন। তাঁর কাছে সরকারে নিজ দলের ভাগ চান তিনি। তিনি বললেন, আমাকে আপনার ২ নম্বর ব্যক্তি করুন। মুজিব তাতে বললেন, না। ভুট্টো বললেন, ঠিক আছে মন্ত্রিসভাতেই না-হয় কিছু প্রান্তিক দপ্তর দিন? না, তা-ও নয়’। “ঠিক আছে, স্পিকারের পদটি তাে দেবেন?’ না’। ভুট্টো এরপর অন্য ধরনের পাঁয়তারা শুরু করেন। ইয়াহিয়া তাকে জানান, লােকটা আমাকে কথা দিয়েছে যে, সে আমাকে প্রেসিডেন্ট করবে। তাে বেশ তাে, আমিও আপনাকে প্রেসিডেন্ট বানাব!’ কী করে আপনি আমাকে প্রেসিডেন্ট করবেন?’ ‘ও সেই কথা, ভাববেন না, পশ্চিমপাকিস্তান তাে আমাদের থাকবে। আপনি হবেন প্রেসিডেন্ট আর আমি হব প্রধানমন্ত্রী। এসব কথাবার্তার আলােকে ভুট্টো তাকে শিকারের দাওয়াত দিয়ে লারকানায় নিয়ে যান। সেখানে তারা এক মতলব আঁটেন। এটিকেই বলা হয়, ‘লারকানা পরিকল্পনা’। পরিকল্পনাটি ছিল এরকম : “স্থলবর্তী হবার মতাে সরকার না রেখেই পূর্বপাকিস্তান থেকে আমরা সরে পড়ব, ব্যস”। আমি এরকম দাবি আবারও করছি।
প্র: জি হ্যা। আপনি সে-কথা আপনার বইয়ে বলেছেনও। পূর্বপাকিস্তানে ক্ষমতায় কোনাে উত্তরাধিকারী না রেখেই আপনারা সেখান থেকে সরে আসবেন। কিন্তু আপনারা লারকানা পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে পারলেন কী করে? উ: বিষয়টি গােপনীয়। কাজী আজম নামে একজন ডিএসপি ছিল। সিকিউরিটির লােকেরা তাকে লারকানায় পাঠায়। কাজী আজম লারকানায় গিয়ে এক লােকের সাথে দেখা করে। ঐ সময়ে ভুট্টো ও ইয়াহিয়া শিকার-ভ্রমণের নৌকায় বসে পরিকল্পনাটি করেন। ঐ আলােচনাকালে সেখানে এক লােক ছিল। আমি কাজী আজমের কাছ থেকেই বিষয়টি জানতে পারি, কাজী আজম জানতে পারে সেই লােকটির কাছ থেকে। তবে ঐ লােক তথ্য ফাস করার পর সেটি ভুট্টোর কানেও যায়। তিনি এটিকে চেপে যেতে চেয়েছিলেন এই মনে করে যে, বিষয়টি আর কেউ জানে না মনে করে। আর সে-কারণেই ওটা জানাজানি হয়ে যায়। না হলে ঘটনাটি গােপনই থেকে যেতাে। কিন্তু কেউ একজন বুদ্ধি করে পরিকল্পনার কথা জানিয়ে দেয়। পত্রপত্রিকাতেও তখন এ-খবর ছাপা হয়।
প্র: কবে এ-খবর সংবাদপত্রে ছাপা হয়? উ: ঐ সময়ই। আমার ধারণা, তখন ফেব্রুয়ারি মাস চলছে। এরপর পরিকল্পনার হােতারা তাদের পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু করে দেয়। একটি পরিকল্পনামাফিক কাজে সর্বোত্তম ফললাভের উপায় ছিল দেশের পশ্চিমাঞ্চলে জোরেশােরে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া যার অর্থ আমাদের এখানে অর্থাৎ পূর্বপাকিস্তানে লড়াই চালানাের জন্য সেনা সরবরাহ পাওয়া যাবে কম, বিপুল সেনা মােতায়েন থাকবে পশ্চিমপাকিস্তানে। এভাবে আমরা পশ্চিমপাকিস্তানে ভারতকে পরাজিত করব আর পূর্বপাকিস্তানে পাকিস্তানী বাহিনী ভারতের কাছে পরাজয় বরণ করবে। লারকানা পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করলেও ওরা একথাটি ভুলে যায় যে, তাদের

বরাতজোর সবচেয়ে বেশি নিশ্চিত করতে হলে পশ্চিমপাকিস্তানের মাটিতে লড়েই সেটি জয় করে নিতে হবে। আর সে-পরিকল্পনা শুধু ফলপ্রসূ হতে পারে যদি আমরা এখানে পরাজিত হই। যদি আমি ঘটনাক্রমে এখানে জয়ী হই বা কোনাে নাজুক, জটিল প্রকৃতির একটা নিষ্পত্তি এখানে সম্ভব হয় তাহলে সেক্ষেত্রে লারকানা পরিকল্পনা সফল হবে না। এ-ধরনের নিষ্পত্তির আওতায় রাজনীতিবিদরা যদি সরকার করায়ত্ত করতে পারে তাহলে ইয়াহিয়া খানকে এজন্যে দায়ী করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে। আর তেমন পরিস্থিতিতে ভুট্টোও কোথাও পাত্তা পাবেন না কেননা, পূর্বপাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠতা তাতে বাধ সাধবে। কাজেই এই খেলায় যে বাদ পড়বে তাকে চলে যেতে হবে বিস্মৃতির নিভৃত নেপথ্যে।
প্র: এ-কারণেই সঙ্কটের রাজনৈতিক মীমাংসার সকল সম্ভাবনাই পুরােপুরি নাকচ হয়ে যায়?
উ: সেটিই কারণ। ওটা হলে তাে ঐ দুটি লােকের কারাে তাে আর কোনাে সম্ভাবনাই থাকে না।
প্র: কখন আপনি বুঝতে পারলেন যে, সঙ্কটের কোনাে রাজনৈতিক সমাধান হতে যাচ্ছে না? উ: পরিকল্পনাটি নিয়ে যখন তারা উদ্যোগী হন। পরিকল্পনাটি ছিল এই যে,…। প্র: আপনি ছিলেন পুর্বাঞ্চলীয় কম্যান্ডের অধিনায়ক। আপনি জানতেন যে, লারকানা পরিকল্পনা বা চক্রান্ত একটা রয়েছে?
উ: না, জানা ছিল না। আমি পশ্চিমপাকিস্তানে ফিরে আমার বই লেখার সময় সেটি জানতে পারি।
প্র: ঐ সময়েই পত্রপত্রিকায় সে-খবর ছাপা হলাে আর আপনি তা আদৌ জানলেন না, এ কেমন কথা?
উ: তখন ইয়াহিয়া মারা গেছেন। ভুট্টোও ক্ষমতা হারিয়েছেন। আর সে-সময়টায় বহু লােকের কাছ থেকে বহু তথ্য বেরিয়ে আসতে থাকে।… সে যা-ই। হােক, তারা তাদের পরিকল্পনা-অনুযায়ী কাজ করতে থাকেন। তাদের ধারণা ছিল আমার পরাজয়ে তাদের ফায়দা হবে। তাদের বিশ্বাস ছিল, গেরিলাযুদ্ধ যারা করে তারা কখনও পরাজিত হয় না। অথচ আমি মাত্র ২ মাসে গেরিলাদের পরাজিত করেছিলাম। আমি নিজে ইন্দোনেশীয় গেরিলাদের বিরুদ্ধে লড়েছি, লড়েছি মালয়ে চীনা গেরিলাদের বিরুদ্ধে।
প্র: আপনি সে-সব আপনার বইতে উল্লেখ করেছেন। উ: সে সামর্থ্য আমর ছিল। আমার চোর ধরার ক্ষমতা যেমন ছিল, তেমনি চোর আমি নতুন কোনাে বাড়িতে সেঁধিয়ে দিতেও পারতাম। দুমাসের মধ্যে আমি এমন এক অবস্থান নিয়েছিলাম ও অবস্থা যা দাঁড়ায় তা গেরিলাযুদ্ধে রীতিমতাে

বিদ্যুতগতিসম্পন্ন অভিযান বলেই বিবেচিত হয়। এসবের বিবরণ আমার বইয়ে রয়েছে।
প্র: কখন সেই গেরিলা যুদ্ধের শুরু? উ: যেদিন আমি দায়িত্ব নিই সেইদিন থেকেই। প্র: অর্থাৎ দিনটি?
উ: ১০ এপ্রিল, ১৯৭১। ঐ সময় আমি দারুণ খােশমেজাজে ছিলাম। ওরা এতদিন ছিল কাদামাখা, উর্দিহীন। কিন্তু ঐ দিন থেকে ওদের গায়ে উর্দি চড়ে। কর্নেল ওসমানী হলেন ঐ গেরিলাবাহিনীর প্রধান। ঘটনাক্রমে তিনি ছিলেন আমার বন্ধুমানুষ। একসময় ওসমানী ছিলেন পাকিস্তানের সেনা সদরদপ্তরে, আর আমি তখন ছিলাম এখানে। আমার অন্যতম খেতাব ছিল ‘শেরা’ (বাঘ)। তাই ওসমানী যখনই আমাকে টেলিফোন করতেন কখনই বলতেন, ‘টাইগার! হ্যালাে, আমি টাইগার বলছি।
প্র: সেটার অভিজ্ঞতাও আপনার হয়েছে নিশ্চয়ই?
উ: আমি জবাবে বলতাম, আরে আপনি তাে সিনিয়র টাইগার। আপনি তাে ইস্ট পাকিস্তান (বেঙ্গল রেজিমেন্টের লােক যাদের প্রতীক ‘বাঘ’! এজন্য তাকে টাইগার হিসেবে ভালােই দেখাত। এভাবে ওসমানী হলেন প্রধান সেনাপতি। আমি এই ভেবে খুশি হলাম যে, আমি এখন উর্দিপরা সশস্ত্রবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ব, কিছু অসামরিক লােকের বিরুদ্ধে নয়।
প্র: এই ‘শেরা ছাড়া আপনার আর আর কি খেতাব আছে?
উ: তারিখ বিন যিয়াদ, একজন পশ্চিম পাকিস্তানী আমাকে এই নামটা দেয়… আমার আরেক খেতাব মেরিডােন… আমি একসময় রাজপুত রেজিমেন্টে (ব্রিটিশ ভারতে) ছিলাম। আপনারা জানেন, রাজপুতরা রাজপুতানার লােক। রাজপুতরা সাহসী লােক। রাজপুতদের এক বীরনায়কের নাম অমর সিং রাঠোর। সেনাবাহিনীতে আমার মুসলিম সহকর্মীরা আমাকে ডাকত অমর সিং বাহাদুর বলে। এসব হলাে গিয়ে… মানে এসবের তিনটি খেতাব ছিল আমার পাকাপােক্ত। তাই আমি যখন গােরিলাদের বিরুদ্ধে অভিযানে সীমান্ত অবধি পৌছে গেলাম… সে এক লম্বা কাহিনী গুছিয়ে বলতে গেলে…।
প্র: না, আপনি এসব বিষয় বিস্তারিত আপনার বইতেই লিখেছেন, লিখেছেন। আপনার রণবিন্যাস সম্পর্কেও। আমরা বরং কিছুটা অন্য ধরনের প্রশ্নের জবাব জানতে চাইব আপনার কাছে। আপনি ১০ এপ্রিল দায়িত্বে আসার পর জেনারেল টিক্কা খানের যুদ্ধ পরিকল্পনা ছিল, বিদ্যুতগতিতে এক অভিযান পরিচালনার। কথা ছিল সে-অভিযান শুরু হবে ২৫ মার্চ। অভিযানের নাম ছিল: অপারেশন সার্চলাইট। এ-অভিযানের পর পরই চলবে চিরুনি অভিযান (কম্বিং অপারেশন) ও অন্য আর সবকিছু। মনে করা হয়েছিল, এ-অভিযানে বিক্ষোভ দমন হবে ও তাঁরা। একটা রাজনৈতিক নিষ্পত্তিতে উপনীত হবেন। এ-ই ছিল পরিকল্পনা। কিন্তু

আপনারা যদি, আপনাদের কথামতাে দুমাসের মধ্যে বিদ্রোহী বা মুক্তিবাহিনীকে কজা করেই ফেলেন তাহলে তখন কেন আপনারা একটা রাজনৈতিক মীমাংসায় পৌছুতে পারলেন না? কেন আপনারা সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের মতাে বিকল্প বেছে নিলেন? শ্রীলঙ্কা হয়ে পশ্চিমপাকিস্তান থেকে আপনাকে পূর্বপাকিস্তানে রসদ, অস্ত্র, সেনা সাহায্য পাঠানাের কাজটিকে সেক্ষেত্রে খুবই কঠিন ছিল না?
উ: সে কথা আমি আপনাকে বলছি। ইয়াহিয়া ও সাহেবজাদা ইয়াকুব খান। ছিলেন। তাদের একটা পরিকল্পনা ছিল যার নাম ছিল, ‘অপারেশন ব্রিজ।
প্র: ‘৭০-এর গােড়ার দিকে? নির্বাচনের আগে না পরে?
উ: না, না। নির্বাচনেরও অনেক আগে। এমনকি ১৯৬৯-এ তিনি। এ-পরিকল্পনা করেন।
প্র: আপনি কি বলতে চাচ্ছেন, এ-হলাে সেই পরিকল্পনা যা তিনি তৈরি করেছিলেন…
উ: নির্বাচনের আগেই পরিকল্পনা করা হয়। ঠিক করা হয়, নির্বাচন হােক বা হােক যদি গােলযােগ দেখা দেয়, কোনােরকম গােলযােগ দেখা দেয় তাহলে সে-ধরনের উত্থান দমন করার জন্য তিনি এই পরিকল্পনা তৈরি করেন।
প্র: না, আমি বলতে চাই, আপনি আপনার বইয়ে অপারেশন ব্লিজ সম্পর্কে। যা দাবি করছেন তার কিছু কিছু জবাব জেনারেল ইয়াকুব পত্রিকায় দিয়েছেন। আপনি কি তা দেখেছেন?
উ: দেখেছি। সেটি অন্য প্রশ্ন। ফিল্ড মার্শাল রােমেল বলেছেন, কোনাে পরিকল্পনায় তার শেষাবধি প্রাসঙ্গিকতা রক্ষা করে না। হুবহু একরকম থাকে।
। যদি সেনাপতি তার পরিকল্পনা-অনুযায়ী লড়াই করেন তাহলে ভালাে। কিন্তু তিনি কেমন করে সে-লড়াই লড়বেন সেটি একান্তই ট্যাকটিকাল বা কৌশলের ব্যাপার। তাই রণপরিকল্পনা একটা রূপরেখামাত্র। যদি কোনাে রণপরিকল্পনা করা হয় সে-পরিকল্পনা যা-ই হােক-না কেন তাতে শক্তি প্রয়ােগের ব্যাপার থাকবেই। বলপ্রয়ােগ না করলে তেমন কোনােই সাফল্য আসবে না তা থেকে। তবে তিনি সময়ের বিষয়ে খেয়ালে রাখেন নি। আর তাই মুজিব ও তাঁর সহযােগীরা ধ্বংসাত্মক ও নিষ্ঠুরতামূলক কার্যকলাপ নির্বিচারে শুরু করে দেন। এসবের উল্লেখ যা করা হয় নি আমি আমার বইয়ে সেসবের বিবরণ দিয়েছি। আর তিনি যখন এসব কাজকারবার চালিয়ে যাচ্ছিলেন তাঁরা নীরব ছিলেন। তিনি সে-অবস্থায় সবকিছু অঙ্কুরেই খতম করে দিতে পারতেন। ঐ সময়ে তাঁর সে-ক্ষমতাও ছিল। তখনও পূর্বপাকিস্তানী সেনারা বিদ্রোহ করে নি। তারা আমাদের সাথেই ছিল। যারা গােলযােগ করছিল তারা অত্যন্ত অসংগঠিত কিছু জনতা মাত্র।
প্র: কখন তার অপারেশনে যাওয়া উচিত ছিল বলে আপনি মনে করেন? উ: সাথে সাথে, তক্ষুনি।।

প্র: সেটা ঠিক কখন?
উ: নির্বাচনের পরের দিনগুলিতে যখন ওরা ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য হইচই করছিল।
প্র: তার মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন ২৫ মার্চের আগেই?
উ: মার্চেই তার অ্যাকশানে যাওয়া উচিত ছিল যদিও তিনি তা করেন নি। তিনি এতে বিলম্ব করেন ও পদত্যাগ করেন। আর এভাবে পাখি উড়ে যেতে দেন। এরপর টিক্কা পূর্বপাকিস্তানে যান যখন বাঙালিরা দাঙ্গাহাঙ্গামা বাধিয়ে তুলেছে। তারও আগে থেকে ওখানকার উর্দুভাষী লােকজনের বিরুদ্ধে হামলা চলছিল। ইয়াকুবের কারণে এগুলি ঘটে। তিনি অন্তত সেগুলি থামাতে পারতেন। তারপর সেখানে যান টিক্কা। তিনি ২৪ বা ২৫ মার্চ রাতে বাঙালিদের বিরুদ্ধে অ্যাকশান নেন। গােয়েন্দাবিভাগের খবর-অনুযায়ী ঐ একই রাতে (২৫ মার্চ) মুজিব স্বাধীনতা ঘােষণা করবেন বলে খবর পাওয় যায়। জানা যায়, তিনি স্বাধীনতা ঘােষণা করবেন, ব্যবস্থাও নেবেন। তাই তিনি কয়েকদিন আগেই অ্যাকশান নেন। সেই অ্যাকশনের শক্তি ব্যবহার করা হয় কিন্তু তা ছিল খুবই কঠোর।
প্র: ২৫ মার্চের রাতের অ্যাকশানের কথা বলছেন? উ: আমি সেকথাই বলেছি। প্র: ব্যবস্থাটি খুবই কর্কশ বলছেন? উ: খুব বেশিরকমের কঠোর। প্র: আমিও বলি খুবই নির্মম ধরনের কঠোর।
উ: কোন লােকের অধীনে এ অ্যাকশান চলছে তার ওপরই নির্ভর করে এর প্রকৃতি কী হবে। কেননা, আগ্নেয়াস্ত্রের গুলি যখন ছোড়া শুরু হয়ে যায় তখন এসবে জড়িত লােকের আচরণ অত্যন্ত অদ্ভুত হয়ে ওঠে। দেখা গেল তখন কর্তাব্যক্তি হালকা মেজাজে বসে শিকার ধরার সংলাপে ব্যস্ত, সেই জোশে মত্ত। এর পরিণতি হিসেবে আমরা দেখি, তিনি বলছেন, আমি মানুষ নয়, মাটি চাই।
প্র: কে সেই লােক? টিক্কা খান?
উ: তিনিই। তিনিই বলেন, আমি মানুষ নয়, মাটি চাই। ইয়াহিয়া এসব দেখেশুনে ভড়কে গিয়ে টিক্কা খানকে ১০ দিনের মধ্যে সরিয়ে নেবার সিদ্ধান্ত নেন। বলা দরকার এখানে যে, যদি কোনাে জেনারেল অপারেশানে থাকেন তাকে সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়া এক ভয়ানক ব্যাপার। এটি ঐ জেনারেলের জন্য মৃত্যুর পরােয়ানার শামিল। যাহােক, ঐ সিদ্ধান্তের আলােকে কর্তাব্যক্তিরা বিষয়টি আগাগােড়া বিবেচনার পর কিছু লােককে দায়িত্ব নেবার জন্য বলেন। আর তারপর তারা চূড়ান্ত পর্যায়ে ঠিক করেন, সিনিয়রিটি নিয়ে ভাবার এখানে অবকাশ নেই, ওটা ভুলতে হবে। এখন যে কাজটা পারবে তাকেই সেখানে পাঠাও। শেষপর্যন্ত আমাকেই এজন্যে বাছাই করা হয়। যদিও আমি বেশ কয়েকজনের পেছনের অবস্থানে ছিলাম। তখন একডজন জেনারেল ছিলেন আমার চেয়ে সিনিয়র।
৮০
আমাকে পাঠানাে হলাে যেখানে আমার আগে আমার চেয়ে সিনিয়র দুই জেনারেল ব্যর্থ হয়েছেন। যাহােক আমাকে বাছাই করার পর আমি পূর্বপাকিস্তানে আসি। এখানে এসে দেখি সবকিছুই ওলটপালট হয়ে আছে। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ক্যান্টনমেন্টগুলির চারপাশে লড়ে চলেছে। আর যে যে শহর-নগর তাদের কজায় রয়েছে সেখানেও চলেছে তেমনি লড়াই। প্রদেশের অবশিষ্ট অংশ দখলে রয়েছে মুক্তিবাহিনীর। প্রাদেশিক সরকার অচল হয়ে গেছে। দেশের আন্তর্জাতিক সীমান্ত গায়েব হয়ে গেছে। হিন্দুরা সীমান্ত পারাপার করছে অবাধে। আমাদের তথ্যসূত্র-অনুযায়ী আমি যখন দায়িত্বভার নিই তখন অন্যান স্থানে আমাদের সৈন্যরা চারদিক থেকে পরিবেষ্টিত, রুদ্ধ অবস্থায় ছিল। তাদের সাথে যােগাযােগের একমাত্র উপায় ছিল হেলিকপ্টার। ঢাকা ও প্রদেশের বাকি অংশের সড়ক ও নৌযােগাযােগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছিল। এখন হলাে কি, স্থানীয় লােকজনের মাঝে এক লােক ছিল (মুক্তিযােদ্ধা?) তাকে সবাই ফিল্ড মার্শাল বলে ডাকত। কেউ একজন আমাদের এই অবস্থার খবর দেয় তাকে। সেই ফিল্ড মার্শাল আমাকে চ্যালেঞ্জ জানালেন এই বলে যে, তােমাদের অবস্থা তাে কাহিল। আমাদের জন্য চমৎকার। তােমাদের যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন। আমরা এখন তােমাদের ওপর আক্রমণ চালাব। আমিও পাল্টা তাকে ঠিক একই কথা বললাম: “তােমাদেরকে আমরা ঘিরে ফেলেছি। তােমাদের যােগাযােগব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন। তােমাদের রসদ নেই। অবস্থা চমৎকার। আমি এখন আক্রমণ চালাব তােমাদের ওপর।’ আমি আক্রমণও চালাই। এ-আক্রমণটা ছিল সুনিশ্চিতভাবেই ভড়কে দেওয়ার মতাে, এটা ওদের কাছে ছিল অপ্রত্যাশিত। তারা এরকমটাই ভেবেছিল যে তাদের প্রতি গেরিলা যদি একজন করেও পাকিস্তানী সৈন্য হত্যা করে তাহলে ওরা দুই মাসে খতম হয়ে যাবে। তাই তারা আশা করতে পারে নি যে আমি এ-ধরনের আক্রমণ পরিচালনার সাহস করব। আমি এ-ধরনের চকিত অভিযান শুরু করেই সৈন্যদের নির্দেশ দিলাম দ্রুততম গতিতে তােমরা সীমান্তের সম্ভব সকল জায়গায় পৌছে যাও— এটাই আমার নির্দেশ। আমি সরাসরি এরিয়া কম্যান্ডারদের কাছে গেলাম। তারবার্তায় কোনাে কিছুই পাঠান গেল না কেননা কিছুই তাতে গােপন রাখা সম্ভব হতাে না। টেলিফোন স্থাপনাগুলি বাঙালিদের দখলে ছিল। তাই আমাকে ওভাবেই যেতে ও খবর দিতে হয়। আমি সেই মােতাবেক সােজা সীমান্তে গিয়ে হাজির হয় সবজায়গায় সবকিছু নিয়েই। আর তারপর আমরা সেখানে গিয়ে কাজ শুরু করে দিই। এটা গােপন রাখা হয়। একটা পরিকল্পনা ছিল এরকমের যে, যে সংখ্যক গেরিলা বাঙালিদের রয়েছে তা দিয়ে তারা বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। আর ওদের ঠেকাতে হলে আমার দরকার হবে তিন লাখ সৈন্যের। কিন্তু আমার মােট সেনাশক্তি ছিল মাত্র ৪৫,০০০। এই ৪৫ হাজারের মধ্যে আবার ৩৪ হাজার ছিল নিয়মিত সৈনিক আর ১১ হাজার ছিল পুলিশ বা এ-ধরনের আরও কিছু। বাহিনীর রেকর্ডে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনামে তার নিজ সৈন্য মােতায়েন করেছিল ৭
লাখ আর ঐ দক্ষিণ ভিয়েতনাম সরকারের মােট সরকারি সৈন্য ছিল ১০ লাখ। ভিয়েতনামে ৫০ হাজারের মতাে গেরিলার বিরুদ্ধে নিয়ােজিত ছিল ১৭ লাখ সেনার এক বিশাল বাহিনী। আলজিরিয়াতে ফ্রান্স ১০ লাখ সৈন্য মােতায়েন করেছিল। আমার ৪৫ হাজার সেনা লড়েছে ৪ লাখ গেরিলার বিরুদ্ধে যা ছিল বাঙালি, রুশ ও ভারতীয়দের গালে চড়ের শামিল। তখন ভারতীয়রা… মানে রুশরা বলছিল যে, গেরিলাদের সঙ্গে রয়েছে ৫০ হাজার ভারতীয় সৈন্য। আমি যখন দায়িত্ব নিই। তখনকার অবস্থা ছিল এরকম। আমাদের একটা জাহাজ ছিল কিন্তু তার কোনাে রাডার ছিল না, রাতে দূরের কিছু দেখার যন্ত্রপাতি ছিল না কিন্তু আমরা সীমান্তে পৌছে গিয়েছিলাম। আমি প্রধান সেনাপতি জেনারেল হামিদকে অনুরােধ জানিয়েছিলাম, আমি এখন ভারত সীমান্তে রয়েছি, আমাকে ভারতে প্রবেশের অনুমতি দিন। কিন্তু ওরা তাে আসলে আমার পরাজয় দেখতে চাচ্ছিল। কাজেই আমার সাফল্যের খবরে ওরা আঁতকে ওঠে। আমি আগেই অনুমান করতে পেরেছিলাম ওরা হয়ত আমাদের থামিয়ে দিতে পারে। আর সেজন্যই আমি কী করছি তা আমি ওদের জানাই নি। তারা প্রত্যাশিতভাবেই আমাকে অগ্রাভিযান স্থগিত করতে বলে। বলে, ভারত ভূখণ্ডের ভেতরে যাওয়া চলবে না। এর দুদিন পর জেনারেল হামিদ পূর্বপাকিস্তানে আসেন। তাকে আমি বলি, আমি এখন ওদের ঠিক কলিজার কাছেই রয়েছি। ওরা পালাচ্ছে। আমরা ওদের সাফ করছি। তাদের দিকে গুলি চালাচ্ছি। আপনি যদি এখন ভারতের দিকে এগিয়ে যাবার অনুমতি দেন, আমি বঙ্গের (পশ্চিমবঙ্গের) একটা বিশাল অঞ্চল কজা করতে পারব। আমি ব্রহ্মপুত্র ও নাগাল্যান্ডের এদিকে রয়েছি; সবকিছু আমাদের ঠিকঠাক রয়েছে। আপনি যদি একবার অনুমতিটা দেন, দুই ডিভিশন সৈন্য দেন কোলকাতাও দখল করে নিই। আমি ভারতীয় বাহিনীকে চুরমার করে দিয়ে আসাম, বঙ্গ ও বিহারের গােটা অঞ্চলটিই পদানত করব। ভারত পরাজিত হবে। তিনি বললেন, বিলকুল ঠিক, আমি তােমাকে সাহায্য করব। কিন্তু জেনারেল এসেছিলেন পরিস্থিতি দেখতে, ভারতের সাথে খােলাখুলি যুদ্ধ করার জন্য নয়। ভারতীয়রা তাদের লেখায় স্বীকার করেছে যে, ইয়াহিয়া যদি ঠিক ঐ সময়টায় আঘাত হানতেন তার পক্ষে দেশের উভয় অঞ্চলের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য জয় করা সম্ভব হতাে। আমি বললাম, আমি কাশ্মীরেও ঢুকে পড়তে পারতাম… শিলিগুড়ির দিকে এগুতে পারতাম। আপনি আমাকে অনুমতি দিন। তখনও ভারতীয়রা সবরকম অস্ত্রসজ্জায় সজ্জিত হতে পারে নি। তাই সুযােগ ছিল অক্টোবর পর্যন্ত। অক্টোবরের পর আমার পক্ষে আর উল্লিখিত সাফল্য অর্জন সম্ভব ছিল না। আমার বাহিনীতে ১৮টি ভারী। কামান, ৭৪টি মাঝারি পাল্লার কামান, একশ’টির মতাে অ্যাটাক গান ও ট্যাঙ্কবিধ্বংসী কামান ঘাটতি ছিল। গােটা পদাতিকবাহিনীতে ছিল এই অবস্থা। তবে আমার যা কিছু ছিল তা হলাে সেনাবাহিনীকে প্লাটুন থেকে নির্দেশ দেওয়া। এসব প্লাটুন আবার ১৮টি রণক্ষেত্রে লড়ছিল। ওরা ঐসব রণক্ষেত্রে অনড় অবস্থান

নিয়ে বসেছিল। তাই কেমন করে যুদ্ধ চালাতে হবে সেটি আমিই জানতাম। যেসব লােক আমার সুমুখে ছিল তারা তখনকার চ্যালেঞ্জ নেবার লােক ছিল না।
প্র: বিমানবাহিনীর অবস্থা কেমন ছিল?
উ: বিমানবাহিনীর মাত্র একটি এয়ারক্র্যাফট ছিল। তাই বিমানবাহিনীর পক্ষে যুদ্ধে অংশ নেবার নেবার মতাে সামর্থ্য ছিল না। এর আগে ছয়টি যুদ্ধবিমান ছিল। ছয়টিই খােয়া যায়। আমার হাতে কেবল স্থলবাহিনী তথা পদাতিকবাহিনীর শক্তিই অবশিষ্ট ছিল।
প্র: আমার মনে হয় আপনি যে-অবস্থার কথা বলছেন তা বেশ চমৎকারই। বলতে হয়। কিন্তু তখন বাংলাদেশের ভেতরের অবস্থা কী? আপনারা কি দরকার মতাে সৈন্য-রসদ আনতে পারছিলেন? না, সিভিল আর্মড ফোর্সের লােকদের বেশি করে ব্যবহার করেছেন?
উ: যুক্তিসঙ্গতভাবেই আমরা তাদের কিছু লােককে কাজে লাগিয়েছি।
প্র: আপনারা কখন এই অসামরিক সশস্ত্রবাহিনী তথা আল-বদর, আল-শামস বাহিনীতে লােকভর্তির সিদ্ধান্ত নেন? এজন্য তাে একটা লম্বা প্রক্রিয়ার দরকার?
উ: আমার যদুর মনে পড়ে সেটা মে মাসের দিকে। মে মাসের দিকেই আমি ওদের রিক্রুট করতে শুরু করি।
প্র: ওরা কি সরাসরি আপনার কম্যান্ডে ছিল?
উ: তাই। কেউ-কেউ বলে, ওরা জামায়াতে ইসলামীর অধীনে ছিল। কিন্তু আমি তা স্বীকার করি না। আল-বদর ও আল-শামস নাম হওয়ার নেপথ্যে জার্মানির এক শাসকের ধারণা রয়েছে। সেখান থেকে আমি ধারণাটি নিই। প্র: আপনি আপনার বইয়ে বলেছেন, আপনি ওদের নেতাদের সঙ্গে করে নিয়ে আসেন যারা…।
উ: হাঁ, ওদের কিছু লােককে পাকড়াও করার জন্য লােকজন খোঁজাখুঁজি করছিল। ওরা ছিল অত্যন্ত পরিচিত। যেহেতু ওরা সকলের চেনা ওদের খতম করে দেওয়া হতাে।
প্র: কেন? উ: কারণ, তারা বিখ্যাত ব্যক্তি ছিলেন। প্র: ওদের পরিচয় কী? উ: ওরা বাঙালি। প্র: আপনি কি ওদের সম্পর্কে…?
উ: আমি জানতাম না, আমার স্টাফের লােকেরা তাদের চিনত, তাদের সাহায্য সমর্থন করত।
প্র: সেটা কি জামায়াতে ইসলামী রাজাকার তৈরিতে সাহায্য-সহযােগিতা করেছে বলে?

উ: এমনকি, বাঙালিরাও আমাকে সমর্থন জানিয়েছে।
প্র: সে-তাে বটেই। কেননা, জামায়াতে ইসলামীর লােকেরাও তাে বাঙালিই বটে!
উ: তারা জামায়াতে ইসলামীর কেউ নয়। আমি রাজনীতিদের ঘৃণা করি। যারা রাজনীতি করে আমি তেমন কাউকেই ক্যান্টনমেন্টে ঢুকতে দিই না। কাজেই আমি কেমন করে একাজে সাহায্য-সহযােগিতা করতে কোনাে রাজনৈতিক দলকে বলতে পারি?
প্র: রাও ফারমান আলির ভূমিকা কী ছিল? তিনি কী ছিলেন? উ: তিনি ছিলেন গভর্নরের পরামর্শদাতা। প্র: তাহলে তার কি কিছু করার ছিল না?
উ: যুদ্ধ কিংবা এসবে তার কিছুই করার ছিল না। তিনি কেবল গভর্নরের পরামর্শদাতা ছিলেন। আমি আর গভর্নরের মাঝে ছিল সেনাবাহিনী।
প্র: আপনি জানেন, আন্তর্জাতিক পত্রপত্রিকা ও নিরপেক্ষ তথ্যমাধ্যমগুলি পর্যন্ত নিষ্ঠুরতা ও অন্যসব ঘটনার ওপর রিপাের্ট প্রকাশ করেছে। তবে এজন্য দায়ী হবে সামরিক আইন-কর্তৃপক্ষ, গভর্নরের পরামর্শদাতা নয়। এই কি?
উ: পরামর্শদাতা… আবদুল মােতালিব মালিক যখন গভর্নর হন ইয়াহিয়া খান তখন আমাকে বলেছিলেন, দ্যাখাে, মালিক কোনাে আদেশ দিলে মনে করবে সে আদেশ আমার আদেশ। তাই তিনি আদেশ জারি করতেন।
প্র: আপনার বইতে তা বলেছেন।
উ: বলেছি যে, আমাদের আওতায় দেওয়া হয় সিভিল আর্মড ফোর্সকে আর গভর্নরের আওতায় থাকে পুলিশ…। আমরা পরিস্থিতির চাপজনিত কারণে ওদেরকে কোনাে কোনাে কাজে ব্যবহার করছিলাম।
প্র: কার্যত ওরা ছিল আপনার কম্যান্ডে। উ: কিন্তু ওদের বেতন দেওয়া হচ্ছিল সিভিল…। আমি তাে…।
প্র: ওরা ছিল আপনার কম্যান্ডে। দরকার মতাে আপনি তাদের কাজে লাগাতেন।
উ: কিন্তু ওদের বেতন দিত অসামরিক কর্তৃপক্ষ।
প্র: কিন্তু কাজ তাে করাতে চাইত সামরিক আইন-কর্তৃপক্ষ। এমন হতে পারে তারা হয়ত এমন সব কাজ ওদের দিয়ে করাচ্ছিলেন যা বস্তুত অসামরিক-কর্তৃপক্ষ
-ও চাইতে পারে। পুলিশ এমন কাজ করছিল যা সরকার চান নি তারা তা করুক।
উ: না, আমি যখন দায়িত্ব নিই তখন টিক্কা খান ছিলেন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। সামরিক আইন-কর্তৃপক্ষের এতে কিছুই করার ছিল না। সামরিক আইন টিক্কা খানের এখতিয়ার। ফরমান ছিলেন তার পরামর্শদাতা।
প্র: না, তিনি ছিলেন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক।

উ: আমি টিক্কা খানের অধীনে কাজ শুরু করি। তিনি ছিলেন সিএমএলএ। আমি সেপ্টেম্বরে আমার দায়িত্বপালন শুরু করি। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যা কিছু হয়েছে তা করেছেন টিক্কা খান।
প্র: কিন্তু আপনি আপনার বইয়ে লিখেছেন যে, রাও ফরমান আলি অত্যন্ত একাগ্রতার সাথে, নিখুঁতভাবে ২৫ মার্চে টিক্কা খানের আদেশ পালন করেন ও নির্বিচার হত্যাকাণ্ড অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু তিনি বলছেন যে, তিনি এ-বিষয়ে কিছুই জানতেন না! উ: ওরা তা করেছে ঠিকই, কিন্তু ওদের একটা পরিকল্পনা ছিল। জেনারেল টিক্কা যখন দায়িত্বভার গ্রহণ করেন তখন তার দায়িত্ব ছিল তিনটি: এক, তিনি। ছিলেন, সামরিক আইন প্রশাসক; দুই, তিনি ছিলেন গভর্নর; তিন, তিনি ছিলেন সেনাধিনায়কও। তাই যে-রাতে তিনি ও রাজা খাদেম ঐসব আদেশ জারি করেন। কাজেই টিক্কা ছিলেন সুপ্রিম কম্যান্ডার। ঢাকায়…।
প্র: না, তিনি…
উ: টিক্কা লিখেছিলেন যে, পূর্বপাকিস্তানের সবুজ-শ্যামল প্রান্তর লাল রঙে রাঙিয়ে দিতে হবে। আমার ধারণা, কাজী জাফর তার এক রাজনৈতিক বক্তৃতায় এ-কথার উল্লেখ করেছিলেন। তবে সে যা-ই হােক একটি ডায়েরিতে লেখা হয়েছিল যে পূর্বপাকিস্তানের সবুজ মাঠ লাল হয়ে যাওয়া উচিত। ওটা যারই লেখা হােক, লেখাটা দেখানাে হয়েছিল ভুট্টো বা শেখ মুজিবকে, ঢাকায় দেখানাে হয়ছিল। এখন ভুট্টো বা মুজিব কেমন লােক তা তাে আপনারা জানেন। মুজিব এ-নিয়ে উচ্চবাচ্য করেন নি কিন্তু ভুট্টো তা ফাঁস করে দেন। তাদেরকে ঐ ডায়েরিটা তারিখসহ দেওয়া হয়। প্র: আমরা এখন সুনির্দিষ্টভাবে জানতে চাইছি আপনার কাছে পূর্বপাকিস্তান ট্রাজেডির শেষের দিকটায় যে-বুদ্ধিজীবী নিধন ঘটে তার জন্য দায়ী কারা? রাও ফরমান দাবি করেছেন, তিনি এসবের কোনাে কিছুতে জড়িত নন।
উ: বুদ্ধিজীবীরা আমার কাছে কোনাে তাৎপর্যের অধিকারী ছিলেন না। আমার মাথাব্যথা ছিল আমার অস্ত্রধারী দুশমনদের নিয়েই। তাই বুদ্ধিজীবীরা আমার কোনাে বিষয় নয়। তবে আলতাফ গওহর? একথা উল্লেখ করেছেন যে, কেউ। একজন আমাকে জানায় যে, ফরমানের কাছে বুদ্ধিজীবীদের একটা তালিকা রয়েছে। তিনি তার সত্যাসত্য যাচাই করার জন্য কেউ একজনকে পাঠান আর তার অনুরােধে রাও ফরমান ঐ তালিকা থেকে দুটি নাম কেটে বাদ দেন। আমি বিষয়টা জানতাম না। আমি এটি আলতাফ গওহরের কাছ থেকেই জেনেছি।
প্র: তাহলে, ফরমান ছিলেন এর নেপথ্যে? উ: সেটা হয়ে থাকতে পারে। প্র: হয়েছিল কি না? উ: আলতাফ এ-বিষয়ে কিছু লিখেছে, আপনারা সেটা জানেন। আমি কেন
৮৫

এসব করতে যাব? কেন এমন তালিকা রাখার দরকার আমার হবে? আমি তাে যা ইচ্ছা তাই করার ক্ষমতার অধিকারী ছিলাম?
প্র: আমি আসলে সে-কথাই বলতে চাচ্ছিলাম। আমি বলতে চাই এ-কথাই যে, আপনার ও-বিষয়ে জানা থাকারই কথা কেননা…।
উ: আমি আপনাকে বলি, আমি বাঙালিদের কাছে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ এজন্য যে, তাদের প্রায় সকলেই ভারতের হস্তক্ষেপের ব্যাপারে খুশি হতে পারে নি। তারা এজন্যে এটাকে দোষারােপ করছিল। তাদের সাহায্য-সহযােগিতা ছাড়া আমি এতগুলি লােকের(?) বিরুদ্ধে টিকে থাকতে পারতাম না। আমি তাে আর ফেরেশতা নই।
প্র: আপনি এখানে বাংলাদেশে ফিরে আসার পর আপনাকে প্রায় পরিত্যক্ত অবস্থায় কাটাতে হয়েছে সেটা আপনি এখন বুঝেছেন, সে-অবস্থায় আপনার ব্যক্তিগত অনুভূতি কী ছিল সেটা জানতে পারি, জেনারেল নিয়াজি? আমার একথা বলার কারণ, এখানকার মানুষ তাে পাকিস্তানীই ছিল, তারাই মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা করেছে… তারাই পাকিস্তান প্রস্তাবের প্রণেতা?
উ: আমি আপনাকে একটা কথা বলি…। প্র: আপনার কি মনে এমন সন্দেহ ছিল যে, ওরা ঠিক যথার্থ পাকিস্তানী নয়? উ: আমি এখনও বিশ্বাস করি যে, তারা মুসলামান। প্র: তাহলে সেটাই আপনার ধারণা?
উ: আমি ওটাই লক্ষ করেছি। আমি ওটা আগে থেকেই জানতাম। কেননা, ওরা এখানে পশ্চিমপাকিস্তানে ১৯৬৫-র যুদ্ধে লড়েছে। প্র: কিন্তু ঐ সেনাদের মস্তিষ্ক ধােলাই তাে হয়েছিল যাদের দিয়ে তাদের তাে সবাই প্রায় ছিল হিন্দু। আপনিই…।
উ: না, না, তা নয়। ওরা সবাই দেশপ্রেমিক। একটা কাহিনী বলি, শুনুন। এক প্রাণবন্ত হিন্দু তরুণ ছিল। তার বাড়ি দেশের একেবারে ভেতরের দিকে কোথাও। একদিন হলাে কি, আমার রক্ষী তাকে কী কারণে যেন এই বলে হুমকি দেয় যে, আমি তােমাকে খুন করব। সে ছেলেটি রক্ষা পেতে আমার শরণাপন্ন হলাে। মায় নে কাহা, কিউ, ইসকো তুম মারতে? তুম শায়েদ ইনকো মারতে, তাে মায় ভি তাে হাে সাকতা, তুম মুঝে মারতে? ইন লােককো তুম মারতে একেলে, তাে মারাে, মায় একেলে, মারাে। আমি আমার চায়নিজ রাইফেল তার হাতে তুলে দিয়েই কথাগুলি বললাম। বললাম, যে করছটা কী, নিজের কাজ কর, যাও, ভাগ! আমি আপনাকে বলেছি, আমার এ-ধরনের ভাবনার কোনাে অবকাশই ছিল না। আমি ছিলাম এসব থেকে অনেক দূরের লােক। আমি আপনাদেরকে বলেছি, জেনারেল হামিদ কিছু পরিকল্পনার কথা বলেছিলেন, আমি বলেছিলাম, বাঙালিরা সঙ্কটের একটা জটিল, নাজুক প্রকৃতির রাজনৈতিক নিষ্পত্তিতে রাজি। কেননা, ঐ সময় ফজলুল কাদের চৌধুরী আমার কাছে ঘনঘন যাওয়া-আসা করছিলেন। তিনি

আমার কাজে জানতে চাচ্ছিলেন, আমি ঐসব লােকজনের সাথে যােগাযােগ করতে চাই কি না। তারা এখন আমাদের কথা শুনতে তৈরি। তিনি আমাকে এ-কথাও বলেছেন, নিয়াজি এ-নিয়ে তােমার খুব উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই যদিও এটা তােমার জন্য খুব শক্ত ব্যাপারই বটে, বিশেষ করে, ব্যাপারটা যদি নাজুক ও জটিল প্রকৃতির হয়। শুধু দ্যাখাে একটা রক্ষার প্রস্তাব তােমাকে দেওয়া হয় কি না। কেননা ওরা তাে আর রাজনেতিক সমাধান চায় না। এই রাজনৈতিক সমাধান ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর স্বার্থের পরিপন্থী। তারা এটা চায় না। নভেম্বর অবধি রাজনৈতিক সমাধানের একটা সম্ভাবনা ছিল। হতেও পারত। ভুট্টো যখন জাতিসংঘে যান তখনও রাজনৈতিক নিষ্পত্তি সম্ভব ছিল। এটা সম্ভব হতে পারত শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে। পরে বাঙালিদের সাথে সম্পর্ক ছেদ করলেই চলত। সেটিই হতাে রাজনৈতিক নিষ্পত্তি। তাতে কোনো আত্মসমর্পনের প্রয়ােজন হতাে না। কিছুই দরকার হতাে না। কিন্তু সেটা যে হবার নয়। আত্মসমর্পনের বিষয়ে একটি বিষয় বলার আছে। আমাকে আত্মসমর্পন করতে বাধ্য করা হয়েছে। আমি পরাজিত হই নি। আমাকে পরাজিত করা যেত না! সেটা যদি করতেও হতাে আমি আমার অবস্থা বুঝে সেটা তাে করতে পারতাম। ওরা তাে ওখানে বসে সময় কাটাচ্ছিল আর তাদের সিনিয়র ভূমিকা জায়েজ করছিল। ফলে তারা এখানেও হারে, পশ্চিমপাকিস্তানেও পরাজিত হয়। মালিক (গভর্নর মালিক) তাঁর সম্পর্কে লেখেন ইয়াহিয়াকে এই মর্মে সতর্ক করে যে, জেনারেল নিয়াজি যদি এখানে আত্মসমর্পন না করেন তাহলে তাকে পশ্চিমপাকিস্তানও হারাতে হবে। এই মালিক ছিলেন পূর্বপাকিস্তানের গভর্নর, সামরিক আইন প্রশাসক সবকিছু। সেই তিনিই একথা বলেন। এখন সেনাবাহিনী একই কথা বলে যে, এক আদেশে জানানাে হয় যে, আমাকে… সেনাবাহিনীকে আত্মসমর্পন করতে হবে।
প্র: আমার জিজ্ঞাস্য হলাে, আপনি বলেছেন যে, পূর্বপাকিস্তানের মানুষ অনেক ভালাে মুসলমান। তাহলে আপনি বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তান বা পূর্বপাকিস্তানের বিশ্বাসঘাতকতা বলতে কী বােঝাতে চেয়েছেন? এই বিশ্বাসঘাতকতার অর্থ কী? পূর্বপাকিস্তানের মুসলিম যদি অনেক ভালাে মুসলমানই হয়ে থাকে তাহলে পূর্বপাকিস্তানের বিশ্বাসঘাতকতা বলতে কী বােঝাতে চেয়েছেন? উ: পশ্চিমপাকিস্তানের কথা বলছেন? ঠিক তা নয়। পূর্বপাকিস্তানের মানুষ বিশ্বাসঘাতক ছিল না। ছিল না পশ্চিমপাকিস্তানের জনসাধারণও। এজন্যে দায়ী। যারা পশ্চিমপাকিস্তানে ক্ষমতায় ছিল, তারা ছিল সবকিছুর কর্ণধার… ইয়াহিয়া ও ভুট্টো… পাকিস্তানের সাধারণ নয়! পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষ এখনও পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের লােকজনকে পছন্দ করে, ভালােবাসে। বরং নাটের গুরু হলাে ঐ সব লােভী লােক যারা তাদের ওপর শাসন চালাতে চেয়েছিল। আমি পশ্চিমপাকিস্তানের মানুষকে দোষ দেব না।
প্র: তিন হাজার অফিসারকে হত্যা করা হয়। তাদের স্ত্রী ও কন্যাদের ধর্ষণ।

করা হয়। আপনার এ-খবরের সূত্র কী?
উ: কারণ, এ-ঘটনা ঘটেছিল।
প্র: কিন্তু এ-খবর তাে খবরের কাগজে ছাপা হয় নি। আমরাও এরকম কোনাে। খবর পাই নি? আপনার সূত্র কী?
উ: সূত্র হলাে সংশ্লিষ্ট অফিসার ও ধর্ষিত মহিলারা। তারাই বলেছে। প্র: কিন্তু এ-সংখ্যা আপনারা স্থির করলেন কী করে? উ: কারণ, আমরা তাে ওখানে ছিলাম।
প্র: কিন্তু আমি যদি বলি যে, ঘটনা আদৌ ঘটে নি, সে ক্ষেত্রে আপনি কি বলবেন? ওটা কি কোনাে রিপাের্ট ছিল?
উ: ওটা একটা রিপাের্ট।
প্র: ওটা একটা অনুমান কেননা, এমনকি রাও ফরমান আলি ও আরও অনেকে। বলেছেন যে, এটা হওয়া সম্ভব নয়।
উ: আমার সূত্র জানিয়েছে, ওরা আর ফিরে আসে নি।
প্র: কিন্তু আপনি তাে বললেন অফিসারদের স্ত্রী ও কন্যারা ধর্ষিত হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এ-ধরনের কোনাে ঘটনা ঘটে নি। তাই আমি জানতে চাই, আপনি। কোন সূত্রে এ-খবর পেয়েছেন? উ: সূত্র…। সূত্র আমি দেই নি। কেননা, যারা ঐ সব ঘটনায় প্রাণে বেঁচে। পালিয়েছিল ও ফিরে এসেছিল তারা আমাকে বলেছে। সেসব বিবরণই আমি। বইতে দিয়েছি। ওদের বর্ণনা খুবই মর্মান্তিক।
প্র: তাহলে এসব আপনার বইয়ের কথা। ওটা থেকেই তথ্যগুলি আসছে?
উ: না, আমি অবশ্য বলতে চাচ্ছি না যে আমি ভুল করতে পারি না, ভুল হতেই পার।
প্র: তাহলে কখনও-কখনও আপনার এমনও মনে হয় যে, কিছু কিছু ভুল। আপনি করেছেন?
উ: হাঁ, আমি তা করেছি। এখন আপনাদের মতাে ব্যক্তিদের কেউ-না-কেউ, কোনাে কোনােভাবে কেননা আপনারা তাে জানেন, প্রতিটি হিন্দুই একজন। শিবাজি; তারা যা-ই করুক-না কেন তা অহিংস ব্যাপার নয়। ওরা আমাদেরকে। নিমূল, উৎখাত করতে চায়। আপনাদেরকে ধ্বংস করা ওদের পক্ষে কঠিন কাজ। নয়। ওদের কারণেই আমারা বিচ্ছিন্ন, একাকী। আমাদের এক হতে হবে।
প্র: কবে আপনি ভারতীয়দের সাথে প্রথম যােগাযােগ করেন? উ: ১৪ …। প্র: ১৪ ডিসেম্বর, ১৪-র আগে নয়?
উ: আর সেটা করা হয়েছিল আমেরিকানদের মাধ্যমে, ভারত নয়। যখন আরােরা আমাকে সতর্ক করে দেন তখনও আমরা হাতে তিন থেকে চার ডিভিশন। সৈন্য ছিল। আর ওরা যখন এল তাদের মধ্যে ছিল জ্যাকব, আর খারা নামের এক।

কর্নেল। খারারা হলাে রিসলপুরের শিখ বংশদ্ভুত লােক। মােগল সম্রাটের আমলে। তার পূর্বপুরুষ সরনাম সিং সাঙ্গা ইসলাম গ্রহণ করে হন গােলাম মােস্তাফা খারা। আমার দেখা করে আমার সাথে একথা-সেকথা আলােচনা করে। সে আমার কাছে জানতে চায় আমাদের কত… আছে। তার কথার ইশারা আমি ধরতে পারলাম। আমি বললাম, তুমি তাে একজন শিখ। তােমার তাে শিখের মতােই হওয়া উচিত, তাই নয়? আমার ৯ ব্যাটালিয়ন সেনা রয়েছে। তােমাদের ১০ হাজার সেনার সাথে। আমরা কি আর লড়ব। একগুণ, দ্বিগুণ হয় তাহলে না-হয় লড়ার প্রশ্ন উঠতেও পারে। কিন্তু ১০,০০০! সেটা সম্ভব নয়। সে আমাকে জেনারেল আরােরার নির্দেশ পড়ে জানিয়ে দিল, আমাদেরকে ফোর্ট উইলিয়ামে যেতে হবে।
প্র: এটা কোন সময়ের কথা?
উ: সে আসার পর, আর তখনই আমরা কোলকাতায় যাই। তখন ২০ ডিসেম্বর কিংবা ২১ ডিসেম্বর।
প্র: আপনাকে কি যুদ্ধবন্দি হিসেবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়? উ: না। প্র: কিন্তু রাও ফারমান আলি তার বইয়ে…। উ: তিনি তা লিখে থাকতে পারেন। না, আমাকে নয়। প্র: কিন্তু আপনার এ-বিষয়ে কিছু জানা নেই?
উ: ওরা তাে আমাকে নিয়ে গেল। আমি ভারতীয় অফিসারদের সংস্পর্শে গেলাম। আমাকে সেখান থেকে ভারতের আরও ভেতরে যেতে হয়। এখন আপনি। ধরুন দূরে রয়েছেন সেই সুযােগে আমি কিছু বলি নি সে-রকম কিছু ফাস করে দিতেও পারি!
প্র; এখন একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরে আপনার অনুভূতি কী, কেমন ছিল। বলবেন? আপনি তাে বলেন, দিনটি ছিল হিন্দুদের কাছে আত্মসমর্পনের দিন…। উ: ওহ! সেদিনই তাে আমার আত্মসমর্পনের দিন। আমি সেদিন চুপচাপ কাটিয়েছি। ম্যায় খামুশ থা। কেয়া করু। দেখুন, সেনাবাহিনী কার্যত একটা ঘােড়ার মতাে। ইয়াকুবের অধীনে আমাদের সেনাবাহিনীর কোনাে কিছু করার ছিল
। সেই একই সেনাবাহিনী টিক্কার অধীনে মানুষ মারতে শুরু করে দেয়। সেই একই সেনাবাহিনী পরে যুদ্ধ লড়েছে… লড়েছে কার্যত ক্লান্ত, ঘােড়ার মতাে। এর আচরণ ছিল তারই সওয়ারের মতাে। সওয়ার যদি দক্ষ না হয় তাহলে ঘােড় লাথি মারে। যদি সওয়ার সুদক্ষ অশ্বারােহী হয় তাহলে সে ঘােড়া ছােটে তীর-বেগে। শিকারি কুকুরকে শিকারকে আমন্ত্রণ করে, পথ দেখিয়ে তাকে খাচায় ঢােকাতে, ওতে একরকমের অদ্ভুত মজা আছে। একই কথা বলা যায়, শাহীন বা শিকারি বাজপাখির বেলায়। একই কথা সেনাবাহনীর বেলাতেও। শিকারির জানা উচিত। কখন সে বাজকে তার মুঠো থেকে মুক্ত করে দেবে। কখন সে শিকারি কুকুরকে ছেড়ে দেবে শিকারের পেছনে…।।

প্র: আমরা যে-সময়ের কথা আলােচনা করছি, অর্থাৎ আমি বলতে চাই এপ্রিল থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে কত লােক প্রাণ হারিয়েছে বলে আপনি মনে করেন?
উ: আমাদের পক্ষে আনুমানিক ৩০ হাজার, হিন্দুরা অনেকে পালিয়েছে, মারা গেছে, আর মুক্তিবাহিনীর হতাহতের সংখ্যা তার চেয়েও বেশি।
প্র: আর অসামরিক লােকজনের ব্যাপারে কি বলবেন আপনি?
উ: টিক্কা খান যে-রাতে অ্যাকশানের আদেশ দেন তখন ৫০ হাজার লােক নিহত হয়।
প্র: আর পরের বাকি সময়ে? উ: তেমন বেশি নয়।
প্র: আমি জানতে চাই এ-জন্য একটা অফিসিয়াল হিসেবে তাে থাকতে পারে! রেকর্ড নিশ্চয়ই! আপনাদের কি এ-ধরনের কোনাে সরকারি রেকর্ড ছিল?
উ: আমরা সেকথা উল্লেখ করেছি। আমরা ওটা সংগ্রহ করেছিলাম। আমরা একটা সিচুয়েশান রিপাের্ট তৈরি করতাম। তাতে হতাহতের সংখ্যা ইত্যাদি তথ্য থাকত। প্র: ওটা তাে আপনারা করতেন যুদ্ধ চলাকালে। ঘােষণা করা হয় ৩ ডিসেম্বর রাতে।
উ: ২১ নভেম্বর। ভারত এইদিন আমাদের বিরুদ্ধে আক্রমণ শুরু করে। আমাদের ১৩ হাজার সৈন্য ছিল।
প্র: তারা তাে পুরােপুরি আধিপত্যমূলক অবস্থাতেই ছিল। ওদের সাথে কোনাে সামনাসামনি লড়াইয়ের প্রশ্নই তাে ছিল না।
উ: এখানে মুক্তিবাহিনীর লােকজনের হতাহতের সংখ্যা দেওয়া হয়েছে ৩০ হাজার।
প্র: কিন্তু আমি তাে অসামরিক লােকজনের কথা বলছি।
উ: আমাদের কাছে সে হিসেব নেই। আমরা তাে সিভিলিয়ানদের সাথে যুদ্ধ করি নি।
প্র: আপনি কি জানেন, রাজাকাররা… আল-বদর, আল-শামস ব্যাপক হত্যাকাণ্ডে জড়িয়েছিল?
উ: না। আমার ৩৮ হাজারের মতাে সৈন্য ছিল। ওরা অকাতরে মারা পড়ছিল। তাই আমাকে মৃত সৈনিকের স্থান পূরণ করতে হতাে। আমি এসব আল-বদর ও আল-শামসদের বিভিন্ন সেনা ডিভিশনে নিয়ােগ করতাম। সেনা ডিভিশনগুলি তাদের কাজে লাগাত…সেটি অন্য কথা। এইসব আল-বদর ও আল-শামস অনেকে দলছুট হয়ে পালিয়ে গিয়ে এটা-সেটা তখন করেছে। তাদেরকে একটা ধর্মীয় বাধ্যবাধকতার মধ্যে নিয়ােগ করা হয়। তাদেরকে ব্যবহারও করা হয় সেভাবেই। এখন যদি ওরা বাড়াবাড়ি কিছু করে থাকে সেটা নিশ্চয় করে বলার জন্য সময় লাগবে। তাছাড়া ওদের হাতে তাে অস্ত্রও দেওয়া হয়েছিল।
৯০

আমি আগে যেরকমটা বলেছি, ইয়াকুব যদি কাজটা ঠিকঠাক করতেন, টিক্কা আসতেন না। নিয়ন্ত্রণ করতেন কিছুই ঘটত না। সামরিক অ্যাকশানের দরকার হতাে না। আমি সেখানে যেতাম না। যা কিছু করা হয়েছে ওখানে কোনােকিছুই করার দরকার হতাে না। মুজিবকে যদি ক্ষমতা দেওয়া হতাে যে-ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়েছিল সে-ক্ষেত্রে এতসব ঘটনা ঘটত না। তিনি নির্বাচনে জিতেছিলেন তাকে ক্ষমতা না দেওয়াটা অন্যায় হয়েছে। ভুট্টো সে-ক্ষমতা দিতে দেন নি যা একজনের প্রাপ্য ছিল।
প্র: আপনি আপনার বই উৎসর্গ করেছেন রাজাকারদের উদ্দেশে, আপনার সৈনিকদেরকে নয়, কেন?
উ: আমাদের একটা কর্তব্য ছিল আর ওরা এসেছিল স্বেচ্ছায়।
১২ পাকিস্তানে ১৯৭১ সালের নীতিনির্ধারক বা জড়িত যাদের সঙ্গে কথা হয়েছে তাদের মধ্যে জেনারেল রাও ফরমান আলিকে সবচেয়ে বুদ্ধিমান এবং আবেগহীন মনে হয়েছে। তিনি ঠাণ্ডামাথার লােক, বুঝেসুঝে কাজ করেছেন। অর্থাৎ পাকিস্তানের স্বার্থ দেখেছেন। শীর্ণকায় বৈশিষ্ট্যহীন চেহারার লােক রাও ফরমান আলি। কথাবার্তা বলেন নিরূত্তাপ ভঙ্গিতে। ১৯৭১ সালের সম্পূর্ণ সময় তিনি ছিলেন তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের বেসামরিক প্রশাসনের দায়িত্বে। পূর্বপাকিস্তানের সে-সময়কালের ঘটনাবলি তিনি জানতেন না, এ-কথাটা তিনি যতই বলার চেষ্টা করুন-না কেন তা যে সত্য নয় তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু এ-কথাটাই তিনি আমাদের বলতে চেয়েছেন, তাঁর বইতে তুলে ধরেছেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যে ক’জন পাকিস্তানী জেনারেল লিখেছেন তাদের মধ্যে জেনারেল রাও ফরমান আলি খানের বইটি গুরুত্বপূর্ণ। বইটির নাম হাউ পাকিস্তান গট ডিভাইডেড। গুণগতভাবেও অন্য জেনারেলদের থেকে তার বইটি উন্নত, অন্তত রচনাশৈলী, বিন্যাসের দিক থেকে। বােঝা যায়, তিনি পড়াশােনা করতেন, দূরদর্শী ছিলেন এবং চতুরও। ফরমানের এ-বই লেখার মূল কারণ, তিনি। ইয়াহিয়া, টিক্কা খানের ঘনিষ্ঠজন ছিলেন। নিয়াজির সঙ্গেও যুদ্ধকালীন সহযােগী হিসেবে কাজ করেছেন। ফলে গণহত্যার, বিশেষ করে ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়দায়িত্ব তার ওপরই বর্তিয়েছে। এ-দায়দায়িত্ব ও অভিযােগ থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্যই তাকে রচনা করতে হয়েছে বর্তমান গ্রন্থটি।
বইটি কেন তিনি লিখলেন, এ-সম্পর্কে ফরমান আলির ভাষ্য, “অন্য অনেকে যা দেখেছেন বা দেখতে পেরেছেন, আমি তার চেয়ে অনেক বেশি দেখেছি। সেনাবাহিনীর একজন লে. কর্নেল হিসেবে ১৯৬২ ও ১৯৬৩ সালে পূর্বপাকিস্তানে আমার প্রথম সংক্ষিপ্ত সফরকালে এবং পরে অসামরিক প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকাকালে আমি ছিলাম এই বিয়ােগান্ত নাটকের সূচনা, বিকাশ ও মঞ্চায়নের

প্রত্যক্ষদর্শী।” শুধু তাই নয়, অন্য আরাে সৈনিকের মতাে এটা আমারও দুর্ভাগ্য যাদেরকে ১৯৭১ সালে ট্রাজেডিতে টেনেহিচড়ে জড়িত করা হয়েছিল। তিনি আরাে লিখেছেন, “যখন পেছন ফিরে দেখি, আমি দেখতে পাই বিপুল পৈশাচিকতা আমার চোখের সামনে উঠে আসছে।” অথচ পাঠক যখন বইটি পড়বেন তখন লক্ষ করবেন, এ-পৈশাচিকতার কারণ যে-পাকিস্তানী বাহিনী তা অস্বীকার করা হয়েছে।
জেনারেল ফরমান লিখেছেন, “আমার এ-গ্রন্থের উদ্দেশ্য হলাে বিভিন্ন ঘটনা ও স্রোতধারাকে, উন্মাদ আবেগ ও সংবেদনহীন পাগলামােকে পাশাপাশি সাজানাে এবং ধূর্ত নেতৃবৃন্দের চিত্তাকর্ষক ক্ষমতা ও তাদের সেইসব প্রতারণামূলক স্লোগান ও অঙ্গীকারের প্রকৃতি উদঘাটন করা যা পাকিস্তানের ভাঙন ঘটিয়েছে এবং যার পর পর এসেছে এই ঘৃণ্য নাটকের প্রধান অভিনেতাদের বিনাশ।” এখানেও সেনাবাহিনীর কথা, তাদের ভূমিকা, দায়দায়িত্ব সম্পূর্ণ অস্বীকার করা হয়েছে।
একই মুখবন্ধে আবার তিনি কিছু বাস্তব সত্যও তুলে ধরেছেন। যেমন লিখেছেন- “মুসলিম-মানসই এমন যে, তা বীরত্বপূর্ণ বাগাড়ম্বর ও অতিরঞ্জন দাবি করতে ভালােবাসে।” জেনারেলদের বইগুলাে তার প্রমাণ। “সঠিক ও সময়ােচিত পদক্ষেপ নেয়া হলে আমরা ঢাকার ঘটনাপ্রবাহকে সহজেই রক্ষা করতে পারতাম— যার পরিণতি ছিল আত্মসমর্পণ। আমার কথাটি হলাে, আমরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেব, না হলে অতীত-ভুলের পুনরাবৃত্তির জন্য আমাদেরকে নিন্দিত হতে হবে। একজন বাস্তববাদীর কথা, যা রাজনীতিবিদরা, বিশেষ করে বাংলাদেশের ১৯৭১ সালের বহু আগ থেকেই বলছিলেন।
মুখবন্ধের উপসংহারে পাকিস্তানের সাম্প্রতিক অবস্থা নিয়ে তিনি যে মন্তব্য করেছেন তা বিশেষভাবে প্রণিধানযােগ্য। লিখেছেন তিনি, “আমরা পূর্বপাকিস্তানে একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন দেখেছি, এখন আরেকটি দেখছি সিন্ধুতেযদিও এটা অতটা বিপজ্জনক নয়। এর মীমাংসা করতে হবে রাজনৈতিক পন্থায় এবং আর্থ-সামাজিক পদক্ষেপের মাধ্যমে। শক্তিপ্রয়ােগ বিপরীত ফল ঘটাবে। আমরা প্রশাসনিক পদক্ষেপের মাধ্যমে পাকিস্তানকে রাষ্ট্র হিসেবে পরিচালনা করছি। জাতি গঠনের জন্য প্রয়ােজন উদার দার্শনিক ও মনস্তাত্ত্বিক মনােভাব এবং জনগণের মন তৈরি করার জন্য শিক্ষামূলক পদক্ষেপ।”
ফরমান আলি বলছেন, “আমাদের সমাজের সকল অংশই জ্ঞাতসারে বা অন্য কোনােভাবে পাকিস্তানের ভাঙন ঘটানােয় অবদান রেখেছে। রাজনীতিবিদ, সাধারণ আমলা, পররাষ্ট্রনীতি প্রণেতা, সংবাদপত্র এবং পূর্বপাকিস্তানের ছাত্রসমাজ কেউই গঠনমূলক পথে তাদের ভূমিকা পালন করে নি, বরং তারা আগুনে ইন্ধন যুগিয়েছে। কিন্তু মূল বইয়ে এর কোনাে প্রতিফলন পাওয়া যাবে না শুধু শেষের দু’লাইনের বক্তব্য ছাড়া।
এভাবে ফরমান আলির কাহিনী এগিয়েছে। বাস্তব পরিস্থিতি তিনি বুঝেছেন, বুঝতেনও; কিন্তু সেগুলাে তিনি সুচতুরভাবে অস্বীকার করে গেছেন। তাই ফরমান

আলির বই শেষ করলে আমরা দেখব, তাতে অতিরঞ্জন আছে, অর্ধসত্য আছে, আবার সত্যও আছে। এবং এ-সব কিছু তিনি এমনভাবে মিলিয়েছেন যে, তার লেখা পাঠকের কাছে অনেক সময় অনেক ক্ষেত্রে বিশ্বাসযােগ্য মনে হবে। এ-কৌশল তার জন্য ভালাে, কিন্তু ইতিহাস বা ভবিষ্যতের জন্য ভয়ংকর। তবে ঝাড়াই-বাছাইয়ের পরও এ-বইয়ের এমন কিছু তথ্য বা জানার বিষয় আছে যা ১৯৭১ সালের ইতিহাস রচনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। জেনারেল ফরমানের বলার ভঙ্গিটিও উল্লেখ্য। এমন এক ভঙ্গিতে তিনি লিখেছেন যা পড়ে মনে হবে, আসলে বাঙালিদের প্রতি তাঁর কোনাে বিদ্বেষ নেই। ঘটনাচক্রে ১৯৭১ সালে তিনি জড়িয়ে পড়েছিলেন মাত্র। শেখ মুজিবের সঙ্গে যে তার সুসম্পর্ক ছিল এ-কথা বারবার উল্লেখ করতে তিনি ভােলেন নি। এর মাধ্যমে তিনি এই ইঙ্গিত করতে চেয়েছেন যে, যার সঙ্গে স্বয়ং মুজিবের সুসম্পর্ক সেই লােক কতটা খারাপ হতে পারে?
আমি এখন সংক্ষেপে বইয়ের মূল বিষয় ও জেনারেল ফরমান আলির মনােভঙ্গি তুলে ধরার চেষ্টা করব।
পাকিস্তানী জেনারেলদের মধ্যে রাও ফরমান আলি সবচেয়ে বেশিদিন ছিলেন বাংলাদেশে। একপর্যায়ে ১৯৬৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত। সামরিক আইন জারির পর, সামরিকবাহিনীর পক্ষ থেকে তিনি বেসামরিক প্রশাসনের দেখাশােনা বেশি করেছেন। স্বভাবতই অন্য জেনারেলরা তাকে প্রভাবশালী মনে করতেন এবং ভাবতেন তিনি ইয়াহিয়ার ঘনিষ্ঠজন। জে. জিয়াউল হকের অন্যতম সহকর্মী জেনারেল আরিফও লিখেছেন তাঁর স্মৃতিকথায়— ফরমান ছিলেন ইয়াহিয়ার প্রিয়পাত্র যার কথায় প্রেসিডেন্ট গুরুত্ব দিতেন এবং তিনি যে প্রভাবশালী ছিলেন তার প্রমাণ তার নিয়ােগ। ঘনিষ্ঠ যে তিনি ছিলেন তা বােঝা যায় তাঁর স্মৃতিকথা পড়লেও। যদিও বারবার তিনি একথা লিখতে ভুল করেন নি যে, পূর্বপাকিস্তান’ সম্পর্ক তাঁর পরামর্শগুলাে প্রেসিডেন্ট বা জেনারেল হামিদ ও পিরজাদা কেউ-ই রাখে নি।
পাকিস্তানের অন্য জেনারেলদের লেখা বই থেকে ফরমানের বইটি ভিন্ন ধরনের। এ-বই পড়ে বােঝা যায়, তিনি বেসামরিক জগতের খবরাখবর রাখতেন, পড়াশােনাও করতেন এবং দু’বার ভেবে কদম ফেলতেন। অন্য জেনারেলদের মতাে বাঙালিদের সম্পর্কেও তাঁর কিছু পূর্ব ধারণা ছিল এবং অনিচ্ছাসত্ত্বেও কোথাও তা প্রকাশ পেয়েছে। এ-পূর্ব ধারণার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ পূর্ব ধারণা থাকলে যে-কোনাে সিদ্ধান্তে পূর্ব ধারণা প্রভাব ফেলে এবং ফরমান তাঁর লেখায় সচেতনভাবে একটা ভারসাম্য রাখার চেষ্টা করেছেন। তাঁকে একদিকে পশ্চিমপাকিস্তানের কথা খেয়াল রাখতে হয়েছে, অন্যদিকে পূর্বপাকিস্তানের প্রতি যে তার দৃষ্টিভঙ্গি নমিত ছিল। তাও দেখাতে হয়েছে। সেজন্য দেখি, পূর্বপাকিস্তানের দৃষ্টিভঙ্গিও তিনি তুলে ধরতে

চেয়েছেন। এর আরাে একটি কারণ থাকতে পারে। তিনি ঘনিষ্ঠভাবে পূর্বপাকিস্তানের ঘটনাবলি প্রত্যক্ষ করেছেন, রাজনীতিবিদদের সঙ্গেও তার যােগাযােগ ছিল। তবে, আরেকটি বিষয় বাদ দেওয়া যায় না। ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যার সঙ্গে তার যােগাযােগ ছিল বলে অভিযােগ আনা হয়েছে যে-কারণে হয়ত তিনি অমনভাবে লিখেছেন, অনেকের সঙ্গে কথােপকথন উদ্ধৃত করেছেন, যার সত্যতা এখন নির্ণয় করা যাবে না। তার ভঙ্গিটা এরকম— পাকিস্তান এক ছিল। যে-কোনাে কারণেই হােক দু’পক্ষের যুদ্ধ হয়েছে যার জন্য মূলত রাজনীতিবিদরাই দায়ী। দু’পক্ষই। হত্যাকাণ্ড করেছে। কিন্তু আমরা তাে একসময় একসঙ্গে ছিলাম। আমরা তাে জানি, যা ঘটেছে তার অনেকটাই অতিরঞ্জিত। এরকম একটা ভাব আছে। তিনি দেখাতে চেয়েছেন, তিনি বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ ছিলেন। সুতরাং তার বিরুদ্ধে হত্যার সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোেগ কি ঠিক? অনেক বর্ণনায় অর্ধসত্য আছে। ফলে ইংরেজিতে লেখা এ-বই পড়ে ধারণা অন্যরকম হতে পারে।
বাঙালিদের সম্পর্কে সামগ্রিকভাবে পশ্চিমপাকিস্তানীদের পূর্ব ধারণা কী ছিল তা বিধৃত হয়েছে ফরমান আলির বইয়ের প্রথম অধ্যায়ের প্রথম লাইনেই। লিখেছেন তিনি, ছােটবেলা থেকে বাঙালিদের সম্পর্কে যে-কথা শুনছেন তা হচ্ছে বাঙালি বাবু, বাঙালি জাদু এবং ভুখা বাঙালি। বাঙালি বাবু অর্থাৎ শিক্ষিত বাঙালি কেরানিকুল; আরাে নির্দিষ্টভাবে শিক্ষিত বাঙালি হিন্দু-কেরানিকুল যাদের কথা মনে হলেই চোখের সামনে ভেসে উঠত বৃটিশদের হয়ে তারা পুরনাে শাসক মুসলমাদের যাতাকলে পিষছে। বাঙালি জাদু শুনে এসেছেন, পশ্চিমা কেউ বাঙাল গেলে থেকে যায়। কেন? এ-কারণে এক-ধরনের ভয় ও কৌতূহল সৃষ্টি হয়েছিল বাংলা ও বাঙালিদের সম্পর্কে। আর বাঙালি ভুখা। প্রাকৃতিক কারণে বাংলায় সবসময় খাদ্যের অভাব থাকে এবং বাঙালিরা ভুখা থাকে যা তিনি স্বচক্ষে দেখেছেন ১৯৪৩ সালে মন্বন্তরের সময়।
১৯৬২ সালে ফরমান তৃতীয়বারের মতাে এবং পাকিস্তান হওয়ার পর প্রথমবারের মতাে পূর্ববাংলায় আসেন এবং আশ্চর্য হয়ে যান এ-কারণে যে, বাঙালিরা তখন ১৯৪৬ সালের হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার কথা ভুলে গেছে, বরং বলাবলি করছে। পশ্চিমপাকিস্তানের শােষণের কথা অর্থাৎ পশ্চিমপাকিস্তানীরা জানত না যে, কেন্দ্রীয় সরকার শােষণ, নিপীড়ন চালাচ্ছে এবং বাঙালিদের মনােভাব বদলে গেছে।
দ্বিতীয়বার পূর্ববাংলায় এসে ফরমান কিছুদিন ছিলেন। তখনও এ-পরিবর্তন লক্ষ করেছেন। দেয়ালে দেয়ালে আইয়ুববিরােধী স্লোগান, মােনেম খানের প্রতি ঘৃণা। কেননা তিনি আইয়ুবের ধামাধরা। হ্যা, পাকিস্তানের উন্নতি হচ্ছিল, পূর্বপাকিস্তানের জিএনপিও বাড়ছিল কিন্তু মানসিক মিল আর ছিল না।
১৯৬৭ সালে ঢাকায় তিনি নিয়ােগ পান। তার আগে তাকে ডিডিএমও নিয়ােগ করা হয়। এখানে একটি ঘটনার তিনি উল্লেখ করেছেন যাতে সেনাবাহিনীর দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায় বাঙালিদের সম্পর্কে। অবশ্য, একথা তিনি স্বীকার করেন নি।

ঘটনাটি এরকম। লে. কর্নেল ওসমানী ছিলেন তার সিনিয়র ও ডিডিএমও। ফরমান তার কাছে চার্জ বুঝে নিতে গেলে দেখেন যে, ওসমানীর কাছে কোনাে ফাইলই যেত না। চাপরাশিরাও তাকে অবজ্ঞা করত। তার অফিস ছিল ধূলিপড়া স্নান-বিবর্ণ, অথচ মিলিটারি অপারেশন বিভাগটি গুরুত্বপূর্ণ। ফরমান লিখেছেন, পাকিস্তান বাহিনীতেও তাকে প্রমােশনের যযাগ্য মনে করা হয় নি। হয়ত বাঙালি বলেই তাকে বিশ্বাস করা হতাে না। কথাটি সত্য এবং নিজের অজান্তেই তিনি তা উল্লেখ করেছেন।
১৯৬৭ সালে এখানে এসে তার মনে হয়েছিল, পাকিস্তান ভেঙে যাওয়ার ঝোক দেখা দিচ্ছে। বাংলাদেশের দাবি নিয়ে প্রকাশ্যে আলােচনা চলছে। উর্দু ভাষা ও উর্দু ভাষাভাষীদের প্রতি ঘৃণা উপচে পড়ছে। ছাত্ররা বিক্ষুব্ধ এবং জনগণের ওপর তাদের প্রভাব অত্যন্ত বেশি। হরতালের সময় ছাত্ররা যদি বলত পাখি উড়বে না আকাশে, তাহলে পাখিও তা মেনে চলত। একটি পােস্টারের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি। পােস্টারে ছিল, পাগড়ি পরা বলিষ্ঠ একটি লােক ক্ষুদ্রকায় ধুতি পরা একজনকে আলিঙ্গন করছে, হাতে তার লুকানাে একটি ছুরি অর্থাৎ পশ্চিমপাকিস্তান বিশ্বাসঘাতক। পাঠক এখানে ছােট একটি শব্দ ধুতি’ শব্দটি লক্ষ করুন অর্থাৎ বাঙালিরা হিন্দু অর্থাৎ ভারতের দাস। এর ভিত্তি সেই পূর্ব ধারণা। কারণ এত বছর বাংলাদেশে থেকে ফরমান আলি ধুতি ও লুঙ্গির পার্থক্য বুঝতে পারেন নি, তা কি আশ্চর্য নয়? ফরমান লিখেছেন, ইসলাম ও ভ্রাতৃত্ববােধ নিয়ে যে-পাকিস্তান গঠিত হয়েছিল বােধহয় তার আর অবশিষ্ট ছিল না। তার ভাষায় “It had electrified the entire man of Bhooka Bengali with rage against a distant cousin. West Pakistan for supposedly having snatched away everything from him. History was sought to be falsified and disowned, presumaly in vain as has been testified by the two decades that have passed since Pakistan’s breakup.” এ অনুচ্ছেদের সঙ্গে তার পূর্বের অনেক অনুচ্ছেদের মিল নেই। ওসমানীর ঘটনাটি তাে তিনি নিজেই উল্লেখ করেছেন। এখানে ইতিহাস অতিরঞ্জনের বা মিথ্যা কথনের কোনাে অবকাশ নেই।
এরপর কিন্তু তিনি আবার পূর্ব ও পশ্চিমপাকিস্তানের বৈষম্যের কথা উল্লেখ করেছেন। বৈষম্য থাকলেই অসন্তোষ থাকবে, এ তাে স্বাভাবিক। কিন্তু সেই স্বাভাবিক সত্য তিনি উল্লেখ করেন নি। তারপর জানাচ্ছেন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কথা যা তাঁর ভাষায় সত্য ছিল। এ-মামলা করার সময় তিনি আসামির তালিকা থেকে শেখ মুজিবের নাম বাদ দিতে বলেছিলেন, কিন্তু গােয়েন্দাপ্রধান মেজর জেনারেল আকবর মুজিবের নাম অন্তর্ভুক্ত করে বলেছিলেন, এর ফলে “লােকে তার চামড়া তুলে নেবে।” না, তার ভবিষ্যদ্বাণী ঠিক হয় নি, বরং ইতিহাস উল্টোটা বলে। আগরতলা মামলা যে ঠিক ছিল তা প্রমাণে তিনি লেখক মােয়াজ্জেম হােসেনের স্ত্রীর একটি চিঠির উদ্ধৃতি দিয়েছেন ১৯৭২ সালের ২৬
৯৫

মার্চের ‘পূর্বদেশ’ থেকে। চিঠিটি আমি দেখি নি তবে ফরমান আলির ইংরেজি উদ্ধৃতি থেকে অনুবাদটি এরকম। “প্রিয় স্বামী…তুমি আজ আমার সঙ্গে নেই। বাংলাদেশের স্বাধীনতায় তােমার অবদানের কথা মনে পড়ছে। মনে পড়ছে, কিভাবে ছদ্মনামে করাচি থেকে ঢাকায় এসে আগরতলা সীমান্তে ভারতীয় ও বাঙালি অফিসারদের নিয়ে তুমি দেখা করেছিলে ভারতীয় দূতাবাসের প্রথম সচিব পি.এন. ওঝার সঙ্গে। অস্ত্র ও অন্যান্য সাহায্যের জন্য তুমি ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ করেছিলে…।” তিনি দেখাতে চেয়েছেন, ভারত কতিপয় বাঙালির সাহায্যে অনেকদিন থেকেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছিল। অবশ্য, শেখ মুজিবের সম্পৃক্ততা সম্পর্কে তিনি কোনাে প্রমাণ দাখিল করতে পারেন নি। “এই সময়ই ভুট্টোর সঙ্গে ইয়াহিয়ার সম্পর্ক গড়ে ওঠে।” এ উক্তি থেকে ধরে নিতে পারি ১৯৭১ সালের পটভূমিকা তখন থেকেই সৃষ্টি হচ্ছিল।
ফরমান আলির বইয়ের দ্বিতীয় অধ্যায় ১৯৭০ সালের নির্বাচন। এখানে তার একটি উক্তি মনে রাখার মতাে। কিভাবে নির্বিকারে মিথ্যাকে যুক্ত করতে হয় ন্যারেটিভের সঙ্গে তার একটি প্রমাণ ১৯৭০ সালের নির্বাচন সম্পর্কে তার কয়েকটি উক্তি। তিনি লিখেছেন, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রচুর টাকা খরচ করেছে এবং সে-টাকা এসেছে ভারত থেকে। ১৯৭০-এ আমরা যারা ছিলাম। বাংলাদেশে তাদের কি তা মনে হয়েছে? এসব উক্তির কারণ, এ-সিদ্ধান্তে পাঠককে নিয়ে যাওয়া যে, ১৯৭১ সালের পুরাে ব্যাপারটা ছিল ভারতীয় ষড়যন্ত্র ও হস্তক্ষেপের ব্যাপার। সেই পূর্ব ধারণা! তিনি আরাে লিখেছেন, এ-সময় ইয়াহিয়ার সঙ্গে মুজিবের ভালাে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। কারণ শেখ সাহেব ইয়াহিয়াকে বলেছিলেন প্রেসিডেন্ট করবেন।
এ-প্রসঙ্গে অজান্তে রাও কিছু তথ্য দিয়েছেন যা থেকে বােঝা যায় সামরিক বাহিনী গােপনে কিভাবে রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করছে এবং তা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। নির্বাচনে সেনাবাহিনী ডানপন্থি দলগুলােকে অর্থ দিয়ে সাহায্যে করেছিল। পরে শেখ মুজিব তা জানতে পেরে অনুযােগ করায় রাও বলেছিলেন, পার্লামেন্টে ডানপন্থি কিছু সদস্য গেলে র্যাডিক্যালদের হাত থেকে মুজিব মুক্তি পাবেন। তারপর বলছেন, পূর্বপাকিস্তানীরা শেষপর্যন্ত পাকিস্তানের প্রতি অনুগত ছিল। তাদের নেতারাই তাদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে আর পশ্চিমপাকিস্তানের নেতারা তাদের ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। রাও আগে যেসব মন্তব্য করেছেন, এ-মন্তব্য তার বিপরীত। তবে কেন এ-পর্যায়ে তিনি এই উক্তি করেছেন তা বােঝা যায়। কারণ এরপর থেকে তিনি রাজনৈতিক নেতাদের খালি দোষারােপ করেছেন।
তিনি বলছেন, রাজনীতিবিদরা সবসময় দু’মুখাে নীতি গ্রহণ করেছিলেন। যেমন, মওলানা ভাসানী ও ইয়াহিয়ার সঙ্গে একটি বৈঠকের সময় তিনি উপস্থিত ছিলেন। ভাসানীর আন্দোলনের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করায় মওলানা বলেছিলেন, “আপনি গদিতে বসে আছেন, বসে থাকুন। আমরা আন্দোলনকারী, আন্দোলন।

করেই যাব। আপনার গদিতে আপনি থাকুন।” পূর্বপাকিস্তানের ছাত্রদের কথা উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, রাজনৈতিক আন্দোলনে তাদের প্রভাব সম্পর্কে। পশ্চিমপাকিস্তানীদের কোনাে ধারণাই নেই। তারপর অবশ্য একটি সত্য মন্তব্য। করেছেন। তার ভাষায় “The Army had been ruling over East Pakistan for a long time. All political leaders wanted to get rid of them. and probably rightly so. Army has no right to rule. They may come in to restore law and order but they should handover power to the civilian authority as soon as possible.”
১৪ নির্বাচন চুকেবুকে গেল। আওয়ামী লীগের অফিসিয়াল স্ট্যান্স” ছিল। শাসনতান্ত্রিক। শুধু তাই নয়, ছয় দফার ক্ষেত্রে মুজিব নমনীয় হতেও রাজি। ছিলেন। কিন্তু ভুট্টো নমনীয়তা দেখাতে রাজি হন নি, বরং ইয়াহিয়ার মনকে তিনি বিষিয়ে তুলেছিলেন। ১৭ জানুয়ারি ইয়াহিয়া ভুট্টোর আমন্ত্রণে লারকানায় যান। ভুট্টো বলেছিলেন, জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বাতিল করে ইয়াহিয়ার উচিত। মুজিবের আনুগত্য পরীক্ষা করা। যদি এই স্থগিতকরণের বিরুদ্ধে তিনি আন্দোলন করেন তাহলে বুঝতে হবে তিনি পাকিস্তানের প্রতি অনুগত নন। ভুট্টো কি ছিলেন। এ উক্তি তা প্রমাণ। ১৯ ফেব্রুয়ারি ফরমান ইয়াহিয়ার সঙ্গে দেখা করেছিলেন। এসময় ইয়াহিয়ার সঙ্গে তার কথােপকথনের বিবরণ দিয়েছেন। ইয়াহিয়া বলেছিলেন : “I am going to sort out that Bastard.” I said, “Sir, he is no longer a bastard. He is an elected representative of the people and he represent whole of Pakistan. I recommend that you handover power to Mujib. I assure that he will be the most unpopular man in East Pakistan within six months.”
যিনি রাজনীতিবিদদের সমালােচনায় মুখর তিনি মুজিবের পক্ষে ওকালতি করবেন। ভাবতেই অবাক লাগে! এ-মন্তব্যের সত্যতা যাচাইয়ের উপায় নেই। এমনও হতে পারে, রাও এ-মন্তব্যে দেখাতে চেয়েছেন তিনি ছিলেন শাসনতান্ত্রিক। শাসনের পক্ষে।
অন্যদিকে, ফরমান লিখেছেন, জেনারেলরা ভুট্টোকে চাপের মুখে রাখছিল যাতে মুজিব ক্ষমতায় যেতে না পারেন। ভুট্টোর সঙ্গে অনেকদিন ধরে জেনারেলদের সখ্য ছিল। উপযুক্ত এই দুই উক্তিতে ফরমান এই ইঙ্গিতই করতে চেয়েছেন যে, তিনি অন্য জেনারেলদের মতাে রক্তপিপাসু নন। তিনি আলাদা! এভাবে তিনি পাঠককে তৈরি করতে থাকেন যাতে বাংলাদেশের গণহত্যার সঙ্গে তার যােগাযােগের কথা। বিশ্বাসযােগ্য না হয়। “That Punjabi Army circle put pressure on Bhutto to

ensure that power does not go to Mujib is quite plausable and significant by itself. It does not have to be Farman Ali’s defence.” ২৩ ফেব্রুয়ারি ইসলামাবাদে বৈঠক হয়েছিল এম,এল,এ.দের। এডমিরাল আহসান, লে.জেনারেল ইয়াকুব ও মে. জেনারেল ফরমান একমত হয়েছিলেন যে, জাতীয় পরিষদের অধিবেশন না হওয়ার অর্থ সামরিক হস্তক্ষেপ অর্থাৎ তা হলে বিশৃঙ্খলা হবে এবং ভারতীয় সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপ করবে এ-বিষয়ে একমত হয়ে তারা ইয়াহিয়াকে লিখেছিলেন। ঢাকায় ফিরে আহসান আওয়ামী নেতৃবৃন্দকে ডেকে জানালেন যে, ১ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করা হয়েছে।
তিনি তাজউদ্দিন ও মুজিবের কিছু মন্তব্যের উল্লেখ করেছেন। লক্ষণীয় যে, তিনি তাজউদ্দিনকে অপছন্দ করতেন, তার আরাে উদাহরণ দেয়া যাবে। এ-ক্রোধের কারণ, তাজউদ্দিন মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়ে তা সফল করেছিলেন। অন্যদিকে তিনি মুজিবকে সবসময় নমনীয় দেখাতে চেয়েছেন। এটিই তুলে ধরতে চেয়েছেন যে মুজিব যদি র্যাডিক্যালদের থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারতেন তা’হলে ১৯৭১ হতাে না। কিন্তু কিছু বিষয় যে অনিবার্য হয়ে উঠেছিল তা ফরমানের মাথায় আসে নি। ইতিহাসের অনিবার্য স্রোতে অনেক সময় ব্যক্তি তুচ্ছ হয়ে যায়।
আহসান, ইয়াকুব ও ফরমান জাতীয় পরিষদ স্থগিতের ঘােষণা শুনে। ইসলামাবাদে জেনারেল হামিদের সঙ্গে যােগাযােগ করলেন এবং তাকে অনুরােধ জানালেন নতুন তারিখ ঘােষণার জন্য। সিদ্দিক সালেক লিখেছেন, এ-ঘােষণার পরও মুজিব শান্ত ছিলেন এবং বলেছিলেন, “এ-নিয়ে আমি কোনাে ঘটনা সৃষ্টি করব না যদি আমাকে নতুন কোনাে তারিখ দেওয়া হয়। যদি নতুন তারিখটি সামনের মাসে (মার্চ) হয়, আমি পরিস্থিতি সামলাতে পারব। এপ্রিল হলে কষ্টকর হবে। কিন্তু স্থগিতকরণটি যদি অনির্দিষ্টকালের জন্য হয় তাহলে পরিস্থিতি সামলানাে আমার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়বে।” মুজিব বাস্তব অবস্থা অনুধাবন করেছিলেন। ইসলামাবাদ থেকে কোনাে উত্তর এল না। ফরমান এ-প্রসঙ্গে ঠিকই লিখেছেন, ১ তারিখ পরিষদের অধিবেশন স্থগিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বলা যেতে পারে পাকিস্তান ভেঙে গেল। এরই মাঝে নাটকীয়ভাবে গভর্নর আহসানকে ক্ষমতাচ্যুত করা হলাে। ঐদিন আহসান ইয়াকুব ও ফরমান বসে আলাপ করছেন। এমন সময় পিরজাদার ফোন। আহসান ফোন ধরলেন। কিন্তু পিরজাদা চাইলেন ইয়াকুবকে। আহসান ইয়াকুবকে ফোন দিলেন। কিছুক্ষণ পরে ফোন রেখে ইয়াকুব বললেন, “এখন আমিই গভর্নর।” আহসান বললেন, “ঠিক আছে, আমি গভর্নর হাউস ছেড়ে দিচ্ছি।” ইয়াকুব কিছুই বললেন না। ফরমানের কাছে বিষয়টি ভালাে লাগে নি। কারণ ইয়াকুব আহসানকে কোনাে সমবেদনা জানান নি। ছয় তারিখ আহসান যখন চলে। যান তখন তাঁর স্টাফদের চোখে ছিল পানি।

এরপর বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে লুটপাট শুরু হলাে, লিখেছেন ফরমান। এবং এক্ষেত্রে ফরমান বিষয়টি অতিরঞ্জিত করে বর্ণনা করেছেন অন্যান্য পাকিস্তানীর মতাে। লিখেছেন তিনি, “The act of kidnapping and raping of non-local young girls and throwing of children into burning house were never heard of in Pakistan since its inception. But this is what was actually happening.”
পাঠক, এ ধরনের কোনাে ঘটনা কি ঘটেছিল? কিন্তু ফরমান কেন অতিরঞ্জন করেছেন? কারণ এভাবে তিনি পাকিস্তানী বাহিনীর নৃশংসতার যৌক্তিকতা খুঁজেছেন অর্থাৎ এসব কারণে পাকিস্তান সরকার ও সেনাবাহিনী ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছিল এবং ২৫ মার্চ হস্তক্ষেপ করা ছাড়া কোনাে উপায় ছিল না।
আহসান চলে যাওয়ার পর ইয়াকুবের বাসায় একদিন রাতে খেতে গেছেন ফরমান। জেনারেল খাদিমও ছিলেন সেখানে। এ-সময় পিরজাদার ফোন। তিনি জানালেন, প্রেসিডেন্ট ঢাকায় আসতে পারবেন না। ইয়াকুব বললেন, তাহলে যেন তার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা হয়। ফরমান ও খাদিমও বললেন ইয়াকুবকে, এ-সঙ্গে যেন তাদের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা হয়।
জেনারেল খাদিম ও ফরমান আলির এরপর পাকিস্তান যাবার কথা। ফরমান ভাবলেন, যাবার আগে মুজিবের সঙ্গে যােগাযাগ করে যাবেন যাতে তার সর্বশেষ অবস্থান জানা যায়। মুজিবের সঙ্গে দেখা করে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “পাকিস্তানকে কি বাঁচানাে সম্ভব?” মুজিব বললেন, “সম্ভব, যদি আমার কথা শােনা হয়। আমরা এখনও আলােচনায় প্রস্তুত।” এমন সময় পর্দার ওপাশ থেকে যেন কে সরে গেলেন! তাজউদ্দিন! মুজিব তাঁকে ডাকলেন। ফরমান তাকে একই প্রশ্ন করলেন। তাজউদ্দিন বললেন, দেশজুড়ে যে-বর্বরতা চলছে তার কারণ ভুট্টো। তার সঙ্গে বসা যাবে না। পাকিস্তান বাঁচানাে সম্ভব যদি দুটি পরিষদ হয়। দু’টি পরিষদ আলাদাভাবে নিজেদের শাসনতন্ত্র রচনা করবে। তারপর একসঙ্গে মিলিত হয়ে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র রচনা করবে। ফরমানের ভাষায়, এককথায় কনফেডারেশন। এরপর তাজউদ্দিন সম্পর্কে তার মন্তব্য “Tajuddin, the die-hard Pro-Indian Awami Leaguer, came in and sat down. He hated West Pakistan and perhaps Pakistan itself. He was reputed to have been a Hindu up to the age of 8. I do not think this story was correct but it revealed his mental make-up.” কেন এ-ধরনের মন্তব্য তা আগেই উল্লেখ করেছি।
অন্যদিকে, এর বিপরীতে হত্যাকারী জেনারেল টিক্কা সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য CN, “He was a straightforward, honest and obedient soldier, a man with determination and a strong will.” ৭ মার্চ থেকে এখানে অদৃশ্য সরকার চালু হলাে। ১৫ তারিখ ইয়াহিয়া এলেন।
ঢাকায়। ফরমানের আলােচনায় ইয়াহিয়া এমন একটি মন্তব্য করেছিলেন তা ফরমানকে চমকিত করেছিল। ইয়াহিয়া বলেছিলেন, যেখানে জাতির পিতাই [জিন্নাহ দু’টি পাকিস্তানের ব্যাপারে আপত্তি ছিল না সেখানে এই আইডিয়ার বিরুদ্ধাচারণ করার তিনি কে?
২১ তারিখ ঢাকায় আলােচনা শুরু হলাে। মুজিব একবারও সরাসরি ভুট্টোর সঙ্গে কথা বলেন নি। ইয়াহিয়ার মাধ্যমেই কথাবার্তা চলেছে।
১৫ ২৫ তারিখের অপারেশন সার্চলাইটের ব্যাপারে জেনরেল খাদিম ও জেনারেল ফরমান ইচ্ছুক ছিলেন না। এ-কথা ফরমান যেমন লিখেছেন, অন্য জেনারেলরাও তা উল্লেখ করেছেন। সালিকও লিখেছেন, “এ-দু’জনের ব্যাপারে সদর দফতরের আস্থা ছিল না।” জেনারেল হামিদ দু’জনের স্ত্রীর সঙ্গে আলাদা আলাদাভাবে কথা বলেন। পরে দুজনেই জানান তারা আদেশ পালন করবেন।
অন্যদিকে অপারেশন সার্চলাইট সম্বন্ধে তদানিন্তন সিভিল সার্ভেন্ট হাসান জহির তার The Separation of East Pakistan বইতে বলেছেন “Major General Farman Ali was the executor of Dhaka part of ‘Searchlight. He succeeded in ‘shock action’ by concentrated and indiscremenation firing on target areas ” অর্থাৎ মেজর জেনারেল ফরমান আলি ছিলেন অপারেশন সার্চলাইট অর্থাৎ পঁচিশে মার্চে ঢাকা অংশের কালােরাতের বিভীষিকার হােতা। কিন্তু ২৫ মার্চের রাত সম্পর্কে ফরমান যখন বর্ণনা দেন তখন তিনি অন্যান্য। পাকিস্তানী জেনারেলের মতােই সত্য গােপন করেন এবং এমন ভাষ্য তৈরি করেন যা পাকিস্তানীদের বিবেক শান্ত করতে পারে কিন্তু আমাদের নয়।
লিখেছেন তিনি, কথা ছিল শুধু নেতাদের ধরা হবে এবং কোনাে রক্তপাত হবে। কিন্তু এ-নির্দেশও ছিল, ইয়াহিয়া করাচি না পৌছা পর্যন্ত যেন অপারেশন শুরু করা না হয়। কারণ তাদের ধারণা ছিল তাহলে ভারতীয় জঙ্গিবিমান প্রেসিডেন্টের প্লেন আটকে দিতে পারে। প্রেসিডেন্ট পালালেন। জেনারেলরা ভাবলেন, কেউ জানল না, কিন্তু ফরমান জানাচ্ছেন, বিমানবন্দর থেকে উইং কমান্ডার খােন্দকার পালিয়ে যাওয়া দেখেন এবং সঙ্গে সঙ্গে মুজিবকে তা জানিয়ে দেন। সালিকও তাই। লিখেছেন। তাঁরা বলতে চাচ্ছেন, এভাবে আওয়ামী লীগ সতর্ক হয়ে যায় এবং প্রস্তুতি নেয়।
ফরমান জানাচ্ছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আক্রমণ করলে সবচেয়ে বেশি। প্রতিরােধ এসেছিল জগন্নাথ হল থেকে। কারণ সেখানে হিন্দুরা থাকত এবং তারা ছিল পাকিস্তানবিদ্বেষী। তাহলে প্রশ্ন, মুসলমান ছাত্ররা কি পাকিস্তানীদের পক্ষে ছিল? কেউ-কেউ বলেন, লিখেছেন ফরমান, যে সৈন্যদের হাতে ছাত্ররা নিহত হয়েছে। কিন্তু এ-প্রশ্নও করা উচিত, লিখেছেন তিনি : “When does a student
১০০

cease to be a student? The answer that a student ceases to be student when he carries arms should clear the Army of the charge; all those who were killed were carrying arms, had refused to stop firing and accept order to surrender.”
পাকিস্তানী সব জেনারেলই ২৫ মার্চ এভাবে দেখেছেন। জেনারেল আরিফ তাে। ২৫ মার্চের কথাই উল্লেখ করেন নি। তিনি লিখেছেন, ২৫-২৬ মার্চ আওয়ামী লীগ ও তার সহযােগীরা পূর্বপাকিস্তানের সেনানিবাসগুলােতে যেসব পশ্চিমপাকিস্তানী ছিল। তাদের পরিবারপরিজনসহ ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করেছিল। চাটগাঁয় ২৫ মার্চ থেকে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত হাজার হাজার পশ্চিমপাকিস্তানী ও বিহারিদের হত্যা করা হয়। এ-কারণে সৈন্যদের মধ্যে আবেগের সৃষ্টি হয় এবং যখন স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনার জন্য সেনাবাহিনী নিয়ােগ করা হয় তখন দুষ্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে ‘বেশি বল। প্রয়ােগকারী’ কিছু রিপাের্ট পাওয়া গেছে। ফরমান আলিও গণহত্যার পক্ষে এ-ধরনের ওকালতি করেছেন। জানিয়েছেন, গৃহযুদ্ধের সময় দু’পক্ষই জন্তু হয়ে যায়। গৃহযুদ্ধ’ শব্দটি তিনি ব্যবহার করেছেন যা অনেকে করেন নি। আবার এও লিখেছেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনী জাতীয় সেনাবাহিনীর মতাে আচরণ করতে পারে নি। কেন পারে নি তার একটি যুক্তিও অবশ্য তিনি দাঁড় করিয়েছেন। “Some of its members exceeded their authority and killed a number of civil and police officials without proper trial. The Army was not able to control Biharis in taking revenge when badly affected areas were liberated by them.”
রাও ফরমান আলি তারপর একটি অধ্যায় ব্যয় করেছেন ভারতীয় কারসাজির। ব্যাপারে। এ-বিষয়ে জেনারেলরা একমত ছিলেন যে, পাকিস্তান ভাঙার চক্রান্ত ভারত ১৯৪৭ সাল থেকেই করছে এবং এই যে মুক্তিযুদ্ধ চলছে তাও ভারতীয় চক্রান্ত। এই ইস্যুশন থেকে পাক-জেনারেলরা কখনও মুক্ত হতে পারেন নি।
ফরমান আলিকে ‘পূর্বপাকিস্তান’-এর সিভিলিয়ান কাজ-কর্ম দেখার দায়িত্ব। দেয়া হয়েছিল। তিনি লিখেছেন, সবসময় তিনি রাজনৈতিক সমাধানের পক্ষে ছিলেন। শান্তি কমিটি গঠনের উদ্যোগ তিনিই গ্রহণ করেন। এজন্য নূরুল আমীন, গােলাম আযম, ফরিদ আহমদ প্রমুখকে ডেকে পাঠালেন। তাঁদের সম্পর্কে ফরমান আলির মন্তব্য— খাটি অনুগত পাকিস্তানী। এঁদের দিয়ে বাঙালিদের তিনি জয় করতে চাচ্ছিলেন। অনেক সেনা অফিসারও তাই চেয়েছিলেন। শুধু তারা বুঝতে পারেন নি যে, কাজটি অসম্ভব। ফরমান লিখেছেন, কাজটি সব হতাে যদি না জেনারেল নিয়াজি অন্যরকম চাইতেন। নিয়াজি “Wanted to change the racial character.” নিয়াজির সঙ্গে ফরমানের বনাবনি হয় নি কখনও। ঐ সময় ফরমান লিখেছেন, বাঙালি, পশ্চিম পাকিস্তানী, বিহারি সবাই নাস্তানাবুদ হচ্ছিল তার।

কাছে— এই তিন পর্যায়েই ছিল পাকিস্তানী। যেমন কুমিল্লার ডিসির স্ত্রী এলেন তার সঙ্গে দেখা করতে। পশ্চিমপাকিস্তানীরা (অর্থাৎ সৈন্যরা) তাঁর স্বামীকে হত্যা করেছে। তাঁর ভাই ছিল সঙ্গে এবং তার বউ পশ্চিমপাকিস্তানী। বউয়ের আত্মীয়-স্বজনকে আবার চাটগার বাঙালিরা মেরে ফেলেছে।
“জোড় হাতে কাঁপতে কাঁপতে” টাঙ্গাইলের ডি.সি, এলেন দেখা করতে। পশ্চিমপাকিস্তানী একজন সহকারী কমিশনারকে হত্যার পিছনে তার হাত ছিল। ফরমান তাকে আবার কাজে পাঠালেন এবং তারপর তিনি সম্পূর্ণ সহযােগিতা করেছেন।” ফরিদপুর, পটুয়াখালীর ডি.সি-কে সেনাবাহিনী গ্রেফতার করল। ফরমান তাদের ছেড়ে দিতে বললেন। তারা শুনল না। তিনি গভর্নর টিক্কাকে হস্তক্ষেপ করতে বললেন। ফরমান যেটা বলতে চেয়েছিলেন তা হলাে— পূর্বপাকিস্তানে যা চলছিল তা তার পছন্দ ছিল না। তার পক্ষে যতটুকু করা সম্ভব। তিনি করছিলেন। কারণ তার “heart was bleeding.” কিন্তু নিয়াজির জন্য কিছু করা সম্ভব ছিল না। জেনারেলদের এই পছন্দ-অপছন্দ পরে পাকিস্তানী রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলেছে। ভুট্টোর সময় টিক্কা ও ফরমান উচ্চপদ পেয়েছিলেন। নিয়াজি নাজেহাল হয়েছিলেন। সুতরাং ফরমানের বই পড়ার সময় এটি মনে রাখা উচিত। নিয়াজি সম্পর্কে ফরমান লিখেছেন, তিনি নিজেকে সর্বেসর্বা মনে করতেন। বাঙালিদের তিনি জনগণের শত্রু বলে ঘােষণা করেছিলেন। অন্যদিকে টিক্কা ভালাে প্রশাসক ছিলেন বটে, কিন্তু রাজনীতিবিদ ছিলেন না। এ-সময় জে, হামিদ এলেন ঢাকায়। রাও অনুরােধ জানালেন তাকে যেন পশ্চিমপাকিস্তানে বদলি করা হয়। জে, হামিদ তা শুনলেন না, বরং তাকে মেজর জেনারেল করে রাজনৈতিক বিষয়ের। ভার দেয়া হলাে। ফরমানের মনে হয়েছে, মার্চের শুরুতে সেনাবাহিনীর পরিকল্পনা। সমর্থন না করায় তাকে এ-ধরনের শাস্তি দেয়া হলাে। অন্যদিকে নিয়াজি যা-তা ব্যবহার করছিলেন, গুজব রটেছিল যে, তিনি মেয়েমানুষ নিয়েই থাকতে ভালােবাসতেন। ঐ সময় পাকিস্তান এখানে আওয়ামী লীগের খালি আসনগুলােতে উপনির্বাচনের উদ্যোগ নেয়। এই নির্বাচন সেনাবাহিনীই করেছিল, এককথায় কে কতটা আসন পাবে তাও তারা ঠিক করে দিয়েছিল। সিদ্দিক সালেকও এই কথা উল্লেখ করেছেন। ডানপন্থি দলগুলাে যেহেতু পাকিস্তানী বাহিনীকে সাহায্য করেছিল তাই তাদেরকে তিনি পুরস্কৃত করতে চাইছিলেন। আসন ছিল স্বল্প, কিন্তু আকাক্সক্ষীদের সংখ্যা ছিল প্রচুর।”
কিন্তু নির্বাচনেও সংকট মােচন হয় নি। কারণ প্রতিটি পর্যায়ই বিপক্ষে চলে যাচ্ছিল, উল্লেখ করেছেন ফরমান আলি। একবার তিনি টিক্কা খান ও যােগাযােগ সচিব-এর সঙ্গে আলাপ করছিলেন ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে কিভাবে খাদ্যশস্য পাঠানাে যেতে পারে সে-বিষয়ে। তারা ঠিক করেছিলেন রেলে করে চাঁদপুর দিয়ে পাঠাবেন। দু’দিন পর দেখা গেল চাঁদপুরে রেললাইন উপড়ে ফেলা হয়েছে অর্থাৎ এ-তথ্যটি
যােগাযােগ সচিব পাচার করেছিলেন মুক্তিযােদ্ধাদের। অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানে বসে প্রেসিডেন্ট বা জেনারেলরা হােড়াই কেয়ার করছিলেন পূর্বপাকিস্তানের ব্যাপার। ফরমান ঠিকই লিখেছেন, “The power to be of the future had already written off East Pakistan and were only planning for West Pakistan.”
১৭ এর পরের অধ্যায়গুলােতে ফরমান মুক্তিযুদ্ধের বর্ণনা, পাকিস্তানীদের ভয় ও হতাশার কথা বিস্তারিতভাবে লিখেছেন। এখানে তার পুনরুল্লেখ করলাম না।
জেনারেল ফরমান লিখেছেন, আত্মসমর্পণে বিশেষ করে মুক্তিবাহিনীর কাছে তিনি রাজি ছিলেন না, নিয়াজিকেও তিনি তাই বলেছিলেন। কিন্তু নিয়াজি আত্মসর্মণের দলিলে সই করলেন। অবশ্য, নিয়াজি উল্টো কথা বলেছেন।
যুদ্ধবন্দি হিসেবে তারপর যাত্রা। কলকাতায় পৌঁছার পর অ্যাডমিরাল শরিফ নিয়াজিকে বলেছিলেন, “তুমি-না কলকাতায় আসতে চেয়েছিলে? এখন পৌছে গেছ কলকাতায়।” নিয়াজি প্রায়-ই বড়াই করে বলতেন, সেনাবাহিনী নিয়ে তিনি পৌছে যাবেন কলকাতায়। আগেই উল্লেখ করেছি, জেনারেল ফরমান কিছু সত্য, কিছু অর্ধসত্য ও কিছু মিথ্যা মিলিয়ে বইটি রচনা করেছেন। কারণ তাঁর অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল এ-কথা বলা যে, পূর্বপাকিস্তানে যে-হত্যাকাণ্ড চালানাে হয়েছে তার সঙ্গে তার যােগ নেই। কারণ তিনি যুক্ত ছিলেন বেসামরিক কর্মের সঙ্গে, বরং তিনি সিভিলিয়ানদের বাঁচাতে চেয়েছিলেন যেমন, লিখেছেন, মশিউর রহমান, আতাউর রহমান খান প্রমুখকে তিনি রক্ষা করেছেন। হয়ত এ-কারণেই তারা সামরিক শাসকদের ভক্ত ছিলেন। সাঈদুল হাসানকে হত্যার পর হত্যাকারীকে খুঁজে বের করতে বলেছিলেন এবং বাঙালির প্রতি তার এই সহানুভূতি নাকি জান্তা পছন্দ করে নি।
১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যার সঙ্গে ফরমান জড়িত ছিলেন বলে অভিযােগ করা হয়। এ-প্রসঙ্গে আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, উত্তরে তিনি বললেন, “আমার বইতে আমি ও-প্রসঙ্গে লিখেছি। কাজী জাফর সেই সময় তার এক বক্তৃতায় (১৯৭১ সালের ঠিক আগে) বলেছিলেন, বাংলাদেশের সবুজ লাল হয়ে যাবে। তিনি বােঝাতে চেয়েছিলেন লাল ঝান্ডার প্রভাব পড়বে। তার বক্তৃতায় এই লাইনটিই আমি লিখে রেখেছিলাম। সেই লাইনের মানে এই করা হয়েছে। মুজিবকেও এ-কথা বলা হয়েছিল। তিনি বিশ্বাস করেন নি।”
কিন্তু ঢাকার পতনের পর বললাম আমি, “গভর্নমেন্ট হাউসে আপনার হাতে লেখা একটি তালিকা পাওয়া গেছে বুদ্ধিজীবীদের।”
“ঐ সময় অনেকে আমার কাছে এসে নানা জনের কথা বলত। যাদের বিরুদ্ধে বলত তাদের নাম আমি শুধু টুকে রেখেছিলাম।”
হামুদুর রহমান কমিশনও এই অভিযােগ বিচার করেছিলেন। ফরমানকে
সবাই এই দায় থেকে মুক্তি দিয়েছে। সেটা স্বাভাবিক। কারণ ফরমান দায়ী হলে যুদ্ধটাকেই স্বীকার করে নেয়া হয়। বরং তিনি লিখেছেন, “আমার আশংকা, পূর্ববর্তী আদেশকে বাতিল করে সম্ভবত নতুন আদেশ আর জারি করা হয় নি এবং কিছু লােককে গ্রেফতার করা হয়েছিল। আমি আজও পর্যন্ত জানি না যে, কোথায় রাখা হয়েছিল। সম্ভবত তাদেরকে এমন কোথাও বন্দি করা হয়েছিল, যার প্রহরায় ছিল মুজাহিদরা। আত্মসমর্পণের পর ঢাকা গ্যারিসনের কমান্ডাররা তাদের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিল এবং তারা মুক্তিবাহিনীর ভয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। কারণ মুক্তিবাহিনী নির্দয়ভাবে মুজাহিদদের হত্যা করছিল। পাকিস্তান আর্মিকে দুর্নাম দেয়ার উদ্দেশ্যে মুক্তিবাহিনী কিংবা ইন্ডিয়ান আর্মিও বন্দি ব্যক্তিদের হত্যা করে থাকতে পারে। ভারতীয়রা ইতােমধ্যেই ঢাকা দখল করে নিয়েছিল।” [“They could have been killed by any body except the Pakistan army as it had already surrendered on 16th December.”)
অর্থাৎ তিনি তাে ননই, পাকিস্তান হানাদারবাহিনীও নয় , বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিল মুক্তিবাহিনী অথবা ভারতীয় বাহিনী। এ যে কত বড় মিথ্যাচার তা বলাই বাহুল্য। তিনি কি ভুলে গেছেন বুদ্ধিজীবীদের শুধু ১৪ ডিসেম্বর নয়, এর আগে থেকে হত্যা করা হচ্ছিল?
গণহত্যার বিষয়েও আমি প্রশ্ন রেখেছিলাম ফরমান আলির কাছে। গণহত্যা’ শব্দটিতে তিনি আপত্তি জানালেন। বললেন, “গণহত্যা হয় নি।”
“মানুষ মারা গিয়েছিল?” জিজ্ঞেস করি আমি। “তা গিয়েছিল।” “কত, বিশ, ত্রিশ, পঞ্চাশ হাজার?” “পঞ্চাশ হাজার হবে হয়ত।” বলেই বুঝলেন তিনি ভুল করে ফেলেছেন। “জেনারেল, পঞ্চাশ হাজার লােককে হত্যা আপনার কাছে গণহত্যা নয়?”
তিনি এর উত্তর দেন নি। পরে আমি, আলতাফ গওহর, এয়ার মার্শাল আসগর খানের সঙ্গে এ বিষয়ে আলাপ করেছি। আলতাফ গওহর ইঙ্গিত করেছেন রাও ফরমান আলি বুদ্ধিজীবী হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। আলমদার রাজা উত্তেজিত হয়ে বলেছিলেন, “আপনারা ফরমান আলির সঙ্গে দেখা করেছেন, আপনাদের সঙ্গে তাে কথাই বলা যাবে না।” এয়ার মার্শাল হেসে বলেছেন, “এই সব লােক এখন এ-ধরনের কত কথা বলবে।”
১৮ তাহলে, পুরাে বিষয়টির জন্য কে দায়ী? ফরমানের ভাষায় অবশ্যই, রাজনীতিবিদরা। এ-ধরনের মন্তব্যের সঙ্গে আমরা অপরিচিত নই। গত পঞ্চাশ বছর, অধিকাংশ সময় আমরা দেখেছি জেনারেলরা রাজনীতিবিদদের দোষারােপ করেন। তা না করলে তাদের শাসনের যৌক্তিকতা থাকে না।
তিনি লিখেছেন, “ছয় দফার ওপর ভিত্তি করে প্রচারণা চালাতে গিয়ে মুজিব ও তার দল কিভাবে পশ্চিমপাকিস্তানের বিরুদ্ধে ঘৃণার সৃষ্টি করেছিলেন, কিভাবে পশ্চিমের ভাইদের বিরুদ্ধে বাঙালিদের ভাবাবেগ ও অনুভূতিকে উস্কে দিয়েছিলেন এবং শেষপর্যন্ত কিভাবে সরকারের সকল কার্যক্রম দখল করে নিয়েছিলেন। এটা ছিল এক প্রকাশ্য বিদ্রোহ, যার বিরুদ্ধে আর্মিকে অ্যাকশানে যেতে হয়েছিল, এরপর ঘটেছিল ভারতীয় হস্তক্ষেপ, যার পরিণাম ছিল। আমাদের দেশের ভাঙন।” শুরুতে যে পূর্ব ধারণার কথা বলেছিলাম, অন্তিমে দেখুন সে-ধারণার পরিপ্রেক্ষিতে জেনারেল ফরমান উপসংহার টানছেন অর্থাৎ সবকিছুর জন্য ভারতীয় ও বাঙালি রাজনীতিবিদরা দায়ী। তবে, এ-মন্তব্যকে জোরদার করার জন্য ভুট্টোকেও তিনি খানিকটা দায়ী করেছিলেন। বেশি নয়, কারণ আমাদের মনে রাখতে হবে, যুদ্ধবন্দি হিসেবে পাকিস্তান ফেরার পর ভুট্টোর অধীনে তিনি আবার উচ্চপদ পেয়েছিলেন। আর হ্যা, জেনারেলদের কয়েকজন দায়ী। যেমন নিয়াজি আর জেনারেল। ইয়াহিয়া। তার ভাষায় “ওপরে যা বলা হয়েছে তা সত্ত্বেও ইয়াহিয়ার দায়িত্বকে খাটো করে দেখার উপায় নেই। যা কিছু ঘটেছে তার সব কিছুর জন্যই সম্পূর্ণরূপে তিনি দায়ী ছিলেন শুধু আর্মিকে সমালােচনা ও দোষারােপ করার প্রবণতাটুকু ছাড়া।” সুতরাং, এটা স্পষ্ট যে, পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ও জেনারেলদের পক্ষ সমর্থন করার জন্যই এই বই। তিনি বলেছেন “একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে আর্মিকে সমালােচনা ও দোষারােপ করার অর্থ হলাে আমাদের শক্রর অশুভ উদ্দেশ্যকে সাহায্য
1 [“…the tendency to criticize and blame the army, as an institution, can only help the evil intentions of our enemy.”]
১৯ জেনারেল রাও ফরমান আলির সাক্ষাৎকার প্র: তখন (১৯৭০) সামরিক আইনের প্রশাসন চলছিল, আর আপনি ছিলেন বেসামরিক বিষয়ের দায়িত্বে? উ: বেসামরিক বিষয় অবশ্যই। সচিবালয় থেকে গভর্নর হাউসে আসত এমন সকল নথিই আমার কাছেই প্রথমে আসত। গভর্নর হাউসে দায়িত্ব পালন করতাম আমি। আমার হাত ঘুরে নথি যেত গভর্নরের কাছে। এ-নথি বা ফাইলগুলাে সাধারণত পূর্ণাঙ্গ নথি। তাতে আমার করার কিছু থাকত না। মাঝে মাঝে আমি কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করতাম। আমার পর্যায়ে একজন সাধারণ অফিসার হিসেবে যে জেনারেল ভারপ্রাপ্ত গভর্নর হিসেবে কাজ করছেন তার কাছে এ-রকম কিছু প্রশ্ন তােলার এখতিয়ার ছিল। জিওসি তথা জেনারেলের কাজ ছিল কম্যান্ড দেওয়া, কাজেই বেশ অনেক কিছুর দায়িত্বই আমার ওপর ছিল।
১০৫

প্র: আপনার জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার কাজটি কি আসলে জনগণের নিরাপত্তা ছিল?
উ: ক্ষমতার লীলাখেলার ধারণায় জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার কাজ-কারবার আমি করছিলাম না। আমি এই ধারণা ও অর্থে জাতীয় নিরাপত্তা-সংক্রান্ত কাজ করছিলাম যে, দেশকে এক থাকতে হবে, এর সংহতি রক্ষা করতে হবে। এটিই জাতীয় নিরাপত্তা। এর অর্থ আমি পূর্বপাকিস্তানে নেওয়া প্রতিটি পদক্ষেপ বা ব্যবস্থার রাজনৈতিক দিকগুলির দেখাশােনা করতাম। কথাটা দৃষ্টান্ত দিয়েই বলি। তখনকার দিনে সামরিক আইন জারির আগে বাস্তবিকপক্ষেই ছাত্ররা রাজনীতি নিজেদের হাতে নিয়েছিল। ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের আমলে সকল রাজনৈতিক দল। নিষিদ্ধ ছিল। তাই রাজনৈতিক দলগুলির কার্যকলাপ ছিল না। এ পরিস্থিতির স্বাভাবিক পরিণতি হিসেবে কাউকে না কাউকে দায়িত্ব নিতে হয়। ছাত্ররা রাজনীতি করতে থাকে। আর আমি এ ছাত্রদের বিষয়ে ব্যাপৃত থাকি।
প্র: এই ছাত্রদের ব্যাপার দেখতে গিয়ে মূলত আপনার কর্মসূচি কী ছিল?
উ: কাজটি ছিল ছাত্রদেরকে সপক্ষে নিয়ে এসে তাদের মন জয় করার। এ-কাজটি ছিল ছাত্রসম্প্রদায়ের যত বেশি সংখ্যক সম্ভব সদস্যকে সপক্ষে নিয়ে। আসার, শ্রমিকদের বেলায়ও সেই একই কথা প্রযােজ্য। প্রশাসনকে সঠিক অবস্থায় নিয়ে আসার জন্য আমি প্রচুর সময় ব্যয় করেছি। আমার মতে, এ-অধিকার রয়েছে প্রতিটি প্রশাসনের। অনেক জিনিসকেই ঠিক করে আনা যায়। প্রশাসনের দিক থেকে অনেক কিছু ঠিকঠাক চলে না বলেই হতাশা ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয় আর। সে-জন্য মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়, বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। একই পটভূমিতে দেখা দিয়ে থাকে শ্রম-সমস্যা। এসব সমস্যা দেখা দেয় সামরিক আইন জারি হবার আগে। এ-সমস্যাগুলির সমাধানের দরকার ছিল। সে জন্য আমি ছাত্র ও শ্রমিকদের সাথে আলােচনায় বসে সবকিছু সমাধানের চেষ্টা করি।
প্র; এসব সমস্যার জন্য ঐ সময় কে দায়ী ছিল বলে আপনি মনে করেন?
উ: দেখুন, খুবই জটিল সমস্যা এটি। আপনি যদি শ্রম-সমস্যার কথাই তােলেন, তার সাথে জড়িয়ে আছে জনসংখ্যা সমস্যা। আপনি তাে আর সবাইকে কাজ বা চাকরি দিতে পারেন না। কিন্তু যারা চাকরিতে ইতিমধ্যে ছিল, তাদের স্বার্থই তারা দেখছিল। কাজেই একে বলা চলে একটা দুষ্টচক্র। এটি ভাঙা সম্ভব তখনই যখন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটে। এই প্রক্রিয়ায় শ্রমবিক্ষোভ দেখা দেয়, ছাত্ররাও এতে শামিল হয়। আর যেমনটি আমি বলেছি, ছাত্ররা এসবের পথ ধরে একসময় রাজনীতিতে এসে পড়ে। এভাবেই ছাত্ররা কার্যত গােটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ কজা করে নিয়েছিল। তারা যাচ্ছেতাই করছিল। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের হােস্টেল বা হলে পুলিশকে যেতে দেওয়া হয়। নি। শুধু ছাত্রবাস তাে দূরের কথা বিশ্ববিদ্যালয়েই ঢুকতে দেওয়া হয় নি। ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছাকাছি একটা উঁচু গাছ ছিল। আমরা ওটায় দিনে ৫ বার উঠে।

পর্যবেক্ষণ করতাম। আর তারা যা খুশি তাই করত।
প্র: তাহলে আপনার এই নিয়ােগটি বেশ গুরুত্বপূণই ছিল, মানে আমি এটা বলতে চাইছি, কেননা, আপনি তাে ইয়াহিয়া খানের ঘনিষ্ঠ ছিলেন, তাই না?
উ: সত্যিকার অর্থে ঠিক তা নয়… তিনি আমার সম্পর্কে খুব বেশি জানতেন। কেননা, কখনও আমি মদ্যপান করি নি, মাতাল হই নি। সুরা স্পর্শ করি নি আমি কখনও। না, কখনও আমি ঐ দলভুক্ত ছিলাম না। দ্বিতীয়ত, আমি ছিলাম জুনিয়র পদমর্যাদার লােক। আমার পদোন্নতি ঘটে অত্যন্ত দ্রুত। আমি অন্য ছয়জনের আগে জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি লাভ করি।…
প্র: আপনি মার্শাল ল কালচারেরই লােক! আপনি যদি গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের কথা বলেন, বলেন সংখ্যাগরিষ্ঠের কথা, সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনের কথা তাহলে সেক্ষেত্রে যে জনসমষ্টিকে চিরকালই সংখ্যাগরিষ্ঠ হিসেবে জানেন, তারাই তাে পাবে আইন পরিষদে সর্বোচ্চসংখ্যক আসন… আর তাই– উ: জ্বি হ্যা, এ-কথাটিই আমি শেষপর্যন্ত বলতে চেয়েছি, অন্তত উপলব্ধি করেছি যে, পূর্বপাকিস্তানীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। আমি মনে করি, আমি যখন পূর্বপাকিস্তানে ছিলাম, গােড়ার দিকে এগুলি আদৌ আমার চিন্তায়ই আসে নি। কিন্তু যখন ওখানকার পরিস্থিতি মােকাবিলার কাজ করতে শুরু করলাম তখন আমার গােটা ধারণাই বদলে গেল। এর আগে আমি একজন প্রশাসক মাত্র ছিলাম। নানা বিষয় আসত। আমি সিদ্ধান্ত দিতাম। এরপর যখন পরিস্থিতির ছবি বদলাতে শুরু করল, প্রশাসক হিসেবে প্রত্যক্ষ করলাম যা ঘটে যাচ্ছে যা গােড়াতে আমি বুঝি নি। যেমন, দৃষ্টান্ত হিসেবে বলি, আমার ওখানকার দায়িত্বের গােড়ার দিকে ঢাকা সেনানিবাস এলাকায় ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক অব পাকিস্তানের একটি শাখা খােলা হয়েছিল। আমি তার উদ্বোধন করেছিলাম। আর সে-অনুষ্ঠানে আমি বক্তৃতাও দিয়েছিলাম। ঐ ভাষণের বক্তব্যে আমার মনে হয় আমি বলেছিলাম, পূর্বপাকিস্তানীরা হিন্দুদের দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে। তবে তখন আমার জানা ছিল না, একজন হিন্দু-নেতা সেখানে বসে আছেন।
প্র: আপনার বইতে আপনি—
উ: এমনকি আমি এও পর্যন্ত উপলব্ধি করতে পারি নি যে গােটা সমাজেই তারা মিশে আছে। ঠিক নয়, বরং আমরা এখনও পুরােপুরি বুঝি ও বিশ্বাস করি যে, হিন্দুরা পূর্বপাকিস্তানের মন-মানসিকতাকে প্রভাবিত করেছে।
প্র: আপনার বইয়ে আপনি এও উল্লেখ করেছেন যে, সাধারণ বিশ্বাস এই যে, তাজউদ্দিন আহমদ হিন্দু-চিন্তাধারায় প্রভাবিত ছিলেন। আমার মনে হয় এই জিনিসটি ঐ ধারণারই অংশবিশেষ। আর তাই আপনি ধরে নিয়েছেন, জনাব তাজউদ্দিনের পরিবার ছিল…
উ: না ঠিক তা নয়। তবে তাজউদ্দিন পাকিস্তানবিরােধী ছিলেন। মুজিব তা ছিলেন না। মােশতাক খােন্দকার পাকিস্তানবিরােধী ছিলেন না।

প্র: তার মানে আপনি বলতে চান, তাজউদ্দিন ছিলেন বাংলাদেশবাদী, বাঙালির পক্ষ সমর্থক?
উ: না, এ-ক্ষেত্রে বিষয়টি একটু আলাদা। আপনি বাঙালিবাদী হতে পারেন। প্রত্যেকেরই তাই হওয়া উচিত। যা আলাদা আমি বলেছি তা হলাে তিনি পাকিস্তান। ভাঙতে চেয়েছিলেন। আর সকলে তা চায় নি।
প্র: তাই! এজন্যই আপনি … তাজউদ্দিনের বিরুদ্ধাচারণ করেছেন বইয়ে?
উ: অন্যদের তুলনায় তাজউদ্দিনের বিরুদ্ধে তাই আমার মনােভাব ছিল প্রবল, অন্যেরা সঠিক পক্ষেই ছিল।
প্র: অথচ ‘৪৭-এর এই সেই বাঙালি জনগােষ্ঠী যারা তখনকার পূর্ববঙ্গের অধিবাসী ছিল যাদের মধ্যে আপনি হিন্দুর আধিক্য দেখেছেন, দেখেছেন আমাদের দেশে হিন্দু বেশি এখন এরা যদি হিন্দু-প্রভাবিতই হযে থাকে তাহলে আমি বলব তারা পাকিস্তানের প্রস্তাব করত না।
উ: আসলে এ-নিয়েই আমি শুরু করতে চেয়েছিলাম। আমার বইতেও আমি কিন্তু বলেছি যে, কী ঘটেছিল যার জন্য পূর্ববাংলার শতকরা ৮৫ জন মুসলমান পাকিস্তানের জন্য ভােট দিয়েছিল। যদি তারা এভাবে কাজ না করত কি হতাে? এই পূর্বপাকিস্তানের বাঙালিরাই পাকিস্তান সৃষ্টি করেছে। তাই পাকিস্তানের এই সৃষ্টি পূর্বপাকিস্তানের ওপর পশ্চিমপাকিস্তানের চাপিয়ে দেওয়া কিছু নয়। বরং পাকিস্তানের হেফাজত করার স্বার্থ পূর্বপাকিস্তানের।
প্র: ঠিক তাই। উ: নয় কি? প্র: কেবল যখন তারা…
উ: কেবল যখন তারা ভাবল যে, সম্ভবত পশ্চিমপাকিস্তানীরা তাদের সাথে ন্যায্য আচরণ করছে না, ওরা তাদের প্রাপ্য অধিকারগুলি দিচ্ছে না। এসব বিষয়ে আমি বাঙালিদের পক্ষে। প্রাপ্য অধিকারগুলির জন্য তাদের প্রশ্ন তােলার এখতিয়ার রয়েছে। কিন্তু পাকিস্তান ভাঙার প্রয়াসে আমি তাদের সাথে নেই। আমার ধারণা ও চিন্তায় আমি মনে করি তাদের কাজটা ঠিক হয় নি। এর কারণ, আপনারা বােধ করি জানেন যে, উপমহাদেশে পাকিস্তান আন্দোলনের গােটা কাল-পরিধিজুড়ে পাকিস্তানের প্রয়ােজনীয়তাটুকু পূর্বপাকিস্তানীরাই পশ্চিমপাকিস্তানীদের তুলনায় বেশি উপলব্ধি করেছিল, পাকিস্তান যারা সৃষ্টি করেন সেই পশ্চিমপাকিস্তানের পাকিস্তানীরা করে নি… ভারতের মুসলিমরাও পাকিস্তান আন্দোলনের প্রয়ােজনীয়তা বুঝেছিল।
প্র: আপনি কি মনে করেন না, পাকিস্তানের জন্য অনুভূতির বিষয়টিকে বাঙালিদের ন্যায্য অনুভুতিকে পাশ কাটানাের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে? এর কারণ, দেশের বনেদী শাসকগােষ্ঠীও ছিল সেনাবাহিনীর ভেতরেই যারা পাকিস্তানের ঠিকাদারি নিয়েছিল। তারাই ঠিক করেছিল, পাকিস্তানকে কেমন করে

চালাতে হবে। আর সে-কারণে ক্ষমতার সেই কাঠামাের মধ্যে বাঙালিদের জন্য কোনাে জায়গা ছিল না। আমি একথাই বলতে চাচ্ছি, বাঙালিদের মাঝে শেষ বন্ধনের ধারণা ও জ্ঞানের বিষয়টির কি কোনাে যৌক্তিকতাই ছিল না?
উ: ঠিক, তাদের ঐ ধরনের চিন্তাভাবনা একান্তই সঠিক ছিল। আমি এর পরও বলি, তাদের সে-অধিকার ছিল, তাদের শাসনের অধিকার থাকা উচিত ছিল কিংবা তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলে ক্ষমতা তাদেরকেই দিতে হবে। আমি তখনও এটি মনে করতাম, এখনও করি এ দুটি জিনিসের মধ্যেকার পার্থক্য হলাে আমার মতে এই যে যে-কোনাে অঞ্চলের জনগােষ্ঠীর তাদের নিজ অধিকার চাইবার বৈধতা আছে। তা ন্যায়সম্মত। কিন্তু তারা যে-কাঠামাে (রাষ্ট্রকাঠামাে) নিজেরা তৈরি করেছে তা ভাঙা, পাকিস্তানকে ভেঙে ফেলা সঠিক নয় যদিও ধারণার অমিল হতেই পারে।
প্র: ঠিক।
উ: আমি বলি, পূর্বপাকিস্তানীরা পাকিস্তান ভাঙে নি, ভেঙেছে পশ্চিম পাকিস্তানীরা। তবে আমি মনে করি এর মধ্যেও বাস্তবতা আছে যে, উভয় তরফের ভুলের কারণে পাকিস্তান ভেঙেছে। পূর্বপাকিস্তান কিছু ভুল করছে, পশ্চিম পাকিস্তানীরা ভুল করেছে। আর দেশের কেন্দ্রীয় সরকার এমন কিছু অন্যায় বা ভুল করেছে যা পাকিস্তানের সংহতি ও অখণ্ডতা রক্ষার জন্য ঠিক নয়। আমি নিশ্চয়ই। আপনাদেরকে বিষয়টি খােলসা করে বােঝাতে পেরেছি।
প্র: ৬-দফা সম্পর্কে আপনার মত কী?
উ: কথা ছিল ছয়দফার সংশােধন করে তা নমনীয় করে তুলবেন কেননা, ওটা কোনও কুরআনী কানুন তাে ছিল না। ৬-দফা আর যা-ই হােক বেহেশত থেকে আসে নি। আর এও আমাদের জানা ছিল আওয়ামী লীগের ভেতরেই কিছু লােক ছিল যাদের মধ্যে ছয়দফার বিষয়গুলির ধারণা নিয়ে মতপার্থক্য ছিল। এমন পরিস্থিতিতে মুজিব যদি কম ভােট পেতেন তাহলে তিনি যেভাবে চেয়েছিলেন সেভাকেই সবকিছু করার অপেক্ষাকৃত যুক্তিসঙ্গত সুযােগ পেতেন। কিন্তু কল্পনাতীত সংখ্যাগরিষ্ঠ ভােট পেলেন তিনি। মাত্র দুটি আসনে হারতে হয় তাকে। আর এর পরিণতিতে তিনি ৬-দফার দাবিদারদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েন। কাজেই ছয়দফার প্রশ্নে সর্বাত্মক সমর্থন ঘােষণা ছাড়া তার কোনাে গত্যন্তর রইল
। ৬-দফা চূড়ান্ত ও অপরিবর্তনীয় হয়ে উঠল। ৬-দফা হয়ে গেল মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন— এ-জাতীয় অনিবার্য কিছু। অথচ রাজনীতিতে লেনদেনমূলক আলাপ-আলােচনা চলছিল এমন সময়ে এটি হওয়া উচিত ছিল না। আর যুগপৎ আমি ভুট্টোর বিরুদ্ধে কী বলেছিলাম তাও আপনাদেরকে জেনে রাখার অনুরােধ জানাব। কাজেই পরিস্থিতির মােকাবিলায় আমাকে অনেকটা নিরপেক্ষ অবস্থান নিতে হয়েছিল। আমি তাদের সমালােচনাও যেমন করি নি তাদের প্রতি সমর্থনও জানাই নি। আমি বৈঠক আয়ােজনের চেষ্টা করেছি ও সব তরফকে বলেছি।

আপনারা একত্রে আলােচনায় বসুন। এই তারা আসলে কারা? তারা পূর্বপাকিস্তানীই বটে, ওরা পশ্চিমপাকিস্তানের কেউ ছিল না।
প্র: আপনি ডানপন্থিদের কথা, নুরুল আমীনের কথা বলছেন? গােলাম আজম?
উ: ওরা সকলেই ছিল পূর্বপাকিস্তানী। তাই এ ধরনের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার পরিস্থিতি না হলে পূর্বপাকিস্তান সঙ্কটের একটা সমাধান আমরা খুঁজে পেতাম। শেখ মুজিবের দল যদি সকল আসন না পেত তাহলে আমরা তাঁকে চাপ দিতে সক্ষম হতাম।
প্র: তাহলে এখন আপনারা দেখলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অর্থাৎ আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়ী হয়েছে। কিন্তু সে-ক্ষেত্রে আপনি কি মনে করেন না, সরকারের কর্তব্য ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়া? কী কারণে, তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না?
উ: উচিত কথা নি:সন্দেহে। প্র: তাহলে তারপর কি ঘটে গেল?
উ: অন্তত আমার তরফ থেকে আমি বলতে পারি, আমি তাঁকে প্রধানমন্ত্রীর পদে দেখতে চেয়েছিলাম এমনকি শেখ মুজিব জেলে থাকার পরেও। ঐ সময় অন্য কেউ একজন প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন। সে-কথা আমি জেনারেল ইয়াহিয়াকে। বলেছিলাম…।
আমার ধারণা ছিল নির্বাচনের পর বিভিন্ন দফা নিয়ে কিছু সমঝােতার পর পরিস্থিতির উন্নতি হবে, কিন্তু বাস্তবে তার বদলে দেখা গেল সমঝােতা নয় সংঘাত শুরু হয়েছে। ঐ সময় থেকে উভয় তরফে মনে সুগভীর সন্দেহ ও অবিশ্বাস প্রবল হয়ে ওঠে। শেখ মুজিব ভুট্টোকে বিশ্বাস করেন নি। ভুট্টো বিশ্বাস করেন নি শেখ মুজিবকে। আমার তাে মনে পড়ে শেখ মুজিব নিজে আমাকে বলেছিলেন সেই রাতে ভুট্টো শেখ মুজিবের দাবি প্রত্যাখ্যানের পর আমি যখন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাই তখন আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম আপনাদের দু’জনের আলােচনায় কি হলাে?
প্র: আপনি তথাকথিত লারকানা পরিকল্পনার কথা জানতেন? আপনার মতে, কখন এসব ঘটছিল?
উ: আমি এর কিছু জানতাম না। জেনারেল উমর আমাকে এ-সম্পর্কে সামান্য ছিটেফোটা জানিয়েছিলেন। তাই আমি সরাসরি যা জানতাম শুধু সে-সব কথাই আমার বইয়ে লিখেছি।
প্র: ঠিক আছে, পরে জেনারেল উমর আপনাকে কি বলেছিলেন?
উ: তিনি আমাকে বলেন যে, প্রেসিডেন্ট ঢাকা থেকে ফেরার পর তারা লারকানায় যান। এর আগে ঢাকায় জেনারেল ইয়াহিয়া ঘােষণা করেন যে, শেখ মুজিব হবেন পাকিস্তানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী। তবে লারকানায়, ভুট্টো ইয়াহিয়াকে
১১০

বলেন, আপনি তাে মুজিবকে প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছেন। তিনি বলেছিলেন, আমি নই, জনসাধারণই তাঁকে প্রধানমন্ত্রী করেছে। পরে কিছু কথাবার্তার পর তিনি তাকে। বলেন যে, মুজিবের স্বদেশপ্রেম যাচাই করতে হবে আর সে-যাচাই পরীক্ষাটি হবে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করে। এতে যদি তিনি প্রতিক্রিয়া দেখান তাহলে তিনি দেশপ্রেমিক নন, যদি না দেখান, তিনি একজন স্বদেশপ্রেমিক ব্যক্তি। আমার লেখা বইতে আমি সম্ভবত উল্লেখ করেছি যে, যদি বিপরীত পরিস্থিতি যাচাই হিসেবে আসত তাহলে কী ঘটত সে-সম্পর্কে আমি ঐ সময় প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলােনায় বলেছি…।
প্র: তাঁর প্রতিক্রিয়া কী ছিল? উ: দেখুন, আপনি যখন… মানে কাজ করেন… প্র: গােয়েন্দা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে…?
উ: কিংবা বলুন রাজনীতি। তখন নানাদিক থেকে চাপ ছিল। তার ওপর জেনারেলদের চাপ এত প্রবল ছিল যে, তিনি কার্যত আমাকে বলেই ফেলেন যে, দ্যাখাে, আমি… আমি পশ্চিমপাকিস্তানে চললাম। তবে আমার ধারণা, আমি বােধ হয় একটা চরম অবস্থায় পৌছেছি। এ-কথা বলছি কেননা, ভুট্টো প্রধানমন্ত্রী হবার খায়েশ প্রকাশ করেছিলেন অথচ দেশ একটা। দুজনে প্রধানমন্ত্রী হতে হলে দুটো দেশ দরকার। তিনি নিজে একজন মার্কিন সাংবাদিকের কাছে দুই প্রধানমন্ত্রীর কথা বলেছিলেন। আর পরে সে-কথা অস্বীকার করেছিলেন।
প্র: কে? জনাব ভুট্টো?
উ: জনাব ভুট্টোই বলেছিলেন ও পরে সেটি অস্বীকার করেছিলেন। এ-ঘটনা বেশ অনেকটা গােড়ার দিকে ঘটে। কিন্তু এটিই তখনকার চিন্তা-ভাবনায় দাড়িয়ে যায়। অর্থাৎ শান্তি সমঝােতার বদলে মােকাবিলা, সংঘাত শুরু হয়ে যায়। আমি আমার স্মৃতিচারণে আরও কিছুটা পেছনে চলে যাচ্ছি যখন মুজিব বিবৃতি দিয়েছিলেন, ভুট্টোও একটি বিবৃতি দিয়েছিলেন আর এ-ভাবে বিবৃতির পিঠে বিবৃতি দেওয়া চলতে থাকে। মুজিবের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় তার তেমন বাধ্যবাধকতা বা দায় ছিল না। তিনি অত্যন্ত আক্রমণাত্মক ভূমিকা নিয়েছিলেন। ভুট্টো যে-ভাবে চিন্তা-ভাবনা করছিলেন সেটি বােধহয় তাকেই সাজে। দেখুন, একজন রাজনীতিক স্বাভাবিকভাবে যা করেন তিনি তাই করেছিলেন। তাঁর জায়গায় আপনি কিংবা পুরনাে আমলের মুসলিম নেতাদের কথাই ভাবুন। তাদের পক্ষেই তার মনােভাব সম্ভব। তারা মুজিবকে স্বীকার করে নিতে পারলে ল্যাঠাই চুকে যেত। কিন্তু তিনি চেয়েছিলেন তারা নিজ দলকে বাঁচিয়ে রাখতে। একটা কিছুর জন্য সংগ্রামের প্রেরণা জইয়ে রাখতে না পারলে এ দল ভেঙে যাবার ঝুঁকি থাকে— নেতাকে আক্রমণাত্মক হতে হয়। ভুট্টো এ-কাজটি করতে গিয়েই বাড়াবাড়ি করে সীমা অতিক্রম করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘হাম উধার, তুম উধার’। নাহলে আমি যাকে পাব, যা কিছু পাব টুকরাে করে ফেলব। আমার

ধারণা… যা বলতে চাচ্ছি হৃদয়ঙ্গম করেছেন। যদি না করে থাকেন, আমাকে আরও বলতে হবে।
প্র: কাজেই যেভাবে হােক, আলােচনা ব্যর্থ হােক সেটিই ছিল ইচ্ছে। আর এ-ভাবেই কি আপনি পরিস্থিতির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে চান?
উ: আলােচনার ব্যাপারে ইয়াহিয়া যদুর সম্পর্কিত সে-সম্পর্কে এ-কথাই বলা যায় তিনি প্রথমে আলােচনা বৈঠকের জন্য ১৬ মার্চ পৌছান বলেই আমার মনে পড়ে। আমার আলােচনায় দুই ব্যাক্তি উপস্থিত ছিলেন। এক, আমি নিজে আর দুই, বিমানবাহিনীর অফিসার মাসুদ, ৬৫’র পাক-ভারত যুদ্ধের বীর নায়ক। আমরা ঐ আলােচনা বৈঠকে কোন কথা বলি নি। জেনারেল শাহ আলি কিছু বলছিলেন, তাকে থামিয়ে দেওয়া হয়। আমি তাকে বলেছিলাম, স্যার, এমন এক নীতি অনুসরণ করা ঠিক নয় যাতে পূর্বপাকিস্তান আমাদের ছেড়ে যায়। আমরা এখন তার “ভেঙে যাওয়া” শব্দগুলি ব্যবহার করি নি।
প্র: আপনি কুসংস্কারের ইঙ্গিত দিচ্ছেন?
উ: আর তিনি বললেন, জাতির জনক জনাব সুহরাওয়ার্দির প্রস্তাব মেনে নিতে রাজি ছিলেন। আমি তখন সেটি মেনে নিই নি। এখন এসব থেকে একান্তই পরিষ্কার যে, জেনারেল একটি রফা মেনে নেবার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। তিনি, ভুট্টো ও মুজিব… আমার ধারণা কোনােরকমে একটা সমাধানে উপনীত হয়েছিলেন। আমি ১৯ মার্চের সন্ধ্যায় মুজিবকে টেলিফোন করে জানতে চাইলাম, ভাই কুছ। হুয়া? আপনারা জানেন, মুজিবের সাথে আমার বন্ধুসুলভ সম্পর্ক ছিল। তিনি বললেন, হ্যা, হয়েছে। আমি প্রধানমন্ত্রী হব, পাঞ্জাব থেকে কয়েকজন মন্ত্রী হবে, পূর্বপাকিস্তান থেকে হবে পাঁচজন। আমি বললাম, খুবই খুশি হলাম শুনে। কিন্তু পরেরদিন সকালে সেখানে ভুট্টোর উদয় হলাে, তিনি সবকিছু ভেঙেচুরে মিসমার করে দিলেন।
প্র: এ-ঘটনা ২০ মার্চের।
উ: ঠিকই ধরেছেন। তিনি বললেন, আপনারা সামরিক আইন তুলে দিতে পারেন না। তাহলে পাকিস্তান ফেডারেশনকে আর একত্রে রাখা যাবে না। তখন দেশে কোনাে শাসনতন্ত্রও ছিল না। সামরিক আইন তুলে দেওয়ার ব্যাপারে এ-ছিল ভুট্টোর আপত্তি। একই বছরের নভেম্বরে, ভারতীয় আক্রমণ শুরুর ঠিক আগে লাহােরে ইয়াহিয়ার সাথে দেখা হয়। ওখানে পিপলস পার্টি তাঁকে এক সামরিক আইন আদেশের আওতায় এ-দলের কাছে ক্ষমতা হস্তন্তরের আহ্বান জানায়। আমি বললাম, দেখুন ওরা কিভাবে বদলে গেছে? এ-কাজটিই কি একবছর আগে করা যেত না? এ অবস্থা, আমি যদুর মনে করতে পারি, পূর্বপাকিস্তানের বহু লােকের সঙ্গে আমার কথাবার্তা হয় তাতে দেখতে পাই- এমন একটা ধারণাই শেকড় গাড়ছে যে, সিঙ্গাপুর স্বাধীন থাকতে পারলে বাংলাদেশ কেন স্বাধীন দেশ। হিসেবে টিকে থাকতে পারবে না। পূর্বপাকিস্তানেও তখন একজন মার্কিন রাষ্ট্রদূত
ছিলেন। ভারতের মার্কিন রাষ্ট্রদূত তখন এরকম একমত প্রকাশ করেছিলেন যে, পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিমপাকিস্তানকে ঝেড়ে ফেললে পূর্বপাকিস্তান অর্থনৈতিক দিক থেকে অধিকতর বাস্তবসম্মত ও টেকসই হয়ে উঠবে। এ-ধরনের জিনিসের চিন্তা-ভাবনা, পরিকল্পনা কমিশনের মাথাতেও ছিল। কাজেই এরকম বহু ধরনের জিনিস পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় পরিমণ্ডলে ঢুকে পড়ে। আর তার পরিণতিতে জনসাধারণ যৌক্তিক বিচার-বিবেচনার বিষয়টি বন্ধ করে দেয়। এমতাবস্থায় আবেগানুভূতি অত্যন্ত প্রখর হয়ে ওঠে। আমি আমার বইয়ে এ-অবস্থার উল্লেখ করে বলেছি, এমনও একটা সময় আসে, কেউ-কেউ বলতে থাকে ঐ হারামজাদাকে আমরা আমাদের ওপর শাসন চালাতে দেব না। এ-কথার জবাবে আমি বলেছিলাম, ওরা যদি হারামজাদা হয় তাহলে ওদের কাছে আমরাও হারামজাদা। আমি আরও বলেছিলাম, আমাদের সামনে একটা আশার সম্ভাবনা অপেক্ষা করছে। অনেকে সে-ধরনের আশাবাদীও ছিল। কিন্তু নি:সন্দেহে। পশ্চিমপাকিস্তানে এমন লােক ছিল যারা পূর্বপাকিস্তানকে উপনিবেশ ভাবেতাে। প্র: হ্যা, পূর্বপাকিস্তান একটা দায় বােঝা!
উ: হ্যা, সেটি এখনও ভাবা হয়। তবে প্রশ্ন, তাহলে কেন আমরা এখনও বলি আমরা পূর্বপাকিস্তান হারিয়েছি? বরং পূর্বপাকিস্তান পশ্চিমপাকিস্তানকে হারিয়েছে। কেননা ওরাই তাে আসলে সংখ্যাগরিষ্ঠ।
প্র: জেনারেল, আমরা আপনাকে ২৪, ২৫ ও ২৬ মার্চের কথা জিজ্ঞেস করতে চাই। কখন ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর পরিকল্পনা করা হয়েছিল, কেন করা হয়েছিল? উ: প্রকৃতপক্ষে ওটা ছিল ১৯ মার্চে, আলােচনা বৈঠকের পরে। আমি সবকিছুতে তুষ্টই ছিলাম। কিন্তু ২০ তারিখে এসে আমাদের এরকম একটা উপলব্ধি জন্মায়, কোনাে কোনাে জায়গায় ভুল ঘটেছে। ২৫ মার্চেই আমার ধারণা অপারেশনের শুরু। এটাকে বাংলাদেশ দিবস বা অন্য যা-কিছুই হােক ধরা যেতে পারে।
প্র: ২৩ মার্চ ছিল পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবস।
উ: ২৩ মার্চের পাকিস্তান দিবসে আমার মনে হয় মুজিব এসেছিলেন একটা বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে প্রেসিডেন্টের সাথে দেখা করতে। ঐ দিন তাঁর বাড়ির সামনে এক কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয়। শেখ মুজিব ঐ কুচকাওয়াজে সালাম গ্রহণ করেন এবং বলা যায়, বাংলাদেশ ঘােষণা করেন। কিন্তু ঐ সময়নাগাদ আমাদের হাতে, এমনকি আমাদের সদরদপ্তরে তেমন কোনাে তথ্য ছিল না। প্রেসিডেন্ট হাউসে আলােচনা চলছিল নিজস্ব কায়দায়। ওখানে ছিলেন, আমার যদুর মনে পড়ে, প্রেসিডেন্ট, জবাব পীরজাদা, কর্নেল ইলিয়াস, জনাব আহসান, জনাব হামিদ এবং আরও ২/১ জন। কিন্তু তারা সকলে সবকিছু গােপন রাখছিলেন। আমি ও জিওসি এসবের বাইরে ছিলাম। আমাদের হাতে কোনাে কাজ ছিল না। আমরা গভর্নর হাউস থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম। জেনারেল খাদেম হােসেন রাজাকে
কম্যান্ডার নিয়ােগ করা হয়। আমরা প্রেসিডেন্ট হাউসে কী হচ্ছে তা জানার জন্য জেনারেল টিক্কাকে বলি কেননা ওখানে কী হচ্ছে তার বিন্দুবিসর্গ আমাদের জানা ছিল না। শুধু আমরা এটুকুই জানতাম, একটা কিছু গােলমাল কোথাও হয়েছে। সে-কথা আমি আমার কথাবার্তায়ও বলেছি। অন্তত আবছা হলেও গােলামালের আভাস পেয়েছিলাম তাই টিক্কা সেখানে গেলেন। ফিরে এসে তিনি জানালেন, একটা কিছু গােলমাল হয়ে গেছে, দর কষাকষির আলােচনা ভালাে চলছে না। সরকারের কর্তৃত্ব পুন:প্রতিষ্ঠা করার জন্য একটা কিছু করতেই হবে। ঐ দিন কী ঘটছিল… আমাদের ফিরে যেতে হবে— তারিখ বদলানাে হলাে, ঘােষণাও দেওয়া হলাে, ঢাকায় একটা ইতস্তত ভাব লক্ষ করা গেল। আমরা পুরনাে ঢাকার নওয়াবগঞ্জে লােকজনকে হত্যার খবর পেলাম। সেখানে সেনসবাহিনী পৌছে গেছে। ওখানে একটি বড় আকারের সমাবেশ হয়। আর ঐ সমাবেশে শেখ মুজিব ঘােষণা করেন যে, আওয়ামী লীগ সরকার চালাবে। তাজউদ্দিন কার্যত সেই সরকারের প্রধানমন্ত্রী হয়ে গেলেন। তিনি ব্যাঙ্ক ও কার্যত সকলের প্রতি নির্দেশ। জারি করলেন। সেনাবাহিনী তখন ব্যারাকের মধ্যেই ছিল। এমনকি তারা সেনানিবাসগুলির বাইরে যেতে পারছিল না, বাজারঘাট থেকে কিছু কিনতেও পারছিল না, কোনাে ঠিকাদারও সেনাবাহিনীকে এমনকি শবজি পর্যন্ত সরবরাহ করছিল না, শবজির সরবরাহ আনতে হচ্ছিল পশ্চিমপাকিস্তান থেকে। আর পূর্বপাকিস্তানের সকলে ভাবছিল এ-ভাবে যত হাজার আসছিল তার প্রতিটিতে করে পশ্চিমপাকিস্তান থেকে সৈন্য আনা হচ্ছিল। অথচ বাস্তবিকপক্ষে, এগুলিতে আলু, পিয়াজের মতাে রেশনসামগ্রী আনা হচ্ছিল। এ-জাহাজে বলতে গেলে…।
প্র: পশ্চিমপাকিস্তান থেকে সৈন্য আনা হয় নি?
উ: ২৬ … প্র: ২৬ মার্চের আগে পূর্বপাকিস্তানে ৯০ হাজার সৈন্য ছিল… না, ক্রমে সৈন্য সংখ্যা এ-পর্যন্ত বাড়ানাে হয়েছিল?
উ: না, এটি একেবারেই এক আলাদা প্রশ্ন। ২৬ মার্চের প্রথম ব্যাটালিয়ন সৈন্য পৌছায় পশ্চিমপাকিস্তান থেকে। ২৫ মার্চের পর।
প্র: তাহলে এখন আপনি আমাদেরকে “অপারেশন সার্চলাইচ”-এর বিস্তারিত পরিকল্পনা সম্পর্কে বিশদ আকারে বলতে পারেন। এর যে টার্গেট বা লক্ষ্য ছিল তার উদ্দেশ্য হলাে…।
উ: উদ্দেশ্যের কথাই বলি। পরিকল্পনাটি প্রণীত হয় একটা সময় ধরে। এতে নিরূপণ করা হয় কী ধরনের অভিযান সফল হবে। যেমন, দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করা যায়, অমৃতসরে ভারতীয় বাহিনী আক্রমণ চালায়। ঐ আক্রমণে তারা ট্যাঙ্ক, মর্টার কিংবা যা পারে ব্যবহার করে। শুধু তারা ঐ অভিযানে বিমান ব্যবহার করে নি। তারা তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ ভাঙতেও সক্ষম হয়-এ-জন্য যে সেখানে একটা প্রতিরােধ ছিল। যখন সেনাবাহিনীকে নামানাে হয় সেনাবাহিনীর কাজ আর

বেসামরিক ব্যাপার থাকে না। ঐ অবস্থায় সেনাবাহিনী সফল হয় বা হবার চেষ্টা করে। আর সেটি সাধারণ পা টেনে টেনে ধীর গতিতে একটা সময় নিয়ে চলে না। পূর্বপাকিস্তানে ঐ সময় সান্ধ্য আইন, সামরিক আইন সবকিছুই তাদের কার্যকারিতা হারিয়েছিল। কেউ সামরিক আইন মানছিল না। পূর্বপাকিস্তান সরকার নামক ব্যবস্থা শেষ হয়ে গিয়েছিল। তা আমরা ৭ মার্চের কথায় চলে এসেছি। আওয়ামী লীগ পূর্বপাকিস্তান সরকারের ক্ষমতা হাতে তুলে নেয়। আর পরিস্থিতি সেনাবাহিনীর জন্য বেসামরিক সমর্থন থেকে একেবারেই ভিন্ন ছিল। সেনাবাহিনীকে, আরেক দৃষ্টিভঙ্গিতে একটা শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছিল। আমরা আবেগানুভূতির বিষয়টি বিবেচনায় না এনে আমার মতে ভুল করেছি। আমরা সেনাবাহিনীর অনুভূতি বুঝে উঠতে পারি নি। ফলে যা ঘটছিল তা হলাে বহু জায়গায় তাদের মারধর করা হচ্ছিল, সেনা অফিসারদের লাঞ্ছিত করা হচ্ছিল। ওরা বাইরে বেরুতে পারছিল না। ফলে, ক্ষোভ-ক্রোধমিশ্রিত আবেগ-উত্তেজনা পুঞ্জীভূত, ধূমায়িত হয়ে উঠছিল- আমরা এক সরকারের সেনাবাহিনী, আমরা। এমনকি, বাজার থেকে মাংসও কিনতে পারব না! এ-অবস্থায় পরিকল্পনা ছিল একেবারে সােজা। আমরা কারফিউ বসাব আর গিয়ে নেতাদের গ্রেপ্তার করব।
প্র: কিন্তু এর আগে আপনি বলেছেন, ১৯ মার্চ তখন ভুট্টো আপনাদের বলেছিলেন, সব জিনিসের মিটমাট হয়ে গেছে…।
উ: ভুট্টো বলেন নি, বলেছিলেন মুজিব। প্র: ভুট্টো নিষ্পত্তি করতে সম্মত হয়েছিলেন।
উ: কিন্তু তিনি তা করেন নি। ইয়াহিয়া খান সম্মত হলেও ভুট্টো সম্মত হন নি, ভুট্টো এসেই তাে! প্র: ইঙ্গিত দিলেন, আর তাতেই।
উ: বেশ, সেটিই ধরুন না, কেননা, পাকিস্তানে ফিরে আসার পর ভুট্টোর সাথে আমার দেখা হয়। এর আগে আর কখনও তাঁর সাথে আমার দেখা হয় নি। আমি পূর্ব পাকিস্তানে থাকতে ভুট্টোর সাথে দেখা করার জন্য একজন ব্রিগেডিয়ার ছিল। অতি নগন্য। তার সাথে আমার কখনও দেখা হয় নি। তাই যা বলছিলাম, সেনাবাহিনীর সদস্যদের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছিল। দ্বিতীয় দিন আমি বলব, ঢাকার অধিবাসীরা পরিস্থিতির জন্য ভালােরকমে তৈরি ছিল। এই তৈরির ভাব ছিল ৭ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত। অসামরিক প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে পুলিশ, রাজাকার, মুজাহিদ, আনসার সবকিছুই ছিল। এরা সকলেই ঐ সময় সরকারের কমান্ডে ছিল। এই সরকার কোনাে ঘােষিত সরকার না হলেও কর্তৃত্বের অধিকারী ছিল। রেডিও স্টেশন দখল করে নিতে যাচ্ছিল এ-সরকার। রাজনৈতিক নেতাদের বাড়িঘরগুলি চিহ্নিত করা হয়েছিল, অন্যান্য কাজও সারা হয়েছিল, সৈন্যদের তল্লাসী পরিকল্পনাও দেখানাে হয়েছিল। রাজনীতিক নেতাদেরকেই কেবল গ্রেফতার করার বিষয় স্থির হয়েছিল যাতে কোনাে জনগােলযােগ হাঙ্গামা বেধে না যায়। কিছুই না।
১১৫

ঘটে। তবে সন্ধ্যার পর রাত ১১টার দিকে ইয়াহিয়া চলে যান। সূর্যাস্তের পর যখন তখনও ভাল করে আঁধার জমাট বাঁধে নি, তখন ইয়াহিয়া একটি ছােট্ট কারে বিমানবন্দরে পৌঁছান ও ২৫ মার্চের সে-রাতে ঢাকা ছেড়ে যান। তবে তিনি জানতেন না যে, এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খােন্দকার ঐ সময় বিমানবন্দরে ছিলেন। আমার ধারণা তিনি পরের দিকে এসেছিলেন, তিনি ঐ সময় শেখ মুজিবকে ইয়াহিয়ার পশ্চিমপাকিস্তানে চলে যাওয়ার কথা জানান। এসময় শেখ। মুজিবের বাড়িতে আওয়ামী লীগের বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। আমাদের ধারণা ছিল, আমরা গিয়ে তাঁকে গ্রেপ্তার করব। কাজটা সােজা আর সহজ— দুই-ই হবে। তবে এর আগে আমি কিছু কথা বলে নিতে চাই। এসব আলােচনা যখন চলছিল তখন সােনবাহিনীর জনসংযােগ অফিসার সিদ্দিক সালিককে আমি একটা কাগজ দিই। সিদ্দিক সালিক ছিলেন লিয়াজোঁ অফিসারও বটে। তিনি গভর্নর হাউসে যাচ্ছিলেন। ঐ কাগজে আমি দু’টি ত্বরিৎ কার্যকৌশল বা কার্যব্যবস্থা গ্রহণের প্রস্তাব করেছিলাম। বলেছিলাম, ক্ষমতা বা শক্তি থাকতে হবে তবে একটা রাজনৈতিক সমাধানও দিতে হবে। এগুলি করুন, রাজনৈতিক সমাধান দিন। এগুলি করতে হবে অনতিবিলম্বে আমাদের তালিকার লােকগুলিকে গ্রেপ্তারের পর পরই। প্রেসিডেন্টকে সেখানে গিয়ে ঘােষণা করতে হবে যে, ছয়দফার বদলে পাকিস্তান পিপলস পার্টির আটদফা মেনে নেওয়া হবে। আপনারা হয়ত জানেন, এই ছয়দফা— এগুলি কার্যত একই শুধু পার্থক্য এই যে, একটি খুবই চরম ও অন্যটি বেশ মৃদু, তবে পূর্বপাকিস্তানের জন্য একই রকমের প্রাদেশিক স্বায়ত্বশাসনের উদ্দেশ্যসাধক। তাই যখন সামরিক আইন সদরদপ্তরে শেখ মুজিবকে নিয়ে কী করা যাবে- এই আলােচনা চলছিল তখন আমি প্রস্তাব দেই যে তাকে হত্যা করা উচিত হবে না কেননা এসসি তাঁর বাড়িতে হানা দিতে যাচ্ছে। এতে ওরা খুশিই বােধ হলাে। আমি বললাম শেখ মুজিবকে হেফাজতে নিতে হবে ও তারপরে এ-কথা বললাম ঘােষণা করতে হবে আমরা তাকে হেফাজতে নিয়ে চরমপন্থিদের থেকে। তাকে আলাদা করেছি। তবে তাকে জনসাধারণ থেকে আমরা আলাদা করি নি। আলাদা করেছি সেইসব লােকদের কাছ থেকে যারা স্বাধীনতা চায়। আমার প্রস্তাবের প্রথমাংশে শেখ মুজিবকে হত্যা করা যাবে না— এটি গৃহীত হয় কিন্তু একই প্রস্তাবের দ্বিতীয় অংশ— যুগপৎ একটি রাজনৈতিক সমাধানের কথা ঘােষণা। করতে হবে- এটি গৃহীত হয় নি, বাস্তবায়িতও হয় নি। আমার মনে হয় না যে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আদৌ এ-প্রস্তাব নিয়ে মাথা ঘামিয়েছিলেন বা সেজন্য সময় দিয়েছিলেন। কেননা, তিনি পশ্চিমপাকিস্তানে চলে যান। এখন এরপর আমি ও জিওসি দু’জনে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। আর সকলে অন্য অবস্থান নেয়। আমাদেরকে হয়রানিতে পড়তে হয় এ-কারণে। এরপর আমরা আমাদের স্ত্রীদের সাথে দেখা করতে যাই। জেনারেল হামিদ ও জেনারেল খাদেমের ওখানেও যাই। আমরা দু’জন একত্রে ছিলাম এ-কারণে যে, আমি গভর্নর হাউস থেকে বেরিয়ে
এসেছিলাম। ওরা আমাদের জানাল, আমরা সামরিক ব্যবস্থা নিতে ভয় পাচ্ছি। আমরা দু’জন— আমি ও খাদেম এই সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের বিরােধী ছিলাম। আমাদের স্ত্রীদেরও এসব কথা ওরা জানাল যে, আমরা সামরিক ব্যবস্থা নিতে চাই।
। আমি বললাম, স্যার আমি আমার জীবনের জন্য ভীত নই, আমি পাকিস্তানের অস্তিত্বের প্রশ্নে উদ্বিগ্ন ও কেননা এসবের পর আর পাকিস্তানের অস্তিত্ব থাকবে না। এসব কাজ করলে একদিন একই সত্ত্বার পক্ষ থেকে প্রশ্ন উঠতে পারে, কেন তুমি এসবে ছিলে? এখন আমরা সামরিক অফিসার হিসেবে পদত্যাগ করতে পারি না। সাহেবজাদা ইয়াকুব একাজটি করে বদনাম কুড়িয়েছেন আর বহুদিন তার সবকিছু কুয়াশাবৃত, অস্পষ্ট ছিল। এমনকি এখনও এমন লােক আছে যে তাকে কাপুরুষ মনে করে। বাস্তবিকপক্ষে তিনি তা ছিলেন না, তার একটা দৃঢ়, স্বকীয় বিশ্বাস ছিল, থাকতেও পারে। কিন্তু আমরা যা বিবেচনায় রেখেছিলাম তা হলাে, ধরুন, আমি যুদ্ধক্ষেত্রে, প্রকৃত যুদ্ধে এমন এক অবস্থানে আক্রমণ চালানাের জন্য আদেশ দিচ্ছি যে আক্রমণ বা যুদ্ধে আমি জানি, প্রাণ হারাব, সৈনিকদের প্রাণহানি ঘটবে। কিন্তু তার পরেও আমি আক্রমণ চালাব কেননা, ওপরের নির্দেশ রয়েছে। আমার ওপরে।
প্রশ্ন সেনাবাহিনীতে কি এমন বিধি নেই যার আওতায় কোনাে নির্দেশ, নির্বোধ পাগলসুলভ হলে তা অগ্রাহ্য করা যাবে?
উ: নেই, অন্তত এ-ধারণা নেই।
প্র: বলতে চাই, আমি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারানুষ্ঠান প্রত্যক্ষ করেছি। সেখানে তারা বলছে, পাগলসুলভ ক্ষেত্রে আপনি এ-আদেশ বাস্তবায়িত না করার অধিকার বেছে নিতে পারেন। উ: এ-হলাে যুদ্ধ অপরাধীদের ব্যাপার— এ-হলাে বিজ্ঞ বিচারক মহােদয়দের
অভিমত মাত্র… জার্মান সেনাবাহিনীর কোনাে জেনারেল কি… প্র: জার্মান সেনাবহিনী নয়। এ-ধরনের একটি বক্তব্য কোনাে এক ট্রাইবুনাল গ্রহণ করেছিল।
উ: হতে পারে। তবে এটি স্বাভাবিক নয় যে, কোনাে কিছু করতে বলা হলে ও তা পালিত না হলে ঐ জেনারেল পদে ইস্তফা দেবেন। আর ঘটনাক্রমে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে আমি জিওসি ছিলাম না। প্র: আমার মনে পড়ে, জেনারেল নিয়াজি লিখেছেনও টিকা খান আদেশ দিয়েছিলেন যে, চেঙ্গিজ খান বুখারা ও হালাকু খান বাগদাদে যে বর্বরতা চালিয়েছিল পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে তার চেয়েও নির্মম হতে হবে। আমি এদেশের মানুষ চাই না, শুধু মাটি চাই। তিনি নিজে এও বলেন যে, জেনারেল রাও ফারমান আলি ও ব্রিগেডিয়ার… অননুকরণীয় ভাবে সে-আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন আর আপনি তাে আপনার ডাইরিতে লিখেছিলেন যে, সবুজ দেশ। পূর্বপাকিস্তানকে লাল রঙে রাঙাতে হবে।

উ: দুটো ভিন্ন জিনিস। আমি দু:খিত এ-কথা বলার জন্য যে, জেনারেল নিয়াজি একজন মিথ্যাবাদী। তবে আসুন সবুজ পূর্বপাকিস্তানকে লাল রঙে রঙিন করার কথায় আসি।
প্র: জেনারেল নিয়াজির বইটি সম্পর্কে আপনার কী ধারণা?
উ: তিনি অন্যদের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে আত্মরক্ষার প্রয়াস পেয়েছেন। এর বেশি বলার আমার কিছুই নেই। কেননা, এটি সর্বাত্মক ও পরিপূর্ণ মিথ্যা, তিনি নিজে বইটি লেখেন নি। আপনি তাকে ঐ বইটির একটিমাত্র পৃষ্ঠা লিখতে বলুন। আবার, আমি মেনে নেব বইটি তারই লেখা। জনসাধারণ তাে আর খোজ রাখে না, রাখবেও না, আর তাই তারা এই বই লিখেছেন তাদের খেয়ালখুশি-অনুযায়ী। জেনারেল টিককা কখনও একথা বলেন নি। আমার বিশ্বাসও, তিনি একজন চমৎকার মানুষ ছিলেন গভর্নর হিসেবে। দূর্ভাগ্য তার, সেজন্য তার বালুচিস্তানের ও পূর্বপাকিস্তানের কথাই বলে তার দুর্নাম জুটেছে। তার সাথে দেখা হলে, দেখবেন তিনি একজন চমৎকার মানুষ।
প্র: আপনি কি তার সাথে দেখা করতে বলেন? উ: তার অবস্থা ভালাে নয়। ভয়ানক অসুস্থ তিনি। প্র: তা নিয়াজি কী বলেছিলেন?
উ: নিয়াজি যেদিন দায়িত্ব নিয়েছিলেন সেদিন পরিষ্কার বলেছিলেন তার কথা। চেয়ার ঘুরিয়ে নিয়ে তাতে বসে তিনি বলেছিলেন, রুশদের সম্পর্কে আমি যা শুনেছি, তাতে মনে হচ্ছে দুশমনের দেশে রয়েছি। বর্মায় আমরা রেশন যােগাড় করতাম জমি থেকে। গবাদিপশু পাওয়া যেত কিন্তু তা ছিল সীমিত। কাজেই দেখা যাচ্ছে, তিনি এমনই ব্যাক্তিদের একজন যিনি পূর্বপাকিস্তানকে বলছেন দুশমনের দেশ। আমরা কখনও একে দুশমনের দেশ ভাবি নি। আমাদের কাছে ওটা ছিল পাকিস্তান। তিনি আরও সব ভয়ঙ্কর কথাবার্তা বলেছিলেন তিনি বলেছিলেন, আমরা পূর্বপাকিস্তানের নর গােষ্ঠী পরিচয় বদলে দেব। অর্থাৎ নিয়াজি ছিলেন কিছুটা চতুর ব্যক্তি। যে-আদেশ তিনি দিয়েছিলেন, খুবই চমৎকার যেমনটি তাঁর সাথে আপনাদের বৈঠকে মনে হয়ে থাকবে। এসব আদেশ আপনাদেরকে তিনি দেখিয়েও থাকতে পারেন। তবে যে ব্যক্তি এসব আদেশ তাদের জন্য লিখে দিয়েছেন আর তিনি তাতে সই করেছেন, সেই ব্যক্তিই লিখেছেন তার বই। কিন্তু তার আদেশের সেই বাস্তবায়ন ছিল ভয়ঙ্কর।
প্র: বলা হয়ে থাকে, আপনি রাজাকারবাহিনী গড়েছিলেন। কাজেই ইপিসিএএফ বা সিভিল আর্মড ফোর্সেস গঠন সম্পর্কে কি কিছু বলতে পারেন?
উ: আমার ধারণা এ-বাহিনী গঠন করেছিল মার্শাল ল সদর দপ্তর। প্র: এটি কার মস্তিষ্কজাত? উ: ফোর্স কম্যান্ডন্টরা অবশ্যই…। প্র: এ সময়ে ফোর্স কম্যান্ডান্ট কে ছিলেন?

উ: নিয়াজি। তিনি দাবি করেন, শামস ও বদররা হাতিয়ার। প্র: তাঁর বইও তাদের উদ্দেশ্যে নিবেদিত।
উ: তিনি তাদের স্রষ্টা, ব্যবহারকারী, আর আমি মনে করি, অন্য যে-কেউ এটি করত।
প্র: পরিস্থিতি ছিল যুদ্ধাবস্থা। নিয়াজি তার বইতে বলেছেন যে, আল-বদর ও আল-শামস-এর নেতাদেরকে যুদ্ধবন্দিদের সাথে ফিরিয়ে আনা হয়?
উ: আমি জানি না। প্র: কিছুই জানেন না, আপনি?
উ: দেখুন, ঘটনা হলাে এই যে, আমার কর্তৃত্বই ভেঙে পড়েছিল, আমি বস্তুত আর কেউ-ই ছিলাম না। যদুর মনে পড়ে ১৩ তারিখে গভর্নর মালিক পদত্যাগ করেন। আমি গভর্নর হাউসে ছিলাম। ভারতীয় আক্রমণের মুখে তিনি পদে ইস্তফা দেন। এরপর আমার কোনাে কাজ ছিল না, কেউ আর ছিলাম না আমি।
প্র: এ-ঘটনা ‘৭১-এর ১৩ ডিসেম্বরের। তাই ১৩/১৪ ডিসেম্বরে বুদ্ধিজীবীদেরকে…
উ: হ্যা, হতে পারে। ঠিক ধরেছেন আপনি। নিয়াজি ওদের হত্যার জন্য দোষ দেয়… বস্তুত ওরা সকলেই এ-জন্য আমাকেই দোষারােপ করে।
প্র: আন্তর্জাতিক তথ্যমাধ্যমগুলি এবং পাশ্চাত্যের ও নিরপেক্ষ আন্তজার্তিক তথ্যমাধ্যমও তাে আপনাকেই দায়ী করেছে, কেন?
উ: ব্যক্তি হিসেবে আমি জানি না, একাই ছিলাম তখন আমি… কাজেই। প্র: তারা প্রমাণ দিয়েছে আর কেউই সেগুলি এপর্যন্ত অস্বীকার করে নি। উ: আমি আন্তর্জাতিক মিডিয়ার এসব দেখি নি।
প্র: বুদ্ধিজীবীদের হত্যার ব্যপারটি প্রকৃতপক্ষে অক্টোবরে শুরু হয়। কেননা ঢাকার নটরডেম-এর কাছে একজন ডাক্তারকে হত্যা করা হয়। আমি বলি বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড আগেই শুরু হয়, ১৪ ডিসেম্বর সেই সব হত্যালীলার চূড়ান্ত পরিণতি। এ গেল একদিক। আরেকটি কথা হলাে এই যে, আপনি বেসামরিক প্রশাসনের দায়িত্বে ছিলেন। নিয়াজি নিয়ােজিত ছিলেন রণাঙ্গণের দেখাশােনায়।
উ: না, তিনি ছিলেন সামরিক আইন প্রশাসক। প্র: আপনি ছিলেন বেসামরিক প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতাদের দায়িত্বে। যেমন, গােলাম আজম ও মাওলানা মান্নানের সঙ্গে যােগাযােগ ছিল আপনার। তারা আপনার সাথে বৈঠকে মিলিত হতাে, আপনার পরামর্শ নিত আর এমন হতে পারে যা হয়ত জানি না, পরামর্শ-অনুযায়ী কাজও করত। কাজেই যুক্তিসঙ্গতভাবেই ধরে নেওয়া যায় কোনােকিছুই আপনার অবগতির বাইরে হতে পারত না। আপনি কি এসবের সাথে একমত?
উ: কেন? প্র: কেননা আপনিই তাে…

উ: কিছুই না বলতে কি হত্যাকে বােঝায়? প্র: এ তাে সবকিছুরই অন্তর্ভূক্ত, প্রশাসনও?
উ: না, সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের পর অবস্থা বদলে যায়। সামরিক আইন শেষ শক্তি হিসেবে কাজ করতে থাকে। গভর্নর হাউসের কোনাে নিজস্ব অবস্থান আর ছিল না। কেননা, গভর্নর হউসের নিয়ন্ত্রণ কেবলমাত্র সচিবালয়, পুলিশ ও রাজাকারের ওপর বজায় ছিল। সেনাবাহিনী, ইপিসিএএফ ছিল সামরিক আইন প্রশাসক ও কোর কম্যান্ডারের নিয়ন্ত্রণে, এমনকি আমার অধীনে নয়।
প্র: তাহলে ও-সবের জন্য দায়ী জেনারেল নিয়াজি? উ: জেনারেল নিয়াজি আইন-শৃঙ্খলার জন্য দায়ী ছিলেন। প্র: রেখে আসা ঐতিহ্য বলে…
উ: সত্যি। আমি আপনাকে বলেছি, জেনারেল সামশের যিনি পিলখানায় সিএএফও-এর দায়িত্বে ছিলেন তিনি আমাকে তাঁর সাথে দেখা করতে বলেন। তিনি জানান, আমাদেরকে জেনারেল নিয়াজির সাথে দেখা করতে যেতে হবে। জেনারেল নিয়াজির সাথে সাধারণত আমার কখনও কোনাে বৈঠক হয় নি। আমি বললাম, ঠিক আছে, আজই আমরা যাব, পরিস্থিতি তাে ভালাে নয়। পিলখানায় পৌছুতে দেখলাম কিছুটা আঁধার নেমেছে। ওখানে কয়েকটি গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকতে লক্ষ করলাম। আমি তাকে বললাম, আমি কেন তােমার গাড়িতে যাচ্ছি আর এ গাড়িগুলি ওখানে দাড়িয়ে কেন? তিনি বললেন, বিশেষ উদ্দেশ্যে আমরা জেনারেল নিয়াজির কাছে যাচ্ছি আর সেজন্যেই গাড়িগুলি এখানে। যাবার পথে তিনি আমাকে বললেন, কয়েকজন লােককে গ্রেপ্তার করতে হবে। আমি জানতে চাইলাম, কেন? তিন বললেন, কথাটা নিয়াজিকেই তুমি জিজ্ঞেস কর। আমরা নিয়াজির দপ্তরে যেতে তিনি বললেন, তােমার মত কি? আমি বললাম, স্যার, কাউকে গ্রেপ্তারের সময় এটি নয়। আপনাদেরকে বরং দেখতে হবে কত বেশি লােক আপনার সাথে আছেন।
প্র: এ কত তারিখের কথা?
উ: ৯ ডিসেম্বরের। আত্মসমর্পণের ঠিক আগে ৯ কিংবা ১০ ডিসেম্বরের। আমি বললাম, তাদেরকে গ্রেপ্তার করা ঠিক হবে না। সে প্রশ্নই ওঠে না। আমি নিয়াজির ওখান থেকে ফিরে এলাম। ১৬ বা ১৭ ডিসেম্বর সকালে ভারতীয় জেনারেল ও আর ঠাকুর আমাকে ডেকে পাঠান। তিনি বললেন, আপনার আদেশে এই লােকগুলি প্রাণ হারিয়েছে। আমি জবাবে বললাম, কিন্তু আমি আমার আদেশ কার্যকর করতে হলে তাে পরিস্থিতি-অনুযায়ী আমাকেই তাে সেটি করতে হয়, সেটি কী করে সম্ভব? কাকে আমি সে আদেশ দিয়েছি? আমি একা গিয়ে লােকগুলিকে হত্যা করতে পারি? আমার তাে কোনাে সৈন্য ছিল না!
প্র: ঐ লােকগুলি কারা ছিল? উ: ওরা সবাই ছিল বুদ্ধিজীবী…
১২০

প্র: বাংলাদেশ দখলমুক্ত হওয়ার পর বঙ্গভবন মানে গভর্নর হাউসে কিছু লিখিত দলিল পাওয়া যায়। তাতে যেসব বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়েছে তাদের নামের একটা তালিকা পাওয়া যায় যা আপনার হাতের লেখা।
উ: আমার লেখা নয়। গভর্নর হাউসে তখন অনেক লােক আমার কাছে। আসত দেখা করার জন্য। ওরা আমাকে এ-ধরনের তালিকা দিত। আমি কখনও…
প্র: কিন্তু তা দিত কেন? কী কারণে?
উ: ওরা ছিল পাকিস্তানবিরােধী। তাই ওদের ওসব আমি রেখে দিতাম বটে তবে সেগুলির ওপর কোনাে অ্যাকশন নিতাম না। আর এই একইসব তালিকা কোর কম্যান্ডারকেও দেওয়া হতাে। এই লােকগুলি এখানে-সেখানে নানা জায়গায় যাতায়াত করত। তাদের দেওয়া এসব কোনাে গােয়েন্দাতথ্য ছিল না কিন্তু ওদের কাজ ছিল সুযােগ-সুবিধে বাগিয়ে নেওয়া। প্র: কিন্তু রাও সাব, আপনি তাে নিরপেক্ষ তথ্যমাধ্যমগুলাের বিরুদ্ধে ছিলেন, তাই নয় কি?
উ: কিন্তু… আপনিই বলুন, কোনাে ব্যক্তির একার পক্ষে ১৬ ডিসেম্বরের রাতে যাওয়া ও…।
প্র: না, না, ঘটনা তাে ঘটে ১২, ১৩ ও ১৪ ডিসেম্বর রাতে।
উ: না, আমার কোনাে ধারণা নেই। তবে আমি আপনাদেরকে একজন সম্পর্কে বলব যার কথা জেনারেল নিয়াজিও বলেছেন। আমার মনে পড়ে তিনি। হয়ত ছিলেন বিবিসি প্রতিনিধি। ঘটনা এই যে, ৭ ডিসেম্বর বিবিসি এই বলে খবর প্রচার করে যে, জেনারেল নিয়াজি পালিয়ে গেছেন আর রাও ফরমান তার জায়গায় দায়িত্ব নিয়েছেন আসলে এটি সম্ভব ছিল না কেননা, আমি ছিলাম জুনিয়র পদে। কোর হেডকোয়ার্টার থেকে আমার কাছে টেলিফোন আসে। তাতে বলা হয়, কে এই লােকটা দেখ, তাকে বললা এরকম খবর তার দেওয়া উচিৎ হয় নি বা প্রকাশ করবে না। সে-অনুযায়ী আমি বিবিসি সংবাদদাতাকে টেলিফোন করি। সম্ভবত ঐ সংবাদতাতার টেলিফোনের সাথে সিস্টেম রেকর্ডার ছিল। তবে সে যা-ই হােক, লােকে জানত না যে, আমি সেনাবাহিনীর লােক হলেও সেখানে দুটি আলাদা সত্ত্বার অস্তিত্ব রয়েছে। সেনাবাহিনীর আদেশ কার্যকর করার ব্যাপারে আমার আদৌ কোনাে গরজ ছিল না। কেননা আমি সেনাবাহিনীর অধীনে ছিলাম না। আমি সেই সংবাদদাতাকে তাই বললাম যে, কে ভাই দেখিয়ে, সেনাবাহিনী হয়ত আপনার বিরুদ্ধে খুব কড়া অ্যাকশান নিতে পারে, আমি আপনাকে সাহায্যের উদ্দেশ্যেই। বলছি, আপনি এ-ধরনের খবর আর বাইরে পাঠাবেন না। আর এটাই আমার বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছে। ব্যবহার করেছে সেটা আন্তর্জাতিক তথ্যমাধ্যমগুলি। এসব মাধ্যমে আরও বলা হয়, রাও ফরমান আলি শুধু কাজটাই করেন নি, তাকে শাসিয়েছেনও। আমি তাকে এই বলে হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলাম, না, আসলে যা ঘটেছিল তা হলাে সরকারের একজন সাবেক সচিব। তিনি ছিলেন গভর্নরের সচিব,
হুসেন বা এই নামের কেউ। তিনি আমার সাথে দেখা করে জানান, অনেক লােককে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। আপনি আমাকে বাঁচাতে পারেন। আমি বললাম, কে। গ্রেপ্তার হয়েছে বলুন? তিনি জানালেন, লােকজনকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে অথচ আমি সে-সম্পর্কে কিছুই জানি না। এখন আপনাদেরকে আমি জানাই যে, তখন সেনাবাহিনীর নিজস্ব একটা জেল ছিল, যা আমাদের কারও জানা ছিল না। তারা লােকজন ধরে সেই জেলে ভরে রাখছিল। আমরা গভর্নর হাউজের কেউ এ-ব্যাপারে কিছুই জানতাম না। আমরা জানতাম যে তাদের একটা জেল আছে। বটে কিন্তু সে জেল সেনাবাহিনীর লােকেরা যে-সব অপরাধ করে সেসবের জন্য ওটা ছিল তাদের কথামতাে তাদের জেলখানা। অন্যথায় ব্যাপার যদি বুদ্ধিজীবীদেরই হয়ে আমার পক্ষে তাদের খোঁজখবর নেবার ও তাদের সাথে আমি দেখা করতে আমার পক্ষে কেমন করে যাওয়া সম্ভব?
প্র: জেনারেল নিয়াজি এ-দাবিও করেছেন যে- আর আপনি তাে জানেনই যে, আপনার বই আগে আর পরে বই বেরিয়ছে নিয়াজির। এখন তিনি তাে’ পুরােপুরি দোষ আপনার ঘাড়েই চাপিয়ে দিয়েছেন। কাজেই উপায় বলতে তাে হাতে থাকে আপনার আরেকটা বই লেখা, লিখে ব্যাখ্যা করা
উ: না, তবে আমার মনে হয় আমি যখন ভারতে ছিলাম ঘটনা তখন যা ঘটে। তা হলাে, ভারতীয় সেনাবাহিনী আমার বিরুদ্ধে কোনাে একটা বিষয়কে কেন্দ্র করে আমার বিচার করার ব্যাপারে বেশ একপায়ে খাড়াই ছিল। তারা ইপিআর থেকে। ৫০ জনকে গ্রেপ্তার করে। তাদের মধ্যে ছিলেন ব্রিগেডিয়ার বশির। তাদের সবাইকে এই বলে প্রস্তাব দেওয়া হয় যে, যারা জেনারেল ফরমানের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে তাদেরকে সবার আগে পশ্চিমপাকিস্তানে তাদের নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে যেতে দেওয়া হবে। তাদেরকে কৃতিত্ব দিতেই হয় এজন্যে যে, তাদের একজন। এতে সাড়া দিয়ে জানায় যে, ফরমান খারাপ কিছুই করেন নি। আমিও এ মুহূর্তে দাবি করে বলছি আমি কোনাে কিছু খারাপ কাজ করি নি। আমি সবার আগে পাকিস্তানকে হেফাজত করার চেষ্টা করেছি আর সেটা করেছি কাউকে হত্যা না করে। কেউ যদি দাবি করতে পারে আমি একজনকেও হত্যা করেছি আপনারা আমাকে ফাঁসি-কাঠে লটকে দিতে পারেন। আমি এ-প্রস্তাব দিয়েছিলাম জব্বলপুরে। এমআইআরসিপির কাছে। বলেছিলাম, আমাকে একবার মেহেরবাণী করে ঢাকায় নিয়ে চলুন ও ৫ মিনিটের জন্য হলেও মুজিবের সাথে দেখা করতে দিন। তারপর যদি তিনি আমাকে আলিঙ্গন না করেন তাহলে আপনারা আমাকে নিয়ে যাচ্ছে-তাই করতে পারেন।
প্র: এই এমআই আরসিপি কী? উ: আসলে ওটা বলতে আন্তর্জাতিক রেডক্রস বােঝায়। প্র: তাই নাকি? বেশ। উ: জব্বলপুরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ডেপুটি ডিডিএআই, লেসলি আমার
সাক্ষাৎকার নেন আর সেই সময় আমাকে বলেন, জেনারেল আপনার বিরুদ্ধে ২০০ লােক হত্যার অভিযােগ রয়েছে, … প্র: আপনি এসব জিজ্ঞাসাবাদের কথা আপনার বইতেই বিস্তারিত উল্লেখ করেছেন। আমার তাে মনে হয় ঐ খানেই যেন এখন জেনারেল নিয়াজি বসে রয়েছেন। নিয়াজিকেও কি জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল? উ: বেশ তাে তাহলে ওখানে গিয়ে জিজ্ঞেস করুন আমি কি ঐসব লােকের গ্রেপ্তারের বিরােধিতা করি নি? আর তা যদি আমি করে থাকি আমার তাদের হত্যা করার কথা নয়। তবে সে যা-ই হােক কি আমার ছিল? শুধু ছিল পুলিশ।
প্র: আপনি তাে জেনারেল হিসেবে আদেশ দিতেই পারেন? উ: কিন্তু কাকে? প্র: না, অভিযােগ আছে এ কাজ করেছে আল-বদর ও আল-শামস! উ: না, ওদের উপর আমার কোনাে নিয়ন্ত্রণ ছিল না। প্র: রাজাকারদের ওপর আপনার কোনাে নিয়ন্ত্রণই ছিল না! উ: এ নিয়ন্ত্রণ পরিচালিত হতাে সামরিক আইন সদরদপ্তর থেকে। প্র: সামরিক আইন সদরদপ্তর ওদের কাজে লাগত?
উ: আর ওদের কাজে লাগাতে হলে সেটা করতেন জেনারেল নিয়াজি। আওয়ামী লীগের লােকজনের সাথেই আমার সুসম্পর্ক ছিল। তবে ওরা তখন কোলকাতায় চলে যায়। আমার বেশিরভাগ সময় কাটে যারা তখনও পূর্বপাকিস্তানে ছিল এমন এক বিপুল সংখ্যক লােকের সাথে সম্পর্ক রক্ষায়। আমার অনুমান ওদের সংখ্যা ছিল ৪২/৪৩ জনের মতাে। ওরা ছিল এমএনএ। আমি চেষ্টা করছিলাম যােগাযােগ করতে…।
প্র: ওখানে তাে তখন নতুন একদল এমএনএ নির্বাচিত হয়েছে। কেননা, আপনারা নির্বাচন তত করেছিলেন।
উ: সেটা অনেক পরের কথা। অনেক দেরি হয়ে গেছে তখন। আমার তাে মনে হয় আমরা এ-কথায় পরে আসতে পারি, তার আগে নিশ্চয়ই বিষয়টা পরিষ্কার করে নেওয়া যায়? অবশ্য আপনাদের যদি আপত্তি না থাকে। আপনারা আমার কথায় নির্ভর করতে পারেন।
প্র: না, না, ঠিক আছে। দেখুন, এরকম কথা তাে উঠতেই পারে, উঠেছেও। কিন্তু আমি তাে আর সেখানে সাক্ষী-প্রমাণ নিয়ে বসি নি। আমি আবারও বলি, ঐ নয় মাসে… আপনি কি জানতেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনী তখন বহুলােককে হত্যা করছে, বহু নারী তাদের দ্বারা ধর্ষিত হচ্ছে, ওরা শিশুহত্যা করছে? এটা করা হচ্ছিল পাকিস্তানী বাহিনীর জ্ঞাতসারে, পরিকল্পিতভাবে?
উ: জি হ্যা। ঐ সময় আমি চেষ্টা করেছিলাম ব্যবস্থা নিতে। আমি সেনাবাহিনীর স্টাফপ্রধান জেনারেল আবদুল হামিদকে একথা বলেছিলাম ও কিছু। কিছু লােকের নামও তাকে বলেছিলাম যাদেরকে সেনাবাহিনী হত্যা করে তাদেরকে

বন্দি করার পর। এসব নামের মধ্যে সাইদুজ্জামান। প্র: সেনাবাহিনীর লােকেরা দুই একজনকে ধরে নি বা হত্যা করে নি, সেকথা আমি বলছি না। আমি বলতে চাই এভাবে বহু লােক বন্দি হয়েছে, বহু লােককে হত্যা করা হয়েছে… এদের সংখ্যা অনেক বেশি, গণহত্যা।
উ: ঠিক নয়। গণহত্যা হয়েছে আমি সেকথা মেনে নিচ্ছি না। সামরিক পরিভাষায় গণহত্যার ব্যাখ্যা রয়েছে। গণহত্যা হয় তখনই যখন আপনি কোনাে রকম কারণ ছাড়াই মানুষ মারতে শুরু করেন।
প্র: তার মানে তাহলে কোনাে যুদ্ধই হচ্ছিল না বসনিয়া কিংবা হারজেগােভিনায়?
উ: ওটা অবশ্য গণহত্যা।
প্র: জাতিগােষ্ঠীগত মানুষকে এভাবে মেরে সাফ করা নাসল বদলা দেনা’র মতােই খারাপ কাজ।
উ: উওতাে খায়র হােগা। আমি মনে করি না তিনি সেটি করেছিলেন। আমার অন্তত জানা নেই। আমার ধারণা তিনি তা করেন নি। তিনি শুধুই হয়ত আলগা জবানে কথা বলছিলেন। তবে আমি মনে করি না ওটা ঘটেছিল, যেখানে সম্ভব…। সামরিক আইন হলাে বেসামরিক আইন ভেঙে পড়ার চূড়ান্ত পরিণতি। আর সে-রকম অবস্থাতেই সামরিক আইন আসে। আর সামরিক আইন ব্যর্থ হলে সামরিক কার্যব্যবস্থা তার জায়গা নেয়। সামরিক আইন ব্যর্থ হবার পর অর্থাৎ আমি বলতে চাই, আমরা আমি ও গভর্নর ব্যর্থ হবার পর সেনাবাহিনী আমাদের জায়গায় অবস্থান গ্রহণ করে কিন্তু এই সেনাশাসনই পূর্বপাকিস্তানে নয়মাস অস্তিত্বশীল ছিল, গভর্নরের শাসন নয়।
প্র: তার মানে বলতে চান বসনিয়া-হারজেগােভিনায় যা ঘটছে তা গণহত্যা, তাহলে আপনাদের সামরিক ব্যবস্থা কেন গণহত্যা হবে না?
উ: আমি দাবি করি, ওটা গণহত্যা ছিল না। ওতে বেশি প্রাণহানি ঘটে নি। প্র: তাহলে আন্তর্জাতিক দুনিয়ার তামাম তথ্যমাধ্যম যা বলেছে তা ভুল?
উ: না, না, সেকথা সত্যি নয় যে আমরা যারা ঢাকায় ছিলাম তারা বলেছে ঘটনা গণহত্যা ছিল না। গণহত্যা চালানাে হয় একটা মতলব নিয়ে, মতলব নিয়ে মানুষ মারা হয়। আর আমাদের কথা যদি বলেন তাহলে আমি বলব আমরা সেনাবাহিনী থেকে আলাদা ছিলাম।
প্র: আপনারা উভয়েই ছিলেন জেনারেল, তাহলে কেন…? উ: না, না, অনেক জেনারেলই তাে ছিল।
প্র: না, আপনারা সেনাবাহিনী থেকে আলাদা কেউ ছিলেন না তবে আমি জানতে চাই, আপনার কি জানা ছিল না যে, পূর্বপাকিস্তানে তখন ঐ সব ঘটনা ঘটে চলেছে?
উ: আপনারা যে-মাত্রায় বলছেন সেই মাত্রায় নয়।

প্র: আচ্ছা সে কথা যাক। উ: ওটা হলাে আমার অভিমত। প্র: আন্তর্জাতিক সংবাদপত্র এসব ঘটনার খবর প্রচার করেছিল?
উ: জ্বি! ইয়াহিয়া ওদের বের করে দেন বলেই আন্তর্জাতিক পত্রপত্রিকা, রেডিও-টিভি চটে যায়। ইয়াহিয়ার কাজটি ঠিক হয় নি! ওরা ওদের মতাে ছিল।
প্র: আসলে ওদেরকে বের করে দেওয়া তাে আর ঠিক হয় নি ওরা কার্যত ফিরে আসে ও বিস্তারিত আলােকচিত্রসহকারে তখনকার অবস্থার খবর পরিবেশনও করে। ফটোগ্রাফ ও আরও সবকিছু উপকরণসহকারেই ওরা ঐসব খবর দেয়। আমি বলতে চাই, এখন তাে আপনার কাছে তখনকার নেপথ্যে থাকা ব্যাপারগুলি পরিষ্কার। এখন যদি অনেকে আপনার এই দাবি মেনে নিতে তৈরিও থাকে যে, এমনকি হত্যাকাণ্ডের শতকরা একশতাংশের জন্যেও আপনি বা আপনারা দায়ী নন… এই দাবি আপনি করেছেন অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে তবু কেউ-না-কেউ তাে এটা করেছে সে-বিষয়ে তাে আপনার এখন সংশয়ের কোনাে অবকাশ নেই?
উ: তবে কোন পরিস্থিতে যেই সেনাবাহিনী আইনের সীমা অতিক্রম করে থাকুক সে তার জন্য দায়ী তবে গােটা অবস্থাটাও বিবেচনায় নেওয়া দরকার… এ-যুক্তি মেনে নিতে হবে। প্র: জেনারেল নিয়াজি যদি তখন যুদ্ধ লড়েই থাকেন আর সেটি যদি যুদ্ধাবস্থা হয়ে থাকে তাহলে যুদ্ধে যে এসব ঘটনা ঘটে সেটা কারও বােধগম্য হবে না তাে বিশ্বাযযাগ্য নয়। তবে কথা হলাে এই যে, আপনি পরিষ্কার উল্লেখ করেছেন, নিয়াজির কথায় তিনি তখন অবস্থান করছিলেন দুশমনের দেশে। স্পষ্টতই তিনি যুদ্ধ লড়ছিলেন। আমি বলতে চাই যে, যদি তর্কের খাতিরে হলেও ওটা মেনে নেওয়া হয়, আমি আর যা-ই হােক বিশ্বাস করতে পারছি না যে, ঐ সময়কার একজন সক্রিয় জেনারেল হিসেবে আপনি এত ব্যাপক আকারের হত্যাকাণ্ডের কথা জানতেন না।
উ: আমি ২০ লাখ লােক নিহত হওয়ার হিসাব মেনে নিতে পারি না। প্র: না, আমরা তাে ওটা নিয়ে তাে তর্কাতর্কিতে যেতে চাচ্ছি না। উ: সংখ্যা ৪০/৫০ হাজারের মতাে হবে। প্র: তাহলে আপনার বিবেচনায় এই ৪০/৫০ হাজার বিরাট সংখ্যা নয়? উ: না, এটা…। প্র: সেনাবাহিনী নিরীহ, নির্দোষ লােকদের হত্যা করেছে।
উ: জ্বি হাঁ, সংখ্যাটি বিরাট। আমি স্বীকার করছি সংখ্যাটি সত্যিই বিরাট। তবে একই সাথে বলব ৭ থেকে ২৮ তারিখের ভেতরে কি সব ঘটেছে সেদিকেও দৃষ্টি দিতে। এক বিপুল সংখ্যক লােক তখন প্রাণ হারায়। ওদের শনাক্ত করা যায়। আমাদের ইপিআর-এর সব পশ্চিমপাকিস্তানী এনসিওকে হত্যা করা হয়। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সকল জেসিওকে হত্যা করা হয়। পাবনায় ঘেরাও করে রাখা সকল সৈন্যকে জবাই করা হয়।
১২৫

প্রশ্ন: নিয়াজি এই বিশেষ ঘটনার উল্লেখ করেছেন। তিনি ২০০০ অফিসার হত্যার কথা বলেছেন। এ-ব্যাপারে আপনার অভিমত কী, বলবেন?
উ: সেনাবাহিনীর অফিসার নয়।
প্র: সেনাবাহিনীর অফিসার ও তাদের পরিবার-পরিজনদের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন এ-সম্পর্কে পত্রপত্রিকায় কোনাে খবর প্রকাশিত হলাে না কেন? অন্তত পাকিস্তানী ও আন্তর্জাতিক পত্রপত্রিকায় সে-খবর তাে ছাপা হওয়া উচিৎ ছিল?
উ: ২০০০?
প্র: জ্বি, দুই-তিন হাজার বা এরকম। এটা ঘটে ৭ থেকে ২৫ ডিসেম্বরের মধ্যে। পূর্বপাকিস্তানে অবস্থানকারী সকল সেনাবাহিনী অফিসারদেরকে হত্যা করা হয়, তাদের স্ত্রীদের ধর্ষণ ও হত্যা করা হয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
উ: যে সেনা অফিসারদের হত্যা করা হয় তাদের খবর আমি জানি। সেটাই। আমি আপনাদেরকে বলছি। ঢাকা অঞ্চলে সেনাবাহিনীর দুজন অফিসারকে হত্যা করা হয়। এদের একজন হলাে ক্যাডেট কলেজের কম্যান্ডান্ট ও সেন্টার কম্যান্ডান্ট জানজুয়া। জানজুয়াকে হত্যা করে তার স্ত্রীকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। এই দুই অফিসারের একজনের স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন, তার গর্ভস্থ সন্তান বের করে ফেলা হয়। এরকম কিছু ঘটনা আছে। বগুড়ায় একটা ছােট সামরিক অস্ত্র-গুদাম ছিল। সেটির দায়িত্বে নিযুক্ত ছিলেন একজন মেজর। তাকে হত্যা করা হয়। হত্যা করার পর তার মাথা নিয়ে ওরা ফুটবল খেলে আর তার স্ত্রীকে সে-দৃশ্য দেখার জন্য সেখানে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়।
প্র: কখন?
উ: এই সময়ে। ৭ থেকে ২৫ মার্চের মধ্যে। এক বিরাট সংখ্যক বিহারিকে হত্যা করা হয়।
প্র: সৈয়দপুরে?
উ: আমি বলছি, কেয়া নাম হ্যায়…. কি জায়গাটার নাম, মনে আসছে না। তবে এক বিপুলসংখ্যক বিহারিকে হত্যা করা হয়। শহরের একটি এলাকায় ৫০০ নারী ও শিশুর লাশ পাওয়া যায়। তাদের পরিবারের পুরুষ লােকদের হত্যা করে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। একজন পশ্চিমপাকিস্তানী অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার ও আইবি প্রধানের জামাতাকে টাঙ্গাইলে টানাহ্যাচড়া করে মারা হয় ও যশাের এলাকায় দুজন অফিসারকে হত্যা করা হয়।
প্র: তাহলে কি একে বলা যাবে… এ ছিল একধরনের প্রতিশােধমূলক হত্যাকাণ্ড?
উ: না, তা নয়। এ ঘটনা ঘটে ৭ ও ২৩ মার্চের মধ্যে যখন ওরা দেশের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে তুলে নেয়। তার আগে কিছুই ঘটে নি। প্র: তাহলে ঐ ঘটনা কেন পাকিস্তানী সংবাদপত্রে ছাপা হলাে না? পূর্বপাকিস্তানী সংবাদপত্রেও কেন ছাপা হলাে না। তখন আমরা তাে ঢাকাতেই।

ছিলাম। আমরা একাগ্র মনােযােগ দিয়ে তখন পূর্ব-পশ্চিমপাকিস্তান সব জায়গার খবরের কাগজই পড়তাম।
উ: কিন্তু ভাসানী তাে চট্টগ্রামের হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে এক বিবৃতি দিয়েছিলেন। চট্টগ্রামের রেলের সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে হত্যা করা হয়েছিল.. এ-কথা কি সত্যি নয়?
প্র: ২৫ মার্চের পরে? উ: না, ২৫ মার্চের আগে।
প্র: না, তারা বেশ আগে নিহত হয়েছিল। তা সে যা-ই হােক, এসব পরিস্থিতির জন্য আপনার কি কোনাে অনুশােচনা জাগে?
উ: জাগে, সেটা এমনকি এখানেও! একটিমাত্র দিনের ভেতর আমার সাথে তিন ব্যক্তি বা দলের সাথে ঐ সময় দেখা হয়। একজন হলেন কুমিল্লায় তখনকার ডেপুটি কমিশনারের স্ত্রী, বিহারি মহিলাদের এক প্রতিনিধিদল ও পশ্চিমপাকিস্তানী অফিসারদের একটি প্রতিনিধিদল। আমি তখন অবস্থা দেখে কাঁদছিলাম কেননা, আমি তাে মনেপ্রাণে একজন পাকিস্তানী! পশ্চিমপাকিস্তানী বা পূর্বপাকিস্তানী আমার কাছে তাে সবাই সমান!
প্র: গােটা ঐ সময়টায় মানে আপনার নিজের কার্যকলাপ, সেনাবাহিনীর নেওয়া ব্যবস্থা… এগুলির জন্য কোনাে অনুভূতি…?
উ: অত্যন্ত বেদনাদায়ক! এরকমটা ঘটা উচিত ছিল না। প্র: আপনি কি এজন্য ব্যক্তিগতভাবে অনুশােচনা বােধ করেন? উ: আমি যা করতে পারতাম তা করতে পারি নি বলে… প্র: শুধু সেসব কাজই করেছেন যা আপনার করা উচিত ছিল না, তাই নয় কি?
উ: না, আমি যা-ই করেছি সেটা করেছি আমার সর্বোচ্চ সামর্থ্যে ও বিবেকের তাড়নায়। আমার ধারণা, আমার তখনকার কাজ নিয়ে আমার কোনাে অনুশােচনা নেই। তবে আমার এমন একটা অনুভূতি আছে যে, তখন ইস্তফা দিতে পারলেই বােধহয় ভালাে ছিল। আপনারা জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুবকে জিজ্ঞাসা করলেই জানতে পারবেন যে আমি সেটা চাইলেও তিনি আমাকে হুশিয়ার করে বলেছিলেন যে, তােমার এ-জন্য কোর্ট মার্শাল হতে পারে।
প্র: তা বাংলাদেশের মানুষের জন্য আপনার কোনাে বার্তা আছে কি?
উ: দেখুন, আমি পাকিস্তানী। আমি এখনও মনে করি, পাকিস্তানের সৃষ্টি যদি ঠিক হয়ে থাকে, পাকিস্তানকে হেফাজত করতে চাওয়াও বেঠিক হতে পারে না। যদি পাকিস্তানের সৃষ্টি না হতাে, কখনও বাংলাদেশের অভ্যুদয় হতাে না।
প্র: তাঁর (জেনারেল নিয়াজির) বইতে তিনি যা লিখেছেন তার বক্তব্য হলাে আপনিই নিয়াজির পতনের জন্য দায়ী। মানে আমি বলতে চাই, তিনি আত্মসমর্পণ করতে চান নি। কিন্তু আপনি সকল কলকাঠি ঘুরিয়েছেন।
উ: আচ্ছা! তাহলে রুশদের নিয়ে বকওয়াজ! কিন্তু তা কি সম্ভব? তাহলে
সেটা হবে ইতিহাসের প্রথম ঘটনা যার আওতায় একজন বেসামরিক লােক একজন জেনারেলকে সারেন্ডার করিয়েছে।
প্র: তাহলে আত্মসমর্পণের দলিলটির খসড়া আপনি লিখলেন কেন? উ: আমি লিখি নি। প্র: আপনি তাে বার্তা পাঠিয়েছিলেন জাতিসংঘে, তাই না।
উ: ওটার খসড়া তৈরি করেছিলেন ঐ সময়ে পূর্বপাকিস্তান সরকারের প্রধান সচিব সৈয়দ মুজাফফর হুসেন ও গভর্নর। মুজাফফর এটির খসড়া লিখেছিলেন আর আমি ও মুজাফফর হুসেন দুজনে একত্রে সেটি নিয়ে যাই জেনারেল নিয়াজির কাছে। তাকে আমরা বলি যে, কেন্দ্রীয় সরকার এই মর্মে বার্তা পাঠিয়েছে যে, পূর্বপাকিস্তানে আপনারা আপনাদের বিবেচনামতাে ব্যবস্থা নিতে পারেন। এর আগে জেনারেল নিয়াজি পশ্চিমপাকিস্তানে দু’দুটি সঙ্কেত বা বার্তা পাঠিয়েছিলেন তিনি কি তার বরাত দিয়েছেন? সে-বার্তায় তিনি বলেছিলেন, আমি লড়াই চালিয়ে যেতে পারি এখনও।
প্র: আমার ধারণা এ-বিষয়টির উল্লেখ রয়েছে জেনারেল গুল হাসানের বইতে।
প্র: তিনি বলতেই পারেন যে, তিনি আরও দুদিন বা আরও কয়েকটা দিনের জন্য লড়াই চালিয়ে যেতে পারেন। এখন যদি প্রমাণিত হয় যে আপনি মাত্র কয়েকটা দিনের জন্যই লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখেন তাহলে আমাকে আর নন্দঘােষ বানানাে কেন? আমি বরং চেষ্টা করছিলাম যাতে অস্ত্রবিরতি হয়, আত্মসমর্পণ নয়। অস্ত্রবিরতি আত্মসমর্পণের চেয়ে ঢের ভালাে। কাশ্মীরে ভারতীয়রা অস্ত্রবিরতি করেছে আর ওরা আজও সেখানে আছে। আমরা তাে একটা অস্ত্রবিরতি করতে পারতাম।
প্র: ঠিক ব্যাপারটা ওরকম নয় কারণ ভুট্টো জাতিসংঘে ঐ সময়ে যখন যান। তখন অস্ত্রবিরতির চেষ্টা করেছিলেন।
উ: না, তিনি তা করেন নি। বরং তিনি সে-সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করেছিলেন। অন্যথায় একটা অস্ত্রবিরতি সম্ভব ছিল, আমরা সবাই একসাথে বসে আলােচনা করে ঢাকায় পূর্বপাকিস্তানের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে একটা সরকার গঠনের সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারতাম। তাই আমার মতে অস্ত্রবিরতি সম্ভব হলে আর আত্মসমর্পণের প্রশ্নই উঠত না। অবমাননাকর অবস্থা হতাে না, যা কিছু ঘটেছে তা ঘটত না। পূর্ব ও পশ্চিম একসাথে বসতে পারত আর তারপর একটা সমাধানও হয়তাে পাওয়া যেত। তবে ভারতীয় বাহিনী ঢাকায়, পূর্বপাকিস্তানে প্রবেশের সাথে সাথে পূর্বপাকিস্তানী জনসাধারণের মেজাজমর্জি পাল্টে যায়, অন্তত আমার কাছে তাই মনে হয়েছে যদিও ঠিক জানি না তা কেন। আপনাদের মনে থাকতেও পারে কেননা বিষয়টির চর্চা করছেন এখন আপনারা, আবার না-ও পারে যে, এরকম একটা অনুভূতি প্রভাব ফেলে যে, হয়ত পাকিস্তানী বাহিনীর স্থলাভিষিক্ত হচ্ছে ভারতীয় বাহিনী দিয়ে।

প্র: না, না, তা নয়! বরং আমরা খুশি ছিলাম এ-কারণে যে ওরা আমাদেরকে পাকিস্তানী বাহিনীর সাথে লড়তে সাহায্য করেছে। কেননা, পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ঐ ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটিয়ে চলেছিল তখন। আমরা ঐ সময় ঢাকায় ছিলাম। ঐ সময় ঐ সব ঘটনা ঘটছিল আর সে-কারণেই অনুভূতি ছিল ভিন্নধরনের। আপনারা ক্ষমতায় ছিলেন। ছিলেন ক্ষমতার আসনে। আপনাদের অনুভূতি আমাদের সাথে এক হবার কথা নয়। আমরা তা বুঝি। তবে কথা হলাে, ইদানীং পাকিস্তানের পত্রপত্রিকায় একটা বিতর্ক চলেছে। কেউ একজন লিখেছেন যে, বাংলাদেশে যা ঘটানাে হয়েছে সে-সবের জন্য পাকিস্তান সরকারের উচিত পাকিস্তান সরকারের ক্ষমা চাওয়া। এ আপনার প্রতিক্রিয়া কী, বলবেন?
উ: আমার মতে ব্যাপারটা পারস্পরিক হওয়া উচিৎ। প্র: কেন তা হওয়া উচিৎ? উ: আমার ধারণা, উভয় তরফই ভুল করেছে। প্র: তার মানে আপনার কথার ব্যাখ্যা হলাে উভয় তরফই ভুল করেছে?
উ: উভয় পক্ষই। পূর্বপাকিস্তানে যা ঘটেছে তার তিনটি পর্যায় রয়েছে: এক, পূর্বপাকিস্তানকে নিজের কলােনি মনে করা পশ্চিমপাকিস্তানের একেবারেই ঠিক হয়নি; পূর্বপাকিস্তানীদের ক্ষমতা না দেওয়া বা ক্ষমতায় অংশীদার না করা ভুল হয়েছে। দুই, পুর্বপাকিস্তানে যেভাবে বিক্ষোভ-আন্দোলন শুরু হয় তা ছিল মাত্রছাড়া; আর তিন, পাকিস্তানের সেনাবাহিনী আইন-শৃঙ্খলা পুন:প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে সৈন্য লেলিয়ে দিয়ে ভুল করেছে।
প্র: তা হলে কী করতে হবে আর কে করবে প্রথমে সেটা?
উ: প্রথমে আমাদের স্থির করতে হবে, আমাদের পাকিস্তানের মানে পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও ভারত সম্পর্কে আমাদের ধারণা পুরনাে দিনগুলিতে কী ছিল।
প্র: এটা হবার নয়। আমার মনে হয় না যে সেটা এখন আর সম্ভব। সে-যুগ হয়েছে বাসি। এখন আপনি আর সেই পুরনাে ধারণা নিয়ে বসে থাকতে পারেন।।
উ: আমি আসলে বলতে চাই, আমরা এখনও অভিন্ন বিপদেই আছি যে বিপদ, যে আশঙ্কা পাকিস্তান সৃষ্টির আগে ছিল। যদি আমাদের সে-উপলব্ধি থাকে তাহলে এক না হতে পারলেও আমাদের একে অন্যের আরও কাছাকাছি আসা উচিত। এক রাষ্ট্র আমরা হয়ত হতে পারব না। আমার মতে জনাব সুহরাওয়ার্দি হয়তাে বা এ ব্যাপারে সঠিক চিন্তাভাবনার অধিকারী ছিলেন। তবে বাংলাদেশের প্রশাসনিক কাঠামােটি নেই। যদি আপনাদের এমন কোনাে উপলব্ধি থেকে থাকে যে, হিন্দুরা ভারতে আধিপত্যশীল। আমাদেরকে ভারতীয় নয় বরং সে হিন্দু মানসিকতার আধিপত্যে পড়তে হবে, ওরা আমাদেরকে দেখবে অচ্ছুত, ম্লেচ্ছ হিসেবে যেমনটি তারা আমাদের দেখে এসেছে অতীতেও তাহলে তেমন এক প্রেক্ষাপটে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া দরকার… এমন একটি মনােভাব বা অনুভূতি বাংলাদেশ ও

পাকিস্তান মধ্যে গড়ে উঠতে পারে। আর সেটায় যদি আমাদের পারস্পরিক স্বার্থের অনুকূল হয় তাহলে আমাদের উভয় তরফের উচিত হবে এ-বিষয়ে একমত হওয়া যে আমরা নিভৃতে একপক্ষ বলব, আমাদের মাফ করে দিন, অন্যপক্ষ বলবে আমরাও দু:খিত। কেননা, আমরা যা করেছি তার জন্য কোনাে পক্ষকে একতরফাভাবে অপরাধের জন্য সাফ কবুল করতে না বলে বরং এটায় একটা রাজনৈতিক ভাষা দেবার দরকার রয়ে গেছে। তবে পষ্টাপষ্টি রাষ্ট্রীয় ক্ষমার প্রার্থনার আনুষ্ঠানিকতা বা এ-ধরনের কিছু বলা পশ্চিম পাকিস্তানের সামর্থ্যে না-ও কুলােতে পারে। যেমন, আমি বলতে পারি, আমি দু:খিত, মেহেরবানি করে আমাকে মাফ করাে, ভাই!
২০ উল্লিখিত বইগুলিতে জেনারেল গুলাম উমরের নাম পেলাম যিনি ১৯৭১ সালে ইয়াহিয়ার ঘনিষ্ঠ এবং ন্যাশনাল সিকিউরিটির সচিব ছিলেন। তিনি কোনাে আত্মজীবনী লেখেন নি। সম্প্রতি, করাচি গেলে তার সঙ্গে দেখা করে ১৯৭১ নিয়ে আলাপ করি। তিনি যা বলেছেন তার সঙ্গে আগে যে ইতিহাসতত্ত্বের আলাপ করেছি তার কোনাে অমিল নেই। শুধু তাই নয়, দেখা যাচ্ছে নিজের কৃতকর্ম ঢাকার জন্য অতিরঞ্জন করছেন বা সত্য লুকিয়েছেন যা অত্যন্ত স্বাভাবিক। সত্য। যাচাইয়ের জন্য তখন সংশ্লিষ্ট অন্যদের সঙ্গে আলাপ করেছি। তখন পাওয়া যাচ্ছে। অন্য তথ্য। এ পরিপ্রেক্ষিতেই বিচার করব মেজর জেনারেল (অব) গুলাম উমরের প্রদত্ত ১৯৭১ সম্পর্কিত তথ্যাবলি। তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎকারের পর আমার মনে হয়েছে, পরাজিত পাকিস্তানী জেনারেলদের পূর্বপাকিস্তান ও বাঙালিদের সম্পর্কে কিছু পূর্ব ধারণা আছে যা থেকে তারা মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত বদলাতে পারবেন না। এবং এই পূর্ব ধারণাই তাদের সমস্ত রচনার ভিত্তি যার কথা আগেই উল্লেখ করেছি।
করাচির খায়াবান শেহারে মেজর জেনারেল গুলাম উমরের বাড়ি। দরজায় একজন নয় দু’জন সশস্ত্র শান্ত্রী। উমর সত্তর পেরিয়েছেন কিন্তু এখনও সুস্থ ও সবল, শুধু একটু খুড়িয়ে হাঁটেন। তাঁর বাড়িটি চমৎকারভাবে সাজানাে গােছানাে, লনের একপাশ ফুলে ভরা। উমর জানালেন, এগুলির সব কৃতিত্ব তার পুত্রবধূর।
উমরের জন্ম আম্বালায়, আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স করেছিলেন। মােহাম্মদ আলি জিন্নাহর উৎসাহে তারপর সেনবাহিনীতে যােগ দেন (১৯৪০)। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানে হিজরত করেন। পূর্বপাকিস্তানেও ছিলেন কিছুদিন। সেনাবাহিনীতেই থাকার সময় লন্ডন ও ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেন। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর মিলিটারি অপারেশনের ডিরেকটর জেনারেল ছিলেন। বাদশাহ ফয়সলের সামরিক সচিব হিসেবেও কাজ করেছেন। ১৯৭১ সালে ইয়াহিয়া খানের নিরাপত্তা কাউন্সিলের সচিব হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত
১৩০

পশ্চিমপাকিস্তানের একটি ডিভিশনের কমান্ডার হিসেবে কাজ করছিলেন।
জেনারেল উমর কিন্তু বাংলাদেশেও পােস্টেড ছিলেন। তার ভাষ্য-অনুযায়ী। ১৯৫৮ সালে প্রথম তাঁকে পােস্টিং দেয়া হয় তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানে। পূর্বপাকিস্তানের পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের বলেছিলেন পাকিস্তানের জন্য প্রয়ােজন নিজস্ব সামরিক তত্ত্ব যা নির্ধারিত হবে নিজ প্রয়ােজনে। সুতরাং পাকিস্তানকে নিজস্ব সামরিক তত্ত্ব তৈরি করতে হবে। খুব সম্ভব তার অ্যাকাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ডের জন্য তিনি আইয়ুব খানের নজরে আসেন। পাকিস্তানের সামরিক তত্ত্ব তৈরির ভার দেয়া হয় তার ওপর। চার বছর এ-দায়িত্বে ছিলেন এবং সে পরিপ্রেক্ষিতে কয়েকবার এসেছিলেন বাংলাদেশে। ১৯৬২ সালে সামরিক বাহিনী প্রধান জেনারেল মুসা তাকে জিজ্ঞেস করলেন, “তােমাকে পূর্বপাকিস্তানে পােস্টিং, দিতে চাই আপত্তি আছে?’
সুতরাং একজন লে. কর্নেল হিসেবে তিনি এলেন ঢাকায়। জেনারেল ওয়াসি উদ্দিন তখন জিওসি। উমর জিএসও। ওয়াসিউদ্দিনকে উমর বলেছিলেন, “আপনি। আমাকে মার্শাল ল’র কোনাে কাজ দেবেন না। আমি আমার কাজ করব।” তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের প্রতিরক্ষার অবস্থা কী ছিল? উমর বলছেন, সেখানে তখন কোনাে গােলন্দাজবাহিনী ছিল না, মর্টার ব্যাটারি ছিল একটি, আর দুটি যুদ্ধবিমান। ট্যাংক রেজিমেন্টও ছিল না। “আমরা সবসময় বলেছি”, বললেন উমর, “ডিফেন্স অব ইস্ট লাইস ইন দি ওয়েস্ট, এটা বােগাস থিউরি। ব্রিটিশরা প্রথম এই কথা শুরু করেছে, তারপর সবাই আউড়ে গেছে।”
প্রেসিডেন্ট আইয়ুব সেই সময় এসেছেন ঢাকায়। উমর জিওসিকে বললেন প্রেসিডেন্টকে সহ একটি মিটিং ডাকতে, যেখানে তিনি পূর্বপাকিস্তানের সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরবেন। তুলে ধরলেনও, “যদি যুদ্ধ বাধে ভারতের সঙ্গে, চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন উমর, তা হলে এখানকার অবস্থা কী হবে?” “ভারতের তেমন কোনাে ইচ্ছে নেই”, উত্তরে জানালেন কর্মকর্তারা। পশ্চিমা কর্মকর্তাদের তবুও অনুরােধ জানানাে হলাে তারা যেন একটি ট্যাংক ও একটি আর্টিলারি রেজিমেন্ট পাঠান পূর্বপাকিস্তানে।
এর ছয় মাস পর উমরকে বিদেশে একটি কোর্স করার জন্য বদলি করা হয়, বদলি করা হয় ওয়াসি উদ্দিনকেও। আগা মােহাম্মদ ইয়াহিয়া খান এলেন জিওসি। হয়ে। তিনি উমরকে বললেন, “তােমার এখন কোর্সে যাওয়া চলবে না, আমাকে সাহায্য কর।” সেই থেকেই কি উমরের সঙ্গে ইয়াহিয়ার ঘনিষ্ঠতার শুরু? যে কারণে ১৯৭১ সালে ইয়াহিয়া তাকে নিরাপত্তা কাউন্সিলে নিয়ে এলেন। ১৯৬৫ সালে যুদ্ধের সময়”, বললেন উমর, “আমার মনে হয়েছিল, ভারত পূর্বপাকিস্তান। আক্রমণ করবে না?” কিন্তু কেন তার এরকম মনে হলাে? “আমার পূর্বপুরুষ ছিলেন কামেল পুরুষ”, বলে বােঝাতে চাইলেন এ-কামেলত্বের কারণেই তিনি বুঝেছিলেন।
“তারপর?” বললাম আমি।
“তবে, ভারত যদি ১৯৬৫ সালে পূর্বপাকিস্তান আক্রমণ করত তা হলে ছয় ঘণ্টাও পূর্বপাকিস্তানের পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব হতাে না। আর বাঙালিরা তখন বুঝেছিল তাদের কেউ রক্ষা করবে না।”
এরপর উমর বেশ খানিকক্ষণ একধরনের অ্যাকাডেমিক লেকচার দিলেন। বাধা দিলাম না। যদি তার আত্মােপলব্ধি হয় এই বয়সেও, ক্ষতি কী। উমর যা বললেন তার মূল কথা হলাে— গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯৫৮ সালে সামরিক আইনের মাধ্যমে সে-প্রক্রিয়া খর্ব করা হলাে। বলা যেতে পারে পাকিস্তান ভাঙার কাজ তখনই শুরু হলাে। সামরিক আইনের প্রতিক্রিয়া পাকিস্তানের দুই অংশে দুই রকমভাবে হয়েছে। পূর্বপাকিস্তানের মানুষ শিক্ষিত, রাজনীতি সচেতন। তাদের মনে হয়েছে এভাবে চলতে পারে না। পশ্চিম পাকিস্তানে সামন্ত সংস্কৃতি, মানুষ কম রাজনীতি সচেতন, সেখানে তাই তেমন প্রতিক্রিয়া হয় নি। আসলে, কোনাে নীতি প্রণয়নে পূর্বপাকিস্তানের মানুষদের কোনাে অংশীদারিত্ব ছিল না। ১৯৭১ সালে একদিনে হয় নি। “ভারত”, বললেন উমর, “শুরু থেকেই পাকিস্তান ভাঙার নীতি গ্রহণ করেছিল এবং পূর্বপাকিস্তানে সে কাজ শুরু করেছিল। নিজের অজান্তেই হেসে ফেললাম। জানতে চাইলাম, “ভারতীয় এই এজেন্ডার বিরুদ্ধে পাকিস্তানের এজেন্ডা কি ছিল?” জেনারেল উমর সরাসরি এর উত্তর দিলেন না। বললেন, “আমরা ইনটেগ্রেডেট স্টেট হিসেবে বিকশিত হই নি। হয় আমরা এর অর্থ বুঝি নি অথবা নিজেদের স্বার্থ দেখেছি। নিজেদের স্বার্থ অর্থাৎ ফিউডাল লর্ডদের স্বার্থ। যেমন, দু’অঞ্চলের বৈষম্য থাকার কথা ছিল না; কথা ছিল না সেনাবাহিনীতে বেঙ্গল বালুচ বিভিন্ন নামের রেজিমেন্ট থাকার। বাঙালিদের আমরা হেয় চোখে দেখতাম; নিজেদের বলতাম মার্শাল জাতি কিন্তু পৃথিবীতে মার্শাল জাতি বলে কিছু নেই। নিরাপত্তার মানেও আমরা বুঝি নি। বন্দুক দিয়ে কি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়? এই যে আমরা এত টাকা খরচ করছি ডিফেন্সের পিছে তা দিয়ে কি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে?” তাঁর এই মনােলগের উত্তর হয় না। বরং, আগরতলা মামলা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করি। তিনি বলেন, “আমি সেই সময় মিলিটারি অপারেশনের ডিজি ছিলাম, এখানে আগরতলা মামলা সবাই বিশ্বাস করেছিল এবং সবাই চেয়েছিল পাবলিক ট্রায়াল হােক। তাতে মুজিব যদি নির্দোষ প্রমাণিত হন তাহলে নির্দোষী, যদি দোষী প্রমাণিত হন তবে দোষী.।”
জেনারেল আরাে জানালেন, আগরতলা মামলার পরিচালনা ভুল ছিল। এরপর এলাে ১৯৭০ সালের নির্বাচন। রাও ফরমান আলির বইতে পড়েছি, ঐ সময় সামরিক গােয়েন্দা বাহিনী ডানপন্থি দলগুলির মধ্যে টাকা বণ্টন করেছিল যাতে তারা নির্বাচন জিততে পারে। এ প্রসঙ্গে উমর জানালেন, হ্যা, নির্বাচনের আগে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যােগাযােগ করা হয়েছিল। নানাজন নানা দাবি

করেছিলেন। যেমন, নুরুল আমীন চেয়েছিলেন তিন কোটি টাকা। “নির্বাচনের পর” জানালেন উমর, “আমি শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করেছিলাম। বললাম, আপনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন। একবার পশ্চিমপাকিস্তান ঘুরে আসুন। তিনি মােটামুটি রাজি ছিলেন। খন্দকার মুশতাক আমাকে জানালেন, মুজিব ভয় পাচ্ছেন পশ্চিমপাকিস্তান যেতে। কারণ তার ধারণা তাঁকে সেখানে খুন করা হতে পারে। এটা জেনে আমি তাকে বললাম, আমার এক ছেলে লেফটেন্যান্ট। সে আপনার সঙ্গে থাকবে। এই গ্যারান্টি আমি আপনাকে দিচ্ছি। তারপর দেখা করলাম ভুট্টোর সঙ্গে। বললাম, মুজিব চান ঢাকায় সেশন হােক। ভুট্টো রাজি হলেন।”
আমরা জানি এরপর লারকানায় ইয়াহিয়া-ভুট্টো বৈঠক হয় এবং দৃশ্যপট বদলে যায়। উমরও স্বীকার করেছেন, আগরতলা যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ইয়াহিয়া চেয়েছিলেন মুজিব প্রাইম মিনিস্টার হবেন কিন্তু তারপর সব বদলে গেল। উমর সে বৈঠকে ছিলেন
। তাকে ছাড়া নাকি সবাইকে আমন্ত্রণ জানানাে হয়েছিল। তিনি শুনেছেন, ইয়াহিয়াকে নাকি ভুট্টো বলেছিলেন, তাকে রিটায়ার করিয়ে দিতে।
উমর, মনে হলাে, ভুট্টোর ওপর খানিকটা ক্ষুব্ধ। তিনি জানালেন, ঐ সময় ক্ষমতার শীর্ষে জেনারেল গুল হাসান ও পীরজাদা ছিলেন শক্তিশালী। যারা চেয়েছিলেন ভুট্টো ক্ষমতায় আসুক, তা হলে তারাই হবেন সর্বেসর্বা।
“পিপলস পার্টি ওয়াজনট ইন্টারেস্টেড ইন ইস্ট পাকিস্তান, দৃঢ়ভাবে জানালেন উমর, “ভুট্টো শুধু পাকিস্তান ভাঙতে চায় নি, আর্মিরও সর্বনাশ করতে চেয়েছে।” ভুট্টোর কি কোন ক্যান্ডিটেন্ট ছিল পূর্ব পাকিস্তানে? না। কিন্তু মুজিবের ক্যান্ডিটেট ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। আসলে ভুট্টো কোনাে আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়েই যেতে চায় নি। একটি ঘটনা বলি একটু থেমে বললেন, উমর, “১৯৭১ সালের জানুয়ারিতে ঢাকায় একটু ঝামেলা হচ্ছিল। জেনারেল ইয়াকুব থেকে এই খবর যখন জানতে পারলাম তখন আমি ছিলাম করাচিতে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াও ছিলেন করাচিতে। তিনি আমাকে ডেকে পাঠালেন। গিয়ে দেখি ভুট্টোও আছেন সেখানে। ইয়াহিয়া আমাকে বললেন, ইয়াকুবকে খবর পাঠাও- বি ফার্ম বাট জাস্ট। ভুট্টো বাধা দিয়ে বললেন, না আরাে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেয়া উচিত। আমি প্রেসিডেন্টকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কি মি. ভুট্টোকে অথরিটি দিয়েছেন। আমাকে নির্দেশ দেয়ার। প্রেসিডেন্ট কিছু বললেন না?”
“২৫ মার্চ ঢাকায় কী হয়েছিল আপনি জানেন?” “হ্যা, ২৫ মার্চ আমি ঢাকায় ছিলাম”, জানালেন উমর, “জেনারেল ইয়াকুব অপারেশন ব্লিৎসক্রিগ তৈরি করেছিলেন বটে কিন্তু তিনি পলিটিক্যাল সলিউশনের পক্ষে ছিলেন। ২৫ মার্চ কী হয়েছিল জানি। সকালে রেডিয়ােতে ঘােষণা দেয়ার জন্য কাউকে পাওয়া যাচ্ছিল না তখন রােয়েদাদ খান রেডিয়ােতে ঘােষণা দিয়েছিলেন। তখন এটা নর্মাল মনে হয়েছিল কিন্তু পরে দেখলাম তা নর্মাল নয়।”

“তাহলে পূর্বপাকিস্তানের ঘটনার জন্য কে দায়ী?”
“সবাই রেসপনসিবল। ভুট্টো ক্ষমতায় যতদিন ছিলেন ততদিন আমি হয় জেলে নতুবা গৃহবন্দি ছিলাম। জেনারেল জিয়া অনেকবার তার সঙ্গে যােগ দিতে বসেছিলেন। আমি যাই নি।” তারপর হঠাৎ তিনি আবার ভারতের প্রসঙ্গ নিয়ে এলেন। ভারত তাে সবসময় পাকিস্তান ভাঙতে চেয়েছে। ১৯৪৭ সালে মাইগ্রেশন হলেও পূর্বপাকিস্তানে হিন্দু শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীরা থেকে গিয়েছিলেন। পূর্বপাকিস্তানের শিশু-কিশােরদের তারা অ্যান্টিপাকিস্তান করে তুলেছিলেন। আমার মনে হলাে এই কথাটি যেন কোথায় পড়েছি বা শুনেছি। মনে পড়ল রাও ফরমান আলিও তার বইয়ে সেই একই কথা লিখেছেন, যার মূল কথা হলাে বাঙালিরা হিন্দুদের চিন্তায় প্রভাবান্বিত হয়ে পাকিস্তান ভাঙতে চেয়েছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের দুর্বলতার সুযােগ নিয়েছে। তারপর অপ্রাসঙ্গিভাবে বললেন, “ইকবালের সঙ্গে তাে আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তুলনা চলে না।”
জেনারেল উমর সাক্ষাৎকারে স্পষ্টভাবে জানালেন, ১৯৭১ সালের মার্চের পর পূর্ব পাকিস্তানে কী ঘটেছে তিনি জানতেন না। এ-ব্যাপারে একেবারে অজ্ঞ তিনি। অবাক হয়ে প্রশ্ন করি, আপনি ছিলেন ইয়াহিয়ার ঘনিষ্ঠ, নিরাপত্তা কাউন্সিলের সচিব, আর আপনি কিছুই জানতেন না।”
“না, কিছুই জানতাম, না,” জানালেন উমর, নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠিত হয়েছিল বটে কিন্তু কোনাে মিটিং ডাকা হতাে না। দেখুন, পূর্বপাকিস্তানের লােক বহুত পেয়ারে, সাচ্চা মুসলমান। ১৯৭১ সালে কয়েকজন লােক পলিসি ডিকটেট করেছে, সাধারণ মুসলমানরা নয়।” নিয়াজির বইয়ের প্রসঙ্গ তুলে আমি জেনারেলকে জিজ্ঞেস করলাম, “নিয়াজি লিখেছেন, আপনারা ঢাকায় তাকে পরিত্যাগ করেছিলেন?” “ইটস নট কারেক্ট”, উত্তেজিত হয়ে গেল তার গলার স্বর। “নিয়াজি লুট করেছে, সােনা পাচার করেছে। তার চরিত্রও খারাপ। হি ওয়ান্টস টু জাস্টিফাই হিমসেলফ। সে ব্যালান্সড পার্সন ছিল না। সে-সময় সিনিয়র জেনারেলরা কেউ পূর্বপাকিস্তানে যেতে রাজি ছিলেন না। সে জন্য নিয়াজিকে ঢাকা পাঠান হয়েছিল।”
এই হলাে জেনারেল উমরের বক্তব্য তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে। তিনি সাক্ষাৎকারে যা বলেছেন, বই লিখলে তা-ই বলতেন, হয়ত ঘটনার বিস্তৃতি ঘটত মাত্র। জেনারেল উমরের কাহিনী কতটা বিশ্বাসযােগ্য তা আলােচনা করব অন্যান্য তথ্য ও সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে। পাকিস্তানী জেনারেলদের প্রতিটি কাহিনী এভাবে বিশ্লেষণ হওয়া দরকার।
প্রথমে দেখি জেনারেল ইয়াহিয়ার রাজনৈতিক নীতি নির্মাণে উমরের ভূমিকা।

ছিল কি না যা তিনি অস্বীকার করছেন। এ-সম্পর্কে সবচেয়ে পুরনাে ভাষ্য মেজর জেনারেল ফজল মুকিম খানের। তিনি লিখেছেন (১৯৭২) উমর সম্পর্কে যে, ইয়াহিয়ার নিজস্ব যে চক্র ছিল তাতে ন্যাশনাল সিকিউরিটির প্রধান হিসেবে উমরও অন্তর্ভুক্ত হলাে। “He was an opinionated man and took pride in his supposedly superior knowledge of Pakistani affairs, and how they should be handled.” চক্রের মধ্যে, উল্লেখ করেছেন ফজল মুকিম, তিনিই প্রেসিডেন্টের ট্রাবল শুটার’ হয়ে উঠছিলেন, উমর কথা বলতে পারতেন, ছিলেন শিক্ষিত এবং এ-কারণে বােধহয় প্রেসিডেন্টকে প্রভাবান্বিত করতে পারতেন।
জেনারেল নিয়াজী (১৯৭১) তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, জেনারেল উমর গােড়া থেকেই নীতি নির্ধারণ ও অন্যান্য বিষয়ে একটি ভূমিকা পালন করেছেন, ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসেই তিনি রাজনীতিবিদদের বলছিলেন ঢাকায় না যেতে। শুধু তাই নয়, যারা পূর্বপাকিস্তানে আছে তারাও ঐ স্থান ত্যাগ করলে ভালাে। এ দেশটিকেই পরিত্যাগ করা উচিত। নিয়াজির ভাষায়, “The reason he gave was that East Pakistan had became a hub of international intrigue. Therefore, it should be discarded,” তিনি আরাে জানাচ্ছেন, সরকার তখন কেন্দ্রীভূত প্রেসিডেন্ট হাউসে। এবং সেখানে বসে দেশ ও পূর্বপাকিস্তানের সব ব্যাপার চালাছিলেন জেনারেল ইয়াহিয়া, হামিদ, পিরজাদা, উমর ও মিঠা।
এবার ২৫ মার্চের ঠিক আগের কথায় আসি। ব্রিগেডিয়ার এ আর সিদ্দিকি ছিলেন সেনাবাহিনীর প্রধান জনসংযােগ অফিসার। তিনি লিখেছেন, ঢাকার পত্র-পত্রিকায় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যে-সব মন্তব্য ও ছবি ছাপা হচ্ছিল তাতে জেনারেল ইয়াহিয়া অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছিলেন। তখন, সিদ্দিকির ভাষায়, ইয়াহিয়ার প্রধান রাজনৈতিক উপদেষ্টা জেনারেল উমর এসে তাকে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে অভিযােগ জানিয়ে বলেছিলেন, “what sort of DPR are you, he asked, if you cant even control these (TTC ) bastards.”
আরাে পরে জেনারেল উমরকে নিয়ে নিরাপত্তা কাউন্সিল করেছিলেন ইয়াহিয়া। শের আলি তখন প্রচার মন্ত্রী। উমর একই সঙ্গে শের আলির হয়েও কাজ করছিলেন। লিখেছেন সিদ্দিকি “It was a sort of cross between intelligence and PR. Yahyah desired the two generals to control the strong drift towards political extremism.” জেনারেল উমর কি গণহত্যা সম্পর্কে জানতেন, বা মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকায় কী ঘটছিল তা কি অজানা ছিল তার? উমর বলেছেন, না তিনি কিছুই জানতেন না। নিরাপত্তা কাউন্সিলের সচিব কিছুই জানতেন না? না, উমরের উত্তর, আমি একজন সদস্য ছিলাম মাত্র। তাহলে এবার শুনুন রফি রাজার বয়ান। রফিরাজা ছিলেন পিপিপির নেতা। ২৫ মার্চের আগে ঢাকায় এসেছিলেন ভুট্টোর সঙ্গে। ২৬ মার্চ ঢাকা
১৩৫

ত্যাগ করেন। এক সাক্ষাৎকারে তিনি আমায় বলেছেন- “জেনারেল উমরের সঙ্গে দেখা হয়েছিল ঢাকায়। ২৫ মার্চ তিনিও ছিলেন সেখানে। আমরা যখন প্লেনের ভেতর বসে আছি। উমর বেশ একটা ভাব নিয়ে ঢুকল সবার পরে। ভাবটা, মস্তো এক কাজ করে এসেছে। কারাে সঙ্গে কথা বলল না উমর। এমনকি ভুট্টোকে দেখেও মনে হলাে না সে তাকে চেনে। ১৯৭১-এর সব ঘটনায় উমর অবশ্যই ইনভলভড় ছিল।”
গণহত্যার ব্যাপার উমর জানতেন না? এ-প্রসঙ্গে আলাপ করি পাকিস্তানের এক সময়ের ডাকসাইটে আমল আলতাফ গওহরের সঙ্গে। তিনি এ-প্রসঙ্গ তুলতেই হেসে ফেললেন। বললেন, উমর ও রােয়েদাদ খান (তৎকালীন তথ্য সচিব) তখন প্রায়ই যেত ঢাকায়। ঢাকা থেকে ফিরে এসে আমার বাসায় আড্ডা দিতে আসত। তখন, তারা জানাত ঢাকার সব কথা। সুতরাং, কোথায় কী ঘটছে সব কিছুই তারা জানত।
গণহত্যার বিষয়টি নিয়ে বারবার জিজ্ঞাসার পরিপ্রেক্ষিতে একসময় উমর বললেন, “সব কিছু পরে জেনেছি। জানেন, আপনার আসার আগে আপনাদের জন্য কোরান পড়ছিলাম আর সে-সময়কার কথা মনে করে আপনাদের জন্য কাঁদছিলাম আর দোয়া করছিলাম।”
আলতাফ গওহর এ-প্রসঙ্গে বললেন, “এখন সবাই এ ধরণের কথা বলছে। ফিলােসফিক্যাল ভাব দেখাচ্ছে। এরা সবাই ১৯৭১ এর পর ভালাে ভালাে চাকরি পেয়েছে। উমর তাে একটি ইন্সটিটিউটের প্রধান ছিল। এখন নাকি আবার দরবেশ দরবেশ ভাব করে!”
এই ছিল পাকিস্তানী জেনারেলরা। এভাবেই ২৫ বছর তারা পাকিস্তান চালিয়েছিল। বাঙালিদের হাতে পর্যদস্ত হওয়ার পরই প্রথম তাদের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে।
যে-বইটির কথা এখন আলােচনা করব তা খানিকটা আলাদা ধরনের। যিনি লিখেছেন তিনিও ব্যতিক্রমি। তাই আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকে না। নাম জেনারেলস ইন পলিটিকস, পাকিস্তান ১৯৫৮-১৯৭২। লেখক মােহাম্মদ আসগর খান। এক সময়ের এয়ার মার্শাল। রাজনীতির প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিই বলে দেয় তাঁর বইটি কেমন হবে। চাকুরি থেকে অবসর নেয়ার পর থেকে আসগর খান রাজনীতি করছেন কিন্তু গত তিন দশকে, তার রাজনীতি পাকিস্তানে প্রভাব বলয় সৃষ্টি করতে পারে নি। তাঁর অবস্থানও প্রান্তিক। এর কারণ, রাজনীতিতে কখন পিছু হটতে হয়, কখন প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করতে হয় তা আসগর খানের জানা নেই। কিন্তু, তার অন্য একটি দিকও আছে। সম্প্রতি পাকিস্তান সফরে গিয়ে দেখেছি, আসগর খানের রাজনীতির শত্রু-মিত্রু যে-ই হােক-না কেন ব্যক্তি আসগর খানকে তারা শ্রদ্ধা।

করে। কারণ, তাঁর এই দীর্ঘ জীবনে তিনি এমন কিছু করেন নি যা তাঁর বিরুদ্ধে যেতে পারে।
আসগর খানের বইটি বেরিয়েছিল ১৯৮৩ সালে। তখন আমরাও সামরিক শাসনের অধীনে। এ-কারণে, সেনাবাহিনীর প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি আমাকে বিস্মিত করেছিল। কারণ, তিনিও পাকিস্তানী জেনারেল, যারা কোনাে-না-কোনােভাবে বেনিফিশিয়ারি। সম্প্রতি, পাকিস্তানী জেনারেলরা কি ভাবে দেখেছেন ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ তা পর্যালােচনা করতে গিয়ে আসগর খানের বইটি আবারও পড়লাম। এবং মনে হলাে, এ-বইটিই ব্যতিক্রম। তবে, এ-বইয়ের প্রথম ৫১ পাতা আমাদের ঘটনাবলীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। সুতরাং আমার আলােচনা এর মধ্যেই সীমিত রাখব।
ভূমিকার শুরুতে তিনি একটি মূল্যবান কথা বলেছেন, পাকিস্তানের সৃষ্টি গণতান্ত্রিক ও শাসনতান্ত্রিক আন্দোলনের কারণে। সামরিক বিজয়ের কারণে তা সৃষ্টি হয় নি বা দখলও করা হয় নি। কোনােও জেনারেলও এর স্থপতি নন। এর স্থপতি হচ্ছে গৃহহারা লক্ষ লক্ষ লােক। এবং তারা কখনও ভাবে নি পাকিস্তান ভবিষ্যতে শাসিত হবে জেনারেলদের একটি ক্ষুদ্র চক্রের দ্বারা। তাঁর এই উক্তি-ই বইটির উদ্দেশ্য স্পষ্ট করে তােলে। সামরিক শাসন বা জেনারেলদের বিরুদ্ধেই তাঁর বই।
আসগর খান লিখেছেন, পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই বহু অঞ্চলের বৈষম্য চোখে পড়ছিল। পূর্বপাকিস্তান সংখ্যাগরিষ্ঠ অথচ সেনাবাহিনী থেকে শুরু করে সবখানে ছিল তারা সংখ্যালঘিষ্ঠ। সেনাবাহিনীতে ৮৫ ভাগ ছিল পশ্চিমপাকিস্তানী যার মধ্যে আবার পাঞ্জাবীরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। আরেকটি বিশেষ বিষয়ের প্রতি তিনি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। সেনাবাহিনী যখন প্রথম ক্ষমতা দখল করে পাঞ্জাবে তখন তেমন প্রতিক্রিয়া হয় নি কিন্তু পূর্বপাকিস্তানে হয়েছে। করাচি এবং পরে ইসলামাবাদে বসে যখন শাসকরা অগণতান্ত্রিক সব সিদ্ধান্ত নিচ্ছিল তখন পূর্বপাকিস্তান ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল। এর কারণ, পশ্চিমপাকিস্তান ছিল সামন্ততন্ত্রের নিগঢ়ে বাধা, অন্যদিকে, পূর্বপাকিস্তান ছিল তা থেকে মুক্ত এবং অধিক। গণতন্ত্রমনা। তার ভাষায়, “the people of the eastern wing were sensitive and politically more conscious than those living in West Pakistan who were suffering under the age old domination of feudal lords and serfdom of tribal sardars.”
এ-পরিপ্রেক্ষিতে তার আরও একটি পর্যবেক্ষণের কথা উল্লেখ করতে চাই যা কারাে বইতে দেখি নি এমনকি বাঙালি গবেষকদের বইয়েও। তিনি লিখছেন, পূর্বপাকিস্তানের অসন্তুষ্টি একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে ব্রেক হিসেবে কাজ করছিল এবং মানুষকে গণতন্ত্রমুখি করছিল। এবং এ-কারণে শাসক গােষ্ঠি ভেবেছিল, পূর্ব পাকিস্তান না থাকলেই পরিত্রাণ পাওয়া যেতে পারে- “They would be better off without the eastern half of the country.”

পূর্বপাকিস্তান কিভাবে বঞ্চিত হচ্ছিল তার সংক্ষিপ্ত বিবরণের পর আইয়ুব খানের ক্ষমতা দখলের বিবরণ দিয়েছেন যা অন্য বইতে পাওয়া যাবে না। এখানে একটি ঘটনার উল্লেখ করতে চাই যাতে স্পষ্ট হবে পশ্চিমপাকিস্তানী সবাই তাদের স্বার্থের ব্যাপারে একাট্টা ছিল, তিনি বিচারপতিই হােন আর সৈনিকই হােন। বিচারপতি মােহাম্মদ মুনিরের ঘটনাটি তার উদাহরণ।
গুরুত্বপূর্ণ এক সভায় আইয়ুব খান বিচাপতি মুনিরকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, জনসমর্থিত একটি নতুন শাসন গ্রহণের প্রক্রিয়া কী হতে পারে? বিচারপতি মুনির বললেন, বিষয়টা খুব সােজা। আগে গ্রীসে ‘publc acclaim’ এর মাধ্যমে শাসনতন্ত্র গৃহীত হতাে। এভাবে পাকিস্তানের খসড়া শাসনতন্ত্র প্রণীত হলে তা খবরের কাগজে প্রকাশিত হবে এবং তারপর আইয়ুব করাচি, ঢাকা, লাহাের এবং পেশােয়ার জনসভা করবেন। এবং পাবলিককে জিজ্ঞেস করবেন, নতুন শাসনতন্ত্র গ্রহণে তারা রাজি কি না। উত্তর হবে- হ্যা। এই প্রধান বিচারপতিই পরবর্তীকালে, বলেছিলেন সামরিক আইন বৈধ।
এ-প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, আমাদের দেশের বিচারপতিরাও ১৯৭৮ সালে এক রায়ে বলেছিলেন, সামরিক আইন শাসনতন্ত্রের ওপরে। ভাগ্যিস তারা বলেন নি, তাদের উপাধির মাঝে মেজর জেনারেল বা লে. জেনারেল উপাধিটিও থাকা।
উচিত।
ইস্কান্দার মির্জা ও তাঁর হবু বেয়াইয়ের এক টেলিফোন কথােপকথনের টেপের পরিপ্রেক্ষিতে আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করেন। এ-ব্যাপারে তাকে সমর্থন করেছিলেন জেনারেল ইয়াহিয়া খান। মির্জা থেকে পদত্যাগপত্র নিয়ে আসার জন্য আইয়ুব খান আসগর খানকেও অনুরােধ করেন। আসগর ছিলেন তখন বিমানবাহিনীর প্রধান। আসগর খান যেতে রাজি হন নি। অবশ্যি পরদিন তিনি। বিমানবন্দরে গিয়েছিলেন মির্জা দম্পতিকে বিদায় দিতে। দেখলেন মির্জা দম্পতির পাশে এক ক্যাপ্টেন বসে আছে পা দুটি সামনের টেবিলের ওপর তুলে। আসগর খান তাকে ধমক দিয়ে রুম থেকে বের করে দিলেন বটে কিন্তু তখনই তার মনে হলাে সেনাবাহিনী রাজনীতিতে এলে পরিস্থিতি এমনই হবে। তাদের ঔদ্ধত্য প্রকাশ পাবে কারণ তারা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ নয়। বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ, তাই বড় হওয়া সত্ত্বেও আসগর খানের বক্তব্যটি উদ্ধৃত করছি- “The conduct of this officer typifies the dangers inherent in the involvement of the armed forces in politics. When power is wielded by the Defence services, it is untimely exercised by people who both by experience and temperement, are the least suited for this role. Since they are not responsible to the people, their arrogance finds expression in ways that are more harmful than the one typified by the ill manners of a young officer at Mauripur airfield on that october morning.”

বাংলাদেশে যারা পাকিস্তানী কায়দায় ক্ষমতা দখল করেছিল তাদের ঔদ্ধত্যের কথা নিশ্চয় মনে আছে আপনাদের। ১৯৬৯-এর দিকে, আসগর খান ইঙ্গিত করেছেন ইয়াহিয়া ক্ষমতা দখলের পরিকল্পনা করেন। তিনি ছিলেন সামরিক গােয়েন্দা দফতরের প্রধান। আইয়ুবকে তিনি ভুল সব তথ্য দিচ্ছিলেন। বা আইয়ুব যা শুনতে চান তাই বলছিলেন। এ-তথ্যটি অবশ্য নতুন। এরপর ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা দখল করেন।
আসগর খান লিখেছেন, পশ্চিমপাকিস্তানে তিনিই একমাত্র এর বিরােধিতা করেছিলেন। অন্যদিকে, জুলফিকার আলি ভুট্টো সামরিক শাসনকে স্বাগত জানিয়ে ছিলেন। এখানেই দু’জনের ব্যক্তিচরিত্রের পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে যায়। তারপর তিনি প্রাক। ১৯৭০-এর ঘটনাবলির বর্ণনা দিয়েছেন যা আমাদের সবার কম-বেশি জানা।
সম্প্রতি, আমি এবং প্রকাশনা সংস্থা ইউপিএলের স্বত্বাধিকারী মহিউদ্দিন আহমদ পাকিস্তান সফর করেছিলাম। উদ্দেশ্য ছিল, মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তাদের ধারণা কী ছিল তা জানা। আসগর খান আমাদের সাদরে গ্রহণ করে প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। অবশ্য, এও বলেছেন, এর সবই তার বইয়ে আছে। পাঠক তার বিবরণ। বই-য়ে পাবেন। আমি এখানে আমাদের সাক্ষাৎকারের অংশবিশেষ উদ্ধৃত করব। প্রথমেই জানতে চাই, ১৯৭০-এর পরের ঘটনাবলি বা ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের তাৎক্ষণিক পটভূমিকা সম্পর্কে।
“১৯৭০-এর নির্বাচনের আগে ইয়াহিয়ার সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল। তিনি বলছিলেন, ভুট্টো তাকে বলেছিলেন, নির্বাচন বাদ দিতে। সৈনিক ইয়াহিয়া খান ও রাজনীতিবিদ জুলফিকার আলি ভুট্টো ভালাে টিম হবে এবং একসঙ্গে তারা দেশ শাসন করতে পারবে। ইয়াহিয়ার মনে হয়েছিল প্রস্তাবটা মন্দ না, কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের ব্যাপারটা কী হবে? ভুট্টো বলেছিলেন, পূর্বপাকিস্তান কোনাে সমস্যা নয়। সেখানে হাজার বিশেক লোেক খতম করে দিলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, এ প্রস্তাবে আপনার কী প্রতিক্রিয়া হলাে। ইয়াহিয়া বললেন, হােয়াট ক্যান ওয়ান সে টু সাচ এ সাজেশন।
নির্বাচনের পর ইয়াহিয়া খান ঢাকায় গেলেন। মুজিবের সঙ্গে সৌহাদ্যপূর্ণ আলােচনও হলাে। ইয়াহিয়া ফিরে এসে ঘােষণা করলেন, মুজিব হবেন পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী।”
“তারপর?”
“এরপর সিনে এলেন ভুট্টো। ইয়াহিয়া খান গেলেন লারকানা। সেখানেই সিদ্ধান্ত হলাে মুজিব যদি তার স্ট্যান্ড থেকে না সরেন তা হলে শক্তি প্রয়ােগ করা হবে। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি রাওয়ালপিন্ডিতে সামরিক জান্তার বৈঠকে এই সিদ্ধান্তটি গৃহীত হয়।”

আমার মনে হলাে, আসগর খানের এই কথায় যৌক্তিকতা আছে। এই। সিদ্ধান্তের কারণেই ঢাকায় সৈন্য পাঠানাে শুরু হয় এবং ভুট্টো পশ্চিমপাকিস্তানে। জ্বালাময়ী সব ভাষণ দিতে থাকেন। “আপনি কি এইসময় ঢাকায় গিয়েছিলেন?” জিজ্ঞেসা করি আমি।
“মার্চের প্রথম সপ্তাহেই আমি ঢাকা গিয়েছিলাম। রওয়ানা হওয়ার আগে ভুট্টোকে জানিয়েছিলাম ঢাকা যাচ্ছি। তিনি আমাকে করাচি হয়ে যেতে বললেন। করাচি গেলাম কিন্তু তিনি আমার সঙ্গে দেখা করলেন না। ঢাকায় মুজিবের সঙ্গে আমার তিনটি মিটিং হয়েছে। মুজিব জানিয়েছিলেন, তিনি নিশ্চিত যে, ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন না এবং পূর্বপাকিস্তানে শক্তি প্রয়ােগ করবেন। তিনি বলছিলেন, পাকিস্তানের জন্য যখন তারা আন্দোলন করেন তখন ভুট্টো ইয়াহিয়া। কোথায় ছিল?” বাঙালিদের তারা কখনও মানুষ মনে করে নি।” আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন। তিনি। “মুজিবকে পশ্চিমপাকিস্তান যাওয়ার আমন্ত্রণ জানানাে হয়েছিল কিন্তু তিনি। যান নি। কেন যান নি, এ-প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানালেন, ব্যস্ত ছিলেন। কিন্তু। আমার ধারণা তার ও তার ঘনিষ্ঠজনদের ধারণা হয়েছিল পশ্চিমপাকিস্তান গেলে। তাকে হত্যা করা হবে। তা হলে ভবিষ্যতটা কী? তিনি বললেন, ইয়াহিয়া খান। প্রথমে ঢাকা আসবেন, তারপর আসবেন এম এম আহমদ এবং তারপর ভুট্টো। ইয়াহিয়া খান এরপর সামরিকবাহিনী লেলিয়ে দেবেন এবং তাঁকে গ্রেফতার করা। হবে। যদি গ্রেফতার করা না হয় তাহলে, পাকিস্তানী বাহিনী অথবা তার লােকেরাই তাকে হত্যা করবে। আশ্চর্য নয় কি তিনি যা বলেছিলেন ঠিক তাই ঘটেছে।” বলে আসগর খান চুপ করে থাকলেন।
“আপনি কি মনে করেন” জিজ্ঞাসা করলেন মহিউদ্দিন ভাই, “মার্চে যে আলাপ-আলােচনা চলছিল তার ভিত্তিতে কিছু করা যেত?”
“হয়ত ইয়াহিয়া খান কিছু করতে পারতেন”, বললেন আসগর খান, “কিন্তু, ইয়াহিয়া ছিলেন প্রধানত পাঞ্জাবী সেনাবাহিনীর প্রধান। তাকে চাপ দিচ্ছিল ভুট্টো যিনি ছিলেন পাঞ্জাবের নির্বাচিত নেতা। ইয়াহিয়া খানের অ্যামবিশন না থাকলেও পাঞ্জাবীদের চিন্তাকে হালকাভাবে নেয়ার কোনাে উপায় তার ছিল না। আমি মুজিবকে বলেছিলাম পাঞ্জাব সফর করতে। আরও বলেছিলাম তাকে অধিকার দেয়া হয়েছে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার। শুধু তাই নয়, পাকিস্তানকে রক্ষা। করতে হবে এবং পূর্বপাকিস্তানের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। উনি। বলেছিলেন, অনেক দেরি হয়ে গেছে। এখন আমার মনে হয় তিনি ঠিকই। বলেছিলেন।”
“৬-দফা সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কী?” জিজ্ঞাসা করি আমি।
“পশ্চিমপাকস্তানে অনেকে ভেবেছিল ৬-দফার অর্থ পাকিস্তান ভঙ্গ। আসলে তা নয় এবং আমার মনে হয় মুজিব ক্ষমতায় গেলে ৬-দফা মডিফাই করতেন
১৪০

কারণ তাঁকে তখন পুরাে পাকিস্তানের পটভূমিকায় বিষয়টি বিবেচনা করতে হতাে।”
২৫ মার্চ সম্পর্কে আপনি কী জানেন?” আবারও জিজ্ঞাসা করি। “পুরাে ব্যাপারটাই ছিল স্টুপিড। মিলিটারি টার্মসে এটি ছিল ম্যাডনেস।”
“আপনি কি ২৫ মার্চের পর ঢাকা গিয়েছিলেন?” জিজ্ঞেসা করলেন মহিউদ্দিন ভাই।
“হ্যা, দুইবার,” বললেন আসগর খান। “যা দেখেছিলাম তাতে আরও ডিপ্রেসড হয়েছিলাম। ঢাকায় জামাতিরা রিডিকুলাস এক আগুমেন্ট দিচ্ছিল যে তাদের স্থান আওয়ামী লীগের পরে সুতরাং তাদের ক্ষমতা হস্তান্তর করা হােক। যেসব রাজনীতিবিদ একমাস আগেও বলেছিল মুজিবকে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে তারা তখন আওয়ামী লীগকে হেনস্থা করার জন্য ইয়াহিয়াকে সমর্থন করছিল।”
“দ্বিতীয় দফায় গবর্নর মালেকের সঙ্গে কথা হয়েছিল। ফ্যান্টাস্টিক সব কাহিনীর তিনি অবতারণা করেছিলেন। আমার বইতে তার বর্ণনা দিয়েছি। যা হােক ঐ সময় আমি এখানে এ-ব্যবস্থা গ্রহণের বিরােধিতা করেছি, বিরুদ্ধে বলেছি। আমাকে সবাই গালাগাল করেছে, পূর্বপাকিস্তানের দালাল বলেছে। আসলে পশ্চিমপাকিস্তানের অ্যাটিচিউডটা ছিল এ-রকম- শেখ কিভাবে পাকিস্তান রুল করবে? পূর্বপাকিস্তান বা এসব ব্যাপারে পাবলিকের একটা ফিক্সড নেশন ছিল এবং তা তৈরিতে ভুট্টো এক বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল।”
আসগর খান ২৫ মার্চের পর ঢাকা আসেন প্রথমে জুলাই এবং তারপর অক্টোবরে। ঢাকা থেকে ফিরে ১৮ জুলাই তিনি প্রেসিডেন্টকে একটি চিঠি লিখে জানান, বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে পাকিস্তান বাঁচানাে যাবে না। লিখেছিলেন 101- you are no doubt aware that ever since the event of March, I have differed with your Government about the best method of tackling this problem. I am, however, anxious, as many of our country-men are that a policy should be adopted which is both practical as well as enduring, a policy that has a reasonable chance of success.”
ইয়াহিয়া খান যখন এবােটাবাদ যান তখন আসগর খান তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। পরামর্শ দেন, ১৯৭০-এর নির্বাচনের ফলাফলের পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষমতা হস্তান্তরের। ইয়াহিয়া এ-পরামর্শে কর্ণপাত করেন নি। বরং বলেছিলেন। ফিলিপাইনে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত আবদুল মালেককে তিনি ঢাকায় গভর্নর করে পাঠাবেন। আসগর খান বললেন, বাঙালিরা তাকে ইয়াহিয়ার ‘জ’ বলে বিবেচনা করবে। ইয়াহিয়া বললেন, মালেক কেবিনেটে থাকার সময় পূর্বপাকিস্তানের পক্ষে কথা বলতেন। আসগর জানালেন, কেবিনেটে থেকে কথা বলা একব্যাপার আর গভর্নর হয়ে যাওয়া আলাদা ব্যাপার। এবং এতে পরিস্থিতির কোনাে বদল হবে না, বরং অবনতি হবে।

আসগর খান লিখেছেন, দ্বিতীয় দফা সফরে গভর্নর মালেকের সঙ্গে কথা হয় এবং মালেক তাকে অদ্ভুত সব কাহিনী শােনান। শুধু তাই নয় আসগর খানের বক্তব্য সেন্সর করা হয়। আসগর গভর্নর মালেককে ৩ নভেম্বর দীর্ঘ এক চিঠি লেখেন, এতে তিনি জানান- I have maintained that the will of the people must be allowed free expression, that the people alone could keep the country together, that the political problems should be solved politically and not by force, that the democratically elected representatives of the people have the right to administer the country, and that any approach alien to these principles will create further complications from which we may not be able to extricate ourselves.” আসগর খান আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উল্লেখ করেছিলেন চিঠিতে। উন্নয়নশীল যে-কোনাে দেশের সরকারের জন্যই মন্তব্যটি প্রযােজ্য। তাঁর ভাষায়ই উল্লেখ করি- “It is a familiar phenomenon that governmnents start believing that their interest are synonymous with the interests of the country and treat all criticism and dissent as anti-state.”
“তাহলে ১৯৭১-এর দায়ী কে?” জিজ্ঞাসা করি আমি। “ভুট্টো এবং ইয়াহিয়া।”
“কিন্তু আমরা যাদের সঙ্গে পাকিস্তানে আলাপ করেছি তাদের অনেকেই বলছেন, হিন্দুরাই এর জন্য দায়ী।”
“এসব কথা বলা হয়েছে এবং হচ্ছে” বললেন, আসগর খান, “ঐ অ্যাকশন জাস্টিফাই করার জন্য।”
“পাকিস্তানে এখন বিতর্ক চলছে বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা নিয়ে এ-বিষয়ে আপনার বক্তব্য কী?” ‘দু’পক্ষই একসেস করেছে, বললেন আসগর খান, “মুজিবকে ক্ষমতা হস্তান্তর
করার জন্য আমাদের ক্ষমাপ্রার্থনা করা উচিত। এজন্য অবশ্য আমরা বেশি দায়ী কারণ ক্ষমতায় ছিলাম আমরা এবং ব্যাপারটা আমরাই শুরু করেছিলাম।”
দু’পক্ষ শব্দটি আমার কান এড়ায় না। গণহত্যার কথা বললে, পাকিস্তানের সবাই কেমন যেন ডিফেনসিভে চলে যায়। বলতে হয়, অপরপক্ষও হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। তাই আমার মনে হলাে, যত সহানুভূতি বা মানবিকতাই আমরা প্রদর্শন করিনা কেন পরস্পরের প্রতি, অন্তিমে একজন পাকিস্তানী জেনারেল পাকিস্তানীই আর একজন বাঙালি বাঙালি-ই।
২৪ লে. জেনারেল গুল হাসান ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শেষ কমান্ডার ইন চিফ, ১৯৭১ সালের নীতিনির্ধারকদের একজন। বলা হয়ে থাকে, তিনি ছিলেন

ভুট্টোর সুহৃদ এবং পাকিস্তান ভাঙায় বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন। ভুট্টো ক্ষমতায় এসে প্রথমেই যে-কাজটি করেছিলেন তাহলে তাকে কমান্ডার ইন চিফ করা। কিছুদিন পর তাঁকে রাষ্ট্রদূত করে পাঠানাে হয় অস্ট্রিয়া এবং গ্রীসে। এরপর ভুট্টোর সঙ্গে তার মনান্তর হয় এবং এক কড়া চিঠি লিখে তিনি পদত্যাগ করেন। হয়ত, এসব কারণে তার মনে হয়েছে আত্মজীবনী লেখার। ১৯৯১ সালে তিনি শেষ। করেন ‘মেমােয়ার্স’ কিন্তু তখন তা প্রকাশ করেন নি, কারণ, বেনজীর মাত্র ক্ষমতায় এসেছেন। তাঁর বই বেনজিরবিরােধীরা ব্যবহার করুক তা তিনি চান নি। ভুট্টোর সঙ্গে তাঁর মনান্তর হতে পারে, বেনজিরের সঙ্গে তাে নয়। ১৯৯৩ সালে তাই প্রকাশিত হয় জেনারেল গুল হাসানের আত্মজীবনী ‘মেমােয়ার্স’।
এ-বইয়ে তাঁর জীবনের ধারাবাহিক বিবরণ আছে। কিন্তু আমি ব্যবহার করেছি যে অধ্যায়গুলি সেগুলিতে এসেছে বাঙালি বা বাংলাদেশ প্রসঙ্গ।
কোয়েটার এক মধ্যবিত্ত পরিবারে গুলের জন্ম। বয়স হতেই, অন্যান্য মুসলমান পরিবারের মতাে তাকেও সেনাবাহিনীতে পাঠানাে হয়। তিনি একদিকে ভাগ্যবান। চাকুরির শুরুতে নিয়ােগ পান জেনারেল নিকলসনের এডিসি হিসেবে তারপর জেনারেল স্লিমের। স্মিমের এডিসি হওয়ার সুবাদে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভ্রমণ করেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন রণাঙ্গন। ১৯৪৭ সালে, ভারত বিভক্ত হলে, নিযুক্তি পান কায়দে আজম মুহম্মদ আলি জিন্নাহর এডিসি হিসেবে যদিও এডিসি হিসেবে তিনি আর কাজ করতে চাচ্ছিলেন না।
জিন্নাহ, তাঁর মতে, পাকিস্তান চাইলেও সব ধর্মের প্রতি ছিলেন সহিষ্ণু , মিতব্যয়ী এবং শৃংখলাপূর্ণ। মােল্লারা ভেবেছিলেন, পাকিস্তানে তারাই হবে আধিপত্যকারী কিন্তু জিন্নাহ তাদের প্রশ্রয় দেন নি। ফলে, পাকিস্তানকে তারা বলত নাপাকিস্তান এবং জিন্নাহকে কাফিরদের রাজা।
জিন্নাহর এডিসি হিসেবে কিছুদিন কাজ করার পর মাঠপর্যায়ের পােস্টিং পান। ১৯৬১ সালে নিযুক্ত হন ডিরেক্টর আর মিলিটারি অপারেশন যেটি তার প্রথম গুরুত্বপূর্ণ পােস্টিং। এরপর মুলতানে আর্মাড ডিভিশনের কমান্ডার ছিলেন। ১৯৬৮ সালে হন সিজিএস। এ-সময়টুকুর এক বিস্তারিত বিবরণ তিনি দিয়েছেন যাতে উল্লেখ করেছেন সেনাবাহিনীর গঠন, পাক-ভারত যুদ্ধ ইত্যাদি যা আমাদের আলােচনার জন্য প্রয়ােজন নেই। এখানে তার একটি মন্তব্য উল্লেখ্য। লিখেছেন গুল, তিনি যখন ডিএমও হন তখন সেনাবাহিনীর সিনিয়র অফিসারদের মধ্যে খানিকটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। অনেকে বলাবলি করছিল, সেনাপ্রধান মুসা যেহেতু বালুচি, তাই আরেকজন বালুচিকে এরকম গুরুত্বপূর্ণ পদে নিযুক্ত করেছেন। তার মতে, “…..Parochialism, sectarianism and sycophancy can devastate any country or institutions including a well-disciplined army.”
সুতরাং, অস্তিত্ব রক্ষার খাতিরে রাজনীতিবিদ, আমলা সেনাবাহিনীকে এসব থেকে মুক্ত থাকতে হবে। এটি যদি তাঁর আন্তরিক ভাবনা হয় তাহলে বাঙালি,

বাংলাদেশ, বাঙালি রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে পশ্চিমপাকিস্তানের জেনারেলরা যখন বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন তখন তিনি প্রতিবাদ করেন নি কেন? এবং তার পুরাে বইতে, বাঙালি, রাজনীতিবিদ সম্পর্কে একটি সহানুভূতিপূর্ণ বাক্য নেই, শুধু, তাই নয়, এরপর তিনি অনেক মন্তব্য করেছেন তা উল্লিখিত মন্তব্যের বিপরীত। আমি এখানে কয়েকটি উদাহরণ দেব।
গুল হাসান লিখেছেন, পাকিস্তানে যদি প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক ভিত্তি থাকত তাহলে সেনাবাহিনীকে এত ঝামেলা পােহাতে হতাে না। যদি রাজনৈতিক সরকার থাকত তাহলে সেনা ম্যানুপুলেশন হতাে না। পাকিস্তানে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক ভিত্তি থাকলে পাকিস্তানের থাকত প্রথম শ্রেণীর সেনাবাহিনী। তারপর, তিনি উদাহরণ দিয়েছেন, ১৯৬২ সালে ভারত-চীন যুদ্ধের পর কৃষ্ণমেনন ও জেনারেলদের নেহেরু বরখাস্ত করেছিলেন। এখানে, গুল স্বীকার করে নিচ্ছেন, দেশের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করার ফলে সেনাবাহিনী আর প্রথম শ্রেণীর থাকে নি। কিন্তু, গুল প্রশ্ন রাখেন নি নিজের কাছে যে, আইয়ুব খান ও জেনারেলরাই জোর করে ক্ষমতা দখল করেছিলেন এবং বেসামরিক কর্তৃক যাতে বিস্তৃত না হয় সে-চেষ্টা করেছেন। পাকিস্তানের ৫০ বছরের ইতিহাসই হচ্ছে বেসামরিক কর্তৃক। প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম।
বইয়ের উপসংহারে আবার গুল হাসান বলছেন, রাজনীতিবিদরা সামরিক আইন আনার পরিবেশ তৈরি করেন। এটি যেন না করা হয় এবং সেনাবাহিনীও যেন কথায় কথায় সামরিক শাসন জারি না করে। আসলে তিনি কোন পক্ষ নেবেন তা ১৯৯৩ সালেও ঠিক করতে পারেন নি। কারণ, আজীবন তিনি বা তারা ছিলেন সামরিক শাসনের বেনিফিশিয়ারি।
এ-প্রসঙ্গে তিনি আরাে বলছেন, আইয়ুব ক্ষমতা দখলের পর যে ভুলটি করেছেন, তাহলাে রাজনীতিবিদের কাঠগড়ায় দাঁড় করান নি। তাদের তিনি অজ্ঞ, নীতিহীন, কাণ্ডজ্ঞানহীন বলে বর্ণনা করে বলেছেন, তাদের পরীক্ষা নেয়া উচিত ছিল এবং তারপর নির্বাচন। নির্বাচনের ফলাফল স্পষ্ট না হলে আবার নির্বাচন। সে-নির্বাচনেও কেউ যদি সরকার গঠন করতে না পারে তাহলে চার-পাঁচ বছরের জন্য আবার জারি করতে হবে সামরিক আইন। এই কয়েক বছরের মধ্যে রাজনীতিবিদদের তাদের যােগ্যতা প্রমাণ করতে হবে। এই এক্সপেরিমেন্ট চালালে বেসামরিক কর্তৃত্ব কিভাবে ভিত্তি পাবে? গুল হাসান এই প্রশ্নের উত্তর দেন নি। তাছাড়া সামরিক আইনের অধীনে রাজনীতিবিদরা কিভাবে প্রমাণ করবেন যােগ্যতা? এই যােগ্যতা কি প্রমাণিত হবে সামরিক শাসকদের অনুগ্রহের? এর উত্তরও তিনি দেন নি। জেনারেলদের অর্ডারের মতাে তিনি শুধু মন্তব্য করে গেছেন।
আগরতলা ষড়যন্ত্র সম্পর্কে তিনি বলছেন, শেখ মুজিব ভারতের সঙ্গে ‘hobnobbing’ করেছিলেন। ভারত তাকে প্রচুর অর্থ ও অস্ত্র দিয়েছিল। কথা ছিল,

পূর্বপাকিস্তানের একঅংশ দখল করে শেখ সাহেব স্বাধীন বাংলাদেশের ঘােষণা দেবেন এবং ভারত তখনই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে।
শেখ মুজিব সম্পর্কে তিনি মূল্যায়ন করেছেন এভাবে যে, শেখ মুজিব আমেরিকা থেকে স্টাইপেন্ড পেতেন এবং পূর্বপাকিস্তানের ধনী হিন্দুরা তাকে টাকা যােগাতেন। পাকিস্তান যে-সবের প্রতীক, শেখ মুজিব ছিলেন তার বিপরীত এবং তাই তিনি ছিলেন পূর্বাংশের “most amenable leader.” এরপর, ভারতীয়রা তাকে বিচ্ছিন্নতাবাদের ব্যাপারে প্রভাবিত করে। এই প্রত্যয়ের ওপর ভিত্তি করে শেখ মুজিব, তাঁর সহকর্মীরা বা ভারতীয়রা বা সবাই মিলে সৃষ্টি করে ছয়দফা। ছয়দফা কেন্দ্রীয় সরকার মেনে না নেয়ায় অসহিষ্ণু হয়ে তারা করেন আগরতলা ষড়যন্ত্র।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার শেষে হলাে গােলটেবিল বৈঠক এবং তারপর যে সব ‘ট্র্যাজিক’ ঘটনাবলি ঘটে, তার জন্য দায়ী রাজনীতিবিদরা, লিখেছেন গুল হাসান। এবং ছয়দফা ও শেখ মুজিবকে সমর্থন করেছিলেন পূর্ববঙ্গের অধিবাসী এবং হিন্দুরা (যেন তারা পূর্ববঙ্গের অধিবাসী নন) ভারতের উষ্ণ সমর্থনে।
জেনারেল লিখেছেন, পশ্চিমপাকিস্তানের ফেললা সিটিজেনদের বিরুদ্ধে পূর্বপাকিস্তানের অনেক অভিযােগ ছিল। অভিযােগ করা হতাে, পশ্চিমপাকিস্তানে অধিকাংশ উন্নয়নমূলক প্রকল্প করা হয়েছে। উচ্চ চাকুরিতে প্রায় সবাই পশ্চিমপাকিস্তানী। পাটের টাকায় স্ফীত হচ্ছে পশ্চিমপাকিস্তান। তিনি স্বীকার করছেন, এর মধ্যে খানিকটা সত্য আছে তবে, যে-রকম বলা হচ্ছে সে-রকম উন্নয়ন পশ্চিম পাকিস্তানে হয় নি। স্থানীয় হিন্দু ও ভারত পূর্বপাকিস্তানের মানুষদের ভালােভাবে ব্রেইন ওয়াশ করেছে। আসলে, পূর্বপাকিস্তানের অবস্থা আগে থেকেই খারাপ ছিল এবং ১৯৪৭-এর পর পূর্বাংশ থেকে ভারতে পাট পাচার করা হচ্ছিল। সুতরাং এর জন্য পশ্চিমপাকিস্তান দায়ী নয়।
আইয়ুব খানের প্রশংসা করে লিখেছেন তিনি, আইয়ুব ছিলেন জাতীয় নেতা। রাজনৈতিক নেতারা জাতীয় নেতা নয়। “He thought in terms of Pakistan as an entity, unlike our politicians whose vision never extended beyond provincial boundaries.” রাজনীতিবিদের সম্পর্কে এ-ধরনের আরাে অনেক মন্তব্য করেছেন তিনি। ভুট্টো ও মুজিব সম্পর্কে বলেছেন, মিথ্যা যদি লক্ষ্য হাসিলের মাধ্যম হয় তাহলে তারা তাই বলেছেন, সত্য কখনও নয় এবং আসলে তারা সৃষ্টিশীল মিথ্যাবাদী। গুল হাসান এটাই বলতে চেয়েছেন তার বইয়ে প্রচ্ছন্ন ভাবে, পাকিস্তানে সত্যের একমাত্র প্রতীক ছিল জেনারেলরা।
গুল হাসানের বইয়ের তৃতীয় এবং চতুর্থ অধ্যায়ের শিরােনাম ‘দি এন্ড অফ। অ্যান ইরা’ ও ‘দি ইনএভিটেবল’। এ দুই অধ্যায়ে ১৯৬৯ ও ১৯৭১ সালের ঘটনাবলির বর্ণনা আছে। ১৯৭০ থেকে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত তার বর্ণনা অন্যান্য জেনারেলদের মতাে গতানুগতিক, জেনারেল ফজল মুকিম খানের থেকে
১৪৫

ধার করা। এ-বিবরণে একটি বিষয়ই বারবার জোর দেয়া হয়েছে যে, শেখ
মুজিবের নিরন্তর প্ররােচনার ফলে অবস্থার অবনতি ঘটছিল, সেনাবাহিনীর সঙ্গে ছােটখাট সংঘর্ষ হচ্ছিল এবং সেনাবাহিনীও ক্রমেই ধৈর্যহারা হয়ে উঠছিল ফলে, ২৫ মার্চ সামরিক অ্যাকশন ছাড়া আর কোনাে পথ ছিল না। এ-বিবরণে গুল হাসান নতুন কোনাে তথ্য সংযােজন করেন নি, একটি ছাড়া। তিনি জানাচ্ছেন, ২৫ মার্চের সামরিক অ্যাকশনের প্রস্তাব করেছিলেন ভুট্টো। ২৫
মার্চের আগে, ভুট্টোকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন ইয়াহিয়া। সংকটের সমাধানের আশায়। ভুট্টো বলেছিলেন, সমাধান একটি আছে। তা হলাে, সংক্ষিপ্ত কিন্তু তীব্র সামরিক ব্যবস্থা যা শেখ মুজিব ও তাঁর অনুসারীদের মাটিতে নামিয়ে আনবে। তিনি আরাে জানাচ্ছেন, ১৯৭৭ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর ইসলামী জমহুরিয়ায় গােলাম আজমের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে ভুট্টো একথা স্বীকার করেছেন। সেনাবাহিনী যে-বাঙালির ওপর নির্যাতন করেছে সে-সম্পর্কে একটি লাইন আছে। তার মতে, বাঙালিরা বিদ্রোহ করে, সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাদের সহকর্মীদের হত্যা করে। “Later, atrocities were committed by the Army on the Bengalis.”
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ইসলামাবাদের সেনা সদরে কী ঘটছিল তার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন গুল। এসময় তিনি কায়েকবার ঢাকা সফর করেন। তিনি লিখছেন, তিনি অনুধাবন করেছিলেন, শেষরক্ষা হবে না। একারণে সিজিএস হিসেবে বারবার তিনি সেনাধ্যক্ষ জেনারেল হামিদ ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে তা বােঝাতে চেয়েছেন কিন্তু কেউ তাতে গুরুত্ব দেয় নি। তিনি যা বলতে চেয়েছেন, তা’হলাে ঢাকায় পাকিস্তানী বাহিনীর আত্মসমর্পনের জন্য দায়ী জেনারেল হামিদ ও জেনারেল ইয়াহিয়া। এরপর বর্ণনা দিয়েছেন পাকিস্তানে ভুট্টোর ক্ষমতা দখল, তার সেনাপ্রধান হওয়া ও ভুট্টোর সঙ্গে মনান্তর ইতাদি যা আমাদের রচনার জন্য প্রয়ােজনীয় নয়। এ-বিবরণে একটি বিষয় কয়েকবার তিনি উল্লেখ করেছেন। ভুট্টো তাকে বলেছিলেন, শেখ মুজিব যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে চান এবং এর জন্য ৯০ জনের একটি তালিকা তৈরি করেছেন যার মধ্যে গুল হাসানের নামও আছে। পরে এ-বিষয়ে গুল হাসান ওসমানীকে লিখেছিলেন। ওসমানী জানিয়েছিলেন, কথাটি সত্য নয়। উপসংহারে, জেনারেল অবশ্য একটি কথা স্বীকার করেছেন। পাকিস্তানের পরাজয়ের পর, জেনারেল হামিদ যখন জুনিয়র অফিসারদের ভাষণ দিচ্ছিলেন। তখন গুল হাসান পূর্বপাকিস্তানের প্রতি তাদের উপেক্ষার কথা ভাবছিলেন। “I was still pondering over our indifference to the people of our former Eastern wing.” ৪২৪ পাতার বইতে আর কোথাও তার এ-ধরনের মন্তব্য নেই। অন্যান্য জেনারেলরা কিন্তু স্বীকার করেছেন দুই প্রদেশের অসাম্যের কথা।
গুল হাসান ১৯৬৫ ও ১৯৭১-এর যুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয়, সামরিক শাসন,
বিপর্যয়ের জন্য সেনাবাহিনীর দায়-দায়িত্ব মেনে নিয়েছেন। এর জন্য দোষী উচ্চ পদের সামরিক কর্মকর্তারা। কিন্তু বাকি সৈনিক, অফিসাররা সর্বক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছে। সামরিক শাসন জারি হতাে না, অন্যান্য জেনারেলদের মতাে তিনিও ভূমিকায় ও উপসংহারে বলেছেন, যদি রাজনীতিবিদরা ঠিক থাকতেন। অর্থাৎ সবকিছুর জন্য তারাই দায়ী। সুতরাং “As far as I can foresee, the spectre of Martial Law will be ever-present in Pakistan, unless she produces political leaders who can look beyond provincial horizons, be above-board, possess honesty of purpose, command the solid rapport of the masses, and the genuinely concerned with their welfare, and, last but by no means least, be patriots.”
তবে, তা সম্ভব কি না তাে বিষয়ে তাঁর সন্দেহ আছে।
মেজর জেনারেল তােজাম্মেল হুসাইন মালিক ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যােগ দিয়েছিলেন ১৯৪৬ সালে। যখন যােগ দিয়েছিলেন সেনাবাহিনীতে তখন কিন্তু স্বপ্নেও ভাবেন নি ভারতীয় মুসলমানদের আবাসভূমি পাকিস্তান হবে। পাকিস্তান হওয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই তিনি অপশন দেন পাকিস্তানের পক্ষে। ১৯৪৭ সালে ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে তিনি রওয়ানা দেন ঢাকার উদ্দেশ্যে। দশজন অফিসারের একটি দল রওয়ানা হয়েছিল ঢাকার পথে। তাদের একজন মেজর এসজি এমএম পীরজাদা পরবর্তীকালে লে. জেনারেল হয়েছিলেন এবং ১৯৭১ সালে ইয়াহিয়া খানের ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা ছিলেন।
প্রথমে তারা পৌছেন চাটগা। সেখানে তাদের অভ্যর্থনা জানান। আঞ্চলিক সেনা কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার আইয়ুব খান। চাটগাঁর মানুষও তাদের আন্তরিক অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন। ঢাকায় পৌছলে ঢাকার মানুষজনও তাদের দিয়েছিলেন গ্র্যান্ড রিসেপশন।’ উল্লেখ্য, দশজনের মধ্যে মালিক ছিলেন কনিষ্ঠতম। ক্যান্টনমেন্ট ছিল তখন তেজগায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নির্মিত, প্রায়
পরিত্যক্ত কিছু কুটির নিয়ে ছিল ক্যান্টনমেন্ট। সামান্য কিছু সৈন্য ছিল তখন এবং এই ক্ষুদ্র বাহিনীর নিয়ােজিত ছিল পূর্বপাকিস্তান রক্ষায়।
পূর্বপাকিস্তানের মানুষজনের তখনকার অবস্থা বর্ণনা করেছেন মালিক কয়েক কথায়। কিন্তু তাতেই ফুটে উঠেছে এ-ভুখণ্ডের একটি রূপ। অধিকাংশ সামরিক বেসামরিক কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীরা ছিলেন অবাঙালি। বাঙালিদের তারা হেয় চোখে দেখতেন এবং আলাদা থাকতেন। লিখেছেন তিনি, “They maintained their soical contact in their own circles and treated the locals as Niggers same as the Britishers used to call them” তার মতে, বাঙালিদের শুধু প্রভু

বদলেছিল, ব্রিটিশদের বদল প্রভু হয়েছিল পশ্চিমপাকিস্তানীরা কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে যারা ছিল পূর্ববর্তীদের থেকেও খারাপ।
মালিক লিখছেন, বাঙালিরা “affectionate and unsophiticated people” শহর এবং গ্রামাঞ্চলে মাদ্রাসা নেটওয়ার্কের কারণে, পশ্চিমপাকিস্তান থেকে এখানকার মানুষজন ইসলাম সম্পর্কে বেশি জানতেন। তাদের অবজ্ঞা করা হলে তারা স্পর্শকাতর হয়ে উঠত। আবার সমান মর্যাদা দিলে তারা ছিল ‘ডিপেন্ডেবল ও হেলপফুল’। দুর্ভাগ্যবশত পশ্চিমপাকিস্তানী অফিসাররা বাঙালিদের বিনয়কে ভুল বুঝত। তারা মনে করত বাঙালি নতজানু ও কাপুরুষ এবং বাঙালিদের প্রতি। দুর্ব্যবহার করলেই কাজ আদায় সম্ভব। বাঙালিদের এমন চিত্র আর কোনাে জেনারেলের বইতে পাওয়া যায় না।
আইয়ুব খানের অধীনে ছিল দু’টি ইনফেনট্রি ব্যাটালিয়ন। তাকে প্রায়ই মন্ত্রিসভার বৈঠকে আমন্ত্রণ জানানাে হতাে, রাজনৈতিক বিষয়ে পরামর্শও চাওয়া হতাে। মালিক লিখছেন, এটা ছিল একধরনের সদিচ্ছার বহি:প্রকাশ। তার মতে, “They did so sheer out of sincereity and not because General Ayub was intellectually a more superior person and they needed his advice to run the government.” আইয়ুব সাদাসিধে জীবনযাপন করতেন। কিন্তু তাঁর প্রধান দুর্বলতা ছিল লােভ ও ক্ষমতায় আকাঙ্ক্ষা।
মালিক যা উল্লেখ করেন নি, কিন্তু যা বলা যেতে পারে, তা হলাে, পূর্বপাকিস্তানে তাঁকে রাজনীতিবিদ ও সরকারি কর্মচারীরা অত্যধিক মর্যাদা দেয়ায় ক্ষমতায় প্রতি তার আকাক্ষা হয়ত বৃদ্ধি পেয়েছিল। তিনি রাজনীতিবিদ ও আমলাদের দুর্বলতা জানতেন এবং মনে করতেন শক্তি এবং ছলচাতুরির বলে তিনি তাদের নিজ আয়ত্তে রাখতে পারবেন। হয়ত পূর্বপাকিস্তানে আইয়ুব খানের অবস্থান তাকে ক্ষমতাকাতক্ষী করে তুলেছিল।
মােহাম্মদ আলি জিন্নাহ ১৯৪৮ সালে এসেছিলেন ঢাকায়। রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কিত জিন্নাহর সেই বিখ্যাত ভাষণ সম্পর্কে তিনি যে-তথ্য দিয়েছেন, প্রচলিত তথ্যের সঙ্গে তার মিল নেই। প্রচলিত তথ্য হলাে, রমনা রেসকোর্সে এক ভাষণে জিন্নাহ ঘােষণা করেছিলেন। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু এবং সঙ্গে সঙ্গে তার প্রতিবাদ হয়েছিল। মালিক বলছেন, জিন্নাহর উক্তির প্রতিবাদ সেখানে হয় নি “When he decleared that the state Language shall be Urdu there was not a even murmur from any quarter. They had come there not to question his decision but only to have glimpse of their beloved leader.”
অন্যদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলের প্রভােস্ট অধ্যাপক পি সি চক্রবর্তী তাঁর স্মৃতিকথায় অন্য একটি তথ্য জানাচ্ছেন। কার্জন হলে ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন। মঞ্চে জিন্নাহর পাশে বসেছিলেন তিনি। বক্তৃতার এক পর্যায়ে জিন্নাহ ঘােষণা করেন, রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রদেশের যােগাযােগের ভাষা হিসাবে

একটি ভাষা থাকবে এবং সে-ভাষা হবে উর্দু, অন্য কোনাে ভাষা নয়। সঙ্গে সঙ্গে তিন ধরনের মােগান দেয়া হয় যা “reiterated their faith in the unity of Pakistan, the leadership of Jannah, and their determination to have Bengali as a state language-য় জিন্নাহ রমনায় বক্তৃতা করেছিলেন ২১ মার্চ আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৪ মার্চ। রমনার জনসভায় প্রতিবাদ হলে কি জিন্নাহ একই উক্তি আবার করতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে? আর প্রতিবাদ জনসভায় হওয়া থেকে ক্ষুদ্র পরিসরে সেই পরিস্থিতিতে হওয়া বেশি যৌক্তিক। ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে যারা গবেষণা করছেন তারাই এ-সম্পর্কে ভালাে বলতে পারবেন। সেনাজীবনের বিবরণও দিয়েছেন মালিক। একজন দ্বিতীয় লেফটেন্যান্টের মাসিক বেতন ছিল তখন প্রায় ৪০০ টাকা। তাতে তার ভালােভাবে চলে যেত। যদিও থাকতেন তারা কুটিরে কিন্তু তা ছিল পরিচ্ছন্ন আরামদায়ক। ক্ষমতার স্বাদ সেনাবাহিনী তখন পায় নি, তাদের দায়িত্ব ছিল তখন শুধু সীমান্ত রক্ষা করা এবং তাতেই তারা সন্তুষ্ট। সিলেটেও কিছুদিন ছিলেন মালিক তারপর ১৯৫০ সালে ফিরে যান পশ্চিমপাকিস্তান।
ঐ সময়ের পূর্বপাকিস্তান সম্পর্কে তিনি যে-বিবরণ রেখে গেছেন তাতেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, পূর্ব ও পশ্চিমে ফাটল ধরছিল। অকপটে তিনি সে-বর্ণনা দিয়েছেন। করাচি ফেরার আগে কয়েকদিন ছিলেন তিনি ব্যবসায়ী সদরি ইস্পাহানির বাসায়। ইস্পানি প্রায়ই বলতেন, পূর্ব ও পশ্চিমপাকিস্তানের সম্পর্কে আরাে বেশি “Social contact and fair dealing” থাকা উচিত। না হলে তাদের সম্পর্ক অক্ষুন্ন থাকবে
। এবং পূর্বপাকিস্তানকে পশ্চিমপাকিস্তানের কোনােভাবেই কলােনি হিসেবে বিবেচনা করা উচিত নয়। তাদের “home land” হিসেবেই এ-অঞ্চলকে বিবেচনা করা উচিত। পূর্বপাকিস্তান ছিল তখন অরক্ষিত। এর কোনাে বিমান বা নৌবাহিনী ছিল না অথচ বৈদেশিক মুদ্রার বেশির ভাগ অর্জন করত পূর্বপাকিস্তান। বলা হতাে, ভারতীয় বাহিনী যদি ঢাকা দখল করে তাহলে পশ্চিমপাকিস্তানের বাহিনী দিল্লী অধিকার করবে। সে-কারণে ভারত পূর্বপাকিস্তান আক্রমণ করবে না। বলা হতাে তার ভাষায় “the defensce of East Pakistan lies in West Pakistan the useal lofty talk and a bogus theory which miserably failed in 1971.” aire লিখেছেন, ভারত ঢাকা পৌছেছিল কিন্তু পাকিস্তানবাহিনী ওয়াগা সীমান্তও পেরুতে পারে নি। বরং, “আমাদের ভূখণ্ডের একটা বড় অংশ আমরা হারিয়েছি।” মালিক অবাক হয়ে লিখেছেন, পূর্বপাকিস্তানের প্রতি এই যে বৈষম্য তার জন্য ১৯৫০ পর্যন্ত কোনাে অনুযােগ বাঙালিরা জানায় নি। এ-দিক থেকে দেখলে, “they showed more sense of patriotism than could be expected from any regional unit of a Federal state.”
চতুর্থ অধ্যায়ে মালিক আইয়ুব খানের ক্ষমতারােহণ, পাকিস্তানী বাহিনীর প্রশিক্ষণ এবং বাঙালি সৈনিকদের সম্পর্কে কিছু তথ্য দিয়েছেন। এসব তথ্য দিয়ে

তিনি পাকিস্তানের ভাঙনটি বুঝতে চেয়েছেন। অন্যকোনাে জেনারেল এত আবেগহীন ভাবে এসব তথ্য প্রদান করেন নি।
১৯৫১ সালে আইয়ুব খান পাকিস্তানের সেনাধ্যক্ষ হন। জ্যেষ্ঠতার তালিকায় আইয়ুব খানের স্থান ছিল দশম কিন্তু সেনাধ্যক্ষের পদটি তিনি পেলেন, মালিক জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার পূর্বপাকিস্তানী সদস্যদের কারণে। এ তথ্য কেউ আগে জানান নি। এতে বােঝা যাচ্ছে আইয়ুব খানের ‘ঢাকা কানেকশন কাজে লেগেছিল। অবশ্য, বাঙালিরা তখন নিশ্চয় বুঝতে পারেন নি তারা কী বিপদ ডেকে আনছেন।
আইয়ুব খান ক্রমেই ক্ষমতার দিকে এগােতে লাগলেন। ১৯৫৮ সালে দেশ যখন নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করলেন। এ-কাজটি করে মালিক জানাচ্ছেন, দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলাে বিকাশে তিনি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে ক্ষতি করলেন। সেনাপতিরা তখন বােঝেন নি যে, পাকিস্তান ভাঙনের বীজ তারা বপন করলেন। কারণ “the lust for power is often so tempting for such small minds that for their personal ambitions and greed they are always prepared to sacrifice the national interest as long as their own purpose is served.”
সামরিক শাসন জারির পর সেনাবাহিনীর আনুগত্য কাগজে-কলমে রইল দেশের প্রতি, আসল আনুগত্য রইল সেনাধ্যক্ষের প্রতি। মালিক জানাচ্ছেন এটিই ছিল সমস্যার মূল। এ-প্রসঙ্গে তিনি একটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন। তিনি তখন আংকারায় পাকিস্তান দূতাবাসে কর্মরত। এক পার্টিতে ব্রিটিশ এয়ার ফোর্সের অ্যাটাচের স্ত্রী তার স্বামীকে বলেছিলেন, “ডার্লিং আমাদের দেশে মার্শাল ল হতে পারে না। তার স্বামী হেসে বলেছিলেন, হতে পারে, কিন্তু যিনি এ-ঘােষণা করবেন সারা দেশের লোেক তাকে পাগল বলবে। তার মতে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণে এ-বিষয়টি ছিল না এটি “deliberately ignored and the central governments gave no protection to those who showed reluctance to obey the illegal orders of this superiors.”
এ-প্রসঙ্গে উল্লেখ করা বােধ হয় অসমীচীন হবে না যে, ১৯৭৫ থেকে বাংলাদেশের যতগুলাে আর্মি কু হয়েছে তার প্রতিটির নেতা ছিলেন পাকিস্তান প্রশিক্ষিত। এদের কেউ-কেউ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেও পাকিস্তানী প্রশিক্ষণের বিষয় থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। এ-বিষয়ে ভূমিকায়ই আলােকপাত করেছি।
১৯৫৪ সালে মালিককে কাবুলে মিলিটারি একাডেমিতে প্রশিক্ষক করা হয়। সেখানে তার ছাত্র হিসেবে ছিলেন বাংলাদেশের পরবর্তীকালের চারজন মেজর জেনারেল মান্নান সিদ্দিকি, মােহাম্মদ জান, ওয়াজিউল্লাহ ও নূরউদ্দিন। তিনি
১৫০

জানাচ্ছেন, বাঙালি ক্যাডেটেদের উপেক্ষা করা হতাে, “Their number had reduce due to shunting out as duds” মালিক লিখেছেন, এরা যে পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে উন্নতি করেছে তাই প্রমাণ করে যে অন্যদের থেকে এরা অযোেগ্য ছিলেন না।
২৭ ১৯৬৩ সালে ১৫ বছর পর মালিক ফিরলেন পূর্বপাকিস্তানে। কুমিল্লায় ছিল তার পােস্টিং। তিনি লিখেছেন, ১৫ বছরেও পূর্বপাকিস্তানের তেমন কোনাে উন্নতি হয় নি তবে কুর্মিটোলায় নতুন ক্যান্টনমেন্টের উন্নতি হয়েছে। তাও বােধ হয় পশ্চিমপাকিস্তানী সৈন্যদের জন্য। কারণ তখন পর্যন্ত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দুইকি-তিনটি ব্যাটেলিয়ান মাত্র গড়ে তােলা হয়েছে। যে-কোনাে নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকই বুঝতে পারতেন, পশ্চিমপাকিস্তানীরা বাঙালিদের তখনও ‘নিগার’ মনে। করে। সাধারণ মানুষ ছিল গরিব। কিছু ধনী ছিল যার মধ্যে ছিল পশ্চিমপাকিস্তানী ব্যবসায়ীরা।
এখানে মালিক বাঙালিদের সম্পর্কে পাকিস্তানীদের সেই পূর্ব ধারণার উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, যা কিছু পূর্বপাকিস্তানে ঘটেছে তার জন্যে হিন্দুরা দায়ী এটি বলা প্রতারণার সামিল। তার ভাষায় ‘To say that whatever happened in East Pakistan was because of Hindu progaganda amounts to deceiving one self.”
রাজনীতি সম্পর্কে যাদের সাধারণ জ্ঞান আছে তারাও বুঝতে পারছিলেন ভাঙন ধরেছে। পশ্চিমপাকিস্তানী শাসকদের বাঙালিরা ঘৃণা করত। বাঙালিরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ কিন্তু তাদের সাথে ব্যবহার করা হতাে আমেরিকার নিগ্রোদের মতাে। “This position of second class citizenship, they were not prepared to accept long.” মালিক এখানে একটি রূপক ব্যবহার করেছেন। ইব্রাহিম লােদির অত্যাচারে টিকতে না পেরে তার চাচা দৌলত খান বাবরের সাথে মিত্রতা করেন। বাঙালিরা দেখছিল স্বাধীনতার সাথে প্রভু বদল যা তারা চায় নি। বিদেশী শাসক থেকে মুক্ত হওয়া যায় নি এবং হয়ত আগরতলা ষড়যন্ত্র ছিল সেদিকে একটি পদক্ষেপ কারণ এর উদ্দেশ্য ছিল পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকদের উৎখাত করে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা। সে-কারণে, “Mujib in fact, was not a traitor. He was a great patriot for his own people.” মালিক লিখেছেন, ১৯৬৫-এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচন যদি সার্বজনীন ভােটাধিকারের ভিত্তিতে হতাে তাহলে ফাতিমা জিন্নাহ জিততেন। আইয়ুব জিতলেন বটে কিন্তু ফাতিমা মৌলিক গণতন্ত্রীদের ৪০% ভােট পেয়েছিলেন। এই ফলাফলই বিরােধীদলের আন্দোলনের সূত্রপাত করে যা অন্তিমে আইয়ুব খানের

পতন ডেকে এনেছিল। ঐ সময়ই মালিক প্রমােশন পেয়ে কর্নেল হলেন কিন্তু সেনাবাহিনীতে তখন চলছিল ওপরওয়ালাকে খুশি করার প্রতিযােগিতা। ওপরওয়ালাকে খুশি না-করলে তখন ওপরে ওঠা ছিল মুশকিল। “Ever since our higher military leadership got involved in politics, their priorities changed.”
নয় থেকে চৌদ্দ অধ্যায় পর্যন্ত মালিক পশ্চিমপাকিস্তানে বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান, ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে তার অংশগ্রহণ ইত্যাদি নিয়ে আলােচনা করেছেন যা আমাদের জন্যে প্রাসঙ্গিক নয়। প্রাসঙ্গিক হলাে সেনাবাহিনী ও সামরিক শাসন সম্পর্কে তার মূল্যায়ন। সামরিকবাহিনী বিশেষ করে ক্ষমতা দখলের পর তা অনুধাবন করা যায়। মন্তব্য করেছেন তিনি, সামরিক শাসনকে বাইরে থেকে যতটা দৃঢ় ও স্থিতিশীল মনে হয় আসলে তা নয়। এ-ধরনের সরকার বরং সবচেয়ে দুর্বল সরকার। যতদিন চলে ভালাে চলে, একটু গড়বড় হলেই তার ভিত্তি কেঁপে ওঠে। ভালােমন্দ বৈঠকের পর পশ্চিমপাকিস্তানে জনপ্রতিক্রিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি এ-মন্তব্য করেছেন এবং তাশখন্দের জন্য আইয়ুব খানকেই দোষী করেছেন।
১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পর মালিক আঙ্কারায় পাকিস্তান দূতাবাসে চাকরি করেছেন। ১৯৬৯ সালে ফেরত আসেন করাচি। তখন সামরিক আইন। প্লেন থেকে নামার পর খুব খাতির-যত্ন করে তাকে ভিআইপি লাউঞ্জে নিয়ে যাওয়া হলাে। মালিক লিখেছেন, তিনি তখন ব্রিগেডিয়ারও হন নি। সামরিক শাসনে এ-ধরনের বাড়তি সুবিধা মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করে তােলে। লিখেছেন তিনি, “Such are the privileges of Martial law which knowingly or unknowingly army officers keep availing and when they get used to it, most of them become corrupt.”
১৯৭১ সালে তাকে সদর দফতরে বদলি করা হয়। চিফ অফ স্টাফ হামিদকে তিনি জানালেন, মনে হচ্ছে যুদ্ধ আসন্ন। সুতরাং সদর দফতর থেকে যুদ্ধক্ষেত্রে থাকা তিনি পছন্দ করলেন। মালিক তখন ব্রিগেডিয়ার। পশ্চিমপাকিস্তানে কোনাে পােস্ট ছিল না। হামিদ জিঞ্জেস করলেন, তিনি পূর্বপাকিস্তান যেতে রাজি কি না। মালিক বললেন, পূর্বপাকিস্তানও তাে পাকিস্তান। সুতরাং যাব না কেন? এ উত্তর খুব খুশি করল হামিদকে, কারণ ঐ সময় পূর্বপাকিস্তান যেতে কেউ রাজি ছিল না। এবং পূর্বপাকিস্তানে কারাে পােস্টিং হলে হাসপাতালে আশ্রয় নিত যাতে পােস্টিং-অর্ডার ক্যানসেল হয়। সামরিক সচিবকে ঐ সময় একটি চিঠি ইস্যু করে নির্দেশ দিতে হয়েছিল যে, একবার পােস্টিং হলে তা বাধ্যতামূলক। তা বাতিল করা যাবে না। মালিকের বিবরণ থেকে এ-সমস্যাটিই বেরিয়ে আসে যে, পূর্বপাকিস্তানের সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে সামরিকবাহিনীর অফিসাররা কমবেশি সবাই জানতেন। ঐ সরকারের নীতিনির্ধারক এবং সামরিক ব্যক্তিবর্গ আমার সঙ্গে সাক্ষাৎকারের

সময় বলেছেন, পূর্বপাকিস্তানে কী হচ্ছিল তারা তা জানতেন না। বক্তব্যটি যে-মিথ্যা ছিল তা বলাই বাহুল্য। মালিকের বিবরণ এর দালিলিক প্রমাণ। মালিক। আরাে লিখেছেন, তার মার কাছ থেকে যখন তিনি বিদায় নিতে গেলেন তখন তার মা কান্না শুরু করলেন। মালিকের মতে তা স্বাভাবিক কারণ, “Everybody knew the risks involved for going to East Pakistan in those days.”
১৬ নভেম্বর (১৯৭১) মালিক পৌছলেন ঢাকায়। ১৭ নভেম্বর তাকে বগুড়ায় পাঠানাে হলাে ২০৫ ব্রিগেডের অধিনায়ক হিসেবে। পরের দিন মালিককে নির্দেশ দেয়া হলাে লালমনিরহাট যেতে। কারণ জেনারেল নিয়াজি সেখানে যাবেন। মালিক লিখেছেন, “প্রথম দর্শনে নিয়াজিকে ‘আনসফিসটিকেটেড সােলজার’ মনে হতে পারে। আমি নিজেও তার অনেক অশ্লীল জোকস পছন্দ করি নি। কিন্তু দেখলাম কথা বলে সৈন্যদের তিনি উজ্জীবীত করতে পারেন এবং মনে হলাে সব। কিছু তার নিয়ন্ত্রণে।” ৩ ডিসেম্বরের আগেই হিলি সীমান্তে সংঘর্ষ শুরু হয়। মালিক জানাচ্ছেন, ৩ ডিসেম্বর সরকারিভাবে যুদ্ধ শুরু হওয়ার একসপ্তাহ আগে থেকেই সংঘর্ষ শুরু হয়। ৩ তারিখ তারা ইয়াহিয়ার জিহাদে যােগ দেয়ার ডাক শুনলেন বেতারে। বক্তৃতায় সােমনাথ মন্দির ও সুলতান মাহমুদ সম্পর্কে হয়ত কোনাে রেফারেন্স ছিল। কারণ, মালিক মন্তব্য করছেন, ইয়াহিয়া খান জানেন না সােমনাথ মন্দির যিনি দখল করছিলেন তিনি ছিলেন সাচ্চা মুসলমান, ইয়াহিয়া খানের মতাে মদ্যপ বা লম্পট নন।
যুদ্ধ পুরােদমে শুরু হলাে ৭ ডিসেম্বর। জিওসিকে সঙ্গে নিয়ে মালিক রওয়ানা হলেন বগুড়ার দিকে। পীরগঞ্জের কাছাকাছি পৌছতেই ভারতীয় ট্যাংক বহরের সামনে পড়ে গেলেন। মালিক বিস্মিত, কারণ করতােয়া পেরিয়ে এদিকটায় আসা দুরূহ। যা-হােক তারা দু’জন ও পথপ্রদর্শক লাফিয়ে নেমে পালাতে লাগলেন। তাদের ড্রাইভারকে গ্রেফতার করা হয়। ড্রাইভার থেকে মালিকদের খবর পেয়ে ভারতীয়রা তাদের খোঁজ শুরু করে। মালিক ও জিওসি এরই মধ্যে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। পরে জিওসি তাকে জানিয়েছিলেন, এক বৃদ্ধ তাকে তার কুটিরে আশ্রয় দিয়েছিল, মুক্তি’রা সে-কুটির মার্চ করতে এলে বৃদ্ধ তাদের জানায় যে, তার ঘরে কেউ নেই। মালিক যে-জায়গায় ছিলেন সেখান থেকে বগুড়া ৪০ মাইল আর রংপুর ২৪ মাইল। কী করবেন বুঝতে পারছেন না। স্থানীয় এক বাঙালির কাছে সাহায্য চাইলেন। বাঙালি জানান, পীরগঞ্জে পাকিস্তানী কিছু সৈন্য আছে। মালিক তাকে গাইড হতে বললেন। সন্ধ্যায় পীরগঞ্জ পৌছলেন। সে-জায়গা খালি। আবার সে ব্যক্তির বাড়িতে ফিরে এলেন। খানিকপর আবার মালিক সেই বাঙালি গাইড নিয়ে চলা শুরু করেন পাকিস্তানী সৈন্যদের খোঁজে। পথে একদল বাঙালির সঙ্গে দেখা। গাইড তাদের সঙ্গে কথা বলল। ২০ মাইল দূরে দরগায় নাকি তারা কিছু পাকিস্তানী সৈন্য দেখেছে, হেঁটে দরগা পৌছে তিনি একদল পাকিস্তানী সৈন্য পেলেন। সেখান

থেকে জিপ নিয়ে আবার রংপুর এলেন। জিওসির সঙ্গে দেখা হলাে। কিছু সৈন্যসামন্ত নিয়ে তারা পীরগঞ্জের দিকে রওয়ানা হলেন ভারতীয় আক্রমণ রুখতে। প্রায় ১৮ ঘণ্টা রুখেছিলেন। তারপর পিছু হটতে হয়। মালিক বগুড়ায় তার সদর দফতরে ফিরে যেতে চাচ্ছিলেন। ৯ তারিখ তিনটি জিপের কনভয় নিয়ে তিনি রওয়ানা হলেন বগুড়া। ৯ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত বিভিন্ন সংঘর্ষের বর্ণনা তিনি। দিয়েছেন যা যুদ্ধ বিশারদদের হয়ত কাজে লাগবে। ১২ তারিখ মহাস্থানের কাছে করতােয়া পার হয়ে দেখেন একদল সৈন্য ফিরে আসছে। ক্রুদ্ধ হলেন মালিক তাদের পলায়ন দেখে। সেখানেই তিনি কমান্ডিং অফিসারকে পদচ্যুত করে এক বক্তৃতায় সৈন্যদের বলেন, যারা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহুকে বিশ্বাস করে তাদের লজ্জিত হওয়া উচিত যে কাফিরদের আক্রমণে তারা ফিরে আসছে। তিনি হুমকি দিয়ে বলেছিলেন, বগুড়ার দিকে যদি কাউকে ফিরে আসতে দেখা যায় তাকে গুলি করা হবে। মালিক জানিয়েছেন, ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার নির্দেশ দিয়েছিলেন, ৭৫ ভাগ। ক্যাজুয়ালিটি না-হওয়া পর্যন্ত ডিফেনসিভ পজিশন কেউ ছাড়তে পারবে না। কিন্তু সে-নির্দেশ কেউ মানে নি। মালিক বগুড়ার আশপাশের কিছু পজিশন পরিদর্শন। করে সদরে ফেরার পর ব্রিফিংকালে এক অফিসার জানালেন, ইতােমধ্যে কয়েকজন অফিসারকে হিলাল-ই-জুরাত দেয়া হয়েছে। এরা হলেন, লে. জে, নিয়াজি, মে, জে, রহিম, মে, জে, আনসারি, রিয়ার অ্যাডমিরাল শরিফ এবং মে. জে. জামশেদ। মালিক বলছেন, আরাে অনেক অফিসার তখন যুদ্ধ করে মরছেন কিন্তু মেডেল পাচ্ছেন বড়রা। শুধু তাই নয়, অনেক জায়গায় ভেড়ার পালের মতাে পাকিস্তানী। সৈন্যরা পালাচ্ছে আর তারা মেডেল নিয়ে কাড়াকাড়ি করছেন। লিখেছেন তিনি, “What justification was there, to give Hilal-E-Jurat to officers for killing their own contrymens whereas in actual was against the Indians they had made no significant contribution and at the end, most of the so-called heroes prefered to surrender to save their on lives.”
এই বাক্যটি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি স্বীকার করছেন, তার দেশের সেনাবাহিনী তার দেশের লােকদের হত্যা করছে। সাংবাদিক আই. এ. রেহমান আমাকে বলেছিলেন, গণহত্যার কথা বাদ দিন। পাকিস্তানী সৈন্য যদি একটি লােককেও হত্যা করে থাকে সেটি হত্যা এবং অপরাধ। জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুবও বলেছিলেন, শেষ আশ্রয় হিসেবে সাধারণ মানুষ যায় সেনাবাহিনীর কাছে। আর যদি কোনাে দেশে নিজেদের সেনাবাহিনী দেখে লােকজন পালায় তখন সে-সেনাবাহিনী সম্পর্কে আর কী বলা যায়!
১৪ ডিসেম্বর বিকেল থেকে বগুড়া ক্যান্টনমেন্টের ওপর গােলাবর্ষণ শুরু হলাে। মালিক নিজেও লক্ষ করলেন তার অধস্তনদের মনােবল দুর্বল হয়ে পড়েছে। খবর পেলেন অনেকে আত্মসমর্পণের কথা ভাবছে। আত্মসমর্পণের কথা তিনি। ভাবতেও পারেন না। ঠিক করলেন কয়েকজন অফিসারকে নিয়ে “ফ্রন্টলাইন”

পরিদর্শনে যাবেন। সন্ধ্যা ৬টায় ৮ম বালুচ রেজিমেন্টের কাছে পৌছলেন। বললেন, মুসলমান হিসেবে তারা কিভাবে কাফেরদের কাছে আত্মসমর্পণের কথা চিন্তা করছে? ঠিক করলেন রাতটা তাদের সঙ্গেই কাটাবেন।
১৫ তারিখ পুরাে দিনরাত তুমুল সংঘর্ষ হলাে, ১৬ তারিখ এক অফিসার তাকে জানালেন, বিবিসিতে শুনেছেন জেনারেল নিয়াজি আত্মসমর্পণ করেছেন। এদিকে যৌথবাহিনীও গােলাগুলি বন্ধ করে মাইকে আত্মসমর্পণের কথা ঘােষণা করছিল। ১৪ তারিখে গােলাতে মালিকের সিগন্যালব্যবস্থা ধ্বংস হওয়ায় সদরের সঙ্গে যােগাযােগ করতে পারেন নি। ভেবে দেখলেন, বগুড়ায় সদরে ফেরা তার পক্ষে সম্ভব নয়।
অন্য রাস্তা দিয়ে সে-জায়গা থেকে বের হয়ে যাওয়া যায় কি না ভাবছিলেন মালিক। ৬০/৭০ জন সৈন্য নিয়ে রওয়ানা হলেন। খানিকটা এগােতেই ভারতীয় বাহিনীর সম্মুখীন হলেন। তবুও তিনি আত্মসমর্পণ করবেন না। কিন্তু তার এক মেজর শাদা রুমাল দেখিয়ে আত্মসমর্পণের সিগন্যাল দিল। সাথে সাথে আরাে কয়েকজন। একজন ল্যান্সনায়েককে নিয়ে কোনােরকমে সরে ২০০/৩০০ গজ দূরে কয়েকটি কুঁড়ে দেখতে পেলেন। এরকম একটা কুঁড়েতে জোর করে ঢুকে পড়লেন। তখন প্রায় দশটা বাজে। ৬ টা পর্যন্ত রইলেন সেখানে।
সন্ধ্যার সময় মালিক ও ল্যান্সনায়েক আশরাফ তাদের টুপি-ব্যাজ ইতাদি খুলে ফেলে গায়ে চাদর জড়িয়ে নিলেন। ঘরের একজন প্রৌঢ়কে বললেন, তাদের পথ দেখাতে। তার কোনাে ভয় করছিল না কারণ তার মতে তিনি কোনাে অন্যায় করেন নি। একটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন তিনি। বগুড়ায় জয়েন করেই তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন বিনা তদন্তে কোনাে বাঙালিকে শাস্তি দেয়া যাবে না। কয়েকদিন পর ৭/৮ জন বাঙালিকে ধরে আনা হলাে। একজন অফিসার জানাল, তারা মুক্তি’, সুতরাং ব্যবস্থা নেয়া হােক। মালিক জিজ্ঞেস করলেন, প্রমাণ কী? একজন বলল, তাদের একটি দল যখন যাচ্ছিল তখন গুলি ছােড়া হয়েছে তাদের ওপর। সুতরাং গ্রাম সার্চ করে তারা এদের পেয়েছে। মালিক বললেন, তখন এরা কী করছিল? জবাব পেলেন, নিত্যদিনের স্বাভাবিক কাজকর্ম করছিল। “এ-ধরনের পরিস্থিতিতে কী করা হয়?” এ-প্রশ্নের জবাব পেলেন, “গুলি করা হয়।” মালিক তাদের ছেড়ে দিলেন। কারণ, তিনি বিশ্বাস করতেন, ইসলাম বলে, যে অন্যের ওপর দয়া দেখায় না সে নিজেও দয়া পায় না।
এ-বিবরণে একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। অফিসার তাকে জানিয়েছিল, কাউকে ধরে আনলেই গুলি করা হতাে। প্রতিটি সেনাছাউনিতে প্রতিদিন এরকম ধরে এনে গুলি করলে মুক্তিযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা কত দাঁড়াবে? এ-কথা উল্লেখ করলাম এ-কারণে যে, বাংলাদেশে যত বলা হয় তত মানুষ মারা যায় নি এমন একটা কথা ইদানীং বলার চেষ্টা করা হয়।
শান্তাহার ৪০ মাইল দূর। মালিকের কাছে কোনাে ম্যাপ, কম্পাস কিছু নেই।
১৫৫

রাত ৮টার দিকে রওয়ানা হলেন শান্তাহারের দিকে। পথে ভারতীয় পেট্রোল চ্যালেঞ্জ করলে তিনি গুলি করলেন। এ-ফাকে দেখলেন তার বাঙালি গাইড কেটে পড়েছেন। তার ধারণা ছিল বগুড়ার পশ্চিমে শান্তাহার। রেললাইন খুঁজতে লাগলেন। তিনি। খুঁজতে খুঁজতে এক কুটিরে পৌছলেন। বাড়ির মালিক ‘ভালাে মুসলমান’। পানি খেতে চাইলে তাকে পানি দেয়া হলাে। সারাদিন তিনি খান নি। কিন্তু চাষির ঘরে কিছু ছিল না। তিনি আবার হাঁটা শুরু করলেন। ভাের ৪টায় কাহলুর কাছে। এক গ্রামের পরিত্যক্ত এক কুঁড়েতে আশ্রয় নিলেন। সকালে অজু করে নামাজ পড়ার সময় স্থানীয় কয়েকজন বাঙালির সঙ্গে দেখা। একজন তাকে নামাজ পড়ার জন্যে মাদুর এনে দিল। মালিক মন্তব্য করেছেন, “That again shows that despite what we had done to them, the fraternal feelings of Islam were still there.”
অন্যান্য সেনাপতি মুক্তিযুদ্ধের সময়কাল বর্ণনা করতে গিয়ে হত্যা, লুট, ধর্ষণের কথা এড়িয়ে গেছেন বা কিছু জানেন না, এমন ভাব করেছেন। তােজাম্মেল হুসাইন মালিক যে-সময় বগুড়া পৌছেছেন তখন তার অনেক কিছুই অজানা থাকার কথা। তা সত্ত্বেও যেটুকু জেনেছিলেন নিশ্চয় তার কাছে ভয়াবহ মনে হয়েছিল। না হলে এ-উক্তি করতেন না যে হােয়াট উই হ্যাড ডান টু দেম। নামাজ পড়ে জামাতের কাউকে কোথাও পাওয়া যাবে কি না জানতে চাইলেন। একজন বলল, সামনের মাদ্রাসায় গিয়ে খোঁজ নিতে। মাদ্রাসার শিক্ষক তাকে গাইড দিতে পারলেন না কিন্তু কিছু মুড়ি দিলেন। কিছুদূর এগােতেই। মুক্তিবাহিনী তাদের ঘিরে ফেলল। তিনি ও আশরাফ গুলি করেছিলেন। কিন্তু আশরাফ নিহত হয় এবং তারপরই দেখেন ৭/৮ ‘মুক্তি’ ও লাঠি হাতে স্থানীয় লােকজন তাকে ঘিরে ফেলেছে। লাঠির বাড়ি পড়তে লাগল মাথায়। একসময় তিনি বললেন, “আমি বিগ্রেড কমান্ডার, আমাকে জ্যান্ত ধরে নিয়ে গেলে পুরস্কার পাবে।” ব্রিগেড কমান্ডার শুনে মুক্তিযােদ্ধারা স্থানীয় লােকদের চলে যেতে বলল এবং তাকে সম্মানের সঙ্গে কাহলু নিয়ে গেল। পরদিন যে মুক্তিসেনা তাকে গ্রেফতার করেছিলেন তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তিনি কি বালুচি?
“হ্যাঁ” উত্তর দিলেন মালিক।
“চিন্তার কারণ নেই। আমার ছেলেকেও ধরা হয়েছিল কিন্তু বালুচিরা তাকে বাঁচিয়েছে। আপনার কোন ক্ষতি হবে না।” মালিকের মনে হলাে, কয়েকদিন আগে তিনি যাদের মুক্তি দিয়েছিলেন তাদের কেউই হয়ত হবে এই মুক্তিযোেদ্ধার সন্তান।
মালিককে যুদ্ধবন্দি হিসেবে ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেয়া হলাে। তিনি খুশি যে তাকে আত্মসমর্পণ করতে হয় নি। তারপর ভারতে যুদ্ধবন্দি হিসেবে কাটিয়ে তিনি পাকিস্তান ফিরে যান। মেজর জেনারেল হন। কিছুদিন পর তাঁকে অবসর দেয়া হয়। জামাতে ইসলামীর তিনি ভক্ত ছিলেন যদিও তাতে যােগ দেন

নি। জিয়াউল হক আমলে জিয়াউল হককে উৎখাত করার দায়ে গ্রেফতার হন। ২৪ থেকে ৪০ অধ্যায় পর্যন্ত এসব কাহিনীই বর্ণিত হয়েছে। এসব আমাদের রচনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয় দেখে আলােচনা করা হলাে না।
তিনি লিখেছেন, পূর্বপাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ব্যুহ ঠিকই ছিল কিন্তু কেউ তা কার্যকর করে নি। জেনারেল নিয়াজিকে তিনি পাকিস্তানের পরাজয়ের জন্যে দোষী করেন নি। লিখেছেন, নিয়াজি নামী কেউ ছিলেন না বটে তবে ‘কাপুরুষ ছিলেন
।’ তার মতে, আত্মসর্পণের সিদ্ধান্ত নিয়াজির একার নয়, এটি সব জেনারেলের একটি সিন্ডিকেট সলিউশন।’ জেনারেল ইয়াহিয়ার ঘনিষ্ঠ জেনারেল রহিমকে তাদের মুখপত্র হিসেবে ইয়াহিয়ার কাছে পাঠাবার কথা হয়েছিল। এটি সম্ভব হলে, তার মতে হামদুর রহমান কমিশন হতাে না।
মালিক সামরিকবাহিনীর কথাই বলেছেন তার বইতে, রাজনীতি বা রাজনৈতিক প্রসঙ্গে আলােচনা করেন নি। তিনি একটি কথা অবশ্য বারবার বলেছেন যে, সামরিক শাসনই সবকিছুর জন্যে দায়ী। ইয়াহিয়াকেও তিনি দায়ী করেছেন। ১৯৭১ সালের অক্টোবরে ইয়াহিয়ার পুত্রের বিয়ে হয় ধুমধাম করে। অনেকে তখন বলেছিলেন, রােম যখন পুড়ছে তখন নিরাে বাঁশি বাজাচ্ছেন। তিনি পাকিস্তান ভাঙার জন্যে এই জেনারেলদের দায়ী করেছেন এবং তারা যে-গণহত্যা করেছে তাও উল্লেখ করেছেন। তার এই মন্তব্য গুরুত্বপূর্ণ বিধায় তার ভাষায় উদ্ধৃতি দিচ্ছি—
“I must say most of our senior officers had very slavish mentality. They knew the things were going wrong and often kept cribbing about it-yet they took no steps to dislodge Yahyah Khan who in any case was a usurper and had no legal right to be where he was. Their attitude was that of a mercenary soldier. They were only concerned with their own bread and butter. It never pricked their conscience that hundred of their own countrymen were being massacred by these butchers only because they wanted to stay in power at all costs. In fact most of the senior generals were as much to be blamed for the break up of Pakistan as Yahyah Khan himself.
যে-ফ্রেমের আলােকে বইটি আলােচনা করছি সে-ফ্রেমের পরিপ্রেক্ষিতে বলতে হয়, তােজাম্মল হুসাইন মালিকের দি স্টোরি অফ মাই স্ট্রাগল একমাত্র ব্যতিক্রম। নিজের পেশাকে সমালােচনার সাহস তিনি দেখিয়েছেন, তকালীন পূর্বপাকিস্তানের চিত্রটিও সঠিকভাবে তুলে ধরেছেন। যারা আত্মজীবনী লিখেছেন, তাদের মধ্যে একমাত্র তিনিই মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ লড়াই করেছেন। কিন্তু মুক্তিবাহিনী সম্পর্কে কোথাও বিরূপ মন্তব্য করেন নি। তবে, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ অন্তিমে তার কাছে ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তানী বাহিনীর যুদ্ধ হিসেবেই প্রতিভাত হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা থাকে নি। কারণ, এ-সত্যটি কোন পাকিস্তানীর মনস্তাত্ত্বিকভাবে মেনে নেয়া সম্ভব নয়।

জেনারেল তিনি নন, তবে ব্রিগেডিয়ার বটে। এ.আর. সিদ্দিকি হয়ত জেনারেলই হয়ে যেতেন, যদি না ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বিপর্যয় হতাে। ঐ সময় সরাসরি তিনি নির্ধারণ করেন নি বটে কিন্তু এর বাইরেও ছিলেন না এবং প্রভাবশালী নীতিনির্ধারকদের সঙ্গেও তাঁর সম্পর্ক ছিল। ১৯৭১ সালে তিনি। ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান জনসংযােগ কর্মকর্তা। সম্প্রতি তাঁর একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে, নাম দি মিলিটারি ইন পাকিস্তান ইমেজ অ্যান্ড রিয়ালিটি। জেনারেলদের মন এবং তাদের লেখা গ্রন্থ (বিশেষ করে ১৯৬৯-৭১ সম্পর্কিত) বুঝতে এ-বইটি সাহায্য করবে। সম্পূর্ণ, নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে বিচার করেছেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কোনাে সদস্যের এ-ধরনের লেখা এই প্রথম প্রকাশিত হলাে। মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গও এসেছে গ্রন্থটিতে, তাই তা আমাদের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। ওপরে, জেনারেলদের তৈরি যে-ইতিহাস তত্ত্বের কথা উল্লেখ করেছি, এ-বইটি সে-তত্ত্বও স্পষ্ট করতেও সাহায্য করবে।
গ্রন্থকার শুরুতেই অজ্ঞাত এক ব্যক্তির একটি মন্তব উদ্ধৃত করেছেন”Countries which worship armies tend to use armies.” TT CAICO এটিই তার বইয়ের মূল বিষয়। পাকিস্তানীরা সেনাবাহিনীকে ভজনা করেছে এবং ব্যবহার করেছে। তবে, তিনি বিষয়টি অন্যভাবে দেখলে যথাযথ হতাে। পাকিস্তানীরা সেনাবাহিনীকে ভজনা করেছে আর সেনাবাহিনী রাষ্ট্রকে ব্যবহার করেছে, ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধার করেছে এবং রাষ্ট্রকে ছিবড়ে করে ছুঁড়ে ফেলেছে। সিদ্দিকি পুরাে বইয়ে একটি বিষয়ই বলতে চেয়েছেন, পঞ্চাশের দশক থেকে। পাকিস্তানের সামরিকবাহিনীর একটি ইমেজ গড়ে তােলা হয়েছে যার সঙ্গে বাস্তবতার কোনাে মিল নেই। ইমেজ বৃদ্ধির এই নিরন্তর ধান্ধা তাদের মধ্যে এ-ধারণার সৃষ্টি করেছিল যে, তারা কোনাে ভুল করতে পারে না। জেনারেলরা সবসময় মনে করেছেন, রাজনীতিবিদরা যে-বিশৃংখলা (mess) সৃষ্টি করে যান। তারা তা দূর করতে পারবেন। এ-বইয়ের উদ্দেশ্য এটি দেখানাে যে, সেনা ভজনা। কী ধরনের ধ্বংসাত্মক অভিঘাত সৃষ্টি করে। প্রথম অধ্যায়ের শিরােনাম ‘দি বার্থ অফ দি ইমেজ (১৯৪৭-৫২)’। ১৯৪৭-৫২, এই পাঁচ বছর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইমেজের ছিল ক্ৰণাবস্থা। পাকিস্তান সৃষ্টির পর সেনাবাহিনীর প্রধান ছিল বৃটিশ। আইয়ুব খান-কে সেনাবাহিনীপ্রধান রাখার মাধ্যমে সেনাবাহিনীর পাকিস্তানীত্ব কায়েম হয়। অন্যান্য বৃটিশ অফিসার যারা ছিলেন তারাও চলে যান। স্যান্ডহার্স্ট শিক্ষিত পাঞ্জাবি অফিসাররা ক্ষমতায় চলে আসেন। আইয়ুব খান সচেতনভাবে সেনাবাহিনীর ইমেজ সৃষ্টি করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এবং এই ইমেজ সৃষ্টি দুই প্রদেশে দুই রকমভাবে হয়েছিল।

পশ্চিমপাকিস্তানের যুদ্ধের একটা ঐতিহ্য ছিল। সেনাবাহিনীর অধিকাংশ ছিল সে-অঞ্চলের। ফলে, সেনাবাহিনীর ইমেজ সৃষ্টিতে সেখানে বাধা ছিল না। কিন্তু, পূর্বপাকিস্তানে, লিখেছেন, সিদ্দিকি, যুদ্ধের কোনাে ঐতিহ্য ছিল না। আইয়ুব খান ছিলেন পূর্বপাকিস্তানের প্রথম জিওসি। বাঙালিদের সেনাবাহিনীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য তিনি গ্রামে-গঞ্জে ফ্ল্যাগ মার্চ করাতেন। বাঙালিরা, দীর্ঘদেহী, সুবেশী পশ্চিমা এই সৈন্যদের দেখে মুগ্ধ হতাে, একধরনের শ্রদ্ধা জন্মাত।
১৯৪৭-৫২ সময়কালে, ওপরের দিকে সবাই ছিলেন পশ্চিমা, একজন ছাড়া। তিনি ছিলেন আসাম ক্যাডারের বাঙালি মেজর জেনারেল মজিদ। রাওয়ালপিন্ডি ষড়যন্ত্রের বিচারের সময় বিনা কারণে জেনারেল মজিদকে সংশ্লিষ্ট দেখিয়ে চাকুরিচ্যুত করা হয়। এসময় লে. কর্নেল ওসমানী বিশেষভাবে ক্ষুব্ধ হন। ব্রিগ্রেডিয়ার সিদ্দিকি যা উল্লেখ করেন নি তা’হলাে, জেনারেল মজিদ-কে চাকুরিচ্যুত করার মাধ্যমেই সেই ১৯৫০ সালে পূর্বপাকিস্তানের প্রতি পাকিস্তানীদের দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এ-সময় আইয়ুব খানের সঙ্গে ওসমানীর বাক-বিতণ্ডা (চরম অর্থে নয়) হয় যা আইয়ুব খান ভুলতে পারেন নি। এবং ওসমানীকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে আর কোনাে প্রমােশন দেয়া হয় নি। ওসমানী হয়ত এ-বিষয়টি আগেই অনুধাবন করেছিলেন। কারণ, এরপর যতদিন তিনি পাকিস্তান
সেনাবাহিনীতে ছিলেন ততদিন ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট গড়ায়ই মন দিয়েছিলেন। এ-পটভূমিকায় ১৯৫০ সালে, এ.আর, সিদ্দিকি ক্যাপ্টেন হিসেবে যােগ দেন সেনাবাহিনীর জনসংযােগ বিভাগে। কারণ, সেনাবাহিনী তখন সচেতনভাবে ইমেজ সৃষ্টির পরিকল্পনা নিয়েছে।
১৯৫০ থেকে ১৯৫৬ সালটি ছিল সেই ইমেজের বিকাশ। সিদ্দিকির দ্বিতীয় [অধ্যায়ের নাম তাই ‘দি গ্রোথ অফ দি ইমেজ’। ১৯৫৩ সালে, জামাতে ইসলাম লাহােরে দাঙ্গার সৃষ্টি করে। কাদিয়ানীদের ওপর ছিল তাদের আক্রমণ। লাহােরে সামরিক আইন জারি করা হয় এবং জেনারেল আজম খান হন লাহােরের প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। উচ্চাভিলাষী ছিলেন আজম খান এবং জনসংযােগেও ছিলেন দক্ষ। সামরিক আইন প্রশাসক হয়ে তিনি ক্ষমতার সম্পূর্ণ সদ্ব্যবহার করলেন। তিনি দেখালেন, এ-ধরনের দাঙ্গা ত্বরিৎ গতিতে একমাত্র সেনাবাহিনীই দমন করতে পারে। দাঙ্গা বাধাবার জন্য মওদুদীর মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলাে (কার্যকর হয় নি)। ধর্মীয় কোনাে নেতার মৃত্যুদণ্ড ঘােষণার সাহস সেনাবাহিনীর ইমেজ বৃদ্ধিতে সাহায্য করল এভাবে যে, তারা শান্তিরক্ষায় অকুতােভয়। সিদ্দিকির waty – “Officers were treated and projected as popular heroes and leaders.” জেনারেলের নামে লাহােরে প্রতিষ্ঠা করা হলাে— ‘আজম ক্লথ মার্কেট।’
এ-সময়টিতে কিছু কিছু বাঙালি সেনাবাহিনীতে নিয়ােগ পেতে লাগল। কিন্তু, জানিয়েছেন আরেক জেনারেল তােজাম্মল হােসেন মালিক যে, কাকুলে মিলিটারি একাডেমিতে বাঙালি ক্যাডেটদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করা হতাে। কিন্তু, তা

সত্বেও দেখি ১৯৫২ সালে অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর ছােটভাই আবদুল কাইয়ুমকে ঠেকানাে যায় নি। শ্রেষ্ঠ ক্যাডেট হিসেবে তিনি ‘সাের্ড অফ অনার’ লাভ করেন। তিনি পাকিস্তানী মহিলাকে বিয়ে করে পাকিস্তানেই থেকে যান কিন্তু কর্নেলের ওপর তাঁকে প্রমােশন দেয়া হয় নি। এর ব্যতিক্রম জেনারেল ওয়াসিউদ্দিন। কিন্তু, মনে রাখতে হবে তিনি ছিলেন ঢাকার খাজা পরিবারের সঙ্গে যুক্ত এবং ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত (এবং পরেও) তারা ছিলেন ক্ষমতার সঙ্গে কোনাে-না-কোনােভাবে যুক্ত এবং বাংলা যাদের মাতৃভাষা ছিল না।
এ-প্রসঙ্গে, বাঙালিদের প্রতি জেনারেলদের দৃষ্টিভঙ্গি কী ছিল তা তুলে ধরেছেন সিদ্দিকি আইয়ুব খানের উদাহরণ দিয়ে। তার ভাষায়- “Even as a local major-general in East Pakistan back in 1948, Ayub had conceived a profound contempt or commiseration for the Bengalis, from the chief minsister (Khawaja Nazim-un-Din) down to the common man in the street.” পিন্ডি ষড়যন্ত্র মামলা চলার সময় সােহরাওয়ার্দীর প্রশ্নবানে জর্জরিত হয়েছিলেন সামরিক অফিসাররা। আইয়ুব কখনও একথা ভােলেন নি। ১৯৪৮ সালে, পূর্ববঙ্গ পরিষদের সামনে যখন বিক্ষোভ চলছিল তখন আইয়ুব বগুড়ার মহাম্মদ আলীকে কঠোর ভাষায় বাড়ি চলে যেতে বলেছিলেন- “I tapped Muhammad Ali on the sholder and said, ‘Are you looling for a bullet?” বাঙালিদের আইয়ুব কতটা ঘৃণা করতেন তার উল্লেখ আছে আইয়ুবের আত্মজীবনীতে। সেখানে থেকে বড় হওয়া সত্ত্বেও উদ্ধৃত করছি কারণ এর ফলে আমাদের বুঝতে সহজ হবে বাঙালিদের কি ভাবে দেখেছেন জেনারেলরা এবং তাদের নীতিনির্ধারণ এ-দৃষ্টিভঙ্গি কিভাবে প্রভাবিত করেছিল। আইয়ুব লিখেছিলেন- “It would be no exaggeration to say that up to the creation of Pakistan, they (the Bengalis) had not known any real freedom. They have been in turn ruled eiher by the caste Hindus, Moghuls, Pathans or the British. In addition, they have been and still are under considerable Hindu cultural and linguistic influence. As such they have all the inhabitions of down-trodden races. ইতিহাস জ্ঞান না-থাকলে যা হয় আরকি। আইয়ুব খান বলতে ভুলে গেছেন, যে পশ্চিমপাকিস্তানীরাও একইভাবে বর্ণ হিন্দু, মুঘল ও ব্রিটিশদের অধীনে ছিল। বিশেষ করে পাঞ্জাবিদের সবাই ব্যঙ্গ করত বৃটিশদের ধামাধরা হিসেবে।
এ-সময়, পাকিস্তানের সামরিকবাহিনী আমেরিকার নজরে আসে, জানিয়েছেন সিদ্দিকি। তবে, তিনি যা বলে নি তা’হলাে, সামরিকবাহিনী আমেরিকার কজায় চলে যায়, এবং আমেরিকা নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে থাকে সামরিকবাহিনী ও পাকিস্তানকে। এ-বিষয়ে খানিকটা আলােচনা করতে চাই।
১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান যখন পাকিস্তানে সামরিক আইন জারি করেছিলেন
১৬০

তখন ঘােষণা করেছিলেন, তিনি এমন অবস্থার সৃষ্টি করতে চান যেখানে জনগণ পাবে একটি সৎ, গণতান্ত্রিক এবং কার্যক্ষম সরকার। নিউইয়র্ক টাইমস মন্তব্য করেছিল, আইয়ুবের আন্তরিকতায় সন্দেহ করার কোনাে কারণ নেই। তারিক আলি অভিযােগ করেছেন, এই সামরিক অভ্যুত্থানে আইয়ুবকে সহায়তা করেছিল সিআইএ। এমনকি আইয়ুবের ভাইও এ-বক্তব্য স্বীকার করেছেন। তারিক আলির বইতে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। পাকিস্তানের একজন প্রাক্তন মন্ত্রী তারিক আলিকে ঘটনাটা বলেছিলেন। সামরিক আইন জারির পর মন্ত্রীসভার প্রথম বৈঠকে নতুন প্রেসিডেন্ট বৈদেশিক নীতির কথা নাকি স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন এ-বলে যে, ব্যক্তিগতভাবে একটি দূতবাসের ব্যাপারেই তার আগ্রহ তা হলাে মার্কিন দূতাবাস। আইয়ুব খানের সঙ্গে মার্কিনীদের মধুর সম্পর্কের কথা কলিম সিদ্দিকিই উল্লেখ করছেন। লিখেছেন মার্কিনীরা তাকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে পেয়ে এতই খুশি হয়েছিল যে, একবছরের মধ্যে মার্কিন সাহায্যের পরিমাণ বৃদ্ধি পেল তিনগুণ। ১৯৫৮ সালে যে-সাহায্যের পরিমাণ ছিল ৬ কোটি ১ লক্ষ ডলার ১৯৫৯ সালে বৃদ্ধি পেয়ে তা দাঁড়াল ১৮ কোটি ৪ লক্ষ ডলার। এখানে উল্লেখ্য যে, মার্কিন অস্ত্র সাহায্য নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে (অক্টোবর ১৯৫৩) যে-আলােচনা হয়েছিল তাতে পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন আইয়ূব এবং এর আগে এ-বিষয়ে দু’দেশের মধ্যে তেমন কোনাে আলােচনাই হয় নি।
সামরিক খাতে প্রচুর মার্কিন সাহায্য সত্ত্বেও জাতীয় মােট উৎপাদনের তুলনায় প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় হ্রাস না পেয়ে বরং বৃদ্ধি পেয়েছিল। নিচের সারণি তার উদাহরণ।
ওয়েন এ উইলকক্স একটি প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের ফলে একদশক ধরে পাকিস্তানের সমরখাতে খরচ করতে হয়েছে খুব কম। উপরের সারণি সে-কথা বলে না। একই প্রবন্ধে আবার উইলকক্স স্বীকার করেছেন যে বৈদেশিক (অর্থাৎ মার্কিন হস্তক্ষেপ এশিয়ার আঞ্চলিক বিরােধগুলিকে প্রশমিত করতে পারে নি, বরং সেগুলির ব্যাপ্তি ও কুফল বাড়িয়ে তুলেছিল।
‘নিউইয়র্ক টাইমসের মতে, ১৯৫৪-১৯৬৫ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্র থেকে অস্ত্রখাতে সাহায্য পেয়েছে ১.৫ বিলিয়ন ডলার। ১৯৭২ সালে, মার্কিন প্রশাসন পাকিস্তানকে অস্ত্র সাহায্য-সংক্রান্ত যেসব তথ্য উন্মুক্ত করে দিয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে সাহায্যের পরিমাণ টাইমসে উল্লিখিত অঙ্কের অর্ধেক। দুটি উৎসের এ-গরমিল থেকে ধরে নেওয়া যেতে পারে, গােপনে যেসব অস্ত্র দেওয়া হয়েছে তার পরিমাণ সরকারি নথিপত্রে উল্লেখ করা হয় নি। এমস জর্ডনের দেওয়া হিসাব এ-সন্দেহ আরাে জোরদার করে [ড্রেপার কমিটির সদস্য থাকাকালীন এমস সরকারি হিসাব দেখেছেন তার মতে, ১৯৬০ পর্যন্ত পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্র থেকে সমরখাতে ৩৯০-৪৪০ মিলিয়ন ডলার সাহায্য পেয়েছে। পাকিস্তান বিমানবাহিনীর একটি হিসাব নিলে এ-বক্তব্য আরাে স্পষ্ট হবে।

১৯৬২-এর দিকে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর ৭টি B-57 এর এক স্কোয়াড্রন এবং ১২টি F-104 স্টার ফাইটার এবং চার স্কোয়াড্রন বিমান ছিল। একবছরের মধ্যে পাকিস্তানের যুদ্ধবিমানের সংখ্যা দাঁড়াল ২৫০ টিতে। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল। দুই স্কোয়াড্রন B-57B-লাইট বােম্বার, এক স্কোয়াড্রন F-104 স্টার ফাইটার এবং চার স্কোয়াড্রন F-86 F স্যাবর।
এ-পরিপ্রেক্ষিতে কংগ্রেসনাল সাবকমিটির সামনে প্রদত্ত মার্কিন সহকারী

প্রতিরক্ষা সচিব কর্নেল উলফ পি গ্রসের বক্তব্যের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। ১৯৭৩ সালের মার্চ মাসে কমিটির সামনে এক শুনানিতে তিনি বলেন, ১৯৫৪-১৯৬৫-এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে ৬৯ কোটি ৩ লক্ষ ডলারের সমরাস্ত্র এবং ৭০ কোটি ডলারের অন্যান্য সরঞ্জামাদি দিয়ে সাহায্য করেছে। গ্রস-প্রদত্ত হিসাব-অনুযায়ী এ-পরিমাণ প্রায় ১.৪ বিলিয়ন ডলার যা নিউইয়র্ক টাইমস’-উল্লিখিত অংকের কাছাকাছি।
১৯৫৩ সালে প্রকাশিত পাকিস্তানের ইকোনমিক এপ্রাইসাল কমিটির মত অনুসারে (১৯৫২ সালে রাজস্বের ৫৪ থেকে ৮৬ ভাগ সমরখাতে ব্যয় না করে বরং উন্নয়ন ও সমরখাতের মধ্যে সামঞ্জস্য সাধন করা উচিত। কিন্তু তাতে কেউ কর্ণপাত করে নি। মার্কিন অনুদান বৃদ্ধির ফলে সমরখাতের উদ্বৃত্ত ব্যয় করা হয়েছিল সেনাবাহিনী ও তাদের পরিবারের আরাম-আয়েস বা ভােগ-বিলাসের জন্য।
মার্কিন নীতিনির্ধারকরা ঠিকই জানতেন যে, তাদের সাহায্যের ফলে পাকিস্তানে বিলাসপ্রিয় এক সামরিক এলিটদের বিকাশ হচ্ছে। যাদের জীবনযাপনের মান সাধারণ লােক থেকে অনেক উঁচুতে। শুধু এ-কারণেই সেনাবাহিনীর নিচের দিকে বা সাধারণ মানুষের মনে বিক্ষোভ দেখা দেওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু আমলারা এক্ষেত্রে সুচতুরভাবে ভারত-ভীতির ব্যাপারটা আতঙ্কের পর্যায়ে নিয়ে গেলেন। প্রচারমাধ্যমগুলি ছিল তাদের নিয়ন্ত্রণে ফলে এ-আতঙ্ক ছড়াতে তারাও সাহায্য করেছিল। ১৯৭১ সালের পরও পাকিস্তানে গণঅসন্তোষ মাথাচাড়া দেবার পরিস্থিতি ছিল। কিন্তু সেই একই আমলারা জনমনে উপরােক্ত আতঙ্কজনিত বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে সমর্থ হয়েছিলেন নিজেদের বাঁচাতে।
পাকিস্তান এবং যুক্তরাষ্ট্রের আমলাদের যােগাযােগের ওপর তেমন কোনাে গবেষণা হয় নি। তবে, এ সম্পর্ক যে-ঘনিষ্ঠ ছিল তাতে কোনাে সন্দেহ নেই। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে স্বাধীনতাযুদ্ধ-চলাকালীন ঘটনাবলিই এর প্রমাণ। ঐ সময় পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহে মার্কিন সরকারের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও নিয়ত পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহ করা হয়েছিল। এবং এটা সম্ভব হয়েছিল দু’দেশের আমল বিশেষ করে সামরিক আমলাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে।
১৯৫৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তান সামরিক আঁতাত চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকেই এ-সম্পর্কের শুরু। লিখেছেন ফজল মুকিম খান, “শিঘ্রই পাকিস্তানের অফিসাররা মার্কিন মতামতকে গুরুত্ব দিতে শিখল। এ-ধরনের বােঝাপড়া হয়ে যাবার পর পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক অফিসারদের সম্পর্ক মধুর হতে সময় লাগল না। [ফলে) প্রয়ােজনীয় অস্ত্র সংগ্রহের কঠোর দায়িত্ব পালনের সময় যুক্তরাষ্ট্রের অফিসাররা পাকিস্তানী অফিসারদের সমর্থন জানিয়েছে।” “সুস্থ ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তােলার জন্য বন্দোবস্ত করা হয়েছিল শিক্ষা সফরের। আয়ােজন করা হয়েছিল অরিয়েন্টেশন ট্রেনিংয়ের।’ এর অর্থ হ্যারল্ড এ. হােভের মতে, মার্কিন সামরিক কেন্দ্রগুলি দেখানাে এবং বিভিন্ন ঘাঁটিতে অবস্থানরত মার্কিন অফিসারদের

সঙ্গে সামাজিক সম্পর্ক স্থাপন। এ-প্রশিক্ষণের তত্ত্ব ছিল যে, এর মাধ্যমে ঐ দেশের (পাকিস্তানের) উঠতি নেতারা মার্কিন সামরিক সংস্থা ও জনগণ সম্পর্কে জানতে পারবে। এবং মার্কিন নীতিরও তারা সমর্থক হয়ে উঠবে। তারিক আলির মতে এসব শিক্ষাসফর ছিল ঘুষ এবং এভাবে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের সামরিকবাহিনীর ওপর প্রভাব বিস্তার করছিল। আমরা লক্ষ করি এর ফলে সামরিক আমলারা এতই শক্তিশালী হয়ে উঠছিল যে পেন্টাগনের সঙ্গে আলাপ-আলােচনার সময় তারা সহযােগী বেসামরিক আমলাদের উপেক্ষা করত। এ-কারণেই বােধ হয় ১৯৭১ সালে সামরিক আমলারা নিশ্চিত ছিল যুক্তরাষ্ট্র তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসবেই। যদিও সে আশা সফল হয় নি কিন্তু শেষসময়ে মরিয়া হয়ে পৃথিবীর একটি মহাশক্তিশালী নৌযান পরমাণুচালিত বিমানবাহী এন্টারপ্রাইজ বঙ্গোপসাগর অভিমুখে। প্রেরণ প্রমাণ করে যে, দু’দেশের সামরিক আমলাদের বন্ধন কত ঘনিষ্ঠ ও দৃঢ় ছিল। মার্কিন ও পাকিস্তানী সেনা প্রশাসনের বিবরণটুকু নেয়া হয়েছে আমার ও জয়ন্তকুমার রায়ের লেখা প্রশাসনের অন্দরমহল : বাংলাদেশ থেকে সিদ্দিকি জানিয়েছেন, এই মৈত্রী ‘centre of gravity’ পশ্চিমপাকিস্তানের কাছে নিয়ে আসে। এবং জাতীয় পরিপ্রেক্ষিতে পূর্বাঞ্চল নিঃসঙ্গ বােধ করতে থাকে। এ-সময় তুলনামূলকভাবে সেনাবাহিনীতে বিশেষ করে নৌ ও বিমানবাহিনীতে বাঙালির সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও সম্পূর্ণ সেনা এস্টাবলিশমিন্টের তুলনায় তা ছিল ভগ্নাংশ মাত্র। আমেরিকার সাহায্যের প্রায় পুরােটা লাভ করে পশ্চিম ও সামরিকবাহিনী। এতে তা’হলে বাঙালির কী লাভ? কিছুই না। লিখেছেন Fiin – “The Bengalis paid the piper, while the West Pakistanis called the tune. The inflow of the American aid and all the progoganda in respect of its benefit touched the Bengalis where it hurt them most that is, inadequate representation in the armed forces as the largest repository of power and authority.” এ-ছাড়াও ১৯৫৮ পর্যন্ত, সেনাবাহিনী প্রতিবছর বিভিন্ন জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের আয়ােজন করে। সেনাবাহিনীর ইমেজ, ফুলে-ফেঁপে উঠতে থাকে। অন্যদিকে, জাতীয় ক্ষেত্রে রাজনীতিবিদরা জাতীয় বিভিন্ন ইস্যুতে ঐকমত্যে পৌছাতে ব্যর্থ হন। সৃষ্টি হয় বিশৃংখল অবস্থার। সেনাবাহিনী তখন প্রস্তুত জোর কদমে ক্ষমতা দখলের জন্য।
১৯৫৮ থেকে ১৯৬৪-এর সময়কালটুকু-কে ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিকি উল্লেখ করেছেন সেনাবাহিনীর ইমেজের পরিপূর্ণতা লাভের সময় হিসেবে। তৃতীয় অধ্যায়ের শিরােনাম দিয়েছেন তিনি দি রাইজ অব দি ইমেজ’।
আইয়ুবের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করে ১৯৫৮ সালে। ১৯৪৮

থেকে ১৯৫৮ পর্যন্ত যে-ইমেজের সৃষ্টি করেছিল সেনাবাহিনী তার ফল পাওয়ার যায় এ-সময়ে। সামরিক শাসনকে অধিকাংশ মানুষ স্বাগত জানায়। সিদ্দিকি যে-বিষয়টি উল্লেখ করেন নি, তা’হলাে, পাশ্চাত্য বিশেষ করে মার্কিন অ্যাকাডেমিশিয়ানরা একটি নতুন তত্ত্বের সৃষ্টি করেন এ-সময়। তা হলাে পাকিস্তানের মতাে অনুন্নত দেশে উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে হলে সামরিক শাসনের প্রয়ােজন। এই তত্ত্ব, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সামরিক শাসনকে মদদ যােগায়।
ক্ষমতা দখলের পর আইয়ুব জনসংযোেগ-কে ঢেলে সাজান। তার তখন মনে হয়েছিল, শক্তি দ্বারা সবকিছু জয় সম্ভব নয়, ক্ষমতাও সংহত করা যাবে না। এজন্য সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে এবং এক্ষেত্রে তা সম্ভব হবে “Only through persuasion and education.” সুতরাং সামরিকবাহিনী ও বেসরকারি জনসংযােগে যুক্ত হলাে এ দুটি উপাদান। সিদ্দিকি লিখেছেন- “With his deeply ingrained soldiers contempt for the ‘bloody civilion’, the scruffy intellectual and wretched penpusher, Ayub instantly realized and accepted their nuisance value.”
এ-পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্টি করা হয় রাইটার্স গিল্ডের। দুই অংশের লেখকরা কিছু পাবার আশায় গিল্ডে ভিড় জমাতে থাকেন। এই প্রথমবারের মতাে দুই অংশের লেখকদের একটি ফোরাম গঠিত হয়। কর্তব্যরত জেনারেলদের বিভিন্ন উচ্চপদে বসান হয়। ইয়াহিয়া খানকে রাজধানী গড়ার ভার দেওয়া হয় এবং এভাবে প্রথম তিনি পাদপ্রদীপের আলােয় এসে দাঁড়ান। আইয়ুব খানকে প্রপাগাণ্ডার মাধ্যমে জাতীয় বীর’-এ পরিণত করা হয়। সংবাদপত্র ও সরকারি মাধ্যমও এই বীরবন্দনায় রত হয়। আইয়ুব খান এ-সময় “ইনটেলেকচুয়াল রেজিমেন্টেশনের জন্য গঠন করেন ‘ব্যুরাে অফ ন্যাশনাল রিসার্চ অ্যান্ড রিক্সট্রাকশন যা আমাদের কাছে পরিচিত বিএনআর নামে। আইয়ুবের প্রচারণা প্রধান ব্রিগেডিয়ার এফ.আর. খানকে এর দায়িত্ব দেয়া হয়। সিদ্দিকি এ-সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানিয়েছেন। তাঁর sta1, “The Bureau was a most skilfully designed instrument of brain wahing through a combination of PR and intelligence. Police and security agencies were integrated into the Brureu to serve as a watchdog on the country’s intelligentsia.” সেনাবাহিনী শুধু প্রচারণার মাধ্যমে কিভাবে পাকিস্তানের রক্ষক হিসেবে। সেনাবাহিনীর ইমেজ গড়ে তুলেছিল তার একটি উদাহরণ দিয়েছেন সিদ্দিকি। জেনারেল আজম খান-কে পূর্বপাকিস্তানের গভর্নর নিযুক্ত করা হয়েছিল। তাকে অপসারণ করা হলে “Bengalis wept and cried and staged rallies against centres decision. The military had virtually become an object of worship in East Pakistan.”

বাঙালি যুবকরা এই ইমেজের মােহে সেনাবাহিনীতে যােগ দিতে থাকে। অন্যদিকে, মার্কিনীরা সর্বতােভাবে এই ইমেজ রক্ষায় সহায়তা দিতে থাকে যার ফল আগেই উল্লেখ করেছি। এ-পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৬০ সালের জানুয়ারিতে শুরু হয় “আর্মড ফোর্সেস ডে’ পালন। এ-দিনের মাধ্যমে জনসাধারণকে দেখান হতে থাকে। সেনাবাহিনী কত শক্তিশালী। অন্যান্য জাকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান তাে চলতেই থাকে।
৩০ ১৯৬৫ সালটি ছিল, সিদ্দিকীর মতে, এই ইমেজের পরীক্ষার সময়কাল- “দি টেস্ট অফ দি ইমেজ’। এ-সময় পাক-ভারত যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এর আগে দু’একটি সীমান্ত সংর্ঘষে পাকিস্তান ভালাে অবস্থায় থাকলে সেনাবাহিনীর জনসংযােগ তুঙ্গে ওঠে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শৌর্য-বীর্য সম্পর্কে নানা খবরাখবর পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে। এগুলির সরবরাহের দায়িত্ব নেয় জনসংযােগ বিভাগ। রেডিয়ােতে সেনাবাহিনীর বীরত্বগাথা নিয়ে গান প্রচারিত হতে থাকে। পশ্চিমে এই সময় একটি গান তাে ছিল সবার মুখেমুখে- “মেরা মাহি চাইল চাবে লি/ কানাইল নি জার্নাইল নি’ (আমার প্রেমিক হয় কর্নেল নয় একজন জেনারেল)। বা মেরা চান মাহি কাপ্তান’ (আমার প্রেমিক, মুখ তার চাদের মতাে, সে একজন ক্যাপ্টেন)। আমরা তখন স্কুলের ছাত্র। সিদ্দিকি যেই উন্মাদনার কথা বলেছেন তা এখনও মনে পড়ে। সেপ্টেম্বর ২৩, ১৯৬৫ থেকে মার্চ ২৩, ১৯৬৬ পর্যন্ত এই ইমেজের ছিল জয়জয়কার (দি ট্রায়াম্প অফ দি ইমেজ)।
এ-সময় লাহােরের দক্ষিণে কাসুর সেক্টরে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট লড়েছিল। গুল হাসান ছিলেন মিলিটারি অপারেশনের পরিচালক, ওসমানী উপ-পরিচালক। কিন্তু ওসমানীকে এ-সময় কোনাে কাজ দেয়া হয় নি।
ওসমানী এতে দমেন নি। তিনি ব্যস্ত ছিলেন কীভাবে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বীরত্বগাথা প্রচার করা যায় তা নিয়ে। সে-সময় তিনি অভিযােগ করেছিলেন, পাঞ্জাবি প্রেস ইচ্ছাকৃতভাবে বাঙালি সৈনিকদের বীরত্বগাথা ব্ল্যাক আউট করছে। সিদ্দিকির কাছে তিনি অভিযােগ করে বলেছিলেন, আলতাফ গওহর পাঞ্জাবিদের তুলে ধরছে আর বাঙালিদের কথা চেপে যাচ্ছে। ওসমানী একজনের জন্য “নিশান-ই-হায়দার’ দাবি করেছিলেন কিন্তু ব্যাটালিয়ন কমান্ডার তা অগ্রাহ্য করেন। তবে, এই রেজিমেন্ট-কে দুটি সিতারা-ই-জুরাত ও ছয়টি তমঘা-ই-জুরাত দেয়া হয়। এককভাবে কোনাে ব্যাটেলিয়ান এতগুলি মেডেল পায় নি। ওসমানী এককভাবে বেঙ্গল রেজিমেন্টের বীরত্বগাথা প্রচারের কাজ করে গেছেন। সিদ্দিকির মতে, এই প্রচার পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে পার্থক্যের সৃষ্টি করেছিল। কারণ, সামরিকবাহিনীর সবকিছু ছিল পশ্চিমপাকিস্তানের একচেটিয়া এবং “they hated sharing it with the Bengalis.”
এই সময় আইএসপি আর-এর ডিরেক্টর কর্নেল জেড এ সুলেরি প্রচারে নতুন

এক মাত্রা যুক্ত করেন। তিনি ধর্মকে ব্যবহার করেন। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী এত বীরত্বপূর্ণভাবে লড়েছিল কেন? কারণ, সে মুসলমান। সে ইসলামের জন্য যুদ্ধ করেছে। সেনাবাহিনী হলাে তার মতে, “the ultimate sanction behind the creation of Pakistan.” পশ্চিমপাকিস্তানে এই নথি পত্র-পত্রিকা জোরেশােরে প্রচার করতে লাগল। আমরা এর প্রকাশ দেখেছি। যখনই কোনাে আন্দোলন হয়েছে শাসক বা সামরিকচক্রের বিরুদ্ধে তখনই বলা হয়েছে, আন্দোলনকারীরা ইসলামের বিরুদ্ধে, তাদের মদদ যােগাচ্ছে হিন্দুরা (অর্থাৎ ভারত)। ইসলাম বিপন্ন। সুতরাং ইসলাম রক্ষায় এদের বিরুদ্ধে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সিদ্দিকির ষষ্ঠ অধ্যায়ের শিরােনাম ‘দি ম্যানিপুলেশন অফ দি ইমেজ।’ এর সময়কাল তিনি নির্দিষ্ট করেছেন সেপ্টেম্বর ১৯৬৬ থেকে মার্চ ২৫,১৯৬৯ পর্যন্ত। তার A60, “The 1965 war had exalted the military image to mythical heights.” কিন্তু প্রশ্ন জাগে কেন এই হোঁচট খেল। কারণ, আমরা দেখি, তাশখন্দ চুক্তির পরদিন থেকে এর বিরুদ্ধে ধিক্কার শুরু হলাে। এ-বিষয়টির প্রতি সিদ্দিকি তেমন আলােকপাত করেন নি। এ-থেকে আবার এই বিষয়টাও পরিস্কার হয় যে কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে এই জনসংযােগ ছিল রঙিন ফানুস মাত্র। পাকিস্তান যদি যুদ্ধে জিতেই থাকে তাহলে তাশখন্দ চুক্তি করতে পাকিস্তান বাধ্য হবে কেন? এর অন্য একটি দিক আছে, একদিকে যখন সামরিকবাহিনীর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলছিল অন্যদিকে রাজনীতিবিদরা এর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধও হচ্ছিলেন যার বিবরণ সিদ্দিকি দেন নি। ত
কালীন পূর্বপাকিস্তান গােড়া থেকেই সামরিক শাসন মেনে নেয় নি। তাশখন্দ চুক্তি রাজনীতিবিদদের সুযােগ এনে দেয়। আইয়ুব খান তাশখন্দের প্রতিক্রিয়ার বিপরীতে ‘এক দশক’ পালনের উদ্যোগে নেন ব্যাপকভাবে। এই প্রচারণা পূর্ব ও পশ্চিমপাকিস্তানকে আরাে আলাদা করে দেয়। কারণ- “The overplay in the Decades publicity of the prosperity theme created, in general an agonizing awareness of the gap between appearance and reality.” lefest 21, উন্নতি হয়েছে তা পশ্চিমপাকিস্তানের, পূর্বপাকিস্তানের নয়।
অন্যদিকে ওসমানী সচেষ্ট ছিলেন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মর্যাদা বৃদ্ধিতে। তিনি, এই রেজিমেন্টের এক পূনর্মিলনীর আয়ােজন করেন এবং সেখানে সিদ্দিকিকেও আমন্ত্রণ জানান হয় জনসংযােগ কর্মকর্তা হিসেবে। এই রেজিমেন্টের নাম, প্রতীকস, সব ছিল বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত এবং আলাদা। যদিও তা ছিল পাকিস্তানী afats sent tops “it prided itself in being the only post-indepedance army regiment which did not carry a foregin flag. Practically monolithic in class composition (unlike the mixed Pakistani regiments) it developed a sense of apartness from the rest of the army.” সিদ্দিকির মতে, এই বৈশিষ্ট্যের প্রতি গুরুত্ব আরােপ সেনাবাহিনীর মধ্যে সূক্ষ বিভেদের সৃষ্টি করেছিল। এর রেজিমেন্টাল সেন্টারকে বলা হতাে টাইগার সেন্টার, যে-রাস্তা গেছে।

সেন্টারের দিকে তার নাম ছিল টাইগার রােড, সেন্টারের কমান্ডেন্টকে বলা হতাে পাপা টাইগার আর রিক্রুটসদের টাইগার কাবস। জেনারেল নিয়াজি তার আত্মজীবনীতে উল্লেখ করছেন, টাইগার রােডের নামকরণ হয়েছিল তার নামে (টাইগার নিয়াজি)। তিনি যে, সত্য বলেন নি, সিদ্দিকির তথ্যই তার প্রমাণ।
আইয়ুবের ডিকেড পালনের মধ্যেদিয়েই রাজনৈতিক বিশৃংখলা দেখা দেয়। শুরু হয় গণআন্দোলন। ইয়াহিয়া খান ধৈর্য-সহকারে তাঁর ইমেজ সৃষ্টি শুরু করেন। জনসংযােগ বিভাগ আবার এর মধ্যেই ইমেজ ম্যানুপুলেট’ করতে সমর্থ হয়। এবং এ-কারণেই, রাজনৈতিক অস্থিরতা দমনে ইয়াহিয়া সামরিক শাসন ঘােষণা করলে মানুষ তা সাময়িকভাবে মেনে নেয়।
সিদ্দিকি উল্লেখ করেছেন, আইয়ুবের একদশক শুরু হয়েছিল সামরিক শাসনের মাধ্যমে, শেষও হলাে সামরিক শাসন জারি করে। এসময় জনসংযােগ ব্যবহৃত হয়েছে “as the main prop and instrument of governance” এর কাজে। এ-ইমেজ শাসকদের মধ্যে আত্মসন্তুষ্টির সৃষ্টি করেছিল এবং তারা তা বিশ্বাসও করত। আলতাফ গওহরের তােষামােদী জনসংযােগ সহায়তা করেছিল সামরিকবাহিনীকে “to build its action oriented image in a political vacuum.”
৩১ সপ্তম অধ্যায়ের শিরােনাম দিয়েছেন সিদ্দিকি ‘দি টুইলাইট অফ দি ইমেজ ইমেজের গােধূলিবেলা— যার সময়কাল ২৫ মার্চ ১৯৬৯ থেকে ২৫ মার্চ ১৯৭১। ইয়াহিয়া নিজেকে যে-ভাবে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন তা’হলাে, তিনি। সামরিকবাহিনীপ্রধান বটে কিন্তু কট্টর সামরিকপ্রধান নন। তিনি জনগণের কাছাকাছি। সিভিলিয়ানও বটে। এটি প্রমাণ করার জন্য তিনি কারণে-অকারণে সাংবাদিকদের সঙ্গে রসিকতা করতেন, সাংবাদিকদের নানা প্রশ্নের উত্তর দিতেন। ঢাকায় এ-সময় এক সাংবাদিক সম্মেলনে ‘দি পিপল’-এর সম্পাদক আবেদুর রহমান তাকে ‘আংকেল ইয়াহিয়া’ বললেও তিনি তা মেনে নেন। সিভিলিয়ান হওয়ার তার বাসনা জনসংযােগের ক্ষেত্রে এক জটিলতার সৃষ্টি করে। সিদ্দিকির ভাষায়, “messed up the popular image of the armed forces.”
১৯৭০ এর প্রলয়ংকরী ঝড় জনসংযোেগ তথা সামরিকবাহিনীর জন্য বিপর্যয় ডেকে আনে। ইয়াহিয়া খান পূর্বপাকিস্তান সফরে এসে তড়িঘড়ি করে ফিরে যান। বাঙালিরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। ২১ নভেম্বর চিফ অফ জেনারেল স্টাফ গুল হাসান ডেকে পাঠান জনসংযােগের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিকিকে। তিনি সিদ্দিকিকে জানান, পরিস্থিতি সংকটময়, ঢাকার সংবাদপত্রসমূহ খােলাখুলি সেনাবাহিনীর সমালােচনা করছে। এবং

সেনাবাহিনীর জনসংযােগ বিভাগের প্রেস রিলিজ পর্যন্ত ছাপছে না। সিদ্দিকিকে ঢাকায় যেতে হবে।
সিদ্দিকি ঢাকায় এসে দেখলেন কথা সত্য বটে। তবে, পরিস্থিতি আরাে খারাপ করে তুলছে বিদেশী সাংবাদিকরা। এ-প্রসঙ্গে সিদ্দিকী যা বলছেন তা মেনে নেয়া যায় না। কারণ, আমরা তাে তখন ঢাকায়-ই ছিলাম। তিনি লিখেছেন, অনেক বাঙালি সাংবাদিক বিদেশী সাংবাদিকদের হয়ে কাজ করছিল। বিদেশীরা বাঙালিদের অতিরঞ্জন বিশ্বাস করছিল। “The foreign press teams spent most of their time in their Dacca hotels, visting the affected areas only rarely,” পাকিস্তান সেনাবাহিনী যে মানুষের দুর্দশা মােচনে কাজ করে যাচ্ছিল তা যেন বিদেশী সাংবাদিকদের নজরেই পড়ছিল না— আক্ষেপ করেছেন সিদ্দিকি। সামরিক শাসনের পক্ষে সাংবাদিকরা ছিল না এবং তা লুকোবার চেষ্টাও তারা করে
নি।
যে সিদ্দিকি পূর্ববর্তী ছয়টি অধ্যায়ে সামরিকবাহিনীর একটি অ্যাকাডেমিক বিবরণ তুলে ধরছিলেন, তার দু’তিনটি অনুচ্ছেদ তার লুকোনাে পূর্ব ধারণা তুলে ধরে। অর্থাৎ, পাকিস্তানী জেনারেল যতই চেষ্টা করেন তার নিরপেক্ষ ইমেজ তুলে ধরতে তাতে তিনি ব্যর্থ হন। বাঙালিদের প্রতি পূর্ব ধারণা থেকে তারা মুক্ত হতে পারে না। মাত্রার হেরফের থাকতে পারে শুধু এই পূর্ব ধারণার ক্ষেত্রে।
ইয়াহিয়া ঢাকায় এসে প্রেস কনফারেন্স করেন। আওয়ামী লীগ সমর্থিত সাংবাদিকরা তাকে অস্বস্তিতে ফেলতে চেয়েছিল, পারে নি। সিদ্দিকির মতে, ইয়াহিয়া সেনাবাহিনীর ইমেজ আবার খানিকটা ফিরিয়ে আনেন এবং সাধারণ নির্বাচনের কথ ঘােষণা করেন। নির্বাচন হলাে এবং সিদ্দিকির ভাষায় তারা প্রমাণ করল সংখ্যাগরিষ্ঠতার ব্রুট ফোর্সের মাধ্যমে তারা সবসময় পাকিস্তানের ক্ষমতায় থাকবে।
পশ্চিমপাকিস্তানের শাসকচক্র, বিশেষ করে সেনাবাহিনী এতে আতংকিত হয়ে ওঠে। নির্বাচনের ফলাফল ছিল সেনাবাহিনীর প্রতি হুমকিস্বরূপ। সিদ্দিকি লিখেছেন, সেনাবাহিনী নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন পরিচালনা করেছে কিন্তু তাদের ‘উইজডম’ নিয়ে প্রশ্ন তােলা যায়। তিনি প্রশ্ন রেখেছেন— “How come that none amongst the generals could foresee the invitable outcome of the election clearly enough to forestall it in good time? The military image in West Pakistan thus received a temporary set-back.”
নির্বাচনের পর যেন, সেনাবাহিনী তার কাজ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলল। বাঙালিরা ক্ষমতায় এলে সেনাবাহিনীর কী হবে? এ-প্রশ্ন ছিল সেনাবাহিনীর সব জেনারেলের মনে। ইয়াহিয়া যদিও বারবার বলছিলেন তিনি ব্যারাকে ফিরে যেতে ইচ্ছুক, কিন্তু সে-জীবনে তিনি আর ফিরে যেতে ইচ্ছুক ছিলেন না।
সিদ্দিকির এই বিবরণে আমরা একটি ইঙ্গিত পেয়ে যাই পরবর্তী ঘটনাবলির।

সেনাবাহিনী ক্ষমতা হস্তান্তরে ইচ্ছুক ছিল না, ভুট্টোকে তারা ব্যবহার করেছিল। সৃষ্টি করেছিল অজুহাতের এবং এ-পরিপ্রেক্ষিতে মরিয়া হয়ে সৃষ্টি করেছিল ২৫ মার্চের। অর্থাৎ, নির্বাচনী ফলাফল প্রকাশের পরপরই সেনাবাহিনী প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিল।
এই অধ্যায়ের উপসংহারে সিদ্দিকি বর্ণনা দিয়েছেন সেনাবাহিনীর ইমেজের “The military found itself in the twilight region of political power after the elections. In the gathering dusk the military image looked like the sphinx-half beast and half woman a freak on the emerging national scene.”
১৯৭১ ছিল ইমেজের সূর্যাস্ত (দি সানসেট অব দি ইমেজ)। এ অধ্যায়টি আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, সে সময় সিদ্দিকী সামরিক বাহিনীর জনসংযােগের প্রধান ছিলেন। এবং তার ব্রিফ ছিল, বিশ্ববাসীকে বােঝানাে যে, বাংলাদেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক। সিদ্দিকি জানাচ্ছেন, নির্বাচনের পর সেনাবাহিনীর মধ্যে এই ভাব-ই জাগছিল যে তারা অপাংক্তেয়। জাতীয় সব কর্মকাণ্ড থেকে তারা বাদ পড়ে যাবে। ১৩ বছরের সামরিক শাসনে তারা পেয়েছিল অপার ক্ষমতার স্বাদ। সামরিকবাহিনীর স্থান যেখানে হওয়া উচিত, নির্বাচন তাদের সে-স্থান নির্ধারণ করে দিয়েছিল। তাছাড়া অন্য একটি বিষয়ও ছিল। বাঙালিরা এখন ক্ষমতায় আসবে, আরাে বাঙালি সেনাবাহিনীতে আসবে, ভারতের সঙ্গে শান্তি স্থাপিত হবে এবং “the consequent diminution of the West Pakistan military power and of it image.” এ-বক্তব্য থেকেই আমরা জেনারেলদের মানসিক জগতের ধারণা পাই। আসলে, কখনােই তারা ক্ষমতা হস্তান্তরে প্রস্তুত ছিল না। তাদের ধারণা ছিল, নির্বাচনে কেউ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না। গােয়েন্দা রিপোের্টও তাই বলছিল। সুতরাং, সেনাবাহিনীই শাসন চালাবে। নির্বাচনের ফলাফল তাদের ছক উল্টে দেয়। পূর্বপাকিস্তানে এ-সময় একটি ঘটনা ঘটে। জানিয়েছেন সিদ্দিকি। সেনাবাহিনীর ইমেজ তখন বাঙালিদের কাছে আলাদা কিছু নয়। তারা আর পশ্চিমপাকিস্তানীরা এক যারা দমিয়ে রাখতে চায় বাঙালিকে। এ-পরিস্থিতিতে ৯ মার্চ সেনাবাহিনীর চাপে প্রাদেশিক সরকার একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। তাতে বলা হয় এ-পর্যন্ত ১৭২ জন নিহত হয়েছে, এর মধ্যে ২৩ জন নিহত হয়েছে। সেনাবাহিনীর দ্বারা। সেনাবাহিনী বােঝাতে চেয়েছিল, বাঙালিদের ওপর শুধু তারা নয়, পুলিশও গুলি চালাচ্ছে এবং সিংহভাগ মানুষ মারা গেছে বাঙালির গুলিতে।

এতদিন বাঙালি আধাসামরিকবাহিনী বা পুলিশ, পশ্চিমপাকিস্তানী ওপরঅলার হুকুম শুনছিল। কিন্তু, এবার তারা শংকিত হয়ে পড়ে এবং ক্রুদ্ধও। সেনাবাহিনী থেকে শুরু করে পুলিশ পর্যন্ত সবখানে এখন বাঙালি-অবাঙালি বিভেদের সৃষ্টি হয়। এর দশদিন পর জয়দেবপুরে ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আবরারের হুকুম মানতে বাঙালি সৈন্যরা অস্বীকার করে। জেনারেলরা যে কী রকম জেনােফোবিয়ায় ভুগছিলেন তার একটি উদাহরণ এখানে দেয়া যেতে পারে। সিদ্দিকি লিখছিলেন, দি পিপল-এ প্রতিদিন সামরিক শাসনবিরােধী প্রবন্ধ প্রকাশিত হতাে। জ্বালাময়ী এরকম একটি প্রবন্ধের নাম ছিল ‘Whos who in the Aviary’ লেখক একজন শওকত ওসমান। তিনি জানাচ্ছেন, আসলে এটি ছিল কর্নেল ওসমানীর লেখা। সামরিকবাহিনীর জনসংযােগের প্রধানের ধারণা ছিল এরকম।
পত্র-পত্রিকায় তখন নিয়মিত সামরিকবাহিনীর বিরুদ্ধে লেখা হচ্ছিল, বিশেষ করে দি পিপল-এ। (বাংলা তারা পড়তে জানত না দেখেই পিপল-এর কথা ঘুরেফিরে এসেছে)। সিদ্দিকি জানাচ্ছেন, সেনাবাহিনী ক্রমেই ক্রুদ্ধ হয়ে উঠছিল এবং “the mere word Bengali stank in their nostrils.” বাঙালিরা তাদের কাছে ছিল বিদেশী আর বাঙালিদের কাছে পশ্চিমপাকিস্তানীরা বিদেশী। যে-কারণে ২৫ মার্চ প্রথমেই দি পিপল-এর অফিস জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিল।
২০ মার্চ, ঢাকা শহরে কোনাে পাকিস্তানী ফ্ল্যাগ না দেখে ইয়াহিয়া খান ক্রুদ্ধ। হয়ে ওঠেন এবং তখনই প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দেন। তারপর এল ২৫ মার্চ। ২৬ মার্চ বিদেশী সাংবাদিকদের ফেরৎ পাঠানাে হলাে। সিদ্দিকি লিখেছেন, ও-কারণেই তারা পাকিস্তানবিদ্বেষী হয়ে ওঠে। কিন্তু, পরক্ষণেই জানাচ্ছেন, ভাগ্যিস ২৬ মার্চ তাদের ঢাকা ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছিল। না হলে ২৬ মার্চ সকালে ঢাকার রাস্তায় বেরুতে পারলে আরাে খারাপ হতাে কারণ, “it was a picture of death and desolation.
এ-সময় জনসংযােগের ক্ষেত্রে প্রবেশ করেন তথ্যসচিব রােয়েদাদ খান। তিনি তখন অত্যন্ত ক্ষমতবান ব্যক্তি, জানাচ্ছেন সিদ্দিকি, তার কাছে “every problem was ultimately a PR problem.” তিনি বাঙালিদের মধ্যে আল্লাহর ভয়’ ঢােকাতে চাচ্ছিলেন। প্রয়ােজনে, বাঙালিকে জাতি শুদ্ধ করার ব্যবস্থাও। শেখ মুজিবকে বন্দি করে পাকিস্তান নিয়ে গেলে, রােয়েদাদ বলেছিলেন, “Let the world know that the bastard is in our hands. Fifa utca 14 দিয়েছিলেন। পশ্চিমপাকিস্তান থেকে এ-সময় সাংবাদিকদের নিয়ে আসা হয় পূর্বপাকিস্তানে। তারা তাদের ডেসপ্যাচে পাকিস্তানী সৈনিকদের বীরত্ব তুলে ধরতে থাকেন। কিন্তু সমস্যা হলাে, সিদ্দিকি লিখছেন, সবই যদি স্বাভাবিক থাকে তাহলে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা যুদ্ধ করছিল কেন? এই কন্ট্রাডিকশন নিয়ে
১৭১

পশ্চিমপাকিস্তানীরা মাথা ঘামায় নি। তারা খুশি ছিল যে, পাকিস্তানী সৈন্যরা পূর্বপাকিস্তানে বেশ ভালাে কাজ করছে। এ ভাবে, সিদ্দিকি লিখেছেন, সেনাবাহিনীর এতদিনকার গড়ে ওঠা ইমেজে ফাটল ধরল। “It was ‘foregin’ in the East and ‘national’ in the west, a devoted and a self sacrificing fighting force for one wing and an engine of oppression for the other.” পেশাগতভাবে, একজন সৈনিকের মনে সন্দেহ জাগছিল, তারা কী ভাবে কাউন্টার ইনমারজেন্সির বিরুদ্ধে লড়বে যার জন্য তাদের প্রশিক্ষণ নেই। তাই একমাত্র প্রপাগান্ডায়-ই তারা স্বস্তি খুঁজে পাচ্ছিল।
ইয়াহিয়া তখন আদেশ দিয়েছিলেন পূর্ণোদ্যমে পাকিস্তানের পক্ষে প্রচার চালানাের। শ্বেতপত্র প্রকাশের তােড়জোড় শুরু হলাে। নির্মিত হলাে ডকুমেন্টারি “দি গ্রেট ব্রিটেয়াল’, এ-ব্যাপারে সবধরনের সহায়তা করলেন বাঙালি অধ্যাপক জি, ডব্লিউ, চৌধুরী। ইয়াহিয়া ও জেনারেলরা ছবিটা দেখলেন। ছবি শেষ হলে, ইয়াহিয়া প্রশ্ন করলেন, “I hope all the devastation shown in the film is not result. of army action.” ছবিটি আর রিলিজ করা হয় নি। সিদ্দিকি ১৩ ডিসম্বের পর্যন্ত সেনাবাহিনী ও পাকিস্তান সরকারের প্রচারণার পুংখানুপুংখ বিবরণ দিয়েছেন। দেখা যাচ্ছে, পরিস্থিতির যতই অবনতি হচ্ছে, ততই প্রচারণা চলছে— সব স্বাভাবিক। কিন্তু, পৃথিবীময় ছড়িয়ে পড়ছিল পরিস্থিতি স্বাভাবিক নয়। এখানে একটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে যায়, জেনারেলরা সবাই জানতেন বাংলাদেশে কী ঘটেছে। ঘটনা আর তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল না। প্রপাগান্ডার আড়ালে তারা স্বস্তি খুঁজছিলেন। ১৩ ডিসেম্বর পাকিস্তানবাহিনীর পরাজয়ের পর এতদিনের গড়ে ওঠা ইমেজ ভেঙে খানখান হয়ে যায়। এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ্য, সিদ্দিকি তার কুশীলব যাদের কথা উল্লেখ করেছেন। তাদের প্রায় সবাইকে জিজ্ঞেস করেছি, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে কী ঘটেছিল? তারা কি তা জানতেন? সবাই একবাক্যে বলছেন, না তারা জানতেন না। এমনকি রােয়েদাদ খানও একই কথা বলেছেন।
সম্প্রতি করাচিতে ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিকির সঙ্গে আমার ও প্রকাশক মহিউদ্দিন আহমদের আলাপ হয়। আমাদের বিষয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কথােপকথন এখন উদ্ধৃতি করছি।
আমরা তার থেকে এমনি কিছু বিষয় জানতে চাচ্ছিলাম যা বইতে নেই। প্রথম পনেরাে মিনিট নানাবিধ আলাপ-আলােচনার পর হঠাৎ মহিউদ্দিন ভাই জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা, ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিকি, আমরা এখানে অনেকের সাথে আলাপ করে জেনেছি, পাকিস্তানীরা একসময় পূর্বপাকিস্তানকে লায়াবিলিটি ভেবে এসেছে?’
‘এ-বিষয় কোনাে সন্দেহ নেই, ‘ দৃঢ়ভাবেই বললেন সিদ্দিকি, বিন্দুমাত্র দ্বিধা

করে, “একেবারে গােড়া থেকেই এ-ভাবনা ছিল, আমি একটা উদাহরণ দিই। ১৯৪৭-এ পাকিস্তান স্বাধীন হলাে। পাকিস্তানের ৫৬ ভাগ মানুষ বাস করে। পূর্বপাকিস্তানে। পাকিস্তানের স্রষ্টা গবর্নর জেনারেল মােহাম্মদ আলি জিন্নাহ দিল্লি থেকে ঢাকা না দিয়ে করাচি গেলেন কেন?”
সত্যিই তাে ব্যাপারটা এভাবে চিন্তা করি নি। জিন্নাহ ঢাকা এলেন একবছর পর এবং এসেই বাঙালিদের সংস্কৃতিতে আঘাত হানলেন। তা হলে, জিজ্ঞেস করি আমি, “আপনি কি বিশ্বাস করবেন হিন্দুরা প্রভাবান্বিত করেছে বাঙালিদের? বাঙালিদের তারাই উস্কেছে স্বাধীনতার জন্য? আপনাদের এখানে অনেকে তা বিশ্বাস করে।”
“এগুলাে একেবারে বাজে কথা,” বললেন সিদ্দিকি “আমি শুনেছি এবং অনেকে লিখেছেনও যে হিন্দু শিক্ষকরা বাঙালি তরুণদের প্রভাবান্বিত করেছেএগুলাের কোনাে মানে হয় না। আমার তাে মনে হয়, বাংলাদেশ কখনও সেভাবে সেপারেশন চায় নি।”
“আপনি সিদ্দিক সালেকের বইটি পড়েছেন?”
সিদ্দিক সালেকের উইটনেস টু সারেন্ডার মুক্তিযুদ্ধের ওপর কোনাে পাকিস্তানীর লেখা প্রথম বই (যিনি ঢাকায় ছিলেন)। ব্রিগেডিয়ার জানালেন বইটি পড়েছেন। কিন্তু সালেক সম্পর্কে দেখলাম তার মনােভাব বিরূপ। তিনি জানালেন, সালেক তার অধীনে কাজ করেছেন। ঐ বইতে এমন অনেক তথ্য আছে যা সঠিক নয়। তিনি জিএইচকিউকে খুশি করার জন্য বইটি লিখেছিলেন। পুরস্কৃতও হয়েছিলেন। তার প্রমাণ চটজলদি সব প্রমােশন। পরে জেনারেল জিয়াউল হকের সঙ্গে প্লেন দুর্ঘটনায় নিহত হন। সিদ্দিক সালেকের বই সম্পর্কে পাকিস্তানে এমন মন্তব্য অনেকেই করেছেন।
“আপনি তাে নীতিনির্ধারকদের ঘনিষ্ঠ ছিলেন।” জিজ্ঞেস করি।
“হ্যাঁ, আমি জড়িত ছিলাম জিএইচকিউর সঙ্গে। ইন্টার সার্ভিস পাবলিক রিলেশন-এর ডিরেক্টর পদে আমাকে নিযুক্ত করা হয়েছিল। অর্থাৎ সামরিক শাসনের ঐ সময়টায় সামরিকবাহিনী-সংক্রান্ত যাবতীয় প্রচারের কাজ আমাকে করতে হয়েছে। সে-কারণে নীতিনির্ধারকের সঙ্গে যােগাযােগ ছিল।”
মার্চ মাসে ঢাকায় ছিলেন আপনি?” জিজ্ঞেস করেন মহিউদ্দিন ভাই। “হ্যা ছিলাম”, বললেন ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিকি। “ঢাকায় গিয়েছিলাম ১৬ মার্চ ফিরেছি ১ এপ্রিল। ২৫ মার্চ ঢাকায় ছিলাম।”
“কী হয়েছিল ২৫ মার্চ?” জিজ্ঞেস করি আমি।।
“২৫ মার্চ রাতে দেখলাম, দি পিপল’ আফিস জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। এরপর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত আমাকে অবশ্য পাবলিক রিলেশন নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। রাস্তাঘাটে ২৬ মার্চ লাশ পড়েছিল। কারফিউ তুলে নেবার পর লােকজন পালাচ্ছিল শহর থেকে।”

বােঝা গেল— এর বেশি তিনি কিছু বলতে চাইছেন না।
“জেনারেল উমর ও আরও অনেকে বলছিলেন,” বললাম আমি, “যে তারা ২৫ মার্চ ঢাকায় থাকা সত্ত্বেও তেমন কিছু দেখেন নি বা তেমন কিছু জানতেন না।” “এটা কি বিশ্বাসযােগ্য”, বললেন সিদ্দিকি, “জেনারেল উমর ওয়াজ পার্ট অফ ইট। তিনি সবকিছুই জানতেন। আমাকে ২৫ মার্চের ঘটনার পর বলেছিলেন, “আরে মন খারাপ করে আছ কেন? চিয়ার আপ। জেনারেল জ্যাকবও বলেছেন, ‘উমর ওয়াজ ইয়াহিয়াস ব্রাদার।”
ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিকির সচিব এ-সময় চা নিয়ে এলেন। চা খেতে খেতে আমরা, সাধারণভাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিয়ে আলাপ করতে লাগলাম। সিদ্দিকি পাকিস্তান সেনাবাহিনী সম্পর্কে যে-সব মন্তব্য করেছিলেন, চাকরিতে থাকাকালীন সেসব করার সাহস নিশ্চয় তার ছিল না। তাঁর মতে, পাকিস্তান সামরিকবাহিনী সবসময় শৌর্যবীর্যের একটি মিথ গড়ে তুলতে চেয়েছিল। তারাই ইতিহাসের স্রষ্টা একথাটাই তুলে ধরতে চেয়েছিল। বলাই বাহুল্য, তাতে সে সফল হয় নি। জনসংযােগের প্রধান হিসাব ১৯৭১ সালে তাঁকে জেনারেলদের অ্যাবসার্ড সব পরিকল্পনার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। তিনি বলছিলেন, একটা সময় বাস্তবতার সঙ্গে তারা যােগসূত্র হারিয়ে ফেলেছিল। ১৯৭১-এর পাকিস্তানী রণকৌশলেরও কোনাে বাস্তব ভিত্তি ছিল না। তার মতে affordable defence is good defence.” এ পরিপ্রেক্ষিতে মহিউদ্দিন ভাই প্রশ্ন রাখলেন, “১৯৭১ সালে এতবড় একটা ঘটনা ঘটল, আর এখানকার মানুষ কিছু আনল না, এটা কেমন কথা?” “দেখুন”, বললেন সিদ্দিকি, “ঘটনাটা ছিল এরকম। টিক্কা খান ভেবেছিল ২৫ মার্চের অ্যাকশনে ১০ এপ্রিলের মধ্যে সব ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। এ-ধারণা তার কেন, পশ্চিমপাকিস্তানের অনেক রাজনীতিবিদ ও জেনারেলও তাই মনে করতেন। তারা মানুষের ক্রোধের গভীরতা বােঝে নি। ভুলটা ছিল সেখানে। অন্যদিকে মিলিটারি অ্যাকশনের বিরুদ্ধে এখানে কোনাে অর্গানাইজড প্রটেষ্ট হয় নি। হলে, ঘটনা এতদূর গড়াত না।”
“আপনি জেনারেল নিয়াজির বইটি পড়েছেন?” জিজ্ঞেস করি আমি, “নিয়াজি বা তার বই সম্পর্কে আপনার মতামত কী?” “আমি সে-সময় ঢাকায় প্রায়ই যেতাম। আমার কাজই ছিল তা। বিদেশী রিপাের্টাদের সামলানাে জিএইচকিউ যেভাবে চাচ্ছে সেভাবে পৃথিবীকে বােঝানাে ইত্যাদি। নিয়াজির সঙ্গে তখন আমার দেখা হতাে। তাকে আমি সর্বশেষে দেখি পহেলা অক্টোবর। নিয়াজি ভাবত সবকিছু তার নিয়ন্ত্রণে। নিয়াজি ‘like a fool he was thought he was in control যেটি ছিল হাস্যকর।
২১-২২ নবেম্বর ভারত আক্রমণ করে। আমরা যে-সব সিচুয়েশন রিপাের্ট পাচ্ছিলাম সবই ছিল হাস্যকর।” একটু থামলেন তিনি। আমি লক্ষ করলাম, অন্য আরও অনেকের মতাে তিনি বিষয়টিকে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হিসাবেই মূলত

দেখছেন। ১১ ডিসেম্বর,” আবার শুরু করলেন তিনি, “জেনারেল গুল হাসান আমাকে ডেকে পাঠালেন, বললেন, ইস্ট পাকিস্তান ইজ লস্ট। আমি স্টান্ড হয়ে। গেলাম যদিও জানতাম তা সময়ের ব্যাপার মাত্র।”
“রণবিদ হিসাবে নিয়াজি কেমন?” আফসান জিজ্ঞেস করে। “নিয়াজি একজন মেজর হিসাবে ভালাে, জেনারেল হিসাবে ওয়ার্থলেস,” তার চাঁছাছােলা উত্তর, “দেখুন, জেনারেল নিয়াজি ও জ্যাকবের বই দুটি আমি পড়েছি। দুজনের বলার ধরনটা একই রকম। দু’জনেই যা করেছেন একাই করেছেন, সুপারম্যানের মতাে। তাদের সুপিরিয়ররা কিছুই না। একজন জেনারেল কি এ-ধরনের উক্তি করতে পারেন?”
“রাও ফরমান আলির বইটি আপনি পড়েছেন কি না জানি না”। বললাম আমি, “তার বই পড়ে মনে হয় তিনি কিছুই জানতেন না অথচ গণহত্যার পুরাে সময়টা তিনি সেখানে ছিলেন। এ-সম্পর্কে আপনার কী ধারণা?”
“তিনি ছিলেন পূর্বপাকিস্তানের বেসামরিক প্রশাসনের চার্জে মেজর জেনারেল। সেখানে তিনি জানবেন না কিন্তু কোন ঘটনা ঘটবে এটা সম্ভব ছিল না। ফরমান ইজ দ্য ম্যান যে হয়ত বুদ্ধিজীবী হত্যার ব্যাপার জানে। I never trusted him. He always weared a mask ruthless.”
“আর ভুট্টো?”
তিনি চাচ্ছিলেন শুধু ক্ষমতা আর ক্ষমতা। আর কোনাে বােধ ছিল না তার। আর্মির সমর্থন ছিল তাঁর প্রতি। আর্মি ছিল পশ্চিমপাকিস্তানের পক্ষে আর ভুট্টো। ছিলেন তাদের মুখপত্র। ফ্যান্টাস্টিক সব কাহিনী বলতেন তিনি ট্যাংক নিয়ে। তিনি লড়বেন ইত্যাদি। হি ওয়াজ এ ডিজাস্টার পার এক্সেলেন্স।”
অন্য জেনারেলদের থেকে ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিকির বইটি অনেক বেশি। অবজেকটিভ। তিনি তুলে ধরেছেন, কী ভাবে ফাঁকা বুলির উপর ভিত্তি করে সেনাবাহিনীর ইমেজ গড়ে উঠেছিল যার সঙ্গে বাস্তবের কোনাে মিল ছিল না। এবং কী ভাবে সে-প্রচারণা আবার দু’প্রদেশের মধ্যে বিচ্ছিন্নতার সৃষ্টি করছিল। বাস্তবতার সঙ্গে জেনারেলদের কোনাে ধারণা না-থাকায় মিথ্যার ওপর গড়ে ওঠা এ ইমেজ ১৯৭১ সালে ভেঙে খানখান হয়ে গিয়েছিল। এ-ইমেজ তারা ব্যবহার করতে চেয়েছিল শুধু ক্ষমতা দখলের জন্য। এখনও পাকিস্তানে তারা আবার সে ইমেজ গড়ে তুলতে চাচ্ছে। কিন্তু পারছে না। বাংলাদেশের পরাজয়ের শােধ তুলতে তারা জড়িয়ে পড়েছিল আফগানিস্তানে। সেখানেও তারা মার খেয়েছে। যে-কারণে, নওয়াজ শরিফের পক্ষে সম্ভব হয়েছে সামরিকবাহিনীর প্রধানকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা যা পাকিস্তানের ইতিহাস বিচার করলে অভূতপূর্ব ঘটনা। বলা যেতে পারে, বাংলাদেশের অভ্যুদয় পাকিস্তানীদের সাহায্য করছে। গণতন্ত্রের পথে যেতে।

অবজেকটিভ হওয়া সত্ত্বেও লক্ষণীয় যে, বাংলাদেশের যুদ্ধ অন্তিমে তার কাছেও ছিল পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ। বাঙালিরা যে ন্যায্য বিচারের জন্য যুদ্ধ করছে। তা তার বইতে একেবারেই অনুপস্থিত। শুধু তাই নয়, তার এক লেখায় (পরিশিষ্ট ৫) উল্লেখ করেছেন, ১৯৭১ সালে সংকটের জন্য উভয় অংশই দায়ী। এবং মুজিব-ভুট্টো দু’জনই এর জন্য দায়ী। তার ভাষায়, “while West Pakistan’s share of blame is admittedly much larger than East Pakistan, the latter cannot be altogether absolved. As for the Army, it was inexorably sucked into the political quagmire. Mainly of the making of Mujib and Bhutto.”
৩৪
উপযুক্ত বিবরণ আশা করি, প্রথমে উল্লিখিত তাত্ত্বিক ফ্রেমটি স্পষ্ট করে তুলেছে। জেনারেলদের বিবরণের মধ্যে গােটা তিনেক বইকে খানিকটা ভিন্নধর্মী বলা যেতে পারে।
আসগর খানের বইটি, প্রথম থেকেই ধরে নেয়া যায় যে ব্যতিক্রমি হবে। গত তিন দশক ধরে তিনি রাজনীতি করছেন, তার মতামত সবার জানা। মুক্তিযুদ্ধের সময় সামরিকবাহিনীর কর্মকাণ্ডে সমালােচনা করেছেন তিনি প্রকাশ্যে। কিন্তু, তা সত্ত্বেও পাকিস্তান ও বাংলাদেশ উভয় পক্ষের মধ্যে বাড়াবাড়ি খুঁজে পেয়েছেন। এর অন্য অর্থ করা যেতে পারে যে, একপক্ষ দোষী নয়।
ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিকির বইটির বিষয়-ই ভিন্নধর্মী কিন্তু, অন্তিমে তিনিও আসগর খানের মতাে একই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। ১৯৭১-এর জন্য ভুট্টো-মুজিব উভয়কেই তিনি দায়ী করেছেন।
তােজাম্মেল হােসেন মালিকের বইটি শুধু সর্বক্ষেত্রে ব্যতিক্রমি মনে হয়েছে। মালিক গোঁড়া মুসলমান, শরিয়ত মেনে চলেন। কিন্তু, আশ্চর্য যে, আগাগােড়া বইটিতে তিনি সামরিকবাহিনীর সমালােচনা করেছেন। পাকিস্তান যে-কারণে ভাঙল তা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন এবং তাতে সফলও হয়েছেন (একজন সৈনিকের পক্ষে যতটা সম্ভব)। তাঁর বইটি গুরুত্বপূর্ণ এ-কারণে যে, জেনারেলদের মধ্যে তিনিই একমাত্র ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সম্মুখ লড়াইয়ে অংশ নিয়েছিলেন।
বাঙালিদের হাতে ধরা পড়ার পর মুক্তিবাহিনী তাকে বালুচি দেখে হত্যা করে নি। মুক্তিযুদ্ধের সময় মনে আছে, অবরুদ্ধ বাংলাদেশে, বাঙালিরা বালুচিদের অন্য চোখে দেখতেন। ভাবতেন, তারা অপেক্ষাকৃত দয়ালু। ঘৃণাটা পাকিস্তান তাে বটেই, আরাে নির্দিষ্টভাবে পাঞ্জাবিদের প্রতি ছিল। বালুচিদের দেখা হতাে বাঙালিদের মতাে যারা দলিত। হয়ত, বালুচিরাও সেভাবে দেখতেন। কিন্তু, প্রশ্ন ওঠে, জেনারেল গুল হাসানের জন্মও তাে কোয়েটায় কিন্তু, তার অবস্থান একেবারে বিপরীতে। আবার ১৯৭১ সম্পর্কিত জেনারেল মুসার বিবরণ মালিকের কাছাকাছি।
জেনারেল মুসাও ছিলেন বালুচি। রাজনীতিবিদদের সমালােচনা তিনি পাঞ্জাবিদের মতাে করেন নি। এ-পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করলে আবার বলতে হবে, গুল হাসান বালুচিদের মধ্যে ব্যতিক্রমি। বা বালুচিস্তানে জন্ম হলেও আগাগােড়া তার কেটেছে পাঞ্জাবে। আসলে যে-প্রশ্নটি করতে চাই, তা’হলাে, সব রচয়িতাকে কি অন্তিমে জাতীয়তা প্রভাবিত করে? ইতিহাসও?
এ-ক্ষেত্রে দু’টি উদাহরণ দিয়ে শেষ করব। আইয়ুব খানের সময় পাকিস্তানের সেনাপ্রধান হন জেনারেল মােহাম্মদ মুসা। সাধারণ সৈনিক থেকে তিনি জেনারেল ও সেনাপ্রধান হয়েছিলেন। পূর্বপাকিস্তানেও জিওসি হিসেবে কাজ করেছেন।
তারপর জেনারেল ইয়াহিয়া সেনাপ্রধান হন। মুসা, ইয়াহিয়াকে রেকমেন্ড করেননি। আইয়ুব বেছেছিলেন। ইন্টারেস্টিং হলাে, ইয়াহিয়াই আইয়ুবকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। অন্যদিকে, ভুট্টো জেনারেল জিয়াকে সেনাপ্রধান করেছিলেন। জিয়াই তাকে ফাঁসি দিয়েছিলেন। ১৯৬৬ সালে মুসা অবসর গ্রহণ করেন। তার সঙ্গে পরবর্তীকালে ঘটনাবলির কোনাে সম্পর্ক ছিল না। তাঁর আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন, আওয়ামী লীগকে সরকার গঠন করতে দেয়া উচিত ছিল। তাছাড়া, সরকার তাে আওয়ামী লীগের ছয় দফার ব্যাপারে কোনাে আপত্তি করে নি এবং তারা সেই প্রােগ্রামের ভিত্তিতেই জয় লাভ করেছে। সুতরাং, তাদের অধিকার ছিল ক্ষমতায় যাওয়ার। তাঁর মতে, শাসকচক্র আসলে এ-ধরনের নির্বাচনী ফলাফল আশা করে নি। সুতরাং, যা করার তা না-করে “In their disturbed and confused state of mind, the resorted to political manipulations.” মুসা একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। ইয়াহিয়াকে যখন আইয়ুব ঠিক করেছিলেন তখন মুসা জানিয়েছিলেন ইয়াহিয়া, ভুট্টোর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ, এ-পরিপ্রেক্ষিতে তাকে সেনাপ্রধান না-করাই উচিত। এটি ১৯৬৬ সালের কথা। মুসা আরাে জানিয়েছেন, ভুট্টো যখন শুনলেন ইয়াহিয়া সেনাপ্রধান হচ্ছেন। তখন তিনি অত্যন্ত খুশি হয়েছিলেন। এ-থেকে অনুমান করা যায়, ভুট্টো-ইয়াহিয়ার বন্ধুত্ব অনেক পুরনাে এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা তারা একত্রে পরিকল্পিতভাবে করেছিলেন। জেনারেল মুসা পরামর্শ দিয়েছেন, সেনাবাহিনীকে রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে। কারণ, তা তার কাজও নয় এবং সেজন্য তার কোনাে প্রশিক্ষণও নেই। ১৯৭১ সাল থেকে তিনি সবাইকে নিতে বলেছেন— “Neither God nor history forgives those who do not learn from past mistakes and repeat them.”
অন্যদিকে জেনারেল আরিফের কথা ধরা যাক। জেনারেল জিয়াউল হকের আমলে তিনি ছিলেন সেনাপ্রধান। ১৯৭১ ও সামরিক শাসন প্রসঙ্গ আলােচনা করতে গিয়ে তিনি চিরাচরিত প্রথায় সেই রাজনীতিবিদদেরই দোষারােপ করেছেন। পাকিস্তান ভাঙার জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের বিশ্বাসঘাতকতা ও ভুট্টোর উচ্চাশা
ও ভারতের ষড়যন্ত্রকে দায়ী করেছেন। লক্ষ করুন ‘বিশ্বাসঘাতক’ ও ‘উচ্চাশা’ wafa Tute betoot 619 satu- “In the final analysis, Pakistan’s internal mismanagement, the treachery of Sheikh Mujibur Rahman, the overambitiousness of Mr. Bhutto and the inept leadership of General Yahyah Khan contributed to converting East Pakistan into Bangladesh, no less than the covert and overt aggression committed by India.”
তথ্যপঞ্জী
1. Maj. Gen. Fazal Muqeem Khan, Pakistan’s Crisis in Leadership,
Lahore, 1972. 2. Lt. Gen. A. A. K. Niazi, The Betrayal of East Pakistan, Karachi,
1998. 3. Maj. Gen. Rao Farman Ali Khan, How Pakistan Got Divided,
Lahore, 1992. 4. Air Marshall Mohammad Asghar Khan, Generals in Politics,
Pakistan, 1958-1982, Dhaka, 1983. 5. Lt. Gen. Gul Hassan Khan, Memoirs of Lt. Gen. Gul Hassan
Khan, Karachi, 1993. 6. Maj. Gen. Tajammal Hussain Malik, The Stroy of My Struggle,
Lahore, 1991. 7. Brig. A. R. Siddiqi, The Military in Pakistan image and Reality,
Lahore, 1996. 8. General Mohammad Musa, Jawan to General, Karachi, 1984. 9. General K. M. Arif, Working with Zia, Pakistan’s Power Politics,
1977-1988, Karachi, 1995.
১৭৮