বাংলার বাণী
ঢাকা : ৫ই অক্টোবর, শনিবার, ১৯৭৪, ১৮ই আশ্বিন, ১৩৮১ বঙ্গাব্দ
কৃষি সংকট : গ্রামীণ সমাজ কল্যাণ
রংপুরে দু’লাখ একর ধানের জমি পোকায় আক্রান্ত : কুড়িগ্রামে ৪ হাজার কীটনাশক স্প্রে মেশিন বিকল, কয়েক হাজার একর জমির ধান পোকায় কেটে ফেলেছে : সেতাবগঞ্জ চিনি কল এলাকায় ৭ হাজার একর জমির আখ পোকায় ধরেছে : চট্টগ্রাম সদর মহকুমায় দক্ষিণাঞ্চলে বিস্তীর্ণ এলাকার ধানের জমি পোকার আক্রমণে বিনষ্ট হতে চলেছে। বগুড়া জেলায় আমন ধানে মাজরা পোকা লেগেছে : মোবারকগঞ্জ চিনি কলে শতকরা ৪০ ভাগ উৎপাদন হ্রাস পাবার আশঙ্কা; প্রধান কারণ পার্শ্ববর্তী ইক্ষু ক্ষেতগুলোতে পোকার আক্রমণ এবং ঔষধের তীব্র অভাব। এ সবগুলো হলো ঢাকায় প্রকাশিত ৩টি দৈনিকের গতকল্যকার খবর। মফঃস্বল সংবাদদাতারা নিজ নিজ এলাকাগুলোর অভাব-অভিযোগ ও দুঃখ-দুর্দশার কথা সবিস্তারে পাঠিয়ে থাকেন এবং একদিনে প্রকাশিত একই ধরনের এতগুলো সংবাদের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ না করার কথা নয়। মাত্র দেড় মাস আগেকার বন্যায় খাদ্যশস্য সহ দেশের বিপুল পরিমাণ সম্পদ বিনষ্ট হওয়ায় স্বভাবতঃই আমরা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিপর্যস্ত এবং তারই ফলশ্রুতিতে ভয়াবহ এক দুর্ভিক্ষ অবস্থার মধ্য দিয়ে সময় অতিক্রম করতে হচ্ছে। বন্যায় কৃষি ক্ষেত্রে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পর পুনরায় নতুন উদ্যমে ক্ষেতের কাজ শুরু করতে গিয়েই দেখা গেল, জমি আছে তো হালের বলদ নেই, বলদ আছে তো বীজ ধান নেই। বীজ ধান আছে, অথচ পানি সেচের জন্য পাওয়ার পাম্প নেই এবং সাম্প্রতিককালের ব্যাপক আকারে সারের অভাবের খবর। আজ আবার আতঙ্কিতভাবে পাঠ করতে হচ্ছে দেশের বিস্তীর্ণ এলাকায় কৃষি ক্ষেত পোকায় আক্রান্ত এবং প্রয়োজনীয় কীটনাশক ঔষধের অভাব সর্বত্র।
‘অভাব’ এবং ‘নেই’ নামক শব্দ দু’টোর সাথে ইদানীং কালে অত্যন্ত বেশী করে পরিচিত হলেও বাংলাদেশের কৃষি ক্ষেত্রে এ শব্দগুলোর সাথে দীর্ঘদিনের পরিচয় আমাদের। কিন্তু সবচাইতে দুর্ভাগ্যের হ’লো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সবকিছু জেনেশুনেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে না জানার ভান করে থাকেন। বন্যা নেমে গেলে নতুন করে ফসল বুনতে বীজ ধানের প্রয়োজন; প্রতি বছরের এই ধরনের অভিজ্ঞতাকে তারা ভবিষ্যতে কোনোদিনই কাজে লাগান না এবং লাগান না বলেই প্রতি বছর একইভাবে আমরা বীজ ধানের অভাব, সারের দুষ্প্রাপ্যতা, পাওয়ার পাম্পের স্বল্পতা, কীটনাশক ঔষধের অভাবের কথা শুনে আসছি। সুতরাং সমস্ত দায়-দায়িত্বটাই খবরের কাগজের লোকদের—এই মহাজনোচিত চিন্তায় বিভোর থাকেন তারা এবং সংবাদপত্রে লেখালেখি শুরু হলেই সংকট দূরীকরণের জন্য তৎপর হয়ে উঠেন এদেশের কুম্ভকর্ণরা অথচ এমনটা হবার কথা নয়। শুধুমাত্র গাফিলতি এবং সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের কর্তব্য কর্মে অবহেলাই গোটা দেশকে এইভাবে সংকটের দিকে টেনে নিয়ে চলেছে। আমরা সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্ণধারদের কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, বীজ ধানের অভাব, অসময়োচিত সার বন্ধের নির্দেশ সকল প্রকার প্রাকৃতিক ও নিজেদের সৃষ্ট দুর্যোগ একে একে যখন অতিক্রম করা যাচ্ছে, এবারও অন্ততঃপক্ষে কীটনাশক ঔষধ ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করার ব্যবস্থা করুন, যাতে করে চাষীরা সময়মতো ফসল তাদের ঘরে তুলতে পারে।
এক্ষেত্রে সরকারের কাছে আমাদের কিছু বক্তব্য আছে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সরকারের সমাজকল্যাণ দপ্তর ৭২ লক্ষ ১৩ হাজার টাকা ব্যয় সাপেক্ষে গ্রামীণ সমাজকল্যাণ সার্ভিস কর্মসূচী বাস্তবায়নের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সমাজকল্যাণ প্রতিষ্ঠান অর্থমঞ্জুরী দিচ্ছেন। এই কর্মসূচীর আওতায় ১১টি মৌলিক আদর্শ রয়েছে। অশিক্ষা দূরীকরণ, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, জরুরী পরিস্থিতি মোকাবেলা, পল্লী উন্নয়নের সাথে জাতীয় উন্নয়ন কর্মসূচীর সমন্বয় সাধন প্রভৃতি উক্ত এগারোটি আদর্শের অন্তর্গত।
খবরটি নিঃসন্দেহে যুগপৎভাবে আশাব্যঞ্জক এবং আনন্দের, তবে কর্মসূচীর ৭২ লক্ষ টাকার মধ্যে কর্মচারীদের বেতন এবং আসবাবপত্র ক্রয়ে সিংহভাগ বরাদ্দ করার সিদ্ধান্তটি আমাদের কাছে আপাততঃ বিতর্কিত লাগলেও সরকারের কাছে অনুরোধ করতে পারি, উক্ত এগারোটি মূল আদর্শের থেকে এককভাবে কৃষি উন্নয়নকে প্রাধান্য দেয়া যেতে পারে। কারণ, অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে আমরা দেখেছি পল্লী উন্নয়নমূলক কর্মসূচী অধিকাংশ ক্ষেত্রে খাতা-কলমেই সীমাবদ্ধ থাকে। শুধুমাত্র কিছু সংখ্যক বেকার যুবকের কর্মহীন চাকুরীর সংস্থান করে তা। সুতরাং গ্রামীণ সমাজকল্যাণ কর্মসূচীর সাথে গ্রামীণ কৃষি কর্মকে সম্পর্কযুক্ত করা যেতে পারে এবং তাতে করে সার্বিক কর্ম সমন্বয়ের মাধ্যমে কৃষি ক্ষেত্রে গ্রামীণ অপরিহার্য সংকট যথা : বীজ, সার, সেচ এবং কীটনাশক ঔষধ বিতরণে সবিশেষ উপকৃত হবার সম্ভাবনা রয়েছে সমধিক।
বিশ্ব বাজারের পণ্যমূল্য স্থিতিকরণ প্রসঙ্গে
বাংলাদেশ সরকারের অর্থমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ গত দুই তারিখে বিশ্বব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের গভর্ণরদের সমাবেশে একটি ভাষণ দিয়েছেন। ভাষণে তিনি মূল্য স্থিতিকরণের ব্যাপারে তার অভিমত ব্যক্ত করেছেন। দ্রব্য মূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি এবং বিশ্বের পণ্য বাজারের স্থিতিহীনতায় বাংলাদেশের মতো একটি দেশের টিকে থাকাই সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেছেন। বিশ্বের জাতিসমূহের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেছেন—অনিশ্চিত বিশ্ব বাজার থেকে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য সংগ্রহে নবীন জাতিগুলোর সংকট সম্পর্কে উন্নত দেশের বিবেচনা করা উচিত। বিশ্ব বাজারে গম ও চালের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে তিন থেকে পাঁচ গুণ। অন্যদিকে খাবার, তেল, জ্বালানী ও জাহাজ ভাড়ার খরচ বেড়েছে যথাক্রমে চার গুণ, পাঁচ গুণ ও চার গুণ। অনুরূপভাবেই বেড়েছে কাপড় ও নির্মাণ সামগ্রীর দাম। অর্থমন্ত্রী মূল্য বৃদ্ধির কথা বলতে গিয়ে দুঃখ প্রকাশ করে বলেছেন, কতিপয় দেশ যখন মূল্য বৃদ্ধির সুযোগ ভোগ করছে তখন বাংলাদেশের পাট ও চায়ের মতো রপ্তানীযোগ্য দ্রব্যের যথার্থ মূল্য এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। জনাব তাজউদ্দীন বিশ্ব ব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের গভর্ণরদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে সবশেষে বলেছেন, উন্নয়নকামী দেশগুলোকে জ্বালানী ক্রয়ে সাহায্য করার জন্য যে বিশেষ তহবিল গঠিত হয়েছে তা থেকে ঋণদানের শর্তাবলী নমনীয় করতে হবে। বিশ্বের সর্বত্র সকল জিনিসের দাম বাড়ার দরুণ গরীব দেশগুলোকে এমন একটি মর্মান্তিক অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়েছে যে, তারা আজ অনন্যেপায় হয়ে তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলতে বসেছে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো তাদের উৎপাদিত পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্য বাড়িয়েছে—সেক্ষেত্রে দরিদ্র বা উন্নয়নকামী দেশের রপ্তানীযোগ্য পণ্যের যথার্থ দাম বাড়েনি। যে সকল দেশ তাদের উন্নয়ন কাজ সবে শুরু করেছিল—তারা সিমেন্ট ও নির্মাণ কাজের প্রয়োজনীয় জিনিসের অস্বাভাবিক দাম বাড়ার দরুণ তা স্থগিত রাখতে বাধ্য হচ্ছে। ঠিক পাশাপাশি জাহাজ ভাড়াও বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে পূর্বের তুলনায় চার গুণ। ফলে সকল দুর্ভোগ উন্নয়নশীল দেশসমূহকেই পোয়াতে হচ্ছে। স্বাধীনতা লাভ করার পর থেকেই বাংলাদেশ নানা প্রকার বাধা ও দুর্যোগের সম্মুখীন হয়েছে। বিভিন্ন প্রকার সমস্যার মধ্য দিয়ে তাকে অগ্রসর হতে হচ্ছে। বিশ্বের বাজারে প্রতিটি পণ্যের দাম বাড়ার দরুণ তাকে আরো সংকটের সম্মুখীন হতে হয়েছে। বর্তমানে দেশের অর্থনৈতিক মেরুদন্ড পর্যুদস্ত হয়ে পড়েছে। দেশে দুর্ভিক্ষাবস্থা বিরাজ করছে। এহেন সংকটময় মুহূর্তে বিশ্বের ধনী দেশগুলো যদি তাদের পণ্য মূল্য স্থিতিশীল না করে ক্রমান্বয়ে মূল্য বাড়ানোই হয় তাহলে বাংলাদেশ সীমাহীন নাজুক অবস্থার মধ্যে নিপতিত হবে। হয়তো তেমন অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়বে। আমাদের মতো এমনি আরো অনেক দেশ সমস্যার সাগরে নিমজ্জিত হয়ে হাবুডুবু খাচ্ছে। উন্নত দেশসমূহ তাদের পণ্যের মূল্যের প্রশ্নে যদি নীতি পরিবর্তন না করে তাহলে সংকট নিরসন হবেনা। পৃথিবীর সর্বত্রই এমন সংকটাপন্ন কোটি কোটি মানুষ রয়েছে যারা আকুল আহ্বান জানাচ্ছে পণ্যমূল্য স্থিতিকরণের জন্যে, উন্নয়নশীল দেশের উৎপাদিত রপ্তানীযোগ্য পণ্যের যথার্থ দাম বাড়ানোর জন্যে। নইলে এশিয়া ও আফ্রিকার বহু দেশেই হাহাকার ধ্বনিত হবে।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক