This is a temporary post for collecting data. Not for posting and not for publishing. Saved only as readable for the editors. Not clickable and not downloadable.
গনতন্ত্র এবং জাতীয়তার অগ্নিপরীক্ষা
জয়ন্তকুমার রায়
পাকিস্তানের জন্ম ও জন্মদাগ
এ গ্রন্থের মুখ্য বিষয়গুলি এই অধ্যায়ের প্রথম দুটি অনুচ্ছেদে বিধৃত। পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যা দ্বিবিধ। প্রথমতঃ, জন্মাবধি পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারে চলে এসেছে পশ্চিমপাকিস্তানীদের একাধিপত্যের অবিচ্ছিন্ন একটি ধারা, অবশ্য ১৯৫৮ র সামরিক শাসন প্রবর্তিত হবার পূর্বে এই অবস্থার মধ্যেও সাময়িক পরিবর্তনের নিদর্শন ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানীদের এই কর্তৃত্ববাদী অভিসন্ধির মধ্যে অর্থনীতি, রাজনীতি এবং সংস্কৃতি ক্ষেত্রের তুলনামূলক গুরুত্ব নিয়ে বিতর্কের অবকাশ হয়তাে আছে। তবে এই অভিসন্ধির অস্তিত্ব তর্কাতীত। দ্বিতীয়ত , বৌদ্ধ, খৃষ্টান এবং সংখ্যার দিক থেকে সংখ্যালঘুদের মধ্যে প্রবল গরিষ্ঠতা বিশিষ্ট হিন্দুদের বিরুদ্ধে বিভেদমূলক আচরণের মধ্যেমে তাঁদের ভারতের সন্নিহিত এলাকাসমূহে বিতাড়িত করার যে পরিকল্পনা, তার তীব্রতার হ্রাসবৃদ্ধি ঘটলেও পূর্ণ বিরতি ঘটেনি কখনােই।
পূর্বপকিস্তানে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার যে লক্ষ্য পশ্চিমপাকিস্তানী শাসকচক্রের কাছে অগ্রাধিকার পেত, তারই পরিপূরক ছিল ঐ সংখ্যালঘু বিতাড়নের পরিকল্পনাগুলি। একটু সরলীকৃত হলেও এই ব্যাখ্যার মাধ্যমে পূর্বোক্ত দুটি বিষয়ের যােগসূত্র প্রতীয়মান হবে। অবশ্য পূর্বপাকিস্তানের সংখ্যালঘু উৎখাত পর্বেরও দৈনন্দিন, অনতিতীব্র একটি ধারার মধ্যে ১৯৫০ এর ফেব্রুয়ারী এবং ১৯৬৪র জানুয়ারীর ভয়ঙ্কর তাণ্ডবগুলি ছিল সম্পূর্ণ পৃথক ধাঁচের। পরবর্তী বৎসর গুলিতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর এই আক্রমণের তীব্রতা এবং পৌনঃপুনিকতা হ্রাস পেয়েছিল। পূর্বপাকিস্তান সমস্যার যে-দুটি ধারার উল্লেখ করা হয়েছে তাদের আরাে একটি ঐক্যসূত্র ছিল। পাকিস্তানী শাসকচক্র যদিও সমস্ত পূর্বপাকিস্তানীকে পাকিস্তানের প্রতি অবিশ্বস্ত মনে করতেন, তবুও সংখ্যালঘুদের ক্ষেত্রে এরূপ সন্দেহ ছিল তীব্রতর। সংখ্যালঘুদের প্রশ্নটিকে যেন ভারতের সঙ্গে দরকষাকষি বা ভারতের উপর চাপসৃষ্টির উপায় মনে করা হত। বিশেষতঃ দেশভাগের পরে নিছক সন্দেহই এই ধরণের সিদ্ধান্তের মূলে থাকলেও, পাকিস্তানের প্রতি উক্ত পাকিস্তানবাসীদের বিশ্বস্ততার অভাবের ধারণা জন্মেছিল যে ঐতিহাসিক এবং ভৌগােলিক পটভূমিতে তার আলােচনা করা যেতে পারে।
পাকিস্তানের দাবিতে আন্দোলনে অবাঙালী মুসলিমরা বর্তমান পাকিস্তানের পশ্চিমাংশ এবং বাঙলাকে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে ভারত-বহির্ভূত দুটি স্বতন্ত্র অঞ্চল হিসাবে চিহ্নিত করতেন। পাকিস্তান ভাবনার জনক হিসাবে চিহ্নিত স্যার
মুহম্মদ ইকবাল-ও ১৯৩০ সালে মুসলিম লীগের এলাহাবাদ সম্মেলনে বালুচিস্তান, পাঞ্জাব এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ নিয়ে পাকিস্তান গঠনের কল্পনা করেছিলেন। (১) ১৯৩৩ সালে পাকিস্তান জাতীয় আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা-সভাপতি চৌধুরী রহমৎ আলির কল্পনায় কাশ্মীর এবং সিন্ধুর সংযােজন হলেও, ইকবালের সূত্রের মতােই। * এবারেও বাঙলা বাদ থেকে গেল। ভারতীয়বাদের বিপদ এড়াতে পাকিস্তানের মতােই বাঙলাকেও একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রে পরিণত করতে হবে’—একথাই তিনি বলেন। পরবর্তী বৎসর গুলিতে পাকিস্তানের দাবি জোরদার হলে বাঙলার মুসলিমদের তিনি আহ্বান করেন স্বতন্ত্র মুসলিম রাষ্ট্র বাঙলার দাবিতে সংগ্রাম করতে। এর পরে হায়দারাবাদদাক্ষিণাত্য অঞ্চলে উসমানিস্তানের দাবি পেশ করলেন রহমৎ আলি। পাকিস্তান, বাঙলা এবং উসমানিস্তানের তিনটি জাতির মৈত্রী ভারতীয়দের বিপদ থেকে মুসলিমদের মুক্ত করবে—এ আশাও তিনি প্রকাশ করেন। (২)
রহমৎ আলি তাঁর বাহীন কল্পনায় ভারতবর্ষের জন্য পূর্ণাঙ্গ বলকান-পরিকল্পনাও পেশ করেছিলেন ; হিন্দুপ্রধান অঞ্চলগুলােও খন্ড খন্ড করে হিন্দুস্তান, রাজস্থান, মহারাষ্ট্র এবং দ্রাবিড়িয়া নামে পৃথক সব স্বাধীন রাষ্ট্রের ধারণা করেন। তাঁর কল্পনায় আসাম বাঙলার সঙ্গে অঙ্গীভূত হয়ে যাবে—এ আশাও ছিল। ভারতের অভ্যন্তরে বাসরত মুসলিমদের স্বার্থে উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, উড়িস্যা প্রভৃতির অন্তবর্তী নানা নামের মুসলিম রাষ্ট্রের চিন্তাও তিনি করেন। এ সবে আস্থা মুসলিম জনসাধারণেরও ছিল না। তথাপি এই সকল উদ্ভট ভাবনার পৃষ্ঠপােষক হিসাবে উইনস্টন চার্চিল এবং লর্ড লয়েডের নাম বিস্ময়ের উদ্রেক করবে। (৩)
এল হামজার পাকিস্তান-একটি জাতিসত্তা গ্রন্থটির ১৯৪১ থেকে ১৯৪৪ এর মধ্যে তিনটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। (৪) গ্রস্থলেখক হামজা উত্তর পশ্চিমভারতের প্রস্তাবিত রাষ্ট্র এবং পূর্বভারতের বাঙলার জলবায়ু, জমির ফসল, অধিবাসীদের শারীরিক গড়ন, ভাষা, খাদ্যাভ্যাস, পােশাক ইত্যাদির পার্থক্য বিশেষভাবে আলােচনা করে বলেন এই দুই অঞ্চলের স্ত্রীলােকরাও পরস্পরকে সহানুভূতি দেখাবে না। এ দুই স্বতন্ত্র অঙ্গ নিয়ে একটি জাতিসত্তা গড়ে উঠবে একথা ভাবা যায় না। (৫) | ১৯৪০ সালে ভারতের মুসলিম লীগের লাহাের প্রস্তাবে উত্তর-পশ্চিম ভারত এবং পূর্বভারতের মুসলিমপ্রধান অঞ্চলগুলির জন্য যে দুটি পৃথক রাষ্ট্রের কথা বলা হয়, তাদের পার্থক্য স্পষ্ট ভাষায় প্রকাশ করেছেন হামজা তাঁর গ্রন্থে। অবিকল রহমতের মতাে বহুধা বিভক্ত ভারতের চিন্তা না করলেও, পাকিস্তান, বাঙলা ছাড়া হিন্দুপ্রধান ভারতের যে অঞ্চল সেখানে হিন্দুস্তান, রাজস্থান, মহারাষ্ট্র এবং দ্রাবিড়িয়ার মতাে পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্রগুলির চিন্তা তিনিও করেছিলেন।(৬)
এম, আর, টি—এই সাঙ্কেতিক নামে বিভিন্ন প্রবন্ধের এক লেখকও(৭) উত্তর
পশ্চিম এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের মুসলিমদের সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক স্বাতন্ত্রের কারণে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের কথা বলেছিলেন। (৮) রহমতের মতাে ভারতবর্ষকে টুকরাে টুকরো করার কোনাে চিন্তা তাঁর ছিল না। পাকিস্তান’ শব্দে পা ধ্বনি পাঞ্জাব এবং • পে অন্যান্য ধ্বনি আফগান, সিন্ধু, বালুচিস্তান সূচিত করছে। বাঙলা এই
কারা অনুপস্থিত। তাই উত্তর-পূর্ব ভারতে বাঙলা একটি ভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্র হিসাবে এণত হয়েছে পাকিস্তান-আন্দোলনে। লাহাের প্রস্তাবেও পাকিস্তান এবং বাঙলার অত রাষ্ট্র হিসাবেই উল্লেখ ছিল। হামজার বা রহমত-এর তুলনায় এম. আর. টি-র শিণে অধিকতর পুঙ্খানুপুঙ্খ। বাঁকুড়া, বীরভুম, দার্জিলিং প্রভৃতি হিন্দুপ্রধান ( গুলি এম, আর, টি-র পূর্ব পাকিস্তান রাষ্ট্রের বাহিরে ছিল। অবশ্য আসামের wহD এবং গােয়ালপাড়া এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। পশ্চিম এবং উত্তর বাঙলার বিস্তীর্ণ অল বাদ দেওয়া সত্ত্বেও প্রস্তাবিত বাঙলা বা পূর্বপাকিস্তানের জনসংখ্যা মিশর, *স্য বা তুর্কীর দ্বিগুণ এবং আফগানিস্তানের তিনগুণ ছিল। (৯) ভারতের দুই প্রান্তে
লথিত দুটি মুসলিম প্রধান রাষ্ট্র এম, আর, টির মতে ‘হিন্দু ভারতের দুরভিসন্ধির লি। দুটি প্রহরীর কাজ করে ভারতের ক্ষুদ্রায়তন প্রতিবেশী রাষ্ট্রদের আশা ভরসার লণ হবে। | জিয়াউদ্দিন আহমাদ সুলেরি (১০) এবং জামিলউদিন (১১) একই প্রকার চিন্তা
।। তাঁরাও উত্তর-পশ্চিম এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের মুসলিম প্রধান অঞ্চলে দু’টি * রাষ্ট্রের কথাই বলেছিলেন। অর্থাৎ উত্তর-পশ্চিম ভারতের পাকিস্তান প্রস্তাবে
ও অন্তর্গত ছিল না। বাঙলা ছিল একটি পৃথক রাষ্ট্র। অন্ততঃ গােড়ার দিকের *ণিজানের প্রতি প্রবক্তাই এইরূপ কল্পনা করেছিলেন।
১৯৯৪৭ এ বাঙলার মুসলিম প্রধান অংশকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্তর্গত করা হ’লেও, এতদিন ধরে আলােচিত সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক যে বৈশিষ্ট্যগুলি পৃথক লালা রাষ্ট্র চিন্তার মূলে ছিল, তাদের বিলােপসাধন নিশ্চয়ই ঘটে নি। উত্তর-পশ্চিম
নং উত্তর-পূর্ব ভারতের মুসলিম প্রধান যে দুই ভূখন্ড জুড়ে এক অখন্ড রাষ্ট্র *নি নাম নিয়ে আবির্ভূত হ’ল তাদের মধ্যে হাজার মাইলের যে-ব্যবধান তা জুড়ে ইল ভারত রাষ্ট্র। শুধু ভৌগােলিক অবস্থানগত দূরত্ব নয়, বাঙলা মুলুকের ভাষাও যে। | “গুণ স্বতন্ত্র। এই ভাষা তাে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের-ও ভাষা। সুতরাং wit,মবঙ্গের মারফৎ ভারতীয় প্রভাব, পাকিস্তানের পূর্বখন্ডের মানুষদের উপরে প্রভাব (লে। পাকিস্তানের পশ্চিমখন্ডের শাসককুল এই বৈদেশিক প্রভাবের সম্ভাবনার
শ্য পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় সংহতি বিনষ্ট হতে পারে—এমন বিপদও দেখলেন। পূর্ণভাতের মুসলিমদের স্বদেশ হিসাবে বাঙলা যথেষ্ট ঐক্যবদ্ধ এবং শক্তিশালী রাষ্ট্র হণে, এই মতের সমর্থনে প্রাক-দেশবিভাগ আমলের মুসলিম লেখকরাও বাঙালী হিন্দু
এবং বাঙালী মুসলমানের জীবনধারা, ভাষা এবং সংস্কৃতির অভিন্নতার উল্লেখ করতেন। ঐ একই কারণে গান্ধীজি আবার পাকিস্তানের দ্বিজাতি তত্ত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলতেন। তিনি বাঙালী হিন্দু আর বাঙলী মুসলমানের মধ্যে কোনাে প্রভেদ লক্ষ্য করেন নি। সুতরাং তাঁর মতে, ধর্মভিত্তিক জাতিসত্তা তর্কের বিষয় হয়ে ওঠে। কিন্তু সােহরাবর্দি যখন পশ্চিমবঙ্গ এবং পূর্ববঙ্গ সংযুক্ত করে অখন্ড বাঙলা রূপে স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের চিন্তা করলেন, সেই ১৯৪৭ সালে এসে কিন্তু এই উদ্যমও পশ্চিম পাকিস্তানীদের সন্দেহের উদ্রেক করে। (এ সম্পর্কে জ্ঞাতব্য বিষয়ের অবতারণা পরে করা হবে।) দেশভাগের পরবর্তী পর্যায়ে অবশ্য দূরে অবস্থিত রাজধানী থেকে পরিচালিত শাসনব্যবস্থা বাঙলা অঞ্চলের মুসলিমদের নৈরাশ্য বা আশাভঙ্গের কারণ হবে—এই আশঙ্কা গড়ে ওঠে ঐ পশ্চিমাঞ্চলের শাসকচক্রের মধ্যে। বিশেষতঃ রাজনীতি বােধে পশ্চিম পাকিস্তানীদের চেয়ে অধিক অগ্রসর হিন্দু বাঙালীদের সাহচর্যে বাঙালী মুসলিমরা, পশ্চিমখন্ডের শাসকদের ঠেলে দিতে পারে এক প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে—এমন আশঙ্কাও ছিল শাসকদের মনে। (১২)
নিজেদের পশ্চিম এশিয়া উদ্ভূত মনে করে, হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত বাঙালী মুসলিমদের প্রতি ধর্মীয় ঐক্যের পরিবর্তে অবজ্ঞাসূচক মনােভাবকেই প্রশ্রয় দিত পশ্চিমপাকিস্তানী মুসলিমরা। সমাজের খুবই নিচু স্তরের হিন্দুরাই জাতিভেদের বা জাতপাতের পীড়ন থেকে অব্যাহতি পেতে ইসলামের শরণ নেন। বাঙলার মুসলিমদের এইসব কারণে দ্বিতীয় শ্রেণীর মুসলিম জ্ঞানে অবজ্ঞা করাটাই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানী মুসলিমদের রেওয়াজ। (১৩) পূর্ববঙ্গের বুদ্ধিজীবীরা এই মত খন্ডন করে বলতেন, যে-সময় বাঙলায় ইসলাম জনপ্রিয় হয় তখন হিন্দুধর্মের তেমন কোনাে প্রাধান্য সেখানে ছিল না। তা ছাড়া ভাষাসংস্কৃতির দিক থেকে পূর্ববঙ্গীয়রা পশ্চিম পাকিস্তানের অধিবাসীদের চেয়ে অনেক বেশি উন্নত—এ কথাও এই বুদ্ধিজীবীরা জানতেন। পশ্চিম পাকিস্তানী আমলাদের রূঢ় এবং দাম্ভিক আচরণে তাদের উচ্চ রুচি বা পরিশীলিত সংস্কৃতির কোনাে পরিচয় সত্যই পাওয়া যেত না। উচ্চপদে নিযুক্ত হ’তে না পারার জ্বালা পূর্ববঙ্গীয়দের স্বভাবতঃই ছিল। বহিরাগত ঐ আমলাদের দুর্ব্যবহারে তা আরাে বর্ধিত হয়। (১৪)।
১৯৪৬-এর ক্যাবিনেট মিশন প্রস্তাব অনুযায়ী গঠিত অবিভক্ত ভারতের গণপরিষদ সদস্যদের মধ্যে ১৯৪৭ এ গঠিত পাকিস্তান অংশের প্রতিনিধিদের নিয়ে পাকিস্তানের প্রথম যে গণপরিষদ কার্যকর হয় তাতে ছিল পূর্ববঙ্গীয়দের বিপুল সংখ্যাধিক্য। পাকিস্তানী শাসকদের মর্জি মতাে আইনে তা গঠিত হলে এ সংখ্যাধিক্য নিশ্চয়ই থাকতাে না। ৪৪ জন পূর্ববঙ্গীয় সদস্যের ১৪ জন ছিলেন হিন্দু ; তা ছাড়া জিন্নার মনােনীত তিনজন অবাঙালীও পূর্ববাঙলার প্রতিনিধিত্ব করতেন। এই বাঙালী
প্রধান গণপরিষদের কারণে পশ্চিম পাকিস্তানীরা বিশেষভাবে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল বাঙলাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার উদ্দেশ্যে। জিন্না একাধারে সাংবিধানিক এবং আইনগত প্রধান হিসাবে একনায়কের ক্ষমতা ভােগ করতেন। যদিও কাগজে কলমে গভর্ণর। জেনারেল হিসাবে তিনি নিতান্তই সাংবিধানিক প্রধান ভিন্ন কিছু ছিলেন না। জিন্নার জীবদ্দশায় গণপরিষদে বাঙালীর সংখ্যাগত আধিপত্য পাকিস্তানী রাজনীতিতে কোন প্রভাব ফেলতে পারে নি। সে সুযােগই তখন ছিল না। কিন্তু জিন্নার অভাবে পাকিস্তানী শাসকচক্র ঐ সংখ্যাগত আধিপত্যকে সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করলাে। (১৫)
| জিন্নার মৃত্যুর পরে খাজা নাজিমুদ্দিন গভর্ণর জেনারেল পদে প্রতিষ্ঠিত হলেও জিন্নার উত্তরাধিকারী বলে পরিচিত প্রধান মন্ত্রী লিয়াকৎ আলির প্রবল প্রতাপের মুখােমুখি নিজস্ব প্রভাব-প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারেন নি। প্রশাসন এবং সামরিক বিভাগের গুরুত্ব পূর্ণ পদগুলিতে পাঞ্জাবীদের আধিপত্য ঐ প্রদেশের নেতাদের উচ্চাকাঙক্ষা বাড়িয়ে দিল। শুধু উত্তর-পশ্চিম ভারতের মুসলিম প্রধান অঞ্চলগুলি নিয়ে পাকিস্তান গঠিত হলে পাঞ্জাবীরা হত তার অবিসংবাদী কর্ণধার এবং সুবিধাভােগী। (১৬) কিন্তু বুদ্ধি, রাজনৈতিক চেতনা এবং হিন্দুদের সহয়তা গুণে এখন তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হবার যােগ্যতা রাখে পূর্ববঙ্গীয়রা। তাই বাঙলার হিন্দু-মুসলিম ঐক্য। বিনষ্ট করতে তারা উর্দুকে চাপিয়ে দিতে উদ্যত হ’ল বাঙলা ভাষার উপরে। পাঞ্জাবীদের সর্বেসর্বা হয়ে ওঠার এই দুরভিসন্ধি সংযত করার ক্ষমতা জিন্না এবং লিয়াকৎ আলির অবশ্যই ছিল। কিন্তু তাঁরা সে ক্ষমতা প্রয়ােগ করেন নি। বরং পাঞ্জাবীরা ওঁদের সমর্থনই পেয়ে গেছে। (১৭) | রাশব্রুক উইলিয়ামস জিন্নাকে যেভাবে পাকিস্তানের দুই অঙ্গের প্রতি সমভাবাপন্ন হিসাবে চিহ্নিত করেছেন তা অতিরঞ্জিত। ১৯৪৮ এর মার্চে ঢাকা পরিদর্শন কালে জিন্না যে বিক্ষোভের সম্মুখীন হন তার ফলেই চারজন পূর্ববঙ্গীয় পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় স্থান পান। এরা হলেন তফাজ্জল আলি, ডঃ এ, এম, মালিক, মুহম্মদ আলি এবং খাজা নাসরুল্লা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে উপস্থিত জিন্নাকে ছাত্ররা তিনটি ধ্বনি শুনিয়ে তাঁদের মনােভাব ব্যক্ত করেন। পাকিস্তানের ঐক্য, জিন্নার নেতৃত্ব এবং বাঙলাভাষাকে সরকারী ভাষার মর্যাদা দান সম্পর্কে এই শ্লোগানগুলির কথা সেদিন জিন্নার পার্শে উপবিষ্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যক্ষ বাপ্রােভােস্ট অধ্যাপক পি, সি, চক্রবর্তী, বর্তমান লেখককে জানিয়ে ছিলেন। সমাবর্তন ভাষণে জিন্না কিন্তু ভারতীয় সংবাদপত্রাদি যেন এই পূর্ববঙ্গীয় ভাষা উত্তেজনার কারণ এমন কথা বললেন। জিন্না এই আন্দোলনের সঙ্গে পাকিস্তানের প্রতি অবিশ্বস্ততাকে জড়িয়ে যেইঙ্গিত সেদিন তাঁর ভাষণে দিয়েছিলেন, অচিরাৎ তারই প্রতিফলন ঘটলাে পূর্ববঙ্গে নিযুক্ত পাঞ্জাবী আমলাদের বঙ্গভাষা সমর্থকদের উপরে পুলিশ এবং গুণ্ডা লেলিয়ে
৫
দেবার মধ্যে। ঐ সমর্থকরা সভাসমিতিতে প্রচার করছিলেন বাঙ্গলাভাষার ন্যায্য অধিকারের কথা। কারণ ঐ সময় পাঞ্জাবী আমলারা বাঙালীদের উপর উর্দু ভাষা জোর করে চাপিয়ে দেবার প্রথম পদক্ষেপটি গ্রহণ করে। (১৮)। . ১৯৫০ এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ফলে সংখ্যালঘুরা বিপুল সংখ্যায় পূর্ববঙ্গ ত্যাগ করে যাবার পরেও ১৯৫১ র আদমসুমারি অনুসারে বঙ্গভাষাভাষীর সংখ্যা ছিল পাকিস্তানের জন সংখ্যার ৫৪.৬ শতাংশ। উর্দুভাষাভাষীর সংখ্যা ছিল নগণ্য। মাত্র ৭.২ শতাংশ পাকিস্তানবাসীর ভাষা উর্দুকেই পূর্ববঙ্গীয়দের উপরে চাপানাের চেষ্টা হ’ল। বাঙলা ভাষাকে বিশুদ্ধ ইসলামিক বলা যায় না। হিন্দুরাও বাঙলা ভাষার জন্য আন্দোলনে নিরত—এই দুটি অজুহাত অবশ্যই তুলে ধরা যেত ঐ বাঙলাভাষা সর্মথকদের আন্দোলনের বিরুদ্ধে। হিন্দুরা এই আন্দোলনে থাকার জন্য তাদের উপরে পাকিস্তান-বিরােধিতার অভিযােগও করা হ’ল। কিন্তু কুৎসা সহ্য করেও পাকিস্তানের হিন্দু রাজনীতিকরা বাঙলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করেন। ১৯৪৮ এর ২৫ শে ফেব্রুয়ারী ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত পাকিস্তানের গণপরিষদের সদস্য হিসাবে ঐ পরিষদেই দাবি করলেন, “উর্দুর সঙ্গে বাঙলাতেও আইনসভার কার্যবিবরণী লিপিবদ্ধ করতে হবে। প্রধান মন্ত্রী ক্রুদ্ধ জবাবে জানালেন, পাকিস্তানের মতাে। মুসলিম রাষ্ট্রে উর্দুই হবে একমাত্র জাতীয়ভাষা। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে ভারতের চর ভেবে নিন্দা করা দূরের কথা, বাঙালী মুসলিমরা তাঁর উর্দুর আগ্রাসী ভূমিকার বিরােধিতায় মদত দিলেন। গণপরিষদের বাঙালী-মুসলিম সদস্যরা যে জিন্নালিয়াকতের প্রবল প্রভাব কাটিয়ে সর্বদা বাঙালীর হয়ে কিছু বলতে পারেন না একথা তখন তাঁদের বিশেষভাবে মনে এল। (১৯) যে-সময় জিন্না ছিলেন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল, লিয়াকৎ এবং নাজিমুদ্দিন যথাক্রমে পাকিস্তানী প্রধান মন্ত্রী এবং পূর্ববঙ্গীয় মুখ্যমন্ত্রী তখনকার দিনের ছাত্রদের উদ্যোগে বাঙলা-ভাষার পক্ষে যেআন্দোলন চলতাে তাকে কী অবজ্ঞার চোখে শাসকচক্র দেখতাে তার একটি দৃষ্টান্ত। আয়ুব-সুহৃদ মােহাম্মদ আহমদের কথায় পরিষ্কার হয়ে যায়। (২০) আহমদ বলেন, ‘পাকিস্তানের শত্রুদের উস্কানিতে পূর্ববঙ্গীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজের ছাত্ররা বাঙলা ভাষার জন্য রাজনীতির নামে ছেলেখেলা শুরু করেছে। শ্লোগান, মিছিল নয় ।
তাে মন্ত্রীকে জোর করে বাঙলা ভাষার পক্ষে ভাষণ দান করানাে—এই সব চিত্তবিনােদনের নূতন বিকৃত পন্থাতেই তাদের শিক্ষায়তনে সময়ের বেশির ভাগ কেটে যায়। তবে অবস্থা আয়ত্তের বাহিরে চলে গেলে স্থানীয় দুর্গের মজুত সেনাবাহিনীর সাহায্য নিতেই হবে প্রশাসনকে। এ সময় পূর্ববঙ্গে মুসলিম লীগের জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়তে শুরু করলাে। জিন্না-লিয়াকতের কঠোর নিয়ন্ত্রণে আনুগত্য দেখিয়ে মুসলিম লীগ, পাঞ্জাবী আমলাতন্ত্রের চক্রান্ত এবং দৌরাত্ম সবই মুখ বুজে সহ্য করেছিল।
পূর্ববঙ্গের স্বার্থে সে সবের প্রতিবাদ পর্যন্ত করে নি। ১৯৫৪র প্রাদেশিক নির্বাচনে এর মূল্য দিতে গিয়ে নাকাল হ’ল এই মুসলিম লীগ দল। (এ গ্রন্থে সে আলােচনা পরবর্তী পর্যায়ে করা হবে। কোনাে কোনাে বিদেশী বিশেষজ্ঞ’-ও পাকিস্তানী শাসকচক্রের কথার প্রতিধ্বনি করে বাঙালা ভাষা ঘটিত প্রশ্নটিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিতে চান নি। ক্যালার্ড এই শ্রেণীর একজন বিশেষজ্ঞ। তাঁর মতে ইসলামিক রাষ্ট্রের রূপ নির্ণয় এবং প্রয়ােগের সমস্যাটাই ছিল গণপরিষদের মূল বিবেচ্য। ভাষা আন্দোলনে তিনি ক্রুদ্ধ আবেগ ভিন্ন কিছু দেখেন নি, যদিও সে আবেগের তীব্রতা তাঁকেও স্বীকার করতে হয়েছিল। ইসলামিক রাষ্ট্রের প্রশ্নটির চেয়ে পূর্ববঙ্গীয়দের চোখে বাঙলাভাষার সরকারী স্বীকৃতির প্রশ্ন কোনক্রমেই কম জরুরী ছিল না—এটুকু ক্যালার্ড বুঝতে পারলেই ভালাে করতেন। (২১)।
পাঞ্জাবী আমলারা ভাষা প্রশ্নে পূর্ববঙ্গীয় হিন্দু-মুসলমান ঐক্যে সন্ত্রস্ত বােধ করে। ঐ ঐক্যে ফাটল ধরাতে ১৯৫০-এর ব্যাপক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধায়। ইসলামিক রাষ্ট্রের সঙ্গে সঙ্গতি রাখতে বাঙলা ভাষার সংস্কারের অজুহাতে হিন্দু আবেগে ঘা দিয়ে ঐক্যবদ্ধ ভাষা আন্দোলনে ভাঙন ধরাতে উদ্যোগ গ্রহণ করে কেন্দ্রের বশংবদ পূর্ববঙ্গ সরকার। এই উদ্দেশ্যে সরকার নিয়ােজিত কমিটি এক প্রশ্নোত্তরিকায় পাকিস্তানকে সরাসরি ইসলামিক রাষ্ট্র বলে উল্লেখ করে। মূল লক্ষ্য সনদে বা অবজেকটিভ রেজোলিউশনে কিন্তু এমনটি ছিল না। বেছে বেছে পাঞ্জাবী আমলা এবং কেন্দ্রের বশংবদ মুসলিম লীগের মতে মত দেবে এমন সব লােকের কাছে এই প্রশ্নোত্তরিকা উপস্থিত করা হ’ল। আরবি লিপি, যথেচ্ছ আরবি, ফারসি এবং উর্দু শব্দ, আমদানি ইত্যাদি মাধ্যমে বাঙলা ভাষার প্রকৃতি ধ্বংস করার সঙ্গে সংখ্যালঘু স্বার্থরক্ষার ছুতােয় দুই ধর্মের মানুষের জন্য দু’ জাতের বাঙলা ভাষার আশ্বাস দিয়ে আসলে হিন্দু এবং মুসলমানের সাংস্কৃতিক সংহতি বিনাশেই ব্রতী হ’ল কেন্দ্রের বশং বদ প্রাদেশিক সরকার। উর্বর কল্পনার বেগে জমি-জায়গার মতাে ভাষারও এলাকাভাগ করতে উদ্যত হ’ল বাঙলা ভাষা সংস্কার কমিটি। (২২) ‘আজাদ’সম্পাদক মৌলানা আক্রাম খান বাঙলা ভাষার প্রস্তাবিত সংস্কারের একজন উৎসাহী সমর্থক ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডঃ সরােজেন্দ্র নাথ রায় ঐ ‘আজাদ পত্রিকা ‘ থেকেই নানা উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ করেন, ‘আনন্দবাজার’-পত্রিকার ভাষা থেকে ঐ ভাষা ভিন্ন নয়। ডঃ রায় তখনকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডঃ মুয়াজিম হুসেইনের রচনা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে দেখান, প্রকৃতই আরবি ভাষার এই পন্ডিতের রচনায় বাঙলাভাষার মধ্যে আরবি শব্দ জোর করে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় নি। উভয় ভাষার মর্যাদাই হুসেইন এইভাবে রক্ষা করেছেন। ডঃ রায় আরাে বলেন, উর্দু অথাৎ আরবি লিপিতে বাঙলাভাষা চালু করার অর্থ হবে বাঙলাভাষার উপর পীড়ন তথা
লুণ্ঠনের শামিল। (২৩) ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ পূর্ববঙ্গের অগ্রণী শিক্ষাব্রতী। ভাষাবিদ এবং ভাষাতাত্ত্বিকদের মধ্যেও তাঁর স্থান শীর্ষে। তিনি এই সময় ৮০ পৃষ্ঠার এক পুস্তিকা রচনা করেন। আমাদের সমস্যা’ বা ‘আওয়ার প্রবলেম নামের এই পুস্তিকায় ভাষা সংস্কার এবং সংশ্লিষ্ট প্রশ্নের সমাধানে তিনি যা লিখেছেন তার মধ্যে রাজনীতির উত্তপ্ত পক্ষপাতিত্ব নেই। তিনি বুঝিয়েছেন, বাঙলা ভাষার বিকাশ হিন্দুযুগে বা হিন্দুধর্মপ্রভাবে ঘটে নি। কারণ বৌদ্ধযুগে উদ্ভূত এই বাঙলাভাষাকে পরবর্তী হিন্দুরাজগণ (বৌদ্ধধর্মের প্রতি বিদ্বেষবশতঃ) আদৌ ভালাে চোখে দেখেন নি। এই ভাষার প্রাথমিক বিকাশ এবং উন্নতি ঘটেছে পাঠান রাজত্বে। মুসলিম ধর্মাবলম্বী এই পাঠান রাজগণ এই ভাষার পৃষ্ঠপােষকতা করতেন। অর্থাৎ হিন্দুরাজাদের বিরূপতা সত্ত্বেও পরবর্তী মুসলিম রাজশক্তির সহায়তায় যে-ভাষার বিকাশ ঘটেছে তাকে নিছক হিন্দুধর্মসংস্কৃতির প্রচার মাধ্যম বলা সম্পূর্ণ ভুল। তদুপরি বাঙলা ভাষা শুধু অধিকাংশ পাকিস্তানীর মাতৃভাষাই নয়, এ খুবই সমৃদ্ধ একটি ভাষা। বিপরীতক্রমে, উর্দু পাকিস্তানের কোনাে অঞ্চলের অধিবাসীর-ই মাতৃভাষা নয়। তথাপি ইংরেজির উচ্ছেদ হলে উর্দুকে দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা করা যেতে পারে। বাঙলাকে অবশ্যই প্রথম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে হবে। ধর্ম এবং ভাষার প্রশ্ন মিশিয়ে ফেলার কাজটি নিন্দনীয়। লিপি প্রসঙ্গে যে উর্দু হরফে বাঙলাভাষা প্রবর্তনের কথা চলছে, এটি হলে পূর্ববঙ্গের শিক্ষাদীক্ষার মূল উৎসমুখই শুকিয়ে যাবে। পূর্ববঙ্গের বিনাশ হবে এর ফলে। আদালতে এবং শিক্ষায়তনে বাঙলাভাষার স্থলে উর্দুর প্রচলন শুধু বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থার-ই পরিপন্থী হবে তা নয়। এই পরিবর্তনের ফলে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন তথা আত্মনিয়ন্ত্রণের মূলনীতিকেই খন্ডন করা হবে। (২৪)
বাঙলালিপিকে ব্রাহ্মী লিপি বলা মারাত্মক ভুল। ভারত, শ্যাম, যবদ্বীপের যাবতীয় লিপি ঐ ব্রাহ্মী লিপি থেকে উদ্ভূত। ব্রাহ্মী লিপি নাম দিয়ে বাঙলা লিপিকে হিন্দু ব্রাহ্মণদের ব্যাপার হিসাবে প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে এই ইচ্ছাকৃত প্রমাদের আশ্রয় গ্রহণ করেছিল পূর্ববঙ্গবিদ্বেষী শাসকচক্র। উর্দু লিপিতে বাঙলা ভাষার মতাে কৃত্রিম প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ক্যালার্ড বা রাশব্রুক উইলিয়ামসের মতাে যশস্বী লেখকরাও কিছু লেখেন নি। নিরপেক্ষ শিক্ষাসংস্কৃতির পৃষ্ঠপােষকতার নিদর্শন তাে অন্যায় স’য়ে যাওয়া নয়। বরং একালের মনীষার সম্পর্কে এই সহিষ্ণুতা দেখে বিরূপ মন্তব্যের ইচ্ছা জাগে। বাঙালী এবং পশ্চিম পাকিস্তানীদের লিপির মিল যদি মনের মিল ঘটাতে পারে তা হলে লিপির মিল থাকা সত্ত্বেও জার্মানদের সঙ্গে ইংরাজ বা ফরাসির যুদ্ধ বাধে কেন—এ প্রশ্ন তুললেন পূর্ববঙ্গের লেখককুল। পূর্ববঙ্গের হিন্দুদের মধ্যে বিশিষ্ট অনেকে এমন কথাও বললেন, “আমরা উর্দু শিখতে প্রস্তুত আছি। কিন্তু উর্দু লিপিতে বাঙলা পড়বাে না।’ পূর্ববঙ্গের লেখকসম্প্রদায় মনে করলেন, উর্দু লিপিতে বাঙলা
প্রচলিত হলে ছয় শত বৎসর ব্যাপী বাঙলা ভাষার যা-কিছু সমৃদ্ধি লাভ হয়েছে তার সবই মুছে যাবে। (২৫) ফের নতুন করে সব কিছু শুরু করতে হবে। পূর্ববঙ্গের ভবিষ্যৎ অগ্রগতি’ বা ‘দি ফিউচার প্রগ্রেস অব ইস্ট বেঙ্গল’ নামের এক প্রবন্ধে ডঃ শহীদুল্লা অভিযােগ করেন, “উর্দু লিপিতে বাঙলা ভাষা সংক্রান্ত রিপাের্ট সরকারী কমিটি পেশ করার পূর্বেই সরকার ঐ কর্মে অগ্রসর হয়েছে। প্রাপ্তবয়স্কের শিক্ষায় উর্দু লিপিতে বাঙলাভাষা ব্যবহার করতে কেন্দ্রীয় সরকার বিপুল অর্থ মঞ্জুর করেছে। এর কী অর্থ ? ক’টাই বা বই সদ্যশিক্ষাপ্রাপ্ত পড়তে পাবে যার ভাষা বাঙলা অথচ লিপি উর্দু ?’ (২৬) প্রাপ্তবয়স্কের শিক্ষায় উর্দু লিপিতে বাঙলাভাষা ব্যবহারের জন্য ১৯৪৯ সালে সরকার ২০ টি স্কুল খুলেছিল। এ ব্যাপারে ১৯৫০ সালে সরকারী ব্যয়বরাদ্দ দ্বিগুণ করা হয়। উর্দু লিপিতে বাঙলার সমর্থনে এই সময় যে প্রচারপত্র ছড়ানাে হয় তার মূলে যে সরকারী আনুকূল্য ছিল,সেই তথ্য ফাঁস করে দিয়েছিল ‘অগত্যা’ নামের এক বাঙলা পত্রিকা। (২৭)
এইরূপ একটি প্রচারপত্রে চট্টগ্রামবাসী কোনাে এক মৌলানা জুলফিকর আলির স্বপ্নাদেশ বর্ণিত হয়েছিল। ঐ প্রচারপত্র অনুসারে, পয়গম্বর স্বপ্নে ঐ মৌলানাকে আদেশ করেন উর্দু লিপিতে বাঙলা ভাষা চালু করতে। পাকিস্তানের জন্ম যেমন মুসলিমদের উপর হিন্দুদের রাজনৈতিক আধিপত্য খতম করেছে, উর্দু লিপিও তেমন হিন্দুদের সাংস্কৃতিক আধিপত্য শেষ করবে। কোরান যখন মুসলিমকে পড়তেই হবে, আর বাঙলা হরফের দ্বারা যখন কোরাণের আরবি ভাষা লেখা অসম্ভব অতএব আরবি লিপি অবশ্য জ্ঞাতব্য। সুতরাং ঐ আরবি অথাৎ উর্দু লিপি সর্বত্র চলা সঙ্গত। বাঙলাভাষার লিপি হিসাবেও যুক্তিসঙ্গত হবে উর্দুর ব্যবহার। ঐ সব প্রচারপত্রে বাঙলা লিপিকে হিন্দুসংস্কৃতির আধিপত্যবাদ তথা পূর্ব-পশ্চিম পাকিস্তানের অনৈক্যের বীজ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। অর্থাৎ উর্দু লিপির কারসাজিতে পাঞ্জাবী শাসকচক্র চেয়েছিল পূর্ববঙ্গের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য এবং পূর্ববঙ্গের হিন্দু-মুসলিম সংহতি—দুয়েরই সর্বনাশ করতে। বাঙলার সাধারণ সংস্কৃতির নামের পৌত্তলিকতা উর্দুর হাতুড়ির ঘায়ে চূর্ণ করতে হবে। কারণ ঐ সাধারণ সংস্কৃতির ধুয়া তুলে তারা পাকিস্তানের মধ্যে শত্রশিবিরের আদর্শ ছড়াতে এবং পাকিস্তানের সংহতি ধ্বংস করতে চায়।'(২৮) একটি প্রচারপত্রে এই মন্তব্যটুকু ছিল। | এই সব প্ররােচনামূলক প্রচারপত্রের পরে বিদগ্ধ লেখক ডঃ শহীদুল্লার বক্তব্য নিশ্চয়ই ক্লান্তিহরণ করবে। তুর্কীতে কামাল আতাতুর্ক আরবি লিপির স্থলে রােম্যান। লিপি চালু করে যে সাফল্য পেয়েছিলেন এবং ইন্দোনেশিয়াতেও যে অনুরূপ পরিবর্তন সাধনে সুফল ফলেছে তার উল্লেখ করে বাঙলা লিপির স্থলে উর্দু অর্থাৎ আরবি লিপি আনার তিনি বিরােধিতা করেন। আহমদ শরিফ লেখেন যে, পারস্যের
অনুসরণে ইসলামের শিক্ষা সফলভাবে প্রচার করতে হলে চাই বাঙালীর মাতৃভাষা বাঙলায় সেটি করা। (২৯)
সরকার পক্ষের এই সঙ্কীর্ণ স্বার্থপর এবং ক্রুর পরিকল্পনার ব্যাপারে একটাই আশার কথা যে, ঐ পরিকল্পনা কার্যকর হতে পারে নি। পূর্ববঙ্গের মুসলিমদেরই এ এক কৃতিত্বের কথা। কিন্তু হিন্দু-মুসলিম ঐক্য এ ক্ষেত্রেও প্রতিফলিত হয়, এই কারণে পাৱাৰী প্রশাসকরা এটি ধ্বংস করার ফন্দি আঁটতে লাগলো। হিন্দুরা, গণতান্ত্রিক আন্দোলনেও অংশ গ্রহণ করতাে। ১৯৪৯-এ ঢাকার হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মহিলারা করােনেশন পার্কে অধিকতর নাগরিক অধিকারের দাবিতে জনসভার আয়ােজন করলে সভাস্থলে প্রথমে গুণ্ডাবাহিনী পরে পুলিশও তাঁদের সম্পূর্ণ বিবস্ত্র করে সম্ভ্রমহানি করে। পুলিশ প্রথমে গুণ্ডাদের কাজেই সন্তুষ্ট ছিল। পরে তার নিজস্ব কর্তব্যজ্ঞান জেগে উঠলে তারাও ঐ মহৎ কর্মে ঝাঁপিয়ে পড়ে গুণ্ডাদের সহযােগী হয়। (৩০) আরাে একটি আন্দোলনে মুসলমান কৃষকের পাশে হিন্দু মহিলাদের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরােধ নারীসম্প্রদায়ের কৃতিত্বের পরিচয় বহন করছে। শ্রীহট্টের মুসলমান কৃষকদের এমন কি তাঁদের পত্নীদের-ও অত্যাচারী জমিদার তার ব্যক্তিগত সম্পত্তি মনে করতাে। ঐ অঞ্চলের মুসলমান কৃষকরা এই কুপ্রথার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে তার দমনকল্পে সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী প্রেরিত হয়। এই আন্দোলনের নেতৃত্বে দু’জন হিন্দুরমণীও ছিলেন। এই দুই মহিলাকে পুলিশ চুল ধরে দু মাইল দীর্ঘ ধানখেতের উপর দিয়ে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায়। (৩১) এই সংগ্রামী ঐক্যের বুনিয়াদ যে সাংস্কৃতিক ঐক্য, বহুদশকের সেই মৈত্রীবন্ধন ছিন্ন করবে এমন সহজ পন্থা সরকারের জানা ছিল না। নীরােদ চৌধুরী লিখেছেন, পােশাক এবং খাদ্যভ্যাস বা রন্ধনপ্রণালী ব্যাপারে (বাঙালী হিন্দু এবং মুসলমানের) একীভবন কিছুদূর পর্যন্ত ঘটেছে। সাহিত্যে ঘটেছে আরাে বেশি। কিন্তু লােকায়ত সংস্কৃতি এবং জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে এই মিলন সর্বাধিক। হিন্দু এবং মুসলমানরা (এই স্তরে) একই লােকগীতি গায়। একই উৎসব উভয়ের। ধর্মের ক্ষেত্রে অবধি এই মিলনের সুর লক্ষণীয়। হিন্দু দেবমন্দিরে মুসলমান কৃষক ব্রত করেন। আবার হিন্দুও গিয়ে পীরের দরগায় বা মুসলিম ধর্মানুসারে অনুরূপ কোনাে পবিত্রস্থানে মানত করেন। সেই পীর ঐতিহাসিক বা কিংবদন্তীর যাই হােন একই অনুষ্ঠান চলে। (৩২)।
যে-সংস্কৃতিক মিলনে বাঙালী লেখক শ্লাঘান্বিত পাঞ্জাবী শাসকচক্রের মলব সিদ্ধ করতে হলে সেই ঐক্য ধ্বংস না করলেই যে নয়। ১৯৪৬-এর আগষ্টে সােহরাবর্দি মুখ্যমন্ত্রী থাকা কালে কলকাতা শহরে যে হত্যালীলা চলে দুই সম্প্রদায়ের দাঙ্গার ফলে, তার অনুরূপ কিছু করতে উদ্যত হল ঐ শাসকচক্র। (৩৩)।
পাকিস্তানের জন্মের পরে ১৯৪৬-এর দাঙ্গা স্মরণ করে কিছু প্রতিষ্ঠিত হিন্দু ভারতে চলে যান। শূন্যস্থান পূরণ করে আর্থিক এবং সামজিক প্রতিষ্ঠা লাভ করেন কিছু মুসলিম।
১০
হিন্দুদের আর্থিক এবং সামাজিক প্রতিপত্তি হ্রাস পেলে অর্থাৎ হিন্দু ব্যবসায়ী এবং নানা ওরের এবং পেশার বুদ্ধিজীবী হিন্দুরা ব্যাপক ভাবে পূর্ববঙ্গ ত্যাগ করলে ঐ শূন্যস্থান পুরণের আরাে বড় সুযোেগ মুসলিমদের সামনে এসে পড়বে—এ তাে সত্যই। (৩৪) পাকিস্তান সরকারের নীতি নিয়মিতভাবে হিন্দুদের পাকিস্তান ছেড়ে যেতে বাধ্য করেছে। অথচ দেশবিভাগের অব্যবহিত পূর্বে সন্ত্রস্ত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বুদ্ধিজিীবী মানুষ (যারা অধিকাংশই হিন্দু) ভারতে চলে যেতে শুরু করলে জিন্না এবং লিয়াকৎ আলি তার নিন্দা করে বলেন, পাকিস্তানের প্রশাসন এবং অর্থনীতিকে অচল করে দেবার এই অপচেষ্টা ভারতের প্ররােচনায় ঘটছে। (৩৫) আসলে হিন্দুদের পাকিস্তান ত্যাগ করে যাওয়া তাঁদের অভিপ্রেত হলেও, এত দ্রুত এত বেশী সংখ্যায় শূন্যপদের সৃষ্টি হলে উপযুক্ত মুসলিম প্রার্থীর সংখ্যাগত অভাব দেখা দেওয়াতেই পাকিস্তানী শাসকরা অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন।
| ১৯৪৭-এ দেশভাগের পরেও পাকিস্তানে অর্থাৎ পূর্ববাঙলায় স্থায়ীভাবে বসবাসে আগ্রহী অনেক বুদ্ধিজীবী ১৯৫০ এর ফেব্রুয়ারীর সরকার চালিত বীভৎস হিন্দুনিধন স্বচক্ষে দর্শন করে, নিরাপত্তার কারণে ভারতে চলে আসেন। পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে বহু নির্যাতন এবং অপমান সহ্য করেও জন্মভূমি আঁকড়ে তাঁরা ১৯৫০ এর ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত পূর্ববঙ্গে থেকে যান। অথচ বিদেশী লেখক ক্যালার্ড লেখেন, পূর্ববঙ্গে দাঙ্গা বড়জোর ব্যতিক্রমের মতাে কখনাে ঘটলেও, মােটের উপর পূর্ববঙ্গ দেশবিভাগের পরে দাঙ্গামুক্ত এলাকা হিসাবেই রয়ে গেছে। (৩৬) ১৯৫০ এর ফেব্রুয়ারীর বিধ্বংসী দাঙ্গার কথা এই লেখক উল্লেখই করেন নি। (৩৭) | আনসার বাহিনী (ন্যাশানাল গার্ড) সাদরে গ্রহণ করতে সমাজ-বিরােধী গুণ্ডাদের। কুট্টিরা ছিল বিহারী গুণ্ডা। ঢাকার নবাবরাও এদের দিয়েই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধাতেন। সবের উপরে পয়লা নম্বরের দাঙ্গাবাজ ছিলেন পাঞ্জাবী প্রধান সচিব আজিজ আহমেদ। তিনি নিজেকেই পূর্ববঙ্গসরকার ভাবতেন। দাঙ্গাবাজ অফিসারদের পদোন্নতির ব্যবস্থা ইনিই করে দিতেন। অবশ্য এই সব কুচক্রীদের উস্কানি না পেলে সাধারণ মানুষ নীতি বিগহিত কাজ অপছন্দই করতেন। (৩৮) একসময় পূর্ব পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রী প্রভাস চন্দ্র লাহিড়ী জানিয়েছিলেন একবার লুঠ করা জিনিসপত্র তাঁর অনুরােধে দাঙ্গাকারীরা আসল মালিককে ফেরৎ দিয়েছিল। (৩৯) ক্যালার্ডের ধারণা যে কতাে ভ্রান্ত আনসার বাহিনী এবং কুট্টিদের কথা জানার পরে তা বুঝিয়ে বলার দরকার করে না।
সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের নীতিবােধ জাগ্রত হলে পূর্ববঙ্গের কেন্দ্র নির্ভর প্রাদেশিক সরকারও ব্যাপারটা লাভজনক মনে করতেন না। তাঁদের লাভ হ’ত আনসার এবং কুট্টিরা সাধারণ মুসলমান জনসাধারণের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার বিষ সংক্রমিত করলে। আনসার এবং কুট্টিরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সম্পদ ছিনিয়ে নিয়ে নিজেরা লাভবান হ’ত। শুধু নির্যাতনে তারা পরিতৃপ্তি পেত না। তাদের এই গুণ্ডামিতে মদত না দিয়ে অনেক
উদারচেতা মুসলমান ভদ্রলােক এই গুণ্ডাদল অথাৎ আনসার বাহিনীর হাতে নিগৃহীত হয়েছে। আনসাররা জানতাে সরকারের উপর মহলে তাদের এই সব বেআইনী কাজের জন্য প্রশংসা বই নিন্দা হবে না। তাই বেশ উচ্চ পর্যায়ের অফিসারকেও আনসার বাহিনী প্রয়ােজন বােধ করলে অবজ্ঞা করতাে। রাজশাহীর জেলাশাসক খন্দকার আলি তােয়েব ছিলেন পূর্ববঙ্গের মানুষ। তিনি যথাসাধ্য সংখ্যালঘুদের আগলে রাখতেন। শুণ্ডারা তাঁকে বিদ্রুপ করে বলতাে কালী তােয়েব। কালী হিন্দুদেবী; তােয়েবকে তাঁরা হিন্দুঘেঁষা বলতে চাইতাে। এই উদার অফিসারকে সচিবালয়ে সরিয়ে দিয়ে মজিদ নামে দাঙ্গাবাজ এক অবাঙ্গালীকে রাজশাহীর জেলা শাসক করা হয়। রাজশাহী জেলা জুড়ে হিন্দুদের উপর। নৃশংস অত্যাচারের পাণ্ডা এই মজিদ অনাচারী এবং নিষ্ঠুর অফিসার হিসাবে তােয়েবের প্রাতিপদিক অবস্থানে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। এর পরে এই ব্যক্তি মৈমনসিংহে বদলি হয়ে একসঙ্গে ৭ শত হিন্দু বাড়ি ক্রোক করেন। মজিদের দ্রুত উন্নতি হয়েছিল। তায়েবের হয় নি। প্রভাস লাহিড়ী মজিদের নৃশংসতার রিপোের্ট প্রধানমন্ত্রী লিয়াকৎ এবং গভর্নর জেনারেল নাজিমুদ্দিনকে পাঠান। অবশ্য ফল হয়েছিল শূন্য। (৪০) পাকিস্তানের সৃষ্টিলগ্নেই অথবা অব্যবহিত পরেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সম্ভাবনা ছিল। তখনকার মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে নাজিমুদ্দিন কিছু হিন্দু নেতাদের সঙ্গে নিয়ে সেই সময় কয়েকটি নির্দিষ্ট জেলায় সফর করে সেই সম্ভাবনাকে তখনকার মতাে দূর করেছিলেন। কিন্তু মুখ্যসচিব আজিজ আহমেদ যখন হিন্দুদের পূর্ববঙ্গ থেকে বহিষ্কার করার মলবে একের পর এক হিন্দুর বাড়ি ক্রোক করে চলেন, নাজিমুদ্দিন সে কুকাজ মেনেই নিয়েছিলেন। ভারতভাগ এবং পাকিস্তান রাষ্ট্রের উদ্ভবের প্রথম দিকে ব্যবসা, চাকুরী, বৃত্তি নির্ভর জীবিকা সর্ব ব্যাপারে হিন্দুরা গড় হিসাবে মুসলমানদের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিলেন। হিন্দু বিতাড়ন জনিত শূন্যস্থানে মুসলিমদের প্রতিষ্ঠিত করতে হলে আজিজের ঐ বেআইনী, বে-আব্র দৌরাত্ম্যের পথে অত্যল্পকালের নােটিশে হিন্দুদের ঘরবাড়ি জবরদখল বা ক্রোক করার সহজ বিকল্প ছিল না। স্কুল, কারখানা, বাসস্থানে একই ভাবে হিন্দুদের গুণ্ডা বা পুলিশ দিয়ে, প্রয়ােজনে বিনা নােটিশে, দূর করে তস্থলে মুসলিমদের প্রতিষ্ঠিত করার কোনাে বিরাম ছিল না। কোনাে অফিসার কিছু পুলিশ বা গুণ্ডার সাহায্যেই এই কাজগুলাে করতে পারতেন। ভাড়া একটা দেবার কথা থাকতাে সরকারের পক্ষে। তার মূল্য কিন্তু তুচ্ছ। প্রায়ই তা দেওয়াও হ’ত না। হিন্দুবিতাড়নের পন্থা হিসাবে এটি বেশ ধীর, দীর্ঘস্থায়ী এবং কার্যকর একটি ব্যবস্থা হিসাবে গৃহীত হয়েছিল। (৪১, ৪২)।
এই সময় ঢাকার মনিং নিউজ পত্রিকায় এই সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল যে, সরকারী অফিসার এবং কেরানিদের ঢাকায় বাসস্থানের অভাব দূর করতে আজিমপুরায় বহু অর্থ ব্যয়ে সরকার যে বাড়িগুলি তৈরি করেছে তাতে কোনাে অফিসার যেতে চাইছেন না। কারণ হিন্দুদের থেকে ক্রোক করা সুন্দর সব বাড়ি, সরকার-নির্দিষ্ট নামমাত্র ভাড়ায় তাদের
পক্ষে ঢের বেশি সুবিধাজনক (৪৩)।
| রিচার্ড সিমণ্ডস বলেছিলেন, পূর্ব পাকিস্তানের অমুসলিমরা সব চেয়ে গুরুতর যে অভিযােগ করেছেন তা তাঁদের ঘরবাড়ি নির্দয়ভাবে ক্রোক করারা সম্পর্কেই।’ (৪৪) একই প্রকার নিষ্ঠুরতার নিদর্শন সম্রান্ত ব্যক্তি এবং রাজনৈতিক নেতাকে ভারতের গুপ্তচর অপবাদ দিয়ে গ্রেপ্তার করার ক্ষেত্রেও পাওয়া গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডঃ পি, সি, চক্রবর্তীকেও এই দুর্ভোগ সইতে হয়েছিল। গান্ধী বা নেহেরুর প্রতিকৃতি রাখার কারণেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অফিসাররা তাে বটেই আনসাররাও যে-কোনাে হিন্দু বাড়ি তল্লাস করার নামে উৎপীড়ন করার ক্ষমতা রাখতাে। স্ত্রীলােকদের সম্ভ্রমহানি করাও হত। কখনােই অপরাধমূলক কিছু পাওয়া যেত না। হয়রানি করাটাই প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। পি, টি, আই প্রতিনিধিদের হয়রানি করা হ’ত নিয়মিতভাবে। সংখ্যালঘুদের উপর এই সব উৎপীড়ন মুলতবী প্রস্তাব আকারে আইনসভায় তুলতেও দেয় নি সরকারপক্ষ। ফলে অফিসারদের অবাধ সুযােগ ছিল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর লুণ্ঠন এবং পীড়ন যুগপৎ চালাবার। যশােরের কোন সময়ের জেলা শাসক এক হিন্দুব্যবসায়ীকে তাঁর চাল, আটা এবং সুড়কির সব কল বন্ধ করতে আদেশ দিয়ে বিনা রসিদে ঐ ব্যবসায়ীর কারখানাগুলাের জন্য মজুত ২০ ওয়াগান কয়লা জবরদখল করে নেন। জিন্না-লিয়াকৎ যদি হিন্দুদের পাকিস্তান ত্যাগ করাকে চক্রান্ত মনে করেন, তাকে বস্তুনিষ্ঠ বলা যাবে না। ধানখেতের ধান, পুকুরের মাছ—সবই গুণ্ডারা কেড়ে নিত। হিন্দুদের নিজস্ব ফসল ঘরে তােলা সম্ভব হ’ত
। অভিযােগ করলে অভিযােগকারীকে পুলিশের পীড়নের মুখে পড়তে হ’ত। ভারত ছেড়ে আসা মুসলিমরা এই সব ছিনিয়ে নেওয়ার দুষ্কর্মে বেশি তৎপর ছিল। তাদের তাে আর পরিচিত ব্যক্তির উপর চড়াও হবার যে চক্ষুলজ্জা সেটাও ছিল না। যে-হিন্দুরা অবস্থা কী দাঁড়াবে বুঝে আত্মরক্ষা করতে পাকিস্তান ত্যাগ করেছিলেন, তাঁরা ঐ যশােরের ব্যবসায়ীর দুর্গতি এড়িয়েছেন—এ অভিযােগ অবশ্য ঐ গুণ্ডারা করতে পারে। বিধর্মী পীড়নের ‘স্বর্গসুখ’ থেকে তাদের অন্যায় ভাবে বঞ্চিত করার মন্ত্রণা তাদের ভারত ছাড়া কে-ই বা দেবে? (৪৫)।
| ১৯৪৯ সালে নুরুল আমিন ছিলেন পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর কাছে স্মারকলিপি পেশ করে কংগ্রেস পরিষদীয় দল। ১৯৪৮ এর ১৯শে এপ্রিল ভারত-পাকিস্তান চুক্তিমতাে সংখ্যালঘু বাের্ড গঠিত হয় নি অনেক এলাকায় অথবা হলেও কোনাে সভা হয় নি। যে-সব পুরসভায় হিন্দুদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল সে-সব সরকার ভেঙে দিয়েছে। আইন শৃঙ্খলার অভিভাবকরা সংখ্যালঘুদের করা অভিযােগ কর্ণপাত করেন না। এই সমস্ত কথা ঐ স্মারক লিপিতে তাে ছিলই, এমন কি, গুণ্ডারা কীভাবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে উৎপীড়ন করে চলেছে—সে কথাও ছিল। (৪৬) অবশ্য স্মারকলিপি কোনাে কাজেই আসে নি।
পাঞ্জাবী আমলারা এবং তাদের সহযােগী মুসলিম লীগের নেতারা এবারে নিলেন এক
চরম পরিকলম্পনা। এখনাে যে মধ্যত্তি বুদ্ধিজীবী শ্রেণীভুক্ত হিন্দুরা পূর্ববঙ্গে রয়ে গেছেন তাঁদের বহিষ্কার, সীমান্ত অঞ্চলে দলবদ্ধভাবে বসবাসকারী পেশীবলে বলীয়ান্ নমঃশূদ্রদের নিধন, অবশিষ্ট হিন্দুদের হীনম্মন্য ক্লীবত্বে পর্যবসিত করা এবং অবাঙালী মুসলিমদের সম্পর্কে বাঙালী মুসলিমের সন্দেহ দূর করা এবং ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য বন্ধের অর্থনৈতিক কুফল থেকে জনসাধারণের নজর অন্যত্র ঘুরিয়ে দেওয়া—এই পাঁচদফা কর্মসূচি যে একটি মাস্টারপ্ল্যানের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়েছিল তাই হ’ল ১৯৫০-এর ফেব্রুয়ারীর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। আজিজ আহমেদ এই নরমেধযজ্ঞের হােতা পুরুষ। দীর্ঘদিন ধরে হিন্দু-নিধনের যে * মহড়া চলেছিল এই দাঙ্গাই ছিল যেন তার শেষ অঙ্ক ! (৪৭)
১৯৪৯ এর অগাষ্ট থেকে ১৯৫০ এর জানুয়ারী—এই সময়ের মধ্যে আনসার, পুলিশ, ধর্মান্ধ মুসলিম, সমাজবিরােধী এবং সামরিকবাহিনীর ঘাতকদের হাতে এবং উচ্চপদস্থ প্রশাসকদের নির্দেশে অথবা উপস্থিতিতে একের পর এক হত্যালীলা এবং আনুষঙ্গিক নারীধর্ষণের মাধ্যমে এক জঙ্গলের রাজত্ব কায়েম হয় পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন জেলায়। শ্রীহট্টের হিন্দুসম্প্রদায়, বরিশালের সংখ্যালঘু, রাজসাহীর পুঁটিয়া রাজবাড়ি, খুলনার বাগেরহাটের অন্ততঃ কুড়িটি গ্রামের সংখ্যালঘু নারী-পুরুষ, রাজশাহীর সাঁওতাল সম্প্রদায় এবং তাদের ঘরবাড়ি—এই নরপিশাচদের পৈশাচিক তাণ্ডবে পর্যুদস্ত হয়। খুলনার কালশিরার বিভিন্ন গ্রামের নমঃশূদ্রদের উপর পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট, মিলিটারি, আনসার এবং মুসলিম দাঙ্গাকারীরা বর্বরতম আক্রমণ চালায়। শ্রীহট্টের হবিগঞ্জের তফশীল সম্প্রদায়ের মানুষজন মিলিটারির জিঘাংসার শিকার হন। তাঁদের নারীদের মিলিটারি ক্যাম্পে ধরে নিয়ে ধর্ষণ করা হয়। পুরুষদের বাধ্য করা হয় পরিবারের নারীদের ঐ কাম্পের পশুদের লালসার বলি হবার জন্য প্রেরণ করতে। (৪৮) যােগেন মন্ডল কিছু অভিযোেগ করেছিলেন আইনমন্ত্রী হিসাবে। প্রধান মন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছিলেন এ সম্পর্কে তদন্ত রিপাের্ট প্রকাশের। আশ্বাসটা ছিল ভূয়া। (৪৯) বাগেরহাটের ঘটনায় জোর করে ইসলামে দীক্ষিত করাও হয়েছিল। সংবাদপত্রে এই সব কুকর্মে উস্কানি দেওয়া হয়। আইন সভায় হিন্দু সদস্যদের পঞ্চমবাহিনী বলা হয় কারণ তাঁরা এই পৈশাচিকতার অবসান চেয়ে। ছিলেন। সংবাদপত্রে গুজব ছড়ানাে হয় । কলকাতায় মসজিদ চূর্ণ হয়েছে, মুসলিমদের জোর করে হিন্দু করা হচ্ছে।”(৫০) | পাকিস্তানের ইউনাইটেড প্রেসের আবদুল মতিনকে খবরের কাগজের পাতায় মেরে ফেলা হয়। বলা হয় কলকাতায় ওঁকে হত্যা করা হয়েছে। কাগুজে মৃত্যুর কিছুদিন পরে মতিন ঢাকায় এলে তাঁকে চাপ দেওয়া হয় কলকাতার অলীক দাঙ্গা সম্বন্ধে গল্প ফাঁদার জন্য। এই চাপ দেন ঐ মুখ্যসচিব স্বয়ং। আসলে তাে মতিন কলকাতায় কোনাে দাঙ্গাই দেখেন নি। (৫১)
১৯৫০ এর ৬ এবং ৭ই ফেব্রুয়ারী অস্ত্রধারণ করে হিন্দুদের নিধন করতে উস্কানি ,
দিল ঢাকা রেড়িও। ১০ তারিখে পূর্ব এবং পশ্চিমবঙ্গের সরকারের মুখ্য সচিবরা দাঙ্গা নিরােধকল্পে বৈঠক করছিলেন। ঠিক সেই সময় রক্তমাখা শাড়ি পরে কপালে সিন্দুর হাতে শাখা পরে কিছু স্ত্রীলােক সচিবালয়ে এসে অভিযােগ করে, তাদের জোর করে হিন্দু ধর্মে দীক্ষিত করে হিন্দুর সঙ্গে বিবাহে বাধ্য করা হয়েছে। সচিবালয় ভেঙে পড়লাে গর্জন করে। ভিক্টোরিয়া পার্কে বেলা একটায় সভা ডেকে হিন্দুদের খতম করার ডাক দেওয়া হ’ল। বিদ্যুৎবেগে হিন্দুনিধনের ঢেউ ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম, বরিশাল, শ্রীহট্টে ছড়িয়ে পড়লাে। কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে ধর্মান্তরিত হয়ে হিন্দুরা প্রাণে বাঁচেন। নিখুঁতভাবে সময়সূচি মেনে এত ব্যাপক এলাকায় এই নরমেধ যজ্ঞ প্রশাসনিক স্তরের দক্ষ পরিকল্পনা ভিন্ন অসম্ভব ছিল। (৫২) ঢাকায় গণহত্যার তাণ্ডব ছিল বীভৎস। তার পরােক্ষহিসাব নিম্নোক্ত পরিসংখ্যান থেকে পাওয়া যাবে। পাকিস্তানের জন্মলগ্নে ঢাকা শহরের ৫৯ শতাংশ অধিবাসী ছিলেন হিন্দু। হিন্দুদেরই ছিল শহরের মােট সম্পত্তির ৮৫ শতাংশ। ঐ হিন্দুজনসংখ্যার ৯০ শতাংশ ‘ ৫০-এর হাঙ্গামার পরে ভারতে চলে আসেন। ঢাকা শহরে হিন্দুসম্পত্তির পরিমাণ হয় ১২.৭ শতাংশ। এই নরহত্যালীলার ফলে ঢাকা শহরে হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত স্কুল ছাত্রের সংখ্যা হয় একশ’চল্লিশ। হাঙ্গামার পূর্বে এই সংখ্যা ছিল দু’হাজার। ছাত্রীসংখ্যা বারাে শত থেকে কমে গিয়ে দাঁড়ায় ২৫। ১৯৫০ এর ১০ ই ফ্রেব্রুয়ারী হিন্দুদের দোকানগুলির ৯০ শতাংশতে লুণ্ঠন চলে। অনেক ক্ষেত্রে অগ্নিসংযােগও করা হয়। ঐ একটি দিনেই ঢাকা শহরে ৫০ হাজার হিন্দু গৃহহীন হন। ফেব্রুয়ারীর তাণ্ডবে পূর্ববঙ্গে ১০ হাজার হিন্দুকে হত্যা করা হয়েছিল। (৫৩) ১৯৫০ এর ১৭ই মার্চ পূর্ববঙ্গীয় সংসদ সদস্য মৌলবী ইব্রাহিম খান গণপরিষদে তাঁর ভাষণে হিন্দুদের জীবন এবং সম্পত্তিহানির উল্লেখ করে বলেন, হিন্দুরা কোনাে প্ররােচনা সৃষ্টি করেন নি একথা সত্য ; আমার ভ্রাতৃপ্রতিম একটি সম্প্রদায়ের প্রতি সহানুভূতি জানাতেও যা কিছু ঘটেছে। সে সবের জন্য আমার হৃদয়ে রক্ত ঝরে, লজ্জায় মাথা হেঁট হয়।
১৯৫০ এর গণহত্যার পুচ্ছপট হিসাবে উল্লেখ্য, বরিশালের তাণ্ডবের অধিকর্তা জেলাশাসক ফারুকি খােলাখুলি হিন্দুহত্যায় ইন্ধন জোগানাের জন্য অবিভক্ত ভারতের বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী সতীন সেন কর্তৃক অভিযুক্ত হন। সতীন সেনের মৃত্যু হয়। কারারুদ্ধ দশায়, ফারুকির পদোন্নতি ঘটে। হিন্দু সম্প্রদায়কে নিশ্চিহ্ন করার অভিসন্ধিতে সংগঠিত এই ভয়ঙ্কর পাশবিকতায় দুস্তর মরুতেও মরুদ্যানের সাক্ষাৎ মিলেছে। ক্ষেত্র বিশেষে মুসলমান প্রতিবেশী তাঁর পরিচিত হিন্দুবাড়িতে পূর্বাহেই হামলাকারীর তাণ্ডব শুরুর পূর্বনিদিষ্ট লগ্ন জানিয়ে দিয়ে সংশ্লিষ্ট হিন্দু পরিবারের প্রাণ বাঁচাবার জন্য নিরাপদ দূরত্বে আশ্রয় নেবার সুযােগ করে দিয়েছেন। এই ধরণের ঘটনা মানবিক মূল্যবােধের উত্তম নিদর্শন হলেও এ থেকে পরিষ্কার বােঝা যায়, দাঙ্গার গােটা ব্যাপারটাই ছিল পূর্বপরিকল্পিত। (৫৪)
।
১৫
১৯৫০ এর ৮ই এপ্রিল নেহেরু-লিয়াকৎ চুক্তি সম্পাদিত হয়। ফেব্রুয়ারীর গণহত্যা এবং হিন্দুদের উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে আশ্রয় গ্রহণের পুনরাবৃত্তি রােধে এই চুক্তি। প্রথমে রাজী না হলেও শেষ পর্যন্ত লিয়াক, দিল্লিতে এসে এই চুক্তি সম্পাদনে অংশগ্রহণ করেন। এই দিল্লিচুক্তির পরে জে, এন, মন্ডল পূর্ববঙ্গের সেই সব তফশীল শ্রেণী অধ্যুষিত অঞ্চল সফর করেন, যেখানে বিগত ফেব্রুয়ারী দাঙ্গার প্রকোপ তুলনামূলক বিচারে কম তীব্র ছিল। সশস্ত্র আনসারদের অত্যাচার, ঘনঘন ডাকাতি এবং নারী ধর্ষণ, ইউনিয়ন বাের্ড এবং জেলা বাের্ড নির্বাচনে দুই মুসলিম প্রার্থীর মধ্যে অসমর্থিত জনের রােষ—এ সবের সঙ্গে ছিল ভারতের চর অভিযােগে মামলায় জড়িয়ে উৎকোচ গ্রহণ বা ব্ল্যাকমেল করা। অর্থাৎ পুলিশ, আনসার এবং গুণ্ডাদের এই সাজানাে মামলা থেকে ত্রাণ পেতে অর্থদণ্ড বরদাস্ত করতে হত অমুসলিমদের। উদ্ধৃত অংশ জে. এন, মণ্ডলের তদন্ত রিপাের্টের সামান্য অংশমাত্র। এই রিপাের্টে আনসারদের নিরস্ত্র করা এবং অমুসলিম পুলিশ অফিসার নিয়ােগ করার মাধ্যমে সংখ্যালঘুদের কথঞ্চিৎ নিরাপত্তার ব্যবস্থার যে পরামর্শ ছিল তার কণামাত্র সরকার গ্রহণ করে নি। (৫৫) | এত শত তদন্ত করে যােগেন মণ্ডলের কোন্ মহৎ উদ্দেশ্য সিদ্ধ হ’ল? ৮ই সেপ্টেম্বর লিয়াকৎ তাঁর মন্ত্রিসভার আইন এবং শ্রম দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রীর সঙ্গে যেআচরণ করলেন তা ঐ আনসারবাহিনীর ‘ব্ল্যাকমেল’ কৌশলেরই একরূপ। একদা এই ভদ্রলােক মুসমিল লীগের পক্ষে অন্তর্বর্তী সরকারের মন্ত্রিত্ব করে গেছেন অবিভক্ত ভারতে। এ-হেন যােগেন মন্ডলকে এর পরেই দেখা গেল পাকিস্তান থেকে পলায়ন করে ভারতে আশ্রয় নিতে। উনি, ১৯৫০ এর অক্টোবরের প্রথম দিকেই লিয়াকতের কাছে তাঁর পদত্যাগপত্র প্রেরণ করলেও কীথ ক্যালার্ড না জেনে, না শুনে ঐ মর্মে ভুল অভিযােগ করেন, ‘পদত্যাগপত্র পাঠানাে হয় নি। সরকার প্রদত্ত তথ্যনির্ভর কাহিনী, কাহিনী-ই। ইতিহাস হয় না। (৫৬) ঐ পদত্যাগপত্র জুড়ে তাঁর অতীত এবং বর্তমান নানা অভিজ্ঞতার কথা ছিল। তাঁর পত্রে প্রাদেশিক মুসলিম লীগ প্রেসিডেন্ট আক্রাম খানের সর্বনাশা লেখার উল্লেখ ছিল। সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রী ডঃ এ, এম, মালিক বেতারভাষণে বলেছিলেন, ‘পয়গম্বর ইহুদীদের আরবে থেকে স্বাধীনভাবে নিজস্ব ধর্মমত পােষণের অধিকার স্বীকার করেছিলেন। তারই জবাবে ‘মােহম্মদী’ পত্রিকায় আক্রাম খান লেখেন, ‘ইহুদিদের আরব থেকে বিতাড়নের যে নির্দেশ পরবর্তীকালে পয়গম্বর দিয়েছিলেন মালিক সেকথা গ্রাহ্যই করেন নি। সংখ্যালঘুদের বিপদসঙ্কেত এই লেখার মধ্যেই জে, এন, মন্ডল দেখেছিলেন। তা ছাড়া হিন্দু বহিষ্কার নীতি পূর্ববৎ চালু ছিল বলেই সার্কেল অফিসাররা কোনাে ইউনিয়ন বাের্ডে হিন্দু সভাপতি বরদাস্ত করেন নি। তাঁকে সরিয়ে মুসলিম কাউকে সভাপতি করা হ’ত। কোনাে স্কুলে কোনাে হিন্দুকে প্রধান শিক্ষক বা স্কুল কমিটির সম্পাদক রাখা হয় নি। ফল দাঁড়িয়েছিল এই যে, ১৫০০ উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ের মধ্যে মাত্র ৫০০ স্কুলেই ।
নিয়মিত কাজ হত । হিন্দু অফিসারদের পদোন্নতি নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু তাঁদের যে-কোনাে সময় ছাঁটাই করা যেত। চট্টগ্রামে হিন্দু পাবলিকি প্রসিকিউটার কে অকারণে সরিয়ে দিলে নেলী সেনগুপ্তার প্রতিবাদেও কোন কাজ হয় নি। অনভিজ্ঞ মুসলিম কর্মচারীদের ঠেলে অভিজ্ঞ হিন্দু অফিসারের উপরওয়ালা করে দেওয়া ইচ্ছে। চুরি, ডাকাতি, ক্রীত পণ্যের মূল্য না দেওয়া বা ইচ্ছামতাে স্বল্পমূল্য দেওয়া এসবের সঙ্গে নারীহরণ, ধর্ষণ এসবও চলেছে। (৫৭) কোনাে অন্যায়ের কোনাে প্রতিকার নেই। আইনের আশ্রয়ে গিয়েও ফল নেই। যােগেন মন্ডলের পত্র সম্পর্কে প্রভাস লাহিড়ী মন্তব্য করেন, নিজ আত্মীয়পরিজনের দুর্দশায় উনি বিহবল বােধ করেন এবং পাকিস্তান ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ। করেন। (৫৮)
এই দীর্ঘ পত্রের শেষ অনুচ্ছেদের পূর্বেরটিতে তিনি উল্লেখ করেন, মুসলিম লীগের ক্ষমতাসীন কিছু ব্যক্তির কথা স্বতন্ত্র। অপর মুসলিম নাগরিকদেরও পূর্ব, পশ্চিম কোনাে অঞ্চলেই নাগরিক স্বাধীনতা নেই। খান আবদুল গফফর খান এবং তাঁরই ভ্রাতা ডঃ খান সাহিব যেমন উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে অন্যায় এবং অবিচারের শিকার হয়েছেন, পূর্ববাংলার সােহরাবর্দি এবং ফজলুল হকের ক্ষেত্রেও অবস্থা অন্যরূপ নয়। বাঙলায় লীগদলের সাফল্যের অনেকখানি কৃতিত্ব যাঁর সেই সােহরাবর্দি এবং লাহাের প্রস্তারের উত্থাপক হিসাবে যিনি একদা সর্বজনপ্রিয় ছিলেন সেই ফজলুল হকের আজ কী দশা ? সােহরাবর্দি কার্যতঃ বন্দীর জীবন যাপন করছেন। আর ফজলুল হক ঢাকা হাইকোর্টের নিঃসঙ্গ প্রাঙ্গণে আইনজীবীর সকরুণ বৃত্তিতে মগ্ন আছেন। জনসংখ্যার প্রাধান্য সত্ত্বেও পূর্ববঙ্গকে পরিণত করা হয়েছে পাকিস্তানের পশ্চিম খন্ডের উপনিবেশে। করাচির আজ্ঞাবহ পূর্ববঙ্গ আজ বড়ই ম্লান। বড়ই গুরুত্বহীন তার অস্তিত্ব।
পূর্ববঙ্গ যে পাকিস্তানের অবহেলিত অংশ – ১৯৪৮ সালের ১লা মার্চ তারিখেই গণপরিষদের আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত অধিবেশনে এই অভিযােগ করেছিলেন পূর্ববঙ্গীয় সদস্য আজিজউদ্দিন আহমেদ। পরবর্তী দিবস পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী পূর্ববঙ্গের নানা দাবির সঙ্গে সেনাবিভাগে যুক্তিসঙ্গত পরিমাণে অংশগ্রহণের অধিকারও দাবি করে কেন্দ্রীয় শাসকদের গােচরে ঐ অবহেলার প্রসঙ্গটি আনলেন। এই সব দাবি প্রাদেশিকতা মাত্র। প্রাদেশিক এবং কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যে ফারাক নেই’—এই সব ফাঁকা কথার আড়ালে মূল সমস্যাটি চাপা দিতে চেষ্টা করলেন লিয়াকৎ। যে কারসাজি করে মুসলিম লীগ কাউনসিলে জনসংখ্যার কারণে পূর্ববঙ্গের স্বাভাবিক আধিপত্য ক্ষুন্ন করেছিলেন ঐ প্রধান মন্ত্রী লিয়াকাৎ স্বয়ং তা থেকে আশঙ্কা জাগলাে সর্বত্র এই কৌশলই অবলম্বন করা হবে। পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশগুলিকে একত্র করে এক অখন্ড পশ্চিমাঞ্চল সৃষ্টির চেষ্টা লিয়াকৎ যে করছিলেন, তারও মূলে ছিলপূর্ববাঙলার তুল্যমূল্য এক শিবির রচনা। পাঞ্জাবকে কৃত্রিম উপায়ে বাঙলার সমকক্ষ করে তুলতে লিয়াকৎ পাঁচজন পাঞ্জাবীকে এবং করদ মিত্র রাজ্যের প্রধানদের
গণপরিষদে তাঁর পদাধিকার বলে সদস্য করে নিয়েছিলেন। (৫৯)
| অবশ্য মুসলিম লীগ পার্টি যন্ত্রের উপরে লিয়াকতের যে-প্রভাব ছিল শুধু তার জোরেই তিনি গণপরিষদে পূর্ববঙ্গীয় সদস্যদের আধিপত্য প্রতিহত করতে পারতেন। ঐ প্রভাব খাটিয়েই বি, পি, সিতে পূর্ববঙ্গীয় প্রতিনিধিদের সংখ্যালঘুতে পরিণত করতে পেরেছিলেন। (বেসিক প্রিনসিপিলস কমিটি কে সংক্ষেপে বি, পি, সি বলা হ’ত।) বি, পি, সি-র তিনটি উপসমিতির-ও প্রত্যেকটিতে ঐ বিষয়ে লিয়াকতের ইচ্ছারই জয় হয়। পূর্ববঙ্গীয় প্রতিনিধিরা সংখ্যালঘুতে পর্যবসিত হন। উপসমিতি তিনটির একটির ক্ষেত্র অন্যান্য বিষয়ের সংগে কেন্দ্র-প্রদেশ ক্ষমতা বিভাজনও ছিল। প্রাদেশিক সরকারের ক্ষমতা ভবিষ্যতের ফেডারেল সরকারে বাড়ানাের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন পূর্ববঙ্গীয়রা। ১৯৪৯ এর ডিসেম্বরে মুসলিম লীগের পূর্ববঙ্গীয় পরিষদীয় দল একটি অলঙ্খনীয় আদেশ জারী করলাে এই মর্মে যে, প্রত্যেক পূর্ববঙ্গীয় গণপরিষদ সদস্য পূর্ববঙ্গের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সচেষ্ট হতে বাধ্য থাকবেন। বলা হ’ল কেন্দ্রের হাতে থাকবে শুধু প্রতিরক্ষা এবং পররাষ্ট্র দপ্তর। ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং নাগরিক অধিকার খর্ব করেছিল পাকিস্তান সরকার দেশ জুড়ে। রাজনৈতিক অধিকার খর্ব করেছিল সরকার। যার ফলে মুসলিম লীগের জনপ্রিয়তা হ্রাস পেল। সাধারণের মধ্যে এমন একটা ধারণা জন্মালাে, পূর্ববঙ্গ সরকার যেন কেন্দ্রের সম্পূর্ণ বশংবদ। লােক্যাল বাের্ডের নির্বাচনে দলনিরপেক্ষ মুসলিম প্রার্থীদের কাছে অনেক ক্ষেত্রেই পরাজিত হলেন মুসলিম লীগ প্রার্থী। নির্বাচনী রায়ে ভীত হয়ে তড়িঘড়ি পূর্ববাঙলার জন্য স্বায়ত্তশাসনের দাবি তুলতে হ’ল লীগ দলকে এই সময়। পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকচক্র এবং আমলাতন্ত্র ১৯৫০ এর দাঙ্গার মাধ্যমে পূর্ববঙ্গের মুসলিমের নজর স্বায়ত্তশাসন থেকে ঘুরিয়ে দিল ঐ সাম্প্রদায়িকতার দিকে। (৬০)
References:
Speeches and Statements of Iqbal, Complied by SHAMLOO (AlManar Academy, Lahore, 1948), pp. 9-36.
C. RAHMAT ALI, The Millat of Islam And the Menace of Indianism (Cambridge, England, 1940), pp. 5-16. Also see C. RAHMAT ALI, “Menace of Indianism,” in Pakistan (Adabistan, Delhi, 1940), pp. 32, 33, 36.
R. W. SORENSEN, My Impression of India (Meridian Books, London, 1946), p. 110. TIRTHANKAR, “Where Will they Lead Us ?” (Ora Amader Kothay Niye Jaben ?) Janamat (Bengali Weekly, Dacca), 27 September 1949, p.9.
EL HAMZA, Pakistan : A Nation (Muhammad Ashraf, Lahore, 1944), p. 33.
Ibid., p. 60. Also see pp. 7-8, 32-34, 47, 60, 77, 131-32. 6. Ibid., pp. 7, 150-51.
M.R.T., Nationalism in Conflict in India (Home Study Circle, Bombay, 1942), and Pakistan and Muslim India (Home Study Circle, Bombay, 1942).
M.R.T., Nationalism in Conflict in India, pp. 26, 93, 100, 113, 179, 181, 203-4, 219, 222, 225-26, 235.
M.R.T., Pakistan and Muslim India, pp. 1-2, 9, 13-14, 59, 61-63, 103-7, 118-20, 126. Also see RAHMAT ALI, n. 2, p. 16.
ZIAUDDIN AHMAD SULERI, The Road to Peace and Pakistan (Muhamad Ashraf, Lahore, 1944), pp. 51, 66, 112. Also see K. M. Husain in Dawn (Karachi), 16 May 1944.
JAMIL-UD-DIN AHMAD, The Indian Constitutional Tangle (Muhammad Ashraf, Lahore, 1941), pp.87, 88.
M. K. GANDHI, “It’s Baffling”, in Pakistan, n. 2, p. 79. M.R.T., n. 9. p. 120. MOHAMMAD AHMAD, My Chief (Longmans, Lahore, 1960), pp. 8, 87. KEITH CALLARD, Pakistan : A Political Study (Allen and Unwin, London, 1958). p. 68. L. F. RUSHBROOK WILLIAMS, The State of Pakistan (Faber, London, 1962), pp. 138-39. RICHARD SYMONDS, The Making of Pakistan (Faber, London, 1949), p. 98.
Testimony of DR. CHARLES B. MARSHALL, Adviser to the Prime Ministers of Pakistan during 1955-57, before a Sub-Committee of the Committee on Foreign Affairs, the United States House of Representatives-Review of Mutual Security Program : Development and Implementation : Pakistan, January 21 and 22, 1959 (Wash. D.C., 1959, p. 4.
ABDUL MAJEED KHAN, “Research about Muslim Aristocracy in East Pakistan”, in Pierre Bessaignet (ed.), Social Research in East Pakistan (Asiatic Society of Pakistan, Dacca, 1960), pp. 23-24. RUSHBROOK WILLIAMS, n. 12, pp. 38-39. CALLARD, n. 12, p. 157. SYMONDS, n. 12, p. 152.
LEONARD BINDER, Religion and Politics in Pakistan (University of California, Berkeley, 1963), pp. 120-23, 129-33. CALLARD, n. 12, pp. 19-21, 131-32. SYMONDS, n. 12, p. 93. Dawn, 13 July 1947.
See, for instance, M.R.T., n. 9, pp. 96-97.
CALLARD, n. 12, pp. 5, 184. BINDER, n. 15, pp. 119, 205. SAMAR GUHA, Swadhin Purva Bangla (in Bengali ; Calcutta, 1965), pp. 8-9. JYOTI SENGUPTA, Eclipse of East Pakistan (Renco, Calcutta, 1963), pp. 21, 22, 27.
RUSHBROOK WILLIAMS, n. 12, pp. 38-39. SYMONDS, n. 12, p. 151. SENGUPTA, n. 17, pp. 30-31, 35. GUHA, n. 17, pp. 12-14.
Census of Pakistan, 1951, Vol. 1, p. 71. Constituent Assembly of Pakistan, Debates, Vol. II, 25 February 1948, pp. 15, 17.
AHMAD, n. 12, p. 8. Italics added.
CALLARD, n. 12, pp. 94, 182. Ittefaq (Dacca), 14 August 1949 (Editorial). 22. Janamat, 23 August 1949, pp. 1-2. 23. lbid., 13 September 1949, pp. 5-6.
MUHAMMAD SHAHIDULLAH, Amader Samasya (in Bengali: Renaissance Publications, Dacca, 1949).
SAROJENDRANATH RAY, “Bengali Language in Arabic Script”, Janamat, 6 December 1949, pp. 5-6. Ibid., 13 December 1949, pp. 3-4. Also see ibid., p. 1.
Ibid., 20 September 1949, p. 3. 27. Cited in Janamat, 19 September 1950, p. 9.
For these and other excerpts, Ibid., pp. 9, 11.
Ibid., 20 December 1949, p. 5. AHMAD SHARIF, “Bhashar Kotha”, (i.e., Thoughts on Language), in Hasan Hafizur Rahman (ed.), Ekushe February (i.e., Twenty-first February), Punthipatro Prokashoni, Dacca, 1965, pp. 73-74 ; in Bengali.
SENGUPTA, n. 17, p. 68. 31. Ibid., pp. 66-67.
NIRAD C. CHAUDHURI, “East Pakistan in Ferment–1″, The Statesman (Delhi), 3 August 1966.
MICHAEL BRECHER, Nehru : A Political Biography (Abridged Edition, Oxford University Press, London, 1961), pp. 121-22. TAYA ZINKIN, India (Thames & Hudson, London, 1965), pp. 74-5. Recurrent Exodus of Minorities from East Pakistan and Disturbances in India : A Report to the Indian Commission of Jurists by its Committee of Enquiry (New Delhi, 1965), p. 2; MR. PURSHOTTAM TRIKAMDAS was the Chairman of this Committee.
M.R.T., n. 8, pp. 46, 169, 173, 178-9, 180, 185-89. SULERI, n. 10, pp. 85-88, 101-5. SYMONDS, n. 12, pp 144-45. WILFRED C. SMITH, Modern Islam in India (Gollancz, London, 1946), p. 264. WILFRED C. SMITH, Islam in Modern History (Mentor Books, New York, 1959), p. 244. MURRAY T. TITUS, Islam in India and Pakistan (Y.M.C.A., Calcutta, 1959), p. 216. CALLARD, n. 12, p. 259. SAMAR GUHA, Non-Muslims Behind the Curtain of East Pakistan (Dacca, 1950), pp. 21, 83.
RUSHBROOK WILLIAMS, n. 12, p. 38. LIAQUAT ALI KHAN, Pakistan : The Heart of Asia (Harvard University Press, Cambridge, Mass., 1950), pp. 34-35,44-45. Ian Stephens, Pakistan (Ernest Benn, London, 1963), p. 224. Quaid-i-Azam Speaks (Karachi, 1949), p. 33.
For a thought-provoking analysis of factors inhibiting objective reporting these days, see NIRAD C. CHAUDHURI, The Continent of Circe (Chatto and Windus, London, 1965), pp. 22-30.
CALLARD, n. 12, p. 237.
SENGUPTA, n. 17, pp. 7, 68. GUHA, n. 17, p. 9. P. C. LAHIRY, Letter to this author dated 27 July 1966.
P. C. LAHIRY, India Partitioned and Minorities in Pakistan (Writers’ Forum, Calcutta, 1964), pp. 9-10.
Ibid., pp. 17-22.
GUHA, n. 34, p. 69. 42. The Foreign Relations Society of India, Genesis of Communal Violence in East Pakistan (New Delhi, 1950), pp. 11-21. GUHA, n. 34, pp. 21-22. The Hindusthan Standard (Calcutta), 3 April 1949.
The Foreign Relations Society of India, n. 42, p. 22. 44. SYMONDS, n. 12, p. 146. 45. The Foreign Relations Society of India, n. 42, pp. 33-39. Ian Stephens, n. 35, p. 224. RUSHBROOK WILLIAMS, n. 12, p. 38.
For a summary of this memorandum, see TRIKAMDAS, n. 33, p. 5. GUHA, n. 34, pp. 72-75. Also see SAMAR GUHA, East Bengal Minorities Since Delhi Pact (Calcutta, 1953).
P. C. LAHIRY, letter to this author dated 27 July 1966. GUHA, n. 34, pp. 82-84. GUHA, n. 46, pp. 4-5. LAHIRY, n. 39, p. 26. SENGUPTA, n. 17, p. 100.
Memorandum, 20 March 1950, submitted before the Hon’ble Prime Minister of Pakistan by Members of the opposition party (Assembly), East Bengal-in TRIKAMADAS, n. 33, Appendix II, p. 333.
J. N. MANDAL, Letter of Resignation to the Prime Minister of Pakistan, 9 October 1950-in Genesis of Communal Violence in East Pakistan, n. 42, Appendix A, p. 62.
See, for instance, The Morning news (Dacca), 30 January, 5, 10 February 1950. 51. SENGUPTA, n. 17, pp. 95-96.
Memorandum, 20 March 1950, n. 48, p. 336. Also see GUHA, n. 34, pp. 80-81.
53 TRIKAMDAS, n. 33, p. 4. Memorandum, 20 March 1950, n. 48, p. 335.J. N. MANDAL, n. 49, p. 67.
LAHIRY, n. 39, pp. 26-27.
J. N. MANDAL, Report (June 1950) to the Prime Minister of Pakistan, in Genesis of Communal Violence in East Pakistan, n. 42, Appendix B.
CALLARD, n. 12, pp. 81, 246-47. 57. J. N. MANDAL, n. 49, pp. 68-74. 58. LAHIRY, n. 39, p. 27.
BINDER, n. 15, pp. 126-28, 203-5. Constituent Assembly of Pakistan (Legislature) Debates, Vol. I, pp. 82, 127, 140-41.
Janamat, 27 December 1949, p. 1 ; 3 January 1950, p. 1. GUHA, n. 34, pp. 76-77. CALLARD, n. 12, p. 177.
Source: গনতন্ত্র এবং জাতীয়তার অগ্নিপরীক্ষা, জয়ন্তকুমার রায়, pp 1-18
অস্তমিত মুসলিম লীগ
১৯৫০ এর পূর্ববঙ্গের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা পাকিস্তানের ইতিহাসে পথনির্দেশ চিহ্ন বিশেষ। এই নরঘাতী যজ্ঞের হােতা অথাৎ এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার স্থপতি ছিলেন যাঁরা তাঁরা নিজেরাও অবহিত ছিলেন না তাঁদের কৃতকর্মের ফলে একদিন তাঁদের এ রাজ্যের রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং অর্থনৈতিক আধিপত্যকে অস্বীকার করার আন্দোলনের মুখে পড়তে হবে। অস্বীকার করার বীজ সুপ্ত আছে তাদের ঐ হিন্দুনিধন যজ্ঞের গভীরে এ তাঁরা কল্পনাও করেন নি। বর্তমান লেখক শ্রীভূপেন্দ্র নাথ দত্তের মারফৎ এ সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর যে-তথ্য লাভ করেন তার উৎস পাকিস্তানের জনৈক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। দুটি পাকিস্তানী গণপরিষদের সদস্য ভূপেন বাবু ঐ মন্ত্রীর নাম প্রকাশ করেন নি। তথ্য হ’ল এই: চৌধুরী মুহম্মদ আলি ছিলেন পাকিস্তানে সরকারের প্রথম তথা একমাত্র মহাসচিব পদে ব্রীত ব্যক্তি। এই ব্যক্তির তত্ত্ব ছিল খুবই সরল। পূর্ববঙ্গ আজ হােক আর কাল হােক পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। সুতরাং পূর্ববঙ্গের আর্থিক উন্নতিকল্পে অপব্যয় না করে ঐ প্রদেশের হিন্দু অধিবাসীদের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার চাপে পূর্ববঙ্গ থেকে সরিয়ে দিলে সেটাই হবে কাজের কাজ। (১) আমলারা হিন্দু-বিতাড়নের জন্য কারসাজি করেছিলেন পাকা হাতে। বেশ কিছু পশ্চিম পাকিস্তানী ব্যবসায়ী উচ্চবিত্ত হিন্দুদের স্থলে জমিয়ে ব্যবসা ফেঁদে বসেছিলেন, এও সত্য। তথাপি ঐ আত্মসন্তুষ্ট পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত পূর্ববঙ্গে নিয়ুক্ত আমলারা একটা হিসাব কষে দেখে নি যে, হিন্দুদের পরিত্যক্ত বহু আসনেই, বহু চাকুরীস্থলে এবং বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে পূর্ববঙ্গবাসী মুসলিমরা নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে শীঘ্রই একটি আলােকপ্রাপ্ত তথা সচ্ছল মধ্যশ্রেণীর সৃষ্টি করবে। কলেজের অধ্যাপিকা পদে মুসলিমের সংখ্যা ১৯৪৭ এর অগাস্টে ছিল নগণ্য। এক দশক পরের হিসাবে ঐ সম্প্রদায়ের নারীরই সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রতিষ্ঠিত হয়। (২)
চৌধুরী মুহম্মদ আলির মন্ত্রণা মতাে দ্রুত কিছু ফয়দা লুটে পূর্ববঙ্গের উপরে আর্থিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক পীড়নের মাত্রা বাড়িয়ে চললাে ঐ অবাঙালী আমলারা। উন্নয়নে ব্যয় না করে বরং শােষণের মাত্রা বাড়িয়েই পূর্ববঙ্গের বিচ্ছিন্ন হবার ব্যাপারটিকে আর কিছু না হােক কিছু বিলম্বিত করা যাবে – এই ছিল চৌধুরী সাহেবের তত্ত্ব। (৩) তত্ত্ব বলে একে উপাত্ত বলাই সঙ্গত। পশ্চিমাঞ্চলের পাকিস্তানীদের তুলনায় পূর্ববঙ্গের অধিবাসীর রাজনৈতিক চেতনা যে অনেক সমৃদ্ধ এবং নব্য মধ্য শ্রেণীর উদ্ভবে সেই চেতনা যে নুতন ভরবেগ লাভ করেছে এ সব ঐ আমলারা ভেবে দেখে নি। নিছক চাপের কাছে নতি স্বীকার পূর্ববঙ্গবাসীর ধাতে নেই। (৪)
পাকিস্তানের পূর্ব এবং পশ্চিম খণ্ডের ভৌগােলিক এবং সাংস্কৃতিক ব্যবধান জনিত সমস্যার সমাধানের চিন্তা না করে, পেষণ এবং পীড়নের পথে অবাঙালী শাসকচক্র ঐ সমস্যাকে চেপে দিতে চেয়েছিল। পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হলে জাতীয় সংহতি রাষ্ট্রীয় ঐক্যকে সঙ্কীর্ণ আঞ্চলিকতার ঊর্ধ্বে স্থান দিতে যে সংযম এবং নমনীয়তার প্রয়ােজন হয় তার কোনাে অভাব পূর্ববঙ্গবাসীর আচরণে ছিল না। ভারতত্যাগী অবাঙালী মুসলিম উদ্বাস্তুদের সঙ্গে আচরণে পূর্ববঙ্গবাসী তার রাষ্ট্রীয় সংহতি বােধের পরিচয় দিয়েছেন। এমন কি, রাষ্ট্রের নামকরণে অথাৎ ‘পাকিস্তান’ শব্দের বর্ণসঙ্কেতে পূর্ববঙ্গ সূচক কোন বর্ণ না থাকা সত্ত্বেও তাঁরা কোনাে প্রশ্ন তােলেন নি। আসলে ‘প’ পাঞ্জাব, আ’ আফগানিয়া অথাৎ উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, ‘ক’ কাশ্মীর, ‘স’ সিন্ধু এবং তান’ বালুচিস্তানের দ্যোতক। অথাৎ পূর্ববঙ্গ সূচক কোনাে বর্ণ রাষ্ট্রের নাম ‘পাকিস্তান’ শব্দে অনুপস্থিত। তথাপি ‘পাকিস্তান নাম মেনে নিয়েছিলেন পূর্ববঙ্গ বাসী। দেশের পশ্চিম খণ্ডের শহর করাচী রাজধানী নিবাচিত হবার ফলে যে বিপুল আর্থিক সুবিধা তার সবটুকুই তাে পশ্চিমখণ্ডের বাসিন্দারা পাবেন। এজন্য কোনাে ক্ষোভ প্রকাশ করেন নি পূর্ববঙ্গবাসী। শুধু যে ভারত ছেড়ে আসা অবাঙালী মুসলিমদের পূর্ববঙ্গ সরকারের হাজার হাজার পদে নিয়ােগ করা হয়েছিল তা নয়। পূর্ববঙ্গ সরকারের সচিব পদগুলি সহ সকল গুরুত্বপূর্ণ পদে অবঙালী মুসলিমদের নিয়ােগ করা হয়েছিল। পূর্ববঙ্গের প্রাদেশিক সরকারে পূর্ববঙ্গের স্থানীয় অধিবাসীকে কোনাে উচ্চপদ পেতে না দিয়ে কেন্দ্রীয় শাসকচক্র যে-জঘন্য পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করেছিল তার সমর্থনে যে যুক্তি দেখাতাে তা ছিল সমান জঘন্য। বলা হত। পূর্ববঙ্গে ঐ সব গুরুত্ব পূর্ণ পদে নিযুক্ত হবার মতাে যােগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থী নেই। আই, সি, এস-এর অভাব পুরণ করতে অডিট, ফরেস্ট ইত্যাদি সার্ভিসের কর্মচারীদের সি, এস, পি পদে উন্নীত করা হয়েছিল। পুলিশ সার্ভিসের ক্ষেত্রে এই সুযােগ দেওয়া হয় নি। আসলে অনেক বাঙালী আই, পি, কে ঐ সুযােগ থেকে বঞ্চিত করার চক্রান্ত করা হয়েছিল। বাঙালীদের মধ্যে তখন বেশ কিছু পুলিশ সার্ভিসের সদস্য অথাৎ আই, পি, ছিলেন। এই বাঙালী বিদ্বেষের কারণেই কেন্দ্রীয় সচিবালয়ে পাকিস্তানের জন্মের পরে কোনাে বাঙালী সচিব ছিলেন না। এ সম্পর্কে প্রশ্ন তুললে প্রশ্নকতাকেই প্রাদেশিকতা ক্লিষ্ট বলা হ’ত। প্রাদেশিকতা দোষে দুষ্ট শাসকচক্র পূর্ববঙ্গবাসীকে সমস্ত সরকারী উচ্চপদ থেকে অন্যায় ভবে সরিয়ে রেখে ঐ সম্পর্কে প্রশ্নের সম্মুখীন হলে ঐরূপ অদ্ভুত কথা বলতাে। পূর্ববঙ্গ রেলের পদস্থ অফিসার বলতে বাঙালী কেউ ছিলেন না। অন্যদিকে পশ্চিমখণ্ডের রেল বিভাগে পশ্চিমখণ্ডের অধিবাসীই সকল উচ্চ পদে নিযুক্ত হতেন। পাকিস্তান গণপরিষদে পর্যন্ত পূর্ববঙ্গের প্রাপ্য সদস্যসংখ্যার মধ্যে ছয়টি ছেড়ে দিতে হয়েছিল পশ্চিমখণ্ডের প্রার্থীদের স্বার্থে। স্বয়ং লিয়াকৎ আলি খান-ও পূর্ববঙ্গের আসন থেকে গণপরিষদে সদস্যপদ লাভ করেন। পূর্ব বঙ্গ ভিন্ন অন্য কোনাে প্রদেশ এই ভাবে আসন বন্টনে ত্যাগ স্বীকার করে নি। পূর্ববঙ্গ বাসী দেখতেন, চাকুরী থেকে গণপরিষদের আসন—সমস্ত ব্যাপারেই পূর্ববঙ্গ সকলের। অথচ অন্যান্য প্রদেশগুলির প্রত্যেকটি নিজের জন্য। (৫)
১৯৫০-এর হিন্দুনিধনের পরিণামে বিপুল সংখ্যায় হিন্দুরা পূর্ববঙ্গ ছেড়ে গেলেও, পাকিস্তানের জনসংখ্যার অধিকাংশই পূর্ববঙ্গবাসী ছিলেন। সংবিধান চালু করতে ইচ্ছাকৃত বিলম্বের কারণ ছিল এই সংখ্যাধিক্য, যার ফলে গণতান্ত্রিক বিধানে আইনসভা ইত্যাদি স্তরে পূর্ববঙ্গেরই আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হত ।(৬) এমন কি এক পৃষ্ঠার দলিলটুকু অথাৎ মূল লক্ষ্যের প্রস্তাবনা বা অবজেকটিভস রেজোলিউশান রচনা শেষ হয় ১৯৪৯ সালে। গণপরিষদে পূর্ববঙ্গের একজন হিন্দু সদস্য ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত বলেন, পাকিস্তানে এই পরিষদ দিনে মাত্র দু’ঘন্টা কাজ করে যেখানে ব্রিটেনে এই কাজ দীর্ঘ সময় ধরে চলে। এর জবাবে লিয়াকৎ দেন লােকসানাে জবাব – ‘কারণ ব্রিটেনের লােকেরা বড় বেশি বকে। অবশ্য অপর একজন পূর্ববঙ্গীয় সদস্য হামিদুল হক চৌধুরীও ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বক্তব্যে সায় দিয়েছিলেন।(৭) গণপরিষদে মুসলিম লীগের বাঙালী সদস্যদের সংখ্যার সঙ্গে আনুপাতিক হারে দরকষাকষির ক্ষমতা ছিল না। ২৬ জন মূলনীতি কমিটির সদস্যের মধ্যে বাঙালী ছিলেন মাত্র ছয় জন – তার মধ্যে তিন জন ছিলেন হিন্দু। ডাঃ মামুদ হুসেইন, ডঃ আই, এইচ, কুরেশি এবং লিয়াকৎ স্বয়ং পূর্ববাঙলার প্রতিনিধি বিবেচিত হলেও এরা প্রত্যেকেই ছিলেন অবাঙালী। অবশ্য এই কমিটির সভাপতি করা হয়েছিল একজন বাঙালীকেই। এই কমিটির অন্তর্বর্তী রিপাের্টে উর্দু একমাত্র সরকারী ভাষা হিসাবে চিহ্নিত হয়ে বাঙালী মুসলিম লীগ সদস্যদের যে লিয়াককে মেনে চলা ভিন্ন কিছু করার ছিল না তারই প্রমাণ দিল। কেন্দ্রীয় আইনসভা সম্বন্ধে ঐ রিপাের্টের দ্বিতীয় অধ্যায়ে বলা হ’ল, এর দুটি কক্ষ থাকবে। উচ্চকক্ষ বা আপার হাউসে পাকিস্তানের উভয় অঙ্গের সমপ্রতিনিধিত্ব থাকবে। নিম্ন কক্ষ বা লােকসভা হবে জনগণ দ্বারা নির্বাচিত। বিবাদ-বিসংবাদ মেটাতে উভয় কক্ষের যৌথ অধিবেশন আহূত হবে। জনগণ-নিবাচিত প্রতিনিধিরা ঠিক কী পদ্ধতিতে নিবাচিত সেকথা উহ্য রইলাে। পূর্ববঙ্গের জনসংখ্যার গরিষ্ঠতার ফল বানচাল করার এই আভাস আসলে গণতন্ত্রের উপর শাসকচক্রের প্রাধান্য বিস্তারের ছক মাত্র। স্বভাবতঃই পূর্ববঙ্গবাসী এই আশঙ্কা বােধ করলেন যে, সংখ্যাগরিষ্ঠতার শাসনের গণতান্ত্রিক বিধি লঙঘন করা হচ্ছে সংখ্যালঘু ক্ষমতাসীনচক্রের আধিপত্য কায়েম করতে। অথাৎ অদ্ভুত এক সংবিধান খাড়া করে সংখ্যালঘু পশ্চিমখণ্ডকে সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্বখণ্ডের উপর ছড়ি ঘােরানাের অনাচারকে সাংবিধানিক অজুহাতে চালিয়ে নেওয়া হবে – এটা বােঝা গেল। (৮)
১৯৫০ এর নভেম্বরে এক জাতীয় সম্মেলনে আতাউর রহমান, ফজলুল হক প্রমুখ নেতারা ঐ অন্তর্বর্তী রিপাের্ট খারিজ করে তৎপরিবর্তে দেশের উভয় অঙ্গের জন্য স্বায়ত্তশাসন দাবি করলেন। প্রতিবাদী গণ আন্দোলন দমনে ব্যাপক ধরপাকড় চললাে। অবশ্য এই আন্দোলনের চাপে পূর্ববঙ্গীয় মুসলিম লীগ বাধ্য হ’ল ঐ অন্তর্বর্তী রিপাের্টের আমূল পরিবর্তনের দাবি জানাতে। (৯)
১৯৫০ এর ২১ শে নভেম্বর গণপরিষদে ঐ রিপোের্ট সংক্রান্ত আলােচনা স্থগিত রাখার প্রস্তাব করে লিয়াকৎ এই রিপাের্টকে আরাে ইসলামিক করার ব্যাপারে জনসাধারণের মতামত আহ্বান করলেন। মূল লক্ষ্যানুগ করার কথাও বললেন একে। কিন্তু উল্লেখ-ও করলেন না পূর্ববঙ্গের প্রতিবাদের কথার। যদিও ঐ প্রতিবাদ যে বেশ জোরালাে গণপ্রতিবাদ তা তিনি ভালােই জানতেন। লিয়াকতের প্রস্তাবিত ইসলামীকরণ সংখ্যালঘু হিন্দু এমন কি আহমাদি মুসলিমদেরও নিরাপত্তা ব্যাহত করেছিল – এ কথা পরে আলােচনা করা হবে। জনৈক পূর্ববঙ্গের মুসলিম লীগ সদস্য নূর আহমেদ এই সময় ঐ স্থগিত রাখাটা ভালাে হচ্ছে বলে মন্তব্য করলেন, পূর্ববঙ্গে এই সন্দেহ দানা বাঁধছে যে অন্তর্বর্তী রিপাের্ট কার্যকর হলে তা আসলে পূর্ববঙ্গকে উপনিবেশ বানিয়ে ছাড়বে। অতি দ্রুত নুর আহমেদ যােগ করলেন তিনি নিজে ঐ সন্দেহ করেন না। শুধু নূর নন, পুরাে পূর্ববঙ্গীয় মুসলিম লীগই যেন শাসকচক্রের আজ্ঞাবহ সেবাদাসে পরিণত হয়েছিল। (১০)।
পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল ১৯৪৮ সালে ২৭ টি এবং ১৯৪৯ সালে ২০ টি আদেশনামা বা অর্ডিনেন্স জারী করেন। ভারত সরকার বিলের দ্বিতীয় সংশােধনীতে ৩১ শে ডিসেম্বরের পরে জারী আদেশ আইন সভার অধিবেশন ফের শুরু হবার ছয় সপ্তাহের মধ্যে বাতিল বলে গণ্য করা হবে যদি আইন সভা তাকে প্রত্যাখ্যান করে। মুসলিম লীগ ব্রিটিশ ভারতে অনুরূপ অগণতান্ত্রিকভাবে চাপানাে অর্ডিনেন্স-এর বিধির বিরােধিতা করে গণ আন্দোলনে নেমেছিল। এই প্রকার গণআন্দোলন তার পক্ষে ছিল এক অনন্যসাধারণ পদক্ষেপ। বর্তমান বিলের প্রশ্নে মুসলিম লীগ আইন সভায় আদেশনামা পেশ করারই প্রয়ােজন দেখলাে না। হিন্দু সদস্যদের মধ্যে অধ্যাপক রাজকুমার চক্রবর্তী প্রমুখ বিলটিকে ৩১ সে ডিসেম্বর ১৯৪৯ এর পূর্বে জারী নিরাপত্তা-ঘটিত আদেশনামাগুলির সম্বন্ধে প্রয়ােগ করার প্রস্তাব দিলে মুসলিম লীগ বিরুদ্ধে ভােট দেয়। যে-দুজন অবাঙালী মুসলিম এই বিলের বিরােধিতা করেছিলেন রাজকুমার বাবুর সংশােধনী প্রস্তাবের সময় তাঁরাও পাশ কাটান। পূর্ববঙ্গের মুসলিম লীগ তার কর্তাভজা চরিত্র প্রকাশ করে পূর্ববঙ্গে জনপ্রিয়তা অনেকটাই হারালাে।(১১)
এই বিল পাশ করে আমলাতন্ত্র প্রমাণ করলাে রাজনীতিকদের উপরে তার প্রভাব কতাে বেশি। আমলাতন্ত্র এখানেই থেমে থাকে নি। অন্তর্বর্তী রিপাের্ট স্থগিত রাখা এবং টিমে তালে হলেও একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান রচনার প্রয়াস – এই দুটি কারণে আমলাতান্ত্রিক চক্র লিয়াককে বাঙালীদের প্রতি সহানুভূতিশীল মনে করলাে। লিয়াককে হত্যা করার পশ্চাতে এই চক্রের প্রশ্রয় ছিল এই সন্দেহ জাগে নানা কারণে। যে-পুলিশ অফিসার লিয়াকতের আততায়ীকে তৎক্ষণাৎ গুলি করে হত্যা করে তার সঙ্গে সঙ্গে পদোন্নতি হয়। পদোন্নতি হয় সেই সব পাঞ্জাবী আমলার যাদের সঙ্গে ঐ গুপ্তহত্যার সংস্রব সন্দেহ করা হয়েছিল। তা ছাড়া লিয়াকতের গুপ্ত হত্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তদন্ত রিপাের্ট ইত্যাদিও এক বিমান দুর্ঘটনায় লােপাট হয়ে গেলে, বিমান দুর্ঘটনার কোনাে তদন্ত হয় নি। লিয়াকৎ পত্নীও তাঁর স্বামীকে হত্যা করার পশ্চাতে আমলাদের সংস্রব সন্দেহ করে নানা জনসভায় ভাষণ দিয়েছেন। অবশেষে এই মহিলাকে রাষ্ট্রদূতের পদে অধিষ্ঠিত করে তাঁর। মুখ বন্ধ করা হয়। (১২)
লিয়াকতের মৃত্যুর পরে বাঙালী নাজিমুদ্দিন হলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। ভীরু এই ব্যক্তিকে চালিয়ে নেওয়া সহজ হবে ভেবে ইনি বাঙালী হলেও এঁকে পাঞ্জাবীরা মেনে নিলেন। অসুস্থ গুলাম মহম্মদকে সামলানাে সহজ হবে ভেবে বাঙালীরাও ওঁকে গভর্নর জেনারেল পদে মেনে নিলেন। বাঙালীদের হিসাবে ভুল ছিল। তবে পাঞ্জাবী আমলাতন্ত্র প্রকৃতই নাজিমুদ্দিনের দুর্বলতার সুযােগে নিজেদের অভিসন্ধি পূর্ণ করেছিল। (১৩) * ১৯৪৮ এ ছাত্ররা যখন বাঙলাভাষাকে সরকারী ভাষা হিসাবে গণ্য করানাের দাবিতে তখনকার মুখ্যমন্ত্রীর ঢাকার বাসভবন ঘেরাও করেন, মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে নাজিমুদ্দিন সেদিন ছাত্রদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়ে ১৯৫২-র ২৬ শে জানুয়ারী সেই নাজিমুদ্দিন ঐ ঢাকাতেই ঘােষণা করলেন, উর্দুই হবে একমাত্র সরকারী ভাষা। সেক্ষেত্রে বাঙালীদের উর্দু না জানার অজুহাতে সরকারী চাকুরী থেকে আরাে বেশি বঞ্চিত করা হবে। স্টেট ব্যাঙ্কের গভর্নরও ঐ একই দিনে বিজ্ঞপ্তি জারী করেন যে, এখন থেকে চেকেও উর্দু ব্যবহৃত হবে। নাজিমুদ্দিনের ডােল বদলে ছাত্র সমাজ অবিলম্বে প্রতিবাদ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রয়ােজন অনুভব করলাে। (১৪)
নাজিমুদ্দিনের ১৯৫২ র ২৬ শে জানুয়ারীর বিবৃতি পূর্ববঙ্গের জনগণকে মুসলিম লীগ সম্বন্ধে বীতশ্রদ্ধ এবং বাঙলাভাষার মর্যাদারক্ষায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ করলাে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের উদ্যোগে বৃহত্তর প্রতিরােধ আন্দোলনের প্রস্তুতি চললাে। সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে পশ্চিম খণ্ডের এই আগ্রাসন অথাৎ উর্দুকে জোর করে চাপিয়ে দিয়ে বাঙলা ভাষার মর্যাদা হানির উদ্ধত অনাচার ছাত্রসম্প্রদায় তথা সাধারণ মানুষ যে-কোনাে মুল্যে প্রতিহত করতে সঙ্কল্প গ্রহণ করলাে। ১৯৫২র ২১ শে ফেব্রুয়ারী ছাত্র বিক্ষোভকারীদের উপর কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়া হয়। মিছিলে চলে গুলি- দু’জন ছাত্র তৎক্ষণাৎ মৃত্যুবরণ করেন। অবস্থা বেগতিক দেখে পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিন ২২ শে ফেব্রুয়ারী উদ্যোগ নিয়ে প্রাদেশিক আইনসভার পক্ষে এক প্রস্তাবে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে দাবি জানালেন বাঙলাকেও সরকারী ভাষার স্বীকৃতি দিতে হবে। কয়েক সপ্তাহ ধরে ছাত্র এবং জনসাধারণ ভাষা আন্দোলনের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। দুটো দিন আগে নুরুলের চৈতন্যোদ্য হলে দুটি তাজা প্রাণ এভাবে ঝরে যেত না। নুরুল এবং দলগত ভাবে মুসলিম লীগ ভাষা আন্দোলনের মধ্যে কমিউনিস্ট এবং ভারতীয় প্রভাবের কথা রটনা করে সাধারণের বিশ্বাসে ভাঙন ধরাতে ব্যর্থ হন। সংস্কৃত থেকে উৎপন্ন এই ভাষা হিন্দু সংস্কৃতির বাহক’এমন কথা প্রচার করতে শুরু করলেন মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ। কথাটা অমূলক। বাঙলা ভাষার প্রায় অর্ধেক শব্দ আরবি, ফারসি এবং উর্দুভাষাজাত। বাঙালীর সংস্কৃতি ধর্মভেদে দ্বিধাবিভক্ত নয়। হিন্দু মুসলমানের ঐক্যবদ্ধ ভাব-ভাবনা, জীবন-বেদ এই সংস্কৃতির প্রাণ। মাত্র ৭.২ শতাংশ লােকের ভাষা উর্দু অথচ ৫৪.৬ শতাংশ পাকিস্তান বাসীর ব্যবহার্য ভাষা বাঙলা। ১৯৫১-এর আদমসুমারির নিরিখে বাঙলা ভাষাকে অন্যতম সরকারী ভাষা করার দাবি নিতান্তই বিনীত। অবশ্য নুরুল আমিন প্রমুখ নেতারা এটা বুঝেও বুঝেছেন বলার সাহস পেলেন না। (১৫)
২১ শে ফেব্রুয়ারি পুলিশী তাণ্ডবের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কায় ২২ শে ফেব্রুয়ারি প্রাদেশিক আইনসভায় ভাষা আন্দোলনের লক্ষ্য সমর্থন করে প্রস্তাব গ্রহণ করলেও মুসলিম লীগের বাঙালী নেতৃত্বাংশও পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকচক্রের প্রতি দাসমনােভাব দেখাতে বাধ্য ছিলেন। অবশ্য আন্দোলনের প্রতিঘাতে গোঁড়া মুসলিম লীগ পন্থী দৈনিক আজাদ’, ঐ আন্দোলনের যথাযথ প্রতিবেদন পেশ করেছিল। পত্রিকার সম্পাদকও মুসলিম লীগ সংসদীয় দল থেকে পদত্যাগ করেন। পুলিশী নৃশংসতার যে-সব তথ্য তাঁর কাগজে ছাপা হয়েছিল তার পরিণামে তাঁকে এ সিদ্ধান্ত নিতে হয়তাে বাধ্য করাই হ’ত। ১০ ই এপ্রিল, ১৯৫২ গণপরিষদে মুসলিম লীগের পূর্ববঙ্গশাখার চরিত্র উদ্ঘাটিত হয়। যে-কারণেই হােক নুর আহমেদ ভাষা আন্দোলনের উদ্যোক্তাদের দাবিকে প্রস্তাব আকারে রেখে বাঙলাকে অন্যতম সরকারী ভাষা হিসাবে গ্রহণ করার অনুরােধ করলে, সে প্রস্তাবের বিবেচনা অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত রাখার আদেশ হ’ল। পশ্চিমখণ্ডের ক্ষমতাচক্রের ভয়ে নুরুল, নূরকে। বক্তৃতা করে তাঁর রাখা প্রস্তাব সমর্থন করতে নিষেধ করলে প্রগতার জন্য বিখ্যাত নূর তৎক্ষণাৎ চুপ করে গিয়েছিলেন। নুরুল, পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হলেও গণপরিষদের সদস্য ছিলেন। ঐ সময় ঐ পরিষদই ছিল কার্যতঃ পাকিস্তানের সংসদ। পিরজাদা আবদুস সাত্তার আবদুল রহমানের তােলা যে- প্রস্তাবে নূর আহমেদের প্রস্তাব স্থগিত রাখতে বলা হয়েছিল, পশ্চিমাঞ্চলের শাসকচক্রের তাতে সায় ছিল। তথাপি ফজলুল হক এই স্থগিত প্রস্তাব সম্পর্কে বিদ্রুপ করেও তাঁর সমর্থন জ্ঞাপন করেন এই কারণে যে, নুরের প্রস্তাব স্থগিত রেখে পূর্ববঙ্গীয় সদস্যদের অপ্রস্তুত দশায় পড়াটা এ যাত্রা রক্ষা পেল। বিবেকের অনুশাসন ছাড়াও শাসকচক্রের প্রতি আনুগত্যের নিগড়ে বাঁধা এই সব সদস্য হয়তাে ভােট দিতেন নূরের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে। সুতরাং স্থগিত – প্রস্তাব মন্দের ভালাে হয়ে এসেছে। নুরুলের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে পূর্ববঙ্গীয় হিন্দু সদস্যরা সেদিন বাঙলাভাষার দাবির পক্ষে ক্ষুরধার যুক্তির অবতারণা করলে, নুরুল প্রথমে বলেন, এই হিন্দু সদস্যরা এমন ভাবে কথা বলছেন যে তাঁরাই যেন বাঙলা ভাষার একমাত্র অছি এবং স্রষ্টাও।’ নুরুল এর পরে বলেন, হিন্দুর বাঙলা আর মুসলমানের বাঙলা ভাষা হিসাবে আলাদা। হিন্দুর জল মুসলমানের ‘পানি’ তার দৃষ্টান্ত। আসলে নুরুল গুলিয়ে দিতে চেয়েছেন সব কিছু। উত্তর ভারতের হিন্দুরাও ‘পানি’ বলে থাকে। মুসলিম লীগের কর্তাভজাদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে নূর যে কাণ্ডটি করলেন সংসদীয় ইতিহাসে তা এক বিশ্বরেকর্ড। তাঁর নিজের উত্থাপিত প্রস্তাবের বিবেচনা এখন করারই প্রয়ােজন নেই, ওটা স্থগিত থাক – এই মত তিনিও নির্লজ্জের মতাে প্রকাশ করে দোষস্থান করলেন।(১৬)।
এক অশ্রুতপূর্ব স্বৈরাচারী বিল এপ্রিল, ১৯৫২ তে খাজা নাজিমুদ্দিনের প্রধান মন্ত্রিত্বকালে উপস্থিত করা হল। যে-কোনাে মন্ত্রী যে-কোনাে ব্যক্তিকে এক বছরের জন্য গ্রেপ্তার করার হুকুম দিতে পারবেন। গ্রেপ্তার যিনি হলেন তাঁকে কারণ জানানাে হবেনা। তিনি কোনাে আদালতে এর বিরুদ্ধে বিচার চাইতে পারবেন না। এক উপদেষ্টা কমিটি বৎসরান্তে ঐ আটক ব্যক্তির প্রশ্নটি বিবেচনা করতে পারেন। কিন্তু বৎসর শেষ হবার মুখে দু’চার দিনের জন্য ঐ ব্যক্তিকে ছেড়ে দিয়ে ফের ঐ নিরাপত্তা আইনে তাঁকে গ্রেপ্তার করা যেতে পারে। এভাবে অনির্দিষ্টকাল বিনা বিচারে আটকের হয়রানির সুযােগকে দেশের নিরাপত্তার পক্ষে প্রয়ােজনীয় মনে করলেন পূর্ব বঙ্গের মুসলিম লীগপন্থী গণপরিষদ সদস্যরাও। অবশ্য পাঞ্জাবের শৌকত হায়াৎ খান এই বিলের বিরােধিতা করেছিলেন। অধ্যাপক রাজকুমার চক্রবর্তী সংশােধনী প্রস্তাব এনে ঐ বিলের সর্বনাশা দিকটিকে একটু প্রশমিত করতে চেয়েছিলেন। তাঁর সকল সংশােধনীই প্রত্যাখ্যাত হয়। নাগরিক অধিকারের উপর এরূপ উন্মত্ত আক্রমণ যে বিলের লক্ষ্য তাকে পাশ করাও হয় তড়িঘড়ি। (১৭) | পূর্ববঙ্গের মুসলিম লীগকে তল্পিবাহকে পরিণত করে পাকিস্তানের অবাঙ্গালী শাসকচক্রের উদ্যোগ এবারে অন্যান্য দল এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ঐক্য ধ্বংস করার মধ্যে নিহিত হ’ল। বঙ্গীয় প্রাদেশিক আইনসভাকে ধর্মীয় মেলার মতাে রঙ বেরঙে বিভক্ত করতে চেয়ে সাধারণ হিন্দু, তফসীল হিন্দু, খৃষ্টান, বৌদ্ধ প্রতি সম্প্রদায়ের জন্য পৃথক নির্বাচনী ব্যবস্থা করা হ’ল। যদিও তফসীল ফেডারেশন ১৯৪৯ এর নভেম্বরে এবং পূর্ববঙ্গ । আইনসভার হিন্দু সদস্যগণ ১৯৫১ র মার্চ মাসে যৌথ নির্বাচনী ব্যবস্থা দাবি করেছিলেন। সংখ্যালঘুরা নিজেরা তাঁদের স্বার্থ রক্ষার্থে যা চায় নি, সরকার তা চাপিয়ে দিতে এগিয়ে এল কেন? বিশেষতঃ পাঞ্জাব এবং সিন্ধু প্রদেশে তফসীলী এবং সাধারণ হিন্দুদের নিবাচনী ব্যবস্থা এক এবং অভিন্ন হওয়া সত্ত্বেও পূর্ববঙ্গের জন্য এই বহুধা বিভক্ত বন্দোবস্তের একমাত্র কারণ ছিল সরকার বিরােধী রাজনীতির মধ্যে বিরােধের বীজ উপ্ত করা। তা ছাড়া শাসকচক্রের পরম অনুগত মুসলিম লীগের হয়তাে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি থেকে কিছু সুবিধা হলেও হতে পারে এমন ভাবনা শাসকচক্র করে থাকবে। জনপ্রিয়তা নাশের ফলে ‘ আগামী কোনাে নির্বাচন-ই যে মুসলিম লীগের পক্ষে সুখকর সংবাদ বয়ে আনবে না – এটুকু ঐ ধূর্ত চক্র ভালােই বুঝতাে। (১৮)
সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের শাসকচক্রের জোর করে চাপিয়ে দেওয়া পৃথক নিবাচনী বিলের সমালােচনা করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যরা বলেন, এ হল সংখ্যালঘুদের নিকৃষ্ট শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করার ছল। এ কথাও তাঁরা বললেন, ‘গণতন্ত্র ধ্বংস পাবে। এর ফলে। সাম্প্রদায়িকতা এবং একদলের একনায়কত্ব দেখা দেবে। জাতীয় সংহতিরও ক্ষতি করবে পৃথক নির্বাচনী ব্যবস্থা। উপনিবেশবাদীদের সেই সাবেকী কৌশলে জনগণের ঐক্যে ফাটল ধরিয়ে শাসন কায়েম করার পুনরাবৃত্তি এই বিলে নিহিত।’ (১৯)
নুরুল আমিন পৃথক নিবাচনী বিলের সমর্থনে বলেন, অনুন্নত সম্প্রদায়ের কোনাে প্রতিনিধি যৌথ নির্বাচনী প্রথায় আইন সভায় আসতে পারেন নি কোনাে দিন। সঙ্গে সঙ্গে ঐ সম্প্রদায়ভুক্ত প্রেমহরি বর্মা প্রতিবাদ করে জানান, তিনি অবিভক্ত বাঙলার আইনসভা সদস্য ছিলেন। এরপর নুরুলের অপ্রাসঙ্গিক এবং অশালীন বক্তব্যে না গিয়ে জাফরুল্লা খানের বক্তৃতার কথা বলা যাক। ইনি মান্ধাতার আমলের অপ্রাসঙ্গিকতা ভুলে গিয়ে বর্তমান পরিস্থিতিতে শূদ্রদের অনুন্নত সম্প্রদায়ের অন্তর্গত করতে বলেন। বেদ, স্মৃতি, নানা পুরাণ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে জাফরুল্লা খান ব্রাহ্মণ এবং শূদ্রের পার্থক্য ব্যাখ্যা করেছিলেন। জনৈক হিন্দু সদস্য অবশ্য এঁদের উৎসাহে ভাটা পড়ে এমন কিছু বলেন। জিন্নার মত উদ্ধৃত করে ইনি বলেন, “তা হলে জিন্না সাহেব তফসীল জাতিকে পৃথক না বলে হিন্দুজাতিরই অংশ বলেছেন। জিন্নার মত গ্রহণ করলে তাে তফসীল এবং সাধারণ হিন্দুদের পৃথক নির্বাচন চিন্তা করা চলে না। (২০)
| ভারত সরকার তৃতীয় সংশােধনী বিলে পাঞ্জাবীদের জন্য প্রতি এক লক্ষ চার হাজার নাগরিক পিছু একটি প্রাদেশিক আইনসভা আসনের বরাদ্দ হলেও পূর্ববঙ্গের জন্য এক একটি আসনে এক লক্ষ চল্লিশ হাজার নাগরিককে ঠাসা হ’ল। প্রাদেশিক আইনসংখ্যায় জনসংখ্যা বিচারে আসনহ্রাস হয়তাে ভবিষ্যতে কেন্দ্রীয় আইনসভায় অনুরূপ হ্রাসের পূর্বসঙ্কেত, এমন আশঙ্কার কারণ থাকা সত্ত্বেও মুসলিম লীগ এ ব্যবস্থা মেনে নিল। পৃথক নির্বাচনী ব্যবস্থার ফলে অবস্থাপন্ন হিন্দুদের আর উৎসাহ রইলাে না পূর্ববঙ্গে বিনিয়ােগ করার ব্যাপারে। এর ফল পূর্ববঙ্গের দীন অর্থনীতির পক্ষে নিশ্চয়ই শুভ হয় নি। এদিকে সংখ্যালঘুর সঙ্গত আশঙ্কা দূর করার বদলে সংখ্যাগরিষ্ঠরাই দাবি করলাে তাদের কাছে এমন আচরণ যাতে সংখ্যাগরিষ্ঠদের মন থেকে সংখ্যালঘুদের সম্বন্ধে আশঙ্কা- অবিশ্বাস দূর হয়। (২১)।
করলেন। ৪০০ সদস্যের লােকসভা দেশের উভয় অঙ্গ থেকে সমসংখ্যক প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত হবার কথা এবং হাউস অব ইউনিটস- এ ১২০ জন অনুরূপ সমবিভাজন নীতিতে সদস্যপদ লাভ করতে পারবেন – রিপাের্টে এই তথ্য ছিল। হাউস অব ইউনিটস-এর প্রয়ােজনীয়তা এবং দুই কক্ষে বিবাদ-বিসংবাদ মিটিয়ে নেবার ব্যবস্থা – এর কোনােটিরই ব্যাখ্যা ঐ রিপাের্ট ছিল না। (২২)
পাঞ্জাবী চক্র সমতা নীতিটুকুকেই তাদের একাধিপত্যের পক্ষে যথেষ্ট মনে করলাে । যতাে হােক নটি খণ্ডে বিভক্ত পশ্চিমাঞ্চল, পূর্বাঞ্চলের ঐক্যবদ্ধ সাংসদদের পাশে অসুবিধা বােধ করবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দিন আবার পশ্চিমাঞ্চলের অন্যান্য প্রদেশে পাঞ্জাব-বিরােধী মনােভাব জাগাতে প্ররােচনা দিয়ে থাকেন। আশার কথা, নাজিমুদ্দিনের অন্তরঙ্গ ফজলুর, গুলাম মুহম্মদের চক্ষুশূল। এই বিদ্বেষটা কাজে লাগিয়ে হয়তাে গুলামকে দিয়ে নাজিমুদ্দিন মন্ত্রিসভা খারিজ করা যাবে – এমন মৎলব করলাে পাঞ্জাবী চক্র। মুসলিমদের একটি ক্ষুদ্র শাখা বা সেক্ট আহমাদি সম্প্রদায়। তাদের বিরুদ্ধে দাঙ্গা বাধিয়ে, পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী দৌলাতানা দাঙ্গার দায় চাপালেন নাজিমুদ্দিনের উপর। এটা হ’ল ১৯৫৩ র মার্চ-এপ্রিলের কথা। নাজিমুদ্দিন মন্ত্রিসভা বরখাস্ত করলেন গভর্নর জেনারেল গুলাম মুহম্মদ। পূর্ববঙ্গের এম, সি, এ-দের নিকট সুবিধা আদায়ের পরিস্থিতি এবারে হাতে এল পাঞ্জাবীদের। (২৩)
আহমাদি-নিধন পর্বের নেপথ্য কাহিনী পাঞ্জাবীচক্রের ক্রুর চক্রান্তের কাহিনী। ১৯৫২-র জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে এই কাহিনীর মূলসূত্র খুঁজতে হবে। পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী দৌলাতানার সমর্থন নিয়ে, ঐ সরকারের বয়স্কদের নিরক্ষরতা দূরীকরণের জন্য বরাদ্দ অর্থ সংবাদপত্রদের মত ক্রয় করার কাজে ব্যবহার করা হয়। সংবাদপত্র-উলামা সমস্বরে আহমাদিদের অমুসলিম ঘােষণা করার দাবি তুললাে। উলামাদের প্রতিনিধিদল প্রধান মন্ত্রী নাজিমুদ্দিনের কাছে একই দাবি পেশ করলাে। এমন কি, আহমাদি মুসলিম জাফরুল্লা খানকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী পদ থেকে বরখাস্ত করার দাবিও তােলা হ’ল। পাঞ্জাব প্রাদেশিক মুসলিম লীগ পূর্বেই আহমাদি-বিরােধী প্রস্তাব পাশ করেছিল। ১৯৫৩-র ৬ ই মার্চ পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী দৌলাতানা ঘােষণা করলেন, পাঞ্জাব সরকার আহমাদি-বিরােধী আন্দোলনকে যুক্তিসঙ্গত মনে করে। একজন প্রাদেশিক মন্ত্রীকে এই সম্পর্কে আলােচনা করতে শীঘ্রই কেন্দ্রীয় সরকারের সমীপে পাঠানাে হবে। (২৪) | একই মুসলিম লীগ দলের কেন্দ্রীয় সরকার করাচিতে প্রতিষ্ঠিত ছিল। তথাপি পাঞ্জাবের মুসলিম লীগ এবং পাঞ্জাবের প্রাদেশিক সরকার, কেন্দ্রীয় সরকারের আদেশ লঙঘন করে ঐ দাঙ্গা প্রতিহত না করে তাতে ইন্ধন জুগিয়ে চললাে। দৌলাতানা স্পষ্ট জানালেন, নাজিমুদ্দিনের ঐ মূলনীতি রিপোের্ট তিনি মনে-মনে মানেন না। দাঙ্গা থামাতে শেষে সেনাবাহিনীকে নামাতে হয়। লাহােরে মে মাসের মধ্যভাগ অবধি সামরিক শাসন চালু ছিল। বাঙালীরা নাজিমুদ্দিন রিপাের্টে যথেষ্ট কূপকাৎ হয় নি বলেই নাজিমুদ্দিনকে সরিয়ে দেবার গূঢ় উদ্দেশ্যে এই আহমাদি বিরােধী দাঙ্গার আগুন জ্বালা হয়েছিল। (২৫) | রাজনৈতিক চক্রান্ত সম্বন্ধে অবহিত হ’য়েও নাজিমুদ্দিন কেন প্রথমেই আহমাদি বিরােধী দাঙ্গাকে আইন-শৃঙ্খলার সমস্যা গণ্য করে কঠোর হস্তে দমন করেন নি? আসলে নাজিমুদ্দিনের বি, পি, সি বা মূলনীতি রিপাের্টও ধর্মান্ধ উলামাদের এবং ইসলামের বিধি নিষেধকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দিয়েছিল। ইসলামের নামে ধর্মান্ধরা এবং উলামারা এখন তাঁকে অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে ফেললেও তাঁর কিছু করার ছিল না। উলামার বিচারে তিনি ইসলাম বিরােধী হয়ে গেলে তাঁর যে আরাে বড় বিপদে পড়তে হবে! এতএব ধীরে চলা বই পথ ছিল না তাঁর। (২৬)
পাকিস্তানকে ইসলামিক রাষ্ট্র গণ্য করা এবং কোরান ও সুন্নার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এই বাণিজ্যিক তথা প্রযুক্তিনির্ভর যুগের সংবিধান রচনা করা এবং একই সঙ্গে জনসাধারণকে প্রীত করতে গণতন্ত্রের কথা বলা – এত সবের মধ্যে সঙ্গতি রক্ষা করা যায় । তা ছাড়া খলিফা তাে পাকিস্তানের নন, সকল মুসলমানও পাকিস্তানের অধিবাসী নন। তা হলে তাে ইসলামিক রাষ্ট্রের সংজ্ঞানুসারে পাকিস্তানকে ইসলামিক রাষ্ট্র ভাবাই যায় না। ইসলামের জয়জয়াকারের ঐতিহাসিক কাহিনী কল্পনা করে সরলচিত্ত নাগরিকদের ধর্মীয় উন্মাদনায় প্ররােচিত করার গঢ় উদ্দেশ্য সহজেই অনুমেয়। আহমাদি নিধন ঠেকাতে উলামাকে খােসামােদ করেও নাজিমুদ্দিনের লাভ হয় নি। অথচ ঐ হত্যালীলা বন্ধ করতে না পারার অজুহাতে ১৯৫৩-র ১৭ ই এপ্রিল নাজিমুদ্দিন মন্ত্রিসভাকে বরখাস্ত করে দিলেন গভর্নর জেনারেল গুলাম মুহম্মদ। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। মুহম্মদের পরবর্তী কালে ইসলামিক সনাতন বিধিনিষেধে কোনাে সংযােজনের দৃষ্টান্ত নেই। শারিয়া – বিধি আধুনিক ব্যক্তিস্বাধীনতা তথা গণতান্ত্রিক মূল্যবােধের পরিপন্থী। সীমাহীন ক্ষমতার অধিকার বর্তায় রাষ্ট্রনেতার উপরে। এই ইসলামিক ধ্যান-ধারণার সঙ্গে আধুনিক গণতন্ত্র খাপ খায় না। (২৭)। | নাজিমুদ্দিন – কথিত ইসলামিক রাষ্ট্রব্যবস্থা এলে উলামা অন্তহীন ক্ষমতালাভ করবে। ব্যক্তিস্বাধীনতার উল্লেখ ছিল নাজিমুদ্দিনের আমলের মূলনীতি প্রস্তাবনায়। উলামা এর মধ্যে ইসলাম – বিরােধী ভাব ছাড়া আর কিছু দেখে নি। তা ছাড়া, শিয়া, সুন্নি, বারেলভি । এবং দেওবান্দি গােষ্ঠীগুলাের প্রত্যেকটি অপরগুলিকে কাফির বা ইসলাম -বহির্ভূত গােষ্ঠী। ভাবে। ইসলামিক রাষ্ট্রের দ্বারা বিজিত রাষ্ট্রের অমুসলিমেরা ‘জিমি’ স্তরের নাগরিক হবেন এবং ইসলামিক রাষ্ট্রের অন্তর্গত অমুসলিম মুয়াহিদ স্তরের নাগরিক হবেন যদি ঐ রূপ বন্দোবস্ত রাষ্ট্র করে থাকে। অবশ্যই তাদের পূর্ণ নাগরিক অধিকার থাকবে না। উদ্ধৃত নির্দেশ উলামার। অথাৎ পাকিস্তানের অমুসলিমদের অধিকার উক্ত দুই শ্রেনীর নাগরিকদের তুলনাতেও নগণ্য হবে। (২৮) • পাকিস্তানের সংবিধান রচয়িতারা ইসলামিক রাষ্ট্রের কল্পনা করে উলামার গুরুত্ব বিস্তর বাড়িয়ে দেন। ফলে উলামার ধর্মান্ধ প্রচারগুণে সাধারণের মধ্যে বিধর্মীদের উপর নৃশংস আচরণ করার প্রবণতা দেখা দেবে। সম্রাট আকবরের হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি রক্ষার নীতি এবং তাঁর জিজিয়া কর উচ্ছেদ করার নীতি শেখ সিরিন্দির মনঃপূত ছিল না। এই সিরিন্দির প্রতি শ্রদ্ধাশীল উলামাই আহমাদি হত্যার নির্দেশ দেন। কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মচারীদের মধ্যে তালিমাত-ই-ইসলামি বাের্ডের সদস্যরা নিজ সরকারের বিরুদ্ধে আনা প্রস্তাব সমর্থন করেছিলেন এবং আহমেদি-নিধনের সমর্থক ছিলেন। ধর্মান্ধদের প্রচারে বিভ্রান্ত দার্শনিক – কবি ইকবাল পর্যন্ত আহমেদিদের অমুসলমান হিসাবে চিহ্নিত করার দাবি জানিয়েছিলেন।(২৯)
১৯৪৭ এর ১১ই অগাস্ট জিন্না বলেছিলেন, ‘ধর্ম ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ব্যাপার। গণতান্ত্রিক অধিকার সকলের জন্য সমান। ধর্ম, জাতি এ সব এখানে নিয়ামক নয়। কিন্তু ১৯৪৯ এর ১২ ই মার্চের মূললক্ষ্য ঘােষণায় সংখ্যালঘুদের স্বার্থ বিঘ্নিত করা হয়। জিন্নার বক্তব্যের বিপরীত মেরুতেই ঐ লক্ষ্যবস্তুর অবস্থান চিহ্নিত হয়েছিল। আহমাদি নিধন দৌলাতানার কারসাজি। অথচ শান্তিরক্ষায় ব্যর্থতার অজুহাতে ঐ আহমাদি নিধন দাঙ্গাকে উপলক্ষ করে গুলাম মুহম্মদ নাজিমুদ্দিনের মন্ত্রিসভা খারিজ করলেন ১৯৫৩ র ১৭ই এপ্রিল।(৩০)
আয়ব্যয় বা বাজেট প্রস্তাব পাশ করিয়ে নাজিমুদ্দিন গণপরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন অক্ষুন্ন রেখেছেন, এ প্রমাণ উপস্থিত করার পরেও তাঁর মন্ত্রিসভা খারিজ করে দিয়ে গভর্নর জেনারেল ক্ষমতার যে অপব্যবহার করেন, তেমন বেহদ্দ অগণতান্ত্রিকতার নজির দুর্লভ। অতঃপর পূর্ববঙ্গের বগুড়ার মুহম্মদ আলিকে প্রধান মন্ত্রী নিযুক্ত করে নিরাপদ একটি উপায় আবিষ্কার করা হ’ল যার ফলে বাঙালী ভাবাবেগ প্রীত হবে অথচ কাটিয়ে এবং মুসলিম লীগ দলের উপর প্রভাবশূন্য হয়ে পুতুল প্রধানমন্ত্রীপদের যােগ্যতা সর্বাধিক অর্জন করেছিলেন বগুড়ার এই ব্যক্তি। পালামেন্টারি রাজনীতি হয়ে এল, নিরুত্তাপ। কুচক্রী আমলাতন্ত্র কিংবা নাটের গুরু চৌধুরী মুহম্মদ আলি এমন কি ঐ চক্রের ক্রীড়াপুত্তলিকা স্বরূপ নূতন প্রধান মন্ত্রী বগুড়ার মুহম্মদ আলি – কারুর সম্পর্কে কোন বিরূপ মন্তব্য নেই রাজনীতিকদের মামুলি ভাষণে। সংসদীয় প্রথার যথেচ্ছ লঙ্ঘনে ঐ শাসকচক্রকে কোনাে বাধা দেবার মতাে ঐক্য ছিল না সাংসদদের। খালিদ বি, সয়িদ এই অবস্থাকে রাজনীতিকদের বিশৃঙ্খলতা বলে এর সাথে ফুটবল মাঠের হুটোপুটির তুলনা করেন। অবশ্য তাঁর মন্তব্যে ফাঁক ছিল। বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি রাজনীতিকরা নন, করেছিলেন ঐ আমলারা।(৩১) | প্রধানমন্ত্রী মুহম্মদ আলি গভর্নর জেনারেলের অন্তর্বর্তী সংবিধানের পরিকল্পনা মেনে নিয়ে বশংবদতা প্রমাণ করলেন। এই পরিকল্পনা অনুসারে, গভর্নর জেনারেল তাঁর মর্জিমাফিক ব্যবহার্য বিশেষ ক্ষমতার প্রয়ােগ করে আইনসভায় পাশ হওয়া সত্ত্বেও কোনাে আইনকে নাকোচ করতে পারবেন। কোরান এবং সুন্নার সঙ্গে সঙ্গতিহীন আইন প্রণয়নের অধিকার দূর করার ব্যবস্থাও এই পরিকল্পনায় নিহিত ছিল। চালু গণপরিষদের প্রতিনিধিত্ব মূলক চরিত্র না থাকায় নূতন গণপরিষদ গঠনের কথাও এতে ছিল। মুসলিম লীগের পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক কমিটি অন্তর্বর্তী সংবিধান প্রত্যাখ্যান করে এবং সে ব্যাপারে উলামার সমর্থনও অর্জন করে। উলামার ক্ষমতা যে বেড়েছে তার প্রমাণ পাওয়া গেল পূর্ববঙ্গীয়রা যখন বি, পি, সি-র সুপারিশে সায় দিয়ে রাষ্ট্রপ্রধান পদে মুসলিম আবশ্যিক এই ধারা মেনে তাে নিলেনই এবং কোরান অথবা সুন্নার পরিপন্থী কোনাে আইন প্রণয়ন চলবে না- এও মেনে নিলেন। পাঞ্জাবী শক্তিচক্র পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলের প্রদেশগুলি একাকার করার মলবে বি, পি, সি-র সুপারিশ সংশােধন করতে চাইলাে। তখন দুই অঞ্চলের মােট প্রতিনিধির সমতার অপব্যবহার করে গণপরিষদে বাঙালীর আধিপত্য খর্ব করার যে- ইচ্ছা তার প্রধান বাধা পূর্ববঙ্গীয়রা। এমনিতেই ছােট প্রদেশগুলাের পাঞ্জাবী আধিপত্য ভীতি ছিল। পূর্ববঙ্গীয়রা তার সুযােগ নিলেন। শুধু নাজিমুদ্দিনকে হটাতে পারার ক্ষমতা দেখিয়ে গণপরিষদ কঞ্জা করা গেল না দেখে শাসকচক্র আরাে চরম পন্থার কথা ভাবতে বাধ্য হল। (৩২)। | প্রধানমন্ত্রী বগুড়ার মুহম্মদ আলির মস্তিষ্কপ্রসূত বলে খ্যাত নূতন এক প্রতিনিধিসমতা সূত্র গভর্নর জেনারেল মেনে নেবার ফলে গণ পরিষদে ফের বি, পি, সি নিয়ে আলােচনার সুযােগ এল। হাউস অব পিপলে পূর্ববঙ্গের ১৬৫ টি এবং পশ্চিমাঞ্চলের ১৩৫ টি আসন থাকবে। অন্যদিকে হাউস অব ইউনিটসে পূর্ববঙ্গের ১০ টি এবং পশ্চিমাঞ্চলের প্রদেশগুলাের মােট ৪০ টি আসন থাকবে। উভয় হাউসের অন্ততঃ ৩০ শতাংশের সমর্থন না থাকলে বিবাদ নিরসনে দুই হাউসের যৌথ অধিবেশন কোন সিদ্ধান্তই কার্যকর করতে পারবে না। মুহম্মদ আলির নূতন সূত্র পূর্ববঙ্গীয়দের সংখ্যাগত আধিক্যের রাজনৈতিক গুরুত্ব সম্পূর্ণ ধ্বংস করে। তবু জনগণকে কিছু করা হচ্ছে বােঝাতেই পাঞ্জাব এবং পূর্ববঙ্গ এই নূতন সমতা নীতি গ্রহণ করলেন। বি, পি, সি রিপাের্টে প্রাদেশিক সরকার গুলাে কোন্ নিরিখে তাদের প্রাপ্য লাভ করবে সে কথার কোনাে উল্লেখ ছিল না। একই প্রকার। বিস্ময়কর ব্যাপার ছিল, সংসদীয় পদ্ধতি উপেক্ষা করে গণপরিষদের বাহিরে ঐ সমতা। নীতি গৃহীত হয়েছিল। (৩৩)।
মুহম্মদ আলি সূত্রে পাকিস্তানের দুই অঙ্গের পারস্পরিক অবিশ্বাস এবং ঈষাপরায়ণতা মেনে নিয়েই যা কিছু করা হয়েছিল। নাজিমুদ্দিন সূত্রের চেয়েও বেশি প্রকট হয়ে পড়েছিল ঐ সংহতিহীনতা। তাকেই যেন একটি প্রতিষ্ঠানিক রূপ দিতে চেয়েছিল। নূতন সূত্র। আপার হাউস বা উচ্চপরিষদ জননির্বাচিত না হয়েও নিম্নপরিষদের বা হাউস অব দি পিল-এর সমতুল ক্ষমতার অধিকারী ছিল এই নূতন সূত্রে। পরােক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে ধনীদের এই হাউসে প্রতিনিধি হয়ে আসার সমধিক সম্ভাবনা ছিল। ধনিক সম্প্রদায় তার স্বার্থহানিকর সমাজকল্যাণ মূলক আইন প্রণয়নে বাধাসৃষ্টিই করবে এ তাে। সহজ কথা। আর এই উচ্চকক্ষ বা আপার হাউসের ৫০ টির মধ্যে ৪০ টি আসনই বরাদ্দ । করা হয়েছিল পশ্চিমাঞ্চলের জন্য। এর ফলে পশ্চিমাঞ্চলে ভূমিসংস্কারের কাজে প্রতিবন্ধকতা আসবে এমন অশুভ সম্ভাবনা থেকেই গেল। প্রাদেশিকতা ভিত্তিক রাজনৈতিক দলের উদ্ভব হবে মুহম্মদ আলি সূত্র থেকে। এই সূত্রের প্রকাশ ঘটামাত্র পশ্চিম খণ্ডে বাঙালীবিদ্বেষ বেড়ে গেছে। পূর্ববঙ্গেও মুসলিম লীগ ভিন্ন দলগুলি এই সূত্রের বিরােধিতা করেছে। পাঞ্জাব মুসলিম লীগের কিছু নেতা এই সূত্রের বিরুদ্ধে প্রাদেশিক আইনসভার অভ্যন্তরেই মতামত ব্যক্ত করতে উদ্যত বুঝে ঐ আইনসভার অধিবেশনই আকস্মিকভাবে স্থগিত করে দেওয়া হয়। তিরিশ শতাংশ ধারার আড়ালে দুর্নীতিগ্রস্ত মন্ত্রিগণ আশ্রয় পাবেন – এ সম্ভবনাও থেকে গেল। এত বাগাড়ম্বরের পরও পূর্ববঙ্গের আসন্ন নির্বাচনের অজুহাতে বলা হ’ল বি, পি, সি রিপাের্ট সম্পূর্ণ করা এই সময় সম্ভব হবে না। বেগম সইতা সােহরাবর্দি ইক্রামুল্লাহ এর প্রতিবাদে দীর্ঘদিনের মুসলিমলীগসদস্য পদ পরিহার করার কথা ঘােষণা করলেন গণপরিষদ কক্ষের অভ্যন্তরেই। তিনি বলেন, কয়েকটি ধারা অনুমােদন, তাদের উপরে ইসলামিক তকমা লেপন এবং তারপরেই সংবিধান বস্তুটিকে ঠাণ্ডাঘরে বন্ধ করে রেখে দেওয়া – জনগণকে এইভাবে প্রতারিত করে যেতে তিনি আর পারছেন না।(৩৪)
মুহম্মদ আলি সূত্র মেনে নিয়ে বি, পি, সি রিপাের্ট এর বিবেচনা পুনরায় শুরু করার সিদ্ধান্ত নেবার সময় মুসলিম লীগপন্থীরা পূর্ববঙ্গের আসন্ন নির্বাচনের কথা মনে রেখেছিলেন একথা সত্য হলেও সংখ্যালঘুদের শক্ত করে তুলেছিলেন তাঁরা ইসলামিক রাষ্ট্রের সােৎসাহ সমর্থনের ফলে। কোরান বা সুন্নার সঙ্গে মিল না থাকলে দেশের আইন কেন ব্যক্তিগত প্রশ্নে সংশ্লিষ্ট আইনও অগ্রাহ্য হবার সংবাদে এস্ত হিন্দুরা শেষােক্ত ক্ষেত্রে অব্যাহতি চেয়েও পান নি। ধর্মীয় আগ্রাসন যেন সাংবিধানিক অনুমােদন নিয়ে বিধর্মীদের উপর উদ্যত- এমন আশঙ্কা বােধ করলেন সংখ্যালঘুরা। তাঁদের নিকৃষ্ট শ্রেণীর নাগরিক হিসাবে চিহ্নিত করা হবে – এও তাঁরা বুঝে নিলেন। (৩৫)
উলামা থেকে পশ্চিমাঞ্চলের সংবাদপত্র – সর্বত্র নিদর্শন ছিল যে সংখ্যালঘুদের আশঙ্কা অমূলক নয়। তালিমত-ই-ইসলামি বাের্ডসদস্যদের রচিত এক রিপাের্টে কোরাণের স্তোত্র উদ্ধৃত করে উল্লেখ করা হয়, অমুসলিমের সঙ্গে মুসলিমের সখ্য সম্ভব নয়। অপর এক স্তোত্র উদ্ধৃত করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন এই সদস্যগণ যে, সরকারী উচ্চপদে অমুসলিম অচল। হিন্দু এম, সি, এ গণ একবার তাঁদের এক ধর্মীয় অনুষ্ঠানে গভর্নর জেনারেলকে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে গেলে ঐ অনুষ্ঠানকে শুভ বলে তিনি উল্লেখ করেন। করাচির দৈনিক ডন এই মন্তব্যের সমালােচনা করে লেখে, অন্য ধর্মের অনুষ্ঠানকে শুভ বলাটা অসঙ্গত। বাঙলা ভাষার স্তুতি করে একটি গান গেয়েছিলেন কিছু মুসলিম এবং হিন্দু এম, সি, এ। ‘মর্নিং নিউজ’ এর মধ্যেও পৌত্তলিকতা আবিষ্কার করেছিল। শিক্ষিত মুসলিমরাও ইসলামিক রাষ্ট্রের ভাবনা থেকে উদ্ভূত সঙ্কীর্ণ সাম্প্রদিয়কতার শিকার হয়ে ছিলেন এই পর্যায়ে। বহু দশক ধরে হিন্দু-মুসলমান একযােগে যে হিন্দু ধর্মোৎসবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শােভাযাত্রায় উৎসাহ সহকারে যােগ দিতেন তারও চিরাচরিত গতিপথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন কিছু সংরক্ষণশীল মুসলিম। মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে নাজিমুদ্দিন ইচ্ছা সত্ত্বেও তাঁদের নিরস্ত করতে পারেন নি। (৩৬)
১৯৫০- এর বীভৎস সংখ্যালঘুনিধনের পরেও কোনাে সহৃদয়তার পরিচয় পাওয়া যায় নি। নেহেরু – লিয়াকৎ চুক্তিকে অগ্রাহ্য করে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে সরকারী আদেশনামা পাঠানাে হয় যাতে জেলাশাসকের অনুমােদন ব্যতীত কোনাে অমুসলিমকে কর্মে নিযুক্ত করা না হয় সেই মর্মে। ৫০-এর দাঙ্গাসন্ত্রস্ত হিন্দুরা ফিরে এলে তাদের সম্পত্তি ফিরিয়ে দেওয়াও নিষিদ্ধ হয় অপর এক আদেশবলে। চাকুরী নেই, ব্যবসাও অসম্ভব বুঝে হিন্দুদের পাকিস্তানে বাস করার পাট চুকিয়ে ভারতে চলে যেতে হল। কেন্দ্রীয় সরকারের পূর্ববঙ্গে শিল্প প্রতিষ্ঠায় অনিচ্ছা যে- সময় ঐ অঞ্চলকে শিল্পের দিক থেকে বড় দীন অবস্থায় রেখেছিল, তখন পাকিস্তানকে নিজের দেশ জ্ঞান করে অনেক ধনী হিন্দু কোটি টাকা বিনিয়ােগও করেছিলেন পূর্ববঙ্গের শিল্পোন্নয়ন কল্পে। অথচ আমলাতন্ত্রের প্রতিকূলতায় তার পরেও তাঁদের পূর্ববঙ্গ ত্যাগ করতে হয়েছিল। তখন আবার দেশত্যাগী বলে এঁদের দেশপ্রেমে সন্দেহ প্রকাশও করতে ছাড়ে নি ঐ একই শাসকচক্র। লিয়াকৎ হত্যার দায়-ও হিন্দুদের ঘাড়ে চাপানাের চেষ্টা প্রথম দিকে হয়েছিল। ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কের কোনাে অবনতি ঘটলে, তার খেসারত দিতে হত হিন্দুদের। একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রকাশ্য জনসভায় ঘােষণা করেছিলেন, পাকিস্তান কোনাে জাতীয়তাভিত্তিক রাষ্ট্র নয়, এ হ’ল ইসলামিক রাষ্ট্র। গােলার ধান, পুকুরের মাছ যখন অমুসলমানদের থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হত, পরিস্থিতির গুণে তার বিরুদ্ধে নালিশও কেউ না জানিয়ে মুখ বুজে সহ্য করতেন। কারণ অভিযােগকারীকেই সেক্ষেত্রে পুলিশের হামলার মুখে পড়তে হ’ত। অমুসলিমদের সকল অধিকারের উপর আগ্রাসনে প্রশ্রয় দিয়ে সরকার কার্যতঃ সমগ্র সামাজিক কাঠামাে এবং তার শৃঙ্খলাই চূর্ণ করে দিয়েছিল। (৩৭) | অমুসলিমদের চোখের সামনে গণতান্ত্রিক শাসনের সম্ভাবনাও ভাসে নি সে সময়। চতুর্দিকে অমানিশার অশুভ ইঙ্গিতের মধ্যেও সান্ত্বনার কথা শুনিয়েছিলেন মিঞা মুহম্মদ ইফতিখার উদ্দিন। যেদিন বগুড়ার মুহম্মদ আলি বি, পি, সি রিপাের্ট পেশ করেন সেই ১৯৫৩ র ২২ শে অক্টোবর গণপরিষদের সমক্ষে উল্লেখ করেন, পাকিস্তানে হিন্দুদের চেয়ে ঢের ভালাে ব্যবহার পেয়ে থাকেন ভারতে মুসলিমরা। অমুসলিমদের পাকিস্তানের জাতীয় জীবনে অঙ্গীভূত হতে বাধা দেওয়া হচ্ছে ইসলামিক রাষ্ট্রের শ্লোগানের আড়ালে। যে-সব দেশে মুসলিমরা সংখ্যালঘু সেখানকার মুসলমানদের উপরেও তাে এ সবের প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। (৩৮)।
মুসলিম লীগ নেতৃত্ব শুধু ইসলামিক রাষ্ট্র শ্লোগানের জোরেই পূর্ববঙ্গের নির্বাচনে উতরে যাবার ভুল স্বপ্ন দেখেছিল। পূর্ববঙ্গের প্রতি কেন্দ্রীয় শাসকচক্র যে অবিচার করে চলেছিল তার প্রতিকারের কোনাে ক্ষমতাই এই দলের ছিল না। তখনকার অর্থমন্ত্রী গুলাম মুহম্মদের এক সংশােধনী বিলের ফলে বিক্রয়কর ১৯৫০ থেকে আরাে দু’বছরের জন্য। কেন্দ্রীয় তালিকাভুক্ত রইল। পাট রপ্তানি ঘটিত শুল্কের ক্ষেত্রেও পূর্ববঙ্গের বঞ্চনার মান আংশিক লাঘব হয়েছিল রেইসমান রােয়েদাদে। ঐ রােয়েদাদে অবশ্য তামাক, চা, সুপারির উৎপাদন শুল্কের কিছু অংশ কেন্দ্র ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল পূর্ববঙ্গ সরকারকে। কিন্তু যে বিক্রয়করই ছিল পূর্ববঙ্গ সরকারের ভরসাস্থল, তার অধিকার কেন্দ্রে বর্তানাের অর্থ ছিল সর্বনাশা। আদমসুমারির তথ্যে পূর্ববঙ্গের দুই তৃতীয়াংশ মানুষ অপুষ্টিক্লিষ্ট একথা জানার পরেও, পূর্ববঙ্গে বিক্রীত দ্রব্য সামগ্রীর বিক্রয়কর পূর্ববঙ্গসরকার পেত না। যদিও আমদানি অনুজ্ঞাপত্ৰ সহজেই লাভ করে পশ্চিমাঞ্চলের ব্যবসায়ীরা ঐ সব পণ্যের বিক্রয় মাধ্যমে মােটা হারে মুনাফা ঘরে তুলতাে। অবশ্যই এ সবের ক্রেতা হ’ত অভাবক্লিষ্ট পূর্ববঙ্গবাসীই। বিদেশ থেকে এই সব পণ্য সরাসরি সুলভে আমদানি করা সঙ্গত হলেও সম্ভব ছিল না কারণ পূর্ববঙ্গীয়রা ঐ আমদানি অনুজ্ঞাই পেতেন না। শাসকচক্রের পূর্ববঙ্গনীতির ছিল এমনই মহিমা। (৩৯) পাকিস্তানের অন্যান্য প্রদেশের তুলনায় পূর্ববঙ্গের প্রতি বিরূপ আচরণ করে চলার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকার যেন খােলাখুলি বৈরিভাবের আশ্রয় নিতেও সঙ্কোচ করতাে না। পাকিস্তানের জন সংখ্যার ৫৬ শতাংশ পূর্ববঙ্গের অধিবাসী হওয়া সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় রাজস্বের ১৮.৭ শতাংশ মাত্র পূর্ববঙ্গের প্রাপ্য ছিল ১৯৫২-৫৩ র বাজেটে। পাট পূর্ববঙ্গের একচেটিয়া উৎপন্ন দ্রব্য। পাটের কারণে প্রাপ্যটুকু এই হিসাবে ধরা হয় নি। জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে পূর্ববঙ্গের প্রাপ্য কেন্দ্রীয় সাহায্য ২৫ কোটি টাকার চেয়েও বেশি হ’ত। অথচ পূর্ববঙ্গ পেয়েছে ১০ কোটি টাকারও কম। ঋণের অঙ্কও সেই হিসাবে হওয়া উচিত ছিল প্রায় ২৮ কোটি টাকা, হয়েছিল সাড়ে ১৫ কোটি টাকার চেয়েও কম। পশ্চিমাঞ্চলের তুলা উৎপাদক কেন্দ্রীয় সরকারের যে অর্থানুকূল্য লাভ করে থাকে পূর্ববঙ্গের পাট উৎপাদক তদ্রপ সহায়তা থেকে বঞ্চিত। পাঞ্জাবী তুলা উৎপাদক যে ভরতুকি পেয়ে থাকেন, পূর্ববঙ্গের পাট উৎপাক তা থেকে পুরােপুরি বঞ্চিত। তদুপরি পশ্চিমাঞ্চলের যেসব অধিবাসী পূর্ববঙ্গ সরকারের বড় মাপের আমলা এবং কর্মকর্তা, তারা পূর্ববঙ্গবাসীকে অত্যন্ত অবজ্ঞা করে থাকে। শাহুদুল হক তাই ১৯৫২ র ১৮ই মার্চ গণপরিষদে এই উক্তি করেছিলেন, এ সত্য গােপন করে লাভ নেই যে পূর্ববঙ্গ বাসী ক্ৰমশঃই আরাে স্পষ্ট অনুভব করছেন, পূর্বাঞ্চল হতে চলেছে পশ্চিমাঞ্চলের উপনিবেশ। (৪০)।
বাঙালীর রাজনৈতিক চেতনায় শঙ্কিত ব্রিটিশ সরকার বাঙালীদের সেনাবাহিনী থেকে দূরে রাখতাে। একই পদ্ধতি নিল পাকিস্তান সরকার। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ উপদেষ্টাদের মতে একমাত্র বাঙালী ব্যাটেলিয়ন সুদক্ষ হওয়া সত্ত্বেও রটনা করা হত। বাঙালীর সামরিক দক্ষতা নেই। ১৯৪৮ এ পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে নাজিমুদ্দিন তাঁর বাজেট বক্তৃতায় এই ভেদ-নীতির বিরুদ্ধে মুখ খুললেও যখন প্রধান মন্ত্রী হলেন এ ব্যাপারে মুখ খুলতেও ভয় পেলেন। ১৯৫২-৫৩ র কেন্দ্রীয় বাজেট অধিবেশনে পূর্ববঙ্গীয় এম, সি, এ গণ এই প্রসঙ্গে পুনঃ পুনঃ তথ্যাদি পেশ করে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। বস্তুতঃ বিমানবাহিনীতে নিয়ােগ করার জন্য ৮ টির মধ্যে যে ১ টি মাত্র কেন্দ্র পূর্ববঙ্গে ছিল তারও ৩৩ শতাংশ আসন সংরক্ষিত ছিল পশ্চিমঅঞ্চলের পাকিস্তানীদের জন্য। সামরিক শিক্ষা প্রদানের ৭ টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যেও ১ টি মাত্র অবস্থিত ছিল পূর্ববঙ্গে। পূর্ববঙ্গীয় এম, সি, এ গণ তিক্তকণ্ঠে বলেন তাঁরা এই অবিচার অবসানের দাবি করে করে বিরক্ত হয়ে পড়েছেন। (৪১) | পূর্ববঙ্গীয় এম, সি, এ-দের বক্তৃতায় প্রকাশ পেল শাসকচক্রের বাঙালী-বিদ্বেষের নানা তথ্য। শিক্ষা স্বাস্থ্য খাতে পশ্চিমাঞ্চলের প্রাপ্য সাড়ে ১২ কোটি টাকা। পূর্বাঞ্চলের বরাদ্দ ঐ একই কারণে মাত্র সাড়ে ৫ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালিত ৭ টি প্রযুক্তি শিক্ষায়তনের প্রত্যেকটিই পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত। তাদের মােট ছাত্র সংখ্যা ১১ শত। আর পূর্বাঞ্চলের অনুরূপ প্রতিষ্ঠানগুলি সব বন্ধ হয়ে গেছে। ঢাকায় যে একটি মাত্র প্রযুক্তিশিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু আছে তার শিক্ষার্থী সংখ্যা মাত্র ১ শত ৫০ জন। পদোন্নতি ব্যাপারেও পশ্চিমাঞ্চলের আমলারা পূর্ববঙ্গীয়দের অন্যায়ভাবে বঞ্চিত করতাে। সৈয়দ আবুল বাসার মামুদ হুসেইন এই সময় যথার্থই বলেছিলেন, ইসলামের নামে ধ্বনি সবাই দেয়। ইসলামের আদর্শ মানে খুব কম লােকই। আর কতােদিন আপনারা ঐ ইসলামের নাম করে পূর্ববঙ্গকে শােষণ করবেন? পূর্ববঙ্গের জন্য সরকারী প্রকল্পাদির ক্ষেত্রে কেন্দ্রের ‘ধীরে চলাে নীতির আসল উদ্দেশ্য পূর্ববঙ্গকে পঙ্গু করে রাখা। (৪২)
পূর্ববঙ্গের সমস্যাগুলাের সমাধানকল্পে প্রয়ােজন প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন। অথচ বি, পি, সি রিপাের্ট মুহম্মদ আলি যখন পেশ করলেন, স্বায়ত্তশাসনের নামগন্ধও তার মধ্যে পাওয়া গেল না। মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন সহ মুসলিম লীগের অন্যান্য নেতারা মনে। করেছিলেন ঐ ঘাটতি পূরণ করা যাবে ইসলামিক রাষ্ট্রের ধ্বনিমাহাত্ম্যে। অথাৎ পূর্ববঙ্গে যে-নির্বাচন আসছে, সেখানে মুসলিম লীগ সাম্প্রদায়িকতাকেই মূলধন করবে প্রচার অভিযানে – এই ছিল তাঁদের অভিমত। অবশ্য বি, পি, সি রিপাের্টে সায় দিয়ে নুরুল আমিন একটা কাজ করতে পেরেছিলেন। শাসকচক্রকে খুসি করার বিনিময়ে কিছু বাঙালী মুসলিম লীগপন্থীদের জুটে যায় কেন্দ্রীয় আইন সভায় বেশ কিছু চাকুরী। অবশ্য ব্যাপক হারে বাঙালীর জন্য পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত কেন্দ্রীয় সভায় চাকুরী লাভ ছিল ধরা ছোঁয়ার বাইরে। এদিকে পূর্ববঙ্গের স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে বিরােধীরা গড়ে তুলছেন নির্বাচনী যুক্তফ্রন্ট। তার মুখােমুখি একটু কিছু না করলে ঐ দাবির জোরে বিরােধীরা মুসলিম লীগকে ছাপিয়ে যাবে এই ভাবনা থেকে মুসলিম লীগের পূর্ববঙ্গীয়রা দাবি করলেন, কেন্দ্রীয় আইনসভার অন্ততঃ একটি অধিবেশন ঢাকায় অনুষ্ঠিত করতে হবে। এর ফলে পূর্ববঙ্গের মর্যাদা বাড়বে। উপনিবেশে পরিণত হচ্ছে পূর্ববঙ্গ এই প্রচারও মার খাবে—এমন কিছু ওঁরা কল্পনা করেছিলেন। মিঞা মুহম্মদ ইফতিকারউদ্দিন অবশ্য এই একটি অধিবেশনকে মস্করা বলে উড়িয়ে দেন কারণ ‘প্রকৃত স্বয়ত্তশাসনের প্রসঙ্গের উল্লেখমাত্র ঐ বি, পি, সি রিপাের্টে নেই। লাহাের প্রস্তাবের হােতাদের ব্যক্তিগত ক্ষমতা মাথায় ছিল না। তাঁরা অবিভক্ত ভারতেই দু’টি স্বশাসিত প্রদেশ মুসলিমদের সুবিধার খাতিরে চিন্তা করেন। বর্তমানে যাঁরা পাকিস্তানের শাসক ক্ষমতার কাড়াকাড়িতে তাঁরা এতই লিপ্ত যে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের মতাে সঙ্গত ব্যবস্থাও তাঁরা করে উঠতে পারেন না। (৪৩)
১৯৫৩-৫৪ র মধ্যবর্তী কালে আমলাতন্ত্র এবং সামরিক প্রশাসন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সামরিক সাহায্য চুক্তি সম্পাদনের মলব আঁটে। এর ফলে কাশ্মীর প্রশ্নে ভারতের উপর চাপ সৃষ্টি করা যাবে। তা ছাড়া, যে- স্বৈরাচারী শাসনযন্ত্রে পূর্ববঙ্গের মানুষ আস্থা হারিয়েছেন তার জৌলুশ অনেকটাই বাড়ানাে যাবে এর ফলে। এমন চিন্তাও হয়তাে করা হয়েছিল যে একটা সময় আসতে পারে যখন পূর্ববঙ্গকে শাসনাধীন রাখতে হবে নিছক সামরিক শক্তির জোরে। অবশ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঐ চুক্তি ১৯৫৪-র মে মাসের পূর্বে সম্পাদন করা সম্ভব হয় নি। (৪৪) ইতােমধ্যে পূর্ববঙ্গের রাজনীতি এক নাটকীয় মােড় নিলে পশ্চিমখণ্ডের শাসককুল সেই সুবাদে এক চরম বাধার সম্মুখীন হয়।
References:
MR. DATTA elaborately dealt with these points in his typewritten statement dated 30 November 1965, submitted to the Commission of Enquiry on the exodus of minorities from East Pakistan (appointed) by the Government of India and presided over by Jusitce J. L. KAPUR ). This author consulted that statement.
MD. AFSAR UDDIN, “Notes on Researches about Student Problems at the University of Dacca”, in Pierre Bessaignet (ed.), Social Research in East Pakistan (Dacca, 1960), p 57. BERNARD BARBER, “Change And The Stratification System in Russia, Great Britain and the United States”, in B. BARBER and E. G. BARBER (ed.), European Social Class : Stability and Change (New York, Macmillan, 1965), pp. 139-40. A. F. A. HUSAIN, Employment of Middle Class Muslim Women in Dacca (Dacca University Socio-Economic Research Board, 1958), p. 69.
Speech by ATAUR RAHMAN KHAN,Constituent Assembly of Pakistan Debates ( CAP Debates for short), 6 September 1955, Vol. I. no. 17, p. 525. Ataur was for some time the Chief Minister of East Pakistan.
Testimony of DR, CHARLES B. MARSHALL, Adviser to the Prime Ministers of Pakistan, 1955-57,beofre a Sub-Committee of the Committee on Foreign Affairs, the United States House of Representatives-Review of the Mutual Security Program : Development and Implementation : Pakistan, January 21 and 22, 1959 (Washington D.C., 1959), p. 5.
CAP (Legislature ) Debates, 19 March 1952, Vol. I. no. 5, pp. 257-58. Speech by H. S. SUHRAWARDY, CAP Debates, 12 September 1955, Vol. I, No. 22, p. 679. Speech by SHAIKH MUJIBUR RAHMAN, CAP Debates, 21 January 1956, Vol. I, No. 53, p. 1915. Speech by ABUL MANSUR AHMAD, Constituent Assembly (Legislature) of Pakistan Debates (CAP (Legislature) Debates for short), 22 March 1956, Vol. I, No. 7, pp. 359-60. Also see National Assembly of Pakistan Debates (NAP Debates for short), 29 May 1963, Vol. II, No. 2, pp. 83-84 ; NAP Debates, 18 June 1963, Vol. II, No. 12, p. 676.
G. W. CHOUDHURY, “The Constitution of Pakistan”, Pacific Affairs, September 1956, p. 246. Speech by MIAN MUHAMMAD IFTIKHARUDDIN, CAP Debates, 22 October 1953, Vol. XV, No. 11, pp. 300-01.
CAP Debates, 18 January 1950, Vol. VI, No. 4, pp. 66, 84-85.
CAP Debates, 28 September 1950, Vol. VIII, 8. N. 1, pp. 15-42. KEITH CALLARD, Pakistan : A Political Study, pp. 91-92.
G. W. CHOUDHURY, Democracy in Pakistan (Dacca, Green Book House, 1963), pp. 70-71, 227. CAP Debates, 6 September 1955, Vol. I, No. 17. p. 522. Speech by DHIRENDRA NATH DATTA, CAP Debates, 6 January 1950, p. 54. KHALID B. SAYEED was wrong when he stated that this Interim Report of the B.P.C. did not mention any state language-See his Pakistan : The Formative Phase (Karachi, Pakistan Publishing House, 1960), p. 412.
LEONARD BINDER, Religion and Politics in Pakistan, pp 115, 205-07. CAP Debates, 21 November 1950, Vol. VIII, No. 6, pp. 181-83. 11. Cap Debates, 6 january 1950, pp. 34-61.
Ibid., p. 36. KHALID BIN SAYEED, n. 9, pp. 413-14. JYOTI SENGUPTA, Eclipse of East Pakistan, pp. 23-24. 13. KHALID BIN SAYEED, n. 9, pp. 414-15. 14. CAP DEBATES, 10 APRIL 1952, VOL. XI, No. 3. pp. 25, 31-32
CAP (Legislature ) Debates, 17 March 1952, Vol. I, No. 3. pp. 132-33, 146 ; Speech by A.M.A. HAMID, pp. 185-86. Speech by KAMINI KUMAR DUTTA, 10 April 1952, Vol. XI, No. 3, pp. 27-29. JYOTI SENGUPTA, n. 12, pp. 128-35. Census of Pakistan, 1951, Vol. I, p. 71. HASAN HAFIZUR RAHMAN (ed.), Ekushe February (i.e., Twentyfirst February); this collection of thirty essays, stories, dramas, sketches, poems and songs amply brings out the significance of 21 February 1952 in the history of East Bengal.
JYOTI SENGUPTA, n. 12, p. 133. CAP Debates, 10 April 1952, Vol. XI, No. 3, pp. 22-47. Speech by A. K. FAZLUL HUQ, Ibid., pp. 3436; speech by NURUL AMIN, pp. 43-46.
Speech by RAJ KUMAR CHAKRAVARTY, CAP Debates, 21 April 1952, Vol. I, No. 24, pp. 1550-53. Speech by SARDAR SHAUKAT HYAT KHAN, CAP Debates, 22 April 1952, Vol. I, No. 25, pp. 1602-04. CAP Debates, 25 April 1952, Vol. I, No. 27, pp. 1687-1706.
CAP Debates, 10 April 1952, Vol. XI, No. 3, pp. 47-49. CAP Debates, 15 April 1952, Vol. XI, No. 4, pp. 76-77. CAP Debates, 16 April 1952, Vol. XI, No. 5, pp. 87, 90-91, 106.
CAP Debates, 15 April 1952, Vol. XI, No. 4, pp. 68-69, 70-71, 74. CAP Debates, 10 April 1952, Vol. XI, No. 3, p. 51.
CAP Debates, 16 April 1952, Vol. XI, No. 5, p. 106 ; speech by NURUL AMIN, Ibid., pp. 97-100. CAP Debates, 17 April 1952, pp. 133, 138 ; speech by SIR MUHAMMAD ZAFRULLAH KHAN, Ibid., pp. 128-33. CAP Debates, 19 April 1952, Vol. XI, No. 8, p. 220.
CAP Debates, 15 April 1952, Vol. XI, No. 4, pp. 65-66, 69. CAP Debates, 18 January 1950, Vol. VI, No. 4, pp. 84-85. CAP Debates, 11 April 1951, Vol. IX, No. 2, p. 12.
Appendix I, in CAP Debates, 22 December 1952, Vol. XII, No. 2, pp. 80-160, contains the Report of the Basic Principles Committee.
BHUPENDRA KUMAR DATTA (Interview, 12 September 1966) laid a great emphasis on the personal enemity between Ghulam Muhammad and Fazlur Rahman as an explanation of the dismissal of the Nazimuddin Ministry on 17 April 1953. G. W. CHOUDHURY, n. 9, pp. 71-72. K. B. SAYEED, n. 9, pp. 415-16. HERBERT FELDMAN, A Constitution for Pakistan (Karachi, Oxford University Press, 1955), pp. 46-47. Z. A. SULERI, Politicians & Ayub (Rawalpindi, Capital Law & General Book Depot, 1964), pp. 8-9. Speech by FAZLUR RAHMAN, CAP Debates, 25 January 1956, Vol. I, No. 56, p. 2046. LEONARD BINDER, n. 10, pp. 246-47.
Report of the Court of Inquiry constituted under Punjab Act ll of 1954 to enquire into the Punjab Disturbances of 1953 (Lahore, Government Printing, Punjab, 1954), pp. 1, 237, 240, 263-65, 274-75, 386.
Ibid., pp. 1, 231, 237, 276, 285, 385, 387. 26. JYOTI SENGUPTA, ‘n. 12, p. 51. LEONARD BINDER, n. 10, pp. 142-43, 155-56. Report of the Court of Inquiry, n. 24, pp. 237, 239, 240-41, 264-65, 282.
H. A. R. GIBB, “Constitutional Organization”, in MAJID KHADDURI AND HERBERT J. LIEBESNEY (eds.), Law in the Middle East (Washington, The Middle East Institute, 1955), p. 3. NOEL J. COULSON, “The State and the Individual in Islamic Law”, International and Comparative Law Quarterly, January 1957, pp. 50-52. NOEL J. COULSON, “The Concept of Progress and Islamic Law”, in ROBERT N. BELLAH (ed.), Religion and Progress in Modern Asia (New York, Free Press, 1965), pp. 74-75. Report of the Court of Inquiry, n. 24, p. 210. Professor AJIT KUMAR SEN of Dacca University wrote a brief article in Janamat, 13 September 1949, p. 3, exposing effectively the fallacies
inherent in the description of Pakistan as an Islamic State. For an ingenious, thogh unconvincing, interpretation of an Islamic State as the repository of justice, see W. C. SMITH, Pakistan As An Islamic State (Lahore, Shaikh Muhammad Ashraf, 1951).
Report of the Court of Inquiry, n. 24, pp. 203, 212-15, 218-19.
SAIYID A. A. RIZVI, Muslim Revivalist Movements in Northern India in the Sixteenth and Seventeenth Centuries (Agra University, 1955), pp. x, 212, 247-49. MAULANA MUHAMMAD ALI, “Sir Muhammad Iqbal’s statement re the Qadianis”, The Ahmadiyya Anjuman Isha’ at-i-Islam Tract Series (Lahore), October 1935, Vol. I, No. 2, pp. 24, 26, 28-29, 31. Report of the Court of Inquiry, n. 24. pp. 242-43.
G. W. CHOUDHURY, Constitutional Development in Pakistan (Lahore, Longmans Green, 1959), pp. 65-66. Speech by Jinnah, CAP Debates, 11 July 1947, Vol. I, No. 2, pp. 19f. KEITH CALLARD, n. 8, pp. 135-36. Report of the Court of Inquiry, n. 24, p. 282. BINDER, n. 10, pp. 302-03.
KHALID B. SAYEED, “Martial Law Administration in – Pakistan”, Far Eastern Survey, May 1959, p. 72. HUGH TINKER, India
and Pakistan (London, Pall Mall Press, 1962), p. 76. K. B. SAYEED, n. 9, pp. 417-19. MUSHTAQ AHMAD, Government and Politics in Pakistan (Karachi, Pakistan Publishing House, 1959), p. 13. BINDER, n. 10, pp. 296-98, 300-01. CALLARD, n. 8, pp. 136-37.
Civil and Military Gazette, 1 July, 5 August, 17, 29 September 1953. SULERI, n. 23, pp. 74-75. Dawn, 19 October 1953. BINDER, n. 10, pp. 327-28, 345-46.
G. W. CHOUDHURY, n. 9, pp. 73-74. Speech by DHIRENDRA NATH DATTA, CAP Debates, 7 October 1953, Vol. XV, No. 2, pp. 5354. Speech by FAZLUR RAHMAN, CAP Debates, 21 October 1953, Vol. XV, No. 10, p. 258. SULERI is not correct when he observes that, under the Muhammad Ali formula, “the real power resided in the Lower House”-SULERI, n. 23, p. 76. BINDER is not clear when he suggests that thirty percent requirement is an additional safeguard” for East Bengal–BINDER, n. 10, p. 312.
Speech by Prof. RAJKUMAR CHAKRAVARTY, CAP Debates, Vol. XV, No. 3, 8 October 1953, pp. 70-72. CAP Debates, Vol. XV, No. 11, pp. 321-22. CAP Debates, 7 October 1953, Vol. XV. No. 2, p. 37. Speech by DR. MAHMUD HUSAIN, CAP Debates, 13 October 1953, Vol. XV, no. 6, p. 157. Speech by BEGUM S. S. IKRAMULLAH. CAP Debates 14 November 1953, Vol. XV, No. 28, pp. 748-49.
CAP Debates, 14 October 1953, Vol. XV, No. 7, p. 185. CAP Debates, 31 October 1953, Vol. XV, No. 19, pp. 630, 638-39, 656. Speech by SRIS CHANDRA CHATTOPADHYAY, CAP Debates, 2 November 1953, Vol. XV, No. 20, pp. 658-59. BINDER is not accurate in asserting that Hindus succeeded in securing a safeguard for their personal laws-BINDER, n. 10, p. 328.
CAP Debates, 29 October 1953, Vol. XV, No. 17, pp. 590-91. CAP Debates, 30 October 1953, Vol. XV, No. 18, p. 606.
CAP (Legislature) Debates, 17 March 1952, Vol. I, No. 3, pp. 132-33, 145-46. CAP (Legislature) Debates, 28 March 1952, Vol. I, No. 12, pp. 677-78. CAP Debates, 19 October 1953, Vol. XV, No. 8, p. 201.
Speech by MIAN MUHAMMAD IFTIKHARUDDIN, CAP Debates, 22 October 1953, Vol. XV, No. 11, pp. 294-95.
CAP Debates, 27 March 1950, Vol. VII, No. 1, pp. 4-9. CAP Debates, 20 March 1952, Vol. XI, No. 1, pp. 12-13. G. W. CHOUDHURY, n. 30, pp. 192-93. G. W. CHOUDHURY, n. 9, pp. 23537. CAP (Legislature ) Debates, 18 March 1952, Vol. I, No. 4, p. 185.
Speech by SHAHOODUL HAQUE, CAP (Legislature) Debates, 18 March 1952, Vol. I, No. 4, pp. 197-98. Speech by MOULAVI EBRAHIM KHAN, Ibid., pp. 195-96. Sppech by ABDUL MONEM KHAN, CAP (Legislature) Debates, 19 March 1952, Vol. I, No. 5, p. 256.
CAP (Legislature) Debates, 19 March 1952, Vol. I, No. 5, pp. 247, 254, 257.
Speech by SYED ABUL BASHER MAHMUD HUSAIN, CAP (Legislature) Debates, 19 March 1952, Vol. I, No. 5, pp. 253-55 ; Speech by ABDUL MONEM KHAN, Ibid., pp. 256-57.
Speech by IFTIKHARUDDIN, CAP Debates, 22 October 1953, Vol. XV, No. 11, pp. 301-2, 304-5. CAP Debates, 6 November 1953, pp. 699-700. Speech by NUR AHMED, CAP Debates, 7 November 1953, pp. 705-6. Speech by IFTIKHARUDDIN, Ibid., pp. 706-8.
Dawn, 20 May 1954.
Source: গনতন্ত্র এবং জাতীয়তার অগ্নিপরীক্ষা, জয়ন্তকুমার রায়, pp 18-35
সামরিক একনায়কত্বের পথে
সাময়িক স্বার্থের তাগিদে অবাঙালী শাসকচক্রের হাতে চালিত হয়ে মুসলিম লীগের বাঙালী নেতারা পূর্ববঙ্গের অতি জরুরী প্রয়ােজন গুলাের প্রতিও অবহেলা দেখান। পরিণামে তাঁরা ক্রমাগত জনগণের অপ্রিয় হয়ে পড়লেন। বিষয়টির সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ সেই কারণেই ১৯৫২ – তে ধার্য নির্বাচনও ক্রমাগত পিছিয়ে চললেন। উপনির্বাচনের সম্মুখীন হবার সাহসও ছিল না তাঁদের। একটা সময় তাে প্রাদেশিক বিধানসভার ৩৪ টি আসন-ই শূন্য হয়ে পড়ে ছিল। রাজনীতি, অর্থনীতি তথা সংস্কৃতি – সর্বত্র চলেছিল তীব্র সঙ্কট সে সময়। সে-সবের কারণেই পথ উন্মুক্ত হ’ল বিকল্প রাজনৈতিক দলের সামনে। ক্ষমতার দ্বন্দ্বে মুসলিম লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী দাবিদার হয়ে এল দুটি রাজনৈতিক দল – ১৯৪৯ সালে মৌলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানি প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগ এবং ১৯৫৩ সালে পূর্ববঙ্গের প্রবীণতম তথা সর্বাধিক শ্রদ্ধাভাজন এ, কে, ফজলুল হকের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত কে, এস, পি বা কৃষক-শ্রমিক পার্টি। এই ফজলুল হকই ঐতিহাসিক লাহাের প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন। হুসেইন শহীদ সােহরাবর্দি পরে ভাসানির দলে যােগদান করেন। এই দলের পরে নাম হয় আওয়ামি লীগ। আওয়ামি লীগের অন্তর্ভুক্ত শেখ মুজিবর রহমানই বর্তমান মুহূর্তে (অগাস্ট, ১৯৬৮) পূর্বপাকিস্তানের স্বাধিকার সংগ্রামের সবাগ্রগণ্য নেতা। (১)
অবাঙালী আমলারাই পূর্ববঙ্গের শাসন কার্য চালাতেন। এদের শাসনে জনগণের বাকস্বাধীনতা, ভাবপ্রকাশের স্বাধীনতা ইত্যাদি মৌলিক অধিকার ভীষণভাবে খর্ব করা হয়েছিল। অথচ মুসলিম লীগ এই অবিচারে হয় প্রশ্রয় দিত নয় নিবীর্যের মতাে নিষ্ক্রিয় থাকতাে। গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়গুলির প্রতি জনসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে নূতন পাটি দুটির কোনাে বেগ পেতে হয় নি। সরকারের আনুকুল্যে এবং প্রশ্রয়ে পূর্ব পাকিস্তানকে যে কীভাবে পশ্চিম পাকিস্তানীরা শােষণ করতেন এবং কী পরিমাণে পূর্বপাকিস্তানের উপার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করা হত দেশের পশ্চিম খণ্ডকেই শুধু শিল্পোন্নত করার উদ্দেশ্যে সে। সবই নূতন পার্টি গুলি জনসাধারণের সামনে তুলে ধরলাে। সরকারী পক্ষপাতিত্বের ফলে শিল্পস্থাপনে অনুমতিপত্র বা পারমিট এবং আমদানিসংক্রান্ত অনুজ্ঞাপত্র বা লাইসেন্স যে একতরফাভাবে বিতরণ করা হয় পশ্চিম পাকিস্তানী ব্যবসায়ীদের – এসবই জন সাধারণের। গােচরীভূত হ’ল নূতন দলগুলির প্রচার গুণে। সমস্যা শুধু শিল্পপতি বা ব্যবসায়ীদের স্তরেই সীমাবদ্ধ ছিল না। সাধারণ ক্রেতা পূর্ববঙ্গে যে সব আমদানীকৃত পণ্যসম্ভার ক্রয় করতেন তার সব ক্ষেত্রেই মূল্যমান ছিল অত্যধিক। অথচ করাচিতে ঐ পণ্য আমদানি করা হয়েছিল অনেক কম দামে। বিক্রয়মূল্যের এই পার্থক্য, যা করাচি এবং পূর্ববঙ্গের যে কোনাে বাজারের মধ্যে দেখা যেত, তার ব্যাখ্যা পরিবহণ ব্যয়ের মধ্যে মিলবে না। এ ছিল মুনাফা শিকার। যার ভুক্তভােগী ছিলেন পূর্ববঙ্গবাসী। এই সব শােষণের চিত্র সরকারী তথ্যপুস্তিকাতেও প্রকাশ পেত। পূর্ববঙ্গবাসী দেশের এই পূর্ব-পশ্চিম খণ্ডের মধ্যে যে-বৈষম্য, তার সম্পর্কে যথেষ্ট অবহিতও ছিলেন। নূতন রাজনৈতিক দলগুলি তাঁদের চিন্তাভাবনাগুলাে আরাে সুসংহত করেছিল – এই মাত্র। (২)। | পূর্ব পাকিস্তান আইন সভার জন্য সাধারণ নির্বাচন ধার্য হ’ল ১৯৫৪ র মার্চ মাসে। এই ভােটযুদ্ধে মুসলিম লীগের প্রবল প্রতিপক্ষ ছিল ২১-দফা কার্যক্রমের ভিত্তিতে গঠিত। যুক্তফ্রন্ট। আওয়ামি মুসলিম লীগ এবং কৃষক শ্রমিক পার্টি এরাই ছিল ফ্রন্টের বড় শরিক। লাহাের প্রস্তাবের সূত্র ধরে পূর্ববঙ্গের জন্যে সর্বাঙ্গীণ স্বায়ত্বশাসনের দাবি জানানাে হ’ল এই কার্যক্রমে। প্রতিরক্ষা, মুদ্রাব্যবস্থা এবং পররাষ্ট্রনীতি ভিন্ন সর্ব বিষয়ে পূর্ব বঙ্গের স্বাধিকারের এই দাবির সঙ্গে স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা এবং নৌবাহিনীর সদর দপ্তর পূর্ববঙ্গে স্থাপনের দাবিও করা হল। অথাৎ মূলতঃ বাঙালী মুসলিমরা যে-সকল দিক থেকে অবাঙালী মুসলিমদের শােষণ-শাসনে নিপীড়িত হয়েছেন এতকাল এবং যার প্রতিকারের চিন্তাও কখনাে করে নি মুসলিম লীগ দল, সেই দিকগুলির সম্পর্কে ইতিকর্তব্যের রূপরেখা স্বরূপ। ছিল ঐ ২১-দফা নির্বাচনী ইশতেহার। যুক্তফ্রন্ট তার প্রচারাভিযানে পূর্ববঙ্গীয় মুসলিম জনজীবনের বাস্তব চিত্রটি মনে রেখেছিল। তাই প্রতি শুক্রবার হাটে-হাটে নামাজ পড়তে জড়াে হওয়া সাধারণ মানুষের মধ্যে ফ্রন্টকর্মীরা নির্বাচনী প্রচার চালাতেন। হামিদুল হক চৌধুরীর এক পয়সা দামের এক পৃষ্ঠার সংবাদ’ নামের সংবাদ পত্র-ও ফ্রন্টের প্রচারাভিযানে ব্যবহৃত হতাে। এই পত্রিকায় ফ্রন্টের বক্তব্যই স্থান পেত। অন্যদিকে মুসলিম লীগের ছিল সরকারী ক্ষমতার অপব্যবহারে দলীয় প্রচার চালানাের সুযােগ। সাম্প্রদায়িকতায় উস্কানিদানও এই দল প্রচার কৌশল হিসাবে ব্যবহার করতাে। অবশ্য জনগণ ধিকৃত মুসলিম লীগ, ৩১০ টি আসন বিশিষ্ট প্রাদেশিক আইনসভায় কোনক্রমে নটি আসন লাভ করেছিল।। অথাৎ মাত্র আড়াই শতাংশ ভােট পেয়ে এবং প্রায় সকল আসনে শােচনীয় পরাজয় বরণ করে, রাজনৈতিক মৃত্যুর সম্মুখীন হ’ল মুসলিম লীগ এই নির্বাচনের ফলে। মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন মুসলিম লীগের সব চেয়ে নামী প্রার্থী হয়েও অজ্ঞাতকুলশীল পঁচিশ বছরের যুবার কাছে নির্বাচনযুদ্ধে হার মেনে এই মৃত্যুঘন্টাই যেন শুনিয়ে গেলেন। (৩)
অবাঙালী রাজনৈতিক নেতা এবং আমলারা এই নির্বাচনের ফলাফলে এক অস্বস্তিকর এবং অবাঞ্ছিত পরিস্থিতির মুখে পড়লেন। যুক্তফ্রন্ট ৯৭.৫ শতাংশ ভােট পেয়ে তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী পূর্ববঙ্গের স্বায়ত্ত্বশাসন দাবি তুলে ধরবে। সেই সঙ্গে তারা পাকমার্কিন সামরিক সহায়তা চুক্তি সম্পাদনেও বিঘ্ন সৃষ্টি করবে। জনসমর্থনহীন মুসলিম লীগের। নেতাদের মতাে কিংবা পুতুল-প্রধানমন্ত্রী বগুড়ার মুহম্মদ আলির মতাে আনুগত্য স্বীকার করার পাত্র যে জনতার মাথার মণিরূপ ফ্রন্ট নেতৃত্ব নয়- এটা স্মরণ করে পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন চক্র বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লাে। নবনির্বাচিত ফ্রন্ট নেতারা পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তির তীব্র বিরােধিতা করলে পাকিস্তান সরকারের কর্মকর্তাদের শঙ্কা সত্য প্রমাণিত হল। এই চুক্তির কথা নির্বাচনের পূর্বেই আইজেনহাওয়ার উল্লেখ করেছিলেন। সিডনি হার্জবার্গের মতে, তিনি হয়তাে এই ভেবেছিলেন, লীগ দল আমেরিকার মতাে বৃহৎ শক্তির মৈত্রী অর্জন করার সুবাদে ভােটে কিছু সুবিধা পাবে। ফল হয়েছিল অবশ্যই বিপরীত। (৪) | যুক্তফ্রন্টের নেতা হিসাবে ফজলুল হক, ১৯৫৪ র ২ রা এপ্রিল পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী পদে আসীন হবার অল্পকাল পরে ৪ঠা মে কলকাতায় শ্রীঅজিত দত্তর গৃহে ঘরােয়া বৈঠকে প্রসঙ্গক্রমে জানান, হিন্দুদের দুর্গতি নিরসনের ক্ষমতা তাঁর হাতে নেই কারণ প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলার দায়িত্ব অবাঙালীদের হাতে। তথাপি ভাষাগত ঐক্যের তাৎপর্য অনুধাবন করে রাজনৈতিক বিভাজন সত্ত্বেও দুই বাংলার বাঙালীদের একাত্মবােধের কথা তিনি বলেন। পশ্চিম পাকিস্তানী কর্তাব্যক্তিরা এই ভাবাবেগ পূর্ণ বক্তব্যের বিকৃত ‘ভায্য করে রটনা করলাে – হক নাকি পাকিস্তানের সৃষ্টিরই নিন্দা করেছেন। অথাৎ ফ্রন্ট সরকারকে খারিজ করার উদ্দেশ্যে হকসাহেবকে দেশদ্রোহী হিসাবে দেখানাে শুরু হল। ঐ ঘরােয়া বৈঠকে অবশ্য হক সাহেব, আশা প্রকাশ করেছিলেন – পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন পাবার পরে সংখ্যলঘুদের অসহায় দশা দূর করা সম্ভব হবে। (৫)
১৯৫৪ র ১০ই মে হক, তাঁর ভাষণের বিকৃত ভাষ্যকারদের স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন। তিনি বলেছিলেন শুধু এই কথা যে রাজনৈতিক ভেদ বশতঃ বন্ধুত্ব বা যােগাযােগ নষ্ট হয় না। চক্রান্ত আরাে গভীরে চলে গেছে তখন। তা বােঝা গেল, ২৩ শে মে ‘নিউ ইয়র্ক টাইমসের। সংবাদ দাতা যখন বিবৃতি দিলেন যে করাচিতে সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গে হক তাঁকে বলেছিলেন, পূর্ববঙ্গের স্বাধীনতাই তার লক্ষ্য কারণ ভৌগােলিক ব্যবধান ছাড়াও সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য রয়েছে পাকিস্তানের দুই অঙ্গের মধ্যে। এই বিচ্ছিন্নতাবাদ সম্পর্কে কেন্দ্রীয় সরকারের মতামত কী হবে – এই প্রশ্নের উত্তরে হক নাকি ঐ সাংবাদিককে বলেন – যখন কেউ স্বাধীনতা চায়, সে তা-ই চায়। বাধা যতােই আসুক। ঐ বিদেশী সাংবাদিক আগাগােড়া বানানাে বিবৃতিকে একটু বিশ্বাসযােগ্য করে তুলতে একথারও উল্লেখ করেন, সাম্প্রতিক নিবাচনী প্রচারে ‘হকের’ ফ্রন্ট, পূর্ববঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যয়বরাদ্দের ন্যূনতার কথা উল্লেখ করেছে। পাট রপ্তানি করে পূর্ববঙ্গ-ই বৈদেশিকমুদ্রার্জনের প্রধান শরিক হয়েও, কেন্দ্রীয় সরকারকে তার সিংহভাগ প্রদান করতে হয় – নির্বাচনী প্রচারে এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল সাংবাদিক প্রবর এ কথাও মনে করিয়ে দেন। পাকিস্তান সরকার, হকের কথামতাে ঐ সাংবাদিকের বিবৃতি বানানাে মনে না করে, উভয়ের সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করে উভয়ের। বক্তব্যই প্রচারপুস্তিকা আকারে প্রকাশ করে। সাংবাদিক কালাহান তাঁর বিবৃতির কোনাে অংশ প্রত্যাহার করেন নি এবং তাঁর সব কথা এবং হকের অস্বীকার ঐ পুস্তিকায় স্থান পায়। (৬)
হক- কালাহান বিতণ্ডা যে কেন্দ্রীয় পাকিস্তান সরকারের কারসাজিমাত্র এ সন্দেহ। বদ্ধমূল হয় যখন ১৫ই মে হক মন্ত্রীসভা গঠিত হয়ে মন্ত্রীদের শপথগ্রহণ পর্ব এসে যাওয়া । মাত্র নারায়ণগঞ্জের আদমজি জুট মিলসের বাঙালী এবং অবাঙালী শ্রমিকদের দাঙ্গা বাধলাে। দাঙ্গা দমনে সম্পূর্ণ অনিচ্ছা দেখালেন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার ভারপ্রাপ্ত অফিসাররা যাঁরা কেন্দ্রের চর বই কিছু নয়। ২৬ শে মে ‘ডন’ পত্রিকা আইন-শৃঙ্খলার অবনতির দায় চাপালাে। হক মন্ত্রীসভার উপর। অর্থাৎ কালাহান, নারায়ণগঞ্জ, কেন্দ্রস্তাবক প্রশাসন এবং কেন্দ্রের অনুগত ‘ডন’ – এদের সঞ্চারপথ বেশ ফুটে উঠল। হক মন্ত্রিসভাকে অযােগ্যতার অপবাদ দিয়ে তাকে খারিজ করার ফন্দি আঁটা হ’ল। (৭)।
অন্যায়ভাবে হক মন্ত্রিসভাকে যে খারিজ করতে চলেছে কেন্দ্র এই সত্য চাপা দিতে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটানাের জন্য দায়ী কেন্দ্রের চরসুলভ প্রশাসনকে আড়াল করে অহেতুক দায়ভাগী করা হ’ল হক মন্ত্রিসভাকে। ল, টাইমস (লণ্ডন) এই চক্রান্তে হাত মিলালাে। আরাে এক আজব অভিযােগ করা হ’লহক মন্ত্রিসভার মুজিবর একজন কমিউনিস্ট। মুজিবর ছাড়াও দু’জন কমিউনিস্ট মন্ত্রী আছেন ঐ মন্ত্রিসভায় এই প্রচার করা হ’ল। কেন্দ্রীয় শক্তিচক্রের হাতের পুতুল মুহম্মদ আলি প্রধানমন্ত্রী হিসাবে জাতির উদ্দেশ্যে বেতার ভাষণে হককে বললেন দেশদ্রোহী, বিশ্বাসঘাতক এবং মুসলিমে – মুসলিমে খুনােখুনির নায়ক। ১৯শে এই বেতার ভাষণের দিনই মার্কিন – পাক সামরিক সহায়তা চুক্তি সই করা হয় এবং হক মন্ত্রিসভাকে বরখাস্ত করা হয় গভর্নর জেনারেলের আদেশানুসারে। প্রশাসক বসানাে হয় তৎস্থলে। ৩১মে আতাউর, যিনি ঐ খারিজ মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন, তিনি এই আদেশের তীব্র নিন্দা করেন। (৮)। | পূর্ববঙ্গের জনগণের গণতান্ত্রিক রায় নাকোচ করলাে যে-শক্তি তার পিছনে দুনিয়ার পহেলা নম্বরের সামরিক শক্তি-ও রয়েছে। পূর্ববঙ্গবাসী বুঝলাে সবই, কিন্তু করতে পারলাে ।
কিছু। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার এর পরে যা করলাে তা থেকে পরিষ্কার হ’ল হককে দেশদ্রোহী বলাটা ছিল একটা কারসাজি। কারণ পরে ঐ হককেই পর্যায়ক্রমে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এবং পূর্ববঙ্গের গভর্ণর পদে আসীন করেছিল কেন্দ্রীয় সরকার। জেড, এ, সুলেরি হকমন্ত্রিসভা বরখাস্ত করার কুকীর্তিকে ক্ষমতার নিকৃষ্ট অপব্যবহার বলেছিলেন। (৯) | পূর্ববঙ্গে বন্যার প্রকোপ দেখা দেয় নারায়ণগঞ্জ দাঙ্গার পরে। পাকিস্তান টাইমসের এই মন্তব্য থেকেই পূর্ববঙ্গের প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের বিরূপতা স্পষ্ট হবে যে, সুদূর আমেরিকা যদি অনুরূপ কিছু পৌঁছাতে, সেটাই শােভন হ’ত। প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখেও পূর্ববঙ্গ বিদ্বেষ কমে না পশ্চিম পাকিস্তানী হােমরা-চোমরাদের – এটা এবারে পরিষ্কার হল। (১০) | দেশের পূর্ব এবং পশ্চিম খণ্ডের মধ্যে সমতার যে নীতি বগুড়ার মুহম্মদ আলি তুলে ধরেন, চৌধুরী মুহম্মদ আলি গােষ্ঠী তা গ্রহণ না করায় সংবিধান রচনা সম্পূর্ণ হবার পরেও এক অচলাবস্থার সৃষ্টি হ’ল। পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশগুলােকে একটি মাত্র প্রশাসনিক এককে পরিণত করার যে-দাবি ঐ পাঞ্জাবী গােষ্ঠী করতে থাকেন এবং যার হয়ে ওকালতি করে চলে ‘টাইমস অব করাচি’র ২০ শে অগাস্ট, ১৯৬৪ র সম্পাদকীয়, তাতে সম্মতি দিলেন না পূর্ববঙ্গের সাংসদরা। বঙ্গীয় প্রাদেশিক আইনসভায় মুসলিম লীগ পর্যদস্ত হলেও কেন্দ্রীয় সংসদ-সদস্য হিসাবে যাঁরা পূর্বে ছিলেন, তাঁরাই রয়ে গেছেন। পশ্চিমী কুচক্রীদের। সামাল দিতে না পেরেই যে তাঁদের দল জনতা কর্তৃক আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে পূর্ব বঙ্গের প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচনে সেই কথা মনে করে পূর্ববঙ্গের সাংসদরা ঐক্যবদ্ধ পশ্চিম পাকিস্তান প্রস্তাবের বিরােধিতাই করতে চান। এই সময় ক্ষমতা কুক্ষিগত করেন গুলাম মহম্মদ এবং চৌধুরী মুহম্মদ আলি। তাঁরা আঞ্চলিক সাব ফেডারেশন নামে পুরানাে ঐক্যবদ্ধ পশ্চিম পাকিস্তান প্রকল্পের এক বিকল্প উপস্থিত করলে নাজিমুদ্দিন তার নিন্দা করে।
চৌধুরী মুহম্মদ আলি গােষ্ঠী চা-পানের মতাে ছুতােয় কালক্ষেপ করে সংবিধানগঠন পরিষদ বা কনসাট টুয়েন্ট অ্যাসেমব্লির কাজে বাধা দিয়ে চলে। গভর্নর জেনারেল প্রােডা আইনের জোরে সদস্যপদ খারিজ করার ভয় দেখিয়ে চৌধুরীর তাঁবেদারি করে চলেন। গভর্নর জেনারেলের অনুপস্থিতির সুযােগে ১৯৫৪ র সেপ্টেম্বরে এম, সি, এরা জোটবদ্ধ হয়ে প্রােডা বাতিল করলেন। ঐক্যবদ্ধ পশ্চিম পাকিস্তানের এর পরে আর আশা নেই বুঝে সি, এ বা কনসটিটুয়েন্ট অ্যাসেমব্লিটাই বাতিল করা হ’ল গভর্নর জেনারেলের ২৪ শে অক্টোবর, ১৯৫৪ র আদেশবলে। শাসকচত্রের পছন্দ মাফিক সংবিধান না করার কারণেই সদস্যদের এই ভাবে জব্দ করা হল – এই মত প্রকাশ করেন কে, বি, সইদ। (১২)। | ২৫ শে ডিসেম্বর সংবিধানের উদ্বোধন করা হবে প্রধানমন্ত্রীর এই ঘােষণা শুনেই তড়িঘড়ি ২৪ শে অক্টোবর সি, এ বাতিল করা হয়েছিল। সংবিধান চালু হয়ে গেলে গভর্নর জেনারেল কোনমতেই এভাবে সি, এ বাতিল করতে পারতেন না। কাজটা এমনিতেই বিধিসম্মত ছিল না। অবশ্য সি,এ আর জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধিত্ব করছে না এই আপাতসুন্দর যুক্তি গর্ভনর জেনারেল দেখালেও, সি, এ বাতিল করা উচিত ছিল বঙ্গীয় আইন সভা নির্বাচনে বঙ্গীয় সি, এ সদস্যদের অধিকাংশের দল অথাৎ মুসলিম লীগ পর্যুদস্ত হবার সময়। এ সময় ঐ অজুহাত অর্থহীন ছিল। বাঙালী সদস্যদের বাগে আনতে পারেন নি বলেই এই অদ্ভুত গণতন্ত্রবিরােধী কাজ করে সংসদীয় গণতন্ত্রের সমাধি রচনা করেন ঐ গুলাম মুহম্মদ।
| গুলাম মুহম্মদ পার্লামেন্টে আস্থাবান আদৌ ছিলেন না। বাঙালী যেখানে সংখ্যায় অধিক এবং অবাধ্য তেমন সি, এস র চেয়ে সামরিক এবং প্রশাসনিক মহলের উপরই ভরসা বেশি ছিল এই গভর্নর জেনারেলের। কিন্তু ফজলুল হক, সােহরাবর্দির মতাে অভিজ্ঞ তথা দক্ষ নে তারা, পূর্ববঙ্গীয় যুক্তফ্রন্টের শক্তিতে শক্তিমান হয়ে আগামী দিনে তাঁদের মৌরসিপাট্টায় চ্যালেঞ্জ জানালে কী ভাবে সামাল দেওয়া যাবে এ তাে ভাবতেই হবে। ভেবে যা তিনি পেলেন, তা হ’ল ফ্রন্টের ঐক্যে ফাটল ধরানাের পথেই তাঁর টিকে থাকার সম্ভাবনা উজ্জ্বল। ইস্কান্দার মিজা বাঙলার গভর্নর হ’য়ে ফ্রন্টের নতুন নেতাদের ভয় এবং প্রলােভনের যৌথ প্রয়ােগে অনেক ক্ষেত্রেই কৰ্জা করে ফেললেন। (১৪)।
ফ্রন্ট নেতাদের মধ্যে অনেকেই সরকারী সুযােগ-সুবিধা পেলে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ভুলে যাবেন এটা বুঝে গুলাম মুহম্মদ অগণতান্ত্রিক এবং আজগুবি এক পার্ষদমণ্ডলী তৈরী করলেন। এর মন্ত্রিসভা নামটা এমনিতেই হাস্যকর। প্রতিভাধরদের মন্ত্রিসভা নাম দিয়ে তিনি চাপা হাসির বদলে অট্টহাসির প্রথম জোগান দিয়ে স্মরণীয় হলেন। এই প্রতিভা মন্ত্রিসভা ইস্কান্দারের ফ্রন্ট-বিরােধী কার্যকলাপ এবং কারসাজির পুরস্কার ঘােষণা করলাে তাকে এর আভ্যন্তরীণ বিষয়ের মন্ত্রী করে। আয়ুব প্রতিরক্ষা এবং সােহরাবর্দি আইন দপ্তর। পেলেন। চৌধুরী মুহম্মদ আলির জন্য নির্দিষ্ট হ’ল অর্থদপ্তর। সুবিধাবাদীর ঐক্য টেকে না। ফজলুল হক সােহরাবর্দির বিরােধী বগুড়ার মুহম্মদ আলিকে সমর্থন করলেন। সােহরাবর্দি। চাইলেন এ এম এল দলের আতাউর রহমানকে যুক্তফ্রন্টের নেতা হিসাবে। কিন্তু ঢাকায় ১৯৫৫ র ফেব্রুয়ারিতে এ এম এল এবং কে এস পি-র বিরােধ প্রকাশ্য সভাস্থলে ঠিকরে। পড়ে ফ্রন্টের ঐক্য কী স্তরে এসে ঠেকেছে তা দেখিয়ে দিল। দুই দল, একই ফ্রন্টের দুটি পৃথক সভা ডেকে সেদিন দল দুটির মধ্যে স্থায়ী ব্যবধান রচনা করে দিল। (১৫)।
প্রতিভা – মন্ত্রিসভায় আইনমন্ত্রী হতে পেরে সােহরাবর্দির ভােল-বদল হ’ল চূড়ান্ত রকম। মার্কিনী সামরিক সাহায্য চুক্তির তিনি পৃষ্ঠপােষক হয়ে উঠলেন, এমন সংবিধানের খসড়া করলেন যা ইসলামিক সংবিধানে পরিণত হয়েছিল সহজেই। তা ছাড়া পূর্ববঙ্গের দাবি সনদ, যা গত নির্বাচনে ফ্রন্টের জয় এনে দিয়েছিল সে কথা ভুলেও উচ্চারণ করলেন না।
৪০
এত তাঁবেদারি করেও বগুড়ার মুহম্মদ আলিকে সরানাে বা এ এম এল – চালিত পূর্ববঙ্গীয়। মন্ত্রিসভার ব্যবস্থা — কোনােটিই তিনি ক’রে উঠতে পারলেন না। যে – হককে বিশ্বাসঘাতক বলে নিন্দা করতে এক বছর আগে বাধে নি মুহম্মদ আলির, সেই হকের-ই অনুগামী আবু হুসেইন সরকারকে পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বানালেন তিনি। অবশ্য হিন্দু সদস্যরা কলকাতার ১৯৪৬ – এর দাঙ্গার কারণে সােহরাবর্দির চেয়ে হককে বিশ্বাস করতেন ঢের বেশি – এ কারণে হকের মনােনীত ব্যক্তি একটা বাড়তি জোর পেয়ে থাকবেন। এর পরে অবশ্য ফেডারেল কোটের নির্দেশে নূতন কনসটটুয়েন্ট অ্যাসেমব্লির শীঘ্র অধিবেশন আহূত হতে চলেছে দেখে ফজলুল হক সংখ্যালঘুদের আশ্বাস দেন তিনি ধর্মনিরপেক্ষ তথা গণতান্ত্রিক সংবিধানের জন্য প্রয়াস চালাবেন। হক-মুহম্মদ আলি সমঝােতার ফলেই আলি সফল হলেন সােহরাবর্দিকে প্রতিভাধরদের মন্ত্রিসভা থেকে অপসারিত করতে। (১৬)
কনসটিটুয়েন্ট অ্যাসেমব্লির পুনরাবির্ভাব সত্ত্বেও গুলাম রাজনীতিকদের ধার শেষ করে। আগে থেকেই নিরাপদ হয়ে ছিলেন। কিন্তু গুরুতর রােগভার গ্রস্ত গুলাম ১৯৫৫ র অগাস্টে কাজে ছুটি নিয়ে চলে গিয়ে আর কখনােই ফিরে আসেন নি। তখন থেকে গভর্নর জেনারেল হলেন ইস্কান্দার মির্জা। সামরিক বাহিনী থেকে আগত মিজা অনুরূপ একজনকে অর্থাৎ চৌধুরী মুহম্মদ আলিকে প্রধান মন্ত্রী করলেন। এ এম এল ব্যতীত ফ্রন্ট হকের নেতৃত্বে মুসলিম লীগের সঙ্গে সমঝােতার মন্ত্রিসভা গঠন করলে পর, হককে প্রথমেই সংযুক্ত বা ঐক্যবদ্ধ পশ্চিম পাকিস্তান প্রস্তাবে সায় দিতে হ’ল। যুক্তফ্রন্টের পূর্ববঙ্গের স্বাধিকার সংক্রান্ত দাবির কথা প্রথমে মুখে আনলেও পরে যেন ভুলেই গেলেন হক সাহেব অতীত সংগ্রাম এবং অঙ্গীকারের সমস্ত কথা। সংখ্যালঘুদের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে ঐশ্লামিক সংবিধান ও হক মেনে নিলেন। এ সংবিধানে সংখ্যালঘুদের নিকৃষ্ট শ্রেণীর নাগরিক বিবেচনা করা হয়েছিল। এবং ধর্ম সম্প্রদায় ভিত্তিক পৃথক নির্বাচনের ব্যবস্থাই এতে ছিল। (১৭)।
গুলাম মুহম্মদের অন্তর্ধানে ইস্কান্দার মির্জা এবং চৌধুরী মুহম্মদ আলিই রাজনীতির মঞ্চে মুখ্য ভূমিকায় রইলেন। ফজলুল হকও মেনে নিলেন একই পাঞ্জাব প্রদেশ থেকে গভর্নর জেনারেল এবং প্রধান মন্ত্রীর বন্দোবস্ত। দ্বিতীয় সি, এ-তে চুক্তি হয়েছিল দেশের দুই প্রান্তের দুই খণ্ড থেকে এই দুই মুখ্য পদাধিকারী মনােনীত হবেন। ফেডারেল কোর্টের নির্দেশ অনুসারে আইনগুলির পুনবৈধকরণ প্রথমে না করে, সি, এ প্রথমেই করলাে সংযুক্ত পশ্চিম পাকিস্তানবিলের তােড়জোড়। পশ্চিম পাকিস্তানের গভর্নর এবং পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল ঐ অঞ্চলের সব কিছুর বিধাতা হয়ে যাবেন – এমন ব্যবস্থা ঐ বিলে ছিল। স্বেচ্ছাচারিতার মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়ে ঐ বিল পাশ হবারও পূর্বাহ্নে পশ্চিম পাকিস্তান প্রদেশের। গভর্নর এবং মুখ্যমন্ত্রী নিয়ােগও করা হল। (১৮) | পশ্চিম পাকিস্তান বিলের উপর বিতর্কে ১৯৫৪-র নভেম্বরে চৌধুরী মুহম্মদ আলির তত্ত্বাবধানে উচ্চপর্যায়ের আমলাদের দিয়ে একটি রাজনৈতিক ইশতেহার প্রস্তুত হয়। তার শিরােনাম ছিল, সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতি’ বা ‘ক্লীয়ারিং দি ডেকস। সংযুক্ত পশ্চিম পাকিস্তান হলে সংসদে বাঙালীদের দাবিয়ে রাখা যাবে এবং পূর্ববঙ্গে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাও বন্ধ করা যাবে। এসব কথা স্পষ্ট ভাষায় এই বিতর্ককালে জানা গেল। কেন্দ্রীয় সরকার তার মর্জি। অনুসারে সিন্ধুর পিরজাদা মন্ত্রিসভা খারিজ করে, তাঁর এই বিলে আপত্তি ছিল বলে।
পাঞ্জাবের মালিক ফিরােজ খাঁ নূন-ও মুখ্যমন্ত্রিত্ব খােয়ালেন একই কারণে। তার বদলে মুখ্যমন্ত্রী করা হ’ল এমন একজনকে যিনি আইনসভার সদস্যও নন। সীমান্ত প্রদেশের আবদুর রসিদ খান একই কারণে মুখ্যমন্ত্রিত্ব হারান। তার স্থলে এসে বাহাদুর খান জানালেন—ঐ সংযুক্ত পশ্চিম পাকিস্তান বিলের বিরােধীকে পাকিস্তানে অন্তর্ঘাত চালানাের অভিযােগে সাজা পেতে হবে। (১৯)
গণ ভােটের জোরে বিল পাশ করানাের চেষ্টা বা সাহস না করে বিরােধী আইন সভা প্রভৃতির সদস্যদের শাস্তি এবং তাঁদের পক্ষে রায় দিলে বিচারপতির পর্যন্ত শাস্তির ব্যবস্থা করা হ’ল। পূর্ববঙ্গ-প্রতিনিধিদের সংসদের অভ্যন্তরেও দাবিয়ে রাখার এই চক্রান্তে হক এবং পূর্ববঙ্গের অপর নেতারা কার্যতঃ শরিক হলেন। শীঘ্রই তারা ব্যক্তিগত ক্ষমতাও হারালেন। নিজ প্রদেশের ক্ষতি মেনে নিয়েও তারা শাসকচক্রের কৃপা বেশি পান নি। (২০) | দ্বিতীয় সিএর মারী অধিবেশনে পূর্ববঙ্গের স্বায়ত্তশাসন এবং দেশের উভয় খন্ডের মধ্যে সমতানীতির শর্তে ঐশ্লামিক সংবিধানের উপরে বিতর্ককালে সংযুক্ত পশ্চিম পাকিস্তানে সম্মতি দিয়েছিলেন পূর্ববঙ্গের সাংসদরা। চুক্তিতে উর্দু, বাঙলার সম মর্যাদা নীতিও গৃহীত হয়েছিল। সাময়িক ভাবে ইংরেজিকেই সরকারী ভাষা হিসাবে ব্যবহার করার কথাও হয়েছিল। কিন্তু নূতন সংবিধানে রাষ্ট্রভাষার বিকাশ বা ডেভলেপমেন্ট প্রশ্নটি পূর্ববঙ্গের সদস্যদের সন্দিগ্ধ করে তুললাে। যে- সংবিধান এবারে উপস্থাপিত হ’ল তাতে পূর্ববঙ্গের স্বার্থরক্ষা পায় মারী চুক্তির সেই অংশগুলি বাতিল হয়ে গেছে দেখা গেল। ক্রমাগত বিশ্বাসঘাতকতা করে ফজলুল হক ঢাকার মানুষদের এতই বিরক্ত এবং ক্রুদ্ধ করে তুলেছিলেন যে ঐ সময় তিনি ঢাকা শহরে সভা করতে গিয়েও ব্যর্থ হন। যদিও সংবিধানে। পূর্ববঙ্গের স্বায়ত্বশাসনের বিধান না থাকার প্রতিবাদে ষাট হাজার মানুষ ঢাকার পল্টন ময়দানে জমায়েত হয়েছিলেন। হামিদুল হক চৌধুরী তখন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। তিনি স্তাবকতার চরম নিদর্শন রেখে বললেন, সংবিধানে প্রাদেশিক স্বায়ত্বশাসনের ব্যবস্থা তাে রয়েইছে। পূর্ববঙ্গের জন্য। ক্ষমতার লড়াই-এ এ সময় সব চেয়ে সুবিধাপ্রাপ্ত ব্যক্তি ছিলেন চৌধুরী মুহম্মদ আলি। আতাউর রহমান, হামিদুলের ক্ষমতা হাতানাের ক্রুর কাহিনীর উধ্বর কটাক্ষপাত করেন যুক্তফ্রন্ট পরিষদীয় দলের বৈঠকে। অবশ্য ফজলুর রহমান সংবিধানরচনার ইতিহাসকে এই বলে ব্যঙ্গ করেন যে, এ হ’ল চৌধুরী মুহম্মদ আলির ক্ষমতার সিঁড়ি ব’য়ে শীর্ষে ওঠার ইতিহাস। (২১) | যৌথ নির্বাচন যুক্তফ্রন্টের ২১-দফায় এবং মারী চুক্তিতে গুরুত্ব পেলেও, পাকিস্তানের ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের সংবিধানে তার নামগন্ধও ছিল না। ঐশ্লামিকতা নিয়ে সরকার পক্ষ গর্ব করলেও আওয়ামী লীগ এই সংবিধানকে ন্যায়ধর্ম বিরােধী এবং সেই সূত্রে ইসলামবিরােধী বলে চিহ্নিত করে। পূর্ববঙ্গের মুসলিম-অমুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের দাবি ছিল যৌথ নিবাচন প্রথা। তা অগ্রাহ্য করে ন্যায়নীতিকে বির্সজন দেওয়া হয়েছে—এই অভিমত তারা ব্যক্ত করেন এবং সঙ্গে একথাও বলেন, পাকিস্তান বহির্ভূত ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের কথা কি এই সংবিধানে আছে ? তারাও তাে ঐশ্লামিক শব্দের আওতায় আসবেন। তা ছাড়া ইসলামের সংজ্ঞা কি নির্দিষ্ট ? ১৯৫৩-র পাঞ্জাবের দাঙ্গার কথা তারা। স্মরণ করিয়ে দেন ঐ সংজ্ঞা প্রসঙ্গে। সমালােচকরা আরাে বলেন, জুয়াখেলা এবং মদ্যপান নিষিদ্ধ না করে এ সংবিধান ইসলামের মূল আদর্শকেই বহুলাংশে লঙঘন করেছে। এই বিতর্কে যােগ দিয়ে মুজিবর রহমান বলেন—‘পাকিস্তান, পাকিস্তানীদের জন্য। কিন্তু শুধুই মুসলিমদের জন্য তাে পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়নি। মুল্লাদের সমর্থন আদায় করে সেই সূত্রে জনগণকে শােষণ করার জন্য ইসলাম’-এই ল্যাবেল বা বিজ্ঞাপনটা সংবিধান রচয়িতারা গত সাত আট বছর ধরে ব্যবহার করে আসছেন। আতাউর রহমান এই সংবিধানকে তুলনা । করেন ইসলামে নিষিদ্ধ শরাবখানার সঙ্গে যাতে সাইনবাের্ড ঝুলছে-‘ইসলামিক শরাব । খানা। (২২)।
ফজলুল হকের ভােল পাল্টানােতে বিক্ষুব্ধ যতাে হিন্দু এখন আওয়ামি লীগ সমর্থক হয়েছেন তারা এই সংবিধান পাশ হবার পথে রীতিমতাে বাধার সৃষ্টি করেছেন। অবশ্য মুসলিমলীগ এবং ফজলুল হকের ফ্রন্টের মধ্যে সরকারী আনুকুল্যলাভের উদ্দেশ্যে সৃষ্ট ঐক্যে কোনাে ফাটল ধরে নি এই সময় পর্যন্ত। বিরােধীপক্ষ ৭ই ফেব্রুয়ারী ১৯৫৬ সভাকক্ষ ত্যাগ করলে সেই সুযােগে সংবিধানের পঞ্চাশটা ধারা পাশ করিয়ে নেওয়া হয়েছিল। বিতর্কমূলক ধারাগুলির নিষ্পত্তির জন্য সােহরাবর্দি, বিরােধী পক্ষের নেতা হিসাবে যে গােলটেবিল বৈঠকের পরামর্শ দেন, সরকার তাও প্রত্যাখ্যান করলে আওয়ামি লীগ সদস্যরা সঙ্গে সঙ্গে সভাকক্ষ ত্যাগ করেন। প্রায় সকল হিন্দু সদস্যও তাঁদের অনুসরণে সভাকক্ষ ত্যাগ করেন। সংবিধানের চূড়ান্তভাবে গৃহীত হওয়ার পথে ঐ কক্ষত্যাগ কোনাে গুরুত্ব পায় নি। কারণ একই দিনে অথাৎ ১৯৫৬র ২৯শে ফেব্রুয়ারী এই সংবিধান গৃহীত হয়। এরই ঠিক পূর্বে পূর্ববঙ্গে বন্যার প্রকোপ দেখা দেয়। বন্যা নিয়ে বাঙালীরা আরাে বেশি ব্যস্ত থাকুক। সংবিধান নিয়ে মাথা ঘামানাের সময় যেন তারা তেমন না পায়—হয়তাে এই কারণেই বন্যাত্রাণে অত্যন্ত গাফিলতি করে কেন্দ্রীয় ত্রাণদপ্তর। অবশ্য ১৫ই জানুয়ারী তারিখে ভাসানি হুমকি দিয়ে বলেছিলেন- পূর্ববঙ্গবাসীর উপর অবিচারের অবসান কেন্দ্রীয় সরকার না ঘটালে পূর্ববঙ্গ বিচ্ছিন্ন হয়ে সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠন করবে।’ (২৩) | ১৯৫৬-র ২৩শে মার্চ সংবিধান চালু হতেই ফজলুল হক হয়ে এলেন পূর্বপাকিস্তানের গভর্নর। পূর্ববঙ্গ নামটা এতদিন পাল্টাতে পারে নি শাসকচক্র। এবারে এই নামের সঙ্গে পূর্ববঙ্গবাসীর সাংস্কৃতিক গৌরবটাও মুছে দিতে প্রথম ধাপ নিল। হকের এতদিনের তাবেদারির কারণটা এবার বােঝা গেল। সােহরাবদি আইনমন্ত্রী থাকা কালে যুক্তফ্রন্টের ২১দফা সম্পর্কে নিশ্ৰুপ ছিলেন—এ অভিযােগ করে হক পূর্ববঙ্গবাসীর সহানুভূতি মােটেও পান নি। কেন্দ্রের অনুগত হয়ে নানা সুযােগ পেলেও তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ তিনি নিজ কর্মদোষেই শেষ করে এনেছেন। হকের যেহেতু ঐশ্লামিক সংবিধানে সম্মতি ছিল, হকের দল এবং আবু হুসেইনকে ছেড়ে প্রায় সব হিন্দু রাজনীতিক এসে জুটলেন আওয়ামি লীগে। যার নূতন নামে সাম্প্রদায়িকতার চিহ্নও আর ছিল না। এবং যৌথ নিবাচন যারা চাইতাে। আবু হুসেইন সরকার, হক-পন্থীদের ভরসায় সংখ্যাধিক্য রাখতে আর পারছিলেন না। হিন্দুদের। টোপ ফেলে, এমন কি রাষ্ট্রদূত করে, হিন্দু সদস্যদের সমর্থনের ব্যর্থ চেষ্টাও তিনি করে চললেন। এ সময় টোপ গিলতে লােকও জুটলাে অনেক প্রকার। মােট ৪০ জন মন্ত্রী এবং পার্লামেন্টারি সচিব পদ সৃষ্টি করে তিনি লােকসানাে এক বনাম অর্জন করলেন। তার ৪০ অনুগৃহীতের ললাকে নাম দিল—“আলিবাবা এবং তার ৪০ তস্কর’। লাইসেন্স, পারমিট ইত্যাদির দুর্নীতি এই বামের কারণ ছিল। (২৪)
সংখ্যালঘু সরকার মন্ত্রিসভা ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকার স্বার্থে স্পীকার নির্বাচনের উপলক্ষেই শুধু একবার প্রাদেশিক আইনসভার বৈঠক করতে দিয়েছিল। বড় দেরিতে শুধু বাজেট পাশ করার জন্য ১৯৫৬র ২২শে মের অধিবেশনে সরকারের মুরুব্বি এবং গভর্ণর হকের নির্দেশে অন্য আলােচনা নিষিদ্ধ হবার জন্য ক্রুদ্ধ স্পীকার আবদুল হাকিম, অতিবিলম্বের কারণে ঐ বাজেট পেশ হ’তেও না দিয়ে অধিবেশন স্থগিত করলে, সাংবিধানিক কারণে রাষ্ট্রপতি শাসন ৯দিন চলে। ফের ক্ষমতায় এসে হিন্দু সদস্যদের হাত করতে চেষ্টা করেও সফল না হয়ে হিন্দুদের ভারতের চর বলে নিন্দা করেন আবু হুসেইন সরকার। মুজবর রহমান-ই বাজেট পেশে বিলম্বের প্রশ্ন তুলে ধরেছিলেন। অতএব বিরােধী-স্পীকার যােগসাজশে অধিবেশন স্থগিত করা হয়েছে এমন রটনাও আবু হুসেইনপন্থীরা সে সময় করেছিলেন। এখন পুনর্বার ক্ষমতায় ফিরেও সংখ্যাগরিষ্ঠতার কোনাে সুযােগ করে নিতে পারলেন না হকের অভিভাবকত্বের সুবিধাভােগী এই আবু হুসেইন সরকার। (২৫)।
কেন্দ্রীয় সরকারী কর্তাব্যক্তিরা সব সময়ই চাইতেন সামরিক বাহিনীর প্রতি সাধারণের অবিশ্বাস কমাতে এবং রাজনীতিকদের সাধারণের শ্রদ্ধার আসন থেকে টেনে নামাতে। ১৯৫৬-র জুলাই মাসে পূর্ব পাকিস্তানের খাদ্যসমস্যার মােকাবিলায় সামরিক বিভাগের উপর আবু হুসেইন সরকার খাদ্যদ্রব্যের পরিবহন এবং বিতরণের দায়িত্ব অর্পণ করলেন। অসামরিক প্রশাসনের উচ্চপদস্থ ম্যাজিসট্রেট পর্যন্ত ঐ সামরিক কর্তাব্যক্তিদের রূঢ়তা সহ্য করতে বাধ্য হলেন। সরকার মন্ত্রিসভা তার অযােগ্যতা প্রমাণ করে সাধারণের মনে রাজনীতিকদের সম্বন্ধে অশ্রদ্ধা জাগিয়ে তুলছে—এই ধারণার বশবর্তী হয়ে এই জনগণধিকৃত এবং আবু হুসেইন-চালিত সরকারকে না ফেলে বরং জিইয়ে রাখতে চাইলেন কেন্দ্রীয় শাসকচক্র। ১৯৫৬-র ৪ঠা অগাষ্ট ভুখা মিছিলের পুরােভাগে ছিলেন মুজিবর রহমান। পুলিশের ব্যারিকেড সে মিছিলের গতিরােধ করতে না পেরে গুলি চালিয়ে কয়েকজনকে হত্যা করলে, মুজিবর স্বয়ং একটি মৃতদেহ তুলে ধরে মিছিলের পথে নেতৃত্ব দিয়ে চলেন। জনতার মন জয় করে নিল মুজিবের এই মহান্ দৃষ্টান্ত। হাইকোর্ট এ সময় যেরায় দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেটের অধিকার অথাৎ খাদ্যসংক্রান্ত অপরাধের বিচারের ক্ষমতা সামরিক বিভাগে ন্যস্ত হওয়াকে অসাংবিধানিক এবং বেআইনী বলেছিলেন, শীঘ্রই এক প্রশাসনিক ফরমান জারী হ’ল সেই রায়কেই বাতিল করে। বিচার বিভাগের উপরে ছড়ি ঘােরালাে প্রশাসন, জনগণের উপর সামরিক বিভাগ ! আবুর পুতুল-সরকার এই সব স্পষ্টতঃ অগণতান্ত্রিক ক্রিয়াকলাপের অংশীদার হয়ে রইলাে। অবশ্য এ সরকারের মেয়াদ ফুরিয়ে এসেছিল। (২৬) ।
১৩ই অগাস্ট বাজেট-অধিবেশন ডাকা হল। অধিবেশন শুরু হবার মাত্র চার ঘন্টা পূর্বে। আবু হুসেইনের অনুরােধে গভর্ণর সেই অধিবেশনের উপর স্থগিতাদেশ জারী করলে, স্পীকার বিরােধীপক্ষের তােলা প্রশাসনে সামরিক অনুপ্রবেশ নিয়ে আলােচনার অনুমতি দিলেন। ২০০ ভােট পড়লাে আবু-সরকারে অনাস্থা জানিয়ে। মােট ২৯৭ জন সদস্য সেদিন উপস্থিত। অধিকাংশ মন্ত্রীই হেনস্তা হবার ভয়ে গা ঢাকা দিয়েছিলেন। অনাস্থা প্রস্তাব তুলেছিলেন মুজিবর। স্পীকার কিছু সময় পরে অবশ্য সভাকক্ষ ত্যাগ করেছিলেন।
আইনসভার সদস্যরা তার পরেও দীর্ঘ সময় সভার অনুষ্ঠান করে চলেন। এই সময় প্রস্তাব নেওয়া হয় গভর্ণরকে বরখাস্ত করার দাবিতে। কারণ তিনি সংবিধান লঙঘন করে দলবিশেষের পৃষ্ঠপােষকতা করছেন। সােহরাবর্দি সংবাদ দেন, গভর্নরকে প্রাদেশিক আইনসভা ভেঙে দিতে বলেছিলেন আবু। এ অতি বড় গহিত কাজ। কেননা, ১৯৫৩র মার্চ থেকে বাজেট পাশ করানাে হয় নি। সােহরাবর্দি শাসকচক্রকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন—সামরিক বাহিনী শুধু হুকুম তালিম করবে যেমন করেছিল প্রথম সংবিধান রচনা পরিষদ ভেঙে দেবার সময়, তা কিন্তু নয়। একটু পশ্চাদৃষ্টি নিয়ে এই কথা বিচার করে এর মধ্যে সম্ভবতঃ আয়ুবশাহীর অভুত্থানের ইঙ্গিতই পাওয়া যাবে। (২৭)
| কে-এস-পিকে ক্ষমতার স্বাদ দিয়ে তার ঐক্য এবং ভাবমূর্তি নষ্ট করে কেন্দ্রীয় শাসকচক্র এবারে ঐ কর্তব্যগুলাে আওয়ামি লীগের দিকে টানলাে। আস্থা প্রস্তাব এড়াতে পারবে না, তার চাপ কেন্দ্র দিচ্ছে, অতএব ৩১শে অগাস্ট আস্থা প্রমাণ না করে পদত্যাগ-ই করলাে আবু সরকার। আতাউর রহমান আওয়ামি লীগের মন্ত্রিসভার মুখ্যমন্ত্রী হলেন। নামের মধ্যে থেকে মুসলিম শব্দ মুছে এবং যৌথ নির্বাচন চেয়ে হিন্দু সমর্থন ভালােই লাভ করেছিল আওয়ামি লীগ এ সময়। ৬ই সেপ্টেম্বর আতাউর-মন্ত্রিসভা গঠিত হলে সংখ্যাগরিষ্ঠের সরকার প্রতিষ্ঠত হয়ে দীর্ঘদিন পরে পালামেন্টারি গণতন্ত্রের পথে ফিরলাে পূর্ব পাকিস্তান। অবশ্য গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা মিজার অভিসন্ধি হতে পারে না। সামরিক বাহিনীর এই পূবর্তন অফিসার প্রশাসনের অভিজ্ঞতাসম্পন্নও। তাই তার পেটোয়া ডঃ খান সাহেবকে দিয়ে রিপাবলিকান পার্টি গড়ে বেশ কিছু মুসলিম লীগপন্থীকে নিজের দলে টেনে আনলেন তিনি। পূর্ব পাকিস্তানে ঐ সােহরাবর্দিদের লােভ-লালসাই আওয়ামি লীগের ঐক্য বিনষ্ট করে তার ইচ্ছা পুরণ করবে-রাজনৈতিক ছকটা তিনি কেটেছিলেন এই নিরিখেই। (২৮)
এবারে মুসলিম লীগ-যুক্তফ্রন্ট সমঝােতায় ফাটল ধরলাে। নূতন রিপাবলিকান দল, মুসলিম লীগের প্রতিপক্ষ হয়ে, আওয়ামি দলের সঙ্গে মিলে কেন্দ্রে সরকার গঠন করলাে। পূর্বতন প্রধান মন্ত্রী চৌধুরী মুহম্মদ আলি পদত্যাগ করলেন। নূতন প্রধানমন্ত্রী সােহরাবর্দি অবশ্য ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার বেশি কিছু না ভাবলেও, প্রকাশ্য সভায় ভাসানি-গােষ্ঠী তার মতের উপর নির্ভর না করে পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তির বিরুদ্ধে এবং পূর্বপাকিস্তানের স্বাধিকারের পক্ষে প্রস্তাব নিলেন। ঢাকার সেই জনসভায় সােহরাবর্দি মুখ বুজে সহ্য করলেন। সবই, যদিও তার সােচ্চার নীরবতা বুঝিয়ে দিল তিনি শাসকচক্রের প্রতিই আনুগত্য স্বীকার করে চলবেন এখন থেকে। যতাে তােক প্রধান মন্ত্রীর সম্মান তাে আর হেলার বস্তু নয়। সােহরাবর্দি এবং আতাউর পারমিট, লাইসেন্স ইত্যাদির সঙ্গে সরকারী পদে নিয়ােগের মাধ্যমে তাদের অনুগামীসংখ্যা বাড়িয়ে চললেন; এই সুযােগ ভাসানির ছিল না। ভাসানিকে কোণঠাসা করতে অবাধ স্বজনপােষণ অনুগৃহীত তােষণ ইত্যাদির ব্যবহার করলেন। জাতীয় ব্যবস্থাপক সভা বা সংসদেও প্রথমােক্ত উপদলের সদস্যরাই অধিক সংখ্যায় ছিলেন। এম, এন, এ বলতে আওয়ামী লীগ দলে ঐ সােহরাবর্দি-আতাউর অনুগামীরাই ছিলেন। যাও বা একজন ভাসানি-পন্থী ছিলেন, ডেপুটি মন্ত্রীপদ প্রদত্ত হ’তেই তিনিও পক্ষ বদল করলেন। অবশ্য কাগমারির সভাস্থলে ভাসানি পূর্বপাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্ন তুলে জনপ্রিয়তার বিচারে উপরে রইলেন। পাক পররাষ্ট্রনীতিরও তিনি সমালােচনা করেন কাউনসিল সভায়। সােহরাবর্দি তারই নেতৃত্বে চালিত নীতির পক্ষে বললেন। অতঃপর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ভারত এবং পাকিস্তান—উভয়দেশের হিন্দু মুসলমান প্রতিনিধি এবং ভারত সহ নানা দেশের স্মরণীয় ব্যক্তিদের নামে তােরণ ঐ অনুষ্ঠানকে জাতিধমতীত মর্যাদা দান করলাে। অথচ কুৎসাকারীরা ঐ কারণেই ভাসানিকে ভারতের চর বলে নিন্দা করলাে। (২৯)।
১৯৫৭-র ৩রা এপ্রিল অধ্যাপক মুজাফফর আহমেদ পূর্বপাকিস্তানের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন দাবি করে এবংকেন্দ্রের অধিকারসীমা মুদ্রাব্যবস্থা, পররাষ্ট্রনীতি এবং প্রতিরক্ষায় বেঁধে রাখতে চেয়ে প্রস্তাব তুললেন প্রাদেশিক আইন সভায়। মুজিবর তার আবেগময়। বক্তৃতায় প্রস্তাবকারীর ভাষণও যেন ম্লান করে দিলেন। মুখ্যমন্ত্রী আতাউর ঐদিন উপস্থিত-ই হন নি। যে-সােহরাবর্দি কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করার প্রাক্কালে ভাসানিকে লিখিতভাবে অঙ্গীকার করেন যুক্তফ্রন্টের সেই ২১-দফার জন্য লড়াই করে ব্যর্থ হলে পদত্যাগ করবেন, তিনি তখনাে কিছু করেন নি এবং এখন প্রধানমন্ত্রী হয়ে সরাসরি পূর্বপাকিস্তানের ন্যায্য স্বাধিকারের দাবিকে প্রতিহত করতে চাইছেন—এই তথ্য পেশ করতে ভাসানি ৫ই এপ্রিল একটি সাংবাদিক সম্মেলন ডেকেছিলেন। মুজাফ্ফর আহমেদের প্রস্তাব সম্পর্কে কেন্দ্রীয় আভ্যন্তরীণ মন্ত্রী বলেন, কেন্দ্র এই প্রকার ‘বিচ্ছিন্নতাবাদের কঠোর হস্তে মােকাবিলা করবে। আওয়ামি লীগ কাউনসিলের পরবর্তী সভা ১৩ এবং ১৪ জুন যখন অনুষ্ঠিত হ’লতার পূর্বেই বেশ কিছু ভাসানিপন্থী উপঢৌকন এবং অন্যায় সুযােগ-সুবিধার টানে সােহরাবর্দির উপদলে ভিড়ে গেছে। সভাস্থলে সােহরাবর্দির সরকারি কর্মচারী, পিয়ন ইত্যাদিও আওয়ামি লীগ কর্মী সেজে ঢুকে পড়ে। ভাসানি সভাপতি হওয়া সত্ত্বেও পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে ভাষণ শেষ না করে সভাস্থল ত্যাগ করতে বাধ্য হন অন্য উপদলের ভাড়াটে লােকদের উপদ্রবে। ইত্যবসরে পররাষ্ট্রনীতি সংক্রান্ত প্রস্তাব তড়িঘড়ি পাশ করানাে হয়। জনসাধারণকে স্তোক দিতে সােহরাবর্দি গােষ্ঠী আগামী নির্বাচনে দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে সংবিধান পাল্টে পূর্বপাকিস্তানের স্বাধিকার বিবেচনা করবে—একথা সেদিন বলেছিল ।(৩০)।
সােহরাবর্দির সুবিধাবাদের চূড়ান্ত রূপটি ফুটে ওঠে জাতীয় ব্যবস্থাপক সভায় হামিদুল হক চৌধুরীর শ্লেষাত্মক ভাষণে। তিনি বলেন, “যে সােহরাবর্দি এই সংবিধানকে কার্যকর হ’তে দেবেন না বলতেন এর পূর্বপাকিস্তান বিরূপতার কারণে এখন তিনিই বলছেন এই সং বিধান পূর্ব পাকিস্তানের ৯৮ শতাংশ দাবি পূরণ করেছে। অনুরূপ প্রাক্তন সংবিধানবিরােধীদের উচ্চপদে নিয়ােগ করা হলে নিশ্চয়ই শতকরা একশাে ভাগ দাবিই আদায় হয়ে গেছে বলা হবে। এর পরেই জুলাই-এর ২৫ এবং ২৬ তারিখে ঢাকা শহরে ভাসানি যেনূতন পাটি গঠনের কথা ঘােষণা করেন, সেই পার্টি বা জাতীয় আওয়ামি পার্টি পশ্চিম এবং পূর্ব উভয় পাকিস্তানে প্রবলভাবে নানা দলের নেতা এবং সমর্থকের সাধুবাদ লাভ করে। অচিরাৎ এর জনপ্রিয়তা এবং ক্ষমতা এতদূর বৃদ্ধি পায় যে পশ্চিম পাকিস্তান আইন সভার ক্ষমতার ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা এই জাতীয় পার্টির করতলগত হয়। পূর্বপাকিস্তানের আওয়ামি দলের-ও ভাসানি-অনুগামীরা এবং গণতন্ত্রীদল পর্যন্ত ভাসানির নূতন পার্টিতে যােগদানের অনুকূল অবস্থান গ্রহণ করলেন। ইতােমধ্যে এই পার্টির শক্তি বৃদ্ধি পাওয়াতে, রিপাবলিকান পার্টি এবং মুসলিম লীগ-ও এর সমর্থন আশা করতাে। অবশ্য সােহরাবদিও, তার ভাসানি-মুক্ত আওয়ামি লীগের সঙ্গে কে এস পি ইত্যাদির সুসম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করেছিলেন। তবে তাকে কেউ-ই বাধিত করেন নি। নূতন পাটির গঠনের কারণে ২৪শে জুলাই তারিখেই ভাসানি, আওয়ামি লীগ দল থেকে পদত্যাগ করার জন্য ইস্তফাপত্র পাঠিয়ে দেন ঐ দলের সম্পাদক মুজিবর রহমানের কাছে । (৩১)
পশ্চিম পাকিস্তানের জাতীয় পার্টি এবং পূর্বপাকিস্তানের ভাসানিপন্থী আওয়ামি লীগের অংশটুকু এবং সেই সঙ্গে পূর্বপাকিস্তানের গণতন্ত্রী দল একত্র হয়ে জাতীয় আওয়ামি পার্টি গঠিত হলেও প্রাক্তন আওয়ামি লীগের প্রধান দাবি এবং প্রাক্তন জাতীয় পার্টির প্রধান দাবি অথাৎ পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন এবং একীভূত পশ্চিম পাকিস্তান প্রদেশের পূনবিভাজন বিশেষভাবে অন্তর্ভূক্ত ছিল এই নূতন পার্টির ইশতেহারে। অবশ্য পশ্চিম খণ্ডের ভিন্ন প্রদেশদের যােগসূত্র তথা সংহতির উদ্দেশ্যে একটি আঞ্চলিক ফেডারেশন গঠনের কথা এই ইশতেহারে উল্লেখ করা হয়েছিল। অবশ্য ২৫ এবং ২৬ শে জুলাই নূতন দলের অধিবেশনে সােহরাবর্দি স্বয়ং প্রশাসন এবং গুণ্ডাবাহিনীর জঘন্য ব্যবহার করে প্রতিপক্ষ দলের অনুষ্ঠান। সূচি বানচাল করতে গিয়ে রাজনীতিকদের চরিত্রে কলঙ্ক লেপন করেন। একবার কে, এস, পি একবার সংখ্যালঘু – কোন মহলেই সমর্থন পাকা করতে না পারলেও, প্রাসাদ-ষড়যন্ত্রের। বাদশাহী রাজনীতির পথে পশ্চিম পাকিস্তানের বাঙালী-বিদ্বেষী গভর্ণর গুরমানির সাহায্য নিয়ে সােহারাবর্দি এর আগেই যে ব্যর্থ হন মিজাকে হটাতে, সেই পরাজয়ের গ্লানি যেন ঐ ভাসানি, সীমান্ত গান্ধী, বালুচি গান্ধীদের কনভেনশনে গুন্ডামি দিয়ে কথঞ্চিৎ মােচন করলেন। নিক্ষিপ্ত ইষ্টকখণ্ডে আহত বহিরাগত বর্ষীয়ান নেতারা সেদিন সভাস্থল ত্যাগ করে গেলেও, সমগ্র পাকিস্তান জুড়ে এই নূতন দল যে সাড়া জাগায়, তাকে প্রতিহত করার ক্ষমতা সােহরাবর্দির হয় নি কোনক্রমেই। রিপাবলিকান পার্টি এখন পশ্চিম পাকিস্তানের একীভ বনের বিরুদ্ধে গেলে, সােহরাবর্দি তাঁর পূর্বতন মত বদলে ঐ সংযুক্ত পশ্চিমপাকিস্তানকেই সমর্থন করতে শুরু করলেন। এত করেও মিজা-খান সাহেব অক্ষের কোন ক্ষতিই সােহরাবন্দি করতে পারেন নি। তাঁর মুরুবি গুরমানিকেই বরং মিজা বরখাস্ত করেন। কে, এস, পি-র আজিজুল গােষ্ঠীর সঙ্গে আঁতাতও সােহরাবর্দির হ’ল না। আজিজুলের দাবি—মােচায় অমুসলিমদের রাখা চলবে না। এটা মানা সােহারাবর্দি বিচক্ষণতার কাজ মনে করেন নি। (৩২)। | সােহারাবর্দিকে প্রধান মন্ত্রী পদে সহ্যই করতে পারছিলেন না খান সাহেব। এক বছর প্রধানমন্ত্রী পদে এসে তার মধ্যে ২০০ দিন দেশের বাইরে কাটিয়েছেন সােহরাবদি। তাঁর নিজস্ব আওয়ামি লীগ দলভুক্ত মন্ত্রীরা যাতে পালা করে বিদেশ ভ্রমণ করার সুযােগ পান। এবং তাঁর অনুগামীদের যাতে বরাত খুলে যায় সে সব ঠিক ঠিক দেখতেন সােহরাবর্দি। বড় মাপের দুর্নীতির অভিযােগ তাঁর বিরুদ্ধে এবং তাঁর অনুগামীদের বিরুদ্ধে ছিল। আগামী নির্বাচনের মাধ্যমে মিজাকে সরানাে যাবে এই আশায় এবং রিপাবলিকান দলের সমর্থনে প্রধান মন্ত্রিত্ব লাভ করা সত্ত্বেও, ভবিষ্যতের চিন্তা থেকে সােহরাবর্দি এই সময় নির্বাচনের দাবি করতে থাকেন। রিপাবলিক্যানদের অনেকের সঙ্গে তিক্ততা সৃষ্টি হবার কারণে প্রকাশ্য জনসভায় পর্যন্ত তিনি রিপাবলিকান দলের নিন্দা করে চলেন। এমন সময় বিনা মেঘেই ।
হ’ল বজ্রপাত। মিজা, ১১ই অক্টোবর সােহরাবর্দিকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করলেন। সংসদে শক্তিপরীক্ষার সুযােগও তাঁকে দেওয়া হল না। সােহরাবর্দিকে অপমান করে তাড়াবার প্রতিবাদে পূর্বপাকিস্তানে আওয়ামি লীগ হরতাল ডেকেছিল। সে হরতালের ডাকে জনসাধারণ সাড়া দেন নি। হরতাল সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। যৌথ নির্বাচন চালু করা ছাড়া সােহরাবর্দির আমলে ভালাে কিছু হয় নি। ১৯৫৬র অক্টোবরে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য এবং ১৯৫৭র এপ্রিলে পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য যৌথ নিবাচন নীতি গৃহীত হয়। অন্যান্য মুসলিম দেশে যৌথ নির্বাচন প্রথার নজির দেখিয়ে এবং আহমাদি দাঙ্গার মতাে সম্ভাবনা এড়াতে সােহরাবর্দি স্বতন্ত্র নির্বাচন প্রথাকে দূরে রাখা প্রয়ােজন মনে করেন। দেশের দুইখণ্ডে একই প্রকার যৌথ নির্বাচন দেশের অখণ্ডতার প্রয়ােজনেই বিবেচ্য একথাও তিনি বলেন। অবশ্য সােহরাবর্দিকে প্রধান মন্ত্রিত্ব থেকে অপসারণ করার সময় রিপাবলিকানরা, স্বতন্ত্র নির্বাচন সমর্থনের কথা বলে মুসলিম লীগকে জোটের মধ্যে টেনে আনে। অন্যদিকে কে, এস, পি-র হামিদুল হক চৌধুরী পরিচালিত উপদলকে জোটে নিয়ে সরকারের হাত শক্ত করতে গিয়ে উল্টো কথাই তারা বলে চলে ; তারা হামিদুলের জন্য যৌথ নির্বাচনের সমর্থক সাজে। অর্থাৎ সােহরাবর্দিকে দূর করে দিল যে- রাজনীতি, সততার বড়াই তারও সাজে না।(৩৩)।
| রিপাবলিক্যান-মুসলিম লীগ জোটের সরকারে প্রধান মন্ত্রী করা হ’ল আই, আই, চুন্দ্রিগড়কে। চুন্দ্রিগড় কেন যৌথ নির্বাচন হলে সরকারী সংস্রব ত্যাগ করতে চাইতেন জামাত-ই-ইসলামি পাকিস্তানের একটি শ্বেতপত্রে তা-ই বিবৃত ছিল – বলা চলে। পূর্ব পাকিস্তানে ৮৯ টি আইনসভা আসনে হিন্দু ভােটার অন্ততঃ ১২ শতাংশ এবং তাদের মেয়েরাও বেশ ভােট দিয়ে থাকে। এর মধ্যে ১৪ টি আসনে হিন্দুরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ, ৩৫ টিতে হিন্দুরাই মােট ভােটারের ৩৬ থেকে ৪৯.১৯ শতাংশ। অতএব পূর্ব পাকিস্তানে যৌথ নির্বাচন চালু হলে হিন্দুরা ঐ অংশে রাজনৈতিক প্রভাব তাে ফেলবেই, তাদের ছায়া এসে কেন্দ্রে-ও পড়বে। রিপাবলিক্যানরা অবশ্য পূর্ব পাকিস্তানে যৌথ বনাম স্বতন্ত্র নির্বাচন প্রশ্নে সরেজমিন তদন্তের ব্যবস্থা করে অধিকাংশ পূর্বপাকিস্তানীর অভিমত পরখ করতে একটি প্রতিনিধিদল পাঠালেন। জাতীয় আওয়ামি পাটি সঙ্গে সঙ্গে সর্বদলীয় কমিটি স্থাপন করে। যৌথ নিবাচনের পক্ষে প্রচারে নামলাে। আওয়ামি লীগও একই বক্তব্য পৃথক মঞ্চ থেকে। প্রচার করে হৃত রাজনৈতিক জমি পুনরুদ্ধারে লেগে পড়লাে। সােহরাবর্দি বললেন স্বতন্ত্র নির্বাচন হলে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে যে সব এলাকায় তাদের নিয়ে হিন্দুরা দাবি করবে। নিজস্ব বাসভূমি বা প্রদেশ। এ ভূমি অতঃপর ভারতেই যােগ দেবে। অর্থাৎ যৌথ নিবাচনই সঙ্গত। স্বতন্ত্র নির্বাচনের বিরুদ্ধেই ঐ কেন্দ্রীয় তদন্ত টীম মতপ্রকাশ করে। চুন্দ্রিগড় এর প্রতিবাদে পদত্যাগ করেন। (৩৪)।
মালিক ফিরােজ খাঁ নুন নূতন প্রধান মন্ত্রী হলেন। মির্জা এবারে চাল বদল করে বরং মুসলিম লীগ দলকেই মদত দিয়ে চললেন। রিপাবলিকানদের প্রভাব বেড়ে যাওয়াতে এটা করতে হ’ল। অবশ্য রাজনীতিকদের ঐক্য নষ্ট করাই মিজর প্রথম লক্ষ্য। দলাদলি, রেষারেষির টানাপােড়েনে সােহরাবর্দিকেও আমল দিতে হ’ল প্রধান মন্ত্রী নূনকে। সােহরাবর্দির আওয়ামি লীগের সংসদীয় সমর্থন এখন তাঁর প্রয়ােজন। পূর্বপাকিস্তানে মুখ্যমন্ত্রী আতাউর, মুজিবর-অনুগামীদের প্রিয় ছিলেন না। মুজিবরও মুখ্যমন্ত্রী পদে যােগ্যতর ভাবতেন নিজেকে। প্রাদেশিক স্তরে আওয়ামি লীগের এই অনৈক্য সত্ত্বেও, কেন্দ্রে সােহরাবদিহ নেতা বিবেচিত হতেন। সােহরাবর্দি নির্বাচন দাবি করতে শুরু করলেন। ঐ পথেই স্বেচ্ছাচারী কুচক্রী মিজাকে দূর করতে চান তিনি। মিজাও নির্বাচনের বিরুদ্ধে, রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে প্রচার চালালেন। সংবিধান চালু হবার পরেই সাধারণ নির্বাচনের উদ্যোগ নেওয়া উচিত ছিল – এই ছিল আওয়ামি লীগের প্রচার কৌশল। নিবচিনবিধি যৌথ হবে না স্বতন্ত্র হবে – এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের মীমাংসা ছিল না সংবিধানে। এর সুযােগেই শাসকচক্র যে নির্বাচন শিকেয় তুলে রেখেছে – একথাও বলা হ’ল ঐ সব প্রচারাভিযানে। নির্বাচনের অনুষ্ঠান বন্ধ করতে, মিজা-এ সময় নতুন করে মুসলিম লীগের মাধ্যমে যৌথ নির্বাচন বিধি খারিজ করার কাজে নেমে পড়লেন। নির্বাচন যতাে পিছিয়ে যাবে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার দৌড়ে মির্জা ততােই এগিয়ে যেতে পারবেন। অতএব নির্বাচনে বাগড়া দাও। নিবার্চন-বিধি নিয়ে বিতণ্ডা ফের চালু করাে। অবশ্য চৌধুরী মুহম্মদ আলি বা সােহরাবর্দি-ও প্রধান মন্ত্রী পদে আসীন থেকে প্রতিশ্রুতিমতাে নির্বাচন-অনুষ্ঠানের উদ্যোগ গ্রহণ করেন নি – একথাও সত্য। কারণ ঐ পিচ্ছিল পদে থেকে পদচারণা করলে পদসস্থলনেরই সম্ভাবনা। স্রেফ বসে থেকে বা ক্ষমতার দালালদের পদচিহ্ন ধরে চললে, প্রধান মন্ত্রিত্বের মেয়াদ। তবু দু দণ্ড বাড়তে পারে। সুতরাং ওঁরাই বা মেয়াদ কমাতে সক্রিয় হবেন কেন? ১৯৫৮ র ২৯ শে জানুয়ারি মুজিবর সংসদ-ভাষণে জানতে চান – সংবিধান পাশ করার তিনবছর পরেও কোন অদৃশ্য হাতের খেলায় ভােটগ্রহণ হ’ল না? ভােটার তালিকার পর্যন্ত প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয় নি। করিম বলেন – বিগত সংসদের সদস্যদের মতােই আমরা কিছু করি না, আবার সংসদ ছাড়িও না। ইচ্ছে করি সংসদটা এভাবেই থেকে যাক। কিন্তু তবুও বিগত সংসদটিকে ভেঙে দেওয়া হয়েছিল।(৩৫) | সামরিক শাসন প্রবর্তনের অশুভ ইঙ্গিত এল ১৯৫৭ র ডিসেম্বর নাগাদ। ও, সি, ডি বা অপারেশন ক্লোজড ডাের অর্থবহ শব্দসমষ্টি নয়। রুদ্ধকক্ষ কার্যক্রম বললে কাৰ্যটাই যে কী তা অস্পষ্ট থেকে যায়। স্পষ্ট অবশ্য দ্রুত হ’ল। পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান চোরাচালান রদে সামরিক বাহিনীর সাহায্য চেয়ে বসলেন। এই বাহিনী শুধু চোরাচালান বন্ধ করতে এল তা নয়। জনসাধারণের উপর এবং বিশেষত সংখ্যালঘুদের উপর প্রতিহিংসা। চরিতার্থ করলাে তারা। একাধারে সেনা, ম্যাজিসট্রেট, বিচারক সব দায়িত্ব নিজেদের হাতে তুলে নিয়ে অবিভক্ত ভারতের আমলের কিছু কলমদানি রাখার দায়ে হেনস্থা করে তারা। একজনকে। উপযুক্ত সরকারি পারমিট নিয়ে কিছু পণ্য মজুত করে সাজা পেল এক দোকানী। এই সব তথ্য সংসদে পেশ করেছিলেন হামিদুল হক চৌধুরী। একজন উচ্চশ্রেণীর আইনজ্ঞ হিসাবে তিনি নিজে এই ঘটনাগুলাে পরখ করে দেখেছিলেন। অবশ্য চোরাচালান বলে অপরাধমূলক কার্যকলাপের মধ্যে যতােই ফেলা হােক, হরিয়ানা থেকে আসা গবাদি পশু কিংবা ভারতে চালান দেওয়া সুপারি বা পাট – পূর্ব পাকিস্তানের জনজীবনের বাস্তব অর্থনীতির অপরিহার্য অঙ্গ। এসব বন্ধ করলে প্রাণে মারা পড়বেন অনেক স্বল্পবত্ত কৃষক তথা ব্যবসায়ী। এ সবের আমদানি এবং রপ্তানির বিকল্প বাজার সৃষ্টি না করে, চোরাচালানবিরােধী ভাবাবেগ খাইয়ে সংশ্লিষ্ট মানুষগুলােকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে না – এই।শ্লেষােক্তি করেন সংসদভবনে হামিদুল স্বয়ং। (৩৬)
অন্যদলভুক্ত প্রতিদ্বন্দ্বীদের কাবু করতে ও, সি, ডি-র ব্যবহার করতে আতাউর বড় উৎসাহ পেতেন। কিন্তু এই ও, সি, ডি-ই তাঁর নিজের কাল হ’ল। হিন্দুদের সম্পত্তিলুঠ, নারী-শিশু অপহরণ, অন্যান্য উৎপীড়ন ও,সি,ডি চালালাে। আতাউর, এ সব বন্ধ না করে গুজব বলে উড়িয়ে দিলে ও, সি, ডি যা চাইছিল তা-ই হ’ল। আতাউর-সরকার, সংখ্যালঘু সমর্থন খােয়ালাে। জাতীয় আওয়ামি পার্টির মামুদ মুলতবি প্রস্তাবের উপর বিতর্ক কালে বলেন, আতাউর সমরনায়কদের অভিসন্ধির কাছে আত্মসমর্পণ করে ও, সি, ডি কে আহ্বান করে এনেছেন। অবশ্য আওয়ামি লীগের এই আতাউর পরিচালিত মন্ত্রিসভা ফেলে দিতে চাইছিল যে কে, এস, পি এবং মুসলিম লীগ, তারা কট্টর সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে জোট বেঁধেছিল বলে ভাসানি তথা পশ্চিম পাকিস্তানী নেতৃবৃন্দ আদেশ করা সত্ত্বেও পূর্বপাকিস্তান আইন সভার জাতীয় আওয়ামি পার্টির সদস্যরা আতাউর- সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা-ভােট দিয়ে অনুপস্থিত থাকেন। ফলে, আতাউর সরকার এ যাত্রা বেঁচে যায়। সরকার ফেলে দিলে ঐ কট্টর সাম্প্রদায়িক শক্তি ফের রক্তক্ষয়ী দাঙ্গায় সংখ্যালঘু নিধন করে ছাড়তাে। তা ছাড়া রাজনৈতিক অস্থিরতার অজুহাতে কেন্দ্র হয়তাে পালামেন্টারি শাসন ব্যবস্থাই বানচাল করে দিত। অনির্দিষ্ট কালের জন্য ঐ অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই সেক্ষেত্রে চলতাে। অবশ্য জাতীয় আওয়ামি পার্টি বা ন্যাপের বিধায়কদের কাজের ফলে আতাউর – মন্ত্রিসভার পতন কিঞ্চিৎ বিলম্বিত হলেও প্রতিহত হয়নি। (৩৭)।
পূর্ব পাকিস্তানী রাজনীতিকরাও কতাে অপরিণামদর্শী তার প্রমাণ অচিরেই মিললাে। ১৬ই এপ্রিল পর্যন্ত যে-প্রাদেশিক আইনসভার অধিবেশন চলার কথা, ৩১শে মে, বাজেট পর্যন্ত পেশ না করে তাকে স্থগিত করতে গভর্নর ফজলুল হককে অনুরােধ করে বসলেন আতাউর। হক, রাজী হলেন না এবং জানালেন আতাউর মন্ত্রিসভার সংখ্যাগরিষ্ঠতাই নেই। ক্রুদ্ধ আতাউর ৩১শে মে তারিখেই প্রধানমন্ত্রীকে অনুরােধ করলেন ‘হককে হটান। সঙ্গে সঙ্গে হকই ঐ একই দিনে আতাউরকে বরখাস্ত করে নিজ পেটোয়া আবু হুসেইন সরকারকে মুখ্যমন্ত্রী বানালেন। আবুর কথায় ঐ হক-ই এবারে আইনসভা স্থগিত করে দিলেন। শেষে সমর্থন তুলে নেবার ভয় দেখিয়ে সােহরাবদি বাধ্য করলেন নূনকে ঐ হককে বরখাস্ত করতে। প্রধান সচিব হামিদ আলি ১লা এপ্রিল থেকে অস্থায়ী গভর্নর হলেন। অবাঙালী হামিদ, ১২ ঘন্টা আগে সৃষ্ট মুখ্যমন্ত্রী আবুকে দিলেন বরখাস্ত করে। গভর্ণর হবার এক ঘন্টার মধ্যেই হামিদ ফিরিয়ে আনলেন আতাউর-চালিত সরকারটি। এই নিয়ােগ- বরখাস্তের চালাচালি শেষ হ’ল মুজিবর আনীত আস্থাজ্ঞাপক প্রস্তাবের পক্ষে আতাউর সরকার আইন সভার সম্মতির প্রমাণ পেলে। (৩৮)। | এর পরে ১৮ই জুন আইনসভায় পরাজয় বরণ করে আতাউর পদত্যাগ করলে ফের আবু মুখ্যমন্ত্রী হন। ২২শে জুন হট্টগােলের মধ্যে মুজিবর আনীত অনাস্থা প্রস্তাবের পরিণামে আবু-ও পদত্যাগ করলে, ২৫শ জুন প্রেসিডেন্টের আদেশে পালামেন্টারি শাসনব্যবস্থার উপর স্থগিতাদেশ জারী হয়। আওয়ামি লীগ, নূনকে বলে কয়ে ২৫শে অগাস্ট আতাউরকে ফের মুখ্যমন্ত্রিত্বে ফিরিয়ে আনেন। পূর্বপাকিস্তানে স্বায়ত্বশাসনের বিরােধিতা করেছিলেন সােহরাবর্দি সে কথা ভুলে তাঁর অনুগামী আওয়ামি লীগ পুনরায় ঐ মর্মে প্রচার চালিয়ে জনপ্রিয়তা অর্জনে সচেষ্ট হ’ল। মিজাকে না সরালে গণতন্ত্র বিপন্ন হবে – এমন কথা পর্যন্ত উচ্চারণ করলেন মুজি। ভারতে তৃতীয় সাধারণ নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে একথা বলে সােহরাবর্দি অনুযােগ করেন, পাকিস্তানে আজও একটা সাধারণ নির্বাচন হ’ল না। (৩৯)।
১৯৫৮-র সেপ্টেম্বরে মিজা স্বাক্ষর করলেন ১৯৫৯ এর ফেব্রুয়ারীতে অনুষ্ঠিতব্য সাধারণ নির্বাচন বিলে। এদিকে আজিজুল, হামিদুলের শত্রু, পুরানাে কে, এস, পির আমল থেকেই। সেই হামিদুল এখন কেন্দ্রেরমন্ত্রী তাে হয়েইছেন, সােহরাবর্দির সঙ্গেও মাখামাখি। করছেন। হামিদুলকে জব্দ করা যাবে সােহরাবর্দির দল আওয়ামি লীগের আতাউর-চালিত মন্ত্রিসভা খারিজ করতে পারলে। স্পীকার আবদুল হাকিম আবার এই আজিজুলের বন্ধু। আওয়ামি লীগের এর ফলে আশঙ্কা দেখা দিল, স্পীকার বিরােধীদের মদত দিয়ে আতাউরসরকার ফেলে দেবেন। এই স্পীকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনলাে আওয়ামি লীগ।
স্পীকার তাঁর পদাধিকার বলে ঐ অনাস্থা প্রস্তাব তুলতেই দিলেন না। নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ লঙঘন করে সরকারি উকীল ইত্যাদি পদে নিযুক্ত ছয়জন আওয়ামী লীগ বিধায়ককে সভাকক্ষ থেকে তাড়াবার চেষ্টা ব্যর্থ হয়। বিধায়ক ও বহিরাগতদের দৌরাত্ম্যে ২০ শে সেপ্টেম্বর, ১৯৫৮ র আইনসভা কক্ষ হয়ে ওঠে রীতিমতাে নারকীয় তাণ্ডবক্ষেত্র। স্পীকার সভাকক্ষ ত্যাগ করেন। পরে ঐদিন তাঁর বিরুদ্ধে দুটি প্রস্তাব পাশ করা হয় ঃ একটিতে তাঁর বিরুদ্ধে অনাস্থা ব্যক্ত হয়, অন্যটিতে তাঁকে বিকৃতমস্তিষ্ক প্রতিপন্ন করা হয়। (৪০)।
২৩ শে সেপ্টেম্বর যখন প্রাদেশিক আইনসভার অধিবেশন শুরু হতে চলেছে তখন আতাউর-সরকার নিরাপদ অবস্থানে পৌঁছে আছে। কে, এস, পির অথাৎ বিরােধীদলভুক্ত কিছু সদস্যকে টাকা দিয়ে হাত করেছিল আওয়ামি লীগ। সরকার পক্ষ সেনা, পুলিশ ইত্যাদির জোরে হাকিমকে সভাকক্ষে ঢুকতে দেয় নি, যদিও ডেপুটি স্পীকার সাহিদ আলি ঢুকে পড়েন এবং হাকিমের বদলে তিনিই স্পীকারের আসন দখল করেন। বিরােধী সদস্যরা হাতের কাছে যা কিছু পেয়েছিলেন – তা সে চেয়ার, মাইক্রোফোন রড যাই হােক – তাই ছুড়ে অচৈতন্য এবং আহত করেন সাহিদকে। সাহিদকে হাসপাতালে দেওয়া হয়। পুলিশ। ইত্যাদি দাঙ্গারত বিরােধীদের অনেককেই সভাকক্ষ থেকে বহিষ্কৃত করে দেয়। এতে ধস্তাধস্তিও হয়। সরকার এত সব সত্ত্বেও অপর একজনকে স্পীকারের চেয়ারে বসিয়ে সভার কাজ চালিয়ে যায় ঐ যুদ্ধক্ষেত্র শান্ত হয়ে এলে। ২৪ শে সেপ্টেম্বর আইনসভা স্থগিত করা হয়। ২৬ শে ঐ হাসপাতালেই সাহিদ আলির মৃত্যু হয়। (৪১)।
পাকিস্তানে পালামেন্টারি গণতন্ত্রের মেয়াদ ফুরিয়ে আসছিল। নানা দলকে খুসি রেখে মন্ত্রিসভা বাঁচাতে গিয়ে নূন মন্ত্রিসভায় এক সময় দু’জন অর্থমন্ত্রী ছিলেন – আমজাদ আলি এবং হামিদুল হক চৌধুরী। অবশ্য শীঘ্রই আওয়ামি লীগ প্রতিনিধিরা ঐ মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়েন। তখন অর্থমন্ত্রী পদের দ্ব্যর্থকতা দূর হয়। কিন্তু এ সবই অর্থহীন হয়ে পড়লাে ৭/৮ অক্টোবরের রাতভর রাজনৈতিক নেতাদের যখন গ্রেপ্তার করলাে সামরিক কর্তৃপক্ষ। ৮ ই অক্টোবর সমরবিভাগের করা খসড়া হু ছেপে প্রভাতী পত্রিকাগুলি তার শিরােনাম-সংবাদে জানালাে, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট মিজা, সংবিধান, সংসদ, প্রাদেশিক আইনসভা এবং কেন্দ্রীয় তথা প্রাদেশিক মন্ত্রিসভা সব বাতিল বা বরখাস্ত করে দিয়েছেন। সেনাবিভাগের সর্বাধিনায়ক জেনারেল মুহম্মদ আয়ুব খানকে মুখ্য সামরিক প্রশাসক এবং ১৯৫০- এর সাম্প্রদায়িক ধ্বংস লীলার প্রধান স্থপতি আজিজ খানকে সহকারী মুখ্য সামরিক প্রশাসক পদে নিযুক্ত করেছেন প্রেসিডেন্ট মিজা— এ সংবাদও প্রকাশ পেল। এর পরে মিজা, আয়ুবকে প্রধান মন্ত্রীর শিরােপা দান করলেন। মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যেই মিজাও পদ ত্যাগ করলে আয়ুব প্রেসিডেন্ট হয়ে প্রধান মন্ত্রী পদের বিলােপ সাধন করেন। আয়ুব একথাও বলেন, মিজা পদত্যাগ করেছেন ঘটনা এমন নয়। মিজাকে তিনিই নাকি বরখাস্ত করেছেন। নিয়ােগকারীকে বরখাস্ত করার বৈধতার প্রশ্ন অবশ্য সামরিক বাহিনীতে অবান্তর। (৪২)
আয়ুবের অন্যতম জীবনীকার, মহম্মদ আহমদ লিখেছেন, গুলাম মহম্মদ একাধিকবার আয়ুবকে বলেছিলেন সরকারের দখলদার হতে। কিন্তু গুলাম মহম্মদের চেয়েও ক্রুর সব। চাল চেলে পরবর্তী প্রেসিডেন্ট মিজা, রাজনীতিকদের ঐক্য, আদর্শবাদ এবং শক্তি শেষ। করে আনার পরেই আয়ুব ক্ষমতা গ্রাস করলেন। আয়ুব-ই পশ্চিম পাকিস্তানকে এক প্রদেশে। পরিণত করার প্রধান হােতা, এবং সলেরির সেই অভিমত যে, সামরিক শাসন না চাপালে ঐ কৃত্রিম পশ্চিমপাকিস্তানী ঐক্য ধ্বংস হ’ত – এ সবই তকাতীত। কিন্তু আসল কথাটা বলে গেছেন কে, জে, নিউম্যান – যে-সংবিধান মাত্র আড়াই বছর আগে পাশ হয়েছে তার। কার্যকারিতা পরখ করার মতাে যথেষ্ট সময় না কাটতেই, মিজা তার উৎসাদন করে কী বুঝিয়ে দিচ্ছেন না যে, গণতান্ত্রিক ঐ প্রথা চালু থাকলে তিনি আর ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারবেন না বলেই সে সবের সমূলে উৎপাটন করতে হল। নিউম্যানের এই বক্রোক্তি আসলে সরল এবং সত্য তাৎপর্য বহন করে। গুলামের হিংস্র আঘাত সংবিধান গৃহীত হওয়া শেষ মুহূর্তে বানচাল করেছিল। আয়ুবের আঘাত-ও সাধারণ নির্বাচন আসন্ন এমন দিনে এল। আক্রান্ত অবশ্য উভয়ক্ষেত্রেই গণতন্ত্রকামী রাজনীতিকরা। আয়ুব অবশ্য গণতন্ত্রের পয়লা নম্বর শত্রু মিজাকেও হটিয়ে দেশত্যাগী হতে বাধ্য করেন। তার কারণ নিশ্চয়ই প্রতিদ্বন্দ্বিতাভীতি। অবশ্য সামরিক প্রশাসনের খবরদারির মধ্যে রাজনীতিকদের স্বাধীন ভাবে কাজের সুযােগ কোনােদিনই ছিল না। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে জোর করে উৎখাত করে তার আযােগ্যতাকে এই বিলােপের কারণ বলাটা যে ভণ্ডামি এই মত এ প্রসঙ্গে প্রকাশ করে উইলক আসলে সত্যটাই উদ্ঘাটিত করেছেন। (৪৩)।
১৯৫৪-৫৮ র বছরগুলােতে পূর্বপাকিস্তানের উপর পশ্চিমপাকিস্তানী শােষণ-পীড়নের কোনাে হেরফের হয় নি। অথচ পূর্ব পাকিস্তানী সরকার কেন্দ্রের বরাদ্দ অর্থ খরচ করতে ব্যর্থ হয় – এ অপবাদ পশ্চিমী তথা কেন্দ্রীয় মহল রটাতাে। সংসদ কক্ষে একবার মুজিবর তিক্তকণ্ঠে এই অপবাদের পেছনে যে তা আছে তা ফাস করে দিতে গিয়ে বলেন – পরিকল্পনামতাে কাজ শুরু করতে গিয়ে দফায় দফায় প্রশাসনিক বিভাগগুলাের দরজায় ধরনা দিতে দিতে, ঐ কাজের মেয়াদ ফুরিয়ে যায় বলে টাকা ফিরে যায়। কেন্দ্রীয় আমলাদের বাধাতেই পূর্ব পাকিস্তান সরকার সময়মতাে কাজ তুলতে পারেন না। প্রধানমন্ত্রী সােহরাবর্দির উদ্যোগে বৈদেশিক সহায়তা প্রাপ্ত ৫৮ টি শিল্পোদ্যোগ অঙ্কুরে বিনষ্ট হয়। সােহরাবর্দির পতনের পর সবটাই চাপা পড়ে যায়। অথচ ঐ ৫৮ টি উদ্যোগ কার্যকর হলে পূর্ব পাকিস্তান বিশেষভাবে উপকৃত তাে হতই, পশ্চিম পাকিস্তানও হ’ত। কেন না, দুখণ্ডেই কিছু কিছু শিল্প স্থাপনের ভাবনাচিন্তা ঐ প্রকল্পে ছিল। ফিরােজ খাঁ নূন তখনকার পূর্ববঙ্গ সরকারের উপর কেন্দ্রের পেষণের একটি দৃষ্টান্ত গণপরিষদে তুলে ধরেছিলেন। কেন্দ্রীয় ভাণ্ডার ভিন্ন অন্য উৎস থেকে কোনাে শিল্পজাত দ্রব্য স্বাধীনভাবে ক্রয় করার অধিকার পূর্ববঙ্গ সরকারের ছিল । এমন কি, তিন-চার টাকা দামের যে পাম্প তারও কয়েকটা কিনতে পারে নি একবার ঐ পূর্ববঙ্গ সরকার। কারণ ঐ জলের পাম্প ঘটিত পরিকল্পনাটি কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমােদন লাভ করে নি। পূর্বপাকিস্তানের ছােট ব্যবসায়ীদের নিজদেশের আভ্যন্তরীণ বাজারে পণ্য পৌছে দেবার রাস্তাই ছিল না বহু ক্ষেত্রে। প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য করে তারা জীবিকা নির্বাহ করতাে। এদিকে ও, সি, ডির ছুতােয় চোরাচালানের উপরে খড়হস্ত কেন্দ্রীয় তদন্ত কমিটি ঐ রাস্তার সমস্যার সরেজমিন তদন্তে আসেন। স্থানীয় মানুষের ভাষা সম্পর্কে অজ্ঞ এই কেন্দ্রের চরবাহিনী কারুর সমস্যাই তেমন কানে নেয় নি। নিলেই কী বুঝতাে কিছু, ভাষাই যেখানে বাধা! তাঁরা আরামে বিলাসে থেকে টি, এ ইত্যাদি ভাতা হাতিয়ে প্রভুকে খুসি করার মতাে রিপাের্টই পাঠালেন। পূর্ববঙ্গে নতুন রাস্তার কোনাে প্রয়ােজন নেই। গণপরিষদে এবং সংসদে পূর্ব পাকিস্তানীরা এই দুরভিসন্ধি প্রসূত প্রতিবেদনের তীব্র সমালােচনা করেও কোনাে সুফল লাভ করেন নি। (৪৪)। | কেন্দ্রীয় সরকার, ১৯৪৭-৪৮ থেকে ১৯৫৫-৫৬ র বছর গুলােতে প্রতিরক্ষা-ব্যয় করেছিল মােট ৭০৫.৭০ কোটি টাকা, যার সবটাই পশ্চিম পাকিস্তান অংশের কাজে এসেছিল। ১৯৫৬-র ১৬ ই জানুয়ারী আবুল মানসুর আহমদ, কেন্দ্রীয় তথ্য বিজ্ঞাপন এবং ফিল্ম দপ্তর প্রকাশিত একটি পুস্তক থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে গণপরিষদের সদস্যদের জানান, পূর্ব পাকিস্তানীরা কেন্দ্রীয় রাজস্ব থেকে মাথাপিছু বৎসরে পান ১ টাকার বেশি (১ ১/৮ টাকা), পূর্ব পাকিস্তানীর ক্ষেত্রে এর পরিমাণ ৩২ টাকা। কেন্দ্রীয় দপ্তরের উচ্চপদে বাঙালীদের নিয়ােগ কী অনুপাতে করা হ’ত, ১৯৫৬ -র শুরুতে লব্ধ পরিসংখ্যান থেকে তা স্পষ্ট হবে। ১৯ জন সচিবের একজনও বাঙালী ছিলেন না। ৫০ জন যুগ্ম সচিবের মধ্যে মাত্র দু’জন ছিলেন বাঙালী। ১৩৫ জন উপসচিবের মধ্যে ১০ জন এবং ৫৩০ জন অধস্তন সচিবের মধ্যে ৩০ জন – এই ছিল বাঙালীর জন্য বরাদ্দ। ১৯৫৮ র মার্চেও দেখা গেল, সহকারী সচিব পদে বাঙালী ১৬ জনের স্থলে পশ্চিম পাকিস্তানী ছিলেন ১৫১ জন। তথ্য এবং বেতার বিভাগের মন্ত্রী ১৯৫৮ র ৩রা মার্চ জানান, তাঁর বিভাগে সচিব, দু’জন উপসচিব এবং চারজন অধস্তন সচিব আছেন – তাঁরা সকলেই পশ্চিম পাকিস্তানী। অবশ্য পূর্ববঙ্গ থেকে একজন অধস্তন সচিবও তাঁর বিভাগে ছিলেন। প্রেস কমিশনের নয় জন সদস্যের মধ্যে কিং বা গবেষণা-পদে বা পরিদর্শক পদে কোনাে বাঙালী ছিলেন না। ১৯৫৮ র ৪ ঠা মার্চ মুহম্মদ আবদুল খালেক বলেন, পূর্ব পাকিস্তানীদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদ জেগে উঠছে যে সব কারণে তার থেকে উপযুক্ত পাঠ নিয়ে দেওয়ালের লিখন পড়তে হবে। নইলে সে ভাঙন শত আওয়ামি লীগও রুখতে পারবে না। (৪৫)।
১৯৫৫ র ৩১ শে অগাস্ট আবুল মনসুর আহমদ, পাকিস্তান সরকারের পরিসংখ্যান পত্র থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, পাট পূর্ববঙ্গজাত। তথাপি পাট থেকে লব্ধ বৈদেশিক মুদ্রার বৃহৎ অংশই পূর্ববঙ্গের আর্থিক উন্নয়নের স্বার্থে ব্যবহৃত হয় না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুজাফফর আহমদ দেখান, ১৯৪৭-৪৮ থেকে ১৯৫৪-৫৫ পর্যন্ত হিসাবে গড়ে বাৎসরিক ৩৪ কোটি ১২ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা করে ক্ষতি স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তান। পূর্ববঙ্গের অর্থনৈতিক রক্ত শুষে নিয়ে তার প্রাণপ্রবাহ শুকিয়ে দেবার ব্যবস্থাই চালু আছে। কোনাে সভ্যসমাজে এ সবই অচিন্ত্য। ভােগৌলিক কারণেই দুরস্থিত কেন্দ্র পূর্ববঙ্গের প্রতি নজর রাখতে পারে না – এ-ও যদি ক্ষেত্রবিশেষে সত্য হয়, তবে এ-ও তাে হবে পূর্ব খণ্ডের স্বাধিকার দাবির পক্ষে আর একটি যুক্তি। (৪৬)
ব্রিটেনের অনুসরণে ১৯৪৯ সালে ভারত অবমূল্যায়ন মানলেও পাকিস্তান মানলাে না। এর কুফল ফললাে পূর্ববঙ্গে পাট উৎপাদনে জড়িত মানুষদের উপর। অবমূল্যায়নে আপত্তি ছিল পশ্চিম পাকিস্তানীদের। তাদের যন্ত্রাংশাদি আমদানির পক্ষে অবমূল্যায়নে অসুবিধাই হ’ত। তা ছাড়া, ১৯৪৮-৪৯ সালে ২৫ বছর মেয়াদী পাটক্রয় চুক্তির যে প্রস্তাব ভারত দিয়েছিল, হামিদুলের মতে, তা ব্যর্থ করে দেয় পাকিস্তান সরকার। হামিদুল ঐ চুক্তিকল্পে বৈঠকাদি সব কিছু সদস্য হিসাবে দেখেছিলেন। ১৯৪৯- এ পাট সংক্রান্ত যে আদেশনামা যা ১৯৫৭- তে বিলে রূপায়িত হয়, তার ফলে পূর্ববঙ্গের পাটচাষী পারমিট ধারীর শিকারে পরিণত হয়। সরকার নির্দিষ্ট ন্যূনতম মূল্য তারা দিত না। মিথ্যা রসিদ করে নিত এটা বােঝাতে যে ন্যায্য মূল্যেই পাট কেনা হয়েছে। গণপরিষদে ১৯৫৬-র ১৭ ই মার্চ, আবদুর। রহমান খান বলেছিলেন – গত পঞ্চাশ বছরে ব্রিটিশ এবং হিন্দু বেনিয়ারা একযােগে পাটচাষীর যে ক্ষতি করেছে তার চেয়ে ঢের বেশি ক্ষতি করছে সরকারের মুদ্রা নীতি (অথাৎ অবমূল্যায়নে বিরত থাকা)। (৪৭)
বন্যার মতাে প্রাকৃতিক দুর্যোগের দমনেও পূর্ববঙ্গ বিদ্বেষে কোনাে হেরফের হয় নি কেন্দ্রের কর্তাব্যক্তিদের। বন্যায় নদীগর্ভে বাড়তি পলি জমে নদীর তলদেশ ৫ – ৬ ফুট উচু করে পুনঃ পুনঃ বন্যাই ডেকে আনতাে। অথচ পলি উদ্ধারের ব্যবস্থা হত না। বন্যা যে শুধু মানুষ এবং গৃহপালিত পশুসম্পদের বিনাশ ঘটাতাে তা নয়। কৃষিকর্মের সর্বনাশ হ’ত এর ফলে। ১৯৫৬ – র ১৮ ই মার্চ মুজিবর রহমান বলেন তিনি তথ্য প্রমাণ দিয়ে দেখাতে পারেন কী বিপুল সংখ্যায় অর্থসঙ্কটে ক্লিষ্ট পূর্বপাকিস্তানীরা ভারতে চলে যাচ্ছেন নিছক প্রাণের তাগিদে। আতাউর রহমান বলেছিলেন – ‘কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন হয়ে আপনারা নতুন রাজধানী গড়ার বিলাসিতায় হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করতে পারেন। অথচ ডুবে। মরছে বা রােগে মরছে যে পূর্ব পাকিস্তানীরা, জলে ভাসছে যে পূর্বপাকিস্তানীরা তাদের বাঁচাতে কয়েক কোটি টাকাও আপনারা বরাদ্দ করেন না। আপনাদের খয়রাতির বহরটা তাে ঐ ২৫ বা ৩০ লাখ টাকা। (৪৮)। | একে তাে পূর্ব পাকিস্তানে শিল্প স্থাপন করতেই দেবে না, তদুপরি পশ্চিমী আমলাদের খবরদারি চলবে যে মুষ্টিমেয় শিল্প কেন্দ্রের আনুকূল্যে পূর্বপাকিস্তানে স্থাপিত তাদের উপর – এই ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের অভিসন্ধি। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৫ পর্যন্ত উন্নয়ন প্রকল্পাদির জন্য প্রাপ্ত ১১২৫ কোটি টাকার বৈদেশিক সাহায্যের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ অর্থ ছিল মাত্র ১২৬ কোটি টাকা। ১৯৫৬ র সংবিধানে পূর্ব পশ্চিম সৌষম্যের কথাটা ছিল কথার কথা। সােহরাবর্দির মন্ত্রিসভার অর্থমন্ত্রী আমজাদ আলি ১৯৫৭ ৫৮ র কেন্দ্রীয় বাজেটে এই ব্যবস্থা করে ছিলেন যে, ইতােমধ্যে প্রতিষ্ঠিত শিল্পের জন্যই বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবহার কার্যতঃ সীমিত থাকবে। কার্যতঃ পূর্ব পাকিস্তানে শিল্পবিকাশ বন্ধ করার এই চক্রান্তে চৌধুরী মুহম্মদ আলির হাত আছে এমন সন্দেহ হামিদুল হক চৌধুরী প্রকাশ করে পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের মনের কথাটাই বলেছিলেন। চৌধুরী মুহম্মদ আলি নিশ্চয়ই আমজাদ আলির মাধ্যমে তাঁর পরবর্তী প্রধান মন্ত্রীর জনপ্রিয়তা ধ্বংস করতে এ কাজ করিয়েছেন। সর্বমােট হিসাব নিলে পশ্চিম পাকিস্তানের বরাদ্দ ঢের বেশি হলেও, উন্নয়ন নামের খাতে এই তফাৎ কমিয়ে একটা সমতার বাতাবরণ সৃষ্টি করা হয়েছিল ১৯৫৮-৫৯ এ। পূর্বখণ্ডে ৪৫ কোটি টাকার স্থলে ঐ খাতে পশ্চিমখণ্ডে দেখানাে হয়েছিল ৫৪ কোটি টাকা। (৪৯) | ১৯৫৬র ২১ শে মার্চ মুহম্মদ আবদুল খালেক গণপরিষদে অভিযােগ করেন, সরবরাহ এবং উন্নয়ন আধিকারিকের দপ্তরে বিভিন্ন উচ্চপদে পূর্বপাকিস্তানীদের প্রতি উপেক্ষা করে সংবিধানের ৩১ ধারা লঙঘন করা হয়েছে। কারণ সমতার নীতি মানা হয় নি। ২৭ জন আধিকারিকের মধ্যে ২৬ জনই ছিলেন ঐ ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানী। ডিরেক্টর জেনারেল বা তাঁর চার ডেপুটির কেউ-ই পূর্বপাকিস্তানী ছিলেন না। পি, আই, ডি, সি বা পাকিস্তানের শিল্পোন্নয়ন সংস্থাতেও ছিল পশ্চিম পাকিস্তানীদের দৃষ্টিকটু সংখ্যাধিক্য। মুজিবর রহমান। ২১ শে মার্চ তারিখে বলেন, ‘পি, আই, ডি, সির প্রতিশ্রুতির কোনাে মূল্য নেই। স্থানীয় লােকেরা বড় অফিসারদের কারসাজিতে চাকুরী পায় না। যদিও পূর্বপাকিস্তানের। শিল্পপ্রতিষ্ঠানে এ প্রতিশ্রুতি মতাে ৭৫ শতাংশ চাকুরী স্থানীয়দের-ই পাবার কথা। মহাশয়, বাংলার মানুষরা কি পাকিস্তানের-ও মানুষও নন? পি, আই, ডি সি তার ৬১ টি প্রকল্পের মধ্যে মাত্র ১৭ টি পূর্ব পাকিস্তানের ভাগে রেখেছে। ১৯৫৬- ৫৭ র কেন্দ্রীয় বাজেটের স্মারকলিপি উদ্ধৃত করে একই দিনে জহিরুদ্দিন জানান, পি, আই, ডি, সি-র যে ১৬ টি প্রকল্প সম্পূর্ণ হয়েছে তার মধ্যে মাত্র ৩ টির অবস্থান পূর্ব পাকিস্তানে। এ অবস্থায় কী কারণে। পূর্বপাকিস্তান, পাকিস্তানের অঙ্গীভূত থাকবে?’ (৫০)। | পি, আই, ডি, সি-র যে নগণ্য সংখ্যক প্রকল্প পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত ছিল তার প্রায় সকল শেয়ার মালিক এবং অধিকাংশ কর্মচারী হ’তেন পশ্চিম পাকিস্তানী। ১৯৫৬- র ২১ শে মার্চ মুজিবর জানান, একজন বাঙালী-ও অন্য দেশ থেকে কয়লা ক্রয় করার সরকারী অনুমতি পান নি। নিউজপ্রিন্ট বিতরণেও চুড়ান্ত পক্ষপাতিত্ব ছিল। পশ্চিম। পাকিস্তানের সংবাদ দৈনিকের ৩২, ৩৬ এমন কি ৫৬ পৃষ্ঠা পর্যন্ত দেখা যেত। পূর্ব পাকিস্তানের দৈনিক সংবাদপত্রের পৃষ্ঠা সংখ্যা ছিল চার বা ছয়। বাণিজ্যিক লাইসেন্স, পারমিট থেকে জাহাজে পশ্চিম থেকে পূর্ব পাকিস্তানে পণ্য আমদানি করতে গিয়েও পূর্ব পাকিস্তানীরা বৈষম্যের ক্রুর নীতির শিকার হতেন। প্রচুর ঘুষ দিয়ে মশলা প্রেরণার্থে জাহাজে জায়গা পেতে হত। জাহাজে পণ্য বােঝাই সংক্রান্ত স্থানবরাদ্দ নিয়েও একটি সরকারী বাের্ড ছিল ১৯৫৭ সাল থেকে। তার ফলে ঐ দুর্নীতির কোনাে হেরফের হয় নি। ফরিদ আহমদ এই বাের্ড সম্পর্কে ১৯৫৮ র ১১ই মার্চ মন্তব্য করেন – ‘এবাের্ড পূর্বপাকিস্তানীর মর্যাদাহানিতে ইন্ধন জোগায়। (৫১)
১৯৫৬-র ১৭ ই মার্চ গণপরিষদে জহিরুদ্দিন এক সরকারী শ্বেতপত্রের তথ্য উদ্ধৃত করে জানান, ঘনবসতির পূর্ববঙ্গে কৃষির প্রসারের আর সুযােগ না থাকায় তার প্রয়ােজন। শিল্পায়ন। অথচ শিল্প প্রতিষ্ঠিত একতরফা হয়ে চলেছে পশ্চিম পাকিস্তানেই। এন, এ, কুরেশির গবেষণা থেকে জানা যায়, শ্রমজীবীদের বেকারি পূর্বখণ্ড ১৭ শতাংশ এবং পশ্চিমে মাত্র ৪.৭ শতাংশ। তথাপি ৫৫ শতাংশ পাকিস্তানীর বাসভূমি পূর্বখণ্ডে মাত্র ৫ টি কর্ম বিনিয়ােগ কেন্দ্র রয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানে এই সংখ্যা ১৩।(52)
৫৫
ভােগ্যপণ্যের ব্যবহারের সংকেতেও দেখা যায়, ১৯৫১-৫২ তে যে-সব ক্ষেত্রে পূর্বপাকিস্তান, পশ্চিমের চেয়ে এগিয়ে ছিল বা তুল্যমূল্য ছিল, ৭-৮ বছরেই সেই সব ক্ষেত্রেও পূর্ব পাকিস্তান ঢের পিছিয়ে পড়েছে। মাথা পিছু বস্ত্রের ব্যবহার ১৯৫১ র আমলে বাৎসরিক গড় হিসাবে পূর্ব পাকিস্তানে ছিল ১.৭ গজ, পশ্চিম পাকিস্তানে এই সংখ্যা ছিল ১.৪। ১৯৫৯-৬০-এ পশ্চিমের সংখ্যা উঠে পড়লাে ৯ এর স্তরে, আর পূর্ব পাকিস্তানের সং খ্য হ’ল ৩। ১৯৫৯-৬০ এ বিদাতের ব্যবহারের তুলনামূলক বিচারে পশ্চিমের ২৮.৮ কিলােওয়াটের স্থলে পূর্বের পরিমাণ ছিল ১.৬ কিলােওয়াট। পেট্রোলের সূচকগুলাে ঐ বৎসর ছিল ১.৩ গ্যালন এবং .১ গ্যালন। এ সবই মাথা পিছু বার্ষিক হিসাব। সব ক্ষেত্রেই বৈষম্যের নীতির কুফল স্পষ্ট। এস, ইউ খানের গবেষণা লব্ধ এই সকল তথ্যে বােঝা যায়। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ১৯৫৫ তে চালু হলেও পূর্ব-পশ্চিমের সমতার কোনাে চিহ্ন ধরা যায় নি। আতাউর ১৯৫৬ র ১৯ শে মার্চ, এই ভেদনীতি সম্পর্কে তিক্ত মন্তব্য করে বলেন, পাকিস্তান যেন এক চাকার গাড়ি। একটি চাকা ধ্বংস করেই যেন গাড়িটা চালানাের চেষ্টা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় শাসকচক্রে কোনাে আস্থা পূর্বপাকিস্তানীর নেই – এর জন্য দায়ী ঐ চক্রই। (৫৩)।
১৯৫৭-র আদমসুমারিতে প্রকাশ পায়, শিল্প ইউনিটের মােট সংখ্যার মাত্র ১৮ শতাংশ পূর্বপাকিস্তানে অবস্থিত ছিল। উৎপন্ন পণ্যের ২৬ শতাংশ এবং গড় দৈনিক কর্মনিয়ােগের ৩০ শতাংশ মাত্র পূর্বপাকিস্তানের অংশে পড়েছিল। শিল্পে অনুন্নত রেখে পূর্ব পাকিস্তানকে বাধ্য করা হ’ত পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বহুল পরিমাণে ভােগ্যদ্রব্যাদি আমদানি করতে। ১৯৪৮-৪৯ থেকে ১৯৫১-৫২র গড় হিসাবে, নুরুল ইসলাম প্রদত্ত তথ্যানুসারে পূর্ব পাকিস্তান যেখানে সাড়ে বাইশ কোটি টাকা মূল্যের পণ্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আমদানি করতাে, পশ্চিম পাকিস্তান সেখানে পূর্ব পাকিস্তান থেকে যে-পণ্য আমদানি করতাে তার মূল্য ছিল ৫ কোটি টাকার চেয়েও কম। ১৯৫৬ র ৩১শে জানুয়ারি সােহরাবর্দি বলেন – “ইংরেজদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযােগ ছিল আমাদের দেশের অর্থ তারা চালান করছে নিজের দেশে। একই প্রকারে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থও চালান করা হচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তানে উৎপন্ন হস্তচালিত তাঁতবস্ত্র কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে করাচিতে ঢুকতেই পেতনা। কৃত্রিম ভাবে পূর্ব পাকিস্তানী শিল্পপতিদের বাজার কেড়ে নিতে পশ্চিম পাকিস্তানী শিল্পপতিরা সাময়িক ভাবে স্বল্পমূল্যে পণ্য বিক্রয়ের ক্রুর পথও ধরবে – এ আশঙ্কাও পূর্ব পাকিস্তানীদের ছিল। (৫৪)।
| ডঃ কলিন ক্লার্ককে উন্নয়ন প্রকল্পের পরামর্শদাতা হিসাবে নিয়ােগ করেছিল পাকিস্তান সরকার। তিনি পূর্ব পাকিস্তানে শিল্প এবং পশ্চিম পাকিস্তানে কৃষি বিকাশের সুপারিশ করেছিলেন। শাসকচক্র তাঁর সুপারিশ প্রকাশ পর্যন্ত করে নি। পূর্ব পাকিস্তানীরা বুঝে ফেলেছিল, পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশ বানাতে চায় কেন্দ্রীয় শাসকচক্র। ১৯৫৮র ১লা মার্চ প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আবদুল লতিফ বিশ্বাস ঠিক এই কথাই বলেন। পূর্ব পাকিস্তানকে অবর-অস্পৃশ্য মনে করা হচ্ছে এ কথাও তিনি উল্লেখ করেন। পরের দিন, ক্লার্কের রিপাের্ট চেপে যাওয়ার কথা তুলে মুহম্মদ আবদুল খালেক বলেন, ‘পশ্চিম পাকিস্তানের চিরস্থায়ী বাজার বানাতে চায় পূর্ব পাকিস্তানকে আমাদের শাসকবর্গ।
হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, ‘ভাসানি যে পাকিস্তানকে বিদায় জানাবে পূর্ববঙ্গ একথা বলেছিলেন তার মূলে আছে সঙ্গত ক্ষোভ এবং নৈরাশ্য।” (৫৫)।
পাকিস্তানে যেন দুটি স্বতন্ত্র অর্থনীতি বিরাজ করতাে। পূর্ব পাকিস্তান বিদ্বেষী মিঞা দৌলাতানাও গণপরিষদে এ সময় বলেন – একটা জনসমষ্টির বিবেচনা শুধুই ভুল না ভেবে পূর্ব পাকিস্তানীদের আশঙ্কা এবং অবিশ্বাসের সঙ্গত কারণ আছে এ সম্পর্কে আমরা সচেতন হয়েছি।” ২৬শে অগাষ্ট ১৯৫৫ দৌলাতানার এই উক্তির কয়েকদিন পরেই আতাউর রহমান ৬ই সেপ্টেম্বর তারিখে বিবৃত করেন এক বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা। পশ্চিম পাকিস্তানী শক্তিচক্রের কয়েকজন নেতা আতাউরকে তাঁর লাহােরে বাসস্থানে নামাজ পড়তে দেখে বলেন – ‘আপনি তাে খাটি মুসলমান। আপনার তাে বাঙলা ভাষার হয়ে দাবি তােলা। চলে না।’ ইসলামের বিধি মেনে যিনি চলবেন তাঁর জন্য বাঙলা ভাষা হবে নিষিদ্ধ বস্তু – এই ফরমান বঙ্গভাষাভাষী ভালাে মনে নেবে কেমন করে ? গেজেট, পাশপাের্ট, বিমানবন্দরে ঘােষণা – সর্বত্র বাঙলা ভাষাকে মুছে ফেলে বাঙালীর ভাবাবেগ এবং সাংস্কৃতিক অধিকার পদদলিত করতে চায় বলেই এই সরকার ২১শে ফেব্রুয়ারী, ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশের প্রবেশ এবং নৃশংস হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করার কোন তদন্ত করে নি। (৫৬)।
| পরবর্তী বৎসর (১৯৫৬) মুজিবর গণপরিষদে অনুযােগ করেন, ‘পরিষদের দৈনন্দিন নির্দেশবার্তাও উর্দু এবং ইংরেজিতে প্রকাশ করা হয়; বাঙলাভাষা এখানেও পরিত্যক্ত। ঢাকা বিমান বন্দরেও বাঙলা ভাষা নিষিদ্ধ এবং জুরিখ, লণ্ডন, জেনেভা ভ্রমণে গিয়েও বিদেশের অনুভুতি এত তীব্র হয় নি, করাচিতে এলে যতাে হয়- ১৯শে মার্চ আতাউরের এই উক্তি এবং ২২শে মার্চ জহিরউদ্দিন নিবেদিত এই সংবাদ যে পূর্ববঙ্গের দুর্ভিক্ষপীড়িত অঞ্চলে চাল সরবরাহ না করার সাফাই হিসাবে পশ্চিম পাকিস্তান বিদেশে চাল রপ্তানি কৃত্রিমভাবে বন্ধ রেখেছে যাতে চালের মজুত ধরা না পড়ে পশ্চিম পাকিস্তানী কর্তাব্যক্তিদের অপশাসনে পূর্বপাকিস্তানীর দুর্দশার দিকটি আবার তুলে ধরলাে। পূর্বপাকিস্তানের প্রতি বিদ্বেষ পশ্চিম পাকিস্তানীদের সমাজে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে’ – এ সত্যও আতাউর স্বরচিত “ওজারতির দুই বছর’ গ্রন্থে বিশদভাবে আলােচনা করে দেখিয়েছেন। (৫৭)।
প্রতিরক্ষা দপ্তরের কর্তারা পূর্ববঙ্গবাসীকে কী চোখে দেখে থাকেন তার একটি নিদর্শন এই যে, পাকিস্তান সৃষ্টির পরের নয় বছরে বেঙ্গল রেজিমেন্টে মাত্র দুটি ব্যাটেলিয়ন যুক্ত হয়েছে। সামরিক ঘাঁটি স্থাপন, গােলাগুলি বন্দুকের কারখানা প্রতিষ্ঠা অথবা সামরিক কলেজ স্থাপন সম্পর্কে পূর্ব পাকিস্তানীদের দাবি উপেক্ষা করার পরেও সামরিক বিভাগের প্রধান মুহম্মদ আয়ুব খান বলে দিলেন – “পশ্চিম পাকিস্তানের উপরই পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তা নির্ভর করবে – পূর্ব পাকিস্তান আত্মরক্ষার সুযােগ পাবে না। এই স্বৈরাচারীর বিদ্বেষপ্রসূত বন্দোবস্তে আস্থা রাখলে কি চীন, ভারত প্রভৃতি বৃহদায়তন প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হওয়া যাবে। — এ প্রশ্নও তুললেন আতাউর রহমান খান। ১৯৫৫ – তে পাকিস্তানী প্রধান মন্ত্রী যে প্রিক্যাডেট কলেজ পূর্ববঙ্গে হতে চলেছে বলে স্তোক দিয়েছিলেন ১৯৫৭৫৮ র বাজেটেও তদ্রপ কোন কলেজের জন্য ব্যবস্থা রাখা হয় নি এ তথ্য পেশ করেন ফরিদ। ১৯৫৬-৫৭ র বাজেটে চট্রগ্রামে নৌঘাঁটি নির্মাণের ভাসাভাসা ইঙ্গিতটুকুই ছিল না। কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে যেসব তথ্য প্রয়ােজনীয় ঐ স্কোবাক্যে তার চিহ্নও ছিল না। পিটার পল গােমেজ বলেন – “পূর্ববঙ্গের জনগণের সঙ্গে সংস্রবহীন পশ্চিম পাকিস্তানীদের দিয়ে গড়া পাকিস্তানী যে সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে মােতায়েন আছে, এ বাঙলার সাধারণ মানুষ তাকে দখলদার সেনা বই অন্য কিছু ভাবে না। (৫৮)
১৯৫৪-৫৮ -এই সময় জুড়ে সংখ্যালঘু দলনে এবং কেন্দ্রীয় শাসকচক্রের সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনীতিকদের উৎপীড়নে ঘন ঘন সামরিক বাহিনীর ছল বল কৌশল ব্যবহার করেছে ঐ শাসকচক্র। নিরাপত্তা আইনের নামে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে বিনা বিচারে আটক রাখার এক জঘন্য রেওয়াজ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে ১৯৫৮ র ৭ ই জানুয়ারি সংসদের। অধিবেশনে সদার ফজলুল করিম এই উক্তি করেন – এই নিরাপত্তা আইনকে জনসাধারণ এখন আর দেশের নিরাপত্তার আইন ভাবেন না। তাঁরা জেনে গেছেন, এ হল ‘গদির’ নিরাপত্তা রক্ষা করার আইন। ক্ষমতাসীন চক্র যাতে ক্ষমতায় নিরাপদে টিকে থাকেন, এ তারই আইন। এই আইন নিয়ে লােকে হাসি তামাসা করেন। গভীর আলােচনা কালে অবশ্য তাঁরা বােঝেন – এই আইনে আটক হলে বুঝতে হবে আটক ব্যক্তি প্রকৃত দেশপ্রেমিক। একই দিনে হামিদুল বলেন, ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলনের ন্যায্য দাবির সমর্থন করার কারণে। তাঁকে বিনা পরােয়াণায় বিনা কৈফিয়তে গ্রেপ্তার করা তাে হয়-ই – সঙ্গে তাঁর সংবাদপত্র ‘পাকিস্তান অবসাভার’ প্রকাশ করাও ঐ একই কারণে বন্ধ করা হল। মামুদ আলি ঐ দিন জানান, নিরাপত্তা আইনে তাঁদেরও নির্বিচারে আটক করা হয়েছে যাঁদের বীরােচিত সংগ্রাম পাকিস্তানের জন্মকথার অন্যতম অধ্যায়। (৫৯) | এই অধ্যায় শেষে এই কথাই মনে হবে যে, পাকিস্তান সরকারের আমলাতন্ত্র এবং সামরিক কর্তৃপক্ষ জোট বেঁধে পূর্ব পাকিস্তানীদের পীড়ন করে চলে বলেই নিপীড়িত পূর্ব পাকিস্তানীদের মধ্যে অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক স্বাধিকারের যে – দাবি জাগরূক হয়, তাকে দমন করতে ফের ঐ সামরিক বাহিনীর তৎপরতা দেখা যেত। আবুল মনসুর আহমদের কথায় – ‘পাকিস্তানী রাজনীতিকদের উপরে এক দুরূহ দায়িত্ব ন্যস্ত হয়েছিল। পাকিস্তান সৃষ্টির জন্য সংগ্রাম এবং ধর্মবিশ্বাস – এই দুটি বিষয়ে মিল থাকলেও ভাষা খাদ্য পােশাক জীবনধারা, আচার-আচরণ সমস্ত বিষয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং ভৌগােলিক অবস্থানেও বিচ্ছিন্ন তথা দূরবর্তী এক অঙ্গের সঙ্গে অপর অঙ্গের মিশ্রণে গড়া এক রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করতে যে অনন্য যােগ্যতার প্রয়ােজন হয়, যে বিচক্ষণতার প্রয়ােজন হয়, পাকিস্তান সরকারের। পরিচালনায় তার হদিশ মেলে নি কোনােদিন।(৬০)
References:
J. SENGUPTA, Eclipse of East Pakistan, pp. 43-47, 85-89. ATAUR RAHMAN KHAN, Ojarotir Dui Bachchar [i.e., Two Years in Power), Dacca, Abhijan Printing House, 1964, pp. 21-29; (in Bengali).
CAP Debates, 1 September 1955, Vol. I, No. 14, pp. 388-90. CAP Debates, 16 January 1956, Vol. I, No. 51, pp. 1816-25. CAP Debates, 17 January 1956, Vol. I, No. 52, pp. 1846-48. CAP (Legislature) Debates, 17 March 1956, Vol. I, No. 2, p. 67.
K. CALLARD, Pakistan : A Political Study, pp. 57-58. H. TINKER, India and Pakistan, p. 77. CAP Debates, 31 August 1955, Vol. I. No. 13, pp. 371-72. KHONDKAR ABDUL KHALEQUE, Ek Shotabdi [i.e., One Century-a political biography of Fazlul Haq), Dacca, Prokash Bhaban, 1963, pp. 205-8. (In Bengali).
SIDNEY HERTZBERG, “The Crisis in U.S. Foreign Policy”, Commentary, June 1954, p. 524. The New York Times, 21 April 1954. The Round Table, June 1954, p. 289.
Dawn, 9, 11 May 1954. AJIT KUMAR DATTA, Interview, 6 January 1967. One of the topranking lawyers at the Calcutta High Court, Ajit Kumar Datta is the son of Kamini Kumar Datta, a member of Pakistan’s Constituent Assembly.
The New York Times, 23 May 1954. Dawn, 25, 26 May 1954.
J. SENGUPTA, n. 1, pp. 186-87. Ittefaq (Dacca), 16 May 1954. ALEXANDER CAMPBELL, The Heart of India (New York, A. A. Knopf, 1958), p. 264. Dawn, 26 May 1954.
J. SENGUPTA, n. 1, pp. 188-89. The Times (London), 25 May 1954. Dawn, 26 May, 31 May, 1 June 1954. The Economist (London), 22 – May 1954, p. 612. HERBERT FELDMAN, A Constitution For Pakistan, pp. 59.60. Speech by ABUL MANSUR AHMAD, CAP Debates, 8 February 1956, Vol, 1, No. 67, p. 2717 ; speech by SHAIKH MUJIBUR RAHMAN, Ibid., p. 2718.
Z. A. SULERI, Politicians & Ayub (Rawalpindi, Capital Law & General Book Depot, 1964), p. 133.
The Pakistan Times, 16 August 1954. United States, Congress, House of Representatives, Committee on Foreign Affairs, 84th Congress, 1st Session, Mutual Security Act of 1955, p. 144.
CAP Debates, 15 September 1954, p. 361. SULERI, n. 9, pp. 7374. K. B. SAYEED, Pakistan : The Formative Phase, p. 420. The Times of Karachi, 20 August 1954.
SAYEED, n. 11, p. 422 ; also see Ibid., pp. 420-21. Speech by M. M. IFTIKHARUDDIN, CAP Debates, 9 September 1955, Vol. I, No. 20, p. 630. Speech by FAZLUR RAHMAN, 25 January 1956, Vol. I, No. 56, p. 2047. Dawn, 21, 23, 25, October 1954. L. Binder, Religion and Politics in Pakistan, pp. 352-61. The Times of Karachi, 17 September 1954. For an entirely biased account of circumstances leading to the dissolution of the Constituent Assembly, see AYUB KHAN, Friends Not Masters (London, Oxford University Press, 1967), pp. 50-53.
SAYEED, n. 11. p. 422. TINKER, n. 3, p. 77. G. W. CHOUDHURY, Democracy in Pakistan, pp. 74-75. AYUB KHAN, Message to the Nation (Karachi, Ferozsons, 1958), pp. 4-5. KARL VON VORYS, Political Development in Pakistan (Princeton University Press, 1965), pp. 93-94.
KEITH CALLARD, “The Political Stability of Pakistan”, Pacific Affairs, March 1956, p. 11. FELDMAN, n. 8, p. 60. S. GUHA, Swadhin Purba Bangla, pp. 42, 45-46. CAMPBELL, n. 7, pp. 264-65.
SENGUPTA, n. 1, pp. 224-30. G. W. CHOUDHURY, “The East Pakistan Political Scene 1955-1957”, Pacific Affairs, December 1957, p. 312. SULERI, n. 9, p. 134. Pakistan Observer, 18 February 1955. Speech by HAMIDUL HAQ CHOUDHURY, CAP Debates, 14 September 1955, Vol. I, No. 24, p. 766.
SENGUPTA, n. 1, pp. 234-37. GUHA, n. 14, p. 45. Pakistan Observer, 3, 4, 5, 6, 7 June 1955. Dawn, 8 July 1955. G. W. CHOUDHURY, n. 15, pp. 312-13. Speech by MUHAMMAD ABDUL KHALEQUE, CAP Debates, 23 January 1956, Vol. I, No. 54, p. 1931.
SENGUPTA, n. 1, pp. 238-41. GUHA, n. 14, pp. 57-58. KHALID B. SAYEED, “The Political Role of Pakistan’s Civil Service”, Pacific Affairs, June 1958, p. 134. G. W. CHOUDHURY, n. 13, pp. 75-76. Speech by ATAUR RAHMAN KHAN, CAP Debates, 7 September 1955, Vol. I, No. 18, p. 531.
AHMAD, CAP Debates, 8 February 1956, Vol. I, No. 67, p. 2661. Speech by SHAIKH MUJIBUR RAHMAN, CAP Debates, 21 January 1956, Vol. I, No. 53, pp. 1911-12.
Speech by MAULANA A. R. TARKABAGISH, CAP Debates, 21 January 1956, Vol. I, No. 53, pp. 1890-91. Speech by SHAIKH MUJIBUR RAHMAN, Ibid., pp. 1903-04, 1911. Speech by ATAUR RAHMAN KHAN, CAP Debates, 27 January 1956, pp. 2116-17. [Sharab Khana=Liquor shop.]
Speech by ZAHIRUDDIN, CAP Debates, 23 January 1956, Vol. 1, No. 54, p. 1940. CAP Debates, 7, 29 February 1956. CALLARD, n. 3, pp. 121-22. Speech by NURUR RAHMAN, CAP (Legislature) Debates, 20 March 1956, Vol. I, No. 5, p. 254. Pakistan Observer, 16 January
1956.
Speech by SHAIKH MUJIBUR RAHMAN, CAP Debates, 25 August 1955, Vol. I, No. 11, p. 296. GUHA, n. 14, pp. 54-56. Speech by A. K. FAZLUL HAQ, CAP Debates, 23 January 1956, pp. 1932-33. SENGUPTA, n. 1, pp. 245-48 ; Sengupta, an Indian journalist stationed in Dacca, was requested by Abu Husain Sarkar to act as a mediator, and help Sarkar in patching up differences with some Hindu legislators and bringing them back to the United Front. 25.G. W. CHOUDHURY, n. 15, p. 316. Pakistan Observer, 22, 23 May, 1, 2, 3, June 1956. SENGUPTA, n. 1, pp. 251, 253-54. Speech by HAMIDUL HAQ CHOUDHURY (ex-Foreign Minister), NAP (i.e., National Assembly of Pakistan) Debates, 13 April 1957, Vol. II. No. 6, p. 313.
Pakistan Observer, 1, 2, 11, 12 July, 4, 5, 15, 16, 20, 21 August 1956. SENGUPTA, n. 1, pp. 249-50, 253, 259. Speech by MUHAMMAD ABDUL KHALEQUE, National Assembly of Pakistan Debates (NAP Debates for short), 8 January 1958, vol. I, No. 2, p. 196.
Ittefaq, 13, 14, 17, 18 August 1956.
SAYEED, n. 17, p. 135. CHOUDHURY, n. 15, pp. 316-17. Ittefaq, 6, 7, September 1956. Morning News (Dacca), 24 August 1956. Speech by M. A. KHUHRO, NAP Debates, 12 April 1957, Vol. II, No. 5. p. 233.
Azad (Dacca), 7, 8, 9 February 1957. Ittefaq, 7, 8, 9 February 1957.. Pakistan Observer, 12, 13, 14 September 1956 ; 7, 8, 9 February
Morning News, 7, 8, 14 February 1957. Speech by HAMIDUL HAQ CHOUDHURY, NAP Debates, 12 February 1957, Vol. I, No. 3, pp. 143-44. Speech by MIAN MUMTAZ MUHAMMAD KHAN DAULATANA, NAP Debates, 13 February 1957, Vol. I, No. 4, pp. 261, 270-71. RICHARD D. LAMBERT, “Factors in Bengali Regionalism in Pakistan”, Far Eastern Survey, April 1959, pp. 56-57.
Dawn, 3, 4, 5 April 1957. Pakistan Observer, 12, 13, 14, 17 June 1957. SENGUPTA, n. 1, pp. 326-34. CHOUDHURY, n. 15, pp. 318-19.
Pakistan Observer, 18 June, 24, 25 July 1957. SENGUPTA, n. 1, pp. 335-36.
Pakistan Observer, 18 April, 24, 25, 26, 27 July, 10 August, 23 September 1957. Dawn, 26, 27 July 1957. Pakistan Times, 12 May, 18 September, 4 November 1957.
SAYEED, n. 11, pp. 429-30. SENGUPTA, n. 1, pp. 357-60. Dawn, 10, 12, 13 October 1956. The Times, 31 October 1957. Speech by SUHRAWARDY, NAP Debates, 22 April 1957, Vol. II, No. 13, pp. 84147. Speech by M. A. KHUHRO, Ibid., pp. 1011-14. Speech by M. A. KHUHRO, NAP Debates, 20 April 1957, Vol. II, No. 12, p. 804. SAYEED, n. 17. p. 136.
SAYED ABUL ALA MAUDOOHI, in JOSHUA FAZL-UD-DIN, Separate Electorates-The Life blood of Pakistan (Lahore, Panjabi Darbar Publishing House, 1956), Part III, Chapter I, esp., pp. 129, 14245. Jamaat-e-Islami Pakistan, White Paper on The Electorate Issue (Karachi, n.d., 1958?), pp. 7-20, 23. Dawn, 23 October 1957. Ittefaq, 3, 6. December 1957. Pakistan Observer, 3, 6 December 1957.
Speech by SARDAR FAZLUL KARIM (now belonging to the National Awami Party), NAP Debates, 7 January 1958, Vol. I, No. 1, p. 82. Speech by SARDAR FAZLUL KARIM, NAP Debates, 21 February 1958, Vol. II, p. 360. Speech by SHAIKH MUJIBUR RAHMAN, Ibid., pp. 355-56. NAP Debates, 13 March 1958, Vol. II, pp. 1445, 1448-49. WAYNE A. WILCOX, n. 20, p. 200.
Speech by MUHAMMAD ABDUL KHALEQUE, NAP Debates, 8 January 1958, Vol. I, No. 2, pp. 195-97. Speech by HAMIDUL HAQ CHOUDHURY, NAP Debates, 3 March 1958, Vol. II, pp. 668-70. KHALID B. SAYEED, “Martial Law Administration in Pakistan”, Far Easern Survey, May 1959, p. 73. Pakistan Observer, 18 December 1957.
Pakistan Observer, 18, 22, 23, 25 March 1958. HENRY FRANK GOODNOW was not probably correct in observing that the O.C.D. raised the popularity of the army in East Pakistan-GOODNOW, The Civil Service of Pakistan (New Haven, Yale University Press, 1964), p. 107. BHUPENDRA KUMAR DATTA, Interview, 12 September 1966.
Ittefaq, 1, 2 April 1958. Pakistan Observer, 1, 2 April 1958. GOODNOW, n. 37, p. 95.
ATAUR RAHMAN KHAN, Press Conference, Karachi, 4 June 1958. Morning News, 6 June 1958. Pakistan Observer, 19, 20, 21, 23, 24, 26 June 1958. SUHRAWARDY, speech at Narayanganj, 6 July 1958. Ittefaq, 25, 26 August 1958.
Ittefaq, 21 September 1958. Pakistan Observer, 21 September 1958.
Ittefag, 24, 25, 27 September 1958. Pakistan Observer, 24, 25, 27 September 1958. The Times, 25, 26 September 1958.
Dawn, 3, 8 October 1958. The New York Times, 8, 25, 28, 29, 31 October 1958.
SAYEED, n. 17, p. 135. SULERI, n. 9, p. 141. K. J. NEWMAN, “Pakistan’s Preventive Autocracy and its Causes”, Pacific Affairs, March 1959, p. 31. WILCOX, n. 20, p. 203. MOHAMMAD AHMAD, My Chief (Lahore, Longmans, 1960), pp. 3-5, 85-93, 97. TENDULKAR, n. 19, p. 513. For a confirmation of Mohammad Ahmad’s observation by AYUB himself, see Friends Not Masters, pp. 52, 58, 186-88.
Speech by FIROZ KHAN NOON, CAP Debates, 25 August 1955, Vol. I, No. 11, p. 316. Speech by MUHAMMAD ABDUL KHALEQUE, NAP Debates, 2 March 1958, Vol. II, pp. 565-66, 568-69. Speech by SHAIKH MUJIBUR RAHMAN, NAP Debates, 3 March 1958, Vol. II, p. 676. Speech by SARDAR FAZLUL KARIM, NAP Debates, 4 March 1958, Vol. II, p. 771. Speech by HAMIDUL HAQ CHOUDHURY, NAP Debates, 12 February 1957, Vol. I, No. 3, pp. 145-46, 149-50, 157-58. HAMIDUL Remarked : “You have created hell for the people within 10 miles of the border and they cannot move in the evening after dusk…….. This is too much. These poor people do not get even justice before a court of law.”-Ibid., p. 158.
Speech by ABUL MANSUR AHMAD, CAP Debates, 16 January 1956, Vol. I, No. 51, pp. 1819-21. Speech by FAZLUR RAHMAN, CAP
Debates, 25 January 1956, Vol. I, No. 56, pp. 2049-50. Speech by HAMIDUL HAQ CHOUDHURY, NAP Debates, 3 March 1958, Vol. II, p. 637. Speech by MUHAMMAD ABDUL KHALEQUE, NAP Debates, 4 March 1958, Vol. II, p. 773.
Speech by ABUL MANSUR AHMAD, CAP Debates, 31 August 1955, Vol. I, No. 13, pp. 381-82 ; Speech by ABUL MANSUR AHMAD, 16 Janary 1956, Vol. I, No. 51, pp. 1822-23. Speech by FAZLUR RAHMAN, CAP Debates, 25 January 1956, Vol. I, No. 56, pp. 2049-50 : Fazlur quoted extensively from a series of articles written by PROF. MUZAFFAR AHMAD.
Speech by ABUL MANSUR AHMAD, CAP Debates, 17 January 1956, Vol. I, No. 52, pp. 1847-48. Speech by A. H. DELDAR AHMAD, CAP (Legislature) Debates, 17 March 1956, Vol. I, No. 2, p. 60. Speech by ABDUR RAHMAN KHAN, Ibid., pp. 63-64. Speech by HAMIDUL HAQ CHOUDHURY, NAP Debates, 26 February 1957, Vol. I, NO. 16, pp. 1214-15, 1217-18.
Speech by ABDUR RAHMAN KHAN, CAP Debates, 25 August 1955, Vol. I, No. 11, pp. 308-09. Speech by ATAUR RAHMAN KHAN, CAP Debates, 7 September 1955, Vol. I, No. 18, p. 538. Speech by SUHRAWARDY, CAP Debates, 31 January 1956, Vol. I, No. 60. p. 2234. Speech by DELDAR AHMAD, CAP (Legislature) Debates, 17 March 1956, Vol. I, No. 2, p. 59. Speech by MUJIBUR, CAP (Legislature) Debates, 18 March 1956, Vol. I, No. 3, p. 102. Speech by SUHRAWARDY, CAP (Legislature) Debates, 19 March 1956, Vol. I, No. 4, p. 225.
Speech by ABUL MANSUR AHMAD, CAP Debates, 17 January 1956, Vol. I, No. 52, pp. 1846-47, 1867. Speech by HAMIDUL, NAP Debates, 12 February 1957, Vol. I, No. 3, pp. 142, 144, 147. Speech by KHALEQUE, NAP Debates, 3 March 1958, Vol.II, p. 636. Speech by ZAHIRUDDIN, Ibid., pp. 710-11. Speech by MUJIBUR, CAP (Legislature) Debates, 21 March 1956, Vol. I, No. 6, p. 311. Speech by DELDAR, Ibid., 320.
Speech by KHALEQUE, Ibid., p. 305. Speech by ZAHIRUDDIN, Ibid., p. 307. Speech by MUJIBUR, IBID., pp. 310-11. Speech by DELDAR, Ibid., p. 320. 51. Speech by MUJIBUR, Ibid., p. 312. Speech by FARID AHMAD, NAP Debates, 12 February 1957, Vol. I, No. 3, pp. 187-88. Speech by
FARID AHMAD NAP Debates, 11 March 1958, Vol. II, pp. 1262-63. Speech by ZAHIRUDDIN, NAP Debates, 11 March 1958, Vol. II, pp. 1262-63. Speech by ZAHIRUDDIN, NAP Debates, 11 March 1958, Vol. II, pp. 1266-67.
Speech by ZAHIRUDDIN, CAP (Legislature) Debates, Vol. I. No. 2, pp. 52-54. N. A. QURESHI, “Research about Employment Levels and Structure of the Labour Force in East Pakistan”, in P. BESSAIGNET (ed.), Social Research in East Pakistan (Dacca, 1960), pp. 68, 81, 83.
S. U. KHAN, “A Measure of Economic Growth in East and West Pakistan”, Pakistan Development Review (Karachi), Autuman 1961, pp. 50, 52-54. Speech by ATAUR, CAP (Legislature) Debates, 19 March 1956, Vol. I, No. 4, p. 215.
NURUL ISLAM, “Some Aspects of Interwing Trade and Terms of Trade in Pakistan”, Pakistan Development Review, Spring 1963, pp. 23, 5. NAFIS AHMAD, An Economic Geography of East Pakistan (London, Oxford University Press, 1958), p. 312. Speech by SUHRAWARDY, CAP Debates, 31 January 1956, Vol. I, No. 60, p. 2233. Speech by ZAHIRUDDIN, CAP Debates, 8 February 1956, Vol. I, No. 67, p. 2706. Speech by DELDAR, CAP (Legislature) Debates, 21 March 1956, Vol. I, No. 6, p. 320. Speech by FARID, NAP Debates, 11 March 1958, Vol. II, pp. 1262-63.
Speech by ZAHIRUDDIN, CAP (Legislature) Debates, 21 March 1956, Vol. I, No. 6, p. 307. Speech by HAMIDDUL, NAP Debates, 12 February 1957, Vol. I, No. 3, pp. 148-49. Speech by KHALEQUE, NAP Debates, 8 January 1958, Vol. I, pp. 191-92. Speech by LATIF, NAP Debates, 1 March 1958, Vol. II, pp. 491-93. Speech by KHALEQUE, NAP Debates, 2 March 1958, Vol. II, pp. 563-64.
For a reference to “two economies” in Pakistan, see speech by FARID AHMAD, NAP Debates, 12 February 1957, Vol. I, No. 3. Speech by DAULATANA, CAP Debates, 26 August 1955, Vol. I, No. 12, p. 348. Speech by ATAUR, CAP Debates, 6 September 1955, Vol. I, No. 17, pp. 517-19.
Speech by MUJIBUR, CAP Debates, 17 January 1956, Vol. I, No. 52, p. 1841. Speech by ATAUR, CAP Debates, 27 January 1956, Vol. I, No. 58, p. 2124. Speech by ATAUR, CAP (Legislature) Debates, 19 March 1956, Vol. I, No. 4, pp. 215-18. Speech by ZAHIRUDDIN, CAP (Legislature) Debates, 22 March 1956, Vol. I, No. 7, p. 341. ATAUR
RAHMAN KHAN, Ojarotir Dui Bachchar, pp. 39-50.
Speech by ZAHIRUDDIN, CAP (Legislature) Debates, 17 March 1956, Vol. I, No. 2, pp. 55-56. Speech by ZAHIRUDDIN, CAP (Legislature) Debates, 20 March 1956, Vol. I, No. 5, pp. 273-74. Speech by MUJIBUR, Ibid., p. 275. Speech by PETER PAUL GOMEZ, CAP (Legislature) Debates, 22 March 1956, Vol. I, no. 7, pp. 332-33. Speech by ATAUR, CAP Debates, 27 January 1956, Vol. I, No. 58, p. 2131. Speech by FARID AHMAD, NAP Debates, 12 February 1957, Vol. I, No. 3, p. 193.
NAP Debates, 7 January 1958, Vol. I, No. 1-Speech by KARIM pp. 82-83 ; Speech by HAMIDUL, pp. 86-87 ; Speech by MR. MAHMUD ALI, p. 100.
Speech by ABUL MANSUR, CAP Debates, 16 January 1956, Vol. I, No. 51, p. 1816.
গনতন্ত্র এবং জাতীয়তার অগ্নিপরীক্ষা – জয়ন্তকুমার রায়, pp 36-58
আইয়ুব খানের সামরিক আইনের আওতায় সেই দিনগুলাে
১৯৫৮ র অক্টোবর মাস শুরু হয়েছে। কী ভাবছেন সচেতন পাকিস্তানী নাগরিকরা? খন্দকার আব্দুল খালেকের কথায়—“উপর মহলের কারসাজি মুক্ত, অবাধ সাধারণ নির্বাচনের আশা জেগেছে জনমানসে এই ক্ষণে – এতােদিনে। আশঙ্কাও কি নেই কিছু? হয়তাে আছে। গণতন্ত্রের বিলােপসাধনের সেই ভয়ংকর আশঙ্কা আজ অমূলক মনে হচ্ছে। এই তাে সেদিন বামুলুকে সামরিক আইন জারী হওয়াতে নিন্দা করেছে পাকিস্তান সরকার। সুতরাং আশঙ্কা থেকে আশ্বস্ত স্বস্তি। আশা মরীচিকাই। আশাবাদীদের মর্মাহত করে অলক্ষিত চরণের নিঃশব্দ গােপনীয়তায় এল ৭ই অক্টোবরের সেই বিনা মেঘে বজ্রপাত সম বজ্রনির্ঘোষ ঃ ‘পাকিস্তানে সামরিক আইন জারী হয়েছে। ৭ই অক্টোবর সামরিক আইন প্রবর্তিত হবার দু’দিনের মাথায় প্রেসিডেন্ট মিজা ঘােষণা করলেন তিনি। নাকি পুরাে এক বছর জুড়ে এই প্রতীতি নিয়ে অধিষ্ঠিত ছিলেন যে, পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অবাস্তব তথা অবান্তর। সামরিক শাসনে প্রকৃত ক্ষমতার দখলদার সেই আয়ুব একই ৯ই অক্টোবর তারিখে এক পদা চড়িয়ে বাগাড়ম্বর করলেন এই দম্ভোক্তি মাধ্যমে – ‘রাজনীতিকদের ব্যর্থতার গ্লানি মুছে দেবার দায়িত্ব তাে সমরবাহিনীর-ই। প্রেসিডেন্ট মিজার ১৫ তারিখের বিবৃতি যেন আরাে নরমপন্থী তাত্ত্বিকের ভাষণ মনে হ’ল যখন তিনি জানালেন এই সামরিক শাসন নিতান্তই এক সাময়িক পদক্ষেপ মাত্র। আয়ুবের স্পর্ধিত ভাষণের পাশে মিজার মধুর কথনে যে গরমিল তার উৎস সন্ধান অতঃপর জরুরী ঠেকবে। (১)
প্রথমেই মির্জা কেন সামরিক আইনের সাফাই গেয়েছেন সে কথায় আসা যাক। এই ব্যক্তি, এক দলের সঙ্গে অপর দলের কিংবা এক নেতার সঙ্গে অপর নেতার তিক্ততা সৃষ্টি করে ক্ষমতায় টিকে আছেন। তিনি নিজে ভালােই জানেন, এর পরিণামে সব দলেই তাঁর শবৃদ্ধিই মাত্র ঘটেছে। সুতরাং গণতান্ত্রিক নিবাচনী পদ্ধতি গ্রহণ করলে মিজা সাহেব ক্ষমতায় ফিরতে ব্যর্থ হবেন – এ তাে তাঁর নিজের ভালােই জানা ছিল। একটি ঘােষণা মারফত অর্থাৎ সামরিক আইন জারী করে আরাে কিছু কাল উচ্চ রাজশক্তি ভােগ করতেই তিনি গণতান্ত্রিক পদ্ধতির বিরুদ্ধে গেছেন। আতাউর রহমানকে যদিও উনি ভােটপর্বের দাঙ্গাহাঙ্গামার ভয়ের কথা শুনিয়ে সুবিধা করতে পারেন নি অথবা পূর্ববঙ্গের ১৯৫৪ র শান্তিপূর্ণ ভােটের বাস্তবের মুখে তাঁর বক্তব্যকে দাঁড় করাতেও পারেন নি, তথাপি চক্ষুলজ্জাটুকু ত্যাগ করে আতাউর সাহেবকে উনি স্পষ্টই জবাব দেন – হ্যা, ভােটাভুটি এড়াতে গিয়েই এই সামরিক শাসনের বিধি প্রবর্তিত হয়েছে। এ তাে গেল, মিজার প্রসঙ্গ। আয়ুবের কথায় এলে প্রথম থেকেই তার একটা সর্বেসর্বা ভাব ছিল চলনেবলনে। সেই ৯ তারিখের বিবৃতিতেই তাঁর দম্ভোক্তি স্মরণ করি। তিনি বলেছিলেন, “মিজা নিবোধের মতাে আচরণ করলে, যথােচিত ব্যবস্থা গ্রহণ করে তিনি তাঁর গুরু দায়িত্ব পালন করবেন। ঐ প্রতিবিপ্লব, আয়ুবেরই কারসাজি – এই মত কুরেশির। (২)।
আয়ুব এবং তার অনুগামীরা এই গণতন্ত্র হত্যাকে এক ‘রক্ত পাতহীন বিপ্লব আখ্যায় ভূষিত করলেও লণ্ডনের ডেলিমেল পত্রিকার সংবাদদাতা, সমস্ত তথ্য সংগ্রহ করে, পাকিস্তানী নিষেধাজ্ঞা এড়াতে ঐ দেশের সীমানার বাইরে পৌছে যে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেন তা থেকে আয়ুবের দাবি সম্পূর্ণ তথ্য বিকৃতি বই কিছু মনে হবে না। ঐ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সামরিক হােমরা-চোমরাদের মধ্যে যাঁরাই ঐ ষড়যন্ত্রমূলক ক্ষমতা দখল বা ক-র বিরােধিতা করেছিলেন, তাঁদের প্রত্যেককে হত্যা করা হয়। সামরিক আইনের অবসানের পরে জাতীয় ব্যবস্থাপক সভায় সদার আতাউল্লা খান, বালুচিস্তানের প্রতিনিধি হিসাবে এই তথ্য পেশ করেন যে, বালুচিস্তানের জনগণ সামরিক আইন প্রবর্তনের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন। আয়ুবের সেনাবাহিনী নৃশংস হত্যালীলার মাধ্যমে সে বিক্ষোভ দমন করে। সর্বময় কর্তৃত্ব বজায় রাখতে গিয়ে নিজস্ব সামরিক বিভাগের কর্মাধ্যক্ষদের আপন খেয়াল মতাে অন্যত্র, এমন কি অসামরিক বিভাগেও, স্থানান্তরিত করে আয়ুব স্বার্থান্ধ কুটিলতার এক নির্লজ্জ নিদর্শনও রেখে গেছেন। স্টিফেন বারবার জানিয়েছেন – ‘অন্ততঃ ১৩ জন জেনারেলকে, আয়ুব পদচ্যুত বা অপসারিত করেছেন সেই সময়। শুধু তাই নয়, সমরবিভাগের সদর দপ্তরে আয়ুবকে থাকতেই হবে। রাজধানী-শহর দূরে হলে তাঁর কর্তৃত্ব শিথিল হবে এই ভয়ে, করাচী থেকে রাওয়ালপিণ্ডিতে দেশের রাজধানীটাই সরিয়ে আনলেন এই ক্ষমতা লােলুপ সমরবিশারদ। একনায়কতন্ত্রের পথে আরাে এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে স্বঘােষিত ফিল্ড মার্শাল পদগৌরবে ভূষিত করলেন আয়ুব খান নিজেকে এর পরেই। (৩)’।
সামরিক শাসকেরা তাদের রাজনৈতিক অভ্যুত্থানকে জনসমর্থনের মর্যাদায় ভূষিত করার জন্যে কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করে। তাই বৃহৎ জমিদারদের জমির উর্ধ্ব সীমা বেঁধে দিয়ে, জনসাধারণের পরােক্ষ কিছু উপকারও সামরিক শাসন কালে হয়েছিল। অবশ্য সে-সবই পশ্চিম পাকিস্তানে সীমাবদ্ধ ছিল। পূর্ব পাকিস্তান কোনাে সুবিধাই সেই সুবাদে পায় নি। উপরন্তু নয়া রাজধানী স্থাপনে স্থাপত্য-কর্মকাণ্ডের আর্থিক লাভ সবটুকুই পেয়ে যায় ঐ পশ্চিম পাকিস্তানীরা। অন্যান্য সামরিক শাসকের মতাে আয়ুব-ও দুর্নীতি মুক্ত প্রশাসনের বাগাড়ম্বর করতেন। কার্যতঃ তাঁর অনুগতদের দুর্নীতির কোনাে শাস্তির কোনাে প্রশ্নই ছিল না। নৈতিকতার অজুহাতে খড়গ গিয়ে পড়তাে বিরােধী প্রশাসকের গ্রীবাদেশে। নৈতিক যুদ্ধে অবশ্য আয়ুবের প্রধান প্রতিপক্ষ ছিলেন নানা রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ। আতাউর রহমান তিক্তকণ্ঠে বলেছিলেন — ‘মাইনে-করা দালাল বাহিনী পথে-ঘাটে, হাটে-বাজারে, দোকানে-গঞ্জে শুধু রাজনৈতিক নেতাদের চরিত্রহননের উদ্দেশ্যে কুৎসা অভিযান চালিয়ে গেছে। সর্বৈব ভিত্তিহীন সব অভিযােগ এরা করে যেত অবিরত। (৪)।
সামরিক শাসনের ফলে পূর্ব পাকিস্তানীদের উপর পশ্চিম পাকিস্তানীদের বিশেষত পশ্চিম পাকিস্থানের শীর্ষস্থানীয় পুঁজিপতিদের-রাজনৈতিক প্রাধান্য ও অর্থনৈতিক শােষণের পথ অবশ্যই অধিকতর উন্মুক্ত হলাে। এমনিতেই পশ্চিম পাকিস্তানের শাসন-শােষণে পূর্ব পাকিস্তানের জনজীবন পর্যদস্ত ছিল। উপরন্তু শামরিক স্বৈরাচার তন্ত্রের তথাকথিত লৌহ মানবদে র আবির্ভাবের ফলে শােষণ ও দমনপীড়নমূলক আইনের সংখ্যা ও শক্তি বৃদ্ধির বিপুল সম্ভাবনা দেখা দিল। সামরিক শাসনের প্রবর্তনে কাদের ভূমিকা ছিল অগ্রণী—পুঁজিপতি-বণিকদের না সামরিকঅসামরিক আমলাদের– এ ব্যাপারে বিতর্ক সহজেই উঠতে পারে। এই বিতর্ক বােধহয় সীমাহীন, তবে এর অন্যতম যুক্তিপূর্ণ সমাধান এই যে প্রভাবশালী পুঁজিপতিআমলা এবং দূরদৃষ্টিহীন রাজনৈতিক নেতাদের একাংশের সােৎসাহ সমর্থন ছাড়া সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠা হতাে না। ভবিষ্যতে সেনাপতিদের অনুচর ঐ রাজনীতিকরা অবশ্য কতােদিন নিজেদের অভিনন্দিত করেছিলেন সেটা বলা দুষ্কর।
১৯৬০-৬২ র বৎসর দুটি পূর্ব পাকিস্তানের প্রশাসনিক ইতিহাসে ব্যতিক্রম বিশেষ। খােদ গর্ভণর এবারে পূর্ববঙ্গ দরদীর ভূমিকায় অবতীর্ণ। সরকারী কমোদ্যোগ পূর্বখণ্ডে অতীব সীমিত। সেই সীমার মধ্যেও যথাসাধ্য জনদরদী ভূমিকা পালন করে নূতন গভর্ণর লেঃ জেনারেল আজম খান পূর্ববঙ্গে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা লাভ করেন। উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের প্রধান অন্তরায় আমলাতান্ত্রিক ঔদাসীন্য এবং দীর্ঘসূত্রতা, গভর্ণরের নিজস্ব প্রচেষ্টায় দূরীভূত হয়েছিল। ত্ৰাণকার্যে তিনি নিজে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। চট্টগ্রাম এলাকার ঘূর্ণিঝড়ের পরবর্তী ত্রাণকার্যে আজম যেন দিনে আঠারাে ঘন্টা খেটে গেছেন – এই মত প্রকাশ করেছিলেন ইশওয়ার সাগর নামের জনৈক ভারতীয় সাংবাদিক। (৫)।
ফিরে-ফিরেই ঝড়-জল বন্যার প্রকোপে উপকূলবর্তী পূর্ববঙ্গবাসী নিরাপত্তাহীন শঙ্কার মধ্যে থাকতেন। আজম খান এই ঘূর্ণিঝড়-প্রবণ এলাকার জন্য পাকা বাসস্থান এবং আনুষঙ্গিক বন্যানিরােধ প্রকল্পের খসড়াও করেছিলেন। কিন্তু তাঁর জনপ্রিয়তা তখন পূর্ববঙ্গে তুঙ্গে। এই হ’ল তাঁর কাল। ঈর্ষাপরায়ণ আয়ুব তাঁকে পূর্ববঙ্গের গভর্নর পদ থেকে সরিয়ে দিলে ১৯৬২ র ১৮ই জুন কামারুল আহসান এই খেদোক্তি করেন – “যাঁরাই পূর্ববঙ্গবাসীর কল্যাণ করতে আসেন, তাঁদেরই প্রস্থান ঘটে ত্বরিতে। পাকিস্তানের দুই খণ্ডের মধ্যে আর্থিক সাম্যের দাবি জানাতে গিয়ে আজম খান, আয়ুবের বিরাগভাজন হন। অবশ্য পূর্ববঙ্গের কোনাে অধিবাসীকে পূর্ববঙ্গের সরকারের প্রধান সচিব পদে নিযুক্ত করার কৃতিত্ব আজম খানের-ই। আজম খানের বিদায় সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে যাঁরা অশ্রুপাত করেন, আয়ুবপন্থী সংবাদপত্র তাঁদের ভারতের চর এবং পাকিস্তানে অন্তঘাত মুলক কার্যকলাপের তাত্ত্বিক বলে অভিহিত করে। অবশ্য স্টিফেন বারবার বলেছেন, আজমের জনপ্রিয়তায় ভীত আয়ুব-ই তাঁকে ঈর্ষাবশতঃ সরিয়েছেন। (৬)
(গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ইত্যাদি মতবাদের বিরুদ্ধে শুধু প্রত্যক্ষ দমননীতিই যথেষ্ট নয় যুদ্ধোত্তর দুনিয়ার কোনাে প্রান্তে। আয়ুবরাজেও তাই মেকী গণতন্ত্রের বুলি কপচানাের প্রয়ােজন ছিল। জনগণের গণতান্ত্রিক অভীপ্সা খােলাখুলি অস্বীকার না করে, এক জটিল পরােক্ষ গণতন্ত্রের মস্করার ব্যবস্থা করা হ’ল। এ হ’ল জনতােষণ। যা’ সামরিক একনায়কতন্ত্রের কলঙ্ক আংশিক মােচন করবে এমন আশা আয়ুবচক্রের ছিল।)।
১৯৫৯ এ প্রণীত হ’ল মৌল গণতন্ত্রের নির্দেশনামা। কী এই গণতন্ত্র। শুধু সর্বনিম্ন স্তরে নির্বাচন; অপর চারটি স্তরে পরােক্ষ নির্বাচন। প্রতি স্তরের প্রতিনিধি পরবর্তী উচ্চতর পর্যায়ের প্রতিনিধিদের নিবাচিত করবেন। লােভ জাগিয়ে এবং ভয় দেখিয়ে মৌল বা সবনিম্ন স্তরের প্রতিনিধিদের সরকারের ক্রীড়নকে পরিণত করা অবশ্যই হ’ত। প্রতি স্তরের তথাকথিত নির্বাচনে আনুগত্যের পুরষ্কার এবং বিরােধিতার শাস্তির ঢালাও বন্দোবস্ত করা থাকতাে। এই কি গণতন্ত্র ? আসলে ব্রিটিশ আমলে বাংলা, বােম্বাই, আসাম প্রভৃতি রাজ্যে চালু সতেরােটি আইনের জগাখিচুড়ি বিশেষ এই মৌল গণতন্ত্রের আদেশনামা, পূর্বতন আইনের চেয়েও অনেকাংশে অগণতান্ত্রিক ছিল। জেলাপরিষদের অধ্যক্ষপদে সরকারী আমলার নিয়ােগ আবশ্যিক করা এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অপসারিত করার অধিকার ঐ আমলাদের উপর আরােপ করা – এই সব স্বৈরাচারী বিধি ১৯২০-র ব্রিটিশ ভারতের সংশ্লিষ্ট আইনে ছিল না। (অর্থাৎ, মৌল গণতন্ত্র ছিল এক মৌলিক প্রতারণামাত্র।) (৭)।
১৯৫৯ গােড়ার দিকে আয়ুব প্রবর্তিত সামরিক শাসনের পিছনে জনসমর্থন আবিষ্কার করেছিলেন কে, জে, নিউম্যান। তথাকথিত জনসমর্থন জাহির করার জন্য আয়ুব, ১৯৬০এর ফেব্রুয়ারী, আশি হাজার মৌল গণতন্ত্রী অর্থাৎ ইউনিয়ন কাউনসিলর নির্বাচিত করালেন। তাঁরা আয়ুবে আস্থা জ্ঞাপনও করলেন। পিওডিও আইন তাে ছিলই। যা দিয়ে বেয়াড়া অফিসারকে দূর করা যেত। আরাে যে ছিল সেই ই বি ডি ও, যার জোরে বিরূপ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অপসারিত করা যেত। এই আইনের ভয়ে একবাক্যে আয়ুব সমর্থক বনে গেলেন ঐ তথাকথিত মৌল গণতন্ত্রীরা। নির্বাচনটাও ছিল প্রহসন। আমলাদের তদারকিতে আয়ুবপন্থীদের জয় সুনিশ্চিত করাই ছিল। (৮)
গণতান্ত্রিক মূল্যবােধ আরাে একটু জাহির করার ছক কষলেন আয়ুব খান ১৯৬০-এর
ফেব্রুয়ারী নাগাদ। এবারে তিনি এগিয়ে এলেন জাতিকে এক সংবিধান উপহার দিতে। ১৯৬০-এর ফেব্রুয়ারীতে গঠিত সংবিধান আয়ােগ বা কনস্টিটিউশন কমিশন পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তান সফর করে জনমতের নমুনা সংগ্রহের ভান করে। প্রশ্নোত্তরিকা মাফিক জবাব লিপিবদ্ধ করা হয়। প্রশ্নের গন্ডীতে উত্তর বাঁধা থাকতে বাধ্য। স্বভাবতঃই আয়ুবচক্র বিব্রত হতে পারে এসব প্রসঙ্গ ঐ লিখিত প্রশ্নমালায় স্থান পায় নি। উপরন্তু, এর উপক্রমণিকায় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ব্যর্থতা দূর করতে সামরিক শাসন এসেছে—এই ফরমান জারী করা ছিল। আতাউর এই উপক্রমণিকাকেই অস্বীকার করে উক্ত আয়ােগের সম্মুখে বলেন—“সামরিক শাসন, গণতন্ত্রের ব্যর্থতার ফল নয়, গণতন্ত্রের সম্ভাবনার সমাধি। নিকট ভবিষ্যতে গণতন্ত্রের প্রাদুর্ভাবের বিরুদ্ধে এটি একটি প্রতিষেধক মাত্র। … ১৯৫৯ এর জন্য নির্দিষ্ট সাধারণ নির্বাচন বাতিল করে গণতন্ত্রের মূলে আঘাত হানা হয়েছে। সামরিক শাসনের প্রণেতা এবং পৃষ্ঠপােষক কেউ-ই আর আত্মসন্তুষ্ট থাকতে পারলেন না এই পর্যায়ে। কেননা, সংবাদপত্রে জনগণের স্পষ্ট উক্তি-প্রত্যুক্তি প্রকাশ করা হচ্ছিল এই সময়। আয়ােগের সফর পর্বে এ এক উপসর্গ হয়ে এল শাসকগােষ্ঠীর সামনে। উপসর্গের অপনােদন অচিরাৎ করা হ’ল। সাংবাদিকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ হ’ল আয়ােগের সমীপে। বুদ্ধিজীবীরা এককাট্টা হয়ে গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধারের দাবি জানাতে থাকেন এই সময়। পশ্চিম, পূর্ব উভয় ভূখন্ডেই একই দাবি উঠছে দেখে, তড়িঘড়ি সংবাদপত্রে বিরােধীদের বক্তব্য প্রকাশ নিষিদ্ধ করে দিলেন আয়ুব খান। আশ্চর্য কান্ড ঘটলাে এসবের পরেও। সংবিধান আয়ােগের কর্তাব্যক্তিদের আয়ুবপন্থীই মনে করতে হবে। কারণ আয়ুব-ই তাঁদের নিয়ােগকর্তা। তথাপি তাঁদের প্রতিবেদনে সংসদীয় প্রথার পক্ষে সুপারিশ করা হল। ১৯৬১-তে এই অপ্রত্যাশিত সুপারিশ পেশ করা হলে আয়ুব তাে জ্বলে উঠলেন। রিচার্ড ভি উইকসের কথায়, “পর্দার অন্তরালে নানা কারসাজি করে, ঐ সুপারিশের বিপরীতধর্মী এক সংবিধান পেশ করলেন আয়ুব খান। তারিখটা ছিল ১লা মার্চ, ১৯৬২। কুরেশির ‘দি ডেভলপমেন্ট অব পাকিস্তান প্রবন্ধে এই গুরুত্বপূর্ণ অনিয়মের প্রসঙ্গটির উল্লেখ পর্যন্ত করা হয় নি। কিঞ্চিৎ বিলম্ব ঘটেছে এটির প্রকাশকালে—এই তাঁর মন্তব্য এ প্রসঙ্গে। (৯)
সংবিধান প্রকাশ করতে বিলম্ব হবার কারণ, আদ্যন্ত একে এমন ভাবে রচনা করা। হয়েছিল যাতে আয়ুবের হাতেই প্রশাসনের সর্বময় কর্তৃত্ব বর্তায়। আমলা-নিয়ন্ত্রিত মৌল গণতন্ত্রী, সর্বশক্তিমান প্রেসিডেন্ট (অথাৎ আয়ুবের) বশংবদ নিবীর্য ব্যবস্থাপক সভার। সভাসদ তথা স্ব-নির্বাচিত মন্ত্রিপরিষৎ—এ সবই সেই গণতন্ত্রের মােড়কে একনায়কতন্ত্র কায়েম করার কৌশল। বেগম রােকেয়া আনােয়ার তাে বলেই ফেলেন—“মন্ত্রিপরিষৎ ব্যবস্থাপক সভার কাছে দায়বদ্ধ নয়, দায়বদ্ধ প্রেসিডেন্টের কাছে। কারণ এর সদস্যরা তাঁরই বেতনভুক কর্মচারী। পি ও ডি ও এবং ই বি ডি ও-র খড়া মাথার উপর ঝুলতে দেখেও পূর্ববঙ্গীয় প্রতিনিধিরা সামরিক শাসনের প্রকৃত চরিত্র উদঘাটিত করতে ইতস্ততঃ করেন নি কোনক্রমেই। এ তাঁদের সঙ্কল্পের দৃঢ়তাই প্রমাণ করে। ব্যবস্থাপক সভার বাজেট নির্ধারণে কোনাে ভূমিকা স্বীকৃত ছিল না। নতুন কোনাে ব্যয়ের দাবিতে প্রস্তাব দেওয়ার অধিকারটুকুই ছিল শুধু। মাহাবুবুল হক এই ব্যবস্থাকে আত্মমর্যাদাহীন মনে করেছেন। সমস্ত ব্যবস্থাকে কামারুল আহসান বলেছেন—“নিয়ন্ত্রণাধীন গণতন্ত্র। ইঙ্গিত স্পষ্ট। আত্মমর্যাদায় আঘাত করে যে-নিয়ন্ত্রণ, তার মধ্যে গণতন্ত্রের মুক্ত বাতাস বইতে পারে না। (১০)। |
(স্বৈরাচারী শাসনের অনিবার্য একটি উপসর্গ হ’ল আঞ্চলিক বৈষম্যসৃষ্টি। কেন্দ্রীভূত পুঁজিবাদের প্রয়ােজনেই একটি অঞ্চলকে কাঁচামাল যােগানের কাজে বেঁধে রেখে অন্য শিল্পোন্নত অঞ্চলে প্রস্তুত পণ্যের লাভের বাজার হিসাবে ব্যবহার করা হয়। পাশাপাশি ভাষাগত এবং সাংস্কৃতিক বিকাশও এই অনুন্নত অঞ্চলে বিশেষ ভাবে ব্যাহত হয় ঐ স্বৈরাচারী শাসনের কল্যাণে।)।
পূর্ববঙ্গের স্কুলে উর্দু আবশ্যিক করা হ’ল আয়ুবের আমলে। পশ্চিম পাকিস্তানে কিন্তু বাঙলা স্বীকৃতি পেল না। ঢাকা বিমান বন্দরের ঘােষক বাঙলা নয় উর্দু এবং ইংরেজি ব্যবহার করতেন। যানবাহনে, পথে-ঘাটে সর্বত্র বাঙলা ভাষা বর্জন করে ঐ দুই ভাষা ব্যবহৃত হতে থাকলাে। পূর্ববঙ্গ রেজিমেন্টের বিভাগীয় পদোন্নতিকল্পে উর্দুতে পাশ করতে হত। বাঙলা এক্ষেত্রেও ছিল অপাঙক্তেয়। জাতীয় ব্যবস্থাপক সভার শৌচাগারেও উর্দুলিপি। পুরুষ সদস্যদের কেউ ভুল করে মহিলাদের শৌচাগারে ঢুকে পড়তে পারেন—এমন তিক্ত রসিকতাও করেছিলেন মেজর মহম্মদ আসরাফউদ্দিন সাহেব। সর্বতােভাবে প্রয়াস চালানাে হয়েছে এই ধারণা ছড়াতে যে, বাঙলা মুলুকের সংস্কৃতি, পশ্চিমখন্ডের তুলনায় নিম্নস্তরের। (১১)
আয়ুবের আমলের মেকী গণতন্ত্রের সমালােচনা করলে সাংবাদিককে নিগৃহীত হ’তে হতাে। মুনির সাহেবের মতাে বিচারক এই নিগ্রহের সমর্থনে সাফাই গাইতেও লজ্জা পেতেন না। (১২) তদানীনন্তন পুনবাসন মন্ত্রী লেঃ জেঃ আজম খানকে প্রশ্ন করতে গিয়ে আয়ুবশাসনের বিরুদ্ধে প্রশ্ন উত্থাপিত করার কারণে একজন সাংবাদিকের কারাদন্ড হয় সাত বছরের জন্য। এই বিচারের বিরুদ্ধে ঐ সাংবাদিক পশ্চিম পাকিস্তান হাইকোর্টে আপীল করলে তা না-মঞ্জুর করে বলা হয়—“সামরিক শাসনের আইনকে প্রশ্ন করাই চলে না। (১৩)
স্বাধীনচেতা অর্থাৎ আয়ুবের বশংবদ নন এমন মেধাবী সাংবাদিক নিজ গুণে বিদেশ সফরের ডাক পেলেও বিমান বন্দরে তাঁকে প্রতিহত করা হত। চল্লিশ হাজার টাকার বিজ্ঞাপন প্রতিমাসে পেত পূর্ববঙ্গের ইত্তেফাক, সংবাদ এবং পাকিস্তান অবসাভার পত্রিকাগােষ্ঠী। এই দৈনিকগুলাে সরকারী বিজ্ঞাপন লাভে বঞ্চিত হ’ল। কারণ তাদের গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গী স্বৈরাচারীচক্রের অপছন্দ। জনগণের স্বার্থে এবং দেশের দুইখন্ডের সাম্যপ্রতিষ্ঠার পক্ষে লেখার জন্যই তাদের এই শাস্তি। (১৪)
আঞ্চলিক অসাম্য দূর করার ক্ষেত্রে সামরিক শাসনের কর্তাদের কোনাে সদিচ্ছা ছিল না। কেন্দ্রে অবশ্য কয়েকজন মন্ত্রী পূর্ববঙ্গ থেকে নেওয়া হয়। কিন্তু তার তাৎপর্য জনজীবনে ছিল শূন্য। উনিশজন সচিব পূর্ববঙ্গের সরকারে ছিলেন সে সময়। তাঁদের একজনও পূর্ববঙ্গের অধিবাসী নন। ৭৬৩ জন সেকশন অফিসারের মধ্যে মাত্র ৮৮ জন ছিলেন স্থানীয় অথাৎ পূর্ববঙ্গবাসী। অর্থমন্ত্রকের ৩৩৭ জন কর্মচারীর মধ্যে মাত্র ৩৭ জন ছিলেন পূর্ববঙ্গের বাসিন্দা। একই চিত্র অন্যান্য ক্ষেত্রেও। তাই তাে মাহাবুবুল হক বলেছিলেন—‘সরকারী নিয়ােগে একটু সমতার চিহ্ন থাকলেও পূর্ববঙ্গবাসীর অনাস্থা এবং অবিশ্বাসের লাঘব হ’ত। (১৫)
মাত্র কুড়ি কোটি টাকা ব্যয়ে সেচের কিছু উন্নতি ঘটালে পূর্বপাকিস্তানের কৃষিব্যবস্থার যথেষ্ট উপকার হ’ত—এই কথা বলেছিলেন মাহাবুবুল হক। (১৬) ব্যবস্থা অবশ্য হয় নি। মার্কিন মুলুক থেকে প্রাপ্ত পণ্যসহায়তার ৩৪ শতাংশ জুটতাে পূর্বপাকিস্তানের বরাতে। অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রে এই হার ছিল আরাে নগণ্য—মাত্র ৪ শতাংশ। (১৭)
পূর্ববঙ্গের কৃষি এবং কৃষকের গভীর সমস্যার কথা প্রকাশ পায় ঢাকা বিস্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফারুকের গবেষণায়। অধ্যাপক হবিবুল্লার সামগ্রিক তত্ত্বাবধানে নােয়াখালি অঞ্চলে গবেষণাকর্ম চালিয়ে যান ১৯৬১-র জুলাই থেকে ১৯৬২র জুন ঐ গবেষক এবং তাঁর সহযােগীরা। জানা যায়, পরিবার পিছু মাত্র ১.১ একর চাষের জমি আছে। তাও বহুধা বিভক্ত অবস্থায়। মাত্র দশ শতাংশ পরিবারের নিজস্ব লাঙল ছিল। পরিবার পিছু গরু বা বলদের সংখ্যা একের চেয়েও বেশ কম। কাজের উপযুক্ত দিনগুলাের ৬৯ শতাংশ ব্যবহারযােগ্য ছিল তাঁদের কাছে। বৃষ্টি, উৎসব ইত্যাদি আরাে ৬ শতাংশ কর্মদিনের হিসাব দিত। তা হলে এক চতুর্থাংশ কর্মদিন ছিল অব্যবহৃত। ব্যবহৃত ৬৯ শতাংশ শ্রমদিবসের মধ্যে কৃষিকার্যে ব্যবহৃত ছিল ৪২ শতাংশ, ৭ শতাংশ ছিল বাগিচার কাজে আর ২০ শতাংশই ছিল খেতখামার বহির্ভূত ক্ষেত্রে। সাবিলপুরের এই তথ্য, গ্রামীণ কর্মহীনতার যে-চিত্র তুলে ধরেছিল, তার সংবাদ পাকিস্তান অবসাভারে প্রকাশিত হয়। ঐ দৈনিকে আশা প্রকাশ করা হয়, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এই সমীক্ষা গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করবেন। (১৮)
পাকিস্তানের অর্থকরী ফসলের মধ্যে শীর্ষে অবস্থিত পাটের উৎপাদন বন্টন-বিক্রয় ইত্যাদির ভারপ্রাপ্ত পাটবাের্ড ১৯৪৯-এ স্থাপিত হলেও তার অস্তিত্বের যৌক্তিকতা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছিলেন মহম্মদ সিরাজুল ইসলাম। (১৯) যখন সামরিক শাসন চলছিল, এই বাের্ডের ফলে কিছু সুবিধা পাটব্যবসায়ীরা পেয়েছিল—পাটচাষী পায় নি। অক্টোবর ১২, ১৯৬১ তারিখের মহম্মদ ওসমান হাসানের বিবৃতি থেকে জানা যায়, নারায়ণগঞ্জে পাঁচমণী বস্তার পাটের দাম মাত্র ৬০ টাকা ছিল যখন স্টার্লিং এলাকায় তার দাম ছিল ২৭৫ টাকা।
৬৫
সর্বনিম্ন দর বেঁধে দেওয়া হয় নি বলে, মধ্যস্তরের ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে পূর্বপাকিস্তানের চাষী ১২ বা ১৪ টাকায় এক মণ পাট বেচতে বাধ্য হতেন। ভারতীয় ক্রেতারাও ৩৫ থেকে ৪০ টাকা মণে পাট কিনতে প্রস্তুত ছিলেন সে সময়। সীমান্তরক্ষীর গুলি অর্থাৎ প্রাণের ভয় তুচ্ছ করেও পূর্বপাকিস্তানী চাষী প্রাণের দায়ে ভারতে পাট বেচতেন। সামরিক শাসনের সামনে এই ‘অবৈধ’ চালান বন্ধ করা ছিল এক চ্যালেঞ্জ বিশেষ। প্রাণ হরণ না করে বা পীড়ন না করে এটা করা সম্ভব ছিল না। (২০)। | এসম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এ, এফ, এ, হাসানের নেতৃত্বে সমীক্ষা চালিয়ে যে তথ্য পেশ করা হয় তা থেকে জানা যায় নানা ক্ষুদ্র মধ্যস্বত্বভােগীরাই চাষীর পাটের ক্রেতা। কিন্তু চড়া সুদ, ঋণ সংগ্রহের অসুবিধা, মন্থর যানবাহন এবং অন্যান্য কারণে তারাও ন্যায্য মূল্য চাষীকে দিতে পারে না। সরকারী গাফিলতি তাে আছেই। বাজারে পাট পৌঁছে দেবার প্রকৃত অর্থে সাধ্যই যেন নেই পাট চাষীর। তাকে যানবাহনের অভাবে ভুগতে হচ্ছে ক্রমশ আরাে বেশি। (২১)।
পূর্ব পাকিস্তানীর অর্থনৈতিক প্রয়ােজন এবং দাবিদাওয়া সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন এই আয়ুব সরকারের আমলেই পশ্চিমপাকিস্তানী বিদগ্ধ বুদ্ধিজীবী ডঃ মাহাবুব উল হক, নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ করে (২২) জানান, পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদ পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার করে এমন এক বৈষম্যের সৃষ্টি করা হয়েছে যে, ১৯৫১র পরের মাত্র আট বছরে পশ্চিম পাকিস্তানীরা মাথা পিছু আয়ের ক্ষেত্রে পূর্বপাকিস্তানীর চেয়ে ১৮র স্থলে ২৯ শতাংশ এগিয়ে গেছেন। ১৯৪৯-৫৩র মধ্যে গড়পড়তা মূল্যের হিসাবে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধান খাদ্য গমের দাম ছিল পূর্বখন্ডের প্রধানখাদ্য চালের দামের প্রায় অর্ধেক মাত্র। (২৩)
শুধু চাল-গমের দরে বৈষম্য নয়, সকল ভােগ্য পণ্যের ব্যবহারেই পূর্ব পাকিস্তানী অথভাবে অনেক পিছিয়ে ছিলেন তাঁর ভাগ্যবান পশ্চিমী সহনাগরিকের তুলনায়। মাথা পিছু ব্যবহারের হিসাবে বিদ্যুতের ক্ষেত্রে ২০ গুণ, মােটর গাড়ির ক্ষেত্রে ১০ গুণ, চার বেলায় ৮ গুণ, চিনি এবং বস্ত্রের ক্ষেত্রে ৩ গুণ করে বেশি ভােগ করেছেন পশ্চিম পাকিস্তানী তাঁর পূর্বের সহনাগরিকের তুলনায়। শুধু মাথা পিছু আয়ের অঙ্কের মধ্যে পূর্বপশ্চিম খন্ডের বৈষম্যের ছবি ধরা পড়বে না—মাহাবুব উল হকের-ও এই অভিমত। তাঁরই পেশ করা উপরের তথ্যাদিও একই কথা বলবে। এই বৈষম্য দু’খন্ডের শহরবাসীদের ক্ষেত্রেই প্রকট। আর শহুরে মানুষ তাে মুখবুজে স’য়ে যাবার পাত্র নন। (২৪)।
পুরানাে দিনের কথা না তুলেও, ১৯৫৯-৬০এর হিসাবেই দেখা যাবে পূর্ব পাকিস্তান তার মােট আমদানির ৪৭.৬ শতাংশই করেছিল পশ্চিম পাকিস্তান থেকে। পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষেত্রে অন্যোন্যক সংখ্যাটি মাত্র ১৭.৭। অর্থাৎ বাণিজ্যের মাধ্যমে পূর্বের সম্পদ পশ্চিমে গিয়ে শিল্পব্যবসায় ইত্যাদির পুঁজি সংগ্রহের সুরাহা করেছে ঐ খন্ডে। তাছাড়া বৈদেশিক মুদ্রার অধিকাংশের ভােক্তাও ঐ পশ্চিম পাকিস্তান। ১৯৪৮-৫৩ তে পশ্চিম পাকিস্তানের মােট রপ্তানির ২১.৮ শতাংশ ছিল পূর্ব পাকিস্তানে। ১৯৫৫-৬০ এর আমলে এই মাত্রা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৭.৯ শতাংশে। পাকিস্তানের দুই অঙ্গের মধ্যে আন্তর্বাণিজ্যের এই সব তথ্য সহযােগে ডঃ নুরুল ইসলাম এই মত প্রকাশ করেছিলেন, পূর্বপাকিস্তানই আসলে পশ্চিম পাকিস্তানের বাজারে পরিণত হয়েছে। বিপরীতক্রমে বক্তব্য সত্য হবে না। জন. এইচ, পাওয়ারের সমীক্ষা অনুসারে ১৯৪৮ থেকে ১৯৬১ পর্যন্ত গড়ে বৎসরে ১৮ কোটি টাকা করে অর্থাৎ মােট ২৫০ কোটি টাকা পূর্বপাকিস্তান থেকে পাচার হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানে। অসম বাণিজ্যই এই বিপুল অর্থপাচারের কারণ। পরিকল্পনা-কালের হিসাবটুকু ধরলেই দেখা যায়, পশ্চিম পাকিস্তান মাত্র ৫ শতাংশ সঞ্চয়ের জোরে ১২ শতাংশ বিনিয়ােগ করেছে। পূর্বের সঞ্চয় পরিকল্পনা-কালেও পূর্বের মতাে ৭ শতাংশই ছিল। তবু তার বিনিয়ােগে সূচক সংখ্যা পশ্চিমখন্ডের ১২ শতাংশের অর্ধেক মাত্র—অথাৎ ৬ শতাংশ। অসম শর্তের বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্থ যতােই জমুক পূর্ব থেকে পশ্চিমে, পূর্বাংশের শ্রমজীবীদের পশ্চিমে নিযুক্ত আদৌ করা হয় নি। এ সবেরই কুফল হিসাবে ক্রমবর্ধমান বেকারি পূর্ব পাকিস্তানের ভাগ্যে জুটেছে। (২৫)
আয়ুব-ও তাঁর ১৯৬১-র ১৮ অক্টোবর তারিখে ঢাকা শহরে প্রদত্ত ভাষণে পূর্বপাকিস্তানের অনগ্রসরতা দূরীকরণের সদিচ্ছা প্রকাশ করেন। মতের অমিল হওয়ায় দেশের দু’খন্ডের বৈষম্য দূরীকরণের জন্য দু’ খন্ডের আয়ােগ-সদস্যরা দু’রকম প্রতিবেদন পেশ করেন। পূর্ব পাকিস্তানী আয়ােগ সদস্যরা দ্বিতীয় পাঁচ সালা পরিকল্পনাকে ঢেলে সাজাতে হবে—এই দাবি তােলেন যাতে পূর্ববঙ্গের সমস্যার কিছু সুরাহা হয়। যাই হােক, অর্থমন্ত্রী সােইব, ১৯৬২-র ২৮শে জানুয়ারী ঘােষণা করেন, নূতন রােয়েদাদ অনুসারে পশ্চিম পাকিস্তান ২ কোটি টাকা এবং পূর্ব পাকিস্তান ১১ কোটি টাকা বাড়তি রাজস্ব হিসাবে লাভ করবে। অধ্যাপক জি, ডব্লিউ, চৌধুরী এই প্রসঙ্গে যা বলেন, তা গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, উন্নয়নখাতে বরাদ্দ টাকার অঙ্ক এবং বৈদেশিক মুদ্রার প্রাপ্তির প্রশ্নে এমন কিছু করা আরাে বেশি প্রয়ােজনীয় যার ফলে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতি চাঙ্গা হতে পারে। অন্যথা পূর্ব-পশ্চিম খন্ড দুটোর আর্থ বৈষম্য দূর হবে না। (২৬)
পূর্বপাকিস্তানের সরকারের রাজস্ব, বৈদেশিক সাহায্য-কোনাে বিষয়েই কেন্দ্রনিরপেক্ষ উদ্যোগ গ্রহণের আইনগত অধিকার ছিল না। তা ছাড়া পশ্চিমাঞ্চলাগত আমলাদের চক্রান্ত, কেন্দ্রীয় আমলাদের নানা কারসাজি, পূর্বপাকিস্তানের উন্নয়ন প্রকল্প গুলির কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি করতাে। কোন পরিকল্পনা পেশ করতে হলে কেন্দ্রীয় আমলাদের চাপে ৭৫ কপি একযােগে পেশ করতে হত। পূর্ব পাকিস্তান সরকার উন্নয়ন প্রকল্প পেশ করলে কেন্দ্র কী করতাে ? কালক্ষেপ করতাে এবং শেষটায় প্রত্যাখ্যান করতাে।(২৭)
সামরিক শাসনের প্রবক্তারা দেশের পূর্ব-পশ্চিম খন্ড দুটোর আর্থিক অসাম্যের জন্য রাজনীতিকদের দায়ী করেন। পূর্ব পাকিস্তানের বিখ্যাত গাণনিক এস, জামান কিন্তু কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী সােইবকে চ্যালেঞ্জ করে বলেন, সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান প্রকাশ পেলে দেখাই যাবে সামরিক শাসনের আওতায় উক্ত বৈষম্য আরাে বৃদ্ধি পেয়েছে। (২৮)
প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় কাগজেকলমে যে চিনি, ডি, ডি, টি, ইস্পাত এবং স্ট্রেপটোমাইসিন কারখানা পূর্বপাকিস্তানে স্থাপিত হবার কথা ছিল, আমলাতান্ত্রিকতা এবং অর্থের যােগানে কেন্দ্রের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী বশতঃ তার কোনটিই কার্যকর হয় নি। প্রথম পরিকল্পনার শেষভাগে সামরিক শাসন আসে। অথচ প্রথম কেন দ্বিতীয় পরিকল্পনাতেও সামরিক আইনের কর্তারা পূর্ববঙ্গে উপযুক্ত শিল্পপ্রতিষ্ঠার কথা তুললেন না একটি বারও। পূর্ব পাকিস্তানে টেলিফোন পরিষেবাও পশ্চিম পাকিস্তানের সরবরাহ করা অব্যবহার্য টেলিফোন সেট এবং যন্ত্রাংশর কারণে রীতিমতাে বিঘ্নিত হ’ত —এই মর্মে জামান সাহেব সংসদে তথ্যাদি পেশ করেন। জামান সাহেব আরাে জানান-‘খাদ্য, ওষুধ সবই নিম্নমানের। এমন কি ভেজাল পর্যন্ত বেমালুম চাপানাে হয় পশ্চিম থেকে পূর্বখণ্ডে। পূর্বপাকিস্তান যেন ওদের অবাধ লুণ্ঠনের বাজার বিশেষ। সরষের তেল ? তাতেও ভেজাল। (২৯)।
সামরিক শাসন নাকি কঠোর শৃঙ্খলার শাসন। অথচ পূর্ব পাকিস্তানের খাদ্যশস্য উৎপাদনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত গঙ্গা-কপােতাক্ষ পরিকল্পনার রূপায়ণে চিরাচরিত টালবাহানা এবং অনিয়মের এতটুকু তারতম্য লক্ষ্য করা যায় নি। ১৯৫৪-তে যে-পরিকল্পনা শেষ হবার কথা, ১৯৬১-৬২র মাথায় এসে দেখা গেল, ১৯.৭৮ কোটি টাকার প্রাককলন মানের পরিকল্পনায় ঐ সময় পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে মাত্র ১০ কোটি টাকা। পশ্চিম পাকিস্তানের অনেক বৃহত্তর পরিকল্পনাও যে অনেক ক্ষিপ্রতা সহকারে রূপায়িত হয়ে থাকে—এই প্রসঙ্গে কামারুল আহসান তার উল্লেখ করেন। এন, এ, পি-তে বিতর্কচ্ছলে তিনি প্রশ্ন তােলেন—“পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষেত্রে এতাে ভুলভ্রান্তি ঔদাসীন্য-এ সবের অর্থ কী ?’ (৩০)
বাণিজ্যমন্ত্রকের পক্ষে সংসদীয় সচিব এক প্রশ্নের উত্তরে যা বলেন, তা থেকে পূর্ববঙ্গের ন্যায্য পাওনা অবহেলিত হবার কোনাে কারণ পাওয়া যায় না। অবশ্য সামরিক শাসনে পূর্ববঙ্গের প্রতি বিরূপতা পূর্ববৎ প্রকট ছিল। শুধু ১৯৬১-৬২র হিসাব টুকুই ঐ সচিবের বক্তব্য থেকে উদ্ধৃত করলে দেখা যাবে রপ্তানির সিংহভাগ পূর্বখন্ডের গুণে হওয়া সত্ত্বেও বাড়তি সুযােগসুবিধা সবই পশ্চিমখন্ডকে দিয়ে যাওয়া নিতান্ত অসঙ্গত আচরণ হিসাবে চিহ্নিত হবে। ঐ বৎসরকালে পশ্চিম পাকিস্তান রপ্তানি করে ৫৪.২৮ কোটি টাকার পণ্য। আর পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষেত্রে এই অঙ্ক ১৩০.০৬ কোটি টাকা—অথাৎ পশ্চিম পাকিস্তানের প্রায় আড়াই গুণ। তথাপি পূর্ববঙ্গের প্রতি অবহেলার কোনাে তারতম্য সামরিক আইনের আমলেও করা হয় নি। (৩১)।
১৯৫৯ থেকে ১৯৬২ র বৎসর গুলিতে পাকিস্তানে গড়পড়তা ৯টি বৈদেশিক বাণিজ্য প্রতিনিধিদল বৎসরে এসেছে। এদের মধ্যে গড়পড়তা ২.৭৫ টিকে বৎসর-প্রতি পূর্ববঙ্গে আসতে দেওয়া হয়েছে অর্থাৎ এক তৃতীয়াংশের চেয়েও কম সুযােগ দেওয়া হয়েছে। (৩২) রাওয়ালপিন্ডির কাছে ইসলামাবাদে পাকিস্তানের নূতন রাজধানী স্থাপন এবং পুরানাে রাজধানী করাচী বন্দরকে পশ্চিম পাকিস্তানের অধিকারে প্রত্যর্পণ করায় পূর্বপাকিস্তানীরা ক্ষুব্ধ হন। এই সব জাতীয় গুরুত্ববিশিষ্ট প্রশ্ন পূর্বপাকিস্তানের সঙ্গে আলােচনা পর্যন্ত করা হয় নি। যদিও করাচী বন্দরের রাজধানী-সুলভ রূপান্তরের জন্য প্রয়ােজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার যােগান ঐ পূর্ব পাকিস্তান-ই দিয়েছিল। (৩৩)
পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি কেন্দ্রীয় পাকিস্তান সরকারের বিমাতৃসুলভ আচরণের তথ্যাদি পেশ করেছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের এন, এ, পি সদস্যরা। সামরিক আইন রদ হওয়ামাত্র ১৯৬২-র ২০শে জুন সয়িদ আবদুস সুলতান বিতর্ককালে সংসদে পেশ করেন এই চাঞ্চল্যকর তথ্য যে, বিগত ১৪ বছরে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য উন্নয়ন প্রকল্পাদিতে মােট ব্যায় হয়েছে ৩০০ কোটি টাকা। অন্যদিকে একই সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নে ব্যয় করা হয়েছে ৯৯৮ কোটি টাকা। তদুপরি শিল্পঋণ, গৃহনির্মাণকল্পেঋণ ইত্যাদি কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানের থেকে মােট লব্ধ অর্থের মাত্র এক চতুথাংশ বা তারও কম জনবহুল পূর্বপকিস্তানের ভাগ্যে জুটেছে। বৈদেশিক ঋণ ইত্যাদির মাত্র ১৬ শতাংশ পেয়েছে পূর্ব পাকিস্তান। যে-সময়ে পূর্ব পাকিস্তান ১১২৫ কোটি টাকা মূল্যের বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করেও মাত্র ৫৪০ টাকা মূল্যের বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করার অধিকার পেয়েছিল, সেই সময়ে পশ্চিম পাকিস্তান মাত্র ৮১৫ কোটি টাকা মূল্যের বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করা সত্ত্বেও ১৪০০ কোটি টাকা মূল্যের বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করতে সুযােগ পেয়েছিল। অর্থাৎ যােগ্যতার বিপরীত অনুপাতে অধিকার—এই ছিল সরকারী বন্টননীতি। একটা অজুহাত দেখিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের কর্তাব্যক্তিরা পূর্ববঙ্গের শিল্পবিকাশে বাধা দেন। তাঁরা বলে বেড়ান, পূর্ববঙ্গে নাকি শিল্প প্রসারের জন্য প্রয়ােজনীয় সম্পদ নেই। মাহাবুবউল হকের মতে, অবশ্য, চট এবং বয়ন শিল্প ছাড়া প্রায় অন্য সকল ক্ষেত্রে আমদানি করা কাঁচামাল ইত্যাদির উপর এ কালে শিল্পবিকাশ নির্ভর করে। কাজেই কাঁচামালের চেয়েও কারিগরি এবং প্রশাসনিক দক্ষতার প্রশ্নই প্রধান। আর এ সবের ভালাে-মন্দ তাে শিক্ষানবীশীর সুযােগই না দিয়ে নির্ধারণ করা চলে না। জাতিপুঞ্জের সহায়তায় যে-শিক্ষানবীশী, সেখানে পর্যন্ত পূর্বপকিস্তান থেকে মাত্র ১০০ জন এবং এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ৭৩২ জনকে সুযােগ দেওয়া হয়েছিল। কলম্বাে প্রকল্পে ১৪৩১ জন পশ্চিম পাকিস্তানীর স্থলে মাত্র। ১৫০ জন পূর্ব পাকিস্তানীকে বেছে নেওয়া হয়েছিল শিক্ষানবীশ হিসাবে। উন্নয়ন বহিভূর্ত খাতে যে-কালে পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় করা হয়েছিল তিন হাজার কোটি টাকা, সেই। সময়ে পূর্ব পাকিস্তানে ব্যয় করা হয়েছিল মাত্র পাঁচ শত কোটিটাকা। (৩৪)
কেন্দ্রীয় বাজেটের সিংহভাগ প্রতিরক্ষা খাতেই ব্যয় করা হ’ত। তদুপরি মার্কিনসাহায্যও ছিল রীতিমতাে। কিন্তু প্রতিরক্ষার এই বিপুল ব্যয়ের কোনাে সুফল পুর্ব পাকিস্তান পেত না। সামরিক দপ্তর অথবা সামরিক উৎপাদনের কারখানার কোনটিই পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত ছিল না। যেখানে পশ্চিম পাকিস্তানী লেখক আসলাম সিদ্দিকি পর্যন্ত এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, পূর্ব পাকিস্তানে বহিঃশত্রু যে কোনাে দিক থেকে আক্রমণ শানাতে পারে, সেখানে কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তানের স্ব-নির্ভর আত্মরক্ষার প্রশ্নটিকে বরাবর উপেক্ষা করে এসেছে। পূর্ব পাকিস্তানীদের সমরকুশলতা নেই—এই অজুহাত কেন্দ্রীয় কর্তাব্যক্তিরা দেখিয়ে পূর্ব পাকিস্তানকে প্রতিরক্ষা কর্মকান্ডের মানচিত্রে স্থানই দিতে চান না। এই কুৎসার জবাবে সয়িদ আবদুস সুলতান বলেছিলেন ঈশা খাঁর সামরিক প্রতিভার কথা। মােগল সম্রাট আকবরের সেনাধ্যক্ষও যে-ঈশা খাঁর কাছে পরাভূত হন, তিনি তাে পূর্ববঙ্গের-ই মানুষ ছিলেন। (৩৫)
পূর্ব পাকিস্তানের ভাগে সামরিক বিভাগের মােট ব্যায়ের ৫ শতাংশ মাত্র বরাদ্দ। না আছে একটার বেশি ক্যাডেট কলেজ, না আছে যােগ্যতা অনুসারে পদোন্নতির সুযােগ। সামরিক বিভাগে পদোন্নতির যােগ্যতা দেখালে তাঁকে অসামরিক বিভাগে সরিয়ে দেওয়াও হত। আফসারউদ্দিন এ সমস্ত কারণেই খেদোক্তি করেন—“পূর্ব পাকিস্তানীরা যেন সমরবাহিনীতে কোনাে নিয়ামক ভূমিকা পালনের সুযােগ না পায়, কেন্দ্রীয় সরকার তাই যেন দেখছেন—এ সন্দেহ থেকেই যায়। (৩৬) ১৯৪৮ এবং ১৯৪৯-এ প্রতিষ্ঠিত দুটি ব্যাটেলিয়নের পরে পূর্বপাকিস্তানী কোনাে ব্যাটেলিয়নের সৃষ্টি করা হয় নি। পূর্ববঙ্গ রেজিমেন্টের যােগ্যতাকে একজন বৈদেশিক সমরনায়ক পাকিস্তানের পক্ষে দৃষ্টান্তমূলক-—এই প্রশক্তি করেন। তথাপি পূর্ব পাকিস্তানীদের বঞ্চনা চলতেই থাকে। ১৯৬১র ২৩ শে মার্চ আয়ুব অবশ্য মৌখিক আশ্বাস একটা দিয়েছিলেন এই মর্মে যে, পূর্ববঙ্গ রেজিমেন্টের আরাে দুটি ব্যাটেলিয়ন চালু করা হবে। (৩৭)
সংখ্যালঘুদের উপরে পীড়নের মাত্রা, সামরিক শাসনে আদৌ কমে নি, বরং বেড়েছে। ইসলামিক সংবিধানের সুবাদে অসামাজিক শক্তিরা উস্কানি পেয়ে যায়। মিসেস জিনকিন, ম্যানচেষ্টার গার্ডিয়ান পত্রিকায় যে বার্তা প্রেরণ করেছিলেন তাতেই লিখেছিলেন, ‘হিন্দুরা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসাবে গণ্য হন পাকিস্তান রাষ্ট্রে।’ ১৯৫৬-র সংবিধান চালু হবার পরে করা এই মন্তব্য, সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তাে বটেই বিচারকের নজরেও সত্য এবং সঙ্গত বিবেচিত হ’ত। অপহৃতা হিন্দু তরুণী মামলা করলে মামলা চলাকালে তাকে বাস করতে হ’ত হরণকারীর হেফাজতে। হিন্দুদের তাড়িয়ে সাংবিধানিক নিরিখেও পূর্বপাকিস্তানকে হীন প্রতিপন্ন করতে যে সাম্প্রদায়িকতার চক্রান্ত পশ্চিম পাকিস্তানীরা করতেন সে কথা মিসেস জিনকিন জানিয়ে গেছেন। আতলান্তিক পত্রিকায় ১৯৫৭-র সেপ্টেম্বরে যে মাসে দশ হাজার হিন্দু বিতাড়নের সংবাদ ছিল, তার-ও মূলে ছিল পূর্ব পাকিস্তানের মােট জনসংখ্যা হ্রাস পাইয়ে তার সংখ্যাগত প্রাধান্য দূর করা। (৩৮)
৭০
সামরিক শাসনে নানা প্রতারণাময় প্রতিশ্রুতির মধ্যে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার উল্লেখ-ও ছিল। আয়ুব নিজে এবং তাঁর পররাষ্ট্র মন্ত্রী মনজুর কাদির এই মর্মে আশ্বাসও দিয়েছিলেন। (৩৯) কার্যক্ষেত্রে বিপরীত লক্ষণই প্রকট হল। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ গ্রেপ্তার হয়, অথবা ফরিদপুর এবং তারপরে রাজশাহীতে ১৯৬১ এবং ১৯৬২ সালে নিম্নবর্গের সংখ্যালঘুদের গৃহে অগ্নি সংযােগ করা হয়। হত্যাও করা হয় শুধু ফরিদপুরের গােপালগঞ্জ দাঙ্গায় তিন হাজার নিরপরাধ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষকে। ভারতের সহকারী হাই কমিশনারের চাপে শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনী নামানাে হয় এবং তার পরে ঐ জিঘাংসা বন্ধ হয়। হিন্দু সম্পত্তি এবং হিন্দু নারী এই দাঙ্গাকালে লুঠেরাদের সম্পত্তি বিশেষ হয়ে ওঠে।(৪০)
মনােরঞ্জন ধরের মতাে হিন্দু নেতাকে হাতকড়া পরিয়ে তাঁর নিজস্ব বাসস্থান-শহর মৈমনসিংহের পথে-পথে পরিক্রমা করিয়ে সমারিক শাসনের কর্তারা হিন্দুদের আরাে সন্ত্রস্ত করে তােলেন। এ সময় পূর্ব পাকিস্তানীদের বিদ্রোহী কণ্ঠও সংসদকক্ষে আর শােনা যেত না।(৪১)
মুসলিম নেতাদের মধ্যে যাঁরা আয়ুবের স্তবক ছিলেন না, তাঁদেরও প্রকৃত এবং নিরপেক্ষ বিচারের ব্যবস্থা না করে খেয়াল অনুসারে জেলে পুরে দেওয়া হত। পূর্ব পকিস্তানের মুসলমানদের বিপুল সমর্থন না পেলে যে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টিই হ’ত না, এটুকু স্বীকৃতি দিতেও নারাজ ছিলেন সামরিক শাসকরা। এতােই তীব্র ছিল তাঁদের পূর্বপাকিস্তান সম্পর্কে বিদ্বেষ। সামরিক শাসনের অবসানের পর অবশ্য এ অনুচ্ছেদে বিবৃত সকল কথাই পূর্ব পাকিস্তানের এম, এন, এরা সংসদে তুলেছেন। (৪২)
বিরােধী রাজনীতিক সােহরাবর্দিকে আটক করে জেলে পুরে দেওয়া হ’ল ১৯৬২-র ৩০শে জানুয়ারী। তাঁর মার্কিন লবির ভয়ে, আয়ুব এই কাজটা এতাে দেরিতে করলেও, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সম্প্রদায়, সােহরাবর্দি সহ সকল রাজবন্দীর মুক্তির দাবির সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের অন্যান্য গণতন্ত্র সম্মত দাবিতে সােচ্চার হয়ে ওঠে। এখন আয়ুব চীনের দিকে ঝুঁকছেন। তাই মার্কিন রাষ্ট্রদূত রুনটরী তাঁর পাকিস্তানের দৌত্যকর্মে ইস্তফা দিয়ে দেশে পাড়ি দিলেন। তাঁর বিদায় সভার পূর্বেই তাঁর সুহৃদ সােহরাবর্দিকে কারারুদ্ধ করা হ’ল। (৪৩)
১৯৬২-র ৩১ শে জানুয়ারী ঢাকায় আয়ুব তাঁর হােমরাচোমরা প্রশাসকদের সঙ্গে সম্মেলন ডাকেন। সােহরাবর্দি পাকিস্তানের শত্রু এবং সাধারণভাবে দেশদ্রোহী—এ কথা আয়ুব ঘােষণা করেন। অখন্ডবঙ্গ নিয়ে ইঙ্গিত এক সময় সােহরাবর্দির প্রতিযােগীরা করে জব্দ হন কারণ জিন্না স্বয়ং দুই বঙ্গ যােগে তৃতীয় রাষ্ট্র সৃষ্টির প্রয়াস চালাতে নির্দেশ দিয়ে ছিলেন। আসলে সােহেরাবর্দির আইন এবং সংবিধান সংক্রান্ত জ্ঞানগম্যিকে আয়ুব ভয় পেতেন। সােহরাবর্দি নতুন সংবিধানের গলদ ধরে আয়ুব-বিরােধী শক্তিকে জোরদার করবেন এই ভয়ে তাঁকে আটক করতে বাধ্য হন আয়ুব। (৪৪)
১৯৬২র ১লা ফেব্রুয়ারী। আয়ুৰ এই দিনও ঢাকাতে রয়ে গেছেন। সবাত্মক এক ছাত্র বিক্ষোভ ঢাকা শহরের দীর্ঘ জাড্যদশার অবসান ঘটালাে। শুধু বন্দী মুক্তি নয়। গণতন্ত্র এবং ব্যক্তিস্বাধীনতার দাবিতে উত্তাল ছাত্র ফৌজ সরকার পক্ষকে যেন আচমকা হতচকিত করে দিল। (৪৫)
বিহুল সরকার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বাধ্য করলাে রমজান উপলক্ষ্যে দীর্ঘ এক মাস ছুটির এক নজির বিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে। ছাত্র মিছিল বের হ’ল ৬ ফেব্রুয়ারী এই বিচিত্র ছুটির আদেশের বিরুদ্ধে। সঙ্গে রইলাে পূর্বের সব দাবি। পুলিশ লাঠি চালালাে। সংবাদপত্রে এ সব বিরােধী রাজনৈতিক কার্যকলাপ প্রকাশ করা এই আমলে সম্ভব ছিল না। তবু ছাত্রনেতারা জানালাে, এই মিছিল এবং পুলিশী জুলুমের সত্য ঘটনা চেপে গেলে সংবাদপত্র অফিস আক্রমণ করা হবে। ৬ই ফেব্রুয়ারীর বিক্ষোভ কালে আয়ুবের শত শত আলােকচিত্র পদদলিত হ’ল। ছাত্ররা তাঁর আলােকচিত্র নিয়ে রীতিমতাে বহূৎসবও করে ছাড়লাে। আসলে তারা প্রমাণ করে ছাড়লাে আয়ুবের জনপ্রিয়তা কতাে সামান্য, অন্ততঃ এই পূর্ব পাকিস্তানে। পরের দিন, ৭ই ফেব্রুয়ারী ছাত্ররা ধর্মঘট ডাকে। (৪৬)।
৭ই ফেব্রুয়ারীর ধর্মঘটে সাধারণ মানুষও সামিল হন। কিন্তু সরকারী তৎপরতা তথা পুলিশী পীড়ন এই আন্দোলনকে প্রথম থেকেই আয়ত্তে রেখে দেয়। মুজিবর রহমান, ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হােসেন প্রমুখ কাররুদ্ধ হন। কাঁদানে গ্যাস, সামরিক বাহিনীর টহল, একযােগে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে বন্ধ করে দেওয়া এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ—এ সবের লক্ষ্য ছিল এবারের শহীদ দিবস ২১ শে ফেব্রুয়ারীর উপলক্ষ্যে সম্ভাব্য বিক্ষোভ-আন্দোলনকে পূর্বাহ্নেই স্তব্ধ করে দেওয়া। সংবাদপত্রের জন্য বিবাচনবিধি বা সেনসরশিপ কঠোরতর করা হয়। সংবাদের অংশবিশেষ দুই কপি ঐ বিবাচকের জন্য পেশ করতে হ’ত। অতঃপর পরবর্তী দিবস তা ছাপা যেত। এইভাবে ইত্তেফাক এসে ঠেকল চার পৃষ্ঠায়। ছাত্র বিক্ষোভ ইত্যাদির নামগন্ধও সংবাদপত্রে ছাপা গেল না। দু’বার সেনসর সামলাতে গিয়েই ইত্তেফাকের দুটো পৃষ্ঠা কমে গেল। অথচ এ কারণে দুঃখপ্রকাশ করাও নিষিদ্ধ ছিল। ভারতীয় পত্রিকা স্টেটসম্যানও ১৯৬২-র ৪ঠা ফেব্রুয়ারীর পরে সাধারণের সমক্ষে পৌছাতে পারে নি। (৪৭)
ঢাকার ছাত্রদের দাবিয়ে রাখা গেলেও চট্টগ্রাম এবং বরিশালের ছাত্রসম্প্রদায় বিক্ষোভ-সমাবেশ করলাে। এদিকে স্কুল শিক্ষকদের রাজনৈতিক লাইন সম্পর্কে রিপাের্ট করতে আদেশ পাঠানাে হ’ল স্কুল পরিদর্শকদের কাছে। আয়ুব-বিরােধীরা চাকুরী হারাবার আশঙ্কা করলাে এর ফলে। (৪৮) পূর্ব পাকিস্তানে দমন-পীড়ন চালিয়ে বিক্ষোভ-সমাবেশ অসম্ভব করলে কী হবে? সংসদীয় গণতন্ত্রের দাবিতে লন্ডনে ১৮ই ফেব্রুয়ারী প্রবাসী পাকিস্তানী ছাত্রদের ডাকা সভায় শ্রমিক দলের আন্তজাতিক দপ্তরের সচিব ডেভিস এনালস সভাপতিত্ব করলেন। অনেক ব্রিটিশ এম, পি এই সমাবেশের সাফল্য কামনা করে বার্তা পাঠান। অন্যদিকে পাকিস্তানী হাই কমিশন ভবনে পােষ্টার, শ্লোগান, বিক্ষোভে ছাত্ররা তাদের আয়ুবশাহীর প্রতি বিরূপ মনােভাব তিক্তভাবে প্রকাশ করে। রাজবন্দীদের মুক্তি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খােলার দাবিতে শ্লোগান শােনা যায় বিক্ষোভ-জমায়েতে। (৪৯)।
ঢাকা থেকে ২০শে ফেব্রুয়ারী প্রেরিত এক প্রতিবেদনে নিউ ইয়র্ক টাইমস এবং টাইমস অব ইন্ডিয়ার নিউজ সার্ভিস উল্লেখ করে, পূর্ব পাকিস্তানে আয়ুব পড়েছেন এক রাজনৈতিক সঙ্কটের মুখে। নিরক্ষরতার ভূয়া অজুহাতে গণতন্ত্র নিধন এবং সামরিক আইন। চালু রাখার পরিণামে বুদ্ধিজীবীদের মেজাজ বেশ তেতে আছে। (৫০) ২১শে ফেব্রুয়ারী শহীদ দিবসে ছাত্র উদ্যোগে এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। পূর্ব পাকিস্তানের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান কার্জন হলে অনুষ্ঠিত এই সভায় ভাষণ দেন। সার্বজনীন ভােটাধিকারের ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তনের প্রস্তাব পাশ হয়। সভাস্থলের মুখেই পােস্টার। শােভা পায়। স্বৈরাচার এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার উপরে আক্রমণের বিরুদ্ধে সে সব পােস্টার এই সমাবেশের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল। (৫১)।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙালী উপাচার্যকে সরিয়ে অবাঙালী প্রশাসক বসানাের ফলে ১৯৬০-এর ডিসেম্বর থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ পূর্বপাকিস্তানের সকল শিক্ষায়তনের ছাত্ররাই স্বৈরাচার বিরােধী অবস্থানে কৃতসঙ্কল্প হয়। সংবিধান রচনার স্বার্থে যে প্রশ্নোত্তরিকা বিলি করা হয় জনসাধারণের মধ্যে, তা থেকে দেখা যায় শতকরা ৯০ জন চেয়েছেন সংসদীয় প্রথা এবং ফেডারেল বা যুক্তরাষ্ট্রীয় পদ্ধতির সরকার। সােহরাবর্দির গ্রেপ্তারের প্রতিক্রিয়া ছাত্রমহলে তীব্ররূপ নেয়। কে, জে, নিউম্যানের মতে, সােহরাবর্দির গ্রেপ্তার, ঢাকার দাঙ্গা এবং ১লা মার্চ প্রতিশ্রুত আয়ুবীয় সংবিধান—এদের মধ্যে যােগসূত্র আছে। ছাত্রদের একরােখা মেজাজের পরিচয় ৩রা ফেব্রুয়ারীতেই পেয়েছেন পাক পররাষ্ট্র মন্ত্রী মনজুর কাদির। ছাত্রদের সঙ্গে ঐ মন্ত্রীর আলােচনা সংবাদপত্রে ছাপা নিষিদ্ধ হলে ছাত্ররা মন্ত্রীর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাক্ষাৎ করার কথা রক্ষা করবে না—এও জানানাে হল সেদিন। (৫২)।
অবশ্য ৭-ই ফেব্রুয়ারী, ১৯৬২ র ছাত্র বিক্ষোভকারীরা তেজগাঁও বিমানবন্দরে আয়ুব। বিরােধী শ্লোগান দিয়েও এবং আয়ুবের স্তাবকদের গড় আয়ুব-তােরণটি চূর্ণ করেও, পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসকের কারণে শাস্তি থেকে অব্যাহতি পায়। একটা মুচলেকার বিনিময়ে এই অব্যাহতি। এই নরমপন্থী ভাব সরকার দেখাতে বাধ্য হয়। ফেব্রুয়ারী মাস জুড়ে ছাত্র বিক্ষোভ সংগঠিত হচ্ছে। না জানি ২১ শে ফেব্রুয়ারী এ বিক্ষোভ কী চেহারা নেবে—এই শঙ্কাই ঐ উদারতার কারণ। (৫৩)
ছাত্রদের সম্বন্ধে উপযুক্ত নরম মনােভাবের মূলে আছে আজম-আয়ুবের দ্বন্দ্ব—একথা বলেছেন নিউম্যান। প্রায়ই মুষ্টিমেয় ব্যক্তির হাতে পরিচালিত রাষ্ট্রব্যবস্থার উপরে আঘাত আসে ভিতর থেকেই। সােহরাবর্দির গ্রেপ্তারে আজমের সম্মতি ছিল না। প্রতিবাদী ছাত্রদের বিরুদ্ধেও তিনি কোনাে জোরালাে ব্যবস্থা গ্রহণ করেন নি—এই মত অনেকেই পােষণ করতেন। (৫৪)
১লা মার্চ, ১৯৬২ কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে প্রকাশ করা হ’ল আয়ুবের সেই তথাকথিত সংবিধান। পুলিশ এবং গুপ্তচররা ছাত্রদের উপর লক্ষ্য রেখেও সংবিধানবিরােধী আলাপ আলােচনা বন্ধ করতে পারে নি। এ দিকে আয়ুবের মৌল গণতন্ত্রের মৌল গণতন্ত্রীরা—অথাৎ ৮০ হাজার ইউনিয়ন কাউনসিল সদস্য—পরােক্ষভাবে প্রাদেশিক এবং কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপক সভা নির্বাচিত করলেন। তাদের নয়, আয়ুবের হাতে ছিল ১ম চার্লসের মতাে ক্ষমতা—এই কথা বলেছেন স্টিফেন বাবার। ১৫ই মার্চ। মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গণে ঘটা করে সংবিধানের সারাংশের নকল পুড়িয়ে ছাই করে বিদ্রোহী ছাত্ররা। প্রেসিডেন্ট প্রথা, রাজনৈতিক দলের বিলােপ, দমন-পীড়ন মূলক আইন—এ সবের বিরুদ্ধে জনমত ধূমায়িত হতে থাকে। সংবিধান প্রকাশে আয়ুব বিরােধিতা প্রবলতর হয়। পূর্বপাকিস্তানে তাে বটেই। গার্ডিয়ানের মতও অনুরূপ ছিল। অবশ্য অধ্যাপক রাশব্রুক উইলিয়ামস ভয়েই হয়তাে একটু রেখে ঢেকে বলেছেন এই সংবিধান-বিরােধিতার কথা। (৫৫)
বেকায়দায় পড়ে সরকার উঠে পড়ে লাগলাে এই কথাটা প্রতিপন্ন করতে যে, ছাত্র বা অন্যদের সংবিধান-বিরােধী বিক্ষোভ, সংবিধানের দোষে নয়, কমুনিস্ট এবং বৈদেশিক শত্রুদের প্ররােচনার ফলে ঘটে চলেছে। তথ্যসচিব এই তথ্য দিতে গিয়ে পশ্চিম। পাকিস্তানেও কমুনিষ্ট ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করে ফেলেন। সংখ্যালঘু অথাৎ হিন্দুরাও এই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত একথাও বলতে দ্বিধা করেন নি সরকারী কর্তারা। তথাপি কুষ্টিয়ায় ছাত্রসমাবেশে সংবিধান পােড়ানাে হ’ল। আয়ুব পেশােয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন উপলক্ষে ভাষণ দিতে গিয়ে কলকাতা এবং কাবুলে পাক-বিরােধী কমুনিষ্ট কুচক্রীদের কথা বলেন। পরােক্ষভাবে একথাও মনে করিয়ে দেন হিন্দু যারা এখনাে পাকিস্তানে র’য়ে গেছে তাদের লক্ষ্য পাকিস্তানকে ধ্বংস করা। এদিকে বিক্ষোভ আন্দোলন দমনে কোনাে। কোনাে পূর্ব পাকিস্তানী আমলা নরম মনােভাব দেখাবেন ভেবে তাদের স্থলে পশ্চিম পাকিস্তানী আমলার বসিয়ে পূর্ব পাকিস্তানীদের আয়ুব-বিরােধী মনােভাবে নূতন প্রেরণা যােগানাে হ’ল। যদিও উদ্দেশ্য ছিল অন্যপ্রকার। পাকিস্তানকে ধ্বংস করার চক্রান্তেই সংবিধানের সমালােচনা করা হচ্ছে—এই আজব যুক্তি আয়ুবপন্থীরা অনর্গল বলে চললেন। অন্যদিকে দমন-পীড়নের ব্যবস্থাও জোরদার হ’ল। (৫৬)
আয়ুব তার নয়া ইশতেহার প্রকাশ করলেন। বলা হ’ল, পূর্বপকিস্তানকে প্রথমে বিচ্ছিন্ন করে, পরে সমগ্র পাকিস্তানকে ধ্বংস করার চক্রান্ত বানচাল করতে হলে দেশের দুই খন্ডের ঐক্য প্রসারিত করতে হবে। তাই সাংবাদিকদের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তিনি বললেন—হিন্দু প্রভাব মুক্ত হতে এবং দেশের দুই অংশের মধ্যে ঐক্য দৃঢ় করতে প্রয়ােজন বাঙলা ভাষার জন্য উর্দু লিপির প্রচলন। জনৈক পূর্ব পাকিস্তানী সংবাদপত্র সম্পাদক, আয়ুবের উক্তিকে তাঁদের দেশপ্রেমের উপরে গুঢ় ইঙ্গিত মনে করেন। তখন আয়ুব বলেন, তিনি তাদের দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তােলেন নি। (৫৭)।
অতঃপর ১লা এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তথা বিভিন্ন কলেজের অধ্যক্ষদের সঙ্গে ঘরােয়া বৈঠকে সংবিধান বিরােধিতার মূলে বৈদেশিক কুচক্রীর হাতে খেলার কথা বললেন আয়ুব। তিনি এই বিরােধিতার মূলে যে দীর্ঘ দিনের রাজনৈতিক দাবিদাওয়া জড়িত সে কথা না বােঝার ভাণ করলেন। ছাত্ররা সংবিধানের কিছু বােঝে না। তাদের এ বিষয়ে অনধিকার চর্চা বন্ধ করতেও তিনি পরামর্শ দেন এই বৈঠকে। (৫৮)।
ঢাকার প্রেসিডেন্ট ভবনে আহূত এক বৈঠকে ২রা এপ্রিল স্থানীয় সাংবাদিকদের জন্য বক্তব্য রাখতে গিয়ে আয়ুব পুনবার কলকাতা, আগরতলার কমুনিষ্টদের কথা এবং কলকাতা বন্দরের পশ্চাৎভূমি হিসাবে পূর্ব পাকিস্তানকে দখল করার ভারতীয় ষড়যন্ত্রের কথা আউড়ে গেলেন। অতীতের কোনাে অন্যায়ের বিরুদ্ধে বর্তমানের ছাত্ররা বিদ্রোহ করছে কিনা এ প্রশ্নের উত্তরে আয়ুব বলেন, অতীতের ঘটনার দায় তার নয়। ছাত্ররা অপরের ক্রীড়নক একথা বলে আয়ুব জানতে চান এত ভালাে কাজ হ’ল সামরিকশাসনে, সে কথা এরা বলে না কেন? (৫৯) ঢাকায় জাতীয় সংসদের প্রধান কার্যালয় করার তাৎপর্য কতােটুকু ? যে-সংসদের কোন ক্ষমতা নেই তার অবস্থান অমূলক। ঠিক তেমন, পূর্ব পাকিস্তানে পূর্ব পাকিস্তানী গভর্ণর বা মন্ত্রীর ব্যবস্থা অথবা বাঙলাকেও উর্দুর পাশাপাশি রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দান—এ সবই আয়ুবের আমলে ঘটেছে। কিন্তু গণতন্ত্র, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং আর্থিক সমানাধিকারের দাবি এই সব মামুলি সংস্কার দিয়ে চেপে দেওয়া সম্ভব ছিল না। আয়ুবের স্বৈরাচারী ব্যবস্থায় গভর্নর বঙ্গবাসী হলেও তাকে পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল সামরিক চক্রের বশংবদ হতে হবে। ভারত-বিরােধী জিগির তুলতে আজাদ-কাশ্মীরের প্রেসিডেন্ট খুরশিদকে দিয়ে পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে ঝটিকা-সফর তথা ভাষণ দেওয়ানাে হয়। তবু কিন্তু ঢাকার ছাত্ররা ২৪শে মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ে চকিত ধর্মঘটের ব্যবস্থা করে। বিক্ষোভকারী ২০৭ জন ছাত্রকে গ্রেপ্তার করে ১৩০ জনকে মুচলেকার বিনিময়ে খালাস করা হয়। (৬০)
যৎসামান্য আর্থিক সুবিধা পাইয়ে দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানীদের হাত করতে না পেরে আয়ুবপন্থীরা সেই ভারত-বিদ্বেষ ছড়িয়ে চললাে। ভারতের টাইমস অব ইন্ডিয়াতে এই ভারত-বিরােধী জিগিরের বিশ্লেষণমূলক প্রবন্ধ ছাপা হয় ১৯৬২-র ৩রা এপ্রিল। একই দিনে ডন পত্রিকা লিখলাে—পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুরা মুসলিম নিধনকে নৈমিত্তিক কর্ম মনে করে। এ-হেন হিন্দুরা নিজেরা পূর্বপাকিস্তান দখল করবার মতলবে পূর্বপাকিস্তানকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করার মন্ত্রণা দিচ্ছে। পাকিস্তানীদের উচিত নিজেদের দাবি নিজেরাই আদায় করে নেওয়া। (৬১)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২ দিনের ধর্মঘট ৪ঠা তুলে নিয়ে ছাত্ররা ফের ১৬ই এপ্রিল তিনদিনের ধর্মঘট ডাকে। বাঙলা হরফের সমর্থনে, রাজবন্দীদের মুক্তির দাবিতে এবং গ্রেপ্তারী পরােয়ানা বাতিলের দাবিতে ছাত্ররা সােচ্চার হ’ল। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তুচ্ছ কিছু অজুহাতে ৩১শে মে, ১৯৬২ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দিলেন। তিনজন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এবং একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অথাৎ নুরুল আমিন, আবুহুসেন সরকার, আতাউর রহমান এবং হামিদুল হক চৌধুরী সহ সাতজন পূর্ব পাকিস্তানী নেতা ১৪ই এপ্রিল এক বিবৃতিতে জেলে আটক ছাত্রদের সঙ্গে অন্যান্য রাজবন্দীদেরও মুক্তির দাবি জানালে পশ্চিম পাকিস্তানের গুজরানওয়ালার মৌল গণতন্ত্রীরা তাদের সমর্থন করে। সরকারকে ঐ সব দাবি মেনে নিতে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের দাবিসমূহও মেনে নিতে আহ্বান জানালেন। এঁরা আরাে জানালেন, এর ফলে পাকিস্তানের দুই অঙ্গের সম্পর্ক স্বাভাবিক হবে। ডন পত্রিকা অবশ্য সােহরাবর্দিকে গ্রেপ্তার করায় মৃদু এবং দাসসুলভ সমালােচনা করার ছলে ঢাকার ছাত্র বিক্ষোভের নিন্দা এর আগেই প্রকাশ করেছিলা ১৮ই এপ্রিলের সম্পাদকীয়াতে। আর এই নিন্দাই ছিল তার একমাত্র লক্ষ্য। (৬২)
২৩শে এপ্রিল ছাত্রবিরােধী সকল কুৎসার জবাব দিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসংসদের সাধারণ সম্পাদক মুহম্মদ এনাইতুর রহমান। ছাত্ররা কোনাে রাজনীতিকের ক্রীড়নক নয়, দেশদ্রোহী নয় একথা তিনি জানালেন তার ঐ তারিখের বিবৃতি মারফত। লণ্ডনে ৩০শে এপ্রিল পাকিস্তানে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠাকামী কমিটি ছাত্রসহ সকল রাজবন্দীর মুক্তি দাবি করে এবং গণতন্ত্রকামী পূর্বপাকিস্তানীদের উপর সামরিক শাসনকালে যে নিপীড়ন চলছে তার নিন্দা করে। (৬৩)
ছাত্রদের একনিষ্ঠ সংগ্রামের চাপে শেষ পর্যন্ত আয়ুব ছাত্রদের প্রতি একটু নরম হলেন। কিছু কিছু দাবিও মেনে নিয়ে তাদের শান্ত করতে চাইলেন। অন্যদিকে প্রাক্তন মুসলিম লীগ দলের এবং অন্য দলেরও বেশ কিছু নেতা জাতীয় ব্যবস্থাপক সভায় নির্বাচিত হয়ে চমক সৃষ্টি করলেন, সংখ্যায় এঁরা ছিলেন শতাধিক। ১৫০ জনের সংসদে এ বেশ বড় সংখ্যা। দলীয় টিকিটে না জিতলেও তাদের জয় প্রমাণ করলাে গণতন্ত্রসম্মত নানা দলের অবাধ রাজনীতি এখনাে জনপ্রিয়। বিশেষতঃ আয়ুব পরিচালিত এই নির্বাচনে জয়লাভ কম কৃতিত্বের নয়। এ থেকে সামরিক শাসনে নির্বাচকদের অনাস্থাই সূচিত হ’ল। এই সব নয়। অঢেল অর্থব্যয় করেও আয়ুব কিন্তু ব্যবস্থাপক সভায় সংখ্যাগরিষ্ঠের সর্মথন পেলেন না। প্রাদেশিক আইন সভার নির্বাচনী ফলাফলেও আয়ুবের মুখরক্ষা হল না। জনগণতন্ত্রের দাবি একদিন ব্রিটিশ শাসকরাও মানতে বাধ্য হয়েছিলেন। পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবীর রাজনৈতিক চেতনাকে আয়ুব ছােট করে দেখেছিলেন। (৬৪)
উপরে আলােচিত নিবাচনগুলি পদ্ধতিগত অর্থে প্রহসন মাত্র হয়েও, গভীর তাৎপর্যপূর্ণ ফলাফলের কারণে যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছিল। ন্যাশনাল হেরাল্ড মন্তব্য করেছিল, আয়ুব কোন কিছুই পাল্টাতে পারেন নি। শুধুমাত্র ভয়বশতঃ দলীয় কোন্দল আর খেয়ােখেয়ি স্তব্ধ ছিল। অবশ্য এই প্রথম জাতীয় বা প্রাদেশিক স্তরে বর্ণহিন্দুর প্রতিনিধিত্ব ছিল না। প্রাদেশিক আইন সভাতেও মাত্র তিনজন অমুসলিম প্রতিনিধির দু’জন তফসীল সম্প্রদায়ের এবং একজন পার্বত্য উপজাতির লােক ছিলেন। উচ্চবর্ণের হিন্দুরা আয়ুবের আমলে যেন আপাঙক্তেয় হয়ে গেল রাজনীতির দরবারে। (৬৫)।
আয়ুব নিজস্ব রাজনীতির প্রতিপক্ষদের দূরে রাখতেই অবিরত রাজনীতিকদের বিদ্রুপ করতেন। কিন্তু ব্যবস্থাপক সভায় পূর্ব পাকিস্তানীরা, রাজনৈতিক দলের ‘পুনরুদ্ধারের’ দাবি করতে থাকে। আয়ুব অবশ্য সামরিক আইনে আটক বিক্ষোভকারী সকল পূর্ব পাকিস্তানী ছাত্রকে জেল থেকে খালাস করে দিলেন। এর প্রশস্তি করল স্তবক ডন পত্রিকা। বাধ্য হয়ে এটা উনি করেন। এর মধ্যে কূটনীতিজ্ঞতার প্রমাণ বা উদারতার চিহ্ন খোজা অবান্তর। (৬৬)
পূর্বপাকিস্তানীদের ক্ষোভ প্রশমিত করতে আয়ুব খান এবারে উর্দু, বাঙালা উভয় ভাষাকেই আধুনিক বিজ্ঞান-প্রযুক্তির উপযুক্ত মাধ্যমে উন্নীত করার উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে উদ্যোগ নিলেন। নিজেই দুই ভাষাঘটিত বাের্ডের পৃষ্ঠপােষক হলেন। অবশ্য শুধু পুরস্কার, পারিতােষিকের উপর ভরসা করার মানুষ আয়ুব নন। ১৯৬২-র এপ্রিল-মে মাসে তার জমানার কর্তাব্যক্তিরা বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে ঢাকা, রাজশাহী এবং পাবনা এলাকায় সংখ্যালঘু নিধন তথা বিতাড়নের উদ্দেশ্যে ভয়ঙ্কর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধালেন। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিমানবাহিত সেনাবাহিনী পূর্বপাকিস্তানে উপনীত হয়ে ভারত-বিরােধী জিগির জোরদার করলাে। ভারতীয় সহকারী মহাধ্যক্ষ বা ডেপুটি হাইকমিশনার-ভবন সেনাবষ্টিত রেখে, দূতাবাসের বাসিন্দাদের পক্ষে ঐ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লাভের পথ বন্ধ করে রাখলাে একই সঙ্গে। রাজেশ্বর দয়াল তদানীন্তন ভারতীয় হাইকমিশনার। তিনি ঢাকায় এসেছিলেন। তাঁকেও রাজশহী-পাবনা অঞ্চলে যেতে দেওয়া হয় নি। তা ছাড়া আয়ুবের অনুগত গুলাম ফারুককে ১১ই মে, ১৯৬২ তারিখ থেকে দেওয়া হল পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর পদ। আজমকে তার স্থানীয় জনপ্রিয়তার জন্য আয়ুব বরাবরই ঈর্ষা এবং সন্দেহ করতেন। অবশ্য আয়ুবের একান্ত ভক্ত পাকিস্তান টাইমস পত্রিকাতেও লেখা হ’ল বরিশাল এবং চাঁদপুরে বিশাল জনতা আজমকে যে আবেগাপ্লুত বিদায় সংবর্ধনা দিয়েছিলেন ৬ই মে তারিখে, তার কথা এবারের দাঙ্গার মেজাজটাই ছিল আলাদা। সেই সঙ্গে যুদ্ধোন্মাদনার উস্কানি দিয়ে এবং পূর্বপাকিস্তানীরপ্রিয় গভর্নর আজমকে সরিয়ে দিয়ে, আয়ুব বুঝিয়ে দিলেন—তিনি প্রবােধ-সান্ত্বনা দানের পাশাপাশি কঠোরতর পদক্ষেপের প্রস্তুতিও গ্রহণ করতে কুণ্ঠা করবেন না। (৬৭)
সামরিক আইনের মেয়াদ ফুরিয়ে আসছে। সামরিক শাসনকাল শেষ হবার একমাসকাল পরে, বিগত আমলে অনুষ্ঠিত তথাকথিত সাধারণ নির্বাচন অথাৎ সামরিক শাসনের নাগপাশ বজায় রেখে নির্বাচনের ঠাট বজায় রাখার যে-সুযােগ সামরিক শাসককুল পেয়েছিলেন, তার জন্য সংকোচ এবং লজ্জা অনুভব করে আবুল কাশেম খান ভাষণ দেন। তার মতে, গণতন্ত্র ব্যর্থ হয়েছিল একথা সত্য নয়—গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে। পরীক্ষা করে দেখাই হয় নি। সংসদ চালু হবার মুখে সংবিধান বাতিল করা এবং নির্বাচনের মুখে সামরিক শাসনের জোয়াল চাপানাে অথবা ঐ শাসনের পীড়নের পরিবেশে সংবিধান চালু করা—এসবের কোনটিই প্রতিহত করতে না পারাই খান সাহেবের লজ্জা অনুভবের কারণ। (৬৮)
রাজনীতিকদের দুর্নীতির কথা বলে আয়ুবতন্ত্র যে কাচের ঘরে বাস করে ঢিল ছোড়ার ভুল করেছিল তার প্রমাণে তথ্য পেশ করেন পশ্চিম পাকিস্তানী এম, এন, এ চৌধুরী ফজল ইলাহী। আমলা তন্ত্রের উপরে প্রভাব বিস্তার করতে তাদের অবাধ দুনীতির সুযােগ দিয়েছিল আয়ুব জমানা। ফলে প্রশাসনিক ব্যয় ২৯ কোটি থেকে ৪০ কোটি টাকায় ঠেকে এই আমলে। আসামরিক বিভাগে নিজেদের আত্মীয় অনুগতদের যথেচ্ছ চাকুরীদান ও স্বজন পােষণের চূড়ান্ত রূপটি মাহাবুবউল হকের কথায় পরিষ্কার হয়ে যায়। তিনি আয়ুবশাহীকে ফ্যাসিস্ত গণ্য করে বলেন—বিস্তর অর্থের অপচয় হ’ত কিছু লৌহমানব পুষতে। ফ্যাসিস্ত জমানার এরাই তাে স্তম্ভ। পূর্ব পাকিস্তানী এম, এন, এ এবং প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রামিজউদ্দিন আহমেদের কথায় সামরিক শাসনের পূর্বের আমলে যদি দুর্নীতির অঙ্কগুলাে শত বা সহস্রের গন্ডীতে বাঁধা থেকে থাকে, সামরিক শাসনকালে তা লক্ষ এবং কোটির ঘরে পৌঁছে গিয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে, প্রশাসনকে নিজেদের খেয়ালমতাে চালিত করতে হলে উৎকোচগ্রহণ, অর্থের অপব্যবহার এ সব সুযােগ ঐ প্রশাসকদের জন্য উন্মুক্ত রাখতে হয়—কার্ল ভােরিসের এই মতই সমর্থিত হয়েছে উপযুক্ত তথ্য এবং যুক্তির মাধ্যমে।(৬৯)
References:
KHONDKAR ABDUL KHALEQUE, Ek Shotabdi, pp. 217-18. K. J. NEWMAN, “Pakistan’s Preventive Autocracy and its Causes”, Pacific Affairs, March 1959, p. 31. Dawn, 10, 16 October 1958.
ATAUR RAHMAN KHAN, Ojarotir Dui Bachchar, p. 355. Dawn, 10 October 1958. I. H. QURESHI, “The Development of Pakistan”, in GUY S. METRAUX and FRANCOIS CROUZET (ed.), The New Asia (New York, Mentor Books, 1965, for UNESCO), p. 253. AYUB KHAN, Friends Not Masters, pp. 56-57.
J. SENGUPTA, Eclipse of East Pakistan, pp. 445-46. Daily Mail Correspondent’s despatch, cited in The Hindu (Madras), 16 October 1958 ; despatch from London. Speech by SARDAR ATAULLAH KHAN, quoted in SENGUPTA, n. 3, pp. 431-32, and in The Times of India, 6 July 1962. STEPHEN BARBER, “Hopes and Hazards in Pakistan”, The Daily Telegraph, 15 May 1962. For some authoritative comments on Ayub’s coup, see TENDULKAR, Abdul Ghaffar Khan, pp. 515-16.
QURESHI, n. 2, pp. 255-57. ATAUR, n. 2, p. 362. HERBERT
FELDMAN, Revolution in Pakistan (London, Oxford University Press, 1967), p. 206. For facts indicating that Ayub’s land reforms in West Pakistan were largely illusory, see “Spotlight on Ayub’s Dictatorship II”, written by “a wellknown Left-wing leader of Pakistan, who has been working underground in East Pakistan,” in Mainstream (New Delhi), 2 March 1968, pp. 24-25.
EASWAR SAGAR, “East Pakistan under the New Regime”, The Hindu, 6 December 1960. Speech by QAMARUL AHSAN, NAP Debates, 16 April 1963, Vol. I, pp. 1882-83. Speech by MAJOR MOHD. AFSARUDDIN, NAP Debates, 13 June 1963, Vol. II, No. 8, p. 430.
Speech by QAMARUL AHSAN, NAP Debates, 18 June 1962, Vol. I, No. 4, pp. 94-95. Speech by S. M. HABIBUL HAQ, NAP Debates, 17 June 1963, Vol. II, No. 11, p. 577. Speech by JAMALUS SATTAR, NAP Debates, 19 June 1963, Vol. II, No. 13, p. 711. KARL VON VORYS, Political Development in Pakistan, p. 105. The Pakistan Times, 11 May 1962. BHUPENDRA KUMAR DATTA, Interview, I September 1966. STEPHEN BARBER, n. 3.
Speech by NURUL AMIN, Leader of the Opposition, NAP Debates, 4 August 1965, Vol. II, No. 37, pp. 2531-33. Speech by BEGUM ROQUYYA ANWAR, NAP Debates, 19 March 1963, Vol. I, No. 9, p. 596. QURESHI, n. 2, pp. 257-58.
NEWMAN, n. 1, p. 33. QURESHI, n. 2, p. 258. SENGUPTA, n. 3, p. 456.
ATAUR RAHMAN KHAN, n. 2, p. 373. RICHARD V. WEEKES, Pakistan : Birth and Growth of a Muslim Nation (Princeton, Van Nostrand, 1964), p. 118. SENGUPTA, n. 3, p. 454. G. W. CHOUDHURY, Democracy in Pakistan, pp. 227-28. QURESHI, n. 2, p. 258.
Speech by MAHBUBUL HAQ, NAP Debates, 18 June 1962, Vol. I, No. 4, pp. 105-6. Speech by BEGUM ROQUYYA ANWAR, n. 7. Speech by QAMARUL AHSAN, NAP Debates, 15 June 1963. Vol. II, No. 10, p. 518.
Speech by EBRAHIM KHAN, NAP Debates, 3 July 1962, Vol. I, No. 17, p. 941. Speech by BEGUM ROQUYYA ANWAR, Ibid, p. 944. Speech by MAJOR MOHD. AFSARUDDIN, Ibid., p. 954. VORYS, n. 6, pp. 90-91.
Dawn (Karachi), 28 October 1958.
Pakistan Observer, 22 February 1959. One may indeed be shocked by Herbert Feldman’s observation, that at no time in the history of the Martial Law administration was sight ever lost of the democratic idea”, in Revolution in Pakistan,p. 206..
Speech by FARID AHMAD, NAP Debates, 11 July 1962, Vol. I, No. 24, pp. 1308, 1368-69. Speech by MAHBUBUL HAQ, Ibid., p. 1370.
Speech by MAHBUBUL HAQ, NAP Debates, 18 June 1962, Vol. I, No. 4, pp. 111-12. 16. Ibid., pp. 107-8.
Speech by SYED ABDUS SULTAN, NAP Debates, 20 June 1962, Vol. I, No. 6, p. 194.
The Pattern of Agricultural Unemployment: A Case Study of an East Pakistan Village (Bureau of Economic Research, Dacca University, 1962), esp., pp. 34-36.
Speech by MD. SERAJUL ISLAM MIAH, NAP Debates, 26 June 1962, Vol. I, No. 11, p. 529.
MOHAMMAD OSMAN HASAN, “Border Problems and Economic Security of East Pakistan”, Journal of the Pakistan Academy for Village Development, Comilla, July 1962, pp. 42-43.
Marketing of Jute in East Pakistan (Dacca University SocioEconomic Research Board, 1961), esp., pp. 127-28, 153-54, 156-57.
MAHBUB UL HAQ, The Strategy of Economic Planning (Karachi, Oxford University Press, 1963). 23. Ibid., pp. 92-93. 24. Ibid., pp. 93-95. 25. Ibid., pp. 100:4. NURUL ISLAM, “Some Aspects of Interwing Trade and Terms of Trade in Pakistan”, The Pakistan Development Review, Spring 1963, p. 6. JOHN H. POWER, “Industrialization in Pakistan : A Case of Frustrated Take-Off ?”, The Pakistan Development Review, Summer 1963, p. 205. It is surprising to note how Ayub simply denies the transfer of resources from East to West Pakistan in Friends Not Masters, p. 225.
G. W. CHOUDHURY, n. 9, pp. 235-40, esp., p. 240. Pakistan Observer, 19 October 1961. A. H. M. NURUDDIN CHOUDHURY,
“The Weight of Tax Revenue in the Pakistan Economy”, The Pakistan Development Review, Spring 1963, pp. 100-1.
ATAUR RAHMAN KHAN, n. 2, pp. 159-62. VORYS, n. 6, pp. 94-96.
Speech by S. ZAMAN, NAP Debates, 18 June 1963, Vol. II, No.12, pp. 659-60.
Ibid., pp. 661-63. 30. Speech by QAMARUL AHSAN, NAP Debates, 18 June 1962, Vol. I, No. 4, p. 95.
NAP Debates, 10 April 1963, Vol. I, p. 1544. 32. NAP Debates, 30 March 1963, Vol. I, No. 16, p. 1020. 33. Speech by MAHBUBUL HAQ, NAP Debates, 18 June 1962, Vol. I, No. 4, p. 109.
Speech by SYED ABDUS SULTAN, NAP Debates, 20 June 1962, Vol. I, No. 6, p. 194. MAHBUB UL HAQ, n. 22, p. 114 ; this name must not be confused with the name of the East Pakistani MNA, MAHBUBUL HAQ, mentioned, for instance, in n. 33.
ASLAM SIDDIQI, A Path for Pakistan (Karachi, Pakistan Publishing House, 1964), pp. 10, 11, 26. Speech by SYED ABDUS SULTAN, NAP Debates, 20 June 1962, Vol. I, No. 6, p. 193. Speech by MAJOR MOHD. AFSARUDDIN, NAP Debates, 27 June 1962, Vol. I, No. 12, p. 643.
Ibid., pp. 643-44. Speech by MAHBUBUL HAQ, NAP Debates, 15 June 1964, Vol. II, No. 12, p. 755. 37. SIDDIQI, n. 35, p. 78. AFSARUDDIN, n. 35.
ZINKIN, quoted in SENGUPTA, n. 3, pp. 142-43. Also see Ibid., pp. 141-42. The Atlantic, September 1957, p. 8.
Pakistan Observer, 31 January, 10 March 1959. The Pakistan Times, 25 February 1959.
P. C. LAHIRY, India Partitioned and Minorities in Pakistan, pp. 50-56. The Statesman (New Delhi), 15 August 1961. 41. LAHIRY, n. 40, pp. 37-38.
NAP Debates, 18 June 1962, Vol. I, No. 4, p. 117. NAP Debates, 9 July 1962, Vol. I, No. 22, p. 1215. NAP Debates, 16 April 1963, Vol. I, p. 1895.
Dawn, 31 January 1962. The Hindu, 31 January 1962.
The Pakistan Times, 31 January, 1 February 1962. The Amrita bazar Patrika (Calcutta), 1 February 1962. ATAUR RAHMAN KHAN, n. 2, pp. 17-18.
The Pakistan Times, 2 February 1962. The Hindu, 2 February 1962.
Despatch from Staff Correspondent in Dacca, The Statesman (New Delhi), 7 February 1962. 47. Ibid., 8, 9 February 1962.
The Amrita Bazar Patrika, 11 February 1962. Also see GIRILAL JAIN, “Prospects in Pakistan”, The Times of India, 15 February 1962. 49. The Hindu, 20 February 1962. 50. The Times of India, 21 February 1962. 51. The Amrita Bazar Patrika, 22 February 1962.
K. J. NEWMAN, “Pakistan’s rulers fear a political revival”, The Guardian (Manchester), 1 March 1962. VORYS, n. 6, pp. 100-01.
The Pakistan Times, 13 March 1962. The Amrita Bazar Patrika, 23 February 1962.
STEPHEN BARBER, n. 3. NEWMAN, n. 52.
The Guardian, 2 March 1962. The Amrita Bazar Patrika, 3, 16 March 1962. The Pakistan Times, 15 March 1962. BARBER, n. 3. Also see The Times, 2 March 1962.
The Times, 20 March 1962. The Indian Express (New Delhi), 29 March 1962. The Pakistan Times, 23, 29, 30 March 1962. Feldman, n. 4. pp. 160-63 57. The Statesman (New Delhi), 30 March 1962. 58. Dawn, 2 April 1962. 59. The Pakistan Times, 3 April 1962. 60. HUGH TINKER, India & Pakistan (London, Pall Mall Press, 1962), p. 92. The Times of India, 26 March 1962. The Pakistan Times, 26 March 1962. Despatch from INDER JIT, stationed in Karachi, The Times of India, 4 April 1962. RICHARD V. WEEKES, Pakistan : Birth and Growth of a Muslim Nation (Princeton University Press, 1964), pp. 12627 ; WEEKS appears to share Tinker’s views.
১৭০
Dawn, 3 April 1962. INDER JIT, n. 60. 62. The Pakistan Times, 5 April 1962. Dawn, 15, 17, 18 April 1962. The Hindu, 19 April 1962.
The Pakistan Times, 25 April 1962. The Hindustan Times (New Delhi), 30 April 1962. 64. BARBER, n. 3. The Times, 30 April, 3 May 1962. 65. The National Herald (Lucknow), 3 May 1962. LAHIRY, n. 40, p. 38.
The Amrita Bazar Patrika, 22 April 1962. Dawn, 5 May 1962. BARBER, n. 3.
Despatch from INDER JIT in Karachi, The Times of India, 30 April 1962. The Pakistan Times, 2, 3, 8 May 1962. The Amrita Bazar Patrika, 5 May 1962. The Pakistan Times, 3 June 1962. 68. NAP Debates, 9 July 1962, Vol. I, No. 22, p. 1219. 69. VORYS, n. 6, p. 296. Speech by CH. FAZL ELAHI, NAP Debates, 14 June 1963, Vol. II, No. 9, p. 474. Speech by RAMIZUDDIN AHMED, NAP Debates, 17 June 1963, Vol. II, No. 11, p. 567. Speech by MAHBUBUL HAQ, NAP Debates, 27 June 1964, Vol. II, No. 24, p. 2046
গনতন্ত্র এবং জাতীয়তার অগ্নিপরীক্ষা – জয়ন্তকুমার-রায়, pp 58-78
মৌল গণতন্ত্র – তত্ত্বে এবং প্রয়ােগে
১৯৬২ র ৮ই জুন সামরিক শাসনের অবসান ঘটল। যুগপৎ উদ্বোধন হ’ল দ্বিতীয় পাকিস্তান প্রজাতন্ত্রের জাতীয় সংসদ বা ব্যবস্থাপক সভার। উদ্বোধন লগ্নেই আয়ুব অবহিত ছিলেন এ সংসদ ঝানু সব রাজনীতিকে ঠাসা। সামরিক আইনের নিগড়ে গণতন্ত্রকে বাঁধার ফাঁকে, আবার একই সঙ্গে মৌল গণতন্ত্রের সােনার পাথরবাটি সাজাতে-সাজাতে আয়ুব খান যেন জানতেই পারেন নি কী কৌশলে রাজনীতিকরা নিজেরা অথবা তাদের-ই বাছাই করা প্রার্থীরা সংসদ ভবনে তাদের আসন পাকা করে নিয়েছে নির্বাচনে জয়লাভ করে। অথাৎ এত করেও, নিজের তাঁবেদার দিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরেও, ঠিক স্তবকে-ভরা একটি সংসদ ভােগ করার বাসনা তাঁর পূর্ণ হ’ল না। ঐ রাজনীতির পাণ্ডারাই কি কম ধূর্ত ? ওদের ভােটে দাঁড়ানাে নিষিদ্ধ করা মাত্র ওরা ওদেরই চ্যালাদের ভােটে নামালাে এবং সংসদ-সদস্য করে ছাড়লাে! পূর্ব পাকিস্তানী পাঁচ জন মন্ত্রিপরিষদে অন্তর্ভুক্ত হলাে। এরা প্রত্যেকেই এম, এন, এ। দশজন মন্ত্রিপরিষৎ সদস্যের অধিকাংশই ছিলেন এম, এন, এ। অবশ্য সংবিধানে সুযােগ ছিল সংসদ বহির্ভূত ব্যক্তিকে মন্ত্রী করার। আয়ুবের মলব, মন্ত্রিত্বের বিতরণে সংসদ-সদস্যদের মধ্যে খেয়ােখেয়ি বাধানাে। বগুড়ার মুহম্মদ আলিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রী করা হ’ল। ইনি প্রাক্তন পাক প্রধান মন্ত্রীও বটে। সংসদীয় সচিব হিসাবে আয়ুব, বহুল সংখ্যক ব্যক্তিকে মনােনীত করলেন এম, এন, এ-দের মধ্য থেকে। এতে আয়ুবের স্তবক-সংখ্যা বাড়লাে। পূর্ব পাকিস্তানী রাজনীতিকদের মধ্যে বিরােধ তীব্রতর করতে প্রাক্তন মুসলিম লীগ নেতাদের-ই মন্ত্রিত্বে বরণ করা হ’ল। যে সংসদের কাছে মন্ত্রী দায়বদ্ধ নয়, তার বেলায় এত সচিব পদ সৃষ্টির প্রকৃতই কোনাে কারণ ছিল না। অবশ্য মলব সিদ্ধি-ও তাে একটা ব্যাপার। সমরনায়ক রাষ্ট্রনায়ক হলে সেটাই যে হয় একমাত্র ব্যাপার! ডন পত্রিকাও অনাবশ্যক সচিবপদ সৃষ্টির অভিসন্ধির মূল উদ্ঘাটিত করে সমালােচনা করে। রাজনীতিকদের কল্পনাশক্তিও নাগাল পাবে না এমন এক কীর্তি আয়ুবকে এ সব সত্ত্বেও সংবাদস্রষ্টার গৌরব দিল। তিনি সেই কে, এ, সাবুরকে কেন্দ্রীয় যােগাযােগ মন্ত্রীর আসনে বসালেন যাঁকে তাঁর নিজের-ই সৃষ্ট সামরিক আইন কিছু কাল পূর্বেই সাজা দিয়েছিল। (১) পূর্বপাকিস্তানের কুশলী সাংসদদের মােকাবিলা করার তাগিদেই আয়ুব খানকে নানা রাজনৈতিক ছলাকলার আশ্রয় নিতে হত। পশ্চিম পাঞ্জাব থেকে অসাংসদ মন্ত্রী দুজন ছিলেন। কিন্তু দক্ষ বিতার্কিক বলতে যা বােঝায় তারা সবাই যে ঐ বিরােধী ভাবাপন্ন। পূর্ব পাকিস্তানী সাংসদ। পাঞ্জাবী সাংসদরা সীমান্ত প্রদেশের সদস্যদের চেয়ে, এবং পূর্ব পাকিস্তানীর চেয়ে তাে বটেই, কেমন যেন অপরিণত ছিলেন – এই মন্তব্য ১৯৬২-র ৩রা মে তারিখে ‘দি টাইমস’ পত্রিকাতে করা হয়েছিল। সভাধ্যক্ষ বা স্পীকার পদে সকল পূর্বপাকিস্তানী সদস্য একবাক্যে তমিজউদ্দিন খানকে সমর্থন করে তাঁদের সংহতি এবং শক্তি প্রতিপন্ন করেন। অথচ উপাধ্যক্ষ নির্বাচন প্রশ্নে পশ্চিম পাকিস্তানী সদস্যদের মতানৈক্য ছিল রীতিমতাে তীব্র। পূর্বপাকিস্তানীদের সংহতির মুখে আয়ুবপন্থীদের গােপন বাসনা পুরণ সম্ভব নয় বুঝে, তাদের প্রার্থী হবিবুর রহমান, অধ্যক্ষপদের জন্য তমিজুদ্দিনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে শেষ পর্যন্ত সাহস-ই পান নি। পূর্বপাকিস্তানীরা সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত অনুসারে তমিজুদ্দিনকে সমর্থন করছেন একথা জেনেই আয়ুবপন্থী হবিবুর পিছিয়ে যান। প্রথম গণপরিষদ বা কনসটিটুয়েন্ট অ্যাসেমব্লির চেয়ারম্যান এবং মুসলিম লীগের তখনকার দিনের অন্যতম প্রধান তমিজুদ্দিনকে সুসংহত সমর্থন জ্ঞাপন করে পূর্ব পাকিস্থানীরা ‘পাকিস্তান টাইমস’ – এর পর্যন্ত প্রশস্তি লাভ করেছিলেন। পশ্চিমখণ্ডের অনৈক্য ঠিক একই সঙ্গে সমালােচিত হয়েছিল ঐ পত্রিকায়। পূর্বখণ্ড থেকে শিক্ষা নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানীদের ঐক্যবদ্ধ হবার উপদেশও বিতরণ করে ঐ পত্রিকা। নইলে, ঐ পত্রিকার মতে নাকি উভয় খণ্ডের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনে অসুবিধা হতে পারে। অর্থাৎ পত্রিকার লেখক বড়ই ভাবনায় ছিলেন, পূর্বের সঙ্গে লড়াই করবেন কী ভাবে এঁরা যাঁদের নিজেদেরই এত বিবাদ? (২)
ডন পত্রিকাও যে-বিষয়টি চেপে রাখতে চায় নি তা হ’ল পূর্বপাকিস্তানীদের বিত্ত, শিল্প, আর্থিক ব্যাপার ইত্যাদি উন্নয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দপ্তর গুলির মন্ত্রী করা হয় নি। এদিকে আবার মুহম্মদ আলির চাপে, আয়ুব সংবিধান শুধরে মন্ত্রীদের সংসদ সদস্য থেকে যাবার সুযােগ দিলেন। পাঁচ জন পূর্বপাকিস্তানী সাংসদকে মন্ত্রী করে নিলেন আয়ুব এই সঙ্গে। কিন্তু নিজ প্রদেশের দাবিদাওয়া মেটানাের প্রতিশ্রুতি না পেয়ে এবং নিজ প্রদেশের সাংসদদের সঙ্গে পরামর্শ না করে মন্ত্রিত্বে ব্রীত হবার জন্য এই পাঁচজনের প্রত্যেককে কার্যতঃ দলত্যাগী ঘােষণা করা হ’ল। ৭৮ জন পূর্ব পাকিস্তানী সদস্যের মধ্যে ৬২ জনই এই নিন্দাপ্রস্তাবের এবং কার্যতঃ দল বা গােষ্ঠী থেকে বহিষ্কারের সমর্থন করেছিলেন। (৩)
পাকিস্তান টাইমস এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করে, পূর্ব পাকিস্তানী সদস্যরা যদি এর ফলে বিরােধী ভূমিকাই গ্রহণ করে চলে, তা হলে মন্ত্রিপরিষৎ সংসদের ভােটযুদ্ধে পরাভূত হতেও তাে পারে। অর্থাৎ মন্ত্রীদের যে সংবিধান শুধরে এম, এন, এ পদে ব্রীত থাকার অধিকার দিয়ে ঐ মন্ত্রিপরিষদের উপর একটুখানি গণতান্ত্রিক প্রলেপ দেওয়া হয়েছিল তাই তাে মুছে যাবে ভােটে হেরে গেলে। অবশ্য পূর্ব পাকিস্তানীদের সুদৃঢ় ঐক্যে যে একটু ফাটল ধরানাে গেছে অর্থাৎ কয়েকজন দলছুটের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে—এটাই আয়ুবের একমাত্র সাফল্য বা সান্ত্বনা। (৪)
পূর্বপাকিস্তানী সাংসদদের শক্তি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা সরকারের ছিল। ১৬ই জুন, ১৯৬২-র পাকিস্তান টাইমস এই শক্তির উৎস নির্ণয় করে লেখে—পূর্ব পাকিস্তানীরা নিজ অঞ্চলের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ। ব্যক্তিগত স্বার্থচালিত পশ্চিম পাকিস্তানীদের সঙ্গে এই তাদের পার্থক্য।
আয়ুব চিরাচরিত স্বৈরাচারী ধাঁচে পুরস্কার এবং শাস্তির যুগপৎ যােগানের ব্যবস্থা রেখে চললেন। অনাবশ্যক সংসদ সচিব পদ গুলাে যেমন পুরস্কার, দুত মারফৎ হুমকি তেমন-ই শাস্তির হুঁশিয়ারি। সামরিক শাসন ফিরতে পারে – এই গুজবটি ছড়িয়ে আয়ুবতন্ত্র সন্ত্রস্ত করতে চেষ্টা করে গেছে সাংসদদের। প্রেসিডেন্টকে চ্যালেঞ্জ করলে সাংসদরা যেটুকু স্বাধীনতা ভােগ করছে তাও খােয়াবে। কারণ ফের সামরিক শাসন আসবে সেক্ষেত্রে – এই গুজব কিছু সাংসদকে নিশ্চয়ই নিস্তেজ করে থাকবে। (৫)। রাজবন্দীদের মুক্তির মূলতবী প্রস্তাবের বিতর্কে পূর্বপাকিস্তানী এম, এন, এ-দের সুসংহত শক্তির মুখে মন্ত্রিত্বের সুবিধাপ্রাপ্ত হয়েও বগুড়ার মুহম্মদ আলি পর্যন্ত বন্দীমুক্তির বিরুদ্ধে কথা বলতে সাহস করেন নি। মশিউর রহমান বলেন, বিনা বিচারে সাড়ে তিন বছর জেল তাে বন্দীরা খেটেইছেন – সরকার আইনসম্মত বিচার করে অভিযােগ প্রমাণের চেষ্টা করতে ব্যর্থ হয়েছে এতদিন। এর পরে বিচারের প্রহসন অর্থহীন। বিনাবিচারেই
যেখানে সাজা হয়ে গেছে তাঁদের। সােহরাবর্দিকে দেশদ্রোহী বা দেশের শত্রুদের সঙ্গে যােগসাজশকারী বলা ভুল, একথা জোরের সঙ্গে বলেন কামরুল আহসান। এত বড় অভিযােগের প্রমাণ হ’ল না কেন এতদিনে – এ প্রশ্ন করে তিনি বন্দীমুক্তির অন্যথা হলে পূর্বপাকিস্তান যে উদ্বেল হয়ে উবে — সেই হুঁশিয়ারি দেন। (৬)
এর পরেই মুলতবী প্রস্তাবের পক্ষে এম, এন, এ-দের এককাট্টা অবস্থানে এবং তাদের বিস্তৃত বক্তৃতা শুনে, সন্ত্রস্ত আয়ুব মন্ত্রিপরিষদের মুখরক্ষা উদ্দেশ্যেই এম, এন, এ-দের সঙ্গে এক ভদ্রলােকের চুক্তি করেন। ছাঁটাই প্রস্তাব তােলা যাবে না বাজেট প্রস্তাবের উপর – ঐ চুক্তির এই শর্ত, বিরােধী ভাবাপন্ন সাংসদরা অগ্রাহ্য করেন এবং মামুলি এক টাকা হেঁটে দেবার প্রস্তাবের ছলে আলােচ্য প্রশ্নের সমস্যার দিকটি তুলে ধরেন। কামারুল আহসান ঐ দিন পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক অধিকারের প্রশ্নটি — বিশেষ করে তার প্রতিরক্ষাকে স্বনির্ভর করার দীর্ঘ দিনের দাবি – উত্থাপন করেন। এ সব সত্ত্বেও ঐ মন্ত্রিপরিষৎকে খারিজ করার কোন সাংবিধানিক সুযােগ ছিল না। বিভাজনের দাবিকে কেন্দ্র করে প্রেসিডেন্টের সহকারী ভুট্টোর সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানী সাংসদদের বেশ বচসা হয়ে গেল। অবশ্য মন্ত্রিপরিষৎ, আয়ুবের অদৃশ্য হাতের ইঙ্গিতে জয়লাভ তাে করতে বাধ্য করলেও জয়লাভ। আয়ুবের দোসর পাকিস্তান টাইমস পত্রিকার প্রাজ্ঞ সাংবাদিক পূর্ব পাকিস্তানীদের ভৎসনা করলেন কারণ তাংরা সংসদীয় পরিমিতি বােধের পরিচয় দেননি।(৭)
সামরিক আইনের প্রথম দিকে দলীয় ব্যানারে ভােটে নামা নিষিদ্ধ ছিল। পরে দলগুলাের পুনরুত্থান নিষেধ করে অর্ডিন্যান্স বা আদেশনামা জারী-ও করা হয়। সামরিক আইন তােলার লগ্নে ৮ই জুন, ১৯৬২ তারিখেও রাজনৈতিক দলগুলাে যে সংসদীয় কার্যক্ষমতা নষ্ট করে তার উল্লেখ করেন আয়ুব খান। অথচ মাত্র একমাস পরেই বিশেষ শর্তসাপেক্ষ আইনের বলে ঐ রাজনৈতিক দলগুলির পুনরভ্যুত্থানের ব্যবস্থা করা হল। অবশ্য পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের তীব্র আন্দোলনের চাপেই এটা করতে হয়েছিল। মন্ত্রিপরিষৎ তথা সরকারের প্রতি সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন আদায় করার আশায় আয়ুব, রাজনৈতিক দলগুলাের বৈধতা স্বীকার করার মতলব আটেন – এটা সত্য হলেও, কার্যক্ষেত্রে ঐ সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুযােগ সরকারের ভাগ্যে জোটে নি। বগুড়ার মুহম্মদ আলির গণতান্ত্রিক গােষ্ঠীর ৩৫ জন এবং সরকার-সমর্থক মুসলিম প্রগতিশীল গ্রুপের বারির নেতৃত্বাধীন ৩০ জন সদস্য, সংসদে থাকলেও সদার বাহাদুর খানের নেতৃত্বাধীন নিরপেক্ষ গােষ্ঠীর ৩০ জন এবং মশিউর রহমান ও ফরিদ আহমদের নেতৃত্বে আস্থাবান্ প্রায় ৩০ জন পূর্ব পাকিস্তানীর কথা ১৯৬২র ১৭ই জুলাই তারিখের পাকিস্তান টাইমস পত্রিকায় লেখা হয়েছিল। গােষ্ঠী বহির্ভূত সদস্যদেরও আনুগত্যে বিভাজন ছিল। (৮)
এই অবস্থায় এম, এন, এ পদে কায়েম থেকেও মন্ত্রীর আসনে ‘অভিষিক্ত থাকার ব্যাপারটি জটিলতার সৃষ্টি করলাে। সংসদে ভােটে ‘হার মন্ত্রীদের পক্ষে অতীব অবমাননাকর হতাে। প্রেসিডেন্ট নিয়ন্ত্রিত এই মন্ত্রিবর্গ অবশ্য সরকারী প্রস্তাবাদির পক্ষে সাংসদদের সমর্থন অর্জনে সচেষ্ট হতেন। সরকার পক্ষকে পরাজিত করলে আয়ুবের কোপে পড়তে হবে – এই ভীতি প্রদর্শন তাে করাই হ’ত। তদুপরি, ভােটাভুটিতে হেরে গেলেও মন্ত্রিপরিষৎ বহাল থাকবে – এমন আদেশনামা জারী তাে করাই হয়েছিল। সংসদীয় ব্যবস্থায় তথাপি ভােটাভুটিতে জিতে যাবার প্রয়ােজনে একটি তাঁবেদার রাজনৈতিক দলের প্রয়ােজনের কথা আয়ুব যে অনুভব করতেন, তা তাঁর স্তবক পাকিস্তান টাইমস ১৯শে জুলাই, ১৯৬২র সংখ্যায় স্বীকার করা হয়েছিল। পরােক্ষ ভাবে হলেও একটি তাঁবেদার দলের নেতা হিসাবে আয়ুবের আবিভাব হােক – এই কামনাও ঐ পত্রিকায় প্রকাশ করা হয়েছিল। (৯)
খােলাখুলি রাজনীতি করলে এক দলকে অপর দলের বিরুদ্ধে প্ররােচিত করে প্রেসিডেন্ট প্রথার বিরােধী সংসদপন্থীদের কোণঠাসা করতে সুযােগ পাবেন আয়ুব – এই হিতকথা পাকিস্তান টাইমস বর্ষণ করে চললাে। (১০) আয়ুবের মন্ত্রীরা না পেয়েছিলেন সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন না পেরেছিলেন সংসদ ভবনের বাহিরে রাজনীতির খােলা ময়দানে জনসমর্থন। এবডাে – সাজা প্রাপ্ত রাজনীতিকরা পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট প্রথার বিরুদ্ধে বিরাট বিরাট জনসভা করে চলেন পূর্ব পাকিস্তানে। তাদের সােহরাবর্দিকে গ্রেপ্তারের প্রতিক্রিয়ার অনুরূপ বিক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া পশ্চিম পাকিস্তানে ও ছিল। খান আবদুল কাইয়ুম খানের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদেই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানীদের বিক্ষোভ। এদিকে আয়ুব স্তাবকতার পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে পাকিস্তান টাইমস ১০ই জুলাই ১৯৬২ যে মন্তব্য করলাে তা ছিল প্রেসিডেন্ট প্রথাকে জনপ্রিয় প্রমাণ করা এবং তার পক্ষে রাজনৈতিক দল গড়ার কথা কর্তৃপক্ষকে নিবেদন করার ছল মাত্র। প্রকৃত ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়েছিল টাইমস অব ইণ্ডিয়ার সম্পাদকীয় কটাক্ষে – ‘আয়ুব জমানা এই সত্য আবিষ্কার করে হতাশ হচ্ছে যে, স্বৈরতন্ত্র এবং গণতন্ত্রের মাঝামাঝি কিছু হয় না।’ (১১) আয়ুবের গণতান্ত্রিক ঠাটবাটের মধ্যে তাঁর স্বৈরাচারী প্রবণতা কিছুমাত্র হ্রাস পায় নি। কোনাে সময়ে যাঁর ছয় মাসের কারাবাস হয়েছে ঐ স্বেচ্ছাচারী নিরাপত্তা আইনের সুবাদে, তিনি কোনাে রাজনৈতিক দলে যােগ দিতে পারবেন না- এই অনুজ্ঞা জারী করা হ’ল। অথাৎ নিরাপত্তা আইনকেই আবার-ও সক্রিয় করে তােলা তাে হ’লই এই কৌশলের সাহায্যে, তার প্রযােগক্ষেত্রও আরাে সম্প্রসারিত হ’ল। এই সব একতন্ত্রবাদী বিধি নিষেধ রাজনৈতিক দলেগুলাের কার্যকলাপের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করে গণতন্ত্রের উদ্দেশ্যই ব্যর্থ করে দিয়েছিল। পূর্বপাকিস্তানের নাসরুল্লা খান, রাজনৈতিক দল সংক্রান্ত নূতন বিল সম্পর্কে তীক্ষ্ণ মন্তব্য করেছিলেন এই কথায় যে, এ বিল এক হাত দিয়ে যাকিছু দিয়েছিল অন্য হাতে তার সবটাই ফের কেড়ে নেবে। ঢাকায় ৮ই জুলাই, ১৯৬২ তারিখে এক মহতী জনসভায় এই গণতন্ত্রবিনাশী প্রতারণাপূর্ণ বিলের তীব্র নিন্দা করে প্রস্তাব গৃহীত হয়। করাচী এবং লাহাের প্রভৃতি স্থানেও অনুরূপ প্রতিবাদ-সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ামকের ভূমিকা জনগণের। কিন্তু এ বিলে সেনাবাহিনী এবং আমলাতন্ত্রের উপরেই সেই ভূমিকা বর্তায়। রাজনীতির অবাধ কার্যকলাপ এবং প্রতিবেশী ভারতের মতাে দু’ তিনটি অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে সরকারী স্তরে দুর্নীতি হ্রাস পেত—এই মত ফরিদ আমেদ প্রকাশ করে আয়ুবপন্থীদের মত খন্ডন করেন। অর্থাৎ রাজনীতিকে দুর্নীতির ক্ষেত্র এবং রাজনীতিককে তার নায়ক প্রতিপন্ন করার অপপ্রচারের জবাব দিয়ে যে সত্য পরােক্ষ ইঙ্গিতে ফাঁস করা হ’ল তা হ’ল স্বৈরাচারী প্রশাসকরা দুর্নীতির আধার। একাধিপত্য রক্ষার প্রয়ােজনেই আমলাদের অবাধ লুণ্ঠনের সুযােগ করে দেয় স্বৈরাচারী শাসক স্বয়ং।(১২)
মাত্র কয়েক সপ্তাহ হ’ল সামরিক শাসনের অবসান হয়েছে। এই অবস্থায় আয়ুব জমানার সমালােচনার যে-সুযােগ দীর্ঘ ৪৪ মাস পরে এসেছে তার সদ্ব্যবহার সংসদের বাহিরে যেমন ভিতরেও তেমন করলেন মধ্য জুলাই-এর সংসদ অধিবেশনের বক্তারা। বিতর্কের গুণ বিচারে সরকার পক্ষের যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে হার মানতে হয়েছে—একথা পাকিস্তান টাইমসও স্বীকার করলাে। ডন-তাে এবারের সংসদ অধিবেশনে বক্তাদের দৃপ্ত এবং অকপট কার্যকলাপের সাধুবাদ করে প্রাক সামরিক শাসন কালের সাংসদদের চেয়েও এই সীমিত গণতন্ত্রাধীন সাংসদদের উদ্দীপ্ত বাচন ভঙ্গি এবং তাকে জোরের সঙ্গে অকপটভাবে প্রকাশ করার ক্ষমতাকে বড় করে দেখালাে। পশ্চিম পাকিস্তানী সাংসদরা উত্তেজনা প্রবণ এলাকার ঐতিহ্য বহন করেও আনেন নি, আবার বিশেষ কোনাে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশজনিত একরােখা ভাব-ও তাদের ছিল না। উপরন্তু স্বভাবতঃই স্বল্পভাষী এবং সঙ্গতিপন্ন হবার কারণে জ্বালাময়ী বক্তৃতা নির্ভর রাজনীতি তাঁদের ধাতে নেই। এমন অনেক কথাই পাকিস্তান টাইমস লিখলাে যা থেকে বেশ বােঝা যায়, পূর্বপাকিস্তানী সাংসদদের সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে পশ্চিম পাকিস্তানী সাংসদরা ঐ আয়ুব-স্তুতিকার সাংবাদিকের মনঃক্লেশের কারণ হয়েছিলেন। প্রতিক্রিয়া বিরূপ হতে পারে এই আশঙ্কায় সকল সমালােচনা বন্ধের ঝুঁকি নিতে না পেরে সরকারকে এই পর্বে পূর্ব পাকিস্তানী নেতাদের উপস্থাপিত অনেক অসন্তোষজনক কথাবার্তা সহ্য করতে হয়েছে। যদিও ঐ মহল থেকেই বিপদ আসতে পারে এটা জানা ছিল, তবু সামরিক শাসন বাতিল করামাত্র পুনবার সেই প্রত্যক্ষ পীড়নের পথে যেতে অসুবিধা ছিল। কাইয়ুমকে গ্রেপ্তার করা কিংবা সােহরাবর্দির কারাবাস দীর্ঘতর করার বেশ বিরােধিতাই করেছিল ডন পত্রিকা। অবশ্য একই সঙ্গে ঐ পত্রিকা খােসামােদ করতেও ছাড়ে নি এই কথা বলে যে ওদুটো কাজ নাকি সরকারের কার্যাবলীর অমৃতভান্ডে পতিত মক্ষিকা সুলভ। অথাৎ, ঐ সাংবাদিকের মতে, সরকারের সাম্প্রতিক কার্যাবলী ছিল অমৃত ! (১৩)।
নেতাদের আটক রাখায় সরকার-বিরােধী আন্দোলন উঠেছিল তুঙ্গে তাঁদের মুক্তির দাবিতে এতাে সরকার পক্ষ দেখেইছে। আবার ছাড়া পেয়ে সােহরাবর্দি পশ্চিম-পূর্ব উভয় অংশ জুড়ে এক জাতীয় ফ্রন্টের সংগঠন করে সংবিধানকে গণতন্ত্রসম্মত করতে সচেষ্ট হন। পুনরায় আটক হবার ভয় অগ্রাহ্য করে মুজিবর রহমান ঝাঁপিয়ে পড়লেন ক্রিয়াকলাপে, অগণতান্তিক সরকারী নীতির কঠোর সমালােচনায় হলেন মুখর। একটি তাঁবেদার রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে গণতান্ত্রিকতার ধূম্রজাল সৃষ্টি করার মানসে মুসলিম লীগ দলকে চাঙ্গা করলেন আয়ুবপন্থীরা। কিন্তু কেন্দ্রীয় মন্ত্রিমন্ডল বেছে বেছে প্রতিনিধি। মনােনীত করেও প্রথম অধিবেশনে পূর্বপাকিস্তানী প্রতিনিধিদের তােলা কাইয়ুম-এর। মুক্তিপ্রস্তাব নাকোচ করতে ব্যর্থ হলেন। একটি সংশােধনী প্রস্তাবের ফলে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, উপমন্ত্রী এবং সংসদ সচিবদের আর অধিকার রইলাে না মুসলিম লীগদলের মধ্যে কোন দলীয় পদ লাভ করার। কর্তাব্যক্তিদের তৈরি দলীয় সংবিধান আরাে এক বড় ধাক্কা খেল। দেশের দুই খন্ডের সুষম প্রতিনিধিত্ব-র সংশােধনী পাশ হলে। এর ফলে লীগের কাউনসিল, কার্যকরী সমিতি এবং সংসদীয় বাের্ডে তাে বটেই, পার্টির সর্বোচ্চ পদসমূহ বিতরণের ক্ষেত্রেও এই নীতি অনুসরণের দাবি করেছিলেন পূর্ব পাকিস্তানীরা। এই প্রশ্নে অবশ্য পাকিস্তানের দুই খন্ডের প্রতিনিধিদের বিরােধ সাধারণ্যে প্রচার পায়। (১৪)
১৯৬২র সেপ্টেম্বরে প্রাক্তন আওয়ামী লীগ এবং তখন লুপ্ত জাতীয় আওয়ামী দলের নেতাদের সঙ্গে তাে বটেই, প্রাক্তন মুসলিম লীগের যে দুই নেতা আয়ুবের মুসলিম লীগ থেকে সরে ছিলেন সেই সদার বাহাদুর খান এবং মিঞা মমতাজ দৌলাতানার সঙ্গেও আলাপ-আলােচনা চালাতে সােহরাবর্দি ব্যস্ত ছিলেন, যদিও তাঁর কোনাে রাজনৈতিক দলে যােগ দেবার বা ভােটভিত্তিক কোনাে পদে ব্রীত হবার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা ছিল। অক্লান্ত পরিশ্রম করে পশ্চিম-পূর্ব উভয় খন্ডের জনগণের সমর্থন-ধন্য একটি জাতীয় ফ্রন্ট তিনি গড়ে তুললেন এবং আয়ুবকে এই ফ্রন্ট নেতাদের সঙ্গে গােলটেবিল বৈঠকে মিলিত হয়ে নূতন একটি সংবিধান রচনার উদ্যেগ নিতে পরামর্শ দিলেন। আয়ুবকে পূবর্তন সংবিধান রচনার উদ্যোক্তারা বিপথে চালিত করেছেন এই মত প্রকাশের সঙ্গে তিনি এই দাবি-ও করেন যে, জাতীয় ফ্রন্টকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রত্যেকে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের ৯৫ শতাংশ অধিবাসী সমর্থন করে। সােহরাবর্দি একথা কিন্তু মেনে নেন নি যে, এই জাতীয় ফ্রন্টের আড়ালে পূর্বপাকিস্তানীদের রাজনৈতিক অভিসন্ধি রয়েছে। তার মতে, রাজনৈতিক চেতনা সমধিক ব’লেই পূর্ব পাকিস্তানী নেতৃবৃন্দ এই ফ্রন্ট গঠনে অধিকতর উদ্যেগ গ্রহণ করেছেন। (১৫)
সােহরাবর্দির উপর উপরে বর্ণিত নিষেধাজ্ঞা থাকার কারণে, মৌলানা ভাসানি হলেন এই ফ্রন্টের অথাৎ জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের বা এন, ডি, এফ-এর কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা। পশ্চিম এবং পূর্ব পাকিস্তানের পৃথক পৃথক প্রাদেশিক কমিটি ইতঃপূর্বেই গঠিত হয়েছিল। ভাসানির জাতীয় আওয়ামী দল পাকিস্তানের উভয় অঙ্গেই জনপ্রিয় ছিল। ভাসানির উপরেই দলীয় সংহতি প্রতিষ্ঠা এবং কোনাে রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে গণআন্দোলনের রূপরেখা রচনার দায়িত্ব বর্তায়। পূর্ব পাকিস্তানী নেতারা কিন্তু তখনকার নানা বিধিনিষেধের নিগড়ে বাঁধা রাজনৈতিক দল গঠনে আপত্তি করেন। ভাসানি-ও তাদের যুক্তি মেনে নেন। আন্দোলন অবশ্য চলতেই থাকে। ঢাকার পল্টন ময়দানে ১৯৬৩র ১৭ই মার্চ নুরুল আমিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জনসভার উদ্যোক্তা ছিল এন, ডি, এফ। প্রাপ্তবয়স্কের ভােটাধিকারের ভিত্তিতে গঠিত সংসদের প্রতিনিধিরা যাতে পূর্ব পাকিস্তানের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন এমন গণতন্ত্র-সম্মত সংবিধানের দাবিতে প্রস্তাব, এই জনসভায় গৃহীত হয়। মুজিবর তাে নয়া সংবিধানের দাবিতে আন্দোলন সদলবলে পরিহার করবেন এই কথা জানান এই শর্তে যে আয়ুবের চালু করা সংবিধানের পক্ষে দেশের দশ শতাংশের সমর্থন আয়ুবকে গণভােটের মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে। অর্থাৎ মুজিবর বুঝিয়ে দেন, দেশ শুদ্ধ মানুষ এই স্বৈরাচারী তথা নাগরিক অধিকার খর্বকারী সংবিধানের উপরে বীতশ্রদ্ধ। (১৬)।
পূর্বপাকিস্তানীছাত্রমহল থেকে এল আয়ুবতন্ত্রের বিরুদ্ধে তীব্রতর সংগঠিত আঘাত। পূর্ব পাকিস্তানের বাসিন্দা হয়েও, আয়ুবের কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রী হবার কারণে খান এ সাবুরের ডাকা জনসভার অনুষ্ঠান, রংপুরের ছাত্রদের নেতৃত্বে এবং জনসাধারণের সহযােগিতায় আদৌ সম্ভবই হয় নি। সভা করতে ব্যর্থ হয়ে সাবুবের অনুগামীরা ছুরিকাঘাত করে ছাত্রদের । পাকিস্তান দিবসে, ১৯৬৩-র ২৩শে মার্চ, পুলিশের গুলিতে একজন ছাত্র নিহত হন। কিন্তু এই সব ঘটনা সম্পর্কে কোনাে মুলতবী প্রস্তাব সংসদে উত্থাপন করতে দেওয়া হয় নি। অবস্থা ক্রমশঃ আয়ুবের নাগালের বাইরে চলে যায়। স্বয়ং আয়ুব ঢাকায় উপস্থিত থেকেও বিশ্ববিদ্যালয়-সমাবর্তন অনুষ্ঠান বর্জন করতে বাধ্য হন। রাজশাহীতে গিয়েও আয়ুব সেখানকার ছাত্রদের বিক্ষোভের মুখে পড়েন। কার্জন হলে ডাকা ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশে পুলিশ আক্রমণ করে। এ সব সম্পর্কে সংসদে মুলতবী প্রস্তাব তােলার দাবি অগ্রাহ্য করা হলেও, ছাত্রদের আন্দোলন এবং বিক্ষোভ সমাবেশ ইত্যাদির চাপে পূর্ব পাকিস্তানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলাে কার্যতঃ অচল অবস্থায় পৌছায়।(১৭)
গণ-আন্দোলনে সন্ত্রস্ত আয়ুব সরকার, জাতীয় ব্যবস্থাপক সভার নির্বাচন শেষ হতেই ১৯৬২-র জুন মাসে পাকিস্তান দন্ডবিধি বা পীন্যাল কোড জারী করে। ছাত্রবিক্ষোভ এবারে কিন্তু করাচী, লাহাের পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। বহু ছাত্র লাহােরে কারারুদ্ধও হয়। সমস্ত বিষয় উল্লেখ করে ঐ দন্ডবিধি বাতিল করার দাবি জানিয়ে সংসদে বক্তৃতা করেছিলেন মাহাবুবউল হক। স্বাধীন পাকিস্তানে মুক্ত পরিবেশে শিক্ষাব্যবস্থার যে-আদর্শের কথা জিন্নার মুখে জেনে ছাত্ররা মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তার এই বীভৎস পরিণামে ছাত্রসমাজ গর্জে উঠলাে স্বাভাবিকভাবেই। মাহাবুব উল হক বিশেষ ভাবে উল্লেখ করেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ কীভাবে এই কালাকানুনের পর থেকে হয়ে উঠেছে সন্ত্রাসের বিভীষিকা সেই কথা। (১৮)
অতঃপর এল আয়ুব-সংবিধানের প্রথম সংশােধনী বিল। সরকারপক্ষ এই বিলে পাকিস্তানকে ঐশ্লামিক রাষ্ট্র ঘােষণা করে তার নূতন নামকরণের প্রস্তাব করলে, বিরােধী সাংসদরা বাধা দেন, এবং নামে ইসলাম-প্রীতি জাহির করার প্রতিবাদ করে বলেন–যেসরকার বিদেশী সুরা আমদানীর পরিমাণ ক্রমশঃ বাড়তে দেয়, যদিও ইসলামে সুরাপান সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ, তার এই অহেতুক নামকরণে ইসলাম-প্রীতি জাহির করা হাস্যকর। ফরিদ আহমদ তাে তীক্ষ বিদ্রুপ করে বলেন—ঐশলামিক ভাবাবেগকে আজ সুরাপানের আবেগ পিছু হটতে বাধ্য করেছে। (১৯)
ব্যক্তিস্বাধীনতা, রাজনৈতিক স্বাধীনতা হরণ করে, মধ্যযুগীয় ধর্মাশ্রিত রাষ্ট্রব্যবস্থার উদ্যোগ নিয়ে স্বৈরতন্ত্রের ভিত্তি দৃঢ় করার অভিসন্ধি কথঞ্চিৎ আড়াল করার প্রয়ােজনে সংবিধান-সংশােধনী বিলটিতে এক চমকপ্রদ প্রস্তাব ছিল। মৌলিক অধিকারকে আইন প্রণয়নের নীতিগত নিয়ামকের ভূমিকা থেকে সাংবিধানিক মর্যাদা দেবার এই প্রস্তাবের বিপক্ষে মাহাবুবউল হক বলেন, সরকার এই সব আপাত গণতান্ত্রিক নীতিগত সূক্ষ্ম কারুকার্যের আড়ালে বড়ােই স্থূলভাবে সামরিক শাসনকালের দমন-পীড়ন মূলক নির্দেশনামাগুলাে জীবন্ত করে তুলতে চাইছে। এই প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রীকে প্রশ্ন নিক্ষেপ করেন বেগম রােকেইয়া আনােয়ার-“যদি ১৯৫৮-৬২ আমলের সামরিক শাসনকালে চাপানাে আইনগুলাে পূর্ববৎ বলবৎ থাকে, তা হলে ব্যক্তিস্বাধীনতা প্রদান করার দাবি আইনমন্ত্রী কোন্ যুক্তিতে করতে পারেন? জনগণের সচেতনতা এবং আশা-আকাঙ্ক্ষাকে ছােট করে দেখার বিপদ সম্পর্কে হুঁশিয়ারী দিয়ে কামরুল আহসান-ও বক্তৃতা করেন। তিনি স্মরণ করিয়ে দেন জনসাধারণের প্রতিবাদ অভ্যস্ত সংযমের সীমা লঙ্ঘন করলে তার জন্য দায়ী থাকবে সরকারী দমননীতি। (20)
রাজনৈতিক দল সংক্রান্ত এক নম্বর আদেশনামার জোরে রাজনীতিকদের স্বাধীনতা আরাে খর্ব করার ব্যবস্থা হ’ল। এবডাের পীড়নে লাঞ্ছিত নেতারা পাকিস্তানের সৃষ্টির জন্য যে ত্যাগ স্বীকার করেছেন, এবডাের ছলে তাদের বিপজ্জনক বলে প্রচার করেও সরকার পক্ষ দেখলাে তাদের জনপ্রিয়তা কিছুমাত্র হ্রাস পায় নি। আজিজুল নামের জনৈক ব্যক্তি কোনাে এক সরকারী কর্মচারী সভার পরিচালনা করেছিলেন—এই অজুহাতে নেতা আজিজুল হককে এবডাের কবলে ফেলা হয়েছিল। পল্টন ময়দানে সরকার সমর্থকরা একবার চ্যালেঞ্জ দিয়েও সভা করতে ব্যর্থ হয়। ঢাকার জনগণের সরকারের প্রতি অনাস্থা এতদূর তীব্র ছিল যে, সরকারের স্তাবকদের বক্তৃতা শােনার শ্রোতাই পাওয়া গেল না পল্টন ময়দানে। প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে এবং মাৎসর্য বশতঃ জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থিত নেতাদের জনসভায় ভাষণ দান কিংবা সংবাদপত্রে বিবৃতি দান নিষিদ্ধ হ’ল নূতন আদেশনামার জোরে কারণ এই সব নেতাদের উপর এবাের প্রয়ােগ করা হয়েছিল ঐ সামরিক শাসনকালে। (২১)
একই সঙ্গে এবডােসাজা প্রাপ্ত নেতাদের পছন্দমতাে ঐ অর্ডিন্যান্সের কোপ থেকে অব্যাহতি দেবার ক্ষমতা নিজের হাতে রেখে আয়ুব চাইলেন বিরােধী শিবিরে ফাটল ধরাতে।(২২)।
এরপরেই আক্রমণ নেমে এল সংবাদপত্রের স্বাধীনতার উপর। ২রা সেপ্টেম্বর, ১৯৬৩ দেশ জুড়ে সরকারী আদেশনামাজারী হ’ল এই মর্মে যে সরকার পক্ষের বক্তব্য, প্রচারপত্র পুরাে বা সংক্ষিপ্তভাবে ছাপতে প্রতিটি পত্রিকা বাধ্য থাকবে। অথচ সংসদভবনে বিরােধীদের ভাষণের যে-ভাষ্য অধ্যক্ষ বা স্পীকার মারফৎ সংবাদপত্র দপ্তর প্রাপ্ত হবে, অবিকল তাই ছাপতে হবে। অন্যথা সংবাদপত্রের লাইসেন্স কেটে যাবে। ইচ্ছা করলেই সরকার একটি কমিশন নিয়ােগ করে সংবাদপত্রাদির আর্থিক শৃঙ্খলা পরীক্ষা করতে এবং সেই ছলে পেটোয়া পত্রিকার স্বার্থে বিরােধীভাবাপন্ন পত্রিকার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেও পারবে -কা র্যতঃ এই মর্মে হুঁশিয়ারী দেওয়া হয়েছিল সংবাদ পত্র ঘটিত ঐ আদেশনামায়।(২৩)
সােহরাবর্দি যখন কেন্দ্রীয় পাকিস্তান সরকারের প্রধান মন্ত্রীর উচ্চপদ গ্রহণ করেন। তখন যে-ভাসানি তার বিরুদ্ধে যুক্তি দেখাতেন, সেই ভাসানিই এবারে চীনের মুক্তিদিবসে প্রতিনিধি হবার সামান্য সুযােগে আয়ুবের তাঁবে চলে গেলেন। অবশ্য ভাসানির নিজেকে ঠকানাের মতাে ছুতাে একটা ছিল। ১৯৬৩-র অক্টোবরের আগে থেকেই আয়ুব চীনের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করতে লেগে পড়েছিলেন। স্ববিরােধের চূড়ান্ত নিদর্শন দেখিয়ে ঐ। ভাসানিই নিজের পুরানাে দল ন্যাপের পুনরুভ্যুত্থানে ব্যস্ত হলেন এবং ১৯৬৩-র ১৫ ই ডিসেম্বরের মধ্যে তার প্রস্তাবিত পূর্বপাকিস্তানস্বার্থবাহী ছয় দফা দাবি পূরণ না হলে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করবেন সে কথাও জানালেন। (২৪)।
অন্যদিকে পূর্বপাকিস্তানের মতাে পশ্চিম পাকিস্তানেও বিরােধীদের জনসভায় সরকার পক্ষের ভাড়াটে গুন্ডারা হামলা শুরু করেছিল। পশ্চিম পাকিস্তানী সাংসদ চৌধুরী মুহম্মদ হুসেইন চাটঠা সংসদে বলেন—এই সংসদের ক্ষমতা কিছু না থাকলেও, এটিই আমাদের নিরাপদ বিলাপ-কক্ষ। জনসভাও তাে আজ বিপজ্জনক। মৌল গণতন্ত্র যে প্রকৃত গণতন্ত্র নয় তা এই সংসদের ক্ষমতাশূণ্যতাই প্রমাণ করে। আয়ুবপন্থী মুসলিম লীগ রাওয়ালপিন্ডির একটি বালিকা বিদ্যালয় এবং শিয়ালকোটে জিন্নার স্মারক একটি হাসপাতাল ভবন জবরদখল করে এই সময় (জুন, ১৯৬৩)। আয়ুব এই দলের সদস্যপদ গ্রহণ করার পর থেকে নির্লজ্জ ভাবে সরকারী অর্থে এবং আনুকূল্যে দলীয় স্বার্থ উদ্ধারে ব্রতী হয় এই দল। মাহাবুব উল হক বলেন— একেই বলে পাকিস্তানী গণতন্ত্র। আয়ুব এই দলের নিম্নতম পর্যায়ের সদস্য বলে দলীয় ইশতেহারকে সরকারী প্রেস বিজ্ঞপ্তি হিসাবে চালানাে হচ্ছে এবং দৈনিক পত্রিকাকে বাধ্য করা হচ্ছে সে সব ছাপতে। পৃথিবীর আর কোন্ দেশে এটা সম্ভব ? (২৫)
যে সংসদের ক্ষমতাই নেই আদপে তার সদস্যদের দায়িত্বপালনের প্রশ্নই ওঠে না। অথচ আয়ুব তাঁদের দায়িত্বজ্ঞানহীন ফুটবলপ্রেমীদের সঙ্গে তুলনা করলেন। সৈয়দ হুসেইন মানসুর বলেন, ক্ষমতাই নেই কিছু কার যেখানে আমরা করবােই বা কী ? এক অর্থে। আয়ুবের কথা ঠিক। কিন্তু একথাও সরকারকে মনে করিয়ে দিতে চাই, এ সংবিধানে আমাদের সাংসদ হয়েও কোন কিছু করার অধিকার নেই। সৈয়দ হুসেইন মানসুর বলেন, ব্যবস্থাপক সভা বা সংসদের হাতে ক্ষমতা কিছু নেই। তথাপি নির্বাচন জিতে এম, এন, এ হয়ে আর কিছু না হােক এই সংবিধানের বিচ্যুতিগুলাে আমরা প্রকাশ করতে পারবাে এই ধারণাটুকু ছিল। বিরােধী রাজনীতিকদের উপর পাকিস্তান দন্ডবিধি আদেশের যথেচ্ছ। অপপ্রয়ােগ রুখতে যে-সংশােধনী মুহম্মদ আবদুল হক চেয়েছিলনে তা-ও প্রত্যাখ্যাত হয়। তিনি আদপেই তা উত্থাপন করার সুযােগই পান নি। (২৬)।
প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের জন্য যে-দাবি পূর্বপাকিস্তানীরা করছিলেন তা মােটেও স্তিমিত হয় নি। সে সব সত্ত্বেও পূর্বপাকিস্তানে পাকিস্তান বেতারবার্তা জোর করে উর্দুভাষায় প্রচারমাত্রা বাড়িয়ে এবং পশ্চিম পাকিস্তানে বাঙলা ভাষায় প্রচারের সময়সীমা নগণ্য করে এনে সমালােচনার সম্মুখীন হল। বেতার-উপদেষ্টামন্ডলের সদস্যা এবং এম, এন, এ বেগম শামসুন নাহার এই বিসদৃশ ভেদবুদ্ধির নিন্দা করলেন সংসদকক্ষের ভিতরে। অবশ্য সাংস্কৃতিক নিপীড়নের প্রতিরােধে আন্দোলন সংসদকক্ষেই আবদ্ধ ছিলএমন নয়। (২৭)।
পূর্বপাকিস্তানের স্থানীয় বাসিন্দা মােনেম খানের মতাে মক্কেলবিহীন আইনজীবীকে প্রাদেশিক গভর্নর বানিয়ে কিংবা বাঙলাভাষার সমৃদ্ধিকল্পে বাের্ড গঠনের কথা প্রচার করে পূর্বপাকিস্তানীদের স্বাধিকারের আন্দোলনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারেন নি আয়ুব খান এবং তাঁর অনুগামীরা। এমন কি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধিয়েও ঐ ন্যায্য দাবি স্থায়ীভাবে চাপা দিতে ব্যর্থ হয়েছে শাসককুল। নূতন সংসদে ১৮ই জুন, ১৯৬২ কামারুল আহসান দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জ্ঞাপন করেন তাদের সঙ্কল্পের কথা : প্রতি বাজেটকে আমরা বিচার করবাে আমাদের পূর্ব পাকিস্তানের মৌলিক প্রয়ােজনগুলির নিরিখে। দেশের পূর্বখন্ড কতােদিনে পশ্চিমখন্ডের সঙ্গে আর্থিক বিকাশের দিক থেকে সম পর্যায়ে পৌছাবে তার কোনাে ইঙ্গিত নেই এ বাজেটে। অথচ ন্যূনতম কালক্ষেপ করে এইটি সম্পন্ন করা ছিল জরুরী। আজিজুর রহমান পরের দিনই বলেন, একটি দিন কেন একটি ঘন্টার কথাও আমার মনে পড়ে না যখন সংসদভবনে দেশের দুই খন্ডের আর্থিক বৈষম্য অপনােদনের দাবি আমরা করি নি। কিন্তু আমাদের বলা সব কথাই গিয়ে পড়েছে যে-কৰ্ণ কুহরে সে কর্ণ যে বধিরের। পূর্ব পাকিস্তানের যতাে অশান্তি, বিশেষতঃ ছাত্রমহলের যতাে অস্থিরতা তা ঐ বৈষম্যের কারণেই। (২৮) অমুসলিম সকল সম্প্রদায়কে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘায়ে তছনছ করে পুর্বপাকিস্তানবাসীকে তার রাজনৈতিক স্বাধিকার দাবি ছেড়ে সঙ্কীর্ণ ভ্রাতৃঘাতী জেহাদে মত্ত করা ছাড়াও একটি বিশেষ লক্ষ্য সম্ভবতঃ ছিল। ঐ দাঙ্গার প্রতিক্রিয়াজাত দাঙ্গা ভারতে এবং বিশেষতঃ কাশ্মীরে ছড়িয়ে গেলে কাশ্মীরে ছােবল সহজ হবে—এটাও সম্ভবতঃ আয়ুব ভাবতেন। তাই অপহৃত পবিত্র কেশ কাশ্মীরের মসজিদে এক সপ্তাহের মধ্যে উদ্ধার করার পরেও আয়ুবপন্থী পত্রপত্রিকা হজরৎ মুহম্মদের পবিত্র কেশ উদ্ধারকে ধাপ্পা বলে প্রচার করে চলে। দাঙ্গা চালু থাকলে অমুসলিমরা প্রাণের ভয়ে পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করবে। তখন পূর্বপাকিস্তানের জনসংখ্যাগত গরিষ্ঠতা দূর হবে। এই ছিল তাদের গুঢ় উদ্দেশ্য। (২৯)
উক্ত অপহরণের ঘটনা ঘটেছিল ১৯৬৩-র ২৭ শে ডিসেম্বর এবং পুনরুদ্ধারের তারিখ ছিল ৪ঠা জানুয়ারী ১৯৬৪। কেন্দ্রীয় যােগাযােগ মন্ত্রী খান এ সাবুর ৩রা জানুয়ারী, ১৯৬৪ খুলনার দৌলতপুরের শ্রমিক-এলাকায় ঐ পবিত্রকেশ অপহরণের প্রতিবাদ সভায় তীব্র প্ররােচনাপূর্ণ ভাষণ দেবার পরেই সংখ্যা গরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের মানুষরা সংখ্যালঘুদের জীবন, সম্পত্তি এবং তাদের নারীর সতীত্ব লুণ্ঠন করে। একই দিনে গভর্ণর মােনেম খান বাগেরহাটে এমন বক্তৃতা করেন যে তিনি বক্তৃতা শেষ করে হেলিকপ্টারে উঠতে-না। উঠতে অমুসলিমদের উপরে জনতার আক্রমণ শুরু হ’ল। দাঙ্গাকারীরা পরের দিন সম্ভবতঃ একটু ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। তাদের বদলে অমুসলিম নিধনে নেমে পড়লাে সামরিক বাহিনী। নির্দিষ্ট আদেশ ছাড়াই তারা গুলি চালালাে সংখ্যালঘুদের উপর। দাঙ্গাবিধ্বস্ত বা দাঙ্গাসন্ত্রস্ত হিন্দুদের ভারতে পালিয়ে যেতে পাকিস্তান সরকার যেন সাহায্যই করলাে এর পরে। প্রতিক্রিয়াজাত দাঙ্গা পশ্চিমবঙ্গে বাধলে পূর্ব পাকিস্তানে তার জবাবে আরাে বড় দাঙ্গা বাধানাের আকাঙক্ষায় ভারতে যাবার পথে কোনাে বাধা দেওয়া হয় নি অমুসলিম পলাতকদের। (৩০)
খুলনার হিন্দুনিধনপর্বের প্রতিক্রিয়ায় বাধা কলকাতার দাঙ্গা দ্রুত সামরিক বাহিনীর সাহায্যে কঠোর হস্তে দমন করা সত্ত্বেও এবং পবিত্রকেশ উদ্ধারের পরেও, আয়ুবসরকারের বড়কর্তারা অবাঙালী মিল মালিকদের সঙ্গে গােপন সভায় ১৪ এবং ১৫ই জানুয়ারী মিলগুলিতে ছুটি ঘােষণা করে। ঐ দু’দিন অবাঙালী শ্রমিকদের হাতে সর্ববিধ মারণাস্ত্র তুলে দেওয়া হয়। নারায়ণগঞ্জের আদমজি কারখানা এবং টাঙ্গির নিষাত কারখানা এলাকায় ঐ সব অবাঙালী শ্রমিকরা অমুসলিমদের হত্যা করে উৎসবের মেজাজে। সঙ্গে সম্পত্তি লুণ্ঠন, নারীধর্ষণ, গৃহে অগ্নিসংযােগও ব্যাপকভাবে চলে। হিন্দুরা বিতাড়িত হলে বা ভয়ে পালিয়ে গেলে রুজিরােজগারে মুসলিম বেকারেরা সুবিধা পাবে—এই প্রচারের ফলে সাধারণ বেকাররাও ঐ হিন্দুনিধন পর্বে উৎসাহভরে যােগ দেয়। (৩১)
১৪ই জানুয়ারী, নেলী সেনগুপ্ত তার প্রভাব খাটিয়ে উচ্চ পদস্থ ব্যাক্তিদের বাধ্য করেন চট্টগ্রাম শহরে অমুসলিম নিধন তাণ্ডবের পরিকল্পনা ভন্ডুল করতে। ঐ দিন হিন্দু বৌদ্ধ ইত্যাদি অমুসলিমদের বাড়িতে প্রত্যুষে লক্ষ্য করা গেল বাড়ির দেওয়ালে-দেওয়ালে ক্রশ চিহ্ন আঁকা। অর্থাৎ এই বাড়িগুলােতে ঐদিন হামলা হ’ত। সংসদ স্পীকার ফজলুল কাদের চৌধুরী, এই পূর্বপাকিস্তানী নেতার বিশেষ অবদান ছিল ঐ দাঙ্গা প্রতিহত করায়। (৩২) ইউনিয়ন কাউনসিল সদস্যরা অনেকেই অথাৎ আয়ুবের বিচিত্র সংবিধান সম্মত ঐ সব মৌল গণতন্ত্রীদের মধ্যে বিশেষ ধান্দাবাজরা সব সময়ই আয়ুব জমানায় সুযােগ পেত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা কিছু পরিমাণে জিইয়ে রেখে হিন্দুদের ধন সম্পত্তি টাকাকড়িতে ছােবল দেবার। ভারত থেকে বিতাড়িত বা নিষ্ক্রান্ত এই মিথ্যা পরিচয় দিয়ে খাড়া করতাে তারা নিজেদের পেটোয়া মুসলিমদের। হিন্দুদের ভয় দেখাতাে ঐ মৌল গণতান্ত্রীরা এই মর্মে যে, বিস্তর পয়সাকড়ি ভেট না পেলে তারা হিন্দুগৃহে ঐ সব ‘উদ্বাস্তু মুসলিমদের আবাসনের ব্যবস্থা করবে। যে দু একটি ক্ষেত্রে উদ্বাস্তুরা সাজানাে নয়, প্রকৃতই ভারতত্যাগী মুসলিম, সেক্ষেত্রে তাে এ ব্যবস্থা প্রযুক্ত হ’তই। মিথ্যা অজুহাতেই হ’ত অধিকাংশক্ষেত্রে। এই সব নৃশংস এবং ক্রুর ইউনিয়ন কাউনসিল সদস্যরা কীভাবে হিন্দুনির্যাতন চালাতে সে সংবাদ পূর্ব পাকিস্তানের প্রগতিশীল সংবাদপত্রে ছাপাও হয়েছে সে সময়। মানবতাবাদী এবং প্রগতিশীল পূর্ব পাকিস্তানী নেতৃবৃন্দ সেই হাঙ্গামার সময়ে আয়ুবশাহীর সমাজবিরােধীদের হাতে প্রাণ হারাবার ঝুঁকি নিয়েও হিন্দু নির্যাতন বন্ধ করতে কার্যকর ব্যবস্থাদি গ্রহণ করেন। মুজিবর রহমন, হামিদুল হক চৌধুরী, সবে পুনঃ প্রতিষ্ঠিত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার বিষয়টি এবারে বিশেষ গুরুত্ব পেল। সেই প্রসঙ্গে প্রতিক্রিয়াশীল শাসকচক্রের সাম্প্রদায়িকতা জীইয়ে রাখার কুৎসিৎ চক্রান্তের স্বরূপ উদঘাটন করে ভাষণ দিলেন ছাত্রনেতৃবৃন্দ। ও পক্ষ থেমে ছিল না। ১৭ই ফেব্রুয়ারী এক নির্দেশনামা জারী হ’ল, যার ফলে অমুসলিমরা সংশ্লিষ্ট অফিসারের অনুমতি ব্যতিরেকে সম্পত্তি বিক্রয় করার অধিকার হারালাে। অথাৎ সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি হয়ে পড়লাে আয়ুবপন্থী লুটেরাদের অবাধ মৃগয়াভূমি। (৩৫)
‘ওয়াশিংটন সানডে স্টার’ এবং নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকাতেও অমুসলিম নিধনে। পাকিস্তান সরকারের পৃষ্ঠপােষকতার কথা লেখা হ’ল, যা পূর্বে কখনাে হয় নি। কারণ, এক লক্ষ খৃষ্ঠান এই দাঙ্গায় বিপর্যস্ত হয়ে পাকিস্তান ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেন। খৃষ্টানরাও যে ১৯৬৪-র জানুয়ারীর ভয়ংকর দাঙ্গায় লাঞ্ছিত হয়েছিলেন সে কথা মার্কিন এবং ইতালিয়ান খৃষ্টধর্ম যাজকদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ভিত্তিক বিবৃতিতেও উল্লেখ ছিল। (৩৬)
কায়েদ-ঈ-আজম জিন্নার ভগিনী, ১৪ই ফেব্রুয়ারী, ১৯৬৪ তঁার ঈদ-বাতায় পাকিস্তান সরকারের সমালােচনা করে বলেন, প্রাপ্তবয়স্কের ভােটাধিকারই যেখানে জনসাধারণকে রাজনৈতিক বিচক্ষণতার শিক্ষা দেয়, সেই অধিকার থেকে তাঁদের বঞ্চিত করে, বিচক্ষণতার অভাবে তারা ভােটাধিকার প্রয়ােগে অযােগ্য—একথা প্রতারণাময়। বিশেষতঃ ঐ সার্বজনীন ভােটাধিকারের সার্থক প্রয়ােগেই যেখানে পাকিস্তানের জন্ম হয়। জিন্নার ভগিনী ফতেমা জিন্নার ঐ বক্তব্যের প্রতিবাদে কেন্দ্রীয় তথ্যমন্ত্রী কাশ্মীর সমস্যা, সাধারণ লােকের অজ্ঞতা, ইত্যাদিকে সার্বজনীন ভােটাধিকারের বিরুদ্ধ যুক্তি হিসাবে খাড়া করেন। অবশ্য সে-সময় কাউনসিলর মুসলিম লীগ সভাপতি খাজা নাজিমুদ্দিন, এন, ডি, এফ এবং মুজিবর রহমান ফতেমার ঈদ-বার্তাকে স্বাগত জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছিলেন। ব্রিটিশ শাসকরা যেমন স্বাধীনভাবে দেশ শাসনে অযােগ্য এই ছুতােয় ভারতবর্ষকে স্বাধীনতা দিতে চাইতাে না, পাকিস্তানের শাসকচক্র-ও তেমন জনগণের অজ্ঞতার ছুতােয় প্রাপ্ত বয়স্কের ভােটাধিকারে রাজী হচ্ছেন না—এই মত প্রকাশ করা হল এন, ডি, এফ-এর পক্ষে। (৩৭)
পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিস্থিতিও ছিল শােচনীয়। বিরােধী পক্ষের সদস্যদের প্রাপ্য সুযােগ-সুবিধা, প্রশাসকরা মানতেন না। আইন-সভাতে আইন নয়, আদেশনামা বা অর্ডিনেন্স ঢালাও ভাবে সৃষ্টি করা হত। আয়ুবের স্তাবক কিন্তু অযােগ্য ত্রিশ জন পালামেন্টারি সচিব পদ সৃষ্টি করে আইনসভার সদস্যদের কিনে নিয়ে সরকারের শক্তিবৃদ্ধি করা হত। ঐ সব অযােগ্য সচিবরা প্রশ্নোত্তর পর্বে স্ববিরােধী উক্তি-প্রতুক্তি করে, ভুল তথ্য দিয়ে এবং পরে তা চাপে পড়ে শুধরে নিয়ে আইনস ভার মর্যাদাই শুধু ক্ষুন্ন করার যােগ্যতা দেখাতেন। (৩৮)
১৯৬৪র ২১শে ফেব্রুয়ারীতে শহীদ দিবস পালন করা হল। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সন্নিহিত শহীদ মিনারে। ছাত্রনেতৃত্ব, আগে থেকেই এবারের আওয়ামী লীগে যােগদানকারী প্রাক্তন লীগের নেতা শাহ আজিজুর রহমান এবং আতাউর রহমান প্রমুখ নেতৃবৃন্দের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার ঐকান্তিক প্রয়াসের সঙ্গে ছিল প্রগতিশীল পত্রিকা সংবাদের প্রাঞ্জল ব্যাখ্যা সম্বলিত প্রবন্ধদি যা বুঝিয়ে বলতাে, দাঙ্গা বাধিয়ে হিন্দুদের তাড়িয়ে দিলে পূর্ব পাকিস্তানী মুসলিমরা সংখ্যালঘু অঞ্চলের বাসিন্দায় পরিণত হয়ে আয়ুতন্ত্রের পীড়ন আরাে তীব্রভাবে ভােগ করতে বাধ্য হবে। সংবাদ পত্রিকা পরিচালকরা পশ্চিমবঙ্গের সংবাদপত্রাদিকেও আহ্বান জানিয়েছিলেন, তাদের সঙ্গে যৌথভাবে সাম্প্রদায়িকতা নির্মূল করার অভিযানে যােগ দিতে। ইত্তেফাক সম্পাদক তােফাজ্জল হুসেইনের মতে, দু’ একটি ব্যতিক্রমের কথা ছেড়ে দিলে পশ্চিমবঙ্গের সংবাদপত্রগােষ্ঠী ঐ আহ্বানে যথাযথ সাড়াই দিয়েছিল। (৩৩)
যে-আয়ুবপন্থী প্রশাসন দাঙ্গা বাধিয়েছিল তা থামাবার প্রশাসনিক দায়িত্ব এড়িয়ে গিয়ে ঐ দাঙ্গা চালু রাখার সহজপন্থাই তারা বেছে নিয়েছিল। তারা বলতাে দাঙ্গা নেই। ১৯৬৪-র জানুয়ারী দাঙ্গার চরম অবস্থায় গভর্ণর মােনেম খান ঢাকায় ছিলেন না। ১৬-ই জানুয়ারী তিনি ফেরামাত্র প্রগতিশীল সাংবাদিকরা ছুটে গেলেন তার কাছে। ইত্যবসরে ইত্তেফাক এবং পাকিস্তান অবজার্ভার দৈনিক দুটো, দাঙ্গার সংবাদ চেপে না রেখে সরকারপক্ষের মিথ্যাভাষণ ফাঁস করে দিয়েছে, এই ‘অপরাধে’ পত্রিকা দুটোর কার্যালয়ে আয়ুবপন্থী দাঙ্গাবাজরা হামলা করে। সরকারী আদেশ জারী করাও হ’ল ইত্তেফাক সম্পাদক তােফাজ্জল হুসেইনের উপর। তাকে পঁচিশ হাজার টাকা জমা রাখার আদেশ করলাে সরকার। তার উপর আক্রোশের মূল কারণ নারায়ণগঞ্জের ভয়ংকর দাঙ্গার সংবাদ চেপে না রেখে তিনি তার কাগজে সব খুলে লিখেছিলেন। শুধু সাংবাদিক বা রাজনীতিক নন—অনেক বুদ্ধিজীবী এই ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গদমনে প্রাণের ভয় তুচ্ছ করে এমন ভাবে লড়ে গেছেন যা সর্বদেশের শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষকে উদ্বুদ্ধ করবে। অনেকক্ষেত্রেই হিন্দুদের বাঁচাতে গেছেন যে-সব মুসলিম, আয়ুবশাহীর সন্ত্রাসবাদীরা তাঁদেরও সমানভাবে আক্রমণ করেছে। (৩৪)
এসব উপেক্ষা করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষাকল্পে কাজ করে চললেন প্রগতিশীল বাঙালী মুসলিমরা। ঈদের প্রাক্কালে সম্পাদকীয় প্রবন্ধে ইত্তেফাক ১৪ই ফেব্রুয়ারী বিগত জানুয়ারীর দাঙ্গাকে ধিক্কার জানালাে। ২২শে ফেব্রুয়ারী, ‘আজাদ, ইত্তেফাক’, ‘ঢাকা টাইমস’ পাকিস্তান অবসাভার’ এবং সংবাদ সহ সাতটি সংবাদপত্রের সম্পাদকদের যৌথ বিবৃতিতে সমাজবিরােধীরা যাতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধাতে না পারে এই মর্মে সক্রিয় হবার জন্য পাকিস্তান এবং ভারতের সচেতন নাগরিকদের কাছে আবেদন করা হল। ইত্তেফাকের ২৪ শে ফেব্রুয়ারী সংখ্যায় মােসাফির এমন কথাও লিখলেন যে, কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গে কী হ’ল বা হ’ল না সে সব অগ্রাহ্য করে অন্ততঃ পূর্ব পাকিস্তানীরা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নিরােধকল্পে সর্বপ্রকার ব্যবস্থা যেন গ্রহণ করেন। ২১ শে ফেব্রুয়ারীর শহীদ দিবসের অনুষ্ঠান গুলিতে এবং তার প্রস্তুতিপর্বে ছাত্রসমাবেশগুলিতেও শহীদ দিবসের প্রতিজ্ঞার কথা প্রচার করেছিল। আয়ুব যে ভােটাধিকার সংক্রান্ত একটি বিল আনতে চলেছেন তারই পরিপ্রেক্ষিতে সার্বজনীন ভােটাধিকার এবং স্বায়ত্ত্বশাসন আদায় করে সমস্ত দমন-পীড়নের অবসান ঘটানাের সঙ্কল্প ছাত্রনেতারা গ্রহণ করেছিলেন। শহীদ মিনার সমাবেশে ভাসানি এবং মুজিবর ভাষণ দেন। পূর্ব পাকিস্তানের সকল দাবি-দাওয়ার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় আদেশনামা রদ করার দাবির প্রস্তাব-ও পাশ হল ঐ সম্মেলনে। অবশ্যই দেশের দুই খন্ডের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণের প্রস্তাবও গৃহীত হয়েছিল’। (৩৯)
১১ই মার্চ ঢাকা শহরে যে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ বা অ্যাকশন কমিটি গঠিত হয়, তার পক্ষে ঘােষণা করা হ’ল পরাধীনতার নাগপাশ কাটিয়ে উঠেছে যে-জাতি তাকে পুনবার পরাধীন করা যাবে না। দাবি করা হ’ল সার্বজনীন ভােটাধিকার এবং প্রত্যক্ষ নিবাচন। নির্বাচনী বিধি সংক্রান্ত দাবি পুরণ-ই ছিল এই সমিতি গঠনের প্রাথমিক লক্ষ্য এবং এর গঠনপর্বে ছাত্রদের ভূমিকাও ছিল বেশ উজ্জ্বল। সদ্য পুনর্গঠিত ন্যাপ এবং আওয়ামি লীগের বিরােধ প্রশমনে ছাত্রদের উদ্যোগে গঠিত এই সংগ্রাম সমিতির একটা ভূমিকা ছিল। এন, ডি, এফ একই প্রকার দাবি তাদের ১৫ই মার্চের দাবিদিবসে জানালেও, ঐ সংগ্রাম পরিষদে যােগ দেয় নি। পাটিদের এই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সকল পাটির কর্মচাঞ্চল্য বৃদ্ধি পেয়ে প্রকারান্তরে পূর্ব পাকিস্তানের দাবি আদায়ের আন্দোলনের কিছু লাভ-ই হয়েছিল। আয়ুবের মুসলিম লীগই ছিল সার্বজনীন প্রত্যক্ষ নির্বাচন বিরােধী একমাত্র দল। আয়ুব অন্য সব দল সম্বন্ধে কটুকাটব্য করে চলেন। প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মুহম্মদ ইব্রাহিম বলেন, (আয়ুবকথিত) খচ্চর অপবাদ পেতেও যদি হয় আয়ুবের কনভেনশনিষ্ট মুসলিম লীগ ছাড়ার জন্য, তবু বলবাে, ঐ খচ্চর-ও লীগ দলের চেয়ে শ্রেয়। এই সময় আয়ুব প্রচার করছিলেন বিরােধীদের বিরুদ্ধে নানা কুৎসা। বিদেশী শক্তির কাছে দেশ বেচে দেওয়া, পশ্চিম পাকিস্তানের ঐক্য নষ্ট করা এবং পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করা—এই সবই নাকি বিরােধীরা ক্ষমতায় এলে একে একে করে চলবে। বিরােধী শিবির এই সব কুৎসায় না দমে তার সংগ্রামী ঐতিহ্য স্মরণ করে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হ’ল জোর লড়াই-এর উদ্দেশ্যে। একদিন তারা লিয়াকতের বি পি সি রিপাের্ট এবং উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার সঙ্কল্প ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের ধাক্কায় চৌচির করে দিয়েছিলেন সে কথা স্মরণ করে তারা মনােবল রক্ষা করে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে চললেন। (৪০)
সংগ্রাম পরিষদ ১৮ই মার্চ পথসভা, ছােট মিছিল ইত্যাদির অনুষ্ঠান করে। প্রত্যক্ষ সার্বজনীন ভােটের দাবিতে এই যে আন্দোলন একে ঢাকার ডেপুটি কমিশনার সমাজবিরােধীদের কাণ্ড’ আখ্যাত করলেও এ-আন্দোলনে ছাত্রীরাও সামিল হয়েছিলেন। ১৯শে বড় মিছিল এবং সাধারণ ধর্মঘটের ডাক। ১৮ তারিখের সন্ধ্যায় সরকার পক্ষের দালালবাহিনী জিপে জিপে মাইকযােগে প্রচার করে বেড়াল–সংগ্রাম-কমিটি ধর্মঘট হরতাল বাতিল করেছে, কাল ধর্মঘট নয় একথা জানিয়েছে। এত বড় রাজনৈতিক অসাধুতা সত্ত্বেও ১৯শে ধর্মঘট এবং বড় মিছিল পূর্ণ সাফল্য লাভ করেছিল। (৪১) গণতান্ত্রিক আন্দোলনের এই পর্যায়ে ছাত্ররাই ছিল এর অগ্রণী বাহিনী। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধিকার হরণ করে এবং অগণতান্ত্রিক তথা বৈষম্যমূলক আচরণের ফলে সরকার পক্ষ ছিল ছাত্রমহলে ধিকৃত। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সমাবর্তন উৎসব প্রায় সকল ছাত্র বয়কট করেন। আয়ুব-স্তাবক কিছু সরকারী চাকুরীপ্রাপ্ত স্নাতক ঐ উৎসবে যােগ দেন। উৎসবমঞ্চে আয়ুবপন্থীদের ভাড়াটে লােক দিয়ে পূর্বাহ্নে অগ্নিসংযােগ করিয়ে, ঐ কুকীর্তির দায় ছাত্রদের ঘাড়ে চাপায় কুচক্রী প্রশাসন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতাদের ঐ অগ্নিসংযােগের সাজানাে দায়ে গ্রেপ্তার করা হয়। সমাবর্তনের উৎসব কক্ষে বিরাট ছাত্র স্কোয়াড গভর্ণর বিরােধী শ্লোগান দেন। গ্রেপ্তার ছাত্রনেতাদের লক্ষাধিক টাকার জামিন ছাড়া ছেড়ে দেওয়া হবে না সরকারের এই ক্রুরতা, ছাত্রদের আরাে বেশি বিক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। পােকায়কাটা বইপত্র এবং জীর্ণছিন্ন সার্টিফিকেট পেয়ে দালাল ছাত্ররা সমাবর্তনে যােগ দেওয়া সত্ত্বেও বিক্ষোভ প্রকাশ করে ঐ সব অবহেলিত প্রাইজ ইত্যাদি ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করে। নূতন করে প্রাইজ দেবার কথা সরকার পক্ষে বলা হয়। সমাবর্তনের তারিখটা ছিল ১৬ই মার্চ। (৪২) ১৮ই মার্চ ঢাকা এবং রাজশাহীতে ছাত্রধর্মঘট পালিত হয়। (৪৩)
মােনেম বিরােধী, আয়ুব-বিরােধী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা যে মােনেমের ভাষণ শুনবেন না এবং সমাবর্তন উৎসব প্রকাশ্যে বয়কট করবেন এটুকু মােনেম-গােষ্ঠী ভালােই জানতাে। আগে থেকে জমায়েত গুন্ডা দিয়ে সম্ভাব্য ছাত্র বিক্ষোভের নেতাদের সমাবর্তন উৎসব প্রাঙ্গণে দারুণভাবে প্রহৃত এবং লঞ্ছিত করালাে ঐ ক্রুর প্রশাসন। এটি ঘটে ২১শে মার্চ।(৪৪)
২২শে মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসব-প্রাঙ্গণ ঠাসা ছিল সশস্ত্র পুলিশে। পুলিশের অবাঞ্ছিত উপস্থিতির প্রতিবাদ করলেন ছাত্ররা। পরিণামে হ’ল খন্ডযুদ্ধ। অধিকাংশ চেয়ার ভেঙে গেছে—এই অবস্থাতেও মােনেম তার তথাকথিত সমাবর্তন ভাষণ পাঠ করে ছাড়লেন। তিন শতাধিক ছাত্র গ্রেপ্তার হলেন। তিনজন সাংবাদিকের অভিজ্ঞানপত্র থাকা সত্ত্বেও গ্রেপ্তার হতে হয় ঐ দিন। (৪৫)
দাবি পুরণ করা দূরের কথা বিবেচনা করাও আয়ুবতন্ত্রের দর্শনশাস্ত্রে ছিল না। ছিল দাবির জবাবে উৎপীড়ন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু ছাত্রকে লােভ এবং ভয়ের যথার্থ ব্যবহারে আয়ুবপন্থী করা হ’ল। সঙ্গে যােগ দিল কিছু গুণ্ডা। এরা সরকারের নির্দেশমতাে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে কিছু গােলযােগ বাধালাে। শুধু এটুকুর অজুহাতে অনির্দিষ্ট কাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ—এই মর্মে আদেশ জারী হ’ল। ইকবাল হলে এ সব অনাচারের প্রতিবাদে সভা করছিলেন ছাত্ররা। পুলিশ সেখানে হামাল চালালাে। বহু ছাত্র গ্রেপ্তার হলেন।(৪৬)
ভােটাধিকার বিবেচনার যে-কমিশন ১৯৬২ তে প্রায় সর্বস্তরে প্রত্যক্ষ সার্বজনীন ভােটভিত্তিক নিবার্চনপ্রথার সুপারিশ করেছিলেন, তার প্রতি ক্ৰক্ষেপ না করে ঐ উদ্দেশ্যে গঠিত নূতন কমিটি প্রাপ্ত বয়স্কের ভােটাধিকার অগ্রাহ্য করলেন। বিরােধী সদস্যদের প্রতিবাদ তারা সংখ্যাধিক্যের এবং সরকারী চাপের কারণে গ্রাহ্য করলেন না। ১৪ই এপ্রিল এই অগণতান্ত্রিক বিল সংসদে পাশ করিয়ে নিয়ে গণতন্ত্রের ভাঁড়ামি করা হ’ল। ২৬শে মার্চ পশ্চিম পাকিস্তানী সদস্য গুলাম জিলানি মালিক আয়ুব সরকারকে মৌলগণতন্ত্রী ধান্দাবাজদের সরকার বলেছিলেন। সরকারের কিছু স্তবক নিজেদের স্বার্থে গণদাবি উপেক্ষা করায় তােফাজ্জল এই নির্বাচনী বিলের কঠোর সমালােচনা করলেন ১৫ই এপ্রিল। (৪৭) ১৯৬০-এর সংবাদপত্র প্রকাশনা আদেশনামা, ১৯৬৩র অক্টোবরে সংশােধিত হয়ে। সাংবাদিক স্বাধীনতা নিশ্চিহ্ন করেছিল। ফলে, ১৯৬৪র মার্চের শেষ সপ্তাহে ছাত্র আন্দোলনের সংবাদ প্রকাশ এবং সেই সম্পর্কে সম্পাদকীয় রচনার কারণে আজাদ, ইত্তেফাক এবং সংবাদ-এর উপর আদেশ জারী হ’ল। পঁচিশ হাজার টাকা করে প্রত্যেক পত্রিকার কাছে কেন জামিন দাবি করা হবে না তার কারণ দর্শাতে বলা হ’ল। একই সপ্তাহে দু’বারে মােট পঞ্চান্ন হাজার টাকা জামিন বাবদ দাবি করল সরকার ইত্তেফাক দৈনিক পত্রিকাটির কাছে। সরকারী বিবাচন বিধি বা সেন্সরের খেয়ালে অনেক ক্ষেত্রে শেষ মুহূর্তে সংবাদ বিশেষের প্রকাশ নিষিদ্ধ হবার ফলে ঐ সংস্করণ প্রকাশ করাই যেত না। এইভাবে প্রায়ই সংবাদপত্রহীন দিন কাটাতে হ’ত নির্ভীক দৈনিকগুলির পাঠকদের। এত করেও সংবাদিকদের অংশবিশেষকে সন্ত্রস্ত করতে ব্যর্থ হয়ে আয়ুব সরকার একটি বিজ্ঞাপন সংস্থা এবং একটি প্রেস ট্রাস্টের সৃষ্টি করার উদ্যোগ নিল। পেটোয়া কাগজে ভিন্ন সরকারী বিজ্ঞাপন যেন না প্রকাশিত হয় এবং বিরােধী সংবাদপত্রাদি যেন লােপ পায়—এই ছিল যথাক্রমে লক্ষ্য এই দুই হবু-প্রতিষ্ঠানের। (৪৮)
আয়ুব শাসনে প্রাক্তন বালুচি, সিন্ধু, সীমান্ত প্রদেশ প্রভৃতি অঞ্চল দমন-পীড়নে জর্জর ছিল–মুজিবর এবং খাজা নাজিমুদ্দিন পশ্চিম পাকিস্তান সফর করে এ সত্য প্রত্যক্ষ করেন। নিপীড়ন এবং বঞ্চনার প্রতিকার মানসে সংসদ-ভবনে ঐ সব অঞ্চলের সাংসদরা প্রস্তাবাদি তুলেছেন মাঝে মাঝে। সব মিলিয়ে দেশের উভয় খন্ডের আয়ুব বিরােধীদের সংহতির সম্ভাবনা বেশ উজ্জ্বল ছিল ১৯৬৪-র মধ্যভাগে এসে। আয়ুবের সামরিক শাসনের বিরােধী বালুচিদের উপর ১৯৬৪ ঈদ উৎসবের দিন বিমান থেকে বােমা-নিক্ষেপ করা হয়েছিল। ‘কপ’ বা কমবাইনড অপােজিশন পার্টি নামের যে সংগঠনটির উদ্ভব হ’ল তার সদস্য এবং কর্মকর্তারা দেশের উভয় খন্ড থেকেই এসেছিলেন। পরিস্থিতির তাগিদেই দেশের উভয় অঙ্গের বিরােধীরা জোট বেঁধেছিলেন। নয় দফা কর্মসূচির মাধ্যমে এক পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক ইশতেহার এই কপ’ জোটের পক্ষে প্রকাশ করা হয়েছিল। পূর্ণ গণতন্ত্র এবং প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের উপরে ঐ ইশতেহারে গুরুত্ব দেওয়া হয়। (৪৯)
আয়ুবের মুসলিম লীগ, মৌল গণতন্ত্রী বা বি, ডিদের দৌরাত্ম্যের জন্য দায়ী এমন ধারণা জনসাধারণের ছিল। বি, ডি রা রাস্তা নির্মাণ প্রকল্পের অর্থ আত্মসাৎ করেছিল এ কথা তাে সকলে স্বচক্ষে দেখেছে। প্রকল্পে নির্মিত রাস্তা এক পশলা বৃষ্টিতেই ধুয়ে যেত। আয়ুবের মুসলিম লীগ, বি, ডি নির্বাচনে দলীয় ব্যানারে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সাহস পেল না। তাদের না-বাচক প্রস্তাব থেকে এটা বােঝা গেল। প্রাদেশিক আইনসভার ক্ষেত্রেও ঐ দল গতবারের বিজয়ী প্রার্থীদের-ই মনােনয়ন প্রদান করবে— ১৯৬৪র ২০শে অগাস্ট গৃহীত তাদের প্রস্তাবে একথাও বলা হ’ল। অথাৎ আয়ুব এবারেও দুনীর্তির শিরােমণিদের-ই কারচুপির মাধ্যমে ভােটে জয়ী করতে চাইলেন। জনপ্রিয়তা তার কাছে কোনাে ব্যাপারই ছিল না। কারচুপি এবং পর্দার অন্তরালের গােপন রাজনীতির জোরে বি, ডি-দের হাত করে প্রাদেশিক স্তরের নির্বাচনী বৈতরণী পার হবার আশা করলেও, বি, ডি দের নিবাচিত করা যে এই পথে দুষ্কর—এটা ভালােই বুঝেছিল আয়ুবের দল। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনেও যে দুর্নীতি এবং কারচুপির জোরে এবারেও আয়ুব জয়ী হবেন—এমন সম্ভাবনা কেউ-ই উড়িয়ে দেন নি। (৫০)
আয়ুব তার জয় নিশ্চিত করতে নির্বাচনের প্রচার-প্রস্তুতির জন্য অর্থব্যয়ের উর্ধসীমা পূর্বের চেয়ে আটগুণ বাড়িয়ে ভােট কেনাবেচার পথটা প্রথমেই সুগম করে নিলেন এবারে। ভােটপত্রের বিপরীত পৃষ্ঠা অফিসারকে দেখিয়ে তবে বাক্সে ফেলা যাবে। অর্থাৎ গােপনীয়তা বিধিও লঙিঘত হ’ল নূতন নিয়মে। (৫১) নিবাচনী আইনে প্রাদেশিক এবং কেন্দ্রীয় আইন সভাগুলাের সদস্যদের নির্বাচনী ব্যয়ের হিসাব দিতে বাধ্য করা হয়েছিল। অথচ প্রেসিডেন্ট পদের প্রার্থীর ক্ষেত্রে এইরূপ ব্যয়ের হিসাব দাখিল করার কোনাে প্রশ্ন ছিল না। তদুপরি মাত্র তিনজন নূতন প্রার্থী গ্রহণযােগ্য হবেন—এই বিধানের অপপ্রয়ােগ করে সাজানাে প্রার্থী দু’জন এবং একজন প্রকৃত প্রার্থীর মধ্যে প্রেসিডেন্ট পদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা সীমাবদ্ধ করে, শেষ মুহূর্তে ঐ ভূয়া দুজনের নাম কার্যতঃ তুলে নেবার ছুতােয় তাদের খাতের ব্যয়যােগ্য অর্থ-ও আয়ুব নিজের প্রচারভিয়ানে ব্যয় করবেন—এ আশঙ্কা ‘কপ’ নেতৃত্ব করছিলেন। প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীকে তার সম্পত্তির হিসাব দিতে হবে—বিরােধী পক্ষের এ দাবি অগ্রাহ্য করা হয়। আসলে তারা নির্বাচন বিধির সংশােধনে যা কিছু প্রস্তাব করেন সবই অগ্রাহ্য করা হয়। (৫২)
স্বৈরাচারকে মদত দিতে যে-সব বেআইনি আইন একের পর এক প্রণয়ন করে চলেছিল আয়ুব সরকার তাদের মুখােমুখি গণআন্দোলন সহজে অভীষ্ট অর্জন করবে না এ কথা বােঝা যাচ্ছিল। তথাপি ২৯ শে মার্চ ১৯৬৪-র বর্ষণসিক্ত পল্টন ময়দানের জমায়েতে মানুষের ঢল নামে। ২৯শে অগাস্ট ১৩-দফা দাবির ভিত্তিতে রাজ্য জুড়ে ছাত্র ধর্মঘট হয়। মিছিল নিষিদ্ধ হয় সেদিন। ছাত্র-পুলিশে ইষ্টক বিনিময় এবং বেশ কিছু গ্রেপ্তার—ছিল এই দিনের উল্লেখযােগ্য ঘটনা। ৩১শে অগাস্ট পুলিশী নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রদেশ জুড়ে সভা সমাবেশের ঘােষণাও ছাত্র সংগ্রাম সমিতির পক্ষে করা হয়। ১৩ দফা দাবির মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা, ছাত্রদের উপরে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বন্ধ এবং সাধারণ গণতান্ত্রিক অধিকারের বিষয়গুলি ছিল। (৫৩)
ছাত্রদের উপর প্রদেশ জুড়ে পীড়ন নেমে এল। লাঠি, কাঁদানে গ্যাস—এ সবের যথেচ্ছ ব্যবহার শুরু হল। টাঙ্গাইল শহরের অভিভাবকরা ছাত্রদের অবাধ পড়াশুনার ব্যবস্থার দাবিতে শহরের বার লাইব্রেরীতে সমবেত হয়ে সমস্যাটির উপরে আলােচনা করেন। এস, ডি, ও এই সভা বন্ধ করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। (৫৪)
কণ্ঠরােধকরা বিধি নিষেধের প্রহরায় যন্ত্রণাকাতর সাংবাদিকদের ডাকে পূর্ব পাকিস্তানের কর্মরত সাংবাদিকদের তিনঘন্টার প্রতীকী ধর্মঘটের পরে মাত্র তিনদিন কাটতেই ২৯শে সেপ্টেম্বর ‘কপ’-এর ডাকে ‘নিপীড়ন বিরােধী দিবস’ পালন উপলক্ষে ডাকা সর্বাত্মক ধর্মঘট সর্বাঙ্গীণ সাফল্য লাভ করলাে। শিক্ষা নিকেতন থেকে খেতখামার কারখানা, নদীপথের নৌকাজাহাজ থেকে রেলপথেট্রেন আকাশপথে বিমানপােত—সর্বত্র কর্মবিরতির সঙ্গে শ্লোগানে, মিছিলে, সমাবেশে আয়ুবশাহীর অপশাসনের প্রতি ধিক্কারধ্বনিত প্রতিবাদ। চূড়ান্ত পর্যায়ে পল্টন ময়দানের মহতী জনসভায় গণতন্ত্রের অধিকার অর্জনে সর্বত্যাগস্বীকারের অঙ্গীকারের প্রস্তাব গৃহীত হ’ল মৌলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে। ঢাকার চেয়ে তীব্রতর আক্রমণ নেমে এসেছিল সেদিন চট্টগ্রামের ছাত্রদের উপর। সন্ত্রস্ত আয়ুব সরকার পূর্বাহ্নেই করাচিতে মিছিল নিষিদ্ধ করেছিল। (৫৫)
আগামী নির্বাচনে সর্বাধিক দুর্নীতির ব্যাপক আয়ােজনের ব্যবস্থা হ’ল খিদমতগারিতে অভ্যস্ত সার্কেল অফিসারদের সাহায্যে। নির্বাচনী এলাকার অযৌক্তিক পুনর্বিন্যাস বা জেরিমেন্ডার করা হ’ল যত্র তত্র। বিরােধী ভােটারদের নাম কেটে দেওয়া হল। এক নম্বর সিদ্দিকবাজার ইউনিয়ন কমিটির পঞ্চাশ শতাংশ ভােটারের নাম খারিজ করা হয়েছিল। নারায়ণগঞ্জে ২৬, সনাতন পাল লেনের ১৯৪ জন বাসিন্দার নাম কাটা হ’ল ভােটার তালিকা থেকে এবং এমন ৮ জনের নাম স্থান পেল যারা আদৌ ঐ ঠিকানায় বাস করেননা। (৫৬)
‘কপ’ বা সম্মিলিত বিরােধী দলের পক্ষ থেকে প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী ছিলেন একজন মহিলা ফতেমা জিন্না। ২৬শে সেপ্টেম্বর আয়ুবের নির্দেশে ২৩ জন ধর্মীয় নেতা করাচিতে এক বিবৃতি দিয়ে জানান, ইসলামের বিধিমতাে কোনাে মহিলা রাষ্ট্রনেত্রীপদে বৃতা হতে পারেন না। (লক্ষণীয় ইসলামের তত্ত্ব যখন রচিত হয়, গণতান্ত্রিক ভােটাভুটি তখন দুনিয়াতে ছিল প্রায় অজ্ঞাত। সুতরাং মূল ইসলামি ধর্মগ্রন্থে এমন ফতােয়া জারি না হয়ে থাকারই কথা।) যাই হোক প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকা। ব্যয় করেও পূর্ব পাকিস্তানের জনসভায় কলার খােসা, পাদুকা নিক্ষেপ—ইত্যাদির বেশি সমাদর আয়ুবের কখনােই জোটে নি। অন্যদিকে ফতেমা সম্বর্ধিত হয়েছেন প্রতি সমাবেশে। (৫৭) অফিস এবং কারখানায় কপ-সমর্থক ভােটার সমধিক। এঁদের ভােট দেওয়া অসম্ভব করতে ভােটগ্রহণের সময় করা হয়েছিল ৯ টা থেকে দুটো। দিনগুলােও ছিল কাজের দিন। অফিস বা কারখানায় কামাই করে ভােট দিতে গেলে একদিনের বেতন শুধু নয়, চাকুরীটাই বিপন্ন হতে পারে—আয়ুবসরকারকে এতদিনে এটুকু ঐ কর্মচারী বা শ্রমিক জনসাধারণ ভালােই চিনেছিলেন। (৫৮)
পরাজয়ের সম্ভাবনাও আছে এই ভয়ে দিশেহারা আয়ুব ৮ই নভেম্বর, ১৯৬৪ ঢাকায় সাংবাদিক সম্মেলনে ঘােষণা করলেন, প্রেসিডিন্ট নির্বাচনে ভােটাররা নির্বােধের মতাে ভােট দিলে এবারে যে নূতন বিপ্লব করা হবে তা হবে আরাে কঠোর। অথাৎ আয়ুবকে ভােটাররা ভােট না দিলে উনি রাজনীতিকদের দেখে নেবেন এবং এই দেখে নেওয়া বা প্রাণ কেড়ে নেওয়াকে উনি বিপ্লব বলবেন। এক প্রশ্নের উত্তরে ঐ কথাগুলাে বলে উনি বােঝালেন, ভােটে হেরে গেলেও ওঁর ক্ষমতা এবং অত্যাচার বাড়বে বই কমবে না। (৫৯)
সর্ববিধ দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে ১০ই নভেম্বর থেকে যে বি, ডি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হ’ল তার ফলাফল আয়ুব তথা সরকারী মুসলিম লীগ সমর্থিত প্রার্থীদের বিরুদ্ধেই গেল। আয়ুব এই নির্বাচনে সন্ত্রাস, প্ররােচনা, পক্ষপাতিত্বের চূড়ান্ত করেও যখন সামাল দিতে পারলেন না তখন ব্যক্তিগত পত্রযােগে নবনির্বাচিত বি, ডি-দের সমর্থন চাইলেন এই অজুহাতে যে মৌল গণতন্ত্রের স্রষ্টা তিনিই! নজিরবিহীন এই পত্রের ঘটনা থেকে ‘কপ’ আশঙ্কা করলাে, তার নেতাদের জন্য আরাে বড় দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছে। অথাৎ আরাে জঘন্য সব আয়ুবীয় কারসাজি। (৬০)
নিপীড়ন এবং কারচুপির মাত্রা না বাড়ালে আশা নেই আয়ুবচক্ৰ এটা বেশ বুঝে গেল। প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনের তারিখ ২রা জানুয়ারী, ১৯৬৫ যতােই এগিয়ে এল, আয়ুবের সমর্থক যেন সাধারণের মধ্যে ততােই দুর্লভ হয়ে পড়লাে। এর ফল সীমিত নিবাচকমন্ডলীতেই পড়তে পারে এই আশঙ্কায় সন্ত্রাসের আয়ােজন অনেক আগে থেকেই করা হ’ল। ফতেমা ফাস করে দিয়েছিলেন, জিন্নার অনুকম্পা প্রদর্শনে আয়ুব সেই ১৯৪৭-এই প্রাণদন্ড থেকে অব্যাহতি পান। গুরুতর অপরাধে তার সামরিক বিচার হয়েছিল সে সময়। বিরােধী নেতারা ‘কপে’র পক্ষে প্রচার করেন, আয়ুব এই সামরিক শাসনের চার বছরের একাধিপত্যের সুযােগে তার সম্পত্তির পরিমাণ করেছেন ৫০ কোটি টাকা। গান্ধার শিল্পসংস্থার অধিকারী হয়ে রয়েছেন তারই পুত্র গাওহর আয়ুব। তিনি অবসরপ্রাপ্ত কাপ্তেন মাত্র। জবাব মুখে দিতে না পেরে, পুলিশের লাঠির মাধ্যমে দিতে হয়। আর তাই হ’ল সাবুরের বিরুদ্ধে ছাত্রবিক্ষোভের ক্ষেত্রে। ফতেমাকে অভ্যর্থনা জানাতে এসে রাজশাহী রেলস্টেশনে পুলিশ এবং গুণ্ডাদের সমবেত আক্রমণে দুই শতাধিক ব্যক্তি আহত হন। ১৪ই ডিসেম্বর ‘জনতা’ ছেপেছিল আয়ুবের হয়ে নির্বাচনী প্রচার চালাবার সেই নির্দেশ যা জেলা প্রশাসক পাঠিয়েছিলেন তার অধস্তনদের কাছে। অথাৎ নির্বাচন প্রহসনে পরিণত হয়েছিল পুরােপুরি। (৬১) তিন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী-ভুট্টো সােইব এবং সাবুর—প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী হলে ফতেমাকে প্রার্থী হিসাবে খারিজ করা হবে এ আশঙ্কা ‘কপ’ করেছিল। কিন্তু অমনটি করা হলে প্রতিবাদের ঝড়ে আইন-শৃঙ্খলা ভেঙে পড়বে। সারা দেশে প্রচন্ড অশান্তি দেখা দেবে—এই ভয়ে ফতেমার প্রার্থীপদ নাকোচ করতে সাহস করে নি সরকার পক্ষ। কাজেই ঐ সব মন্ত্রী-প্রার্থীরা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালেন। এমনিতেই হাওয়ায় ছিল বারুদের গন্ধ। ডিসেম্বরের দশ তারিখ থেকে সমস্ত পাকিস্তান জুড়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি একটানা ২৫ দিন বন্ধ ছিল। পাকিস্তানের উভয়খন্ডের ছাত্রদের উপর গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে ছাত্র আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে সেই সময়। এমনি আশঙ্কাবশতঃই কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা তাদের প্রেসিডেন্ট পদের জন্য ‘প্রতিদ্বন্দ্বিতার সঙ্কল্প ত্যাগ করেন—এমনটি মনে করা চলে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি ৫ই জানুয়ারী, ১৯৬৫ খােলার কথা হ’ল। প্রেসিডেন্ট নির্বাচন তার আগেই হয়ে যাবে। অবশ্য এসবের পরেও ‘কপ’-এর শক্তির প্রধান উৎস যে সেই ছাত্রসমাজ সে কারণে ছাত্রনির্যাতনে কোন ছেদ পড়ে নি। (৬২)
মােনম খান ডিসেম্বরের শেষ দিনগুলাে সন্ত্রাসের দিনে পরিণত করলাে। সামরিক বাহিনী,ই, পি, আর, পুলিশ—স্পর্শকাতর এলাকা এবং অঞ্চল জুড়ে এদের তৎপরতা বৃদ্ধি পেল। ক্ষমতার উচ্চাকাশচারীর-ও পাখির মতাে দুটো ডানায় ভর দিয়ে ভাসতে হয়। ক্ষমতার আর লােভের ডানা দুটোর ঝাপটানি এ সময় আরাে তীব্র হ’ল। খিদমতগারকে পুরস্কারের লােভ আর দুষমনকে শাস্তির ভয়-আয়ুবতন্ত্র এই দ্বিবিধ ভ্রষ্টাচার দোষে দুষ্ট ছিল। সৈন্য মােতায়েন করে বিরােধী জনসাধারণকে হত্যার ভয় দেখানাের সঙ্গে বি, ডিদের লটারি ভিত্তিক শত টাকার পুরস্কারের লােভ-ও দেখানাে হ’ল প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রাক্কালে। বি, ডি-রা কোন রাজনীতির সমর্থক তা দ্রুত জানালে লটারির মাধ্যমে পুরস্কার পেলেও পেতে পারবেন—এই বিজ্ঞপ্তি জারীহ’ল প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের অব্যবহিত পূর্বে। টীকা নিষ্প্রয়ােজন। (৬৩)
আয়ুব, পরােক্ষ নির্বাচনে টাকার জোরে, পুলিশ-প্রশাসন-গুন্ডাবাহিনীর জোরে, ফতেমাকে পরাজিত করবেন এ তাে জানা কথা। কিন্তু এই জয়ের পিছনে বি, ডি-পিছু ভােট কেনার খরচ দু’হাজার থেকে সাত হাজার টাকার জোগান দিল কারা ? মূলতঃ সেই পুঁজিপতিরা যাদের স্বার্থে আয়ুবতন্ত্র এসেছে এবং যাদের সর্মথনে টিকে আছে। বি, ডি-রা শুধু নগদ-বিদায়টুকুই চিন্তা করেন নি। আয়ুব হেরে গেলে পরােক্ষ ভােটের মস্করা চালাবার এই বি, ডি প্রথাটাই থাকবে না—এ আতঙ্কও তাদের ছিল। বছর জুড়ে দুর্নীতির মাধ্যমে নানা প্রাপ্তিযােগ বন্ধ হয়ে গেলে তাদের কী হবে? তাই তারা উৎকোচ না পেলেও আয়ুবকেই সমর্থন করতেন। উৎকোচটা ছিল বকশিস! ফতেমার ভােটারদের পুলিশ বহুক্ষেত্রে আটক করে ভােটদানের সুযােগই কেড়ে নিয়েছে তাদের। নির্বাচন কক্ষের অভ্যন্তরে আমলা, অফিসার, আয়ুবপন্থী গুণ্ডাবাহিনী নির্লজ্জের মতাে কারচুপি, বলপ্রয়ােগ ইত্যাদি সবই করেছে। অথাৎ স্বৈরাচারের দেশে ভােট-ও একটা স্বৈরাচার—এটাই আয়ুবশাহী প্রমাণ করে দিয়েছে। আয়ুবের হয়ে বেআইনী কাজ কারবার চলাকালে নির্বাচন কক্ষের কপ’ পক্ষীয় পােলিং এজেন্ট প্রতিবাদ করামাত্র বহিষ্কৃত হয়েছেন। পুলিশ সর্বত্র এইরূপ বহিষ্কারের কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফল কী হ’ল? আয়ুব নির্বাচন জিতলেন। একটু ছােট্ট পুনশ্চ যােগ না করলে সত্যটা বােঝা যাবে না। সেই ছােট্ট কথাটুকু জুড়ে পুরাে বাক্যটা দাঁড়ায় এই প্রকার। নির্বাচনে আয়ুবের জয় হ’ল কিন্তু নির্বাচনটা হয় নি। (৬৪)
References:
1. The Times, 3 May 1962. The Guardian, 8 June 1962. The Statesman, 14 June 1962. Dawn, 18 July 1962. Speech by MASHIUR RAHMAN, NAP Debates, 18 June 1962, Vol. I, No. 4, p. 117.
2. The Times, 3 May 1962. The Pakistan Times, 11 June 1962. G. S. BHARGAVA, “Pakistan Politics—I”, The Hindustan Times, 6 July 1962.
3. Dawn, 14 June 1962. The Pakistan Times, 15 June 1962. G. S. BHARGAVA, n. 2.
4. The Pakistan Times, 15 June 1962.
5. G. S. BHARGAVA, “Pakistan Politics-II”, The Hindustan Times, 7 July 1962. The Pakistan Times, 15, 16 June 1962.
6. Speech by MASHIUR RAHMAN, NAP Debates, 18 June 1962, Vol. I, No. 4, pp. 117-18. Speech by QAMARUL AHSAN, Ibid., p. 119. The Pakistan Times, 17 July 1962.
7. Speech by QAMARUL AHSAN, NAP Debates, 18 June 1962, Vol. I, No. 4, p. 95. Speech by MAJOR MOHD. AFSARUDDIN, NAP Debates, 27 June 1962. Vol. I, No. 12, pp. 643-44. Speech by FARID AHMAD, Ibid., p. 633. The Pakistan fimes, 30 June 1962. G. S. BHARGAVA, n. 5.
8. G. S. BHARGAVA, n. 2. The Pakistan Times, 17 July 1962. 9. Dawn, 18 July 1962. The Pakistan Times, 12, 19 July 1962. 10. Ibid., 7, 10, 19 July 1962. Speech by MAHBUBUL HAQ, NAP Debates, 10 July 1962, Vol. I, No. 23, p. 1248.
11. The Times of India, 3 July 1962. Speech by MASHIUR RAHMAN, NAP Debates, 14 July 1962, Vol. I, No. 27, p. 1563.
12. Speech by FARID AHMAD, NAP Debates, 9 July 1962, Vol. I, No. 22, pp. 1212-15. Speech by NASRULLAH KHAN, Ibid., pp. 122223. Speech by MAHBUBUL HAQ, NAP Debates, 10 July 1962, Vol. I, No. 23, pp. 1248-49. Pakistan Observer, 9 July 1962.
13. The Pakistan Times, 17 July 1962. Dawn, 18 July 1962. The Statesman, 13 July 1962.
14. The Statesman, Ibid. Despatch from SITANSHU DAS stationed in Karachi, The Times of India, 6 September 1962. The Hindustan Times, 7 September 1962. Pakistan Observer, 5, 6 September 1962.
15. Despatch from the Correspondent in Rawalpindi, The Statesman, 25 September 1962.
16. Pakistan Observer, 18 March 1963. Despatch from P. DASGUPTA stationed in Dacca, The Hindustan Times, 18 March 1963. Despatch from the Correspondent in Dacca, The Statesman, 19 March 1963.
17. NAP Debates, 4, 10, 11, 12, 16 April 1963, Vol. I, pp. 1296-1301, 1559-60, 1574-77, 1757-60, 1882-83. Ittefaq, 12 April 1963.
18. Speech by MAHBUBUL HAQ, NAP Debates, 16 December 1963, Vol. III, No. 6, pp. 1073-75.
19. Speech by FARID AHMAD, NAP Debates, 19 March 1963, Vol. I, No. 9, p. 538. Despatch from P. DASGUPTA stationed in Dacca, The Hindustan Times, 29 March 1963.
20. Speeches by ABUL QUASEM ABDUR RASHID and BEGUM ROQUYYA ANWAR, NAP Debates, 19 March 1963, Vol. I, No. 9, pp. 522-23, 550, 597. Speeches by QAMARUL AHSAN and MAHBUBUL HAQ, NAP Debates, 20 March 1963, Vol. I, No. 10, pp. 604, 609.
21. Speeches by DR. GOLAM MAWLA, MAHBUBUL HAQ and MASHIUR RAHMAN, NAP Debates, 16 April 1963, Vol. I, pp. 188081, 1889, 1901. Speeches by SYED ABDUS SULTAN and SYED HUSAIN MANSUR, NAP Debates, 17 April 1963, pp. 1911, 1923.
22. Speeches by FARID AHMAD and QAMARUL AHSAN, NAP Debates, 16 April 1963, Vol I, pp. 1865-70, 1881-82. NAP Debates, 17 April 1963, Vol. I, p. 1958.
23. Despatch from the Rawalpindi Correspondent, The Statesman, 4 September 1963. NAP Debates, 28 March 1963, Vol. I, No. 4, p. 894.
24. The Hindustan Times, 3 September 1963. Despatch from SITANSHU DAS stationed in Karachi, The Times of India, 26 September 1963.
25. Speech by MAHBUBUL HAQ, NAP Debates, 14 June 1963, Vol. II, No. 9, p. 484. Speech by A. K. MD. YUSUF, NAP Debates, 17 June 1963, Vol. II, No. 11, p. 604. Speech by CHAUDHRI MUHAMAD HUSAIN CHATTHA, NAP Debates, 18 June 1963, Vol. II, No. 12, p. 631.
26. Speech by SYED HUSAIN MANSUR, NAP Debates, 19 June 1963, Vol. II, No. 13, pp. 730-31. Spech by MUHAMMAD ABDUL HAQUE, NAP Debates, 16 December 1963, pp. 1093-95.
27. Speech by BEGUM SHAMSOON NAHAR MAHMOOD, NAP Debates, 13 June 1963, Vol. II, No. 8, p. 422.
28. Speech by QAMARUL AHSAN, NAP Debates, 18 June 1962, Vol. I, No. 4, p. 96. Speech by AZIZUR RAHMAN, NAP Debates, 19 June 1963, Vol. II, No. 13, p. 783.
29. Dawn, 29, 30 December 1963 ; 1, 6, 7, 8, 13 January 1964. Morning News (Dacca), 31 December 1963 ; 2, 4, 9, 11, January 1964. The Pakistan Times, 3, 4, 5, 6, 9, 10, 11, 12, 13 January 1964. Pakistan Observer, 4, 5, 14 January 1964. Ittefaq, 5, 14, 17 January, 23, 24 February 1964. Sangbad, 6, 14 January 1964.
30. Committee of Enquiry, The Indian Commission of Jurists, Recurent Exodus of Minorities from East Pakistan and disturbances in
India, pp. 21-40, 58-59. SAMAR GUHA, Whither Minorities of Eastern Pakistan (Calcutta, 1964, Published by the author), pp. 2-4. SAKUNTAL SEN, Inside Pakistan (Calcutta, Compass Publications, 1964), pp. 15-16. MR. SEN presents in this booklet an account of his adventurous trip to East Pakistan undertaken, in the disguise of a Muslim, shortly after the 1964 massacre. 31. GUHA, n. 30, pp. 5-16. SEN, n. 30, pp. 16-17. 32. GUHA, n. 30, p. 12. SEN, n. 30, pp. 18-19.
33. Janata (Weekly, Dacca), 23 October 1963. Committee of Enquiry, Indian Commission of Jurists, n. 30, pp. 19-20, 311. Ittefaq, 24 February, 8 March 1964. AJIT KUMAR DATTA, Interview, 6 January 1967. HAMIDUL met some prominent citizens of Calcutta, including MR. DATTA, who, at the time of writing (i.e., May 1967), is the AdvocateGeneral of the Government of West Bengal.
34. Ittefaq, 17 January, 24 February, 29 March 1964. GUHA, n. 30, pp. 17, 19-21.
35. Ittefaq, 14, 17, 18, 23, 24 February 1964.
36. Despatch from T. V. PARASURAM in Washington, The Indian Express (New Delhi), 21 January 1964. PARASURAM gave excerpts from the Washington Sunday Star and the New York Times. The Hindustan Times, 23, 28 February 1964. The Indian Express, 26 February 1964. 37. Ittefaq, 17, 18, 21, 22 February 1964.
38. Ibid., 14, 17, 18, 19, 20 February 1964. The Staff Reporter of the Ittefaq wrote detailed surveys of the working of the provincial legislature of East Pakistan on, among others, the aforesaid dates.
39. Ibid., 17, 21, 22 February 1964. The Patriot (New Delhi), 3 March 1964.
40. Ittefaq, 1, 6, 9, 12, 13, 14, 16 March 1964. The Statesman, 17 March 1964.
41. Ittefaq, 17, 18, 19, 20, 21 March 1964. 42. Ibid., 27 February, 17, 21 March 1964. 43. Ibid., 18, 19 March 1964. 44. Ibid., 22 March 1964. 45. Ibid., 23 March 1964.
46. Ibid., 25 March 1964. 47. Speech by AKHTARUDDIN AHMAD (of East Pakistan), NAP Debates, 16 March 1964, Vol. I, No. 2, pp. 90-95. NAP Debates, 15 June 1964, Vol. II, No. 12, p. 725. Ittefaq, 22, 27, 29 March, 15 April 1964.
48. Compass (Bengali weekly, Calcutta), 18 April 1964, pp. 50-52. Ittefaq, 29, 30, 31 March, 3 April 1964. Sangbad, 29 March, 3 April 1964.
49. Speech by GHULAM MUHAMMAD WASSAN, NAP Debates, 13 June 1963, Vol. II, No. 8, p. 425 ; Speech by MUFTI MAHMOOD, Ibid., 14 June 1963, Vol. II, No. 9, pp. 465, 467 ; Speech by AMIR HYDER SHAH, Ibid., 17 June 1963, Vol. II, No. 11, pp. 602-3. WASSAN, MAHMOOD and SHAH all belonged to West Pakistan. Ittefaq, 13 April, 1, 2, 8, 10 August 1964. 50. Ittefaq, 12, 31 March, 19, 21 August 1964. 51. NAP Debates, 8 August 1964, Vol. III, No. 8, pp. 519-22. 52. Ittefaq, 18, 30 August 1964. NAP Debates, 18 August 1964, Vol. III, No. 15, pp. 988-90, 992-93, 1006-7, 1014-15. Special Correspondent, Rawalpindi Commentary, The Patriot, 25 August 1964. 53. Ittefaq, 30 March, 19, 30 August 1964. 54. Ibid., 25 August 1964. 55. Janata, 30 September 1964. The Indian Express, 1 October 1964. 56. Ittefaq, 8, 19 August 1964. 57. Morning News (Dacca), 27 September 1964. Janata, 21 October, 4 November 1964. Special Correspondent, Dacca Commentary, The Patriot, 5 November 1964
58. The Hindustan Times, 15 October 1964. Janata, 14 October 1964. The Patriot, 5 November 1964.
59. Janata, 11 November 1964. 60. Ibid., 11, 18, 25 November 1964.
61. The Hindustan Times, 5 November 1964. Janata, 2, 9, 16, 23 December 1964.
62. The Statesman (New Delhi), 10, 11 December 1964. Janata, 2, 16 December 1964. The Nagpur Times, 26 December 1964.
63. Janata, 30 December 1964. The Hindustan Times, 31 December 1964-AP despatch from Karachi, dated 30 December 1964.
১৭৫
64. Pakistan Observer, 4 January 1965. Anandabazar Patrika (Bengali daily, Calcutta), 6 January 1965. Janata, 25 November 1964. Compass, 9 January, 1965. pp. 17-18-a commentary by its own correspondent who visited East Pakistan for making a study of the Presidential elections.
65. গনতন্ত্র এবং জাতীয়তার অগ্নিপরীক্ষা – জয়ন্তকুমার রায়, pp 79-100
স্বশাসন সংগ্রামে পূর্ববঙ্গ
প্রেসিডেন্ট পদ আঁকড়ে থেকেও ফিল্ড মার্শাল মুহম্মদ আয়ুব খান কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের গণতন্ত্র এবং স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন স্তব্ধ করে দিতে পারেন নি। তবে এর ফলে ঐ আন্দোলন যে বাধাপ্রাপ্ত হয় সে কথা সত্য। অসন্তোষের যে-কারণগুলাে এই আন্দোলনে ইন্ধন জুগিয়েছে তাদের অপনােদন দূরের কথা প্রশমনের চেষ্টাও হয় নি। কেন্দ্রীয় সরকার বরং কিছু প্রতীকী শব্দগুচ্ছ উপহার দিয়ে উত্তেজনা সামাল দিতে চেয়েছে। তার প্রকৃত সমাধানের চিন্তাও করে নি কখনও। ১৯৬২-র সংবিধানের উদ্বোধন লগ্ন থেকে এই কৌশলই অবলম্বন করা হয়েছে। গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবির সামাল দিতে মৌল গণতন্ত্রের প্রতীক এবং অর্থবৈষম্য বিলােপ দাবির মুখােমুখি জাতীয় আর্থিক পরিষদ নামের প্রতীকী সমাধান বাতলানাে হয়। এই পরিষদ গঠিত হয় ১৯৬২-র সংবিধানের ১৪৫ ধারা অনুসারে। অর্থসারূপ্য, অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় পূর্বপাকিস্তানের পিছিয়ে-পড়া অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে অতি দ্রুত দেশের দুই অঙ্গের মধ্যে সমতা ফিরিয়ে আনতে নানা পরিকল্পনার খসড়া করার দায়িত্বও ঐ আর্থিক পরিষদের উপর ন্যস্ত ছিল। বৈষম্য দূরীকরণের কাজে ফী বছর সংসদে অগ্রগতি-সংবাদ পেশও করতে বাধ্য ছিল পরিষদ। শুধু কি তাই ? প্রতি প্রাদেশিক আইনসভা ঐ অগ্রগতি-সংবাদের কপি বা অনুকৃতিও পাবে—এমন কথা ছিল। দেশের দুই অঙ্গের মধ্যে সমতা প্রতিষ্ঠায় এভাবে আদানুন খেয়ে লেগে পড়ায় কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ সাধারণ পূর্বপাকিস্তানীর মনে ইতিবাচক সাড়াও নিশ্চয়ই জাগিয়ে থাকবেন সে সময়। অবশ্য ১৯৬৪-র ১৩ই আগস্ট জাতীয় ব্যবস্থাপক সভাকক্ষে অর্থাৎ সংসদে মাহাবুবউল হক যে ভাষণ দিলেন তা ছিল প্রচারে বিভ্রান্ত পূর্ববঙ্গের অতি-সরল অংশের কাছে নিতান্তই মােহমুগর। মাহাবুবউল বলেন, ‘মহাশয়, ১৯৬২-র মতাে ১৯৬৩-র বছরটা অতিক্রান্ত হয়েছে। ১৯৬৪-ও অতিক্রান্ত হতে চলেছে। জাতীয় আর্থিক পরিষদ আজ অবধি কোনাে রিপাের্ট পেশ করে নি। যদিও তা ছিল সাংবিধানিক কর্তব্য। অর্থাৎ, সংবিধান প্রয়ােগ আমরা কতােটুকু করছি। তারই একটি নমুনা এই পরিষদের কার্যধারা।’ (১)
একই সমতার লক্ষ্যে জাতীয় অর্থ কমিশনও প্রতীকী অর্থে উৎসর্গীকৃত ছিল। কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল, তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় উন্নয়নখাতে পূর্বখণ্ডের জন্য বরাদ্দ হয়েছে পশ্চিম খণ্ডের চেয়ে ঢের কম। মাথা পিছু আয়ের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক বৈষম্য। কতােদূর তা না জেনে বৈষম্য দূর কোনাে ক্ষেত্রেই সম্ভব নয়। তথাপি ১৯৬৩ তে গঠিত জাতীয় আয় কমিশনের রিপোের্ট প্রকাশিত হবার পূর্বেই এই পরিকল্পনায় স্থির করা হয়ে যায় যে এই পাঁচবছরে পরিকল্পনা মারফৎ পূর্বপাকিস্তানে মাথা পিছু ৪৯২ টাকা এবং পশ্চিম পাকিস্তানে মাথা পিছু ৭৬৬ টাকা ব্যয় করা হবে। গৃহীত নীতি যে পূর্ব-পশ্চিম অঙ্গ দুটোর মধ্যে বৈষম্য আরাে বাড়িয়ে তুলবে এই সহজ সত্য চাপা দিতে সমতা এল ঐ’এমনি জোর প্রচার চালানাে হ’ল সরকারী তরফ থেকে। তৃতীয় পরিকল্পনা সমাপ্ত হলে ঐ বৈষম্য এক পঞ্চমাংশ হ্রাস পাবে, এমন গাণিতিক সংকেতও ছিল ঐ প্রচারে। এই সব বেহিসাবী আশ্বাস দেওয়ার অভ্যাস গণতন্ত্রে অবিশ্বাসী সরকারের তাে থাকবেই। (২)
পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সৌষম্য চাইলে অনেক পিছিয়ে পড়া পূর্বপাকিস্তানের জন্য অর্থবরাদ্দ সাময়িক ভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে ঢের, ঢের বেশি ধরতে হত। ১৯৬৪-৬৫তে পশ্চিমের বরাদ্দ ১৯৫ কোটির চেয়ে মাত্র ১০ কোটি টাকা বেশি পূর্ববঙ্গের জন্য বাজেটে বরাদ্দ করা হয়। বি, ডি-দের ভােটর বছর খুসি রাখতে কর্মপ্রকল্পেও পূর্বপাকিস্তানীদের বরাদ্দ ২৫ কোটি টাকা অন্ততঃ পশ্চিমপাকিস্তানের বরাদ্দ ১৫ কোটি টাকার চেয়ে বেশি ছিল। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের এলাকার জন্য ধরা ৭৩ কোটি টাকার উপকারটুকু-ও তাে পশ্চিম পাকিস্তানীরা পাবেন। বৃহৎ সিন্ধু উপত্যকা পরিকল্পনায় ৮৫০০ কোটি টাকা ব্যয় হলে, তার উপকারও পশ্চিম পাকিস্তানীরাই পাবেন। প্রতিরক্ষাই তাে মােট বাজেটের অর্ধেক টেনে নেয়। এ-ও তাে পূর্বপাকিস্তানীর উপকারে তেমন আসে না। অতএব বাজেট বহির্ভূত নানা খাতে এখনও পশ্চিম পাকিস্তানীদের স্বার্থই পূর্ব পাকিস্তানীর চেয়ে সমধিক রক্ষা পাচ্ছে – এই সত্য চাপা দিতে প্রচারের মাত্রা আরাে বাড়ানাে হ’ল। (৩)
সামুদ্রিক জলকে লবণমুক্ত করার প্রকল্পে ৮০০ কোটি টাকা খরচ করে শুধু পশ্চিম পাকিস্তানীদের স্বার্থ ভাবছে যখন কেন্দ্রীয় সরকার, পূর্বপাকিস্তানের ১৯৬৫ র ১১ই মের প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে বিপন্ন এক কোটি মানুষের কথা তখন তাদের কাছে কোনাে ব্যাপার-ই মনে হয় নি। খয়রাতির বহর থেকেই তা বােঝা যাবে। অন্ততঃ ২০০ কোটি টাকার ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে সম্পত্তির ক্ষতির সঙ্গে সরকারী অট্টালিকা প্রভৃতির মেরামতি এবং পুনর্নির্মাণ ব্যয়ে ৩০০ কোটি টাকা প্রয়ােজন – এই সব ভীষণ সংবাদের মুখে কেন্দ্র ত্ৰাণকার্যে দান করলাে ১ কোটি ৭৫ লক্ষ টাকা। এই প্রকার প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়ও কেন্দ্রীয় সরকার তার বাঙালী-বিদ্বেষ ভােলে না। ১৯৬২-র চার চার বার বন্যার তাণ্ডবেও এটা তারা মনে রেখেছিল। ১৯৬৫-র ঘূর্ণিঝড়ের সাত দিনের মধ্যে প্রাদেশিক গভর্নরকে দেখাও যায় নি দুর্গত মানুষদের এলাকায়। উপকূল অঞ্চলে যে বাঁধ এবং প্রাচীর নির্মাণ এ সবের প্রতিরােধে অবশ্য করণীয় তার প্রতি চরম অবহেলা দেখাতাে কেন্দ্রীয় সরকার। তাই ১৯৬৩ র ১৭ই জুন পূর্ব পাকিস্তানী সাংসদ সৈয়দ মুহম্মদ হাবিবুল হক বলেন, ‘লবণমুক্ত জলের কারণে কেন্দ্রীয় সরকার যে ৮০০ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নিয়েছে তার এক চতুর্থাংশ ব্যয়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে মুক্ত করা যেত পূর্ব পাকিস্তানের বহু মানুষকে চির অবহেলিত বাঁধ এবং প্রাচীর নির্মাণের মাধ্যমে। নিষ্ঠুরতার চেয়েও অসহ্য ঠেকে মেকী সহানুভূতি। ৩০০০ মাইল কর্দম-প্রাচীর গাঁথার সরকারী পরিকল্পনা পূর্বপাকিস্তানীদের সেই কারণে আরাে ক্ষুব্ধ করলাে। ঐ প্রাচীর তাে সামান্য ঝড়েই ধ্বসে যাবে – এ তাঁরা অভিজ্ঞতায় দেখেছেন। সরকারী খয়রাতির হাস্যকর অপ্রতুলতা প্রসঙ্গে সংসদে আজিজুর রহমান বলেন, ‘ছুটি ছাঁটায় শৈলশহর মুরীতে প্রমােদ ভ্রমণ করতে পেলে প্রাকৃতিক দুর্যোগে আক্রান্ত পূর্বপাকিস্তানীদের কথা মনে আসবে কী করে?’ (৪)
ঢাকা শহরে কিছু অট্টালিকা বা রাস্তা নির্মাণ করলেও গ্রামীণ অর্থনীতি ছিল দুর্দশাগ্রস্ত। আয়ুবের রক্ষাকবচ তার আশ্রিতদের সকল দুর্নীতির পরেও অভয় দিত। গঙ্গা কপােতাক্ষ পরিকল্পনায় কাজের নামে বর্ষার মুখে কিছু খাল খনন করা হত। বর্ষা নামলে সে কাজ ধুয়ে মুছে যেত। কাঁচা গাঁথুনিরও হত একই দশা। অথচ ঠিকাদাররা পুরাে কাজের দাম আদায় করে নিত। সে-কাজের পরিমাণ যাতে না করা যায় তার জন্যই তাে বর্ষার মুখে কাজের ধুম পড়ে যায়। যে কাঁচা গাঁথুনির কথা বলা হ’ল তা ঐ কর্মপ্রকল্পের অন্তর্গত। মার্কিনী খয়রাতি খাদ্য বেচে পাওয়া টাকায় ঐ প্রকল্প শুরু হয় হাভার্ড-এর পরামর্শ দাতাদের অন্যতম রিচার্ড গিলবার্টের অনুরােধ-উপরােধ ইত্যাদির চাপে। আয়ুব শেষ পর্যন্ত গিলবার্টের পরামর্শ গ্রহণে বাধ্য হন। কর্মপ্রকল্পের কোন স্তরে আয়ুবচক্রের কৃতিত্বসূচক কোনাে কথা বলার নেই। (৫)
১৯৬৪-র আমলে পূর্বপাকিস্তানের অর্থনীতি নিয়ে মাথাব্যথা প্রকাশ করাটা আয়ুবগােষ্ঠীর অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যায়। ঐ বছরও যে ৯ টি শিল্প নূতন করে স্থাপিত তার সব কটি হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। পূর্ব পাকিস্তানে একটিমাত্র শিল্পের কিছু সম্প্রসার ঘটে। আমদানি বাণিজ্যে ১৯৬০ সালে মধ্যবিত্ত পূর্বপাকিস্তানী যে-সুযােগ প্রথম পান, অচিরাৎ পশ্চিম পাকিস্তানী ধনী বণিকদের স্বার্থে তা থেকে তাঁদের বঞ্চিত করা হয়। এই উদ্দেশ্যে আমদানি সংক্রান্ত বিধি-নিষেধ সরকারপক্ষ পাল্টে ফেলে ১৯৬৬ সালে। (৬)
ন্যূনতম যে-বরাদ্দ পূর্ববঙ্গের প্রকল্পাদির জন্য কেন্দ্র বরাদ্দ করে থাকে, তাও অব্যবহৃত হয়ে কেন্দ্রের অর্থ কেন্দ্রের-ই হাতে থেকে যেন যায়, সেই উদ্দেশ্যে নিমণি প্রকল্পের জন্য অবশ্য প্রয়ােজনীয় সিমেন্ট, লােহার রড, এ সবের অনুমতি আটক রাখা হয়। নির্দিষ্ট সময়সীমা এই ভাবে পার করে দেবার চক্রান্ত সফল হলে পর ঐ কেন্দ্রের কর্তারাই বলে বেড়ান, পূর্ব পাকিস্তান সরকার, কেন্দ্র-প্রদত্ত অর্থের ব্যবহারের যােগ্যতাই রাখে না। ১৯৬৩-র ১৭ই জুন রামিজুদ্দিন, কেন্দ্রের ছড়ানাে কুৎসার যােগ্য উত্তর দিতে এই তথ্য পেশ করেছিলেন। (৭)।
পশ্চিম পাকিস্তানী ব্যবসায়ীদের স্বার্থে শিল্প-ঋণ প্রতিষ্ঠান ই, পি, আই, ডি, সি নিজস্ব উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত শিল্প এককগুলি ঐ ব্যবসায়ীদের খপ্পরে তুলে দিত। অন্যদিকে পি, আই, সি, আই, সি নামের অপর প্রতিষ্ঠান ২৫ লাখ টাকার কম মূল্যের ঋণ দেওয়া বন্ধ করে, পূর্ব পাকিস্তানীদের জন্য তার দরজা বন্ধ করে দিল। ২৫ লাখ টাকার চেয়ে বেশি মাপের শিল্প স্থাপনের সাধ্য তাঁদের ছিল না, ছিল পশ্চিম পাকিস্তানী ধনী ব্যবসায়ীদের। যে-একটি ব্যাঙ্ক ঋণ দিত, তার ঋণের মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রা না থাকায় শিল্প প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কাজের কাজ কিছু হত না। ২৫ লাখ টাকার কম ঋণ এই ব্যাঙ্ক-ই দিত, যা ছিল অকেজো। ১৯৬৩-র মার্চ থেকে সরকারের নূতন ঋণদান নীতির সমালােচনা করে মাহাবুবউল হক এবং আবদুল মুস্তাকুইম চৌধুরী ভাষণ দিয়েছিলেন ঐ বছরের ১লা অগাস্ট সংসদ সমক্ষে।(৮)
১৯৬৬-র মার্চে উৎপন্ন পণ্যের উপরে শুল্ক বা একসাইজ ডিউটির পরিবর্তে শিল্প এককের উৎপাদন ক্ষমতার উপরে আয়কর এবং বিক্রয়কর বসানাে হ’ল। এই মর্মে সংবিধানের যষ্ঠসংশােধনী বিল উপস্থাপিত হলে পূর্ব পাকিস্তানী সাংসদরা তীব্র প্রতিবাদ করেন। তাঁরা বলেন, নূতন শিল্পের পথে শ্রমিক, বাজার ইত্যাদির বহু সমস্যা। লিখিত উৎপাদন ক্ষমতার একটা অংশমাত্র কার্যক্ষেত্রে প্রযুক্ত হয়। করের এই অন্যায় বােঝা বয়ে পূর্বপাকিস্তানের শিল্পপতিরা – যাঁরা এই উদ্যোগ সবে মাত্র নিয়েছেন তাঁরা পশ্চিমী প্রতিষ্ঠিত শিল্পপতিদের ধাক্কায় উৎখাত হয়ে যাবেন। আয়ুবের মুসলিম লীগের সদস্য ফজলুল কাদের চৌধুরী পর্যন্ত বলেন, নিয়মানুবর্তিতায় আস্থাশীল সদস্য না হলে তিনি এই বিলের বিরুদ্ধে ভােট দিতেন। ১৯৬৫- ৬৬ র বাজেটে মূলধনী পুঁজির উপর সাড়ে বারাে শতাংশ কর ধার্য হওয়ার ফলে পূর্ব পাকিস্তানের শিল্পায়ন এমনিতেই ব্যাহত হচ্ছিল। তদুপরি নূতন এই বিল পশ্চিম পাকিস্তানী শিল্পপতিদের একচেটিয়া অধিকারের ক্ষেত্র প্রসারিত করা ভিন্ন অন্য কিছুই ছিল না। (৯)
১৯৬৫ র সেপ্টেম্বরে ভারত পাকিস্তান বিরােধের সময় ভারত থেকে কয়লা আমদানি বন্ধ থাকে। বস্ত্রশিল্প, আভ্যন্তরীণ জলযান, নির্মাণ প্রকল্প ইত্যাদি চরম সঙ্কটে পড়লাে এর ফলে। কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তানের কয়লা সঙ্কটে কোনাে সহায়ক ভূমিকা গ্রহণ করে নি। ইটের প্রস্তুতিতে নিযুক্ত অজস্র মানুষ এই সময় বেকার হয়ে যান। রঙ এবং রাসায়নিকের আমদানির জন্য আলপত্র বা লেটার অব ক্রেডিটের কার্যকারিতা থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত হ’ল পূর্ব পাকিস্তানের শিল্পমহল। পশ্চিম পাকিস্তানে কেন্দ্রীভূত ব্যাঙ্কগুলির হাতেই ছিল বৈদেশিক মুদ্রা বন্টনের সুযােগ। ‘প্রথমে আবেদন করেছে’ – এই অজুহাতে এই সম্পর্কিত সবটুকু বৈদেশিক মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানীদের ইতােমধ্যে প্রদত্ত হয়েছে – এই সংবাদটুকুই শুধু প্রাপ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানীদের। স্থানীয় ব্যাঙ্কে ঐ মর্মে সংবাদ এসেছিল। পূর্ব পাকিস্তান বিরােধী কেন্দ্রীয় ষড়যন্ত্রের অন্যতম দৃষ্টান্ত হয়ে রইল ঘটনাটি। (১০)
১৯৬২ র সংবিধানের ভণ্ডামির সূত্রে পাকিস্তানের দুই অঙ্গের মৈত্রী প্রসারে ৫০ লক্ষ টাকার বরাদ্দকে ব্যঙ্গ করে সিরাজুল ইসলাম মিঞা জানান, ১৯৬৩ র ৩১ শে জানুয়ারী পর্যন্ত গৃহনির্মাণে পূর্ব পাকিস্তান পেয়েছে ২ কোটি ৮০ লক্ষ টাকা এবং করাচি পশ্চিম পাকিস্তানে যাবার ফলে করাচি সহ পশ্চিম পাকিস্তান পেয়েছে প্রায় ১৪ কোটি টাকা। শুধু করাচির-ই ভাগে পড়েছে প্রায় দশ কোটি টাকা। সমরবিভাগের নিয়াৈগ পরিষদের ১৬ জন। সদস্যের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানী মাত্র এক জন। অথাৎ ১৯৬২-র সংবিধানের পরে বৈষম্য কমছে না, বাড়ছে। (১১)
১৯৬০-৬৫ র মধ্যে অর্থাৎ দ্বিতীয় পরিকল্পনাকালে করাচি এবং চট্টগ্রামে দু’টি তৈল শোধনাগার স্থাপিত হবে’- এমন প্রস্তাব থাকা সত্ত্বেও ১৯৬৪ র মার্চ নাগাদ করাচির শােধনাগার স্থাপনকর্ম বেশ এগিয়ে গেলেও, চট্টগ্রামেরটি থেকে গেল শুধু কথার কথা।(১২)
আখতার উদ্দিন আহমদ ১৯৬৪-র ২৭ শে জুন সংসদে বিবৃত করলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানীদের নূতন ব্যাঙ্ক খােলার দরখাস্ত সরকার বাক্সবন্দী অবস্থায় ফেলে রেখেছে। ১৮ টি বিধিবদ্ধ ব্যাঙ্কের ১৬ টি যেখানে পশ্চিম খণ্ডের, এবং ৩৩ টি বীমা কোম্পামির মধ্যে পূর্বখণ্ডে কেন্দ্রীয় কার্যালয় মাত্র ৩ টির এই যেখানে অবস্থা, তখন সরকারী বিজ্ঞাপন বন্টনের কেন্দ্রীভূত ব্যবস্থা করা হ’ল বীমা কোম্পানি গুলির জন্যে। এর কুফল পড়বে পূর্ব পাকিস্তানী বীমা কোম্পানিদের উপর। যে বীমা কোম্পানি গুলির কেন্দ্র পশ্চিম পাকিস্তান, তারা পশ্চিম পাকিস্তানে ২৮ কোটি টাকা বিনিয়ােগ করলেও পূর্ব পাকিস্তানে করেছিল মাত্র ২ কোটি টাকা বিনিয়ােগ। অথাৎ শিল্পপুঁজি সংগ্রহের উৎসও যেন পূর্ব পাকিস্তানীরা না পেতে পারেন, কেন্দ্রীয় শাসকচক্র সেই ব্যবস্থাই করে চলেছেন এ সময় (১৩)
পশ্চিম পাকিস্তানেই অবস্থিত ছিল পাকিস্তানের মােট ছ’টি বাস-ট্রাক নির্মাণের কারখানার প্রত্যেকটি। তথাপি আয়ুব পুত্রের গান্ধার শিল্প প্রতিষ্ঠানকে অনুরূপ বাস-ট্রাক নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হল। (১৪)
পশ্চিম পাকিস্তানী বয়নশিল্পের মালিকদের কলকাঠি নাড়ার ফলে পূর্ব পাকিস্তানী হস্তচালিত বয়নশিল্পের জন্য প্রয়ােজনীয় সূতাে দুষ্প্রাপ্য এবং দুর্মূল্য হয়ে পড়লাে। সরকার ঐ পশ্চিম পাকিস্তানী বৃহৎ শিল্পপতিদের ট্যাক্স-ছুটি দিয়ে পূর্বপাকিস্তানী কুটির শিল্পকে বিষম প্রতিযােগিতার মুখে ঠেলে দেয়। (১৫)
প্রায় ২৫ লক্ষ পূর্ব পাকিস্তানীর জীবিকা নির্ভর করতে ভারত থেকে আমদানি করা তেন্দু পত্রের ব্যবহারে প্রস্তুত বিড়ির শিল্পের উপর। ১৯৫৫ তে যে আমদানি শুল্ক ছিল ৩৫ শতাংশ, দফায় দফায় বাড়িয়ে তা ১৯৬৪ তে ১২৫ শতাংশ হলে বহু বিড়ি প্রস্তুত কারক উৎপাদন বন্ধ করতে বাধ্য হন। তবুও যেটুকু আমদানি করা তেন্দুপত্রের জোরে বিড়ি উৎপাদন চলছিল তাকে সরকারী আদেশনামা দিয়ে বন্ধ করা হল। তেন্দুপত্রের বিড়ি উৎপাদন বা বিক্রয় পূর্ব পাকিস্তানে নিষিদ্ধ হ’ল। এ কি ভারত বিদ্বেষ? মােটেও না। বিশুদ্ধ পূর্ববঙ্গ বিদ্বেষ। পশ্চিম পাকিস্তানে এই সুযােগে তেন্দুপাতার বিড়ির রমরমা ব্যবসা জাঁকিয়ে বসল পশ্চিম পাকিস্তানীরা। (১৬)
পশ্চিম পাকিস্তানী চক্র রটনা করতাে; উচ্চশিক্ষিত এবং মেধাবী লােকের সংখ্যাল্পতা হেতু পূর্ব পাকিস্তান শিল্পোন্নত হতে পারে নি। বাঙালীকে সেনাবাহিনীতে নিতে ব্রিটিশ সরকার ভয় পেত কারণ বাঙালীর রক্তে গােলামি নেই। কিন্তু মুখে বলতাে, বাঙালীর সমর প্রতিভা নেই। যে-পশ্চিম পাকিস্তানী কুচক্রীদের ষড়যন্ত্রে অর্থাভাবে পূর্ব পাকিস্তানে উচ্চশিক্ষা ব্যাহত হচ্ছে, যে সরকার একতরফা পশ্চিমখণ্ডেই শিক্ষাখাতের কর্মকাণ্ড কার্যতঃ সীমিত রেখেছে তারাই ব্যঙ্গ করছে ! বাঁচার মতাে বেতন না পেয়ে ১৯৫৭-৬১ র মধ্যে সাতাশ শতাধিক শিক্ষক, স্কুলের চাকুরী ত্যাগ করেন পূর্ব পাকিস্তানে। অথচ পশ্চিমে শিক্ষকতা আদরণীয় জীবিকা। যতাে সরকারী স্কুল তার প্রায় সবই যে পশ্চিম পাকিস্তানে। তবুও যে ১৯৬১ তে পশ্চিম পাকিস্তানের ২৪ হাজার স্নাতকোত্তর ডিগ্রীধারীর বিপরীতে পূর্ব পাকিস্তানে ৭ হাজার অনুরূপ ডিগ্রীধারীর তথ্য পাওয়া যায়, তার মূলে পূর্ব পাকিস্তানী মানুষের বুদ্ধিমত্তা এবং বিদ্যোৎসাহিতাই প্রতিপন্ন হয়। এতে বিদ্রপ করা গর্হিত। (১৭)
কালা কানুনের প্রয়ােগে ঢাকা ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হতে দেওয়া হ’ত খুব কম ছাত্রকে। করাচিতে প্রায় সবাই পেত প্রথম শ্রেণী। উপাধ্যক্ষ এবং অন্যান্যরা এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত হয়ে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রদের জাতীয় স্তরের প্রতিযােগিতায় পিছিয়ে দিত। যে- আইন গুলাে জোর করে ছাত্রদের পরীক্ষার ফল খারাপ করতাে তাদের অবসানের দাবি করলাে ছাত্ররা। সন্ত্রস্ত কর্তৃপক্ষ ২৮ শে জুন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দিয়ে, ৪ঠা জুলাই আন্দোলনের নেতাদের নামের তালিকা চেয়ে সার্কুলার পাঠায়। (১৮)
১৯৬৩-র ২৩শে এবং ২৪ শে মে জাতীয় আর্থিক পরিষদের প্রকাশিত প্রতিবেদনে পূর্ব পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক ভেদের কারণ হিসাবে যা বলা হ’ল তাদের বৈষম্যের কারণ না বলে বৈষম্যের বহর বা সূচক বলা উচিত – এই মন্তব্য করে পূর্ব পাকিস্তানী সরকার। এটা তাৎপর্যপূর্ণ যে এটুকু সৎসাহস প্রাদেশিক সরকার দেখিয়েছিল। যােজনা পরিষদের পক্ষে পেশ করা ঐ প্রতিবেদনে বলা হয় – প্রতুলতর পুঁজি, বৃহৎ শিল্পে দ্বিগুণের চেয়ে বড় মাপের দক্ষতর শ্রমশক্তি, অধিকতর শহরাঞ্চল, প্রশাসনিক এবং কারিগরি উৎকর্ষ প্রভৃতি কারণে পশ্চিম পাকিস্তান, পূর্ব পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছে। স্পষ্টতঃই ফলকে কারণ বলা হয়েছে। (১৯)
মাহাবুবউল হক ১৯৬৪ র ১৩ ই অগাস্ট তাঁর দীর্ঘ ভাষণে উক্ত প্রতিবেদন, বিরােধী প্রতিবেদন এবং পূর্ব পাকিস্তান সরকারের মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে যে বিষয়গুলির উল্লেখ করেন তা সংক্ষেপে বলা হবে। মাহাবাবউল বলেন, ১৯৪৭-এ কৃষি, যানবাহন, শিল্প এবং অন্যান্য মৌলিক বিষয়ে পূর্ব পাকিস্তান-ই ছিল এগিয়ে। একটানা ঔপনিবেশিক শোষণপীড়ন চালিয়ে ১৯৬৪-তে অবস্থার আমূল পরিবর্তন সাধন করে পশ্চিম পাকিস্তানকে তুলনামূলক অর্থে অনেক এগিয়ে নেওয়া হয়েছে। ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা কী কী ভাবে এবং কোন্ কোন্ দিকে চাপানাে হয়েছে তার উল্লেখ জরুরি।
(১) পূর্ব – পাকিস্তানের উদ্বৃত্ত বৈদেশিক মুদ্রা সম্পদ পশ্চিম পাকিস্তানে স্থানান্তরিত করে তা দিয়ে তার পণ্য এবং পূজির প্রয়ােজন মেটানাে হয়েছে।
(২) পূর্ব পাকিস্তানে লভ্য কাঁচামাল ব্যবহার না করে পূর্ব পাকিস্তান উপার্জিত বৈদেশিক মুদ্রার সাহায্যে বৈদেশিক কাঁচামাল আমদানি করে তাকে পশ্চিম পাকিস্তানীরা পাকামাল বা শিল্প পণ্যে রূপান্তরিত করে ঐ পূর্ব পাকিস্তানেই সেসব রপ্তানি করেছে।
(৩) পূর্ব পাকিস্তানের পাটের বিনিময়ে লব্ধ বৈদেশিক কারিগরি বা যান্ত্রিক সহায়তায় শিল্পস্থাপন বা শিল্প প্রসার করা হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানে।
(৪) চামড়া ইত্যাদি কাঁচামাল পূর্ব পাকিস্তান থেকে আমদানি করে সংশ্লিষ্ট চামড়াশিল্পাদিজাত পণ্য ফের ঐ পূর্ব পাকিস্তানে বিক্রয় করা হয়েছে।
(৫) বিদেশী পণ্য পূর্ব পাকিস্তানে বিক্রয় করা কার্যতঃ বন্ধ করে পূর্ব পাকিস্তানকে বাধ্য করা হয়েছে চড়া দামে পশ্চিম পাকিস্তানী পণ্য ক্রয় করতে।
(৬) পূর্ব পাকিস্তানে শিল্প বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান স্থাপিত করে পশ্চিম পাকিস্তানীরা যে লাভ করেছে তা পশ্চিম পাকিস্তানে সরিয়ে ফেলেছে।
(৭) পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন সরকারী এবং আধাসরকারী প্রতিষ্ঠানে এবং বাণিজ্যিক এজেন্সিতে পশ্চিম পাকিস্তানীদের নিযুক্ত করা হয়। উপার্জিত অর্থের একাংশ পশ্চিম পাকিস্তানে স্থানান্তরিত হয়। সর্বশেষে, কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিম এবং পূর্ব পাকিস্তানের জন্য যে অর্থ বরাদ্দ করে থাকে, তাতে থেকে যায় বিরাট বৈষম্য। (২০)
রাজনৈতিক স্বাধিকার অর্জন না করতে পারলে পশ্চিম পাকিস্তানীদের শোষণের নাগপাশ থেকে মুক্তি নেই — একথা বুঝে পূর্ব পাকিস্তানীরা তাঁদের দাবির সমর্থনে আন্দোলন চালিয়ে গেলেন। ১৯৬৫-তে আয়ুব প্রেসিডেন্ট পদে পুনর্নির্বাচিত হলেও এ আন্দোলন চালু রইলাে। শ্রমিকবুদ্ধিজীবীর ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন ভিন্ন কেন্দ্রীয় সরকারের কঠোর দমননীতির মুখে আন্দোলনে সাফল্য আসা দুরহ। এ সময় অবশ্য পশ্চিম পাকিস্তানী শিল্পপতিদের পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত কলে কারখানায় শ্রমিক আন্দোলন ব্যাপকরূপ ধারণ করতে থাকে। যেহেতু মৌলগণতন্ত্রের কর্তারা শ্রমিকদের ভােটের চেয়ে মৌল গণতন্ত্রীদের খরিদ করার অর্থের তাগিদে ধনী পশ্চিম পাকিস্তানী শিল্পপতিদের উপর সমধিক নির্ভরশীল, সুতরাং শ্রমিকদের গণতান্ত্রিক বা আর্থিক অধিকার স্বীকার করার কোনাে আগ্রহ তাঁদের ছিল না। শ্রমিক আন্দোলন বন্ধ করতে তাঁদের দাবি মেনে না নিয়ে, অন্যপথ ধরলাে আয়ুবচক্র। ১৯৬৫তে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণার পথেই নামলাে ঐ চক্র।
১৯৬৪ র জুলাই-এ পাঁচটি পূর্ববঙ্গীয় চটকলের ৫০ হাজার শ্রমিক লাগাতার ধর্মঘট চালিয়ে যান। নানা দাবির ভিত্তিতে চলা এই ধর্মঘটের ঊনিশ দিনের দিন অর্থাৎ ২ রা অগাস্ট বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন ঐ ধর্মঘটী শ্রমিকদের সমর্থনে সভা, শােভাযাত্রা ইত্যাদির আয়ােজন করে। ৪ঠা অগাস্ট অপর কয়েকটি চটকলের শ্রমিকরাও ধর্মঘটে সামিল হন। পরের দিন অন্তর্বর্তী বেতন বৃদ্ধি এবং অপরাপর সুযােগ সুবিধার দাবি মানা হয়েছে এই কারণে এবং সকল দাবিই আলাপ-আলােচনার মাধ্যমে মানা হবে এই সরকারী প্রতিশ্রুতির ফলে শ্রমিক ধর্মঘট প্রত্যাহত হয়। তথাকথিত এতিশ্রুতি রক্ষা করে নি সরকার। আলােচনাই ভেস্তে যায়। ১২ই অক্টোবর সমস্ত চটকলের একলক্ষ শ্রমিক ধর্মঘট করেন। একই দিনে খুলনায় বিনা প্ররােচনায় শান্তিপূর্ণ শ্রমিক সমাবেশে পুলিশ এবং ভাড়াটে গুণ্ডাবাহিনী হামলা চালায়। শত শত শ্রমিকের জীবনহানি ঘটায় তারা। ৩রা নভেম্বর রাজ্যজুড়ে প্রতিবাদ দিবস পালিত হয়। এর পূর্বে অক্টোবরের ২৪ এবং ২৫ তারিখে রাজ্যের ১১৮ টি ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিনিধিদের সম্মেলন ঘােষণা করে, সামরিক আইন উঠে গেলেও প্রকৃত শ্রমিক স্বার্থ বাহী আন্দোলন সরকার করতে দেয় না। আন্দোলন চালানােই দুরূহ। আবেদন নিবেদনের বাইরে কিছু করাই নিষিদ্ধ। উনিশ শতকে ফিরে গেছি যেন আমরা আজ।(২১)
ধর্মঘটী শ্রমিকদের খুলনায় যে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল ১৯৬৪ র ১২ই অগাস্ট তার তদন্ত পর্যন্ত না করে প্রতিক্রিয়াশীল কর্তৃপক্ষের প্ররােচনায় শত শত চটকল শ্রমিক ছাঁটাই হলেন। অনেককে সাজানাে মামলায় জড়ানাে হ’ল। পীড়নের মাত্রা বাড়িয়েও সরকার এর পরেই ধার্য ১৯৬৫ র ২৭শে মের রেল ধর্মঘট বানচাল করতে পারে নি। ২৭ শে মের ধর্মঘটের মুখে শ্রমিক নেতাদের গ্রেপ্তার করা হ’ল এবং ধর্মঘটকে বেআইনী ঘেষণা করলাে সরকার। তথাপি ২০ শে মে চট্টগ্রামের ধর্মঘট ইঙ্গিত দিল ২৭ শে মে কী হতে চলেছে তার। ২৭ শে মে রেল ধর্মঘট শুরু হল। চট্টগ্রামে ২৮ শে মে একজন শ্রমিককে পুলিশ হত্যা করে। অনেক শ্রমিক পুলিশের হামলায় আহত হন। ২৯ শে মে চট্টগ্রাম এবং ঢাকায় যথাক্রমে ছাত্র-শ্রমিক এবং ছাত্র ধর্মঘট হয়। ভারত নাকি পূর্ব পাকিস্তান আক্রমণ করবে- সুতরাং এ সময় রেল ধর্মঘট হবে দেশদ্রোহিতা — এই সব অসার সরকারী প্রচারে ছাত্র-শ্রমিক কেউ-ই বিভ্রান্ত হন নি। (২২)
পূর্ব পাকিস্তানী সাংসদরা স্বায়ত্ত্বশাসনের দাবি লাগাতার করে চললেন। এর ফলে আর কিছু না হােক পূর্ব পশ্চিম পাকিস্তানের আর্থবৈষম্য বৃদ্ধি পাবে না – এই তাঁরা মনে করতেন। অর্থমন্ত্রকে বাঙালীর চিহ্নমাত্র রাখা কোনদিনই হয় নি বলে এই বৈষম্য হয়ে উঠেছে এত তীব্র। এই কারণে পূর্ব পাকিস্তান পুঁজিগঠন বা ক্যাপিটাল ফরমেশান – এর সুযােগ পায় নি। ঐ সুযোেগ একতরফাভাবে পেয়ে এসেছে পশ্চিম পাকিস্তান। ১৯৬৫ র ২১ শে জুন নুরুল আমিন বলেন, “যে-আর্থবৈষম্য পাকিস্তান সরকার নিজেই সৃষ্টি করেছে। তাকে দূর করতেও হবে ঐ একই সরকারকে। ঐ দিনেই এ, এইচ, এম কামারুজ্জমান বলেন, দুই অঙ্গে সাম্যপ্রতিষ্ঠার দাবি ভিখারীর আবেদন নয়, এ হ’ল ন্যায্য দাবি, আমাদের এই দাবি ন্যায্য এবং সঙ্গত। অবশ্য আয়ুবের অভিভাবকত্বধন্য ‘ডন’ সম্পাদক ব্রিটিশ এবং হিন্দুদের শােষণেই পূর্বপাকিস্তান দুর্দশাগ্রস্ত হয়েছে – এ সব প্রচার করে সমতাকামী পূর্ব পাকিস্তানীদের বিভ্রান্ত করতে পারেন নি। বরং ২৪ শে জুন ইত্তেফাক, সম্পাদকীয় প্রবন্ধে ‘ডন’ সম্পাদকের কথা উড়িয়ে দিয়ে জানালাে – পাকিস্তানের জন্মলগ্নে নানা দিক দিয়ে বিচার করলে দেশের পূর্বখণ্ডই পশ্চিম খণ্ডের চেয়ে অধিক সমৃদ্ধ ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের কতিপয় পুঁজিপতিকে ক্রমাগত মদত দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারই সেই তুলনামূলক অর্থে অগ্রসর অর্থনীতির অঞ্চলকে আজ পশ্চিমাঞ্চলের উপনিবেশে পরিণত করেছে। সরকারপক্ষের জুলফিকর এবং কিজিলবাশ এই সময়ে অথাৎ ১৯৬৫ জুন মাসে ভারতীয় আগ্রাসনের আশঙ্কার কথা সংসদে তুলে পূর্ব-পশ্চিম বৈষম্য প্রশ্নটি চাপা দিতে চেষ্টা করেন।(২৩)
অবশ্য পাকিস্তান সরকার যে স্বভাবতঃই ভারতের সঙ্গে বিবাদ বাধিয়ে এই প্রশ্নটি চাপা দিতে চাইছে ইত্তেফাকের ভীমরুল’ ছদ্মনামের একজন বিভাগীয় লেখক তাঁর প্রবন্ধে তার উল্লেখ করেছিলেন। ১৯৪০ – এর লাহাের প্রস্তাবের সূত্র ধরে ঐ পত্রিকায় মুসাফির লিখলেন, আঞ্চলিক বৈষম্যের অবসান কল্পে চাই আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন। ১৯৬৫ – র ১৯ শে অগাস্ট ইত্তেফাক লিখলাে, কেন্দ্রীয় সরকারের চরম অবহেলার পরিণামে ১৯৪৭-৪৮ সালের ৬৮,৭৩ লক্ষ বস্তার স্থলে ১৯৬৪-৬৫ তে পাটের উৎপাদন নেমে এসে হয়েছে। মাত্র ৫৩ লক্ষ বস্তা। সেদিন বিশ্বের মােট পাট উৎপাদনের ৮০.৫৮ শতাংশ উৎপাদনের গৌরব ছিল পূর্ব পাকিস্তানের। ১৯৬৪-৬৫ তে আজ তা এসে ঠেকেছে মাত্র ৩৫ শতাংশে। যে-পাট পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতির মূল স্তম্ভ, তার বিলুপ্তির পথেই তাে কেন্দ্রীয় সরকার চলেছে। পাট চাষীর প্রতি বিরূপ আচরণ করে সরকার এই অবস্থার সৃষ্টি করেছে। তাদের ন্যূনতম প্রয়ােজন ও মেটানাে হয় নি। ২২ শে অগাস্ট ঢাকার সংবাদপত্রে চাঞ্চল্যকর সংবাদ প্রকাশ পেল। বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলি যে-অর্থ পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যয় করার জন্য ধার্য করেছিল, পশ্চিম পাকিস্তানী বণিক জোট পরিচালিত ব্যাঙ্কগুলি সেই অর্থ পশ্চিম পাকিস্তানে সরিয়ে ফেলছে। এমন কি, ব্যাঙ্ক এবং বীমায় পূর্ব পাকিস্তানীদের প্রদত্ত আমানতও পূর্ব পাকিস্তানের কল্যাণে ব্যয় করা সম্ভব ছিল না। ১৯৬৫ র ২৫ শে অগাস্ট ‘আজাদ’ সংবাদ দিল যে, বীমা কোম্পানিগুলির আদায়ীকৃত কিশতির অর্থের ৪০ শতাংশ আসে পূর্ব পাকিস্তান থেকে। অথচ এখন পর্যন্ত বীমা কোম্পানিরা তার মােট বিনিয়ােগের মাত্র ৭ শতাংশ এই প্রদেশের জন্য ধার্য করে চলেছে। (২৪)
ইত্তেফাক, ১৯৬৫ র ২৮ শে অগাস্ট শাসকচক্রের আরাে এক ভণ্ডামি ফাঁস করে দেয়। দ্বিতীয় পরিকল্পনাকালে পূর্ব পাকিস্তানে ১৫০ টি স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপনের প্রস্তাব করে মাত্র ৫০ টির মতাে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ব্যবস্থা হয়। অথচ পূর্ব পাকিস্তানে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের নিদারুণ অভাব আছে। পশ্চিম পাকিস্তানে মফঃস্বল বা গ্রাম এলাকার বাসিন্দার সংখ্যা পূর্ব। পাকিস্তানের চেয়ে ঢের কম হওয়া সত্ত্বেও সেই অঞ্চলে ১০০ টি স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপিত হয়েছিল একই সময়ে। ইত্তেফাক ধারাবাহিক ভাবে লিখে চলে আমলা এবং সরকারী কর্তৃপক্ষের নানা কারসাজি, প্রতিবন্ধকতা এবং টালবাহানায় কীভাবে পূর্ববঙ্গের যৎসামান্য উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ-ও পূর্ব পাকিস্তান সরকার সম্পন্ন করার সুযােগই পান না সেকথা। উন্নয়নমূলক কাজের যে প্রাথমিক অবলম্বন সেই বিদুৎশক্তির উৎপাদনেও পূর্বপাকিস্তানকে কৃত্রিমভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় অনেক নিচে ফেলে রাখার জন্য দায়ী তথ্যাদি পেশ করে ইত্তেফাক’ লিখলাে, পশ্চিম পাকিস্তানকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ২৩ কোটি টাকা দিলেও কেন্দ্রীয় সরকার কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানকে ঐ খাতে দিয়েছে মাত্র ৭ কোটি টাকা। ফল যা হবার তাই হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা পৌনে ৮ লক্ষ কিলােয়াট, আর পূর্ব পাকিস্তানে এই পরিমাণ মাত্র ২ লক্ষ কিলােয়াট। তা ছাড়া, ই, পি, আই, ডি, সি সব সময় উন্মুখ হয়ে আছে নিজেদের শিল্প সং স্থাগুলি পশ্চিম পাকিস্তানী শিল্পপতিদের হাতে তুলে দিতে, কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানী শিল্পপতিরা বিশেষ কয়েকটি শিল্প প্রতিষ্ঠান নিজেদের হাতে নিতে চেয়ে আবেদন করেও বিফলমনােরথ হয়েছেন। ই, পি, আই, ডি, সি এই হস্তান্তরে সম্মত হয় নি। (২৫)
১৯৬৫ র এই অগাস্ট মাসে শ্রমিকদের উপর চূড়ান্ত দমনমূলক বিধিনিষেধ চাপানাে হয়। শ্রমবিরােধ বিলের নামে ধর্মঘট বেআইনী ঘােষণার অধিকার সরকার হাতে নেবার তােড়জোড় করলাে। একই সঙ্গে সরকারী বা আধা-সরকারী সংস্থার শ্রমিকদের পক্ষে নিষিদ্ধ হ’ল বেসরকারী সংস্থায় সক্রিয় ট্রেড ইউনিয়নদের ফেডারেশনের সঙ্গে সংস্রব রক্ষা করা। প্রাদেশিক আইনসভায় পূর্বপাকিস্তানের শ্রমমন্ত্রী জানালেন, পাকিস্তান আই, এল, ও – বিধি মানতে বাধ্য নয়। শ্রমিক দলনের আয়ােজনের পাশাপাশি ভারত-বিরােধী। জিগির তুলে ভারতের উপর আক্রমণ শানানাের প্রস্তুতিও নিয়ে চললাে পাকিস্তান সরকার।(২৬)
পূর্ব পাকিস্তানে বর্ষার সময় বন্যা নিয়মিত দেখা দেয়। জলধারার অভাব নয় আধিক্যও তার সমস্যা। ভারত সরকারের ফারাক্কা পরিকল্পনা চল্লিশ হাজার কিউসেক জলধারা পদ্মা থেকে হুগলীমুখী করে নিলে প্লাবনের দেশ পূর্ব পাকিস্তানে খরা দেখা দেবার কথা নয়। তবু সেই অসম্ভব কথাই বলে চললাে পাকিস্তান সরকার। উদ্দেশ্য ছিল ভারত-বিরােধী জিগির উচ্চগ্রামে তােলা। (২৭)
কাশ্মীর প্রশ্নও ভারত-বিরােধী মনােভাব জাগানাে সরকারী প্রচারে গুরুত্ব পেল। অবশ্য ফারাক্কা বা কাশ্মীরের প্রশ্নে আবেগ তাড়িত হয়ে সাম্প্রতিক শ্রমিক-বিরােধী আইন গুলাে স’য়ে যাবার মতাে অবােধ পূর্ব পাকিস্তানীরা ছিলেন না। শ্রম বিরােধ বিল পাশ করানাে হয় ৩রা অগাস্ট। ঐ দিনই শ্রমিক-বিরােধী আইন প্রতিরােধ সমিতির ডাকে ঢাকা, নারায়ণ গঞ্জ এবং পােস্তা গাে লার শ্রমিক জনতার সঙ্গে সাধারণ মানুষ এক জোট হয়ে যে বিশাল জনসভার আয়ােজন করেন সেখানে প্রস্তাব নেওয়া হয়, ‘৬-ই অগাস্ট রাজ্য জুড়ে ধর্মঘট। নিধারিত দিনে শ্রমিকদের একদিনের প্রতীক ধর্মঘট এবং ঢাকার পল্টন ময়দানে লক্ষ মানুষের জমায়েতে শ্রমিকশ্রেণীর উপস্থিতি আয়ুব-চক্রকে সন্ত্রস্ত করে থাকবে। মালিক এবং সরকার পক্ষ শ্রমিকসংহতি বিনাশে এবং গুণ্ডাবাহিনীর সাহায্যে সন্ত্রাসসৃষ্টিতে আত্মনিয়ােগ করলাে। পূর্ব পাকিস্তান শ্রম পরিষদ, ২৮ শে অগাস্ট এই মর্মে সংবাদপত্রে বিবৃতি পেশ করলাে যে, শ্রমিকদের মৌলিক অধিকার ছিনিয়ে নিয়ে তাদের বিশৃঙ্খলতার পথে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। ভারতকে আক্রমণ করার দিনটি যখন অদূরে দৃশ্যমান ঠেকছে, পাকিস্তানী সরকার তখন কিন্তু সত্য সত্যই শ্রমিক শ্রেণীর বিশৃঙ্খলতার আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছে। আয়ুবচক্রের জন্য ১৯৬৫-র অগাস্ট জুড়ে দিনগুলি ছিল এই যুদ্ধপ্রস্তুতি এবং শ্রমিক অশান্তির দোটানায় বাঁধা। (২৮)
অথচ বুদ্ধিজীবী মহলে ভারত-বিরােধী প্রচারে তেমন ফয়দা তুলতে পারে নি। আয়ুবগােষ্ঠী। ইত্তেফাক ৯-ই অগাস্ট সাফ লিখলাে, পশ্চিম পাকিস্তান-ভারতের মধ্যে নদীর জল বাঁটোয়ারা শান্তিপূর্ণ ভাবে সম্পন্ন হয়েছে। ভারতই তার উদ্যোগ নিয়েছিল। ফারাক্কা প্রশ্নের মীমাংসাও ভারতের সঙ্গে আলাপ-আলােচনার মাধ্যমেই করতে হবে। আয়ুবচক্রের মুখপাত্ররা আবেদন করে চললেন, কাশ্মীরে ভারতের হামলার ফলে সৃষ্ট সমস্যার সমাধান কল্পে আয়ুবের পাশে দাঁড়ান। এই যুদ্ধোন্মাদনার উপযুক্ত জবাব দিলেন ‘ইত্তেফাকে’র ২৪ শে অগাস্ট সংখ্যায় মােসাফির। তিনি লিখলেন, পাকিস্তানীদের গণতান্ত্রিক অধিকার অস্বীকার একটি জ্বলন্ত সমস্যা। এর গুরুত্ব ঐ কাশ্মীরের তথাকথিত সমস্যার চেয়ে অনেক বেশি। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের খুলনা, মৈমনসিংহ এবং যশাের শাখা, পূর্ব পাকিস্তানে সম্পূর্ণ স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করে প্রস্তাব নেয়। ঐ ছাত্রসংগঠনের পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে প্রভাব ছিল অসামান্য। (২৯)
১৯৬৫ র সেপ্টেম্বর মাসে ২২ দিনের যে-যুদ্ধ ভারতের বিরুদ্ধে চালিয়েছিল পাকিস্তান সরকার তার একটা উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানের শ্রমিক-বুদ্ধিজীবীদের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে একটা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা। সে উদ্দেশ্য তাে ফলেই নি, এই যুদ্ধের অভিজ্ঞতা পূর্বপাকিস্তানী সাংসদদের আরাে সােচ্চার করে তুললাে পূর্বখণ্ডের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার দাবিতে। যুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তানের আত্মরক্ষার কোনাে ব্যবস্থা ছিল না। অবশ্য পাকিস্তান সরকার এবং তার সমর্থক পত্র পত্রিকা, পূর্ব পাকিস্তানীদের তথা ইত্তেফাক পত্রিকার দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তুলেও ঐ প্রতিরক্ষা ঘটিত দাবিকে স্তব্ধ করতে পারে নি। (৩০)
সচেতন পূর্ব পাকিস্তানী ভালােই বুঝতেন, ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে দু’দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ক্ষুন্ন হবে। এর কুফল জনসাধারণের উপর পড়বে। যুদ্ধে লাভবান হবে ধনিক শ্রেণী মাত্র। তাই চট্টগ্রাম, ঢাকা এবং খুলনায় ভারতীয় বিমান থেকে বােমাবর্ষণের আজগুবি সংবাদ প্রচার করেও ২২ শে অক্টোবরের ভারতকে ধ্বংস করাে দিবস পালন করতে গিয়ে আয়ুবের মুসলিম লীগ কোনাে বিক্ষোভ-সমাবেশ বা মিছিলের আয়ােজনও করতে পারে নি। পুলিশ মিলিটারির কড়া প্রহরার মধ্যেও যুদ্ধ বিরােধী, গণতন্ত্র এবং শান্তিকামী দেওয়াল-লিপি সর্বত্র লক্ষ্য করা গেছে। ভারত-পাকিস্তান মৈত্রীর স্বপক্ষে এবং পূর্বপাকিস্তানের জন্য স্বাধিকারের দাবিতেও দেওয়াল-লিপি নজরে পড়েছে। আয়ুব-ভুট্টোর সমরবাদ এবং আয়ুবের পূর্ব পাকিস্তানে উপনিবেশবাদ নিপাত যাক – এমন পােষ্টারও লেখা হয়েছে ঐ তথাকথিত ভারত ধ্বংস ডাকের দিন। (৩১)
অবশ্য সরকার পক্ষ ও চুপ করে বসে ছিল না। পাঞ্জাবী মুখ্যসচিবের মাধ্যমেই পূর্ব পাকিস্তানীদের স্বার্থবিরােধী কেন্দ্রীয় সরকারের হুকুম তামিল করা বরাবরই হ’ত। এবারে এক অতিরিক্ত মুখ্যসচিবও এলেন। তিনিও পাঞ্জাবী। কলকাতায় প্রকাশিত বাঙলা বই বিক্রয় পর্যন্ত নিষিদ্ধ হ’ল। বিদেশী বই’ সংক্রান্ত এই হুকুমের লক্ষ্য যে, বাঙালীসুলভ চিন্তাভাবনা তথা পশ্চিম বাংলার সঙ্গে মতাদর্শগত যােগসূত্র বিনষ্ট করা একথা বলাই বাহুল্য। বিদেশী বই পূর্ব পাকিস্তানে পুনর্মুদ্রিত হলেও ২ বছরের জেল এবং হাজার টাকা জরিমানার ফতােয়া ছিল ঐ হুকুমনামায়। কিন্তু পাঞ্জাবী আমলাদের ঔদ্ধত্যে আয়ুবের মুসলিম লীগের পূর্বপাকিস্তান শাখার কার্যকরী সমিতিতে বিরােধ এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে, ঐ সমিতি ভেঙে দিয়ে সাময়িক কাজ চালাবার মতাে অ্যাড হক কমিটি করতে হ’ল (৩২)
তাসখন্দ চুক্তিকে অভ্যর্থনা জানালাে ‘ইত্তেফাক’, ‘সংবাদ’, ‘আজাদ’ প্রভৃতি সংবাদপত্র। সময়টা ছিল ১৯৬৬ র ১১ই সেপ্টেম্বর। অথচ কাশ্মীর সমস্যার যুদ্ধের মাধ্যমে মীমাংসায় বিশ্বাসী পশ্চিম পাকিস্তানীরা তাশখন্দ চুক্তির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করতে থাকলে পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ, ঐ বিক্ষোভকে সাম্প্রদায়িকতার সহায়ক বলে বিবৃতি দিলেন। তাশখন্দের সমর্থনে মত প্রকাশ করলেন নুরুল আমিন, মুজিবর থেকে শুরু করে ছাত্রনেতারা পর্যন্ত সকলে। মুজিবর বললেন, ‘ভারতের সঙ্গে বিগত যুদ্ধের অভিজ্ঞতা হ’ল এই যে, জাতীয় সংহতির স্বার্থে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধিকার এবং স্ব-নির্ভর প্রতিরক্ষাব্যবস্থা অবশ্য প্রয়ােজন। ১৯৪০ এর লাহােরের প্রস্তাবের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই এই স্বাধিকারের প্রসঙ্গ তােলা হয়েছে। (৩৩)।
১৯৬৬ র ৫ই এবং ৬ই ফেব্রুয়ারি লাহােরে যে সম্মেলন কাউনসিলরস মুসলিম লীগ, আওয়ামি লীগ, জমাত-ই-ইসলাম এবং নিজাম-ই-ইসলাম – এই দলগুলি ডেকেছিল এন, ডি, এফ তা বয়কট করে। মুজিবরের নেতৃত্বে আওয়ামি লীগও ঐ সম্মেলনের প্রথম অধিবেশনের পরে বীতশ্রদ্ধ হয়ে সম্মেলন পরিহার করেন। ৭৪০ জন প্রতিনিধির মধ্যে ৭১৯ জনই ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানী। এঁদের উৎসাহেই তাশখন্দ বিরােধী মিছিল ইত্যাদি হয়েছিল কিছুদিন পূর্বে। মুজিবর পরে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায্য দাবি যারা শুনতে প্রস্তুত নয়, তাদের সঙ্গে সম্মেলন কী কারণে করবাে? ‘সংবাদ’, ‘ইত্তেফাক’ প্রভৃতি সংবাদপত্র ঐ যুদ্ধবাজদের সমালােচনা করে লেখে যে, ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আশঙ্কা বাড়িয়ে দিতে পারে। শান্তিপূর্ণ পথেই কাশ্মীর প্রশ্নের সমাধান সম্ভব। ইত্তেফাকে’ ১৯৬৬ র ১৩ই ফেব্রুয়ারী মােসাফির লিখলেন, কাশ্মীরীদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার-ই যদি মেনে নিতে হয়, তবু ঐ উদ্দেশ্যে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঝুঁকি নেওয়া পাকিস্তানের পক্ষে বাস্তববুদ্ধির পরিচায়ক হবে না। (৩৪)
প্রভাবশালী, সমরবাদী উর্দু দৈনিক ‘নােয়া-ই-ওয়াকৎ’ ১লা ফেব্রুয়ারী সম্পাদকীয় মন্তব্যে পূর্ব পাকিস্তানীদের তাশখন্দ প্রস্তাবের সমর্থক হবার হিসাবে দেখালাে তাদের ভারতে চোরাচালানের তথাকথিত দিকটিকে। এই সম্পাদকীয় প্রবন্ধে পরামর্শ দেওয়া হল – পূর্ব পাকিস্তানের সংশ্লিষ্ট নদীগুলি থেকে ভারত যে সুবিধা পায় তা বন্ধ করে ভারতকে বাধ্য করতে হবে কাশ্মীর প্রশ্নে পাকিস্তানের দাবি মেনে নিতে। আসলে ভারতের সঙ্গে দীর্ঘকাল যে-সব ব্যবসা চলছিল আচমকা তা আইনের বলে বন্ধ করলে ঐ ব্যবসা চোরাচালান অপবাদ নিয়েও চলতে থাকে। একই উর্দু দৈনিকে অতীতে সংবাদ ছিল পশ্চিম পাকিস্তানী গম ভারতে পাচার করা সম্পর্কে। তাই পত্রিকাটি পূর্ব পাকিস্তানীদের এককভাবে চোরাচালানে জড়িত বলায় পাকিস্তান অবসাভার’ লিখলাে — পশ্চিম পাকিস্তান আর পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে কোনটি অপরটিকে চোরাচালান খেলায় হার মানায় সেকথা বলতে গেলে আঞ্চলিক পক্ষপাতিত্ব-ই এসে, যায়।’ (অথাৎ নিরপেক্ষ বিচারে বলতে হত, কেউ কম যায় না।) ৬ই ফেব্রুয়ারির সম্পদকীয় স্তম্ভে সংবাদ পত্রিকা মন্তব্য করে — যুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তান-ভারত দু’দেশের মধ্যস্থ সমস্যাগুলির আদৌ কোনাে সমাধান মেলে নি – এই অভিজ্ঞতা থেকেই পূর্ব পাকিস্তানীরা তাশখন্দ ঘােষণাকে স্বাগত জানিয়েছেন। একই দিনে ঐ বাঙলা দৈনিকেই ‘নােয়া-ই-ওয়াকৎ’- এর মন্তব্যে যে ঢাকার সর্বস্তরের মানুষ ক্ষুব্ধ একথা প্রথম পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছিল। (৩৫)
তাশখন্দ ঘােষণা সৃষ্ট নূতন পরিস্থিতিতে রাজনীতিক নেতা থেকে ছাত্রনেতা মাত্রেই দাবি তুললেন রাজবন্দীদের মুক্তি, জরুরী অবস্থা বিধির বিলােপ এবং প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের স্বপক্ষে। ভাসানি ১৭ই ফেব্রুয়ারির বিশাল শ্রমিক-কৃষক সমাবেশে ঐ দাবিগুলির স্বপক্ষে ভাষণ দিলেন। ২৬ শে ফেব্রুয়ারি ন্যাপ’ দল ‘জরুরী অবস্থা রদ করাে’ দিবস পালন করলাে শােভাযাত্রা, প্রচারপত্র বিলি, জনসভা ইত্যাদির মাধ্যমে। তাশখন্দ ঘােষণার অব্যবহিত পরেই উৎসাহী ছাত্রনেতারা বিবৃতি দিয়েছিলেন, কোন প্রকার স্বৈরাচারী শাসনে আমাদের আস্থা নেই। তাশখন্দ চুক্তির কল্যাণে জরুরী অবস্থা রদ করার পরিস্থিতি এসে গেছে। প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন এবং গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য আমরা লড়াই চালিয়ে যাবাে। এই ছাত্রনেতারা ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের কার্যকরী পরিষদের সদস্য। ১৪ই ফেব্রুয়ারি ইত্তেফাক দৈনিকে মােসাফির লিখেছিলেন – ৫ কোটি বৈধ ভােটারের মধ্যে নগণ্য সংখ্যক অথাৎ মাত্র ৮০ হাজারকে ভােটাধিকার দেওয়া হয়েছে বলেই নজিরবিহীন ব্যাপকতা নিয়ে দুর্নীতির রাজত্ব চলছে। … পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যার সমাধান করতে হবে সমস্যা আছে মেনে নিয়ে, নেই বলে উড়িয়ে দিলে সমাধানও উবে যাবে। (৩৬)
১৪ই ফেব্রুয়ারী পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ সপ্তাহব্যাপী বঙ্গভাষা প্রচার অনুষ্ঠান চালায়। সর্বস্তরে বাঙলাভাষার ব্যবহারের দাবিও করা হয়। সাপ্তাহিক ‘ঢাকা টাইমস লেখে, ‘কার্যতঃ বাঙলা ভাষা সরকারী ভাষার কোনাে মর্যাদাই পায় নি। উচ্চশিক্ষায় পর্যন্ত বাঙলা ভাষা অপাঙক্তেয়। ১৯৫২ র ২১ শে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিতে শহীদ দিবস এবারেও প্রতিপালিত হ’ল। ঢাকা টাইমসের উদ্ধৃত বক্তব্য শহীদ দিবসেই প্রকাশিত হয়। একই দিনের ইত্তেফাকে’ লেখা হ’ল – ১৯৫২ র ভাষা আন্দোলনই পূর্ব পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পথিকৃৎ। এই ভাষা আন্দোলনই সম্প্রসারিত হয়েছে গণতান্ত্রিক অধিকার এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের দাবির রূপে। জীবনের সর্ব অঙ্গে এই অধিকার বােধ আজ পূর্ব পাকিস্তানীর ভাবাবেগের সঙ্গে অঙ্গীভূত হয়ে গেছে। (৩৭)।
পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন-আন্দোলন এই সময় প্রবল উদ্দীপনা এবং সুনির্দিষ্ট গতিবেগ পেল মুজিবর রহমানের ছয় দফা দাবি সম্বলিত পুস্তিকা আমাদের বাঁচার দাবি প্রকাশিত হলে। অবশ্য একই সময়ে পূর্ব-পশ্চিম বৈষম্যের উপর আবুল কালাম আজাদ লিখিত পুস্তিকা পাকিস্তানের আঞ্চলিক বৈষম্য’-ও ছিল একটি সাড়া জাগানাে পুস্তিকা। আজাদ ছিলেন বি, এ পাঠরত ছাত্র মুজিবর অত্যন্ত অর্থনৈতিক বাস্তববােধের পরিচয় দিয়ে ১৯৪০-এর লাহাের প্রস্তাবের ধাঁচে স্ব-শাসিত প্রদেশ গুলি দিয়ে গঠিত একটি ফেডারেশন হিসাবে পাকিস্তানের বিবর্তনের প্রয়ােজনের কথা বলেন। সার্বজনীন বা প্রাপ্তবয়স্কের ভােটাধিকার এই রাষ্ট্রের সংসদীয় গণতন্ত্র নিশ্চিত করবে। অর্থনীতির ক্ষেত্রে যে-প্রদেশ কর আদায় করবে সেকর ঐ প্রদেশ থেকে গৃহীত বলে প্রদেশের-ই প্রাপ্য হবে। দেশের দুই অঙ্গে সহজ বিনিময়যােগ্য দুটি মুদ্রা চালু থাকবে। প্রতিরক্ষা এবং পররাষ্ট্র নীতি থাকবে কেন্দ্রীয় বা ফেডারেল সরকারের হাতে। তবে আর্থিক হিসাব রক্ষা এবং তার দায়-দায়িত্ব প্রাদেশিক স্তরে প্রাদেশিক সরকারের উপর বর্তাবে। প্রতিরক্ষা কেন্দ্রীয় সরকারের এক্তিয়ার হলেও প্রাদেশিক সরকার গুলির থাকবে স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা রক্ষা করার দায়িত্ব এবং অধিকার। সংক্ষেপে মুজিবরের ছয়দফা বলতে স্বায়ত্বশাসিত প্রদেশদের সমন্বয়ে গণতান্ত্রিক ফেডারেশনের জন্য এই মূলনীতিগুলিই বােঝায়। পূর্ব পাকিস্তানীদের স্বাধিকার অর্জনের সংগ্রামে মুজিবরের ইশতেহারই সর্ব প্রথম পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক তথা অর্থনৈতিক বাস্তবের রূপরেখা হিসাবে বিশেষ প্রণিধানযােগ্য। পূর্ব পাকিস্তানীদের স্বায়ত্তশাসন অর্জনের সংগ্রামে এই ছয়দফার অগ্রণী ভূমিকা স্বীকার করতেই হবে। (৩৮)।
পশ্চিম পাকিস্তানী শক্তিচক্রের অঙ্গুলি হেলনে পাকিস্তান সরকারের আইন, প্রশাসন, সংসদ সবই চালিত হয়। এই পরিস্থিতির সুযােগে পশ্চিম পাকিস্তানী পুঁজিপতি বণিক গােষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশে পরিণত করেছে – এ অভিযােগ পূর্ব পাকিস্তানী সাংসদরা দীর্ঘদিন ধরে করে আসছেন। মুজিবরের ছয়দফা সেই অভিযােগের পুনরাবৃত্তি নয়। যে-পরিস্থিতির বিরুদ্ধে এত অভিযােগ তারই পরিবর্তনের ইশতেহার এটি। শুধু পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধিকার নয়, সমগ্র পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্য বিজ্ঞান সম্মত গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার নির্দেশিকা হিসাবে মুজিবরের ছয় দফা বরেণ্য। (৩৯)
প্রকৃত প্রস্তাবে একই দেশে দুটি অর্থনীতি চালু করেছিল পাকিস্তানী শাসকগােষ্ঠী। ঔপনিবেশিক মুনাফা লুণ্ঠনের অর্থনীতির ধারক পশ্চিম পাকিস্তান, দেশের-ই পূর্বখণ্ড বা পূর্ব পাকিস্তানকে করে ফেলেছিল নিজস্ব উপনিবেশ। এই দ্বিবিধ অর্থনীতির প্রাথমিক রূপকার কেন্দ্রীয় শাসকচক্র। তার প্রায় সবটুকুই পশ্চিম পাকিস্তানীদের নিয়ে গঠিত। নামে পূর্ব পাকিস্তানী এক আধজন সরকারের উচ্চপদে আসীন থাকলেও তাঁর ভূমিকা ছিল ক্রীড়াপুত্তলীর। সরকারী নীতি কীভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের সমৃদ্ধি ঘটিয়ে চলেছে তার সহজ দৃষ্টান্ত দেশের রাজধানী পশ্চিম খণ্ডে স্থাপন। এমন কি, রাজধানী শহর পরিবর্তিত হলেও ঐ খণ্ডেই অবস্থিত হয়েছে। রাজধানীর সাজসজ্জা, সড়ক বা ইমারত নির্মাণ সবই আঞ্চলিক ব্যবসায়ীদের পুঁজি সংগ্রহের পথ খুলে দেয়। বাণিজ্যিক দপ্তর গুলির অবস্থানের বাড়তি সুবিধাও ঐ পশ্চিম পাকিস্তানীরাই পেয়েছে। সরকারী পক্ষপাতিত্বে শিল্প স্থাপন, আমদানি-রপ্তানির পারমিট লাইসেন্স ইত্যাদি সকল অনুষঙ্গ বিচারেই পরিকল্পিত ভাবে পূর্ব পাকিস্তানীদের বঞ্চিত করা হয়েছে। চট শিল্পের স্বাভাবিক এলাকা পাট উৎপাদনক্ষম পূর্ব পাকিস্তান। অথচ পশ্চিম পাকিস্তানে অর্থনীতিগত বিবেচনা না করে চটশিল্প প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অবস্থানদোষে যে শিল্প পশ্চিমখণ্ডে অচল, সরকারী ভরতুকির জোরে সেই শিল্প ঐ অঞ্চলে স্থাপিত করে ঐ ভরতুকির জোরেই তাকে লাভজনক দেখানাে হয়েছে। পেট্রোকেমিক্যাল এবং চিনির কল-ও অযৌক্তক ভাবে পশ্চিম পাকিস্তানে খােলার চিন্তা করা হয়েছে। উদাহরণ বাড়িয়ে কী হবে? চটকলের উদাহরণই বুঝিয়ে দিচ্ছে পূর্ব পাকিস্তান নিতান্ত কৃষিকর্মে লিপ্ত তথা পশ্চিমপাকিস্তানী পণ্যের লাভের বাজার এলাকা হিসাবে থেকে যাবে – এই ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের অভিসন্ধি। (৪০)
পূর্ব পাকিস্তানে খনিজ সম্পদের ঘাটতির কারণে শিল্পায়ন দুঃসাধ্য এ যুক্তিও অনুপপত্তি দোষে দুষ্ট। পশ্চিম পাকিস্তানও তার প্রাকৃতিক সম্পদের উপর নির্ভর করে শিল্পের পর শিল্প প্রতিষ্ঠা করে চলছে – একথা সম্পূর্ণ ভুল। বিদেশ থেকে নানা প্রকার কাঁচামাল (শুধু যন্ত্র, প্রযুক্তি নয়) আমদানি করে থাকেন পশ্চিম পাকিস্তানীরা তাঁদের শিল্প
১১৫
প্রতিষ্ঠানগুলির প্রয়ােজনে। রাসায়নিক শিল্প, পেট্রোকেমিক্যাল শিল্প, মূল ধাতু শিল্প অথবা বিদ্যৎ শিল্প – সর্বত্রই কাঁচামাল আসে বহুলাংশে বিদেশ থেকে। এই সব শিল্পে ন্যূনতম যে আমদানি করে থাকে পশ্চিম পাকিস্তান তা-ও ৬১ শতাংশ। সর্বোচ্চ পরিমাণ ৮৬ শতাংশ। প্রয়ােজনে বিদেশ থেকে কাঁচামাল আমদানির পাশাপাশি যেখানে সম্ভব পশ্চিম পাকিস্তান থেকেও কাঁচামাল আমদানি করে অনুরূপ ভাবেই শিল্প প্রতিষ্ঠার এবং শিল্পোৎপাদন বজায় রাখার সুব্যবস্থা পূর্বপাকিস্তানীরাও নিশ্চয়ই করতে সমর্থ হবেন। শিল্পজাত ভােগ্য পণ্য যে চড়া দামে আজ পূর্ব পাকিস্তানী জনসাধারণকে কিনতে হয় ঐ পশ্চিম পাকিস্তানী ব্যবসায়ীদের নিকট থেকে, কাঁচামাল আমদানি করা সত্ত্বেও নিজস্ব অঞ্চলে উৎপন্ন ভােগ্যপণ্য তার চেয়ে ঢের কম দামেই বিক্রীত হতে পারবে। আসলে কোন্ পণ্যের জন্য শিল্প কোন্ অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হবে তা ঐ পণ্যের বাজারের প্রসার দ্বারা নিরূপণ করা হয়। কাঁচামালের সহজলভ্যতা এখানে নির্ভরযােগ্য সূচক বা নিরিখ হতে পারে না। অর্থনৈতিক বিবেচনা থেকে একথা নিশ্চিত ভাবেই বলা চলে, পূর্ব পাকিস্তানে সিগারেট, বস্ত্র, দিয়াশলাই, চট, চর্ম, তণ্ডুল, চটিজুতা, উন্নত পর্যায়ের ইট এবং তাপসহ ধাতব পদার্থের উৎপাদনের জন্য সংশ্লিষ্ট শিল্পগুলির জন্য পূর্ব পাকিস্তান উপযুক্ত। (৪১)
মৈমনসিং-এর এক মহতী জনসভায় মুজিবর সহজ ব্যাখ্যা দিয়ে বুঝিয়েছিলেন করাচী, রাওয়ালপিণ্ডি এবং ইসলামাবাদ – পর পর তিনটি রাজধানীই স্থাপিত হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানের এলাকায়। সাধারণ সরকারী দপ্তরগুলি ছাড়াও সামরিক বিভাগের সদর দপ্তর গুলির প্রয়ােজনে যে বিপুল অর্থ লগ্নী করা হয়, যতাে সড়ক এবং অট্টালিকা নির্মাণ করা হয় এবং রাজধানীর সুবিধায় যতাে শিল্প আশে পাশে গড়ে ওঠে, তার সবটুকু উপকার পেয়েছে পশ্চিম পাকিস্তান। পূর্বপাকিস্তান স্বাধিকার পেলে অনুরূপ সুযােগ তারও সামনে আসবে। বিগত ১৮ বছরে পশ্চিম পাকিস্তানীরা পূর্ব পাকিস্তানকে যতাে শােষণ করেছে ২০০ বছরের ব্রিটিশরাজও ততাে করে নি – এই মন্তব্য করেন মুজিবর। পূর্ব পাকিস্তানে স্বাধীন অর্থনীতি এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ছয় দফা কর্মসূচি যে বিচ্ছিন্নতাবাদ নয়, একথা বলেও মুজিবর জোরের সঙ্গে বলেন, ‘অবশ্য আমরা ঐ সব কুৎসার জন্য প্রস্তুত আছি। পাকিস্তানের সৃষ্টিতে উল্লেখযােগ্য অবদান রেখেও যখন ফজলুল হক এবং সােহরাবর্দিকে অনুরূপ কুৎসা লাভ করতে হয়েছে, তখন কুৎসাকে মূল্য দেওয়া অর্থহীন।(৪২)
মুজিবরের ছয়দফা কর্মসূচি, পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য অনুরূপ আর্থরাজনীতিক স্বাধিকার চেয়েছিল। ফেডারেল প্রথামতাে একটি কেন্দ্রীয় পাকিস্তান সরকারের দুই অঙ্গ হয়েই এই দুই স্বায়ত্ত্বশাসনাধীন প্রদেশ বা অঞ্চলের অর্থ পশ্চিম বঙ্গপূর্ববঙ্গ মিলে নূতন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা নয়। এ প্রস্তাব মূলতঃ পূর্ব পাকিস্তানীদের বহুদিনের দাবিরই প্রতিরূপ। সব জেনে শুনে ইচ্ছাকৃত বিকৃতি ঘটিয়ে আয়ুব স্বয়ং মুজিবর পন্থীদের পশ্চিমবঙ্গ- পূর্ববঙ্গ একীকরণপন্থী তথা পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হবার রাজনীতি প্রচারক হিসাবে দেখাতে চাইলেন ১৬ই মার্চ থেকে ১৮ই এপ্রিল, ১৯৬৬ র মধ্যে অন্ততঃ ছয়টি ভাষণের প্রত্যেকটিতে। আয়ুব ব’লে চললেন, “ব্রিটিশ আমলে হিন্দুরা মুসলমানদের দাবিয়ে রেখেছে। কখনাে বললেন, ‘মুজিবের সার্বভৌম বঙ্গদেশ প্রবল ভারত সরকার বরদাস্ত করবে না – এ তার বৃথা আশা। আসলে সার্বভৌম বঙ্গদেশ মুজিবর দাবি করেন নি। সার্বভৌম পাকিস্তানের দুটি প্রদেশের জন্য দুই বিধির বদলে একই বিধি দাবি করেছিলেন। যা উভয় প্রদেশকে অনুরূপ ধাঁচের স্বায়ত্ত্বশাসনের অধিকার দেবে। ২০ শে মার্চ ঢাকার পল্টন ময়দানে মুজিবর এই সব কুৎসার জবাব দিয়ে বলেন, দেশের দুটি অঙ্গ সবল হলে দেশ দুর্বল হয় না। এই সঙ্গে ছয়দফা দাবি পুনর্বার তিনি জোরের সঙ্গে তুলে ধরেন এবং আয়ুবকে কুৎসা অভিযান বন্ধ করার পরামর্শ দেন। (৪৩)।
আয়ুব- আশ্রিতরা, যেমন মােনেম খান, ২৯ শে মার্চ এবং ১৮ ই এপ্রিল বক্তৃতা করেন, যুক্তফ্রন্টের ১৯৫৪-র ২১ দফা দাবিসনদ এবং তারই অংশবিশেষ মুজিবরের ৬ দফা কর্মসূচি জনসাধারণকে ধোঁকা দেওয়ার ছল। ১৯৬২ র সংবিধান পাকিস্তানের দুই অঙ্গের আর্থিক বৈষম্য দূরীকরণে অঙ্গীকারবদ্ধ। অতএব স্বায়ত্তশাসনের দাবি অমূলক। ১৮ই এপ্রিলের ভাষণে মােনেম খান তথ্যবিকৃতির চূড়ান্ত পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে দাবি করলেন, লাহাের প্রস্তাবে যে লেখা হয়েছিল ‘স্টেটস অব পাকিস্তান’ শব্দনিচয়, তা ছিল ছাপার ভুল। মুদ্রাকর- প্রমাদ শুধরে দিলেন তিনি নিজেই এই বলে যে ওটা হবে ‘স্টেট অব পাকিস্তান। অর্থাৎ মুজিবর কর্মসূচিতে ব্যাখ্যাত যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামাের ঐতিহাসিক সমর্থন, মমানেম ‘ছাপার ভুলে’র ধোঁকা দিয়ে কাটিয়ে দিলেন। কার্যতঃ তঞ্চকতার ধারে কাটে না কিছুই। বঞ্চনার ভারে দিনই কাটে না যার সে এই চটুল, তাৎক্ষণিক অনৃত ভাষণে কর্ণপাত করে না। আয়ুব এবং মােনেম যতােই প্রচার করলেন পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধিকার এসে যাবার কথা, জনসাধারণ ততােই আঁকড়ে ধরলেন তাঁদের অভিজ্ঞতালব্ধ বিশ্বাসভাজন পূর্ব পাকিস্তানী নেতাদের কার্যক্রমের মূলসুরটি যে, পূর্ব পাকিস্তান হয়ে আছে পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশ। ৫ই এপ্রিল পাকিস্তান অবসাভার’ লিখলাে, একটি বিন্দু থেকে যেখানে আইন, প্রশাসন প্রভৃতি সর্ববিধ ক্ষমতা বিকীর্ণ হয়, সেখানে আত্মনিয়ন্ত্রণ বা স্বাধিকার ঐ একটি মাত্র বিন্দুতেই অবস্থান করে। আর সেই সর্বগ্রাসী বিন্দুটি ছিল প্রেসিডেন্ট পদাধিকার। ২০ শে এপ্রিল ঐ সংবাদপত্রে সম্পাদকীয় মন্তব্যে আয়ুবের স্ববিরােধের ইঙ্গিত দিতে লেখা হ’ল – যে-আয়ুব রাজনীতিকে সর্বনাশের কারণ বলতেন আজ তিনিই একটি রাজনৈতিক দলের সদস্য। রাজনীতিক মাত্রেই ভিন্নমতের অস্তিত্ব স্বীকার করেন। করেন না শুধু আয়ুব। ভিন্নমতকে দেশদ্রোহিতা, বিশৃঙ্খলতা ইত্যাদি অপবাদ দিয়ে মুছে দিতে চান। অথাৎ রাজনীতিকের যেটুকু সততা এবং ন্যায়নিষ্ঠা থাকে আয়ুবের তা নেই। ২০ শে এপ্রিল পাকিস্তান অবসাভার সম্পাদকীয় প্রবন্ধে এই কথাগুলিই একটু মৃদু ঢঙে বলা হয়েছিল। সঙ্গে এ সব কুৎসা বন্ধ করতে আবেদন করাও হয়েছিল। (৪৪)
আয়ুব প্রচার করতেন পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন তত্ত্ব কিছু স্বার্থান্বেষী রাজনীতিকের মগজ-উদ্ভূত উদ্ভট কল্পনামাত্র। কিন্তু ১৯৬৬ র এপ্রিল এবং মে মাসে ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস, এবং লণ্ডনের ‘অবসাভার’ বা ‘টাইমস পত্রিকাগুলি স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানীদের আন্দোলনকে পূর্বের মতাে উপেক্ষা করতে পারলাে না। অবশ্য তারা এর অতি সরলীকরণ করে দেখাতে চাইলাে, ১৯৬৫ র সেপ্টেম্বরে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের দিনগুলাে ভারতের সম্ভাব্য আক্রমণের মুখে পূর্ব পাকিস্তানকে অরক্ষিত ফেলে রাখার প্রতিক্রিয়াতেই এই উদাসীন-কেন্দ্র-বিরােধী প্রাদেশিক স্বাধিকার সংগ্রাম শুরু হয়েছে। ভারত, চীনের পাল্টা আক্রমণের ভয়ে পূর্ব পাকিস্তানে হামলা করবে না জেনেই পূর্ব পাকিস্তানকে অরক্ষিত রাখা হয়েছিল — এমন একটা ধারণা ভূট্টো চেষ্টা করেও জনপ্রিয় করতে পারেন নি। প্রতিবেশী ভিয়েনামের যুদ্ধেই যে-চীন প্রত্যক্ষ ভাবে অংশ নেয় নি, তার সম্পর্কে ভুট্টোর কথা আজব। সেপ্টেম্বরে যুদ্ধারম্ভের দু’মাস পূর্বেই ১০ই জুলাই পূর্ব পাকিস্তানী সাংসদরা পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার স্বয়ংসম্পূর্ণতার দাবিতে চরম কথা বলেছিলেন। তাঁরা বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তাদের জন্মভূমিকে চরম অবহেলা করে অরক্ষিত রেখে দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্টপক্ষকে কোনােদিন ক্ষমা করবে না। এই সাংসদরা বলতেন, শাসকচক্রের যুক্তি অসার। পূর্ব পাকিস্তানে ভারত হামলা করলে পশ্চিম পাকিস্তানের নিকটবর্তী দিল্লি নাকি জয় করে নেওয়া হবে। তা ছাড়া আক্রান্ত পূর্ববঙ্গে চটজলদি সেনা পাঠানাে হবে। প্রথমটি অলীক। দ্বিতীয়টিও দুঃসাধ্য। এই দীর্ঘ পথ জলপথে বা বায়ুপথে অতিক্রম করে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যথাযথ করা যায় না। ছয়দফাকে যুদ্ধোত্তর দাবি বলে পশ্চিম দুনিয়ার সাংবাদিকরা ভুল করেছেন। প্রতিরক্ষার সমস্যা পূর্ব পাকিস্তানীরা যুদ্ধের অব্যবহিত পূর্বে জুলাই মাসেও যেমন তুলে ধরেছিলেন, যুদ্ধ যখন কল্পনাও করা যেত না সেদিনও ধরেছিলেন। (৪৫)
পাশ্চাত্ত্য সাংবাদিকরা পল্লব গ্রাহিতার দৃষ্টান্ত তুলে ধরলেও অপর একজন পাশ্চাত্ত্য পণ্ডিত ডঃ জন ই ওয়েন কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানীদের ক্ষোভের বাস্তবানুগ ব্যাখ্যা করেছিলেন। উঃ ওয়েন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৬০-৬৩ সালে জাতিসঙ্ঘের পক্ষে পরামর্শদাতা হিসাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত ছিলেন। হিন্দু পত্রিকায় তাঁর একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। লখনৌ এর ‘দি পাইওনিয়র পত্রিকা তার পুনর্মুদ্রণের ব্যবস্থা করে। ঐ প্রবন্ধে ডঃ ওয়েন লেখেন – সামরিক শক্তি বৃদ্ধিকেই অত্যধিক গুরুত্ব দিতে গিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থ ক্ষুন্ন করেছে আয়ুব প্রশাসন। পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় ঢের বেশি দরিদ্র এবং বঞ্চিত পূর্ব পাকিস্তান, স্বভাবতঃই সুবিধাপ্রাপ্ত অঙ্গের প্রতি বিরূপ হয়েছে। আয়ুবজমানার অস্তিত্বের ব্যাখ্যা তার সামরিক শক্তি। পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশমাত্র গণ্য করা হয় এই জমানায়। অনেক বাঙালী মুসলিম তাঁকে জানিয়েছেন তাঁরা ১৯৪৭ এর চেয়েও এখন পূর্ব পাকিস্তানকে অধিকতর দৈন্যক্লিষ্ট দেখছেন। ডঃ ওয়েনকে অপরপক্ষে পশ্চিম পাকিস্তানী বিশিষ্ট নাগরিকরা এমন কথাও বলেছেন, পাটের লাভজনক দিকটা আছে। তাই– নইলে ঐ পূর্ব পাকিস্তানকে আমরা পরিত্যাগ করতাম, ওদের মুখদর্শন করতাম না। দেশের ভিতরের সমস্যা থেকে নজর অন্যদিকে চালিত করা ছাড়া ১৯৬৫-র সেপ্টেম্বরে কাশ্মীর-যুদ্ধ বাধাবার আর কী কারণ ছিল আয়ুবের। একনায়কত্বের কর্ণধাররা বিদেশে যুদ্ধের ভেল্কি দেখিয়ে ঘরের সমস্যা ভুলিয়ে রাখতে চেষ্টা করেই থাকেন। প্রেসিডেন্ট ধাঁচের একনায়কত্ব-ই তাে আয়ুব প্রশাসনের স্বরূপ। এখানে সাংবাদিকের স্বাধীনতাও নেই। সামন্ততান্ত্রিক আতঙ্কবাদী এক চক্র এখানে সক্রিয়। সংখ্যালঘুদের অধিকার পদদলিত বলেই বিগত কুড়ি মাসের মধ্যে ১০ লক্ষ হিন্দু, বৌদ্ধ এবং খৃষ্টান পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠাকল্পে আন্দোলন করলে পূর্ব পাকিস্তানীদের উপর চলে ক্রমবর্ধমান অত্যাচার এবং নিপীড়ন। এই নিপীড়ন ভরসা করে। সরকার চালিয়ে আয়ুবপ্রশাসন ধরা পড়ে গেছে। সত্যই নিজের দেশের নাগরিককেই তার সব চেয়ে বেশি ভয় – এ সত্যই ধরা পড়েছে আয়ুবতন্ত্রের এই দমন পীড়নের প্রশাসনের মধ্যে।(৪৬)
১৯৬৬ র ২০ শে মার্চ ঢাকায় প্রথাবাদী মুসলিম লীগের সমাপ্তি পর্বের অধিবেশনে আয়ুব, বিশৃঙ্খলতা সৃষ্টি কারী স্বায়ত্তশাসন পন্থীদের অস্ত্রের সাহায্যে মােকাবিলার হুমকি দিলেন। ২০ শে ফেব্রুয়ারী ‘আজাদ পত্রিকাকে ২০ হাজার টাকা নিরাপত্তা দাদন হিসাবে। জমা দিতে আদেশ করা হ’ল। সরকার ঘেঁষা এই পত্রিকাকেও ছাড় দেওয়া হল না তার। একটিমাত্র অপরাধের কারণে। অপরাধটি ছিল মুজিবরের একটি বিবৃতি ছাপা। ছাত্র আন্দোলন অথবা অন্য যে সব রাজনৈতিক আন্দোলন পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ভুল বােঝাবুঝির সৃষ্টি করতে পারে সে-সব ছাপা চলবে না — এই আদেশ জারী হ’ল। ইত্তেফাক, সান্ধ্যপত্রিকা ‘আওয়াজ’ এবং ইংরেজি সাপ্তাহিক ‘ঢাকা টাইমস’ পত্রিকার উপরে। এই নিষেধাজ্ঞার সংবাদ ছাপা-ও নিষিদ্ধ হ’ল। এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবিতে পােষ্টার পড়লাে ঢাকা শহরে। যা ছাত্রদের কাজ বলে অনুমান করা চলে। একই সঙ্গে আওয়ামি লীগের সভাপতি মুজিবর সহ সর্বোচ্চ পর্যায়ের সকল নেতাকে গ্রেপ্তার করা হ’ল। ছয়-দফার দাবি উচ্চারণ করাও বলপ্রয়ােগে বন্ধ করতে বদ্ধপরিকর এই স্বৈরাচারী সরকারের কাছে আবেদন করে পূর্ব পাকিস্তানীরা যে কোনাে ফল পাবেন না, সেকথা ইত্তেফাকের ৫-ই জুন লেখা হ’ল। লেখক মােসাফির। (৪৭) |
১৩ই মে ‘সংবাদ’ লিখলাে, ‘মুজিবর এবং তাঁর সহযােগীদের গ্রেপ্তার করে সরকার বুঝিয়ে দিল ‘জরুরী অবস্থা’ কে বিরােধী রাজনীতিকদের দূর করতেই ব্যবহার করা হল তার অভিসন্ধি। নেতৃবৃন্দ কারারুদ্ধ হ’লেও ছয়দফার সমর্থনে ঢাকার পল্টন ময়দানে বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হ’ল। উদ্যোক্তা আওয়ামি লীগ। আওয়ামি লীগ এবং ছাত্র সম্প্রদায় সরকারের দমন নীতির প্রতিবাদে এবং মুজিবর প্রমুখ নেতৃবৃন্দের গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে ধিক্কার জানাতে ৭ই জুন রাজ্য জুড়ে সর্বাত্মক ধর্মঘট ডাকলেন। ৫ই জুন গভর্নর মােনেম খান নারায়ণ গঞ্জে হরতালের বিরুদ্ধে বক্তৃতা করতে গিয়ে স্বায়ত্তশাসনবাদীদের নিন্দা করা মাত্র সভার জনতা দলবদ্ধ ভাবে সভাস্থল ত্যাগ করেন। স্বায়ত্তশাসনের দাবির সমর্থনে শ্লোগানও দেওয়া হয় ঐ সভা চলাকালে। (৪৮)
৭ই জুনের হরতাল পূণাঙ্গ সাফল্যলাভ করে। হরতাল আহ্বায়কদের শােভাযাত্রা এবং সভা ভিন্ন রাজ্যের কোথাও অন্য কোনাে সরকারী বা বেসরকারী কার্যক্রম বা দপ্তর চালানাে সম্ভব হয় নি সেদিন। গুণ্ডাদের দিয়ে অশান্তি সৃষ্টি করে হরতাল সমর্থকদের উপরে গুলি চালানাের পিছনে সরকারের হাত ছিল এই ইঙ্গিত দিয়ে ঐ দিনেরই বিশেষ সান্ধ্য সংস্করণে ‘সংবাদ সরকারের নিন্দা করে। রাজনীতিতে পরাস্ত সরকার পশুবলের মাধ্যমে জিততে চাইছে। এই সত্যই বেরিয়ে পড়ে নিরস্ত্র প্রতিপক্ষকে গুলি করে শেষ করার প্রবৃত্তির মধ্যে। সংবাদে এমন কথাও লেখা হয়, এ সরকারের কাছে মানুষ জীর্ণ সম্মার্জনীর চেয়েও যেন তুচ্ছ। ক্ষীণতম প্রতিবাদের কণ্ঠ স্তব্ধ করতে এ সরকার করে লাঠি, গ্যাস, গুলির ব্যবহার করে গ্রেপ্তার চালিয়ে দেয় অত্যাচারের দুর্দম রথচক্র। পরবর্তী দিনের সংবাদ প্রকাশ করা হয় নি। হরতাল চলাকালে পৈশাচিক যে- আচরণ সরকারপক্ষ করেছে এবং ঐদিনের সংবাদ প্রকাশে যে নিষেধাজ্ঞা চাপিয়েছে তার প্রতিবাদেই ‘সংবাদ’ দৈনিকটির পরিচালকরা এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ৭ই জুনের ‘ইত্তেফাক, স্বায়ত্ত্ব শাসনবাদীদের বিরুদ্ধে যে সন্ত্রাস বা পীড়ন চলছে তার নিন্দা করলেও হরতাল সম্পর্কে কোনাে সংবাদ দেয় নি। ঐ দিনের ‘পাকিস্তান অবসাভার’ যে বিদ্রুপাত্মক সম্পাদকীয় রচনা করে, তার উদ্দেশ্য ধরতে পারলে আয়ুবপন্থীদের গায়ে ফোস্কা পড়তাে। কোন্ কোন্ জাতের আমের ঘুম পাড়ানাের গুণ কতােটা তার বিশ্লেষণ এই প্রবন্ধের পাশাপাশি কোথাও কোনাে খবর ছিল না হরতাল সম্পর্কে। (৪৯)
সফল হরতালে ক্ষিপ্ত সরকার ব্যাপক ধরপাকড় শুরু করলাে। থানার ভিতরে তাে বটেই, মাঝরাস্তায় মাঝরাতে বিচারের প্রহসনের পরে আটক করা শুরু হ’ল। গভর্নর মােনেমের হুমকি যে সত্য, সরকার যে আরাে বীভৎস নৃশংসতার পথ ধরবে স্বাধিকারপন্থীদের বিরুদ্ধে তা শীঘ্রই বােঝা গেল। মােসাফির ৯ই জুন খুবই তাৎপর্য পূর্ণ এক ইঙ্গিত দিয়ে লিখলেন, “ভাষা আন্দোলনের দাবি মেনে নিয়েছে ওরা পূর্ব পাকিস্তানীদের রক্ত ঝরার পরে। ১৭ থেকে ১৯ শে জুন পূর্ব পাকিস্তানীরা প্রতিবাদ দিবস পালন করেন। ১৬ ই জুনের ইত্তেফাকে’ ৭ই জুনের হরতালের সব তথ্য প্রকাশ করা হয়, যা করা সেদিন নিষিদ্ধ ছিল বলে করা যায় নি। ১৬-ই জুনের ইত্তেফাকের সকল সংখ্যা সরকার বাজেয়াপ্ত করে। ঐ দিনই রাত্রিতে ‘ইত্তেফাক দৈনিকের নির্ভীক সম্পাদক তােফাজ্জলকে নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার করা হয়। যে “নিউ নেশান প্রিন্টিং প্রেস থেকে ইত্তেফাক’, ‘ঢাকা টাইমস’ এবং চলচ্চিত্রের সাপ্তাহিক পূর্বাশা’ ছাপা হত তা বাজেয়াপ্ত হয়। ২০ শে জুন সংবাদপত্র এবং মুদ্রণ শিল্পের সমস্ত কর্মচারী এবং শ্রমিক ধর্মঘট পালন করেন। সংবাদ পত্র, সাংবাদিক এবং মুদ্রণ সংস্থার উপরে যথেচ্ছ অত্যাচারের এই ‘সরকারী অরাজকতা’র প্রতিবাদ করতেই এই ধর্মঘট ডাকা হয়েছিল। তােফাজ্জলকে ডি, পি, আর বা পাকিস্তানের নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার করার বিষয়টিও অবশ্যই এই ধর্মঘটের অন্যতম কারণ ছিল। সংবাদ পত্র জগতের রাজ্য জুড়ে এই ধর্মঘটের দিনে সরকারের পেটোয়া কিছু দৈনিক পুলিশ প্রহরায় ছাপা হয়। এই দৈনিক গুলি হল ‘আজাদ’, ‘দৈনিক পাকিস্তান এবং মনিং নিউজ’। খুবই সংক্ষিপ্ত সংস্করণ বের করা হয়েছিল সংবাদপত্র গুলির। কিন্তু সংবাদপত্রের ফেরীওয়ালারা ঐ সরকারসমর্থক পত্রিকাগুলাে বিক্রয় করা দূরের কথা, হাত দিয়ে স্পর্শ পর্যন্ত করে নি। ধর্মঘটী সাংবাদিক এবং সংবাদপত্র সেবীদের প্রতি তথা জনগণের অধিকারের প্রতি ফেরীওয়ালাদের এই মমত্ববােধ উচ্চ প্রশংসার দাবি করে। রাজ্যজুড়ে রাজনৈতিক চেতনা কতদূর বিকাশ লাভ করেছিল এই আশ্চর্য ঘটনা যেন তারই সংকেত। (৫০)
একটানা পীড়ন, আর্থিক চাপ এ সবের ফলে সংবাদপত্র গুলি এর পরে নরমপন্থী হ’তে বাধ্য হ’ল। স্বায়ত্তশাসন সমর্থক সম্পাদক জাহিদ এবং সম ভাবাপন্ন সংবাদিকদের সরিয়ে দিয়ে ‘জনতা’ আত্মরক্ষা করলাে। সংবাদ’ কলেরা, বন্যা এই সব সংবাদ দিয়ে কাগজ ভরতি করতাে। ১২ই জুলাই থেকে একটি ব্যক্তিগত মালিকানায় চলা ছাপাখানা থেকে ‘ইত্তেফাক’ এক পাতার কাগজ আকারে যাওবা বের হ’ত, ২৭ শে জুলাই থেকে তা-ও বন্ধ হ’ল। সরকারী অনুমােদন থেকে নবপর্যায়ের ইত্তেফাক’ বঞ্চিত হবার কারণে। ঐ তারিখের ‘আওয়াজ, ইত্তেফাক দৈনিকের অনুমােদন নামঞ্জুর করাকে নিন্দা করে। বলে, বর্তমান পাকিস্তান সরকারের আমলের চেয়ে ব্রিটিশ আমলেও দেশবাসীর স্বাধীনতা ছিল অনেক বেশি। ১৯৬৬ র ১১ই অগাস্ট ‘পাকিস্তান অবসা ভার’-এ সৈয়দ কামারুল আহসান লিখলেন, ভারত প্রশাসনে ব্রিটিশরা যেটুকু নৈতিকতার নিদর্শন রেখেছিলেন সেখানে পাকিস্তানী প্রশাসকরা এখনও পৌঁছাতে পারেন নি। ‘নিউ নেশান প্রিন্টিং প্রেস’ বাজেয়াপ্ত করার সরকারী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ঢাকা হাইকোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্টের রায় সরকার স্বৈরাচারের চূড়ান্ত ব্যভিচারের পথে অগ্রাহ্য করে। নিরাপত্তা আইনের সুযােগে সুপ্রিম কোর্টের রায় অগ্রাহ্য করার ক্ষমতাকে আইনসিদ্ধ করে নেয়। যে-তড়িঘড়ি উপায়ে এটি করা তা এক তাজ্জব ব্যাপার। (৫১)
অগাস্টের গােড়ার দিকে ছয়দিনের সফরে ঢাকায় এসে স্বায়ত্তশাসনবাদীদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘােষণা করলেন আয়ুব খান। হাজার আন্দোলন কারীকে জেলে পুরে দিয়ে তারপরেও আয়ুব এই উক্তি করলেন যে, এ হ’ল মুষ্টিমেয় লােকের আন্দোলন এবং বড়ই দায়িত্বজ্ঞানহীন তারা। এদিকে কারান্তরালে অবস্থিত নেতা-কর্মীদের পরিবার-পরিজনের সংসার নির্বাহ করাই দুঃসাধ্য হয়ে পড়লাে। প্রায় উপােস করে দিন কাটাতে হবে – এমন অবস্থা এসে গেল অনেক ক্ষেত্রে। ৭ই অগাস্টের আগে-পরে যে ব্যাপক ধরপাকড় হয়, তার পুনরাবৃত্তি হলে স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন আরাে ঝিমিয়ে পড়বে। জঙ্গী কার্যক্রমের বদলে তাই আওয়ামি লীগ গণস্বাক্ষর অভিযানের সিদ্ধান্ত নিল। নিতান্ত নিস্তেজ হয়ে পড়া আন্দোলনের সময়ও আওয়ামি লীগকে ১৬ই অগাস জনসভা করার অনুমতি দিল না সরকার।(৫২)
নরমপন্থী আন্দোলনও আংশিক কার্যকারিতা পেতে পারে সকল আন্দোলনকারী ঐক্যবদ্ধ হলে। জমাত-ই-ইসলাম এবং কাউনসিলরস মুসলিম লীগ ঠিক ছয়-দফা মেনে নিলেও এবং প্রথমােক্ত দল ১৯৬৬-র জুন মাসে স্বায়ত্তশাসন-আন্দোলনে যােগ দিলেও, মমাটের উপর পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যার সমাধানে ছয়-দফার অধিকাংশ কার্য সূচির সঙ্গে এই সব দলের বড় কোনাে মতভেদ ছিল না। তবে সম্পূর্ণ স্বাধীন অর্থনীতির দাবি পর্যন্ত। অনেকে যেতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। নুরুল আমিনের বাড়িতে বিভিন্ন দলীয় নেতাদের এক বৈঠকে যুক্ত কর্মসূচি প্রস্তুত করার উদ্দেশ্যে আলােচনা বেশ ফলপ্রসু হয়। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাকল্পে এইরূপ আলােচনা আরাে চলবে একথা ঐ বৈঠকের পরে জানানাে হয়।(৫৩)
৭ই জুনের হরতালে কিংবা তার পরিণামে মৌলানা ভাসানী এবং তাঁর অনুগামী ন্যাপপন্থীরা সম্পূর্ণ অসহযােগিতা এবং ঔদাসীন্য দেখালেও, ভাসানী স্বায়ত্তশাসন সমর্থক হিসাবে নিজেকে চিহ্নিত করলেন। ঐ উদ্দেশ্যেও তিনি আওয়ামি লীগের সঙ্গে হাত মেলাবেন না একথাও বলতে দ্বিধা করলেন না। কাগমারির সম্মেলনের আমল থেকেই তিনি মুজিবরের বিরােধী – শুধু এটুকু বললে যথেষ্ট হবে না। ভাসানি আসলে আয়ুবের প্রশ্রয়ে প্রীত হয়েছেন এখন। চীনপন্থী বলে পরিচিত ভাসানির চীনভক্ত সহকর্মীদের আয়ুব জেল থেকে মুক্তিও দিলেন এই সময়। চীনের আনুকূল্য লাভ করে আয়ুব এটুকু করতে বাধ্য ছিলেন। ভাসানির ন্যাপ দলের শ্রমিকরাও যখন মুজিবরপন্থীদের ডাকা ৭ই জুনের হরতালে দলে-দলে যােগ দিলেন, ন্যাপ এবং ভাসানি স্বয়ং হকচকিয়ে গিয়ে স্বায়ত্তশাসনের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করলেন। কিন্তু মুজিবরের ছয় দফা মানবেন না এটুকু যােগ করতে ভাসানির ভুল হ’ল না। যাই হােক ১৪-দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে ১৪ই অগাস্ট ন্যাপ তার আন্দোলন শুরু করে। আয়ুবের মুসলিম লীগ ঐদিন জাতীয় সংহতি দিবস হিসাবে পালন করতে গিয়ে জনসমর্থন আদৌ পায় নি। অন্যদিকে ন্যাপ যথেষ্ট জনসমর্থন লাভ করেছিল। (৫৪)
আওয়ামি লীগ নেতা সব জেলে। ন্যাপ নেতারা মুক্ত। এই সুযােগে স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের চালকের আসনে দেখা গেল ন্যাপকে। ৪ঠা সেপ্টেম্বর তদানীনন্তন বন্যার ত্রাণকার্যের দাবিতে এক দাবি দিবস পালন করে ন্যাপ। রাজবন্দীদের মুক্তির দাবিও করে।
২রা এপ্রিল, ১৯৬৭ ফের দাবিদিবস পালিত হল। এবারে ছিল প্রায়-দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি। ঐ বন্যার পরিণামেই এই খাদ্যাভাব। ২রা এপ্রিলের দাবিদিবসে চাকুরী এবং বর্ধিত মজুরির দাবিও ছিল। কাজেই ন্যাপের সর্বস্তরের কর্মী এবং নেতার সঙ্গে ছাত্র-শ্রমিক নেতা এবং বহু শিক্ষকও কারারুদ্ধ হলেন এই সময়। ন্যাপের সহ-সভাপতি দানেশ এবং সাধারণ সম্পাদক হুসেইনকে গ্রেপ্তার করা হল। চীন-পন্থী নয় এমন ন্যাপ সদস্যদের সমর্থক ‘সং বাদ’ ২৫ শে মে, ১৯৬৭ থেকে তার প্রকাশনা বন্ধ করতে বাধ্য হ’ল। পূর্বতন সম্পাদক পদত্যাগ করলে নূতন সম্পাদকের নিয়ােগ হয় সংবাদ পত্রিকায়। সরকার নূতন পরিস্থিতিতে অনুমােদন প্রত্যাহার করে পত্রিকাটি স্তব্ধ করে দিল। পরিকল্পিতভাবে একের পর এক বিরােধী সংবাদপত্র উৎখাত করে চললাে সরকার পক্ষ। (৫৫)
১৯৬৭ র ৩০ শে এপ্রিল, এন, ডি, এফ নেতা আতাউর রহমানের বাসভবনে আওয়ামি লীগ, কাউনসিলরস মুসলিম লীগ, জমাত-ই-ইসলাম, নিজাম-ই- ইসলাম এবং এন, ডি, এফ প্রতিনিধিরা ৮ – দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে পি, ডি, এম নামে এক পাকিস্তানী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ফ্রন্ট গঠন করেন। ১৯৫৬ র সংবিধান ফিরিয়ে আনা এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামাের তথা প্রত্যক্ষ এবং প্রাপ্তবয়স্ক মাত্রের ভােটাধিকার দাবির সঙ্গে পাকিস্তানের উভয় অঙ্গের মধ্যে সর্বাঙ্গীণ সমতার দাবি করা হয়। স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে ছয়দফার মতাে অর্থনৈতিক স্বাতন্ত্র্য দাবি ছিল না। পরিবর্তে কেন্দ্রীয় বিষয় গুলি অথাৎ মুদ্রা, ব্যাঙ্ক, বৈদেশিক মুদ্রা এবং দেশের দুই অঙ্গের মধ্যে অন্তর্বানিজ্য তথা যােগাযােগ পরিচালন এবং পর্যবেক্ষণের জন্য পৃথক পৃথক বাের্ডের প্রস্তাব করা হ’ল। প্রত্যেক বাের্ডে পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানী সদস্য সংখ্যা সমান থাকবে – এ প্রস্তাবও ছিল। ন্যাপ এই ফ্রন্টে যােগ দেয় নি। নেতারা তাদের জেলে তাই মার্কিন চক্রান্তে সৃষ্ট এই ফ্রন্টে তারা যােগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারে নি—এই হাস্যকর চপলােক্তি সত্ত্বেও এটা পরিষ্কার হয়ে গেল যে, তারা আয়ুবকে চটাতে চায় না। (৫৬)
বিরােধী ঐক্যের অভাবে এই স্তিমিত আন্দোলনে কাজের কাজ কিছু না হলেও লােক-দেখানাে অর্থে ঢাকাকে পাকিস্তানের দ্বিতীয় রাজধানী হিসাবে জাহির করতে বেশ কিছু ইমারত গড়া হল। নূতন নূতন অট্টালিকা শােভিত এলাকার নাম দেওয়া হ’ল আয়ুব নগর। সরকারী দপ্তরগুলােও এল না। সে সবে পূর্ব পাকিস্তানীদের নিয়ােগ করাও হ’ল না। এই প্রতীকী সমতার প্রয়াস সরকারের দমননীতির পাশাপাশি একটি ভণ্ডামির নিদর্শন বই কিছু ছিল না। পূর্ব পাকিস্তানের মূল দাবিগুলির কোনােটি, এমন কি ভাষা-সংস্কৃতির সমস্যার কোনাে সমাধান হ’ল না। ধাপ্পাবাজির চরম নিদর্শন দিয়েছিলেন যােগাযােগ মন্ত্রী সাবুর যিনি ঢাকায় দুটি বন্দুক কারখানার কথা এমন কি একটিতে উৎপাদন চালু হয়ে। গেছে এমন কথা বলেছিলেন ১০ই এপ্রিল ঢাকায় এসে। সংসদে প্রতিরক্ষা সচিবের উক্তি অনুসারে ঐ কারখানা ভবিষ্যতে হবে। এই উক্তির ২৬ দিন পরেই সাবুরের উক্তি। ১২ই এপ্রিল ‘ইত্তেফাক’ এই নিয়ে প্রশ্ন তােলে। ঐ দিন ‘আজাদ’ লেখে, ‘সাংবাদিকদের কারখানার কাজ দেখিয়ে সন্দেহ দূর করা হােক।’ (৫৭)।
অতি স্বল্প সংখ্যক পাকিস্তানীর মাতৃভাষা উর্দুকে পাকিস্তানী ভাষা শিরােপা দেবার প্রস্তাব করে বসলেন কেন্দ্রীয় উর্দুবাের্ডের সভাপতি। ১৯৬৬ র ২৬ শে অগাস্ট এই অদ্ভুত প্রস্তাব উত্থাপিত হলে ‘সংবাদ পত্রিকা লিখলাে, এ হ’ল বাঙলা ভাষা এবং বাঙালীকে হিন্দুজাতির ব্যাপার হিসাবে দেখানাের পুরানাে খেলা।’ রবীন্দ্র সঙ্গীত উভয় বঙ্গেই জনপ্রিয়। ১৯৬৭ র জুনে যে রেডিও পাকিস্তানকে আদেশ করা হ’ল রবীন্দ্র সঙ্গীত প্রচার বন্ধ করতে তার মূলে সামরিক শাসকদের ঐ অমূলক ভীতি। দুই বাঙলার যােগসূত্র খতম করলে ওদের কী যে বিপদ হত ওরাই জানে। (৫৮)।
‘পাকিস্তান অবসাভার’ ১৯৬৬ র ৫ই সেপ্টেম্বর একটি সংবাদ প্রকাশ করলাে। সংসদে সরকার পক্ষ জানিয়েছিল ন্যাশানাল শিপিং করপােরেশনের ৫ লাখ টাকার শেয়ার মূলতঃ পূর্ব পাকিস্তানের গরিবদের ক্রয় করার সুযােগ দেওয়া হবে। ৫ই সেপ্টেম্বর ঐ শেয়ার ক্রয় করতে হত। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের ব্যাঙ্কে সংশ্লিষ্ট ফর্ম ৩রা সেপ্টেম্বরের আগে পৌছায় নি। ঢাকাতেই এই অবস্থা ছিল। মফঃস্বলের কথা বলাই বাহুল্য। অথাৎ পূর্ব পাকিস্তানীদের ঐ শেয়ার কেনা থেকে সম্পূর্ণ দূরে রাখা হ’ল। কারসাজির এ ছিল এক বড় প্রমাণ। (৫৯)
পশ্চিম পাকিস্তানী রাজনীতিকরা ব্যক্তিগত স্বার্থে রাজনৈতিক ক্ষমতা তুলে দিয়েছিলেন সমরবিভাগের এবং প্রশাসনের হাতে। পূর্ব বাঙলার স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের দুই শীর্ষ নেতা মুজিবর এবং তােফাজ্জলকে প্রলােভন দিয়ে আন্দোলন বিমুখ করতে ব্যর্থ হয়েছিল শাসকচক্র। (৬০) আন্দোলনের পক্ষে নেতৃত্বের এই নিষ্ঠা ছিল একটি প্রধান শক্তি। অবশ্য চাকুরীর টোপ গিলে অনেক ছাত্রনেতাই আন্দোলনের পথ থেকে সরে দাঁড়ায় এ সময়। তথাপি জনজাগরণের সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক অনিবার্যতা নিয়ে যে আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়েছিল, নিছক পাশব বলের জোরে তাকে স্তব্ধ করতে গেলে প্রতিক্রিয়া সহজেই অনুমেয়। বিশেষতঃ পাকিস্তানের জন্মের এতদিন পরে পূর্ব পাকিস্তানেও জেগে উঠেছিল যে মুসলিম মধ্যশ্রেণী আন্দোলনের পুরােভাগে তারই তাে আসার কথা। (৬১)
আবুল মনসুর ১৯৫৬ র ২২ শে মার্চ সংসদে বলেছিলেন – সংবিধান চালু হবার পূর্বে যারা পূর্ব পাকিস্তানকে শােষণ করতাে আজ তারা সংবিধানের নামে ঐ শােষণ বজায় রাখছে। ভৌগােলিক ব্যবধান, সমুদ্রের ফারাক অগ্রাহ্য করে আমেরিকাকে যে চোখে দেখতাে ইংরেজরা, এডমণ্ড বার্ক তা শুধরে নিতে বললেও কেউ তাঁর কথা মানে নি। আমেরিকার জনগণের কথা মেনে নিতে কিন্তু সবাই বাধ্য হয়েছিল। ভূগােলের সত্য। অস্বীকার যে করবে ইতিহাস তাকে ক্ষমা করবে না। এর প্রায় দশবছর পরে নুরুল ইসলাম বলেছিলেন — যদি পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায্য অধিকার না মানা হয়, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মুখে হয়তাে পাকিস্তান সরকার শুনবে বিদায় সম্ভাষণ। অধ্যাপক রুপার্ট এমার্সনের কথায়, “যে-কোন কিছু দাঁড় করানাের ব্যাপারে উতরে গেলে শুধু সেই কারণেই জাতিসত্তা প্রতিপন্ন হয়। অন্ততঃ পাকিস্তানের ক্ষেত্রে তাই হয়েছে। অনুরূপে পূর্ব পাকিস্তান যদি আজ পৃথক জাতি হিসাবে বেরিয়ে আসে তত্ত্বগত ভাবে তার বিরােধিতা করার কিছু নেই। (৬২)।
ব্যাপক ভাবে আগ্নেয়াস্ত্র এবং কয়েদখানার যথেচ্ছ ব্যবহারে গণদাবির সমাধি রচনায় তৎপর এই আয়ুবতন্ত্র। পূর্ব পাকিস্তানের আর্থ-সাংস্কৃতিক মুক্তিসংগ্রামের লক্ষ্য কিংবা বলিষ্ঠ জাতীয়তাবােধের উদ্ভবের মাধ্যমে পাকিস্তানের দুই অঙ্গের স্বতঃপ্রণােদিত মিলনের দিন আজো যেন দূরেই রয়ে গেল।
আয়ুবরাজ বাহুবলের জোরে টিকে আছে। শক্তির কেন্দ্রভূমিতে অবস্থান করছেন পশ্চিম পাকিস্তানী সমরনায়কগােষ্ঠী এবং অসামরিক প্রশাসনের শীর্ষব্যক্তিবর্গ। তাঁদের কেউ কেউ আয়ুবের মতােই পুরাদস্তুর রাজনীতিকে রূপান্তরিত হয়েছেন। এই শাসকগােষ্ঠী দেশের উভয় অঙ্গের পেটোয়া রাজনীতিকদের সহায়তায় পূর্ব পাকিস্তানে এক ঔপনিবেশিক শাসনের জগদ্দল পাথর চাপিয়েছে। তার অনিবার্য পরিণামে সেখানে বিরাজ করছে এক চরম নৈরাশ্য। রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি – সর্বত্র একই বঞ্চনার হাহাকার। এই উপনিবেশবাদ চালিয়ে যাবার স্বপক্ষে যে চিরাচরিত অজুহাত দেখানাে হচ্ছে তার কথা উপনিবেশবাদের গবেষকমাত্রেরই জানা আছে। বলা হচ্ছে, স্বায়ত্তশাসনের যথাযথ প্রয়ােগের যােগ্যতাই নেই পূর্ব পাকিস্তানীদের। মুষ্টিমেয় বিপথগামী লােকের এই দাবির পিছনে শত্রুদেশগুলির মদত আছে। অবশ্য এই দাবির যৌক্তিকতার স্বপক্ষে বিস্তর তথ্য প্রমাণ সন্নিবিষ্ট হয়েছে এই গ্রন্থের পাতায় পাতায়। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়ােজন বর্তমান গ্রন্থলেখক পদার অন্তরালের বিশিষ্ট সাক্ষীসাবুদের সহায়তা লাভ করেছেন। সেই বিশিষ্ট এবং সাধারণ ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে সাক্ষাৎকার গৃহীত হয়েছিল তাঁদের পরিচয় অপ্রকাশিত রাখার শর্তে। তা ছাড়া বহুলাংশে অবহেলিত বাঙলা সংবাদ পত্র পত্রিকা এবং ‘ বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন শিরোনামাক্লিষ্ট সংসদীয় বিতর্কের অপ্রকাশিত অংশাদি এ গ্রন্থের তথ্যসূত্রের অন্তর্গত। বর্তমান বিষয়বস্তুর উপরে গ্রন্থরচনার ক্ষেত্রে পূর্বতন গ্রন্থকাররা সংসদীয় বিতর্কের অসম্পূর্ণ তথা অপ্রতুল উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছেন। প্রাগুক্ত বাঙলা সংবাদপত্রাদির ব্যবহারও যথেষ্ট ছিল না সে সব গ্রন্থে।
সন্ত্রাসের বল্গাহীন অপপ্রয়ােগ, যােগাযােগ মাধ্যমগুলির উপর একপেশে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে যে আবহাওয়া সৃষ্টি করেছে এই শাসনযন্ত্র, তার পেষণে থেকে নিকট ভবিষ্যতে পূর্ব পাকিস্তানীদের অভীপ্সা পূর্ণ হবে – এমন কথা বলা দুরূহ। সামরিক একনায়কতন্ত্রের মােকাবিলায় বলপ্রয়ােগের প্রয়ােজন হলেও সুযােগ নেই। গােপন
১২৫
অস্ত্রাগারের বন্দোবস্তও সম্ভব নয়। প্রতিবেশী কোনাে দেশও এখন পর্যন্ত প্রয়ােজনে অস্ত্রের যােগান দেবে – এমন আভাস নেই। মৌল মানবিক অধিকার পদদলিত হলে নীরব দর্শকের ভূমিকা গ্রহণে অভ্যস্ত জাতিসঙ্খ-ও পূর্ব পাকিস্তানে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করবে – এমন আশা করা যায় না। কেন না, বৃহৎ শক্তিদের হস্তক্ষেপ অসম্ভব না হলেও অবাঞ্ছিত। বৃহৎ শক্তিদের ঘাত-প্রতিঘাতে পূর্ব পাকিস্তান দ্বিতীয় ভিয়েনামে পরিণত হতে পারে সেক্ষেত্রে। বরং পশ্চিম পাকিস্তানীদের মধ্যেই সুস্থ গণতান্ত্রিক চেতনার উন্মেষ ঘটলে পূর্ব পাকিস্তানীদের বাসনা চরিতার্থতা পেতে পারে। কারণ সেক্ষেত্রে তাদের অভীপ্সা পুরণের পথে যা কিছু অন্তরায় তারই তাে অপনােদন হবে। এই মুহূর্তে সেই শুভ পরিস্থিতির প্রতীক্ষা করাই পূর্ব পাকিস্তানীদের পক্ষে বাঞ্ছনীয় মনে হয়।
References:
1. G. W. CHOUDHURY, Democracy in Pakistan, pp. 242-43. NAP Debates, 13 August 1964, Vol. III, No. 12, p. 769.
2. G. W. CHOUDHURY, n. 1, p. 242. Ittefaq 29, 30 August 1964. Janata, 23 December 1964.
3. NAP Debates, 18 June 1962, Vol. I, No. 4, p. 109. NAP Debates, 12 June 1963, Vol. II, No. 7, pp. 353-54, 367. NAP Debates, 15 June 1963, Vol. II, No. 10, pp. 537-38. NAP Debates, 15 June 1964, Vol. II, No. 12, pp. 744-45. KHALID B. SAYEED, “Pakistan’s Constitutional Autocracy”, Pacific Affairs, Winter 1963-64, p. 372.
4. NAP Debates, 13 June 1963, Vol. II, No. 8, p. 404. NAP Debates, 14 June 1963, Vol. II, No. 9, p. 479. NAP Debates, 17 June 1963, Vol. II, No. 11, pp. 577-78. Ittefaq, 17 June 1964. NAP Debates, 17 June 1965, Vol. II, No. 3, pp. 186-87.
5. Ittefaq, 22 March 1964. ASGAR ALI, “Eleven years of the Ganges-Kabodak Project”, Janata, 28 October 1964. An Evaluation of the Rural Public Works Programme East Pakistan 1962-63, by an Evaluation Team (Comilla, East Pakistan, Pakistan Academy for Rural Development, 1963), pp. 3, 110-12.
6. Janata, 21 October 1964. Pakistan Observer, 14 March 1966. 7. NAP Debates, 17 June 1963, Vol. II, No. 11, p. 565.
8. NAP Debates, 1 August 1963, Vol. II, No. 39, pp. 2438-39, 2443, 2446, 2449, 2451-52.
9. Pakistan Observer, 18, 19 March 1966. NAP Debates, 17 June 1965, Vol. II, No. 3, p. 163.
10, Pakistan Observer, 24, 27 April 1966.
11. NAP Debates, 15 June 1963, Vol. II, No. 10, pp. 536-38.
12. Ittefaq, 9 March 1964. NAP Debates, 18 June 1963, Vol. II. No. 12, p. 662
13. NAP Debates, 27 June 1964, Vol. II, No. 24, pp. 1996-97. NAP Debates, 17 June 1963, Vol. II, No. 11, pp. 556-57. 14. Janata, 28 October 1964. 15. Ittefaq, 28 February 1964.
16. NAP Debates, 27 June 1964, Vol. II, No. 24, p. 2004. The Times of India, 6 December 1965. Azad, 14 May 1966. Sangbad, 20, 21 May 1966.
17. NAP Debates, 12 June 1963, Vol. II, No. 7, pp. 334-35.Ittefaq, 23, 25 February, 5, 12, 13 March 1964. REHMAN SOBHAN, “The Problem of Regional Imbalance in the Economic Dvelopment of Pakistan”, Asian Survey, July 1962, p. 36.
18. Sangbad, 25, 29 June, 22 July 1966. Compass, 10 September 1966, pp. 984-86.
19. NAP Debates, 13 August 1964, Vol. III, No. 12, pp. 772-73. 20. Ibid. 21. Ittefaq, 2, 3, 4, 5 August 1964. Janata, 21 October, 4, 25 November 1964.
22. Ibid., 5 May 1965. Provatee (Weekly, Chittagong), 7 May 1965. Ittefaq, 10, 19, 21, 28, 29, 30 May 1965. The Pakistan Times, 19, 28 May 1965. Compass, 29 May 1965, pp. 16-17.
23. NAP Debates, 17 June 1965, Vol. II, No. 3, pp. 184-85, 193-94. NAP Debates, 21 June 1965, Vol. II, No. 6, pp. 300-01, 312, 359. NAP Debates, 22 June 1965, Vol. II, No. 7, pp. 416, 420-21, 422-24. Ittefaq, 23, 24 June 1965. Purbodesh, 27 June 1965.
24. Ittefaq, 3, 14, 19, 22 August 1965. Azad, 24, 25 August 1965. Sangbad, 14, 22 August 1965. 25. Ittefaq, 28, 30 August 1965. The Patriot, 3 August 1965. 26. Pakistan Observer, 4, 5, 7 August 1965. Ittefaq, 6 August 1965. Sangbad, 6, 9, August 1965.
27. S. P. CHATTERJEE, Bengal in Maps (Calcutta, Orient Longmans, 1949), pp. 10-11. ASIT BHATTACHARYA, “The Farakka Barrage and East Bengal”, Compass, 24 July 1965, pp. 14-15. The Times of India, 4 August 1965. Azad, 4, 9, August 1965. Ittefaq, 8, 16 August 1965. The Morning News (Dacca), 9 August 1965.
28. Pakistan Observer, 4, 5 August 1965. Ittefaq, 7, 29 August, 3 September 1965. Sangbad, 7, 29 August, 2 September 1965.
29. Ittefaq, 9, 24 August, 3, 4 September 1965.
30. NAP Debates, 19 November 1965, Vol. III, No. 4, pp. 205, 21011, 235-36, 243-44, 257-58.
31. Ittefaq, Sangbad, Pakistan Observer, 22, 23 October 1965. The Bombay Chronicle (Bombay), 28 October 1965. The Amrita Bazar Patrika, 29 October 1965. The Patriot, 3 November 1965. Ittefaq, Sangbad, 10 February 1966.
32. Ittefaq, Sangbad, 1, 2 November 1965. The Patriot, 3, 28, 29 November 1965. The Times of India, 4 November 1965.
33. Azad, 11, 15, 18 January 1966. Ittefaq, 11, 16, 18 January, 5 February 1966. Sangbad, 11, 12, 14, 16, 18, 22 January, 6 February 1966.
34. Azad, 3 February 1966. Ittefaq, 3, 6, 10, 12 February 1966. Sangbad, 4, 9, 10 February 1966.
35. Pakistan Observer, 4 February 1966. Sangbad, 6 February 1966.
36. Ittefaq, 22 January, 3, 14 February 1966. Sangbad, 20, 21 January, 17, 27 February 1966. Pakistan Observer, 6, 20 February 1966.
37. Azad, Ittefaq, Sangbad-For the week 14-20 February 1966. Dacca Times, 21 February 1966. Ittefaq, 21 February 1966.
38. Ibid., 27, 28 February 1966. SHAIKH MUJIBUR RAHMAN, Amader Banchbar Dabi (Dacca, 1966); ABUL KALAM AZAD, Pakistaner Ancholik Boishamyo (Dacca, 1966); both in Bengali.
39. GUNNAR MYRDAL, Development And Under-Development (Cairo, National Bank of Egypt, Fiftieth Anniversary Commemoration Lectures, 1956), pp. 53-55. NAP Debates, 12 June 1963, Vol. II, No. 7, p. 367. Ibid., 19 June 1963, Vol. II, No. 13, pp. 705-6. NAP Debates, 17 June 1965, Vol. II, No. 3, pp. 184-85.
40. MYRDAL, n. 39, pp. 27-31. K. L. SETH, The Pattern of Economic Development in Pakistan (Ph. D. Dissertation, Indian School of International Studies, New Delhi, 1965), pp. 198-99. NAP Debates, 13 August 1964, Vol. III, No. 12, pp. 771, 775. J. C. EDDISON, “Industrial Location and Physical Planning in Pakistan”, The Pakistan Development Review, Spring 1961, pp. 2-3. REHMAN SOBHAN, “The Problem of
Regional Imbalance in the Economic Development of Pakistan”, Asian Survey, Berkeley, July 1962, pp. 35-36.
41. SETH, n, 40, pp. 200-21. NURUL ISLAM, “Some Aspects of Interwing Trade and Terms of Trade in Pakistan”, The Pakistan Development Review, Spring 1963, pp. 3-5.
42. Ittefaq, 4, 12 March 1966. 43. Pakistan Observer, 17, 19, 20, 21 March, 4, 19 April 1966. Ittefaq, 1 April 1966.
44. Pakistan Observer, 5, 19, 20 April 1966. 45. Ittefaq, 16 March 1966. Pakistan Observer, 4 April 1966. The New York Times, 21, 24 April 1966. The Observer (London), 24 April 1966. The Times (London), 17 May 1966. NAP Debates, 22 June 1965, Vol. II, No. 7, pp. 420-21. NAP Debates, 10 July 1965, Vol. II, No. 17, pp. 1264, 1273, 1278.
46. JOHN E. OWEN, “Frustrations of East Pakistanis”, The Pioneer (Lucknow), 14 November 1965.
47. Azad, 20, 26, 27 February 1966. Dacca Bengali Press reports, 1-15 April 1966. Ittefaq, 5 June 1966. Pakistan Observer, 5 June 1966.
48. Ittefaq, 13, 15 May 1966. Sangbad, 13 May 1966. Dacca Times, 27 May 1966.
49. Ittefaq, 7 June 1966. Pakistan Observer, 8 June 1966. Sangbad, 7 June 1966.
50. Ittefaq, 9 June 1966. Pakistan Observer, 16, 22 June 1966. Sangbad, 16-22 June 1966.
51. Pakistan Observer, 22 June, 10, 11 August, 16, 17 November 1966. Awaz, 12, 27 July 1966.
52. Pakistan Observer, 7, 8, 17 August 1966. The Pakistan Times, 13 June 1966.
53. GHULAM AZAM, Purbo Pakistaner Mukti Kon Pathey (i.e., Which Way Lies the Emancipation of East Pakistan), Dacca, 1966. Azad, 1 August 1966. Sangbad, 1 August 1966. 54.The Patriot, 4, 5 December 1965. Sangbad, 19, 20 July, 14, 15 August 1966.
55. Sangbad, 2, 3, 4, 5 September 1966 ; 1, 2, 3 25 April 1967. Pakistan Observer, 25 May 1967.
56. Sangbad, 1, 2 May 1967. 57. Azad, 11, 12 April 1966. Ittefaq, 12 April 1966. 58. Sangbad, 26 August 1966. Jugantar, 29, 30 June 1967. 59. Pakistan Observer, 5 September 1966. 60. Interviews. 61. P. C. LAHIRY, Letter to the author, dated 20 July 1966. BROJOMADHAB DAS, Letter to the author, dated 22 August 1966. Mr.Das was a member of the provincial legislature of East Pakistan during 1947-58, and came to India a few days before the outbreak of hostilities in September 1965.
62. Speech by ABUL MANSUR AHMAD, CAP (Legislature) Debates, 22 March 1956, Vol. I, No. 7, pp. 361-62. Speech by A. B. M. NURUL ISLAM, NAP Debates, 10 July 1965, Vol. II, No. 17, p. 1278. RUPERT EMERSON, From Empire to Nation (Boston, Beacon Press, 1962), p. 92.
63. গনতন্ত্র এবং জাতীয়তার অগ্নিপরীক্ষা – জয়ন্তকুমার রায়, pp 101-126
স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধীনতা
১৯৬৮ সালে প্রকাশিত পুস্তকটিতে ষষ্ঠ অধ্যায় ছিল সর্বশেষ অধ্যায়। ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত এই ভাষান্তরে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশের পূর্ববর্তী কয়েক বৎসরের ঘটনাবলী ও পরিপ্রেক্ষিত অতিসংক্ষেপে সংযােজিত হওয়া যুক্তিযুক্ত (তাই এই পরিশিষ্ট)।
শেখ মুজিবর রহমান গ্রেফতার হন ১৯৬৬ সালের মে মাসে। তার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহের অভিযােগ আনা হয়। এই অভিযােগ সত্ত্বেও তিনি জামিনে মুক্তিলাভ করেন। তখন তাকে জননিরাপত্তা আইনে আটক করা হয়। কারাগারের অভ্যন্তরে মুজিবরের বিচার অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকচক্র সাংবাদিকদের বিচারকক্ষে উপস্থিতির অনুমােদন দেয়। বিচারসভার কার্যাবলী সংবাদপত্রে প্রকাশিত হওয়ায় মুজিবরের জনপ্রিয়তা অসামান্য হারে বৃদ্ধি পায়। কিন্তু সরকারের দমন নীতির আংশিক সাফল্যের কারণে ১৯৬৭ সালের ৭ জুন বিগত বৎসরের ৭ জুন – এর ঘটনাবলীর পুনরাবৃত্তি ঘটেনি। আওয়ামী লীগের দৃঢ়চেতা নেতারা ছিলেন কারাগারে। ছাত্ররা – বিশেষতঃ পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র লীগ এবং মস্কোপন্থী পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন-এর সদস্যবৃন্দ – ১৯৬৭ সালের ৭ জুন প্রতিবাদ সভা, শােভাযাত্রা, ইত্যাদির প্রস্তুতি নেয়। কিন্তু শীর্ষস্থানীয় ছাত্রনেতারা কারাগারে বা পলাতক থাকতে বাধ্য হয়। সশস্ত্র আধাসামরিক বাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমগ্র প্রাঙ্গন ঘিরে রাখে। অতএব ছাত্ররা বিক্ষোভ প্রদর্শনে ব্যর্থ হয়। (১)
আপাতদৃষ্টিতে, পূর্ব পাকিস্তান আয়ুবশাহীর নিয়ন্ত্রনে ছিল। বাস্তবে, সরকারবিরােধী গণআন্দোলন পৃথক পৃথক খাতে বিভিন্ন গতিতে প্রবাহিত হােচ্ছিলাে। ছাত্র আন্দোলন অব্যাহত ছিলাে। তাছাড়া, সিরাজ শিকদারের নেতৃত্বে ষাটের দশকের শুরুতে প্রতিষ্ঠিত মাও গবেষণা কেন্দ্র ১৯৬৮ সালের জানুয়ারীতে পূর্ব পাকিস্তান শ্রমিক আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়। ঐ কেন্দ্র ও আন্দোলন গ্রামাঞ্চলে গেরিলা সংগঠন গড়ে তােলে। সরকারী বিধিনিষেধের কারণে সংগঠনটি গােপনে কার্য পরিচালনা করলেও পূর্ব পাকিস্তানের কিছু কিছু দূরবর্তী গ্রামেও এর শক্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। (২)
অন্যদিকে, আয়ুবচক্র (এবং পূর্ব পাকিস্তানে তার তল্পিবাহক মােনেম চক্র) দমন নীতি আরও কঠোর ভাবে প্রয়ােগের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন উপায় উদ্ভাবন করে। পূর্ব পাকিস্তানের যেসব স্থানে অবাঙ্গালীদের সংখ্যাধিক্য — যেমন, ঢাকার মিরপুর ও মােহম্মদপুরে, ঈশ্বরদি, খুলনা, চট্টগ্রাম, লালমনিরহাট, সৈয়দপুর, ও শান্তাহারের কিয়দংশে – সরকার অবাঙ্গালীদের হাতে অস্ত্রশস্ত্র বিতরণ করে। ঐ সব অঞ্চলে কর্মরত অবাঙ্গালী প্রশাসকবৃন্দ এ কাজে উদ্যোগ নেয়। মনে হয়, তারা যেন ছয়দফা আন্দোলনের প্রবক্তাদের বিরুদ্ধে আয়ুব যে গৃহযুদ্ধ এবং সশস্ত্র হস্তক্ষেপের হুমকি দেন, সেটিকেই কাজে পরিণত করতে তৎপর। উপরন্তু, পূর্ব পাকিস্তানের রাজ্যপাল মােনেম-এর সহযােগিতায় আয়ুব সরকার ছয় দফা আন্দোলনের সমর্থকদের বিচ্ছিন্নতাবাদী ও ষড়যন্ত্রকারী চিহ্নিত করার প্রয়াস নেয়। শেখ মুজিবর রহমান ও তার ঘনিষ্ঠ সহকর্মীদের জনপ্রিয়তা বিনষ্ট করার উদ্দেশ্যে আয়ুবশাহী এই অভিযােগ আনে যে তারা এবং কিছু সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা-কর্মচারী ভারতের সহায়তায় পাকিস্তানের অখণ্ডতা ধ্বংসের চক্রান্তে লিপ্ত। প্রথমে, ১৯৬৮ সালের ৬ জানুয়ারী, দুইজন প্রবীণ সি এস পি (সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তান) কর্মকতাসহ ২৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়। সরকারী বার্তায় বলা হয় যে তারা পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার জাতিবিরােধী পরিকল্পনায় সংশ্লিষ্ট। এর পর ১৯৬৮ সালের ১৮ মার্চ আর একটি সরকারী ঘােষণায় বলা হয়, ইতিপূর্বে পাকিস্তান। প্রতি রক্ষা বিধি অনুযায়ী ধৃত উপরােক্ত ২৮ জনকে ঐ সময়ে স্থল-নৌ-বায়ু সেনাবাহিনীদের প্রতি প্রযােজ্য আইন অনুযায়ী আটক রাখা হলাে। এদের বিরুদ্ধে যে মামলা রুজু করা হলাে, সরকার তার আখ্যা দিলাে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’, এবং শেখ মুজিবর রহমানকে ঐ ষড়যন্ত্রের নায়ক বলে অভিহিত করা হলাে। যে মুজিবর ইতিমধ্যে এক বৎসরেরও বেশি সময় কারাগারের অভ্যন্তরে দিন যাপন করেছেন, তাকে ঐ মামলায় জড়ানাে নিঃসন্দেহে কৌতূহলােদ্দীপক। মুজিবর এবং অন্যান্য অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যপ্রমাণ প্রস্তুতির নিমিত্ত তাদের আত্মীয়-বন্ধু-সহকর্মীদের নানাভাবে হয়রানি করা হয়, বিপুল সংখ্যায় গুপ্তচর নিয়ােগ করা হয়, এবং এই ষড়যন্ত্র মামলার নথিপত্র তৈরীতে সরকারের দশ লক্ষেরও বেশি টাকা খরচ করতে হয়। মুজিবর জড়িত হওয়ায় ঐ মামলা বিশাল গুরুত্ব অর্জন করলাে। উল্লেখযােগ্য, আওয়ামী লীগের যেসব নেতা কারাগারের বাইরে ছিলেন, তারা – এবং ঐ দলের সঙ্গে দীর্ঘদিন সংশ্লিষ্ট প্রবীণ ব্যবহারজীবীরাও – এত ভীতিবিহ্বল হয়ে পড়ে যে তিনজন নবীন ব্যবহারজীবীকে মুজিবের সমর্থনে মামলা পরিচালনার জন্য এগিয়ে আসতে দেখা যায়। পরে লণ্ডনে বসবাসকারী কিছু পূর্ব পাকিস্তানীদের আনুকূল্যে বৃটেনের একজন খ্যাতনামা ব্যবহারজীবী মুজিবকে সমর্থনের সিদ্ধান্ত নেন। (৩)
পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রসংগঠনগুলির মধ্যে তাত্ত্বিক ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক নানা বিভেদ ছিলাে। কিন্তু মুজিবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের হওয়ার অব্যবহিত পরে ঐ বিভেদ অনেকটাই দূরীভুত হয়। ১৯৬৮ সালের ২৬ জানুয়ারী ছাত্র সংগঠনগুলি তাদের বিবাদ বিস্মৃত হয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে রাজনৈতিক বন্দী মুক্তি দিবস পালন করে। এই উপলক্ষে অনুষ্ঠিত একটি সভায় ছাত্ররা দাবি করে যে মুজিবের বিচার হােক প্রকাশ্যে। বিভিন্ন ছাত্রসং গঠনগুলি সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে, এবং ১৯৬৮ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী শহীদ দিবস পালনের উদ্দেশ্যে পল্টন ময়দানে একটি যুগ্ম সভা আহ্বান করে। এক ধরণের সাংস্কৃতিক অভ্যুত্থানও ঘটে যায়। শিক্ষা সম্পর্কে হামুদুর রহমান কমিশনের রিপাের্ট-এর বিরুদ্ধে শিক্ষা সংকোচন ও শিক্ষাক্ষেত্রে দমন নীতির অভিযােগ তুলে ১৯৬৮ সালের ২৪ জুলাই ছাত্র ধর্মঘট ডাকা হয়। একই কারণে ১৯৬৮ সালের ১০ আগষ্ট ছাত্ররা। হরতাল দেয়। সরকার-সমর্থক সাংবাদিক, রাজনীতিক ও শিক্ষকগণ রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্মের ওপর নিষেধাজ্ঞার দাবি জানায়, কারণ ঐ সাহিত্য ইসলামবিরােধী। প্রবেশিকা পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ তথ্য মন্ত্রী, খাজা সাহাবুদ্দিন, একটি বিবৃতিতে বলেন যে রবীন্দ্রসঙ্গীত ও রচনাবলীর ওপর নিষেধজ্ঞা জারী হবে। কিন্তু এই বিবৃতি ও তদনুসারী। সরকারী নির্দেশকে অগ্রাহ্য করে ১৯৬৮ সালে পূর্ব পাকিস্তানে অধিকতর আড়ম্বর ও উদ্দীপনার মধ্যে রবীন্দ্রজয়ন্তী পালিত হয়। (৪)।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা সম্পর্কে সরকারী ঘােষণার একমাসের মধ্যেই আয়ুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। ঐ অসুস্থতাজনিত রাজনৈতিক অস্থিরতা দ্রুত বৃদ্ধি পায়, কারণ পশ্চিম পাকিস্তানে আয়ুবের প্রাক্তন অনুচর জুলফিকার আলী ভুট্টোই তার প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে অতীব সংঘর্ষমুখী হয়ে ওঠেন। ১৯৬৮- র নভেম্বর মাসে পশ্চিম পাকিস্তানে ছাত্রদের সঙ্গে সরকারের বিবাদ রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাকে অভূতপূর্ব মাত্রা প্রদান করে। উক্ত মাসে রাওয়ালপিণ্ডির ৭০ জন ছাত্রকে পুলিশ চোরাচালানিকৃত দ্রব্য সংগ্রহের অপরাধে গ্রেফতার করে। এই ব্যাপারটিকে রাওয়ালপিণ্ডি পলিটেকনিকের ছাত্ররা আয়ুবের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে উদ্যোগী হয়। এজন্য তারা ভুট্টোর সহায়তা কামনা করে। ছাত্ররা সিদ্ধান্ত নেয়, ৭ নভেম্বর ভুট্টো তাদের সমাবেশে বক্তৃতা দেবেন। পুলিশ ভুট্টোকে সমাবেশে উপস্থিত হতে দেয় নি। অসন্তুষ্ট ছাত্রদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে একজন পলিটেকনিক ছাত্র নিহত হয়। বিক্ষোভের আশংকায় সরকার রাওয়ালপিণ্ডির সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়। এতদসত্ত্বেও ৮ নভেম্বর বিশাল আয়ুববিরােধী ছাত্র মিছিল দেখা যায়। জনসাধারণও ছাত্র বিক্ষোভে যােগ দেয়। আয়ুবের অসংখ্য প্রতিকৃতিতে অগ্নিসংযােগ করা হয়। সান্ধ্য আইন জারী হয়। সেনাবাহিনী আইনশৃংখলার দায়িত্ব গ্রহণ করে। ৯ নভেম্বর বিনা অপরাধে পুলিশের গুলীতে দুইজন পথচারী প্রাণ হারায়। পশ্চিম পাকিস্তানের নানা শহরে — করাচী, লাহাের, মুলতান, পেশােয়ার ও হায়দ্রাবাদে – ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়। বহুসংখ্যক ছাত্রকে আটক করা হয়। ১০ নভেম্বর পেশােয়ারে জনসভায় বক্তৃতারত আয়ুবকে লক্ষ্য করে জনৈক ছাত্র গুলী চালায়, ও ধরা পড়ে। পুলিশের কাছে তার সখেদ স্বীকারােক্তি ছিল, সে অত্যাচারী শাসককে হত্যা করায় ব্যর্থ হলাে। দেশের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করার জন্য ভুট্টোসহ বেশ কিছু আয়ুব বিরােধী রাজনৈতিক নেতাকে গ্রেফতার করা হয়। অচিরেই পশ্চিম পাকিস্তান সরকার বুঝতে পারে। যে শুধুমাত্র নির্যাতন – গ্রেফতার দ্বারা ছাত্র অসন্তোষ স্তব্ধ করা যাবে না। তাই আপােষ আলােচনার পথও খােলা হয়। ছাত্ররাও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্বাভাবিক কাজ শুরু করার পক্ষপাতী ছিল। অতএব, নভেম্বর ১৯৬৮-র প্রথম সপ্তাহে পশ্চিম পাকিস্তানে যে বিক্ষোভকে সর্বগ্রাসী মনে হয়েছিল, তা অল্প দিনের মধ্যে খানিকটা স্তিমিত হলাে। কিন্তু, আবার তা জ্বলে ওঠার সম্ভাবনাও রয়ে গেল। (৫)
পশ্চিম পাকিস্তানের ছাত্রবিক্ষোভ পূর্ব পাকিস্তানের গণআন্দোলনে নতুন গতিবেগ সঞ্চার করে। ১৯ নভেম্বর ১৯৬৮ ঢাকায় বায়তুল মােকাররম চত্বরে পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানে জেল-জুলুমের প্রতিবাদে বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে সকল ধৃত ছাত্র ও রাজনৈতিক বন্দীর মুক্তি ছাড়াও আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন, প্রাপ্তবয়স্কের ভােটাধিকার, প্রত্যক্ষ নির্বাচন, ইত্যাদি দাবি তােলা হয়। ২২ নভেম্বর ঢাকায় এক যুক্ত বিবৃতিতে কবি জসীমুদ্দিন, কবি সুফিয়া কামাল, সাংবাদিক মানিক মিয়াসহ ১২ জন সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও বিশিষ্ট নাগরিক পশ্চিম পাকিস্তানে ছাত্রজনতার ওপর দমন-পীড়নে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। ২৬ নভেম্বর রাওয়ালপিণ্ডির বন্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি খুলে দেয়া হয়। সেদিনই শিক্ষা সংক্রান্ত দাবি নিয়ে ছাত্ররা যে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ জানায় তাতেও পুলিশের গুলিতে একজন পথচারীর মৃত্যু ঘটে। এর প্রতিবাদে ২৯ নভেম্বর আহূত ছাত্র ধর্মঘটে পশ্চিম পাকিস্তানে রীতিমতাে ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষ বেধে যায়। রাওয়ালপিণ্ডিতে ছাত্রদের আহ্বানে শ্রমিকরা হরতাল পালন করে। শ্রমিক ও ছাত্ররা দুটি থানায় আগুন জ্বালিয়ে দেয়। পেশােয়ারে ছাত্ররা মার্কিন তথ্যকেন্দ্রের পাঠাগারে হামলা চালায়। পশ্চিম পাকিস্তানে ১৯৬৮ -র ২৯ নভেম্বর আয়ুবশাহীর বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার যে রােষ স্ফুরিত হয় তা ১৯৬৯ সালে পূর্ব পাকিস্তানে আয়ুববিরােধী গণঅভ্যুত্থানের সূচনায় নিশ্চিত সহায়ক হয়। (৬)
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কার্যবিবরণী সংবাদপত্রে প্রকাশিত হােতে থাকায় জনমানস ক্রমাগত আন্দোলিত হচ্ছিল। ১৯৬৮-র ১ ডিসেম্বর ছাত্ররা প্রতিবাদ দিবস পালন করে। সেদিন এবং তার পরের দিন ছাত্ররা যেসব জনসভা ও বিক্ষোভের আয়ােজন করে তাতে জনসাধারণের সরকার বিরােধী মনােভাব প্রকট হয়। যে মৌলানা ভাসানী এতদিন পরােক্ষে আয়ুবকে সমর্থন দিচ্ছিলেন, তিনিও ৬ ডিসেম্বর দমনবিরােধী দিবস পালনের ডাক দেন, এবং ৭ ডিসেম্বর সাধারণ ধর্মঘটের নির্দেশ দেন। ৭ ডিসেম্বর আয়ুব ঢাকা সফরে এসে বিক্ষোভের সম্মুখীন হন। পুলিশ গুলী চালাতে বাধ্য হলে দুই ব্যক্তির মৃত্যু হয়। এই দিন আয়ুব আসলে সর্বপ্রথম ঢাকায় সেনাবাহিনী তলব করেন। ১৩ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ যে হরতালের ডাক দেয় তাকে ভাসানীর নেতৃত্বাধীন পিকিংপন্থী ন্যাপ ব্যতীত সব প্রগতিবাদী ছাত্রসংস্থা সমর্থন দেয়। ঐ হরতাল এতটা সফল হয় যে ঐ দিন ঢাকা থেকে করাচী ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত আয়ুবকে বাতিল করতে হয়। ডিসেম্বরের
১৩০
শেষ সপ্তাহে পবিত্র ইদ দিবসে ছাত্ররা কালাে চিহ্ন পরিধান করে আয়ুবশাহীর বিরুদ্ধে ধিক্কার জানায়। ২৯ ডিসেম্বর গ্রামাঞ্চলের হাটবাজারে ধর্মঘট আয়ােজন করতে গিয়ে ৩ জন কৃষক প্রাণ হারায়। তবে, যে অবস্থায় আওয়ামী লীগ নেতারা কারাগারে, আর অন্যান্য বিরােধী দলগুলি হয় আয়ুবের সমর্থক, অথবা সাংগঠনিক ক্ষেত্রে দুর্বল ও নিস্ক্রিয়, সেই অবস্থায় ছাত্রদেরই আয়ুব-বিরােধী আন্দোলনের পুরােভাগে থাকতে হয়েছিল। (৭)।
অনেকের মতেই – এমন কি কোন কোন পাকিস্তানী লেখক, যেমন তারিক আলীর, মতেও – পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র ও বুদ্ধিজীবী সমাজের রাজনৈতিক চেতনা ও সংবেদনশীলতা সমপর্যায়ের পশ্চিম পাকিস্তানীদের তুলনায় অধিকতর অগ্রগামী ছিল। ১৯৬৯-র ৫ জানুয়ারী সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ (যার নামের বহুল প্রচলিত ইংরেজী আদ্যাক্ষরসমষ্টি হলাে অ্যাপস্যাক) একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল প্রকাশ করে ? এগারদফা কর্মসূচী। আওয়ামী লীগের অধিভুক্ত পূর্বপাকিস্তান ছাত্র লীগ ছিল অ্যাপস্যাক- এর অভ্যন্তরস্থ সবচেয়ে শক্তিশালী সংগঠন ছাত্র লীগ প্রস্তাব দেয়, মুজিবের ছয়দফা এগারদফার অন্তর্ভুক্ত হােক। কিন্তু ভাসানীর ন্যাপ – এর অধিভুক্ত মেননপন্থী ছাত্র ইউনিয়ন এই প্রস্তাবের বিরােধিতা করে। তখন মতিয়াপন্থী ছাত্র ইউনিয়ন যে আপােষ আলােচনার উদ্যোগ নেয় তার ফলশ্রুতি এগারদফা। এতে ছয়দফার অতিরিক্ত আরও কিছু কার্যক্রম ছিল। পূর্ব পাকিস্তানের ওপর রাজনৈতিক নির্যাতন ও অর্থনৈতিক শােষণের প্রতিবাদ করা ছাড়াও এগারদফায় সিন্ধু, বালুচিস্তান ও উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের জন্য স্বায়ত্তশাসনের দাবি করা হয়েছিল। উপরন্তু, এগারদফায় ব্যাংক, ইনসিওরেন্স কোম্পানি, পাট ও ভারী শিল্পের জাতীয়করণ দাবি করা হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানে বন্যা সমস্যার সমাধান, কৃষক – শ্রমিকের স্বার্থ সংরক্ষণ, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার, গােষ্ঠী নিরপেক্ষ বিদেশ নীতি অবলম্বন, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে মাতৃ ভাষার ব্যবহার, বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বায়ত্তশাসন, ইত্যাদি নানা দাবির সমন্বয় এগারদফাকে একটি ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। (৮)
বিশদ কর্মসূচী থেকে প্রকৃত কর্মে উত্তীর্ণ হওয়ার নিমিত্ত অ্যাপস্যাক ১৯৬৯-র ৭ জানুয়ারী হরতালের ডাক দেয়ার প্রস্তুতি নেয়। ইতােমধ্যে অনেকগুলি রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ একটি যৌথ কার্যক্রম অনুসরণের উদ্যোগ নেন। এই দলগুলি – পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ, ন্যাশানাল আওয়ামী পার্টি (ওয়ালি), জামাত -ই- ইসলামি, নেজাম -ইইসলামি, জামিয়াত -উল- উলেমা -ই- ইসলাম, পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কাউন্সিল), ন্যাশানাল ডেমােক্রেটিক ফ্রন্ট (এনডিএফ), এবং পাকিস্তান গণতান্ত্রিক আন্দোলন (পি ডি এম) – সম্মিলিতভাবে ডেমােক্রেটিক অ্যাকশান কমিটি (ইংরাজী আদ্যাক্ষর অনুযায়ী ডি এ সি) গঠন করে। কিন্তু এসব পেশাদার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সিদ্ধান্তহীনতা ছিল মজ্জাগত। ফলে, যখন অ্যাপস্যাক ৭ জানুয়ারী থেকে কয়েকদিন রাজনৈতিক দলগুলির আহ্বানের ব্যর্থ প্রতীক্ষার পর ১৭ জানুয়ারী সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয়, তখন ডি এ সি যেন উপায়ান্তর না দেখে – এবং সম্ভবত আত্মবিশ্বাসের অভাবে – ১৭ জানুয়ারীই হরতালের ডাক দেয়। ঐ দিন সরকার ছাত্রদের ওপর চরম নির্যাতন প্রয়ােগ করে। ১৮ জানুয়ারী আধাসামরিক বাহিনী বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে প্রবেশ করে ছাত্রদের আবাসিক ভবনের ওপর হামলা চালায়। ফলে, ছাত্র-বিক্ষোভ প্রায় একটি অভ্যুত্থানে রূপান্তরিত হয়। যে ছাত্রসংস্থা (এন এস এফ) সরকারী পুতুল হিসেবে চিহ্নিত ছিল, তার সদস্যরাও আইনরক্ষকদের অত্যাচারী ভূমিকার নিন্দা করে। ২০ জানুয়ারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের উদ্দেশ্যে আয়ােজিত মিছিলের ওপর পুলিশ গুলীবর্ষণ করলে ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামান নিহত হন। আসাদ গণঅভ্যুত্থানের পথিকৃৎ ছিলেন কিনা, তার মৃত্যু আত্মাহুতি না অঘটন, এ সব নিয়ে বিতর্ক (অতি বামপন্থীদের কাছে প্রিয়, কিন্তু) নিষ্ফল ও নিষ্প্রাণ। যে সত্য অকাট্য তা হলাে, জনগণের স্বার্থরক্ষায় যারা শহীদ হন, আসাদ তাদেরই একজন। তাছাড়া, ১৯৬৯ সালের পরিপ্রেক্ষিতে, আসাদের মৃত্যুতে গণআন্দোলন অধিকতর আপােষবিরােধী ও সং ঘর্ষমুখী হয়ে উঠলাে। সাধারণ মানুষ আসাদের মৃত্যুতে ছাত্রদের নেতৃত্বে গণআন্দোলনে যােগ দেয়ায় অনুপ্রাণিত হলাে। তিনদিনব্যাপী শােকপালনের যে কর্মসূচী অ্যাপস্যাক গ্রহণ করে তার দ্বিতীয় দিনে ঢাকায় একটি মশাল মিছিল পরিচালিত হয়। এর একটি অভিনব বৈশিষ্ট্য ছিল শােভাযাত্রাকারীদের স্বাগত জানাবার জন্য পথের দুই পাশে যে বিরাট জনতা অপেক্ষমান ছিল, তারাও যেন একটি সমান্তরাল (যদিও নিশ্চল) শােভাযাত্রার আয়ােজন করেছিল। (৯)
ছাত্রনেতা আসাদের মৃত্যুতে পালিত তৃতীয় শােকদিবসে – ২৪ জানুয়ারী ১৯৬৯ – শােভাযাত্রাকারীরা হিংসাত্মক পদক্ষেপ নেয়। সচিবালয়ের ওপর আক্রমণে একাংশ পুড়িয়ে দেয়া হয়। ছাত্রদের সঙ্গে জনতা – বিশেষত দিনমজুর, রিকশাচালক – হাত মেলায়। ফলে, গণতান্ত্রিক শাসনের জন্য মধ্যবিত্তের সংগ্রাম প্রায় রূপান্তরিত হয় জনগণের বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানে। সরকারী সংবাদপত্র দৈনিক মর্নিং নিউজ এবং দৈনিক পাকিস্তান- এর দফতরে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হয়। এভাবে ২৪ জানুয়ারী ছাত্ররা যে গণ অভ্যুত্থান দিবস’ পালনের ডাক দেয়, তা সার্থকনামা হয়। মাহফুজউল্লাহ লিখেছেন ঃ ২৪ জানুয়ারী সন্ধ্যা পর্যন্ত শহরের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। বাধ্য হয়ে সরকারকে তলব করতে হয় সেনাবাহিনী। … সান্ধ্য আইন জারীর পর থেকে এক থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করতে থাকে। … কিন্তু ২৫ জানুয়ারী সেনাবাহিনী ও ই পি আর এক নারকীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি করে ঢাকা শহরে। বেপরােয়াভাবে গুলী চলে নিরীহ জনসাধারণের উপর।” দিনের পর দিন হরতাল, মিছিল, সান্ধ্য আইন আয়ুবশাহীর ভিত্তি নড়িয়ে দেয়। এই পরিস্থিতিতে মত্তলানা ভাসানী তার আয়ুব-প্রীতি সত্ত্বেও গ্রামাঞ্চলে ঘেরাও আন্দোলন শুরু করেন। মেসবাহ কামাল লিখেছেনঃ “গ্রামাঞ্চলে জোতদার, মহাজন টাউট, ফড়িয়া, বাটপার, গরুচোর ও তাদের সহযােগী পুলিশদের বিরুদ্ধে জনগণের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ কোথাও কোথাও বিক্ষোভে রূপান্তরিত হতে শুরু করে। বিভিন্ন এলাকায় গণ আদালত গঠিত হয়। এবং সেই আদালতে বিচারের মাধ্যমে অনেকের বিরুদ্ধে চরম ব্যবস্থা পর্যন্ত নেয়া হয়।” (১০)
গণআন্দোলনে অভূতপূর্ব গতিবেগ সঞ্চারিত হওয়ায় সশঙ্কিত রাষ্ট্রপতি আয়ুব ১ ফেব্রুয়ারীর এক ভাষণে আপােষ আলােচনার প্রস্তাব দেন। কিন্তু ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সঙ্গতভাবে বলে যে রাজনৈতিক নেতাদের কারাগারে রেখে কোন আলােচনা সম্ভব নয়। ৬ ফেব্রুয়ারী আয়ুব ঢাকায় আসেন। পরদিন তিনি পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধির প্রয়ােগ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত ঘােষণা করেন। ৮ ফেব্রুয়ারী ইত্তেফাক সংবাদপত্র গােষ্ঠীর ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহৃত হয়। ৯ ফেব্রুয়ারী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে পল্টন ময়দানে বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। আলাপ মীমাংসার পথ প্রশস্ত করার উদ্দেশ্যে সরকার ১১ ফেব্রুয়ারী পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধি অনুযায়ী ধৃত সব রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তিদানের সিদ্ধান্ত নেয়। এটা অবশ্যই ছাত্রদের এগারদফা আন্দোলনের বিজয় সূচিত করে। আওয়ামী লীগ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহম্মদ মুক্ত হন ১২ ফেব্রুয়ারী। ইতােমধ্যে আয়ুব সরকারের সঙ্গে আলােচনায় যােগদান করা – এবং তার ফলে গণআন্দোলনের গতি রুদ্ধ করার বিষয়ে – ছাত্রসংগ্রাম পরিষদে তীব্র মতভেদ দেখা দেয়। কিন্তু গণআন্দোলনের শক্তি তখন এতই প্রবল ছিল যে ঐ মতপার্থক্য পরিষদে ভাঙ্গন ধরাতে পারে নি। আয়ুব কর্তৃক আহূত কোন বৈঠকে যােগদানের পূর্বশর্ত হিসেবে আওয়ামী লীগ দাবি করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা খারিজ করতে হবে। ছাত্র আন্দোলনের অপ্রতিরােধ্য সাফল্যে বিচলিত হয়ে ডি এ সি নেতৃবৃন্দ ১৪ ফেব্রুয়ারী সাধারণ ধর্মঘট ও জনসভার আয়ােজন করে। কিন্তু যেসব নেতা – যেমন নুরুল আমিন – দীর্ঘকাল পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থের বিরুদ্ধাচরণ করার জন্য বাঙ্গালীদের কাছে বেইমান হিসেবে চিহ্নিত — তাদের ১৪ ফেব্রুয়ারী পল্টন ময়দানে সভামঞ্চে উঠতেই দেয়া হয় নি। বিশাল জনসমষ্টির দাবিতে ছাত্রনেতৃবৃন্দ মঞ্চ অধিকার করে। সমবেত জনগণ হাত তুলে এগারদফার প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানায়। এভাবে স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন জাতীয়তাবাদী রূপ পরিগ্রহ করে স্বাধীনতার লক্ষ্যে ধাবিত হবার শক্তি সংগ্রহ করে। মহিলারাও এই আন্দোলনে সামিল হয়ে ১৩ ফেব্রুয়ারী সরকারী দমননীতি বিরােধী সমাবেশ-শােভায়াত্রার আয়ােজন করে। (১১)
ঢাকার সেনানিবাসে ১৫ ফেব্রুয়ারী আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামী সার্জেন্ট জহুরুল হককে হত্যা করা হয়। সরকারী বক্তব্য, বন্দী জহুরুল পালাবার চেষ্টা করায় এই দুঃখজনক ঘটনা ঘটে। জনসাধারণ সরকারী ভাষ্য বিশ্বাস করেনি। লক্ষাধিক লােকের সমাবেশে ঢাকায় জহুরুলের গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয় ১৬ ফেব্রুয়ারী। জনতার একাংশের মনে এই আশংকা দানা বাঁধে যে মুজিবরকেও সেনানিবাসের অভ্যন্তরে হত্যা করা হতে পারে। ১৬ ফেব্রুয়ারী উপরােক্ত জনসভায় প্রধান বক্তা ছিলেন ভাসানী। জনসভা শেষ হবার আগেই বিক্ষুব্ধ জনগণ সভা ছেড়ে দুই প্রাদেশিক মন্ত্রী ও এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর গৃহে অগ্নিসংযােগ করে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান বিচারপতি এস এ রহমানের বাসভবনেও আগুন লাগানাে হয়। ঐ মামলার সরকারী অভিশংসক মনজুর কাদির সত্বর লাহােরে পলায়ন করেন। জনগণ বেপরােয়া হয়ে কিছু পুলিশের হাত থেকেও বন্দুক ছিনিয়ে নেয়। এক ধরণের অরাজকতার সৃষ্টি হয়। সান্ধ্য আইন এবং সেনাবাহিনীর উপস্থিতি সত্ত্বেও গণবিক্ষোভ প্রশমিত হয় নি। উপরন্তু, ১৮ ফ্রেব্রুয়ারী ১৯৬৯ ঐ বিক্ষোভ আরও ঘনীভূত হয়, কারণ ঐদিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রােক্টর। অধ্যাপক শামসুজ্জোহা ও অধ্যাপক নুরুল ইসলাম নিরাপত্তা বাহিনীর গুলীতে নিহত হন। এই হত্যার প্রতিবাদে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে সব বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও স্কুলের শিক্ষকবৃন্দ প্রতিবাদ মিছিল করে। আয়ুব যদিও ১৭ ফেব্রুয়ারী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বৈঠকে বসতে রাজী ছিলেন, ডি এ সি নেতারা সিদ্ধান্ত নেন যে মুজিবের অনুপস্থিতিতে আলােচনা নিষ্ফল। ১৯৬৯ সালে সরকার প্রথম ২১ ফেব্রুয়ারী ছুটির দিন বলে ঘােষণা করে। পরদিন, অথাৎ ২২ ফেব্রুয়ারী, সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করায়। জননিরাপত্তা আইনে আটক মুজিবসহ আরও ৩৪ জন বন্দী মুক্তি লাভ করেন। জামিনে বা শতাধীন মুক্তি নিয়ে মুজিব আয়ুবের সঙ্গে আলােচনায় বসবেন কিনা এ নিয়ে ছাত্র সংগঠন ও রাজনৈতিক দলগুলিতে যে বিতর্ক ও মতান্তরের সৃষ্টি হয়েছিল, তার অবসান ঘটলাে। (১২)
প্রসঙ্গত, একটি বক্তব্য বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে পুনরায় উপস্থাপিত হবার দাবি রাখে। স্বৈরাচারী আয়ুব খান যে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলােচনায় বসতে এবং সেজন্য আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করতেও রাজী হন, তার মৌলিক কারণ ছিল, ১৯৬৯-র জানুয়ারী-ফেব্রুয়ারীতে অ্যাপস্যাক বা সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের ১১দফার জন্য আন্দোলন ঢাকা ছাড়িয়ে পূর্ব পাকিস্তানের নানা জেলা, উপজেলা, থানা, গ্রাম, পাড়া, কারখানা ও বিদ্যালয়ে পরিব্যাপ্ত হয়। এমন কি পশ্চিম পাকিস্তানে আয়ুবের ক্ষমতার কেন্দ্র বিন্দুতেও এর প্রভাব পড়ে, যেমন, আসাদের মৃত্যুজনিত বিক্ষোভে ঢাকায় পুলিশের গুলিচালনার প্রতিবাদে ২৭ জানুয়ারী করাচী, লাহােরে ও পেশােয়ারে তুমুল বিক্ষোভ দেখা দেয়, সেনাবাহিনীও তলব করতে হয়। অবশ্য, পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলন অন্য পর্যায়ে উঠে যায়। মেসবাহ কামালের ভাষায়, “গণতন্ত্রের দাবিতে স্বৈরশাসনবিরােধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে এসে গ্রাম-গঞ্জে ও শহরের খেটে খাওয়া মানুষ কেবল সরকার বিরােধী পদক্ষেপ গ্রহণ করেই থেমে থাকেন না, তাদের একটা অংশ স্ব স্ব এলাকার ক্ষমতা-বলয়ে অধিষ্ঠিত শােষণকারী শ্রেণী সমূহের প্রতিনিধিদের বিরুদ্ধেও জনমতকে সংগঠিত করতে শুরু করেন। সাধারণ মানুষ হয়তাে এ ব্যাপারে যুক্তির চেয়ে ভাবাবেগকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছিল। অথবা, বলা যেতে পারে, সাধারণ মানুষের চিন্তাধারা ছাত্রদের তুলনায় অধিকতর অগ্রগামী ছিল। অন্যদিকে, আয়ুবের ভাবনাচিন্তা ছিল পুরােপুরি অনগ্রসর; তাই তার ১ ফেব্রুয়ারী ১৯৬৯-র আলােচনাপ্রার্থী বক্তৃতায় তিনি এগারদফার আন্দোলনকে শুধু মাত্র আইনবর্জিত আখ্যা দিয়েই সন্তুষ্ট ছিলেন। (১৩)
কারাগার থেকে মুক্তি লাভের পরই মুজিব ১১ দফার প্রতি তার অকুণ্ঠ সমর্থন ঘােষণা করেন, কারণ ৬ দফা ১১ দফার অন্তর্নিহিত। ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ ২৩ ফেব্রুয়ারী ১৯৬৯ মুজিবকে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বিপুল সম্বর্ধনা জানায়। মুজিব বলেন, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা জনতার মুক্তির উপায়। তিনি আশ্বাস দেন, আয়ুবের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত আলােচনায় যদি স্বায়ত্তশাসনের দাবি গৃহীত না হয়, তাহলে তিনি বৈঠকের পর পূর্ব পাকিস্তানে ঐ দাবি আদায়ের নিমিত্ত তুমুল আন্দোলন শুরু করবেন। মুজিব প্রতিশ্রুতি দেন যে প্রস্তাবিত গােল টেবিল বৈঠকে তিনি কেন্দ্রীয় আইনসভায় লােকসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্ব দাবি করবেন — অথাৎ পূর্ব পাকিস্তানীরা কেন্দ্রীয় আইনসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করবে। ২৩ ফেব্রুয়ারী জনসভায় মুজিবকে ‘বঙ্গ বন্ধু’ খেতাব প্রদান করা হয়। মুজিব আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাকে ইসলামাবাদ যড়যন্ত্র মামলা’ বলে আখ্যা দেন। ২৩ ফেব্রুয়ারী বিকেলেও পুলিশের গুলী বর্ষণে তিনজন আহত হলে জনতা প্রতিশােধপরায়ণ হয়ে ওঠে। অবস্থা নিয়ন্ত্রণে রাখার উদ্দেশ্যে মুজিব শান্তি স্থাপনের আহ্বান জানান। ঢাকা রেডিও থেকে মুজিবের আহ্বান পুনঃ পুনঃ প্রচারিত হয় – মনে হয় যেন রাজ্যপালের বানী জনগণকে বারবার শােনানাে হচ্ছে। এতে অবশ্যই পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীদের চিত্ত জাতীয়তাবাদী আবেগে মথিত হয়। (১৪)
২৫ ফেব্রুয়ারী ১৯৬৯ রাওয়ালপিণ্ডিতে গােলটেবিল বৈঠক শুরু হয়। কিন্তু এটি ছিল আনুষ্ঠানিক সূত্রপাত। এর পরদিনই ইদ উৎসব উপলক্ষ্যে সভার অধিবেশন মুলতবি রাখা হয়। সভা পুনরায় শুরু হয় ১০ মার্চ। ইতােমধ্যে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ নানা দফায় আলােচনা করেন। কিন্তু গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিষদ বা ডি এ সি-র নেতৃবৃন্দের মধ্যে – বিশেষত পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানী নেতাদের মধ্যে – কোন ঐকমত্য গড়ে উঠে নি। যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন কাঠামােয় সার্বজনীন ভােটাধিকারের ভিত্তিতে পরিষদীয় গণতন্ত্র স্থাপনের ব্যাপারে সাধারণভাবে মতৈক্য ছিল। কিন্তু ১৯৫৬ সালে যে সংবিধান পূর্ব পাকিস্তানীরা গ্রহণ করেছিল, জাতীয়তাবাদী ধ্যানধারণার উন্মেষের ফলে ১৯৬৯ সালে পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীরা সেই সংবিধান বা তদনুরূপ সংবিধান গ্রহণে সম্পূর্ণ গররাজী ছিল। রাওয়ালপিণ্ডিতে মুজিবের সঙ্গে কামাল হােসেন, আমীরুল ইসলাম ও মত্তদুদ আহমেদ আইনজ্ঞ-উপদেষ্টা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। আয়ুবের আইনমন্ত্রী এস এম জাফর
১৩৫
ও বেসরকারী আইন-উপদেষ্টা মনজুর কাদির মুজিবের উপরােক্ত উপদেষ্টা এয়ীর সঙ্গে আলােচনায় যে ধ্যানধারণা ব্যক্ত করেন, তাতে বােঝা যায় যে পূর্ব পাকিস্তানীদের জাতীয়তাবাদকে সম্মান জানিয়ে পাকিস্তানের অখণ্ডতা বজায় রাখার জন্য যে পরিমাণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন মানা প্রয়ােজন, সেটা আয়ুব সরকার মানতে রাজী নয়, আয়ুবশাহী ১৯৬২-র সংবিধানে ছােট খাটো পরিবর্তন করতেই উৎসুক। মুজিবের উপরােক্ত উপদেষ্টাত্রয়ীর সঙ্গে স্থল সেনাবাহিনী প্রধান আগা মহম্মদ ইয়াহিয়া খানের একটি গােপন বৈঠক হয়। ইয়াহিয়া তাে প্রায় হুমকিই দিলেন যে, রাজনৈতিক নেতারা যদি একমত হতে পারেন – যেমন, আয়ুবকে রাষ্ট্রপতি, মুজিবকে প্রধানমন্ত্রী ও দৌলতানাকে অর্থমন্ত্রী করে একটি জোড়াতালি দেওয়া সরকার গঠনেও প্রস্তুত না থাকেন – তাহলে দেশের স্বার্থরক্ষায় সামরিক বাহিনী এগিয়ে এসে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করতে বাধ্য হবে। পূর্ব পাকিস্তানে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি জনমানসে কি স্থান অধিকার করেছে। তৎসম্পর্কে ইয়াহিয়ার বিন্দুমাত্র বােধােদয়ও ছিলাে না। আয়ুবও এ ব্যাপারে খুব একটা প্রাগ্রসর ছিলেন না। তাই গােল টেবিল বৈঠকের শেষ দিনে অথাৎ ১৩ মার্চ – তিনি ইসলামের দোহাই দিলেন, ইসলামের নির্দেশ অনুযায়ী রাষ্ট্র, সমাজ ও অর্থনীতির সমস্যা সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিলেন, কিন্তু ১৯৫৬ সালের সংবিধানের মূল নীতিগুলিকেই মােটামুটি আঁকড়ে ধরে রইলেন। আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন তাে দূরের কথা, কেন্দ্রীয় আইনসভায় জনসংখ্যার ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানকে প্রতিনিধিত্বদানের স্বীকৃতিও তিনি দিলেন না। বলাই বাহুল্য, মুজিব দ্বিমত জানিয়ে বৈঠক ত্যাগ করলেন, এবং ১৩ মার্চ আওয়ামী লীগও ডিএ সি-র সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করলাে। মুজিব ঢাকায় ফিরে এলেন। বঙ্গ বন্ধু নামের মর্যাদা বজায় রইলাে। গণআন্দোলনের শীর্ষে তার নেতৃত্ব বহাল থাকলাে। কোন কোন বামপন্থী মহলের অসূয়ামিশ্রিত রটনা ছিল যে মুজিব বাঙ্গালীদের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে আয়ুবের সঙ্গে আপােষ করবেন। এ রটনা মিথ্যা প্রমাণিত হলাে। (১৫)
উপরােক্ত সময়ে গণআন্দোলনের নেতৃত্ব চুড়ান্তভাবে মুজিবের ওপর ন্যস্ত হবার একটি প্রধান কারণ ছিল, গ্রামাঞ্চলে গনআন্দোলনের শ্রেণী উপাদান ও রণােন্মত্ততা অত্যন্ত প্রকট হয়ে ছাত্র নেতাদের আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছিল। উদাহরণস্বরূপ, মৌলিক গণতন্ত্রীদের প্রতি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নির্দেশ ছিল, তারা যেন পদত্যাগ করে। কিন্তু অত্যুৎসাহী জনতা অনেক ক্ষেত্রেই স্বেচ্ছামূলক পদত্যাগের জন্য অপেক্ষা না করে বাধ্যতামূলক পদত্যাগের অবস্থা সৃষ্টি করে। বলাবাহুল্য, আয়ুবশাহী মৌলিক গণতন্ত্র মারফত গ্রামাঞ্চলের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের রাজনৈতিক ক্ষমতা দিয়ে তাদের পূর্বাহ্নত অর্থনৈতিক সামাজিক শােষণের ক্ষমতাকে আরও বাড়িয়ে দেয় ও দীর্ঘস্থায়ী করে। অতএব, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নির্দেশ পালন করতে গিয়ে শােষিত গ্রামবাসী যদি তার প্রতিশােধ স্পৃহা চরিতার্থ করার প্রয়াস নেয়, সেটা নিতান্তই স্বাভাবিক। নৌকা থেকে ধান লুট করা, ঘুষখাের তহশিলদারের গলায় জুতাের মালা পরানাে, ধনী গ্রামবাসীর গৃহে অগ্নিসংযােগ, ইত্যাদি ঘটনা অনেক জায়গায় ঘটেছিল। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের। পক্ষে এটা স্বীকার করার বিকল্প ছিল না যে এই জঙ্গী গ্রামীন’আন্দোলনের রাশ টেনে রাখা তাদের পক্ষে অসম্ভব। ১৯ মার্চ ১৯৬৯ শেখ মুজিব রাজনৈতিক কর্মী, ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক, সবাইকে জনগণের অধিকার অর্জনের জন্য শক্তি সংরক্ষণ করার, এবং এই উদ্দেশ্যে শান্তি বজায় রাখারও আবেদন জানান। একই দিন ছাত্ররা ১১ দফা আদায় ও মােনেমকে রাজ্যপালের পদ থেকে বিদায়ের লক্ষ্যে ২৫ মার্চ হরতালের ডাক দেয়। কিন্তু ঐ হরতালের কয়েকদিন পূর্বেই, সবারই অজ্ঞাতসারে, মােনেম ঢাকা থেকে পলায়ন করেন। ২১ মার্চ তার স্থলভিষিক্ত হন অধ্যাপক এম এন হুদা। হরতালের আগের দিন – ২৪ মার্চ – ভাসানী ১৫ দিনের পশ্চিম পাকিস্তান সফর শেষ করে ঢাকায় পৌঁছান। তিনি ইঙ্গিত দেন যে পর দিন – ২৫ মার্চ – সামরিক আইন জারী হবে। ভাসানীর ইঙ্গিত সত্য প্রমাণিত হলাে। মাহফুজউল্লাহর ভাষায়, “পুর্নবার, বিপথগামী ও লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের আন্দোলন”।(১৬)
মৌদুদ আহমেদ সঠিক ভাবেই মন্তব্য করেছেন যে সামরিক আইন আয়ুবের কাছেও অভিপ্রেত ছিল, আর সেনাবাহিনীর কাছেও। কারণ পাকিস্তানের শাসকচক্রের নেতা প্রতিভূ কারও কাছেই পূর্ব পাকিস্তানকে স্বায়ত্তশাসন প্রদান লাভজনক ছিল না। স্বায়ত্তশাসনভােগী। পূর্ব পাকিস্তানকে শােষণ করা যাবে না, এই শােষণের সুযােগ না থাকলে শাসকচক্রের ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগত লাভ শূন্যের কোঠায় পৌঁছাতে পারে। ১৩ মার্চ গােলটেবিল বৈঠক পরিত্যক্ত হবার পর আয়ুব একটি গােপন বৈঠকে মুজিবকে জিজ্ঞাসা করেন, পাকিস্তানের অখণ্ডতা বজায় রেখে ছয় দফার রূপায়ন সম্ভব কিনা। এর পর মুজিব ঢাকায়। ফিরে এলে তার আইনজ্ঞ-উপদেষ্টাবৃন্দ (যেমন, কামাল হােসেন, মৌদুদ আহমেদ) ছয়দিনের মধ্যে ১৯৬২ সালের পাকিস্তান সংবিধানের একটি সংশােধনী প্রস্তুত করেন, যাতে পাকিস্তানের অখণ্ডতা ও ছয়দফার সার্থক সমাহার পরিলক্ষিত হয়। মুজিবের ঘনিষ্ঠ সহকর্মী এবং সারা পাকিস্তান আওয়ামী লীগের মহাসচিব এ এইচ এস কামারুজ্জামান ২০ মার্চ ঐ খসড়া সংশােধনী আইন নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে যান। কিন্তু ঐ খসড়াপ্রাপ্তির চারদিনের মধ্যে – অর্থাৎ ২৪ মার্চ ১৯৬৯ – আয়ুব ইয়াহিয়া খানকে যে চিঠি দেন তাতে সংবিধানের উপরােক্ত সংশােধনীকে সামরিক আইন বহালের অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করা হয়, বলা হয় যে ঐ সংশােধনী পাকিস্তানকে বিখণ্ডায়নের দিকে ঠেলে দেবে। আয়ুবের চিঠিতে তাই পাকিস্তানকে ধ্বংসের হাত থেকে পরিত্রাণের জন্য সেনাবাহিনীকে আমন্ত্রন জানানাে হয়। স্পষ্টত, জীবনের সায়াহ্নে গণঅভ্যুত্থান থেকে উদ্ভূত পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়ার আত্মবিশ্বাস আয়ুবের ছিল না। অপর দিকে, সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে যারা ছিলেন – যেমন ইয়াহিয়া খান — তাদের তাে গণআন্দোলনের গতিপ্রকৃতি অনুধাবনের ন্যূনতম ক্ষমতাও ছিল না। গণজাগরণের তাৎপর্য উপলব্ধি তাে দূরের কথা, পাকিস্তানের বিদ্যমান সংবিধানও তারা কতােটা বুঝতেন বলা মুস্কিল। কারণ আয়ুব যেভাবে স্থল সেনা প্রধানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করলেন, তা ছিল পাকিস্তান সংবিধানের সম্পূর্ণ বিরােধী। ১৯৬২ সালের পাকিস্তানী গঠনতন্ত্রে এই হস্তান্তরের কোন বিধানই ছিল না। তবে, অন্যান্য অনেক দেশের রাজনৈতিক প্রভুত্বকামী সেনাপতিদের মতাে পাকিস্তানের সেনাপতিরাও একটি কৌশল জানতেন ? কিভাবে অন্ততঃ কিছুদিনের জন্য গণপ্রতিরােধ এড়ানাে যায়। তাই তারা আশ্বাস দিলেন যে তারা শাসন করতে চান না, তারা চান নিবাচিত জননেতাদের হাতে ক্ষমতা তুলে দিতে। তাদের কোন রাজনৈতিক উচ্চাশা নেই, তাদের লক্ষ্য সংবিধানসম্মত সরকার প্রতিষ্ঠার উপযােগী অবস্থার সৃষ্টি করা। ২৬ মার্চ ১৯৬৯ জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণে ইয়াহিয়া খান এসব সুললিত বাণীই প্রচার করেন। কারও কারও মতে অবশ্য, ইয়াহিয়া খান ও তার সহকর্মীরা (যেমন, চীফ অব জেনারেল স্টাফ গুল হাসান) আয়ুবকে না জানিয়েই সামরিক আইন জারীর গােপন সিদ্ধান্ত নেন। আয়ুব চেয়েছিলেন, তিনিই থাকবেন সামরিক সরকারের নেতা। কিন্তু তার মনস্কামনা পূর্ণ হলাে, তাকে পদত্যাগ করতে হলাে। সামরিক আইন জারীর পরই চট্টগ্রামে শ্রমিক ধর্মঘট হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের ছাত্র নেতা তারিক আলীর মন্তব্য অনুবাদ করে মাহফুজ উল্লাহ লেখেন, “পূর্ব পাকিস্তানীরা এক বছরের বেশী আরেকজন পশ্চিম পাকিস্তানী একনায়ক মেনে নেবেন বলে মনে হয় না। সামান্যতম ঘটনাও আরেকটি অভ্যুত্থানের জন্ম দিতে পারে, যার পরিণতি হবে স্বাধীন এবং সার্বভৌম পূর্ব পাকিস্তান।” (১৭)
২৬ মার্চ ১৯৬৯ ইয়াহিয়া খান তার বক্তৃতায় গণতন্ত্রের পুনরুজ্জীবন ও সাধারণ নিবাচনের ওপর জোর দেওয়ায় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও জনসাধারণ এটা ভেবে উল্লসিত হলাে যে পাকিস্তানের জন্মের পর এই প্রথম সারা দেশে সাধারণ নিবাচন অনুষ্ঠিত হােতে চলেছে। কিন্তু অন্যান্য অনেক দেশের সমরনায়কদের মতাে একবার রাজনৈতিক ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে ইয়াহিয়া খানও নিজেকে মুখ্য সামরিক প্রশাসকের সংকীর্ণ গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ রাখতে চাইলেন না। ৩১ মার্চ ইয়াহিয়া রাষ্ট্রপতির পদ দখল করলেন। একটি অস্পষ্ট কিন্তু অশুভ রাজনৈতিক সংকেত তিনি দিলেন ২ জুলাই, যখন তিনি বললেন যে ১৯৭০ সালে বা তার পূর্বে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারটি জনগণের আকাংখার ওপরই নির্ভর করবে। আর ৭ আগষ্ট তাে ইয়াহিয়ার রাজনৈতিক অভিলাষ গভীরতর প্রতীয়মান হলাে, তিনি ৭ জন মন্ত্রী নিযুক্ত করে মন্ত্রীপরিষদ গঠন করলেন। ২৮ নভেম্বর ১৯৬৯ একটি বক্তৃতায় ইয়াহিয়া শাসনতন্ত্রের আইনগত কাঠামাের আদেশ (লীগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার, সংক্ষেপে এল এফ ও) ৩১ মার্চ এর মধ্যে জারী করার প্রতিশ্রুতি দেন, এবং সাধারণ নির্বাচনের দিন ধার্য করেন ৫ অক্টোবর ১৯৭০। উপরােক্ত ভাষণে ইয়াহিয়া তিনটি বিতর্কিত শাসনতান্ত্রিক বিষয়ের উল্লেখ করেন, এবং প্রতিটি বিষয়ে স্বীয় সিদ্ধান্তও জ্ঞাপন করেন। প্রথমত, তিনি এক ইউনিট রদ করে পুনরায় পশ্চিম পাকিস্তানে ৪ টি প্রদেশের অস্তিত্ব ঘােষণা করেন। দ্বিতীয়ত, কেন্দ্রীয় আইনসভায় দুই অঞ্চলের – অথাৎ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের – ‘সমতার ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা নাকচ করে এক ব্যক্তি এক ভােট নীতি – বা জনসংখ্যার অনুপাতে প্রতিনিধিত্বের নীতি – গ্রহণের পক্ষে মত দেন। তৃতীয়ত, কেন্দ্র ও প্রদেশের সম্পর্কের ব্যাপারে ইয়াহিয়া খান প্রদেশগুলিকে সর্বোচ্চ সম্ভব মাত্রায় স্বায়ত্তশাসন প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেন। আবুল মনসুর আহমদ লিখেছেন, “ পশ্চিমা রাষ্ট্র নায়কদের মধ্যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াই সর্বপ্রথম এই কথাটা প্রকাশ্যে স্বীকার করিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেন ঃ পূর্ব পাকিস্তানীরা রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশীদারি অনুভব করিতে পারিতেছে না। তাই সেন্স অব পার্টিসিপেশন হইতে তারা বঞ্চিত। কথাটা সত্য। কিন্তু অংশতঃ সত্য। তাই জনসংখ্যা – ভিত্তিক প্রতিনিধিত্ব দিয়া তিনি অংশতঃ তার প্রতিকারের চেষ্টা করিয়াছেন। অংশতঃ এই জন্য যে, শুধু পালামেন্টে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভায় ও চাকুরিতে পূর্ব পাকিস্তানীদের মেজরিটি দিয়াও আসল বৈষম্যের প্রতিকার করা যাইবে না। কারণ, তাতে পূর্ব পাকিস্তানীদের সেন্স অব পার্টিসিপেশন দেওয়া হইবে বটে, কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক ফায়দা দেওয়া হইবেনা।” (১৮)।
যেমন ২৮ নভেম্বর ১৯৬৯ ভাষণে, তেমনি ৩০ মার্চ ১৯৭০ আইনকাঠামাে আদেশে, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের মাত্রা কতােটা তা ইচ্ছাকৃতভাবেই অস্পষ্ট রাখা হলাে, প্রলােভন জাগ্রত করা হলাে, কিন্তু আকাংখা পূরণের নিশ্চয়তা দেওয়া হলাে না। তবে, আইনকাঠামাের আদেশে ইয়াহিয়া খান ও সেনাবাহিনীর রাজনৈতিক ক্ষমতা জবরদখল করে রাখার প্রয়াস কিন্তু বেশ স্পষ্টই ছিল। ঐ আদেশের অন্ততঃ দুটি ধারায় ঐ প্রয়াস প্রকট। একটি ধারায় বলা ছিল, কেন্দ্রীয় আইনসভা সংবিধানের খসড়া সত্যয়নের নিমিত্ত রাষ্ট্রপতির কাছে। পাঠাবে, সত্যয়ন প্রত্যাখ্যাত হােলে আইনসভাই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। অপর একটি ধারায় আইনকাঠামাে আদেশের শতাবলী ব্যাখ্যায় রাষ্ট্রপতিকে চূড়ান্ত ক্ষমতা দেয়া হয়, এবং বলা হয় যে তার কোনও সিদ্ধান্ত নিয়ে আদালতে প্রশ্ন তােলা যাবেনা। উপরন্তু ঐ আদেশ সংশােধনের ক্ষমতা কেন্দ্রীয় আইনসভাকে না দিয়ে রাষ্ট্রপতিকেই দেয়া হয়। আইনকাঠামাে আদেশ পর্যালােচনায় এই সন্দেহ হওয়া স্বাভাবিক যে নির্বাচন যতই অবাধ-নিদোষ হােক, কেন্দ্রীয় আইনসভা রচিত সংবিধানের খসড়া যতই গণতন্ত্রসম্মত হােক, তার নাকচ হােয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল অত্যন্ত প্রবল। এই সন্দেহের বশবর্তী হয়ে সাধারণ নির্বাচন বর্জন করলে বােধহয় সেনাবাহিনীর রাজনৈতিক ক্ষমতাভােগ দীর্ঘায়িত হােতাে। অন্ততঃ মুজিব হয়তাে সেরকমই ভেবেছিলেন, তাই তিনি কোনও কোনও উগ্রবামপন্থী মহলের নির্বাচন। বর্জনের প্ররােচনা অগ্রাহ্য করেছিলেন। ঐসব বামবন্থী মহল আবার স্বৈরাচারী আয়ুবের অনুরক্তও ছিল। তাছাড়া নির্বাচনে ঐ বামপন্থী মহলের বিপুল সংখ্যক আসনে জয়লাভেরও বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা ছিল না। অতএব, কেউ যদি মনে করেন যে মুজিবের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার প্রতি অসূয়া এবং সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিরাট সাফল্যের সম্ভাবনাকে অংকুরেই বিনষ্ট করার জন্য নির্বাচন বর্জনের ধূয়া তােলা হয়েছিল, তিনি বােধহয় ভুল করবেন না। কিছু বামপন্থী দল যখন ভাসানীর নেতৃত্বে হঠাৎ ‘ভােটের বদলে ভাত চাই’ আওয়াজ তুললেন, তখন উপরােক্ত অনুমানই সত্য বলে প্রমাণিত হলাে। অপরদিকে জামাত-ই-ইসলামী আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা খর্ব করার জন্য এই অপপ্রচার চালালাে যে পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের মধ্যে বৈষম্যের অভিযােগ তােলা হচ্ছে। ইসলামের বিরুদ্ধে শত্রুতা। (১৯)।
উগ্র বামপন্থী-ডানপন্থী নেতাদের উপরােক্ত প্রচারে মুজিব বিভ্রান্ত বা বিচলিত হন নি, এটা তার আত্মবিশ্বাস ও রাজমতিক দূরদর্শিতার প্রমাণ। তিনি নিশ্চয়ই বুঝেছিলেন, ছয়দফা রূপায়নের জন্য প্রয়ােজন রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জন, এবং তার জন্য জরুরী আসন্ন সাধারণ নির্বাচনে বিপুল সাফল্য। পক্ষান্তরে, পূর্ব পাকিস্তানে মুজিব ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধপন্থীরা সম্ভবতঃ ছয়দফা কার্যে পরিণত করার চাইতে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতার বাইরে রাখতে বেশি উৎসাহী ছিলেন। অতএব, দেখা গেল, ১৯৭০ সালে নির্বাচনী প্রচারাভিযানে আওয়ামী লীগ যতাে এগিয়ে গেল, এবং গণসম্মােহনী ভাষনের দ্বারা মুজিব যখন প্রায় প্রবাদ পুরুষে পরিণত, তখন পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় সব কয়টি সংবাদপত্র এবং প্রায় সকল বাম-ডানপন্থী রাজনৈতিক দল মুজিব ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ব্যাপক অপপ্রচারে লিপ্ত হলাে। এই দলগুলির নেতিবাচক কার্যক্রম অত্যন্ত ন্যক্কারজনক পর্যায়ে পৌঁছে গেল সেপ্টেম্বর ১৯৭০ -এ, যখন পূর্ব পাকিস্তান বন্যার শিকার হলাে। প্রায় প্রতি বৎসরই পূর্ব পাকিস্তানে বিধ্বংসী প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দেয়। কিন্তু সেপ্টেম্বর ১৯৭০-র বন্যা পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধভাবাপন্ন দলগুলিকে ৫ অক্টোবর ১৯৭০ এর নিবচিন বানচাল করার একটা অজুহাত এনে দিলাে। মহা উৎসাহে তারা জনহিতার্থে নিবাচন পেছানাের দাবি তুললাে, তারা ভাবলাে, এভাবে নির্বাচনী দৌড়ে আওয়ামী লীগের সাফল্যের গতি রােধ করা যাবে। কিন্তু ঐ গতি যে অপ্রতিরােধ্য (কারণ যুগােপযােগী) সেটা অচিরেই উপলব্ধ হলাে। আওয়ামী লীগের প্রতিবাদ উপেক্ষা করে ইয়াহিয়া খান সাধারণ নির্বাচনের দিন পিছিয়ে স্থির করলেন ৭ ডিসেম্বর ১৯৭০া মুজিবের প্রচারাভিযানকে অবশ্য স্তব্ধ করা যায় নি, যথারীতি তা এগিয়ে চললাে। নির্বাচন পেছানাের ফলে শেষ পর্যন্ত বােধহয় মুজিব আরও সুবিধাজনক অবস্থানে পৌঁছে গেলেন। কারণ ১২ নভেম্বর ১৯৭০ স্মরণকালে সবচেয়ে বিধ্বংসী ঘূর্ণীঝড় ও জলােচ্ছাসে পূর্ব পাকিস্তান আক্রান্ত হলাে। এ সময় পাকিস্তান সরকারের কার্যকলাপে পূর্ব পাকিস্তানের জনমানসে মুজিবের ছয়দফার অপরিসীম গুরুত্ব অনুভূত হলাে। পূর্ব পাকিস্তানে যখন অন্ততঃ দশলক্ষ ব্যক্তি মৃত, এবং পশুসম্পদ ও স্থাবর সম্পত্তি নাশের পরিমাণ অজ্ঞত, তখন দশ দিন ইয়াহিয়া খান ব্যস্ত থাকলেন তার অধস্তন সেনানায়কদের পদোন্নতির দাবি মেটানাের
১৪০
উদ্বিগ্ন আলােচনায়। সংঘর্ষমুখী সমরনায়কদের দাবিপূরণ তখন ইয়াহিয়ার কাছে পূর্ব পাকিস্তানে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ত্রানকার্যের চাইতে অনেক বেশি জরুরী — কারণ নিছক আত্মরক্ষা, ইয়াহিয়ার নিজের পদচ্যুতি নিবারণ ও রাজনৈতিক মর্যাদা সংরক্ষণ। অতএব, পূর্ব পাকিস্তানে ত্রাণ সামগ্রী এলাে সুদূরবর্তী বৃটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশ থেকে, কিন্তু পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার থেকে কোন সাহায্য আসেনি। পূর্ব পাকিস্তানের দুর্গত জনসাধারণের কাছে ছুটে যাবার সময় বা মানসিক ঔদার্য পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ছিল না। কিন্তু তারা যে শােকার্ত, এটা প্রচারের এক অভিনব উপায় তারা আবিষ্কার করে তারা দাবি তােলে যে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে নির্বাচন পুনরায় পিছিয়ে দেয়া হােক। একই দাবি তােলে সেনা বাহিনীর দ্বারা সঙ্গোপনে পুরস্কৃত কিছু রাজনৈতিক দল, যেমন, পাকিস্তান ন্যাশনাল লীগ, কৃষক শ্রমিক দল, জামাত-ই-উলেমা -ইইসলাম। অথচ, যাতে এটা বােঝা না যায় যে তারা সেনাবাহিনীর সেবাদাস, এবং যাতে মুজিবের জনপ্রিয়তাকে হুমকির মুখােমুখি করা যায়, ঐ দলগুলি হঠাৎ পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি তােলে, যদিও অতীতে তারা মুজিবের ছয়দফারও বিরােধিতা করেছে। (২০)।
মুজিব অবশ্য নিবাচন পেছােনাের অপকৌশলের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ তােলেন, ও হুমকি দেন, দশলক্ষ লােক যদি প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রাণ হারিয়ে থাকে, আরও দশ লক্ষ প্রস্তুত আছে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের আশাপূরণে আত্মাহুতি দিতে। শেষ পর্যন্ত দুর্গত এলাকা বাদে সর্বত্র ৭ ডিসেম্বর ১৯৭০ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলাে। নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হলে দেখা যায়, জাতীয় পরিষদের ৩১৩ টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ১৬৭ টিতে জয়ী হয়েছে। প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন হয় ১৭ ডিসেম্বর, আওয়ামী লীগ ৩১০ টি আসনের মধ্যে ২৯৮ টিতে জয়ী হয়। অপরদিকে ভূট্টোর নেতৃত্বাধীন পিপলস পার্টি জাতীয় পরিষদে মাত্র ৮৮ টি আসন পায়। আবদুল ওয়াহেদ তালুকদার লিখেছেন : “বঙ্গবন্ধুর নিরংকুশ বিজয় মাশাল ল’ কর্তৃপক্ষের কাছে ছিল অপ্রত্যাশিত। গােয়েন্দা বিভাগের রিপাের্ট অনুসারে তারা ভেবেছিল আওয়ামী লীগ ১০২ টা আসনের বেশী পাবে। কিন্তু বাস্তবে তা মিথ্যা প্রতিপন্ন হলাে। মেজর জেনারেল ওমর ও গােয়েন্দা বিভাগের ডাইরেক্টর জেনারেল এন এ রিজভী বিভিন্ন শিল্পপতিদের ওপর চাপ প্রয়ােগ করে ২০-২২ লাখ টাকা যােগাড় করে আওয়ামী লীগ বিরােধী ৫-৬ টি দলের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু তাতেও আওয়ামী লীগকে ঠেকানাে যায়নি।” (২১)।।
এর পর শুরু হলাে গভীর এবং ব্যাপক ষড়যন্ত্র কি ভাবে অবাধ-নিরপেক্ষ সাধারণ নিবাচনে অর্জিত নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগকে – এবং মুজিবকে— ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে দূরে সরিয়ে রাখা যায়। এ ব্যাপারে অগ্রনী হলেন ভুট্টো এবং কট্টরপন্থী পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাপতিবৃন্দ, যেমন, ওমর, হামিদ, গুল হাসান, টিক্কা খান, ইত্যাদি। এই সব সেনানায়কগণ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানেই উৎসুক ছিলেন না – ইয়াহিয়া নির্বাচনে রাজী হওয়ায় এরা অতীব অসন্তুষ্ট হন। নির্বাচনের ফলাফল যখন আওয়ামী লীগ ও ছয়দফার পক্ষে গেল, তখন এরা প্রমাদ গণলেন। কারণ ছয়দফা রূপায়িত হােলে, এবং পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চলের অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীভূত করার জন্য পূর্ব পাকিস্তানে উন্নয়ন ব্যয় বিপুলভাবে বাড়ানাে হােলে, সেনাবাহিনীর জন্য নির্দিষ্ট বার্ষিক ব্যয় অনেকটাই হ্রাস পাবে। ফলে সমরনায়কদের ক্ষুদ্রস্বার্থ আহত হবে। একই কারণে আহত হবে পশ্চিম পাকিস্তানী ব্যবসায়ীদের স্বার্থ, যারা দুই দশকেরও অধিক সময় পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে শােষণ করতে অভ্যস্ত। আওয়ামী লীগ শাসনে, ছয়দফার দ্বারা প্রভাবিত রাষ্ট্রনীতি, ঐ শােষণ বিলােপেই নিয়ােজিত হবে। পশ্চিম পাকিস্তানে যেসব গােষ্ঠী সর্বাধিক ক্ষমতাশালী – যেমন, সামরিক আমলাবর্গ (এবং তাদের সুহৃদ ও লেজুড় বেসরকারী আমলাবর্গ), এবং বৃহৎ ব্যবসায়ী (যাদের সঙ্গে জড়িত সামন্ততান্ত্রিক ভূস্বামীবৃন্দ) — তাদের স্বার্থের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনীতিক ভুট্টোর স্বার্থ বেশ মিলে গেল। উভয়েরই উভয়কে বিশেষ প্রয়ােজন। সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল যাই হােক, ভুট্টো যে কোন উপায়ে মুজিবকে এড়িয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবেন। তার এই অন্যায় অভিলাষকে প্রশ্রয় দিলাে আমলা-ব্যবসায়ী-ভূস্বামীচক্র। স্বয়ং একজন বৃহৎ জমিদার, ভুট্টো, ঐ চক্রের প্রতিভূ হয়ে ১৯৭০ এর নির্বাচনী ফলাফল নস্যাৎ করার জন্য সর্বাত্মক ষড়যন্ত্রে সামিল হােলেন। (২২)।
গণতান্ত্রিক নির্বাচনের ফলাফল নাকচ করার ষড়যন্ত্রে ভুট্টো নানাবিধ কলাকৌশল প্রয়ােগ করলেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তান সফরে এলেন, মুজিবের সঙ্গে আলাপ-আলােচনা করলেন। ছয়দফার ওপরে সমাজবাদের হেঁয়ালিকে অগ্রাধিকার দিলেন, কিন্তু, বলা বাহুল্য, মতৈক্য হলাে না। কট্টরপন্থী সেনাপতিদের উসকানিতে বলীয়ান হয়ে ভুট্টো ইয়াহিয়াকেও হুমকি দিলেন। ফলে, ঢাকায় মুজিবের সঙ্গে আলােচনায় ইয়াহিয়া তাকে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সম্বােধন করলেও, এবং জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা মুজিবের বারবার অনুরােধ সত্বেও, ইয়াহিয়া সত্বর জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসাতে ব্যর্থ হলেন। অযথা বিলম্বের পর ৩ মার্চ ১৯৭১ অধিবেশনের দিন ধার্য হয়। কিন্তু ছয়দফা মানতে গররাজী ভুট্টো অধিবেশন বর্জনের ডাক দিলেন। তার দল এবং কায়ুমপন্থী মুসলিম লীগ ব্যতীত পশ্চিম পাকিস্তানের আর সব দলই জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যােগ দিতে প্রস্তুত ছিল। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের কোন সাংসদ যাতে ঢাকায় ঐ অধিবেশনে যােগ দিতে না যায়, সেজন্য ভুট্টো হত্যার হুমকি দিতেও ইতস্তত করেন নি। ভুট্টোর আওয়ামী লীগ বিরােধিতার সঙ্গে যুক্ত হলাে তার দুর্নিবার ভারত বিরােধিতা, তার এক হাজার বছরব্যাপী যুদ্ধের আওয়াজ। এভাবে প্রচেষ্টা হলাে আওয়ামী লীগের ছয়দফা তথা সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াইকে ভারতের সঙ্গে লড়াই -এর জিগিরের
আড়ালে ঠেলে দেয়া। ছয়দফা অনুসারে এবং পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থসাধক রাষ্ট্রনীতি অনুযায়ী ভারত ও পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক সহযােগিতা বৃদ্ধির সম্ভবনা ভুট্টো ও পশ্চিম পাকিস্তানী কায়েমী স্বার্থগােষ্ঠীকে চূড়ান্ত ভাবে বিরূপ করেছিল। জানুয়ারী মাসে যখন একটি ভারতীয় যাত্রীবাহী বিমান ছিনতাই করে লাহােরে আনা হলাে, এবং পরে পাকিস্তানী নিরাপত্তা বাহিনীর সামনে বিনা বাধায় সেটিকে ধ্বংস করা হলাে, তখন পাকিস্তানের পূর্ব-পশ্চিম বিরােধকে ভারত-বিরােধিতার দ্বারা আচ্ছন্ন করার চেষ্টা হলাে। ভুট্টোর উদ্যোগে পাকিস্তানের নানা শহরে উপরােক্ত আতঙ্কবাদী ও নাশকতাকারীদের সম্মানে জনসভা আহ্বান করা হলাে। (২৩)।
পূর্ব পাকিস্তানের বিরুদ্ধে উপরােক্ত ষড়যন্ত্রের মুখােমুখি হয়ে পূর্বাঞ্চলের জনগণ ও আওয়ামী লীগ একের পর এক সময়ােপযােগী ব্যবস্থা গ্রহণ করে। পাকিস্তানের অতীত ইতিহাস থেকে জানা যায়, অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপ গ্রহণে সামরিক-বেসামরিক আমলাবর্গের উপর্যুপরি সাফল্যের অন্যতম মৌলিক কারণ ছিল নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের অনৈক্য। ১৯৭০ নির্বাচনে জয়ী আওয়ামী লীগ প্রতিনিধিরা যাতে ঐক্য বজায় রাখতে অনুপ্রাণিত হন, এবং অনৈক্য ও বিশ্বাসঘাতকতার কি চরম মূল্য দিতে হবে সেটা অবহিত থাকেন, সেজন্য ৩ জানুয়ারী ১৯৭১ ঢাকায় রেসকোর্স ময়দানে একটি শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান * আয়ােজিত হয়। সেখানে মুজিব বলেন, যদি ছয়দফার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা হয়, তাহলে জনতা যেন আওয়ামী লীগকে ক্ষমা না করে, এবং মুজিবকেও জীবন্ত কবর দিতে দ্বিধা না করে। ১ মার্চ মধ্যাহ্নে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্ট কালের জন্য মুলতবী রাখার সিদ্ধান্ত প্রচার করা হয়। আবুল মনসুর আহমদের মূল্যায়নে, “নিতান্ত সদিচ্ছা সত্ত্বেও মানুষ বড় অন্যায় কাজ করিয়া ফেলিতে পারে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার বেলাও ঠিক তাই ঘটিয়াছে। বিভিন্ন দলের মধ্যে আপােস ঘটাই বার চেষ্টা করিতে গিয়া নিতান্ত স্বাভাবিকভাবেই তিনি নিরপেক্ষতা হারাইয়াছেন। এক দলের পক্ষে ও অপরাপর দলের বিপক্ষে গিয়াছেন। শুধু মনের দিক হইতে নয়, কাজের দিক হইতেও। ১ মার্চ যখন কেন্দ্রীয় আইনসভার অধিবেশন অনির্দিষ্টকাল পেছানাের ঘােষণা দেয়া হলাে, তখন ঢাকার পূর্বানী হােটেলে মুজিব ও আওয়ামী লীগের সংবিধান প্রণেতারা ছয়দফা অনুসারে অখণ্ড পাকিস্তানের নতুন সংবিধান রচনার কাজ প্রায় শেষ করে ফেলেছিলেন। তারা জানতেনও না, রেডিওতে কি ঘােষণা প্রচারিত হয়েছে। কিন্তু জনসাধারণ জানতাে। তারা বিক্ষোভে ফেটে পড়লাে। শহরের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মিছিল এসে পূর্বানী হােটেলের সামনে সমবেত হলাে। আওয়ামী লীগের সহচর সংগঠন ছাত্র লীগের নেতৃবৃন্দ প্রচণ্ড ভাবে ক্ষিপ্ত হলেন। ছাত্রনেতারা আর স্বায়ত্তশাসনের সংকীর্ণ গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ থাকতে রাজী ছিলেন না, পল্টন ময়দানে সভা করে তারা স্বাধীনতার দাবি তুললেন। মনে রাখা প্রয়ােজন, ঐ সময় সারা দেশে ছাত্র লীগের প্রভাব তুঙ্গে। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৭০ এর এপ্রিলের অবস্থা অনুযায়ী, ১৩৪ টি কলেজের মধ্যে ১২৪ টিতেই ছাত্র ইউনিয়নগুলি ছিল ছাত্র লীগের অধিকারে। অতএব ছাত্র লীগ পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা দাবি করলে তার অভিঘাত সুদূরপ্রসারী হতে বাধ্য। ১ মার্চ হরতাল পালিত হলাে স্বতঃস্ফূর্তভাবে, এবং পরদিন মুজিবের আহ্বানে হরতাল অব্যাহত রইলাে। ১ মার্চ পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা ও জিন্নাহর প্রতিকৃতি দাহ করা হয়। জনতা আওয়াজ ওঠায়, “এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলা ভবনের সম্মুখে একটি বিরাট ছাত্রসভায় বাংলাদেশের (পূর্ব পাকিস্তানের নয়) স্বাধীনতা ঘােষণা করা হয়, এবং সদ্যপ্রস্তুত নতুন জাতীয় পতাকা উত্তোলিত করা হয়। প্রসঙ্গত মনে করা যায়, ৫ ডিসেম্বর ১৯৬৯ সােহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে মুজিব ঘােষণা করেন যে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের প্রদেশকে বাংলাদেশ নামে অভিহিত করা উচিত। (২৪)।
১ মার্চ নিরাপত্তা বাহিনীর গুলীতে একজন বিক্ষোভকারী নিহত এবং সাতজন আহত হয়। ৩ মার্চ ছাত্র লীগ ও জাতীয় শ্রমিক লীগের উদ্যোগে পল্টন ময়দানে বিশাল জনসভা হয়। সভার সংগঠকগণ আওয়াজ দেন ঃ “কৃষক শ্রমিক অস্ত্র ধরাে, বাংলাদেশ স্বাধীন করাে”। ঐ দিনই কট্টরপন্থী লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান পূর্ব পাকিস্তানের শাসনভার গ্রহণের উদ্যোগ নেন। যেমন জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠান বা মুলতবীর ব্যাপারে, তেমনি টিক্কা খানকে নিয়ােগের ব্যাপারেও আইনসভায় নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার অধিকারী – এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীত্বের একমাত্র ন্যায়সঙ্গত দাবিদার – মুজিবের সঙ্গে কোন পরামর্শই করা হয় নি। এসব সত্ত্বেও মুজিব ৩ মার্চ বক্তৃতায় ছিলেন। সহনশীলতা, মধ্যপন্থা ও গণতন্ত্রমনস্কতার মূর্ত প্রতীক। নিদারুণ প্ররােচনা সত্ত্বেও তিনি পাকিস্তান বিভাজনের আহ্বান দেননি। তিনি হুঁশিয়ারি দিলেন, গুলীবর্ষণ ও নিরস্ত্র মানুষের হত্যা নিছক কাপুরুষতা, এবং, সাড়ে সাত কোটি মানুষের নিধন অসম্ভব। মুজিব নির্দেশ দিলেন, যতদিন না পর্যন্ত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতার পরিপূর্ণ হস্তান্তর ঘটছে ততদিন অহিংস অসহযােগ আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। সরকারকে কোনও খাজনা দেয়া বন্ধ। কিন্তু হিংসা প্রতিরােধ করতে হবে। শান্তি বজায় রাখতে হবে। মুজিব ডাক দিলেন, সব সরকারী সংস্থার কর্মীবৃন্দ দায়িত্বপালনে বিরত থাকবে। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে তিনি আবার ভাষণ দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের কার্যক্রম পর্যালােচনা করে পুনরায় প্রয়ােজনীয় নির্দেশ দেবেন বলে ৩ মার্চ ঘােষণা করলেন। ঐ দিন ৩০০ বিক্ষোভকারী নিরাপত্তা বাহিনীর গুলীতে নিহত হয়। পাকিস্তানী সৈন্যরা অত্যাচারী দখলদার বাহিনীর ভূমিকা অবলম্বন করেছিলাে। এই পরিস্থিতিতে ৬ মার্চ রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া যখন পুনরায় – এবং এবারও মুজিবের সঙ্গে পরামর্শ করার ন্যূনতম সৌজন্য প্রদর্শন না করে – ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের উদ্বোধন দিবস ধার্য করলেন, তখন বােধহয় পূর্ব পাকিস্তানের কোন ব্যক্তিই রাষ্ট্রপতির বাতার ওপর আস্থা স্থাপন করতে পারেন নি। ৪, ৫, ও ৬ মার্চ অর্ধ দিবস সাধারণ ধর্মঘট চলে। ৭ মার্চ ঐতিহাসিক ভাষণে মুজিব বলেন, জনসাধারণ তাকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্ত করেছিলাে। জনতার সহিত তিনি রক্তের ঋণে আবদ্ধ। নিজের রক্ত দিয়ে তিনি ঐ ঋণ শােধে প্রস্তুত। নির্বিচারে হানাদার বাহিনী জনসাধারণের ওপর গুলী চালিয়েছে। অতএব, মুজিব ঘােষণা দিলেন, শহীদের রক্তের ওপর হেঁটে তিনি ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদে প্রবেশ করবেন না। চারটি দাবি পূরণ হলেই তিনি আইনসভায় যাবেন। ঐ দাবিগুলি ছিলাে সামরিক আইন প্রত্যাহার, সেনাবাহিনীর ছাউনিতে প্রত্যাবর্তন, গণহত্যার তদন্ত এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতা অর্পণ। ঐদিন মুজিবের মর্মস্পর্শী আহ্বান হলাে ঃ “এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সং গ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”। টিক্কা খান হুকুম দিলেন, মুজিবের ৭ মার্চ এর বক্তৃতা বেতারে প্রচার করা যাবে না। এর প্রতিবাদে ঢাকা বেতার কেন্দ্রের সব কর্মী ধর্মঘট করে। কর্তৃপক্ষ। পরদিন ঐ বক্তৃতা প্রচারে মত দেয়ায় ধর্মঘটের অবসান হয়। বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য, ঐ সময়ে ঢাকা বেতার ও দূরদর্শন কেন্দ্রের প্রায় সব কর্মীই কেন্দ্রীয় সরকারের অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে স্ব স্ব পেশাগত দক্ষতার প্রয়ােগে চমকপ্রদ প্রতিবাদ প্রতিরােধ গড়ে তুললেন। সঙ্গীত ও অন্যান্য কার্যক্রম মারফত তারা পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণের বিদ্রোহী সত্ত্বাকে সদা জাগ্রত ও উদ্বুদ্ধ রাখলেন। (২৫)।
টিক্কা খান পূর্ব পাকিস্তানের রাজ্যপালের পদ অলংকৃত করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পারেন নি, কারণ মুজিবের অসহযােগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে ঢাকা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি টিক্কা খানকে শপথ গ্রহণ করাতে অস্বীকার করেন। অতএব টিক্কা পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্য সামরিক প্রশাসক হিসেবেই কার্যভার গ্রহণ করেন। ১৯৭১ এর মধ্য মার্চের মধ্যে দেখা গেলাে,” লিখেছেন মুনতাসীর মামুন এবং জয়ন্ত কুমার রায়, “সরকারী কর্তৃত্ব সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে সেনানিবাস ও বিমানবন্দরের মধ্যে। তা সত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তানে কর্মরত পশ্চিম পাকিস্তানী সেনা কতারা ভাবতাে, যথাযথ কর্তৃত্ব পেলে পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীদের তারা দমন করতে পারবে। সেনানিবাসে খাদ্যসরবরাহকারী ঠিকাদাররাও সরবরাহ বন্ধ করে দিলাে। একই ভাবে, সেনানিবাসে প্রকৌশলী শাখার বেসামরিক কর্মচারীরাও কাজে যাওয়া থেকে বিরত থাকলেন। পাকিস্তানের দুই অংশে বানিজ্য বন্ধ রইলাে। কিন্তু চট্টগ্রাম ও চালনা বন্দরে জাহাজ ভর্তি সেনা এসে নামলাে। বার্মা, চীন ও শ্রীলংকার ওপর দিয়ে বিমানে করে বেসামরিক পােশাকে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা এসে নামতে লাগলাে ঢাকা বিমানবন্দরে।” (২৬)। | ইয়াহিয়া খান অবশ্য কূটকৌশল প্রয়ােগ অব্যাহত রাখলেন। তিনি পুনরায় ঢাকা। এলেন। ঘােষিত উদ্দেশ্য মুজিবের সঙ্গে আলাপ আলােচনা, কিন্তু অঘােষিত ও প্রকট লক্ষ্য হানাদারবাহিনী কতােটা শক্তিশালী হয়েছে, এবং নির্বাচনী ফলফল সামরিক অভিযানে নিশ্চিহ্ন করা যাবে কিনা, এসব পর্যবেক্ষণ ও পর্যালােচনা করা। ১৯৭১ মার্চ মাসে মুজিব
১৪৫
ইয়াহিয়া আলােচনার পরিপ্রেক্ষিতে, লিখেছেন এম আর আখতার মুকুল, “ পরবর্তীকালে গণহত্যা, মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় হলেও সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, মুজিব-ইয়াহিয়া আলােচনা কিন্তু সেদিন অসমাপ্ত ছিলাে। ১৬ ই মার্চ থেকে শুরু করে ২৩ শে মার্চ পর্যন্ত এই আট দিনব্যাপী আলােচনার প্রতিটি বৈঠকে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে তার পরামর্শদাতারাসহ অন্যান্য বাঙালি নেতৃবৃন্দ যে প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন, তা অবিস্মরণীয় হয়ে থাকার কথা। কেননা আলােচনার বাহানা করে কালক্ষেপণের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে অতিরিক্ত সৈন্য আমদানী করে বাংলাদেশে গণহত্যার পূর্ব সিদ্ধান্ত সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার পক্ষে আলােচনা ব্যর্থ হয়েছে এই কথা বলা সম্ভব হয় নি। … প্রকৃতপক্ষে কোন রকম ঘােষণা ছাড়াই ২৩ শে মার্চ ছিলাে শেষ বৈঠক।”(২৭)।
পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে দ্রুত বিলীয়মান বন্ধনের শেষ সূত্র বােধহয় ছিলেন মুজিব স্বয়ং। কিন্তু ৬ মার্চ এর ভাষণে ইয়াহিয়া খান যখন আইনসভার বৈঠক বাতিলের জন্য মুজিবকে দায়ী করেন, তখন তিনি ঘােরতর অন্যায় করেছিলেন। এই অন্যায়ের পুনরাবৃত্তি ঘটলাে ২৩ মার্চ যখন মুজিবকে কোন কিছু না জানিয়ে ইয়াহিয়া মুজিবের সঙ্গে আলােচনায় সমাপ্তি ঘটালেন। অথচ মার্চ মাসের প্রথম তিন সপ্তাহে মুজিব কার্যত পূর্ব পাকিস্তানের শাসনকর্তা হিসেবে কাজ করে পাকিস্তানের অখণ্ডতার প্রতি পূর্ণ সমর্থন বজায় রেখেছেন। “ ছয়দফা যে পাকিস্তানের অখণ্ডতা-বিরােধী নয়, শেখ মুজিব .. তিনটি সপ্তাহ সম্পূর্ণ স্বাধীন ভাবে পূর্ব পাকিস্তানের ডি ফ্যাক্টো সরকার চালাইয়া তা প্রমাণ করিয়াছেন। এই একুশ দিনে বাংলাদেশে কেন্দ্রীয় সরকার বলিতে কিছু নাই। তবু শেখ মুজিব ছয়দফার বাইরে এক ইঞ্চি জমিতেও পদক্ষেপ করেন নাই। পররাষ্ট্র ও দেশরক্ষা ব্যাপারে তিনি কোনও হস্তক্ষেপ করেন নাই,” লিখেছেন আবুল মনসুর আহমদ।(২৮) | ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসে কোনও সরকারী বা বেসরকারী ভবনে পাকিস্তানের পতাকা ওড়ে নি। কিন্তু বাংলাদেশের নতুন পতাকা ছিল সর্বত্রই উড্ডীন। ঐ দিন শত শত মিছিল শহর প্রদক্ষিণ করে মুজিবের আবাসভবনে এসে বাংলাদেশের স্বাধীনতার আওয়াজ তােলে। বৃহত্তম মিছিল ছিল ছাত্রদের, নেতৃত্বে ছিলেন এ এস এম আবদুর রব। এরপর শুরু হলাে গগনভেদী জাতীয়তাবাদী গণধ্বনি। এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হলাে যে তার নিজের বাড়ীতেও মুজিবকে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করতে হলাে। ২৪ মার্চ অপরাহ্নে মুজিব ও ইয়াহিয়ার উপদেষ্টাদের মধ্যে শেষ আলােচনা অনুষ্ঠিত হলাে, যদিও পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের প্রকৃতি পরিমাণের ব্যাপারে মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হলাে না। সরকারীভাবে অবশ্য আলােচনা সমাপ্ত হয় নি। কিন্তু ২৪ মার্চ সন্ধ্যায় ও ২৫ মার্চ সকালে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত রাজনীতিকবৃন্দ এবং ইয়াহিয়ার উপদেষ্টাগণের প্রায় সকলেই ঢাকা ত্যাগ করেন। ২৫ মার্চ সকাল ৯ টায় ভুট্টো ইয়াহিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আওয়ামী লীগের শাসনতান্ত্রিক প্রস্তাবের প্রতি তার চূড়ান্ত অসম্মতি জ্ঞাপন করেন। শাসকচক্রের শীর্ষস্থানীয় চরমপন্থী সেনাপতিবৃন্দ – হামিদ, ওমর, মিঠা, পীরজাদা, টিক্কা — সকাল দশটায় রাষ্ট্রপতি ভবনে ইয়াহিয়ার সঙ্গে আলােচনায় বসেন। অপরাহ্নে সেনানিবাস সূত্র থেকে মুজিব জানতে পারেন, রাজনৈতিক মীমাংসার কোনও সম্ভাবনা নেই, ইয়াহিয়া ঢাকা ত্যাগ করেছেন, এবং সামরিক বাহিনী হিংসাত্মক অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ২৫ মার্চ বেলা এগারােটায়ই টিক্কা খান পূর্ব পাকিস্তানের ভারপ্রাপ্ত সেনানায়ক মেজর জেনারেল খাদিম হােসেন রাজাকে ঐ দিন রাতে অভিযান শুরুর নির্দেশ দেন। এই অভিযানের সাংকেতিক নাম ছিলাে অপারেশন সার্চলাইট। অভিযান শুরুর সময় ২৫-২৬ মার্চ রাত্রি একটা। অসমসাহসী মুজিব অভিযানের খবর পেয়ে তার সহকর্মীদের অজ্ঞাতবাসে যাবার নির্দেশ দিলেন, কিন্তু নিজে তার আবাসভবনেই থাকলেন। অভিযান শুরুর অল্প সময় পরই মুজিবকে গ্রেফতার করা হয়, সাধারণ সৈনিকেরাও তার প্রতি ভয়ানক অভদ্র আচরণ করে। ইংরেজী তারিখ ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে গ্রেফতার হওয়ার আগেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ইষ্ট পাকিস্তান রাইফেলস এর বেতারযন্ত্র মারফত চট্টগ্রাম ও নানা স্থানে স্বাধীনতার ঘােষণা প্রেরণ করেন। পরে ২৬ মার্চ অপরাহ্নে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের জেলা সম্পাদক এম এ হান্নান স্বাধীনতার ঘােষণা প্রচার করেন। আরও পরে ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় চট্টগ্রামের কালুরঘাটে সদ্যস্থাপিত বিপ্লবী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমান (ভবিষ্যতে রাষ্ট্রপতি) স্বাধীনতার বাণী ঘােষণা করেন। মুজিব তার স্বাধীনতা ঘােষণায় বলেনঃ “সম্ভবতঃ এটাই আমার শেষ বাণী। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণকে আমি এ মর্মে আহ্বান জানাচ্ছি, আপনারা যেখানেই থাকুন না কেন এবং আপনাদের হাতে যা কিছু রয়েছে, তাই-ই দিয়ে দখলদার সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত লড়াই করুন। বাংলাদেশের মাটি থেকে দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যকে বহিষ্কার করে বিজয়লাভ না করা পর্যন্ত আপনাদের লড়াই অব্যাহত থাকবে।” (২৯)।
এর পর একদিকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর নৃশংস গনসংহার, গণধর্ষন, পরিকল্পিত বুদ্ধিজীবী হত্যা, ইত্যাদি, অপরদিকে জনসাধারণের মুক্তিযুদ্ধে যােগদান, মার্চ ১৯৭১ থেকে ডিসেম্বর ১৯৭১ মুক্তিবাহিনীর উত্তরােত্তর সাফল্যলাভ, মুক্তিবাহিনীর প্রতি প্রতিবেশি রাষ্ট্র ভারতের ক্রমবর্ধমান সমর্থন, শেষ পর্যন্ত ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ যৌথভাবে ভারতীয় সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর কাছে ঢাকায় পাকিস্তানী সৈন্যদের আত্মসমর্পন, এবং স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ। এসব বিষয়ে আছে বহু বিতর্ক, প্রকাশিত হয়েছে অনেকের গ্রন্থ-প্রবন্ধ (বর্তমান লেখকেরও), কিন্তু ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত একটি পুস্তকের ভাষান্তরের পরিশিষ্ট হিসেবে রচিত এই সপ্তম অধ্যায়ে এসব বিষয়ের অবতারণা নিষ্প্রয়ােজন। যেটার উল্লেখ-এবং পুনরুল্লেখ – অবশ্য প্রয়ােজনীয়, সেটা হলাে, গণতন্ত্র এবং জাতীয়তাবাদের অগ্নিপরীক্ষায় পাকিস্তানী শাসকচক্রের চরম ব্যর্থতা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত। এই ব্যর্থতার কারণেই স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন রূপান্তরিত হয় অসহযােগ আন্দোলনে, আর অসহযােগ আন্দোলন পরিণত হয় সফল স্বাধীনতা সং গ্রামে। অসহযােগ আন্দোলন পরিচালনায় শেখ মুজিবর রহমান অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন — মুজিব প্রদত্ত বিশদ ৩৫ টি নির্দেশ ছিল অতীব সুচিন্তিত। বােরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর-এর ভাষায়, “৩৫ টি নির্দেশের লক্ষ্য ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব প্রতিরােধ এবং অস্বীকার করা এবং একই সঙ্গে এই ভূখণ্ডের জনজীবনের স্বাভাবিকতা এবং শৃঙ্খলা রক্ষা করা। কর্তৃত্ব প্রতিরােধ এবং অস্বীকার করার মাধ্যম পাকিস্তান রাষ্ট্রের সঙ্গে সর্বাত্মক অসহযােগিতা এবং জনমুখী কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যম বাঙালী জনসাধারণের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতৃত্বাধীন প্রশাসনের সর্বাত্মক সহযােগিতা। এই সহযােগিতার ভিত্তি বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং এই জাতীয়তাবাদ দায়িত্বশীল।” বর্তমান পুস্তকের উপসংহারে জাহাঙ্গীর-এর আর একটি মন্তব্য উদ্ধৃত করা সমীচীন ঃ “ অসহযােগ আন্দোলন রাষ্ট্রের সংজ্ঞা বদলে দিয়েছে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের সংজ্ঞার ভিত্তিতে কাজ করেছে। জনপ্রতিনিধিত্বহীনতা, সামরিকতা এবং জবরদস্তি। বিপরীতে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভিত্তি মূলে কাজ করেছে সিভিল সমাজ প্রতিষ্ঠা, রাষ্ট্র পরিচালনায় জনপ্রতিনিধিত্বতা প্রবর্তন, সামরিকতা উচ্ছেদ এবং সম্মতিবােধ শক্তিশালী করে তােলা।” (৩০)।
১৪৮
স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধীনতা।
1. KAMRUDDIN AHMAD, A Socio Political History of Bengal (Inside Library, Dhaka, 1975), pp. 206-7.
2. JAGLUL ALAM, Bangladeshe Bamponthi Rajnitir Garidhara (Pratik, Dhaka, 1990), p. 46.
3. MOUDUD AHMED, Bangladesh : Constitutional Quest for Autonomy (University Press Limited, Dhaka, 1979). pp. 99-104 ; KAMRUDDIN AHMAD, n. 1. pp. 207-8.
4. The Pakistan Observer, 27 January, 23 February 1968 ; Sangbad, 20 February 1968 ; KAMRUDDIN AHMAD, n. 1, p. 209.
5. Dawn, 8 November 1968 ; The Pakistan Observer, 11, 14 November 1968 ; MAHFUZULLAH, Obhyuthyaner Unosottor (Dana, Dhaka, 1983), pp. 9-13.
6. Dainik Pakistan, 20, 23 November 1968 ; MAHFUZULLAH, n. 5, pp. 13-8.
7. MOUDUD AHMED, n. 3, pp. 135-6; KAMRUDDIN AHMAD, n.
১৮০
1, pp. 212-3; MESBAH KAMAL, Srenidristite Bangladesher Muktijuddho (Kapotakshi, Dhaka, 1984), p.22.
8. The Pakistan Observer, Sangbad, 6 January 1969 ; Bichitra (Weekly, Dhaka), 9 September 1977, p. 68 ; TARIQ ALI, Pakistan : Military Rule or People’s Power (Jonathan Cape, London, 1970), p. 172; MOUDUD AHMED, n. 3, p. 138 ; JAGLUL ALAM, n. 2, p. 49.
9. KAMRUDDIN AHMAD, n. 1, pp. 213-4 ; The Pakistan Observer, 18, 19, 24 January 1969 ; BADRUDDIN UMAR, Society and Politics in East Pakistan (Calcutta, 1980), pp. 55-7, 104 ; Shyamali Ghosh. The Awami League 1949-1971 (Dhaka, 1990). p. 151 ; MOHAMMAD HANNAN, Bangladesher Chhatra Andoloner Itihas (Warsee Prokashanee, Dhaka, 1987), p. 167.
10. MAHFUZULLAH, n. 5, p. 67 ; MESBAH KAMAL, n. 7. pp. 245; MOUDUD AHMED, n. 3, p. 140; KAMRUDDIN AHMAD, n. 1, p. 214.
11. MAHFUZULLAH, n. 5, pp. 71-3; ABDUR ROUF, Agartala Sharajantra Mamla O Amar Nabik Jiban (Papyrus, Dhaka, 1992), pp. 857; MOUDUD AHMED, n. 3, pp. 140-1 ; KAMRUDDIN AHMAD, n. 1, pp. 214.-5.
12. MOUDUD AHMED, n. 3, pp. 141-5; KAMRUDDIN AHMAD, n. 1, pp. 215-8; MAHFUZULLAH, n. 5, pp. 72-5.
13. The Pakistan Observer, 26 January, 2 February 1969 ; MESBAH KAMAL, n. 7, p. 24 ; MAHFUZULLAH, n. 5, pp. 72-5.
14. The Pakistan Observer, 23 February 1969 ; KAMRUDDIN AHMAD, n. 1, pp. 217-8 ; MAHFUZULLAH, n. 5, pp. 75-7 ; MOUDUD AHMED, n. 3, pp. 148-9.
15. MAHFUZULLAH, n. 5, pp. 78-81 ; MOUDUD AHMED, n. 3, pp. 148-60; KAMRUDDIN AHMAD, n. 1, pp. 218-20.
16. Dainik Pakistan, 7, 8, 11, 12 March 1969 ; The Pakistan Observer, 15, 20 March 1969 ; MOHAMMAD FORHAD, Unosttorer Gonoabhyuthyan (Dhaka, 1989), pp. 82-4 ; MESBAH KAMAL, n. 7, p. 27 ; MAHFUZULLAH, n. 5, pp. 81-2; KAMRUDDIN AHMAD, n. 1, p. 220.
17. MOUDUD AHMED, n. 3, pp. 163-86, 188-91 ; KAMRUDDIN AHMAD, n. 1, pp. 221-2; ABDUL WAHED TALUKDAR, 70 Theke 90: Bangladesher Rajnaitik Prekshapat (Pandulipi, Dhaka, 1991). pp. 11-2; MAHFUZULLAH, n. 5, pp. 85-6.
18. MOUDUD AHMED. n. 3, pp. 191-2 ; KAMRUDDIN AHMAD, n. 1, pp. 231-2 ; ABDUL WAHED TALUKDAR, n. 17, p. 12 ; ABUL MANSUR AHMAD, Amar Dekha Rajnitir Panchash Bachhar (Nowroze Kitabistan, Dhaka, 1975). p. 155.
19. MOUDUD AHMED, n. 3, pp. 192-6 ; ABDUL WAHED TALUKDAR, n. 17, p. 12; KAMRUDDIN AHMAD, n. 1, pp. 232-4.
20. ABDUL WAHED TALUKDAR, n. 17, p. 12 ; KAMRUDDIN AHMAD, n. 1, pp. 236-7 ; MOUDUD AHMED, n. 3. pp. 220-1 ; MUNTASSIR MAMOON and JAYANTA KUMAR RAY, Bangladeshe Civil Samaj Pratisthar Sangram (Abosar, Dhaka, 1995), p. 44.
21. ABDUL WAHED TALUKDAR, n. 17, p. 13; MAMOON and RAY, n. 20, p. 45 ; MOUDUD AHMED, n. 3, pp. 201-4 ; KAMRUDDIN AHMAD, n. 1, p. 238; ZILLUR R. KHAN, Leadership Crisis in Bangladesh (University Press Limited, Dhaka, 1984), pp. 15-6.
22. ABUL MANSUR AHMAD, n. 18, pp. 380, 391-2 ; MOUDUD AHMED, n. 3, pp. 206-10; ZILLUR R. KHAN, n. 21, pp. 17-8.
23. ABUL MANSUR AHMAD, n. 18, pp. 393-5 ; MOUDUD AHMED, n. 3, pp. 209-15, 218-9 ; KAMRUDDIN AHMAD, n. 1, pp. 238-40; ABDUL WAHED TALUKDAR, n. 17, pp. 13-4.
24 ABUL MANSUR AHMAD, n. 18, p. 394 ; ABDUL WAHED TALUKDAR, n. 17, p. 12 ; Ittefaq, 28 April 1970 ; KAMRUDDIN AHMAD, n. 1, pp. 240-2 ; MOUDUD AHMED, n. 3, pp. 221-2 ; MAMOON and RAY, n. 20, pp. 45-6.
25. KAMRUDDIN AHMAD, n. 1, pp. 252-5; MAMOON and RAY, n. 20, p. 47; ABDUL WAHED TALUKDAR, n. 17, pp. 15-6 ; MOUDUD AHMED, n. 3, pp. 223-31. 26. MAMOON and RAY, n. 20, p. 48.
27. M. R. AKHTAR MUKUL, Chollish Theke Ekattor (Sagar Publishers, Dhaka, 1990). p. 80 ; MOUDUD AHMED, n. 3, pp. 237-44. 28. ABUL MANSUR AHMAD, n. 18, p. 396; also see p. 388. 29. M. R. AKHTAR MUKUL, n. 27, pp. 80–2 ; ABDUL WAHED TALUKDAR, n. 17, pp. 17-22 ; MOUDUD AHMED, n. 3, pp. 245-9; KAMRUDDIN AHMAD, n. 1, pp. 265-7.
30. BORHANUDDIN KHAN JAHANGIR, Rashtrer Dayabaddhata (Agamee, Dhaka, 1995), pp. 7-9; for an eleaborate account of monstrous atrocities committed by the Pakistan army on the eve of surrender, see Major Rafiqul Islam PSC, Buddhijibi Hatyakander Nepatthey (Agamee, Dhaka, 1992).
বেঙ্গল ষ্টাডিজের বিভিন্ন দিক সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান এখনও সীমিত। ইদানিং গবেষণামূলক কাজে দেখা যাচ্ছে নানান সমস্যা। এর একটা মূল কারণ, গবেষণার জন্য যে আর্থিক ও অন্যান্য। আনুষঙ্গিক সাহায্যের প্রয়ােজন তার বিশেষ অভাব। দক্ষিণ এশিয়ার বাইরে বেঙ্গল স্টাডিজের নানা দিক নিয়ে কাজ হচ্ছে অনেক কম। তুলনামূলকভাবে দক্ষিণ এশিয়ার চেয়ে পূর্ব এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের উপর গবেষণামূলক কাজ হচ্ছে বেশী।
আরও একটা সমস্যা হচ্ছে, এ বিষয়ে যারা কাজ করছেন তারা প্রয়ােজনীয় তথ্য পাননা।
অনেক মূল্যবান কাজ, বিদেশে প্রকাশিত হয়, বিভিন্ন বিদেশী ভাষায়, যা অনেকের কাছে। অধিগম্য নয়। এছাড়া ইংরাজী ভাষাতেও যা প্রকাশিত হচ্ছে তা ব্যয়বহুল বলে গ্রন্থাগারগুলির পক্ষে এসব সংগ্রহ করা অত্যন্ত কঠিন। বেঙ্গল ষ্টাডিজের বিভিন্ন দিক নিয়ে লেখাপত্র এবং গ্রন্থাদির বাংলায় অনুবাদ করা জরুরী। বাংলা ভাষায় প্রকাশিত এ সংক্রান্ত লেখাপত্র ও গ্রন্থাদির ইংরেজী ভাষায় অনুবাদও দরকার।
আই সি বি এস গবেষণামূলক কাজের ফল ব্যাপকভাবে ইংরেজী ও বাংলা ভাষায় প্রচার করতে চেষ্টা চালাচ্ছে। ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, নৃবিজ্ঞান, অর্থনীতি, রাজনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ের বিভিন্ন দিক এই প্রচেষ্টার অন্তর্গত। ভবিষ্যতে আর্থিক সঙ্গতি অনুযায়ী মৌলিক গবেষণা প্রকাশনার আশাও এই কেন্দ্র পােষণ করে।