You dont have javascript enabled! Please enable it! Draft - সংগ্রামের নোটবুক

This is a temporary post for collecting data. Not for posting and not for publishing. Saved only as readable for the editors. Not clickable and not downloadable.

কারা স্মৃতি
আবদুশ শহীদ

নিবেদন
পাকিস্তান সৃষ্টির পর লেখক সাংবাদিক-রাজনীতিবিদ-শিক্ষক-সমাজকর্মী আবদুশ শহীদ ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ সাত বৎসর তৎকালীন পূর্ব বাংলার দু’টি কেন্দ্রীয় কারাগারসহ চারটি কারাগারে বন্দী ছিলেন। মূলত: সেই কারা জীবনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নিয়ে কারা স্মৃতি’ বইটি লেখা হলেও কেবল বন্দী জীবনের স্মৃতির মধ্যে তিনি তার লেখাকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। সে সম্বন্ধে দু’এক কথা বলার আগে কীভাবে এই বই পুনঃমুদ্রণ ও প্রকাশনার সাথে জড়িয়ে পড়লাম তা বলা প্রয়ােজন। বইটির প্রথম প্রকাশ ১৯৭৭ সালে। তারপর কোন এক সময় ওটা পড়েছিলাম । আরও অনেক পাঠকের মতাে ওই বইটিতে ১৯৫০ সালের ২৪ এপ্রিল রাজশাহী খাপড়া ওয়ার্ডে পাকিস্তানী বর্বর শাসকদের গুলিতে ৭ জন রাজবন্দীর শহীদ ও আবদুশ শহীদসহ ২৯ জনের গুরুতরভাবে আহত হওয়ার বিবরণ পড়ে শিহরিত হই । ভাবতে থাকি যদি লেখকের সাথে পরিচিত হতে পারতাম। সেই সাক্ষাৎ ঘটে নব্বই-এর দশকে বাংলা একাডেমীর একুশের বইমেলায় যখন তিনি কাঁধে বই ঝুলিয়ে তাঁর লেখা বই বিক্রি করছিলেন। আবদুশ শহীদের তিরােধানের পর তাঁর সাথে পরিচয়ের সেই স্মৃতি বর্ণনার মাধ্যমে তাঁর পরিবারের সাথে পরিচয় ঘটে। ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে আবদুশ শহীদের আরও কিছু বই প্রকাশিত হলেও কারা স্মৃতি’ কোন কপি দোকানে পাওয়া যায়না। তাঁর পরিবার ও আমরা অনেকেই বইটি পাঠকদের কাছে পৌঁছে দেয়ার তাগিদ অনুভব করি। কী কারণে জানি না আবদুশ শহীদের স্ত্রী রাজিয়া শহীদ ও দুই কন্যা তানিয়া ও জয়া আমার তত্ত্বাবধানে বইটি প্রকাশ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। আমি সানন্দে সম্মত হই এবং তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করি। তবে খোঁজ করে দেখি বহু বছর আগে সংগৃহীত বইটির কপি এখন আমার কাছে নেই। আবদুশ শহীদ পরিবারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক মােঃ জয়নাল আবেদীনের কাছ থেকে সংগ্রহ করে অল্প কিছুদিনের জন্য একটি কপি পাই। সেটা থেকে ফটোকপি করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাতত্ত্ব বিষয়ে এম.এ অনুজ প্রতিম মহিউদ্দিন অপুর সহযােগিতা ও ব্যবস্থাপনায় প্রকাশনা সংস্থা জনান্তিকের পরিবেশনায় বইটি পাঠকদের হাতে তুলে দেওয়ার প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছে।
কারা স্মৃতির পাণ্ডুলিপি পড়ে প্রখ্যাত লেখক- দার্শনিক-সমাজ চিন্তাবিদ ও খ্যাতিমান বুদ্ধিজীবী সরদার ফজলুল করিম একটি ভূমিকা লিখেছিলেন। প্রথম প্রকাশিত বইটিতে সেটি ছাপা হয়েছিল। লেখক ও বইটি সম্পর্কে সরদার ফজলুল করিমের মূল্যায়ন পাঠকদের মনন ও চিন্তাশক্তি বৃদ্ধির সহায়ক হবে আশা করি।
বইটিতে লেখক কারা জীবনের নানা বর্ণনার সাথে সে সময়কার রাজনৈতিক-সামাজিক বিভিন্ন আন্দোলন বিশেষ করে বামপন্থীদের আন্দোলন, দেশের রাজনৈতিক অবস্থা ও বিভিন্ন দলের অবস্থান সস্পর্কে বর্ণনা দিয়েছেন। বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর বিশ্লেষণ নিয়ে মতদ্বৈধ থাকতেই পারে। কিন্তু ব্যক্তি, দল বা ঘটনার বর্ণনায় তিনি যে নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছেন তা অনুকরণীয়। দু’একটি উদাহরণ উল্লেখ করা যায়। জেলখানায় মানুষ দিয়ে ঘানি টানার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি লিখেছেন
জেলখানায় একদিন জুমার নামাজ পড়তে গিয়ে দেখি, কয়েকজন কয়েদী তেলের ঘানির বিরাট লােহার রড কাঁধে নিয়ে গরুর মত ঘুরছে। সে দৃশ্য না দেখলে লিখে বুঝানাে সম্ভব নয়। মনে হলাে আমরা যেন চলে এসেছি সেই রােমান যুগে সেখানে কৃতদাসদের দিয়ে যা খুশী করানাে যেত। বিরাট ওজনের দীর্ঘ লােহার রড কাঁধে নিতে এক একজন কয়েদী ভাঁজ হয়ে প্রায় মাটিতে মিশে যাচ্ছে এবং এই অবস্থাতেই অবিরাম ঘুরে সরষে ভেঙে তেল বের হচ্ছে।—- গরু দিয়ে যে কাজ করানাে হয় তা মানুষেরই করতে হবে।
সাম্প্রদায়িকতার শিকড় সন্ধান করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন-
সঠিক অর্থে সাম্প্রদায়িকতা শুধু হিন্দু-মুসলমানের বিরােধ নয় বরং সম্প্রদায়ে-সম্প্রদায়ে বিরােধযেমন নমশূদ্রের সাথে বর্ণহিন্দুর বিরােধ, বিহারীদের সঙ্গে বাঙালিদের বিরােধ এমন কি এক জেলার । লােকের সঙ্গে আর এক জেলার লােকের বিরােধও সাম্প্রদায়িকতার আত্মঘাতী রূপের বিভিন্ন দিক। অথচ আমরা এই বিরাট বিষবৃক্ষের দিগন্ত প্রসারিত অথচ অনেক সময় অদৃশ্য শিকড়গুলির সন্ধান রাখি না। ফলে প্রকৃত অর্থে সাম্প্রদায়িকতাও দূর করতে পারি না।
দেশ-বিদেশের নারী বিপ্লবীদের আত্মত্যাগের বিষয়টা লেখক অত্যন্ত বড় করে দেখেছেন। শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেছেন:
দেশ বিভাগের পর জেলের ভিতরে এবং বাইরে যে সমস্ত বিপ্লবী বিভিন্নভাবে নির্যাতন ভােগ করেছেন, জেল খেটেছেন, জীবন দিয়েছেন, দীর্ঘ দিন আত্মগােপন করে অবর্ণনীয় দুঃখকষ্ট ভােগ করেছেন তাদের মধ্যে খুব অল্প কয়েকজনের হলেও পুরুষদের সম্পর্কে কিছু বলা হয়েছে বা লেখা হয়েছে। কিন্তু আমার মনে হয় অসংখ্য মহিলা বিপ্লবীও আছেন যারা হয়ত অত্যন্ত সাধারণ ঘরের কৃষকবন্ধু, মাতা বা ভগ্নি। কিন্তু তাদের নাম আমরা জানি না, জানতে চেষ্টাও করিনি বা জনসাধারণের মধ্যে তাঁদের নাম প্রকাশের তাগিদও অনুভব করিনি। অথচ যে কোন দেশে বিপ্লবী আন্দোলনে মহিলাদের অবদান অনেক বেশী মূল্যবান হতে বাধ্য।
কারা স্মৃতিতে রাজবন্দীদের ওপর কারাভ্যন্তরে অত্যাচার-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের যেমন বর্ণনা রয়েছে তেমনি রয়েছে বন্দী অবস্থায় তাদের দৈনন্দিন জীবন, পাঠাভ্যাস, সাহিত্য সাধনা, সাংস্কৃতিক কার্যকলাপ, স্বাস্থ্য-চর্চা, খেলাধুলা, হাস্য-কৌতুকসহ পরস্পরের প্রতি সহমর্মিতা গড়ে তুলে সুন্দরস্বাভাবিক-সুখী জীবন যাপনের সকল প্রচেষ্টার বর্ণনা। জেলজীবনেই আবদুশ শহীদ বেশ কিছু কবিতা লিখেছিলেন। তিনি সেগুলি বাইরে নিয়ে আসতে পারেন নি। পরে অবশ্য তাঁর কবিতা আমরা তেমন দেখতে পাইনি।
বইটি ছাপার বিষয়ে আবদুশ শহীদের পরিবারের পক্ষ থেকে প্রচ্ছদসহ মূল কাঠামাে প্রথম মুদ্রণের অনুরূপ রাখার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। কিছু মুদ্রণ সংশােধন ব্যতীত বর্তমান সংস্করণটি তেমনটি রাখার প্রয়াস নেয়া হয়েছে। তবে আবদুশ শহীদের একটি সংক্ষিপ্ত জীবনী সন্নিবেশিত করা হল।
পেশাদার ও যােগ্য লােকের ওপর তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব অর্পিত হলে বইটি সুন্দরতর হতে পারতাে। অত্যন্ত ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আজ স্মরণ করছি বইটির পুনঃ মুদ্রণের উদ্যোক্তা আবদুশ শহীদের সহধর্মিণী রাজিয়া শহীদকে। বইটি প্রকাশের সকল দিক যখন গুছিয়ে এনেছিলেন তখন অকস্মাৎ এক বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। পিছিয়ে যায় বইটি প্রকাশের কাজ। শোেক কাটিয়ে উঠে তাঁর সন্তানরা বইটি প্রকাশের উগ্যোগ গ্রহণ করেন।
কাজী মােহাম্মাদ শীশ
ঢাকা, নভেম্বর-২০১৩

প্রথম সংস্করণের ভূমিকা
জনাব আবদুশ শহীদের পাকিস্তান আমলের কারা স্মৃতির পাণ্ডুলিপিখানি আমি পড়েছি। তাঁর এ স্মৃতি কথা ‘দৈনিক আজাদে’ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। জনাব আবদুশ শহীদ বাংলাদেশের গণআন্দোলনের একজন নিবেদিত প্রাণ কর্মী। শর্ষীনার পীর পরিবারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হলেও এবং কিশাের বয়সে শর্ষীনা মাদ্রাসার ধর্মীয় পরিবেশে শিক্ষা শুরু করলেও তিনি কিছু-কালের মধ্যে সেই ব্যবহার, একদেশদর্শিতা, গোঁড়ামী ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে দেশের বৃহত্তর প্রগতিশীল জীবন এবং আন্দোলনের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেন এবং ভারত বিভাগের পূর্ব থেকেই একজন সক্রিয় কমিউনিস্ট কর্মী হিসেবে কৃষক জনতার মধ্যে চেতনা ও সংগ্রামের বীজ বপন করার আদর্শে নিজেকে উৎসর্গ করেন। এই কারণেই তিনি ১৯৪৮ সালে গ্রেফতার হয়ে দীর্ঘ সাত বৎসর পাকিস্তানী কারাগারে বন্দী থাকেন। সেই বন্দী জীবনের স্মৃতি নিয়ে তিনি তাঁর কারা স্মৃতি রচনা করেছেন। কেবল কারা স্মৃতি বলেই যে রােমাঞ্চকর, তা নয়। বাংলাদেশের রাজনীতিক চেতনা এবং সংগ্রামের বিবর্তন ও বিকাশের যে পর্যায়ের উপর এই গ্রন্থ রচিত, সে পর্যায়টি একদিকে বর্তমানকালের রাজনীতিক আন্দোলন এবং কর্মীদের কাছে যেমন অপরিচিত, তেমনি আবার বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ভিত্তি হিসাবে তা বিশেষ মূল্যবান। একদিন সহস্র সহস্র ছাত্র-যুবককৃষক-শ্রমিক যে অসহনীয় নির্যাতন, নিষ্পেষণ ভােগ করে এবং বীরত্বপূর্ণ ত্যাগ ও জীবনদানের মাধ্যমে বাংলাদেশের সংগ্রামী গণআন্দোলনের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেছিল তার ঘনিষ্ঠ পরিচয় ব্যতীত বর্তমানের সংগ্রামও তার চরম পরিণতির দিকে সাফল্যজনকভাবে অগ্রসর হতে পারবে না, এ কথাটি আজকের আন্দোলনের কর্মীদের স্মরণ রাখা কর্তব্য। অথচ আফসােসের বিষয় ১৯৪৭-এর আগে ও পরের সেই অনুপ্রেরণাদায়ক আন্দোলন এবং তার বীর সেনানীদের, তার কর্মীদের নাম কিংবা জীবনেতিহাস এদেশে রক্ষিত হয়নি। কোন উপযুক্ত হাতে তা বর্ণিত হয়নি। সেই মহৎ ইতিহাসের অবলুপ্তি এবং তার সঙ্গে অপরিচয়ের মধ্যে পরবর্তী পর্যায়ের বিভিন্ন বিচ্যুতির উৎস যে নিহিত, এটিও আজ স্বীকার করা আবশ্যক। এ কারণে প্রয়ােজন হচ্ছে বাংলাদেশের গণআন্দোলনের অতীত ইতিহাসকে তার প্রতিটি বর্ণে এবং শব্দে পুনঃনির্মাণ করা। সেই লুপ্ত প্রায় ইতিহাসকে উদ্ধার করা। জনাব আবদুশ শহীদ বর্তমান এবং ভবিষ্যতের সমাজ প্রগতির কর্মীদের তথা ব্যাপকতর জনসাধারণের ধন্যবাদের পাত্র হবেন এ জন্য যে, তিনি এই শূন্যতায় নিজের সাধ্যমত অবদান রাখার চেষ্টা করেছেন। বস্তুত বাংলাদেশের কোন রাজবন্দীর স্মৃতিকথাই জনাব আবদুশ শহীদের ন্যায় এরূপ বিস্তারিত উদার এবং নিরপেক্ষ হয়েছে বলে আমার জানা নেই। জনাব আবদুশ শহীদের একটি সংবেদনশীল সাহিত্যিক মন আছে। তাঁর প্রকাশ ক্ষমতাও
স্বচ্ছন্দ। কিন্তু যে-কোন সাহিত্যিকের শক্তির সবচেয়ে বড় উৎস হচ্ছে তাঁর অভিজ্ঞতা। কারা স্মৃতি’র লেখক অবশ্যই কারা জীবনের সেই অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ। ১৯৫০-এর ২৪শে এপ্রিল রাজশাহী সেন্ট্রাল জেলের অভ্যন্তরে খাপড়াবন্দী নিবাসে রাজবন্দীদের উপর গুলিবর্ষণ করা হয়। সাতজন রাজবন্দী তাতে শহীন হন। জনাব আবদুশ শহীদ সেদিন খাপড়াবন্দী নিবাসে রাজবন্দী হিসেবে আটক ছিলেন। নিজে আহত হয়েছেন। তাই বলা চলে বন্দীজীবনের চরম বিপদকে তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন। তার দৈনন্দিন নির্যাতনকে, তার নির্জন ডিগ্রীবাস, তাঁর শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার যাতনাকে তিনি ভােগ করেছেন। কিন্তু সে অভিজ্ঞতাকে লেখক কেবল ভােগ করেননি। তাঁকে তিনি পর্যবেক্ষণও করেছেন। তাঁর স্মরণ শক্তিও প্রখর। তা না হলে কারাবাসের এত দীর্ঘকাল পরে, বিশ বৎসরেরও অধিককাল পরে তাঁর এত বিস্তারিত বর্ণনা সম্ভব হত না। এবং এ বর্ণনাতে যে নিরপেক্ষতা রয়েছে তাও সকলের পক্ষে সহজসাধ্য নয়।
একটি সুখী, সঙ্গতিপূর্ণ সমাজ-সৃষ্টির রােমান্টিক স্বপ্নে আমরা একদিন দেশের বিপ্লবী রাজনীতিক সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলাম। সেদিন সে আন্দোলনের সংগঠন ক্ষুদ্র কলেবুর হলেও তা ছিল ঐক্যবদ্ধ এবং অনুপ্রেরণাদায়ক । আজ সে সংগঠন এবং আন্দোলন নানা দল, উপদল, মত-অমতে বিভক্ত। একদিনের সহকর্মীরা আজ পরস্পর বিচ্ছিন্ন এবং পরস্পর বিরােধী শিবিরে সন্নিবিষ্ট। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবােধ আজ বিনষ্ট। তেমন আবহাওয়াতে আবদুশ শহীদ তাঁর স্মৃতিচারণে যথার্থই এক দুর্লভ উদারতার পরিচয় দিয়েছেন। কারাগারে ছােট বড় সকল রাজনীতিক কর্মী এবং নেতাকেই তিনি সহানুভূতি এবং শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেছেন। তার একটি চেষ্টা বিশেষ করে মহৎ। তিনি যাকেই স্মরণ করতে পেরেছেন সেই কর্মীর নামই তাঁর কাহিনীতে উল্লেখ করে তাঁকে ইতিহাসে রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন। সেদিক থেকে বাংলাদেশের গণআন্দোলনের ইতিহাস নির্মাণে তার এ কারা স্মৃতি মূল্যবান উপাদানের কাজ করবে।
বর্ণনা প্রসঙ্গে লেখক অনেক সময়ে কারাগারের বাইরের রাজনীতিক অবস্থা এবং বিভিন্ন দল সম্পর্কে কথা বলেছেন। কারাগার দেশের কারাগার । কারাগারের রাজনৈতিক বন্দীরা দেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের কর্মী। কিন্তু একদিকে কারা স্মৃতি বর্ণনা করা, অপরদিকে কারাগারের বাইরের অবস্থা সঠিকভাবে বিবৃত করা খুবই দুঃসাধ্য কাজ। এজন্য যে সমস্ত বর্ণনা তাঁর সাধ্যের অতিরিক্ত বলে বােধ হয়েছে এবং যে আলােচনা কারা স্মৃতির সঙ্গে সংযােগহীন হয়ে তাঁর কারা-কাহিনীকে অপ্রধান করে তুলছে তেমন আলােচনা আমি পুস্তকাকারে প্রকাশের সময়ে বাদ রাখার পরামর্শ দিয়েছি।
জনাব আবদুশ শহীদের কারা স্মৃতি’খানি উপযুক্তরূপে প্রকাশিত হবে এবং প্রকাশিত হলে তা রাজনীতিক কর্মী এবং পাঠক সাধারণের বিশেষ সংবর্ধনা লাভ করবে বলেই আমার বিশ্বাস।
সরদার ফজলুল করিম
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৬/১০/৭৫

এক
৪৮-এর প্রথম ভাগ। কৃষক সমিতির সভায় চলছি। পুরােনাে কৃষক সমিতি-পুরনাে বলতে ভারত বিভাগের পূর্বেকার । পথে কাজী সাহেবের সঙ্গে দেখা। বাকপুরের জনাব মােশারফ কাজী । বিদ্যে নাই কিন্তু বুদ্ধি প্রখর, বুকে সাহসও রাখে যথেষ্ট। প্রায় গ্রামেই এ রকম দুই একজন থাকে, ভাল কাজে এরা বিলেতের ভিলেজ হ্যাস্পডেন, আবার মন্দ কাজেও লাগে। দেশে সুষ্ঠু আন্দোলন থাকলে এরা দেশের দশের অনেক বড় কাজ করতে পারত।
আমাকে দেখেই জিজ্ঞেস করল-যান কোথায় শহীদ সাহেব? বললাম-সমিতির সভা আছে। ঘাড়টা ঈষৎ টান করে বলল-ও বুঝেছি, আপনারা ত পাকিস্তান মানেন না। ঠিক সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিতে পারলাম না। একটু পরেই বলল-আপনারা বলেন, ‘ইয়ে আজাদী ঝুটা হায়, লাখাে ইনসান ভুখা যায়। তারপরেই চোখে মুখে একটা আত্ম-প্রত্যয়ের ভাব ফুটিয়ে বলল-তা মানেন না মানেন আমার একটা প্লান শুনুন।আমি সিচুয়েশন বুঝে কাজ করতে চাই। মাথাটা একটু ঝাঁকি দিয়ে বলল, আমি চাই আপনাদের কাজের সুযােগ করে দিতে । আমার হাইস্কুল জিন্নাহ্ সাহেবের নামে করতে চাই। বললাম-কী, কায়েদে আযম স্কুল করবেন নাকি? বলল দেখুন কায়েদে আযম-টাম আমি বলি না। আমার স্কুলের নাম হবে জিন্নাহ্ হাইস্কুল । বলেই খপ করে আমার হাত ধরে ফেলে বলল-আপনিই হবেন এর প্রথম হেডমাস্টার। আমি কমিউনিস্ট নই, কিন্তু জানি দেশের কাজে কমিউনিস্টদের জুড়ি নেই, আমার বিশ্বাস, জিন্নাহ সাহেব এ স্কুলের কথা শুনলে নিশ্চয়ই বিপুল পরিমাণ অর্থ সাহায্য করবেন। শুনছি তিনি শীঘ্রই ঢাকা আসছেন।
খর্বাকৃতি, গায়ের রং কালাে, দৃঢ় ও পুষ্ট ওষ্ঠদ্বয় । ঠিক নিগ্রোনে লুথার উইলিয়ামকে স্মরণ করিয়ে দেয় । ছাতার উপর হাত দু’টি রেখে অত্যন্ত দৃঢ়তার সংগে বলল, কথা দিচ্ছি আপনাদের কাজে আটকাবাে না । চলুন ঢাকায়, কালই স্কুলে আসুন কাগজপত্র রেডি করুন। আমি বললাম, আপনার কাজের আইডিয়া আছে এত জানি বরাবর। কাজী সাহেব একটু ঈষৎ হেসে বলল, তা মজিদের (অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম) মত বা আপনাদের মত এম, এ, বি. এ নই। তবে আল্লার রহমতে কাজ যেটা ধরেছি সেটা না করে ছাড়িনি। বিড়ি ত খান না, বলেই কাজী সাহেব একটা বিড়ি ধরালেন। বললেন, চাখারে আসলে হক সাহেব একবার আমাকে ডেকে পাঠিয়ে আলাপ করবেনই। শুধু চাখার কেন তাঁর কোলকাতার
১১
বাসায়ও তিনি আমাকে ডেকে পাঠাতেন।
আমার মাথায় তখন মিটিং-এর চিন্তা। আচ্ছা একটু চিন্তা করে দেখি, বলেই আমি যেতে উদ্যত হলাম। কাজী সাহেব বললেন, আপনাকে পেলেই আমি খুশী হতাম। অবশ্য আপনাদের না পেলেও আমি আমার প্রান ঠিক রাখবাে । ভেবে দেখুন-বলে তিনিও তাঁর পথ ধরলেন। পথে পথে ভাবলাম-খুব যেন ভরসা পেলাম না -জানি কাজী সাহেবের কাজের দক্ষতা আছে কিন্তু তিনি জিন্নাহ সাহেবের নামে স্কুল খুললেই ওটা ফুলে ফেঁপে উঠবে এ বিশ্বাসও করতে পারলাম না।
তা ছাড়া তিনি দীর্ঘ দিনের ইউনিয়ন বাের্ডের প্রেসিডেন্ট বলেই তার বিরুদ্ধে দলও রয়েছে গ্রামে। তিনি সবার সহযােগিতাও পাবেন না।
এর ঠিক তিন চারদিন পর হবে, তিনি আমাদের বাড়ীতে এসে উপস্থিত। পাশেই তার এক আত্মীয়ের ঘরে আমাকে ডেকে পাঠালেন। হাত ধরে একেবারে তার কাছে বসালেন। তার পিঠার দাওয়াত । আমার সম্পর্কীয় ভাই-ঝি আমেনাও আমাকে পেয়ে খুশী, বলল, চাচা ঘর-বাড়ী ছেড়ে এ কী রাজনীতি করেন। সঙ্গে সঙ্গে থালাভর্তি পিঠা নিয়ে এল-পাটিসাপটা, বড়া, লুচি ইত্যাদি। যা হােক পিঠা খেতে খেতে অনেক কথার পর কাজী সাহেব আমাকে স্কুলের ব্যাপারে কথা আদায় করে ছাড়লেন।
দুদিন পরেই বাকপুরে গিয়ে জিন্নাহ্ হাইস্কুলে প্রধান শিক্ষকের পদ গ্রহণ করি । পুরােনাে মাইনর স্কুল ঘরের সঙ্গে আরও ২/৩টি কোঠা বাড়িয়ে শুরু করা হলাে হাইস্কুল। কাজী সাহেব এটার নাম দিলেন জিন্নাহ্ ফ্রি হাইস্কুল । ঐ সময় জিন্নাহ সাহেব পাকিস্তান মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট এবং গভর্নর জেনারেলও। তাঁর কাছে। এ বিষয়ে চিঠি দেওয়া হলে তিনি জবাব দিলেন। এবং জবাবে এ নিয়ে প্রাদেশিক সরকারের সঙ্গে যােগাযােগ করতে বললেন, কিন্তু কাজী সাহেব চাচ্ছেন তিনি নিজেই জিন্নাহ সাহেবের সঙ্গে দেখা করবেন। আমাকেও নিয়ে যাবেন । কাগজপত্র তৈরী করলাম । প্রেসিডেন্ট সাহেব জিজ্ঞেস করলেন আমার জন্য কোর্ট প্যান্ট তৈরি করবেন কিনা। আমি বললাম, আমরা সাধাসিধে পােষাকেই যাব । কাজী সাহেব তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে মাথা ঝাড়া দিয়ে বললেন, তিনি তাে আর গান্ধীজীর মত অর্ধ উলঙ্গ ফকির নন । জামা-কাপড়ে তিনি পুরােপুরি সাহেব । এমনও শােনা গেছে কংগ্রেসের পাতা বিছানায় বসতে তার প্যান্টের ইস্ত্রী ভেঙ্গে যাবে দেখে তিনি কংগ্রেস ছেড়েছেন। একটু হেসে বললেন, ও যাক, ওসব বাতকে বাত। বললেন, গান্ধীজী দরিদ্র ভারতবাসীর মুক্তিদাতা হিসাবে নিজে ফকিরি পােষাক নিয়েছিলেন-আসলে তিনি ছিলেন টাটা বিড়লার মুখপাত্র। বললাম, কাজী সাহেব আপনি এত কথা জানলেন কী করে? বললেন, বাহ এত আপনারাই শিখিয়েছেন।
১২
সঙ্গে সঙ্গে বললেন, জিন্নাহ্ সাহেব দারিদ্রকে অভিশাপ মনে করতেন। তাই দেশকে উন্নত করার জন্য নিজেও দামী স্যুট পরতেন। স্পষ্ট লক্ষ্য করলাম, তার কথা সূক্ষ্ম বিদ্রুপের ছটায় ঝলকিত।
বলে রাখা ভাল কাজী সাহেব জিন্নাহর সঙ্গে দেখা করতে পারেননি, আর আমার ঢাকা যাওয়াই হয়নি।
দেশ বিভাগ ছিল আমাদের উপর সাম্রাজ্যবাদের সুচতুর প্রতি-আক্রমণ, তাই সে আক্রমণের মুখে আমরা সাময়িকভাবে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। বৃটিশ এদেশ থেকে গিয়েছে। দেশ স্বাধীন হয়েছে। মুসলমানের পাকিস্তান হয়েছে। গ্রামের মানুষ আশায় বুক বেঁধে রয়েছে তাদের জন্য অনেক কিছু হবে । কিন্তু প্রতিবিপ্লবী শক্তি স্পষ্টতঃই বুঝতে পেরেছিল, সময় থাকতেই আঘাত করতে হবে প্রকৃত মুক্তিকামী এদেশের মানুষকে- এদেশের দেশপ্রেমিকদের।
স্কুল আগের মতই চালিয়ে যাচ্ছি। স্কুলটি অবশ্য অনেক পরে মঞ্জুরি পেয়েছিল। আমি ওখানে থাকতেই বাকপুরের বিখ্যাত সূর্যমুণি মেলা আরম্ভ হয়েছিল। তবে এর ইতিহাস বহু পুরােনাে-সে আলােচনা এখন করব না। তবে এর পুরােনাে ঐশ্বর্য অতীতের বস্তু হয়ে গেলেও এই মেলা আজও মেলে। অন্তত দক্ষিণবঙ্গের বহু স্থান থেকে হাজার হাজার দোকানদার এখানে আসে। তিনদিনের মেলায় প্রায় কয়েক লক্ষ লােক এখানে আনাগােনা করে। এতদঞ্চলের কামারকুমার-মুচি-বারুজীবী, বাঁশের, বেতের বিভিন্ন জিনিষ নির্মাতারা সারা বছরের আয় করে নেয় এই কয়দিনে। আবার গৃহস্থেরা হাঁড়ি-পাতিল থেকে শুরু করে লাঙ্গল, খুন্তি, কোদাল সবই সংগ্রহ করে এই মেলা থেকে। তাই অর্থনৈতিক দিক দিয়ে এই বাৎসরিক মেলাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হিন্দুদের এই মেলাটিকে ধ্বংস করে দেবার জন্য গোড়াপন্থী মােল্লা-মৌলভীরা বহু চেষ্টা করেছেন, কিন্তু শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছেন। দুঃখের বিষয় কয়েক বছর হলাে এখান থেকে সূর্যমুণীর পাথরের মূর্তিটি চুরি হয়ে গিয়েছে। যা হােক এই মেলায় এ সময় খুব বড় বড় সার্কাস আসত। এই মেলা শেষে এতদঞ্চলের শিশুদের হাতে হাতে থাকে বাঁশি। হাজার হাজার রকম খেলনা ওঠে এই মেলায়। ছােট ছােট ছেলেমেয়েরা এক মাস আগে থেকেই বায়না ধরে মেলায় যাবে। ঘরের বধূরা আগেই গায়ের ব্লাউজ-শাড়ী থেকে কুলা-চালনির অভাব দিয়ে রাখে গৃহকর্তার কাছে। পূর্বে এখানে ঢাকা-মাণিকগঞ্জ থেকে কমলা সার্কাস ছাড়াও অন্যান্য সার্কাস আসত! এখানেই আসত বড় বড় সিংহ, সুন্দর বনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার ।
১৩

দুই
সার্কাসের ছেলে-মেয়ে বিভিন্ন রকম জটিল শারীরিক কুন্তি দেখিয়ে স্কুলের ছাত্র ও যুবকদের অলস মনে একটা শিহরণ জাগিয়ে তুলত। মেলা শেষে দেখতাম ঘরে ঘরে যুবকরা কুস্তির মহড়া করছে। কিশাের শিশুরাও তা থেকে বাদ পড়ছে না। মােট কথা বিভিন্ন দিক দিয়ে এই মেলাটি এতদঞ্চলের প্রাণস্বরূপ ছিল। তাছাড়া এখানে স্থাপিত সূর্য-মুণীর পাথরের মূর্তির পাদমূলে ফুল-কলা দিয়ে অসংখ্য ধর্মপ্রাণ হিন্দু নরনারী আত্মার পরিতৃপ্তি লাভ করত। ছােট একটি পাথুরে মূর্তি আমাদের কল্পনাকে টেনে নিয়ে যেত কয়েক হাজার বৎসর পূর্বের ভারতীয়। পশুপালন ও প্রথম কৃষি সভ্যতার দিকে।
তিনদিনব্যাপী কয়েক লক্ষ লােকের এই মেলাটির স্বাস্থ্যরক্ষা, মেয়েদের নিরাপত্তা, চোর-বদমায়েশদের হাত থেকে দোকানীদের রক্ষা করা, গ্রাম্য টাউট ইজারাদার এবং বিভিন্ন ছুতায় পুলিশ কর্মচারীদের ঘুষ আদায় বন্ধ করা, মেলার চার, পুলগুলি রক্ষা করা, সার্কাস দর্শকদের টিকেট ফাঁকি দেওয়া থেকে বিরত করা-বলাবাহুল্য এইসব কাজে বহু সংখ্যক স্বেচ্ছাসেবক দরকার। এই মেলায় দেখেছি দেশ সেবায় জীবন উৎসর্গকারী বানারীপাড়ার শ্রদ্ধেয় কুমদরঞ্জন গুহঠাকুরতাকে জলচ্ছত্র প্রতিষ্ঠা করে সবাইকে পানীয় জল সরবরাহ করতে । আমিও স্থির করলাম স্কুলের ছাত্রদের নিয়ে একটি শক্তিশালী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে মেলার কাজ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে সাহায্য করি । তদনুযায়ী ছেলেদের ডেকে প্রস্তুতি নিলাম। গ্রাম্য যুবকরাও এল । প্রায় ৩ শত জন ছেলেকে কয়েকটি গ্রুপে ভাগ করা হলাে। প্রত্যেক গ্রুপের একজন ক্যাপ্টেন নিযুক্ত হলাে। আমি হলাম সমগ্র বাহিনীর অধিনায়ক।
আমার দুই বাহুতে আমার পদানুযায়ী বিরাট লাল ব্যাজ দেওয়া হলাে। অন্যান্য সকল স্বেচ্ছাসেবক এবং গ্রুপ ক্যাপ্টেনদের তাদের পদমর্যাদানুযায়ী চিহ্ন এঁটে দেওয়া হলাে। মেলার ঠিক উত্তর দিকে সুদৃশ্য ক্যাম্প করা হলাে। আমাদের কাজ হলাে পার্শ্ববর্তী হাইস্কুলগুলি এবং চাখার কলেজের ছাত্রদের জন্য কনসেশনে বা ফ্রি টিকেটে সার্কাসে প্রবেশের সুযােগ করে দেওয়া। সার্কাস মালিকদের সঙ্গে কথা বলে এটা ঠিক হলাে যে, আমরা ছাত্র ও স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে সার্কাসগুলিকে
১৪
রীতিমত পাহারা দেব, যাতে বিনা টিকিটে সাধারণ লােক প্রবেশ না করতে পারে-এর বিনিময়ে তারা স্বেচ্ছাসেকদের ও ছাত্রদের বিনামূল্যে সার্কাস দেখতে দেবে। অবশ্য পার্শ্ববর্তী স্কুল-কলেজের ছাত্রদের আমার দস্তখতসহ ক্যাম্প থেকে স্লিপ নিয়ে যেতে হবে। এর ফলে আমাদের ক্যাম্পের গুরুত্ব যথেষ্ট বেড়ে গেল । মেলার পুলিশবাহিনীর পালটা একটা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে উঠল। এদের কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হলাে। সূর্যমুণির মূর্তির নিকট সার্কাসগুলির চারপাশে জলচ্ছত্রের নিকট প্রস্রাব-পায়খানার জায়গাগুলােতে। এছাড়া আর একটি উল্লেখযােগ্য স্থানে স্বেচ্ছাসেবক নিযুক্ত করা হলাে। সেটা ছিল মেলার উত্তর দিকে, পূর্ব-পশ্চিম দিকে প্রবাহিত খালটির উপর সব সময়ের জন্য ব্যবহৃত চারটি সংরক্ষণ করা। কারণ মেলার সময় এটা নষ্ট হয়ে গেলে পরে আর মেরামত করা হয় না। ফলে সারা বৎসর লােকের যাতায়াতের ভয়ানক অসুবিধা হত। মেলার জন্য তৈরী অস্থায়ী চারগুলি দিয়ে উক্ত স্থায়ী চারটিকে ঐ কয়দিনের জন্য ব্যবহার করতে সম্পূর্ণ নিষেধ করে দেওয়া হলাে এবং সেখানে কড়া পাহারা বসানাে হলাে। অথচ ঐ চারটি নিয়েই বাঁধল এক অনাসৃষ্টি কান্ড । ইংরেজ সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর করে। গেল। পাকিস্তান হলাে; কিন্তু দেখা গেল সবই নতুন বােতলে পুরনাে মদ ভর্তির মত। আমলারা আগের মতই রয়েছে। বৃটিশ আমলের আমলারা কী করে নিজেদের শােধরাবেন। ঘটনাটি বলছি: আমার দায়িত্ব হলাে মেলার সব জায়গা সময় করে ঘুরে বিভিন্ন গ্রুপের কাজকর্ম তদারক করা।
সেদিন ঠিক কী বার মনে নেই, তবে বেলা ১২টা হবে । সমগ্র মেলা জুড়ে জনসমুদ্র থৈথৈ করছে। আমি যথারীতি পরিদর্শনে (রাউন্ডে ) বেরিয়েছি। ঘুরতে ঘুরতে আমাদের সেই নিষিদ্ধ চারটির কাছে এসে দেখি তিনজন পুলিশসহ একজন। সেকেন্ড অফিসার চারের উপর উঠে এসেছে।
১৫
তিন
আমাদের স্বেচ্ছাসেবকরা চারের গােড়ায় বসে হৈ চৈ করছে, খালের দুই পাড়ে বহু লােক দাড়িয়ে গেছে। দারােগা সাহেব প্রায় চারের অর্ধেক এসে গেছেন। সামনে। একজন পুলিশ প্রায় এপারে এসে পড়েছে । আমি দ্রুত চারে উঠে পুলিশটিকে আগলে দাঁড়ালাম এবং চিৎকার করে দারােগা সাহেবকে চার পাড়াতে নিষেধ করলাম । কিন্তু পুলিশটি আমাকে একরূপ ধাক্কা দিয়েই এ পারে লাফিয়ে পড়ল, সঙ্গে সঙ্গে আমি হুইসেল দেওয়াতে রিজার্ভ স্বেচ্ছাসেবকরা এসে পড়ল । ইতিমধ্যে কয়েক হাজার জনতা খালের দুই পাড়ে দাঁড়িয়ে গেছে। দারােগা সাহেব বেগতিক দেখে তাড়াতাড়ি একটা নৌকায় পার হয়ে মেলার ক্যাম্পে ঢুকে পড়ল। পুলিশ ও দারােগার এই মেলার নিয়ম-বিরােধী কার্যকলাপের জন্য স্বেচ্ছাসেবক ও উপস্থিত জনতার মধ্যে উত্তেজনা চরমে পৌছাল । আমি পুলের ওপর থেকেই দুই পাড়ের জনতাকে উদ্দেশ্য করে উক্ত চারটি সম্পর্কে মেলা কর্তৃপক্ষের নির্দেশের কথা বললাম এবং শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষাকারী তৎকালীন দারােগা পুলিশ সাহেবদের হেন কার্যাবলী যে রাষ্ট্রের পক্ষে কতখানি ক্ষতিকর তা বুঝিয়ে বললাম। এদিকে স্বেচ্ছাসেবক এবং জনতার একটা বিরাট অংশ মেলার পুলিশ ক্যাম্প ঘেরাও করে ফেলেছে। আমি আমার ক্যাম্পে ফিরে এলাম । ক্রুব্ধ জনতা ও স্বেচ্ছাসেবকদের দাবী হলাে দারােগা সাহেব কী করে স্বেচ্ছাসেবকদের অনুরােধ ও মেলার আইন ভঙ্গ করে পুলিশ নিয়ে চারে উঠল- এজন্যে তাকে প্রকাশ্য কৈফিয়ৎ দিতে হবে। খবরটি দ্রুত চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল । চাখার কলেজ ও পার্শ্ববর্তী এলাকার ছাত্ররাও চরমভাবে বিক্ষুদ্ধ হলাে। আমি পরিস্থিতি আয়ত্তে আনার জন্য কী করা যায় স্থির করার জন্য কাজী সাহেবসহ অন্যান্য মাতব্বরদের ডেকে আলাপ করছি; এমন। সময় চাখারের আশরাফ মিয়া হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে আমাকে ডাক দিল, এই শহীদ শােন । চাখারের সম্ভ্রান্ত জমিদার শ্রেণীর শরফউদ্দীন নূর আহম্মদ মজুমদার ওরফে চান্দু মিয়ার বড় ভাই আশরাফ মিয়াকে আমরা সমীহ করি । অতিরিক্ত উচ্ছঙ্খল জীবন-যাপন করায় একটু অপ্রকৃতস্থ হলেও স্পষ্টবাদী তিনি। আমাকে ডেকে দুহাতে জড়িয়ে ধরলেন এমনভাবে যে, আমি তার কথা না শুনলে তিনি আমাকে ছাড়বেন না। বললেন, শহীদ চান্দু আমাকে পাঠিয়েছে দারােগার সঙ্গে আপােষ করতে যাও এ নিয়ে আর বাড়াবাড়ি করাে না।
১৬
আমি তখন মেলা কর্তৃপক্ষ ও অন্যান্য মাতব্বরদের নিয়ে পুলিশ ক্যাম্পে গেলাম । আমাদের দেখে জনতা ও স্বেচ্ছাসেবকেরাও তখন অনেকটা শান্ত হলাে। আমি ক্যাম্পে ঢুকতেই সেকেন্ড অফিসার আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। আমার যতদূর মনে পড়ে আমি এড়িয়ে গেলাম এবং দারােগা সাহেবকে থানায় চলে যেতে বলে আমি বেরিয়ে গেলাম। ব্যাপারটি এই ভাবে মিটে গেলেও বুঝলাম অফিসারটি অপমানে জর্জরিত হলাে এবং সময়মত এর প্রতিশােধ নেবে-এমনি এক সংকল্প নিয়ে আমার সামনেই থানা হেড কোয়ার্টারে চলে গেল।
এর পরের দিন মেলা থেকে পুলিশ উধাও। দোকানদাররাও যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল । ঐ মেলায় আমরা জনসাধারণকে বুঝিয়ে দিতে চেষ্টা করি যে, কাগজপত্রে যে উপর তলার স্বাধীনতা তার ফলে বৃটিশ সৃষ্ট আমলাতন্ত্রের বা পুঁজিবাদী অর্থনীতির কোনই পরিবর্তন হয়নি। ঘটনাটি উল্লেখ করলাম এই জন্য, যে স্বাধীনতা এসেছিল তা কত ভূয়া। লক্ষ্য করছিলাম তথাকথিত সদ্য স্বাধীনতার প্রতি, বহুল প্রচারিত শিশু। রাষ্ট্রের প্রতি জনগণের কিছু মােহ থাকলেও তার অপদার্থ আমলা-কর্মচারীদের প্রতি তাদের ক্ষোভ ও ঘৃণা কত প্রবল ছিল।
যা হােক, ঐ সময় স্কুলে তৎকালীন বিভাগীয় পরিদর্শক জুলফিকার আলী সাহেব আসেন। তিনি আমার পরিচয় পেয়ে খুশীই হলেন। তিনি কিছু মার্কসবাদী সাহিত্যও পড়েছেন বলে আমাকে বললেন । তিনি আমাকে স্কুলটা গড়ে তােলার জন্য বললেন, এদিকে জিন্নাহ স্কুল করে কাজী সাহেব যা আশা করছিলেন তার কিছুই হলাে না। কেবলমাত্র মঞ্জুরিটা হয়েছিল।
ইতিমধ্যে পাকিস্তানের বড় লাট জিন্নাহ্ ঢাকায় এসে গেছেন। তিনি জানতেন, পূর্ব বাংলার স্বাধীনতাকে অংকুরে বিনাশ করতে হলে তার মূলে আঘাত করতে হবে । তাই ঢাকায় এক বক্তৃতায় ঘােষণা করলেন উর্দু এবং কেলব উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ। সারা দেশ যেন বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল । পূর্ব বাংলায় জিন্নাহ্র প্রথম আগমনে মানুষ অনেক কিছু আশা করেছিল। আর এ কিনা তাদের সংস্কৃতি তথা জাতীয় মুক্তির আশা-আকাঙ্খর উপর নির্মম ছােবল । ইসলামী সংস্কৃতি রক্ষার্থে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে হবে, পূর্ব বাংলার যুবকদের কাছে তা বিষবৎ মনে হলাে ।
১৭

চার
কারণ বাঙালীরা জানত যে, তাদের মাতৃভাষা ধ্বংস হলে তাদের শিক্ষা ধ্বংস হবে, তাদের মুক্তি-স্বাধীনতার আশা চিরতরে বিলুপ্ত হবে, তারা পরিণত হবে পশ্চিমাদের দাসানুদাসে। তাই ছাত্রসমাজ প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠল । জিন্নাহ, তাঁর কথা রদ করলেন না বরং ছাত্রদের প্রতিবাদে ভয়ানক চটে গেলেন । ছাত্ররাও আর বসে রইল না, শীঘ্রই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলােতে ধর্মঘট অনুষ্ঠিত হলাে। বাংলার গ্রামান্তরে ছড়িয়ে পড়ল এ সংগ্রাম। চাখার কলেজ, খলিশাকোঠা, নারায়ণপুর গভঃহাইস্কুলের ছাত্ররা ধর্মঘট করে বেরিয়ে এল । ধর্মঘট করলাে বানারীপাড়ার ছাত্ররা, জিন্নাহ্ স্কুলের ছেলেরাও বেরিয়ে পড়ল জিন্নাহর দাম্ভিক উক্তির প্রতিবাদে। আর বসে থাকতে পারলাম না আমি। বানারীপাড়ায় আমিও আমার তৎকালীন সহকর্মী বন্ধু অতুল ভট্টাচার্য একত্রে চাখার কলেজ, জিন্নাহ স্কুল এবং খলিশাকোঠা হাইস্কুলের মিলিত ছাত্রদের শােভাযাত্রায় নেতৃত্ব দিলাম । বিরাট মিছিল । রাষ্ট্রভাষা বাংলা ধ্বনিতে দিকমন্ডল প্রকম্পিত । ভাগ্যের এই বড় পরিহাস কে দেখেছে। পাকিস্তান হতে না হতেই তার শাসকবর্গ জনতার শত্রুতে পরিণত হবে। বিস্ময়বিমূঢ় স্কুলের ছাত্ররা স্লোগান দেয়, কিন্তু অপার বিস্ময়ে পরস্পরের জিজ্ঞাসুনেত্রে তাকিয়ে থাকে। এই কি তাদের দশ কোটি মুসলমানের একচ্ছত্র নেতার আসল রূপ। স্বাধীনতা লাভের পর যেন এক বিরাট প্রবঞ্চনা। মিছিল এগিয়ে চলেছে। আমরা বানারীপাড়া গ্রামে ঢুকেছি। গ্রামের বড় রাস্তা দিয়ে থানার দিকে এগােচ্ছি। উদ্দেশ্য থানার সম্মুখে বিক্ষোভ প্রদর্শন করা। এমন সময় খবর পেলাম আমাকে আর অতুল ভট্টাচার্যকে মিছিলে না থাকতে অনুরােধ করা হচ্ছে। মিছিল থানায় প্রবেশ করলেই আমাদের ধরা হবে। অন্ততঃ আমাদের দু’জনকে গ্রেফতার করবেই। আন্দোলনের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে এবং ছাত্রনেতাদের সঙ্গে আলাপ করে আমরা মিছিল থেকে বিচ্ছিন্ন হলাম। মিছিল থানার সম্মুখ দিয়ে ঘুরে এল বানারীপাড়া জাতীয় বিদ্যালয়ের সামনে। এটি একটি ঐতিহ্যবাহী জাতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বিদ্যালয়টি অসহযােগ আন্দোলনেরই সৃষ্টি। এর প্রধান পরিচালক শ্ৰীযুক্ত কালাচাঁদ বসু (মহারাজ) ছিলেন একটি উৎসর্গকৃত প্রাণ । দেশমাতৃকার সেবার আদর্শে অনুপ্রাণিত ছিলেন এই বিশাল বপু মানুষটি। যতদূর মনে পড়ে লাল ছােপানাে একখানা বড় ধুতি পরতেন। মাথায় কোঁকড়ানাে চুল মহাদেবের জটার
১৮
কথা মনে করিয়ে দেয়। স্বল্পভাষী এই পুরুষটির আয়ত চোখ দুটি যেন উদ্ভাসিত হতাে পরাধীন ভারতের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের এক কঠিনতম সংকল্পের দ্যুতিতে। একদিন মহারাজ বললেন, আমরা আর এগােতে পারলাম না-কিন্তু স্বাধীনতার সংগ্রাম শেষ হয়নি, আপনারা চালিয়ে যান। মিছিল এসে থামল ন্যাশনাল স্কুলের সামনে। বেরিয়ে এল জাতীয় বিদ্যালয়ের ছেলেরাও। মহারাজ ছিলেন সে সভায়। কোনরকম ভূমিকা না করেই সমবেত ছাত্রদের সম্মুখে বক্তৃতা করলেন কমরেড অতুল ভট্টাচার্য। বেশ চাপা অথচ সুস্পষ্ট ভাষায় তিনি বললেন, “আমার সংগ্রামী জনতা ও ছাত্র ভাইয়েরা আমাদের বুঝতে হবে, এটা শুধু ভাষার উপর আক্রমণ নয়-এটা আমাদের স্বাধিকারের উপর আক্রমণ। বাঙালীর অস্তিত্ব মুছে ফেলার এক জঘন্য ষড়যন্ত্র। এ আক্রমণ প্রতিহত করতে হবেই। আমরা যদি এর কাছে মাথা নত করি তা হলে জাতি হিসেবে আমাদের ধ্বংস অনিবার্য।”
সভায় আমিও সংক্ষিপ্ত বক্তব্য পেশ করলাম। বললাম, ভাষাকে কেন্দ্র করে। আজ প্রকৃত স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু হয়েছে। পশ্চিমা একচেটিয়া পুঁজিপতিদের হাত থেকে আমাদের মুক্তি কেড়ে আনতে হবে। তবে স্বাধীন বাঙালী জাতির বেঁচে থাকবার জন্য আমাদের যে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আসতে হবে, এ প্রশ্ন আমাদের মনে কতখানি স্পষ্ট ছিল তা আজ সঠিক বলতে পারব না। অতঃপর সভাভঙ্গ হলে ছাত্ররা যার যার ঘরে চলে গেল।
৪৮-এ পাকিস্তানে ক্ষমতাসীন একচেটিয়া বৃহৎ পুঁজিপতি ও সামন্ত মুৎসুদ্দিদের কারসাজির সামগ্রিক দিক এখনও পুরাপুরি অনুভব করতে না পারলেও ছাত্র জনসাধারণ ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সেই প্রথম বুঝল যে, শাসকশ্রেণীর স্বার্থ ও তাদের স্বার্থ এক নয়। সমগ্র কৃষক-মজুর-মধ্যবিত্তের বাঁচা মরার প্রশ্নে আন্দোলন অপরিহার্য। দেশ বিভাগের পর পরই পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন যে এক অনাগত ঝড়ের পূর্বে মৃদু বায়ু কম্পন। এই আন্দোলনে পূর্ব বাংলার নির্যাতিত জাতীয় বুর্জোয়ারাও যেন সম্বিত ফিরে পেল । এডভােকেট কমরউদ্দীন আহমদের কনভেনশন আহবান, বি, বি, সি, রিপাের্টের বিরুদ্ধে আন্দোলন, এ সবই তার প্রমাণ বহন করে।
আমরা গ্রামে বসে এর পরবর্তী কার্যক্রম নির্ধারণ করতে পারিনি। মনে আছে, আমি আমার বন্ধুবর অতুল ভট্টাচার্যকে নিয়ে ভাষা আন্দোলনকে কী ভাবে স্থায়ী করা যায় তা নিয়ে অনেক ভাবলাম । এবং এই আন্দোনলকে সংহত করার জন্য পশ্চিম বাখরগঞ্জ ছাত্র সম্মেলন আহবান করার সিদ্ধান্ত নিলাম । এই উপলক্ষে আমি পিরােজপুর মহকুমার বিভিন্ন হাই স্কুলে গমন করি। মনে আছে, কাউখালি, জলাবাড়ী, কামার কাঠি, মুটিয়া, স্বরূপকাঠি, কাউন্দিয়া, আকলম এই সমস্ত স্কুলে ছাত্র-শিক্ষকদের মিলিত সভায় বক্তৃতা করি ।
১৯

পাঁচ
পিরােজপুর মহকুমায় এই সময় কামারকাঠিই ছিল ছাত্র আন্দোলনে অগ্রগণ্য। আমি প্রায় দেড় সপ্তাহ ভ্রমণ করে খলিশাকোঠায় প্রত্যাবর্তন করি। এই সময় ছাত্রদের সম্মুখে কাগজ কেরােসিনের উচ্চমূল্য, ছাত্র বেতন বৃদ্ধি, শিক্ষা নীতির পরিবর্তন, ভাষার সমস্যা, ছাত্র আন্দোলন করার মৌলিক অধিকারের প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল। বুঝতে হবে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে বিধ্বস্ত বিশ্বে যে সমস্ত দেশের পুঁজিপতিদের কজা থেকে দেশকে উদ্ধার করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। তারা কোন রকমে বেঁচে গেছে। কিন্তু সুচতুর সাম্রাজ্যবাদীরা আমাদের দেশের বিপ্লবী আন্দোলনের দুর্বলতার সুযােগ নিয়ে এ দেশে তাদের তল্পিবাহক সরকার গঠন করে আগের মতই শশাষণকার্য চালিয়ে যেতে পেরেছে। কাজেই উপরে স্বাধীনতার লেবেল এঁটে দিলেও পাক-সরকারের মূল লক্ষ্য ছিল সকল রকম ন্যায্য আন্দোলনকে নস্যাৎ করা। ৪৮-এ দেখি ছাত্র সম্মেলনের উপর হামলা। তৎকালীন কমিউনিস্টদের বেপরােয়া ধরপাকড়, কৃষক এবং শ্রমিক আন্দোলনগুলিকে স্তব্ধ করার প্রচেষ্টা। যেখানেই গিয়েছি ছাত্রদের একটা বিরাট অংশ আমাদের কথা শুনেছে । কিন্তু সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে একটা কিংকর্তব্যবিমুঢ় ভাব লক্ষ্য করেছি । হয়ত শিশুরাষ্ট্রের এসব সমস্যা একটা স্বাভাবিক ব্যাপার বলেই তাদের মনে হয়েছিল। পাকিস্তানের শােষকগােষ্ঠী সময়ান্তরে এর একটা সমাধান করবে বলে। তাদের অবচেতন মনে একটা ধারণাও ছিল। যে কোন গণ-আন্দোলনকে কমিউনিস্টদের ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ বলে অহরহ সরকারী প্রচারে কিছু ছাত্র, বুদ্ধিজীবী ও জনতার এক অংশ বিভ্রান্ত হতাে। বিভ্রান্ত হতাে বেশী ছাত্রদের অভিভাবকগণ। এদিকে সম্মেলনের কাজ এগিয়ে চলেছে। কামারকাঠি থেকে সুশীল নামে একটি ছাত্র আর্টিস্ট নিয়ে আসা হলাে। সে সম্মেলনের জন্য সুকান্তের একটি বড় চিত্র অংকন করবে এবং অন্যান্য পােষ্টার তৈরী করবে। খলিশাকোঠা বাজারে সম্মেলনের অফিস বসেছে। জিলা ছাত্র নেতা প্রশান্ত দাসগুপ্তের নেতৃত্বে তৎকালীন ছাত্র ফেডারেশনের কর্মীরা সম্মেলনের বিভিন্ন কাজে অংশগ্রহণ করছে।
এ ছাড়া এ সময় আমাকে সবচেয়ে বেশী সাহায্য করেছে আমার ভাগ্নে আজাদ সুলতান। শর্ষিণার পীরের পিতা পীর মওলানা নেছার উদ্দীন সাহেবের অন্যতম সহকর্মী অক্লান্ত কর্মী মরহুম এমদাদ আলী সাহেবের দ্বিতীয় পুত্র আজাদ সুলতান ।
২০
শর্ষিণার অন্ধ গোঁড়ামিকে অগ্রাহ্য করে সেখান থেকে বেরিয়ে এলে তাকে আমার কর্মস্থানে নিয়ে আসি এবং স্থানীয় খলিশাকোঠা হাইস্কুলে ভর্তি করে দিই। আজাদ ছাত্র ফেডারেশনের সুযােগ্য কর্মী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে। পরবর্তীকালে তার রাজনৈতিক অগ্রগতির সূত্রপাত এখান থেকেই। আজাদকেই খলিশাকোঠা সম্মেলনের অফিসের দায়িত্ব দিয়ে আমি বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করতাম। গ্রামে গ্রামে ভ্রমণ করে সম্মেলন সম্পর্কে ব্যাপক উৎসাহের সৃষ্টি করা হলাে। প্রতিক্রিয়াশীল চক্রও এ ব্যাপারে তৎপর হয়ে উঠল।
চাখারের নিকটেই খলিশাকোঠা। ফজলুল হকের প্রাধান্যের পূর্ব থেকেই চাখার একটি উচ্চ মধ্যবিত্ত মুসলিম তালুকদার এবং অভিজাত শ্রেণীর বাসস্থান। বৃটিশ আমল থেকেই ইউনিয়ন বাের্ডের প্রেসিডেন্ট চাখার থেকেই নির্বাচিত হতাে। অত্যাচারী পুরানাে তালুকদারের দুই একটি পরিবার ধ্বংস হয়ে গেলেও বেশ কয়েকটি পরিবার লেখাপড়া শিখে বিভিন্ন চাকুরিতে ঢােকে এবং চল্লিশ-উত্তর যুগে হক সাহেবের আনুকূল্যে অবিভক্ত বাংলার রাজধানী কলকাতায় ও অন্যত্র চাকুরীতে ঢুকিয়ে রাখতে পেরেছিল। তাদের মধ্যে দুটি বড় পরিবার চান্দু মিয়া এবং নয়া মিয়ার মধ্যে কোন্দলও ছিল।
এ কোন্দলের সুযােগ আমরা বলহারের উঠতি মধ্যবিত্তরা কিছুটা গ্রহণ। করতাম। কোন্দলটা আসলে ছিল পুরানাে সামন্ততান্ত্রিক অর্থনীতির ধারক চান্দু মিয়ার সঙ্গে আধুনিক আধা সামন্ততন্ত্র ও ব্যাংক ইত্যাদির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়া মিয়ার সঙ্গে। অবশ্য চান্দু মিয়া উলানিয়ার জমিদার আধুনিক ব্যবসায়ী হামিদ চৌধুরী সাহেবের সঙ্গে মিলে পাইওনির ইন্ডাষ্ট্ৰীজ প্রতিষ্ঠা করে আধুনিক শিল্পে পা বাড়াতে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ঐ সময় বাবুগঞ্জে আখের কল বা অন্যান্য দুই একটি ক্ষুদ্র শিল্পের জন্য প্রয়ােজনীয় মেশিনারীর লাইসেন্স সংগ্রহ করতে পারল না তারা। পাকিস্তানের একচেটিয়া পুঁজিপতি ও সামন্ত প্রভুরা প্রথম দিকে ক্ষুদ্র বুর্জোয়াদের প্রতিষ্ঠান আদৌ সহ্য করতে পারেনি, এটা তারই একটা নিদর্শন। অধুনা এর একটি দৃষ্টান্ত বরিশালের কৌড়ি খাড়ার মৌলানা আবদুল জব্বারের ইউসুফ জুট মিল স্থাপনের চেষ্টা সম্পূর্ণ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
২১

ছয়
এই নিদারুণ ব্যর্থতার আঘাত আগ্রহী শিক্ষিত আধুনিকমনা সরলকর্মী শ্রদ্ধেয় জব্বার মাওলানার অকালমৃত্যুর জন্য দায়ী হওয়া কিছুমাত্র অসম্ভব নয়।
যাক দীর্ঘদিন ইউনিয়ন প্রেসিডেন্ট থাকার জন্য ও চাখারের কোন কোন পরিবারের কৃষক-মজুর-বিরােধী মনােভাবের জন্য স্বভাবতই আমাদের কৃষক সমিতির ও ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে এর বিরােধিতা ছিল। পরবর্তী সময় এরা হক সাহেবের বদৌলতে অনেকেই ফুলে-ফেঁপে ওঠে। কিন্তু মূলতঃ এরা ছিল রক্ষণশীল । ৪৬-এর নির্বাচন, পরবর্তী সময় চাখার কলেজ কমিটি নির্বাচন সংক্রান্ত আন্দোলনে চাখারের প্রভাবশালী মহলের সঙ্গে আমাদের বিরােধিতা প্রকট হয়ে ওঠে। এ সব ব্যাপারে হক সাহেব কোন সময়ই চাখারের প্রভাব এড়াতে পারতেন না।
যুক্তফ্রন্টের যুগে হক সাহেবের নেতৃত্বে সৈয়দ আজিজুল হক (নান্নামিয়া) প্রভৃতির লীগ-বিরােধী ভূমিকা কৃষক-শ্রমিক মুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে তেমন কোন মূল্য সৃষ্টি করতে পারেনি। চাখারের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উপর এর প্রভাব অতি নগণ্য ছিল। যা হােক, ছাত্র সম্মেলনের মাত্র তিন দিন পূর্বে আমি খলিশাকোঠা অফিসে বসে কাগজপত্র দেখছিলাম হঠাৎ চাখারের জনৈক যুবক অতর্কিতে আমার অফিসে ঢুকল এবং “কি রে শহীদ, মিটিং-টিটিং করতেছ শুনলাম” বলে মন্তব্য করল। হ্যা’ বলে আমি মুখ তুলতেই সে আমার মুখে একটা প্রচন্ড ঘুষি মারল । আকস্মিক এই আক্রমণে আমি ক্ষণিকের জন্য অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম। পরক্ষণেই খেয়াল হলাে যে, এটা শান্তিভঙ্গের অজুহাত সৃষ্টি করে সম্মেলন পণ্ড করার প্রচেষ্টারই একটা ধাপ। কাজেই আমি মারটা সম্পূর্ণ হজম করতে চাইলাম। অফিসে থাকা নিরাপদ নয় মনে করে বাইরে বেরিয়ে দেখি রাস্তায় আরও কয়েকটি যুবক হল্লা করছে। অদূরে পুলের নিকট একজন দফাদারসহ আরও কয়েকজন বাঁশের লাঠি হাতে দাঁড়ানাে। আমার মুখ থেকে প্রচুর রক্ত ঝরতে থাকলে আমি কোন রকমে মুখ চেপে সেখান থেকে সরে পড়লাম। সরকার যাতে শান্তিভঙ্গের অজুহাত সৃষ্টি না করতে পারে তজ্জন্য আমার উপর এই আক্রমণ সম্পূর্ণ চেপে গেলাম । অবশ্য চেপে রাখা গেল না, সঙ্গে সঙ্গে খবর ছড়িয়ে পড়ল। আমাদের সমর্থক, কর্মী, বাজারের জনসাধারণ উত্তেজিত হলেও তাদেরকে এই আক্রমণের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বুঝিয়ে শান্ত করলাম। শুনেছি ঔ সময় বানারীপাড়া থানার দারােগা সাহেব চাখারের চান্দু মিয়ার বাড়ীতে ছিলাে। আমরা সম্মেলন করবই এই সংকল্প নিয়ে কাজ চালাতে লাগলাম । কিন্তু সরকারের ষড়যন্ত্রই সফল হলাে। ওরা আজাদ সুলতান, মাদারকাঠির
২২
আজিজ, সােনাহারের আহমদ ও আমার নামে গ্রেফতারী পরােয়ানা জারী করেছে বলে শুনলাম। আমরা আত্মগােপন করলাম। অল্পদিনের মধ্যেই আহমদ ও মীর আজিজ ধরা। পড়ল। বলা বাহুল্য সম্মেলনের একদিন পূর্বে ১৪৪ ধারা জারী করা হলাে। পূর্ব পরিকল্পনানুযায়ী শান্তিভঙ্গের আশংকা দেখিয়ে সম্মেলন বন্ধ করে দেওয়া হলাে।
আমি তখনও পূর্বোক্ত জিন্নাহ হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে কাজ করছিলাম। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হবার পর জিন্নাহ্ স্কুলের একজন শিক্ষক থাকাকালেই আমাকে আত্মগােপন করতে হলাে। একজন শিক্ষাবিদ হিসাবেই ছাত্র ও শিক্ষার সর্বাঙ্গীন উন্নতির জন্যই খলিশাকোঠা সম্মেলন আহবান করেছিলাম। যতদূর মনে পড়ে সম্মেলনের প্রধান অতিথি হিসেবে আমরা বি. এম কলেজের একজন প্রখ্যাত শিক্ষাবিদকে নিমন্ত্রণ করেছিলাম । দেশ বিভাগের অব্যবহিত পরে তৎকালীন বামপন্থী আন্দোলনসমূহ চরম সংকটে পতিত হয়েছিল। সে সম্বন্ধে পরে লিখছি। অগত্যা কলকাতা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। সেখানে গিয়ে উঠলাম আমার জনৈক বাল্যবন্ধুর বাসায়। তার মা আমাকে পাকিস্তানে ফিরে যেতে বারণ করলেন। বললেন, শহীদ তুমি আমার পুত্রের মত। পাকিস্তানে গিয়ে ধরা পড়লে বেরােতে পারবে না। বললেন দেখ, পাকিস্তানের শাসক শ্রেণীর কেউই জেল খাটে নাই তারা জেলের দুঃখকষ্ট বুঝবে না। অবশ্য আমার বন্ধু ননীগােপাল আমাকে পাকিস্তানে কাজ করার প্রয়ােজনীয়তা সম্বন্ধে বলল, কিন্তু কঠোরভাবে আত্মগােপন করে থাকতে অনুরােধ করল। সেদিন সন্ধ্যায় কলিকাতা কলেজ স্কোয়ারে আমি আর ননী মৌন হয়ে বসে রইলাম। পরস্পর থেকে আসন্ন বিচ্ছেদের সময় আমাদের সম্পূর্ণ অভিভূত করে ফেলল। গাছের ফাঁক থেকে স্বল্প চন্দ্রালােক ছায়ার সঙ্গে মিশে আমাদের দুঃখকে আরাে নিবিড় করে তুলল। মনে হলাে, দেশমাতৃকার ডাকে আমি যেন ছুটেছি প্রাণপ্রিয় বন্ধু-বান্ধব ছেড়ে কোথায় কোন অনির্দিষ্ট পথে ।
২৩

সাত
আমার চোখে সেদিনের জন্য প্রকৃতি যেন বহু ইঙ্গিতে রঙ্গময় হয়ে উঠলাে। অনেকক্ষণ পর ননী মুখ খুললাে। ননী রাজনীতিক নয় । কিন্তু সে ছিল একান্ত বন্ধুবৎসল। এ পথ থেকে ফিরাতে পারবে না বলে সে মনে মনে নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে করত। বলল, শহীদ বিপ্লবের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছ আমি যা পারিনি। এ কাজ থেকে তােকে বিরত হতে বলব না, তবে তাের সঙ্গে যে আবার কবে কোথায় দেখা হবে জানি না। সুযােগ পেলেই কিন্তু কলকাতা আসবি। সেদিন মনে হলাে রাজনীতির গর্ব করি আমরা। কিন্তু আমাদের চেয়ে উঁচুস্তরের এরা। এ রকম উদার ও সহানুভূতিশীল বন্ধু রাজনীতির সহায়ক, এরূপ বন্ধু বিরল।
মাত্র ১ সপ্তাহ কলকাতায় থেকে দেশে ফিরে আসি। ইতিমধ্যেই কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। কংগ্রেস থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানী প্রতিনিধিরা ফিরে এসে ‘ইয়ে আজাদী ঝুটা হায়, লাখাে ইনছান ভুখা হ্যায়’ বলে। ধ্বনি দিতে লাগলাে। স্বভাবতই তথাকথিত সদ্য স্বাধীন দেশের জনগণ এ শ্লোগানকে শত্রুর স্লোগান বলে মনে করে এর প্রতি কর্ণপাত করলাে না। কমিউনিস্ট পার্টি জনগণ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল এবং সরকার এর সম্পূর্ণ সুযােগ গ্রহণ করে সারা পাকিস্তানে প্রায় সকল বিপ্লবীদেরই গ্রেফতার করে জেলে পাঠিয়ে দেয়। রাষ্ট্র ভাষার প্রশ্নে যে প্রতিবাদটুকু হয়েছিল তাও সাময়িকভাবে স্তিমিত হলাে। ঐ সময় জিন্নাহর প্রভাব ছিল অক্ষুন্ন। তাছাড়া কাশ্মির সমস্যা মােহাজের সমস্যা প্রভৃতিকে জনগণ নিজস্ব জাতীয় সমস্যা বলে মনে করছে। তখন আভ্যন্ত রীণ গণতন্ত্র বা অর্থনৈতিক দাবী আদায়ের সংগ্রামকে সরকার পঞ্চম বাহিনীর কাজ। বা ভারতীয় চরদের কাজ বলে প্রচার করে জনগণকে বিভ্রান্ত করছে। জনগণের চেতনায় এই দুর্বলতার সুযােগ গ্রহণ করে সরকার চরম সন্ত্রাস চালালাে। গ্রামে গ্রামে আনসার বাহিনী সৃষ্টি হলাে। সে সময় আত্মগােপন করে থাকা অত্যন্ত কঠিন ছিল। আনসার কমান্ডারগণ আমাদের ধরিয়ে দিতে পারলে নিজেদের ধন্য মনে। করত।
এই প্রসঙ্গে কলকাতায় অনুষ্ঠিত পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেস সম্বন্ধে দু’একটা কথা বলা দরকার। ২য় কংগ্রেস অবিভক্ত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির জেনারেল
২৪
সেক্রেটারী পি. সি যােশীর পাকিস্তান ঘেঁষা দক্ষিণপন্থী নীতির তীব্র সমালােচনা করে একটি সশস্ত্র সংগ্রামের নীতি ঘােষণা করতে গিয়ে আর এক চরম বামপন্থী বা হঠকারীনীতি ঘােষণা করল এবং বি. টি রনদিভেকে জেনারেল সেক্রেটারী নির্বাচিত করল । বি, টি রনদিভে বললেন, সমাজতন্ত্রের সংগ্রাম শুরু করতে খুবই দেরী হয়ে গেছে। অবিলম্বে সশস্ত্র সংগ্রামের আহবান দিলেন তিনি। কিন্তু সংগ্রামের শত্রু মিত্র নির্ধারণে চরমভাবে ব্যর্থ হলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সম্রাজ্যবাদের আধা ঔপনিবেশিক দেশগুলােতে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে স্ব স্ব দেশীয় অত্যাচারিত জাতীয় বুর্জোয়াসহ সমগ্র কৃষক শ্রেণীর, (জোতদার ও সামন্ত। প্রভু ব্যতিত) জনগণতান্ত্রিক সরকার গঠনের বিপ্লবী সংগ্রামে অংশগ্রহণ করার যে একটি ঐতিহাসিক শর্ত-তা তিনি বেমালুম ভুলে গেলেন এবং শহরের একমাত্র সর্বহারা শ্রমিক শ্রেণী এবং গ্রামের ক্ষেতমজুরদের নিয়ে সশস্ত্র বিপ্লব সংগঠিত করার একটি অবাস্তব ঘােষণা জারী করে সম্মেলনের সমাপ্তি ঘােষণা করলেন। দেশ বিভাগজনিত পরিবর্তিত পরিস্থিতি, পাকিস্তান ও ভারতে কংগ্রেস ও লীগ নেতাদের প্রভাব, অতীত ভুলের জন্য পার্টির সংগ্রামী ও সাংগঠনিক শক্তির অবস্থা কিছুই কমরেড রণদিভে তলিয়ে দেখলেন না। সর্বোপরি জাতীয় বুর্জোয়া ও কৃষক শ্রেণীর প্রায় সকল অংশই বাইরে ফেলে রেখে যে সংগ্রাম আহবান করা হলাে-তার অবশ্যম্ভাবী বিষময় ফল ফলতে দেরী হলাে না। হঠকারী কার্যকলাপে বহু শ্রমিক ও কৃষক কমরেড জীবন দিলেন। বাকী প্রায় সবাই কারাবরণ করতে বাধ্য হলেন।
২৫

আট
গ্রেফতারের পর
বলা বাহুল্য দ্বিতীয় পার্টি কংগ্রেসের নতুন সিদ্ধান্তের আসল ভুল হলাে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের স্তর বাদ দিয়ে সরাসরি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সংগ্রাম শুরু করা। স্বভাবতই এ রকম একটা কর্মসূচী গ্রহণ করে গ্রামাঞ্চলে বিশেষ কিছু করা গেল না এবং অনতিকাল পরেই আমরা অনেকেই গ্রেফতার হয়ে যাই।
মনে আছে, আমাকে যখন আনসাররা ধরে নিয়ে চাখার রাস্তার অভিমুখে যাচ্ছিল তখন আমি রাস্তায় স্লোগান দিচ্ছিলাম, ‘সস্তা মূল্যে চাউল দাও, নইলে গদী ছেড়ে দাও। মনে হয়, ঐ সময় চাউলের মূল্য জনগণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গিয়েছিল। তারা আমাকে চাখার ডাকবাংলায় নিয়ে আসল। ঐ সময় জনৈক আনসার কমান্ডার চিৎকার করে বলছিল, সে পাকিস্তানের একজন বড় দুশমনকে ধরেছে-তার জীবন সার্থক। এ সময় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম চাখার স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। তিনি আমাকে দেখে যেন মুষড়ে পড়লেন। তিনি ছিলেন। অত্যন্ত কোমল হৃদয়ের মানুষ । দেখলাম তার চোখ দুটি জলে পূর্ণ হয়ে আসছে। ঐ অবস্থায় তিনি তাড়াতাড়ি কোথা থেকে কিছু খাবার যােগাড় করে আনলেন। তার কাছে যতবারই আমার জেলের অভিজ্ঞতার উপর বই লেখার কথা বলেছি ততােবারই তিনি আমাকে উৎসাহ দিয়েছেন। আজ এই স্মৃতিকথা লিখতে গিয়ে যখন দেখি তিনি বেঁচে নেই, তখন যেন কলম বন্ধ হয়ে যায়। মন গুমরে ওঠে এক অব্যক্ত বেদনায়। আমাকে ডাকবাংলােয় নিয়ে আসা হলে চাখার কলেজ ও স্কুলের ছাত্ররা এসে জড়াে হয়। অদূরে দেখলাম একদা সংগ্রামী কৃষক-কর্মী গাববাড়ির মতলেব মুন্সী । ইতিমধ্যেই বানারীপাড়া থেকে বন্দুক কাঁধে সিপাহীরা চলে এসেছে। আমার সঙ্গে কলকাতা থেকে আনীত বইগুলাের লিস্ট নিচ্ছেন একজন। Castata fofa Garlaicas Empirio Criticism Teatce Empire Criticism মনে করে বললেন, সাম্রাজ্যের সমালােচনা বইটা ভালই হবে । মনে মনে হাসলাম। যাক আমাকে নৌকায় উঠিয়ে বানারীপাড়া নিয়ে যাওয়া হলাে। মনে আছে, ঐ সময় বানারীপাড়ার হাবিব মৃধা তখন ছােট ছিল; আমাকে দেখতে এলে দারােগা সাহেব তাকে জিজ্ঞেস করলেন, দস্যু মােহন সিরিজ পড়েছ? হাবিব চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকায় দারােগা সাহেব বললেন, আমরা মােহনদের বাপকে ধরে নিয়ে এসেছি। অবশ্য আমি থানায় তখন ভাল ব্যবহারই পেয়েছিলাম। থানার বড় জমাদার
২৬
জয়নুউদ্দীনের সঙ্গে দেখা হতেই সে বলে উঠল, আপনার সূর্য মুণীর কথা মনে আছে? আমরা সেদিন থেকেই আপনাকে গ্রেফতারের জন্য উঠে পড়ে লেগেছিলাম। এটা লক্ষ্য করেছি যে, পাকিস্তানের তৎকালীন ব্যবসায়ী মহল খুদে ধনীরা আমাদেরকে দেশের শত্রু হিসেবেই মনে করেছে। তার প্রমাণ আমাকে থানায় নিয়ে এলে কোন কোন মহলে বেশ খুশিরই সঞ্চার হয়েছে দেখলাম। আমাকে পরদিন স্টীমারে পিরােজপুর চালান দেওয়া হলাে। পুলিশের সঙ্গে সঙ্গে আনসারও উঠে এসেছে স্টীমারে । আমার পরিষ্কার মনে আছে, দরিকরের সােবহান নামে একটি যুবক আনসার পুলিশকে সতর্ক করে দিচ্ছে যেন স্টীমারে আমাকে খুব সতর্ক পাহারা দেওয়া হয়। আমার নাকি ৩০ হাজার শিষ্য রয়েছে। আমারই পার্শ্ববর্তী গ্রামের সেই খুদে সৈন্যটি আজ বেঁচে নেই। সে সময় আনসাররা নিজেদের মনে করত নব্য রাষ্ট্র পাকিস্তানের সবচেয়ে বিশ্বস্ত জিম্মাদার। কী গভীর প্রত্যাশা নিয়ে তারা তখন রাষ্ট্রের খেদমত করছিল!
আমাদের সম্বন্ধে পুলিশ কর্মচারীদের আরাে সতর্ক করে দেওয়ার প্রয়ােজনীয়তা তারা বােধ করছিল । কড়া পুলিশ বেষ্টনীতে স্টীমারের একেবারে সামনের ডেকে বসলাম। খুব সম্ভব একটা কম্বল পেতে বসে ছিলাম। ছােবহানসহ আরও কয়েকজন আনসার স্টীমার থেকে নেমে গেলে স্টীমার ছেড়ে দিল । এমন সময় মনে কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল আজ সঠিক বলতে পারবাে না। তবে আমার স্বভাবই এরূপ-আমি আত্মপ্রচার আদৌ পছন্দ করি না। ব্যাপারটি আমার কাছে। কেমন যেন স্বাভাবিক বলেই মনে হয়েছিল। হয়ত এর কারণ এর জন্য একটা মানসিক প্রস্তুতি আগে থেকেই ছিল। নিস্তরঙ্গ নদীতে স্টীমার এগিয়ে চলেছে। সিপাইদের সাথেও কথা বলার তেমন কোন উৎসাহবােধ করছিলাম না। নিজের মনে কোন হতাশা বা গৌরব কোনটাই অনুভব করছিলাম বলে মনে পড়ছে না।
ঐদিন ঠিক সন্ধ্যায় পিরােজপুরে পৌছলে সঙ্গে সঙ্গে আমাকে জেলের অভ্যন্তরে নিয়ে যাওয়া হয়। এই-ই প্রথম বাইরের মুক্ত আলাে বাতাস বিবর্জিত চার দেয়ালের মধ্যে প্রবেশ করলাম। আমাকে গেটের ভিতর দিয়ে নিয়ে যাবার সময় কে একজন সিপাহী জমাদার সুলতানকে ডেকে বলল, একজন বি.এ পাস নিয়ে এসেছি। জমাদার তার চেয়ারে বসেই বেশ জোরের সাথেই বলল, নিয়ে যাও-ভিতরে এম. এ পাসের কল আছে। কথার মধ্যেই তীব্র শ্লেষ, মূখতা এবং ঔদ্ধত্য দেখে আমি যেন থ হয়ে গেলাম। একজন বি. এ. পাস কে, সে কেন এসেছে কিছুই জানার ইচ্ছে হলাে না তার। বুঝলাম জেলখানা সম্পূর্ণ এক ভিন্ন জগৎ; এখানে সবারই এক পরিচয়-সে কয়েদী, মানুষ না। এম. এ পাসের কল সে কি। কিছুই ভাবার অবসর পেলাম না, এরই মধ্যে গেটের ওপাশে পা দিতেই ‘বিড়ি দে শালা’ বলেই কালাে, সাক্ষাৎ যমের মত চেহারার একটি কয়েদী এসে
২৭
সামনে দাঁড়াল। জেলের আচরণ সম্বন্ধে আমার পূর্বের কোন অভিজ্ঞতাই ছিল না, তখন রাত হয়ে গেছে। গেটের অস্পষ্ট আলােকে লােকটার মুখও দেখতে পাচ্ছিলাম না ভাল করে, বা আমাকেও সে ভাল করে দেখে নিয়েছে বলে মনে হলাে না । দিনের বেলা হলে হয়ত তার ব্যবহার এতটা খারাপ হতে পারত না। হঠাৎ আমি যেন কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। বললাম, আমি বিড়ি খাই না। কিন্তু কয়েদী যেন তা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারল না, পিছে হাত দুটি রেখে মাথা নীচু করে সে যেন কি ভাবল, পর মুহূর্তেই ‘দে তাের লগে আছে কত দে’ বলেই সে আমার জামা ধরে এমন জোরে সামনের দিকে টান দিল যে, আমি জেলের বাঁধানাে রাস্তার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলাম এবং হাতে ও কোমরে ভীষণ আঘাত পেলাম। খােরশেদ আমার কাছে কিছুই না পেয়ে ‘শালায় ফুডা বাবু’ বলে এক ধাক্কা দিয়ে ঘরের ভিতর ঢুকিয়ে দিল। মাত্র ৮০ জন কয়েদী থাকতে পারে, এমন একটা একতলা দালানে প্রায় ২ শতাধিক কয়েদী রাখা হয়েছে। বেশ কিছুদিন আত্মগােপন করে থাকার পর আমার স্বাস্থ্য হয়েছিল খুবই খারাপ। লক আপের পর সেই বীভৎসতার মধ্যে যেন নিজেকে হারিয়ে ফেললাম। আমার সমস্ত অহমিকা মুহূর্তে বিলীন হয়ে গেল। মনে হলাে মানুষের এত সান্নিধ্যে আর কোন দিন আসিনি। সমস্ত দোষগুণ নিয়ে মানুষ যে আপন সত্তায় মহিমান্বিত, এ ধারণা যেন মনের অবচেতন স্তরে উঁকি মারল। জেলের ঐ পরিস্থিতিতেও কেন যেন কয়েদীদের ভাল লাগল । অত তাড়াতাড়ি তাদের সঙ্গে কেমন যেন স্বাভাবিক হয়ে গেলাম। আমি যে তাদের চেয়ে আলাদা কেউ এটা মনে হলাে না, ঐ রাতে খুব সম্ভব ওরা খাবার দেয়নি। কিন্তু খাবার কথা আমি ভুলে গেলাম। জেলে কয়েদীদের নিরাভরণ উদ্দামতা দেখে আমার পেট ভরে গেল। নিজেকে একজন শিক্ষিত, রাজনৈতিক বা তাদের চেয়ে আলাদা কিছু তা প্রকাশ করতে মন চাইল না। কেবলই মনে হলাে, তােমরা ভদ্রবেশী সাধুর দল যাদের চোর বলে এখানে ধরে নিয়ে এসেছ তােমরাই বা বড় কিসে?
মনে পড়ল রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত লাইন দু’টি ‘তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ আমি আজ চোর বটে । আগেই বলেছি মাত্র ৮০ জনের জায়গায় দুই শতেরও অধিক কয়েদী হাজতী এনে ঠেসে দিয়েছে ওয়ার্ডটিতে । ফলে অবস্থা যে কি হলাে বর্ণনা করাও দুঃসাধ্য-এক রকম পরস্পরের ঠেলা ধাক্কায় জানলার গা ঘেঁষে সামান্য একটু ফাঁকে পা-মাথা প্রায় এক করে শুয়ে পড়লাম । সে কি কোলাহল-পুরােনাে মেটদের শালা পৈলা ছাড়া কোন গাল নাই-কাকেও লাথি, কাকেও ধাক্কা, কেউ বিড়ি খাচ্ছে-একটা বিড়ির জন্য দেখলাম প্রায় দশজন যেন হামাগুড়ি দিয়ে তার কাছে যাচ্ছে। ততক্ষণে আলাে প্রায় নিভিয়ে দিয়েছে। মেট চিৎকার করে বললাে, কোনাে শালা একটা কথা কইছাে কি যমের বাড়ী পাঠিয়ে দেব।
২৮

নয়
পাহারাদার মেট আমাদের কথা শুনে তেড়ে এল, ‘শালারা কথা বলে। আমরা সবাই চুপ করে গেলাম। সারারাত একটুকুও ঘুম হলাে না। সেই বীভৎস নারকীয় পরিবেশে যেন আমার অনুভবশক্তি হারিয়ে ফেললাম। দেখতে দেখতে ভাের হয়ে গেল। শরীরের দিকে চেয়ে দেখি, এক ধরনের সাদা উকুনে সারা দেহ ভরে গেছে। মাথার চুল জট বেঁধে গেছে। হাত-পা শুকিয়ে মৃতের শরীরের মত ফ্যাকাশে হয়ে গেছে । হঠাৎ দরজা খুলে গেল । সিপাহী গুনতি নিতে এসেছে। আমাদের ফাইলে বসতে হলাে। ততক্ষণ মন শক্ত করে নিয়েছি। ভাবলাম এ অবস্থায় মুষড়ে পড়লে চলবে না। কোন রকম হাত মুখ ধুয়ে আবার ফাইলে বসলাম। এবার জেলার আসবে । হঠাৎ দেখলাম, ছিপছিপে অদ্ভুত কালাে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, ছােট চোখ দু’টি লাল, তাতে আবার মিসকালাে প্যান্ট পরা এবং কোটটিও তদ্রুপ- জেলার সাহেব ঝড়ের গতিতে ঢুকেই ফাইলের পশ্চিম প্রান্তে চলে গেল এবং দ্রুত বেরিয়ে যাবার সাথে সাথে কারাে কোনাে নালিশ আছে’- জিঞ্জেস করেই আবার বেরিয়ে গেল। মনে হলাে যেন যুগ যুগ ধরে সাধনায় রত জেলের কয়েদীদের কৃতার্থ করার জন্য বা মৃত্যুর পরােয়ানা জারী করার জন্য কবরের আজরাইল চকিতে দর্শন দিয়ে গেল । আমার কথা বলার ইচ্ছা থাকলেও কিছুই বলার সুযােগ পেলাম না। অন্য কয়েদীদের জিজ্ঞেস করে জানলাম, এই জেলার এরূপই করে । সাত আটদিন চেষ্টা করে কেউ হয়ত এর কাছে নিজেদের অভিযােগ উপস্থিত করতে পারে। এরই এক ফাঁকে এক বৃদ্ধের সাথে আমার আলাপ হয়েছিল । তার বয়স আশি বছরের উপর । চুরি করে ধরা পড়েছে। বলল, সে অভাবের তাড়নায় আষাঢ় মাসে কচু পাতা কেটে মাথায় দিয়ে রাতে একখানা ভাঙা ডিঙ্গি বেয়ে আর এক গ্রামে গিয়ে কয়েক ছড়া কলা মােচা প্রভৃতি কেটে নিয়ে আসত এবং দূরের বাজারে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করত। বৃদ্ধের ঘরে পাঁচ-ছয়জন খাইয়ে। হঠাৎ সেই বৃদ্ধকে এক মেট ফাইলের সবার সামনে উপস্থিত করে তার ছেড়া লুঙ্গি ধরে টান দিয়ে তাকে উলঙ্গ করে ফেলল এবং তার মলদ্বারে থুথু দিয়ে এক উন্মত্ত অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল । বৃদ্ধ কাপড়টাকে কোন রকম টেনে লজ্জায় দুঃখে হাউ হাউ করে চিৎকার করে উপুড় হয়ে পড়ে রইল । কি করে জানি না, ততক্ষণে কয়েদী হাজতীরা আমার সম্বন্ধে জেনে গেছে। কয়েকজন মেট জিভ কাটতে কাটতে আমার কাছে দৌড়ে এসে আমাকে জায়গা করে দিল। “শালারা সরে যা” পাশের কয়েকজন কয়েদীকে লাথি
২৯
দিয়ে সরিয়ে দিল। আমি মানা করলাম। কিন্তু কে শুনে? আমি তখন অনেকখানি জায়গা নিয়ে আরামে বসলাম। দেখলাম অনেক হাজতী কয়েদী আমার সঙ্গে আলাপ করতে উৎসুক- কিন্তু মেটের জন্য সাহস পাচ্ছিল না। হঠাৎ আমার চোখ পড়ল একটি হাজতীর উপর-নাম তার আয়ুব আলী, পরনে শতছিন্ন একখানা। লুঙ্গি। সমস্ত গা ফোঁড়া পাঁচড়ায় পচে গেছে । জিজ্ঞেস করলাম, তােমার কেস কি? বলল, আমার বিরুদ্ধে হাস চুরির কেস দিয়েছে । তার কথা বলার ভঙ্গি, শরীরের অবস্থা এবং চোখ-মুখের ভাব দেখে আমার চোখ ফেটে কান্না আসতে লাগল। সে বলল, বাবু আমি আজ এক বছর হাজতে, আমার কোন উকিল-মােক্তার নেই । আমি নাকি অন্য বাড়ির হাঁস তাড়িয়ে নিজের বাড়ি নিয়ে এসেছি। তাকে বললাম, আমি যেদিন কোর্টে যাব সেদিন আমার সাথে যেতে চেষ্টা করবে। হলােও তাই, আমার কোর্টে যাবার দিন জমাদারকে বলে কয়ে ওকে সঙ্গে নিলাম। বলা বাহুল্য, আয়ুব আলীকে একেবারে এস-ডি-ও’র কাছে নিয়ে গেলাম। একজন মােক্তার দিয়ে ওর কথা এস-ডি-ও সাহেবকে বলায় তিনি ওকে ৪ ঘণ্টা কোর্ট সাজা দিয়ে খালাস করে দিবার আদেশ দিলেন। এস-ডি-ও’র সামনে আয়ুব আলী আমার সঙ্গে কথা বলার সাহস পায়নি। দূর থেকে আমার প্রতি যেন তার অন্তর নিংড়ানাে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টি ফেলে নীচে হাজতে চলে গেল।
এ দিকে আমার গ্রেফতারের সংবাদ পেয়ে আমার মেজভাই মাওলানা নূরুদ্দিন, আমার শর্ষিণার ভাগ্নে মাওলানা মতিন জেলগেটে উপস্থিত। ততক্ষণে জেলারের হুঁশ হয়েছে। দৌড়ে আমাকে ভিতরে গিয়ে বললেন, আপনি আমাকে আপনার পরিচয় দেননি। সেই কালাে চোখ-মুখে তখন মুচকি হাসির রেখা ফুটে উঠেছে, বলল, চলুন জেলগেটে-আমার অফিসে। গেটে গিয়ে দেখি, তাঁরা গভীর উদ্বেগ নিয়ে বসে রয়েছেন। জানলাম, জেলার হাবিবুল্লাহ সাহেব আমার ভগ্নিপতি জনাব এমদাদ আলী সাহেবের এককালের দোস্ত।
আমার সঙ্গে এসেই পরিচয় না হওয়ার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে বললেন যে, জেলে আমার কোন অসুবিধা হবে না। সাবজেলে চায়ের কোন বন্দোবস্ত নেই বলে তিনি তখনই বাইরে থেকে যাতে প্রত্যহ ভােরে চা ডিম বিস্কুট আসে তার ব্যবস্থা করলেন, অবশ্য এর দাম আমাকেই দিতে হয়েছে। কিছুক্ষণ পর মেঝভাইকে একটু আড়ালে ডেকে কথা বললেন- মনে হলাে, যে-ভাবেই হােক আমাকে এ পথ থেকে ফিরাতে পারবেন-তাকে এরূপ আশ্বাস দিয়েছেন। মেঝভাই মামলা দায়ের করে আমাকে মুক্ত করার সমস্ত চেষ্টা করবেন এবং ভাগ্নে মতিন তার স্বভাবসিদ্ধ সাহস ও জোর দিয়ে বলল, যেভাবেই হােক আমাকে মুক্ত করবেই । অতঃপর তারা বিদায় নিলে জেলার সাহেব সেই মুহূর্তে আমার জন্য পশ্চিম দিকের দালানের দোতলা
৩০
সম্পূর্ণ ছেড়ে দিলেন এবং চারজন কয়েদীকে আমার দেখা-শুনার জন্য ঠিক করে দিলেন। এ দিকে আমার কোর্টে যাবার তারিখ পড়ল। আমাকে কোর্টে নিতে এসে এক সিপাই আমার কোমরে দড়ি পরাতে চাইলে আমি দড়ি পরতে অস্বীকার করি। এতে নিকটস্থ একজন বৃদ্ধ কয়েদী বলল, মিয়ার পাে ওটা আইনের দড়ি, ওতে কোন অসম্মান নাই। যাই হােক, আমাকে এমনিই কোর্টে নিয়ে যাওয়া হলাে। এটা ঠিকই, সাধারণ লােকের দৃষ্টিতে আইনের দড়ি কোন অসম্মানকর কিছু নয়। কিন্তু তারা বুঝল না যে, আইন নির্বিশেষ জিনিষ নয়। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের আইন’ পুঁজিবাদী সংরক্ষণের জন্যই তৈরি হয়েছে। পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে কথা বলাই আইনের চোখে দোষী। ও দড়ি যে সর্বহারা বিপ্লবের নেতা ও কর্মীদের কোমরে কঠিন নাগপাশ সৃষ্টি করার জন্য তৈরী হয়েছে তা সকলের বুঝা সম্ভবও নয়।
কোর্টে আমার ডিফেন্সের জন্য তৎকালীন স্বনামখ্যাত সােবহান মােক্তার, উকিল আলতাব উদ্দীন, জয়নাল মােক্তার সাহেব (যিনি পরে এম-পি-এ হয়েছিলেন) আরও কয়েকজন উকিল-মােক্তার উপস্থিত ছিলেন, তাঁরা মামলার ফিস নেননি। তাদের আগ্রহ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এই প্রথম একটি রাজনৈতিক কেস পরিচালনা করে কিছুটা দেশের খেদমত করে এবং একই সঙ্গে রাজনৈতিক মামলা সম্পর্কে অভিজ্ঞতা ও সুনাম অর্জন করা।
আমার বিরুদ্ধে অভিযােগ ছিল, আমি জমিদারদের এবং ধনীদের উৎখাত করতে বলেছি।
আমার পক্ষে ডিফেন্সের মূল কথা ছিল, মুসলিম লীগের ঘােষণাপত্রেই জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের কথা রয়েছে। কাজেই আমার জমিদারদের বিরুদ্ধে কথা বলায় মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে কথা বলা হয় নাই। তা ছাড়া যে সভা ১৪৪ ধারা দিয়ে বেআইনী করা হয় নাই সে সভায় বক্তৃতার বিষয়াবলীর উপর কোন অভিযােগ তৈরী হতে পারে না। প্রতি তারিখেই কোর্টে ভিড় হতাে।
একবার এস-ডি-ও সাহেব জেলের ভিতরে গেলেন এবং আমার সঙ্গে আলাপ প্রসঙ্গে বললেন, দেখুন, আপনার যা কেস তাতে আমি খালাস দিতে পারি। কিন্তু জানেন তাে তাতে আমার হাতে কড়া পড়বে । বুঝেনই তাে আমাদের গার্ড দিবার জন্য টিকটিকির দল রয়েছে। আশ্চর্য লাগে ভাবতে যে, দেশ স্বাধীন হয়েছে-পাকিস্তান হয়েছে বলে শাসকচক্র কত বড়াই করে, কিন্তু আসলে ব্যক্তি স্বাধীনতা বা আইনের স্বাধীনতা বিন্দুমাত্র অর্জিত হয় নাই। তা না হলে একজন মহকুমা হাকিম তার স্বাধীন মতানুযায়ী কাজ করতে সাহস পাচ্ছে না-পাছে। বৃটিশসৃষ্ট গােয়েন্দা বিভাগ তাকে নাজেহাল করে। তারপর আর একদিন আলাপে তিনি বললেন, ‘আচ্ছা আমরা তাে সবাইকে ভােটের অধিকার দিয়েছি-আপনারা
৩১
ভােট দিয়ে ভাল লােক আইন সভায় পাঠালেই তারা আপনাদের ইচ্ছানুযায়ী আইন। তৈরী করতে পারে। আমি বললাম-জনগণকে ভােটের অধিকার দিলেই কি তারা। তা প্রয়ােগ করতে পারে? উদাহরণস্বরূপ বললাম, ধরুন চাখারের চান্দু মিয়া, মঠবাড়ীর হাতেম জমাদ্দার বা অনুরূপ তালুকদার জোতদার বা মিল মালিকগণ যদি নির্বাচন-প্রার্থী হয় সেখানে জনসাধারণকে তার নিজস্ব লােকদের বাদ দিয়ে তাদেরকেই ভােট দিতে হবে। কাজেই দেশে যতদিন অত্যাচারী ধনিক শ্রেণীর অস্তিত্ব থাকবে, ততদিন সার্বজনীন ভােটাধিকার দ্বারাও জনস্বার্থ আদায় সম্ভব নয়। জনতার চেতনার নীচু স্তর ও আমলাতন্ত্রের প্রাধান্যের কথা চিন্তা করলে সেই ৪৮ সালে জনগণের ভােট জনস্বার্থে প্রয়ােগ করা আদৌ সম্ভব ছিল না। মহকুমা হাকিম সাহেব একটু হেসেই বললেন, আপনাদের সঙ্গে কথায় পারা যাবে না তা জানি। বললাম, আমি যা বলছি তা একটি সাধারণ সত্য মাত্র। যাক এদিকে আমাকে দোতালার যেখানে জায়গা করে দিলেন সেখানে রায়েরকাঠির জমিদার পরিবারের রাজবন্দী কালীশ বাবুর সঙ্গে আলাপ হলাে। ইনি একজন পুরনাে কংগ্রেস কর্মী। মুন্ডিত মাথা, গােলগাল চেহারার অত্যন্ত সংযমী ভদ্রলােক।
৩২

দশ
অবশ্য তিনি আমার সঙ্গে তেমন কোন রাজনৈতিক আলাপ করেন নাই। সম্ভবত সেটা তিনি তার মুক্তির পক্ষে অন্তরায় মনে করতেন। জমিদার কালিশ বাবুর বাড়ী থেকে বিভিন্ন প্রকারের পিঠা, নাস্তা, মাংস, পােলাও ইত্যাদি সরবরাহ করত । তিনি তা থেকে আমাকে না দিয়ে খেতেন না। তিনি যে কয়দিন জেলে ছিলেন আমি প্রচুর খেতে। পেতাম। এর মধ্যে বিভিন্ন রকম ফলমুলাদিসহ নারিকেলের তৈরী অনেক পিঠা ও মিষ্টিদ্রব্য ছিল। আমার যাতে কোনরূপ অসুবিধা না হয় তিনি সেদিকে লক্ষ্য রাখতেন। তাঁর বয়স যথেষ্ট ছিল কিন্তু তিনি আমাকে স্নেহ করতেন আবার শ্রদ্ধাও করতেন। বলতেন, আপনারাই দেশের ভবিষ্যৎ-আমাদের দ্বারা আর কিছু হওয়া সম্ভব নয়।
একদিন নীচে নেমে এসে পায়চারি করছি-দেখি আমাদেরই উত্তর দিকের বাড়ীর আয়েনালী জেলের মেঝে ধুইছে। জিজ্ঞেস করলাম “আয়েনালী, তুমি এখানে?” আয়েনালী নীচের দিকে দৃষ্টি ফেলে বলল, “মিয়ার পাে আপনিত সেদিন দেখলেন।” ব্যাপারটা এতক্ষণে বুঝলাম । আমার গ্রেফতার হবার দুইদিন পূর্বে শেষ রাত্রে আয়েনালীকে একটা গরু নিয়ে আমারই পাশ দিয়ে যেতে দেখেছিলাম। তখন কেউ কারও সঙ্গে কথা বলি নাই। পাশের বাড়ীর গরু চুরি করে আয়েনালী বিক্রি করতে যাচ্ছিল, পরে ধরা পড়ে জেলে আসে। অবশ্য ২/১ দিনের মধ্যেই সে জামিনে বের হয়। পরে তার কি হলাে জানতে পারিনি।
সাব-জেলে খবরের কাগজ পড়া বা অন্য কোন সুযােগ-সুবিধা না থাকলেও একটা বিষয়ে খুবই সুবিধা হয়েছিল-তা হলাে দোতলা থেকে সর্বদাই বাইরের জনতাকে দেখা যেত । আগেই বলেছি, আমাকে বাইরের রেষ্টুরেন্ট থেকে চা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আমাকে যে দোকান থেকে চা দেওয়া হতাে তা দোতলার জানালা থেকে দেখা যেত। আমি ভােরে হাত-মুখ ধুয়েই দোকানের দিকে তাকিয়ে দেখতাম আমার জন্য চা তৈরী করছে। এবং একটি ট্রেতে বিস্কুটসহ জেল গেটের দিকে নিয়ে আসছে। আমি তখনই আমার জন্য নির্দিষ্ট ফালতুকে(কয়েদী) চা আনতে পাঠিয়ে দিতাম। আমি জেলে বন্দী, আমার জন্য বাইরের কোন দোকান থেকে চা তৈরী করে নিয়ে আসছে, আর আমি সমস্ত ব্যাপারটাই জেলখানা থেকে দেখতে পাচ্ছি-এতে যে আমি কতখানি আনন্দানুভব করতাম তা ভাষায় ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। মনে হত শাসকচক্র, তােমরা
৩৩
আমাকে যতই বন্দী করে রাখ না কেন, বাইরের জনতা আমাকে মরতে দিবে না। আমার কাছে জেল তখন জেল মনে হত না বরং মনে হতাে আমি যেন বিশাল দুর্গের দ্বিতলচত্বর থেকে এক স্বৈরাচারী রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করছি। আর চা-এর বাহক যেন রণাঙ্গন থেকে আমাকে রীতিমত সংবাদ সরবরাহ করছে। যা হােক আমাকে যে দোকান চা সরবরাহ করত তার মালিক ছিল ভান্ডারিয়ার মানিক শরীফের বাড়ীর লােক। জেল থেকে মুক্ত হয়ে আমি তাদের বাড়ীতে একবার যাই। তারা আমাকে দেখে যেরূপ যত্ন করল তা বলে শেষ করা যায় না। বাড়ীর সমস্ত মেয়েছেলেরা জড়াে হয়েছে। রাজবন্দী দেখবে বলে। একজন বললে, “ইনি পাকিস্তানের রাজার সঙ্গে যুদ্ধ করেছে। ইনি কয় গরীরের কথা, ইনি চায় সবাই সমান হইবে । চায় গরীবের রাজত্ব।” একজন বললে, “যদিও তারা তাকে আটকে রেখেছিল তবুও তাকে যমের মত ভয় করত।”
যাক এ সময় মাঝে মাঝে যা দু’একটি খবরের কাগজ পেতাম তাতে কাশ্মীর সমস্যা ও প্যালেস্টাইন সমস্যাই প্রধান খবর হিসেবে থাকত। কালীশ বাবু অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই বেরিয়ে যাওয়ায় আমার একাই জেলে থাকতে হয়েছে। আমি দোতলায় থাকতাম বলে কয়েদীদের সঙ্গে মেশার সুযােগও কম হতাে। তবে এই সময় অন্য একটি ব্যাপারে আমি বেশ বিব্রত বােধ করছিলাম। জেলার সাহেব প্রায়ই আমার কাছে আসতেন এবং নানা আলাপের মধ্যে তাঁর একটি মেয়ে অষ্টম শ্রেণীতে পড়ে তাও জানালেন। আমি তাকে উৎসাহ দিয়ে বললাম, “বেশ তাে, আজ কাল মেয়েদের অবশ্যই লেখাপড়া শেখানাে দরকার।” তিনিও এতে বেশ উৎসাহ পেতেন। একদিন তিনি মেয়ের একটি সেলাই করা বালিশের কভার নিয়ে আসলেন। আমি সেলাই দেখে প্রশংসা করায় তিনি খুবই আনন্দিত হলেন এবং বললেন, “ওর যা হাত তাতে ও পড়াশুনার সঙ্গে সঙ্গে সেলাইয়ের কাজেও খুব দক্ষ হতে পারবে।” আমি বললাম, “আপনি ওকে তালপাখার উপর জরির কাজ করতে শিক্ষা দেন।” তারপর আর একদিন তিনি একটি “বেগম” কাগজ নিয়ে এলেন এবং বললেন, “মেয়েকে এর গ্রাহক করা হয়েছে, সে রীতিমত ‘বেগম’ পড়ে।” ক্রমেই বুঝতে পারলাম তিনি চেষ্টা করছেন তাঁর মেয়ে সম্বন্ধে আমার মনে আগ্রহের সৃষ্টি করতে । আমি অবশ্য এতে কিছুটা অপ্রস্তুতই হলাম, তবুও কোনরূপ ভাবাবেগ প্রকাশ না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখলাম । আমি অবশ্য এ বিষয়ে খুবই সতর্ক ছিলাম যে, এ-সব ব্যাপারে কোনরূপ দুর্বলতা প্রকাশ করা হবে না । কিন্তু মেয়ের পড়াশুনার প্রতি যেটুকু আগ্রহ প্রকাশ করলাম তাতে জেলার সাহেব হয়ত মনে করেছিলেন যে, আমার মনেরও পরিবর্তন হতে পারে। তিনি এই আলাপের সুযােগে একদিন আমাকে বললেন, আমি মুক্ত হলে যেন এম.এ-তে ভর্তি হয়ে পড়াশুনা করি। আমি অনেক সময় চুপ করে তাঁর কথা শুনতাম। দেখলাম এতে তিনি আমার উপর খুবই প্রসন্ন হতেন। এতে আমার লাভ হলাে এই যে, তিনি জেলখানায় আমার থাকার, খাবার এবং চিকিৎসার এরূপ সুযােগ করে দিলেন-যা একটা সাব
৩৪
জেলে বন্দীর পক্ষে অভাবনীয় বলতে হবে । ঐ সময় আমাকে ডাব, দুধ এবং পর্যাপ্ত মাছ-মাংস দেওয়া হতাে।
একদিনের ঘটনা মনে পড়ে। পিরােজপুরের দক্ষিণস্থ কোন এক ইউনিয়ন বাের্ডের প্রেসিডেন্ট বন্দুক সম্পর্কীয় মামলায় জেল হাজতে আসেন। তিনি কিভাবে দোতলায় এসে আমার সঙ্গে আলাপ প্রসঙ্গে আমার বিছানায় বসতেই তৎকালীন বিহারী জমাদ্দার ইমামুদ্দীন সাহেব তাঁকে এমন ধমকই দিলেন যে, প্রেসিডেন্ট সাহেব একবারে ভ্যাব্যাচ্যাকা খেয়ে গেলেন। জমাদ্দার সাহেব চিকার করে বললেন-“তােমলােগ ইসকো বিছানা পর বয়ঠা! বেতমিজ ইসকা পা ধােয়ানে কি নসীব তােম লােগকা কভি না হােগা” । জমাদ্দার সাহেব তারপর বললেন যে, তিনি ইন্ডিয়ার বহু বড় বড় ক্যুনিস্টদের জেলে দেখেছেন এবং তাদের সম্মানও তিনি জানেন বলে বেশ আত্মপ্রসাদ লাভ করলেন। আমার যতদূর মনে পড়ে, জমাদ্দার সাহেবকে পরে ঢাকা জেলেও দেখেছিলাম। অত্যন্ত কর্তব্যপরায়ণ ইমামুদ্দিন সাহেব যে রাজনীতিকদের সম্বন্ধে অভিজ্ঞ ছিলেন তাতে সন্দেহ নেই। লক্ষ্য করলাম, যে সমস্ত সিপাহী বিভাগ পূর্বকাল হতে জেলে চাকরি করছে বা যারা বেশ বয়স্ক এবং অভিজ্ঞ তারা পাকিস্তান হলেও আমাদের সম্বন্ধে খারাপ ধারণা পােষণ করতেন না। তবে তাদের চিন্তা ছিল, পাকিস্তান বিরােধিতা নয় বরং দেশে অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে যে-কোনাে সংগ্রামে তারা সমর্থন করবে।
জেলার সাহেবের মেয়ের ব্যাপারে তাঁর নিজের যতখানি আগ্রহ ততখানি আগ্রহ আমি দেখাতে না পারায় তিনি যে একটু দমে যেতেন তা লক্ষ্য করেছি। কিন্তু যাকে না। দেখেছি তার সম্পর্কে আমার মনে খুব একটা আগ্রহ হওয়া স্বাভাবিকও ছিল না। দ্বিতীয়ত, যে সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র সংগ্রামে আত্মনিয়ােগ করেছি যার সবচেয়ে বিশ্বস্ত
অফিসারের অধীনে বন্দী রয়েছি, তার মেয়ে সম্বন্ধে কোনরূপ দুর্বলতা প্রকাশ করার চিন্তাও করতে পারতাম না। অবশ্য জেলার সাহেব হতােদ্যম হলেন না। তিনি তাঁর মেয়ের স্বাস্থ্য, বিভিন্ন বিষয়ে তার আবদার, এমন কি আমার কথা শুনে তার অনেক কিছু জানার আগ্রহ জন্মেছে বলেও তিনি আমাকে জানালেন । এ সব শুনে আমিও তার সম্বন্ধে কিছু কিছু প্রশ্ন করতাম-তার মেধা কি রকম, ম্যাট্রিক পাস করে পড়াশুনা করবে কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি।
যা হােক, এই সময় জেলখানার দক্ষিণ দিকের মাঠে প্রায় হাজার খানেক আনসারের প্যারেড দেখতাম। আমি প্রায়ই জানালার কাছে তাদের দিকে চেয়ে থাকায় আমার সম্পর্কে তাদেরও একটা আগ্রহের ভাব লক্ষ্য করলাম। আমাকে ইশারা করে তাদের অভিযােগও তারা জানাতে চেষ্টা করত। এসময় আনসারদের দুর্দশারও সীমা ছিল না। তাদেরকে পােশাক ও খাবার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভর্তি করিয়ে পরে তাদের পিরােজপুর এনে নিজের খরচায় খেতে হবে বলে জানিয়ে দিত। ফলে
৩৫
আনসারদের মধ্যে দারুণ বিক্ষোভ দেখা দেয়। একদা যে আনসার নব্যরাষ্ট্র পাকিস্তানের অন্যতম সেবক এবং বিশ্বস্ত বাহিনী হিসাবে নিজেদের মনে করত, পরে তারা প্রয়ােজনীয় সরকারী আনুকূল্য না পেয়ে দুনীর্তিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। অবশ্য পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নবগঠিত ন্যাশনাল গার্ড ও আনসার বাহিনী বিপুল আশা আকাঙ্খ নিয়ে রাষ্ট্রের সেবা করতে থাকে, কিন্তু ২/১ বছর যেতে না যেতেই এ সম্বন্ধে মােহমুক্তি ঘটে। অবশ্য ন্যাশনাল গার্ড প্রতিষ্ঠার ইতিহাস মনে নেই, তবে যতদূর মনে পড়ে, বরিশালে এর ২/১ জন নেতৃস্থানীয় লােক দেখেছি। এর একজনকে ফ্যাজি আর একজনকে সামাদ বলে জানতাম । এরা উগ্র সাম্প্রদায়িক ছিল কিনা মনে নেই, তবে এদের মনে একটা নব্য মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং তাকে বিশ্বের অন্যতম করে গড়ে তােলার যে আবেগ দেখেছিলাম তা বিস্ময়কর। মনােবলে, ত্যাগে-তিতিক্ষায় এরা অনেকের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করেছিল । খুব সম্ভব এর প্যান ইসলাম জাতীয় ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ ছিল ।
৩৬

এগারাে
এই ইসলামপন্থীরা যতই কর্মোদ্যম বা সাহস দেখাত তা আমাদের মনে কোনরূপ দাগ কাটতে পারত না। কারণ প্যান ইসলামবাদ বা সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আবেদন আমাদের কাছে শূন্য-গর্ভ ও নিরর্থক বলে মনে হতাে।
এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভাল যে, আমি একা পিরােজপুর সাব-জেলে থাকায় এবং বাইরে আমাদের পার্টি চরম নিষ্পেষণের শিকার হবার ফলে আমার সঙ্গে কোন যােগাযােগই করতে পারেনি। যতদূর মনে আছে, আমার গ্রেফতারের প্রায় ৩ মাস পরে কে যেন কিছু কাপড় জেলগেটে জমা দেয়। অবশ্য আমার বােন বাড়ী থেকে যথেষ্ট কাপড় বিছানা পাঠিয়ে দিয়েছিল। যাহােক পার্টির সঙ্গে সম্পূর্ণ যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন এবং আমাদের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে এক বিরাট অনিশ্চয়তা আমাকে জেল থেকে যে-কোন রকমে বেরােবার ভাবনায় ভাবিয়ে তুললাে।
এ সময় এ জাতীয় একটা ঘটনাই সবকিছু ওলট-পালট করে দেয়। একদিন ঠিক ১টার সময় আমি দোতলায় পায়চারী করছি। সবাই যার যার ওয়ার্ডে লকআপে ঘুমুচ্ছে। এমন সময় জেলার সাহেব বিকট গর্জন করে কোন হায়’ বলে। হান্টার দিয়ে মেইন গেটে সজোরে আঘাত করল, সঙ্গে সঙ্গে পাহারারাত সিপাহী গেট খুলে দেওয়ায় তিনি দৌড়ে উপরে আমার সামনে চলে আসেন এবং আমাকে তখনই নীচে জানান ফটকে আটকে রাখার নির্দেশ দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেলেন। তাঁর হাব-ভাব দেখে আমি কিছু জিজ্ঞেস করতেই সাহস পেলাম না। তার সর্বশরীর কাঁপছে। কোথা থেকে কী রিপাের্ট পেয়ে তিনি এ রকম অসময়ে ছুটে এসে আমাকে এরূপ অর্ডার করলেন তা আমার কিছুতেই বােধগম্য হলাে না। সঙ্গে সঙ্গে আমাকে জানানা ফটকে নিয়ে যাওয়া হলাে। সেটা একটা সেল বিশেষ। একসময় মাত্র একজন স্ত্রীলােকই তাতে থাকতে পারে। এমনও শুনেছি যে ঐ সেলেই এক এক সময় ৯/১০ জন মেয়ে হাজতি রাখা হয়। ব্যাপারটা আমার কাছে রহস্যাবৃতই রয়ে গেল। জেলার সাহেব এরপর ২/৩ দিন আমার কাছে আসেন নাই। দিন কয়েক পর একবার আমার দরজার সামনে দিয়ে হান্টারখানা দু’হাতে ধরে নাড়াতে নাড়াতে আবার চলে গেলেন। তার মুখের ভাব অনেকটা কোমল কিন্তু আমার মনে হলাে একটা রুদ্ধ ক্ষোভ ও অভিমান তার মনে জমাট বেঁধে রয়েছে। কয়েদী ম্যাট
৩৭
সিপাহীদেরও এ সম্বন্ধে জিজ্ঞাসার অন্ত ছিল না। এক সিপাহী বলল, আপনাকে দোতালায় রাখায় হাকিম হয়ত জেলার সাহেবকে কিছু বলেছেন। বলল, আপনাকে উপর থেকে আনসারদের সাথে কথা বলতে দেখে কেউ হয়ত হাকিমের কাছে রিপোের্ট করে থাকবে। কিন্তু এর কোনটার জন্যই ঐ ভাবে ঐ সময় জেলারের ওরূপ চটে এসে আমাকে জানান ফটকে আটকিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেয়ার প্রশ্ন উঠে না । তার পর হঠাৎ একদিন জেলার সাহেব একটা বেগম’ কাগজ এনে আমাকে পড়তে দেন এবং কথা প্রসঙ্গে বলেন যে, সাব-জেলে আপনাদের রাখার কোন সুবন্দোবস্ত নাই। আপনাদের রাখলে আমাদের চাকরি রাখাই দায়। আই-বি’রা নানা রকম রিপাের্ট করে। জিজ্ঞেস করলাম আপনি সেদিন হঠাৎ চলে এসে ওভাবে আমাকে এখানে আনার নির্দেশ দিলেন কেন? জেলার একটু গম্ভীর এবং ক্ষুব্ধ হয়ে বললেনঃ রিপাের্ট পেয়েছিলাম আপনি জেল থেকে পালানাের চেষ্টা করছেন। এরপর তিনি আমাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করার সুযােগ না দিয়ে চলেন গেলেন। এর পর আমি ‘বেগম’ কাগজটি নিয়ে পড়তে লাগলাম। সেদিনকার ঘটনা, জেলার সাহেবের অস্বাভাবিক হুমকি, জেলারের অদেখা মেয়ে, ‘বেগম’ কাগজ সব মিলিয়ে আমার মনে একাধারে করুণা, আসক্তি এবং বিরক্তির এক অদ্ভুত মিশ্রণ ঘটেছিল।
ঐ দিনের ঘটনার ঐরূপ অস্বাভাবিকতা প্রদর্শনের একমাত্র কারণ এও হতে। পারে যে, যাকে এত সুযােগ-সুবিধা দেওা হলাে তার কিনা এমন আচরণ যাতে তার জীবিকার উপায় একমাত্র চাকরি খােয়া যেতে পারত। যা হােক তা হলেও সামগ্রিকভাবে তার ব্যবহার আমি চিরদিনই মনে রাখব। তিনি আমাদের রাজনৈতিক মতবাদ সম্বন্ধে কোন দিন বিরূপ মন্তব্য করেন নাই। তার চাকরি হিসাবে তাঁকে বেশ মানিয়েছিল। তাকে কয়েদীরা খুবই ভয় করত । জেল থেকে বেরিয়ে এটা শুনেছি যে, আমি ঐ সময় মুক্ত হলে তাঁর মেয়েকে আমার সঙ্গে বিবাহ দিবার ইচ্ছে তাঁর ছিল। কিন্তু পিরােজপুর থাকতেই এ সম্বন্ধে তিনি যে সম্পূর্ণ নিরাশ হয়েছিলেন তাতে সন্দেহ নেই।
মনে পড়ে খােরশেদের কথা। প্রথম জেলে ঢােকার দিন সে আমাকে হুঙ্কার দিয়েছিল। পরে সে একদিন আমার কাছে এসে বলল, বাবু আপনি যদি মাফ না করেন তাহলে আমি সারা জীবনে শান্তি পাব না। আপনার সঙ্গে না বুঝে দুর্ব্যবহার করেছি, আমাদের জেলখানায় এরূপ করতেই হয়। সিপাইরা আমাদের ওরূপ কাজ করতে বাধ্য করে। এভাবে হাজতী কয়েদীদের কাছ থেকে যে বিড়ি বা টাকা পয়সা পাই সিপাইদের তার অংশ দিতে হয় এবং তাদের জন্য রীতিমত এসব সংগ্রহ করে না দিলে তারা জেলখানায় আমাদের নানারকম জুলুম করে। খােরশেদের বাড়ী কাউনিয়া । খােরশেদ তখন জেলখানার মেট । তার সেখানে দুর্দান্ত প্রতাপ। যেমন
৩৮
স্বাস্থ্য তেমনি সাহস। কিন্তু সে সাহস শুধু কয়েদীদের বা হাজতীদের ঠ্যাংগাবার বেলায়। সৎসাহস বলতে যা বুঝায় তা তার নেই। আমি অবশ্য খােরশেদকে মাফ করে দিয়ে বলেছি, দেখ সেজন্য আমি কিছুই মনে করি নাই। জেলখানায় তুমি এসব করতে বাধ্য হয়েছে। তবে দেখ হাজতীদের জুলুম না করে অন্যভাবে। তােমার দায়িত্ব পালন করতে পার কিনা এবং যদি আমাদের সম্পর্কে কিছু বুঝে থাক তাহলে বের হয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কৃষকদের সংঘবদ্ধ করতে পার কিনা দেখবে । খােরশেদ বলল, বেশ কইছেন বাবু তাহলে আবার ঢুকতে সময় লাগবে না । তবে ডাকাতি না করে খাব কি? এছাড়া আমাদের যে আর কোন পথ নেই। দেখলাম ওর সঙ্গে এ নিয়ে বেশী কথা না বলাই ভাল।
জেলখানায় পিক পকেট বা পকেটমার সম্বন্ধে সেই আমার প্রথম অভিজ্ঞতা। একদিন কোর্টে এস-ডি-ওর কাছে যাবার আগে হাজতে অপেক্ষা করছি। সেখানে ৪/৫টি পকেটমারের সঙ্গে আলাপ হলাে; তারা বলল, আমাদের অনেকেরই হাজতে না এনে জেলখানা থেকে ভােরে ছেড়ে দেওয়া হয় এবং আমরা ইচ্ছে করেই সন্ধ্যায় ধরা পড়ি। আমাদের আয়ের একটা অংশ কোন না কোন সিপাইকে দিতে হয়। এর বিনিময়ে তারা আমাদের সন্ধ্যায় ধরে এনে জেল হাজতে রাখে। এভাবে আমাদের রাতে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে যায়। এগুলি স্বভাবতই জেলারের অগােচরে হয়ে থাকে। অনেক সময় জেল জমাদাররাও এর সঙ্গে জড়িত থাকে।
সাবজেলগুলিতে যে সচরাচর নারকীয় কান্ড ঘটে তা ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না। পিরােজপুর সাব-জেলে যেখানে মাত্র ৮০ জন কয়েদী থাকতে পারে সেখানে অন্যূন ২০০ জন কয়েদী হাজতী রাখা হতাে। সিপাইরা ছিল চরম অত্যাচারী এবং কথায় কথায় হাজতী কয়েদী নির্বিশেষে সবাইকে লাথি ঘুষি মেরে আনন্দ লাভ করত।
আলাপ করে দেখেছি সিপাইদের সঙ্গে। জিজ্ঞেস করেছি, পাকিস্তান হলাে এখনও আপনারা এরূপ ব্যবহার করছেন। তারা বলত ওসব বলবেন বাইরে গিয়ে, এখানে কোন পাকিস্তান হিন্দুস্থান নাই-এটা আলাদা রাজত্ব। দেখুন না পাকিস্তান হয়েছে তাতে আমাদেরই বা কি হলাে-এখন আনসাররা পেয়েছে পাকিস্তান-পাকিস্তানের কথা বলে চোর-ডাকাতেরা আরাে স্বাধীন হয়েছে।
যাই হােক, কয়েদীদের খাওয়া-দাওয়া নিয়ে কন্ট্রাক্টররা যা খুশী তাই করতাে। ফলে কয়েদীদের জন্য নির্দিষ্ট সামান্য মাছ-তরকারীটুকুও তাদের জুটত না। এ নিয়ে কয়েদীদের বিক্ষোভ কম ছিল না। এককথায় বলা যায়, ১৯৪৮ সালের জেলগুলি বিশেষ করে সাব-জেলগুলি ছিল এক একটা নরকের ক্ষুদ্র সংস্করণ বিশেষ। এবং তার কর্তৃপক্ষ জেলার-জমাদাররা ছিল ঠিক যেন নরকের
৩৯
পাহারাদার। তা না হলে আমার কথা যখন বলা হলাে যে, একজন বি এ পাস ধরে এনেছি তখন জমাদার কি করে বলল, নিয়ে যাও ভিতরে এম-এ পাসের কল আছে। এবং সে কল কি তা গেট পার হবার সঙ্গে সঙ্গে বুঝেছিলাম । শিক্ষার প্রতি, মানুষের প্রতি এ ধরনের অবজ্ঞা নরকেও সম্ভব নয় বলে আমার ধারণা।
এদিকে আমার মামলা পরিচালনায় পিরােজপুরের ১০/১২ জন উকিল-মােক্তার এগিয়ে আসছিলেন, তাদের সবার নাম আজ মনে করতে পারব না-যে কয়জনের নাম মনে আছে তারা হলেন-জনাব সােবহান মােক্তার সাহেব, জনাব আবতাব উদ্দিন উকিল, জনাব এছমাইল উকিল সাহেব। অবশ্য মামলার মূল দায়িত্বে ছিলেন জনাব জয়নাল আবেদীন মােক্তার সাহেব। তিনি পরে আওয়ামী লীগ আমলে এমপি-এ হয়েছিলেন। ৪৮ সালে আমার মামলা পরিচালনা পরবর্তীকালে তাঁর নির্বাচনী প্রচারণায় একটা বিশেষ উল্লেখযােগ্য ঘটনা হিসেবে দেখান হয়েছিল।
৪০

বারাে
এভাবে আমার কেস সম্বন্ধে ব্যাপক প্রচার হলাে। হাজার হাজার লােক রাজনৈতিক মামলার রায় দেখার জন্য কোর্টে জমায়েত হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে একটা কথা বলা দরকার। আমার মামলার রায় শুনার জন্য যারা এসছিল তারা নিতান্তই বলতে হবে দীর্ঘদিন গ্রামে কৃষক আন্দোলন করতে গিয়ে যাদের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি-প্রায় সবই সেই শ্রেণীর লােক এবং রাজনীতির চেয়েও আমার ব্যক্তিগত ত্যাগ, কারাবরণের সাহস ইত্যাদিই তাদের আকৃষ্ট করেছিল। যদিও ৪৮-এ ভাষা আন্দোলন হয়েছে, ছাত্র ও বুদ্ধিজীবীরা তাতে অংশ গ্রহণ করেছে, তথাপি এর মূল অনুপ্রেরণার উৎস কমিউনিস্টদের সম্পর্কে তারা মারাত্মকভাবে উদাসীনই ছিল। তাই দেখি দীর্ঘ এক বছর পর্যন্ত পিরােজপুর সাব-জেলে বন্দী অবস্থায় কাটলেও কমিউনিস্ট বলে সেটা মুসলিম ছাত্র ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে কোন সাড়া জাগাতে পারেনি। কৃষকরা তাদের দুরাবস্থার প্রত্যক্ষ বাস্তবতায় আমাদের নেতৃত্ব মেনে নিয়ে আন্দোলনে যােগ দিত। কিন্তু দেখা গেছে কমিউনিস্টদের পাকিস্তান বিরােধী, ধর্ম-বিরােধী বলে সুকৌশলী প্রচার তখনও কৃষকদের ব্যাপকভাবে বিভ্রান্ত করতে পারত। তার প্রমাণ শত শত কৃষক যুবকদের তৎকালীন আনসার বাহিনীতে যােগদান করা এবং নিছক নিজেদের সাময়িক বা কাল্পনিক সুযােগ-সুবিধার জন্য আমাদের বিরুদ্ধাচরণ করার মধ্য দিয়ে পাওয়া গিয়েছে।
যা হােক মামলায় আমার এক বছর সাজা হলাে। কিন্তু পরে আপীলে এক হাজার টাকার জামিনে জেল থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম। পরের তারিখে আর উপস্থিত হইনি। কারণ জানতাম এরা পুনরায় ধরতে পারলে সাজার মেয়াদ পূর্ণ হলে পুনরায় জেল গেটে বিনা বিচারে আটক করে রাখবে। হয়েছিলও তাই। আমি পুনরায় গ্রেফতার হলে ওরা আমাকে এক বছর সাজা দেয়। এবং সঙ্গে সঙ্গে নিরাপত্তা আইন প্রয়ােগ করে অনির্দিষ্টকালের জন্য জেলে আটক রাখে।
আমাকে সাব-জেলে রাখা অসুবিধাজনক মনে করে বরিশাল জেলে চালান দেওয়া হয়। আমি যে সময় বরিশাল জেলে পৌছি, ঐ সময় কমিউনিস্ট নেত্রী মনােরমা বসু (মাসিমা) সহ ছাত্রনেতা স্বদেশ বসু ও আরও অনেকে বরিশালে ভুখা মিছিল এবং ম্যাজিস্ট্রেটকে ঘেরাও-সংক্রান্ত মামলায় জামীনে বাইরে ছিলেন। জামীনে বের হয়ে মাত্র অল্প কয়েক মাস বাইরে আত্মগােপন করে থাকতে
৪১
পেরেছিলাম। পরে শুনেছি আমি তারিখ মতাে উপস্থিত না হওয়ায় আমার জামীন জনাব এডভােকেট শমসের আলীকে এক হাজার টাকার স্থলে পাঁচশত টাকা দিতে হয়েছিল । ঐ টাকাটা প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও অনুবাদক আমার মেজভাই মাওলানা নুরুদ্দীন সাহেবকে দিতে হয়েছিল।
প্রথম ও দ্বিতীয়বার আত্মগােপনের দিনগুলাে ছিল অত্যন্ত কষ্টসাধ্য, বিভীষিকাময় এবং সন্ত্রাসমূলক। তখন আনসার বাহিনী মারফত কমিউনিস্টদের সম্বন্ধে জনগণের মনে নানা রকম বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা চালানাে হতাে। তাদের আশ্রয় দিলে তারা রাষ্ট্রদ্রোহিতাজনিত শাস্তি ভােগ করবে বলে প্রচার করা হতাে। ফলে আমাদের লােকালয়ে আশ্রয় পাওয়া দুঃসাধ্য ছিল। তখন বড় বড় ঝুপড়িওয়ালা গাছের মাথায়, নদীতীরে পরিত্যক্ত নৌকার খােলের মধ্যে ভাঙ্গা কবরে আশ্রয় নিতে হতাে। আমাদেরই ছিল এই অবস্থা। তাহলে বুঝতেই পারেন হিন্দু কমরেডদের অবস্থা ছিল কত শােচনীয়। ঐ সময় যারা ভারতে যায়নি বা জেলেও ধরা পড়েনি তাদের অনেকের আত্মগােপনের কাহিনী অত্যন্ত মর্মন্তদ। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে উজিরপুরের ফণী চক্রবর্তী বা আমাদের প্রিয় ফনীদা’র কথা । পটুয়াখালির কামিনী চক্রবর্তী বা কামিনীদা’র কথা।
এ দিকে আমার জামীনে বের হবার পর দ্বিতীয়বার গ্রেফতার হওয়ার মধ্যে একটি মর্মস্পশী ঘটনা ঘটে যায়। জামীনে বেরিয়ে আসার পর আমার বিয়ের কথা উঠে এবং গত ৫০-এর দাঙ্গায়* নিহত কমিউনিস্ট নেতা অমৃত নাগ এ সম্বন্ধে কথাবার্তা চালাবেন বলে স্থির করেন। এ প্রসঙ্গে আমার জনৈক বন্ধু কাউখালি থানার সেহাঙ্গলের রশীদউদ্দিন খানের বােন রেনুর নাম তিনি উল্লেখ করেন। রশীদউদ্দীন (মানিক ভাই) সরকারী চাকরি করতেন। অবশ্য দেশের সমস্যা সম্পর্কে তিনি প্রগতিশীল মত পােষণ করতেন। কথা হলাে যাত্রাপুরে মেয়ের মামা বাড়ীতে এ সম্বন্ধে একটা আলাপ-আলােচনা চালান হবে। একটা তারিখও ঠিক হলাে-এবং আমি আত্মগােপন করেই সেখানে যাব। ঐ তারিখে রশীদউদ্দীন ও অমৃত দা সেখানে থাকবেন। এর পূর্বে আমার সহকর্মী মীর আজিজ গ্রেফতার হয়ে পিরােজপুর জেলে থাকায় আমি তার জন্য কোনরূপ তদ্বির করতে পারি নাই। এ জন্য তার পিতার কাছে যাই। তিনি আমাকে দেখেই আমাকে একটু বসতে বলে একটা ঘটি নিয়ে বাইরে গেলেন। তখনও সূর্য ওঠে নাই।
এর আধ ঘণ্টার মধ্যেই নিকটবর্তী রাশেদ চৌকিদার আর কে একজন আমাকে গ্রেফতার করা হলাে বলে জানাল। তাদের ভাবগতিক ছিল অত্যন্ত উগ্র। আমি
…………………………………………..
* ১৯৫০ সনের দাংগা-খুলনা জিলার কালসিরা থানার সম্পত্তি আত্মসাতের উদ্দেশ্যে কতিপয় গ্রাম্য টাউটদের হাতে কয়েকজন নিরীহ সংখ্যালঘু নিহত হওয়ার ফলে কলিকাতায় সাম্প্রদায়িক দাংগা শুরু হয়। তারই প্রতিক্রিয়ায় বরিশাল জিলায় ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাংগা অনুষ্ঠিত হয়।
…………………………………………………..
৪২
একেবারে অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। অগত্যা তাদের সঙ্গে বানারীপাড়া চলে আসি। যতদূর মনে পড়ে মাদারকাঠি থেকে বানারীপাড়া সারা পথ তারা ২/৩ জন আর আমি হেঁটেই যাই। একটি কথা বলা বা কোনরূপ পালানাে বা হৈ চৈ করার চেষ্টাও করি নাই। এর কারণ বােধ হয় ঐ ধরা পড়ার অভাবনীয় আকস্মিকতা। বানারীপাড়া এসে একখানা এক বৈঠার চলতি নৌকায় উঠতেই দেখি বন্ধু মানিক মিয়া সেই নৌকায় বসা। আমার মনে হয় আমাদের পূর্ব নির্দিষ্ট তারিখানুযায়ী তিনি সম্ভবত হুলা হয়ে যাত্রাপুর যাচ্ছিলেন। আমাকে বন্দী অবস্থায় দেখে তার চক্ষু ছল ছল করে উঠল। অত্যন্ত স্বল্পভাষী, গম্ভীর ও আবেগপ্রবণ মানিক ভাইয়ের চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়তে দেখলাম । কিন্তু পুলিশের সম্মুখে কেউ কারও সঙ্গে কথা বললাম না। মনে পড়ল যতীন্দ্র মােহন বাগচীর কবিতা-
কঠিন বিবাহ ঘনায়েছে আজ
তারি লাগি সবে পর নব সাজ।
আমার হাতের কড়া যেন আংটি হয়ে ফুটে উঠল- লােহার শৃঙ্খল সােনার হার হয়ে শৃঙ্খলিত দেশবধূকে মুক্ত করার জন্য নতুন বররূপে সজ্জিত করল আমাকে। মনে হলাে আমার বাসর ঘর তৈরি হচ্ছে চার দেয়ালের মধ্যে। যতক্ষণ নৌকায় ছিলাম আমি ও মানিক ভাই নীরবে পরস্পরের দৃষ্টি আকর্ষণ করতাম। মনে হলাে পুলিশ দুটি আমাকে ধরে খুব খুশী হতে পারেনি। যদিও তারা আমার সঙ্গে তেমন কোন আলাপ করেনি। কিন্তু আমি যে রাজবন্দী সেটা তারা জানত এবং আমার গ্রেফতারে মনে মনে দুঃখই পেয়েছিল। কী এক অননুভবনীয় চিন্তায় আমি যেন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। আমার ও মানিক ভাইয়ের গভীর দৃষ্টি বিনিময়ের সঙ্গে যেন নদীর কুলকুল শব্দ আমাদের অনুভূতিকে আরাে গভীরতর করে তুলল। দেখলাম মানিক ভাই ক্ষণিক আমার দিকে দৃষ্টিপাত করেই তার দূরদৃষ্টিভেদী ছলছল আঁখি দুটিকে নৌকার বাইরে অসীমে নিক্ষেপ করে নীরব হয়ে রয়েছেন। নৌকা হুলারহাট ভিড়লে মানিক ভাই উঠে চলে গেলেন। ইশারায় যেন বলে গেলেন আমি কিছুতেই যেন নীতি বিচ্যুত না হই।
যা হােক অল্প দিন পরেই আমাকে বরিশাল জেলে নিয়ে আসা হলাে। আমাকে ডি-আই ওয়ানের সামনে নিয়ে আসতেই কিছু কিছু ওয়াচারের মাথায় যেন রক্ত চাপল তারা আমার উপর শারীরিক অত্যাচার চালাবার মতলব আঁটছিল। এটাই ছিল সে সময়কার সরকারী নীতি। কিন্তু ডিআই সাহেব আমাকে বসতে দিয়ে আমার সঙ্গে যে সম্মানজনক আচরণ করলেন তা দেখে তারা দমে গেল। আমার পরিবারবর্গের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ছিল বলে তিনি ব্যক্তিগতভাবে আমাকে অতটুকু। সম্মান দেখিয়েছিলেন। তিনি বললেন- “আপনার ভাগনে আজাদ সুলতান, অমিয় দাশগুপ্ত প্রভৃতির সঙ্গে আপনার শীঘ্রই জেলে দেখা হবে। এখন জেলে গিয়ে
৪৩
তাদের জন্য অপেক্ষা করতে পারেন। তাঁর কথায় তীব্র শ্লেষ এবং আন্তরিকতা প্রকাশ পাচ্ছিল। বললাম, বেশত যদি পারেন তাদের গ্রেফতার করবেন। তিনি গম্ভীরভাবে বললেন- পারেন মানে তাদের সম্বন্ধে সব রকম খোজ খবর নেয়া হয়েছে। এখন শুধু গ্রেফতার করা বাকি।
আমাকে বরিশাল জেলে নিয়েই রাজবন্দীদের জন্য নির্দিষ্ট ২নং ওয়ার্ডে পাঠিয়ে দিল। রাতে আমি একাই বিশাল ২নং ওয়ার্ডে কাটালাম। রাতে মনে হলাে সমস্ত অন্ধকার যেন একত্র হয়ে আমাকে চেপে মারতে চায়। কার পায়ের শব্দে ঘুম ভাঙতেই দেখি বিশাল বপু একজন সিপাহী বেশ দূরে থেকেই আমার দিকে তাকিয়ে কি যেন খাতায় টুকে নিয়ে আবার সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে গেল। বুঝলাম লকআপ খুলে আমার গুনতি* নিয়েছে। বিশাল বপু ঐ সময়কার অধিকাংশ সিপাহীই ছিল বিহারের বাসিন্দা। বাঙালীদের দমিয়ে রাখার জন্যই তা করা হয়েছিল। বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলনের পর তারা সঠিকভাবে বুঝতে পেরেছিল যে, এ জাতিকে চিরদিন স্তব্ধ করে রাখা যাবে না। তাই তারা প্রথম থেকেই খুব কঠোর মনােভাব গ্রহণ করেছিল আমাদের সম্বন্ধে । ঐ দিন সকাল দশটায় আমাকে জেলারের সামনে হাজির করা হলাে। ওখানে আমার সম্বন্ধে সবিশেষ জেনে-শুনে আমাকে জেলের আমলনামা একখানা টিকিট ইস্যু করবে। আমি সুপারিনটেনডেন্ট বা জেলার সাহেবের সম্মুখে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। কিছুক্ষণ পর দুজন বিহারী সিপাহী কিছুটা বিস্ময় ও ক্রোধ নিয়ে একটা ধমকের সুরেই সাহেবকে ছেলাম দিজিয়ে বলে উঠল । তখন আমার মনে পড়ল কোথায় যেন শুনেছি রাজবন্দীরা জেলে সরকার সালাম দেয় না। আমার মনে হলাে এটাই সরকার সালামকাজেই আমি নিশ্ৰুপ দাঁড়িয়ে রইলাম। সুপার সামনের টেবিলের দিকে তাকিয়ে আছে। যেন আমার দিকে তাকিয়ে দেখার বা কথা বলার মত কেউ নই আমি। বরিশাল জেলের কর্তার সে ভঙ্গী আমি ভুলব না।
—————————
* গুনতি-জেলে বন্দীদের দৈনন্দিন সংখ্যা গণনা ।
————————–
৪৪

তেরাে
ঐ দিনই বিকেলে কি তার পরদিন ভুখা মিছিলের আসামীদের জামীন নাকচ হয়ে গেলে তারা জেলে চলে আসে। তাদের অনেকের মধ্যে ছিল স্বদেশ বােস, মনােরমা বসু (মাসিমা), বঙ্কিম চ্যাটার্জি, বিনয় গুহ, পানােগড়ের কমুনিস্ট কর্মী, বরিশালের বুক ভিলার মালিক কমরেড আনােয়ার হােসেন, বর্তমান বাংলাদেশ সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি আর-এস-পি নেতা শ্রী নির্মল কুমার সেন, তৎকালীন আর-এস-পি কর্মী দৈনিক বাংলার বিশিষ্ট সাংবাদিক জনাব আবদুল খালেক, বরিশালের আর-এস-পি নেতা শ্রী সুধীর কুমার সেন এবং ঝালকাঠির তরুণ আর-এস-পি কর্মী নারায়ণ সাহা প্রমুখ। দেখতে দেখতে রাজবন্দীতে ২নং ওয়ার্ড সরগরম হয়ে উঠল। এই সময় জিন্নাহর মৃত্যু সংবাদ জেলে পৌছে। সংবাদ পেয়ে জেলের কয়েদীরা শােক সভা করে। আমরাও সেখানে যাই। এর কয়েকদিন পর আমাকে আবার পিরােজপুর নিয়ে যাওয়া হয়। এবং অল্পদিনের মধ্যেই নিরাপত্তা বন্দী হিসেবে বরিশাল নিয়ে আসা হয়।
এবার বরিশাল জেল পরিপূর্ণ। এই সময় বাইরে দেশের বিভিন্ন স্থানে চলছিল। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের উপর সুপরিকল্পিত হামলা। বরিশালের গৌরনদী থানার চাদসী এলাকা এর অন্যতম। চাদসী ইউনিয়ন বাের্ডের নির্বাচনে কৃষক সমিতি শতকরা একশতটি স্থান দখল করায় স্বভাবতই প্রতিক্রিয়াশীল সরকার নানা অজুহাতে এর ক্ষমতা খর্ব করতে চাইল । কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসের পরে পরেই সারা দেশের বহু জায়গায় যেমন হাজং এলাকা, রাজশাহীর নাচোলে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হয়েছিল । চাঁদসীতেও তখন কৃষক সংগ্রাম দানা বেঁধে উঠেছিল। সরকার তাই কৃষক সংগ্রামকে অংকুরে বিনাশ করার জন্য বরিশাল শহর থেকে লঞ্চ ভর্তি করে পুলিশ পাঠায় এবং তারা আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা রাজনৈতিক নির্বিশেষে কয়েক শত লােককে গ্রেফতার করে নিয়ে আসে। বহু ঘর পুড়িয়ে দেয় ।
মনে হলাে চাদসীর সমগ্র গ্রামখানাকে জেলে এনে পুরেছে। রাজনীতির সঙ্গে। সংশ্রব নাই এ রকম বহু নিরীহ লােককে গ্রেফতার করা হয়েছে । পূজা পার্বনে যারা নিষ্ঠাবান নিত্য ভােরে মহাভারত, চন্ডীপাঠ যাদের ধর্মানুষ্ঠানের অপরিহার্য অঙ্গ, তারা জেলে এসে অত্যন্ত অসুবিধায় পড়ল। এ ছাড়া স্ত্রী পুত্র, ছােট ভাই বােনসহ
৪৫
চিত্ত বাবুর গােটা পরিবারকেই গ্রেফতার করে আনা হয়েছিল। এদের মধ্যে অল্প বয়স্ক বিনয় গােপালের নাম মনে পড়ে। গৌরনদী থেকে ধৃতদের মধ্যে দশ বারাে বছরেরও কম বয়েসী ছেলেমেয়ে ছিল। তাছাড়া তৎকালীন চাদসী ইউনিয়ন বাের্ডের শক্তিশালী সদস্য স্থানীয় কৃষক নেতা জনাব আবদুল আজীজ, মােবারক। সরদার, কাসেম সরদার এবং হেলালউদ্দীন মুনশী ছিলেন। বিপ্লবের জন্য জীবনকে তিল তিল করে বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত ছিলেন হেলাল ভাই। মােটা না হলেও একেবারে পাতলা ছিলেন না তিনি। উজ্জ্বল চোখ বিশিষ্ট ও ঘন কালাে ভ্রসহ চাপ দাঁড়িতে তাঁকে মনে হতাে বাবর বা তৈমুরলঙ্গের মত । কালাে ঘন দাড়ির মধ্য থেকে হেলাল ভাইয়ের হাসিমুখ মনে পড়লে আজও মন সরস হয়ে উঠে। কিন্তু জেলে তার শরীর ভেঙ্গে পড়ে। তারপর বেরিয়েও তিনি আর সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন না। মুন্সী হেলালউদ্দীন তাঁর স্বগৃহে মারা যান। এক দিনের কথা মনে আছে, তৎকালীন ডিসি জনাব ফারুকী জেল ভিজিটে আসছেন। আমরা দাঁড়িয়ে গেছি। কেরামত সরদারও বাম দিক হতে ৫/৬ জনের পরে দাঁড়িয়েছে। ফারুকী আমাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে বা জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চলে গেলেন। কিন্তু সরদারের দিকে তিনি কোনরূপ ভ্রুক্ষেপও করলেন না। এর ফলে সরদার নিজেকে অপমানিত বােধ করলেন এবং ডিসিকে তাঁর বক্তব্য আছে বলে আহ্বান করায় তিনি থমকে দাঁড়ালেন এবং বেশ একটু ক্রুব্ধও হলেন। পরে আমাদের মুখপাত্র। শদ্ধেয় অমির দাশ গুপ্ত কেরামত সরদার সম্বন্ধে ডিসিকে বললেন । জেলে ঢুকে অতি অল্প সময়ের মধ্যে কেরামত ভাইয়ের এরূপ নির্ভীকতা সত্যিই উল্লেখযােগ্য।
১৯৪৮-৪৯ এর বরিশাল রাজবন্দী ওয়ার্ড ছিল যেন একটি বিপ্লবী পরিবার বিশেষ। ঐ সময় দমদম জেলে গুলি চলে এবং তিনজন রাজবন্দী নিহত হয়। এ সংবাদে আমরা হতবাক হয়ে পড়ি। সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত একটি রাষ্ট্রের জেলখানার ভিতরে রাজবন্দীদের গুলি করে মারার এই সংবাদে আমাদের অনেক সাধারণ কর্মীরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে।
বরিশাল জেলে আকুব আলী নামে ১৫/১৬ বছরের একটি যুবক আমাদের ওয়ার্ডে দুধ দিয়ে যেত। জানলাম ছেলেটির বাড়ী বাউফল থানার কালিকাপুর গ্রামে। খুন কেসে জেলে এসেছে। সঙ্গে তার বড় ভাই আছে। পরে অনশনের পর যখন জেল হাসপাতালে যাই তখন আকুব আলী আমাকে এবং অন্যান্য রাজবন্দীদের বিশেষভাবে সেবা করে। এ সময় আকুব আলীকে কথা দিয়েছিলাম যে মুক্ত হয়ে তার বাড়ীতে যাব। আকুব আলী বলল, আপনারা যাবেন আমাদের বাড়ী । আচ্ছা যদি যান তা হলে বুঝবাে আপনারা আমাদের মত সাধারণ লােককে
৪৬
ভালবাসেন। আমি বললাম- আমি যাবই। জেলে তার বড় ভাই আহম্মদ সাহেবের সঙ্গেও দেখা হয়েছিল, গাট্টা শরীর, শ্যামবর্ণ, চোখ দুটি বেশ স্বচ্ছ। আমরা রাজবন্দী শুনে সে খুব আফসােস করল। বলল, শালারা পাকিস্তান বানাইছেপাকিস্তান না যেন গােরস্থান। আপনারা আমাদের কথা বলেন, সে জন্যইতাে আপনাদের ধরে এনেছে। আমি জানি, বাউফলের বয়াতি বাড়ীর নয়া মিঞা আপনাগাে দলের না? বললাম হ্যা। আহমদ ভাইও আমাকে তাদের বাড়ী যাবার জন্য খুব অনুরােধ করল । আমার মুক্তির পর ১৯৫৬ সনে আমি ওদের বাড়ীতে যাই । সে প্রায় আট বছর পরের কথা। আকুব আলী তখন পুরাে জোয়ান। শরীর আরও হৃষ্টপুষ্ট হয়েছে। দাড়ি রেখেছে। চোখ দুটি তেমনি বড় বড়। আমি ওদের বাড়ী ঢুকতেই দেখি উঠানে সে একটা বাঁশ চিরে বেড়া তৈরী করছে। আমাকে দেখেই চিনে ফেলল । দৌড়ে এসে আমার সঙ্গে আলিঙ্গন করল এবং আমাকে ঘরে নিয়ে গেল ।
আকুব আলীর আনন্দ আর ধরে না। ওর গা ঘেঁষে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে। ওকে টেনে নিতে গেলে আকুব আলী একটু সলজ্জ আনন্দ প্রকাশ করে জানালে যে ঐ তার একমাত্র মেয়ে। গত তিন বছর হয় সে বিয়ে করেছে। সে তার বউকে ডেকে বলল, এই ভাইয়ের কথাই তােমাকে কতদিন বলেছি। আমি যে মাঝে মাঝে সমিতির কথা বলতাম ভাই আমাকে তা শুনিয়েছে। এরপর আকুব আলী আমাকে এক কাপ দুধ এনে দিল। বলল, বিশ্রাম করুন। আমারও হাতে কাজ, আজই ঘরের চাল ছাইতে হবে। তা না হলে আর শিগগির হবে না । কিন্তু আমি থাকতে পারব না বলায়, সে যেন আকাশ থেকে পড়ল- না ভাইজান, তা হয় না। খুব পীড়াপীড়ি করায় আমি পরে আসার কথা দিয়ে সেখান থেকে চলে এলাম। দেখলাম মানুষ অফুরন্ত জীবনীশক্তির আধার। জেলখানায় কি নিদারুণ ভীতি, অনিশ্চয়তা, উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সে, আর আজ সে পূর্ণ যৌবন নিয়ে সংসার করছে। দরিদ্র আকুব আলী কিন্তু বয়সের শক্তিতে সে যেন দারিদ্রকে থােড়াই পরােয়া করে। লক্ষ্য করেছি সরকারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে শুনে আকুব আলীর সমস্ত শরীরে রক্তের ঢেউ খেলে যায়।
সে যাই হােক, আবার বরিশাল জেলে ফিরে আসা যাক। এ সময় জেলখানার ভিতরের ঘটনার চেয়ে বাইরের ঘটনার জন্যই আমরা উদ্বিগ্ন ছিলাম বেশী । জিন্নাহর মৃত্যু, হায়দারাবাদ, জুনাগড়, কাশ্মীর-সমস্যা, পাখতুনদের আত্মনিয়ন্ত্রণের আন্দোলন ও সরকারের নজীরবিহীন অত্যাচার, ভাষা আন্দোলন আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করত।
৪৭
এ কথা বলতে আজ দ্বিধা নেই যে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হবার পর এ দেশের বিপ্লবী পার্টিগুলাে একে তত্ত্ব ও বাস্তব কোন দিক দিয়েই মেনে নিতে পারেনি। ফলে ‘ইয়ে আজাদী ঝুটা হায় লাখাে ইনছান ভুখা হায়” প্রভৃতি শ্লোগানের সঙ্গে জনতার চেতনার স্তর বিচার না করেই আন্দোলনের ক্ষেত্রেও কিছু কিছু উগ্র কার্যসূচী তারা গ্রহণ করেছিল। সরকারও এই অবস্থার সুযােগ পুরাপুরি গ্রহণ করতে ভুল করেনি। আজ ২৪ বছর পরে আমাদের দেশের ছাত্র-যুবক-কৃষক-মজুরদের অঝােরে রক্ত ঝরিয়ে এদেশ থেকে পশ্চিমা হানাদারদের নির্মূল করতে হয়েছে- যদি ২৪ বছর পূর্বে আমাদের দেশের ছাত্র যুবকরা সাম্প্রদায়িকতার বিষময় ফল সম্পর্কে বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিশ্বে নয়া ঔপনিবেশিক পরিকল্পনা সম্বন্ধে সঠিক জ্ঞান অর্জন করতে পারত তা হলে গত ২৪ বছর পর্যন্ত পশ্চিমা শাসকগােষ্ঠী এ দেশকে এরূপ কঙ্কালের বাসভূমিতে পরিণত করতে পারত না। সাধারণভাবে জনতার থেকে বিচ্ছিন্নতার সুযােগ নিয়ে সরকার বাইরে ও ভিতরে অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছিল । জেলখানায় তার উলঙ্গ রূপ প্রকাশ পেল। ইতিমধ্যে মহারাজ’দা (অমিয় দাশগুপ্ত), আজাদ সুলতান, আরও কয়েকজন গ্রেফতার হয়ে জেলে এসেছেন। যতদূর মনে পড়ে, চাঁদসীর অধিকাংশ রাজবন্দী হয় জামীনে না হয়ে মামলায় খালাস হয়ে বাইরে চলে গেছে।
জেলখানায় একদিন সন্ধ্যায় মহারাজ-দা সহ আমরা কয়েকজন বসেছি। মহারাজদা গান ধরলেন। কিছুক্ষণ পরেই তৎকালীন জেলার মন্নান মিঞা গেটের উপর হান্টার দিয়ে আঘাত করল এবং হুমকির সুরেই বলল- জেলখানায় গান। গাওয়া যাবে না। আধা জল্লাদ এই মান্নান সাহেব পরবর্তী সময় রাজশাহী জেলে গুলি চলাকালীন সেখানকার জেলার ছিল।
৪৮

চৌদ্দ
আমরা সঙ্গে সঙ্গে এর প্রতিবাদ করলাম। কিন্তু জেলার তার অর্ডার ঠিকই রাখল। আমরা সিদ্ধান্ত করলাম পরদিন এর প্রতিবাদ স্বরূপ অনশন ধর্মঘট করব। পূর্ব সিদ্ধান্তানুযায়ীই আমরা অনশনের কথা জানিয়ে গেটে নােট দিলাম। অর্ডার পেয়েই ওরা আমাদের নেতৃস্থানীয় কয়েক জনকে সেলে পাঠাল। এবং আমাকেসহ আরও কয়েকজনকে দক্ষিণ দিকের দালানের তেতলায় পাঠিয়ে দিল। আমরা ভােরেই অনশন শুরু করছিলাম। আমার জীবনে অনশন এই প্রথম। একদিন, দুইদিন, তিন দিন যায়, বেশ চলেছে। সরকার পক্ষ অনমনীয়। আমরা একসঙ্গে রয়েছি কেরামত সরদার, আজাদ সুলতান, হরিপদ মজুমদার ও আরও অনেকে। বিচিত্র অভিজ্ঞতা এই অনশনের। জেল কর্তৃপক্ষ আমাদের সামনে খাবার রেখে যেত। আমার মনে আছে, ৫/৬ বছর পর পূর্বে যেখানে যত সুস্বাদু ও মূল্যবান খাদ্য খেয়েছি তার কথা মনে পড়তে লাগল। অনেক ক্ষেত্রে যেন খাদ্যগুলি চোখের সামনে ভেসে উঠতাে। মনে পড়ল, আমার বড় ভাই মাওলানা ফিরােজী সাহেব, আমার বাবা ও আমি ফুরফুরার পীর জনাব মৌলানা আবু বকর সাহেবের বাড়ীতে একত্রে বসে মাংস, পােলাও কোর্মাসহ বিভিন্ন রকম পিঠা নাস্তা খাচ্ছি আবার দেখলাম কলকাতা টাওয়ার হােটেলে বন্ধুবর অতুল ভট্টাচার্যের সঙ্গে প্রচুর পােলাও সহ মাংসের বিভিন্ন রকম তৈরী ব্যঞ্জন দিয়ে ডিস ভর্তি করে খাচ্ছি।
দেখতে দেখতে ৫/৬ দিন অতিক্রান্ত হলাে। স্নান করতে পারতাম কিন্তু স্নান করার সঙ্গে সঙ্গে শরীরের জল মুহূর্তের মধ্যে শুকিয়ে যেত। ৭/৮ দিনের মধ্যে দৃষ্টি শক্তি প্রায় হারিয়ে ফেললাম। তখন আর উঠে বসার মত শক্তি ছিল না, অবশ্য তখনও অন্যান্য কমরেডদের অবস্থা আমার মত এত খারাপ হয়নি। অদূরে জানলার পাশে ছিল সরদার কেরামত আলী, সে যেন কি করে টের পেল নীচে জেল ভিজিটে এসেছেন তৎকালীন ডি সি ফারুকী না হয় ওসমানী ঠিক মনে নেই। সরদার সেই অবস্থায় জানলার শিক ধরে দাঁড়িয়ে নীচে ফারুকীকে দেখে যেতে বলে চিৎকার করে ডাক দিয়ে প্রায় অচৈতন্য অবস্থায় ঝপ করে শুয়ে পড়ল। এ সময় ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব তেতলায় আসছিলেন কিনা খেয়াল নেই। এদিকে অনশনের দশম দিনে আমি চৈতন্য হারিয়ে ফেলি এবং আমার অবস্থা নাকি অত্যন্ত বিপজ্জনক হয়ে উঠছিল। তখন সিভিল সার্জনসহ কয়েকজন জেল ভিজিটর
৪৯
আমাকে দেখেন এবং আমার আসন্ন মৃত্যু সম্বন্ধে আশঙ্কা প্রকাশ করেন। এর ফলে সরকার দ্রুত গানের দাবি মেনে নিল এবং আমাদের অনশন প্রত্যাহার করার জন্য অনুরােধ করল । আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম জেলে আটক অন্যান্য সমস্ত বিশেষ করে কমরেড অমিয় দাশগুপ্ত ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দের নির্দেশ ব্যতীত আমরা অনশন ভাঙ্গব না। অতঃপর তাদের সম্মতি আনানাে হলে আমরা একযােগে অনশন। প্রত্যাহার করলাম। অনশন করা এবং তা প্রত্যাহার করা আমার জীবনে এই প্রথম। খুব সম্ভব প্রথম একটু গুকোসের জল বা কমলার রস পান করেছিলাম । শুনেছিলাম এ সময়টা বিপজ্জনক। আসলেও তাই উপলব্ধি করলাম। দীর্ঘ এগারাে দিন পর পাকস্থলীতে হঠাৎ কিছু দেওয়ায় যেন চতুর্দিকে অন্ধকার দেখলাম। মনে হলাে যেন হুশ হারিয়ে ফেলি। মনে আছে এর দুই তিন দিন পর যখন হাসপাতালে প্রথম ভাত খাই, তখন খেয়ে উঠে নিজের বিছানায় যেতেই ধপাস করে মেঝেতে পড়ে যাই। বরিশাল জেলের এই সংগ্রামে আমরা জয়যুক্ত হই।
মনে রাখতে হবে সেটা ৪৮ সনের ঘটনা। জেলখানায় বসে নিজের মনে একটু গান গাওয়ার অধিকার আদায় করার জন্য প্রায় পনের কুড়ি জন রাজবন্দীর দীর্ঘ এগারাে দিন অনশন ধর্মঘট পালন করতে হয়েছে। নির্মম এই ফ্যাসিস্ট গােষ্ঠীর বিরুদ্ধে জেলের মত ভয়াবহ জায়গায় থেকেও অনুরূপভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হয়েছিল আমাদের। গান গাইবার সম্মতি দেওয়ার সময় কর্তৃপক্ষ অবশ্য বলছিল, আমরা কোন রাজনৈতিক গান গাইতে পারবাে না। এমনি ছিল তাদের জিদ। আমরা অবশ্য এর কোন জবাব দেই নাই। পরে আমাদের গান চলছিল দেদার। সুর আমাদের কোথায় টেনে নিয়েছে কে জানে। আমাদের গায়কদের সুরে কম্পন ধরিয়েছিল অসুরদের অন্তরে। আমরা গাইতাম, “কারার ঐ লৌহ কপাট, ভেঙ্গে ফেল কররে লােপাট, গাইতাম “বিচারপতি তােমার বিচার করবে যারা আজ জেগেছে সেই জনতা”- তখন সুরের মূর্ঘনায় জীবন্ত হয়ে উঠত জেলের গরাদগুলি। এরপর প্রায়ই আমরা কোরাস বা ঐকতান গাইতাম। কারণ দ্বার রুদ্ধ হতে পারে কিন্তু আমাদের প্রাণ তাে মুক্ত । বরিশাল জেলে আমরা শেষের দিকে যে-কোনাে শাস্তির ঝুঁকি নিয়েই গাইতাম। সমস্বরে গাইতাম আন্তর্জাতিক সঙ্গীত । কিন্তু তারপর জেল কর্তৃপক্ষ কখনও বাধা দিতে আসেনি।
এই সময় বরিশাল জেল হাসপাতালে মারা যায় খাঞ্জাপুরের কমরেড সুশীল দে। কমরেড সুশীল দে ছিল যেন একটি জীবন্ত প্রন্তরমূর্তি। খুব কম কথাই বলতাে সুশীল দা। কিন্তু রাজনৈতিক প্রশ্নে কঠোর ছিল তার মতবাদ। তার সুঠাম শরীরে আঘাত খেয়ে যে-কোন লৌহবস্তু বিচূর্ণ হতে পারে বলে মনে হতাে। বাইরের এই শক্ত কাঠামাের মধ্যেও সুশীল দা’র অন্ত্রে ঘা হয়েছিল বলে মনে হয়। জেলে আর তেমন চিকিৎসা কই। বাঁচাতে পারলাম না আমরা কমরেড সুশীল দা’কে। জেলে
৫০
বঙ্কিম বাবুর ছিল ব্রঙ্কাইটিশ। তার সম্বন্ধে এটুকু বলে রাখি যে, আত্মােৎসর্গে মহিমান্বিত এক একটি জীবন যে কী আনন্দের উৎস হতে পারে কমরেড বঙ্কিমকে না দেখলে তা বােঝা যাবে না। ব্রঙ্কাইটিশ জনিত প্রতিক্রিয়ায় শ্বাসরােধ হওয়ায় অজ্ঞান হয়ে পড়ত বঙ্কিম বাবু। এই অবস্থায় নাক দিয়ে প্রচুর রক্ত বের হয়ে আসতাে। একটু সুস্থ হয়ে চোখ খুলে আমাদের দেখলেই অনাবিল হাসিতে আমাদের সমস্ত দুশ্চিন্তা দূর করে দিত। মানব জীবনের অপরিহার্য প্রয়ােজন মিটানাে যেখানে অস্বীকৃত তেমনি পরিবেশে এ ধরনের কমরেডদের সাহচর্যের প্রয়ােজনীয়তা যে কত বেশী তা বলে শেষ করা যায় না। এ সময় আমাদের সঙ্গে বরিশাল জেলে ছিল কমরেড উৎপল সেন, স্বদেশ বােস, বিনয় গুহ, প্রশান্ত দাশগুপ্ত ও আরও অনেকে। বরিশাল জেলে থাকাকালীন আমার ও অন্যান্য অনেকের বিরুদ্ধে মামলা থাকায় আমাদের নিয়মিত কোর্টে নিয়ে যেত। চোর ডাকাত ও অন্যান্য হাজতিদের বিশাল সারির সাথে যেতাম আমরাও। যারা আমাদের চিনত তারা রুদ্ধ আবেগ নিয়ে তাকিয়ে থাকতাে আমাদের দিকে। যারা আমাদের জানত না তাদের বলতে শুনেছি হাঁটতে হাঁটতে, এমন লােকও চোর হয়। কেউ বলছে এরা শিক্ষিত কিন্তু ডাকাত। সব সময় কোর্টে উপস্থিত করা হতাে না- অনেকদিন হাজত থেকেই ফিরে আসতে হতাে। একদিন হাজতে একটি পিক পকেটের সঙ্গে আলাপ হলাে- সে আমাকে ইশারায় বলল, দেখুন ওর পকেট থেকে কিভাবে পয়সা বের করে আনি। এরপর সম্মুখস্থ হাজতিকে একটা বিড়ি দিল এবং সঙ্গে সঙ্গে তার বিড়ির আগুন দিয়ে তাকে বিড়ি ধরাবার জন্য বলে তাকে নিজের দিকে ঝুঁকিয়ে রাখল এবং ওদিকে তার হাতখানা পকেটে পুরে দিয়ে পয়সা বের করে আনল । আমার অনুরােধে অবশ্য গােপনেই আবার তার পকেটে তা পুরে দিল।
একদিন সন্ধার পর আমরা কয়েকজন দক্ষিণ দিকের রােয়াকের কাছে বসে কথা বলছিলাম। নৃপেনদা (কমরেড নৃপেন সেন) কোর্টে গিয়েছেন, তিনি ফিরে এলে আমরা রাতের ভাত খাব । এমন সময় ডেপুটি জেলার কামালউদ্দীন সাহেব “কি করছেন বলে বঙ্কিম বাবুকে ডাকলেন। জবাবে তিনি বললেন, “কি আর করব । তা নৃপেন দা এখনও কোর্ট থেকে আসছেন না। ব্যাপার, কি?
কামাল সাহেব বললেন, “আরে সেই কথাইতাে বলতে এলাম।’ কথা শুনে আমরা সবাই রােয়াক ধরে দাঁড়িয়ে গেলাম। তিনি বললেন, নৃপেন বাবু নাকি কোর্টে নিজেই জেরা করেছেন। আর করবেনই বা না কেন, তিনি তাে বি.এল.। তিনি কিছু পরে আদালত থেকে বেরিয়ে এসেই নাকি সিপাহীদের বলেছেন তাঁর জামীন হয়ে গেছে “আই এম বেইলড আউট” বলেই একটা রিকশা ডেকে কোথায় চলে গেলেন। একটু পরেই ব্যাপারটা ধরা পড়ল- তখন আর তাকে কে পায় । “বলুন তাে আপনাদের নিয়ে কি করি” বলে কামাল সাহেব একটু গম্ভীর হয়ে
৫১
গেলেন। নৃপেন দা ভাগল’, বলে চেঁচিয়ে উঠল বাচ্চা বিনয়। অনেকদিন পরে শুনছিলাম নৃপেন দা নাকি এরূপ ভেগে যাবার মতলব আটছিল আগের দিন রাত্রে দাবা খেলার সময়। অবশ্য এর পূর্ব দিন রাতের দাবা খেলা আমার পরিষ্কার মনে আছে । নৃপেনদা’র বিপক্ষে ছিলেন খুব সম্ভব বঙ্কিম বাবু। উভয় পক্ষে কয়েকজন ভাল যােগানদার বসেছিল। প্রায় আড়াই ঘণ্টা ধরে নৃপেনদা খেললেন। একটি কথাও বললেন না। অথচ খেলায় প্রতিপক্ষকে মাত করে দিলেন- এখন বুঝি সে দিন দাবায় বিপক্ষকে মাত করার চিন্তার সঙ্গে তিনি পরদিন আরও এক পক্ষকে মাৎ করার চিন্তায় মগ্ন ছিলেন। এই দীর্ঘ আড়াই ঘণ্টার মধ্যে নৃপেনদাকে কেউ অন্যমনস্ক বা ডাইভার্ট করতে পারেননি।
৫২

পনের
বরিশাল জেলে থাকতেই ৪৮-৪৯ এর মধ্যে খুলনায় ব্যাপক খাদ্য সঙ্কট দেখা দেয় এবং দুর্ভিক্ষ শুরু হয়। আমরা আমাদের এক বেলার খাদ্যের দাম দুর্ভিক্ষপীড়িত এলাকায় পাঠাতে চাইলাম। সরকার সেটা মনজুর করেনি।
এ সময় বাইরে কি ধরনের অত্যাচার চলছে তার নজির পেয়েছি জেলে বসেই। শুধু আমাদের পার্টির লােকই নয় সামান্য গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন বা সংখ্যালঘুর প্রতি কাল্পনিক সন্দেহে বহুলােককে জেলে গ্রেফতার করে আনা হয়েছিল। এবার পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনী যেমন প্রথম দিকে ব্যাপকভাবে হিন্দুদের মেরে মুছলমানের সমর্থন জোগাতে চেয়েছিল ঠিক চব্বিশ বছর আগেও পাক সরকার একই নীতি প্রয়ােগ করে এদেশের মুছলমানদের মনে সাম্প্রদায়িকতার এক বীভৎস আনন্দ সৃষ্টি করতে প্রয়াস পেয়েছিল। ঐ সময় হিন্দুদের মধ্যে যাদের ধরে এনেছিল তার মধ্যে ছিলেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, ভান্ডারিয়া হাইস্কুলের হেমন্ত বাবু। তাঁর পুত্রকেও গ্রেফতার করা হয়েছিল। এর পিছনে কোন রাজনীতি ছিল না। ছিল স্থানীয় প্রতিক্রিয়াশীলদের জঘন্য ষড়যন্ত্র। চঁাদসী হাইস্কুলের হেড মাস্টার, তা ছাড়া ছিলেন খলিশা কোঠার শ্রদ্ধেয় তুষারকান্তি চট্টোপাধ্যায় (ইনি বর্তমানে পশ্চিম বঙ্গ আইন সভার সদস্য), বরিশাল শহরের বাণীপীঠ স্কুলের শ্রদ্ধেয় প্রেমাংশু সেন। শিক্ষা-দীক্ষা আচার-আচরণে ধ্যান-ধারণায় এঁরা ছিলেন আদর্শস্থানীয় । যদিও এঁরা কেউ সমাজতান্ত্রিক বা মার্কসবাদী ছিলেন না। তথাপি এঁদের জীবনের লক্ষ্য ছিল Plain living and high thinking. এঁরা তেমন কোন বিপ্লবী না হয়েও কারাগারে আত্মমর্যাদা অক্ষুন্ন রেখেছেন- মানব শত্রু জল্লাদ সরকারের কাছে কিছুতেই মাথা নত করেননি। অন্যান্যদের মধ্যে ছিলেন। কলসকাঠির স্বনামখ্যাত জমিদার রাজ্যেশ্বর বাবু। তাঁর সঙ্গে তাঁর নাতি মিহিরকেও এরা ধরে নিয়ে এসেছে। রাজ্যেশ্বর বাবুর সঙ্গে আলাপ করে আনন্দ পেতাম। অবশ্য অল্পদিন পরেই তিনি মুক্তি পেয়েছিলেন। ঐ সময় জেলা কর্ডন প্রথা চালু ছিল। একদিন হঠাৎ একদল লােক সিকিউরিটি হিসেবে আমাদের ওয়ার্ডে আসে। তাদের মধ্যে একটি ছেলের বাড়ী ছিল ঢাকার নিকট কলাতিয়া। নাম দুদু মিয়া । খাটো মােটাসােটা কালাে ছেলেটি জেলে এসেও বেশ শক্ত পােক্তই ছিল। অন্যান্য দশ বারােজন কৃষক ঐ একই আইনে আটক হয়ে জেলে আসে। এরা কর্ডনের
৫৩
আইন ফাঁকি দিয়ে নাকি ধান চালান দিতেছিল। তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানতে পেলাম অনেক জায়গায় তৎকালীন আনসাররা ধান চাল পাহারা দেওয়ার অজুহাতে বহু নৌকা লুট করেছে। একদিন থাকার পরে তাদেরকে আমাদের কাছ থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়। মুক্তি পেলে আমাকে দুদু মিঞার বাড়ী বেড়াতে যেতে বলেছিল। আজও যাওয়া হয়নি। কিন্তু মনে পড়ছে সেই টিপটিপে চোখওয়ালা বুদ্ধিমন্ত চাপা কথার ছেলেটাকে।
তখন খবরের কাগজে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ঘটনা ছিল চীন বিপ্লবের অগ্রগতি। মনে পড়ে মুলাদির কমরেড কালীপদ দাসের কথা। যেন এক ঝলক আগুন। খবরের কাগজ এলেই তার জানার বিষয় ছিল চীনের মুক্তিবাহিনী কতদূর এগিয়েছে। কবে তারা পিকিং দখল করে বিপ্লবী চীনের জন্ম দিবে। মুলাদিতে কমরেড কালীপদ দাসের সঙ্গে দীর্ঘ দিন কাজ করেছি । ঠিক এই সময়ই মাও-এর নেতৃত্বে জনগণতান্ত্রিক চীনের উদ্ভব হয়। বাংলাদেশে জল্লাদ ইয়াহিয়ার গণহত্যা সম্বন্ধে চীনের নীরব ভূমিকা পালন আমাদের মনে গভীর দুঃখ ও সংশয়ের সৃষ্টি করলেও এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধোত্তর উপনিবেশগুলিতে জাতীয় মুক্তি আন্দোলন যখন এক প্রচন্ড রূপ গ্রহণ করছিলযখন তৎকালীন সােভিয়েত সমাজতন্ত্রের নেতৃত্বের প্রতি দেশের নিপীড়িত জাতিসত্তা সমাজতন্ত্রকে লক্ষ্য করে নিজেদের মুক্তির কথা চিন্তা করছিল, ঠিক তখনই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায়, মধ্যপ্রাচ্যে লাতিন আমেরিকায় এবং পশ্চিম ইউরােপের বহু দেশে তথাকথিত জাতীয় মুক্তির নামে সাম্রাজ্যবাদের তল্পীবাহকদের সরকার গঠন করে কার্যত ঐ সকল দেশে কমিউনিস্ট তথা সত্যিকারের মুক্তিকামী মানুষের বিরুদ্ধে এক স্বৈরাচারী সরকার কায়েম করতে প্রয়াস পেয়েছিল এবং বহুলাংশে সক্ষমও হয়েছিল। কিন্তু তাদের এই স্বপ্ন সম্পূর্ণ হতে পারেনি। বাদ সাধল বিশাল ভূখন্ড বিশিষ্ট মহান চীন। এখানেই চীনের বৈশিষ্ট্য। ঐ সময় সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও একচেটিয়া পুঁজিবাদ বিরােধী জনগণতান্ত্রিক চীনের উদ্ভব না হলে আজ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার চিত্র সম্পূর্ণ অন্যরকম হতাে।
এক সময় বাচ্চা বিনয় গুহ বলে উঠল, – ‘দাদা বিশ্বের বেদনা’ আজ পূর্বাঞ্চলে নবজীবন দান করল। মনে আছে আমরা আন্তর্জাতিক সঙ্গীত গেয়ে চীনকে অভিনন্দন জানালাম। ৪৮-এর জুনে বরিশাল শহরে ভূখা মিছিলে যােগদানকারী ১৪ বছরের কিশাের বিনয় গুহ কারাবরণ করতে বাধ্য হয়। বিনয় কেবলই বলতাে দাদা ‘বিশ্বের বেদনা’ । ভােলার পূর্ব সীমান্তে মেঘনার পাড়ে শুকদেব গ্রামে বিনয়ের বাবা এক জমিদারের কাছারিতে সামান্য কেরানীর কাজ করতাে। কঠোর দারিদ্র্যে নিষ্পেষিত বিনয়, বৃদ্ধ পিতামাতা ছােট বােন পুষ্প থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে
৫৪
ফ্যাসিস্ট সরকারের লৌহ কারায় এসে বিশ্ব বেদনার প্রত্যক্ষ রূপ অবলােকন করছিল । তাই হয়ত ‘দাদা বিশ্বের বেদনা বলে নিজেকে একটু হালকা করতাে। ঝাকড়া চুল, সরােবরের সকাল বেলার পদ্মফুলের মত টলটলে দুটি বড় চোখ, অথবা আশ্বিনের প্রভাতের মত ছল ছল করা দুটি আঁখি নিয়ে বিনয় কি যেন খুঁজে বেড়াত জেলের গরাদে, দেওয়ালে দেওয়ালে, মানুষের চোখে-মুখে, প্রকৃতির হাওয়া বাতাসে আর যখনই সামনে পড়ে যেতাম অমনি হাত দুটি প্রসারিত করে দিয়ে, পাতলা ওষ্ঠদ্বয়ের ভিতর দিয়ে, বেদনা মিশ্রিত হাসি দিয়ে এমন এক কোমল অথচ ব্যথিত কণ্ঠে বলে উঠত দাদা ‘বিশ্বের বেদনা’। বলতাম বিনয় ও কি এক কথা বারবার। স্নান কর, চুলগুলি উসকোখুশকো হয়ে গেছে, তেল দাও না কেন? বলত- দাদা, ও আপনাদের জন্য, বুঝবেন না দাদা বিশ্বের বেদনা বলেই ছুটে যেত আর একদিকে । অদ্ভুত ধৈর্যও ছিল বিনয়ের। মাত্র ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ত সে; কিন্তু জেলে বসেই খেটে খেটে শেষ পর্যন্ত তাকে স্টেটসম্যানের সম্পাদকীয় পড়েও বুঝতে দেখেছি। জানি না, এখন সে কোথায়। কিভাবে আছে। তার বড় ভাবনা ছিল তার ছােট বােন পুষ্পের জন্য। এমনি জীবন প্রভাতের আলােছায়া কত কিশাের যুবককে দলিত মথিত করেছে ফ্যাসিস্ট পাক সরকার চার দেওয়ালের মধ্যে আটকে রেখে । ব্যাহত করেছে তাদের জীবনের পাপড়িগুলি বিকশিত করতে। এমনি মনে পড়ে গৌরনদীর কিশোর গােপাল, বিনয়, মনে পড়ে অনিমেষ, রাখাল, নেপালী ছেলে লাল বাহাদুর, আনিস, বাচ্চু, নিমাই, আরও অনেকের কথা।
৫৫

যােল
দেখতে দেখতে পঞ্চাশ সালের দাঙ্গা শুরু হলাে। জেল থেকে আমরা দাঙ্গার কিছু কিছু খবর পেতে লাগলাম, কিন্তু মুলাদি, মাধবপাশার বীভৎস পাইকারী হত্যা সম্বন্ধে তখনও কিছু জানতে পারিনি। কেবল একটা খবর শুনেছিলাম যে, আমাদের মুলাদির কমরেড কালীপদ দাসের ভাই হরিপদ দাস, তার স্ত্রী, বৃদ্ধ পিতা দাঙ্গাকারীদের হাতে নিষ্ঠুরভাবে নিহত হয়েছেন। আমি যতদিন বরিশাল জেলে ছিলাম ততদিন এ খবর তাকে জানানাে হয়নি। এই মুলাদিতেই আমরা হাট তােলা’র বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তুলেছিলাম। এখানেই ছােমেদ তালুকদার, হাসুবারি, আর্শেদ হাওলাদারের মত কৃষক নেতার জন্ম হয়েছিল। এখানেই কমরেড কানাই পুততুন্ড , খগেন দাস, মাউলতলার বিজয় চ্যাটার্জী মৃত্যুপণ সংগ্রাম করে গড়ে তুলেছিল একটি প্রগতিশীল শিবির। এখানেই প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব দিত মােহাম্মদ হােসেন, কাজিরচরের ছাত্র তােকাদ্দস। আর সেই মুলাদিতেই নাকি চরম কলঙ্কময় দাঙ্গা সংঘটিত হলাে। অবশ্য এর বীজ ছিল সেখানে মনে আছে ১৯৪৬ সনের কথাআমি তখন মাউলতলার শিক্ষক। একদিন মুলাদি হইস্কুল থেকে আমারই একটি ছাত্রের জন্য সার্টিফিকেট নিয়ে ফেরার পথে আক্রান্ত হই কয়েকটি মুসলিম লীগপন্থী ছাত্রের হাতে। ওরা আমাকে মেরে অজ্ঞান করে পার্শ্ববতী খালে ফেলে দিয়েছিল।
যাক আমাদের পুরােনাে শক্তিশালী ঘাঁটিতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হওয়ায় এটাই প্রমাণিত হয় যে, আমরা জনগণকে অসাম্প্রদায়িক ও শ্রেণী সচেতন করে তুলতে পারিনি । সারাদেশব্যাপী ব্রিটিশবিরােধী আন্দোলনের জোয়ারের মুখে আমরা কিছু কিছু অর্থনৈতিক আন্দোলনই করেছি মাত্র। কিন্তু জনগণকে পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থার গতি প্রকৃতির পরিণতি সম্বন্ধে মােটেই সচেতন করে তুলিনি, তার ফলে প্রতিক্রিয়াশীল সরকারের দালালদের উস্কানীতে নিরীহ জনসাধারণ আত্মঘাতী কার্যে লিপ্ত হয়ে পড়ল । সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার দ্বারা দেশের ধনিক বণিক জমিদারদের স্বার্থ রক্ষা হয়- সে কথা সাধারণ মুসলিম ছাত্র যুবক জনতাকে বুঝাতে পারিনি।
আমার পরিষ্কার মনে আছে আমরা রাতে আমাদের ওয়ার্ডের জানালায় দাঁড়িয়ে বরিশাল টাউনের কোন কোন স্থানে দুস্কৃতিকারীদের দ্বারা প্রজ্বলিত অগ্নিশিখা দেখতে পেলাম। পরদিন আমরা কর্তৃপক্ষকে জানালাম যে, আমাদের হাতকড়া অবস্থায় বাইরে
৫৬
যেতে দিলে আমরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য জনগণের কাছে আবেদন করতাম। কিন্তু কর্তৃপক্ষ আমাদের কথায় কর্ণপাত করেনি। খুব সম্ভব বরিশাল শহরে তিনদিন পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক উন্মত্ততা সক্রিয় ছিল। শুনলাম দাঙ্গাকারী একটা বিরাট সংখ্যক লােককে জেলে এনে পুরেছে।
এ সময় অধুনা ন্যাপ নেতা জনাব মহিউদ্দিন ও এডভােকেট শাজাহানও ছিলেন।
হঠাৎ খবর এল আমার, উজিরপুরের দিলীপ সেন, গাভার কমরেড সদানন্দ ঘােষ, বাউফলের রশিদ উদ্দিন আহমদের বরিশাল থেকে বদলির আদেশ হয়েছে। সকাল দশটায় রওয়ানা হয়ে বারােটায় ঢাকাগামী জাহাজে উঠতে হবে। কিন্তু ঐ দিন আমি ভীষণ অসুস্থ ছিলাম। ব্যাপারটা ছিল এরূপ । আমাকে স্থানান্তরিত করা হবে শুনে আমাকে বলা হলাে ক্যাস্টর অয়েল খেতে যাতে করে আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি এবং আমাকে ট্রান্সফার করতে না পারে। কথামত কাজ, খুব ভােরে উঠেই বেশ পরিমাণ ক্যাষ্টের অয়েল গলাধঃকরণ করলাম । শরীরটা যেন একটু কেঁপে উঠল । আর দেখে কে, পাঁচ মিনিটের মধ্যে ইপ্সিত গন্তব্যস্থানে যেতে হলাে। মনে হলাে পেটের নাড়ীভুড়িও পড়ে যাচ্ছে। কোন রকম হেঁটে এসে বিছানায় শুয়ে গােঙ্গাতে লাগলাম। আমার স্ট্রং ডায়রিয়া হয়েছে বলে খবর ছড়িয়ে দেওয়া হলাে। ডাক্তারকে ডেকে পাঠানাে হলাে। মনে আছে খুব উদ্বিগ্নচিত্তে আমার শিয়রে বসে আমার মাথায় জল দিচ্ছিলেন বাণী পীঠ স্কুলের হেডমাষ্টার শ্রদ্ধেয় প্রেমাংশু সেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন শ্রদ্ধেয় কুমুদ গুহ ঠাকুরতা ও আরও দুই একজন।
বেলা দশটার সময় আমার জন্য একখানা স্ট্রেচার পাঠানাে হলাে। আমার বিছানাপত্র ওয়ার্ডে রয়ে গেল। আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবে বলে বেশ নিশ্চিত হলাম। এদিকে ডাক্তার এসে আমার নাড়ী দেখে মুচকি হাসল, এটা আমি লক্ষ্য করলাম। যা হােক স্ট্রেচার যখন জেল গেটের সামনে এল, তখনই জেল সুপার সামনে এসে দাঁড়াল এবং ওখানে স্ট্রেচার নামাতে বলল, আমি তখনই বুঝলাম আমাকে ফাঁকি দিয়ে চালান দেওয়ার জন্যই আনা হয়েছে। আমি ওখান থেকেই চিৎকার শুরু করলাম । চিৎকার শুনে আমাকে চালান দেওয়া চলবে না বলে ওয়ার্ড থেকে কমরেডরা আওয়াজ দিল, কিন্তু কিছুতেই কিছু হলাে না। ভিতরে গিয়ে দেখি অন্যান্যরা স্টেশনে চলে গেছে এবং আমাকে নেওয়ার জন্য পুলিশ এবং গাড়ী প্রস্তুত হয়ে আছে। যতদূর মনে পড়ে। আমাদের সঙ্গে যে চারজন সিপাহী দেওয়া হয়েছিল তারা বাংলা জানেও না, বলতেও পারে না। আমাদের স্টীমারে নিয়ে একটা দড়ির ঘেরাওর মধ্যে জায়গা করে দিল।
বরিশাল থেকে চাঁদপুর, লৌহজং হয়ে গােয়ালন্দ এ পর্যন্ত সুদীর্ঘ স্টীমার পথে। আমরা তখনও স্বচ্ছন্দে কথাবার্তা বলতে পারিনি কারণ আমাদের সঙ্গে সিপাহী। আমাদের কথা বুঝত না। ফলে আমাদেরকেও কথা বলতে দিত না। একটু কথা
৫৭
বললেই ক্ষেপে উঠত । দেখেছি স্টীমারে অন্যান্য যাত্রীরা আমাদেরকে দাঙ্গার আসামী মনে করে বেশ একটা বিজাতীয় আনন্দও অনুভব করতাে। তাদের ভাবভঙ্গিতে মনে হতাে যে, দাঙ্গা করে আমরা জেলে গেলেও আসলে আমরা বীরের কাজ করেছি। আমাদের চাঁদপুরে এনে জি.আর.পি হাজতে রাখা হলাে। স্টেশনেও অনেক লােক আমাদের বরিশালের দাঙ্গার আসামী মনে করে দেখতে এলাে। সাথী রশিদউদ্দিন (আবু) ছিল কড়া মেজাজের। সে প্রায়ই সিপাহীদের ক্ষেপাতাে- আমি বহু কষ্ট করে তাকে নিরস্ত করতাম। আমাদের সঙ্গে একজন আই-বি-ওয়াচার দেওয়া হয়েছিল। সে উর্দুওয়ালা সিপাহীদের কাছেও ঘেষতাে না- আমাদের সঙ্গেও মিশতাে না। সারা পথে তার অসহায় অবস্থা দেখে করুণাই হতাে।
যতদূর মনে পড়ে এই দীর্ঘ যাত্রায় আমরা রাজবন্দী হিসেবে যাত্রীদের বা জনসাধারণের কাছে পরিচিত হতে পারিনি। এ দ্বারাই তখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনুমান করা যায় । যা বলতে চেয়েছি তা হলাে এই যে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হবার পর সাধারণ লােক এটা মনে করতাে যে, এখন তাদের সমস্যার সমাধান হয়েছে বা দ্রুত হয়ে যাবে। দীর্ঘ পথযাত্রায় আমরা তাদের কাছে শুধুমাত্র কয়েদীই রয়ে গেলাম । নব্য শিশু রাষ্ট্রে যে কোন রাজনৈতিক কয়েদী থাকতে পারে এ ধারণা করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয় ।
স্টীমার লৌহজংয়ের কাছাকাছি আসতে চোখের সামনে যেন বিক্রমপুর পরগণার ইতিহাস ভেসে উঠলাে। অতীত ভারতের একচ্ছত্র সম্রাটরাও যে বাংলাকে বশে আনতে পারেনি সেই বাংলার স্বাধীন রাজাদের লীলাভূমি এই বিক্রমপুর । কিন্তু আজ তার সমস্ত কীর্তি ধ্বংস করে নদী কীর্তিনাশা নাম ধারণ করেছে। বিক্রমপুর পরগণার বহু প্রতাপশালী রাজা-মহারাজা বা জমিদার ভূস্বামীদের কীর্তি আজ নদী গর্ভে। নদীর চলমান তরঙ্গ যেন তরঙ্গায়িত অনাদি কালকে স্মরণ করিয়ে দেয়। লৌহজং স্টেশন পেরিয়ে পশ্চিমে কিছুদূরে এগিয়েই চোখে পড়ল এক অত্যুচ্চ সমাধিস্তম্ভ। এটা এ অঞ্চলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। পরে দেখেছি সারা বিক্রমপুরে এরূপ অসংখ্য মঠ রয়েছে। তার মধ্যে আলােচ্য বিরাট সামসিদ্ধির মঠ, মাইজপাড়া দত্তদের মঠ, শিমুলিয়া বা কুমার ভােগের কাছাকাছি নদী তীরের মঠটি বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। বিক্রমপুরের বহু এলাকায় এই বহুল খরচ সাপেক্ষ আকাশচুম্বী মঠগুলি মুসলিম আমলের শেষ যুগের বা ব্রিটিশ আমলের প্রথম যুগের বণিক ও সামন্ত প্রভুদের পুঞ্জীভূত ধনসম্পদের উক্তৃঙ্গ রূপ। তা বােঝা যায় এই মঠগুলির সঙ্গে জড়িত বর্তমান উত্তরাধিকারীদের দেখলে। এদের অধিকাংশই ব্যবসায়ী সাহা সম্প্রদায় বা অন্যান্য বণিক সম্প্রদায়। স্বল্প পরিসর নদীর তরঙ্গ কেটে কেটে জাহাজ ভাগ্যকুলের কাছাকাছি এসে গেছে। সাংঘাতিক কৌতুহল হল এলাকাটি দেখতে । কিন্তু উপায় ছিল না। সিপাহীরা দড়ির বেষ্টনীর বাইরে যেতে দিচেছ না। এই ভাগ্যকুলই বাংলার বিখ্যাত ধনী ব্যবসায়ী কুন্ডদের
৫৮
বাসস্থান। এদেশে ব্রিটিশের আশ্রয় যারা ধনার্জন করে আধুনিক ব্যবসায় বাণিজ্যে পুঁজি নিয়ােগ করেছে, তাদের মধ্যে ভাগ্যকুলের কুন্ডরা অন্যতম। তাছাড়া মার্টিন কোম্পানীর সঙ্গে জড়িত বিদ্যোৎসাহী রাজেন্দ্রলাল, রবীন্দ্রনাথের পরিবার বাংলাদেশে ব্যবসায়ী পুঁজি নিয়ােগ করে ধনতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ব্যবসায় বাণিজ্যের পথ উন্মােচন করেন। পরবর্তীকালে একষট্টি সালে কুন্ডদের বাড়ী দেখার সুযােগ হয়েছিল। কুন্ডদের তিনটি বাড়ী এর মধ্যে প্রধান বাড়ীটিতে এখনও সুদৃশ্য দালান রয়েছে। মেঘমুক্ত নীলাকাশের নীচে দেখি দীঘি ও বাগান বেষ্টিত হলদে রং এর দালানটিকে দেখে মনে হলাে বিরাট পটে আঁকা নবাব সিরাজদৌল্লার বা মােঘল সম্রাটদের সৌধ দেখছি। দালানটির দুই দিকে ফুলের বাগান- একদিকে ঘনকৃষ্ণ মেঘের রং এর নিবিড় বনানী-সামনে সুপ্রশস্ত দীঘি। বিভিন্ন ফলের গাছের ঘন পাতার মধ্য দিয়ে বিকেলের সােনালী সূর্যের রং গাঢ় হলদে দালানে পতিত হয়ে যে অপূর্ব শােভা ধারণ করেছে, তা আবার সম্মুখস্থ দীঘিতে প্রতিবিম্বিত হয়ে অনন্য সুন্দর হয়ে উঠেছে। মূল দালানটির পূর্ব দিকে আর একটি দালান পূর্ব পশ্চিমে বিলম্বিত। তারই সামনে বিস্তৃত ফুলের বাগান- লাল-সাদা অসংখ্য গােলাপে পরিপূর্ণ বাগানটি।
৫৯

সতর
আমরা সন্ধ্যার পরে গােয়ালন্দ পৌছলাম । জাহাজ থেকে নেমে উঁচু বাঁধ বেয়ে রাস্তায় উঠে আসলাম। পাড়টা এত উঁচু মনে হলাে যেন ছােট খাটো পাহাড় বেয়ে উপরে উঠেছি। এখানে এসে পরিষ্কার মনে হলাে দক্ষিণ বঙ্গ ছেড়ে উত্তরবঙ্গের দ্বারােঘাটন করলাম। গােয়ালন্দ যেন উত্তর বঙ্গের দ্বার বিশেষ। এর উঁচু পাড় বেয়ে উপরে উঠতে মনে হয়েছে দক্ষিণে সমুদ্রের তীর ছেড়ে উত্তরে হিমালয়ের পাদদেশে এসে পৌছেছি। এখানে এলে সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে এ অঞ্চলের উচ্চতা স্পষ্ট ধরা পড়ে।
গােয়ালন্দ একটি ছােট্ট স্টেশন, সমগ্র উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার এই স্টেশনটির দোকানপাট দেখে এ অঞ্চলের অধিবাসীদের গরীব বলেই মনে হয়। স্টেশনটি। নােংরা ও ধুলাবালি পূর্ণ। যতদূর মনে হয় সমগ্র স্টেশনে একখানি ভাল দোকানও চোখে পড়ে নাই।
ট্রেনে আমাদের যাত্রীদের মধ্যে ভারতগামী যাত্রীই বেশী মনে হলাে। তাদের কথাবার্তা হাব-ভাবের মধ্যে একটা আতঙ্কের সুস্পষ্ট ছাপ লক্ষ্য করা গেছে। বাস্তুত্যাগীদের এই দেশান্তর গমন আমাকে এত অভিভূত করছিল যে, আমি। নিজেদের অবস্থা সম্পূর্ণরূপে ভুলে গিয়েছিলাম। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম যে, আমার হাতে কড়া। মনে আছে একদল বাস্তুত্যাগীর সঙ্গে কথা বলতে বলতে জনৈক ব্যক্তির কোল থেকে একটি ফুটফুটে শিশুকে কোলে নেবার জন্য হাত বাড়াতেই হাতের কড়ায় টান পড়ল। শিশুটি আমার দিকে ঝুঁকেই থেমে গেল। আমিও আর হাত তুলতে পারলাম না। ভাবলাম আমার ভালবাসার কোন অধিকার নেই, যে হাত তুলে শিশুকে কোলে নেব সে হাত শৃঙ্খলিত। এ শিশুর ধমনীতে পূর্ববঙ্গের রক্ত প্রবাহিত। পূর্ববঙ্গের জল বায়ুতে যারা লালিত-পালিত হয়েছে। তাদেরই ঔরসজাত শিশুরা আজ চির দিনের জন্য ছেড়ে চলেছে এ দেশ। তাদের। শেষ বারের মত কোলে নিবার অধিকারটুকুও আমার নাই। সারা পথ এই বাস্তুত্যাগীদের গভীর বেদনাময় মুখমণ্ডল দেখতে দেখতে চলেছি। কেবলই মনে হলাে মানুষের জীবনে, জাতির জীবনে বােধহয় এর চেয়ে বড় ট্রাজিক ঘটনা আর কিছু হতে পারে না। কত ছেলেকে মা ছেড়ে, কত স্ত্রীকে স্বামী ছেড়ে, কত ভাই
৬০
বােনকে কত প্রাণপ্রিয় সহােদরকে ছেড়ে চিরদিনের জন্য ভারতে চলে যেতে হচ্ছে, তা ভাবতেও শরীর শিউরে ওঠে।
তাছাড়া সমস্ত পথটিতে বহু যাত্রীর উন্মত্ত সাম্প্রদায়িক কথাবার্তা শুনতে হলাে। কেউ বলেছে ‘শালারা যত তাড়াতাড়ি দেশ ছেড়ে যায় ততই ভাল। কেউ বলেছে ‘এখন ত যাই- সুযােগ পেলে আবার আসব । সেই একদিকে উগ্র সাম্প্রদায়িক মনােভাব, অন্যদিকে সন্ত্রাস- দেশ ত্যাগজনিত অসহনীয় বেদনাময় পরিবেশে কে আমাদের দিকে লক্ষ্য করে! অনেককেই দেখলাম কৌতুহলী চোখ নিয়ে আমাদের দিকে তাকায়। কিন্তু কিছুই যেন বুঝতে পারে না এমনি ভাব দেখায়। আমাদের মধ্যে এক দিলীপ সেন আর আমি ছাড়া দুজনই ছিল উগ্র প্রকৃতির। একজন সদানন্দ ঘােষ, তিনি কলকাতায় আর-সি-পি-আই এর সদস্য ছিলেন। এক এক সময় তিনি উত্তেজিত সিপাহীদের আক্রমণ করার মতলব আঁটতেন। অত্যন্ত ক্ষীণাঙ্গ এই ব্যক্তিটি ছিলেন খুবই উগ্র প্রকৃতির। বাঙ্গালী রাজবন্দীর জন্য উর্দুওয়ালা স্কোয়াড দেওয়ার ফলে তার ক্রোধের সীমা ছিল না। বিভিন্ন দোষ-গুণের অদ্ভুত মিশ্রণ এই কমরেডটির সম্পর্কে আমি যথাসময় আলােচনা করব। অপরজন রশীদউদ্দিন*। বিশাল বপু, বড় নাক, লম্বা থুতনি, চোখ দুটি বড় বড়, পাতলা ঠোট। আমাকে সােহাগ করেই দাদা ডাকত, আমি মাঝে মাঝে তার গাল দুটি টিপে দিয়ে তাকে ক্রিকেটিয়ার পাতাওদির নবাব অথবা শওকত বলে ডাকতাম। বাড়িতে আর্থিক অবস্থা ভাল বলে সে জেলখানায় প্রচুর বই কিনেছে। একটু তোতলা বলে কথা বলতে বলতে সে কখনও কখনও ভীষণ । রেগে যেত। রাগের মাথায় সে একবার ট্রেনের জানালার সঙ্গে হাতের কড়া দিয়ে সাজারে ঘা দিত। সিপাহীরা ভয়ানক চটে যেত। আমাকে উভয় পক্ষকে শান্ত। করতে হতাে। অদূরে বেচারা ওয়াচার সবই লক্ষ্য করতাে। কিন্তু কাছে আসতে বা কোনরূপ মন্তব্য করতে সাহস করতাে না।
——————————–
* রশিদ উদ্দীন ঃ ১৯৭৪ সালে রশিদ উদ্দীন নিজ গ্রামে রাজনীতিক আততায়ীর হাতে নিহত হয়েছেন।
——————————-
৬১

আঠার
রাজশাহী পৌছার পূর্বে বরিশাল জেল-জীবনের আরও কিছু বিবরণ দিচ্ছি। আমি বরিশাল এসে শুনতে পেলাম আমার সঙ্গে ওয়ারেন্টে আমার পূর্বে ধৃত আজিজ মীর বরিশাল জেলের ফাইলে আছে। আমরা তখনই তাকে আমাদের ওয়ার্ডে আনাবার ব্যবস্থা করলাম। সে মাত্র দুই তিন দিন কয়েদীদের সঙ্গে ফাইলে রয়েছে। ইতিমধ্যেই তার সমস্ত চুল জট বেঁধে গেছে। চুলগুলি ফুলে সমস্ত মাথা ও মুখমণ্ডল ঢেকে ফেলেছে। সমস্ত মুখে ব্রণ উঠেছে। হাত পা অদ্ভূত শ্রী ধারণ করেছে। ঘুম থেকে উঠেই দেখি আমাদের নির্দিষ্ট কয়েকজন ফালতুর সঙ্গে হাতে একটি বাসন- একটা কম্বল এবং একখানা টিকিট নিয়ে আজিজ ভাই আমাদের ওয়ার্ডে ঢুকেছে।
সঙ্গে সঙ্গে আমরা হৈ-চৈ করে উঠলাম। আমাদের দেখেই অত্যাচার ক্লিষ্ট রুক্ষ্ম চুলে অর্ধাবৃত মুখমন্ডলের ফাঁক দিয়ে তার স্বভাবসুলভ মিষ্টি হাসি বেরিয়ে এলাে। বুঝলাম আজিজ ভাই ঠিকই আছে। ঐ দিনই আমরা তার চুল কাটার ব্যবস্থা করাই, সাবান-তৈল দিয়ে বেশী জলে স্নান করাই তাকে ধরাে বাটি ঢালাে জল* (মানে মাপা জল) থেকে মুক্ত করলাম, দুই তিন দিনের মধ্যে সে একেবারে সুস্থ হয়ে উঠল। অবশ্য এর এক সপ্তাহের মধ্যে তাকে খালাস করে দেওয়া হয়। আমার মনে হয় আমাকে ধরার পর একমাত্র আজাদ সুলতান ছাড়া অন্য সকলকে ছেড়ে দেওয়ার পরিকল্পনা পূর্ব থেকেই করা ছিল। বরিশাল জেলে আমাদের ওয়ার্ডে কোন বৈচিত্র্য ছিল না। অবশ্য তার কারণও ছিল। আমরা তখনও সিকিউরিটির মর্যাদা পাই নাই। জেলের কম্বল গায় দিয়ে ও দুর্গন্ধযুক্ত লাপসি* খেয়ে আমরা ফুর্তি করতে পারতাম না। তবে এক দিনের কথা মনে আছে।
সকালে লাপসি এসেছে। বালতি ভরা লাপসি ওয়ার্ডে আনতেই এমন একটা উৎকট গন্ধ বেরুল যাতে পেটের নাড়ী-ভুড়ি বেরিয়ে আসতে চায়। আমরা কয়েকজন লাপসি খেতেই চাইলাম না। অথচ ভাের বেলা ওই ছাড়া অন্য কোন খাবার ছিল না। মহারাজদা কি যেন চিন্তা করলেন। পরে আমাদের কয়েকজনকে ডেকে বসালেন। তিনি আমাকে বুঝিয়ে দিলেন যে, এই মুহূর্তে আমরা এর পরিবর্তন করতে পারব না অথচ খেলে স্বাস্থ্যের দিক থেকে আমরাই দুর্বল হয়ে
———————-
* ধরাে বাটি, ঢালাে-জল পানির খুব সীমিত ব্যবহারের নিদের্শ।
* লাপসি ফেনা-ভাত।
———————
৬২
পড়ব। মহারাজদা বললেন, সরকারও চায় যাতে আমরা না খেয়ে দুর্বল হয়ে পড়ি এবং শেষ পর্যন্ত সংগ্রামী শক্তি হারিয়ে ফেলি। সুতরাং আমাদের এটুকু মনােবল থাকা উচিত যে, আমরা এই খাদ্য খেয়েই হজম করব এবং শারীরিক ও মানসিক শক্তি অক্ষুন্ন রেখে যত বছর পরেই হােক জেল থেকে বেরিয়ে পুনরায় সংগ্রামে আত্মনিয়ােগ করব । অবশ্য এই ধরনের খাদ্যের পরিবর্তনের চেষ্টা আমরা চালিয়েই যাব। আমরা তার কথার বৈপ্লবিক তাৎপর্য অনুধাবন করলাম এবং ঐ দিন পেট ভরে লাপসি খেলাম । অবশ্য এর অল্প কয়েকদিন পরেই আমি রাজশাহীতে বদলি হয়ে যাই।
মনে পড়ে জব্বার নামে আমাদের দুই নং ওয়ার্ডে একজন ফালতু ছিল । সামান্য জমিজমার মামলায় দুই বছর জেল হয়েছে। কালাে হ্যাংলা শরীর। আলাপ করে বুঝলাম অত্যন্ত গরীব কৃষক। তার গােষ্ঠীতে কেউ কোন দিন চুরি ডাকাতি করেনি, একদিন আলাপ প্রসঙ্গে বললাম, দেখ আমরাও জেলে আসি। আবার মুক্তি পেয়ে জেল থেকে বেরােই। আমরা জেলে এলে বাইরের জনতা আমাদের জন্য দুঃখ করে। আবার যখন বেরুই তখন জেল গেটে আমাদের সম্মানের জন্য মালা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। জনতা বিজয়ের আনন্দে আমাদের গ্রহণ করে। আর তােমাদের অবস্থা কি? যারা চুরি করে জেলে আসে জনগণ মনে করে আপদ গেছে, ভালই হয়েছে, ঝগড়া-বিবাদ চুরি ডাকাতি কিছু কমল। আবার যখন বের হবে তখনও মানুষ ঘৃণায় তােমাদের থেকে দূরে থাকতে চেষ্টা করবে। কাজেই যদি জেলে আসতে হয় আমাদের মত আস। আর যদি বের হতে হয় তাহলে আমাদের মত বের হবে। জব্বার অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাে আমার দিকে। বহুদিন পরে বাইরে একবার গা ঢাকা দিয়ে খুলনা স্টেশনে ঘােরাফেরা করছি। হঠাৎ একেবারে পিছন থেকে কে যেন আমাকে আস্তে ডাক দিল। প্রায় কেঁপে উঠেই পিছনে তাকিয়ে দেখি রিক্সায় জব্বার । সে রিক্সা চালাচ্ছে। সে আমাকে রিক্সায় তুলে নিল এবং একটু আড়ালে নিয়ে বলল, ‘ভাইসাব আমি খালাস হয়ে রিক্সা চালিয়ে জীবনযাপন করছি এবং এখানে রিক্সা ইউনিয়নের সক্রিয় কর্মী হিসেবে কাজ করছি। আমি পার্টিরও সদস্য। জেলে থাকাকালীন একদা রুগ্ন অসহায় ফালতু জব্বারকে আজ অন্য মানুষ বলে মনে হলাে। তার চোখ মুখে গভীর প্রশান্তি ও দৃঢ়তার স্পষ্ট ছাপ দেখতে পেলাম। তার চোখে মুখে বিপ্লবীর দীপ্তি । তাকে দেখে মনেই হয় না যে, সে কোনদিন জেলে ফালতু ছিল । সমগ্র জেল জীবনে এটা লক্ষ্য করেছি যে, অসংখ্য কয়েদীতে জেলখানা পরিপূর্ণ। তারা এক রকম সবাই বর্তমান সমাজ ব্যবস্থার শিকার। আসলে সুযােগ পেলে এরা সবাই হতে পারতাে দেশের। উপযুক্ত নাগরিক।
বরিশাল জেলে থাকাকালীনই দেখেছি আমাদের এলাকার বিখ্যাত ডাকাত খবিরউদ্দিন সরদারকে।
৬৩

উনিশ
ছিপ ছিপে লম্বা, এক চোখ কানা খবির সরদার যখন গুলি তাক করতাে তখন তা হতে অব্যর্থ । হঠাৎ একদিন ইন্টারভিউ দিতে গেটে যাওয়ার পথে দেখি হাতে বন্ধন, সরদার দাঁড়িয়ে আছে অন্য অনেকের সঙ্গে। আমাকে দেখেই তার এক চোখের তীক্ষ্ম দৃষ্টি দিয়ে আমার দিকে তাকাল এবং বলল, ‘মিয়ার পাে আছেন কেমন-আদাব। আপনার আসার কথা শুনেছি। জিজ্ঞেস করলাম, কেমন আছেন খবির ভাই’- বলল, শরীর খুবই খারাপ। শালারা জীবিত বের করবে কিনা কে জানে।’ এই সেই সরদার গােষ্ঠী। একদিন যাদের দেহে বল ছিল, জমিতে ধান ছিল। বিরাট গােষ্ঠী। এরা পুরুষানুক্রমে আমাদের পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলি এবং আমাদের গ্রামের পুরানাে জমিদার তালুকদারের লাঠিয়াল হিসেবে কাজ করত। তিরিশ চল্লিশের দশক, তখনও গ্রামে ছােটখাটো সামন্তদের প্রভাব মােটামুটি অক্ষুন্ন । তখনও এই সরদারদেরও পেশা কার্যকরী ছিল। দুই বা ততােধিক তালুকদার বা সামন্ত গােষ্ঠীর মধ্যে জায়গাজমি দখল নিয়ে প্রায়ই দু’একটি সংঘর্ষ লেগে থাকত। এরা তখন তাদের ভাড়াটিয়া লেঠেল হিসেবে জমিতে দখল নিতে নেমে পড়ত । জান যেত, তবুও নিমকের মর্যাদা এরা রাখতােই। আমাদের গ্রামের স্বনাম খ্যাত আছরদ্দিন সরদার ছিল বিশাল গােষ্ঠীর অন্যতম বয়ােজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি। ঝাঁকড়া চুল, কামানের গােলার মত রক্তাভ দুটি চোখ তখনও প্রথম বয়সের সরদারীর স্মৃতি বহন করত। কথায় কথায় বলত, মিয়ার পাে, নাই সেই দিন বুড়া হাইয়া গেছি। এহনগাে ছ্যামরারা আর কি করবে ওরা একখানা ঢালও কি জাগাতে পারে । আপনেগাে দোয়ায় এহনও মাঠে যাইয়া ডাক দেলে সামনে কেউ আইতে সাহস করবে না। সরদার আছরদ্দিনকে দেখলে অনুভব করা যায় যে, একদিন দেশে কৃষক ছিল। কৃষকের বুকের পাটা ছিল।
বাংলায় বংকিমের বাঁশ ছিল—ছিল লেঠেল। আজ সেই বাংলা সেই কৃষক ধ্বংসের শেষ সীমান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। জেলে দেখলাম লস্করপুরের প্রখ্যাত ডাকাত সােনামদ্দিকেও। জীবন সংগ্রামের তাগিদে এরা ডাকাত হয়েছে। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থার বৈগুণ্যে এরা ডাকাতি করতে বাধ্য হয়েছে- তা না হলে এরা সামর্থ্য, সাহস, বুদ্ধি, ক্ষমতার দিক দিয়ে এক একজন অসাধারণ হতে পারত।
৬৪
মনে আছে, ঢাকা জেলে দেখা হয়েছিল বিখ্যাত গ্যাং লিডার শের আলির সঙ্গে। ঊনষাট বছরের সাজাপ্রাপ্ত দম দম জেল থেকে আগত এনছান আলির সঙ্গে। উভয়েই শারীরিক গঠনের দিক দিয়ে কালপুরুষের মত। শের আলীকে দেখলে রীতিমত ভয় জন্মে। এনছান আলিকেও তদ্রুপ। প্রায় আধহাত লম্বা দাড়িতে তাকে রহস্যময় বলে মনে হত । চোখ দুটি কপালের মধ্যে এমনভাবে লেগে রয়েছে, মনে হচ্ছিল যেন পাথরে কেউ চোখ বসিয়ে দিয়েছে । দুটা দীর্ঘ। দ্রুর সঙ্গে মাথার চুল কানের উপর দিয়ে এসে মিশে তাকে যেন কোন পিরামিড যুগের যাদুকর বলে। মনে হচ্ছিল। শের আলি আরও ভয়ঙ্কর। তার চেহারা বর্ণনা করে তার শরীরের অসামান্যতাকে সীমাবদ্ধ করতে চাই না। শের আলি সম্পর্কে মােটামুটিভাবে এটুকু বলা যায় যে, তাকে এখন মিউজিয়ামে রেখে আরব্যোপন্যাসের কোন দস্যু সর্দারের রক্ষিত দেহ বললে তা হলে সকলেই সানন্দে তা স্বীকার করে নিত।
দমদমের এনছান আলী। আমাদের ওয়ার্ডে এক রাত ছিল। সে বলল যে, সে ব্রিটিশ আমলের বড় বড় স্বদেশী বাবুদের জেলে দেখেছে। সে আরও বলল যে, আপনাদের কিসমতে কিছু নেই। সে সময় স্বদেশীদের ওয়ার্ডে ডিউটি পড়লে আমরা খেয়ে দাঁড়াতে পারতাম না। বলল, এ শরীরের অনেক অনেক রক্ত স্বদেশী বাবুদের খাওয়া খেয়ে হয়েছে। তখন সিকুরিটি ওয়ার্ডের ড্রেন দিয়ে ঘি বেয়ে নামত আর এখন ফেনও না, বলে দীর্ঘ দাড়ির মধ্যে হাত বুলাতে বুলাতে এমন এক ভংগি করল যেন আমরা এখানকার স্বদেশীরা তার কাছে কৃপার পাত্র মাত্র।
ঠিকই, ব্রিটিশ আমলের শেষের দিকে তৃতীয় দশকে, রাজবন্দীরা ভাতাসহ অনেক কিছু খাবার ও কাপড়-চোপড় পেত। একজন রাজবন্দী পনের বিশ বছর জেল খাটলে বহু টাকার মাল নিয়ে বেরুতে পারত। এমন শুনেছি যে, অনেক ছেলে মেয়ের মা-বাপ পুরানাে রাজবন্দীদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করত কি করলে তারা জেলে যেতে পারে। বলা বাহুল্য, মনে রাখা দরকার যে, তৎকালে রাজবন্দীরা দীর্ঘ পঁচিশ বছর সংগ্রাম করে উপরিউক্ত সুবিধা আদায় করেছিল।
যাক শের আলী, এনছান আলী, মুকুল প্রভৃতি বড় বড় ডাকাতেরা জেলে আমাদের বলছে যে, বাবু সময় হলে আমাদের ডাক দিবেন আমরা হয়তাে বিপথে গেছি কিন্তু দেশের ভালর জন্য উপযুক্ত লােক পেলে তাদের পিছনে নামতে রাজি আছি। রুশ বিপ্লবের ইতিহাসে দেখা গেছে এক সময় বহু ভবঘুরে সর্বহারারা বিপ্লবে অংশগ্রহণ করেছে এবং তাদের এই পথে আনার জন্য যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তাকে ‘ব্যাচমাকি আন্দোলন বলে অভিহিত করা হয়েছে। চীন বিপ্লবে এর নজীর রয়েছে।
জেলে যে সমস্ত বড় বড় ডাকাতদের সঙ্গে দেখা হয়েছিল তাদের কারও
৬৫
কারও অধীনে চারশ থেকে পাঁচশ পর্যন্ত ডাকাত থাকত।
মনে পড়ে, বরিশালের বিখ্যাত ডাকাত কুদুস মােল্লার কথা। আমি তখন সফিপুর স্কুলের হেড মাস্টার। খুব সম্ভব মােল্লা তখন ফেরারী। কুদুস মােল্লা খবর দিল সে আমার সংগে দেখা করতে চায়। অবাক হলাম। আমার আত্মমর্যাদায় বাঁধল। স্থানীয় লােকদের জিজ্ঞাসা করায় বলল, বলেন কি এ সুযােগ ছাড়বেন কেন! স্কুলের জন্য ভাল টাকা আদায় করতে পারবেন। আমি কিছুতেই রাজী হলাম না। একজন ডাকাতের সঙ্গে আমার কি দরকার! এরই দুই দিন পর প্রায় দশ-বারাে জন লােকসহ মােল্লা হন হন করে আমার বৈঠকখানায় এসে উঠল । খবর পেয়ে ইউনিয়ন বাের্ডের চেয়াম্যানসহ বহু লােক উপস্থিত । অনেকে পানি পড়া নেবার জন্য গ্লাস হাতে এসে জড়াে হয়েছে। তাদের মধ্যে মেয়ে লােকই বেশী। পরনে একটা নীল রঙের স্যুট। মাথায় বাবরি। মাথার উপর সােজা সিতা কাটা, উজ্জ্বল চোখ দুটি দেখে মনে হয় কোন জমিদার নন্দন তার মহল্লায় দয়া করে পদার্পণ করেছেন।
৬৬

কুড়ি
আমি চুপ করে বসে আছি। সে বলল, শুনেছি আপনার কথা। আপনি ইচ্ছা করলে আমার একটু উপকার করতে পারেন। আমি ঠায় আমার চেয়ারে বসা, মােল্লা চৌকির এক কোণে বসে আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে। আমি কোন কথা না বলায় সে নিজেই বলতে লাগল, তার বাড়ী নিলাম হয়ে যাবে, আমি যেন এ ব্যাপারে শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে একটু যাই। খুব সম্ভব তখন তিনি তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের একজন প্রাদেশিক মন্ত্রী। আমি তখন মােল্লার দিকে চেয়ে বললাম: এ সরকার হুমকি দেয়- আসলে ঘরবাড়ী নিলাম করবে না। কাজেই আমার শেখ সাহেবের কাছে যাওয়ার দরকার হবে না। মােল্লা বলল যে, সে যখন পঞ্চমশ্রেণীর ছাত্র তখনই সে ডাকাতদের কথা জানত। আসলে সফিপুর, মনিহার চর, নিকটবর্তী ছিলিমপুর থেকে আরম্ভ করে গোসাইরহাট পর্যন্ত নদীর এপার-ওপর এ ধরনের পেশাদার নিশাচরদের সংখ্যা নিতান্ত নগণ্য নয়। নন্দীর বাজার থেকে শুরু করে গোসাইরহাট পর্যন্ত নদীর এই বিরাট বাঁকে এরা ওঁৎপেতে লক্ষ্য করত কখন চাঁদপুর থেকে মীরেরহাট হয়ে দক্ষিণবঙ্গে আবার মীরের হাট থেকে চাঁদপুর হয়ে উত্তরবঙ্গের বেপারীদের নৌকা যাতায়াত করে। এই ব্যবসা একদিন বড় লাভজনক ছিল। কারণ তখন বেপারীরা টাকা-পয়সা সঙ্গে নিয়েই যেতেন। আজকের মত তখন না ছিল এত ব্যাংক ড্রাফট- না ছিল এত লঞ্চ, না ছিল ফোন।
এই সময় বরিশাল জেলে নারাদা নামে একজন বৌদ্ধ সাধু নিরাপত্তা আইনে বন্দী হয়ে আমাদের ওয়ার্ডে আসে। অত্যন্ত আমােদ-প্রিয় নারা দা কখনও জেল পােশাক পরেনি। সে তার দীক্ষানুযায়ী সাধুর পােশাকই পরত। মুন্ডিত মাথা, গেরুয়া বসন, সুন্দর গােলগাল মুখ । নারা দা ছিল একজন উদারপন্থী সাধু । তিনি সবার সঙ্গে মিশতে পারতেন। আমাদের কমিউনিস্ট জেনেও আমাদের সংগে মিশতে একটু কুণ্ঠাবােধ করতেন না। যতদূর মনে পড়ে তিনি রাজনীতি-সচেতন ছিলেন। ভিয়েতনামের বৌদ্ধরা যে মুক্তিসংগ্রামে অংশগ্রহণ করে আত্মাহুতি দিতে পারে কমরেড নারা দাকে দেখলে তা বিশ্বাস করতে আদৌ কষ্ট হয় না।
বলা বাহুল্য পটুয়াখালি মহকুমার সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলগুলিতে প্রায় চল্লিশ পঞ্চাশ হাজার বার্মিজ বাস করত। ব্রিটিশ আমল থেকে এরা নানাভাবে নির্যাতিত হতাে। এদের তেমন কোন নাগরিক অধিকার ছিল না। দক্ষিণ বরিশালের বিস্তৃত
৬৭
অঞ্চল জুড়ে এই বৌদ্ধ সম্প্রদায় কোন রকম সরকারী সুযােগ-সুবিধা না পেয়ে দূর্বিষহ জীবন যাপন করতে বাধ্য হতাে। তাদের অধিকাংশই ছিল অত্যন্ত দরিদ্র। কোন রকম প্রতিবাদ করার মত সাংগঠনিক শক্তি না থাকায় খাজনা ট্যাক্সের জুলুমই হতাে এদের উপর বেশী। তা ছাড়া সংখ্যালঘু বলেই স্থানীয় জোতদার জমিদাররাই এদের ওপর নানা রকম জুলুম করত। বিভাগ পূর্বকালে আমাদের কৃষক সমিতির নেতৃবৃন্দ তাদের মধ্যে কাজ করত। এর ফলে এরা অনেকটা সংগঠিত হয়েছিল। এদের মধ্যে শিক্ষা-দীক্ষার আগ্রহ জন্মেছিল এবং এদের এলাকায় কিছু কিছু স্কুল পাঠশালাও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এদের ওপর খাস মহলের অত্যাচারই ছিল বেশী। এক সময় এক একটা সরকারী প্লটে এরা ঘাস খাওয়াবার জন্য গরু মহিষ নিয়ে আসছিল। এদের ঘাসের অভাব থাকায় এরা দাবি করে আসছিল যে সমস্ত চরে খাস জমি আছে সেখানে যেন তারা গরু, ছাগল, মহিষ চরাতে পারে। কিন্তু সরকার তাদের দাবির প্রতি কর্ণপাত না করায় এরা একদিন চরে গরু নিয়ে এল। ফলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় এবং তাদের গুলিতে জনৈক বৃদ্ধ মগ নিহত হয়। এটা ঘটে ফাতরার চরে। এই ঘটনার পরে তাদের ভিতর রাজনৈতিক চেতনা প্রবল হতে থাকে। দীর্ঘদিনের চরম অবহেলিত মগদের ভিতর কৃষক আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। এদের মধ্যে যারা কৃষক নেতা হিসাবে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসে তাদের মধ্যে থােংজা অন্যতম। কমরেড থােংজাকে শেষ বারের মত দেখেছি মুলাদী কৃষক সম্মেলনে বক্তৃতা করতে। এরা তাদের সাবেক দেশ বার্মার গণ-আন্দোলন থেকে অনুপ্রেরণা লাভ করত। রাজনৈতিক আন্দোলন করে এদের অনেকেই কারাবরণ করতে বাধ্য হয়েছে। বরিশাল জিলার এই সংখ্যালঘুদের অভাব-অভিযোেগ, তাদের আন্দোলন নিয়ে অনেক কথা লেখার আছে।
৬৮

একুশ
এই প্রসঙ্গে কমরেড কামিনী চক্রবর্তীর (কামিনী দা) কথা উল্লেখ না করে পারছি না। কী অস্বাভাবিক কষ্ট স্বীকার করে এই কমরেড বার্মিজদের মধ্যে কাজ। করেছেন তা ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না। সর্ব সময়ের কর্মী হিসাবে কামিনী দা গ্রামে গ্রামে ঘুরে কৃষক সমিতি করতেন এবং খাওয়া দাওয়ার জন্য সম্পূর্ণ তাদের উপরই নির্ভর করতেন। একবার তিনি আরও কয়েকজন কমরেডের সঙ্গে গ্রেফতার হন এবং তার কাছ থেকে পার্টির গােপন কথা আদায় করার জন্য তাকে মারতে মারতে একেবারে অজ্ঞান করে ফেলে এবং পরে মেরে ফেলার ভয়ও দেখায়। কিন্তু মৃত্যুর মুখােমুখি দাঁড়িয়েও কামিনী দার মনে পড়ল কোথায় রেইনবাে নামক একখানা বিপ্লবী বইয়ে কোন এক কমরেডের কথা পড়েছেন। বিপ্লবীরা জীবনের বিনিময়েও পার্টির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে না। কামিনী দা-ও স্থির করলেন জীবন গেলেও তিনি পুলিশের কাছে পার্টির কোন কথা ফাঁস করবেন না। কামিনী দা আজও বেঁচে আছেন এবং পশ্চিমবঙ্গে অবস্থান করছেন।
এই সময় বরিশাল জেলে যারা ছিলেন তাদের মধ্যে মনে পড়ে শ্রদ্ধেয় নয়নাঞ্জন বাবু, তুষার কান্তি চ্যাটার্জিকে। দীর্ঘ দিনের পরীক্ষিত এই সমস্ত রাজবন্দীদের চেহারায় এমন একটা সংকল্পের ছাপ ছিল যা সহজেই অন্যকে আকর্ষণ করতে পারত। এরা সন্ত্রাসবাদী যুগের বা নিজেরা সন্ত্রাসবাদী ছিলেন বলেই শারীরিক মানসিক উৎকর্ষের জন্য এরা সাধনা করতেন। আমরা যেমন গণ-আন্দোলনে বিশ্বাস করি এবং জনতার শক্তিকেই মূল শক্তি বলে মনে করি, তারা তা মনে করতেন না। তারা মনে করতেন মুষ্টিমেয় প্রাণােৎসর্গকারীর বৈপ্লবিক কার্যকলাপের ফলেই একটা দেশ থেকে বিদেশীরা অপরাসারিত হতে বাধ্য। এমনি সন্ত্রাসবাদী ছিলেন আমাদের শ্রদ্ধেয় নলিনী দাস । আন্দামান ফেরৎ চিরকুমার কমরেড নলিনী দাস মেছুয়া বাজার বােম কেসের আসামী ছিলেন। ইনি পরে মার্কসবাদ গ্রহণ করেন।
মনে আছে আমাকে গ্রেফতার করে ডি আই ও ওয়ানের কাছে নিয়ে অন্যান্য কথা-বার্তার পর সে বলল, যান, কয়েক দিনের মধ্যেই অমীয় দাসগুপ্তসহ আপনাদের অন্যান্য বন্ধুরা আপনাদের সঙ্গে দেখা করবে। কয়েক দিনের মধ্যে নয় তবে এই সময় মহারাজদা, অমীয় দাস গুপ্ত, হীরেন ভট্টাচার্য, হিরালাল দাস গুপ্ত,
৬৯
হরিপদ মজুমদার, নজু ফরাজী, জীতেন মিন্ত্রী ধৃত হয়ে জেলে আসেন। তাদের গ্রেফতার হওয়ার ঘটনাটি আমরা তাদের কাছ থেকে বিস্তৃত শুনি। ঘটনাটি এরূপঃ তখন ১৯৫০ সাল। উল্লিখিত সবাই ফেরারী। এরা বাবুগঞ্জ থানার রাকুদিয়ার কোন একটি ঘরে জমায়েত হয়েছেন। এদিকে বরিশাল শহরে দাঙ্গা শুরু হয়েছে । এরা সে খবর রাখতে পারেনি। হিন্দুদের একটা পরিত্যক্ত ঘরে তারা পার্টির বৈঠক দিয়েছে। ঘরটিকে ভিতর থেকে আটকিয়ে দেওয়া হয়েছে। একজন মুসলমান এসে ভিতর থেকে দরজা আটকা দেখে জোরে কবাটের উপর আঘাত করতে লাগল, এরপর ভিতর থেকে নলিনী দা দরজা খুলতেই “এই হিন্দুরা রায়টের মিটিং করছে” বলে চেঁচাতে লাগল। বলা বাহুল্য, ঐ পরিত্যক্ত ঘরটি উক্ত মুসলমানটি কিনেছিল এবং সে সেটা ভেঙে নেওয়ার জন্য ওখানে আসছিল। তার চিৎকার শুনে চতুর্দিক থেকে কয়েক শত মুসলমান তাদের ঘিরে ফেলল । ঠিক এই সময় বা এর কিছু আগে-পরে হবে কলস গ্রাম থেকে বরিশাল জিলার অন্যতম বিপ্লবী কমরেড অমৃত নাগ বরিশাল শহরে যাওয়ার পথে দাঙ্গাকারী কর্তৃক নিহত হন। বিপ্লবী আদর্শ যাদের জীবনকে খাঁটি সােনার মত করেছে অমৃত নাগ ছিলেন তাঁদেরই একজন। অত্যন্ত সংগ্রামী পুরুষ অমৃত দা’র কথা মনে করে আজও শােকে মুহ্যমান হতে হয়। বরিশাল শহরের কমিউনেই (পার্টির অফিস) তিনি থাকতেন। মফস্বল থেকে কমিউনে আসতেই অমৃত দা প্রথম আমাদের খাওয়া হয়েছে কিনা, সঙ্গে পয়সা। আছে কিনা জিজ্ঞেস করতেন। সঙ্গে সঙ্গে কাজের খতিয়ানও নিতেন। একদিনের একটা ঘটনা মনে পড়ছে, তাতেই বুঝেছি কি অদম্য সাহস, কর্ম-শক্তি ও বিপ্লবী চিন্তাধারার অধিকারী ছিলেন অমৃত দা। একদিন বরিশাল হেড পােস্ট অফিসের কোন একজন সাধারণ পিয়নের উপর উপরস্থ কর্তৃপক্ষের বা পুলিশের অপমানজনক আচরণের প্রতিবাদে গর্জে উঠলেন অমৃত দা। আমার পরিষ্কার মনে আছে হেড পােস্ট অফিসের সামনে হাজার হাজার লােক জমায়েত হয়েছে। বেশ কিছু পুলিশও জড়াে হয়েছে সেখানে। সেই অগণিত জনতা ও উত্তেজিত পুলিশের। মধ্যে শুভ্র খদ্দর পরিহিত, নাতিদীর্ঘ, বলিষ্ঠদেহী অমৃত দা জনতাকে উদ্দেশ্য করে বক্তৃতা দিচ্ছেন। তার চোখ থেকে যেন আগুনের ফুলকি ছুটছে। মাথার চুলগুলি যেন কালনাগিনীর মত ফুঁসে উঠছে। সেদিনকার সেই ঘটনা শুধু একটা জিনিসই প্রমাণ করে যে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে জনতাকে সংঘবদ্ধ করার জন্য চাই শুধু বিপ্লবী মনােবল। আজও যেন মানসচক্ষে দেখতে পাচ্ছি একটি শুভ্র শ্বেতপদ্ম ঘিরে অসংখ্য জনতা-আত্মাহুতি দেবার জন্য নৃত্য করছে।
৭০

বাইশ
বলা বাহুল্য, বিভাগ-পরবর্তী কালে তদানীন্তন মুসলিম লীগ সরকার কমিউনিস্টদের সম্পর্কে বিরূপ ধারণা সৃষ্টি করাতে সক্ষম হয়েছিল। তখনকার হিন্দু প্রধান কমিউনিস্টদের দাঙ্গাকারী বলে প্রচার করলে সাধারণ ধর্মভীরু মুসলমান জনসাধারণের বিভ্রান্ত হওয়া একেবারে অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। তখনকার পার্টিরও সীমাবদ্ধতা ছিল যথেষ্ট। হিন্দুপ্রধান বলেই তা নাচোলের মত হিন্দুঘেঁষা সাঁওতাল, ময়মনসিংহের হাজং, সিলেটের তফসীলি আধা-তফসিলী হিন্দু এবং প্রত্যেক জেলার হিন্দু মধ্যবিত্ত এবং সহজে আকৃষ্ট হওয়া সাপেক্ষে নমশুদ্ররা। কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে কৃষক সমিতি বা অনুরূপ গণসংগঠনে জমায়েত হয়েছিল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তৎকালীন কমিউনিস্টদের চরম ভুল পদক্ষেপ, নেহরু বা ভারত সম্বন্ধে দুর্বলতা সাধারণ মুসলমান বুদ্ধিজীবীদের মনেও কমিউনিস্ট সম্বন্ধে দারুণ সন্দেহের সৃষ্টি করেছিল। অবশ্য এই কমিউনিস্টদের নেতৃত্বেই ‘৪৬ সনের হিন্দু-মুসলিম কৃষকদের তে-ভাগার সংগ্রাম ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে, কিন্তু সে জন্য ‘৪৮-এর পরিবর্তিত অবস্থায় আমাদের। সম্বন্ধে উপরােক্ত মন্তব্যের যথার্থতা কিছুমাত্র অস্বীকার করা যাবে কি?
না, আরও খতিয়ে দেখার দরকার আছে। যে সংগ্রাম সত্যিকারের একটা গণসংগ্রামে পরিণত হয়েছিল কেন তা কৃষকের রাষ্ট্র দখলের সংগ্রামে পরিণত হয়নি? অবশ্য সে প্রশ্ন আরও গুরুতর রাজনৈতিক প্রশ্ন- সংগ্রামের সেদিকের ব্যর্থতার কথা বাদই দিলাম। নেহায়েত অর্থনৈতিক দাবি তে-ভাগার সংগ্রামও কি মূলত হিন্দু কৃষক এলাকায় সীমাবদ্ধ ছিল না? তা যদি না হতাে তাহলে তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার সরকারের পক্ষেও তা অমনভাবে স্তব্ধ করে দেওা সম্ভব হতাে না। তবে যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম সে সম্পর্কে বলা যায় যেখানে কমিউনিস্টদের ভাল কৃষক সংগঠন ছিল স্থানীয় ও আংশিক সংগ্রাম সেখানে তাদেরকে দাঙ্গাকারী বলে চিহ্নত করা যেত না। কিন্তু পাতারহাটের মত জায়গায় বা সাধারণভাবে অরাজনৈতিক, মুসলিম এবং মুসলিম লীগ প্রভাবিত এলাকায় এটা সম্ভব ছিল।
এখন আগের ঘটনায় ফিরে আসা যাক। ও. সি সাহেব আমার পরিচয় পেয়ে ছাত্র ও অন্যান্যদের ধমক দিয়ে সরিয়ে দিলেন এবং পরে স্থানীয় পরিস্থিতি খুব
৭১
খারাপ বলে আমাকে পরদিন সূর্য ওঠার পূর্বেই পাতারহাট ত্যাগ করার নির্দেশ দিলেন। আমি থানায়ই রয়ে গেলাম এবং পরদিন সূর্য ওঠার অনেক পূর্বে পাতারহাট ত্যাগ করলাম। আজ পাতারহাটের কথা স্মরণ করলে মন শিউরে ওঠে। বর্বর পাক-বাহিনীর হামলায় আজ বরিশালের তৃতীয় বৃহত্তম বন্দর পাতারহাট শ্মশানে পরিণত হয়েছে। একদিন আমরা বুঝেছিলাম যে, তৎকালীন কংগ্রেস-মুসলিম লীগ পার্টিদ্বয় ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ইঙ্গিতে এদেশে হিন্দুমুসলিম দাঙ্গা সৃষ্টি করে এদেশের সত্যিকারের মুক্তি ও স্বাধীনতাকে নস্যাৎ করে দুটি পৃথক দালাল রাষ্ট্র সৃষ্টি করবে এবং একটি সরাসরি আমেরিকা আর একটি পুরনাে মনিব ব্রিটিশের পক্ষপুটে আশ্রয় নেবে। তাই আমরা জীবন দিয়ে এই হীন চক্রান্তে উভূত ঘৃণ্য দাঙ্গা বা দাঙ্গার সম্ভাবনা রােধ করার জন্য এগিয়ে গিয়েছিলাম। তখনই উগ্র মুসলিম জাতীয়তাবাদের মােহে আচ্ছন্ন বুদ্ধিজীবী ছাত্ররা। আমাদের দাঙ্গাকারী কমিউনিস্ট আখ্যা দিয়ে পাতারহাট থেকে বের করে দিল। আর আজ পঁচিশ বছর পরে সাম্প্রদায়িকতার অগ্নিকণা পাকিস্তানে দাবানলে পরিণত হয়ে সেই পাতারহাটসহ সারা বাংলাদেশকে ভষ্মে পরিণত করে দিল। ইতিহাসের কী নির্মম শিক্ষা! ভাগ্যের কি পরিহাস!
যাহােক, থানায় পূর্ব রাত্রে অভুক্ত থাকায় অত্যন্ত ক্লান্তি বােধ করছিলাম এবং পাতারহাট স্টীমার স্টেশনের কিছুদূর পশ্চিমে এক চরে গিয়ে এক বাড়িতে কিছু খাবার চাইলাম। চর হলেও যতদূর মনে পড়ে নদীর পানি বাড়ির দরজা দিয়ে প্রায় ঘরের কাছে গিয়ে মৃদু বাতাসে থৈ থৈ করছে। সামান্য কয়েকটি গাছে ঘেরা অত্যন্ত গরীব একটি পরিবারের বাড়ি মনে হলাে। ছােট্ট একটি বাচ্চাসহ একটি মহিলা বাড়ীতে আছে । সে একা বলেই কথা বলতে ইতস্তত করছে। কিন্তু আমাকে দেখে যে তার অনুকম্পা হয়েছে এটা পরিষ্কার বুঝতে পারছি। এর কারণও আছে। সাধারণত বড় বড় নদীপার্শ্বস্থ বাড়িওয়ালাদের বিশেষ করে চরের লােকদের নদীতে বিপদগ্রস্ত বহু লােককেই আশ্রয় দিতে হয়। সর্বনাশা মেঘনা থেকে উঠে আসা বরিশালের দিকে ধাবমান নদীগুলি যেমন খরস্রোতা তেমনি কুলভাঙা। তাই এর দুই পাড়ে এবং চরে চরে অবস্থিত অধিবাসীদের মন অত্যন্ত অতিথিপরায়ণ, দরদী এবং সাহায্যপ্রবণ।
মহিলা বলল যে, খােকার বাবা ছােট জাল নিয়ে নদীতে মাছ ধরতে গেছে এবং সঙ্গে তার একটি ছেলেও গেছে । আসতে দেরী হবে। আমি তারপরও যাচ্ছি না। দেখে সে আমাকে ঘরেই ডেকে নিল এবং একটি মাদুর পেতে ভাত খেতে দিল । ছােট ঘর-প্রায় ভিজা মেঝে। আমি খেতে বসলাম। ভােরের আলাে বেড়ার ফাঁক দিয়ে এসে মাদুরের ওপর খেলা করছিল। বাইরে নদীর মৃদু কলকল ধ্বনি, ঘরে প্রভাতের নির্মল হাওয়া এবং তার চেয়েও নির্মল এক পল্লীবধূর হাতের সলজ্ব।
৭২
পরিবেশনা। অত্যন্ত ক্ষুধা নিয়ে সেদিনের খাওয়া আমার কাছে এক অনাবিল আনন্দ নিয়ে উপস্থিত হলাে। আমাকে সে ভাতের সঙ্গে চিংড়ি মাছের বড়ার ঝােল খেতে দিল । বেশ কয়েকটা বড়ার সাথে ঝােল দিয়ে অনেকটা ভাত খেয়ে নিলাম। বুঝলাম দরিদ্র স্বামী তার ছেলেকে নিয়ে নদীতে বহু পরিশ্রম করে মাছ ধরে বাড়িতে ফিরে যে ভাত খাবে-তাই আমাকে সে খাইয়ে দিল। আজও স্পষ্ট মনে পড়ছে বধূটির মহিমান্বিত মুখখানা। যতক্ষণ খেলাম সে কাছেই বসেছিল। বললাম, জানেন এখন আমাকে তিন-চার মাইল হেঁটে ভাসান চর যেতে হবে। সেখান থেকে স্টীমারে বরিশাল।
৭৩

তেইশ
ঐদিন ঈদ ছিল। বধূটি বলল-“আমরা ঈদের জন্য কিছুই করতে পারিনি। খােকার বাপ আসলে বিকেলে হাট থেকে কিছু কিনে আনলে তারা ঈদ করবে। বললাম-ভাবি, এর চেয়ে আমার কাছে বড় ঈদ হতে পারে না। এই কথা বলে সেখান থেকে বেরিয়ে এলাম। মন যেন আমার নাড়া দিয়ে উঠল। গরীবের ঘরের ঐ কয়টা ভাত আমি খেয়ে নিলাম। কেবল ভাবলাম, আমাকে বাঁচতেই হবে-এই ভেবে কিঞ্চিৎ সান্তনা পেলাম। শ্যামলা রঙের বড় খােপওয়ালা মাঝারি গড়নের চরের সেই বধূটি যেন মনুষ্যত্বের সমস্ত গুণ নিয়ে সেদিন দেখা দিয়েছিল আমার সামনে। চন্ডীদাস ঠিকই বলেছিল-সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই। ঘুরেছি সেই মানুষের মধ্যে। অর্থ লালসায়, সামাজিক জিঘাংসায়, রিপুর তাড়নায়, পৈশাচিক উন্মাদনায় পরের শ্রম আত্মসাৎ করে এক নারকীয় পদ্ধতিতে যে মানুষ দানবে পরিণত হয়নি, ঘুরেছি সেই সর্বহারা মানুষের মধ্যে। উৎপাদনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ জড়িত, শ্রমের মহিমায় উজ্জ্বল সেই নারী-পুরুষ, কিশাের-যুবক-যুবতীদের মধ্যে। দেখেছি ক্ষুধার হাত থেকে কোন মতে বেঁচে থাকার জন্য মানুষের অন্যতম সম্পদ ইজ্জত বাঁচানাের জন্য, প্রাণের চেয়েও প্রিয় সন্তান-সন্ততিদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য, প্রকৃতির হাত থেকে বাঁচার জন্য, একখানা ঘরের জন্য, এদের কী আকুলআকাঙ্খ! বাঁচার পথ না পেয়ে দেখেছি তাদের অসহায় আর্তনাদ। আবার যখন পথ পেয়েছে তখন দেখেছি এই সর্বহারা মানবের সে কি দুর্বার অভিযান, কী প্রচন্ড রূপ। কী প্রলয়ঙ্করী শক্তি। ভাবি জীবনের এই চল্লিশটি বছর চারণের মত যাদের মধ্যে ঘুরলাম তাদের বিশ্বাসই আমার বিশ্বাস, তাদের সুখই আমার সুখ, তাদের আশাই আমার আশা, তাদের ভাষাই আমার ভাষা-সেই কোটি মানুষের আয়ুই আমার আয়ু।
যাক ওখানে আর দেরী না করে নদী পার হয়ে ভাসান চর স্টীমার স্টেশনের দিকে দ্রুত এগােতে লাগলাম । চিন্তা ছিল ১১টায় স্টীমার ধরতে না পারলে ঐ দিনই বরিশাল খবর পৌঁছানাে সম্ভব হবে না। বেলা তখন প্রায় দশটা। রাস্তার পাশেই লােকে ছােট একটি ময়দানে ঈদের নামাজ পড়ছে। আমি পাশ কাটিয়ে। এগিয়ে গেলাম। কিছু দূর এগােতেই শুনি পিছনে কিসের শব্দ। তাকিয়ে দেখি একদল যুবক আমার দিকে ছুটে আসছে। তারা আমাকে এই মশায় দাঁড়ান’ বলে, ইশারা করল। আমি প্রমাদ গণলাম। ইতিমধ্যেই তারা আমাকে ঘিরে ধরেছে ।
৭৪
আমার পরণে ছিল ধূতি, গায় পাঞ্জাবী, তারা বলল যে, আমি হিন্দু এবং দাঙ্গা করার জন্য শিখ নিয়ে আসতে যাচ্ছি। আমাকে তারা মারতেই উদ্যত হলাে। আমি বললাম যে, আমি মুসলমান ‘অত্যন্ত জরুরী ব্যাপারে স্টীমার ধরতে হবে বলে নামাজের জন্য অপেক্ষা করা সম্ভব হয়নি। চল তােমাদের ওখানের লােক নিশ্চয় আমাকে চিনবে। অগত্যা তারা আমাকে ময়দানে নিয়ে গেল। মনে আছে ঐ সময় দাঙ্গা প্রসঙ্গে শিখদের কথা শুনতাম। এটা মুসলিম জনসাধারণের মধ্যে। ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছিল। খুব সম্ভব ইতিপূর্বের কলকাতার দাঙ্গায় লােকে শিখদের কথা শুনেছে এবং এরা যে অত্যন্ত দুর্ধর্ষ সে ধারণাই সাধারণ লােকে করে থাকে।
যা হােক তারা আমাকে ঘিরেই নামাজে দাঁড়াল। আমিও দাঁড়ালাম । কিন্তু ওরা যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না যে, আমি মুসলমান। ওদের ধারণা, ঠেকলে অনেকেই নামাজ পড়ে, জীবনের তাগিদে আবার প্রয়ােজনে মানুষ অনেক কিছুই করে। এবারের পাক-বাহিনীর হামলার সময় প্রথম দিকে বহু হিন্দু মুসলমানের নামাজ রােজা সব কিছুই শিখে নিয়েছিল। জানাজার নামাজে সেজদা নাই এটাও তারা শিখে নিয়েছে। একজন হিন্দুর কাছে শুনেছিলাম এক পাক মিলিটারি তাকে ধরেছে এবং নামাজ পড়তে বললে সে বলল, “স্যার, আমার কাপড় নাপাক এ অবস্থায় নামাজ পড়ব কেমন করে। এতে মিলিটারি নাকি তাকে আরও প্রশংসা করে ছেড়ে দিয়েছে।
ইতিমধ্যে নামাজ শেষ হয়ে গেলে ওরা হৈ-চৈ করে উঠল। আমি তখনই খুব জোরের সাথে আমার পরিচয় দিলাম। আমি যেই বললাম আমি শর্ষিণা বুড়া পীর সাহেবের অন্যতম খলিফা মাওলানা হাফিজউদ্দীন ফিরােজী সাহেবের ভাই, বরিশাল জিলা কৃষক সমিতির সহ-সভাপতি বলহারের শহীদ মিঞা। সঙ্গে সঙ্গে বেশ কয়েকজন আমার পরিচিত হয়ে গেল। তারা তখন যেন অতিমাত্রায় লজ্জিত হলাে। উক্ত ছেলেগুলিও তাদের ব্যবহারের জন্য আমার কাছে ক্ষমা চাইল । আমি তখন মুসল্লিদের সামনে সাম্প্রদায়িকতার কুফল এবং এ যে ইসলাম বা পাকিস্তান কোন কিছুরই সহায়ক নয় এবং বিশেষ করে এ যে দরিদ্র কৃষক-মজুরের আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য ধনীদের ষড়যন্ত্র তা বিশদভাবে বললাম। এরপর অনেকেই আমাকে ঈদ করতে তাদের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করতে লাগল । কিন্তু আমি কোথাও না গিয়ে সরাসরি ভাসান চর স্টেশনে চলে গেলাম এবং যতদূর মনে পড়ে সেখান থেকে হেঁটে শায়েস্তাবাদের। মধ্যে দিয়ে রাত্রে বরিশাল শহরে পৌছি। তবে একথা উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে, ঐ দিন ভাসান চর থেকে নির্বিঘ্নে আসতে পেরেছি। তার কারণ এই নয় যে,
৭৫
তাদের আমি সাম্প্রদায়িকতার কুফল বুঝাতে পেরেছি। বরং আমি যে শর্ষিণার বুড়া পীরের খলিফা অন্যতম বাগ্মী মাওলানা ফিরােজী সাহেবের ভাই সেটাই ছিল তখন আমার বড় রক্ষাকবচ। বলা বাহুল্য, সাম্প্রদায়িকতার এই সহজাত রূপটি আজও আমরা তথাকথিত বামপন্থীদের বুঝাতে পারিনি। আজ যে ভারতের বিরুদ্ধে লােকের কিছুটা বিক্ষোভ দেখা দিয়েছে, তার কারণ এ নয় যে, ভারতের একচেটিয়া পুঁজিপতিরা আমাদের শােষণ করতে চাইছে-তাদের বিক্ষোভ বাংলাদেশে হিন্দুরা আবার মুসলমানের উপর প্রাধান্য বিস্তার করতে চাইছে। অসংখ্য পেটি বুর্জোয়া মুসলিম এবং সাধারণভাবে গ্রামের জনসাধারণের মনােভাবই আমি ব্যক্ত করলাম। আমরা সাম্প্রদায়িকতাকে একটা পােশকী এবং বাইরের ব্যাধি বলে মনে করি, কাজেই কয়েকটা তত্ত্বগত স্লোগানে এ ব্যাধি দূর করা যায় বলে মনে করি না। অথচ একে যে একটা স্মরণাতীতকালের ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করতে হবে তা খেয়াল রাখি না।
বলে রাখা প্রয়ােজন যে, সঠিক অর্থে সাম্প্রদায়িকতা শুধু হিন্দু-মুসলমানের বিরােধ নয় বরং সম্প্রদায়ে-সম্প্রদায়ে বিরােধ-যেমন নমশূদ্রের সঙ্গে বর্ণহিন্দুর বিরােধ, বিহারীদের সঙ্গে বাঙালীদের বিরােধ, এমন কি এক জেলার লােকের সঙ্গে আর এক জেলার লােকের বিরােধও সাম্প্রদায়িকতার আত্মঘাতী রূপের বিভিন্ন দিক। অথচ আমরা এই বিরাট বিষবৃক্ষের দিগন্ত-প্রসারিত অথচ অনেক সময় অদৃশ্য শিকড়গুলির সন্ধান রাখি না। ফলে প্রকৃত অর্থে সাম্প্রদায়িকতাও দূর করতে পারি না। এ কথা সত্য যে, পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা যতক্ষণ থাকবে সাম্প্রদায়িকতা ততদিন থাকবে। আবার এ-ও সত্য যে, এই পুঁজিবাদী সমাজকে উচ্ছেদ করতে হলে সাম্প্রদায়িকতামুক্ত ব্যাপক জনগণের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামেরও প্রয়ােজন হবে। যতদিন গণ-ঐক্য প্রতিষ্ঠা না হবে ততদিন পুঁজিবাদ থাকবে আবার যতদিন সাম্প্রদায়িকতা থাকবে ততদিন গণ-ঐক্য সম্ভব নয়।
৭৬

চব্বিশ
এবার জেলের কথায় আসি। পঞ্চাশ সনের রায়টের দিন বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জের বাকুদিয়া গ্রাম থেকে যারা ধৃত হয়ে জেলে এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন শ্রদ্ধেয় নলিনী দাস, হীরেন ভট্টাচার্য, হীরালাল দাশগুপ্ত, হরিপদ মজুমদার, জিতেন মিস্ত্রী, নজু ফরাজী। এই গ্রেফতার সম্বন্ধে পরে জেলখানায় নলিনীদা আমাদের কমিক অভিনয় দেখাতেন। তিনি সেখানকার চৌকিদার সাজতেন এবং আমাদের গােল করে বসাতেন। তারপর ধৃত ব্যক্তিদের এক একটা নাম ঠিক করে দিতেন। অতঃপর একখানা কাষ্ঠখন্ড হাতে নিয়ে তখনকার চৌকিদারের বীভৎস অভিনয় করতেন। যারা নলিনী দা’কে দেখেছেন, তাঁরা বুঝবেন কালাে, মাথার চুল পাকা, এককালের সারা ভারতের অগ্নিপুরুষকে কত সাধারণ মনে হয়। দেখতে ঠিক যেন কোন একজন গাট্টা গােট্টা নৌকার মাঝি, না হয় চৌকিদার-টৌকিদার হবে।
তিনি কল্পিত হীরেন ভট্টাচার্যকে উদ্দেশ্য করে-হারে ভট্টাচার্য্যের পাে তােমার লাঙ্গল যার জমি তার চিৎকারে আমরা সারারাত ঘুমুতে পারিনি- এইভাবে লাঙ্গল যার’-বলে তাকে একবার পিটান-জমি তার’ বলে আর একবার পিটান। এইভাবে তালে তালে তাকে কয়েকবার পিটিয়ে বললেন যে, আসলে তুমি হিন্দু। কৃষক সমিতি-টমিতি ওসব শয়তানি। আমরা প্রথম তার আর্ট প্রায় ধরতে পারিনি। তিনি একবার বলেন এবার লাঙ্গল দিয়ে তােমার টাক চষে দিব। পরক্ষণেই তার নজর পড়ল হরিপদ মজুমদারের উপর । আরে শালা, তােমার বাড়ী না ভারূ কাঠি-‘তুমি গােপনে ইন্ডিয়ায় যাও’ বলে একবার পিটান এবং ‘গােপনে আও’ বলে আর এক পিটান। এখন তােমাকে ভালাে মতই ইন্ডিয়ায় যাওয়ামু’ বলে একবার পিটান-‘আর আওয়ামু’ বলে আর এক পিটান। এভাবে তাকে কয়েকবার পিটিয়েই তার চোখ পড়ল কমরেড হীরালাল দাশ গুপ্তের উপর । আরে শালার বেটা, শালা। তুমি না উকিল । তুমি মামলাও কর’ বলে পিঠের উপর এক ঘা, ‘আবার রায়টও। করাে’ বলে আর এক ঘা। তুমি না সতীন সেনের ভাইগনা। এবার তােমারে পাইছি’ বলে এক পিটান, আর তােমার মামারেও পাইব’ বলে আর এক পিটান । এইরূপ অবিশ্রান্ত ভাবে মারতে মারতে উত্তেজিত চৌকিদারের দৃষ্টি পড়ল জীতেন মিস্ত্রীর উপর। “ আরে শালা” বলে নলিনী দা তার চোখ দুটি আরও লাল করে
৭৭
বলল তুমি না নােমমা- তােমরা আর আমরা পাকিস্তান আনছি। এবার মিশছ ওদের দলে । শালা নেমকহারাম’, সে কি গর্জন নলিনীদার-তার হাত কাঁপতে লাগল, রাগে মুখ থেকে লালা বেরিয়ে যেতে লাগল। পরনের লুঙ্গী প্রায় কোমর পর্যন্ত উঠে আসতে চায়-যেন হুঁশ নাই তাঁর। শালা আমাগাে লগে মিশ্যা পাকিস্তান আনছ” বলে এক পিটান, আর এবার ওদের সঙ্গে মিশে রায়ট করছ’ বলে আর এক পিটান। এমনিভাবে নলিনী দা চলা হাতে লাফিয়ে লাফিয়ে মারতে লাগলেন আর পিটাতে লাগলেন জিতেন মিস্ত্রীকে। নলিনীদার এ অভিনয় এত বাস্তব হয়েছিল যে, আমরা কিছুক্ষণের জন্য যেন ভুলে গিয়েছিলাম যে, আমরা জেলে কমিক অভিনয় দেখছি। এর পরে তিনি একটু বিশ্রাম নিলেন-হঠাৎ নলিনী দা লাফিয়ে উঠলেন এবং কল্পিত নলিনীদার কাছ থেকে কল্পিত রিভলভারটি টেনে নিলেন এবং সেটা ক্ষুব্ধ জনতার সামনে তুলে ধরলেন। তারপর নিজের হাতের কাষ্ঠখণ্ড দিয়ে তাঁকে বেদম প্রহারের সঙ্গে সঙ্গে বলতে লাগলেন “তুমিই নাকি এদের পাণ্ডা-তােমার এটা যেখানে দিয়ে ডুহামু” বলে এক পিটান “আবার দেহান দিয়ে বাইর হরমু” বলে আর এক পিটান। নলিনী দা জেলে দীর্ঘ সময় ধরে এই অভিনয় দেখাতেন। ঐ সময় নাকি উত্তেজিত জনতা তাদের হত্যা করতে চাইলে কমরেড হীরেন ভট্টাচার্যের উপস্থিত বুদ্ধিতে তারা বেঁচে ছিল, তিনি নাকি বলেছিলেন-“ তােমরা আমাদের জীবিত নিয়ে যেতে পারলে সরকারের কাছ থেকে অনেক পুরস্কার পাবে।” তখনকার বীভৎস বাস্তবের অভিনয়ও ছিল বীভৎস। নলিনীদা’র চোখে ফুটে উঠল রক্তলােলুপ চৌকিদারের হিংস্র দৃষ্টি। সেই দাঙ্গা আমাদের এই শিক্ষা দিল যে, আমরা বিশাল কৃষক সমাজের মধ্যে আমাদের শ্রেণী সংগ্রামের রাজনীতি কতটুকু দিতে পেরেছি। লাঙ্গল যার জমি তার এ ধরনের কিছু অর্থনৈতিক স্লোগানে যে সাম্প্রদায়িকতা দূর করা সম্ভব নয় বা চরম মুহূর্তে কৃষকদের স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গী অটুট রাখা সম্ভব নয় তা বুঝিনি-তা না হলে ‘লাঙ্গল যার জমি তার স্লোগানের উল্লেখ করে তারা একজন একনিষ্ঠ কৃষক নেতাকে পিটোবে কেন? জাতি, ধর্ম, সম্প্রদায় নির্বিশেষে শােষক ও শােষিতদের ভূমিকা সম্বন্ধে কৃষকদের মধ্যে শ্রেণীসংগ্রামের রাজনীতি না দিতে পারলে তারা যে চরম সাম্প্রদায়িকতার শিকারে পরিণত হবে এবং প্রতিক্রিয়াশীল স্বার্থ সংরক্ষণ করবে পৃথিবীতে এর বহু নজীর রয়েছে।
যা হােক, বরিশাল জেলে আমরা আমাদের রাজনৈতিক মর্যাদার লড়াই শুরু করবাে বলে চিন্তা করছিলাম । জেলের কম্বল গায় দিয়ে আর লাপসি খেয়ে চুপ করে থাকা ঠিক হবে না। কাজেই আর বিলম্ব না করেই এর জন্য যা কিছু একটা করা দরকার বলে সিদ্ধান্ত নেব-এই সময়ই ঢাকা সেন্ট্রাল জেল থেকে খবর আসল আমাদের কিছু কিছু দাবি সরকার মেনে নিয়েছে এবং সেখানে কমরেডরা অনশন
৭৮
ধর্মঘট প্রত্যাহার করেছে। বরিশাল জেল কর্তৃপক্ষও আমাদের জন্য মঞ্জুরীকৃত হওয়া জাজিম, খাট ও অন্যান্য জিনিস পাঠিয়ে দিল। বলা বাহুল্য তখন কেবল তাদের আংশিক দাবি দাওয়া মেনে নেওয়া হয়েছিল।
বরিশাল জেলে থাকাকালীন আমরা স্টেটসম্যানসহ অন্যান্য দুই একটি খবরের কাগজ পেতাম। আমাদের কাছে তখন বেশী বই পুস্তকও ছিল না। এদিক দিয়ে আমরা খুবই অসুবিধায় ছিলাম। বাইরে থেকেও আমাদের তেমন কোন বই জমা দিত না। কাজেই দুই একটি খবরের কাগজই ছিল আমাদের ভরসা। এ সময় পড়াশুনার চেয়ে খেলার চর্চাই হতাে বেশী এবং তা শুধু তাস। দাবার কোটও ছিল একটি। তাস আমি নিজে জানতাম না। দীর্ঘ সময় বসে তাস খেলে আনন্দ পেতে দেখে আমার কেমন হাসি পেত । অবশ্য এক সময় দাবা শিখতে চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু শিখতে পারিনি। যারা আমাকে শিক্ষা দিবার দায়িত্ব নিয়েছিলেন আসলে খেলাটা তারাই খেলতেন। এমন বিশ্রী নেশার জিনিস এ সব।
বরিশাল জেলে আমাদের ওয়ার্ডের সামনেই ছিল মেয়েদের ওয়ার্ড। জেলখানায় সাধারণ ছুতানাতার অজুহাতে বিভিন্ন রকম অত্যাচারের দিকে লক্ষ্য রেখে আমরা আমাদের মেয়ে কমরেডদের জন্য খুবই উদ্বিগ্ন থাকতাম। তারা কখন কোর্টে যায়, কখন ফিরে আসে, কখন তাদের খাবার আসে, কখন ইন্টারভিউ আসে-অফিসে ডেকে নেয় এই সমস্ত বিষয়ের খোঁজ-খবর নিতাম। তবে একটা ভরসা ছিল অন্যান্য মেয়ে বন্দীদের মধ্যে অভিজ্ঞ ও পুরানাে আমাদের মনােরমা মাসিমা ছিলেন। মেয়েদের মধ্যে অন্য যারা ছিল তাদের একজন হলাে পুতুল দাস গুপ্তা, ছাত্র নেতা প্রশান্ত দাস গুপ্তের বােন। মেয়েদের ওয়ার্ডটি আমাদের নিকটে ছিল বলেই তাদের যে-কোন ব্যাপারে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারত। অনেক সময় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মেট্রন এবং সিপাহীদের সঙ্গে জোরে জোরে কথা। কাটাকাটি হলে আমরা উদ্বিগ্ন হয়ে শুনতাম ও আসল ঘটনাটি জানতে চেষ্টা করতাম। অনেক সময়ই দেখতাম আমাদের বঙ্কিম চাটার্জিকে ওয়ার্ডের দক্ষিণ ও পূর্ব কোণের জানালায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গুণগুন করতে। বিপ্লবের অগ্নিস্ফুলিঙ্গের পশ্চাতে যে একটি প্রেমের ফল্গুধারা প্রবাহিত ছিল তা ধরতে পারিনি। পরবর্তীকালে পুতুল দাশ গুপ্তের সঙ্গে বঙ্কিমের বিবাহে তা পরিণতি লাভ করে। পূর্বেই বলেছি। পুতুলও তখন জেলে ছিল।
৭৯

পঁচিশ
বরিশাল জেলে আমার স্বল্পকাল থাকা হলেও মােটামুটি আনন্দের মধ্য দিয়ে দিনগুলি কেটে যায়। কারণ যাদের সঙ্গে বাইরে কাজ করেছি-তারা প্রায় সবাই জেলে আসছিলেন। ইহা আনন্দের কারণ নয় কিন্তু সবাইকে নিয়ে দিন ভালই কাটছিল। আমার সেই-ই ছিল প্রথম জেল-জীবন। আমার পক্ষে বানারীপাড়ার কুমুদ গুহ ঠাকুরতার (কুমুদা) মত অভিজ্ঞ, মহারাজদা’র (অমিয় দাশ গুপ্ত) মত তত্ত্বজ্ঞ এবং তুষারদা’র মত পুরােনাে সন্ত্রাসবাদী, নয়নাঞ্জন বাবুর মত আত্মস্থ, অন্যদিকে বংকিম চ্যাটার্জীর মত আমােদপ্রিয়, প্রশান্ত, উৎপলের মত বিপ্লবগত। প্রাণ, বিনয় গুহের মত আনন্দ ও বিষাদের এক আশ্চর্য প্রতিমূর্তি গভীর প্রেরণার বস্তু ছিল। তখন এ ছাড়াও ছিল ছােট ছােট বাচ্চারা তারা একদিকে ছিল গভীর উদ্বেগের কারণ। উদ্বেগ এ জন্য যে, এ রকম একটা পরিবেশে এদের যে-কোন মুহূর্তে অসুখ-বিসুখ হতে পারত, মানসিক বিকার ঘটতে পারত। আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তার দরুন এদের মনে এমন প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হতে পারত যা ভবিষ্যৎ জীবনের পক্ষে ক্ষতিকর। এদের মধ্যে পার্টি-পরিবার ছাড়াও ছিল ঢাকাস্থ হজরতপুরের দুদু মিয়া। তা ছাড়া ছিল বিনয়, পঙ্কজ, গােপাল, বিনােদ ও আরও দুই একটি ছেলে । এরা যেমন ছিল উদ্বেগের কারণ তেমনি ছিল মনের আনন্দের খােরাক। এদের দেখে আমাদের মনে এক অপরূপ বাৎসল্যরসের সৃষ্টি হতাে। এরা রাজনৈতিক তত্ত্বের কচকচানি জানে না, এদের ব্যক্তিগত জীবন সবরকম কমপ্লেক্স বা জটিলতামুক্ত। এরা আত্মম্ভরী নয় । এই কঠোর পরিবেশে এদের একটু আনন্দ দিয়ে রাখতে পারলে নিজেদের চরিতার্থ মনে করতাম।
আবার এদের মত সম্পূর্ণ নির্দোষ ছেলেদের জেলে আটক করে রাখায় শাসক। শ্রেণীর নির্মমতা সব সময়ই চোখের সামনে প্রকট হয়ে থাকত। তার ফলে আমাদের সংগ্রামের ইচ্ছাও সদাজাগরূক থাকত। মনে পড়ে আধা সর্বহারা বিনয় গুহের কথা। মনে পড়ে সরলপ্রাণ কৃষকের ঘরের গােপাল বিনােদের কথা। মনে। পড়ে চাদসীর ধনী ডাঃ নলিনী দাসের আদুরে ছেলে পঙ্কজের কথা। কলসকাঠির জমিদার নন্দন মিহিরের কথা। জেল-জীবনে যদি এদের একটুও আনন্দ দিতে পারি, তা সারা জীবনের সম্পদ হয়ে থাকবে। তাছাড়া কিছু বন্দী ছিলেন, তাঁরা সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক, তাঁদের একমাত্র অপরাধ ছিল তারা সংখ্যালঘু । এঁদের মধ্যে
৮০
ছিলেন কলসকাঠির জমিদার রাজ্যেশ্বর বাবু, ভান্ডারিয়া হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক হেমন্ত বাবু, চাঁদসী হাইস্কুলের হেডমাস্টার (নাম মনে নেই)। এঁরা বয়সে প্রবীণ হলেও জেলে এসে যথেষ্ট অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিলেন। আমার কথা হলাে, শুধু নিজেদের পার্টির দাদারাই নয়-ছােট বড় রাজনৈতিক অরাজনৈতিক মিলিয়ে জেলে আমাদের ওয়ার্ডটি ছিল একটি বৈচিত্র্যপূর্ণ পরিবারের মত। এতে একদিকে ছিল দাদাদের গায়ে পড়ে উপদেশ শােনানাের বিরক্তি এবং কিছুটা তত্ত্ব ও তথ্য শােনার সুযােগ। অন্যদিকে ছােটদের কাছ থেকে উপদেশ শােনার অজ্ঞতাপ্রসুত তৃপ্তি । কারণ দাদা হওয়ার উপযুক্ততা ছিল না-পার্টির বাইরের অন্যান্য শিক্ষক ও নিরীহ লােকদের সঙ্গে মামুলী ঘরকন্নার আলাপের আনন্দ।
সরকার তার প্রথম আক্রমণে দেশের বহু মানুষকে যে জেলে টেনে নিয়ে এসেছিল তা আটচল্লিশের বরিশাল জেল না দেখলে বােঝা যাবে না। অথচ ভাগ্যের। পরিহাস-ছােট-বড়-কিশাের-যুবা এরা সবাই তৎকালীন জেল-জীবনের সকল রকম অসুবিধাই ভােগ করে গেছে। আমরা বাহান্ন পরবর্তী জেল জীবনে যেটুকু সুযােগসুবিধা ভােগ করেছি, এরা তার কিছুই দেখে যেতে পারেনি।
স্বল্পকালীন বরিশাল জেল-জীবনে খুলনার দুর্ভিক্ষ, বরিশালের দাঙ্গা, জিন্নাহ্র মৃত্যু, আমাদের এগারাে দিন অনশন, আবার আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে চীনের কমিউনিস্টদের ক্ষমতা দখল; সব মিলিয়ে বৈচিত্র্যময় ও ঘটনাবহুল ছিল। এ ছাড়া প্রতি সপ্তাহে না হােক অন্তত দশ পনেরাে দিন অন্তর একবার কোর্টে যেতে পারতাম-তখন কয়েক ঘণ্টার জন্য বাইরের জগতের সংস্পর্শে আসতাম। অনেক সময় দেখতাম ছাত্ররা স্কুল-কলেজে যাবার পথে কিছুটা বিস্মিত হয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। এ শুধু আমাদের কাপড়-চোপড় দেখে আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে তাদের মনে হতাে না যে, আমরা চোর, ডাকাত বা ব্লাক মার্কেটিয়ার বা দাঙ্গাকারী হতে পারি। কারণ আমরা যে রাজবন্দী তা বাইরের অল্প লােকেরই। জানা ছিল। সেই আটচল্লিশের জনসাধারণের চেতনা, কমিউনিস্ট সম্বন্ধে সাধারণ। মানুষের মনােভাব, মুসলিম লীগের প্রভাব, সাম্প্রদায়িকতা কোন পর্যায়ে ছিল তা আজ আটাশ বছর পরে সম্যক উপলব্ধি করা সহজ হবে না।
৮১

ছাব্বিশ
আমরা কিন্তু হাতকড়া পরা অবস্থায় রাজশাহী যাবার পথে গােয়ালন্দ পর্যন্ত পাঠকদের রেখে একটু বরিশাল জেলে চলে গিয়েছিলাম। এবার আমরা পৌছলাম রাজশাহী রেলস্টেশনে। তখন মার্চের শেষের দিক। শীত নেই, কিন্তু তেমন গরমও নয়। বাতাস রুক্ষ। বেলা তখন আনুমানিক পাঁচটা হবে। আমরা এক একজন পাহরাদার সিপাহীসহ এক একটা ঘােড়ার গাড়িতে চাপলাম। একটা ঘােড়া-বাহিত এই আধা খােলা গাড়িগুলিকে এখানে বলে টাঙ্গা। খুব হালকা মনে হলাে এ গুলিকে । ঘােড়াগুলি অত্যন্ত কৃশ। গাড়ােয়ানও তদ্রুপ । যেন আমাদের যেতে হবে তাই যাচ্ছি-যেন গাড়ােয়ানের চালাতে হবে তাই চালাচ্ছে। আনন্দ-কোলাহল জীবন বিবর্জিত এক অপরিহার্য বাস্তবের তাগিদে এই কঙ্কালসর্বস্ব গাড়ােয়ান ও ঘােড়াগুলি ছুটে চলেছে। মনে হচ্ছে যেনাে স্বর্গ ছাড়িয়ে নরকের পথে এক জনহীন প্রান্তর দিয়ে ছুটে চলেছি আমরা। দেখলাম এখানে যাত্রীর কোন মর্যাদা নেই। একটা চালের বস্তা বা কিছু তরিতরকারি বহন করে নিয়ে যাবার মত আমাদেরও নিয়ে চলেছে। সারা পথে টাঙ্গাওয়ালার কাছ থেকে একটা বাবু সম্বােধনও পেলাম না।
টাঙ্গা রাজশাহী সেন্ট্রাল জেলের সামনে এসে থামল। হঠাৎ যেন থমকে গেলাম এর সুউচ্চ গেট দেখে । মনে হলাে এ গেট আকাশ থেকে নেমে পাতাল পর্যন্ত বিদ্ধ করেছে। সুউচ্চ দেয়ালগুলি যেন অত্যাচারিতদের রক্তের ছােপে লাল হয়ে রয়েছে। খুব সম্ভব সাড়ে পাঁচটায় আমরা গেটের অভ্যন্তরে প্রবেশ করলাম। সঙ্গে সঙ্গে একটি সিপাই এসে আমাদের একজন জেলারের কাছে নিয়ে গেলেন। ভদ্রলােক আমাদের দিকে না তাকিয়েই, এদের সার্চ করাে’ বলে একজন জেল ওয়ার্ডারকে আদেশ দিল । জেলার আমাদের বসতে না দেওয়ায় আমরা ক্ষুব্ধ হলাম। বললাম, আমরা না হয় একটু বসেই নি-দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে আমরা এখন ক্লান্ত । ডেপুটি জেলার অন্যদিকে তাকিয়েই বলল, বসা-টসা ভিতরেই হবে । আমাদের সঙ্গের রশীদউদ্দীন তখন বলল, আচ্ছা সার্চটার্চও তা হলে ভিতরেই হবে । এই বলে আমরা ওখান থেকে ভিতরের গেটের দিকে এগােলাম। ডেপুটি জেলারটি অগত্যা কিছু বলল না। আমাদেরকে সরাসরি খাপড়া ওয়ার্ডে* রাজশাহীর কেন্দ্রীয় কারাগারে রাজবন্দীদের জন্য নির্দিষ্ট ও সুরক্ষিত টালির
—————
* খাপড়া ওয়ার্ড-রাজশাহীর কেন্দ্রীয় কারাগারে রাজবন্দীদের জন্য নির্দিষ্ট সুরক্ষিত টালির ছাদ বিশিষ্ট বিরাট আটচালা ঘর।
———————
৮২
ছাদ বিশিষ্ট বিরাট আট চালা ঘরে নিয়ে এল । তখন কে ভেবেছিল যে, এই খাপড়াতে এক দিন রক্তের হােলি খেলা হবে। এখানেই আমাদের অমূল্য সম্পদ সাত সাতটি বিপ্লবী জীবন হারাতে হবে । যাহােক আমি ভিতরে ঢুকতেই কে একজন আমাকে সর্দার ভাই’ বলে সজোর আলিঙ্গন দিল । ততক্ষণ খাপড়ায় অন্ধকার নেমে এসেছে। অত্যন্ত অস্পষ্ট আলােতে দেখতে পেলাম ছােটখাটো গােলগাল মােটা একজন কমরেড আমার মুখের দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারল তার ভুল হয়েছে, আমি তার সর্দার ভাই নই।
সর্দার মানে বরিশালের সর্দার ফজলুল করিম । ক্ষীণাঙ্গ, শরীরে টোকা দিলে পড়ে যাবার মত। দর্শন শাস্ত্রে এম. এ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনাকালে বিপ্লবের সংস্পর্শে এসে অতি দ্রুত কৃষক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। তীক্ষ্মধী, হাসিমুখ এই ক্ষীণাঙ্গ পুরুষটিকে দেখলে বলতে হয় এতটুকু বাঁশিতে এত সুর । তাঁর সম্পর্কে পরে আরাে বলার ইচ্ছা রইল।
খুব সম্ভব তখনাে লক আপ হয়নি। আমাদের তাড়াতাড়ি করে চা করে খাওয়ানাে হলাে। ততক্ষণে খাপড়ায় বাতি দেওয়া হয়েছে। দেখলাম, অনেক কমরেড দৌড়ে খাপড়ার গেটের দিকে জড়াে হলাে এবং সঙ্গে সঙ্গে স্লোগান দিতে লাগল নুরুল আমীন সরকার ধ্বংস হােক’, ‘সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হােক’, ‘কয়েদীদের দাবি মানতে হবে’ ইত্যাদি ইত্যাদি। আমরাও বসে রইলাম না। দৌড়ে গিয়ে তাদের সঙ্গে যােগ দিলাম । কিন্তু শেষের শ্লোগানটি শুনে যেন কিছুই বুঝতে পারলাম না । যেন জ্ঞানবুদ্ধি হারিয়ে মুহূর্তের মধ্যে স্থবির বনে গেলাম । জেলে হাতিয়ার লেকর হাে তৈয়ার শ্লোগানের অর্থ কী! দেখলাম, অনেকে বসে রয়েছে। তারা গেটেও আসেনি ওরূপ ধ্বনিও দেয়নি। তখন রাজশাহী জেলে কেউই আমাদের পুর্বপরিচিত ছিল না। যা হােক আমাদের। চারজনের কিভাবে শােবার ব্যবস্থা করবে তা নিয়ে কয়েকজনকে বেশ ব্যস্ত হতে। দেখলাম। একজন বেশ লম্বা, গায়ের রং শ্যামলা। কিছুটা গম্ভীর প্রকৃতির। লম্বা পদক্ষেপে আমার দিকে এগিয়ে আমার হাতে একটি বালিশ দিয়ে বলল, কমরেড এটি হাতে রাখুন। বললাম, কমরেড আপনি শােবেন কিসে? হঠাৎ ঈষৎ হেসে বলল, তা একরাত না হয় বালিশ ছাড়াই শােব। এই বলেই অন্য কাজে চলে গেলেন। পরে জানলাম ইনিই কুষ্টিয়ার কমরেড হানিফ-যিনি পরবর্তীকালে খাপড়া ওয়ার্ডে জেল কর্তৃপক্ষের গুলীতে নিহত হন। কুষ্টিয়ার শ্রমিক নেতা আত্মােৎসর্গকারী কমরেড হানিফ খাপড়ার নেতৃস্থানীয়দের তিনজনের অন্যতম ছিলেন।
ঐ সময় রাজশাহী জেলে নেতৃস্থানীয় কমরেডদের মধ্যে ছিলেন অবিভক্ত বাংলার কৃষক সমিতির সম্পাদক কমরেড মনসুর হাবিব । আন্দামান ফেরত রাজশাহীর কমরেড বিজন সেন । যশােরের কমরেড আবদুল হক। এ ছাড়াও রাজশাহীর সিতাংশু মৈত্র,
৮৩
কুষ্টিয়ার হানিফ শেখ, সৈয়দপুরের শ্রমিক নেতা সুনীল ধর প্রভৃতির নাম উল্লেখযােগ্য। মনে আছে বিজন দা আরও কে কে খাওয়া-দাওয়ার পর আমাদের নিয়ে বসলেন এবং বরিশাল জেলের বিশেষ করে বরিশাল জেলার বিভিন্ন বিষয় ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্বন্ধে প্রশ্ন করে জানতে চাইলেন। আমরা গানের জন্য অনশনের কথা বললাম। তিনি রাজশাহী জেল গেটে অনুরূপ শ্লোগান দেওয়া সম্বন্ধে আমাদের মতামত জানতে চাইলে আমরা অর্থাৎ আমার কথা বলতে পারি কোন জবাব দিতে পারিনি। কারণ, বাইরে ‘রণদিবে লাইন’ গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে আমরা গ্রেফতার হই এবং জেল সম্বন্ধে তাদের কোন বক্তব্য বা দলিল পড়ে আসতে পারিনি। খুব ক্লান্ত বলে ঐ রাত্রি আমরা আর আলােচনা না বাড়িয়ে যার যার নির্দিষ্ট বিছানায় শুতে গেলাম। আমরা শুতে যাবার পূর্বে একবার কমরেড সদানন্দ ঘােষের কাছে গেলাম। তিনি ছিলেন একটু আত্মভােলা ধরনের লােক। হঠাৎ নূতন জায়গায় এলে কোন অসুবিধায় না পড়েন দেখতে গেলাম। সদানন্দ বাবু তার অভ্যাসানুযায়ী সােজা চিত হয়ে শুয়েই বললেন-“কি শহীদ সাহেব, এসেছেন-হ্যা, একবার আসবেন তা মনে করেছি। তবে আজ আর আমার ঘুম হবে না । অত্যন্ত ক্ষীণাঙ্গ, সমস্ত শরীরটা যেন বিছানার সঙ্গে একেবারে মিশে গেছে। জিজ্ঞেস করলাম, কেন ঘুম হবে না? বললেন, এখানে এসেই আমাকে অনেক ভাবতে হয়েছে এবং দেখলাম ভাবতেও হবে । বুঝলাম জেল গেটে শ্লোগান দেওয়া বা রাজবন্দীর মর্যাদা নিয়ে লড়াইয়ের পদ্ধতি সম্বন্ধে তাকে ভাবিয়ে তুলছে। অগত্যা তাঁর সঙ্গে কোন গুরুতর বিষয় আলােচনায় না গিয়ে যে ভাবেই হােক তাকে ঘুমােতে বলে নিজের বিছানায় গেলাম।
৮৪

সাতাইশ
কমরেড সদানন্দ ঘােষের বাড়ী বরিশাল জেলার গাভায়। তিনি কলকাতায় থাকতেন এবং আর-সি-পি-আই দলের সদস্য ছিলেন। খুব সম্ভব দেশ বিভাগের পর স্বদেশে (পাকিস্তান) এসে গ্রেফতার হন। বিচিত্র স্বভাব এই কমরেডের। আমার সঙ্গে আলাপ হলে প্রায়ই বলতেনঃ ‘কমরেড, আমাদের যেন কোথাও ভুল হচ্ছে। তা না হলে আমাদের চেয়ে কম শিল্পোন্নত হয়েও চীন আমাদের আগে বিপ্লব করে ফেলল!” আমি জিজ্ঞেস করলাম, আমাদের কী ধরনের ভুল হতে পারে বলে আপনার মনে হয়। তাতে তিনি বলতেন, আমি আপনাদের মত অত তত্ত্বটত্ত্ব বুঝি না। তবে আমার কেবল মনে হয়, আমরা বড় বেশী গুছিয়ে টুছিয়ে বিপ্লব করতে চাই। বড় বেশী হিসেব করে কাজ করতে চাই। যেমন পার্টি করাে, সংগঠন করাে, বিভিন্ন স্তর পেরিয়ে এসাে, জনগণের চেতনার চুলচেরা বিচার করাে, তারপর আঘাত করাে-এত হিসেব করলে হিসেব করা হয়, কাজ করা হয় না। আমি বলতাম, ভুল হয়ত কোথায়ও রয়েছে, তা না হলে আমরা এগােই না কেন?
সদানন্দ বাবুর ব্যক্তিগত জীবনে ভুল ছিল অদ্ভুত ধরনের। এটা তাঁর স্বভাবে পরিণত হয়েছিল। অনেক সময় তিনি তাঁর নিজের পা চুলকালে পাশের লােকের পা চুলকিয়ে দিতেন। তখন আমরা সেলে থাকি। আমি আমার সেল ছেড়ে অমূল্যদা বা অন্য কারাে সেলে গিয়েছি। ফিরে দেখি, সদানন্দ বাবু আমার সিটে শুয়ে শুয়ে বই পড়ছেন। অত্যন্ত স্বল্পভাষী কমরেডটি ঈষৎ হেসে আমাকে বসতে বলে আবার বইয়ে মনােযােগ দিলেন, বইটি বৃটিশ পার্লামেন্টের মেম্বার সাইকের ‘হিষ্টরি অব দি টার্কিস এম্পায়ার’। বইটা হাতের উপর ধরে রাখতে না পেরে বুকের উপর রেখে পড়ছেন।
বইটার ভারে মনে হলাে তার বুকের পাঁজর ভেঙে যাচ্ছে। আমি কোন কথা বলে তার পাশে বসে কি যেন ভাবছি। তখন লক-আপের বেশী বাকি নেই। সদানন্দ বাবু বই থেকে কুর্দিস্থানের কোন একখানের দৃশ্য পড়ে শােনাচ্ছিলেন। সে কি অদ্ভুত বর্ণনা। মধ্যপ্রাচ্যে কুর্দিস্থানের দিগন্তে পাহাড়ের পাদদেশে সূর্য অস্ত । যাচ্ছে। পাহাড়ের চূড়ায় হাল্কা মেঘে সূর্যের স্বর্ণালি বর্ণ, নীচে দিগন্তবিস্তৃত মরুভূমির বালুর উপর সূর্যের স্বর্ণালি রং-মরুভূমির মধ্যস্থ মরুদ্যানের ছােট ছােট
৮৫
গুল্মলতা ও ঝােপঝাপের উপর সূর্য সােনা ছড়িয়ে দিয়েছে। তারই অদূরে কোথাও পাহাড় বেয়ে নেমে আসা ছােট ঝরনার অস্তমিত সূর্যের রং জলধারাকে তরল সােনায় পরিণত করেছে। সাইক লিখেছেন সমস্তটা মিলিয়ে সেদিন কুর্দিস্থানের সন্ধ্যা যেন তাঁর কাছে এক সােনার অলকাপুরীতে পরিণত হয়েছিল। মনে হচ্ছিল দিগন্তের পাহাড়সহ সমস্ত প্রকৃতিই যেন এক স্বর্ণরাজ্য-অপরূপ সে বর্ণনা । আমরা তন্ময় হয়ে শুনছিলাম। ঠিক তখনই পাশের সেলে সিপাহীর পদশব্দ শােনা গেল । সিপাহী লক আপ করতে এসেছে। আমি সদানন্দ বাবুকে উঠতে বললে তিনি বললেন লক-আপ করে যাক আমি আর উঠব না। আপনি সেলে যান। শুনে আমি বললাম, বলেন কী, এত আমার সিট। তখনই তিনি ধড়ফরিয়ে উঠলেন এবং নিজের সিটে চলে গেলেন। সন্ধ্যের পরে আমি ভাত খেতে গিয়ে দেখি আমার থালায় ভাত বা বাটিতে তরকারী নেই। চিৎকার করে সদানন্দ বাবুকে জিজ্ঞেস করলাম-তিনি বললেন, শহীদ সাহেব, তাতে আমি আমার ভাত মনে করে খেয়েদেয়ে শুয়েছিলাম । তা আপনি আমার ভাত নেবার ব্যবস্থা করুন। তখন বহু চেঁচামেচি করে লক-আপ খুলে ভাত নিয়ে খাই। এমন অদ্ভুত প্রকৃতির আত্মভােলা। লােক ছিলাে কমরেড সদানন্দ ঘােষ । তারপর তাঁকে চেপে ধরলামঃ আপনার এ রকম ভুল হয় কেন? বললেন, বলতে পারি না। তবে আর একদিনের কথা শুনুন। একদিন কলকাতায় থাকতে আমাকে বাজারের জন্য টাকা দেওয়া হয়েছিল মাছতরকারী কিনতে এবং সঙ্গে ব্যাগও ছিল । আমি কিছু দূর গিয়ে সব বেমালুম ভুলে গিয়ে নিকটস্থ এক পোেস্ট অফিসে গিয়ে বেশ কিছু পােস্ট কার্ড এনভেলাপ কিনে। ফিরে আসি। বললাম, বেশত এ দেখি ‘দাদখানি ডাল সরিষার কৈ-এর মত । সদানন্দ বাবু বললেন, দেখুন, আমি কোন সময়ই চিন্তা থেকে মুক্ত নই । ধরুন, ঐ বাজারের পথে হয়ত ভাবছিলাম অমুককে চিঠি দিতে হবে। তাই হয়ত পােস্ট অফিসে গিয়ে পােস্ট কার্ড কিনে আনলুম। তিনি একজন সুগায়ক ছিলেন। তার ‘বন্দর ছাড় যাত্রীরা ঐ জোয়ার এসেছে আজ’ বা ‘আজ কুঞ্জে গাে মধু জোছনায়’ ইত্যাদি গান সুরের মূর্ঘনায় আমাদের সম্মােহিত করে রাখত। একটু উগ্র প্রকৃতির ছিলেন বলেই ছােটখাটো বিষয় নিয়ে জেল সিপাইদের সঙ্গে ঝগড়া বেঁধে যেত । আমরা নিষেধ করলে চটে যেতেন এবং ওদের কোনরূপ প্রশ্রয় দেয়া উচিত নয় বলে মন্তব্য করতেন। এ সময়টা ছিল রাজবন্দীদের মর্যাদা আদায়ের শেষের দিক। সমগ্র আটচল্লিশ উনপঞ্চাশ সালব্যাপী ঢাকায় চলেছে অনশন ধর্মঘট। এ অনশনরত অবস্থায়ই কুষ্টিয়ার শিবেন রায় আত্মাহুতি দিয়েছিলেন।
৮৬

আটাশ
অনশনের একটা নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে গেলে তাঁদের মৃত্যুর আশঙ্কা দেখা দেয়। তখন জেল কর্তৃপক্ষ বা সরকার তাদের খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখতে চেষ্টা করে। কিন্তু অনশনকারীদের কখনও মুখ দিয়ে কিছু গ্রহণ করার রীতি নেই। তাতে মৃত্যু হলেও তারা অনশনের মর্যাদা নষ্ট করবে না। তবে তাদের জোরপূর্বক নাক দিয়ে ডিম ফেটা, দুধ ইত্যাদি খাওয়ান হয়- তাও যখন তাদের বাধা দেবার শক্তি থাকে।
তা ছাড়া অনশনকারীরা পূর্ব হতেই এ নিয়ম মেনে আসছে। গান্ধীজীও এ নিয়ম মানতেন। শিবেনকেও একদিন জেল ডাক্তার ন্যাজাল ফিডিং বা নাক দিয়ে খাওয়াতে এল । কিন্তু শিবেন কি কারণে বাধা দিয়ে মাথা ঝাঁকুনি দিলেই নলের দুধ ফুসফুসে চলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ফুসফুস থেকে রক্ত মুখে উঠতে লাগল । এর মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে শিবেনের প্রাণনাশ হয়। উভয় পাশের সেলের বন্দীরা শিবেনের মৃত্যুকালীন পা ছোঁড়াছুঁড়ি এবং গােঙ্গানির শব্দ পেয়ে আকুলভাবে চিৎকার করতে থাকে। তখন রাত। তারা ক্রুব্ধ হয়ে সজোরে লােহার জানালার উপর আঘাত হানতে থাকে এবং শিবেন-শিবেন কী হয়েছে বলে আর্তনাদ করতে থাকে। জল্লাদ ডাক্তার, আরও দুই একজন সিপাহী মৃত শিবেনকে ঐ অবস্থায় ফেলে রেখে যায়। পরে বেশ রাত থাকতে তার লাশ সেলের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়। বিপ্লবী যতীন দাসের মত পাকিস্তানে রাজবন্দীর মর্যাদার লড়াইয়ের প্রথম শহীদ শিবেন। শুনেছি, আজও তাঁর পিতা জীবিত। সেই শােকোন্মাদ অশীতিপর বৃদ্ধ বাড়ির সম্মুখস্থ রাস্তা দিয়ে কাকেও যেতে দেখলে শিবেন শিবেন বলে ডাক দেন।
অনশন হলাে রাজবন্দীদের সংগ্রামের একটি পদ্ধতি । ভারতীয় স্বাধীনতার ইতিহাসে কারাগারে যতীন দাসের ৬৪ দিন অনশনের কথা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। জেলে এই ধরনের সংগ্রামের তাৎপর্য হলাে, জেলের মধ্যে থেকে শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে যখন সশস্ত্র সংগ্রাম করার কোন সুবিধা নেই অথচ কি ভিতরে কি বাইরে কোনরূপ অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ বা প্রত্যক্ষ সংগ্রামের সমর্থন দরকার তখনই কারাগারের রাজবন্দীরা অনশনের আশ্রয় নিতেন। এ হলাে এক ধরনের আত্মাহুতি। তাঁরা মনে করতেন, এভাবে জীবন দিয়ে আসন্ন কোন ফল হােক বা না হােক ভবিষ্যত বংশধরদের সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করা যাবে। অনশনের ফলে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনেক ছােটখাটো সুযােগ-সুবিধা আদায় করা সম্ভব। বাইরে কোন অত্যাচারমূলক ঘটনা ঘটলে ভিতরে রাজবন্দীরা অনশনের মাধ্যমে
৮৭
তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায় এবং এভাবেই বাইরের সংগ্রামে শরীক হয়। বলাবাহুল্য, অনশনের কনভেনশন বা আবহমানকালের রীতি অনুযায়ী নাক দিয়ে খাদ্য গ্রহণ করলে তার মৃত্যুর কোন আশঙ্কা থাকে না। তবে দীর্ঘদিন অনশনের ফলে বহু বন্দীর স্বাস্থ্য ভঙ্গ হতে দেখেছি। বিশেষ করে গ্যাস্ট্রিক, কোলাইটিস, ক্রনিক পেইন প্রভৃতি রােগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থাকে।
এই সময় রাজশাহী জেলে যাদের সঙ্গে আলাপ হয় তার মধ্যে ছিলেন অন্যতম বিপ্লবী হাজী মুহাম্মদ দানেশ । দিনাজপুরের এক ধনাঢ্য পরিবারে জন্মগ্রহণ করে এবং আলীগড় থেকে এমএ পাস করেও হাজী দানেশ আত্মপ্রতিষ্ঠার কথা চিন্তা করেন নাই। তাছাড়া এখানে দেখা পেয়েছিলাম দিনাজপুরের বিখ্যাত কৃষক নেতৃদ্বয় কমরেড ডােমা রাম ও কম্পম সিংয়ের সঙ্গে। তাদের আরও এক ছােট ভাই তাদের সঙ্গে ছিল । এই বীর ভ্রাতৃদ্বয় সারা দিনাজপুরে তেভাগার সংগ্রাম ছড়িয়ে দিয়েছিল। তেভাগার সংগ্রাম দমন করতে গিয়ে তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার শাসক কর্তৃপক্ষ তাদের বাড়ীতে চড়াও হয়ে গুলি চালায় এবং সেখানেই চারজন কৃষক নিহত হয়। বিশাল বপুর অধিকারী এই বীর ভ্রাতৃদ্বয়ের একজন রাজশাহী জেলে ২৪শে এপ্রিলের গুলিতে প্রাণ দেন। অত্যন্ত সরল দেশপ্রেমিক ডােমারামের সঙ্গে আলাপ করে বুঝতে পারতাম যে, তারা কত নির্ভীক। হাজং উপজাতীয়দের মত তাদের সম্প্রদায় চরমভাবে শােষিত হতাে দিনাজপুরের জোতদার মহাজনদের দ্বারা। মনে পড়ে এই প্রসঙ্গে দিনাজপুরের কয়েকজন জোতদারের নাম আমরা শুনেছিলাম, তাঁরা হলেন যথাক্রমে কাশীস্বর দে, হাফিজুদ্দিন চৌধুরী প্রমুখ ।
যাক, পূর্বে যা বলেছিলাম। এই সময় জেলে কোন রকমে বেঁচে থাকার সংগ্রামই ছিল মুখ্য। দীর্ঘদিন সংগ্রাম করে রাজবন্দীরা আংশিকভাবে তাদের দাবি আদায় করেছিল। প্রথম দিকে বছরে দুটো জামা, একখানা লুঙ্গি, একটি পাজামা না হয় দুটো লুঙ্গি, দুটো পাজামা, একটি মশারি, শােবার জন্য একটি জাজিম, লােহার খাট, একটি কম্বল, দু’খানা বিছানার চাদর, একটি তােয়ালে বা গামছা দিত। খুব সম্ভব শীতের সময় একটি অতিরিক্ত কম্বল দিত । এ গেল কাপড় চোপড় বিছানাপত্রের দিক। খাদ্যের ব্যাপারে তিন দিন মাছ, তিন দিন গােস্ত, ডাল থাকতােই। আর একদিন তরিতরকারী থাকত বলে মনে পড়ে। কিন্তু এর পরিমাণ ছিল সামান্যই। দৈনিক পাঁচসিকা থেকে দেড় টাকার মত মাথাপিছু বরাদ্দ ছিল । আমাদের কিচেন ম্যানেজার এই বরাদ্দকৃত টাকার দ্বারা বাজার করাতাে। এর ভালাে মন্দ কন্ট্রাক্টরের মর্জির উপর নির্ভর করতাে। বিভিন্ন পর্ব যেমন ঈদ ও পূজা উপলক্ষে কিছু বেশী বরাদ্দ ছিল । মনে আছে, খাদ্যের লিস্টের মধ্যে কিছু টকের ব্যবস্থা ছিল, তাকে ট্যামারিন বলা হতাে। লেবু আনালে একটি লেবু ষােলজনকে
৮৮
ভাগ করে খেতে হতাে। এ ছাড়া ছিল দিনে দুবার চা। ভােরে টিফিনের জন্য একটা আটার রুটি এবং সঙ্গে একটু তরকারী। রাজশাহী এসে শুনলাম প্রথমদিকে নাকি রুটির সঙ্গে তরকারী দেওয়া হতাে না। দীর্ঘ এক বছর এ নিয়ে দরবার চলে, তারপর সরকার রুটির সঙ্গে একটু তরকারী, ভাজি মঞ্জুর করেন।
সপ্তাহে একদিন বােপা পাওয়া যেত। ক্ষুরকর্মের জন্য নাপিতেরও ব্যবস্থা ছিল।
অন্যান্য সুযােগ সুবিধার মধ্যে কয়েকটি দৈনিক কাগজ পাওয়া যেত। তাছাড়া বাইরে থেকে বই খাতা জমা দিবার সুযােগ ছিল। অবশ্য ঐ সমস্ত বই আইবি-দের সেন্সর হয়ে আসত। বন্ধু বান্ধব ও আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে দেখাশুনা করার সীমাবদ্ধ সুযােগ ছিল- মাসে দুবার, কোন কোন সময় একবারের বেশী সাক্ষাৎকার মঞ্জুর করা হতাে না। ঐরূপ চিঠিপত্র লেখালেখির জন্য অত্যন্ত সীমাবদ্ধ সুযােগ আদায় করা গিয়েছিল। মাসে একখানার বেশী চিঠি লেখা যেত না। আর খুব সম্ভব মাসে দু’খানা চিঠি বাইরে থেকে আসতে দেওয়া হতাে। চিঠিগুলি কড়া সেন্সরের পরই শুধু আসতে দেয়া হতাে।
৮৯

উনত্রিশ
সদা সন্ত্রস্ত সেই সরকারের কী নির্দেশ ছিল জানি না। বাহির থেকে আসা চিঠিগুলির বহু জায়গাই এমনভাবে কালাে কালি দিয়ে লেপে দিত যার ফলে সমগ্র চিঠিরই কোন মর্মোদ্ধার করা সম্ভব হতাে না। প্রথম দিকে এমনভাবে কালি দিত যাতে চিঠির দুই দিকের লেখাই সম্পূর্ণ অদৃশ্য হয়ে যেত। আমরা এ নিয়ে বহু লেখালেখি এবং কথা কাটাকাটির পর এর একটি সুরাহা হয়েছিল । সবচেয়ে অসুবিধা হতাে খবরের কাগজ নিয়ে। এর যে যে সংবাদ কর্তৃপক্ষ জেলখানায় রাজবন্দীদের না জানানাে বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে করত সেই অংশটা কেটে দিত । কিন্তু এই কেটে দিবার ফলে কাগজের অপর দিকের খবরও কাটা পড়তাে। ফলে যে খবর আমাদের জানার পক্ষে নিষিদ্ধ ছিল না তাও আমরা জানতে পারতাম না । যেমন অন্য কোন জেলে আমাদের কোন রাজবন্দীর উপর অত্যাচার বা বাইরে কোন গণ-আন্দোলনের সাফল্য বা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের সংবাদ কাটা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার অপর পৃষ্ঠায় পাকিস্তান অলিম্পিকে হকিতে চ্যাম্পিয়ান হয়েছে। এ খবরও আমাদের অগােচর রয়ে যেত। এ যেন সরকারের নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গের মত। পুঁজিবাদী সমাজের শেষ স্তরে বিকৃতচিত্ত সরকারের এহেন কার্যকলাপ হাসি ও করুণার উদ্রেক না করে পারে না। তা না হলে খবরের কাগজ কেটে দিলেই কী বিপ্লবীদের কাছ থেকে সংবাদ গােপন রাখা যায়!
মনে আছে তখন ১৯৫১ সাল। রাজশাহী জেলে বসে একদিন স্টেটসম্যানের পাতা খুলেই দেখি প্রথম পাতার হেডিং দুই আঙ্গুল পরিমাণ জায়গা কাটা। আমরা ভেবেই পেলাম না এত বড় হেডিং কিসের হতে পারে।
ভারতের কোন দুঃসংবাদ হলে তা কখনও কাটতাে না। নিশ্চয়ই এটা পাকিস্তানের সংবাদ । আমাদের সঙ্গে ছিলেন হীরেন সেন নামে যশােরের এক ভদ্রলােক। তিনি ফরওয়ার্ড ব্লক-এর কর্মী ছিলেন। তিনি বলে উঠলেন, আরে দেখুন না শহীদ সাহেব, আমি বলে দিচ্ছি এ পাকিস্তানের গােড়ায় কী ঘটেছেকোন বড় নেতা টেতা একেবারে টপমােস্ট জাতীয়- হয়ত সাবার হয়ে গেছে।
এরই মিনিট পনের পর ডেপুটি জেলার সাহেব কোথা থেকে যেন আমাদের ওয়ার্ডের কাছাকাছি এসে কাকে সম্বােধন করে বললেন, আপনারা কি শুনেছেন।
৯০
লিয়াকত আলী সাহেব আততায়ীর গুলিতে নিহত হয়েছেন?
যে খবরটা গােপন রাখার জন্য এত কসরত করল অথচ তার মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যে আমাদের জানা হয়ে গেল । ভাবি হীরেন বাবুর কথা- তিনি কি করে আগেই এ রকম অনুমান করছিলেন।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হতাে চিঠি পত্র নিয়ে । এগুলির প্রতিটি লাইনে এরা যেন নিজেদের মৃত্যুর ভয়াল ছবি প্রতিবিম্বিত দেখত। ব্যক্তিগত চিঠিপত্রের কাটাকাটি দেখলে মনে হতাে যেন এরা সারা চিঠিটাই কেটে দিতে পারলে খুশি হয়।
এছাড়া বাইরে থেকে কেউ দেখা করতে আসলে আইবির সামনে তার সঙ্গে কথাবার্তা বলতে হতাে। কথা বলার সময়ও নির্দিষ্ট ছিল। একটু দেরী হলে কোন কোন আই-বি খুবই বিরক্তি বােধ করত । মনে আছে ঐ সময় পাকিস্তান সরকারের কোন সরকারী কর্মচারীর মধ্যে বিন্দুমাত্র দেশপ্রেম ছিল না। আমাদের প্রতি সহানুভূতি বা সাধারণভাবে একটা মানবিক উদারতার আদৌ লক্ষণ তাদের মধ্যে দেখতে পাইনি। ইচ্ছা করলেই তারা কথার মধ্যে বাধা দিত। সাধারণ কথাবার্তার মধ্যেও তারা অনেক কিছু আবিষ্কার করার চেষ্টা করতাে। একবার রাজশাহী থাকতে দেখা করতে এলেন আমার বড় ভাই এককালের কলকাতা আলীয়া মাদ্রাসার স্বনামখ্যাত ছাত্র মাওলানা হাফিজউদ্দীন ফিরােজী সাহেব। তিনি এসেছিলেন পাকশীতে ফুরফুরার পীর সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে। সেখান থেকে তাঁর নিজের কিছু মুরীদ নিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করলেন। দেখলাম, আই-বি যেন এই ইন্টারভিউতে খুবই খুশী। তার ধারণা ছিল বড় বড় মাওলানা আমার সঙ্গে দেখা করে আমার মন পরিবর্তন করতে পারবেন। কিন্তু মিয়াভাই যখন শেষ পর্যন্ত। বললেন, জানাে তাে, জেহাদই আমার জীবনের লক্ষ্য? তবে আমরা জেহাদ করি। বেহেস্তের পথ পরিষ্কার করার জন্য, তােমরা জেহাদ করাে দুনিয়ার অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে, জেহাদ আমাদের উভয়েরই মূলমন্ত্র । দেখলাম আই-বির মুখ চুন হয়ে গেল ।
যা হােক রাজবন্দীদের মর্যাদা আংশিকভাবে আদায় হলেও আমাদের বহু রকম অসুবিধা রয়ে গেল। এ ছাড়া খাতা, বইপত্র পড়ার সুযােগ, খবরের কাগজ পড়ার সুযােগের কথা আসে। তখন খবরের কাগজের মধ্যে ভারতীয় সত্যযুগ, স্টেটসম্যান পেতাম। পাকিস্তানের কাগজের মধ্যে পেতাম দৈনিক আজাদ আর অবজারভার। তবে কিছুদিন পশ্চিম পাকিস্তানের সিভিল মিলিটারি গেজেটও পেয়েছি, খুব সম্ভব তা ঢাকা জেলে থাকতে। এ ছাড়া বিভিন্ন পর্বে বিভিন্ন ওয়ার্ডের রাজবন্দীদের সঙ্গে দেখাশুনা করার সুযােগ পেতাম। জেল কর্তৃপক্ষ আমাদের
৯১
শুক্রবারে নামাজ পড়তে এক জায়গায় একত্র হতে দিতাে। কিন্তু সেখানে আমরা রাজনৈতিক আলােচনা করতে পারি এই আশঙ্কায় তাও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
বলাবাহুল্য, হাসপাতালে ভর্তি হবার সুযােগ ছিল কিন্তু সেখানে কোন ঔষুধ ছিল না। আপনার যত রকম রােগ হবে- একটাই প্রেসক্রিপসন-ওষুধের অবস্থা যা তাতে তাই বলতে হয় তা হলাে-কারমিনেটিভ মিক্সার । জেলের এ অবস্থা দেখে খুব সম্ভব বাচ্চা বন্দী পরিতােষ না হয় অনিমেষ ছড়া লিখেছিল-
দাঁতের ব্যথায় কারমিনেটিভ
চোখের ব্যথায় কারমিনেটিভ
পেটের ব্যথায় কারমিনেটিভ
কারমিনেটিভ খেতে ভাল লাগে ।
রােগ সারাতে কারমিনেটিভরােগ
বাড়াতে কারমিনেটিভ
কারমিনেটিভ খেয়াে সবার আগে।
আমাদের কমরেডদের জটিল রােগের জন্য আমরা বাইরে থেকে নিজেদের টাকায় ওষুধ কেনার ব্যবস্থা করতাম।
যাক রাজশাহী জেলে আমাদের নিজেদের সুযােগ সুবিধা ও মর্যাদা আদায়ের প্রশ্ন সাময়িকভাবে চেপে রেখেও আমরা অন্যদিকে দৃষ্টি না দিয়ে পারলাম না। তা হলাে জেলে কয়েদীদের অবস্থা ।
৯২

ত্রিশ
জেলখানায় একদিন জুমার নামাজ পড়তে গিয়ে দেখি, কয়েকজন কয়েদী তেলের ঘানির বিরাট লােহার রড কাঁধে নিয় গরুর মত ঘুরছে। সে দৃশ্য না দেখলে। লিখে বুঝানাে সম্ভব নয়। মনে হলাে আমরা যেন চলে এসেছি সেই রােমান যুগেযেখানে কৃতদাসদের দিয়ে যা খুশী করানাে যেত । বিংশ শতাব্দীর গালভরা ধনতান্ত্রিক সভ্যতার গহ্বরে যে এত কুৎসিত ঘটনা ঘটে যাচ্ছে, মনুষ্যত্বের এত বড় অপমান যে এমন অবাধে করা সম্ভব হচ্ছে, তা দেখে আমরা যেন হতবাক হয়ে গেলাম। বিরাট ওজনের দীর্ঘ লােহার রড কাঁধে নিতে এক একজন কয়েদী ভাঁজ হয়ে প্রায় মাটিতে মিশে যাচ্ছে এবং এই অবস্থাতেই অবিরাম ঘুরে সরষে ভেঙ্গে তেল বের করছে। জেল কর্তৃপক্ষের বক্তব্য হলাে এ এক ধরনের শাস্তি। বললাম এটা সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশ আমলের প্রবর্তিত শাস্তি । আজ এই গলা ফাটানাে স্বাধীন ইসলামী রাষ্ট্রে মানুষের এতটুকু মুক্তি হবে না যে, গরু দিয়ে যে কাজ করানাে হয় তাই মানুষেরই করতে হবে। ইংরেজদের পক্ষে তা সম্ভব। শুনেছি কোন এক ইংরেজ নাকি দেশে গিয়ে গল্প করেছে যে, সে ভারতে তিনটি গরু দিয়ে জমি চাষ করতে দেখে এসেছে এবং সেখানকার অধিকাংশ মানুষকে জ্যান্ত কবরে বাস করতেও দেখে এসেছে। তাকে যখন একথা আরও ব্যাখ্যা করে বলতে বলা হলাে তখন সে বলেছে যে, চাষের বেলায় দেখেছি দুটি গরু সামনে থাকে আর একটি লাঙ্গলের পিছনে থাকে। অর্থাৎ পিছনের চাষীটিকে সে গরুর চেয়ে বেশী মূল্য দিতে রাজী নয়। ভারতের অধিকাংশ লােক জ্যান্ত কবরে বাস করে বলতে সে বুঝাতে চেয়েছে, দরিদ্র কৃষকদের কুঁড়ে ঘরে বাস করার কথা। সামনের চাল একেবারে মাটিতে মেশানাে এবং চতুর্দিকে জানালাবিহীন ঘরগুলিকে সে কবরের সাথে তুলনা করেছে। এটা স্বাভাবিক। এদেশের মানুষ সম্বন্ধে সাম্রাজ্যবাদী কোন কোন ইংরেজের কাছ থেকে এর থেকে ভাল মন্তব্য আশা করা যায় না। ভারত বলতে আমি বিভাগপূর্ব ভারতের কথাই বলছি । কিন্তু এদেশে এখনও কয়েদীরা গরুর মত ঘানি টানবে- আমরা এটাকে অমানুষিক পৈশাচিক এবং সরকারের বর্বরােচিত ব্যবহার বলেই এ ব্যবস্থা বন্ধ করে দিতে বদ্ধপরিকর হলাম। তাছাড়া জেলে। সাধারণ কয়েদীদের বিড়ি-তামাক খেতে দেওয়া হতাে না। আমাদের মতে, এর চেয়ে নিষ্ঠুরতা বা অবিচার আর কিছুই হতে পারে না। কারণ, কৃষক শ্রেণী থেকে
৯৩
আগত দীর্ঘদিন জেলে বসবাসকারী এই সমস্ত কয়েদীদের কাছে বিড়ি-তামাক ছিল অপরিহার্য। জেল কর্তৃপক্ষ এদের বিড়ি মঞ্জুর না করলে এরা বিভিন্ন উপায়ে তা সংগ্রহ করে। কখনও কখনও এমনও ঘটে যে একটা বিড়ির জন্য একজন। কয়েদী তার গায়ের কম্বল বেচে দিতে বাধ্য হয়। ফলে জেলের অনেক সিপাহী বা পুরানাে ডাকাত সর্দার বা ঝানু মেটরা* এর সুযােগ নেয়। এবং ঐ সমস্ত কম্বল বাইরে বিক্রির জন্য পাচার করে প্রচুর টাকা জমায়। তাছাড়া জেলে বহু হাজতি বছরের পর বছর পচতে থাকে। জেল কর্তৃপক্ষ এদের সম্বন্ধে বাইরে কোর্টের সঙ্গে যােগাযােগ করলেই এদের অনেকের মামলা গ্রহণ করা বা ত্বরান্বিত করার ব্যবস্থা হতাে। কিন্তু জেল কর্তৃপক্ষ তা না করায় এসব হাজতি কোন রকম সুব্যবস্থার অভাবে জেলে অসহ্য কষ্ট ভােগ করতে থাকে। এছাড়াও কয়েদীদের সামান্য খাদ্য। ও তাদের উপর অকথ্য জুলুম সম্বন্ধে আমাদের কিছু একটা করা একান্ত কর্তব্য বলে মনে করলাম।
এই সময় একটি ঘটনা সারা জেলের কয়েদীদের মধ্যে দারুন উত্তেজনার সৃষ্টি করল । ঘটনাটি এই ঃ জান খা নামক একজন কয়েদীর উপর কি জন্য ঠিক বলতে পারছি না জেল কর্তৃপক্ষ খুব নির্যাতন চালায় এবং সে এর প্রতিবাদে অনশন ধর্মঘট শুরু করে। যতদূর মনে পড়ে জান খাঁ শুধু তার নিজের উপর অত্যাচারের প্রতিবাদেই নয় বরং তার অনশনের কারণ হিসেবে অন্য কয়েদীদের উপর থেকে অকথ্য অত্যাচার তুলে নেয়ার এবং তাদের কতকগুলি দাবি মেনে নেয়ার কথা উল্লেখ করে। আমরা আর এ বিষয়ে নীরব দর্শকের ভূমিকা গ্রহণ না করে সক্রিয় সহযােগিতা করার সিদ্ধান্ত নিলাম এবং কয়েদীদের কতকগুলি ন্যায়সঙ্গত দাবি মেনে নেওয়ার জন্য জেল কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করার জন্য অনশন শুরু করলাম। দেখতে দেখতে আমাদের সঙ্গে রাজশাহী সেন্ট্রাল জেলের প্রায় দেড়শ’ কয়েদী অনশন শুরু করল। আমার মনে হয়, উপমহাদেশে কেন, পৃথিবীর ইতিহাসে জেলখানায় কয়েদীদের এ ধরনের সংগ্রামের নজির খুব বেশি নয়। অবশ্য বাইরে বিপ্লবী সংগ্রামের অগ্রগতির এক বিশেষ মুহূর্তে ইনসিন প্রভৃতি জেল থেকে কয়েদীদের বেরিয়ে আসা অথবা বাইরের জনতা রাজবন্দীসহ অন্যান্য কয়েদীদের মুক্ত করে নিয়ে আসার ঘটনা কোথাও কোথাও ঘটেছে। আজ একথা বলা প্রয়ােজন যে, পশ্চিমা হানাদারদের বিরুদ্ধে বাংলায় বিপ্লব অভ্যুত্থানের ফলে তাদের তাড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হলাে এবং এই সংগ্রামের এক বিশেষ মুহূর্তে বিভিন্ন জেল থেকে রাজবন্দীদের মুক্ত করে মুক্তি সংগ্রামীরা যে গৌরবােজ্জ্বল ঐতিহ্যের সৃষ্টি করল তার পিছনে পঞ্চাশের এই বিপ্লবীদের এবং তৎকালীন রাজশাহী জেলের কয়েদীদের সংগ্রামকে এক ঐতিহাসিক অবদান বলতে হবে ।
—————-
* মেট- বিশ বছরের সাজাপ্রাপ্ত কয়েদীদের খালাসের কয়েক বছর পূর্বে জেল পরিচালনার জন্য প্রাপ্ত পদ।
—————
৯৪
যাহােক, কয়েদীদের অনশন এবং তার সঙ্গে আমাদের যােগদান কর্তৃপক্ষকে উদ্বিগ্ন করে তুলল । কিন্তু কর্তৃপক্ষ জান খাঁর দাবি বা কয়েদীদের দাবির প্রতি কর্ণপাতও করল না। বরং মনে হলাে তারা আমাদের চরম শাস্তি দেবার কথাই চিন্তা করছিল। আগেও বলেছি, এই সময় আমাদের জুম্মার নামাজে অন্যান্য কয়েদীদের যাওয়া নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। কর্তৃপক্ষের ধারণা, আমরা জুম্মায় গিয়ে অন্যান্য কয়েদীদের সঙ্গে রাজনৈতিক আলাপ-আলােচনা করি। যার ফলে সাধারণ কয়েদীরা সংগ্রামমুখী হয়ে উঠে। এ সবই তাদের মিথ্যা অভিযােগ এবং এই ঘটনায় আমরা চরমভাবে ক্ষুব্ধ হই। মনে আছে, নেতৃস্থানীয় হাজী মােহাম্মদ দানেশের মত ধর্মপরায়ণ রাজবন্দীরা সদ্য প্রতিষ্ঠিত ইসলামিক রাষ্ট্রের এরূপ ধর্মাচরণের প্রতি প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে দারুণভাবে মর্মাহত হন। এই ঘটনায় জননেতা। মাওলানা ভাসানী ভীষণ ক্ষুব্ধ হন এবং সঙ্গে সঙ্গে তিনি এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সরাসরি অভিযুক্ত করে এ ধরনের অন্যায় ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ বন্ধের দাবি জানান। আমরা শুধু অনশন করেই ক্ষান্ত ছিলাম না। পূর্বেই উল্লেখ করেছি, এ সময় আমরা কয়েদীদের বিভিন্ন দাবি পূরণ করার কথা উল্লেখ করে জেলখানায় শ্লোগান দিতাম। বলা বাহুল্য, আমাদের সঙ্গে অনশনরত শতাধিক কয়েদী ঐ শ্লোগানে অংশগ্রহণ করতাে। স্বভাবতই জেলখানার এই পরিস্থিতি কর্তৃপক্ষকে খুবই ভাবিয়ে তুলল ।
৯৫

একত্রিশ
আমাদের দিক থেকে এ আন্দোলনের পক্ষে যুক্তি ছিল এই যে, একজন চোর, ডাকাত ও অপরাধীকে কারান্তরালে পাঠাবার উদ্দেশ্য কি? এর উদ্দেশ্য যদি কয়েদীদের সংশােধন করাই হয় তা হলে সে ব্যবস্থাই করা উচিত। জেল দেওয়ার অর্থ তাকে চুরিডাকাতি থেকে বিরত করা। কিন্তু জেলে ঢুকে যদি তার মন পরিবর্তনের জন্য তাকে জেলের ভিতরেও নির্মম শাস্তি পেতে হয়, তার মনুষ্যত্বকে চরমভাবে উপেক্ষা করা হয়, তার শারীরিক ও জৈবিক প্রয়ােজনকে অস্বীকার করে অত্যন্ত অস্বাভাবিক ও অমানুষিক অবস্থায় রাখা হয় তাহলে সে হয়ে ওঠে প্রতিহিংসাপরায়ণ। তাছাড়া প্রয়ােজনীয় সুবিধাদির অভাবে তার স্বাস্থ্য যায় ভেঙ্গে। এর ফলে তার আর নতুন জীবনে ফিরে যাওয়া সম্ভব হয় না। সামান্য বিড়ি-তামাকের জন্য জেলখানায় বসেই তাকে চুরির আশ্রয় নিতে হয় এবং সামান্য প্রয়ােজনেও তাকে জেলে বড় বড় ডাকাতের সর্দারদের শরণাপন্ন হতে হয়। ফলে একজন সামান্য চোর তাদের সংশ্রবে এসে ডাকাত হয়ে বেরিয়ে আসে। এ রকম নজীর বহু আছে। কর্তৃপক্ষ চায় শাস্তি দিয়ে তার মন পরিবর্তন করতে । আসলে তার আর্থিক অবস্থার একটা সুরাহা না করে তার মন পরিবর্তন করা যাবে না এবং তাকে কোন শাস্তি দিয়েও তার জীবিকা উপার্জনের উপরােক্ত পথ থেকে ফিরানাে যাবে না।
তাছাড়া কয়েদীদের আর একটা দিক রয়েছে। তা হলাে এই যে, তারা দীর্ঘদিন জেলে থাকার ফলে বাইরে উপার্জনহীন তাদের তাে পরিবার পরিজন নিঃস্ব হতে নিঃস্বতর হয়ে পড়ে। এমনিতেই নিদারুণ দারিদ্র্যবশত এরা চুরি ডাকাতি করতে বাধ্য হয়। তারপর দীর্ঘদিন জেল খেটে বাইরে বেরিয়ে এলে সে তার সর্বহারা পরিবারবর্গের জন্য অন্য কোন কাজকর্ম জুটিয়ে নিতে পারে না। কারণ একদিকে সে দাগী চোর, তাই লােকে তাকে বিশ্বাস করতে চাইবে না। দ্বিতীয়ত, তারা অন্য কাজে অনভ্যস্ত, স্বাভাবিকভাবেই ভগ্ন স্বাস্থ্য। গ্রামে কোন চুরি-ডাকাতি হলে স্থানীয় সরকারী কর্তৃপক্ষ বারবার তাকেই ধরে এনে মারধর করে। অগত্যা তাকে পুনরায় চুরি-ডাকাতি করতে নামতে হয় । একথা সর্ব সত্য যে, এই চুরির জন্য মূলত সে ব্যক্তিগতভাবে দায়ী নয় । পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় জীবিকার যে নিদারুণ অনিশ্চয়তা বিরাজ করে তারই হাত। থেকে রেহাই পাবার জন্য অসংখ্য মানুষ উক্ত পথ গ্রহণ করে। কাজেই এ জন্য দায়ী। আমাদের বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা। আজ যে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির কোটি কোটি লােকের মধ্যে একটিও চোর বা চুরি নাই- এ কথা সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার ঘাের বিরােধীরাও স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে। পুঁজিবাদী সমাজে বেশ্যাবৃত্তি সম্বন্ধেও ঐ
৯৬
একই কথা। এ সব চিন্তা করেই আমরা চেয়েছিলাম যে, সরকার এমন কিছু করুক যাতে জেলখানায় থাকতে থাকতেই তারা সত্তাবে উপার্জনক্ষম হতে পারে।
অবশ্য এ জন্য যা করা উচিত তা হলাে প্রতিটি কয়েদীকে জেলখানায় বিভিন্ন ধরনের হাতের কাজ শিক্ষা দেওয়া। জেলে কম্বল তৈরি, বেতের কাজ, বাঁশের কাজ, তাঁতের কাজ অর্থাৎ হস্তশিল্পের প্রায় সবটাই শিক্ষা দেওয়া যেতে পারে। দীর্ঘদিন জেলে থাকাকালীন কয়েদীরা এসব ভাল করেই শিখে নিতে পারে। পরে এরা খালাস হলে সরকার এদের প্রত্যেককে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ মূলধন দিয়ে ঐ সমস্ত কাজ করানাের ব্যবস্থা করে দিতে পারে। এছাড়া জেলে থাকাকালীন প্রতিটি কয়েদীকে প্রয়ােজনমত পারিবারিক ভাতা দিতে পারে। অবশ্য কয়েদীদের সম্বন্ধে এগুলি আমরা আশু দাবি হিসেবে রাখিনি। আমরা তেলের ঘানি টানা, কয়েদীদের বিড়ি তামাক সরবরাহসহ হাজতিদের কিছু কিছু দাবি নিয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ আলােচনা করতে চাইছিলাম ।
যা হােক, অনশনরত বন্দীরা শ্লোগানে অংশগ্রহণ করলে তাদের কাউকে শাস্তি দেয়া হয়েছিল কিনা মনে নেই।
এই সময়ই ঢাকা থেকে খুলনার কমরেড আনােয়ার এবং মিরপুরের কমরেড নাছির বদলি হয়ে রাজশাহীর খাপড়া ওয়ার্ডে আসে। তারা ঢাকা জেলে রাজবন্দীদের মর্যাদার দাবিতে দীর্ঘ দেড়শত দিনের অনশন সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিল। আমরা তাদের কাছে ঢাকার রাজবন্দীদের এই বীরত্বপূর্ণ ও সুদীর্ঘ সংগ্রামের রিপাের্ট পাই। বিস্তারিত রিপাের্ট পাই কমরেড শিবেন রায়ের মৃত্যু সম্বন্ধে। এই সময় তাদের রিপাের্টের মধ্যে আর একটি বিষয় উল্লিখিত হয় এবং তা নিয়ে প্রকাশ্য মতদ্বৈততা দেখা দেয়। Storm the gate’ তাহলাে জেল বিপ্লবের তত্ত্ব। এই রকম একটি কথা আমরা বরিশাল জেলে থাকতে শুনে আসছিলাম। শুনে আসছিলাম এরই ফলে পশ্চিমবঙ্গের দমদমে গুলি চালনার কথা এবং কমরেড সুমখসহ আরও দুজন রাজবন্দীর নিহত হওয়ার কথা। আমরা তখনও শুনে আসছিলাম যে, বরিশাল জেলে লাল পতাকা উড়ান হবে। কিন্তু এর পরেপরেই আমরা রাজশাহীতে চলে আসি। এখানে কমরেড আনােয়ার ও নাসিরের রিপাের্টের পরই বুঝলাম যে তৎকালীন পার্টি জেল বিপ্লবের একটা পরিকল্পনা নিয়েছে। বক্তব্যটা ছিল নিমরূপঃ
যেহেতু পাকিস্তান সৃষ্টি একটি প্রতিবিপ্লবী কার্যক্রমের ফল। এ দ্বারা জনতার বিন্দু মাত্র উপকার তাে হয়ই নাই বরং এর ফলে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কজা আরও শক্তিশালী হয়েছে, জনগণ তাই এর জোয়াল থেকে মুক্ত হবার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত। কাজেই এটাকে বিপ্লবী পরিস্থিতি বলা চলে এবং এই পরিস্থিতিতে জেল ভেঙ্গে বেরিয়ে যাবার চেষ্টা করলে কি বাইরে, কি ভিতরে জনতার সক্রিয় সহযােগিতা পাওয়া যাবে । বলাবাহুল্য, আমরা অনেকেই এ তত্ত্বের সমর্থক ছিলাম না ।
৯৭

বত্রিশ
বর্ধমানের কমরেড মনসুর হাবিব সরাসরি এর বিরুদ্ধাচরণ করলেন। তিনি বললেন যে, তিনি লেনিনের কোন গ্রন্থে জেল বিপ্লবের তত্ত্ব বলে কিছু পাননি। কিন্তু তার এই প্রতিবাদ অত্যন্ত ক্ষীণ কণ্ঠের মত শােনাল। তৎকালীন বামপন্থী হঠকারিতার প্রবল জোয়ারে তা কোথায় ভেসে গেল- আমরাও চুপ করে গেলাম।
যা হােক, তার কয়েকদিন পরে রাজশাহী জেল পরিদর্শন করতে আসেন। আইজিপি প্রিজন্স বা ইন্সপেক্টর জেনারেল অব প্রিজন্স আমিরুদ্দিন সাহেব। তিনি এলে আমরা তার সঙ্গে দেখা করতে চাই। ইতিপূর্বে আমরা রাজবন্দীদের দাবি। এবং তৎসঙ্গে যতদূর মনে পড়ে কয়েদীদের কিছু কিছু দাবি দাওয়া নিয়ে উধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে স্মারকলিপি জাতীয় কিছু পাঠিয়েছিলাম। আমরা তার সঙ্গে দেখা করতে চাইলে তিনি আমাদের বলে পাঠান যে, তিনি দেখা করতে পারেন, যদি রাজবন্দীরা জেলের চিরাচরিত প্রথানুযায়ী তাকে সম্মান দেখায়। তাই সম্মান দেখানাের অর্থে খুব সম্ভব তিনি চেয়েছিলেন তার ওয়ার্ড ভিজিটের সময় আমরা যেন ফাইলে’ বসি এবং তাঁকে সরকার সালাম দেই। সরকার সালামের কায়দা হলাে আমরা দু’পায়ের উপর ভর দিয়ে ফাইলে অর্থাৎ সারিবদ্ধভাবে বসবাে এবং একজন জেল সিপাই সরকার সালাম’ বলে চিৎকার করলে আমরা দাঁড়িয়ে হাত তুলে তাঁকে সালাম দিব ।
আমরা সরাসরি এ ধরনের শর্ত প্রত্যাখ্যান করলাম। আমাদের কথা হলাে রাজবন্দীরা ফাইলেও বসবে না, সরকার সালামও দিবে না। আমরা তাদেরকে জানিয়ে দিলাম যে, রাজবন্দীদের মর্যাদা আদায়ের জন্য বিপ্লবী যতীন দাস ৬৩ দিন অনশন করে মৃত্যুবরণ করেন। ফলে রাজবন্দীদের জন্য ব্রিটিশ আমল থেকে ফাইলে বসা বা সরকার সালাম দেওয়ার রেওয়াজ উঠে গেছে। আমরা পাকিস্তানের নব্য শাসকশ্রেণীকে সে কথা স্মরণ করতে বলি।
তাছাড়া আমাদের বক্তব্য হলাে নিশ্চয়ই আমরা যে কোন অফিসারের সঙ্গে ভদ্র ব্যবহার করব। সেটা ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু সরকারীভাবে আমরা তাঁকে বাধ্যতামূলক সম্মান দেখাতে রাজি নই।
শেষ পর্যন্ত কি ভেবে আইজিপি আমাদের সঙ্গে দেখা করতে রাজি হলেন এবং উপরােক্ত শর্তাবলী আরােপ থেকে বিরত রইলেন ।
৯৮
এদিকে আমরা খাপড়া ওয়ার্ডের এবং খুব সম্ভব অন্যান্য ওয়ার্ডেরও প্রতিনিধি হিসাবে এখান থেকেই দশ বারাে জন কমরেডকে আইজিপি এর সঙ্গে আলাপে পাঠাই। এই প্রতিনিধিদের মধ্যে ছিলেন কমরেড অমূল্য লাহিড়ী (পাবনা), কমরেড সীতাংশু মৈত্র (রাজশাহী), কমরেড মনসুর হাবিব (বর্ধমান), কমরেড আবদুল হক (যশাের), কমরেড বিজন সেন (রাজশাহী), কমরেড হানিফ শেখ (কুষ্টিয়া)। এ ছাড়া আর কারাে নাম মনে করতে পারছি না। এদের জেল গেটের অফিসে দাঁড় করিয়ে রেখেই আইজিপি কথা শুরু করলে এরা তাঁর কথার জবাব দিতে অস্বীকার করেন এবং কথা বলার পূর্বে বসার দাবি করেন। আইজিপি অগত্যা তাদের বসার ব্যবস্থা করেন।
এর পর আলাপ শুরু হয় এবং প্রথমেই আমাদের প্রতিনিধিরা কয়েদীদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া তার কাছে উল্লেখ করেন। এর ফলে তিনি চটে যান এবং আমরা জেলখানার কয়েদীদের কথা বলি কেন জিজ্ঞেস করেন। আমাদের উত্তর হলাে- কয়েদীরা আর আমরা যখন একই জেলে আছি এবং তাদের দাবি যখন ন্যায়সঙ্গত তখন নিশ্চয়ই আমাদের তাদের জন্য কিছু করা উচিত। কারণ আমরা জনতার দুঃখ-দুর্দশা মােচনের জন্যই জীবন উৎসর্গ করেছি । আসল কথা হলাে জেল এবং বাইরের প্রশ্ন নয় দেশসেবক হিসেবে যেখানেই জনসমষ্টি অন্যায় অত্যাচারে জর্জরিত হচ্ছে সেখানেই আমরা তাদের হয়ে সংগ্রাম করে যাব। সঙ্গে সঙ্গে আই-জি-পি’র কাছে আমরা নিজেদের দাবি-দাওয়ার কথাও তুলে ধরি। শেষ পর্যন্ত তিনি বললেন, আমি আপনাদের দাবি দাওয়া বিবেচনা করতে চাই। ইতিমধ্যে এগুলাে নিয়ে জেলমন্ত্রী এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপও করেছি । কিন্তু তারা কোন কিছু না করলে আমি কি করতে পারি? এভাবে গতানুগতিক আমলতান্ত্রিক কায়দায় একের দোষ অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে কোন রকমে আমাদের বুঝ দিতে চেষ্টা করেন। আমাদেরও সুস্পষ্ট কোন জবাব না পেয়ে ওয়ার্ডে ফিরে আসতে হলাে।
আপাতত কয়েদীরাও অনশন ভেঙে শান্ত রইল । খুব সম্ভব অনশনের জন্য যাদের শাস্তি হয়েছিল জান খাঁ সহ তাদের উপর থেকে শাস্তি উঠিয়ে নেয়া হয়েছিল ।
এরপর আই-জি-পি জেল ত্যাগ করার সময় সুপারকে অর্ডার দিয়ে যান আমাদের প্রতিনিধি স্থানীয় বারাে চৌদ্দজনকে খাপড়া ওয়ার্ড থেকে অন্যত্র সরিয়ে নিতে হবে । যথাসময় সুপার মিঃ বিল আমাদের কয়েকজনকে খাপড়া ওয়ার্ড ত্যাগ করে চৌদ্দ নং সেলে যেতে হবে জানিয়ে দেয় এবং এজন্য মাত্র একদিন সময় দেয়।
৯৯
এটা সম্পূর্ণ নতুন অবস্থা। বাইরের শক্তিই আমাদের শক্তির উৎস । কিন্তু তখন বাইরের রাজনৈতিক অবস্থা কোনক্রমেই আমাদের অনুকুলে ছিল না। ১৯৪৮ সনে ভাষা আন্দোলন এবং মূলনীতির রিপাের্টের উপর এডভােকেট জনাব কমরউদ্দীনের নেতৃত্বে ঢাকায় একটি কনভেনশন হয়ে যাবার পর গণতান্ত্রিক মহল থেকে তেমন উল্লেখযােগ্য কিছু করা হয়নি।
১০০

তেত্রিশ
তখনও জনসাধারণ মনে করতাে যে, শিশু রাষ্ট্র পাকিস্তানে কোনরূপ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক আন্দোলন করে তৎকালীন সরকারকে বিব্রত করা উচিত নয়। তদুপরি কমিউনিস্টরা পঞ্চম বাহিনী এবং দেশের শত্রু’ এ প্রচারও জোরদার ছিল। আমরা যে একটা বিরাট সংখ্যক রাজবন্দী গত ৪৮ থেকে কারান্তরালে ধুকে মরছি এ সংবাদ বাইরের জনসাধারণের এমন কি বুদ্ধিজীবী মহলের একটা ক্ষীণ অংশেরও জানা ছিল না।
এমতাবস্থায় আমরা জেল কর্তৃপক্ষের আদেশ অমান্য করব কিনা তা গভীরভাবে ভেবে দেখা দরকার ছিল। কিন্তু ফলাফল যাই হােক, আমাদের কাছে প্রশ্ন ছিল একটা নেহায়েত অন্যায় আদেশ মেনে নেয়া যায় কি করে। আমাদের কথা ছিল জেলে একত্র থাকার অধিকার যাকে বলে Right of association সেটা দীর্ঘদিনের সংগ্রামের দ্বারা অর্জিত অধিকার। সে অধিকার আমরা কিছুতেই ছেড়ে দিতে রাজি নই। কি করব না করব তা নিয়ে আমাদের মধ্যে দীর্ঘ আলােচনা হলাে। জেল সুপারের উক্ত আদেশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা প্রায় ২৪ ঘণ্টা স্থায়ী বৈঠক করি। প্রথম কথা হলাে, আমরা কিছুতেই বিচ্ছিন্ন হতে পারি না। যে রাজবন্দীর মর্যাদা আদায়ের জন্য বিপ্লবী যতীন দাস জীবন দিয়েছেন, এই সেদিন জীবন দিলেন কমরেড শিবেন; দীর্ঘ অনশনের ফলে অসংখ্য রাজবন্দী চিরদিনের জন্য রুগ্ন হয়ে রইল, আমরা নিজেরাই সহজে সেই অধিকারকে বিকিয়ে দিতে পারি
তাছাড়া জেল কর্তৃপক্ষ আমাদের কয়েকজনকে বিচ্ছিন্ন করে চৌদ্দ নং সেলে নিয়ে যেতে চায়। সেখানে কিছুতেই যাওয়া চলে না, কারণ সেটা হলাে condemned cell অর্থাৎ সেখানে যক্ষ্মা ও কুষ্ঠরােগী রাখা হতাে। যে কোন মৃতের লাশ সেখানে Post mortem করা হতাে। ফাঁসির আসামী রাখার সেলও ওখানেই। কাজেই কঠিন শাস্তিপ্রাপ্ত এবং ব্যাধিগ্রস্ত আসামীদের জন্য নির্দিষ্ট সেলে আমরা যাব কেন? যা হােক, আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম আমাদের কাকেও এখান থেকে নিয়ে যাওয়া চলবে না। আমাদের সকলেই একমত হলাম। অবশ্য তখন অবস্থা এমন ছিল যে, জেল নেতৃত্ব সবাইকে মতামত প্রকাশের সুযােগও দেয়নি। মনে হয় জেল বিপ্লবের তত্ত্ব ততক্ষণে অনেকের মনে সংক্রমিত হয়েছিল অথবা নেতৃত্বের কঠোর ও একগুঁয়ে মনােভাবের বিরুদ্ধে কেউ দ্বিমত প্রকাশের সাহস পাননি। তবুও মনে আছে দিনাজপুরের ডাঃ গণেশ সরকার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন যে,
১০১
আমাদের এ আদেশ অমান্য করা উচিত নয়। এখন আমরা সেলে গিয়ে পরে আবার একত্র হওয়ার জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ নেব। তাঁর বক্তব্য শেষ হলে আমাদের জনৈক বন্ধু যশােরের হীরেন সেন তাঁর স্বভাবসিদ্ধ অবস্থায় দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসে বেশ গাম্ভীর্যের সঙ্গেই চিৎকার দিয়ে বলেছিলেন, দেখ হক, যদি না যাও তাহলে যে কোন অবস্থার জন্য প্রস্তুত থেকো বলে দিলাম। তীক্ষ্ণধী এই বন্ধুটি কথা কয়টি বলে অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে গেলেন। কিন্তু সেই চরম উত্তেজনার মুহূর্তে কেউই তাঁর বা ডাঃ সরকারের কথায় কান দিল না বা দেয়ার কোন প্রয়ােজনীয়তাও উপলব্ধি করল না। কমরেড মনসুর হাবিব এ ব্যাপারে চুপ। করেছিলেন বলেই মনে হয়। এটা ধরে নেওয়া যায় যে, আমাদের এ সিদ্ধান্ত যথাসময় কর্তৃপক্ষের কানে গিয়েছে। আমাদের যেদিন ১৪নং এ যাবার কথা তার পূর্বদিন বিকালে সুবেদার আকবর খা এসে জানাল, “ঠিক হ্যায়, তােমলােগকে পরশু দিন লে যায়েঙ্গে চৌদ্দ ওয়ার্ড মে- উহা আভি হােয়াইট ওয়াস হােনেলাগা ।” আমরা বুঝলাম হােয়াইট ওয়াসের নামে তারা তাদের মুখরক্ষা করতে এসেছে এবং আমরা যখন যাবােই না, তখন তাদের কি করণীয় তা নিয়ে ভাবার জন্য সময় নিচ্ছে। অন্তত সুবেদারের ভাবভঙ্গীতে তাই মনে হলাে।
এ সিদ্ধান্তের পর সারা জেলে এক থমথমে পরিস্থিতির সৃষ্টি হলাে। আমরা অবশ্য আমাদের পার্টির বহু আভ্যন্তরীণ সমস্যা নিয়ে আলাপ আলােচনায় ব্যস্ত ছিলাম। আমাদের এই সিদ্ধান্তের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সম্বন্ধে অতিরিক্ত সময় নষ্ট করার অবকাশ ছিল না বা এটা পুনর্বিবেচনা করার কথা কেউ চিন্তাও করে নাই। তবে এ কথা সত্য যে, আমাদের মধ্যে সবাই মনে মনে এ সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। যতদূর জানি, কমরেড মনসুর হাবিবের এ ব্যাপারে দ্বিমত ছিল; কিন্তু এ নিয়ে প্রকাশ্য বাদানুবাদ করে নিজের মত প্রতিষ্ঠার চেষ্টা তিনি করেননি। আরও কিছু কমরেড জেল কর্তৃপক্ষের এ জাতীয় আদেশকে সরাসরি অমান্য করাকে চরম হঠকারিতা বলে মনে করলেও আপাতত চুপ করে রইলাে। এই ভয় যে, পাছে কেউ তাকে ভীরু বা বিপ্লববিরােধী মনে করে। আজ মনে হয় এ ধরনের সিদ্ধান্তের পিছনে হয়ত জেল বিপ্লবের ভ্রান্ত তত্ত্ব কাজ করছিল।
এই সময় একটি ঘটনা ঘটল। ভােলা নিবাসী আরশেদ, নামক আমাদের পূর্ব পরিচিত একজন রাজবন্দীকে খাপড়া ওয়ার্ড থেকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হলাে। আরশেদ ছাত্র আন্দোলন করত। সে কখন গ্রেফতার হয় জানি না কিন্তু তাকে গিয়ে রাজশাহী জেলের খাপড়ায় দেখি । ঠিক যে ভাবে যে সময় তাকে খাপড়া ওয়ার্ড থেকে নিয়ে যাওয়া হয়, সেটা রহস্যজনকই বলতে হবে। আরশেদ আজ বেঁচে নেই। তার নিজেরই প্রবল ইচ্ছায় সে খাপড়া ওয়ার্ড ত্যাগ করে। ঠিক ঐ দিনই
১০২
খুব সম্ভব বরিশালের দিলীপ সেনকেও ওয়ার্ড থেকে সরিয়ে নেয়া হয়। তার সম্বন্ধেও আমাদের মনে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে।
এদিকে আমাদের পূর্ব নির্দিষ্ট কমরেডদের খাপড়া ত্যাগ করার দিন এসে গেছে। সেটা ছিল ১৯৫০ সালের ২৪শে এপ্রিল। খুব সম্ভব সােমবারই হবে । এদিন আবার সুপারের সাপ্তাহিক জেল ভিজিটের তারিখ । প্রকৃতিতে সে দিন কোন অস্বাভাবিকতা ছিল না বলেই মনে হয়। হয়ত বা ছিলও। কিন্তু আমরা ছিলাম নিজেদের কোন বিষয় নিয়ে আলাপ আলােচনায় এত মগ্ন যে এ দিন সে সম্পর্কে কিছুই ভাববার অবকাশ পাইনি। হয়ত সে দিন আকাশ পৃথিবী বৃক্ষলতাসহ সমস্ত প্রকৃতি শ্বাসরুদ্ধ করে আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিল। হয়ত সেদিন এক আকস্মিক বিপদ সংকেত বাতাসে প্রবাহিত হচ্ছিল। পত্র পল্লবগুলি কম্পিত হচ্ছিল। ভাের সূর্যের লালিমা আরও রক্তাক্ত হয়ে উঠেছিল। হয়ত আমাদের চারিদিকে উঁচু দেয়ালগুলি ভয়ার্ত চক্ষু মেলে তাকিয়ে ছিল আমাদের দিকে কিন্তু আমাদের তা লক্ষ্য করার সময় ছিল না।
বাইরের লক্ষ লক্ষ জনতা যখন বুভুক্ষু, দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা, নিত্য অনাহারে অর্ধাহারে, অগণিত মানুষ যখন মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তখন জেলে আইন অমান্য করে আমাদের গুটিকয়েক রাজবন্দীর ভাগ্যে কি ঘটবে তা নিয়ে ভাবার অবসর ছিল না। আমরা ভাবছিলাম কি করে চার দেয়ালের মধ্যে থেকেই আমরা বাইরে গণতান্ত্রিক সংগ্রামের পথনির্দেশ করতে পারি।
আমাদের মনে আছে আমরা আমাদের পার্টির আভ্যন্তরীণ কোন বিষয়ের উপর আলােচনা করার জন্য রবিবার সন্ধ্যায় বসে সমস্ত রাত কাটিয়ে মাত্র ঘণ্টা খানেকের জন্য একটু ঘুমিয়ে নিয়ে আবার ভাের ছটায় আমাদের সভা পুনরায় শুরু করেছি। কুষ্টিয়ার শ্রমিক নেতা জেল পার্টি কমিটির অন্যতম সদস্য (তিন সদস্যবিশিষ্ট সেক্রেটারিয়েটের অন্যতম) কমরেড হানিফ সভায় সভাপতিত্ব করছেন। কমরেড মনসুর হাবিব না হয় কমরেড সীতাংশ মৈত্র আলােচনা করছেন বিভিন্ন সমস্যার ওপর।
১০৩

চৌত্রিশ
খাপড়া ওয়ার্ডে গুলি চালনা
২৪শে এপ্রিল আমাদের কিচেনের রাজবন্দীরা রুটি, চা নিয়ে আসছে। কেউ কেউ খাটের কোণায় কেটলী, রুটির থালা রেখে আলােচনা শুনছে । আমরা সবাই অত্যন্ত অবসাদগ্রস্ত, ক্লান্ত, নিদ্রাকাতর। পূর্বেই বলেছি, গতকাল সারা রাত ধরে আলােচনা চলেছে। এখন বেলা প্রায় ৯টা হবে। মনে আছে আলােচনা যখন দীর্ঘ হতে চলেছে তখন সভাপতি হানিফ বলল ঃ কমরেড সংক্ষেপ করুন, আর সময়। নেই। এখন বুঝি, এর দুটো অর্থ হতে পারে, আপনি আলােচনা সংক্ষিপ্ত করুন, অন্য কমরেডরাও রয়েছেন, তারাও বলবেন অথবা এখনই সুপার পরিদর্শনে আসবেন। আমাদের বৈঠক বন্ধ করতে হবে। তবে কে জানত যে, এটাই ছিল কমরেড হানিফের শেষ কথা। সময় নাই ঠিকই, তার সময় আর হলাে না এ পৃথিবীতে।
কমরেড হানিফের কথা সারা হতে না হতেই খাপড়া, ওয়ার্ডের বাইরে অনেকগুলি বুটের খট খট আওয়াজ শুনতে পেলাম। সভাপতি উঠে দাঁড়াতেই আমরা পিছন ফিরেই দেখি সুপার মিঃ বিল, ডাক্তার, দুইজন ডেপুটি জেলার, সুবেদার আকবর খা, কয়েকজন মেট এবং সিপাহীসহ প্রায় পঁচিশ ত্রিশ জন। ওয়ার্ডের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। সুপার সরাসরি পূর্ব দিকে হক সাহেবের কাছে গিয়েই বলল “Be ready Haque, some of you are to be segregated now” হক সাহেব সঙ্গে সঙে্গ বললেন : Just sit down please, we have talks with you about this matter” আমি তখন ঠিক বিলের পাশেই দাঁড়ান। সে হকের কথা শেষ না হতেই “Shut up the door” বলে চিৎকার করে উঠল। মনে হলাে এই আদেশ দেওয়ার পরই তার খেয়াল হল খাপড়ার একটি মাত্র গেট বাইরে থেকে আটকে দিলে তাতে সবাইকে নিয়ে আটকা পড়বে। তাই সে অর্ডার দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত দৌড়ে বেরিয়ে যেতে চাইল। গেটে দাঁড়ান ছিল পাবনার উল্লাপাড়ার বাবর আলি, কুষ্টিয়ার দেলওয়ার, বরিশালের আবু (রশীদউদ্দীন)। তারা গেটটি প্রায় বন্ধ করে আনছিল, এরই মধ্যে বিল এসে বাবর আলির হাতে হান্টার দিয়ে সজোরে আঘাত করে তার কবজি ভেঙ্গে দিল এবং বুট দিয়ে প্রচন্ড
১০৪
ধাক্কা মেরে গেটের বাইরে বেরিয়ে গেল । বিলের ঠিক পশ্চাতে ছিল কমরেড সদানন্দ। সে সুবেদারের পাগড়ি ধরে টান দেওয়ায় সুবেদার পাগড়ি রেখেই বেরিয়ে গেল । এদিকে বিল বেরিয়েই বাঁশিতে হুইসেল দিল। সঙ্গে সঙ্গে প্রায় চল্লিশ জন সিপাই লম্বা বাঁশের লাঠি নিয়ে খাপড়ার বারান্দায় এসে উপস্থিত হলাে। ইতিমধ্যে আমরা ভিতর দিয়ে গেট আটকিয়ে দেয়ায় ওদের কেউ ভিতরে ঢুকতে পারল না। কিন্তু ওরা সমস্ত জানালার গরাদের ফাঁক দিয়ে লাঠি ছুঁড়ে মারতে লাগল । উন্মত্ত আক্রোশে সিপাইরা গরাদের উপর লাঠি দ্বারা প্রচন্ড আঘাত করতে লাগল। আমরাও আমাদের লােহার খাটগুলি এগিয়ে নিয়ে জানালার কপাটগুলি আটকাতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু ওদের লাঠির সামনে এগােতে পারছিলাম না । এরই এক ফাঁকে আমি জানালার কাছে গিয়ে উর্দুতে সাধারণ সিপাইদের উদ্দেশ্যে বলতে লাগলাম ঃ “সিপাহী ভাইও ইয়ে লড়াই তােমলােগাে কা নেহি হায়। মগার ইস সরমায়াদার সরকারকে সাথ জো তােমকো আওর হামকো ভি দুশমন হ্যায়।” বলা শেষ হতে না হতেই এক মেট এসে আমার হাতে এমন বাড়ি মারল যে আমার ডান হাতের তর্জনীটি কেটে সামান্য একটু চামড়ার সঙ্গে ঝুলে রইল । আমি দৌড়ে ভিতরে গেলে কমরেড সত্যেন সরকার আমার আঙ্গুল বেঁধে দিলাে। তারপর আবার আমরা খাট নিয়ে জানালার দিকে এগুতে লাগলাম। আমরা এবার আমাদের কাঁসার থালা, ঘটি, বাটি, শিশি, দোয়াত যাবতীয় জিনিস জানালার ফাঁকা দিয়ে ওদের দিকে ছুড়তে লাগলাম। ওরাও এমনভাবে লাঠি দিয়ে জানালায় দেওয়া আমাদের লােহার খাটগুলিকে ধাক্কা দিয়ে ফেলতে লাগল যে আমাদের দিনাজপুরের কমরেড কালী সরকার এবং মিরপুরের নাসির খাটের নীচে পড়ে গেল । মনে আছে খাপড়ার দক্ষিণ দিকে আমি একটি দোয়াত নিয়ে বাইরে সজোরে নিক্ষেপ করছি এমন সময় ফায়ার শব্দে খাপড়া যেন বিদীর্ণ হলাে। চকিত দৃষ্টিতে দেখলাম, খাপড়ার প্রায় পঞ্চাশটি জানালায় বন্দুকের নল লাগিয়ে সিপাহীরা দাঁড়িয়ে আছে। আমি তৎক্ষণাৎ উপুড় হয়ে বালিশের নীচে মাথা গোঁজার সঙ্গে সঙ্গে রাইফেলের গর্জনে খাপড়ার ভিত যেন ফেটে চৌচির হতে চাইল। গেটের দিকে। একটু চোখ পড়তেই দেখলাম ফিনকি দিয়ে রক্ত একেবারে ছাদ পর্যন্ত উঠছে। আমার মাথা একটি সাপাের্টিং ওয়ালের আড়ালে বালিশের নীচে গোঁজা ছিল, পাকনুই বাইরে ছিল। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম হাঁটু দু’ফাঁক করে স্পিলিন্টার ঢুকে গেল। বালিশের নীচ থেকে দেখলাম পাশেই কমরেড হানিফের বাহুর উপরিভাগ ছিড়ে গেছে এবং সেখান থেকে অঝােরে রক্ত ঝরছে। একটু পরেই কমরেড হানিফকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে দেখি । যেন দেখলাম আমার অদূরেই কুষ্টিয়ার কমরেড নন্দ সান্যাল রক্তাক্ত শরীরে মেঝের উপর লুটিয়ে পড়েছে। আমার হুশ হারাবার
১০৫
পূর্বে যতটুকু মনে আছে দেখলাম খাপড়া ওয়ার্ডে রক্তের স্রোত বইছে। আমার শরীর বুক পর্যন্ত রক্তে ডুবন্ত।
এর পর আমার কিছু মনে নেই। সংজ্ঞা হারাবার পূর্বে গুলিবিদ্ধ রাজবন্দীদের বীভৎস আর্তনাদের কথা আমার মনে পড়ে। যখন হুঁশ হলাে তখন বেলা দশটা । তখনকার দৃশ্য বর্ণনা করা যায় না। সে দৃশ্য ভয়ঙ্কর। রক্তের গন্ধে অসংখ্য মাছি এসে জুটেছে। মাছিগুলাে আহতদের ঘিরে ধরেছে। ইতস্তত বিক্ষিপ্ত লােহার খাটগুলি, রাইফেল নির্গত অসংখ্য স্পিলিন্টার, বুলেট, সারা মেঝেয় ছড়ানাে থালা বাসন, গ্লাস, দোয়াত, ওষুধের শিশি, রক্তে ভেজা স্তুপীকৃত কাপড়চোপড়, বইপত্র সব মিলে যে দৃশ্যের সূচনা করছিল তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তবে কেউ যদি কোন কাল্পনিক নরকের ভয়াবহ চিত্র কোনদিন কল্পনা করে থাকে তার কল্পনার সঙ্গে এই বাস্তব দৃশ্যের সাদৃশ্য থাকবে নিশ্চয়ই। মানুষ কর্তৃক রক্তের হােলি খেলার পর মাছি এবং বালুকণার আক্রমণ শুধু এই কথাটাই স্মরণ করিয়ে দেয় যে, পুঁজিবাদী সমাজে দেশপ্রেম এক বীভৎস অভিশাপ। এ অভিশাপের বাস্তব রূপ নিয়ে তারা যেন আমাদের মাংস টুকরা টুকরা করে ছিড়তে আসছিল । গুলি চালনা শেষ হবার সাথে সাথে খাপড়ার গেট খুলে দেওয়া হলাে। অমনি মােটা বাঁশ নিয়ে সিপাহীরা ঝড়ের বেগে ঢুকে অন্যান্য কমরেডদের উপর লাঠিচার্জ শুরু করল। তা দেখলে হৃৎকম্প উপস্থিত হয়। খুঁটির মত এক একটা মােটা বাঁশ দুই হাতের উপরে তুলে যেন কলাই পিটানাের মত এক একজনকে পিটুচ্ছে। লাঠির প্রচণ্ড আঘাতে সিলেটের অনন্ত দেবের মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙ্গে গেল। এক একটা বাড়িতে যেন কমরেডরা খাপড়ার সিমেন্টের মেঝের সঙ্গে মিশে যেতে লাগলাে। লাঠির আঘাতে কমরেড আবদুল হকের হাত অকেজো হয়ে গেলাে । যে সমস্ত কমরেড গুলিবিদ্ধ হয় নি অথচ লাঠির আঘাতে শুয়ে পড়তে হয়েছে, তারা গড়িয়ে গড়িয়ে মুমূর্ষ আহত কমরেডদের কাছে এগুচ্ছিলেন। এ দেখে সিপাইরা দ্বিতীয়বার লাঠিচার্জ করল । এই দ্বিতীয়বার লাঠিচার্জের পর বিল সাহেব নিজে হান্টার হাতে আমার সামনে ক্ষণিকের জন্য দাঁড়িয়ে আমাকে দেখতে লাগল। আমি তখন কেমন করে যেন একটা লােহার খাটের নীচে বারাে আনি ঢুকে রয়েছি। এ অবস্থায় না থাকলে হয়ত আমি লাঠিচার্জ এড়াতে পারতাম না। যতদূর মনে পড়ে, খাটের উপর কমরেড বিজন সেন চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। তার পেটে গুলি লেগেছিল এবং পেট অসম্ভব। রকম ফুলে উঠেছিল। সে চিৎকার করে বলেছিল, কমরেড, আমরা মরি নাই, আমরা জয়লাভ করেছি, ভবিষ্যত আমাদের।” আমি নীচু থেকে চিৎকার করে বললাম ” বিজন দা আমরা মরি নাই, বেঁচে আছি।’ এরপরই বিজনদা আর কথা বলেনি। ঐ খাটের উপরই তার মৃতদেহ পড়ে রইলাে। ইতিমধ্যে বিল সাহেব এসে গেছে। বিল কমরেড হককে খুঁজছিল । আমাকে হক মনে করে খাটের তলা
১০৬
দিয়ে বিশেষভাবে লক্ষ্য করছিল কিন্তু যখনই বুঝতে পারল আমি হক নই, তখনই একটু সরে গিয়ে হককে পেয়েই তার মাথায় হান্টার দিয়ে আঘাত করল। দেখলাম, আঘাতের চোটে কমরেড হক চিৎকার করে উঠে বসে আবার ধপাস করে পড়ে গেল এবং তার মাথা থেকে ফিনকি দিয়ে অনেক রক্ত উপরে উঠতে লাগল। দেখলাম, বিল এরপর আহত কমরেডদের গা মাড়িয়ে হন হন করে বেরিয়ে গেল। এরপরও যে সমস্ত কমরেড কোন রকম হামাগুড়ি দিয়ে আহত কমরেডদের কাছে। আসছিল সিপাইরা তৃতীয় দফায় তাদের উপর প্রচন্ড লাঠি চালাল। এই তৃতীয় বার লাঠি চালনার পুরােভাগে ছিল ভাগলপুরের মনছুর নামে জনৈক বিহারী সিপাই। সে কথায় পরে আসছি।
যাহােক ইতিমধ্যে আহত কমরেডদের ক্ষতের প্রতিক্রিয়াস্বরূপ অসহ্য যন্ত্রণা শুরু হলাে। ডাক্তার এসে আমাদের অনেককে ক্যাথিডার দিয়ে প্রস্রাব করালাে এবং আমাদের সবাইকে মরফিয়া ইনজেকশন দিয়ে দিল। আমরা যখন জ্ঞান ফিরে পেলাম, তখন দেখি রাইফেল হাতে প্রায় চল্লিশজন সিপাহী দাঁড়িয়ে আছে। তাদের একজন অধিনায়ক বলল, “আমরা মিলিটারীতে ছিলাম। যুদ্ধও করেছি, কিন্তু আবদ্ধ ঘরে এরূপ নৃশংসভাবে গুলি করে মারার নজির কোথাও আছে জানি না । এর চেয়ে নিষ্ঠুরতা যে কী হতে পারে জানি না।” জেলে পাগলা ঘণ্টি পড়লে বাইরে থেকে সশস্ত্র সিপাইদের ভিতরে আসতে হয় । তাই এরা এসেছে। আমরা তাদের কাছে আমাদের মৃত কমরেডদের লাশ দেখবার জন্য চিৎকার করে আবেদন করলাম। আমার মনে আছে আমি তাদের উদ্দেশ্য করে বললাম, “আজ আমরা বন্ধুদের হত্যার প্রতিশােধ নিতে পারলাম না। কিন্তু জনতা এর প্রতিশােধ নেবেই।”
১০৭

পঁয়ত্রিশ
এ সময় আর একটি ঘটনা। এই ঘাের বিপদের মধ্যে এক মহান সান্ত্বনা এনে দিল। পাশ ফিরতেই দেখি আমার শিয়রে এক কাপ গরম দুধ হাতে আমারই পাশের গ্রামের বিখ্যাত ‘ডাকাত’ আরশেদ বসে আছে। তার দিকে চাইতেই সে বলল, “মিয়ার পাে, খাপড়ার রক্ত ধুইতে আমাদের আনা হয়। ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ আপনাকে দেখলাম। সেই সময় থেকে এই দুধের কাপ নিয়ে বসে আছি, ভাবলাম সার্থক আপনাদের জীবন, এমনি করে আপনারা আমাদের জন্যই জীবন দিতে বসেছিলেন এখানে।” বলতে বলতে আরশেদ কেঁদে দিল । দুধ তখনও ঈষৎ গরম রয়েছে। আরশেদের হাতেই এক বাটি দুধ, সবটা পান করলাম। জিজ্ঞেস করলাম, আরশেদ ভাই এখানে কবে এলে। বলল, জানেন না আমাদের কৃষ্ণপুরের মুসলিম লীগের বড় পান্ডা আফতাবউদ্দিন ডাকুয়া আমাদের সম্পত্তি দখল করতে চাইলে তাকে জমিতেই শােয়াইয়া দিই। সেই কেসে ধরা পড়ে জেলে আসি। বলল, পঞ্চাশের দাঙ্গায় দেশে যে কী হয়েছে বের হলে জানতে পারবেন। খলিশাকোঠার দাসের বাড়িসহ সমস্ত বাড়ির সম্পত্তি দেদার লুট হয়ে গেছে। তবে তাদের কাউকে প্রাণে মারা হয়নি। আরশেদরা দু’ভাই আরশেদ আর আকবর। এক নামে বরিশালের বহু জায়গার লােকে এদের চেনে। নিকটস্থ বাকপুরেও রয়েছে কয়েকটি বিখ্যাত ডাকাত পরিবার। সেদিন আরশেদের মধ্যে আসল মানুষটি আবিষ্কৃত হয়েছিল। পুঁজিবাদী সমাজ এদের ডাকাতি করতে বাধ্য করেছে। কিন্তু ধর্মের মুখােশধারী জাকালাে পােশাকে সজ্জিত বড় চাকুরে বহু ভদ্রলােকের চেয়ে মনুষ্যত্বে। এরা অনেক শ্রেষ্ঠ।
এরপর বিকেল ৩টা নাগাদ আমাদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলাে। বলা বাহুল্য, যারা মারা গেছেন তাদের সঙ্গে সঙ্গে খাপড়া থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে । আমরা তাদের মধ্যে একমাত্র হানিফকেই দেখেছিলাম কারা তার লাশ টেনে নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের সহবন্দীরাই হবে- আর তাদের কোলেই হানিফ শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছিল। হাসপাতালে গুরুতরভাবে আহত কমরেডদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানে গিয়ে শুনলাম পাবনার লাহিড়ী মােহনপুরের অশীতিপর বৃদ্ধ কমরেড অমূল্য লাহিড়ী তখন ওখানে ছিলেন, রােগশয্যা থেকে তিনি খাপড়ায় আমাদের হত্যাযজ্ঞ দেখতে পেয়ে খাট থেকে একটা ঔষুধের বােতল নিয়ে লাফিয়ে উঠে আবার অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। বিপ্লবের জন্য সারাজীবন উৎসর্গ
১০৮
করেছেন লাহিড়ী, মােহনপুরের জমিদার অমূল্য দা’রা। তারই এক ভাই শ্রী রাজেন লাহিড়ী ব্রিটিশ আমলে দেশের জন্য ফাঁসিকাষ্ঠে জীবন দিয়েছিলেন।
ঐ সময় হাসপাতালে গুরুতর আহতদের মধ্যে ছিলেন বর্ধমানের কমরেড মনসুর হাবিব, যশােরের আবদুল হক, দিনাজপুরের কম্পম সিং (তিনি পরের দিন হাসপাতাল মারা যান) বগুড়ার শ্যামাপদ সেন, পাবনার আমিনুল ইসলাম, পবিত্র প্রসাদ রায়, বাবর আলী, কুষ্টিয়ার সত্যেন সরকার, নন্দ সান্যাল, বরিশালের সদানন্দ ঘােষ, সিলেটের প্রিয়ব্রত দাস, অনন্ত দেব । আরও কয়েক জন হবে নাম মনে করতে পারছি না- এরা সবাই কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। আর একজনের নাম মনে পড়ছে তিনি হলেন মুর্শিদাবাদের নুরুন্নবী চৌধুরী। এর ক্ষতস্থানে গ্যাংগ্রীন হওয়ার ফলে হাঁটুর উপর দিয়ে একটি পা কেটে ফেলতে হয়। হাসপাতালের সম্পূর্ণ দোতালাটি আমাদের জন্য ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। আমাদের চিকিৎসার জন্য মােটামুটি ভাল ব্যবস্থাই করা হয়েছিল।
তবে পাকিস্তানী সরকার যদি সভ্য সরকার হতাে তাহলে কমরেড হানিফকে খাপড়া ওয়ার্ডের মধ্যেই বাঁচাতে পারতাে। হয়তবা তার মত আরও দুই একজনকেও বাঁচাতে পারতাে। শুনেছি সরকার নাকি এ রকম সার্কুলার দিয়েছিল যে, আহতদের মধ্যে আর একজনও যেন মৃত্যুমুখে পতিত না হয়। এটা সত্য যে, হাসপাতালে এক কম্পদা ছাড়া আহতদের মধ্যে আর কেউ মারা যায়নি। তবে কম্পদাকে বাঁচানাের জন্য যে চিকিৎসা করা উচিত ছিল তা হয়নি। আমারই পাশে একজনের বেডের পরই কম্পদার বেড ছিল। দেখেছি তার উরুতে প্রায় সহস্রাধিক ছররা বা স্পিলিন্টার লেগে ওটাকে একেবারে ঝাঝরা করে ফেলেছে। বিশাল বপুর এই কৃষক বীরের মৃতদেহ কখন যে হাসপাতাল থেকে নিয়ে গেল তা আমরা দেখতে পাইনি। কিন্তু পরদিন ভােরে যখন তাঁর বেডটি খালি দেখলাম এবং তাঁর মৃত্যু হয়েছে শুনতে পেলাম, তখন এক তীব্র বেদনায় সমস্ত পাঁজর ভেঙে যেতে চাইল । তাঁর সাদা চাদরপাতা শূন্য বেডটির দিকে চেয়ে মনে হলাে, তিনি যেন বলে গেলেন আমি তােমাদের জায়গা ছেড়ে দিলাম। এসাে আরাে যুদ্ধাহত সৈনিক বিপ্লবের অবিরাম তরঙ্গে ভাসতে ভাসতে এসাে। আমার হাঁটুতে স্পিলিন্টার ঢুকে জোড়ার হাঁড় এমনভাবে ভেঙে দিয়েছিল যে পা সােজা করার জন্য একখন্ড ভারি কাঠ পায়ের সঙ্গে লাগিয়ে উপরে কড়িকাঠের সঙ্গে বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। পাশেই ছিল পাবনার কমরেড আমিনুল ইসলাম। তার পায়ে গােড়ালির উপরিভাগে বুলেট লেগে একটা শিরা ছিড়ে নিয়ে গেছে। ফলে সে চিরতরে খোঁড়াই হয়ে গেল । শুয়ে শুয়ে দেখতে পেলাম উত্তর-পশ্চিম কোণের খাটে সমস্ত মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা কমরেড হক। শুনেছি মিঃ বিলের লাঠির আঘাতে তার মাথায় এমন চোট লেগেছিল যে, তাঁর চৈতন্য ফিরে আসতে সাত দিন লেগেছিল। মারাত্মকভাবে
১০৯
আঘাতপ্রাপ্তদের মধ্যে ছিলেন বগুড়ার শ্যামাপদ সেন, সিলেটের প্রিয়ব্রত দাস, পাবনার পবিত্র প্রসাদ রায়, বর্ধমানের মনসুর হাবিব এবং মুর্শিদাবাদের নুরুন্নবী চৌধুরী। চিকিৎসায় দেরী না হলে নুরুন্নবী চৌধুরীকে গ্যাংগ্রীনের হাত থেকে বাঁচানাে যেত এবং তাঁর পাটা রক্ষা পেত। বহু চেষ্টা করেও কমরেডটি পরে একখানা রাবারের পা সংগ্রহ করতে পারেননি। তাঁকে দু’খানা বাঁশের উপর ভর করেই চলতে হয়েছিল । অবশ্য এই অপরাজেয় বিপ্লবী জেল থেকে মুক্ত হয়ে ঢাকায় পার্টি অফিস খুলেছিলেন। খুব সুন্দর, অত্যন্ত দৃঢ় মজবুত শরীরের গঠন। মুক্তোর মত শুভ্র দন্তপাটিদ্বয় । সদাহাস্য এই খােড়া বিপ্লবী জেল থেকে বের হয়ে যেন তৈমুরের শক্তিতে চ্যালেঞ্জ করছিলেন তৎকালীন স্বৈরাচারী মুসলিম লীগ সরকারকে। যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে পার্টির সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণের প্রাথমিক প্রস্তুতিতে কমরেড নুরুন্নবীর দান উল্লেখযােগ্য।
ঐ সময় খাদ্য হিসেবে গােট লিভার বা ছাগলের কলিজা, মাখন, মাছের ঝােল ইত্যাদি দেওয়া হতাে। গুলিবিদ্ধ শরীরের পচনক্রিয়া বন্ধের জন্য পেনিসিলিন ইনজেকশন দেওয়া হতাে। আমাকে ঐ সময় অন্তত এক কোটি ক্ষমতার পেনিসিল দেওয়া হয়েছিল। এছাড়া কমরেড শ্যামাপদ সেন ও প্রিয়ব্রত দাসকে বাঁচিয়ে তােলায় ডাক্তারদের চিকিৎসা নৈপুণ্যেরই পরিচয় বহন করে। সরকার হয়ত ভেবেছিল যে মৃতের সংখ্যা আরও বাড়লে ভবিষ্যতে এর প্রতিক্রিয়া অপ্রতিরােধ্য হয়ে উঠবে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সেই সরকারের আমলেই পরবর্তীকালে ভাষা আন্দোলনকারীদের উপর গুলি এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা তাদের জন্য মারাত্মক পরিণতি ডেকে এনেছিল । ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের অবিশ্বাস্য রকম পরাজয় এটা প্রমাণ করে।
এই সময় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকায় একদিনের একটা ঘটনা মনে পড়ছে। পূর্বেই বলেছি খাপড়ায় আমাদের তৃতীয়বার লাঠি চালনা কালে ভাগলপুরের মনসুর নামক এক সিপাহীকে উন্মত্ত আক্রোশে লাঠি চার্জের নেতৃত্ব দিতে দেখেছিলাম। একদিন বেলা তখন নটা হবে। উক্ত মনসুর আমাদের হাসপাতালে ঢুকতে গেলে আমি চিৎকার করে আমাদের রাইটার বগুড়ার শরাফতকে জানিয়ে দেই যে, সে যেন আমাদের ওয়ার্ডে না ঢােকে। কারণ সেই আমাদের সবচেয়ে বেশি লাঠি পেটা করেছে। শরাফত এগিয়ে গিয়ে তাকে ডেকে বাইরে নিল এবং বেশ কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে আমাদের জানাল যে, ঠিকই সেদিন ঐ সিপাহীই তৃতীয় বারের মত একদল সিপাহী নিয়ে এসে আপনাদের উপর ঝাপিয়ে পড়েছিল । সে বলল যে, সে গত দাঙ্গায় কলকাতায় তার বাপ, মা, ভাই, বােন সবাইকে খােয়ায় এবং সে নিজে অতি কষ্টে প্রাণ বাঁচাতে সক্ষম হয়। এবং
১১০
সে কলকাতার সেই দাঙ্গায় কমিউনিস্টদের দায়ী করে। আজ সে যখন হাতের কাছে তাদের পেয়েছে তার প্রতিশােধ নেবেই। সে নাকি বলেছে খাপড়ায় তাকে রাইফেল দেওয়া হয়নি এটাই তার আফসােস।
দেখলাম শরাফত এই রিপাের্ট করে জিজ্ঞাসু নেত্রে আমার দিকে তাকিয়ে আছে । বুঝলাম সিপাহীর বক্তব্যে শরাফতও প্রভাবান্বিত হতে পারে। তখন তাকে কমিউনিস্টদের রাজনীতি বুঝালাম। বললাম যে, কমিউনিস্টরাই। সাম্প্রদায়িকতাকে সবচেয়ে বেশী ঘৃণা করে। কারণ তারা জানে যে, সাম্রাজ্যবাদীদের হাতে যখন দেশের স্বাধীনতা আন্দোলন বন্ধ করে দেয়ার জন্য। অন্য কোন অস্ত্র থাকে না তখন সাম্প্রদায়িকতাই তাদের একমাত্র হাতিয়ার। আমি বললাম, যদি ব্রিটিশ এই শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে এদেশে বার বার হিন্দু মুসলিম শিখ প্রভৃতির মধ্যে দাঙ্গা বাধাতে না পারতাে, তা হলে সে এত দিন এদেশে টিকতে পারতাে না। ব্রিটিশের দালাল হিন্দু মহাসভা, মুসলিম লীগ তাদেরই প্ররােচনায় দাঙ্গা বাধায় এবং জনতার ক্রোধ থেকে আত্মরক্ষার জন্য উভয়ই কমিউনিস্টদের ঘাড়ে দাঙ্গার বদনাম চাপিয়ে দেয় অথচ কলকাতার দাঙ্গায় কমরেড বঙ্কিম মুখার্জির মত বৃদ্ধ লোেকও নিজের জীবন বিপন্ন করে দাঙ্গা রােধ করতে চেষ্টা করেছে। কলকাতার কমিউনিস্ট পার্টি তখন দাঙ্গা রােধের জন্য অসম সাহসিকতা ও আত্মত্যাগের পরিচয় দিয়েছিল। যাহােক শুধু মনসুরের মত সিপাহীই নয়, পরে শুনেছি রাজশাহী জেলের সরলপ্রাণ হিন্দু মুসলিম কয়েদী ও মেটদের মধ্যে আমরা দাঙ্গাকারী, পাকিস্তানের শত্রু, নাস্তিক ইত্যাদি প্রচার অত্যন্ত চতুরতার সঙ্গে করা হয়েছিল। জেল কর্তৃপক্ষই এ প্রচারণা চালায়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল ২৪শে এপ্রিল আক্রমণের জন্য প্রয়ােজনীয় পরিবেশ সৃষ্টি করা। এটা বুঝতে পেরেছি ২৪শে সাধারণ কয়েদী ও মেটদের আচরণ দেখে। এমনিতে তারা। আমাদের শ্রদ্ধা করলেও সাধারণভাবে রাজনৈতিকভাবে আমাদের আপন মনে করতে পারেনি।
১১১

ছত্রিশ
খাপড়ায় গুলিতে যে সাতজন বীর শহীদ হয়েছেন তাঁরা হলেন যথাক্রমে বিজন সেন (রাজশাহী), হানিফ শেখ (কুষ্টিয়া), দেলওয়ার (কুষ্টিয়া), আনােয়ার (খুলনা), সুখেন ভট্টাচার্য (ময়মনসিংহ), সুধীন ধর (রংপুর), কম্পম সিং (দিনাজপুর)। এছাড়া আহতদের মধ্যে যারা বেঁচেছিলেন তাঁদের নাম নিমে দেওয়া হলাে। এঁদের মধ্যে কয়েকজন চিরতরে পঙ্গু ও বিকলাঙ্গ হয়ে রয়েছেন। এখানে সবসহ মােট বেঁচেছিলেন ২৯ জন। তাঁরা হলেন যথাক্রমে ও বরিশাল জেলার ১) আবদুশ শহীদ ২) রশীদ উদ্দীন (আবু) ৩) সদানন্দ ঘােষ, যশােরের; ৪) পরিতােষ দাশ গুপ্ত ৫) সন্তোষ দাশ গুপ্ত ৬) আবদুল হক ৭) হীরেন সেন; সিলেটের ৮) অনিমেষ ভট্টাচার্য ৯) প্রিয়ব্রত দাস; কুষ্টিয়ার-১০) নন্দ সান্যাল ১১) সত্যেন সরকার ১২) গারিবুল্লা সরদার; বগুড়ার ১৩) ফটিক রায় ১৪) সত্য ভট্টাচার্য ১৫) শ্যামাপদ সেন; দিনাজপুরের; ১৬) ডােমারাম সিং ১৭) ভুজেন পালিত ১৮) কালী সরকার-১৯) বটুক দত্ত পাবনার ২০) আমিনুল ইসলাম ২১) বাবর আলী ২২) রংপুরের পবিত্র প্রসাদ রায় ২৩) গনেশ সরকার; ঢাকার ২৪) নাসির; বর্ধমানের ২৫) মনছুর হাবিব, মুর্শিদাবাদের ২৬) নুরুন্নবী চৌধুরী, রাজশাহীর ২৭) সিতাংশু মৈত্র; বিহারের ২৮) মােঃ ইলিয়াস; সিলেটের ২৯) অনন্তদেব। যে সাতজন শহীদ হয়েছেন বিপ্লবী সংগ্রামে বাইরে তারা সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। আন্দামান ফেরত কমরেড বিজন সেন, তাঁর রাজনৈতিক জীবনের একটা বিরাট অংশ নির্বাসনে, ক্যাম্পে ও বিভিন্ন কারাগারে কাটিয়ে গিয়েছেন। মহান আত্মত্যাগে এঁরা চির অমর হয়ে থাকবেন ইতিহাসের পাতায়, মানুষের হৃদয়ে। কমরেড হানিফ শেখের জীবনও কেটেছে কঠিন শ্রেণীসংগ্রামের ভিতর দিয়ে। তিনি কুষ্টিয়া সুতাকলের একজন নেতৃস্থানীয় কমরেড ছিলেন। নিজের বিপ্লবী নিষ্ঠা ও সংগঠনের প্রতি কঠোর আনুগত্যের ফলে রাজশাহী জেলেও পার্টির তিন প্রধানের অন্যতম ছিলেন। কমরেড দেলওয়ার- ঝাকরা চুল, পাতলা গড়নের শ্যামলা রং এর মানুষটি ছিলেন হাসিখুশি । জেলে আসার মাত্র এক সপ্তাহ পূর্বে বিবাহ করেছিলেন। তিনিও শ্রমিক আন্দোলন থেকে আসছিলেন। যতদূর মনে পড়ে রাজশাহী জেলে যে আমাদের উপর মারাত্মক এক বিপদ আসছে যারা একটু সচেতন তারাই অনুভব করছিলেন। সেটা বুঝেছিলাম একদিন কি কথায় কথায় কমরেড দেলওয়ার বলছিলেন, মৃত্যুর জন্য কিছু মনে করি না বরং সংগ্রাম করতে গেলে মৃত্যুকে
১১২
এড়িয়ে চলা যায় না। তখন কে বুঝেছিল যে কমরেডের এই নির্মম সত্য কথাটি এত দ্রুত বাস্তবে পরিণত হবে। মনে পড়ে কমরেড সুধীন ধরের কথা। তার সঙ্গে প্রত্যক্ষ কোন আলাপ করবার সুযােগ হয়নি। এক ফালি রৌদ্রের মত ঝকঝকে পাতলা লম্বা ধরনের মানুষটি। দাঁত দুপাটি যেন শুভ্র ও স্ফটিকের মত স্বচ্ছ। সদাহাস্য এই মানুষটি বােধ হয় বিষন্নতা কাকে বলে জানতেন না। রংপুরের। সৈয়দপুরে দীর্ঘদিন শ্রমিক আন্দোলন করেছেন। মানুষের সঙ্গে মেশার অদ্ভুত ক্ষমতা লক্ষ্য করেছি কমরেড সুধীন ধরের মধ্যে। যেন অন্যের থেকে নিজের কোন আলাদা অস্তিত্ব নেই তবুও সবার মধ্যে তাকে আপন মহিমায় পৃথক করে দেখা যেত ।
তারপর আসে কমরেড সুখেন ভট্টাচার্যের কথা। যেন কয়েকটি মার্বেল পাথরের খাম্বা দিয়ে তৈরী মানুষটি। মজবুত গড়নের গৌরবর্ণের কমরেডটি ছিলেন। ছাত্র । ভিয়েতনাম দিবসে ময়মনসিংহে প্রচন্ড ছাত্র আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। স্বল্পভাষী গম্ভীর প্রকৃতির কমরেড সুখেনের ব্যক্তিত্ব তার বয়সের তুলনায় আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করত বেশী ।
খুলনার কমরেড আনােয়ার ছিল ওখানকার জিলা স্কুলের ছাত্র । সেখান থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে ম্যাট্রিক পাস করে কলেজে ঢুকেছিল। এর বাপ ছিল না। স্কুলে থাকতেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হয় কমরেড আনােয়ার। বেঁটে, মজবুত গড়ন, কাঁচা সােনার মত গায়ের রং, কমরেড ঢাকা জেলে দীর্ঘদিন অনশনে অংশগ্রহণ করেও শরীর সুস্থই রাখতে পেরেছিল। অন্তত বাইরে থেকে তাে তাই মনে হতাে । বয়স অনুপাতে খুবই আত্মস্থ ও বাস্তবমুখী মনে হয়েছে তার সমবয়সীদের সঙ্গে আমুদে কথাবার্তায় আলাপ করে দেখলাম ভাল পড়াশুনা করেছে। কথায় কথায় একদিন সে হিটলারের মেইন ক্যাম্প থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছিল। তখন খাপড়ার দিনগুলি কাটতাে এক ভয়ঙ্কর আশঙ্কা ও অনিশ্চয়তা জনিত অবস্থার মধ্যে দিয়ে। সবাই এক দ্রুত ভয়াবহ পরিণতির কথা অস্পষ্ট হলেও আঁচ করতে পারছিলাম । অবশ্য আমাদের কার্যকলাপই এই পরিণতিকে দ্রুতায়িত করেছে। মনে আছে। একদিন সন্ধ্যার কিছু পূর্বে আনােয়ার, প্রিয়ব্রত, সদানন্দ আরও দুই একজন কার সঙ্গে কথা বলছিল। আমিও বয়সের দিক দিয়ে একটু নিজের দুরত্ব রক্ষা করে অদূরে দাঁড়িয়েছিলাম। আমরা অবশ্য সবাই ওখান থেকে গেট পাহারা দিচ্ছিলাম। কখন কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে আমাদের উপর হামলা শুরু হয়। এটা খুব সম্ভব গুলি চলার এক দিন কি দুই দিন পূর্বের কথা। কমরেড আনােয়ার ওদের কার কাছে যেন একটি সিগারেট চাইল এবং সেটা ধরাতে ধরাতে বলল, দাও খেয়েনি । কালই হয়ত সিগারেটের ধোঁয়ার মত উড়ে যাব কোথায়? খুব সহজভাবেই কথাটা বলছিল কমরেড । এ যেন নাজিম হিকমতের সেই কথার মত; কমরেড একটু
১১৩
আগুন দেবে? সিগারেট ধরাবে- বুলেটের আগুনে ধরিও। তখন কে জানত যে সেই আনােয়ারেরই প্রাণবায়ু তার একদিন না দুদিন পর ধোঁয়ার মত কোথায় মিলিয়ে যাবে। জীবন দানকে এমন সহজভাবে বিপ্লবীরা ছাড়া আর কারা গ্রহণ করতে পেরেছে। কমরেড আনােয়ারের জীবন সিগারেটের ধোঁয়ার মত বাতাসে মিশে গেছে কিন্তু তা বাতাসে ছড়িয়ে দিয়েছে সুবাস। যা কোন দিনও নিঃশেসিত হবে ।
১১৪

সাঁইত্রিশ
মনে পড়ছে কম্পদার কথা। অতিকায় এই কম্পদাকে দেখলে মনে পড়তে রামায়ণের যুগের কোন বীরকে। তাকে মহাভারতের ভীমের সাথে তুলনা করলে বােধ হয় অত্যুক্তি হয় না। দিনাজপুরের কম্পদা ছিলেন বিখ্যাত ডােমারাম সিংহের ভাই । ১৯৪৮ সনে হাজং কৃষক বিদ্রোহে এবং তার পূর্বে তে-ভাগা আন্দোলনে এরা সত্যিকার বীরত্বের পরিচয় দিয়েছে। আগেই বলেছি তে-ভাগা সংগ্রামের সময় তকালীন ফ্রন্টিয়ার রাইফেল বাহিনী এদের বাড়ী ঘেরাও করে গুলী চালায় এবং চারজনকে হত্যা করে। কম্পদা গুলীর পরদিন হাসপাতালে প্রাণত্যাগ করেন। যে আঘাত নিয়ে কম্পদা একদিন বেঁচেছিলেন-তা তার বিশাল সুঠাম শরীরের জন্যই। সময়ােচিত চিকিৎসা হলে হয়ত কম্পদাকে বাঁচানাে যেত ।
রাজশাহী জেলে গুলী চালনাকালীন আর একটা বিষয়ের উল্লেখ করতে ভুলে গিয়েছিলাম। তা’হলাে খাপড়া ওয়ার্ডে আমরা ছাড়া দশ নম্বর সেলে অন্যান্য রাজবন্দীও ছিলেন। এ ছাড়া ছয় নম্বর ও জানানা ফাটকেও মহিলা বন্দী ছিলেন। খাপড়ায় গুলী চালনার পূর্বেই পাগলা ঘন্টি দিয়ে তাদেরকে নিজ নিজ সেলে লআপে বন্ধ করে রেখেছিল। তারা গুলীর শব্দ শুনে লআপ অবস্থায় সেলে বসে প্রচণ্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়েন এবং জেল কর্তৃপক্ষকে গালাগালি করতে থাকেন। এবং পাহারারত সিপাই-জমাদারদের হাতের কাছে যা পান তাই ছুড়ে মেরে আক্রমণ করতে থাকেন। এ জন্য সিপাই লআপ খুলে তাদের উপর প্রচন্ড আক্রমণ চালিয়েছিল বলে শুনেছি। কিন্তু ঐ অবস্থায়ও তারা বিপ্লবী শ্লোগান দিয়ে আমাদের প্রতি সহানুভূতি জানাতে থাকেন।
এদিকে প্রায় তিনমাস হাসপাতালে রাখার পর আমাদের উক্ত ১৪নং কনডেমড সেলেই নিয়ে যায়। এখানে আমাদের প্রায় দু’বছর থাকতে হয়েছে । এই প্রসঙ্গে সেলগুলির অবস্থা একটু বর্ণনা করা প্রয়ােজন। প্রতিটি সেল আয়তনে এতটুকু যাতে হাসপাতালের বেডের মত একখানা লােহার খাট স্থাপন করলে পাশে মাত্র এক হাতের মত জায়গা থাকে। সেলটি লম্বায় ঐ খাটটির মতই । ইহার একটি মাত্র দরজা। ভিতরের খাটের নীচে থালা-বাসন, দোয়াত-কলম, বই-পত্র রাখা যেত । তাছাড়া খাটের এক কোণে মলমূত্র ত্যাগের জন্য একটি আলকাতরা লেপা বেতের টুকরি থাকত। প্রতিদিন ভােরে সেটা পরিষ্কার করা হতাে। দরজার
১১৫
সামনেই অশ্বখুরের মত ঘুরানাে একটি দেয়াল। তাকে এন্টি-সেল বলা হতাে। এখানে স্নানের জন্য পানি রাখা হতাে। তারপর দুইদিকে লম্বমান আর এক প্রস্থ দেয়াল। মাঝখানে সরু পথ এই দেয়ালের শেষ প্রান্তে আর একটি ছােট্ট গেট। মাথার উপরে এক হাত উঁচুতে তির্যকভাবে ঘন কাঁটা তারের ছাদ। এই ছাদ সামনের দেয়াল পর্যন্ত বিস্তৃত। সামনের এই দরজা বা গেটের পরে মাত্র দুই তিন। হাতের মত প্রশস্ত বারান্দা। এই বারান্দা সমগ্র ওয়ার্ডের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত এবং এই বারান্দার প্রতি দুইটি সেলের পর পরই আর একটি গেট। এই গেটে খুব সম্ভব কাঠের কপাট রয়েছে। এই বারান্দা আবার অনতিউচ্চ দেয়াল দিয়ে ঘেরা। বলাবাহুল্য, এই দেয়ালের পরে গিয়ে বাইরে কিছু দূরে জেলের আকাশছোঁয়া দেয়াল। মােট কথা, মনুষ্য বাসের অনুপযােগী বীভৎস এই সেলগুলিতে ঢুকলে প্রথমে গা ছমছম করে। সন্ধ্যার পূর্বে এর একমাত্র দরজা লকআপ হয় বা বন্ধ করে। তখন মনে হয় সমস্ত পৃথিবী যেন সংকুচিত হয়ে এই ক্ষুদ্র অন্ধকার প্রকোষ্ঠে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। কিন্তু তাতে লক্ষ্য করেছি ওরা যতই আমাদের ঠেলে ক্ষুদ্র সেলে ভরে দেয় ততই যেন আমাদের মনের সাহস ও সংগ্রামী স্পৃহা সীমাহীন হয়ে পড়ে। এ যেন ঠিক বাতাস ভরে ফানুস ফোলানাের মত । ফানুসের ভেতরে যতই বাতাস বন্ধ করে ততই ওটা ফুলতে থাকে। আয়তনে বড় হয়। এখানেও তাই ওরা আমাদের দেহ যতই ঠেলে রুদ্ধ সেলে ভরে দেয় ততই আমাদের মন মুক্ত হয়ে বিরাট পরিসর দখল করে। তালাবদ্ধ সেলে মনে হয় পৃথিবীর উন্মুক্ত আকাশ বাতাসকে কে যেন এক গুহার গহ্বরে আটকিয়ে দিয়েছে। বাইরের দরজা বন্ধ করলে মনে হয় যেন দু’দিক কড়া লাল দেয়ালের প্রতিটি ইট রক্তজিব্বা দিয়ে আমাকে চেটে নেবার জন্য চতুর্দিকে থেকে এগিয়ে আসছে। সাধারণভাবে এটা একটি চরম ভীতিপ্রদ বাসস্থান। কিন্তু আমরা বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে অনায়াসে সেগুলিতে কাটিয়েছি। এর একমাত্র কারণ বিপ্লবী আদর্শে বিশ্বাসী মনােবল।
পূর্বেই বলেছি যে, এটা কনডেমনড বা অপরাধীদের জন্য শাস্তিমূলক সেল । সুপারের আদেশ অনুযায়ী খাপড়া ওয়ার্ড থেকে বিচ্ছিন্ন না হওয়ার শাস্তিস্বরূপ গুলী চালানাের পরও তাদের আরও শাস্তি দেয়ার প্রয়ােজনে এই সেলে নিয়ে আসা হয়েছে। ফ্যাসিস্টদের এরূপ নির্বোধ ও উন্মত্তের মত প্রতিহিংসাপরায়ণতার নজীর পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল নয়। মনে পড়ে বৃটিশ তখনকার নিছক জিদ বশত আমেরিকার স্বাধীনতাকামী জনগণের উপর মাত্র একটি দ্রব্যের উপর শুল্ক বসাতে গিয়ে অচিরেই আমেরিকাকে স্বাধীনতা দিতে বাধ্য হয়েছে।
সেলে আসার পর আমাদের উপর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে চিঠিপত্র আদান। প্রদান, খবরের কাগজ প্রভৃতি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। প্রথম দিকে বেশ
১১৬
কিছুদিন আমাদের চব্বিশ ঘণ্টা লপআপে বন্ধ করে রাখা হয়েছে। ওরা আমাদের সাতজনকে মেরেছে। তার মধ্যে নেতৃস্থানীয়রাও রয়েছে। পনেরাে-বিশজনকে গুরুতরভাবে আহত করেছে। সবাইকে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত করে দিয়েছে। তারপরও আমাদের একজন একজন করে কঠোর বেষ্টনীর সেলে রেখেছে। কিন্তু সেখানেও আবার আমাদের চব্বিশ ঘণ্টা তালাবন্ধ করে রাখল। এটা কি আমাদের কোন অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন মনে করে ভয় পেয়ে করেছে, না এটা তাদের পাশবিক প্রতিহিংসা! মনে আছে, শুধু গােছলের সময় সামান্য একটুক্ষণের জন্য এন্টিসেলে এসে অত্যন্ত অপর্যাপ্ত তােলা জলে স্নান করে সঙ্গে সঙ্গে ভিতরে চলে যেতে হতাে। এই সময় আমরা চিৎকার করেও একে অন্যের সঙ্গে কথা বলতে পারতাম না।
১১৭

আটত্রিশ
আরও ঠিক করলাম অবস্থা যত কঠিনই হােক না কেন আমাদের প্রতি চরম হিংসাপরায়ণ জল্লাদদের উপযুক্ত শিক্ষা দিতে হবেই। তাই অত্যন্ত গােপনে সেলের সবার সঙ্গে আলাপ করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলাে যে, সুপার যখন তার সাপ্তাহিক ভিজিটে আসবে তখন ফাইলে বসে বা দাড়িয়ে তাকে সম্মান দেখানাে তাে দূরের কথা, সে আসলে আমরা গেটের দিকে পা দিয়ে শুয়ে থাকব। এবং বই হাতে নিয়ে এমন ভান করব-যেন পড়াশুনায় গভীরভাবে নিমগ্ন । অবশ্য ঐ সময়ের মধ্যে আমরা কিছু বই সংগ্রহ করতে পেরেছিলাম । কে আসলাে না আসলাে যেন তার কোন তােয়াক্কাই আমরা করি না। আমার মনে আছে, ঐ সময় সেই ছয় ফুট দীর্ঘ হত্যাকারী জল্লাদ-সুপার যখন সেল পরিদর্শন করতে আসতাে আমি তখন ১৩ নং সেলে থাকতাম । পূর্ব দিক দিয়ে তারা ঢুকলেই বুটের শব্দে বুঝতাম ওরা আসছে । তৎক্ষণাৎ একখানা বই হাতে দক্ষিণ দিকের দরজার সঙ্গে পা লাগিয়ে মুখের উপর। বইখানা ধরে চিৎ হয়ে পড়ার ভান করতাম। ততক্ষণে সুপার মিঃ বিল এসে যেত । ঐ সময় তার সঙ্গে থাকতাে পনেরাে-বিশজন সিপাই, একজন ডাক্তার, একজন ডেপুটি জেলার এবং সুবেদারসহ আরও দুই চারজন ঝানু মেট । অতজন সিপাই ও স্টাফের সামনে সেন্ট্রাল জেলের সর্বময় কর্তা বিগত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের প্রতিভূ পাক সরকারের সুযােগ্য প্রতিনিধি যে ঐভাবে অপমানিত হবে তা হয়ত সে কল্পনাও করতে পারেনি। বিপ্লবী রাজবন্দীদের উপর গুলী চালিয়ে সে মনে করেছিল আমাদের খুব জব্দ করেছে। আমরাও মনে করলাম অন্য যে কারণই থাকুক না কেন সূচনায় সরকার সালাম দিতে অস্বীকার করায় ঘটনা যখন এতদূর পর্যন্ত গড়াল এবং গুলী করে লােক হত্যা করার পরও জল্লাদদের জেদ বজায় রাখবার জন্য পূর্বনির্দিষ্ট সেলের ভিতর নিয়ে এসেছে, তখন আমরাও আমাদের সাধ্যানুযায়ী এর প্রতিশােধ নেবাে। সালাম’ কেন সামান্য দাঁড়িয়ে তাকে কোনরূপ অভ্যর্থনা তাে করবই না বরং তার দিকে পা দিয়ে সটান শুয়ে থাকব। এ যেন হাত উঁচিয়ে ‘সালাম’ নয়, বরং পা উঁচিয়ে লাথি মারা। পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সে যখন তার বাহিনী নিয়ে দরজার সামনে দাঁড়াত তখন সমস্ত দরজাটি লােকের ভীড়ে আচ্ছন্ন। হয়ে যাওয়ায় ভিতরটা আঁধার হয়ে যেত। সঙ্গের সমস্ত লােকের সামনে এরূপ অপমানে মিঃ বিল যেন দিশেহারা হয়ে যেত। চতুর বিল তখন-আমরা অসুস্থ তাই শুয়ে রয়েছি-সঙ্গের লােকদের এরূপ একটা ধারণা দিয়ে তাড়াতাড়ি সেখান থেকে
১১৮
কেটে পড়তাে। আবার কোন কোন দিন শুনেছি এই অপমানে স্বৈরাচারী সুপারের সাদা মুখ ক্রোধে লাল হয়ে উঠতাে। সমস্ত শরীর রাগে থরথর করে কাঁপতাে। আমাদের কেউ কেউ আবার সুপার আসার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমের ভান করত। অনেকে। আবার নাক ডেকে তাদের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিয়ে মনের তীব্র ক্ষোভ মিটাতাে।
বলতে গেলে, তখনকার পরিস্থিতিতে ওরূপ আচরণ আত্মহত্যাকর বলে গণ্য হওয়া উচিত। এটা বুঝতেই হবে যে, আমাদের মান-অপমান আমাদের জন্য নয় বরং একজন বিপ্লবীর মান-অপমানের মাপকাঠি হবে জনগণের সম্মান-অসম্মানের। দৃষ্টিভঙ্গীতে। সেদিক দিয়ে খাপড়া ওয়ার্ডে একদল ঘৃণ্য শত্রু কর্তৃক পরাজিত হয়ে সাময়িকভাবে আত্মরক্ষার কৌশল ও কর্মপন্থা গ্রহণ করা উচিত ছিল। কারণ লেনিন ও মাওয়ের কথায়ও যারা প্রয়ােজনমত পশ্চাদপসরণ করতে পারে না তারা এগােতেও পারে না। কিন্তু আজ বুঝি আমাদের ঐ সময়কার বিশেষ করে গুলীর পরবর্তী অবস্থায়, সেলের উপরােক্ত কার্যকলাপের পিছনে জনগণের জন্য মানসম্মানের বিচার ছিল না-ছিল জনগণের চিন্তা থেকে বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিগত মান-অপমান বােধ এবং তার থেকে সন্ত্রাসবাদী একগুয়েমি ও হঠকারিতা। কারণ এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ঐসময় সুপার মিঃ বিল ইচ্ছে করলে আমাদের এক একজনকে সেল থেকে বের করে যা ইচ্ছে তাই করতে পারতাে।
এ ভাবে সম্ভবত দু’সপ্তাহ চলেছিল। আমরা সব ব্যাপারেই সুপারের সঙ্গে অসহযােগিতা করে চললাম । কিন্তু এতে আমাদেরই ক্ষতি বাড়লাে। আমাদের কাগজ বন্ধ। হাসপাতালে যাওয়া বন্ধ । চিঠিপত্র বন্ধ । ইন্টারভিউ বন্ধ । তাছাড়া জেলখানায় বিশেষ করে জেলের ভিতর অনির্দিষ্টকালের জন্য জেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে অসহযােগিতা করে থাকা সম্ভব নয়। বিশেষ করে সেলের মধ্যে। সেলে প্রত্যেকের কতকগুলি অপরিহার্য জিনিস নিজের কাছে থাকতে হয়। এসােসিয়েশন ওয়ার্ড বা একত্র থাকার কতকগুলি সুবিধা রয়েছে তা থেকে আমরা সম্পূর্ণ বঞ্চিত ছিলাম।
১১৯

উনচল্লিশ
খাপড়ায় গুলীতে আহত অনেকে এতটা অসুস্থ হয়ে পড়েন যে, খাবার দাবার, ঔষধপত্রসহ বাইরে বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে যােগাযােগের জন্য অত্যন্ত প্রয়ােজনবশত জেলকর্তৃপক্ষের সঙ্গে একটা সমঝােতায় আসা উচিত ছিল। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম সুপারের সঙ্গে আলাপ করে মােটামুটি আমাদের কতগুলি অসুবিধা দূর করা প্রয়ােজন। যা মনে হলাে তাতে সুপার আমাদের সঙ্গে একটা সমঝােতায় আসতে চাইছিল। আমাদের এই সিদ্ধান্ত ও দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহণের ব্যাপারে কমরেড মনসুর হাবিবের ভূমিকা উল্লেখযােগ্য। অবশ্য কমরেড অমূল্য লাহিড়ী ও রাজশাহীর সিতাংশু মৈত্রও একই মত পােষণ করেন। এরপর সুপার পরিদর্শনে আসলে আমরা তার সঙ্গে স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করতাম। তবে এর পরই আমাদের উপর থেকে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা উঠে গেল না। বেশ কিছুদিন পর্যন্ত আমাদের খবরের কাগজ সরবরাহ বন্ধ ছিল। কিন্তু অন্যান্য কিছু সুবিধা পেতে লাগলাম। এই সময় সেলে আভ্যন্তরীণ অবস্থা খুবই সংকটজনক পর্যায়ে পৌঁছেছিল।
এদেশে বিপ্লবের পথ ও পদ্ধতি নিয়ে অনেক সমালােচনার সূত্রপাত হয়। জেল- বিপ্লব এবং জেলগুলিতে সত্যি সত্যি প্রাণ হারানাে ও চরম হঠকারিতার পরিপ্রেক্ষিতে এ প্রশ্নগুলি তীব্র হয়ে ওঠে কমরেডদের মনে। প্রশ্ন ওঠে দেশের বর্তমান অবস্থায় সমস্ত বুর্জোয়া শ্রেণী অর্থাৎ জাতীয় ধনিক শ্রেণী, মাঝারী ব্যবসায়ী, ধনী কৃষকের প্রগতিশীল ভূমিকা শেষ হয়ে গেছে কিনা। দেশে সাম্রাজ্যবাদ, সামন্ত বাদ, একচেটিয়া পুঁজিবাদবিরােধী আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে, না সমগ্র বুর্জোয়া অর্থাৎ অত্যাচারিত জাতীয় বুর্জোয়া, ছােট ও মাঝারি বুর্জোয়া এবং ধনী কৃষকের বিরুদ্ধে সমাজতান্ত্রিক সরকার শুরু করার সময় এসেছে। প্রশ্ন উঠেছে অবস্থাটা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব না জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের স্তর। তবে যতদূর মনে পড়ে রাজশাহী জেলে ঐ সময় চীন প্রবর্তিত জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্বন্ধে সুস্পষ্ট কোন ধারণা কারাে তেমন ছিল না।
বাইরের গণআন্দোলনের ব্যর্থতা ব্যাপক সংখ্যক রাজনৈতিক কর্মীর গ্রেফতার, বিভিন্ন জেলে শাসকশ্রেণীর চরম অত্যাচার, এসব স্বভাবতই আমাদের মনে বিপ্লবের রণনীতি ও রণকৌশল সম্বন্ধে বিরাট প্রশ্ন সষ্টি করে । শ্রদ্ধেয় কমরেড মনসুর হাবিবসহ আমরা কয়েকজন মনে করলাম যে, এদেশে এখনও বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব অসমাপ্ত রয়েছে। অবশ্য এই বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব ক্ল্যাসিক
১২০
বা সনাতনী কায়দায় নয়। এটা সম্পূর্ণ কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বেই সমাধা করতে হবে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ধনতান্ত্রিক সংকটের নতুন বৈশিষ্ট্য বিচারে সেটা হবে। জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব যদিও ঐ সময় আমরা চীন বিপ্লবে এবং বিপ্লব পরবর্তী অবস্থা সম্পর্কে বিশদ আলােচনার জন্য পড়াশুনা বা জানাশুনার সুযােগ করতে পারিনি। তবুও এটা বুঝেছিলাম যে, সনাতনী বা সাবেকী বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব নয় বরং চীনের ন্যায় জনগণতান্ত্রিক একনায়কত্ব কায়েম করতে হবে। কিন্তু কমরেড আবদুল হকসহ আরও কয়েকজন কমরেড এই মত গ্রহণ করতে পারেননি। তারা এমন কি জেল-বিপ্লবের তত্ত্বকেও ভুল মনে করতেন না। তারা ভারতের দ্বিতীয় পার্টি কংগ্রেসের ‘রণদিভে লাইনকেই’ সঠিক মনে করতে লাগলেন।
বলা বাহুল্য এই মতপার্থক্য নিয়ে মনােমালিন্য এবং গ্রুপিং বা দলাদলি এমন পর্যায়ে পৌছলাে যে, একদল অন্য দলের সঙ্গে কথা বলা পর্যন্ত বন্ধ করে দিল। তাছাড়া ঢিল ছোঁড়াছুঁড়ি প্রায় আরম্ভ হয়েছিল। অবস্থা আর কয়েকদিন এরূপ চলতে থাকলে আমরা কোন পর্যায়ে পৌঁছতাম বলা যায় না। এ দলের এক দিকের নেতা ছিলেন কমরেড আবদুল হক, অন্য দলের নেতা ছিলেন কমরেড মনসুর হাবিব। কিন্তু কেন যেন ব্যাপারটা বেশী দূর গড়ায়নি।
কমরেড মনসুর হাবিবের বক্তব্য হলাে তিনি গ্রেফতার হবার পূর্বে ভারতীয় দ্বিতীয় পার্টি কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত যে ভুল এ সম্পর্কে কমিন ফর্মের কোন লেখা বা রাশিয়ার মেসেলিনিকভের কোন প্রবন্ধ থেকে কিছু পড়ে আসছিলেন তবে তাও তিনি পুরােপুরি পড়ার সুযােগ পাননি বা তার সমস্ত বক্তব্য সুষ্ঠুভাবে বলতে পারছিলেন না। আমার মনে আছে তার সঙ্গে গ্রুপে বসে আমি আলােচনায় দেখিয়েছিলাম যে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর উপনিবেশের সামন্ত ও বৃহৎ বুর্জোয়াদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে সাম্রাজ্যবাদ কিভাবে জাতীয় ধনিকদের একটা অংশকে বা প্রায় সমগ্র অংশকে বিকাশলাভ করতে দিচ্ছে না। উদাহরণ স্বরূপ চাখারের চান্দু মিঞা এবং উলানিয়ার হামিদ চৌধুরী বাবুগঞ্জে পাইওনিয়ার ইন্ডাষ্ট্রী খুলতে গিয়ে সামান্য আখের কলের জন্য লাইসেন্স সংগ্রহ করতে পারছিল না।
একদিকে রাজনৈতিক সংকট অন্যদিকে সেলের বন্দীজীবন। কিন্তু বিপ্লবীরা কোন অবস্থাতেই মনােবল হারাতে পারে না। তাই একদিকে আমাদের তীব্র মতপার্থক্য নিয়ে যতদূর সম্ভব আলাপ-আলােচনা করে এক মতে আসতে চেষ্টা করতাম, অন্যদিকে সেলের দৈনন্দিন জীবনের অসুবিধাগুলি দূর করার জন্য বিভিন্ন উপায়ে চেষ্টা করতাম। অবশ্য অনেক দিক দিয়ে এসােসিয়েশন ওয়ার্ড বা একত্রে থাকার চেয়ে সেল-জীবন ভালই মনে হয়। বিশেষ করে পড়াশুনার জন্য এরূপ ব্যবস্থাই উত্তম। তবে এর জন্য প্রয়ােজনীয় কাগজ-পত্র, বই-পুস্তকের ব্যবস্থা থাকতে হবে। বলা বাহুল্য জেলখানায় পড়াশুনার ইচ্ছে থাকলে সেলই
১২১
সুবিধাজনক। এখানে বইতে গভীরভাবে মনােনিবেশ করা যায়। আমার মনে আছে ঐ সময় আমি বিলেতে পার্লামেন্টের সদস্য সাইকের এক হাজার পাতার History of Turkish Empire খুব অল্প সময়েই পড়ে শেষ করেছিলাম।
৪নং সেলে খুব সম্ভব আমরা পুরাে দুটো বছর কাটাই। এখানে আসার পর ৬ মাস পর্যন্ত আমরা খবরের কাগজ, চিঠিপত্র থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলাম। তারপর কোনরূপে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসে। এরই মধ্যে আমরা সেলের জীবনকে আনন্দমুখর করে তুলতে চেষ্টা করতাম। এ জন্য আমরা পিছু লাগতাম বৃদ্ধ শ্রদ্ধেয় অমূল্য লাহিড়িকে নিয়ে-তার বাড়ী ছিল পাবনায় । অমনি অমূল্য দাকে নিয়ে ছড়া তৈরী হলাে-
ছেরির বাড়ী বরিশাল
ছেরার বাড়ী পাবনা
দিল মে লাগিয়ে দিল ভাবনা।
১২২

চল্লিশ
বৃদ্ধ অমুল্যদাকে ‘ছেরা’ চিত্রিত করে চটানাে যেত না। তিনি উল্টো আমাদের আক্রমণ করতেনঃ “হ্যা, তােমরা এখন ষােল বছরে বুড়াে হয়ে যেতে পারাে। কিন্তু আমরা আশী বছরেও জোয়ান ছােকরা।” তার জবাব শুনে আমরা হাে হাে করে হেসে উঠতাম। অমূল্যদা ও বংকিম বাবু দীর্ঘদিন একত্রে দমদম জেলেও। কাটিয়েছেন। সেই সূত্রে তাঁদের মধ্যে গড়ে ওঠে একটা মধুর সম্পর্ক।
অমূল্যদা ছিলেন কারাগারে আমাদের আনন্দের অন্যতম উৎস। দু’চার কথায় এঁদের জীবনের মাধুর্য বা বিপ্লবী তাৎপর্য তুলে ধরা যাবে না। জেলখানায় সেল জীবনের বৈশিষ্ট্য হলাে এই যে, সেল খুব অল্প পরিসরের বলে প্রত্যেককে অনেকখানি একান্ত করে জানা যায়। বেশী সংখ্যক লােকের সংঘবদ্ধ জীবনে প্রত্যেকের সকল বৈশিষ্ট্য নজরে পড়ে না বা সবার সঙ্গে নিবিড়ভাবে আলাপ করার সময় ও সুযােগ হয়ে ওঠে না।কিন্তু সেলে থাকতে পরস্পর পরস্পরকে অনুধাবন। করতে অসুবিধা হয় না।
তবে ১৪নং-এ আমরা ছয় মাস পর্যন্ত বাইরের জগৎ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। ছিলাম। কাজেই দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্বন্ধে একরূপ অন্ধকারে থাকতে হয়েছে। এ অবস্থায় মনে স্বস্তি পাওয়া দুষ্কর। তবুও সেল জীবনকে বৈচিত্রময় করে তােলার জন্য আমাদের চেষ্টার ত্রুটি ছিল না। আমাদের ১১নং সেলে ছিলেন। উল্লাপাড়ার কমরেড বাবর আলী। খাপড়া ওয়ার্ডে গুলী চলার পূর্ব মুহূর্তে বাবর আলী ছিলেন ওয়ার্ডের একমাত্র দরজায়। সুপার মিঃ বিল যখন বাঁশি বাজাবার পূর্ব মুহূর্তে ওয়ার্ড থেকে বেরােনাের জন্য দরজার কাছে আসে তখন বাবর ভাইকে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভীষণ জোরে হান্টার দিয়ে তার বাম হাতে আঘাত করেছিল। ফলে পরবর্তীতে তার বা হাতটা সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে যায়। কথায়, কথায় বাবর আলী ভাই বলতেন, কমরেড আর কোন আফসােস নেই, শুধু মার খেলাম, মার দিতে পারলাম না এটাই আফসােস।”
কমরেড বাবর আলী একজন খাটি কৃষক। আত্মভােলা এই লােকটির মাথার চুল কর্কশ এবং খাড়া। কথা খুবই কম বলে। মনে হয় আমরা যারা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বলে দাবি করি তাদের সামনে বেশী কথা বলতে সংকোচ বােধ করে। তথাপি কোন বৈঠকে সমালােচনা বা আত্ম-সমালােচনাকালে কমরেডটি খুবই মুখর
১২৩
ছিল। পরে এই কমরেডের সঙ্গে টাঙ্গাইল দ্বি-বার্ষিক সম্মেলনে দেখা হয়। টাঙ্গাইলে দেখা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার একই সুর “কমরেড, আমরা মানুষের জন্য। কিই বা করতে পারলাম।” জিজ্ঞাসা করলাম, “আপনি তবে পার্টিতে আছেন কেন?” তিনি বললেন, “এত আমার একার কথা নয়। আমিত পার্টির কথাই বলছি। কি শহীদ ভাই! পার্টি আমাদের কি করল?”
আমরা সেলে অনেক সময় তাকে ঘিরে ধরে বলতাম-কমরেড মার খেলেন তবে মার দিতে পারলেন না। বাবর ভাইকে চটানোে যেত না সহজে। নির্বিকারভাবে জবাব দিতেন, “সবুর করুন, মার দেওয়া যাবে। তবে দেবার আগে খেতে হয়।”
এ ছাড়া ছিলেন দিনাজপুরের কমরেড কালী সরকার। সন্ত্রাসবাদী যুগে হিলি রাজনৈতিক ডাকাতি মামলার আসামী ছিলেন তিনি। তে-ভাগা আন্দোলনের সময় কালীদা, একটা ব্যাপক অঞ্চল জুড়ে তে-ভাগার সংগ্রাম চালিয়েছিলেন। বেটে কিন্তু অত্যন্ত সুঠাম শরীর তাঁর। কালাে কুচকুচে রং, চোখ দুটি যেন টগবগ করছে কমরেডটির। কালীদা কথা বলার সময় হাতের আঙুলগুলি একত্র করে হাত ঝুলিয়ে কথা বলতেন। কথার মধ্য দিয়ে তাঁর দৃঢ় আত্মপ্রত্যয় ফুটে বেরুততা। হিলি ডাকাতির আসামী কমরেড কালী সরকার আমাদের বলতেন কমরেড, শুধু বক্তৃতা আর জনসভা করে দেশের মুক্তি আসবে না। এই প্রসঙ্গে তিনি ১৯৪৬ সালের তেভাগার কথা উল্লেখ করতেন। তিনি বলতেন, দেশ বিভাগের পূর্বে একমাত্র সার্থক সংগ্রাম ছিল তে-ভাগা। “হয় তে-ভাগা, নয় নাই ভাগা” বলে বাংলার ষাট লক্ষ কৃষক তে-ভাগা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। অবশ্য সে আন্দোলনে যথেষ্ট ভুলত্রুটিও ছিল। কিন্তু মূলত সেটা ছিল এদেশের সামন্ত শ্রেণী ও বড় বড় জোতদারের বিরুদ্ধে কৃষকদের সংগ্রাম। তেভাগার মূলকথা হলাে বর্গাদার চাষী চাষাবাদের অনেক খরচ দিয়েও ফসলের সামান্য অংশই পায় অথচ জমির মালিকানার দাবিতে জমির কাছে না গিয়েও জমিদার জোতদার ফসলের প্রায় সবটাই ভােগ করে। তাই তে-ভাগার দাবি হলাে, যে চাষী জমি চাষ করে এবং অনেক সময় বীজ ধান ও হালের গরু সরবরাহ করে, তাকে দিতে হবে ফসলের চার ভাগের তিন ভাগ। বাকী এক ভাগ পাবে জমির মালিক। ফসল কেটে বর্গা জমির উঠানে ধান উঠবে। সেখান থেকে জমির মালিক উক্ত হার অনুযায়ী ধান নিয়ে যাবে।
দেশ বিভাগের পূর্বে সাম্রাজ্যবাদের পরিকল্পিত সাময়িকভাবে হলেও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা রােধে তে-ভাগা আন্দোলনের অবদান ছিল অনস্বীকার্য।
এই তে-ভাগার সংগ্রাম স্তব্ধ করার জন্য অবিভক্ত বাংলার মন্ত্রিসভার নির্দেশে
১২৪
দিনাজপুরের চিরির বন্দরে যে গুলী চলেছিল, কমরেড কালী সরকার সেই সংগ্রামে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ করেছিলেন। ঐ সময় চিরির বন্দরে ঈস্টার্ণ ফ্রন্টিয়ার রাইফেল বাহিনীর গুলীতে নিহত হল সংগ্রামী বিয়ার শেখ ও সমরউদ্দিন। জেলখানায় তেভাগা সংগ্রামের কথা বলতে গিয়ে কমরেড কালী সরকার লাফিয়ে উঠে হাতে তালি দিয়ে গান ধরতেন।
‘জয় জয় রণডঙ্কা বাজিল রে”-এই রণহুংঙ্কারের সঙ্গে সঙ্গে দেখতাম তাঁর চোখ দুটি অগ্নিগােলকের মত জ্বলজ্বল করতাে। তিনি যখন গুরু-গম্ভীর আওয়াজে সংগ্রামের উপরােক্ত ধুয়া ধরতেন, তখন উপস্থিত আমাদের রক্তে যেন আগুন ধরিয়ে দিত। রাজশাহীর কারাগারের খাপড়া ওয়ার্ডে রক্তাক্ত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আসার ফলে ১৪ নং সেলের পরস্পরের প্রতি গড়ে উঠেছিল নিবিড়তম সম্পর্ক। তবে একদিকে যেমন জীবন দেওয়া-নেওয়া খেলা শেষ করে আসার জন্য গড়ে উঠেছিল এক অবিচ্ছেদ্য রক্তের সম্পর্ক, তেমনি সেই সংগ্রামের আশু ব্যর্থতায় সবার মনে সাধারণভাবে জেগে উঠেছিল এক বিরাট জিজ্ঞাসা । নেতৃত্ব সম্বন্ধে সৃষ্টি হয়েছিল সন্দেহ ও অনাস্থার ভাব। ঐ সময় কী ব্যবহারিক জীবনে, কী রাজনৈতিক জীবনে আমাদের সংকট ছিল অত্যন্ত গভীর । কিন্তু তা হলেও বিপ্লবী আদর্শ আমাদের ঐ সময় হতাশা ও বিভ্রান্তি থেকে বাঁচিয়েছে।
আমাদের সঙ্গে যশােরের কমরেড পরিতােষ দাশগুপ্ত ও কমরেড সন্তোষ দাশগুপ্ত নামে দুই বিপ্লবী ১৪ নং সেলে ছিল। এই দুই সহােদর ভাই একই আদর্শে মরণপণ করে সংগ্রামে নেমেছিলাে। ধন্য তাদের গর্ভধারিণী মা! কমরেড পরিতােষ ছিলাে বয়সে ছােট কিন্তু মনােবলের দিক দিয়ে আদর্শ স্থানীয় । সে বাইরে বন্ধুবান্ধবদের কাছে চিঠি লিখতাে এবং তার উত্তরে যে চিঠি পেতাে তার ভাষায় যে নিষ্ঠা, যে আত্মপ্রত্যয় ফুটতাে, রূপকের মাধ্যমে বিপ্লবের বাণী অনবদ্য ভক্তি ফুটিয়ে তুলত তার কোন তুলনা হয় না। খুবই রসিক ছিলাে কমরেড পরিতােষ । তার রসিকতা, তার আনন্দোল্লাসের সঙ্গে আমরাও যােগ দিতাম।
১২৫

একচল্লিশ
কমরেড পরিতােষ এবং আমি কয়েকদিন পাশাপাশি সেলে থাকতাম। সারাদিন হৈ হৈ করে, সন্ধ্যায় লকআপে বসে মাঝে মাঝে পরিতােষ গান। ধরত-“কবে তুমি আসবে বলে, আমি রব না বসে, আমি রব না বসে, আমি চলবাে বাহিরে। শুকনাে গাছের পাতাগুলি পড়িতেছে ঝরে আর সময় নাহিরে”, ……….. ইত্যাদি গেয়েই কিছু সময় পর ডাক দিত “শহীদদা, রবিঠাকুর কাকে আহবান করছেন বলতে পারি না, কিন্তু আমি কাকে আসতে বলছি বুঝতে পারছেন তাে।” বললাম, না। “বুঝলেন না বিপ্লব বিপ্লব!”
এ জীবনে স্মৃতির যদি কোন জীবনদায়িনী শক্তি থাকে তবে ঐসব স্মৃতি আজও আমার মনকে সজীব করে রেখেছে। তবে বিপ্লবীদের স্মৃতি বুঝি। আপেক্ষিক-কারণ রক্তের রাখীবন্ধনে সেই যে নিবিড়তম সম্পর্ক তারও স্থায়িত্বের জন্য চাই বিপ্লবীদের মূল আদর্শের বাস্তবায়ন-অর্থাৎ জনতার মুক্তিই হলাে আমাদের বন্ধুত্বের চির স্থায়িত্বের পূর্বশর্ত। কিন্তু আজ আমরা কোথায়? একথা বলতে দ্বিধা নেই যে, একদিন যাদের নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলাম জনতার শৃংখল ভাঙ্গতে, বিপ্লবের সিংহদ্বারে পৌছাবাে বলে ছুটেছিলাম, রক্তের তরঙ্গ বেয়ে বেয়ে-আজ সে ধারা বহু খাতে প্রবাহিত। মনে হয় আমরা পুরানাে বিপ্লবীদের একটা বিরাট অংশ জনগণের দিকে পিঠ ফিরিয়ে দাঁড়িয়েছি। তাই বলছিলাম একই কেন্দ্রবিন্দু থেকে শুরু করে আজ আমরা পরস্পরের থেকে এত দূরে সরে এসেছি, যেন কেউ কাউকে চিনতে পারছি না। তাই বলছিলাম স্মৃতির মণিকোঠায় শুধু আনন্দেরই গুঞ্জন ধ্বনি শুনছি না, সেখানে বেদনা, বিরক্তি ও বিচ্ছেদের হাহাকারও ধ্বনিত হচ্ছে।
আমরা ১৪নং সেলে থাকাকালীন ১৯৫১ সনের কোন এক সময় পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান রাজশাহী আসেন। তিনি নাজিমুদ্দিন। পার্কে বক্তৃতা করবেন। এই পার্কটি ছিল আমাদের ওয়ার্ডের খুব কাছে। আমরা জেলখানায় বসে মাইকের আওয়াজ শুনতাম, বক্তৃতা বুঝতে পারতাম না। আমাদের কোন কোন কমরেড বারান্দার দেয়ালে উঠতে চেষ্টা করতেন। কিন্তু দেওয়ালের সঙ্গে কাঁটা তারের ছাদ আটকানাে। এই সময় একটি ঘটনা ঘটে।
১২৬
ঘটনাটি বেশ কৌতুকপ্রদ, আবার গুরুত্বপুর্ণও। ঘটনাটি এইঃ জেলের নিকটেই সভা বসে এবং স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী এসেছেন শুনে সমস্ত সিপাই-ই সভায় গিয়েছে। এদিকে দু’চারজন ছাড়া অতবড় জেলে কোন ওয়ার্ডার বা সিপাই নাই। জেলার বা সুপার এই ব্যবস্থা দেখে চটে গিয়ে সিপাইদের আনার জন্য পাগলা ঘন্টি বাজিয়েছিল । জেলে পাগলা ঘন্টি পড়তে সভায় উপস্থিত শতাধিক সিপাই এস্তব্যস্ত হয়ে সভাস্থল ত্যাগ করে দৌড়াতে থাকে। তাদের দৌড়াদৌড়ি দেখে সাধারণ শ্রোতারাও দৌড়িয়ে যে যেদিকে পারে ছুটতে থাকে। ফলে সভায় এমন গন্ডগােল হয় যে, আর সভার কাজ চালানাে সম্ভব হয় না। শােনা যায় এতে লিয়াকত আলী খান ভয়ানক ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন এবং নিজেকে অপমানিত বােধ করেছিলেন। বলাবাহুল্য, এর ফলে জেলার অথবা একজন উচ্ছপদস্থ জেল অফিসারকে সাসপেন্ড করা হয়। পাগলা ঘন্টি শুনে সভাস্থ সমস্ত জনসাধারণের আতঙ্ক ও উদ্বেগের কারণ ছিল এই যে, এর কয়েক মাস পূর্বেই রাজশাহীর খাপড়া ওয়ার্ডে আমাদের উপর গুলী চলে এবং ঐ সময় দীর্ঘস্থায়ী পাগলা ঘন্টি পড়েছিল।
এর অল্পদিন পরেই আমাকে ১২ নং সেলে বদলী করা হয়। ১৪ নং ওয়ার্ডের একেবারে পশ্চিম প্রান্তের সেল এটি। এটা ছিল ফাঁসির সেল। অর্থাৎ ফাঁসির আসামীকে এখানে রাখা হতাে। ফাঁসির সেলে যে ক’দিন ছিলাম সে ক’দিন কেন যেন ভালই লাগছিল। মনে হলাে এখানেই মৃত্যুর সঙ্গে মুখােমুখি লড়াই করছি। অনেক সময় নিজে ফাঁসির আসামী হতে না পেরে মনে মনে ক্ষুব্ধ হতাম। মনে হতাে ক্ষুদিরাম এ রকম একটি সেলে বসেই মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছিল। সে মৃত্যু কি মহৎ! মাওয়ের কথায় সে মৃত্যু পাখির পালকের মতই হালকা নয় বরং তা পর্বতের চেয়েও ভারী । দিনের বেলাটা কোন রকম কেটে গেল । কিন্তু সন্ধ্যার পর এক বিচিত্র অনুভূতিতে মনপ্রাণ ভরে উঠল। মনে হলাে মৃত্যু এক বিরাটত্ব নিয়ে আমাকে অভিভূত করে ফেলেছে। এ মৃত্যু শরৎচন্দ্র বর্ণিত ‘আঁধারের রূপ বর্ণনার ‘অতলস্পর্শী কালাে বা রবীন্দ্রনাথের ‘তুহু মম শ্যাম সমান নয়। এ মৃত্যু এক মহাসংগ্রামের যাত্রাপথের পথিক। এ মৃত্যু এক রক্তাক্ত বাস্তব। এ মৃত্যু বরং বেগম সুফিয়া কামালের ‘পুষ্প বিকাশের প্রয়ােজনে’র মতই মনে হলাে। এ মৃত্যু-মৃত্যুকে জয় করার জন্য; মৃত্যুকে মেরে ফেলার জন্য নয়।
আশ্চর্য লেগেছে এই ভেবে যে, ফাঁসির সেলে গভীর রাতে ঘুম ভেঙেও একটু ভয় অনুভব করিনি। অনেক সময় মনে হয়েছে অনেক অনেক মৃত্যু এখানে এই অন্ধকারে রূপ ধরে বসে আছে । কেমন যেন মনে হতাে, তারা আমার গায় ঠেকছে। কিন্তু কৈ ভয় হয়নি তাে। অনেক সময় পরিতােষ ডেকে বলতাে, কী, শহীদ ভাই, ঠাট্টা করে বলতাম, আমার ফাঁসি হয়ে গেছে। শুনেই বাচ্চা কমরেড
১২৭
চিৎকার করে উঠে সারা ওয়ার্ড মাতিয়ে তুলত । ডাকতাে, অমূল্যদা শহীদ ভাইয়ের নাকি ফাসি হয়ে গেছে। এখন তার প্রেতাত্মা কথা বলছে। আমার কিন্তু ভয় করছে, অমূল্যদা। ফাঁসির সেলে বসে মনে পড়ল মাস্টার দা’র (সূর্য সেনের) কথা। মনে পড়ল বাঘা যতীনের কথা। ৪২-এর অস্তি চিনরের বন্দীদের কথা, মনে পড়ল জুলিয়াস ফুচিল, রােজেন বাগেদের কথা। মনে পড়ল ভারতের মুক্তিসংগ্রামে আত্মাহুতি দানকারী বহু বিপ্লবীদের কথা, গেয়ে উঠতাম আপন মনে ‘ফাসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান, আসি অলক্ষ্যে দাড়িয়েছে তারা দিবে কোন বলিদান। আসামীকে শেষ কয়দিন এখানে থাকতে দেওয়া হয়। এর অল্প দূরেই পশ্চিম দিকে ফাঁসির গাছটি। একদিন সন্ধ্যার পর খুব সম্ভব যশােরের কমরেড পরিতােষ দাশগুপ্ত ১৪নং এ আসার ফলে আমাকে ১২নং-এ স্থানান্তরিত করা হয় । তখন জানতেও পারিনি যে এটা ফাসির সেল । পরদিন ভােরে ঘুম থেকে উঠেই দেখি সেলের দেয়ালে দুটো ফুটো। ফুটো দুটো এমন যার ভিতর দিয়ে দুটো বন্দুকের নল ঢুকতে পারে বা বাইরে থেকে ভিতরে উঁকি মেরে দেখতে পারা যায়। আমি ডিউটির সিপাইকে জিজ্ঞেস করলাম। সে বলল-এটা ফাসির সেল । এবং ফাঁসির আসামীকে পাহারা দেয়ার জন্য অনেক রকম ব্যবস্থা রয়েছে বলেই সে আমার নিকট ফাঁসির গাছটি দেখিয়ে দিল । এর কয়েক দিন পর দেখলাম কয়েকজন লােক মিলে একটা ভারী বস্তা ফাঁসির দড়ির সঙ্গে বেঁধে ওটাকে উঠানামা করছে। সিপাইর কাছে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম যে, ফাঁসি দিবার সময় দড়িটির সড়কা যাতে দ্রুত নেমে গিয়ে গলায় আটকে যেতে পারে, ভারী বস্তা বেঁধে তারই মহড়া চলছে। বস্তায় বালি ভরা ছিল। শুনলাম অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই একজন ফাঁসির আসামীকে সেলে নিয়ে আসা হবে। ঠিকই এর এক সপ্তাহের মধ্যে আমাকে উক্ত সেল থেকে সরিয়ে নেয়া হয়।
ফাঁসির সেলটাকে মনে হলাে স্টেশনের ওয়েটিংরুমের মত। মনে হলাে। আগের ট্রেনেই ত চলে গেছে ক্ষুদিরামসহ কত যাত্রী। এসব ওয়েটিংরুমে থেকে অনেকেই ট্রেন ধরেছে, সেই ব্যারাকপুর থেকে মঙ্গলপাড়ের টিকিট কাটা। সেটা ১৮৫৭ সালের কথা। সেই প্রথম। ভারতীয় সিপাইদের ডাক দিয়ে বলে গেল, “আমি চললাম, ভারত স্বাধীন হবেই-এই বটগাছটাকে সাক্ষী রেখে গেলাম।”
আজও সেটা আছে । তখন কে জানত যে আরাে কত যাত্রী এ ট্রেন ধরবে । বরকত, সালাম, রফিক ও জব্বার ওরা তখন প্রস্তুতি নিচ্ছে রওয়ানা হবার জন্য। বাড়ীতে জামাকাপড় গােছাচ্ছে। তবে ওরা নাকি প্লাটফরমে অপেক্ষা করবে না। যেমন করেনি আনােয়ার, নতুন দেলওয়ার কম্পম-এইতাে সেদিন গেল ওরা।
অনেক সিপাই সন্ধ্যায় বদলিতে এসে আমাকে দেখেই ফাঁসির আসামী বলে
১২৮
মনে করে থমকে দাঁড়াত । সেলের সামনেই আসত না-দূরে দাঁড়িয়ে মাথা নীচু করে থাকত। তখন ওদের বলতাম-আমি ফাঁসির আসামী নই। আমি সিকিউরিটি। তখন সে সামনে চলে আসতাে এবং নানা বিষয় আলাপ করতাে। সিপাইকে তখন জিজ্ঞেস করলাম। আপনি কি কোনদিন ফাঁসির আসামী পাহারা দিয়েছেন? সে বলল, দিয়েছি তবে বড় ভয় করে, কেবলই মনে হয় ওটা ভূত।
মাত্র এক সপ্তাহ এই কুঠুরিতে ছিলাম। অনেক সময় মনে হতাে আমি এক জীবন্ত মৃত্যুর সঙ্গে বাস করছি। এক সময় মনে হলাে আমরা আদর্শের জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত আছি বলেই মৃত্যু আমাদের কাছে এক মহান রূপ নিয়ে আসে। আমরা নির্ভয়ে তাকে আহ্বান করি। কিন্তু যারা অন্য কারণে ফাঁসির দন্ডাদেশ প্রাপ্ত হয়, তাদের মনের অবস্থা কিরূপ হয়? এই সেলে বসে বসেই হয়ত তারা মৃত্যুর দিন গুনতে গুনতে অজ্ঞান হয়ে পড়েছে। হয়ত কেউ উন্মাদ হয়ে গেছে। হয়ত কারও মনে জন্ম থেকে সমস্ত জীবনের চিহ্ন অগণিত তরঙ্গের মত মনের তটে আঘাত করেছে। হয়ত সে নিজের অজ্ঞাতেই জীবনাতীত এক অলৌকিক কল্পনায় নিমগ্ন হয়ে পড়তাে। তাতে থাকত ভয় অভয় চিন্তনীয় অচিন্তনীয় এক অতলস্পর্শী অনুভূতি-তা কেউ ভাষায় বর্ণনা করতে পারে না, অবশ্য আমার কথাই বলি- যে পর্যন্ত মৃত্যুর কাঠগড়ায় এসে দাঁড়াতে না পারব সে পর্যন্ত শুধু আদর্শবাদের বড়াই করা কি ঠিক হবে?
১২৯

বেয়াল্লিশ
এক সপ্তাহ পরে আমাকে এবং খুব সম্ভব ওখান থেকে অনেককেই অন্য ওয়ার্ডে স্থানান্তরিত করা হয়। এই সময় হঠাৎ একদিন অর্ডার এল আমরা সব খালাস পেয়েছি। সে এক এলাহি কান্ড । সংবাদ পাবার সঙ্গে সঙ্গে যেন ওয়ার্ডের প্রতিটি ইট হাতে হাতে উঠে এল । এক অভাবিত বিজয়ােল্লাসে আমাদের বাচ্চা কমরেডরা ওয়ার্ডটি মাতিয়ে তুলল । আমাদের অবস্থাই বা কি! এও কি সত্য হতে পারে! আমরা হতবাক হয়ে এ ওর মুখের দিকে তাকালাম। শুনলাম আমরা হেবিয়াস কর্পাসে মুক্ত হয়েছি। ভাবলাম এই আদেশের তাৎপর্য কি? সত্যিই কি আমরা মুক্ত হয়েছি? সরকার কি আমাদের মুক্তি দেবে? এও কি সম্ভব। এরই মধ্যে কয়েকজন সিপাই এসে গেল। তারা বলল, আপনারা সবাই গেটে চলুন। সেখান থেকে আপনাদের উপর কী অর্ডার হবে জানি না। তবে শুনলাম আপনারা নাকি খালাস। বললাম- তা হলে আমাদের জিনিসপত্র সব কিছু নিয়ে চলি। সিপাইরা বলল, না আগে গেটে চলুন। অর্ডার নিয়ে আসুন তারপর যা হয় করবেন।
অবশ্য আমরা বুঝতে পারলাম যে, হেবিয়াস কর্পাসে আমরা মুক্তি পেয়েছি কিন্তু তার অর্থ এ নয় যে আমাদের একেবারে ছেড়ে দেয়া হবে। নিশ্চয়ই জেল গেটের বাইরে নিয়ে অন্য কোন নতুন অর্ডার দিয়ে আবার ধরে রাখবে। যাহােক আমরা বিরাট হৈ হুল্লোড় করে গেটের দিকে এগােলাম। গিয়ে দেখি অন্যান্য সমস্ত ওয়ার্ড থেকেও রাজবন্দীরা সব ওখানে জড়াে হয়েছে। সবাই মিলে সে এক জটলা। নানা রকম জল্পনা কল্পনা। জেল কর্তৃপক্ষও দেরী না করে আমাদের মুক্তি দিল। আমাদের সবাইকে গেটের বাইরে নিয়ে গেল। দীর্ঘ তিন চার বছর পর কমরেডরা রাজশাহী জেলের মেইন গেটের বাইরে খােলা চত্বরে ঝকঝকে রােদে বেরিয়ে এল। বহু লােক রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়ল আমাদের দেখতে। আমরা চেয়ে। দেখলাম আমাদের কর্ডন করে অর্থাৎ ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রায় একশত বন্দুকধারী পুলিশ।
জেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ করলে তারা বলল, আপনাদের খালাস দেওয়া। হয়েছে ঠিকই এবং আপনারা ইচ্ছে করলে ট্রাকে করে আমাদের সঙ্গে রাজশাহী
১৩০
শহরেও ঘুরে আসতে পারেন। কিন্তু সবই করতে হবে আমাদের পাহারাধীনে। এ যেন বিড়ালের ইঁদুর নিয়ে খেলা।
বুঝলাম- আমাদের মুক্তি দেওয়া হবে না। আমাদের জন্য কিছু সময়ের । মধ্যেই অন্য অর্ডার আসবে। জেল কর্তৃপক্ষও তাই বলল । বলল যে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ রেডিওগ্রাম করে আমাদের জন্য তৈরি অর্ডিনেন্সটি জানিয়ে দেওয়ার পূর্ব পর্যন্ত আপনারা মুক্ত। এই অর্ডিনেন্সটি না আসা পর্যন্ত আমরা আপনাদের জেলের ভিতরে নিয়ে যেতে পারি না। তারা সিপাহীদের আপনাদেরকে কর্ডন করে রাখতে বলেছে। আমাদের কেউ কেউ তখন শ্লোগান দিতে চাইল ‘আমরা জেলে ফিরে যাব না। কিন্তু সেটা আর শেষ পর্যন্ত হয় নাই। যতদূর মনে পড়ে মাত্র দেড় ঘণ্টার মধ্যে অর্ডিনেন্স বলে আমাদের আবার জেলে নিয়ে গেল।
পুনরায় গ্রেফতারের এই মােক্ষম অস্ত্রটি হলাে ১৮১৮ সালের কুখ্যাত ৩নং রেগুলেশন। শুনে আমরা হতবাক হলাম। সরকারের নির্লজ্জ বেহায়াপনা আর। ঔদ্ধত্য দেখে রাগে ঘৃণায় ক্ষোভে আমরা ফুলতে লাগলাম। জানি এই সরকার ব্রিটিশের পদলেহী- কিন্তু তা বলে আমাদের আটক করার জন্য একটি তথাকথিত হলেও স্বাধীন সরকারের ১৮১৮ সনের সেই কোম্পানী আমলের আইন প্রয়ােগ করতে একটুও আটকালাে না। বুঝলাম সাম্রাজ্যবাদের যারা দালাল তাদের কাছে কোন কিছুই আটকায় না। বিপ্লবীদের দমন করতে তারা সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ সাহায্য নিতেও কোন দিন কুণ্ঠাবােধ করে না।
যাই হােক এই রেগুলেশন থ্রি দিয়ে নাকি ভারতের স্বাধীনতাকামী শ্রেষ্ঠ রাজনীতিবিদদের আটকানাে হয়েছে। এই ধারায় আটক বন্দীদের নাকি স্টেট প্রিজনার বলে এবং তাদের মর্যাদাও নাকি অনেক উচ্চে। তা হলে জেল গেটে আমাদের ওপর এই অর্ডিনেন্স প্রযুক্ত হবার পর পরই আমরা State Prisoner হয়ে গেলাম। এখন আর আমরা সাধারণ নিরাপত্তাবন্দী নই। আমরা এখন গান্ধী, জওহরলাল, সুভাষ বােস, মাওলানা আজাদ-এর সমমর্যাদায় উন্নীত হয়েছি।
বিশ্বের অন্যতম বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ইংল্যান্ডের ইতিহাস বিখ্যাত হেবিয়াস কর্পাস করে মুক্তি পেয়েও আমাদের আবার সঙ্গে সঙ্গে জেলে ঢুকতে হলাে। যাক এ দুঃখের মধ্যেও আমরা মনের স্ফুর্তি বজায় রাখার জন্য নিজেদের স্টেট প্রিজনার বলে জাহির করে সান্ত্বনা খুঁজতে লাগলাম। আমােদপ্রিয় বঙ্কিম বাবু বললেন, “ঠিক আছে। স্টেট প্রিজনার হিসেবে আমাদের মর্যাদানুযায়ী আমরা আমাদের ওয়ার্ডে হেঁটে যেতে পারি না। আমাদের জন্য গাড়ী চাই।” বঙ্কিম বাবু কথাটা এমন ভারিক্কী চালে বললেন যে ডেপুটি জেলার একটু ভড়কে গেলেন। তিনি হয়ত ভাবছেন কী জানি হতেও পারে, State Prisoner চাট্টিখানি কথা নয়,
১৩১
গাড়ী লাগতেও পারে। তাঁকে থতমত খেতে দেখে আমরা বললাম, “আরে চলুন-জেলের মধ্যে গাড়ী পাবেন কোথায়? হেঁটেই যাব আমরা যার যার নির্দিষ্ট কামরায় । কিন্তু বলে দিচ্ছি আজকেই আমাদের জন্য জাজিম, গালিচা, বড় গেরদা বালিশ ইত্যাদি পাঠাতে হবে।”
আমরা ওয়ার্ডে গিয়ে সুপারকে ডাকাবার প্রস্তাব করলাম। আমরা এখন State Prisoner, আমাদের তদনুযায়ী মর্যাদা দিতে হবে। আমাদের মাথাপিছু খাবার জন্য দিতে হবে প্রতিদিন কমপক্ষে পনেরাে টাকা করে। পরদিন বেলা দুটো পর্যন্ত জেল কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে কেউ এল না। আমরা ভুলে গেলাম যে এরা রেগুলেশন থ্রিতে আটকাতে পারে কিন্তু সে মর্যাদা দিতে পারে না। কারণ, যাদের নিজেদের মর্যাদা নাই, তারা অন্যের মর্যাদা দেবে কি করে। এত আর ময়ুর নয়, ময়ূরপুচ্ছ কাক। কত জঘণ্য এরা। আমাদের এমন কোন অপরাধ ছিল না যা পাকিস্তানী কোন অর্ডিনেন্সের আওতায় আনা যায়। তাই এদেশে দস্যু বৃটিশদের প্রথম যুগের আইন প্রয়ােগ করে আমাদের আটকাতে হলাে। যতদূর মনে পড়ে এই রেগুলেশন তৎকালীন দেশীয় রাজা-মহারাজাদের বিরুদ্ধেও প্রযুক্ত হতাে। সেদিক দিয়ে আমাদের স্টেটাস ছিল একজন রাজা-মহারাজার সঙ্গে তুল্য। যাই হােক আর কিছু না হােক আমরা State Prisoner বলে আখ্যায়িত হলাম। এ যেন ভিস্তি বাদশার গল্পের মত । জেল কর্তৃপক্ষের কেউ ওয়ার্ডে না আসায় আমরা কড়া নােট দিলাম । ফলে পরদিন ১২টায় একজন তালপাতার সিপাহীর মতাে সেকেন্ড অফিসার (অবশ্য ডেপুটি র্যাংকের) এলেন আমাদের সঙ্গে দেখা করতে। তিনি হঠাৎ ঢুকে পড়লেন। কী করি, সামনা সামনি ভদ্রলােককে অপমান করা যায় না। তবু বলা হলাে, স্টেট প্রিজনাররা একজন সেকেন্ডে অফিসার অর্থাৎ ডেপুটি মহকুমা হাকিমের সঙ্গে দেখা করে কি বলবে । কিন্তু ভদ্রলােক বড় অমায়িক। বলল, দেখুন আমরা আপনাদের সম্মান করি। আপনারা অবশ্যই অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করবেন। আপনাদের জন্য প্রতি মিল বা ওয়াক্তের খাবারের জন্য বারাে আনা পয়সা বেশী করে ধার্য করেছে। তবে আপনারা কালই অন্য অর্ডিন্যান্সের আওতায় আসবেন। একজন স্টেট প্রিজনারের জন্য বারাে আনা বেশী ভাতা-বারাে টাকা নয়। আর করি কি। অবস্থা বুঝে আমরা পরস্পরের মুখের দিকে অর্থহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম ।
১৩২

তেতাল্লিশ
এই সময় জেলে থাকতে আমরা লিয়াকত আলীর মৃত্যু সংবাদ পাই। সেদিন আমরা যার যার সেলে বসে আছি। হঠাৎ পাশের সেল থেকে যশােরের কমরেড হীরণ সেন চিৎকার করে বললেনঃ শহীদ সাহেব দেখুন এসে, স্টেটসম্যান পত্রিকা কতখানি কেটে দিয়েছে। আমি বলে দিলাম পাকিস্তানের রাজধানীতে বড় একটা কিছু ঘটেছে। বলেই হীরণ বাবু এক হাতের উপর একহাত দিয়ে জোরে চাপড় মেরে গম্ভীর হয়ে গেলেন। চশমার ফাক দিয়ে তাঁর বড় বড় চোখ জ্বল জ্বল করতে লাগল। আমরা সকলে এক জায়গায় জড়াে হলাম । ভাবতে লাগলাম, এমন কি খবর হতে পারে যার জন্য এত বড় হেডিং দিতে পারে । নিশ্চয় এটা ভারতীয় খবর। নয়। কারণ ভারতের যে-কোন দুঃসংবাদ পাকিস্তান সরকার আমাদের কাছ থেকে। গােপন রাখবে না। আমরা বসে শুধু ভাবছি। এমন সময় আমাদের সকল জল্পনাকল্পনা নিরসন করে একজন ডেপুটি জেলার কাকে যেন ডেকে বলল, শুনছেন, আমাদের প্রধানমন্ত্রী মারা গেছেন। ঠিক মারা নয়, শহীদ হয়েছেন। রাওয়ালপিন্ডিতে এক জনসভায় বক্তৃতা দেবার সময় জনৈক আততায়ীর গুলীতে তাঁর প্রাণবিয়ােগ হয়। আমরা অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইলাম। মনে হলাে, লিয়াকত আলীর এই মৃত্যু পাকিস্তানের রাজনীতিতে গভীর ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত বহন করছে। এ ঘটনা বস্তুত পাকিস্তানের রাজনীতিতে এক গভীর সংকটের সূচনা করলাে। তখন। কোরিয়ায় যুদ্ধ চলছে। শুনেছিলাম, লিয়াকত আলী কোরিয়ায় জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সৈন্য পাঠাতে অস্বীকার করেছিলেন। আমেরিকা লুব্ধদৃষ্টিতে। পাকিস্তানের বাজারের দিকে তাকিয়ে আছে। এমন সময় লিয়াকত আলী রাশিয়া ভ্রমণের ইচ্ছা প্রকাশ করে সম্ভবত আমেরিকাকে চটিয়েছে। অবশ্য লিয়াকত আলী খান রাশিয়া যান নাই-আমেরিকায়ই গিয়েছিলেন। নানা কারণে লিয়াকত আলীর এই হত্যাকান্ডের পিছনে সাম্রাজ্যবাদের হাত ছিল এবং তা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদও হতে পারে।
ঐ সময় রাজশাহী জেলে খাপড়া ওয়ার্ড ছাড়া অন্যান্য ওয়ার্ডে যে সমস্ত রাজবন্দী ছিলেন তার মধ্যে সিকিউরিটি ছাড়া বেশ কিছু সাজাপ্রাপ্ত রাজবন্দীও ছিলেন। এঁরা হলেন কমরেড সুধীর মুখার্জি, যশােরের কমরেড নূর জালাল ও কমরেড অনিমেষ লাহিড়ী । নূর জালালের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক হত্যা মামলায় মাত্র পাঁচ বছর সাজা হয়েছিল। কিন্তু আপীল করায় ঐ সাজা বেড়ে একুশ বছরে
১৩৩
দাঁড়িয়েছিল। এ ছাড়া ছিলেন ইলা মিত্রসহ নাচোল মামলার বন্দীরা। নাচোল আন্দোলন ছিল তৎকালে উত্তরবঙ্গের কৃষক সংগ্রামের একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। নাচোল রাজশাহী জেলার অন্তর্গত একটি থানা। এ থানার অধিবাসীদের অধিকাংশই গরীব কৃষক। এরা সাঁওতাল শ্রেণীর। এরা ছিল সবদিক দিয়েই বঞ্চিত। ‘৪৮ সনে ময়মনসিংহে হাজংদের মধ্যে যখন বিদ্রোহ দেখা দেয়-নাচোলে তার ঢেউ লাগে। কৃষক নেতা আজহার ও অনিমেষ লাহিড়ীর নেতৃত্বে আন্দোলন যখন সশস্ত্র সংগ্রামের রূপ নেয়, সেই সময় সেখানে উপরােক্ত ইলা মিত্র ঘুরে ঘুরে কৃষকদের পক্ষে প্রচার করতে থাকেন। কুসংস্কারাচ্ছন্ন সাঁওতাল ও দরিদ্র কৃষকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে যে, ইলা মিত্র আর কেউ নয় স্বয়ং কালীমাতা। তিনি অত্যাচারীর রক্ত চান। ধর্মান্ধ গরীব কৃষকরা এতে তাদের সংগ্রাম তীব্রতর করেন এবং ফলে ক্রুদ্ধ জনতার হাতে নাচোলের একজন দারােগাসহ তিনজন পুলিশ নিহত হয়। কিন্তু সরকারের প্রচন্ড দমন নীতির সামনে অচিরেই এই সংগ্রাম স্তব্ধ হয়ে যায় এবং ইলা মিত্রসহ প্রায় দুই তিন শত কৃষককে গ্রেফতার করে রাজশাহী জেলে আনা হয়। জমিদার-জোতদারদের শতাব্দীব্যাপী অত্যাচারের বিরুদ্ধে নিজেদের বাঁচার দাবি আদায় করতে গিয়ে অসংখ্য নাচোল-কৃষক পাকিস্তানী জল্লাদ বাহিনীর হাতে চরমভাবে নির্যাতিত হয়। ঐ সময় বাইরে এবং ভিতরে নাচোলের কৃষক ও রাজনৈতিক কর্মীদের উপর যে অত্যাচার ও হত্যাযজ্ঞ চলে তদানীন্তন মুসলিম লীগ সরকারের অগণিত কলঙ্কময় ঘটনার মধ্যে তা অন্যতম। রাজশাহী জেলে নাচোল কেসের আসামীদের মধ্যে রসিক লাল, বৃন্দাবন দাস, যদু মাঝি, অনিমেষ লাহিড়ী ছাড়া আরও বহু বন্দী অসহনীয় নির্যাতন ভােগ করেন। বহু নাচোল বন্দী বিনা চিকিৎসায় জেলে মারা যান। এদের কোনরূপ রাজনৈতিক মর্যাদা দেওয়া হয়নি। এইভাবে অনাহারে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর নজীর একমাত্র হিটলারের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পগুলিতে সম্ভব ছিল। বলা বাহুল্য দুশাে বছরের বৃটিশ শাসনে যে কজন রাজবন্দী জেলে মৃত্যুবরণ করেছেন মাত্র কয়েক বছরের মুসলিম লীগ শাসনে তার চেয়ে বেশী বন্দী জেলখানায় মারা যান। নাচোলের বীর। রাজবন্দীরা দেশের জন্য হাসিমুখে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন কিন্তু কখনও সরকারের কাছে মাথা নােয়াননি। আর ঐ নাচোল আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী হলেন শ্রীমতী ইলা মিত্র। ইনিই একমাত্র মহিলা যিনি বিভাগােত্তরকালে মুসলিম লীগের স্বৈরশাসনের আমলে সবচেয়ে বেশী নিগৃহীত হয়েছেন। তিনি একজন উচ্চ | শিক্ষিত মহিলা হয়েও কৃষক আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়তে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি। বন্দী অবস্থায় তার উপর জনৈক পুলিশ পাশবিক অত্যাচার করে এবং তাঁর যােনিদ্বার দিয়ে গরম সিদ্ধ ডিম প্রবেশ করিয়ে দেয়। কিন্তু এত অত্যাচার সত্ত্বেও এই বীর রমণীর কাছ থেকে পুলিশ কোন কথা উদ্ধার করতে পারেনি। অকথ্য
১৩৪
অত্যাচারে তিনি জেলখানায় অর্ধমৃত অবস্থায় উপনীত হলে তাকে চিকিৎসার জন্য ছুটিতে ভারতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তার জন্য তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং তাঁর ছুটির জন্য সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করেন। অবশ্য ইলা মিত্র কলকাতায় িয়ে আর এদেশে ফেরেন নাই। সুলেখিকা ইলা মিত্রের কয়েকটি কবিতা ও চিঠি রিবর্তীকালে পুস্তকাকারে ছাপা হয়েছিল। তিনি কলকাতায় একবার আইন পরিষদের সদস্যাও হয়েছিলেন।
রাজশাহীতে আমাদের সঙ্গে বরিশালের অন্যতম মহিলা নেত্রী মনােরমা বসু (মাসীমা) ছিলেন। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা দরকার যে, বৃটিশ বিরােধী সংগ্রামে আমাদের দেশে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের সঙ্গে জড়িত প্রীতিলতা ওয়াদ্দার, মাতঙ্গিনী হাজরা থেকে বহু সংগ্রামী মহিলার সঙ্গে বিভাগােত্তর কালে কৃষক সংগ্রামে বীর ইলা মিত্রের নাম স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এ ছাড়া সিলেটের অর্পনা পাল, হাজং আন্দোলনের গুণমনি হাজং, তেভাগার জয়মণি, অনিমাদি, যশােরের সরলাদির নামও ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে।
এই প্রসঙ্গে তথ্য উল্লেখ করা দরকার যে, দেশ বিভাগের পর জেলের ভিতরে এবং বাইরে যে সমস্ত বিপ্লবী বিভিন্নভাবে নির্যাতন ভােগ করেছেন, জেল খেটেছেন, জীবন দিয়েছেন, দীর্ঘদিন আত্মগােপন করে অবর্ণনীয় দুঃখকষ্ট ভােগ করেছেন তাঁদের মধ্যে খুব অল্প কয়েকজনের হলেও পুরুষদের সম্পর্কে কিছু বলা হয়েছে বা লেখা হয়েছে কিন্তু আমার মনে হয় অসংখ্য মহিলা বিপ্লবীও আছেন যারা হয়ত অত্যন্ত সাধারণ ঘরের কৃষকবধূ, মাতা বা ভগ্নি । কিন্তু তাঁদের নাম আমরা জানি না, জানতে চেষ্টাও করিনি বা জনসাধারণের মধ্যে তাঁদের নাম প্রকাশের তাগিদও অনুভব করিনি। অথচ যে-কোন দেশে বিপ্লবী আন্দোলনে মহিলাদের অবদান অনেক বেশী মূল্যবান হতে বাধ্য। এদেশে সন্ত্রাসবাদী যুগে বহু মহিলাই চরম বিপ্লবী মনােভাবের পরিচয় দিয়েছেন। বিপ্লবীদের আত্মগােপন কালে মেয়েদের সাহায্য অপরিহার্য। বর্তমান ভিয়েতনাম যুদ্ধে মিনখাইসহ অসংখ্য মহিলার বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম বিশ্বকে বিস্ময়াবিষ্ট করে রেখেছে। কে না জানে আলজিরিয়ার রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে জমিলা বুয়াদ, জমিলা বুরহিদ ও আরও এক মহিলা বৈপ্লবিক সংগ্রামে এবং মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য বীরত্ব ও সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে বিশ্ব-নারী সমাজে উজ্জ্বল মহিমার স্বাক্ষর রেখে গেছেন।
১৩৫

চুয়াল্লিশ
এবার জেলখানায় পড়াশুনা সম্পর্ক কিছু বলবাে। লেনিন নাকি বলেছেন যে, রাজবন্দীদের জন্য জেলখানা একটি বিশ্ববিদ্যালয়। আমার মতে আসলেও তাই। জেলের এবং বাইরের পরিবেশ সুস্থ থাকলে, স্বাস্থ্য অনূকুল হলে লেখাপড়ায় এরূপ সুযােগ আর কোথাও মেলে কিনা সন্দেহ।
সত্য বলতে কি, জেলে বইপুস্তককে একটা জীবন্ত সাথী বলে মনে হয়। লক্ষ্য করেছি বাইরে পড়ার জন্য পড়েছি। আর জেলে পড়াশুনার জন্য একটা বৈপ্লবিক দৃষ্টিভঙ্গির সৃষ্টি করতে পেরেছি। তা হলে কেন পড়াশুনা? বিপ্লবীরা বিপ্লব সার্থক করার জন্য প্রয়ােজনীয় তত্ত্ব ও তথ্যাদি বই পুস্তক থেকে আহরণ করবে। জেলে সরকারের প্রত্যক্ষ অত্যাচারের সম্মুখীন হলেই এ ধারণা এবং উদ্দেশ্য সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। ফলে পড়াশুনার সুদূরপ্রসারী তাৎপর্যের সৃষ্টি হয়। তা ছাড়া এই দৃষ্টভঙ্গি হলাে মহৎ সৃষ্টিকে জানার উদগ্র আকাঙ্খ। জ্ঞান সাধনার অতৃপ্ত বাসনা। এই জ্ঞান সাধনার ইচ্ছা শুধু একটু ভাবাবেগপ্রসূত কিছু নয়, জেলে এর বাস্তব দিকই উপলব্ধি করেছি বলে মনে হয়েছে। মনে হয়েছে-আমরা যে জীবনাহুতি দেওয়ার সংকল্প করেছি এর মূল প্রেরণা এল কোথা থেকে। অতীতের মহৎ স্রষ্টারাই এই প্রেরণা যুগিয়েছে। এবং তারা তাদের সৃষ্টিকে ধরে রেখেছেন অমর লেখনীর মধ্য দিয়ে।
এ কথা সত্য যে, পৃথিবীতে অনেকগুলি মহৎ গ্রন্থই জেলখানায় বসে সৃষ্টি হয়েছিল। যেমন ঊনিশ শতকের বিখ্যাত ইংরেজ স্টেটসম্যান ডিজরেলির মন্তব্য: ‘ther men condemned the exile and captivity as they survive despair. The man of letter may reckon those days as the sweetest of life’. তিনি জেলে হুগাে গ্রোটিয়ামের লেখা সম্বন্ধে উপরােক্ত মন্তব্য করছিলেন।
তাছাড়া স্পেনীয় কারভেন্টেসের বিশ্ববিখ্যাত বই ডনকুইকজোট, জন বানিয়ানের অমর ‘Pilgrims Progress’ জেলেই তৈরী হয়েছিল। পন্ডিত নেহেরু তাঁর Glimpse from the World History’ বা সুভাষ বসু তরুণের স্বপ্ন’ প্রভৃতি গ্রন্থ জেলে বসেই লিখেছিলেন।
বিপ্লবীদের জীবনে মহৎ প্রেরণা সৃষ্টিকারী পত্র-সাহিত্য ফু চিকের Notes from the Gallows, Rosenburg দম্পতির পত্রাবলী জেলে বসেই লেখা। হয়েছিল। তাই একথা বলতে একটুও দ্বিধা নেই যে, আজও বাইরে বিরাট
১৩৬
বিপর্যয়ের মধ্যেও পড়াশুনার যেটুকু অভ্যাস রক্ষা করতে পেরেছি তা সৃষ্টি হয়েছিল জেলে থেকে। জেলেই বুঝেছি পড়ার জন্য পড়া নয় বরং বাঁচার জন্যই পড়া। বিশ্বকে পরিবর্তনের জন্য পড়া। অবশ্য জেলে অফুরন্ত সময় থাকলেও বইপত্র ছিল খুবই অল্প। জেল-জীবনের প্রথম দিকে অর্থাৎ ৪৮ থেকে ৫২ এর চার বৎসর গিয়েছে শুধু কোন রকম বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করে । যেটুকু পড়াশুনা করতে পেরেছি তা হলাে ৫২-এর ভাষা আন্দোলনের পর থেকে, এর পূর্বেও যে না পড়েছি তা নয়। এবং লক্ষ্য করেছি সেই পড়াশুনা যেন আরও জীবন্ত হয়েছে। অনেক সময় আমাদের ধারণা হয় যে, একটা নিঝঞাট পরিবেশেই পড়াশুনা হয় কিন্তু আসলে সংগ্রামের মধ্যে পড়াশুনার প্রয়ােজনীয়তা ও বাস্তবতা যেরূপ জীবন্ত হয়ে দেখা। দেয়, শান্তির সময় সেরূপ মনে হয় না।
বইপত্র ছাড়াও এসময় আমরা দশ বারােটি খবরের কাগজ পেতাম। বাইরের প্রত্যক্ষ আন্দোলন ও ঘটনাবলী সম্বন্ধে নিজেদের ওয়াকিফহাল রাখার জন্য খবরের কাগজ পড়া ছিল আমাদের কাছে অপরিহার্য। তখন The Statesman, পশ্চিম পাকিস্তানের Civil & Military Gazette, এবং কখনও কখনও লন্ডনের ডেলি টেলিগ্রাফ ইত্যাদিও আমাদের কাছে পৌঁছত। এগুলি পড়তে আমাদের অনেক সময় কেটে যেত। আমি অধিকাংশ সময় ছিলাম এসােসিয়েশন ওয়ার্ডে অর্থাৎ দুশাে-তিনশাে কমরেডদের সঙ্গে একত্রে। কাজেই এদের সবার পড়ার সুযােগ করে দিতে হতাে। আমরা জেলখানায় বইপত্র একত্র রেখে পড়াশুনার একটি নিয়ম কানুন গড়ে তুলেছিলাম। আমি পুরাে দুবছর আমাদের নিজস্ব বইয়ের লাইব্রেরীয়ান ছিলাম। এর ফলে বাইরের কোন বই আসার সাথে সাথেই আমার হাতে আসত প্রথম। কাজেই বই সম্বন্ধে একটা প্রাথমিক ধারণা করার সুযােগ আমার ছিল। এতে অসুবিধাও ছিল এই যে লাইব্রেরীয়ান বলেই আমাকে অন্যের পড়াশুনার ব্যবস্থা করে দেওয়াই ছিল একটা বড় কাজ। তাতে নিজের পড়া অনেকটা ব্যাহত হতাে। একখানা বই আসলে একই সাথে আমার কাছে হুমড়ি খেয়ে পড়তাে ডজন। ডজন কমরেড । কেউ কেউ রাত দু’টার পর হলেও যেন তাকে বই দেওয়া হয় বলে জানাত। কেউ অন্যের স্নানের সময়, কেউ নিজের খাবারটা ঢেকে রেখে ঐ সময় বইখানা পড়ে নিবার জন্য সময় করে দিতে বলতাে।
পড়াশুনার অদ্ভুত নেশা পেয়ে বসেছিল আমাদের কমরেডদের। মনে আছে রাজশাহীর কমরেড চিত্ত চ্যাটার্জী এতই পড়াশুনায় ব্যস্ত থাকতেন যে, তাঁর সঙ্গে যদি কেউ কথা বলতে যেতেন তা হলে তিনি তাকে বলতেন, “দেখুন, আমি যে সময় স্নানে যাই ঐ সময় পথে আমার সঙ্গে কথা বলতে পারেন। এ নিয়ে আমরা তাঁকে কত না ক্ষেপাতাম । আমাদের অনেক অসুস্থ কমরেড এবং বাচ্চা কমরেডরা রাত জেগে পড়াশুনা করত বলে আমরা রাত একটার পর কাউকেও জেগে পড়া
১৩৭
শুনা করা নিষেধ করেছিলাম । বইয়ের মধ্যে কীট ঢুকলে তাও যদি কোন সময় বই ছাড়ে কিন্তু এই সমস্ত পড়ুয়ারা এমনই গ্রন্থকীটে পরিণত হয়েছিলেন, তাঁদের কখনও বই থেকে আলাদা করা যেত না। এবং এটা ছিল অত্যন্ত স্বাভাবিক। দীর্ঘদিন আবদ্ধ অবস্থায় বাইরের বিশাল জনতাকে আমরা বইয়ের মধ্যে দেখতে চাইতাম, বই, খবরের কাগজ এসব ছিল আমাদের বাইরের অন্য জগতের একমাত্র সেতু।
এ সময় যে সমস্ত বই, ম্যাগাজিন, মাসিক পত্রপত্রিকাদি পড়েছি তার অনেকগুলির-অনেকগুলির কেন প্রায় সকলেরই নাম ভুলতে বসেছি। কিন্তু এটা সুস্পষ্ট অনুভব করতে পারছি যে, তখনকার প্রতিটি বই থেকে আহরিত জ্ঞান যেন এক একটি সুধাভান্ড। আর আজও যেন তা মনের পাতায় সুধা ঢালছে । ঐ সময়। পড়েছি ফ্রান্সের পল সাত্রের What is Literature, পড়েছি হাওয়ার্ড ফাস্টের Last Frontier, Conceived in Liberty, Freedom Road, Spartacus. আমেরিকার কমুনিস্ট ও বিশ্ববিখ্যাত লেখক এই বইগুলােতে দেখিয়েছেন কিভাবে আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের হােয়াইট বা সাদা গােষ্ঠী, দক্ষিণ দেশীয় অনুন্নত। নিগ্রো ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের সব দিক দিয়ে দমিয়ে রাখতাে কিন্তু এর বিরুদ্ধে এই সমস্ত দক্ষিণাঞ্চলীয় সংখ্যালঘু ও নিগ্রোরা কি ভাবে লড়াই করেছে তার একটা পরিষ্কার চিত্র তুলে ধরেছেন এই সমস্ত বইতে। তবে Spartacus রােমে দাসবিদ্রোহের নেতা স্পার্টাকার্সের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামকে কেন্দ্র করে লেখা। তাছাড়া পড়েছি বিখ্যাত মার্কসবাদী তত্ত্ববিদ ইংল্যান্ডের তরুণ বিপ্লবী যােদ্ধা, যিনি ১৯৩৬ সনের স্পেনে আন্তর্জাতিক ক্যুনিস্ট বাহিনীর অন্যতম সৈনিক হিসেবে জেনারেল। ফ্রাঙ্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জীবন দিয়েছেন সেই কডওয়েলের লেখা Studies in Dying Culture, Illusion and Reality। এ সমস্ত বইতে তিনি ভাববাদের বিরুদ্ধে প্রচন্ড সংগ্রাম করে বস্তুবাদী দর্শনকে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। জেলখানায়। পেয়েছি জুলিয়াস ফুচিকের Notes from the Gallows, Gabriel Pary এর লেখা বই। এঁরা হিটলারের Concentration Camp-এ জীবন দিয়েছিলেন। পড়েছি সােভিয়েত বিজ্ঞানী মিচুরিম লাইসেস্কোর বই। এরাই বিজ্ঞান আলােচনায় জীব-জগতে অপরিহার্য উত্তরাধিকার তত্ত্বের বিরােধিতা করে দেখিয়েছেন যে, উত্তরাধিকার তত্ত্ব আসলে বুর্জোয়া তত্ত্ব। কারণ বুর্জোয়ারা চায় বুর্জোয়া সমাজের পরেও বুর্জোয়া সমাজই থাকবে। কিন্তু এই সমস্ত বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন বিভিন্ন পরিবেশে উপযুক্ত সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও প্রাকৃতিক প্রভাবে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত গুণাবলী অর্জন করা সম্ভব। এইভাবে তারা কী জীব-জগতে কী সমাজবিজ্ঞানে সনাতনী চিন্তাধারার মূলে কুঠারাঘাত করে বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদের গােড়া আরও শক্ত করেন।
১৩৮
দীর্ঘ সাত বছর জেলের পড়াশুনা সম্বন্ধে লিখতে গেলে অনেক কিছুই লিখতে হয়। তবে বলতে পারি এখানেই আমার মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গির বিশালতা ও ব্যাপকতা সম্বন্ধে একটা ধারণা জন্মে। এখানেই পড়ার সময় প্রতিটি বইকে মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা বিচার করার প্রাথমিক জ্ঞান লাভ করি। জীব-জগতে ও বিশ্বব্রহ্মান্ডের বস্তুনিচয়কে এবং তার সঙ্গে মানবেতিহাসকে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা এবং সমস্ত কালে এই সমস্ত সমাজের সকল রকম লেখকের গ্রন্থকে উক্ত দৃষ্টিভঙ্গির মাপকাঠিতে বিচার করার মধ্যে যে সুবিপুল আনন্দ ও আত্মপ্রত্যয়ের সৃষ্টি হয়, তা একজন মার্কসবাদী ছাড়া অন্যকে বােঝানাে সম্ভব নয়।
জেলখানায় পাঞ্জাবের দাঙ্গার উপর কারাককার Betrayer in India বইখানা পড়ি। এছাড়া পড়ি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের উপর লেখা War Monopoly and peace। এই বইতে দেখিয়েছে কিভাবে হিটলারের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত থেকেও ইংরেজ আমেরিকা ও জার্মানীর সঙ্গে গােপনে ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়েছে।
১৩৯

পঁয়তাল্লিশ
এই সময় আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কয়েকখানা কবিতার বই পড়ার সুযােগ হয়। এসব বইয়ের লেখক হলেন যথাক্রমে তুরস্কের নাজিম হিকমত, ফ্রান্সের পল এলুয়ার, দক্ষিণ আমেরিকার নিগ্রো কবি পাবলাে নেরুদা, ফ্রান্সের লুই আরান । তদুপরি বিখ্যাত মার্কসবাদী তত্ত্ববিদ এবং ফ্যাসিজম সম্বন্ধে অন্যতম লেখক রজনী পাম দত্তের কয়েকখানা বই। এগুলাে ইন্ডিয়া টুডে, এম্পায়ার ক্রাইসিসও পড়ার সৌভাগ্য হয়। রজনী পাম দত্তের আর একখানা বই খুব সম্ভব Problems of Socialism পড়ি প্রখ্যাত সাংবাদিক ও লেখক শ্রদ্ধেয় রণেশ দা’র সঙ্গে একত্রে আলােচনা করে। আগেই উল্লেখ করেছি জেলখানায় পড়ি বৃটিশ পার্লামেন্টের সদস্য মিঃ সাইকের History of Tarkish Empire, এই বইয়ের একটা বৈশিষ্ট্য হলাে বুর্জোয়া লেখক হয়েও সাইক মধ্যপ্রাচ্যে বিভিন্ন রাষ্ট্রের বিশেষ করে আধুনিক মিশরের উদ্ভব দেখাতে গিয়ে দেখিয়েছেন যে, কিভাবে মিশরের পাশারা একটি পশুপালক গােষ্ঠী থেকে ক্রমান্বয়ে শক্তিশালী হয়ে ভূসম্পত্তি দখল করে এবং ক্রমান্বয়ে আধুনিক হয়ে ওঠে। রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্বন্ধে এমন বাস্তব ও প্রত্যক্ষ উদাহরণ সকল বুর্জোয়া লেখকদের দ্বারা দেওয়া সম্ভব নয়। অগাধ পান্ডিত্যের অধিকারী এই সমস্ত লেখকেরা ইতিহাসের এই বাস্তবতাকে আর অস্বীকার করতে পারছেন না। কারণ সমাজ ও রাষ্ট্র বিকাশের মার্কসবাদী তত্ত্বের প্রচারের পর এরা একে সম্পূর্ণ এড়িয়ে না গিয়ে কিছুটা উক্ত পদ্ধতি ধরে আলােচনা করে থাকেন। অবশ্য সমাজবিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে অনেক বুর্জোয়া তত্ত্ববিদ, সমাজ ও রাষ্ট্র সম্বন্ধে এমন অনেক তথ্য পরিবেশন করেছেন যা মার্কসের মতবাদকে পূর্ণাঙ্গ করেছে। সাইক এই বিরাট বইখানিতে ছােট ছােট গিরিশ্রেণী বেষ্টিত মসুল, কুর্দিস্তান-বিশেষ করে। মধ্যপ্রাচ্যের বহু জায়গার এমন প্রাকৃতিক দৃশ্য ফুটিয়ে তুলেছেন পড়তে পড়তে মনে হয় আমি চলে গেছি সেই রাজ্যে-যেখানে সান্ধ্যপ্রকৃতি পাহাড়ের গায়ে গায়ে সােনা ছড়িয়ে দিয়েছে। যেখানে আধা মরু অঞ্চলের অনতিউচ্চ দিগন্তব্যাপী বৃক্ষলতাদির উপর সান্ধ্যসূর্যের কিরণ পড়ে তাকে অপূর্ব সৌন্দর্যে সুশােভিত করেছে। মনে হয় আমি চলেছি এক স্বর্গরাজ্য পেরিয়ে আর এক স্বর্গরাজ্যে। দূর-দিগন্তে স্বর্ণালী পাহাড় ঝলমল করছে মনে হয় পাহাড়ের ওপারেও আর এক স্বর্গরাজ্য-সীমাহীন বিস্তৃত তৃণভূমি বা। স্টেপল্যান্ডের প্রকৃতি বর্ণনায় সাইক যে পারদর্শিতা দেখিয়েছেন তা শুধু একজন
১৪০
প্রত্যক্ষদর্শীর পক্ষেই সম্ভব। আর সাইক নিজেই সে সব জায়গা ঘুরে দেখেছেন। যাক এখানেই বরেন বসু ও বিখ্যাত হিন্দী লেখক মুলকরাজ আনন্দের গ্রন্থের সঙ্গে প্রথম পরিচিত হই।
নিঃসন্দেহে মার্কসবাদ একটি dogma বা অনড়-সনাতন কিছু নয়। মূল নীতি ঠিক রেখে যুগে যুগে এর নির্দিষ্ট গন্তব্যস্থানে পৌঁছতে অনেক নতুন জ্ঞান যােজনার প্রশ্ন আসে। সে দিক দিয়ে বিচার করতে গেলে আজ অনেক আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে খ্যাতনামা মার্কসবাদী তত্ত্ববিদদের লেখা এবং রচনাবলীও নতুন বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গী। দিয়ে বিচার করতে হবে। ঐ সময় গাের্কিসহ সােভিয়েত লেখকদের অনেক উপন্যাস পড়ার সুযােগ পেয়েছি। এছাড়া বিলেতের ‘লেবার মান্থলি থেকে শুরু করে অনেক পত্র পত্রিকা। জেল-জীবনের শেষের দিকে আমরা মার্কস, এঙ্গেলস ও লেনিন-স্ট্যালিনের অনেক তত্ত্বগত বইও সংগ্রহ করে পড়াশুনা শুরু করেছিলাম। মনে আছে ঐ সময় লেবার মান্থলি থেকে Socialist Realism নামে একটি অত্যন্ত মূল্যবান প্রবন্ধ পড়েছিলাম।
ব্যক্তিগত পড়াশুনা ছাড়াও আমরা সমষ্টিগত পড়াশুনা অর্থাৎ সংগঠিতভাবে পড়াশুনার ব্যবস্থাও করেছিলাম। এই ব্যবস্থানুযায়ী আমাদের কুষ্টিয়ার কমরেড ফকির শাহ, আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতত্ত্বের ওপর কয়েকদিন ক্লাস নিয়েছিলেন। তাছাড়া কমরেড জ্ঞান কাঞ্জিলাল জীববিজ্ঞানের উপর কয়েকটি ক্লাস নিয়েছেন। সে ক্লাসগুলি চলবার সময় অদ্ভুত দৃশ্যের অবতারণা হত। আমরা যে জেলে আটক আছি সে চিন্তা অনেকের মনে স্থান পেত না। হৈ চৈ করে আমরা সবাই বড় বড় খাতা নিয়ে বসে যেতাম। বক্তার একটি কথাও যাতে নােট করা থেকে বাদ না যায়। এই ছিল আমাদের লক্ষ্য। সে নােটগুলি ছিল এক একখানা বড় ভলুমের বইয়ের মত। জানার এরূপ উদগ্র আকাঙ্খ একমাত্র অনুসন্ধিৎসু বিপ্লবীদেরই থাকা সম্ভব । উপরন্তু আমরা গ্রুপ রিডিং-এর ব্যবস্থাও করেছিলাম । কোন একটা ভাল বই আসলে সেই গ্রন্থের বিষয় সম্বন্ধে বিজ্ঞ কমরেডের সঙ্গে একত্রে বসে পড়াশুনা করা হতাে। এ সমস্ত গ্রুপগুলি ছিল আলােচনায়-সমালােচনায় জীবন্ত । বন্ধুবর সন্তোষ | গুপ্তকে নিয়ে পড়তাম ইংরেজী কবিতা। করতাম ইংরেজী কবিতার অনুবাদ। তা ছাড়া জেলে আমি কবিতা লিখলেই তাঁকে দেখাতাম। তিনি সংশােধন করে দিতেন। অত্যন্ত ক্ষীণাঙ্গ এই কমরেডটি ঠিক পাশ্চত্যের কবিদের মত প্রত্যয়শীল, বাজয় এবং তীক্ষ্ম মনে হতাে। কমরেড সন্তোষ গুপ্ত সাহিত্যের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যকে ক্ষুন্ন করে আধুনিক এক শ্রেণীর কবিদের মত কবিতাকে রাজনীতিক পােস্টারে বা রিপাের্টে পরিণত করতেন না। তাঁর ইংরেজী সাহিত্য, উপন্যাস, কবিতার উপর অগাধ জ্ঞান দেখে মুগ্ধ হয়েছি। অত্যন্ত স্পষ্টবাদী এই কমরেড কোনদিন অযৌক্তিকভাবে তথাকথিত দাদাদের বশংবদ হতে পারেননি বা অনাবশ্যক গুরুগিরিও কোথাও করতে যাননি। লেখাপড়া বা জানাশুনার ব্যাপারে জেলে তিনি অত্যন্ত পরিশ্রম করতেন। দেশের রাজনীতি যাই হােক স্বীকার করতে হবে যে, এ
১৪১
ধরনের জ্ঞান পিপাসু বস্তুনিষ্ঠ কমরেডদের কাছ থেকে অনেক কিছু জানার আছে। বাইরে অতিমাত্রায় প্রগতিশীল, লেখায় বিপ্লবের আগুন ছােটানাে, পােশাকে এক বিশেষ সংস্কৃতির ছাপ লাগানাে তথাকথিত বহু বিদগ্ধ জনের ব্যক্তিগত জীবনের গভীরে জনবিরােধী আরাম-আয়েস উপভােগের প্রকৃতি সমস্ত গুপ্ত রয়েছে, কমরেড। সন্তোষ গুপ্তকে এখনও সে পর্যায়ে ফেলতে পারিনি। বর্তমানে তিনি দৈনিক সংবাদ পত্রিকার বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।
জেলখানায় আর একটা দিক দিয়ে আমরা যথেষ্ট সাফল্য অর্জন করেছিলাম তা ছিল খবরের কাগজের পর্যালােচনা এবং সপ্তাহে একদিন অথবা ১৫ দিনে একদিন অথবা মাসের বিশেষ কোন একটি নির্দিষ্ট তারিখে ঐ সময়ের মধ্যে জেলে প্রাপ্ত সমস্ত খবরের কাগজগুলির খবরের পর্যালােচনা।
এতে সকলের অংশগ্রহণ ছিল বাধ্যতামূলক। খবরের কাগজে বা বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত খবরগুলি সংগ্রহ করে রিভিউর ভারপ্রাপ্ত কমরেডকে একটা নির্দিষ্ট সময়। জাতীয়, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির যথাসম্ভব বিশ্লেষণ করে-জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গতি-প্রকৃতি-শান্তি ও যুদ্ধের সম্ভাব্যতার মূল ধারাটিকে তুলে ধরে একটা সিদ্ধান্ত দাঁড় করাতে হতাে। এবং এই সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করেই অন্যান্য কমরেডরা আলােচনায় অংশগ্রহণ করতেন। কেউ কেউ মূল বক্তার বক্তব্যকে বিভিন্ন প্রমাণাদি দ্বারা শক্তিশালী করতেন। কেউ আবার এর বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ এক নতুন সিদ্ধান্ত তুলে ধরতেন। এই রিভিউ ছিল জেল জীবনে রাজনৈতিক আলাপ-আলােচনার অন্যতম উৎস। কোন কোনদিন এই আলােচনা শেষ হতে এক নাগাড়ে পনর দিনও লেগেছে। এই সময় কমরেডরা খাওয়া-দাওয়া খেলা-ধুলা ভুলে যেতেন। বলাবাহুল্য, সময়ানুযায়ী বিশ্বের বিভিন্ন ঘটনাকে সামনে রেখে এই আলােচনা অব্যাহত থাকত; যেমন- ন্যাটো পরিকল্পনা, মার্শাল প্ল্যান, ট্রম্যানের ফোর পয়েন্ট, কোরিয়ার যুদ্ধ, ইরাকের তৈল কোম্পানীর জাতীয়করণ, ইন্ডিয়ার ডিভ্যালুয়েশন, যুক্তফ্রন্ট, ৯২ক ধারা, বার্লিন সমস্যা, ভারতীয় সাধারণ নির্বাচন, বৃটেনের সাধারণ নির্বাচন, মধ্যপ্রাচ্য সমস্যা, কাশ্মীর সমস্যা এইগুলি ছিল প্রধান। বলা বাহুল্য, অশেষ পরিশ্রম করে তথ্যাবলী সংগ্রহ করে আমাদের নেতৃস্থানীয় কমরেডরা প্রথম পর্যালােচনা উপস্থিত করে একটি সিদ্ধান্ত দাঁড় করতেন। কি বলার ভঙ্গী, কি তথ্যের সমৃদ্ধি, কি সিদ্ধান্তের বলিষ্ঠতা- সর্বদিক দিয়ে এই আলােচনাকারীরা আমাদের। বিপুলভাবে উৎসাহিত করতেন। এ ব্যাপারে আলােচনার ভিতর দিয়ে গােটা পৃথিবীর যে রাজনৈতিক অবস্থার নিদর্শন পাওয়া যেত তার মূল্য ছিল অসামান্য। এ সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবী কি শীঘ্র আমেরিকার নেতৃত্বে আর একটি তৃতীয় মহাযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ছে, না সমগ্রভাবে শান্তির শক্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে, এটাই প্রতিবাদ করা প্রত্যেক রিভিউয়ারের অন্যতম কর্তব্য ছিল। অনেক সময় কোন কোন সিদ্ধান্তের উপর তুমুল তর্কবিতর্ক চলত ।
১৪২

ছেচল্লিশ
বই-পত্র পড়াশুনার সঙ্গে সঙ্গে আরাে দু’একটি উৎসাহব্যঞ্জক ঘটনার উল্লেখ করতে হয়। তা হলাে- কমরেড মনসুর হাবিবের নিকট ডেভেলপমেন্ট অফ ক্যাপিটালিজম, পুস্তকের লেখক বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ মরিস ডবের লেখা চিঠি । এ চিঠির বিষয়বস্তু মনে নেই তবে এ নিয়ে আমরা জেলে খুব হৈ চৈ করেছিলাম।
আর একটি ঘটনা হলাে বিখ্যাত অধ্যাপক ও মার্কসবাদী বৈজ্ঞানিক জে, ডি, বার্ণালের আমাদের কাছে দু খানা বই পাঠানাের ঘটনা। ঢাকা জেলে আসবার মাত্র দু’এক মাস পূর্বে এই বই দু’খানা আমাদের কাছে আসে। এর একখানার নাম ‘হিন্ত্রী অব দি সােশ্যাল সায়েন্স’। মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিকাশ নিয়ে মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে লেখা তাঁর এই বই। আর একখানা ছিল বিখ্যাত লেখক ফ্যারিংটনের লেখা। বইয়ের নাম সম্ভবত নেসেসিটি অব হিষ্ট্রি’ । বই দু’খানা সম্পূর্ণ পড়ার সুযােগ আমার হয়নি কারণ এর অল্প দিন পরেই আমরা মুক্তি পাই। তবে প্রথমােক্ত বইতে বার্ণাল দেখিয়েছেন যে ইংল্যান্ডে বিশেষ করে । ইউরােপে ধনতন্ত্রের বিকাশের পূর্বেই প্রাচ্যে পুঁজি বিকাশের পটভূমি তৈরী হয়েছিল। কিন্তু পাশ্চাত্য ধনতন্ত্র প্রাচ্যের ফিউডালদের সঙ্গে যােগসাজশে প্রাচ্যে ধনতন্ত্রের বিকাশ লাভ করতে দেয়নি। দেখান হয়েছে যে, মধ্যপ্রাচ্যে সামন্তবাদের শেষ যুগে যে সকল মনীষীর জন্ম হয়েছিল, সাম্রাজ্যবাদের আঘাত না আসলে তারা অচিরেই সেখানে ধনতান্ত্রিক সভ্যতা গড়ে তুলতে পারত। এই বই দুটি পাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল গুপ্তকে জি ডি বার্ণালের কাছে জ্ঞানপিপাসু হাসানুজ্জামান কামাল সাহেবের পত্র বিনিময়ের ফলে। তার লন্ডনে চিঠি লেখার দেড়মাস কি দু’মাসের মধ্যে যখন বই জেল গেটে এসে পৌছে তখন আমাদের ওয়ার্ডে সে কী হৈ চৈ । মনে আছে ঢাকা কেন্দ্রীয় জেলে তখনও আমি লাইব্রেরীয়ান। রাজবন্দীদের এই অমূল্য গ্রন্থখানা পড়ার রুটিন করে দিতে আমাকে কী হিমসিম খেতে হয়েছে।
এই সময় বাইরে থেকে আমাকে মওলানা মওদুদির একগাদা বই দেওয়া হয়। তার মধ্যে ছিল ফাহালে কোরআন, ইসতারা কিয়াত আওর কুমনিজম, কেয়া খােদা নেহি হ্যায়? ইত্যাদি। খুব সম্ভব বইগুলি আমাকে ইসলামী সমাজতন্ত্রে দীক্ষিত করার জন্যই বাড়ী থেকে পাঠান হয়েছিল । মূল উর্দুতে লেখা এই বইগুলি
১৪৩
আমি পড়ে ফেলি। আমি অবশ্য এতে আধুনিক জগতের সমস্যাবলীর কোন সমাধান খুঁজে পাইনি।
জেলে অন্যান্য বিষয় পড়াশুনার সঙ্গে উর্দু পড়ার ঝোক দেখা দিল আমাদের কয়েকজন উৎসাহী সহ-বন্দীর মধ্যে। এর মধ্যে কমরেড মনসুর হাবিব ছিলেন অন্যতম। পরে সিতাংশু মৈত্র, রণেশদা, প্রিয়ব্রত দাস, সরদার ফজলুল করিম এতে যােগ দেন। তারপর বঙ্কিম চ্যাটার্জি, অমূল্যদা, কালী সরকার, পরিতােষ দাশগুপ্ত, ভুজেন পালিত এবং আরও কিছু কমরেড উর্দু শেখার প্রতি ঝুঁকেছিলেন। তবে এর মধ্যে ভুজেন পালিত, পরিতােষ এরকম কয়েকজন চঞ্চলমতি কমরেডের ‘কেয়া সিপাই সাব খানা আয়া’- এর বেশী শেখা সম্ভব হয়নি। খুব সম্ভব কালীদারও ঐ অবস্থা ছিল।
আমি এই সময় মাওলানা আজাদের ‘গােবারে খাতের পড়ার চেষ্টা করি । আমাদের অন্যান্য কাগজের সঙ্গে ছিল উর্দু ‘পাসবান’। এছাড়া তখন ভারতে আবদুর রাজ্জাক মহিলাবাদী অথবা জোশ মানিহাবাদীর ‘তাহজিব’ পত্রিকা আসত । আমি মাদ্রাসায় পড়েছিলাম। স্বভাবতই আমার উর্দুর উপর কিছুটা দখল ছিল। তবে তা ছিল সেকেলে উর্দু। কিন্তু উর্দু সাহিত্যে এতদিনে আধুনিক রাজনীতি-সংস্কৃতি ও প্রগতিশীল চিন্তাধারা স্থান পেয়েছে। তার জন্য উর্দু ভাষারও আধুনিকীকরণ হয়েছে অনেক। এই সময় খুব সম্ভব কমরেড মনসুর হাবিবের চেষ্টায় আমাদের হাতে আসে বিখ্যাত উর্দু লেখক কিষাণচন্দর-এর কয়েকখানা বই । প্রেমাদ মুনসীর বইও পড়ি দুই একখানা। উর্দু লেখক কিষাণচন্দর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সম্বন্ধে অনেক কিছু লিখেছেন। তাঁর রচনার স্টাইলও ছিল অনন্য। অত্যাধুনিক রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক সমস্যাকে তিনি সাহিত্যিক সুষমা ও আবেগ দিয়ে লিখতে পারতেন। এই সময় কমরেড আমীন উর্দুতে মাওসেতুং-এর উপর দীর্ঘ কবিতা লেখেন। আমি তার বাংলা অনুবাদ করি। ঐ কবিতাটির প্রতিটি লাইনের শেষ কথাটি ছিল পেয়ারে মাও। মাওসেতুংয়ের অবদান সম্বন্ধে ঐ কমরেডের চিন্তা ধারার উৎস ঐ জেলের পরিবেশে কি ছিল তা ভাবতে আজ বিস্ময় লাগে। কারণ আমার যতদূর মনে হয় ১৯৪৭ সালে চীন বিপ্লবােত্তর ক্ষমতা দখলের কয়দিনে আমরা, বরিশাল জেলে চীন সম্পর্কে সাময়িক যে উৎসাহ দেখিয়েছিলাম তারপর সমগ্র জেল-জীবনে চীন আমাদের দৃষ্টির বাইরে চলে গিয়েছিল।
রাজশাহী জেলেই আমার হাতে আসে রাহি মাছুম রেজার একটি উর্দু কবিতা । আমি এর কাব্যানুবাদ করি । এই অনুবাদ কতখানি সার্থক হয়েছিল বলতে পারি না তবে পড়ার পর আমাকে ওয়ার্ডের প্রতিটি সহবন্দী অন্তত দশবার করে বলেছেন যে, এ রকম সার্থক অনুবাদ তারা আর কখনও পড়েননি । ঐ কবিতাটির বিষয়বস্তু ছিল-বিপ্লব এমনি এক জিনিস যা সৌন্দর্য সৃষ্টি করে। আর এই সৌন্দর্য যা গাছে
১৪৪
লতায়-পাতায়, মানুষের মনে, আকাশে-বাতাসে সমস্ত প্রকৃতিতে প্রতিবিম্বিত হয়। অত্যাচারী সরকার তুমি কয়েকজনকে জেলে বন্দী করে রাখতে পার কিন্তু তুমি কি সৌন্দর্যকে বন্দী করতে পারাে? তা যেমন পারাে না। তেমনি পারবে না বিপ্লবকে বন্দী করতে। একই সময় আমরা উর্দুতে স্তালিনের একখানা বড় রকমের জীবনী গ্রন্থ পাই। এর উর্দুও ছিল চমত্তার প্রাঞ্জল। পরবর্তীকালে ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের উর্দু কবিতাও আমরা সংগ্রহ করে পড়েছিলাম। এছাড়া জেলে সিপাহী বিদ্রোহের যুগের কবি গালিবের কবিতাও পড়েছিলাম। জেল থেকে বেরিয়ে রণেশদা সহ আরও দুই একজন যারা উর্দুর প্রতি বেশী আকৃষ্ট হন তাঁদের হাতেখড়ি হয় ওখানেই।
১৪৫

সাতচল্লিশ
ধর্মপ্রাণ ও রক্ষণশীল ঘরে জন্ম বলেই খেলাধুলায় কোন সময়ই উৎসাহ বা সমর্থন পাইনি। বিশেষ করে আমার দশ-বারাে বছর বয়স থেকেই শর্ষিণা পীরের বাড়ীর মক্তবের ছাত্র হিসাবে পঞ্চম শ্রেণী পাস করে সেখান থেকে সরাসরি ঐ মাদ্রাসায় ঢুকেছি। ফলে নিজের স্বভাবসুলভ জীবনাবেগের তাড়নায় এবং কালবৈগুণ্যে দূরে হিন্দু পাড়ায় গিয়ে লুকিয়ে ফুটবল খেলে আসতাম । বলা বাহুল্য, ঐ খেলা উপলক্ষেই আমার পরিচয় হয় পাশ্ববর্তী হিন্দু পরিবারগুলাের সাথে । মনে আছে, নিকটস্থ গুহ বাড়ির আমার বাল্যবন্ধু মাধবের মা আমাকে একদিন নাড়-খৈমুড়ি খেতে দিয়ে বললেন, দেখাে তুমি আমার ছেলের মত। আমি মনে করি, তুমি ইংরেজী স্কুলে পড়ে চাকরি-বাকরি করাে। জানােইতা ধর্মের ব্যবসা এখন লােকে পছন্দ করে না। এ ব্যাপারে আরাে প্রত্যক্ষ এবং জোরের সাথে বলত আমার অন্যতম আর এক বাল্যবন্ধু ননীগােপাল দাসের মা। বলতে গেলে, তাদের উপদেশেই মাদ্রাসা শিক্ষার প্রকৃত কার্যকারিতা সম্বন্ধে আমার মনে সংশয়ের সৃষ্টি হয় এবং আস্তে আস্তে আমার মনে আধুনিক চিন্তাধারার ছাপ পড়তে শুরু করে। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালাে, আমার মেজভাই অধুনা প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও অনুবাদক মৌঃ নুরুদ্দীন সাহেব ছিলেন অলংকার কাঠি হাইস্কুলের মৌলভী । অবশ্য লুকিয়ে ফুটবল খেললেও তাস-পাশা বা দাবা খেলার কথা চিন্তাও করতে পারতাম না। ঐ সময় মাদ্রাসায় শুনতাম কুলুলায়েবুন হারামুন অর্থাৎ প্রত্যেক খেলাই হারাম। কিন্তু আমার মনে তা আদৌ দাগ কাটতাে না এবং ওগুলি কাঠ মােল্লা সুলভ নিরর্থক গোঁড়ামি বলেই মনে করতাম। তবে এ কথা সত্য যে, একটা পিউরিটান চিন্তাধারার প্রভাবেই তাস-পাশায় হাত দিই নাই।
যা হােক, জেলখানায় রাজবন্দীদের মর্যাদা আদায়ের সংগ্রামের মধ্যে খেলাধুলার অধিকার আদায়ের দাবিও অন্যতম ছিল। ফলে শেষ পর্যন্ত আমরা তাস, দাবা, পাশা, লুডু, ক্যারাম বাের্ড, বাগাডুলিসহ সকল রকম indoor games এবং outdoor games- এর মধ্যে ভলিবল খেলার অধিকার আদায় করি । অবশ্য রাজশাহীতে ফুটবল খেলার মাঠ থাকায় মনে আছে দুই একবার ফুটবল খেলার সুযােগও পেয়েছিলাম।
শুনেছি, বৃটিশ আমলে রাজবন্দীরা তাস ছাড়া ম্যাজংও খেলত। এ খেলাটি
১৪৬
তাসের চেয়েও খেলােয়াড়দের নেশাগ্রস্ত করে রাখার দিক দিয়ে অদ্ভুত। জেলখানার অন্যতম সাধারণ খেলার মধ্যে তাসই ছিল প্রধান। এই খেলাটি সম্বন্ধে আমার কোন ধারণাই নেই। তবে সমাজের সকল স্তরে তাস খেলা প্রচলিত। উচ্চাঙ্গের বুদ্ধিজীবী থেকে জীবনে সর্বদিক দিয়ে বঞ্চিত ‘লুমপেন প্রলেতারিয়েত বা ভবঘুরেদের কাছেও তাস পরম আদরের খেলা। আমাকে অনেক বন্ধু তাস খেলা শেখার উপদেশ দিয়েছেন। অনেকের সঙ্গে যে দু’চার দিন বসে শিখতে চাইনি তা নয়, কিন্তু কিছুতেই ওটা শিখতে পারিনি। অবশ্য শেখার ধৈৰ্য্য আজও আয়ত্ত করতে পারিনি। তখন নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দিই যে, সবাই সব কাজ পারে না। মনে পড়ে সুশিক্ষিত রাজনারায়ণ বসুর কথা। মাইকেল ও ভূদেব মুখােপাধ্যায়ের সমসাময়িক এই মহাপন্ডিতের ছিল গণিতে সম্পূর্ণ অনিচ্ছা বা অজ্ঞতা। তিনি বলতেন, ক্ষ্যাপা কুকুরে কামড়ালে যেমন রােগীর জলাতঙ্ক হয় তেমনি গণিতের কথা মনে উঠলেই তিনি গণিতাতঙ্ক রােগে আক্রান্ত হতেন। তবে ব্যাপক জনগণের মধ্যে এই খেলার ব্যাপকতা ও অপরিহার্যতা দেখলে মনে হয় যেন সকল স্তরের সকল মানুষের জীবনকাঠি যেন তাসের ঐ কয়টা ফোটার মধ্যে নিহিত রয়েছে। বিশ্বের বহু উচ্চাঙ্গের উপন্যাসে, সাহিত্যে এমন কি রাজনৈতিক নিবন্ধে মহামতি লেনিন পর্যন্ত ট্রাম্পকার্ড কথাটি ব্যবহার করেছেন। জানি না ট্রাম্পকার্ডের আসল স্থান কোথায় বা এর তাৎপর্য কী। তা হলেও মনে হয়েছে কী কূটনৈতিক কী ষড়যন্ত্র বা প্রেমের যুদ্ধে কোথাও জয়লাভের আভাস প্রদানের জন্যই ট্রাম্প কার্ড কথাটি ব্যবহৃত হয়েছে। তাছাড়া তাসের প্রতিটি নামই হরতন-রূইতনটেক্কা-গােলাম-সাহেব-বিবি-একফোটা-দুইফোটা-দশফোটা সবই খেলােয়াড়দের কাছে বিচিত্র অর্থ বহন করে খেলাটিকে আমাদের কাছে রহস্যঘন ও তাৎপর্যপূর্ণ করে তােলে। মনে পড়ে কার একখানা বিখ্যাত উপন্যাসের নামই রয়েছে ‘Queen Spade’। এই প্রসঙ্গে বিমল মিত্রের বিখ্যাত বই ‘সাহেব-বিবি-গােলাম’-এর কথাও মনে পড়ছে।
আসলে তাস খেলার মধ্যে এমন একটা ঈর্ষাজনিত মাদকতা রয়েছে যা অন্য পক্ষকে পরাজিত করার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা খেলােয়াড়দের আটকে রাখতে বাধ্য। করে। অবশ্য খেলায় অন্য পক্ষকে পরাজিত করার জন্য যে সংকল্প ঈর্ষা উদ্যম তা জীবন-যুদ্ধের পক্ষে ক্ষতিকর নয়। বরং ওটাই স্বাভাবিক। মার্কসবাদে এটাই হলাে ডায়লেকটিক বা দ্বন্দ্ববাদ বা জীবন সংগ্রামের দ্বান্দ্বিকতা। তবুও মনে হয় কিছু বুদ্ধির কসরৎ হলেও তাস-দাবা-পাশা-ক্যারাম এই জাতীয় Indoor games আমাদের বৈপ্লবিক জীবনযাত্রার পক্ষে বা ছাত্র, বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ মানুষের সংগ্রাম স্পৃহার কতখানি সহায়ক সে সম্পর্কে আমার মনে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। যতদূর জানি তাসের সাহায্যেই জুয়া ইত্যাদি খেলা হয়। এবং বলা বাহুল্য, এটা সমাজ-জীবনের
১৪৭
পক্ষে, বিরাট ক্ষতিকর। অবশ্য জেল-জীবনের এক অস্বাভাবিক পরিবেশে এই ধরনের খেলাধুলা এড়ান যায় না।
তথাপি আমার মনে হয়েছে, জেলে পড়াশুনার যেটুকু সুযােগ পাওয়া গেছে। অনেকে তাস খেলার নেশায় পড়ে সে সুযােগের সদ্ব্যবহার করতে পারেনি। আবার অনেক পড়ুয়াকে দেখেছি পড়ে পড়ে নােট করে অত্যন্ত ক্লান্ত বােধ করায় তাসদাবার মধ্যে কিছুটা বিশ্রাম খুঁজে নিয়েছে। তাসের আর এক ধরন আছে-পেসেন্স এবং একা একই খেলা যায়। শুনেছি দ্যাগল মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্বেও পেসেন্স খেলেছেন।
আমি তাস খেলতে জানি না সেটা আমার পক্ষে কোন কৃতিত্ব বা আত্মতুষ্টির ব্যাপার নয়। তাহলেও যেখানে শারীরিক কসরতের উদ্দামতা নেই, দেহমনকে বলিষ্ঠ করার ব্যবস্থা নেই, সে খেলা না জেনে হয়ত খুব খারাপ করিনি। তবে তাস শিখবােই না এ-ধরনের গোঁড়ামি আমার নেই ।
যা হােক ঢাকা, রাজশাহী, বরিশাল সব জেলেই আমাদের কাছে বেশ কয়েক সেট তাস ছিল এবং একই সময় বহু গ্রুপ তাস খেলায় বসতে পারত। ঢাকা জেলে একবার তাদের লীগ খেলা হয়েছিল। সে এক এলাহি কান্ড । সারা জেলে আমি যেন প্রায় নি:সঙ্গ হয়ে পড়লাম। মনে হলাে যেন আমি সত্যিই ভুল করেছি তাস খেলা না জেনে। মনে আছে আমি খেলার অন্য কোন একটা বিভাগের দায়িত্বে থাকতে স্বভাবতই ঐ লীগ খেলার গ্রুপগুলির মধ্যেও ঘােরা-ফেরা করতাম। একদিন কোন একটা তাসের গ্রুপের মধ্যে বসেছি। ঠিক উঠে যাবার সময় তাদের প্রশংসায় কিছু বলতে হয় মনে করে বললাম খেলাটি বেশ ভালই হয়েছে-অমনি তারা সবাই হাে-হাে করে হেসে উঠল। বলল, আপনিত বােঝেন না-এই খেলাটি খুবই খারাপ হয়েছিল। যাহােক এবার দাবার কথায় আসি। এটাও একটা বিশ্ববিখ্যাত খেলা।
১৪৮

আটচল্লিশ
আমি অবশ্য দাবাও আয়ত্ত করতে পারিনি। তবে এ ব্যাপারে আমার আগ্রহ কম ছিল না। শুনেছি রাশিয়ানরা দাবায় খুবই পারদর্শী । বিপ্লবের পর রাশিয়ানরা দাবার জ্ঞানকে শ্রেণীসংগ্রামের সহায়ক বলে চিত্রিত করেছেন। মনে পড়ে একটি প্রবন্ধ পড়েছিলাম তাতে দাবার কোটকে সমরক্ষেত্র এবং রাজা, মন্ত্রী ও ঘােড়াকে। শশাষকশ্রেণীর প্রতিভূ এবং ছােট গুটিগুলিকে কৃষক-মজুরের সঙ্গে তুলনা করেছে।
ঠিকই দাবার কোটের উপর দুই পক্ষের গুটিগুলি সাজালে মনে হতাে যেন। একদিকে মুষ্টিমেয় বণিক শ্ৰেণী আর অন্যদিকে বিপুল সংখ্যক সর্বহারা মুখােমুখি দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের জেলখানায় দাবার বাের্ড দুই-তিনটির বেশী ছিল না। কাজেই অতি উৎসাহী এবং প্রকৃতিগতভাবে উগ্রপন্থী কিছু ছাত্র যুবকদের জন্য দাবায় বসার সুযােগ করতে পারতাম না। যদি কখনও বসতাম তখন আমাকে সাহায্য করার নামে আমাদের বরিশালের স্বদেশ বােস প্রভৃতি সহবন্দীরা নিজেরাই চাল দিত। কখন কিস্তি মাৎ হলে অট্টহাসির সঙ্গে এক বিচিত্র ভাব-ভঙ্গি করে সরে। পড়ত। এসব ছেলে ছােকরাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে আর খেলা শেখার ধৈর্য থাকত না বলে দাবা আর শেখা হয়নি। তখনকার ঐ সমস্ত যুবকদের ঐরূপ ব্যবহারের মধ্যে নীতিবােধ বর্জিত, মধ্যবিত্তসুলভ এক ধরনের সূক্ষ্ম বখাটেপনার কথা মনে পড়ে আজ ভাবতে ইচ্ছে হয় যে আমাদের বিপ্লবী জীবনে ব্যর্থতার কারণগুলির শিকড় কত দিকে কতভাবে যে বিস্তৃত ছিল তা নির্ণয় করতেই হবে তা না হলে ভবিষ্যতেওঁ আমরা কিছু করতে পারব না। দাবা খেলায়ও নেশার সৃষ্টি করে । উচ্চ-মধ্যবিত্তদের অবসর বিনােদনের জন্য দাবা একটি উত্তম খেলা। এতে বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা হয় বলে তারা বলেন । মনে পড়ে কমরেড নৃপেন সেন যেদিন বরিশাল কোর্ট থেকে পালিয়ে যান তার আগের রাত্রিতে তিনি গভীর অভিনিবেশ সহকারে প্রায় আড়াই ঘণ্টা খেলে প্রতিপক্ষকে হারিয়ে দেন। পরে কিন্তু তিনি বলছেন যে তিনি আগের রাত্রিতে দাবা খেলার সময়ই পরদিন কোর্ট থেকে পালানাের পরিকল্পনার কথা ভেবে রেখেছিলেন। ঘটনাটি ছিল এরূপ: আমরা সেদিন সন্ধ্যায় ওয়ার্ডের দক্ষিণ দিকে রেলিংয়ের কাছে বসে হাওয়া খাচ্ছিলাম এবং কথাবার্তা বলছিলাম। তখন ডেপুটি মেজর কামালউদ্দিন সাহেব এসে ডাক দিল-বংকিম বাবু কি করছেন? তখন তিনি বললেন, “আমরা নৃপেনদার জন্য অপেক্ষা করছি। এখনও তিনি কোর্ট থেকে না ফেরার কারণ বুঝতে পারছি না। তিনি না এলে আমরা খেতেও পারছি না।”
১৪৯
ডেপুটি জেলার তখন বলল, “আমি সে কথা বলতেই তাে এলাম নৃপেন বাবু কোর্ট থেকে পালিয়ে গেছেন। দেখুন আপনারা যদি এ রকম করেন তা হলে সেটা কি ভাল কথা?” জেলার আবার বলল: “তিনি নিজেই জেরা করছিলেন। ইংরেজীতে জেরা হচ্ছিল। হঠাৎ এক সময় মঞ্চ থেকে নেমে তিনি বললেন, “I am bailed out-আমার জামীন হয়ে গেছে। আমাদের সিপাহীরা মনে করেছে তিনি ঠিকই বলছেন। নৃপেন বাবু বেরিয়েই একটি রিক্সা ডেকে সেই কোথায় চলে গেলেন। কিছু পরেই ব্যাপারটা বােঝা গেল কিন্তু তখন আর তাকে পায় কে।”
আমাদের ওয়ার্ডে পাশা খেলার দুই একটি কোট ছিল কিনা খেয়াল নেই। খুব সম্ভব দুই একটি ছিলও। তবে কখনও ঐ সমস্ত জটিল খেলার কাছ দিয়েও ঘেঁষিনি । মনে আছে ছােট বেলায় যখন স্কুলে যেতাম তখন সেই তিরিশের দশকের সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়া খলিশাকোঠার সামন্ত তালুকদারদের পাশা খেলার আসরের কাছ দিয়েই যেতাম। একদা সচ্ছল তালকুদার খলিশাকোঠার ধরানাথ সমাদ্দার, রাজু মুখার্জির আসরে ডাক দিয়ে পাশার ছক খেলতাে। তখন তাদের চোখের কুঞ্চিত দ্রুর দিকে তাকালে মনে হতাে এ যেন সেই মহাভারতীয় যুগের পান্ডবদের বাজি রেখে পাশা খেলা এবং ধরা-দা যেন শকুনি’র অভিনয় করেছেন। মনে হয়েছে এরা যেন তাদের হৃত সাচ্ছল্য ফিরে পাবার জন্যে বাজি রেখে খেলছে। মনে হয়েছে এরা বুর্জোয়া ও সামন্ত যুগের চরম অবক্ষয়ের যুগে জীবনের প্রতি সম্পূর্ণ বীতশ্রদ্ধ হয়েই কোন রকম দিনগত পাপ ক্ষয়ের জন্য পাশার আশ্রয় নিয়েছে।
Indoor games- এর মধ্যে ক্যারম খেলা ছিল আমার প্রিয় । মুখােমুখি চারজন বসে কথাবার্তা বলার সঙ্গে সঙ্গে খেলাটি আমি খুবই উপভােগ করতাম। ঢাকা ও রাজশাহী জেলে আমাদের কয়েকটি ক্যারম বাের্ড ছিল। জেলখানায় নলিনীদাসহ অনেকেই ক্যারম পছন্দ করতেন। ক্যারম খেলায় যারা নৈপূণ্য দেখাতে পেরেছেন তাদের মধ্যে মনে পড়ছে কুষ্টিয়ার সত্যেন সরকার, আমাদের নলিনীদা এবং বরিশালের ব্রজগােপাল ভট্টাচার্য। অবশ্য এই খেলায় স্ট্রাইক করার সূক্ষ্ম কলাকৌশল অনেকেই আয়ত্ত করতে পারে না। এমনও দেখেছি যে, প্রথম। স্ট্রাইকেই প্রায় পাঁচ-ছয়টি গুটি পকেটস্থ করেছে। নিজেদের সমস্ত গুটি পকেটস্থ করার আগে এদের কাছ থেকে স্ট্রাইক পাওয়া প্রায়ই কঠিন হয়ে ওঠে। অত্যন্ত মসৃণ বাের্ডকে পাউডার দিয়ে আরও মসৃণ করে তােলা হয়। এই অবস্থায় ৫টি মেরে পকেটস্থ করতে গেলে হাতের উপর যথেষ্ট কন্ট্রোল থাকা চাই: শক্তি (Energy), গতি ও জ্যামিতিক কোণ সম্বন্ধে নিখুঁত বৈজ্ঞানিক ধারণা এই খেলার উৎকর্ষের জন্য অপরিহার্য । ক্যারম খেলায় স্বপক্ষীয় দু’জনের একজন অন্যজনকে গুটি মারা সম্বন্ধে অনবরত উপদেশ দিতে গেলে অনেক সময় দুইয়ের মধ্যে
১৫০
মনােমালিন্য ও শেষ পর্যন্ত তিক্ততার সৃষ্টি হয় ও অনেক সময় সেটা চাপা ক্রোধের সৃষ্টি করে। তবে একই পার্টি বার বার হারলে খেলার উৎসাহ অনেক খানি নষ্ট হতে দেখেছি। অনেক সময় ক্যারমের প্রতিযােগিতা জেলখানায় খুবই আনন্দের সঞ্চার করত। মেঝেতে বিরাট সাদা ধবধবে চাদর পাতা হতাে এবং তার উপর সুদৃশ্য বাের্ডখানি পেতে যখন দু’পক্ষের খেলা শুরু হতাে তখন বন্ধুরা চারদিকে জড়াে হয়ে এক দৃষ্টিতে তা দেখতাে। মনে আছে এরূপ একটি হার্ড কনটেস্টেড খেলা শেষ হতে প্রায় পনর কুড়ি বাের্ড পর্যন্ত খেলতে হতাে।
১৫১

উনপঞ্চাশ
ক্যারমে বারবার হারলে মন-মেজাজ খুবই খারাপ হতাে আবার ‘নীল’ গেম খেলে তার উপর বন্ধুরা টিপ্পনী কাটলে তা হয়ে উঠত আরও দুঃসহ। অবশ্য সবার ক্ষেত্রেই এ-কথা প্রযােজ্য নয়। তবু আমার মন খারাপ হতাে। কিন্তু জেলের অস্বাভাবিক পরিবেশে এই ধরনের টিপ্পনীর যে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া হতে পারে বন্ধুদের অনেকেই সেটা বিবেচনায় আনতেন না বলে আজ স্পষ্ট মনে পড়ছে। এই প্রসঙ্গে একটি ঘটনার উল্লেখ করছি । তখন আমরা রাজশাহী জেলে। যতদূর মনে পড়ে আমি আর যশােরের শ্রদ্ধেয় কমরেড ফরিদুদ্দাহার বড়দা একদিকে আর অন্যদিকে খুব সম্ভব সদানন্দ ঘােষ এবং কুষ্টিয়ার সত্যেন সরকার (সত্যেন দা) ক্যারম খেলছি। খেলায় আমরা কয়েকবার হেরেছি। বড়দার দিকে চেয়ে দেখি তার চোখ মুখ লাল হয়ে উঠছে। আমরা একেবারে প্রায় ‘নীল’ গেম খেতে যাচ্ছি এমন সময় বড় দা হঠাৎ বলে উঠলেন: “শহীদ কেবল স্ট্রাইক দিয়ে গুটি মারছাে-গুটি দিয়ে স্ট্রাইক মারতে হবে” বলেই বড়দা হঠাৎ লাফিয়ে উঠে বাের্ড ডিঙ্গিয়ে নীচে পড়ে কাপড়চোপড় প্রায় আলগা করে দক্ষিণ দিকে দৌড়াতে লাগলেন। এ সম্পর্কে অন্যত্র বলেছি। অবশ্য বড়দার ‘সিজনাল ম্যাডনেস’ ছিল। ক্যারম খেলার সময় এক বিরক্তিকর মুহূর্তে ওটা আত্মপ্রকাশ করেছিল মাত্র । যা হােক জেলের অবরুদ্ধ। অবস্থায় এই সমস্ত ইনডাের গেমস এর কিছু প্রয়ােজনীয়তা থাকলেও বাইরে এর কোন তাৎপর্য আছে বলে আমি মনে করি না। এ ধরনের খেলা মেয়েদের কোমল হাতেই শােভা পায় ।
এরপর আসে বাইরে মুক্ত মাঠে ভলি খেলার কথা। বাইরে মানে জেলের মুক্ত অঙ্গনে। ঢাকা-রাজশাহী উভয় জেলেই উপযুক্ত মাঠ থাকায় ভলিবল খেলার সুযােগ ছিল। এ জন্য আমাদের ভলিবল ও নেট সরবরাহ করা হতাে। এই ভলি খেলার মধ্যেই আমরা বেশ কিছু, রাজবন্দী জেলের অস্বাভাবিকতাকে মুছে ফেলে মাঠে নেমে আসতাম। আসলে খেলা-ধুলা জীবনের সর্বাঙ্গীণ বিকাশের জন্য কতখানি সহায়ক তা এসব খেলায় অংশগ্রহণ করেই বুঝতাম। বাইরেও শর্ষিণার পীর সাহেবের বাড়ীর কঠোর নিয়ন্ত্রণে থেকেও সব কিছু অগ্রাহ্য করে ছুটে যেতাম দুই তিন গ্রাম পেরিয়ে অলংকার কাঠির খেলার মাঠে। সেখানে মনপ্রাণ ঢেলে দিয়ে উদ্দাম আনন্দে ফুটবল খেলায় আত্মনিয়ােগ করতাম। মনে আছে প্রতি বৃহস্পতিবার হাফ মাদ্রাসা করে শর্ষিণা থেকে ষ্টীমারে বানারীপাড়া গিয়ে সেখান
১৫২
থেকে দীর্ঘ পাঁচ মাইল রােদ-বৃষ্টি মাথায় করে হেঁটে নিজ গ্রামে ঐ দিন চারটার সময় ফুটবল খেলায় নেমে পড়তাম। এর মধ্যে শুধু যে ফুটবল খেলার নেশাই ছিল তা নয় বরং কৈশাের ও যৌবনের জীবনের আনন্দোচ্ছলতা এবং জীবনের মুক্ত অঙ্গনে বেরিয়ে আসার অপ্রতিরােধ্য বাসনাও সক্রিয় ছিল।
যা হােক জেলখানায় ভলি খেলা ছিল আমাদের মধ্যে প্রাণসঞ্চারের একটা বড় রকম মাধ্যম। রাজশাহী এবং ঢাকা জেলে আমাদের মধ্যে অনেকেই ভাল ভলিবল খেলতে পারত। নেটে থেকে সজোরে চাপ মেরে এবং মধ্য লাইন থেকে ফিংগারিং মেরে সঠিকভাবে নেটে বল পাস করে খেলা সত্যি দেখার মত। অবশ্য আমি, নলিনীদা এ-রকম কয়েকজন ফিংগারিং মারতে পারতাম না। আমরা থার্ড লাইন থেকে দু’হাত জোর করে কোপ মেরে বল সঠিকভাবে নেটে দিতে পারতাম। অবশ্য ফিংগারিং ছাড়া এভাবে বল মারা খেলার বিধিসম্মত নয়।
জেলে যারা ভাল ভলি খেলত তাদের মধ্যে নারায়ণগঞ্জের লাল মােহন সাহা, রাজশাহীর কমরেড কাসেম চৌধুরী (বর্তমানে অধ্যাপক), সিলেটের কাজল, বরুন রায়, বরিশালের বঙ্কিম চাটার্জি, ব্রজগােপাল ভট্টাচার্যের নাম মনে পড়ে।
প্রায় প্রতি জেলায় বেশ একটা সংখ্যক ভাল ভলি খেলােয়াড়ও ছিল। কাজেই আমাদের গেম-কমিটি এক এক সময় জেলায় জেলায় প্রতিযােগিতার ব্যবস্থা করত। কোন কোন সময় দুই তিনটি জেলা একত্র করে খেলার ব্যবস্থা করা হতাে। এই ধরনের খেলার দিন সারা মাঠের চেহারাটাই পালটে যেত । সমস্ত ওয়ার্ডে দেখা দিত বিরাট প্রাণচাঞ্চল্য। বলা বাহুল্য জেলের সর্বত্রই এই খেলার কথা ছড়িয়ে পড়ত । অনেক সময় দক্ষিণবঙ্গের কয়েকটি জেলার সঙ্গে উত্তরবঙ্গের কয়েকটি জেলার প্রতিযােগিতা হতাে। এ ধরনের খেলায় বেশ কিছু সিপাই-জমাদাররাও দর্শক হিসাবে উপস্থিত হতাে। প্রায়ই দুই দলের দু’জন ক্যাপ্টেনকে বিচিত্র বেশভূষায় সজ্জিত করে মাঠে আনা হতাে। নির্দিষ্ট সময়ে আমরা মাঠে এসে অপেক্ষা করতাম কখন আমাদের উভয় পক্ষের ক্যাপ্টেন মাঠে আসে সেই অপেক্ষায়। সঠিক খেলা আরম্ভ হবার পনের মিনিট আগে দেখতাম কি এক অদ্ভূত সাজে সজ্জিত হয়ে ক্যাপ্টেন দু’জন এগিয়ে এসে তাদের নির্দিষ্ট আসন গ্রহণ করছেন। কোন পক্ষের বরিশাল জেলা থেকে ক্যাপ্টেন করা হলাে তার মাথায় পরিয়ে দেওয়া হতাে নারিকেলের ছােবড়ার তৈরী মুকুট। কারণ ওটাই নাকি বরিশাল জেলার প্রতীক। পরিধানে থাকত বিচিত্র বর্ণের পােশাক তাতেও ফুটে উঠত উক্ত জেলার বৈশিষ্ট্য। আবার সিলেটের একজন ক্যাপ্টেনকে কমলার খােসা দিয়ে তৈরী মুকুট পরিয়ে মাঠে আনা হতাে। কোমরে জড়িয়ে দেওয়া হতাে অসংখ্য চায়ের খালি প্যাকেটের মালা । কারণ চা সিলেটের প্রতীক। এমনি পটল বা শুকনাে বীটের মালা দিয়ে রাজশাহীর কোন ক্যাপ্টেনকে মাঠে আনা হতাে এবং এই সমস্ত
১৫৩
কাজে লাগান হতে প্রতি জেলার সবচেয়ে প্রবীণ, শ্রদ্ধেয় বৃদ্ধ, খেলা-ধুলায় সম্পূর্ণ উদাসীন কমরেডদের। এতে করে আমাদের আনন্দ আরও বেড়ে যেত। তাদের এরূপ সাজ-গােজ দেখে মাঠে হাসির হুল্লোড় পড়ে যেত। কয়েদীরা (ফালতুরা) অবশ্য যারা আমাদের ওয়ার্ডে আসতে পারত, কিছুক্ষণের জন্য জীবনের সমস্ত গ্লানি ভুলে গিয়ে তারা আনন্দে ডুবে থাকতে পারত ।
যা হােক ক্যাপ্টেন দু’জন ঐরূপ বেশ-ভূষায় সজ্জিত হয়ে মাঠে ঢােকার পথে দু’পাশে দু’জন চেয়ারে বসে থাকতেন। আমরা খেলােয়াড়রাও খেলার উপযুক্ত পােশাক পরে যখন তাদের সঙ্গে করদর্শন করে মাঠে নেমে আসতাম, তখন মনে হতাে আমরা যেন জেলের দেয়াল ও দালানের পটভূমিকায় সেই প্রাচীন গ্রীসের অলিম্পাস পর্বতের পাদদেশে খেলার জন্য প্রস্তুত হচ্ছি। মনে হয়েছে যেন আমরা। সেই যুগের অলিম্পিকের খেলােয়াড় আর ক্যাপ্টেন দু’জন পৌরাণিক গ্রীক দেবতা। জেলে আমি নিয়মিত ব্যায়াম করতাম। তাই আমার বেশ কয়েকটি হাতা কাটা নিমা, কৌপীন এবং হাফপ্যান্ট ছিল। যথাযথভাবে ওগুলাে পরে যখন খেলায় নামতাম তখন নিজেকে মনে হতাে একজন রােমান এম.পি. থিয়েটারের গ্লাডিয়েটরের মতাে। জেলের অবরুদ্ধ জীবনের অবসাদকে যেন এক প্রচন্ড বেগে। খেলার মুক্ত অঙ্গনে নিয়ে আসতাম। খেলায় যােগ দিত না এ-রকম কিছু সংখ্যক সহ-বন্দী অত্যন্ত উৎসাহী হয়ে আমাদের খেলা দেখত। এ-রকম সহ-বন্দীদের মধ্যে মনে পড়ে রংপুরের কমরেড শান্তি সান্যাল ও খুলনার কুমার বাবুর কথা। নিয়মিত ব্যায়াম করায় আমার শরীর ছিল অত্যন্ত নমনীয় Flexible. অপরপক্ষ থেকে যখন বল আসত এবং আমার মাথার উপর দিয়ে বল পিছনে ছুটে যেতে চাইত তখন যে ভাবে দু’হাত জোর করে সমস্ত শরীরটাকে আলগা করে কোমর ভেঙে একেবারে পিছন থেকে বল টেনে আনতাম তখন তা অনেককেই বিস্মিত করত। মনে আছে এ-ভাবে বল মারার সময় শান্তি দা হৈ-চৈ করে সকলের দৃষ্টি আমার দিকে আকৃষ্ট করতে চেষ্টা করত।
১৫৪

পঞ্চাশ
জেলখানায় ভলির মাঠ ছিল শান বাঁধানাে। অনেকে খেলতে গিয়ে হঠাৎ পড়ে গিয়ে বেশ আঘাত পেত বলে মনে পড়ে। এভাবে খেলতে গিয়ে নারায়ণগঞ্জের যুবক কমরেড নিশি পা পিছলে সটান চিৎ হয়ে পড়ে যায়। এতে তার দেহে এত প্রচন্ড চোট লাগে যে, সঙ্গে সঙ্গে তার পেট থেকে ভাত বেরিয়ে আসে। সে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলে। আমরা বহু রকম চেষ্টা করে তার জ্ঞান ফিরিয়ে আনি। বিভিন্ন পর্ব উপলক্ষে জেলের বিভিন্ন ওয়ার্ড বা সেলের রাজবন্দীদের নিয়েও আমরা পূর্ব ঘােষণানুযায়ী প্রতিযােগিতায় নামতাম। সে খেলা আমাদের মনে বিপুল আনন্দের সৃষ্টি করত। মনে হতাে আমরা যােদ্ধারা বিভিন্ন রণাঙ্গন থেকে ছুটে এসে আজ পরীক্ষা দিচ্ছি এক সাধারণ রণাঙ্গনে।
অনেক বন্ধুর সঙ্গে একত্র হয়ে মুক্ত মাঠে খেলাধুলার মধ্য দিয়েই শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলিকে সক্রিয় রাখা এবং বলিষ্ঠ করে গড়ে তােলা সম্ভব । সমস্ত outdoor game-কে যুদ্ধক্ষেত্রের সঙ্গে তুলনা করা চলে । খােলা মাঠে একটি সুনির্দিষ্ট নিয়মাধীনে খেলে প্রতিপক্ষকে হারিয়ে দেয়ার মধ্যে রয়েছে জীবনসংগ্রামে নিজেকে সফল করার বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। আমাদের দেশে মওলানা শওকত আলীসহ বহু রাজনীতিবিদ ভাল খেলােয়াড় বলেও বিখ্যাত ছিলেন। এই প্রসঙ্গে পাকহানাদারদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে শহীদ ক্রিকেটার জুয়েলের কথা মনে পড়ে।
জেলখানায় আমাদের কথিত বুদ্ধিজীবী গ্রন্থকীটগণ বাইরে মাঠে খেলা-ধুলা সম্বন্ধে এমন একটা উদাসীনতা দেখাতেন যাতে আমরা খেলাধুলা করতে সংকোচবােধ করতাম, কিন্তু শারীরিক কসরৎ ও মুক্ত মাঠে খেলাধুলা বিমুখ বন্ধুরা আজ গ্যাস্ট্রিক, কাল ডিসপেপসিয়া পরদিন বাতকোলাইটিস পাইওরিয়ায় আক্রান্ত হতেন। এই সমস্ত রুগ্ন বিপ্লবীদের দ্বারা সঠিক তত্ত্ব ও তথ্য যে বেরিয়ে আসা কোনমতেই সম্ভব নয়, তা নি:সন্দেহেই বলা যায়। এ নিয়ে এতখানি লেখায় অনেকেই হয়ত একে একটি আমার অতিরঞ্জিত কথা বলে মনে করবেন। কিন্তু আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা দ্বারা আমি বলতে পারি যে, জনতার সঙ্গে প্রাণ খুলে মেশার দিক দিয়ে আমাদের অনেক বুদ্ধিজীবী কমরেডের যে অপারগতা তার সূত্রপাত এখানে। ঘরের এক কোণে বেশ এক নিরাপদ জায়গায় তাস দাবায় বসে বেশ বুদ্ধির কসরত করা যায় । কিন্তু বিপ্লবী রাজনীতিকে সফল করার জন্য সে
১৫৫
উদ্যম, মানসিক ও শারীরিক সুস্থতা নিয়ে সমাজের সমস্ত প্রতিক্রিয়াকে সঠিকভাবে মােকাবেলা করে বিপ্লবী কর্মপন্থা নির্ধারণ করা যায়, আমি তা বিশ্বাস করি না।
বলা বাহুল্য রাজশাহী জেলে ফুটবল খেলার মাঠও ছিল এবং দুই একবার সেখানে সিপাহীদের সঙ্গে ফুটবল প্রতিযােগিতায়ও নেমেছিলাম।
খাওয়া দাওয়া প্রসঙ্গে
প্রাণী মাত্রেই, এমনকি মানুষ অন্য যত কিছুই করুক খেতে তার হবেই। কাজেই জেলখানায়ও অন্য যে-কোন সংগ্রামের মধ্যে আমাদের খাওয়া-পরার। দাবিই ছিল অন্যতম। আবার তৎকালীন সরকার ও জেল কর্তৃপক্ষ এই খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারেই আমাদের ঘায়েল করার কু-মতলব পােষণ করত। মনে আছে। প্রথম দিকে আমরা যখন বরিশাল জেলে থাকতাম, তখন আমাদের কয়েদীদের জন্য রান্না ‘লাপসি’ খেতে দিত। সেটা ছিল এক রকম ফেনা ভাত। প্রায়ই চাল খারাপ থাকায় ঐ ফেনাভাত এমন দুর্গন্ধযুক্ত হতে যে খাবার বালতি ওয়ার্ডে আসলেই দুর্গন্ধের চোটে আমাদের পেট থেকে নাড়ী ভূড়ি পর্যন্ত উল্টে আসতে চাইত। আমাদের অনেক কমরেড তা খেতে চাইত না। আমরা কিন্তু নাছােড়বান্দা। অবস্থা এরূপ চলতে থাকলে আমরা দীর্ঘদিন জেলে বাঁচবাে কি করে! তাই ভাল চাল দিবার জন্য আমরা অহরহ জেল সুপারকে দাবি জানাতাম। কিন্তু তখনও আমরা রাজবন্দীর স্বীকৃত মর্যাদা অর্জন করতে পারিনি। তাই তারা আমাদের কথা গ্রাহ্য করত না। অগত্যা একদিন আমরা নিজেরা বসলাম। এবং আমাদের শ্রদ্ধেয় মহারাজ দা (অমিয় দাশগুপ্ত) বললেন: আমরা বিষ খেয়েই বিষ হজম করব, তাই লাপসি খেয়েই আমাদের বাঁচতে হবে। কারণ ওরা চায় আমরা অসুস্থ হয়ে মরি। কিন্তু আমরা চাই বেঁচে থেকে সংগ্রাম করতে। এরপর সবাই লাপসি খেতাম। ফেনা ভাত খেয়ে অনেকে আগের চেয়ে মােটাও হয়েছিল। আমরা অবশ্য ভােরে ভাল নাস্তা দিবার সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছিলাম। কিন্তু মনে আছে, ভােরে একটু রুটির সঙ্গে তরকারী পেতে আমাদের পুরাে একটি বছর লড়াই করতে হয়েছে।
যা হােক দীর্ঘ দিন সংগ্রাম করে আমরা খাওয়া-দাওয়ার যেটুকু সুযােগ অর্জন করেছিলাম তা এতই সামান্য যে তা মনে করতে গিয়ে শরীর শিউরে ওঠে। লাভের মধ্যে আমাদের নিজস্ব কিচেন ছিল। রান্না আমরা তদারক করতে পারতাম। অর্থাৎ আমরাই রান্না করতাম। আমাদের জন্য বরাদ্দকৃত টাকায় আমাদের ইচ্ছানুযায়ী বাজার করাতে পারতাম। যতদূর মনে আছে প্রতি বেলায় মাথাপিছু বারাে আনা বরাদ্দ ছিল । হিসেব করে দেখা গেছে এতে চাল ছাড়া আর কোন
১৫৬
খাদ্যই ছটাকের উপর যায়নি।
প্রগাঢ় বিপ্লবী আদর্শ না থাকলে ঐ পরিমাণ খাদ্য খেয়ে জেলে বাঁচা বা সুস্থ থাকা সম্ভব ছিল না। কয়েদীরা যা পারত আমাদের পক্ষে তা সম্ভব ছিল না। আমরা একটা ডালসহ তিনদিন মাছ, তিনদিন মাংস ও একদিন নিরামিষ খেতাম । জেলের সমস্ত রাজবন্দীর জন্য একটা কিচেন থেকেই খাবার যেত। তার ফলে অনেক সময়। প্রায় কয়েক শত রাজবন্দীর রান্না এতে হতাে। এতে আমাদের একটু সুবিধাই হতাে। কারণ অনেক সদাই একত্রে করার জন্য কিছুটা সস্তায় জিনিস পেতাম। অবশ্য এর মধ্যেও কন্ট্রাক্টরের চুরি ছিল। তবে উপযুক্ত কিচেন ম্যানেজারের তত্ত্বাবধানে আমরা মােটমুটি কিছুটা ভাল খেতে পারতাম।
জেলে এই খাওয়া-দাওয়ার বন্দোবস্ত করা এক দুরূহতম ব্যাপার । একেত খাদ্যর পরিমাণ অতি সামান্য, তাছাড়া আমাদের রাজবন্দীদের মধ্যে যেমন ছিল দীর্ঘদিনের জেলখাটা অসুস্থ, বৃদ্ধ কমরেড তেমনি ছিল সদ্য ধরা পড়া বহু যুবক ও কিশাের। তা ছাড়া এমন লােকও কিছু ছিল যারা ঠিক আমাদের একই পার্টিভুক্ত ও বিপ্লবের আদর্শে উদ্বুদ্ধ নয় অথচ সিকিউরিটি আইনে ধরা পড়ে আমাদের সঙ্গে বন্দী হয়েছিল। এ ছাড়া ছিল অন্য পার্টিভুক্ত লোেক। জেলের খাওয়া-দাওয়া, আচারআচরণ সম্বন্ধে এরা আমাদের চেয়ে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পােষণ করত। একই কিচেন থেকে এদের সবার জন্য খাবার ব্যবস্থা করা সত্যিই কষ্টকর ছিল।
জেলে চা ছিল আমাদের এক প্রধান অবলম্বন। বাইরেও চা রাজনৈতিক কর্মীদের কাছে অমৃত সমান । চা আমরা দিনে তিন বারই খেতাম। আমরা সকালে রুটির সঙ্গে কিছু মাখনও খেতে পেতাম। এটা ছিল আমাদের হাসপাতালের রােগীদের বরাদ্দ। ওয়ার্ডে থাকতে তারা আমাদের না দিয়ে খেত না। অবশ্য সে মাখন ছিল অত্যন্ত নিকৃষ্ট ধরনের। রােগীদের জন্য এ ধরনের মাখনের ব্যবস্থা। করার অর্থ হলাে রােগী মেরে ফেলা।
খাবার ব্যবস্থাপনার জন্য আমাদের নিজস্ব বাের্ড বা কমিটি থাকত। তারা আলাপ-আলােচনা করে একে কতখানি সুষ্ঠু করা যায়, তার চেষ্টার ত্রুটি করত না। বাের্ডের উদ্দেশ্য ছিল এই সামান্য খাদ্যটুকুর সঙ্গে কিছু আনন্দ দান করা। যাতে এই খাদ্যের স্বল্পতা এবং একঘেঁয়েমীজনিত অরুচিকে কাটিয়ে একে স্বাস্থ্যের অনুকূল করে তােলা যায়।
আমরা তৎকালীন ঊনিশটি জেলার কয়েক শত রাজবন্দী এক এক সময় একটি জেলে কাটিয়েছি। এদের বেশ কিছু জেলের বিভিন্ন ওয়ার্ডে থাকলেও এসােসিয়েশন ওয়ার্ডে বা একই জায়গায় আমরা শতাধিক কমরেড থাকতে পেতাম। স্বভাবতই কিচেন বাের্ড ঠিক করল-জেলাওয়ারি কিচেন ম্যানেজারী
১৫৭
দিবে। ১৫ দিনের জন্য বা কখনও এক সপ্তাহের জন্য এক এক জেলাকে কিচেন ম্যানেজারী দেয়া হতাে। ফলে প্রত্যেক জেলার কমরেডরা চেষ্টা করত ঐ কয়দিনে তার পূর্বৰ্তম ম্যানেজারদের চেয়ে ভাল খাবার পরিবেশন করে নিজ নিজ জেলার শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখতে । সে এক এলাহি কান্ড । আমরাও দাবি করলাম যে জেলার ম্যানেজারী যখন পড়বে, তারা সেই জেলার বিশিষ্ট খাবার আমাদের খাওয়াবে। আর দেখে কে। বরিশালের ম্যানেজারী- আর কথা কি। বঙ্কিম বাবু, রশিদউদ্দিন (আবু) এসব উৎসাহী কমরেডদের আগ্রহে আসতে লাগল নারিকেল । সবই নারিকেলের রান্না । নারিকেলের পিঠা, সরিষা বাটার সঙ্গে নারিকেলের দুধ দিয়ে ইলিশ মাছের পাতুরি । অদ্ভূত স্বাদ। নারিকেলের গন্ধে উত্তর বঙ্গের কমরেডরা আকুল হয়ে উঠত। তেমনি রাজশাহী জেলার কমরেডরা বীট পটলের তরকারী খাইয়ে আমাদের রসনা তৃপ্তি করত । সে কি কড়া লাল লাল বীট । দেখে আমরা অনেকগুলি কাচাই খেয়ে ফেলতাম।
আসলাে ঢাকা জেলার ম্যানেজারী। রাজধানী জেলা। তারাই বাহাদুরি রাখতে চায় সবচেয়ে বেশী। কেমন কেমন ভাব, কথা ছড়াল তারা যা খাওয়াবে তা কেউ কল্পনাও করতে পারছে না। পরদিন কেহ খেলছি। হঠাৎ হৈ-চৈ-বাজার আসছে । মাছ আসছে, নীচে দৌড়ে নামলাম। সে কী কুড়ি দুয়েক বুড়ি গঙ্গার গলদা চিংড়ী । একেবারে জীবন্ত । অত বড় চিংড়ি মাছ আমি কখনও দেখেছি বলে মনে হয় না । এ মাছ দেখলেই পেট ভরে যায়। মনে আছে আমি একবার নারায়ণগঞ্জে গিয়েছি। সেখানে আদমজীতে আপার ডিভিশনে কাজ করত আমারই এক প্রিয় ছাত্র, রায়পুরের রুহল আমিন। সে আমাকে খাওয়াবে। বলল, স্যার-মাংস পােলাও তাে কত খান, আসুন আপনাকে একটা জিনিস খাওয়াই। বললাম-বেশত তাই হােক। কিছু দূর গিয়ে সে এক হােটেলের দোতালায় উঠে ভিতরে গিয়ে কী অর্ডার দিয়ে আসল । ভাত আসল সঙ্গে সঙ্গে বড় বাটি ভর্তি একটা আস্ত রান্না করা চিংড়ি । আমি দেখেই অবাক। বলল-স্যার, এটা বুড়িগঙ্গার গলদা চিংড়ি। এই একটা মাছেই এক টাকা নিবে। জানি না, সৈয়দ মুজতবা আলী, অন্নদাশংকর, আগা খাঁ দুনিয়ার যত জায়গায় যত কিছুই খেয়ে থাকুক না কেন, বাংলার এই গলদা খেয়েছেন কিনা।
কেউ বলল সিলেটকে ম্যানেজারি দাও, বেশ তা হলে চা দিয়ে ভাত খেতে। হবে বলে কেউ তাদের বিদ্রুপ করল। একদিন ভােরে দেখি বঙ্কিম বাবু নাক-মুখ হাতে চেপে ধরে হুস হুস শব্দ করে চলেছেন। জিজ্ঞেস করলাম কী হয়েছে, বলল ও তাও জানেন না, গন্ধে তাে জেলে থাকতে পারছি না। চট্টগ্রামের ম্যানেজারি। শুটকীর গন্ধ পাচ্ছেন না আপনারা? তবে জেলে শুটকী খেয়েছিলাম কিনা মনে নেই। তবে অনেকের শুটকী খাবার ইচ্ছা ছিল । বাইরে এসে বিক্রমপুর-ঢাকায় প্রচুর শুটকী খেয়েছি । প্রচুর তৈল পিয়াজের সাহায্যে শুটকীকে যথেষ্ট উপাদেয় করা
১৫৮
যায়।
প্রত্যেক ম্যানেজারির শেষ দিনে তারা চেষ্টা করত আমাদের একটা ফিস্ট বা ভােজ খাওয়াতে । এই খাওয়ানাের ব্যাপারে বেশ প্রতিযােগিতা চলত। অমুক জেলার চেয়ে আমরা ভাল খাওয়াব। এক এক ম্যানেজার গ্রুপের আয়ু সাত বা পনর দিন ছিল । ঐ সময়ের মধ্যে তারা প্রতিদিনের রেশন থেকে কিছু বাঁচিয়ে শেষের দিকে বেশ কিছু মশল্লা ডাল-চাল-তৈলসহ কিছু টাকাও বাঁচাতে পারত । ঐ দিন খাবার সময় হেড ম্যানেজারকে বিচিত্র বর্ণের কাগজের ফুলের মালা দেওয়া হতাে। জেলের বাগানে ফুল থাকলে তা দিয়েও মালা গাঁথা হতাে। শুধু হেড ম্যানেজারকেই নয়, গ্রুপের প্রত্যেককেও একটি করে মালায় ভূষিত করা হতাে। তারপরেই তারা খাদ্য পরিবেশন করত । ভাের হতেই আসতে শুরু করত বিভিন্ন খাবার । চায়ের সঙ্গে কত কি! যতটা সম্ভব ঐ দিন মাংস, লুচি, পরটা বিভিন্ন রকম মিষ্টি তৈরী হতাে।
১৫৯

একান্ন
জেলের যে কিচেন গ্রুপ যতটা দক্ষ ও হিসেবী তারাই শেষ দিন ততটা ভাল খাওয়াতে পারত। কয়েক রকম মাছের ঝােল, ভাজি, চচ্চড়ি, শুকতা রান্না হতাে। এ ছাড়া কিছু কিছু পিঠাও তৈরী হতাে। ঐ দিন আমাদের ক্রনিক পেটের রুগীদের জন্য দুঃখ হতাে। শ্রদ্ধেয় গুরুদাস তালুকদার, সরদার ফজলুল করিম বা অন্যান্য অবাঙালী খাইয়েরা ঐ সমস্ত খাবার খেতে পারত না। অবশ্য তাদের জন্যও যথােপযুক্ত ব্যবস্থা করা হতাে।
বাইরে থেকে জেলের অভ্যন্তরের অস্বাভাবিকতা কিছুই উপলব্ধি করা যায় না। দীর্ঘদিন এই অসহনীয় পরিবেশে বাস করার ফলে এক অদ্ভুত মানসিকতার সৃষ্টি হয়। এবং খাবার-দাবারের মত ডেলিকেট বা মনে লাগার মত বা স্পর্শকাতর। ব্যাপারে সকলকে সন্তুষ্ট রাখা যে-কী দুরূহ তা যারা জেলে না কাটিয়েছেন, তাদের বােঝান যাবে না। এ সব ব্যাপারে পার্টির চরম বিপ্লবী নিষ্ঠাই জেলে আমাদের বাঁচিয়েছে। তবুও যে এ ব্যাপারে এটা ওটা নিয়ে কিছু অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি তা নয়। তবে বৃটিশ আমলে এমনও শােনা গেছে যে, কংগ্রেসী বা সন্ত্রাসবাদী রাজবন্দীরা জেলে একটি মাছের মুড়াে নিয়ে মারামারি ধস্তাধস্তি থেকে ছােরা মারামারিতে পর্যন্ত শরিক হয়েছেন।
জেলে একটি মাত্র কিচেন থেকে অন্যান্য সমস্ত ওয়ার্ডেও এমনকি মেয়েদের ওয়ার্ডেও খাবার পাঠান হতাে। ঐ সমস্ত ওয়ার্ডের কমরেডদের প্রয়ােজন, রুচি, চাহিদা সম্বন্ধে সম্যক ধারণা করাও সম্ভব ছিল না। ফালতু বা মেটদের মারফত খাবার পাঠান হতাে। তাদের খাবার দাবার নিয়ে অনেক সময় কিছু কিছু কথাবার্তা যে না হয়েছে এমন নয়। তবে এ কাজে শ্রদ্ধেয় জ্ঞান চক্রবর্তী যথেষ্ট খেটেছেন এবং তার সুষ্ঠু পরিচালনায় অনেক ঝামেলা এড়ানাে গেছে।
এছাড়া বিভিন্ন পর্বোপলক্ষে আমাদের জন্য কিছু অতিরিক্ত পয়সা বরাদ্দ হতাে যেমন, পূজা, ঈদ, কোরবানী, শবেবরাত প্রভৃতিতে । আমরা ঐ সকল পর্বে অন্যান্য সমস্ত কমরেডদের একত্র করার দাবী জানানােতে জেল কর্তৃপক্ষ তাতে রাজী হয়। ফলে এই পর্বগুলিকে আমরা সর্বতােভাবে সার্থক করে তােলার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতাম। কী খাওয়া-দাওয়া, কী খেলাধুলা, কী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, কী অন্যান্যদের সঙ্গে পরিচয়ের সূত্রে বিপ্লবী মনােভাবের আদান-প্রদান সবটাকেই
১৬০
আমরা এমন বৈশিষ্ট্যমন্ডিত ও আনন্দমুখর করে তুলতাম যেন বছরের পর বছর জেল জীবনের অসহনীয় দুঃখ কষ্টকে ঐ চব্বিশ ঘণ্টার জন্য সম্পূর্ণ ভুলে থাকতে পারতাম।
আমাদের জেলের এবং বাইরে অবস্থা মােটামুটি অনুকূল মনে করলে আমরাই পর্বের দুই তিন মাস আগে থাকতেই ব্যাপক প্রস্তুতি নিতে থাকতাম। দুই এক মাস আগে থেকেই আমাদের রেশন থেকে কিছু বাঁচাতাম । এর সঙ্গে যুক্ত হতে জেল কর্তৃপক্ষের পর্বের অতিরিক্ত ভাতা। পর্বের দিন যতই এগিয়ে আসত কমরেডদের জিহ্বা ততই জলে সিক্ত হতে থাকত। তার মন অধীর হয়ে উঠত বহু অচেনা কমরেডদের দেখার জন্য। দেখতে দেখতে পর্বের দিন এসে যেত। এর আগেরদিন থেকেই অসংখ্য মেনু বা পদের ঘােষণা হতে থাকত। এ ব্যাপারে আনন্দোজ্জ্বল কমরেড হাসনুজ্জামানের (কামাল) একটি গ্রুপ কাজ করত। ঘােষণাগুলি এরূপ থাকত।
Tea with butter toast will be served within 7-30 a. m. Lateriser must be alert about the time. অমনি যারা দেরীতে উঠত বাচ্চা কমরেডরা তাদের ঘিরে ধরত। আজ রাতে ঘুমুবেন না দাদা আবার ঘােষণা হতাে Pudding & Chop will be served at 9.30 a.m. No help for those who keep themselves engaged at latrine for hours together. এবার অনেকের মুখেই দেখতাম উদ্বেগের ছায়া ফুটে উঠতাে কারণ জেলে বহু কমরেডই Constipation এ ভুগছে। অনেকেরই বিশেষ সাধনার ক্ষেত্র হলাে latrine. ঐ দিন তারা যাতে ও পথে পা না বাড়ানাের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন সে কথাই হৈ চৈ করে বলত বাচ্চারা। দেখতাম দেয়ালের গায়ে ছােট চিরকুট আটা-লেখা রয়েছে Comrades please remain conscious of the declarations given about food and menue and the time of its serving. Otherwise you all will fail to have many delicious items. ঘােষণা থাকত Comrades, we cannot but express our utmost sorrow for those suffering from Ulcer, Gastrics etc. Please submit your names to the authority concerned in time ইত্যাদি।
ভােরে দোতালা থেকে নীচে নেমে দেখতাম ইতিমধ্যে এসেছে সরদার ফজলুল করিমের নারিকেল ছােলা, কুষ্টিয়ার কমরেড ফকির শাহর রুটি বেলা। কেউই সেদিন বসে নাই। সারাদিন খাওয়ার পর খাওয়া চলছে। হয়ত একদল স্নান করতে মুরিতে আসছে। ওদিকে চা-চা করে হাক ডাক শুরু হয়েছে। শুধু কী চা, চায়ের সঙ্গে হয়ত আছে চন্দ্রপুলি বা অন্য কোন পিঠা। অমনি দে দৌড়-কেউ কেউ ভিজে কাপড়ে ছুটলাে চা খেতে ।
১৬১
এরই মধ্যে সকাল থেকে আসতে শুরু করত বিভিন্ন ওয়ার্ডের কমরেডরা । ঐ সময় গেটে পড়ে যেত ভীষণ হৈ চৈ। যে সমস্ত কমরেডরা হয়ত বছরের পর বছর একই জেলে রয়েছে অথচ তাদের সঙ্গে দেখা হয়নি, তাদের সঙ্গে আজ দেখা। কী বিপ্লবী আলােতে উদ্ভাসিত তাদের মুখমন্ডল । মনে হতাে যেন বিভিন্ন রণাঙ্গন থেকে আসছে বিভিন্ন সেনাপতিরা। সে কী আলিঙ্গন, সে কি কোলাকুলি । একদল তাদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে অন্যদের সঙ্গে। একদল জটলা করছে ঐদিনের জন্য বিশেষভাবে ঘােষিত তাস খেলার পাশে। নেতৃস্থানীয় কমরেডরা বসে গেছে আগত কমরেডদের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ আলাপ-আলােচনা করতে। হঠাৎ কিচেনের দিকে শুনি হৈ চৈ- বের হয়েই দেখি দু’টো বড় রুহিত মাছ। মনে হলাে ঢাকার বাজারের সবচেয়ে সেরা মাছ দুটি আনানাে হয়েছে। মাছ দুটি তখনও লেজ নাড়ছে। দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। আর তারই পাশে রয়েছে ভাড়ে ভাড়ে অন্যান্য জিনিস।
মাঝে মাঝে ছুটে আসছে কমরেডরা-কী একটু চা হবে নাকি। আমরাও সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠতাম চা চাই, এমনি হয়ত বেলা বারােটার সময় আর একবার চা হতাে। এই হবে নাকি শুনে আমার মনে পড়ে গেল সারা ভারতের অন্যতম বিপ্লবী রমেশ চ্যাটার্জির কথা। যেন কেউটে সাপ । কালাে, পাতলা, প্রতিজ্ঞা দৃঢ় দুটি চাপা ঠোট যেন অসম্ভব কে সম্ভব করে দিতে পারে-চোখ ঈষৎ লাল, মিটমিট করছে অহরহ, চেহারা ক্ষুদ্র হলেও যেন কোন দক্ষিণ আমেরিকার দ্বীপের ড্রাগনের মতই ভয়াবহ। এই সেই রমেশ চ্যাটার্জি যিনি দিল্লী অসহযােগ আন্দোলনের সময় বরিশালে অত্যাচারী জ্যোতীষ দারােগাকে হত্যা করেছিলেন। চৌদ্দ পনরাে বছরের যুবক দিবালােকে সামনা-সামনি ছােরা বসিয়ে দিয়েছিল কুখ্যাত জোতিষ দারােগাকে। কারণ সেই নর পিশাচ পিকেটিংরত মেয়েদের বুকে পা দিয়ে অফিসে গিয়েছিল । মনে আছে আন্দামান থেকে ১৯৪৬ সনে নলিনীদা সহ রমেশ চ্যাটার্জি আরও কে কে বরিশালে পদার্পণ করে। তখন তাঁদের ষ্টীমার ষ্টেশনে অভ্যর্থনা করি আমরা । রমেশ দা খুব স্বল্পভাষী লাজুক প্রকৃতির ছিলেন। চায়ের ব্যাপারে তিনি এক টেকনিক বের করেছিলেন। হবে নাকি’ বললেই বােঝা যেত তিনি চা খেতে চান। কারণ চায়ের কথা উল্লেখ করলে অনেক সময় দেখা যেত আপ্যায়নকারিকে তাঁকে ছাড়া আরও অন্যান্য অনেকের চোখের দিকে তাকাতে হতাে। এই হবে নাকি’ বলে আমরা রমেশ দাকে নিয়ে যথেষ্ট কৌতুক করতাম।
যা হােক দেখতে দেখতে এদিকে দুপুরের মেইল বা মূল খাবারের সময় ঘনিয়ে আসত । কারণ রাতে অন্য ওয়ার্ডের কমরেডরা থাকতে পারবেন না-তাই আসল খাবারের ব্যবস্থা দুপুরেই করা হতাে।
১৬২

বায়ান্ন
পর্ব উপলক্ষে পােলাও, ইলিশ মাছ ভাজি, লুচি, মাংস-এ এছাড়াও মাছের বিভিন্ন রকমারি খাবার তৈরী হতাে। মাংসের ভুনা ঝােল ইত্যাদিও হতাে। ভাল ভাল রাঁধিয়েরা ঐ দিনের খাবারগুলি পরম উপাদেয় করে তুলত। কে কী রকম খাইয়ে কিচেন কমরেডরা তা জানত। মনে আছে লুচি, মাংস পরিবেশন করতে এসে তাদের চোখ পড়ল নারায়ণগঞ্জের কমরেড সুধীন চন্দ্রের উপর । যেন একটা মটকা বসে আছে । অমনি হৈ-চৈ ‘সুধীর দা কটা লুচি লাগবে।’ সুধীর দাও আস্তে করে বললেন, ‘যা দিতে পারাে। তখন আরাে কয়েকজন খাইয়ে জুটল। শুরু হলাে। লুচি দেওয়া। এক একখানা লুচির সঙ্গে প্রায় এক ছটাক মাংস। খাওয়া শুরু হলাে। অন্য কয়েকজনও বসল। তাদের নাম মনে নেই। আমরা সবাই হা করে তাকিয়ে। দেখি কেউ পনর, কেউ বিশ পঁচিশ-ত্রিশখানা করে লুচি মাংসসহ খেয়ে থেমে গেল। কিন্তু চালালেন সুধীর দা। মনে আছে শেষ পর্যন্ত উনষাট খানা লুচি খেয়ে তিনি ‘আর নয়’ বলে ওখানেই চুপ করে বসে রইলেন। পরদিন ভােরে তার ছিটে গিয়ে দেখি সুধীর দা শুয়ে আছেন। আমাকে দেখে বললেন খাওয়াটা একটু বেশী হয়েছিল তবে সব ঠিক আছে। কোন অসুবিধা হয়নি।
যাক শুধু মাছ মাংস নয়-বিভিন্ন রকম মিষ্টি-ফিরনী-পায়েসও তৈরী হতাে ঐ দিন। বলা বাহুল্য বাইরে থেকেও কোন কোন রাজবন্দীর নামে ফলমূল বা মিষ্টান্ন। আসত। তাও আমরা যথাসম্ভব ভাগ করে খেতাম। এইভাবে খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে আমরা অতিথি কমরেডদের সঙ্গে বসতাম। হয়ত এই সুযােগে ঢাকার কমরেড সুকুমার চক্রবর্তী সবাইকে কিছু কমিক’ শুনিয়ে দিতেন। এই ফাঁকে কিচেন কমিটি বিভিন্ন ওয়ার্ডের কমরেডদের খাবার পাঠানাের ব্যাপারটির সুবিধাঅসুবিধা বিস্তৃত আলােচনা হতাে। ঐ দিনের ভােজসভায় আমরা জেলের পাহারারত সিপাহিদের যথা সম্ভব খাওয়াতাম। বেশ কয়েকজন জমাদারকেও নিমন্ত্রণ করা হতাে। এরই মধ্যে তিনটা বেজে যেত তখন আবার চায়ের সঙ্গে অন্য কিছু খাবার দেওয়া হতাে। এরপর পূর্ব ঘােষণানুযায়ী অন্যান্য ওয়ার্ড থেকে আগত কমরেডদের নয়জন এবং আমাদের এসােসিয়েশন ওয়ার্ডের বাছাই করা নয়জন খেলােয়াড় নিয়ে শুরু হতাে ভলিবল খেলা। কোন গ্রুপে হয়ত ঔদিন তাস-দাবারও প্রতিযােগিতা চালিয়ে নিত। তবে ভলিবল খেলাই অধিকাংশ কমরেড উপভােগ করতেন। দেখতে দেখতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসত। জেলের দেয়ালের নীচে নেমে যেত
১৬৩
সূর্য। সমস্ত দিনের খাওয়া-দাওয়া আনন্দ সত্ত্বেও ঐ সময় আমাদের মন ভারী হয়ে উঠত । এক অব্যক্ত বেদনায় আমাদের মনে কালাে ছায়া বিস্তার করতে চাইত। এর দুটো কারণ। প্রথম আমাদের বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকে আগত কমরেডদের তখন বিদায় দিতে হবে। দ্বিতীয়ত তখন আমাদের ওয়ার্ডে লক আপে ফিরে যেতে হবে। খেলার পরেই আমরা শেষবারের মত চায়ের সঙ্গে অন্য কিছু পরিবেশন করতাম। এরপরই যার যার ওয়ার্ডে ফিরে যাবার সময় হয়ে আসত। এ দিকে লক আপের সময় হয়ে। গেছে। সিপাহীরা তাগিদ দিচ্ছে। এ দিকে আমরা সহ-বন্দীদের বিদায় দিতে ব্যস্ত। সে কী দৃশ্য! কারণ আর কার সঙ্গে কোথায় দেখা হবে ঠিক নেই। এ যেন যােদ্ধাদের আবার যার যার রণাঙ্গনে ফিরে যাওয়া। মনে পড়ে সন্ধ্যার অন্ধকারে আলােকিত দেখতাম চলে যাওয়া কমরেডদের। যেন সেই অন্ধকারের বুক চিরে আওয়াজ এসে আমাদের বুকে শিহরণ জাগিয়ে তুলত ‘চলি কমরেড। লাল সালাম। আবার দেখা হবে” ইত্যাদি।

জেলের সাংস্কৃতিক জীবন
সংস্কৃতি বলতে আমরা বুঝি জীবন বিকাশের জন্য সংগ্রামের একটি দিককে। সংগ্রাম ছাড়া কোন জীবন নেই-তেমনি সেই সংগ্রামকে মােহনীয় চিরন্তন ও মানবিক করে তােলার জন্য আমরা যে সমস্ত কার্যকলাপের আশ্রয় গ্রহণ করি সাংস্কৃতিক কার্যকলাপও তার মধ্যে অন্যতমঃ অবশ্য জেলের ভিতর আবার সাংস্কৃতিক জীবন কি রকম। কথাটা যেন একটু কেমন কেমন লাগে। কিন্তু দেখেছি বাঁচার সংগ্রাম এবং বাইরে মানুষকে বাঁচাবার জন্য অধীর আগ্রহ জেলেই তীব্রতর হয়। নিজেকে বাঁচানাে অর্থাৎ জনতার শত্রু স্বৈরাচারি সরকারের কাছে মাথা উঁচু করে রাখা এবং বাইরের জনতাকে মুক্তি দেওয়ার প্রয়াসকে সজীব করে রাখার জন্যই যে কার্যকলাপ তারই একটা কঠোর ও সুকুমার দিককে সাংস্কৃতিক কার্যকলাপ বলতে পারি। সংস্কৃতি ঠিক যেন কোন খাদ্যে লবণের মত । লবণ না হলে যেমন কোন খাদ্যই স্বাদযুক্ত হয় না তেমনি জীবনের সকল কার্যেই সংস্কৃতির লবণ দরকার। তাই জেলেও আমরা এদিকে বেশী নজর দিলাম । সংস্কৃতির ব্যাখ্যায় বুর্জোয়া ধ্যান ধারণায় আমরা সন্তুষ্ট হতে পারি না। তারা এর অর্থ বুঝেন। শুধু মানসিক বিকাশ । আবার এই মানসিক বিকাশ বলতে তারা শুধু গান বাজনার। মাধ্যমে মানসিক চর্চাকেই সাংস্কৃতিক বিকাশ বলে আখ্যায়িত করে। অন্য পক্ষে। আমরা এই মানসিক বিকাশকে বস্তু নিরপেক্ষ বা জনতার জীবনের বাঁচার সংগ্রাম নিরপেক্ষ কিছু মনে করি না। আমাদের মতে মানসিক বিকাশ ঘটানাের জন্যই পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত হতে হবে । পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে সংগ্রাম করে তাকে মানবের মুক্তির অনুকূলে আনাই হলাে মানসিক বিকাশের অন্যতম শর্ত।
১৬৪
তবে পড়া-শুনা, নাচ-গান-বাজনা, খেলা-ধুলা-নাট্যানুষ্ঠান, ভ্রমণ সাংস্কৃতিক জীবনের নি:সন্দেহে একটি বিশিষ্ট অঙ্গ। সেদিক দিয়ে জেলের মত একটি অস্বাভাবিক পরিবেশে আমাদের সাংস্কৃতিক কার্যকলাপ উপরােক্ত দিকগুলাের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হয়েছে। তবুও আমরা জনতার জন্য কাজ করেই বাঁচব এই চেতনার দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে জেলে আমাদের কাজের জন্য নিযুক্ত কয়েদী ফালতুদের পড়াশুনার দায়িত্ব নিতাম।
১৬৫

তিপান্ন
আমরা সময় পেলেই জেলের কয়েদী ফালতুদের পড়াতাম। এটাকে আমরা আমাদের সাংস্কৃতিক কার্যকলাপের অঙ্গ বলে মনে করতাম । নিছক গ্রন্থকীটের মত পড়াশুনাকে আমরা উৎসাহ দিতে পারতাম না। খুব সম্ভব এসব দেখাশুনার জন্য আমাদের একটি কালচারাল টীম বা সাংস্কৃতিক গ্রুপ করা হয়েছিল। এর লক্ষ্য ছিল জেলের মধ্যেও কমরেডরা যাতে এখানকার বিভিন্ন কাজে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন ও সহযােগিতা দেন। এ জন্য আমরা আমাদের ওয়ার্ডের সংলগ্ন ফুলের বাগানটির দিকেও নজর দিতাম। স্বাস্থ্যের সকলরকম খুটিনাটির দিকে লক্ষ্য রাখা, রীতিমত শেভ করা, ঔষধপত্রের ব্যবহার, কাপড় চোপড় পরিষ্কার রাখা, খেলাধুলায় সক্রিয় অংশগ্রহণ করায় উৎসাহিত করা- এসবও আমরা দেখতাম। বাইরে থেকে আসা চিঠিপত্রের রীতিমত জবাব দেওয়া, পড়াশুনা করা, নােট নেওয়া, সামগ্রিকভাবে কমরেডদের পরস্পরের মধ্যে সম্পর্কের উন্নয়ন প্রচেষ্টা, খাওয়াদাওয়ার মানােন্নয়ন, সর্বোপরি পড়াশুনার সুযােগ-সুবিধা আদায়ের প্রচেষ্টাকে আমরা সাংস্কৃতিক জীবনের অঙ্গীভূত মনে করতাম । জল ছাড়া মাছের মত বাইরের জগৎ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ফ্যাসিষ্ট কারাগার বলেই সমস্ত রকম সুযােগ-সুবিধা রহিত একটা অস্বাভাবিক জীবন যাত্রাকে সহনীয় করে তােলার প্রচেষ্টা যে কত আয়াসসাধ্য, তা লিখে বুঝান সম্ভব নয়। তা ছাড়া এখানে রয়েছেন কিশাের, যুবক, বৃদ্ধ, মহিলা, নবাগত, পুরনাে জেল খাটিয়ে, বিপ্লবী, আধাবিপ্লবী, মায় পশ্চিমবাংলাসহ সতেরটি বিভিন্ন জেলার অসংখ্য কমরেড। এরা কখনও সেলের নির্জন কোঠায়, কখনও এসােসিয়েশন ওয়ার্ডে, কখনও দীর্ঘদিন হাসপাতালে ছিলেন। এই দূরতিক্রম্য বিভিন্নতার মধ্যে একমাত্র ঐক্যসূত্র ছিল বিপ্লবী আদর্শ। কাজেই জেলে আমাদেরও অন্যতম কাজ হলাে এই আদর্শগত জীবনকে অনুপ্রাণিত করে তােলা। তা ছাড়া আমাদের সাংস্কৃতিক কাজের মধ্যে অন্যতম ছিল বিভিন্ন দিবস পালন করা-যেমন মে দিবস, নভেম্বর বিপ্লব দিবস, ২১শে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস, নজরুল-রবীন্দ্র জন্মবার্ষিকী, ২২ শে এপ্রিলের শহীদ দিবস। এছাড়া বিভিন্ন বিষয়ের উপর আলােচনার ব্যবস্থা করা যেমন সুকান্ত, সােমেন চন্দের উপর। আলােচনা। তাছাড়া ছিল বিভিন্ন কমরেডের চিঠিপত্র নিয়ে আলাচনা ইত্যাদি। মনে আছে রাজশাহী জেলের ১৪ নং সেলে থাকতে আমরা একদিন মে দিবস পালন করেছিলাম। তখন সেলে কমরেড মনসুর হাবিব, অমূল্য দা, সীতাংশু মৈত্র,
১৬৬
সদানন্দ ঘােষ, বঙ্কীম চার্টাজী সহ আরও অনেক কমরেড ছিলেন। ঐ সময় মে দিবসের তাৎপর্য সম্পর্কে অনেকেই গুরুত্বপূর্ণ আলাচনা করছিলেন। আমি ঐ দিবস উপলক্ষে একটি কবিতা লিখি। কবিতাটির শেষ দু লাইন এখনও আমার মনে আছে:
আজি মে দিবসে বাহিরে
জনতা তুলিছে তূর্যনাদ
বন্দীরা মােরা হাকিছি হেথায়
মে দিবস জিন্দাবাদ।
এই ভাবে আমরা আমাদের লেখা ও অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বাইরের জগতের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতাম।।
এই সময় আমাদের রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে উদ্দীপনাপূর্ণ বিষয় ছিল কলকাতার ‘সত্যযুগ’ কাগজ।
ভারত বিভক্ত হবার পর ভারত-পাকিস্তান উভয় রাষ্ট্রই সমানভাবে বামপন্থী তথা কমিউনিস্টদের উপর নির্যাতন চালিয়েছে। এখানে যেমন রাজশাহী জেলে গুলী চালিয়েছে, ওখানে তেমনি মাদ্রাজের ছালেন জেলে গুলী চালিয়ে নেহেরুজী তার সমাজতান্ত্রিক আদর্শের নমুনা দেখিয়েছেন। সরকারীভাবে কমিউনিস্ট পার্টি বে-আইনী ঘােষিত না হলেও প্রকৃতপক্ষে সমস্ত কমিউনিস্টদের কারাগারে আটক বা যে কোনরূপে আত্মগােপন করতে বাধ্য করা হয়েছে, আর এখানে আটচল্লিশ সন থেকেই কমিউনিস্ট পার্টিকে বে-আইনী ঘােষণা করা হয়েছে। তবুও দুই রাষ্ট্রের মধ্যে অনেকখানি পার্থক্য ছিল। ভারত ইউনিয়নে শিল্প-খারখানার আধিক্য (পাকিস্তানের তুলনায়) থাকায় স্বভাবতই সেখানের ধনিক শ্রেণীর সাথে সাম্রাজ্যবাদের কিছু কিছু বিরােধিতা হয়েছে। কারণ তৎকালীন ভারতীয় শিল্পপতিরা এটা চায়নি যে সাতচল্লিশ এর ক্ষমতা হস্তান্তরের ফলে তাদের হাতে যে রাষ্ট্রক্ষমতা আসছে সেখানে বৃটিশের অবশিষ্ট স্বার্থের উপর এবং নিজেদের স্বার্থের উপর নতুন করে আমেরিকা তাদেরকে সম্পূর্ণ নতুন কায়দায় পরাধীন করুক। এ জন্য দেখি আমেরিকা যখন অর্থনৈতিক সাহায্যের জন্য হেনরি গ্রাডিকে ভারতে পাঠালেন, নেহরু তখন তাকে প্রত্যাখান করলেন। কিন্তু পাকিস্তানের অবস্থাটা একটু অন্য রকম ছিল। এখানে জাতীয় শিল্পের অনুপস্থিতির ফলে পাকিস্তানের সামন্ত প্রভুরা এবং ফড়িয়া ব্যবসায়ীরা সহজেই আমেরিকার খপ্পরে পড়ে গেল। সে নাটকের নায়ক হলেন বগুড়ার মােহাম্মদ আলী। পাকিস্তানে সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্র কত দ্রুত শিকড় গেড়েছিল লিয়াকত আলী হত্যা তারই প্রমাণ।
দু’রাষ্ট্রের আর একটা দিক এই প্রসঙ্গে একটু উল্লেখ করতে চাই। তা হলাে
১৬৭
শিল্পে কিছুটা অগ্রসর এবং বিশাল এলাকা বলেই ভারতে শ্রমিক আন্দোলন জোরদার ছিল। ফলে সেখানে কমিউনিস্ট পার্টিও যথেষ্ট শক্তি সংগ্রহ করেছিল। কাজেই আটচল্লিশ সনে নেহেরুর প্রচন্ড দমননীতি সত্ত্বেও পার্টির নেতৃত্বে এবং বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের নিপীড়িত জাতীয় বুর্জোয়াদের সঙ্গে নিয়ে সেখানে কংগ্রেসবিরােধী ঐক্যফ্রন্ট গড়ার আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠল। উপরােক্ত কারণসমূহের জন্যে ভারতে এটা খুব দ্রুত ঘটল, কিন্তু পাকিস্তানে সামন্ত প্রাধান্যের। জন্য এবং শিল্পের একরূপ শূন্যতার জন্য শ্রমিক আন্দোলন তথা কম্যুনিস্ট আন্দোলন আটচল্লিশের আক্রমণের মুখে স্তব্ধ হয়ে গেল। কিন্তু তা সত্ত্বেও বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড আক্রোশে ফেটে পড়ল।
১৬৮

চুয়ান্ন
ভাষা আন্দোলন পাকিস্তানের মূল দ্বিজাতিতত্ত্বের আদর্শকে ভয়ানকভাবে দুর্বল করে দিল। ফলে এখানেও মুসলিম লীগ বিরােধী রাজনৈতিক আন্দোলনের বিকাশ এবং বিশেষ করে পূর্ববঙ্গের অত্যন্ত দুর্বল পুঁজির বিকাশের জন্য রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার । অংশগ্রহণের প্রশ্ন গভীর গুরুত্ব নিয়ে দেখা দিল। যখন পূর্ববঙ্গের রাজবন্দীরা জেলখানায় রুদ্ধ আবেগে গুমরে মরছে-কি করে দেশকে মুসলিম লীগের জোয়াল থেকে মুক্ত করা যায়- যখন বাইরে ৪৮-এর ভাষা আন্দোলনের পর এদেশের কৃষক মজুর মধ্যবিত্তের মনে মুসলিম লীগ শাসন থেকে মুক্ত হবার প্রশ্ন ভিতরে প্রচন্ড আলােড়ন তুলছে-ঠিক তখন ভারতে কংগ্রেস বিরােধী যুক্তফ্রন্ট গড়ার সংগ্রামী আহবান পরিবেশকে আন্দোলনমুখী করে তুলছে। এ সময় কলকাতার সত্যযুগ কাগজ জেলখানায় সেই আহবান বয়ে নিয়ে এল। সে খবর পড়ে আমরা যেন পথ পেলাম। তাই আমাদের জেলের রাজনৈতিক জীবন তথা সাংস্কৃতিক জীবনে এই ‘সত্যযুগ’ পত্রিকার ভূমিকা অপরিসীম। আমাদের জেলের সাংস্কৃতিক জীবনে সত্যযুগের এই অবদানের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করলাম এই জন্য যে, দেশ বিভাগজনিত অস্বাভাবিক পরিস্থিতি আমাদের রাজনৈতিক জীবনকে পঙ্গু করে দিচ্ছিল এবং জেলে যখন আমরা নানা মতামতের অন্ধ গলিতে পথ হাতড়াচ্ছিলাম তখন এই পত্রিকাটি খুব অল্প দিনের জন্য হলেও আমাদের জেল জীবনে একটা নতুন প্রাণের বন্যা বইয়ে দিয়েছিল। গভীর বিস্ময় ও আশা নিয়ে আমরা ভারতীয়। জনগণের মুক্তি সংগ্রামের প্রস্তুতি লক্ষ্য করছিলাম। অবশ্য এই প্রসঙ্গে বলা দরকার যে, ভারতের কম্যুনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসে যে সশস্ত্র বিপ্লবের একটি চমক। লাগানাে ঘােষণা দেওয়া হয়েছিল সেটা ছিল এতই বাস্তব বিবর্জিত পুঁথি সর্বস্ব কর্মসূচী যা ব্যাপক জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে পারেনি। এবং পারেনি বলেই পার্টি জনতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল। এটা উভয় রাষ্ট্রের ব্যাপারেই সমানভাবে প্রযােজ্য। এ রকম একটা পরিস্থিতিতে ভারতে কংগ্রেস বিরােধী নির্যাতিত বুর্জোয়াদের নেতৃত্বে ঐক্যফ্রন্টের সংগ্রাম স্বভাবতই আমাদের কারারুদ্ধ মনকে কিছুটা উৎসাহান্বিত করে তােলে। যাক সে কথা-এবার জেলের কিছু প্রত্যক্ষ সাংস্কৃতিক কার্যকলাপের কথায় আসি।
একবার কলকাতায় বরিশালের বঙ্কিম বাবুর কাছে শুনছিলাম যে, জেলে তার। একটি একাঙ্কিকা নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল। মঞ্চস্থ অর্থে ঠিক মঞ্চ তৈরি করে সিনসিনারি লাগিয়ে নাটক করা নয় এবং ততদূর করার মত সুযােগ বা সুবিধা আমাদের
১৬৯
ছিলও না। আমি ওটা দেখিনি । শুনেছি ওর বিষয় বস্তু ছিল পুরােপুরি রাজনৈতিক। মাত্র তিনটি চরিত্র, তিনটি দৃশ্য। খুব সম্ভব পার্টিশনের পরবর্তী তিনটি সংগ্রামী কাহিনী ছিল এর মূল প্রতিপাদ্য বিষয়।
মনে পড়ে রাজশাহী থাকতে আমরা একবার নজরুল দিবস পালন করি এবং ঐ অনুষ্ঠানে আমি সভাপতিত্ব করি । বেশ গাম্ভীর্য নিয়ে দিবসটি পালিত হয়েছিল । আমি বিদ্রোহী কবি নজরুলের বিশেষ এক সময়ের পােষাকের মত পােষাক পরিধান করলে এ নিয়ে বেশ আনন্দ ও উৎসাহের সৃষ্টি হয়। যতদূর মনে পড়ে ঐ অনুষ্ঠানে আমি একটি নাতিদীর্ঘ লিখিত বক্তব্য পাঠ করি। বক্তব্যের বিষয়বস্তুর মধ্যে কবির কারাজীবন এবং তাঁর জীবনের দুটি শ্রেষ্ঠ অবদানের কথা তুলে ধরা হয়। তার একটি হলাে তিনি শ্রমিকদের প্রগতিশীল ভূমিকা তুলে ধরেছেন। অন্যদিকে তিনিই প্রথম সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ জেহাদ ঘােষণা করেছিলেন। এই প্রসঙ্গে ক্যুনিস্ট আন্তর্জাতিক সঙ্গীতের অনুবাদ করার মধ্য দিয়ে তার সর্বহারায় আন্তর্জাতিকতার প্রতি গভীর আস্থার কথা উল্লেখ করা হয়েছিল; এখন এই কাহিনী লেখার সময় বিদ্রোহী কবি নজরুল ঢাকায় অবস্থান করছেন।
আমরা রাজশাহী থাকাকালেই মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক আকাশে আশার আলাে ফুটে উঠেছিল। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের আয়ের অন্যতম উৎস পারস্যের এ্যাংলাে ইরানিয়ান অয়েল কোম্পানীকে জাতীয়করণের সংগ্রামে ডা: মােসাদ্দেক সমগ্র শক্তি নিয়ােগ করেন। তাঁর সঙ্গে রয়েছেন অন্যতম সংগ্রামী ইরানী নেতা মওলানা আয়াতুল্লাহ কাসানী। ইরানের সে আন্দোলন আমাদের দেশের মাওলানা ভাসানীর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। অবশ্য ইরানে মওলানা কাসানী পরে কর্ণেল জাহেদীর সামরিক সরকারকে সমর্থন দিয়েছিলেন। বলা বাহুল্য, আমাদের দেশেও মওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক ভূমিকা সম্বন্ধে শেষ কথা বলার সময় এখনও আসেনি।
১৭০

পঞ্চান্ন
রাজশাহী জেলে ছিল কলকাতার কমরেড আরিফ ও আমিন। এরা দুজনেই উর্দু ভাল জানত। কমরেড আমিনের উদ্যোগে এ সময় অনেকের মধ্যে উর্দু শিক্ষার ইচ্ছা জন্মে। এ ব্যাপারে আমারও কিছু উদ্যোগ ছিল কারণ আমিও মােটামুটি উর্দু জানতাম । কমরেড আমিন উর্দুতে ভাল কবিতা লিখত। বর্তমানে সে কলকাতায় আছে। গত কোন নির্বাচনে সে পশ্চিমবঙ্গের সি.পি.এম থেকে মন্ত্রী পদও পেয়েছিল। আমরা মাঝে মাঝে তাকে নিয়ে আসর করতাম । এবং তাঁর লেখা উর্দু কবিতা শুনতাম। জেলখানায় সামান্য যেটুকু স্থিতিশীলতা ও শান্তি বিরাজ করলে মােটামুটি সাংস্কৃতিক কার্যকলাপ তথা কোন অনুষ্ঠান আলােচনা বা লেখা-পড়া সম্ভব হয় রাজশাহী জেলে আমাদের তাও ছিল না। তবুও ঐ অবস্থায় আমরা মাঝে মাঝে উত্তর বঙ্গের বিশেষ সংস্কৃতি হাজং-এর জীবন, গৌড়ীয় সংস্কৃতি ময়মনসিংহ গীতিকা ইত্যাদি সম্বন্ধে জানার আগ্রহ প্রকাশ করতাম। রাজশাহীতে আমাদের ওয়ার্ডে চুলকাটার ও শেভ করার জন্য একজন শীল আসত । নাম তার বিজয় মন্ডল । আমার মনে আছে দীর্ঘ ছয়মাস পর্যন্ত তাকে আমি হিন্দু বলেই জেনেছি। একদিন আলাপ প্রসঙ্গে জানলাম সে মুসলমান। এর দ্বারাই বােঝা যায় ধর্মের নামে, সম্প্রদায়ের নামে প্রতিক্রিয়াশীল চক্র আমাদের সমাজে যে বিভেদ ও হানাহানির সৃষ্টি করে রেখেছে আসলে সমাজের শােষিত শ্রেণী কৃষক মজুরের ভিতর সেটা কত কম। বিজয় মন্ডলের সঙ্গে আলাপ করে জেনেছি তারা এ রকম নাম রাখায় কিছু। মনে করে না। এবং তাদের গ্রামে পূজা-পার্বণে মুসলমানরা রীতিমত যােগ দেয়। হিন্দুরাও তেমনি মুসলমানদের সকল উৎসবে যােগদান করে। রাজশাহী জেলে গুলী চলার পর যেমন একদিকে আমাদের মধ্যে রাজনৈতিক মতানৈক্য তীব্র হতে তীব্রতর হয়ে শেষ পর্যন্ত প্রায় অচল অবস্থার সৃষ্টি করেছিল, অন্যদিকে তেমনি ২৪এর রক্তাক্ত সংগ্রাম আমাদের পরস্পরকে বেধে দিয়েছিল এক অটুট বন্ধনে। আমরা খাপড়ার বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামে আত্মদানকারীদের আরও মহান করে তােলার জন্য আমাদের শহীদদের উদ্দেশ্যে উদাত্ত সুরে গান গেয়ে উঠতামঃ
বিচারপতি তােমার বিচার করবে
যারা আজ জেগেছে সেই জনতা… ঠিক জনতা
ওরা আনােয়ারের রক্তস্নানে প্রাণ পেয়েছে-২
ওরা সুধীন ধরের রক্তস্নানে প্রাণ পেয়েছে-২
১৭১
এমনি করে হানিফ, বিজন, দেলওয়ার, কম্পরাম, সুখেন সবার উদ্দেশে আমাদের হৃদয় নিংড়ানাে ভালবাসা প্রকাশ করতাম।
রাজশাহী জেলে আমাদের আর একটি বৈশিষ্ট্য ছিল। আমরা সেখানে সম্পূর্ণ কয়েদী-হাজতী থেকে বিচ্ছিন্ন কয়েকজন বিনা বিচারে আটক বন্দীই ছিলাম না, আমাদের নাচোল কেসে আটক বহু সংখ্যক কনভিক্ট বা সাজাপ্রাপ্ত বন্দীও ছিল। তারা কয়েদীদের জাঙ্গিয়া পরত-কয়েদীদের মত তাদের কাজ দিতে চাইলে তারা বাধা দিত। তাদের মধ্যে ছিল সদ্য কৃষক সংগ্রাম থেকে ধৃত বহু সাঁওতাল, ছিল নাচোলের অনিমেশ লাহিড়ী, ছিল যশােরের নূর জালালের মত দুর্দান্ত বিপ্লবী। এদের কথা উল্লেখ করলাম এই জন্য যে, এদের মাধ্যমে আমরা জেলের অন্যান্য কয়েদীদের জীবনধারার অনেকটা কাছাকাছি আসতে পেরেছিলাম এবং সমস্ত জেলে আমাদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিলাম । একবার জেল ঘুরতে গিয়ে এমনি জাঙ্গিয়া পরা আমাদের বন্ধুদের তাদের ওয়ার্ডের দরজায় দাঁড়ানাে দেখেছিলাম। মনে হলাে তারাই প্রকৃত যােদ্ধা। জেলের জীবনকে যেন তারা চ্যালেঞ্জ দিয়েছে। মনে হয়েছে তারা স্পার্টাকাসের নেতৃত্বে সংগ্রামে প্রস্তুত। রােমের কারাকক্ষে এক এক জন দাস নেতা।
চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট আমলের অব্যবহিত পূর্বে ও পরে জেলের অবস্থা মােটামুটি কিছুটা স্থিতিশীল ছিল। কারণ ঐ সময় বাইরে নির্বাচনের তােড়জোড় চলছিল । সরকারও তা নিয়ে ব্যস্ত। কাজেই ঐ সময়টায় জেলের ব্যাপারে তারা তেমন কোন হস্তক্ষেপ করেনি। ততদিন আমি ঢাকা জেলে এসে গেছি।
এখানেও আমরা ২১শে ফেব্রুয়ারির শহীদ দিবস, মে-দিবস ও অন্যান্য বিপ্লবী দিবসগুলি পালন করেছি। ৫৩ সালের মাঝামাঝি ঢাকায় আমরা একটা বিরাট সংখ্যক কমরেড একত্র হয়েছিলাম। এবং বহু দিক দিয়েই ঢাকা জেলে ৫৩ সাল থেকে মুক্ত হবার আগে পর্যন্ত জেলজীবন স্মরণীয় হয়ে থাকবে। আমাদের জেলজীবনে দুটো দিন দুই বিশেষ দিক নিয়ে এল । এক হলাে, বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন। অন্যটি ৫০-এর ২৪শে এপ্রিল। ৪৮ সাল থেকে আমরা জেলের অন্ধ কুঠরিতে-বাইরের জনসমুদ্রে ইতিমধ্যে যে তরঙ্গের সৃষ্টি হয়েছিল বাহান্ন সালে তা প্রচন্ড শক্তিতে আঘাত করল সরকারের পাষাণ সৈকতে। আমরা জেগে উঠলাম সে গর্জন শুনে। তরঙ্গের আঘাত কাঁপিয়ে তুলল জেলের দেয়াল, দালান কোঠা-সব কিছু। সরকারের সবচেয়ে দুর্ভেদ্য দুর্গ জেলখানায় চিড় ধরল অসংখ্য। পাথর ভেঙ্গে যেমন প্রচন্ড জলধারা এগিয়ে যায়, সৃষ্টি করে নদী, ধাবিত হয় সমুদ্রের দিকে-তেমনি পর্বতসমান বিশ্ববিদ্যালয়ের গহ্বর থেকে যে ছাত্রধারা বেরিয়ে এল, তা যেমন গ্রাম-গ্রামান্তর প্রাবিত করে ছুটতে লাগল, মিশল গিয়ে অসংখ্য জনস্রোতের সঙ্গে, তেমনি জেলের মধ্যেও গেল এর অসংখ্য ধারা । এরা যেন ছুটে
১৭২
গেল গুহাবদ্ধ জলপুঞ্জকে উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে নিয়ে আসতে। ভাষা আন্দোলনে ধৃত অসংখ্য নতুন মুখ দেখে আমরা বুঝতে পারলাম, আমরা বিপ্লবী কর্মকান্ডের যে বীজ বপন করে এসেছিলাম, রক্ত দিয়ে যে মাঠ সিক্ত করে আসছিলাম, আজ তা পত্রপুষ্পে মঞ্জুরিত হয়ে উঠছে। ফলের জন্য আলােড়ন উপস্থিত হয়েছে এর গর্ভকেশরে।
যা হােক যা বলতে চেয়েছিলাম। ভাষা আন্দোলন বাইরের সংগ্রামের এক উচ্চতর পর্যায়। ২৪ শে এপ্রিলও তেমনি জেলের ভিতরে সংগ্রামের আর এক উচ্চতর পর্যায়। যদিও এ সংগ্রাম তকালীন অবস্থায় এক চরম হঠকারিতা ছিল। তথাপি বিপ্লবী আত্মত্যাগ নির্ভীকতা-নিষ্ঠা ও বিপ্লবী মর্যাদা সৃষ্টিতে এ ছিল মহৎ । ভুল হােক শুধু হােক ফ্যাসিষ্টদের কাছে আত্মমর্যাদা বিক্রি না করে হাসিমুখে প্রাণ দেওয়ার যে দৃষ্টান্ত তারা উপস্থিত করল যুগ যুগ ধরে ইতিহাসের পাতায় তা জ্বলজ্বল করতে থাকবে।
আমরা পূর্ণ মর্যাদার সঙ্গে এ দুটি দিনই পালন করতাম। ২৪শে এপ্রিল আমাদের জেলে সমগ্র অত্যাচারের বিরুদ্ধে বীরের মত সংগ্রাম করতে উদ্বুদ্ধ করত। রাজশাহীর খাপড়া ওয়ার্ডে আত্মদানকারী সাত সাতটি শহীদ যেন ধ্রুবতারার মত আমাদের বিপ্লবী আকাশে স্থির হয়ে আমাদের পথ নির্দেশ করত। ঠিক তেমনি ভাষা আন্দোলন আমাদের বাইরের জনতার সঙ্গে অবাধ যােগসূত্রের সৃষ্টি করে। জেলের দুর্ভেদ্যতাকে মেকিতে পরিণত করেছিল।
খাপড়া ওয়ার্ডে গুলীর সময় থাকাকালীন কমরেডদের মধ্যে একা আমিই ছিলাম ঢাকা জেলে। কাজেই এ দিবসের অনুষ্ঠানে মূল বক্তব্য আমারই উপস্থিত করতে হতাে। অবশ্য এ সম্পর্কে বিস্তারিত অন্যত্র বলছি।
১৭৩

ছাপ্পান্ন
খুব জোর দিয়ে যা বলেছি তা হলাে বিপ্লবীরা মৃত্যুকে থােড়াই পরােয়া করে। মৃত্যুর মুখােমুখি হয়েও তারা নীতি বিসর্জন দিয়ে শত্রুর সাথে আপােষ করতে জানে না – আপােষ করে না। প্রচন্ড গণ-আন্দোলনের মুখে অনেকেই প্রাণ বিসর্জন দিতে পারে। কিন্তু জনতা যখন সম্পূর্ণ মােহগ্রস্ত তখন মুষ্টিমেয় বিপ্লবীর পক্ষে আদর্শের জন্য মৃত্যুবরণ করা সহজ নয়। রাজশাহী জেলের বিপ্লবী রাজবন্দীরা এদেশে বিপ্লবী আন্দোলনের গােড়াপত্তন করে। জেলখানায় এ সব অনুষ্ঠান যথারীতি আর্ন্তজাতিক সংগীত গেয়ে আরম্ভ করা হতাে। অনেকেই আলােচনায় অংশগ্রহণ করতেন। খুলনার কমরেডরা শহীদ আনােয়ার সম্পর্কে আর দিনাজপুরের কমরেডরা শহীদ কম্পাম সম্পর্কে আলােচনা করতেন। এইভাবে যিনি যে শহীদ সম্পর্কে বিশদভাবে জানতেন তিনি তার সম্পর্কেই আলােচনা করতেন। শহীদানের আরদ্ধ কার্য শেষ না করে আমাদের শান্তি নেই বলে শপথ গ্রহণ করে অনুষ্ঠান শেষ হতাে।
এ সময় জেলখানায় একটি হাতে লেখা ম্যাগাজিন বের হতাে। এর সম্পাদনা করতেন দিনাজপুরের কৃষক নেতা জনাব নূরুল হুদা কাদের বখশ (ছুটি ভাই)। অন্যান্য অনুষ্ঠানের আলােচনায় মনে পড়ে কমরেড জ্ঞান কাঞ্জিলালের কথা। খুলনার বিখ্যাত ডাক্তার, কাঞ্জিদার গলার স্বর ছিল অত্যন্ত মিষ্টি এবং উঁচু গ্রামের । তিনি কীর্তনের আসর জমাতেন। এ বিষয়ে উৎসাহী অন্যান্য কমরেডদের ধরে তিনি আসর জমিয়ে শুরু করতেন কীর্তন। সে কি অদ্ভুত সাজ। কপালে লম্বা চন্দনের তিলক টানা, গলায় ফুলের মালা, কানে ও কপালে ঠিক পেশাদার কীর্তনীয়াদের মত রং লাগানাে। গায় পাতলা হাতাকাটা নীমা। পরনে মিহি ধুতি, দীর্ঘ কোচা খুব কায়দা করে পাকিয়ে তার এক অংশ কোমরে গুঁজে দিতেন। কাঞ্জিদার দেহ ছিল দীর্ঘ ও বলিষ্ঠ । ঠিক নিমাই সন্ন্যাসীর কায়দায় হাত দুটি উপরে তুলে শুরু করতেন কীর্তন। সে কীর্তনের বিষয়বস্তু ছিল সম্পূর্ণ রাজনীতি। কিন্তু তাতে ছিল রাধাকৃষ্ণের বিরহ, রাগ, অনুরাগ, প্রেম ইত্যাদি। যতদূর মনে পড়ে পাকিস্তানের সঙ্গে আমেরিকার প্রেমই ছিল তাঁর কীর্তনের বিষয়বস্তু। হয়ত তৎকালীন পাকিস্তানে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত হােরেস হিলড্রেখ শ্রীকৃষ্ণ, অথবা প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান বা আইসেনহাওয়ারকে কৃষ্ণের ভূমিকায় দেখান হতাে। এদিকে মহম্মদ আলী, গােলাম মােহাম্মদ ইত্যাদিকে শ্রী রাধিকার ভূমিকায় দেখান হতাে।
১৭৪
আবার কমুনিস্টদের আবির্ভাব কংস রাজার রাজত্বে শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব হিসাবে দেখান হতাে। আইসেনহাওয়ার যেন কংস হিসেবে আদেশ দিলেন। এরপর তাঁর রাজত্বে যে-কোন পুরুষ শিশুসন্তানের জন্মের খবর পেলে তাকে হত্যা করা হবে। (বলা বাহুল্য এটা কমিউনিস্টদের আবির্ভাবের আশংকা করে)। অদ্ভুত দক্ষতা ছিল। কাঞ্জিদার। একই সময় একই গলায় কৃষ্ণ, রাধিকা, জটিলা, কুটিলা, সকলের সুরই তুলে ধরতে পারতেন। নাচার ভঙ্গীও ছিল দেখার মত। মাথায় লম্বা টিকি বানিয়ে তার অগ্রভাগে ফুল বেঁধে দেওয়া হতাে, নৃত্যের তালে তালে তাও অদ্ভুতভাবে দুলতে থাকত মাথার চারপাশে। কাঞ্জিদার কীর্তন শুনে মনে পড়তাে লেনিনের কথা। তিনি তখন নির্বাসিত জীনব-যাপন করছেন প্যারিসে। ক্রুপস্কায়া লিখেছেন: “লেনিন উৎসাহ করে নানা ধরনের কাফে আর শহরতলীর রঙ্গমঞ্চে যেতেন বিপ্লবী কীর্তনীয়াদের গান শুনতে। মজুর মহল্লায় এরা রাষ্ট্রের যাবতীয় বিষয় নিয়েই গান গেয়ে বেড়াত, ভূঁইফোড় এক বক্তাকে কীভাবে লােকসভায় নির্বাচিত করে পাঠাল মদ টেনে আনা চাষীরা” ইত্যাদি ইত্যাদি। কাঞ্জিদার এই কীর্তনে খুব সম্ভব যােগ দিত সিলেটের কমরেড যােগেশ দাশ। তার কথা পরেও উল্লেখ করা হবে । হ্যা, বিপ্লবী কীর্তনীয়ার ভূমিকাই পালন করছিল তখন কাঞ্জিদার দল ।
জেলের মত শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশে শুধু নীরস কথায় তত্ত্ব উপস্থিত করে তা সবার মনে প্রবেশ করান দুরূহ’। বিশেষ করে তখনকার জেলগুলিতে অনেক ছিল কিশাের-যুবক, ভাষা-আন্দোলনে ধৃত বহু ছাত্র যাদের কাছে রাজনীতিকে সরস করে উপস্থিত করা অত্যন্ত প্রয়ােজন হয়ে পড়ছিল।
তাছাড়া জেল-জীবনকে সহজ করে তােলার জন্য এই সমস্ত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের গুরুত্ব ছিল সর্বাধিক। দুঃখের বিষয়, কাঞ্জিদার ঐ সকল কীর্তনের একটি কলিও আজ মনে করতে পারছি না। কিন্তু জেলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তন্ময় হয়ে তাঁর কীর্তন উপভােগ করেছি, আনন্দ পেয়েছি। তাছাড়া পাহারারত সিপাহীরাও আমাদের এবং আমাদের ওয়ার্ডের বিভিন্ন কাজে ফালতু কয়েদীরাও ঐ কীর্তন শুনে আনন্দ পেত । কাঞ্জিদা ছিলেন পেশায় ডাক্তার। মনে আছে, কি অদ্ভুত দরদ দিয়ে তিনি জেলখানায় কমরেডদের চিকিৎসা করতেন। বােধহয় কিছু হােমিওপ্যাথিক ঔষধ রাখার অনুমতি তিনি পেয়েছিলেন। তাঁরই চিকিৎসার ফলে দারুণভাবে আমাশায় আক্রান্ত কমরেড ফণী চক্রবর্তী চার বছরে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে জেল থেকে মুক্ত হতে পেরেছেন। | এই প্রসঙ্গে আরাে একজন কমরেডের কথা মনে পড়ে। তিনি হলেন, চট্টগ্রামের কমরেড ধীরেন শীল । যতদূর মনে পড়ে তাকে প্রথম দেখি ১৯৫৩ সনে। আমরা দুজনেই হাসপাতালে শয্যাশায়ী। সেখান থেকেই খবর পেলাম কমরেড স্ট্যালিনের মৃত্যু হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে অত্যন্ত অসুস্থ থেকেও প্রায় চিৎকার
১৭৫
করে উঠে বসলেন তিনি। আমিও সঙ্গে সঙ্গে উঠে তাকে ধরতে গেলাম। তিনি বললেন কমরেড স্ট্যালিন মারা গেছেন। দুনিয়ার বিপ্লবী সূর্য ডুবে গেইল-শহীদ ভাই, হামরা অন্ধকারে রইলাম । বিপ্লবী সূর্য ডুবে গেইল। বলতে বলতে বাষ্পরুদ্ধ কষ্ঠে উঠে দাঁড়িয়ে আন্তর্জাতিক সঙ্গীত গাইতে শুরু করলেন। হাসপাতালে মৃদু। আলােতে দেখলাম কমরেড কাঁদছেন। আমিও দু’হাত জোর করে বুকের উপর রেখে মাথা নীচু করে আন্তর্জাতিক সঙ্গীত গাইলাম।
কমরেড স্ট্যালিনের জীবন বা রাজনীতি আলােচনা করব না। তবে তার সম্বন্ধে একটু বলা যায় যে, লেনিনের গড়া প্রথম সমাজতান্ত্রিক দেশকে যখন সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়ার জন্য হিটলার তার সর্বশ্রেষ্ঠ যান্ত্রিক বাহিনী নিয়ে সােভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করেছিল, তখন তাঁর মহান নেতৃত্বেই ফ্যাসিষ্ট বাহিনীকে নির্মূল করা হয়েছিল এবং লালফৌজ বার্লিন পর্যন্ত অগ্রসর হয়ে নাজী বাহিনীর কবর রচনা করেছিল। তার নেতৃত্বেই স্ট্যালিনগ্রাডে যে লড়াই হয়েছিল তা সমকালীন বিশ্বে অতুলনীয়। উপরে হিটলারের বিরােধিতা করলেও ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মূল লক্ষ্য রাশিয়াকে ধ্বংস করার পরিকল্পনা নিয়ে যখন চার্চিল রুজভেল্ট কোম্পানী সেকেন্ড ফ্রন্ট খুলতে গড়িমসি করেন, তখন বিপ্লবী নিষ্ঠায় অবিচল মার্শাল স্ট্যালিন বিশ্বসাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে লড়াই অব্যাহত রেখে শেষ পর্যন্ত সমাজতন্ত্রের জয়লাভকে সুনিশ্চিত করেছিলেন। স্ট্যালিনই মিউনিক চুক্তি করে রাজনীতিক কুটকৌশলের পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছিলেন।
স্ট্যালিনই মার্কসবাদী তত্ত্বানুযায়ী সােভিয়েত রাশিয়ার তথা বিশ্বের নিপীড়িত জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণ তথা প্রকৃত স্বাধীনতার পথ দেখিয়েছিলেন। মার্কসএঙ্গেলস লেনিনের পরেই মার্কসবাদী তত্ত্বে তাঁর মৌলিক অবদানের কথা কেউই অস্বীকার করতে পারবে না।
কী অপূর্ব বিপ্লবী উন্মাদনা ছিল কমরেড ধীরেন শীলের মধ্যে। মাঝারি গড়নের শরীর, ঈষৎ মােটা-কালাে চোখ দুটি গােল । ওষ্ঠদ্বয় কিঞ্চিৎ পুরু, দেখতে বাহ্যত স্বাস্থ্যবান মনে হয়। কিন্তু ভিতরে তিনি ছিলেন রুগ্ন। ধীরেন বাবুর মত প্রাণােৎসর্গকারী বিপ্লবী খুব কমই দেখেছি। পুঁজিবাদ এবং পুঁজিবাদীদের প্রতি ঘৃণায় যেন ফুলে ফুলে উঠতেন কমরেড । তিনি ছিলেন অদ্ভুত মিষ্টি কণ্ঠস্বরের। অধিকারী। তিনি নিজেই অনেক গান লিখেছেন-পুঁজিবাদের ধারক-বাহক তৎকালীন মুসলিম লীগের পান্ডাদের উদ্দেশ্য করে তিনি তীব্র ব্যঙ্গ ও শ্লেষাত্মক গান লিখতেন এবং নিজেই আমাদের গেয়ে শুনাতেন। ধর্মের নামে যে-কোন রকম গুণ্ডামিকে তিনি উম্মােচন করতেন অত্যন্ত জোরালাে স্পষ্ট বক্তব্য দিয়ে।
১৭৬

সাতান্ন
জেলখানায় প্রায় প্রতি অনুষ্ঠানে কমরেড ধীরেন শীল তাঁর রচিত গান গেয়ে শােনাতেন। সমস্ত রাজনৈতিক আলােচনায় ধীরেন বাবু আগ্রহ সহকারে অংশগ্রহণ করতেন এবং অত্যন্ত জোরের সাথে নিজের মতামত ব্যক্ত করতেন। সরল প্রাণ এই কমরেডটির পরে মস্তিক বিকৃতি ঘটে এবং জেলখানায় অশেষ দুর্ভোগে পতিত হন। এমনও শুনেছি যে তার কাছে যখন জেল থেকে খালাসের আদেশ নিয়ে যাওয়া হয় তখন তিনি কিছুতেই জেল থেকে বেরুতে চাননি।
আমাদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আর একটি আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ছিল কমরেড বটুদা। এই সব রাজবন্দী কেবল যে বিশেষ কোন একটা বিষয়ে পারদর্শী তাই নয়, তারা ছিল সমগ্রভাবে বিপ্লবগতপ্রাণ। বটুদা ছিল সবারই প্রিয়। খৈনী ছিল তার প্রিয় নেশা। খৈনী অর্থ তামাকের গুঁড়া । দেখেছি উত্তর ভারতীয়, বিহারী, মধ্যপ্রদেশী। সিপাহীরা শুকনাে তামাক হাতে ঘষে গুঁড়াে করে খৈনী তৈরী করে এবং তা মুখে দাঁতের গােড়ায় পুরে দিয়ে তামাকের নেশা চরিতার্থ করে । বটুদাও তাই করতেন।
কিন্তু বটুদার আসল গুণ ছিল সে দু’হাতের মাত্র চারটি আঙ্গুল দিয়ে এমনভাবে শব্দ করতে পারতাে যেন মনে হতাে ঢােল বাজাচ্ছে এবং ডাঃ কাঞ্জিদা যখন কীর্তনের সুরে চড়া তাল ওঠাতেন বটুদাও তখন দুই হাত কোমরের দুই পাশে রেখে আঙুল দিয়ে এমন শব্দ করতাে যেন মনে হতাে কেউ গান বাজনার আসরে ঢােল বাজাচ্ছে। বটুদার বাজনার এই কৌশলটি কিন্তু জেলে চেষ্টা করেও অন্য কেউ আয়ত্ত করতে পারেনি। এই ধরনের কমরেডরা জেল জীবনের পক্ষে অত্যন্ত সহায়ক। এ রকম আর একজন কমরেড ছিলেন রাজশাহী জেলে। তিনি হলেন লালুপাড়ে। ইনি অদ্ভুত মিশুক ছিলেন। জেলখানায় সমস্ত কমরেডদের সুবিধাঅসুবিধার প্রতি তাঁর ছিল সদা-সতর্ক দৃষ্টি। নওগাঁর কমরেড লালুপাড়ে আজ নেই। কালাে পাতলা ধরনের এই কমরেডের চোখ দুটি ছিল তীক্ষ্ম কিন্তু মৃদু দৃষ্টি সম্পন্ন । বৈপ্লবিক কর্মে তিনি ছিলেন উৎসর্গিত প্রাণ।
এ ছাড়া আমরা ৭ই অক্টোবর দিবস পালন করতাম। এরূপ একটা অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করছিলেন দিনাজপুরের কৃষক নেতা নূরুল হুদা কাদের বকশ। মনে আছে। ফর্সায় চীনাদের মত কিন্তু বেটে নয়, প্রশস্ত ললাট, উচু চোয়াল, পূর্ণ রক্তাভ গন্ডদয় । উজ্জ্বল ও কটা চোখ বিশিষ্ট ছুটি ভাই যখন বক্তৃতা করতেন তখন তা
১৭৭
আমাদের মুগ্ধ করতাে।
জেলখানায় আমরা ২১শের শহীদ দিবস পালন করতাম। ২১শে ফেব্রুয়ারীকে আমরা ভাষা দিবস বলে আখ্যায়িত করি। কিন্তু এটা ছিল প্রকৃতপক্ষে মুক্তি ও স্বাধীনতা সংগ্রাম দিবস। এই স্বাধীনতার আকাঙ্খ আমাদের মনে ১৭৫৭ সাল থেকেই জমাট বাঁধছিল। পাকিস্তান সৃষ্টি সেই স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ছিল পাল্টা আক্রমণ। এরপর সাম্রাজ্যবাদের দালালরা পাকিস্তানকে স্বাধীনতা বলে সাময়িকভাবে ভাওতা দিতে পারলেও তাদের আসল রূপ বেশীদিন গােপন রাখতে পারেনি। তাদের এক মাত্র উপনিবেশে যখন গণ-আন্দোলন দানা বাঁধছিল তখনই তারা আক্রমণ করল এ দেশের ভাষা ও সংস্কৃতির উপর। তখন আর এদেশের ছাত্র-যুবক-কৃষক-মজুর মধ্যবিত্ত চুপ করে থাকতে পারল না। প্রবল আক্রোশে ফেটে পড়ল বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে। ফেটে পড়ল নিজেদের স্বাধিকার কায়েমের সংগ্রামে।
জেলখানায়ও আমরা প্রতি বছর ভাষা দিবস পালন করছি। লক্ষ্য করেছি শাসক শ্রেণী ‘৫২ সনের প্রবল আন্দোলনের চাপে সাময়িক ভাবে বাংলা ভাষাকে সরকারী ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও সরকার তাকে কার্যকরী না করার চেষ্টা করত বেশী। যা হােক আমরা জেলখানায় বসেও এই দিবসকে যথাযােগ্য মর্যাদার সঙ্গে পালন করেছি। শপথ গ্রহণ করেছি শহীদদের আরব্ধ কার্য আমরা সমাপ্ত করবই।
এই বইয়ের প্রথমদিকে ‘৪৮ এর ভাষা আন্দোলনের কথা আলােচনা করেছি। কিন্তু সেই আন্দোলনের মৃদু ঢেউ যে বাইরে গত চার বছরে এক বিপুল শক্তিশালী, অপ্রতিরােধ্য, সর্বগ্রাসী তরঙ্গের সৃষ্টি করেছে ১৯৫২ সনে এ জেলে বসে তার কিছুটা আভাস আমরা পেয়েছিলাম। ১৯৪৮-এর প্রথম দিকেই এর তরুণ পরবর্তীকালে পূর্ব বাংলার জাগ্রত ছাত্র, যুবক ও জনসমাজ তাদের উপর সুপরিকল্পিত আক্রমণকে জীবন দিয়ে রুখে ছিল। তবে একথা বলতেই হবে যে, ৪৮-এ আমরা ভাষার প্রশ্নে যে সংগ্রামের ইন্ধন জুগিয়েছিলাম, তাই ‘৫২ সনে দাবানলের সৃষ্টি করছিল।
আমি তখন রাজশাহী সেন্ট্রাল জেলে। হঠাৎ একদিন দেখি অসংখ্য লােকে জেলখানা ভরে উঠেছে। তারা অধিকাংশই ছাত্র যুবক। বিস্মিত হয়ে দেখলাম এক অপ্রতিরােধ্য স্রোতের মত জেলের ভিতর চলে এসেছে আটদশ বছরের ছেলেরা। তারা জেলের ভিতর ঢুকেও ঐ একই ধ্বনি দিচ্ছে। রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, নূরুল আমীনের কল্লা চাই। জেলের কোন আইনই মানছে না তারা। যতদূর মনে পড়ে ছােট ছােট ছেলে-মেয়েরা দালানের ছাদের উপর উঠে শ্লোগান দিতে লাগল, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। কিন্তু তখন আমরা জেলের ভিতর কঠোর নিয়ন্ত্রণে। এটা
১৭৮
হলাে ১৯৫০ সালে জেলে গুলী হবার জের। ঐ সময় কোন ফাঁকে জেল হাসপাতালে যাওয়ার সময় দূরে জেল গেটের দিকে উক্ত দৃশ্য লক্ষ্য করি । আমাদের সাধ্য ছিল না ইশারা করেও তাদের অভিনন্দন জানাই। পরে শুনলাম, ঢাকার রাজপথে ছাত্র মিছিলের উপর গুলি চলেছে। মনে হলাে, সে তরঙ্গ জেলের অভ্যন্তরও প্লাবিত করে গেল । এ শিশুরা আর কেউ নয় বরকত, ছালামের ক্ষরিত রক্তের জীবন্ত কণিকা।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে বাইরে যে বাঁধ ভেঙেছিল তারই ফলে টনক নড়ে উঠল তৎকালীন স্বৈরাচারী সরকারের। ১৯৫২ সনের ২১শে ফেব্রুয়ারীর আন্দোলনের ফলেই আমাদের সঙ্গে বাইরের যােগসূত্র স্থাপিত হয়েছিল। বাইরে গণআন্দোলনের অনুপস্থিতির সুযােগে এরা ভিতরে আমাদের উপর চালাত নির্মম অত্যাচার। যার পরিণতি ১৯৫০ সনের রাজশাহীর গুলি।
জেলে রাজবন্দী হিসেবে আমাদের মর্যাদার সংগ্রাম চলেছে দীর্ঘদিন। কিন্তু রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মধ্যদিয়ে যখন বাইরে ব্যাপক জনতার কাছে আমাদের দীর্ঘ কারাবাস এবং নির্যাতনের কথা প্রকাশ হয়ে পড়ল, তখন আর সরকার আমাদের। দাবি অগ্রাহ্য করতে পারল না। মার্কসের ভাষায়: ‘শােষকরা নিজেদের কবর নিজেরাই খোড়ে।
১৭৯

আটান্ন
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মিছিল থেকে সরকার অনেক নিরীহ লােককে ধরে এনেছিল জেলখানায়। তারাই পরে জেলে আমাদের শক্তি যুগিয়েছে। এদের ব্যাপক গ্রেফতারের ফলেই আমাদের সম্পর্কে বাইরের জনতার জ্ঞান বৃদ্ধি পেয়েছে।
সেই থেকে জেলে আমরা ২১শে ফেব্রুয়ারী শহীদ দিবস পালন করে এসেছি। মনে আছে, তখন আমি ঢাকা জেলে। ২১শে ফেব্রুয়ারীর সকালে লকআপ খুলে দেবার সঙ্গে সঙ্গে ওয়ার্ডের বাইরে বেরিয়েছি। হঠাৎ চোখে পড়ল বাইরে জেলখানার অদূরেই ছাদের উপর একদল মেয়ে। আমরা অনেকেই তখন বাইরে। ওরা হাত উঠিয়ে মুষ্টিবদ্ধ করে আমাদের অভিনন্দন জানালাে। বুঝলাম ২১শে । ফেব্রুয়ারীর বিপ্লবী অভিনন্দন। সে সময় ওদের দেখে আমি যে কবিতা লিখেছিলাম তার কয়েকটি লাইন কোন রকমে মনে রাখতে পেরেছি :
ওরা শক্ত মুঠি উঠিয়ে ঘােষণা করছে
ছিনিয়ে আনবেই ওরা সূর্যকে
শতাব্দীর গাঢ় অন্ধকার থেকে
অজ্ঞানতার নাগপাশ থেকে
জীর্ণ আচারের কালাে পর্দা ছিড়ে
বেরিয়ে আসবেই ওরা।
তাই ওদের বেণী দুলছে
ওদের কঙ্কনে দামামা বাজছে
ওদের কোমল বক্ষে বজ্রের কাঠিন্য জাগছে
বেগম লক্ষ্মীবাই ও রােকেয়ার
পথচারী ওরা
আমার দেশের মায়েরা!
আমার দেশের বােনেরা!
তারপরই ওরা দ্রুত নেমে গেল । বােধ হয় রাস্তায় মৌন শােক মিছিলে যােগ। দেবে ওরা। বুঝলাম ওরা আমাদের অভিবাদন জানাতেই ছাদে উঠেছিল । সত্যি বলতে কি জেলকে তখন জেল মনে হচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল বাইরের বিরাট গণ
১৮০
মিছিলের আমরাও একটা অংশ। সিদ্ধান্ত হলাে আমরাও জেলে শহীদ দিবস পালন করব। জেলেই তৈরী হলাে শহীদ বেদী। এখানে ফুল নেই বাগানে। কিন্তু অনুভব করলাম আমাদের হৃৎপিন্ড রক্তপাপড়িতে পরিণত হয়েছে। তা যেন আপনিই ঝুঁকে পড়েছে বেদির দিক।
বস্তুত যে কয়বছর জেলে ছিলাম ২১শে ফেব্রুয়ারীতে তার হিসেবের খাতা হাতে নিয়ে দেখলাম আমরা বিপ্লবী জীবনে দেউলে হয়ে গেছি, না পাথেয় তখনও কিছু আছে? দেখলাম শহীদের রক্ত আমাদের জীবনের মূল সিঞ্চিত করে রেখেছে। এ আর শুকোবার নয়। দেখলাম শহীদ দিবসের ডাক আমাদের বৃহত্তম জগতের সঙ্গে একাত্ম করে দিয়ে যায়। আমরা তখন বুঝি এ জেলের দেয়াল কত কৃত্রিম। শপথ নিলাম। বাইরের রাজপথে মানুষ মুক্তির জন্য রক্ত ঝড়িয়েছে। আমরাও বেরিয়ে সেই রক্তপিচ্ছিল পথে দাঁড়িয়ে লড়াই করব। সমাপ্ত করব তাদের আরদ্ধ কাজ।
বলা প্রয়ােজন যে, তৎকালীন যুক্তফ্রন্টের নামাবলী গায়ে দিয়ে এই সমস্ত সাম্প্রদায়িক ও স্বার্থান্বেষীরা যুক্তফ্রন্টে কম্যুনিস্ট প্রভাবকে সর্বতােভাবে ক্ষুন্ন করতে চেষ্টা করত। আর এও সত্য যে আমরাই কি জেলে কি বাইরে এই সমস্ত অশুভ চক্রের সুযােগ সেখানে করে দিতে এতটুকুও কুণ্ঠাবােধ করেছি? কিন্তু শ্রেণী সমাজে যা হয়, তখনকার বাংলার উঠতি বুর্জোয়ারাও নিজেদের অর্থনৈতিক তাগিদে মুসলিম লীগ বিরােধী ভূমিকা গ্রহণ করলেও মার্কসবাদীদের প্রভাব স্বীকার করে নিতে রাজী হয়নি। রাজী হয়নি ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ফ্যাসিষ্টরূপী পেন্টাগণ চক্র যে ঔপনিবেশিক, আধা ঔপনিবেশিক দেশের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনগুলিকে ক্যুনিজম তথা সমাজতন্ত্রের হাত থেকে রক্ষা করতে এবং এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার কৃষক, শ্রমিক ও নির্যাতিত জাতীয় বুর্জোয়াদের মুক্তি সংগ্রামকে নস্যাৎ করতে সর্বদা সচেষ্ট থাকত, আমাদের শত চিৎকারেও তারা ইতিহাসের ঐ সত্যটাকে উপলব্ধি করতে চায়নি। তাই যুক্তফ্রন্টের বিজয়ে যখন পাকিস্তানে আমেরিকান রাষ্ট্রদূত হােরেস হিলথে আন্তর্জাতিক আইন শালীনতা ও দেশের সার্বভৌমত্বকে পদদলিত করে নির্লজ্জ দাম্ভিকের মত হুমকি দিল যে, পূর্ব বাংলায় যুক্তফ্রন্টের বিজয়ে কেন্দ্রের রাজনীতির উপর কোন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারবে না, তখন তেমন কোন প্রতিবাদ উচ্চারিত হয়নি এ দেশের তথাকথিত নেতৃবৃন্দের। মুখ থেকে। এরপর যখন অকস্মাৎ ৯২ ধারার খড়গ নেমে এল তাদের মাথার উপর তখন যেন মনে হলাে ৯২ ক ধারার যুপকাষ্ঠে বলিদান হতে পারলে তাদের স্বর্গে স্থান হবে। ৯২ ক ধারার পরবর্তী আমলের যুক্তফ্রন্ট নেতৃবৃন্দের কেন্দ্রের সঙ্গে। আপসের মধ্য দিয়ে উপরােক্ত উক্তির নির্ভেজাল সত্যতা প্রমাণিত হচ্ছে।
১৮১
যাক, জেলের সাংস্কৃতিক জীবনকে সব রকম কলুষমুক্ত করে রাখার জন্য। আমরা উপরােক্ত সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পকে প্রসারিত হতে দেইনি।
মনে আছে ৯২ ক ধারা করে তারা ইউনিভার্সিটির ছাত্রদের সঙ্গে বহু ছাত্রীকেও ধরে নিয়ে এসেছিল। ৪৮ থেকে পাকিস্তানের অন্ধ প্রকোষ্ঠ থেকে যখন আমরা প্রত্যক্ষ করলাম এতদিনে পূর্ব বাংলার শুধু ছেলেরা নয়, মুসলিম সমাজের মেয়েরাও মুক্তি ও স্বাধীনতার সংগ্রামে রাজপথে নেমে এসে হাসিমুখে কারাবরণ করছে, তখন আমরা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম। আমরা আধা বুড়ােরা আমাদের স্বভাবসিদ্ধ অভিভাবকত্বের তাগিদে মনে করলাম আহা ওরা জেলে কোন রকম ভেঙ্গে না পড়ে। তারা যে একটুও ভেঙে পড়েনি এবং কোন রকম সরকারী চাপের কাছে মাথা নত করবে না তাও আমাদের জানাল।
এ সময় একটি ঘটনায় আমাদের মন উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিল। ইউনিভার্সিটির যে ছাত্রদের তারা ধরে আনছিল এবং তাদের যখন আমাদের ওয়ার্ডের পাশ দিয়ে। নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন আমরা তাদের দেখার জন্য দালানের রেলিং ধরে এসে দাঁড়ালাম, দেখলাম সেদিন সােনার কান্তি শত শত (অন্যূন পাঁচশত হবে) ছেলেকে ওরা বন্দী করে নিয়ে এসেছে। মনে হলাে ফ্যাসিস্টরা একটা গােটা ফুলের বাগান থেকে সদ্য প্রস্ফুটিত সমস্ত ফুল ছিড়ে নিয়ে এসে পায়ে দলছে। যাবার পথে আমরা ওদের দেখে ‘বিপ্লবী ভাইরা আমাদের অভিনন্দন গ্রহণ করাে” বলে মুষ্টিবদ্ধ হাত উঠিয়ে সজোরে ওদের আহ্বান করলাম। ওরাও আমাদের দেখে থমকে দাঁড়াল এবং ঐখানে দাঁড়িয়েই ‘রাজবন্দীদের মুক্তি চাই’ বলে ধ্বনি দিতে লাগল। ওরা ভুলে গেছে যে, ওরাও বন্দী হয়ে এসেছে। আমরা বললাম, আমরা তােমাদের মুক্তি চাই’ তারা বলল ‘আপনাদের মুক্তি না হলে আমরা মুক্তি নেব না। সে কী আবেগ, সে কী অপরূপ দৃশ্য! দেখলাম ওদের মধ্যে অসংখ্য ছেলে চিত্রাপিতের মত দাঁড়িয়ে শুধু আমাদের দেখছে। ছাত্র নেতৃত্বের কথা বলছি না কিন্তু বন্দী অসংখ্য সাধারণ ছাত্ররা আমাদের দেখে যেন বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে গেছে। তারা কি জানত যে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই সাম্রাজ্যবাদের দোসর এ দেশের মুক্তি সংগ্রামীদের, আমরণ বিপ্লবীদের এমনি করে জেলে পুরে রেখেছে। নিজেরা যে জেলে বন্দী সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নাই । তারা মূহুর্মুহু ধ্বনি দিচ্ছে “রাজবন্দীদের মুক্তি চাই।” দুঃখ ও আনন্দের আতিশয্যে আমাদের অনেকের চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ল। আনন্দ এ জন্য যে, আজ বাংলা জেগেছে-৪৮ থেকে ৫২ মাত্র পাঁচ-ছয় বছরে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে দেশের সমস্ত প্রভাবান্বিত রক্ষণশীল মুসলিম যুবকদের এ কি জাগরণ! এ কি বিস্ময়! দুঃখ এ জন্য যে, এই সােনার কান্তি যুবকদের আজ এরা কারাগারে ধরে আনতে সক্ষম হলাে।
১৮২
রমেশ শীলের গ্রেফতার
এবার আসা যাক জেলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আর একটি পর্যায়ে। এ পর্যায় শুরু হলাে বিপ্লবী কবিয়াল রমেশ শীলের গ্রেফতার হয়ে জেলে প্রবেশের পর থেকে।
একদিন সকালে অথবা বিকেলে নিজের চৌকিতে বসে পড়ছি হঠাৎ শুনি হৈ চৈ। আশপাশের কমরেডরা “কৈ কোথায়?” বলতে বলতে ছুটে নীচের তলায়। যাচ্ছেন। আমি পড়া রেখে উঠছি।
কাছাকাছি কেউ নেই যে জিজ্ঞেস করি কি ব্যাপার। সিড়ির দিকে এগােতেই দেখি এক শুভ্রকেশী, দীর্ঘকায় বৃদ্ধ তার উজ্জ্বল দৃষ্টি সামনের দিকে নিবন্ধ করে আমার দিকে এগিয়ে আসছেন। এতক্ষণে জানলাম ইনিই কবিয়াল রমেশ শীল । ভাবলাম বটেই তাে। প্রতিভার এই-ত লক্ষণ। আমার পাশেই তাঁর খাট নির্দিষ্ট হলাে। অশীতিপর বৃদ্ধ কবিয়াল যেন এক শতাব্দীর অভিজ্ঞতা সারা দেহে মনে জড়িয়ে আমাদের সম্মােহিত করে দিলেন। বিস্ময় বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম তাঁর দিকে। কী-যে তাঁকে জিজ্ঞেস করব ভেবেই পাই না। অবশ্য শারীরিক কুশলাদি জিজ্ঞেস করলাম। তিনিও তার স্মিত হাসি দিয়ে কথার জবাব দিলেন। বললেন, আমার বয়েস আশী বছর পেরিয়ে গেছে এই অবস্থায়ও আমাকে ধরে কারাগারে নিয়ে এল। দেখি, আরাে কত কি করতে পারে। আত্মসমাহিত কবিয়ালকে দেখলাম সমস্ত কথাবার্তার মধ্যেও আপন মনে যেন কবিতা আওড়াচ্ছেন-অথবা ছড়া ঠিক করছেন। এটা আমাদের পরম সৌভাগ্য যে এত বড় একটি প্রতিভার সাহচর্য পেয়েছি আমরা। চট্টগ্রামের গােমদন্ডী বা ঐ রকম কোন এক পল্লীগ্রামে কবির জন্ম হয়। প্রায় অর্ধশতাব্দীরও বেশী সময় তিনি তাঁর কবি গানের দ্বারা এ দেশকে মুগ্ধ করে গেছেন। এদেশে মুকুন্দ দাসের পর বােধ হয়। তাঁর মত আর কেউ এত বেশী জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেনি। তিনি কবি শেখ গােমানির মত বিখ্যাত কবিয়ালদের সঙ্গে লড়েছেন।
যে কোন দেশের বিপ্লব বা স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য শুধু রাজনৈতিক তত্ত্বই যথেষ্ট নয়, তার জন্য চাই জনগণের মধ্যে তাদের ভাষায় তাদের সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তাদেরই হৃদয়গ্রাহী করে বিপ্লবী সংগ্রামের প্রচার । চাই সংগ্রামের অনুকূল সাংস্কৃতিক পরিবেশ গড়ে তােলা। আমার মনে হয়, দেশের কবিসাহিত্যিকদের মত এই কাজে চারণ কবি ও কবিয়ালদের অবদান কোন অংশেই ন্যূন নয়। এই দৃষ্টিভঙ্গীতে বিচার করলে এ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বিপ্লবী কবিয়াল রমেশ শীলের দান অপরিসীম। ১৯০৫ সাল থেকে এ দেশের। বৃটিশবিরােধী সংগ্রামে রমেশ শীলের গান জুগিয়েছে অপূর্ব প্রেরণা। তাঁর
১৮৩
সার্ধশতাব্দীব্যাপী সাধনার জীবনকাহিনী আজ এদেশের জনগণের কাছে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হওয়া উচিত। বিদ্রোহী কবিয়াল তাঁর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সমস্ত রকম অন্যায় ও শােষণের বিরুদ্ধে সােচ্চার ছিলেন। তাই দেখি অশীতিপর এই বৃদ্ধকেও কারাগারে আবদ্ধ হতে হয়। কত বড় তেজ, কত বড় বিপ্লবী নিষ্ঠা থাকলে এই বয়সেও অকৃতােভয় কবিয়াল কারাবরণ করতে দ্বিধাবােধ করেননি। আমরা জেলে যতটুকু তাকে দেখেছি তারই আলােচনা করছি। আগেই বলেছি, আমার পাশের সিটেই তিনি ছিলেন। সত্যি কথা বলতে কি, কাছে থাকতে কি যে তীব্র আকর্ষণ অনুভব করতাম তা ভাষায় ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। . আমি এ সময় মাঝে মাঝে দুই একটি কবিতা লিখতাম। কবিকে একদিন তারই দুই একটি কবিতা দেখিয়েছিলাম। তার বিষয়বস্তু কি ছিল তা এখন মনে নেই। তবে তা জেলের বা বাইরের কোন অত্যাচার-অবিচারের কাহিনীকে কেন্দ্র করে হবে হয়ত। আমার কবিতার বৈশিষ্ট্য হলাে তা সহজবােধ্য, ঘটনামূলক, আবেগাশ্রয়ী। কিন্তু ঘটনাবহুল বলেই বাস্তব। কবিতা আমি বেশী লিখিনি। তবে যা-ও লিখছি তা সংগ্রহ করে রাখত পারিনি। জেলে আমার কমপক্ষে কুড়ি পঁচিশটি কবিতা ছিল।
সেদিন ঢাকায় দিনাজপুরের ছটি ভাই (নূরুল হুদা কাদের বখশ) সাহেব। আমার জেলের কবিতাগুলির জন্য খুব আফসােস করেছেন। বললেন, ওগুলাে আপনার রেখে দেওয়াই উচিত ছিল। যাক কবিয়াল রমেশ শীল আমার কবিতা খুব মনােযােগ দিয়ে পড়লেন এবং সন্তুষ্ট হলেন। দেখলাম তিনি ওগুলাে নিজের কায়দায় সুর দিয়ে পড়ছেন। আহা! আজ যদি তার একটি পংক্তি মনে করতে পারতাম। বৃদ্ধ কবিয়ালকে দেখতাম প্রায়ই তার কাপড়-চোপড় সেলাই করছেন আর আপন মনে গুণ গুণ করছেন। সমস্ত প্রতিভা যে সাধনালব্ধ এক সাধনার প্রকৃত রূপ কি তা এই কবিয়ালের সাহচর্যে থেকে বুঝেছি। শ্রদ্ধেয় পূর্ণেন্দু দস্তিদার কবিয়ালের একটি সংক্ষিপ্ত জীবনী লিখেছেন। আমার মতে বাংলা একাডেমী, বিশ্ববিদ্যালয় প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের উচিত কবিয়াল রমেশ শীল সম্বন্ধে গবেষণার সুযােগ করে দেওয়া। তিনি যেমন রাজনৈতিক বিষয়বস্তু নিয়ে অসংখ্য গান কবিতা লিখেছেন, তেমনি তার জীবনের অন্যতম উৎস ছিল হজরত শাহ জালাল প্রভৃতি আধ্যাত্মিক সাধকদের জীবনকাহিনী। ধর্মীয় জগতে কি হিন্দু, কি মুসলিম সকল সম্প্রদায়ের মধ্যেই ধর্মের নামে যখন চরম কুসংস্কার ও নিছক আচারনিষ্ঠা প্রবল হয়ে দেখা দিয়েছিল, তখন তার বিরুদ্ধে কবিয়ালের সংগ্রামী সুর ধ্বনিত হয়েছিল।
এই সময় সিলেটের কবিয়াল শ্রদ্ধেয় যােগেশ দাসও ঢাকা জেলে ছিলেন । জগতে মানুষই মানুষের আনন্দের উৎস। এটা ভাল করে উপলব্ধি করেছি যােগেশদা’র সান্নিধ্যে এসে। কালােপনা বেঁটে ধরনের অত্যন্ত স্নেহপ্রবণ যােগেশদা
১৮৪
ছিলেন কৃষকের ঘরের সন্তান। খোঁচা খোঁচা দাড়ি কিন্তু একেবারে খাড়া। তাঁর মুখে ছিল ব্রণ বা ফোড়া জাতীয় কতগুলি ফোটক। তিনি এর জন্য ঔষধ সেবন করতেন এবং তা হােমিওপ্যাথ। যােগেশদা’ প্রায় লাইকোপডিয়াম নামীয় ঔষধের কথা বলতেন। এজন্য আমরা তাঁকে লাইকোপডিয়াম দা’ বলে ডাকতাম। কিন্তু তিনি ক্ষেপতেন না কিছুতেই। যােগেশদা গরীব ছিলেন। সংসারের কথা ভাবতেন প্রায়ই।
যােগেশদা’ কিন্তু সহজে ছড়া বলতে চাইতেন না। এবারে রমেশ শীল আসায় আমরা তাকে ধরলাম। বহু বলে কয়ে ঠিক হলাে রমেশদার সঙ্গে তাঁর কবিযুদ্ধ হবে। সময় ও তারিখ ঠিক হলাে। আর দেখে কে, সারা ওয়ার্ডটি যেন কথা কইতে শুরু করল । সে কি হৈ হুল্লোড়! জেলজীবনে দু’জন লব্ধ প্রতিষ্ঠ কবিয়ালের তর্কযুদ্ধ শােনা ও দেখা যে কি আনন্দের ব্যাপার হতে পারে তা অন্যকে বােঝানাে যাবে না ।
মঞ্চের উপর চটের জাজিম এবং জাজিমের উপর শুভ্র চাদর বিছিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আমরা স্তব্ধ হয়ে বসলাম। জেলখানার স্বল্পোজ্জল আলােকে যেন আরও উজ্জ্বলতর করে বেরিয়ে এলেন মহান কবিয়াল রমেশ শীল । শুভ্র কেশ, ততােধিক শুভ্র বস্ত্র, গৌরবর্ণ চেহারা, উজ্জ্বল চোখ, উন্নত নাসিকা, প্রশস্ত ললাট। সারা জীবনব্যাপী সাধনার আলােকে আরও সমুজ্জ্বল কবিয়াল যখন ধীর পদক্ষেপে মঞ্চে পদার্পণ করলেন তখন তাঁকে দেখে বিস্ময়ে বিমােহিত হলাম ।
অপূর্ব এক ভঙ্গী করে তিনি উঠে দাঁড়ালেন মঞ্চে। খুব সম্ভব কবিয়ালদের চিরাচরিত নিয়মানুযায়ী অভিবাদন করলেন আমাদের । বিনয়, ব্যক্তিত্ত্ব, বলিষ্ঠতা, আত্মপ্রত্যয়ের সে এক মহিমান্বিত রূপ।
ওদিকে উঠে এসেছেন আমাদের যােগেশদা’। কবিয়ালের সামনে কত বেঁটে দেখায় তাকে, কিন্তু তিনি যেন আর এক রূপ। তাঁর কালাে, দেহ কবিয়ালের শুভ্রতাকে যেন আরও শুভ্র করে তুলেছে। মনে হলাে একজন স্বর্গের, একজন মর্ত্যের। যােগেশদাও আমাদের অভিবাদন করে দাঁড়ালেন। তাঁর ভাবভঙ্গী দেখে বুঝলাম ছাড়বার পাত্র নন তিনি। মনে হলাে কবিয়ালসুলভ যুদ্ধোন্মাদনায় তাঁকে চাঙ্গা করে তুলেছে। সেই কালাে বেঁটে লােকটি মঞ্চের সঙ্গে পা দুটি শক্ত করে। আটকে দাঁড়িয়েছেন। তাঁর ওষ্ঠদ্বয় দৃঢ়বন্ধ, চোখ দুটি স্থির । কবিয়াল রমেশ শীল প্রথম মুখ খুললেন, এবার তারা আসর বন্দনা করবেন। সে কি সুর! গলার সে কি মিষ্টি আওয়াজ। উভয়েরই কণ্ঠ শ্রুতিমধুর । কিছুক্ষণ তাঁরা আসর বন্দনা করলেন। আসরের শ্রোতাদের প্রতি অকুণ্ঠ সম্মান-শ্রদ্ধা-ভক্তি ভালবাসা প্রকাশ করলেন তাঁরা বন্দনার মধ্যে। আমরা পুলকিত হলাম, রােমাঞ্চিত হলাম, অভিভূত হলাম
১৮৫
ঐটুকুতেই। এখনই আরম্ভ হবে ঐদিনের বিতর্কের বিষয় একাল সেকাল নিয়ে । প্রথমে আরম্ভ করলেন কবিয়াল রমেশ শীল । সে যেন এক অপূর্ব ভঙ্গিমা, ছন্দ ও যতির মিলের কি নিখুঁত সংমিশ্রণ। কবি কথা বলছে না যেন বেহালার তারে তারে ঝংকার দিচ্ছে। সে স্বর কোথাও উঠে কোথাও নামছে-কোথাও হ্রস্ব, কোথাও দীর্ঘ, কোথাও একটু মােটা আবার কোথাও সরু হতে হতে মিলিয়ে যাচ্ছে বাতাসে।। গানের সঙ্গে কখনও মাথা উঁচু করছেন, কখনও আবার মাথা উঁচু করে তার দৃষ্টি ফেলছে, প্রতিপক্ষের দিকে। কখনও সুরের মূর্ঘনায় চলে যাচ্ছেন কোন অচিনপুরে। আবার যেন সম্বিৎ ফিরে আসে- বিস্ফোরিত দৃষ্টি মেলে ধরেন আমাদের সামনে। সে দেহভঙ্গী যেন এক নৃত্যস্বরূপ-মনে হয়, যেন আলাের তরঙ্গ কেঁপে কেঁপে যাচ্ছে। প্রতিপক্ষকে প্রশ্ন করে কখনও ‘তাহা বল না তাই বলাে না বলে টান দেন- শরীর সােজা উন্নত করে যােগেশদা’র সামনে চলে আসেন। আবার বক্তব্য বলতে গিয়ে যুক্তি দিতে দিতে অনর্গল কথা মিলাতে থাকেন। তখন যে কি অনির্বচনীয় আনন্দে আমরা মগ্ন হতাম, তা এখানে লিখে বুঝাতে পারব না। কবিয়াল থেমে গেলেন। একবার চকিতে আমাদের দেখে নিয়ে মাথাটা একটু তির্যক করে তাঁর অতলস্পর্শী দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে রইলেন তাঁর শিকারীর দিকে, যেন। মনে হলাে যুক্তির বাণে বাণে যােগেশদা’কে বিদ্ধ করে দেখছেন তিনি কেমন করেন।
কিন্তু এত রক্তাক্ত বাণে বিদ্ধ নয়, এ যে সুরভিত ফুলের আঘাত, (এ যে গােলাপ কন্টককে স্মরণ করিয়ে দেয়) সে আঘাতে বেদনা আছে আবার জাগার আনন্দও আছে। ঠিক মনে নেই কবিয়াল রমেশ শীল ‘একাল’ বলছিলেন না ‘সেকাল’ বলছিলেন। জবাব আরম্ভ হলাে। শুরু করলেন যােগেশ দা। বুঝলাম তিনিও পেশাদার কবিয়াল । ভাষা মিষ্টি, ছন্দের উপর আশ্চর্য দখল। যােগেশদা’ যেন নেচে নেচে সুরে সুরে পূর্ববর্তী বক্তার কথা কাটতে লাগলেন এক এক করে । কবিয়াল আস্তে আস্তে মাথা নাড়ছেন আর শুনছেন আর স্মিত হাসছেন। মাঝে মাঝে পিছনে হাত দুটি দিয়ে রাবীন্দ্রিক ভঙ্গীতে বা কোন প্রাচীন কালের বাল্মীকি পরাশরের ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে ভাবছেন যােগেশদা’র কথার পালটা জবাব । আমরা ঠায় বসে রইলাম সেখানে, যেন মন্ত্রমুগ্ধ সব । যােগেশদা’ থামলেন। কিন্তু ঠিক যেন এক ঝড়ের জন্য অপেক্ষা করছেন এমনি ভাব। হঠাৎ ঝড় ছুটলাে, দমকা হাওয়ার মত বেরিয়ে এল কবিয়ালের সুর । তিনি যখন কথা বলার বা শেষ চরণে দেখনাবলােনা শুনােনাভাবােনা করাে না বলে টান দিতেন তখন যে আমাদের টেনে নিয়ে যেতেন কোথায়। তারপর আবার যােগেশদা’র পাল্টা জবাব। ততক্ষণে রাত অনেক গড়িয়ে গেছে ।
১৮৬

ঊনষাট
শেষ পর্যন্ত উভয়ের মিলন। কবি-যুদ্ধের নিয়মানুযায়ী শেষে সাধারণভাবে কয়েকটি ছড়া বলে যখন কবিয়াল রমেশ শীল “এস মােরা যযাটকেতে মিলি দুজনা”- বলে প্রতিপক্ষকে আহবান করলেন তখনকার সেই টান, সেই সুরের রেশ, সেই মূৰ্ছনা এখনও আমার হৃদয়ের তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে যেন ঝংকৃত হচ্ছে। সে সুরের স্মৃতি আমাকে আকুল করে তােলে। যেমন আকুল করে তার নিজের স্মৃতি।
এরপর বােধ হয় আরও এক রাত্রি যুদ্ধ হয়েছিল। এবং সেদিনের বিষয়বস্তু ছিল, যতদূর মনে পড়ে, নারী ও পুরুষ’। এই দিনের তর্ক খুবই মনােজ্ঞ ও দীর্ঘ হয়েছিল। দেখলাম এই দিন যােগেশদা’ও খুব দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। দেখলাম অন্যান্য কবিয়ালদের মত কবিয়াল রমেশ শীল গানে অশ্লীলতা খুব কমই প্রয়ােগ করেছেন। তিনি একজন বিপ্লবী মতাবলম্বী বলেই এটা সম্ভব হয়েছে। কবিয়ালদের মধ্যে অশ্লীলতা আসার কারণ বােধ হয় এই যে, মুসলিম রাজত্বের শেষে এবং ইংরেজ রাজত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার মধ্যবর্তী যুগে সমাজে ও রাষ্ট্রে যে অরাজকতা দেখা দিয়েছিল এবং নতুন ইংরেজী শিক্ষা-সংস্কৃতির অভ্যুদয়ে সমাজে উপরের অংশ তা লুফে নিল-ফলে সেই গােলযােগপূর্ণ শূন্যস্থান পূরণ করতে নির্যাতিত শ্রেণীর লােকদের মানসিকতা, ধর্মপ্রিয়তা, ইচ্ছা-আকাঙ্খ আশংকা মীমাংসা সব কিছু প্রতিফলিত হতাে এক ধরনের তরজা, খেউড়, টপ্পা, পৈপ্পা-কবির লড়াই প্রভৃতির মধ্য দিয়ে। কাজেই সে ক্ষেত্রে অশ্লীলতা ছিল একরূপ অপরিহার্য। কিন্তু যেহেতু কবিয়াল কবির লড়াইতে নেমেও উন্নত সমাজ ব্যবস্থার জন্য নির্যাতিত শ্রেণীকে সক্রিয় বিপ্লব টেনে আনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন সেহেতু সেখানে অন্যান্য কবিয়ালদের চেয়ে তার বৈশিষ্ট্য অনেকখানি আলাদা হতে বাধ্য।
একদিন একটি ঘটনা ঘটে যা স্মরণ করতে আজও শরীর শিউরে ওঠে। ঘটনাটি এই: আমি আমার বিছানায় বসে লিখছি। হঠাৎ উপরের ছাদের আস্তর ভেঙে বেশ বড় একটা খন্ড আমাদের উভয়ের মাঝখানে (কবির বেশী নিকটে) গিয়ে পড়ল। আজও ভাবতে খারাপ লাগে-সেদিন ওই বড় ও পুরু ইটভাঙা খন্ডটি যদি কবির মাথায় পড়ত তাহলে অবস্থা কী হতাে! অতখানি উঁচু থেকে পড়ে নিশ্চয়ই যে-কোন অঘটন ঘটতে পারত। আমার মাথায় পড়লেই বা আমার কী অবস্থা হতাে! আমরা সেদিন নিজেদের সৌভাগ্যবান বলে মনে করলাম। অন্যান্য অনেকে এসে কবিয়ালের গুরুতর বিপদাশঙ্কার কথা শুনে জেল কর্তৃপক্ষের উদ্দেশে অনেক অপ্রিয় কথা বললেন। এরপরই একজন জেল কর্তৃপক্ষের লােক ডাকান
১৮৭
হলাে। আমাদের উভয়ের চৌকি ওখান থেকে সরান হলাে। কিন্তু যতদিন ঢাকা ছিলাম, ছাদের ঐ জায়গা আর মেরামত হয়নি। এরপর কবিয়ালকে ঘিরে শুরু হলাে কত কথা। ওয়ার্ডের যত কমরেড, বিশেষ করে পড়াশুনায় ও জানাশুনায় আগ্রহী কমরেডরা তাঁর কাছে ভিড় করতে লাগলেন । কবিয়ালও তার সারা জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতেন তাঁদের কাছে। আমার মনে আছে আমি ঐ কয়েকটা দিন এক রকম খাওয়া-দাওয়া ভুলে গিয়ে কবির কাছে পড়ে থাকতাম। দেখতাম গুন গুন করে তিনি নিত্য নতুন ছড়া তৈরী করছেন। আমি খবরের কাগজ থেকে তাঁকে নিয়মিত খবর শুনাতাম। তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক খবরের উপর মূল্যবান মন্তব্য করতে পারতেন। তিনি শুধু একজন কবিয়ালই ছিলেন না। তিনি ছিলেন বিপ্লবী রাজনীতিতে বিশ্বাসী এবং সক্রিয় অংশগ্রহণকারী। এভাবে কয়েকদিন কেটে যাবার পর একদিন এল এক শুভলগ্ন। কবিয়াল রমেশ শীলের জন্মদিন। এদেশে বৃটিশের দোর্দন্ড প্রতাপের যুগে দাসত্বের কঠিন শৃঙ্খল ভাঙতে যে কবির জন্ম হয়েছিল চট্টলার পাহাড়ের পাদদেশে, যে কবি জন্ম দিয়েছিল। সূর্যসেন-প্রীতিলতার আর কল্পনার, সারা জীবন সাধনার শেষ মুহূর্তেও সে কবি দেখল তার জন্মদিবস হচ্ছে বৃটিশ কারাগারের চেয়েও কঠিন দেয়ালের মধ্যে। তার জন্মের সময় সারা দেশ ছিল কারাগার বিশেষ । আর সেই কারাগার থেকে দেশের মানুষকে মুক্ত করার আজীবন সংগ্রামের পরেও কবি ও আমরা এক তথাকথিত স্বাধীন দেশের প্রত্যক্ষ চার দেয়ালের মধ্যে। পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদের দালালদের মুখে সমাজতন্ত্র, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র যে কত বড় ভাঁওতা, কত বড় পরিহাস তা পাকিস্তান হওয়ার দুই এক বছর যেতে না যেতেই আমাদের কাছে অনেকটা পরিষ্কার হয়ে গেছিল।
যাক আমরা, শ্রদ্ধেয় (সর্দার ভাই) সরদার ফজলুল করিম সহ, সিদ্ধান্ত নিলাম কবির জন্মদিবস পালন করা হবে এই জেলেই। এই লৌহকারার অন্তরাল থেকে বিপ্লবী কবিয়ালের পাশে দাঁড়িয়েই শপথ নিতে হবে-আমাদের শােষণমুক্ত সমাজ গড়ার। শপথ নিতে হবে এক বিপ্লবী ঢেউ দেশের কোণায় কোণায় পৌছে দেবার । এ জন্য সঙ্গে সঙ্গে একটি সাবকমিটি তৈরী হলাে। কথা হলাে কবিকে জন্মদিনের উপহার দিবার জন্য যদি কেউ কিছু তার পি. সি. বা পার্সোনাল ক্যাশ থেকে টাকা উঠিয়ে কিছু কিনতে চায়, তা হলে সে যেন উক্ত কমিটির সঙ্গে যােগাযােগ করে। আর দেখে কে, প্রত্যেকেই তার সাধ্যানুসারে কবির জন্য উপহার সংগ্রহ করতে লাগল। ওদিকে শান্তিনিকেতনের শিল্পী ধীরেন বাবু (ময়মনসিংহের ধীরেন সরকার)-কে বৃহদাকার পটে কবিয়ালের একখানা কুটির অংকনের ভার দেওয়া হলাে। যথাসময় সব প্রস্তুত হয়ে গেল। কবিকে বসান হলাে সভা-মঞ্চে। যেন। অপূর্ব এক জ্যোতিচ্ছটা। পিছনে দাঁড় করানাে ধীরেন বাবুর অংকিত কবিয়ালের পল্লীকুটির। চিত্রপটে বাস্তবকে যে এমনভাবে তুলে ধরা যায়, ঐ চিত্র না দেখলে। তার সম্যক জ্ঞান আমার হতাে না।
১৮৮

ষাট
কবিয়াল রমেশ শীলের গ্রামের বাড়ী দেখিনি। কিন্তু মনে হলাে কবি ঠিকই তার কুঁড়েঘরের দাওয়ায় বসে আছেন। মাঝারি আকৃতির দু’খানা ঘর। রান্নাঘরখানা একটু ছােট। ঠিক গ্রামে যেমন থাকে-রান্নাঘরের সামনে একটু ছায়াচ্ছন্ন আঙ্গিনা। আঙ্গিনার তিনদিকে সুপারী, কলা ও দুই একটি নারিকেল গাছ। অদূরে ছােট পুকুরে হাঁস খেলা করছে । পুকুরপাড়ে লেবু গাছের ঝাড়। ছনের ঘরে চাচের বেড়া। তা আবার কেটে বাঁশের বেড়া দিয়ে বুনে জানালা করা হয়েছে। জানালা আটকানাের জন্য আবার বাঁশের তৈরী ঝাপ-ঘরে বাতাস ঢােকার প্রয়ােজনে তা ছােট কাঠি দিয়ে জাগানাে রয়েছে। যতদূর মনে পড়ে কবির জন্যে ঘরের দাওয়ায় একটা হুঁকাও আঁকা হয়েছিল। মনে হলাে যেন আমরা কবির বাড়ীর সামনেই দন্ডায়মান। তাছাড়া আর একটি প্রতীক এঁকেছিলেন শিল্পী কমরেড । তাহ’ল কবির কুটিরের সামনেই একটি অতি পুরাতন মােটা গাছ। তার মাঝামাঝি এক জায়গায় দুটি বড় কুঠরির মধ্য থেকে দুটি সাদা ও বলিষ্ঠ পায়রা দৃপ্ত ডানা মেলে যেন উড়ে যাবার জন্য উদ্যত । শিল্পী হয়ত দেখাতে চাচ্ছেন-ঘুণেধরা ঐ গাছটি পুঁজিবাদী ও ক্ষয়িষ্ণু সমাজের প্রতীক এবং তারই গহ্বর থেকে বেরিয়ে আসছে শান্তির দূত পায়রা দুটি। তা ছাড়া বৃদ্ধ কবিয়াল যেন বিশ্বে বৈপ্লবিক শান্তি স্থাপনের জন্য ছেড়ে দিচ্ছেন পায়রা দুটি। বলিষ্ঠ পাখা মেলে পায়রা দুটি যেন উড়ে যেতে চায় দেশে দেশে শান্তির শক্তি প্রচার করতে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবী। সঙ্গে সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদী উন্মাদদের তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের পাঁয়তারা, ফ্যাসিস্ট কারাগারে নির্যাতিত, নিগৃহীত রাজবন্দীরা, অশীতিপর বৃদ্ধের শৃঙ্খলিত কারাজীবন-সমস্ত কিছুর পটভূমিকায় সেদিনের। কবিয়ালের কুটির ও পায়রা দুটি যেন শান্তি ও সংগ্রাম, সংগ্রাম ও শান্তির এক ভাস্বর দৃষ্টান্ত হয়ে আমাদের সামনে দেখা দিল। যতদূর জানি, যুদ্ধোন্মত্ত পৃথিবীতে শান্তির প্রতীক হিসেবে পায়রার কল্পনা করেছিলেন বিশ্বের অন্যতম মহাশিল্পী ফরাসী দেশের পাবলাে পিকাসাে। এই মহান শিল্পীর মহৎ ও নির্যাতিত বিশ্বমানবতার জন্য মুক্তিসংগ্রামী জীবন নিয়ে আলােচনা করার অবকাশ এখানে নেই। কিন্তু তার শান্তির প্রতীক পায়রা আজ বিশ্বের শান্তি ও মুক্তিকামী মানুষের অনন্য ঘােষক।
১৮৯
কবির উপহারের সামগ্রী তাঁর চারদিকে স্তুপীকৃত হয়ে আছে। যতদূর মনে পড়ে আমি তাকে একখানা রুমাল দিয়েছিলাম। অনেকেই অনেক জিনিস কিনেছিলেন কবির জন্য। সুটকেশ, ছাতা, বইপত্র, কাপড়, কলম, তােয়ালে, সাবান প্রভৃতি। জেলখানায় প্রত্যেকেরই টাকা পয়সা সীমাবদ্ধ। তা সত্ত্বেও আমরা সবাই বন্দী অবস্থায় কবিকে প্রায় তিন শতাধিক টাকার জিনিস দিতে সমর্থ হই। কবি গভীর আনন্দ, বিনয় ও ভালবাসার সঙ্গে প্রতিটি উপহার গ্রহণ করেছিলেন। সেদিনের অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেছিলেন জনাব সরদার ফজলুল করিম। দর্শন ও সাহিত্যে যথেষ্ট পান্ডিত্যের অধিকারী-আমাদের সর্দার ভাই । কবির কাব্য-ভাবনা নিয়ে অপূর্ব বক্তৃতা করেছিলেন। আরও যেন কে সেদিন কবির জীবনী আলােচনা করছিলেন, তা মনে নেই। আমি নিজে পড়লাম কবির উদ্দেশে স্বরচিত একটি কবিতা। কবিতাটির কয়েকটি লাইন তুলে দিচ্ছিঃ
তােমার সুরে জেগেছে সৃষ্টির আদিম-উদ্যমতা,
আর জেগেছে-বর্তমান সংগ্রামের প্রচন্ডতা।
তােমার শুভ্র কেশে যেন মহা শান্তি,
আর জীর্ণ অস্থিতে যেন দধীচির শক্তি যুদ্ধ,
দাঙ্গা দুর্ভিক্ষের দিনে ।
তােমার অভয়বাণী শুনছি দিকে দিকে
ঐতিহ্যের সিঁড়ি বেয়ে উঠে এসেছ পিতা
মহান জীবন সংগ্রামের প্রতীক-পিতা
তােমায় অভিবাদন করি-পিতা।
তারপর কবি বসে বসে তাঁর সুদীর্ঘ জীবনের অনেক কিছুই আলােচনা করলেন। ১৯০৫ সাল থেকে এদেশ সন্ত্রাসবদী যুগ; অসহযােগ আন্দোলন, খেলাফত আন্দোলন, দেশের বড় বড় কৃষক-শ্রমিক-আন্দোলন, ‘৪২ সনের ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলন- কোনটা থেকেই কবি রমেশ শীল দূরে থাকেননি। কবিয়াল চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের বীর সেনানীদের উদ্দেশে উদ্দীপনাময় গান লিখেছিলেন। তাছাড়া চট্টগ্রামের যে কোন সংগ্রামের উপর আলােকপাত করেছেন তিনি। দেখলাম কবি এমন ভাবে এ সব বর্ণনা করছেন যেন ঘটনাগুলি তিনি তখন চোখের সামনে প্রত্যক্ষ করছেন। তারপর শুরু হলাে সভাপতির ভাষণ । সর্দার ভাই তার। স্বভাবসুলভ সুললিত কন্ঠে এক বিশেষ ভঙ্গিতে উচ্চারণে জোর দিয়ে বক্তৃতা করলেন। বললেন, চারণ কবিরা, কবিয়ালরা, দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বড় সম্পদ। উপস্থিত কবিয়াল তার উজ্জ্বলতম সাক্ষ্য। বললেন, বিপ্লবী আন্দোলনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাপ্রসূত প্রত্যেকটি ছড়া ও গান এ দেশের মানুষকে চিরদিন অনুপ্রাণিত করে রাখবে । অনুপ্রাণিত করবে ভবিষ্যৎ সংগ্রামীদের। এভাবে সেদিন
১৯০
অনুষ্ঠান শেষ হলাে ।
মনে আছে একদিন আমরা বায়না ধরলাম কবিয়াল তাঁর রচিত কতগুলি গান আমাদের শােনাবেন। কবিয়াল শােনালেন তাঁর পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরবর্তী আমলের লেখা ও গাওয়া গানের কয়েকটি। কি তীক্ষ্ম শ্লেষ প্রয়ােগ করতে পারেন তিনি তাঁর গানের মাধ্যমে তা দেখলাম সেদিন। পাকিস্তানের মুসলিম লীগ নেতাদের জনতাকে ভাওতা দেবার প্রত্যেকটি কাজ ও বক্তব্যকে গানের মাধ্যমে। কঠিন বিদ্রুপ করলেন তিনি। কিভাবে বগুড়ার মােহাম্মদ আলী হজ্জে যাবার কয়দিনের জন্য দাড়ি রেখেছিলেন এবং হজ্ব থেকে ফিরে এসে আবার দাড়ি কামিয়েছিলেন তাও বললেন গানের মাধ্যমে। গণপরিষদের বৈঠকে অথবা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের আইনসভার অধিবেশনে তুমুল তর্ক-বিতর্ক এবং পরিষদের আলাে নিভে যাওয়ায় কিভাবে নিজেদের মধ্যে তুমুল হাতাহাতি হয়েছিল, কবি তাদের এই ন্যাক্কারজনক দলাদলিকে কঠোর ও শাণিত শ্লেষ বাক্য প্রয়ােগ করে আমাদের সামনে তুলে ধরলেন। আমরা শুনে স্তম্ভিত হলাম। দেখলাম এদের বিরুদ্ধে বৃদ্ধ কবি তার অন্তরে কী তীব্র ঘৃণার দাবানলই জেলে রেখেছেন আজও।
এছাড়া কবি ভাষা-আন্দোলনে জেগে উঠেছিলেন তাঁর সমস্ত সত্ত্বা নিয়ে। তারই বিখ্যাত গান রমনার মাঠ রক্তে ভাসাইলি” আজও আমাদের প্রত্যেকের মুখে মুখে ।
১৯১

একষট্টি
আজীবন সাধনায় সিদ্ধ কবিয়াল রমেশ শীল আজ আমাদের মধ্যে নেই। আজ তাঁর পরিবারবর্গের স্বাচ্ছন্দ্যের উদ্দেশ্যে কবিয়ালের সমস্ত রচনা ও চিঠিপত্র সংরক্ষণের জন্য আমাদের এগিয়ে আসা উচিত। সুখের কথা, চট্টগ্রামের অনেকে এগিয়ে আসছেন। কিন্তু এ নিয়ে সারা দেশে তেমন কিছু হয়নি।
এই প্রসঙ্গে চাটগাঁয় রমেশ শীলের বাড়ীতে তাঁর সঙ্গে বিখ্যাত কবি সুভাষ মুখােপাধ্যায়ের দেখা হলে তিনি যা বলছিলেন তা তুলে দিলাম। টিকের আগুনে ফু দিতে দিতে গল্প শুরু করলেন রমেশ শীল: “সে কি আজকের কথা? তখন বয়েস হবে বছর বাইশ। গাছ-পালার শিকড় দিয়ে ঘা সারানাের ব্যবসা করতেন বাবা। আমিও শুরু করছিলাম সেই পৈত্রিক ব্যবসা। কিন্তু তাতে মন বসছিল না আমার। লােকের দুঃখ-কষ্ট আর নানান চিন্তা মাথার মধ্যে ভিড় করে আসত।
সেবার জগদ্বাত্রী পূজো। সদরঘাটে কবিগানের আসর হবে খবর পেলাম। গাইবেন চিন্তাহরণ আর মােহনবাশী। দুজনেই সেকালের নামকরা কবি। গিয়ে দেখি আসরের চারপাশে লােকে লােকারণ্য। গান শুরু হয়ে গিয়েছে। একজন দেন। চাপান, একজন কাটান। এক একটা কলি শােনে আর লােকে হৈ হৈ করে ফুর্তিতে, কখনও মাথা ঝকানি দিয়ে, কখনও দাঁড়িয়ে উঠে বাহবা দেয়।
সেই রাত্তিরে গান শুনে কবি হবার শখ আমায় পেয়ে বসল । তারপর দিন নেই, রাত নেই, শুয়ে বসে আমার কেবল এক চিন্তা-কেমন করে ছন্দ আর মিল দিয়ে মনের কথা হাজার হাজার মানুষের কাছে বলা যায়। রাস্তা দিয়ে হাঁটি আর মনে মনে কথার সঙ্গে কথা মেলাই।
-‘মনের সঙ্গে সনে’ ‘ভবের সঙ্গে ‘রবে’ মিলের জন্য সব সময় ছটফট করে মন।
এদেশে তখন সবেমাত্র রেল লাইন বসেছে। গরীব চাষীবাসীর জায়গা জমি কিনে নিতে বিদেশীরা এল । নদীর দুধারে কেঁপে উঠছে বিদেশীদের কারবার । সেই রাগে প্রথম আমি আস্ত গান বানাই। দু-চারজন সেই গান শুনে খুব তারিফ করল।
পরের বছর পূজোর সময় আবার সেই কবিয়ালদের জলসা বসেছে। গান
১৯২
গাইতে গাইতে গােড়াতেই চিন্তাহরণের গলা হঠাৎ ভেঙ্গে গেল। মহা মুশকিল। চিন্তাহরণ না গাইলে আসর মাটি হয়ে যায়। বায়না করা গান পালা পুরাে করতে না পারলে বেচারীদের অনেক টাকা গুণাগার দিতে হবে। কিন্তু চিন্তাহরণের গলা দিয়ে স্বর বেরােচ্ছে না। এখন উপায়?
এমন সময় আসরের এক পাশ থেকে কয়েকজন মুসলমান এসে জোর করে আমাকে টেনে তুলল। বলল, আসর মাটি হয়ে যায় তুমি ওঠো। উঠে দাঁড়াতে গিয়ে দেখি পা ঠক ঠক করে কাঁপছে। সভায় দাঁড়িয়ে কবিগান করতে হবে ভাবলেই বুক শুকিয়ে যায়। তার ওপর শহর-বাজার জায়গা।
মােহনবাঁশী এসে পিঠ চাপড়ে বললেন, মেরে কেটে দাদা রাত দশটা বাজিয়ে দাও, নইলে বায়নার টাকাটা মাঠে মারা যায়।
কী আর করব । যা থাকে বরাতে বলে কপাল ঠুকে উঠে দাঁড়ালাম।
গানের গােড়াতেই মােহনবাশী এমন যা তা বলে গালাগালি দিতে লাগলেন যে, রাগে সর্বাঙ্গ জ্বলে উঠল । কথার তীর দিয়ে মােক্ষম করে বিধলাম মােহনবাশীকে। গায়ের জ্বালায় মুখে যেন আপনা আপনি কথা ফুটে যেতে লাগল । জমে উঠল আসর । আমারও সাহস বেড়ে গেল।
এ দিকে রাত দশটা কাবার হয়ে পরদিন সকাল দশটা বেজে গেল। আসর আর ভাঙ্গতে চায় না। মােহনবাশীকে দুয়াে দিতে লাগল আসরের লােক। -এতটুকু একটা ছেলের কাছে হিমশিম খাচ্ছে মােহনবাশী ।
কিছুতেই কেউ কাউকে হারাতে পারছে না। কিন্তু একটা রফা তাে হােক। কাঁহাতক আসরে বসে থাকা যায়? লােকে চাচাতে লাগল-যােটক দাও, যােটক দাও।
যােকট দিতে জানলে তাে আমি যােটক দেব? মােহনবাঁশীরও রােখ চেপেছে নাবালক ছেলের যােটক সে কিছুতেই দিবে না । লােকে তখন আর উপায় না দেখে নিজেরাই আসর ভেঙ্গে দিয়ে যে যার বাড়ী চলে গেল। যাবার সময় বলে গেল মােহনবাঁশীর হার হয়েছে।
সেই থেকে আমার নাম লােকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল। আস্তে আস্তে বায়না পেতে লাগলাম শুরু করে দিলাম গানের ব্যবসা।”
বলতে বলতে পুরানাে দিনগুলাের মধ্যে যেন রমেশ শীল হারিয়ে যান। জ্বলজ্বলে দুটো চোখ কোনদিকে তাকিয়ে আছে ঠিক বােঝা যায় না।
আমাদের দিকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে হুঁকোয় টান দিতে দিতে রমেশ শীল আবার শুরু করেন তাঁর জীবনকথা ।
১৯৩
এ-গাঁয়ে সে-গাঁয়ে গান গেয়ে কাটল কয়েক বছর। একদিন তিনি শুনলেন মাইঝভান্ডারের পীরের কথা। অবাক কান্ড । সেখানে নাকি গান দিয়ে সব উপাসনা হয়। চাটগাঁর নিজস্ব ভাষায় নিজস্ব সুরে গান হয় সেখানে। পূর্ব বাংলার লক্ষ লক্ষ ধর্মপ্রাণ মুসলমান বছরের একটা সময় সেখানে এসে জড়াে হয়। পীরকে দেখে মজে গেলেন রমেশ শীল। একটানা সাত বছর তিনি সেখানে গান গেয়ে কাটালেন।
আরও অনেক নামকরা কবিয়াল মাইজভাণ্ডারে গান গেয়েছেন, কিন্তু রমেশ শীলের মত এত জনপ্রিয়তা আর কেউ পাননি। হাজার হাজার লােক তার গান শুনে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে ; মুর্খা গেছে। এখানে গান গাইবার জন্যে পুরাণ আর কোরানের অনেক কিছু পড়তে শুনতে হয়েছিল তাকে। সাধারণ মানুষের সুখ দুঃখ, আশা আকাঙ্খকে তিনি ফুটিয়ে তুলেছিলেন ধর্মের জবানিতে। তাই পূর্ব বাংলার সমস্ত মুসলমানের কাছে রমেশ শীলের আর এক নাম ‘মাইঝভান্ডারের মাঝি’ ।
কিন্তু মাইজভাণ্ডারে মন টিকল না রমেশ শীলের। গাঁয়ের দুঃখী মানুষগুলাে যে তাঁকে ডাকছে।
সমাজে নানা রকমের অন্যায় আর অবিচার চলেছে। লােকের মধ্যে রয়েছে। নানা কুসংস্কার। তার বিরুদ্ধে একা মাথা তুলে দাঁড়ালেন রমেশ শীল । অন্ধ মানুষগুলাে তার গান শুনে চোখে দৃষ্টি ফিরে পেল।
স্বদেশী আন্দোলনের ঢেউ গায়ে এসে যখন লাগল, তখন মেতে উঠলেন গ্রাম্য কবি রমেশ শীল। ক্ষুদিরামের ফাঁসি, পটুয়াখালির সত্যাগ্রহ, এই সব নিয়ে তাঁর বাঁধা গান লােকের মুখে মুখে ফিরতে লাগল ।
প্রথম মহাযুদ্ধের সময় লােকের দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে তিনি গান বাঁধলেন। এখনও তার একটা কলি তার মনে আছে ।
‘পাঁচ গজ ধুতি সাত টাকা দেহ ঢাকা হয়েছে কঠিন, রমেশ কয় আঁধারে মরি পাইনা কেরােসিন।
তারপর সারা চাটগাঁ জুড়ে জ্বলে উঠল বন্দুক আর পিস্তলের আগুন। পুলিশের অত্যাচারে পুরাে দু’বছর কবিগানের আসর বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু তাতে গান থামেনি। সূর্য সেন আর কল্পনা দত্ত, পাহাড়তলী আর জালালাবাদ নিয়ে তৈরী হয়েছে গান আর সে গান পুলিশের চোখ এড়িয়ে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ছড়িয়ে পড়েছে।
১৯৪

বাষট্টি
তারপর জোয়ার যখন নেমে গেল তখন দেখা গেল চারদিকে পাঁক জেগে উঠেছে। কবিগান আবার শুরু হলাে বটে, কিন্তু সে গানের মধ্যে শুধু কুরুচি আর কথার কচকচি ।
রমেশ শীল তখন জেলার বাইশজন কবিয়ালকে নিয়ে একটা দল গড়ে তুললেন। সবাইকে একসঙ্গে করে তিনি প্রতিজ্ঞা নেওয়ালেন যে, কুরুচিপূর্ণ গান কেউ গাইবেন না-যদি কেউ গায় তাকে একঘরে করা হবে। হাতে হাতে তার ফল ফললাে।
এরপর এল যুদ্ধ। ছারখার হতে লাগল চাটগা। কবিয়ালরা মহা ফাপলে পড়ল। পুরনাে গান আর লােকের মনে ধরছে না।
হুঁকোটা দেয়ালে হেলান দিয়ে এক মুখ হাসি নিয়ে রমেশ শীল বললেন:
“মুন্সিরহাটে হঠাৎ একটি চেনা ছেলের সঙ্গে দেখা। হাতে তার একটা কাগজ। তার ওপর লেখা ‘জনযুদ্ধ। ছেলেটি বলল, নিয়ে যান, পড়ে দেখবেন। বাড়ীতে নিয়ে গিয়ে আগাগােড়া পড়লাম। দেশের কথা ঠিক এভাবে জানবার কখনও সুযােগ হয়নি। নতুনভাবে গান লিখতে মনে খুব উৎসাহ পেলাম। অনেক দিন ধরে ভেতরে ভেতরে কেমন যেন হাঁচড় পাচাড় চলছিল। এতদিনে একটা রাস্তা পেয়ে গেলাম। ঠিক করলাম সারা চাটগাঁয়ে এবার গান দিয়ে মানুষ জাগাব। তারপর গায়ে গায়ে নতুন গান নিয়ে গিয়েছি। লােকেও যেন ঠিক এমনি গানের জন্যই এত দিন ওত পেতে বসে ছিল। আমাদের গান তারা লুফে নিল।
বলতে বলতে উঠে বসেন রমেশ শীল । কুঁচকে যাওয়া চোখে-মুখে তাঁর জোয়ান বয়সের উদ্দীপনা।
১৯৫

তেষট্টি
খুব সম্ভব আমাদের মুক্তির মাত্র কয়েকমাস পূর্বে জেলজীবনের শেষ দিকে আমরা মুনীর চৌধুরীর ‘কবর’ নাটক মঞ্চস্থ করি। ভাষা আন্দোলনে শহীদদের কেন্দ্র করে ‘কবর’ নাটক এ দেশের ফ্যাসিস্টদের নিষ্ঠুরতম হত্যাকান্ডের চিত্র তুলে ধরেছে। একাত্তরের শেষের দিকে বর্বর পাক-হানাদার বাহিনীর বুদ্ধিজীবী হত্যার শিকার হন তিনি।
এক সময়কার ছাত্রনেতা মুনীর চৌধুরী শেষের দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন। সারা জীবন তিনি প্রগতিশীল ধ্যান ধারণাই পােষণ করে আসছিলেন। ইংরেজী, বাংলা উভয় ভাষায়ই তিনি অসামান্য দক্ষতা অর্জন। করেছিলেন। তাঁর ‘কবর’ নাটকে সেক্সপীয়ারের প্রভাব রয়েছে। মনে আছে আমরা মেঝেয় তিনটি কবর তৈরী করলাম। এবং তিনটিকেই লাল সালু দিয়ে ঢেকে দিলাম। বরকত, সালাম, রফিকের কবর। শহীদের রক্তে ছােপানাে সে কবর । রাত্রে কৃত্রিমভাবে আলাে ফেলে গােরস্থানকে আরও ভয়ার্ত ও রহস্যপূর্ণ করে তুললাম। তারপর পর্দার আড়াল থেকে কে যেন ডাক দিল- কী লাশগুলি, তােমরা কবরস্থ হয়েছে। তখন সেই রহস্যময় আঁধার অন্ধকারে কবর থেকে উঠে এসে ওদের একজন বলল, না আমরা কবরস্থ হবাে না। সেই মুহূর্তে পাশ দিয়ে একদল শ্লোগান দিয়ে যেতে যেতে বলল, রাষ্ট্র বাষা বাংলা চাই’, ‘শহীদ স্মৃতি অমর হােক, অমর হােক।’ তখন কবর ভেদ করে আর একজনের মাথা উঠে আসল। রক্তাক্ত সে মাথা । বিভীষিকাময় সে ছবি। এক হাত নেই, বলছে, ‘কৈ এখনও তাে বাংলা রাষ্ট্রভাষার পূর্ণ মর্যাদা পেল না’? তখন প্রথম জন ডেকে বলছে, কে তুই, বরকত…? ততক্ষণে গােরস্থানের মালিক চেচাচ্ছে-‘তােমরা কবরে যাও, না হলে আমাদের কারাে চাকরি থাকবে না। তখন ওরা বলছে, না আমরা গােরে যাব না । আবার গুলীর শব্দ, আবার শ্লোগান-ইত্যাদি। খুব অল্প সাজ-সরঞ্জাম হলেও বিষয়বস্তুর গাম্ভীর্যে, নাটকে অংশগ্রহণকারীদের আন্তরিকতায় সমাধিক্ষেত্র-তুল্য জেলখানার পরিবেশে সেদিনের কবর নাটক আমাদের মনে গভীর রেখাপাত করতে সমর্থ হয়।
এছাড়া আমরা একদিন জেলে অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীকে ধরলাম । আমাদের সেক্সপীয়ারের মূলগ্রন্থ থেকে কিছু পড়ে শােনাতে হবে । রাজি হলেন তিনি । আমরা
১৯৬
প্রায় শতাধিক কমরেড বসে গেলাম তাকে ঘিরে। মনে আছে পর পর কয়েকদিন তিনি সেক্সপীয়ার থেকে পড়লেন। যথাক্রমে ম্যাকবেথ, ওথেলাে, হ্যামলেট এবং কিং লিয়ার । মনে হলাে যেন একজন ইংরেজ নাগরিকের কাছ থেকে পড়া শুনছি। যারা সেক্সপীয়ারের ইংরেজী পড়েছেন তারা বুঝবেন ক্ল্যাসিকাল, প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ইংরেজী ভাষার উপর কতখানি দখল থাকলে ওভাবে সেক্সপীয়ারের নাটক পড়া সম্ভব।
যা হােক সংস্কৃতি বলতে আমরা জীবনের এক সামগ্রিক রূপই বুঝি । সে হিসেবে জেলেও আমরা একজন কয়েদীর সঙ্গে ব্যবহার করা থেকে একটি ফুল গাছে জল দেওয়া, পড়াশুনা করা ও স্বাস্থ্যরক্ষা সবটার ভিতর দিয়েই আমাদের সাংস্কৃতিক জীবনের বিকাশ সাধন করি।
জেলে নারায়ণগঞ্জের মােস্তফা মারওয়ার ছিল বুলবুল ললিতকলা একাডেমীর ছাত্র। সে ভাল নৃত্য করতে জানত। সে কয়েকবারই রবীন্দ্রনাথের কবিতার নৃত্যরূপ দিয়ে আমাদের নাচ দেখিয়েছে। মনে আছে এই নৃত্য দেখানাের জন্য সে কবির বর্ষা ও বসন্তের কবিতাগুলি বেছে নিত।
এই প্রসঙ্গে আর একটা কথা বলা দরকার তা হলাে চিঠিপত্র সম্পর্কে। এটা ছিল বাইরের সঙ্গে আমাদের যােগাযােগের একটা অন্যতম মাধ্যম। যদিও চিঠিপত্র সব সময়ই এবং কোন কোন বিশেষ সময় কড়া সেন্সর বা চেক-আপের পর ভিতরে আসত বা ভিতর থেকে বাইরে পাঠানাে হতাে, তা হলেও এটা আমাদের সুদীর্ঘ জেল জীবনকে সহনীয়, সংগ্রামী ও বিপ্লবী করে রাখতে সাহায্য করেছে।
পৃথিবীর ইতিহাসে বহু বিপ্লবীদের জেল থেকে লেখা চিঠিপত্র সারা দেশের সংগ্রামীদের চিরদিন অনুপ্রেরণা যােগাবে। এই প্রসঙ্গে জুলিয়াস ফুচিক, রােজেনবার্গ দম্পতির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। আমাদের বহু কমরেড জেল থেকে বাইরে চিঠি দিতেন এবং অনেকে নিয়মিত বাহির থেকে চিঠি পেতেন। আগেই বলেছি যে, যশােরের পরিতােষ দাশগুপ্তসহ আরও অনেকের চিঠিতে এমন ভাষা, আবেগ, সংকল্প ও মানসিকতার ছাপ থাকত যা আমরা পড়ে আনন্দ। পেতাম। আমাদের কমরেডদের অনেকের পরিবারবর্গ পার্টির প্রতি অনুগত ছিল এবং অনেকের স্ত্রী, ভগ্নি, কন্যারাও পার্টির সমর্থক ছিলেন। ফলে তাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত চিঠিগুলি ছিল একদিকে রাজনীতিক তথ্যসমৃদ্ধ, অন্যদিকে ব্যক্তিগত হলেও তা ছিল সংশ্লিষ্ট কমরেডদের জেল-জীবনের পক্ষে পরম সহায়ক। আমাদের জেল-জীবনের সাংস্কৃতিক মান উন্নত করতে এ চিঠিগুলির অবদান ছিল অনন্য।
১৯৭

চৌষট্টি
এ ছাড়াও জেলে আমাদের সাংস্কৃতিক কার্যকলাপের আর একটি দিকের কথা উল্লেখ করি। তা হলাে- অনেক সময় আমাদের মধ্যে কিছু কিছু কমরেড তাঁদের ইচ্ছানুযায়ী আরও দু’চার জন কমরেডকে ডেকে গােল টেবিলে বসাতেন এবং এটা হতাে একটা চা-চক্রের অনুষ্ঠানের মতাে। সেখানে তারা পূর্ব পরিকল্পনানুযায়ী কোন একটা বিষয়ের অবতারণা করতেন এবং তা নিয়ে কমরেডদের মধ্যে মনােজ্ঞ আলাপ-আলােচনা হতাে। যেমন বাইরে থেকে জেলে পাওয়া কয়েকখানা চিঠি নিয়ে আলােচনা; সংশ্লিষ্ট কমরেডের কোন কবিতা বা প্রবন্ধ নিয়ে আলােচনা। এই সব চা চক্রে কমরেডরা কিচেন ম্যানেজারের সঙ্গে আলাপ করে বা নিজের ক্যাশ খরচ করে কিছু খাবারও যােগাড় করতেন। একদিনের কথা মনে পড়ে-আমরা কয়েকজন কমরেড ফণী চক্রবর্তী (ফণীদা) কর্তৃক আহূত হয়ে সেখানে গেলাম। (এটা অক্টোবর বিপ্লব দিবস উপলক্ষেও হতে পারে)। খুব সম্ভব ঐ বৈঠকে কমরেড চুনী চক্রবর্তী (চুনীদা) ও ছিলেন। বৈঠকে আরও কি কি আলােচনার পর ফণীদা পড়লেন কমরেড স্ট্যালিনের উপর লেখা একটা কবিতা। কবিতাটির নাম Mirror of My Life Size। একটি ইংরেজী কবিতা। সুদীর্ঘ এই কবিতাটি ছিল একটি মূল্যবান কবিতা। এখানে বলা হয়েছে স্ট্যালিন ছিলেন একটি সূর্যের মত। সূর্য অস্ত গেলেও যেমন আমরা তার উদয়ের জন্য অপেক্ষা করি, ঠিক স্ট্যালিনও মরেননি, অক্ষয় সূর্যের মত তিনিও আমাদের মধ্যে আলাে বিকিরণ করবেন চিরদিন। মনে পড়ে ঐ বৈঠকেই একটি কবিতা পাঠ করেছিলেন কমরেড চুনী চক্রবর্তী। তিনি লিখেছিলেন: জনতা ও বিপ্লবীরা একটা আপেলের মত। তার অর্ধাংশ জনতা। অপর অর্ধাংশ বিপ্লব। অর্থাৎ বিপ্লবীদের থেকে জনতাকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না।
আজ আমরা আমাদের অনেক দাদাদের দেখি-দু’চার কথায় নিজেদের আত্মকেন্দ্রিক পুরানাে কাসুন্দি পরিবেশন করে পাবলিশারদের কাছে বেচে দেন। তাঁরা বড় টাইপ দিয়ে ছাপিয়ে বইয়ের আকারে বড় করে সুদৃশ্য পুরু মলাটে মুড়ে তার দাম আট টাকা দশ টাকায় চড়িয়ে দিয়ে বিপ্লবের নামে ব্যবসা জমিয়ে তােলেন। সেদিন কিন্তু এমনি এই চুনীদা, ফণীদার মত সবাইকে নিয়ে বসে, সাধারণ কমরেডদের সঙ্গে মিশে, এক সহজ সরল সচ্ছল ও আনন্দঘন পরিবেশ সৃষ্টি করে দু’কথা লিখতে বা পড়তে শুনিনি। বরং তাদের দেখেছি সাধারণ কমরেডদের থেকে বিচ্ছিন্ন এক স্বেচ্ছাসৃষ্ট অনতিক্রম্য পরিবেশে মুষ্টিমেয় হাহুজরদের নিয়ে এক কষ্টকল্পিত তত্ত্বের অবতারণা করতে । কমরেড চুনী চক্রবর্তী
১৯৮
মারা গেছেন। পুরু ওষ্ঠদ্বয়, মাংসল নাক-মুখ, গােল গােল রক্তচোখ, খোঁচা খোঁচা দাড়িতে কুষ্টিয়ার কমরেডকে দেখতে অনেকটা মার্জিত নিগ্রো নেতাদের ন্যায় । চুনীদা ছিলেন গ্যাস্ট্রিক রােগী। মনে হতাে তাঁর শরীরের সমস্ত কষ্ট যেন মুখমন্ডলে চেপে তাকে ভারী করে তুলেছে। কথার মধ্যে গাম্ভীর্য ছিল। কোন কোন সময় হাসলেও শরীরের কষ্ট বা অন্য যে-কোন কারণেই হােক হাসিতে বিষণ্ণতা লেগে থাকত। চুনীদার বিষন্ন হাসি ও ঈষৎ রক্ষাভ চোখের দৃষ্টি আজও যেন আমার স্মৃতির মণিকোঠায় উজ্জ্বল হয়ে আছে। তা ছাড়া আমাদের সাংস্কৃতিক কমিটি কর্তৃক আয়ােজিত কমিকানুষ্ঠানে ঢাকার কমরেড সুকুমার চক্রবর্তী অনেক ভালাে ভালাে কমিক শুনাতেন। তিনি এর মধ্যে ঢাকার আদি বাসিন্দাদের মধ্যে প্রচলিত কমিকই বলতেন বেশী। অবশ্য সব কমিকেই কিছু কিছু অশ্লীলতা থাকে-তবে সুকুমারদা সেগুলি যথাসম্ভব মার্জিত করে বলতেন। দুই একটি কমিক মনে আছে। জনৈক ভদ্রলােক বাজারে টুপি কিনতে গিয়ে একটি টুপির দর জিজ্ঞেস করায় দোকানদার বললেন, দু’টাকা। ভদ্রলােক তখন বললেন, আট আনায় দিবার পার? তখন দোকানদার একটু রেগে বলল, আরে সাব তা হলে টুপী কিনবার আইছেন ক্যান। কুমারপট্টি গিয়ে একটা সরা কিন্বার পারেন না? মাথায়ও দিবার পারবেন মাছও লইবার পারবেন। আর এক ভদ্রলােক বাজারে ডিম কিনতে গিয়ে দেখে, ডিমের হালি বারাে আনা। (মনে রাখবেন এ আজ থেকে বিশ বাইশ বছর আগেকার কথা বলছি। তখন বারাে আনা ডিমের হালি) লােকটি দেখলেন বাজারে বেশী ডিমও নাই। ভদ্রলােক ডিম বিক্রেতাকে জিজ্ঞেস করলেন, কওতাে এত দাম হইল ক্যান ডিমের! তখন বিক্রেতা বলল-আরে সাব আর কইবেন না-না বেঁচে যাই কোথায়, বাজারে ডিম দেখেন-কটা ডিম উঠেছে-বলবেন না সাব আজকাল হাঁসের ভি চরিত্র ভাল অইয়া গেছে। এ সমস্ত কমিকে আমরা হাসতে হাসতে ফেটে পড়তাম। তা ছাড়া সুশিক্ষিত সুকুমার দা ‘৪৩ সনের দুর্ভিক্ষ ও পরবর্তী অবস্থা বলতে গিয়ে। একটা নিদারুণ সত্য আমাদের সামনে তুলে ধরছিলেন। তিনি কোন এক আলােচনা প্রসঙ্গে বলছিলেন, জনৈক শিক্ষক ক্লাসে তৎকালীন ব্লক মার্কেট, মজুতদারী ও চোরাকারবারীদের দুর্নীতি সম্বন্ধে ক্লাসে বক্তৃতা করে স্কুল শেষে বাসায় কোন কোন ছেলেকে ডেকে বলতেন: দ্যাখ, ও তাে ক্লাসে বলতে হয় বলেছি। তবে বুঝইত শিক্ষকদের বর্তমান অবস্থা। কিছু চিনি আটা কনট্রোলে পেয়েছি । একটু বেশী দর পেলেই বেঁচে দিব। তােরা খরিদ্দার পাস কিনা দেখিস। আর তােরা কেউ নিলেও নিতে পারিস, দর একটু বেশী দিবি। সুকুমারদা অত্যন্ত মাইডিয়ার ধরনের লােক ছিলেন।
এ ছাড়া জেলে আমরা হাতে-লেখা ম্যাগাজিনও বের করতাম।
১৯৯

পঁয়ষট্টি
জেলে অন্যান্য আমােদ-প্রমােদ
জেলখানা এমনই এক অস্বাভাবিক পরিবেশ যে, বাইরের যে-কোন লােককে তা সম্যক উপলব্ধি করানাে যাবে না। এখানে প্রতি মুহূর্তে জীবনের অনিশ্চয়তা, রােগাশঙ্কা, খাদ্যাল্পতা, খাদ্যের একঘেঁয়েমী রূপ ও স্নানের জলের অপ্রতুলতা, মােট কথা জীবনের বহুবিধ প্রয়ােজনীয়তা থেকে একরূপ বঞ্চিত অবস্থায় বন্দীদের অবস্থা যে কতদূর অসহনীয় হয়ে দাঁড়ায়, তা কল্পনা করতেও শরীর শিউরে ওঠে। একজন বন্দীর সবচেয়ে মানসিক উদ্বেগের কারণ হলাে তার মুক্তির অনিশ্চয়তা। সাজাপ্রাপ্ত কয়েদীরা তবু ভাবতে পারে যে, এত বছর পরে তার নিশ্চিত মুক্তি। কিন্তু একজন বিনা বিচারে অনির্দিষ্ট কালের জন্য আটক রাজবন্দীর পক্ষে ব্যাপারটা খুবই ভয়াবহ ও উদ্বেগজনক। অবশ্য একমাত্র আদর্শ এই সমস্ত বিপ্লবী বন্দীদের অসুবিধা অগ্রাহ্য করতে সাহায্য করে। কিন্তু তারও একটা সীমা আছে। বাইরে যখন চরম প্রতিক্রিয়াশীল সরকারের প্রভাব অক্ষুন্ন এবং বিপ্লবী ও বামপন্থী। আন্দোলন একরূপ অনুপস্থিত থাকে, তখন স্বভাবতই জেলের মধ্যে রাজবন্দীদের। মনের উপর তার প্রতিক্রিয়া অন্যরূপ হতে বাধ্য। বিশেষ করে জেলে যখন অল্পবয়স্ক অনভিজ্ঞ কিশাের ও বাচ্চা কমরেডরা থাকে। আলােচ্য সময় ঢাকা, রাজশাহী, বরিশাল জেলে এরূপ অসংখ্য কিশাের কমরেডদের ধরে নিয়ে আসা হয়েছিল। তাই এদের জন্য দীর্ঘকাল জেলে থাকার মত পরিবেশ গড়ে তােলা একান্ত অপরিহার্য ছিল। বলা বাহুল্য ঐ সমস্ত কিশাের ও যুবক কমরেডদেরও বিনাবিচারে নিরাপত্তা বন্দী হিসাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য জেলে আটকে রাখা হতাে। এদিকে দীর্ঘ দিন জেল খেটে খেটে যারা জেল ঘুঘু হয়েছেন, তারা স্বকল্পিত তত্ত্বের খােলসে থেকে বা জেলে চিরাচরিত নিয়মানুযায়ী তাঁদের আসরে বসে দিন কাটিয়ে দিতে পারেন অথবা রবীন্দ্রনাথের সেই বিধবা মেয়ে দ্বারা লুচি মাংস রান্না করানাের মত পিতৃসুলভ আচরণে অভ্যস্ত দাদারা বাচ্চা কমরেডদের জন্য নিষিদ্ধ হলেও নিজেরা অনেক কিছুই করে জেলে আরামে থাকতে পারেন। কিন্তু তাতে সাধারণ ও বাচ্চা কমরেডদের অবস্থা হয়ে উঠে অসহনীয়। তাই তাদের জন্য জেলে খেলাধুলা এবং অন্যান্য বিভিন্ন রকমের আমােদ-প্রমােদের প্রয়ােজনীয়তা দেখা দিল। অবশ্য এই সমস্ত আমােদ-প্রমােদে উল্লিখিত দাদাদের টেনে নামাতে বা তাদের জড়িয়ে ফেলতে চেষ্টা করত ছেলেরা। এর দুটো উদ্দেশ্য ছিল। একটা
২০০
হলাে এর দ্বারা বুড়ােদের বাচ্চাদের থেকে বিচ্ছিন্নতা কাটিয়ে ওঠানাে। দ্বিতীয়ত, এদের ঘিরে একটু কৌতুক ও আনন্দ করা। এগুলি ছিল এরূপ- দেখা গেল একদিন ঘুমন্ত অবস্থায় কয়েকটি যুবক কমরেড নলিনীদা, বা ঐ ধরনের একজন। বুড়াে কমরেডকে তার খাটসহ ধরে এমন এক জায়গায় রেখে দিল যে, পরে ভাের হওয়ার সাথে সাথেই তারা ওয়ার্ডময় চিৎকার শুরু করে দিল-নলিনীদা’কে পাওয়া। যাচ্ছে না এমন কি তার চৌকিও জেল কর্তৃপক্ষ হয়ত রাতে সরিয়ে ফেলেছে। খুব হৈ চৈ, খোঁজাখুঁজি পড়ে গেল। এ খবরে সবাই অতিমাত্রায় বিস্মিত হয়ে ছুটে আসত। কী হতে পারে সবাই ভীষণ উদ্বিগ্ন, একদল ছেলে ছুটল জেল সুপারকে খবর দিতে নীচের তলায় (সবই লােক দেখানাে)। চক্রান্ত করে ততক্ষণে সারা ওয়ার্ডটি তন্ন তন্ন করে খুঁজতে বেরিয়েছে-হঠাৎ কয়েকজন কমরেড চিৎকার করে উঠল-“পেয়েছি পেয়েছি।” কমরেডও চিৎকার শুনে হঠাৎ জেগে দেখতেন তিনি। শুয়ে আছেন উপরে কোন একটি নির্জন সরু জায়গায়, হয়ত ল্যাট্রিন বা সিঁড়ির গােড়ার কোনখানে। তিনি উঠেই কিছু চিন্তা করার আগেই ছেলেরা বলতে শুরু করত আপনি কিসের জন্য এরূপ স্বেচ্ছা নির্বাসন গ্রহণ করেছেন? আমাদের উপর কি রাগ করেছেন? না আপনি নিজে বৈরাগ্য অবলম্বনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এরপর তাকে খাটসহ আবার স্বস্থানে নিয়ে যাওয়া হলাে। এটা যে নিতান্ত আমােদপ্রমােদের জন্যই করা হয়েছে, তা বুঝতে অবশ্য কারাে বাকি থাকে নাই । যে সমস্ত কমরেড সকালে ৯টা দশটা পর্যন্ত ঘুমাতেন, তাদের নিয়ে এরূপ কৌতুক করা হতাে।
আবার একদিন দেখা গেল অমুক কমরেড সারা ওয়ার্ডের কোথাও নেই। তাকে প্রয়ােজন বলে একটা কথা উঠিয়ে শুরু হলাে খোঁজাখুঁজি। সারা ওয়ার্ডময়, পায়খানা পর্যন্ত। সিপাহীর কাছে খোজ নিয়ে জানা গেল সে অফিসেও যায়নি। অনেক কমরেডই ব্যাপারটায় হতভম্ব হয়ে যেত। সাধারণ ভাবে নীচে-বাইরের মাঠে, ফুলের বাগানে, কোথাও খুঁজে পাওয়া গেলনা। সবাই চিন্তিত হৈ-চৈ। এমন সময় হয়ত অনিমেষ, নয় বাচ্চু-রাখাল বিনয় বা লাল বাহাদুর চেঁচিয়ে উঠল-আরে! বটুকদা এখানে হয়ত সন্ন্যাস রােগে আক্রান্ত হয়ে স্নানের মুড়িতে পড়ে মরে রয়েছে। চিৎকার দিয়ে তারা কেঁদে উঠল । সবাই যখন এসে উপস্থিত, তখন হয়ত। বটুকদা কম্বলের নীচ থেকে উঠে এসে সবাইকে হাসিয়ে দিত। যারা রসিকতা সহ্য করতে অভ্যস্ত তারাই অংশগ্রহণ করত এসব কৌতুকে। বলা বাহুল্য পূর্ব পরিকল্পনানুয়ী সংশ্লিষ্ট আমুদে কমরেডটি কম্বল গায়ে মুড়ির মধ্যে পড়েছিল।
আমাদের ওয়ার্ডে নির্দিষ্ট একটা দিনে চিঠি আসে। ঐ চিঠিগুলি নির্দিষ্ট কোন কমরেড এনে সবাইকে বিলি করে দিত। জেলে চিঠি পাওয়া যেন চাতকের কাছে। বৃষ্টির জল । সবাই অধীর আগ্রহে চিঠি পাওয়ার ঐ নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অপেক্ষা
২০১
করত । এমন সময় দেখা গেল রাখাল বা বাচ্চু এই চিঠি নিন চিঠি নিন বলে নিজেই চিঠি দিয়ে দিল সবাইকে। কোন দল তাস খেলছে। দুজনে কোথাও ক্যারম খেলছে। হয়ত কোথাও পাঁচ-ছয় জন মিলে গুরুত্বপূর্ণ আলােচনায় বসছে সেখানে। চিঠি দিয়ে এল। সাধারণত এ রকম কাউকে চিঠি দেওয়া হতাে না- কেউ হয়ত শুয়ে রয়েছে-আধঘুমে তার বালিশের নীচে চিঠি রেখে বলে আসা হলাে চিঠি রেখে দিলাম। কেউ হয়ত পায়খানায় যাচ্ছে তাকে বলা হলাে এই চিঠি আপনার সিটে রেখে আসি। পনর মিনিট, আধ ঘণ্টার মধ্যে সারা ওয়ার্ডে একটি মৃদু গুঞ্জন শােনা গেল, এ ওর মুখের দিক তাকাচ্ছে। কেউ হাসিতে ফেটে পড়ছে, কেউ লজ্জা পাচ্ছে, কেউ একটু বিরক্তও হচ্ছে। ব্যাপারটা হলাে: খাম খুলে বা পােষ্টকার্ড-এর চিঠি পড়তে গিয়ে তারা দেখল তাদের হাতে দেওয়া হয়েছে পুরানাে ২/৩ মাস আগের চিঠি। এমনও দেখা গেছে কেউ তা ধরতে পেরেছে সমগ্র চিঠিখানা পড়ে। ছেলেরা ইতিমধ্যেই কৌশলে অনেকের কাছ থেকে তাদের চিঠি নিয়ে গেছে। অবশ্য ঐ দিন চিঠি আসার তারিখও ছিল। এবং কিছু নতুন চিঠির সঙ্গে পুরানাে চিঠি মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল ।
২০২

ছেষট্টি
আর এক ধরনের ব্যাপার আমাদের কাছে খুবই উপভােগ্য হয়েছিল। মনে। আছে একদিন আমরা রাজশাহী জেলের ১৪নং সেলে কয়েকজন আলাপ করছি এমন সময় একজন সিপাহী এসে অমূল্যদাকে একটি স্লিপ দিল-আপনার ট্রান্সফার বেলা ১১টায় । সিপাহীর হাতে একটি স্লিপ। অমনি বংকিম চ্যাটার্জি উঠে এসে তার হাত থেকে স্লিপটি নিয়ে গম্ভীর ভঙ্গীতে বলে উঠল-অমূল্যদা পাবনা ট্রান্সফার । এগারটায় গাড়ী, এখনই তৈরী হতে হবে। দেখলাম অমূল্যদার মুখে চাপা হাসি। সংবাদ দ্রুত ওয়ার্ডে ছড়িয়ে গেল, দৌড়ে এল যশােরের পরিতােষ, জড়িয়ে ধরল অমূল্যদাকে । যেতে দেব না আপনাকে অমূল্যদা। কি বলিস-নিজ জেলায় ট্রান্সফার সেত ভাল কথা। তবে অমূল্যদা আমাদের ছেড়ে যাবেন বই আর কি। যখন তখন আবদার করে আমাদের চা খাওয়া ইতি-বলে উঠল দিনাজপুরের কমরেড ভুজেন পালিত-ছােট্ট গোঁফের মধ্য থেকে একটু মুচকি হেসে। কথায় কথায় আনন্দের ফোয়ারা ছুটিয়ে দেয় আর কি!
কমরেড হিসেবে ভুজেন পালিতকে ভুলতে পারব না কোনদিন। এরা যেন হাসতে হাসতে মৃত্যুর সঙ্গে খেলা করতে পারে। গুলী খাওয়া-টাওয়া, লড়াই করা, মরে যাওয়া যেন খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। যাই হােক চোখ দুটি বড় করে, চশমাটা খুলে হাতে নিয়ে ছুটে এলেন মনসুর ভাই। কি বলাে মৈত্র। রাজশাহীর কমরেড সিতাংশু মৈত্র । হঠাৎ এখন অমূল্যদার পাবনা ট্রান্সফার! ব্যাপারটার রাজনৈতিক গুরুত্ব ভেবে দেখা দরকার। বলাে দেখি বংকিম কি হতে পারে? ওদিকে সিপাহীর তাড়া। এ দিকে প্রিয়ব্রত দা (সিলেটের), কালিদা বিছানা বেডিং বেঁধে ফেলেছে। কমরেড বাবর আলি কেবল হাত কচলাচ্ছে। অমূল্যদা পাবনা জেলে যাচ্ছেন। যদি দেশের কোন খবর দিতে পারেন। বললাম বাবর ভাই বলে দিন না অমূল্যদাকে যা বলার। পাশের কোঠায় ইতিমধ্যে অমূল্যদাকে ধরে নেওয়া হয়েছে ফেয়ারওয়েল মিটিং-এ। মালাও দেওয়া হয়েছে। বক্তৃতার পর বক্তৃতা। কেউ বলল ট্রান্সফার বিপ্লবীদের পক্ষে এ এক জেল থেকে অন্য জেলে যাওয়া নয়, বরং এক রণাঙ্গন। থেকে অন্য রণাঙ্গনে যাওয়া। কমরেড সদানন্দ বলল, যান অমূল্যদা, হয়ত একক্ষণে দেখা হবে সংগ্রামের মাঝে । আর না হলেই বা কি আমরা যার যার ফ্রন্টে লড়ে যাব। ইতিমধ্যে অর্ডার দেওয়া হয়েছে অমূল্যদার যাওয়া উপলক্ষে একটু চা হবে। দাঁড়ালেন অমূল্যদা, সে কি আবেগময় কণ্ঠ! কমরেড আপনাদের ছেড়ে
২০৩
যেতে ইচ্ছে হয় না, কিন্তু যেতে হবে। নিজের জেলায় গেলে অন্তত জেলার সঙ্গে যােগাযােগ ভাল হবে। আপনাদের রেখে যাচ্ছি। রাজশাহীর স্মৃতি আমরা কোনদিন ভুলতে পারব না, এখানেই আমরা কারারুদ্ধ অবস্থায়ও ফ্যাসিস্টদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম করেছি। এখানে আমরা রক্ত দিয়ে প্রমাণ করছি বিপ্লবীদের কাছে ‘জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য বই আর কিছু নয়।
এ দিকে সিপাহীর তাড়ায় তাড়াতাড়ি যথাক্রমে কোলাকুলি করমর্দন করে, লাল সালাম দিয়ে অমূল্যদাকে গেটের কাছে নিয়ে যাওয়া হলাে। পিছনে লক্ষ্য করলাম মুখ চেপে হাসছে পরিতােষ, ভুজেন পালিত । কিন্তু বংকিম বাবু গম্ভীর। চক্রান্তের প্রধান নায়ককে শেষ পর্যন্ত গােপন থাকতেই হবে। অমূল্যদা গেট থেকে বেরিয়েছে-বিছানাপত্র নিয়েও কেউ কেউ বেরােয়। এমন সময় বংকিম বাবু সিপাইকে ডেকে স্লিপ দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল এটা কি সুপারের হাতের দস্তখত? কোথা থেকে এনেছেন এটা? সিপাই বলল, আপনারাই তাে দিলেন এটা? সঙ্গে সঙ্গে চক্রান্তকারীরা চিৎকার করে উঠল: আরে ফল্স; বিলকুল ফলস ট্রান্সফার স্লিপ । কি ভােগানােটাই না ভােগালাে ওরা বৃদ্ধ অমূল্যদাকে! ততক্ষণে সম্পূর্ণ ব্যাপারটা যে কৌতুক করার জন্য করা হয়েছে তা ফাঁস হয়ে গেল। মনসুর ভাই বলল, “তােমরা দেখি আচ্ছা।”-অমূল্যদা ত হাসছে-আমাকে নিয়ে কবে ফ্যাসাদ বাধাও……..এর পর স্লিপ আমি নিজে চেক করে তবে ট্রান্সফার হবাে-সবাই হাে হাে হৈ-হৈ করে যার যার রুমে ফিরে গেলাম।
বলতে কি, আর একদিন এর কয়েক মাস পরে ঐ রাজশাহীতেই অন্যান্য কমরেডসহ আমাকেও ফাঁকি দিয়েছিল ওরা। কিছুই বুঝতে পারিনি- সে কি বক্তৃতা! নলিনীদার মত লােককেও ওরা এই ফাঁদে ফেলেছিল। সেদিন কৌতুকটা খুব উপভােগ্য হলেও খুবই রূঢ় কৌতুক বলে মনে হলাে। যাক এই সব নির্দোষ আমােদ-প্রমোেদ জেলজীবনের জন্য অপরিহার্য।
এ ছাড়া আমাদের আনন্দের উৎস ছিল আর একজন কমরেড তিনি হলেন ফরিদপুরের আশু ভরদ্বাজ। এমন গায়ের রং আমি কম লােকেরই দেখেছি। অবিবাহিত কমরেডকে খালি গায় দেখলে মনে হতাে কে যেন এইমাত্র নতুন বরের গায়ে হলুদ মাখিয়ে দিয়েছে। তার ছিল নানা তাল, নানা ভঙ্গী। শুনেছি জীবনের বারাে আনি সময়ই তিনি জেলে কাটিয়েছেন। তাই জেলখানার জীবন তার কাছে। যেন একান্তই স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল। তাঁর নিজের জন্য নয় বরং জেলের কিশাের-যুবক সদ্য আটক ও নানাভাবে বিপদগ্রস্ত কমরেডদের কাছে জেলজীবন সহনীয় ও স্বাভাবিক করার জন্য তিনি অনেক সময়েই আনন্দ ও শূর্তির অবতারণা করতেন। এ ছাড়া আমরা একদিন আশুদাকে ধরলাম আপনি নাকি বিভিন্ন দেশের ভাষা জানেন? আশুদা বললেন ‘হ্যা। হনলুলু, মর্দান ডিস্ট্রিক্ট, মাদাগাস্কার ও
২০৪
ফিজিদ্বীপের ভাষা শিখেছি। তা ছাড়াও শিখেছি ক্রীট, হন্ডুরাস, জাম্বিয়া, লাপল্যান্ড ও পেম্বা প্রভৃতি দ্বীপের ভাষা। যেটা শুনতে চাও। বললেন যেদেশের ভাষা বলব সে দেশের লােকের মত সাজতে হবে। শুরু হলাে আশুদাকে সাজানাে। অগত্যা তাঁকে ফিজিদ্বীপের লােক সাজানাে হলাে-সে কী অপরূপ সাজ! বড় বড় পালক মাথায় এঁটে দেওয়া হলাে, তীর ধনুক দেওয়া হলাে কোমরে বেঁধে । এরপর তিনি বসলেন চোখ বুজে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে শুরু করলেন তাঁর ফিজিদ্বীপের ভাষায় বক্তৃতা: নাইচং-বেড়ানাে হামু লিবা পাও বুপে-পনা না তরাংলােয়া চে-চুংবি বিহিহি তােহালি-জুজু মামাথি দোয়াই অতং তাে তাে খাও খাও খিরাং। খিরাং পেহি পেহি-এভাবে বক্তৃতা চললাে অনেকক্ষণ। বক্তৃতার সঙ্গে কখনও জোরে কখনও আস্তে হাত নাড়লেন। কখনও মুষ্টিবদ্ধ করে বলে যেতেন আশুদা। কার সাধ্য আছে-বলবে যে এগুলাে বানানাে কোন কথা। মনে হতাে আমরা কোন আদিকালের গুহা-মানব-কেবল ভাষা শিখেছি অথবা পর্বত শীর্ষ থেকে নেমে এসেছে কোন কল্পিত দেবাদিদেব- ভাষা শিখাচ্ছে গুহামানবদের। নয়ত দেববাণী শুনাচ্ছে তাদের। বলতাম আশুদা এর অর্থ কী? আশুদা হেসে বলতেন তা জিজ্ঞেস করতে নেই-আমার এক সম্মােহিত অবস্থায় আমি নিজে কী বলি নিজেই শুনি না । আসলে এ সব কথাও আশুদার বানানাে কথা। সম্মােহন-টম্মােহন কিছু না। কোনদিন গােছলের সময় আশুদা সারা গায় কাদা মেখে চুপ করে কোথাও দাঁড়িয়ে থাকতেন। কেউ স্নান করতে এলেই হঠাৎ গােপন স্থান থেকে বেরিয়ে তাকে আলিঙ্গন করতেন। কেউ দৌড়ে গেলে বলতেন আরে এটা কমরেডসুলভ ব্যবহার হল না। কমরেড দেখে যে আলিঙ্গন দেবে না, যে সরে যাবে বুঝব তার ভিতর বৈপ্লবিক ভ্রাতৃত্ববােধের অভাব। এরকম কাদামাটি খেলা খুবই উপভােগ্য হতাে।
২০৫

সাতষট্টি
মনে আছে রাজশাহী জেলের খাপড়া ওয়ার্ডে গুলী চলার পর ১৪ নং ওয়ার্ডে একবার সুপার ভিজিটে এসেছেন। সব কয়টি সেল ভিজিট করে অমূল্যদার কাছে গেলে তিনি আমাদের মুখপাত্রস্বরূপ আমাদের প্রাপ্য কাপড়ের কথা বললেন। আশুদা পাশের সেল থেকে তা শুনলেন। আশুদা তখন সেল থেকে চিৎকার করে বললেন- কাপড় না। নিয়ে এদিকে আসবেন না। কাপড় নেই একেবারে ন্যাংটা দাঁড়িয়ে আছি। সুপার বিল সাহেব আশুদাকে চিনতেন। অগত্যা আর কি করেন তিনি আশুদাসহ সবারই টিকেটে কাপড় লিখে দিলেন।
আশুদা ছিলেন এমনি আনন্দময় কমরেড । কিন্তু জেলের রাজনীতি আলােচনায় এবং অন্যান্য খুঁটিনাটি কাজে (জেলে যার গুরুত্ব খুবই) কমরেডদের দেখাশুনার কাজে তার জুড়ি ছিল না।
জেলের ভিতর প্রতিদিনই অসংখ্য কবুতর উড়ে আসত । ওরা আমাদের কেবিনের চারপাশে ঘুরে ঘুরে খাবার খুঁটে খেত। একবার আমাদের বরিশালের আবুর মাথায় চাপল কবুতর ধরবে। অমনি আর কি! কোথা থেকে বড় ঝাপি (সাজি) যােগাড় করা হলাে এবং তার পিছনে রশি লাগিয়ে রাখা হতাে। ঝাপির মধ্যে ভাত ছড়িয়ে দেওয়া হতাে। তখন ঐ ভাত খেতে কোন কোন সময় চার পাঁচটা থেকে দশ বারটা কবুতর ঢুকে পড়ত। সাজিটা বেশ বড় থাকায় অনেকগুলি কবুতর এক সময় ঢুকত । যখন ওগুলি ঠিক সাজির ভিতরে চলে যেত তখনই রশি ছেড়ে দিয়ে ওগুলি সাজির মধ্যে আটকিয়ে ফেলত। এভাবে ধরে আমরা প্রায় দু’শাের উপর কবুতর খেয়েছি বলে মনে পড়ছে। এটার পিছনে অবশ্য বয়স্কদের সক্রিয় সমর্থন না থাকলেও যুবকদের এই কাজে কেউ বাধা দিত না। সবাই আমরা খুব হৈ চৈ করেই কবুতরের মাংস খেতাম । ব্যাপারটা পর পর কয়েক দিন চলতে থাকলে এ নিয়ে কয়েকদিনের মধ্যে কানাঘুষা শুরু হয়ে যায়। কারণ, ঐ গুলি ‘জালালী কবুতর’ । সিলেটের হযরত শাহজালালের দরগা থেকে নাকি ওরা আসে । অথবা সুফী শাহজালাল নাকি ঐ ধরনের কবুতর পুষতেন। সবগুলিই যে জালালী তবুতর ছিল তা বলতে পারব না। জালালী কবুতরের রং সাদা কালােয় মিশানাে। পেটের পাশ ও নীচ দিয়ে কিছুটা সাদা, ঘাড় এবং পিঠ ও লেজের দিকটা কালাে, এ নিয়ে ধর্মভীরু শিক্ষিত মুসলমানদের মধ্যেও সংস্কার আছে।
তাছাড়া বাইরে থেকে উড়ে আসা জেলের সৌন্দর্য বৃদ্ধিকারী কবুতরগুলিকে এভাবে
২০৬
ধরে ধরে খাওয়ার মধ্যে একটা স্থূলরুচির পরিচয় ফুটে উঠে বলে আমাদেরও কিছুটা প্রতিক্রিয়া হলাে। জেল কর্তৃপক্ষও এটা আমাদের মর্যাদার পক্ষে হানিকর বলে মনে করতেন। এবং জমাদার ও সিপাইরাও এতে খুশী হতে পারেননি। অগত্যা আমরা ওটা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিলাম । আজ অবশ্য ভাবতেও কেমন লাগে যে ঐ ধরনের কাজ আমরা চলতে দিলাম কীভাবে । প্রশ্নটা জালালী কবুতরের নয়। এখন সমস্ত ব্যাপারটাই একটু বাড়াবাড়ি স্কুল রুচির পরিচায়ক বলে মনে হয়েছে। জেলের পরিবেশই আমাদের কাছে অনেক কিছু স্বাভাবিক করে দিয়েছিল।
তা ছাড়া জেলের মধ্যে কারও পেছনে লাগা ছিল বাচ্চা কমরেডদের এক বিশেষ আনন্দের ব্যাপার। যে সমস্ত কমরেড একটু মিশুক ও সহনশীল, ছেলেরা তাদের পেছনে লাগত । এর দুটো উদ্দেশ্য ছিল। এক ছিল ঐ সমস্ত হাস্যরসিক সাথীদের সঙ্গে মিশে অনেকে আনন্দ উপভােগ করে জেলজীবনকে কিছু সময়ের জন্য সহজ ও হালকা করা। আবার কোন কমরেড মনে কোন দুশ্চিন্তা পােষণ করলে বা সাধারণ ব্যাপারে বা ব্যক্তিগত আচরণে কোন শৈথিল্য দেখালে পরােক্ষভাবে কমরেডসুলভ ব্যঙ্গাত্মক সমালােচনা দ্বারা তাকে শােধরাবার চেষ্টা করা।
জেলখানায় যাদের পিছু লেগে কমরেডরা আনন্দ পেত, তার মধ্যে ছিলেন যশােরের বটুদা, ফরিদপুরের আশুদা-যার কথা আগেই বলেছি এবং নওগাঁর লালু পাড়ে। আমাদের লালুদা আজ নেই । এ সমস্ত কমরেডদের মধ্যে এমন একটা সহজ স্বাভাবিকতা ছিল, যা জেলজীবনে কেন সাধারণভাবে সমাজে চলার পক্ষে অপরিহার্য। তাছাড়া ছিল সিলেটের যােগেশদা, যাকে আমরা লাইকোপােডিয়ামদা বলে ডাকতাম। অবশ্য উপরােক্ত কমরেডরা সমস্ত রকম রসিকতা সহ্য করার ক্ষমতা রাখতেন। নওগাঁর লালুদা অর্থাৎ লালু পাড়ের মৃত্যু আজও মনকে দারুণভাবে ব্যথিত করে তােলে। এরা ছিলেন সহজ সরলতার প্রতীক। নেতৃত্বের প্রতি ছিল তাঁদের অবিচলিত আস্থা; কিন্তু সেই অবিচলিত এবং সমালােচনাবিহীন আস্থাই আমাদের জেলজীবন ও বিপ্লবীজীবনকে আজ ভরে দিয়েছে এক শূন্যময় হতাশা ও ব্যর্থতার গ্লানিতে। নেতৃত্বের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকেছিল সুবিধাবাদ ও আমলাতান্ত্রিকতা। এরা সহজ হতে পারতেন না সাধারণ কমরেডদের সঙ্গে। মার্কসবাদের নামে এমন কতকগুলি অদ্ভুত আচার-অনুষ্ঠানের, নিয়ম-কানুনের অবতারণা করলেন এরা, সাম্প্রদায়িকতার বিলুপ্তির নামে এমন সূক্ষ্ম সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি করলেন এঁরা, যার ফলে জেলে দীর্ঘদিন থেকেও কেউই খাঁটি মার্কসবাদী হয়ে বেরুতে পারেনি।
যাক, যা বলছিলাম। মনে আছে কলিকাতা থেকে আগত কমরেড আরিফ জেলে অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে ডাক্তার যখন ইনজেকশন দিচ্ছিল, তখনই সে ভয়ে চিৎকার করে উঠে বলেছিল: “ডাক্তার ছাহাব, ম্যায় বেহুশ হাে গিয়া; ইনজেকশন মাত দেও।” আমরা এই কথা নিয়ে পরে তাকে ক্ষেপাতাম। বলতাম আরিফ ভাই, বেহুশ হয়ে গেলে
২০৭
কেউ কি বলতে পারে “ইনজেকশন মাত্, দেও।” কমরেডরা দেখলেই তাকে “মায়। বেহুশ হাে গিয়া” বলে ক্ষেপাত । কমরেড আরিফ ঠিক কোন অঞ্চলের ছেলে আজ মনে। নেই। বড় কমনীয় চেহারা, নাক-মুখের আকৃতি অর্থাৎ সেই চক্ষু, সেই কপাল ও সারা মুখমন্ডলের মধ্যে একটা আনন্দঘন ব্যক্তিত্ব জড়িত থাকত । আরিফ ভাই কথা বলতে একটু তােতলাতাে। সে একটু চটে গেলেই উর্দুতে কথা বলত । সাধারণত যারা একটু তােতলা, তাদের রাগ বেশী হয়। কিছু কিছু লােক আছে যারা বহু দিক দিয়ে খাটি মানুষ এবং বহু বর্ণচ্ছটায় চাকচিক্যময় বিষধর সর্প নয়। এরা সাধারণ জ্ঞানবুদ্ধি নিয়েই জীবনের মােহনীয় দিকগুলাের অধিকারী। আরিফ ভাই ছিল তেমনি একজন।
চারদেয়াল দ্বারা বাহির থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন কমরেডরা জীবনের বহু দিক থেকে বঞ্চিত অবস্থায় থাকে। এ অবস্থায় নিজেদের মধ্যে কৌতুক, রসিকতা যাকে ইংরেজীতে “হিউমার’ বলে তা স্বাভাবিকভাবেই বৃদ্ধি পায়। তবে তার যেমন ভাল দিক আছে তেমন খারাপ দিকও আছে। অনেকেই দেখেছি রসিকতা সহ্য করতে পারে না। বাল্যজীবন, পারিবারিক ইতিহাস, প্রত্যক্ষ পরিবেশ, শিক্ষাদীক্ষা, নানা কারণে প্রতিটি মানুষের চরিত্রের কতকগুলি বিশেষ বিশেষ দিক থাকে। আমার কথাই বলি আমি রসিকতা আদৌ সহ্য করতে পারতাম না। বিশেষ করে জেলে এটা আমার কাছে অসহ্য লাগত। অত্যন্ত ধর্মভীরু এক পরিবেশে জন্মগ্রহণ করে এবং শর্ষিণার মত এক চরম পিউরিটান ও শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশে বাল্যশিক্ষা গ্রহণের ফলে সবমানুষের সঙ্গে অবাধ মেলামেশা বা হাস্য-রসিকতার মধ্য দিয়ে পরস্পরকে বােঝার সুযােগের অভাবে এবং কেবল। নিজেরা আল্লার খাস বান্দা আর অন্য সবাই কাফের অমানুষ এই ধারণা থেকে অত্যন্ত আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ি। ফলে রসিকতাকে তার সঠিক অর্থে গ্রহণ করতে পারতাম না। জেলে বলে নয়, আসলে বুদ্ধিজীবীদের মধ্যবিত্তসুলভ শাণিত রসিকতার সামনে নিজেকে অপ্রস্তুত মনে করতাম । আমরা গ্রামে থাকতে অভ্যস্ত, কৃষকজীবনের সরলতা ও প্রত্যক্ষানুভূতিলব্ধ স্পষ্টোক্তির প্রবণতাকে বেশী পছন্দ করতাম । ফলে তাদের রসিকতাকে অনেক সময় কুটিল ও হৃদয়হীন মনে হতাে। মনে আছে তারা আমাকে হিউমার সহ্য করার অবস্থায় নিয়ে আসতে ইচ্ছুক ছিলেন কিন্তু তার জন্য যে ধৈর্য ও প্রবীণতা দরকার তা তাদের ছিল না। ফলে তাদের ঐ প্রচেষ্টায় আমার উপকার না হয়ে অপকার হয়েছিল কিনা বলতে পারবনা-তবে সময়তে এ ভাবে মনে হয়েছে, যেমন মনে হয়েছে পুকুরে খেলারত ব্যাঙদের ঢিল ছােড়ারত বালকদের সম্বন্ধে । কমরেড বন্ধুদের সম্বন্ধে এই কঠোরতম উক্তিতে অনেকেই মর্মাহত হবেন-কিন্তু জেলখানায় তথাকথিত মধ্যবিত্ত বিপ্লবীদের সঙ্গে আমাদের মত কিছু গ্রামঘেষা কমরেডদের যে সম্পর্ক ছিল তার বিচারে এটা মােটেই অত্যুক্তি নয় ।
২০৮

আটষট্টি
জেলে রাজবন্দীদের আর্থিক অবস্থা
আগেই বলেছি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এক বছরের মধ্যেই প্রায় সব কম্যুনিস্টরাই জেলে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। সরকার তখন এদের উপর চালায় অকথ্য নির্যাতন। ঐ সময় রাজশাহীর নাচোলের বন্দীসহ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন জেলে বহু কমরেড বিনা চিকিৎসায় এবং জেলের অখাদ্য কুখাদ্য খেয়ে মারা যান। এ দিকে জেলের রাজবন্দীদের মর্যাদা আদায়ের সংগ্রাম শুরু হয়। এবং দীর্ঘ দু’বছর ধরে অনশন ধর্মঘটের ফলে রাজবন্দীরা কিছু সুযােগ-সুবিধা আদায় করে। এবং তখনই তারা নিজেদের জন্য বাইরে থেকে জমা দেওয়া টাকা খরচ করার সুযােগ পায়। অবশ্য নিজের টাকা জেল অফিসে জমা থাকলে তা সব সময়ই ব্যবহার করা যেত। কিন্তু ‘৪৮-৪৯ সনে ধরপাকড়ের হিড়িক, ‘৫০-এর রায়ট (সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা) প্রভৃতি মিলিয়ে এমন অবস্থা ছিল যে, বাইরে থেকে কমরেডদের আত্মীয়-স্বজন তেমন কোন টাকা পয়সা জমাই দিতে পরত না, বিশেষ করে ৫০-এর দাঙ্গার পরে বিপুল সংখ্যক হিন্দু ভারতে চলে যায় এবং সেখান থেকে কোন টাকা পয়সা পাঠান বন্ধের ফলে জেলে বন্দী হিন্দু কমরেডদের অবস্থা খুবই খারাপ হতে থাকে। অর্থাৎ ১৯৫২ সনের পূর্বে আমাদের পার্সোনাল ক্যাশ বলতে কিছুই ছিল না। মনে আছে বরিশাল জেলে প্রথম দিকে আমার কিছু টাকা ছিল । আমি ধূমপান না করলেও অন্যান্য কমরেডদের ঐ ব্যাপারে খুবই অসুবিধায় পড়তে হয়। তখন ঐ টাকা দিয়ে বিড়ি কিনে দেয়া হতাে এবং ঐ সময় আমাদের এমন অবস্থা গেছে যে, একটা বিড়ি কমপক্ষে পাঁচ জনকেও খেতে হয়েছে । সেও সারা দিন মাত্র একবার । তার বেশী নয় ।
এই ভাবে যখন ব্যাপক সংখ্যক কমরেড গ্রেফতার হয়ে জেলে নিক্ষিপ্ত হলেন এবং তার মধ্যে অল্প কিছু কমরেডই পার্সোনাল ক্যাশের মালিক ছিলেন। এ অবস্থায় আমরা ঠিক করলাম কোন কমরেডকেই তার টাকা পয়সা (পার্সোনাল ক্যাশ) নিজের ইচ্ছা মত ব্যয় করতে দেওয়া হবে না। অবশ্য এটা সম্ভব হলাে তখনই যখন একই পার্টিভুক্ত কমরেডরা সংখ্যায় বেশী হলাম। আমরা তখন নিজেদের সবাইকে নিয়ে একটি অর্থনৈতিক সাব কমিটি গঠন করলাম। এঁদের হাতে ছিল প্রতিমাসের বাজেটের দায়িত্ব ও ক্ষমতা। কার কত জমা আছে, তাঁদের নিজের কি প্রয়ােজন এবং সমগ্র ভাবে ওয়ার্ডের অন্যান্য কমরেডদের জন্য কি
২০৯
প্রয়ােজন সব আলাপ আলােচনা করে তারা বাজেট করতেন। এইসব কমিটির মূলনীতি হলাে ঐ টাকার মালিক পার্টি এবং পার্টির মাধ্যমে ঐ কমিটি তার প্রয়ােজন বােধে সমস্ত কমরেডদের জন্যই তা খরচ করতে পারত। তবে যার টাকা সমগ্রভাবে পার্টিস্বার্থ ক্ষুন্ন না হলে তার খরচ করার অগ্রাধিকার থাকবে। বলা বাহুল্য। তাও উপরােক্ত সাব কমিটির অনুমতি সাপেক্ষ।
দেখা গেছে আমাদের এই টাকার বিরাট অংক যেত ঔষধপত্র সংগ্রহ করতে । কারণ, জেল হাসপাতালে বলতে গেলে এক কারমিনেটিভ মিকচার ছাড়া আর কোন ঔষধ ছিল না। অথচ জেলে কমরেডদের গ্যাস্ট্রিক, কোলাইটিস, পাইওরিয়া, জন্ডিস, মাইগ্রেনাস হেডেক, পাইলস বা অর্শ, ক্রনিক পেইন, ইনফ্লুয়েঞ্জা, ব্রংকাইটিস, আমাশয় ছিল এক রকম নিত্য-নৈমত্তিক রােগ। দীর্ঘদিন অনশন, পুষ্টিহীনতা, ব্যায়াম বিমুখতা, দুশ্চিন্তা এবং নানা রকমের কমপ্লেক্স-এর জন্য ঐ সব রােগ দেখা দিত । এই সমস্ত রােগীদের জন্য কমিটি বাজেট করে ঐ টাকা দিয়ে ঔষধ কিনে দিত। এমন বহু রােগী ছিল যাদের নিজেদের ক্যাশে এক টাকাও জমা ছিল না। অথচ তাদের চিকিৎসা করতেই হবে। তা ছাড়া ছিল কিছু কিছু পরীক্ষার্থীদের জন্য খরচ। তা ছাড়া বাচ্চা ও কিশাের কমরেডদের বইও কিনে দিতে হতাে। তা ছাড়া কোন ফিষ্ট বা ভােজ উৎসব হলেও ঐ বাজেট থেকে কিছু টাকা খরচ করা হতাে। তবে এই সাধারণ ক্যাশ ব্যবহারের বেলায় সব সময় সবার প্রতি সমদৃষ্টি রাখা গেছে কিনা সে কথা সঠিক করে বলা যাচ্ছে না। তা সত্ত্বেও এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে একটি বিপ্লবী পার্টির পক্ষেই শুধু সম্ভব এভাবে জেলের মত অস্বাভাবিক অনিশ্চিত পরিবেশে সকলের টাকা একটি সাধারণ। তহবিলের অন্তর্ভুক্ত করে তা সকল কমরেডদের জন্য ব্যয় করা এবং এটা সম্ভব হয়েছিল বলেই দীর্ঘ আট দশ বছর একটি ফ্যাসিষ্ট সরকারের কারাগারে বন্দী থেকেও কমরেডরা অনেকেই মােটামুটি কর্মক্ষম শরীর নিয়ে বেরিয়ে আসতে পেরেছেন। তবুও সমগ্র আটচল্লিশ থেকে পঞ্চাশ সাল পর্যন্ত কী ভিতরে কী বাইরে একটা চরম অবস্থা গিয়েছে বলে রাজবন্দীরা প্রয়ােজনীয় টাকা পয়সা সংগ্রহ করতে পারেননি। ফলে চিকিৎসাদি আদৌ হয়নি যার ফলে অসংখ্য কমরেড নানা রকম ব্যাধি অবস্থায়ই বাইরে বেরিয়ে আসেন।
২১০

ঊনসত্তর
জেলে আই-বি-দের পরিদর্শন
রাজবন্দীদের চিঠিপত্রও যেমন আই-বি দ্বারা সেন্সর হয়ে বাইরে পাঠান হয় তেমনি বাইরে থেকে ভিতরে আসার সময়ও সেন্সর করা হয়। তাদের বাইরের কোন আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করার বেলায়ও ঐ একই ব্যবস্থা। শুধু আত্মীয় স্বজন নয়, যে কোন ইন্টারভিউ যেমন মামলা থাকলে উকিলের সঙ্গে ইন্টারভিউ বা কোন চিকিৎসার ব্যাপারে ডাক্তারের সঙ্গে ইন্টারভিউ অথবা জেলের ভিতরে অন্য যে কোন ওয়ার্ডের রাজবন্দীর সঙ্গে ইন্টারভিউ । এর কারণ হলাে আত্মীয়স্বজন বা কারও সঙ্গে কোন কথা বলার সময় এরা বাইরে কোন রাজনৈতিক খবর পাঠান। কিনা বা বাইরে থেকে কোন রাজনৈতিক খবর সংগ্রহ করেন কিনা অথবা কোন জিনিসপত্র আদান-প্রদান করেন কিনা তা লক্ষ্য করা । কিন্তু ইচ্ছে থাকলে উপায়ও বের হয়। শুনেছি একজন বন্ধু বা আত্মীয় ইন্টারভিউ দিতে এল । কথায় কথায় রাজবন্দীটি তাকে সিগারেট খেতে দিল । আই-বিকেও হয়ত দিল। কিন্তু যাকে দিল অর্থাৎ যে দেখা করতে এসেছে সে হয়ত বলল থাক পরে খাব এখন কাশি উঠছে। (বলে হয়ত একটা কাশিও দিল)। এইভাবে সে সিগারেটটি পকেটে পুরে রাখল। এমনও হয়েছে ঐ সিগারেটের ভিতরেই থাকত বাইরে পাঠানাের জন্য মূল্যবান তথ্যাদি বা দলিল । কিন্তু এগুলাে হলাে কঠোর নিয়ন্ত্রণের যুগের কথা। আমাদের সময় এত কিছু করার প্রয়ােজনীয়তা ছিল না।
অবশ্য এ ছাড়া আর এক ধরনের ইন্টারভিউ আছে তা হলাে আই-বিদের রুটিন ওয়ার্ক। প্রতিমাসে অন্তত দু’বার না হয় একবার রাজবন্দীদের মনােভাব বােঝার জন্য আই-বি এসে রাজবন্দীর ইন্টারভিউ নিত। তাদেরকে সরকারের আনুকূল্যে আনার প্রচেষ্টা করা হত। তাদের দ্বারা এই মর্মে মুচলেকা আদায় করা যে তারা মুক্তির পর আর সরকার বিরােধী বা বিপ্লবী রাজনীতি করবে না। রাজবন্দীদের বেলায় আই-বিদের কর্তৃত্ব বিরাট। মনে আছে, পিরােজপুর জেলে। যখন আমার নামে কেস ছিল এবং আমি হাজতে ছিলাম, তখন একদিন এস ডিও সাহেব জেলে গিয়ে বললেন- “আপনার বিরুদ্ধে যে চার্জ তাতে আমি আপনাকে যে-কোন সময় মুক্তি দিতে পারি। কিন্তু আমার হাত বাঁধা। আমার পেছনে যে ‘টিকটিকি আছে-তারা যে আমার হাতে কড়া লাগাবে।” এতেই বুঝা যায় যে,
২১১
একজন মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেট পর্যন্ত আই-বিদের কাছে কত অসহায়। মােটকথা, বিনা বিচারে আটক সিকিউরিটি প্রিজনারদের ব্যাপারে আই-বি’রাই সর্বেসর্বা। এবার আগের কথায় ফিরে আসি। অবশ্য এই সব ইন্টারভিউয়ের সময়ও অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত । প্রথম দিকে অর্থাৎ আটচল্লিশ ঊনপঞ্চাশের দিকে কেউ দেখা করতে আসলে তাদের সঙ্গে তেমন কোন কথাই বলা যেত না। পরে অবশ্য এটা একটু শিথিল করা হয়।
মনে আছে, একবার আমার ভাগ্নে বর্তমানে শ্রমিক নেতা মাওলানা আবদুল মতিনকে আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমীনের কাছ থেকে অনুমতি আনতে হয়েছিল। তারপর এই দেখাশূনা ও কথাবার্তার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক খবর আদান-প্রদানের ব্যাপারে আইবি যতই চেষ্টা করুক তেমন বাধা দিতে পারেন না। সন্ত্রাসবাদী যুগে জেলখানায় কাঁঠালের ভিতর রিভলবার পুরে দেয়ায় কথা শুনেছি। কৃষণ চন্দের বইতে এ সম্পর্কে চমৎকার ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। কথাবার্তার মধ্যে হয়ত বলা হলাে-আমাদের গাইটা অর্থাৎ গাভীটা হারিয়ে গেছে কিছুতেই খুঁজে পাওয়া গেল না। এর অর্থ হলাে অমুক কমরেড কঠোরভাবে। আত্মগােপন করেছে। তাকে সরকার খুঁজেই পাবে না। হয়ত বলা হলাে তৌফিক মাঝে মাঝে বেড়াতে আসে। এর অর্থ হলাে, আত্মগােপনকারী কমরেডদের সঙ্গে মাঝে মাঝে দেখা হয়। কাজেই এ ব্যাপারে আই-বিদের আপ্রাণ চেষ্টা দেখে হাস্যোদ্রেক হয় মাত্র।
ঢাকা জেলে একবার আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন আমার শিক্ষক শ্রদ্ধেয় মাওলানা ওসমান গনি সাহেব। তিনি বর্তমানে শিক্ষকতা থেকে অবসর নিয়েছেন। আরবীতে ফাস্ট ক্লাস ফাস্ট। সেদিন দেখা হওয়ায় বললেন, তিনি এখনও কর্মক্ষম অথচ সরকার তাকে জোর করে রিটায়ার করাচ্ছেন । তিনি আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। জেলে কথা প্রসঙ্গে বললেন, মন খারাপ করবেন না। তিনি কেন যে আমাকে আপনি সম্বােধন করতেন বুঝতাম না। বললেন, “বাইরে আন্দোলন উঠেছে।” এটা ৫৩ সালের শেষের দিকের কথা। বলতেই আই-বি বাধা দিল, “ও সব বলবেন না” । তিনি তখনই জবাব দিলেন এ কথা কি আপনারা অস্বীকার করতে পারবেন? চেপে রাখলে আল্লাহ বেজার হবেন। অতঃপর তিনি আমাকে দোয়া করে চলে গেলেন। আই-বিদের দ্বিতীয় এবং প্রধান উদ্দেশ্য ছিল মাসান্তর তাদের সঙ্গে একবার দেখা করে তাদের মন ভাঙানাের চেষ্টা। নতুন এবং তরুণ রাজবন্দীদের বেলায় তারা এ ব্যাপারে সাফল্য অর্জনের আশা রাখে । কিন্তু দেখা গেছে, প্রকৃত বিপ্লবী সে যত তরুণই হােক, তাদের মন ভাঙানাে মােটেই সহজ নয়। প্রথমে তারা নানারকম প্রলােভন দেখায়। যেমন বের হলে আপনার সমস্ত পড়াশুনার খরচ বহন করা হবে অর্থাৎ তাকে আই-বি হিসাবে কাজ করার জন্য
২১২
প্রলুব্ধ করা। কাউকে বড় চাকরি দেবার প্রলােভন দেখায়। এতে কাজ না হলে নানারকম ভয় ও হুমকি দেখায়। যেমন আপনাকে দীর্ঘদিন জেলে আটক রাখা হবে। ইত্যাদি-ইত্যাদি। তা ছাড়া আই-বি’দের নির্দেশে অনেক রাজবন্দীর উপর চলে অমানুষিক নির্যাতন যার কথা উল্লেখ করতেও কলম থেমে যায়। পৃথিবীতে এর অসংখ্য নজীর রয়েছে। উদ্দেশ্য, দলের গােপন খবর সংগ্রহ করা। এ ছাড়া কোন কোন আই-বি রাজনৈতিক আলাপ আলােচনা করেই অনেককে স্বমতে আনবার প্রয়াস পেত । প্রথম দিকে আমাকে, বিশেষ করে মুসলিম কমরেডদের পাকিস্তান সম্বন্ধে মােহ সৃষ্টি করতে চেষ্টা করত । এরা বলত নানা কথা যেমন, ইসলামী রাষ্ট্র বিশ্ব মুছলিম আন্দোলন। অনেক ঝানু আই-বি’রা সেই সময়ই ইসলামী সমাজতন্ত্রের কথা বলত। তারা জানত যে, সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদের কথা বাদ দিয়ে এদের সঙ্গে অন্য কথায় সুবিধা হবে না। তখন তারা ইসলামী সমাজতন্ত্রের কথা বলত। আমাকে বিশেষ করে আমার পরিবারবর্গের কথা, শর্ষিণার পীর সাহেবের (বুড়াপীর) কথা বলে আমার মন নরম করার চেষ্টা করত । কিন্তু জেলে এসে আমি আরও শক্ত হয়েছি, ইসলামী সমাজতন্ত্রের (সােনার পাথর বাটি) রূপও আমার কাছে অজানা ছিল না।
রাজবন্দীদের মন দুর্বল করার জন্য আই-বি’রা নানা কূট-কৌশল প্রয়ােগ করত। একবার এক বৃদ্ধ অতি প্রবীণ আই-বি এসে বলল, “দেখুন, আমি জওহরলাল, সুভাষ বােস, সবারই ইন্টারভিউ নিয়েছি। চল্লিশ বছরের উপর আমার চাকরি। আমি হাজার রাজবন্দীর ইন্টারভিউ নিয়েছি এবং তাদের সম্বন্ধে যা বলেছি তা হুবহু মিলে গেছে। তার কথার ধরণ এমন যেন অবিশ্বাস করার উপায় থাকে না । সে বলল, “আপনাকে যা দেখলাম গুলীবিদ্ধ হওয়ার পর (রাজশাহী জেলে খাপড়া ওয়ার্ডের গুলী) আপনার এমন একটা সম্ভাবনা রয়েছে যে আপনি যদি বেশী দিন জেলে থাকেন তা হলে আপনার মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটতে পারে। অথবা একটা দুরারােগ্য ব্যাধিও হতে পারে। তার লক্ষণগুলি আপনার মধ্যে সুস্পষ্ট,” বলে তিনি এমনভাবে আমার চোখ ও কপালের দিকে তাকালেন যেন সত্যিই তিনি যেন কোন রােগের পূর্বাভাস পেয়েছেন আমার মধ্যে। অবশ্য ঐ সময় আমি দীর্ঘ ছয়মাস পর্যন্ত জণ্ডিস রােগে ভােগার পর একটু সুস্থ হয়েছি। মনে আছে সে যতই কথাগুলি জোর দিয়ে বলত ততই আমি যেন তার কথার অসারতা সম্বন্ধে আরও নিঃসন্দেহ হতাম। তার কথা শেষ হলে এক রকম হেসেই জবাব দিলাম। তা রােগত সাধারণ ব্যাপার, জেলে মরে গেলেই বা কী। আই-বি জবাব দিল- “দেখুন প্রথম দিকে ওভাবে অনেকেই বলে থাকে কিন্তু পরে দেখা গেছে অনেকেই আমাদের কথানুযায়ী বণ্ড দিয়ে বেরিয়ে যায়।”
২১৩

সত্তর
অনেক সময় কমরেডদের নানারকম ভয় দেখান হয়। যেমন, জনৈক আই-বি জেলে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসে বলল- “দেখুন এই যে কোরিয়ায় যুদ্ধ চলেছে (১৯৫১ সনে কোরিয়ায় আমেরিকান সৈন্যের প্রবেশ) এ যুদ্ধে যদি উত্তর কোরিয়ার ক্যুনিস্ট সরকারের পতন ঘটে, তা হলেও এখানে তার মারাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে। আপনি হয়ত জানেন চিয়াং সরকার কী ভাবে চুংকিং জেলে। কম্যুনিস্ট বন্দীদের গুলী করে মেরেছে। তেমনি এখানেও আপনাদের অবস্থা অনুরূপ হতে পারে। আই-বি’র ঔদ্ধত্য দেখে আমার শরীর রাগে কাঁপতে লাগল । বুঝলাম পাকিস্তান কতখানি আমেরিকার খপ্পরে চলে গেছে। নিজেকে অনেক কষ্টে সংযত করলাম। বললাম, আপনাদের ম্যাকআর্থার হারিয়ে দেবে কোরীয় কম্যুনিস্টদের যার পশ্চিমে ও দক্ষিণ জুড়ে রয়েছে মহাচীন, রাশিয়া? মনে ত হয় না । আচ্ছা দেখা যাবে। আই-বি বেশ একটু গম্ভীর হয়ে গেল । এবং কিছুক্ষণ বসে থেকে “ভেবে দেখুন, আচ্ছা এখন চলি”-বলে বেরিয়ে গেল । ঠিক মাস দু’য়েক পরে সেই আই-বি’টিই আবার আমার ইন্টারভিউ নিতে এসেছে। ততদিনে আমেরিকার সেনাধ্যক্ষ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম সেনানায়ক ম্যাকআর্থারকে সিউল থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। (ঐ সময় চীন থেকে ১০ লক্ষ ভলান্টিয়ার কোরিয়ায় এসেছিল কোরিয়াকে মুক্ত করতে)। আমেরিকান সৈন্যরা ৩৮ অক্ষাংশ পেরিয়ে কোরিয়া ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। আমি তার বসার একটু পরেই বললাম, আপনি নিশ্চয়ই কোরিয়ার যুদ্ধের খবর নিয়ে এসেছেন। আমরা যা শুনলাম ম্যাকআর্থার তার সব সৈন্যসামন্তসহ ৩৮ অক্ষাংশ থেকে সরে এসে সিউল বন্দর ত্যাগ করে দেশে ফিরে গেছে। – তা কি সত্য? দেখলাম কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে তার মুখ লাল হয়ে গেছে। ভাবটা এমন যে, আমাকে মারতে পারলে যেন তার ক্রোধ প্রশমিত হয়। আমি একটু দমে গেলাম। কিছুক্ষণ উভয়ে কোন কথা বললাম না। তারপর আমরা কি কথার মধ্য দিয়ে যেন স্বাভাবিক হয়ে এলাম।
কোন কোন আই-বি রাজবন্দীদের উপর মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা-নিরীক্ষাও চালায়। তারা বন্দীদের সঙ্গে নানা কথার মধ্যে লক্ষ্য করতে থাকে তার মধ্যে কোনরূপ দুর্বলতা ঢুকেছে কিনা। তারা মনে করে যে, অনেক বন্দীই হয়ত সরাসরি মুচলেকা দেয়ার কথা বলতে অবমাননাকর মনে করে বা লজ্জানুভব করে। কিন্তু মনে তার
২১৪
দুর্বলতা রয়েছে-ছাড়া পেলে সে বিপ্লবী রাজনীতি ছেড়ে দেবে, অবস্থা এরূপ হলে আই-বি এ সমস্ত রাজবন্দীদের ছেড়ে দেয়ার পরামর্শ দেয়। লক্ষ্য করছি এ প্রচেষ্টা সবচেয়ে বেশী চালায় তারা রাজশাহী জেলে গুলী চলার পর। এরপরে যে সব ইন্টারভিউ হয়েছে তাতে আই-বি’রা আমাকে বলেছে “দেখুন বাইরে আপনাদের কিছু নেই।” তা না হলে জেলে এত গােলাগুলী হল, সাতজন মারা গেল, আরও কুড়ি-পঁচিশজন মারাত্মকভাবে আহত হল, কিন্তু কৈ এ নিয়ে বাইরে আজ পর্যন্ত একটি কথাও উঠেনি। আমরা ভাবছিলাম এর প্রতিক্রিয়া বাইরে যেন কত মারাত্মক হবে। কাজেই বুঝতে পারছেন অবস্থা। বাইরে জনগণ আপনাদের মনে না করলে কেন আপনারা নিরর্থক জেলে পঁচে মরবেন? তখন ভাবলাম ওরা। আমাদের কাবু পেয়ে যা তা বলতে শুরু করেছে। আমরাও কিছুমাত্র দুর্বলতা প্রকাশ না করে খুব জোরের সাথেই জবাব দিতাম। জনতার উপর আমাদের অগাধ বিশ্বাস আছে। জেলের ঘটনা আপনারাই তাদের কাছ থেকে গােপন করে রেখেছেন। কিন্তু জানবেন এ ঘটনা গােপন থাকবে না-সেদিন এই জনতাই এর যথাযােগ্য বিচার করবে। জনতাই এই জেল থেকে বের করে নেবে রাজবন্দীদের গুলীর পর ওরা। মনে করেছিল আমরা দুর্বল হয়ে পড়েছি। কিন্তু আসলে মনের দিক দিয়ে তখন। আমরা একেবারে বেপরােয়া। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আজ আমরা সেই সর্বশক্তির আধার জনতার জোরেই বাইরে বেরিয়ে এসেছি। মনে আছে, গুলীর কিছুদিন পূর্বে যশােরের কমরেড হক রাজশাহী জেলে এক আই-বি’কে স্যাণ্ডেল ছুঁড়ে মারতে চেয়েছিল। ঐদিন রাগে কাঁপতে কাঁপতে খাপড়ায় ঢুকে তিনি আমাদের নির্দেশ দিলেন- আজ হতে সমস্ত আই-বি ইন্টারভিউ বাতিল । কি নিয়ে কথা কাটাকাটি হওয়ায় কমরেড হক স্যান্ডেল নিয়ে পিটাতে চেয়েছিল। অবশ্য নানা দিক ভেবে তখন আমরা আই-বি ইন্টারভিউ বাতিল করিনি। অবশ্য সব আই-বি যে খারাপ, তা নয়। কোন কোন আই-বি আমাদের উপর যথেষ্ট সহানুভূতিশীল ছিল।
২১৫

একাত্তর
স্বভাবতই উপরিউক্ত দলগুলি বিশেষ করে কৃষক-শ্রমিক পার্টি, নেজামে ইসলাম, আওয়ামী লীগ এই তিনটি মূল সংগঠনই মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে নিজেরা এককভাবে ক্ষমতা দখলের মনােভাব পােষণ করতাে। শ্রেণীভিত্তিক সমাজে এটা হতে বাধ্য। প্রত্যেকেই শােষণের হাতিয়ার রাষ্ট্রযন্ত্রকে নিজ আয়ত্তে আনতে সচেষ্ট থাকে। এ ব্যাপারে তারা শ্ৰেণীস্বার্থে অন্ধ এবং তাদের সমস্ত প্রগতিশীল শ্লোগানসমূহ জনতাকে নির্বাচনে নিজের কাজে লাগানাের জন্যই ব্যবহৃত হয়। তবু জনতার চেতনা, নির্যাতিত বুর্জোয়া ও উঠতি মধ্যবিত্ত ও কৃষকদের রাজনৈতিক মানের কথা চিন্তা করে কম্যুনিস্ট পার্টি নির্বাচনকেই সংগ্রামের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করল । এই প্রসঙ্গে মরহুম অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের অবদান বিশেষভাবে স্মরণীয় । অবশ্য ঐ সময় কম্যুনিস্ট পার্টি নির্বাচনের বাইরে সশস্ত্র বিপ্লবের মারফত ক্ষমতা দখলের রণদিভে তত্ত্ব’কে সম্পূর্ণ বিসর্জন দিতে পেরেছিল বলে মনে হয়। কারণ ঐ সময় রণদিভে তত্ত্বের অত্যন্ত উগ্র সমর্থক যশােরের কমরেড আবদুল হককেও জেল থেকে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দেখেছি। বলা বাহুল্য, কম্যুনিস্ট পার্টিকে যুক্তফ্রন্টের অন্তর্ভুক্ত না করলেও তারা স্বাধীনভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এবং এর মধ্যে চট্টগ্রামের শ্রদ্ধেয় পূর্ণেন্দু দস্তিদার জেল থেকেই নির্বাচিত হন। এ ছাড়া সিলেটের বরুণ রায় (প্রসূনকান্তি রায়) নির্বাচিত হন। পূর্ব বাংলার আইন পরিষদে আরও একজন কম্যুনিস্ট সদস্য ছিলেন কিন্তু তাঁর নাম আমার ঠিক মনে পড়ছে না। কম্যুনিস্টদের পৃষ্ঠপােষকতায় আরও বেশ কয়েকজন প্রগতিশীল যুবক নির্বাচিত হয়েছিলেন। যশােরের কমরেড আবদুল হক অবশ্য নির্বাচিত হতে পারেননি। কিন্তু তিনি জেলে থেকেও বিপুল ভােট অর্জন করেছিলেন।
শােনা যায় যুক্তফ্রন্টের নেতা জনাব ফজলুল হক সাহেব নাকি তাঁর নির্বাচনের বিরােধী ছিলেন।
ঘটনাটি যেরূপ শুনেছি- কমরেড হকের ভাই তৎকালীন যশাের আওয়ামী লীগের সেক্রেটারী মাইকেল মধুসূদন দত্ত কলেজের অধ্যক্ষ জনাব আবদুল হাইয়ের চেষ্টায় যুক্তফ্রন্টের সম্মতিক্রমেই তাকে আওয়ামী লীগ উক্ত আসনটি ছেড়ে দেয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও ড: আহাদের মনােনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে নাকি জনাব ফজলুল হকের ব্যক্তিগত প্রভাব কাজ করেছিল। ফলে জেলে থেকে অন্যূন ৮ হাজার ভােট পেয়েও তাকে হেরে যেতে হয়।
২১৬
এই সময়েই আন্তর্জাতিক ঘটনা বলতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় দিয়েন বিয়েন ফুতে ফরাসীরা বিপ্লবীদের হাতে চরম মার খায় । বেশী না হলেও অন্তত এতটুকু বলা যায় তৎকালীন যুক্তফ্রন্ট নেতৃবৃন্দের ক্যুনিস্ট বিরােধিতার ফলে তাদেরও মুক্তি আসেনি। এ কথা বলা প্রয়ােজন যে কমুনিস্টরা এবং মূলত তাদের প্রভাবান্বিত বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা বিরাট সংখ্যক ছাত্রদের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় শ্রেণীদ্বন্দ্বে উন্মত্ত নির্বাচনাগ্রহী বিভিন্ন দলের যুক্তফ্রন্ট গঠিত হলাে। সেই কম্যুনিস্ট পার্টিকে কিন্তু যুক্তফ্রন্ট তার অঙ্গীভূত করে নাই। এমনও শুনেছি যে, নির্বাচনের পূর্বে ফজলুল হক সাহেবের নিকট যুক্তফ্রন্টের চুক্তিনামায় সই করতে গেলে তিনি নাকি ‘সােহরাওয়ার্দীর সঙ্গে সমঝােতা করে তার নির্বাচন করতে হবে’ দেখে চুক্তিনামা ছিড়ে ফেলতেও চেয়েছিলেন। কিন্তু তৎকালীন ছাত্রসমাজ একরূপ জোর করেই তার দ্বারা সই আদায় করেছিলেন।
পশ্চিমা হানাদারমুক্ত বাংলাদেশের উৎপত্তির পিছনে মওলানা ভাসানী সহ মরহুম। সােহরাওয়ার্দী ও শেখ মুজিবের অবদান কখনও বিস্মৃত হবার নয়। কিন্তু এ কথা অনস্বীকার্য যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আওতাধীন একটা আধা সামন্ততান্ত্রিক আধা। ঔপনিবেশিক দেশে ক্যুনিস্ট পার্টির সঙ্গে বলিষ্ঠ সহযােগিতা এবং ইতিহাসের বিচারে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব তাদেরকে নেতৃত্বের অংশীদার করেই যে প্রকৃত মুক্তি আনা সম্ভব তার সম্যক উপলব্ধি না থাকায় পরবর্তী কালে ৯২ (ক) ধারা, ৫৮ সাল, ৬৪ সালের নির্মম আঘাত ও শেষ পর্যন্ত ৭১ সনের রক্ত সমুদ্রে হাবুডুবু খেতে হয়েছে । ইহা ইতিহাসের শিক্ষা। ইতিহাস ও সমাজ-বিজ্ঞানকে কে কবে অস্বীকার করতে পেরেছে? তবে এও নির্দ্বিধায় বলতে হবে যে, কম্যুনিস্টরা তখন এমন সক্রিয় শক্তি ছিল না যার নেতৃত্ব মেনে নিতে বা তাদের। সঙ্গে আঁতাত করতে তারা বাধ্য থাকবে।
বলা বাহুল্য, ক্যুনিস্ট পার্টিও দেশ বিভাগের পর সঠিক রাজনীতি গ্রহণ করতে পারায় জনগণ থেকে তাদের বিচ্ছিন্নতা এমন এক পর্যায়ে এসে পৌছেছিল যে বহুদিন পর্যন্ত তার জের তারা আর কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তবুও আমার মনে হয়, বায়ান্নর ভাষা আন্দোনের পর পর এবং চুয়ান্নর নির্বাচনের প্রশ্নে ক্যুনিস্ট পার্টি তার তৎকালীন ক্ষুদ্র শক্তিতে যে কর্মসূচী ঘােষণা করেছিল তা আত্মকেন্দ্রিক বুর্জোয়াদের জনতার কাতারে নামাতে বিপুল ভাবে সাহায্য করেছে ।
এতদসত্ত্বেও প্রকৃত সত্যটি তুলে ধরতে হবে। তাহলাে কম্যুনিস্ট পার্টির অসংখ্য ভুলভ্রান্তি ও সীমাবদ্ধতা নিয়েও সেই ১৯৪৮ থেকে ‘ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায়’ ধ্বনি, রাজশাহী জেলে, নাচোলে, হাজং এলাকায় রক্ত ঝরিয়ে ও তত্ত্বগতভাবে সশস্ত্র বিপ্লবের শিক্ষা ছড়িয়ে এ দেশের লাখাে লাখাে কৃষক-শ্রমিক ও ছাত্র-যুবককে রক্তদানের প্রেরণার সৃষ্টি করেছে। অন্যান্যদের সঙ্গে মিলিত হয়ে উহারই ক্ষীণ ধারা ১৯৭১ সনে রক্তের মহাসমুদ্র সৃষ্টি করে তার অতলে ডুবিয়ে দিয়েছে পশ্চিমা হানাদারদের। কিন্তু ভাগ্যের এমনি নির্মম পরিহাস যে, আজও এদেশবাসীর (মূলত ক্যুনিস্ট পার্টির নেতৃত্বের অভাবে) প্রকৃত মুক্তি এলাে না।
২১৭

বাহাত্তর
এই সময় জেলখানায় দেখলাম শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক অজিত গুহ ও মুনীর চৌধুরীকে। তারা অবশ্য আমাদের ওয়ার্ডে ছিলেন না। তবে তাঁরা তাঁদের ওয়ার্ডের বাইরে বেড়াতে পারতেন। ঐ সময় অল্প সময়ের জন্য আমাদের সঙ্গে দেখা হতাে। অবশ্য অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীকে আমরা একদিন সেক্সপিয়র পড়ে শােনাতে কাছে। পেয়েছিলাম। সে কথা আগেই বলেছি। অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী ও অজিত গুহ সম্বন্ধে এ কালের বুদ্ধিজীবীদের নতুন করে কোন পরিচয় দেয়ার প্রয়ােজন নেই। তবে অনাগত ভবিষ্যৎ পাঠকদের জন্য স্বল্প পরিসরে এটুকু বলে রাখা যায় যে অধ্যাপক অজিত গুহ ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের অন্যতম ভক্ত। তিনি ছিলেন। একজন নীরব বিপ্লবী। এ দেশের ছাত্র-যুবকদের মনে অসাম্প্রদায়িতা, মুক্তবুদ্ধি ও গণচেতনা আনয়ন করেছিলেন তিনি তাঁর অসংখ্য প্রবন্ধাদির মাধ্যমে। তাঁর বহু লেখা দেশ প্রেমের অত্যুজ্জ্বল নিদর্শনস্বরূপ। তিনি মনে হয় উপদেশের চেয়ে দৃষ্টান্তের উপরই জোর দিতেন বেশী। তাই দেখি তার ব্যক্তিগত চরিত্র অত্যন্ত নমনীয়। পােশাক সাদাসিধা। তাঁকে দেখেছি একটি থলে হাতে নিয়ে বাজার করতে। ঘাড় একটু বাঁকা করে চলতেন তিনি। স্বাস্থ্য তেমন ভাল ছিল না। মনে হতাে পুঁজিবাদী সমাজের সমস্ত চাপ তাঁর কাঁধ নুইয়ে দিলেও তিনি হারকিউলিসের মত সােজা হয়ে চলতে চাইতেন। তিনি জেল থেকে বেরিয়েও অধ্যাপনা করেছেন।
এককালে অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী ছিলেন স্বনামখ্যাত ছাত্র নেতা। পরে মুনীর ও তার বােন নাদেরা উভয়েই কারাগারে আবদ্ধ হন। বেরিয়ে এসে মুনীর চৌধুরী অধ্যাপনা শুরু করেন এবং শেষ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের দায়িত্ব। গ্রহণ করেন।
জেলে সেই দিনটি স্মরণ রাখার মত । হঠাৎ অসংখ্য চেনা-অচেনা কমরেড এসে আমাদের ওয়ার্ডটি পূর্ণ করে ফেলল। মনে আছে তাদের স্থান সংকুলানের জন্যে আমরা আমাদের খাট সরিয়ে দালানের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড় করিয়ে রাখলাম এবং নীচে সবাইর জায়গা দিবার ইচ্ছায় ঢালা বিছানার ব্যবস্থা করলাম। ঐ সময় ইউনির্ভাসিটির বহু ছাত্রের মধ্যে ছিল ছাত্র নেতা এ. টি. বারী, বরিশালের আবদুল লতিফ (বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক), তৎকালীন আওয়ামী লীগ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান আরও অন্যান্য আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ। তা ছাড়া
২১৮
অসংখ্য রাজনৈতিক কর্মী যারা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হবার পর গণ-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নিজেদের সংগ্রামী করে তুলেছেন।
ইউনিভার্সিটির ছাত্রদের সেই প্রদীপ্ত মুখগুলি আজও স্পষ্ট মনে পড়ছে। তারাও যেন আমাদের দেখে বিস্মিত হলাে। আমরাও তেমনি দেখলাম যে, সারা দেশে কি বিপুল পরিমাণ ছাত্র, যুবক ও জনতা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ হয়েছে। আমরা অবশ্য ভিতর থেকে যুক্তফ্রন্ট আন্দোলনের দুর্বার গতির কিছুটা আঁচ করছিলাম। কিন্তু সেই দিকবিদারী গর্জনের ঢেউগুলির প্রত্যক্ষ রূপ দেখলাম এ সময়। আমরা প্রস্তাব করলাম ৪৮-এর পরবর্তী ঘটনাসমূহ সম্বন্ধে বিস্তারিত রিপোের্ট শুনবাে তাদের কাছ থেকে। তারাও আগ্রহ সহকারে রাজী হলাে। তখন প্রােগ্রাম করা হলাে একের পর এক ছাত্রনেতা গণ-আন্দোলন, যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, সরকারী দমন নীতি, আন্তর্জাতিক ঘটনাবলী সম্বন্ধে রিপাের্ট পেশ করবে। আমরা ঠাসাঠাসি করে বসলাম । উৎকর্ণ হয়ে শুনলাম। বক্তাদের মধ্যে বন্ধুবর আবদুল লতিফ ও এ. টি. বারী এঁদের দুজনার কথাই মনে আছে। অবশ্য আরও অনেকে বক্তৃতা করেছিলেন। ৫৪-এর নির্বাচনে মুসলিম লীগের শােচনীয় পরাজয়ের কারণ হিসেবে তারা বলল যে, “এ সময় আমরা প্রকাশ করতে পেরেছিলাম কী করে মুসলিম লীগ হাজংয়ে, নাচোলে ও অন্যান্য স্থানে হত্যাকান্ড চালিয়েছিল। আমরা বলেছিলাম, কি করে রাজশাহী জেলে আবদ্ধ রাজীদের উপর গুলী চালিয়ে তাদের হত্যা করেছিল। তারা বলল, এ সমস্ত ঘটনা জনসভায় বলার সময় জনতা এতই উত্তেজিত হয়ে উঠছিল যে, তাদের মধ্যে নিকটস্থ থানা ও সরকারী অফিস আদালত আক্রমণ করার মত মনােভাবের সৃষ্টি হয়েছিল। তারপর ৫২-এর ভাষা আন্দোলন। ঐ সমস্ত দেখে শুনে জনতা মুসলিম লীগকে আস্তাকুড়ে ছুঁড়ে দেওয়ার দৃঢ়সংকল্প গ্রহণ করল। তারা এও বলল, সমগ্র নির্বাচন কালে কোথাও এমন কোন উস্কানিমূলক বা হঠকারী কাজ হয়নি যার সুযােগ নিয়ে সরকার নির্বাচন বানচাল করে দিতে পারত। সে সময় জনতা যে ধৈৰ্য্য, যে সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছে তা পার্লামেন্টারী রাজনীতিতে অতুলনীয়। যতদূর মনে পড়ে এ.টি বারী সুয়েজ সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে নাসের কর্তৃক তাঁর কাছে প্রদত্ত একটি টেলিগ্রাফ পড়ে শােনাচ্ছিলেন। কিন্তু এর সঠিক সময়টি আমার পক্ষে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
সুয়েজ সংকটের সময় ঢাকার ছাত্ররা এখানে বৃটিশ হাই কমিশন অফিসে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। নাসের টেলিগ্রামে বলছিলেন যে, তিনি জানেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) ছাত্র-জনতা তার পিছনে রয়েছে। তিনি তাদের আন্তরিক অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। মধ্যপ্রাচ্যের বিপ্লবী নাসের ৮০ হাজার বৃটিশ সৈন্য তাড়িয়ে দিয়ে সুয়েজকে জাতীয়করণ করেছিলেন।
২১৯
৯২(ক) ধারার পর দেশে নেমে এল এক দীর্ঘস্থায়ী অন্ধকার। এর পর যুক্তফ্রন্টের অন্যতম দুটি অঙ্গদল আওয়ামী লীগ এবং কৃষক শ্রমিক পার্টির নেতৃবৃন্দ কেন্দ্রের কূটকৌশল ও চাপের কাছে নতি স্বীকার করে যুক্তফ্রন্টের আদর্শকে বিসর্জন দিল সে কথা সকলেরই জানা আছে। সে সময় অর্থাৎ ১৯৫৪ এর ৯২ (ক)। ধারার পর ১৯৫৮ অর্থাৎ আয়ুবের মার্শাল ল’ এর মধ্যবর্তী সময় ও কিছু আগে পরে যে ভাবে পূর্ব বাংলার এমনকি কেন্দ্রেও সরকারের রদবদল হয়েছে তা ঠিক সার্কাসের পুতুল খেলার মত মনে হয়। মনে হয় কোন অদৃশ্য শক্তি পর্দার আড়াল থেকে সুতাে টানছে আর এক পুতুল কেউ এক প্রধানমন্ত্রী, কেউ গভর্নর জেনারেল, কেউ গভর্নর ইত্যাদি রূপে মঞ্চে উঠছে নামছে-নাচছে। এই অবসরে কেউ হলিউডে যাচ্ছে, কেউ তাস খেলছে, কেউ হজ্জ্বে যাচ্ছে । কত রং, কত ভােজবাজি। অবশ্য এই পুতুলদের পর্দার আড়াল থেকে যে অদৃশ্য শক্তি খেলাচ্ছিল সেই ইঙ্গ-মার্কিন-রুশ প্রভুরা ঐ সময় আরও ছােট বড় কত সার্কাসওয়ালার আবির্ভাব। ঘটিয়েছিল তা কে না জানে। সুখের বিষয়, এরই একটা ফাকে আমরা বেরিয়ে আসছিলাম। যে জনতা এতবড় আন্দোলন করে আমাদের বের করে আনল, সে জনতার জন্য আমরা কিছুই করতে পারলাম না। পুতুল খেলার এক অংকে আবার বেরিয়ে এল জনতা ভুখা মিছিলে-পূর্ব বাংলার আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আরােহণপশ্চিমাদের তাড়াব কিন্তু বৈদেশিক নীতিতে আমেরিকা থাক, অর্থাৎ অদৃশ্য শক্তির হাত থেকে সুতাে আনার দরকার নেই। না, মাওলানা নারাজ। এল কাগমারী, এল। নতুন কথা, ন্যাপ, আমরা কমুনিস্টরা, দীর্ঘ কারাবাসে ক্লান্ত-শ্রান্ত তা নিয়েও যথাশক্তি জনতার সঙ্গে মিশে থাকলাম কিন্ত তাদের নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা। আমাদের ছিল না। ৫৮-এ নির্বাচনের কথা হচ্ছে, ন্যাপ, আওয়ামী লীগ সারাদেশ। চষে বেড়াচ্ছে। কম্যুনিস্টরাও আছে-জনতাও পুতুল খেলার হাত সাফাই ধরে। ফেলেছে। পুলিশও স্ট্রাইক করে। আর পুতুল খেলা নয়, মার্শাল খেলা, স্টেজ। ভেঙে দাও, লাইট নিভিয়ে দাও, এবার সুতাের টান নয়, বন্দুকের কুঁদো।
২২০

তিয়াত্তর
গত ১৯৪৮ থেকে ৫৫-এই সাত বছর কী বাইরে কী ভিতরে মুসলিম লীগ যে জঘন্য অত্যাচারে চালিয়েছে তার কতটুকুই বা আমরা জনসাধারণের কাছে তুলে। ধরতে পেরেছি। সেই অন্ধকার যুগের বহু কিছুই আজও অন্ধকারের অতল গহ্বরে নিমজ্জিত। ১৯৪৮ সালে কম্যুনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসের প্রস্তাব গ্রহণের পর হাজং, নাচোলে কৃষি-সংগ্রাম শুরু হবার পর, সাধারণভাবে সমস্ত দেশে সন্ত্রাস সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে তারা যে কত লােককে বাইরে হত্যা করেছে, কত গ্রাম, ঘর, বাড়ী পুড়িয়ে দিয়েছে আর ইয়ত্তা নেই। কত কিশাের, যুবক, বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে নানা অজুহাতে জেলে পুরেছে, তা বলে শেষ করা যায় না। যে সমস্ত কিশাের যুবকদের জেলে পুরেছে তাদের মধ্যে মনে পড়ে বরিশালের গােপাল দাস, বিনােদ গুহ, পঙ্কজ দাস, বিনােদ দাস, নারায়ণ সাহা, সিলেটের অনিমেষ ভট্টাচার্য, প্রিয়ব্রত দাস, অনন্ত দেব, বগুড়ার সত্য ভট্টাচার্য (বাচ্চু), শ্যামাপদ সেন, চট্টগ্রামের রাখাল দাস, নওগাঁর আনিসুর রহমান, বরিশালের আজাদ সুলতান, নারায়ণগঞ্জের মােস্তফা সারওয়ার, কুষ্টিয়ার আমীনুল ইসলাম প্রভৃতি। এছাড়া প্রায় প্রত্যক জেলা থেকে বহু শত ছাত্রকে ধরে জেলখানায় আটক করে রেখেছিল। ধরে এনেছিল মুক্তাগাছা জমিদার পরিবার থেকে দুটো ছেলেকে। অনেক পরীক্ষার্থীকে ধরে এনে তার পড়াশুনা বন্ধ করে দিয়েছিল। অবশ্য শেষের দিকে কিছু কিছু ছাত্রকে পরীক্ষা দেওয়ার সুযােগ দিয়েছিল।
আমরা ঢাকা জেলে এই সমস্ত ছাত্রদের পরীক্ষা দেওয়ার ব্যাপারে তাদের সাহায্য করতে পেরেছিলাম। এইসব কিশােরদের মধ্যে বিশেষ করে মনে পড়ে নেপালের অধিবাসী লালবাহাদুর থাপার কথা। একেবারে খাঁটি নেপালী। সে সিলেটের কোন এক দোকানে দারােয়ানের কাজ করত। বয়সে ১৪/১৫ বছরের হলেও একটি নেপালী ছেলের হাতে ভেজালী থাকলে সে আর কিছুরই পরওয়া করে না। দোকানদারের সঙ্গে কি নিয়ে একটু ঝগড়া হওয়ায় সে ভারতে চলে যাচ্ছিল। পথে তাকে ভারতের চর বলে ধরে জেলে নিয়ে এসেছে। এর চেয়ে নির্মমতা আর কী হতে পারে। একেবারে বর্ণজ্ঞানহীন সরল এই নেপালী ছেলেটি নিতান্ত পেটের দায়ে দোকানে দারােয়ানী করছিল। রাজনীতির ‘র’ও সে বােঝে না। তাকে ভারতের চর বলা হয়েছে। তার সঙ্গে যখন আমার ঢাকা জেলে দেখা হয় তখন তার তিন চার বছর জেল খাটা হয়ে গেছে। ছােট গােলগাল চেহারা, ছােট
২২১
চোখ দুটি মাংসল মুখমন্ডলের মধ্যে টিপ টিপ করছে। ওষ্ঠদ্বয় পুরু, বলিষ্ঠ চেহারা। বেশ কিছু দিন এ দেশে থাকায় বাংলা বলতে পারে । তাকে আমরা নিঃসঙ্গ মনে। করতে দিইনি। খেলাধুলা, নানা রকম আমােদ প্রমােদের মধ্যে দিয়ে তার মন সতেজ রাখতে চেষ্টা করেছি। ক্রমে ক্রমে তার সঙ্গে সহজভাবে রাজনৈতিক আলাপ করা হতাে। ধীরে ধীরে সে অনেক কিছুই বুঝতে পেরেছিল। পরে তার লেখাপড়ার দিকে আগ্রহ জন্মে। আমি তাকে বাংলা ইংরেজি শিখাতাম। সে মােটামুটি বাংলা লিখতে পারতাে। একদিন দেখি সে তার খাতায় এক গল্প লিখে নিয়ে এসেছে। গল্পটি আমি আমার খাতায় তার দ্বারাই লিখিয়ে নেই- খাতাটি এখনও আমার কাছে রয়েছে। গল্পটি নিমরূপ, ঠিক গল্প নয়- তার মনের ভাব । “একদিন একটি সুন্দর পাখি কোথা থেকে উড়ে এসেছে। সে এসে এ দেশের একটি পাখির সঙ্গে বন্ধুত্ব করল । এবং কিছুদিন পর তাকে নিমন্ত্রণ করে তার দেশে নিয়ে গেল । সে দেখল, যে দেশে সে এসেছে তার নাম আমেরিকা। ঐ পাখিটি তখন আর থাকতে চাইল না। সে বলল, এটা সাম্রাজ্যবাদীর দেশ, এখানে শােষণ । কিন্তু সে আর আসতে পারল না। তাকে ওখানের লােকে মেরে খেয়ে ফেলল।” এতটুকুই সে লিখেছিল । দেখলাম, আমেরিকার ধনীরা যে দেশ শােষণ করে তা সে বুঝে এবং সেই কিশাের, সরল নেপালী ছেলেটি বড় বড় বাংলা অক্ষরে ঐ কথা ক’টি লিখে আমাকে দেখাল। মনে হলাে, নেপালের পাহাড়ের গহ্বরে অগ্নি সৃষ্টি হয়েছে বা তখন জালামুখের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
আমি বিস্মিত হলাম। ভাবলাম একেই বলে ভস্মাচ্ছাদিত বহ্নি। আজ যে কয়টি ভাঙ্গা ভাঙ্গা কথা সে বাঁকা লেখার মধ্য দিয়ে প্রকাশ করল অদূর ভবিষ্যতেই এই হয়ত এক হাতে লেখনি, আর এক হাতে বন্দুক নিয়ে সাম্রাজ্যবাদের মৃত্যুকাল ঘনিয়ে আনবে। ক্রমে যখন সে সবাইর সঙ্গে সহজ, স্বাভাবিক হয়ে এল, তখন কেউ কেউ তাকে ‘গুর্খারা বৃটিশ ভক্ত, ব্রিটিশের হয়ে লড়াই করাই তাদের কাজ ইত্যাদি বলে ক্ষেপাত । দেখতাম এতে লাল বাহাদুর খুবই ব্রিত বােধ করত । সে কোন জবাব দিতে পারত না। তখন নেপালে কৈরালার যুগ। নেপালেও চলছিল প্রবল গণ-আন্দোলন। ওকে বললাম সে কথা। তখন ওর মন খুব তাজা হলাে। বলল ‘খবরের কাগজে নেপালের কথা উঠলে আমাকে দেখাবেন।
একদিন কথায় কথায় ও আমাকে দুটি নেপালী গান শােনাল। আমি ওর কাছে এর বাংলাও শুনে নিলাম এবং একটির কাব্যানুবাদও করলাম । অন্যটির অর্থ আজ মনে নেই। দুটি গানই আমি সঙ্গে সঙ্গে খাতায় টুকে নিলাম। সেখান থেকেই তুলে
দিচ্ছি :
২২২
কাঁদৈই মা রাইফেল হাতৈই
মা গুলী।
জানুমা পরিয় জারমানক
ধাইও মা।
সফ সিপাই বন্দাইছ কান্দছি
কান্দছি।
রাজা মা সাহেবকো নকরি মাই
গরচ্ছ,
হুকুমই যদি না শুনে
ভনে,
পাঠাওনছ লয় লয়
জলৈমা।
ধাওই মা জানছ, গুলী
মা করছ
মারছু লয় লয় আমৈ বা
বাবই।

অনুবাদ :

আমার কাঁধে রাইফেল,
হাতে গুলী।
ওরা বলছে জার্মানদের বিরুদ্ধে আমার লড়াই,
সিপাইদের চোখে অশ্রু নেমেছে।
রাজা সাহেবের নােকর
আমি।
হুকুম যদি না শুনি ওরা আমায় বন্দী করবে, জেলে পুরবে ।
কিন্তু কোথায় কার বিরুদ্ধে
আমার লড়াই,
কোন মা-বােনের বুক আমার রাইফেলের গুলীতে বিদ্ধ হবে?
বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের কামানের খােরাক শান্তিপ্রিয় সাধারণ সৈন্যদের এই যে জিজ্ঞাসা চিহ্ন- তা যেন সমগ্র বিশ্বব্রহ্মান্ড পরিবেষ্টন করে আছে। জবাব অবশ্য দিয়েছিল- স্টালিনগ্রাদ, হুপে-হুনান, দিয়েন বিয়েন ফু, কিন্তু সে মহা জিজ্ঞাসার আজও নিরসন হয়নি।
২২৩

চুয়াত্তর
পূর্বেই বলেছি, তার কাছ থেকে আর একটি গানও লিখে নিয়েছিলাম। এর কোন অর্থই আজ মনে করতে পারছি না। তবে যতদূর মনে পড়ে তার বলার ভঙ্গীতে মনে হয়েছিল এটি কোন প্রেম নিবেদনের গান বা ঐ জাতীয় কিছু হতে পারেঃ
সাইরঙ্গে নদী ইউচিস পানী,
সসমল মা তমল
নক্কলে গাও মা
সাথী কো ন্যম্মা।
মবসু তপস,
এতিমা চরকো
ঘানৈমা হুজুর,
মভয়ে কালাে।
লালবাহাদুর থাপাকে দেখলে মনে হতাে নেপালের পাহাড়ের কোন গুহা থেকে প্রস্তরময় শরীর নিয়ে বেরিয়ে এসেছে এক আদিম মানব সন্তান। মনে হয় পর্বতেরই সন্তান যেন। তাকে দেখলে মনে পড়ে কামিনী রায়ের কবিতা :
আমি চাই শিশু হেন।
উলঙ্গ পরাণ,
মুখে মাখা সরলতা- কয়লা
সাজানাে কথা,
জানে না যােগাতে মন করি।
নানা ভান।
আজ সে কোথায়, বেঁচে আছে কিনা তাও জানি না। কিন্তু তার স্মৃতি আমার মনে বিপুল আনন্দের সৃষ্টি করে। আমি ‘নেপালী’ নাম নিয়ে তার সম্বন্ধে একটি কবিতা লিখছিলাম- তার কয়েকটি লাইন নিম্নরূপ-
বাহাদুর বলছিল
২২৪
আর কিছুই জানি না আমাদের
শুধু জানতে হয় কেমন করে
গুলি ছুঁড়তে হয়। উড়িয়ে দিতে মাথার খুলি
লাখাে মানুষের
কিন্তু আর নয়,
জেগে উঠেছি আমরা কঠিন
বিদ্রোহে,
জেগে উঠেছি আমরা গ্রামে
গ্রামে শহরে শহরে,
আমাদের রাইফেলের লক্ষ্য
গিয়েছে ঘুরে।
এবার খতম করব রাজ
রাজাদের ।
খতম করব শ্বেত প্রভুদের।
নেপাল হবে স্বাধীন সুখী
শােষণহীন।
এমনি মনে পড়ে বরিশালের বিনয় গুহ, পঙ্কজ, রাজশাহীর আনিস, চট্টগ্রামের রাখাল, সিলেটের অনিমেষ, বগুড়ার বাচ্চু, সেই কৈশােরেই তারা আত্মত্যাগের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু বিপ্লবের ব্যর্থতা তাদের অনেকের জীবনে এনে দিয়েছে। হতাশা, সংশয়। অনেকেই গা ঢেলে দিয়েছে এক গতানুগতিকতার স্রোতে।
জেলে আমার কবিতাবলী
কবিতা আমি বেশী লিখিনি কোন দিন। বাইরেও নয়। যতদূর মনে আছে। কলেজ জীবনে সেই ১৯৪২ সালের কথা। একটি কবিতা লিখে আমার বাংলার অধ্যাপক শ্রদ্ধেয় হেমন্ত গাঙ্গুলী (ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট)কে দেখিয়েছিলাম। তিনি কবিতাটি পড়ে তার মনের গভীরে সমাহিত চোখ দুটি মেলে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন, কোন কথা বললেন না। আমি জিজ্ঞেস করলাম, স্যার এর নাম কী হতে পারে। তিনি কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, এর নাম দাও ‘অসীমের ভিখারী। ও নামের তাৎপর্য নিয়েও আর আমি চিন্তা করিনি। সেই কবিতার উৎস ছিল কী তাও আজ মনে নেই। কিন্তু আধ্যাত্মিকতা যে নয় সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত। তখনই আমার চিন্তা জগতে চলছিল ভীষণ আলােড়ন । মার্কসবাদ তখনও
২২৫
আয়ত্ত করতে পারিনি। কিন্তু সমস্ত রকম ধর্মান্ধতা থেকে মুক্ত। শ্রেণী সংগ্রাম বিবর্জিত অহিংসার উপর এবং সন্ত্রাসবাদের উপর বিতৃষ্ণা । চিন্তার ক্ষেত্রে এই মােড় ঘুরানাের সময় কোন কবিতা লেখা হয়নি। শুধু নিঃসর্গ নিয়ে কবিতা লেখা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। কারণ তখনই মানুষকে, শুধু মানুষকেই আমার সমস্ত সত্তার স্বীকৃতি হিসেবে দেখতে শুরু করেছি। অথচ তাদেরকে মুক্ত করার বৈজ্ঞানিক পথও আমার জানা ছিল না। তাই জেলে এসে বিভিন্ন ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যে, প্রত্যক্ষ সংগ্রামের মধ্যে, তা যত সীমাবদ্ধই হােক এবং মার্কসবাদ সম্বন্ধে পড়াশুনা করে মানুষকে যখন প্রকৃতির এক অনিন্দ্যসুন্দর অঙ্গ হিসেবে বুঝলাম, সর্বহারা ও সংগ্রামী মানুষের জীবন তথা শ্রেণীসংগ্রামকে যখন বিশ্বের পরিচালিকা শক্তির একমাত্র উৎস হিসেবে জানতে পারলাম- তখনই পেয়েছিলাম বাস্তব থেকে সৃষ্ট রােমান্টিকতা বা মহৎ আবেগ সৃষ্টি করতে । এই আবেগ আমার কাছে খন্ড কিছু ছিল না। আদি জীবন সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের কবিতা তখনই পড়েছিলাম যেমন “শৈবালে শৈবালে তৃণে, শাখায় বল্কলে পত্রে উঠে সরসিয়া নিগূঢ় জীবন রস।” তাই আদি সৃষ্টিতে একটি ঘাসের উগমের মত মানুষের সৃষ্টি এবং সেই সৃষ্টির অবিরাম প্রবাহ যখন শ্রেণী সংগ্রামের মধ্যে দেখতে পেলাম তখনই সম্ভব হলাে আমার পক্ষে কবিতা লেখা । অল্প কথায় বললে আমার কবিতার একটি নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তা হলাে বাস্তব ও ঘটনাভিত্তিক। সেই সমস্ত ঘটনাবলী যার সূত্র ধরে এক অখন্ড বিপ্লবী সৌন্দর্যের দিকে এগােনাে যায় তাকে কেন্দ্র করেই আমার কবিতা । তবুও যেমন বিপ্লবের ক্ষেত্রে, তেমনি চিন্তার ক্ষেত্রে, সাহিত্যের ক্ষেত্রে স্তর পরম্পরা এগুতে হবে। কোন স্তরকে সম্পূর্ণ এড়ানাে যায় না। তত্ত্বে ও মুখে আমরা যত প্রগতিশীলতার বড়াই করিনা কেন একটু গভীরে নাড়া দিলে দেখা যাবে কী আদিমতা সেখানে বাসা বেঁধে আছে। দুঃখ আমাদের তথাকথিত বিপ্লবীরা আজও একথা বােঝেননি।
২২৬

পঁচাত্তর
জেলের সেই কবিতাগুলি আমি বাইরে নিয়ে আসতে পারি নাই। সর্বমােট কুড়ি-পঁচিশটি কবিতা হবে। লিখছিলাম ‘একজোড়া মােজা’ নাম দিয়ে একটি কবিতা। একদিন শীতের সন্ধ্যায় (ঢাকা জেলে) লকআপের কিছু পূর্বে খালি পায়ে হাঁটছি, সঙ্গে সিলেটের বিজন পুরকায়স্থ। বলতে কি, বিজন নিজেই ছিল একটি কবিতা । অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ, ঋজু দেহ, ছন্দায়িত চলন ভঙ্গী, বিজন ছিল মৃগনাভি কস্তুরীর মত বিপ্লবের আনন্দে আপনিই আকুল। তার ছিল সুন্দর দেহকান্তি । চলতে চলতে এক সময় বললাম পায়ে ঠান্ডা লাগছে। বিজন বলল, “আপনার মােজা নাই?” বললাম ‘না’ । সে তখন আর কোন কথা বললনা। রাতে বিছানায় শুতে গিয়ে বালিশ নাড়তেই দেখি তার নীচে এক জোড়া হলদে রং এর মােজা । বুঝলাম বিজনই রেখে গেছে। এমনিতে আমি নিতে চাইবাে না বলে গােপনে রেখে গেছে। কবিতার পঙক্তি মনে নেই। লিখছিলাম তরুণ বিপ্লবীরা আমাদের মরতে দেবে না। এ মােজা যেন তাদের হৃদয়ের আবেগ উষ্ণতারই এক অনন্য রূপ। লিখছিলাম এমনি করেই বিপ্লবীরা বরফে জমে গেলেও পরস্পরের নিশ্বাস দিয়ে। পরস্পরকে উষ্ণ রাখে। আর একটি কবিতা- সাত সাতটি রুদ্ধ বসন্ত’। কয়েকটি লাইন এখানে তুলে দিচ্ছি :
পাখি যেমন চেয়ে থাকে
খাঁচা থেকে দূর দিগন্তে
তেমনি চেয়ে থাকি গরাদের
ফাক দিয়ে নীল আকাশের দিকে।
এমন সুন্দর নীলাকাশ যেন পান্ডুর
হয়ে আসে চোখে
বিশীর্ণ বিবর্ণ লাগে, বৃক্ষের সবুজগুলি ।
… … …
কাকগুলি উড়ে আসে বাইরে
থেকে ভাত খেতে,
কখন তাড়া খেয়ে স্বচ্ছন্দে উড়ে
যায় বাইরে আকাশে,
আর আমি, লৌহগরাদের
২২৭
বেষ্টনী আমার চার পাশে,
মেরে ফেললেও এক পাও নড়তে
পারব না আমি।
আমার অফুরন্ত যৌবন ঠুকে
মরল জেলের দেয়ালে
আমার জীবন ফুসে ফুসে উঠে।
রুদ্ধ আবেগে।
সাত সাতটি বসন্ত কেটে গেল
বাইরের জীবনে
কোকিলের ডাক যেন অস্পষ্ট
হয়ে গেছে স্মৃতি থেকে।
… … …
তবুও তাে বেঁচে আছি।
ভাবছি বাইরে যাব
যাদের ভালবেসেছি তাদের
আবার ভালবাসব।
আজও তো কৃষাণ কৃষাণীরা
মরে অনাহারে
আজও তাে মজুররা কাজ করে
পেটে পাথর বেঁধে।
আমি চেয়েছিলাম কেউ
থাকবে না অনাহারে
হাসির ফোয়ারা ছুটবে
প্রতি ঘরে ঘরে,
আমার কাজ এখনও
বাকি রয়ে গেল,
মরব না আমি কাজ যে ,
আমার ফুরােয়নি এখনও।
ঢাকা জেল ১৭/৭/৫৫ইং
এছাড়া লিখেছিলাম সিগারেটের ধোঁয়া নাম দিয়ে একটি কবিতা। খাপড়া ওয়ার্ডে গুলী বর্ষণের আগের দিন শহীদ কমরেড আনােয়ার একটি সিগারেট খেতে খেতে বলেছিল কাল হয়ত আমরা এই সিগারেটের ধোঁয়ার মতই উড়ে যাব।’ নিকটেই দাঁড়িয়েছিলাম আমি। আমরা প্রতিদিনই সরকারের আক্রমণের আশঙ্কা
২২৮
করছিলাম। তাই সন্ধ্যার প্রাক্কালে গেটে পাহারা দিতে হতাে রুটিন করে। আমরা কয়েকজন দাড়িয়েছিলাম গেটে- দেখলাম বাস্তব কল্পনার চেয়ে কত মােহনীয় হতে পারে অথবা সংগ্রামী কল্পনা কত দ্রুত বাস্তবের রঙে রঞ্জিত হতে পারে।
তার পরদিনই মৃত্যুকে এমনভাবে আলিঙ্গন করতে পেরেছে কে? কবিতার একটি পংক্তি হয়ত এরূপ হবে : হঁ্যা আনােয়ার নেই, সিগারেটের ধোঁয়ার মতই সুবাস ছড়িয়ে গেল সে।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের জয়ের পর একদিন হঠাৎ চোখে পড়ল ঢাকা জেলের কোণের বিরাট অশ্বথ গাছটি ভরে গেছে নতুন পাতায়। সে কী সবুজের সমারােহ। কবিতার নাম দিলাম ‘অশ্বথ’। কবিতার পংক্তি মনে নেই। কথাগুলি নিমরূপ ঃ আকাশের নীল সমুদ্রে ভাসমান একখানা নৌকা চলছে মঞ্জিলের দিকে। এতে পাল খাটান হয়েছে- এক কুড়িরও বেশী ।
তাছাড়া কোরবানী’ কবিতায় লিখলামঃ
* * *
আমরাও দিয়ে চলেছি কোরবানী
দেখ, সারা দেশ পরিণত
হয়েছে বধ্যভূমিতে
প্রতিদিনই কোরবানী দিতে
হয় আমাদের,
আমাদের বরকত, ছালাম, রফিক
নবযুগের ইছমাইল এরা।
* * *
ব্যর্থ হবে না আমাদের কোরবানী,
ঐ আলী, আইক, চার্চিলের
আসন টলছে,
সারা দুনিয়া আমাদের
ঈদগাহ,
সারা শহীদ আমাদের
ইছমাইল।
(ঢাকা জেল)
এছাড়া আরও যে কয়টি কবিতা লিখছিলাম ওগুলাের নাম ছিল যথাক্রমে নেপালী, বিনয় গুহ, লেনিন, ওরে, ওরাও জেগেছে (মেয়েদের উদ্দেশ্যে) মে ডে, শুকরিয়া দিবস, সাথী।
২২৯
একদিন মনে পড়ে রাত্রে ঘুম হচ্ছিল না। হঠাৎ পিছন থেকে কে এসে শহীদ ভাই’ ঘুম হচ্ছে না বলে পিঠে হাত বুলাল। তাকিয়ে দেখি স্নেহভাজন আমীনুল ইসলাম। কুষ্টিয়ার এই তরুণ যুবক বর্তমানে ব্যারিস্টার এবং এস, সি- এ, সদ্য ইউরােপআমেরিকা ঘুরে এসেছে। তাকে উদ্দেশ্য করে আমার লেখা ‘সাথী’ কবিতা।
… … …
রাত হয়েছে অনেক
কারাগারের পাষাণ কক্ষে
অন্ধকারগুলাে যেন
মৃত্যুর মতই ভয়ঙ্কর,
যেন ওরা পিষে
মারতে চায় আমাকে।
শুতে গিয়েও শুতে পারলাম না ।
পাষাণ কক্ষকে যেন
মনে হলাে কবর,
জানালার গরাদগুলি যেন
আজরাইলের
আঙ্গুলের মতই হিংস্র।
ক্ষণিকের তরে হলেও
হারিয়ে ফেললাম
নিজেকে অর্থহীন মনে হলাে
আকাশের তারাগুলি,
গাড়ীর হুইসল যেন মৃত্যুর
আর্তচিৎকার।
হঠাৎ স্পন্দিত হলাে
সারা দেহ,
কে যেন মৃদু হাত বুলাল
পিঠের উপর
‘সাথী’ মৃদুস্বর ভেসে আসল
কানের কাছে
চেয়ে দেখলাম তােমাকে
যাদের নিয়ে মৃত্যুর মধ্যেও
বেঁচে আছি।
তাদেরই একজন তুমি
২৩০
তােমার মৃদুস্পর্শ যেন বলল,
‘সাথী’ ভয় কি আমাদের
সারা মেহনতী মানুষের
শক্তি আমাদের বুকে
রক্তপতাকার মত নাচছে
আমাদের হৎপিন্ডগুলি,
তুমি বললে, ফ্যাসিস্টরা আমাদের মেরে
ফেলতে চায়,
ওরা কি দেখছে না লৌহকারায়ও পাশাপাশি
দাঁড়িয়ে লড়াই
করছি আমরা আমাদের শক্তি জুগিয়ে ।
গেছে রােজেনবার্গ,
আমাদের বন্ধু শিবেনজীবন-
মরণের সাথী আমরা
মৃত্যুকে আমরা থােড়াই
পরােয়া করি ।
ঢাকা জেল
১৯/১১/৫৪ইং।
আমার উক্ত কবিতাগুলি কতখানি কাব্যরসােত্তীর্ণ হয়েছে জানি না। তবে এই সামান্য কবিতা কয়টি নিয়ে আলােচনা করলাম এ জন্য যে আজকাল বিপ্লবী ও আধুনিক কবিতার নামে এত বেশী করে কবিতা লেখা হচ্ছে যার দুটো দিকই চরমপন্থী । কেউ কবিতাকে কাব্য রসােত্তীর্ণ করতে গিয়ে এত সূক্ষ্ম রূপকের আশ্রয় নেন যাতে সেই রূপকের মধ্যেই কবিতা হারিয়ে যায়, এর বাস্তবতা তখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না। আবার সেই রূপকও কোন অব্যবহিত বা প্রত্যক্ষ বাস্তবকে। নিয়ে নয়, সেও এক কল্পিত বাস্তবতা। আবার কেউ বিপ্লবী কবিতা লিখতে গিয়ে এত বেশী বাস্তব হয়ে পড়েন, আবার সেই বাস্তবও এত স্থূল ও খণ্ডিত যে তাতে আর কাব্যের সৌন্দর্য থাকে না। থাকে না এক অখন্ড আবেগ যা কাব্যের জন্য প্রয়ােজন। এদিক দিয়ে আমাদের সুকান্ত অনেকখানি উত্তীর্ণ। তবুও এর অনেক কবিতায় বাস্তবতার পরিধি এত বিশাল যে তা প্রত্যক্ষের বাইরে গিয়ে আধুনিক রােমান্টিকতার গণ্ডি স্পর্শ করে।
২৩১

ছিয়াত্তর
আমার ধারণা এ সবের প্রধান কারণ হলাে যারা কবিতা লেখেন, তারা যত বিপ্লবী ভাববাদীই হােন না কেন, তারা নিজেরা বিপ্লবী সংগ্রামের প্রত্যক্ষ অংশীদার নন। সে জন্য তাঁদের বাস্তবতাও হয় কষ্টকল্পিত অতিবাস্তবতা। তাই তাঁদের কল্পনাশ্রয়ী কবিতাও হয় মায়ের চেয়ে মাসীর বেশী দরদ দেখানাের মত। তবুও একথা বলছি না যে, বর্তমানে এ দেশে বিপ্লবাত্মক ভাল কবিতা হয়নি। ২১শে ফেব্রুয়ারীকে কেন্দ্র করে আমাদের দেশে কয়েকটি ভাল কবিতা হয়েছে। পশ্চিমা হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়াইকে কেন্দ্র করেও বেশ কয়েকটি ভাল কবিতা লেখা হয়েছে। তবুও আমার মনে হয় ম্যাক্সিম গাের্কির লেখা, নাজিম হিকমতের কবিতা সম্বন্ধে আমাদের লেখকদের গভীরভাবে অনুশীলন করতে হবে। নাজিম হিকমত লিখতে পেরেছিলেনঃ
‘কি আগুন চাই
সিগারেট ধরাবে?
কাল বুলেটের আগুনে
ধরিও। ইত্যাদি।

সতীন সেনের মৃত্যু
এই সময়ে শ্রদ্ধেয় সতীন সেনের মৃত্যু হয়। সাধারণত কংগ্রেসী রাজনীতি করতেন বলে বা বয়ােবৃদ্ধ বলে এবং আমার কর্মক্ষেত্র গ্রামাঞ্চল ছিল বলেই এই আমরণ সংগ্রামীর সঙ্গে আমার কোন পরিচয় ছিল না। তবে যতদূর মনে হয় একবার তাকে বরিশাল টাউন হলে তার শােবার ঘরে দেখেছিলাম। অস্পষ্ট মনে আছে বলিষ্ঠ দেহ, আত্মভােলা এই লােকটিকে দেখলে শ্রদ্ধা করতে ইচ্ছে হতাে। তার সম্বন্ধে সাম্প্রদায়িকতার দোষ ছড়ানাে হয়েছিল অত্যন্ত সার্থকভাবে। প্রায় আমরা তাঁর সম্বন্ধে কিছু না জানার আগেই তাকে একজন উগ্র সাম্প্রদায়িক বলে মনে করতাম; কিন্তু বিশ্বাস করতাম কিনা তা এখন বলতে পারব না। তবে আমার মতে সুবিধাবাদী রাজনীতিকদের চেয়ে বরং আত্মােৎসর্গকারী, স্বমতে অটল, কিছু সাম্প্রদায়িকতাও ভাল। ঢাকা জেলে থাকতে হঠাৎ একদিন শুনলাম সতীন সেনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে জেলখানায় কোন আলােচনা হয়েছিল কিনা মনে নেই। কিন্তু তাঁকে যে ভাবে জেলে মারা হয়েছে, তা নিয়ে আমাদের মনে ক্রোধ ও
২৩২
ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছিল। মনে আছে ঐ সময় যশােরের শ্রদ্ধেয় কমরেড লতিফ ভাই খুব সম্ভব রংপুর জেল থেকে ঢাকায় স্থানান্তরিত হন। আমিও ঐ সময় সতীন দা’র স্বাস্থ্য সম্বন্ধে কোন সঠিক খবর জানবার উদ্দেশ্যে হাসপাতালে ভর্তি হই। সেখানে লতিফ ভাই যা বললেন তা অত্যন্ত মর্মান্তিক। তিনি বললেন যে, জল্লাদেরা রংপুর জেলেই তার স্বাস্থ্য পুরােপুরি ভেঙ্গে দিয়েছে। গান্ধীজীর শিষ্য সতীনদা জেলে নিজেই রান্না করে খেতেন। অনেক সময় জেল কর্তৃপক্ষ তাকে প্রয়ােজনীয় জ্বালানী কাঠ দিতাে না। ফলে তাঁকে প্রায়ই অনাহারে থাকতে হতাে। তাকে ১৯৫৪ সনে গ্রেফতারের পর এক রকম অসুস্থ অবস্থায় পটুয়াখালী, বরিশাল, রংপুর, পাবনা, ঢাকা প্রভৃতি জেলে থাকতে হয়েছে। এই টানাটানির ফলে তিনি ভয়ানক অসুস্থ হয়ে পড়েন। একসময় জেলখানার প্রধান চিকিৎসক সিভিল সার্জন মেডিক্যাল রিপাের্টে তাঁর অসুখের গুরুত্ব উপলব্ধি করে তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে বদলী করার কথা রিপাের্টে লিখে দেওয়ার পরও কর্তৃপক্ষ তাকে ঢাকায় আনাতে অহেতুক বিলম্ব করেন। ঐ সময় তিনি পাবনা জেলে ছিলেন। অনেকের বিশ্বাস যথাসময়ে হাসপাতালে ভর্তি করলে হয়তাে তার অবস্থা আয়ত্তে আনা যেত, কিন্তু তা হয়নি। শেষমুহূর্তে ঢাকা হাসপাতালেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ঐ সময় তাঁর শেষকৃত্য যারা করেছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মিশনের সম্পাদক ও সাবেক কৃষক-শ্রমিক পার্টির ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক সাহেবের আমরণ সাথী এস এম আজিজুল হক, অন্যজন “স্মৃতি ও সম্ভাবনা” গ্রন্থের রচয়িতা সুসাহিত্যিক রফিকুল হায়দার চৌধুরী (ঈষিকা) যিনি সম্প্রতি পাকবাহিনী কর্তৃক বুদ্ধিজীবী হত্যার । শিকারে পরিণত হয়েছেন। বলতে কি এ দু’জন চেষ্টা না করলে তার শব সৎকার আদৌ হতাে কিনা সন্দেহ।
সতীন সেনকে সাম্প্রদায়িক বলে উগ্র মুসলিম লীগপন্থীরা প্রচার করলেও যুক্তফ্রন্টের প্রবল আন্দোলনের সময় তিনি পূর্ববঙ্গে মুসলিম যুব শক্তির প্রগতিশীল ভূমিকাকে সমস্ত অন্তর দিয়ে আশীর্বাদ করেছিলেন। শুনেছি ঐ সময় তিনি বরিশাল টাউন হলে বক্তৃতায় বলেছিলেন যে, খুব সম্ভব ভাষা আন্দোলনকে লক্ষ্য করে মাত্র এই কয়েক বছরে মুসলিম প্রগতিশীল যুবশক্তি একশত বছর এগিয়ে গেছে। তিনি তা দেখে বিস্ময়ে বিমুগ্ধ হন।
বলাবাহুল্য দেশ বিভাগের পর তিনি ভারতে চলে গেলে অনেক প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারতেন; কিন্তু তিনি রয়ে গেলেন পূর্ববাংলার ভাষা আন্দোলন ও যুক্তফ্রন্ট আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করে। এদেশে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টিতে তিনি সাহায্য করছিলেন। ঐতিহাসিক কুলকাঠি হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে একবার তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন।
২৩৩
বরিশালের পুরনাে আর.এস.পি নেতা শ্রদ্ধেয় মােশাররফ হােসেন (boyভাই)। সতীনদা কুলকাঠির ঘটনায় তাঁর দায়িত্ব এড়াননি। কিন্তু বলেছিলেন কেন ব্রিটিশ এটাকে হিন্দু-মুসলিমদের শুভেচ্ছার উপর ছেড়ে না দিয়ে (মসজিদের সম্মুখ দিয়ে মিছিল নেয়া) একটা ইস্যু করে তুলল । কেনইবা মামলায় তাঁকে জড়ানাে হলাে না। তিনি এই ঘটনা দ্বারা ব্রিটিশের সাম্রাজ্যবাদী কুটনীতি তুলে ধরেছেন।
শ্রদ্ধেয় সতীন সেন আমরণ তাঁর নীতিতে অটল ছিলেন। পূর্ব বাংলার স্বাধিকার প্রশ্নে তিনি তখনই ভেবেছিলেন যে, যেভাবে পশ্চিম পাকিস্তানীরা এ দেশকে শােষণ ও শাসন করছে তাতে অদূর ভবিষ্যতে তাদের দেশ পরিত্যাগ করতেই হবে। জীবনের দীর্ঘ পঁচিশ বছর তিনি জেলেই কাটিয়ে দেন। তৎকালীন সরকার তাকে এভাবে নাও মারতে পারতেন। আমার মনে হয় তাঁর প্রগতিশীল ভূমিকার জন্যই তাঁকে জেলে জীবন দিতে হয়েছে।
২৩৪

সাতাত্তর
কয়েদীদের জগৎ
জেলখানা সৃষ্টির ইতিহাস জানি না। এখানে সে আলােচনাও নিষ্প্রয়ােজন। তবে প্রাচীন রােমেও ছিল জেলখানা। অবশ্য একথা বলা যায় যে, শ্ৰেণীসমাজে সারা দেশটাই আধা জেল সদৃশ । তাই মহাত্মা গান্ধী একবার জেল থেকে মুক্ত হয়ে বলেছিলেন, আমি ছােট জেল থেকে বড় জেলে বেরিয়ে এলাম মাত্র। সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদ দেশে যে দুর্ভিক্ষ, অনাহার, বেকার, ভূমিহীন তৈরী করে তারই অবশ্যম্ভাবী ফলস্বরূপ দেখা দেয় চুরি-ডাকাতি, রাহাজানি, লাম্পট্য, বাটপারী, পকেটমার, ব্ল্যাক মার্কেটিয়ার, মদ্যপ, মাতাল, নারী ধর্ষণকারী ইত্যাদি। ব্যক্তি মালিকানায় জমি ও সম্পত্তি নিয়ে কোন্দল, মারামারি, কাটাকাটিজনিত অপরাধে অপরাধী। দেখা দেয় শ্রেণী শােষণের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড রাজনৈতিক সংগ্রাম। এসব কিছু দমন করার জন্য শ্রেণীসমাজে জেল এক অপরিহার্য অস্ত্র। অবশ্য এ এক নরকবিশেষ। উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা এই স্থানটুকুর সঙ্গে বাইরের জগতের কোন সম্পর্ক নেই। জেলে এমনও অনেক কয়েদী দেখেছি যারা বলেছে- আমরা ইচ্ছে করেই সারা জীবন এখানে থাকি। বাইরে আমাদের কিছু নেই। মেয়াদ থেকে মুক্তি পেলেও আবার এখানে আসার ব্যবস্থা করি। এখানে রাজবন্দী ছাড়া দু’রকম বন্দী আছে। একদল হাজতী আর একদল কয়েদী। বিচার শেষে দোষী সাব্যস্ত হয়ে শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত এদের অনেককে জামিন না দিয়ে জেলে রাখা হয়। এরা হাজতী। তবে দোষী সাব্যস্ত না হলেও এই হাজতীদের কয়েদীদের চেয়ে কোন। অংশে ভাল রাখা হয় না। এর চেয়ে অন্যায় জুলুম কি হতে পারে জানি না। এখানে মানুষের কোন পরিচয় নেই। পরিচয় তার নম্বরে। টিকেটে মেটদের চাপরাসে থাকে নম্বর। সত্যি বলতে কি, ছবিতে রােমের দাসদের যে অবস্থা দেখেছি, বিংশ শতাব্দীর সভ্যতা গর্বিত রাষ্ট্রনায়কদের আধুনিক জেলগুলির অবস্থা তার চেয়ে কোন অংশে ভাল নয়।
তাদের খাওয়া দাওয়া, থাকা, এদের সঙ্গে কর্তৃপক্ষের ব্যবহার সব কিছু দেখে মনে হয় মানুষের চেহারায় একদল পশু নিয়ে এই জেলখানা!
এদের রাতে শােবার জন্য তিনটি কম্বল- একটি পাতার জন্য, একটি বালিশ হিসাবে ব্যবহারের জন্য আর একটি গায় দিবার জন্য। তাদের থাকবে একখানা
২৩৫
থালা, একটি ঘটি আর ঐ কম্বল। তাই বলা হয় ঘটি বাটি কম্বল, জেলখানার সম্বল। এছাড়া জেলে আরও একটি কথা চালু আছে তা হলাে ঃ ফাইল-ডাইলগাইল জেলখানার ভাইল। যখন তখন বসতে হবে ফাইলে (উঁচু হয়ে বসা), কথায় কথায় খেতে হবে গাইল, আর ভাতের সঙ্গে জলের ন্যায় ডাইল। এরা গােসলের সময় তিন বাটি জল পাবে (অবশ্য এগুলি বিনা বিচারে আটক রাজ বন্দীরে প্রতি প্রযােজ্য নয়), মুরির দুই পাশে এরা বাটি হাতে বসবে, একজন সিপাই বলবেধরাে বাটি, তােল জল, ঢালাে মাথায় । এমনি করে কথার তালে তালে মাত্র তিন বাটি জল দেবে। আদেশ এত দ্রুত দেওয়া হয় যে, সঙ্গে সঙ্গে অনেকে পুরাে জল তুলতে পারে না বা গায়েও ঢালতে পারে না, কারণ একটু এদিক ওদিক হলে সঙ্গে সঙ্গে শপাং শপাং। পায়খানার তেমন কোন বন্দোবস্ত নেই বলে হাজার হাজার। কয়েদী হাজতি এক অসহ্য যন্ত্রণায় দিন কাটায়। মুনাফালােভী অনেক কন্ট্রাক্টরদের দৌলতে বা জেলের স্বকীয় ব্যবস্থায়ই ওখানে কয়েদীদের খাদ্য দেওয়া হয়। এক বেলায় প্রতি কয়েদীকে চার ছটাক চাল, জেলের মাঠে তৈরী বিভিন্ন রকম শাক সবজি, পেকে শক্ত হয়ে যাওয়া ডাটা, পাতা, সপ্তাহে একদিন মাছ, মাছতাে নয় মাছের টুকরাে । এই সামান্যতম খাদ্য নিয়ে আবার জেলখানার দীর্ঘ দিনের কয়েদী সুবিধাভােগী ঝানু পাহারা মেটদের ছিনিমিনি । এই সব খাদ্যের অধিকাংশই তাদের ঘরে জমা হয় বিক্রির জন্য। ঐগুলি বিক্রি করে বিড়ি সংগ্রহ করা হয়। মােট কথা স্বল্প খাদ্য, অখাদ্য প্রভৃতি খেয়ে কয়েদী হাজতীরা পেটের অসুখে ভােগে, আমাশয় ভােগে, স্নানের অভাবে সারা গায় দেখা দেয় স্কার্বেশ বা ফোড়া, পাচড়া, চুল জট ধরে গায় উকুন পড়ে। মশা ও ছারপােকার কামড়ে সমস্ত শরীর ফুলে ওঠে- সে এক বীভৎস, নারকীয় দৃশ্য। যেখানে ৩০ জন কয়েদী থাকতে পারে, সেখানে অন্যূন একশত- সােয়া শতেরও বেশী লােক রাখে। এ অবস্থায় আমি পিরােজপুরে। এক রাত কাটিয়েছিলাম। পূর্বেই বলেছি তাতেই আমার শরীরে একরূপ সাদা উকুন পড়েছিল।
এখানে যেটুকু ভাল ব্যবস্থা আছে, বলাবাহুল্য সেটুকু ভােগ করে দীর্ঘদিনের সাজাপ্রাপ্ত পাহারারত সিপাহী জেল ওয়ার্ডার, জমাদারদের অনুগ্রহপুষ্ট কয়েদী মেটরা। অনেক মেট সিপাহীদের সাহায্যে কম্বল, হাসপাতালের বেড কভার প্রভৃতি বিক্রি করে টাকা সংগ্রহ করে। এদের গলার খােড়লে টাকা পয়সা রাখার এক অদ্ভুত ব্যবস্থা দেখলে হিমশিম খেতে হয়।
জেলের এহেন দুরবস্থা দেখেই হয়ত আমাদের প্রিয় কমরেড ধীরেন শীল লিখেছিলেনঃ
অ-ভাই দিলের মাঝে নাইরে সুখ ।
শরীরে না সহন-ন-যায় অ-ভাই
২৩৬
জেলখানার দুঃখ
জেলখানার চাইর দিকে
পােড়ানি দেবাল।
এদের মাঝে রাইখ্যা বাঁধিরে ভাই
মানুষের ছাওয়াল।
খানাপিনা পানির জ্বালায়
রে অ-ভাই
কারে বুঝাইউম,
কপালের দুঃখ
শরীরে না সহন-ন যায় ভাই
জেলখানার দুঃখ।
ইংরেজ আমলেরে পরাধীন
ছিলাম
একথা শুনি।
এ বেলা চান বা’ওটা টুইক্ক্যা
মাথায়
হলাম পাকিস্তানী
আবার ধন-জন-জান দিলাম রে
অ-ভাই
তবু গেল না কপালের দুঃখ
শরীরে না সহন না যায়…
আবার ছেলেপিলে উয়াসে
মরেরে
তারা কতই করেরে ফন্দি
বিনা দোষে হইলাম রে ভাই
জেলখানার বন্দী।
এখানে কথায় কথায় আইন, শান্তি, স্বাধীন মত করা ও একচুল নড়ার ব্যবস্থা নাই । শান্তি রক্ষার নামে এক চরম জিঘাংসাবৃত্তি চরিতার্থ করা হয় এখানে।
সশ্রম কারাদণ্ড ভােগীরা নানা রকম কাজ করে । দড়ি পাকানাে, ঘানি টানা, ডাল ভাঙা, তরকারির খেতে কাজ করা। এ ছাড়া রয়েছে নানা রকম কাজ। অনেক জেলার, ডেপুটি জেলার, সুপারদের ঘরে এরা ডজনে ডজনে গিয়ে খাটে।
এ ছাড়া রয়েছে জেল হাসপাতাল। এখানে সাধারণ রােগীর বারাে আঁনি খাদ্যই চলে যায় অন্যত্র । বােঝা যাবে না, খাতা পত্র ঠিক থাকলেই হলাে।
২৩৭
নানা রকম অপরাধের অজুহাতে বহু বাচ্চাদেরও জেলখানায় আনা হয়। এদের অধিকাংশই নাকি পিক-পকেট। অত্যাচার ছাড়া কিছুই করা হয় না এদের উন্নতির জন্য। জেলে এদের অধিকাংশই চিরদিনের জন্য স্বাস্থ্যহীন হয়ে পড়ে।
দেখেছি জেল কর্তৃপক্ষের গাফিলতির জন্য বহু হাজতীকে কোন কোর্টে পাঠানাে হয় না। বছরের পর বছর এরা জেলে পচতে থাকে। সবাই চুরি ডাকাতি করে আসে তা নয়। বহু হাজতী কয়েদী আছে যারা জমিজমা সংক্রান্ত মামলায়। শক্তিশালী জোতদার মহাজনের কারসাজিতে দোষী সাব্যস্ত হয়ে জেল খাটছে। বাইরে জোতদাররা ও সম্পন্ন গৃহস্থরা ছলে বলে কৌশলে এদের জমি অপহরণ করছে আবার এদেরই কৌশলে এরা জেল খাটছে। আমার সাত বছর জেল জীবনে যে কত সাধারণ কয়েদী হাজতীদের সংস্পর্শে এসেছি তার ইয়ত্তা নেই।
২৩৮

আটাত্তর
বাইরের জীবনের স্বাভাবিকতা থেকে বঞ্চিত হয়ে এরা জেলখানায় গড়ে তুলেছে নিজস্ব এক জীবন। তা যে কত বৈচিত্র্যপূর্ণ তা শুধু অনুভব করাই যায় । মানুষের চরম অবমাননা, অস্বাভাবিক পরিবেশে মানুষের যৌন বিকৃতি থেকে শুরু করে কত বিচিত্র ধ্যান ধারণার সৃষ্টি হয় তা কল্পনাতীত । অনেক কয়েদীকে দেখেছি। কোন অনুতাপ নেই তাদের জেল জীবনের জন্য। অনেকের কাছে এটা বড় রকমের চুরি-ডাকাতি শেখার কারখানা।
তাছাড়া এখানের অনেক প্রতিভাবান ডাকাতদের কথাই আজ মনে পড়ে- শের আলী, এনছান আলী, মুকুন্দ, খবিরউদ্দীন, কুদ্ছ মােল্লা, তরুপ আরও অনেক ডাকাতদের কথা। এরা বাইরের সমাজে সুযােগ পেলে এক একজন সমাজ সেবায় অসাধারণ বিপ্লবী কৃতিত্বের অধিকারী হতে পারত। মােগল আমলের শেষে এবং কোম্পানীর আমলের আরম্ভের এই মধ্যবর্তী সময় এবং সিপাহী বিদ্রোহের পরবর্তী সময় আমাদের দেশে ডাকাতির প্রাদুর্ভাব ঘটে। এদের মধ্যে মনে পড়ে নদীয়ার বিশ্বনাথের কথা। একটা পরাধীন দেশ বলেই এরা ডাকাত নামে পরিচিত ছিল। অবশ্য এরা ডাকাতই ছিল । পিন্ডারী সরদার আখার খা ঠগী-বর্গি এদের রাজনৈতিক ঘৃণাও ছিল। স্বাধীন দেশ হলে ওরা ইংল্যান্ডের রবিনহুড, হকিংস ব্যালের মত ইতিহাসে স্থান পেত । বিদেশী শাসকদের বিরুদ্ধে মুক্তিসংগ্রামে বা দেশীয় অত্যাচারী জমিদার-মহাজনদের বিরুদ্ধে যখন গণসংগ্রাম শুরু হয় এদেশেও দেখা গেছে রাশিয়ার মত তখনও অনেক তথাকথিত ডাকাত সর্দার জনতার পাশে এসে দাড়িয়েছে।
কোন আদর্শবাদের দ্বারা উদ্বুদ্ধ না হয়ে কিংবা কোন শিক্ষাদীক্ষা না থাকলেও দেখেছি জেলখানায় অত্যন্ত সাধারণ কয়েদী- হাজতী আমাদের কত শ্রদ্ধা করে। তারা আমাদের জন্য অনেক ঝুঁকি নিতে রাজি হয়েছে। রাজশাহী জেলে কয়েদীদের। অনশন সংগ্রাম এর একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
দুঃখের বিষয়, সরকার মনে করেন যে, চোর, ডাকাত জেলে আটক করে রাখলেই দেশ থেকে চুরি, ডাকাতি বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় এ চেষ্টা ফুটা পাত্রে জল ঢালার মত । গাছের গােড়া কেটে আগায় পানি ঢালার মত অর্থহীন।
২৩৯
সত্যি কথা বলতে কি, আজও আমার স্মৃতিতে ভেসে ওঠে এমন অনেক কয়েদী হাজতীর চেহারা যারা সমাজ ব্যবস্থার বৈগুণ্যে চার দেয়ালের মধ্যে, কিন্তু তাদের সঙ্গে মিশে তাদের অন্তরের মণিকোঠা থেকে যে জিনিসটি বের করে আনা গেছে তা বাইরের যে কোন সভ্যতাগর্বিতের চেয়েও অনেক মূল্যবান।

আমাদের মুক্তি ও জেলে আওয়ামী লীগের সৌজন্যে খাবার
১৯৫৪ সালে ৯২ ক ধারা করে এক বছর আইন সভা বন্ধ করে দিয়ে দেশে সন্ত্রাসের রাজত্ব চালিয়েছিল পাকিস্তান সরকার। কিন্তু জনতা তখন চরমভাবে বিক্ষুব্ধ। জাতীয় নেতারাও বুঝতে চেষ্টা করলেন যে, চুপ করে বসে থাকলে চলবে , যেভাবেই হােক ক্ষমতায় গিয়ে জনতার দাবি আদায় করে তাদের শান্ত করতে
পারলে তাদেরও মুছে যেতে হবে জনতার মন থেকে। তাই দেখি কৃষক প্রজাপার্টির অন্যতম জনাব আবু হােসেন সরকার মন্ত্রিত্ব গঠন করেই রাজবন্দীদের মুক্তির প্রশ্নটি সামনে নিয়ে এলেন। আমরাও পরিস্কার বুঝতে পারলাম আমাদের জন্য অতি অল্পদিনের মধ্যেই জেলের লৌহকপাট উন্মুক্ত হতে যাচ্ছে ।
২৪০

উনাশি
দীর্ঘ সাত বছর ২টি সেন্ট্রাল জেলসহ চার চারটি কারাগারের অন্ধপ্রকোষ্ঠে থেকেছি। এবার মনে হলাে প্রভাতের রাঙা আলাে কারাগারের উচ্চ দেয়ালের উপর দিয়ে আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে । আমরা যেন শুনতে পেলাম বাইরে পাখির কূজন, জনতার কল-কোলাহল। তখন শুধু আমাদের দিন গণনের পালা, কবে। কোন মুহূর্তে আমরা বেরিয়ে যাব মৃত্যুর গহ্বর থেকে জীবনের রাজপথে । কবে মুক্ত হব শত্রুর হাতের মুঠো থেকে। মিশবাে গিয়ে জনতার কাতারে। আবার কেবলই চিন্তা হতাে জনতা কি আমাদের গ্রহণ করবে? কি বা আমরা করেছি তাদের জন্য। জেলে আটকা পড়া কৃতিত্বের কিছু নয়। বাইরে যখন জনতা রক্ত দিচ্ছে, শত্রুর মুখােমুখি লড়ছে, তখন এখানে আমরা নির্বাক দর্শক ছাড়া আর কিছু নয়। বাইরে গিয়ে দ্রুত পরিবর্তনশীল জগতের সঙ্গে তাল মিলাতে পারব আমরা। কৈ এ নিয়ে তাে কোন চিন্তা দেখছি না দাদাদের।
হঁ্যা তবে একটাই সান্ত্বনা এখানে আমরা শত্রুর হাতে আমাদের রাজনৈতিক মর্যাদা ক্ষুন্ন হতে দেইনি। রাজশাহী জেলে হাসিমুখে মৃত্যুবরণ করেছে আমাদের বন্ধুরা। মনে পড়ে খুলনার বিষু বৈরাগী, বরিশালের সুশীল দে, নাচোলের যদু মাঝিসহ আরও অনেক বন্দীর কথা। মনে পড়ে সিলেটের অর্পণা পাল । কুষ্টিয়ার শিবেন রায়ের কথা। মনে পড়ে শ্রদ্ধেয় সতীন সেনের কথা। মনে পড়ে বীর নারী নাচোলের ইলা মিত্রের কথা, যিনি পুলিশের নিষ্ঠুরতম অত্যাচারের মুখেও তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করেননি বা গােপন তথ্য ফাঁস করেননি। (তিনি এখনও বেঁচে আছেন কলকাতায়)। তবুও মন দ্বিধাগ্রস্ত, পারব কি বাইরের তরুণদের রক্তস্রোতের সঙ্গে নিজের রক্ত মিশিয়ে দিতে। এরূপ নানা চিন্তায় যখন মগ্ন তখন হঠাৎ একদিন দেখলাম সারা জেল সুগন্ধে ভরে গেছে। সবাই ছুটাছুটি করছে। কী ব্যাপার!.ওপরে জানালা থেকে দেখলাম, মাথায় মাথায় ডেকচি ভরে কি আনছে ফালতুরা। নেমে দেখি মাংস পােলাও ভর্তি। অর্থাৎ বিরিয়ানি ভর্তি বড় বড় ডেকচি- একটি নয় দুটি নয়- অনেকগুলি। শুনলাম ঢাকা শহরবাসী আমাদের জনৈক বন্ধু ইয়ার মােহাম্মদ খানের নেতৃত্বে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সংগঠন আমাদের জন্য খাবার পাঠিয়েছে।
বাইরের জনতা ও তার সংগঠনের এই অভাবনীয় আপ্যায়নে আমরা অভিভূত
২৪১
হয়ে পড়লাম । মনে আছে সে কি আনন্দ ফুর্তির মধ্যে আমরা উদর পুর্তি। করেছিলাম ঘিতে চপ চপ প্রচুর মাংস সম্বলিত অত্যন্ত সুস্বাদু বিরিয়ানী দ্বারা । আমাদের সঙ্গে বহু সিপাহী এবং জেলের অন্যান্য কর্মচারীও এতে অংশগ্রহণ করেছিল। আমরাও এজন্য তাদেরকে জানালাম আমাদের আন্তরিক ভালবাসা, শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।
দেখতে দেখতে মুক্তির দিন ঘনিয়ে এলাে। তখন ঢাকা জেলে আমাদের আগে বা পরে কারা বেরােল স্মরণ নেই, তবে মনে আছে স্লিপ এল । আমি, হাসানুজ্জামান (কামাল) (বর্তমানে বাসসে কাজ করছেন), রশিদ উদ্দিন ও সদানন্দ ঘােষ বেরিয়ে এলাম বিশাল লৌহ কপাট পিছনে রেখে । বলাবাহুল্য, আমরা এক কাপড়ে বেরিয়ে এলাম । কিছুই আনতে দেওয়া হয়নি। শুনেছি ব্রিটিশ আমলে এমনি সাত বছর পর কেউ জেল থেকে বেরিয়ে এলে সে অন্যূন সাত হাজার টাকার জিনিসপত্র নিয়ে বেরিয়ে আসতে পারতাে।
যা হােক, বেরিয়ে এসেই দেখি স্নেহভাজন কুষ্টিয়ার আমিনুল ইসলামও (বর্তমানে ব্যারিস্টার ও এমসিএ) মালা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার সঙ্গে আরও একজন কে ছিল মনে নেই। অত্যন্ত সঙ্কোচবােধ করলাম। গভীর আবেগে মাথা নুইয়ে মালা গ্রহণ করলাম । অন্যান্যকে অন্য জনে মালা পরাল। তারপর আমরা যে যার পথে চলে গেলাম। সেদিনের মনের অবস্থা আজ সম্যক মনে করতে পারবাে না। আসলাম এক জগত থেকে আর এক জগতে শত্রুর শিবির থেকে জনতার শিবিরে।
মনে আছে তারই এক ঘণ্টা পরে দেশে খবর দেওয়ার জন্য নিকটস্থ এক পােস্ট অফিসে গেলাম। জনৈক পপাস্ট মাস্টারের কাছে একখানা ইনভেলাপ চাইতেই সে এমন ভঙ্গিতে বলল ‘নেহি হায়’ যে আমি একেবারে থমকে গেলাম । জিজ্ঞেস করলাম “কিউ নেহি?’ তারপর সে যা বলল তার অর্থ হলাে তােমাকে তার কৈফিয়ত দিতে হবে নাকি? মনে হলাে আমি করাচীতে বসে কথা বলছি। তার আচরণে আমি যেমন কষ্ট পেলাম তেমনি হতবাক হলাম। সামান্য একজন পােস্ট মাস্টার তারও এমন আমলাতান্ত্রিক মেজাজ! বুঝলাম সাপের লেজে এখনও বিষ আছে।
২৪২

জীবনলিপি

জন্ম
আজীবন বিপ্লবী কমরেড আবদুশ শহীদের জন্ম ১৯১৭ সালের ১৭ নভেম্বর বরিশাল জেলার চাখারের বলহার গ্রামে। পিতা মুনশী মােহাম্মদ আফতাব উদ্দীন, মাতা কাজী হামিদা। পিতা ছিলেন ধার্মিক এবং সাহিত্যপ্রাণ মানুষ। কবিতা, প্রবন্ধ ইত্যাদি লিখতেন। আবদুশ শহীদরা ছয় ভাই-বােন। বড় ভাই মওলানা হাফিজুদ্দিন ফিরুজী সাহেব প্রখ্যাত আলেম ছিলেন। বরিশাল শহর থেকে তিনি আল-ঈমান নামে একটি পত্রিকা বের করতেন ত্রিশ এর দশকে। এ পত্রিকায় পিতা আফতাব উদ্দীনের অনেক কবিতা ছাপা হয়েছে। মেঝভাই মাওলানা নুরুদ্দীন আহমদ বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ ও গবেষক। ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে তার বেশ কিছু গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। বড় বােন। নুরুন্নেসা। মেঝবােন হুরুন্নেসারও লেখালেখির হাত ছিল। জীবনের সেই দিনগুলি নামে তার একটি আত্মজৈবনিক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ছােট বােন সৈয়দুন্নেসা ছিলেন আবদুশ শহীদের যমজ।

শৈশব
জন্মের দু’বছরের মাথায় মাকে হারান আবদুশ শহীদ। মায়ের স্মৃতি বলতে বড়ির উঠানে সাদা কাপড়ে ঢাকা একটি অবয়বই শুধু মনে করতে পারতেন তিনি। মেঝ বােন হুরুন্নেসাই কোলে পিঠে করে মানুষ করেছেন তাকে। শর্ষিণা পীরের অন্যতম অনুসারী মােঃ এমদাদুল হকের সঙ্গে হুরুন্নেসার বিয়ে হলে বােনের সঙ্গে শর্ষিণা চলে যান আবদুশ শহীদ। শৈশবে খুব বেশি দুরন্তপনার সুযােগ না থাকলেও ফুটবল খেলার প্রতি ছিল প্রচণ্ড ঝোঁক। মাদরাসা থেকে আধাবেলা ছুটি পেলেই শর্ষিণা থেকে লঞ্চে চেপে, মাইলের পর মাইল হেঁটে খলিশাকোঠায় চলে আসতেন ফুটবল খেলার নেশায়। মাদরাসার কঠোর অনুশাসনে অচিরেই হাঁপিয়ে ওঠে আবদুশ শহীদের শৈশব।

শিক্ষা
শর্ষিণার পীর পরিবারের সাথে ঘনিষ্ঠতা থাকায় মাদ্রাসা থেকে আবদুশ শহীদের শিক্ষাজীবন শুরু হয়। কিছুতেই মাদ্রাসা শিক্ষার প্রতি অনুরাগী হতে পারছেন না দেখে মেঝ ভাই মওলানা নূরুদ্দীনের প্রচেষ্টায় খলিশাকোঠা হাইস্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হন। ১৯৪০ সালে সাফল্যের সাথে প্রবেশিকা পরীক্ষা উত্তীর্ণ হন। ১৯৪২ সনে চাখার কলেজ থেকে প্রথম শ্রেণীতে আই এ পাস করেন। একই কলেজ থেকে ১৯৪৫ সনে গ্রাজুয়েশন ডিগ্রি সম্পূর্ণ করেন। গ্রাজুয়েশনের জন্য বরিশাল বি এম কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন কিন্তু
২৪৩
শ্রদ্ধাভাজনদের অনুরেধে পুনরায় চাখার কলেজে ফিরে আসেন। এম এ প্রথম পর্ব। ভালােভাবে শেষ করলেও পার্টি নির্দেশে দ্বিতীয় পর্ব পাশ করা হয়নি আবদুশ শহীদের। পার্টি নির্দেশে চলে যান গােপন জীবনে।

রাজনীতি চর্চা
শৈশব থেকেই মুক্ত মনের অধিকারী আবদুশ শহীদ স্কুলের ছাত্রাবস্থায়ই বাম রাজনীতির প্রতি ঝুঁকে পড়েন এবং ১৯৪৩ সনে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য পদ লাভ করেন। নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন শােষিতের ভাগ্য পরিবর্তনের দুর্বার আকাঙ্ক্ষার শেকলে। ‘৪৩এর ভয়াবহ মন্বন্তরে গ্রামে গ্রামে বিরামহীন ঘুরে দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের জন্য কাজ করেছেন। পাক-ভারত স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে বৃটিশ সরকারের রােষানল থেকে বাঁচতে কঠোর গােপন জীবন যাপন করতে হয় তাকে। ‘৪৭ এর স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর প্রথম ঢাকা আগমণ এবং উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাবে ছাত্র-জনতার তীব্র প্রতিবাদ। ভাষার দাবীতে গ্রাম-গঞ্জের ছাত্র-শিক্ষক-জনতাও উদ্বেল হয়ে ওঠে। ভাষার এ দাবীকে সংহত ও দীর্ঘস্থায়ী করার অভিপ্রায় পশ্চিম বাখরগঞ্জ ছাত্র সম্মেলন আয়ােজনের ফলস্বরূপ ১৯৪৮ সালে গ্রেফতার হন আবদুশ শহীদ। গ্রেফতার হয়ে ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৭ বছর কারাভােগ করেন। কারাভােগের এ সময়কালেই ১৯৫০ সনের ২৪ এপ্রিল রাজশাহী সেন্ট্রাল জেলের খাপড়া ওয়ার্ডে গুলি চালনার নারকীয় হত্যাযজ্ঞের শিকার হন। গুলিবিদ্ধ হয়েও অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান তিনি। এই হত্যাযজ্ঞসহ ৭ বছরের জেলজীবন নিয়েই রচিত হয় কারাস্মৃতি’। ‘৬৯ এর গণ আন্দোলনসহ ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামে সার্বিক অংশগ্রহণ করেছেন দেশের অভ্যন্তরে থেকেই। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে পার্টি থেকে বিচ্ছিন্ন হলেও ব্যক্তি মার্কসবাদী হিসেবে নিজের প্রতি বিশ্বাস আমৃত্যু লালন করেছেন তিনি।

বিবাহ
রাজনীতি অন্তপ্রাণ আবদুশ শহীদের অনিশ্চয়তায় ভরা জীবনকে গ্রহণ করতে না পেরে প্রথম স্ত্রী তাকে ছেড়ে যান। পরবর্তীতে ১৯৬৫ সনে রাজনীতি সচেতন রাজিয়া শহীদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বােহেমিয়ান আবদুশ শহীদের সংসারী জ্ঞান তেমন না থাকলেও স্ত্রী রাজিয়া শহীদের সহায়তায় তিন সন্তান তানিয়া, জয়া ও পাভেলকে নিয়ে পরবর্তীতে কিছুটা সুস্থির জীবন কাটান আবদুশ শহীদ।

কর্মজীবন
মেহনতি মানুষের মুক্তির আকাঙখায় কলকাতা পাের্টের প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা পদে চাকুরীর প্রস্তাব, সওগাত পত্রিকায় সম্পাদকীয় বিভাগের চাকুরীসহ বহু লােভনীয় প্রস্তাব পার্টির নির্দেশে বিনা প্রশ্নে ত্যাগ করেছেন আবদুশ শহীদ। চল্লিশের দশকে গ্রাজুয়েশন সমাপ্ত করেও সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করার উদ্দেশে শিক্ষকতাকেই আদর্শ ভেবে গ্রামের প্রত্যন্ত এলাকাকে নিজের কর্মক্ষেত্র হিসেবে বেছে নেন। বৃহত্তর বরিশালের ভবানীপুর, উজিরপুর, কালিপূরী, মােমিনপুর, পাথরঘাটা, ধামুরা, কাকর, বড় বাইশদিয়া, মুলাদি, ভাসানচর, কাউয়ারচর, বাকপুর, হােগলা, ষােলক, বড়কোঠা,
২৪৪
গাববাড়ি, কলসকাঠি, কর্ণকাঠি, গাবা স্কুলসহ অসংখ্য মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক ও সহ প্রধান শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি নিজ হাতেও গড়ে তুলেছেন অসংখ্য স্কুল ও পাঠাগার। বরিশাল ছাড়াও বিক্রমপুরের লৌহজং, ষােলঘর, রুশদীসহ ঢাকার বেশ কয়েকটি স্কুলেও শিক্ষকতা করেছেন তিনি। যে কারণে সারাদেশের ছড়িয়ে আছে তার অসংখ্য ছাত্র। যাদের স্মৃতিতে একজন আদর্শ শিক্ষক হিসেবেই তিনি বেঁচে আছেন আজও।
শিক্ষকতা ছাড়া আবদুশ শহীদের জীবন একটি অংশ কেটেছে সাংবাদিকতা পেশায়। কাজ করেছেন প্রাচ্য বার্তা, গণকণ্ঠ, দৈনিক দেশ, হলিডেসহ বেশ কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে। সাংবাদিকতার পাশাপাশি কলাম লেখেন সংবাদ, দৈনিক আজাদ, দৈনিক বাংলা, ভােরের কাগজ, আজকের কাগজসহ অসংখ্য দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকায়।

সাহিত্য চর্চা
ছােটবেলা থেকেই সাহিত্যের প্রতি অনুরাগী ছিলেন। পড়াশুনা করতে পছন্দ করতেন প্রচুর। দীর্ঘ ৭ বছরের কারাজীবনে নিজেকে সমৃদ্ধ করেছেন সাহিত্য চর্চায় । জেলখানায়, জেলের বাইরে কবিতা লিখেছেন বেশ কিছু। যদিও তা খুব একটা সংরক্ষণ। করতে পারেননি নিজের বােহেমিয়ান জীবনের কারণে। তথাপি যে কয়েকটি কবিতার পরিচয় পাওয়া যায় তাতে বিপ্লবের ছোঁয়া আদ্যপান্ত । জীবদ্দশায় প্রায় ১০টির মতাে পুস্তক প্রকাশিত হয়েছে আবদুশ শহীদের। খাপড়া ওয়ার্ডে শহীদ আনােয়ার’ এর জীবনী রচনা করেছিলেন। কিন্তু নিজের অসুস্থতার সময়ে সেটি হাতছাড়া হয়ে যায় তাঁর।

অনুবাদ ও সম্পাদনা
মৌলিক সাহত্যি চর্চার পাশাপাশি বেশকিছু বইয়ের অনুবাদ করেছেন তিনি। এর মধ্যে রয়েছে চেন চ্যাঙভেঙ এর মাও সেতুঙ ও লং মার্চ, ওয়াং মাে’র যৌবনের গান ইত্যাদি। তাছাড়া কাহলিল জিবরানের একটি বই অনুবাদ শুরু করলেও অসুস্থতার জন্য সেটি শেষ করতে পারেননি। নিজে সম্পাদনা করে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কিছু গণমুখী কবিতা নিয়ে পুস্তক প্রকাশ করেন ১৯৯৪ সনে। কীর্তনখােলা নামে একটি সাময়িকী সম্পাদনা করেছেন।

সম্মাননা
শেরে বাংলা পদক, বরিশাল বিভাগ সমিতি পদক লাভ করেন মৃত্যুর পরে । জীবদ্দশায় ঢাকা বিশ্ববদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ ও ফ্যাসিবাদ বিরােধী লেখক শিল্পী সামবেশ থেকে তাকে সম্মাননা প্রদান করা হয়।

মৃত্যু
১৯৯৬ সনে বার্ধক্যজনিত কারণে অসুস্থ হয়ে বারডেম হাসপাতালে ভর্তি হন। প্রায় ৬ মাস অসুস্থ থেকে ১৯৯৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর নীতির সাথে আপােষহীন, হার না মানা এ ত্যাগী বিপ্লবীর মহাপ্রয়াণ ঘটে।