বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ কপিরাইট সমস্যা যাতে না হয় সেকারণে সকল লেখা শুধুমাত্র ‘only Readable’, ‘non-downloadable’ ও ‘non-clickable’ রাখা হয়েছে। সংগ্রামের নোটবুকের সকল নথি-পত্রিকা-দলিল-সংকলন-বই থেকে নেয়া তথ্য-ছবি-ভিডিও শুধুমাত্র গবেষণার কাজে ব্যবহার্য। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণার জন্য সংগ্রামের নোটবুক একটি অলাভজনক অবাণিজ্যিক বিজ্ঞাপনমুক্ত ডোনেশনমুক্ত স্বেচ্ছাশ্রমে গড়া প্রচেষ্টা।
একাত্তরের ঘাতক দালাল ও যুদ্ধাপরাধীদের সম্পর্কে জাতীয় গণতদন্ত কমিশনের দ্বিতীয় রিপোর্ট
গণআদালতে একাত্তরের ঘাতক ও যুদ্ধাপরাধী গােলাম আযমের বিচারের প্রথম বার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষ্যে ২৬ মার্চ ১৯৯৩ তারিখে আয়ােজিত সমাবেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি পর্যায়ক্রমিকভাবে একাত্তরের শীর্ষস্থানীয় ঘাতক, দালাল ও যুদ্ধাপরাধীদের অপরাধ উদঘাটনের কর্মসূচী ঘােষণা করে। একাত্তরে স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে এদের যাবতীয় কার্যকলাপ তদন্ত করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের যৌক্তিকতা নিরূপণের জন্য গঠন করা হয় ১১ সদস্য বিশিষ্ট জাতীয় গণতদন্ত কমিশন। বাংলাদেশের যে সকল বরেণ্য নাগরিকের সমন্বয়ে এই কমিশন গঠিত হয়েছে তাঁদের ভেতর রয়েছেন- কবি ও নারী আন্দোলনের নেত্রী বেগম সুফিয়া কামাল (চেয়ারপার্সন), সাহিত্যিক শওকত ওসমান, শিক্ষাবিদ ডঃ খান সারওয়ার মুরশিদ, বিচারপতি (অবঃ) দেবেশচন্দ্র ভট্টাচার্য, বিচারপতি (অবঃ) কে এম সােবহান, কবি শামসুর রাহমান, অধ্যাপক অনুপম সেন, অধ্যাপক এম এ খালেক, প্রাক্তন সাংসদ এডভােকেট সালাউদ্দিন ইউসুফ, এয়ার ভাইস মার্শাল (অবঃ) সদরুদ্দীন ও ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ (সমন্বয়কারী)। একাত্তরে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর প্রধান সহযােগী যুদ্ধাপরাধী গােলাম আযমকে যখন জামাতে ইসলামী তাদের দলের আমীর ঘােষণা করে, সারা দেশ তখন বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল। পাকিস্তানী নাগরিক গােলাম আযমকে দলের প্রধান নির্বাচন করে জামাতে ইসলামী বাংলাদেশের সংবিধান লংঘনের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকেও লাঞ্ছিত করেছে। সরকার এর বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা
আমকে কাও হেজামাতে গ্রহণ না করায় একাত্তরের ঘাতক দালালদের প্রতিরােধ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব নিরাপদ করার প্রয়ােজনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী বরেণ্য ব্যক্তি ও সংগঠনের সমন্বয়ে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গঠিত হয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি। এই সমন্বয় কমিটির উদ্যোগে গঠিত গণআদালতে (পরিশিষ্ট ক দ্রষ্টব্য) ২৬ মার্চ ১২ তারিখে যুদ্ধাপরাধী গােলাম আযমের বিচার হয়। আদালতের রায়ে বলা হয় তাঁর অপরাধ মৃত্যুদণ্ডযােগ্য। এরপর অপরাপর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং তাদের দল জামাতে ইসলামী সহ অন্যান্য সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিষ্ট রাজনৈতিক সংগঠন নিষিদ্ধ করার দাবিতে সারা দেশে গড়ে ওঠে ব্যাপক আন্দোলন। ১৯৯৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের অপরাধ তদন্ত করার জন্য যে কমিশন গঠন করা হয় সেটা দেশব্যাপী সংগঠিত এই জনমতের মূর্ত প্রকাশ। জাতীয় গণতদন্ত কমিশন প্রথম পর্যায়ে আটজন ব্যক্তির অপরাধ সম্পর্কে তদন্তের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং ২৬ মার্চ ১৯৯৪ তারিখে জাতীয় সমন্বয় কমিটির জনসমাবেশে এই তদন্তের রিপাের্ট প্রকাশ করে। একই সঙ্গে কমিশন আরও আট ব্যক্তি সম্পর্কে তদন্তের সিদ্ধান্ত ঘােষণা করে, যাদের ভেতর রয়েছেন, (১) এ এস এম সােলায়মান, (২) সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, (৩) মওলানা আবদুস সােবহান, (৪) মওলানা এ, কে, এম ইউসুফ, (৫) মােহাম্মদ আয়েন উদ-দিন, (৬) আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, (৭) এ বি এম খালেক মজুমদার ও (৮) ডঃ সৈয়দ সাজ্জাদ হােসেন। এই প্রতিবেদন উক্ত ৮ ব্যক্তি সম্পর্কে জাতীয় গণতদন্ত কমিশনের অনুসন্ধানের সংক্ষিপ্ত ভাষ্য।
জাতীয় গণতদন্ত কমিশন দ্বিতীয় পর্যায়ে ঘােষিত ৮ জন ব্যক্তির অপরাধ সম্পর্কে প্রকাশিত সংবাদ, দলিলপত্র, ইতিহাস বিষয়ক গ্রন্থ এবং সরেজমিনে অনুসন্ধান করে খসড়া রিপাের্ট প্রণয়নের দায়িত্ব লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবিরকে অর্পণ করেন। কমিশনের সেক্রেটারিয়েট (পরিশিষ্ট-খ দ্রষ্টব্য) সদস্যদের ভেতর এই কাজে সহায়তা করেন তরুণ সাংবাদিক ও আইনজীবীদের একটি দল— যাঁদের ভেতর রয়েছেন জুলফিকার আলি মাণিক, ইমন শিকদার, মেহেদী হাসান, প্রভাষ আমিন, ব্যারিস্টার সারা হােসেন, জাভেদ হাসান মাহমুদ, আসাদুজ্জামান, আবু জুনায়েদ সেনেকা, ফায়েজউদ্দিন আহমদ, উম্মে হাবিবা সুমী, ফয়েজ আহমেদ সেতু, মােহাম্মদ রেজা প্রমূখ। ২৩ মার্চ ‘৯৫ তারিখে জাতীয় গণতদন্ত কমিশন খসড়া রিপাের্টটি চূড়ান্তভাবে অনুমােদন করেন এবং তা প্রকাশের জন্য জাতীয় সমন্বয় কমিটির স্টিয়ারিং কমিটিকে (পরিশিষ্ট-গ দ্রষ্টব্য) অর্পণ করেন। তদন্ত পরিচালনাকালে ডঃ সৈয়দ সাজ্জাদ হােসেনের মৃত্যু ঘটায় কমিশন তাঁর সম্পর্কে মাঠ পর্যায়ে তদন্ত না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সরকারী গেজেট ও ’৭১, ‘৭২-এর সংবাদপত্রে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে তাঁর যেসব তৎপরতার বিবরণ লিপিবদ্ধ হয়েছে তার অংশবিশেষ কমিশনের রিপাের্টে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বাকি ৭ জন সম্পর্কে তদন্ত পরিচালনাকালে জানা গিয়েছে এদের কয়েকজন এখনও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে নানাবিধ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছেন এবং নিজেদের এলাকায় ব্যাপকভাবে ভয়ভীতি ও সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম রেখেছেন। এর ফলে মুক্তিযুদ্ধের সময় এদের হাতে নির্যাতিত ও ক্ষতিগ্রস্ত অনেক ব্যক্তি ও পরিবারবর্গ সাক্ষ্য প্রদানের সময় প্রাণনাশের আশঙ্কায় কমিশনকে অনুরােধ করেছেন তাঁদের নাম ঠিকানা প্রকাশ না করার জন্য। তদন্তকার্য পরিচালনা করতে গিয়ে গণতদন্ত কমিশন আরও লক্ষ্য করেছেমুক্তিযুদ্ধের বহু দলিল ও তথ্যাদি বিভিন্ন সময়ে বিনষ্ট করা হয়েছে এবং সংরক্ষিত
(১) আরাস আলী খান, (২) মতিউর রহমান নিজামী, (৩) মােঃ কামরুজ্জামান, (৪) আবদুল
আলীম, (৫) দেলােয়ার হােসেন সাঈদী, (৬) মওলানা আবদুল মান্নান, (৭) আনােয়ার জাহিদ এবং (৮) আবদুল কাদির মােল্লা।
তথ্যাদি প্রদানে সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলাের সর্বাত্মক অসহযােগিতার কারণে। যুদ্ধাপরাধ সম্পর্কিত অনেক তথ্যই উদ্ঘাটন করা যাচ্ছে না। মুক্তিযুদ্ধের সময় হানাদার পাকিস্তানী বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দালাল, রাজাকার, আলবদরদের নৃশংস হামলার প্রধান শিকার ছিল হিন্দু সম্প্রদায়, পরবর্তী কালের বৈরী সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশ তাদের আরও বেশি ভীত সন্ত্রস্ত জীবন যাপনে বাধ্য করেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় নির্যাতিত এবং নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বহু হিন্দু পরিবার গত কয়েক বছরে দেশ ত্যাগ করার ফলে তাঁদের সম্পর্কে প্রতিবেশীদের সাক্ষ্য গ্রহণ করতে হয়েছে। গতবারের মতাে বর্তমান তদন্তেও একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের অপরাধের প্রকৃতি ও মাত্রার একটি অংশমাত্র উদ্ঘাটিত হয়েছে। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের প্রকৃত অপরাধ আরও বেশি গুরুতর ও বিস্তৃত।
এ এস এম সােলায়মান
এ এস এম সােলায়মান। পিতাঃ মােঃ জোনাব আলী, সাং-গ্রাম ঃ বৈদ্যের বাজার, পােঃ বৈদ্যের বাজার, থানাঃ সােনারগাঁ, জেলাঃ নারায়ণগঞ্জ, বর্তমান ঠিকানা ঃ ২০/১, পল্লবী, থানাঃ পল্লবী, জেলাঃ ঢাকা। বর্তমানে কৃষক শ্রমিক পার্টির সভাপতি। ১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর এ এস এম সােলায়মান মালেক মন্ত্রীসভার শ্রম, সমাজ কল্যাণ ও পরিবার পরিকল্পনা দফতরের মন্ত্রী ও জেলা সমন্বয় কমিটির সভাপতি হিসেবে ঢাকা ডেপুটি কমিশনার অফিসে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, পুলিশ অফিসার ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের সভায় সভাপতিত্ব করেন। সভায় আইন ও শৃংখলা বজায় রাখার ব্যাপারে দৃঢ় সংকল্প ঘােষণা করে কতিপয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। (তথ্যসূত্র : একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায়, মুক্তিযুদ্ধ চেতনা বিকাশ কেন্দ্র, পঞ্চম মুদ্রণ, ফেব্রুয়ারী ১৯৯২, ঢাকা, পৃষ্ঠা ও ৭৯)। মুক্তিযুদ্ধের সূচনাপর্ব থেকেই এ এস এম সােলায়মান বাংলাদেশ বিরােধিতায় তৎপর হয়ে ওঠেন। ৮ এপ্রিল (১৯৭১) প্রদত্ত এক বিবৃতিতে সােলায়মান—’পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে সমাজ ও রাষ্ট্র বিরােধীদের নির্মূল করে দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার কাজে সেনাবাহিনীকে সহায়তা করার আহ্বান জানান। (প্রাগুক্ত)। স্থানীয় জনগণ ও মুক্তিযােদ্ধাদের ধরিয়ে দেবার জন্য সােলায়মান ১৯৭১ সালের ৭ মে বৈদ্যের বাজারে শান্তি কমিটির সভায় সকল সমাজ বিরােধী ও রাষ্ট্রদ্রোহী ব্যক্তিদের ভালভাবে পরীক্ষা করার আহবান জানান। (তথ্যসূত্র : প্রাগুক্ত)। ১৫ নভেম্বর ১৯৭১ করাচীতে সােলায়মান সাংবাদিকদের বলেন, ‘রাজাকাররা অত্যন্ত প্রশংসামূলক কাজ করেছে এবং তাদেরকে জাতীয় বীর বলা উচিত। (তথ্যসূত্রঃ প্রাগুক্ত)। এ এস এম সােলায়মানের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ এবং পরােক্ষভাবে সােনারগাঁবাসী হত্যা, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোেগ, ধর্ষণ, নির্যাতন ইত্যাদির অভিযােগ এনেছেন।
আমিনপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য মােঃ তৈয়বুর রহমান, গণতদন্ত কমিশনকে সােনারগাঁ থানার এগারটি ইউনিয়নে এ এস এম সােলায়মানের রাজাকার বাহিনী গঠনের পূর্ণ বিবরণ প্রদান করেছেন। তৈয়বুর রহমান জানান- সােলায়মান প্রতিটি (১১টি) ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানকে স্ব-স্ব ইউনিয়নের শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত করেন। এদের মধ্যে (১) আমিনপুর ইউনিয়নের দায়িত্বে রাজা মৌলভী, (২) পিরােজপুর ইউনিয়নে সামসুল হক খান, (৩) বৈদ্যের বাজার ইউনিয়নে আলাউদ্দিন, (৪) সম্মানদী ইউনিয়নের গফুর সরকার, (৫) জামপুর ইউনিয়নে আব্দুল মন্নাফ ভূইয়া, (৬) কাঁচপুর ইউনিয়নে হােসেন খাঁ, (৭) সাথীপুর ইউনিয়নে বাখর আলী, (৮) নােয়াগা ইউনিয়নে নাসিরউদ্দিন, (৯) বারদী ইউনিয়নে আব্দুল রব মিলকী, (১০) মােগড়া পাড়া ইউনিয়নে রফিকুল ইসলাম, (১১) সম্ভুপুরা ইউনিয়নে এম এ জাহের শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। আর এদের সকলকে পরিচালিত করেন থানা। (সােনারগাঁ) শান্তি কমিটির সভাপতি এ এস এম সােলায়মান। সােনারগাঁ থানা শান্তি কমিটির সাধারণ সম্পাদক মনােনিত হন এম এ জাহের। সাংগঠনিক সম্পাদক হন রাজা মৌলভী। থানা শান্তি কমিটির সভাপতি এ এস এম সােলায়মানের অনুপস্থিতিতে দায়িত্বে থাকতেন আলাউদ্দিন ও এ এস এম সােলায়মানের ভাই মহিউদ্দিন মােল্লা। তৈয়বুর রহমান তদন্ত কমিশনকে আরাে জানিয়েছেন— ‘৭১ এর মে মাসে শাহপুর গ্রামের শম্ভু ঘােষের বােন বিভারাণী ঘােষকে এ এস এম সােলায়মানের সহযােগী জমির আলী কেরানী পাকবাহিনীর হাতে তুলে দেয়। পাকবাহিনীর সদস্যরা বিভারাণীর উপর সারারাত পাশবিক নির্যাতন চালানাের পর অর্ধমৃত অবস্থায় ছেড়ে দেয়। বিভারাণী বর্তমানে ভারতে অবস্থান করছেন। এ ছাড়াও জমির আলী কেরানীর নেতৃত্বে পাকবাহিনী বৈদ্যের বাজার স্কুলের পূর্ব-উত্তর দিকে নরেন্দ্র প্যাটেলের বাড়িতে হামলা করে। তৈয়বুর রহমান সে সময় ঘটনা স্থলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এগিয়ে যান এবং নৌকায় করে ৫ জন যুবতী মেয়েকে পার্শ্ববর্তী আড়াই হাজার থানার দুবদাড়া গ্রামে নিরাপদে পৌছে দেন।
তৈয়বুর রহমান জানান—’৭১ এর ২৪ মে মুক্তিযােদ্ধা আনােয়ার, সােহরাব ও তিনি সহ আরাে অনেকে বৈদ্যের বাজার গড়ের জঙ্গলে বসে মিটিং করছিলেন এমন সময় সােলায়মানের নেতৃত্বাধীন রাজাকার বাহিনী তাদের উপর চড়াও হয়। তিনি (তৈয়বুর) দু’ দুবার ধরা পড়েছেন এবং স্থানীয় অবাঙালী পােস্টমাস্টারের অনুরােধে ছাড়া পেয়ে যান। তিনি আরাে জানান— ‘সন্মানদী গ্রামে শতাধিক, কোম্পানীগঞ্জে দশটি, সাথীপুরে পাঁচটি এবং পিরােজপুর গ্রামের সব বাড়িই রাজাকাররা জ্বালিয়ে দিয়ে যায়। অগ্নিকান্ড, নারী সরবরাহে জমির কেরানী ও আলাউদ্দিন এ এস এম সােলায়মানের পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করতাে। হারিয়া গােপিন্দি গ্রামের মােসাম্মৎ আজিমােন নাহার গণতদন্ত কমিশনকে জানিয়েছেন তাঁর স্বামী মােঃ সিদ্দিক মিয়াকে ১৪ ডিসেম্বর ‘৭১ সন্ধ্যা ৭ টায় আদমজী এলাকায় হত্যা করা হয়। এ হত্যাকান্ডে সােলায়মানের নেতৃত্বাধীন স্থানীয় রাজাকাররা জড়িত ছিল। তিনি তাঁর স্বামী মােঃ সিদ্দিক মিয়া হত্যার বিচার দাবী করেন।
হাতকোপা গ্রামের আওয়ামী লীগ কর্মী সুমন জানিয়েছেন— ‘এ এস এম সােলায়মানের বিশ্বস্ত অনুচর টেক্কা সামসুর নেতৃত্বে পাকবাহিনী হাতকোপা গ্রামে তাদের বাড়ি আক্রমণ করে। আক্রমণের উদ্দেশ্য ছিল বাড়ির যুবতী মেয়েদের ধরে আনা। সামসুর নেতৃত্বে পাকবাহিনী তাদের বাড়িতে ঢুকলে বাড়ির মেয়েরা পাশ্ববর্তী পাটক্ষেতে লুকিয়ে আত্মরক্ষা করে। বসন দরদী গ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা মুক্তিযােদ্ধা নুরুল ইসলাম নুরু তদন্ত কমিশনকে জানিয়েছেন- ‘ভৌগােলিক দিক থেকে সােনারগাঁ বন্দর এলাকা হওয়ায় সার্বক্ষণিকভাবে সে অঞ্চল দিয়ে পণ্যবাহী বিভিন্ন ধরনের নৌকা, ট্রলার, জাহাজ চলাচল করে। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে এ এস এম সােলায়মান রাজাকার বাহিনী গঠন করে ঐ সব পণ্যবাহী নৌযানের যাবতীয় চাল, চিনি, ময়দা, তৈল, সার, চা লুট করাতাে। ব্যবসায়ীরা পণ্য হারিয়ে এ ব্যাপারে সম্মানদী গ্রামের মুক্তিযােদ্ধা ক্যাম্পে অভিযােগ নিয়ে যেত। নুরুল ইসলাম আরাে জানিয়েছেন’৭১ এ সােনারগাঁ থানার সম্মানদী গ্রামের যােগাযােগ ব্যবস্থা অনুন্নত থাকায় মুক্তিযােদ্ধারা সেখানে ট্রেনিং ক্যাম্প স্থাপন করে। এ সংবাদ রাজাকাররা। পাকবাহিনীকে জানালে পাকবাহিনী সম্মানদী গ্রামে আক্রমণ চালায়। ২০/২৫ জন। রাজাকার সহ শ’ দুয়েক পাকসেনা সম্মানদীতে হামলা চালায়। রাজাকাররা যাওয়ার সময় সম্মানদীর দু’জন মেয়েকে ধরে নিয়ে যায়। মেয়ে দুটি পরবর্তীতে আর ফিরে আসেনি। তবে তাদের পরিবার এখনাে রয়েছে। তদন্ত কমিশন লক্ষ্য। করেছে সামাজিক ও পারিবারিক সম্ভ্রমের কারণে এ ধরনের বহু নারী নির্যাতনের ঘটনা চাপা পড়ে রয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীরা তদন্ত কমিশনকে জানিয়েছেন—শাহাপুর,বানীনাথপুর, জয়রামপুর, ভট্টপুর, বাড়িরঘুভাঙা, বাগমুছা, পানামনগর, বৈদ্যেরবাজার, সাতভাইয়াপাড়া, রামগঞ্জ ও পঞ্চবটী গ্রামে হিন্দু বসতি বেশী থাকায় রাজাকারদের দৃষ্টি ছিল সেদিকেই। এ এস এম সােলায়মানের সম্মতিতে জমির কেরানী ও সামসুর নেতৃত্বে রাজাকাররা হিন্দু নাগ বংশের যুবতী মেয়ে ও জেলে পাড়ার মেয়েদের ধরে এনে বৈদ্যের বাজারের পাকবাহিনী ক্যাম্পে সরবরাহ করতাে। এ ব্যাপারে সােলায়মানকে জানানাে হলে তিনি কোনাে প্রকার সাড়া দিতেন না বলে জানান আমিনপুর ইউনিয়ন পরিষদ মেম্বার তৈয়বুর রহমান। মুক্তিযােদ্ধা নূরল ইসলাম জানান- ‘সােলায়মান প্রায়ই খােলা জিপ নিয়ে টহল দিত এলাকায়।
এছাড়াও সােনারগাঁয়ে এ এস এম সােলায়মান কর্তৃক রাজাকার বাহিনীর ব্যাপক অগ্নিসংযােগ, লুটপাট ও গুপ্ত হত্যার বিস্তৃত বর্ণনা পাওয়া গেছে সাক্ষ্য প্রদানকারী স্থানীয় অধিবাসীদের কাছ থেকে।
সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, পিতা-মৃত ফজলুল কাদের চৌধুরী, সাং-গহিরা, থানা-রাউজান, জেলা চট্টগ্রাম। তিনি পঞ্চম জাতীয় সংসদের সাবেক এমপি এরশাদ সরকারের আমলে মন্ত্রী ছিলেন। বর্তমানে তিনি ন্যাশনাল ডেমােক্রেটিক পার্টির (এনডিপি) নেতা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ব্যাপক কার্যক্রম পরিচালনা করেন এবং পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে সর্বোতভাবে সহযােগিতা করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর এই অপতৎপরতার ক্ষেত্র ছিল চট্টগ্রাম জেলা। চট্টগ্রাম শহরের গুড় হিলস্থ নিজ বাসভবনে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী তাঁর পিতা ফজলুল কাদের চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে ও ভাই গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সহযােগিতায় আরাে অনেক স্বাধীনতাবিরােধী লােকজনকে সংগঠিত করে স্বাধীনতাবিরােধী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারীর দৈনিক বাংলা পত্রিকায় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী গংদের মুক্তিযুদ্ধকালীন কর্মকাণ্ড সম্পর্কে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে— ‘সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও তার পিতা ফজলুল কাদের চৌধুরীর “গুড সাহেবের হিলস্থ বাসায় মরহুম ডঃ সানাউল্লার এক ছেলে সহ চাটগাঁ-এর কয়েক’শ ছেলেকে ধরে এনে নির্মম অত্যাচার করত। ১৭ই জুলাই ১৯৭১-এ ছাত্র নেতা ফারুককে ধরে এনে পাক বাহিনীর সহায়তায় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী গিয়ে ‘গুডস্ হিল’ সম্পকে এ বাড়িটি ফজলুল কাদের মে মাস থেকে চৌধুরীদের বাসায় পাক বাহিনীর এক প্লাটুন সৈন্য মােতায়েন থাকত। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, ফজলুল কাদের চৌধুরী সহ তাদের পরিবার প্রায় দেড়মণ সােনা সহ পালানাের সময় মুক্তিবাহিনীর কাছে গত ১৮ই ডিসেম্বর ’৭১ ধরা পড়েন।
চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত, সাখাওয়াত হােসেন মজনু লিখিত ‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের শহর চট্টগ্রামের নির্যাতন কেন্দ্র ও বধ্যভূমি’ গ্রন্থে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বাঙালী দালালদের নির্যাতন কেন্দ্রগুলাের বর্ণনা দিতে গিয়ে ‘গুডস্ হিল’ সম্পর্কে লিখেছেন— ‘মুসলিম লীগের চরমপন্থীদের দ্বারা এ নির্যাতন কেন্দ্র পরিচালিত হতাে। এ বাড়িটি ফজলুল কাদের চৌধুরীর বাড়ি। তিনি স্বাধীনতার সূচনাতে তেমন অপরাধের সাথে জড়িত হননি, কিন্তু মে মাস থেকে মুসলিম লীগের চরমপন্থীদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পাকিস্তানী সৈন্যদের সহযােগিতা করতে শুরু করেন। এক পর্যায়ে তার গুডস হিল’ স্বাধীনতার স্বপক্ষের মানুষের নির্যাতন কেন্দ্রে পরিণত হয়। শােনা যায় এ কেন্দ্র পরিচালনার সাথে তার পুত্র সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। শহরের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে স্বাধীনতার স্বপক্ষের মানুষজনকে এখানে ধরে এনে লটকিয়ে পেটানাে হতাে। উল্লেখযােগ্য যে, এ বাড়িতে প্রখ্যাত মুক্তিযােদ্ধা ওমর ফারুককে হত্যা করা হয়েছে। আল্-বদর বাহিনীর একটি বিশেষ গ্রুপ এ বাড়ির নির্যাতনের প্রত্যক্ষ সহযােগী ছিলাে। | চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত মাহবুব-উল-আলম-এর ‘বাঙ্গালীর মুক্তিযুদ্ধের ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থের ৬৯ নম্বর পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে নিজামুদ্দিন ১৮ই নবেম্বর চট্টগ্রাম জেল থেকে মুক্তি পেয়েছে। সে বলেঃ …… আমি ধরা পড়ি ৫ই জুলাই। আমাকে ফজলুল কাদেরের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে পিঠ মােড়া করে বেঁধে ফজলুল কাদেরের পুত্র সালাহুদ্দীন, অনুচর খােকা, খলিল ও ইউসুফ বড় লাঠি, বেত প্রভৃতি হাতে আমাকে পিটাতে থাকে। পাঁচ ঘন্টা মারের চোটে আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি। ৬ই জুলাই রাত্রি সাড়ে ১১টায় আমাকে স্টেডিয়ামে চালান দেওয়া হয়। এ পর্যন্ত আমাকে কিছু খেতে দেওয়া হয়নি, পানি পর্যন্ত না। পানি খেতে চাইলেই বলা হয়েছে ঃ তুই শালা হিন্দু হয়ে গেছিস, তােকে পানিও দেওয়া হবে না। ১৩ই জুলাই আমাকে জেলখানায় সােপর্দ করা হয়। এই সময়টা আমাকে পা উপরের দিকে মাথা নীচের দিকে করে লটকিয়ে মারা হতাে। যখন নীচে নামানাে হতাে তখন সারা দিনে দুখানা রুটি ও পানি দেওয়া হতাে বটে, কিন্তু কথায় কথায় লাথি মারা হতাে।
বিপদে পড়ে আমি আলেমের ছেলে নামাজ শুরু করেছিলুম। কিন্তু নামাজের জন্য দাঁড়ালেই সৈন্যরা পেছন থেকে লাথি মারতাে, বল্তাে ঃ তুই শালা হিন্দু হয়ে গেছিস, তাের আবার কিসের নামাজ।। একই গ্রন্থে ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিলের একটি ঘটনা সম্পর্কে বলা হয়েছে—’এই তের এপ্রিলই কুণ্ডেশ্বরী ভবনে অধ্যক্ষ নূতন চন্দ্র সিংহ নিহত হলেন। গহীরা হাই স্কুলের ছাদে কামান বসিয়ে মিলিটারী সকাল থেকে চার ধারে গােলা বর্ষণ করতে থাকে। তার কোন কোনটি এসে কুণ্ডেশ্বরী ভবনকে আঘাত করছিল। অধ্যক্ষ সকলকে সরিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু, নিজে কুণ্ডেশ্বরীর মন্দিরকে আকড়ে পড়ে রইলেন। তবে মিলিটারী আসতে পারে অনুমান করে উঠানে তাদের অভ্যর্থনার জন্যে চেয়ার টেবিল সাজিয়ে রেখেছিলেন। মিলিটারী এলাে ২ খানি জীপে, এক খানির ভেতর ফজলুল কাদের চৌধুরীর বড় ছেলে সালাউদ্দীনও রয়েছে। পেছনে চারখানি ট্যাঙ্ক কুণ্ডেশ্বরীর রাস্তায় দাঁড়িয়ে। অধ্যক্ষ মিলিটারীকে অভ্যর্থনা জানালেন। তিনি তাদের বুঝিয়ে দিলেন। আমি এই কাজ করেছি, আরাে এই কাজ কর্তে চাই। মিলিটারী সন্তুষ্ট হয়ে চলে গেল। কিন্তু সালাউদ্দীন তাদের ফিরিয়ে আনলেন। তার বাবা বলে দিয়েছেন। এই মালাউনকে আস্ত রাখলে চলবেনা। সেদিন বীরত্ব ছিল যাদের হাতে অস্ত্র ছিল তাদের নহে। বীরত্ব ছিল সম্পূর্ণ নিরস্ত্র এই সত্তর বর্ষীয় বৃদ্ধের। তিনি মন্দিরের সম্মুখে বিগ্রহের দৃষ্টির সামনে সম্পূর্ণ আত্মস্থ হয়ে দাঁড়ালেন। তারা তাঁকে তিনটি গুলি করে। একটি গুলি একটি চোখের নীচে বিদ্ধ হয়, একটি গুলি তাঁর হাতে লাগে, আর তৃতীয় গুলি তাঁর বক্ষভেদ করে যায়। তিনি মায়ের নাম করে মাটিতে পড়ে যান।……… তাঁর জন্য কেদেছে হিন্দু, কেঁদেছে মুসলমান। মুসলমান যখন কেঁদেছে সালাউদ্দীন প্রবােধ দিয়েছে ঃ ‘মালাউন’ মলাে, তােমরা শােক কচ্ছ কেন?…….১৩ই এপ্রিল, ১৯৭১ শুধু কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের অধ্যক্ষ নূতন চন্দ্র সিংহের হত্যার জন্য স্মরণীয় নয়, অন্য দুইটি হত্যার জন্যও স্মরণীয়। ফজলুল কাদের চৌধুরীর পুত্র সালাউদ্দীনের পরিচালনায় গুণ্ডা বাহিনী সকাল সাড়ে দশটায় গহীরার বনেদী বিশ্বাস পরিবারে ঢুকে চিত্তরঞ্জন বিশ্বাসের পুত্র কলেজ ছাত্র ও ছাত্র কমী দয়াল হরি বিশ্বাসকে ধরে ফেলে এবং তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে।’ (পৃষ্ঠা ২৫৪-২৫৫)। | সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী গংদের বিরুদ্ধে ২৫/৪/৯১ ইং তারিখে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল্লাহ আল-হারুন কর্তৃক একটি নির্বাচনী মামলা করা হয় নির্বাচন কমিশন বরাবর।
এই মামলায় সাতজন বিবাদীর মধ্যে এক নম্বরেই রয়েছেন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। মামলায় মুক্তিযুদ্ধের সময় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর কুকীর্তির কথা উল্লেখ করে আব্দুল্লাহ আল-হারুন জানিয়েছেন, ‘১নং বিবাদী শক্তি প্রয়ােগ, হিংস্রতা ও সন্ত্রাসে বিশ্বাসী। তিনি আইন কানুনের ধার ধারেন না। নির্বাচন আচরণ বিধিতে কোন কালে তাহার কোন আস্থা ছিলনা। জনগণের ভােটেও তাহার কোন বিশ্বাস নাই। ১নং বিবাদী ১৯৭১ ইং সনে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তৎকালীন পাকিস্তানের পক্ষে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরুদ্ধে ন্যাক্কারজনক নারকীয় ভূমিকা পালন করিয়াছিলেন। তিনি বহু হত্যাযজ্ঞে ও লুঠতরাজে অংশগ্রহণ করিয়াছিলেন বলিয়া প্রকাশ।……….. তাহার বিরুদ্ধে ১৯৭২ ইংরেজী সনে দালালী আইনে চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী থানায় ১৩/৪/৭২ ইং তারিখে ১৭ নং মামলা দায়ের করা হয়। ……….. দানবীর নূতন চন্দ্র সিংহের নিষ্ঠুরতম হত্যাকাণ্ডের জন্য ১নং বিবাদীর বিরুদ্ধে রাউজান থানায় ৪১ (১) ৭২ নং এবং ৪৩ (১) ৭২ নং মামলা দায়ের করা হয়। বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের পূর্বে আত্মরক্ষার জন্য ১নং বিবাদী দেশ ত্যাগ করিয়া বিদেশে পালাইয়া যান। তার স্বভাবসিদ্ধ কায়দায় ও সুকৌশলে ১নং বিবাদী এরশাদের মন্ত্রী সভায়ও কিছু দিনের জন্য ঠাঁই করিয়া নিয়াছিলেন। | নূতন চন্দ্র সিংহ হত্যা মামলা হয়েছিল ১৯৭২ সালে। নূতন চন্দ্রের পুত্র সত্য রঞ্জন সিংহ সহ মােট ১২ জন স্বাক্ষী ছিলেন এই মামলার। মামলার এফ আই আর নং ইউ/এস/ ৩০২/১২০ (১৩) /২৯৮ বিপিসি। এই মামলা ১৯৭২ সালের ২৯ জানুয়ারী শুরু হয়। মামলার আসামীদের মধ্যে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী সহ পাঁচজন পলাতক ছিলেন। অন্যদিকে তার পিতা ফজলুল কাদের চৌধুরী সহ পাঁচজন ছিলেন জেলহাজতে। এই মামলার চার্জশিটে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী সহ আসামীদের বিরুদ্ধে অভিযােগ প্রমাণিত হয়েছে বলে বলা হয়েছে।
চট্টগ্রামের একজন শহীদের সন্তান শেখ মােহাম্মদ জাহাঙ্গীর গণতদন্ত কমিশনকে জানান, তাঁর পিতা শহীদ শেখ মুজাফফর আহমদ ও ভাই শহীদ শেখ আলমগীরকে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও তার সহযােগীরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযােগিতায় ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল হাটহাজারীর পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ক্যাম্পের কাছাকাছি সড়ক থেকে ধরে নিয়ে যায় হাটহাজারী ক্যাম্পে এবং পরে তাদের মেরে ফেলা হয়। স্বাধীনতার পর শেখ মােহাম্মদ জাহাঙ্গীরও বাদী হয়ে একটি মামলা করেছিলেন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী গংদের বিরুদ্ধে। হারুন-অর-রশীদ খান, চট্টগ্রামে জাতীয় পার্টির অন্যতম নেতা। তিনি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় চট্টগ্রামে লিয়াজোঁ অফিসার ছিলেন।
(১নং সেক্টরের অধিনায়ক মেজর (অবঃ) রফিকুল ইসলাম তাঁকে এই দায়িত্ব প্রদান করেছিলেন।) তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তিনি একটি পাবলিসিটি সেল গঠন করেন এবং ইনফরমারদের দ্বারা তথ্য সংগ্রহ করে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও তাঁর হত্যা, লুণ্ঠন সহ বিভিন্ন কর্মতৎপরতা সম্পর্কে লিখিত প্রতিবেদন তৈরী করে তার কপি ১নং সেক্টরের অধিনায়ক মেজর রফিকুল ইসলাম ও রাজনৈতিক নেতাদের কাছে পাঠাতেন। সেই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তিনি জেনেছিলেন যে, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, তাঁর পিতা ফজলুল কাদের চৌধুরী ও তাঁর সহযােগীরা চট্টগ্রামে তাদের গুডস হিলস্থ বাসভবনে। অসংখ্য মুক্তিযােদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষকে ধরে এনে নির্যাতন এবং হত্যা করেছেন। এমন কি মেয়েদেরও তারা ধরে এনে পাকিস্তানী সৈন্যদের হাতে তুলে দিয়েছেন তাদের মনােতুষ্টির জন্য। তিনি বলেন, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী স্বাধীনতার ঠিক আগে দেশ থেকে পালিয়ে যান। মুক্তিযােদ্ধারা তাঁকে মারার জন্য উদ্যোগ নিয়েও ব্যর্থ হয়েছিলেন। তবে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পায়ে গুলি লেগেছিল। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী দেশে ফিরে স্বাধীনতার চরিশ বছর পরও চট্টগ্রামে, বিশেষ করে রাউজানে মানুষ হত্যা ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপ পরিচালনা করে চলেছেন। এর সমর্থন পাওয়া যাবে সরকারের গােয়েন্দা বিভাগের প্রতিবেদনে। বর্তমানে এনডিপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী চট্টগ্রামে তিনটি মামলার এজাহার ভুক্ত আসামী।
মওলানা আব্দুস সােবহান
মওলানা আব্দুস সােবহান, পিতাঃ মৃত নঈমুদ্দিন, মহল্লাঃ পাথরতলা, পাবনা, জামাতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরার সদস্য এবং বর্তমানে পাবনা সদর থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ও জামাতের সংসদীয় দলের উপনেতা। এই জামাত নেতা ১৯৭১ সালে পাবনা জামাতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত আমির ছিলেন এবং তথাকথিত উপ-নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে মনােনীত হন। মওলানা আব্দুস সােবহান পাবনা শান্তি কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। গণতদন্ত কমিশনের মাঠ পর্যায়ের অনুসন্ধানে সাক্ষ্যদানকারী অধিকাংশ ব্যক্তি জানিয়েছেন, ‘মওলানা সােবহানের প্রত্যক্ষ সহযােগিতায় পাবনার আল বদর, রাজাকার এবং শান্তি কমিটি গঠিত হয়। মওলানা সােহান উর্দু ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারতেন বলে পাকিস্তানী বাহিনীর খুব কাছাকাছি আসতে সমর্থ হন এবং নীতি নির্ধারক হিসেবে স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরােধী ভূমিকায় তার সার্বিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মওলানা সােবহানের বাংলাদেশের স্বাধীনতা, বাঙালী জাতিসত্তার বিরােধী ভূমিকা, মুক্তিযােদ্ধাদের সমূলে ধ্বংস করার লক্ষ্যে আলবদর, রাজাকার, শান্তি কমিটি গঠন করে ৩০ লক্ষ নিরীহ, নিরস্ত্র, শান্তিকামী মানুষ হত্যায় সহায়তা এবং পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর যাবতীয় নৃশংস কার্যকলাপে সহায়তার জন্য তার বিরুদ্ধে ’৭২ সালে স্পেশাল ট্রাইব্যুনালে মামলা রুজু করা হয়। ২৯ ফেব্রুয়ারী, ১৯৭২ সাল, বেলা ৩টায় তাঁকে পাবনার মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে হাজির হতে বলা হয়। কিন্তু সে সময়ে তিনি গােলাম আযমের সাথে পাকিস্তান পালিয়ে গিয়েছিলেন।’
(সূত্র ঃ ‘একাত্তরের দালালেরা’ ও শফিক আহমেদ এবং এ্যাডভােকেট শফিকুল ইসলাম শিবলী, পাথরতলা, পাবনা)।
‘৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে রাজধানী ঢাকার মতাে পাবনাতেও পাকিস্তান বাহিনী অতর্কিতে নিরীহ বাঙালীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তবে পাবনার অবস্থা ছিল একটু ব্যতিক্রম। তদন্তকালে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রত্যক্ষদর্শী একজন মধ্য বয়স্ক মহিলা জানান, ২৫ মার্চ ’৭১ সাল রাত থেকেই পাবনার গণ্যমান্য বরেণ্য ব্যক্তিদের পাকিস্তানী আর্মি স্থানীয় দালালদের সহযােগিতায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে ধরে নিয়ে আসে। ২৬ মার্চ দুপুর আনুমানিক ৩টার দিকের ঘটনা। এই মহিলা তখন পাবনা রায়ের বাজারের প্রধান সড়কের ধারে একটি পুরনাে বাড়ির দোতলার জানালায় দাড়িয়ে ছিলেন। জানালার খড়খড়ি দিয়ে দেখছিলেন ভীত সন্ত্রস্ত্র পাবনা শহর। হঠাৎ তিনি পাকিস্তানী আর্মির একটি লরী রাস্তার উপর থামতে দেখেন। উপর দিয়ে টেনে আনা হয়েছে। প্রত্যেক বন্দীর জামা-কাপড় ছিন্ন-ভিন্ন, তাঁদের হাঁটু থেকে পায়ের পাতা অব্দি সাদা হাড় দেখা যাচ্ছিল আর শরীর ছিল রক্তে মাখামাখি। লরীর ভেতরে তিনি পাকিস্তানী আর্মিদের সঙ্গে মওলানা আব্দুস সােবহানকে বসা দেখেছিলেন। আর যাদের সিমেন্টের রাস্তার উপর দিয়ে হেঁচড়ে টেনে আনা হচ্ছিল তাঁদের মধ্যে তিনি পাবনার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আবু সাঈদ তালুকদার, এডওয়ার্ড কলেজের প্রফেসর হারুন, বিশিষ্ট দন্ত চিকিৎসক অমলেন্দু দাক্ষি এবং এডভােকেট ও আওয়ামী লীগের নেতা আমিনউদ্দিনকে চিনতে পেরেছিলেন। লরী থেকে নেমে কিছু সৈন্য কয়েকটি দালানের উপর ওড়ানাে বাংলাদেশের পতাকা নামানাে এবং পােড়ানাের ব্যবস্থা করে চলে যায়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, ভীত-সন্ত্রস্ত মহিলা জানান—২৯ মার্চ ‘৭১ সালের মধ্যে তাঁর দেখা ঐ সব পরিচিত ব্যক্তিদের সবাইকে মেরে ফেলা হয়। | তিনি আরাে বলেন, ২৬ তারিখে এ দৃশ্য দেখার পর ২৭ মার্চ অমলেন্দু দাক্ষির বাড়িতে গিয়ে তাঁর স্ত্রীর কাছ থেকে জানতে পারেন, দন্ত চিকিৎসক অমলেন্দু দাক্ষির বাড়িতে মওলানা আব্দুস সােবহান পাকিস্তানী আর্মিদের নিয়ে এসেছিলেন।
পাবনা জজ কোর্টের সিনিয়র এডভােকেট, প্রাক্তন পাবলিক প্রসিকিউটর। এবং আওয়ামী লীগের প্রধান নেতা আলহাজ্ব গােলাম হাসনায়েন (কাচারীপাড়া, পাবনা) বলেন, ‘মওলানা আব্দুস সােবহান আওয়ামী লীগ নেতা আমিনউদ্দিন। সাহেবের বাসা পাক আর্মিদের চিনিয়ে দিয়েছিল। তিনি আরাে বলেন, ‘পাবনার আল বদর, রাজাকার, শান্তি কমিটির যতজন সদস্য ছিল তা মওলানা সােবহান সংগ্রহ করেছিলেন। দৈনিক ইত্তেফাকের জেলা প্রতিনিধি আনােয়ারুল হক, (শালগাড়িয়া, পাবনা)। এবং এডভােকেট শফিকুল ইসলাম শিবলী বলেন, আব্দুস সােবহান পাবনা জিলা স্কুলের প্রধান মওলানা ও স্কাউট কমী কছিমুদ্দিনকে হত্যার ব্যাপারে পাকিস্তানী সৈন্যদের প্ররােচিত করেছিলেন। মওলানা সােবহান মুক্তিযােদ্ধা ও সঙ্গীত শিল্পী সাধনকেও পাকিস্তানী সৈন্যদের দিয়ে হত্যা করান। এ কথা জানিয়েছেন সাধনের মা সুফিয়া বেগম, (স্বামী আব্দুল হামিদ খান)। তিনি বলেন, ‘সাধনের সঙ্গে আরেক মুক্তিযােদ্ধা গেদা মনি ধরা পড়লেও সে আর্মির হাত থেকে ছাড়া পায়। কিন্তু সাধনকে মওলানা সােবহানবাঁচতে দেয়নি। অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মােঃ আব্দুল গনি (কালাচাঁদ পাড়া, পাবনা) জানান, ‘১৭ এপ্রিল দুপুরে হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা কুচিয়াপাড়া ও শাঁখারী পাড়ায় মওলানা আব্দুস সােবহান পাকিস্তানী আর্মিদের সঙ্গে নিয়ে অপারেশন চালান। ঐ দিন সেখানে সুধীর চন্দ্র চৌধুরী, অশােক কুমার সাহা, গােপাল চন্দ্র চৌধুরী সহ ৮ ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়। তারা ২০/২৫ টি ঘর পােড়ায় এবং সেই সঙ্গে লুটতরাজ ও নারী নির্যাতনও করেছিল।
অধ্যক্ষ আব্দুল গনি আরাে বলেন, ‘মে মাসে পাবনা ফরিদপুর থানার ডেমরাতে মওলানা আব্দুস সােবহান, মওলানা ইসহাক, টেগার ও আরাে কয়েকজন দালালের একটি শক্তিশালী দল পাকিস্তানী আর্মি নিয়ে ব্যাপক গণহত্যা করে। সেখানে ঐ দিন আনুমানিক ১০০০ জন মানুষ হত্যাসহ ঘর বাড়ি পােড়ানাে, লুণ্ঠন, নারী নির্যাতন ইত্যাদি করা হয়। পাবনার দ্বিতীয় বৃহত্তর গণহত্যাটি হয় সুজানগর থানায়। মে মাসের প্রথম দিকে এক ভােরে নাজিরগঞ্জ-সাতবাড়িয়া ইউনিয়নে হত্যা করা হয় প্রায় ৪০০ জনকে, বলেন মুজিব বাহিনীর সুজানগর থানা লীডার এবং ঢাকার ব্যবসায়ী জহিরুল ইসলাম বিশু। তিনি জানান, সুজানগর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ও শান্তি কমিটির একজন সদস্য মৌলভী মধুকে তারা ‘৭১-এর মে মাসের শেষের দিকে গ্রেফতার করেন এবং পরে মেরে ফেলেন। জিজ্ঞাসাবাদের সময় এই ঘাতক জানিয়েছিলেন, ‘সুজানগর অপারেশনের আগের দিন পাথর তলায় আব্দুস সােবহানের বাসায় মিটিং হয়েছিল এবং মিটিং-এ সুজানগর অপারেশনের পরিকল্পনা নেয়া হয়। পাবনার যে কোন অপারেশনের আগে মওলানা সােবহানের বাসায় পরিকল্পনা করা হতাে বলে জহিরুল ইসলাম বিশু গণতদন্ত কমিশনকে জানান।
মওলানা এ, কে, এম, ইউসুফ
মওলানা এ, কে, এম, ইউসুফ (গ্রাম-রাজৈর, থানা-স্মরণখােলা, জেলা-বাগেরহাট)। বর্তমানে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ-এর নায়েব-এ আমীর। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি স্বাধীনতা বিরােধী ভূমিকা রাখেন। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে তাঁর এই কর্মতৎপরতার অংশ হিসেবে তিনি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন মালেক মন্ত্রী সভার সদস্য হন। ১৯৭১ সালের মে মাসে খুলনা জেলায় তিনিই প্রথম রাজাকার বাহিনী প্রতিষ্ঠিত করেন ৯৬ জন জামাত কর্মীর সমন্বয়ে। মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকেই মওলানা এ, কে, এম, ইউসুফ খুলনা জেলায় জামায়াতে ইসলামীর নেতা ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার পর তিনি পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর পক্ষে ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে কর্মতৎপরতা চালান। মূলতঃ তিনি নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ছিলেন বলে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধাচরণ করে বক্তৃতা বিবৃতি দেয়া এবং স্বাধীনতার পক্ষের মানুষদের হত্যা, তাদের বাড়িঘর লুটপাট, পুড়িয়ে দেয়া, নারী নির্যাতন, প্রভৃতি দুষ্কর্মে তাঁর সহযােগীদের নির্দেশনা দিয়ে কাজ করানােই ছিল তাঁর মূল দায়িত্ব। আর এসব কাজ করতে গিয়ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে সহযােগিতা করেছেন তিনি, নিয়েছেন তাদেরও সহযােগিতা।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন, মওলানা এ, কে, এম, ইউসুফ মুক্তিযুদ্ধের বিরােধিতা করে যে বক্তৃতা, বিবৃতি প্রদান করেছেন তা তৎকালীন বিভিন্ন সংবাদপত্র ও গ্রন্থে পাওয়া যায়। ১০ অক্টোবর ‘৭১ খুলনার জনসভায় ভাষণদানকালে শান্তি কমিটি ও রাজাকারদের ভূয়সী প্রসংসা করে তিনি বলেন, প্রত্যন্ত অঞ্চলে সফর করে জনগণকে ভারত কর্তৃক সৃষ্ট তথাকথিত বাংলাদেশের অসারতা বােঝাতে হবে। বিছিন্নতাবাদী, দুষ্কৃতকারী এবং নকশালীরা দেশের এই অংশে বিপর্যয় সৃষ্টিতে তৎপর রয়েছে, আপনাদের তাদেরকে সমূলে উৎখাত করতে হবে।
(সূত্রঃ | একাত্তরের ঘাতক দালালরা কে কোথায়, ৫ম সংস্করণ, পৃঃ ৫৪)।
২৬ অক্টোবর ’৭১ সিলেটের জনসভায় মওলানা ইউসুফ বলেন, ‘পাকিস্তান সৃষ্টির ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞ আমাদের কিছু সংখ্যক তরুণ ভারতীয় মিথ্যা প্রচারণায় বিভ্রান্ত হয়ে সীমানা অতিক্রম করে ওপার গিয়েছে এবং ভারতীয় চরদের যােগসাজসে আমাদের ভূখণ্ডে ঘৃণ্য নাশকতামূলক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। এসব নাশকতামূলক কার্যকলাপ সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে আমাদের ভূখণ্ড থেকে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদকে সমূলে উৎখাত করতে আপনারা গ্রামে-গঞ্জে আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়ুন। মিত্রবাহিনীকে হুশিয়ার করে দিয়ে মওলানা ইউসুফ বলেন, ‘আমাদের ওপর যদি কোন যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হয়, তবে বীর সেনাবাহিনী ও বীর রাজাকাররা অবশ্যই তার পাল্টা আঘাত করবে।(সূত্রঃ প্রাগুক্ত)। ১২ নবেম্বর ’৭১ সাতক্ষীরার রাজাকার শিবির পরিদর্শন কালে এ, কে, এম ইউসুফ রাজাকারদের ‘ভূয়সী প্রশংসা করেন। ভারতীয় চর ও অনুপ্রবেশকারীদের নির্মূল করার কাজে সাতক্ষীরার রাজাকাররা মূল্যবান ভূমিকা পালন করেছে বলে উল্লেখ করে তিনি আশ্বাস দেন যে রাজাকারদের চাকুরীর ব্যবস্থা করা হবে। (সূত্রঃ প্রাগুক্ত)। | ২৮ নবেম্বর ‘৭১ করাচীতে সাংবাদিকদের সাথে আলােচনাকালে এ, কে, এম ইউসুফ বলেন, ‘রাজাকাররা আমাদের বীর সেনাবাহিনীর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ভারতীয় হামলার মােকাবিলা করেছেন। তিনি দুষ্কৃতকারীদের দমনের জন্য রাজাকারদের হাতে আরও আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র দেবার দাবী জানান। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে আলবদর আলশামস বাহিনীর সদস্যসংখ্যা প্রায় এক লাখে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া মুজাহিদবাহিনীও তাে রয়েছে। এরা সকলেই আমাদের সেনাবাহিনীর সহায়তায় সীমান্ত রক্ষার কাজে নিয়ােজিত রয়েছে। দুষ্কৃতকারী দমনে রাজাকাররা বিশেষ সাফল্যের পরিচয় দিচ্ছে এবং এ জন্যই বর্তমানে দুষ্কৃতকারীদের কার্যকলাপে ভাটা পড়েছে।
খুলনার শহীদ শেখ আব্দুর রাজ্জাকের মা গুলজান বিবি জানিয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় আষাঢ় মাসের এক দিন খুলনার রাজাকার খালেক মেম্বার তার ছেলে শেখ আব্দুর রাজ্জাককে রাজাকার বাহিনীতে যােগ দিতে বলেন। কিন্তু খালেক মেম্বার এর এই প্রস্তাব আব্দুর রাজ্জাক প্রত্যাখান করেন। এরপর শ্রাবণ মাসের ১১ তারিখে সকাল বেলায় এই রাজাকার খালেক মেম্বার ও আদম আলী পুনরায় তাঁদের বাড়ি যায় এবং তাঁর ছেলে শেখ আব্দুর রাজ্জাককে বাড়ি থেক ডেকে বাইরে নিয়ে যায়। সেদিন সন্ধ্যায়ই গুলজান বিবি স্থানীয় লােকজনের কাছে জানতে পারেন যে, তার ছেলে শেখ আব্দুর রাজ্জাককে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। তাই তিনি তার ছেলেকে ছাড়িয়ে আনার সুপারিশ করার জন্য রাজাকার বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা মওলানা এ, কে, এম ইউসুফের কাছে যান এবং করজোড়ে তার কাছে ছেলেকে ফিরিয়ে দেবার অনুরােধ জানান। সে সময় মওলানা ইউসুফের সাথে রাজাকার খালেক মেম্বারও উপস্থিত ছিলেন। এবং তিনিই জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, শেখ আব্দুর রাজ্জাককে ছাড়ার ব্যাপারে কোন সুপারিশ চলবেনা। গুলজান বিবি তাঁর ছেলেকে আর পাননি। তবে তিনি বিভিন্ন জনের কাছে শুনেছেন যে, তার ছেলেকে মেরে ফেলা হয়েছে, কিন্তু লাশের সন্ধান মেলেনি। গুলজান বিবি তার পুত্রের হত্যাকারীদের বিচার দাবী করেন।
রাজাকার বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা মওলানা ইউসুফের সহযােগী খালেক মেম্বার ও আদম আলীর মত এমনি অনেক রাজাকার মুক্তিযুদ্ধের সময় বহু মুক্তিযােদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের নারী, পুরুষকে হত্যা করেছে, নারী ধর্ষণ করেছে। মওলানা ইউসুফের নির্দেশেই তার অনুসারী রাজাকাররা এই নৃশংস তৎপরতা চালাতে এসব তথ্য খুলনার অধিবাসীরা দিলেও স্বাধীনতার চব্বিশ বছর পর তাদের অনেকেই প্রাণভয়ে নিজের নাম প্রকাশ করতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এমন অনেকে জানিয়েছেন, মওলানা ইউসুফ রাজাকার বাহিনী প্রতিষ্ঠা করার পর মােড়লগঞ্জ থানা সহ নিজস্ব এলাকা থেকে বহু লােককে জোর করে ধরে এনে রাজাকার বাহিনীতে যােগ দিতে বাধ্য করেছিলেন। বাধ্য করেছিলেন তাদের বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে কাজ করতে। মওলানা ইউসুফের রাজাকার বাহিনীর হেড কোয়ার্টার ছিল তৎকালীন ‘ভূতের বাড়িতে যা বর্তমানে খুলনা জেলা আনসার ক্যাম্পের হেড কোয়ার্টার। এই আনসার ক্যাম্পেই প্রথম রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়েছিল মওলানা ইউসুফের নেতৃত্বে। এই ক্যাম্পই ছিল রাজাকারদের প্রধান নির্যাতন কেন্দ্র। এছাড়াও শিপ ইয়ার্ড, খালিশপুরের ভাসানী বিদ্যালয় সহ বিভিন্ন স্থানে রাজাকার বাহিনীর ক্যাম্প গঠন করা হয়েছিল। মওলানা ইউসুফের নেতৃত্বাধীন রাজাকার বাহিনী যেই হত্যাকাণ্ডগুলাে সংঘটিত করেছে তার জন্য কোন নির্দিষ্ট স্থান ছিল না। স্বাধীনতার পক্ষের নিরীহ নির্দোষ মানুষকে ধরে আনার পর যেখানে সুবিধা মনে করেছে সেখানেই গুলী করে অথবা জবাই করে মেরে ফেলেছে। আবার কখনাে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের নিরীহ মানুষ ধরে এনে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছিল এই রাজাকাররা।
খুলনায় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর মূল ক্যাম্প ছিল সার্কিট হাউজে। এছাড়াও, হেলিপাের্ট, নেভাল বেস, হােটেল শাহীন, আসিয়ানা হােটেল সহ আরাে ঘাঁটি ছিল পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর। তাদের এই ক্যাম্পগুলােতেই নির্যাতন করা হতাে নিরীহ বাঙালীদের উপর। এই ক্যাম্পগুলাের সাথে রাজাকার বাহিনী সহ স্বাধীনতা বিরােধী সকল সংগঠনের যােগাযােগ ছিল নিয়মিত। মূলতঃ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী, এই রাজাকার বাহিনীসহ স্বাধীনতা বিরােধী বাঙালীদের সহযােগিতায় হত্যাকাণ্ডগুলাে সংঘটিত করতাে গল্লামারি, ফরেস্ট ঘাট (সার্কিট হাউজের পেছনে), আসিয়ানা হােটেলের সামনে, স্টেশন রােড সহ নির্দিষ্ট আরাে কিছু স্থানে। মওলানা ইউসুফ স্বাধীনতার পক্ষের অনেক মানুষকে রাজাকার বাহিনীতে কাজ করতে বাধ্য করেছিলেন বলে অভিযােগ পাওয়া গেছে। মওলানা এ, কে, এম ইউসুফের নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনী মুক্তিযুদ্ধের সময় খুলনায় যে ব্যাপক নৃশংসতা চালিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের নিরীহ নারী-পুরুষের ওপর তার নজির খুলনার বাড়িতে বাড়িতে পাওয়া গেলেও প্রাণভয়ে অধিকাংশই এখন মুখ খুলতে চান না।
মােহাম্মদ আয়েন উদ-দীন।
এডভােকেট হাজী মােঃ আয়েন উদ-দীন। পিতাঃ মৃত মােঃ মইনুদ্দিন। গ্রাম ও পােস্ট ঃ শ্যামপুর। থানা ঃ মতিহার। জেলাঃ রাজশাহী। বর্তমানে তিনি মুসলিম লীগের মহাসচিব এবং ঢাকা হাইকোর্টে ওকালতি করেন। ১৯৭১ সালে মুসলিম লীগের এই নেতা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরুদ্ধে তাঁর যাবতীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি রাজশাহী জেলার কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন এবং ‘৭১ সালে তথাকথিত প্রাদেশিক পরিষদ উপ-নির্বাচনে রাজশাহী-১৩ আসন থেকে কনভেনশন মুসলিম লীগের প্রার্থী হয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকে প্রতিরােধ করার জন্য তাঁর প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে বৃহত্তর রাজশাহী জেলায় রাজাকার, আল বদর ও শান্তি কমিটি গঠিত এবং পরিচালিত হয়। মূলতঃ ‘৭১ সালের এপ্রিল মাসের পর থেকে রাজশাহীতে যুদ্ধ ক্ষেত্রের বাইরে যে শত শত হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে তার প্রায় প্রত্যেকটিতে আয়েন উদ-দীনের নেতৃত্বাধীন শান্তি কমিটি, রাজাকার প্রভৃতি ঘাতক বাহিনী জড়িত ছিল বলে গণতদন্ত কমিশনের মাঠ পর্যায়ের অনুসন্ধান এবং বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়। | শান্তি কমিটি গঠনের পর ‘৭১ সালের ৩১ মে দৈনিক আজাদ পত্রিকায় প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে আয়েন উদ-দীন বলেছিলেন, ‘তারা অসীম ধৈর্যের সাথে শত্রুর মােকাবেলা করতে সক্ষম হয়েছে। রাজশাহী জেলার সর্বত্র স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এসেছে। প্রতি মহকুমা, থানা, ইউনিয়নে শান্তি কমিটি গঠন করা হয়েছে। ৪ আগষ্ট ’৭১ তারিখে দৈনিক সংগ্রামে প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়- ‘রাজাকার বাহিনীর প্রথম গ্রুপের ট্রেনিং উপলক্ষে আজ স্থানীয় জিন্নাহ ইসলামিক ইনষ্টিটিউটে এক সমাপনী উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে পবিত্র কোরআন স্পর্শ করে শপথ গ্রহণ করা হয়। অনুষ্ঠানে শান্তি কমিটির সভাপতি জনাব আয়েন উদ্দিন রাজাকার বাহিনীকে যথাযথ কর্তব্য পালনে বিশ্বস্ততার সাথে পাকিস্তানের আদর্শ, সংহতি ও অখণ্ডত্ব রক্ষার জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার উপদেশ দেন। অনুষ্ঠানে স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তি ও সামরিক অফিসারবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
আয়েন উদ-দীনের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ এবং পরােক্ষভাবে তার এলাকাবাসী-আত্মীয়স্বজন হত্যা, অগ্নিসংযােগ, লুটতরাজ, নারী নির্যাতন, জোর । পূর্বক রাজাকার বাহিনীতে নিয়ােগ ও ব্রীজ পাহারাদার হিসেবে নিয়ােগের অভিযােগ এনেছে। এমনকি স্বাধীনতার পক্ষের নিরীহ জনগনকে পাকিস্তানী আর্মির হাতে ধরিয়ে দিয়ে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির পরিবার থেকে টাকা-পয়সা, সম্পদ হাতিয়ে নেবার অভিযােগও তার বিরুদ্ধে পাওয়া গেছে। | রাজশাহী শহরের রানী বাজার এলাকার মুক্তিযােদ্ধা এডভােকেট আব্দুল্লাহিল বাকী এবং নওহাটা কলেজের অধ্যাপিকা ও রাজশাহী নগর মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী জিনাতুন নেসা বলেন, ‘স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে আয়েন উদ-দীন ১৪ এপ্রিল ‘৭১ রাজশাহী শহরে মাইকিং করে। মাইকিং-এর ভাষ্য ছিল, আব্দুল্লাহিল বাকীকে জীবিত অথবা মৃত, দেহ অথবা মাথা যে এনে দিতে পারবে তাকে দশ হাজার টাকা পুরস্কার দেয়া হবে।’ তৎকালীন রাজশাহী ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে পাকিস্তানী আর্মি ক্যাম্পের দায়িত্বে নিয়ােজিত ক্যাপ্টেন মােঃ ইলিয়াস খানকে লেখা এক চিঠিতে (চিঠি নং ড ৪৪ CPC Date 13-9-71) আয়েন উদ-দীন দশ জন ব্যক্তির নাম ও অবস্থান উল্লেখ করে তাদের অবিলম্বে গ্রেফতার করার অনুরােধ জানান। সেই চিঠির তালিকায় আব্দুল্লাহিল বাকীর নামও ছিল। এ সম্পর্কে আব্দুল্লাহিল বাকী বলেন, চিঠির লিস্টে প্রাপ্ত নামের নয় জন ধরা না।
পড়লেও একজন আব্দুর রহমান (পিতাঃ সসালেমান, গ্রামঃ রামচন্দরপুর, থানা ঃ পবা), পাড়িলা গ্রাম থেকে সেপ্টেম্বর মাসে ধরা পড়েন। পাড়িলা অভিযানে পাকিস্তানী আমি যাকে পেয়েছে তাকেই হত্যা করেছে। এভাবে তারা। ২৫/৩০ জনকে হত্যা করে এবং ১৫০টির মতাে বাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দেয়। আব্দুল্লাহিল বাকী এবং জিনাতুন নেসা আরাে জানান, সম্পত্তি নিয়ে দ্বন্দ্ব থাকায় আয়েন উদ-দীন ‘৭১-এর এপ্রিলের শেষের দিকে তানাের থানার চান্দুয়া গ্রামের হারুন-অর-রশিদ ওরফে হারাধনকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। অতঃপর হারাধনের নয় বছরের নাবালিকা বালিকা ও বড় ছেলের তের বছরের স্ত্রীকে পাক-বাহিনীর হাতে তুলে দেন। হারাধন হত্যাকাণ্ডের একজন প্রত্যক্ষদর্শী আয়েন উদ-দীনের খালু-শ্বশুর আব্দুল গনি মুক্তার (বর্তমানে মৃত) স্বাধীনতার পর রাজশাহী বার কাউন্সিলে ঘটনাটি বলেছিলেন বলে আব্দুস সােবহান গণতদন্ত কমিশনকে জানিয়েছেন। আব্দুস সােবহান রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সভাপতি এবং বাংলাদেশ কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। তিনি গণতদন্ত কমিশনকে জানান, মির্জাপুর-বেনােদপুর (বর্তমান মতিহার থানা, সাবেক পবা থানা) গ্রাম থেকে রহিমুদ্দিন সরকার, রহিমুদ্দিনের ছেলে পিন্টু (আয়েন উদ-দীনের চাচাতাে ভাই) সহ মােট নয় জনকে আয়েন উদ-দীন পাকিস্তানী আর্মির হাতে ধরিয়ে দেন। পরবর্তীতে জোহা হলের পেছনে অন্যান্যদের সঙ্গে পাক-সেনারা তাদের হত্যা করে। এ ছাড়া তালাইমাড়ীর ধনী ব্যবসায়ী বাবর আলীকেও আয়েন উদ-দীন পাক-সেনাদের হাতে তুলে দেয় এবং জোহা হলের পাশ্ববর্তী বধ্যভূমিতে তাঁকেও হত্যা করা হয়।’ সােবহান আরাে জানান, আয়েন উদ-দীনের সহায়তায় রাজশাহী মঞ্জু বাের্ডিং-এর মালিক আমিনুল হক চৌধুরী, মকবুল চৌধুরী, এডভােকেট তসলিমউদ্দিন, ঠিকাদার আলতাফ হােসেন, নওরােজদৌল্লা খান, এডভােকেট আবুল হােসেন সহ আরাে বেশ কয়েকজনকে নবেম্বরের শেষের দিকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। স্বাধীনতা লাভের পর ১৮ ডিসেম্বর রাজশাহীর বাবলা বনের সামনে বালুচরের ভেতর থেকে কোমরে দড়ি বাঁধা অবস্থায় উল্লিখিত ব্যক্তিবৃন্দ সহ বেশ কয়েকজনের লাশ উদ্ধার করা হয়।
উদ্ধারকৃত লাশের শরীরে কোন জখমের চিহ্ন ছিল না। ধারনা করা হয় সবাইকে জীবন্ত বালুর মধ্যে পুতে ফেলা হয়েছিল। সােবহান বলেন, ‘আয়েন উদ-দীন ছেলে বেলা থেকেই আমাদের বাড়ীতে থেকে পড়ালেখা শিখেছে— বড় হয়েছে। অথচ ১৯৫৫ সালে আয়েন উদ-দীন (খুব সম্ভব তখন সে সবেমাত্র ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেছে। আমার বাবা আব্দুস সালামকে খুন করে। সেই হত্যা মামলায় আয়েন উদ-দীন এক অথবা দুই নম্বর আসামী ছিল এবং জেলেও ছিল। কিন্তু জুরীদের মধ্যে দু’জন মুসলিম লীগের সমর্থক ও মাদ্রাসার শিক্ষক থাকায় আয়েন উদ-দীন ছাড়া পায়। আয়েন উদ-দীন এবং তাঁর বাহিনীর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত অনেকে বর্তমানে মুখ খুলতে ভয় পান। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এমন একজন জানিয়েছেন, ‘৭১ সালের অক্টোবরের শেষের দিকে পাক-আর্মিরা সমস্ত গ্রাম ঘিরে ফেলে প্রায় একশজন মানুষ পাবনা রােডে জড়াে করে। তখন আয়েন উদ-দীন এসে পাঁচ জনকে আলাদা করে পাক-সেনাদের হাতে তুলে দেন। তাদের অপরাধ, তারা ‘৭০-এর নির্বাচনে আয়েন উদ-দীনকে ভােট দেয়নি। পাঁচ জনকেই জোহা হলে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। নির্যাতন চলাকালীন সময়ে পাকিস্তানী উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের সহায়তায় তিন জন মুক্তি পেলেও—দু’জন ইদ্রিস আলী মণ্ডল এবং আজমতের ঘর জামাই রশিদকে মেরে ফেলা হয়।
আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ
আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, বর্তমানে জামায়াতে ইসলামীর অন্যতম সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল, ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি এবং আলবদর বাহিনীর ঢাকা মহানগরীর প্রধান ছিলেন। আলী আহসান। মুহাম্মদ মুজাহিদ ‘৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন দলীয় আদর্শ অনুযায়ী পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর গণহত্যা, লুটপাট, ও নারী নির্যাতনে সহযােগিতা করেছেন। তাঁর নেতৃত্বাধীন আল বদর বাহিনী বিজয়ের পূর্বমুহূর্তে সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে এদেশের বরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের। আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদের স্বাধীনতা বিরােধী তৎপরতার বিবরণ পাওয়া গেছে সে সময়ের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত তার বক্তৃতা-বিবৃতিতে। ‘৭১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ফরিদপুরে ছাত্রসংঘের এক জমায়েতে ‘বিপুল করতালির মধ্যে আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ ঘােষণা করেন ঘূণ্য শত্রু ভারতকে দখল করার প্রাথমিক পর্যায়ে আমাদেরকে আসাম দখল করতে হবে। এজন্যে আপনারা সশস্ত্র প্রস্তুতি গ্রহণ করুন। ১৫ অক্টোবর ‘৭১ প্রকাশিত একটি সংবাদে বলা হয় ‘রাজাকার ও আলবদরের ভূমিকা সম্পর্কে আপত্তিকর মন্তব্য করায় পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি জনাব আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ জনাব ভূট্টো, কাওসার নিয়াজী ও মুফতী মাহমুদের তীব্র সমালােচনা করেন ….। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানে দেশপ্রেমিক যুবকেরা ভারতীয় চরদের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য এগিয়ে এসেছে। এবং রাজাকার, আলবদর ও অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সদস্য হিসেবে জাতির সেবা করছে। অথচ সাম্প্রতিককালে দেখা যাচ্ছে কতিপয় রাজনৈতিক নেতা যেমন জনাব জেড, এ, ভূট্টো, কাওসার নিয়াজী, মুফতি মাহমুদ ও আসগর খান রাজাকার, আলবদর ও অন্যান্য দেশ হিতৈষী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর বিরুদ্ধে আপত্তিকর মন্তব্য করে বিষােদগার করছেন।
এসব নেতার এ ধরনের কার্যকলাপ বন্ধ করার জন্যে এবং এ ব্যাপারে কঠোর মনােভাব গ্রহণ করার জন্যে সরকারের প্রতি আবেদন জানান। পরিশেষে ছাত্রসংঘ নেতা ক্লাসে যােগদানের জন্যে এবং সেই সঙ্গে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীকে সহায়তা করার জন্য আলবদর ও দেশ হিতৈষী ছাত্রদের প্রতি আহবান জানান। ২৫ অক্টোবর ’৭১ তারিখে এক বিবৃতিতে আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ ১৭ রমজান বদর দিবস পালনের আহবান জানিয়ে বলেন আমরা আজ ইসলাম বিরােধী শক্তি ও চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। এই পবিত্র দিবসে আমরা জাতির স্বার্থে এবং এদেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্যে আত্মােৎসর্গের শপথ গ্রহণ করবাে।’ (সূত্র ও একাত্তরের ঘাতক দালালরা কে কোথায়)। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ ফকিরাপুল, নয়াপল্টন এলাকার বিভিন্ন বাড়িতে থাকতেন, তার মধ্যে একটি বাড়ি হলােঃ শেখ ভিলা, ৩/৫, নয়াপল্টন। তবে আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদের প্রধান আডডা ছিল ফকিরাপুল গরম পানির গলিতে ফিরােজ মিয়ার ১৮১ নং (বর্তমান ২৫৮ নং) বাড়িটি। ‘৭১-এ মতিঝিল, ফকিরাপুল এলাকার মুক্তিযুদ্ধের কমাণ্ডার বর্তমানে জাতীয় পার্টি নেতা আবদুস সালাম, মুক্তিযােদ্ধা ও সাংবাদিক জি, এম, গাউস, মুক্তিযােদ্ধা ও কলামিস্ট মাহবুব কামালের সাক্ষ্য অনুযায়ী জানা গেছে, ফিরােজ মিয়া ছিলেন এ এলাকার রাজাকার কমাণ্ডার। তার। বাড়িটি শুধু ফকিরাপুল এলাকার নয়, পুরাে ঢাকা শহরের রাজাকারদের অন্যতম ঘাঁটি ছিল। এখানেই অনুষ্ঠিত হতাে রাজাকারদের বিভিন্ন সভা, সশস্ত্র ট্রেনিং ইত্যাদি। এখান থেকেই পরিচালিত হতাে রাজাকারদের বিভিন্ন অপারেশন, রাজাকার রিক্রুটমেন্ট।
এখানে এলাকার মুক্তিযােদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তির লােকদের ধরে এনে নির্যাতন চালানাে হতাে। ফিরােজ মিয়া গংয়ের নীতি নির্ধারক ছিলেন আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ। কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে তার নির্দেশেই পরিচালিত হতাে ফকিরাপুল এলাকার মুক্তিযুদ্ধবিরােধী যাবতীয় তৎপরতা। জি এম গাউস বলেন ‘৭০-এর মাঝামাঝি সময় থেকেই আমরা ফকিরাপুল এলাকার ভাড়াটিয়া আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদকে চিনতাম জামাত ও ইসলামী ছাত্রসংঘের লােক হিসেবে। তিনি এলাকায় দলের সাংগঠনিক তৎপরতা চালাতেন। কেন্দ্রীয় সমাবেশে এলাকা থেকে মিছিল নিয়ে যেতেন। এলাকার ছেলেদের ছাত্রসংঘে যােগদানের ব্যাপারে প্ররােচিত করতেন। ‘৭১-এর মার্চের পর মুজাহিদের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ফকিরাপুলে রাজাকার বাহিনী সংগঠিত হয়। যার নেতৃত্বের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল ফিরােজ মিয়া (ফেরু মেম্বর)-কে।। মুজাহিদের সরাসরি নির্দেশেই পরিচালিত হয়েছে ফকিরাপুল এলাকায় রাজাকার বাহিনীর তৎপরতা, অস্ত্র ট্রেনিং, রিক্রুটমেন্ট ইত্যাদি। তিনি এলাকার রাজাকারদের অস্ত্র-অর্থ সংগ্রহ সহ যাবতীয় দুষ্কর্মে সহযােগিতা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি পর্যায়ে অত্র এলাকার মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক এবং স্বাধীনতার পক্ষের বুদ্ধিজীবীদের ধরে এনে অত্যাচার-নির্যাতন, এমনকি হত্যা করার উদ্দেশ্যে গঠিত আলবদর বাহিনীর নেতা ছিলেন আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ। জাতীয় পাটি নেতা আবদুস সালাম বলেন, ‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় ফকিরাপুল গরম পানির গলির ফিরােজ মিয়ার বাড়িটি ছিল রাজাকারদের অন্যতম নির্যাতন কেন্দ্র।
ফকিরাপুলের ফিরােজ মিয়া গংয়ের নীতিনির্ধারক বা পরামর্শদাতা ছিলেন আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ। অবশ্য কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে মুজাহিদের অপতৎপরতা শুধু ফকিরাপুল এলাকায় নয়, বিস্তৃত ছিল পুরাে ঢাকা শহরে। বিজয়ের পর আমি আমার সহযােদ্ধাদের নিয়ে ফিরােজ মিয়ার বাড়ি থেকে প্রচুর মূল্যবান দলিল ও ছবি উদ্ধার করি। কাগজপত্রগুলােতে ঢাকা শহরের রাজাকারদের তালিকা, বায়ােডাটা, ছবি এবং তাদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের ছবি ও দলিল ছিল, যার একটি ছাপা হয়েছে একাত্তরের ঘাতক-দালালরা কে কোথায়’ গ্রন্থে। পরে বিভিন্ন সময়ে আমার বাসায় পুলিশী হামলার সময় ছবি ও দলিলপত্রগুলাে হারিয়ে যায়। বিজয়ের পর ফিরােজ মিয়ার বাড়িটি ছিল মুক্তিযােদ্ধাদের ক্যাম্প। ফিরােজ মিয়ার বাড়িটিকে ষড়যন্ত্রের ঘাঁটি হিসেবে অভিহিত করে কলামিস্ট মাহবুব কামাল বলেন, ‘এই বাড়িতে বসেই আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ ও ফেরু মেম্বার বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের গুটি চালতেন। মুজাহিদের নির্দেশে ফিরােজ মিয়া গং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের বাড়িতে তল্লাশী চালাতাে। তৎকালীন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জোবেদ আলীর বাড়িতে বেশ কয়েকবার তল্লাশী চালানাে হয়েছে। আমাদের বন্ধু মুক্তিযােদ্ধা নাজুর বাড়িতেও বেশ কয়েকবার তল্লাশী চালানাে হয়। আগস্ট-সেপ্টেম্বরের দিকে নাজু নিখোঁজ হয়ে যায়। ধারনা করা হয়, মুজাহিদের নির্দেশে ফিরােজ মিয়া গংই তাকে হত্যা করেছে। ‘৭১ সালে যুদ্ধের আগে আমার এক চাচাতাে ভাই মহসিন চাকরী খুঁজতে রাজশাহী থেকে ঢাকা আসে। সে আমাদের বাসাতেই থাকতাে। মহসিন নিয়মিত নামাজ পড়তাে। যুদ্ধের মাঝামাঝি সময় তাকে খুব অস্থিরচিত্ত ও ভীত দেখাচ্ছিল।
জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম মসজিদে আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদের সাথে তার যােগাযােগ হয়েছে। মুজাহিদ তাকে রাজাকার বাহিনীতে যােগ দিতে বলেছে এবং হুমকি দিয়েছে রাজাকার বাহিনীতে যােগ না দিলে তাকে মেরে ফেলা হবে। মুজাহিদের হাত থেকে বাঁচানাের জন্যে আমরা তাকে লুকিয়ে রাজশাহী পাঠিয়ে দেই। সে বর্তমানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত। মুজাহিদের রিক্রুট ফিরােজ মিয়া ফকিরাপুল এলাকার ৩০০ সদস্যের একটি রাজাকার প্লাটুন গড়ে তােলে। ফকিরাপুল এলাকার পুরােনাে বাসিন্দাদের সাক্ষ্য থেকে জানা যায় ‘ফিরােজ মিয়া গং যুদ্ধের সময় ফকিরাপুল ও আরামবাগ এলাকার শত শত বাঙালীকে ধরে নিয়ে হত্যা করেছে। নির্যাতন চালিয়েছে এলাকার মেয়েদের ওপর। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ফকিরাপুল এলাকার এক কৃতী ফুটবলার জানিয়েছেন, “ফিরােজ মিয়ার দল আমাকে ধরে নিয়ে যাবার পর প্রথমেই একটি বাড়িতে নিয়ে রুলার দিয়ে বেদম প্রহার করে। পরে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় ফিরােজ মিয়ার রাজাকার বাহিনীর অফিসে। এখানেও আমাকে মাটিতে শুইয়ে কখনও সিলিং থেকে ঝুলিয়ে ফিরােজ মিয়া বহু মারধাের করেছে। এই বাড়িতে বহু ভদ্র ও শিক্ষিত বাঙালী মেয়েকে ধরে এনে বেঁধে রাখা হয়েছিল। এদের ওপর প্রতিদিন-প্রতিরাতে চরম নির্যাতন চালানাে হত।
(সূত্র : একাত্তরের ঘাতক দালালরা কে কোথায়) ।
‘৭১-এ ছাত্রসংঘ নেতা ও বদর বাহিনী প্রধান মুজাহিদের অপতৎপরতার ছবিও প্রকাশিত হয়েছে পত্রিকায়, ‘৭১-এর ১১ ডিসেম্বর দৈনিক আজাদে প্রকাশিত একটি ছবির ক্যাপশন ছিল গতকাল গুজব সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে হুশিয়ারী প্রদান করিয়া আলবদর আয়ােজিত পথসভায় বক্তৃতা করিতেছেন আলবদর প্রধান জনাব মুজাহিদ। | আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদের স্বাধীনতা বিরােধী তৎপরতা ও নৃশংসতা ৭১-এই শেষ হয়ে যায়নি। এর ধারাবাহিকতা চলছে এখনও। আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ বর্তমানে জামায়াতে ইসলামীর অন্যতম সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল। সাপ্তাহিক বিচিত্রায় ১১ নবেম্বর ১৯৮৮-তে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়- ১৯৭৮ সালে ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার ভিন্নমতাবলম্বী ছাত্রনেতা মওলানা আবদুস সােবহানকে শিবির কর্মীরা কোরআন পাঠরত অবস্থায় নির্মমভাবে হত্যা করে। বিশেষ সূত্রে জানা যায়, এই হত্যা অভিযানের নেতৃত্ব দেয় ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধচলাকালীন ঘাতক আল বদর বাহিনী প্রধান আলী আহসান মুজাহিদ।
এ বি এম খালেক মজুমদার
এ. বি. এম. খালেক মজুমদার, পিতা ও আবদুল মজিদ মজুমদার, গ্রামঃ দোহাড়া, থানাঃ হাজিগঞ্জ, জেলা কুমিল্লা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন জামায়তে ইসলামী ঢাকা মহানগরীর দপ্তর সম্পাদক (অফিস সেক্রেটারী) ছিলেন। বর্তমানে তিনি স্বাধীনতা বিরােধী জামাত-শিবির চক্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হলেও েদলীয় কার্যক্রমে সক্রিয় নন। দলের আদর্শ অনুযায়ী ’৭১ সালে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে পাকিস্তানী বাহিনীকে সাহায্য করেছেন এবং নিজেও হত্যা, লুটতরাজে সহযােগিতা করেছেন বলে অভিযােগ পাওয়া গেছে। ’৭১ সালে তিনি জামাতের ঘাতক বাহিনী আলবদরের কমাণ্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। বদর বাহিনীর কমাণ্ডার হিসেবে বিজয়ের পূর্ব মুহুর্তে সুপরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গেও এই ব্যক্তি জড়িত ছিলেন। ৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় খালেক মজুমদারের নেতৃত্বে একদল আলবদর পুরােনাে ঢাকার ২৯ নং কায়েতটুলি থেকে দৈনিক সংবাদের তৎকালীন যুগ্ম সম্পাদক এবং দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিক শহীদুল্লা কায়সারকে জোরপূর্বক ধরে নিয়ে যায়। বাংলার এ প্রতিভাধর সন্তান আর ফিরে আসেননি, খুঁজে পাওয়া যায়নি তার মৃতদেহও। এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী শহীদুল্লা কায়সারের ছােট বােনের স্বামী নাসির আহমেদ, স্ত্রী সায়ফুন্নাহার ওরফে পান্না কায়সার, ছােট ভাই চিত্র পরিচালক ও প্রযােজক জাকারিয়া হাবিব ও তাঁর স্ত্রী নীলা জাকারিয়ার বর্ণনা থেকে জানা যায়
১৯৭১ সালে যুদ্ধাবস্থার কারণে শহীদুল্লা কায়সারের বাসায় তাঁর অনেক আত্মীয়-স্বজন আশ্রয় নিয়েছিলেন। ১৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৬টা-সাড়ে ৬টার দিকে বাসার নিচতলায় জাকারিয়া হাবিবসহ অনেকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শােনার চেষ্টা করছিলেন। কারফিউ ও ব্ল্যাক আউটের কারণে পুরাে এলাকা। অন্ধকার ছিল। এমন সময় বাইরের দরজায় ধাক্কা দেয়ার শব্দ হয়। শব্দ শুনেই জাকারিয়া হাবিব দৌড়ে ওপরে চলে যান। শহীদুল্লা কায়সার তখন ড্রইং রুমে বসে চা খাচ্ছিলেন, সে রুমে ছিলেন নীলা জাকারিয়াও। আগমণকারীদের কথা শহীদুল্লা কায়সারকে জানিয়ে নিচে চলে আসেন জাকারিয়া হাবিব। এ সময় ভয়ে শহীদুল্লা কায়সারের বােন শাহানা বেগম (বর্তমানে আমেরিকা নিবাসী) ও নীলা জাকারিয়াসহ অন্যরা দোতলা ও একতলার সব আলাে জ্বেলে দেন। শহীদুল্লা কায়সার ড্রইং রুম থেকে বেডরুমে গিয়ে টেলিফোন করার চেষ্টা করেন। ততক্ষণে আগমণকারীরা নিচের দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে যায়। প্রথমে শহীদুল্লা কায়সারের ছছাটভাই ওবায়দুল্লাকে (বর্তমানে আমেরিকা নিবাসী) রাইফেলের বাট দিয়ে আঘাত করে ফেলে দেয়। মুখােশ আঁটা আগমণকারীরা জাকারিয়া হাবিবকে ধরে, শহীদুল্লা কায়সারকে খুঁজতে খুঁজতে সিঁড়ি বেয়ে দোতালায় উঠে সরাসরি তাঁর বেডরুমে চলে যায়। টেলিফোন হাতে শহীদুল্লা কায়সার নিজের পরিচয় দিয়ে তাদের আগমণের কারণ জানতে চান।
শহীদুল্লা কায়সারের পরিচয় পেয়েই একজন ‘মিল গিয়া’ বলে উল্লাস ধ্বনি করে তাঁর চুলের মুঠি চেপে ধরে। অন্যদের কেউ জামার কলার, কেউ হাত ধরে তাঁকে টেনে-হেঁচড়ে নিয়ে যেতে থাকে। এসময় শাহানা বেগম, পান্না কায়সার, নাসির আহমেদ প্রমুখ জোর করে তাঁকে ছাড়ানাের চেষ্টা করেন। ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে শাহানা বেগম একজন আততায়ীর মুখােশ টান দিয়ে খুলে ফেলেন। উজ্জ্বল আলােতে সবাই তাকে চিনে ফেলেন। পরে আদালতে খালেক মজুমদারকে সনাক্তকরণের সময় তাঁরা পৃথকভাবে জানান, এই ব্যক্তিই ১৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যা রাতে শহীদুল্লা কায়সারকে অপহরণ করতে গিয়েছিলেন। মুখের আবরণ খুলে ফেলার পর খালেক মজুমদার ক্ষিপ্ত হয়ে শাহানা বেগমকে লাথি মেরে ফেলে দিয়ে, অন্যদের আঘাত করে শহীদুল্লা কায়সার ও জাকারিয়া হাবিবকে টেনে হেঁচড়ে সিঁড়ি দিয়ে নামিয়ে আনেন। আততায়ীদের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে শহীদুল্লা কায়সার তখন আশেপাশের সব কিছু, এমনকি দেয়াল আঁকড়ে ধরেও প্রতিরােধের চেষ্টা চালান। শহীদুল্লা কায়সারের কন্যা, আজকের সুপরিচিত অভিনেত্রী শমী কায়সার তখন দু’বছরের অবােধ শিশু— সেও আয়ু, আয়ু, বলে চিৎকার করে বাবাকে ডাকছিল। কিন্তু আততায়ীরা সব বাধা উপেক্ষা করে তাঁদের দুজনকে নিয়ে যায়। পরে রাস্তায় নিয়ে জাকারিয়া হাবিবকে ছেড়ে দিয়ে শহীদুল্লা কায়সারকে মােড়ে দাঁড়ানাে জীপে তুলে নিয়ে যায়। সেটাই ছিল তাঁর শেষ যাওয়া। খালেক মজুমদার তখন একই এলাকার ৪৭ নং আগামসী লেনে থাকতেন। কায়েতটুলী মসজিদের তৎকালীন ইমাম আশ্রাফউল্লাহ, যিনি বর্তমানে বনানী গােরস্থানে কাজ করেন, জানান, ঘটনার দিন অর্থাৎ ১৪ ডিসেম্বর ‘৭১ সালে বিকেলে খালেক মজুমদার তাঁর কাছে শহীদুল্লা কায়সার কখন বাসায় থাকেন ইত্যাদি জানতে চান। আশ্রাফউল্লাহ উত্তরে জানি না বলেন। তখন তিনি নিজেও জানতেন না খালেক মজুমদার শহীদুল্লা কায়সারকে মেরে ফেলার জন্যে খুজছে। সেদিন সন্ধ্যা রাতে আশ্রাফউল্লাহ মসজিদের দোতালায় জানালা দিয়ে দেখতে পান শহীদুল্লা কায়সার রাস্তার ল্যাম্পপােষ্ট আঁকড়ে ধরে ‘বাঁচাও বাঁচাও’ বলে চিৎকার করছেন, আর কয়েকজন লােক তাঁকে জোর করে গাড়িতে তুলে নিয়ে গেল। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের পরদিন, অর্থাৎ ১৭ ডিসেম্বর আশ্রাফউল্লাহ একথা নাসির আহমেদ ও জাকারিয়া হাবিবকে জানিয়েছিলেন।
১৪ ডিসেম্বর ‘৭১-এর রাতেই নাসির আহমেদ কোতােয়ালী থানায় ফোন করে ঘটনাটি জানান, কিন্তু তখন পুলিশ প্রশাসন বলে কিছু না থাকায় কোন সাহায্য পাওয়া যায়নি। ১৬ ডিসেম্বর দেশ হানাদার মুক্ত হওয়ার পর নাসির আহমেদ শহীদুল্লা কায়সারকে ফিরে পাওয়ার জন্য খালেক মজুমদারকে খুঁজতে থাকেন। ২০ ডিসেম্বর তিনি বাদী হয়ে কোতােয়ালী থানায় একটি মামলাও দায়ের করেন। ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের কথা শুনেই খালেক মজুমদার কৃতকর্মের শাস্তির ভয়ে তাঁর বাড়ি থেকে পালিয়ে যান। নাসির আহমেদ, জাকারিয়া হাবিবসহ অন্যরা তাঁর বাসায় গিয়ে তাঁকে পাননি, তবে তাঁর রুমে গুলিসহ একটি রিভলবার এবং বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র পান, যাতে বেশ কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তা ও আলবদর হাই কমাণ্ড সদস্যের নাম পাওয়া যায়। বিজয়ের পর গঠিত বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড তদন্ত কমিশনকে এসব কাগজপত্র হস্তান্তর করা হয়। মূলতঃ শহীদুল্লা কায়সারকে ফিরে পাওয়ার আশায় নাসির আহমেদ ২ নং সেক্টরের কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধাকে নিয়ে দিনের পর দিন খুঁজতে থাকেন খালেক মজুমদারকে। শেষ পর্যন্ত মালিবাগের এক আত্মীয়ের বাসা থেকে গ্রেফতার করা হয় তাকে। খালেক মজুমদারের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলায় সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, তিনিই শহীদুল্লা কায়সারকে মেরে ফেলার জন্যে অপহরণ করে নিয়ে যান। ‘৭২ সালের ১৭ জুলাই এই মামলার রায়ে তাকে ৭ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। খালেক মজুমদারের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট ও প্রমাণিত অভিযােগ থাকায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ঘােষিত সাধারণ ক্ষমার আওতায়ও তিনি পড়েননি। জিয়াউর রহমানের আমলে পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুযােগ নিয়ে উচ্চতর আদালতে আপীল করে ’৭৬ সালের ২৯ এপ্রিল খালাস পেয়ে যান খালেক মজুমদার।
১৯৮৫ সালে প্রকাশিত ও খালেক মজুমদার কর্তৃক লিখিত ‘শিকল পরা দিনগুলাে’ গ্রন্থে লেখক নিজেই স্বীকার করেছেন তিনি সে সময় জামায়াতে ইসলামীর সিদ্দিকবাজারস্থ ঢাকা মহানগরী অফিসের সেক্রেটারী ছিলেন। ‘৭১-এ তাঁর দল জামায়াতে ইসলামী ছিল স্বাধীনতার বিরুদ্ধে। সারাদেশে রাজাকার ও আলবদর বাহিনী গঠন করে তারা পাক বাহিনীকে সহায়তা করেছে এবং নিজেরাও প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়েছে গণহত্যা, নারী ধর্ষণ, লুটতরাজ, অগ্নিসংযােগ ইত্যাদিতে। সে সময় জামাতের অফিস সেক্রেটারীর মত গুরুত্বপূর্ণ পদের দায়িত্ব থাকা খালেক মজুমদার স্বীকার করেছেন দলের আদর্শ বাস্তবায়নের তাগিদে এসব কাজ তাকে করতে হয়েছে। তাঁর লেখা বইয়ে তিনি এটাও স্বীকার করেছেন তার সাথে আরেক যুদ্ধাপরাধী আলবদর প্রধান জামাত নেতা মতিউর রহমান নিজামী ও বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের অপারেশন ইনচার্জ চৌধুরী মঈনুদ্দীনের সঙ্গে পরিচয় ছিল। চৌধুরী মঈনুদ্দীন একই এলাকায় বাস করতাে। তাঁর বই থেকে আরও জানা যায়, তাঁর সাথে পাক বাহিনীরও যােগাযােগ ছিল। স্বাধীনতার ১৪ বছর পর প্রকাশিত ‘শিকল পরা দিনগুলাে’র ছত্রে ছত্রে রয়েছে খালেক মজুমদারের মুক্তিযুদ্ধ বিরােধী মনােভাব ও মুক্তিযােদ্ধাদের বিরুদ্ধে কুৎসা। ‘৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের ঘােষণায় ৭ কোটি বাঙালী যখন আনন্দে উদ্বেলিত তখন খালেক মজুমদারের প্রতিক্রিয়া ছিল কিন্তু হায়! সব ধারণার মূল ছিন্ন করে সবাইকে বিস্মিত করে দিয়ে যখন ১৬ই ডিসেম্বর তাদের আত্মগ্লানির ঘােষণা শােনা গেল তখন সকলেই বিস্ময়ে বিমূঢ়। সেদিনই ভােরে জনৈক শ্রদ্ধেয় নেতা আমাকে ত্বরা করে ডেকে পাঠালেন সিটি জামায়াত অফিসে।…. ওখানে গিয়ে বৃত্তান্ত শুনে হতাশায় ছেয়ে গেল সারা মন। শিউরে উঠলাে প্রতিটি লােমকূপ। (শিকল পরা দিনগুলি, পৃষ্ঠা-১০)। ১১ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন ‘তখনাে নিশ্চিত হতে পারছিলাম না আমার ভবিষ্যত সম্পর্কে। তবে লক্ষণ ভালাে ঠেকলাে না, উহ-আহ এর দীর্ঘনিশ্বাসের মধ্যে দিয়েই কেটে গেলাে রক্তিম দিনটা। দিনের শেষে নেমে এলাে রাতের অন্ধকার। আমাদের ভাগ্যাকাশ থেকে বিদায় নিলাে সৌভাগ্যের শুকতারা।
ডঃ সৈয়দ সাজ্জাদ হােসেন
অধ্যাপক ডঃ সৈয়দ সাজ্জাদ হােসেন মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন। ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই সময় তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরুদ্ধে তৎপর ছিলেন। তাঁর এই কর্মতৎপরতার অংশ হিসেবে তিনি পত্রপত্রিকায় বিবৃতি প্রদানের মাধ্যমে পাকিস্তানী সামরিক জান্তার পক্ষে সাফাই পেশ করেন এবং তাদের দুষ্কর্ম আড়াল করার অপচেষ্টা করেন। সেই সময় তিনি পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সঙ্গে নিয়মিত যােগাযােগ রাখতেন। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দৈনিক বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘কুখ্যাত ইয়াহিয়া খাঁর সেনাবাহিনী বাংলাদেশ আক্রমণের কিছুদিন পর ডঃ সাজ্জাদ হােসেন ইয়াহিয়া খাঁর পক্ষে এবং স্বাধীন বাংলার বিপক্ষে প্রচার চালানাের জন্য বিদেশ সফরে বেরিয়েছিলেন। সে সময় লণ্ডন টাইমস পত্রিকায় তার একটি চিঠি বেরিয়েছিল যে, “দেশে কিছু ঘটেছে বলে যা রটেছে তা ঠিক নয়। লণ্ডন টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত চিঠিতে সৈয়দ সাজ্জাদ হােসেন আরও উল্লেখ করেছেন, ২৫ মার্চের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ভেতর যারা নিহত হয়েছেন তার জন্য পাকিস্তানী সেনাবাহিনী দায়ী নয়। তাঁরা দুই দলের ক্রসফায়ারে মারা গেছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে ২৫ ও ২৬ মার্চের পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সব শিক্ষককে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল, তারা সবাই সৈয়দ সাজ্জাদ হােসেনের সহপাঠী ছিলেন।
লণ্ডনের পাকিস্তানী দূতাবাসের কাউন্সিলর বখতিয়ার আলীর কাছ থেকে ডঃ সাজ্জাদ হােসেন দালালীর পারিশ্রমিক গ্রহণ করেছেন তার প্রমাণস্বরূপ তাঁর স্বাক্ষরযুক্ত চিঠিটি দৈনিক বাংলার ১০ জানুয়ারি ’৭২-এর তৃতীয় পৃষ্ঠায় ছাপানাে হয়। যার বঙ্গানুবাদ— লণ্ডনের পাকিস্তানী দূতাবাসের ২৫ জুন ১৯৭১ সালের অফিস আদেশ মােতাবেক আমাকে নিম্নলিখিত হারে টাকা দেওয়া হােক । | (ক) ২৪ জুন থেকে ১লা জুলাই পর্যন্ত ৫০+ ডিএ, ৩ পাউণ্ড ৭৫ পেনী করে ৭ দিনের জন্য ২৫ পাউণ্ড ২৫ পেনী (খ) ১৫০ পাউণ্ড নগদ। আমার হােটেলের বিল পরিশােধের জন্য পরে দেওয়া হবে। | পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী বাংলাদেশে যখন মানবেতিহাসের স্মরণকালের জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞ শুরু করেছে তখন ৫৫জন অধ্যাপক, লেখক, সাংবাদিক, শিল্পী এক যুক্ত বিবৃতি দেন। ১৯৭১ সালের ১৭ মে প্রকাশিত এই বিবৃতিতে, পাকিস্তানের সাম্প্রতিক ঘটনাবলী সম্পর্কে ভারতের দূরভিসন্ধিমূলক প্রচারণায় নিউইয়র্কস্থ আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জরুরী কমিটি সাড়া দেওয়ার জন্য এর নিন্দা করা হয়। ….. বিবৃতিতে আরাে বলা হয়েছে, এই সময়েই ব্যাপকভাবে শিক্ষার অঙ্গনকে রাজনৈতিক স্বার্থ সিদ্ধির কাছে অপব্যবহার করা হতে থাকে। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে ছাত্ররা লেখা পড়া বা। খেলাধুলায় ব্যস্ত ছিল না। তা ছিল বাংলাদেশ মুক্তিফৌজের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, তা ছিল মেশিনগান, মর্টার ইত্যকার সমরাস্ত্রের গােপন ঘাঁটি। ফ্যাসীবাদী, সন্ত্রাসবাদ ও রাজনৈতিক দলগত অসহিষ্ণুতার এই শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ এড়ানাের জন্য আমাদের অধিকাংশই আমাদের গ্রামগুলােতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। পাকিস্তানকে খণ্ড বিখণ্ড করার সশস্ত্র প্রয়াস নস্যাৎ এবং প্রদেশে আইন শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠার আগে কেউ শহরে ফিরে আসেননি। ….. পাকিস্তানী শাসন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আমাদের নিজস্ব অভাব-অভিযােগ রয়েছে। দেশের অর্থনীতি ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আমাদের যেটা প্রাপ্য সেটা না পেয়ে আমরা অসুখী। আমাদের এই অসন্তোষ আমরা প্রকাশ করেছি একই রাষ্ট্র কাঠামাের আওতায়, পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ব্যাপক স্বায়ত্বশাসনের পক্ষে ভােট দিয়ে। কিন্তু আওয়ামী লীগের চরম পন্থীরা এই সরল সহজ আইনসঙ্গত দাবীকে
ডঃ সৈয়দ সাজ্জাদ হােসেন
অধ্যাপক ডঃ সৈয়দ সাজ্জাদ হােসেন মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন। ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই সময় তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরুদ্ধে তৎপর ছিলেন। তাঁর এই কর্মতৎপরতার অংশ হিসেবে তিনি পত্রপত্রিকায় বিবৃতি প্রদানের মাধ্যমে পাকিস্তানী সামরিক জান্তার পক্ষে সাফাই পেশ করেন এবং তাদের দুষ্কর্ম আড়াল করার অপচেষ্টা করেন। সেই সময় তিনি পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সঙ্গে নিয়মিত যােগাযােগ রাখতেন। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দৈনিক বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘কুখ্যাত ইয়াহিয়া খাঁর সেনাবাহিনী বাংলাদেশ আক্রমণের কিছুদিন পর ডঃ সাজ্জাদ হােসেন ইয়াহিয়া খাঁর পক্ষে এবং স্বাধীন বাংলার বিপক্ষে প্রচার চালানাের জন্য বিদেশ সফরে বেরিয়েছিলেন। সে সময় লণ্ডন টাইমস পত্রিকায় তার একটি চিঠি বেরিয়েছিল যে, “দেশে কিছু ঘটেছে বলে যা রটেছে তা ঠিক নয়। লণ্ডন টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত চিঠিতে সৈয়দ সাজ্জাদ হােসেন আরও উল্লেখ করেছেন, ২৫ মার্চের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ভেতর যারা নিহত হয়েছেন তার জন্য পাকিস্তানী সেনাবাহিনী দায়ী নয়। তাঁরা দুই দলের ক্রসফায়ারে মারা গেছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে ২৫ ও ২৬ মার্চের পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সব শিক্ষককে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল, তারা সবাই সৈয়দ সাজ্জাদ হােসেনের সহপাঠী ছিলেন।
লণ্ডনের পাকিস্তানী দূতাবাসের কাউন্সিলর বখতিয়ার আলীর কাছ থেকে ডঃ সাজ্জাদ হােসেন দালালীর পারিশ্রমিক গ্রহণ করেছেন তার প্রমাণস্বরূপ তাঁর স্বাক্ষরযুক্ত চিঠিটি দৈনিক বাংলার ১০ জানুয়ারি ’৭২-এর তৃতীয় পৃষ্ঠায় ছাপানাে হয়। যার বঙ্গানুবাদ— লণ্ডনের পাকিস্তানী দূতাবাসের ২৫ জুন ১৯৭১ সালের অফিস আদেশ মােতাবেক আমাকে নিম্নলিখিত হারে টাকা দেওয়া হােক । | (ক) ২৪ জুন থেকে ১লা জুলাই পর্যন্ত ৫০+ ডিএ, ৩ পাউণ্ড ৭৫ পেনী করে ৭ দিনের জন্য ২৫ পাউণ্ড ২৫ পেনী (খ) ১৫০ পাউণ্ড নগদ। আমার হােটেলের বিল পরিশােধের জন্য পরে দেওয়া হবে। | পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী বাংলাদেশে যখন মানবেতিহাসের স্মরণকালের জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞ শুরু করেছে তখন ৫৫জন অধ্যাপক, লেখক, সাংবাদিক, শিল্পী এক যুক্ত বিবৃতি দেন। ১৯৭১ সালের ১৭ মে প্রকাশিত এই বিবৃতিতে, পাকিস্তানের সাম্প্রতিক ঘটনাবলী সম্পর্কে ভারতের দূরভিসন্ধিমূলক প্রচারণায় নিউইয়র্কস্থ আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জরুরী কমিটি সাড়া দেওয়ার জন্য এর নিন্দা করা হয়। ….. বিবৃতিতে আরাে বলা হয়েছে, এই সময়েই ব্যাপকভাবে শিক্ষার অঙ্গনকে রাজনৈতিক স্বার্থ সিদ্ধির কাছে অপব্যবহার করা হতে থাকে। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে ছাত্ররা লেখা পড়া বা। খেলাধুলায় ব্যস্ত ছিল না। তা ছিল বাংলাদেশ মুক্তিফৌজের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, তা ছিল মেশিনগান, মর্টার ইত্যকার সমরাস্ত্রের গােপন ঘাঁটি। ফ্যাসীবাদী, সন্ত্রাসবাদ ও রাজনৈতিক দলগত অসহিষ্ণুতার এই শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ এড়ানাের জন্য আমাদের অধিকাংশই আমাদের গ্রামগুলােতে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
পাকিস্তানকে খণ্ড বিখণ্ড করার সশস্ত্র প্রয়াস নস্যাৎ এবং প্রদেশে আইন শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠার আগে কেউ শহরে ফিরে আসেননি। ….. পাকিস্তানী শাসন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আমাদের নিজস্ব অভাব-অভিযােগ রয়েছে। দেশের অর্থনীতি ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আমাদের যেটা প্রাপ্য সেটা না পেয়ে আমরা অসুখী। আমাদের এই অসন্তোষ আমরা প্রকাশ করেছি একই রাষ্ট্র কাঠামাের আওতায়, পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ব্যাপক স্বায়ত্বশাসনের পক্ষে ভােট দিয়ে। কিন্তু আওয়ামী লীগের চরম পন্থীরা এই সরল সহজ আইনসঙ্গত দাবীকে একতরফা স্বাধীনতার ঘােষণার দাবিতে রূপান্তরিত করায় আমরা মর্মাহত হয়েছি। আমরা কখনও এটা চাইনি, ফলে যা ঘটেছে তাতে আমরা হতাশ ও দুঃখিত হয়েছি। এই বিবৃতির এক নম্বর স্বাক্ষরদাতা ছিলেন ডঃ সৈয়দ সাজ্জাদ হােসেন।
উপসংহার
অভিযুক্ত ৮ জন ব্যক্তি সম্পর্কে গণতদন্ত কমিশনের তদন্তে তাদের বিচারের দাবির যৌক্তিকতা প্রমাণিত হয়েছে। যুদ্ধাপরাধী, গণহত্যাকারী, মানবতাবিরােধী, শান্তিবিরােধী, ষড়যন্ত্রকারী, প্ররােচনাকারী, উদ্যোগ গ্রহণকারী এবং অপরাধে সাহায্যকারী হিসেবে তাদের বিচার আন্তর্জাতিক ও দেশের আইনের এখতিয়ারভুক্ত বলে পরিলক্ষিত হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক আইনগুলাের ভিত্তি গড়ে ওঠে ঐতিহাসিক নুরেমবার্গ ও টোকিও ট্রায়ালের মাধ্যমে। এরপর জাতিসংঘের বিভিন্ন কনভেনশন, ঘােষণা ও মানবাধিকার দলিলে যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরােধী অপরাধগুলাের বিচার নিশ্চিত করার উপর জোর দেয়া হয়। এই বিচার সম্পাদনের সুদৃঢ় নৈতিক ভিত্তির কারণে পৃথিবীর অনেক দেশই যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য নিজস্ব আইন প্রণয়ন করেছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশে ১৯৭৩ সালের ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল) এ্যাক্টটি যুদ্ধাপরাধ, শান্তিবিরােধী ও মানবতাবিরােধী অপরাধ এবং গণহত্যাজনিত অপরাধের বিচারের জন্য প্রণীত হয়। এই আইনে রাজনীতি, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা ও সংস্কৃতিগত পার্থক্যের কারণে বেসামরিক জনগােষ্ঠীর উপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া, তাদের হত্যা, ধর্ষণ, আটক, নিপীড়ন, সম্পদ ধ্বংস করা বা এসব অপরাধের প্রচেষ্টা, এসব অপরাধে সহযােগিতা, ষড়যন্ত্র ও উদ্যোগ গ্রহণ করা এবং প্ররােচনা প্রদানকে যুদ্ধাপরাধী, মানবতাবিরােধী, শান্তিবিরােধী ও গণহত্যাজনিত অপরাধের সংজ্ঞাভুক্ত করা হয়। ‘৭৩-এর আইনে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে এসব অপরাধের বিচার ও সেই বিচারকার্যে একাত্তরের পত্রপত্রিকা, প্রচার মাধ্যমে পরিবেশিত তথ্যাদিকে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণের বিধান করা হয়।
গণতদন্ত কমিশন অভিযুক্ত ব্যক্তিদের অপরাধ ও প্রাসঙ্গিক আইনগুলাে পর্যালােচনা করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, বাংলাদেশের ১৯৭৩ সালের ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম (ট্রাইব্যুনাল) এ্যাক্ট এবং প্রচলিত আইনের অধীনে এই সকল অপরাধীর বিচার করা যেতে পারে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে নিরাপদ ও অর্থবহ করতে হলে এই ধরনের ঘাতক দালাল ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে হবে। বাংলাদেশে আজ গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় রয়েছে। সরকার ও বিরােধীদলগুলাে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের কথা বলছে। গণতদন্ত কমিশন বিশ্বাস করে এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকালে যারা দখলদার পাকিস্তানী বাহিনীর সহযােগীর ভূমিকা পালন করেছে, যারা তাদের গণহত্যা, ধর্ষণ, গৃহে অগ্নিসংযােগ, লুণ্ঠন ও যাবতীয় ধ্বংসযজ্ঞে প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে সম্পৃক্ত থেকেছে, তাদের বিচার এড়িয়ে গণতন্ত্র, আইনের শাসন কিংবা মানবাধিকার কিছুই প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। এক্ষেত্রে বিচারের মূল দায়িত্ব সরকারের। সরকারেরই ক্ষমতা রয়েছে যে কোন অপরাধ বিচারের।
সূত্র: একাত্তরের ঘাতক দালাল ও যুদ্ধাপরাধীদের সম্পর্কে জাতীয় গণতদন্ত কমিশনের দ্বিতীয় রিপোর্ট