This is a temporary post for collecting data. Not for posting and not for publishing. Saved only as readable for the editors. Not clickable and not downloadable.
একাত্তরের ডায়েরী
সুফিয়া কামাল
ভূমিকা নয়, রক্তে লেখা শােক
একাত্তরের ডায়েরীর সব কটা পাতা ভরে তুলতে পারিনি, অনেক কথাই রয়ে গেছে অব্যক্ত। ডায়েরীটা পেয়েছিলাম ১৯৭০-এর ডিসেম্বরে। ভেবেছিলাম ‘৭১-এই শুরু করবাে।
এর মধ্যে ঘটে গেল ‘৭০-এর ভয়াবহ জলােচ্ছাস। যেতে হলাে দক্ষিণবঙ্গে রিলিফের কাজে। ডায়েরীটা হাতে নিয়ে গেলাম। নিঃস্ব মানুষের শােকে দুঃখে শরিক হয়ে ঢাকায় ফিরে কিছুদিন পরই মানুষের সংগ্রামের মিছিলে অংশ নিলাম। ২৫ মার্চ শুরু হলাে পাক সামরিক বাহিনীর মারণযজ্ঞ। অনেক কিছুই দেখলাম শুনলাম বাসায়। বসে বসে। সব কথা লেখা সম্ভব হয়ে উঠে নি। কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা লেখা হয় নি যা বলা প্রয়ােজন। তাই এ মুখবন্ধ।
মুক্তিযুদ্ধে এদেশের কোটি কোটি কিশাের-যুবা, তরুণ-তরুণী যােগ দিয়েছিল। শহীদ হয়েছে ত্রিশ লক্ষ মুক্তিযােদ্ধা এবং সম্ভ্রম হারিয়েছে তিন লক্ষ নারী। তাদের উদ্দেশ্যেই আমার ডায়েরীটি উৎসর্গ করলাম। ওদের অনেকেই আমার চেনা-জানা ছিল। ওদের জন্য আমি বড়ই উদ্বেগ নিয়ে কাটিয়েছি মুক্তিযুদ্ধের পুরাে সময়টা। ওরা ফেরে নি।
মুক্তিযুদ্ধের নয়টি মাস আমি বারান্দায় বসে বসে দেখেছি পাকিস্তানী মিলিটারীর পদচারণা। আমার পাশের বাসায় ছিল পাকিস্তানী মিলিটারীর ঘাঁটি। ওখানে দূরবীন চোখে পাকবাহিনীর লােক বসে থাকতাে। রাস্তার মােড়ে, উল্টো দিকের বাসায় সবখানে ওদের পাহারা ছিল। নিয়াজী শেষ সময়ে আত্মরক্ষা করতে ঐ বাসায় লুকিয়েছিল।
কাঁথা সেলাই করেছি নয় মাসে নয়টি। প্রত্যেকটি ফোঁড় আমার রক্তাক্ত বুকের রক্তে গড়া। বড় কষ্ট ছিল। কষ্ট এখনাে আছে। স্বাধীন বাংলা গড়ার জন্য যারা ছিল অমূল্য সম্পদ—সেই মুনীর চৌধুরী, মােফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, শহীদুল্লা কায়সার, আলতাফ মাহমুদ, ডা. আলিম চৌধুরী ও ডা. মাের্তুজা এরকম আরাে সােনার ছেলেরা মেয়েরা রাজাকার-আলবদরের হাতে শহীদ হয়েছে। এদের কথা আমি কি করে ভুলি!
মুনীরের কথা ভুলতে পারি না। প্রত্যেক সভা শেষে মুনীর আমার কাছে এসে দাঁড়ায় : ‘চলুন আপনাকে পৌছে দিয়ে আসি’, কণ্ঠ আর শুনি না। ডিসেম্বরের ১০/১২ তারিখ মােফাজ্জল হায়দার চৌধুরী ফোন করেছিলেন, আমি বাড়ী থেকে সরে কোথাও যাব কিনা তা জানতে চেয়েছিলেন। বলেছিলেন, শুনেছি অনেককে মেরে ফেলার লিস্ট হয়েছে, তার মধ্যে আপনার আমারও নাম আছে, কি করবেন? কোথাও সরে যাবেন?-বলতে বলতেই ফোনের লাইন কেটে দেয়া হলাে। আর কথা হয়নি। জালেমের দল তাকে মেরে ফেলেছে। আমি কোথাও যাইনি।
কিন্তু প্রায়ই উর্দুতে হুমকি পেয়েছি ওরা আসবে বাসায়। আমিও বলেছি মােকাবিলা করবাে, আসাে।
আমার বাসার পেছনে সােভিয়েত সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের কার্যালয় ছিল। একাত্তরের দুঃসময়ে ওরা অনেক সহযােগিতা করেছে।
আমার বাসায় ৭ নভেম্বরে সােভিয়েত কন্সাল মি. নভিকভ এসেছিলেন। শহীদুল্লা কায়সার এসেছিল। চায়ের টেবিলে বসে কথা হচ্ছিল। শহীদুল্লাকে ওরা বললাে ঢাকায় থাকা নিরাপদ নয়, সীমান্ত পেরিয়ে যাও।
শহীদুল্লা হেসে উড়িয়ে দিল বললাে, খালাম্মা কোথাও যাচ্ছেন? আমি বললাম, না আমাকে কিছু করবে না। তুমি যাও। বললাে, তা হয় না। খালাম্মা থেকে গেলেন, আমিও যাব না। ৭ ডিসেম্বরের পরেও খবর দেয়া হয়েছিল সােভিয়েত বন্ধুদের কাছে। গিয়ে থাকতে, গেল না। ১৪ ডিসেম্বর রাজাকার-আলবদরের দল ওকে মেরে ফেলল।
ভুলবাে কি করে গিয়াসউদ্দিনের কথা?
মাথায় গামছা বেঁধে লুঙ্গি পরে গিয়াস প্রায়ই চুপিসারে পিছন পথ দিয়ে দেয়াল টপকে আসতাে রিক্সাওয়ালা সেজে। চাল নিয়ে যেত বস্তায় করে মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য। প্রতিবেশী অনেকেই ঢাকা ছেড়ে যাবার আগে আমার কাছে রেশন কার্ড রেখে গিয়েছিলেন। সেই কার্ডে আমি চাল চিনি উঠিয়ে রাখতাম। সেগুলাে গিয়াস নিয়ে যেত। গিয়াসের উপর পাকসেনা রাজাকারদের চোখ ছিল অতন্দ্র। ১৪ ডিসেম্বর ওকেও রাজাকাররা হত্যা করেছে।
একাত্তরের মাঝামাঝি সময়ে যখন মেয়েদের ওপর পাকসেনাদের নজর পড়লাে, ঘটনা ঘটতে থাকলাে মেয়েদের বাড়ী থেকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া, তখন বােরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, বেবী মওদুদ, আইনজীবী মেহেরুন্নেসা খাতুন, নাহাস আরাে অনেকে মিলে এর প্রতিকারের জন্য চেষ্টা করেছিল। এরা সবাই মিলে মেয়েদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতাে। মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য কাপড়, খাবার এসবের যােগান দিত। ওদের সভায় আমাকেও নিয়ে গিয়েছিল। ওদের আমাদের কারাে তেমন কিছু করার ক্ষমতাই ছিল না মেয়েদের ওপর অত্যাচার বন্ধ করার। আমার ডায়েরীতে সংক্ষেপে তখনকার অবস্থা কিছু কিছু লিখে রেখেছিলাম। স্নেহাস্পদ কন্যাসম মালেকা বেগম একাত্তরের ডায়েরী প্রকাশে আগ্রহী হওয়ায় ওর হাতে ডায়েরী তুলে দিয়েছি। কালের স্বাক্ষর। হিসেবে আমার ডায়েরীটি সামান্যতম অবদান রাখতে পারলে ধন্য হব।
সুফিয়া কামাল
১৮.২.৮৯
প্রকাশকের কথা
বাংলাদেশের সমাজ-প্রগতি আন্দোলনের সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব কবি সুফিয়া কামালের ‘একালে আমাদের কাল’ বইটি সাদরে পাঠকদের হাতে তুলে দিতে পেরে আমরা আনন্দিত। মাসিক সাহিত্য-সংস্কৃতিবিষয়ক পত্রিকা গণ-সাহিত্যে প্রায় দশ বছর আগে (১৩৮৫ সালে) সুফিয়া কামাল রচিত ‘স্মৃতি : আমার কথা (অসম্পূর্ণ) প্রকাশিত হয়েছিল। সে লেখার সাথে তাঁর কাছ থেকে সংগৃহীত আরাে কিছু অপ্রকাশিত লেখা যােগ করে প্রকাশিত হলাে ‘একালে আমাদের কাল। তাঁর আত্মজীবনীর জন্য পাঠকের তৃষ্ণা এই বই দিয়ে মিটবে না। কেননা এটি আত্মজীবনী বা স্মৃতিকথা কোনােটিই নয়। কিন্তু তার আত্মজীবনীর সূচনা হিসেবে ‘একালে। আমাদের কাল’ পাঠকসমাজে সমাদৃত হবে বলে আশা করি।
কবি সুফিয়া কামালের ৭৭তম জন্মবর্ষপূর্তি (১০ আষাঢ়, ২০ জুন) উপলক্ষে এই বইটি প্রকাশের মাধ্যমে প্রকাশনা জগতে জ্ঞান প্রকাশনীর যাত্রা শুরু করতে পেরে আমরা ধন্য।
গ্রন্থের পিছন-মলাটে লেখক পরিচিত হিসেবে নিচের রচনাটি মুদ্রিত হয়েছিল :
জন্ম ১৯১১ সালের ২০ জুন, বাংলা ১০ আষাঢ় ১৩১৭, মাতামহ সৈয়দ মােয়াজ্জেম হােসেনের বাড়ী বরিশাল জেলার শায়েস্তাবাদে। পরিবারে চলতি নাম ছিল হাসনা বানু। নানা নাম রেখেছিলেন সুফিয়া খাতুন। দেশে বিদেশে পরিচিতি লাভ করছেন সুফিয়া কামাল নামে। মাত্র সাত মাস বয়সে বাবা সৈয়দ আবদুল বারী সাধকদের অনুসরণ করে নিরুদ্দেশ হয়ে যান। শিশুমনের এই ব্যথা আজও তাকে দুস্থ। মানবতার সংস্পর্শে যেতে প্রেরণা দেয়। বাল্যশিক্ষা পর্যন্ত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পর। নিজ চেষ্টায়, মায়ের উৎসাহে, স্বামীর সহযােগিতায় পড়েছেন লিখেছেন, কবি হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছেন।
নারী আন্দোলন ও সমাজসেবায় হাতেখড়ি ১৪ বছর বয়সে বরিশালে। রােকেয়া সাখাওয়াত হােসেনের সাক্ষাৎ অনুসারী সুফিয়া কামালের কণ্ঠ মানব নির্যাতনের বিরুদ্ধে সােচ্চার। শােষণ-বৈষম্যের বিরুদ্ধে, শান্তির সপক্ষে তাঁর পদযাত্রা আজও রাজপথ প্রকম্পিত করে, অনুপ্রাণিত করে জনগণকে। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির সকল ক্ষেত্রে তাঁর অগ্রণী ভূমিকা তারুণ্যের অমিত সাহস ও প্রতিজ্ঞায় ভাস্বর।
দেশ-বিদেশের অনেক পদক, পুরস্কার, ফেলােশিপ, সংবর্ধনা তাঁকে সম্মানিত করেছে। দেশবাসীর ডাকে তিনি এখনাে সক্রিয় ভূমিকা পালনে তৎপর।
প্রথম গল্প : ‘সৈনিক বধূ’ প্রকাশ ১৪ বছর বয়সে। প্রথম কাব্যগ্রন্থ : ‘সঁঝের মায়া। প্রথম গল্পগ্রন্থ : কেয়ার কাঁটা’ প্রকাশিত হয়েছে ১৯৩৬ সালে। তাঁর সর্বমােট বইয়ের সংখ্যা ১৪টি।
দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকা
একাত্তরের ডায়েরী প্রথম সংস্করণ খুব দ্রুত শেষ হয়ে গেলে আবারও তা প্রকাশের জন্য প্রচুর তাগাদা আসে। শেষ পর্যন্ত জাগৃতি প্রকাশনীই স্বেচ্ছায় প্রকাশের দায়িত্ব নিল দ্বিতীয় সংস্করণের। আমার একমাত্র প্রত্যাশা আজকের প্রজন্ম জানুক সে দিনগুলাে কেমন সংগ্রামমুখর ছিল। সবাইকে আমার আন্তরিক ধন্যবাদ।
সুফিয়া কামাল
৩১.১.৯৫
ভূমিকা
কবি সুফিয়া কামাল ছিলেন মনন ও সৃজনশীলতায় অগ্রগামী নারী। যে সময়ে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন, নিজের সহজাত জ্ঞান ও মেধা দিয়ে সেই সময়কে অতিক্রম করেছিলেন এগিয়ে থাকা মানুষের শাণিত বােধে। যে বয়সে মানুষের বিবেচনা ও অভিজ্ঞতার সঞ্চয় হয় সে বয়সে তাঁর সময়কে তিনি উৎসর্গ করেছিলেন মানবকল্যাণের প্রয়ােজনে।
তাঁর রচিত ‘একাত্তরের ডায়েরী গ্রন্থ এই বিবেচনায় সবটুকু প্রেরণা থেকে রচিত। ডায়েরির শুরু হয় ডিসেম্বর ৩০, ১৯৭০ তারিখে। শেষ হয়েছে ডিসেম্বর ৩১, শুক্রবার। পুরাে এক বছর সময়। তবে প্রতিদিনের দিনলিপি নয়। মাঝে মাঝে কিছু কিছু তারিখ বাদ দিয়ে লিখেছেন।
১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর ভয়াবহ জলােচ্ছাসে ভেসে গিয়েছিল বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল। দুর্যোগে বিপর্যস্ত মানুষের হাতে রিলিফ সামগ্রী তুলে দিতে তিনি গিয়েছিলেন পটুয়াখালীর ধানখালি চর এলাকায়। রিলিফ দিয়ে ঢাকায় ফিরলেন ৮ জানুয়ারি।
সত্তরের জলােচ্ছাসের পরে ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত হয়েছিল পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন। এই নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করেছিল আওয়ামী লীগ। পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান বাঙালি নেতার হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি শুরু করলেন। শেষ পর্যন্ত ১ মার্চ ১৯৭১ সালে গণপরিষদের অধিবেশন ডাকা হয়েছিল। ১ মার্চ, সােমবার রাত দশটায় কবি লিখছেন, ‘বিক্ষুব্ধ বাংলা। ভুট্টো সাহেব পরিষদে যােগ দিবেন না সিদ্ধান্তে পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য মুলতবি রইল। ১২টায় এ খবর প্রচারিত হওয়ায়, স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেল।’
এভাবে বিভিন্ন তারিখে তিনি দেশের পরিস্থিতির কথা নানাভাবে বর্ণনা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের দলিল হিসেবে এই ডায়েরির তথ্য গবেষণার উপাদান হিসেবে কাজ করবে।
ডায়েরীর একটি বিশেষ দিক এই যে কোনাে কোনাে তারিখে তিনি শুধু একটি কবিতা লিখেছেন। একজন কবি এভাবেই নিজের প্রকাশ ঘটান। এপ্রিল ১, বৃহস্পতিবার, রাত আটটায় তিনি লেখাটি শেষ করেছেন এভাবে : কারফিউ চলছে। প্লেনের আসা-যাওয়ার বিরাম নেই। কাল থেকে নাকি ব্যাঙ্ক সব খােলা হবে। আট আনায় তিনটি পান কিনলাম। বাংলার ইতিহাস কে রচনা করবে?’ শেষের বাক্যটি অন্য বাক্যগুলাের চেয়ে ভিন্ন। কিন্তু কোনােভাবেই এটি কোনাে আকস্মিক বাক্য নয়।
কারণ ২৫শের রাতে গণহত্যার পরে শুরু হয়ে গেছে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে রচিত হবে বাঙালির নতুন ইতিহাস। তিনি আহ্বান করছেন
ইতিহাস রচয়িতাকে। এখানেই চিহ্নিত হয় তাঁর অগ্রগামী চিন্তার স্বরূপ। ডিসেম্বর ১৬, বৃহস্পতিবার লিখছেন, ‘আজ ১২টায় বাংলাদেশ যুদ্ধ বিরতির পর মুক্তিফৌজ ঢাকার পথে পথে এসে আবার সােচ্চার হল ‘জয় বাংলা উচ্চারণে। আল্লাহর কাছে শােকর।
ডিসেম্বর ২৯ তারিখে একটি কবিতা লিখেছেন। কবিতাটি শুরু হয়েছে নিজের মেয়ের কথা দিয়ে। লিখেছেন :
‘আমার ‘দুলু’র মুখ দেখি আজ বাংলার ঘরে ঘরে শ্বেত বাস আর শূন্য দুহাত নয়নে অশ্রু ঝরে… শেষ হয়েছে এ দু’টি লাইন দিয়ে :
‘সুন্দর কর মহামহীয়ান কর এ বাংলাদেশ
এই মুছিলাম অশ্রুর ধারা দুঃখের হউক শেষ।’
কবিতাটি বেশ বড়। কষ্ট থেকে আশায় ফিরে এসেছেন তিনি।
ডায়েরী শেষ হয়েছে ডিসেম্বর ৩১, শুক্রবার। শেষ বাক্যটি লিখেছেন, ১৯৭১ আজ শেষ হয়ে গেল। জানি না, আগামী কালের দিন কিভাবে শুরু হবে।’
তিনি বিশাল প্রত্যাশায় তাকান নি আগামী দিনের দিকে। বরং খানিকটুকু দ্বিধা প্রকাশ করেছেন। স্বাধীনতার ঊনচল্লিশ বছরে তাঁর স্বপ্নের বাংলাদেশে অনেক অপূর্ণতা এখনাে রয়ে গেছে।
সেলিনা হােসেন
তারিখ ১০ জানুয়ারি, ২০১১
১২
ডিসেম্বর, ১৯৭০
৩০ ডিসেম্বর, বুধবার ১৯৭০
ভি. এম. জলকপােতা রাত ১১টা
সারা দিনের প্রতীক্ষার পর রাত ৮টায় রিলিফ কমিশনারের কাছে থেকে চিঠি নিয়ে ভি. এম. জলকপােত-এ এলাম। ৪৫ জন আমরা মহিলা রিলিফ কমিটির কাজে চলছি ধানখালি চরে।
মহিলা রিলিফ কমিটির সঙ্গীরা : সুলতানা জামান, মিসেস মজিদ (জ্যোৎস্না), মিসেস আজীজ (ঝুনুর মা), হােসনে আরা চৌধুরী, মিসেস আমীন (বেবী), আয়েশা জাফর, ফাতেমা খানম, মালেকা বেগম, হুরমতুন্নেসা ওদুদ, লুবনা, শিরিন, নুসরাত, সাঈদা জাফর, আরিফা সালাউদ্দীন, রুমী ইমাম, তকী নসরুল্লাহ, মােস্তফা আজীজ, চিন্ধু আমীন, গুল্প, সফু।
গত ১০ তারিখে ধানখালিতে সামান্য সাহায্য দেওয়া হয়েছিল। ওরা বলেছে, সুফিয়া কামাল এসেছে না; মা ফাতেমা এসেছে। একবার আমাদের এখানে থামতে হবে। থামা হয়নি। বলেছিলাম আবার আসব। কিন্তু চর বিশ্বাস ও চর সাগস্তিতে আমাদের রিলিফদ্রব্য শেষ হওয়াতে আর ধানখালি যেতে পারিনি। ওরা বলেছিল-না এলে রােজ হাশর পর্যন্ত দাবী রাখব। আল্লাহ সে দাবী থেকে মুক্তি দেবার জন্যই এবার রিলিফ কমিশনারের মুখ থেকেই ধানখালি যাবার কথা বের হল।
১১টায় ‘জলকপােত ঢাকা ছাড়ল। আল্লাহ ভরসা। কবে পৌছাব দেখা যাক। বাড়ীতে ওয়ারলেস-এ ঢাকা ত্যাগের খবর দিলাম।
১৫
৩১ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার ১৯৭০
রাত ১১টা
বেলা ১২টায় এলাম বরিশাল-৪ ঘণ্টা খামখা বরিশালে কাটল কয়লার জন্য। সন্ধ্যা ৭টায় পটুয়াখালী। রিলিফ অফিসার ও আজাদ সাহেব দেখা করে দুই ঘণ্টা কাটিয়ে গেলেন। লঞ্চ ছাড়ল।
১৬
জানুয়ারী, ১৯৭১
১ জানুয়ারী শুক্রবার ১৯৭১
ভি. এম জলকপােতা রাত ১২টা
১৯৭১ সনের একটি দিন গত হয়ে গেল। ঘর-সংসার, স্বামী-সন্তান থেকে দূরে আজ সকালে গলাচিপা থেকে বেলা ৩টায় ধানখালি এলাম। এবারে এ রিলিফের ব্যাপারে এত যে গণ্ডগােল হচ্ছে। আজও চাল পাওয়া যায়নি। সুলতানারা এতক্ষণে ধানখালি রিলিফ অফিস হতে ফিরল। ২টায় স্পীড বােট অচল। ক্যাম্প করে কিছু মাল নামিয়ে কতক ছেলেরা সেখানে থাকল। কাল থেকে রিলিফ শুরু হবে। বারাে হাজার লােক। ৯টা ইউনিয়ন। গলাচিপা থেকে রেডক্রস কম্বল, কাপড়, খাবার জিনিস, দুধ, চকলেট, শাড়ী, বাচ্চাদের কাপড় প্রচুর দিল। খুব শীত পড়েছে। বাড়ীতে সবাই ঘুম।
১২ জানুয়ারী শনিবার ১৯৭১
রাত ১১টা
আজ সারা দিন দু’হাজার মানুষকে রিলিফ দিয়ে রাত ১০টায় শেষ হল। ধন্য মেয়ে এই সুলতানা জামান। ওই পারছে, কী যে মানুষ আমাদের দেশের। দারিদ্রে ভিক্ষাবৃত্তি মজ্জাগত হয়ে গেছে এদের। কত মানুষ এসে দেখে গেল, দোওয়া করে গেল আমাকে। দেশের মানুষ চেনে, ভালােবাসে, শ্রদ্ধা করে এর চেয়ে গৌরব আর কী আছে!
১৩ জানুয়ারী রবিবার ১৯৭১
রাবনাবাদ নদী৷ রাত ১২টা
আজও ঢাকার কোনাে খবর জানা গেল না। আল্লাহ নেগাহবান। গিয়ে যেন সবাইকে ভালাে দেখি। দলে দলে লােক আসছে, রিলিফ সংগ্রহ করেছে।
১৯
সব শেষ হয়ে গেছে ওদের। হাত না পেতে কি করবে? ধানের দেশ গানের দেশ বরিশাল। তার মানুষ আজ মুষ্টিভিক্ষা নিয়ে বাচ্চা-কাচ্চার প্রাণ বাঁচাবার। প্রয়াস পাচ্ছে। আমাদের দেশে শিক্ষার যে কী পদ্ধতি, আর কী প্রয়ােজন তা বুঝা গেল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের কাণ্ড দেখলাম। জাহাজের লােকদের এবং জনসাধারণকে দেখলাম। এ শিক্ষা আমাদের দেশে না থাকলেই ভাল হত।
৪ জানুয়ারী সােমবার ১৯৭১
রাত ১২টা
হাজার হাজার মানুষ। সর্বহারা, অন্নহীন, বস্ত্রহীন, গৃহহীন। এককালে খেয়েদেয়ে চরের মানুষেরা স্বাস্থ্যবান ছিল। তাই আজও এরা মরণের সাথে যুঝেও সবল। অসহায়, সরল, বােকা, চালাক লােকের অভাব নেই। যুগ যুগ ধরে এরা শিক্ষার আলাে থেকে বঞ্চিত। আজও এরা মৌন, মূক, অসহায়, ভীতু, ভীরু। রাত ১২টা বাজল। ১১টা পর্যন্ত চলেছে রিলিফ। ছেলেরা, মেয়েরা, মহিলারা যা অমানুষিক পরিশ্রম করছে। সরকারি কর্মচারীরা যদি তা করত কত দুঃখ লাঘব হত।
৫ জানুয়ারী মঙ্গলবার ১৯৭১
রাবনাবাদ নদী৷ রাত ১২টা
চর বিশ্বাস, চর সাগস্তিতে গেলাম যখন তখন সে জায়গাকে ধােয়ামােছা। একটি মাটির থালার মতাে লেগেছিল- না পশুপাখি, একটা মশা মাছি। এখানে চারদিকে এখনও অনেক লাশ পড়ে আছে, ভেসে এসে হােগলা বনে, ধান ক্ষেতের আলে আলে লেগে আছে। অবশ্য আমাদের কাছ থেকে দূরে। কিন্তু মাঝে মাঝে গন্ধ পাওয়া যায় আর মাছি এত যে, খাওয়া-দাওয়া কষ্টকর। আজীজ এত মৃত দেহের স্কেচ এত সুন্দর করে করেছে। ভয়াবহ মৃত্যুর বীভৎস চিত্র। আল্লাহ যেন সুমৃত্যু দেন মানুষকে!
২০
২৬ জানুয়ারী বুধবার ১৯৭১
রাত ১২টা
অফুরন্ত দায়িত্ব আর আকাঙ্ক্ষার আজ শেষ। রিলিফ শেষ হল। ১৫ হাজার মানুষ অতি আনন্দে কৃতজ্ঞতায় আপ্লুত হয়ে আমার নাম গানে মুখর হল। এ যে আমার অত্যন্ত গুনাহর কথা। আজ বিকালে মাঠে জনসাধারণ সভা করল। কবেকার পুরানাে কাগজের মালা আমার আর সুলতানার গলায় পরাল। হােক নােংরা পুরানাে তুচ্ছ কাগজের মালা, কিন্তু সবার অন্তরের শ্রদ্ধায় পূত পবিত্র অমূল্য এ মালা। মহিলারা উপস্থিত ছিলেন, কান্নায় আমার বুক ভেঙ্গে গেল। ওরা ভিক্ষা নিয়ে শ্রদ্ধা দিল। আজ দুপুরে মাছ ভাজছি হঠাৎ ওহিদুল হক এসে উপস্থিত। ভােলানাথ কী খুশি আমাকে দেখে! আমারও যে কত ভালাে লাগলাে।
৭ জানুয়ারী বৃহস্পতিবার ১৯৭১
রাত ১১টা
পটুয়াখালী ছাড়লাম। আজ সারা সকাল থেকে ২টা পর্যন্ত গ্রামে ঘুরলাম। এখনও মৃতদেহ পড়ে আছে। ৩টায় লঞ্চ ধানখালি থেকে ছাড়ল। লােকেরা কী কান্নাটাই কাঁদল। কত মেয়েরা জড়িয়ে চুমু খেল। সালাউদ্দীন হেসে অস্থির। ৫টায় গলাচিপা এসে বেলজিয়াম হাসপাতাল দেখে, সােশ্যাল ওয়েল ফেয়ার অব অরফানেজ ক্যাম্পে গেলাম। তবু যা হােক নিজের দেশের একটি প্রতিষ্ঠান দেখলাম। বেলজিয়াম হাসপাতাল ও ক্যাম্প কী পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। ওরা কম ইংরেজি জানে। বাংলা শিখছে। ঢাকা যাচ্ছি, যেন আল্লাহ সবাইকে ভালােই দেখান!
২১
৮ জানুয়ারী শুক্রবার ১৯৭১
ভি. এ. জলকপােত, নদীপথে নন্দীর বাজার
যে মৃত্যু সুন্দর নয় তার কাছ থেকে রাখাে দূরে
মৃত্যু-পদধ্বনির নূপুরে
শুনি যেন আনন্দের গান
যত দিনে এত দিনে জীবনের হবে অবসান।
তােমার সান্নিধ্যে যাব সানন্দ অন্তরে
মৃত্যুর প্রশান্ত ছায়া লয়ে মুখ পরে
নয়নে লইয়া সেই আলাে
ভালােবেসেছিনু ধরণীরে
আর তুমি মােরে বাসিয়াছ ভালাে।
সৃজেছ সুন্দর করি মানুষের দেহ,
আত্মা, মন দিয়েছ লাবণ্য স্নিগ্ধ, শুচি, প্রেম, স্নেহের বন্ধনে,
আবার নিঠুর করি ছিনায়েছ অকরুণ কঠোর হে তুমি
তােমার সুন্দর সৃষ্টি যে সমুদ্র, নদী, তীর ভূমি
কী আক্রোশে এ বীভৎস মৃত্যুর খেলায়
মেতেছ একান্তে, তুমি নাকি দয়াময়!
নাকি যে ভয়াল রুদ্র প্রকাশ তােমার
চিরদিন সে রূপ আমার
ধেয়ানে রয়েছে, আছ নিভৃত অন্তরে
মুছি ফেলি তব রুদ্র করে
ভীষণ ভয়াল হয়ে সৃষ্টি করি নাশ
বাড়ীবে কি তােমার উল্লাস?
দিয়াে না কুৎসিত করি সে অন্তিমে তােমার
মহৎ মৃত্যুরে। দাও মধুর মৃত্যুর উপহার।
২২
৩০ জানুয়ারী শনিবার ১৯৭১
বিমানপথে ঢাকা৷ সময় সােয়া আটটা
হৃদয় আমার! সব হারানাে বাঁশীর সুরে
কেন দিস তুই সাড়া?
তাের হাতে পায়ে শিকল বাঁধা
চার দিকে যে কারা।
ওরে হরিণ মন!
ব্যাধের বাঁশী শুনে যে তুই হরে উচাটন
ও যে নিঠুর নিষাদ
মধুর মধু সুরের জালে পেতে রাখে ফাঁদ
তুই আপন ভুলে সেই সে সুরে
সেই ফাঁদে দিস্ ধরা।
সবায় ভালােবাসতে গিয়ে
আপন করিস পর।
ভাঙ্গন ভরা নদীর কূলে বাঁধতে চাস তুই ঘর
সেথায় এ কূল ভেঙ্গে ও কুল জাগে
বহে সর্বনাশের ধারা।
৩০ জানুয়ারী শনিবার ১৯৭১
বিমানপথাে সাড়ে ৭টা, ঢাকা সময়
৬টা ২ মিনিটে বােয়িং ৭০৭ আকাশে উড়ল। বত্রিশ হাজার ফিট উপর দিয়ে লৌহ বিহঙ্গ চলেছে। নীচে তুষার শুভ্র মেঘলােক। পশ্চিমে এগিয়ে আসছি, দিগন্তে গােধূলি, শাদা শাড়ীর কমলা পাড়। প্রকৃতি সন্ধ্যার আগে সেজেছে। যত পশ্চিমে এগােচ্ছি গােধূলি উজ্জ্বল, দিগন্তে দিনের চিতা জ্বলছে। যাচ্ছি। করাচী লাহাের পিন্ডি, লেখক সংঘের বার্ষিক প্রতিষ্ঠা দিবস উপলক্ষে প্রধান
২৩
অতিথি হয়ে। বাংলাদেশ, ঢাকা থেকে। সত্যি কি বৃক্ষহীন দেশে এরন্ড কাণ্ড আমি হলাম? আল্লাহ জানেন উনি, জামাল, আলভী লুলু, টুলু, শমু এতক্ষণে ঘরে ফিরে কী করছে!
৩০ জানুয়ারী শনিবার ১৯৭১
রাত ১২টা
প্লেন সােয়া ৯টায় এয়ারপাের্ট এল। কী ভিড়! বুলু, জামাল উদ্দিন খালি ছিলেন। পান্না, ছেলেমেয়েরা। বহু দিন পর করাচী এলাম। আমার লেখা, ভাষণ বুলুর পছন্দ হল। আরও কিছুটা জুড়ে ইংরেজী অনুবাদ করাচ্ছে মিলুকে দিয়ে বুলু। এরা যে কত হাসি খুশী করে কাজ করে। বাপ বেটাবেটি, স্বামী স্ত্রী, কত সাবলীল সুন্দর করে সংসারটা চলছে, আল্লাহ নেগাহ্বান থাকুন। লাহাের যাওয়া হবে না। ভারতীয় প্লেন হাইজ্যাক করে লাহাের নামিয়েছে।
৩১ জানুয়ারী রবিবার ১৯৭১
রাত ১২টা
বিকেল সাড়ে ৪টায় পাকিস্তান আর্ট কাউন্সিল হলে লেখক সংঘের দ্বাদশ প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উদযাপন করা হল। সভাপতি কেউ নেই, জাহেদী সেক্রেটারী, আমি প্রধান অতিথি। বেশি লােকজনও নেই, লাহােরে প্লেন হাইজ্যাক হয়েছে, ওখান থেকে কেউ আসতে পারেনি। শওকত সিদ্দিকী আমার ভাষণের খুব সুন্দর অনুবাদ করে শােনাল। আমার কবিতা ‘মাের বাংলা পড়তেই হল। উপস্থিত বাংলা বুঝবে কে—তাই রােজী আহাদ উপস্থিত ছিল, মুখে মুখে কথাগুলাের সুন্দর অনুবাদ করে শােনাল। আহাদ সাহেবও ছিলেন। সন্ধ্যা ৭টায় নজরুল একাডেমীতে মুনীর চৌধুরীর একাঙ্কিকা “জমা খরচ ইজা” ঘরােয়া অভিনয় করা হল। এত সুন্দর অভিনয় ও ঘরের পটভূমিকার পরিবেশে এত মানানসই হল যে দেখে খুশি লাগল। প্রধান অতিথি হয়ে নাজির আহমদ এল। বহু দিন পর দেখলাম। দেখে কত খুশী কত গৌরবও বােধ করলাম। এই সব ছেলেরা একালে পাকিস্তানের স্বপ্নকে সত্য সফল করতে কী না করেছে!
২৪
একাত্তরের ডায়েরী নজরুল একাডেমীর ভিতর বাইরের অবস্থা দেখে রক্ত গরম হয়ে যায়। আব্দুও সাথে ছিলেন। তারই প্রতিষ্ঠিত নজরুল একাডেমীর এই দশা দেখে খুব দুঃখ করলেন বুলু ও মজিবুর রহমান। এ দেশের মজিবুর রহমান এখন। চেষ্টা করেছে ভালাে করতে। আজ হাজেরা মাসরুর ও তার স্বামী দেখা করে গেলেন।
২৫
ফেব্রুয়ারী, ১৯৭১
১ ফেব্রুয়ারী সােমবার ১৯৭১
আজ ভােরে ঘুম ভাঙ্গতেই মনে পড়ল লুলুর পরীক্ষা আজ। ঢাকা সময় ১১টায় বাজারে গেলাম। সেলিমা আহমদকে ফোন করলাম। বৌমার দেওয়া ইনভেলপ বুলু পৌছে দিল আফিসে তার হাতে। ৫টায় প্রবাসী পাঠচক্রে গেলাম। সাড়ে সাতটায় এসে বেগম সেলিমা আহমদের ওখানে গিয়ে জেবুননিসা হামিদুল্লাহর বাড়ী ডিনার খেয়ে ঢাকা সময় ১১টায় বাড়ী এলাম। কাল আব্দু ঢাকা যাচ্ছেন। চিঠি লিখে দেবাে।
২ ফেব্রুয়ারী মঙ্গলবার ১৯৭১
রাত ৩টা, ঢাকা সময়
পান্না আর আমি এতক্ষণ ধরে বসে থাকলাম ঢাকা ট্রাঙ্ককল করে। লাইন পাওয়া গেল না। আজ সকালে গিল্ড অফিস, রেহানার আম্মা ও রেহানার বাড়ী পেলাম। আব্ব আজ ঢাকা গেলেন, চিঠি দিলাম, ফোন করার কথা বলেছিলাম তাও লিখেছি। কিন্তু ফোন তাে পেলাম না। মিসেস তাহের জামিল চায়ের দাওয়াত দিয়েছিলেন নাজিমাবাদ কলােনীতে। সেখান থেকে ফিরবার পথে কায়েদে আযমের মাজারে দেখে এলাম চীনের উপহার বাতির ঝাড়। বিরাট বটে। কিন্তু ওর চেয়ে কত সুন্দর আমাদের শায়েস্তাবাদের মসজিদে ছিল। সব গেছে। এয়ারপাের্টে আখতার সােলেমানের সাথে দেখা হল।
৩ ফেব্রুয়ারী বুধবার ১৯৭১
রাত ১১টা
আজও ঢাকায় ফোন করে লাইন পেলাম না। জানি তাে আমার বাড়ীর ফোন! আজ হয়ত টেলিগ্রাম পেতে পারি। গিল্ড অফিসে গেলাম। মিটিং হল। আজ জিমখানা ক্লাব-এ ডিনার আছে, গিল্ড-এর সভ্যদের নিয়ে। আবারও ফোন
২৯
বুক করে রাখলাম। যদি সকাল ৭টায় লাইন পাওয়া যায়। বেগম সেলিমা আহমদ রােজ ফোন করছেন, মার্কেটিংয়ে নিয়ে যাবেন। আমি করাচীর সওদা করার পয়সা কোথায় পাব?
যে বাঁধন চাই এড়াতে সে থাকে সাথে সাথে।
আগে পিছে ছায়ার মতাে,
সে থাকে সুখে-দুঃখে ব্যথা হয়ে থাকে বুকে
ছাড়াতে গেলে আবার জড়ায় ততাে।
পথ খুঁজিতে পথ সে হারায়
ঘুরে ফিরে সেই সে কায়ায়
ফিরে ফিরে আসে
কঠিন বাঁধন ছিড়তে গিয়ে তারেই ভালােবাসে।
মৃত্যুর সে বিষ পান করে হয় হৃদয় তন্দ্রাহত
কান্না যে হায় পান্না হয়ে বাজে গানের মতাে।
৪ ফেব্রুয়ারী বৃহস্পতিবার ১৯৭১
রাত ১টা
সকালে রেডিও অফিসে গেলাম, একটা ইন্টারভিউ হল আমার। বুলু ও রেডিওর একজন মিলে নিল। কবিতা পড়া হল। বুলু মুখে মুখে “তাহারেই পড়ে মনে” কবিতাটির উর্দু তরজমা শুনিয়ে দিল। ফিরদৌসী ও সুফিয়া আমীন ছিল। এখানেও দেখছি কোন সুবিধা পাচ্ছে না। আর বর্তমান সময়টাতে বাঙালির প্রাধান্য স্বীকার করে এরা অন্তর্দাহে জ্বলে মরছে। | আজ সকালে ঢাকায় ফোনে কথা বলে মনটা ঠান্ডা হল। রাতে আজ হাজেরা মাসরুর ডিনার দিয়েছেন কাছে ক্যান্টন হােটেলে। বিকাল ৫টায় গিল্ড। আফিসে আমাকে সংবর্ধনা দেওয়া হল। বেশ উর্দুতে বক্তৃতা ঝাড়লাম। রেডিওতেও উর্দুতেই ইন্টারভিউ হল। বুলু আর আমি হার মানব না ইনশাআল্লাহ।
৩০
৫ ফেব্রুয়ারী শুক্রবার ১৯৭১
রাত ১২টা
হাজেরা মাসরুর ডিনার দিলেন-‘ক্যান্টন’-এ। অনেক-প্রায় কুড়ি-জন আমরা, মিঃ ও মিসেস আলীও ছিলেন। আজকে পাক-সােভিয়েট সমিতির মিটিং ও আখতার সােলেমানের ওখানে ডিনার ছিল। পাক-সােভিয়েট সমিতি নিজেরাই ক্যানসেল করে দিল। আমরা সবাই মিলে ডিনার বাদ দিয়ে আলী সাহেবকে নিয়ে খুব আড্ডা জমালাম। এত সুন্দর গানে গজলে বেগম আলীর ছেলেমেয়েদের হাসিখুশীতে সময় কাটল। বন্দু খান-এর দোকানে সবাই পরাটা কাবাব খেয়ে রাত ১২টায় বাড়ী ফিরলাম। আজ শেষ রাত করাচীর। আমার জন্য সবাই অস্থির আছে ঢাকায়। ফোনে লুলু বলল, হেনা টেলিগ্রাম করেছে। আজও এল না সে টেলিগ্রাম।
৬ ফেব্রুয়ারী শনিবার ১৯৭১
আকাশপথে-৭০৭ বােয়িং।। ঢাকা সময় ৬টা
সকাল ৫টায় উঠে ৬টায় সবাই এয়ারপাের্টে পৌঁছাতে এসে শুনলাম ৭টায় প্লেন যাবে। ৪টায় একটা আছে। আবার সাড়ে তিনটায় এলাম। জাস্টিস সাত্তার, ভীমজির সাথে দেখা হল। ভি.আই.পি রুমে বসে থাকলাম। জাস্টিস সাত্তার তার মােটরে করে প্লেন-এর সিঁড়িতে পৌছে দিলেন। বুলু, পান্না চলে গেল। সাড়ে চারটার প্লেন পৌনে ৫টায় উড়ল। এখন সমুদ্র উপকূল ধরে চলছে। হাজার ফুট উপর থেকে কিছুই দেখা যাচ্ছে না।
রাত ১১টা
বঙ্গোপসাগর পাড়ি দেওয়া গেল। বেল্ট বাঁধবার কথা প্রচার হল। ঢাকা আসছে। ফিরদৌসী, তার মা-ও সাথে আছেন। কলােম্বাে দেখাই গেল না।
৩১
২৭ ফেব্রুয়ারী শনিবার ১৯৭১
ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় ও সাংস্কৃতিক সম্মেলন উপলক্ষে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সাহেবের দাওয়াতে আজ সন্তোষ হয়ে এলাম। সাথে ছিলেন বৌমা মিসেস নারগিস জাফর ও আয়েশা জাফর। মওলানা আহমদ। হােসেন, ইসলামিক একাডেমীর ডিরেকটার সাহেবও আমাদের সাথে গেলেন। অর্ধসমাপ্ত বিশ্ববিদ্যালয়, তার উদ্বোধন! ড. কাজী মােতাহার হােসেন মূল সভাপতি, প্রধান অতিথি জনাব আবুল হাশেম সাহেব সস্ত্রীক একদিন আগেই গিয়েছিলেন। জনসমাবেশ প্রচুর। লাঠি খেলা হল। ফিরদৌসী, আলীম, আলতাফ আরও কয়েকজন গায়ক-শিল্পীরও সমাবেশ হল। অদ্ভুত মওলানার প্রাণশক্তি। সন্তোষের ইতিহাস বর্ণনা হল ১ ঘণ্টা, তারপরও আধ ঘণ্টা ধরে তার ভাষণ। অক্লান্ত কর্মী হিসাবে এই লােকটিকে শ্রদ্ধা না করে পারা যায় না। মুগ্ধের মত লােকেরা তার ভাষণ শুনল। স্মৃতিশক্তিও প্রখর। কবে কখন কোন তারিখে কোথায় কি কাজ করেছেন তা অনর্গল বলে গেলেন। পায়ে হেঁটে সারা বাংলাদেশ বেড়িয়েছেন, চাষীদের দুঃখদুর্দশা উপলব্ধি করেছেন। এখনও প্রচুর কৃষক গ্রামীণ লােকেরা,তার মুরিদান, তারাই এত লােক খাওয়ার জন্য চাল ডাল মাছ তরকারী যােগাল, রাধল খাওয়াল। এ এক বিরাট ব্যাপার।
৩২
মার্চ, ১৯৭১
২১ মার্চ সােমবার ১৯৭১
রাত ১০টা
বিক্ষুব্ধ বাংলা! ভুট্টো সাহেব পরিষদে যােগ দিবেন না সিদ্ধান্তে। পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য মুলতবী রইল। ১২টায় এ খবর প্রচারিত হওয়ায় স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেল। অনার্স পরীক্ষা ২ তারিখে আর ৬ তারিখে শেষ হওয়ার আশাও গেল। আজ ইন্টারমিডিয়েট কলেজে মেয়েরা শহীদ মিনার উদ্বোধন করার জন্য আমাকে নিয়ে গেল, কিন্তু গােলমালে সবই বন্ধ হয়ে গেল। শেখ মুজিবুর রহমান মওলানা ভাসানী, আতাউর রহমান, আরও অনেক নেতাদের এক হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। কাল ঢাকায় হরতাল, পরশু সারা দেশব্যাপী হরতাল ঘােষণা করা হল।
১২ মার্চ মঙ্গলবার ১৯৭১
রাত ৯টা
আজ রাত ৮টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত কারফিউ অর্ডার হয়ে গেল। আমরা ঘরে এলাম ৭টায়। শামীম কাল রাতে অফিসে গেছে। আজও আসতে পারল না, কালকেও পারবে না, পরশু বাড়ী আসবে। শুধু ঢাকায় হরতাল হবার কথা ছিল। কিন্তু প্রদেশের সব জায়গায় আজ হরতাল হল। কালও হবে। কাল সন্ধ্যা থেকে প্লেন সার্ভিস বন্ধ। এয়ার পাের্টের আলাে পানি টেলিফোন লাইন সব কেটে দিয়েছে। ট্রেন চলাচলও বন্ধ। ফার্মগেট-এ ইটের ব্যারিকেড ঘিরে দেওযার সময় আর্মির গুলীতে একজন মরেছে, ৩ জন আহত হয়েছে। এই মাত্র শােনা গেল নওয়াবপুরে খুব গণ্ডগােল চলছে। দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয় ও ইডেন বিল্ডিং-এর পাকিস্তানী পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের ম্যাপ আঁকা পতাকা উড়িয়েছে। ভাসানী সাহেবের সাথে শেখ মুজিবুর রহমানের আলাপ-আলােচনা প্রকাশ করা হয়নি। বায়তুল মােকাররম-এ আমেনা বেগমকে জনতা অপমান করেছে বলে জানা গেল। কারফিউ ভেঙ্গে জনতা মিছিল করছে, মরছে।
৩৫
৩ মার্চ বুধবার ১৯৭১
কাল সারা রাত হট্টগােল চলেছে। জিন্না এভেনিউ, নবাবপুরে লুট মারামারি হয়েছে। আজ সকালে কাগজে ৩ জনের মৃত্যু সংবাদ দিল। বিকালে পল্টনে ছাত্রদের শােকসভায় লক্ষ লােকের সমাবেশে শেখ মুজিব নিজের আদেশ প্রচার করেছেন। সমস্ত অফিস কারখানা বন্ধ করে দিতে বিগ্রেডিয়ারকে বলেছেন, সে দেশরক্ষার জন্য বেতন নিচ্ছে এখানে জনতার উপর গুলী না চালিয়ে বর্ডারে গিয়ে দেশ রক্ষার কাজ করুক। সাবাশ! এই তাে চাই। জনতা উন্মাদ হয়ে স্বাধীন পূর্ব বাংলা করছে। ৭ তারিখ পর্যন্ত হরতাল। সকাল থেকে ২টা পর্যন্ত চলবে। ১০ তারিখে ইয়াহিয়া নাকি ঢাকা এসে সভা ডাকছে, এসেম্বলি বসবে। আজ রাত ১০টা থেকে সকাল ৭টা কারফিউ। ভাসানী সাহেব পলাতক।
৪ মার্চ বৃহস্পতিবার ১৯৭১
পল্টন ময়দানে শহীদদের জানাজা হল। কত মায়ের বাছা, বধূর স্বামী, ভাইয়ের ভাই চলে গেল। লুটতরাজ আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাসেবকরা রােধ করছে। কারফিউ উঠে গেল। হাসপাতালে আহতের সংখ্যা ৪০, বি, বি, সির খবরে ২ হাজার মারা গেছে। আরও কত যাবে কে জানে। রক্ত সংরক্ষণের জন্য আহ্বান জানানাে হয়েছে। ড. আনিস রক্ত দিয়ে এলেন। সারাদিন মিছিল চলছে।
২৫ মার্চ শুক্রবার ১৯৭১
কাল রাতে কোনাে গােলমাল হয়নি। সকালে টঙ্গিতে মিলিটারী বেপরােয়া গুলি চালিয়ে তােক মেরেছে। ৯টায় শ্রমিকরা মিছিল করে শেখ মুজিবের বাড়ীতে এসেছে। আগামী কাল শহীদ মিনারে মহিলারা বিক্ষোভ মিছিল
৩৬
করবেন আওয়ামী লীগ থেকে। আবার মহিলা পরিষদের প্রতিবাদ সভা বায়তুল মােকাররমে অনুষ্ঠিত হবে। কাল রাতে হঠাৎ মােটর বাইকে করে ইডেন বিল্ডিংয়ের সামনে একটা বােমা নিক্ষেপ করে লােক পালিয়েছে। অন্য কোথাও গােলমাল শােনা যায়নি।
১৬ মার্চ শনিবার ১৯৭১
রাত ১০টা
আজ ৩টায় শহীদ মিনারে আওয়ামী লীগ মহিলা শাখার বিক্ষোভ সভা থেকে বায়তুল মােকাররমে পূর্ব পাকিস্তান মহিলা সমিতির বিক্ষোভ মিছিল বাহাদুর শাহ পার্কে গিয়ে শেষ হল। আওয়ামী লীগের মহিলারা গেলেন তাদের অফিসে। ইয়াহিয়ার বেতার ভাষণে জনতা ক্ষুব্ধ। ২৫শে পর্যন্ত অধিবেশন মুলতবী হল। ইয়াহিয়া রূঢ়ভাবে ঘােষণা করলেন, আর্মি নেভি তার হাতে থাকা পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের গুটিকয় সুবিধাবাদীদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন না। দেখা যাক। আগামীকাল ঘােড়দৌড় ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমানের বিরাট সভা অনুষ্ঠিত হবে।
২৭ মার্চ রবিবার ১৯৭১
রাত ৯টা
সকাল থেকে শহীদ সােহরাওয়ার্দী ময়দানে (ঘােড়দৌড় ময়দানের নাম বর্তমানে এটি) লােকজন জমা হচ্ছে। ১টার সময় তাড়াহুড়া করে আমরাও রিকশা করে গিয়ে পৌছলাম। মঞ্চের সামনেই স্থান পেলাম। মেয়ে স্বেচ্ছাসেবিকারা বল্ল, বসুন আপনি আমাদের নিজের লােক, মনের মানুষ কাছের মানুষ। এম.এন.এ-রা গিয়ে দূরে চেয়ারে বসুন। অন্তরটা জুড়িয়ে গেল শুনে। আমি দেশের মানুষের মনের মানুষ। একী ভাগ্যের কথা। ৩টা ২০ মিনিটে মুজিব এলেন বিমর্ষ মলিন মুখে। সৈন্যবাহিনী সামরিক আইন প্রত্যাহার না করলে তিনি অধিবেশনে যােগ দিবেন না। রেডিওতে তার
৩৭
বক্তৃতা রিলে করতে দেওয়া হলাে না। তিনিও অফিস আদালত স্কুল কলেজ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রাখতে বললেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের আহ্বান জানিয়ে সভা শেষ করলেন।
৮ মার্চ সােমবার ১৯৭১
আজ সাড়ে আটটায় মুজিবুর রহমানের সম্পূর্ণ ভাষণ রেডিওতে রিলে হলাে। সেই তাে মল খসালি, তবে কেন লােক হাসালি। এই কথাই মনে হয়। আজ ঢাকার নাগরিক জীবন স্বাভাবিক। কিন্তু কেমন একটা থমথমে ভাব ঘরে ঘরে। কারুর যেন সােয়াস্তি নেই। আল্লাহ মুজিবুর রহমানকে সুস্থ ও দীর্ঘায়ু করুন। এই প্রার্থনা। আজ তাে মহররমের আশুরা। কিন্তু কোনাে মিছিল বা অনুষ্ঠান হয়নি। সারা বছরই শহীদ দিবস, নতুন করে আর কি হবে! কাল সন্ধ্যায় রেডিও অফিসের সামনে জীপে করে কারা দুটো হাতবােমা ফেলে গেছে।
৯ মার্চ মঙ্গলবার ১৯৭১
রাত ৯টা
আজ বেলা ১টায় মুজিবুর রহমানের বাড়ীর সামনে ছদ্মবেশী পাগল সেজে ৩ জন লােক এসেছিল। সন্দেহজনক ভাব দেখে গ্রেফতার করে। ৩টা পিস্তলসুদ্ধ ধরা পড়েছে মিলিটারী ইনটেলিজেন্সের কাগজপত্রসহ। ৩টার সময় ভাসানী সাহেব পল্টনে বক্তৃতায় স্বাধীন বাংলা ঘােষণা করেছেন। আতাউর রহমান সাহেব সুদ্ধ তা সমর্থন করেছেন। টিক্কা খান-এর গবর্ণর পদ শপথে কোনাে জজই উপস্থিত হয়ে শপথ গ্রহণ করাননি। ভাসানী বলেছেন, দুই পাকিস্তানের আলাদা সংবিধান হবে। দুই দেশের রাষ্ট্রদূত দুই দেশে থাকবে। অখণ্ড পাকিস্তান আর থাকবে না।
৩৮
১০ মার্চ বুধবার ১৯৭১
রাত ১০টা
আজ ঢাকা স্বাভাবিক। চট্টগ্রামে যে লােকেরা বিহারীদের হাতে মরেছে, তার হিসাব নেই। ট্রেন চলছে। প্লেন বন্ধ, ফরেন অফিস, পােস্ট অফিস বন্ধ। শাব্বীরকে চিঠি দিতে পারলাম না। ৩ জাহাজ ভর্তি সৈন্য চাটগাঁ বন্দরে উপস্থিত। পিআই-এর বাঙালি কর্মচারীর হাত থেকে পি.এ.এফ-সম্পূর্ণ ক্ষমতা নিয়ে সৈন্য আনছে। ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট সৈন্যে অস্ত্রে সম্পূর্ণ প্রস্তুত।
১১ মার্চ বৃহস্পতিবার ১৯৭১
রাত ১১টা
মহিলা পরিষদে শান্তি কমিটি গঠনের প্রস্তাব নেওয়া হল। সারা আলীর বাড়ীতে কমিটি মিটিংয়ে আরও সিদ্ধান্ত নেওয়া হল মহিলা পরিষদ থেকে ১ হাজার টাকা রােকেয়া স্মৃতি কমিটিতে দেওয়া হবে। আজ কাগজে আছে। সামরিক রসদ সরবরাহের ব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে না চললে সামরিক আইনে বিশেষভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। রাতে হাজারীর বাড়ী নিয়ােগী বাবুর সাথে দেখা হল, অনেক কথা হল। অন্তর্দ্বন্দ্বে ভুগছি বলে বল্লেন, এ অন্তর্দ্বন্দ্বের কি শেষ আছে? বহু যশ, মান আরও ভাগ্যে নাকি আছে! কিন্তু মৃত্যুর চেয়ে কাম্য আর কি আছে? আজ বসন্ত পূর্ণিমা।
১২ মার্চ শুক্রবার ১৯৭১
রাত ৯টা
কাল গেল বসন্ত পূর্ণিমা। বড় সুন্দর রাত কিন্তু বড় যন্ত্রণায় রাতটা কাটল। মানুষের দেহ কারাগারে বন্দী, আত্মার ক্রন্দনের সীমা নেই, গুমরে গুমরে কাঁদে সে মুক্তির জন্য, সুন্দরে বিলীন হওয়ার জন্য। সংসার যে কত কঠোর! বেঁচে থাকার যে কত মাশুল দিতে হয়!
৩৯
ঢাকার অবস্থা স্বাভাবিক। মিছিল চলছে সারা দিন রাত। কিন্তু এই স্বাভাবিকতাই এখন এত অস্বাভাবিক লাগছে। ঝড়ের আগের স্তব্ধতা নয়ত। টিক্কা খান এত অবহেলা লাঞ্ছনা অপমান নির্বিকারে সহ্য করে যাচ্ছে, আশ্চর্য তাে!
১৩ মার্চ শনিবার ১৯৭১
রাত ১১টা
পথসভা আর পথসভা। সারা দিন চলছে মিছিল-মিটিং। আজ ইয়াহিয়া মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করতে ঢাকা আসছেন। রাত ৮টায় ঘােষণা হল ১৪৪ ধারা। সামরিক কর্মচারীরা সােমবার থেকে কাজে যােগদান না করলে ১০ বৎসর কারাদণ্ড হবে। বি.বি.সি থেকে নাকি প্রচার হয়েছে, মুজিবুর রহমান যেন ইয়াহিয়ার সাথে দেখা না করে, বামপন্থী ছাত্ররা আপত্তি তুলেছে। আজ সারা দিন ব্যর্থ গেল। কি জানি একটা আশা ছিল মনে, সেটা হল না। যে আসবার সে আসেনি।
১৪ মার্চ রবিবার ১৯৭১
রাত ১০টা
এতক্ষণে হয়ত রােজী-শাব্বীরের বিয়ে হয়ে গেল। কাল সারা রাত ভেবেছি আল্লাহ যেন ওদের জীবন শান্তিময় করেন। ছােট পাখীটা অসহায় সন্তানটিকে তেজগাঁ বিমানবন্দরে উড়িয়ে দিয়েছিলাম সাড়ে সাত বছর আগে। আজ যেন ও জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়।
রাশিয়ান কনসাল জেনারেল মি. পপােভ ও মি. নভিকভ আজ এসেছিলেন। শহীদুল্লা কায়সার ও আলী আকসাদও এসেছিল। অনেক কথা হল। কিছু উপহারও পেলাম। দিনে দিনে খ্যাতির বােঝা, মানের বােঝা বেড়ে উঠেছে। এ কী আমি চেয়েছিলাম! আমি কি এর যােগ্য? হাজারীবাগ-এ মহিলা পরিষদের সভা করে প্রাথমিক শিক্ষা ও প্রাথমিক স্বাস্থ্য রক্ষার প্রস্তাব গৃহীত হল। ইয়াহিয়া খান আজ ঢাকায় আসেননি। কাল রাতেও যে আসবার, সে আসেনি।
৪০
১৫ মার্চ সােমবার ১৯৭১
আজ ১লা চৈত্র। বিকাল ৪টায় মহিলা পরিষদের পথসভা ও পথমিছিল করে ৬টায় বাড়ী এসে ৭টায় হাজারীর বাড়ী গেলাম। নিয়ােগী বাবু লুলু টুলুর বিষয়ে বল্লেন, টুলুর বিয়ে খুব শিগগির হয়ে যাবে। বিদেশে বহু দিন থাকবে। সবাই কিন্তু টুলুর বিষয়ে এ কথা বলে, ছবি আঁকায়ও সুনাম অর্জন করবে। লুলুর নাকি শনি প্রভাবে স্বাস্থ্য নষ্ট হয়েছে, গােমেদ ও হীরা ধারণ করতে বলেছেন।
কাল রাতেও সে আসেনি কিন্তু নিয়ােগী বাবু বল্লেন আজ রাতে সে আসবে। ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এসেছেন, আজ রাত মুজিবুর রহমানের সাথে কথা বলবেন। ফার্মগেটে আজ একজন পাঞ্জাবী চেকপােস্ট পার হতে গিয়ে সংঘর্ষে গণ্ডগােল হয়েছে।
১৬ মার্চ মঙ্গলবার ১৯৭১
রাত ১০টা
আজ মুজিব-ইয়াহিয়া আলাপ হল। কিন্তু কি কথা হয়েছে এখনও প্রকাশ হয়নি। শিল্পী সাহিত্যিক কবিদের সভা শহীদ মিনার থেকে বায়তুল মােকাররম হয়ে বাহাদুর শাহ পার্কে মিছিল করে যাওয়া হল। অনেক মিছিল, অনেক সভা, অনেক জনতা, সবাই বেপরােয়া। মরণের মধুর স্বাদ এদের উন্মাদ করেছে। কোনাে ভয়ভীতি নেই।
কাল রাত বড় অস্থিরতায় কেটেছে, সে আসতে চেয়েও আসে না। দূর থেকে কাল দেখা দিয়ে গেছে। আজ হয়ত আসবে। সামান্য কথা নিয়ে বড় আঘাত সয়ে যাচ্ছি। এত সংকটের বােঝা যে আর বইতে পারছি না। বাইরের এত সম্মান, কত মূল্য যে দিতে হয়।
৪১
১৭ মার্চ বুধবার ১৯৭১
কাল রাতে ও আজ সকালে মুজিবুর রহমান-ইয়াহিয়ার বৈঠক হল, কোনাে কথাই এখনও জনসাধারণের কাছে প্রকাশিত হল না। কাল আবার বৈঠক বসবে। জাস্টিস কর্নেলিয়াসকে আনানাে হয়েছে, চারজন জেনারেলও বৈঠককালে প্রেসিডেন্ট হাউজে উপস্থিত থাকেন। মুজিব বন্দী জনগণের মতামতে, ইয়াহিয়া বন্দী সেনাবাহিনীর হাতে। আজ মুজিবের ৫২ বছরের জন্মদিন। আল্লাহ হায়াত দেন। জয়ী হােক বাংলাদেশের ছেলে।
১৮ মার্চ বৃহস্পতিবার ১৯৭১
আজিমপুর লেডিস ক্লাব-এ আজ মহিলা পরিষদ থেকে সংগ্রাম কমিটির সভা হল। অনেক মেয়েরা এসেছিলেন। বেশ উৎসাহী আজ-কাল দেশের মানুষ। তাই দেখা গেল কয়েকজন পুরুষও এসে সভায় শামিল হলেন। উৎসাহ বাক্যে সমর্থন জানালেন। সব দুঃখের মাঝে এ যে কত বড় আশা।
১৯ মার্চ শুক্রবার ১৯৭১
আজ ১১টায় কবি শামসুর রাহমান ও আমার কবিতা রেকর্ডিং হল। যে কবিতা আগে রেডিওতে পড়া হত না, এখন তা স্বচ্ছন্দেই পড়া চলছে। একেই বলে দুনিয়া! বেশ ভালাে লাগল দেশের মানুষ জেগেছে, কে ঠেকাবে। আজ মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক হল। বিকালে আবার মুজিবের পক্ষের ও সৈন্যবাহিনীর পক্ষের লােকের বৈঠক হল। কি বলা কওয়া হল জানা যায়নি। ২৩ তারিখের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।
৪২
২০ মার্চ শনিবার ১৯৭১
৪০ নং এনায়েত বাজার, চট্টগ্রাম রাত ১টা
মহিলা পরিষদের সভায় চাটগাঁ আসবার জন্য বেলা ১২টায় এসে ট্রেনে বসেছি। রাত ১০টায় চাটগাঁ এসে উঠলাম। মালেকা আর আমি। দুলু, সিমিন, আব্দু স্টেশনে ছিল, নজমুল হুদা ছিলেন। কওসর, মােরাদ কেউ বাড়ী নেই। এতক্ষণে দুলুর সাথে গল্প করে উঠলাম।
২০ মার্চ রবিবার ১৯৭১
রাত ২টা সকাল ১০টায় বের হলাম, ফজল সাহেব, বুলবুল, আপার সাথে দেখা করলাম। ১টায় ফিরে এসে খেয়ে সভায় গেলাম। জে. এম. সেন হলের মাঠে দেড় হাজারের মতাে মেয়ে, বাইরেও পুরুষের অসম্ভব ভিড় হল। মালেকা বক্তৃতা দিল। ওখানে হান্নানা, পদ্মপ্রভা সেনগুপ্তা, মিসেস শরফুদ্দিন, মুশতারী শফী বল্লেন। উমু (উমরাতুল ফজল) সভানেত্রী। আমি বল্লাম। আবার মিছিলে জিন্না পার্কে শহীদ মিনার পর্যন্ত গেলাম। ফজল সাহেবের বাড়ীতে কমিটি মিটিং করে বাড়ী এসে ৮টায় বুলুকে দেখতে জাহেদের বাড়ী গেলাম। সাড়ে দশটায় এসে শাহজাহানের বাড়ীতে খেয়ে ১২টায় বাড়ী এসে মাহবুবের কবিতা লিখে দিলাম। ৩টায় শুলাম।
৪৩
২১ মার্চ রবিবার ১৯৭১
রাত ১২টা
দিগন্তে প্রদীপ্ত সূর্যকর
উদ্ভাসিয়া তুলিয়াছে দিনের প্রহর
নবীন জীবনালােকে ক্ষরি
প্রান্তরের দীর্ণ বক্ষভরি
শ্যামলা সতেজ সমারােহ
উদগত হতেছে অহরহ।
প্রাণধর্মে মর্ম মধু রসে
নিত্য পুষ্প বিকশিছে আলােক পরশে।
দিনান্ত তাে শূন্য নহে নিত্য সূর্য চন্দ্র তারকার
জ্যোতির লিখন লেখি নাশি অন্ধকার
প্রভাতে সন্ধ্যায় রাতে দিনে
সুষমা বিথরি যায় বিপিনে বিপিনে
নিত্য আনে নব জাগরণ
সুবীরে জাগায়ে স্পন্দন
আত্ম সমাহিতে করি জাগ্রত প্রভায়
সীমান্তে নবীন সূর্য লক্ষ প্রাণ অঙ্কুর জাগায়।
৪৪
২২ মার্চ সােমবার ১৯৭১
রাত ১০টা
রাত ৩টায় শুয়ে ৫টায় উঠে ৬টার উলকা ধরে বেলা ৩টায় ঢাকা এলাম। ৭টায় শহীদ মিনারে ছায়ানটের গান শুনতে গিয়ে শুনলাম কাল সকালে ৭টায় সেটা শহীদ মিনারে হবে।
বৌমার বাড়ী থেকে ৯টায় ফিরলাম। কওসর ও বুলুর জন্য মনটা যে কি অস্থির। বাড়ীতে এসে আল্লাহর ফজলে সবাইকে ভালাে দেখলাম। দুলুটার বাড়ীর চাকর নেই। সিমিন দুলু যা খাটছে। মনটা ভালাে নেই। বড় ক্লান্তি লাগছে এখন।
২৩ মার্চ মঙ্গলবার ১৯৭১
রাত ১১টা
২৩শে মার্চ-এ পাকিস্তান দিবস উৎসব এবার স্বাধীন বাঙলা উৎসব বলে পালিত হল। বাংলার ম্যাপ আঁকা পতাকা উড়ল ঘরে ঘরে, অফিস, হাইকোর্ট, হােটেল, গাড়ি, বাড়ীতে। অভূতপূর্ব উত্তেজনায় কাটল। এত আন্দোলন, জয়ী হতেই হবে, এই কথাটা মনে পড়ছে।
আজ জিগাতলা-রায়ের বাজার মহিলা পরিষদের সংগ্রাম পরিষদ শাখা উদ্বোধন করে এলাম। এত উত্তেজনায় মেয়েরা দলে দলে যােগ দিচ্ছে, সভা শেষে পরদানশীল বােরকা পরা মহিলারা মিছিল করে শেখ মুজিবের বাড়ী পর্যন্ত এল। বেচারাকে লােকেরা পাগল করে না দেয়। শাব্বীরের কোন চিঠি আজও পেলাম না।
৪৫
২৪ মার্চ বুধবার ১৯৭১
রাত ৯টা
পলাশী ব্যারাক স্কুলে আজ মহিলা পরিষদের সংগ্রাম কমিটির শাখা করে এলাম। শরীরটা ভালাে যাচ্ছে না। তবুও মেয়েদের এই উৎসাহে ভাটা পড়ে যায়। সেই জন্য যাচ্ছি ঐ সব জায়গায়। সবাই যখন আমাকেই চায় তখন গিয়ে উপায় কি?
এ কি সৌভাগ্য না দুর্ভাগ্য তা বুঝতে পারছি না। আজ সকালে মেহেরুন এসে বল্লে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছে বলে কাল রাতে মীরপুর ওদের সেকশনে বিহারীরা আগুন লাগিয়েছে। এই রূঢ়, রুষ্ট বিহারীদের নিয়ে দিনে দিনে সমস্যা জমে উঠছে, বাঙ্গালীরা এবার যথেষ্ট ধৈর্য দেখিয়েছে। আজও ভুট্টো-ইয়াহিয়ার কোনাে শুভবুদ্ধির পরিচয় পাওয়া গেল না। বৈঠকের শেষ নেই।
২৫ মার্চ বৃহস্পতিবার ১৯৭১
রাত ১০টা
নিয়ােগী বাবুর সাথে দেখা করে এলাম। দেশের অবস্থা ভালাের দিকে যাচ্ছে। না। ২৯ তারিখের মধ্যে কিছু সমঝােতা হলে ভালাে, নয়তাে ধাক্কা সামলাতে কষ্ট হবে। আজ সারা ঢাকার জনগণ অধৈর্য। এতদিন ধরে বৈঠক চলছে, কোনাে নিষ্পত্তির কথাই শােনা যাচ্ছে না। জানি না, মুজিবের কপালে কি আছে!
নিয়ােগী বললেন, বিপ্লব মাথা তুলবে। আজ কোনাে সভা-সমিতিতে যাইনি। শরীরটা ভালাে না। মন ভালাে নেই বলে লিখতেও পারছি না কিছু।
৪৬
২৬ মার্চ শুক্রবার ১৯৭১
রাত ১০টা
গতকাল রাত পৌনে ১২টায় হঠাৎ করে চট্টগ্রাম থেকে ফোন এল, ঢাকায় কোনাে গণ্ডগােল হচ্ছে কিনা। ততক্ষণ পর্যন্ত ঢাকা শান্ত। ফোনটা রাখা মাত্র পুলের উপর ‘মা’ বলে একটি আর্তনাদ শােনা গেল, পরপর মেশিনগানের শব্দ ও জয় বাংলা শব্দের পর অবিরাম রাইফেল বােমা স্টেনগান মেশিনগান এর শব্দ, সাত মসজিদ, ই.পি.আর-এর দিক থেকে গােলা কামানের শব্দ, জয় বাংলা আল্লাহু আকবর-এর আওয়াজ ২টা পর্যন্ত হল, তারপর থেকে শুধু কামান গােলাগুলির শব্দ, রাত সাড়ে ৩টায় মিলিটারী ভ্যান বাড়ীর সামনে দিয়ে এসে আবার চলে গেল। কাল থেকে কারফিউ জারি। শােনা যাচ্ছে, মজিব বন্দী। ও দিক থেকে আগুনের আভা দেখা যাচ্ছে। আজ রাত ১০টা পর্যন্ত। রেডিওতে ইয়াহিয়া ৮টায় ভাষণ দিল। আওয়ামী লীগ বন্ধ। মুজিব শর্তে আসেননি, সামরিক শাসন অমান্য করেছেন বলা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত। মেশিনগানের শব্দ আসছে। মানুষের শব্দ কোথাও নেই, ঘর থেকে বের হতে পারছি না।
২৭ মার্চ শনিবার ১৯৭১
রাত ১০টা
সন্ধ্যা ৭টা থেকে রায়ের বাজারে মিলিটারী ধ্বংসলীলা চলেছে ১০টা পর্যন্ত। সমস্ত ঢাকা সামরিক শাসনে সন্ত্রস্ত। হাট বাজার নেই। বৃষ্টি নেই, সব পুড়ে যাচ্ছে। পুড়ে যাচ্ছে অভাবী, সহায়হীন দুঃস্থ মানুষের জীবন। এদের উপর যে অমানুষিক অত্যাচার চলছে, তার জওয়াব আল্লাহর কাছে কারা দেবে? কি দেবে? শােনা গেল টিক্কা খান আহত। মুজিব বন্দী। কারফিউ সকাল ৭টা পর্যন্ত। রাতে কামানের আওয়াজও শােনা গেল। ট্যাঙ্ক বাহিনী সব ধ্বংস করে দিচ্ছে।
৪৭
২৮ মার্চ রবিবার ১৯৭১
আজ ১২টায় কারফিউ হবার কথা ছিল। আবার সময় পালটে বেলা ৫টায় কারফিউ হল। ছেলে মেয়ে কার বুকের ধনরা কে কোথায়! আল্লাহ নেগাহবান। আল্লাহ সবার ভালাে করুন, সুমতি দেন। সারা ঢাকা—সারা দেশ আতঙ্কিত। এই যদি পাকিস্তান বান্দাদের ভাগ্যে আছে, তবে কেন পাকিস্তান হয়েছিল? বিজাতির দমনে অতিষ্ঠ হয়ে মুসলমানরা সর্বহারা হয়ে পাকিস্তান এনেছিল। আজ পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি পাকিস্তানবাসীদের বুকে গুলী। চালাচ্ছে-অসহায়, নিরস্ত্র, নির্বোধ মানুষের বুকে।
২৯ মার্চ সােমবার ১৯৭১
রাত ৯টা
এত দিনে আজ বহু গর্জনের পর বৃষ্টি নামল। অকরুণের করুণা ধারা। বাংলার বুক শ্যামল হােক, সুশােভন হােক, পবিত্র শহীদের রক্ত গন্ধমুক্ত হয়ে শান্ত হােক, শীতল হােক, স্নিগ্ধ হােক, কাটুক বাংলার অভিশাপ। মুক্ত হােক, বন্দী ব্যথিত আর্ত অসহায় জনের আত্মার আত্মীয়। বাংলার বুক ভরুক গৌরবে। আনন্দে। কাল সারা রাত আজ সারা দিন এ পর্যন্ত কোনাে অঘটন ঢাকায় শােনা যায়নি। চাটগাঁর অবস্থা অজ্ঞাত। রেডিও বন্ধ। বৃষ্টি শুধু নয়, প্রবল শিলা বৃষ্টিও হলে সাথে কঠোরতার আর সীমা নেই। সব ফুল ফল আমের গুটি শেষ। আল্লাহ কি করছে এ সব?
৪৮
৩০ মার্চ মঙ্গলবার ১৯৭১
রাত ১০টা
কত দিন হয়ে গেল। চাটগাঁর কোনাে খবর নেই। কওসার সিলেটে, তারও কোন খবর নেই। আমার দোলন, ওর স্বামী সন্তান, সংসার নিয়ে কিভাবে আছে। আছে না মরে গেছে জানি না। মন অস্থির। নামাজ পড়ি, কোরান পড়ি, মন অস্থির। সমস্ত দেশ জ্বলে পুড়ে মরে নিঃশেষ হয়ে যাবে। এ যে কোন জালেমের জুলুম বুঝতে পারি না, আতঙ্কে আশঙ্কায় মানুষের রাত দিন কাটছে। আমার ভয় নেই, ভাবনা কিছু এদের জন্য, নিজের মৃত্যু তাে কাম্য।
৩১ মার্চ বুধবার ১৯৭১
রাত ৯টা
আজ ৩টা থেকে আবার বৃষ্টি, শিলা বৃষ্টি প্রচুর হল। কোথাও কোনাে ভালাে খবর নেই। চাটগাঁর কোনাে খবর নেই, সিলেটের খবর নেই। নামাজ পড়েও ভালাে লাগছে না, ওগাে অকরুণ! এত পরীক্ষা ভঙ্গুর মানুষের উপর চালালে কত সে সইবে। শান্তিনগরের বাজারটা কাল পুড়িয়েছে।
৪৯
এপ্রিল, ১৯৭১
১ এপ্রিল বৃহস্পতিবার ১৯৭১
এইমাত্র রেডিও পাকিস্তান করাচীর সংবাদে বলা হলাে, হিন্দুস্থানী সেনা পাকিস্তান সীমান্তে অনুপ্রবেশ করেছে। গত রাতে নারিন্দার গৌড়ীয় মঠ, বাসাবাে, বাডডায় আগুন জ্বালিয়েছে। আজ তেজগাঁয়ের খাদ্যগুদাম থেকে সমস্ত চাল-সরানাের সংবাদ পাওয়া গেল। চাটগাঁর কোনাে খবর নেই। কারফিউ চলছে। প্লেন-এর আসা-যাওয়ার বিরাম নেই। কাল থেকে নাকি ব্যাঙ্ক সব খােলা হবে।
আট আনায় ৩টি পান কিনলাম।
বাংলার ইতিহাস কে রচনা করবে?
২ এপ্রিল শুক্রবার ১৯৭১
রাত ৮টা
গত রাতে জিঞ্জিরায় জমা, অসহায় গৃহহীন নরনারীর উপর বােমা বেয়নেট গােলাগুলী বর্ষিত হয়। মিল ও কিছু কারখানা আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আজ সকাল সাড়ে ৫টা থেকে ৬টা পর্যন্ত ঢাকায় কামান গুলীর শব্দ শােনা গেছে। র্যাঙ্কিন স্ট্রীটে হিন্দু বাড়ীতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। রেডিও পাকিস্তান থেকে সীমান্তে ভারতীয় সৈন্য প্রবেশ অব্যাহত এবং সিলেট, চুয়াডাঙা, দিনাজপুর, যশাের, কুমিল্লা সীমান্তে ভারতীয় অস্ত্র সরবরাহ; অব্যাহত বলে ঘােষণা করা হয়। ঢাকা শহর ও পূর্ব পাকিস্তানের অন্যান্য শহরে শান্তিময় পরিবেশ বলেও ঘােষিত হল। কি পরিহাস! নির্লজ্জ উক্তি!
এর উত্তর কি দেওয়া যায়, কে দিতে পারে?
৫৩
৩ এপ্রিল শনিবার ১৯৭১
রাত ৯টা
কাল সারা রাত ও আজ দিনেও কোনাে গােলমাল শােনা যায়নি। কিন্তু ৬টায় কারফিউর পরেই গােলার আওয়াজ শােনা গেল। আজ লুলুরা বাড়ী এল। ৮ দিনের পর। দুলুদের খবরটাও যদি পেতাম। যশাের কুষ্টিয়ার খবর ভালাে নয়। কিছুই জানা যাচ্ছে না। কোথায় কি হচ্ছে। সংঘাতে সংগ্রামে অন্তর ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়, তার মধ্যেও আসে কোথা থেকে করুণ মধুর রস সঞ্চার। কিন্তু তাও সহ্য করার সাথী নেই। আমি চিরকালের বােকা, কিন্তু সবার কাছে শুনে শুনে আরও বােকা হয়ে যাচ্ছি। কাউকে খুশি করতে পারলাম না।
.
৪ এপ্রিল রবিবার ১৯৭১
রাত ১০টা
গত রাতে সাড়ে ৯টায় গােলার শব্দ শুরু হল। সারা রাত অবিরাম শব্দ পাওয়া গেছে। কোথায় কি হয়েছে জানা যায়নি। সারা দিন সারা রাত প্লেন উড়ছে। রাশিয়ান কনসাল জেনারেল রাও ফরমান আলীর সাথে দেখা করেছেন। প্রতিবাদও করা হয়েছে। ভারতীয় বেতার বহু আশা ও আশ্বাসবাণী প্রচারিত করেছে, কার্যকালে কি হয় জানা যাবে কখন? গণহত্যা জিঞ্জিরায়ও শুরু হয়েছে। আজ সকালেও জিঞ্জিরার দিক হতে গােলাগুলির শব্দ পাওয়া গেছে। চাটগাঁর কোনাে খবর নেই। আল্লাহ নেগাহবান। আজ অনেক আমেরিকান, বৃটিশ ও অন্য বিদেশী পরিবার ঢাকা ছেড়ে গেলেন।
৫৪
________________________________________
একাত্তরের ডায়েরী
৫ এপ্রিল সােমবার ১৯৭১
রাত ৮টা
গত রাতে কোথায় যেন মেশিনগান চলেছে। নরসিংদিতে রাতে ধ্বংসলীলা চলেছে। সকাল ৫টা থেকে রাত সাড়ে ৭টা পর্যন্ত কারফিউ মওকুফ করা হয়েছে। ঢাকার রাস্তায় লােক নেই। বাজার দোকান অস্বাভাবিকরূপে চলছে। রেডিও পাকিস্তান থেকে শান্তিপূর্ণ জীবনযাত্রা চলছে বলে ঘােষিত হচ্ছে। কত মায়ের বুক খালি করে সােনার সংসারকে ধ্বংস করে চলছে এখনও, আর শান্তির কথা বলছে! নির্লজ্জ! এদের আত্মসম্মানও নেই।
৬ এপ্রিল মঙ্গলবার ১৯৭১
রাত ১০টা
গত রাতে ২টা পর্যন্ত অবিরাম প্লেন উড়েছে। নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদি ধ্বংস হয়েছে। আজও নারায়ণগঞ্জে আগুন জ্বলছে। অন্য কোথায় কি হচ্ছে, খবর আর পাওয়া যাচ্ছে না। আমেরিকানরা বাড়ী রেখে, পরিবার পি.আই.এর প্লেনে পাঠিয়ে দিয়েছে। আজ সারা সকাল প্লেন উড়েছে। গােলাগুলীর শব্দ পাওয়া গেছে খুব কম, অনেক দূরে। দম বন্ধ করা অস্বাভাবিক আবহাওয়ায় ঢাকার আকাশ-বাতাস ভার। কাল রাতে খুব বৃষ্টি হয়েছে। আজ জ্যোৎস্নাপ্লাবিত ধরা, কত মার বুক খালি, ঘর অন্ধকার।
৭ এপ্রিল বুধবার ১৯৭১
রাত ৮টা
আজ সকালে জমিলারা করাচী চলে গেল। কত মানুষ যে ঢাকা ছেড়ে, বাংলাদেশ ছেড়ে গেল। ঘােড়াশালের সার ফ্যাক্টরী বন্ধ বলে রাশিয়ান
৫৫
কর্মচারী অনেকেই আজ গেল। আজ রাশিয়ান নেতা পদগর্নির হুঁশিয়ারির বাণী দৈনিক পাকিস্তানে দিয়েছে, সাথে ইয়াহিয়ার প্রতিবাদও দিয়েছে। মিথ্যাবাদীরা নাকি মুসলমান, পাকিস্তানী, এত মিথ্যা বলতে পারে। মাহমুদ আলী, হামিদুল হকের বিবৃতিও উঠেছে। ভীরু ভীত শয়তানের গােলামরা যে কি করে এসব কথা বলে। আজ ঢাকা থমথমে, বেশী প্লেনও উড়ছে না। গুলগােলার শব্দ নেই। ফতুল্লা থেকে ডেমরা পর্যন্ত সাঁজোয়া বাহিনী ওৎ পেতে আছে শােনা গেল। চাটগাঁর কোনাে খবর নেই।
৮ এপ্রিল বৃহস্পতিবার ১৯৭১
রাত ১০টা
সারা দিন প্লেন উড়ছে। বেতারে নানা বেচাল প্রচারিত হচ্ছে। বীভৎস মৃত্যুর অন্ত নেই। আজ সৈন্যবাহিনী আরিচামুখী। সমস্ত দেশ ধ্বংস করে দেশে স্বাভাবিক অবস্থা যারা প্রচার করছে তারা কি মানুষ? রাত ৯টায় কারফিউ হয়েছে। কিন্তু রাস্তাঘাট সন্ধ্যা থেকে নিঝুম। এ নীরবতা মৃত্যু শীতল ভয়াবহ। তবুও প্রচারের অন্ত নেই যে, দেশ স্বাভাবিকভাবে চলছে।
আজ ৮ তারিখ, বিবাহিত জীবনের বত্রিশ বছর পূর্ণ হল। কত পথ-কত কাল পাড়ি দিয়ে এলাম। আরও কতকাল যে বাঁচব। চাটগাঁর কোনাে খবর নেই, শাব্বীরের চিঠি নেই। সিলেটের খবর নেই।
৯ এপ্রিল শুক্রবার ১৯৭১
রাত ১১টা
কাল সারা রাত আজ সারা দিন প্লেন উড়ছে। কারফিউ থাকা সত্ত্বেও ১০টায় কাছেই গুলীর আওয়াজ পাওয়া গেল। সন্ধ্যায় আগুন ধূম দেখা গেল হয়ত ২ বা ৩ নং রাস্তার দিক থেকে। সব ট্রাক বােঝাই মিলিটারী আরিচার দিকে কাল গেছে। আজও শহর নীরব নিঝুম। কোথাও কোনাে খবর নেই। বিদেশী রেডিও শুধু সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, আর হুশিয়ারি বাণী প্রেরণ করছেন। পাকিস্তানী রেডিও শুধু মিথ্যা প্রচার করেই কর্তব্য সমাপ্ত করছেন। এই নাকি পাকিস্তান! ইসলামী রাষ্ট্র!
৫৬
১০ এপ্রিল শনিবার ১৯৭১
রাত ৯টা
আজ জানা গেল কাল সন্ধ্যায় নিউ মার্কেটের কাঁচা বাজারটা পুড়িয়েছে। এখানে ওখানে হত্যাকাণ্ড চলছে। সারা দুনিয়ায় মানুষকে মিথ্যা সংবাদ দিচ্ছে রেডিও পাকিস্তান এবং খবরের কাগজগুলাে। চোখে দেখছি ঢাকার অবস্থা, শােকে ক্ষোভে অসহায়তায় মানুষ অস্বাভাবিক হয়ে গেছে। আর, রেডিওতে মিথ্যা প্রচার হচ্ছে। বি বি সি, ভােয়া, ইন্ডিয়া রেডিও থেকে সবাই জেনে নিচ্ছে সত্যিকার অবস্থা ঢাকার। গতকাল টিক্কা খান বি. এ. সিদ্দিকীর কাছে শপথ নিয়ে গভর্ণর হল। বােমারু প্লেন উড়ছে, বােমা ফেলে আসছে, চাটগাঁ, রাজশাহী, খুলনা। দিনাজপুর, সিলেট, কুষ্টিয়ার খবর সঠিক কেউ বলতে পারছে না। আজ নাকি নৌবহর সেনা বরিশাল গেছে।
১১ এপ্রিল রবিবার ১৯৭১
রাত ৯টা
আজ চাটগাঁয়ের কিছু খবর পেলাম, মন্দের ভালাে । আল্লাহ নেগাহবান। ফেনীতে নাকি ২টা বােমারু বিমানের পতন হয়েছে, লালমনিরহাট, কুষ্টিয়া অন্য অন্য জায়গায় নাকি মুক্তিসেনারা জয়ী হচ্ছে। হচ্ছে কিন্তু নিরস্ত্র মানুষ। কত যুঝবে? সারা রাত প্লেন উড়েছে। বিকাল থেকে কিছুটা কম। আজ ঢাকায় আদেশ দেওয়া হয়েছে যানবাহন, ই.পি.আর.টি.সি’-র রুট খােলা হয়েছে, কিন্তু মানুষ কোথায়? আসছে যাচ্ছে কারা? ভয় নয় ভীতি নয়, ঘৃণা ও মৃত্যুর জন্য শূন্য জনপদ।
১২ এপ্রিল সােমবার ১৯৭১
রাত ৯টা
৩দিন থেকে প্রবল বৃষ্টির জন্য দু’দিন বােম শেল-এর শব্দ শােনা যায়নি, কাল, সারা রাত বৃষ্টির জন্যই হয়ত প্লেনও ওড়েনি। বেতারে খবর পাওয়া গেল।
৫৭
শিলাইদহর রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ীতেও বােমা ফেলেছে। প্রচণ্ড যুদ্ধ ওদিকে চলছে। ঢাকার রাস্তাঘাট জনশূন্য। সদরঘাট টারমিনালে লঞ্চ, নৌকা, জাহাজ কিছুই নেই। শহর ছেড়ে অসহায় গ্রামবাসীদের ধ্বংস করার জন্য ঢাকায় সামরিক অত্যাচার খুব বেশি শােনা যাচ্ছে না। অনেক প্রসিদ্ধ নাগরিক, ধনিক, ব্যবসায়ীদের আকস্মিক ধরপাকড়ের কথা শােনা যাচ্ছে। সঠিক কোনাে খবর নেই। মীরপুরের কোনাে খবর পেলাম না। আজ অবজারভারে বন্দী দেশনেতার—শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি দেখা গেল। হােক বন্দী, তবু যেন বেঁচে থাকে। মেঘ কেটে যাচ্ছে, আবার সূর্য উঠবে। আল্লাহ যেন দীর্ঘ পরমায়ু দেন।
১৩ এপ্রিল মঙ্গলবার ১৯৭১
চুয়াডাঙ্গা স্বাধীন বাংলার রাজধানী, শেখ মুজিবুর রহমান প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন। নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী, কামরুজ্জামানকে নিয়ে মন্ত্রী পরিষদ গঠিত হয়েছে। ভারতীয় বেতার থেকে প্রচারিত, অস্ট্রেলিয়ান বেতার থেকে সমর্থিত। খবর সত্য নিশ্চয়ই আল্লাহ জানেন। শাহজালালের দরগা ধ্বংস করারও খবর পাওয়া গেল। প্রবল গােলাবর্ষণে চাঁদপুর, সিলেট, রাজশাহী, পাবনা, চট্টগ্রাম বিধ্বস্ত। বৃষ্টির দরুন বাংলায় সেনাবাহিনীর অসুবিধার কথাও বলা হয়েছে। ভারত, রাশিয়া বাংলাকে সাহায্য করতে ইচ্ছুক। সিলেটের বিমানবন্দরে শালুটিকরের রাডার যন্ত্র বাংলা বাহিনী নষ্ট করে দিয়েছে। দিনাজপুরে প্রচণ্ড বােমাবর্ষণ চলেছে।
১৪ এপ্রিল বুধবার ১৯৭১
রাত ১০টা
গতকাল ১৪০ জনের শান্তি মিছিল। পথে পথে শান্তির বাণী শুনিয়ে রাতে চকবাজার পুড়িয়েছে। সারা দিন বােমারু বিমান হেলিকপ্টার উড়েছে। সাভার থেকে এসে দুধওয়ালারা মীরপুর পুলের উপর রক্ত স্রোত দেখে ফিরে গেছে। সিলেট দিনাজপুর নাকি আবার মুজিব বাহিনীর হাতে এসেছে। ঢাকা থেকে
৫৮
২০ কিলােমিটার দূরে প্রচণ্ড যুদ্ধ চলছে পাক-মুজিব বাহিনীতে। কিন্তু কোথায় সঠিক জানা যায়নি। বৃষ্টি থেকে থেকে ঝরছে। ভাইয়ার খবরও পেলাম। রাতে ৩দিন ধরে কোড, এ কারা কথা বলে বােঝা যায় না। পৌনে বারটা থেকে প্রায় সাড়ে বারােটা পর্যন্ত চলে।
১৫ এপ্রিল বৃহস্পতিবার ১৯৭১
রাত ১০টা
আজ ১লা বৈশাখ। নববর্ষ, ১৩৭৮ সনের প্রথম দিনে। প্রতি বৎসর ভােরে রমনার ফুল পাতা শােভিত বটের ছায়াতলে নববর্ষ উৎসব অনুষ্ঠান হত। আজ সকালটা বিষন্ন মলিন, রাতে বৃষ্টি হয়েছে। ভাের থেকে প্লেনে বােমা ফেলছে। মধুপুর, আখাউড়া, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া, গঙ্গাসাগর, সমস্ত দেশব্যাপী। শয়তানীর সীমা আছে। গুটিয়ে আনতে হবে একদিন ওদের অত্যাচারের ফাঁদ। লাখ মানুষের জীবনদান ব্যর্থ হবে না, আজ নববর্ষে এ প্রার্থনা সবমানুষের অন্তর থেকে ধ্বনিত হচ্ছে। মুজিব জিন্দাবাদ। বাংলার সন্তান, শহীদেরা অমর। নববর্ষে যেন সূচিত হয় বাঙালীর নবজীবনের দীপ্তিময় পথের সূচনা।
১৬ এপ্রিল শুক্রবার ১৯৭১
রাত ১১টা
আজ বৃষ্টি নেই। সিলেট, ময়মনসিংহ, কসবা, চুয়াডাঙায় বােমাবর্ষণ চলেছে। ঢাকা আজও অস্বাভাবিক। খবরের কাগজে খুব মিথ্যা প্রচারণা চলছে। কাল সন্ধ্যায় মাগরেবের আজান হচ্ছে আর নিউমার্কেট-এর পিছনের বস্তিতে আগুন জ্বলছে। কাল বেলা ১১টায় আঠার নম্বরের দিকে এক বাড়ীতে গুলী চলেছে, মানুষে মেরেছে, ঘরে বসে শব্দ শুনলাম, আগুন দেখলাম। শহীদ মিনারকে মসজিদ বানাচ্ছে। গত পরশু রাত ও দিনে ভারত থেকে কামরুল সত্য ঘটনা বলেছে। ওরা বাঁচুক। আর কে যে কোথায় ঘরছাড়া দেশছাড়া। আল্লাহ ওদের নেগাহবানী করবেন। শাব্বীরের কোনাে চিঠি পাচ্ছি না। আজ শমুরা চলে গেছে। ভালােভাবে যেন গিয়ে পৌঁছায়।
৫৯
১৭ এপ্রিল শনিবার ১৯৭১
রাত ১০টা
দুপুর ৩টা থেকে বৃষ্টি হচ্ছে, এও আল্লাহর রহমত। কসবা, আখাউড়া, ব্রাহ্মণবাড়ীয়ায় প্রচণ্ড গােলাবর্ষণ হচ্ছে। কোথাও কোনাে পথঘাট খােলা নেই। কাগজে জঘন্য মৃত্যুর প্ররােচনা, মিথ্যা প্রচার চলছে। মেহেরপুরে স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার কথা শােনা গেল । যে যেখানে আছে যেন আল্লাহ হেফাজতে রাখেন। বড় দুঃখ, বড় শােকের ব্যাপার, মেহেরুন নেসা, তার মা, দুই ভাইকে হত্যা করা হয়েছে। আল্লাহ যেন এই নিস্পাপ অসহায়দের রক্তের বিনিময়েই বাংলাদেশকে স্বাধীন করেন। আর কত রক্ত, কত প্রাণ দিতে হবে! বাংলার লাখ লাখ মানুষ কাদের হাতে কোন মােনাফেকের হাতে মরছে। আল্লাহ কি দেখছে না!
১৮ এপ্রিল রবিবার ১৯৭১
রাত ৯টা
আজ বিকাল ৪টা ফোনের উপর ফোন করে নুরুল কাদের এডভােকেট আমাদের বাড়ী আছে কিনা, কোথায় সে থাকে জিজ্ঞাসাবাদ হল। আমি আওয়ামী লীগের মেম্বার কিনা, উনি মেম্বার কিনা, আমি কি করি, কখন। কোথায় থাকি, রিলিফে কোথায় কোথায় গিয়েছি, এন্টি পার্টি করি কিনা। জিজ্ঞাসা করল, বাড়ীর ঠিকানা রাস্তার নম্বর উর্দু ভাষায় জেনে নিল।
পাকিস্তানের রেডিওতে শালুটিকর বিমানবন্দর বলে কোনাে বন্দরই নেই বলা হল। টিক্কা খানের ভাষণে সামরিক কর্মচারী, ই.পিআর-এর কর্মচারীরা কাজে যােগ না দিলে নাস্তানাবুদ করে দেওয়া হবে বলে প্রচারিত হল না নাস্তানাবুদ করতে বাকী আছে কি? বাংলা বাহিনী চুয়াডাঙ্গা, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া, দিনাজপুরে তার জয় নিশান উড়াচ্ছে। ভারতে পাকিস্তানী ডেপুটি হাই কমিশনার হুসেন আলী পাকিস্তানী অফিসে জয় বাংলার পতাকা উড়িয়েছে।
বৃষ্টি আজ এখনও হয়নি। শাব্বীর-এর কোনাে খবর পাচ্ছি না।
৬০
১৯ এপ্রিল সােমবার ১৯৭১
রাত ১০টা
ব্রাহ্মণবাড়ীয়া, টাঙ্গাইল ও ঢাকার উপকণ্ঠে প্রচণ্ড গােলাগুলী চলছে। গত রাতেও মীরপুরে আগুন ধরিয়েছে। রিলিফের জন্য দেওয়া কপ্টারগুলাে আজ বাংলার মানুষের উপর বােমাবর্ষণ করার কাজে নিযুক্ত করা হয়েছে। সমস্ত বিশ্ব এই অন্যায়-অবিচারে প্রতিবাদে মুখর, কিন্তু সক্রিয় অংশ কে নিচ্ছেন বােঝা যায় না। ভারত বাংলার শরণার্থীদের আশ্রয় দিচ্ছে। নির্লজ্জ পাক-বাহিনীর লজ্জা শরম নেই। ইমাম নেই। পদস্থ কর্মচারীর লাঞ্ছনা পশুর অধম সেনাবাহিনীর হাতে দিন দিন বেড়ে চলেছে। আজ বৃষ্টি নেই। বৈশাখী দিন অবসন্ন, স্লান, বিষন্ন।
২০ এপ্রিল মঙ্গলবার ১৯৭১
রাত ১০টা
আজ আবার সিলেট, ভৈরব, কসবা আর ঢাকার কাছে কালিগঞ্জে প্রচণ্ড বােমা নিক্ষেপ করা হচ্ছে। ঢাকার আকাশে আজ খুব কম প্লেন চলছে। কেমন থমথমে ভাব। বাড়ীর সামনে ৩দিন থেকে সন্দেহজনক লােককে পায়চারী করতে দেখা যাচ্ছে। নিউ মার্কেটে দোকানপাট বেশীর ভাগই বন্ধ দেখা যায়। কাজের লােক পাওয়া যাচ্ছে না। বস্তির বাসিন্দারা ঢাকা ছেড়ে বেশীর ভাগ চলে গেছে। সরকারী কর্মচারীরা প্রাণের ভয়ে কেউ কেউ কাজে যােগ দিচ্ছেন। সব কিছু স্বাভাবিকভাবে চলছে বলে রেডিও খবরের কাগজে প্রচার হলেও অফিস, বাজার ফাঁকা। ৫টার পর রাস্তাঘাটে লােক চলাচলও কম।
আজ বৃষ্টি নেই, আকাশ বাতাসও থমথমে।
২১ এপ্রিল বুধবার ১৯৭১
রাত ১১টা।
আজ ইকবাল দিবস। ইকবাল পাকিস্তানের স্বপ্নদ্রষ্টা কবি। কিন্তু খাস পাকিস্তানী বলে যারা দাবী করেন, তারা এর কি মর্যাদা দিচ্ছেন আজ?
৬১
কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, ময়মনসিংহ মুক্তিফৌজের দখলে, সিলেটও। বৃষ্টি কাল রাত থেকে বেশ হয়েছে। আল্লাহর রহমত। শহরে সামরিক গতিবিধি আজ শ্লথ। কোনাে গ্রাম বা শহরের খবরাখবর বা লােক চলাচল নেই। মিথ্যা প্রচার চলছে।
করাচী প্লেন’-এর টিকিটও পাওয়া যায় না। হেলিকপ্টার খুব উড়ছে, বােমারু প্লেন আজ দেখা গেল না। সীমান্তে কি হচ্ছে আল্লাহ জানেন।
২২ এপ্রিল বৃহস্পতিবার ১৯৭১
রাত ৯টা
আজ শাব্বীর-রােজীর টেলিগ্রাম পেলাম। আর্জেন্ট টেলিগ্রাম করে দেওয়া হল, আমরা ভালাে আছি। দুলুদের কওসরের সঠিক খবরটা পেলেও আল্লাহর কাছে শােকর করতাম।
সকাল থেকে খুব প্লেন উড়েছে, সিলেট পাক বাহিনীর দখলে। মিলিটারী গাড়ী চলছে। রাতদিন থমথমে ভাব। ফরিদ আহমদ যে বিবৃতি দিয়েছিল তাতে করে সরকার তথা সেনাবাহিনীর উপকার না হয়ে অপকারই হয়েছে। মিথ্যার পাপ ওদেরকেই গ্রাস করবে। বাঙালী বিনা দোষে অনেকেই তাে মরেছে আরও মরবে। দিন দিন খাবার দাবার জিনিস দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠছে। দেখা যাক, কতদিন আল্লাহ খাওয়ায়।
২৩ এপ্রিল শুক্রবার ১৯৭১
রাত ১০টা
গত ২৩শে সকালে ছায়ানট-এর গণসঙ্গীতের আসর হয়েছিল। আজকের সকালটি সে দিনের মতাে সােনারাঙা ঝলমলে ছিল, কিন্তু সেদিনের তারা আর আজ অনেকেই নেই। অনেকেই নেই। অনেকেই আবার ঘরছাড়া, স্বজনছাড়া হয়ে কে যে কোথায় আছে আল্লাহ জানেন। যে যেখানে আছে, আল্লাহ যেন নেগাহবান থাকেন।
৬২
গত রাতে নাকি ইন্ডিয়া রেডিওতে আমার মত্য সংবাদ দিয়েছে। আমরা শুনিনি, কিন্তু আজ ভাের ছটা থেকে যত লােক পেরেছে ফোন করেছে, এসেছে, খবর নিয়েছে। আহা, যদি আমার প্রাণের বিনিময়ে একটিও প্রাণ বাঁচত, কত সার্থক এ জীবন হত। আমি তাে বাঁচতে চাই না কিন্তু নিঠুর, কঠোর আমাকে যে বাঁচিয়েই রেখেছে, আরও কি লীলার জন্য কে জানে!
২৪ এপ্রিল শনিবার ১৯৭১
রাত ১০টা
সকালটা ঝলমলে রােদে সুন্দর হয়ে এসেছিল। ভােরে অনেক দূরে গােলার শব্দ পাওয়া গেছে। বিকাল থেকে মেঘ করে সন্ধ্যা থেকে বৃষ্টি হচ্ছে। আজ গুজব ছিল, ঢাকায় অবাঙালীরা গত ২৫ তারিখের চট্টগ্রাম দিবস পালন করবে ঢাকায় বাঙালী হত্যা করে, কি কারণে এখন পর্যন্ত তারা এগিয়ে আসেনি। অবশ্য এখন মাত্র সন্ধ্যা, রাত বেশী হতে কি হয় বলা যায় না। শহরে মিলিটারী তৎপরতা অনেক বেড়ে গেছে। আজও সারা দিন আমি বেঁচে আছি কি না জানতে কত লােকের আনাগােনা হয়েছে। আমার মৃত্যু কিভাবে হবে জানি না। তবে দেশের, দশের ভালাের জন্য যেন হয়। কুমিল্লার কোনাে খবর পাচ্ছি না। আমি তাে বেঁচে আছি। কিন্তু নীলিমা ইব্রাহিম কোথায়? সেই জন্য বুঝি রেডিওতে আমাকে আমার বেঁচে থাকার ঘােষণা করতে দেওয়া হয়নি।
২৫ এপ্রিল রবিবার ১৯৭১
রাত ১০টা
ঠিক ১ মাস পর ঢাকার পথে বের হলাম। কি দেখলাম। প্রায় শহরটাই ঘােরা হল, জনমানবহীন রাজপথ। প্রধান প্রসিদ্ধ দ্রষ্টব্য স্থান ধ্বংসস্তুপ। স্বাভাবিকভাবে চলছে বলে পাক রেডিও, খবরে কাগজে যা প্রচার করছে তা সবই অস্বাভাবিক। এই ঢাকার দিকে দিকে এখনও মরণযজ্ঞ চলেছে—এর শেষ পরিণতি কি আল্লাহ জানেন। গত রাতেও দূরে কামান গর্জন শােনা গেছে। আজ সকালেও প্লেন উড়েছে। বিকালে বৃষ্টি হয়েছে, কাল সারা রাত
৬৩
বৃষ্টি হয়েছে। আল্লাহর রহমত। দলে দলে সেনাবাহিনী ধানমণ্ডি স্কুলে এসেছে। শেখ সাহেবের বাড়ীতে ভিতরে আলাে জ্বলছে, লােকজনও আছে বলে মনে হয়। বাইরে থেকে কিছু বােঝা যায় না।
২৬ এপ্রিল সােমবার ১৯৭১
রাত ১০টা
গতকাল গেছে স্মরণীয় ২৫শের রাত। বাংলার মাটি মা সন্তানশােণিত সিক্ত হয়েছে। পৈশাচিক হত্যালীলায় মুসলমানকে মুসলমানের হাতে নির্বিচারে প্রাণ দিতে হয়েছে। রাত ১২টার পর যে ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছে, আজ পর্যন্ত তার পুনরাবৃত্তি চলছে। বাংলার সন্তানও তার সাহস বীর্যে শক্তিতে আল্লাহর পরম অবদান লাভ করে বিশ্বনন্দিত হয়েছে। কিন্তু পথে পথে ঘরে ঘরে যে মায়ের বুকের শিশু, স্বামীর পাশে স্ত্রী, স্ত্রীর পাশ থেকে স্বামীকে, তরুণ তাজা যুবকদেরকে সারি বেঁধে দাঁড় করিয়ে হত্যা করা হয়েছে তার প্রতিফল আল্লাহ কবে দিবেন। আজ বৃষ্টি নেই, সারা দিন ধরে বােমারু প্লেন উড়েছে। বরিশালে গানবােট থেকে পাশের গ্রামগুলােতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
২৭ এপ্রিল মঙ্গলবার ১৯৭১
রাত ১১টা
আজ পবিত্র রবিউল আউয়ালের প্রথম দিন। পুণ্যপূত অবিস্মরণীয় মানুষের জন্ম মাসের প্রথম দিন। তাঁর পুণ্যে দুনিয়ার মানুষের মঙ্গল হােক, এই প্রার্থনা মানববন্ধু। আর্তের ত্রাতা, তার মানবতার ধর্ম ইসলাম। তাঁর এই অবমাননা যারা করছে তাদের চৈতন্য হােক। আজ শের-এ-বাংলার নবম মৃত্যুবার্ষিকী। শয়তানের চক্রে কোনাে পুণ্য, কোনাে মঙ্গল, কোনাে আনন্দ, সুন্দরের শান্তির বিকাশ হতে পারে না। স্তব্ধ নগরী ঢাকা আজ সমস্ত আনন্দ উৎসব পুণ্য কর্ম হতে বিরত। হযরত রসুলে করিমের দোওয়ায় এ শয়তানির কদর্যতার অবসান হােক।
৬৪
২৮ এপ্রিল বুধবার ১৯৭১
রাত ১০টা
আজ চাটগাঁ থেকে ফোন পেলাম। কওসর জাহেদের খবর পেলাম, ওরা ভালাে আছে। হাজার শােকর আল্লাহর কাছে। নওয়াব আজ চাটগাঁ গেল। আজ সকাল থেকে মিরপুরে গণ্ডগােল। ৭৫ জন মরেছে, ২৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পাবনা, আরিচার ২টি কোচ বিহারীরা আটকে সবাইকে মেরেছে। রেশনে কিছু নেই, চাল, গম, তেল, চিনি, নুন কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না। কাগজে ছবি দেওয়া হচ্ছে, রেডিওতে বলা হচ্ছে, ঢাকার জীবনযাত্রা স্বাভাবিক। স্বাভাবিক হবে একদিন ইনশাআল্লাহ!
২৯ এপ্রিল বৃহস্পতিবার ১৯৭১
রাত ১১টা
নিত্য দুঃখের পুনরাবৃত্তি যা লিখতে ভালাে লাগে না। আমার মৃত্যুর মিথ্যা সংবাদে এত লােক অস্থির! আহা! যদি আমার মৃত্যু দিয়েও কিছু মাত্র ভালাে হত এ দেশের কি তৃপ্তি ছিল তার জন্য। কিন্তু আমার মরণ নেই। আরও কি কি যে দেখব জানি না। এত অত্যাচার এত হিংসা এত হত্যা, তবুও আমার মন আশা করছে মঙ্গলের, কল্যাণের। খুব যে হতাশ আমি হতে পারি না, তাই দুশ্চিন্তায় আমার শরীর বা মনও অবসন্ন হয়নি এখনও। সবার খবর কিছু কিছু পাচ্ছি, এও এক সান্ত্বনা। যদি আমার মতাে মেহেরুননেসার মৃত্যু সংবাদটাও মিথ্যা হতাে!
৬৫
৩০ এপ্রিল শুক্রবার ১৯৭১
রাত ১০টা
দানব দল শহরের আওতা ছেড়ে গ্রামে গ্রামে হানা দিচ্ছে। অসহায় সরল নিরস্ত্র জনতা, আত্মরক্ষার কোনাে উপায় নেই, তারা দলে দলে মরছে। ২টি কোচসুদ্ধ ৪০ জনকে অবাঙালীর দ্বারা হত্যা করানাে হয়েছে। এদের রক্তে দেশের পাপ অভিশাপ সব কিছু ধুয়ে তুমি পাক কর, পবিত্র কর, বাংলাদেশের মানুষকে মানুষের মতাে বাঁচাও, আল্লাহ! তুমি শােনাে।
মে, ১৯৭১
১ মে শনিবার ১৯৭১
রাত ১০টা
আজ মে দিবস। সারা দুনিয়ার মেহনতি মানুষেরা এক হােক, জাগুক মানবতা। বিশ্বনবীর উদাত্ত আদেশ—সব মানুষ এক। এ সত্য মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান যে দম্ভে পদদলিত করছে তার সে দম্ভও যেন জন জাগরণের পদতলে পিষ্ট হয়। আজ পাকিস্তানকে গােরস্থানও বলা যায় না, বলা যায় শ্মশান, মহাশ্মশান। মুসলমান যারা, যারা না খেয়েও রােজা রাখে, নামাজ পড়ে ছিন্ন জায়নামাজ পেতে, তাদেরকে হত্যা করে, পুড়িয়ে মেরেছে। আল্লাহ, তুমি কি করে এ সব সহ্য করছ? অসহায় নিরস্ত্র মানুষ, নারী শিশু তরুণ বৃদ্ধ কাউকেই তাে বাদ দেয়নি এ পিশাচ দল। সব তােমারই ইচ্ছে? বিশ্বাস করি না!
২মে রবিবার ১৯৭১
রাত ৮টা
প্রেতনগরী ঢাকা আজাবের করাল আভাস। গ্রামীণ জীবন দুর্বিষহ, মহামারীর কবলে অসহায় কান্নায় মরছে।
আজ ১৮ই বৈশাখে কালবৈশাখীর আভাস কিছুটা পাওয়া গেল। মাগরেবের নামাজ পড়ে উঠে দুলুর ফোন পেলাম। ওরা ভালাে আছে, খবর পেলাম। এই হাজার শােকর। বাচলে একদিন দেখা হবে।
১৩ মে সােমবার ১৯৭১
রাত ৯টা
আজ রেডিও পাকিস্তান থেকে আমি বেঁচে আছি, এই সাক্ষাৎকার রেকর্ড হল। বেঁচে আছি, বেঁচে থাকব। ইনশাআল্লাহ, এই বাংলাদেশকে আবার সুখী সমৃদ্ধ
৬৯
শান্তিময় রূপে দেখে তবে মরব। আজ দুপুর বেলাই কালবৈশাখী দেখা গেল। সকাল থেকেই মেঘে মেঘে বেলা গেল। কাল রাতে কালা-আলুর ৩টা বাচ্চা হল, আর ৩টা বিড়াল তা ভাগ করে নিল। এখন বাচ্চাগুলাে নিয়ে কালা-আলু ঘুমাচ্ছে। গেরিলা যুদ্ধ অব্যাহত। পাক সৈন্যও মরছে কম না। ধীরে ধীরে সুস্থ ছেলেদের ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে রক্ত নিচ্ছে রক্ত শােষার দল। ক’দিন চলবে এ অত্যাচার দেখা যাক।
৪ মে মঙ্গলবার ১৯৭১
রাত ১০টা
৩ দিন প্রচণ্ড কালবৈশাখীর পর আজ ঝকঝকে রােদে ভরা দিন। ৪টা বােমারু প্লেন ২দিন থেকে সমানে উড়ছে। সীমান্তে কি হচ্ছে, কত লােক প্রাণ দিচ্ছে।তার হিসাব নেই। আমার বাঁচার খবরে ভারত থেকে আমেরিকা পর্যন্ত এক বিরাট আন্দোলনের সৃষ্টি হয়েছে। বেঁচে আছি। কিন্তু কি দরকার ছিল আমার এ থাকার। কত গুণী, জ্ঞানী, সাধু, সংসারী, কবি, শিল্পী, গায়ক আজ হত প্রাণে, গৃহহীন। আমার মৃত্যু দিয়ে যদি কিছুও বাঁচত, এ জীবন সার্থক হত। আমার মনে ভয় নেই, ভাবনাও বড় নেই কিন্তু দুঃখের আফসােসের যে অন্ত নেই!
৫ মে বুধবার ১৯৭১
রাত ৯টা
আমার মৃত্যু সংবাদ মিথ্যা জেনে কাল রাত পৌনে ১১টায় আকাশবাণীতে দেবদুলাল বাবু যে কণ্ঠে যেভাবে সকলের হয়ে রেডিও পাকিস্তানকে ধন্যবাদ জানালেন, যদি তার সাথে অন্য মৃত্যু সংবাদও মিথ্যা বলে প্রমাণ করত রেডিও পাকিস্তান, তবেই না এর সার্থকতা সম্পূর্ণ হত। অর্বাচীনের দল, কেঁচো খুঁড়তে যে সাপ বের হবে তা রুখবে কি করে দেখা যাবে।
৭০
৬ মে বৃহস্পতিবার ১৯৭১
রাত ৯টা
আকাশবাণী থেকে কিছু খবর শুনলাম। হানাহানির বিরাম নেই। যেই মরছে মায়ের বাছারা, সন্তানের পিতা, স্ত্রীর স্বামী, বােনের ভাই কত ঘর শূন্য হয়ে যাচ্ছে। মানুষের কোনাে সঠিক খবরই পাওয়া যাচ্ছে না। বােমারু প্লেন উড়ছে। তাে উড়ছেই, জ্ঞান-বিজ্ঞানের উপর ঘৃণা জন্মে যাচ্ছে, বিজ্ঞান যত মারণাস্ত্র তৈরি করেছে জীবন বাঁচাতে তার অর্ধেকও করে উঠতে পারেনি।
৭ মে শুক্রবার ১৯৭১
আজ সারা দিন বৃষ্টি। নিচাপ ঘনিয়ে আসছে, চট্টগ্রাম, চালনায় ২নং বিপদ সংকেত দেওয়া হয়েছে। আজ মিলাদুন্নবী উপলক্ষে মিছিল বের হওয়ার কথা ছিল। বৃষ্টির দরুন হল না। হায় বিশ্বনবী! হায় মানববন্ধু! তােমার নাম নিয়ে শয়তানেরা এ কি খেলা শুরু করেছে। মহান তুমি! শরণার্থীর আশ্রয় তুমি। আজ তােমার নামে মানবতার অবমাননা কি বীভৎস রূপে চলছে। এর নিরসন হােক তােমারই পুণ্য নামের বরকতে। মিল্টনদের বাড়ীতে মিলাদে গেলাম, মন ভরল না।
৮ মে শনিবার ১৯৭১
আজ সারা বিশ্বের মহান মানবের জন্ম-মৃত্যু দিবস। ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী। কতবার কত সভা সমিতি, স্কুল কলেজ ইউনিভারসিটি আমাদের মহিলা সমিতি প্রত্যেকটিতে, এ পবিত্র দিবসটি উদ্যাপিত হয়েছে, কি আনন্দ, কত সমারােহে। আজ জালেমরা এ দিনটিকে বিষন্ন বিষাক্ত অপবিত্র করে পালন করছে, ভাবতেও ঘৃণা বােধ হয়। আজও আখাউড়া, সিঙ্গারবিল, লালমনিরহাট-এ গােলাগুলি চলছে। আজও পথ থেকে ছেলেদের ধরে নিয়ে
৭১
মেরে ফেলা হচ্ছে। আজ একজন নিজের চোখে দেখে এসে বল্ল, দুটি মেয়েছেলেকে মিলিটারী গাড়িতে করে এনে স্কুলে ঢুকলাে। আল্লাহ কি এসব দেখছে না।
১৯ মে রবিবার ১৯৭১
রাত ১১টা
আজ পঁচিশে বৈশাখ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্বকবি, একজন মহামানুষের জন্মদিন। কোথায় আমার ‘ছায়ানট’, কোথায় সন্জীদা, সুকণ্ঠ পাখীরা আমার! সূর্য উদয়ের সাথে সাথে রমণীয় রমনার বটতলায় লাখাে মানুষের সমাবেশে বিশ্বকবির বন্দনাগানে ঝংকৃত আকাশ বাতাস মুখরিত করা দিনগুলাে! কবে আবার ফিরে আসবে সেই দিন! আজ মেহেরের বােন এসেছিল, কি নির্মম নিষ্ঠুরভাবে মেহের তার দুই ভাই মাকে শয়তান বিহারীরা হত্যা করেছে, আহা! সােনার মতাে শিশুর মতাে কবি মেহেরুননেসা। সেই ২৫ তারিখ রাতেই জালিম কাফের ওদের হত্যা করেছে। মেহেররা তাে শহীদ হয়েছে। এই জালেমদের আল্লাহ কি করবেন, আল্লাহই জানেন।
১০ মে সােমবার ১৯৭১
রাত ১০টা
আজ বৈশাখী পূর্ণিমা, বুদ্ধের জন্মতিথি। উনিও ১০ তারিখেই জন্মেছিলেন। সারা দিন মেঘ-বৃষ্টিতে দিনটি বিষন্ন মলিন। এও এক দিকে মঙ্গলকর। মহাপুরুষরাও তাে পৃথিবীতে কম জন্ম নেননি, কিন্তু ধরার দুর্গতি ঘুচল কি? চিরকাল ধরে উত্থান পতন, দুর্গতি যুদ্ধ মহামারী দুর্ভিক্ষ চলেই আসছে। সেই যে এক অদৃশ্য বিশ্বনিয়ন্তা অলক্ষ্যে কি লীলাখেলায় মত্ত আছেন তার কিনারা কে কবে করতে পারল? কিন্তু নারীর উপর যে অত্যাচার চলছে তার কি প্রতিকারও তিনি করবেন না।
মামুনের কোনাে সঠিক খবর আজও নেই। আছে, না মেরেই ফেলেছে কে জানে।
৭২
১১ মে মঙ্গলবার ১৯৭১
রাত ১০টা
আজ গজারিয়ায় দানব দল হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে বলে খবর পাওয়া গেল। শহরে চোরাইভাবে অবাঙালীদের দিয়ে গুপ্তহত্যা চালানাে হচ্ছে। সমস্ত সভ্য দেশ এখন পর্যন্ত শুধু ভাষণ দিয়েই যাচ্ছেন। কোসিগিনের চিঠির কোনাে জওয়াবই পাকিস্তানি প্রধান এখনও দেননি।
চিনি পাওয়া যাচ্ছে না। সরষের তেল নেই। কেরােসিন অগ্নিমূল্য। রাস্তায় বের হওয়া যায় না। এ কি স্বাভাবিক শহর!
১২ মে বুধবার ১৯৭১
রাত ৯টা
আজ মিরপুরের অদূরে আমিন নগরে গােলা চালিয়ে বহু লােক মেরে ধানক্ষেত পুড়িয়ে দিয়ে জালিমরা আরও গ্রামে গ্রামে হানা দিয়েছে। কাকে মারছে ওরা। নিজেরা এক অক্ষর কলমা দরুদ জানে না। মদে-মাৎসর্যে বিভাের। তারা আবার বাঙালিদের কাফের বলে হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে।
মামুনের কোনাে খবর কেউ দিতে পারছে না। শােভার হার্টফেল করে মৃত্যু সংবাদটি কি বড় বেদনাদায়ক। আহা! বাচ্চা মানুষ, এই মৃত্যু তার ছিল।
১৩ মে বৃহস্পতিবার ১৯৭১
রাত ৯টা
আমার বাছা শােয়েব শহীদ হয়েছে আজ ৮ বছর পূর্ণ হল। আজ ঘরে ঘরে আমার মতাে অনেক বুক খালি করা মায়েরা আছে। আমার চোখের পানি তাে কবেই শুকিয়ে গেছে, ওদেরও চোখ-বুক আজ শুকনাে। সব মায়েদের বুকের ধনের বিনিময়েও কি আল্লাহ বাংলার সব অবশিষ্ট সন্তানদের জয়লাভ করতে
৭৩
দিবে না? নিশ্চয়ই দিবে। কোথায় শােয়েব? এই তাে আছে! বুকভরে আমার বাজান। আমার শােভন। আমার বাজান। তাের নিস্পাপ রক্তের বদলে বাংলার মাটি স্বাধীন হােক।
১৪ মে শুক্রবার ১৯৭১
রাত ৯টা
৭টা বােমারু প্লেন উড়ছে। এখনও মুন্সিগঞ্জে বরিশাল পটুয়াখালীতে পামররা গােলাগুলী চালাচ্ছে। সাংবাদিকদের দেখবার জন্য শহর ও শেখ সাহেবের বাড়ীর রূপ পাল্টাতে ওরা কত না চেষ্টা করল। কিন্তু কার চোখে ধুলা দেবে।
১৬ মে রবিবার ১৯৭১
রাত ১১টা
বৈশাখ শেষ হয়ে জ্যৈষ্ঠ এল। আজ ১লা জ্যৈষ্ঠ। ফুলে-ফলে ভরা সে বাংলাদেশ কি আর আছে।
১৭ মে সােমবার ১৯৭১
আশপাশের বাড়ীতে মৃত্যুর বিভীষিকা, সন্তানহারা জননী, স্বামীহীনা স্ত্রী, পিতৃহীন শিশুর মুখ দেখি। গ্রামে গ্রামে মরণলীলা। শহরের পথে সন্ত্রস্ত পথিকের নিঃশব্দ পদচারণা। তবুও হারামজাদারা স্বাভাবিক অবস্থাই বলে যাচ্ছে। শুনি নারীদেহ নিয়ে কামার্ত পশুরা ছিনিমিনি খেলছে। তরুণ তাজা কিশাের-যুবকের রক্ত শুষে নিচ্ছে। আল্লাহ আর কত শােনাবে, কত দেখাবে। এবারে শেষ কর প্রভু। আজ ইডেন বিল্ডিংয়ে, মতিঝিলে ২টি ব্যাংকে ও নিউ মার্কেটে টাইম বােমা ফেলে গেছে। কোনাে কাগজে খবর বের হবে না জানি।
৭৪
১৮ মে মঙ্গলবার ১৯৭১
রাত ১১টা
আজ সারা দিন পাগলের মতাে বােমারু প্লেন, হেলিকপ্টার উড়ছে অনেক। জাহেদের সাথে কথা হল। যার উপর যেভাবে অত্যাচার হয় তার সেইভাবেই ভােগান্তি। বাচ্চা দুটির খবর নেই। কাল রাত থেকে যা গরম পড়েছে, বােম্বিং করার সুবিধাও খুব, রকেট হাইজ্যাক করার খবরও কোথাও প্রকাশিত হয়নি। কিন্তু জানতে কারুর বাকী নেই।
১৯ মে বুধবার ১৯৭১
রাত ১১টা
কি করে যে দিনরাত কেটে যাচ্ছে, আল্লাহই জানেন। সােনার বাংলার সােনার ছেলেরা আর ক’টি রইল। চোখ বেঁধে মিলিটারীরা কোথায় নিয়ে যায়। ঘরে ঘরে মা বােন বধূদের এত আর্ত হাহাকার আল্লাহর কানে পৌছায় না, এই আশ্চর্য। আতঙ্কে মায়ের রাত-দিন কাটছে। মেয়েদের ইজ্জতের ভয়। প্রাণের ভয় কারুরই নেই। এ এক অসীম সংহতি। মীর জাফরের দলে যারা আছে, তারা নির্মূল হবে একদিন অন্য ভাবে। যেমন হয়েছিল মীর জাফর, মীরন। আজ ঢাকায় হাতবােমা পড়েছে ইডেন বিল্ডিং, মতিঝিলে ২টি ব্যাংকে, নিউ মার্কেটে। আরও কি হবে কে জানে। বােমারু প্লেন উড়ছে পাগলের মতাে। দারুণ গরম পড়েছে।
২০ মে বৃহস্পতিবার ১৯৭১
তিক্ত বিরক্ত মন! কিছু লিখতে ইচ্ছা করছে না। নিত্য মৃত্যুর খবর পাই। আশপাশে বাড়ী বাড়ী স্বামীহীনা সন্তানহীনাদের মুখ দেখি। অন্তরে বাহিরে দাবদগ্ধজালা। করুণা কর করুণাময়, আর কত!
৭৫
২১ মে শুক্রবার ১৯৭১
হাতবােমা ছোড়ার সন্দেহে কাগজী ভাষায় ১০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এবং আদর্শ শাস্তি দেওয়া হবে বলে ঘােষণা করা হয়েছে। মিথ্যাবাদীর দল কতজনকে যে ধরেছে মেরেছে ও মারবে তার ঠিক কি? আল্লাহ রহম করুন। আজ শাব্বীরের চিঠি পেলাম। ওরা যেন শান্তিতে থাকে।
২২ মে শনিবার ১৯৭১
রাত ১০টা
ব্যাপার কি, বােঝা গেল না। আজ সারা দিন ঢাকার আকাশে প্লেন উড়ল না। গত ২দিন ধরে ভীষণভাবে চেকিং হল, কলমা পড়িয়ে এমনকি উলঙ্গ করে মুসলমান কি না পরীক্ষা করা হয়েছে। গতকাল অনেক রাত অবধি মিলিটারী গাড়ি চলেছে, আজ সবই অস্বাভাবিকভাবে স্তব্ধ। শয়তান কোন জাল বুনছে, কে জানে! গরমও প্রচণ্ডভাবে পড়ছে। দিন দিন অত্যাচারও সীমাহীন। এদিক ওদিক থেকে গ্রামের যে অবস্থা শােনা যাচ্ছে, বুক ভেঙে যায়। আল্লাহ অসহায়ের সহায় হবেন না?
২৩ মে রবিবার ১৯৭১
কাল থেকে বােমারু প্লেন উড়ছে না। কিন্তু যা বীভৎস অমানুষিক কাণ্ড-কারখানার খবর পাওয়া যাচ্ছে তাতে সমস্ত শহর আতঙ্কিত। পাড়ায় পাড়ায় রাতে দিনে অনুসন্ধানের নাম করে যে অত্যাচার চলছে তার ইয়ত্তা নেই। আজ সকালে রেডিও থেকে সৈয়দ জিল্লুর রহমান, হেমায়েত ও অন্য একটি লােক এসেছিল গত সপ্তাহে ৫৫ জন ঢাকার শিল্পী-সাহিত্যিক যে দেশের নিরাপত্তা রক্ষা ও মৃত্যুর মিথ্যা প্রচারের তীব্র প্রতিবাদ করেছেন।
৭৬
তাদের সাথে নাম সই নিতে এসেছিল ওরা। দেইনি, আল্লাহ ভরসা। বেলা ১টায় মিলিটারী গাড়ি বাড়ীর দুয়ারে এসে থেমে আবার চলে গেছে। কানুর ছােট ছেলে খােকা ১৭ তারিখ সকাল থেকে আর বাড়ী ফিরেনি। সন্ধ্যায় খবর পেলাম, কপাল, আল্লাহ যেন বাঁচিয়ে রাখেন। একদিন ফিরবে।
২৪ মে সােমবার ১৯৭১
রাত ৮টা
১০ তারিখে মানিক বাড়ী গেল। আজ দুপুরে খবর এল মিলিটারীর গুলীতে সে শহীদ হয়েছে। আজ তার ঢাকায় ফিরে আসবার ছিল। আর সে আসবে না। বাড়ীর গাছ পাতা ফুল ফল মানিকের হাতের ছোঁয়ায় ভরে আছে। আল্লাহ তাকে শহীদ করেছেন, তার বিবি-বাচ্চাদের যেন জালেমদের হাত থেকে রক্ষা করেন।
দুপুরে ঝড়বৃষ্টি হয়ে গেল। বােমারু প্লেনও উড়ল। আল্লাহ কি এ আজাব। থেকে আজও মুক্তি দেবেন না।
২৫ মে মঙ্গলবার ১৯৭১
রাত ১০টা
মানিকের অভাব শুধু এখন নয় দিনে দিনে বেদনার্ত হয়ে দেখা দেবে। সারা বাড়ীতে তার চিহ্ন। তার আন্তরিকতার মায়াস্পর্শ। এমনই কত মানিক কত ঘর অন্ধকার করে আজ দস্যু কাফেরদের হাতে শহীদ হয়েছে তার সীমা নেই। ৩টি মেয়ে দুটি ছেলে, বড়টা কি করে যে দিন কাটাচ্ছে, কত শত্ৰু আগেও ছিল, এখন যে কি হচ্ছে ও হবে কে জানে। আবার কাল থেকে বােমারু বিমান খুব উড়ছে।
৭৭
২৬ মে বুধবার ১৯৭১
রাত ৯টা
বিকাল থেকে খুব বৃষ্টি হচ্ছে। খুব গরমের পর এ বৃষ্টি দুনিয়া ঠাণ্ডা করা। কিন্তু বুক আর কারুর ঠাণ্ডা হয় না তাে। কোথায় মায়ের বাছারা সুইসাইড স্কোয়াড বা বাংলা স্বাধীন করতে দলে দলে মরছে, আমরা কি করছি, কি করতে পারি? গত রাতে আদমজী নগরের বাজার পুড়িয়েছে। আজও বােমারু বিমান কোথায় হানা দিয়ে কি করে এসেছে এ খবর দেয়ার মতাে বুকে সাহস ও ঘৃণিত পশুদের নেই। এরা নাকি বীর, এরাই নাকি মুসলমান।
২৭ মে বৃহস্পতিবার ১৯৭১
রাত ৯টা
কোথাও আর অন্য কথা নেই। মা হারা বাপ হারা সন্তান হারা মাতা পিতার নিরুদ্ধ বেদনার্ত কাহিনী। কিন্তু তার মধ্যেও সুগভীর বিশ্বাসে কি অপরিসীম ধৈর্যে প্রতীক্ষা। আল্লাহ সুদিন দেবেন। সকলের মিলিত প্রার্থনায় আল্লাহ দেশের ভালাে নিশ্চয়ই করবে। ৮টার সময় বােমার শব্দ হল। আজ নারায়ণগঞ্জের রাস্তায় একটি দেহ পড়ে থাকতে দেখা গেছে। আহা! কোন মায়ের বাছা।
৭৮
জুন, ১৯৭১
১৪ জুন সােমবার ১৯৭১
রাত ১১টা
আজ বড় একটি স্মরণীয় রাত আমার। ওরা মামাবাড়ী গেল। আল্লাহ যেন সহিসালামতে ইজ্জত বাঁচিয়ে রাখেন। মরার জন্য ভয় নেই। কত ঘর খালি হয়ে গেছে, সােনার সংসার ছাই হয়ে গেছে অসুরের হাতে। আল্লাহ ইজ্জত রেখে যেন ওদের মৃত্যু দেন। ছােটদের চিঠি পাচ্ছি না। চাটগাঁয়ের খবর, সিলেটের খবর কিছুই জানি না। এ কোথায় বাস করছি। ২টা হেলিকপ্টার উড়ল। বােমারু প্লেন উড়ছেই। কোথায় নাকি প্লেন পড়েছে—কি জানি। একই তিক্ততার কথা আর লিখতে ইচ্ছা করে না। লুলু টুলু মুক্তিযুদ্ধে গেল আগরতলা হাসপাতালে।
১৫ জুন মঙ্গলবার ১৯৭১
রাত ৯টা
সন্ধ্যা ৭টায় যেন বুকটা হালকা হয়ে গেল। আল্লাহর কাছে শােকর। খবর যা পেলাম ভালাে। আরও আনন্দ বােধ করলাম আলভীকে দেখে। আজও সারা দিন বােমারু প্লেন-এর শব্দে শুতে পর্যন্ত পারলাম না। কোথায় যে কি হচ্ছে বােঝা যায়নি। আশা করে আছি আল্লাহ সব ভালাে করবেন। কি দীর্ঘ নিঃসঙ্গ দিন। বেঁচে থাকুক দেশের ছেলেমেয়েরা। আবার বাংলা ভরে উঠবে। গরম খুব পড়েছে। খবর পাওয়া গেল, ইকবাল ও তার ভাইকে ধরে নিয়ে গেছে। কি মর্মান্তিক।
১৬ জুন বুধবার ১৯৭১
রাত ১১টা
আজ ১লা আষাঢ়। আমার জন্মমাস। দিনটি গেল রােদে বৃষ্টিতে আলাে ছায়ায়। সন্ধ্যাটি গােধূলি রঙিন। আষাঢ়ের কান্নাভরা সুর জীবনব্যাপী আমার
৮১
তাে রইলই। যদিও দেশের দশের ভালাে খবরটুকু পেতাম, আজ কত ভালাে লাগত। কোথায় আমি। কোথায় মেয়ে তিনটি। বয়সের সাথে সাথে সবাই চায় শান্তি, স্বাচ্ছন্দ্য, আরাম, ছেলে মেয়ে বৌ জামাই নাতি পুতি নিয়ে সুখের সংসার। আমি কি চাইনি তা? এখনও যে চলছে সংগ্রামী জীবন। তবু ক্ষোভ করব না। বাছাদের আমার ভালাে হােক। ডেমরার ফেরী বন্ধ, কোথায় কি হচ্ছে কোনাে খবরই নেই। লুলু বিলকিস বানুর চিঠি এলাে লন্ডন থেকে। কিন্তু আমেরিকার চিঠি নেই।
১৭ জুন বৃহস্পতিবার ১৯৭১
রাত ১১টা
আজ ছােটনের চিঠি পেলাম। ও মাস্টার ডিগ্রী পেয়ে গেছে, এম. এসি। পরম দুঃখের দিনে এটাই চরম সান্ত্বনা। আল্লাহর কাছে শােকর। আবার আমেরিকায় পাকিস্তান এমব্যাসিতে টেলিভিশনে আমার ছবি দেখিয়ে বলা হয়েছে সুফিয়া কামাল অল রাইট। আহা, কি দরদ! আমি বেঁচে আছি, ওরা বাঁচিয়ে রেখেছে আর কি। মারি ঝাড়ু! জিকির ছেলেটা, ইকবাল বাবুর খবর নেই, ছায়ানট-এর ইকবালকে পরশু ধরে নিয়ে গেছে। কি যে ব্যথা মনে। ওগাে অকরুণ! এখনও তােমার রহমত নাজেল করবে না? কি রহমান তুমি, মানুষের বুক যে ভেঙ্গে যাচ্ছে, থামাও এবার তােমার রােষ।
১৮ জুন শুক্রবার ১৯৭১
রাত ৯টা
অসহ্য গরম। ভিতরে বাইরে এ কি দহন জ্বলায় সারা দিন-রাত কাটছে। আমার গানের পাখীরা এখন কোথায় কি করছে। যার হাতে সঁপেছি তারই দৃষ্টিতলে ওরা মঙ্গলে কুশলে থাকুক। নানা দিক থেকে নানা উড়াে খবর পাচ্ছি। আল্লাহ জানেন কবে শান্ত শান্তি কল্যাণের বার্তা আসবে।
৮২
১৯ জুন শনিবার ১৯৭১
রাত ১১টা
সকাল থেকে জঙ্গী প্লেনগুলাে খুব উড়েছে, ২টা পর্যন্ত পাগলের মতাে ঘুরে বেড়িয়েছে। তারপর সন্ধ্যা ৭টায় প্লেনের শব্দও শােনা যায়নি। কি হল বুঝতে পারা গেল না। ট্যাঙ্ক ও সাঁজোয়া গাড়ী খুব গেছে ময়মনসিংহ-এর দিকে। কোথায় কি হচ্ছে আল্লাহ জানেন। অসহ্য গরম। সারা দিন কাটে, এ রকম সন্ধ্যায় পাখী দুটির জন্য মন বড় কেমন করে। আল্লাহর হাতে সঁপেছি, মন কেমন করে কেন যে বুঝতে পারি না।
২০ জুন রবিবার ১৯৭১
বেলা পৌনে ১টায় কওসর এল সিলেট থেকে। নাকে-মুখে চারটি খেয়ে চলে গেল, দেড়টায় দাদীকে নিয়ে জুনেদের সাথে এয়ারপাের্টে যাবে। আড়াইটার ওদের প্লেন, চাটগাঁ যাবে। আল্লাহ মায়ের কোলে নিয়ে ভালােয় পৌছে দেন। জঙ্গী প্লেন আজ ৮টা থেকে আবারও উড়ল, কিন্তু কম। আলুর ফোন পেলাম, ওরা ঢাকায়ই আছে। আমার পাখীরা যেন আল্লাহর রহমতের ছায়ায় ভালাে থাকে।
২১ জুন সােমবার ১৯৭১
রাত ১১টা
আখাউড়া টাংগাইল থেকে খবর আসছে, সেখানে প্রচণ্ড লড়াই চলছে। মানুষের আনাগােনা ঢাকা শহরে বেড়ে গেছে, লােকের মুখে মুখে কত কথা কত গুজব ছড়াচ্ছে। আবার যা রটে তা অর্ধেক তাে বটে বলে নিছক উড়িয়ে দেওয়া যায় না। জঙ্গী প্লেনগুলাে পাগলের মতাে উড়ছে। মিসেস সেলিমা আহমদ মােশফেকাকে মামুনের মৃত্যু সংবাদ দিয়েছেন, কিন্তু সে তা বিশ্বাস করছে না, কোন পাগলা পীর নাকি বলছেন মামুন বেঁচে আছে, আর বৌটা তাই বিশ্বাস করছে, হায়রে আশা! আল্লাহ করে যেন এ আশা সফল হয়।
৮৩
শামীম রাতের ডিউটিতে অফিস গেল। মনটা ভালাে লাগছে না। আল্লাহ নেগাহবান থাকুন।
২২ জুন মঙ্গলবার ১৯৭১
রাত সাড়ে ৮টা
এইমাত্র একটি কামানের শব্দ শােনা গেল। কোন দিক, তা বােঝা গেল না। সিলেট এয়ারপাের্টে প্লেন নামতে পারেনি। সন্ধ্যা পর্যন্ত জঙ্গী বিমান উড়েছে। কওসর চাটগাঁ থেকে কোনাে খবর দিল না। মেয়ে দুটির কোনাে খবর নেই। আল্লাহ ভরসা। ভালাে আছে আশা করছি। কাফেরদের হাতের ছোঁয়া যে ওদের গায়ে লাগবে না, এও পরম নিশ্চিন্ততা। আজ ঝুনুরা এল। আমার পাখীরাও একদিন ফিরে আসবে আশা করছি। আলভীর ফোন আজ আর পাইনি।
২৩ জুন বুধবার ১৯৭১
রাত ৯টা মেঘলা আষাঢ়ের আকাশ। বর্ষণ নেই, বিষন্ন ম্লান। আজ পারভিনরা এসেছিল। কতদিন পর যে ওদের দেখলাম। বাচ্চাদের খবরও আজ পেলাম, ওরা ভালাে আছে। সেবাব্রত, মেয়েদের শ্রেষ্ঠ ব্রত। ওরা জয়যুক্ত হােক। জয়যুক্ত হােক আমার সূর্যসন্তানরা। জঙ্গী বিমানের হামলা যে কোথায় চলছে। দিনভর উড়ছে, মারছে, মরছেও তাে। কবে এর শেষ হবে। আল্লাহ রহমানুর রহিম এবার শেষ কর এ কুফরি জুলমাত।
২৪ জুন বৃহস্পতিবার ১৯৭১
রাত সাড়ে ৮টা
আল্লাহর রহমতেরও তাে অন্ত নেই, তাই আজ সাড়ে ৭টায় উনি অফিস গেলেন, আর সাড়ে ৯টায় টংগি থেকে আবু তৈয়ব সাহেব ফোন করে বল্লেন,
৮৪
ফার্মগেটের মিলিটারী গাড়ির সাথে একসিডেন্ট হয়েছে, হাসপাতালে ফোন করতে। একসিডেন্ট, আবার মিলিটারী গাড়ি, বুক যে কি করে উঠল। কিন্তু পরক্ষণেই প্রশান্তি বােধ করলাম। বেশী কিছু হয়নি। এমারজেন্সীতে আধ ঘণ্টা ফোন করেও কোনাে খবর না পেয়ে শামীম বের হচ্ছিল। উনি এসে গেলেন। খুবই সামান্য এ দুর্ঘটনা। আল্লাহর কাছে শােকর। কাল রাত থেকে বৃষ্টি হচ্ছে। কোথাও থেকে কেউ এলও না, কোনাে খবরও কারুর নেই। আল্লাহ যেন যে যেখানে আছে, সহি সালামতে রাখেন।
২৫ জুন শুক্রবার ১৯৭১
রাত ১০টা
কাল থেকে বৃষ্টি হচ্ছে। আজ ২৫শে জুন। তিন মাস হল জুলুম চলছে। এতক্ষণেও ঢাকায় কি হবে কেউ জানত না। অতর্কিত হামলা শুরু হয়েছিল। রাত ১টা বাজতে ৫ মিনিট থাকতে। কি ভয়ানক, কি জঘন্য, কি নৃশংস সে আক্রমণ। দিনের পর দিন রাতের পর রাত তাে কাটল। এখনও পাশব শক্তির অবসান হল না। আজ মন বড় অস্থির। কারুর কোনাে খবর নেই। কোথায় কোন মায়ের বাছারা আজও আছে না নেই তাই বা কে জানে। যে যেখানে আছে আল্লাহ যেন হেফাজত করেন।
২৬ জুন শনিবার ১৯৭১
রাত ৯টা
গতকাল গেল ১০ই আষাঢ়, আমার জন্মদিন, তাই বুঝি অঝাের ধারা ঝরছে। আজও। কিন্তু জন্মদিনটি ছিল আমার নওয়াব বাড়ীর ‘পুণ্যাহ উৎসবের দিনে। সােমবার বেলা ৩টায় আমার জন্ম। ১৯১১-আর আজ ১৯৭১-কি দীর্ঘ দিন, দুঃসহ আর কতকাল এ অভিশপ্ত জীবন বয়ে বেড়াব। শুধু অভিশপ্তই তাে নয়। কত যে সম্পদও পেলাম। কিন্তু যা চাইলাম তা পেলাম কই। যা আশা করিনি, তা তাে আল্লাহ প্রচুর দিলেন। আজ এ অনিশ্চিত জীবন, কোথায় নিশ্চিত সংসার। কোথায় আমার দেশের সন্তান, কোথায় শান্তি।
৮৫
দলে দলে সবাই অজ্ঞাতবাসে কি করে দিন কাটাচ্ছে আল্লাহই জানেন। আজ কদিন কারুর খবর নেই। সারা দিন বােমারু বিমান কোথায় আগুন জ্বালিয়ে আসছে, আতঙ্কিত ঘৃণায় ভরা এ দিন।
২৭ জুন রবিবার ১৯৭১
রাত ১০টা
আল্লাহর কাছে হাজার শােকর। আজ অনেক খবর পেলাম। জন্মদিনের উপহারও পেলাম। জীবনে এই প্রথম জন্মদিনের উপহার। যারা দিল তারা যেন জীবনে শান্তি পায়। ওরা যেন দীর্ঘায়ু ও জয়যুক্ত হয়। বৃষ্টির বিরাম নেই। আজ মিঃ নভিকভ ও মিসেস নভিকভ এসেছিলেন, আমাকে মস্কো যাবার দাওয়াত দিলেন। এখন আমি এ দেশ ছেড়ে বেহেশতেও যেতে রাজি নই। আমার দেশ আমার দেশের মানুষেরা শান্তি পাক, সােয়াস্তি লাভ করুক—এ দেখে যেন আমি এই মাটিতেই শুয়ে থাকতে পারি।
এত রাতেও প্লেন উড়ছে। শয়তানের পাখা ঝাপটাচ্ছে—দেখা যাক কত কাল এ ঝাপটানি চলে।
২৮ জুন সােমবার ১৯৭১
রাত ৯টা
প্রেসিডেন্টের ভাষণ হবে, ভাষণ হবে বলে কদিন থেকে উৎকণ্ঠিত থাকার পর ৫৫ মিনিটের যে ভাষণ শােনা গেল—তাতে না আছে আশা না আছে আশ্বাস, না হরিষ না বিষাদ। এ কোন অবস্থায় পাকিস্তান’ চলছে। লজ্জা এবং গ্লানিকর এই অবস্থার অবসান কবে কি করে কেমন হবে আল্লাহ জানেন। সন্ধ্যায় খুব বৃষ্টি গেল। মনটা ভালাে নেই। আল্লাহ সবার ভালাে করুন।
৮৬
জুলাই, ১৯৭১
১ জুলাই বৃহস্পতিবার ১৯৭১
রাত ১০টা
দিনে দিনে এ মাসও এসে গেল। দুর্বিষহ দিনরাত কেটে যাচ্ছে। কি করে যে কাটায়, সেই অকরুণই শুধু সে খবর জানে, আর কেউ জানে না। হত্যার শেষ নেই, নারীর লাঞ্ছনার সীমা নেই। জুলুম ধর-পাকড় অব্যাহত। দেশের মানুষ পরাশ্রয়ী, তবু এর কোনাে সুরাহা করছে না শাসকদল। ইসলাম, মুসলমানের নাম শুনে আজ সবাই ঠাট্টা করে, ঘৃণাও করে, কি পরিতাপ। লিখতেও ইচ্ছা করে না। গ্রাম থেকে নিত্যনতুন অত্যাচারের খবর আসছে। বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল সব খালি।
২ জুলাই শুক্রবার ১৯৭১
রাত ১১টা
১০টায় আজ অনেক দিন পর দুলুমণিদের খবর পেলাম। ওরা ভালাে আছে। কওসরটার শরীর সুস্থ আছে জেনে আল্লাহর কাছে শােকর। ওর জন্য আমার বড় ভাবনা। লুলু টুলুদের চাটগাঁ পাঠাতে বলছে। কি করে যাবে। আল্লাহ সবাইকে যে যেখানে আছে সহিসালামতে রাখুন। সবাইকে এক সাথে দেখব বলে আশা করে আছি। ইনশাআল্লাহ দেখা হবে। ওগাে নিষ্ঠুর দরদী, আর কত দুঃখ দিবে? ঘুচাও তােমার রুদ্ররূপ। দেশকে, তােমার সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। মানুষকে বাঁচাও। রহম কর রহমান। তােমার নামের সার্থকতা বজায় রাখ। আবার সানন্দা হই।
৩ জুলাই শনিবার ১৯৭১
রাত ১০টা কাছে ধারে একটা বােম-এর শব্দ হল। সাথে সাথে ৯টা বাজল। বুড়ি এসেছিল শুনলাম। ওদিকে বেইলি রােড সিদ্ধেশ্বরীতে আলাে নেই। আমরা
৮৯
কাল রাত ১টা থেকে আলাে পাইনি, পানি ছিল না। সন্ধ্যায়ও খুব জোর আলাে এল না। কি জানি কোথায় কি হচ্ছে। ছেলে-মেয়েগুলােরও কোনাে খবর নেই। কেউ আসেও না। থমথমে রাত দিন কাটছে। বরিশালের ওদিকে বােমারু বিমান বােমা ফেলে শেষ করছে। বাঙালী উচ্চপদস্থ নিমপদস্থদের চাকরি যাচ্ছে তাে যাচ্ছেই।
৪ জুলাই রবিবার ১৯৭১
রাত ১০টা
আজও ৮টার সময় একটা বােম-এর আওয়াজ হল। বৃষ্টিও হয়ে গেল। এতদিনে একটু বাইরে গেলাম। বুড়ির বাড়ীতে মিলাদ। এই লেকের ওপাড়ে, কতবার সে পথে হেঁটে কত জায়গায় গিয়েছি। কদিন থেকে কারুর খবর নেই, মনটা কেমন করছে। ওর পা-টার ঘাও সারছে না।
সারা দিন কাজ করি, তবুও সময় কাটে না।
৫ জুলাই সােমবার ১৯৭১
রাত ৮টা
শামীম আজও রাতে অফিসে গেল। আল্লাহ নেগাহবান। আজ এতদিন পর কামরুন্নাহার লায়লী এল, কত কথাই না শুনলাম। রােকসানার ব্যাপারে বৌমা ঠিকই বলত। আজও কোনাে খবর কারুর নেই। জাকিয়াও আসে না। ফোনও করছে না। কাল সারা রাত ঘুম হয়নি। মেঘলা বর্ষণহীন বিষন্ন দিন, কাজ করে করেও দিন কাটে না। যে যেখানে আছে আল্লাহ তুমি হেফাজতে রেখাে।
৯০
৬ জুলাই মঙ্গলবার ১৯৭১
রাত ১০টা
অনেক দিন পর জাকু এল। ভালাে লাগছে না। সব শহর নাকি লােকে গিজগিজ করছে। কিন্তু ধানমণ্ডি গােরস্থান হয়ে গেছে। আজও শামীম রাতে অফিসে থাকবে। আল্লাহ নেগাহবান। কি কি যে গুজব রটছে। সারা দিন তাে বােমারু বিমান উড়ছে। অথচ কালিয়াকৈর-এর পুল উড়ছে। সিঙ্গারবিল বা ময়মনসিংহ-এর পথ বন্ধ। মাইনু তাে চাটগাঁ থেকে প্লেনে এল। ফোন করা মাত্রই কেটে গেল। আজ বৌমা আসেনি। শাব্বীরের ২টি চিঠি এক সাথে পেলাম। ওরা ভালাে আছে। হাজার শােকর।
৭ জুলাই বুধবার ১৯৭১
রাত ১০টা
সােয়া ৮টায় বােম-এর শব্দ হল। খুব কাছে মনে হল। মাইনু এসে চলে গেল। কাল ৭টা সকালের প্লেনে ইসলামাবাদ যাচ্ছে। আল্লাহ হেফাজতে রাখুন।
৮ জুলাই বৃহস্পতিবার ১৯৭১
রাত ৯টা
আজ আষাঢ় পূর্ণিমা, কদম ফোটার রাত। আমাদের বাগানে কদম গাছ নেই। অন্য সব ফুল ফুটেছে, মানিকের হাতের লাগানাে সব গাছ, মানিক মিলিটারীর গুলীতে আজ দুনিয়া ছেড়ে যেখানে আছে, সেখান থেকে কি দেখছে?—জ্যোত্সার প্লাবন নেমেছে, সাড়ে ৮টায় বােমার শব্দ হল, কাছেই মনে হল। কাল ৮টার বােমা নাকি সাংহাই রেস্তরায় পড়েছে। রাতে আরও ২ বার শব্দ শােনা গেছে। আজ সকাল সাড়ে ১০টায় শব্দ শুনলাম, সেটা নাকি
৯১
লালমাটিয়ায় মাহমুদ আলীর বাড়ীতে পড়েছে। রাজশাহীতে খুব নাকি সামনাসামনি লড়াই চলছে, আল্লাহ জানেন কি হবে। সব মানুষের সুবুদ্ধি । হােক, দুনিয়ার ভালাে হােক। রাত সাড়ে ১০টায় আবার বােম-এর শব্দ হল।
৯ জুলাই শুক্রবার ১৯৭১
রাত ১০টা
আজ সারা দিনে কেউ এল না। কারুর কোনাে খবর পেলাম না। মনটা যে কি অশান্ত হয়ে ওঠে। বার বার আল্লাহর কাছে নিবেদন করি, আবেদন জানাই, তবুও মানুষের মন তাে। অশান্ত অধীর হয়। আল্লাহ সবার ভালাে করুন, সকলের নেগাহবান থাকুক। দেশের ভালাে হােক।
১০ জুলাই শনিবার ১৯৭১
রাত পৌনে ৯টা
এইমাত্র একটা বােমার শব্দ হল। সারা দিন পাগলের মতাে বােমারু প্লেন উড়েছে। গরমও অসহ্য, মন-মেজাজ কিছুই ভালাে নয়। কোনাে খবরও কারুর কোথাও থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। এতদিনেও কি আল্লাহ মানুষকে শুভবুদ্ধি দিতে পারছেন না। দেশের মানুষই যদি না রইল, তবে কাকে নিয়ে দেশ।
১১ জুলাই রবিবার ১৯৭১
রাত ৯-২২ মি.
এই মাত্র একটা বােম-এর শব্দ হল, আজ স্বপন এসেছিল। আহা! কি করুণ মূর্তিই না দেখলাম। কান্না নেই হাসিও নেই, দৃঢ় কঠোর মুখ, বুঝি অন্তরও,
৯২
কৈশাের ছেড়ে মাত্র যৌবন শুরু। এখনই ওকে সাথীহারা স্বামীহারা আল্লাহ কি করলে। এ কি তার মঙ্গললীলা বুঝি না। আবার আজকেই রুচির ছেলের বৌভাত খেয়ে এলাম। সুন্দর বৌটি হয়েছে, আল্লাহ মােবারক করুন। ওরা পরিবারটি শান্তিতে জীবন যাপন করুক। এই দোয়া করি। কেউ আসে না। কারুর কোনাে খবর নেই। আল্লাহ নেগাহবান। ১০-২৫ শে আবার একটা বােম-এর শব্দ হল।
১৩ জুলাই মঙ্গলবার ১৯৭১
রাত ১০টা।
১ মাস হবে পরশু, আমার পাখীরা নীড়ভ্রষ্ট, কদিন থেকে মন এত অস্থির। ওদের কারুর অসুখ করল নাকি তাই ভাবছি। চারটি প্রাণ দূরে আছে। আল্লাহ নেগাহবান থাকুন। কাল রাতে ১০টায় একটা ও অনেক রাতেও ১টা বােম-এর শব্দ পেলাম। আজ সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত পাগলের মতাে বােমারু প্লেনগুলাে উড়েছে। শামীম রাতের অফিস করছে। সন্ধ্যায় দুলুদের ফোন পেলাম। তবুও অনেক আশা ও সান্তনা ওরা ভালাে আছে। কাল সন্ধ্যায়। বাচ্চু এসেছে।
১৪ জুলাই বুধবার ১৯৭১
রাত ১০টা
আল্লাহর কাছে শােকর। আজ অনেক দিন পর জাকু এল। খবর ভালােই সবার। এখন আল্লাহ দেশের দশের ভালাে করুন। সুমতি সুবুদ্ধি দেন অমানুষগুলােকে, মানুষ হােক সবাই। কালও ২/৩ বার বােম-এর শব্দ হয়েছে, আজ এ পর্যন্ত কিছু হল না। সকাল থেকে বােম্বারগুলাে উড়েছে। প্রচণ্ড গরমে সবাই কাতর, আর বাছারা। যারা মাঠে ময়দানের পথে-প্রান্তরে যুঝছে, মরছে, তারা কি করছে।
৯৩
১৫ জুলাই বৃহস্পতিবার ১৯৭১
রাত ১০টা
বাংলাদেশে পরীক্ষা শুরু হয়েছে, কে যে কি পরীক্ষা দিচ্ছে আল্লাহ জানে। ঘর ছাড়া মা বাপ ছাড়া মরা আধমরারা পরীক্ষা দিচ্ছে। এও এক প্রহসন। আজ ১৫ তারিখে ঠিক এমনই সময়ে ওরা ঘর ছেড়ে গেল। সমুদ্রে কত তরঙ্গ। নদীতে কত স্রোত। বৃষ্টির কত ধারা। মায়ের বুকের কত ব্যথা। আল্লাহ নেগাহবান। বৃষ্টি প্রচুর হল না। ঝড় ঝড় ভাব। গরমটা কমেছে। কোথায় কোথায় যে বােম পড়েছে। বাচ্চু আজ সকালে রওয়ানা হয়ে গেল। নিশ্চয় ভালােমতাে পৌঁছে গেছে।
১৬ জুলাই শুক্রবার ১৯৭১
রাত ১০টা
কাল থেকে বৃষ্টি খুব হচ্ছে। আজ বাইজু এসেছিল। ওর দিকে চাইতে পারি না। বেচারী সাইদ। এত ভালাে লােকটি ছিল। কি পশুর দল দানব দল অসুর দল দেশে এসেছে। ঘর, বুক খালি করে দিল। সব ঘরে হাহাকার। আতঙ্ক। রাজরাণী পথের ভিখারিণী হয়েছে। ভিখারিণী ভিক্ষা পাচ্ছে না। আরও যে আল্লাহ কত দেখাবে। এ বারে শেষ কর। রহিম রহমান। অবসান হােক তােমার রুদ্র রূপের।
১৭ জুলাই শনিবার ১৯৭১
আজ মানিকের চিঠি পেলাম। এতদিন ওরা বেঁচে আছে আল্লাহর কাছে শােকর। আহমদ আলীও এসে দেখা করে গেল। আজ ফোন এল, বলল লুলুর বন্ধু ওরা ভালাে আছে। কে কোথা থেকে কি বলে বুঝতেও পারি না।
৯৪
যে যেখানে আছে আল্লাহ নেগাহবান থাকুন। বৃষ্টি হয়ে গেল। গরম পড়ছে। আজ যেন ঢাকা শহর থমথমে, কি জানি কোথায় কি হচ্ছে।
১৮ জুলাই রবিবার ১৯৭১
আজ ১লা শ্রাবণ। কেতকী-গন্ধা শ্রাবণ আজ নয়, শােণিত-গন্ধা শ্রাবণ আমার শত সন্তান-শহীদ-শােণিত-গন্ধা শ্রাবণ। তবু শ্রাবণ এল। আমার বাগানভরে দোলনচাপা উঁই চামেলী লিলি কামিনী রজনীগন্ধা ফুটে আছে। শ্রাবণ এল। কেতকী কোন কুঞ্জে জানি ফুটেছে। ধানমণ্ডিতে কেতকী নেই। রােদ-বৃষ্টির আলােছায়ায় দিন-রাতটি আজ। এই সাড়ে আটটায় একটা বােমা পড়ল জানি কোথায়। কাল ও আজ বােমারু বিমানগুলাে উড়ছে না। কোথায় আছে আমার পাখীরা। কি করছে, আল্লাহ নেগাহবান থাকুন।
২০ জুলাই মঙ্গলবার ১৯৭১
রাত ৯টা
কাল থেকে দিনে-রাতে কতবার যে বােমার শব্দ হল। চামেলীবাগ হাতীরপুল, ধানমণ্ডি স্কুলে গত রাতে বােমা পড়েছে। আজ বােমারু বিমান উড়েনি। রােদ বৃষ্টি আলাে ছায়ায় দিন কাটছে। ক্ষণে ক্ষণে আলাে পানি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কাল থেকে এই বােমা পড়ার দরুন তেজগাঁ টঙ্গি কোথাও ইলেকট্রিসিটি নেই। ঢাকার অনেক জায়গায় বিদ্যুৎ ও পানি বন্ধ। শাব্বীরের চিঠি নেই, কারুর কোনাে খবর নেই, ফোন করছে না কেউ। বৌমাও আসেনি, ফোন করেনি।
২২ জুলাই বৃহস্পতিবার ১৯৭১
রাত ১১টা
সাড়ে ১০টায় বােমার শব্দ হল। আজ সূর্যগ্রহণ ছিল, পাক-ভারতে অদৃশ্য। বৃষ্টিও খুব ছিল সারা দিন। আজ ক’দিন ধরে শ্রাবণ ধারা ঝরছে, বাংলাদেশের
৯৫
চোখের জল। শাব্বীরের চিঠি আজও এল না। আমি চিঠি দিলাম। আর কারুরই কোনাে খবর নেই, জাকিয়াও আসেনি। ফোনও করেনি। কালা আলু ২টি বাচ্চা দিয়েছে, আজ সে যাকে খুঁজছে, তা আমি বুঝতে পারছি, আল্লাহই একদিন আবার অবলা পশুর আদরের ধনকে পৌঁছে দেবেন ওদের কাছে।
২৪ জুলাই শনিবার ১৯৭১
রাত ১০টা
আজ শামীমের জন্মদিন। ওরে আমার বাছা। আল্লাহ সুপথে সৎ স্বভাবে সুষম রুজিতে হায়াতে বরকত দিয়ে যেন মানুষের মতাে বাঁচিয়ে রাখেন। মনটা ভালাে নেই, কাল রাত থেকে যাত্রাবাড়ীতে মুক্তিবাহিনী-পাকসেনায় প্রচণ্ড লড়াই চলেছে। আজ দুপুর পর্যন্ত নিরীহ গ্রামবাসীদের উপর গােলাগুলি চলেছে। বােমারুগুলাে সারা দিন উড়েছে। রাতে দুলুর ফোন পেয়ে জানলাম। বুলুর শেষ অবস্থা। রক্তবমি হচ্ছে। আজ দুপুরে স্বপ্নটা দেখে অবধি মন খুব। অস্থির ছিল। তবুও বলি আল্লাহ যত শিগগির ওকে কষ্ট থেকে মুক্তি দেন। ফোনে কথা বলাও গেল না। ডেড হয়ে গেল। আজ রাত বুলুর কি করে কাটবে, আল্লাহ জানেন। যেন শান্তিতে মরে।
২৫ জুলাই রবিবার ১৯৭১
রাত ১০টা
৮-৪৫-এ বােমা পড়ার শব্দ হল যাত্রাবাড়ীর পথে। কাল থেকে কারফিউ। আজ শিরিনের বিয়েতে গেলাম। কত মানুষের ভালােবাসাভরা সাদর সঙ্গ লাভ করলাম। আরও লাভ করলাম দেশের প্রতি সবার কি ভালােবাসা। আর দুঃখের খবর। চিঙ্কু ও খসরুর কথা যা শুনলাম, তা যদি সত্যি হয়ে থাকে, সে বড় মর্মান্তিক। আল্লাহ জানেন, ওদের ভাগ্যে কি হয়েছে। আজ আর বুলুর খবর কিছু পেলাম না। ছােটনের চিঠিও না।
৯৬
২৭ জুলাই মঙ্গলবার ১৯৭১
রাত ১০টা
কারুর কোনাে খবর নেই। ছােটনের চিঠি নেই। কেউ আসছেও না। এই তাে সাড়ে ৭টায়ও এক সাথে ৪টা বােম-এর শব্দ পাওয়া গেল। কাল থেকে বাজার শহর ঢাকা থেকে সব দলে দলে চলে যাচ্ছে, কে কোথায় যাচ্ছে কে কোথায় আছে, কিছুই জানা যাচ্ছে না। বরিশাল ফরিদপুরে অমানুষরা তাদের বীভৎস কাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। আল্লাহ আর কত এ নিষ্ঠুর লীলা চলাবেন। আজ বাবু এসেছিল। বৌমা আসেনি।
২৮ জুলাই বুধবার ১৯৭১
রাত ১০টা
আজ ২২ দিন ছােটনদের কোনাে খবর নেই। কাল রাতে ৫টা বােমের শব্দ শােনা গেছে। আজ সারা দিন পাগলের মতাে বােমারু বিমানগুলাে উড়েছে। ঢাকায় নাকি মুক্তিফৌজ-এর পােস্টার লিফলেট ছড়িয়ে বলা হয়েছে ঢাকা ছাড়তে। অবস্থা দিন দিন শ্বাসরুদ্ধকর হয়ে উঠছে।
আজ দুপুরে অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখলাম। কে একজন আমার গােসল করা ভিজা কাপড় দেখবার জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর আমি প্রাণপণে শরমে লুকিয়ে বেড়াচ্ছি। আজ সকালে খবর পেলাম কাল রাত ১০টায় হাসপাতালে হাসিনার একটি ছেলে হয়েছে। আল্লাহ হায়াত দেন। বাচ্চা হবার সময়ও মা কাছে থাকবার অনুমতি পেল না। অমানুষরা মানুষ হবে কি?
৯৭
২৯ জুলাই বৃহস্পতিবার ১৯৭১
রাত ৯টা
ছােটনের চিঠি আজও নেই। জাকু এসেছিল, তবুও কিছু সান্ত্বনা। কোনাে খবরই কারুর নেই, আল্লাহ নেগাহবান থাকুন। কাল নাকি কমলাপুর রেল স্টেশনে বােমা পড়েছে, ঠিক জানি না। আজ একটু আগে একটা শব্দ হলাে। কোথায় কি জানি। বােমারু খুব উড়ছে। দলে দলে লােক চলে যাচ্ছে। সব জিনিসের দাম বাড়ছে। জামাল এসেছিল। আল্লাহ সবাইকে ভালাে রাখুন। সবার ভালাে হােক।
৩০ জুলাই শুক্রবার ১৯৭১
রাত ৯টা
বিকালে বৌমা আমি হাসিনার ছেলে দেখতে হাসপাতালে গেলাম। কি ভীষণ দুর্ব্যবহার যে করল ওখানের মিলিটারীর পাহারাদারটা। হাসিনার মা মাত্র ১০ মিনিটের জন্য গতকাল ওদের দেখতে পেয়েছিলেন। আজ হতে কড়া নিয়ম চালু করা হল, কোনাে মানুষই আর ওদের দেখতে যেতে পারবে না। এ যে কি অমানুষিক ব্যবহার। জেলখানার কয়েদীও সাক্ষাতের জন্য সময় পায়। আল্লাহ আর কত যে দেখাবে। আজও ছােটনের চিঠি নেই, কারুর কোনাে খবর নেই। আল্লাহর হাতে সঁপে দিয়েছি, আল্লাহ নেগাহবান।
৯৮
৩১ জুলাই শনিবার ১৯৭১
রাত ১১টা
কে আছে সৌভাগ্যবতী আমার মতন
এক পুত্রহীনা হয়ে শত পুত্র ধন
লভেছি, সৌভাগ্য মাের। শতেক দুহিতা
সারা বাংলাদেশ হতে ডাকে মােরে মাতা
জননী আমার! তুমি করিয়াে না শােক
তুমি আছ পূর্ণ করি সর্বান্তর লােক।
এ সান্ত্বনা, এ সৌভাগ্য লভি কুণ্ঠা মানি
কতটুকু সাধ্য মাের, কি যােগ্যতা আমি নাহি জানি
পথে চলে যেতে শুধায় কুশল কত হাসিভরা মুখ
মাের পানে চায়, কি জানি আশায় ভরে ওঠে মাের বুক।
আমি ভালােবাসি এ দেশের মাটি, এদেশের মানুষেরে
পথে পথে ফিরি ভিক্ষা মেগেছি সব মানুষের তরে
ভিক্ষার ঝুলি ভরেছে ওরাই ওদেরি হাতের দানে
ওদেরই সভায় ঘুচাতে চেয়েছি ওরা তাও জানে।
অন্তর দিয়ে অনুভব করি ধুকে ধুকে এই বাচা
অত্যাচারীর ছুরিকার তলে দিল প্রাণ মাের বাছা
পথের ধুলায় লুটায়ে রহিল। এখনও দেশের মাটি
রক্তে নাহিয়া হয়ে ওঠে সােনা-হীরকের চেয়ে খাঁটি
আমার বাছার রক্তের সাথে কত সে মায়ের বাছা
বাঁচিয়া বাঁচায় বিপুল ভুবনে মাের সব সন্তানে
বক্ষ বহ্নি হাসির পুষ্পে ফুটাইব সযতনে
শতেক জনার মা ডাকায় মাের শান্তি লভুক মন
কে আছে সৌভাগ্যবতী আমার মতন!
৯৯
আগস্ট, ১৯৭১
২ আগস্ট সােমবার ১৯৭১
সন্ধ্যা ৭টা
আজ দুলুর জন্মদিন। স্বামী-সন্তান-সৌভাগ্যবতী হয়ে বেঁচে থাকুক এই আল্লাহর কাছে প্রার্থনা। জানি না কোনাে দিন দেখা হবে কি না। আজ মুন্নি এসেছিল, তার কাছে শুনলাম জোহরার বাড়ীতে সে শুনে এসেছে বৃহস্পতিবার ২৯শে বুলু এ দুনিয়া ছেড়ে গেছে। কান্না পেল না। একটা ব্যথার সাথে তৃপ্তি পেলাম। হতভাগিনীর সারা জীবন যন্ত্রণার অবসান হল। আল্লাহ বেহেশত নসীব করুন। স্বামী সৌভাগ্যে সৌভাগ্যবতী ক’টি নারী আছে। মেয়েরা চির অভিনেত্রী। তারা বুকে আগুন নিয়ে সংসারে শান্তির স্নিগ্ধ ধারা ঢালতেই জীবন শেষ করে। ব্যতিক্রমও আছে বই কি। বুলুর জীবন এতদিনে অন্ততঃ দগ্ধে মরার হাত থেকে নিষ্কৃতি পেল। আজও কারুর কোনাে খবর নেই।
৩ আগস্ট মঙ্গলবার ১৯৭১
কালকে শামীমের রাতের অফিস ছিল, গ্যানিস-এ বােমা পড়েছে। উপর তলায়ই তার পি.পি.আই-এর অফিস, আজও অফিসে গেল। আল্লাহ নেগাহবান। সারা রাত সারা দিন বৃষ্টির পর সুন্দর জ্যোৎস্না উঠেছে। কারুর কোনাে খবর নেই। বৌমা এসেছিলেন। খােকন চাটগাঁ থেকে এল। আহমদ, গিয়াস উদ্দীন, খােকন দেখা করে গেল। আমার বাছারা কত দূরে দেশে, একটু খবরও পাই না। ছােটন তাে ঠিক চিঠি দেয়ই, কিন্তু আমি পাই না। সারা ঢাকা উত্তেজিত। আজ ইয়াহিয়া খানের আসবার কথা। এল কিনা কে জানে।
৪ আগস্ট বুধবার ১৯৭১
আজ বৌমার মারফত ২৭শে জুলাইয়ের লেখা শাব্বীরের চিঠি পেলাম আর ওদেরও কিছু খবর পেলাম। এও আল্লাহর কাছে শােকর। বৃষ্টির বিরাম নেই। জ্যোৎস্নাও উঠেছে। দুলুর খবর কদিন পাচ্ছি না।
১০৩
৫ আগস্ট বৃহস্পতিবার ১৯৭১
রাত ৯টা
আল্লাহর কাছে অনেক শােকর। আজ সবার খবরই পেলাম। ওরা ভালাে আছে, চিঠি পেয়ে যে কি আরাম বােধ হল। আল্লাহ নেগাহবান থেকে যেন চিরকাল সবাইকে রক্ষা করেন। কতক্ষণ আগে বােম আর গুলীর শব্দ হল। কি জানি কোথায় কি হচ্ছে ও হবে। ঢাকা থমথমে হয়ে আছে, লােকজন চলে যাচ্ছে। শহরে মেঘ বৃষ্টি রােদের খেলাও চলছে। ব্যথা আশা আশঙ্কা উৎকণ্ঠা নিয়ে লােকের দিন কাটছে। আল্লাহ মানুষকে সুমতি দিন।
৬ আগস্ট শুক্রবার ১৯৭১
রাত সাড়ে ৮টা
আল্লাহ যখন দেন অনেক কিছুই দেন। কিন্তু আবার কেড়ে নিতেও এতটুকু সময় লাগে না তার। এমনি করুণাময় নিষ্ঠুর সে। আজ দুলুওর ফোন পেলাম। ওরা ভালাে আছে, বিল্লুর বিয়ের কথা চলছে। আল্লাহ মােবারক করুন।
এইমাত্র একটা বােম-এর শব্দ হল। গতকাল ২টা থেকে জামাল নিরুদ্দেশ। আল্লাহ যেন সহিসালামতে রাখেন। ছােটবেলা থেকে কারুর মুখঝামটা খাইনি, এখন বুড়াে বয়সে কারাে মুখ ঝামটা বড় লাগে মনে। নিজের উপরই ঘৃণা হয়। এই অবস্থায় মানুষ আত্মহত্যা করে নয়ত পাগল হয়ে যায়।
১৮ আগস্ট রবিবার ১৯৭১
রাত ৮টা
কাল আবদুল বাড়ী গেল। সারা ঢাকায় লােকের চলে যাওয়ার হিড়িক। শাদু এসেছিল। ধানমণ্ডিতে চোরাগােপ্তা ধরপাকড় চলছে। আর শুনলাম গুলশানেও
১০৪
খুব গােলযােগ। কালকে আজকে খুব বােমারু উড়ল। বৌমাদের বাড়ীর পথে ৮টার পর কেউ বের হতে পারবে না। বের হলে গুলী করা হবে। ২ বছর পরে বেথেলহেম স্টার ফুল ২টি কালকে ফুটল। আল্লাহ দেশের ভালাে করুন। আজ স্বপ্নে দেখলাম ধানমণ্ডির পথ হারিয়েছি, নানা পথে জ্যান্ত, জবেহ করা মুরগি পড়ে আছে। একটি বন্দী ছেলেও আমার সাথে এল। পরে কে একজন ধানমণ্ডিতে নিয়ে যাবে বলে সাথে এল।
১০ আগস্ট মঙ্গলবার ১৯৭১
রাত ৯টা
আজ ১২টায় সােভিয়েত কনসাল জেনারেল ও নবিকভ এসেছিলেন। প্রচুর সহানুভূতির সঙ্গে অনেক আলােচনা করলেন। আল্লাহ বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করেন। আজ মুজিবুর রহমানের গােপন বিচার সভা বসছে, কি প্রহসন। কার বিচার কে করে।
আজ ভাের রাতে স্বপ্নে দেখলাম আরবান চুপি চুপি এসে আমার হাতের মধ্যে ৪টা সিকি, রূপার সিকি গুজে দিয়ে চলে গেল। কি যে অদ্ভুত স্বপ্ন। আরবানের সাথে দেখা নেই আজ প্রায় পনের বছর ধরে। কি যে স্বপ্নে দেখি আমি।
১১ আগস্ট বুধবার ১৯৭১
রাত ৭টা
শাদু, আলু, জাদু এসেছিল। লিখে দিলাম ওদের কাছে। শান্তি হােক পৃথিবীর। শান্তি হােক, সুমতি হােক পৃথিবীর মানুষের। অবুঝ মন বােঝে না, অস্থির হয়। ক্ষণে ক্ষণে। যার কাছে সব সঁপেছি সেও নিষ্ঠুর লীলায় মেতেছে। তবুও বলছি, ওগাে, এবার শেষ কর এ লীলা। ধ্বংস থেকে এবার সৃষ্টির খেলায় মাতাে। মানুষের অসহায় খেলার পুতুল মানুষ আর কত ধৈর্য ধরবে। তুমি পার এত সহ্য করতে?
১০৫
১২ আগস্ট বৃহস্পতিবার ১৯৭১
রাত ৯টা
আজ ছােটনের চিঠি পেলাম। ওরা ভালাে আছে। সবার ভালাে হােক। কিন্তু মনটা যে কি অস্থির। আজ দুপুরে একটু ঘুমিয়েছিলাম। স্বপ্নে দেখলাম দুধভাত খাচ্ছি, এ বড় ভয়ানক স্বপ্ন, যত বার দুধ খাওয়া স্বপ্নে দেখেছি, একটা
একটা কঠোর নিষ্ঠুর মৃত্যু শােক লাভ করেছি। কুকুটারও কাল থেকে কেঁদে উঠছে, এসব লক্ষণ মােটেই ভালাে নয়। বড় তিক্ত বিষাক্ত অভিজ্ঞতা। কিন্তু কাকে বলি এসব দুঃখের কথা। কি ভীষণ নিঃসঙ্গ যে আমি! ওগাে অনন্ত অন্তর্যামী। তুমি ছাড়া এ নিঃসঙ্গ অন্তরের সঙ্গী আর কে আছে। কাকে রেখেছ! তােমাকেই বলি আর দুঃখ দিয়াে নাকো মরণ দাও, শান্তি দাও। তােমার ইচ্ছা ছাড়াও তাে কিছুই হবার নয়। এবার মঙ্গল ইচ্ছায় ইচ্ছুক হও।
১৪ আগস্ট শনিবার ১৯৭১
রাত ১১টা
১৪ই আগস্ট। কত রক্তস্নানের পর স্নিগ্ধ চন্দ্র তারকা পতাকাবাহী এ দিনটি এসেছিল ২৩ বছর আগে পাকিস্তানের সব মানুষের নিপীড়িত সর্বহারা জনের আশা-আনন্দের প্রতীক হয়ে। দস্যু দুরাচার বর্বর পশ্চিম পাকিস্তানীদের জঘন্য নিষ্ঠুরতায় আজ তা সারা বিশ্বসভায় ম্লান, উপহসিত। মুসলিম নামের উপর কলঙ্ক কালিমা লেপন করে দস্যু বর্বর তার হনন কার্য চালিয়ে যাচ্ছে। ধিক্। কদিন দিন-রাত কুকুরটা কাঁদছে। আজও স্বপ্ন দেখলাম দুধ খাচ্ছি। এ যে কি অন্তর্দাহ অমঙ্গলের আশঙ্কায় পুড়ে মরা, কেউ বুঝবে না। সকাল থেকে বৃষ্টি, সারা ঢাকাও সকাল থেকে মৃত্যুনগরী। বিকাল থেকে আবার লােকজন চলাফেরা করছে।
১০৬
১৫ আগস্ট রবিবার ১৯৭১
রাত ৭টা
শ্রাবণের অবিরাম ধারা বর্ষণ। কার চিত্ত স্নিগ্ধ হল কে জানে। হাট বাজার নেই। আজ রােববার বলে রক্ষা।
২ মাস হয়ে গেল। সন্ধ্যায় মনটা বড় ব্যাকুল হয়। কেউ কেউ আসেন, বৌমা আসে, তাই কথাবার্তায় কেটে যায়। কি নিঃসঙ্গ। কারু কাছে বলার নয় এ অন্তর্বেদনা। ওগাে অনঙ্গ অন্তরঙ্গ। তুমি যে অন্তর্যামী। তাই তুমিই যে ব্যথা, সুখ, আনন্দ দাও, তা তােমারই কাছে ফিরে যায় না কি। কত অমঙ্গল চিহ্ন দেখতে পাচ্ছি। তার মধ্যেও আশা, প্রত্যাশা করে আছি, সব সরিয়ে তােমার মঙ্গল আলােকে উদ্ভাসিত করবেই।
১৭ আগস্ট মঙ্গলবার ১৯৭১
রাত ৭টা
কালকে খবর পাওয়া গেল রফিককে (রফিকুল ইসলাম) সুদ্ধ ৪ জন। ইউনিভারসিটির প্রফেসরকে ১৩ তারিখ রাতে ধরে নিয়ে গেছে। স্ত্রীদের আবেদনক্রমে আজ তাদেরকে ফিরিয়ে দেয়ার কথা। কিন্তু আজ সামরিক অফিস হতে তাদের কাপড় চেয়ে নেওয়া হয়েছে। আল্লাহ জানেন, ওদের ভাগ্যে কি আছে। এখনও দানব বর্বরদের পাশবিকতা অব্যাহত। আল্লাহ রহম করুন।
সন্ধ্যা ৬টায় দুলুর ফোন পেলাম। আল্লাহ নেগাহবান থাকুন। আজ গেন্দু এসেছিল। নওয়াব ঢাকার ডি.সি হয়ে এল। সােমবার থেকে অফিস করবে। কি কার ভাগ্যে আছে কে জানে।
১০৭
১৯ আগস্ট বৃহস্পতিবার ১৯৭১
ভাদ্রের আজ ২ তারিখ। অনেক বৃষ্টির পর যেন আজ রােদের আভাস এল, শরতের স্নিগ্ধতা নিয়ে। বিকালটা মনে হল শরতের বিকাল। শান্তি কোথাও নেই। ধরপাকড় রােজ চলছে। স্বামীবাগ, আজিমপুর, ধানমণ্ডি সবখানে রাতের আঁধারে দিনের আলােয় হানাদাররা হানা দিচ্ছে। দেশের মানুষ মরিয়া হয়েই এবার মরছে।
২০ আগস্ট শুক্রবার ১৯৭১
রাত ৯টা
কতকাল পরে আজ সালু, রুমী, আলু, শাদু, রবি, শাহরিয়ার এল। ওদের যে দেখলাম, ওরা যে বেঁচে আছে, এও শােকর। একটু আগে মেশিন গানের গুলী চলার শব্দ হল ২৭ নং রােডের ওদিক থেকে। কার কোল খালি হল আল্লাহ জানেন। ছােটনের, শমুর কোনাে খবর নেই। আজ বৃষ্টিটা ধরেছে, কাল নাকি সূর্যগ্রহণ, আমরা দেখব না।
২১ আগস্ট শনিবার ১৯৭১
রাত ৯টা
বার বার দুঃস্বপ্ন দেখছি। এত অমঙ্গলের চিহ্ন, আশঙ্কা; মন আর কত যে শক্ত করি। সর্ব মঙ্গলময় সর্ব নিয়ন্তা আল্লাহ রহমানুর রহিম। তিনি রহম করলে সব অমঙ্গল মঙ্গল হয়ে উঠবে, সেই আশা করে নিশ্চিন্ত হবার প্রাণপণ চেষ্টা করছি। শুধু আমার ভালাে হলেই তাে হবে না। আমার সন্তান, আমার দেশ,
১০৮
দেশের মাটি, মাটির মানুষেরা সামরিক নির্যাতন, বন্যা মহামারীতে আর কত মরবে। আল্লাহ ভালাে কর। রহম কর। মুজিবের হায়াত দাও, বাংলাদেশের ভালাে কর। আমারও ভালাে হােক। আজ স্বাধীন বাংলা বেতারে বদরুন (বদরুন্নেসা আহমেদ) বলল। সবাই চলে গেল, আমিই রইলাম।
২২ আগস্ট রবিবার ১৯৭১
সােভিয়েত কনসাল জেনারেল লাঞ্চ খাওয়ালেন। সময় কাটল। নওয়াব এল। খসরুর কথা শুনলাম। জানিনা ওর ভাগ্যে কি হয়েছে। মাঝে মাঝে গুলী মেশিনগান-এর শব্দ পাচ্ছি। গুলশানের ব্যাপার যা শুনলাম অভাবনীয়। কি যে হবে! আমার জন্য ভাবি না, ও হতচ্ছাড়ার ভাগ্যে যে কি আছে আল্লাহ জানেন। আজকে ইন্ডিয়ার বেতার কেন্দ্রে আমার কবিতা পড়া হল।
২৩ আগস্ট সােমবার ১৯৭১
আল্লাহর কাছে শোেকর। ছােটনের চিঠি পেলাম। লালাদের চিঠি পেলাম। আলুর মুখ দেখলাম। সব ভালাে রাখুন আল্লাহ তার নেগাহবানীতে। আজ জাফর সাহেব উধাও। কাণ্ড যা করে তুলেছিলেন, এ ভালােই হল। আল্লাহ যা করেন ভালাের জন্য করেন। রােজ রাতে গােলাগুলী চলছে, আশপাশে ধরপাকড়ও হচ্ছে, আল্লাহ রহম করুন। সিকান্দার আবু জাফর ওপারে চলে যাওয়ার দিন।
১০৯
২৪ আগস্ট মঙ্গলবার ১৯৭১
রাত ৯টা
আজ জাকুদের কলেজে গ্রেনেড চার্জ হল। জাকু আসেনি, আলভীও এল না। বড় দুশ্চিন্তায় কাটছে সময়। গ্রীন রােড কলাবাগান সব জায়গায় গণ্ডগােল।
২৫ আগস্ট বুধবার ১৯৭১
আজ জাকুও এল। তবুও সান্ত্বনা কোথায় যে কি হচ্ছে। ১৮ নং রােডে বন্যাদের বাড়ীর পাশে চার শহীদ হাে গিয়া। অত্যাচারীর শক্তি যত প্রবল হােক। আল্লাহর শক্তি তার চেয়ে যে কত প্রবল। কত শক্তি তিনি অত্যাচারিতকেও দিতে পারেন বাংলাদেশ তার প্রমাণ। আজ পাঁচ মাস গত হতে চলছে! কি দুঃসহ দিন।
মাইনুর সাথে দুলুদের কাপড় আজ তাে পাঠালাম। কবে আবার ওদের খবর পাব সেই আশায় আছি।
২৬ আগস্ট বৃহস্পতিবার ১৯৭১
আলভী এতদিনে এল। অনেক কথাই শুনলাম। দুই দিন দুই রাত পর শামীম আজ বাড়ী এল। আল্লাহ যেখানে যাকে রাখেন যেন তার নেগাহবানীতে রাখেন। সবার ভালাে হােক।
১১০
৩০ আগস্ট সােমবার ১৯৭১
সন্ধ্যা ৭টা
বর্ণাঢ্য পৃথিবী বিবর্ণ হয়ে যায়, ক্ষুধার খাদ্য তৃষ্ণার পানীয় বিস্বাদ হয়ে ওঠে, বিষাক্ত মনে হয় নিঃশ্বাসের বায়ু। ওগাে অকরুণ। আর কত! তুমিও তাে সহ্যের সীমা অতিক্রম কর, কর গজব নাজেল। মায়ের বুক কি তােমার ধৈর্যের চেয়েও সহনশীল! আল্লাহ গাে আল্লাহ। বাচাও মায়ের বাছাদের। রক্ষা কর মেয়েদের ইজ্জত, তােমার দেওয়া শ্রেষ্ঠ সম্পদ। এ কি অকরুণ লেখা। আর যে পারি না। আশেপাশে কারুর ঘরেই যে আলাে নেই, আর কত। আলভী, আলতাফ মাহমুদরা জালিম পাক সৈন্যের হাতে ধরা পড়েছে।
৩১ আগস্ট মঙ্গলবার ১৯৭১
রাত ১০টা
দিনরাত কেটে আজও রাত এল। কে কি ভাবে কাটাল এতক্ষণ। ওগাে আল্লাহ, এবার প্রসন্ন হও, তােমার নামের মর্যাদা রাখ। আমার মতাে ঘরে ঘরে তােমাকে ডাকছে তুমি কি শুনতে পাও না?
১১১
সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
১ সেপ্টেম্বর বুধবার ১৯৭১
রাত ৯টা
শুনেছ শুনেছ, প্রিয় আমার। বন্ধু আমার। অনঙ্গ অন্তরঙ্গ প্রার্থনা আবদার তুমি শুনেছ, অভিমানের মান রক্ষা করেছ, কত যে মহান মহৎ দয়াল তুমি। ওরা ফিরে এল। মেয়েটার খবর এনে দাও। আমার সমস্ত ব্যথিত জীবনের সাথী তুমি, তুমি ছাড়া কে বুঝবে আমার কথা, কে শুনবে, তুমিই তাে শুনছ শুনেছ, আরও শুনবে। শােকর, শােকর লাখ লাখ শােকর। তােমার নামের মর্যাদা তুমি রেখেছ, রাখবে। তবু যে মনে বড় ব্যথা। কালকে ছিল আজাব। বাচ্চা বিড়ালটা কুকুরের হাতেই মরল। তুমি কি সদকা নিলে? আহা মেরে মেরে কি যে অবস্থা করেছে বাচ্চার! তবুও হায়াত জোরে ফিরে যে এল সেই তাে শােকর। আলভী ফিরে এল।
২ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার ১৯৭১
রাত ৯টা
এইমাত্র দুলুর ফোন এল। আল্লাহ ওদের সহিসালামতে রাখুন। কালকে যেন জাকুর খবরটা পাই, আশা করে আছি, আলতুও ফিরে আসবে। আজ বৃষ্টি নেই, ঝকঝকে রােদ। কাটুক বাংলার কালাে দিন, রাতের আঁধার। আশা হচ্ছে ভরসা হচ্ছে, আল্লাহই মুখ তুলে চাইবেন।
মালিক সাহেব গভর্নর। টিক্কা খান অপসারিত।
৩সেপ্টেম্বর শুক্রবার ১৯৭১
রাত ৯টা একটু আগে খবর পেলাম, খবর ভালাে নয়। বুকটা বসে যেতে চায়। অনেক ভালাে না থেকে আল্লাহ বহু ভালাে দিতে পারেন, এই আশা করে আছি। ২
১১৫
দিন থেকে কারুর কোনাে খবর নেই, সবগুলাের হল কি। আল্লাহ তাে অনেক দিলেন, আবারও আশা করে আছি অনেক পাব। তার ভাণ্ডারে তাে কোনাে অভাব নেই। চারদিকে ধরপাকড়কোন মায়ের বাছারা কোথায় ধরা পড়ছে কে জানে। আজ নবিকভ, নায়েলা এল। ছবি নিল। কত যে সামলাতে হচ্ছে। আলতাফ মাহমুদকে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাবার দিন।
৪ সেপ্টেম্বর শনিবার ১৯৭১
রাত ১১টা
আজ মনে অনেক প্রশান্তি। কিন্তু যারা রইল এখন জালেমের হাতে, তাদের জন্য নিয়ত এখন প্রার্থনারত। আল্লাহ, তুমি আছ। অতীব সত্য, মুক্তি আসবে। একদিন তােমার রহমতে। আপনজনেরা এত অত্যাচার সহ্য করছে, দেশের সােনার ছেলেমেয়েরা আজ কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, ওদের মুক্তিযুদ্ধে সাহস । বুদ্ধি দাও। বৌমা আজ প্রথম আমার বাড়ীতে রাত কাটালাে। আহা! কেউ নেই ওর আল্লাহ তুমি ছাড়া। এই দুর্জয় সাহসী মেয়েটার ইজ্জত, শুভ কামনাকে তুমি জয়যুক্ত কর।
৫ সেপ্টেম্বর রবিবার ১৯৭১
রাত ৮টা নবিকভ, নায়েলা আজ খেয়ে গেল। বিদেশের মানুষ বড় আপন হয়ে মিশেছিল, ওরা চলে যাবে সেই তুষারের দেশ রাশিয়ায়। ক’টি বছর কত আপন হয়ে মিশল। কিই বা উপহার দিলাম, তাতে কত খুশী! আবার শামীমকে যে রেকর্ডগুলাে দিয়ে গেল তাও অনেক।
মানিক হতভাগার বউ জামাই কাল এসে আজ চলে গেল, কি বােকা এরা। এখনও কেউ ঢাকা আসে। এতগুলাে পয়সা খরচ করে একটা দিন মাত্র থেকে গেল। আজ বৌমা আসবে না। সকালে মেয়েটা গেল। এখন বৃষ্টি। বাড়ীর পাশে ব্যারিকেড, মেয়েটা একা বাড়ীতে, আল্লাহ ওকে দেখবে।
১১৬
৬ সেপ্টেম্বর সােমবার ১৯৭১
রাত ৯টা
কাল সন্ধ্যা থেকে প্রবল বৃষ্টি। উতল বাতাস আজ সারা দিন চলল। দুপুরে বৌমা এলাে। আজ প্রতিরক্ষা দিবস। প্রহসন চলছে। ধরপাকড় চলছে। নতুন খবর নেই। মিথ্যা প্রচারে ঢাকার শহর গুলজার। কেউ বিশ্বাস করছে না। মিরজাফরী দল মিথ্যার মধ্যেও আলাে জ্বালিয়ে চলছে, ওই আলােতে তাে ওদেরই বিভ্রান্তির সৃষ্টি হচ্ছে। মূঢ়, মূখ স্বখাত সলিলে ডুববে একদিন।
২৭ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার ১৯৭১
রাত ৯টা
রাশিয়ান নতুন ভাইস কনসাল জেনারেল ও ইসলামাবাদ থেকে আগত মিনিস্টার কাউন্সিলার মি, নিকোলাই আই ভয়নভ আজ ১টায় এসে ঠিক ৩টা পর্যন্ত অনেক আলাপ-আলােচনা করে গেলেন। মি. নবিকভও সাথে ছিলেন। নুরুল ইসলাম ও শামীম আমার কথা ওদের ভালােমতাে বুঝিয়ে বলায় অনেক পরিষ্কার কথাবার্তা হল। ১৫ তারিখে নবিকভ চলে যাচ্ছে। খুবই খারাপ লাগছে, বড় অমায়িক লােক। নায়েলা ও নবিকভ বড় আন্তরিকতার সাথে মেলামেশা করত। আল্লাহ সবার ভালাে করুন। বৌমা আজ আসেনি। মিনিস্টার একটি সুন্দর বা উপহার দিয়ে গেলেন।
২৮ সেপ্টেম্বর বুধবার ১৯৭১
রাত ১০টা
আজ বৌমা এসেছিলাে, এতদিনে একটা শান্তির খবর পেলাম। আল্লাহর কাছে হাজার লোেকর। এইমাত্র দুলুর ফোনও পেলাম। মােরাদ পরীক্ষা ভালাে দিয়েছে। সিমিন ভালাে আছে, আব্লু করাচী যাবেন। বাচ্চুর মেয়ে বিব্বুর
১১৭
বিয়ের কথাবার্তা চলছে। ভালাে। আল্লাহ সবার ঠিকানা যেন ভালাে মতাে করে দেন। আজ সারা দিন ঝকঝকে রােদ ছিল। ভাদ্র মাসের দিন। শিশির ঝরানাে রাত। শরঙ্কাল। রজবের চাঁদ, রমজান আগত। কারা কোথায়, আল্লাহ সবার নেগাহবান থাকুন।
১০ সেপ্টেম্বর শুক্রবার ১৯৭১
রাত ৯টা
৪টার সময় ঝিনুর মা এল। কি দুর্ভাগ্য। ছেলে চারটি ফিরে এলাে, জামাইটা না আসায় মেয়ের মুখের দিকে কি করে চাইতে পারে। রুমিকেও ছাড়েনি। আল্লাহ রহম কর। আর কত দুঃখ দেবে মানুষকে। কাহারকে আইয়ুব পিণ্ডি ডেকেছে, না যেন যাওয়া হয়, এটাই প্রার্থনা। শয়তান, ছল, খলদের মনে কি আছে কেউ জানে না, আল্লাহ তাে জানেন, তিনি যেন ওদের হাত থেকে আমার বাছাদের রক্ষা করেন।
১২ সেপ্টেম্বর রবিবার ১৯৭১
রাত ১০টা
কত দিন হয়ে গেল, ওদের খবর পাচ্ছি না। আল্লাহ আর কত দুঃখ দেবে? আজ পাশের বাড়ী বিয়ে খেয়ে খবর শুনলাম। আলতুর দশা কি হয়েছে আল্লাহ জানেন। সত্য মিথ্যা ঠিক নেই, আল্লাহ সব করতে পারেন। চারদিকের অবস্থা জঘন্য, ঘৃণ্য ফাতেমা সাদেক যাচ্ছে দালালি করতে। লজ্জা করে না এদের। সারা দেশের মানুষ মরে যাচ্ছে জালেমের জুলুম, এরা তামাশা করছে।
১৩ সেপ্টেম্বর সােমবার ১৯৭১
রাত ১০টা
রাশান কনসাল জেনারেল মি. পপােভ-এর গুলশানের বাড়ীতে নবিকভের বিদায় সংবর্ধনা ছিল। সে কাল চলে যাবে। আপন আত্মীয়-বিদায় বেদনা
১১৮
অনুভব হচ্ছে। এই সর্বনাশা জুলমাতি দিনে, সাহায্য আশ্রয় সমবেদনা সহানুভূতি দিয়ে সর্বক্ষণ ওরা স্বামী স্ত্রী খবরাখবর রেখেছে, প্রায়ই নানা উপহারে আমাকে খুশী রাখতে চেয়েছে। স্বদেশের কোনাে উচ্চপদস্থ অফিসার, আমাকে এত সম্মান এত মর্যাদা দেয়নি। আল্লাহ ওদের ভালাে করুন। আপন দেশে স্বজনদের মধ্যে শান্তিতে থাকুক। আতাউর রহমান খান সাহেবের সাথে দেখা হল। ৩ মাস পর ছাড়া পেয়ে ভালােই আছেন।
১৪ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার ১৯৭১
৩ মাস পূর্ণ হয়ে ৪ মাসে পড়ল। আমার সােনা লক্ষ্মীমণিরা কেমন আছে জানি না। আল্লাহর হাতে সঁপেছি, ইজ্জতের সাথে তিনি জীবন রক্ষা করুন। মনে হয় বছর হয়ে গেল। আমার দেশের সােনার ছেলেমেয়েরা ভেসে বেড়াচ্ছে। আল্লাহ আর কত দুঃখ দেবে, এবারে মায়ের কোলে সন্তান যারা আছে বাঁচাও, ফিরিয়ে দাও, শূন্য ঘর ভরে দাও আবার শান্তিতে। চোখের উপর উনি শুকিয়ে শুকিয়ে কাবু হয়ে যাচ্ছেন, কিছু করতে পারি না, যতটুকু পারি যত্ন করতে ক্রটি করি না, কিন্তু চিন্তা রােগের কি ওষুধ আমি দিতে পারি!
১৫ সেপ্টেম্বর বুধবার ১৯৭১
আজ ১৫ তারিখ। আমার সােনামণিরা আজ এতক্ষণেও আমার কাছে। কোথায় কখন গেল যেন মনে করতে পারছি না। ৩ মাস আজ পূর্ণ হয়ে গেল। লিখতে গিয়েও মাথা ঠিক থাকে না। গতকালও এই কথা লিখেছি, আজই কালকের লেখাটা ঠিক খাটে। ওলট পালট হয়ে যায়। মনকে কত বুঝাই, তবু কেন যে দিশাহারা হই। আল্লাহ নেগাহবান থাকুন। সবার ভালাে হােক। কোথাও থেকে কোনাে একটা খবর নেই।
১১৯
১৮ সেপ্টেম্বর শনিবার ১৯৭১
রাত ১০টা
মিনু-সাজুর প্রথম বিবাহ বার্ষিকীর দাওয়াত খেয়ে এলাম। কোনাে ঘরে শান্তি নেই। মিনুর শাশুড়ীর কান্না, ছেলে একটি কোথায় গেছে, তার কোনাে খবর নেই। অথচ বেঁচে থেকে সংসারের সব কিছু করতে হচ্ছে—আনন্দ উৎসব আবার দুঃখ ধান্দা। আল্লাহ কবে সবার ঘরে শান্তি এনে দেবেন, সেই প্রতীক্ষায় আছি। ছােটন, রােজীর চিঠি নেই, সােনামণিদের কোনাে খবর নেই। আল্লাহ নেগাহবান থাকুন। নতুন মন্ত্রিসভা গঠিত হল। কি ছিরি কি ছাঁদ। ঘৃণা জন্মে যাচ্ছে, কি দেশে আছি।
১৯ সেপ্টেম্বর রবিবার ১৯৭১
স্বপ্নে দেখলাম তারাবাগের পুকুরে কাপড় ধুচ্ছি, ইকবাল এসে টিপি টিপি হেসে ঘাটের উপর দাঁড়াল, খুব বকা দিলাম। কিন্তু কথা বল্ল না। পরিষ্কার পাঞ্জাবী পায়জামা পরা। আল্লাহ জানেন—ছেলেটি বেঁচে আছে কি না। কারুরই তাে কোনাে খবর নেই।
২০ সেপ্টেম্বর সােমবার ১৯৭১
রাত ৯টা
ছােটনের চিঠি পেলাম। ওরা আল্লাহর ফজলে সবাই ভালাে আছে, এইটুকু জেনে শােকর করি। আজ হাসপাতালে গিয়ে রক্ত পরীক্ষার জন্য দিয়ে এলাম। ওষুধ খাচ্ছি। এত ভালােবাসে সবাই আমাকে, এ যে কি সৌভাগ্য। ডাক্তার, নার্স, বেয়ারারা পর্যন্ত কি আদরে কথা বলল।
১২০
নার্সরা চা না খাইয়ে ছাড়ল না। আমার দেশের বাংলাদেশের মেয়েরা কত খাটছে, কত কম পয়সা পায়, তবুও কত যে উদার।
হাসপাতালে গন্ধে টেকা যায় না। ডাক্তার নার্স বেয়ারা একদম কম। আজ দুপুরেও ইউনিভারসিটির অধ্যাপক রশীদুল হাসানকে ধরে নিয়ে গেছে। বােমারু উড়ছে, গ্যাস বন্ধ।
২২ সেপ্টেম্বর বুধবার ১৯৭১
রাত ৮টা
গতকাল গ্যাস এসেছে। আজ শাগিয়েভ এসেছিল-অনেক কথা, আলােচনা হল। ফোন আজ ৩ দিন থেকে মরা। দুলুরা ফোন করেও সাড়া পাবে না। কি যে পরিস্থিতি। কবে এর নিরসন হবে। কারুর কোনাে খবর নেওয়া দেওয়া অসম্ভব।
২৪ সেপ্টেম্বর শুক্রবার ১৯৭১
আজ চাটগাঁ থেকে কাহহার এল। দুপুর ২টায় আমার সাথে দেখা করে খেয়ে ঠিক ৩টায় এয়ারপাের্ট গেল, করাচী যাচ্ছে ২ সপ্তাহের জন্য। কি জানি ছলনা না কি। আল্লাহর হাতে সঁপলাম তিনি যেন সহিসালামতে ফিরিয়ে আনেন। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা থেকে আটটা পর্যন্ত নিষ্প্রদীপ মহড়া হয়ে গেল। কলকাতার যুদ্ধের সময় ব্ল্যাক আউটে ময়দানে যেতাম, কলকাতার অন্ধকার আকাশ কেমন তাই দেখতে। এখানে তাে কাফেরদের ভয়ে দুয়ার বন্ধ করে থাকতে হল। কারুর কোনাে খবর আজও নেই। আল্লাহ নেগাহবান থাকুন।
১২১
২৫ সেপ্টেম্বর শনিবার ১৯৭১
আজ কুফরি জুলমাতের ৬ মাস পুরাে হল। মুক্তি সংগ্রামী সন্তানদের সংগ্রাম অব্যাহত। আল্লাহ অসহায়ের রক্তে স্নাত বাংলার জনগণকে পূত পবিত্র শপথে উদ্বুদ্ধ করে যেন শান্তিময় জীবনের সন্ধান দেন। ঘর খালি, বুক খালি, কোল খালি, আবার পূর্ণ হােক।
আজ রােজী আহাদ হাঁপানীর ওষুধ নিয়ে গেল। কি ভাগ্য, একটা যােগ্য মেয়ের জীবনে সুখ হয়ত হল, শান্তি পেল না।
১২২
অক্টোবর, ১৯৭১
৩ অক্টোবর রবিবার ১৯৭১
রাত ৮টা
কিছুই যেন নতুন করে জানার নেই, বােঝবার নেই, একই পুনরাবৃত্তি চলছে। মাস ধরে, কোনাে খবর কারুর নেই। আজ ১০ দিন হল জামাইটা গেছে। ফেরাউনের দেশে এজিদের ব্যুহের মধ্যে, কোনাে খবর নেই, চাটগাঁয়ে ফোন করা যাচ্ছে না, তবে মনটা বলছে সবাই ভালাে আছে, কাহহার ফিরে এলে নিশ্চিন্ত হতাম। অক্টোবর বিপ্লব দিবস গত ক’বছরে কত যে সমারােহে পালন করা হয়েছে, এবার কি করে কি হবে জানি না। আল্লাহ নেগাহবান। একটু খবর যদি সবার পেতাম।
৫ অক্টেবর মঙ্গলবার ১৯৭১
আজ শব-ই-বরাত, ভাগ্যের রাত। ওগাে দিন রাতের সন্ধ্যা ঊষা, ইহকাল পরকালের মালিক। তুমি কার ভাগ্যে কি লিখন লিখেছ, কি দান কাকে দিলে। প্রভু। সারা দেশ, কোটি মানুষের ভাগ্যে লিখন কি লিখলে? কত আর দিন কাটাবে এই নিয়ে? আজ একটু খবর পেলাম ,ঘর ছাড়াদের, দুলুটার ফোনও পেলাম। এও তােমার কাছে শােকর। আজ শবে বরাত, কত ঘর মায়ের বুক খালি। ভালাে কর। সবার ভালাে হােক, শান্তি সােয়াস্তি ফিরিয়ে দাও। কাটাকাটি মারামারি জুলুম আর কত সহ্য করবে মানুষ।
৭ অক্টোবর বৃহস্পতিবার ১৯৭১
সন্ধ্যা ৭টা
একটু আগে দুলুর ফোন পেলাম। বাবা বাড়ী এসেছেন, লাখ শােকর, শােকরানার নামাজ পড়লাম। ঝুনুর মা খালা মুক্তার বিয়ের দাওয়াত দিয়ে গেলেন। বাছা ননিদেরও খবর পেলাম। আল্লাহর কাছে শােকর। কত যে হালকা লাগছে বুকটা, আল্লাহ। তুমি ইজ্জত হুরমত হায়াতের মালিক। ছােটনের চিঠি আজও পেলাম না।
১২৫
৮ অক্টোবর শুক্রবার ১৯৭১
মিলনদের পথে ওর ভাইয়ের সাথে মুক্তার বিয়ের গায়ে হলুদের জন্য গুলশানে কুটির বাড়ী গিয়ে কত কথা যে শােনা গেল। আজব গুজব, সুখের দুঃখের ক্ষোভের ব্যথার, আল্লাহ মেয়েদের বেইজ্জতি আর কত সহ্য করবে তা আল্লাহই জানে। দুঃখে ক্ষোভে ব্যথায় বুকের রক্ত ফেটে বের হতে চায়। অসহায় মানুষ। ওগাে স্রষ্টা। ওগাে রহমানুর রহিম। এখনও তােমার রহমত নাজেল হবে না। বুক, ঘর সব খালি করেও কি ধ্বংসলীলার সাধ তােমার মিটল না।
১১ অক্টোবর সােমবার ১৯৭১
মুক্তার বিয়েও হয়ে গেল। বিয়েতে গেলাম। আজ দুপুরে বৌভাতও খেয়ে এলাম। শান্তিতে যেন থাকে দুটি জীবন। আজ শিউলি গাছে ৫টি ফুল পেলাম। পাঁচটি প্রাণ। নির্মল সুগন্ধ সুন্দর নির্মল হয়ে উঠুক, এই শরত দিনের মতাে। আমার বাছারা নিরাপদে থাকুক। কাল রাত থেকে কুকুরগুলাে এক সাথে কাঁদছে। আল্লাহ রহম করুন, সর্ব অমঙ্গল থেকে তার মঙ্গল আশীষ ঝরে পড়ুক।
মনটা অবসন্ন, বিষন্ন ক্লান্ত হয়ে পড়ছে কেন। আল্লাহ নিশ্চয়ই ভালাে করবেন সব কিছু। ছােটদের চিঠিও পাইনি।
২০ অক্টোবর বুধবার ১৯৭১
রাত ৯টা
কতদিন, কতদিন যে লেখাপড়া কিছুই করছি না শুধু আল্লাহর দিকে চেয়ে দিন কাটাচ্ছি, সে অনঙ্গ অন্তরঙ্গের কি খেয়াল আছে। কি করে কাটছে দিনরাত। তবু একটা সুখবর মন্টু খান ছাড়া পেয়েছে, শােকর আল্লাহর কাছে।
১২৬
আলতাফের খবর নেই, কারুর কোনাে খবর নেই, কেউই আসে না আমার এখানে। ভয়ে নয়, আমার জন্যই আসে না। ওরা যে আমাকে ভালােবাসে সেইজন্য। আজ বিকালে ঝুনুর মাকে দেখতে গেলাম। তখন পাড়ায় মিলিটারী ঘুরছিল। মিলটনদের বাড়ী বৌমার বাড়ী জিজ্ঞাসাবাদ হয়েছে। আমি বাড়ী ছিলাম না, কেউ যে আসেনি ভালাে হয়েছে। কেউই তাে ছিলাম না। এসে কি করত কে জানে।
২১ অক্টোবর বৃহস্পতিবার ১৯৭১
রমজান এল। পূত পবিত্র পাবক বিদগ্ধ তাপস কোন সওগাত নিয়ে এবার এল। আগামী কাল রমজান। আজ চাঁদ রাত, কত খুশী কত হাসি আনন্দ আশা আকাঙ্ক্ষায় ভরা এই দিনটি আসত মুসলিমের ঘরে। আজ আকাশ ঘন মেঘাচ্ছন্ন, বিদ্যুৎ বজ্র গর্জনে ভয়াল রূপ বাংলা থমথমে আবহাওয়ায় ভর্তি। একটু আনন্দ উল্লাস হাসি খুশীর সুর শােনা গেল না। ঘরে ঘরে চাঁদ থেকে আদব সালাম মােবারকবাদের আওয়াজ পাওয়া গেল। আল্লাহ যেন সব শেষ ভালাে দিয়ে করেন। দুলুদের ফোন পেলাম এইটুকু খুশী। বিব্বু মাইনুর খবরও পেলাম।
২৩ অক্টোবর শনিবার ১৯৭১
এতদিনে আজ হাফিজটাকেও দেখলাম। এলও। গলা জড়িয়ে ধরে কত আদর যে করল। খসরু, চিঙ্কুর কোন খবর নেই। আলতু, ইকবাল এখনও বন্দী। আল্লাহ জানেন কি আছে ওদের ভাগ্যে। আল্লাহ যেন ভালাে করেন। ২টা রােজা চলে গেল। এ পুণ্য মাসের বরকতেও কি ভালাে হবে না? মঙ্গল আসবে না?
১২৭
২৪ অক্টোবর রবিবার ১৯৭১
ফজরের নামাজ পড়ে শুয়ে কিছুতেই ঘুম এল না, ৬টায় একটু তন্দ্রা এল। দেখলাম টুলুরা এসে রান্নাঘরে ঢুকছে, বল্লাম আমার তুগুর মুগুররা এসে গেলি। চুমু খেতে গেলাম, লুলুটা বললাে আমাকে দেবে না? আমিতাে আগেও একবার এসেছিলাম। টুটাকে আদর কর। টুটা গলা জড়িয়ে ধরে কত যে চুমু খেল। আল্লাহ ওদের যেন সবাইকে সুদ্ধ সহিসালামতে ফিরিয়ে দেন। আজ ডা. আলমকে নিয়ে হেনার মাকে দেখে এলাম। ভালাের দিকেই আছেন। আগামী রবিবার খুলনা যেতে চাইছেন। আল্লাহ সবাইকে ভালাে করুন। উনি এবারে বড় কাহিল হয়ে পড়েছেন। কাল ঘুমাতে পারে নি। আবার কাল অফিসে যাবেন।
২৬ অক্টোবর মঙ্গলবার ১৯৭১
রাত সাড়ে ৪টা
আড়াইটার সময় স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙ্গে গেল। দেখলাম লালানি হঠাৎ এসেছে, এসেই আবার হাফিজের সাথে বেরিয়ে গেল। কতক্ষণ পর আবার এল। একটা পাটি পেতে শুয়ে শুয়ে আমাকে ডেকে বল্ল—আমি ভাত খাব ৭টার সময়, সাতটার সময় খাব, ঠিক এই কথা বলল। আমি ওকে আদর করে অনেক কথা বলবার জন্য কোলে নিতে গেলাম, ঘুম ভেঙ্গে গেল। আর ঘুম আসে না। কি অদ্ভুত স্বপ্ন যে দেখছি কদিন ধরে। আল্লাহ যেন ওদের সহিসালামতে রাখেন। ৭ মাস পূর্ণ হল দেশের দুর্দিন চলছে। মা বাপের আপনজনদের কি দুর্ভোগ যাচ্ছে। আল্লাহ ভালাে কর সবার।
২৭ অক্টোবর বুধবার ১৯৭১
আতােয়ার ফোন করে দুপুরে জানাল, রাত ৩টায় ওর একটি ছেলে হয়েছে। আল্লাহ মােবারক করুন, বেঁচে থাক, মানুষ হােক। আততায়ারেরও সুমতি হােক। সংসার শান্তিময় হােক।
১২৮
২৮ অক্টোবর বৃহস্পতিবার ১৯৭১
আজও সেহরী খেয়ে শুয়েছি। ৫টার পর একটু তন্দ্রা মতন হল, স্বপ্নে দেখলাম লুলু এসেছে, বেশ হাসিখুশী। বল্লাম, আয় আমার কাছে শাে, শুয়ে শুয়ে শুনি এতদিন কোথায় কি করে কাটালি, ওকে বুকে নিয়েই ঘুম ভেঙ্গে গেল। কি যে হয়েছে, কি স্বপ্ন দেখছি এ সব আল্লাহ জানেন। ভালাে থাকুক, ইজ্জতে থাকুক ওরা যে যেখানে আছে।
সন্ধ্যায় পি.পি.আই থেকে শামীম ফোন করে জানাল, বারি সাহেব ইন্তেকাল করেছেন। যূথীর কাছে ফোন করে জানলাম গতকাল এডিনবরায় বারি সাহেব ইন্তেকাল করেছেন, ছােট মেয়ে লিপির কাছে। ছেলে সুইজারল্যান্ডে আছে, বীথি লন্ডনে, যূথী ঢাকায় আছে। ঢাকায় তার দাফন হবে কি না যূথীও বলতে পারল না। আল্লাহ জান্নাত নসীব করুন। ৬ রােজার দিন মারা গেলেন।
২৯ অক্টোবর শুক্রবার ১৯৪১
ছােটনের চিঠি পেলাম। এরা সবাই আল্লাহর ফজলে ভালাে আছে। তবু তাে খবরটুকু পেলাম। কত কত দীর্ঘ দিনে একটু খবর পাই। এও আল্লাহর কাছে শােকর। চারদিকে গােলাগুলী বােম-এর শব্দ। প্লেন উড়ছে সারা দিন রাত।
৩০ অক্টোবর শনিবার ১৯৭১
আজও সেহরী খেয়ে নামাজ পড়ে শুয়েছি, ৫টারও পর ঘুম এল। দেখলাম টুলুটা হাসতে হাসতে এসে বলছে, তুমি নাকি রােজ রােজ লুলুকেই স্বপ্নে
দেখাে। এইতাে আমি আজ এসেছি। বলবার সাথে সাথে দেখি ভীষণভাবে যুদ্ধ লেগেছে, বােমা ফাটছে। প্লেন থেকে বােম্বিং হচ্ছে, আগুন জ্বলছে।
অনেক লােক জমা হয়েছে মণিদের বাড়ী, আমাদের বাড়ী ভর্তি। ঝুনুর মা খুব
১২৯
অসুস্থ আর কুটি তাকে নিয়ে এসেছে, বড় এক কেটলি ভরা চা বানানাে হয়েছে। কিন্তু অত লােকের কুলাবে কি? কুটি বল্ল আপার মেয়েদের চা বানাতে বলাে, টুলুর হাতে করে দিলে কুলিয়ে যাবে, ওরা বেশ বরকত করে সবাইকে খাইয়ে দেবে। ঘুম ভেঙ্গে গেল। আল্লাহ সবার ভালাে করুক, ভালাে হােক। কাল রাত থেকে টিপ টিপ বৃষ্টি, ঝড়ের লক্ষণ।
৩১ অক্টোবর রবিবার ১৯৭১
রাত ৮টা
আশ্চর্য, কি যে অদ্ভুত সব স্বপ্ন দেখে চলেছি। আজও ভাের ৫টায় স্বপ্ন দেখছি, লুলু বলছে দ্যাখাে মা কারা যেন এসেছে। দেখি অতীন রায়, ছেলে বুড়াে সবার দাদু যিনি ছিলেন ঐ লােক। মহারাজ এসে বলছেন দিদি, আপনাকে দেখতে একজন লােক যে এসে দাঁড়িয়ে আছেন, এর আগেও ৩ বার এসে ফিরে গেছেন, আপনি খেতে বসেছিলেন। এখন খেতে যাচ্ছিলেন তাে? আমি বল্লাম, না খাব পরে, কে এসেছেন দেখি, তারা কিছু বল্লেন না। কিন্তু দেখলাম স্বপ্নালু শিশুর মতাে চোখে আমার দিকে দাড়িয়ে চেয়ে আছেন। একজন কালাে কুচকুচে চাপ দাড়ি হাসিহাসি মুখ ছবিতে দেখেছিলাম, কালাে একটা জামা হাঁটু পর্যন্ত ধুতি পরা রামকষ্ণ পরমহংস। কি আশ্চর্য উনি বল্লেন, না না, খেতে যাবে আমি একটু দেখতে এসেছি, দেখেই চলে যাচ্ছি, বলে তিনি যাচ্ছেন, কিন্তু পিছু ফিরে নয়, আমার দিকে চেয়ে চেয়েই পিছু হটে যাচ্ছেন, মিলিয়ে যাচ্ছেন যেন, নৌকায় করে যাবেন, তাও আবার আমাদের শায়েস্তাবাদের বাড়ীর ভিতরের পুকুর কুলগাছের তলার ঘাট দিয়ে। আমি লুলু সাথে সাথে নৌকা পর্যন্ত এসে ওদের মিলিয়ে যাওয়া দেখলাম। কি স্বপ্ন এ? বাল্য কৈশাের যৌবনে স্বপ্ন দেখেছি আমার প্রভুর প্রিয় স্বপ্নের ধন মহানবীকে। আবার এ বৃদ্ধ বয়সে এ সব কাদের স্বপ্ন দেখছি। ঘুম ভেঙ্গে গেল। ভাের হয়েছে তখন। আল্লাহ বাংলাদেশের দুর্যোগ রাতেরও অবসান করুন। সুপ্রভাত হােক।
১৩০
নভেম্বর, ১৯৭১
৪ নভেম্বর বৃহস্পতিবার ১৯৭১
আজ দুলুর ফোন পেলাম। ওরা ভালাে আছে। আল্লাহর কাছে শােকর। কবে কার সাথে যে কোথায় দেখা হবে জানি না। বেঁচে থাকে, ভালাে থাকে, খবর পাই তাই কত সান্ত্বনা। বিল্লুর খবরও পেলাম। ওরা জীবনে সুখী হােক। সারা দেশময় কি তাণ্ডবলীলা আজও চলছে। কবে আল্লাহ এর অবসান করবেন, কে জানে।
৫ নভেম্বর শুক্রবার ১৯৭১
রাত ৮টা
আজ ফজরের নামাজ পড়ে শুয়েছি, ৫টা বেজে গেল, ঘুম এল। স্বপ্নে দেখলাম, লুলু টুলু খুশী হয়ে বলছে, মা আনিস ভাই এসেছেন। দেখলাম আনিস তার বড় মেয়েটিকে নিয়ে এসে ক্লান্তিতে শুয়ে পড়ল। মেয়েটির হাতে একটা ভুট্টা, চঞ্চল মেয়েটি। সেটা পুড়িয়ে খাবে বলে আবদার করছে। দাদী ছিলেন। তিনি নিয়ে গেলেন রান্নাঘরে ভুট্টাটা পুড়িয়ে দিতে। আনিসকে জিজ্ঞাসা করলাম, এতদিন কোথায় না ঘুরলাম। অনেক কথা বল্লেন, যদি আল্লাহ বাঁচিয়ে রেখে আবার দেখা করবার সময় দেন, সব কথা বলা ও শােনা হবে। স্বপ্নের সত্যতাও প্রমাণ হবে, এই আশা করে আছি।
৭ নভেম্বর রবিবার ১৯৭১
গতকাল সন্ধ্যা ৭টায় ও আজ সন্ধ্যা ৬টায় সােভিয়েত বিপ্লব দিবস উৎসব উপলক্ষে ১২ নং রাস্তা ও গুলশানের রিসেপশন সমাবেশে যােগদানের জন্য গেলাম। অনেকের সাথে দেখা হল। আজ বৌমা নার্গিস জাফর হােস্টেলে গেলাে। কি যে দুঃখ বােধ হচ্ছে, রােজ সন্ধ্যায় যে আসত হাসি মুখটি নিয়ে,
১৩৩
আর কবে যে আসবে, কে জানে রােজ তাে আসতে পারবে না। মেয়েরা ছেলেরা দূরে। বৌমাটাও দূরে চলে গেল। ভালাে হােক, ভালাে থাকুক সবাই এই-ই প্রার্থনা আল্লাহর কাছে।
৮ নভেম্বর সােমবার ১৯৭১
আজ হেনা এল, টাকাটা দিয়ে বাঁচলাম। লন্ডন থেকে বুড়নের চিঠিতে জানলাম, ওরা তিন বােন রেনু খালার বাড়ী বেড়িয়ে এল এক সপ্তাহের ছুটিতে। আল্লাহ ওদের শরীর স্বাস্থ্য রুজী হায়াত ইজ্জত রক্ষা করুন এই দোওয়া করি। বৌমা ফোন করেছিল। কি নিঃসঙ্গ যে সন্ধ্যাটা লাগে। কাল রাতে নেপুর ৩টা বাচ্চা হয়েছে। যে খুশী হত আজ কাছে নেই। আল্লাহ যেন আবার খুশীতে হাসিতে অবলা পশুর দরদীকে এনে দেন।
১৩ নভেম্বর শনিবার ১৯৭১
এতদিন, কতদিন পর, আজ একটু হাতে লেখা পেলাম ৩ তারিখে লেখা। আজ দেখে তবু মনটা কত তৃপ্তি লাভ করল। আল্লাহ তুমি নেগাহবান। আলতুকে ফিরিয়ে দাও। রুমী ইকু ওরা কে কোথায় আছে। মায়ের বুকে তােমার রহমত বর্ষণ কর, ওরা বাছাদের বুকে যেন পায়।
১৪ নভেম্বর রবিবার ১৯৭১
আজ দুপুরে আবার একটু তন্দ্রার মধ্যে যে স্বপ্ন দেখলাম। বহুদিন পর ‘ও’ এসে আমাকে নিয়ে যেতে চাইল। গেলাম না। স্বামী-সন্তানকে রেখে যেতে পারি না তাে। কি গভীর মমতায় মাথায় একটি চুমু রেখে ও চলে গেল। ও কে তা-ও জানি না, অথচ কত যুগ থেকে সে আছে, আসে স্নেহে প্রেমে মমতায় মধুর হয়ে।
১৩৪
১৭ নভেম্বর বুধবার ১৯৭১
আজ কি দিন! আজ ২৭শে রমজান, রােজার মাসের শ্রেষ্ঠ দিবস। কাল রাত গেছে হাজার রাতের চেয়ে শ্রেষ্ঠ রাত। আর রাত পােহালে আজ সকাল বেলা ৮টায় হারালাম আমার শ্রেষ্ঠ ধনকে। আমার বাপ আমার দুলুর জীবনের সাথী, আমার আদরের গৌরবের ধন জামাই কাহার চাটগাঁয় রেডিও অফিসে যাবার পথে গুলী খেয়ে আজ চিরতরে ছেড়ে গেল তার দুলুকে, তার সন্তানদের, তার মা বােনকে আমাকে। আজ ৫টা থেকে ঢাকায় কারফিউ। কোনাে মতেও একটা টিকিট পেলাম না আমার বাবার মুখখানি শেষ দেখা দেখতে চাটগাঁ যাবার জন্য। ফোন। শুধু ফোনে ফোনে খবর পেলাম সব শেষ। বেলা ২টায় শাহ্ গরিবুল্লাহর মাজারে আমার বাবা শুয়ে থাকল গিয়ে। আল্লাহ! তুমি আছ তাে? কি করলে? কি চেয়েছিলাম তােমার কাছে? এই তােমার বিচার? এই তােমার দান?
২৭ নভেম্বর শনিবার ১৯৭১
আজ ১-১০ এর প্লেন-এ চাটগাঁ থেকে ফিরে এলাম। ১৮ তারিখে চাটগাঁ গিয়েছিলাম। এই ক-দিনের স্মৃতি কি করুণ, কি কাতর, কি যে অবর্ণনীয়। এই কদিন পৃথিবী আমার কাছে মুছে গেছিল। আমার দুলুর সাদা কাপড়। আমার কওসর, মােরাদ, সিমিনের শােকার্ত মুখ। জুনেদের বিষন্ন ক্লান্ত অবসরহীন সমস্ত ব্যাপারকে গুছিয়ে করার চেষ্টা, আমার বাবার কবর, তার বদ্ধ মা, বিধবা বােনের আত্মীয়স্বজন, অনাত্মীয় বন্ধু-বান্ধবদের সমবেদন সহানুভূতি সব ছাড়িয়ে আমার বাবার, আমার সাধের, গৌরবের জামাইয়ের শেষ শয়ন সমাধি দেখে এলাম। আরও কি যে বাকী আছে জানি না। আল্লাহ ওর সন্তানদের মানুষ করে দিন, এই প্রার্থনা।
১৩৫
ডিসেম্বর, ১৯৭১
৪ ডিসেম্বর শনিবার ১৯৭১
কাল রাত পৌনে ৩টায় প্রথম বিমান আক্রমণ শুরু হল। মুক্তি বাহিনীরই হােক কিংবা ভারতীয়ই হােক, ঢাকার বুকে বিমান আক্রমণ এতদিনে পৌছে গেল। লােকজনের মৃত্যু বা তেমন কোনাে ক্ষয়ক্ষতির কথা শােনা গেল না। কিন্তু আতঙ্ক-উৎকণ্ঠায় লােকজন অস্থির। কত সর্বনাশের পর এ উৎকণ্ঠা আবার কত দিন ধরে চলবে কে জানে। দিনের পর দিন জীবন থেকে মুছে যাচ্ছে। মন-জীবন-দিনক্ষণ বিরস বিবর্ণ বিস্বাদ।
৬ ডিসেম্বর সােমবার ১৯৭১
আজ ১১টায় শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশকে স্বাধীন গণতন্ত্রী বাংলাদেশ বলে স্বীকৃতি দান করলেন। বাংলার এক-এক মুঠো মাটি রক্তসিক্ত শহীদের খণ্ড হৃৎপিণ্ড। জানি না আজকের শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর এ স্বীকৃতির মর্যাদা বাংলার মানুষেরা সঠিকভাবে নিয়ে সত্যই গণতন্ত্রী এক মহান বাংলাদেশকে সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করে রাখার চেষ্টায় আত্মনিয়ােগ করবে কিনা। সন্দেহ, শঙ্কা সবই আছে। আমার যাদুধনদের বুকের রক্তে রাঙা এ মাটি। বড় পবিত্র। আল্লাহ এর মর্যাদা রক্ষা করুন। বিমান আক্রমণ চলছে। পাকিস্তানি একটি বিমানও উড়তে দেখা গেল না।
৮ ডিসেম্বর বুধবার ১৯৭১
আজকের দৈনিক পাকিস্তানের খবরে বলা হয়েছে, গত সােমবার রাতে বেগম। তাইফর ঢাকায় ইন্তেকাল করেছেন। কোনাে খবর বা আসা-যাওয়ার কোনাে উপায় নেই। সাইরেন অথবা সাইরেন ছাড়াও তেজগাঁওয়ের দিকে বিমান। হামলা চলছে। এতদিন একটি ইতিহাস-এর অবসান হল। বেগম তাইফুর, সারা তাইফুর সে যুগের মহিলাদের মধ্যে প্রগতিশীল এবং শিক্ষিতা
১৩৯
সমাজকর্মী বলে পরিচিত ছিলেন। জেল পরিদর্শিকা হিসাবে সুনাম অর্জন করেছেন, কাইজার-ই-হিন্দ পদক সমাজ সেবার জন্য লাভ করেছিলেন। তার লেখা স্বর্গের জ্যোতি, মহানবীর জীবনী সুপাঠ্য। ৯০ বছর বয়সের অভিজ্ঞতাসহ তিনি জান্নাতবাসিনী হলেন। একটি শতাব্দীর অবসান হলাে।
১২ ডিসেম্বর রবিবার ১৯৭১
রাত ১০টা
গতকাল বেলা ৩টা থেকে ঢাকায় কারফিউ দেওয়া হয়েছে, আজ পর্যন্ত চলেছে। আজ ৩ দিন ৩ রাত শামীম বাড়ীতে আর আসতে পারেনি। আজ রয়াল এয়ারফোর্স এসে ঢাকাস্থ বিদেশী দূতাবাস কর্মচারী পরিবার ঢাকা থেকে নিয়ে গেল। প্লেন থেকে গােলাবর্ষণ, তথাকথিত ভারতীয় গােলাবর্ষণ হচ্ছে মাঝে মাঝে। ঢাকার বাড়ীঘর অধিকাংশ শূন্য। ভয়াবহ নীরবতা আতঙ্ক। আশঙ্কায় মানুষ শ্বাস রােধকারী আবহাওয়ার মধ্যে দিনরাত কাটাচ্ছে। আমার ভয় নেই শঙ্কা নেই। আল্লাহ আছে। চাটগাঁ বিচ্ছিন্ন। কোথাও থেকে কারুর কোনাে খবর পাচ্ছি না। ফোনও মৃত।
১৪ ডিসেম্বর মঙ্গলবার ১৯৭১
মুক্তিবাহিনী ঢাকার কাছে এসেছে। আজ ৩ দিন থেকে ঢাকায় কারফিউ, হাটবাজার বন্ধ। আজ পানিও নেই। নিষ্প্রদীপ তাে আছেই। আশা করছি রাত যত গভীর হচ্ছে, ভােরের আলাে ততই এগিয়ে আসছে। জয় হােক সর্বহারাদের। যুদ্ধ বিরতির আলােচনা শুরু হয়েছে। শ্রীমতি গান্ধীর বাংলাদেশ স্বীকৃতি দানের পর শত্রু পক্ষের মেরুদণ্ড ভেঙ্গে পড়েছে। ইন্দিরা গান্ধী জিন্দাবাদ। মায়ের দুধ খেয়েছিল। ও সুকন্যা। আজ আশায় গৌরবে বুক ভরে উঠছে, সব হারিয়েও বাংলাদেশের স্বাধীনতা অনেক বড়। আল্লাহ যেন এ আশায় বাধ না সাধেন। ওগাে অকরুণ দাতা। অনেক দিয়েছ, অনেক নিয়েছ। বাংলাদেশের আজাদী দাও এবার।
১৪০
১৫ ডিসেম্বর বুধবার ১৯৭১
আজ ৬ মাস হল, আমার পাখীরা আমার কোলছাড়া। আল্লাহ নেগাহবানী করছেন। সর্ব দুঃখের দাহন নিয়ে আজও আল্লাহর কাছেই আবার মাথা নােয়াই। ফিরে আসুক বাংলার বুকে শান্তি। আসুক ফিরে মুজিব। আসুক যার যার বুকের ধনেরা, আজও বেঁচে আছে তারা মায়ের কোলে। আমার বাছারাও যেন ফিরে আসে। জোর দিতে ভারত যুদ্ধ বিরতির আদেশ দিচ্ছে। সন্ধ্যা ৫টা থেকে আগামীকাল সকাল ৯টা পর্যন্ত সময় নির্ধারিত হয়েছে। সােভিয়েত থেকে জোর হুমকি চলছে, আল্লাহ যেন এবার রহমত করেন।
১৬ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার ১৯৭১
আজ ১২টায় বাংলাদেশ যুদ্ধ বিরতির পর মুক্তিফৌজ ঢাকার পথে পথে এসে আবার সােচ্চার হল ‘জয় বাংলা উচ্চারণে। আল্লাহর কাছে শােকর। বুক ভেঙ্গে যাচ্ছে। সুখ-দুঃখের অনুভূতি কমে গেছে যেন, তবুও এ কি শিহরণ। আল্লাহ! তােমার দানের অন্ত নেই। ইন্দিরা গান্ধী শতায়ু হােন। শতবার কৃতজ্ঞতা জানিয়েও তার ঋণ শােধ হবে না। জয়যুক্ত হােক সােভিয়েত রিপাবলিক। আমার বাবা আমার কাহহার আজ বেঁচে নেই। আজ ২৯ দিন হল, সে শুয়ে আছে মাটির কোলে। আর আজ কি শােকাবহ ঘটনা। জয় মিছিল দেখতে গিয়ে হাতেম আলীর শালীর মেয়ে জলির বড়বােন ডলি ১৮ নং রাস্তায় গিয়ে মিলিটারির উন্মত্ততার দরুন গুলিতে মারা গেল। আহা! মা বেঁচে আছে যে। এ যে কি করুণ দৃশ্য।
১৭ ডিসেম্বর শুক্রবার ১৯৭১
আজ আমার বাবার মৃত্যুর এক মাস পূর্ণ হল। বাবারে, বাবা! আর তুই ফিরে আসবি না। ফিরে এল আজ মুক্তিবাহিনীতে যারা বেঁচে আছে, বাবুল,
১৪১
শাহাদাত, নাসিম, খােকন, আরও অনেকে, আল্লাহ বাঁচালেন সবাইকে-এও শােকর। আজ আবার ৩টায় বােরহান এসে নিয়ে গেল শহীদ মিনারে। নাগরিক সমিতিতে ভাষণ দিতে, গেলাম। কি বল্লাম মনে নেই। দেখলাম, মেয়েরা, বােনেরা, মায়েরা, ভাইয়েরা অনেকে এসেছেন, অনেকে আজ আসেনি, অনেকে আর কোনাে দিনই আসবেন না। তবু বাংলাদেশ স্বাধীন। বদর বাহিনীর চোরামার, পশ্চিমা সৈনিকদের চোরামার খেতে খেতে যে এখনও রক্তে বাংলাদেশ সিক্ত হচ্ছে, এর শেষ কবে হবে।
১৮ ডিসেম্বর শনিবার ১৯৭১
ভয়ানক, বীভৎস ভয়ঙ্কর শত্রুরা বাংলাদেশকে শােকাকুল, শােকাতুর, আতঙ্কিত, শঙ্কিত করে বদর বাহিনী হাজার হাজার লােককে এখন হত্যা করে চলছে। মুনীর চৌধুরী, রফিক, গিয়াস, মােফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, ডাঃ রাব্বি, ডাঃ আজাদসহ আরও অনেক মহিলাসহ ২৪০ জনের দেহ এখন পাওয়া গেছে। গত ১ সপ্তাহ ধরে কারফিউ দিয়ে দিয়ে জালেম হারামজাদারা এই কাণ্ড করেছে। আল্লাহ। তুমি কি এখনও কিছু করবে না? শেষ হবে না তােমার রক্ত পিপাসার? শহীদুল্লা কায়সার, সিরাজউদ্দীন হােসেনও নাকি নেই। এ কি শুনছি দেখছি?
১৯ ডিসেম্বর রবিবার ১৯৭১
নাগরিক কমিটির সভা হল আমাদের বাড়ীতে। বােরহান আহ্বায়ক, ড. কুদরত-এ-খুদা সভাপতি, তিনি আজ আসেননি। অন্যান্য মেম্বার এসেছিলেন। অনুসন্ধান করতে হবে কে কোথায় গুপ্তভাবে কাজ করেছে। মৃত্যুর সংখ্যারও শেষ নেই, মুক্তি ফৌজ-এর নিরস্ত্রীকরণের কথা হয়েছিল। পূর্বাণী হােটেলে রুহুল কুদুস সাহেবের কাছে তা বন্ধ করার জন্য যেতে হল।
১৪২
তিনি সেখানে না থাকায় সেক্রেটারিয়েট গেলাম বােরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর ও আমি। কথা হল। নওয়াব, ইনাম, মােকাম্মেল সবার সাথে দেখা হল। চাটগাঁর খবরও কিছু পেলাম। আল্লাহ জানেন বদর বাহিনী আরও কি করবে।
২০ ডিসেম্বর সােমবার ১৯৭১
মুক্তিফৌজেরা দলে দলে এসে দেখা করে গেল। কাল রাতে হালাই সাহেবের বাড়ীতে বিহারী হানাদার এসেছিল। আজ ২টা লাশ লেক-এর পাড়ে পাওয়া গেল। বেলা ১টায় একটা ফোন এল। এরিয়া ম্যানেজার ফার্মগেট থেকে ফোন করে উর্দুতে কথা বল্ল, আমার কাছে আসবে ৪ জন, বল্লো কামুফ্রেজে আসবে। কথার ধরন, হাসি ব্যঙ্গপূর্ণ মনে হল। কি জানি সত্যি ওরা ইন্ডিয়ান আর্মি, না পাঞ্জাবী পাক সেনা বুঝলাম না। তাই আজ মুক্তিবাহিনী পাহারা দিচ্ছে। মরবার ভয় করি না। অপমান থেকে আল্লাহ যেন রক্ষা করেন।
২১ ডিসেম্বর মঙ্গলবার
আজ টুলুটার জন্মদিন। আল্লাহ সৌভাগ্যবতী করুন। ইজ্জত বজায় রেখে মানে সম্মানে যেন দীর্ঘায়ু হয়। কবে চোখে দেখব কে জানে। কত যে আশা ভরসা শেষ হয়ে গেল।
২৩ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার ১৯৭১
১৯৬৯ সনের পর আজ আবার এই টেলিভিশন অফিসে গেলাম। কি বল্লাম মনে নেই। বুক, মাথা যেন খালি শূন্য, আমার বাংলার সুসন্তান শিক্ষিত, অভিজ্ঞ ওরা আজ নেই। আমি ওদের মতাে করে কি আজকাল কথা বলতে পারি। ওরা থাকলে কি আনন্দে হর্ষে পরিপূর্ণতায় এ দিনটি উচ্ছসিত হয়ে উঠত। আল্লাহ! কেন কেড়ে নিলে?
১৪৩
২৪ ডিসেম্বর শুক্রবার ১৯৭১
রাত ১০টায় আজ টুলু সােনা কলকাতা থেকে কান্নাভরা কণ্ঠে কথা কইল। লুলু, জাকিয়া বাইরে গেছে, ও কার ওখান থেকে কথা বল্ল, কানে শুনলাম। চোখে কবে দেখব কি জানি।
২৬ ডিসেম্বর রবিবার ১৯৭১
চাটগায় ফোন করলাম। আমার বাবার আজ ৪০ দিন পূর্ণ হল। ওর এতিম বাচ্চারা শাহ গরিবুল্লাহর মাজারে বাপের সমাধি জেয়ারত করে এল। আমার দোলন, আমার প্রথম সন্তান আজ বিধবা। আমি মুক্ত বাংলাদেশ-এর বুকে সভা-সমিতি করে বেড়াচ্ছি। দিল্লী থেকে সাংবাদিক ভট্টাচার্য সাক্ষাৎকার নিয়ে গেলেন। মিরপুরে ভাইয়াকে খাবার সামগ্রী পৌঁছে দিয়ে এলাম। কি দুর্ভাগা ভাইটা আমার, হাতের গ্রাসও যেন মুখে ওর তুলতে দেয় না আল্লাহ। এ কি অভিশাপ। বুকের যন্ত্রণা আর কমে না। কোনাে কিছুই আমার সম্পূর্ণ হয়ে আমাকে নিশ্চিন্ততা দেয় না। আজ হক কলকাতা গেল।
২৭ ডিসেম্বর সােমবার ১৯৭১
আওয়ামী লীগ অফিসে মহিলাদের শহীদ শােকসভা থেকে এলাম। কি সভার ছিরি। মাঠে-ময়দানে দেশের সব মহিলাদের নিয়ে এ শােক বা স্মৃতিসভা করা উচিত ছিল। আজ বাবুল বাকু কলকাতা গেল। হেঁটে। কি পাগলগুলাে সব। সবাইকে নিয়ে ৩ তারিখে ফিরবে বল্ল। দেখা যাক। গতকাল থেকে ইন্ডিয়ান এয়ার লাইন ঢাকা-কলকাতা চালু হল। দেখলাম আরও কি যে দেখব, সব যেন মঙ্গলময় শুভ সুন্দর শান্তিময় হয় এই আল্লাহর কাছে বলি। জাস্টিস নূরুল ইসলাম বাচ্চুকে এ্যারেস্ট করা হয়েছে। জাহানারা আরজুর স্বামী, ও তাে লােক ভালাে বলে জানতাম।
১৪৪
২৮ ডিসেম্বর মঙ্গলবার ১৯৭১
আজ সকালে আকাশবাণীর প্রতিনিধি দ্বীপেশ ভৌমিক, যুগান্তরের সহ-সম্পাদক এসে দেখা করে গেলেন। সাক্ষাৎকারের কথা টেপ করে নিলেন ও শ্রীমতী গান্ধীকে উদ্দেশ করে আমার কবিতাটি লিখে নিলেন, বেতার জগতে ছাপাবেন বলে। নতুন গুড়ের পায়েসটুকু খুশী হয়ে খেলেন। জাহানারা আরজু এসে কেঁদে গেল, বাচ্চুকে ধরে নিয়েছে। কি করব আমি। বিকালে লিনু বেলালের সাথে শহীদুল্লার বাড়ী গেলাম, পন্নাকে দেখলাম। কি বলবার আছে। কি করবার আছে। ২টি বাচ্চা, বৃদ্ধা মা, আল্লাহ! তুমি এত নিষ্ঠুর কেন? আমি আর পারি না। যেন আমার লােলন টোলন, জাকু মিনু কবে আসবে? এখন বড় দেখতে ইচ্ছে করে ওদের। আজ আবার ইয়াকেভ নাম নিয়ে নারায়ণগঞ্জ থেকে ফোন করল। ইংরেজিতে চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বল্ল। আমি ইংরেজি জানি না বলায় খুব ঠাট্টা করে ফোন ছাড়ল।
২৯ ডিসেম্বর বুধবার ১৯৭১
আমার ‘দুলু’র মুখ দেখি আজ বাংলার ঘরে ঘরে
শ্বেতবাসা, আর শূন্য দু’হাত নয়নে অশ্রু ঝরে বু
কে করে সন্তানে
যাপিছে দিবস রাত্রি, কি করে সে কথা ওরাই জানে।
দেউটি নিভেছে নীড় হারা পাখি পক্ষী মাতার মতাে
দু’বাহু প্রসারি আগলিতে চাহে দামাল দুলালে যত,
ওরা তা মানে না, বক্ষে ওদের জ্বলিছে ক্ষুব্ধানল
পিতৃহারা যে করেছে মােদেরে কোথা সে দানব দল,
একবার দেখি! গােপনে যে ভীরু সরীসৃপ সম এসে
লক্ষ প্রাণেরে ছােবল মারিয়া বিবরে লুকাল শেষে
১৪৫
একটি ছােবল বিনিময়ে চাহে শতেক আঘাত হানি
বিদারিয়া দিতে ত্রুর দানবের পাষাণ বক্ষ খানি
অশ্রু নিবারি রক্ত চক্ষু ওরা চাহে প্রতিশােধ
ওদের মনের দাবাগ্নিজ্বালা কে করিবে প্রতিরােধ
অভাগিনী মাতা সকাতরে চাহে আবরি রাখিতে তারে
এখন গােপন শত্রুর দল হানা দিয়ে বারে বারে
পরাজিত-বিদ্বেষে
রক্তের স্রোত বহাইতে চাহে সােনার বাংলাদেশে।
ঘৃণ্য নির্লজ্জ অধম দানব নিষ্ফল আক্রোশে
পথে বাহিরায় সারমেয় সম ক্ষুধিত উদরে এসে।
ঘৃণা ভরে কেহ মারে না ওদের, শহীদ শােণিতে পূত
এ মাটির পরে যেন ওই পাপ রক্তের সােতাল্পুত
বহে না, ঘৃণা কলুষ কালিমা লিপ্ত দানব দেহ
এ মাটিতে পড়ে কলুষিত করে চাহে না তা আর কেহ
তাই আজ মুছি অশ্রুর ধারা সন্তানহীন মাতা
জয়ে, গৌরবে প্রার্থনা করে ওগাে দাতা
ওগাে ত্রাতা সুন্দর কর মহামহীয়ান কর এ বাংলাদেশ
এই মুছিলাম অশ্রুর ধারা দুঃখের হউক শেষ।
৩১ ডিসেম্বর শুক্রবার ১৯৭১
আজ সকালে কলকাতা হিন্দী পত্রিকার সম্পাদক বিষ্ণু কান্ত শাস্ত্রী ও দিল্লীর সাংবাদিক রঘু বীর সহায় এক সাক্ষাৎকারে এসেছিলেন, অনেকক্ষণ ধরে আলাপ আলােচনা করলেন, ছবি তুললেন, কয়েকটি কবিতাও নিয়ে গেলেন। এর মধ্যে ডক ও খুকু এল মিনুর সুটকেস নিয়ে, ওরা আজ বিকালে আসবে বল্লে। কিন্তু সারা দিন ধরে অপেক্ষা করলাম ওরা এল না। সন্ধ্যায়ও আশা করেছিলাম, ওরা এল না। বছর আজ শেষ, কি যে যন্ত্রণা বুকের মধ্যে।
৩টায় বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির সভায় ২১ নং পুরানা পল্টনে গেলাম। মণি সিং ও অন্যান্য কমরেডের সাথে দেখা হল। আমাকেও কিছু বলতে হল, বল্লাম, কি বল্লাম জানি না। ১৯৭১ আজ শেষ হয়ে গেল, জানি না, আগামী কালের দিন কিভাবে শুরু হবে।
১৪৬
বাহাত্তরের ডায়েরি
এপ্রিল, ১৯৭২
১৪ এপ্রিল শুক্রবার ১৯৭২
১০৪ নং পার্ক স্ট্রিট, কলকাতা
৮/বি তারক দত্ত রােড। ঐতিহাসিক বাড়ি। সর্বজনশ্রদ্ধেয় মরহুম কাজী আবদুল ওদুদ সাহেবের বাড়ি। বর্তমানে রবিউদ্দীন সাহেবের বাড়ি। গতকাল ভাের ৬টায় ঢাকার বাড়ি থেকে রওনা হয়ে সাড়ে ৭টা থেকে আরিচাঘাটে বসে বসে বেলা ১টার ফেরি ধরে রাত ৯টায় বেনাপােল পােস্টে এসে শুনলাম গাড়ির পারমিট নেই বলে গাড়ি বর্ডার পার হতে দেওয়া হবে না। রবিউদ্দীন মােহাইমেন নেমে গিয়ে কাস্টমস অফিসারকে আমার কথা বলায় গাড়ির পাশে ভিড় জমে গেল। অনুরােধ এল, আলাে জ্বালিয়ে দেন, সুফিয়া কামালকে দেখব। পুলিশ ওরা, হিন্দু পুলিশ-পরম শ্রদ্ধায় নমস্কার জানাল। অফিসার নিজে এসে বললেন, কেন প্লেনে না এসে এত কষ্ট করে গাড়িতে এলেন? সমস্বরে সবাই বলে উঠল, তাহলে কি আমাদের সৌভাগ্য হত এই মহীয়সী মহিলাকে দেখার। মহীয়সী মহিলা আমি? গা শিউরে উঠল। মন নত-বিনত হয়ে এল। আল্লাহ কত দিয়ে কত নিয়ে তুমি! রাত ১২টায় এসে রবিউদ্দীনের বাড়ি উঠলাম। আজ সকালে অন্নদাশঙ্কর রায়ের বাড়ি গেলাম। কী আদর করলেন মিসেস এবং মিস্টার রায়। মেয়েদের বাড়িও নিয়ে গেলেন। সাড়ে ৪টায় রবীন্দ্রসরােবরে মৈত্রীমেলায় অধিবেশন হল। ৭টায় বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী সেমিনার হল। বিষ্ণুকান্ত শাস্ত্রীর সঙ্গে দেখা হল।
রাত ১১টা বেজে গেছে। আমার বাচ্চারা এখন ঢাকায় কী করছে? আমি রেণুর সঙ্গে কথা বলছি। কত কথা, কত ব্যথা, কারুর ভাগ্যে সুখ থাকলেও শান্তি হল না। আমার দুলু কী না ছাই করেছিল?
১৫ এপ্রিল শনিবার ১৯৭২
বিবেকানন্দ হল
পুরােনাে বছর গিয়ে নতুন বছরের একটা দিন কেটে গেল। আমার অতীতও কি বিলুপ্ত হল? অসুস্থ টুলুকে রেখে এসেছি। মনে বিকার বড়াে একটা নেই।
১৫১
অনেক চেষ্টা সাধনা ব্যর্থ হয়ে গেছে, এবার স্রোতে নিয়তির হাতে ভেসে চলেছি। আমি কি ক্ষয় হয়ে যাচ্ছি; কোনাে আশা-আকাঙ্ক্ষা, ভরসা করতে আর ভরসা পাই না। নিষ্ঠুর দরদী যে খেলা খেলবে তাই ধ্রুব, তাই চরম, তাই অমােঘ। বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির সেমিনার বিবেকানন্দ হলে বসে লিখছি, কী দারুণ ভবিতব্য। ভাইস চ্যান্সেলর ৫০ হাজার টাকার চেক দিলেন কামরুজ্জামান এম.সি.-এর হাতে। শিক্ষামন্ত্রী ইউসুফ আলীর কাছে ছাত্রদের সাহায্যের জন্য ড. কোটারির হাত দিয়ে দেওয়া হল।
১৬ এপ্রিল রবিবার ১৯৭২
ফাইন আর্টস বিল্ডিংয়ে সকাল-সন্ধ্যা কবি সম্মেলন হল। প্রধান অতিথি হলাম। কবিতা পড়লাম। সন্ধ্যায় বিষ্ণু দে ও তার স্ত্রী মনিকুন্তলা সেনের সঙ্গে দেখা হল। এপার বাংলা ওপার বাংলার কবিদের কবিতা পড়া ভালােই হল। মহিলা ফেডারেশনের সভায়ও বিকেলে গেলাম। রমাদি সভানেত্রী। রাত্রে জাহাঙ্গীর কবির সাহেবের ছেলের বিয়ে খেলাম মুসলিম ইনস্টিটিউটে। জাহানারা চৌধুরীর সঙ্গে দেখা হল; ও অমনি আছে। কত আদর করল। রাত ১০টায় এসে দেখি লুলু এসে হয়রান হয়ে শুয়ে পড়েছে। মনে হয় কত কাল যেন ঢাকা ছেড়েছি। কিন্তু আমি তাে স্রোতের কুটা। অনুভূতি কি সব শেষ। হয়ে গেছে?
১৭ এপ্রিল সােমবার ১৯৭২
আজ সন্ধ্যায় গীতা, মৌলিক সবার সঙ্গে দেখা হল। বউ-মা গৌরীকে নিয়ে নিউমার্কেট গেলাম। কফি খেলাম, তিন টাকার সওদাও করলাম। গীতাকে দেখে খুব ভালাে লাগল। মুখের মিষ্টি কথাও মানুষের যে কী প্রয়ােজন! পাখি মরে আঠাতে, মানুষ মরে মিঠাতে। আমি তাে মিঠাতেই মজলাম। আর সেই মিঠা কী হয়ে গেল!
১৫২
তারিখ বােঝা যাচ্ছে না।
রাত ১০ এই মাত্র মৈত্রীমেলা থেকে ফিরলাম। আজ গৌরী আইয়ুবের বাড়ি গেলাম। বউমা, আমি, লুলু। সকালে আম্বিয়ার বাড়ি চা খেয়ে সারা দুপুর ঘুরলাম। লুলু এখনাে ফেরে নি। মনে হয় কতকাল ঢাকা ছেড়ে এসেছি। ভিড় ভিড় মানুষের ভিড়—সবাই কি আন্তরিক, সবই কি সত্য? তবে যেন পৃথিবীর সুন্দর হয়।
তারিখ বােঝা যাচ্ছে না
ঢাকার কোনাে খবর নেই। নেশাগ্রস্তের মতাে আমি চলছি। সুখ, দুঃখ, ব্যথা, বেদনার ক্ষীণ অনুভূতি যদি চলে যেত আমি বাঁচতাম। আজ সংস্কৃতি সংসদের নৃত্যানুষ্ঠান হল। বিপুলভাবে সংবর্ধিত সমর্থিত হল। সবার সঙ্গে দেখা হচ্ছে; চিনতেও পারি না কে কোন জন। তবে বােধ হয় পরে মনে হবে। অনেক বই-কাগজপত্র উপহার পেলাম। কালকে শেষ দিন। কাজী দাদুকে দেখতে গেলাম। বেলা ১২টা। কী পরিণতি! আল্লাহর কী মরজি জানি না। বুক ভেঙে চোখ পানিতে ভরে ওঠে। কী আশ্চর্য! ওরা সবাই দেখল আমার মাথায় রাখলেন, উনি মিষ্টি করে হাসলেন। বাড়িসুষ্ঠু লােক দৌড়ে এসে অবাক হয়ে দেখল, তিনি হাসছেন। আমাকে হাত ধরে আদর করছেন। জানি এ কী!
তারিখ বােঝা যাচ্ছে না
আজ সকাল ৯টায় আবদুল ওদুদ সাহেবের সমাধিফলক স্থাপন করতে তিলজলা গােরস্থানে গেলাম। মানুষের দেহের পরিণতি। ইচ্ছে করছিল শুয়ে পড়ি ওখানে। আম্মার কবর গােবরায়। সেটা বন্ধ আছে। কেই-বা এল গােরস্থানে। মৈত্রী সমিতির ১০/১২ জন, অন্নদাবাবু, তাঁর স্ত্রী, আমি আর রবিউদ্দীন, শওকত ওসমান। গােরস্থানও চরম দুরবস্থার মধ্যে আছে, স্থানীয়
১৫৩
লােকরা খুব অসন্তোষ প্রকাশ করল। ওখান থেকে এসে গেলাম আকাশবাণীতে। আজ শেষ দিন মেলার। বাংলাদেশ মিশনে চায়ের দাওয়াতে গেলাম, বিষ্ণু দের বাড়ি থেকে মেলা। মেলা থেকে মৌলিকের বাড়ি বউ-মাসহ গিয়ে রাত ১১টায় ফিরলাম। উহ্, আজকের ভিড় আর লােকের আপ্যায়নে অস্থির হয়ে গেছি।
২৪ এপ্রিল সােমবার ১৯৭২
আজ সকাল ৭টায় প্লেনে ঢাকা যাচ্ছি। শাহেদ এয়ারপাের্টে পৌঁছে দিয়ে গেল। কত আদর-যত্ন ওদের। ট্যাভি ভাড়াও ও দিল। বার বার মনে পড়ছে যাদের দেখলাম। বিষ্ণু দে, সুভাষবাবু, কাজী দাদু; সবচেয়ে আবু সয়ীদ আইয়ুব আর গৌরীকে মনে পড়ছে। আশ্চর্য মেয়ে। ওর প্রতি মন কী যে অনুভূতিতে ভরে উঠেছে। ঢাকা যাব আমার ঘরে। কী ঘর! লুলু কলকাতায় রইল, কাল যাবে।
২৬ এপ্রিল বুধবার ১৯৭২
হােটেল অশােকা। ২৭১ নং কামরা। আবার লম্বা পথ পাড়ি দেওয়া শুরু হল। যাচ্ছি দিল্লি হয়ে মস্কো, মস্কো থেকে বুলগেরিয়া, তারপর ইস্ট জার্মানি; আবার মস্কো হয়ে ২৬/২৭ তারিখে যদি ফিরি। মালেকা আর আমি মহিলা পরিষদের সভানেত্রী ও সম্পাদিকা বেশ আছি। বাছারা পৌছে দিয়ে গেল এয়ারপাের্টে। ঢাকা সময় ঠিক ৭টায় প্লেন উড়ল, ৯টায় পালামৌ এয়ারপাের্টে এল। ১০টা বাজতে ১২ মিনিট থাকতে অশােকায় এসে উঠলাম। মালেকা ঘুমাচ্ছে, আমার ঘুম নেই।
১৫৪
২৭ এপ্রিল বৃহস্পতিবার ১৯৭২
এয়ার ইন্ডিয়া। ঢাকা সময় সাড়ে ৯টা। বােয়িং ৭০৭ সকাল ৬টায় পালামৌ বিমানবন্দরে এসেছে। বেলা ৯টায় বিমান আরােহণের ব্যাপার নিষ্পত্তি হল। বাপ, কী ঝামেলা। অরুণা, আসফ আলী, বাণী দাশগুপ্তও যাচ্ছেন। তারা লন্ডনের প্লেন ধরে চলে গেলেন। ছেলেটা অনেক সাহায্য করল। ৮ ঘণ্টায় মস্কো যাওয়া। এখন ওখানে সকাল ৬টা, আমাদের ৯টা। ১২টা বেজে গেল, চলছি তাে চলছি। নারকেল তেলগুলাে সব পড়ে গেছে। সুটকেসের একদিকের চাবির কলটা ভেঙে গেছে। শাল আনি নি। ঢাকায় এখন ওরা কী করছে? মােরাদ আল্লাহ চাহে চাটগাঁ পৌছে গেছে। আসার সময় শামীমকে দেখে আসি নি। অনেকে এখন ঘুম দিচ্ছে। আমার ঘুম নেই, সুপারি কাটলাম। একটা কবিতা লিখলাম।
২৮ এপ্রিল শুক্রবার ১৯৭২
রাশিয়ান এয়ারােফ্লোত
ঢাকা সময় সাড়ে ৭টা। এখানে সাড়ে ৮টা। প্লেন উড়ল বুলগেরিয়ার দিকে। ঠিক সামনে মেঘলা আকাশে সূর্য, ঈষৎ বামে। দিনের শেষ নেই। আমার চলারও শেষ নেই। অরুণাদি ও বাণী কালকেই বুলগেরিয়া চলে গেছে। এয়ারপাের্টে রাশিয়ান কনস্যুলেট ও উইমেন্স ফেডারেশনের ট্রেড ইউনিয়নের মহিলা ছিলেন। নিয়ে গেলেন হােটেল ‘স্পুৎনিক’-এ। নানা দেশের মহিলা ডেলিগেশনসে ভর্তি। মালেকার ভাই কিবরিয়া তার বাড়িতে নিয়ে গেল। নাদেরা ভাত রেধে খাওয়াল। রাতে ওখানে থাকলাম; সকালে শামসুর রহমান রাষ্ট্রদূত হােটেল ‘উক্রেনে গেলাম। আফসারী খুব যত্ন করল। স্পুৎনিকে এসে উদয়ন-এর সম্পাদকের সঙ্গে সাক্ষাৎ হল। আমার কবিতা যে অনুবাদ করেছে সে এল, ছবি নিল। ১টায় সময় খেয়ে এয়ারপাের্টে আসতে ২টায় রওনা না হয়ে ৩টায় পৌছলাম। ৩ ঘণ্টা লাগবে বুলগেরিয়া যেতে।
১৫৫
সাব্বিরকে, সিমিনকে চিঠি দিলাম। আমার ঘড়িতে সাড়ে ৯টা বাজল। চা খাওয়া হল। ওদেসা সাগর পার হচ্ছি। নীচে মেঘ, পরে বরফ। সূর্যটা ডানদিকে রেখে এখন চলেছি। প্লেন এখন এত উঁচুতে যে নীচের কিছু দেখা যাচ্ছে না। কাল বিকেল থেকে মস্কোতে বৃষ্টি হয়েছিল। আসার সময় রােদ ছিল। শীত বেশ কম। শাল বা সােয়েটার আনিনি। নাদেরার শাল-সুটকেস নিয়ে এসেছি। মালেকা ক্লান্ত। জর জ্বর ভাব। ঘুমাচ্ছে। আমি অক্লান্ত। নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে।
২৮ এপ্রিল শুক্রবার ১৯৭২
ঢাকা সময় রাত ২টা
এখানে ৪টায় এসে ভার্না এয়ারপাের্টে নামলাম। কাস্টমস, হেলথ হতে হতে ১২টায় এসে হােটেলে উঠলাম। গােসল করলাম। খেলাম। অরুণাদি, বাণীর সঙ্গে দেখা করে এই এলাম। চাঁদের আলােয় ঝলমল করছে সমুদ্র। কত যে রূপ দেখলাম।
২৯ এপ্রিল শনিবার ১৯৭২
হােটেল কমিউনিস্ট পার্টি
ভার্না। ঢাকা সময় ১১টা, বুলগেরিয়া সময় ৭টা সকাল
কাল রাত ১০টায় পথে আসতে লাল সূর্যকে ডুবতে দেখা গেল। আজ আমার ঘড়িতে ৯টায় শুয়ে শুয়ে সূর্য ওঠা দেখা গেল। কত কাব্যে-সাহিত্যে কৃষ্ণ সাগরকূলের সঙ্গে পরিচয়, আমার কি এখানে আসার কথা ছিল, সাধ্য ছিল, যােগ্যতা ছিল? সাধ! সাধ ছিল বইকি। কিন্তু এ যে স্বপ্নের মতাে। তিনি কল্পনার সাধ পূর্ণ করলেন। তিনি আর যে একান্ত সাধ, কত সাধ, তা কেন পূর্ণ করলেন না? মালেকা ক্লান্ত। নেপাল থেকে কলেজের ছাত্রীনেত্রী শােভা সাক্কী আমাদের রুমমেট, ও ক্লান্ত। আমার কী হল। কত কিছু। (…) আমার এই (…) বয়সেও কোথায় কী আছে, কী নাই, কেন হল জানবার ইচ্ছা এত কেন!
১৫৬
২৯ এপ্রিল শনিবার ১৯৭২
ঢাকা সময় ১টা, ভার্না সময় ৯টা।
আজ সারা দিন বিশ্রাম। রােমান পার্ক, রেড স্কোয়ার, অনেক দোকান ঘুরলাম। ১২টায় হােটেল কমিউনিস্ট পার্টিতে এসে খেলাম। একটু শুলাম। আবার গেলাম নীচে সমুদ্রকূলে। অপূর্ব সুন্দর কৃষ্ণসাগর, ওদেসা। এত সুন্দর করে নিজের দেশকে আমার দেশের মানুষরা গড়তে পারবে? পাশের একটা রেস্তোরায় গেলাম, ভাষা জানা নেই। বাংলাদেশের বলতে মালেকা। শােভা আমাকে চা খাওয়াল। দুধ-কমলা খাইয়ে কী খুশি। সমুদ্রের মধ্যে আধমাইল জেটি। সেখানে গেলাম। বুঝি আজ পূর্ণিমা। দুপুরের পর থেকে সমুদ্র অস্থির, উত্তাল, উন্মাদ। তাই নৌকো চলছে না। গােসল করলাম, লিখছি। একটা পয়সা নেই টিকেট পােস্টকার্ড কিনে ঢাকায় চিঠি দেই। আল্লাহর নামে চলছি। সমুদ্র উত্তার, সবাই দেখে; অন্তর উত্তাল কি দেখা যায়।
৩০ এপ্রিল রবিবার ১৯৭২
ঢাকা সময় ২টা, ভার্না সময় ১০টা।
উইমেন ইন্টারন্যশনাল ডেমােক্র্যাটিক ফেডারেশনের বৈঠক শুরু হল। উদ্বোধন করলেন মেয়র। প্রধান অতিথি ভ্যালেনতিনা তেরেসকোভা। সভানেত্রী এলেনা নাস্তজিনােভা। ১টায় হােটেলে গিয়ে খেয়ে এলাম। এখানের ৩টা আমার ৭টা। দ্বিতীয় অধিবেশন চলল। তেরেসকোভার সঙ্গে দেখা হল। সেই কবে দেখেছে মনে নেই, তবু বাংলাদেশে চুম্বন-প্রীতি বিনিময় হল। কাল থেকে সূর্যের দেখা নেই। কৃষ্ণসাগর উত্তাল, উন্মাদ। চাঁদকে খুঁজে মেঘের দিকে আক্রাশে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। কোথায় চাদ, কোথায় সমুদ্র। কোথায় আমি, কোথায় ঢাকা। কে কোথায় কার জন্য কাঁদে, কেন কাঁদে-কী জানি। অরুণা, আসফ আলী অধিবেশন পরিচালনা করছেন।
১৫৭
মিসেস ইলিনা
এলেভেরি, কলম্বাে।
শােভা সাক্কি, নেপাল
ভ্যালেনটিনা তেরেসকোভা
গ্রেট ব্রিটেন
এলবাবান ডােয়েরন, ইকুয়েডর
মিসেস দিমিত্রভ, বুলগেরিয়া
৬টায় হােটেলে ফিরে নুরজাহান মুরশিদের হােটেলে গেলাম। আলতাফ সাহেব, আমজাদ সাহেব ও আবদুর রউফের সঙ্গে ওখানে দেখা হল। ধার করলাম টিকেট-পােস্টকার্ড কিনতে। খেয়ে ৮টায় গেলাম ভার্না অপেরা হাউসে। সব ডেলিগেটরাই। নাচ, গান, অর্কেস্ট্রা দেখাশােনা হল। হােটেলে এসে চিঠি লিখলাম। গােসল করলাম। আমার ঘড়িতে রাত সাড়ে ৩টা; সবাই ঘুম। সমুদ্র অশান্ত আর আমি! ঘুম নেই, যেন ভাবনাও নেই।
১৫৮
মে, ১৯৭২
১ মে সােমবার ১৯৭২
ঢাকা সময় ৩টা, ভার্না ৪টা।
সকাল ১০টা থেকে রেড স্কোয়ারে প্যারেড দেখা হল। সে কী প্যারেড। ভার্নার কেউ ঘরে নেই যেন আর। হােটেলে কাল খেতে যাওয়ার কথা রয়েছে। লােক নেই, যারা কিনছে পয়সা রেখে খাবার নিয়ে যাচ্ছে প্যাকেট করে। হােটেলে আজ আর খাওয়া নেই। পাশের কমিউনিস্ট পার্টির ট্রেড। ইউনিয়ন হােটেলে ১ মার্চ উপলক্ষে খাওয়ার দাওয়াত। তেরেসকোভা এলেন। ১টায় খেতে বসে ৩টায় খাওয়া শেষ হল। টোস্ট করতে আর নাচতেই সময় কাটল। তেরেসকোভার সঙ্গে পানির গেলাস নিয়ে টোস্ট করলাম। বাংলাদেশ! ৯৮টা দেশের লােক বাংলাদেশকে অভিনন্দন। জানাচ্ছে। বাংলা! আমার সােনার বাংলা। কত মূল্য দিয়ে তােমাকে পেলাম। তুমি অমর হয়ে থেকো। বৃষ্টি, মেঘলা সমুদ্র উন্মাদ। আফ্রো-এশিয়া উইমেন কমিটির মিটিংয়ে মঙ্গোলিয়াকে বাংলাদেশের সমর্থন জানাতে মালেকা দাঁড়িয়ে পড়ল।
জুলিও কুরি হল থেকে ভিয়েতনামের ধ্বংসকাণ্ডের ছবি দেখে ফিরে এলাম। ঢাকার কথা মনে পড়ছে। ঘর থেকে বের হওয়ারও উপায় ছিল না। ভিয়েতনামের দৃশ্যও তাই। ৪টায় চায়ের বিরতির পর এখন ৫টায়, আমাদের ৯টায়, মালেকা রিপাের্ট পেশ করছে। বাংলাদেশ! বাংলাদেশ! সমস্ত হলের মহিলা উৎসুক। প্রচুর আগ্রহে সবাই রিপাের্ট শুনলেন, হাততালি অনেকক্ষণ চলল। আমেরিকার মহিলা নিনের কীর্তি শােনালেন। সব দেশে এই শয়তানের হাত প্রসারিত। নিজের দেশের মানুষরা বেকার। মিসেস কারমেন আমেরিকা তথা নিনের বৃত্তান্ত বিবৃত করলেন।
ঢাকা ৩টা, ভার্না ১১টা।
৬টায় হােটেলে এসে তাড়াতাড়ি খেয়ে ছুট ছুট, দিমিত্রভের ৯৯ বছর পালন করার বক্তৃতা-ফিল্ম শাে দেখে এক্ষুনি গােসল করলাম। সমুদ্র শান্ত।
১৬১
২ মে মঙ্গলবার ১৯৭২
ঢাকা সময় ১টা, ভার্না ৯টা।
অধিবেশন শুরু হল, তেরেসকোভা সভানেত্রী। আলােচ্য বিষয় ভিয়েতনাম। ১০টায় বিরতি। মােজাম্বিক মহিলা সমিতির রিপোের্ট পেশ। বিরতির সময় সাক্ষাৎ হল বুলগেরিয়ার উইমেন্স পত্রিকার সাংবাদিক ইলিনা তুরলাকোর সঙ্গে। অনুবাদিকা ইরিনা মিররােভা। এখন মােজাম্বিক মহিলাদের অধিবেশন চলছে। নূরজাহান এসে দেখা করে গেল। ওরা ৮ তারিখে ঢাকা পৌঁছাবে। চিঠি দিলাম সঙ্গে। ইচ্ছা করছে ঢাকা যেতে। কাল থেকে বড় ক্লান্ত লাগছে। ঢাকার খবর নেই। মন অস্থির। দিনটাও মেঘলা, বৃষ্টি হচ্ছে ঝিরঝির করে। প্যালেস্টাইন মহিলা সমিতির রিপাের্ট শুরু হল। সমগ্র আরব দেশ ইহুদিরা দখল করছে। মেয়েরা আন্দোলন চালাচ্ছে। বিপ্লবে তরুণীরা যােগদান করছে। গাজায় ১ লাখ আরব বন্দিশিবির আছে। শিশু, বৃদ্ধ, মহিলারা অসংখ্য বন্দিশিবিরে আছে। প্যালেস্টাইন, জেরুজালেম, গাজায় অমানুষিক অত্যাচার চালাচ্ছে। ইসরায়েলি দেশ আরব দেশকে মুষ্টিগত করতে চেষ্টা করছে। প্যালেস্টাইনের হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী কায়রাে বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসছে। প্যালেস্টাইনের রেড ক্রিসেন্ট দালালি করছে। ড. আয়েশা রিফিউজি শিশু-নারীদের জন্য হাতের কাজ, সেলাই, ওষুধ, খাওয়া-থাকা ও সংস্কৃতি রক্ষার চেষ্টা করছেন। মিসেস রাবিয়া খানম। পানামা মহিলা সমিতি : মা ও শিশুদের সমস্যার আলােচনা হচ্ছে।
ভার্না ৩টা, ঢাকা সময় রাত ৭টা।
দুপুরে খেতে গিয়ে দেখি সমুদ্র কূলে কূলে ভরা। শান্ত, গাঢ়, কালাে। শান্ত হল সমুদ্র। কেন? কী পেল ও? পেল কী, যাতে শান্ত নিস্তরঙ্গ ও আজ? আমি কেন (পাই) না সেই পরশ যাতে শান্ত নিরুদ্বিগ্ন হয়ে দিন কাটাতে পারি? কবি, কবি, কবি শুনে শুনে আর সাক্ষাৎকারে ছবি তােলার ধুমে আমি আচ্ছন্ন। কী মূল্য দিতে হয়েছে এর জন্য, ওরা কি তা কেউ জানবে?
১৬২
৩ মে বুধবার ১৯৭২
ভার্না ৯টা, ঢাকা ১টা।
কাল রাত ৯টা থেকে ১২টা পর্যন্ত দিমিত্রভের জীবনী আলােচনা আর সিনেমা শাে দেখে হােটেলে গিয়ে গােসল করে শুলাম। আজ এখন অধিবেশন শুরু হল। সমুদ্র শান্ত। ৯০ বছর হল সাইপ্রাসের মহিলা সমিতির সেক্রেটারি রিপাের্ট পেশ করেছেন। বাংলাদেশের কথা সহানুভূতির সঙ্গে উল্লেখ করলেন। কম্বােডিয়ার আলােচনা করেছেন কম্বােডিয়ার সেক্রেটারি। এখন অরুণা আসফ আলী তার বক্তব্য পেশ করছেন। বাংলাদেশের বিস্তারিত আলােচনা করেছেন এবং যে যে দেশ স্বীকৃতি দিয়েছে (তার) উল্লেখ করলেন। জর্ডান মহিলা সেক্রেটারি তার বক্তব্য বলেছেন। অরুণাদি খুব চমৎকার করে বললেন ইন্ডিয়া ও বাংলাদেশের কথা। কত বছরের কঠিন অভিজ্ঞতা তাঁর। জাপানি মহিলা সেক্রেটারি তার বক্তব্য পেশ করছে, ওয়েস্ট জার্মানি, সবাই বাংলাদেশের কথা উল্লেখ করছে। চায়ের বিরতির পর সেক্রেটারি জেনারেল ডব্লিউ আইডি এফ-এর রিপাের্ট পেশ করলেন। ৮ হাজার মিলিয়ন মেম্বার আছে। এক ঘণ্টা ধরে বুলগেরিয়া মহিলা ফেডারেশনের রিপাের্ট পড়া শেষে দেড়টায় হােটেলে গিয়ে খেয়ে আসা হল। সাড়ে ৩টায় আবার অধিবেশন আরম্ভ। অরুণাদি যথাসময়ে যথাস্থানে। বাণী আর মালেকার পাত্তা নেই। মনটা খুঁত খুঁত করছে। মেয়েটা না ভেসে যায়।
সাড়ে ৩টা, দ্বিতীয় অধিবেশন।
গায়েনা মহিলা সমিতির সেক্রেটারি। এখন অস্ট্রেলিয়া মহিলা সমিতির সেক্রেটারি ভাষণ দিচ্ছেন। গ্রিক, স্পেন, আরব, মঙ্গোলিয়ান, গায়না, ফ্রেঞ্চ, ডেনমার্ক নানা দেশের মানুষ-মেয়েমানুষেরা নিজের দেশের সংগ্রামের পীড়নের ইতিহাস বর্ণনা করছে। শুনতে শুনতে মাথা ঘুলিয়ে ওঠে। আমার দেশ বাংলাদেশ কম করেছে কি?
১৬৩
৪ মে বৃহস্পতিবার ১৯৭২
ভার্না বেলা আড়াইটা, ঢাকা সাড়ে ৬টা। কাল রাতে বুলগেরিয়ার শ্রেষ্ঠ অপেরা হাউসে গীতিনাট্য দেখে ১১টায় ফিরে খেয়ে শুলাম। শেষ রাতে সমুদ্র ও আকাশ এক সঙ্গে গর্জন বর্ষণ আরম্ভ করে দিল। আজ ৯টায় অধিবেশন হল না। ভিয়েতনাম ও বুলগেরিয়ার সিনেমা শাে দেখানাে হল। ভিয়েতনামও বাংলাদেশের মতাে জয়যুক্ত হােক আল্লাহর কাছে। প্রার্থনা করি। মনটা খুব খারাপ। নাদেরার কাছ থেকে শালটা আনলাম। সকালে গায়ে দিয়ে আবার খুলে কোট পরে ভুলে শালটা হােটেলে ফেলে। গেলাম। পাচ্ছি না আর ফিরে এসে। কী লজ্জা, কী দুঃখ ও কষ্ট যে পাচ্ছি। এ দেশে নাকি কিছু হারায় না। দেখি আমার কপাল। ভার্না সাড়ে ৩টা, ঢাকা সাড়ে ৭টা। জুলিও কুরি হল। অধিবেশন শুরু হল। ৬টা ভাষায় তর্জমা হলাে, বাংলা ভাষা ছাড়া। চিলি মহিলা ফেডারেশনের মিস রােজা বারগেল। স্পেনের মিসেস ক্রিশ্চিনা। পােলিশ মহিলা সমিতির ১৮ সপ্তাহ মেটারনিটি লিভ দাবি। (…)
৬ মে শনিবার ১৯৭২
ভার্না ১১টা, ঢাকা ৩টা।
জানি না আজ কী বার। এইমাত্র হারানাে রােজনামচাটি সােফিয়ার এক মহিলা এনে দিলেন। কাউন্টারে রেখে ভুলে গিয়েছিলাম। কতবার কত কিছু আমার হারাল, আবারও ফিরে পেলাম। তাই মনে হচ্ছে, বাড়িতে সবাই ভালাে আছে। কিন্তু অমূল্য ধন যাকে হারালাম তাদের তাে আর ফিরে পাব না। কত মূল্যে বাংলাদেশ পেলাম। এই দেশেরই জন্য সর্বক্ষতি সহ্য করার ক্ষমতা যেন আল্লাহ দেন। সােফিয়া যাওয়া হবে না। যাচ্ছি ২টার প্লেনে বার্লিন। অরুণাদি সকালের প্লেনে সােফিয়া গেলেন। কাল রাতে হােটেল। ইন্টারকন্টিনেন্টালে ডিনার হল। নাচ-গান, পাল হলেভা। হই হই করে ভালাে লাগল না। বয়সের জন্যই হয়তাে। কাল থেকে মেঘ, বৃষ্টি, রােদ সমান।
১৬৪
আজও বৃষ্টি হচ্ছে, ঝলমলে রােদ। গতকাল তেরেসকোভার সঙ্গে দুপুরে খেলাম। পাটের ব্যাগ ও সােভিয়েতের দিনগুলি বইটি উপহার দিলাম। জানি ও পড়বেও না, তবু দিতে পারার আনন্দে দিলাম। আশ্চর্য এখানেই রীতি। এত বড়াে একটি নামি মহিলা আমাদের সঙ্গে সারা দিনই আসছে, যাচ্ছে, খাচ্ছে, মিটিং করছে। খুব ভালাে লাগল। আজও সমুদ্র শান্ত, ভরা। মাঝে মাঝে হুঙ্কার শােনা যায়। কিন্তু অতটা ভয়ংকর রূপ নেই। মনও ভালাে নেই, অবসরও হল না সমুদ্রস্নানের। যারা থেকে গেলেন তারা খুব সমুদ্রস্নান করছেন। আমাদেরও থেকে যাওয়ার জন্য জোর করা হচ্ছে। কিন্তু মালেকা, আমি আর থাকতে চাই না। বাড়ির কোনাে খবর নেই। শােভা রইল।
রাশিয়ার এয়ারােফ্লোত সােফিয়ার পথে ভার্নার পৌনে ৩টা, ঢাকার পৌনে ৭টায় প্লেন আকাশে উড়ল। প্লেনে এলাম ভার্না, কৃষ্ণসাগর। এরা বলে ওদেসা। কমিউনিস্ট রেস্ট হাউস, কামরা ৩০১। শােভাকে রেখে চলে যাচ্ছি। আরাে অজানার পথে। খুব শব্দ আর বাম্পিং হচ্ছে। মালেকা কাহিল। আর আমি!
আমারে তুমি অশেষ করেছ
এমনি লীলা তব।
কত না কানন, কত না নদীতীরে
বাজালে তােমার এ ছােটো বাঁশিটারে।
তােমায় লীলার বাঁশি আমাকে বাজাও
তােমার মােমের বাতি আমাকে জ্বালাও।
২৭ মে রবিবার ১৯৭২
সােফিয়া কমিউনিস্ট রেস্ট হাউস।
সকাল ৭টা, ঢাকা ১১টা। ৭০১ নং রুম। গতকাল ঠিক ৪৫ মিনিটে সােফিয়ায় প্লেন এসে নামল। মিরার ইন্টারপ্রেটার তাে সঙ্গে ছিলই। সােফিয়ার মহিলারা এসে ঘেঁকে ধরলেন। তক্ষুনি গেস্ট হাউসে এসে আবার পার্টির অফিসে মিটিং-এ গেলাম। বাংলাদেশ! রাস্তার মানুষ হা করে দেখছে। ওখান থেকে
১৬৫
মহিলাদের ক্লাবে গেলাম। সেখানে শিশুদের নামকরণ, আকিকা উৎসব হয়। আগে গির্জায় হত, এখন ক্লাবে হয়। শিশু তিন দিন বা তিন মাস অথবা তিন। বছরের হলেও ক্ষতি নেই। বাবা-মা বা নানা-নানি, দাদা-দাদি প্রকাণ্ড রুটি ও মধু নিয়ে আসবেন। নাম রাখা হয়ে গেলে রুটি ছিড়ে ছিড়ে মধু মাখিয়ে সবার হাতে দিয়ে দেওয়া হয়। আর কেক, বিস্কুট, রুটি যার যা ইচ্ছামতাে খাও। বেশ লাগল (…)। খুবই ক্লান্ত লাগছিল। রেস্ট হাউসে এসে তরুদির (…)। ভারতীয় রাষ্ট্রদূত গােপাল সিং-এর বাড়িতে রাতের খাওয়ার দাওয়াত পেলাম। ভাত খাব, এই ভেবে মালেকা আমি খুব খুশি। (…) এখন রাত ৯টা বেজে গেছে, ঢাকায় ১২টা। সবাই ঘুম। কে কেমন আছে আল্লাহ জানে। ভালাে থাক, ভালাে আছে—এই ভেবেই ভালাে থাকব। সকাল ৯টায় বের। হয়েছি। রােববার সব দোকানপাট বন্ধ। বেশ রােদ ঝলমলে দিন। রাস্তায় দলে দলে লােক। লিবার্টি পার্ক। ২টা বিয়ে দেখলাম। বিয়ে সেই রাশিয়ার মতােই। কিন্তু (…) দিল নুন, আর রুটি বরের মা, কনের মা দিল চকোলেট। সােফিয়া গির্জাও রাশিয়ার তৈরি (…) ভাস্কর্যে অপরূপ সােনালি চার্চ। সেখানে। একজনের মা-বাবার মৃত্যু দিবস উপলক্ষে উপাসনা হচ্ছিল। পাদরি জরির পাগড়ি পরে প্রার্থনা করলেন। দিমিত্রভের মসােলিয়মে গেলাম তার মমি দেখতে। আজ বন্ধ। খুলবে ৯ তারিখ। আর দেখা হবে না। কাল চলে যাচ্ছি। ১০টার প্লেনে বার্লিন। অনেক ঘুরলাম। এদের সব বিরাট পার্ক আর গির্জা-মসােলিয়মে ঘুরতেই কোথা দিয়ে তিন ঘণ্টা কেটে গেল। এসে খেয়ে ৩টায় বের হয়ে বলকান পাহাড়ে ২ হাজার ৬০০০০ কিলােমিটার উপরে উঠলাম গাড়িতে করে। কী অপূর্ব যে এসব জায়গা! মানুষ নিজের হাতে পাহাড় কেটে বরফ ভেঙে তৈরি করেছে। মানুষের রুচি শক্তি সাধনা মানুষের জন্যই। আমাদের দেশের মানুষরা পেট ভরে খেতে পাবে তাে? পথে পথে কবি, শিল্পী, দেশপ্রেমিকদের মূতি। তুর্কি আমলে বুলগেরিয়া ভাষার জন্য ‘পিয়াসি’ নামে যে সন্ন্যাসী আন্দোলন চালিয়েছিলেন তার প্রকাণ্ড মূর্তি পার্কে রাখা আছে। কবি ইভাননের মূর্তির তলায় রােজ ফুল দেওয়া হয়। জার (…) আমলের বহু পুরাতন চার্চ (…) দেখলাম। বলকান পাহাড়ের উপর শত কিলােমিটার উপরে সােনালি ব্রিজ প্রকাণ্ড পাথরের মাঝ দিয়ে বয়ে আসছে। (…) সন্ধ্যায় মিরার বাড়ি গেলাম, চা খেলাম। ওর মেয়ে (…) পিয়ানাে বাজাল।
১৬৬
৮ মে সােমবার ১৯৭২
রাশিয়ান এয়ারফ্লোত
বেলা ১১টা, ঢাকা সময় পৌনে ৪টা। বার্লিনের পথে সকাল ৯টা থেকে মিরা কত কিছু কিনে দিল। ওদের দেশের (…) কোথাও আর চলবে না। এয়ারপাের্ট পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে গেল মিরা আর (…) বুলগেরিয়া মহিলা সমিতি। কাল সারা রাত ঘুম হয় নি। কে কোথায় কেমন আছে আল্লাহ জানে। ২ ঘণ্টা ৪৫ মিনিটে বার্লিন পৌছব। সুন্দর, অতি সুন্দর শহর ও গ্রাম। সােফিয়া পড়ে রইল নীচে। আকাশপথে কিছুই দেখা যাচ্ছে না।
৯ মে মঙ্গলবার ১৯৭২
রুম-৬১০, গেস্ট হাউস অন স্প্রি, বার্লিন
সকাল ৮টা থেকে ১২টা। ঢাকা, মস্কো, ভার্না, সােফিয়া, বার্লিন। কে ঠেলে ঠেলে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। জানি তার লীলার অন্ত নেই। কাল দেড়টায় এসে বার্লিন পৌছলাম। এখানের মহিলা সমিতির সেক্রেটারি ও আর একজন মহিলা উপস্থিত ছিলেন। এয়ারপাের্ট থেকে আমরা যে ভারী সুটকেস আনতে অপারগ মহিলারাই বয়ে নিলে এলেন। কেন ওরা আল্লাহর সাহায্য পারে না। আল্লাহর দেওয়া হাত-পা, শরীর, মনেরও পূর্ণ সার্থক ব্যবহার করে মানুষের জন্য। এদের দরদের অন্ত নেই। এসে গােসল করে চা খেয়ে গেলাম বাংলার মুক্তিযােদ্ধাদের হাসপাতালে ও বাংলাদেশ অ্যাসেমব্লিতে। হাশেম আনােয়ারুল ইসলাম। মরিয়ম হাশিমউদ্দীনের জামাই, আর এখানে শামিমের বন্ধু। হােটেলে আছে। মুক্তিযােদ্ধারা ১৫ জন আছে, অনেকে ২৫ তারিখ চলে যাবে। শকু, শমসের, মুবিন আজ থেকে হাঁটতে শুরু করবে, পরে ও যাবে। কী যে আরামে ও সুব্যবস্থায় এরা আছে। আমাদের হাসপাতালে গেলে তাে বমি আসে। হফম্যান হসপিটাল সিটি। বহু হাসপাতাল এখানে। আশ্চর্য এই যে, বার্লিনের অনেক জায়গা দেখছি আর মনে হচ্ছে আমি যেন আগে এখানে
১৬৭
ছিলাম। আবহাওয়া এখন আমাদের মাঘের শেষ ফাল্গুনের প্রথমের মতাে। এখন এখানে বসন্তকাল। স্প্রি নদীর উপরই এই গেস্ট হাউস; তাই নাম গেস্ট হাউস অন স্ত্রি।
বেলা ৫টা, ঢাকা রাত ৯টা।
এই মাত্র শহর ঘুরে এলাম। দ্রষ্টব্য যা কিছু সবই এরা দেখাচ্ছেন। অজানা। সৈনিকদের স্মৃতিসৌধ, অনির্বাণ দীপশিখা জ্বলছে। নাম না জানলেও সেদিনের মৃতদের সম্মানে পদক রাখা আছে। লাঞ্চ খেলাম বাইরের একটি রেস্তোরায়, আর গেলাম ওয়েস্ট বার্লিনের সীমান্তে। সামান্য জায়গা মাত্র। যেমন তামাবিলের নােম্যানস ল্যান্ড। আর দেখলাম রাইখস্টাগ প্রাসাদ, আগরতলার মতাে মিথ্যা মামলা সাজিয়ে দিমিত্রভ ও অন্য নারী-পুরুষ নেতাসহ সব দেশপ্রেমিক মুক্তিযােদ্ধাদের যেখানে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। সেখানকার স্মৃতিসৌধে সিনেমার মতাে করে বার্লিনের ম্যাপ দেখানাে হল, দেখানাে হল কোন কোন জায়গা আমেরিকানরা সিআইএ-তে ভর্তি করে রেখেছে। সেখানকার প্রদর্শক ভদ্রলােক বাংলাদেশকে অভিনন্দন জানালেন। ছােট টেডিবিয়ার আর (…) উপহার দিলেন। বাংলাদেশ আজ মুখে মুখে। সােফিয়ার পাইওনিয়ার শিশুদল বাংলাদেশের গান রচনা করে শুনিয়েছিল, বাংলা অমর হােক।
১০ মে বুধবার ১৯৭২
সকাল ৭টা, ঢাকা ১১টা।
কাল সন্ধ্যায় ডিনার খেয়ে এখানকার সবচেয়ে প্রসিদ্ধ অপেরা হাউসে অপেরা দেখে যখন ফিরলাম ঢাকার ৪টা, এখানে ১২টা। কাচের জানালা দিয়ে চেয়ে দেখলাম স্প্রি নদীর বুকে অজস্র আলাের মালা। আলােকিত উদ্ভাসিত নগরী বার্লিন। এখনাে অত্যাচারী হিটলারের বর্বরতার সাক্ষ্য কত ভাঙা বাড়ি দাড়িয়ে যেন বলছে, আবার আমরা মুক্তি পেলাম, জাগলাম নতুন অভ্যুদয়ে। আমাদের বাংলাদেশও মুক্তি পেল, কিন্তু জাগবে না আবার ঘুমিয়ে পড়বে—এই কথা মনে হয়। না জাগবে। আহা, কত বাছার রক্তে ধােওয়া বাংলাদেশ।
১৬৮
ঢাকার রাত ১১টা, এখানে ৬টা। এইমাত্র ঘরে ফিরলাম। চা খেয়ে সাড়ে ৮টায় ওয়েস্টার্নর্বার্গে গেলাম হিটলারের তৈরি কনসেনট্রেশন ক্যাম্প দেখতে। দুই ঘণ্টা লাগল যেতে। দূরে ওয়েস্ট বার্লিনের সীমানা। ওয়েস্টার্নবর্গে যেতে পাসপাের্ট দেখাতে হল। ৩০টার মধ্যে মাত্র একটা দেখেই মনে যে কী করছে। ১ লাখ ৩২ হাজার মেয়ে-বাচ্চা বন্দি ছিল; ৯২ হাজার মারা গেছে। ১২ ঘণ্টা কাজ করাত। ৬ হাজার মেয়ে দিনরাত কাজ করত। অসুস্থ হলে ক্ৰেমেটোরিয়ামে জীবন্ত পুড়িয়ে মারত। ৩টা ক্ৰেমেটোরিয়াম দেখলাম। শাস্তি দেওয়ার জঘন্য কঠোর ব্যবস্থা, ফাঁসি দেওয়ার অন্ধকার সেল। বন্দি মেয়েদের ওপর নানা ডাক্তারি পরীক্ষা হত। মাসল কেটে, স্তন কেটে, ইনজেকশন দিয়ে ফল কী হয় দেখার জন্য অমানুষিক নির্যাতনের ছবি তুলে ওরাই রেখেছিল; পালানাের সময় ফেলে গেছে। মেয়েদের চুল কেটে নিত। অসংখ্য আংটি পাওয়া গেছে। এক সারিতে দাঁড় করিয়ে কাজে অক্ষম ২ হাজার মেয়েকে গুলি করে মারা হয়েছে। ১৯৪২ পর্যন্ত এই বর্বরতা চলেছে। ওখান থেকে বের হয়ে ১টার সময় ওয়েস্টার্নবার্গের এক হোটেলে গিয়ে আসতে দুই ঘণ্টা লাগল। এসে প্যানােরমা রেস্টুরেন্টে চা খেলাম ৩৭ তলার কাফেতে।
১১ মে বৃহস্পতিবার ১৯৭২
ইন্টারফ্লোত, বার্লিন থেকে মস্কোর পথে
ঢাকা সময় সন্ধ্যা সাড়ে ৮টা, বার্লিন সময় সাড়ে ৪টা। চলেছি ফিরে মস্কো। সকাল ১০টায় গেলাম টেলিভিশন টাওয়ারে। ২০৭ মিটার উঁচু। সেখানে বসে চা খেলাম। এক ঘণ্টায় বসা অবস্থায় চেয়ারে থেকেই সারা বার্লিন শহর দেখলাম। ঘুরে ঘুরে যাচ্ছে ২০০ লােকসুদ্ধ গােলাকার বস্তুটা। আল্লাহ মানুষকে কী শক্তি দিয়েছে। ১২টায় এসে খেয়ে বৃষ্টির মধ্যেই এয়ারপাের্টে এলাম। কাল থেকে বার্লিনে বৃষ্টি হচ্ছে, কিন্তু কেউ ঘরে বসে নেই। সব কাজ চলছে ঠিক মতােই। আমরাও চলেছি। দুই ঘণ্টা ৫৫ মিনিটে মস্কো পৌছে যাব।
১৬৯
১২ মে শুক্রবার ১৯৭২
হােটেল রাশিয়া, রুম নং ৯৭১
ঢাকা সময় সাড়ে ৩টা, মস্কো সাড়ে ১২টা। ঠিক ২ ঘণ্টা ৫৫ মিনিটে ঝকঝকে রােদ ও ভীষণ ঠান্ডার মধ্যে মস্কো এলাম। ভার্না, সােফিয়া, বার্লিন এবং বাংলাদেশের সময় ৫ ঘণ্টা তফাত ছিল; মস্কোতে ৩ ঘণ্টা। কাল হােটেলে আসার পর মালেকার ভাই এসে তার বাড়িতে নিয়ে গেল। ১৫ দিন পর আলু ভর্তা, ভাত, ডাল খেয়ে আজ সকালে ৮টায় হােটেলে এলাম। শফিকও এয়ারপাের্টে উপস্থিত ছিল। আজ সকালে মহিলা ফেডারেশনের অফিসে গেলাম। এসে লাঞ্চ সেরে আবার মহিলা ফেডারেশনের প্রদর্শনী দেখতে গেলাম। কত কথা এরা জানতে চায়। আর কবি বলে যে (…)। সেখান থেকে এসে ৬টায় গেলাম বাংলাদেশ দূতাবাসে একটি পার্টিতে। মালেকা টিকেটের ব্যাপারে (…) রইল। (…) গেলাম মালেকার ভাইয়ের সঙ্গে। ওখান থেকে ১০টায় মালেকার ভাইয়ের বাড়িতে খেয়ে গেলাম। (…) ১০টায় হােটেল বন্ধ হয়ে যায়। টাকিভর্তা, আলুভর্তা, ডাল, মাছ দিয়ে অনেক খেলাম। নাদেরা খুব যত্ন করেছে। শুনলাম ফ্রেন্ডশিপ সােসাইটি আমাকে এক সপ্তাহ থেকে যেতে বলেছে। অসহ্য। এই ১২টায় হােটেলে এসে গােসল করলাম। এখন শােব। নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে। রাত ১২টা। আজ ১০টায় লেনিন মসােলিয়াম দেখলাম। এক মহান পুরুষ মহাশয়ানে শায়িত। কী যে আশ্চর্য কঠিন পাহারার মধ্যে সুরক্ষিত। এক ঘণ্টা লাইন ধরে ধরে এগিয়ে যেতে হল। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ দেখে যাচ্ছে এ মূর্তি। মনে হয় এখনি উঠে বসবে। ওখান থেকে এসে খেয়ে ৫টার সময় নভিকভের সঙ্গে গেলাম (…) বাড়ি। কী যে খুশি হলেন। উপহার দিলেন। সেখান থেকে সাড়ে ৭টায় প্যালেস অফ কংগ্রেসে। ক্রেমলিনের ভিতরে ব্যালে দেখতে গিয়ে মালেকাদের পেলাম না। আমি দেরি করে গেছি। নাজমা পৌছে দিয়ে চলে গেলে একা ঢুকে পড়লাম। ব্যালেও দেখলাম। পরে আর আসার পথও চিনি না, ভাষাও বুঝি না। এক মহিলাকে বলতে পুলিশের কাছে নিয়ে গেলেন। হেঁটে হেঁটে তাদের নির্দেশমতাে হােটেলে পৌছালাম সাড়ে ১১টায়। রেণু-মালেকা ভেবে অস্থির হয়েছিল। হারালাম না।
১৭০
১৪ মে রবিবার ১৯৭২
রাত, ঢাকা সময় ২টা।
আজ ১০টায় নভিকভ এসে মালেকা ও আমাকে নিয়ে গাের্কি লেনিনস্কিতে গেল। ইদরিস ভাই, নবী সাহেব, কামরুজ্জামান সাহেবরাও হােটেল উক্রেনে থেকে গেলেন। সেখানে লেনিন আহত হয়ে বাস করেছেন, মারাও গেছেন সেখানে। বিরাট জায়গা জুড়ে সে মিউজিয়াম। বাংলাদেশের বলে আমাদের খুব যত্ন করে দেখানাে হল। ২টায় ফিরে এসে কিবরিয়ার ওখানে খেয়ে বিশ্রাম করে গেলাম সাড়ে ৫টায় নভিকভের বাড়ি ডিনার খেতে। ইদরিস ভাইয়েরাও গেলেন। ১০টায় ফিরে সাড়ে ৫টায় ফিরে গােসল সারলাম। কাল যদি বিকেল ৪টায় মস্কো থেকে রওনা হতে পারি, তবে তিবলিসি ও বম্বে হয়ে পরশু ১২টায় ঢাকা পৌছাব। এই আশা করে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইছি।
১৫ মে সােমবার ১৯৭২
রাশিয়ান এয়ারােফ্লোত
ঢাকা সময় রাত ৯টা, মস্কো ৬টা।
প্রবল বৃষ্টির মধ্যে মস্কো থেকে এয়ারপাের্টে এলাম আড়াইটায়। পাের্টে এসে দেখা হল ফজল সাহেব, ইলিয়াস আর দুজন এমসি-র সঙ্গে। বজলুও ছিল, সে যাচ্ছে কায়রাে। নবী সাহেব, কামরুজ্জামান সাহেব আছেন সঙ্গে। এয়ারপাের্টে নাদেরা, কিবরিয়া, আফসারী এল। এলেন ম্যাডাম লুমাে মুদ্রভা, নভিকভ ও দানিলচুক। এত ভালাে লাগল ওদের আপন করা ভাব। ১০টার সময় মাদাম পাপােভার সঙ্গে দেখা করলাম ফ্রেন্ডশিপ অফিসে। কী খুশি হলেন। নবী সাহেব ও ইদরিস ভাইও সঙ্গে ছিলেন। বারবার বললেন আমাকে এসে তিন সপ্তাহ স্যানাটোরিয়ামে বিশ্রাম নিয়ে থাকতে ও আমার লেখার যাতে ব্যাঘাত না হয় তার জন্য খুব শান্তভাবে থাকতে। এয়ারপাের্টেও আবার
১৭১
লুমাে মুদ্রা সে কথা বললেন। আরাে বললেন, তােমার সৌভাগ্যবান স্বামীকে আমার শ্রদ্ধা জানাবে; যে তােমার মতাে স্ত্রী পেয়েছে। তাকে আমি শ্রদ্ধা জানাই। তাই কি? এত কী আমার যােগ্যতা। অনেক সুখের সঙ্গে অনেক দুঃখ। আজ ফিরে যাচ্ছি ঢাকা। আনন্দ, শঙ্কা, বেদনায় বুক ভরে উঠেছে। আমার দুলর কথা মনে পড়ছে। কী ছিল ওর অভাব। আজ সে ভিখারিনী। তার ভাগ্য কেন এমন হল। এখানকার সময়মতাে ৫টায় প্লেন মাটি ছাড়ল। এখন ৬টা ১০, ঢাকা সময় ১টা, তিবলিসিতে রাত ৭টা। এক ঘণ্টার জন্য তিবলিসিতে প্লেন থামল। একটা কার্ড পেলাম। এয়ারপাের্টে গিয়ে গরম কফি খেয়ে বেশ ভালাে লাগল। প্লেনে ৬টায় রাতের খাওয়া দেওয়া হয়েছিল। এখন বম্বের পথে প্লেন চলেছে। সেই ‘৬৭ সালে তিবলিসি এসেছিলাম। আজ প্লেনে বসে দেখছি ককেশাস পাহাড়ের ধাপে ধাপে আলাে জ্বলছে। কোহকাফ শহর; পরিরা কোথায়? ঢাকায় সবাই ঘুম। কখন ঢাকা যাব। বাংলাদেশের অনেকেই প্লেনে আছেন, ঘরােয়া লাগছে। ভার্না, সােফিয়া, বার্লিন, মস্কোতে যাদের ছেড়ে এলাম তাদের কথা মনে পড়ছে।
১৬ মে মঙ্গলবার ১৯৭২
এয়ারােফ্লোত
ঢাকা সময় ৯টা ১৫।
সারা রাত প্লেন চলল। ভাের ৪টায় জানালা দিয়ে দেখলাম সূর্যোদয়। ৭টায় প্লেন বম্বে নামল। এক ঘণ্টা এয়ারপাের্টে ঘুরেফিরে প্লেনে এলাম। সাড়ে ৮টায় প্লেন উড়ল। তিন ঘণ্টা ২০ মিনিটে ঢাকা নামবে। আল্লাহ ভরসা। বাড়িতে গিয়ে কাকে পাব। কেউ জানে না আমরা আজ আসছি।
১৭২
সংক্ষিপ্ত জীবনপঞ্জি
জন্ম : ২০ জুন ১৯১১, সােমবার, বেলা ৩টা
জন্মস্থান : রাহাত মঞ্জিল, শায়েস্তাবাদ, বরিশাল
পৈতৃক নিবাস : শিলাউর, কুমিল্লা।
পিতা : সৈয়দ আবদুল বারী
মাতা : সৈয়দা সাবেরা খাতুন
ঢাকার বাসস্থান : ১৫ ধানমন্ডি আবাসিক এলাকা, সড়ক ১১ (পুরাতন ৩২) ঢাকা-১২০৯
১৯১২ ইসূমে আজম জপ করতে গিয়ে সুফি মতাবলম্বী পিতা সৈয়দ আবদুল
বারীর চিরতরে গৃহত্যাগ।
১৯১৮ কোলকাতায় বেগম রােকেয়ার সাথে প্রথম সাক্ষাৎ।
১৯২৩ মামাতাে ভাই সৈয়দ নেহাল হােসেনের সাথে বিবাহ। শায়েস্তাবাদ থেকে বরিশাল শহরে গমন। বরিশাল থেকে প্রকাশিত তরুণ’ পত্রিকায় সুফিয়া এন. হােসেন নামে প্রথম লেখা “সৈনিক বধূ’ (গল্প) প্রকাশ। কবি কামিনী রায়-এর বরিশাল আগমন। সুফিয়া এন, হােসেন-এর বাসায় এসে লেখার জন্য উৎসাহ প্রদান।
১৯২৫ বরিশাল ‘মাতৃমঙ্গল’-এর একমাত্র মুসলিম সদস্যা হিসেবে সামাজিক কর্মকাণ্ডে আত্মনিয়ােগ। গান্ধীজীর বরিশাল আগমন, নিজ হাতে চরকায় সুতা কেটে প্রকাশ্য জনসভায় গান্ধীজীর হাতে তুলে দেন।
১৯২৬ ‘সওগাত’ পত্রিকায় প্রথম লেখা (কবিতা ‘বাসন্তী’) প্রকাশ।
১৯২৭ প্রথম কন্যা সন্তান আমেনা খাতুন (দুলু)-এর জন্ম।
১৯২৮ পারিবারিক প্রতিবন্ধকতা ও সামাজিক কুসংস্কার উপেক্ষা করে প্রথম বাঙালি মুসলিম মহিলা হিসেবে বিমানে উড্ডয়ন। এজন্যে পরবর্তীকালে বেগম রােকেয়া কর্তৃক অভিনন্দিত।
১৯২৯ বেগম রােকেয়ার ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম’-এর সদস্য হিসেবে কাজ শুরু। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর জন্মদিনে কবিতা প্রেরণ। কবিগুরুর আমন্ত্রণে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে কবির সাথে সাক্ষাৎ। কবি কর্তৃক ‘গােরা’ উপন্যাস উপহার লাভ।
১৯৩০ সওগাত’-এর প্রথম মহিলা সংখ্যায় ছবিসহ লেখা প্রকাশ।
১৭৫
১৯৩১ ‘ইন্ডিয়ান উইমেন্স ফেডারেশন’-এর প্রথম মুসলিম মহিলা সদস্যা মনােনীত।
১৯৩২ স্বামী সৈয়দ নেহাল হােসেনের অকালমৃত্যু।
১৯৩৩ ‘কলিকাতা কর্পোরেশন স্কুল’-এ শিক্ষকতা শুরু (১৯৩৩-১৯৪১)।
১৯৩৭ প্রথম গল্পগ্রন্থ কেয়ার কাটা’ প্রকাশ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিনে একটি কবিতার মাধ্যমে তাঁকে শুভেচ্ছা জ্ঞাপনের পর আলমােড়া থেকে কবিতায় কবিগুরুর প্রত্যুত্তর।
১৯৩৮ প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সাঁঝের মায়া’ প্রকাশ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ‘সাঁঝের মায়া’ গ্রন্থটি উপহার পাঠালে তাঁর কাছ থেকে আশীর্বাদপত্র লাভ। ভূমিকা লেখেন কাজী নজরুল ইসলাম।
১৯৩৯ চট্টগ্রামের কামালউদ্দীন খান-এর সাথে বিবাহ।
১৯৪০ ব্রিটিশবিরােধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ। পুত্র শাহেদ কামাল (শামীম)-এর জন্ম।
১৯৪১ মা সৈয়দা সাবেরা খাতুনের মৃত্যুবরণ।
১৯৪৩ পুত্র আহমেদ কামাল (শােয়েব)-এর জন্ম। বর্ধমানে নারীনেত্রী মণিকুন্তলা সেনের সাথে পরিচয়।
১৯৪৪ পুত্র সাজেদ কামাল (শাব্বীর)-এর জন্ম।
১৯৪৬ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় কোলকাতায় লেডী ব্রবাের্ন কলেজ’-এ আশ্রয়কেন্দ্র পরিচালনা। এ সময় দাঙ্গাবিরােধী কর্মকাণ্ডে শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে প্রথম পরিচয়। দাঙ্গার পর মােহাম্মদ মােদাব্বের, শিল্পী কামরুল হাসান, তাঁর ভাই হাসান জান ও অন্যান্য মুকুল ফৌজ’ কর্মীদের নিয়ে কংগ্রেস একজিবিশন পার্কে (পার্ক সার্কাস) ‘রােকেয়া মেমােরিয়াল স্কুল’ নামে কিন্ডারগার্টেন পদ্ধতির স্কুল চালু।
১৯৪৭ দেশবিভাগের পূর্বে বাংলা ভাষায় মুসলমানদের প্রথম মহিলা সচিত্র সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘বেগম’-এর প্রথম সম্পাদিকার দায়িত্ব গ্রহণ। দেশবিভাগের পর স্বামীর সাথে ঢাকায় আগমন। ঢাকায় প্রখ্যাত মহিলা নেত্রী লীলা রায়, জুইফুল রায় ও আশালতা সেন-এর সঙ্গে পরিচয়। তাঁদের সাথে ‘শান্তি কমিটির কাজে যােগদান।
১৭৬
১৯৪৮ পূর্ব পাকিস্তান মহিলা সমিতির সভানেত্রী মনােনীত।
১৯৪৯ জাহানারা আরজুর সঙ্গে যুগ্ম সম্পাদনায় সাপ্তাহিক সুলতানা’ প্রকাশ।
১৯৫০ কন্যা সুলতানা কামাল (দুলু)-এর জন্ম। ঢাকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় প্রতিরােধ আন্দোলনে নেতৃত্বদান এবং ত্রাণকার্যে আত্মনিয়ােগ।
১৯৫১ ‘মায়া কাজল’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ। ঢাকা শহর শিশু রক্ষা সমিতি’র সভানেত্রী নির্বাচিত।
১৯৫২ ভাষা-আন্দোলনের সময় ঢাকায় মহিলাদের সংগঠিত করে মিছিলের আয়ােজন। মিছিলে নেতৃত্বসহ সামগ্রিক আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ। ‘পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলন’-এর কার্যনির্বাহী কমিটির সহ-সভানেত্রী নির্বাচিত। কন্যা সাঈদা কামাল (টুলু)-এর জন্ম।
১৯৫৪ ‘ওয়ারী মহিলা সমিতি’র প্রতিষ্ঠা এবং এর প্রথম সভানেত্রী নির্বাচিত। ১৯৫৫ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে ঢাকায় রাজপথে প্রথম মহিলাদের ঘেরাও আন্দোলন।
১৯৫৬ দিল্লিতে সাহিত্য সম্মেলনে যােগদান। তাঁর বাসভবনের আঙিনায় (তারাবাগের বাসা) অনুষ্ঠিত সভায় জাতীয় শিশু সংগঠন কেন্দ্রীয় কচি-কাঁচার মেলার প্রতিষ্ঠা।
১৯৫৭ ‘মন ও জীবন’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ।
১৯৫৮ ‘প্রশস্তি ও প্রার্থনা’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ।
১৯৫৯ ‘বাফা’ (বুলবুল ললিতকলা একাডেমী) পুরস্কার লাভ।
১৯৬০ সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে ঢাকায় ‘বেগম রােকেয়া সাখাওয়াত স্মৃতি কমিটি গঠন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রীনিবাসের নাম ‘রােকেয়া হল’ করার প্রস্তাব পেশ।
১৯৬১ ছায়ানট সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিষ্ঠা, এর সভানেত্রী নির্বাচিত।
পাকিস্তান সরকারের তমঘা-ই-ইমতিয়াজ’ পুরস্কার লাভ।
১৯৬২ কাব্যসাহিত্যে বাংলা একাডেমী পুরস্কার লাভ।
১৯৬৩ আততায়ীর হাতে পুত্র আহমদ কামাল (শােয়েব)-এর মৃত্যু।
১৯৬৪ ‘বেগম ক্লাব’ পুরস্কার লাভ। উদাত্ত পৃথিবী’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ।
১৯৬৫ ‘ইতল বিতল’ (শিশুতােষ) ছড়াগ্রন্থ প্রকাশ। নারীকল্যাণ সংস্থা সভানেত্রী নির্বাচিত। পাক-সােভিয়েত মৈত্রী সমিতির সভানেত্রী নির্বাচিত।
১৭৭
১৯৬৬ ‘দীওয়ান’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ। মস্কোয় ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ উৎসবে যােগদানের উদ্দেশ্যে প্রথম সােভিয়েট ইউনিয়ন গমন। সাঁঝের মায়া’র দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ।
১৯৬৭ ‘কেয়ার কাটা’র দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ।
১৯৬৮ ‘সােভিয়েটের দিনগুলি’ (ভ্রমণ কাহিনী) প্রকাশ।
১৯৬৯ ‘অভিযাত্রিক’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ। মহিলা সংগ্রাম কমিটির চেয়ারম্যান নির্বাচিত। আইয়ুববিরােধী গণ-অভ্যুত্থানে ঢাকায় মহিলাদের সমাবেশে সভানেত্রী ও মিছিলে নেতৃত্বদান। আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ স্বরূপ তমঘা-ই-ইমতিয়াজ’ প্রত্যাখ্যান।
১৯৭০ সােভিয়েট ইউনিয়নের সম্মানসূচক ‘লেনিন পদক’ লাভ। মহিলা পরিষদ গঠন ও সভানেত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ। ‘৭০-এর ঘূর্ণিঝড়ে দক্ষিণ বাংলায় রিলিফ বিতরণে নেতৃত্ব। মৃত্তিকার ঘ্রাণ’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ। ‘সমাজ উন্নয়ন সংস্থা’-র সভানেত্রী নির্বাচিত।
১৯৭১ মার্চ মাসে ঐতিহাসিক ‘অসহযােগ আন্দোলন’-এ ঢাকায় মহিলাদের সমাবেশ ও মিছিলে নেতৃত্বদান। মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকার ধানমন্ডিস্থ নিজ বাড়িতে অবস্থান করে মুক্তিযােদ্ধাদের সাহায্য-সহযােগিতা প্রদান। পাকবাহিনীর ভয়ভীতি ও মানসিক নির্যাতন উপেক্ষা করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ। বড় মেয়ে দুলুর স্বামী আবদুল কাহহার চৌধুরীর মৃত্যু। পাকিস্তানের পক্ষে স্বাক্ষরদান প্রস্তাবের বিরােধিতা। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জনসভায় সভানেত্রী। ‘একাত্তরের ডায়েরী’র পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম টেলিভিশন অনুষ্ঠানের উদ্বোধন।
১৯৭২ ‘মাের যাদুদের সমাধি পরে’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ। মহিলা পরিষদ’-এর সভানেত্রী হিসেবে বুলগেরিয়া, পূর্ব জার্মানি ও সােভিয়েত ইউনিয়ন সফর। দুঃস্থ পুনর্বাসন সংস্থা গঠন ও সভানেত্রীর দায়িত্ব পালন।
১৯৭৫ ‘আন্তর্জাতিক নারী দশক’ উপলক্ষে জাতিসংঘ সমিতির ‘অনন্যা নারী পদক লাভ। বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর স্বৈরাচারবিরােধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বলিষ্ঠ নেতৃত্বদান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ‘মাের যাদুদের সমাধি পরে’ কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদ ‘Where My Darlings Lie Buried’ প্রকাশ।
১৭৮
১৯৭৬ ‘স্বনির্বাচিত কবিতা সংকলন প্রকাশ। বাংলাদেশ সরকারের একুশে পদক’ ও লেখিকা সংঘের ‘নূরন্নেছা খাতুন বিদ্যাবিনােদিনী’ পুরস্কার লাভ।
১৯৭৭ স্বামী কামালউদ্দীন খান-এর মৃত্যু। নাসিরউদ্দীন স্বর্ণপদক’ ও ‘শেরে বাংলা জাতীয় সাহিত্য পুরস্কার লাভ।
১৯৭৮ ‘কুমিল্লা ফাউন্ডেশন’ পুরস্কার লাভ। পারিবারিক উদ্যোগে প্রথম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গমন।
১৯৮১ ‘নওল কিশােরের দরবারে কিশাের কবিতাগ্রন্থ প্রকাশ। চেকোস্লোভাকিয়ার ‘সংগ্রামী নারী পুরস্কার’ ও ‘ঢাকা লেডিস ক্লাব পুরস্কার লাভ।
১৯৮২ ‘রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ’-এর সভানেত্রী নির্বাচিত। মুক্তধারা মহিলা পুরস্কার’ ও ‘ফুলকী শিশু পুরস্কার’ (চট্টগ্রাম) লাভ।
১৯৮৩ ‘বেগম জেবউননিসা মাহবুবউল্লাহ ট্রাস্ট পুরস্কার’, ‘কথাকলি শিল্পী গােষ্ঠী পুরস্কার’ ও ‘পাতা সাহিত্য পদক পুরস্কার লাভ।
১৯৮৪ মস্কো থেকে ‘সাঁঝের মায়া’-র রুশ সংস্করণ বলশেভনী সুমেরকী’ প্রকাশ।
১৯৮৫ ‘শহীদ নতুনচন্দ্র সিংহ স্মৃতিপদক’ (চট্টগ্রাম) ও কবিতালাপ পুরস্কার (খুলনা) লাভ।
১৯৮৬ ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাব’ পুরস্কার লাভ।
১৯৮৮ ‘বঙ্গবন্ধু পরিষদ’-এর সভানেত্রী নির্বাচিত। রুমা স্মৃতি পুরস্কার’ (খুলনা) লাভ। একালে আমাদের কাল’ (স্মৃতিকথা) প্রকাশ। বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন’ ও ‘বাংলাদেশ এসােসিয়েশন অব নিউ ইংল্যান্ড’-এর আমন্ত্রণে দ্বিতীয়বার যুক্তরাষ্ট্র গমন।
১৯৮৯ ‘একাত্তরের ডায়েরী’ (স্মৃতিচারণ) প্রকাশ। জসীমউদ্দীন পদক’ (ফরিদপুর) লাভ। বাংলাদেশ সােসাইটি অব নিউইয়র্ক’-এর ‘মেম্বার অব কংগ্রেস’ (যুক্তরাষ্ট্র) সনদ লাভ।
১৯৯০ ঐতিহাসিক স্বৈরাচারবিরােধী আন্দোলনে কাফুর মধ্যে প্রতিবাদী মৌনমিছিলে নেতৃত্বদান।
১৯৯১ ‘মুক্তিযােদ্ধা সংহতি পরিষদ’-এর ‘মুজিব পদক’, ‘বিজনেস অ্যান্ড প্রফেশনাল উইমেন্স ক্লাব পদক’ ও ‘অনােমা’ সাংস্কৃতিক গােষ্ঠীর ‘বৌদ্ধ
১৭৯
একাডেমী পুরস্কার’ (চট্টগ্রাম) লাভ। ৮০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ঢাকায় নাগরিক
সংবর্ধনা।
১৯৯২ ৮১ বছর পূর্তিতে ‘মহিলা পরিষদ’-এর পক্ষ থেকে সংবর্ধনা। কেয়ার কাঁটা’র তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশ। লন্ডনের বাংলা সাহিত্য পরিষদ কর্তৃক আয়ােজিত সাহিত্য সম্মেলন ‘৯২-এ প্রধান অতিথি হিসেবে যােগদান এবং ‘বঙ্গজননী’ উপাধি লাভ। লন্ডনের ডা, বেণুভূষণ চৌধুরীর ‘পিপলস হেল্থ সেন্টার’, ‘বঙ্গবন্ধু পরিষদ’ ও ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি কর্তৃক সংবর্ধনা। নারী কল্যাণ সংস্থা’র ‘বেগম রােকেয়া পদক’ লাভ।
১৯৯৩ ‘কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসর’-এর ৪০ বছর পূর্তিতে ‘শহীদুল্লা কায়সার স্মৃতি পদক’ লাভ।
১৯৯৮ ‘দেশবন্ধু সি. আর. দাশ স্বর্ণপদক লাভ।
১৯৯৯ ২০ নভেম্বর শনিবার সকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল ইউনিভার্সিটি হাসপাতাল’-এ বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যুবরণ। সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় ২৪ তারিখ বুধবার আজিমপুর কবরস্থানে সমাহিত। আজিমপুর সাধারণ মানুষের কবরস্থান। আমি একজন সাধারণ মানুষ, সাধারণ মানুষের মাঝেই আমি কবরে যেতে চাই।’ এটাই ছিল সুফিয়া কামালের শেষ ইচ্ছা।
১৮০