You dont have javascript enabled! Please enable it! Draft - সংগ্রামের নোটবুক

Previous

পড়িয়া গিয়াছিল বলিয়া কথা দুইটা আজও আমার মনে আছে। আমি অনেক বক্তৃতায় এই ধরনের বক্তৃতা করিতাম : আমাদেরে সদা সত্য কথা বলিতে উপদেশ দেওয়া হয়। সেটা যে উচিৎ তাও আমরা বুঝি। কিন্তু তা সম্ভব না। ঘর-সংসার করিতে গেলে, দেনা-পাওনার মধ্যে অভাবের সংসার চালাইতে গেলে, ঝগড়া-ঝাটি না করিয়া কায়-কারবার ও বেচা-কেনা করিতে গেলে, অনেক সময় দু-চারটা ছােটখাটো মিছা কথা বলিতেই হয়। পরােপকার করা বিশেষত প্রতিবেশীর উপকার করা সওয়াবের কাজ, এটাও আমরা বুঝি। কিন্তু নিজের দুঃখ-ধান্ধা লইয়াই আমরা এত ব্যস্ত যে, দম ফেলিবার ফুরসত পাই না। পরের উপকার করিব কখন? সে জন্য আমার উপদেশ এই যে সদা সত্য কথা বলার চেষ্টা বাদ দিয়া আপনারা যার-তার সুবিধামত সপ্তাহের একটি দিন ঠিক করেন। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেন, ঐ দিনটিতে আপনি মিছা কথা বলিবেন না; অন্ততপক্ষে একটি লােকের একটি উপকার করিবেন। সে উপকার যতই ছােট হউক। কাজে না হউক মুখের কথায় হউক, তাতে কিছু মনে করিবেন না, বড় উপকারও উপকার, ছােট উপকারও উপকার। কাজ দিয়া উপকারও উপকার, কথা দিয়া উপকারও উপকার। উপকার কথাটা শুনিয়াই আমরা ঘাবড়াইয়া যাই। মনে করি, টাকা-পয়সা খরচ দরকার। ওটা ভুল। একজনের গরুতে আরেকজনের ক্ষেত খাইতেছে, আপনি ইচ্ছা করিলেই ঐ গরুটা খেদাইয়া খেতওয়ালার উপকার করিতে পারেন। একজনের আইলের পল্লাটা ভাঙ্গিয়া ক্ষেতের পানি সরিয়া যাইতেছে। হউক না ক্ষেতওয়ালা আপনার অনাত্মীয় বা শত্রু। আপনি যদি এক টুকরা মাটি ফেলিয়া পল্লাটা বন্ধ করিয়া দেন, তবে ক্ষেতওয়ালার যে উপকার হইবে, সে তা জানিবে না সত্য, কিন্তু সকলের উপরের যিনি দেখনেওয়ালা তিনি দেখিবেন। উপকৃতের অজ্ঞাতে উপকারের যে কী সওয়াব আল্লা দিবেন না আপনারা কল্পনা করিতে পারিবেন না।

৪. পীরগিরির উপক্রম
এমনি দৃষ্টান্ত হাজার দিতাম। সবই পল্লিজীবনের ঘটনা। এই ধরনের ওয়ায পাড়া-গায়ে একদম নূতন। শুধু এই নূতনত্বের জন্যই আমার বক্তৃতা জনপ্রিয় হইল। চারদিক হইতে আমার ডাক পড়িতে লাগিল। কারাে কাজ বা চাল-চলন ভাল লাগিলেই আমাদের জনসাধারণ তাকে অতিরিক্ত বিশ্বাস
২০১
করিয়া বসে এবং প্রাপ্যাধিক মর্যাদা দিয়া থাকে। এখানে আমার কথাগুলি নূতন; আমি বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করা ইংরাজিওয়ালা লােক; কিছুদিন আগে পর্যন্ত আমি নামাজ-রােযা করিতাম না বলিয়াও জনসাধারণ কানাঘুষা করিয়াছে! সেই লােকটার মুখে এমন সব নূতন কথা! এটা ত সাধারণ ব্যাপার নয়। নিশ্চয়ই লােকটা কোনও বুযুর্গের সহবত অথবা দোওয়া পাইয়াছে। খুবই সম্ভব। এদের বংশে ত এই ধরনের লােক আগেও হইয়াছে।
বস্, আর যায় কোথায়? দোওয়া-তাবিজ ও পানিপড়া, সজ-পড়ার জন্য লােকজন আমার কাছে আসিতে লাগিল। এসব ব্যাপারে ‘না’ করাও যায় না। আমি কিছু জানি না বলিলেও কেউ বিশ্বাস করিবে না। বরঞ্চ তাতে বুযুর্গি আরাে বাড়িয়া যাইবে। সুতরাং তাবিজ-কবচ, পানি-পড়া, সজ-পড়া, মাটিপড়া দিতে লাগিলাম। নশে-সােলেমানী’ চার খণ্ড আমাদের বাড়িতেই ছিল। উহা দেখিয়া তাবিজ দিতে লাগিলাম। কখনও কোরআনের এক-আধটা আয়াত পড়িয়া কখনও ‘আল্লা এই রােগীকে ভাল করিয়া দাও’, মনে মনে বাংলায় এইটুকু বলিয়াও পড়া দিয়াছি। মনে করিয়াছি, যে একবার যাইবে সে আর আসিবে না। কিন্তু তা হয় নাই। অনেকেই উপকার পাইয়াছে। আমার তাবিজে বা পানি-পড়ায় রােগী সঙ্গে সঙ্গে ভাল হইয়া গিয়াছে। কাজেই আর দুইটা নূতন রােগীর জন্য পানি-পড়া নিতে আসিয়াছে। এই সব রােগী বা তাদের আত্মীয়স্বজন প্রথমে ডালিম, আনারস, তার পর মুর্গী, খাসি এবং পরে টাকাপয়সা নজর লইয়াও আসিয়াছে।
আশ্চর্য হইয়া ভাবিয়াছি, এমনি ঝরে বক মরার সুযােগ লইয়া অনেক শাহ ফকির তাঁদের কেরামত বাড়াইয়াছেন এবং প্রচুর রােযগার করিতেছেন। এমনি ব্যবসা আরাে অনেক শ্রেণীর লােকেরাই অবশ্য করিতেছে। জ্যোতিষী বা হস্ত-রেখা পরীক্ষা করিয়া যারা রােযগার করিতেছেন, তাঁদের কাজও প্রায় এই রূপ। যতই আন্দাযি ভবিষ্যদ্বাণী করুন, দু-চারটা মিলিয়া যাইবেই। ভাল চিকিৎসাবিজ্ঞানীর মুখে শুনিয়াছি, শতকরা পঞ্চাশের বেশি রােগ এমনি ভাল হইয়া যায়। প্রকৃতি নিজেই রােগের সঙ্গে লড়াই করিয়া জয়লাভ করে। কাজেই বিনা চিকিৎসায়ও ঐসব রােগী ভাল হইয়া যাইত। পক্ষান্তরে দেশের শ্ৰেষ্ঠ ডাক্তারের হাতেও রােগী মারা যায়। এই কারণে সাধারণ ডাক্তারের কাজ কতকটা ঐ গণকদের মতই। দোওয়া-তাবিজ, পানি-পড়াও তাই। কাজেই গণক বা ডাক্তারদের ব্যবসা দোষের না হইলে তাবিজ-পানিপড়াওয়ালাদের ব্যবসাটাই দোষের হইবে কেন?
২০২
কিন্তু তাবিজ-পানি-পড়াওয়ালাদের ব্যবসা নিছক চিকিৎসায় সীমাবদ্ধ থাকে না। আরােগ্যের জন্য তাবিজ দিতে দিতে এঁরা শেষ পর্যন্ত আখেরাতের জন্যও তাবিজ দিতে শুরু করেন। স্বাস্থ্য বিক্রয়ের ব্যবসা হইতে প্রমােশন পাইয়া এঁরা ক্রমে বেহেশত বিক্রয়ের ব্যবসা আরম্ভ করেন। এঁরা নিজেরা বদমায়েশি বুদ্ধি হইতেই যে এই ব্যবসা শুরু করেন, তা নয়। বিশ্বাসপ্রবণ জনসাধারণই এঁদের পীর-ফকির বানাইয়া থাকে । ঘুষখােরদের সম্বন্ধে কথা আছে যে গােড়াতে এরা ভাল মানুষ ছিল। পাবলিকই প্রথমে এটা-ওটা শেষে টাকাপয়সা দিয়া এদেরে খারাপ করিয়াছে। প্রথমে পয়সা সাধিলে প্রথম প্রথম যারা চটিয়া যাইত, পরে তারাই পয়সা দাবি করিয়াছে। না দিলে কাজ করে নাই। কোনও কোনও পীর সম্বন্ধেও এই কথা সত্য। সাধারণ একটা প্রক্রিয়া বা মুষ্টিযােগে দুই-একজন লােক রােগমুক্ত হওয়ার পর হৈচৈ পড়িয়া গিয়াছে। লােকটা গায়েবি ঔষধ বা দোওয়া পাইয়াছে। লােকের ভিড় হইয়াছে। সে লােক শাহ-সাব হইয়া গিয়াছে। মানুষ ত মানুষ, গাছ-বৃক্ষ ও নদী পুকুরের পানি পর্যন্ত বুযুৰ্গি হাসিল করিয়া ফেলিয়াছে। পা-ভাঙ্গা একটা গরু গড়াইয়া এক পুকুরে পড়িয়াছিল। গরুটা যখন সাঁতরাইয়া পাড়ে উঠিল তখন দেখা গেল গরুটার পা ভাল হইয়া গিয়াছে। আর যায় কোথায়? ঐ পুকুরের পানি নিবার জন্য লােকের ভিড় হইল। মেলা বসিল। পুকুরের পানি কাদা হইয়া গেল। তবু বুযুৰ্গি কমিল না।
কাজেই আমার দোওয়া-তাবিজের বরকত ঐ ‘ঝড়ে বক মরার থনে একটুকুও বেশি ছিল না। তবু আমার কেরামত বাড়িল। দুই-একজন শুধু। তাবিজ, পানি-পড়া নিয়াই সন্তুষ্ট থাকিল না। আমার মুরিদ হইতে চাহিল । পীরগিরি শুরু করিতে উৎসাহ দিল। আমি আঁতকাইয়া উঠিলাম। নিজের জনপ্রিয়তাকে আমি ডরাইলাম। পীরগিরিকে আমি ভণ্ডামি বলি । পীরদেরে আমি ঘৃণা করি। সেই আমিই পীরগিরি করিব? ঘটনাচক্রে এই সময় আমি নিজের গ্রাম ও জিলা ছাড়িয়া কলিকাতা গেলাম। একটা আসন্ন আত্মিক পতনের হাত হইতে বাঁচিয়া গেলাম।

৫. নূতন পরিবেশ
কলিকাতা গিয়া দেখিলাম শুধু আমি একার নয়, মুসলিম তরুণ মাত্রেরই মধ্যে একটা চিন্তার বিপ্লব চলিতেছে। যাদের চিন্তার সাথে নিজের চিন্তার ঐক্য দেখিলাম, তাঁদের মধ্যে বিশেষ করিয়া ইয়াকুব আলী চৌধুরী, ডা. লুত্যর
২০৩
রহমান, মােহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, মি. এস ওয়াজেদ আলী, আব্দুল মতিন চৌধুরী, মি. আয়েনূল হক খ প্রভৃতির নাম না করিয়া পারিতেছি না। আমার বাল্যবন্ধু শামসুদ্দীন ত ছিলই। মুসলমান সমাজে নবজাগরণ আনা সকলেরই উদ্দেশ্য। কিন্তু তা করা যায় কেমন করিয়া? এককালে বিশ্ব-শাসক মুসলমান কেন আজ অধঃপতিত? জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, কৃষ্টি-সভ্যতায়, শিল্পে-বাণিজ্যে। মুসলমানেরা আজ দুনিয়ার সবার পিছনে পড়িয়া কেন? কেন দুনিয়ার চল্লিশপঞ্চাশ কোটি মুসলমানের মধ্যে একটি শিল্পী, একটি বিজ্ঞানী, একটি আবিষ্কারক নাই? কেন মুসলমানরা সকল ব্যাপারে এমনকি তাদের মাথার টুপি ও জায়নামাজ তৈরির ব্যাপারেও অমুসলমানের উপর নির্ভরশীল? বস্তুত দরিদ্র মেসের ভাঙ্গা চৌকির ময়লা-ঘেঁড়া বিছানায় শুইয়া-বসিয়া এমনি ভাবে দুনিয়ার মুসলমানদের ভাগ্য আলােচনা করিতাম। সে আলােচনায় সিদ্ধান্ত এই হইল যে মুসলমানদের বুদ্ধি আড়ষ্ট ও চিন্তা অবরুদ্ধ হইয়া গিয়াছে। ইসলামের ভাল আদর্শ ত্যাগ করিয়া মুসলমানরা শুধু আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যেই ধর্ম সাধনাকে সীমাবদ্ধ করিয়াছে। নামাজ-রােযাকেই তারা একমাত্র ধর্মকার্য মনে করে। ফলে তারা জ্ঞান লাভের চেয়ে সওয়াব হাসিলের দিকে মন দিয়াছে বেশি। স্কুল-কলেজ স্থাপনের চেয়ে মসজিদ নির্মাণকেই বেশি দরকারি কাজ মনে করিতেছে।
মুসলমানদের এই সার্বিক অধঃপতনের জন্য দায়ী মােল্লারা। তারাই ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা করিয়া মুসলমান জনসাধারণকে অজ্ঞান ও দারিদ্র্যের মধ্যে ডুবাইয়া রাখিয়াছে। দুনিয়ার ধন-দৌলত কাফেরদের জন্য মুসলমানদের জন্য বেহেশতে বালাখানা ও হুর গিলমান অপেক্ষা করিতেছে, ইত্যাদি কু-প্রচারণা করিয়াই মুসলমানদেরে বিপথগামী করিয়াছে। ও সব ব্যাপারে আমরা প্রায় সবাই একমত ছিলাম। কাজেই সবাই মােল্লাবিরােধী লেখা চালাইতাম। ডা. লুত্যর রহমান, এস ওয়াজেদ আলী, কাজী নজরুল ইসলাম, কাজী আবদুল ওদুদ, হুমায়ুন কবির, মােহাম্মদ ওয়াজেদ আলী ও আমি চুটাইয়া মােল্লাবিরােধী অভিযান শুরু করিলাম। এটাই আমার আয়নার যুগ। সওগাত-এর সম্পাদক মৌ, নাসির উদ্দীন আমাদের পুরা সমর্থক ছিলেন। অতএব সওগাতকে কেন্দ্র করিয়া আমরা একটি বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন শুরু করিলাম। আমাদের সাথে প্রত্যক্ষ যােগাযােগ না থাকিলেও ঢাকা হইতে একই সময়ে অধ্যাপক আবুল হােসেন ও কাজী আবদুল ওদুদের নেতৃত্বে শিখা সম্প্রদায় একই আন্দোলন শুরু করিলেন।
২০৪
আমি কিন্তু শুধু লেখাতেই এই সংস্কার প্রয়াস সীমাবদ্ধ রাখিলাম না। পােশাক-পাতিতে, চালে-চলনেও এই সংস্কার প্রবর্তন করিলাম। দাঁড়িয়ে কেঁচি লাগাইলাম। কোর্তা খাট করিয়া পাঞ্জাবি বানাইলাম। তহবন্দ ফেলিয়া পায়জামা ধরিলাম। বাবরি কাটিয়া আলবার্ট ফ্যাশন করিলাম।

৬. মােল্লাকি-বিরােধী লীগ
কিন্তু তাতেও তৃপ্ত হইলাম না। কতিপয় বন্ধুতে মিলিয়া ‘এন্টি মােল্লা লীগ’ গঠনের সংকল্প করিলাম। এই সময়ে আমি আমার রাজনৈতিক ও সাংবাদিক গুরু মৌ. মুজিবর রহমান সাহেবের দি মুসলমান-এর সহকারী সম্পাদক। স্বনামধন্য মৌ. আবুল কাসেমের কনিষ্ঠ ভ্রাতা মৌ, আবুল হায়াত, মােহাম্মদ ওয়াজেদ আলী ও আবুল কালাম শামসুদ্দিন তখন আমার সহকর্মী। আমরা সকলে মিলিয়া ঐ সংকল্প করিয়া মৌ. মুজিবর রহমান সাহেবকে উহার সভাপতি হইবার অনুরােধ জানাইলাম। আমাদের আদর্শ ও কর্মপন্থার সমর্থন করিয়াও প্রতিষ্ঠানের প্রস্তাবিত নামে আপত্তি করিলেন। তিনি তখন নিষ্ঠাবান। গান্ধীবাদী কংগ্রেসী। কাজে ও চিন্তায় তিনি অহিংসায় বিশ্বাসী। তিনি আমাদেরে বুঝাইলেন, ঐ নামে হিংসা আছে। মােল্লারা ব্যক্তিগতভাবে সমাজের শত্রু নয়; তাদের মােল্লাকিটাই সমাজের শত্রু। যেমন বৃটিশ জাতি আমাদের শত্রু নয়, তাদের সাম্রাজ্যবাদই আমাদের শত্রু। আমরা ইংরাজ জাতকে খতম করিতে চাই না, ইংরাজ সাম্রাজ্যবাদকেই খতম করিতে চাই। তেমনি আমরা মােল্লাদেরে খতম করিতে চাই না। মােল্লাকি খতম করিতে চাই। আমরা মৌলবী সাহেবের যুক্তির কাছে হার মানিলাম। তাঁর কথামত প্রতিষ্ঠানের নাম রাখিলাম : ‘লীগ এগেনস্ট মােল্লাইম’। তিনি সভাপতিত্ব গ্রহণ করিলেন। অতঃপর এই নবগঠিত প্রতিষ্ঠানের উদ্বোধনী সভার আয়ােজন করিলাম আলবার্ট হলে।
এই অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করিবার জন্য আমরা মওলানা আজাদ সাহেবকে অনুরােধ করিলাম। মওলানা সাহেব ঐ সময় বিশেষ কাজে অনেকদিন দিল্লি থাকিবেন বলিয়া নিজে সভাপতিত্ব করিতে পারিবেন না বলিলেন । কিন্তু তাঁর প্রিয় সহচর ও প্রাইভেট সেক্রেটারি মওলানা আবদুর রাজ্জাক মলিহাবাদীকে সভাপতি করিতে উপদেশ দিলেন। মওলানা মলিহাবাদী মাত্র কিছুদিন আগে মিসরের জামেউল-আযহার হইতে কৃতিত্বের সঙ্গে ফাইনাল ডিগ্রি লইয়া দেশে ফিরিয়া আসিয়াছেন। তাঁর
২০৫
বিদ্যাবত্তার প্রশংসা দেশের বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হইয়াছে। কাজেই মওলানা আজাদকে না পাওয়ার নৈরাশ্য আমাদিগকে খুব বেশি ব্যথিত করিতে পারিল না।

৭. মওলানা মলিহাবাদী
আমরা মওলানা মলিহাবাদীর সাথে দেখা করিলাম। মওলানা আজাদ আগেই বলিয়া রাখিয়াছিলেন। অতএব তিনি আমাদের সভাপতিত্ব করিতে রাজি হইলেন। দেখিলাম, মওলানা মহিলাবাদী ফুটফুটে গৌরবর্ণ খুব-সুরত সুপুরুষ। মুখ ও বুকভরা লম্বা চাপদাড়ি। চোখ-মুখ হইতে প্রতিভা ও জ্ঞানের নূর ফাটিয়া পড়িতেছে। খুশি হইলাম। ভাবিলাম, হাঁ! তারিফের চেহারা বটে। এমন সুরতি-সিরতি পাক্কা মুসলমান আলেম দিয়াই আমাদের মােল্লাবিরােধী জেহাদ ভালরূপ চলিবে ।
সভায় বিপুল জনসমাগম হইল। মওলানা মলিহাবাদী মুদ্রিত উর্দু অভিভাষণ দিলেন। উহা যেমন সুলিখিত, পাণ্ডিত্যপূর্ণ ও যুক্তিপূর্ণ হইয়াছিল, তেমনি জনপ্রিয় হইয়াছিল। তিনি সহী হাদিস ও কোরআন শরিফের বহু উক্তি উদ্ধৃত করিয়া প্রমাণ করিলেন যে, মােল্লারা সকল ব্যাপারে ইসলামের কদর্থ করিয়া ইসলামের বদনাম ও বেইজজত করিয়াছে এবং মুসলমানদের অধঃপতন ঘটাইয়াছে। মওলানা সাহেবের অভিভাষণের যে অংশটি সভাস্থলে সবচেয়ে বেশি অভিনন্দিত হইয়াছিল, তা ছিল এই : তিনি সহী হাদিস হইতে পয়গম্বর সাহেবের উক্তি উদ্ধৃত করিয়া প্রমাণ করিলেন যে, দাড়ি-মােচ মুড়ান বর্তমানে মুসলমানদের জন্য সুন্নতে মােয়াক্কেদা। কারণ পােশাক-পাতি ও চেহারা-ছবিতে তৎকালীন সভ্য জাতি রােমানদের অনুসরণ করিতে উপদেশ দিতে গিয়াই পয়গম্বর সাহেব মুসলমানদিগকে দাড়ি রাখিতে এবং চৌগা পরিতে নির্দেশ দিয়াছিলেন। পােশাক-পাতিতে সর্বস্বীকৃত সভ্য জাতির অনুকরণ না করিলে অমুসলমানেরা মুসলমানদিগকে অসভ্য জাতি মনে করিবে এবং ইসলামের সৌন্দর্য বুঝিবার চেষ্টা না করিয়াই আগে হইতে ইসলামের প্রতি বিরুদ্ধ মনােভাব পােষণ করিয়া বসিয়া থাকিবে। তারা বলিবে ঐ অসভ্য ও নােংরা আরবদের আবার একটা ধর্ম কী? ফলে ইসলাম প্রচারে ও প্রসারে বিঘ্ন হইবে । শুধু প্রচারকের পােশাকের দোষে ইসলামের অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য সম্বন্ধে মানুষ অজ্ঞ থাকুক, এটা যাতে না ঘটে, সেই উদ্দেশ্যেই পয়গম্বর সাহেব চেহারা ও পােশাকে তৎকালীন সভ্য জাতির অনুকরণে
২০৬
মুসলমানদেরে দাড়ি রাখিতে নির্দেশ দিয়াছিলেন। অতএব, মওলানা মলিহাবাদীর যুক্তি এই : বর্তমান যুগে পাশ্চাত্য জাতিসমূহ সর্বস্বীকৃত মতে শ্রেষ্ঠতম সভ্য জাতি, মুসলমানের পােশাকে-পাতিতে তাদেরে অনুকরণ না করিলে ইসলামের প্রতি বিশ্ববাসীর হেকারত-নফরত ডাকিয়া আনা হইবে। এই কারণে মুসলমানদেরও দাড়ি-মােচ মুড়াইয়া চেহারা-পােশাক আধুনিক হইতে হইবে।
মওলানা সাহেবের উদ্ধৃত হাদিসের প্রামাণ্যতা বিচারের কোনও অধিকার আমার তখনও ছিল না, এখনও নাই। কিন্তু তাঁর মুদ্রিত অভিভাষণের কোনও নির্ভরযােগ্য প্রতিবাদ আমার নজরে পড়ে নাই। উদ্ধৃত হাদিসসমূহকে বিশ্বাসযােগ্য ধরিয়া নিলে মওলানা মলিহাবাদীর যুক্তির সারবত্তা স্বীকার না করিয়া উপায় নাই। মওলানা সাহেবের এই বিপ্লবাত্মক উক্তির সঙ্গে তিনি বিপ্লবী একটি কাজও করিয়াছেন। এই সম্মিলনী উপলক্ষে তিনি তাঁর সুন্দর লম্বা দাড়িটি শেভ করিয়া ফেলিয়াছিলেন। এই ঘটনার পরে আরাে পঁচিশ বছর মওলানা সাহেবের সাথে দেখা-শােনা হইয়াছে। ঐ সময় পর্যন্ত তিনি। আর দাড়ি রাখেন নাই। মওলানা আজাদের অনুসারী হইয়াও তিনি বাটোয়ার আগে পর্যন্ত কোনও রাজনৈতিক দলে যােগ দেন নাই। বাঁটোয়ারার পরেও ভারতেই থাকিয়া যান। পরে তিনি কংগ্রেস বিরােধী বামপন্থী রাজনৈতিক দলসমূহের সমর্থক হন। মাত্র কয়েক বছর আগে তিনি ইন্তেকাল করিয়াছেন।
আমার বন্ধুবর আবুল হায়াত সাহেবকে প্রতিষ্ঠানের সেক্রেটারি নির্বাচন করিয়াছিলাম। তিনি খুব উৎসাহী কর্মী ছিলেন। তাঁর উদ্যোগে আমরা কিছু কিছু সাহিত্য সৃষ্টি ও কয়েকটা সভা-সমিতিও করিয়াছিলাম। তৎকালে মুসলিম শিক্ষিত সম্প্রদায়ের অধিকাংশ এবং ছাত্র-সম্প্রদায়ের প্রায় সকলেই মতবাদের দিক দিয়া মােল্লাকি-বিরােধী হওয়ায় কোনও স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান। চালাইবার দরকার ছিল না বলিয়াই বােধ হয় আমাদের প্রতিষ্ঠান অল্পবয়সে মারা যায়।

৮. মােল্লা-বিরােধের প্রসারিত রূপ
কিন্তু আমার বিরােধিতা ক্রমেই প্রবল হইতে থাকিল। মােল্লা-বিরােধিতা শেষ পর্যন্ত আমাকে ইসলামের তথা সমস্ত ধর্মেরই আচার-অনুষ্ঠান ও ক্রিয়াকলাপ-বিরােধী করিয়া তুলিল। আমি বুঝিলাম, খিলাফত আন্দোলনে
২০৭
যােগ দিয়া আমি যে নামাজ বন্দেগি আবার ধরিয়াছিলাম, সেটা কতকটা রাজনৈতিক ঝোঁকের মাথায়, কতকটা তৎকালীন পরিবেশের সহিত সংগতি রাখার জন্য। আমি অল্পদিনেই আবার নামাজবিরােধী হইয়া উঠিলাম । নামাজবিরােধী যুক্তিগুলি অধিকতর প্রবলবেগে মাথা চাড়া দিয়া উঠে। নামাজ আচারমাত্র। আচারনিষ্ঠা শেষ পর্যন্ত মানুষকে আচার-সর্বস্ব করিয়া তােলে। ধর্মের স্পিরিট বর্জন করিয়া শুধু আচার-অনুষ্ঠান পালন করিলে মানুষ মনের দিক হইতে অধঃপতিত হইতে বাধ্য। আচার-অনুষ্ঠান নিতান্তই দৈহিক। মনের উপর তার কোনও প্রত্যক্ষ প্রভাব নাই। কাজেই যারা বেশি মাত্রায় ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করে, তারা আল্লা সম্পর্কে চিন্তা করিবার অবসরই পায় না। অথচ মুসলমানদের মধ্যেই নামাজ বন্দেগির বাড়াবাড়ি সবচেয়ে বেশি। একসময় আমি নিজেই দৈনিক পাঁচ ওয়াকত নামাজ, রাত্রে তাহাজ্জদ ও হরেক রকমের নফল নামাজের জন্য অমুসলমানদিগের নিকট গৌরব করিতাম। এখন আমার মনে হইতে লাগিল, অতিরিক্ত নামাজের বােঝাই মুসলমানদের বুদ্ধির ঘাড় ভাঙ্গিয়াছে। বন্ধুবর আবুল হায়াত বলিতেন : মুসলমানরা সারাদিন নামাজ পড়িতেই ব্যস্ত, কাজ করিবে কখন? আমি তার উপর আরাে এক ডিগ্রি চড়াইয়া বলিতাম : মুসলমানরা দিন-রাত নামাজ পড়াতেই ব্যস্ত, খােদাকে স্মরণ করিবে কখন? শ্রদ্ধেয় বন্ধু ইয়াকুব আলী চৌধুরী আমাদের কথায় ব্যথা পাইতেন। তিনি বলিতেন : মসজিদগুলির দিকে তাকাইয়া দেখ, শতকরা পঁচিশ জন মুসলমানও নামাজ পড়ে না। নামাজে যদি অনিষ্ট হইত, তবে শুধু এই পঁচিশ জনেরই হইত। বেনামাজি বাকি পঁচাত্তর জনের তবে উন্নতি হয় না কেন?

৯. আচার-সর্বস্বতার কুফল
চৌধুরী সাহেবের এই যুক্তি একা চৌধুরী সাহেবের নয়। অনেক মুসলমানেরই ধারণা তাই। কিন্তু যুক্তিটা ত্রুটিপূর্ণ। শতকরা কতজন মুসলমান নামাজ পড়িল, আর কতজন পড়িল না, প্রশ্ন সেটা নয়। প্রশ্নটা হইল ঈমানের দিক হইতে প্রায় সব মুসলমানই নামাজকেই ধর্মকাজ মনে করিয়া থাকে। যারা পড়িল তারা পুণ্যবান, যারা পড়িল না তারা আত্মস্বীকৃত অপরাধী। নামাজিবেনামাজি কেউই নামাজ ছাড়া অন্য কাজকে বড় ধর্মকাজ ও পুণ্যের কাজ মনে করে না। কাজেই জ্ঞান ও কর্মে তাদের উৎসাহ নাই। নামাজ পড়িলে
২০৮
আর কোনও ভাল কাজ করার দরকার নাই, বরঞ্চ ঠিকমত নামাজ পড়িয়া আপনি একশ একটা পাপ করিতে পারেন। মােল্লারা হাদিস-কোরআনের ভুল ব্যাখ্যা করিয়া হাজার হাজার বই-পুস্তক প্রকাশ করিয়া মুসলমানদের মাথায় ঢুকাইয়াছে যে প্রতি ওয়াকত নামাজেই নামাজিদের আগিলা-পিছিলা সব গােনা-খাতা মাফ হইয়া যাইতেছে। বিশেষ বিশেষ দিনে বিশেষ ধরনের নফল নামাজ পড়িলে আগিলা-পিছিলা সত্তর বছরের পাপ ধুইয়া-মুছিয়া যায়। হজ, পীরের কবর যিয়ারত, বিশেষ ধরনের তসবিহ তেলাওত, ‘দোওয়া হাবিবী, ‘দোয়া গাঞ্জল আরশ’ বলিয়া কথিত বিশেষ বিশেষ দোওয়ার বরকত ও ফজিলত সম্বন্ধে মােল্লারা এত সব অদ্ভুত চিত্রাকর্ষক বর্ণনা দিয়া থাকেন যে, ওর যে কোনও একটা কাজ করিয়াই জীবনের সমস্ত অন্যায় ও পাপের শাস্তি হইতে রেহাই পাওয়া ও বেহেশতের হকদার হওয়া যায়। সব ধর্মেই বােধ হয় কম-বেশি আচার-উপাসনার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু মুসলমানদের তুলনায় নিশ্চয়ই আর সকলেরটা নিতান্ত নগণ্য।
কাজেই ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের বিরুদ্ধে আমার মন যত বেশি রুষ্ট হইতে লাগিল, মুসলমানদের প্রতি আমার দরদ-সহানুভূতি তত বাড়িতে লাগিল । আমার মনে হইতে লাগিল, মােল্লা-মৌলবী, শরা-শরিয়ত, পীরপয়গম্বর ও কথিত লৌকিক ধর্ম হইতেছে যালেম, আর মুসলমানরা হইতেছে মযলুম। যালেমের প্রতি ছেলেবেলা হইতেই আমার মন বিরূপ ছিল । মযলুমের প্রতি আমার মমত্ববােধ ছিল একেবারে ইনসূটিংকটিভ উৎপ্রেরণাজাত। জমিদার ও বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীর বিরুদ্ধে যে কারণে আমি রুষ্ট ছিলাম, সেই কারণেই আমি আনুষ্ঠানিক ধর্ম বা শরিয়তের উপর রুষ্ট হইলাম। ভাবিলাম, জমিদারের যুলুম হইতে কৃষক-প্রজাদেরে, বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীর কবল হইতে ভারতবাসীকে মুক্ত করার মতই এবং সঙ্গে সঙ্গেই মুসলমান সমাজকেও শরিয়তের যুলুম হইতে লিবারেট করিতে হইবে। মুসলমানদিগকে জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, শিল্পে-সাহিত্যে দুনিয়ার অন্যান্য সভ্য জাতির সমকক্ষ করিতে হইলে ঐটা করিতেই হইবে।

১০. ধর্মান্তর গ্রহণ অনাবশ্যক
মুসলমানদিগকে ইসলামের হাত হইতে বাঁচাইতে হইলে কি তাহাদিগকে একযােগে ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করাইতে হইবে? এ নিয়াও আমি বহু চিন্তা করিয়াছি। কিন্তু দুইটা কারণে আমি মন হইতে এই চিন্তাকে দূর দূর করিয়া
২০৯
তাড়াইয়া দিয়াছি। প্রথম কারণ, আমি এই সময় ছিলাম ‘শরিয়তি ইসলামবিরােধী ঘােরতর মুসলমান। এই কথাটার ব্যাখ্যা আমি অন্যত্র দৃষ্টান্তসহ করিব। এখানে শুধু এইটুকু বলিলেই হইবে যে আমি মুসলমান পরিচয় দিতে গৌরব বােধ করিতাম। দ্বিতীয় কারণ, ধর্মান্তর গ্রহণ করাকে আমি অনাবশ্যক ও আত্মসম্মানবিরােধী অপমানজনক লাঞ্ছনা-ব্যঞ্জক কাজ মনে করিতাম। এটা অনাবশ্যক এই জন্য যে, ধর্মত্যাগ না করিয়াও মানুষ তার ঈপ্সিত ভাল কাজ করিতে পারে। “আমার পৈতৃক ধর্মে এই দোষ বা অসুবিধা ছিল বলিয়া আমি ধর্মান্তর করিলাম”—এ কথা যে বলে সে হয় মূর্খ, না হয় ভণ্ড মতলববাজ। হামবাগ ত নিশ্চয়ই। কারণ পৈতৃক ধর্ম ত্যাগ না করিয়াও ঐ ধর্মের দোষ সে ত্যাগ করিতে এবং নয়া ধর্মের গুণটুকু গ্রহণ করিতে পারিত। কোনও ধর্মেরই অখণ্ড একটা রূপ নাই। বিভিন্ন মতবাদ ও আচার-অনুষ্ঠান লইয়াই ধর্ম। এই মতবাদ ও আচার-অনুষ্ঠানের দুই-একটা তােমার না-পছন্দ হইলেই তুমি তােমার পৈতৃক ধর্ম ত্যাগ করিতে বাধ্য, এটা ঠিক নয়। তেমনি অন্য ধর্মের দুই-একটা মতবাদ ও ক্রিয়াকলাপ পছন্দ হইলেই ঐ ধর্ম তােমার গ্রহণ করিতেই হইবে, এমনও কথা নয়। ময়লার জন্য কেউ কাপড় ফেলিয়া দেয় না, ধুইয়া লয়। একটা দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। হিন্দু ধর্মে বিধবা-বিবাহ নিষিদ্ধ। তাই বলিয়া যে সব হিন্দু বিধবা-বিবাহের সমর্থক তারা কি হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করিয়া মুসলমান বা খৃষ্টান হইবে? কোনও দরকার নাই। হিন্দুরা তাদের ধর্মের এ বিধানটুকু বদলাইয়া খৃষ্টান ও মুসলমানদের বিধানটুকু গ্রহণ করিলেই এই কারণে ধর্ম ত্যাগ করার কোনও দরকার থাকে না। হিন্দুরা এখন তাই করিয়াছে। তাতে হিন্দুদের কোনও অপমান হয় নাই। হিন্দু ধর্মের কোনাে অসম্মান হয় নাই। সেইরূপ, ইসলাম বলে, নারীর পর্দা করিতে হইবে; দাড়ি রাখিতে হইবে, মানুষের মূর্তি আঁকিতে পারিবে না। এখন আমি মুসলমান নারীর মুক্তির জন্য শেভ করিবার জন্য এবং ফটো তুলিবার জন্য ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করিব? কোনও দরকার নাই। আমরা মুসলমান থাকিয়াই নিজেদের ফটো তুলিতেছি; ঘরে ঘরে কায়েদে আযমের ফটো লটকাইবার সরকারি নির্দেশ দিতেছি। ভাস্কর্য ও চিত্রবিদ্যা শিখিবার জন্য স্কুল-কলেজ খুলিতেছি। সিনেমা করিতেছি, নাচিতেছি, গাইতেছি, দাড়ি কামাইয়া কোট-পাতলন-নেকটাই ধরিয়াছি। তাতে মুসলমানদের অপমান হয় নাই। ইসলামেরও অমর্যাদা হয় নাই। এটা গেল ধর্ম ত্যাগের অনাবশ্যকতার দিক।
২১০
১১. ধর্মত্যাগ অসম্মানসূচক
ধর্মত্যাগ অপমানজনক ও আত্মমর্যাদাবিরােধী বটে। আমি যেমন ইচ্ছা করিলেই বাপ-মা বদলাইতে পারি না, তেমনি ইচ্ছা করিলেই ধর্মও বদলাইতে পারি না। পিতা-মাতা, দেশ ও ধর্ম আমার ইচ্ছাধীন নির্ধারিত জিনিস নয়। এটা অ্যাকসিডেন্ট-অব-বার্থ। যারা আল্লায় বিশ্বাস করে, তারা স্বীকার করিবে যে, সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায়ই এটা হইয়াছে। মঙ্গলময় সৃষ্টিকর্তা জানিয়া-শুনিয়াই বিশেষ উদ্দেশ্যে সকলের মঙ্গলের জন্যই আমাকে এই পিতা-মাতার ঘরে, এই দেশে, এই ধর্মে, এই সমাজে জন্ম দিয়াছেন। আমার বাপ-মার প্রতি যেমন আমার কর্তব্য আছে, আমার দেশ, সমাজ ও ধর্মের প্রতিও আমার তেমনি কর্তব্য আছে। আমার বাপ-মা যেমন লােকই হউন, তাঁদেরে ভক্তি করিতে, তাঁদেরে সেবা করিতে, তাঁদেরে প্রতিপালন করিতে হইবে। তারা যদি দরিদ্র হন, তাঁদের অভাব দূর করিতে হইবে; তারা যদি মূর্খ-জ্ঞানহীন হন তাঁদেরে জ্ঞান দান করিতে হইবে। তারা যদি দুষ্ট লােক হন, তাঁদেরে সৎপথে আনিতে হইবে। কিন্তু কোনও অবস্থাতেই তাঁদেরে ত্যাগ করা চলিবে না। সেটা হইবে চরম ঘৃণ্য স্বার্থপর অকৃতজ্ঞতা এবং পিতা-মাতার প্রতি কর্তব্য-জ্ঞানহীনতা। সমাজ, দেশ ও ধর্ম সম্বন্ধেও আমার কর্তব্য তাই। এ অবস্থায় ভাল ধর্মের সন্ধানে যদি পৈতৃক ধর্ম ত্যাগ করিতে হয়, তবে ভাল সমাজের সন্ধানে আমার সমাজ, ভাল দেশের তালাশে আমার দেশ ও ভাল পিতা-মাতার তালাশে বর্তমান বাপ-মাও ত্যাগ করিতে হয়। এই যুক্তিতেই আমি ধর্ম প্রচার ও প্রসলিটাইজিং-এরও বিরােধী হইলাম। আমি বলিতাম : আমাকে আমার ধর্ম ত্যাগ করিয়া তােমার ধর্ম গ্রহণ করার, দাওয়াত করার অর্থ আমার বাবাকে বাবা ডাকা ছাড়িয়া দিয়া তােমার বাবাকে বাবা বলার দাওয়াত করা। আমার এই যুক্তি শুনিয়া আমার বহু বন্ধু-বান্ধব হাসিত, অনেকে রাগ করিত। কিন্তু যুক্তি হিসাবে আমার কথা কেউ খণ্ডন করিতে পারিত না, অর্থাৎ আমি মনে করিতাম, পারিত না। কাজেই আমার মতে আমি দৃঢ় ছিলাম।

১২. ধর্মে-ধর্মে টলারেন্স
নিজে ঐ যুক্তির ফাঁদে পড়িয়াই এই সময় আমি সকল ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ ও প্রচার করিতে লাগিলাম। যে ব্যক্তি নিজের বাপ-মাকে ভক্তি করে, সে
২১১
অপরের বাপ-মাকে ভক্তি-শ্রদ্ধা না করিয়া পারে না। যে ব্যক্তি নিজের দেশকে ভালবাসে, সে ব্যক্তি অপরের দেশ-প্রেমকে শ্রদ্ধা না করিয়া পারে না। ঠিক তেমনি যে ব্যক্তি নিজের ধর্মকে ভালবাসে, সে অপরের স্বধর্মপ্রীতিকে শ্রদ্ধার চোখে না দেখিয়া পারে না। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি অপরের বাপ-মাকে গাল দেয়, সে ব্যক্তি নিশ্চয়ই নিজের বাবা-মাকেও গাল দেয়। যে ব্যক্তি অপরের দেশ-প্রেমকে অশ্রদ্ধা করে, তার নিজের দেশপ্রেমটা নিশ্চয়ই ভণ্ডামিমাত্র। ঠিক তেমনি যে ব্যক্তি অপরের ধর্মের নিন্দা করে, নিজের ধর্মের প্রতি তার কোনও শ্রদ্ধা নাই।
আমার এই মতবাদ ক্রমেই এতদূর গেল যে, আমি ধর্মে-ধর্মে টলারেন্স বা পরধর্ম-সহিষ্ণুতা ও খুব জোরের সঙ্গে প্রচার করিতে লাগিলাম। আমি বলিতে লাগিলাম : এই টলারেন্স যে ধর্মের মধ্যে যত বেশি, সে ধর্ম তত বেশি মানব-কল্যাণমুখী। আমি এই সময় কোরআন শরিফের ‘লা-ইকরাহফিদ্দিন, ধর্মের ব্যাপারে জোর-যবরদস্তি নাই’, ‘লাকুম দিনুকুম ওলিয়া দিন, তােমার ধর্ম তােমার, আমার ধর্ম আমার’; উদউ ইলাসসাবিল,… মিষ্ট ভাষায় ধর্মের দাওয়াত কর’—এই সব কথার উল্লেখ করিয়া ইসলামের কল্যাণমুখিতা প্রচার করিতাম। আমি বলিতাম, মুসলমানরা যদি কোথাও ইসলামের মূল শিক্ষা হইতে বিচ্যুত হইয়া থাকিয়া থাকে, তা এইখানে। এই ব্যাপারে হিন্দু ধর্মের শিক্ষার দিকে আমি অতিশয় আকৃষ্ট হইয়া পড়ি। হিন্দুশাস্ত্রের শিক্ষা এবং সাধারণ হিন্দুরও বিশ্বাস এই : ভগবান মহাসাগর; বিভিন্ন ধর্মমত নদী-উপনদী মাত্র। সব নদীর পানিই যেমন শেষ পর্যন্ত মহাসাগরে গিয়া পড়ে, তেমনি সব ধর্মই মানুষকে ভগবানের সান্নিধ্যে লইয়া যায়। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যেদিন দুনিয়ার সব ধর্ম-মতের লােকেরা এই মহাশিক্ষা গ্রহণ করিবে, সেদিন ধর্ম সত্য-সত্যই মানুষের কল্যাণ সাধন করিবে।

১৩. সর্বধর্ম-সমন্বয় বনাম সর্বধর্ম-পরিচয়
এই সময় ইউরােপের কোনও কোনও চিন্তানায়ক মানব-প্রেমিক দুনিয়ার সমস্ত ধর্মের সার-নির্যাস লইয়া একটা কমন-ফেথ’ প্রতিষ্ঠার কথা বলিতে শুরু করেন। এ ধরনের চেষ্টা এই ভারতবর্ষের আকবর বাদশাহ, গুরুনানক ও কবির করিয়াছিলেন। কিন্তু সে চেষ্টার ফলে এক একটা নূতন ধর্মের সৃষ্টি হইয়াছে মাত্র। এ সম্পর্কে লর্ড এভারবেরী, ডা. স্মাইলস ও আরাে কোনও কোনও মনীষীর কথা এইরূপ : ‘এভরি অ্যাটেম্পট অ্যাট ইউনিফিকেশন
২১২
অব-রিলিজিয়নস হ্যাজ অনলি অ্যাডেড টু দেয়ার নাম্বার। অর্থাৎ ধর্মসমূহকে এক করিবার প্রত্যেক চেষ্টাই ধর্মের সংখ্যা বাড়াইয়াছে মাত্র। কাজেই ‘কমন-ফেথ’ প্রতিষ্ঠার নয়া স্লোগানে আমি খুব বেশি উৎসাহ পাইতাম না। বরঞ্চ ধর্মে-ধর্মে টলারেন্স স্থাপন এবং সব ধর্মকেই বাস্তবপন্থী করার মধ্যেই মানবকল্যাণ নিহিত রহিয়াছে বলিয়া আমি দৃঢ় মত পােষণ করিতাম।
প্রিন্সিপাল জে আর ব্যানার্জীর পৃষ্ঠপােষকতায় এই সময় কলিকাতায় এবং বাংলায় অনেক জিলাতেই সর্বধর্ম-সমন্বয় সম্পর্কে বছরে বছরে একটি আলােচনা সভা হইত। তাতে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খৃষ্টান ও ব্রাহ্মসমাজের বিভিন্ন বক্তা নিজ নিজ ধর্ম সম্পর্কে বক্তৃতা করিতেন। এই সভার উদ্যোক্তারা একবার আমাকে ঐ সভায় বক্তৃতা করিতে বলেন। আমি এই শর্তে বক্তৃতা করিতে রাজি হই যে, বক্তারা যার-তার ধর্ম সম্বন্ধে বক্তৃতা না করিয়া অপর যে কোনও ধর্ম সম্বন্ধে বক্তৃতা করিবেন। আমি হিন্দু ধর্ম সম্বন্ধে বক্তৃতা করিতে রাজি হই। সভায় সে রকম ব্যবস্থা হয়। আমি হিন্দু ধর্ম সম্বন্ধে বক্তৃতা করি। হিন্দু ধর্ম পলিথিস্ট বা বহু ঈশ্বরবাদী পৌত্তলিক ধর্ম, আমার বক্তৃতায় আমি ঐ অভিযােগ খণ্ডন করি। হিন্দু ধর্মে এক খােদার বদলে তেত্রিশ কোটি খােদা মানা হয়, এটাকে উচ্চস্তরের দার্শনিক মতবাদ বলিয়া ব্যাখ্যা করি। আমি বলি : এই মতবাদের অর্থ এই যে, ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত ব্যাপার। প্রত্যেক ব্যক্তির বিবেকই তার খােদা। একজনের বিবেকের কাছে যা পাপ, অপরের বিবেকের কাছে তাই পুণ্য। দৃষ্টান্ত : মুসলমান ডাকাতেরা ‘আল্লাহু আকবর’ বলিয়া হিন্দু বাড়ি এবং হিন্দু ডাকাতেরা কালী মাই কি জয়’ বলিয়া মুসলমানের বাড়ি লুট করে। গত মহাযুদ্ধে জার্মান কায়সর ও মিত্র পক্ষের উইলসন-লয়েড জর্জ উভয় পক্ষই যুদ্ধ জয়ের জন্য বাইবেল হাতে গির্জায় প্রার্থনা করিয়াছিলেন ।

১৪. ইসলাম-হিতৈষী’ বনাম ‘মুসলিম-হিতৈষী’
সুতরাং ইসলামের উপর আমি ঘােরতর খাফা হইলেও মুসলমানদের কল্যাণের জন্য ইসলাম ত্যাগ করা প্রয়ােজন মনে করিলাম না। আমার উদ্দেশ্য মুসলমানদের কল্যাণ করা। আল্লাহ যখন আমাকে মুসলমান সমাজে মুসলমান পিতা-মাতার ঘরে পয়দা করিয়াছেন, তখন আমার পিতা-মাতা তথা সমাজের প্রতি একটা কর্তব্য দিয়াই আমাকে পয়দা করিয়াছেন।
২১৩
মুসলমানদের প্রতি এই কর্তব্য করিতে গিয়া ইসলাম ধর্মকে যদি আমি প্রতিবন্ধক মনে করি, এই প্রতিবন্ধক দূর করিবার জন্য যদি মুসলমানদেরে একযােগে ইসলাম ত্যাগ করিয়া খৃষ্টান ধর্ম গ্রহণ করিবার উপদেশ দেই, মুসলমানরা আমার উপদেশ গ্রহণ করিয়া যদি একযােগে খৃষ্টান হইয়া যায় এবং তার ফলে তাদের যদি উন্নতি হয়, তবে সে উন্নতি মুসলমানদের হইল না, হইল খৃষ্টানদের। কারণ তখন তারা আর মুসলমান নাই, খৃষ্টান-ধর্মী হইয়া গিয়াছে। কিন্তু গােড়ায় আমার উদ্দেশ্য ছিল মুসলমানদের উন্নতি করা, খৃষ্টানদের উন্নতি করা নয়। তাদের প্রতি আমার জন্মগত কোনও দায়িত্ব ও কর্তব্য ছিল না।
অতএব মুসলমানদিগকে মুসলমান রাখিয়াই তাদের কল্যাণ করিতে হইবে। মুসলমান সমাজে, ইসলাম ধর্মে ও মুসলিম পিতা-মাতার ঘরে পয়দা করিয়া সৃষ্টিকর্তা আমার উপর এই কর্তব্য আরােপ করিয়াছেন। আমি যদি মুসলমান বাপ-মার ঘরে পয়দা না হইয়া হিন্দু বাপ-মার ঘরে জন্মাইতাম, তবে হিন্দু ধর্ম ও সমাজের প্রতি আমার অবিকল এই কর্তব্য হইত। এই কথাটাই আমি গোঁড়া মুসলমান বন্ধুদেরে উত্ত্যক্ত করিবার জন্য বারে বারে বলিতাম। তারা যখন ইসলাম ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনায় মুখে খই ফুটাইত তখনই আমি বলিতাম : ‘তুমি যদি হিন্দু বাপ-মার ঘরে পয়দা হইতে, তবে খুব গোড়া হিন্দু হইতে; হিন্দু ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনায় ও ইসলামের কুৎসায় তােমার মুখে এমনি খই ফুটিত।’
২১৪

অধ্যায় দশ
অনিসলামি মুসলমান

১. স্পর্শকাতর মুসলমান
আগেই বলিয়াছি আমি যতই মােল্লা-বিরােধী, গোঁড়ামি-বিরােধী হইয়া উঠিতে। লাগিলাম, মুসলমানদের প্রতি দরদ ও টান আমার ততই বাড়িতে লাগিল। বাড়িতে লাগিল বলিলাম এই জন্য যে মুসলমানি চেতনা আমার ছেলেবেলা হইতেই ছিল। আভাসে-ইঙ্গিতেও যদি কেউ মুসলমানের নিন্দাসূচক কথা। বলিতেন, তবে আমি ক্ষেপিয়া উঠিতাম। আমি যখন ধানীখােলা পাঠশালার ছাত্র, সেই সময় বৈলরের জমিদারের ম্যানেজার বাবু কেশব চন্দ্র চক্রবর্তী একবার আমাদের পাঠশালার বার্ষিক সভায় সভাপতিত্ব করিয়াছিলেন। কেশব বাবু দয়ালু উদার-হৃদয় অসাম্প্রদায়িক লােক বলিয়া পরিচিত ছিলেন কিন্তু সভাপতির অভিভাষণের এক জায়গায় তিনি বলিলেন : ‘ভদ্রলােকদের দেখাদেখি আজকাল মুসলমানরাও বিদ্যাশিক্ষার দিকে মন দিয়াছে দেখিয়া আমি যারপরনাই আনন্দিত হইয়াছি।’ এতে মুসলমানদিগকে ভদ্রলােক বলা হইল না বলিয়া সাত-আট বছরের শিশু আমি ক্ষেপিয়া গিয়াছিলাম এবং সভাশেষে ম্যানেজার বাবুর সাথে তর্ক করিতে গিয়াছিলাম। আমাদের শিক্ষক ও মুরুব্বিরা আমাকে নিরস্ত করিয়াছিলেন। তৎকালের শ্রেষ্ঠ সাপ্তাহিক খবরের কাগজ বঙ্গবাসীতে একবার এক সভার খবর এই রূপে বাহির হইয়াছিল : সভায় কতিপয় ভদ্রলােক ও অনেক মুসলমান যােগ দিয়াছিলেন। আমি উক্ত সংবাদপত্রে ইহার প্রতিবাদ পাঠাইয়াছিলাম। ছাপা হয় নাই বলিয়া উক্ত পত্রিকার গ্রাহক আমার মুরুব্বিকে ঐ কাগজ না কিনিতে উপদেশ দিয়াছিলাম। তিনি হাসিয়াছিলেন এবং ভবিষ্যতে আর টাকা দিবেন না বলিয়া আমাকে শান্ত করিয়াছিলেন। মুসলমান মাতব্বর প্রজাদেরেও জমিদারের
২১৫
কাচারিতে বসিতে দেওয়া হয় না বলিয়া আমি শৈশবেই জমিদারদের বিরুদ্ধে মুরুব্বিদের উস্কাইতাম। ময়মনসিংহ শহরে পড়িতে আসিয়া যখন দেখিলাম, হিন্দু মিঠাইর দোকানে মুসলমান খরিদ্দারকে ঢুকিতে দেওয়া হয় না, তখন মিঠাই খাওয়ার লােভ অতি কষ্টে নিবারণ করিলাম। এসবই স্বাভাবিক ছিল। তখন আমি চালে-চলনে, মনে-মস্তিষ্কে পাক্কা মুসলমান।
কিন্তু আমি যখন মনের দিক দিয়া ঘােরতর নাস্তিক, পােশাকে-পরিচ্ছদে যখন আমাকে বাঙ্গালী হিন্দু যুবক হইতে আলাদা করিয়া চিনিবার কোনও উপায় ছিল না, তখন আমি কথাবার্তায় মুসলমান যবান যাহির করিয়া গৌরব বােধ করিতাম । ইসলাম ধর্ম ও মুসলমান জাতিকে নিন্দা করিলে আমি সঙ্গে সঙ্গে নিন্দুকের সঙ্গে ঝগড়া বাধাইয়া দিতাম। আমি নিজের ঘরে বসিয়া ইসলাম ধর্ম ও মুসলমান সমাজের চৌদ্দপুরুষ উদ্ধার করিতাম। কিন্তু কোনও অমুসলমান সে কাজ করিলে তার দিকে মুষ্টি উঁচাইয়া যাইতাম। আমি যখন ঘােরতর নাস্তিক সেই সময় যদি কোনও ইউরােপীয় পণ্ডিতের বইয়ে ইসলাম ধর্ম ও পয়গম্বর সাহেবের নিন্দা করিতাম তবে ঐ পণ্ডিতকে মূর্খ আখ্যা দিয়া তার বই ছুড়িয়া ফেলিয়া দিতাম। এমনকি যদি কোনাে দর্শনের বইয়ে ধর্ম প্রবর্তকদের নামের মধ্যে যিশুখৃষ্ট ও বুদ্ধের নামের পাশে মােহাম্মদের নাম অথবা বড়-বড় ধর্মের নামের মধ্যে বৌদ্ধ, হিন্দু ও খৃষ্টধর্মের সাথে ইসলামের নাম না দেখিতাম, তবে ঐ দার্শনিকের প্রতি আমি এক মুহূর্তে শ্রদ্ধা হারাইতাম। ঘােরতর নাস্তিক্যের অবস্থায়ও আমি বরাবরের অভ্যাস-মত উঠিতে-বসিতে, রাস্তায় বাহির হইতে, খাইবার সময় প্রথম নওলা মুখে দিতে, গাড়ি-ঘােড়ায় চড়িতে ‘বিসমিল্লাহ’ বলিতাম। খানা শেষ করিয়া, কোনও আনন্দসংবাদ পাইয়া ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলিতাম। কাকেও উৎসাহ দিতে গিয়া ‘মাশা আল্লাহ’ বলিতাম। কাছে বসিয়া কেউ হাঁচি মারিলে ‘আরহামাকুমুল্লাহ’, বিস্ময় প্রকাশে ‘সােবহানাল্লাহ’, ঘৃণা প্রকাশে নাউযুবিল্লাহ’ বলিতাম। আমার এই পাক্কা মুসলমানি ব্যবহার দেখিয়া অনেক বন্ধু আমার নাস্তিক্য বা মুক্ত-বুদ্ধি অথবা র্যাশনালিযম সম্বন্ধে, এমনকি আমার অসাম্প্রদায়িক উদারতা সম্বন্ধেও সন্দিহান ছিল। অনেক বন্ধু আড়ালে আমার নিন্দা করিয়া বলিত : আরে, কে বলে আহমদ নাস্তিক? ও। আসলে একটা মােল্লা। নিজেকে একজন ফ্রি-থিংকার প্রমাণ করার জন্যই সে নাস্তিক্যের ভণ্ডামি করিয়া থাকে।
২১৬
২. চাল-চলনে গোঁড়ামি
আমার কংগ্রেসি জীবনে আমি দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টাই হিন্দু বন্ধু ও সহকর্মীদের সাথে কাল কাটাইতাম। তাদের বাড়িতে চা-বিস্কুট-মিঠাই খাইতাম। হিন্দু মহিলাদের সাথে কথা বলিতাম। তাদের হাতেও খাইতাম। কিন্তু কদাচ তাঁদের কাছে জল’ চাই নাই। বরাবর পানি’ চাহিয়াছি। তাঁদের বাড়িতে আমি কদাচ ‘ডিম’ ও ‘মাংস খাই নাই। বরাবর ‘আন্ডা’ ও ‘গােশত খাইয়াছি। প্রথম-প্রথম অনেক হিন্দু বন্ধু বিশেষত মহিলা আমার এই ব্যবহারে মনে মনে চটিতেন। এটাকে আমার গোঁড়ামি মনে করিতেন। কিন্তু তাতে আমার ব্যবহার বদলায় নাই। বরঞ্চ উল্টা ফল হইয়াছে। ওরা আমার এই সব শব্দ ব্যবহারে অসন্তুষ্ট হয় বুঝিয়া আমার মুসলমানি আদব-কায়দা আরাে বাড়ায়াছিলাম। আমার নাস্তিক্যের ও ধর্মীয় উদারতার আমলে, বিশেষত কলিকাতার জীবনে, বন্ধুবর মােহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, বন্ধুবর আয়নুল হক খ এবং আরাে অনেক মুসলমান বন্ধুর প্রভাবে একসময় তহবন্দের বদলে ধুতি পরা শুরু করিয়াছিলাম। কিন্তু তহবন্দ বা লুঙ্গি পরা নিয়াই হিন্দুরা মুসলমানদেরে অবজ্ঞা করে বুঝিয়া ধুতি ছাড়িয়া দিলাম। অতঃপর লুঙ্গি ছাড়া আর কিছু পরিতামই না। খিলাফত ও অসহযােগ আন্দোলনে যােগদান করিয়াই যে দাড়ি রাখিয়াছিলাম, তার কারণ এই যে হিন্দু কংগ্রেসি বন্ধুরা দাড়ির নিন্দা করিত।

৩. মিঠাই বর্জন
মফস্বলে হিন্দু মিঠাইর দোকানে মিঠাই না খাওয়া তেমন বড় ত্যাগ ছিল না। কিন্তু কলিকাতায় এটা সত্যই খুব বড় রকমের ত্যাগ ছিল। বাগ বাজারের রসগােল্লা, কলেজ স্কোয়ারের পুটিরামের মিঠাই ও বৌবাজারের ভীম নাগের সন্দেশ যে না খাইয়াছে, তার কলিকাতা-জনম বৃথা। দাড়ি-মুখে লুঙ্গি পরিয়া এইসব দোকানে মুসলমান ঢুকিতে পারে না বলিয়া আমি এমন লােভনীয় মিষ্টান্ন হইতে নিজেকে বঞ্চিত রাখিতাম। শ্রদ্ধেয় বন্ধু ইয়াকুব আলী চৌধুরী পাকা নামাজি-মােত্তাকী-পরহেযগার মুসলমান ছিলেন। তিনিও দাড়ি রাখিতেন। আচকান-পাজামা ও টুপি ছাড়া কদাচ রাস্তায় বাহির হইতেন না। তিনি পর্যন্ত ঐসব মিঠাই বর্জন করিতেন না। তিনি আমার এই আত্মসম্মানবােধের গালভরা প্রশংসা করিয়াও শেষ পর্যন্ত ঐ মিঠাই খাইতে
২১৭
জোর-বরদস্তি করিতেন। তিনি বলিতেন : নিজে ঐসব দোকানে মিঠাই কিনিতে যাইও না; কিন্তু অপরে কিনিয়া আনিয়া দিলে বাড়িতে বসিয়া খাইও। অনেক দিন পরে চৌধুরী সাহেবের এই বাস্তববাদী যুক্তি গ্রহণ করিয়া তাঁরই কিনা মিঠাই তাঁরই সিটে বসিয়া খাইয়াছিলাম।

৪. বেশ্যা-বর্জিত
আরেকটি মজার ব্যাপার এখানে উল্লেখ না করিয়া পারিতেছি না। বন্ধুবান্ধবের কাছে শুনিতাম, কলিকাতার বেশ্যারাও মুসলমান খরিদ্দার গ্রহণ করে না। পরে এই কথার এইরূপ ব্যাখ্যা শুনিলাম যে মুসলমান খরিদ্দারদিগকেও ‘হিন্দুবেশে’ অর্থাৎ ধুতি পরিয়া বেশ্যাবাড়ি যাইতে হয়। প্রথমে হিন্দুদের মুসলিমবিদ্বেষের গভীরতা ও ব্যাপকতা দেখিয়া স্তম্ভিত হইলাম। হিন্দুদের মুসলিমঘৃণা বেশ্যাদের মধ্যে পর্যন্ত প্রসারিত হইয়াছে? শ্রদ্ধেয় বন্ধু ডা. লুত্যর রহমান এই সময় ‘পতিতা উদ্ধারিনী সমিতি’ চালাইতেছিলেন এবং এই উপলক্ষে বেশ্যাদের মধ্যে সভা করিয়া মূল্যবান সদুপদেশ দিতেছিলেন। তাঁর মুখে শুনিলাম, স্বয়ং বেশ্যাদের মধ্যেও অনেক মুসলমান মেয়ে আছে। কিন্তু তারা হিন্দু নামে ব্যবসা করিতেছে বলিয়া তাদেরে চিনিবার উপায় নাই। এর কারণ জিজ্ঞাসা করিয়া জানিতে পারিলাম মুসলমান বেশ্যার বাড়িতে কোনও হিন্দু খরিদ্দার যাইবে না; এমনকি ‘ভদ্রবেশ্যা পল্লি’তে তারা বাড়ি পাইবে না। তাই তারা হিন্দু নাম গ্রহণ করিয়া ব্যবসা করিতেছে। দিন-রাত পাপের মধ্যে ডুবিয়া আছে যে বেশ্যারা তারা পর্যন্ত মুসলমানকে ঘৃণা করে? কথাটা যে সত্যতার প্রমাণ নিজের চোখে দেখিতাম। যেসব মুসলমান বন্ধু-বান্ধব ও পরিচিত লােক কার্য বা চাকুরি উপলক্ষে দিনের বেলা কোট-প্যান্ট, পাজাম-পাঞ্জাবি পরিয়া থাকিতেন, তাঁদেরে দেখিতাম সন্ধ্যার সময়ে ফিনফিনা ধুতি ও সিল্কের পাঞ্জাবি পরিয়া অ্যাসেন্স লাগাইয়া বেড়াইতে বাহির হইতেছেন। তাঁহার অনেকের মুখেই এই স্বীকারােক্তি পাইতাম যে, পাঞ্জাবি-পাজামা পরিয়া গেলে বেশ্যারা বসিতে দিবে না বলিয়াই তারা ঐ পােশাকে যাইতেছেন।
ঘৃণা-লজ্জায় আমার তালু-জিহ্বা লাগিয়া গিয়াছিল। কিন্তু বেশ্যাদের চেয়ে আমার রাগ হইল এই সব আত্মসম্মানবােধহীন বেহায়া ও বেশরম। মুসলমানদের উপরে। আমি এই সময় মেসে থাকিতাম। তার কয়েকটা ছিল খুবই বড় মেস। সেসব মেসে চল্লিশ-পঞ্চাশ জন করিয়া নানা কাজের ও নানা
২১৮
বয়সের লােক থাকিতেন। তাঁদের মধ্যে বেশ্যাবাড়ি যাইবার অভ্যাস কারােকারাে ছিল। তারা অসংকোচে, অনেকে সগৌরবে, বেশ্যাবাড়ির অভিজ্ঞতা বর্ণনা করিতেন। নিজেদের মুসলমানি গােপন করিয়া বেশ্যাবাড়ি যাওয়ার সমর্থনে তাঁরা বলিতেন : মুসলমান পুরুষরা যে মুসমানি বেশে বেশ্যাবাড়ি যায় না এবং মুসলমান মেয়েরা যে মুসলমানি নামে বেশ্যাবৃত্তি করে না, তাতে আমার দুঃখিত না হইয়া বরঞ্চ আনন্দিত হওয়া উচিৎ। কারণ দুনিয়ার লােক জানিতেছে, কলিকাতার হাজার হাজার বেশ্যার মধ্যে একজনও মুসলমান। মেয়ে নাই এবং লক্ষ-লক্ষ বেশ্যাগামীর মধ্যে একজন মুসলমান পুরুষও নাই। যতই চিন্তা করিলাম, ততই বুঝিতে পারিলাম বন্ধুদের যুক্তিটা একেবারে ফেলিয়া দিবার মত নয়। শেষ পর্যন্ত বন্ধুদের ঐ যুক্তিতে আমি যথেষ্ট সান্ত্বনা পাইলাম। আস্তে আস্তে আমার রাগ কমিয়া গেল। কিন্তু ঐ ব্যাপার হইতে একটা শিক্ষা গ্রহণ করিলাম এবং জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার পাইলাম। যত দিন অবিবাহিত অবস্থায় কলিকাতা থাকিলাম, দাড়িও ফেলিলাম না, লুঙ্গিও ছাড়িলাম না। কলিকাতার মত অসংখ্য প্রলােভনের বিশাল নগরীতে লুঙ্গি ও দাড়ি আমার চরিত্রের রক্ষাকবচ হইয়া থাকিল। বেশ্যাদিগকে বেশ্যা হিসাবে আমি ঘৃণা করিতাম বটে, কিন্তু নারী হিসাবে আমি তাদেরে সম্মান করিতাম। ডা. লুত্যর রহমানের সংশ্রবে আসিয়াই যে আমি এই মত অবলম্বন করিয়াছিলাম, তা নয়। তার অনেক আগে হইতেই আমার এই মত ছিল।
১৯২২ সালের ঘটনা। তখন ময়মনসিংহ শহরে কংগ্রেস-খেলাফত নেতাদের অখণ্ড প্রতাপ। আমরা তখন একদলে পনের-বিশজন নেতা দল বাঁধিয়া রাস্তায় টহল দিতাম। সকল শ্রেণীর পথচারীরা আমাদেরে পথ ছাড়িয়া দিত। পথ চলিতে-চলিতেও আমরা তর্কবিতর্ক, আলাপ-আলােচনা করিতাম। এমনি একদিন তর্কের জোশে আমি বন্ধুদের দিকে ঘাড় ফিরাইয়া-ফিরাইয়া পথ চলিতেছিলাম। অপর দিক হইতে দুই-তিন জন বেশ্যা আসিতেছিল। ওরা আমাদেরে রাস্তা ছাড়িয়া এক পাশ হওয়া সত্ত্বেও আমি বেখায়ালে উহাদের একজনের পায়ে পাড়া মারি। উহ’ শুনিয়া আমার হুঁশ হয়। আমি তার দিকে ফিরিয়া নিজের অপরাধ বুঝিতে পারি এবং মাফ করিবেন’ বলিয়া আমি মাথা ফিরাইয়া জোড় হাতে হিন্দু-মতে নমস্কার করি। কারণ আমার ধারণা ছিল সব বেশ্যাই হিন্দু। আমার সাথীরা সকলে হাে হাে করিয়া হাসিয়া উঠিলেন। একজন বলিলেন : “ছি ছি, তুমি একটা বেশ্যাকে নমস্কার করিলে। বিনা-দ্বিধা সংকোচে চট করিয়া আমার মুখ হইতে বাহির হইয়া গেল : যারা বেশ্যাবাড়ি যায়, তাদের জন্যই ইনি বেশ্যা। আমার জন্য ইনি একজন মহিলা মাত্র।
২১৯
মুহূর্তে সকলের হাসি বন্ধ হইয়া গেল। আর বেশ্যা বলিয়া কথিত মেয়েটির চোখ দুইটা ছলছল করিয়া উঠিল। পলকে আমাদের দিক হইতে চোখ ফিরাইয়া সঙ্গিনীদের সাথে চলিয়া গেল।
শুধু মুসলমানদের পােশাক-পাতি নয়, তাদের নাম লইয়াও যদি কেউ প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষ বিদ্রুপ করিত তবে আমি চটিয়া যাইতাম। নামে অশুদ্ধ উচ্চারণ বা বিকৃতিকরণকে আমি এইরূপ বিদ্রুপ মনে করিতাম । হিন্দু বন্ধুদের সাথে এই লইয়া আমার অসংখ্য ঝগড়াঝাটি হইয়াছে। এসব ক্ষেত্রেই আমি হিন্দু বন্ধুদিগকে টিট-ফর-ট্যাট বা ঢিলের বদলে পাটকেল মারিয়া প্রতিশােধ নিতাম। এখানে দুইটা মাত্র ঘটনার উল্লেখ করিব :

৫. ফ্যাসটিডিয়াস
ময়মনসিংহের কংগ্রেস-নেতা বাবু সূর্য কুমার সােম উদার অসাম্প্রদায়িক নেতা ছিলেন। তাঁকে আমি পিতার ন্যায় ভক্তি করিতাম। তিনিও আমাকে আপন। ছেলের মতই স্নেহ করিতেন। কিন্তু তিনি মওলানা শওকত আলীকে মৌলানা ‘সৈকত আলী (ইংরাজি এস দিয়া) এবং আমাকে মশুর (ইংরাজি এস-এইচ দিয়া) উচ্চারণ করিতেন। এই নিয়া তাঁর সঙ্গে প্রায়ই আমার কথা-কাটাকাটি হইত। তিনি নিজের নাম সূর্য কুমার (এস-এইচ দিয়া) ঠিকই উচ্চারণ করিতেন। কিন্তু শওকতের উচ্চারণে তিনি শুধু এস দিয়া সৈ’ উচ্চারণ করিতেন। অর্থাৎ ‘মনসুরে’ ‘স’-এর স্থলে ‘শ’ এবং শওকতে’ ‘শ’-এর স্থলে ‘স’ উচ্চারণ করিতেন। আমার পুনঃপুন প্রতিবাদে তিনি উত্ত্যক্ত হইয়া আমাকে ধমক দিলেন। বলিলেন : নামের উচ্চারণ লইয়া আমার অমন ফ্যাসটিডিয়াস হওয়া উচিৎ নয়। আমি এটাকেও সূর্যবাবুর সাম্প্রদায়িক মুসলিম-অবজ্ঞা মনে করিয়া দুঃখিত হইলাম। কিন্তু বেআদবি না করিয়া টিটফর-ট্যাট মারিবার সন্ধানে থাকিলাম।
সেকালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির বৈঠক শুধু কলিকাতায় না হইয়া ঘুরিয়া ঘুরিয়া বিভিন্ন জিলায় হইত। সেবারে ঐ বৈঠক ছিল ময়মনসিংহে। সেক্রেটারি সুভাষচন্দ্র বসু, সূর্যবাবুর মেহমান। তিনি বন্ধুবান্ধব লইয়া গল্প-গুযারি করিতেছেন। আমিও সেই বৈঠকে আছি। আলাপেআলাপে সুভাষবাবু আমার দিকে চাহিয়া হঠাৎ বলিলেন : সূর্যবাবু গেলেন কোথায় মনসুর সাব? তাকে দেখি না কেন?
আমি আসন হইতে উঠিয়া বাড়ির ভিতরদিককার বারান্দায় দাঁড়াইয়া
২২০
চিৎকার করিলাম : ‘সূর্যবাবু, ও সূর্যবাবু, সুভাষবাবু আপনারে ডাকতেছেন। ‘সূর্য’ ও ‘সুভাষ’ দুইটি শব্দই আমি এমন স্পষ্টভাবে ‘এস’ উচ্চারণ করিলাম, যাতে দুইটা শব্দই প্রায় ছুর্য’ ও ‘ছুভাছ’ শােনা গেল।
ঘরের মধ্যে দৃষ্টিপাত করিয়া বুঝিলাম, আমার ঔষধে ক্রিয়া করিয়াছে। সুভাষবাবু ও তাঁর সঙ্গীরা বিস্ময় বা বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকাইয়াছেন। বারান্দার দিকে দৃষ্টি ফিরাইয়া দেখিলাম, সূর্যবাবু প্রায় আমার কাছে আসিয়া পড়িয়াছেন এবং বলিতেছেন : তুমি আমার নাম লৈয়া ঠাট্টা করতেছ কেন?’
সুভাষবাবু ব্যাপার কী জিজ্ঞাসা করিলেন। সভার মধ্যেই আমি সূর্যবাবুর বিরুদ্ধে অভিযােগ করিলাম। সূর্যবাবুও আমার বিরুদ্ধে বলিলেন। উচ্চ হাসিয়া। সুভাষবাবু বিচার করিলেন। বিচারে সূর্যবাবু অপরাধী সাব্যস্ত হইলেন। আমি বেকসুর খালাস পাইলাম। সকলে অনেকক্ষণ ধরিয়া হাসাহাসি করিলেন।
আরেক দিনের ঘটনা। ময়মনসিংহ টাউন হলে এক কংগ্রেসি সভার সভাপতি রূপে আমি নাকি খুব ভাল বক্তৃতা করিয়াছিলাম। এ জিলার প্রাচীনতম সংবাদপত্র চারু-মিহির এই প্রসঙ্গে আমার প্রশংসায় একটা সম্পাদকীয় লিখিয়া ফেলিল। তাতে আমাকে ‘খ্যাতনামা সাহিত্যিক, জনপ্রিয় কংগ্রেস-নেতা, উদীয়মান উকিল মি. মনসুর আলী সাহেব’ বলিয়া উল্লেখ করা হইল। উক্ত পত্রিকার সম্পাদক মি. মধুসূদন সরকার ময়মনসিংহ বারের প্রবীণ উকিল । কাগজ বাহির হইবার পর দিনই তাঁর সাথে আমার দেখা। সগর্বে তিনি আমাকে বলিলেন : পড়ছেন এবারের সম্পাদকীয়টা? কেমন লাগল?
আমি হাসিয়া বলিলাম : ধন্যবাদ। আমাকে ত বাঁশ দিয়া অনেক উঁচায় তুলছেন। কিন্তু সামান্য একটু ভুল হইছে।
মধুবাবু কিছুটা বিস্মিত এবং তার চেয়ে অসন্তুষ্ট হইয়া বলিলেন : আমি ভুল করছি? কী ভুল?
আমি হাসিমুখে বলিলাম : আমার নাম আবুল মনসুর, মনসুর আলী নয় ।
মধুবাবু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলিয়া বিজ্ঞের হাসি হাসিয়া বলিলেন : ও! এই কথা! এতে ভুলটা কী হইল? নামের মধ্যে মনসুর’ ত আছে।
আমি বিরক্তি গােপন করিয়া বলিলাম : তা আছে বটে, তবে নামটা আমার আবুল মনসুর আহমদ, মনসুর আলী নয়।
মধুবাবু আমার বােকামিতে কৃপা প্রদর্শন করিয়া সান্ত্বনার সুরে বলিলেন : নাম সম্বন্ধে অত ফ্যাসটিডিয়াস হইবেন না। যাহা আবুল মনসুর তাহাই মনসুর আলী। আমি ত কোনও পার্থক্য দেখি না।
এই বলিয়া মধুবাবু আমাকে পাত্ৰাধার তৈল ও তৈলাধার পাত্র এবং
২২১
‘টুইডলডাম’ ও ‘টুইডলডি’র চুলচেরা হিসাবের অন্যাবশ্যকতা বুঝাইবার চেষ্টা করিলেন।
আমি আর কী করিতে পারি? অগত্যা নিরস্ত হইলাম এবং টিট-ফরট্যাট’-এর সন্ধানে থাকিলাম। সৌভাগ্যবশত সুযােগের অপেক্ষায় আমাকে বসিয়া থাকিতে হইল না।
সেই দিনই বিকালে কোর্ট-ফেরতা ডি বি বিল্ডিংদ্বয়ের মধ্যবর্তী রাস্তা দিয়া বাসায় ফিরিতেছিলাম। সেদিন ডি বির মিটিং ছিল। মিটিং শেষে চেয়ারম্যান শরফুদ্দিন সাহেব কতিপয় মেম্বর লইয়া রাস্তায় দাঁড়াইয়া বােধ হয় মিটিং-এরই কোনও আলােচিত বিষয়ের পুনরালােচনা করিতেছিলেন। আমাকে দেখিয়া ডাকিলেন। আমিও তাদের আলাপে শামিল হইলাম। আলাপ করিতে-করিতে হঠাৎ চেয়ারম্যান সাহেব মাথা উঁচা করিয়া বলিলেন : ওটা চারু-মিহিরএর এডিটর মধুবাবু যাইতেছে না?
আমিও চেয়ারম্যান সাহেবের দৃষ্টি অনুসরণ করিয়া দেখিলাম, খানিক দূর দিয়া মধুবাবু যাইতেছেন। বলিলাম : মধুবাবুই বটে।
চেয়ারম্যান : আপনার সাথে ত মধুবাবুর খুব খাতির, একটু ডাকুন না । তার সাথে আমার কথা আছে।
আমি অমনি জোরে চিল্লাইয়া উঠিলাম : সূদনবাবু ও সূদনবাবু। মধুবাবু একবার ঘাড় ফিরাইয়া এদিক-ওদিক তাকি-তুকি করিয়া আবার পথ চলিতে লাগিলেন। দেখিলাম, চেয়ারম্যান সাহেব আমার ভুল সংশােধনের জন্য কী বলিতে যাইতেছেন। আমি তাঁকে কোনও কথা বলিতে না দিয়া গলার সুর আরাে উঁচা করিয়া চিকার করিলাম : ও সূদনবাবু ও চারু মিহির, চেয়ারম্যান সাহেব আপনার সাথে একটা কথা কইতে চান।
এবার মধুবাবু আমাদের দিকে ফিরিয়া চাহিলেন। আমার পাশে চেয়ারম্যান সাহেবকে দাঁড়ান দেখিয়া আমাদের দিকে রওয়ানা হইলেন। তিনি ঘন-ঘন পা ফেলিয়া আমাদের নিকটবর্তী হইয়াই আমার দিকে চোখ পাকাইয়া বলিলেন : মানুষের নাম নিয়া মশকরা করেন কেন?
আমি বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলিয়া বলিলাম : কী কইতেছেন? আপনি মুরুব্বি মানুষ। আপনার নাম নিয়া মশকরা করব আমি?
মধুবাবু জেংরা মারিয়া বলিলেন : বাকি রাখলেন আর কী? আমারে সূদনবাবু বইলা ডাকলেন কেন? আপনি ত জানেন আমার নাম শ্রী মধুসূদন সরকার।
আমি হাসিয়া বলিলাম : আপনার নামের মধ্যে ‘সূদন’ ত আছে। তবে ভুলটা কী করলাম? যাহা মধু তাহা সূদন। নাম সম্বন্ধে আপনি অত
২২২
ফ্যাসটিডিয়াস কেন? এ ত দেখতেছি ‘তৈলাধার পাত্র ও পাত্ৰাধার তৈল’ অথবা ‘টুইডলডাম’ ‘টুইডলডি’র ব্যাপার।
এতক্ষণে মধুবাবুর চৈতন্য হইল। তিনি আমার কাঁধে একটা থাপ্পড় মারিয়া বলিলেন : আপনে বড় বজ্জাত।।
আমি তখন চেয়ারম্যান ও অন্যান্য মেম্বারদের ব্যাপারটা বলিলাম। সকলে অনেকক্ষণ ধরিয়া হাসিয়া মধুবাবুকে একদম তুলাধুনা করিলেন।
আমি এইরূপে একদিকে মুসলমানদের চাল-চলন, কৃষ্টি-তমদুন ও পােশাক-পাতি লইয়া অমুসলমানদের, বিশেষত, প্রতিবেশী হিন্দুদের সাথে অহরহ ঝগড়া করিয়া বেড়াইতাম। অপরদিকে মুসলমান সমাজের, বিশেষত, বাংলার মুসলমান সমাজের দুঃখ-দুর্দশা, দারিদ্র্য, অশিক্ষা-কুশিক্ষা, অনাচার, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে দিন-রাত খিচু-খি করিতাম।
মুসলমানদের এই সার্বিক অধঃপতনের জন্য আমি তাদের অহেতুক ধর্মীয় গোঁড়ামি, শরা-শরিয়তের নামে তাদের বাড়াবাড়ি ইত্যাদিকেই দায়ী করিতাম । এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আত্মঘাতী মনে হইত মুসলমানদের পর্দাপ্রথা ও ভিক্ষা-প্রথা।

৬. মুসলমানদের পর্দা-প্রথা
পর্দা-প্রথার কথাটাই আগে বলিতেছি। এই পর্দা-প্রথা মুসলমান সমাজকে পঙ্গু অথর্ব, অসভ্য ও কৃষ্টিহীন করিয়া রাখিয়াছে। নারী জাতির পর্দার কড়াকড়ির সমর্থনে দিন-রাত শত হাদিস-কোরআন আওড়ান হইতেছে। যেন একমাত্র পর্দা-প্রথার উপরই ইসলামের অস্তিত্ব নির্ভর করিতেছে। অথচ কার্যত এই পর্দা-প্রথা শিক্ষিত উচ্চ ও মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। চাষি-শ্রমিক, কুলি-মজুর ও ভিক্ষুক যারা মুসলমান সমাজের বিপুল মেজরিটি, তাদের মধ্যে পর্দা-প্রথা নাই। এ সম্বন্ধে আলেম সম্প্রদায়ের মনােভাব অদ্ভুত। একজন মধ্যবিত্ত গৃহস্থ বা অফিসারের চৌদ্দ বছরের মেয়েকে পায় হাঁটিয়া বা রিকশায় চড়িয়া খােলামুখে স্কুলে যাইতে দেখিলে এঁরা ইসলাম গেল’ ইসলাম গেল’ বলিয়া আসমান-জমিন কাপাইয়া তুলিবেন। কিন্তু জুম্মাবারে বা ঈদের দিনে রাস্তা-ঘাটে হাজার হাজার আধ-ল্যাংটা ভিখারিনী মেয়েকে হৈ-হল্লা করিতে দেখিয়াও ইসলামের বিপদ সম্পর্কে এঁরা টু-শব্দটি করেন না। এঁদের ভাবগতিকের সহজ অর্থ এই যে মুসলমান মেয়েরা লাখে-লাখে রাস্তার বাহির হইয়া ভিক্ষা করিলেও ইসলাম নষ্ট হইবে না; কিন্তু দু-দশ জন মেয়ে স্কুলে-কলেজে
২২৩
গেলেই ইসলাম ধ্বংস হইবে। ফল হইয়াছে এই যে ইসলামি পর্দা উচ্চ ও মধ্য শ্রেণীর মধ্য সীমাবদ্ধ হইয়াছে। তা-ও আবার কিশােরী ও যুবতীদের মধ্যে। কেবলমাত্র এই শ্রেণীরই ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া শিখাইবার সংগতি আছে। কৈশাের ও যৌবনই মধ্য ও উচ্চশিক্ষার সময়। কাজেই অবস্থাপন্ন। মুসলমানরাও তাঁদের মেয়েদেরে লেখাপড়া শিখাইতে পারিতেছেন না। শিক্ষা ও অশিক্ষা দুইটাই জ্যামিতিক প্রগ্রেশনে বাড়িয়া যায়। মার শিক্ষাহীনতা এই নিয়মকে আরাে জোরদার করিয়া থাকে। এই কারণে প্রতিবেশী সমাজের মােকাবিলা বাংলার মুসলমান সমাজ শিক্ষার দিকে, সুতরাং জীবনের সকল ক্ষেত্রে, জ্যামিতিক প্রগ্রেশনে তলাইয়া যাইতেছে। অথচ এত বড় সর্বনাশের হেতু যে পর্দা-প্রথা, সে পর্দার পর্দা তুলিয়া দেখা হইতেছে না ওটা কী বস্তু । পর্দা জারি করা হইতেছে যে হাদিসের নামে তাতে বয়স ও শ্ৰেণী-নির্বিশেষে সব নারীর কথাই লেখা হইতেছে। কিন্তু কার্যত দেখা যাইতেছে, ওটা শুধু ধনী যুবতীর জন্য। পর্দার জন্য বাড়ির চারিদিকে উঁচা প্রাচীর তােলা হইতেছে হাজার টাকা খরচ করিয়া। কিন্তু পাঁচ সিকার কাপড় দিয়া এই পর্দানশীনকে একটি কোর্তা পরান হইতেছে না। এইরূপ যুক্তিহীন স্ববিরােধী পর্দাই মুসলমান সমাজের অর্ধেক মানুষকে পঙ্গু, অসহায় ও পুরুষের কাধের বােঝা করিয়া রাখিয়াছে। এর জন্য দায়ী মােল্লাদের বিকৃত ইসলাম।

৭. ভিক্ষাবৃত্তি
পর্দা সম্বন্ধে যা, ভিক্ষা সম্বন্ধেও তাই। দান-খয়রাত-চ্যারিটি-দক্ষিণা সব দেশে সব জাতির মধ্যেই আছে। কিন্তু মুসলমান সমাজে ঐ সব প্রথা ভিক্ষাবৃত্তি যে কুৎসিত কার্যের আত্মঘাতী রূপ ধারণ করিয়াছে, এমনটি দুনিয়ার আর কোথাও দেখা যাইবে না। এক পয়সা দান করিলে পরকালে সত্তর পয়সা পাওয়া যায়, সায়েলকে কদাচ না বলিও না’, ‘ভিক্ষুক ভিক্ষা চাওয়ামাত্র তােমার ধন-সম্পদ ক্রোক হইয়া গেল, তাকে কিছু দিয়া সন্তুষ্ট না করা পর্যন্ত ঐ ক্রোক ছুটিবে না : দিনরাত এই ধরনের ওয়াস-নসিহতই মুসলমান সমাজের এই দুর্গতি ঘটাইয়াছে। গােড়াতে মােল্লারা নিজেদের অনার্জিত জীবিকা নিশ্চিত করিবার জন্যই ভিক্ষাদানের উপকারিতার এই চমৎকার ও মনােহারিণী রূপ বর্ণনা করিয়াছিলেন। তখন তাঁদের আশা ছিল, তারা একাই এর ফল ভােগ করিবেন। কিন্তু পরিণামে তাঁদের এত শরিক জুটিয়া গিয়াছে যে বিপুল ভিড়ে তাঁরা দাঁড়াইতে পারিতেছেন না। ফলে মুসলমান জাতির জন-বলের এক বিরাট অংশ
২২৪
নিষ্কর্মা, গলগ্রহ হইয়া গিয়াছে। এর জন্যও দায়ী মােল্লাদের বিকৃত ইসলাম।
এ অবস্থায় সকল বুদ্ধিমান মুসলমানই ইসলামকে এই সব আবর্জনা মুক্ত করিবার চেষ্টা করিবেন ইহাই স্বাভাবিক। এই শ্রেণীর লােককে ধর্ম সংস্কারক বলা হইয়া থাকে। খৃষ্টানদের মধ্যে মার্টিন লুথার, হিন্দুদের মধ্যে রামমােহন। রায় ও স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী, মুসলমানদের মধ্যে স্যার সৈয়দ আহমদ, মওলানা সৈয়দ আহমদ বেরেলভী, সৈয়দ আমির আলী ও মির্যা গােলাম আহমদ কাদিয়ানীর নাম উল্লেখ করা যাইতে পারে। উহাদের মােকাবিলা আমি ক্ষুদ্রাদপি ক্ষুদ্র নগণ্য ব্যক্তি। সে কারণেই হউক, অথবা মত-বিভিন্নতার দরুনই হউক, আমার চিন্তা ওদিকে গেল না। আমার মন ও চিন্তা ঘুরিয়াফিরিয়া ইসলামের চেয়ে মুসলমানদের দিকেই বেশি ঝুঁকিয়া পড়িল। এর অর্থ শেষ পর্যন্ত এই দাঁড়াইল যে আমি মুসলমানদের পরকালের ভাবনার চেয়ে ইহকালের ভাবনাই বেশি ভাবিতে লাগিলাম।

৮. মুসলিম-হিত বনাম হিন্দু-অহিত
মুসলমানদের এই হিত-চিন্তা কার্যত আমাকে অমুসলমানদের অহিতকামী করিয়া তুলিতেছে কিনা, তার পরীক্ষা অল্পদিনের মধ্যেই শুরু হইল। রাজনীতিতে আমি কংগ্রেসি ছিলাম। কংগ্রেসি হিন্দু বন্ধুদের কাছে আমার জাতীয়তাবাদ স্বভাবতই সন্দেহের ব্যাপার হইয়া দাঁড়াইল। আমার রাজনীতিক মতামত ও তার ক্রমবিবর্তনের কথা আমি অন্যত্র বলিয়াছি। এখানে শুধু এইটুকু বলিয়া রাখিতেছি যে মুসলমান সমাজের এই চরম অধঃপতিত অবস্থা আমাকে এ ব্যাপারে অতিশয় স্পর্শকাতর করিয়া ফেলিয়াছিল। ফলে প্রায়ই আমি বলিতাম : মুসলমানের এটা হইল, মুসলমানের ওটা হইল না ইত্যাদি। এতে হিন্দু বন্ধুরা খুব সংগতভাবেই মনে করিতে পারিত এবং করিত যে আমি সমস্ত রাজনৈতিক ব্যাপারও শুধু মুসলমানদের ভাল-মন্দের মাপকাঠি দিয়া বিচার করিয়া থাকি। কাজেই আমি আসলে সাম্প্রদায়িকতাবাদী, জাতীয়তাবাদী আমি নই। আমি হিন্দু বন্ধুদের। এই সন্দেহের প্রতিবাদ করিতাম এবং আন্তরিকতার সাথেই করিতাম । হিন্দুর অহিত কামনা না করিয়াও মুসলমানের হিত কামনা করা যায়, সুতরাং নিজের সম্প্রদায়কে ভালবাসিয়াও জাতীয়তাবাদী হওয়া যায়, ইহাই ছিল আমার রাজনৈতিক মতবাদ। এ মতবাদ আমি জনাব মুজিবর রহমান সাহেবের নিকট শিখিয়াছিলাম। মৌলবী মুজিবর রহমান ও তাঁর রাজনৈতিক
২২৫
মতবাদ সম্পর্কে আমি অন্য অধ্যায়ে আরাে বিস্তারিত আলােচনা করিব। এখানে শুধু এইটুকু বলিলেই যথেষ্ট হইবে যে, আমার মুসলিম-প্রীতির সঙ্গে ইসলাম-প্রীতির কোনও সম্পর্ক ছিল না। বস্তুত ইসলামের প্রতি আমার কোনও প্রীতিই ছিল না। কাজেই আমি হিন্দু ধর্মের প্রতি কোনও বিরূপ ভাবও পােষণ করিতাম না। মানুষের দৈহিক ও মানসিক পরম কল্যাণই ধর্মের মূল উদ্দেশ্য। এই হিসাবে আমি ধর্মকে ঔষধের সাথে তুলনা করিতাম। মােটামুটি এখন পর্যন্ত আমার মত তাই। মাত্র চার-পাঁচ বছর আগেকার একটি ঘটনা এখানে উল্লেখ করিব।

৯. ইসলাম বনাম মুসলমান
ইসলাম ও মুসলমান সম্বন্ধে গভীর ও গুরুতর চিন্তা যারা করিয়া থাকেন বন্ধুবর আবুল হাশিম তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর ক্ষুরধার তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, বলিষ্ঠ চিন্তা ও জোরাল প্রকাশ-ক্ষমতা আমাকে মুগ্ধ করিয়াছে। তার চিন্তায় ও আমার চিন্তায় আশ্চর্য রকম মিল রহিয়াছে। এই কথার উল্লেখ করিয়া একদিন আমি হাশিম সাহেবকে তর্কে-তর্কে বলিয়াছিলাম : আপনার সাথে চিন্তায় আমার পনের আনা মিল থাকা সত্ত্বেও ঐ এক আনার কোথাও এমন একটা বুনিয়াদি বিরােধ আছে, যার ফলে আপনি ও আমি এক সাথে চলিতে পারি না। সেটা কি বলিতে পারেন?
হাশিম সাহেব সরলভাবে বলিলেন : প্রশ্নটা আমারও মনে জাগিয়াছে। কিন্তু কোনও উত্তর পাই নাই।
আমি বলিলাম : আমার মনে একটা উত্তর জাগিয়াছে। কৌতূহলের সুরে হাশিম সাহেব জিজ্ঞাসা করিলেন : কী বলুন ত ।
আমি বলিলাম : আপনি ইসলামকে ভালবাসেন আমি মুলমানকে ভালবাসি।
হাশিম সাহেব প্রথমে একটু হতভম্ব হইয়া গেলেন। খানিকক্ষণ পরে বলিলেন : আপনি আমাকে চিন্তায় ফেলিয়াছেন। আজ এ কথার উত্তর দিতে পারিলাম না। পরে দিব, কিছুদিন পরে হাশিম সাহেব আমাকে বলেন : আপনার ঐ কথার জবাব দিবার জন্য আপনাকে কিছুদিন যাবৎ তালাশ করিতেছি। এইবার জবাবটা নিন।
আমি বলিলাম : দেন।
হাশিম সাহেব প্রতি কথায় জোর দিয়া বলিলেন : আমি যে শুধু মুসলমানদের ভালবাসি না তা নয়, আমি তাদেরে ঘৃণা করি।
২২৬
আমি হাশিম সাহেবের উষ্ণতায় হাসিয়া বলিলাম : তা হইলে দাঁড়াইতেছে এই যে, আপনি ঔষধটাকেই ভালবাসেন, রােগীকে আপনি ঘৃণা করেন।
হাশিম সাহেব অসাধারণ প্রত্যুৎপন্নমতির লােক। তিনি আমার উপমা গ্রহণ করিয়া বলিলেন : যে রােগী ইসলামের মত এমন মূল্যবান ঔষধ নষ্ট করিয়াছে, তাকে ঘৃণা করিব না ত কী করিব?
আমি নিশ্চিত জয়ের আশায় বলিলাম : ঔষধ-মূল্যবান কি না, তার, পরিচয় রােগ নিরাময়ে।
কিছুমাত্র না দমিয়া হাশিম সাহেব বলিলেন : যে উন্মাদ রােগী ঔষধেভেজাল দিয়া খায়, তার রােগ না সারিলে কি ঔষধের দোষ?
হাশিম সাহেবকে তর্কে হারান খুব শক্ত কাজ। কাজেই সেদিন আমিই হারিলাম।

১০. ধর্ম ও ঔষধ
কিন্তু হাশিম সাহেবের কথা ঠিক নয়। তার ঐ কথা লা-জবাব নয়। কারণ রােগী যে ঔষধে ভেজাল মিশাইয়া ডাক্তারকে ফাঁকি দেয়, এটাও তার একটা রােগ। এ রােগও সারাইতে হইবে ঔষধ দিয়াই। রােগীর দোষ দিয়া ঔষধের তারিফ করিতে পারে কেবলমাত্র ঔষধ-ব্যবসায়ী। ঠিক তেমনি যে ধর্ম যত বেশি মানুষের যত বেশি কল্যাণ করিতে পারিল, আমার বিবেচনায় এবং নিরপেক্ষ সকলের বিবেচনায়, সেই ধর্মই শ্রেষ্ঠ ধর্ম। কিন্তু ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব-নিকৃষ্টত্ব বিচার আমার কাজ নয়। আমার একমাত্র চিন্তা আমার রােগী। আমার একমাত্র কামনা। তার রােগ সারা। যে ঔষধ খাওয়াইলে আমার রােগী ভাল হয়, সেই ঔষধই খাওয়াইব। যদি ওভার মেডিক্যাটেড হইয়া যাওয়ার দরুন রােগ জটিল হইয়া থাকে, তবে ঔষধ খাওয়ান বন্ধ করিব। ঔষধের জন্য রােগী নয়, রােগীর জন্যই ঔষধ। ঠিক তেমনি, এ কথাও সর্বজনস্বীকৃত। যে ধর্মের জন্য মানুষ নয়, মানুষের জন্যই ধর্ম। যে ঔষধ রােগীর কাজে লাগিল না, তা যেমন বর্জনীয়; তেমনি, যে ধর্ম মানুষের কল্যাণ করিল না, তা বর্জনীয়।

১১. শাঁস ও খােসা
কিন্তু ঔষধের সঙ্গে ধর্মের তুলনা মাত্র একদিক হইতে সত্য। উপাদান ও অনুপান লইয়াই ঔষধ। ঐসব উপাদানের সবগুলিই ফান্ডামেন্টাল। তার
২২৭
কোনও একটা বাদ দিলে ঔষধ আর ঔষধ থাকিবে না। তেমনি বিশ্বাস ও ক্রিয়া-কর্ম লইয়াই ধর্ম। কিন্তু সে বিশ্বাস ও ক্রিয়া-কর্মের সবগুলি ফান্ডামেন্টাল নয়। একমাত্র সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসই ধর্মের ফান্ডামেন্টাল। বিশ্বাসের অবশিষ্ট অংশ এবং সমস্ত ক্রিয়া-কর্মই ধর্মের অনুষঙ্গ মাত্র। এগুলিকে ঔষধের অনুপানের সঙ্গে তুলনা করা যাইতে পারে। রােগী-ভেদে ও রােগীর দেশ-ভেদে এইসব অনুপান ইতর-বিশেষ করা যাইতে পারে এবং করা উচিতও। ঠিক তেমনি মানুষের দেশ ও অবস্থাভেদে ধর্মের এইসব ননফান্ডামেন্টাল অনুপানগুলির ইতর-বিশেষ করা যাইতে পারে এবং করা উচিতও। এই দিক হইতে বিচার করিলে খােরাক, পােশাক, নাম-নিশানা, উপাসনা-প্রণালি, পার্সনাল ‘ল’, এ সমস্ত ধর্মের নন-ফান্ডামেন্টাল। ধর্মের মূল ঈমানের সাথে-সাথে এসব নন-ফান্ডামেন্টালকেও যদি সকল দেশের সকল যুগের সকল বিশ্বাসীদের জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়, তবে সেটা হইবে অবাস্তব ও ইমপ্র্যাকটিক্যাল। তাতে অনাবশ্যকরূপে ঐ ধর্ম হইতে মানুষকে এবং মানুষ হইতে ধর্মকে দূরে রাখা হইবে; অনাবশ্যককে অত্যাবশ্যক ঘােষণা করিয়া ঐ ধর্মকেই লােক-চক্ষে হেয় করা হইবে। একটা ছােট দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। যদি বলা হয়, খােরমা না খাইলে বা দাড়ি না রাখিলে কেউ মুসলমান হইতে পারিবে না; অথবা যদি কেউ বলে, গলায় টাই না বাঁধিলে বা ক্রস না ঝুলাইলে কেউ খৃষ্টান হইতে পারিবে না; কিম্বা যদি বলা হয় টিকি না রাখিলে বা গলায় রুদ্রাক্ষের মালা না পরিলে কেউ হিন্দু হইবে না, তবে তাতে যথাক্রমে ইসলাম, খৃষ্টধর্ম ও হিন্দুধর্ম হইতে ঐ ঐ ধর্ম-বিশ্বাসীদেরে অনাবশ্যকরূপে দূরে ঠেলিয়া রাখা হইবে। এইসব পােশাক-পাতি ও আচারব্যবহারের মতই উপাসনা-প্রণালিও ধর্মের নন-ফান্ডামেন্টাল। গির্জা, মন্দির মসজিদকে সৃষ্টিকর্তার একমাত্র উপসনাস্থল মনে করাও তেমনি অনাবশ্যককে অত্যাবশ্যক গণ্য করা। এ সব যারা করেন, তাঁরা নিজের ধর্মের মান-মর্যাদা না বাড়াইয়া হীন করিয়াই থাকেন।
আমার মনে হয়, মুসলমানদের ধর্মীয় নেতারাই এই ধরনের ভুল করিয়াছেন সবচেয়ে বেশি। এঁরা নামাজ-রােযা, অযু-গােসল ও তসবিহ তেলাওয়াতকে ধর্মের ফান্ডামেন্টাল খাড়া করিয়া ঐ সব দিয়া মুসলমানদেরে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধিতে চেষ্টা করিয়াছেন। এটা করিতে গিয়া তারা নিজেদের যুক্তির ফাঁদে নিজেরাই ধরা পড়িয়াছেন। যার ফলে নামাজে বুকের উপর ও নাভির নিচে তহরিমা বাঁধা লইয়া, যানাযার নামাজে মাইয়াতের বুক বরাবর বা শির বরাবর দাড়ান লইয়া, বার-তকবির ছয়-তকবির লইয়া, জোরে বা
২২৮
আস্তে আমিন বলা লইয়া মুসলমানে-মুসলমানে খুনাখুনি ঘটাইয়াছেন। এর প্রতিকার একমাত্র টলারেন্স। কিন্তু টলারেন্সকে এরা ভয় পান এই জন্য যে, তাতে ধর্ম থাকে বটে, কিন্তু ধর্মীয় দল থাকে না।

১২. ধর্ম বনাম ধর্মীয় দল
অতএব দেখা যাইতেছে, মুসলমানদের মধ্যে যে ধর্মীয় কড়াকড়ি সেটা ইসলামের খাতিরে নয়, মযহাব বা ধর্মীয় দলের খাতিরে। আমার চাচাজীর মত সব খাঁটি মুসলমানরাই মনে করেন, তাঁর নিজের মযহাব না টিকিলে ইসলাম টিকিবে না। ফলে সব মযহাবের মুসলমানরাই অন্য মযহাবের মুসলমানদের মােকাবিলায় নিজেদেরই ইসলামের একমাত্র রক্ষক মনে করিয়া থাকে ।
ঠিক তেমনি বড় বড় সব ধর্মের উম্মতেরাই নিজেদেরে আল্লাহর বডিগার্ড মনে করিয়া থাকে। বৌদ্ধ, খৃষ্টান, ইসলাম ও হিন্দু ধর্ম এই চারটি ধর্মই বিশ্বের বড় ধর্ম। এই সব ধর্মের শাস্ত্রেই লেখা আছে : ‘ধর্মে যবরদস্তি নাই; ‘তােমার ধর্ম তােমার, আমার ধর্ম আমার।’ অথচ এই উচ্চস্তরের নৈতিক শিক্ষা সত্ত্বেও ধর্মে-ধর্মে যুদ্ধ-বিগ্রহ চলিতেছে। কিন্তু এটাই এদেরে বড় দুর্বলতা নয়। এর চেয়েও বড় ত্রুটি এদের মধ্যে রহিয়াছে। সে ত্রুটি এই যে, বহু ধর্মের বিশ্বাসীরা মনে করে এদের অন্তর্ভুক্ত যারা নয়, তারা সবাই অর্ধামিক, কেবলমাত্র এরাই আল্লার রক্ষক। ভাবটা এই যে, এই সব ধর্ম না থাকিলে আল্লায় বিশ্বাসী আর কেউ থাকিবে না। বিশ্বাসী না থাকিলে কাজেই আল্লাও থাকিবে না।

১৩. ধর্ম বনাম আল্লাহ
কিন্তু এটা সত্য নয়। ধর্ম-বিশ্বাসের সঙ্গে আল্লা-বিশ্বাসের কোনও প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নাই। কোনও ধর্মে বিশ্বাস করিতে গেলে একজন সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করিতে হয় সত্য, কিন্তু একজন সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করিতে গেলেই একটি ধর্মে বিশ্বাস করিতেই হইবে, তার কোনও মানে নাই। ধর্ম ও আল্লার মধ্যে ফান্ডামেন্টাল পার্থক্য এই যে ধর্ম পরিবর্তনশীল, আল্লাহ শাশ্বত, তার কোনও পরিবর্তন নাই। সেজন্য ধর্ম অনেকগুলি, আল্লাহ এক। ধর্মকে রক্ষা করিতে হয় মানুষের, আল্লাহ নিজেকে নিজেই রক্ষা করেন। মানুষ ধ্বংস হইলে ধর্মের
২২৯
অবসান হইবে। কিন্তু আল্লাহ থাকিবেন। ধর্ম মনের জিনিস, আল্লাহ অন্তরের জিনিস। ধর্ম বুঝিতে হয় বুদ্ধি দিয়া, আল্লাহ অনুভব করিতে হয় অন্তর দিয়া । ধার্মিকরা যে মনে করেন, আল্লাহকে মানুষের মনে তারাই জিয়াইয়া রাখিয়াছেন, এটা তাদের দেমাগ-তুকাব্বরি। এটা তাদের অহংকার। এ অহংকার নাস্তিকের অহংকারের চেয়ে কোনও অংশে কম দাম্ভিক নয়। আল্লার অস্তিত্ব এমনি একটা বস্তু যা সাধারণ মানুষ সব সময় দেখে না; শুধু বিশেষ অবস্থায় দেখিতে পায়। একটা মামুলি দৃষ্টান্ত দেই। সাহসী মানুষ ভয় কাকে বলে জানে না। কিন্তু ভয় বলিয়া কোনও বস্তু নাই, এ কথা সেও বলিতে পারে না। অবস্থা-বিশেষে খুব সাহসী মানুষও ভয় পায়। সাধারণ মানুষও শুধু অবস্থা-বিশেষেই আল্লাহকে দেখিয়া থাকে। আল্লাহ অরূপ, নিরঞ্জন, নিরাকার। কাজেই এই রূপহীন আল্লাকে মানুষ যার-তার অন্তরের ব্যাপ্তি দিয়াই অনুভব করিবে। যার-তার অন্তরের ব্যাপ্তির পরিধির সাথে মিল রাখিয়াই সেই অরূপ রতন রূপবিশেষে ধরা দিবেন। সে রূপ আসলে আল্লার রূপ নয়, দর্শকের সসীম অন্তর্দৃষ্টির ‘গােস্পদে বিম্বিত যথা অনন্ত আকাশ। আল্লাহ দার্শনিক জালালুদ্দিন রুমীর বিশাল অন্তরেও ধরা দিতে পারেন, তাঁর কল্পিত নাপিতের ছােট্ট অন্তরেও ধরা দিতে পারেন। এটাই আল্লার কুদরত, তার অপূর্ব মহিমা। এই মহিমার জোরেই তিনি সকল মানুষের মনে জাগ্রত আছেন। কোনাে ধর্মের অনুগ্রহে বা প্রচার-বলে নয়।
কিন্তু সকল অবস্থায় মনে রাখিতে হইবে, ধর্মের সবচেয়ে বড় গুণ হইতে হইবে পরমতসহিষ্ণুতা। হইতে হইবে মানে ধর্ম-বিশ্বাসীদের আচার-ব্যবহারে প্রযুক্ত ও প্রকট হইতে হইবে। আমাদের কোরআন শরিফের দুইটি সুস্পষ্ট উক্তি : ‘ধর্মে কোনও যবরদস্তি নাই’ ও ‘তােমার ধর্ম তােমার, আমার ধর্ম আমার এই বাঞ্ছিত পরমতসহিষ্ণুতার অমর বুনিয়াদ। উক্তিদ্বয়ের যে মর্মার্থই যিনি করুন না কেন, তার মধ্যেও এই পরমতসহিষ্ণুতার নীতিই বলবৎ থাকিবে। ধর্মের ব্যাপারে যে কথাটা শাশ্বত সত্য এবং যে সত্যটা অভিজ্ঞতায় প্রমাণিত হইয়াছে, তা এই যে পরমতসহিষ্ণুতাই ধর্মের শক্তি, অসহিষ্ণুতাই তার দুর্বলতা।
কাজেই আমার মন বলিল, ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য অথবা তার ত্রুটি সংশােধনের জন্য সময় ও শ্রম নষ্ট না করিয়া মুসলমানদেরে কেমন করিয়া সাধু, সৎ ও সুন্দর মানুষরূপে গড়িয়া তােলা যায়, সেদিকে মনােযােগ দেওয়াই সৎ মুসলমানের প্রধান কর্তব্য।
২৩০
১৪. মানব বনাম মুসলমান
আমার এই মতবাদ কি সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক নয়? শুধু মুসলমানদের কল্যাণ চিন্তা করার কারণ কী? অমুসলমানদের প্রতি কি আমার কোনও কর্তব্য নাই? কথাটা যে-কেউ বলিতে পারিতেন—কোনও অমুসলমান বন্ধু ত নিশ্চয়ই। কিন্তু এটা বলিলেন আমার বিশেষ অন্তরঙ্গ এক মুসলমান বন্ধুই। তিনি আমাকে কোনও জবাব দিবার সুযােগ না দিয়াই বলিয়া গেলেন : দেখ, তুমি একজন সাহিত্যিক, তুমি চিন্তাবিদ, আজীবন কৃষক-প্রজা আন্দোলন করিয়াছ। মযলুমের পক্ষে যালিমের বিরুদ্ধে জিভ ও কলম চালাইয়াছ। এই দেখিয়া আমার ধারণা হইয়াছিল, ধর্ম-সম্প্রদায়-নির্বিশেষে সকল মানুষেরই তুমি খাদেম, মানবতাই তােমার ধর্ম। কিন্তু আজ একটি কথা তােমার মুখে শুনিয়াতেছি?
কিন্তু আমার বন্ধু একা ছিলেন না। তারা ছিলেন তিনজন। তিনজনের দুইজনই ধর্মবিরােধী। মানবপ্রেমী। ধর্মবিরােধী কথাটা ঠিক নয়। দুইজনই মানব-ধর্মী। তাদের কাছে হিউম্যানিমই শ্রেষ্ঠ ধর্ম। একজন বিপ্লবী মুসলমান।
অসুবিধা এই যে আমি বন্ধুদের নাম উল্লেখ করিতে পারিতেছি না। তাঁরা যে পজিশন ও পরিবেশে আছেন, তাতে বােধ হয় এই ধরনের কথা সহকর্মীদের বলিতে পারেন না; বলিলে বােধ হয় তাঁদের অনিষ্ট হইতে পারে । তাই বােধ হয় তাঁদের রুদ্ধগতি স্বাধীন চিন্তার স্রোত বাঁধ ভাঙ্গিয়া আমাকে ভাসাইয়া নিবার উপক্রম করিয়াছে।
আমি তর্কে না নামিয়া বলিলাম : মানবপ্রেম অতি বড় কথা। মানবসেবা অতি বড় কাজ। সে কাজ শুরু করিবার আগে মুসলমানদের সেবার হাত মশ করিতেছি মাত্র। আর মানবধর্ম কথাটা অর্থহীন হিউম্যানিযম একটি মেটাফিজিকস মাত্র।
এইবার বন্ধু স্বরূপে প্রকাশ পাইলেন। বলিলেন : ইসলাম সম্পর্কে ভুল ধারণা হইতেই তুমি এ কথা বলিতেছ। ইসলামের ভ্রাতৃত্ব মুসলিম-ভ্রাতৃত্ব নয়, ওটা মােমিন-ভ্রাতৃত্ব। মুসলমান সমাজের বাহিরেও মােমিন আছে এবং আমার অভিজ্ঞতা হইতেই বলিতেছি, অমুসলমান মােমিনের সংখ্যাই বেশি।
আমি হাসিয়া বলিলাম : আমিও তােমার পথেরই পথিক। তুমিও বিপ্লবী নও রিফর্মিস্ট, আমিও তাই। তােমার চিন্তার ক্ষেত্রও সীমাবদ্ধ, আমারও তাই। তুমি ইসলামকে সংশােধন করিতে চাও, আমি মুসলমানকে সংশােধন করিতে চাই। ইসলামকে সংশােধন করিতে পারিলে তার পরে তুমি অন্য ধর্ম সংশােধনে হাত দিবা। মুসলমানকে সংশােধন করিতে পারিলে পরে আমিও
২৩১
অন্যান্য ধর্মের লােকদেরে সংশােধন করিতে চেষ্টা করিব। কেতাব সংশােধনের চেয়ে মানুষ সংশােধন, মনের চিকিৎসার চেয়ে দেহের চিকিৎসাই অনেক ছােট ও সহজ কাজ বলিয়াই আমি এ কাজ করিতে চাই। বড় কাজকে সত্যই বড় কাজ মনে করি বলিয়াই প্রথম চোটেই তাতে হাত দিতে সাহস পাই না।
বন্ধুরা সমস্বরে বলিলেন : কিন্তু যত ছােট এলাকা লইয়াই তুমি সেবার কাজ শুরু কর না কেন, তােমার সেটা শুধু মুসলমানদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখিবে কেন?
আমি জবাব দিলাম : মুসলমানরাই সবার থনে বেশি নির্যাতিত, নিপীড়িত, দরিদ্র ও নিরক্ষর বলিয়া সেবার প্রয়ােজন তারারই বেশি।
সকলে মাথা নাড়িয়া বলিলেন : অমুসলমানদের মধ্যে দরিদ্র, নির্যাতিত, নিরক্ষর লােক নাই বলিতে চাও?
আমি : নিশ্চয়ই আছে। নাই বলিব কেন? তবে তাদের মধ্যে সেবক ও সংস্কারকও আছেন অনেক। তাঁদের মধ্যে রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, মহাত্মা গান্ধী ও প্রফুল্ল চন্দ্র আছেন অনেক। তাদের শিক্ষা-স্বাস্থ্যের জন্য দান করিবার মত দাতাও আছেন বেশ কিছু।
তারা : আমাদের মধ্যেও ত ধনী আছেন, তাঁরাও ত দান-খয়রাত করেন?
আমি : আছেন। কিন্তু তারা তােমাদের মতই ইসলাম সংস্কার লইয়া ব্যস্ত। মুসলমানদের কল্যাণের কথা তারা ভাবেন না। তারা মসজিদ নির্মাণে তাদের টাকা ব্যয় করেন যাতে মুসলমানরা বেহেশতে যাইতে পারেন। মুসলমানদের শিক্ষা-স্বাস্থ্যের জন্য তাঁরা স্কুল-কলেজ ও হাসপাতালদাওয়াখানার টাকা খরচ করেন না।
তারা : কেন হাজী মােহাম্মদ মহসিন?
আমি : এবার তােমরা ঠিক কথা বলিয়াছ। যে কারণে হাজী সাহেব মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষা প্রসারের জন্য সম্পত্তি ওয়াকফ করিয়া গিয়াছেন, ঠিক সেই কারণে আমিও আমার নিজের কর্ম-শক্তিতে মুসলমানদের সেবায় লাগাইবার দায়িত্ববােধ করিতেছি। আমার এই মুসলিম-প্রীতির মধ্যে হিন্দুবিদ্বেষ নাই, সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতাও নাই। প্রধানত মুসলমানদের সেবা করিতে গিয়া যদি দেখি তাতে হিন্দুরও সেবা হইয়া যাইতেছে, তবে তাতে সুখীই হইব। হাজী মহসিনের টাকায় হিন্দুদের ‘ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র’ও শিক্ষা লাভ করিয়াছিলেন। আমরা যখন কৃষক-প্রজা আন্দোলন শুরু করি, তখন আমাদের সামনে ছিল মুসলমান রায়তরাই। কিন্তু পরিণামে হিন্দুরাই তার ফল ভােগ করিয়াছে।
২৩২
অধ্যায় এগার
হকুল এবাদ

১. বুদ্ধির মুক্তির সামাজিক দিক
মানব-মনের আযাদি, বুদ্ধির মুক্তি, স্বাধীন চিন্তা ইত্যাদি আজিকার তরুণ মনের স্বাভাবিক ক্ষুধা এবং সজীব সক্রিয় মনের লক্ষণ। কিন্তু এ সবেরই একটা ব্যক্তিগত ও একটা সামাজিক দিক আছে। পুরাকালের মুনি-ঋষি ও সুফি-দরবেশের আধ্যাত্মিক সাধনার মতই মানবমনের আযাদির একটা নিজস্ব মূল্য আজও আছে। কিন্তু সে মূল্য নিতান্তই ব্যক্তিগত যদি তা মানবসেবায় না লাগে। ব্যক্তিগত সীমার মধ্যে আধ্যাত্মিক উচ্চতা, বুদ্ধির পার্থক্য ও সাধারণ ধন-দৌলতের দাম একই। সমাজের কোনও কাজে লাগে না। আপনি যত মুক্তবুদ্ধির লােকই হউন, আপনার বুদ্ধি যদি সমাজের কাজে না লাগে, তবে সমাজের দিক হইতে আপনার বুদ্ধির দাম কানাকড়িও না। স্বার্থপর ধনী যেমন করিয়া নিজের বিলাসিতায় গড়াগড়ি করে, আপনিও তেমনি মুক্তবুদ্ধির বিলাসিতায় গড়াগড়ি পাড়েন। দুইটা একই জিনিস।
এই জন্যই মুক্ত-বুদ্ধিমান ও স্বাধীন চিন্তকরা পূর্ণ স্বাধীনতার সঙ্গে চিন্তা করিবেন ঠিকই, কিন্তু কথা বলিবেন খুব সাবধানে। কথা ও কাজের দ্বারা সুধী সমাজ যদি সমাজের ‘গােলাকার ঘেঁদার জন্য চার কোনা পেরেক’ হইয়া যান, তবে সমাজের কোনও কাজে তারা লাগিবেন না। কাজেই তাদের মুক্তবুদ্ধিকে জনগণের বুদ্ধির মুক্তির কাজে প্রয়ােগ করিবার জন্যই তাঁদেরে সমাজের দেহে ‘ফিট-ইন’ করিতে হইবে, খাপ খাওয়াইতে হইবে। এটা করিতে হইলে মুক্তবুদ্ধির লােককে দরদি হইতে হইবে। যতই পতিত, বুদ্ধিহীন ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন হউক না কেন, জনগণকে ভালবাসিতে হইবে।
২৩৩
নিজের মুক্তবুদ্ধির অহংকারে ফাটিয়া পড়িলে চলিবে না। আস্তে আস্তে জ্বলিয়াই বাতি আলাে দিতে পারে। ফাৎ করিয়া জ্বলিয়া উঠিলে আলাে দেয়ার পরিবর্তে ঘর পুড়িয়া ফেলিবে।

২. মুক্তবুদ্ধি বনাম চিন্তার অস্থিরতা
আমার ধর্মজীবন সম্বন্ধে এতক্ষণ যেসব কথা ও কাজের উল্লেখ করা হইল, তাতে পাঠকরা নিশ্চয় বুঝিয়াছেন যে, বিপুল ওঠা-নামা, উত্থান-পতন ও ওলট-পালটের মধ্যে দিয়াই আমার চিন্তা-ধারা প্রবাহিত হইয়াছে। কোনও এক স্তরে বেশি দিন স্থির থাকে নাই। অনেক ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা এটাকে আমার মানসিক অস্থিরতা, মেন্টাল ইনস্ট্যাবিলিটি বলিয়াছেন। কেউ বলিয়াছেন, এটা চিন্তার গভীরতার ও মতের স্থৈর্যের অভাব। কেউ সােজাসুজি এটাকে মতহীনতাও বলিয়াছেন।
আমি কিন্তু তাতে বিচলিত হই নাই। কারণ আমি জানিতাম, আমার চিন্তার গভীরতা আছে বলিয়াই তলার সন্ধান পাইতেছি না। যাদের চিন্তা অগভীর ও ভাসা-ভাসা তারাই প্রচলিত সত্যকে সত্য মানিয়া বসিয়া থাকেন। মনের দিক হইতে তাঁরা হয় অলস, নয় ত ভীরু। অলস এই জন্য যে তারা মন ও মগজ খাটানাের শ্রমটুকু করিতে চান না। আর ভীরু এই জন্য যে চিন্তার জঙ্গলে প্রবেশ করাকে তারা নিরাপদ মনে করেন না। সকলেই জানেন বিপদ-আপদের ভয়ে যারা জঙ্গলে ঢুকিতে বা সামনে আগ বাড়িতে ভয় পান, তারা জ্ঞানের অনেক সম্পদ ও মণি-মুক্তা হইতেই বঞ্চিত থাকে।
মুনশী-মৌলবী-মুরুব্বিরার কাছে বিশেষত চাচাজী মুনশী ছমিরুদ্দিন সাহেবের কাছে দর্শন-বিজ্ঞানের কঠোর নিন্দা শুনিতাম। চাচাজী ওগুলিকে ‘ফালসাফা’ বলিতেন। ফালসাফা’ (ফিলােসফি) শয়তানের এলেম, ওএলেমে ঈমান নষ্ট হয়, এসব কথা প্রায়ই তিনি বলিতেন। ফালসাফাকে তিনি নফ্লুমির (জ্যোতিষীর) মতই কুফরি বুদ্ধি বলিতেন। কলেজে দর্শন পড়িয়া এবং বিজ্ঞানের ছাত্র সহপাঠীদের সাথে আলােচনা করিয়া চাচাজীর কথার সত্যতার প্রমাণ পাইয়াছিলাম। সত্যই দর্শন-বিজ্ঞান আমাদের ঈমান নষ্ট, অন্তত শিথিল করিয়াছে। তখন হিন্দু মুরুব্বিদের অনেকের কথাও মনে পড়িয়াছে। তাঁদের মুখে প্রায়ই শুনিতাম : ‘বিশ্বাসে লভয়ে হরি, তর্কে বহুদূর। তর্কশাস্ত্রে সত্য-সত্যই তত দিনে আমাদেরে হরি’ হইতে অনেক দূরে নিয়া আসিয়াছে।
২৩৪
কিন্তু সে দূরত্ব বেশি দিন থাকে নাই। আস্তে-আস্তে ঢুকিবার, পানিতে নামিবার, অথবা তরঙ্গ-বিক্ষুব্ধ নদী পার হইবার সুফল আস্তে-আস্তে পাইতে লাগিলাম। স্তরে-স্তরে সেসব পরিবর্তনের কথা আগেই বলিয়াছি। শেষ বয়সে, এই আত্মকথা লিখিবার সময়ে, সেসব মানসিক চাঞ্চল্য আর নাই। চরম সত্য বা শেষ জ্ঞান লাভ করিয়া ফেলিয়াছি, নিশ্চয়ই এ কথা বলিতেছি না। জ্ঞানের শেষ নাই। চরম সত্য লাভও সম্ভব নয় মানবজীবনটাই জ্ঞানসাধনার একটা প্রসেসমাত্র। এটা অবশ্যই দার্শনিক দৃষ্টিকোণের কথা।

৩. বিজ্ঞান ধর্মবিরােধী নয়
দর্শন, বিজ্ঞান ও রাজনীতি সবাই মিলিয়া ধর্মের বিরুদ্ধে লাগিয়াছে বলিয়া মনে হইবে। এই কারণে আধুনিককালে একদিকে যেমন দর্শন বিজ্ঞানের মাপকাঠি দিয়া ধর্মকে সংস্কার বা আধুনিকীকরণের চেষ্টা চলিতেছে। অপরদিকে ধর্মকে দিয়া দর্শন, বিজ্ঞান ও রাজনীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলিতেছে। এসব চেষ্টার ঐতিহাসিক কারণ আছে। ঐ কারণেই ন্যায়, নীতি, ইনসাফ সুবিচার, এথিকস, মরালিটি, জাসটিস ও ফেয়ারপ্লেকে একাৰ্থবােধক একাঙ্গিকরণ করা হইয়া গিয়াছে। সত্য কথা বলিও,’ ‘মিথ্যা বলিও না, ‘পরের দ্রব্য হরণ করিও না’, ‘এতিমে হেফাযত কর’, কারাে উপর যুলুম করিও না,’ এসব সকল ধর্মেরই উপদেশ। এই কারণেই ঐ সব উপদেশকে আমরা ধর্মের শিক্ষা বলিয়া মনে করি। ব্যাপক অর্থে এ সবই ধর্মের অন্তর্ভুক্ত। ব্যাপক অর্থে যেমন সব জ্ঞানই বিজ্ঞান। কিন্তু নির্দিষ্ট সীমিত অর্থে যেমন রাষ্ট্রবিজ্ঞান, মনােবিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান ইত্যাদির স্বতন্ত্র ও নির্ধারিত এলাকা রহিয়াছে, তেমনি ন্যায়-নীতি, আচার-নীতি, বিচার-নীতি, এথিকস, মরালিটি, ধর্ম ও রিলিজিয়নের স্বতন্ত্র এলাকা আছে। এটা বুঝিতে জাতি-মানুষের যেমন সময় লাগিয়াছে, ব্যক্তি-মানুষেরও তেমনি সময় লাগে । মানবজাতি অনেক বয়সে, বহু অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়া এই জ্ঞান লাভ করিয়াছে। ব্যক্তি-মানুষেরও এ জ্ঞান লাভ হয় বেশি বয়সে। আমার নিজের জীবনের বিভিন্ন বয়সে, বিভিন্ন পরিবেশে, ধর্ম সম্বন্ধে এমনকি খােদ আল্লার অস্তিত্ব সম্বন্ধে, বিভিন্ন ও পরস্পর-বিরােধী চিন্তাধারার মধ্য দিয়া এই বৃদ্ধ বয়সে এই অভিজ্ঞতা লাভ করিয়াছি যে, সজীব ও সক্রিয় মনের এটাই স্বাভাবিক ধর্ম। অমন বিশ্বাস-অবিশ্বাসের আঁকাবাঁকা সংকীর্ণ পথেই মানুষের মন বিকশিত হয়। আমার মত নগণ্য ব্যক্তি ত বটেই, দুনিয়ার সব বড়-বড়
২৩৫
চিন্তাবিদ, পণ্ডিতদের জীবনেও এমনটাই ঘটিয়াছে। এমন যে মুসলিম দুনিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ, হুজ্জতুল ইসলাম (আরগুমেন্ট-অব-ইসলাম) উপাধিতে ভূষিত ইমাম গাযযালীকেও এই আঁকাবাঁকা সংকীর্ণ অন্ধকার গলিপথেই অগ্রসর হইতে হইয়াছে। সুফি আলেম পিতার ঔরসে জন্মলাভ করিয়াও, ধর্মীয় পরিবেশে প্রতিপালিত হইয়াও, এবং শৈশব হইতে ধর্মশাস্ত্রে শিক্ষা লাভ করিয়াও যৌবনে তিনি নাস্তিক হইয়া গিয়াছিলেন। দীর্ঘদিনের সাধনা, চিন্তা, মেডিটেশন, অধ্যয়ন দ্বারাই তিনি এই নাস্তিকের কবল হইতে মুক্ত হইয়াছিলেন। এটাই স্বাভাবিক। সজীব ও সক্রিয় মনের বিকাশের ধারাই এই। কৌতুহল হইতে জিজ্ঞাসা, জিজ্ঞাসা হইতে সন্দেহ, সন্দেহ হইতে অবিশ্বাস, অবিশ্বাস হইতে অনুসন্ধান এবং সর্বশেষ অনুসন্ধান হইতে সত্য লাভ। বিশেষ সাধনা করিলে এটা মধ্যবয়সেও ঘটিতে পারে বটে, কিন্তু সাধারণত এটা অধিক বয়সেই ঘটিয়া থাকে।

৪. অন্ধভক্তি নয়, অর্জিত উপলব্ধি
ধর্ম সম্বন্ধে সারা জীবন চিন্তা-ভাবনা করিয়া মুক্তবুদ্ধির জোরে এদিক-ওদিক, ডাইনে-বামে, উপরে-নিচে, দশ দিক ঘুরিয়া-ফিরিয়া, বলিতে গেলে একেবারে আকাশ-পাতাল বেড়াইয়া, বৃদ্ধ বয়সে একরূপ ক্লান্ত হইয়াই এই স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছি যে, ধর্মে বিশ্বাস না করিয়া উপায় নাই। ধর্ম, আত্মা ও সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বের ধারণা তিনটি এতই অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত, যে একটিতে বিশ্বাস করিলে অপরটিতে বিশ্বাস না করিয়া উপায় নাই। আবার এই তিনটি বিশ্বাসই মানবতা-বিশ্বাস হইতেই উদ্ভূত। অথচ খােদা-ধর্ম ও আত্ম-অবিশ্বাসীরা দার্শনিক নাস্তিকই হউন, আর কমিউনিস্ট নাস্তিকই হউন, সবাই কিন্তু মানবতা-বিশ্বাসী। বস্তুত মানবতার খাতিরেই তাঁরা বর্ণ, শ্ৰেণী ও শােষণহীন সমাজব্যবস্থা চান। আনুষ্ঠানিক ও সংঘবদ্ধ ধর্ম তাঁদের অভীষ্ট লাভের প্রতিবন্ধক, এই অজুহাতেই তারা ধর্ম, খােদা ও আত্মার অস্তিত্ব অস্বীকার করিয়া থাকেন। কিন্তু মানবতা একটা বিমূর্ত ধারণামাত্র নয়। ব্যক্তিমর্যাদার উপরই প্রকৃত মানবতা প্রতিষ্ঠিত। আত্মার ধারণা ব্যক্তি-মর্যাদারই প্রসারিত রূপ। ধর্ম ও সৃষ্টিকর্তার অনিবার্যতাও এইখানেই। ধর্মের দাবির এটা রক বটম। একদম হাড়ডি বা স্কেলিটন বলা যাইতে পারে। রাষ্ট্র, সমাজ, আইন-কানুন, শিল্প-বাণিজ্য আর্ট-সাহিত্য ধর্মের সনাতন এলাকার অনেকখানি দখল করিয়াছে। অভিজ্ঞ আত্মবিশ্বাসী মুরুব্বির মতই ধর্ম সে
২৩৬
বেদখল মানিয়াও লইয়াছে। এখন ধর্মের এই সংকীর্ণ এলাকা এমন এক জায়গায় আসিয়া ঠেকিয়াছে, যেখানে বিজ্ঞানকেও ধর্মের আধিপত্য ও একক এলাকা মানিয়া লইতে হইবেই। মৃত্যুতেই মানবজীবনের অবসান, এটা যারা বলেন বা বিশ্বাস করেন, তাঁরা মানবজাতিকে অন্য সব স্পেশিসের সমপর্যায়ে ফেলেন। তাঁরা সঙ্গে-সঙ্গে ‘পাশবতার কথা না বলিয়া শুধু মানবতার কথা বলিতে পারেন না।

৫. শ্রেষ্ঠ মাবুদ
মহান সৃষ্টিকর্তা, পরকাল, আত্ম ও ধর্ম-বিশ্বাসের সহিত মানবীয় মর্যাদা এমন ওতপ্রােতভাবে জড়িত যে, একটা ছাড়া অন্যটার কল্পনা করা যায় না। অবশ্য সৃষ্টিকর্তার ব্যক্তিত্বের, পরকালের পদার্থকতার ও ধর্মের আনুষ্ঠানিকতার স্কুল ধারণার বাহিরে ও উর্ধ্বে ঐসব ধারণা থাকিতে হইবে। জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা বৃদ্ধির ফলে মানুষ যতই কুসংস্কারমুক্ত হইবে, ঐসব ধারণাও ততই পরিচ্ছন্ন হইবে। মুক্তবুদ্ধি হওয়া মানে, লজিকের বন্দী হওয়া নয়। লজিকের এলাকা ইন্দ্রিয়ে সীমাবদ্ধ। ইন্দ্রিয়ের বাইরে কিছু নাই যারা মনে করেন, মানুষ। হায়ওয়ান ছাড়া আর কিছু নয় যারা বলেন, মৃত্যুতেই মানব-জীবনের অবসান যারা বিশ্বাস করেন, তাঁদের জন্য ধর্ম, খােদা ও পরকালের অস্তিত্ব সত্যই অবান্তর। ব্যক্তিগত ব্যতিক্রম বাদে মানুষ সাধারণভাবে পরাশ্রয়ী। প্রকৃতিগতই হউক, আর শৈশবের পরিবেশের ফলে হউক, মানুষ নিরাপদ আশ্রয় চায়। সে আশ্রয়কে আশ্রয়প্রার্থীর চেয়ে শক্তিশালী ক্ষমতাবান ও বুদ্ধিমান হইতে হয়। মানবসভ্যতার শৈশবে এই আশ্রয় ছিল পেটার ফ্যামিলিয়া, গােষ্ঠী-নেতা, রাজা-বাদশাহ। এখন তা রূপ নিয়াছে ডিক্টেটর বা ফাদার-ইমেজের গণতান্ত্রিক নেতার। ব্যক্তিপূজা বা পার্সনালিটি কাল্ট যাদের অভিমানে বাধে তারাই প্রবর্তন করিয়াছেন রাষ্ট্রপূজা। এক রূপে না এক রূপে পূজাই যখন করিতে হইবে, তখন শরীরী মাবুদের চেয়ে নিরঞ্জন মাবুদই কি মানুষের আত্মমর্যাদার দিক হইতে উন্নততর নয়?

৬. বিজ্ঞানী-শ্ৰেষ্ঠ আইনস্টাইন
কিন্তু অন্ধবিশ্বাস কখনই অর্জিত আস্থার স্থলবর্তী হইতে পারে না। আমাদের মুরুব্বিরা যে নাস্তিকের ভয়ে ‘ফালসাফা’ বা দর্শনশাস্ত্র পড়ার
২৩৭
বিরােধী ছিলেন, আসলে সে ভীতি ছিল অমূলক। প্রকৃত জ্ঞানপিপাসুর কাছে দর্শন-বিজ্ঞান নাস্তিক্যের শিক্ষা-দাতা হইতে পারে না। তার প্রমাণ আধুনিক যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন। তিনি বলিয়াছেন : ‘আবেগের সাথে যার পরিচয় নাই, যে বিস্ময় ও ভক্তির আবেশে স্তব্ধ হয় না, সে মৃত। তার চোখ অন্ধ। সচেতন জীবন নিজেকে কেমন করিয়া অনন্তের মধ্য দিয়া চিরস্থায়ী করিতেছে তা ধ্যান করিতে, দুনিয়া জাহানের দুর্বোধ্য-গঠন-কৌশল সম্বন্ধে ধারণা করিতে এবং প্রকৃতিতে অভিব্যক্ত বুদ্ধিমত্তার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্রাংশ বিনয়াবনত অবস্থায় অনুভব করিবার চেষ্টা করিতে পারাই আমার জন্য যথেষ্ট।
রহস্যময়ের সামনে, গায়েবি কুদরতের কাছে, এমন বিনয়-নম্র ভক্তির স্তব্ধতা ও তাকওয়ার আত্মসমর্পণই জ্ঞানের পরিপক্ক পূর্ণতা। প্রকৃত জ্ঞান। কখনও অহংকারী হইতে পারে না। বিশ্বের সেরা বিজ্ঞানীর এই বিনতিনম্রতা, এই আজিযী-এনকেসারিই প্রকৃত বিজ্ঞানীর আত্মােপলব্ধির প্রমাণ। আইনস্টাইনের এই অমূল্য উক্তিটি যদিও ১৯৩০ সালের ঘটনা, আমি কিন্তু ওটা পড়িয়াছিলাম তার বিশ-পঁচিশ বছর পরে। প্রবাদের ‘অল্পবিদ্যা ভয়ংকরীর সত্যতা উপলব্ধি করিতে শুরু করি আমি তার বহু আগেই। ছাত্রজীবনে দর্শনশাস্ত্রে যখন ডারউইনের উদ্বর্তনবাদ বা থিওরি-অবইভলিউশন পড়িলাম, তখন কোরআন-বাইবেলের সৃষ্টি-তত্ত্বের উপর আস্থা হারাইলাম। আদম-হাওয়ার কিস্সাকে সত্যই মাইথলজির কাহিনী মনে করিলাম। ধর্মে ও সৃষ্টিকর্তার সন্দেহ অবিশ্বাসে পরিণত হইল। নাস্তিকের ভিত্তি মযবুত হইল।

৭. ধর্মবােধের ভিত পাকা
কিন্তু বয়স ও জ্ঞান বৃদ্ধি সাথে সাথেই বুঝিতে শুরু করিলাম, ধর্মীয় সৃষ্টিতত্ত্ব ও থিওরি-অব-ইভলিউশন-এর পরস্পর-বিরােধিতা অত দৃঢ় ভিত্তিক নয়। ক্রমশ এই উপলব্ধি ঘটিল যে ‘ইভলিউশন’ ক্রিয়েশন নয়; উদ্বর্তন সৃষ্টি নয়; পরিবর্তন মাত্র। পদার্থজগতে যেমন আমরা দেখিতে পাই কোনও বিজ্ঞানই সৃষ্টি করে না, রূপান্তর ঘটায়মাত্র, আদমের বেলা ডারউইনিযমও ঠিক তাই করিয়াছে। পদার্থবিজ্ঞান বিজলি, অণু-পরমাণু ও বােমা সৃষ্টি করে না । রসায়নবিজ্ঞানও তেমনি পানি বা অষুধ সৃষ্টি করে না। বিদ্যমান বস্তুসমূহের পরিবর্তন, বিয়ােজন ও সংযােজন করিয়া তাদের রূপান্তর
২৩৮
ঘটায়মাত্র। বিজ্ঞান যেমন প্রকৃতির রহস্যের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ মাত্র ব্যাখ্যা করিতে পারিয়াছে, উদ্বর্তনবাদও তেমনি আদম-সৃষ্টি-রহস্যের সামান্য অতি সামান্য অংশই বুঝাইতে সমর্থ হইয়াছে। উদ্বর্তনবাদ মানুষের জীবন, আত্মা, মন, হৃদয়, ঘৃণা-ভালবাসা, বুদ্ধি-চেতনা কোনােটারই সৃষ্টির ব্যাখ্যা আজও দিতে পারে নাই।
বিজ্ঞান সম্পর্কে এই বিজ্ঞানী মনােভাবই পরিণামে ধর্মকে তথাকথিত বিজ্ঞানের হামলা হইতে বাঁচাইয়া রাখিয়াছে। দর্শন সম্বন্ধেও এই কথাই সত্য। সাধারণ দৃষ্টিতে বিজ্ঞান যে ধর্মবিরােধী, তার আসল রূপ এই যে, ধর্মের আনুষ্ঠানিকতা ও সে সম্বন্ধে ধর্মানুসারীদের ধ্যান-ধারণাকেই বিজ্ঞান। ভ্রান্ত, অসত্য ও মিথ্যা প্রমাণ করিয়াছে। আসলে কোনও অনুষ্ঠানই ধর্মের প্রাণ-বস্তু নয়। ও-সব সামাজিকতা। পুরা ঈমান, পূর্ণাঙ্গ বিশ্বাসই ধর্ম, অন্ধ অনুষ্ঠান ধর্ম নয়। ধর্মের এই রূপকেই বলা হয় স্পিরিচুয়াল বা রুহানি দিক ও এথিক্যাল, আখলাকি বা চারিত্র্য-নীতিক দিন। ইসলাম ধর্মে এই দুই ভাগের একটিকে বলা হয় হক্কুল্লাহ বা আল্লাহর হক এবং হক্কুল এবাদ’ বা মানুষের হক। প্রথমটা সৃষ্টিকর্তার প্রতি মানুষের কর্তব্য, দ্বিতীয়টা মানুষের প্রতি মানুষের কর্তব্য। আল্লার প্রতি কর্তব্য-বিচ্যুতির অপরাধে কারাে বিচার। করিবার অধিকার মানুষের নাই। সে বিচারের মালিক খােদ আল্লাহ। এই কথাটাই কোরআনে বলা হইয়াছে : ধর্মের ব্যাপারে কোনও যবরদস্তি নাই। ধর্ম এখানে হক্কুল্লাহ রুহানি বা স্পিরিচুয়াল ধর্ম। ধর্মের হক্কুল এবাদ অংশে। ত্রুটি-বিচ্যুতির ব্যাপারের বিচার মানুষ করিতে পারে, করা তার কর্তব্যও। এটা তার সামাজিক ও রাজনৈতিক দায়িত্ব। এই হক্কল এবাদই ধর্মের সামাজিক রূপ।

৮. ধর্মের রুহানিয়াত অব্যয়
দৈহিক শৈশবের নফলিয়াত দিয়া আমার ধর্ম-জীবনের কাহিনী শুরু করিয়াছিলাম। আত্মিক শৈশবের রুহানিয়াত দিয়া তা শেষ করিতেছি। যেখান হইতে শুরু সেখানেই শেষ ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন। কুল্লু শাইয়েন ইয়ারজুউ ইলা আসলেহি। আলিমুল-গায়েবের কাছে মানুষ সারা। জীবনই শিশু। তরুণ শিশু ও বৃদ্ধ শিশু, এই যা পার্থক্য। সারা জীবন জ্ঞান আহরণ করিয়া এই জ্ঞান লাভ করিলাম যে এক পরমাণু জ্ঞানও লাভ করিতে পারি নাই। আইনস্টাইনের সাথে এই কথা বলিতে পারাই জ্ঞানীর লক্ষণ। এই
২৩৯
জ্ঞানটুকুও আমরা লাভ করি সারা জীবনে ক্রমবিকাশের মাধ্যমে। জ্ঞানের যৌবনে আমরা পাঁচ ইন্দ্রিয় ছাড়া আর কারাে সাক্ষ্য মানি না। বার্ধক্যে পৌছিয়া ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের সত্তা উপলব্ধি করি। জ্ঞানের যৌবনে যারা মােরাকেবা, মােশাহেদা, তাসাওওয়াফ ও যােগাসনকে কুসংস্কার বলেন, জ্ঞানের বার্ধক্যে তারাই ট্রানসেনডেন্টাল মেডিটেশন’ ও ‘এক্সটা-সেনসরি পারসেপশন’-কে বিজ্ঞান আখ্যা দেয়। ধ্যান ও নেসবতে বায়নান্নাসকে তারাই ‘হিপনােটিযম ও অটোসাজেশন’ নামে বৈজ্ঞানিক সত্য এবং হাইপারটেনশনের ঔষধ রূপে গ্রহণ করেন। এ সবই তিন মাথাওয়ালা জ্ঞান-বৃদ্ধের সামনে জ্ঞান-যুবকের দাম্ভিক শক্তিমত্তার নতি স্বীকার। জ্ঞান জ্ঞানের সম্মান করিবেই।
বিজ্ঞানের বিস্ময়কর চরম উৎকর্ষে মানুষ আজ মহাশূন্যে অগণিত গ্রহ হইতে গ্রহান্তরে উড়িয়া বেড়াইতেছে মানুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর জীবের সন্ধানে। এ উদ্যম সফল হইলে এই ক্ষুদ্রতম গ্রহের মানুষ আর আশরাফুল মখলুকাত থাকিবে না। ফলে সব ধর্মের বুনিয়াদ ধসিয়া পড়িবে। ধর্মবিরােধীরা সে আশায় খুশি হইতেছেন। কিন্তু জীব পাইলেই ত হইবে না রুহও পাইতে হইবে। যদি তা না পাওয়া যায়, তবে কী হইবে?
২৪০

চতুর্থ খণ্ড
সাহিত্যিক জীবন (মামুলি)

অধ্যায় বার
প্রচলিত পথে অগ্রসর

১. কৈফিয়ত
আমার সাহিত্যিক জীবনীকে দুই খণ্ডে ভাগ করিতে বাধ্য হইলাম। কারণ এ দিককার জীবনটাই আমার দুই ভাগে বিভক্ত। দুই ভিন্ন খাতে তা প্রবাহিত। স্থূলত দুই ভিন্ন দিকে। অদূরবর্তী ভিন্ন গন্তব্যের দিকে। পথ ও গন্তব্যের এ ভিন্নতার কারণ রাজনৈতিক। রাজনৈতিক কারণে দেশ ভাগ হইয়াছে। দেশ ভাগ হইলেও সাহিত্য ভাগ হয় নাই যারা বলেন, সে দলের আমি নই। আমার জন্য এটা নূতন কথা নয়। কারণ আমার বিচারে সাহিত্য মানেই জীবনভিত্তিক সাহিত্য। জীবন মানেই জন-জীবন। সে সাহিত্যের ভাষা মানেই গণ-ভাষা। আমার ক্ষেত্রে এ চিন্তাটা উৎপ্রেরণা, সহজাত। দেশভাগ যখন কল্পনাতীত ছিল, সেই ১৯২২ সালে আমি ‘গােলামী সাহিত্য’ শীর্ষক প্রবন্ধে তৎকালীন সাহিত্যিক দিকপালদেরে ধান ক্ষেত ভাঙ্গিয়া গােলাপ বাগান রচনা না করিতে অনুরােধ করিয়াছিলাম। শ্রেণীর জন্য সাহিত্য রচনা না করিয়া জনগণের জন্য সাহিত্য রচনা করিবার দাবি করিয়াছিলাম। পরবর্তীকালে এ কথাটাকেই আইভরি টাওয়ার হইতে মাটির বুকে নামিয়া আসার কাজ বলিয়াছিলাম। এসব লেখার কথা পরে যথাস্থানে বলিব। এখানে শুধু এইটুকু বলিয়া রাখিতেছি যে সাহিত্যের বস্তু জনগণ। জনগণ মানেই একটি জনপদের, একটা ভূখণ্ডের, একটা দেশের, একটা রাষ্ট্রের জনগণ। আমাদের বেলা আগে এটা ছিল গােটা বেঙ্গল। বাটোয়ারার পর এটা প্রথমে পূর্ব বাংলা, পরে পূর্ব পাকিস্তান ও বর্তমানে বাংলাদেশ হইয়াছে। দেশভাগ হওয়ার ফলে কোন কোন ব্যাপারে কী কী পরিবর্তন ঘটিয়াছে, তার ফলে সাহিত্যিকদের কর্তব্যের কী কী মােড় পরিবর্তন।
২৪৩
হইয়াছে, সেসব কথা পরে যথাস্থানে বলিতেছি। এখানে বলিতেছি শুধু সেইটুকু, দেশভাগ না হইলে একই দেশের সাহিত্যিক হিসাবে আমাদের যা কর্তব্য ও করণীয় ছিল। শুধু সেই পথে সেই উদ্দেশ্যে সাহিত্য-সাধনার দায়িত্বটাই ছিল আমাদের সাহিত্যিকদের প্রচলিত মামুলি কর্তব্য ও করণীয়। দেশ ভাগ হওয়ার আগে পর্যন্ত সব সাহিত্য-সেবকের মতই আমিও সেই গতানুগতিক পথেই চলিতেছিলাম। সেইটুকুই ছিল আমার এলাকা ও কর্তব্য এই কারণে এই মুদ্দতের সাহিত্য-সাধনাকে আমি মামুলি গতানুগতিক বা সাধারণ সাধনা বলিয়াছি। এই মুদ্দতের আমার সাহিত্যিক জীবনকেও কাজেই মামুলি সাহিত্যিক জীবনী’ আখ্যা দিয়াছি। ঠিক এই কারণেই বিভাগােত্তর সাহিত্য-সাধনাকে নূতন, অভিনব, অসাধারণ, সুতরাং গরমামুলি বলিয়াছি। এই কারণেই দুই মুদ্দতের সাহিত্য-সাধনাকে, সুতরাং সাহিত্যিক জীবনীকে, স্বতন্ত্রভাবে দুই ভিন্ন খণ্ডে লিপিবদ্ধ করিতে বাধ্য হইয়াছি। দুই মুদ্দতের সাহিত্য ও সাহিত্যিকের দায়িত্বের চরিত্রটা অতিশয় সুস্পষ্ট। তবু এখানে সংক্ষেপে তার উল্লেখ করিতেছি। ১৯৪৭ সালে বেঙ্গল বাটোয়ারা হওয়ার আগ পর্যন্তও আমরা বাঙ্গালীরা সবাই এক দেশের নাগরিক ছিলাম। কলিকাতা আমাদের প্রশাসনিক, সুতরাং ব্যবসায়িক, কৃষ্টিক, সাহিত্যিক ও রাজনৈতিক কেন্দ্রভূমি ছিল। ইংরাজ আমলের প্রায় দুইশ বছর পূর্ব বাংলা কলিকাতার হিন্টারল্যান্ড ছিল এবং সেই হিসাবে দেশের মেজরিটি বাসেন্দার দেহ, মন ও মস্তিষ্ক কলিকাতার জীবনেও বাংলা সাহিত্যে অবহেলিত ছিল। ইংরাজ শাসনের অবসানে অবশ্য সে অবস্থা আর থাকিত না। স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের অবশ্যম্ভাবী চাপে ও প্রভাবে সারা বাংলার, সুতরাং মেজরিটি জনগণের সার্বিক রূপ কলিকাতার সাহিত্যে প্রতিফলিত হইতই। অবিভক্ত বাংলা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হইলে ত কথাই নাই, অখণ্ড রাষ্ট্ররূপে ভারতীয় ইউনিয়নের বা। ফেডারেল পাকিস্তানের অঙ্গরাজ্য হইলেও গণতান্ত্রিক অন্তর্নিহিত শক্তিতেই রাষ্ট্রীয় ও সমাজজীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রের মতই শিল্প-সাহিত্য ক্ষেত্রেও এটা ঘটিত।
স্মরণীয় ব্যাপার এই যে, ইংরাজ আমলের দুইশ বছরে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের যে বিপুল ও সার্বিক উন্নতি সাধিত হইয়াছিল, ঐতিহাসিক কারণে তার ষােল আনা উদ্যোগ ও কৃতিত্ব ছিল হিন্দুদের। মুসলমানদের তাতে কোনও অংশদারিত্ব ছিল না। ফলে খুব স্বাভাবিক কারণেই এই উন্নত বাংলাসাহিত্যের গােটা চেহারাটাই ছিল হিন্দুদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও কৃষ্টির রূপায়ণ। শরিক হিসাবে বাঙ্গালী মুসলমানেরা সেখানে শুধু অনুপস্থিতই ছিল না, ঐ সাহিত্যের তারা বাঙ্গালী বলিয়া স্বীকৃতই ছিল না। এসব কথাই দুই খণ্ডের যথা-যথাস্থানে আলােচিত হইয়াছে।
২৪৪
কিন্তু এখানে উল্লেখযােগ্য এই যে, বাংলা-সাহিত্যের এই চেহারার জন্য হিন্দুরাই এমন দোষী ছিলেন না। মুসলমানদের এই সাহিত্যিক অবমূল্যায়নের জন্য তারা নিজেরাও কম দায়ী ছিলেন না। বিশ শতকের গােড়া হইতেই দেশে গণতান্ত্রিক জাগরণের ফলে দেশের জাতীয় জীবনের সকল ক্ষেত্রে মুসলমানদের। পুনরুজ্জীবনের যে লক্ষণ সুস্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছিল, সাহিত্যের ক্ষেত্রেও তা প্রতিফলিত হইতে শুরু করিয়াছিল। রাজনৈতিক কারণে দেশভাগ না হইলে গােটা বাংলার ভাষিক ও সাহিত্যিক জীবনে বাঙ্গালী মুসলমানদের গণতান্ত্রিক দাবি ও অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন সংঘাত-সংগ্রামের আকারেই দেখা দিত। বস্তুত সে প্রসেস শুরু হইয়াই গিয়াছিল। গােড়ার দিকে কিছু কাল তাতে মতবিরােধ, বিতর্ক, অপ্রিয়তা, ভুল বুঝাবুঝি, এমনকি সাম্প্রদায়িক সংঘাত, দুর্নিবার অবশ্যম্ভাবী হইলেও শেষ পর্যন্ত একটা সমঝােতা অবশ্যই হইত। স্পষ্টতই এবং দৃশ্যতই এটা কঠিন ছিল। রাজনৈতিক বিবর্তনের মত সাহিত্যিক পরিবর্তন অত সহজ হইত না। রাজনীতিতে ফজলুল হকের জন্ম হওয়া যত সহজ, সাহিত্য-ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ পয়দা হওয়া তেমন সহজ নয়। বাঙ্গালী মুসলমানদের মুখের ভাষাকে হিন্দুরা বিশুদ্ধ বাংলাভাষা বলিয়া স্বীকার করিত না । মুসলমানদের ধর্ম-কৃষ্টি-সম্পর্কিত আরবি-ফারসি-জাত শব্দাবলিকে হিন্দু লেখকরা এবং সরকারি শিক্ষা-বিভাগ বাংলা শব্দ হিসাবে গ্রহণ করিতে ত রাজি ছিলেনই না, তাদের দৈনন্দিন ব্যবহৃত অন্য শব্দগুলিও হিন্দুরা সাহিত্যে স্থান দিতে আপত্তি করিতেন। হিন্দুদেরও সরকারি শিক্ষা বিভাগের এই অস্বীকৃতির ভয়ে স্বয়ং মুসলমান লেখকরাও গােড়াতে সেসব শব্দ বর্জন করিয়া চলিতেন। এসব শব্দের ও বাক্যের সাহিত্যিক স্বীকৃতি পাইবার জন্য যে ধরনের অসাধারণ প্রতিভাধর লেখকের দরকার, নজরুল ইসলামের আগে অমন প্রতিভাবান। মনীষী মুসলমানদের মধ্যে আবির্ভূত হন নাই। স্বয়ং নজরুল ইসলামের প্রতিভাও হিন্দুরা সােজাসুজি স্বীকার করেন নাই। মুসলিম ভারত, সওগাত, নওরােজ ইত্যাদি মুসলমান-পরিচালিত কাগজে লিখিয়া ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের রেকর্ডে গান গাহিয়া নজরুল ইসলাম জনপ্রিয়তা অর্জন করিবার পরেই হিন্দু লেখক-সম্পাদকরা নজরুল ইসলামকে মর্যাদা দিয়াছিলেন। এ মর্যাদা দানের মধ্যেও জাতীয় উদারতা ছিল না, ছিল সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতা। কারণ সে স্বীকৃতিও ছিল মুসলমান কবি হিসাবেই, জাতীয় কবি হিসাবে নয়।
তবু দেশভাগ না হইলে এই প্রসেস চলিতে থাকিত এবং কালক্রমে গণতন্ত্রের নিজস্ব জোরেই তার গতিবেগ ও জোর বাড়িত। সব রকমের ভেস্টেড ইন্টারেস্টের স্বাভাবিক বিরােধের মতই সাহিত্য হিন্দু ভেস্টেড
২৪৫
ইন্টারেস্টের প্রতিরােধও স্বভাবতই বাড়িত। কারণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভেস্টেড ইন্টারেস্টের চেয়ে কালচারের ভেস্টেড ইন্টারেস্ট কম শক্তিশালী নয়, বরঞ্চ বেশি। বাংলার মুসলিম সাহিত্যিক জাগরণের মােকাবিলা হিন্দু প্রতিরােধের এই অনমনীয়তা লক্ষ্য করিয়াই আমি ১৯৪৩ সালে এক সাহিত্য সভায় হিন্দু লেখকদের সম্বােধন করিয়া বলিয়াছিলাম : রাজনৈতিক পাকিস্তান হইবে কিনা জানি না, কিন্তু আপনারা বাংলার মেজরিটি মুসলমানের মুখের ভাষাকে বাংলা সাহিত্যে যেমন উপেক্ষা করিয়া চলিয়াছেন, তাতে বাংলায় সাহিত্যিক পাকিস্তান হইতে বাধ্য।
কিন্তু সে সংঘাতের পথে আমাদের যাইতে হয় নাই। তার আগেই দেশভাগ হইয়া গিয়াছে। দৃশ্যত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে দেশভাগ হইয়াছে মনে হইবে । কিন্তু একটু গভীরে তলাইয়া দেখিলেই বুঝা যাইবে যে এ বিভাগের আসল কারণ ছিল কৃষ্টিক। বিশ শতকে এটা প্রমাণিত ও স্বীকৃত হইয়াছে যে, রাজনৈতিক পরাধীনতা মানব-মনের যে ক্ষতি করে, কৃষ্টিক পরাধীনতা ক্ষতি করে তার চেয়ে অনেক বেশি। কাজেই সাহিত্যে দুইশ বছরের হিন্দু প্রাধান্যের অবসান ঘটাইয়া বাংলার গণতন্ত্রের জোরে মুসলিম-প্রাধান্য প্রবর্তন করিলে সেটা হইত হিন্দুর উপর অবিচার। তার বদলে দেশভাগ হইয়া বাংলার হাজার বছরের দুইটা সমান্তরাল কালচারের স্বকীয়তা রক্ষা বৃদ্ধি ও উন্নয়নের নিশ্চিত ব্যবস্থা হইয়াছে। ভালই হইয়াছে। পূর্ব বাংলায়, পূর্ব পাকিস্তানে এবং বর্তমানের বাংলাদেশে মুসলিম-প্রধান বাঙ্গালী কৃষ্টি ও সাহিত্যের নয়া বাগিচা, নূতন প্রাসাদ, নবীনদুর্গ গড়ার সুযােগ হইয়াছে। অথচ এটা করিতে গিয়া হিন্দু-কৃষ্টি সাহিত্যের কলিকাতা-কেন্দ্রিক বাগিচা বা দুর্গ ভাঙ্গার কোনও দরকার থাকে নাই। মুসলমানের হাতে সেটা ভাঙ্গা অশােভন ও হিন্দুর মনে পীড়াদায়ক হইত। আধুনিকতা ও গণতান্ত্রিক দাবিতে ও প্রয়ােজনে তার যদি সংস্কার অথবা কোনও অংশ ভাঙ্গার দরকার হয়, তবে সেটা হিন্দুরা নিজেরাই নিজ হাতে করিবে, এটাই ভাল । বিশ শতকের চতুর্থ-পঞ্চম দশকে হক মন্ত্রিসভা কলিকাতা ভার্সিটি জমিদারি-মহাজানি প্রথাসমূহের মত ‘হিন্দু কৃষ্টি ভাঙ্গিবার যেসব চেষ্টা করিয়াছিলেন, হিন্দুরা ঐক্যবদ্ধভাবে তাতে বাধা দিয়াছিলেন। কিন্তু দেশ বিভাগের পর তাঁরা নিজেরাই সেসব দুর্গ ভাঙ্গিয়া ফেলিয়াছেন। অখণ্ড বাংলার অস্থায়ী ও সাময়িক মুসলিম-প্রাধান্যের মুহূর্তে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা উপলক্ষে মুসলিম দাঙ্গাকারীরা হিন্দুদের মূর্তি-মন্দির ভাঙ্গিয়া ফেলিত। ঐ উপলক্ষে আমার এক শ্রদ্ধেয় কংগ্রেসি হিন্দু বন্ধু আমাকে বলিয়াছিলেন : “তােমরা মুসলমানরা আমাদের সমাজ-সংস্কারে বাধা দিতেছ। আমরা হিন্দুরা নিজেরাই
২৪৬
সেসব মূর্তি ভাঙ্গিয়া ফেলিব স্থির করিয়াছিলাম, তােমরা মুসলমানরা সেগুলি ভাঙ্গিতেছ বলিয়া আমরা একটার জায়গায় আরাে দশটা বানাইতেছি।’ কথাটার অনেকখানি সত্য। এর অন্তর্নিহিত সত্যটা লক্ষণীয়।
দেশভাগের এটাই তাৎপর্য। এই কারণেই অখণ্ড বাংলায় আমরা মুসলমানরা যে কলিকাতা-কেন্দ্রিক সাহিত্য-সাধনা করিতেছিলাম, দেশ ভাগের পরের ঢাকা-কেন্দ্রিক সাহিত্য তার থনে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এক নবজীবনের সাধনা। এই কারণেই আমার সাহিত্যিক জীবনকে দুই আলাদা খণ্ডে বিচারবিবেচনা করিয়াছি। ঢাকার সাহিত্য-সাধনা কলিকাতার সাহিত্য-সাধনার বিকাশ, উন্নতি ও পরিণাম নয়। নয়া জাতির জন্মে অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবেই আমাদের এটা নবজীবন, নয়া জিন্দিগি।

২. শৈশবের খােরাক পুঁথি
আমাদের নিজেদের বাড়িতে এবং দুই মামুর বাড়িতে পুঁথি পড়ার খুব চর্চা ছিল। চাচাজী মুনশী ছমিরুদ্দিন ফরাযী, দুই মামু হােসেন আলী ফরাযী ও ওছমান আলী ফকির নামযাদা পুঁথি-পড়ুয়া ছিলেন। তিনজনের গলাই খুব মিঠা ছিল। ওছমান আলী ফকির সাহেবের গলা খুব দরায ও বুলন্দ ছিল। বিবাহমজলিসে, ছােট-বড় যিয়াফতে, এমনকি ওয়াযের মজলিসের শেষে, নিয়মিতভাবে পুঁথি পড়া হইত। সাধারণত গুরুগম্ভীর বা ধর্ম-ভাবের সভায় কাছাছুল আম্বিয়া, আমির হামযা, শাহনামা, শহীদে-কারবালা, জঙ্গনামা, ফতুহশশামইত্যাদি কেতাব পড়া হইত। এ ছাড়া বিবাহ-মজলিসে, ছােটখাটো মেহমানিতে আলেফ-লায়লা, হাতেম-তাই, লায়লি-মজনু, শিরি-ফরহাদ, বাহার-দানেশ, চাহার-দরবেশ, সূর্য-উজাল, জইগুন ও সােনাভানের কিচ্ছা, তুতিনামা ইত্যাদি হরেক রকমের পুঁথি পড়া হইত। চাচাজী মুনশী মানুষ ছিলেন বলিয়া তিনি বাছাই করা মজলিসে বাছাই করা পুঁথি পড়িতেন। কিন্তু মামুদের বেলা সে রকম কোনও বিধিনিষেধ ছিল না। সকল রকম মজলিসেই তাঁদেরে ডাকা হইত। যাইতেনও তাঁরা। পড়িতেনও হরেক রকমের পুঁথি। পার্শ্ববর্তী হিন্দুপাড়ায় যেমন মাঝে-মাঝে রাতভর কীর্তন হইত, আমাদের গ্রামের মুসলমান পাড়ার অনেক বাড়িতে তেমনি সারারাত পুঁথি পড়া হইত। এমন অনেক দিন গিয়াছে, যখন হিন্দুবাড়ির কীর্তনের লাইন : কালা ত আইল না, কালা ত আইল না’ শুনিতে-শুনিতে ঘুমাইয়া পড়িয়াছি এবং ফযরে যখন ঘুম ভাঙ্গিয়াছে তখনও শুনিয়াছি ভাঙ্গা গলায় গাওয়া হইতেছে : ‘কালা ত আইল
২৪৭
না। ঠিক সেইরূপ, এমন অনেক রাত গিয়াছে, যেদিন ‘ওছি মামুর সুর করা দরা গলার ‘এতেক কহিল যদি আলী পালােয়ান, গােস্বায় জ্বলিয়া গেল বীর। হনুমান’ শুনিতে-শুনিতে ঘুমাইয়া পড়িয়াছি আবার ফযরে ‘গােস্বায় জ্বলিয়া গেল। বীর হনুমান’ শুনিয়াই ঘুম ভাঙ্গিয়াছে।

৩. পুঁথির নিশা এই পুঁথি পড়ায় আমি এত প্রভাবিত হইয়াছিলাম যে সাত-আট বছর বয়সে আমিও একজন মজলিসি পুঁথি-পড়ুয়া হইয়া গেলাম। চাচাজী ও মামুরা পুঁথি পড়িতে পড়িতে ক্লান্ত হইলে আমাকে বদলি দিতেন। এইভাবে অল্পদিনেই স্বাধীন পড়ুয়া হইয়া গেলাম। ছেলেবেলা সকলেরই স্মরণশক্তি খুব প্রখর থাকে। আমারও ছিল। অনেক পুঁথির পৃষ্ঠাকে-পৃষ্ঠা আমার মুখস্থ হইয়া গিয়াছিল। স্কুলে যাইবার কালে পথেঘাটে এবং খেলা করিতে গিয়া মাঠে উচ্চসুরে এইসব আবৃত্তি করিতাম। ক্ষেতে কাজ করিবার সময় চাষিরা এবং গরু রাখিবার সময় রাখালরা যেমন গলা ছাড়িয়া ভাটিয়ালি-ভাওয়াইয়া গান গাইত, আমিও তেমনি। তাদের সাথে পাল্লা দিয়া গলা ছাড়িয়া পুঁথি পড়িতাম। পুঁথি পড়ায় আমি এমন অভ্যস্ত হইয়া গেলাম যে, এক পুঁথি পড়িতে-পড়িতে অন্য পুঁথির অনুরূপ দু-চার। ছতর ঢুকিয়াইয়া দিতাম। শ্রোতারা টেরও পাইত না। এই অভ্যাস শেষ পর্যন্ত এমন হইল যে, পুঁথি পড়িতে-পড়িতে আমি এক্সটেমপাের স্বরচিত দু-চার লাইন ঢুকাইয়া দিতাম। আস্তে আস্তে এ কথা জানাজানি হইয়া গেল। এক কথা একশ কথা হইয়া প্রচারিত হইল। আমার সাহস ও উৎসাহ বাড়িয়া গেল। আমি পুঁথি রচনায় হাত দিলাম। সে সব লেখা অবশ্য আমি ছাড়া আর কেউ পড়ে নাই। কিন্তু নিজেই ঐসব পড়িয়া নিজেকে বাহবা দিতাম।

৪. গদ্য সাহিত্যের সাথে পরিচয়
ধানীখােলা পাঠশালায় আমার পড়া শেষ হওয়ায় আমি পুঁথি ছাড়া অন্য রকম বই-পুস্তক পড়িবার সুযােগ নাই। তার মধ্যে যশােহরের মুনশী মেহের উল্লার মেহেরুল ইসলাম, সিরাজগঞ্জের মুনশী মেহেরুল্লার নসিহত নামা ও ময়মনসিংহের মওলানা খােন্দকার আহমল আলী আকালুবীর শুভ জাগরণ কবিতার বই, দারােগার দপ্তর নামে ডিটেকটিভ গল্পের মাসিক এবং প্রবাসী নামক মাসিক পত্র এবং বঙ্গবাসী, মিহির ও সুধাকরনামক সাপ্তাহিক কাগজের
২৪৮
নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। সম্ভবত ১৯০৭-০৮ সালে ময়মনসিংহ শহরে মুসলিম শিক্ষা সম্মিলনী নামে খুব বড় একটি সভা হয়। চাচাজী ও এ অঞ্চলের অনেক মাতব্বর ও আলেম-ফাযেল ঐ সভায় যােগদান করেন। চাচাজী ঐ সম্মিলনী হইতে অনেক কাগজ-পত্র ও বই-পুস্তক নিয়া আসেন। তাতে বাংলাইংরাজি দুইই ছিল। ইংরাজি পড়িতে পারি নাই। কিন্তু বাংলাগুলি রাক্ষসের ক্ষুধা লইয়া পড়িয়াছিলাম। তার সব কথা মনে নাই। শুধু মনে আছে, মি. শার্প নামে এক ইংরাজ সাহেব মুসলমানদের শিক্ষার কথা বলিয়াছিলেন। আর মনে আছে, করটিয়ার খান পন্নি ও জঙ্গলবাড়ি-হায়বতনগরের দেওয়ান সাহেবদের। কয়েকজনের নাম ছাপার হরফে দেখিয়াছিলাম। তাদের মধ্যে ওয়াজেদ খান পন্নি ও দেওয়ান মান্নান দাদ খাঁর নাম মনে ছিল। আর সব ভুলিয়া গিয়াছিলাম। এর পর সম্ভবত ১৯০৮ সালের ডিসেম্বর মাসে বৈলর বাজারে এক বিরাট সভা হয়। তাতে আমি ভলান্টিয়ার ছিলাম এবং কিছু বই-পুস্তক কিনিয়া ফেলিয়াছিলাম। সিরাজগঞ্জের মুনশী মেহেরুল্লা সাহেব এই সম্মিলনীর প্রধান বক্তা ছিলেন। তাঁর বই-পুস্তক এই সভাতেই বিক্রয় হইয়াছিল।

৫. শৈশবে সম্পাদকতা
পাঠশালার ছাত্র হইয়াও আমি সাপ্তাহিক সংবাদপত্র পড়িতাম, এমনকি, ডিটেকটিভ গল্পের বইও পড়িতাম, এ কথা আজকালকার তরুণ পাঠকদের বিশ্বাস হওয়ার কথা নয়। কিন্তু আমাদের ছেলেবেলা এটা কোনও অসাধারণ ব্যাপার ছিল না। আমার সহপাঠীদের অনেকেই তা করিত। তরুণ পাঠকরা শুনিয়া হয়ত আরাে বিস্মিত হইবেন যে, আমার অন্যতম সহপাঠী শামসুদ্দীন (বর্তমান প্রবীণ সাংবাদিক-সাহিত্যিক আবুল কালাম শামসুদ্দীন) ও আমি নিম্ন প্রাইমারি পাঠশালার শেষ বছর দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়িবার সময় মঞ্জু নামে একটি সংবাদ-সাহিত্য-পত্র বাহির করিয়াছিলাম। এটি স্বভাবতই হইল হাতের লেখা। সম্পাদক-লেখকও হইলাম আমরা দুইজনই। সম্পাদক মানে সত্যই সম্পাদক। কিন্তু লেখক মানে ‘রাইটার’ নয় কপিস্ট । ছাপার বদলে যা করিতে আমরা বাধ্য ছিলাম। প্রথমে ইচ্ছা ছিল সাপ্তাহিক মঞ্জুকরা। সম্পাদনা মানে নিজেদের মৌলিক রচনা নয়, সাপ্তাহিক বিভিন্ন সংবাদপত্র হইতে পছন্দমত নকল করা। এ কাজও কঠিন ও শ্রমসাধ্য বিবেচিত হওয়ায় সাপ্তাহিকের বদলে মাসিক মঞ্জুষা বাহির হইল। শেষ পর্যন্ত সারা বছরে দুই-তিন সংখ্যার বেশি বাহির হইতে পারিল না। তবু চেষ্টা ত করিয়াছিলাম।
২৪৯
আসলে তৎকালে বাংলা ও অঙ্ক শিক্ষার মানই অনেক উন্নত ছিল। ইংরাজি শিক্ষার বােঝা ছিল না। দ্বিতীয় শ্রেণীর শেষ কয়মাস স্পেলিং বুক নামে একটি ছােট্ট বই ছিল মাত্র। আরবি-ফারসি ও বাড়িতেই পড়ার নিয়ম ছিল। সে জন্য বাংলা বই-পুস্তক যা কিছু সামনে পড়িত, তা পড়িতে চেষ্টা করিতাম, পারিতামও। যেসব শব্দ বুঝিতাম না, চাচাজীকে জিজ্ঞাস করিতাম । তিনি না পারিলে মাস্টার সাবকে জিগাইয়া বুঝিয়া নিতাম। তা-ও না হইলে কাল্পনিক অর্থ করিয়া সন্তুষ্ট হইতাম। কাল্পনিক অর্থগুলিই অনেক সময় বেশি রােমাঞ্চকর হইত।
এরপর দাদাজীর নামে মিহির ও সুধাকর নামে একটি সাপ্তাহিক কাগজ আসিতে শুরু করে। আমাদের প্রতিবেশী এবং সম্পর্কে চাচা ওসমান আলী সরকার (পরে খান সাহেব ওসমান আলী) এই সময় বঙ্গবাসীর গ্রাহক ও আমার মামু হুসেন আলী ফরাযী হিতবাদীর গ্রাহক হন। আমি এই তিনখানা সাপ্তাহিকই নিয়মিতভাবে পড়িতাম। পাঠশালার পড়া শেষ করিয়া দরিরামপুর মাইনর স্কুলে যাওয়ার পর গদ্য সাহিত্য পড়িবার সুযােগ আরাে বেশি বাড়ে। পূর্বোক্ত ওসমান আলী সাহেব সাপ্তাহিক বঙ্গবাসীছাড়া দারােগার দপ্তর নামক একটি মাসিক পত্রিকার গ্রাহক ছিলেন। ওসমান আলী সাহেবের ছােট ভাই সাদত আলী আমার সাথে দরিরামপুর স্কুলে পড়িতেন। তিনি বড় ভাই-এর দারােগার দপ্তর গােপনে আনিয়া আমাকে পড়িতে দিতেন। দরিরামপুর স্কুলে অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টার কৈলাস বাবু আমাকে প্রবাসীর গ্রাহক করিয়া দেন। এইভাবে আমি পুঁথিপাঠ হইতে গদ্য বই-পুস্তক পড়িতে শিখি। চাচাজী এই সময় একটি বিষাদ-সিন্ধু কিনেন। তিনি বৈঠকখানায় বসিয়া লােকজনকে এই ‘গদ্যে শহীদে কারবালা পড়িয়া শুনাইতেন।
এই সব বইয়ের মধ্যে দারােগার দপ্তর পড়িয়া আমি খুবই মুগ্ধ হই। কয়েক সংখ্যা দারােগার দপ্তর পড়িয়াই আমি নিজে পরপর কয়েকটি ডিটেকটিভ গল্প লিখিয়া ফেলি। সাদত ও শামসুদ্দীন উভয়েই আমার গল্পের তারিফ করে। কাজেই ছাপাইবার জন্য ঐসব গল্প দারােগার দপ্তর অফিসে পাঠাই। স্বভাবতই একটাও ছাপা হয় নাই। কাজেই বাংলা সাহিত্যের পাঠকরা আমার ঐ ডিটেকটিভ গল্প পাঠ হইতে একদম বঞ্চিত না হন, সেজন্য এসব গল্পের একটির সারমর্ম এখানে উল্লেখ করিতেছি : খুনি নিহত লােকটাকে অন্ধকারে ছুরি মারিয়া খুন করে। তদন্তকারী দারােগা কিছুতেই খুনের আশকারা করিতে পারেন না। অবশেষে খুনি আরাে লােক খুন করিবে বলিয়া দারােগা বাবুকে চ্যালেঞ্জ করিয়া পত্র দেয়। সেই পত্রে প্রথমে সে নিজের নামই লিখিয়াছিল। পরে চিন্তাভাবনা
২৫০
করিয়া সাবধানতা হিসাবে নিজের নাম কাটিয়া সে স্থলে লেখে ‘তােমার প্রতিদ্বন্দ্বী। নামটি সে কাটিয়াছিল বটে, কিন্তু একটু নজর দিয়া পড়িলেই তার পাঠোদ্ধার করা সম্ভব ছিল। দারােগা বাবু কাটা নামটি পড়িতে সমর্থ হন এবং খুনিকে গ্রেফতার করেন। এইভাবে খুনের ঐ ‘গভীর রহস্য উদ্ঘাটিত হয়।

৬. কৈলাস বাবুর প্রভাব
কৈলাস বাবু ছিলেন কবি, সাহিত্যিক ও গায়ক। তার কয়েকখানা কবিতার বই ছাপা হইয়াছে। দরিরামপুরে আমাদের শিক্ষকতা করিবার সময় তিনি ছাত্রদের অভিনয়ােপযােগী নারী চরিত্রহীন নাটক লিখিতেন। তাতে যে সব গান থাকিত তার সবই তার নিজের রচিত। এই সব নাটক তিনি আমাদের। দিয়া অভিনয় করাইতেন। নাটকের বিষয়বস্তু ছাত্রদের প্রতি উপদেশ। যথা : ‘সত্যের পুরস্কার’, ‘মিথ্যাবাদীর শাস্তি’, ‘কুসংসর্গের পরিণাম’। এসব নাটকের মূল চরিত্র ভাল ছাত্রের পার্ট তিনি আমাকে দিয়াই করাইতেন। তিনি আমাকে রবীন্দ্রনাথের কবিতা পাঠে উদ্বুদ্ধ করেন। তাঁরই চেষ্টায় আমি রবীন্দ্রনাথের সােনার তরী প্রাইম পাই। মােট কথা, তারই প্রেরণায় আমার মনে কবি-সাহিত্যিক হওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষা জাগে।

৭. আতিকুল্লাহ
বন্ধুবর আতিকুল্লাহর গুণের কথা ইতিপূর্বেই বলিয়াছি। তাঁর সঙ্গে পরিচয়ের ফলে কী মজার ব্যাপার ঘটিয়াছিল, তাই এখানে বলিতেছি। আতিকুল্লাহর। সঙ্গে আমার পরিচয় একটু ঘনিষ্ঠ হওয়ার পরই তিনি একদিন আমাকে তার বাসায় নিয়া যান। এরপরও অনেক দিন আমি তার বাসায় গিয়াছি। কিন্তু আমি প্রথম দিনের কথাই এখানে বলিতেছি। আতিকুল্লাহ নিকটবর্তী এক বাড়িতে যায়গীর থাকিতেন। আমাকে সেখানে নিয়া যখন তাঁর থাকার ঘরটা দেখাইলেন, আমি অবাক হইয়া গেলাম। ঘরের সামনে দাঁড়াইতেই প্রথমে নজর পড়িল ঘরের দরজার কাঠে কপাট জুড়িয়া একটা কাগজ সাঁটা আছে। তাতে সবুজ ও লাল কালিতে সুন্দর বড়-বড় হরফে লেখা আছে : ‘আতিকিয়া লাইব্রেরি । আরাে কাছে গিয়া দেখিলাম, অপেক্ষাকৃত ছােট হরফে লেখা আছে : ‘এইখানে পাওয়া যায়। তারও নিচে আরাে ছােট-ছােট হরফে দুই সারিতে শতাধিক পুস্তকের নাম ও দাম লেখা আছে। পুস্তকের নামের
২৫১
সারিদ্বয়ের নিচে একটু বড় হরফে লেখা আছে : ‘এতদ্ভিন্ন অর্ডার পাইলে যে কোনও পুস্তক কলিকাতার দরে সরবরাহ করা হয়।’
আতিকুল্লাহ দরজার তালা খুলিয়া ঘরে ঢুকিলেন কিন্তু পিছনে-পিছনে আমি ঢুকিলাম না দেখিয়া তিনি ফিরিলেন। আমাকে তার বিজ্ঞাপন পড়িতে দেখিয়া হাসিতে হাসিতে আমার হাত ধরিয়া টানিয়া ভিতরে নিলেন। আমিও হাসিয়া ঘরে ঢুকিতে-ঢুকিতে বলিলাম : ‘এইসব বই আপনার এখানে পাওয়া যায়?
কিন্তু ঘরে ঢুকিয়া আমার বিস্ময়ের অবধি থাকিল না। আমার প্রশ্নের কথা ভুলিয়া আতিকুল্লাহর ঘরের সৌন্দর্য দেখিতে থাকিলাম। ছােট্ট ঘর। চাটাইর বেড়া। কিন্তু চাটাইর বেড়াতে খবরের কাগজ লাগানাে হইয়াছে। আর সেই খবরের কাগজের উপর সুন্দর-সুন্দর ছবি তরে-তরে সারি-সারিতে লাগানাে হইয়াছে। ছবিগুলির কোনােটা লতা-পাতা, কোনােটা টবের উপর আস্ত একটা গােলাপ গাছ। তাতে অনেকগুলি ছােট-বড় ফুল ফুটিয়াছে। কোনােটা মাত্র কলি। কোনও ছবি একটা নদীর বাঁক। দুই ধারে গাছপালা। নদীর বাঁকে লাল সুরুজ ডুবিতেছে। পাখিরা উড়িয়া বাসায় যাইতেছে। এই ধরনের ছবিগুলাের। ফাঁকে ফাঁকে আরবি ও বাংলা হরফে সুন্দর রূপে সাজান তুা। মােট কথা, চারপাশের এই সুন্দর ছবিগুলি আতিকুল্লাহর ঘরটিকে একটি ছােটখাটো বাগিচা বানাইয়াছে। তার মধ্যে বিছানাটিও পরিপাটি। সাদা বিছানার চাদরটি টান-টান করিয়া পাতা। বালিশের সাদা ওয়াড়ে লতা-পাতা ফুল আঁকা। আতিকুল্লাহ বাহিরে পােশাক-পাতিতে মােটেই বাবু নন। বরঞ্চ তাকে অপরিষ্কার-অপরিচ্ছন্ন বলা যায়। তাঁরই শােবার ঘর ও বিছানা এত সুন্দর। এত পরিষ্কার। জানিলাম ঐ সব তাঁর নিজের হাতের আঁকা। নিজেই ময়দার আটা দিয়া লাগাইয়াছেন। বালিশের ফুলও তিনি নিজেই তুলিয়াছেন। অনেকক্ষণ দেখিবার পর আমার বিস্ময় কাটিলে আমি জিজ্ঞাসা করিলাম : আপনার লাইব্রেরিটা কোথায়?
আতিকুল্লাহ কিছুমাত্র বিব্রত না হইয়া বিছানার পাশে একটি তক্তার উপর রাখা একটি ছােট্ট টিনের বাক্স খুলিলেন। বাক্সের কিছু কাপড়-চোপড় সরাইয়া একখানা-একখানা করিয়া চার-পাঁচখানা পুস্তক ও কেতাব বাহির করিলেন। পুস্তক মানে ছােট সাইযের বই। কেতাব মানে পুঁথি সাইযের বই। পুস্তক মানে বাম দিকে হইতে শুরু করা বই; আর কেতাব মানে ডান দিক হইতে শুরু করা বই। সুতরাং দেখামাত্র চিনিলাম কোনােটা পুস্তক আর কোনােটা কেতাব ।
এগুলি উল্টাইয়া-পাল্টাইয়া আমি বন্ধুকে বলিলাম : আর বই কই? কিছুমাত্র লজ্জিত না হইয়া আতিকুল্লাহ জবাব দিলেন : “আর সব বই কলিকাতায় আছে। চিঠি লিখিলেই চলিয়া আসিবে। বড়জোর সাত দিন।
২৫২
আর পােস্টাফিস যখন আপনার বাড়ির কাছে, তখন আপনার আরাে কম দিন লাগিবে।’

৮. হাজী আহমদ আলী
আমার মুখে নৈরাশ্যের ভাব দেখিয়া আতিকুল্লাহ বাক্সের অজতলা হইতে একটি ছােট বই বাহির করিয়া আমার হাতে দিলেন। আমি দেখিলাম উহা সকল রকম বই পুস্তকের তালিকা।’ পুস্তক বিক্রেতার নাম হাজী আহমদ আলী। আহমদীয়া লাইব্রেরি । …নম্বর মেছুয়া বাজার স্ট্রীট কলিকাতা। পাতা উল্টাইয়া দেখিলাম, পিঁপড়ার মত ছােট হরফে কত যে পুস্তকের নাম লেখা। হইয়াছে, তার লেখাযুখা নাই। আমার পাতা উল্টানাে শেষ হইলে আতিকুল্লাহ বলিলেন : এই হাজী সাহেব কলিকাতার সবচেয়ে বড় ধনী, ইমানদার মুসলমান। আহমদীয়া লাইব্রেরি কলিকাতার শ্রেষ্ঠ পুস্তকের দোকান।
আতিকুল্লাহর অত ক্যানভাসের দরকার ছিল না। আমি প্রথম দৃষ্টিতেই হাজী সাহেবের প্রেমে পড়িয়াছিলাম। তিনি আমার মিতা। হাজী বাদ দিলে তাঁর আর আমার নাম এক। তারপর হাজী আগে না লিখিয়া আমাদের দেশের মত নামের পরে লিখিলে তিনি হন আহমদ আলী হাজী। আর আমি হইলাম আহমদ আলী ফরাযী। এমন খাপে-খাপে মিলিয়া যাওয়া মিতা আর কয়টা আছে? অতএব ইনি যে কলিকাতার শ্রেষ্ঠ ধনী, আর তার লাইব্রেরিই যে সবচেয়ে বড়, সে বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ রহিল না।
অতঃপর আতিকুল্লাহ আমার হাত হইতে তালিকা পুস্তকটি নিয়া পড়িয়া শুনাইলেন, হাজী সাহেবের লাইব্রেরি হইতে পুস্তক কিনিলে শতকরা পঁচিশ টাকা কমিশন পাওয়া যায়। তিনি আমাকে ঐ কমিশনের মর্ম ও তাহা পাওয়ার। সহজ উপায় বাতলাইলেন। তাঁর দরজায় লটকানাে বিজ্ঞাপন পড়িয়া লােকেরা তাঁর কাছে বইয়ের অর্ডার দেয়। তিনি সেই অর্ডারি পুস্তকের জন্য হাজী সাহেবের নিকট পােস্টকার্ড লিখেন। হাজী সাহেব ডাকে সেইসব পুস্তক পাঠাইয়া দেন। এই প্রসঙ্গে আতিকুল্লাহ আমাকে ডাক, পােস্টাফিস, পার্সেল ইত্যাদি কথার অর্থ ও কার্যপ্রণালি প্রাঞ্জল করিয়া বুঝাইয়া দেন। এত সহজে পঁচিশ টাকা কমিশন রােযগারের আমার খুব লােভ হইল। হয়ত মিতাজী আমাকে কমিশন আরাে বাড়াইয়াও দিতে পারেন। মনে মনে ঐ কমিশনে ব্যবসা করা স্থির করিয়া ফেলিলাম। কিন্তু আতিকুল্লাহর কাছে প্রকাশ করিলাম । শুধু তালিকা পুস্তকটি চাহিলাম। ওটি দেওয়ার অসুবিধা বুঝাইয়া তিনি
২৫৩
শীঘ্রই আরেকটি আনাইয়া দেওয়ার ওয়াদা করিলেন। আমি দৃঢ়সংকল্প লইয়াই সেদিন বিদায় হইলাম।।

৯. আহমদীয়া লাইব্রেরি
মাসেক-পনের দিনের মধ্যেই আতিকুল্লাহ আমাকে একটি নূতন তালিকা বই দিলেন। এটি আরাে সুন্দর আরাে বড়, পুস্তকের সংখ্যা আরাে বেশি। ইতিমধ্যে আতিকুল্লাহর শিষ্যত্বে আমি আরাে বেশি পাকিয়াছি। নিজহাতে লাল-সবুজ কালি বানাই। সুন্দর লেখা। আতিকুল্লাহর হুবহু অনুকরণে আমি আমাদের বৈঠকখানার বেড়ায় পুস্তকের তালিকা লটকাইলাম। তালিকার উপরে বড়-বড় হরফে হেডিং বসাইলাম। আহমদীয়া লাইব্রেরি’। আতিকুল্লাহর অনুকরণে লাল-সবুজ-কালির লেখা। দেখিতে বেশ সুন্দর। চাচাজী এটাকে পাগলামি মনে করিয়া গােড়াতে ধমক দিয়াছিলেন। আমি কাঁদিয়া দাদাজীর কাছে নালিশ করি। দাদাজী চাচাজীকে পাল্টা ধমক দেন। চাচাজী আমাকে আর কিছু বলেন না। পাড়ার লােক আসিয়া আমার ‘লাইব্রেরির সামনে ভিড় করিত। যারা পড়িতে জানিত তারা জোরে-জোরে পুস্তকের নাম পড়িত, আর যারা পড়িতে জানিত না তারাও আমার লেখার তারিফ করিত। কিন্তু কেউই আমার কাছে বইয়ের অর্ডার দিত না।
কিন্তু তাতে আমি নিরুৎসাহ হইলাম না। আমি হাজী সাহেবের নিকট পঁচিশ টাকা কমিশনের প্রস্তাব করিয়া পােস্টকার্ড লিখিলাম। হাজী সাহেব আমার প্রস্তাবে রাজি হইয়া খুব তাড়াতাড়িই পত্রের জবাব দিলেন। তাতে আমার কী কী পুস্তক কত কপি চাই অতি সত্বর জানাইতে লিখিলেন। আমার আর কোনও সন্দেহ থাকিল না যে, আমার নাম দেখিয়াই হাজী সাহেব অত সহজে আমার প্রস্তাব গ্রহণ করিয়াছেন এবং অতি সত্বর বইয়ের লিস্টি চাহিয়াছেন। আমি কি আর দেরি করি? হাজী সাহেবের তালিকা পুস্তকের প্রায় অর্ধেক বইয়ের নাম লিখিয়া ফুলস্কেপ কাগজের এক শিট ভরিয়া ফেলিলাম। এবং সেটা ইনভেলাপ ভরিয়া পােস্ট মাস্টারের পরামর্শে অতিরিক্ত টিকিট লাগাইয়া পাঠাইয়া দিলাম। পুস্তকের বদলে আরেকটি চিঠি পাইলাম। তাতে হাজী সাহেব জানাইয়াছেন যে, অর্ডারি পুস্তকের মােট দাম হাজার টাকার উপরে হইবে; অত টাকার পুস্তক বিনা-অগ্রিমে পাঠানাের নিয়ম নাই। অতএব পত্র পাওয়ামাত্র যেন আমি শতকরা পঁচিশ টাকা অগ্রিম হিসাবে অন্তত আড়াই শ টাকা মনি-অর্ডারযােগে হাজী সাহেবের নিকট পাঠাইয়া দেই। ঐ টাকা
২৫৪
পাইয়াই হাজী সাহেব আমার নামে সমস্ত বই পাঠাইয়া দিবেন। অবশ্য অগ্রিম পাওয়া বাদ দিয়াই তিনি পুস্তক ভি পি করিবেন।
এই পত্র পাইয়া আমার মাথা ঘুরিয়া গেল। কোথায় হাজী সাহেব নিজে দিবেন আমাকে শতকরা পঁচিশ টাকা কমিশন। তা না করিয়া তিনি এখন আমারই নিকট শতকরা পঁচিশ টাকা অগ্রিম চাহিয়া বসিয়াছেন? নিশ্চয়ই কোথাও বুঝিবার কোনও ত্রুটি হইয়াছে। কিন্তু কোথায়? হাজী সাহেব যে লিখিয়াছেন ভি পি করিবেন, সে কথারই বা অর্থ কী? বড় ভাবনায় পড়িলাম । যিনি এ বিষয়ে আমাকে পরামর্শ দিতে পারিতেন, সেই আতিকুল্লাহর কাছে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ। কারণ ব্যাপারটা তাঁর কাছে গােপন রাখিয়াছি। তার কাছে শিক্ষা পাইয়া, তাঁরই নিকট হইতে তালিকা আনিয়া তারই ব্যবসাটা নিজের হাতে লইয়া আসিতেছি, এটা জানিলে আতিকুল্লাহ ভাই মনে কষ্ট পাইবেন। বলিয়াই ব্যাপারটা তাঁকে জানিতে দেই নাই। এখন তার কাছে যাওয়াটা বড়ই লজ্জার ব্যাপার হইবে। কাজেই নিজেই বুদ্ধি করিয়া হাজী সাহেবের চিঠির জবাব দিলাম। এইরূপ লিখিলাম : ‘আমি আপনার মিতা, এ কথা ভুলিবেন না। বিনা অগ্রিমে বই পাঠাইয়া দেন। বই বিক্রয় করিয়াই টাকা পাঠাইয়া দিব। আল্লাহর ওয়াস্তে মিতাকে বিশ্বাস করুন। হাজী সাহেবের জবাব পাইলাম। তিনি লিখিয়াছেন : কোনও বয়স্ক ও বিশ্বাসী লােক যামিন না হইলে তিনি অত টাকার বই বিনা-অগ্রিমে বাকি দিতে পারেন না বলিয়া তিনি খুবই দুঃখিত।

১০. বৃদ্ধ মিতাজির দোওয়া
চিঠিটা পাইয়া আমি চমকিয়া উঠিলাম। বয়স্ক লােকের যামিনের কথা হাজী সাহেব লিখিলেন কেন? তবে কি তিনি ধরিয়া ফেলিয়াছেন যে আমি নয় বছর বয়সের ক্লাস থ্রির ছাত্র? বড় ভাবনায় পড়িলাম। এখন করা যায় কী? এতদূর অগ্রসর হইয়া পিছাইয়া পড়া বড়ই লজ্জা ও অপমানের বিষয় হইবে। অনেক চিন্তা-ভাবনা করিয়া বুঝিলাম, “মিতা হওয়ার কথাটা হাজী সাহেব বিবেচনা করিয়াছেন। তাই আমাকে বাকি দিতে না পারিয়া তিনি দুঃখিত হইয়াছেন। তা হইলে বাকি দিবার ইচ্ছা হাজী সাহেবের আছে। শুধু আমাকে নাবালক সন্দেহ করিয়াই হাজী সাহেব দ্বিধায় পড়িয়াছেন কিন্তু আমি যে সত্যই নাবালক সেটা হাজী সাহেবের সন্দেহমাত্র। এই সন্দেহ দূর হইলেই তিনি আমাকে বাকি দিবেন। অতএব আমি লিখিলাম : মিতাজি, আপনি আমার বয়স সম্বন্ধে ভুল বুঝিয়াছেন। আমি নাবালক ছাত্র নই। আমি পঁয়ষট্টি বছর বয়সের বৃদ্ধ। আমি
২৫৫
আহমদীয়া লাইব্রেরির মালিক। এটা খুব বড় পুরাতন পুস্তকের দোকান।
দাদাজীর আনুমানিক বয়সটাই নিজের বয়সরূপে চালাইয়া দিলাম। কম্পিত বুকে চিঠিটা পােস্ট করিলাম। জবাবের আশায় প্রবল আগ্রহে কানখাড়া রাখিলাম। দুই-একদিন পর-পর পােস্টাফিসে খবর লইতে লাগিলাম। শেষ। পর্যন্ত জবাব আসিল। কিন্তু এবারের চিঠি বরাবরের মত পােস্টকার্ডে না । তার বদলে নীল রঙের ইনভেলাপ। কম্পিত হস্তে চিঠিটা খুলিলাম। চিঠিটা নীল রঙের। বরাবর কার্ডের লেখা থাকে এক হাতের, দস্তখতটা অন্য হাতের। দস্তখতের নিচে রবার স্ট্যাম্প মারা। ইতিমধ্যে আতিকুল্লাহর নিকট আমি রবার স্ট্যাম্প দেখিয়াছি। কিন্তু এবারের নীল রঙের পত্রটা আগাগােড়া এক হাতের লেখা। তাতে কোনও রবার স্ট্যাম্প নাই। আমি একদমে চিঠিটা পড়িয়া ফেলিলাম। চিঠিতে আমাকে সম্বােধন করা হইয়াছে। এইভাবে : আমার প্রাণের ক্ষুদে মিতাজি’ । তারপর আমার শতকোটি আন্তরিক দোওয়া-স্নেহ জানিবা,’ বলিয়া শুরু করিয়া বিশেষ স্নেহপূর্ব মােলায়েম ভাষায় লিখিয়াছিলেন, তার সব কথা মনে নাই। কিন্তু তার সারমর্ম ছিল এইরূপ : এত অল্প বয়সে পুস্তক বিক্রয় বা অন্য কোনও ব্যবসায়ের দিকে খেয়াল না দিয়া আমি যেন মন দিয়া লেখাপড়া করি। হাজী সাহেবের দৃঢ় আশা ও বিশ্বাস, আমি যদি মন দিয়া পড়াশােনা করি, তবে আমি ভবিষ্যতে পুস্তকের দোকানদারি না করিয়া পুস্তকের লেখক হইতে পারিব। তিনি এই মর্মে আল্লার দরগায় সর্বদাই মােনাজাত করিতেছেন। পত্রের নিচে তিনি লিখিয়াছেন : ‘দোওয়াগাে তােমার বৃদ্ধ মিতা। তার নিচেই বরাবরের মত দস্তখত।
হাজী সাহেব নিশ্চয়ই বহুদিন আগেই বেহেশতবাসী হইয়াছেন। আজ প্রায় তার সমান বয়সের বৃদ্ধ হইয়া এখন মনে পড়িতেছে, বৃদ্ধ মিতা’র ঐ আশীর্বাদ-পত্রখানা আমার সযত্নে রক্ষা করা উচিৎ ছিল। কিন্তু সযত্নে রক্ষা করার বদলে আমি কী করিয়াছিলাম? অতি সাবধানে ও সঙ্গোপনে আমি চিঠিটা পুনঃপুন পড়িলাম। যতই পড়িলাম, ততই মনে হইল, হাজী সাহেবের ঐ চিঠিটা চিৎকার করিয়া আমাকে জনসমক্ষে তিরস্কার করিতেছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস হইল, চিঠিটা আমার মস্ত বড় একটা কুকর্মের জাজ্বল্যমান সাক্ষী। এই মুহূর্তে ঐ সাক্ষী একদম গায়েব না করিলে যেন আমার আর রক্ষা নাই। কাজেই বিনা-দ্বিধায় আমি চিঠিটা টুকরা-টুকরা করিয়া টুকরাগুলি আবার টুকরা করিয়া, আবার টুকরা করিয়া, অতি সাবধানে বাড়ির পুকুরে ডুবাইয়া দিলাম। যতক্ষণ সবগুলি টুকরা ভিজিয়া লুথা ও সাদা হইয়া পানিতে না ডুবিল, ততক্ষণ আমি ঐ স্থান ত্যাগ করিলাম না।
২৫৬
এইভাবে বাহিরের সাক্ষী নিশ্চিহ্ন করিলাম বটে, কিন্তু আমার ভিতরের সাক্ষী ত বাঁচিয়া থাকিল! বহুদিন পর্যন্ত হাজী সাহেবের চিঠিটা সময় পাইলেই আমার চোখের সামনে ভাসিয়া উঠিত। ঐ চিঠির প্রত্যেক লাইন, প্রত্যেক শব্দ, এমনকি প্রতিটি হরফ, বিকট অট্টহাসিতে আমাকে তিরস্কার করিত। আজ মনে হইতেছে, আমি ভুল বুঝিয়াছিলাম ; ওটা তিরস্কার ছিল না, ছিল আশীর্বাদ।

১১. উচ্চতর পরিবেশ
১৯১৩ সালে ময়মনসিংহ পড়িতে আসিয়া আমার সাহিত্যচর্চার নিশা আরাে বাড়িয়া যায়। বাসায় শামসুদ্দীন ও সাঈদ আলী সাহেবের সাহচর্য এবং স্কুলের শিক্ষকের উপদেশ দুইটাই সাহিত্য-সাধনার অনুকূল ও উপযােগী ছিল। শামসুদ্দীন ও সাঈদ আলী সাহেব নিজেরা বই-পুস্তক কিনিতেন। মাসিক কাগজ লইতেন। সাঈদ আলী সাহেব সম্পর্কে আমার চাচা, বয়সেও কিছু বড়, পড়িতেনও উপরের ক্লাসে। কাজেই সাহিত্য আলােচনা ও রসালাপ তার সাথে হইত না। সেটা সীমাবদ্ধ থাকিত আমার ও শামসুদ্দীনের মধ্যে। তবে সাঈদ আলী সাহেব তার কিনা বই-পুস্তক আমাদেরে পড়িতে দিতেন। আমাদের কিনা পুস্তকও পড়িতে নিতেন। এই সময় আমরা পরস্পরের সঙ্গে পরামর্শ করিয়া কিনিতাম যাতে তিনজন একই বই কিনিয়া না ফেলি। আমি আগে হইতেই প্রবাসীর গ্রাহক ছিলাম বলিয়া শামসুদ্দীন সুরেশ সমাজপতির সাহিত্য ও সাঈদ আলী সাহেব প্রমথ চৌধুরীর (বীরবলের) সবুজ পত্রএর গ্রাহক হইলেন। আমি প্রবাসীর ও শামসুদ্দীন সাহিত্য-এরও গ্রাহক হওয়ায় আমাদের সাহিত্যিক মতও যার-তার কাগজের দ্বারা প্রভাবিত হইয়াছিল। কবি হিসাবে আমি রবীন্দ্রনাথের ভক্ত হইলাম। শামসুদ্দীন অক্ষয় বড়ালও ডি এল রায়ের সমর্থক হইল। ফলে এই সময় রবীন্দ্রনাথ নােবেল প্রাইয পাওয়ায় আমি যতটা খুশি হইলাম, শামসুদ্দীন তা হইল না। নিজেরা বই-পুস্তক কিনায় আমাদের অনেক বন্ধু জুটিল। অবশ্য বন্ধুদের মধ্যে হিন্দুই ছিল বেশি। তাঁদের সাথে আমাদের বই-পুস্তক আদান-প্রদান হইত। তার ফলে শহরে যাওয়ার এক বছরের মধ্যে আমি বঙ্কিমচন্দ্রের বিষবৃক্ষ, দুর্গেশ নন্দিনী ও রাজসিংহ, রবীন্দ্রনাথের চোখের বালি, নৌকাডুবি ও গােরা, কালীপ্রসন্ন ঘােষের প্রভাত চিন্তা, নিশীথ চিন্তা, চন্দ্র শেখর করের উদভ্রান্ত প্রেম, কায়কোবাদের অশ্রুমালা ও মহাশশ্মশান, মাইকেলের মেঘনাদবধ নবীনচন্দ্রের পলাশীর যুদ্ধ, হেমচন্দ্রের বৃত্রসংহার ইত্যাদি কাব্য-উপন্যাস
২৫৭
পড়িয়া ফেলিলাম। এ ছাড়া অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়ের সিরাজদ্দৌলা ও মীর কাসিম ইত্যাদি ইতিহাস গ্রন্থও আমি কিনিয়াছিলাম। মাইকেলের মুসলমান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে আমরা কেউ ডা. আবুল হােসেনের যমজভগ্নি কাব্যও কিনিয়াছিলাম। এসব পুস্তক ছাড়া আমি মাস্টার মশায়দের মুখে নাম শুনিয়া স্কটের আইভানহাে, টেলিসম্যান, মেরি কোরেলির সরােয-অব-স্যাটান, জর্জ ইলিয়টের অ্যাডাম বিডি ইত্যাদি ইংরাজি নভেল স্কুল লাইব্রেরি হইতে আনিয়া পড়িবার চেষ্টা করিয়াছিলাম। বন্ধু-বান্ধবদেরে দেখাইয়াও ছিলাম যে ঐসব বই আমি বুঝিতে পারি ।

১২. বঙ্কিমচন্দ্রের প্রভাব
লােকমুখে শুনিয়া এবং মুসলমান সাপ্তাহিক খবরের কাগজ পড়িয়া আমি বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতি খুব বিরূপ ছিলাম। তাকে আমরা মুসলিম-বিদ্বেষী বলিয়াই জানিতাম। দুর্গেশ নন্দিনী ও রাজসিংহ পড়িয়া সে বিষয়ে আমার আর কোনও সন্দেহ থাকিল না। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষায় খুবই আকৃষ্ট হইয়া পড়িলাম। অবশ্য তৎকালের অন্যান্য লেখক যথা কালীপ্রসন্ন ঘােষ ও চন্দ্রশেখর কর প্রভৃতির ভাষাও খুব ভাল লাগিত। এমনকি বিদ্যাসাগরের সীতার বনবাস-এর ভাষাও আমার কাছে খুব মধুর লাগিত। এটা আমাদের পাঠ্য বহি ছিল। কিন্তু এঁদের মধ্যে সবচেয়ে মজাদার লাগিল আমার কাছে বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষা। বিশেষত দুর্গেশ নন্দিনীর ভাষায় আমি মুগ্ধ হইয়াছিলাম তাঁর বাণী-বন্দনা আমার মুখস্থ ছিল। এটা উদ্ধৃত করিবার সময় আমি ধবল’ কথাটা যােগ করিয়া বলিতাম : হে বাগদেবী, হে কমলাসনে, অমলধবল-কমল-দল-নিন্দিত-চরণ-ভকত-জনবৎসলে ইত্যাদি ইত্যাদি। বন্ধুবান্ধব ও শিক্ষকদের কেউ কেউ ঐ ‘ধবল’ শব্দ দুর্গেশ নন্দিনীতে নাই বলিয়া আমার ভুল ধরিতেন। কিন্তু আমি সেদিকে কান দিতাম না। এইভাবে সমাসবহুল শব্দরচনা আমার ও শামসুদ্দীনের তখন একটা নিশা হইয়া গিয়াছিল। আমরা স্কুলের রচনায় এমনকি, পরীক্ষার খাতায়ও সমাসবহুল শব্দ প্রয়ােগ করিতাম। প্রতিযােগিতায় আমরা এমনি মাতিয়াছিলাম যে, শামসুদ্দীনের চৌষট্টি হরফের শব্দের জবাবে আমি একশ আট হরফের শব্দ রচনা করিয়াছিলাম। পঞ্চাশ-ষাট হরফের শব্দ ত আমাদের ডাল-ভাত হইয়া গিয়াছিল । এইভাবে আমরা স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্রকে হারাইয়া দিয়াছিলাম। কারণ তাঁর সব চেয়ে বড় শব্দেও পঁচিশটার বেশি হরফ নাই।
আমাদের বাংলার শিক্ষক বাবু বিপিন চন্দ্র রায় আমার সাহিত্য-প্রীতির
২৫৮
জন্য আমাকে খুবই স্নেহ করিতেন। তিনি আমাকে সব সময়ে উৎসাহ ও উপদেশ দিতেন। রচনার মুনশীয়ানার জন্য তিনি তাঁর সহকর্মী ও বন্ধুদের নিকটও আমার তারিফ করিতেন। আমার সমাস-বহুলতার প্রশংসা করিয়াও তিনি আমাকে মাত্রাধিক্য বর্জন করিতে পরামর্শ দিতেন। আমি তাঁর অন্য সব উপদেশ পালন করিলেও এ ব্যাপারে তা অমান্য করিতাম ।

১৩. কাব্য-সাধনা
কবিতা না লিখিয়া শুধু গদ্য রচনা করিলে সাহিত্যিক হওয়া যায় না, এই ছিল তৎকালের জনমত। বস্তুত সাহিত্যিকের জীবন আরম্ভই হয় পদ্য রচনা হইতে। আমার বেলাও তাই হইয়াছিল। গােপনে-গােপনে কবিতা লিখিয়া বিভিন্ন কাগজে পাঠাইতে লাগিলাম। কোনও দিন ছাপা হয় নাই। ছাপা না হওয়ার দরুন নিজের কবি-প্রতিভার প্রতি শ্রদ্ধা হারাইতাম না। সম্পাদকদের পক্ষপাতিত্ব ও নির্বুদ্ধিতাকেই সেজন্য দায়ী করিতাম।
গ্রামে থাকিতে প্রথমে অবশ্য পুঁথির অনুকরণে মিত্রাক্ষর ছন্দে পয়ার, ত্রিপদী, একাবলি ইত্যাদি মাত্রায় কবিতা লিখিতাম। ময়মনসিংহ শহরে আসিবার পর মাইকেল, নবীনচন্দ্র, হেমচন্দ্র ও কায়কোবাদের বই পড়িবার পর অমিত্রাক্ষর ছন্দে কবিতা লিখিতে শুরু করি। অমিত্রাক্ষর ছন্দে কবিতা লিখিবার নিয়ম প্রচলন করায় মাইকেল ও তার অনুসারী কবিদের প্রতি মনেমনে কৃতজ্ঞতা জানাইলাম। কারণ পয়ার, ত্রিপদীর চেয়ে মিলহীন কবিতা লেখা অনেক সােজা বলিয়াই ছিল তৎকালে আমার বিশ্বাস। পদান্ত মিল সম্বন্ধেও আমার এবং তৎকালীন সমস্ত বন্ধু-বান্ধবের ধারণা স্পষ্ট ছিল না। ‘খালে’ ‘বিলে’ মিল দিতে তখন আমরা লজ্জা পাইতাম না। ময়মনসিংহ শহরে আসিবার পরই সর্বপ্রথম এ বিষয়ে আমার চোখ খােলে। অতুল চন্দ্র চক্রবর্তী নামক আমাদের বাংলার শিক্ষক একদিন অধম মিলের কবিতাকে বিদ্রুপ করিয়া এই কবিতা আবৃত্তি করেন : কাঁঠালের ঠোঙ্গা নিয়া নাচে নন্দলাল, ফস্ করে নিয়া গেল এক বেটা চিল্। কাঁঠালের জায়গায় ‘মিঠাই’ বসাইয়া অনেককেই এই কবিতা পরবর্তীকালে আবৃত্তি করিতে শুনিয়াছি। কিন্তু আমি জীবনের প্রথমে অতুল বাবুর মুখে ইহা এইভাবেই শুনি। অতুল বাবুর উচ্চারণ ও আবৃত্তি এতই বিদ্রুপাত্মক হইয়াছিল যে, অধম পদান্ত মিলের। হাস্যকরতা না বুঝিবার কোনও উপায় ছিল না।
ফলে অতঃপর পদান্ত মিল সংগ্রহে খুবই সাবধান হইলাম। তার ফলে
২৫৯
পদান্ত মিল দেওয়া খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার হইয়া গেল। শব্দের তালাশে অভিধানে অভিযান চালাইতে হইল। স্কুল-পাঠ্য ছােটখাটো অভিধানে পােষাইল না । এই সময়ে সমাস-বহুল বৃহত্তম শব্দরচনার উদ্দেশ্যেও অষ্টপ্রহর অভিধান খুঁজিতে হইত। এই দুই কারণে আমি তৎকালীন বৃহত্তম দুইটা বাংলা অভিধান ‘প্রকৃতিবােধ’ ও ‘প্রকৃতিবাদ’ কিনিলাম। শব্দকোষ’ বা এই নামের একটি অভিধান কিনিল শামসুদ্দীন। এই সব অভিধান ঘাটিয়া এমন সব অজানা নূতন শব্দ আবিষ্কার করিতাম ও গদ্য রচনায় ব্যবহার করিয়া বসিতাম, যার অর্থ অনেক সময় নিজেই বলিতে পারিতাম না। কিন্তু পদান্ত মিল সম্বন্ধে ক্রমে এতটা সচেতন হইয়া গেলাম যে, অর্থহীন শব্দ প্রয়ােগের দ্বারা হইলেও পদান্ত মিল সুন্দর করিতে হইবে, ইহাই হইয়া উঠিল আমার মতবাদ। অতুল বাবুর বক্তৃতা শুনিবার এবং এ সম্পর্কে শামসুদ্দীন ও অন্যান্য কবি-বন্ধুর সহিত আলাপ করিবার পর আমার বাল্যের ভুলিয়া-যাওয়া স্মৃতিকথা মনে পড়িল। ছেলেবেলা চাচাজীর মুখে আমাদের বাড়ির মাদ্রাসার মৌলবীদের মুখে এবং বিশেষ করিয়া মৌলবী এরফান আলী নামে আমার এক ফুফাত ভাইয়ের মুখে আমি বহু ফারসি কবিতা শুনিয়াছিলাম। আমি অর্থ না বুঝিয়া তার অনেকগুলি নিজেও আবৃত্তি করিতাম। এতদিনে গুনগুন করিয়া মনে-মনে আবৃত্তি করিয়া দেখিলাম, ওগুলির পদান্ত মিল অতি সুন্দর । বাংলা কবিতায়, “চিল’ ও ‘বিল, ‘খাল’ ও ‘লাল’ এইরূপ দুই হরফের মিল হইলেই চমৎকার পদান্ত মিল হইল। কিন্তু ফারসিতে বহু কবিতার শেষের চার হরফে পর্যন্ত মিল আছে। কোনও কোনও কবিতার দুইটা লাইনের প্রথম হইতে শেষ পর্যন্ত আগাগােড়াই মিল । তখন লাইনগুলিরও কোন-কোনটা মনে পড়িয়াছিল । কিন্তু এই বুড়া বয়সে এই বই লেখার সময়ে হাজার মাথা কুটিয়াও একটা লাইন বা তার অংশ মনে। করিতে পারলাম না। হাতের কাছে ফারসি বইও দু-চারটা নাই যা হইতে দৃষ্টান্ত। দেখাইতে পারি। তবু ব্যাপারটা এবং মিলের ধরনটা দেখাইবার জন্য অর্থনির্বিশেষে কয়েকটি অক্ষর-সমষ্টির উল্লেখ করিতেছি। যথা : ‘গেরেফ তানের সঙ্গে ‘সেরেফ খান’, ‘আকরিব’-এর সঙ্গে ফান্ ফরিব’। পরওয়ারদিগারের সঙ্গে সরওয়ারনিগার’-এর পদান্ত মিল হইলে চমৎকার হইবে। এতে পাঁচ-ছয় অক্ষর হইতে আট-নয় অক্ষর পর্যন্ত মিল হইয়া যাইবে।
পয়ারের দুই পদের আগাগােড়া মিলের লাইন মােটেই মনে পড়িতেছে । তবে সেটার কল্পিত রূপ এই :
খাতায়ে বুযুর্গান গেরেফতান খাতাস্ত; আতায়ে হুযুর খান সেরেফ জান আতাস্ত!
২৬০
শুধু মিল দেখাইবার জন্য এই কবিতা’। কাজেই দুসরা ছতরের অর্থ বুঝিবার চেষ্টা করিবেন না। এই ধরনের পয়ার রচনায় যে কী পরিমাণ মুনশীয়ানা ও শব্দ-জ্ঞান-প্রয়ােজন, তা ভাবিয়া বিস্মিত হইতাম। কিন্তু উহার অনুকরণে হাজার চেষ্টা করিয়াও সফল হইতাম না। অথচ অন্তত পাঁচ-ছয় অক্ষরে পদান্ত মিল না দিয়া কবিতা রচনায় মনও উঠিত না।

১৪. মাইকেলের প্রভাব
এমন বিপদের দিনে মাইকেল মধুসূদন আসিলেন আমার বিপত্তারক হিসাবে । প্রথমে তার একাকিনী শােকাকুলা অশােক কাননে’, পড়িলাম পাঠ্যবইয়ে। তারপর আস্ত মেঘনাদবধ কাব্যটাই পড়িয়া ফেলিলাম। তারপর এক-দুই করিয়া পলাশীর যুদ্ধ, বৃত্রসংহার ও মহাশ্মশান কাব্য পড়িলাম। নবীনচন্দ্র ও কায়কোবাদের কবিতা মাইকেলের কবিতার চেয়ে সহজ লাগিল। মাইকেলের কবিতা তুলনায় অনেক কঠিন। কঠিন বলিয়াই উহাকে শ্রেষ্ঠতর কাব্য মনে হইল। কারণ কবিতায় যত বেশি কঠিন শব্দ থাকিবে, কবিতা পড়িতে পাঠককে যত বেশি অভিধান দেখিতে হইবে, যত দুর্বোধ হইবে, কবিতা তত উৎকৃষ্ট হইবে, ইহাই ছিল আমার ধারণা। আমি অমিত্রাক্ষর ছন্দে যথাসম্ভব দুর্বোধ্য কবিতা রচনা করিতে লাগিলাম। তাতে যথেষ্ট নাম হইল। মাসিক কাগজের সম্পাদকরা আমার কবিতা না ছাপিলেও বিবাহ-মজলিসে আমার আদর ছিল। বিভিন্ন স্থান হইতে চেনা-অচেনা অনেক লােক ‘প্রীতি উপহার’ লেখাইতে আমার কাছে আসিত। আগ্রহের সঙ্গে তাদের ফরমায়েশ পালন করিতাম। রাত জাগিয়া নিজের কাগজ-কলম খরচ করিয়া কবিতা লিখিতাম। অত খাটুনির ফল কবিতাটা ছাপার ভুলের জন্য নষ্ট না হয়, সেজন্য প্রেসে গিয়া প্রুফ দেখিয়া দিতাম।
বিবাহের প্রীতি উপহার’ লিখিতে গিয়া এবং প্রেম-ভালবাসার কবিতা। লিখিতে গিয়া বুঝিলাম অমিত্রাক্ষর ছন্দে তা চলে না। প্রেম-ভালবাসার মর্ম অবশ্য তখনও বুঝিতাম না। কিন্তু তাতে প্রেমের কবিতা লিখিতে কোনও অসুবিধা হইত না। কোকিল-পাপিয়া না দেখিয়াই ওদেরে সম্বােধন করিয়া যেমন অনেক কবিতা লিখিলাম, কোনও সুন্দরী না দেখিয়াও তেমনি তাকে সম্বােধন করিয়াও অনেক কবিতা লিখিলাম। বলা বাহুল্য, এসবই বড়-বড় কবিদের অনুকরণমাত্র।
২৬১
১৫. পুস্তক বাইন্ডিং
কবিতা লেখার সঙ্গে নাটক-নভেল পড়াও সমান জোরে চলিতে লাগিল। শামসুদ্দীন, সাঈদ সাহেব ও আমি পুস্তক খরিদে প্রচুর অর্থ ব্যয় করিতাম । তাতে আমাদের তিনজনেরই নিজস্ব লাইব্রেরি গড়িয়া উঠে। শামসুদ্দীনের ও আমার লাইব্রেরি পুস্তক-সংখ্যা সাঈদ মিঞাকে অনেক ছাড়াইয়া যায়। এর একটা গুপ্ত কারণও ছিল। পয়সা দিয়া কিনা ছাড়াও আমি ও শামসুদ্দীন অন্য উপায়ে পুস্তক সংগ্রহ করিতাম। অন্যের নিকট হইতে ধার করিয়া আনা কোনও পুস্তক খুব পছন্দ হইলেই আমরা কয়েক হাত ঘুরাইয়া বইটি শেষ পর্যন্ত গায়েব করিয়া ফেলিতাম। কয়েক দিন গুপ্ত থাকিয়া অন্য চেহারায় সেই বই আসিয়া আমার অথবা শামসুদ্দীনের লাইব্রেরিতে স্থান পাইত। শামসুদ্দীন ও আমার মধ্যে এ কাজের ‘কোড ল্যাংগুয়েজ’ ছিল বাইন্ডিং করা। অর্থাৎ ঐ বইটির মলাট ছিড়িয়া ফেলিয়া নূতন করিয়া বইয়ের আকারভেদে চামড়ার ফুল বাঁধাই, হাফ বাঁধাই ও টিশ বাঁধাই করাইয়া ফেলিতাম এবং প্রয়ােজনবােধে সােনালি-রুপালি হরফে নিজেদের নাম লেখাইয়া ফেলিতাম। এ কাজে আমরা দুইজন এমন সিদ্ধহস্ত হইয়াছিলাম যে, আমাদের বন্ধুবান্ধবদের কেউ কোনও ভাল বই হারাইলেই আমি ও শামসুদ্দীন পরস্পরকে সন্দেহ করিতাম। চোখ ঠারাঠারি করিয়া জিজ্ঞাসা করিতাম : ‘কিহে বাইন্ডিং করিয়া ফেলিয়াছ নাকি? এইরূপ বাইন্ডিং করানাের কাজে যে আমরা শুধু পুরাতন ভেঁড়াছুটা বইই বাঁধাই করাইতাম তা নয়, অনেক নূতন বইয়েরও ভাল বাঁধাই খুলিয়া ফেলিতাম এবং সম্পূর্ণ নূতন ধরনে নূতন বাঁধাই করিতাম। এ কাজে আমাদের বিশ্বস্ত দফতরি ছিল। কিন্তু সব ব্যাপারে শুধু। দফতরির উপর নির্ভর করিয়া নিশ্চিন্ত থাকিতাম না। দফতরির হাতে দিবার আগেই বাঁধাই খােলা হইতে শুরু করিয়া বইয়ের ভিতরে নাম লেখা নিশ্চিহ্ন করা পর্যন্ত সব কাজ নিজ হাতে করিতাম । প্রয়ােজন হইলে দুই-এক পাতা বা পাতার অংশ ছিড়িয়া ফেলিতাম। এ কাজে আমাদের লােভ ও দক্ষতা এমন। বাড়িয়া গিয়াছিল যে, স্কুল-কলেজের লাইব্রেরি-কমন রুমে বা পাবলিক পাঠাগারে কোনও বই আমাদের একজনের পছন্দ হইলে অপর জনকে বলিতাম : বইখানা বাইন্ডিং করার যােগ্য হে’। অতঃপর দুই বন্ধুতে ঐ বইখানা বাইন্ডিং করার সুবিধা-অসুবিধা, বিপদ-আপদ চারদিক চিন্তা করিতাম । অবস্থা গতিকে বাইন্ডিং করার লােভ অনেক ক্ষেত্রেই ত্যাগ করিতে হইয়াছে। এ সব ক্ষেত্রে ইসু-করা পুস্তক একাধিকবার রিইসু করাইয়া দীর্ঘদিন
২৬২
একজনের কাছে রাখিয়াছি। নিয়মে না কুলাইলে দুজনের নাম বদলাবদলি করিয়াছি। তবু বইখানা নিজেদের হাতছাড়া করি নাই। বেশ কিছুদিন এইভাবে রাখিয়াও যখন বাইন্ডিং করার কোনও নিরাপদ পন্থা বাহির করিতে পারি নাই, তখন বাধ্য হইয়া বই ফেরৎ দিয়াছি। প্রিয়জনকে দাফন করিতে গােরস্তানে লইয়া যাইবার সময় মানুষ যেমন শােকে মুহ্যমান থাকে, আমরা দুইজন তেমনি মুহ্যমান অবস্থায় বইখানা ফেরৎ দিতে গিয়াছি।

১৬. চোরের উপর বাটপারি
এইভাবে আমরা দুইজন নিজ-নিজ ব্যক্তিগত লাইব্রেরি এত বড় করিয়া ফেলিয়াছিলাম যে, তক্কালে আমাদের সহপাঠী, পরিচিত বা বন্ধু-বান্ধবের মধ্যে কারাে এত পুস্তক-সম্পদ ছিল না। বলা আবশ্যক, আমাদের লাইব্রেরির আয়-ব্যয়, জমা-খরচ ও হ্রাস-বৃদ্ধিও ছিল। অর্থাৎ আমাদের পুস্তকও হারাইয়া যাইত। সে সব পুস্তকও বাইন্ডিং’ হইয়া যাইত কিনা বলা কঠিন। কারণ যারা আমাদের বই গায়েব করিতেন, তাঁরা আর যাই করুন, বাইন্ডিং করার ফন্দি তাদের মস্তিষ্কে ঢােকার কথা নয়। এটা ছিল আমার-শামসুদ্দীনের নিজস্ব আবিষ্কার। আমাদের বন্ধু-বান্ধবরা ছিল সবাই সাধারণ শ্রেণীর মামুলি পাঠক। আমাদের দুইজনের মত প্রতিভাশালী’ কেউ ছিল না। ঐসব মামুলি পুস্তকের কিড়ারা-ফন্দি আবিষ্কারে আমাদের ধারে-কাছে আসিতেই পারে না। কাজেই তাদের চুরি ছিল মামুলি চুরি । ফলে কালে-ভদ্রে আমাদের হারান পুস্তক দুএকটা ধরাও পড়িয়াছে। কিন্তু আমাদের চুরি ছিল আর্টিস্টিক। ধরা পড়িবার কোনও সম্ভাবনা ছিল না।
কিন্তু আমাদের কিছু বই সত্য-সত্যই বাইন্ডিং হইয়াছিল। কারণ এটা আমরা নিজেরাই করিতাম । অর্থাৎ আমরা দুই বন্ধু বাইন্ডিং কাজে এমন মত্ত হইয়া উঠিয়াছিলাম যে, এক বন্ধু আরেক বন্ধুর উপর হাত সাফাই করিতে দ্বিধা করিতাম না। তবে দুর্নিবার প্রলােভন না হইলে এ কাজ করিতাম না। করিলে এত সাবধানে করিতাম যাতে কিছুতেই ধরা না পড়ি। ধরা পড়িলে আত্মহত্যা করিয়াও লজ্জা নিবারণ করা যাইবে না। কারণ আমার ধারণা, আমিই শুধু শামসুদ্দীনের বই বাইন্ডিং’ করিয়া ঘুমন্ত বন্ধুর পিঠে ছুরি মারিতেছি। কাজেই সময়ে সাবধান হইলাম। হােস্টেলে পুস্তকের স্টক বুকশেলফ হইতে পাের্টমেন্টে তুলিলাম। বাড়িতে বৈঠকখানার আলমারি অন্দর বাড়িতে নিয়া গেলাম। তাতে তালা-চাবি লাগাইলাম। তার পর একদিন নিতান্ত দৈবাৎ জানিতে পারিলাম
২৬৩
আমার একখানা ভাল বই শামসুদ্দীন বাইন্ডিং’ করিয়া ফেলিয়াছে। নিজের চক্ষুকে বিশ্বাস করিতে পারিলাম না। কিন্তু অল্পক্ষণেই সে ভাব কাটিয়া গেল। বুকের উপর হইতে একটা পাপের বােঝা নামিয়া গেল। শুধু আমিই শামসুদ্দীনের বই বাইন্ডিং’ করিয়া ঘুমন্ত সরল বিশ্বাসী বন্ধুর ডাকাতি করিতেছি বলিয়া আমি মনে-মনে শামসুদ্দীনের নিকট অপরাধী ছিলাম। প্রতি কাজে প্রতি কথায় আমার বুকে সেটা কাঁটার মত বিধিত। আজ সেটা হইতে রক্ষা পাইলাম। নিজের প্রিয় জিনিস চুরি হইলেও যে তাতে আনন্দ পাওয়া যায়, এই অভিজ্ঞতা লাভ করিলাম আমি ঐদিন।
আমি কিছু বলিলাম না। কিন্তু অতঃপর আমার কথাবার্তায় ও চাল-চলনে শামসুদ্দীনের মনে সন্দেহ সৃষ্টি হইল। শেষ পর্যন্ত সে কথাটা নিজেই স্বীকার করিল। আমি তার সব কথা শুনিয়া বুঝিলাম সেও নিজেকেই একা অপরাধী মনে করে। আমি যে তার অনেক ভাল বই বাইন্ডিং’ করিয়া ফেলিয়াছি সে ঘুণাক্ষরেও তেমন সন্দেহ করে নাই।
অতঃপর দুই বন্ধুর কনফেশনের পালা। কে কার কতখানা বই বাইন্ডিং করিয়াছি, তার খতিয়ান করা হইল। দেখা গেল : কেহ কারে নাহি পারে, সমানে সমান। দুই জনের খতিয়ান প্রায় কাছাকাছি।
দুই বন্ধু খুব জোরে হ্যান্ডশেক করিলাম। বলিলাম : কুচপরওয়া নাই। তােমার বই আমার বই, আমার বই তােমার বই। আমাদেরটা জয়েন্ট লাইব্রেরি।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমাদের দুইজনের লাইব্রেরির একটাও টিকে নাই। চুরিতে যে লাইব্রেরি গড়িয়া উঠিয়াছিল, ডাকাতিতে তা শেষ হইল। এ ডাকাতি শুরু হইল, চাকরি ও ব্যবসা উপলক্ষে আমরা বাড়ি ছাড়িবার পর। হইতে। কারণ আমাদের বইগুলি লােকেরা নিল বলিয়া-কহিয়া। যিনি নিলেন তিনি আর ফেরৎ দিবার নামটি করিলেন না। আমরা টাকা-কড়ি খরচ করিয়াই বই কিনিতাম। যেগুলি বাইন্ডিং’ করিতাম, তাতেও বেশ পয়সা খরচ হইত। তারপর আমাদের নাম বহন করিয়াই আমাদের লাইব্রেরিতে থাকিত। কিন্তু আমাদের যে সব বন্ধু ও আত্মীয়েরা আমাদের পুস্তক নিয়াছেন, তারা ‘বাইন্ডিং’-এ টাকা খরচ করেন নাই বলিয়া তাদের বাড়িতে বসিয়াই আমাদের পুস্তকগুলি আমাদেরেই বুড়া আঙুল দেখাইতেছে।
২৬৪

অধ্যায় তের
সাহিত্য-সাধনা

১. কবি হওয়ার অপচেষ্টা
ছাপার হরফে নিজের নাম দেখার ইচ্ছা বােধ হয় সব মানুষেরই ছেলেবেলার উচ্চাকাঙ্ক্ষা। বিশেষত কবি-সাহিত্যিক হওয়া যাদের শখ তাদের ত নিশ্চয়ই। আমারও এই শখ ছিল খুব তীব্র। কবি হিসাবে নাম প্রকাশ করিবার আশায় বিভিন্ন মাসিক কাগজে নিজ নামে অনেক কবিতা পাঠাইয়াছি। নিজ নামে ছাপা না হওয়ায় ধারণা হইয়াছে, হিন্দু সম্পাদকরা মুসলমান কবিদের কবিতা ছাপাইবেন না। মুসলমানকে ওরা দু’চোখে দেখিতে পারেন না। কাজেই অবশেষে হিন্দু নামে কবিতা পাঠাইতে লাগিলাম। সে ফন্দিও ব্যর্থ হওয়ায় শেষ পর্যন্ত বড় বড় নাম করা কবিদের নামে কবিতা পাঠাইতাম। আমার যতদূর মনে পড়ে একবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম দিয়াও একটা কবিতা পাঠাইয়াছিলাম।
ছাপার হরফে নিজের নাম মাসিক পত্রিকায় দেখিবার আশাতেই এসব ফন্দি-ফিকির করিয়াছিলাম, বলা বােধহয় ঠিক হইবে না। কারণ ঐসব কবিতা যদি ছাপা হইতও, তবু তাতে আমার নাম থাকিত না। তবে কিসের আশায় এত শ্রম, এত কাগজ ও এক টিকিট ব্যয়? নিজের নাম নয়, নিজের। কবিতা ছাপার হরফে দেখিবার জন্য। নিজের সৃষ্টির প্রতি মানুষের এমনি। একটা টান বােধ হয় স্বাভাবিক ও সহজাত। সন্তান ও আর কেউ যদি বাপমাকে নাও চিনে, তবু বােধ হয় বাপ-মারা নিজের সন্তানকে সুস্থ ও যশস্বী দেখিয়া এমনি একটা পুলকের রােমাঞ্চ অনুভব করিয়া থাকেন।
২৬৫
২. গদ্যে প্রথম সাফল্য
যা হােক শেষ পর্যন্ত কবিতা লেখার দিকে ঝোঁক কমাইতে বাধ্য হইলাম । প্রবন্ধ ও গল্প লিখিতে চেষ্টা করিলাম। একটা লাগিয়া গেল । বােধ হয় ১৯১২১৩ সালের কোনও এক সময়ে নেতৃস্থানীয় সাহিত্যিক-আলেমরা ‘আঞ্জুমনে ওলামায়ে বাঙ্গালা’ নামে একটি সমিতি গঠন করেন এবং তার মুখপত্র রূপে আল-এসলামনামে একটি মাসিকপত্র বাহির করেন। ১৯১৩ সালে এটা আমি প্রথম দেখি। মুসলমানদের নিজস্ব মাসিকপত্র বাহির হওয়ায় আমি উৎসাহিত হইয়া উঠিলাম। অনেক ভাবিয়া-চিন্তিয়া এই কাগজে কবিতা না পাঠাইয়া একটি প্রবন্ধ পাঠান স্থির করিলাম। কারণ, ভয় হইল যদি একবার এই কাগজের সম্পাদক আমার লেখা না-পছন্দ করিয়া বসেন, তবে পরে হাজার ভাল লেখাও তিনি ছাপিবেন না। হয়ত বা নাম দেখিয়াই লেখাটা ফেলিয়া দিবেন, পড়িয়াও দেখিবেন না। অতএব প্রবন্ধই পাঠাইতে হইবে। অনেক খাটিয়া-খুটিয়া একটি প্রবন্ধ পাঠাইলাম। প্রথম গুলিতেই শিকার পড়িল। প্রবন্ধ ছাপা হইয়া গেল। শুধু ছাপা হইল না। পরবর্তী লেখাটার জন্য সম্পাদক সাহেব তাকিদ-পত্র লিখিলেন। সেদিন আমার আনন্দ দেখে কে? বন্ধু-বান্ধবের কাছে, এমনকি মুরুব্বিদের কাছে, আমার কদর কত! কলিকাতায় প্রকাশিত মাসিক কাগজে নিজের নামসহ প্রবন্ধ ছাপা হইয়াছে। সারা গায় রােমাঞ্চ হইল। তা দুই-এক দিনে কাটিল না। নিজের প্রবন্ধটা অন্তত কুড়িবার এবং ছাপার হরফে নিজের নামটা অন্তত হাজার বার পড়িলাম। যতই দেখিতে লাগিলাম, ততই ভাল লাগিতে লাগিল।

৩. অনুবাদ
অথচ প্রবন্ধটা কোনও মৌলিক নিজস্ব লেখা নয়। ওয়াশিংটন আর্ভিং-এর। টেলস-অব আল-হামরা গ্রন্থের অংশবিশেষের অনুবাদমাত্র। কিন্তু সেটাও কম কৃতিত্বের বিষয় ছিল না। কারণ ঐ পুস্তকে বিষয়বস্তু ছিল স্পেনে মুসলিম স্থপতির বিশদ বর্ণনা। গ্রানাডা, কর্ডোভা, সেভিল ইত্যাদি স্পেনীয় প্রাচীন নগরীগুলিতে মুসলিম স্থপতির যেসব বিস্ময়কর নিদর্শন আছে, ঐ বইয়ে তার। নিখুঁত ও বিস্তৃত বিবরণ দেওয়া হইয়াছে। স্থপতি বিদ্যার বহু টেকনিক্যাল ইংরাজি শব্দ ঐ পুস্তকে দেদার ব্যবহার করা হইয়াছে। ঐ সব ইংরাজি শব্দের বাংলা শব্দ খুঁজিয়া পাওয়া কত কঠিন কাজ! কারণ অভিধান দেখিয়া শুধু
২৬৬
ইংরাজি শব্দের বাংলা অর্থ বাহির করিলেই চলিবে না। আমাদের দেশেও মুসলিম স্থপতিতেও ঐসব শব্দের টেকনিক্যাল প্রতিশব্দ আছে। কাজেই এটা এমনিতেই দুরূহ ব্যাপার। আমার মত পনের-ষােল বছর বয়সের ক্লাস সেভেন-এইটের ছাত্রের পক্ষে এটা ছিল আরাে কঠিন। তবু স্পষ্টতই আমার অনুবাদ ভাল হইয়াছিল। প্রমাণ, সম্পাদক সাহেব পরবর্তী প্রবন্ধের জন্য তাকিদ করিয়া পাঠাইয়াছেন। বাল্যের দুর্বলতা ও অহমিকাহেতু ঐ প্রবন্ধের কোথাও উহাকে অনুবাদ বলিয়া স্বীকার করা হয় নাই। ঐ বিশ্ববিখ্যাত গ্রন্থকারের নামও কোথাও উল্লেখ করা হয় না। স্পষ্টই বুঝা যায়, উহাকে মৌলিক প্রবন্ধ বলিয়া চালাইয়া দেওয়াই আমার অভিসন্ধি ছিল। নব্য সাহিত্যিক হিসাবে আমি যে ঐ কাজ করিয়া কত বড় রিস্ক নিয়াছিলাম, তা বুঝিবার মত বুদ্ধি ও বয়স তখনও আমার হয় নাই। আমি তখন জানিতাম না যে, নিজের মৌলিক প্রবন্ধরূপে না পাঠাইয়া ওয়াশিংটন আর্ভিং-এর অনুবাদরূপে চালাইলে তা সম্পাদক সাহেবের অধিক শ্রদ্ধা পাইত সুতরাং প্রবন্ধ ছাপা হওয়া এবং আমার নাম ছাপার হরফে বাহির হওয়া একরূপ নিশ্চিত ছিল। তা না করিয়া আমার মত অখ্যাতনামা নবীন লেখক তৃতীয়চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রের মৌলিক প্রবন্ধরূপে পাঠাইয়া আমি উহার ছাপা হওয়ার চান্সকে শতকরা নিরানব্বই ভাগ কমাইয়া দিয়াছিলাম। তাতেও যে উহা সম্পাদক সাহেবের কাঠোর পরীক্ষায় পাশ করিয়াছিল এইটাই ঐ প্রবন্ধের, তার ভাষার, সুতরাং আমার কৃতিত্বের বিষয়।

৪. আল-এসলাম
কিন্তু তবু আল-এসলাম-এ প্রথমে কবিতা পাঠানাের মত রিস্ক এটা ছিল না। সেটা আমি পরে বুঝিয়াছিলাম। আল-এসলাম-এ প্রথম লেখা পাঠাইবার সময় কবিতার বদলে প্রবন্ধ পাঠাইবার বুদ্ধি কে দিয়াছিল, তা মনে নাই। যতদূর মনে পড়ে বুদ্ধি কেউ দেয় নাই। কারণ কারাে বুদ্ধি চাই নাই। অবিবাহিত মেয়ের গর্ভপাত হওয়ার মতই নব্য-লেখকদের এ ধরনের ব্যাপার চরম গােপনীয় বিষয়। নিছক আল্লার মেহেরবানিতে নিজের মগজের ঢেউ’-এর জোরেই এ কাজ করিয়াছিলাম। এটা না করিয়া কবিতা পাঠাইলে কী হইত, সেটা বুঝিলাম কিছুদিন পরে। আঞ্জুমনে ওলামার অন্যতম নেতা, আল-এসলাম-এর ভারপ্রাপ্ত সহ-সম্পাদক ও মুদ্রাকর মৌ. মােযাফফর উদ্দিন আহমদ ময়মনসিংহ বেড়াইতে আসেন এবং আমার মত নগণ্য অচেনা লােককে খুঁজিয়া বাহির
২৬৭
করেন। সুপারের খাতিরে তিনি হােস্টেলে সরকারি মেহমান। তিনি সকলের সামনে আমার তারিফ করেন। এবং কথায় কথায় বলেন : “এই ছেলের যে বিশেষ গুণটায় আমরা এর সম্বন্ধে আশান্বিত হইয়াছি, সেটা এই যে, সাধারণ নব্য-লেখকদের মত সে কবি হওয়ার চেষ্টা করে নাই। নব্য-কবিদের জ্বালায়। শান্তিতে সম্পাদকতা করা অসম্ভব হইয়া পড়িয়াছে। কবিতার যে বস্তা আফিসে জমা হইয়াছে, তাই ঝটাইয়া ফেলিবার আমার লােকের অভাব। তার উপর কবিরা আফিসে গিয়া পর্যন্ত আমাকে ধাওয়া করে। আমার গা কাঁটা দিয়া উঠিল। গায়েবের মালিক আল্লাহকে মনে-মনে ধন্যবাদ দিলাম।
আল-এসলাম-এ গ্রানাডা-কর্ডোভার স্থপতি সম্বন্ধে কয়েকটা প্রবন্ধ বাহির হওয়ার পর ওদিককার প্রচেষ্টা বন্ধ হয়। এর পরে আমি ছােট-গল্প লেখায় মন দেই। এই সময় শরত্যাবুর পল্লী সমাজ পাঠ করি এবং ঐ একটি বই পড়িয়াই শরত্যাবুর ভক্ত হইয়া পড়ি। অতঃপর শরত্যাবুর বিভিন্ন বই পড়িয়া তার স্টাইল-এ এতই প্রভাবিত হই যে, পরবর্তীকালে শরত্যাবুর প্রভাব হইতে চেষ্টা করিয়াও মুক্তি লাভ করিতে পারি নাই।

৫. পিওর আর্টের বিতর্ক
১৯১৫ হইতে ১৯২০ সাল পর্যন্ত এই পাঁচ বছরে আমি বাংলা ও ইংরাজি সাহিত্যের কাব্য-উপন্যাসের বহুলাংশ পাঠ করিয়া ফেলি। বঙ্কিমচন্দ্র, মাইকেল, রমেশ দত্ত, নবীনচন্দ্র ও হেমচন্দ্রের বসুমতী-প্রকাশিত গ্রন্থাবলি এই সময় হইতেই প্রকাশিত হয়। সে জন্য এঁদের সব বই পড়া তখন খুবই সহজসাধ্য ছিল। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, ডা. নরেশ সেন, নারায়ণ ভট্টাচার্য প্রভৃতির সামাজিক নভেল এবং দীনেন্দ্র কুমার রায় ও পাঁচকড়ি দে প্রভৃতির ডিটেকটিভ নভেল পৃথকভাবে হয় নিজের কিনিতে, নয় ত বন্ধু-বান্ধবকে দিয়া কিনাইতে হইত, অথবা স্কুল-কলেজ, লাইব্রেরি ও পাঠাগার হইতে সংগ্রহ করিতে হইত। প্রাইভেট পাঠাগারের মধ্যে এই সময় ঢাকাস্থিত সারস্বত সমাজের লাইব্রেরিটি উল্লেখযােগ্য। এতে অনেক বই পাওয়া যাইত। বাবু পূর্ণচন্দ্র ভট্টাচার্য নামক এক ভদ্রলােক এই সময় ঐ লাইব্রেরির লাইব্রেরিয়ান। ছিলেন। তিনি আমাকে পঠিতব্য পুস্তক নির্বাচনে অনেক সাহায্য করিয়াছেন। কলেজ লাইব্রেরি হইতে এই সময় হল কেইন, মেরি কোরেলি, স্কট, জর্জ ইলিয়ট, টমাস হার্ডি, গেলসওয়ার্দি, টলস্টয়, ভিক্টর হিউগাে, টুর্গেনিভ ও ডস্টয়ভস্কির নামকরা সব পুস্তক পড়িয়া ফেলি।
২৬৮
এই সময় বাংলা মাসিক পত্রিকাগুলিতে আর্ট ফর আর্টস সেক’ এই প্রশ্ন লইয়া বাদ-বিতণ্ডার ঝড় বইতে ছিল। নাম-করা পণ্ডিত লােকদের প্রায় সবাই। এই বিতর্কে যােগ দিয়াছিলেন। এই সব প্রবন্ধ আমি প্রবল আগ্রহ লইয়া পড়িলাম। কিন্তু সে বিতণ্ডায় আমি কোনও আলাে পাইলাম না।
মাঝখান হইতে এইসব তর্ক-বিতর্কে আমার নিজস্ব একটা মতবাদ গড়িয়া উঠিল। আমার মত নগণ্য তরুণ যুবকের মনােভাবকে মতবাদ বলা ঠিক হয় না। তবু নিজের কথাটা বলিবার আগ্রহ আমার দুর্নিবার হইয়া উঠে। কথাটা ঠিক পজিটিভ কোনও মতবাদ নয়। একটা নিগেটিভ অ্যাটিচুড মাত্র। শরবাবুর বই পড়িবার জন্য আমার মধ্যে একেবারে রাক্ষসী ক্ষুধা ছিল। তাঁর বই আমাকে একেবারে সম্মােহিত করিয়া রাখিত। তবু শরবাবুর পল্লী সমাজ বাদে আর সমস্ত বইয়ের বিরুদ্ধে আমার একটা গােপন বিদ্রোহ ছিল। এ যেন মদখােরের মদ-নিন্দা। মদখােরেরা বন্ধুদের মজলিসে বসিয়া মদ খাওয়ার নিন্দায় সককে ছাড়াইয়া যায় । কিন্তু মদের বােতল দেখিলেই সব কথা ভুলিয়া যায় এবং গােগ্রাসে বােতলকে-বােতল গিলিয়া ফেলে। আমার বিবেচনায় শরৎবাবুর এই গুণটাই ছিল দোষ । রবীন্দ্রনাথের গল্প-উপন্যাস সম্বন্ধেও আমার এই একই রকম অ্যাটিচুড ছিল। একমাত্র গােরা সম্বন্ধেই আমার ধারণা ছিল অন্যরূপ। এটাকে আমি রবিবাবুর শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ বলিতাম। কেন বলিতাম, সে কথা কাউকে বুঝাইতে পারিতাম না। ঠিক তেমনি টলস্টয়, টুর্গেনিভ ও ডস্টয়ভস্কির পুস্তকগুলিকে আমি আদর্শ উপন্যাস বলিতাম। কিন্তু সেগুলি কেন আদর্শ নভেল, তা বুঝাইতে পারিতাম না। ইংরাজি নভেলিস্টদের মধ্যে একমাত্র হল কেইনকেই আমি শ্রেষ্ঠ বলিতাম। ফরাসি নভেলিস্টদের মধ্যে আমি ভিক্টর হিউগােকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ নভেলিস্ট বলিতাম। তাঁর লা মিজারেবলস ও লাফিং ম্যানকে আমি মহাকাব্যের অনুকরণে মহা-উপন্যাস বলিতাম।
কিন্তু একমাত্র রাশিয়ান নভেলগুলিকেই আমি আদর্শ নভেল বলতাম। কিসের জন্য, কী কারণে, ওগুলি আদর্শ নভেল বন্ধু-বান্ধবের এই প্রশ্নের কোনও জবাব দিতে পারিতাম না। কিন্তু নিজে-নিজে চিন্তা করতাম। এই চিন্তার ফল ১৯২২ সালে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত আমার ‘গােলামী সাহিত্য’ নামক প্রবন্ধ। এই প্রবন্ধটা বর্তমানে আমার সামনে নাই। অনেক তালাশ করিয়াও যােগাড় করিতে পারিলাম না। তাই কোন যুক্তিতে কী বলিয়াছিলাম, তা বলিতে পারিব না। কিন্তু ওতে আমার প্রতিপাদ্য ছিল যা সে কথাটা আমার মনে আছে। আমি ঐ প্রবন্ধে বলিতে চাহিয়াছিলাম যে বাংলা সাহিত্যের দিকপাল শিল্পীরা যে সাহিত্য সৃষ্টি করিতেছেন, সেটা বাঙ্গালীর
২৬৯
সত্যিকার জীবনালেখ্য নয়; এটা গােলাম বাংলার সাহিত্য। কাজেই গােলামী সাহিত্য। এঁদের সৃষ্ট আর্ট শুধু আর্টেরই জন্য, জীবনের জন্য নয়। আমার মতে আর্ট আর্টের জন্য নয়, আর্ট মানুষের জীবনের জন্য। যে আট মানুষের। উপকারে আসিল না, সেটা সুন্দর নয়, অসুন্দর। আমি তাতে বলিয়াছিলাম আমাদের শিল্পীরা ধানক্ষেত কাটিয়া সেখানে ফুলের বাগিচা করিতেছেন। এই প্রবন্ধে আমি রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্রকে কঠোর ভাষায় নিন্দা করিয়াছিলাম। তাতে সাহিত্যিক মহলে বেয়াদবির জন্য আমার যথেষ্ট নিন্দা হইয়াছিল। বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক ভােলার কবি মােজাম্মেল হক সাহেব আমাকে বলিয়াছিলেন যে, আমার ঐ প্রবন্ধ ছাপার জন্য কলিকাতার সাহিত্যিকরা তাঁকে তিরস্কার করিতেছেন। এত প্রতিবাদ ও নিন্দার মধ্যে আমি একটা সান্তনা পাইয়াছিলাম বরিশাল হইতে প্রকাশিত বরিশাল হিতৈষীনামক একটি সাপ্তাহিক কাগজে দীর্ঘ সম্পাদকীয় প্রবন্ধে আমার ঐ প্রবন্ধের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা এবং আমার সমালােচকদের নিন্দা করা হইয়াছিল।
আমি শরৎবাবুর যতই বিরােধী হই না কেন, তার প্রভাবমুক্ত হইতে পারিলাম না। তাঁর অনুকরণে অনেকগুলি গল্প লিখিয়া ফেলিলাম। ঐ সব গল্পই সওগাত-এ ছাপা হইয়াছে। ঐগুলি লেখার সময় আমি মাত্র আইএ পড়ি, অথবা সবেমাত্র আইএ পাশ করিয়াছি। সওগাত-এর সম্পাদক নাসিরউদ্দীন সাহেব শুধু মাসের পর মাস আমার গল্পই ছাপিতেন না, আমাকে উৎসাহ দিয়া পত্রও লিখিতেন। সেই হইতে নাসিরউদ্দীন সাহেব ও তাঁর সওগাত-এর সাথে আমার ব্যক্তিগত ও সাহিত্যিক জীবন ওতপ্রােতভাবে জড়িত হইয়া যায়। এ সম্পর্কের মধুরতা এই বৃদ্ধ বয়সেও অটুট রহিয়াছে।

৬. সাহিত্যিকদের সাথে প্রথম পরিচয়
আমি ১৯২২ সালের মাঝামাঝি বােধহয় জুলাই মাসে খিলাফত কমিটির সভায় যােগ দিতে প্রথম কলিকাতা যাই। কিছুদিন আগে শামসুদ্দীন কলিকাতা গিয়াছেন। তিনি মুসলিম জগত নামক সাপ্তাহিক কাগজের সম্পাদকতা করেন। তিনি ছাত্রজীবনের দুই বছরও কলিকাতায় কাটাইয়াছেন। সুতরাং কলিকাতার ব্যাপারে তিনি আমার বিবেচনায় একজন এক্সপার্ট। আর আমি আনাড়ি, একদম বাঙ্গাল। কাজেই আগে হইতে তাঁকে চিঠি লিখিয়া জানাইলাম। তিনি শিয়ালদহ স্টেশন হইতে আমাকে নিয়া গেলেন। আমি তার মেহমান হইলাম। যাকারিয়া স্ট্রিট ও চিৎপুরের মােড়ের একটি বাড়িতে
২৭০
খিলাফত আফিস। সেখানেও শামসুদ্দীনই আমাকে পৌছাইয়া দিলেন। কলিকাতা এত ভাল লাগিল যে খিলাফত কমিটির সভার কাজ শেষ হইবার পরও কলিকাতা ছাড়িতে মন চাহিল না। স্বরাজ ও খিলাফত দুই আন্দোলনেই তখন মন্দা পড়িয়া গিয়াছে। কাজেই নিজের গ্রামে বা জিলায় চাঞ্চল্যকর কিছু করিবারও নাই। শহরের জাতীয় বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করিয়া যা কিছু পাই, তাতে পকেট খরচা ও খাওয়াই চলে না। কাজেই কলিকাতায় কোনও কাজের যােগাড় করা যায় কি না দুই বন্ধুতে সে চিন্তা করিতে লাগিলাম।
একদিন শামসুদ্দীন বলিলেন, কলেজ স্ট্রিটে সাহিত্য-সমিতির সভা আছে। আমাকে যাইতে হইবে। তিনি অন্য মেম্বরদেরে কথা দিয়া আসিয়াছিলেন । আল-এসলাম, সওগাত, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায় গল্প-প্রবন্ধ লিখিয়া আমি তখন সাহিত্যিক সমাজে কতকটা পরিচিত হইয়াছি। কাজেই শামসুদ্দীন বলিলেন সবাই আমাকে দেখিতে চান। ইতিমধ্যে পথে-ঘাটে সমিতির সম্পাদক কবি মােজাম্মেল হক (ভােলা) ও সহকারী সম্পাদক মােযাফফর আহমদ সাহেবের সঙ্গে পরিচয় হইয়াছিল। শামসুদ্দীন তাঁদেরও দোহাই দিলেন। সবচেয়ে আকর্ষণীয় কথা বলিলেন, কাজী নজরুল ইসলাম আজকার। সভায় উপস্থিত থাকিবেন। দু-এক দিনের মধ্যে তিনি ধূমকেতু নামে সাপ্তাহিক বাহির করিবেন।
যথাসময়ে সভায় গেলাম। অনেক নাম-শােনা চোখে-না-দেখা কবিসাহিত্যিকের দেখা পাইলাম। শামসুদ্দীন সভার মধ্যে আমাকে ফরমালী পরিচিত করিতে গিয়া আমার প্রতিভার, লেখার ও রসিকতার অনেক তারিফ করিয়া শেষে বলিলেন : ‘কিন্তু এ ব্যাপারে আপনাদিগকে সাবধান করিয়া দিতেছি। আমার এই বন্ধু যে সব কথা বলিবেন, তার বার আনা বাদ দিয়া মাত্র চার আনা বিশ্বাস করিবেন। আমার প্রতি এই আক্রমণ সকলে উচ্চ হাসিতে উপভােগ করিলেন। আমিও অগত্যা সে হাসিতে যােগ দিলাম। সকলের শেষে আমার জবাবের পালা। তারিফের উত্তরে ততােধিক তারিফ করিয়া বিনয়ের উত্তরে সর্বাধিক বিনয় দেখাইয়া উপসংহারে বলিলাম : বন্ধুবর শামসুদ্দীন আমার কথার বার আনা বাদ দিয়া মাত্র চার আনা বিশ্বাস করিবার উপদেশ দিয়াছেন। সরলভাবে আমি স্বীকার করিতেছি যে, তাতেও আমার দুই আনা নেট মুনাফা থাকিবে।
হাসির হুল্লোড় পড়িয়া গেল। সবার সমবেত উচ্চ-হাসি তলাইয়া দিয়া ছাদফাটা হাসি হাসিলেন যিনি তিনি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি আসন ছাড়িয়া রসিক বটে, এমনটি আর দেখি নাই বলিতে-বলিতে আমাকে
২৭১
হাবিলদারের সমস্ত শক্তি দিয়া জড়াইয়া ধরিলেন। অন্তরে-অন্তরে আমাদের পরিচয় হইয়া গেল।
সাংবাদিক জগতে প্রবেশ করার জন্য কিছু-কিছু প্রাথমিক কোদাল-কাম করিয়া সেবারের মত ফিরিয়া আসিলাম। পরে আরাে কয়বার গিয়া পাকাভাবে গেলাম ১৯২৩-এর মার্চ-এপ্রিলে। সেবারও আবুল কালাম শামসুদ্দীনেরই মেহমান হইলাম। মেহমানদারির বদলা তাঁর সম্পাদিত মুসলিম জগত-এ কিছু-কিছু লেখা দেওয়া আমার কর্তব্য এবং সুযােগ মনে করিলাম। এইভাবে আমি ছহি বড় তৈয়ব নামা’ নামে একখানা স্যাটায়ার কাব্য এবং সভ্যতায় দ্বৈতশাসন’ নামে একটি বড় প্রবন্ধ লিখিলাম। ছহি বড় তৈয়ব নামা’ মশহুর পুঁথি ছহি বড় সােনাভানের অনুকরণে একটি রাজনৈতিক প্যারডি-স্যাটায়ার। আমার রাজনৈতিক সহকর্মী খেলাফত নেতা শ্রদ্ধেয় মৌলবী তৈয়ব উদ্দিন আহমদ দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের স্বরাজ দলের একজন আইন সদস্য। তিনি অন্যতম মন্ত্রী স্যার আবদুল করিম গযনবীর খাতির এড়াইতে না পারিয়া। সরকার পক্ষে একটি ভােট দিয়া দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেন। তার এই কাজের নিন্দায় আমি এই স্যাটায়ারটি লিখি। স্যাটায়ার লেখায় এই আমার প্রথম উদ্যম। মুসলিম জগত-এ এটি বাহির হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কলিকাতার সাহিত্যিক মহলে বিশেষত মুসলিম সাহিত্যিক মহলে আমার সুনাম হয়। আমি খুবই উৎসাহবােধ করি। সভ্যতায় দ্বৈতশাসন’ রাজনৈতিক দার্শনিক দীর্ঘ প্রবন্ধ । ইহা কয়েক মাস কাল ধরিয়া মুসলিম জগত-এ ধারাবাহিক প্রকাশিত হয়। এই সময়ে ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনে যে কিছু আংশিক স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হইয়াছিল, কংগ্রেস-খিলাফত নেতারা উহাকে ডায়ার্কি বা দ্বৈতশাসন’ বলিতেন। কাজেই আমরা তখন দ্বৈতশাসনকে খুব খারাপ জিনিস মনে করিতাম। আমি এই প্রবন্ধে প্রমাণ করিবার চেষ্টা করিয়াছিলাম, ইংরাজের-দেওয়া শাসন-ব্যবস্থাটাই শুধু দ্বৈতশাসন নয়, ইংরাজি সুতরাং গােটা ইউরােপীয় সভ্যতাটাই আসলে দ্বৈতশাসন। কাজেই ইংরাজ সাম্রাজ্যবাদীরা যে আমাদের ঘাড়ে রাজনৈতিক দ্বৈতশাসন চাপাইবার চেষ্টা করিতেছেন, এটা কোনও বিচ্ছিন্ন আকস্মিক ব্যাপার নয়। তাদের সভ্যতার এটা অংশ মাত্র। ছহি বড় তৈয়ব নামা’ বা ‘সভ্যতায় দ্বৈতশাসন’ কোনটারই কপি বর্তমানে আমার কাছে নাই। কাজেই এত বড় বিষয়ে আমার মত সাধারণ যুবক কী লিখিয়াছিলাম, আজ তা বলিতে বা বুঝিতে পারিতেছি না। যতদূর স্মরণ পড়ে, ঐ প্রসঙ্গে আমি বলিবার চেষ্টা করিয়াছিলাম যে পাশ্চাত্য সভ্যতা দু’মুখা সভ্যতা। এ সভ্যতা মুখে-মনে এক কথা বলে না। যা শিখায় তা করায় না।
২৭২
আমার আরাে মনে পড়ে যে তত্ত্বালে মহাত্মা গান্ধীর ইয়ং ইন্ডিয়া এবং রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধাবলি পড়িয়া আমি খুবই প্রভাবিত হইয়াছিলাম। তাদেরই ভাবকে নিজের ভাব মনে করিয়া ছােটমুখে বড় বড় কথা বলিয়াছিলাম। নিজে ঐ সব কথা বলিতে পারিয়া আমি এতটা গর্ব বােধ করিয়াছিলাম যে, গােটা প্রবন্ধের কাটিংগুলি একত্রে গাঁথিয়া আমার দর্শনের অধ্যাপক (তৎকালে ভাইস চ্যান্সেলার) ডা. ল্যাংলির কাছে ঢাকা পাঠাইয়াছিলাম এবং সঙ্গীয় পত্রে তাঁকে সসম্মানে অনুরােধ করিয়াছিলাম, তিনি যেন কাউকে দিয়া উহার অনুবাদ করাইয়া পড়িয়া দেখেন। ল্যাংলি সাহেব ধর্মপ্রাণ খৃষ্টান ছিলেন। কয়েক মাস পরে তিনি একখানা স্নেহপূর্ণ সংক্ষিপ্ত পত্রে জানাইয়াছিলেন, যে আমার প্রবন্ধটা তার ভাল লাগিয়াছে। লেখক হিসাবে আমার সাফল্যের জন্য তিনি দোওয়া করিতেছেন।

৭. প্রথম বইয়ের কপিরাইট
আমি ১৯২২ সালের মাঝামাঝি খুব সম্ভব জুলাই মাসে প্রথম কলিকাতায় যাই। ঐ বছর মাঝে-মাঝে এবং ১৯২৩ সাল হইতে একটানা প্রায় আট বছর কলিকাতা থাকি এবং সংবাদপত্রের সেবা করি। আমার সাংবাদিক জীবন অন্য খণ্ডে বর্ণনা করিব। এখানে শুধু সাহিত্যিক জীবনের কথাটুকুই বলিতেছি। ১৯২৪-২৫ সালে আমি যখন সাপ্তাহিক মােহাম্মদীতে সহকারী সম্পাদকের কাজ করিতাম, তখন আমার বেতন ছিল মাত্র পঞ্চাশ টাকা। এই টাকায় তৎকালে সচ্ছলে আমার চলিয়া যাইত। কিন্তু কিছু সঞ্চয় করিতে পারিতাম না। এই সময় কতকটা উপরি আয়ের আশায় কতকটা গ্রন্থকার হইবার শখে, ছেলেদের উপযােগী করিয়া কাছাছুল আম্বিয়ার কতকগুলি গল্প লইয়া একটি বই লিখিলাম। তার নাম রাখিলাম মুসলমানী উপকথা। বই লেখা সমাপ্ত করিয়া উহা প্রকাশের জন্য প্রকাশক ও ছাপাখানার সঙ্গে দেন-দরবার করিতেছি, এমন সময় বাড়ি হইতে বাপজী জানাইলেন, শত খানেক টাকার জন্য তিনি একটা কাজে ঠেকিয়াছেন। ঐ পরিমাণ টাকা যােগাড় করা আমার দ্বারা সম্ভব হইলে তাঁর খুবই উপকার হয়। ছেলের কাছে বাপের টাকার চাওয়ার এর চেয়ে মােলায়েম ভাষা আর হইতে পারে না। কিন্তু আমি বুঝিলাম নেহাত নিরুপায় না হইলে বাপজী আমার নিকট টাকা চাহিতেন না। কিন্তু একশ টাকা যােগাড় করা তৎকালে আমাদের মত পঞ্চাশ টাকার সাংবাদিকের পক্ষে কল্পনাতীত ব্যাপার ছিল। কাজেই ঠিক করিলাম, আমার জীবনের প্রথম
২৭৩
বই মুসলমানী উপকথার কপিরাইট বিক্রয় করিব। কপিরাইট যদি বিক্রয় করিতেই হয়, তবে যার নিমক খাই, তাঁর কাছেই প্রথম যাচাই করা দরকার। কারণ তাঁদেরও ‘মােহাম্মদী বুক এজেন্সী’ নামক প্রকাশকের ব্যবসা ছিল। কাজেই আমার তৎকালীন মনিব মওলানা মােহাম্মদ আকরম খাঁ ও তাঁর জ্যেষ্ঠ। পুত্র মৌলবী খায়রুল আনাম খাঁর নিকট প্রস্তাব দিলাম। তারা ছয়শত টাকার বেশি দিতে চাহিলেন না। অন্যত্র বেশি দাম পাইলে সেখানে কপিরাইট বিক্রয় করিতে তাদের আপত্তি নাই বলিয়া দিলেন। এই সঙ্গে মাওলানা সাহেব বইটির নামের মধ্য হইতে ‘উপ’ কথাটা বাদ দিয়া শুধু মুসলমানী কথা নাম রাখিবার উপদেশ দিলেন। এ উপদেশ আমার পছন্দ হইল। ডা. দীনেশ চন্দ্র সেনের রামায়ণী কথার অনুকরণে আমার বইয়ের নাম রাখিলাম মুসলমানী কথা।
বেশি দামের সন্ধানে ঘুরিতে-ঘুরিতে অবশেষে এগারশ টাকা কপিরাইট বিক্রয় করিতে সমর্থ হইলাম। খরিদ্দার বিখ্যাত প্রকাশক ও পুস্তক বিক্রেতা ভট্টাচার্য্য এন্ড সন্স। যথাসময়ে পাণ্ডুলিপি তাঁদের হাতে দিয়া এক শ টাকা অগ্রিম লইলাম। বাকি হাজার টাকা পুস্তক ছাপা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাইব, কথা স্থির হইল । ছাপা হওয়ার সময় প্রথম প্রুফটা আমি দেখিয়া দিতে ওয়াদা করিয়াছিলাম। তাই বােধ হয় অভিজ্ঞ ব্যবসায়ী ভট্টাচার্য্য মহাশয় বাকি টাকা দেওয়ার ঐরূপ শর্ত করিয়াছিলেন। আমার তাতে মােটেই আপত্তি ছিল না। কারণ প্রথমত বাড়িতে পাঠাইবার মত টাকা আমি পাইয়াছি; এখন আমার আর টাকার প্রয়ােজন নাই। দ্বিতীয়ত নিজের প্রথম বইটায় ছাপার ভুল না থাকে, সে বিষয়ে আমার আগ্রহ প্রকাশকের আগ্রহের চেয়ে কম ছিল না।
ইতিমধ্যে ভট্টাচার্য্য এন্ড সন্স রঙ্গিন কালিতে বড় বড় হরফে বর্ডারসহ বই ছাপিবার জন্য ব্লকাদি করিয়া ফেলিলেন। একটা সম্পূর্ণ নূতন ধরনের চমৎকার শিশুপাঠ্য পুস্তক বাহির হইতেছে বলিয়া বিজ্ঞাপন বাহির হইল। সঙ্গে সঙ্গে আমার নামও প্রকাশ হইল। ভট্টাচাৰ্য্য এন্ড সন্সের এই সময়ে শিশু সাথী নামে একটি সুন্দর শিশু মাসিক ছিল। এই শিশু মাসিকে ‘কারুনের ধন’ নামক মুসা ও কারুনের গল্পটি ছাপা হইয়া গেল। কলিকাতার সাহিত্যিক সমাজে গল্পটির যথেষ্ট সমাদর হইল । আমার আনন্দ আর ধরে না। ঐ বইয়ে আমার কোনও স্বত্ব নাই। ওটা লাখ লাখ কপি বিক্রয় হইলেও তাতে আমার এক পয়সা লাভ হইবে না। এসব কোনও কথাই আমার আনন্দে বিঘ্ন ঘটাইতে পারিল না।
২৭৪
৮. আরবি-ফারসি বনাম
বাংলা শব্দ কয়েক দিন পরই ভট্টাচার্য্য এন্ড সন্সের মালিক আমাকে নিবার জন্য লােক ও গাড়ি পাঠাইলেন। আমি তাঁদের কর্নওয়ালিস স্ট্রিটস্থ দোকানে গেলাম। কুশলমন্দ জিজ্ঞাসা ও চা’র অর্ডার ইত্যাদি প্রাথমিক ভদ্রতার পরই আমার বইয়ের কথা তুলিলেন। বই খুব জনপ্রিয় হইবে, গল্প ও ভাষা খুবই চমৎকার, ইত্যাদি কয়েক কথার পরেই তিনি বলিলেন : ‘কিন্তু বই-এ অনেক আরবি-ফারসি শব্দ আছে। এইগুলির ফুটনােট দিতে হইবে।’ ভট্টাচাৰ্য মহাশয়ের কথা আমার পছন্দ হইল না । কিন্তু ভদ্রলােকের সঙ্গে তর্ক করা যায় না, কারণ হাজার টাকা এখনাে বাকি। কাজেই খুব সাবধানে অতি মােলায়েম ভাষায় যুক্তি ও দৃষ্টান্ত দিয়া বলিলাম যে অমন সুন্দর রঙ্গিন কালির ছাপ শিশুপাঠ্য বইয়ে ফুটনােট একেবারে বেমানান হইবে। বইয়ের সৌন্দর্য একদম নষ্ট হইয়া যাইবে।
ভদ্রলােক আমার যুক্তি মানিয়া লইলেন। কিন্তু ফুটনােটের বদলে ‘পরিশিষ্টে’ শব্দার্থ দিতে বলিলেন। পরিশিষ্টের বিরুদ্ধে খানিকক্ষণ এটা-ওটা যুক্তি দিয়া শেষ পর্যন্ত আসল যুক্তিটা বাহির করিলাম। বলিলাম : আমার বইয়ে কোনও আরবি-ফারসি শব্দ নাই। সবই বাংলা শব্দ। কাজেই পরিশিষ্টে শব্দার্থ দেওয়ার দরকার নাই।
ভদ্রলােককে বুঝাইবার জন্য বলিলাম যে ঐসব শব্দের উৎপত্তি আরবিফারসি ভাষা হইতে হইয়াছে বটে, কিন্তু যুগ-যুগান্তর ধরিয়া বাংলার জনসাধারণ ঐ সব শব্দ তাদের দৈনন্দিন কাজে ব্যবহার করায় ও-সবই বাংলা হইয়া গিয়াছে। বলিলাম : যেসব শব্দ তিন বছরের নিরক্ষর বাঙ্গালী শিশু বুঝিতে ও বলিতে পারে, মূল যা-ই হােক, যেসব শব্দই বাংলা। দৃষ্টান্ত দিলাম ‘জংগল’ ও ‘জানালা দিয়া। দুইটাই ওলন্দাজ শব্দ। কিন্তু আমাদের দেশের। মাটিতে উহারা এমন মিশিয়া গিয়াছে যে ও-গুলির বাংলা প্রতিশব্দ খুঁজিয়া বাহির করার কল্পনাও কেউ করে না।
ভদ্রলােক আমার কথায় বিরক্ত হইয়া বলিলেন : আমাকে ভাষা-বিজ্ঞান। শিখাইবার চেষ্টা করিবেন না। আমি ব্যবসায়ী মানুষ। আমার বই বিক্রয় দিয়া। কথা। ঐ সব শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ না দিলে হিন্দুরা বুঝিতে পারিবে না। মুসলমানরা ঐসব শব্দ ব্যবহার করিলেও হিন্দুরা করে না।
আমি যখন ভদ্রলােককে বলিলাম যে হিন্দুরা ও-সব শব্দ সাধারণত ব্যবহার না করিলেও তারা সকলেই বুঝিতে পারে, তখন ভদ্রলােক ধৈর্য। হারাইয়া বলেন যে তবু ওগুলি আরবি-ফারসি শব্দ, বাংলা শব্দ নয়।
২৭৫
আমিও রাগ করিয়া প্রশ্ন করিলাম : শতকরা ছাপ্পান্ন জন বাঙ্গালীর মুখের ভাষাকে আপনি বাংলা স্বীকার করেন। ? দেশের দুর্ভাগ্য!
আমি তখন পুরা কংগ্রেসি। মাথা হইতে পা পর্যন্ত মােটা খদ্দর। তিনি নূতন করিয়া আমার পােশাকের দিকে চাহিয়া বলিলেন : দেখুন, আমি ব্যবসায়ী। আপনার সাথে আমি দেশের ভাগ্য লইয়া তর্ক করিতে চাই না। আমার শুধু জানা দরকার আপনি ঐ সব শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ দিবেন কি দিবেন না?
ভদ্রলােকের সুরে অশুভ ইঙ্গিত ফুটিয়া উঠিল। আমি অপেক্ষাকৃত নরম হইয়া বলিলাম : আমাকে ব্যাপারটা বুঝিতে দেন। আপনি কী বলিতে চান, পরিশিষ্টে ‘পানি’ অর্থ জল’, ‘আল্লাহ’ অর্থ ‘ঈশ্বর’, ‘রােযা’ অর্থ উপবাস’, এইভাবে ওয়ার্ড বুকের মত শব্দার্থ লিখিয়া দিতে হইবে?
আমি অনেকটা নরম হইয়াছি মনে করিয়া ভদ্রলােক খুশি হইলেন। বিনীতভাবে বলিলেন : আজ্ঞে হাঁ, ঠিক ধরিয়াছেন।
আমি : তা হইলে আমাকে স্বীকার করিতে হইবে যে পানি, আল্লাহ, নামাজ, রােযা এসব শব্দ বাংলা নয়? জল, ঈশ্বর, উপাসনা ও উপবাসই বাংলা শব্দ?
ভদ্রলােক একটু ভাবিয়া বলিলেন : না, তা কেন? বাংলা শব্দেরও কি বাংলা প্রতিশব্দ থাকে না? ঈশ্বর অর্থ ভগবান, জল অর্থ বারি, এসব কথা কি আমরা বলি না?
আমি বলিলাম : ঠিক আছে। আপনার কথাই মানিয়া লইলাম। ঐ সব শব্দের প্রতিশব্দ আমি লিখিয়া দিব। কিন্তু এক শর্তে।
ভদ্রলােক খুশিতে হাসিতে যাইতেছিলেন। অকস্মাৎ মুখের হাসির বদলে চোখে কৌতূহল দেখা দিল। বলিলেন : কী শর্ত?
আমি : আপনি বহু হিন্দু গ্রন্থকারের বইয়ের প্রকাশক। তাঁদেরে ডাকিয়া রাজি করুন : তাঁদের বইয়ের পরিশিষ্টের শব্দার্থে ঈশ্বর অর্থ আল্লাহ, জল অর্থ পানি, উপবাস অর্থ রােযা; ইত্যাদি যােগ করিবেন। এতে রাজি আছেন আপনি?

৯. প্রথম স্যাক্রিফাইস
ভদ্রলােক রাগে ফাটিয়া পড়িলেন। এর পর যা কথাবার্তা হইল তার খুব স্বাভাবিক পরিণতি হইল আমার জন্য খুব খারাপ। ভদ্রলােক স্পষ্ট বলিয়া দিলেন, আমার সাথে তার চুক্তি বাতিল। তিনি কপিরাইট কিনিলেন না। ব্লক
২৭৬
তৈয়ার করিতে তাঁর যে হাজার খানেক টাকা খরচ হইয়া গিয়াছে, তা তিনি আমার কাছে দাবি করিলেন না। আমার অগ্রিম নেওয়া একশত টাকা ফেরৎ দিয়া যে-কোনও দিন আমি পাণ্ডুলিপি ফেরৎ নিতে পারি বলিয়া ভদ্রলােক। চেয়ার ছাড়িয়া উঠিয়া পড়িলেন। অগত্যা আমিও উঠিলাম। আদাব’ বলিয়া বাহির হইলাম। প্রায় চৌকাঠ পার হইয়াছি এমন সময় ভদ্রলােক ডাকিয়া বলিলেন : মনসুর সাহেব, আপনি রাগিয়া গিয়াছেন। আবার ভাবিয়া দেখুন। পরিশিষ্ট দিতে রাজি হইলে এখনও আপনার বই নিতে পারি।’
কিন্তু এ কথার যে জবাব আমি দিতে চাহিলাম, তা পারিলাম না। তার বদলে কে যেন আমার মুখ দিয়া বাহির করিয়া দিল : ভট্টাচাৰ্য মশায়, আপনি রাগিয়া গিয়াছেন। আবার ভাবিয়া দেখুন। পরিশিষ্ট ছাড়া বই ছাপিতে রাজি হইলে এখনও আপনাকে বই দিতে পারি।
ব্যবহারের প্রতিবিম্বরূপে ব্যবহার করা, আর কথার প্রতিধ্বনি রূপে কথা কওয়ার সেই পুরাতন বদভ্যাস! আমি কিছুতেই এই অভ্যাসের হাত হইতে রেহাই পাইলাম না।
গিয়াছিলাম মােটরে। ফিরিতে হইবে ট্রামে। ফুটপাথ ধরিয়া ট্রামস্টপে যাইতে, ট্রামের জন্য অপেক্ষা করিতে এবং ট্রামে চড়িয়া শিয়ালদহে মােহাম্মদী আফিসে আসিতে শুধু একটা কথাই আমার মাথায় কিলবিল করিতে থাকিল : এটা কী করিলাম? এক হাজার টাকা হারাইলাম একটা জিদের বশে? হাজার টাকা ত গেল, আবার আগাম-নেওয়া টাকাটাও ত ফেরৎ দিতে হইবে। এগারশ টাকার সব গেল? মনে হইল, বাদশাহী তখৃত। হারাইয়া পথের ফকির হইলাম। বস্তুত, তকালে আমার জন্য এগারশ টাকাই ছিল বিপুল সম্পদ। মাসে চল্লিশ হাজার টাকার আইন ব্যবসায় ছাড়িয়া দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন অসহযােগ আন্দোলনে যােগ দেওয়ায় একদা ঐ মহাপুরুষের উদ্দেশ্যে মাথা নত করিয়া আমিও অসহযােগ আন্দোলনে যােগ দিয়াছিলাম। আজ মনে হইল আমার এই এগারশ টাকা ত্যাগ দেশবন্ধুর ত্যাগের চেয়েও বড়। কারণ দেশবন্ধু ঐ ত্যাগের পরেও সুখে-সম্মানে। বাঁচিয়া আছেন। কিন্তু আমার এই ত্যাগে সুখ-সম্মান ত দূরের কথা, একশ টাকা ফেরৎ না দিলে ত আমাকে চরম অপমান হইতে হইবে। কী দরকার ছিল জিদ করিবার? দিলেই ত হইত একটা পরিশিষ্ট লিখিয়া। বইটায় ত আমার কোনও স্বত্বাধিকার থাকিত না। কাজেই তার ভুলত্রুটির জন্য আমাকে কেউ দোষও দিত না, তবে কি ভুল করিলাম?
কিন্তু মুহূর্তেই জবাব পাইলাম। আমার সারা অস্তিত্ব এক সঙ্গে হুংকার
২৭৭
দিয়া উঠিল : না না, ভুল করি নাই। আমার আত্মসম্মানবােধ ঝাকি মারিয়া মাথা তুলিয়া বুক টান করিয়া বলিল : ঠিক করিয়াছি। বাংলার মেজরিটি মুসলমানের মুখের ভাষাকে বাংলা ভাষা বলিয়া স্বীকার করিল না বাংলার মাইনরিটি হিন্দুরা? এ অবস্থা চলিতে থাকিলে মুসলমানের ত ভাল হইবেই না, সারাদেশের, সুতরাং হিন্দুরও ভাল হইবে না। কাজেই এটা বন্ধ করিতেই হইবে। হিন্দুদের বর্তমান মতিগতিতে কাজটা খুবই কঠিন। কাজেই স্যাক্রিফাইস দরকার। আমার মত গরীবের পক্ষে এগারশ টাকা স্যাক্রিফাইস খুব বড় ত্যাগ বটে, কিন্তু উদ্দেশ্যের তুলনায় এ ত্যাগ খুবই সামান্য। হয়ত এর চেয়েও বড় ত্যাগ করিতে হইবে। মনে সান্ত্বনা পাইলাম । আফিসে ফিরিয়া খায়রুল আনাম খাঁ সাহেবকে সব বলিলাম। তিনি দয়া করিয়া পূর্ব প্রস্তাব মত ছয়শ টাকায় আমার বই কিনিতে রাজি হইলেন। এক শ টাকা অগ্রিম দিলেন। পাণ্ডুলিপি ফেরৎ আনিলাম।
যথাসময়ে মােহাম্মদী বুক এজেন্সী আমার মুসলমানী কথা প্রকাশ করিলেন। অতঃপর যা ঘটিল, তাতে মুসলমানের মুখের ভাষার জন্য আমার মত গরীবের স্বার্থ ত্যাগের অহংকার ষােল আনা অটুট থাকিল। কারণ আমার ত্যাগের পরিমাণ আরেকটু বাড়িল । কিন্তু ঐ ত্যাগও যথেষ্ট নয়, আর ত্যাগের দরকার হইতে পারে বলিয়া আমি সেদিন যে আশঙ্কা করিয়াছিলাম, বারটি বছর না যাইতেই সে আশঙ্কা আমারই ঘাড়ের উপর দিয়া কার্যে পরিণত হইল।

১০. দ্বিতীয় স্যাক্রিফাইস
আমি তখন ময়মনসিংহ জজকোর্টে উকালতি করি। নূতন উকিল। পসার খুব জমে নাই। সাহিত্যিক নেশায় এবং উপরি আয়ের জন্য নয়া পড়া নামক চার খণ্ডের একখানা শিশুপাঠ্য বই লিখি। চার খণ্ড বই মকতবের চার ক্লাসের জন্য টেক্সট বুক কমিটি কর্তৃক অনুমােদিত হয়। এই চারখানা বই হইতে আমি যথেষ্ট টাকা-কড়ি পাইতে থাকি। তিন বছর মুদ্দত পার হয়-হয় অবস্থায় বাংলার প্রাইমারি এডুকেশন অ্যাক্ট পাশ হয়। এই নূতন আইনে প্রাইমারি স্কুল ও মকতব এক করিবার বিধান হয়। আমার নয়া পড়াঅনুমােদিত পুস্তকগুলির মধ্যে ‘এ’ ক্লাসের বই ছিল। সুতরাং নূতন বিধানেও আমার বই পাঠ্য-পুস্তক থাকিয়া যাইবে, এ কথা প্রকাশকসহ সকলেই বলিলেন। নয়া পড়ার চাহিদা বাড়িয়া যাইবে। আমার আয়ও বাড়িবে, এই আশায় আমি গােলাপি স্বপ্ন দেখিতে থাকিলাম।
২৭৮
এমন সময় টেক্সট বুক কমিটির তরফ হইতে এক পত্রে আমাকে জানান। হইল যে আমার নয়া পড়া নূতন আইনে পাঠ্য-পুস্তকরূপে অনুমােদিত হইয়াছে, তবে উহাতে যে সব আরবি-ফারসি শব্দ আছে, সেসব শব্দের জায়গায় বাংলা প্রতিশব্দ বসাইতে হইবে।
বার বছর আগেকার ঘটনা মনে পড়িল। তখন ছিলেন ভট্টাচাৰ্য্য এন্ড সন্স, এবার স্বয়ং টেক্সট বুক কমিটি মানে, খােদ সরকার। কিন্তু আমিও আজ বার। বছর আগের অসহায় লােকটি নই। ইতিমধ্যে দেশে বিরাট পরিবর্তন হইয়াছে। কৃষক প্রজা পার্টির নেতা হক সাহেব প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী হইয়াছেন। তাঁর আমি একজন প্রিয় শিষ্য। তাঁকে প্রধানমন্ত্রী করার ব্যাপারে আমার যথেষ্ট হাত আছে। হক সাহেব আমার কোনও কথাই ফেলেন না।
অতএব টেক্সট বুক কমিটিকে আমার সেই পুরাতন মত জানাইলাম, যা ভট্টাটাৰ্য্যকে জানাইয়াছিলাম। টেক্সট বুক কমিটি কিন্তু ভট্টাচাৰ্য্যকে ছাড়াইয়া গেলেন। তারা অন্যান্য যুক্তির সঙ্গে এটাও জানাইলেন : “আল্লা’, ‘খােদা, ‘পানি ইত্যাদি শব্দ প্রাইমারি পাঠ্য-পুস্তকে থাকিলে হিন্দু ছাত্রদের ধর্মভাবে আঘাত লাগিবে । আমার মাথায় আগুন চড়িয়া গেল। আমি জানাইলাম, একশ বছরের বেশি বাংলার মুসলমান ছাত্ররা পাঠ্য-পুস্তকে ‘ঈশ্বর’, ‘ভগবান’, ‘জল’ পড়াতেও যদি তাদের ধর্মভাবে আঘাত লাগিয়া না থাকে, তবে এখন হইতে ‘আল্লা’, ‘খােদা পড়িয়া হিন্দুদেরও ধর্মভাবে আঘাত লাগা উচিৎ নয়।
আমার যুক্তি ভট্টাচাৰ্য যেমন মানেন নাই, টেক্টট বুক কমিটিও মানিলেন না। আমাকে জানাইয়া দিলেন, অত্র অবস্থায় আমার বই বাতিল করিয়া দিতে তারা বাধ্য হইলেন বলিয়া দুঃখিত।
আমি রাগ করিলাম না। মনে মনে হাসিলাম। বেচারা টেক্সট বুক কমিটি জানেন না : কার বই তারা বাতিল করিলেন। তারা জানেন না, প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী হক সাহেবকে দিয়া আমি শুধু তাদের এই বাতিল অর্ডারই বাতিল করিতে পারি না। তাঁদের চাকুরি পর্যন্ত নট’ করিয়া দিতে পারি। অবশ্য আমি বেচারাদের চাকরি সত্য-সত্যিই ‘নট’ করিব না। তবে সে মর্মে ধমক দিয়া। তাদের ভবিষ্যতের জন্য হুঁশিয়ার করিয়া দিতে এবং তাঁদের বাতিলি অর্ডার বাতিল করাইতে আমি কলিকাতা গেলাম। হক সাহেব যথারীতি হৈ চৈ করিলেন : টেক্সট বুক কমিটি ভাঙিয়া পড়িবেন, কর্মচারীদের ডিসমিস করিবেন। বলিয়া হুংকার দিলেন। তাঁদের কৈফিয়ত তলব করিলেন। আমি আশ্বস্ত হইয়া এবং কারাে চাকুরি নষ্ট না করিতে হক সাহেবকে পুনঃপুন অনুরােধ করিয়া ময়মনসিংহ ফিরিয়া আসিলাম। বহুদিন অপেক্ষা করিবার পর আবার কলিকাতা
২৭৯
গেলাম। এইবার হক সাহেব আমাকে জানাইলেন যে হিন্দু বদমায়েশ অফিসারদের জ্বালায় তিনি কিছু করিতে পারিলেন না। বিলম্বও হইয়া গিয়াছে। যথেষ্ট। এখন পাঠ্যবই বদলাইলে ছাত্রদের অসুবিধা হইবে। আমারও আর্থিক লাভ বিশেষ হইবে না। তবে আগামী বৎসর যাতে আমার বই অবশ্যপাঠ্য হয়, সে ব্যবস্থা তিনি নিশ্চয় করিবেন। আমি এতদিন ব্যাপারটার আর্থিক দিক মােটেই ভাবিতেছিলাম না। হক সাহেবের আশ্বাসের পর সে বিষয়েও আমি সচেতন হইলাম । কিন্তু তাঁর প্রতিশ্রুত আগামী বছর আর আসিল না। বাঙ্গালী মুসলমানের মুখের ভাষা বাংলা সাহিত্যে স্বীকৃতি পাইবার প্রয়াসে ইহাকে আমার আরেকটা স্যাক্রিফাইস বলিয়া অবশেষে নিজের মনকে সান্ত্বনা দিলাম।
১৯২৬ হইতে ১৯২৯ সাল পর্যন্ত চার বছর কাল আমি সওগাত-এর ‘সম্পাদকের দফতর লেখায় সাহায্য করি। ঐ সাথেই আমার আয়নার গল্পগুলিও সওগাত-এ বাহির হয়। এই সময় সওগাত আফিস তৎকালীন প্রগতিবাদী সমস্ত মুসলিম সাহিত্যিকদের আড্ডা ছিল। ঐ আডডাতে আমরা সওগাত ক্লাব’ বলিতাম। নজরুল ইসলাম, মােহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, ইয়াকুব আলী চৌধুরী, মােহাম্মদ বরকতুল্লাহ, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, হবিবুল্লাহ বাহার, কবি মঈনুদ্দীন, কবি ফজলুর রহমান, কবি বেনীর আহমদ, কবি মহিউদ্দিন প্রভৃতি সমস্ত সাহিত্যিকদেরই সওগাত আফিসের আড্ডায় যাতায়াত ছিল। কাজী আবদুল ওয়াদুদ ও অধ্যাপক আবুল হুসেন সাহেবরা তক্কালে ঢাকায় শিখা সম্প্রদায় বলিয়া পরিচিত প্রগতিবাদী মুসলিম সাহিত্য সংঘ চালাইতেন। এঁদের সঙ্গে চিন্তার দিক দিয়া আমাদের বহুলাংশে মিল ছিল বলিয়া ব্যক্তিগত সহযােগিতা ও যাতায়াত ছিল।

১১. সাহিত্য-সমিতির সেক্রেটারি
এই মুদ্দতটাতে আমি বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির সেক্রেটারি ছিলাম। বয়স, যােগ্যতা ও জনপ্রিয়তার দিক দিয়া আমাদের সকলের শ্রদ্ধেয় ইয়াকুব আলী চৌধুরী সাহেবকেই আমি সেক্রেটারি করিতে চাহিয়াছিলাম। কিন্তু তাঁর স্বাস্থ্য খারাপ ও দৃষ্টিশক্তি দুর্বল ছিল বলিয়া তিনি আমাকে সেক্রেটারি হইবার জন্য জিদ করেন এবং নিজে আমার সহকারী সেক্রেটারি হইতে সম্মত হন। ফলে বার্ষিক সভায় প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট মি. এস ওয়াজেদ আলী সাহেব প্রেসিডেন্ট, আমি সেক্রেটারি, ইয়াকুব আলী চৌধুরী ও আয়নুল হক খাঁ সাহেবদ্বয় সহসেক্রেটারি ও মৌ. মুজিবর রহমান সাহেব কোষাধ্যক্ষ নির্বাচিত হইলেন। আমরা
২৮০
নির্বাচিত সম্পাদকমণ্ডলী ছাড়া মৌ. ওমেদ আলী নামে এক ভদ্রলােক ড. শহীদুল্লাহ-মােজাম্মেল হক সাহেবের আমল হইতে বরাবর সমিতির আফিস সেক্রেটারি ছিলেন। সাহিত্য সমিতির প্রতি এই ভদ্রলােকের এমন একটা পিতৃস্নেহ ছিল যে, সামান্য বেতনে তিনি বহুদিন এই সমিতির সেবায় কঠোর পরিশ্রম করিয়াছেন। আমাদের প্রেসিডেন্ট সাহেব ক্যাম্বুিজের গ্র্যাজুয়েট ব্যারিস্টার ছিলেন। নামের শেষে তিনি বরাবর ‘বি. এ. ক্যানটাব’ লিখিতেন ও লিখাইতেন। বন্ধুবর ওমেদ আলী এ বিষয়ে খুব সচেতন ছিলেন। সমিতির প্রচারে বাহিরে গিয়া অথবা আফিসে বসিয়া নূতন লােকের প্রশ্নের উত্তরে কেউ আমরা যখন বলিতাম আমাদের প্রেসিডেন্ট মি. এস ওয়াজেদ আলী, ওমেদ আলী সাহেব। ব্রাকেটে বলিয়া দিতেন ‘বি. এ. ক্যানটাব’। স্যার আবদুর রহিম, মৌ. ফজলুল হক, মৌ. আবদুল করিম প্রভৃতি বড়-বড় নেতাদের বাড়িতে আলােচনায় এমনকি সমিতির সভায়ও যদি কেউ কোনও কারণে ‘মি. এস ওয়াজেদ আলী উচ্চারণ। করিতেন, অমনি ওমেদ আলী সাহেব সভার যে-কোনও কোণ হইতে বলিয়া উঠিতেন, ‘বি. এ. ক্যানটাব। আমরা ওমেদ আলী সাহেবের এই ব্যবহারে হাসিতাম। আমরা মনে করিতাম, ওয়াজেদ আলী সাহেবের ক্যানটাব’প্রীতিকে তিনি এইভাবে বিদ্রুপ করিতেছেন। কিন্তু ওমেদ আলী সাহেব ছিলেন সিরিয়াস। তিনি আমাদের হাসিতে মনে মনে দুঃখিত হইতেন।
যা হােক ওমেদ আলী সাহেব ছিলেন সমিতির একটা অ্যাসেট। তাঁর মহানুভবতায় আমি এতদিন নির্বিঘ্নে সমিতির সেক্রেটারিগিরি করিতে পারিয়াছিলাম।
সাহিত্য সমিতির সেক্রেটারিগিরি করিতে গিয়া আমার যে দুইটি চমৎকার অভিজ্ঞতা হইয়াছিল আমার সাহিত্যিক জীবনের সঙ্গে তার কোনও প্রত্যক্ষ সম্পর্ক থাকিলেও এখানে তার উল্লেখ করার লােভ সম্বরণ করিতে পারিলাম না।

১২. চাঁদা আদায়
প্রথমটি নবাব মশাররফ হােসেন সাহেবের সঙ্গে। তিনি একবার বার্ষিক সভায় সমিতির তহবিলে পাঁচ শত টাকা সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন। তখন তিনি বাংলা সরকারের একজন মন্ত্রী। এই প্রতিশ্রুত চাদা আদায়ের জন্য আমরা সম্পাদকমণ্ডলী তাঁর হাজরা রােডের বাড়িতে হানা দিলাম। হাজরা রােড ট্রাম লাইন হইতে অনেক দূরে। কাজেই কিছুদিন হাঁটাহাঁটি করিবার পর প্রথমে ইয়াকুব আলী চৌধুরী, পরে আয়নুল হক খ এবং শেষ পর্যন্ত ওমেদ আলী
২৮১
সাহেবও নিরাশ হইয়া খসিয়া পড়িলেন। আমি সেক্রেটারি পাওনাদারের তাকিদ আমার উপরই ছিল প্রত্যক্ষভাবে। সুতরাং পাঁচ শ টাকা আমি অত সহজে ছাড়িতে পারিলাম না। ঘুরা-ফেরা করিতেই থাকিলাম। একদিন আমি চটিয়া গিয়া বলিয়া ফেলিলাম : নবাব সাহেব, আমাকে আর কত ঘুরাইবেন? টাকা দিবেন কি না আজ স্পষ্ট কথা বলিতে হইবে।’ নবাব সাহেব আমার কথা বলার ভঙ্গিতে বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলিয়া বলিলেন : বড় যে পাওনাদারের মত মেজে কথা বলিতেছেন। আপনার কথা শুনিয়া মনে হয় আমি যেন আপনার খাতক। আমি সমান জোরে বলিলাম : ‘আলবত আপনি আমার খাতক; আলবত আমি আপনার পাওনাদার।’ নবাব সাহেব চোখ লাল করিলেন। ঘর-ভরা বড়-বড় সাহেব আইসিএস অফিসার। তারা আমার দুঃসাহসে ও আসন্ন বিপদে বিস্মিত ও চিন্তিত হইলেন। কিন্তু আমি বিন্দুমাত্র না ঘাবড়াইয়া মাথা উঁচা করিয়া বলিলাম : ‘আপনি যেদিন প্রকাশ্য সভায় দাঁড়াইয়া সমিতির তহবিলে পাঁচ শত টাকা চাঁদা দিবেন ঘােষণা করিয়াছিলেন, সেইদিন হইতে সমিতি আপনার পাওনাদার। আপনি সমিতির খাতক । আপনি যদি ওয়াদা খেলাফ করিতে চান, তবে বলিয়া দেন সে কথা। আমি সমিতির সভা ডাকিয়া সে কথা বলি। সমিতি আপনাকে মাফও করিয়া দিতে পারে।’
নবাব সাহেব আমার দিকে আর না চাহিয়া প্রাইভেট সেক্রেটারিকে একটা পাঁচ শ টাকার চেক লিখিয়া আনিতে বলিলেন। চেক আসিলে তিনি তাতে সই করিয়া আমার দিকে ঠেলিয়া দিলেন। আমিও একটা রসিদ লিখিয়া একটানে ছিড়িয়া তাঁর দিকে ঠেলিয়া দিলাম। খুব নুইয়া একটা ‘আদব আর’ করিয়া বিদায় হইলাম। দুইদিন পরে আমার মনিব মৌ. মুজিবর রহমানের কাছে নবাব সাহেব বলিয়াছিলেন : আপনার ঐ আবুল মনসুরটা একটা মস্তবড় বেয়াড়া লােক। সে আমাকে সেদিন অফিসারদের সামনে কি বেকায়দায়ই না ফেলিয়াছিল। সমস্ত ঘটনা শুনিয়া মৌলবী সাহেব হাসিয়া বলিয়াছিলেন : “ছেলেটা অমন বেয়াড়াই বটে।

১৩. চাদা দান
দ্বিতীয় ঘটনাটা হক সাহেবের সঙ্গে। বাড়িওয়ালা কর্পোরেশনের বকেয়া ট্যাক্স না দেওয়ায় সেবার আমাদের সমিতি অফিস, লাইব্রেরির বই-পুস্তক, আলমারি ও টেবিল-চেয়ার ক্রোক হইয়াছিল। তিন দিন সময় নিয়াছিলাম। সে তিন দিনের শেষ দিন। সেদিন টাকা শােধ না করিলে পরদিন সকালে নিলাম
২৮২
হইবে। মােট দেনা সাড়ে তিনশ টাকা। সম্পাদকমণ্ডলী আড়াই দিন ঘুরিয়া নবাব, জমিদার, ব্যারিস্টার, উকিল, মার্চেন্ট প্রভৃতি বিরাট ধনী লােকের নিকট হইতে মাত্র পঞ্চাশ টাকার মত চাঁদা তুলিতে পারিয়াছি। তৃতীয় দিনের বেলা তিনটা পর্যন্ত বিনা গােসল-খাওয়ায় তিন-চার-বন্ধু নিতান্ত নিরাশ হইয়া ক্ষুধাক্লান্ত দেহে বাসায় ফিরিতেছি। পথে মৌলবী ফজলুল হকের বাসা। বাসার সামনে গিয়া হঠাৎ একজন বলিয়া ফেলিলেন : ‘হক সাহেবের কাছে একবার গেলে হয় না? কিন্তু আমরা কথাটায় আমল দিলাম না। আমরা সবাই হক সাহেবের ভক্ত বটে, কিন্তু তাঁর ওটা চরম দারিদ্র্যের সময়। কাবুলী মহাজনের তাগাদায় তিনি রাস্তায় বাহির হইতে পারেন না। তাঁর ভাঙ্গা ফোর্ড মােটরের হেডলাইট, সাইড লাইট কিছুই না থাকায় দুই দিকে দুইটা হ্যারিকেন বাঁধিয়া রাত্রে রাস্তায় বাহির হন। হাইকোর্টে প্রায় যানই না। শুধু মফস্বলে প্র্যাকটিস করেন। তার বাসার অদূরেই একটা মেসে আমরা থাকি। কাজেই এসবই আমাদের জানা কথা। হক সাহেবকে ঋণমুক্ত করিবার জন্য পাবলিকের কাছে। অর্থ সাহায্য চাহিয়া কিছুদিন আগে ইয়াকুব আলী চৌধুরী সাহেবের নেতৃত্বে আমরা আবেদনপত্র ছাপিয়া বিলি করিয়াছি। এমন বিপন্ন হক সাহেবের কাছে চাদা চাইতে যাওয়া কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেওয়ামাত্র। কিন্তু ঐ বন্ধু জিদ করিলেন : হক সাহেব সমিতির অন্যতম ভাইস প্রেসিডেন্ট। চাঁদা চাই আর না চাই, সমিতির বর্তমান বিপদটা তাঁকে জানান আমাদের কর্তব্য।
এ যুক্তির জবাব ছিল না। কাজেই আমরা হক সাহেবের বৈঠকখানায় ঢুকিলাম। দেখিলাম তিনি একজন মাত্র মওক্কেল লইয়া বসিয়া আছেন। আমরা সবিস্তারে সব কথা তাঁকে বলিলাম। তিনি মাথা চুলকাইলেন এবং মওক্কেলটির দিকে চাহিয়া বলিলেন : বেশ আমি যাইব। বায়নার টাকা ফেলেন। লুঙ্গি-পরা সাদাসিধা বুড়া মানুষ। জলপাইগুড়ির এক কেসে হক সাহেবকে জলপাইগুড়ি নিতে আসিয়াছেন। হক সাহেবের আদেশে তিনি টেবিলের উপর পাঁচশ টাকা রাখিয়া বলিলেন : এটা বায়না। টিকিট আমি কিনিব। বাকিটা জলপাইগুড়িতে দিব।
হক সাহেব আমাদের দিকে চাহিয়া বলিলেন : তােমাদের দরকার কত?
আমাদের দরকার তিনশ। কিন্তু মােটে পাঁচশ টাকার মধ্যে তিনশ টাকা। চাহিতে আমাদের জিভ আড়ষ্ট হইয়া আসিল । আমাদের সংকোচ দেখিয়া হক সাহেব নিজেই হিসাব করিয়া দুইশ টাকা নিজের ড্রয়ার টানিয়া বাকি তিনশ। আমাদের দিকে ঠেলিয়া দিলেন। স্তম্ভিত আমরা কম্পিত হস্তে টাকা তুলিয়া নির্বাক সালাম দিয়া বাহির হইয়া আসিলাম।
২৮৩
১৪. সাহিত্য-জীবনের মুদ্দত ভাগ
প্রকাশিত পুস্তকগুলির রচনাকালের দিক হইতে আমার সাহিত্যিক জীবনকে চারটি মুদ্দতে ভাগ করা যায়। প্রথম মুদ্দত কলিকাতা-জীবন ১৯২২ হইতে ১৯২৯। দ্বিতীয় মুদ্দত, ময়মনসিংহ-জীবন ১৯৩০ হইতে ১৯৩৮। ১৯৩৮ হইতে ১৯৫০ পর্যন্ত আবার কলিকাতা-জীবন আমার সাহিত্যিক জীবনের তৃতীয় মুদ্দত। ১৯৫০ সাল হইতে আজ পর্যন্ত ঢাকা-ময়মনসিংহের জীবন আমার চতুর্থ মুদ্দত। পূর্বেকার মুদ্দতে ছাত্রজীবনে আমি যেসব প্রবন্ধ আলএসলাম-এ এবং যেসব গল্প সওগাত-এ লিখিয়াছিলাম, তা পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয় নাই বলিয়া এই চার মুদ্দতে সেটা পড়ে না।
১৯২২ হইতে ১৯২৯ সাল পর্যন্ত এই আট বছরে আমি যেসব গল্প লিখিয়াছিলাম এবং সওগাত-এ প্রকাশিত হইয়াছিল তার প্রায় সবগুলি আয়নায় ছাপা হইয়াছে। কাছাছুল আম্বিয়ার কিচ্ছাগুলি শিশুদের জন্য লিখিত মুসলমানী কথাও এই মুদ্দতেই লেখা। সেটিও পুস্তকাকারে বাহির হইয়াছিল। এই মুদ্দতেই আয়না প্রকাশের আগেই। এই মুদ্দতের লেখা আমার গােলামী সাহিত্য ও সভ্যতায় দ্বৈতশাসন ইত্যাদি বিতণ্ডামূলক প্রবন্ধগুলি তৎকালে খুবই আলােড়ন সৃষ্টি করিয়াছিল বটে, তবে সেগুলি পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয় নাই। এই মুদ্দতে সওগাত-এ যেসব প্রবন্ধাদি ছাপা হইয়াছিল, সেগুলিরও সংগ্রহ পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয় নাই।
১৯২৯ সালের শেষ দিকে সাংবাদিকতা ও কলিকাতা ছাড়িয়া উকালতি করিতে আমি ময়মনসিংহ শহরে আসি এবং ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত এখানে থাকি। এই সময়ে সওগাত আমি সাহিত্য ও যুগ-ধর্ম’, ‘মুসলমান সমাজে আনন্দ ইত্যাদি যেসব সাহিত্যিক-সামাজিক প্রবন্ধ লিখিয়াছিলাম সেগুলিও পুস্তকাকারে ছাপা হয় নাই। কিন্তু এই মুদ্দতে আমার জীবন ক্ষুধা নামক বিশাল আকারের নভেলটি সওগাত-এ ক্রমশ প্রকাশিত হইতে শুরু হয়। প্রতিমাসে বাহির হইয়াও চার বছরে শেষ হয়। আমার আয়নাও পুস্তকাকারে এই মুদ্দতেই প্রথম প্রকাশিত হয়।
১৯৩৮ সালে সাংবাদিকতা করিতে আবার কলিকাতা যাই। সেখানে। একটানা ১৯৫০ সাল পর্যন্ত বার বছর বাস করি। এই সময়কার লেখা আমার গল্পগুলি ফুড কনফারেন্স-এ এবং দুই-একটা আসমানী পর্দা ও গালিভারের সফরনামাতেও ছাপা হইয়াছে। আমার সত্য-মিথ্যা নভেলও এই মুদ্দতেই লেখা হয়। যদিও এসব পুস্তক আরাে পরে ঢাকা আসার বাদে ছাপা হইয়াছে।
২৮৪
ছােটদের কাছাছুল আম্বিয়াও এ সময়ে লেখা, কিন্তু পরে ছাপা হইয়াছে।
১৯৫০ সাল হইতে বর্তমান সময় পর্যন্ত মুদ্দতে আমার জীবন ক্ষুধা, সত্যমিথ্যা, আবে হায়াত ইত্যাদি নভেল, আসমানী পর্দা, গালিভারের সফরনামা ইত্যাদি গল্পগ্রন্থ ও পাক-বাংলার কালচার (বর্তমান বাংলাদেশের কালচার) ও পরিবার পরিকল্পনা নামক সন্দর্ভ পুস্তক, আল-কোরআনের নসিহত নামে। সিলেকশন অনুবাদ গ্রন্থও এই মুদ্দতেই বাহির হইয়াছে। এই মুদ্দতেই আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর, শেরে বাংলা হইতে বঙ্গবন্ধু ও এন্ড অব এ বিট্রেয়াল (ইংরাজি) ইত্যাদি রাজনৈতিক গ্রন্থসমূহ প্রকাশিত হইয়াছে।
ময়মনসিংহ উকালতি জীবনে (১৯২৯-১৯৩৮) আমার সাহিত্য-সাধনার বিষয়বস্তুর মধ্যে অভিনবত্ব আসিয়াছিল দুই দিক হইতে : একটি স্বভাবের টানে; অপরটি অভাবের টানে। নিতান্ত দৈবাৎ। প্রথমটি আমার পাঠ্য-পুস্তক লেখা। এটি ঘটে এই ভাবে। কলিকাতার সদা-ব্যস্ত সাংবাদিক জীবন হইতে এই প্রথম আসিয়াছি মফস্বল শহর ময়মনসিংহের উকালতি জীবনে। নূতন উকিল। কাজ কম। অবসর প্রচুর। আনন্দ মােহন কলেজের আরবি-ফারসির দ্বিতীয় অধ্যাপক মৌ. আসাদুজ্জমান সাহেব এই শহরেরই ‘ফিরােয লাইব্রেরির মালিক। তিনি আমাকে ধরিলেন শিশু পাঠ্য-পুস্তক লিখিতে। তাঁর অনুরােধে নয়া পড়া নামে চার খণ্ডের একটি পাঠ্য-পুস্তক লিখিলাম । মকতবের ১ম, ২য় ও ৪র্থ শ্রেণীর জন্য পুস্তক চারটি কমপালসারি পাঠ্য-পুস্তক নির্বাচিত হইল। চার বছর পাঠ্য থাকিল। প্রচুর বিক্রি হইল । আমার বেশ অর্থাগম হইল। নূতন উকিলের প্র্যাকটিসের স্বল্পতাহেতু অর্থাভাব এতে পােষাইয়া গেল। এ সম্বন্ধে অন্যত্র বিস্তারিত আলােচনা হইয়াছে। অতএব এখানে এ বিষয়ে আর কিছু লিখিলাম না।

১৫. অভিনব বিষয়বস্তু
দ্বিতীয়টা, আমার জীবনে প্রথম যৌনবিজ্ঞানের পুস্তক রচনা। এটি ঘটে এইভাবে । আমার ছাত্রজীবনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু মােহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম পরে খান বাহাদুর এই সময়ে ময়মনসিংহে মুনসেফ। নবাবযাদা সৈয়দ হাসান আলী এই সময়ে এই শহরে তাঁর নিজস্ব প্রাসাদ হাসান মনজিলে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করিয়াছেন। আমার সাথে রাজনীতি করিবার উদ্যোগ গ্রহণ করিতেছেন। আমরা খুবই ঘনিষ্ঠ হইয়া উঠিয়াছি। সিরাজুল ইসলাম সাহেব ও নবাবযাদা ঘন-ঘন আমার বাসায় যাতায়াত করেন। আমার স্ত্রী এই সময়ে
২৮৫
(১৯৩৫ সালে) তৃতীয় পুত্র মতলুব আনামকে প্রসব করিয়াই টাইফয়েড জ্বরে ঘােরতর অসুস্থ হইয়া পড়িয়াছেন। তার খোঁজখবর করিতে তারা আরাে বেশি ঘন-ঘন আসিতে বাধ্য হন। কারণ আমি এ সময়ে কোর্টে খুবই কম যাইতে পারিতাম । এমনি দিনে তারা দুইজনই এক সঙ্গে এ জিলার এডিশনাল এসপি মি. আবুল হাসানাত মােহাম্মদ ইসমাইলের সাথে আমার পরিচয় করাইয়া দেন। তাঁদের প্রস্তাব : আবুল হাসানাত সাহেব উদীয়মান সাহিত্যিক। তিনি একটি পুস্তক রচনা করিয়াছেন। আমাকে পুস্তকখানা সংশােধন করিয়া দিতে। হইবে। এসপি সাহেব আমাকে যথেষ্ট পারিশ্রমিক দিবেন। আমার বর্তমান অসুবিধা ও অভাবের মধ্যে এতে আমার খুবই উপকার হইবে।
আমি রাজি হইলাম । আবুল হাসানাত সাহেব তাঁর লেখা যে পাণ্ডুলিপিটি আমাকে দিলেন, সেটি একটি যৌন পুস্তক। কলিকাতার আন্ডার ওয়ার্ল্ড বাজারে এই ধরনের পুস্তকের গােপন বিক্রির কথা আমি কিছু-কিছু জানিতাম। এই ধরনের অশ্লীল পুস্তক রচনাকে আমি পাপ ও অপরাধ মনে করিতাম । কাজেই এসপি সাহেবের এ কাজে সহায়তা করিতে আমি অস্বীকার করিলাম। এসপি সাহেব তখন আমাকে বুঝাইলেন, অশ্লীল যৌন রচনা তাঁর উদ্দেশ্য নয়। তিনি পশ্চিমী সভ্য জগতে প্রচলিত বিজ্ঞানের সাহিত্যই রচনা করিতে চান। এই ধরনের কোনও পুস্তক আমি পড়ি নাই, জানিতে পারিয়া তিনি অবাক হইলেন এবং কিছু কিছু পুস্তক আমাকে দিতে লাগিলেন। এইভাবে তিনি আমাকে হ্যাভলক এলিস, ফোরেল এবং মেরিস্টোপস প্রভৃতির বেশ কিছু বই পড়িতে দিলেন। ফলে এই ধরনের পুস্তক রচনায় এসপি। সাহেবকে সহায়তা করিতে রাজি হইলাম। জনাব সিরাজুল ইসলাম ও নবাবযাদার মধ্যস্থতায় আমার পক্ষে সুবিধাজনক আর্থিক চুক্তি হইয়া গেল। এসপি সাহেব আমার স্ত্রীর চিকিৎসা খরচা বাবত বেশ কিছু টাকা অগ্রিম দিলেন। ঔষধের দামের সব বিল তার কাছে পাঠাইবার জন্য ঔষধের দোকানদারকে বলিয়া দিলেন। আমি কোর্টে যাওয়া প্রায় একদম বন্ধ করিয়া দিয়া রুগ্ণ স্ত্রীর শুশ্রুষায় ও যৌন বিজ্ঞানের বিশাল-বিশাল পুস্তক পড়ায় লাগিলাম। আমার স্ত্রীর অসুখ সারিতে চার মাস লাগিয়াছিল। সম্পূর্ণ সুস্থ হইতে আরাে দুই মাস লাগিয়াছিল। প্রথম চার মাস আমি শুধু পড়িলাম ও নােট করিলাম। পরের দুই মাস আমি অবিরাম লিখিয়া গেলাম। চার মাসে। আমি মােট ১৪৩ খানা যৌন বিজ্ঞানের বই পড়া শেষ করিয়াছিলাম। এর মধ্যে চল্লিশখানার বেশি বড়-বড় বই। আর শত খানেকের বেশি চটি বই। এর প্রায় সবাই এসপি সাহেব এ জিলার চার-পাঁচটি বড়-বড় জমিদার বাড়ির
২৮৬
লাইব্রেরি হইতে যােগাড় করিয়াছিলেন। এঁদের মধ্যে ময়মনসিংহের ও সুশুঙ্গের মহারাজা, মুক্তাগাছা ও গৌরীপুরের রাজা, শেরপুর ও আঠারবাড়ির জমিদারদের লাইব্রেরিই বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। রাজা-জমিদাররা এইসব পুস্তক লাইব্রেরি হইতে বাহিরে যাইতে কখনও দিতেন না। কিন্তু একজন এসপির অসাধ্য তকালে কিছুই ছিল না।
এসব পুস্তক ছাড়া দুই-একখানা সর্বাধুনিক যৌন-বিজ্ঞানের বইও তিনি নিজে বিদেশ হইতে খরিদ করিলেন। এইসব বইয়ে দীর্ঘ চার মাস কাল আমি এমন ডুবিয়াছিলাম যে, এই চার মাস কেমন করিয়া কাটিয়া গেল, আমি যেন তার টেরই পাইলাম না। এই সব বই পড়িয়া আমি সম্পূর্ণ নূতন জ্ঞান লাভ করিলাম। সাধারণভাবে জীবন-দর্শন বিশেষভাবে যৌন-জীবন সম্পর্কে আমার ধ্যান-ধারণা বহু পরিবর্তন হইল। অতিশয়ােক্তি না করিয়াও বলা যায়, আমি যেন জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিকে একদম অন্ধকার হইতে আলাের রাজ্যে চলিয়া আসিলাম।
ফলে যে কাজ শুরু করিয়াছিলাম অনিচ্ছা ও অভক্তি লইয়া নিতান্ত আর্থিক টানে বাধ্য হইয়া, সেই কাজই শেষ করিলাম স্বেচ্ছায়, সশ্রদ্ধভাবে এবং বিপুল জ্ঞান ও আনন্দ-উৎসাহের মধ্য দিয়া। মানসিক এই পরিবর্তনে দেহে ও হাতে এমন শক্তি ও উদ্যম আসিল যে দেড়শ বইয়ের সারমর্ম পাঁচশ পৃষ্ঠার একটি বইয়ে জমাট বাঁধাইলাম বিনা আয়াসে দুই মাস সময়ে। লেখাটাও এমন প্রাণবন্ত, জোরালাে, যুক্তিপূর্ণ ও শালীন ভাষায় রচিত হইল যে, যিনি এই বইয়ের জন্য ছয় মাসে আমাকে ছয় হাজারের বেশি টাকা দিলেন, তিনি পুস্তকের ভূমিকার একাংশ পড়িয়াই আর পড়িলেন না। সােজা ছাপার ব্যবস্থা করিলেন। মধ্যস্থ বন্ধুদ্বয় সিরাজুল ইসলাম ও নবাবযাদা পড়িতে বা শুনিতেও চাহিলেন না। বলিলেন : আমরা জানিতাম মনসুর সাব যা লিখিবেন, তাই শ্রেষ্ঠ হইবে । পড়িয়া দেখিতে হইবে কেন?
বড়াই-অহংকার না করিয়াও বলা যায় যে চল্লিশ বছর আগে, তৎকালীন সমাজ-চিন্তার স্তরে ও জনমতের সেই পরিবেশে যৌন-বিজ্ঞানের প্রথম বাংলা। গ্রন্থটি সত্যই ভাল হইয়াছিল। তার প্রমাণ এই যে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের মত চিরকুমার ব্রহ্মচারী-বিজ্ঞানী-দর্শনী এই পুস্তকটিকে ‘যৌন-সংহিতা’ বলিয়া অভিনন্দিত করিয়াছিলেন। তাছাড়া ডা. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি, ডা. গিরিন্দ্র চন্দ্র দে প্রভৃতি বিশেষ বিশেষ দৃঢ় মতবাদী পণ্ডিত ব্যক্তিগণও এই পুস্তকের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করিয়াছেন। কলিকাতার সকল মত, শ্রেণী ও সম্প্রদায়ের দৈনিক, সাপ্তাহিক সংবাদপত্র ও মাসিকাদি সাহিত্য-পত্র যেভাবে এই
২৮৭
তথাকথিত অশ্লীল বিষয়ে লেখা পুস্তকের প্রশংসা করিয়াছেন ও এর প্রকাশককে অভিনন্দন জানাইয়াছেন, তাতে বলা যায়, বইটি সকল দিক দিয়াই সুলিখিত হইয়াছিল।
বইটি ছাপিতে দেওয়া হইয়াছিল কলিকাতা মােহাম্মদী প্রেসে। মােহাম্মদী প্রেসের সব প্রবীণ ও প্রধান কম্পােযিটররাই দীর্ঘদিনের পরিচিতির ফলে আমার হাতের লেখা চিনিতেন। প্রেসে যাওয়া-মাত্র তারা ধরিয়া নিলেন ওটা আমার বই। নিজেদের মধ্যে কথাবার্তায় ও উপরওয়ালাদের কাছে খবর দেওয়ার সময় তাঁরা ওটাকে ‘মনসুর সাহেবের বই’ বলিয়াই উল্লেখ করিতেন। এ সব কথা আমাকে বলিলেন আবুল হাসানাত সাহেব নিজেই। তিনি এ সব খবর আমাকে দিলেন আমাকে তার বইয়ের একটা প্রুফ দেখিতে অনুরােধ করিয়া । তিনি নিজেই ছুটি লইয়া কলিকাতা থাকিয়া আসিয়াছেন। কিন্তু প্রুফ দেখায় তিনি তখনও উস্তাদ নন। খুব ভাল প্রুফরিডার তিনি রাখিয়াছেন সত্য, কিন্তু তাদের দিয়া বিশ্বাস পাইতেছেন না। আমি ত কৃষক-প্রজা সমিতির কাজে ঘন-ঘন কলিকাতা গিয়াই থাকি; এ কাজে কিছুদিন বেশি করিয়া থাকিয়া-থাকিয়া এক-একটা ফাইনাল প্রুফ দেখিয়া দিলে খুব ভাল হয়। সেজন্য তিনি আমাকে যথেষ্ট ক্ষতিপূরণ দিবেন । ততদিনে ১৯৩৫ সাল পার হইয়া ‘৩৬ সালে পড়িয়াছে। আসন্ন নির্বাচনে কৃষক প্রজা পার্টি কনটেস্ট করিবে । এই উপলক্ষে সত্যই আমাকে ঘন-ঘন কলিকাতা যাতায়াত করিতে হইতেছিল। তাছাড়া নিজের লেখা ছাপার সময়ে প্রুফ দেখার আগ্রহ আমার বরাবরের। নিজের লেখাটা, তা যার নামেই প্রকাশ হউক না কেন, ভুল। ছাপান হইলে আমার মনে অসহনীয় কষ্ট হইত । কাজেই আমি রাজি হইলাম। সপ্তাহ-পনের দিনে কলিকাতা যাতায়াত করা, সেখানে থাকা-খাওয়া আমার ব্যবসায়িক লােকসান ইত্যাদি সাকুল্য বিষয় বিবেচনা করিয়া তিনি আমাকে এবারেও যথেষ্ট টাকা দিলেন। আমাকে প্রুফরিডার পাইয়া প্রেসও কাজে জোর দিল । ত্রিশ-বত্রিশ ফর্মার বই দুই মাসে ছাপা হইয়া গেল । ছাপা শেষ হইয়া আসিতে থাকায় আবুল হাসানাত সাহেব আমাকে আরেক বিপদে ফেলিলেন। তিনি আমাকে তার বইয়ের কো-অথার রূপে নাম দিতে চাপিয়া ধরিলেন। আমার মধ্যস্থ বন্ধুদ্বয়ও সে অনুরােধে যােগ দিলেন। কিন্তু এবার আমি দৃঢ়তার সাথে অস্বীকার করিলাম। দুই কারণে। এক, আমি তখনও পাক্কা কংগ্রেসি। অধিকাংশ কৃষক-প্রজা নেতা-কর্মীও তাই। জিলার পুলিশ সুপারের সাথে বইয়ের কো-অথার রূপে নাম ছাপা হইলে সহকর্মী ও কংগ্রেসি সার্কেলে আমার বদনামের সীমা থাকিবে না, এ ভয়ে আতঙ্কিত হইলাম । দুই,
২৮৮
আমি নিজে ততদিনে যৌন-বিজ্ঞানকে একটি সুষ্ঠু-শালীন বিজ্ঞান বলিয়া মানিয়া লইয়াছি বটে, কিন্তু আমাদের দেশের পাবলিক তখনও ওটাকে অশ্লীল কুকর্ম বলিয়াই জানিত। সরকারি অফিসাররা বিশেষত একজন পুলিশ অফিসার অনায়াসে জনমত অগ্রাহ্য করিয়া চলিতে পারেন। কিন্তু একজন রাজনৈতিক নেতা-কর্মীর পক্ষে ওটা সম্ভব নয়। আমাদের মধ্যস্থ বন্ধুদ্বয়কে। উভয় আপত্তিই জানাইলাম বটে, কিন্তু আবুল হাসানাত সাহেবকে শুধু দ্বিতীয় আপত্তির কথাই জানাইলাম। আবুল হাসানাত সাহেব অগত্যা আমাকে কোঅথার করার অভিপ্রায় ত্যাগ করিলেন। কিন্তু নিজে একটি সংক্ষিপ্ত ‘গ্রন্থকারের নিবেদন’ লিখিয়া তাতে বলিলেন, ‘সুসাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমদ এই গ্রন্থ রচনায় আমাকে বিশেষ সহায়তা করিয়াছেন।
আমি নিজে যতই গােপন করিতে চেষ্টা করি না কেন, মুসলিম সাংবাদিক ও রাজনৈতিকদের কাছে ধরা পড়িয়া গেলাম। প্রধানত মােহাম্মদী আফিস হইতে এটা প্রকাশ হইয়া পড়িল। আবুল হাসানাত সাহেব চারিত্রিক সবলতার দরুন নিজেই তার বন্ধুমহলে এটা প্রকাশ করিয়া দিলেন। মােহাম্মদী আফিস হইতে এই সময় দৈনিক আজাদ বাহির হয়। প্রজাসমিতির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও সেক্রেটারি মওলানা মােহাম্মদ আকরম খাঁ সাহেব এই সময় মুসলিম লীগে যােগ দেন। ফলে মােহাম্মদী তথা আজাদ আফিস মুসলিম লীগ নেতা-কর্মীদের আড্ডায় পরিণত হয়। সেখান হইতে প্রায় সকল মুসলিম রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা যৌন-বিজ্ঞানের রচনায় গােপন তথ্য জানিয়া ফেলিলেন। হিন্দু সাংবাদিক বন্ধুরা এবং কংগ্রেসি সহকর্মীরা এটা জানিলেন আনন্দবাজার পত্রিকার মারফতে। কলিকাতার সব ইংরাজি, বাংলা দৈনিক পত্রিকায় সদ্য-প্রকাশিত ‘যৌন-বিজ্ঞানের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা বাহির হয়। আনন্দবাজার পত্রিকার সমালােচক এক ডিগ্রি আগাইয়া যান। বিরাট আকারের সমালােচনা। তাতে অন্যান্য কথার সঙ্গে এ কথাও বলেন : “এই গ্রন্থের ভাষা পড়িয়া আমরা বুঝিলাম গ্রন্থকারকে আমরা চিনি। তিনি ছদ্মনামে এই বই লিখিয়াছেন। এই সময় আমার শ্রদ্ধেয় বন্ধু মি. সত্যেন্দ্র নাথ মজুমদার আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদক। আমরা হিন্দুমুসলিম সাংবাদিকরা প্রায় সবাই তাঁকে ‘সত্যেনদা’ বলিয়া ডাকিতাম। এই সময় আমি সাংবাদিকতা ছাড়িয়া দেওয়া সত্ত্বেও কলিকাতা সফরের সময় প্রায়ই আনন্দবাজার পত্রিকা আফিসে গিয়া ‘সত্যেনদা’র সম্পাদকীয় রুমে আড্ডা দিতাম। ‘যৌন-বিজ্ঞান বাহির হইবার পর একদিন আমি এমনি ধরনের আনন্দবাজার পত্রিকার আফিসে সত্যেনদার রুমে হাজির হইলে
২৮৯
সত্যেনদা সমাগত বন্ধুদের (যাদের অনেকেই আমার পূর্বপরিচিত) উদ্দেশ্য করিয়া বলিলেন : বহুল প্রশংসিত যৌন-বিজ্ঞানের আসল গ্রন্থকারের সঙ্গে আপনাদের পরিচয় করাইয়া দিতেছি। সমবেত বন্ধুদের বিস্ময়-কৌতুহলের জবাবরূপেই যেন তিনি আমার রচনার বৈশিষ্ট্য, শব্দপ্রয়ােগে নিজস্বতা, ভাষার সাবলীল তেজস্বিতা, স্টাইলের অনুকরণীয়তা ইত্যাদি তাঁরই নিজস্ব ভাষার গুণাবলি উদারভাবে আমার উপর আরােপ করিয়া আমার প্রাপ্যাধিক প্রশংসা করিলেন। এ ব্যাপারে সত্যেনদা সত্যই অতুলনীয়ভাবেই উদার ও মুক্ত-রসনা ছিলেন।
আবুল হাসানাত সাহেব তাঁর ‘যৌন-বিজ্ঞান’-কে পরবর্তীকালে আকারে অনেক বিশাল ও বিষয়-সম্ভারে আরাে অনেক সমৃদ্ধিশালী করিয়াছেন। এসব কৃতিত্বপূর্ণ কাজে আমার কিছুমাত্র অবদান বা সহযােগিতা নাই। এ সবই তাঁর নিজস্ব কীর্তি। তিনি আগে হইতেই স্বাধীন চিন্তক ও শক্তিশালী লেখক ছিলেন। যৌন-বিজ্ঞানকে উন্নততর মানের গ্রন্থে পরিণত করা ছাড়াও এ সম্পর্কে আরাে অনেক বই-পুস্তক লিখিয়া তিনি যশস্বী হইয়াছেন।
হয়ত গােড়ায় আমার প্রদর্শিত পন্থায় তিনি কিছুটা উপকৃত হইয়াছেন। কিন্তু আমি নিজে উপকৃত হইয়াছি অনেক বেশি। তার দেওয়া উল্লিখিত বিপুল সংখ্যক বই পড়িয়া আমার জীবন-দর্শনে প্রভূত প্রসারতার উন্মেষ হইয়াছে সে কথা আগেই বলিয়াছি। তাছাড়াও আবুল হাসানাত সাহেবের প্রদর্শিত পথে আরাে অগ্রসর হইয়া কিছুদিনের মধ্যেই ফ্রয়েড ও ইয়ুংয়ের বই-পুস্তকের ও মনােবিকলনের সঙ্গে পরিচিত হই। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে মনােবিকাশের ফলে ফ্রয়েডিয়ান মতবাদের শুধু ভক্ত পাঠকই হই নাই, তাঁর মতবাদের তীব্র সমালােচকও হইয়াছি।
সক্রিয় রাজনীতি ও উকালতি হইতে অবসর গ্রহণের পর বৃদ্ধ বয়সে নিজেই পরিবার পরিকল্পনা নামে যৌন-বিজ্ঞানের একখানা বইও লিখিয়া ফেলিয়াছি। তাতে আমি খাদ্যাভাব মােচনের প্রচলিত উদ্দেশ্যে জন্মনিয়ন্ত্রণের চেয়ে দম্পতি ও পরিবারের সুখ-শান্তির জন্য জন্মনিয়ন্ত্রণকে উচ্চতর ও মহত্তর জীবন-বিধি রূপে প্রমাণ করিবার চেষ্টা করিয়াছি।
২৯০

পঞ্চম খণ্ড
সাহিত্যিক জীবন (গরমামুলি)

অধ্যায় চৌদ্দ
গণভিত্তিক সাহিত্যিক মােড়

১. উৎপ্রেরণা-জাত জাতীয় চিন্তা
সাহিত্যকে জীবন-ভিত্তিক হইতে হইবে এ ধারণাটা আমার ছিল একরকম। সহজাত। এটাকে উৎপ্রেরণা-ভিত্তিকও বলা যাইতে পারে। তবে সে জীবন যে গণজীবন হইতে হইবে, এ উপলব্ধি আসে আরাে পরে। কিন্তু এটা স্বীকার করতেই হইবে যে, গােড়ায় এর মধ্যে কোনও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল না। সাম্প্রদায়িক চেতনা ত ছিলই না। ছাত্রজীবনের গােড়া হইতেই আমি বঙ্কিমচন্দ্র, মাইকেল মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, রমেশ দত্ত, শরৎচন্দ্র প্রভৃতি কবিঔপন্যাসিককে বাংলা সাহিত্যের দিকপাল মনে করিতাম, এবং এঁদের অনুসারী আরাে শত-শত হিন্দু সাহিত্যিককে আমার অনুকরণযােগ্য আদর্শ ভাবিতাম। শ্রদ্ধার সঙ্গে অথবা মনােযােগে পড়িতামও। এই সব মনীষীর লেখায় কোনও মুসলমান চরিত্র নাই। বঙ্কিম-রমেশচন্দ্রের মত দুই-একজনের লেখায় যাও আছে, তা-ও ঘৃণা ও বিদ্বেষপূর্ণ। এসব দেখিয়া মনে আফসােস হইত বটে, কিন্তু তাতেও কোনও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ দেখিতাম না। কাজেই আফসােস হইলেও রাগ হইত না।
বরঞ্চ মনে করিতাম, বলিতামও যে, মুসলমান সমাজে নাটক-নভেলের চরিত্র হইবার মত লােকই নাই। নারী-পুরুষের প্রেমই যখন নাটকনভেলের উপজীব্য তখন কড়া পর্দাপালক মুসলিম সমাজ লইয়া উপন্যাসই। হইতে পারে না। শিশু-সুলভ এই সব চিন্তা-ধারণার যখন অবসান হইল, তখনও হিন্দু সাহিত্যিকদের মুসলিম-চরিত্রহীন বই-পুস্তককে ক্ষমার চক্ষেই দেখিয়া আসিতে থাকিলাম। লেখকদেরে কোনও দোষ দিতাম না। কারণ
২৯৩
দোষটা ত আমাদের সমাজের, মানে আমাদের। নাহক অপরকে দোষ দিব কেন?

২. সাহিত্য-জীবন
ছাত্র-জীবনের অবসানে এ বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গির যে পরিবর্তন হয়, সেটা গােড়ায় ছিল রাজনৈতিক। সে রাজনীতিতেও সাম্প্রদায়িকতা ছিল না। কারণ আমার রাজনৈতিক জীবনই শুরু হয় কংগ্রেসের মধ্য দিয়া। হিন্দু কংগ্রেস নেতাদের প্রশিক্ষণের অধীনে। রাজনৈতিক জীবনের প্রাইমারি স্তরেই ১৯২২ সালে আমি ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও কবি মােজাম্মেল হক সাহেবদ্বয়ের সম্পাদকতায় প্রকাশিত বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায় ‘গােলামী সাহিত্য শীর্ষক প্রবন্ধ লিখি। এই প্রবন্ধে গােটা বাংলা সাহিত্যকেই বিশেষত রবীন্দ্রশরৎচন্দ্রকে কঠোর ভাষায় সমালােচনা করি। সমালােচনা ত নয়, একেবারে নিন্দা। সে নিন্দায় অজ্ঞানতা, সাহিত্য সমালােচনায় অনধিকার, যতই থাকুক তাতে সাম্প্রদায়িকতা ছিল না। সাহিত্যিক সাম্প্রদায়িকতা মানে এখানে রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িকতার মত অবিচার বােধ নয়। এখানে সাম্প্রদায়িকতা মানে হিন্দু-মুসলিম স্বাতন্ত্র বােধ। গােলামী সাহিত্যে আমি গােটা বাঙ্গালী জাতির পক্ষ হইতেই কথা বলিবার চেষ্টা করিয়াছি। গােটা বাঙ্গালী জাতির স্বার্থের দিক হইতেই তৎকালীন সাহিত্যকে গােলামী সাহিত্য বলিয়াছি। বঙ্কিম-মাইকেল তত দিনে উনিশ শতকের ইউরােপীয় নব-জাগরণের বাণীই বাঙ্গালী জীবনে সাহিত্যের মাধ্যমে প্রচারের পথনির্দেশ করিয়াছেন। তাঁদেরই প্রদর্শিত পথে চলিয়া রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্র বাংলা সাহিত্যকে সত্য-সত্যই আধুনিক সাহিত্যে রূপান্তরিত করিয়া চলিয়াছেন। বস্তুত বাংলা সাহিত্যের ‘স্বর্ণযুগ’ তখন আরম্ভ হইয়াছে।
কিন্তু আমার মত তরুণের মনে অতবড় উপলব্ধি কোনও নাড়া দেয় নাই। আমার চোখে পড়িয়াছিল শুধু এই একটা দিক : বঙ্কিম-মাইকেল যা লিখিয়া গিয়াছেন, রবীন্দ্র-শরৎচন্দ্র যা লিখিতেছেন এবং এ দুই শক্তিধরের। অনুকরণে বাঙ্গালী সাহিত্য-সাধকরা যা লিখিতেছেন, তার সাথে বাঙ্গলার বাস্তব জীবনের কোনও মিল নাই। ইংরাজ-ফরাসি সাহিত্যিকদের অনুকরণে আমাদের সাহিত্যিকরা বাংলা ভাষায় বাঙ্গালী নামে কতকগুলি ইংরাজফরাসি চরিত্রের কাহিনী লিখিতেছেন। আমার বিবেচনায় পৌনে দুইশ বছরের বিদেশি প্রভাবে রাজনীতির দিক হইতে আমরা যেমন ইংরাজের
২৯৪
গােলাম হইয়া গিয়াছি, শিল্প-সাহিত্য-কৃষ্টির ক্ষেত্রে তেমনি আমরা ইংরাজের গােলাম হইয়া গিয়াছি। এটা অবশ্য অংশত আমার তৎকালীন রাজনৈতিক ভাবাবেগেরই ফল। কংগ্রেসের অসহযােগ ও খিলাফত আন্দোলনের দ্বারা ভারতের অন্যান্য তরুণদের মতই আমিও বিপুলভাবে প্রভাবিত হইয়াছিলাম। কিন্তু সে কারণে সাহিত্য সম্বন্ধে আমার ঐ মতবাদের মধ্যে কোনও সাম্প্রদায়িক বা আঞ্চলিক সংকীর্ণতা ছিল না। বরঞ্চ জাতীয় সাহিত্যের প্রাণ ও রূপ সম্পর্কে একটা ধারণা প্রকাশের প্রয়াস ছিল। কেউ-কেউ তা স্বীকারও করিয়াছিলেন দেখিয়া আমি উৎসাহিতও হইয়াছিলাম। এখানে উল্লেখযােগ্য যে, কলিকাতার সাহিত্যিক মহলে আমার এই প্রবন্ধে প্রকাশিত আমার মতবাদকে ধৃষ্টতা বলিয়া বিরূপ। সমালােচনা করা হইলেও বরিশাল হিতৈষীর সম্পাদক খ্যাতনামা কংগ্রেস নেতা শ্রীযুক্ত শরৎচন্দ্র ঘােষ তাঁর কাগজের সম্পাদকীয়তে আমার প্রবন্ধের সত্যভাষণের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করিয়াছিলেন এবং একজন অখ্যাতনামা সাহিত্যে-নবাগত’কে অভিনন্দন জানাইয়াছিলেন। এই মতবাদ যে আমার ক্ষণস্থায়ী ভাবাবেগ ছিল না, তার প্রমাণ এই যে পরবর্তীকালের বিভিন্ন সময়ে আমি একাধিক লেখায় এই একই কথা বলিয়া ও লিখিয়াছিলাম। তার মধ্যে ১৯৩২-৩৩ সালের সওগাত-এ ‘সাহিত্য ও যুগ-ধর্ম’ ও ১৯৪১৪২ সালে অধ্যাপক হুমায়ুন কবির-সম্পাদিত চতুরঙ্গ-এ ‘সাহিত্যিকের দৃষ্টিতে রাজনীতি’ শীর্ষক দুইটি বিতণ্ডামূলক দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখিয়াছিলাম । তাতে মােটামুটি ঐ একই কথা বলিয়াছিলাম বিভিন্ন যুক্তি-তর্কের অবতারণা করিয়া ।

৩. খণ্ডতার সংগত কারণ
এই সব বিতর্কমূলক প্রবন্ধে আমি তৎকালীন সাহিত্যিক নেতৃত্বের সমালােচনামূলক অনেক কথা বলিয়াছি বটে, কিন্তু সে সব আপত্তিকর কথার মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা ছিল না। ঐ সব সাহিত্যিক সমস্যার মধ্যে বাংলার হিন্দু-মুসলমানের স্বার্থের কোনও বিরােধ আছে, তেমন কোনও কথা আমি প্রকারান্তরেও বলি নাই। কারণ এ সম্পর্কে আমার কোনও চেতনাই তখনও জন্মে নাই। সামাজিক আচার-আচরণে মুসলমানদের প্রতি হিন্দুদের ব্যবহারে ছেলেবেলা হইতেই আমি ঘােরতর অসন্তুষ্ট ছিলাম। কিন্তু ওটাকেই হিন্দুদের সামাজিক কুসংস্কার, তার মানে তাদের দুর্বলতা মনে করিতাম।
২৯৫
ওতে আমার মনে মুসলমানদের কোনও ইনফিরিওরিটি বা হিন্দুদের কোনও সুপিরিওরিটি কমপ্লেক্স ছিল না। তবু সামাজিক ব্যবসায় হিন্দু ও মুসলমানের স্বাতন্ত্র্য সম্বন্ধে ছেলেবেলা হইতেই একটা ধারণা হইয়া গিয়াছিল । কিন্তু হিন্দুদের প্রতি সাধারণভাবে আমার কোনও বিদ্বেষ বা ঘৃণা ছিল না। হিন্দু শিক্ষক-অধ্যাপকদের ও বহু গুরুজনের প্রতি আমার সীমাহীন ভক্তি-শ্রদ্ধা-ভালবাসা ছিল। আজও আছে। ঐ ধরনের স্বাতন্ত্রের চিন্তাভাবনা আমার সামাজিক চিন্তা-ধারার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। সাহিত্যের ক্ষেত্রে আমার চিন্তা-ধারায় এই প্রকার কোনও ভাবনাই আমাকে স্পর্শ করিত না। রাজনীতিতে আমি ছিলাম জাতীয়তাবাদী ও কংগ্রেসি। সে কারণেও আমার সাহিত্য-চিন্তায় সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি প্রবেশ না করিয়া থাকিতে পারে। কিন্তু আশ্চর্য এই যে বয়স ও অভিজ্ঞতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে হিন্দু-মুসলিম সামাজিক স্বাতন্ত্র্য-চিন্তা আমার মনে আসে রাজনীতি ক্ষেত্রের আগে সাহিত্যক্ষেত্রে। কংগ্রেসি হিসাবে আমি যখন প্রজা-আন্দোলনে প্রবেশ করি, তখন প্রায় সকল হিন্দু কংগ্রেস-নেতাই তার বিরুদ্ধাচরণ করেন। প্রজা-আন্দোলনের বহু মুসলিম সহকর্মী এটাকে হিন্দুদের সাম্প্রদায়িকতা বলিতেন। কিন্তু আমি তা বলিতাম না। সাম্প্রদায়িকতার বদলে এটাকে আমি ভেস্টেড ইন্টারেস্টের স্বার্থপরতা বলিতাম । হিন্দু-জমিদার মহাজনদের দ্বারা হিন্দু মধ্যবিত্ত ও শিক্ষিত সম্প্রদায় সাধারণভাবে উপকৃত হইতেছেন। বলিয়া কৃষক-প্রজা-খাতক আন্দোলনে তারা সাধারণভাবে যােগ দিতেছেন। , এই যুক্তিতে এ ক্ষেত্রেও হিন্দুদের সাম্প্রদায়িকতা অভিযােগ হইতে রেহাই দিতাম।

৪. পীড়াদায়ক অভিজ্ঞতা
কিন্তু সাহিত্যের ক্ষেত্রে এমন কোনও যুক্তিতে হিন্দু সাহিত্যিকদেরে রেহাই দিতে পারিলাম না। সাহিত্য-ক্ষেত্রে কোনও প্রকারের ভেস্টেড ইন্টারেস্ট আমি কল্পনা করিতে পারিলাম না। কাজেই বাংলার অধিকাংশ অধিবাসী। মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও হিন্দু সাহিত্যিকরা তাদেরে লইয়া কোনও বই-পুস্তক লেখেন না, এতে আমি দুঃখিত ছিলাম। কিন্তু এই অভিযােগ ভিত্তি করিয়া মুসলমানদের তরফে কোনও প্রকার লেখালেখি করাটাকে আমি মর্যাদা হানিকর মনে করিতাম। এ ধরনের অভিযােগ আন্দোলনকে আমি নারী জাতির, তফসিলি হিন্দু সম্প্রদায়ের, চাকুরিতে মুসলমানদের এবং কৃষক
২৯৬
খাতকের অধিকার আদায়ের অভিযােগ—আন্দোলনের মতই শক্তিধরের বিরুদ্ধে অশক্তির, ক্ষমতাবানের বিরুদ্ধে অক্ষমের, উৎপীড়কের বিরুদ্ধে উৎপীড়িতের আন্দোলন মনে করিতাম । সাহিত্যের ক্ষেত্রে এটা ছিল আমার চিন্তার অতীত। এই জন্য আমি সওগাত, নওরােজ ইত্যাদি মুসলিম সম্পাদিত সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ সমর্থন করিতাম এবং রাজনৈতিক কারণে দি মুসলমান, মােহাম্মদী, মুসলিম হিতৈষী ইত্যাদি সংবাদপত্র প্রকাশ সমর্থন করিলেও গােড়াতে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি প্রতিষ্ঠা ও মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশের বিরােধী ছিলাম। কিন্তু বেশি দিন এই মনােভাব বাঁচাইয়া রাখিতে পারি নাই। বয়স ও অভিজ্ঞতা যত বাড়িতে লাগিল, জীবন ও সাহিত্যের সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা সম্বন্ধে আমার মত ততই দৃঢ় হইতে লাগিল । আমি উপলব্ধি করিতে থাকিলাম, পরকীয়া প্রেম, নর-নারীর প্রতি আকর্ষণ-বিকর্ষণই সাহিত্যের একমাত্র বিষয়বস্তু নয়। পশ্চিমা সাহিত্যের তথাকথিত ‘ইটারন্যাল ট্রায়েঙ্গল’ই নর-নারীর প্রেমের সত্যিকার ও শাশ্বত রূপ নয়। আমার এই মতবাদ আরাে দৃঢ় হইতে থাকিল যে অনর্জিত ধনসম্পদের অধিকারী কর্মহীন, শ্রমহীন, সুতরাং নিদ্রাহীন, অবসর-বহুলবহুভােগী বড়লােকদের কাছে নারী-প্রেম দুর্লভ ও নারী-হৃদয় দুৰ্জ্জেয় রহস্যপুরী হইতে পারে, কিন্তু হৃদয়বান একভােগী সাধারণ পুরুষের কাছে নারী-প্রেম দুর্লভও নয়, নারী-হৃদয় রহস্যপুরীও নয়। কাজেই জীবন-শিল্পসাহিত্যের একমাত্র বিষয়বস্তুও এটা হইতে পারে না। বরঞ্চ গণ-মানুষের অসংখ্য দুঃখ-বেদনা, হাসি-কান্না, তাদের মহত্ত্ব-নীচতা, বীরত্ব-ভীরুতা, ক্ষমা-ঘৃণা, ত্যাগ-লােভ ইত্যাদি হৃদয়-বৃত্তি অবলম্বনে সাহিত্য রচিত হইলে সেটাই হইবে সত্যিকার শিল্প ও উপভােগ্য সাহিত্য।
এই মতবাদ জোরদার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এমন উপলব্ধিও উন্মােষিত হইতে লাগিল যে সমাজ-ব্যবস্থার দরুন হিন্দু-সাহিত্যিকরা মুসলমান চরিত্র লইয়া গল্প-উপন্যাস লিখিতে পারেন না বলিয়া আমি যে এতদিন তাদেরে ক্ষমা করিয়া আসিতেছিলাম, সে ধারণা আমার ঠিক নয়। আমাদের প্রতি ঘৃণা-অবজ্ঞাই এ অবহেলার কারণ। মুসলমান কবি-সাহিত্যিকদের অযােগ্যতার দরুনই হিন্দু মাসিকাদিতে মুসলমান লেখকদের লেখা ছাপা হয় না, নজরুল ইসলামের আবির্ভাবের পরে এ যুক্তিও আর টিকিল না। মরহুম আফযালুল হকের মুসলিম ভারত ও নওরােজ-এর এবং নাসিরউদ্দীন সাহেবের সওগাত-এর মাধ্যমে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জনের পরেই নজরুল ইসলাম হিন্দু-সাহিত্যিকদের দ্বারা স্বীকৃতি পান, তার আগে নয়।
২৯৭
৫. নূতন উপলব্ধি
রাজনীতির মত সাহিত্যেও হিন্দু-মুসলিমের এই স্বাতন্ত্র-বােধ দেখিয়া ক্রমে আমি নূতন জ্ঞান লাভ করিলাম। আমার ক্রমশ এই উপলব্ধি হইতে লাগিল যে নজরুল ইসলামের মত যুগ-প্রবর্তক প্রতিভাকেও যে দেশে স্বতন্ত্র সাম্প্রদায়িক সিঁড়ি বাহিয়া উপরে উঠিয়া পরিচিত ও স্বীকৃত হইতে হয়, সে দেশে এই স্বাতন্ত্রটাই বােধহয় বাস্তব সত্য। এর পর বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির সেক্রেটারিগিরি গ্রহণ করিতে আমার আর কোনও আপত্তি থাকিল না। রাজনীতিতে অসাম্প্রদায়িক উদারপন্থী কংগ্রেস-খিলাফতী সহকর্মী ও সাহিত্য-ক্ষেত্রে আমার অন্যতম মুরুব্বি ও পথপ্রদর্শক মৌ. মােহাম্মদ ইয়াকুব আলী চৌধুরী সাহেবই বস্তুত আমাকে এই ‘সাম্প্রদায়িক সাহিত্য সমিতির সেক্রেটারিগিরি গ্রহণ করিতে বাধ্য করেন। ততদিনে প্রজাস্বত্ব আইনের ব্যাপারে সকল মতের ও সকল শ্রেণীর হিন্দুর ও সকল মতের ও সকল শ্রেণীর মুসলমানরা দুই পৃথক লাইনে কাতারবন্দী হইয়া উঠিয়াছেন । ভাষা ও শব্দের হিন্দু-মুসলমানিত্ব সম্বন্ধে মুসলমানী কথার অভিজ্ঞতার সাথে যােগ হইল নয়া পড়ার অভিজ্ঞতা। কঠোর বাস্তবতার কাছে ভাবাবেগ-সস্তৃত আদর্শবাদ পরাজিত হইল। জীবন-ক্ষুধা নামক আমার যে নভেল কৃষক-প্রজা আন্দোলন রূপায়ণের উদ্দেশ্যে শুরু হইয়াছিল, তা পর্যবসিত হইল পাকিস্তান আন্দোলনের বাস্তবতা চিত্রায়ণে। আমার সাহিত্যিক চিন্তাধারার এই ক্রমােন্নতি, অথবা বলিতে পারেন, ক্রমাবনতি, এমন স্তরে আসিল যে ১৯৪৩ সালে কলিকাতার প্রােগ্রেসিভ রাইটার্স এসােসিয়েশনের বার্ষিক সম্মিলনীতে এক ভাষণে আমি লিখিয়াছিলাম : ভারতে রাজনৈতিক পাকিস্তান হইবে কি। না জানি না, কিন্তু এটা নিশ্চিত যে বাংলার মেজরিটি সম্প্রদায় মুসলমানদের মুখের ভাষাকে হিন্দু সম্প্রদায়ের লেখক-সাহিত্যিকরা এবং শিক্ষা বিভাগে যেভাবে সাহিত্য ও পাঠ্যপুস্তক হইতে পরিহার করিয়া চলিয়াছেন, তাতে বাংলায় সাহিত্যিক পাকিস্তান হইতে বাধ্য।

৬. জটিলতা বৃদ্ধি
এটা ত গেল লেখ্য বাংলা ভাষার সমস্যা। এর পরেও গােদের উপর একটা বিষফোড়া দেখা দিল। আঠার শতকের শেষ দিককার মার্কিন ও ফরাসি বিপ্লব ও বিশ শতকের গােড়ার রুশ বিপ্লবের ফলে ইউরােপ ও আমেরিকায়
২৯৮
ভাষা ও সাহিত্য একটা গণমুখী মােড় গ্রহণ করিল প্রবল স্রোতের বেগেই। খুব স্বাভাবিক কারণেই বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এটা প্রতিফলিত হইল। কলিকাতা-কেন্দ্রিক বাংলাতে স্বভাবতই এই গণমুখিতা পশ্চিম বাংলায় কেন্দ্রীভূত হইল। কলিকাতা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের আঞ্চলিক কথ্য ভাষা। সাহিত্যের ভাষার মর্যাদা লাভ করিয়া ইতিপূর্বে বাংলায় যেটা ছিল শুধু হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক স্বাতন্ত্র, তার সাথে যােগ হইল পশ্চিম ও পূর্ব বাংলার আঞ্চলিক স্বাতন্ত্র। এই ডাবল সমস্যার সমাধান স্পষ্টত দুঃসাধ্য ছিল। এমনি সময়ে ভারতীয় মুসলমানদের রাজনৈতিক পাকিস্তান দাবি উঠিল। হিন্দুরা স্বভাবতই প্রবল বিরােধিতা করিল। পরিণামে হিন্দুদের দাবিতে বাংলা পশ্চিম ও পূর্ব বাংলায় বিভক্ত হইয়া গেল। কলিকাতাসহ পশ্চিমবঙ্গ ভারতের অন্তর্ভুক্ত হইল । দুইশ বছরের কলিকাতার হিন্টারল্যান্ড পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হইল। ঢাকা পূর্ব-পাকিস্তানের রাজধানী হইল। আগে ছিল যেটা ভাষা-সাহিত্যের ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক ও আঞ্চলিক স্বাতন্ত্রের প্রশ্ন, সেটাই হইয়া গেল দুই স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জাতীয় স্বকীয়তার প্রশ্ন।

৭. আমার উভয়সংকট
এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিটা আমাকে যতটা আঘাতিত ও বিভ্রান্ত করিল, আমার জানা কাউকে বা আমার বন্ধু-বান্ধব ও সহকর্মীদের ততটা। আঘাতিত ও বিভ্রান্ত করিয়াছে বলিয়া মনে হইল না। আমার এই একাকিত্ব ও অনন্য সাধারণত্বের কারণ খুঁজিবার অনেক চেষ্ট করিয়াছি। দেশভাগের আগের প্রায় দশ-পনের বছর ও দেশভাগের পরের পঁচিশ বছর একুনে আমার সাহিত্যিক জীবনের এই চল্লিশটি বছর এই গবেষণায় না হােক, ধ্যান ধারণা ও চিন্তা-ভাবনায় কাটিয়াছে। আমি কোনও অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী নই। তবু আমার এই একাকিত্বের কারণ কী? এর একমাত্র উত্তর, আমার বিবেচনায়, এই যে বাংলার রাজনীতি ও সাহিত্যের উভয় ক্ষেত্রেই আমার বিশেষ একাকিত্ব বরাবরই ছিল। রাজনীতিতে আমি বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী ও কংগ্রেসি ছিলাম আন্তরিকতার সাথেই। কিন্তু সেখানেও আমি গণমুখী, ভাষান্তরে ও কার্যান্তরে, কৃষক-প্রজা কংগ্রেসি ছিলাম । রাজনীতিতে আমার বাঙ্গালী জাতীয়তা ছিল দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের প্যাটার্নের। এ জাতীয়তাবাদে বাঙ্গালী হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের অর্থ ছিল
২৯৯
রাজনৈতিক ফেডারেশন, কৃষ্টিক ফিউশন ছিল না। ব্যবহারিক রাজনীতিতে এটা সম্ভব ও বাস্তব ছিল। কিন্তু সাহিত্য-ক্ষেত্রে এটা সম্ভব ছিল না। কারণ রাজনীতিতে মেজরিটি আধিপত্য, সাহিত্যে মাইনরিটির রাজত্ব। দেশবন্ধুর জাতীয়তাবাদ যখন বাঙ্গালী হিন্দুরা গ্রহণ করিল না তখনই বহুজাতিক উপমহাদেশ ইন্ডিয়ার সঙ্গে সঙ্গে একজাতিক বেঙ্গলও ভাগ হইয়া গেল। বহু জাতীয়তাবাদী কংগ্রেসি মুসলিম পাকিস্তান দাবির সমর্থন করিয়াছেন। বহু জাতীয়তাবাদী কংগ্রেসি হিন্দু বেঙ্গল পার্টিশন-সমর্থন করিয়াছেন। এটা তাঁদের পক্ষে কঠিন ছিল। রাজনৈতিক পরিবেশ ও স্বাধিকার-বােধই জাতীয় চেতনায় বিবর্তন ঘটাইয়া এ কাজ সহজ করিয়া দেয়। কিন্তু কংগ্রেসি মুসলিম সাহিত্যিকের পক্ষে এটা তত সহজ ছিল না। বহু মুসলিম সাহিত্যিক পাকিস্তান দাবির সমর্থন করিয়াছেন। কিন্তু তাঁরা কংগ্রেসি জাতীয়তাবাদী ছিলেন না। পাকিস্তান দাবির সমর্থনের আগে তাঁরা সক্রিয় রাজনীতি করিতেন না। মুসলিম-প্রধান একটা নয়া রাষ্ট্র গঠনের দাবিতে তারা অতি সহজেই সমর্থন করিতে পারিলেন। আমার পক্ষে সেটা সম্ভব ছিল না। কাজেই আমাকে চিন্তা-ভাবনা করিয়া পাকিস্তানি হইতে হইয়াছিল। তাতে তিন-চার বছর লাগিয়াছিল। গােড়াতে আমি আমার সম্পাদিত দৈনিক কৃষক-এ কষিয়া পাকিস্তান দাবির নিন্দা করিয়াছি। মুসলিম স্বার্থ সম্বন্ধে আমি সচেতন ও মুখর ছিলাম না, তা নয়। বরঞ্চ কংগ্রেসে আমি মুসলিম স্বার্থ রক্ষার দাবি সবল ভাষায় করিয়াছি। কিন্তু সে কারণে দেশভাগ করার আমি প্রয়ােজন বােধ করি নাই। বরঞ্চ আমি মনে করিয়াছি, দেশভাগে মুসলমানদের লাভের চেয়ে ক্ষতিই হইবে বেশি। পরে আমি যখন পাকিস্তানবাদী হইলাম, তখন এমন সর্বাত্মক পাকিস্তানি হইলাম যে মুসলিম লীগ নেতাদের চেয়েও গােড়া পাকিস্তানি হইলাম। কারণ আমার পাকিস্তানি। চিন্তার মধ্যে কৃষক-প্রজা অর্থনৈতিক অধিকারের এবং মুসলমানদের কৃষ্টিসাহিত্যিক স্বকীয়তার প্রবল অনুভূতি ছিল। এই দুইটা দাবির মধ্যে প্রথমটা যেমন স্কুল ও দৃশ্যমান ছিল, দ্বিতীয়টা তত স্কুল ও দৃশ্যমান ছিল না। সে জন্য মুসলিম ইন্টেলিজেনশিয়া সাধারণত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাতন্ত্র্য সম্বন্ধে যতটা সচেতন ছিলেন, কৃষ্টি-সাহিত্যের ব্যাপারে তত সচেতন ছিলেন না।
৩০০
৮. পাকিস্তান সংগ্রামে মুসলিম সাহিত্যের দ্বিধাবিভক্তি
অধিকন্তু এটা স্মরণীয় যে বাংলার অধিকাংশ প্রতিভাধর মুসলিম সাহিত্যিকরাই পাকিস্তান আন্দোলনের বিরােধী ছিলেন। সেকালের সাহিত্যিকদের দৃষ্টি ছিল সাধারণত আসমানের দিকে মাটির দিকে নয়। পাকিস্তান দাবিকে তারা সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক দাবি মনে করিতেন। সাহিত্যে সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতার স্থান নাই বলিয়া তারা বিশ্বাস করিতেন। এর দুইটা কারণ ছিল। প্রথমত, কৃষ্টি-সাহিত্যকে তাঁরা ক্লাসের (উচ্চবর্ণের) সম্পদ ভাবিতেন, ‘মাসের’ (জনগণের) সম্পদ ভাবিতেন না। দ্বিতীয়ত, তাঁদের এই আত্মবিশ্বাস ছিল যে হিন্দু-মুসলিম মিশ্রিত জাতীয়তার ক্ষেত্রে তারা আপনআপন প্রতিভাবলেই নিজেদের স্থান করিয়া লইতে পারিবেন। একটি মাত্র দৃষ্টান্তই যথেষ্ট। নজরুল ইসলাম তার মুসলিম-চৈতন্যে আকাশচুম্বী হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তান দাবির তীব্র বিরােধিতা করিয়াছেন। সাহিত্য-ক্ষেত্রে হিন্দুপ্রাধান্য তাঁর অসাধারণ যুগ-প্রবর্তক-প্রতিভাকে দাবাইয়া রাখিতে পারে নাই। এই অভিজ্ঞতার চূড়ায় বসিয়া তিনি বাঙ্গালী মুসলমানের প্রাণের প্রকাশ সােচ্চারে এবং সাফল্যজনকভাবেই করিয়াছেন। কিন্তু তাদের মুখের চিন্তা করা তখনও প্রয়ােজন মনে করেন নাই। নিজের বিপুল আত্মবিশ্বাসের জোরে তিনি পাকিস্তান আন্দোলনের গােড়ার দিকে তার তীব্র বিরােধিতা করিয়াছিলেন বটে, কিন্তু দেশভাগ হইয়া পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরেও তিনি সেই মতবাদে বিশ্বাসী থাকিতেন কি না, আজ তা বলা খুবই কঠিন। যতই কঠিন হােক, এটা অনুমান করা তত কঠিন নয় যে, তাঁর মুসলিম-চৈতন্যের তীব্রতা এবং মুসলিম ঐতিহ্যে আস্থার প্রাচুর্য তাঁকে শেষ পর্যন্ত ঢাকায় আনিত এবং এ দেশেরই কৃষ্টি-সাহিত্যের নবায়নের নেতৃত্ব গ্রহণে বাধ্য করিত। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটে নাই। পাকিস্তান আন্দোলনের গােড়াতেই তিনি শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতায় আক্রান্ত হন। আজ ত্রিশ বছর ধরিয়া তিনি সম্বিৎহারা হইয়াও বাচিয়া আছেন। দুই বছর আগে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সরকার তাকে ঢাকায় আনিয়া সুচিকিৎসার ব্যবস্থাদি করিয়াছেন।
পক্ষান্তরে অপর প্রতিভাবান কবি-সাহিত্যিক গােলাম মােস্তফা বাংলার মুসলমানদের মুসলিম সত্তায় তীব্রভাবে সচেতন ছিলেন বটে, কিন্তু তাদের বাঙ্গালী সত্তার দৈশিক জাতীয় ঐতিহ্য ও স্বকীয়তায় তেমন সচেতন ছিলেন না। এই জন্যই পরবর্তীকালে পাকিস্তান স্থাপনের পরে তিনি পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা রূপে উর্দুর সমর্থন করিতে পারিয়াছিলেন। এই দুই প্রতিভাধরের
৩০১
দৃষ্টান্ত হইতে বুঝা গেল যে পাকিস্তান আন্দোলনের মুখে, পঞ্চম দশকের গােড়ার দিকে বাঙ্গালী মুসলিম লেখক-সাহিত্যিকরা মােটামুটি দুইটি দলে বিভক্ত ছিলেন। একদল ছিলেন পাকিস্তানের বিরােধী। তারা বলিতেন, ধর্মের সাথে জাতীয়তা ও জাতীয় সাহিত্যের কোনও সংশ্রব নাই। শিল্প-সাহিত্যে সাম্প্রদায়িকতার কোনও স্থান নাই। অপর দলে ছিলেন পাকিস্তান আন্দোলনের সমর্থক। তারা দৈশিক জাতীয়তা ও কৃষ্টি-সাহিত্যের স্বাতন্ত্রে বিশ্বাস করিতেন না। ধর্মকেই তারা মুসলমানদের রাজনীতি, কৃষ্টি ও সাহিত্যের একমাত্র নিয়ন্ত্রক মনে করিতেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরেও প্রথম দল বলিতে থাকিলেন, দেশভাগ হইলেও আমাদের কৃষ্টি-সাহিত্য ভাগ হয় নাই। কৃষ্টিসাহিত্য অবিভাজ্য। পশ্চিম বাংলা ও পূর্ব বাংলা পৃথক-পৃথক ও স্বাধীন-স্বাধীন রাষ্ট্র হইলেও দুই বাংলার কৃষ্টি-সাহিত্য অবিভক্ত রহিয়া গিয়াছে। দ্বিতীয় দল বলিতে লাগিলেন, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দ্বারা এটাই প্রমাণিত ও স্বীকৃত হইল যে পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের কৃষ্টি-সাহিত্য অভিন্ন।
আমি এই দুই দলের কোনটারই অন্তর্ভুক্ত ছিলাম না। পাকিস্তান সৃষ্টির আগেও ছিলাম না; পরেও নাই। এ সব কথাই আমি এই খণ্ডে বিস্তারিতভাবে বলিয়াছি।
৩০২

অধ্যায় পনের
স্বাতন্ত্রের স্বীকৃতি

১. সােজা পথ সহজ না
পাকিস্তান সৃষ্টির প্রায় এক যুগ পূর্ব হইতে আমার সাহিত্যিক মতবাদে যে ধীর অথচ দৃঢ় পরিবর্তন আসিতেছিল, তাতে আমার আশা হইয়াছিল অখণ্ড বাংলার কৃষ্টিবােধের ও সাহিত্যিক-স্বাতন্ত্রের জটিলতা বাংলা বাটোয়ারায় সহজ হইয়া গেল। রাজনীতিতে ‘স্পিরিট-অব-পার্টিশন’-এর ব্যাখ্যা করিয়া আমি ভারত বাঁটোয়ারাকে যেমন হিন্দু-মুসলিম সমস্যার সর্বাঙ্গীণ সুন্দর সমাধান বলিয়াছিলাম ও বিশ্বাসও করিয়াছিলাম, পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার স্বতন্ত্রীকরণকে আমি তেমনি আমাদের কৃষ্টিক, ভাষিক ও সাহিত্যিক জটিলতার সহজ সমাধানের পন্থা বলিয়া অভিনন্দিত করিয়াছিলাম। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথকে আমি এই মতবাদের সমর্থক খাড়া করিয়াছিলাম। মৃত্যুর মাত্র দুই বছর আগে বােধ হয় দূরদর্শিতা বলেই তিনি লিখিয়াছিলেন : বাংলা আসলে দুইটা। পূর্ব ও পশ্চিম বাংলা শুধু দেহে নয়, অন্তরেও দুই। কলিকাতা-কেন্দ্রিক পশ্চিম বাংলা হইতে পৃথক হইয়া পূর্ব বাংলা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিকে স্বাধীনতা পাইল, রাজনৈতিক নেতারা অবশ্যই তা উপলব্ধি করিয়াছিলেন। কিন্তু আমার দৃষ্টি ছিল অন্য দিকে। আমি ভাবিয়াছিলাম, কৃষ্টিক-ভাষিক ও সাহিত্যিক দিকে পূর্ব বাংলা পশ্চিম বাংলার সবল দুচ্ছেদ্য বাহু-ডাের হইতে মুক্ত হইয়া স্বকীয়তা আত্মস্থ ও বিকশিত হইবার সুযােগ লাভ করিল। এটা অচিন্তনীয় অপূর্ব সুযােগ। অন্যথায় কলিকাতার পাটকেলের হাত হইতে পূর্ব বাংলার কৃষকদের মুক্তির যেমন কোনও সম্ভাবনা ছিল না, বঙ্কিম-রবীন্দ্র-শরৎচন্দ্রের দুর্ভেদ্য বৃত্ত হইতে পূর্ব
৩০৩
বাংলার শিল্পী-সাহিত্যিকদের মুক্তিরও কোনও আশা ছিল না। এ অবস্থায় কলিকাতা ছাড়িয়া সকলের আগে ঢাকা আসা আমার প্রথম কর্তব্য ছিল লেখক-সাহিত্যিকদের জন্য টেবিল-চেয়ার সাজাইতে, অভাবে সিলেটের শীতল পাটি বিছাইতে; আর, নারী-সাহিত্যিকদের জন্য কলিকাতার শিফনকাথানের বদলে ঢাকাইয়া জামদানি যােগাড় করিতে। কিন্তু ইত্তেহাদ-এর ঢাকা আসার পথে সরকারি প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হওয়ায় উহার সম্পাদনার দায়িত্ব পালনের দরুন আমারও ঢাকা আসিতে তিন বছর দেরি হইয়া গেল । তাই কলিকাতায় বসিয়া পূর্ব পাকিস্তানের সামান্য খেদমত করিবার চেষ্টা করিলাম। পূর্ব পাকিস্তানের শিশুদের জন্য ছােটদের কাছাছুল আম্বিয়া নামক দুই খণ্ডের একটি শিশু-পাঠ্য-পুস্তক লিখিলাম। এই প্রথম চেষ্টায় সরকার পক্ষ হইতে যে বাধা পাইয়াছিলাম, তৎকালে সেটা খুবই কঠোর মনে হইয়াছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে স্বয়ং সাহিত্যিকদের নিকট হইতে প্রাপ্ত বাধার কাছে সে সরকারি বাধাটা ছিল নিতান্তই তুচ্ছ। শিল্পী-সাহিত্যিকদের বিরােধিকার কথা পরে ক্রমে-ক্রমে বলিতেছি। সরকারি বাধাটার কথাটা আগে কহিয়া লই।

২. প্রথম তিক্ত অভিজ্ঞতা
আমি চিত্র-শিল্পকে শিল্প-সাহিত্যের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ মনে করি। এ বিষয়ে আমি আমাদের ওলামা-সমাজের একাংশের সহিত একমত কোনও দিন ছিলাম না। সাধারণ শিল্প-সাহিত্য ছাড়াও শিক্ষাক্ষেত্রেও চিত্রকে অত্যাবশ্যক মনে করিতাম। বিশেষত শিশুশিক্ষায় ‘পিকটরিয়েল রিপ্রেন্টেশন’-কে অপরিহার্য বিবেচনা করিতাম । এই বিশ্বাসকে পাকিস্তানের শিক্ষা-বিভাগে চালু করিবার আশায় ১৯৪৭ সালে কলিকাতা বসিয়াই ছােটদের কাছাছুল আম্বিয়া নামে দুই খণ্ডের একটি সচিত্র শিশুপাঠ্য বই লিখিলাম। তাতে শেষ পয়গম্বর হযরত রসুলুল্লাহ ছাড়া কতিপয় প্রধান নবীর ও সেই সঙ্গে ইবলিস, নমরুদ ও কারুনের কাহিনী লিখিলাম। এই বইয়ে কাহিনীর সাথে সংগতি রাখিয়া কিছুকিছু কাল্পনিক ছবি দিলাম। ছবিগুলি তকালীন শ্রেষ্ঠ মুসলিম আর্টিস্টদের অন্যতম কাজী আবুল কাসেমের হাতে আঁকাইলাম। মানুষের, বিশেষত, পীর-পয়গম্বরদের, ছবি সম্বন্ধে মুসলিম সংস্কারের প্রতি নজর রাখিয়া এই সব কাল্পনিক ছবি আঁকিতেও বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা হইল। কোনও ছবিতেই সংশ্লিষ্ট নবীর মুখ দেখান হইল না। শিশুদের পক্ষে কাহিনী বুঝিবার জন্য যেভাবে যতটুকু দরকার সেইভাবে ও ভঙ্গিতে একজন কল্পিত মানুষের
৩০৪
ছবি আঁকা হইল মাত্র। আমার প্রিয় বন্ধু আয়নুল হক খা ও মােহাম্মদ নাসির আলীর ঢাকায় সদ্য-প্রতিষ্ঠিত নওরােজ কিতাবিস্তান এই বই ছাপিয়া বাজারে ছাড়িলেন। বইটি তকালীন জনপ্রিয়তা লাভ করিল। কোনও কোনও শিক্ষাবিদ বইখানাকে ক্লাস থ্রি-ফোরের র্যাপিডরিডার’ করিবার সুপারিশ করিলেন। এমন সময় পূর্ব বাংলা শিক্ষা দফতরের সেক্রেটারি জনাব এফ করিমের একটি শােকয’ নােটিস ও ঢাকা হইতে প্রকাশিত একমাত্র দৈনিক আজাদ-এর সম্পাদকীয় রূপে একটি হুঁশিয়ারি পাইলাম। সরকারি নােটিসে আমার এ বই কেন বাযেয়াফত হইবে না, তার কারণ দর্শাইতে বলা হইল। আর আজাদ-এর সম্পাদকীয়তে আমাকে ভােলানাথের কথা স্মরণ করাইয়া দেওয়া হইল। উল্লেখ্য যে, কিছুদিন আগে হযরত পয়গম্বর সাহেবের ছবিসহ একটি বই বিক্রির অপরাধে ভােলানাথ সেন নামক কলিকাতার এক পুস্তকবিক্রেতাকে জনৈক মুসলমান আততায়ী হত্যা করিয়াছিল। এই উপলক্ষে আজাদ আমার এই পুস্তকের প্রকাশক ও বিক্রেতাদিগকেও হুঁশিয়ার করিয়া দিলেন। মওলানা আকরম খাঁ সাহেবের আজাদ-এর কথার জবাবে শহীদ সুহরাওয়ার্দীর ইত্তেহাদএর কিছু বলিবার উপায় ছিল না। তাই আমি পূর্ব বাংলা সরকারের শিক্ষা-দফতরের সেক্রেটারি সাহেবের জবাব দিলাম। মি. এফ করিম ছিলেন উর্দু সাহিত্যিক। তাঁর সাথে আমার পরিচয় ছিল। তাই আমার ‘ক শাে’ করিবার কৈফিয়তটি শুধু সরকারি অভিযুক্ত আসামির কাঠখােট্টা লিগ্যাল স্টেটমেন্ট ছিল না। একজন সাহিত্যিকের কাছে অপর একজন সাহিত্যিকের পত্রও ছিল সেটা। পয়গম্বর সাহেবরাও দেহী মানুষ ‘বাশার আল-কোরআনের এই শিক্ষার দিকে এবং পিকটরিয়েল রিপ্ৰেযেন্টেশন ছাড়া শিশুশিক্ষা হয় না বলিয়া আধুনিক শিক্ষাবিজ্ঞানীদের অভিমতের দিকে সেক্রেটারি সাহেবের মনােযােগ আকর্ষণ ত করিলামই, তাছাড়া সদ্য-প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান সরকারের শিক্ষানীতি সম্বন্ধে কতিপয় প্রশ্ন পেশ করিলাম। শিল্প-সাহিত্য সম্পর্কে তাঁর সরকারের অভিমত কী সে প্রশ্নও তুলিলাম। নয়া রাষ্ট্রের নয়া সরকার পাকিস্তানে সিনেমা-থিয়েটার করিতে দিবেন কি না, দিলে সে সবে আউলিয়া-দরবেশপীর-পয়গম্বদের মত আদর্শ ও অনুকরণীয় চরিত্রসমূহ রূপায়ণ ও চিত্রায়ণ করিতে দেওয়া হইবে? না প্রচলিত নাটক-সিনেমার মত শুধু অমুসলমানদের দেব-দেবী ও মহাপুরুষদেরে লইয়াই পাকিস্তানি ছায়াছবি ও ড্রামা-নাটক হইতে থাকিবে? যদি মুসলিম মহাপুরুষদের জীবনালেখ্য নাটকে-সিনেমায়। আঁকিতে হয়, তবে ছবি ত ছবি জিন্দা মানুষকে পীর-পয়গম্বর সাজিতে হইবে
৩০৫
কি না? যদি, পক্ষান্তরে, মুসলিম মহাপুরুষদের জীবন লইয়া কোনও নাটকসিনেমা করিতে না দেওয়া হয় তবে, পাকিস্তানের জনগণ নাটক-সিনেমার মারফত একটা বিপুল সম্ভাবনাময় মহৎ শিক্ষার মাধ্যম হইতে বঞ্চিত থাকিবে কি না? যদি পাকিস্তানের নাটক-সিনেমায় শুধু অমুসলমান দেব-দেবী ও মহাপুরুষদের জীবনালেখ্য প্রদর্শিত হয়; তবে পাকিস্তানি মুসলমানদের ধর্মীয় ও কৃষ্টিক পরিস্থিতি ও পরিবেশ কী দাঁড়াইবে, পাকিস্তানের বর্তমান শাসকরা কি চিন্তা করিয়া দেখিয়াছেন? ইত্যাদি ইত্যাদি।
মি. এফ করিম আমার এই পত্রের প্রাপ্তি স্বীকার করিলেন মাত্র দু-চার লাইনে। কোনও জবাবও দিলেন না। আমার বইটা ফর্মালি বাযেয়াফতও করিলেন না। কিন্তু তার দরকারও হইল না। আজাদ-এর হুমকিতে পূর্ব বাংলার পুস্তক বিক্রেতাদের মধ্যে এমন সন্ত্রাস সৃষ্টি হইল যে তাঁর এই বই আর বিক্রয় করিলেন না। যার-তার মওজুদ কপি হয় পাবলিশারকে ফিরাইয়া দিলেন, অথবা পােড়াইয়া ফেলিয়াছেন বলিলেন। পাবলিশার নিজেও তাই করিলেন। ছবিগুলি বাদ দিয়া নূতন করিয়া বইখানি আবার ছাপাইলেন। ছবিছাড়া শিশুপাঠ্য বই স্বভাবতই ছবিওয়ালা বইয়ের মত চলিল না। এ ঘটনার বেশকিছু দিন পরে শিক্ষা দফতর ছােটদের কাছাছুল আম্বিয়াকে সত্য-সত্যই র্যাপিডরিডার করিয়াছিলেন। কিন্তু সেটা ছবিওয়ালা না ছবিহীন তার উল্লেখ না থাকায় সরকারি আদেশের চেয়ে আজাদ-এর আদেশই পাবলিশার ও বিক্রেতার নিকট বেশি মর্যাদা পাইল ।

৩. পশ্চিমাদের অদূরদর্শিতা
১৯৫০ সালের মে মাসে আমি কলিকাতা ত্যাগ করিয়া দেশে ফিরিলাম । কলিকাতা বসিয়া পূর্ব বাংলার লেখক-সাহিত্যিকদের কৃষ্টিক-সাহিত্যিক স্বকীয়তাবােধ সম্বন্ধে আমি যে আশা ও ধারণা করিয়াছিলাম, ঢাকায় তার কিছুই দেখিলাম না। বরঞ্চ তার উল্টাটাই দেখিলাম । অবশ্য এর রাজনৈতিক কারণও ছিল। স্বয়ং কায়েদে আযম হইতে শুরু করিয়া পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা বাংলার বিরুদ্ধে ও উর্দুর পক্ষে যে অভিযান চালাইয়াছিলেন, পূর্ব বাংলার মুসলিম নেতারা সে অভিযানে যেরূপ আত্মমর্যাদাবােধহীন অদূরদর্শী জি-হুযুর বৃত্তি চালাইয়া যাইতেছিলেন, তাতে পূর্ব বাংলার ইনটেলিজেনশিয়া ও ছাত্রসমাজ স্বভাবতই উর্দু ও পশ্চিমা নেতাদের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ হইয়া উঠিয়াছিলেন। ভাষা-সাহিত্যের ক্ষেত্রে এই উর্দু-বিরােধিতা বােধগম্য কারণেই
৩০৬
পশ্চিম বাংলামুখিতার রূপ নিল। ‘৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের বিপুল সাফল্যও নয়া রাষ্ট্র পূর্ব বাংলার কৃষ্টিক স্বকীয়তা লাভের কোনও কাজে লাগিল না । পূর্ব বাংলার ছাত্র তরুণ ও শিক্ষিত সম্প্রদায় নিতান্ত আত্মরক্ষার দায়ে যে পরিমাণ ও অনুপাতে উর্দু-বিরােধী সংগ্রাম চালাইলেন, সেই পরিমাণ ও অনুপাতে নিজেদের অজ্ঞাতসারেই এবং যুদ্ধের নিয়ম অনুসারেই তাঁরা পশ্চিম বাংলার কৃষ্টি-সাহিত্যিক দুর্গের শক্তিশালী প্রচারের অন্তরালে ঢুকিতে। লাগিলেন। দুই যুগ পরে সত্তরের দশকে রাজনৈতিক অধিকারের সংগ্রামে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র-তরুণ ও শিক্ষিক সম্প্রদায় পাঞ্জাবি সৈন্যের পিটুনিতে যেমন ভারতীয় রাষ্ট্রীয় সামরিক ছায়ায় আশ্রয় লইতে বাধ্য হইয়াছিল, পঞ্চাশের দশকের উর্দুর হামলা হইতে ভাষা-কৃষ্টি রক্ষার জন্য ঠিক তেমনি তারা কলিকাতার কৃষ্টি-সাহিত্যিক দুর্গে আশ্রয় লইয়াছিল। ভাষা-আন্দোলনে আমি সক্রিয় অংশগ্রহণ করিয়াছি। বস্তুত কলিকাতা হইতেই ইত্তেহাদএর লেখায় ও সংবাদ সরবরাহের মাধ্যমে ভাষা-আন্দোলনের সমর্থন শুরু করিয়াছিলাম।
কিন্তু ভাষা-আন্দোলনকে নয়া রাষ্ট্রের কৃষ্টিক স্বকীয়তাবােধ স্ফুরণের কাজে লাগাইতে পারি নাই। পাকিস্তান আন্দোলনের বন্যা-স্রোতের সামনে দাঁড়াইয়া কলিকাতা হইতে চল্লিশের দশকে আমরা কতিপয় সাহিত্যিক পূর্ব পাকিস্তান। রেনেসাঁ আন্দোলনের মাধ্যমে আমাদের যে রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা, কৃষ্টিক স্বকীয়তা ও জাতীয় স্বাতন্ত্রের কথা সগর্বে বুলন্দ আওয়াজে বলিতে পারিয়াছিলাম, পঞ্চাশের দশকে ঢাকায় বসিয়া তার কিছুই বলিতে পারিলাম না। পশ্চিম পাকিস্তান ও পশ্চিম বাংলার মধ্যে লাহাের ও কলিকাতার মধ্যে এবং ইকবাল। ও রবীন্দ্রনাথের মধ্যে যে একটা পূর্ব বাংলা, একটা ঢাকা, একটা নজরুল ইসলাম আছে, তা আমরা কেউ বুঝিলাম না। এই না বুঝারও একটা সংগত কারণ আছে। সেটা পাকিস্তান সৃষ্টির আগের উর্দু ও বাংলা-সাহিত্যের একশ বছরের ইতিহাস। এই মুদ্দতে উর্দু-সাহিত্যের নেতৃত্ব ছিল মুসলমানদের হাতে । বাংলা-সাহিত্যের নেতৃত্ব ছিল হিন্দুদের হাতে। শুধু ফর্ম ও কনটেন্টেই নয়, প্রাণরূপ ও আঙ্গিকেও উর্দু-সাহিত্য ছিল মুসলিম কৃষ্টির বাহন, সুতরাং মুসলিম সাহিত্য। পক্ষান্তরে, ঐ সব ব্যাপারে বাংলা সাহিত্য ছিল হিন্দু কৃষ্টির বাহন, অতএব হিন্দু সাহিত্য। এটা অবশ্য স্থল ও সুপারফিশিয়াল দৃষ্টি। কিন্তু বাস্তব দৃষ্টি। কারণ ভারত বাটোয়ারার সমগ্র ব্যাপারটাই তৎকালে এই দৃষ্টিকোণ হইতে বিচার করা হইতেছিল। রাজনীতি ক্ষেত্রে যেমন স্পিরিট-অবপার্টিশনটা দুই নয়া জাতি-রাষ্ট্রের দুই ফাদারের মৃত্যুর সঙ্গে-সঙ্গেই আমরা ভুলিয়া গিয়াছিলাম, কৃষ্টি-সাহিত্যের ক্ষেত্রেও অবিকল তাই ঘটিয়াছিল।
৩০৭
৪. পূর্ব বাংলার দুধারী বিপদ
পূর্ব বাংলার ভাগ্যে এই বিভ্রান্তির কুফল হইতেছিল বিষময়। একদিকে পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠী প্রথমে একমাত্র উর্দুকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করিবার অপচেষ্টা করিলেন এবং পরে আরবি হরফে বাংলা লিখিবার প্রয়াস পাইলেন। অপরদিকে পূর্ব বাংলার লেখক-সাহিত্যিকরা উর্দু-আরবি-ফারসির সাথে বাংলা ভাষার কোনও মিল নাই দেখাইবার উদ্দেশ্যে বহু যুগ-প্রচলিত বাঙ্গালী মুসলিমদের মুখের ভাষা হইতে আরবি-ফারসি সব শব্দ তাড়াইবার অভিযান শুরু করিলেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য অবিভাজ্য, এই যুক্তিতে। স্বভাবতই তারা হিন্দু মনীষীদের অনুকরণ করিলেন। ঐ মনীষীরা ইতিমধ্যে গণমুখী সাহিত্য সৃষ্টির উদ্দেশ্যে যে পশ্চিম-বাংলার আঞ্চলিক কথ্য ভাষাকে সাহিত্যে স্থান দিয়াছিলেন, আমাদের লেখক-সাহিত্যিকরাও না বুঝিয়া তাই করিতে লাগিলেন। ক্রমে পশ্চিম-বাংলার কথ্য ভাষা পূর্ব বাংলার সাহিত্যের ভাষা হইয়া গেল। পূর্ব বাংলার ভাষিক-সাহিত্যিক, সুতরাং কৃষ্টিক, স্বকীয়তার পথ দ্রুতগতিতে অবরুদ্ধ হইতে লাগিল। আমি আমাদের ভাষা আন্দোলনের মর্ম ব্যাখ্যায় বাংলা একাডেমির বিভিন্ন বৈঠকে, ছাত্র-তরুণদের সভায়, বিভিন্ন সাহিত্য সম্মিলনীতে এবং সংবাদপত্রের বিশেষ সংখ্যায় প্রবন্ধ লিখিয়া আমাদের সাহিত্যকদেরে হুঁশিয়ার করিতে লাগিলাম। বাংলা একাডেমি আমাকে অ্যাওয়ার্ড দিলেন, ফেলাে নির্বাচিত করিলেন, জীবন-সদস্য করিলেন, সম্মান দিলেন খুবই। কিন্তু কথা শুনিলেন না।।

৫. বাংলা সাহিত্যের মুসলমানি রূপ
দেশভাগ হওয়ার আগেকার প্রায় গােটা ত্রিশ বছরের লেখক-জীবনে আমার সাহিত্যকর্মের প্রধান দাবি ছিল এই : বাংলার মেজরিটি মুসলমানের মুখের ভাষাকে বাংলা-সাহিত্যে সম্মানের স্থান দিতে আরবি-ফারসি-উর্দু শব্দ হওয়ার অজুহাতে মুসলমানদের নিত্য-ব্যবহৃত বহু শব্দকে শুধু ঐ কারণে বাংলা সাহিত্যে স্থান দেওয়া হয় না। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের নেতা হিন্দু লেখকরাই। তাদের লেখাতেই যে শুধু মুসলমান বাঙ্গালীর মুখের ভাষা বর্জিত হইত তা নয়, সরকারি শিক্ষা কর্তৃপক্ষ তা-ই করিতেন। অপেক্ষাকৃত অল্প বয়স হইতেই এটা আমার মনে পীড়া দিত। আমার আত্মসম্মানে আঘাত লাগিত । আমার মনে হইত, হিন্দু লেখকদের এই মনােভাব আসলে মুসলমান।
৩০৮
সমাজের প্রতি উপেক্ষার এমনকি অবজ্ঞার শামিল। এ সম্পর্কে আমার অভিমত ক্রমে এত দৃঢ় হইয়া উঠে বলিয়াই উনিশশ তেতাল্লিশ সালে কলিকাতার ‘প্রােগ্রেসিভ রাইটার্স এসােসিয়েশনের সাহিত্য সম্মিলনীতে ভাষণ দিতে গিয়া আমি ভারতে রাজনৈতিক পাকিস্তান হওয়ার চেয়ে বাংলায় সাহিত্যিক পাকিস্তান হওয়ার সম্ভাবনাকে অধিকতর নিশ্চিত বলিয়াছিলাম।
দেশভাগ হওয়ার পর আমার সাহিত্যিক অ্যাপ্রােচে মৌলিক পরিবর্তন আসিল। মুসলমান’ শব্দটার স্থান দখল করিল পূর্ব বাংলা। পূর্ব বাংলা পাকিস্তানের অংশ হয় শুধু রাষ্ট্রীয় অর্থে। কৃষ্টিক অর্থে পূর্ব বাংলা ছিল বরাবর একটি স্বাধীন স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ। এর কৃষ্টিক স্বকীয়তা এক দিকে যেমন পাকিস্তানের অপর অঞ্চল পশ্চিম পাকিস্তান হইতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ছিল, অপরদিকে তেমনি ঐতিহাসিক বাংলার অপর অঞ্চল পশ্চিম বাংলা হইতে ছিল সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। কিন্তু আমাদের কবি-সাহিত্যিক চিন্তা-নায়কদের বিপুল মেজরিটির মধ্যে এই উপলব্ধির অভাব দেখিয়া আমি শুধু দুঃখিত হইলাম না, বিস্মিতও হইলাম। এঁদের মধ্যে একদল বলিতে লাগিলেন, পশ্চিম পাকিস্তানি কৃষ্টি হইতে আমাদের কৃষ্টি স্বতন্ত্র নয়; কারণ উভয়টাই ইসলামি কৃষ্টি | অপর দল সমান জোরে বলিতে থাকিলেন, আমাদের কৃষ্টি পশ্চিম বাংলার কৃষ্টি হইতে স্বতন্ত্র নয়; কারণ উভয়টাই এক বাঙ্গালী কৃষ্টি। ইসলামি কৃষ্টি-ওয়ালারা বলিতে থাকিলেন, ইসলামি বিশ্বকবি ইকবাল আমাদের জাতীয় কবি; বাঙ্গালী কৃষ্টি-ওয়ালারা বলিতে চলিলেন, বাঙ্গালী বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ আমাদের জাতীয় কবি । বিস্ময়ের কথা, এই পরস্পরবিরােধী দ্বিমুখী দল দুইটি আশ্চর্যরূপে একমত যে আমরা পূর্ব বাঙ্গালী বা পূর্ব পাকিস্তানিদের নিজস্ব কোনও কৃষ্টিক স্বকীয়তা নাই। আমাদের স্বতন্ত্র ভাষা-সাহিত্যের কোনও অস্তিত্ব নাই। থাকার প্রয়ােজনও নাই।
এ ব্যাপারে আমি দুই-এর কোনও দলের মিছিলেই শামিল হইতে পারিলাম না। কলিকাতার সাহিত্যিক মহলে আমি ত্রিশ-ত্রিশটা বছর ভাষায় মুসলমান’ রহিয়া গিয়াছিলাম, ঢাকার সাহিত্যিক মহলে আমি তেমনি বাঙ্গাল থাকিয়া গেলাম। কলিকাতায় বরঞ্চ নজরুল ইসলামের মত প্রতিভাধর মনীষী আমার কতকটা পৃষ্ঠপােষক ছিলেন। কতকটা’ বলিলাম এই জন্য যে, আরবি-ফারসি-উর্দু শব্দ ব্যবহারে নজরুল ইসলাম ও আমার মধ্যে একটা মূলগত পার্থক্য আছে। আমি আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহার করি ওগুলি আরবিফারসি বা মুসলমানি শব্দ বলিয়া নয়, শব্দগুলি বাঙ্গালীর দৈনন্দিন ব্যবহারে চালু বলিয়া। সে কারণে এগুলি বাংলা শব্দ হইয়া গিয়াছে বলিয়া। বানানে ও উচ্চারণে অনেকগুলির রূপান্তরও ঘটিয়াছে। ঐ রূপান্তরিত অবস্থাতেই আমি
৩০৯
ও-সব শব্দ ব্যবহার করি। শুধু বাঙ্গালী মুসলমানরাই ব্যবহার করে, হিন্দুরা করে না, এমন আরবি-ফারসি-মূল শব্দকেও আমি বাংলা শব্দ মনে করি এবং আমার লেখায় বাংলা শব্দ হিসাবেই ব্যবহার করি। যে শব্দ এমনভাবে চালু নাই, তেমন শব্দ শুধু আরবি-ফারসি বা মুসলমানি হওয়ার যুক্তিতে ব্যবহার করি না। এই কারণে অজানা ও অপ্রচলিত নূতন আরবি-ফারসি শব্দ আমদানি আমি করি না। এই কারণে আমার সকল বিষয়ের প্রবন্ধে বা গল্পে-উপন্যাসে মােটামুটি একই ধরনের ভাষার ব্যবহার দেখা যাইবে।
কিন্তু নজরুল ইসলাম ঠিক তা করেন নাই। তিনি মুসলমানি বা ইসলামি বিষয়ে কবিতা রচনায় এমন সব সুন্দর-সুন্দর মিঠা-মিঠা ও কঠিন-কঠিন। আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহার করিয়াছেন যেগুলি বাংলার মুসলিম জনসাধারণের কাছেও সুপরিচিত নয়। তার অসাধারণ প্রতিভাবলে শব্দচয়নে ও সুপ্রয়ােগে তিনি এমন কারিগরি দেখাইয়াছেন যে, মনে হইবে ওখানে ঐ শব্দটি না বসাইলে কবিতাটি অমন সুন্দর হইত না। এসবই সত্য কথা। কিন্তু এটাও স্বীকার করিতে হইবে যে নজরুল ইসলাম তার বিস্ময়কর মনীষার বলে এমন অনেক আরবি-ফারসি শব্দ বাংলা ভাষায় ঢুকাইয়াছেন, যা আর কারাে পক্ষে সম্ভব ছিল না। পক্ষান্তরে এটা লক্ষণীয় যে, মুসলমানি’ বিষয় ছাড়া আর কোনও লেখায় তিনি এমন করেন নাই। তিনি তাঁর সাধারণ গদ্য-পদ্য লেখায় হিন্দু কবি-সাহিত্যিকদের প্রচলিত ধারাই বজায় রাখিয়াছেন। যেহেতু আমি কবি নই, কাজী সাহেবের কাব্যিক ভাষা আমার লেখা প্রভাবিত করার প্রশ্নই উঠে না । গদ্য লেখাকে মুসলমানি করার উদ্দেশ্যে আমি চেষ্টা করিয়া বা অভিধান খুঁজিয়া কোনও আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহার করি নাই। মুসলমান বাঙ্গালীর মুখে যেসব শব্দ প্রচলিত আছে, সেগুলিই আমি অবাধে ও নির্দ্বিধায় ব্যবহার করিয়াছি। মােটকথা, বাংলা ভাষার কাব্য-সাহিত্যিকে নজরুল ইসলাম মুসলমানি, মানে সত্যিকার বাঙ্গলার জাতীয় কাব্য করিয়াছেন। কিন্তু গদ্য সাহিত্যকে মুসলমানি করিবার চেষ্টা করেন নাই।

৬. বাংলা সাহিত্যের বাঙ্গাল রূপ
দেশত্যাগের পরে এ বিষয়ে আমার শব্দচয়নের মাপকাঠি রূপান্তরিত হইল ‘মুসলমানি’ হইতে ‘বাঙ্গালে। পূর্ব বাঙ্গালীর শব্দ প্রয়ােগ ও বাচনভঙ্গিই আমার রচনার উপজীব্য হইল। অখণ্ড ভারতে ব্যাপারটা ছিল মাইনরিটির সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা রক্ষার ব্যাপার। অবিভক্ত বাংলায় ছিল অধিকতর অগ্রসর
৩১০
মাইনরিটির দ্বারা অনগ্রসর মেজরিটির সাংস্কৃতিক অবদমনের ব্যাপার। কিন্তু পূর্ব বাংলা বা পূর্ব-পাকিস্তানে (বর্তমানের স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ) এটা হইয়া উঠিল একটা স্বাধীন দেশ ও রাষ্ট্রের কৃষ্টিক ও রাষ্ট্রীয় পরিচিতি, ব্যক্তিত্ব ও স্বাতন্ত্রের প্রশ্ন। অবিভক্ত বাংলায় কলিকাতা ছিল গােটা বাংলার রাষ্ট্রীয়, সাংস্কৃতিক, ভাষিক ও সাহিত্যিক কেন্দ্রবিন্দু। সারা বাংলার শিল্প-বাণিজ্যের কেন্দ্রভূমিও ছিল কলিকাতা। কলিকাতা প্রায় দুইশ বছর বাংলার রাজধানী থাকায় এ সব ঘটিয়াছিল নিতান্ত স্বাভাবিকভাবেই। বাংলা বিভাগের ফলে এই অবস্থার মৌল ও সার্বিক পরিবর্তন ঘটে। কলিকাতার পরে ঢাকা হয় পূর্ব বাংলা, পূর্ব-পাকিস্তান, ও (পরে) বাংলাদেশের রাজধানী। এই রাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলে শাসনতান্ত্রিক, শাসনতান্ত্রিক, প্রশাসনিক সকল ব্যাপারে পূর্ব বাংলা স্বাতন্ত্র্য ও স্বকীয়তা লাভ করিল রাষ্ট্রীয় প্রয়ােজনের অমােঘ ও দুর্নিবার চাপেই। শিল্প-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক প্রয়ােজনও স্বাভাবিকভাবেই নিজস্বতা লাভ করিল আপনা-আপনি, কারাে চিন্তা-ভাবনার ফল ছাড়াই। কিন্তু স্বাধীনসার্বভৌমত্ব সত্তার সাথে-সাথে কৃষ্টিক, সাহিত্যিক ও ভাষিক স্বাতন্ত্রটা অমন সুস্পষ্ট, দুর্নিবার ও অটোমেটিক হইয়া যায় না। কৃষ্টিক, সাহিত্যিক ও ভাষিক ঔপনিবেশিকতটা রাষ্ট্রীয় ও আর্থিক শ্রেণীভেদের মত দৈহিক ও বাহ্যিক প্রাধান্যের ব্যাপার না হওয়ায় এবং প্রধানত মানসিক ব্যাপার হওয়ায় সহজে সাধারণের দৃষ্টিগােচর নয়। কৃষ্টি-সাহিত্যের ব্যাপারটা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যাপারের মত সাধারণ ও প্রাত্যহিক ব্যক্তি বা জাতীয় স্বাতন্ত্রের স্থূল স্বার্থের ব্যাপারও নয়। এটা আসলে সূক্ষ্ম জাতীয় স্বকীয়তার আধ্যাত্মিক স্বার্থের ব্যাপার। রাষ্ট্র-নেতাদের অতিব্যস্ত চোখে এসব ব্যাপার সহজে ধরা পড়িবার কথা নয়; নয়া রাষ্ট্রের ফর্মেটিভ স্তরের নেতাদের ত নয়ই। সে কারণে শিল্পী-সাহিত্যিক প্রভৃতি চিন্তা-নায়কদের উপরই ন্যস্ত হয় এদিককার প্রাথমিক দায়িত্ব। কিন্তু সাধারণ অবস্থায় শিল্পী-সাহিত্যিকরা নিজেদের মনমস্তিষ্ক ও কলমকে রাজনীতির উর্ধ্বে ও বাহিরে রাখায় অভ্যস্ত। এটাকে তারা নিজেদের স্বাতন্ত্র, বৈশিষ্ট্য ও কর্তব্য মনে করেন। রাখিতে পারাকে তারা গৌরবের বিষয় মনে করেন। উনিশ শতকের ইউরােপীয় শিল্পী-সাহিত্যিকদের অনুকরণে বিশ শতকের প্রথমার্ধের কলিকাতা-কেন্দ্রিক বাঙ্গালী শিল্পীসাহিত্যিকরাও বাংলা সাহিত্যকে যথাসম্ভব রাজনীতির ‘ধুলা-মাটি’ হইতে বাঁচাইয়া রাখিবার চেষ্টা করিতেন। এ সময়কার বাংলা সাহিত্য মানেই হিন্দু বাংলা সাহিত্য। নজরুল ইসলামের আবির্ভাবের আগেতক বাংলা সাহিত্যে মুসলমানদের কোনও উল্লেখযােগ্য অবদান ছিল না। এ অবস্থায় বাঙ্গালী
৩১১
মুসলমানদের সাহিত্য-সাধনার সাফল্যের মাপকাঠি ছিল হিন্দু কবিসাহিত্যিক-সাংবাদিকদের অনুকরণ-অনুসরণে সাফল্যের কৃতিত্ব। এই বিচারে ও কারণে বাংলার মুসলমান শিল্পী-সাহিত্যিকদের বিপুল মেজরিটি দেশ বিভাগের বিরােধী ছিলেন। শেষ পর্যন্ত দেশ যখন ভাগ হইয়াই গেল তখন অপর সকলের মত তাঁরাও কলিকাতা ছাড়িয়া ঢাকায় আশ্রয় নিলেন। কিন্তু মনের দিক হইতে তাঁরা কলিকাতায়ই থাকিয়া গেলেন। তাঁরা বলিতে। লাগিলেন : “শিল্প-সাহিত্য অবিভাজ্য। রাজনৈতিক কারণে বাংলা ভাগ হইলেও বাংলা ভাষা ও সাহিত্য ভাগ হয় নাই।’ এসব কথা যাঁরা বলেন, বিশ্বাস করেন, পূর্ব বাংলার সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্রের দাবি বা উপলব্ধি তাদের নিকট আশা করা যায় না। তারা স্বতন্ত্র, স্বাধীন রাষ্ট্র পূর্বপাকিস্তানের রাজধানীতে বসিয়া কলিকাতার ভাষায় পশ্চিম-বাংলার সাহিত্যিক ঐতিহ্য বহন করিয়া চলিলেন। তাঁরা রবীন্দ্রনাথকে পূর্ব-পাকিস্তানের জাতীয় কবি, কলিকাতার কৃষ্টিকে পূর্ব-পাকিস্তানের কৃষ্টির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বলিয়া গৌরববােধ করিতে লাগিলেন। এটা করিলেন তাঁরা স্বাভাবিকভাবেই, অভ্যাসবশতই। তাঁদের বিশ্বাসও অনেকখানি আন্তরিক। নয়া রাষ্ট্র, নয়া জাতি, নয়া কৃষ্টি ও নয়া সাহিত্য যে পরস্পরের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, এটা বুঝিতে একটু সময় লাগেই। এই কারণে এটা উপলব্ধি করিবার প্রাথমিক দায়িত্ব রাজনৈতিক নেতাদের। শুধু প্রয়ােগ করিবার দায়িত্বটাই শিল্পীসাহিত্যিকদের। এক পক্ষ তাদের দায়িত্ব পালন না করায় অপর পক্ষ তাঁদের দায়িত্ব পালন করেন নাই। অথচ উভয় পক্ষেরই দিবার মত কৈফিয়ত আছে। মুখে ও কলমে দিতেছেনও সেসব কৈফিয়ত। আপাতদৃষ্টিতে তারা জিতিতেছেনও। স্থল দৃষ্টিতে দেখা যাইবে, দেশের লেখক গােষ্ঠী ও পাঠক সাধারণের মেজরিটি তাঁদের কথা ও কাজ মানিয়া লইয়াছেন।

৭. বিভ্রান্তির হেতু
কিন্তু ভাষা-সাহিত্য ও শিল্প-কৃষ্টির ইতিহাস একটু তলাইয়া বিচার করিলেই বুঝা যাইবে তাঁদের ধারণাটা ভ্রান্ত ও তাদের কার্যকলাপ অবাস্তব। এটা আজকাল সকলেই জানেন যে, শিল্প সাহিত্য, সুতরাং ভাষাও, এককালে। ভদ্রলােক ও পণ্ডিতদের একচেটিয়া সম্পদ ছিল। বাংলা ভাষা-সাহিত্যের বেলাও ছিল তাই। ইংরাজ শাসনের প্রভাবে বাংলা সাহিত্য যখন পশ্চিমী অর্থে উন্নতির পথ ধরে উনিশ শতকের মাঝামাঝি, তখন এটা সংস্কৃত-ঘেঁষা পণ্ডিতি
৩১২
বাংলা হওয়ার দিকে ধাবিত হয়। বঙ্কিমচন্দ্র প্রভৃতি মনীষীর নেতৃত্বে তার এই গতির পরিবর্তন হয়। বাংলা ভাষা হয় অতঃপর মধ্যবিত্ত শিক্ষিত হিন্দু সম্প্রদায়ের, তৎকালীন কথায় ভদ্রলােকের, সাহিত্যের মাধ্যম। ইউরােপমার্কিন সাংস্কৃতিক বিপ্লবে বিশ শতকের গােড়া হইতেই বাংলা ভাষা ও সাহিত্য গণমুখী হয়। রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র ও তাদের অনুসারীরা এই প্রগতির পথে বিরাট অবদান রাখেন। স্বাভাবিক ক্রমােন্নতি, ভদ্রলােকের ভাষায় ক্রমাবনতি ও ভাষা-সাহিত্যের এই গণমুখিতা, ভদ্রলােকের ভাষায় নিম্নমুখিতা, সাহিত্যের ভাষাকে পরিমণ্ডলীয় চাপেই কলিকাতার পার্শ্ববর্তী ভাগীরথী-তীরবর্তী আঞ্চলিক কথ্য ভাষায় (কনভার্সেশনাল ল্যাংগুয়েজে) পরিণত করে। রবীন্দ্র-শরৎচন্দ্রের অসাধারণ প্রতিভার স্পর্শ পাইয়া ভাগীরথীতীরের ‘গ্রাম্যতা’ (রাসটিসিটি), তার জিভের অশালীন মােচড়সহ (ইন্ডিসেন্ট টাং টুইটিং) সভ্য ও শালীন সাহিত্যের ভাষায় উন্নীত হইল। এটা স্বাভাবিক। ভাষার নিজস্ব অভদ্রতা ও অশালীনতা বলিয়া কিছু নাই। যা ভদ্রলােকের মুখের ভাষা, তাই ভদ্রভাষা। ভদ্রসাহিত্যে যে ভাষা ব্যবহৃত ও প্রযুক্ত হয়, সেটাই ভদ্র, শালীন সাহিত্যের ভাষা। আসলে ভাষা সাহিত্যকে ভদ্র করে না। সাহিত্যই ভাষাকে ভদ্র করে। বস্তুত, ভাষায় স্ল্যাং বা অপভাষা ও অশালীন শব্দ বলিয়া কিছু নাই। সব সভ্য, শালীন ও সাহিত্যের ভাষাই গােড়ায়, সাহিত্যে স্থান পাওয়ার আগ পর্যন্ত, স্ল্যাং থাকে। সভ্য জাতসমূহের সব উন্নত ভাষাই গােড়ায় স্ল্যাং ছিল।
রবীন্দ্র-শরৎচন্দ্রের মনীষার যাদুর কাঠিস্পর্শে ভাগীরথী অঞ্চলের অসাধু কথ্য ভালগার ভাষা যেদিন উন্নত বাংলা সাহিত্যের ভাষা হইতে শুরু করিল, সেদিন অনেক ভদ্র ও শালীনতাবাদী লেখক-সাহিত্যিক ও ভাষাবিজ্ঞানী দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হইয়া ইহার প্রতিবাদ করিলেন। কিন্তু সে প্রতিবাদ বন্যার স্রোতে বাধা দেওয়ার শামিল হইল। তবু সেই প্রতিবাদীদের উদ্দেশ্য মহৎ ছিল, এটা। স্বীকার করিতেই হইবে। সে মহৎ উদ্দেশ্যের দুইটা বড় দিক ছিল। এক দল ছিলেন বাংলা ভাষার মার্জিত রূপের পক্ষে। অপর দল ছিলেন বাংলা ভাষার অখণ্ডতার পক্ষে। আমি এখানে দ্বিতীয় দলের কথাই বলিব। কারণ এঁদের মতের সাথেই আমরা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। এঁদের নেতা ছিলেন স্বনামধন্য সর্বজনমান্য ভাষাবিজ্ঞানী ডা. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়। তাঁর প্রতিপাদ্য ছিল ভাগীরথী-তীরের আঞ্চলিক কথ্য ভাষাকে (কনভার্সেশনাল। ল্যাংগুয়েজকে) সাহিত্যের ভাষা করিয়া বাংলার কবি-ঔপন্যাসিকরা বাংলা ভাষাকে পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার দুই ভাষায় বিভক্ত করিতেছেন। কথাটা তিনি
৩১৩
বলিয়াছিলেন মুসলমানদের পাকিস্তান দাবির ও বাংলা বাঁটোয়ারার অনেক আগে ১৯৩৭ সালে। তিনি তাঁর এক সারগর্ভ ভাষণে বলিয়াছিলেন : ভালর জন্যই হউক আর মন্দের জন্যই হউক, উচিতই হউক, আর অনুচিতই হউক, ভাগীরথী নদীর সংলগ্ন স্থানের বিশেষত কলিকাতা অঞ্চলের ভদ্রসমাজের কথ্য ভাষা আজকাল সাহিত্যে ব্যবহৃত হইতেছে। এই ভাষা অঞ্চল-বিশেষের মৌখিক ভাষা। ইহার ব্যাকরণ ও উচ্চারণ-রীতি সমগ্র বাংলার শিক্ষিত ব্যক্তিগণ ব্যবহারিকভাবে স্বীকার করিয়া লইলেও নিজ মাতৃভাষার রিহ্ হিসাবে উহার বিশেষত্বের অধিকারী হয় নাই সে জন্য অবিসংবাদিতার্থ সাধু বাংলা ভাষার রাজপথ ছাড়িয়া যারা কলিকাতার আঞ্চলিক ভাষার পথে। চলিতেছেন, অচেনা পথে চলার জন্য তাঁদের অনেকে এমন অনেক বিভ্রাট ঘটাইয়া থাকেন, যাহা লেখক ও পাঠক উভয়ের পক্ষেই কষ্টকর। আজকালকার যে কোনও বাংলা দৈনিক সাপ্তাহিক মাসিকপত্রে অনেক লেখকের লেখা পড়িলেই এ কথা বেশ বুঝিতে পারা যায়।’
ডা. সুনীতি কুমার চ্যাটার্জি ভাষাবিজ্ঞানী। তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী নন। কিম্বা সমাজবিজ্ঞানীও নন। তিনি অখণ্ড বাংলার এগার কোটি মানুষের ভাষা হিসাবে বাংলা ভাষা লইয়া গর্ব করিতেন। কাজেই আঞ্চলিকতার অভিশাপে বাংলা ভাষার দ্বিধাবিভক্তির আশঙ্কায় তিনি ঐ হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করিয়াছিলেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সমাজবিজ্ঞানী না হওয়ায় তিনি বুঝিতে পারেন নাই, দুর্বারগতি গণতন্ত্রের চাপে শিল্প-সাহিত্য ও ভাষাকে যে গণমুখী হইতে হইতেছে, বাংলা ভাষার অখণ্ডতা ও সাধুতার দোহাই দিয়া সে দুর্বার গতিরােধ করা কারাে পক্ষেই সম্ভব ছিল না। রাষ্ট্রক্ষমতা ও জাতীয় সম্পদ ভােগের অধিকার যেমন করিয়া সমাজের উপরতলা হইতে মধ্যবিত্ত পার হইয়া সমাজের তথা জাতির একেবারে নিচের তলায় আসিতে বাধ্য ছিল, শিল্প-সাহিত্য ও ভাষার বেলাও তাই ঘটা অপ্রতিরােধ্য হইয়া পড়িয়াছিল। ভাষা ও সাহিত্যের এই গণমুখী গতি স্বভাবতই তৎকালীন রাষ্ট্রক্ষমতার কেন্দ্রস্থল কলিকাতার পার্শ্ববর্তী জনগণের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হইল।

৮. আমাদের কথ্য ভাষার শক্তির উৎস
এটা বুঝিয়াছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি শুধু বিশ্বকবি ছিলেন না। তিনি শুধু বাংলা ভাষাকে বিশ্ব-সাহিত্যের দরবারে উন্নীতই করেন নাই। তিনি শুধু শিল্পীসাহিত্যিক-কবি-সংগীতজ্ঞই ছিলেন না। তিনি ছিলেন একাধারে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী,
৩১৪
সমাজবিজ্ঞানী ও স্বপ্নদ্রষ্টা। রাজনীতিতে ছিলেন তিনি মহাভারত বিশ্ব-ভারতীয় প্রবক্তা। সমাজবিজ্ঞানে ছিলেন তিনি আর্য-অনার্য-হিন্দু-মুসলিম-শক-হুনমােগল-পাঠানের সংমিশ্রণে ভারত-তীর্থের’, মহামিলনের কুম্ভমেলার স্বাপ্নিক। যিনি বিশাল দেখেন, তিনি ক্ষুদ্রও দেখেন। কারণ বিশাল ত খণ্ডেরই সংমিশ্রণ। তাই মহাভারতের স্বপ্ন দেখার সময়ও তার বিশাল চিন্তা-রাজ্যে খণ্ডিত বাংলার দৃশ্যও তার চোখ এড়াইয়া যাইত না। মৃত্যুর মাত্র দুই বছর আগে তিনি তাই বুঝিতে ও বলিতে পারিয়াছিলেন : বাংলা শুধু দেহে দুই নয়, অন্তরেও দুই।’ বাংলা সাহিত্যে কলিকাতা-কেন্দ্রিক আঞ্চলিকতার প্রাধান্যে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের দ্বিখণ্ডিত হইবার আশঙ্কায় সুনীতি বাবুর মত তাই রবীন্দ্রনাথ ভীত হন নাই। এটা স্বাভাবিক বলিয়া তিনি মানিয়া লইয়াছিলেন । ডা. সুনীতি চ্যাটার্জিকে সান্ত্বনা দিবার উদ্দেশ্যেই বােধ হয় রবীন্দ্রনাথ ঐ সময় লিখিয়াছিলেন যে, বাংলা সাহিত্যের ভাষায় কলিকাতা-কেন্দ্রিক আঞ্চলিক প্রাধান্য দোষেরও নয়, অস্বাভাবিকও নয়। কলিকাতার বদলে ঢাকা যদি বাংলার রাজধানী হইত, তবে তথাকার আঞ্চলিকতা “ঢাকাইয়া-বাংলাই” বাংলা সাহিত্যের ভাষা হইত। তাতে পশ্চিম-বাংলা মুখ বাঁকা করিলে সে বক্রতা আপনি সিদা হইয়া যাইত।
খুবই খাঁটি সত্য কথা। স্বাভাবিক ঘটনা। বাস্তব সত্য কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এটা বুঝিয়াছিলেন জীবন-সায়াহ্নে। এটা বুঝিতে তাঁর মহাসাগরের মত বিশাল মনীষার দরকার হইয়াছিল। কারণ এটা ছিল তার জন্য অপরের ব্যাপার। নিজের ব্যাপার এটা তার ছিল না। অপর পক্ষে তাঁর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভক্তঅনুসারী হইয়াও আমি এটা বুঝিয়াছিলাম তরুণ বয়সেই। আমার জন্য মনীষার বিশাল মহাসাগর ত দরকার ছিলই না, বড় রকমের জলাশয়েরও আবশ্যকতা ছিল না। একটি অগভীর ডােবাই আমার জন্য যথেষ্ট ছিল। কারণ এটা আমার ছিল নিজস্ব ব্যাপার। একজন সাধারণ দেশপ্রেমিক আত্মসম্মানী, ‘বাঙ্গালের’ মনই ছিল এটা বুঝার জন্য যথেষ্ট।
বাংলা সাহিত্যের একজন নগণ্য লেখক হিসাবে আমি যথাসময়ে বুঝিয়াছিলাম, সাহিত্যকে জনগণের মনের কথা মুখের ভাষায় প্রকাশের মাধ্যম। হইতেই হইবে। কলিকাতা বসিয়াই এই উপলব্ধি ঘটিল বলিয়া এটাও বুঝিলাম, কলিকাতা-কেন্দ্রিক ঐ আঞ্চলিকতাটা আকস্মিক ও পরিবেশিক। ওটা প্রকৃতির দেওয়া স্বাভাবিকতা নয়। রবীন্দ্রনাথের মত দূরদর্শী ভবিষ্যৎদ্রষ্টা নিশ্চয়ই ছিলাম না। কাজেই ঢাকা বাংলার রাজধানী হওয়ার কল্পনা আমার মাথায় ঢােকে নাই। কিন্তু এটা অতিসহজেই বুঝিয়াছিলাম যে, পশ্চিম-বাংলার
৩১৫
কনভার্সেশনাল ল্যাংগুয়েজে সাহিত্য রচিত হইতেছে হউক, কিন্তু ঐ সঙ্গে পূর্ব বাংলার কনভার্সেশনাল ল্যাংগুয়েজেও সাহিত্য রচিত হইবে। হইতে পারে এবং হওয়া উচিৎ। লেখা শুরুও করিলাম। এটা মুসলমান সাম্প্রদায়িকতা-বােধও ছিল না। পাকিস্তানি রাষ্ট্রীয় স্বাতন্ত্র্য বােধও ছিল না। এটা পাকিস্তান হওয়ার বার বছর আগের কথা। এই সময়ে আমি আমার জীবন সুধা নামক একটা বড় আকারের নভেল লিখিতে শুরু করি। শ্রদ্ধেয় বন্ধু মৌ. নাসিরউদ্দীন সাহেব তাঁর সওগাত-এ ধারাবাহিক ছাপিতে থাকেন। অনেক দিন লাগে শেষ হইতে। নভেল হিসাবে এর বাহাদুরি বা মূল্যায়ন এখানে আমার উদ্দেশ্য নয়। আমার বক্তব্য এই যে, এই পুস্তকে আমি পাত্র-পাত্রীর ডায়লগ পূর্ব বাংলার কথ্যভাষায় লিখিয়াছি তখনকার দিনেই। আরাে কেউ-কেউ পূর্ব বাংলার কথ্যভাষা তাদের নাটক-নভেলে স্থানে-স্থানে ব্যবহার করিয়াছেন।

৯. ‘মনিব’ ও ‘চাকরের ভাষা
কিন্তু অহংকার না করিয়াও আমি বলিতে পারি এবং এখানে সে কথাটাই। বলিতেছি যে, আমার মধ্যে ও তাঁদের মধ্যে মৌল পার্থক্য রহিয়াছে। তারা পূর্ব বাংলার কথ্যভাষা দেন নাই বইয়ের চাকরবাকর শ্ৰেণীর চরিত্রের মুখে। ভদ্রলােক চরিত্রের সবাই বিশুদ্ধ আর্য উচ্চারণে’ কলিকাতার কথ্যভাষাই ব্যবহার করিয়া থাকেন। পশ্চিম-বাংলার কথ্যভাষা যে ভদ্র, শালীন ও শ্রুতিমধুর এটা এমফাসাইয করিবার মতলবেই যেন চাকরবাকরের মুখেও যতটুকু পূর্ব বাংলার কথ্যভাষা ঢােকান তা-ও বিকৃত উচ্চারণে ও বিশ্রীমুখ ও অঙ্গ-ভঙ্গিতে। পূর্ব বাংলার কনভার্সেশনাল বাংলাকে বিদ্রুপ করার সুচিন্তিত মতলবেই যেন ঐটুকু করা হয়। পশ্চিম-বাংলার ‘ভদ্রতা ও পূর্ব বাংলার ‘অভদ্রতা’ আন্ডারলাইন করার জন্য আরাে উপায় ইতিমধ্যে বাহির হইয়াছে। অশিক্ষিত কৃষক, অর্ধশিক্ষিত ইংরাজি না-জানা ব্যবসায়ী, কারবারী ও আরবিফারসি-জানা-মৌলবী বাপ-দাদারা ও ইংরাজি-শিক্ষিত কলেজ-পড়ুয়া ছাত্রছাত্রী ও দারােগা-ডিপুটিদের মধ্যকার ডায়লগের বেলাও ওঁদের মুখ দিয়া পূর্ব বাংলা ও এদের মুখ দিয়া পশ্চিম-বাংলা অসংকোচে বলাইতেছেন। এই নাট্যকার-ঔপন্যাসিকরা ভাল করিয়াই সমঝাইতেছেন যে খােদ পূর্ব বাংলায় (বাংলাদেশে) ও পূর্ব বাংলার কথ্যভাষাটা অসভ্য লােকের ও পশ্চিম-বাংলার কথ্যভাষাটাই ভদ্রলােকের ভাষা। বৈঠকখানা, আফিস-আদালত ও সভাসমিতি সর্বত্রই এটা সত্য। মনে পড়িতেছে, এর মধ্যে এক সিনেমায়
৩১৬
বাংলাদেশের মেন্টাল হসপিটালের একটি ছবি দেখিয়াছিলাম। সে হাসপাতালে সব পাগলও কী সুন্দর কলিকাতার কথ্যভাষা বলিয়াছিল! এ সবই টাওয়ার বাংলা ও খামার বাংলার মধ্যে দুইশ বছরের মনিব-চাকর সম্বন্ধ বজায় রাখিবার অপচেষ্টা। পরিভাষা সৃষ্টির নামে বিদেশি শব্দ’ হওয়ার অজুহাতে ‘আদালত’, কলেজ’ ইত্যাদি চলতি সহজ বাংলা শব্দের জায়গায় ‘ন্যায়পীঠ’ ও ‘মহাবিদ্যালয় ইত্যাদি দুর্বোধ্য-দুরুচ্চার সংস্কৃত শব্দ প্রবর্তন এবং তুলা-মুলা’ ইত্যাদি চেনা শব্দকে তুলাে-মুলাে’ ইত্যাদি অচেনা ভদ্র উচ্চারণ ঐ একই অপচেষ্টার অংশমাত্র। এঁদের মধ্যে কেউ-কেউ পাড়াগাঁয়ের কৃষক-শ্রমিক লইয়া নাটক-নভেল লিখিয়াছেন। ঐ সব বইয়ের পাত্রপাত্রীর মুখে পূর্ব বাংলার কথ্যভাষা দিয়াছেন। লােকাল কালার দানে ও স্বাভাবিকতা ও বাস্তবতা অঙ্কনের তার অনেকগুলিই সুন্দর-সফল-সজীব আর্ট হইয়াছে। কিন্তু যেই ঘটনার মধ্যে কোনও দারােগা-মাস্টার বা অন্য কোনও শিক্ষিত লােকের আমদানি হইয়াছে, অমনি তার মুখে পশ্চিম-বাংলার কথ্যভাষা দেওয়া হইয়াছে। যেন পূর্ব বাংলার শিক্ষিত সম্প্রদায়ের নিজস্ব কোনও সফিসটিকেটেড কথ্যভাষা নাই।
এইখানেই তাঁদের সাথে আমার বিরােধ । আমি জানি, এবং সেটাই বলিতে এবং বই-পুস্তকে দেখাইতে চাই যে, পূর্ব বাংলার বিপুল শিক্ষিত সমাজের মধ্যে স্মরণাতীত কাল হইতে তাঁদের একটা নিজস্ব সুসভ্য, শালীন শ্রুতিমধুর সফিসটিকেটেড কথ্য বাংলা বিদ্যমান আছে। এই ভাষা পূর্ব বাংলার হিন্দুমুসলিম ভদ্রলােক ও শিক্ষিত সম্প্রদায় দেশ বাঁটোয়ারা হইবার আগে হইতে ব্যবহার করিয়া আসিতেছেন, এবং আজও ব্যবহার করিতেছেন। চিরকাল ব্যবহার করিবেন। আমাদের লেখক-সাহিত্যিকরা হাজার পশ্চিম-বাংলার কথ্যভাষাকে আমাদের সাহিত্যের এবং সরকারি কাগজপত্রের ভাষা করিলেও আমাদের শিক্ষিত সম্প্রদায়সহ জনগণের মুখের ভাষা করিতে পারিবেন না । কারণ ব্যক্তির ভাষা বদলান সম্ভব হইলেও জাতির ভাষা বদলান যায় না।
এটা ভাষাবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানের সুপ্রতিষ্ঠিত সত্য হইলেও আমি ঐ সব বিজ্ঞান না পড়িয়াই সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান হইতেই তা বুঝিতে পারিয়াছিলাম। বাংলা বাঁটোয়ারা হওয়ার আগে পূর্ব বাংলার মুখের ভাষার প্রতি আমার এই দরদ ছিল আঞ্চলিক আত্মসম্মানের প্রশ্ন। কলিকাতা রাজধানী রাখিয়াও এবং বাংলাদেশ অখণ্ড রাখিয়াও যে বাংলা-সাহিত্য থাকিত, তাতে পূর্ব বাংলার মুখের ভাষা উপেক্ষিত হইবে, এতে আমি অপমান বােধ করিতাম। সেজন্য আমার জীবনক্ষুধায় এবং তারও আগে ছােটগল্পে পূর্ব বাংলার কথ্যভাষাকে
৩১৭
স্থান দিবার চেষ্টা করিতাম। দেশ ভাগ হইয়া পূর্ব বাংলা প্রথমে পূর্ব-পাকিস্তান ও পরে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ হওয়ার পর এই আঞ্চলিক আত্মমর্যাদাবোেধই জাতীয় মর্যাদায় উন্নীত হইয়াছে। কাজেই দেশভাগের পরে আমি আমার কোনও বইয়েই গ্রন্থকার বা গল্পকারে ভাষায় ত নয়ই, অপশ্চিমবাঙ্গালী পাত্র-পাত্রীর ডায়লগেও পশ্চিম-বাংলার কথ্যভাষা প্রয়ােগ করি নাই। তার বদলে পূর্ব বাংলার শিক্ষিত সমাজের সফিসটিকেটেড ও পরিমার্জিত কথ্য বাংলা ব্যবহার করিয়াছি। এই সব গ্রন্থে মন্ত্রী, মেম্বর, অধ্যাপক, প্রিন্সিপাল, ডাক্তার, বিচারক, উকিল, মােখতার সবার মুখে এই ভাষা দিয়াছি। আমার সত্য মিথ্যা ও আবে হায়াত নামের নভেল, গালিভারের সফরনামা ও আসমানী পদানামক গল্পের বইয়ে এই নিয়ম মানিয়া চলিয়াছি। কর্তব্য যে কঠিন, সে সম্বন্ধে আমিও যে সম্পূর্ণ সচেতন পরবর্তী পৃষ্ঠাসমূহে পাঠক তা বুঝিতে পারিবেন ।

১০. আমার ‘একাকিত্ব’
নিজের অক্ষমতার দরুন গল্প-উপন্যাসে যা পারিলাম না, প্রবন্ধে-নিবন্ধে তা সমাধা করতে উদ্যত হইলাম। আমাদের রাষ্ট্রীয় রূপ ‘পূর্ব-পাকিস্তান বা স্বাধীন বাংলাদেশ’ যা-ই হউক ভাষা-সাহিত্য, কালচার-সংস্কৃতিতে যে আমরা একদিকে পশ্চিম পাকিস্তান ও অপর দিকে ভারত হইতে সম্পূর্ণ পৃথক, এ সব ব্যাপারেই যে আমাদের নিজস্বতা ও স্বকীয়তা আছে, এটা আমার অনড় দৃঢ় মত । দেশের লেখক-সাহিত্যিকদেরে তা বুঝাইবার জন্য আমি ইংরাজিবাংলা মাসিক-দৈনিক কাগজে প্রবন্ধ লিখিতে লাগিলাম। একাধিক সাহিত্যসম্মিলনীতে, বাংলা একাডেমির ও একইশা ফেব্রুয়ারির ছাত্রদের সভায় ভাষণ পড়িতে লাগিলাম। এর সবগুলিই হয় দৈনিক কাগজ নয় ত একাডেমি পত্রিকায় তকালে প্রকাশিত হইয়াছিল। এইসব ভাষণ-নিবন্ধের অনেকগুলি ষাইটের দশকে প্রকাশিত আমার পাক-বাংলার কালচার নামক পুস্তক ছাপা হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই বইয়ের নাম বদলাইয়া বাংলাদেশের কালচাররাখা হইয়াছে। সত্তরের দশকে এন্ড অব এ বিট্রেয়াল নামক ইংরেজি বইয়ে এবং শেরে বাংলা হইতে বঙ্গবন্ধু নামক বাংলা বইয়ে রাজনৈতিক প্রবন্ধসমূহের সঙ্গে-সঙ্গে অনেকগুলি কালচারেল নিবন্ধও সংযােজিত হইয়াছে। রাজনৈতিক প্রবন্ধের সাথে কালচারেল প্রবন্ধগুলি একত্র করিবার কারণ ছিল। আমার প্রতিপাদ্য ছিল এই যে রাজনৈতিক কারণে ১৯৪৭ সালে
৩১৮
যে দেশ ভাগ হইয়াছিল, কালচারেল দিক হইতেও ওটা ঠিকই হইয়াছিল। পাকিস্তানি আমলে একই রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত থাকিয়াও পূর্ব-পাকিস্তান শুধু ভাষায় নয়, আর্ট-কালচারের ব্যাপারেও, অবশিষ্ট পাকিস্তান হইতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ছিল। স্বাধীন হওয়ার পরও বাংলাদেশ তেমনি তার কৃষ্টি-সাহিত্যের ব্যাপারে পশ্চিম-বাংলা-ভারত হইতে সম্পূর্ণ স্বাধীন ও স্বতন্ত্রই আছে। চিরকাল থাকিবে।
কিন্তু আমার এ মতবাদ অন্তত কাগজে-কলমে কেউ মানেন নাই। একদল পাকিস্তানি আমলে পূর্ব-পাকিস্তানের কৃষ্টিক স্বাতন্ত্র মানিতেন না। পূর্বপাকিস্তানের কৃষ্টিকে তারা অখণ্ড পাকিস্তানি কৃষ্টির অংশ মনে করিতেন। অপর দল যারা পাকিস্তানি আমলেও পূর্ব-পাকিস্তানের কৃষ্টি-সাহিত্যকে পশ্চিম-বাংলার কৃষ্টি-সাহিত্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলিতেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাঁদের গলার আওয়াজ ও কলমের জোর বাড়িয়াছে। আমি যতই বলি, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ায় লাহাের প্রস্তাব ভিত্তিক পাকিস্তান বাস্তবায়িত হইয়াছে, তাঁরা তত জোর গলায় বলেন : এতে বেঙ্গলী কালচার-আর্টের অবিভাজ্যতা চূড়ান্তরূপে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। আমি যত বলি, ইংরাজ-আমলের পৌনে দুইশ বছরের বাংলার শিল্প-সাহিত্য আসলে গােটা বাংলা তথা হিন্দুমুসলমানদের আর্ট-কালচার ছিল না ও নাই, তারা তত বলেন, কলিকাতাকেন্দ্রিক পশ্চিমবঙ্গের ঐ কালচার-সাহিত্যই গােটা বাংলার তথা হিন্দুমুসলিমের যুক্ত জাতীয় সাহিত্য ও আর্ট-কালচার। আমি যত বলি, ভাগীরথীতীরের ইংরাজ-সৃষ্ট ঐ বেঙ্গল আসলে ‘টাওয়ার বাংলা’ আসল বাংলা পূর্ব বাংলায়, তাদের বিচারের খামার বাংলায়, আমার কথায় তাঁদের বিদগ্ধ মনে ও প্রস্তরীভূত মস্তকে কোনও আসর হয় না। শুধু আমার কথাই বা কেন? টাওয়ার বাংলা হইতেও বলা হয় :‘তােমাদের আবার কালচার কী? তােমাদের ত একটিমাত্র কালচার : সেটা এগ্রিকালচার। কাজেই ওটা নিয়াই থাক, ভদ্রলােকের হেঁসেলে ঢুকিবার চেষ্টা করিও না। তবু আমাদের বিদগ্ধ’দের হুঁশ হয় না। কারণ তাদের মন-মস্তিষ্ক সত্যই টাওয়ারের কালচারের অগ্নিতাপে বিদগ্ধ হইয়া গিয়াছে। এঁরা মুসলমান’ হইলেও ভদ্রলােক।
শুধু বাঙ্গালী সংস্কৃতির’ ও বাংলা সাহিত্যের অবিভাজ্যতাবাদী এই ভদ্রলােক মুসলমানরাই টাওয়ার বাংলার ‘কথ্য ভাষা-শৈলী’ ব্যবহার করেন তা নয়, যে সব ইসলামী রাষ্ট্রনীতিবাদী, মুসলিম নেশনহুড’-বিশ্বাসী, শরিয়তী আইনের প্রবক্তা’, যারা সাধারণভাবে অমুসলমানদের সাথে বিশেষভাবে হিন্দুদের সাথে পলিটিক্যাল নেশন’ গড়িতেও রাজি নন, তাঁরাও তাঁদের
৩১৯
‘ইসলামি রাষ্ট্রনীতি’ পশ্চিম-বাংলার তথা হিন্দু-বাংলার কথ্যভাষাতেই প্রচার করিয়া থাকেন। পাকিস্তান আমলে এঁরা আমাদের ভাষা আন্দোলনের বিরােধিতা করিয়াছিলেন উর্দুর সমর্থনে। এখন এঁরা নিজেদের সাহিত্যিক আচরণে যেন আমাদেরে আজও ‘উইথ ভেনজ্যান্স’ বলিতেছেন : ইকবালের উর্দু যখন বর্জন করিয়াছ, তখন রবীন্দ্রনাথের বাংলা তােমাদেরে ধরাইয়াই ছাড়িব । যদি এতে তােমাদের আবার হুঁশ হয়।
সুতরাং এই সুস্পষ্ট বিরুদ্ধ মতবাদী দুই দলের কেউ আমার সমর্থন করেন না । তবে কি আমি একা? দৃশ্যত আপাতত তাই মনে হইবে । দুই-একটি মাত্র দৈনিক খবরের কাগজ ছাড়া বাংলাদেশের নগর-শহরের সব কাগজই এমনকি মফস্বল শহরের সাপ্তাহিকগুলি পর্যন্ত কলিকাতার কথ্যভাষায় লেখার চেষ্টা হইয়া থাকে। কাজেই মনে হইবে, বাংলাদেশের শিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত, পণ্ডিতঅপণ্ডিত লেখক সাহিত্যিক সাংবাদিকদের কেউই বাংলাদেশের কৃষ্টিক-ভাষিক সাহিত্যিক স্বাতন্ত্র স্বকীয়তার সমর্থক নয়। এঁরা সবাই বাংলাদেশকে ভারতের অঙ্গরাজ্য পশ্চিম-বাংলার ভাষিক-কৃষ্টিক-সাহিত্যিক হিন্টারল্যান্ড, কলনি বা মার্কেটরূপেই বজায় রাখিবার পক্ষপাতী। কিন্তু এটা হইতে পারে না। সত্যও হইতে পারে না, বাস্তবও হইতে পারে না। সত্যও না, রিয়ালিটিও না। বাংলাদেশের বাংলা ভাষাভাষী আট কোটি মানুষের একটা স্বাধীন সার্বভৌম জাতি অপর রাষ্ট্রের অঙ্গ চার কোটি বাংলা ভাষাভাষীর কালচারেল উপনিবেশ থাকিতে পারে না।
কাজেই আমি একা নই। এই আট কোটি বাঙ্গালীর শতকরা নিরানব্বইজনই আমাদের রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার মতই কৃষ্টিক স্বকীয়তারও দৃঢ় সমর্থক। আর লেখক-সাহিত্যিকদের কথা? তারা কত জন? এঁদের পাঠকই বা কয়জন? জনতার শতকরা মাত্র কুড়িজন লেখা-পড়া জানেন। এঁদের কত ডেসিমেল পয়েন্ট পার্সেন্ট লেখেন, আর কত ডেসিমেল পার্সেন্ট পড়েন? বলা যায়, এঁরা যতই মুষ্টির ভগ্নাংশ হউন, এঁরাই দেশের কৃষ্টি-সাহিত্যের নিয়ামক। কথাটা ঠিক। কিন্তু এঁদের কতজন সজ্ঞানে অপর রাষ্ট্রের ভাষিককৃষ্টিক উপনিবেশের দালালি করিতেছেন? খুবই নগণ্য অংশ। আর সকলে। পশ্চিম-বাংলার কথ্যভাষাকেই বাংলা-সাহিত্যের চলতি মাধ্যম বলিয়া জানেন। তাঁরা ভাবেন, এটাই উন্নত বাংলা। সাহিত্যের উন্নত সর্বাধুনিক ভাষা। এটা যে পশ্চিম বাংলারই কথ্য ডায়লেক্ট তা-ও অনেকে জানেন না। তারা এটাকে সর্বাধুনিক সাহিত্যের ভাষা হিসাবেই চিনেন। যদিও তারা এ ভাষায় শুধু লেখেন, কথা বলেন না। কিন্তু এটাতে তারা কোনও অসংগতি
৩২০
দেখিতে পান না। আমরা কেতাবি ভাষায় কবে কথা বলিয়াছি? যেদিন এঁরা জানিবেন, কেতাবি ভাষা কেতাবি ভাষাই, ওটা অপর কোনও বিদেশের বা অঞ্চলের কথ্যভাষা নয়, সেদিন তারা আত্মমর্যাদার খাতিরেই নিজেদের কথ্যভাষায় যেমন কথা বলিবেন, তেমনি নিজস্ব সফিসটিকেটেড মার্জিত সাহিত্যের ভাষা নিজেরাই করিয়া লইবেন। এত বড় জাতির জনতা যেদিন সংকল্প করিবে : আমরা কারাে থনে নিচু থাকিব না, কারাে কাছে নীচ হইব , সেদিনই আমরা মুক্ত হইব।
তবু আমি বুঝি ও সরলভাবে স্বীকার করি যে, আমি বর্তমানে বাংলাদেশের সাহিত্যের ক্ষেত্রে যুগ-ধর্মের বিরুদ্ধে কথা বলিতেছি। স্রোতের বিরুদ্ধে চলিবার চেষ্টা করিতেছি। এ ব্যাপারে আমি ডা. ইয়ুং ইমার্সনের কথাও ভুলি নাই। বরঞ্চ তাঁদের জীবন হইতে প্রেরণা লাভ করিয়াছি। ডা. ইয়ুং তার পশুচুলেটস অব এনালিটিক্যাল সাইকলজিতে লিখিয়াছেন : “স্পিরিট অব দি এজ, মানে যুগধর্ম, ধর্মোন্মাদনার চেয়েও শক্তিশালী। এটা কোনও যুক্তির ধার ধারে না। ওটা একটা প্রবণতা। অবচেতনার মধ্য দিয়া দুর্বল মনে তা প্রভাব বিস্তার করে দুর্বার গতিতে। এই যুগ-ধর্মের বিরুদ্ধে যাওয়া শুধু নিষ্ফল নয়, পাগলামিও। ওটা অবৈধ, অশালীন কুফরি ব্যক্তির জন্য বিপজ্জনক। তবু আমি এই যুগ-ধর্মের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়াইছি এই সত্য উপলব্ধি করিয়া যে এটা ‘যুগে’র হইলেও ধর্মে’র শক্তি এর মধ্যে নাই। এটা ফ্যাশন মাত্র। মার্কিন জাতির পথ প্রদর্শক ইমার্সন যে তথাকথিত যুগ-ধর্মের বিরুদ্ধে দাঁড়াইয়া ছিলেন তা পরবর্তী অধ্যায়ে বর্ণনা করিয়াছি। তা ছাড়া এঁদের কেউ কেউ যুক্তি দেন, বাংলাদেশের বিভিন্ন জিলা ও অঞ্চলের কথ্যভাষা এতই ভিন্ন ও পৃথক যে, এদেশে বাংলাভাষাকে সর্বাঞ্চলীয় সর্বজনগ্রাহ্য কোনও বাংলাদেশি জাতীয় রূপ দেওয়া সম্ভব নয়।
কথাটা যে কত অসার, অসত্য ও ভ্রান্ত, তা ভাষাবিজ্ঞানীমাত্রেই জানেন। সব রাষ্ট্রের, সব জাতির, সব দেশের বেলাতেই গােড়াতে এই আঞ্চলিক বিভিন্নতা থাকে ও ছিল। দেশ, রাষ্ট্র ও জাতির স্বার্থেই সে বিভিন্নতা ডিঙ্গাইয়া জাতীয় ভাষা ও সাহিত্য সৃষ্টি হইয়াছে। কলিকাতার যে ভাষাকে এঁরা এত সহজে ‘চলতি বাংলা বলেন, তারও জন্ম এইভাবেই হইয়াছে।
৩২১
অধ্যায় ষােল
রাষ্ট্রিক বনাম কৃষ্টিক স্বাধীনতা

১. মার্কিন নজির
আমাদের জাতীয় মর্যাদা, কৃষ্টিক স্বকীয়তা ও রাষ্ট্রিক সার্বভৌম-স্বাধীনতার জন্য যে দুইশ বছরের আমাদের কালচারের টাওয়ার কলিকাতার প্রভাবমুক্ত হইতে হইবে, এটা আমি উপলব্ধি করি জার্মান, ইটালি, আয়ারল্যান্ড ও মার্কিন মুল্লুকের ভাষিক-সাহিত্যিক কৃষ্টিক-উদ্বর্তনের ইতিহাস পড়িয়া। এইসব আন্দোলনের ইতিহাসই আমার মনে গভীর রেখাপাত করিয়াছে সত্য কিন্তু মার্কিন মুলুকের সর্বগ্রামটা আমার মন ও মস্তিষ্ককে উদ্বেলিত করিয়াছে সবচেয়ে বেশি। এ দাগ সৃষ্টি করেন ইমার্সন। ১৯৬২ সালে আমি বাংলা একাডেমিতে ‘সাহিত্যের প্রাণ, রূপ ও আঙ্গিক’ নামে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ পড়ি। তাতে পাক-বাংলার ভাষা-সাহিত্যের স্বাতন্ত্র্য ও কৃষ্টিক স্বকীয়তার কথা বলি এবং বৃটেনের ভাষা-সাহিত্য হইতে মার্কিন ভাষা-সাহিত্যের স্বাতন্ত্রের নজির দেই। সমবেত সাহিত্যিকদের অধিকাংশ আমার প্রতিবাদ করেন। আমার কথাকে তারা অবিভাজ্য বাংলা কৃষ্টি-সাহিত্যকে দ্বিখণ্ডিত করার ষড়যন্ত্র আখ্যা দেন। জবাবে আমি বলি ইমার্সনের মত পণ্ডিত ব্যক্তির কথা বুঝিতে মার্কিনবাসীর পঞ্চাশ বছর লাগিয়াছিল, আমার মত অপণ্ডিত ব্যক্তির কথা বুঝিতে আপনাদের একশ বছর লাগিলেও আমি তাতে বিস্মিত হইব না। পাঠকদের সুবিধার জন্য আমি এখানে মার্কিন জাতির সেই সংগ্রামী উদ্বর্তনের কথাটারই পুনরুল্লেখ করিতেছি।
মার্কিনীরা রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভ করে ১৭৭৬ সালে। কিন্তু ভাষিক ও সাহিত্যিক স্বাধীনতা লাভ করিতে তাদের আরাে দেড়শ বছর লাগিয়াছিল। এ
৩২২
সব ব্যাপারে স্বকীয়তার আবশ্যকতা উপলব্ধি করিতেই তাদের প্রায় একশ বছর লাগিয়াছিল। একবার জাতীয় স্তরে সে উপলব্ধি ঘটিয়া গেলে প্রয়ােগের স্তরে আর বেশি সময় লাগে না। মার্কিনীদেরও লাগে নাই। মাত্র পঞ্চাশ বছরেই মার্কিন জাতি জীবনের সকল ক্ষেত্রে ইংরাজ জাতির থনে পৃথকস্বতন্ত্র-স্বাধীন-স্বকীয় ব্যক্তিত্ব হাসিল করিয়া ফেলে। উপলব্ধির মুদ্দতটা যেমন ছিল দীর্ঘ, প্রসেসটাও ছিল তেমনি কণ্টকাকীর্ণ। রাজনৈতিক সিভিল ওয়ারের মতই এটাও ছিল কৃষ্টিক-সাহিত্যিক সিভিল ওয়ার। রাজনৈতিক যুদ্ধে জিতার চেয়ে কৃষ্টিক যুদ্ধে জিতা আরাে বেশি কঠিন। রাজনীতিক পরাধীনতাটা দৈহিক ও দৃশ্যমান। কিন্তু কৃষ্টিক পরাধীনতাটা মানসিক ও অদৃশ্য। দীর্ঘদিনের পরাধীনতা সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে যেমন অভ্যাসে পরিণত হয় রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ততটা হয় না। কৃষ্টিক-ভাষিক-সাহিত্যিক পরাধীনতাটা যেমন একটা এলিটিযমের পােশাকি ভব্যতায় পরিণত হইতে পারে, রাজনৈতিক পরাধীনতা তেমন হইতে পারে না। ফলে রাজনীতিক চেতনার বিস্ফোরণটা যত সহজে গণভিত্তিক হইতে পারে কৃষ্টিক চেতনাটা তেমন গণভিত্তিক হইতে পারে না। এই কারণে আমাদের দেশের বর্তমান লেখক-সাহিত্যিকরা কলিকাতার ভাষাকৃষ্টির মােকাবিলায় যেমন হীনম্মন্যতায় ভুগিতেছেন, পুরা উনিশ শতকের মার্কিন সাহিত্যিকরা তেমনি হীনম্মন্যতায় ভুগিতেছিলেন লন্ডনের ভাষাসাহিত্যের মােকাবিলায়। আমাদের লেখক-সাহিত্যিকরা বর্তমানে যেমন আমাদের নিজস্ব ভাষার বাক-রীতি ও উচ্চারণ-ভঙ্গিতে কলিকাতাশান্তিনিকেতনের বাক-রীতির মােকাবিলায় হেয় ভালগার ও অভব্য মনে করেন, ঐ যুগের মার্কিন লেখক-সাহিত্যিকরাও তেমনি লন্ডন-অক্সফোর্ডের বাক-রীতি ও উচ্চারণ-ভঙ্গির মােকাবিলায় মার্কিনী বাক-রীতি ও উচ্চারণভঙ্গিকে ভালগার ও অসভ্য মনে করিতেন।

২. স্বাতন্ত্র-বােধের উন্মেষ
মার্কিনীদের ভাষিক-সাহিত্যিক স্বাতন্ত্র্য লাভে দেড়শ বছরের বেশি সময় লাগিলেও দু-চারজন মার্কিনীর মধ্যে সে চৈতন্য-স্ফুরণ ঘটিয়াছিল খুব দ্রুতগতিতেই। এঁদের মধ্যে সকলের আগে নাম করিতে হয় বিশ্ববিখ্যাত। ওয়েবস্টারস ডিকশনারির রচয়িতা নােআ ওয়েবস্টারের। যদিও তিনি তাঁর রচিত ডিকশনারি প্রকাশ করেন ১৮২৮ সালে; কিন্তু তার চল্লিশ বছর আগেই। ১৭৮৯ সালে তাঁর ‘ইংরাজি ভাষা সম্বন্ধে বিশেষ বক্তব্য ‘ডিসার্টেশন অন
৩২৩
ইংলিশ ল্যাংগুয়েজ’ নামক নিবন্ধে বহু তথ্যপূর্ণ যুক্তি দিয়া এই উপসংহার টানিয়াছিলেন : কতিপয় অবস্থা-গতিক ভবিষ্যতে ইংরাজি ভাষা হইতে মার্কিন ভাষার পৃথকীকরণ আবশ্যক ও অনিবার্য করিয়া তুলিবে।’ এই নিবন্ধ প্রকাশের চল্লিশ বছর পরে ওয়েবস্টার ১৯২৮ সালে তাঁর বিশ্ববিখ্যাত অভিধান। প্রকাশ করেন। এই অভিধানে তিনি ইংরাজি ভাষায় অপ্রচলিত বহু মার্কিন শব্দ অন্তর্ভুক্ত করেন।

৩. ওয়েবস্টারের দৃঢ়তা
কিন্তু তার আগেই ১৮০৬ সালেই নােআ ওয়েবস্টারের প্রতিবাদে বেশ কিছু মার্কিন সাহিত্যিক কলম ধরেন। তার মধ্যে ডেভিড ব্যাসনে ওয়েবস্টারকে লেখেন : দুর্ভাগ্যবশত যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের ভাষার মধ্যে এমন কোনও মিল ও মিলন নাই যাতে একটা ঐক্যবদ্ধ মার্কিন ভাষা হইতে পারে। মার্কিন জাতির নিজস্ব ভাষা সৃষ্টির নব উদ্যমকে অঙ্কুরে বিনাশ করিবার এমন চেষ্টা অনেকে করিয়াছিলেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল ও জিলার ভাষিক বৈচিত্র্যকে ঐক্যবদ্ধ ‘ঢাকাইয়া বাংলা সৃষ্টির দূরপনেয় প্রতিবন্ধক আখ্যা দিয়া ‘কোলকেতেয়ে বাংলাকেই আমাদের সাহিত্যের ভাষা রাখিবার যুক্তি যারা দেন, তাঁদের জুড়ি উনিশ শতকের আমেরিকাতে অনেক ছিলেন। এঁদেরে লক্ষ্য করিয়াই ১৮১৭ সালে জেমস পলভিং লিখিয়াছিলেন : ‘এঁদের হাতে মার্কিনী ছাপা কোনও পুস্তক পড়িলেই তার ভাল দিক চাপিয়া গিয়া এঁরা শুধু খারাপ দিকই করিয়া দেখাইয়া থাকেন।
এ সব প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও নােআ ওয়েবস্টার ১৮২৮ সালে তার বিপ্লব সৃষ্টিকারী ডিকশনারি প্রকাশ করেন। এই সালেই এন্ড্রু জ্যাকসন যুক্তরাজ্যের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। জ্যাকশন ছিলেন গােড়া মার্কিন স্বকীয়তাবাদী। স্বাধীন মার্কিন যুক্তরাজ্যের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও রাষ্ট্র-দার্শনিক তৃতীয় প্রেসিডেন্ট টমাস জেফার্সন তাঁর জীবন-সায়াহ্নে ১৮২১ সালে লেখেন : ‘ইংরাজি ও মার্কিন কালচার সম্পূর্ণ পৃথক। আমাদের কালচার বিকশিত হইতে পারে কেবলমাত্র আমাদের নিজস্ব ভাষাতেই। এই সময় ইমার্সন তার অসাধারণ সৃজনশীল ও উর্বর কলম লইয়া মার্কিনী স্বকীয়তার পক্ষে মাঠে নামেন। বৃটিশ ঔপন্যাসিক চার্লস ডিকেনস মার্কিনী ইংরাজির বিদ্রুপ করিয়া কতিপয় চরিত্র সৃষ্টি করেন। আর বলেন যে আমেরিকানরা ঐ রূপ অমার্জিত ভালগারিযমকেই ইডিয়ম মনে করে। ১৮৪২ সালের জার্নালে ইমার্সন
৩২৪
ডিকেনসের রচনার ও মন্তব্যের প্রতিবাদ করেন। তিনি বলেন : যদিও আমেরিকানরা বাস্তব জীবনে তাদের কথাবার্তায় অমন ভাষা ব্যবহার করে না, তথাপি মি. ডিকেনস এখান-ওখান হইতে দু-চারটা অমার্জিত শব্দ যােগাড় করিয়া উহাই মার্কিন চরিত্রগুলির মুখে ঢুকাইয়া দিয়া মার্কিনীদের ভাষার ক্যারিকেচার করিয়া থাকেন।

৪. দেশি শত্রুতা বনাম বিদেশি শত্রুতা
ইমার্সন-বর্ণিত ঘটনার নজির আমাদের দেশেও আছে। তবে সেটা করেন। আমাদের বিখ্যাত পশ্চিম বাংলার লেখকরা না-খােদ আমাদের দেশের ঔপন্যাসিক-নাট্যকাররাই। তাঁদের রচিত নাটক-উপন্যাসের ডায়লগে বাংলাদেশি ভদ্রলােক’ চরিত্রেরা পশ্চিম-বাংলার সাধু কথ্যভাষাই ব্যবহার করেন (যদিও বাস্তব জীবনে তা ঘটে না)। কিন্তু ঐ সঙ্গে চাকরবাকর, কুলি ও মজুরদের মুখে বাংলাদেশের কথ্যভাষার ব্যবহার করা হয় বিকৃতরূপে ও ভঙ্গিতে যেন শুধু ক্যারিকেচার করিবার উদ্দেশ্যেই।
যা হােক মার্কিনী জনগণের মধ্যে নিজেদের ভাষার প্রতি মমতা ততদিনে বেশ সচেতন ও মুখর হইয়া উঠিলেও নামযাদা শিল্পী-সাহিত্যিকরা তখনও বিলাতী ইংরাজির প্রতি তাদের মােহ কাটাইয়া উঠিতে পারেন নাই। তাঁদের মধ্যে হেনরি জেমস, কুপার, হথর্ন ও ওয়াশিংটন আর্ভিংসের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। কুপার ও ওয়াশিংটন জনগণের ভয়ে প্রথম-প্রথম ছদ্মনামে লিখিতেন। শিল্পী হিসাবে খ্যাতি লাভ করার পরে নিজ নামে লেখা শুরু করার পরেও তারা বিলাতী ইংরাজিতেই লিখিতেন। সেজন্য তাঁরা তাঁদের উপন্যাসের চরিত্রগুলিকে ইংরাজ ও ঘটনাস্থলগুলি ইংলন্ডের শহর নগর-পল্লী বাছিয়া লইতেন। ঘটনাকালকেও তারা স্বাধীনতা লাভের আগের দিনে লইয়া যাইতেন। এঁরা সকলেই যার-তার সময়ে নামযাদা শিল্পী হইলেও তাঁরা বলিতেন, মার্কিনীদের জীবনে নাটক-নভেলের উপকরণ খুব দুর্লভ।
বাংলাদেশেও এদের জুড়ির সংখ্যাই বেশি। আমাদের লেখকসাহিত্যিকদেরও অভিমত মনে হয় এই যে বাঙ্গালদের, বিশেষত মুসলমান বাঙ্গালদের, জীবনে নাটক-নভেলের উপকরণের খুবই অভাব। তাই তাঁদের গল্প-উপন্যাসের ঘটনাস্থলের নাম থাকে না। দেশহীন এই সব চরিত্রের নামগুলি বেশির ভাগ মুসলমান হইলেও তাঁদের কথাবার্তা আচার-আচরণে তাঁদেরে পশ্চিম-বাংলায় ‘ভদ্রলােক’ বলিয়াই মনে হইবে।
৩২৫
ঐ যুগের মার্কিনী ঔপন্যাসিকদের মধ্যে এইরূপ হীনম্মন্যতাকে তাই হুইটম্যান-মাৰ্কটুইন, ফকনার কষিয়া গাল দিয়াছেন। মাৰ্কটুইন সগৌরবে ঘােষণা করিয়াছেন : আমাদের জনগণের মুখের ভাষাই আসলে শালীন ভাষা। কতিপয় শিক্ষিত লােকের ভাষাই আসল ভাষা নয়। মুষ্টিমেয় ভদ্রলােকের আচার-আচরণই ভদ্রতা নয়। বিপুলসংখ্যক নিরক্ষর লােকের ভাষাই প্রকৃত জাতীয় ভাষা। এই দিক হইতে মার্কিনী ইংরাজি ও ইংলন্ডের ইংরাজি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র দুইটা ভাষা। হুইটম্যানও প্রায় একই কথা বলিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেন : ভালগারিযম বলিয়া কিছু নাই। সব জীবন্ত ভাষাই গােড়াতে ভালগার ছিল। জনগণের মুখের তথাকথিত অমার্জিত ভাষা জীবনের প্রয়ােজনে সাহিত্যে গৃহীত হয়; তাতেই তা সাহিত্যের ভাষা হইয়া যায়। অবশেষে বৈয়াকরণদের প্রাণহীন শব্দতালিকাতেই সেই সব শব্দ স্থান পায়। হুইটম্যান তার রচনায় বহুল ব্যবহারে প্রমাণ করিয়াছেন যে কথাকথিত ভালগার শব্দ ও শব্দসমষ্টিই বিপুল প্রাণবন্ত ও জীবন্ত ভাষার প্রকৃত সম্পদ। শিক্ষিত ভদ্রলােকদের মুখের ভাষার চেয়ে অশিক্ষিত জনতার তথাকথিত অশ্লীল শব্দগুলিই জীবন্ত কাব্য ও সাহিত্যকে প্রাণবন্ত করিয়া থাকে।

৫. দূরদর্শী বিদেশির সদুপদেশ
শুধু দূরদর্শী দেশপ্রেমিক আমেরিকান লেখকরাই নন, ইউরােপীয় কোনওকোনও মনীষীও মার্কিন জাতিকে ভাষা-সাহিত্যে স্বকীয়তা অর্জনের উপদেশ দিয়াছেন। বিখ্যাত ফরাসি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী পণ্ডিত এলেক্সি-ডি-তােকভিল ১৮৩১ সালে আমেরিকা ভ্রমণ করিয়া লিখিয়াছিলেন : আমেরিকান সাহিত্যিকরা। নিজেদের দেশে বাস করেন না। তাঁরা মনের দিক হইতে ইংলন্ডে বাস করেন। ইংরাজ সাহিত্যিকরাই আজও আমেরিকান সাহিত্যিকদের মডেল। কিন্তু এটা বেশি দিন চলিবে না। মার্কিনী জনগণের ভাষাই হইবে মার্কিন সাহিত্যের ভাষা। মার্কিন জনগণ ইংলন্ডের ভাষায় নয়, তাঁদের নিজস্ব ভাষাতেই সাহিত্য সৃষ্টি চায়। আমেরিকা একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। সে গণতন্ত্রের সম্যক বিকাশ হইতে পারে মার্কিন জনগণের ভাষাতেই।
প্রায় একশ বছর পরে আরেকজন ফরাসি পণ্ডিত প্রায় একই কথা বলিয়াছিলেন। তিনি ছিলেন অধ্যাপক এ জি সুলেয়ার। তিনি ছিলেন ইয়েল ইউনিভার্সিটির ফরাসি ভাষার অধ্যাপক। ১৯২৯ সালে তিনি ইয়েল রিভিউ পত্রিকায় লিখিয়াছিলেন : মার্কিন সভ্যতা যেদিন ইংরাজি সভ্যতার আবেষ্টনী
৩২৬
হইতে মুক্ত হইয়া স্বকীয়তা লাভ করিবে, এবং এটা ঘটিতে আর বেশি বিলম্বও নাই, তখন মার্কিন ভাষা ও ভাষার নিজস্ব জীবনের প্রয়ােজনেই, মার্কিন জাতি জাতীয় ভাষার রূপ প্রদানে মার্কিন বাচনভঙ্গিই গ্রহণ করিবে।
এ ভবিষ্যদ্বাণী সফল হইতে সত্যই বেশি সময় লাগে নাই। কারণ। ততদিনে মার্কিনবাসীর কৃষ্টিক-ভাষিক ও সাহিত্যিক স্বকীয়তার বাণী খুব জোরদার হইয়া উঠিয়াছে। ইমার্সন, মাৰ্কটুইন, হেনরি ক্যাবটলজ, ফাউলার, জর্জ মেইশ, হুইটম্যান প্রভৃতি উনিশ শতকের শেষার্ধের শক্তিশালী লেখকদের প্রচারের ফলে মার্কিন গণ-মনে ততদিনে শুধু মার্কিন ভাষাপ্রীতি নয়, ইংরাজিবিদ্বেষও জাগ্রত হইয়া গিয়াছে। ভাষা-বিদ্বেষ ক্রমে জাতি-বিদ্বেষে রূপান্তরিত হইয়াছে। আমাদের বেলা ‘ঘটি’ ও ‘বাঙ্গালের মত ইংরাজকে ‘জনবুল’ ও মার্কিনকে ‘ব্রাদার জনাথন’ বলাও ততদিনে গালিতে পরিণত হইয়া গিয়াছে। মার্কিন জাতির নিজস্ব ভাষার পক্ষে জনমত ততদিনে এতই তীব্র হইয়া উঠিয়াছে যে ১৯২৩ সালে ইলিনিওস অঙ্গরাজ্যের রাজধানী শিকাগাের আইন পরিষদে এই মর্মে একটা বিল পাশ হয় যে ইলিনিওস অঙ্গরাজ্যের সরকারি ভাষা (অফিশিয়াল ল্যাংগুয়েজ) এর নাম ইংরাজি ভাষার বদলে আমেরিকান ভাষা রাখা হউক।’ এই সময়ে আমেরিকান তরুণ ভাষাবিজ্ঞানী হেনরি লুই মেনকেন (যিনি এর কিছু দিন পরেই আমেরিকান ল্যাংগুয়েজ’ এই নামে একটি বিশাল আকারের পুস্তক প্রকাশ করেন) প্রকাশ্যভাবে ঘােষণা করেন যে, তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা ঘােঘণার দলিলটিকে ইংরাজি হইতে আমেরিকান ভাষায় অনুবাদ করিবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছেন। এরই প্রতিক্রিয়াস্বরূপ ১৯২৩ সালেই কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে বৃটিশ আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালসমূহের ইংরাজি সাহিত্যের অধ্যাপকরা এক সম্মিলনীতে মিলিত হন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইংরাজি হইতে স্বতন্ত্র একটি নয়া ভাষা সৃষ্টির আন্দোলনকে তীব্র ভাষায় নিন্দা করিয়া এই সভায় একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। এই উদ্যোগকে অধ্যাপকরা মার্কিনী বিকট রসিকতা অথবা ঘােরতর অপরাধ (এ ডিপ এ্যামিরিকান জোক অর এ গ্রেট ক্রাইম) বলিয়া আখ্যায়িত করেন। ঐ সম্মিলনীতে কলাম্বিয়া সুট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক হেনরি ভ্যান ডাইক ও মিশিগান ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ফ্রেড নিউটন স্কট হেনরি লুই মেনকেনের উদ্যোগকে মানবতা ও সভ্যতা-বিরােধী জংলি অপরাধ বলেন এবং তাঁকে পশমের চট পরাইয়া শাস্তি দিবার প্রস্তাব করেন। এঁরা মার্কিনবাদের তীব্র নিন্দা করেন এবং ইংরাজি ভাষার পবিত্রতা রক্ষার জন্য কঠোরভাবে ব্যাকরণের নিয়মাদি পালনের নির্দেশ জারি করেন।
৩২৭
কিন্তু ততদিনে মার্কিন জাতির স্বকীয়তার দাবি ও উন্মাদনা দুর্বার হইয়া উঠিয়াছে। ইমার্সনের স্বকীয়তা বাণীতে উদ্বুদ্ধ, মিস জারট্রড স্টেইন, এযরা পাউন্ড ও টি এস ইলিয়টের কৃষ্টি-সাহিত্যিক নবজাগরণের বাণী ততদিনে মার্কিন জাতির মধ্যে কৃষ্টি-সাহিত্যের ক্ষেত্রে আত্মবিশ্বাসী করিয়া তুলিয়াছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে কায়সারের হাতে মার-খাওয়া ইংরাজ জাতিকে বিপন্মুক্ত করার দায়িত্ব পালনে আগাইয়া আসেন যে প্রেসিডেন্ট উড্র উইলসন, তিনিও নীতিতে ইংরাজি ভাষার পবিত্রতা রক্ষার পক্ষপাতী হইয়াও ততদিনে ‘বিশুদ্ধ ইংরাজি’ শব্দের মাঝে-মাঝে ‘অশালীন ও অমার্জিত মার্কিনী’ শব্দও ব্যবহার করিতে শুরু করিয়াছেন। এতে ইংলন্ডের ভাষিক কায়েমি স্বার্থবাদীরা এতই বিচলিত হইয়াছিলেন যে স্যার সিডনি বেপা প্রস্তাব দিয়াছিলেন যে মার্কিনী ছাত্রদের ইংরাজ অধ্যাপকদের নিকট ইংরাজি পড়িতে বাধ্য করা উচিৎ।
৬. উপলব্ধির বাস্তবায়ন কিন্তু কিছুতেই কিছু হইল না। মার্কিন জাতির কৃষ্টিক-ভাষিক স্বকীয়তা লাভের আন্দোলন সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রচারমাধ্যম রেডিও-সিনেমায় হামলা চালাইল। হলিউডের সিনেমা পরিচালক-প্রযােজকরা ইংরাজি ‘সিনেমার নাম বদলাইয়া মার্কিনী নাম রাখিলেন ‘মুভি। মুভির এ্যাকটার-একট্ৰেসরা বিশুদ্ধ ইংরাজি উচ্চারণ করিবার জন্য বিলাত হইতে প্রশিক্ষক আমদানি করা ছাড়িয়া দিলেন। কলাম্বিয়া, ন্যাশনাল ও আমেরিকান নামক তিনটা ব্রডকাসটিং কোম্পানিই তাদের সংবাদপাঠক ও অভিনেতা-অভিনেত্রীদের জন্য ওয়েস্ট এন্ড-অক্সনিয়ার ইংরাজি উচ্চারণ প্রশিক্ষণের বিশেষ স্কুলগুলি উঠাইয়া দিলেন। মার্কিনীরা মার্কিনী ইংরাজি মার্কিন উচ্চারণ-ভঙ্গিতেই বলিতে লাগিলেন। প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের অর্থনৈতিক নিউডিলের উদ্দীপনা মার্কিন জাতিকে ভাষিক নিউডিলেও উদ্দীপিত করিয়া ফেলিল। ইংলন্ডের ভাষিক কায়েমি স্বার্থীরা, মানে শিক্ষক-লেখক ও পুস্তক-প্রকাশকরা, সবাই আগে হইতেই বিপদ গনিতেছিলেন। ১৯২৭ সালে এঁদের সমবেত উদ্যোগে লন্ডনে ইংরাজি ভাষাসাহিত্য সম্পর্কে একটি আন্তর্জাতিক সম্মিলনীর অধিবেশন করিলেন। প্রধানত মার্কিন সাহিত্যিকদের উৎসাহ-উদ্যোগেই এই সম্মিলনী হইয়াছিল। কারণ মার্কিন মুল্লুকের সাহিত্যিক সনাতনীরা খােদ ইংলন্ডের সাহিত্যিকদের চেয়েও বেশি ইংরাজিপ্রীতি দেখাইতেছিলেন। এটা স্বাভাবিকও। আমাদের দেশের বাঙ্গাল’ কবি-সাহিত্যিকদের পশ্চিম বাংলাভাষা প্রীতি পশ্চিম বাঙ্গালীদের
৩২৮
চেয়েও বেশি। যা হােক লন্ডনের এই আন্তর্জাতিক সম্মিলনীতে এই মর্মে প্রস্তাব গৃহীত হয় যে, ইংরাজি ভাষার পবিত্র কুয়া অপবিত্রকরণের মার্কিনী (ডিফাইলিং পিওর অয়েল অব ইংলিশ বাই দি আমেরিকানস) ‘অপচেষ্টা’ যে কোনও উপায়ে ঠেকাইতে হইবে। নিউ স্টেটসম্যান এ সম্পর্কে ১৯২৭ সালের ২৫ জুনের সম্পাদকীয়তে লিখিয়াছিল : আমরা আমাদের মাতৃভাষা ইংরাজি সম্পর্কে আমেরিকানদের সাথে আলােচনায় বসিব না? কারণ ইংরাজি ভাষাকে যারা প্রাণ দিয়া ভালবাসে, তাদের মােকাবিলা আমেরিকানরাই সর্বাপেক্ষা ঘােরতর শত্রু। ঐ প্রস্তাবের ব্যাখ্যা করিয়া বিখ্যাত ব্যঙ্গ পত্রিকা পাঞ্চ সম্পাদকীয় লেখেন : ইংরাজি ভাষায় কুয়া পবিত্র রাখিতে হইলে আমেরিকানরা যাতে ঐ কুয়ায় কাদা না ফেলিতে পারে তার বিধান করিতে হইবে। ইয়াংকিরা যে ভাষায় কথা বলে, তাকে শুধু কাদা-মাটি বলিলেও ঠিক হইবে না। তারা কথা ত বলে না, দস্তুরমত থুথু ফেলে। অতএব তাদের ভাষা আসলে শাব্দিক নিষ্ঠীবন মাত্র।
এ সব স্পষ্টতই রাগের কথা; কটুক্তি ও গালাগালি । লােক রাগ করে যখন তাদের আর কোনও উপায় থাকে না। গাল দেয় যখন যুক্তি থাকে না। ১৭৭৬ সালে মার্কিনীদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা ঠেকাইবার জন্য ইংলন্ড অস্ত্র ধরিয়াছিল। দেড়শ বছর পরে তাদের ভাষিক-সাহিত্যিক স্বাধীনতা ঠেকাইবার কাজে অস্ত্রের বদলে ইংরাজরা জিভ ও কলম ধরিয়াছিল। কিন্তু কৃষ্টিক-ভাষিক স্বকীয়তার বাসনা রাজনৈতিক স্বরাজের বাসনার চেয়ে কম শক্তিশালী নয়।

৭. জনগণের জয়
ইংরাজরা নাহক ভয় পাইয়াছিল। না বুঝিয়া যুদ্ধ করিয়াছিল। ভ্রান্ত ধারণায় মার্কিনীদের ভাষিক-কৃষ্টিক স্বকীয়তায় বাধা দিয়াছিল। রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা লাভ করিয়াও মার্কিনীরা আজও ইংরাজের সাথে একই আন্তর্জাতিক গােষ্ঠী হইয়াই আছে। ভাষিক-সাহিত্যিক স্বকীয়তা হাসিল করিয়াও আজও তারা ইংরাজি ভাষা গােষ্ঠীর সদস্যই আছে। মিসেস জারট্রুডস্টেইনের ভাষায় মার্কিনবাসী ইংরাজি ভাষা ও তার হরফ কিছুই ছাড়ে নাই। শুধু ইংরাজি ভাষা ও সাহিত্যে মার্কিনী শব্দ ও বাচনভঙ্গি আমদানি করিয়া ঐ সাহিত্যে মার্কিনী প্রাণ প্রতিষ্ঠা করিয়াছে। তাই অতবড় বিশ্বশক্তি হইয়াও বৃটিশ সরকার প্রায় নিরস্ত্র মার্কিনীদেরে হারাইতে পারে নাই। ইংরাজি ভাষা ও সাহিত্য অতবড় বিশ্ব সাহিত্য হইয়াও কয়েদির’ বুলি’ ও অশালীন শাব্দিক নিষ্ঠীবন’কে ইংরাজি সাহিত্যের পবিত্র হেঁসেল হইতে দূরে রাখিতে পারে নাই। এইভাবে ভাষা
৩২৯
সাহিত্যের লড়াই-এ শেকসপিয়ার-স্কট-মিলটনের উত্তরাধিকারী জন বুল ভাষা-সাহিত্যের ঐতিহ্যহীন ব্রাদার জনথনের কাছে হারিয়া গিয়াছিল । ইতিহাসের তাকিদেই তেমনি বঙ্কিম, মাইকেল-রবীন্দ্রের উত্তরাধিকারী ভদ্রলােকেরা ‘ভাষা-ঐতিহ্যহীন’ বাঙ্গালদের কাছে একদিন হারিয়া যাইবেন। কারণ বাঙ্গালরা বাংলাভাষা ও হরফ ছাড়িতে চায় না। তারা বাংলা সাহিত্যে বাংলাদেশের প্রাণ প্রতিষ্ঠা করিতে চায় মাত্র।
উপরে আমেরিকাবাসীর ভাষিক স্বকীয়তার সংগ্রামের অতিসংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া হইল। এতে পাঠক নিশ্চয়ই দেখিতেছেন, মার্কিনীদের ভাষিক স্বকীয়তার সংগ্রাম দীর্ঘস্থায়ী হইয়াছিল। দীর্ঘস্থায়ী হইয়াছিল এইজন্য যে সংগ্রামটা ছিল কঠিন। সংগ্রামটা কঠিন ছিল এই জন্য যে সংগ্রামের অভীষ্টটা জনগণের নিকট সুস্পষ্ট ছিল না। সুস্পষ্ট ছিল না এই জন্য যে মার্কিনী ও ইংরাজরা ধর্ম-সমাজকৃষ্টি ও ঐতিহ্যে মূলত একই ছিল। এই দিক হইতে কৃষ্টি-সাহিত্যের ব্যাপারে মার্কিনীদের স্বাতন্ত্র-স্বকীয়তা অপরিহার্য ছিল না। এই অপরিহার্যতা সৃষ্টি হইয়াছিল তাদের রাষ্ট্রীয় প্রয়ােজনে। মানুষের রাষ্ট্রনৈতিক প্রয়ােজন বিষয়ী তাকিদ; সুতরাং মস্তিষ্কের ব্যাপার। পক্ষান্তরে সৃষ্টি-ঐতিহ্যের তাকিদটা তাদের আবেগের তাকিদ; সুতরাং হৃদয়ের ব্যাপার । কৃষ্টিক-ভাষিক সাহিত্যিক স্বকীয়তা ছাড়া রাষ্ট্রীয় আর্থিক স্বকীয়তার রক্ষা বিকাশ ও বিস্তৃতি অসম্ভব। এ সত্য উপলব্ধি করার পরই কেবল এটা তাদের আবেগের মানে হৃদয়ের ব্যাপারে উন্নত হইল। এটা ঘটিতেই তাদের সময় লাগিয়াছিল।
আমাদের বেলা এত দীর্ঘ সময় লাগিবার কোনও হেতু বা কারণ নাই। রাষ্ট্রীয় সত্তার সঙ্গে আমরা ধর্ম-সমাজ-কৃষ্টি-ঐতিহ্য ও ইতিহাসের সকল ব্যাপার ও স্তরে আমরা স্বতন্ত্র। ভাষিক-সাহিত্যিক স্বাতন্ত্র ছাড়া বাংলাদেশ তার রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতাও রক্ষা করিতে পারিবে । এই কারণেই মার্কিন পক্ষের আমার ভাষাবাদের উৎস। মার্কিনীদের জাতীয় ভাষা সাহিত্য বিকাশে নােআ ওয়েবস্টারের আমেরিকান ইংলিশ ডিকশনারি যে অবদান রাখিয়াছিল, বাংলাদেশের ভাষা-সাহিত্য বিকাশে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ-সম্পাদিত পূর্বপাকিস্তানি আঞ্চলিক ভাষার অভিধান-এর অবদান হইবে ঠিক তাই। ১৯৬৫ সালে ড. শহীদুল্লাহ ঐ অভিধান বাহির করিয়াছিলেন বলিয়া কেউ নিরাশ হইবেন না। মনে রাখিবেন, ওয়েবস্টার তার অভিধান বাহির করিয়া ছিলেন ১৮২৮ সালে। আর আমেরিকার ভাষার সাহিত্যের মার্কিনী রূপায়ণ চূড়ান্ত হইয়াছিল একশ বছর পরে বিশ শতকের ত্রিশের দশকে।
৩৩০

ষষ্ঠ খণ্ড
সাংবাদিক জীবন

অধ্যায় সতের
সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি

১. এক ঢিলে দুই পাখি
সাংবাদিক হওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষা আমার ছেলেবেলা ছিল না। যেটা ছিল, সেটা। সাহিত্যিক হওয়ার সাধ। আসলে সাহিত্যিক-সাংবাদিক যে দুইটা আলাদা বস্তু, সে জ্ঞানই তখন আমার ছিল না। সাহিত্যিক যারা তারাই খবরের। কাগজও চালান, এটাই ছিল আমার ধারণা । সাহিত্যিক হওয়ার চেষ্টা ত আমি করিতেছিই। খ্যাতনামা লেখকদের বই-পুস্তক পড়িতেছি। নিজে কবিতা, প্রবন্ধ ও গল্প লিখিতেছি। আর খবরের কাগজ শুধু পড়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ। খবরের কাগজ বাহির করার জ্ঞান ছাপার কৌশল দেখা পর্যন্ত। স্কুল-জীবনে ময়মনসিংহ শহর হইতে প্রকাশিত একমাত্র সাপ্তাহিক চারু-মিহির ছাপা হইতে দেখিয়াছি। বিস্মিত হইয়াছি। কিন্তু আকৃষ্ট হই নাই। কারণ লেখা সম্পাদনের কাজটা কারা করেন, কোথায় করেন, তা দেখার সৌভাগ্য হয় নাই। সাংবাদিক হওয়ার সাধ জন্মানাের জন্য ঐটুকু অভিজ্ঞতা যথেষ্ট নয়। তার উপর, ঐ সময় বঙ্কিমচন্দ্রের বিবিধ প্রবন্ধে’, ‘নবীন লেখকদের প্রতি উপদেশ’ পড়িয়াছিলাম। তাতে তিনি নবীন লেখকদের উপদেশ দিয়াছেন : ‘যদি প্রকৃত সাহিত্যিক হইতে চাও, তবে সাময়িক পত্রিকায় লিখিও না। সাহিত্যিক হওয়ার বাসনাটা প্রবল থাকায় বঙ্কিমচন্দ্রের উপদেশটা মানিয়া চলার একটা অস্পষ্ট সংকল্প আমার নিশ্চয়ই হইয়াছিল। বঙ্কিমচন্দ্রের ঐ উপদেশাবলিতে আরাে একটা উপদেশ ছিল এই : যা লিখিবে তাই। ছাপাইবার জন্য ব্যস্ত হইও না।’ তাঁর এ উপদেশটা মানিতে পারি নাই। আলএসলাম নামক মাসিকে প্রবন্ধ ও সওগাত-এ গল্প লিখিতে শুরু করি। বঙ্গ
৩৩৩
দর্শন-এর সম্পাদক বঙ্কিমচন্দ্র নিশ্চয়ই মাসিক কাগজকে সাময়িক পত্রিকা বলেন নাই। তিনি সাপ্তাহিক দৈনিক খবরের কাগজই মিন করিয়াছেন। কাজেই বঙ্কিমচন্দ্রের উপদেশ অমান্য করার দরকার হইল না।
কিন্তু শিক্ষাজীবন শেষ করিয়াই বুঝিলাম, রােযগারের জন্য চাকরি করিতেই হইবে। রােযগারের জন্য চাকরি ও সাহিত্য সেবার মত এক ঢিলে। দুই পাখি মারা যায় শুধু খবরের কাগজেই। খবরের কাগজের কেন্দ্র কলিকাতা। কাজেই একদিন এই উদ্দেশ্যে কলিকাতা গেলাম।

২. ‘ছােলতান’
আমার সাংবাদিক জীবন শুরু হয় ১৯২৩ সালে। আবুল কালাম শামসুদ্দীন তখন মুসলিম জগত নামক সাপ্তাহিকের সম্পাদক। খান বাহাদুর আহসান উল্লাহ সাহেবের ছােট ভাই মখদুমী লাইব্রেরির পরিচালক মাে. মােবারক আলী সাহেব। (পরে খান বাহাদুর) এই কাগজের মালিক। আমি একটা কিছু চাকরি জোগাড়ের মতলবেই কলিকাতা গিয়াছিলাম। সাংবাদিকতার দাবি সবার আগে। চা-নাশতা হইতে খাওয়া-থাকা সবই শামসুদ্দীনের ঘাড়ে। কাজেই তার সম্পাদকতায় যথাসাধ্য সাহায্য করা কর্তব্য মনে করিলাম। এই কর্তব্যই শেষ পর্যন্ত সুযােগে পরিণত হইল। আস্তে আস্তে ছােট-ছােট সম্পাদকীয় মন্তব্য হইতে বড় প্রবন্ধ লিখিতে শুরু করিলাম। এরই মধ্যে ছহি বড় তৈয়ব নামা নামে পুঁথির ভাষায় একটি রাজনৈতিক প্যারডি স্যাটারার ও সভ্যতায় দ্বৈতশাসন’ নামক একটি দীর্ঘ দার্শনিকরাজনৈতিক প্রবন্ধ লিখি। তাতে মুসলিম সাংবাদিকদের নজরে পড়ি। কতকটা এই কারণে, কতকটা আবুল কালামের চেষ্টায় আমি ত্রিশ টাকা বেতনে মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী সাহেবের ছােলতান-এ সহসম্পাদকের চাকুরি পাই।
ছােলতান-এ আমি প্রায় দেড় বছর কাজ করি। মাওলানা ইসলামাবাদী সাহেবের স্নেহ ও প্রশংসা অর্জন করি। তিনি আমার বেতন ত্রিশ টাকা হইতে চল্লিশ টাকা করিয়া দেন এবং বলেন সাধ্য থাকিলে আরাে বেশি দিতেন। ছােলতান-এ কিছু দিন কাজ করিয়াই জানিতে পারি, মৌ. ইসমাইল হােসেন সিরাজী সাহেবও ছােলতান-এর একজন মালিক। তাঁর সাথেও পরিচয় হয়। তিনি আমার লেখার উদ্দীপনা ও ভাষার তেজস্বিতার বহুৎ প্রশংসা করেন। মওলানা সাহেব কিন্তু আমার লেখার তেজস্বিতার
৩৩৪
চেয়ে যুক্তিবত্তা ও বিষয়বস্তুর প্রশংসা করেন বেশি। যা হােক দুই মুনিবের মন রাখার চেষ্টায় আমার ভালই হইল । আমার লেখায় ওজস্বিতা ও যুক্তিপূর্ণ সমানভাবে উন্নতি লাভ করিল। আমি মওলানা সাহেবের স্নেহ ও আস্থাভাজন হইয়া বেশ সুখেই দেড় বছর ছােলতান-এ কাটাইলাম। ১৯২৪ সালের জুন-জুলাই মাসে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের নেতৃত্ব ও মওলানা আকরম খাঁ সাহেবের সভাপতিত্বে সিরাজগঞ্জে প্রাদেশিক কংগ্রেসের সম্মিলনী হয়। এই কনফারেন্স উপলক্ষে আমি মওলানা আকরম খাঁ সাহেবেরও আস্থা অর্জন করি। তিনি ছােলতান-এ আমার লেখায় আগেই সন্তুষ্ট ছিলেন। কাজেই সিরাজগঞ্জ কনফারেন্সের পর পরই তিনি মওলানা ইসলামাবাদী সাহেবের নিকট চাহিয়া নিয়া আমাকে তাঁর সাপ্তাহিক মােহাম্মদীতে চাকুরি দেন। চল্লিশ টাকার জায়গায় পঞ্চাশ টাকা বেতন পাইতেছি দেখিয়া মওলানা ইসলামাবাদী সাহেব সম্মতি দেন।

৩. ‘মােহাম্মদী’
মােহাম্মদীতেও আমি দেড় বছরের বেশি কাজ করি। এই সময় জনাব ফজলুল হক সেলবর্সী ও জনাব মােহাম্মদ ওয়াজেদ আলীও মােহাম্মদীতে কাজ করিতেন। আমি উনাদের জুনিয়র হইলাম। কাজেই সব সিনিয়রের মতই এই দুই বন্ধুও আমাকে দিয়া প্রায় সব কাজ করাইয়া নিতেন। তাঁরা যথাসম্ভব কম লিখিতেন। এতে আমি অসন্তুষ্ট বা দুঃখিত হইতাম না। বরঞ্চ এটাকে আমি তাঁদের অনুগ্রহ মনে করিতাম। সারা দিন ভূতের মত খাটিতাম। সাপ্তাহিক কাগজে প্রতি সপ্তাহে দুইটা করিয়া সম্পাদকীয়তে মাসে আটটা হইত। কোনও কোনও মাসে পাঁচ-ছয়টাই আমি লিখিতাম। সেলবর্সী সাহেবের লেখা ছিল হৃদয়স্পর্শী উচ্ছ্বাস; তিনি যুক্তিতর্কের ধারে-কাছেই যাইতেন না। পক্ষান্তরে ওয়াজেদ আলী সাহেবের লেখা ছিল যুক্তিপূর্ণ। তিনি উচ্ছ্বাসের ধারে-কাছে যাইতেন না। আমি দুইটাতেই দক্ষ ছিলাম। রক্তচক্ষু’, ‘বজ্রমুষ্টি’ ইত্যাদি বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ-বিরােধী উদ্দীপক হেডিং দিয়া আমি একাধারে ওজস্বিতা ও যুক্তিপূর্ণ বহু সম্পাদকীয় লিখিয়া সাংবাদিক মহলে নাম ও মওলানা আকবর খাঁ সাহেবের প্রশংসা অর্জন করিলাম। স্বয়ং মওলানা আকরম খাঁ সাহেবই বলিতেন আমার লেখার মধ্যে সেলবর্সী সাহেবের উচ্ছ্বাস ও ওয়াজেদ আলী সাহেবের যৌক্তিকতা দুইটারই সমন্বয় হইয়াছে। বস্তুত ‘রক্তচক্ষু’, ‘বজ্রমুষ্টি’, ‘সিংহ নিনাদ ইত্যাদির মত উদ্দীপনাময়ী অনেক লেখা
৩৩৫
‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির’ রিডিং রুমে একজন আবৃত্তির ভঙ্গিতে পড়িতেন, আর সকলে শুনিতেন। একই প্রবন্ধ এমনিভাবে একাধিকবার পড়া হইত। এটা ত গেল সম্পাদকীয় লেখার দিক। একটা সংবাদপত্র, তা সাপ্তাহিকই হউক, আর দৈনিকই হউক, সম্পাদনায় সম্পাদকীয় লেখা ছাড়াও আরাে অনেক দিক আছে। দেশি-বিদেশি সংবাদ ছাপা, সেসব সংবাদের হেডিং দেওয়া, পাঠকদের চিঠিপত্র ছাপা, মফস্বলের অভাব-অভিযােগ ও সভা-সমিতির রিপাের্ট ছাপা, সর্বোপরি কাগজটির সার্বিক ও সামগ্রিক গেটআপ ও মেক-আপের সৌষ্ঠব বৃদ্ধির জন্য প্রকাশিত সংবাদসমূহের স্থাননির্ণয়-নির্দেশ করা এবং ঠিকমত এসব কাজ হইতেছে কিনা, শেষ পর্যন্ত তা নিরীক্ষণ ও ত্যদিক করার জন্য কম্পােযিটার ও মেশিনম্যানদের সঙ্গে সঙ্গে থাকা এবং সবশেষে এ সবের মােটামুটি প্রুফ দেখিয়া দেওয়া খুবই দায়িত্বপূর্ণ ও শ্রমসাধ্য কাজ। বড়-বড় কাগজে এবং দৈনিক কাগজ মাত্রই এ সব কাজ করিবার জন্য বিভাগীয় সাব-এডিটর আগেও ছিলেন। এখন ত আরাে বেশি । কিন্তু একটি সাপ্তাহিকের জন্য তৎকালে এত সব ব্যবস্থা ছিল না। সাধ্যও ছিল না । দরকারও ছিল না। কাজেই সাপ্তাহিক মােহাম্মদীর বেলা এ সবই আমাদেরই করিতে হইত। আমাদের মানে তৎকালে আমরা ঐ তিনজন। ওঁরা দুইজনই আমার সিনিয়র। তাঁদের ছিল যেমন সিনিয়রের বােঝা জুনিয়রের কাঁধে ঢালিয়া দেবার অধিকার ও অভিপ্রায়, আমারও ছিল তেমনি ‘বড় বোেঝা’ বহিবার জন্য কাঁধ পাতিয়া দিবার আগ্রহ। জ্ঞানী সিনিয়ররা যেমন অজ্ঞ জুনিয়রদেরে ‘ছেলে-ভুলানাে’ তারিফ করিয়া কাজ আদায় করিয়া থাকেন, আমার বেলা তা ঘটে নাই, তা বলিতে পারি না। তবে আমি তা বুঝি নাই। বুঝিবার দরকারও হয় নাই, তা বলিতে পারি না। কারণ আমার পরবর্তী সাংবাদিক জীবনে জুনিয়র-স্তরের এই খাটুনি খুবই কাজে লাগিয়াছিল।
যা হােক সিনিয়রদের স্নেহ ও আস্থার ফলে সম্পাদনার উপরােল্লিখিত সব দায়িত্ব ও কর্তব্যই আমার ঘাড়ে বর্তাইত। আমিও ঘাড় পাতিয়া সানন্দেই সব গ্রহণ করিতাম। তারা স্বেচ্ছায় যা দিতেন তার বেশি চাহিয়া নিতাম।
এ সব কাজের মধ্যে সকলের আগে সংবাদে ‘কপি’ তৈয়ার করা। এটা দৃশ্যত ছিল খুবই সহজ কাজ। প্রতিদিন সকালেই বাংলা দৈনিক কাগজগুলি পাইতাম। সে সব কাগজ হইতে বাছাই-করা সংবাদগুলি কেঁচি-কাটা করিলেই সাপ্তাহিকের কপি হইয়া যাইত। কিন্তু শুনিতে এটা যেমন সহজ মনে হয়, আসলে কাজটা তত সহজ নয়। দৈনিকে প্রকাশিত সব খবর
৩৩৬
সাপ্তাহিক কাগজে দেওয়া সম্ভব ছিল না। তাতে সর্ব সংবাদই যে সাপ্তাহিকে দেওয়া হইত না, তা-ও নয়। বাছাই-করা সংবাদগুলিই ছােট করিতে হইত। বড়-বড় লেখাকে ছােট করিবার জন্য স্কুল-কলেজে সামারি লিখিবার যে শিক্ষা লাভ করিয়াছিলাম, তা এখানে কাজে লাগিত না। সামারি করিলে আবার নিজের হাতে নিজের ভাষায় লিখিতে হয়। তাই সাংবাদিকরা বড়বড় লেখাকে ছােট করিবার নূতন কায়দা আবিষ্কার করিয়াছেন। গােটা রিপাের্টটা পড়িয়া তার দরকারি অংশগুলি কেঁচি-কাটা করিয়া সেই কাটা অংশগুলি অন্য সাদা কাগজে পেস্ট করিয়া দেওয়া হইত। এই উদ্দেশ্যে সাদা কাগজের পাশে ছােট ও দীঘে লম্বা করিয়া প্যাড বানান হইত। এই প্যাডে কাটা টুকরাগুলি আঠা দিয়া আঁটিয়া দেওয়া হইত। এতেও দক্ষতা লাগিত । কারণ এমন কাটা বিভিন্ন টুকরার মধ্যে সংগতি ও ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য কেঁচি-কাটা অংশগুলির ফাঁকে-ফাকে কিছু-কিছু কথা ভরিয়া দিতে হইত। এটা হাতের লেখাতেই করা হইত। তা ছাড়া, আরাে একটা খুব বড় অথচ ছােট কাজও করিতে হইত। কলিকাতার সবগুলি বাংলা দৈনিক কাগজই ছিল হিন্দুদের সম্পাদিত ও পরিচালিত। কাজেই তাদের বাংলা ভাষাকেও আমাদের কিছুটা ‘মুসলমানি করিয়া লইতে হইত। এই ধরুন, জলকে ‘পানি’, ‘ঈশ্বরকে’ ‘আল্লাহ’, ভগবানকে ‘খােদা’, ‘পিসা’কে ‘ফুফা, ‘খােড়া’কে ‘চাচা’ করিতে হইত। এটা করিতে হইত এই জন্য যে হিন্দু লেখক-সাংবাদিকরা শুধু হিন্দু ব্যক্তিদের মুখ দিয়াই নয় মুসলমান ব্যক্তিদের মুখেও ঐ সব শব্দ ঢুকাইয়া দিতেন। এমনকি মুসলমান মৃত ব্যক্তিকেও ‘কাফন-দাফন’ না করাইয়া অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া করাইতেন। ঈদের জামাতে মওলানা সাহেবদের দিয়া ‘এমামতি’ না করাইয়া ‘পৌরাহিত্য করাইতেন। বাংলা সাহিত্যের উন্নয়ন যুগের এটা ছিল সেই মুদ্দত যখন বাংলা সাহিত্যের হিন্দু মহারথীদের লেখা নাটক-নভেলে ও মঞ্চে পাঠান-মােগল বাদশাবেগম ও শাহযাদা-শাহযাদীরা পরস্পকে ‘পিসা’-“পিসি’, ‘খােড়া’-‘খােড়ী সম্বােধন করিতেন। কাজেই মুসলমান পাঠকদের জন্য সাপ্তাহিক চালাইতে গিয়া ঐ সব ভাষিক সংশােধন আমাদের জন্য অত্যাবশ্যক ছিল। এ সব কাজকে সাব-এডিটিং বলা হইত ।
সম্পাদকের নামে লিখিত চিঠি-পত্রও সংশােধন করা দরকার হইত। এই সব চিঠি-পত্র সাধারণত দুই প্রকারের হইত। এক শ্রেণীর চিঠি-পত্র স্থানীয় অভাব-অভিযােগ, রাস্তাঘাট নির্মাণ, পােল মেরামত, স্কুল-মাদ্রাসা স্থাপন, পানির ব্যবস্থার অভাব এই সব অভাব-অভিযােগের প্রতিকার দাবিই
৩৩৭
সাধারণত এই শ্রেণীর চিঠি-পত্রের বিষয়বস্তু ছিল। কাজেই এক-আধটু ভাষা। সংশােধন ছাড়া এসব পত্রে আর কিছু করা দরকার হইত না।
অপর শ্রেণীর চিঠিপত্র ছিল বাদ-প্রতিবাদের মত তর্কিত বিষয়। কোনও প্রকাশিত সংবাদের প্রতিবাদ। কোনও স্থানীয় কর্তৃপক্ষের বিশেষ কাজের অবিচার ও পক্ষপাতিত্ব ইত্যাদি। এ ধরনের চিঠিপত্র খুব সাবধানে ‘সম্পাদন মানে সংশােধন করিতে হইত। এ ধরনের পত্রে সাধারণ সত্য-মিথ্যার আশঙ্কা ছাড়াও মানহানি’ এমনকি রাষ্ট্রদ্রোহিতার’ রিস্ক থাকিতে পারিত। কাজেই এ ধরনের পত্রের সম্পাদনায় অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বন আবশ্যক হইত।
সব লেখকদেরই, বিশেষত সাংবাদিকদের, প্রুফ রিডিং জানা অত্যাবশ্যক, এমনকি অপরিহার্য। অবশ্য সব সংবাদপত্রে, সব ছাপাখানাতেও, প্রুফরিডার নামে এক শ্রেণীর বিশেষজ্ঞ থাকেন। প্রুফরিডিংয়ের কাজ এঁরাই করিয়া থাকেন। কিন্তু সম্পাদক, সহকারী সম্পাদক (এ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর), সহ-সম্পাদক (সাব-এডিটর) সবারই প্রুফ রিডিং জানা দরকার। এঁদের মধ্যে অনেকে আমাদের সময়েও ছিলেন, আজকালও আছেন, যাঁরা প্রুফ রিডিংয়ে তেমন মনােযােগ দেন না। ওটা তাঁদের ডিউটি নয় বলিয়া । কিন্তু আমার মতিগতি ছিল অন্য রকম। প্রুফ দেখা আমার একটা বাতিক ছিল বলা চলে। মােহাম্মদীতে এ বিষয়ে আমার মডেল ও শিক্ষাদাতা ছিলেন ওয়াজেদ আলী সাহেব। তারও প্রুফ দেখার নেশা ছিল। ছিলেনও তিনি প্রুফ দেখার উস্তাদ। অবশ্য মােহাম্মদীতে আসার আগেই, ছােলতান-এ কাজ করার সময় হইতেই প্রুফ দেখার কাজে আমি বেশ খানিকটা অভিজ্ঞতা লাভ করিয়াছিলাম। ছােলতান-এর ম্যানেজারই বলুন, মওলানা মনিরুজ্জামান। ইসলামাবাদী সাহেবের সর্বক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিনিধি বা প্রাইভেট সেক্রেটারিই বলুন, আর ছােলতান-এর প্রধান সাব-এডিটরই বলুন, মৌ. আলী আহমদ ওলী ইসলামাবাদী সাহেব ছিলেন মিষ্টভাষী সদালাপী, সর্ববিষয়ে অভিজ্ঞ একজন করিতকর্মা লােক। উপরে সাপ্তাহিক কাগজের সহ-সম্পাদকের যেসব দায়িত্বের কথা বলা হইয়াছে, তার সবগুলি সম্পর্কে অল্পবিস্তর জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা লাভ করি আমি জনাব আলী আহমদ ওলী সাহেবের নিকট হইতেই। তাঁর সাহচর্যে ছােলতান-এর দেড় বছর স্থায়ী চাকুরিজীবনে। সাপ্তাহিক সম্পাদনার অনেক কাজই শিখিয়াছিলাম।
কিন্তু এ সব শিক্ষাই আরাে পাকা হইয়াছিল মােহাম্মদীর চাকুরিজীবনে। কাগজও বড় ছিল, প্রচারও বেশি ছিল। কাজেই দায়িত্ব অনেক বড় ছিল। শিক্ষকও পাইয়াছিলাম ওয়াজেদ আলী সাহেবের মত অভিজ্ঞ ও প্রতিভাবান
৩৩৮
লেখককে। অন্যান্য দিকের মত প্রুফ রিডিংয়েও তিনি আমাকে অনেক শিক্ষাদান করিয়াছিলেন। প্রুফ দেখা শুধু টেকনিক্যাল জ্ঞান লাভ নয়, এটা। যে একটা বিশেষ আর্ট, জ্ঞানের চেয়ে দক্ষতা ও নিপুণতা যে এ কাজে অধিক আবশ্যক, এ জ্ঞান আমাকে দান করেন ওয়াজেদ আলী সাহেবই।। পরবর্তীকালে দি মুসলমান-এ যােগ দিয়া আমার রাজনৈতিক ও সাংবাদিক গুরু শ্রদ্ধেয় মৌলবী মুজিবর রহমান সাহেবের নিকট বিশেষ করিয়া প্রুফ রিডিংয়ে বিশেষ তালিম পাইয়াছিলাম। সে কথা পরে যথাস্থানে লিখিব । মােহাম্মদীতে দেড় বছর কাল খুব সুখে ও উৎসাহেই কাজ করিবার পর। ১৯২৬ সালের প্রথমেই বিনামেঘে বজ্রপাতের মত আমার চাকুরি গেল । আমি ইচ্ছা করিয়া এই চাকুরি ছাড়ি নাই। আমাকে ছাড়াইয়া দেওয়া হয়। ঘটনাটাও এমন বিশেষ কিছু নয়। ১৯২৫ সালের শেষ দিকে মওলানা আবদুল্লাহিল কাফী সত্যাগ্রহী নামে একটি সাপ্তাহিক বাহির করেন। মওলানা আবদুল্লাহিল বাকী ও মওলানা আবদুল্লাহিল কাফী দুই ভাই-এর সাথে আমি মােহাম্মদীআফিসেই পরিচিত ও ঘনিষ্ঠ হই। একই রাজনৈতিক ও ধর্মীয় মতের লােক বলিয়া এই দুই ভাই-এর সাথে মওলানা আকরম খাঁ সাহেবের খুবই মাখামাখি ছিল। কাজেই মওলানা কাফী সাহেব সত্যাগ্রহী বাহির করিলে আমি তার আফিসে ঘন ঘন যাতায়াত করিতাম এবং দরকার হইলে লেখাটেখা দিয়া সাহায্যও করিতাম। মওলানা আকরম খাঁ সাহেব এই খবর পাইয়া মনে-মনে রুষ্ট হইলেন। কিন্তু আমাকে কিছু বলিলেন না। মওলানা আকরম খাঁ সাহেবের অনেক গুণ থাকা সত্ত্বেও এবং তিনি বহু ব্যাপারে খুবই উদার চিন্তানায়ক হওয়া সত্ত্বেও একটা ছােটখাটো দুর্বলতা তাঁর ছিল। মুরুব্বির নিন্দা করিতে নাই। কিন্তু না বলিয়া উপায়ও নাই। কোনও মুসলমান নূতন বাংলা কাগজ বাহির করিলেই তিনি অসন্তুষ্ট হইতেন, এটা তাঁর বরাবরের দুর্বলতা। হয়ত তার সংগত কারণও ছিল। তিনি খুব সম্ভব মনে করিতেন, নূতন কাগজ বাহির হওয়ায় তাঁর কাগজের অনিষ্ট হইবে। এটা ভাবা নিতান্ত অস্বাভাবিক ছিল না। তৎকালে মুসলমানের পক্ষে সংবাদপত্র বাহির করা এবং চালান খুবই কঠিন ছিল। গ্রাহক-পাঠক সংখ্যাও খুব মুষ্টিমেয় ছিল। বােধ হয় সেইজন্যই মওলানা আকরম খাঁ মনে করিতেন, এই নূতন কাগজটা শেষ পর্যন্ত টিকিবে না; মাঝখান হইতে তাঁর নিজের কষ্টের চালু করা মােহাম্মদীর গ্রাহক কমাইয়া এবং তাতে আর্থিক ক্ষতি করিয়া যাইবে। কাজেই নূতন কাগজ বাহির করাই অন্যায় এবং প্রকারান্তরে মওলানা আকরম খাঁ সাহেবের কাগজের
৩৩৯
দুশমনি। এই মনােভাব হইতেই মওলানা আকরম খাঁ সাহেব সত্যাগ্রহী বাহির করার দরুন কাফী সাহেবের উপরও নাখােশ ছিলেন। আমি তাঁরই বেতনভােগী কর্মচারী হইয়া তার দুশমনের সাহায্য করিতেছি, এটাকে হয়ত তিনি ঘােরতর অন্যায় মনে করিলেন। কিন্তু আমাকে তিনি হুঁশিয়ার করিলেন না। কথাবার্তায় বা আভাসে-ইঙ্গিতে বাধাও দিলেন না। দিলে আমি কিছুতেই ও-কাজ করিতাম না। কারণ মওলানা আকরম খাঁ সাহেবের বা মােহাম্মদীর অনিষ্ট করার ইচ্ছাও আমার ছিল না; পঞ্চাশ টাকা বেতনের চাকুরি ছাড়িবার সংগতিও আমার ছিল না। বরঞ্চ এই পঞ্চাশ টাকা বেতনের চাকুরির উপর ভরসা করিয়া মাত্র অল্পদিন আগে বাপ-মার বহুদিনের পীড়াপীড়িতে শেষ পর্যন্ত বিবাহ করিতে রাজি হইয়াছি এবং বিয়ার দিনতারিখও ঠিক হইয়া গিয়াছে।
এমন সময় মওলানা আকরম খাঁ সাহেবের বড় ছেলে এবং মােহাম্মদীর ম্যানেজার মৌ. খায়রুল আলম সাহেব আমাকে হঠাৎ একদিন জানাইলেন, পরদিন হইতেই আমার চাকুরি নাই। কেন নাই, কী আমার অপরাধ, কিছু বলিলেন না। আমি আসমান হইতে পড়িলাম। চোখে অন্ধকার দেখিলাম । আমি অতি বিনীতভাবে কারণ জানিতে চাইলাম। যা বলা হইল, তার সারমর্ম এই যে, মােহাম্মদীতে আর আমার মন নাই। যেখানে মন আছে সেই সত্যাগ্রহীতেই আমার যাওয়া উচিৎ। ততক্ষণে বুঝিলাম আমার অপরাধ কী? এও বুঝিলাম যে হাজার অন্ধকার দেখিয়াও কোনও লাভ নাই।
৪. ‘দি মুসলমান মওলানা কাফী সাহেব শুনিয়া মর্মাহত হইলেন। তিনি সব বুঝিলেন । আমাকে বলিলেনও। কিন্তু পঞ্চাশ টাকা মাহিয়ানা দিয়া আমাকে রাখিবার তাঁর সংগতি নাই বলিয়া আফসােসও করিলেন; তবে এও বলিলেন, কিছু একটা করিতেই হইবে। কিছু-একটা তিনি নিশ্চয়ই করিয়াছিলেন। কারণ দুই-একদিন পরেই মৌলবী মুজিবর রহমান সাহেব আমাকে ডাকিয়া। পাঠাইলেন এবং পঁয়ষট্টি টাকা বেতনের দি মুসলমান-এ চাকুরি দিতে চাহিলেন, কথা-বার্তায় বুঝিলাম মওলানা কাফী সাহেব সব কথাই তাকে বলিয়াছেন। এমনকি, আমি যে বিবাহের তারিখ পিছাইয়া দিতে বাপজীর। কাছে পত্র লিখিতে যাইতেছি, সে কথাটা পর্যন্ত কাফী সাহেব মৌলবী সাহেবকে বলিয়া দিয়াছেন। কারণ মৌলবী সাহেব বলিলেন : ‘এক মাসের
৩৪০
বেতন অগ্রিম লইয়া তুমি বাড়ি যাও । বিবাহের পরেই তুমি চাকরিতে যােগ দাও। বলা বাহুল্য, আমি কৃতজ্ঞতায় গলিয়া পড়িলাম। মনে হইল, গায়ের চামড়া দিয়া মৌলবী সাহেবের পায়ের জুতা বানাইয়া দিলেও এ ঋণ শােধ হইবে না। বিয়ার পরে যথাসময়ে দি মুসলমান যােগ দিলাম। অতি সুখেশান্তিতে মানে-মর্যাদায় একাদিক্রমে চার বছরকাল মৌলবী সাহেবের বিশ্বস্ত ও স্নেহসিক্ত সহকারী হিসাবে সাংবাদিকতা করিলাম। তিনি প্রথম প্রথম সাব-এডিটরের সাধারণ কাজ করান ছাড়াও এডিটরিয়েল নােট লেখাইতেন। এবং শুদ্ধ করিয়া দিতেন। পরে আমাকে দিয়া বড়-বড় বিষয়ে এডিটরিয়েলও লেখাইতেন। ক্রমে আমি তাঁর এত বিশ্বাস অর্জন করিয়াছিলাম যে তিনি। নিজে না দেখিয়াও অনেক সময় আমার লেখা প্রেসে পাঠাইয়া দিতেন। এমন কাজ অন্য কারাে বেলা তিনি করিতেন না। অধ্যাপক জে এল ব্যানার্জি মৌলবী সাহেবের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। তিনি একাদিক্রমে অনেকদিন মৌলবী সাহেবের মেহমানরূপে দি মুসলমান আফিসের দুতালায় বাস করিতেন। এই সময়ে তিনি দি মুসলমা-এর সম্পাদকীয় রূপে বহু লেখা লিখিতেন। এ ছাড়া বাবু রসময় ধারা নামে একজন বিশিষ্ট সাংবাদিক নিয়মিতভাবে দি মুসলমান-এ লিখিতেন। এই দুইজন বিশিষ্ট পণ্ডিত লােকের লেখাও কোনও দিন মৌলবী সাহেব নিজে না পড়িয়া এবং কিছু সংশােধন না করিয়া প্রেসে দিতেন না। সেটা অবশ্য ইংরাজি ভাষা সংশােধন নয় মতবাদ সংশােধন । তিনি আমাকে বলিতেন : এঁরা ভাষা ও বিষয়বস্তুতে পণ্ডিত বটে, কিন্তু মুসলমানের মুখে যেমন করিয়া ফুটা উচিৎ ঠিক তেমনটি এঁরা সব ক্ষেত্রে পারেন না। আরেকটা কথা মৌলবী সাহেব বলিতেন এবং আমাদিগকে সব সময়ে স্মরণ করাইয়া দিতেন : কারাে সমালােচনা এমনকি নিন্দা করিতে গিয়া শিষ্টাচার ও ভদ্রতার খেলাফ করিও না। তিনি এইরূপ দৃষ্টান্ত দিতেন : তুমি জান একজন মিথ্যা কথা বলিয়াছেন। তার কথা লিখিতে গিয়া কখনও লিখিও না তিনি মিথ্যাবাদী, তিনি মিথ্যা কথা বলিয়াছেন। তার বদলে লিখিবে, তিনি সত্যবাদী নন’ বা ‘তিনি সত্য কথা বলেন নাই। কোনও শ্ৰেণী, সম্প্রদায় বা জাতির কোনও সাধারণ দোষের কথা লিখিতে গিয়া কখনও লিখিবে না ‘অমুক শ্ৰেণী সম্প্রদায় বা জাতির এই দোষ’ তার বদলে। লিখিবে ‘ঐ শ্ৰেণী সম্প্রদায় বা জাতির কতকাংশের এই দোষ। এই ধরনের হাজারও নীতি-বাক্য ও মূল্যবান উপদেশ তিনি আমাদিগকে শুনাইয়াছেন। আমরা অনেকেই শিখিয়াছি। পরবর্তী সাংবাদিক জীবনে ঐগুলি আমার পথের দিশারিরূপে কাজ করিয়াছে।
৩৪১
৫. খাদেম’
মৌলবী সাহেব আমার ইংরাজি লেখার খুব তারিফ করিলেও তিনি বলিতেন : ‘কিন্তু তােমাকে দিয়া আমি যদি শুধু ইংরাজি লেখাই, তবে তােমার উপর এবং বাংলা সাহিত্যের উপর আমি অবিচার করিব। কতকটা শুধু তােমারই জন্য আমাকে একটা বাংলা কাগজ বাহির করিতে হইবে। শেষ পর্যন্ত তিনি করিলেনও তাই। তিনি খাদেম নামে বাংলা সাপ্তাহিক বাহির করিয়া তার সম্পাদনা-পরিচালনের সম্পূর্ণ দায়িত্ব আমার উপর ছাড়িয়া দিলেন।
খাদেম সম্পাদনার সময় একটি ব্যাপারে আমার বিরাট জয়লাভ ঘটে। ব্যাপারটা এই : স্বামী সত্যদেব নামে এলাহাবাদের এক আর্য সমাজী ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁকে অভ্যর্থনা দেওয়া লইয়া মুসলমানদের মধ্যে বিরাট হৈ চৈ শুরু হয়। কলিকাতায় তাঁকে অভ্যর্থনা ও টাকার তােড়া দেওয়ার বিপুল আয়ােজন। সব মুসলমান সংবাদপত্র এ কাজের সমর্থন করেন। শুধু খাদেমএ আমি একা এ কাজের প্রতিবাদ করি। আমার বক্তব্য এই যে কোনাে অমুসলমান ইসলাম কবুল করিলেই তাকে অভ্যর্থনা দেওয়ার যে ঘটা হয়, এটা ইসলাম ও মুসলমান সমাজের জন্যই অপমানকর। এতে প্রমাণিত হয়। যে ঐ ভদ্রলােক ইসলাম ও মুসলমান সমাজের শক্তি ও মর্যাদা বাড়াইয়াছেন। এই লেখার দরুন খাদেম-এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হইল, আমার বিরুদ্ধে মৌলবী সাহেবের কাছে নালিশ করা হইল। মৌলবী সাহেব আমার মতের সমর্থন করিয়াও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাইতে আমাকে উপদেশ দিলেন। আমি চুপ করিলাম। স্বামী সত্যদেব মওলানা মহীউদ্দিনরূপে কলিকাতা আসিলেন তাঁকে রাজকীয় অভ্যর্থনা দেওয়া হইল। যতদূর মনে আছে চার লাখ টাকার একটা তােড়া দেওয়া হইল। দেখাদেখি ঢাকা, চাঁটগা এবং রেঙ্গুনে তাঁকে অনুরূপ অভ্যর্থনা ও টাকার তােড়া দেওয়া হইল। এই ধুমধামে আমার পক্ষে রাস্তাঘাটে বাহির হওয়া বিপদসংকুল হইয়া উঠিল। কাগজে ও সভা-সমিতিতে আমার নামে ছি ছি হইতে থাকিল। মওলানা মহীউদ্দিনকে বাংলা-বর্মা ভ্রমণ শেষ করিয়া ফিরিবার পথেও বিরাট বিদায় অভিনন্দন দেওয়া হইল।
এরপর আমার জয়ের পালা। মওলানা মহীউদ্দিন মুসলমানদের পাঁচ লাখের মত টাকা হস্তগত করিয়া এলাহাবাদে ফিরিয়াই আর্য ধর্মে পুনঃ দীক্ষিত হইলেন এবং স্বামী সত্যদেব হইয়া গেলেন। শুধু তা-ই নয়। তিনি আমার অভিজ্ঞতা এই গােছের নাম দিয়া একটি বই লিখিলেন। তাতে তিনি
৩৪২
বলিলেন, ইসলাম ও মুসলমান সমাজ সম্পর্কে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা লাভের জন্যই তিনি ইসলাম গ্রহণ করিয়াছিলেন। কয়েক মাস মুসলমান থাকিয়া তিনি নিঃসন্দেহে বুঝিতে পারিয়াছেন যে ইসলামের মত অসভ্য ধর্ম ও মুসলমান সমাজের মত বর্বর ও ব্যভিচারী জাতি দুনিয়ায় আর নাই । অভ্যর্থনাওয়ালাদের মুখে চুনকালি পড়িল। আমার সমর্থকদের দন্ত বিকশিত হইল। কিন্তু বিজয়ানন্দের উল্লাসের বদলে নিজের হতভাগ্য নির্বোধ সমাজের জন্য আমার চোখে পানি আসিল।

৬. প্রথম পর্যায়ের সমাপ্তি
ইতিমধ্যে আমি উকালতি পাশ করিয়াছিলাম। যদিও মৌলবী সাহেব আমার বেতন বাড়াইয়া পঁয়ষটি হইতে পঁচাশি করিয়া দিয়াছিলেন, তবু ঐ টাকাও যথেষ্ট নয় মনে করিয়া আমি ময়মনসিংহে উকালতি করিবার ইচ্ছা প্রকাশ করি। মৌলবী সাহেবের ন্যায় পিতৃতুল্য স্নেহময় মুরুব্বি এবং সাংবাদিক জীবন ছাড়িয়া আসিতে আমার খুবই কষ্ট হয়। তবু এটা করিলাম। কারণ ইতিমধ্যে একটি ছেলে হইয়াছে। বাড়ির অবস্থাও অধিকতর খারাপ হইয়াছে। বাপজী আরাে দেনাগ্রস্ত হইয়াছেন। কাজেই বেশি টাকা রােযগারের আশায় সাংবাদিক জীবন ছাড়িলাম।
মৌলবী সাহেব আমার স্বার্থপরতায় নিশ্চয়ই মনে-মনে দুঃখিত হইয়াছিলেন। কারণ এই সময় তিনি দি মুসলমানকে দৈনিক করিবার চিন্তা করিতেছিলেন। এ কাজে তিনি আমার উপর অনেকখানি নির্ভরও করিতেছিলেন। তবু আমাকে বাধা দিলেন না। বরঞ্চ আইনের বই-পুস্তক কিনায় আমাকে সাহায্য করিলেন। আমার মত নগণ্য সাব-এডিটারকে নিজ ব্যয়ে এক ফেয়ারওয়েল পার্টি দিলেন। এই পার্টিতে স্যার আবদুর রহিম, মওলানা আবুল কালাম আজাদ, মৌ. আবদুল করিম, মৌ. আবুল কাসেম, নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী, নবাব মশাররফ হােসেন, মওলানা আকরম খাঁ, ডা. আবদুল্লা সােহরাওয়ার্দী, মৌ, এ কে ফজলুল হক, হাজী আবদুর রশিদ, মি. সৈয়দ নাসিম আলী, খান বাহাদুর আজিজুল হক, অধ্যাপক জে এল ব্যানার্জি, খান বাহাদুর আসাদুজ্জামান প্রভৃতি অনেক গণ্যমান্য লােক উপস্থিত ছিলেন। সকলের সামনে তিনি আমার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করিলেন। উপসংহারে বলিলেন : ‘উকালতিতে আবুল মনসুর নাম করুক, আল্লাহর দরগায় এই দোওয়া করিয়াও তাঁকে এই আশ্বাস দিতেছি যে, দি মুসলমান
৩৪৩
এর দরজা সর্বদাই তার জন্য খােলা রহিল। যখনই সে মনে করিবে উকালতি তার ভাল লাগে না, তখনই দি মুসলমান-এ আসিতে পারিবে। আমার দৃঢ়বিশ্বাস মুসলিম সাংবাদিকতায় আবুল মনসুর যথেষ্ট দান করিতে পারিত।
মৌলবী সাহেবের মতের উপর আমার অপরিসীম শ্রদ্ধা ছিল। কাজেই তাঁর প্রশংসায় আমি গর্বিত হইলাম। কিন্তু নিজের সিদ্ধান্ত বদলাইলাম না। ভাগ্যিস, তিনি আমাকে মত বদলাইবার হুকুম করেন নাই। তিনি যদি একবার বলিয়া ফেলিতেন : ‘তােমার যাওয়া হইবে না’ তবে আমার পক্ষে তাঁর আদেশ অমান্য করা সম্ভব হইত না। তিনি তা জানিতেন বলিয়াই তেমন কথা বলেন নাই। এইভাবে আমার সাংবাদিক জীবনের প্রথম পর্যায় শেষ হইল ১৯২৯ সালের ডিসেম্বরে।
৩৪৪

অধ্যায় আঠার
দ্বিতীয় পর্যায়

১. ‘দৈনিক কৃষক
আমার সাংবাদিক জীবনের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয় ১৯৩৮ সালের ডিসেম্বর মাসে। এই সময় নিখিল-বঙ্গ-কৃষক-প্রজা সমিতির উদ্যোগে কৃষক প্রজা আন্দোলনের মুখপত্ররূপে দৈনিক কৃষক প্রকাশ করা সাব্যস্ত হয়। অধ্যাপক হুমায়ুন কবিরকে ম্যানেজিং ডাইরেক্টর এবং মৌ, শামসুদ্দীন আহমদ, মৌ, সৈয়দ নওশের আলী, নবাবযাদা সৈয়দ হাসান আলী, খান বাহাদুর মােহাম্মদ জান ও ডা. আর আহমদকে ডাইরেক্টর করিয়া একটি লিমিটেড কোম্পানি রেজিস্ট্রারি হয়। আমাকে উহার প্রধান সম্পাদক নিয়ােগ করাও তাঁরাই স্থির করেন। ডালহৌসি স্কোয়ারের নিকটবর্তী ৫ নং ম্যাংগাে লেনে আফিস স্থাপিত হয়। নিজস্ব ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। এত সব ঠিক করিয়া আমাকে হুকুম দেওয়া হয় সম্পাদক হও, চালাও কাগজ। সমিতির প্রস্তাব। বন্ধুদের অনুরােধ নয়, আদেশ। অমান্য করিতে পারিলাম না। পারিলাম না মানে কী? করিলাম না। নিজের মনেও বােধ হয় কুকুতানি ছিল। মাসিক দুইশ টাকা বেতন ও পঞ্চাশ টাকা সম্পাদক-এর টেবিল এলাউন্স পাওয়ার শর্তে আমি কৃষক-এর সম্পাদকতার দায়িত্ব গ্রহণ করিলাম। খাটিলাম খুব। অল্পদিনেই কাগজ সাংবাদিক মহলে সম্মান ও জনসাধারণের মধ্যে পপুলারিটি অর্জন করিল। আদর্শ নিষ্ঠায় স্বাধীন মতবাদে এবং নিরপেক্ষ সমালােচনায় কৃষক বেশ নাম করিল।
কিছুদিন যাওয়ার পর আমি জানিতে পারিলাম তৎকালীন কংগ্রেস সভাপতি শ্রীযুক্ত সুভাষচন্দ্র বসু কৃষক-এর একজন পৃষ্ঠপােষক। আমি এতে
৩৪৫
বরঞ্চ খুশিই হইলাম। কংগ্রেসের অনেক মত ও কর্মপন্থার সাথে আমার মিল।
থাকিলেও সুভাষবাবুকে আমি ব্যক্তিগতভাবে শ্রদ্ধা করিতাম। কৃষকশ্রমিকদের প্রতি তার দরদ, কৃষক-প্রজা আন্দোলনের প্রতি তার সমর্থন ও সাম্প্রদায়িক প্রশ্নে তার উদারতা সবই আমার জানা ছিল। কাজেই সুভাষবাবুর মত একজন মুরুব্বি পাওয়ায় কৃষক-এর আর্থিক ও বাণিজ্যিক দিকে অনেকখানি সাহায্য হইবে, ইহা আমি মনে করিলাম। কৃষক-প্রজা সমিতির আদর্শের সাথে সংগতি রাখিয়া কংগ্রেসি রাজনীতিতে ও সুভাষবাবুকে পূর্ণ সমর্থন দিলাম। মহাত্মা গান্ধীর সহিত সুভাষবাবুর বিরােধ ও ত্রিপুরীকংগ্রেসের হট্টগােল আমরা প্রকাশ্যভাবে সুভাষবাবুর পক্ষ অবলম্বন করিলাম। কলিকাতার হিন্দুদের মধ্যে কৃষক বেশ পপুলার হইল ।

২. কৃষক’-এর অর্থাভাব
গেল এমনি করিয়া বছর খানেক। হঠাৎ হুমায়ুন কবির সাহেব জানাইলেন। আর চলে না। অর্থাভাব। আলােচনা করিয়া বুঝিলাম, দৈনিক চালাইবার মত যথেষ্ট মূলধন না লইয়াই এঁরা কাগজ প্রকাশে হাত দিয়াছিলেন। দৈনিক কাগজ চালান যে আগের মত মিশনারি ওয়ার্ক নয়, ইতিমধ্যে সংবাদপত্র যে একটা ইন্ডাস্ট্রি হইয়া উঠিয়াছে, এতে যে অন্যান্য শিল্পের মতই মােটা টাকা মূলধন লাগে পরিচালকরা এ খবর রাখিতেন না। দোষ তাঁদের নয়। কারণ তাঁরা কেউ সাংবাদিক নন, যদিও হুমায়ুন কবির সাহেব সাংবাদিকতার সাথে কিছু কিছু পরিচিত ছিলেন। কাজেই তাদের দোষ দেওয়া যায় না। পক্ষান্তরে আমারও দোষ নাই। কারণ আমার সাথে আর্থিক ব্যাপারে বা পরিচালনা সম্বন্ধে কোনও পরামর্শ করা হয় নাই। সম্পাদকের সাথে এ ব্যাপারে পরামর্শ করিবার কথাও নয়। আর করিলেই যে আমি খুব নির্ভরযােগ্য উপদেশ বা অর্থ সংগ্রহে সাহায্য করিতে পারিতাম, তা-ও নয়। ডাইরেক্টর বাের্ডের মেম্বরদের তুলনায় আমার কি দাম আছে? তারা সব কলিকাতার বাসেন্দা, আমি মফস্বলের লােক। তারা সব আইনসভার মেম্বর, ভূতপূর্ব বা হবু মন্ত্রী। টাকাওয়ালা লােকদের সাথে পরিচয়ও আমার তেমন ছিল না। অতএব টাকা-পয়সার ব্যাপারে তারা আমাকে কিছু না জানাইয়া অন্যায় কিছু করেন নাই।
কিন্তু কৃষক বাঁচাইয়া রাখার ইচ্ছা ও উৎকণ্ঠা পরিচালক বাের্ড ও আমার নিজের সমান। কৃষক প্রজা পার্টি হইতে নিজস্ব দৈনিক বাহির করার চেষ্টা এই
৩৪৬
প্রথম। এটা ব্যর্থ হইলে কৃষক-প্রজা-নেতৃত্ব এবং আন্দোলন একটা মার খাইবে। জনপ্রিয় কৃষক-প্রজা-নেতা প্রধানমন্ত্রী হক সাহেবের সহিত আদর্শগত বিরােধ হওয়ায় এবং তার ফলে হক মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে অনাস্থাপ্রস্তাব দিয়া পরাজিত হওয়ায় ইতিপূর্বে কৃষক-প্রজা-নেতৃত্ব একটা মার খাইয়াছে। তার পরপরই এটা হইলে আরাে বিপদ। কৃষক-প্রজা নেতাদের দুশ্চিন্তা এইখানে। এই চিন্তায় আমিও শরিক।

৩. ব্যক্তিগত বিপদ
আর একটা দুশ্চিন্তা আমার ব্যক্তিগত। আমি দশ বছরের জমানাে উকালতি ব্যবসাটা ছাড়িয়া সপরিবারে কলিকাতার বাসেন্দা হইয়াছি। আসিবার সময় শুধু হাতের মামলা-মােকদ্দমাগুলি নয় বই-পুস্তক, সাজ-সরঞ্জাম, টেবিলচেয়ার, মায় গাউনটা পর্যন্ত বন্ধুবান্ধবের মধ্যে বিতরণ করিয়া আসিয়াছি। অর্থাৎ যাকে বলে ‘পিছনে নৌকা তলাইয়া দিয়া সামনে অগ্রসর হওয়া’, আমি তাই করিয়াছি। সুতরাং ফিরিবার উপায় নাই। নিজের অস্তিত্বের জন্যও কৃষককে বাঁচাইয়া রাখিতে হইবে। পরিচালকদের সকলেই আমার হিতৈষী বন্ধু। তারাও আমার ব্যক্তিগত মঙ্গল-অমঙ্গল ও সুবিধা-অসুবিধায় সম্পূর্ণ সচেতন।
এইসব কারণে কৃষক-এর অর্থাভাব দূরীকরণের জন্য আমিও পরিচালকদের সাথে সক্রিয় সহযােগিতা করিতে লাগিলাম। এতদিন আমি কাগজের সম্পাদনা কার্যের উন্নতির চিন্তায় সময় ব্যয় করিতাম। এখন হইতে উহার আর্থিক দিকটাতেও জড়াইয়া পড়িলাম। কাজটা কঠিন। সম্পাদকরা। লেখক-ভাবুক। শিল্পী। টাকা-পয়সার ঝামেলার মত বৈষয়িক ও ব্যবসায়িক ব্যাপার তাঁদের চোখে নিতান্ত অশিল্পী দোকানদারি ব্যাপার। কাজেই নিম্নশ্রেণির বিষয়। এতদিন ছিল আমার এই ধারণা। এখন বুঝিলাম অশিল্পী অসুন্দর হইলেও এই ব্যবসায়ী দিকটাই আসল। এতদিনে বুঝিলাম, মৌলবী মুজিবর রহমান সাহেবকে একাধারে সম্পাদকতা ও অর্থ সংগ্রহ করিতে কী ঝামেলা পােহাইতে হইত।
বিপদই মানুষের বড় শিক্ষক। কৃষক-এর সম্পাদকতা করিতে গিয়া আমি সংবাদপত্র, সাংবাদিকতা, সংবাদ-শিল্পী ও সংবাদ-বাণিজ্য সকল দিকে নজর দিতে বাধ্য হইয়াছিলাম। শুধু প্রধান সম্পাদকের আসনে বসিয়া থাকিলে আমার চলিত না। ম্যানেজিং ডাইরেক্টরের সঙ্গে যেমন চাদা আদায়ে, বিজ্ঞাপন
৩৪৭
ক্যানভাসিং-এ ঘুরিয়া বেড়াইতে হইত, তেমনি ছাপাখানার আধ-অন্ধকার চিশিলা গরমের মধ্যে কম্পােযিটার, মেশিনম্যানের কাঁধের কাছে দাঁড়াইয়া কাজে তাকিদ দিতে হইত। এটা করিতে গিয়া একদিকে যেমন পরিচালকদের আর্থিক অভাবের কথা জানিলাম। অপর দিকে বেচারা কম্পােযিটারদের শারীরিক অসুবিধার কথাও জানিলাম। কম্পােযিটাররা অন্ধকার সংকীর্ণ ও আলাে-বাতাসহীন কুঠরিতে বসিয়া দিনরাত শিসা হাতাইয়া কীভাবে শরীর, স্বাস্থ্য ও চোখ নষ্ট করিতেছে, তা দেখিয়া শিহরিয়া উঠিলাম। আমাদের অভাব মিটিলে এদের জন্যও কিছু একটা করিব অন্তত দু-চারটা ফ্যানের ব্যবস্থা করিব মনে-মনে প্রতিজ্ঞা করিলাম।

৪. অর্থাভাবের সংগত কারণ
কিন্তু টাকা কোথায়? কে দিবে টাকা কৃষককে? খবরের কাগজের টাকা মানে বিজ্ঞাপনের আয়। কাগজ বিক্রির টাকায় কাগজ-কালির দামটা উঠে মাত্র। বিজ্ঞাপনের টাকা দিয়াই স্টাফ চালাইতে হয়। লাভও থাকে। কিন্তু কৃষক বিজ্ঞাপন পাইবে কেন? বিজ্ঞাপনদাতারা বড়-বড় ধনিক-বণিক শিল্প মালিক। কৃষক কৃষক-শ্রমিক আন্দোলনের সমর্থক। জমিদারি শিল্প-বাণিজ্য সমস্ত কায়েমি স্বার্থ জাতীয়করণ করিতে চায়। এই কৃষককে বিজ্ঞাপন দিয়া তারা শত্রু পুষিবে? হিন্দুরা বিজ্ঞাপন দেয় না কৃষক মুসলমান বলিয়া, মুসলমানরা দেয় না কৃষক ‘হিন্দু-কংগ্রেস’, ঘেঁষা বলিয়া। বিপদের উপর বিপদ। কৃষক-প্রজা দলের একমাত্র মন্ত্রী মৌ. শামসুদ্দীন আহমদ সমিতির নির্দেশে মন্ত্রিসভা হইতে পদত্যাগ করিয়াছেন। মন্ত্রিত্বের প্রভাব খাটাইয়া কিছু বিজ্ঞাপন ও অর্থ সাহায্য পাইব, সে আশায় ছাই পড়িয়াছে। সুভাষবাবুর সাহায্যে হিন্দু ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের কিছু কিছু বিজ্ঞাপন পাইব, সে গুড়ে বালি পড়ে। সুভাষবাবু মহাত্মাজীর সাথে ঝগড়া করিয়া কংগ্রেসের সভাপতিত্ব ত্যাগ করিয়াছেন। ধনিক-বণিকরা আসলে সৎকাজে চাঁদা দেয় না, তারা ভবিষ্যৎ মুনাফার আশায় টাকা খাটায়, ইনভেস্ট করে । অদূরে কংগ্রেস রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করিবে, এটা সকলের কাছেই সুস্পষ্ট। সেজন্য সরকারের বিরােধিতা সত্ত্বেও ধনিকরা তলে-তলে কংগ্রেসকে সাহায্য করিত। সুভাষবাবু প্রেসিডেন্ট থাকিলে তার ‘ছিটাফোটা কৃষকও। পাইত। সে আশাও গেল। শেষ পর্যন্ত সুভাষবাবু দেশ ত্যাগ করিলে এদিককার কোনও আশাই আর থাকিল না।
৩৪৮
৫. খান বাহাদুর মােহাম্মদ জান
এ অবস্থায় অধ্যাপক হুমায়ুন কবির দিন-রাত কঠোর পরিশ্রম করিয়াও কিছু করিতে পারিলেন না। পরিচালক বাের্ডের মধ্যে একমাত্র ধনী ব্যবসায়ী খান বাহাদুর মােহাম্মদ জানের উপর ম্যানেজিং ডাইরেক্টরির ভার চাপান হয়। খান বাহাদুর সাহেব ভাল মানুষ। টাকাও তাঁর আছে। কিন্তু তিনি অবাঙ্গালী। বাংলা জানেন না। কৃষক পড়িতে পারেন না। তিনি কৃষক-শ্রমিক আন্দোলন পছন্দ করেন না। তিনি সাম্প্রদায়িক রাজনীতি সমর্থন করেন না বলিয়া আইনসভায় কৃষক প্রজা পার্টি ও কংগ্রেস পার্টিকে সমর্থন করে। এমন লােকের পক্ষে কৃষকের পরিচালনার এবং মাসে-মাসে দুই-তিন হাজার টাকা লস দেওয়ার উৎসাহ বেশি দিন স্থায়ী হইতে পারে না। কাজেই মাস চার-পাঁচেক পরে তিনি দায়িত্ব বহনে অস্বীকৃতি জানাইলেন।

৬. মি. এইচ দত্ত
এর পরে ম্যানেজিং ডাইরেক্টর হইলেন কলিকাতা কমার্শিয়াল ব্যাংকের ম্যানেজিং ডাইরেক্টর ও অন্যান্য অনেক কোম্পানি পরিচালক মি. হেমেন্দ্র নাথ দত্ত। মি. দত্তের বাড়ি ময়মনসিংহ। ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়াই ব্যস্ত থাকেন বটে তবে অসাম্প্রদায়িক সুস্থ রাজনীতির তিনি উৎসাহী সমর্থক। তিনি ধর্ম বিশ্বাসে ব্রাহ্ম বলিয়া সাধারণ হিন্দুর মত সংকীর্ণ নন। মুসলমানদের প্রতি তিনি খুবই উদার। এইসব কারণেই কংগ্রেসের চেয়ে কৃষক প্রজা পার্টির তিনি বেশি সমর্থক ছিলেন। এ ছাড়া অধ্যাপক হুমায়ুন কবিরের সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠতাও ছিল। সুভাষবাবু দেশত্যাগের আগেই মি. দত্তকে কৃষক-এর একজন শেয়ার হােল্ডার করিয়া দিয়াছিলেন। কাজেই তাকে কৃষক-এর ম্যানেজিং ডাইরেক্টর করিতে কোনােই অসুবিধা হইল না। অন্যতম সুপরিচিত কৃষক নেতা ময়মনসিংহবাসী জনাব আবদুর রশিদ খাঁ এ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজিং ডাইরেক্টর রূপে সমস্ত কাজ পরিচালনা করায় এবং দত্ত সাহেব খুব কমই আফিসে আসায় এই পরিবর্তনের কথা বড় কেউ জানিতেও পারিল না। মােটামুটি স্বচ্ছন্দেই কৃষক চলিতে লাগিল। অপেক্ষাকৃত উন্নত ধরনের আফিস করার উদ্দেশ্যে মি. দত্ত কৃষক আফিস ম্যাংগাে লেন হইতে ক্রীক রােডে স্থানান্তরিত করিলেন। পরিচালনা স্থান সংকুলান ও পরিবেশ সকল দিক দিয়াই ইহাতে কৃষক-এর উন্নতি হইল। আমি কম্পােযিটারদের জন্য ফ্যানের ব্যবস্থা
৩৪৯
করিলাম। বড়-বড় লাভের কাগজ সচরাচর ঐ সময় তা করে নাই। আমার কাজকে তারা বিদ্রুপ করিয়াছে।

৭. নীতিগত বিরােধ
কিন্তু এ সুখ আমাদের বেশিদিন স্থায়ী হইল না। ঐ সময় হক মন্ত্রিসভার প্রস্তাবিত মাধ্যমিক শিক্ষা বিল লইয়া খুবই বাদ-বিতণ্ডা চলিতেছিল। এই বিলের বিধান অনুসারে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার কর্তৃত্ব কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতছাড়া হইয়া যাইবে বলিয়া হিন্দু শিক্ষিত সমাজের প্রায় সকলেই ইহার বিরুদ্ধতা করিতেছিলেন। হিন্দু সংবাদপত্রেরাও সমস্বরে ইহার প্রতিবাদ করিতেছিলেন। কংগ্রেস পার্টি ও আইন সভার ভিতরেবাহিরে এই বিলের বিরুদ্ধে জনমত গড়িতেছিল। এমন সময় কৃষক-এর সম্পাদকীয়তে এই বিলের সমর্থন করা হইল। মি. দত্ত এই সর্বপ্রথম সম্পাদকের দায়িত্বে হস্তক্ষেপ করিলেন। আফিসে আসিয়া আমার রুমে বসিয়া আমার লেখার প্রতিবাদ করিলেন। তিনি বলিলেন যে সম্পাদকীয় ব্যাপারে নাক ঢুকাইবার তার মােটেই ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু এই ব্যাপারে না। করিয়া পারিলেন না। কারণ আমি একটা সাম্প্রদায়িক বিল সমর্থন করিয়া কৃষক-এর মূলনীতি লঙ্ঘন করিতেছি। আমি যুক্তিতর্ক ও তথ্যাদি দিয়া বুঝাইবার চেষ্টা করিলাম যে প্রস্তাবিত বিলটা সাম্প্রদায়িক নয়, হিন্দুদের বিরুদ্ধতাটাই সাম্প্রদায়িক। তিনি আমার যুক্তি মানিলেন না। আমিও তারটা মানিলাম না। ঐ ব্যাপারে পরপর আরাে কয়টা সম্পাদকীয় লিখিলাম। তিনি বাের্ডের মিটিং ডাকিয়া আমার বিরুদ্ধে নালিশ করিলেন। বাের্ডের মেম্বাররা স্বভাবতই আমারই সমর্থন করিলেন। মি. দত্ত পদত্যাগের হুমকি দিলেন। কৃষক-এর জীবনে আবার ক্রাইসিস।
অবস্থা শেষ পর্যন্ত এই দাঁড়াইল যে আমি এডিটর থাকিলে মি. দত্ত ম্যানেজিং ডাইরেক্টর থাকিবেন না। তিনি ম্যানেজিং ডাইরেক্টর না থাকিলে। কৃষক চলিবে না। কাজেই কৃষক বাঁচাইয়া রাখিতে হইলে আমারই পদত্যাগ করিতে হয়। কিন্তু পরিচালক বাের্ডের মেম্বাররা তা মনে করিলেন না। তারা দেখিলেন আমার অবর্তমানে কৃষক চলিবে না। তার মানে এই নয় যে আমার। মত যােগ্য সম্পাদক আর নাই; আমাকে ছাড়া কাগজ চলিবে না। তারা দেখিলেন যে ইস্যুতে বিরােধ তাতে মি. দত্তকে মানিয়া নিলে কৃষক বাচিয়া। থাকিলেও মুসলমানের কাগজ থাকিবে না। কিন্তু আমি অন্য দিক দেখিলাম ।
৩৫০
কৃষক বন্ধ হইলে শতাধিক মুসলিম যুবক বেকার হইবে। কৃষক-এর সম্পাদকীয় বিভাগের কম-বেশি পঁয়ত্রিশ জনের সকলেই মুসলমান। ম্যানেজিং বিভাগের চৌদ্দ-পনের জনের দুইজন বাদে সবই মুসলমান। কম্পােযিং বিভাগের পঞ্চাশজনের মধ্যে সকলেই মুসলমান। ইহাদের সকলকেই আমি নিযুক্ত করিয়াছি। কৃষক বন্ধ হইলে একযােগে এতগুলি লােকের চাকরি যাইবে । এঁরা সকলে আমারই দিকে তাকাইয়া আছেন। তাঁরা আমাকে আন্তরিক ভালও বাসিয়া থাকেন। কারণ সারা কলিকাতার সংবাদপত্র জগতে আমিই সর্বপ্রথম কম্পােয সেকশনে ‘ফ্যান’ দিবার ব্যবস্থা। করিয়াছিলাম। ম্যানেজিং ডিরেক্টরকে বলিয়াছিলাম, যত দিন কম্পােযিটরদেরে ফ্যান দেওয়া না হইবে, ততদিন সম্পাদকের রুমে ফ্যানের দরকার নাই। আমার এই কাজে কলিকাতার কম্পােযিটার শ্রেণীর মধ্যে আমার খুব নাম ছিল। কাজেই একযােগে এতগুলি লােকের বেকারির সম্ভাবনায় আমি কাতর হইলাম। আমার নিজের চাকরির জন্য এতগুলি লােককে বেকার করা আমার বিবেকে কিছুতেই বরদাশত হইল না।

৮. কৃষক’ ত্যাগ
পক্ষান্তরে আমি যদি সম্পাদকতা ছাড়িয়া দেই তবে দত্ত সাহেব কৃষক চালাইবেন। স্টাফের কাউকে তিনি ছাড়াইবেন না। কারণ কাগজের পলিসির। সাথে তাদের কোনও সম্পর্ক নাই। দত্ত সাহেব স্পষ্টভাবেই প্রতিশ্রুতি দিলেন। কাজেই আমি পদত্যাগ করিতেই রাজি হইলাম। দত্ত সাহেব ডিরেক্টর বাের্ডের জরুরি সভা ডাকিলেন। সেখানে আমার বক্তব্য পেশ করিয়া পদত্যাগ করিলাম। আমাকে ধন্যবাদ দিয়া পদত্যাগপত্র গৃহীত হইল।
অতঃপর কৃষক চলিতে থাকিল। কিন্তু দুই-এক দিনের মধ্যেই সব ডাইরেক্টর পদত্যাগ করিলেন। কৃষক কার্যত দত্ত সাহেবের ব্যক্তিগত সম্পত্তি হইয়া গেল। কৃষক-প্রজা সমিতির দুয়েকজন প্রভাবশালী সদস্য এবং আমার কোনও কোনও সাংবাদিক বন্ধু আমাকে বলিলেন : আমি ভুল করিয়াছি। দত্ত। সাহেবের হাতে কৃষক তুলিয়া না দিয়া উহা বন্ধ করিয়াই বাহির হওয়া উচিৎ ছিল। কারণ মুসলমানদের প্রতিষ্ঠিত সংবাদপত্র এইভাবে পুঁজিবাদী হিন্দুর হাতে তুলিয়া দিয়া আমি মুসলমান সমাজের শত্রুতাই সাধন করিয়াছি। মুসলমানের শ্রম ও ঘর্মে অস্ত্র তৈয়ার করিয়া তাতে শাণ দিয়া আমি মুসলমানের গলা কাটিবার জন্য হিন্দুর হাতে তুলিয়া দিয়া আসিয়াছি।
৩৫১
ব্যাপারটা অত সাংঘাতিক এ বিষয়ে আমি ঐ সব বন্ধুর সাথে একমত হইতে পারি নাই।

৯. সাংবাদিকতায় নূতন জ্ঞান
কারণ প্রায় তিন বছর কাল কৃষক-এর সম্পাদকতা করিয়া আমি দুইটা নূতন জ্ঞান লাভ করিয়াছিলাম। (১) সংবাদপত্র পরিচালন একটা ইন্ডাস্ট্রি; এতে প্রচুর মূলধন লাগে; কাজেই ধনী ছাড়া কেউ নূতন কাগজ বাহির করিয়া সফল হইবে না। মুদির দোকান চালাইতে চালাইতে বড় সওদাগর ও শিল্পপতি হওয়ার দিন যেমন আর নাই, সাপ্তাহিক চালাইতে চালাইতে দৈনিক করার দিনও তেমনি আর নাই। (২) ধনতন্ত্রী সমাজের অন্যান্য ইন্ডাস্ট্রিতে যেমন সংবাদপত্র-শিল্পও তেমনি, যার টাকা তিনিই মালিক। কাজেই শিল্পের ইঞ্জিনিয়ার যেমন শিল্পের নিয়ন্তা নন, সম্পাদকও, তেমনি খবরের কাগজের নিয়ন্তা নন। খবরের কাগজে মালিক-এর মত চলিবে, না সম্পাদকের মত চলিবে, এই তর্ক আমার কৃষক-সম্পাদকতার আমলেই উঠিয়াছিল। আমাদের সকল সাংবাদিকের ‘দাদা শ্রীযুক্ত মৃণালকান্তি বােস ও আমার প্রায়ঘনিষ্ঠ বন্ধু ডা. ধীরেন্দ্রনাথ সেনের সঙ্গে অমৃতবাজার পত্রিকার কর্তৃপক্ষের বিরােধ বাধে সম্পাদকীয় পলিসি লইয়া। মৃণালবাবু শ্রমিক আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন। ধীরেনবাবু বামপন্থী কংগ্রেসী ছিলেন। কাজেই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বড়-বড় ইস্যু সম্বন্ধে অমৃতবাজার-এর মালিকদের সাথে এঁরা একমত ছিলেন না। কাগজে তারা নিজেদের মতামত চালাইতেন। অমৃতবাজার কর্তৃপক্ষ এঁদের দুইজনকেই কর্মচ্যুত করেন। ব্যক্তিগতভাবে এঁরা দুইজনই সাংবাদিকদের কাছে খুব শ্রদ্ধেয় ও জনপ্রিয় ছিলেন। কাজেই বিভিন্ন কাগজে অমৃতবাজারকর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় উঠিল । জার্নালিস্ট এসােসিয়েশনে এর কথা উঠিল। ঐ এসােসিয়েশনের অনেক মালিক মেম্বর ছিলেন বলিয়া ওয়ার্কিং জার্নালিস্টরা নিজেদের প্রতিষ্ঠান খাড়া করিলেন এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ আন্দোলন করিতে। কাজেই শিক্ষিত সমাজে, বিশেষত সাংবাদিকদের সামনে একটি মাত্র ইস্যু দেখা দিল : খবরের কাগজে কার মত চলিবে : মালিকের? না সম্পাদকের? সব সাংবাদিক ও অধিকাংশ খবরের কাগজে একই মত দেওয়া হইতে লাগিল : সম্পাদকের মত চলিবে। একমাত্র আমি কৃষক-এর সম্পাদকীয় লিখিলাম : মালিকের মত চলিবে।
৩৫২
১০. সম্পাদক বনাম মালিক
কলিকাতার সাংবাদিক মহল স্তম্ভিত হইল। মালিকরাও বােধ হয় অতটা আশা করেন নাই। মালিকের পক্ষের কথা বলে একজন ওয়ার্কিং জার্নালিস্ট তাও আবার বামপন্থী কাগজে? অনেক বন্ধু আমার নিন্দা করিলেন। ওয়ার্কিং জার্নালিস্ট এসােসিয়েশন আমার কথায় প্রতিবাদ করিলেন। আমি কিন্তু অটল । নিজের কথার সমর্থনে পরপর আরাে কয়েকটা সম্পাদকীয় লিখিলাম। আমি বলিয়াছিলাম সাংবাদিকতা উকালতির মতই একটা প্রফেশন। এটা মিশনারির মত আদর্শ সেবা নয়। উকিল যেমন দোষী-নির্দোষ-নির্বিশেষে সকলের কেস নেন, সাংবাদিকও তেমনি কংগ্রেস, মুসলিগ লীগ, হিন্দু সভা নির্বিশেষে সকলের কেস নিবেন। অর্থাৎ যিনি তাঁর ফিস দিবেন তাঁরই পক্ষে সাংবাদিক কলম ধরিবেন। এটা তার ব্যবসায়িক কাজ। এটাকে তাঁর ব্যক্তিগত মতামত বলিয়া কোনও বুদ্ধিমানই ধরিয়া লইবে না। সাংবাদিক এইভাবে পরের জন্য টাকার বিনিময়ে কলম চালাইতে গিয়া এতটুকু মাত্র দেখিবেন যে ঐ সাংবাদিক কর্তব্যের বাহিরে তাঁর স্বাধীনতা যাতে ব্যাহত বা সংকুচিত না হয়। আপনি যদি কংগ্রেসী হন, তবে কংগ্রেস-বিরােধী কাগজে আপনি চাকুরি নিবেন না। যদি নেন, তবে কংগ্রেস-বিরােধী কথাই আপনাকে লিখিতে হইবে। আপনি কংগ্রেস-বিরােধীর টাকায় খানা খাইয়া তারই কাগজে কংগ্রেসী প্রচার করিবেন, এটা আইন বা নীতির কোনও দিক দিয়াই সমর্থনযােগ্য নয়। যদিও কংগ্রেস-বিরােধী কথা বলিলে কাগজ না চলে, তবে সেটা দেখা যার টাকা তাঁরই কর্তব্য, সাংবাদিকের নয়। সাংবাদিক সে ক্ষেত্রে মালিককে সদুপদেশ দিতে পারেন মাত্র। মালিক যদি সে উপদেশ না রাখেন। তবে সাংবাদিককে কাগজের মালিকের কথাই লিখিতে হইবে। আমি কৃষক ছাড়িবার সময় মুসলিম স্টাফকে এই উপদেশ দিয়াই আসিয়াছিলাম।
৩৫৩

অধ্যায় উনিশ
তৃতীয় পর্যায়

১. ‘নবযুগ’ ১৯৪১ সালের অক্টোবর মাসে হক সাহেব নবযুগ বাহির করেন। আমি ইহার সম্পাদনার ভার গ্রহণ করি। কিন্তু উহাতে সম্পাদকরূপে আমার নাম দিতে রাজি হই নাই। ইহার একাধিক কারণ ছিল। প্রথমত, যদিও আমি সাংবাদিকতাকে প্রফেশন হিসাবে গ্রহণ করিয়া ব্যক্তিগত মতামত নিরপেক্ষভাবে যে কোনও মতের কাগজে চাকুরি নিতে সাংবাদিক বন্ধুদের উপদেশ দিতাম। কিন্তু আমি নিজে তা করিতে রাজি ছিলাম না। কারণ আমার নিজের একটা রাজনীতিক জীবন ছিল। সেটা নষ্ট করিতে আমি প্রস্তুত ছিলাম না। দ্বিতীয়ত, যে উদ্দেশ্য প্রচারের জন্য হক সাহেব নবযুগ বাহির করিলেন, সে উদ্দেশ্যের সহিত আমার পূর্ণ সহানুভূতি থাকিলেও হক সাহেবের মতের স্থিরতায় আমার আস্থা ছিল না। মুসলিম লীগ নেতৃত্বের সাথে বিশেষত জিন্নাহ সাহেবের সহিত হক সাহেবের বিরােধের মূল কথা আমি জানিতাম। মুসলিম বাংলার স্বার্থ জিন্নাহ নেতৃত্বের হাতে নিরাপদ নয় বলিয়াই হক সাহেব জিন্নাহ সাহেবের সাথে কলহ করিতেছেন, হক সাহেবের এ কথা আমি বিশ্বাস। করিতাম। নবযুগ বাহির হইবার মাসাধিক কাল আগে হইতেই হক সাহেব তাঁর উদ্দেশ্যের কথা আমাকে বলেন এবং আমার সহযােগিতা দাবি করেন। আমার কলমের উপর হক সাহেবের আস্থা ছিল। তিনি মুসলিম লীগে থাকিয়া। মুসলিম লীগ প্রধানমন্ত্রী হিসাবেই নবযুগ বাহির করিতেছেন। অথচ শেষ পর্যন্ত মুসলিম লীগ হইতে তিনি বাহির হইয়া আসিবেন। এসব ব্যাপারে তাঁর ধারণা ছিল সুস্পষ্ট। এ অবস্থায় নবযুগ-এর সম্পাদকীয় নীতি পরিচালনার
৩৫৪
দায়িত্ব তিনি আমাকে ছাড়া অন্য কাউকে দিয়া বিশ্বাস পাইতেছেন না, হক সাহেবের এসব কথাও আমি বিশ্বাস করিয়াছিলাম। দাম্ভিকতা ও অহংকার না করিয়াও আমি বলিতে পারি, আমার মত উকিল-সম্পাদক ছাড়া আর কারাে পক্ষে এই সংকটজনক পরিস্থিতিতে হক সাহেবের পছন্দ-মত কাগজ চালানাে সম্ভব ছিল না। এ অবস্থায় আমি সর্ব শক্তি দিয়া হক সাহেবের সমর্থন করিতে প্রস্তুত ছিলাম। এর উপর আমার বিশেষ অন্তরঙ্গ শ্রদ্ধেয় বন্ধু সৈয়দ বদরুদ্দোজা আমাকে বুঝাইলেন যে মুসলিম বাংলার স্বার্থে হক নেতৃত্বের পিছনে দাঁড়াইতে তাঁর মত বহু মুসলিম লীগার প্রস্তুত। আসল কারণ তারাও বিশ্বাস করেন যে হক সাহেব জিন্নাহ সাহেবের নিকট পরাজিত হইলে অথবা হক সাহেবের রাজনৈতিক অপমৃত্যু ঘটিলে মুসলিম বাংলার ভবিষ্যৎ নাই । সুতরাং হক সাহেবের নবযুগ-এ যােগ দেওয়া সম্বন্ধে আমার মনে কোনও দ্বিধা থাকিল না। এলাউন্সসহ মাসে তিনশ টাকা বেতনের অফার দিয়া আর্থিক দিক দিয়া আমার আপত্তিও খণ্ডন করা হইয়াছিল। এসব সত্ত্বেও আমি সন্দেহ করিতাম এবং আমার অনেক বন্ধুও আমার সাথে একমত হইতেন যে, হক সাহেব যে কবে আবার লীগের সাথে রফা করিয়া ঘুরিয়া দাঁড়াইবেন, তার কোনও নিশ্চয়তা নাই। তৃতীয়ত, আমি জানিতাম নবযুগ বেশি দিন টিকিবে না। কারণ আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এই যে, রাজনৈতিক নেতাদের স্থাপিত কাগজ স্থায়ী হয় না। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, মি. জে এম সেন গুপ্ত, শ্রীযুক্ত শ্যামসুন্দর চক্রবর্তী, পণ্ডিত জওয়াহরলাল নেহরু প্রভৃতি বড়-বড় নেতা নিজস্ব দৈনিক কাগজ বাহির করিয়াছেন। বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা ও ধুমধামের মধ্যে কাগজ চলিয়াছে কিছুদিন। তারপর সব ঠাণ্ডা । হক সাহেবের কাগজও এর ব্যতিক্রম হইবে না। সুতরাং ব্যাপারটা যখন শেষ পর্যন্ত একটা অনিশ্চিত এক্সপেরিমেন্ট তখন সম্পাদকরূপে নিজের নামটা দিয়া বদনাম কিনি কেন? বদনামের কথা আমি এই জন্য বলিলাম যে হক সাহেবের বিরুদ্ধে গত তিনচার বছর যত-কিছু লিখিয়াছি ও সভা-সমিতিতে যে সব কথা বলিয়াছি, নবযু”এ সে সবেরই উল্টা উতার গাইতে হইবে। তাছাড়া উকালতি সাসপেন্ড করারও রিস্ক ছিল।

২. বেনামী সম্পাদক
কাজেই হক সাহেবকে পাল্টা প্রস্তাব দিয়াছিলাম। সম্পাদকরূপে তাঁর নিজের নাম দিতে হইবে । যুক্তি দিলাম, প্রথম পর্যায়ে বিশ বছর আগের নবযুগ-এর
৩৫৫
সম্পাদকরূপে তাঁরই নাম ছিল। তাঁর পছন্দ হইল। তিনি নিমরাজি হইলেন। কিন্তু সপ্তাহখানেক পরে তিনি জানাইলেন যে সরকারি আইন ও স্বরাষ্ট্র বিভাগ আপত্তি করিয়াছে। লাট সাহেবও বারণ করিয়াছেন। অতঃপর বন্ধুবর সৈয়দ আজিজুল হক (নান্না মিঞা), জনাব ওয়াহিদুযযামান (ঠাণ্ডা মিঞা) ও স্নেহাস্পদ মাহমুদ নূরুল হুদা প্রভৃতির সঙ্গে পরামর্শ করিয়া হক সাহেবের সম্মতিক্রমে কাজী নজরুল ইসলামের নাম ঠিক করিলাম। কাজী সাহেব এ সময় দায়-দেনায় খুবই বিপন্ন ছিলেন। পাওনাদাররা ডিক্রিজারী করিয়া তাঁকে অপমান করিবার চেষ্টা করিতেছে। পক্ষান্তরে তাঁর পাবলিশাররা ও গ্রামােফোন কোম্পানিরা তাকে ঠকাইতেছে। এ সময়ে কাজী সাহেবকে আর্থিক সাহায্য করাও হইবে। আমার সাড়ে তিনশ টাকা বেতন অফার। করিলাম। কিছু করিতে হইবে না, মাঝে-মাঝে বিকাল বেলা আফিসে আডডা এবং সপ্তাহে এক-আধটা কবিতা দিলেই যথেষ্ট। কাজী সাহেব রাজি হইলেন। ধুমধামের সাথে নবযুগবাহির হইল। চলিলও ভাল। কাজী সাহেব সত্য-সত্যই সন্ধ্যার দিকে আফিসে আড্ডা দিতে লাগিলেন। মুসলিম ছাত্রতরুণরা হক সাহেবের নয়া নীতিতে কতকটা, নজরুল ইসলামের আকর্ষণে কতকটা, নবযুগ আফিসে ভিড় করিতে লাগিল। আচ্ছা খুব জমিয়া উঠিল। নজরুল ইসলামও উৎসাহিত হইয়া উঠিলেন। তিনি জোরদার কবিতাই শুধু নয়, দুই-একটা সম্পাদকীয়ও লিখিয়া ফেলিলেন। এমনই একটার মধ্যে জিন্নাহ সাহেবকে কাফের’ ও পাকিস্তানকে ফাকিস্তান’ বলাতে মুসলিম লীগ মহলে আগুন লাগিল। নবযুগ বাহির হওয়ায় আজাদ স্বভাবতই আতঙ্কগ্রস্ত হইয়াই ছিল। এই সুযােগে নবযুগ ও নজরুল ইসলামকে কঠোর ভাষায় গাল দিয়া এক সম্পাদকীয় লিখিলেন। নজরুল ইসলামের নাম সম্পাদক হিসাবে প্রকাশিত হওয়ায় আমি কবি ও কাদা’ নামে একটি দস্তখতী সম্পাদকীয় লিখি। লেখাটা সত্যই মর্মস্পর্শী ও যুক্তিপূর্ণ হইয়াছিল। ছাত্র-তরুণরা ও সাহিত্যিক-সাংবাদিক মহলে উহা উচ্চ প্রশংসা লাভ করল। অনেকে আফিসে আসিয়া, অনেকে টেলিফোনে আমাকে কংগ্রেচুলেট করিলেন। সবচেয়ে বড় কথা, নজরুল ইসলাম আমাকে ধন্যবাদ দিতে আসিয়া, আমার হাত ধরিয়া আনন্দে কাঁদিয়া ফেলিলেন। আমি নজরুল ইসলামের তর্কিত প্রবন্ধটা ছাপা হওয়ার দরুন নিজেই দুঃখিত ছিলাম। আমার অবর্তমানে লেখাটা ছাপা হইয়া যাওয়ায় নিজের উপরও যেমন রাগ ছিল, নজরুল ইসলামের উপরও গােস্বা ছিল। কিন্তু নজরুল ইসলামের শিশুসুলভ সরলতায় আমি এই দিন সব ভুলিয়া গেলাম।
৩৫৬
কিন্তু নজরুল ইসলামের লেখায় কাজ হইল। হক সাহেব ও জিন্নাহ সাহেবের মধ্যে যে আপােস একরূপ চূড়ান্ত হইয়া গিয়াছিল, কাজী সাহেবের | ঐ লেখাকে কেন্দ্র করিয়া সে আপােস ভণ্ডুল হইয়া গেল। নবযুগ বাহির হইবার দুই-আড়াই মাস মধ্যে ১৯৪১ সালের ডিসেম্বর মাসে মুসলিম লীগ ত্যাগ করিয়া হক সাহেব ‘প্রােগ্রেসিভ কোয়ালিশন পার্টি’ গঠন করিলেন এবং কংগ্রেস, হিন্দু সভা, কৃষক প্রজা সব পার্টিকে লইয়া নয়া মন্ত্রিসভা গঠন করিলেন।
প্রস্তুতই ছিলাম। কলম ঘুরাইয়া ধরিলাম। আগের কথা ত পুরান কথা, গত আড়াই মাস ধরিয়া যা কিছু লিখিয়াছি সে সব কথাও উল্টাইয়া বলিতে শুরু করিলাম। এবার সত্য-সত্যই প্রফেশনাল সাংবাদিকতা শুরু করিলাম। অর্থাৎ নিজের মতামত, আদর্শ ও বিবেক-বুদ্ধি ‘চুঙ্গায় ভরিয়া রাখিয়া নূতন নূতন যুক্তিতে প্রােগ্রেসিভ কোয়ালিশনকে জনপ্রিয় ও সফল করিতে উকিলের মতই আরগুমেন্ট করিতে লাগিলাম। এ কাজে এমন সফল হইয়াছিলাম যে, এই কোয়ালিশনের অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা ও নেতা জনাব সৈয়দ নওশের আলী সাহেব একদিন নবযুগ আফিসে আমার রুমে আসিয়া বলিলেন : কংগ্রেচুলেশন মনসুর সাহেব। আমি নীতিগতভাবেই খবরের কাগজ পড়ি না; কিনিয়া পয়সা অপব্যয় ত করিই না : খবরের কাগজের অফিসেও যাই না। বিনা পয়সায় যায় বলিয়া নবযুগআমার বাড়িতে ঢুকিতে পারে। আপনার লেখা আমার ভাল লাগে। বলিয়া দুই-একদিন নবযুগ’আমি পড়িয়া থাকি। আপনি প্রােগ্রেসিভ কোয়ালিশন সম্পর্কে ক্রমান্বয়ে যে পাঁচ-সাতটা এডিটরিয়েল লিখিয়াছেন, আপনি শুনিয়া আশ্চর্য হইবেন যে সবগুলি আমি এক নিশ্বাসে পড়িয়া ফেলিয়াছি।
আমি গালটি প্রশস্ত করিয়া বলিলাম : তবে ত কংগ্রেচুলেশন দিতে হয় আপনাকেই। কী হইয়াছে?
সৈয়দ সাহেবও হাসিয়া বলিলেন : হইবে আর কী? বুকের বােঝা নামিয়াছে। প্রােগ্রেসিভ কোয়ালিশন করিয়া আমার চোখের ঘুম গিয়াছিল। ভাল করিলাম কি মন্দ করিলাম বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছিলাম না। আপনার সম্পাদকীয় কয়টা পড়িয়া এতদিনে বুঝিলাম, এমন ভাল কাজ জীবনে আর একটাও করি নাই। আমাদের এই কাজের সমর্থনে যে এত-এত যুক্তি আছে, আপনার লেখা পড়িবার আগে তা জানিতাম না।’
সৈয়দ সাহেবের কথার জবাবে আমি মুখে কিছু বলিলাম না বটে কিন্তু মনে-মনে বলিলাম : আপনার ও আমার অবস্থা একই। লিখিবার আগে। আমিও জানিতাম না যে আপনাদের পক্ষে অত কথা বলিবার আছে।
৩৫৭
বস্তুত প্রােগ্রেসিভ কোয়ালিশনের সমর্থনে পরপর কয়েকদিন এডিটরিয়েল লিখিয়া আমি নিজেই নিজের যুক্তির ফাঁদে পড়িলাম। যদিও প্রােগ্রেসিভ কোয়ালিশন গঠনে আমার কোনও কনট্রিবিউশন ছিল না, সুতরাং উহাকে সফল করিবার কোনও দায়িত্ব আমার ছিল না। ক্রমেই আমার মনে হইতে লাগিল চেষ্টা করিলে ইহাকে সফল করা যাইতে পারে এবং সে চেষ্টা করাও উচিৎ। এমন সময় হক সাহেব এক বিবৃতিতে বলিলেন : ডা. শ্যামাপ্রসাদ মুসলিম বাংলার স্বার্থ রক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করিয়াছেন, আর হক সাহেব স্বয়ং নিয়াছেন হিন্দু বাংলার স্বার্থ রক্ষার দায়িত্ব। হক সাহেব তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে যতগুলি ঐতিহাসিক ঘােষণা করিয়াছেন, তার মধ্যে এইটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঘােষণা। কারণ হিন্দু সভার নেতা ডা. শ্যামাপ্রসাদকে এই সময় বাংলার, এমনকি গােটা ভারতের, মুসলমানরা নিজেদের সবচেয়ে বড় শত্রু মনে করিত। সেই ডা. শ্যামাপ্রসাদকেই মুসলিম স্বার্থ রক্ষার ভার দেওয়া হইয়াছে শুনিয়া মুসলমানরা সােজাসুজি বুঝিল বাঘের হাতেই ছাগল রাখানি দেওয়া হইয়াছে।

৩. আমার রাজনীতিক সাংবাদিকতা
কিন্তু আমি হক সাহেবের ঐ ঘােষণার মধ্যে প্রােগ্রেসিভ কোয়ালিশনের সাফল্যের চাবিকাঠি দেখিতে পাইলাম। বাহ্যত অসম্ভব এবং হাস্যকর এ ঘােষণা স্পষ্টতই একটা রাজনৈতিক স্টান্ট। সাংবাদিকের দায়িত্ব এটা নয় । ‘রাজনীতি’ ও ‘সাংবাদিকতা’ সম্পূর্ণ আলাদা কাজ। সাংবাদিকতা উকিলের মত ‘প্রফেশনাল’ মাত্র, এসব কথা মাত্র কয়েকদিন আগে প্রচার করিয়াছি; ওটা তখনও আমার দৃঢ় মত। তবু আমি হক সাহেবের নবযুগ-এ চাকুরি নিয়া তাঁর রাজনীতিতে জড়াইয়া পড়িলাম। সেটা পারিলাম দুই কারণে। প্রথমত, রাজনীতি ও সাংবাদিকতার স্বাতন্ত্রটা আমার সাম্প্রতিক মত। অভিজ্ঞতালব্ধ উপলব্ধি মাত্র। মুরুব্বিদের কাছে-শেখা জ্ঞান হইতে এই মত সম্পূর্ণ আলাদা। মওলানা ইসলামাবাদী, মওলানা আকরম খাঁ ও মৌলবী মুজিবর রহমান প্রভৃতি শিক্ষাগুরুদের কাছে পাওয়া জ্ঞানের এটা সম্পূর্ণ বিপরীত। সাংবাদিকতা মিশনারির দায়িত্ব, চাকুরিয়ার কাজ নয়, এটাই শিখিয়াছিলাম এঁদের খেদমতে। পরে মুরুব্বিদের এই মতের ত্রুটি বুঝিয়াছিলাম। কিন্তু অভ্যাস বদলাইতে পারি নাই। শৈশবে-পাওয়া মুরুব্বিদের-দেওয়া জ্ঞান সত্যই মানুষের স্বভাবে অন্তর্ভুক্ত হইয়া যায়।
৩৫৮
দ্বিতীয়ত, হক সাহেবের তখনকার রাজনৈতিক সাফল্য-অসাফল্যের সাথে নবযুগ-এরা মরা-বাঁচা অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত ছিল। নবযুগ-এর বাচিয়া থাকা শুধু আমার একার নয়, নবযুগ-এর শতাধিক চাকুরিয়ার জীবিকা নির্ভর করিতেছে। দু-চারজন বাদে এঁরা সবাই মুসলমান। নবযুগ না থাকিলে এঁদের বিপদ হইবে। কৃষক-এর সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা হইতে এটা আমি বুঝিয়াছিলাম।
কাজেই অন্তত নবযুগ-এর জন্যও হক সাহেবের এই নয়া রাজনীতিকে সফল করিতেই হইবে, এই প্রয়ােজনের বিচারেই আমি সম্পাদকীয় লিখিয়া চলিলাম। তারই একটাতে বলিলাম : এই মুহূর্তে হক সাহেবের পশ্চিম বাংলা ও ডা. শ্যামাপ্রসাদের পূর্ব বাংলা সফরে বাহির হওয়া উচিৎ। এই সম্পাদকীয়ের সমর্থনে আমি হক সাহেব ও ডা. শ্যামাপ্রসাদকে মৌখিক পরামর্শ দিলাম এবং আমার নিজ জিলায় ডা. শ্যামাপ্রসাদকে নিমন্ত্রণ জানাইলাম। তাকে আমি ভরসা দিলাম, আমি নিজে গিয়া সভার আয়ােজন করিব এবং লক্ষ লােকের সমাবেশ করাইব। ঐ সভায় ডা. শ্যামাপ্রসাদ যদি মুসলিম স্বার্থ রক্ষার ওয়াদা করিয়া আসেন, তবে প্রােগ্রেসিভ কোয়ালিশনের গতি ও জয় দুর্বার হইয়া উঠিবে। আমার এই প্রস্তাবে হক সাহেব ও ডা. শ্যামাপ্রসাদ উভয়েই রাজি হইলেন। মি. সন্তোষ কুমার বসু, অধ্যাপক প্রমথ ব্যানার্জী প্রভৃতি অন্য মন্ত্রীরাও পরম উৎসাহেই আমার প্রস্তাব সমর্থন করিলেন।
কিন্তু কার্যত তা হইল না। বরঞ্চ হক সাহেব পূর্ব বাংলা এবং শ্যামাপ্রসাদ পশ্চিম-বাংলা সফরে বাহির হইলেন। বােধ হয় তারা আগে যার যার ঘর সামলানােকেই অধিকতর আসন্ন জরুরি কাজ মনে করিলেন। আমি বুঝিলাম, এই ভুলের দরুনই কোয়ালিশনের সাফল্যের সম্ভাবনা দূর হইল। যদি শেষ পর্যন্ত এই চেষ্টা ব্যর্থই হয়, তবু এ ব্যর্থতায়ও যাতে হক সাহেবের চূড়ান্ত রাজনৈতিক মৃত্যু না ঘটে, সেদিকে নজর রাখিয়া আমি কলম চালাইলাম। প্রােগ্রেসিভ কোয়ালিশন না বাঁচুক, হক সাহেবকে বাঁচাইতে হইবে ।

৪. আমার ব্যক্তিগত সংকট
এই ধরনের লেখা স্বভাবতই হিন্দু মন্ত্রীদের পছন্দ হইল না। যতদূর মনে পড়ে। এই সময়ে বিভিন্ন বিভাগের চাকুরির ব্যাপারে বিশেষত এ. আর. পি. বিভাগের চাকুরিতে মুসলমানদের দাবি-দাওয়া পদদলিত হইতেছে বলিয়া
৩৫৯
মুসলমানদের মধ্যে যে অসন্তোষ দেখা যাইতেছিল, হক সাহেব এবং তার মন্ত্রিসভার কারাে কারাে সাথে পরামর্শ করিয়াই আমি এ ব্যাপারেও ভারত সরকারের সমালােচনা করিতে লাগিলাম। এতে হিন্দু মন্ত্রীরা আমার উপর চটিলেন। কেউ-কেউ আমার সাথে তর্ক করিলেন। আমি নানা যুক্তি-তর্ক দিয়া বুঝাইবার চেষ্টা করিলাম, প্রােগ্রেসিভ কোয়ালিশনের জনপ্রিয়তা রক্ষার খাতিরেই আমি ঐ সব লেখা লিখিতেছি।
হক সাহেব পরে আমাকে জানাইলেন, তাঁর হিন্দু মন্ত্রীরা আমার যুক্তিতে মােটেই কনভিন্সড হন নাই। তারা আমার উপর খুবই অসন্তুষ্ট। কেউ-কেউ আমাকে সরাইবার কথা বলিতেছেন। সঙ্গে সঙ্গে হক সাহেব অবশ্য আমাকে আশ্বাস দিলেন, আমার চিন্তার কোনও কারণ নাই। আমি যেভাবে সম্পাদকীয় লিখিতেছি, তাতে তাঁর নিজের এবং মুসলমান মন্ত্রীদের পূর্ণ সমর্থন আছে। অন্যতম মন্ত্রী খান বাহাদুর হাশেম আলী ও বন্ধুবর শামসুদ্দীন আহমদও আমার নীতিতে পূর্ণ সমর্থন জানাইলেন। উভয়েই আমাকে নিশ্চিন্ত থাকিতে বলিলেন।
আমি নিশ্চিন্ত হইবার চেষ্টা করিলাম। নিশ্চিন্ত হওয়া আমার দরকারও ছিল। কারণ ইতিমধ্যে এই সনের আগস্ট মাসেই আমার চতুর্থ পুত্র মনজুর আনামের জন্ম হইয়াছে। আমার সংসার-খরচা বাড়িয়াছে।

৫. নজরুলের ধর্মে মতি
ইতিমধ্যে নজরুল ইসলাম সাহেবের মধ্যে একটু-একটু মস্তিষ্ক বিকৃতি দেখা দিল। আগেই শুনিয়াছিলাম, তিনি বরদাবাবু নামক জনৈক হিন্দু যােগীর নিকট তান্ত্রিক যােগ সাধনা শুরু করিয়াছেন। জিজ্ঞাসা করিলে কাজী সাহেব মিষ্ট হাসি হাসিতেন। কিন্তু তার স্বাভাবিক প্রাণ-চঞ্চল ছাদ-ফাটানাে হাসি তিনি আর হাসিতেন না। তার বদলে উঁচু স্তরের এমন সব আধ্যাত্মিক কথা বলিতেন, যা সংবাদপত্র আফিসে মােটেই মানায় না। একদিন আফিসে আসিয়া তিনি আমাকে বলিলেন : একটা জায়নামাজ ও অযুর জন্য একটা বদনা কিনাইয়া দিন। তাই করা হইল । আফিসে দুতালার পিছন দিকে একটি ছােট কামরাকে নামাজের ঘর করা হইল। কাজী সাহেব সপ্তাহে দুচার দিন যা আসিতেন এবং দুই-তিন ঘণ্টা যা থাকিতেন তার সবটুকুই তিনি অযু ও নামাজে কাটাইতেন। অযু করিতে লাগিত কমছে-কম আধ ঘণ্টা। আর নামাজে ঘণ্টা দুই। এ নামাজের কোনও ওয়াকত-বেওয়াকত ছিল না।
৩৬০
কেরাত-রুকু-সেজদা ছিল না। জায়নামাজে বসিয়া হাত উঠাইয়া মােনাজাত করিতেন এবং তার পরেই মাটিতে মাথা লাগাইতেন, সিজদার মত কোমর উঁচা করিয়া নয়, কোমর উরুর সাথে ও পেট জমির সাথে মিশাইয়া। এইভাবে ঘণ্টার-পর ঘণ্টা এক সিজদায় কাটাইয়া দিতেন। আমি যতদূর দেখিয়াছি, তাতে তিনি সিজদা শেষ করিয়া একবারই মাথা উঠাইতেন।
আমাদের দুশ্চিন্তার মধ্যেও এইটুকু সান্ত্বনা ছিল যে অন্তত তান্ত্রিক সাধনা ছাড়িয়া তিনি মুসলমানি এবাদত ধরিয়াছেন। এইভাবে কিছুদিন যাওয়ার পর তিনি একদিন আমাকে বলিলেন : তাঁকে সেই দিনই পাঁচ শত নামাজশিক্ষা কিনিয়া দিতে হইবে। কারণ তাঁর পাঁচ শত হিন্দু মহিলা শিষ্য হইয়াছেন; তাঁদের সকলকে কাজী সাহেব নামাজ শিখাইবেন। তখন শেখ আবদুর রহিম সাহেবের নামাজ শিক্ষা’র দাম পাঁচ আনা। পাঁচশ কপি কিনিতে লাগে প্রায় দেড়শ টাকা। ম্যানেজার, একাউন্টেন্ট ও ক্যাশিয়ার গােপনে আমার সাথে পরামর্শ করিলেন। সর্বসম্মতিক্রমে ঠিক হইল, দশটা টাকা দিয়া একজনকে বাজারে পাঠাইয়া দেওয়া হউক। দশ টাকায় যা পাওয়া যায় আনিয়া বলা হউক, মার্কেটে আর কপি নাই। তাই করা হইল। ত্রিশ কপি নামাজ শিক্ষা আনিয়া কাজী সাহেবকে দেওয়া হইল। ঐ কৈফিয়তটাও দেওয়া হইল। আশ্চর্য এই যে কাজী সাহেব ঐ ত্রিশ কপি পাইয়াই খুশি হইলেন এবং বিনাপ্রতিবাদে চলিয়া গেলেন। আর কপি কোনও দিন চাইলেন না। আরাে কপি কিনিবার ভয়ে কাজী সাহেবের হিন্দু শিষ্যদের নামাজ শিক্ষার অগ্রগতি সম্বন্ধেও আমরা কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করিলাম না। কিন্তু কাজী সাহেবের দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও আমার সহকর্মী মি. কালীপদ গুহ ও মি. অমলেন্দু দাসগুপ্ত এটাকে মস্তিষ্ক বিকৃতির লক্ষণ বলিয়া স্বীকার করিলেন না। এই দুই ভদ্রলােকের সঙ্গে আমার আগের পরিচয় ছিল না। আমার দীর্ঘদিনের সাংবাদিক জীবনে বা কংগ্রেসী রাজনীতিতে এঁদেরে কোনও দিন দেখি নাই। তবু কাজী সাহেবের পীড়াপীড়িতে আমরা এই দুইজনকেই সহকারী সম্পাদক করিয়া নিয়াছিলাম। কাজী সাহেব এবং বােধহয় ম্যানেজমেন্টের কেউ-কেউ আমাকে বলিয়াছিলেন যে উহারা যুগান্তর’-‘অনুশীলন দলের বিপ্লবী লোেক বলিয়াই কংগ্রেসী রাজনীতিতে ওঁদের সাক্ষাৎ পাই নাই। শুনিয়া শ্রদ্ধায় আমার মাথা নত হইল। ওঁদেরে সহকারী সম্পাদক নেওয়া হইল কারণ ওঁদের দুইজনেই শক্তিশালী লেখক ছিলেন। বিশেষত, অমলেন্দু বাবুর কলমে খুবই জোর ছিল। তবে সাংবাদিকতায় প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার অভাবেই বােধ হয়, তাদের লেখাগুলি বাস্তবের চেয়ে অবাস্তব, জার্নালিস্টেকের চেয়ে
৩৬১
লিটারির, অবজেকটিভের চেয়ে সাবজেকটিভই হইত বেশি। সেজন্য তাঁদের সব লেখা ছাপা যাইত না। সেজন্য তারা বােধ হয় মনে-মনে আমার প্রতি অসন্তুষ্ট হইয়াছিলেন এবং কাজী সাহেবের কাছে বােধ হয় এক-আধবার নালিশও করিয়াছিলেন। কাজী সাহেব সম্পাদনার ব্যাপারে মােটেই হাত দিতেন না। তাঁর সময়ই ছিল না। কাজেই তারা মনে-মনে আমার উপর বিক্ষুব্ধ ছিলেন, এটা বলা যায়। কিন্তু আমি তাদের উপর অসন্তুষ্ট হইলাম কাজী সাহেবের অসুখকে তারা অগ্রাহ্য করিতেন বলিয়া। শুধু অগ্রাহ্য করা নয়, এটাকে তারা আধ্যাত্মিক জীবনের অগ্রগতি বলিয়া ব্যাখ্যা করিতেন। আমি ও-সব কথাকে প্রথমে হাসিয়া এবং পরে দৃঢ়তার সাথে উড়াইয়া দিতাম বলিয়া আমার সামনে তাঁরাও ও-বিষয়ে কথা আর বলিতেন না। ফলে লাভ এই হইল যে, কাজী সাহেব আমার রুমে তার নির্দিষ্ট আসনে না বসিয়া প্রায়ই সহ-সম্পাদকের জন্য নির্দিষ্ট রুমে অমলবাবুদের সাথেই বেশি সময় কাটাইতেন। তিনিই আইনত নবযুগ-এর প্রধান-সম্পাদক। তার আসনও প্রধান-সম্পাদকের উপযােগী করিয়া সাজানাে। গদি-আঁটা-চেয়ার, সেক্রেটারিয়েট টেবিল। টেবিলে বিশালকার ব্লটিং প্যাড হইতে শুরু করিয়া প্রকাণ্ড কাচের দোয়াতদান, দুরঙ্গা দুইটা কালি-ভরা দোয়াত-কলমসহ পেন হােল্ডার, পেপার-কাটার সবই সাজান থাকিত। কিন্তু এ সব ফেলিয়া তিনি অমলবাবুদের রুমে কাঠের চেয়ারে বসিয়া চুপি-চাপি আলাপ করিতেন। নজরুল ইসলাম বাংলার তরুণদের বিশেষত মুসলিম তরুণদের জন্য বিরাট আকর্ষণ । প্রধানত তাঁকে দেখিবার জন্যই মুসলিম ছাত্ররা দলে-দলে নবযুগ আফিসে আসিত। অন্য কোনও কারণই ছিল না তাদের। মুসলিম ছাত্রসমাজের প্রায় গােটাটাই এই সময় পাকিস্তান আন্দোলনের সুতরাং মুসলিম লীগের সমর্থক এবং হক সাহেবের নবযুগএর সমর্থক। গােড়াতে নজরুল ইসলামকে ঘিরিয়া মুসলিম ছাত্র-তরুণদের সমাগমে নবযুগ আফিস সরগরম থাকিত। এইরূপ মস্তিষ্ক বিকৃতি দেখা দেওয়ার পর হইতে তিনি যেন ছাত্রদের এই ভিড় না-পছন্দ করিতে লাগিলেন। আমি তাঁকে তাঁর সিটে থাকার পরামর্শ দিয়া আমলবাবু ও বরদাবাবুর যােগটোগের সমালােচনা করায় তিনি গম্ভীরভাবে বলিয়াছিলেন : বরদাবাবু সিদ্ধ পুরুষ, তিনি বারবছর আগে-মরা বুলবুলকে একদিন সশরীরের তার সামনে উপস্থিত করিয়াছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে কেউ কোনও কথা বলিলে তিনি মনে কষ্ট পান। আমার সমালােচনার এটা দৃঢ় প্রতিবাদ। এরপর আমি আর কোনও কথা বলি নাই।
৩৬২
৬. নজরুলের আধ্যাত্মিকতা
তিনি দরজা বন্ধ করিয়া গােপনে আমার সাথে অনেক আধ্যাত্মিক আলােচনা। করিতেন। আলােচনা করিতেন মানে তিনি বলিয়া যাইতেন, আমি শুনিয়া যাইতাম। এ সব কথার মধ্যে দুর্বোধ্যতা, এমনকি অনেক সময়। কাণ্ডজ্ঞানহীনতা থাকিলেও তাতে পাগলামি ছিল না। বরঞ্চ অনেক কথা আমার ভাল লাগিত । এমন ধরনের একটি কথা এখানে উল্লেখ করার লােভ সম্বরণ করিতে পারিলাম না। একদিন তিনি আফিসে আসিয়া নিজের আসনে বসিলেন। মিনিট খানেক কী ভাবিলেন। পরে নিজের আসন ছাড়িয়া আমার টেবিলের সামনের ভিজিটার্স সিটে বসিলেন। তারপর আমার দিকে গলা বাড়াইয়া গােপন কথা বলিবার ভঙ্গিতে বলিলেন, তার সারমর্ম এই : তিনি এবং তাঁর স্ত্রীর মধ্যে একটা দুর্ভেদ্য চীনা দেওয়াল উঠিয়াছে। তারা উভয়েউভয়ের সহিত মিলিত হইবার জন্য আঁকুপাঁকু করিতেছেন। তারা উভয়েই পরস্পরের প্রেমের রঞ্জু টানিয়া একজন আরেকজনকে নিজের কাছে নিতে চাহিতেছেন। উভয়ের মধ্যে এই টাগ-অব-ওয়ার চলিতেছে দীর্ঘদিন ধরিয়া । কিন্তু এ চেষ্টা ব্যর্থ হইয়াছে। কারণ এটা অবৈজ্ঞানিক। কীরূপে, তা বুঝাইবার জন্য তিনি আমার টেবিলের উপর হইতে একটা বড় ডিকশনারি লইয়া তা উপুড় করিয়া টেবিলের উপর বসাইলেন। কলমদানের উপর হইতে এক টুকরা মােটা সুতা লইয়া তার দুই মাথায় দুইটা পেপার-ওয়েট সুকৌশলে বাঁধিলেন। এবং খাড়া করা বইটার উপর তা ঝুলাইয়া দিলেন। তারপর তিনি। বলিলেন : লক্ষ্য করুন, দুইটা পেপার-ওয়েট সমান ওজনের। তাই একটার ভারে অপরটা উঠিয়া আসিতেছে না। উভয়ের ওজন সমান না হইয়া যদি একটা অপরটার দশ গুণ ভারী হইত, তবে ভারীটার টানে পাতলাটা উঠিয়া আসিত। কারণ গত কয়েক বছর ধরিয়া আমি নিজের ওজন স্ত্রীর ওজনের দশ গুণ বাড়াইবার চেষ্টা করিয়াছি। অনেক বাড়াইয়াছি। কিন্তু যথেষ্ট বাড়াইতে পারি নাই। তাই আমি ওজন বাড়াইবার চেষ্টা ত্যাগ করিয়া দেওয়ালের চূড়ায় উঠিয়া সেখান হইতে তাকে টানিয়া তুলিবার চেষ্টা করিতেছি। সেটা কেন দরকার এবং কেমন করিয়া সম্ভব, তাই এখন বুঝাইতেছি।
এইখানে আমাকে তিনি প্র্যাকটিক্যাল ডিমনস্ট্রেশন করিয়া দেখাইয়া দিলেন যে নিচে হইতে টানিয়া অপর পারের পেপার-ওয়েটটা এ পাশে আনা যত কষ্টসাধ্য, বইটার উপর হইতে টানিয়া তােলা তেমন কঠিন নয়, অনেক সহজ। এটা যখন আমি অতি সহজেই স্বীকার করিলাম, তখন তিনি
৩৬৩
আমাকে বলিলেন : ‘অতএব আমি স্থির করিলাম আমি এই চীনা দেওয়ালের উপর উঠিব। সেখান হইতেই স্ত্রীকে টানিয়া তুলিব। গত এক বছর এই চেষ্টা করিয়াও পারি নাই। এখন আমাকে অগত্যা দেওয়ালের অপর পারে নামিয়া পড়িতে হইবে। উপর হইতে রশি ধরিয়া টানিয়া তােলার চেয়ে ওপারে নামিয়া ওকে কাঁধে তুলিয়া নিয়া আসা অনেক সহজ হইবে। আমি ব্যাপারটা বুঝিবার জন্যই জেরা করিলাম। তিনি শেষ পর্যন্ত বলিলেন : ‘আপনি ঠিকই বুঝিয়াছেন আমাকেও আমার স্ত্রীর রােগে পীড়িত হইতে হইবে।

৭. নজরুলের রােগ লক্ষণ
কাজী সাহেবের স্ত্রী বহুদিন ধরিয়া দুরারােগ্য পক্ষাঘাত রােগে ভুগিতেছেন। তাঁর রােগের রােগী হওয়া মানে কাজী সাহেবেরও পক্ষাঘাতগ্রস্ত হওয়া। কথাটা মনে হইতেই গা কাঁটা দিয়া উঠিল। এই অশুভ চিন্তার জন্য মনে-মনে তওবা করিলাম। কাজী সাহেব আমার বিচলিত ভাব দেখিয়া সান্ত্বনা দিলেন : ‘চিন্তার কোনও কারণ নাই। ব্যাপারটাকে যত সাংঘাতিক মনে করিতেছেন, তত সাংঘাতিক এটা নয়। আমি আমার স্ত্রীর মত অসুস্থ হইয়া আবার ভাল হইব এবং তখন স্ত্রীও আমার সাথে-সাথে আরােগ্য লাভ করিবে। আধ্যাত্মিক সাধনার বলে এমন ইচ্ছাধীন রােগাক্রান্তি এবং রােগমুক্তি সম্ভব এটা বৈজ্ঞানিক কথা। এটাকে বলে সাইকো-থিরাপি। আমার মন মানিল না, কারণ আমি ও-সম্বন্ধে কোনও বই-পুস্তক পড়ি নাই। কেমন যেন অশুভঅশুভ মনে হইতে লাগিল। যিনি শুনিলেন তিনিই এটাকে মস্তিষ্ক বিকারের লক্ষণ বলিলেন।
এরপর কাজী সাহেব আফিসে আসা একদম বন্ধ করিয়া দিলেন। শুধু বেতন নিবার নির্ধারিত তারিখে রশিদ সই করিয়া টাকা নিতে আসিতেন। তাও খবর দিয়া আনিতে হইত। কয়েক মাস পরে তা-ও বন্ধ করিলেন। লােক পাঠাইয়া বেতনের টাকা নিতে লাগিলেন। নজরুল ইসলাম সাহেবই ছিলেন নবযুগ আফিসে ছাত্র-তরুণদের বড় আকর্ষণ। তিনি আর আফিসে আসেন না কথাটা জানাজানি হইয়া যাওয়ায় আস্তে-আস্তে তাদেরও যাতায়াত কমিয়া গেল।
ইতিমধ্যে হক সাহেব একদিন কথা প্রসঙ্গে নবযুগ-এর আর্থিক দুরবস্থার কথা আমাকে জানাইলেন। তিনি বলিলেন : মন্ত্রী হওয়ার আগে
৩৬৪
সকলেই তাঁদের বেতনের মােটা অংশ পত্রিকা ফান্ডে দিবার ওয়াদা করিয়াছিলেন। কিন্তু কোনও মন্ত্রীই তাঁর ওয়াদা পূরণ করেন নাই। কিছুদিন ধরিয়া আমিও এই আশঙ্কাই করিতেছিলাম। কারণ পরিচালকদের অর্থাভাবের হাওয়া বেতন-ভােগীদের গায়েই সবার আগে লাগিয়া থাকে । আমার চোখে-মুখে বােধহয় দুশ্চিন্তা ফুটিয়া উঠিয়াছিল। হক সাহেব আমাকে আশ্বাস দিলেন, বিপদটা খুব আসন্ন নয়। আমি হক সাহেবের আশ্বাসে খুব ভরসা পাইলাম না বটে, কিন্তু খুব চিন্তাযুক্তও হইলাম না। কারণ আমার কাছে এটা খুব অচিন্তিত-আকস্মিক ব্যাপার ছিল না। এমন কিছু একটা ঘটিবে, আগে হইতেই তা আমি জানিতাম। তবে অত তাড়াতাড়ি হইবে তা জানিতাম না। তাছাড়া চাকরি পাওয়া-যাওয়া, সাধারণ আর্থিক দুরবস্থা ও বিপদ-আপদের সাথে এই কুড়ি-বাইশ বছরেই এত বেশি পরিচিত হইয়া গিয়াছি যে অদূর-ভবিষ্যতে বিপদের সম্ভাবনাতেও চঞ্চল হইয়া উঠিলাম না।

৮. মি. দত্তের আবির্ভাব
ইহার কিছুদিন পরে মি. হেমেন্দ্র নাথ দত্ত আমার রুমে প্রবেশ করিয়া হাসিমুখে বলিলেন : নমস্কার মনসুর সাব, কৃষক-এ আমাদের ছাড়াছাড়ি হইয়াছিল। ভগবানের ইচ্ছায় নবযুগ-এ আবার একত্র হইলাম।
বিনা-খবরে মি. দত্ত আমার ঘরে প্রবেশ করায় আমি বিস্মিত হইলাম না । কারণ মাত্র কয়েকদিন আগে বন্ধুবর অধ্যাপক হুমায়ুন কবিরের মুখে শুনিয়াছিলাম, মি. দত্ত একটা বড় রকমের চাউলের কন্ট্রাক্ট পাইতেছেন। এবং হক সাহেব ঐ কন্ট্রাক্টের বদলা নবযুগ তহবিলে চাঁদা দাবি করিতেছেন। মি. দত্ত এককালীন চাঁদা না দিয়া নবযুগ-এর পরিচালন-ভার নিতে রাজি আছেন। বলিয়া কিছু-কিছু কানাঘুষা শুনিতেছিলাম। কাজেই বিন্দুমাত্র-বিস্ময়ের ভাব না দেখাইয়া আমি প্রতি-নমস্কার দিলাম এবং হাত ইশারায় সামনের একটা চেয়ার দেখাইয়া মি. দত্তকে বসিতে বলিলাম। সাধ্যমত আত্মসম্বরণ করিয়া হাসি মুখের জবাবে হাসিমুখেই বলিলাম : কী রকম?
জবাবে মি. দত্ত যা বলিলেন তার সারমর্ম এই যে, হক সাহেব তাঁকে নবযুগ পরিচালনের ভার দিয়াছেন। তিনি সাধ্যমত নবযুগ-এর উন্নতির চেষ্টা করিবেন । টাকা-পয়সার জন্য আমাকে আর কোনও চিন্তা করিতে হইবে না। নবযুগকে বাংলার শ্রেষ্ঠ দৈনিক করিতে আমার যত-কিছু স্কিম আছে, এখন
৩৬৫
হইতে তার সবগুলি আমি প্রয়ােগ করিতে পারি।
মি. দত্ত প্রফুল্ল বদনে পরম উৎসাহের সঙ্গেই তার কথাগুলি বলিয়াছিলেন। হয়ত আশা করিয়াছিলেন, আমিও উৎসাহ প্রকাশ করিব। কিন্তু আমি বিন্দুমাত্র উৎসাহ দেখাইলাম না। এক বছর আগে কৃষক উপলক্ষ করিয়া যে সব ঘটনা ঘটিয়াছিল, তার সবগুলি আমার স্মৃতিপথে উদিত হইল। আমি বােধহয় তৎক্ষণাৎ ঠিক করিয়া ফেলিয়াছিলাম নবযুগ-এ কাজ করা আর আমার পক্ষে সম্ভব হইবে না। তাই আমি কৃত্রিম ভদ্রতা দেখাইয়া নিতান্ত জোর-করা হাসি মুখে বলিলাম : এ খােশ-খবরটা আপনি নিজে বহন না করিয়া যদি হক সাহেবের মারফত পাঠাইতেন, তবে ব্যাপারটা সুন্দর হইত।
মি. দত্ত আমার নিকট হইতে এমন রূঢ় কথা শুনিবার জন্য প্রস্তুত ছিলেন কিনা জানি না। কিন্তু তিনি অভিজ্ঞ ব্যবসায়ী লােক। আমার কথার মধ্যেকার অপমানটা গায় না মাখিয়া মুখের হাসি বজায় রাখিয়া বলিলেন : ‘ও-সব টেকনিক্যাল ফরমালিটি যথাসময়ে হইয়া যাইবে। তার জন্য আমাদের বসিয়া থাকা উচিৎ নয়। আমাদের মধ্যে যে বন্ধুত্ব ও অন্তরের সম্বন্ধ তাতে টেকনিক্যাল কথার স্থান নাই।’ নবযুগকে উন্নত করার কাজে তার ও আমার পূর্ণ সহযােগিতা দরকার, এই জন্যই তিনি ফর্মালিটির অপেক্ষায় বসিয়া না থাকিয়া প্রথম সুযােগেই আমার সহিত দেখা করিতে আসিয়াছেন। এ ব্যাপারে আমার সমস্ত দ্বিধা-সন্দেহের অবসান ঘটাইবার জন্যই বােধহয় তিনি কবে, কী শর্তে নবযুগ-এর ভার নিয়াছেন, কার-কার সামনে কথা হইয়াছে, কে-কী বলিয়াছেন, সব কথা বলিয়া ফেলিলেন।
আমি বােধহয় মাত্রাতিরিক্ত চটিয়া গিয়াছিলাম। তাঁর কথা মনােযােগ দিয়া শুনিবার আগ্রহ আমার ছিল না। তবু শুধু ভদ্রতার খাতিরে বাধা দিলাম না। তার কথা শেষ হইলে বলিলাম : ‘এ সব কথা আমাকে বলিয়া লাভও নাই, দরকারও নাই। হক সাহেবের মারফতই এসব কথা জানাইবেন। হক সাহেব আপনাকে নবযুগ-এর পরিচালক বানাইয়াছেন, তিনি নিজেই আমাকে একথা । জানাইবেন। তার পর আপনার পরিচালনায় নবযুগ-এ আমি চাকরি করিব কিনা, সে কথাও আমি হক সাহেবকেই জানাইব। আপনি মেহেরবানি করিয়া এখন যান। আমার কাজ আছে।
বলিয়া একটা প্যাড টানিয়া লেখা শুরু করিবার উদ্যোগ করিলাম, যদিও। তখনি লেখার তাড়া ছিল না ।
৩৬৬
৯. লজ্জাকর দুর্ঘটনা
মি. দত্ত স্বভাবতই অপমান বােধ করিলেন। তিনি ধৈর্য হারাইলেন। এতক্ষণের ভদ্রতা ও শিষ্টাচারের পােশাক তাঁর একদম খসিয়া পড়িল। তিনি। গলায় অতিরিক্ত জোর দিয়া বলিলেন : ‘আমাকে এভাবে এখান হইতে যাইতে বলার কোনও অধিকার আপনার নাই। আপনি জানেন, আজ হইতে এ আফিসের মালিক আমি। আমি বাহির হইয়া যাইব না। যদি আমাদের দুইজনের কারাে বাহির হইয়া যাইতে হয়, তবে সে ব্যক্তি আমি নই, আপনি।
আমি বিদ্রুপের হাসি হাসিয়া বলিলাম : ‘আপনি এ আফিসের কর্তা হইলে আমি এখানে থাকিব না। তা আমি মানি। কিন্তু ঠিক এ মুহূর্তে আমিই এখানে কর্তা। সুতরাং আপনিই দয়া করিয়া বাহির হইয়া যান।’
মি. দত্ত চেয়ার ছাড়িতেছেন না দেখিয়া আমিই চেয়ার ছাড়িয়া দাড়াইলাম। মি. দত্ত আমার এই দাঁড়ানাের খুব খারাপ অর্থ করিলেন। আমাকে উঠিতে দেখিয়াই তিনি চট করিয়া চেয়ার ছাড়িয়া উঠিলেন এবং বলিলেন : আমাকে আক্রমণ করিতে উদ্যত হইয়াছেন? এ অপমানের আমি বিচার করাইব। অবশ্যই করাইব।
মি. দত্তের গলা ও সর্বাঙ্গ কপিতেছিল। তিনি অতি ব্যস্ততার সহিত দরজার দিকে ছুটিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত হুমড়ি খাইয়া চৌকাঠের উপর পড়িয়া গেলেন এবং মূৰ্ছা গেলেন। আমার রুমের সামনেই প্রকাণ্ড হলঘর। এই হলঘরটাই আমাদের আফিস ঘর। ম্যানেজার, একাউন্টেন্ট ও তাদের গােটা স্টাফই এই হলে বসেন। আফিস পাঁচটায় ছুটি হইয়া গেলেও ম্যানেজার ও একাউন্টেন্ট দুইএকজন সহকারী লইয়া কাজ করিতেছেন। মি. দত্ত তার এক ছেলেকে সঙ্গে লইয়া আসিয়াছিলেন। তিনি পিতাকে আমার রুমে ঢুকাইয়া ম্যানেজারের সাথে। বসিয়া গল্প করিতেছিলেন। দত্ত সাহেবকে পড়িয়া যাইতে দেখিয়া এঁরা সকলেই ছুটিয়া আসিলেন। চোখে-মুখে পানি ছিটাইয়া যথাসম্ভব প্রাথমিক তদবিরাদি করিয়া তাকে ধরাধরি করিয়া গাড়িতে তােলা হইল। দত্ত সাহেবের নিজের মােটর রাস্তায় দাঁড়ান ছিল। সেই গাড়িতেই তাকে হাসপাতালে পাঠান হইল। পরে টেলিফোনে জানিতে পারিলাম, পথেই তার সংজ্ঞা ফিরিয়া আসায় হাসপাতালে নেওয়ার দরকার হয় নাই। তিনি এখন ভাল আছেন।
ব্যাপারটা নিতান্তই আকস্মিক। আমার জন্য বড়ই লজ্জাকর। লােকে কী মনে করিবে? আমার মত ছয়ফুট লম্বা একটা জওয়ান মানুষের কামরায়
৩৬৭
চৌকাঠে দত্ত সাহেবের মত বৃদ্ধ ও শীর্ণ মানুষ বিনা কারণে হুমড়ি খাইয়া নিশ্চয়ই পড়েন নাই। দত্ত সাহেবকে নিয়া যাওয়ার পর-পরই আমাদের স্টাফের প্রায় সকলে আমার কামরায় ভিড় করিয়া আমার কথা শুনিলেন এবং সকল কথা শুনিয়া আমাকে কংগ্রেচুলেট করিলেন। কিন্তু আমি নিজে খুব উৎসাহ পাইলাম না। এই ঘটনার পরে এখানে আমার চাকুরি নাই, এ কথাটা হয়ত আমার মনের তলে লুকাইয়া আমাকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করিতে ছিল। কিন্তু আমার মনে যা পীড়া দিতেছিল তা ছিল আমার ব্যবহার। আমার ক্রমেই বেশি করিয়া মনে হইতে লাগিল, সব দোষ আমার, দত্ত সাহেবের কোনও দোষ নাই। মনটা খারাপ হইল। সকলকে বিদায় দিয়া লেখায় ডুবিবার চেষ্টা করিলাম।
পরদিনই হক সাহেব ডাকিয়া পাঠাইলেন। যা অনুমান করিয়াছিলাম তাই। দত্ত সাহেব আগেই হাজির। আমি গেলে হক সাহেব আমাদের দুইজনকে লইয়া তাঁর শােবার ঘরে গেলেন। কাউকে কিছু বলিতে না দিয়া তিনিই শুরু করিলেন। ওয়াদা-করা চাঁদা না দেওয়ার অপরাধে সমস্ত মন্ত্রীদের বিশুদ্ধ বরিশালী ভাষায় গাল দিয়া, আর্থিক দুরবস্থার বর্ণনা করিয়া তিনি আমাকে বুঝাইলেন, তিনিই বাধ্য হইয়া অনিচ্ছুক দত্ত সাহেবকে এ ব্যাপারে টানিয়া আনিয়াছেন । দত্ত সাহেব রাজি না হইলে তিনি অগত্যা নবযুগ বন্ধই করিয়া দিতেন। এমতাবস্থায় আমাকে ও দত্ত সাহেবকে এক যােগে মিলিয়ামিশিয়া কাজ করিতেই হইবে। গতকালের ব্যাপারটা উভয়কেই ভুলিয়া যাইতে হইবে। ওতে দত্ত সাহেবেরও দোষ আছে। দত্ত সাহেব অন্তত নান্না মিয়াকে সঙ্গে না লইয়া আফিসে যাইয়া কাজ ভাল করেন নাই। আমারও দোষ আছে। দত্ত সাহেবকে অপমান করিয়া বাহির করিয়া দেওয়া ঠিক হয় নাই। হক সাহেবই কথা শুরু করিয়াছিলেন। তিনিই শেষ করিলেন। আমাদের কোনও কথা বলিতে দিলেন না। নবযুগ চালাইতে হইলে আমাদের উভয়কে মিলিতে হইবে, এই কথার পুনরাবৃত্তি করিয়া আমাদিগকে মুসাফিহা করাইয়া বিদায় দিলেন।

১০. আগুনে ইন্ধন
আমরা ভুলিতে চেষ্টা করিলে কী হইবে? পাড়ার লােক আমাদের ভুলিতে দিল না । ভােটরঙ্গ ও অবতার নামে এই সময়ে কলিকাতায় খুব জনপ্রিয় দুইটি ব্যঙ্গ-সাপ্তাহিক ছিল। আমাদের ঘটনা লইয়া ওদের একটিতে হেমেন্দ্র বধ
৩৬৮
কাব্য ও আরেকটিতে হেমেন্দ্র-মনসুর সংবাদ নামে অমিত্রাক্ষর ছন্দে দুইটি কাব্য-নাটিকা প্রকাশিত হইল। তার ফলে কয়েক সপ্তাহ ধরিয়া কলিকাতার রাস্তাঘাটে, ট্রামে-বাসে, স্কোয়ারে-ময়দানে, আমরা দুইজন আলােচনার বিষয় থাকিলাম। লেখা দুইটি ছিল মােটামুটি শক্তিশালী লেখকের হাতের। সুতরাং প্যারডি খুব উপভােগ্য হইয়াছিল। ভাষায় যথেষ্ট মুনশীয়ানা ছিল। এই মুনশীয়ানা করিতে গিয়া লেখককে স্বভাবতই কল্পনার আশ্রয় নিতে হইয়াছিল। তবু তাকে সত্য-অর্ধসত্য মিলিয়া মােটামুটি লেখা দুইটিতে সত্যের রূপ দিতে পারিয়াছিল। ওতে আমাকেও যথেষ্ট বিদ্রুপ করা হইয়াছিল। কিন্তু সাহিত্যিক রণযােদ্ধা হিসাবে আমি সে সব বিদ্রুপের। কশাঘাতকে শিল্প হিসাবে গ্রহণ করিলাম। কিন্তু রস-কষহীন নিরেট ব্যবসায়ী ভাল মানুষ দত্ত সাহেব ঐ স্যাটায়ারের রস গ্রহণ করিতে স্বভাবতই অসমর্থ হইলেন। বরঞ্চ তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করিলেন, ও-দুইটা ব্যঙ্গ-রচনা আমার সাহায্যে লেখা হইয়াছে। প্রমাণস্বরূপ তিনি দেখাইলেন যে, রচনা দুইটিতে আমাকে নরম হাতে এবং দত্ত সাহেবকে নির্দয়ভাবে আক্রমণ করা হইয়াছে। ফলে আমরা উভয়কে যথাসম্ভব এড়াইয়া চলিতে লাগিলাম। দত্ত সাহেব এর পরে দুপুরের দিকেই নবযুগ-এ আসিতেন। বিকাল বা সন্ধ্যায় কখনও আসিতেন না।
এই সময়ে আমি কঠিন আমাশয়ে আক্রান্ত হই। ডাক্তার স্থান পরিবর্তনের উপদেশ দেওয়ায় আমি হক সাহেবের নিকট হইতে এক মাসের ছুটি নিয়া সপরিবারে গ্রামের বাড়িতে চলিয়া যাই। বার্তা সম্পাদক কবি বেনীর আহমদকে মাসখানেক কোনও মতে চালাইয়া যাইবার ভার দিয়া যাই।

১১. ‘নবযুগে’ চাকুরি খতম
ছুটির পনের দিন যাইতে না যাইতেই নজরুল ইসলাম সাহেবের এক টেলিগ্রাম পাইলাম : আপনার সার্ভিসের আর দরকার নাই। অর্থাৎ আমার চাকুরি খতম। এমনটি একদিন ঘটিবেই, তা জানিতাম। কিন্তু কাজী সাহেব আমাকে টেলিগ্রাম করেন কেন? হয় হক সাহেব নয় ত মি. দত্তই আমার চাকুরি খতম করিবেন। কাজী সাহেব কেন? আমার সন্দেহ হইল । আমি আগেই জানিতাম, অন্যতম মন্ত্রী এবং কাগজে-পত্রে নবযুগ -এর ম্যানেজিং ডাইরেক্টর খান বাহাদুর হাশেম আলী ঐদিন ময়মনসিংহ শহরে
৩৬৯
আছেন। আমি তাঁর সাথে দেখা করিলাম। তিনি ব্যাপার শুনিয়া আকাশ হইতে পড়িলেন। এটা কিছুতেই বরদাশত করা হইবে না বলিয়া তিনি অবিলম্বে কলিকাতা যাইতে আমাকে পরামর্শ দিলেন। তিনি নির্দিষ্ট ট্যুর। প্রােগ্রাম শেষ করিয়াই দু-চার দিনের মধ্যেই কলিকাতা ফিরিবেন বলিলেন।
মন বলিল কোনও লাভ হইবে না। তবু কলিকাতা গেলাম। কারণ দেনা-পাওনা মিটাইয়া এবং জিনিস-পত্র গােছাইয়া আসিতে একবার কলিকাতা ত যাইতেই হইবে। সে জন্য বাড়িতে কাউকে কিছু না বলিয়া শহরে দু-এক বন্ধুকে আমার জন্য একটি বাড়ি ঠিক করিতে অনুরােধ করিয়া কলিকাতা গেলাম। হক সাহেবের সাথে দেখা করিয়া টেলিগ্রামটা দেখাইলাম। তিনি শুধু বিস্ময় প্রকাশ করিলেন না : ‘কোন বদমায়েশ এই বদমায়েশি করিল’ বলিয়া দু-চারটা হুঙ্কারও দিলেন। কিন্তু নান্না মিয়া, মি. সৈয়দ বদরুদ্দোজা, নূরুল হুদা ও বেনবীর আহমদের নিকট আসল কথা জানিতে পারিলাম। তারা যা বলিলেন তার সারমর্ম এই : আমি ছুটিতে যাওয়ার পর হইতেই মি. দত্ত হিন্দু মন্ত্রীদিগকে দিয়া আমাকে সরাইবার জন্য হক সাহেবের উপর চাপ দেওয়া শুরু করেন। হক সাহেব শেষ পর্যন্ত রাজি হন। কিন্তু নিজে ডিসমিস করিতে রাজি হন না। দত্ত সাহেব নিজেও ডিসমিসের পত্র দিতে ইচ্ছুক ছিলেন না। কাজেই অনেক বুদ্ধি-পরামর্শ করিয়া তিনি কাজী সাহেবকে ধরেন। কাজী সাহেবের সঙ্গে মি. দত্ত একা। অনেক আলাপ করিতেন। সে আলাপে নূরুল হুদা ও বেনীর আহমদকে কাজী সাহেবের কাছে থাকিতে দেওয়া হয় নাই। তবে তাঁরা শুনিয়াছেন। কাজী সাহেবের সমস্ত দেনা শােধ করিবার ওয়াদা করিয়া মি. দত্ত কাজী। সাহেবকে চিঠির বদলে টেলিগ্রাম করিতে রাজি করিয়াছেন। কাজী সাহেবের এই কাজের নিন্দা সকলেই করিলেন। আমিও মনে আঘাত পাইলাম। কিন্তু সঙ্গে-সঙ্গে কাজী সাহেবের তৎকালীন মানসিক অবস্থার কথা মনে পড়ায় তাঁর প্রতি নরম হইয়া গেলাম।
ফলে নবযুগ-এ ফিরিয়া যাওয়ার আশা ও চেষ্টা ত্যাগ করিলাম। তার বদলে মাথায় একটা দুষ্ট-বুদ্ধি গজাইল। মাত্র কয়েকদিন আগে বােম্বাই হাইকোর্টের একটা রুলিং খবরের কাগজে বাহির হইয়াছিল। তাতে বলা হইয়াছে নিয়ােগ-পত্রে নির্দিষ্ট কিছু শর্ত লেখা না থাকিলে সাংবাদিককে বরখাস্ত করিতে তিন মাসের নােটিস লাগিবে । আমি হক সাহেবকে সে কথা বলিলাম। তিনি খুশি হইয়া স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলিলেন। বলিলেন যে মি. দত্তের
७৭০
সঙ্গে আমার বনিবে না, তা তিনি জানিতেন। অথচ আমাকে ছাড়িতেও তাঁর মনে কষ্ট হইতেছিল। এখন আমি স্বেচ্ছায় সরিয়া যাইতে রাজি হওয়ায় তাঁর বুকের উপর হইতে একটা পাথর নামিয়া গেল। তিনি নিশ্চয় মি. দত্তকে দিয়া তিন মাসের বেতন দেওয়াইয়া দিবেন। বােধ হয় পরদিনই তিনি আমাকে জানাইলেন, মি. দত্ত টাকা দিতে রাজি হইয়াছেন। কিন্তু আমার দাবি-মত নয়শ টাকা নয়। কারণ আমার বেতন আড়াইশ। ওরই তিন মাস হইবে । এলাউন্সের পঞ্চাশ টাকা নােটিসের সঙ্গে আসিবে না। বুঝিলাম এটা লইয়া দরকষাকষি করিয়া সময় নষ্ট করা উচিৎ নয়। সাড়ে সাতশ টাকা লইয়া সকল দাবি-দাওয়া ত্যাগের রশিদ লিখিয়া দিলাম। এই ভাবে আমার সাংবাদিক জীবনের তৃতীয় পর্যায় শেষ হইল।
৩৭১

অধ্যায় বিশ
চতুর্থ পর্যায়

১. ইত্তেহাদ’
আমার সাংবাদিক জীবনের চতুর্থ এবং শেষ পর্যায় শুরু হয় ১৯৪৭ সালের জানুয়ারিতে। বাংলার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জনাব শহীদ সােহরাওয়ার্দী সাহেব আমাকে সম্পাদক করিয়া একটি বাংলা দৈনিক বাহির করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। লিমিটেড কোম্পানি করিয়া আমার বিশেষ বিশ্বস্ত বন্ধু নবাব্যাদা হাসান আলী চৌধুরীকে ম্যানেজিং ডাইরেক্টর ও আমার অনুজপ্রতিম বন্ধু মি. ফারুকুল ইসলামকে সহকারী ম্যানেজিং ডাইরেক্টর করিতে শহীদ সাহেব রাজি হওয়ায় আমি সম্পাদকের দায়িত্ব নিতে সম্মত হইলাম। আমি তখন কলিকাতা আলীপুরে উকালতি করি। ব্যবসাও ভাল জমিয়াছে। কাজেই সমস্ত অবস্থা বিবেচনা করিয়া শহীদ সাহেব বেতনে-ভাতায় আমাকে মােট এক হাজার টাকা মাহিয়ানা দিলেন। বিরাট ধুমধামে ইত্তেহাদ বাহির হইল । আমার গােটা সাংবাদিক জীবনের মধ্যে এইটাই আমার সবচেয়ে সুখ, আরাম ও মর্যাদার মুদ্দত ছিল। বরাবরের মত পূর্ণ সাংবাদিক স্বাধীনতা ত এখানে ছিলই, তার উপর ছিল অর্থ-চিন্তার অভাব এবং নবাব্যাদা ও ফারুকুল ইসলামের সুষ্ঠু পরিচালনা।

২. আমার চরম সাফল্য
ইত্তেহাদ অল্পদিনেই খুব জনপ্রিয় হইয়া উঠে। ইহার প্রচারসংখ্যা অনেক। পুরাতন দৈনিকের দুই-তিন গুণ হইয়া যায়। জনপ্রিয় রাজনৈতিক মতবাদের
৩৭২
সমর্থন, সু-সম্পাদন, সুন্দর ছাপা, কাগজ, সাইয, নিয়মিত প্রকাশ ও বিতরণ ইত্যাদি যে সব কারণে দৈনিক কাগজ জনপ্রিয় হইয়া থাকে, সে সব গুণ ইত্তেহাদ-এর ছিল। তবু ঐ সব গুণেই ইত্তেহাদ-এর জনপ্রিয়তা শেষ কথা ছিল না। আমার ক্ষুদ্র বিবেচনায় ইত্তেহাদএর জনপ্রিয়তার গূঢ় তত্ত্ব অন্যত্র নিহিত ছিল। এক কথায়, সেটা সাংবাদিক চেতনা। প্রায় পঁচিশ বছর সাংবাদিকতার সহিত সংশ্লিষ্ট থাকিয়া এবং এ সম্পর্কে বিদেশি বই-পুস্তক ও সংবাদপত্র পড়িয়া সাংবাদিকের দায়িত্ব সম্পর্কে আমার সামান্য যা কিছু জ্ঞান লাভ হইয়াছিল, তার সবটুকু ইত্তেহাদএ প্রয়ােগ করিবার চেষ্টা আমি করিয়াছিলাম। পরিচালকগণ সে সুযােগও আমাকে দিয়াছিলেন। আমার ঐ অভিজ্ঞতার ফলে আমি বুঝিয়াছিলাম :
(১) সাংবাদিকতা নিছক সংবাদ সরবরাহ নয়, সংবাদের সুষ্ঠু ব্যাখ্যাও বটে।
(২) সাংবাদিকতার সাথে রাজনীতি ওতপ্রােতভাবে জড়িত। রাজনীতিতে পার্টিগত শ্রেণীগত মতভেদ অপরিহার্য। কিন্তু এই মতভেদ সত্ত্বেও সাধু সাংবাদিকতা সম্ভব।
(৩) বিরুদ্ধ পক্ষকে অভদ্র কটুক্তি না করিয়াও তার তীব্র সমালােচনা করা যাইতে পারে ভদ্রভাষায়। বস্তুত সমালােচনার ভাষা যত বেশি ভদ্র হইবে, সমালােচনা তত তীক্ষ্ণ ও ফলবতী হইবে।
(৪) প্রত্যেক মতবাদের সুষ্ঠু, উদার, বৈজ্ঞানিক ও নিরপেক্ষ আলােচনার দ্বারা নিজের মতের পক্ষে এবং বিরােধী পক্ষের বিরুদ্ধে জনমত তৈয়ার করা অধিকতর সহজসাধ্য।
(৫) মরহুম মৌলবী মুজিবর রহমান বলিতেন : সংবাদপত্রের কেবলমাত্র সম্পাদকীয় কলমটাই সম্পাদকের; বাকি সবটুকুই পাবলিকের। চিঠিপত্র কলমটা টাউন হল, সম্পাদকের বৈঠকখানা নয়। অতএব সংবাদ প্রকাশে নিরপেক্ষতা চাই। স্বয়ং সম্পাদকের নিন্দা-পূর্ণ পত্রও চিঠিপত্র কলমে ছাপিতে হইবে।
(৬) সাংবাদিকতা সাহিত্য, আর্ট, সায়েন্স, ইন্ডাস্ট্রি ও কমার্সের সমবায়। এর একটার অভাব হইলে সাংবাদিকতা ত্রুটিপূর্ণ এবং পরিণামে নিষ্ফল হইবে।
(৭) বিখ্যাত সাহিত্যিক থেচারে বলিয়াছেন : ছাপার মেশিনের মত সংবাদপত্র নিজেও একটা ইঞ্জিন। সকল যন্ত্রপাতির ঐক্য ও সংহতি অন্যান্য ইঞ্জিনের মত প্রেস ইঞ্জিনেরও অত্যাবশ্যক বটে, কিন্তু তার উপরেও প্রেস ইঞ্জিনে দরকার ইনটেলেকচুয়াল ইউনিটি।
७৭৩
এই সাতটি দফা ছিল বলিতে গেলে আমার জন্য সাংবাদিকতার ক, খ। কিন্তু আমার এইটুকু জ্ঞান লাভ করিতে-করিতে সাংবাদিকতা ঘােড়-দৌড়ে অনেক আগাইয়া গিয়াছিল। আমি পঁচিশ বছর আগে যখন সাংবাদিকতা শুরু করি, তখন সাংবাদিকতা ছিল একটা মিশন। প্রাইভেট স্কুল, হাসপাতাল চালাইবার মত একটা ব্যাপার। আর ১৯৪৭ সালে সাংবাদিকতা হইয়া উঠিয়াছিল একটি পূর্ণমাত্রার ইন্ডাস্ট্রি। এই সম্প্রসারণের ফলে সংবাদপত্র আর সম্পাদকের মন্তব্যসহ খবরের কাগজ মাত্র ছিল না। সাহিত্য শাখা, মহিলা শাখা, শিশু শাখা, সিনেমা শাখা, নগর পরিক্রমা ও খেলাধুলা ইত্যাদি বিভিন্ন ফিচার দিয়া আজকাল দৈনিক খবরের কাগজকে রীতিমত আকর্ষণীয় পঠিতব্য সাহিত্য করিয়া তােলা হইয়াছে। এই সমস্ত বিভাগ মােটামুটি অটনােমাস। সকল বিভাগের পৃথক-পৃথক সম্পাদক আছেন। কাজেই দৈনিক সংবাদপত্রের আর এখন একজন মাত্র সম্পাদক নাই, বহু-সংখ্যক সম্পাদক হইয়াছেন। ফলে কাগজের সম্পাদককে এখন আর শুধু সম্পাদক বলা চলে না। প্রধান সম্পাদক, এডিটর-ইন-চিফ অথবা চিফ এডিটার বলা হইয়া থাকে। এর ফলে আধুনিক দৈনিক খবরের কাগজের সম্পাদক কম-বেশি কনস্টিটিউশন্যাল মনার্কের মতই ফিগার-হেড মাত্র। সকর্মক দায়িত্ব তাঁর সম্পাদকীয় লেখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। দৈনিক খবরের কাগজের বিষয়-বস্তুর এই পরিব্যাপ্তি আমাদের দেশে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় হইতেই শুরু হয়। কাজেই আমি যখন ইত্তেহাদ-এর সম্পাদকতা গ্রহণ করি, তখন আমাকেও ইহাই করিতে হইয়াছিল। এই উদ্দেশ্যে আমাকে বেশ খুঁজিয়া-পাতিয়া অজ্ঞাত মুসলিম ট্যালেন্ট বাহির করিতে হইয়াছে। একটু পরেই সে কথা বলিতেছি।

৩. মুসলিম সাংবাদিকতার অসুবিধা
আমি যে যুগে সাংবাদিকতা করিয়াছি, তখন মুসলমানের পক্ষে সাংবাদিকতা করা খুব দুরূহ ব্যাপার ছিল। বিশেষত বাংলার মুসলমানের সামনে জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রের মতই সাংবাদিকতার ক্ষেত্রও অতি ক্ষুদ্র ছিল। সংবাদপত্র যতই ইন্ডাস্ট্রিতে রূপান্তরিত হইতে লাগিল, মুসলমানের পক্ষে উহা ততই কঠিন হইতে থাকিল । খুব স্বাভাবিক কারণেই মুসলমান যুবকদের হিন্দুসংবাদপত্রে কাজ পাওয়া একরূপ অসম্ভব ছিল। নিজস্ব দৈনিক কাগজ বাহির করার মত টাকাও মুসলমানের ছিল না। প্রধানত অর্থাভাবেই বহুকাল বহু মুসলিম নেতাদের এদিককার চেষ্টা ব্যর্থ হইয়া গিয়াছে। আমার আমলেই
৩৭৪
মওলানা মাে. আকরম খাঁ সাহেবের দৈনিক সেবক ও দৈনিক মােহাম্মদী ও মওলানা ইসলামাবাদী সাহেবের দৈনিক ছােলতান, স্যার এ কে গযনবীর দৈনিক তরষ্কী, মৌ. এ কে ফজলুল হক সাহেবের দুই পর্যায়ের নবযুগ, অধ্যাপক হুমায়ুন কবিরের দৈনিক কৃষক প্রভৃতি বাংলা দৈনিক, স্যার আবদুর রহিমের মুসলিম স্ট্যান্ডার্ড, মৌ. মুজিবর রহমান সাহেবের দৈনিক দি মুসলমান ও কমরেড প্রভৃতি ইংরাজি দৈনিক বাহির হইয়া বন্ধ হইয়াছে। এর ফলে একদিকে যেমন মুসলিম বাংলায় দৈনিক সংবাদপত্রের অভাব ছিল, ঠিক তেমনি সাংবাদিকেরও অভাব ছিল। আগেই বলিয়াছি, হিন্দু সংবাদপত্রে মুসলিম শিক্ষার্থীদের চান্স ছিল না। এটা আমি এত তীব্রভাবে অনুভব করিতাম যে যখনই সম্ভব ও সাধ্য হইয়াছে, তখনই ইহার প্রতিকার করিবার চেষ্টা করিয়াছি। বাছিয়া-বাছিয়া মুসলমান নিয়াছি। অধিকতর যােগ্য হিন্দু বাদ দিয়া অপেক্ষাকৃত অযােগ্য মুসলমানকে চাকুরি দিয়াছি। এতে হিন্দুর প্রতি আমার কোনও বিদ্বেষ ছিল না। শুধুমাত্র মুসলমান যুবকদের সাংবাদিকতায় উদ্বুদ্ধ করিবার জন্যই এ কাজ করিয়াছি। মুসলমানের প্রতি আমার এই পক্ষপাতিত্বের মধ্যে যে কোনও হিন্দু-বিদ্বেষ ছিল না, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ এই যে ইত্তেহাদ-এর সম্পাদকতা লিখার পূর্ব পর্যন্ত আমি ঘােরতর জাতীয়তাবাদী কংগ্রেসী ছিলাম। বাংলার হিন্দু ও মুসলিম মিলিয়া এক রাষ্ট্রীয় জাতি, এই মতে দৃঢ় বিশ্বাসী ছিলাম। তা ছাড়া আমার সম্পাদিত কৃষক ও নবযুগউভয়টাই ছিল বিঘােষিত নীতি ও মতবাদের দিক দিয়াও অসাম্প্ৰয়িক দৈনিক কাগজ। তবু ঐ দুটি কাগজের সম্পাদকীয় বিভাগে লােক নিয়ােগ করিবার সময় আমি মুসলমান প্রার্থীকে প্রাধান্য দিয়াছি। ইহাতে আমার অনেক হিন্দু সাংবাদিক বন্ধু ও হিতৈষী আমার এই কাজে অসন্তোষ প্রকাশ করিয়াছেন। আমি সরলভাবে তাদের কাছে আমার উদ্দেশ্য বর্ণনা করিয়াছি। অনেক দূরদর্শী হিন্দু বন্ধু আমার কথা বুঝিয়াছেন। এইভাবে আমি যখনই ক্ষমতা ও সুযােগ পাইয়াছি, তখনই মুসলিম যুবদিগকে সাংবাদিকতায় উদ্বুদ্ধ করিবার চেষ্টা করিয়াছি, পরকেও এই কাজের উপদেশ একরূপ গায় পড়িয়াই দিয়াছি। দৃষ্টান্তস্বরূপ দৈনিক আজাদ-এর কথাই বলিতেছি। আজাদ-এর পরিচালকগণ তার সৃষ্টি হইতে ঢাকায় আসার পূর্ব-পর্যন্ত বার বছরকাল আজাদ-এর কপালে ছাপাইতেন ‘মুসলিমবঙ্গ ও আসামের একমাত্র দৈনিক’ । এটা সুরুচির পরিচায়ক ছিল না। সে জন্য আমার মত অনেক সাংবাদিকও এতে অসন্তোষ প্রকাশ করিতেন। কিন্তু তলাইয়া বিচার করিলে বুঝা যাইবে, আজাদ-এর এই দাবি অংশত সত্য। কারণ তৎকালের সমস্ত বাংলা দৈনিকের
७৭৫
মধ্যে একমাত্র আজাদই আর্থিক দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। মুসলমান পরিচালিত অন্যান্য দৈনিক টিকিয়া থাকিবে কিনা সে বিষয়ে তৎকালে স্বয়ং সাংবাদিকদেরই সন্দেহ ছিল। আজাদসম্বন্ধে সে সন্দেহ ছিল না। এই হিসাবে আজাদকে তকালের মুসলিম বাংলা ও আসামের একমাত্র ‘দৈনিক’ বলা যাইতে পারে। এই ধারণা হইতেই শুধুমাত্র চাকুরির সিকিউরিটির দিক বিবেচনা করিয়া মুসলিম সাংবাদিকরা সাধারণত অন্যান্য দৈনিকের চাকুরির চেয়ে আজাদ-এর চাকরি বেশি আকর্ষণীয় মনে করিতেন। ঠিক এই কারণেই মুসলমান সাংবাদিকদের উপর আজাদপরিচালকের দায়িত্ব ছিল বেশি। আমি কৃষক ও নবযুগ-এ এবং পরে ইত্তেহাদএ শুধুমাত্র মুসলিম সাংবাদিক নিয়ােগ করিবার সময় আজাদ কর্তৃপক্ষকেও এই অনুরােধ করিতাম। কিন্তু আজাদ এর পরিচালকরা আমার উপদেশে কর্ণপাত করিতেন না। তাঁরা স্পষ্টই বলিতেন, তাঁদের নীতি অল্প বেতনে যােগ্য লােক নিয়ােগ করা। হিন্দু শিক্ষিত বেকারের সুতরাং যােগ্য সাংবাদিকের সংখ্যা ছিল মুসলমানের চেয়ে অনেক অনেক বেশি। ফলে স্বভাবতই অল্প বেতনে অনেক বেশি যােগ্য হিন্দু সাংবাদিক পাওয়া যাইত। আজাদ কর্তৃপক্ষ তাই করিতেন। ফলে তক্কালে আজাদ-এর স্টাফের শতকরা আশিজন ছিলেন হিন্দু। এটা আমাকে খুব পীড়া দিত। সরকারি চাকুরিতে মুসলিম অংশ দাবির উত্তরে যােগ্যতার যে জবাব হিন্দুরা দিতেন, আজাদ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি সেদিকে আকর্ষণ করিলে তারা খােলাখুলিই বলিতেন, সরকারের মত আর্থিক বুনিয়াদ যেদিন আজাদ-এর হইবে, সেইদিনই তারা মুসলমানের কথা ভাবিবেন। বর্তমান অবস্থায় আজাদ টিকাইয়া রাখাই তাদের দায়িত্ব; মুসলমানদের সাংবাদিকতা শিখানাের পাঠশালা খােলা তাঁদের দায়িত্ব নয়।

৪. সমাজ-প্রাণতা বনাম বাস্তববাদিতা
কথাটা হয়ত ঠিক। এটাই ছিল বাস্তববাদী বুদ্ধিমান বিষয়ী লােকের কাজ। কিন্তু আমার মন তৎকালে উহা গ্রহণ করে নাই। উহাদিগকে আমি তখন অপরিণামদর্শী সমাজ-প্রাণহীন স্বার্থপর লােক মনে করিতাম । এই স্বার্থপরতা জনসাধারণের মধ্যে দেখিলে তা সহ্য করা যায়। কিন্তু মুসলিম স্বার্থের কথায় যাদের মুখে খই ফুটে, তাঁদের মধ্যে এই বিষয়-বুদ্ধি’ এমন বেমানান যে আমি এতে শুধু অসন্তুষ্ট হইতাম না; দস্তুরমত চটিয়া যাইতাম। স্বদেশি আন্দোলনের সময় যখন বাংলার অনেক যুবক দেশের জন্য প্রাণ দিতেছিল;
৩৭৬
নেতারা বিলাতী কাপড়ের বদলে দেশি কাপড় পরিবার আবেদনে গলা ফাটাইতে ছিলেন, অসহযােগ আন্দোলনের সময় নেতারাই যখন বিলাতী লবণ বয়কট করিয়া দেশি লবণ, করকচ লবণ খাইবার আবেদন। করিতেছিলেন; তখনও দেশের জনসাধারণকে সস্তায় মিহিন পাড়ের পাকা রং-এর যুক্তিতে বিলাতী কাপড়, এবং স্বাদ ও চেহারার যুক্তিতে বিলাতী লবণ কিনিতে দেখিয়াছি। অজ্ঞ জনসাধারণ বুঝে না বলিয়া তাদেরে ক্ষমাও করিয়াছি। কিন্তু কলিকাতার মুসলিম লীগের নেতাদিগকে যখন ওয়াছেন মােল্লা, এল মল্লিকের দোকানের বদলে ইস্টবেঙ্গল সােসাইটি হইতে এবং আমার নিজের জিলার লীগ নেতাদিগকে যখন ‘মৌলবীর দোকানে’র বদলে বঙ্গলক্ষ্মী বস্ত্রালয়’ হইতে সওদা কিনিতে দেখিতাম সস্তার যুক্তিতে, তখন আমার মেজাজ ঠিক থাকিত না। আমি যখন ঘােরতর কংগ্রেসী ছিলাম এবং খদ্দর ছাড়া কিছু পরিতাম না। তখনও খদ্দর কিনিতে বাজারে গিয়া প্রথমে পরিচিত মুসলিম দোকানে খদ্দর তালাশ করিতাম; না পাইলে খদ্দরের স্টক রাখিবার উপদেশ দিয়া আসিতাম এবং দু-চার দিন অপেক্ষা করিতাম। আমার বেশ মনে পড়ে তকালে কংগ্রেস-বিরােধী হিন্দু-বিদ্বেষী বহু মুসলিম বন্ধু আমাকে হিন্দুর গােলাম বলিয়া গাল দিতে দিতে সস্তা ও ভেরাইটির অজুহাতে হিন্দু দোকানে ঢুকিয়া পড়িতেন।
এঁদেরেও হয়ত ক্ষমা করা যায়। কিন্তু মাঝে-মাঝে নয় প্রতিদিন যারা মুসলিম সমাজকে আত্মস্থ ও আত্মনির্ভরশীল হইতে উপদেশ দিতেছেন; অন্য সমাজের প্রভাব ও শােষণ-মুক্ত হইবার জন্য কর্মপন্থাও নির্দেশ করিতেছেন, তারাও সস্তার যুক্তিতে মুসলমানের বদলে হিন্দু সাংবাদিকদিগকে চাকুরি দিবেন, এটা আমার বিবেচনায় ক্ষমার অযােগ্য অপরাধ ছিল।

৫. ইত্তেহাদ’-এর প্রয়াস
কাজেই যখন ইত্তেহাদএর স্টাফ নিয়ােগের ক্ষমতা আমার হাতে আসিল, তখন ইহাকে আমি মুসলিম সাংবাদিক গােষ্ঠী গড়িয়া তুলিবার অপূর্ব সুযােগ মনে করিলাম। সে সুযােগের সাধ্যমত সদ্ব্যবহার করিলাম। সাংবাদিকতা-শিক্ষার্থী উচ্চ-শিক্ষিত যুবকরা দলে-দলে আসিয়া ভিড় করিল। কতকালের বুভুক্ষা লইয়া যেন তারা অপেক্ষা করিতেছিল। মুসলিম শিক্ষিত যুবকরা সাংবাদিকতা লাইনে আসিতে চায় না বলিয়া কোনও-কোনও কাগজের কর্তারা যে অভিযােগ করিতেছিলেন, মুসলিম যুবকদের বিরুদ্ধে ঐ অভিযােগ যে মিথ্যা এলাম এটা
৩৭৭
স্পষ্ট প্রমাণিত হইয়া গেল। আমি শুধু সম্পাদকীয় বিভাগে যে পঁচিশছাব্বিশজন লােক নিয়ােগ করিলাম তার মধ্যে কুড়িজনই ছিলেন গ্র্যাজুয়েট, তাঁদের দশ-বারজন ছিলেন এমএ। সরকারি চাকুরির প্রতি মুসলমান যুবকদের টান বেশি, এই অভিযােগের উত্তরে বলিতে চাই যে, উপযুক্ত পঁচিশ-ছাব্বিশজনের মধ্যে চৌদ্দ-পনেরজনই ছিলেন সরকারি কর্মচারী। তারা সাংবাদিকতায় হাত পাকান সাপেক্ষে সরকারি চাকুরি করিয়া যাইতেছিলেন মাত্র। আমি ইত্তেহাদ-এ তাঁদের চাকুরি কনফার্ম করামাত্র অধিকাংশই সরকারি চাকুরিতে ইস্তাফা দিতে প্রস্তুত হইয়াই আসিয়াছিলেন। এই ব্যাপারে তাঁরা এতই দৃঢ় ছিলেন যে, মুসলমান সরকারি কর্মচারীরা ইত্তেহাদ-এর সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ করিতেছেন বলিয়া কলিকাতার বিভিন্ন সংবাদপত্রে যখন আন্দোলন শুরু হয় এবং দৈনিক বসুমতী যখন তাঁদের নাম-ঠিকানা পর্যন্ত প্রকাশ করিয়া দেন, তখনও উহাদের অধিকাংশেই অবিচলিত থাকেন।
শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার সুযােগ অন্যান্য শিল্প-মালিকদের মত সংবাদপত্রের কর্তারাও ষােল আনা গ্রহণ করিতেন। কাজেই সংবাদপত্রের স্টাফের বেতন ছিল অত্যন্ত কম। বেতনের অল্পতার জন্যই শিক্ষিত যুবকরা সহজে সাংবাদিকতার দিকে আকৃষ্ট হইত না। হিন্দু যুবকরা যে মুসলমান যুবকদের চেয়ে বেশি সংখ্যায় ঐ অল্প বেতনে চাকুরি করিতেছে, তা তারা ঐ অল্প বেতনে সন্তুষ্ট বলিয়া নয়, শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা হিন্দু সমাজে বেশি বলিয়া। কাজেই আমি ইত্তেহাদ-এর স্টাফের এমন বেতনের সুপারিশ করিলাম, যা তাদের প্রয়ােজনের মিনিমাম। এটা করিতে গিয়াও আমি প্রুফরিডারদের জন্য সর্বনিম্ন একশ এবং সাব-এডিটরদের জন্য সর্বনিম্ন সােওয়াশ বেতন ধার্য করিলাম। ম্যানেজারিয়াল ও কেরানির সর্বনিম্ন বেতন হইল প্রুফরিডারদের সমান। এই সমতা অনেক পুরাতন দৈনিক কাগজেই ছিল। অনেকেই পঞ্চাশ-ষাট টাকার প্রুফরিডারি ও সাব-এডিটারি করিতেছিলেন। অথবা যুদ্ধের পরিণামে মাংগা-বাজারের ফলে আফিসআদালতের পিয়ন-চাপরাশিরা পর্যন্ত এই সময় আশি টাকার বেশি পাইতেছিল।

৬. ইত্তেহাদ’-এর জনপ্রিয়তার কারণ
অবস্থা-মাফিক সংগত পরিমাণ বেতন ধার্য হওয়ায় ইত্তেহাদ আফিসে গােড়া হইতেই প্রতিভাবান মুসলিম তরুণদের সমাবেশ হইল। এঁদের অতি অল্প
৩৭৮
সংখ্যকই অভিজ্ঞ ছিলেন, বাকি সকলে স্বভাবতই নূতন ছিলেন। ইঁহাদের ট্রেনিং দেওয়ার উদ্দেশ্যে জার্নালিযম সম্পর্কে আমি এক আলমারি বই কিনাইয়া ফেলিলাম। তার মধ্যে পিটম্যানের প্রকাশিত ম্যানস ফিল্ডের কমপ্লিট জার্নালিযম এন্ড সাব এডিটিং; চার্লস রিগবির দি স্টাফ জার্নালিস্ট; মি. এস. কারের মডার্ন জার্নালিম; টি. এ. বিডের রিপাের্টার্স গাইড, উই লিকাম স্টিডের দি প্রেস ইত্যাদি পুস্তক বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। আমি স্টাফের সহকর্মীদের ঐ সব বই-পুস্তক পড়িতে উৎসাহ দিতাম। ঠিকমত পড়িলেন কি না, তা পরখ করিতাম। ফলে দুই-তিন মাসের মধ্যে ইত্তেহাদ এর স্টাফের অধিকাংশ কর্মী শুধু হাতে-কলমে নয়, পুঁথিগত বিদ্যাতেও মােটামুটি ভাল সাংবাদিক হইয়া উঠিলেন। ফলে হেডলাইন, ডিসপ্লে, মেকআপ, গেট-আপ, টাইপ বিতরণ, প্রুফ রিডিংয়ে অল্পদিনেই ইত্তেহাদ কলিকাতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও সুন্দর বাংলা দৈনিকে পরিণত হইল। মি. ওয়ালীউল্লাহ, মি. মােহাম্মদ মােদাব্বের, মি. জনার আলী, মি. খােন্দকার ইলিয়াস, মি. কে. জি. মুস্তফা, মি. সিরাজুদ্দীন হােসেন, মি. রশীদ করীম প্রভৃতি বিখ্যাত সাংবাদিকরা সকলেই ইত্তেহাদ-এর বার্তা বিভাগের বিভিন্ন শাখার দায়িত্ব বহন করিয়াছেন। প্রথমে মিস হাযেরা খাতুন (পরবর্তীকালে মিসেস হাযেরা মাহমুদ) ও পরে মিস মরিয়ম খানম (পরে মিসেস হাশিমুদ্দীন) নামী দুইজন প্রতিভাবতী মহিলা গ্র্যাজুয়েট মহিলা শাখা সম্পাদন করায় মুসলিম মহিলাদের মধ্যে নবজীবনের সঞ্চার হইল। কবি আহসান হাবীব সাহিত্য শাখা, রুকনুযযামান খান ও মি. মােহাম্মদ নাসির আলী শিশুশাখা পরিচালনা করায় ঐ সব বিভাগ দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করিল। মি. কাজী মােহাম্মদ ইদ্রিস, মি. তালেবুর রহমান, মি. খােন্দকার আবদুল হামিদ, মি. যহুরুল হক, মি. কবি গােলাম কুদ্স, মি. এ এম শাহাবুদ্দীন প্রভৃতি প্রতিভাবান লেখকগণের প্রথম তিনজন আগাগােড়া এবং শেষ তিনজন সাময়িকভাবে এ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর বা লিডার রাইটার ছিলেন। এতগুলি প্রতিভাশালী লেখকের লেখা হইলেও ইত্তেহাদ-এর সম্পাদকীয় প্রবন্ধগুলির মধ্যে সুরে-মতবাদে এমনকি ভাষায় একটা ঐক্য ছিল। তার কারণ এই যে আমি সকল এ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটরদেরে লইয়া সকালে আমার বাসায় কম-সেকম দুই ঘণ্টা বৈঠক করিতাম। চিফ এডিটরের বাড়িতে প্রতিদিন যাতায়াত করাটা যাতে এ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটরদের পক্ষে আর্থিক ক্ষতিকর না হয় সেই উদ্দেশ্যে আমি সকলের সম্মতিক্রমে আমার বাসায় উহাদের সকলের ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থা করিয়াছিলাম। এই ব্যবস্থা আমার উপরও দুর্বহ আর্থিক
৩৭৯
বােঝা ছিল না ‘সম্পাদকের টেবিল খরচা’ বাবত আমাকে মাসে যে একশ টাকা এলাউন্স দেওয়া হইত, সে টাকা হইতে কিছু টাকা বাঁচাইয়া এই দিককার খরচা পােষাইয়া লইতে অথবা পাতলা করিতে পারিতাম। এই বৈঠকের উপকারিতা অল্পদিনেই সকলের কাছে সুস্পষ্ট হইয়া উঠিল এবং কিছুদিনের মধ্যেই কলিকাতায় বড়-বড় দৈনিকের অনেকেই তাদের সম্পাদকীয় বিভাগে এই ব্যবস্থার প্রবর্তন করিলেন। এই বৈঠকে চাসিগারেট খাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে ঐদিনকার সম্পাদকীয় লেখার বিষয়বস্তু লইয়া আলােচনা চলিত। ইত্তেহাদ-এ নিয়মিতভাবে দুইটা সম্পাদকীয় ও চারপাঁচটা মন্তব্য থাকিত। সম্পাদকীয় মন্তব্যগুলির হেডিং ছিল ‘একনজর। এগুলি আমি নিজে লিখিতাম। সম্পাদকীয়গুলি সকলে ভাগ করিয়া নিতাম। সপ্তাহের সাত দিনে চৌদ্দটা সম্পাদকীয় যাইত। চৌদ্দটা সম্পাদকীয় পাঁচজনের মধ্যে ভাগ করিলে গড়ে প্রতি সপ্তাহে এক-একজনের তিনটা করিয়া প্রবন্ধ লিখিতে হইত। এটা ছিল সাধারণ নিয়ম। বিষয়-বস্তু-ভেদে এ ব্যবস্থার ব্যতিক্রম হইত। বিষয়-বস্তুর বৈশিষ্ট্য না থাকিলে ব্যক্তিগত সুবিধার খাতিরে একজনেরটা অপরজনও গছিয়া নিতে পারিতেন। কিন্তু সেটা ছিল নিতান্তই ব্যতিক্রম। সাধারণত প্রাতঃকালীন বৈঠকে বিষয়-বস্তু ও তাদের বিভিন্ন পয়েন্টসমূহ ঠিক হইয়া যাইত। যার উপর লেখার ভার পড়িত, তিনি সে সব পয়েন্টস নােট করিয়া নিতেন। তারপর তাদের সুবিধামত হয় বাসায় অথবা আফিসে বসিয়া সম্পাদকীয় লিখিয়া আমার টেবিলে রাখিয়া দিতেন। আমি নিজে বাসায় বসিয়া ‘একনজর’ ও আমার ভাগে সম্পাদকীয় লেখার ভার পড়িয়া থাকিলে তা লেখা শেষ করিয়া সন্ধ্যার দিকে অথবা সান্ধ্য-ভ্রমণ শেষ করিয়া আটটার দিকে আফিসে যাইতাম। যার উপর যেদিন লেখার দায়িত্ব পড়িত না, সেদিন তিনি আফিসে যাইতে বাধ্য ছিলেন না। আর যাদের উপর লেখার ভার পড়িত, তারাও তাদের লেখা আমার টেবিলে। রাখিয়া আফিস ত্যাগ করিতে পারিতেন। কিন্তু সাধারণত তারা আফিস ত্যাগ করিতেন না। আমি তাঁদের লেখা ‘পাশ করিয়া না দেওয়া পর্যন্ত তারা আফিসে থাকিতেন। আমি তাঁদের লেখা ‘পাশ করিয়া প্রেসে দিবার জন্য তাঁদেরই টেবিলে ফেরত পাঠাইতাম। এতে তাঁরা তাঁদের ভুল-ত্রুটি বা আমার সাথে তাদের মতভেদ ধরিতে পারিতেন। আমার ঐসব সহকর্মী এতে অতি অল্পদিনেই এমন পাকা হইয়া গেলেন যে, অতঃপর সকাল বেলার আলােচনাই যথেষ্ট হইত। তাদের লেখায় আমার কলম ধরিবার কোনও প্রয়ােজনই হইত না। এঁদের অনেকে আমার মতবাদ প্রকাশ-ভঙ্গির ভাষা ও
৩৮০
যুক্তি-তর্কের ধারা এমন রফত করিয়া ফেলিলেন যে, উচ্চ-শিক্ষিত সাহিত্যিক ও বৃদ্ধা পাঠকদেরও অনেকে তাঁদের লেখাকে আমার লেখা বলিয়া ভুল করিতেন। আমার হাজার প্রতিবাদেও তারা মত বদলাইতেন না। মনে করিতেন ও বলিতেন, আমার সহকর্মীদের ইজজত বাড়াইবার জন্যই আমি ঐ ভদ্রতা করিতেছি।

৭. ‘পাঠকের মজলিস
সাধারণভাবে সংবাদপত্র ও তাদের পাঠকদের মধ্যে এবং বিশেষভাবে ইত্তেহাদ-এর লেখক-গােষ্ঠী ও পাঠকদের মধ্যে একটা চিন্তাগত আত্মীয়তা প্রবর্তনের উদ্দেশ্যে আমি ইত্তেহাদ-এ ‘পাঠকের মজলিস’ নামে একটা ফিচার খুলি। এই ধরনের ফিচার সংবাদপত্র-জগতে এটাই প্রথম। এটা প্রচলিত সম্পাদকের নামে চিঠিপত্র কলাম নয়। লেখার বিষয়-বস্তু, মর্যাদা ও বলার ভঙ্গি সকল দিক দিয়াই চিঠিপত্রের ও মজলিসের মধ্যে পার্থক্য ছিল। এই পার্থক্য সম্বন্ধে পাঠকগণকে সচেতন করিবার জন্য ইত্তেহাদএর চিঠিপত্র কলামও যথারীতি যথাস্থানে বজায় রাখা হইয়াছিল। পাঠকের মজলিস’ ছিল পাঠকদের ডিবেটিং ক্লাব। এতে পাঠকরা সম্পাদকের দায়িত্ব ও অধিকার লইয়া কথা বলিতে পারিতেন। এতে বুদ্ধিমান পাঠকরা অল্পদিনেই এমন অভ্যস্ত হইয়া গিয়াছিলেন যে, বড়-বড় জটিল, গুরুতর, তর্কিত ও এখতেলাফী বিষয়েও সংক্ষেপে সুন্দর আলােচনা করিতেন। এইসব আলােচনার অনেকগুলি এত সুন্দর ও মূল্যবান হইত যে, আমাদের সম্পাদকীয়ের চেয়েও ভাল হইয়া যাইত। মরহুম মৌলবী মুজিবর রহমান। সম্পাদকীয় কলম ছাড়া খবরের কাগজের বাকি সবটুকু অংশকে টাউন হল মনে করিবার যে উপদেশ দিতেন, সেই উপদেশ কার্যে পরিণত করিবার উদ্দেশ্যেই আমি ‘পাঠকের মজলিস’ খুলিয়াছিলাম। এই মজলিসে স্বাধীন মত প্রকাশ করিবার সম্পূর্ণ নিরঙ্কুশ ক্ষমতা পাঠকদের ছিল। পাঠকরা ওতে স্বয়ং সম্পাদকের লেখার ও মতের সমালােচনা ও প্রতিবাদ করিতে পারিতেন। এতে একদিকে যেমন পাঠকদের মধ্যে লেখক ও সম্পাদক হওয়ার সুপ্ত প্রেরণা জাগ্রত হইত, অপর দিকে তেমনি সকল মত ও দলের নিকট ইত্তেহাদ-এর নিরপেক্ষতা সুস্পষ্ট হইয়া উঠিত। ফলে পাঠকরা ইত্তেহাদকে শুধু নিরপেক্ষ সুবিচারী কাগজই মনে করিতেন না, ইহাকে তাঁদের নিজের কাগজ মনে করিতেন। এইভাবে এক বছর পুরা হইবার বহু আগেই ইত্তেহাদ
৩৮১
আফিস বাংলার মুসলিম তরুণ চিন্তানায়কদের পীঠস্থানে এবং ইত্তেহাদ মুসলিম-বাংলার প্রগতিবাদীদের মুখপত্রে পরিণত হইল।

৮. পশ্চিমবঙ্গ-সরকারের উদারতা
ইতিমধ্যে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ভারত বাটোয়ারা হইয়া পাকিস্তানের জন্ম হইল। বাংলা ভাগ হইল। কলিকাতা পশ্চিম বাংলার ভাগে পড়িল। ঢাকা পূর্ব বাংলার রাজধানী হইল। ফলে স্বভাবতই মুসলিম-বাংলার সরকারিবেসরকারি শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মেজরিটি আস্তে-আস্তে কলিকাতা ছাড়িয়া ঢাকায় আসিতে লাগিলেন। এমতাবস্থায় কলিকাতাস্থ পাকিস্তান-সমর্থক সমস্ত সংবাদপত্রের কলিকাতা ছাড়িয়া ঢাকায় চলিয়া আসা খুবই স্বাভাবিক ও বাঞ্ছনীয় ছিল। কিন্তু বাস্তব অসুবিধাহেতু কোনাে কাগজই আমরা কলিকাতা ত্যাগ করিলাম না। ভারতের বুকে বসিয়া পাকিস্তানের সংবাদপত্র চালাইয়া যাইতে লাগিলাম। পশ্চিম বাংলা ও ভারত সরকারের অসাধারণ কৃতিত্ব ও মহত্ত্ব এই যে, তারা সমস্ত মুসলিম সংবাদপত্রকে অবাধে বিনা-অসুবিধায় চলিতে দিলেন। পশ্চিম বাংলা সরকার ও ভারত সরকারের এই উদারতা, মহত্ত্ব ও সহনশীলতার কথা মুসলিম বাংলার সাংবাদিকরা চিরকাল কৃতজ্ঞতার সহিত স্মরণ রাখিবেন। এটা অতি স্পষ্ট কথা যে, দেশ ভাগ হওয়ার বহু আগে হইতেই মুসলিম সংবাদপত্রসমূহের লেখা হিন্দুদের বিরক্তি ক্রোধের উদ্রেক করিয়াছিল। দেশ ভাগ হওয়ার পর সম্পত্তি ও দায়-দেনার বাঁটোয়ারা লইয়া এই বিরক্তি ও ক্রোধে অধিকতর ইন্ধন ঢালা হইতেছিল। এক উত্তপ্ত পরিবেশে কলিকাতায় থাকিয়া সার্বিক কন্ট্রোলের ব্যবস্থার পশ্চিম বাংলার ভাগের নিউযপ্রিন্ট ব্যবহার করিয়া পশ্চিম বাংলা ও ভারতের স্বার্থের বিরুদ্ধে ও পাকিস্তানের পক্ষে কঠোর ভাষায় গলাবাজি করিতে দেওয়া কম উদারতা ও সহনশীলতার পরিচায়ক নয়। এসব লিখিতে গবর্নমেন্ট আমাদের কোনও বাধা-নিষেধ ত দেনই নাই; বরঞ্চ বেসরকারি স্তরের কেউ আমাদের কাজে প্রতিবন্ধকতা করিবার চেষ্টা করিলে সরকার দৃঢ়হস্তে তা দমন করিয়াছেন। একটা দৃষ্টান্ত দিলেই বুঝা যাইবে। দেশ বাঁটোয়ারা ঘােষণা হওয়ার অব্যবহিত পরেই দেশের বিভিন্ন অংশে হিন্দু-মুসলমানে অমানুষিক হত্যাকাণ্ড শুরু হয়। কলিকাতায়ই হয় বেশি। পুনঃপুন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় উভয় পক্ষেই আক্রমণকারী হইলেও পাকিস্তানােত্তর কলিকাতার দাঙ্গায় স্বভাবতই হিন্দুরাই ছিল আক্রমণকারী। কাজেই মহাত্মা গান্ধী সাম্প্রদায়িক শান্তি স্থাপনের
৩৮২
উদ্দেশ্যে স্বয়ং কলিকাতা আসেন এবং জনাব শহীদ সােহরাওয়ার্দীসহ দাঙ্গাপীড়িত এলাকায় অবস্থান অনশন করিতে থাকেন। এই সময় একদিন এক উন্মত্ত হিন্দু জনতা দৈনিক আজাদ আফিস আক্রমণ করে। ফলে একদিন আজাদ বাহির হইতে পারে নাই। আমরা প্রায় পঁচিশটি দৈনিক কাগজের সম্পাদকরা অমৃতবাজার-এর চিত্তরঞ্জন এভিনিউস্থ সিটি আফিসে সভা করিয়া এই গুণ্ডামির প্রতিবাদ করি; সরকারের নিকট প্রতিকার দাবি করি; জনসাধারণের সদিচ্ছার আবেদন জানাইয়া সংবাদপত্রে বিবৃতি দেই। এই সভায় পঁচিশজন সম্পাদকের মধ্যে আমরা মাত্র তিনজন ছিলাম মুসলমান। একমাত্র স্টেটসম্যান-এর সম্পাদক মি. আয়ান স্টিফেন ছাড়া আর সবাই ছিলেন হিন্দু। এ সম্পর্কে জনসাধারণের নিকট আবেদন করিয়া যে বিবৃতি দেওয়া হইয়াছিল, তাতে মুসলমান ছিলাম আমি একা। শ্রীযুক্ত তুষার কান্তি ঘােষ, শ্রীযুক্ত সত্যেন্দ্র নাথ মজুমদার, শ্রীযুক্ত চপলাকান্ত ভট্টাচার্য, মি. সােমনাথ লাহিড়ী ও মি. স্টিফেন প্রভৃতি সবাই ছিলেন অমুসলমান। পশ্চিম বাংলা সরকার এমন ক্ষিপ্রতার ও দৃঢ়তার সঙ্গে কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বন করিলেন যে, পরদিনই বিনা-বাধায় আজাদ প্রকাশিত হইল।
পশ্চিম বাংলার প্রধানমন্ত্রী ডা. প্রফুল্ল চন্দ্র ঘােষ স্বাধীনতা লাভের চারপাঁচ মাসের মধ্যেই ১৯৪৮ সালের ১৫ জানুয়ারি পদত্যাগ করায় আমরা মুসলমানরা বিশেষত মুসলিম সাংবাদিকরা বেশ সন্ত্রস্ত হইয়া পড়িয়াছিলাম। কিন্তু ডা. বিধান চন্দ্র রায় অতঃপর ২০ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রিত্ব গ্রহণ করেন। ডা. রায়, ডা. ঘােষের উদার নীতি অনুসরণ করিয়া চলিলেন। মুসলমানদের মধ্যে সাহস সৃষ্টির জন্য তিনি আমার এবং কলিকাতা ও হাওড়া শহরের অন্যান্য অনেক মুসলিম নেতার সক্রিয় সহযােগিতা চাহিলেন। আমি নিজে মুসলিম-প্রধান এলাকাসমূহে সভা করিলাম। মন্ত্রিসভার উদার নীতির অনুসরণ করিয়া হিন্দু রাষ্ট্র-নেতা, সাহিত্যিক ও সাংবাদিকরাও আমাদের সাথে বন্ধুত্বসূচক উদার ব্যবহার ও আমাদের যথাযােগ্য মর্যাদা দিতে লাগিলেন। পাক-ভারতের সম্পর্ক সম্বন্ধে মূলনীতি নির্ধারণের আলােচনা সভাতেও সম্পাদক হিসাবে এবং সাংবাদিক ও সাহিত্যিক হিসাবে সাংবাদিক ও সাহিত্যিকদিগকে নিমন্ত্রণ করিতে থাকিলেন। এই সমস্ত ঘটনার দুইটির উল্লেখ করা দরকার মনে করি। পশ্চিম বাংলা সরকার নিয়ােজিত পরিভাষা কমিটির রিপাের্ট আলােচনায় আমাকে নিমন্ত্রণ করা হইয়াছিল এবং আমার মতামত রিপাের্টের বিরােধীও হইয়াছিল। সে কথা অন্যত্র উল্লেখ করিয়াছি। অপর ঘটনাটি এই : মহাত্মাজীর হত্যার পর পশ্চিম বাংলা সরকারের প্রচার
৩৮৩
দফতরের উদ্যোগে মন্ত্রী প্রফুল্ল চন্দ্র সেনের সম্পাদনায় মহাত্মাজী সম্পর্কে একটি পুস্তক প্রকাশিত হয়। এতে বাংলার বিখ্যাত চৌদ্দ-পনেরজন সাহিত্যিক-সাংবাদিকের লেখা ছাপা হয়। আমারও একটি লেখা তাতে ছিল । আমার চিন্তায়ও মহাত্মাজীর প্রভাব ছিল অসাধারণ। কাজেই তার প্রতি আমার ভক্তি-শ্রদ্ধা একটু বিশেষ ধরনের। এমন মহাত্মার হত্যায় আমি একরূপ ক্ষিপ্ত হইয়া গিয়াছিলাম। এমন সময় পশ্চিম বাংলার সরকার মহাত্মাজীর হত্যা সম্পর্কে লেখা চাওয়ায় আমি সাগ্রহে লেখা দিলাম। লেখাটা ইত্তেহাদ-এর সম্পাদকীয়ের চেয়ে অনেক কড়া হইল। এ প্রবন্ধে কঠোর ভাষায় আমি যা লিখিয়াছিলাম, তার সারমর্ম এই : রােগের গুরুত্ব দিয়া চিকিৎসকের কৃতিত্ব বুঝা যায়। চিকিৎসকের শ্রেষ্ঠত্ব দিয়াও তেমনি রােগের কঠিনতা বুঝা যায়। ছােট রােগে কেউ বড় ডাক্তার ডাকে না। ভারতীয় হিন্দুরা যে চরম দুশ্চিকিৎস্য ব্যাধিগ্রস্ত জাতি, তা প্রমাণিত হইল মহাত্মাজীর হত্যায় । যে গান্ধী আফ্রিকার গভীর অরণ্যে খালি পায়ে, খালি গায়ে ঘুরিলেও তাঁকে সাপে-বাঘে মারিত না, তেমন মহাপুরুষকে হত্যা করিবার মত আততায়ী পাওয়া গেল হিন্দু সমাজে। এতে প্রমাণিত হইল, এই জাতি বন্য পশুর চেয়েও হিংস্র ও নিকৃষ্ট। এই হিন্দু জাতিকে ব্যাধি-মুক্ত করিবার জন্য আল্লাহ যে চিকিৎসক পাঠাইয়াছেন তিনি যে সত্য-সত্যই মহাত্মা আজ তা নিঃসন্দেহ রূপে প্রমাণিত হইল। লেখাটা পাঠাইয়া চিন্তা করিতেছিলাম, ওটা ছাপা হইলেও হয়ত বইয়ের শেষ দিকে স্থান পাইবে। কিন্তু বই যখন আসিল, তখন দেখিলাম আমার লেখা প্রথম দিকেই সম্মানজনক স্থান পাইয়াছে। এই পুস্তক বাজারে প্রচারিত হওয়ার পর স্বয়ং প্রফুল্ল বাবুসহ অনেক পরিচিত-অপরিচিত হিন্দু ভদ্রলােক মুখে ও টেলিফোনে আমাকে কংগ্রেচুলেট করিয়া ছিলেন। পাকিস্তানে বসিয়া মুসলমানকে অমন গাল দিলে মহাত্মাজীর পিছনে-পিছনেই আমাকেও পরলােকগামী হইতে হইত। ভারতে তা হইল না দেখিয়া বুঝিলাম, হিন্দু সমাজ নীচ বটে কিন্তু সে নীচতা বুঝিবার মত উচ্চতাও তাদের আছে।
সরকার যতই উদার ও সহিষ্ণু হউন না কেন, হিন্দু জনসাধারণ অমন। উত্তপ্ত পরিবেশে উদার ও সহিষ্ণু থাকিতে পারে না, আজাদ-এর উক্ত ঘটনার পর হইতে আমরা সকলেই সে বিষয়ে সচেতন হইলাম। বিশেষত আমরা মুসলিম সাংবাদিকরা এটা বুঝিলাম, আমরা আসলে পশ্চিম-বাংলা সরকারের অতিথিমাত্র। কাজেই সেই আতিথেয়তার অপব্যবহার করা আমাদের উচিৎ নয়। হিন্দুস্থানের বুকে বসিয়া আমরা পাকিস্তানের পক্ষে কথা বলিয়া হিন্দু
৩৮৪
জনসাধারণকে ক্ষেপাইব, আর সেই ক্ষিপ্ত জনতার আক্রমণ হইতে আমাদিগকে রক্ষা করা হিন্দুস্থানি সরকারের ও পুলিশের পবিত্র দায়িত্ব বলিয়া দাবি করিব, এই মনােভাবকে কিছুতেই উৎসাহ দেওয়া যায় না। এমনিতেই নয়া স্বাধীন দেশের সকল সমস্যা তাদের মিটাইতে হইতেছে। দেশ ভাগ হওয়ার সাথে-সাথেই নেতাদের নিষেধ সত্ত্বেও লােকেরা লাখে-লাখে দেশত্যাগ শুরু করিয়াছে। ফলে পাকিস্তানি সরকারের ন্যায় হিন্দুস্তানি সরকারও বাস্তুত্যাগী পুনর্বাসনের বিরাট সমস্যার সম্মুখীন হইয়াছেন। এই সমস্ত সমস্যার ‘বােঝার উপর শাকের আঁটি স্বরূপ নূতন কোনও সমস্যায় হিন্দুস্তানি সরকারকে ভারাক্রান্ত করা কিছুতেই উচিৎ হইবে না।

৯. ‘ইত্তেহাদ’-এর অপমৃত্যু
কাজেই আমরা মুসলিম সংবাদপত্রেরা সকলেই কাল-বিলম্ব না করিয়া ঢাকায় আসিবার জন্য প্রস্তুতি নিতে লাগিলাম। কিন্তু পূর্ব বাংলার মন্ত্রিসভার নিকট আমরা ইত্তেহাদ ওয়ালার কোনও অভ্যর্থনা বা সহানুভূতি পাইলাম না। সহানুভূতি বা অভ্যর্থনা আমরা আশাও করি নাই। কারণ ইত্তেহাদ সােহরাওয়ার্দী-সমর্থক কাগজ হিসাবে নাজিমুদ্দিন মন্ত্রিসভায় বিরােধীদলের সংবাদপত্র ছিল। কাজেই আমরা তাদের কোন বিশেষ অনুগ্রহ চাই নাই। শুধু সরকারের মামুলি দায়িত্ব পালনই আশা করিয়াছিলাম। কিন্তু পূর্ব বাংলার মন্ত্রিসভা আমাদের জবাব দিলেন ইত্তেহাদএর পূর্ব বাংলা প্রবেশ নিষিদ্ধ করিয়া। প্রথমবারের নিষেধাজ্ঞা অবশ্য মাত্র পনের দিন স্থায়ী হইয়াছিল। কিন্তু এটাই সবেমাত্র-আত্মপ্রতিষ্ঠ ইত্তেহাদ-এর আর্থিক মেরুদণ্ডে বিশাল ঝুঁকি লাগাইয়াছিল। কারণ ইত্তেহাদ-এর বিপুল সাকুলেশনের, সুতরাং এই বাবত আয়ের, চৌদ্দ আনাই ছিল পূর্ব বাংলার । এই আঘাত সামলাইয়া উঠিতে-নাউঠিতেই আরাে দুই-দুইবার ইত্তেহাদএর উপর নিষেধাজ্ঞা জারি হইল। এই দুইবারই দীর্ঘদিনের জন্য এবং শেষবারের অনির্দিষ্টকালের জন্য ইত্তেহাদ-এর পূর্ব বাংলা প্রবেশ নিষিদ্ধ হইয়াছিল। এই মুদ্দতে ইত্তেহাদ-এর ম্যানেজিং ডাইরেক্টর নবাবযাদা সৈয়দ হাসান আলী নিজে একাধিকবার ঢাকা আসিয়া ইত্তেহাদএর জন্য বাড়ি ভাড়া করিয়া ও তাতে প্রয়ােজনীয় মেরামত করিয়া প্রচুর অর্থব্যয়ও করিয়াছিলেন। কিন্তু পূর্ব বাংলা সরকার তার কাজে পদে-পদে বাধা সৃষ্টি করিয়া বিশেষত বিজলি সংস্থাপনের অসহযােগিতা করিয়া নবাবযাদার সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ করিয়া দেন।
৩৮৫
এইভাবে ১৯৫০ সালের গােড়ার দিকে ইত্তেহাদ-এর অপমৃত্যু ঘটে।
কিন্তু এটাও সত্য যে, দেশভাগ হওয়ার পরে ভারতের ভূখণ্ড হইতে পাকিস্তানি খবরের কাগজ বাহির হওয়ার কোনও যুক্তিও ছিল না।

১০. কলামিস্ট
মাত্র ইত্তেহাদ-এর মৃত্যুর পর আমারও সাংবাদিক জীবনের অবসান ঘটে। ১৯৫০ সাল হইতে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত চব্বিশ বছর ইংরাজি-বাংলা কাগজের কলামিস্ট হইয়া থাকাতেই আমার সাংবাদিকতা সীমাবদ্ধ ছিল। এটা ঘটে অবস্থাগতিকেই! পরিবার রক্ষার জন্য উকালতি ও পাকিস্তান রক্ষার জন্য রাজনীতি ধরিতে হইল। পেশায় ব্যস্ত উকিল ও রাজনীতিতে মেম্বর-মন্ত্রী হইলাম। জেল-যুলুমও খাটিতে হইল। এত ব্যস্ততায় সাহিত্য-সাধনা বিশেষ ব্যাহত হইল না সত্য, কিন্তু সাংবাদিকতায় কলামিস্টের বেশি কিছু হওয়া গেল না।
ঢাকার সম্পাদক-সাংবাদিকদের অধিকাংশই আমার কলিকাতার সাংবাদিক-জীবনের বয়ঃকনিষ্ঠ স্নেহাস্পদ সহকর্মী। হাজার ব্যস্ততার অজুহাতেও তাদের উপরােধ এড়ান গেল না। কলামিস্ট হইতে হইল। প্রথম বার বছরে ঢাকার প্রায় সব বাংলা দৈনিক-সাময়িকীর অন্তত বিশেষ সংখ্যায় গল্প-উপন্যাস-রম্যরচনা লিখিলাম অনেক। পরবর্তী বার বছরে ইংরাজি-বাংলা উভয় ভাষার কাগজেই লিখিলাম। এই মুদ্দতে একাধিক কারণে আমি সক্রিয় রাজনীতি থনে অবসর নিলাম। ফলে দলীয় রাজনীতির উর্ধ্বে উদারতা ও নিরপেক্ষতা লইয়া রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক তর্কিত সমস্যা-ভিত্তিক নিবন্ধ লিখিতে-পারিলাম প্রচুর।
এইসব গল্প-উপন্যাস-রস রচনার প্রায় সবগুলিই প্রকাশকদের আগ্রহে জনপ্রিয় বই আকারে বাহির ত হইলই এমনকি ইংরাজি-বাংলা প্রবন্ধনিবন্ধগুলির অনেকগুলিও পুস্তকাকারে প্রকাশিত হইল। | কলামিস্ট হওয়াতেই বােধ হয় এতগুলি পুস্তকের মেটিরিয়াল স্বতই তৈয়ার হইয়া গিয়াছে। সম্পাদক-সাংবাদিক থাকিলে এটা নাও হইতে পারে।
৩৮৬

সপ্তম খণ্ড
আমার সংসার-জীবন

অধ্যায় একুশ
দাম্পত্য জীবন

১. বিবাহ
আমার বিবাহ হয় ইংরাজি ১৯২৬ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারি, মােতাবেক বাংলা। ১৩৩২ সালের ১৩ই ফাল্গুন। তখন আমার বয়স আটাইশ বছর সাত মাস। আমার স্ত্রীর জন্ম ১৯১৬ সালের ১লা জানুয়ারি, মােতাবেক বাংলা ১৩২২ সালের ১৮ই পৌষ। অতএব তাঁর বয়স দশ বৎসর দুই মাস। এত ছােট নাবালিকাকে বিবাহ করিতে আমি রাজি হইয়াছিলাম কয়েকটি কারণে। আমার অসহযােগ আন্দোলনে যােগ দেওয়ায় আমার বাপ-মা মুখে না বলিলেও মনে-মনে কষ্ট পাইয়াছিলেন, এটা আমি বুঝিয়াছিলাম দেরিতে। বাপ-মার এই অসন্তোষ দূর করিবার মতলবে শেষ পর্যন্ত বিবাহ করিতে রাজি হইয়াছিলাম। আমাদের তল্কালীন তরুণ কংগ্রেসী নেতা বিপ্লবী মধুদা’র (শ্রীযুক্ত সুরেন্দ্র মােহন ঘােষের) অনুপ্রেরণায় দেশের স্বাধীনতা উদ্ধারের জন্য চিরকুমার থাকিবার সংকল্প করিয়াছিলাম। বাপ-মাকে খুশি করিবার উদ্দেশ্যে এই সংকল্প ভাঙ্গিলাম। সুতরাং বাপ-মার খেদমত করিবার জন্যই যে বিয়া, সে বিয়ার পাত্রী ছােট হােক, বড় হােক, তাতে কী আসে যায়? দ্বিতীয়ত, আমার এক বন্ধু (মৌ, আবদুল মান্নান খা আমার চাচাত ভায়রা) যখন এই বিয়ার প্রস্তাব নিয়া আসেন তখন দেখিয়া আহ্লাদিত হইলাম যে, পাত্রী আমার এক শ্রদ্ধেয় আলেম নেতার মেয়ে। মওলানা খােন্দকার আহমদ আলী আকালুবী সাহেবকে আমি ছাত্রজীবন হইতেই শ্রদ্ধা করিতাম। তার দুধে-আলতা রঙ্গের চেহারা, বিশাল কালাে মিসমিসা চাপদাড়ি, বলিষ্ঠ গঠন, উন্নত নাসিকা শােভিত সুডৌল মুখমণ্ডল যে কোনও দর্শকের শ্রদ্ধা-ভক্তি ও প্রশংসা আকর্ষণ করিত। কাল আলপাকার
৩৮৯
শেরওয়ানি ও কালাে ইরানি টুপিতে তাঁকে খুব মানাইত। এই পােশাকেই তাঁকে প্রথম দেখিয়াছিলাম। এই চেহারাটাই আজও আমার মনে দাগ কাটিয়া আছে। তার উপর ছিলেন তিনি কবি ও বক্তা। আসলে তিনি ছিলেন ইসলাম। প্রচারক—মিশনারি। তৎকালে তাঁর সহকর্মী সমাজ-সংস্কারকদের প্রায় সকলেই কবিতার বই লিখিতেন। যশােহরের মুনশী মেহের উল্লা, সিরাজগঞ্জের মুনশী মেহেরুল্লা ও মৌ. সৈয়দ ইসমাইল হােসেন সিরাজী প্রভৃতি সকলেই কবি ছিলেন। অথচ নিছক কাব্য-সাধনা তাঁদের আদর্শ ছিল না। অধঃপতিত মুসলিম সমাজকে জাগরণে উদ্বুদ্ধ করিবার জন্যই এঁরা যেমন মুখে বক্তৃতা করিয়া বেড়াইতেন, লিখিবার বেলা তেমনি কবিতায় উপদেশ দিতেন। আমি পাঠশালার জীবন হইতেই এই শ্রেণীর যে কয়জন কবি-বক্তার ভক্ত হইয়াছিলাম তাঁদের মধ্যে মওলানা আকালুবী ছিলেন অন্যতম। আমার স্কুল জীবনে মওলানা আকালুবী সাহেবের শুভ-জাগরণ, সিরাজী সাহেবের অনল প্রবাহ, মুনশী মেহেরুল্লার বিধবা-গঞ্জনা ইত্যাদি বই সরকার কর্তৃক বাযেয়াফত হয়। এতে এঁদের প্রতি আমার বিদ্রোহী মন অধিকতর আকৃষ্ট হইয়া পড়ে। তারপর মওলানা সাহেবের সাত শ্যালক ও আমি একই হােস্টেলে থাকিয়া পড়াশােনা করিতাম। তিনি প্রায় প্রতি মাসেই এক-আধবার হােস্টেলে আসিতেন। আমি শ্রদ্ধা-ভরে দূর হইতে তাঁকে দেখিয়া গর্ববােধ করিতাম। এই মুদ্দতেই আমার চাচা মুনশী ছমিরুদ্দিনের সাথে মওলানা সাহেবের ঘনিষ্ঠতা হয়। মওকাটা ছিল এক শিক্ষা সম্মিলনী উপলক্ষে উভয়েই একই ট্রেনে ঢাকা যাওয়া। আমিও চাচাজীর সঙ্গী ছিলাম। গােটা পথটাই চাচাজী ও মওলানা সাহেব আলাপে কাটাইয়াছিলেন। বাড়ি ফিরার পর চাচাজী সময় পাইলেই মওলানা সাহেবের তারিফে পঞ্চমুখ হইতেন। তাতেই আমরা জানিতে পারি যে, মওলানা সাহেব আমাদের জমাতি লােক এবং ঐ অঞ্চলের মােহাম্মদীদের সর্দার। শুধু তা-ই নয় মওলানা সাহেবের দাদা (বাপের বাবা) মৌলবী খােন্দকার যহিরুদ্দীন সাহেব আমার দাদা গাজী আশেকুল্লা সাহেবের সঙ্গে একই সময়ে জেহাদে গিয়াছিলেন। এবং এক সঙ্গে বালাকোট ও অন্যান্য যুদ্ধক্ষেত্রে জেহাদ করিয়াছিলেন। ঐ অঞ্চলে তিনিও গাজী সাহেব বলিয়াই পরিচিত ছিলেন। তবে ত মওলানা সাহেব আমাদের আপনজন। ঐ একটি মাত্র খবরেই মওলানা সাহেবের প্রতি আমাদের পরিবারের সকলের বিশেষত আমার একটা টান জন্মিয়া গেল। চাচাজীর নিকট হইতে আমরা আরাে জানিয়াছিলাম যে, মওলানা সাহেবরা আসলে টাঙ্গাইলের লােক, জামালপুরের নহেন। টাঙ্গাইলের অন্তর্গত আকালুর খােন্দকার বংশের লােক তাঁরা। আকালুর খােন্দকার মৌলবী মােহাম্মদ আবদুল্লার পাঁচ পুত্রের
৩৯০
মধ্যে মওলানা আকালুবী সাহেব অন্যতম। মওলানা সাহেবের অন্যান্য ভাইয়েরাও আলেম ও সুবক্তা। তারপর তিনি খিলাফত ও কৃষক আন্দোলনে নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। মওলানা মােহাম্মদ আকরম খাঁ, মওলানা আবদুল্লাহিল বাকী, মওলানা ইসলামাবাদীদের সহকর্মীরূপে তিনি ইতিপূর্বেই এ জিলার আঞ্জুমানে-ওলামায়ে-বাংলার প্রচার ও সংগঠনে অনেক দূর অগ্রসর হইয়াছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত এই সময়ে তিনি দুরারােগ্য ডায়েবিটিককার্বাঙ্কল রােগে আক্রান্ত হইয়া শয্যাশায়ী হন। তাঁর সাহিত্য সেবা, রাজনীতি, ধর্ম-প্রচার সমস্তই যুগপৎভাবে বন্ধ হইয়া যায়। আমি এর পর মওলানা সাহেবের আর কোনও খোঁজখবর পাই নাই।
বন্ধু যখন বিবাহের প্রস্তাব প্রসঙ্গে উনার নামােল্লেখ করিলেন, তখন পূর্ববর্ণিত সব কথা আমার মনে পড়িয়া গেল । যা-যা মনে ছিল না বন্ধু তা-ও স্মরণ করাইয়া দিলেন। স্বভাবতই আমি তার বর্তমান হাল-হকিকত জিজ্ঞাসা করিলাম। বন্ধু বলিলেন, মওলানা সাহেবের অবস্থা খারাপ। তিনি জীবনের আশা ত্যাগ করিয়াছেন। মেয়েদের বিবাহ শেষ করিবার জন্য তিনি ব্যস্ত হইয়াছেন। তাদের বিবাহযােগ্য হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করিবার মত সময় তার নাই, এই বিশ্বাস তার হইয়া গিয়াছে। মওলানা সাহেবের প্রতি একটা সুপ্ত টান হঠাৎ পুনর্জীবিত হইয়া উঠিল। বাপ-মার সম্মতি সাপেক্ষে বন্ধুর প্রস্তাবে সম্মতি দিলাম। বন্ধু আমার সমবয়সী লােক। আলেম মানুষ। তখন দূর-সম্পর্কের আত্মীয়। বিবাহ হইলে আমার চাচাত ভায়রা ভাই হইবেন। সুতরাং তিনি তাঁর কর্তব্যে ত্রুটি করিলেন না। অতি অল্প সময়েই আমার মুরুব্বিদের রাজি করিয়া ফেলিলেন। আমি তখন খদ্দর-ভূষিত লম্বা দাড়িওয়ালা প্রায় ছয়ফুট উঁচা ঘােরতর কৃষ্ণবর্ণের জওয়ান। আর পাত্রী গােলাপের পাপড়ির মত কচি লকলকা দশ বছরের একটি শিশু। সার্থক ডাকনাম জিনত মানে বিউটি। আসল নামটি আরাে অর্থবহ আকিকুন্নেসা মানে জুয়েল।
বিয়া হইয়া গেল। শ্বশুরের দিককার আত্মীয়-স্বজন ন্যায়তই বেশি খুশি হইলেন না। কিন্তু আমার শ্বশুর পঞ্চমুখে আমার প্রশংসা করিয়া বেড়াইতে লাগিলেন। এই সময় আমি সাহিত্যিক, গাল্পিক ও প্রাবন্ধিক হিসাবে কিছুটা পরিচিত হইয়াছি এবং তৎকালে সক্রিয়ভাবে সাংবাদিকতা করিতেছি। আমার শ্বশুর আমার লেখা ছাপা হইয়াছে এমন সংখ্যার সওগাত, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা পড়িয়া শুনাইয়া-শুনাইয়া আমার অনুকূলে জনমত সৃষ্টি করিতে লাগিলেন। আমার স্ত্রীর ও আমার নিজের মধ্যে বয়স ও চেহারার এমন গরমিল ছিল যে, পরবর্তীকালে আমরা দুজন যখন কলিকাতার রাস্তায় ট্রামে ও
৩৯১
ট্রেনে একত্রে চলাফেরা করিতাম, তখন অনেকেই আমাদেরে বাপ-মেয়ে। বলিয়া ভুল করিত। আমার মেস-জীবনে আমার সিটের উপর দেওয়ালে। আমার স্ত্রীর একটি জোড়া ফটো লটকাইয়া রাখিয়াছিলাম। ছবিটিতে আমি চেয়ারে বসিয়া আছি। আমার স্ত্রী আমার ডান-কাঁধে বাঁ হাত রাখিয়া চেয়ারের পিছনে দাঁড়াইয়া আছেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন ও মিসেস দাশের একটি জোড়াফটোর অনুকরণে আমি এই ফটোটি তুলাইয়াছিলাম। কাজেই ফটোটি আমার খুব প্রিয় ছিল। ফটোতে আমি দাড়িওয়ালা শেরওয়ানি-পরা নব্য প্রৌঢ় লােক। আর আমার স্ত্রী কালডুরি-পাড়ের সাদা শাড়ি-পরা নিরাভরণা একটি কচি খুকি। গহনা-পত্র ও নকশি শাড়িটাড়ি পরিলে তবু হয়ত একটু বউ-বউ মনে হইত। গহনা-পত্রহীনা সাদা শাড়ি-পরা অবস্থায় তাকে বউ’ বলিয়া কিছুতেই মনে হয় না। আমার রুম মেটের এক নয়া মেহমান ঐ ফটো দেখিয়া মন্তব্য করেন : ‘মৌলবীর ত শখ কম না। মেয়েরে নিয়া ফটো তুলিয়াছে।’ বন্ধু জিভে কামড় দিয়া আঙুলে তার পেটে গুঁতা মারিয়া চোখ ইশারায় সাবধান করিয়া দিলে তিনি চুপ করেন। মেহমানের কোনও দোষ ছিল না। কারণ যখন তিনি এই মন্তব্য করিতেছিলেন, তখন আমি চাপদাড়ি ছটিয়া ফ্রেঞ্চকাট করিয়াছি, শেরওয়ানির বদলে কোট-পায়জামা পরিয়া অনেকটা যুবক হইয়াছি। ঐ ফটোর মৌলবী সাব যে আমিই তা বুঝিবার উপায় ছিল না।

২. বয়সের দূরত্ব লােপ
কিন্তু আমাদের এই বয়সের ও চেহারা-ছবির গরমিল আমার স্ত্রীর মনে কোনও বিরূপ ক্রিয়া করিয়াছিল বলিয়া আমি ঘুণাক্ষরেও বুঝিতে পারি নাই। আমি মুখে-মুখে যতই সন্ন্যাসীগিরি দেখাই না কেন, মনে-মনে আমি কবি ও প্রেমিক ছিলাম নিশ্চয়ই। সেই জন্যই বােধহয় বিয়ার দিনেই স্ত্রীকে দেখিয়া আকৃষ্ট হইয়াছিলাম। বাপ-মার সেবার একমাত্র উদ্দেশ্যে যে বউ ঘরে আনিলাম, বাপ-মার খেদমতে তাঁকে নিয়ােগ না করিয়া কর্মস্থল কলিকাতায় নিয়া গেলাম। আমি নিশ্চয়ই তাঁর রূপে মুগ্ধ হইয়াছিলাম। কিন্তু তিনি আমার প্রতি কিসে আকৃষ্ট হইয়াছিলেন? আকৃষ্ট যে হইয়াছিলেন তার প্রমাণ এই যে, আমি যেদিন তাঁর নিকট হইতে বিদায় লইয়া কলিকাতা কর্মস্থলে চলিয়া যাইতাম সেদিন তিনি গােসল ও খানাপিনা ত্যাগ করিয়া যে বিছানা নিতেন। আমার মা-ফুফু-ভাবিরা হাজার জোর করিয়াও একাধদিন না গেলে কিছু খাওয়াইতে পারিতেন না। এগার বছরের বালিকার পক্ষে ত্রিশ বছরের স্বামীর
৩৯২
বিরহে এমন ভাত-পানি ছাড়িয়া দেওয়া মােটেই স্বাভাবিক ছিল না। কিন্তু এটা তিনি করিতেন। এ বিষয়ে তাঁর কোনও লজ্জা-শরম ছিল না; অথবা লজ্জাশরম কাকে বলে তা বুঝিবার বয়সই তার হয় নাই। এতদিন পরে বুঝিতেছি, বয়সের এই পার্থক্যটা আমি ভুলাইয়া দিতে পারিয়াছিলাম। আমাকে তুমি’ বলাইতে পারিয়াছিলাম। মাত্র এগার বছরের খুকির পক্ষে ত্রিশ বছরের একটা দাড়িওয়ালা জওয়ানকে ‘তুমি’ সম্বােধন করা নিশ্চয়ই খুবই কঠিন কাজ। কিন্তু এটা আমার স্ত্রী পারিয়াছিলেন। এটা যখন পারিলেন তখন বয়সের পার্থক্যটা বােধ হয় একদম তলাইয়া গিয়াছিল। তা যদি না হইবে তবে ঐটুকু ছােট্ট খুকি আমার উপর ধমকাইয়া হুকুম জারি করিতে পারিতেন না। আমার ভুল-ত্রুটির জন্য ধমকাইতে-শাসাইতে পারিতেন না। তাছাড়া আমি বুঝিয়াছিলাম ঐটুকু খুকির মধ্যেও একটা অসাধারণ ব্যক্তিত্ব, আত্মমর্যাদাবােধ ও স্বাধীনতা ছিল। বিয়ার পর বছর-খানেকের মধ্যেই যখন তাঁকে কলিকাতা নিয়া বাসা করি তখন তাঁকে সহায়তা করার কেউ ছিল না। পাশের বাসার চাকরকে দিয়া বাজার করাইতেন, আর রান্না-বান্না নিজেই করিতেন। আমার দীর্ঘ আফিস আওয়ারে বাসায় একাই থাকিতেন। প্রথমবারের মুদ্দতে তিনি কলিকাতায় ছিলেন মাত্র এক বছর। এই এক বছরেই তিনি আমার বন্ধু-বান্ধবের স্ত্রী মহলে বিশেষত সওগাত আফিসে সমাগত মহিলা মহলে খুব জনপ্রিয় হইয়া উঠেন। এই সময়ে কাজী নজরুল ইসলাম, সওগাত সম্পাদক নাসিরুদ্দিন, কবি গােলাম মােস্তফা, সুরশিল্পী আব্বাসউদ্দীন, সাহিত্যিক আবুল কালাম শামসুদ্দীন, কবি মঈনুদ্দীন, হবিবুল্লা বাহার প্রভৃতি সবাই আমাদের বন্ধুমহল। এদের সবারই পরিবারের মধ্যে আমার স্ত্রীর যাতায়াত। এই মহলের মহিলারা সবাই বয়সে আমার স্ত্রীর অনেক বড়। তবু সওগাত আফিসে যে কয়বার মহিলাদের গ্রুফ ফটো তােলা হইয়াছে, তাতে আমার স্ত্রীকেই মধ্যমণি হিসাবে বসান হইয়াছে। এ সব দেখিয়া ক্রমে আমার মনেও এই প্রত্যয় জন্মিয়াছিল যে, লেখাপড়া কম জানিয়া এবং বয়সে অপরিণত হইয়াও ব্যক্তিত্ব প্রজেকশনের ক্ষমতা তার মধ্যে জন্মগতভাবেই ছিল।
আমার শ্বশুর মওলানা আকালুবী সাহেব নারী শিক্ষার খুব জোর সমর্থক ছিলেন। বহু ধনী শাগরিদ-মুরিদকে তিনি মেয়েদেরে উচ্চশিক্ষা দিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিলেন। কিন্তু নিজের মেয়েদের কাউকে তিনি উচ্চশিক্ষা দেন নাই। তকালে মেয়েদের উচ্চশিক্ষা খুব ব্যয়সাধ্য ছিল। মওলানা আকালুবী সাহেব গরীব মানুষ ছিলেন। কাজেই নিজের বাড়িতে বালিকাদের জন্য একটি স্কুল খুলেন। তাতে আরবি, ফারসি, বাংলা, অঙ্ক, ইতিহাস, ভূগােল ও সামান্য
৩৯৩
ইংরাজি পড়াইবার ব্যবস্থা ছিল। পাড়াগাঁয়ের মেয়েরাও সাধারণত কমপক্ষে বার বছরের বেশি কেউ অবিবাহিত থাকে না। এর পরেই হয় মেয়েদের বিবাহ হইয়া যায়, নয়-ত বিবাহের যােগ্য মেয়েকে বাপ-মারা পর্দায় বন্ধ। করিয়া থাকেন। মওলানা সাহেবের পাঁচ মেয়ের সবারই লেখা-পড়া ঐ স্কুল পর্যন্ত। আমার স্ত্রীও ঐটুকু বিদ্বান হইয়াই আমার ঘর করিতে আসেন। পাড়াগাঁয়ের আমার বাপ-মার খেদমত করার জন্য এইটুকু বিদ্যাই যথেষ্টের চেয়ে বেশি হইল । কিন্তু আমি তাঁকে সাংবাদিকের সহধর্মিণী হিসাবে যখন কলিকাতা নিয়া গেলাম, তখন স্বভাবতই তার আর একটু লেখা-পড়া জানার দরকার হইল । আমার কিছু বলিতে হইল না। আমার শ্বশুর ও সম্বন্ধীই আমার স্ত্রীকে তা বুঝাইলেন। দ্বিতীয় বার দেখা হইবার সময়েই দেখিলাম, তাঁরা এঁকে কিছু-কিছু নূতন পুস্তক কিনিয়া দিয়াছেন। আমিও দিলাম। গােড়াতে আমার নিজের ও আমার স্ত্রীর সংকল্প ছিল যে তিনি প্রাইভেট ম্যাট্রিক পরীক্ষা। দিবেন এবং তদনুসারে কিছুদিন পড়াশােনাও চালাইলেন। কিন্তু দুই-এক বছরের মধ্যেই আপনা-আপনি তিনি লেখাপড়া ছাড়িয়া সংসারী হইয়া গেলেন। এবং আমিও যেন তা বিনা প্রতিবাদে মানিয়া লইলাম।
কারণ তার পনের বছর বয়স হইবার আগেই আমরা একটি পুত্র সন্তান লাভ করিলাম এবং আর দুই বছর পরে আরেকটি পুত্র সন্তান লাভ করিলাম। এটা খুবই নিষ্ঠুরতা হইয়াছিল। সতের বছর বয়সের নারী দুইটি সন্তানের মা হওয়া কোনও নারীর স্বাস্থ্যের পক্ষেই শুভ হইতে পারে না।

৩. কচি ঘাড়ে ভারী বােঝা
বিয়ার তিন বছর পরেই আমি উকালতি শুরু করিলাম। কলিকাতা ছাড়িয়া ময়মনসিংহ শহরে আসিলাম। নূতন উকিলের পক্ষে পেটে-ভাতের আয়ের বেশি কিছু করা সম্ভব ছিল না। তবু আমি দুই সন্তানের মা সতের বছরের বয়সের বালিকাকে শহরে আনিয়া আমার অভাবের সংসারের দায়িত্ব তার উপর চাপাইয়া দেই। এর আগে কলিকাতার জীবনে তাঁকে বিশেষ কোনও দায়িত্ব বহন করিতে হয় নাই। আমরা দুজনের জন্য একবেলা ডাল-তরকারি রাঁধিয়া দুই বেলা শুধু এক পােয়া চাউল সিদ্ধ করিলেই রান্না-বান্নার কাজ শেষ। কয়লার চুলাটাও তাঁর নিজের ধরাইতে হইত না। প্রতিবেশী বন্ধু আমাদের বাজারটাও করিয়া দিতেন। তাঁর চাকরটা আমাদের বালতির চুলাটাও ধরাইয়া দিত। কাজেই কলিকাতায় সপরিবারে বাস করা সত্ত্বেও আমি না শিখিয়াছি বাজার
৩৯৪
করিতে; আমার স্ত্রী না শিখিয়াছেন কয়লার চুলা ধরাইতে। কাজেই আমরা উভয়েই শুরু করিলাম ইংরাজিতে যাকে বলে ফ্রম দি ক্র্যাচ। আঁচড় হইতে।’
কথায় বলে আম ছােট হইলে কী হইবে আঁটি বড় আছে’; আমারও আয় কম ও বাবুর্চি নাবালিকা হইলে কী হইবে, আমার বাসায় মেহমানের জোর ছিল। এই সময় প্রতিমাসে আমার বাসায় চার মণ চাউল খরচ হইত। তার মানে প্রতিবেলা গড়ে পনের-বিশ জন লােক খানা খাইতাম। এত লােক হইবার প্রধান কারণ এই যে আমি স্থানীয় লােক। আত্মীয়-স্বজন অন্য কাজেই শহরে আসুন, আর মামলা-মােকদ্দমা করিতেই আসুন, আমাকে দিয়াই মামলা করান, আর অপর উকিলকে দিয়াই মামলা করান, আমার বাসায় চারটা ডালভাত না খাইয়া গেলে আমি অসন্তুষ্ট হইতে পারি, এ সম্পর্কে আত্মীয়-স্বজনরা সর্বদাই সচেতন ছিলেন। মেহমান বেশি হওয়ার দ্বিতীয় কারণ প্রজাআন্দোলনের নেতা ও প্রজা-সমিতির সেক্রেটারি হিসাবে সমিতির আফিসের লােকদের খাওয়ার ব্যবস্থাটা আমারই দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এছাড়া মফস্বল হইতে নেতৃস্থানীয় কর্মীরা আসিলে তাঁদেরে সম্মান করা ও তাদের থাকা-খাওয়ার সুবিধার দিকে নজর রাখাও আমারই কর্তব্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এছাড়া আমার বৈঠকখানায় সমাগত ভদ্রলােকদের চা খাওয়ানাের রেওয়াজ ছিল। আমার রাজনৈতিক গুরু মৌলবী মুজিবর রহমান সাহেবের নিকট আমি এটা শিখিয়াছিলাম। তিনি সকলকে উপদেশ দিয়াছিলেন, যদি তােমরা নূতন কোনও মতবাদ প্রচার করিতে চাও, তবে নিজের বৈঠকখানাকে চায়ের আড্ডায় পরিণত কর। এই ধরনের চায়ের বৈঠকেই দুনিয়ার সমস্ত নূতন। মতবাদ দানা বাঁধিয়াছে। মৌলবী সাহেবের এই উপদেশ আমি সাধ্যমত মানিয়া চলিতাম। ফলে বাসায় খাবার ব্যবস্থা যেমন থাকুক, চায়ের ব্যবস্থা থাকিতই। এ সবে যে খরচ খুব বেশি হইত তা নয়। কারণ চা তখন আটদশ আনা পাউন্ড। দুধ তখন টাকায় ষােল সের; চিনি পাঁচ আনা সের। ছয় পয়সা করিয়া তশতরিসহ চায়ের কাপ পাওয়া যাইত। সুতরাং ডজনে-ডজনে। চায়ের কাপ কিনিতেও খুব কষ্ট হইত না। কিন্তু কষ্ট হইত আমার স্ত্রীর। একটি মাত্র চাকর লইয়া তিনি এতলােকের জন্য রান্না-বান্না ও চা তৈরি করিতেন। তা ছাড়া আমার মেহমানদারির কোনও ওয়াকত-বেওয়াকত ছিল না। মফস্বলে মিটিং করিতে গিয়া হয়ত রাত একটার সময় তিন-চারজন। মেহমান লইয়া বাসায় ফিরিলাম। স্ত্রীকে জানাইলাম আমার নিজের অবশ্য ক্ষিধা নাই, না খাইলেও চলে। কিন্তু মেহমানদের ত আর ভুকা রাখা যায় না। কাজেই আর কিছু না হউক, কয়টা আলু, বেগুন বা শিম ভর্তা ও কয়টা আন্ডা
৩৯৫
ভাজা করিলেই চলিবে, আর কয় ছটাক চাউল সিদ্ধ করা, এই ত? আর কিছু করার দরকার নাই। সদ্য ঘুম-ভাঙ্গা এই বালিকা আমার এই ভণ্ডামিতে রাগ করিতে পারিতেন। তার বদলে একটু হাসিয়া পাক ঘরে ঢুকিলেন। ঘণ্টা খানেকের মধ্যে মেহমানসহ আমাকে খাওয়াইয়া দিতেন। এমনি ঘটিত প্রায়ই।
আয়-ব্যয়ের কোনাে খোঁজখবর করিতাম না। আমি যা রােযগার করিতাম স্ত্রীর হাতেই আনিয়া দিতাম। যা খরচ করিতাম তাও স্ত্রীর কাছ থনেই চাহিয়া নিতাম। পনের-ষােল বছরের বালিকা স্ত্রীর উপর এমন গুরুদায়িত্ব দেওয়াটা ছিল বিশ্বাস ও ভরসা উভয় দিকেই অসাধারণ। টাকা-পয়সার দায়িত্ব স্ত্রীর হাতে ছাড়িয়া দেওয়ার নজির খুবই বিরল। কাজেই আমার এমন ব্যবহার দেখিয়া-শিখার ব্যাপার নয়। তবে এটা আমি শিখিলাম কই? শিখিতে হয় নাই। অমনিতেই হইয়াছে। কিন্তু তারও ত একটা কারণ থাকার কথা? আমার মনে হয় সে কারণটা আমার স্ত্রীরই কৃতিত্ব। আর্থিক ব্যাপারে তার তখনকার ব্যবহার সেটা ছিল নিতান্তই অসাধারণ। খুব হিসাবি মিতব্যয়ী স্ত্রীরাও স্বামীর টাকা-পয়সার ব্যাপারে নিজের খরচের বেলা মিতব্যয়ী হন না। কিন্তু আমার পনের-ষােল বছরের বালিকা স্ত্রীর মধ্যে আমি এর ব্যতিক্রম দেখিলাম । পুলকিত ত হইয়া ছিলামই, চমৎকৃতও হইয়াছিলাম। প্রথম ঘটনাটা এই :
স্ত্রীকে ময়মনসিংহ বাসায় আনার পর প্রথম শীতের আগমনেই স্ত্রীর জন্য আট টাকা দামে একটি গরম ফুলহাতা সুয়েটার কিনিয়াছিলাম। বাসায় ফিরিয়া গায়ে দিতেই বুঝা গেল আস্তিনটা তিন-চার ইঞ্চি খাট। বদলাইয়া আনিতে একাই দোকানে গেলাম। দুইটা অসুবিধা দেখা দিল। সুয়েটারের রং বদলাইতে হয়। আর পাঁচ টাকা দাম বেশি দিতে হয়। স্ত্রীর সাথে পরামর্শ করিতে বাসায় ফিরিলাম। স্ত্রী রং বদলাইতে আপত্তি করিলেন না। কিন্তু পাঁচ টাকা বেশি খরচ করিতে আপত্তি করিলেন। তার বদলে তিনি পশমি মােটা সুতার একজোড়া বেবি হাফ মােজা কিনার হুকুম দিলেন। তাঁর নির্দেশমত আমি এক জোড়া পশমি হাফ মােজা কিনিলাম। কেন মােজা কিনিলাম বুঝিবার চেষ্টা করিলাম না । পাঁচ টাকার বদলে দশ আনার মােজা কিনিয়াই আমি খুশি হইলাম। পরদিন সন্ধ্যায় কোর্ট হইতে ফিরিয়াই দেখিলাম, কবজি-তক লম্বা আস্তিনের সুয়েটার গায় দিয়া আমার স্ত্রী আমার অপেক্ষায় দাঁড়াইয়া আছেন। তাঁর মুখে মুচকি হাসি। বেবি হাফ মােজা দিয়া তিনি সে সুয়েটারের আস্তিন লম্বা করিয়াছেন, তাঁর ভাষায় এই ‘সােজা কাজটা’ও তিনি আমাকে নাশতা-চা দেওয়ার আগে বুঝাইলেন না। জোড়া মিলানের কৌশল ও অদৃশ্য সিলাইর
৩৯৬
নিপুণতা বুঝাটা আমার জন্য নিতান্ত ‘সােজা কাজ ছিল না। তার সিলাই নিপুণতা আমাকে মুগ্ধ করিয়াছিল। নিশ্চয়ই। কিন্তু অব্যক্ত আনন্দে পুলকিত হইয়াছিলাম অন্য কারণে। তাঁরই পােশাক বাবত স্বামীর টাকা খরচে অমন মিতব্যয়িতা? একটি বালিকা স্ত্রীর মধ্যে? আমি এক মুহূর্তে বুঝিলাম এই বালিকার উপর আমি সব ভার ছাড়িয়া দিতে পারি। দিলামও। এর পরও অমন অনেক ঘটনা ঘটিয়াছে। সবটাতেই আমি বুঝিয়াছি, আমি ভুল করি নাই।

৪. কুশলী নিপুণা গিন্নি
তাঁর এই আর্থিক স্বাধীনতা ও আমার একান্ত স্ত্রী-নির্ভরতা আমার জীবনের অমূল্য সম্পদ। আমার সুখ-শান্তির আকর। সম্পূর্ণ নিশ্চিন্তে, নিরুদ্বেগে ও বেপরােয়াভাবে উকালতি, রাজনীতি, সাহিত্য ও সাংবাদিক জীবন যে আমি যাপন করিতে পারিয়াছি, তা একান্তভাবেই আমার এই বৈষয়িক নিশ্চিন্ততা। সংসার পরিচালনায়, মেহমানদারিতে আমাকে কোনও দিন ভাবিতে হয় নাই। আমার স্ত্রী আমাকে ভাবিতে দেন নাই। টাকা নাই কোনও দিন বলেন নাই। আমারও তার এমনকি ছেলেদের (ততদিনে তিনি মনসুর আনাম ও মহবুব আনাম এই দুই পুত্রের মা) কাপড়-চোপড়, জুতা-জামার ভাবনাও তিনি আমাকে ভাবিতে দেন নাই। কী কবে খাইব, কোন শেরওয়ানি-পাজামা-জুতা পরিয়া কোর্টে যাইব, তা-ও তিনিই আগে হইতে ঠিক করিয়া রাখিতেন। এটা ঘটিয়াছে অবশ্য সারাজীবনই। এটা বুঝিয়া ফেলিয়াছিলাম উকালতি জীবনের প্রথম দশ বছরেই। শুধু ব্যক্তিগতভাবে আমি নই, আমার সারা সংসারজীবনই তার মুঠায়। আমার সংসারে তিনি নিজেও গলাতক ডুবিয়াছেন, তার। প্রথম উপলব্ধি ঘটে আমার কৃষক-সম্পাদনার জন্য উকালতি ও ময়মনসিংহ ছাড়িয়া কলিকাতা যাওয়ার প্রাক্কালে। কলিকাতার প্রতি তার টান ছিল আগে হইতেই। কাজেই তিনি খুশিই হইলেন। কিন্তু অসুবিধাও দেখাইলেন। এই দশ বছরে তিনি সংসার কম গােছান নাই। এই ভাড়াটিয়া বাসায় তিনি গলাতক পুঁতিয়া গিয়াছেন। ইতিমধ্যে তিন ছেলের মা হইয়াছেন। বাড়িওয়ালাকে দিয়া বাড়ি কুশাদা করাইয়াছেন। ডাইনিং হল ও গেস্ট রুম করাইয়াছেন। তার উপযােগী টেবিল-চেয়ার-চৌকি-আলনা-মিটসেফ করিয়াছেন। প্রয়ােজনমত লেপ-তােষক বাড়াইয়াছেন। গােসলের জন্য বাথরুম বানাইয়াছেন। বাড়ির মধ্যে ফুলের বাগান করিয়াছেন। উঠানের এক কোণে গােলাঘর করিয়াছেন। এতে তিনি চাউল-সরিষা ও কলাইর স্টক
৩৯৭
করেন। মওসুমের সময় সস্তা দামে কিনিয়া গােলাজাত করেন। বাজার চড়িলে বিক্রয় করিয়া লাভ করেন। এসব কাজে তিনি কোনও দিন আমার সাহায্য চান নাই। প্রজা-কর্মী বা মুহরী-মক্কেলদের সাহায্যে তিনি এ সব খরিদ-বিক্রি করিয়া থাকেন। নিজের খরচে হাঁস-মুরগি-কবুতরের ঘর বানাইয়াছেন, বাড়ির মধ্যে বেগুন, মরিচ, আলু, ভঁাটার ক্ষেত করিয়াছেন। লাউ-কুমড়াশসা-করল্লা-ঝিঙ্গার জাংলা করিয়াছেন। শাক-সবজি, তরি-তরকারি, মুরগমুরগি তাঁর বাজার হইতে কিনিতে হয় না। বরঞ্চ চাকরকে দিয়া তিনি ঐ সব বিক্রি করিয়া থাকেন। এ সব সত্ত্বেও বাসার ভিতরে তিনি একটু ময়লাআবর্জনা হইতে দেন নাই। তিনি নিজ হাতে ঝটা-দা-কোদাল মারিয়া বাড়ির ভিতর ঝক-ঝকা রাখিতেন। দেওয়াল ঘেঁষিয়া ফুলের গাছ লাগাইয়াছেন। তার মাঝে-মাঝে লেবু-ডালিমের গাছ করিয়াছেন। এ সবই তিনি করিতেন আমার অজ্ঞাতে। কারণ বাসায় থাকিলে বৈঠকখানায় মক্কেল লইয়া বৈঠক করা, সারা দিন কোর্টে থাকা, সভা-সমিতি উপলক্ষে মফস্বলে বা কলিকাতায় কাটান, এত সব করিয়া আমি বেচারীর খোঁজখবর খুব কমই রাখিতাম। অবসর সময়ে এসবের জন্য যদি তার তারিফ করিতাম, তখন জবাব দিতেন : প্রশংসার আসল দাবিদার তার মা—আমার শাশুড়ি। কথাটা সত্য। তারই জন্য আমার স্ত্রীর পক্ষে রান্নাঘরের বাহিরে এতসব কাজ করা সম্ভব
হইয়াছিল।
এখানে উল্লেখযােগ্য যে আমার স্ত্রী তৃতীয় পুত্র মতলুব আনামকে প্রসব করিয়াই অসুস্থ হইয়া পড়েন। তাঁর এ নবজাত শিশুর দেখ-শােন করিবার জন্য আমার শাশুড়িকে বাসায় নিয়া আসি। স্ত্রীর অসুখ দীর্ঘস্থায়ী হয়। শাশুড়িও থাকিতে বাধ্য হন। ওদিকে বাড়িতেও তার খুব তাকিদ ছিল না। তাঁর নিজের আর কোনও সন্তানাদি ছিল না। আমার শ্বশুরের এন্তেকালের পরে তিনি সৎ-পুত্রদের সাথেই থাকিতেছেন। ছয় মাস এক নাগাড়ে আমার বাসায় থাকার পর তিনি মাঝে-মাঝে নিজ বাড়িতে যাইতেন বটে কিন্তু দু-চার দিন না যাইতেই তাকে আমরা নিয়া আসিতাম। তিনিও নাতিদেরে ছাড়া থাকিতেন পারিতেন না। তাঁকে ছাড়া আমাদেরও চলিত না। এইভাবে তিনচার বছরের মধ্যে তিনি নাতিদের হাতে স্থায়ী বন্দিনী ও আমার সংসারের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হইয়া পড়িলেন। আমার স্ত্রীর প্রচুর অবসর জুটিল। তিনিও বই-পুস্তক, সিলাইর কল ও বাড়ি-ঘর লইয়া মাতিলেন। এমনি অবস্থায় আমি যখন সপরিবারে কলিকাতা রওয়ানা হইলাম আমার ছেলেরা নিজেদের দাবির জোরেই নানিকে টানিয়া গাড়িতে তুলিয়া নিল।
৩৯৮
৫. কলিকাতার জীবন
মেহমানের ভিড় নাই। কাজের বাড়াবাড়ি নাই। ছােট রান্নাঘরের সমস্ত দায়িত্ব আম্মার কাছে। কলিকাতা গিয়া আমাদের উভয়ের জীবনের মােড় ফিরিল। আমরা পরম সুখে দিন কাটাইতে লাগিলাম। আমার স্ত্রীর মতে এ সময়টাই তাঁর সবচেয়ে বেশি সুখের মুদ্দত। কারণ প্রথম কয়দিন রাত খাটিয়া কাগজ চালু করিবার পর প্রায় সারাদিনই আমি স্ত্রীর কাছে থাকিতাম। বাসায় বসিয়া সম্পাদকীয় লিখিতাম। বিকালের দিকে আফিসে যাইতাম। দুই-এক ঘণ্টা আফিসে কাটাইয়া সন্ধ্যার একটু পরেই বাসায় ফিরিতাম। ছেলেদেরে শাশুড়ির হেফাযতে পড়ায় বসাইয়া চাকরকে রান্নার ভার দিয়া আমরা মিয়া বিবিতে গড়ের মাঠ, নিউ মার্কেটে বেড়াইতে অথবা সিনেমা দেখিতে যাইতাম। খুব কম দিনই এই প্রােগ্রামের ব্যতিক্রম হইত। স্ত্রী ছিলেন এতদিন উকিলের বিবি। ফিক্সড ইনকামের কোনও জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা তাঁর ছিল না। সম্পাদক হিসাবে প্রতি মাসের প্রথম দিকে আড়াই শত টাকা আনিয়া তার হাতে দিতাম। খরচের জন্য তিনি এক সঙ্গে এত টাকা এর আগে আর কখনও পান নাই। এই নূতন পরিবেশে তিনি নূতন ব্যবস্থা করিলেন। তিনি মাসের পনের দিনে একবার বাজারে যাইতে আমাকে বাধ্য করিলেন। এই দিনে চাউল, ডাইল, লবণ, শুকনা মরিচ, পিঁয়াজ, রসুন, আদা, হলুদ, গরম মসল্লার একটা বিরাট তালিকা করিয়া আমার হাতে দিতেন। একেবারে এক মাসের বাজার। প্রতিদিনের বাজার তিনি চাকরকে দিয়াই করাইতেন। মাছ, গােশত, মুরগি, তরিতরকারি ও কাঁচা মরিচ, শাক-সবজি ছাড়া সারা মাসে তিনি আর কিছুর বাজার করাইতেন না। বাজে খরচ, গাড়ি ভাড়া, রিকশা ভাড়া, সিনেমা ইত্যাদির এবং কাপড়-চোপড় কিনার খরচ দুইজন একত্রেই করিতাম । আমার একার নিজস্ব খরচ বিশেষ-কিছু ছিল না। কারণ ট্রামে চলাচলের জন্য মাসিক টিকিট ছিল। আফিসে যাতায়াত তাই দিয়া চলিত। আফিসে বসিয়া যে চা-সিগারেট খাইতাম, তার দামও মাসের শেষে এক সঙ্গেই দিতাম।
ফলে পাকা গিন্নির মতই তিনি আমার অজ্ঞাতে বেশ কিছু টাকা সঞ্চয় করিলেন। এটা টের পাইলাম যখন আমার কৃষক-এর চাকুরি গেল। আমি উদ্বিগ্ন চিত্তে বিষন্ন মুখে এই দুঃসংবাদ লইয়া যখন বাসায় ফিরিলাম, তখন। তিনি ভরসা দিলেন : কোনও চিন্তা করিও না। কিছুদিন চালাইতে পারিব । ইতিমধ্যে একটা চেষ্টা-চরিত কর। আমি ময়মনসিংহ ফিরিয়া উকালতি করিব বলায় তিনি খুব উৎসাহ দিলেন না। বলিলেন : সেটা ত হাতের পাচ আছেই।
৩৯৯
তার আগে কলিকাতা থাকার সবচেষ্টা শেষ করা দরকার। তার জন্য যে কয়দিন সময় লাগে, তিনি চালাইয়া নিতে পারিবেন। বুঝিলাম, কিছু সঞ্চয় করিয়াছেন। চালাইয়া গেলেন তিনি। কিন্তু বেশিদিন চালাইতে হইল না। দুই-তিন মাসের মধ্যেই হক সাহেবের নবযুগ-এর চাকুরি পাইলাম। বেতনও কৃষক-এর চেয়ে পঞ্চাশ টাকা বেশি। বিবি হাসিয়া বলিলেন : দেখ, সবুরে মেওয়া ফলে। সাহস করিতে হয়। সাহসই লক্ষ্মী।
কিন্তু লক্ষ্মী এক বছরও টিকিলেন না। নবযুগ-এর চাকুরি গেল। এবার ময়মনসিংহ ফিরিয়া যাওয়া ছাড়া উপায় নাই। চাকুরিটা যাওয়ার সময় আমি সপরিবারে গ্রামের বাড়িতে ছুটি উপভােগ করিতেছিলাম। চাকুরি যাওয়ার খবরটা বাড়ি বসিয়াই পাইলাম। কাউকে কিছু না বলিয়া কলিকাতা চলিয়া গেলাম। বিনা-নােটিসে আমাকে চাকুরি হইতে ডিসমিস করায় হক সাহেব আমাকে তিন মাসের বেতন দিয়া দিলেন। আমি এই টাকাটা হাতে করিয়া বিবি সাহেবকে সমস্ত অবস্থা জানাইয়া পত্র দিলাম জিনিস-পত্র গােছাইয়া ময়মনসিংহে ফিরিয়া যাইবার জন্য। ছেলেপিলেকে বাড়িতে রাখিয়া একা আসিতে তাঁকে উপদেশ দিলাম। তিনি উত্তরে তাঁর আসিবার তারিখ জানাইলেন।

৬. সংকল্পে দৃঢ়তা
নির্ধারিত দিনে তাঁকে আনিবার জন্য শিয়ালদহ স্টেশনে উপস্থিত হইলাম। প্ল্যাটফরম টিকিট কিনিয়া ভিতরে ঢুকিলাম। কারণ বেচারী একা আসিতেছেন, কুলি ঠিক করিতে অসুবিধায় পড়িতে পারেন। লম্বা ট্রেন। যাত্রীর ভিড়। কাজেই এক-ধারসে সব কামরা দেখিয়া-দেখিয়া অগ্রসর হইতে লাগিলাম। হঠাৎ দূর হইতে ‘আব্বা আব্বা বলিয়া ছেলেদের সমবেত কণ্ঠস্বর শুনিলাম। বিস্মিত হইয়া দেখিলাম, বিছানা-পত্রের হােল্ড-অলের লটবহরের মধ্যে চার ছেলেরে লইয়া বিবি সাহেবা দাড়াইয়া আছেন। তিন ছেলে দৌড়িয়া আমার কাছে আসিয়া সালাম করিল। মেজো-সেজো আমাকে জড়াইয়া ধরিল। কোলেরটি হাত নাড়িয়া আনন্দ জানাইতে লাগিল। বিবি সাহেবা মুচকি-মুচকি হাসিতে থাকিলেন। আমি রাগে ভিতরে-ভিতরে ফাটিয়া পড়িতেছিলাম। মেয়ে লােকটার বিবেচনা দেখ! আমার চাকুরি গিয়াছে।। জিনিসপত্র গােছাইতে দুইদিনের জন্য কলিকাতায় আসিয়াছেন। অথচ নিয়া আসিয়াছেন সব ছেলে-পিলেকে। মনে হয় যেন লটবহর কিছু বাড়াইয়া
৪০০
আনিয়াছেন। যে কয়টা টাকা আছে, এদের যাতায়াত ও ফুট-ফরমায়েশ সারিতেই ত শেষ হইবে। কিন্তু প্ল্যাটফরমে অতলােকের মধ্যে ত স্ত্রীর উপর রাগ দেখাইতে পারি না। আচ্ছা চলাে যাই আগে বাসায়। আজ তােমারই একদিন কি আমারই একদিন। ছেলেদের আর দোষ কী? ওরা কী বুঝে? কাজেই ওরা যখন কাড়াকাড়ি করিয়া আমাকে জড়াইয়া ধরিল, তখন ওদেরে আদর করিলাম। কোলের ছেলেটা ৪র্থমনজুর আনাম হাত বাড়াইয়া থাকায় তাকে কোলেও লইলাম।
ফিটনে চড়িয়া বাসায় ফিরিবার পথে স্ত্রী কানের কাছে মুখ আনিয়া বলিলেন : তুমি খুব রাগ করিয়াছ জানি। কিন্তু এখন কিছু বলিব না বাসায় গিয়া সব কথা বলিব। সব শুনিলে তােমার রাগ থাকিবে না।
রাগ তখনই পড়িয়া গেল। বিবির সব কথা শােনার আর দরকারই হইল না। যা বলিলেন তাই যথেষ্ট। তাতেই রাগের স্থান দখল করিল দুশ্চিন্তা। বিনাকারণে এত ব্যয়বহুল কাজ করার মেয়ে ত তিনি নহেন। তবে কি বাড়িতে কোনও অসন্তোষ বা অমঙ্গলের কারণ ঘটিয়াছিল? দুশ্চিন্তা অসহ্য হইয়া উঠিল। কী ঘটিয়াছে তা না বলিয়া আমিই উল্টা তাঁকে খােশামুদি করিতে লাগিলাম। কিন্তু বাসায় গিয়া ঠাণ্ডা হইয়া সব বলিব’ বলিয়া তিনি আমার দুশ্চিন্তা আরাে বাড়াইয়া বােধহয় মনে-মনে কৌতুক উপভােগ করিতেছিলেন।
পাশের ফ্ল্যাটের ভাড়াটিয়া ময়মনসিংহ জিলার অধিবাসী কংগ্রেস ও কৃষকপ্রজা সমিতির আমার ঘনিষ্ঠ সহকর্মী আবদুল রশিদ খাঁ সাহেবের বাসায়। আমাদের নাশতার ব্যবস্থা হইয়াছিল। দুইজনের নাশতার কথা বলিয়া আমি শিয়ালদহ চলিয়া আসিয়াছিলাম। কিন্তু খাঁ সাহেব খুব সাবধানী মানুষ। তিনি একটু বেশিই করিয়াছিলেন। এক রকমে সকলের নাশতা হইয়া গেল। ছেলেপেলেরা সঙ্গে আসিয়া পড়িয়াছে দেখিয়া খাঁ সাহেব দুপুরের খাবার ব্যবস্থায়ও নিজের বাসাতেই করিলেন। কাজেই গােসল-নাশতা সারিয়া আমরা নিশ্চিন্তে আলাপ করিতে লাগিলাম। বিবি সাহেবা কিছুমাত্র ভূমিকা না করিয়া আসল কথায় আসিলেন। বলিলেন : কলিকাতা ছাড়িব না বলিয়াই ছেলেদেরে লইয়া আসিয়াছি। অনেক তর্ক করিলাম। তার সংকল্পের অসম্ভাব্যতা দেখাইলাম। সাংবাদিকতার চাকুরির দুর্লভতা এবং প্রধান সম্পাদকতা করিবার পর কোনও কাগজের নিম্নতর চাকুরি নেওয়ায় আমার অসম্মানের কথা সবই বলিলাম। তিনি জবাবে বলিলেন যে তিনি সংবাদপত্রের চাকুরির কথা বলিতেছেন না। উকালতির কথা বলিতেছেন। আমি তার সরলতায় ঠাট্টার হাসি হাসিয়া। বলিলাম : ‘উকালতি করিব বলিলেই ত হয় না। নিজের জিলাতেই সংসার
৪০১
খরচ চালাইবার মত রােযগার করিতে আমার তিন-চার বছর অপেক্ষা করিতে হইয়াছিল। এই বিদেশ-বিভুয়ে কলিকাতার মত বিশাল শহরে হাজার-হাজার উকিলের মধ্যে কে আমাকে কেস দিবে? তাছাড়া কলিকাতার বাসা খরচও অনেক বেশি। কী খাইয়া এখানে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করিব?
সমান আত্মবিশ্বাসে তিনি বলিলেন : রাখে আল্লাহ মারে কে! তুমি সে জন্য চিন্তা করিও না। যত কষ্টই হােক, কলিকাতায় আমাদের থাকিতেই হইবে । ময়মনসিংহে তােমার ফিরিয়া যাওয়া হইবে না।
এতক্ষণে বিবি সাহেবা আসল কথা বলিতেছেন মনে করিয়া আমার বুক দুরুদুরু করিয়া উঠিল। তাঁর চোখের দিকে চাহিয়া বলিলাম : কেন?
সুরে একটু আবেগ মাখিয়া তিনি বলিলেন : কলিকাতা ছাড়িয়া নিজের জিলায় ফিরিয়া যাওয়া হইবে পশ্চাৎ গমন। সেটা হইবে তােমার পরাজয়। এই পরাজয় মানিয়া নিতে আমি তােমাকে দিব না।
এটা ভাবালুতা। কিন্তু উচ্চ ও মহৎ ভাবালুতা, আত্মসম্মানবােধের কথা সুতরাং এতে যথেষ্ট জোর আছে। আমার আত্মসম্মান ও জয়-পরাজয়ে স্ত্রীর এই অনুভূতিতে আমি গর্ববােধ করিলাম। কিন্তু উপায় কী? উপায়ান্তর নাই বলিয়া তাঁকে ঐ পরাজয় মানিয়া নিতে বলিলাম। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলিলেন : উপায় একটা আল্লাই করিয়া দিবেন।
এ কথার কোনও জবাব নাই। সুতরাং চুপ করিয়া হুক্কা টানিতে লাগিলাম। তিনি উঠিয়া অন্য কাজে চলিয়া গেলেন। ভাবটা এই যে, তাঁর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত, এতে আর আলােচনার কিছু নাই। চিন্তা করিব না বলিলেই ত হয় না। আমার মাথা জুড়িয়া চিন্তা কিলবিল করিতে লাগিল । বিবি সাবের এই জিদের পিছনে নিশ্চয়ই শক্তি আছে। সে শক্তির উৎস কী? তাঁর হাতে কি তবে কিছু টাকা আছে। আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু কতই বা থাকিতে পারে? সংসার খরচ সম্বন্ধে আমার কোনও ধারণা নাই। কোনও দিন তার খোঁজখবর করি নাই। কাগজে-কলমে ত দূরের কথা মনে-মনেও কোনও দিন হিসাব করি নাই। এখন হিসাব করিতে বসিলাম। এ যাত্রায় চার বছর কলিকাতায়। আছি। সাংবাদিক ও সাহিত্যিক রােযগারের এই চার বছরে হাজার পনের টাকা আমি আয় করিয়াছি এটা আন্দাজ করা যাইতে পারে। কিন্তু কত খরচ হইয়াছে? তার ধারণার আশপাশ দিয়াও যাইতে পারিলাম না। বাজে খরচের বিভিন্ন দফা ধরিয়া-ধরিয়া হিসাব করিতে লাগিলাম। হাজার কষিয়া খরচ করিলেও দুইশ টাকার কম মাস চলে নাই। তাতে চার বছরে দশ হাজার টাকা লাগিয়াছে। চার বছরে কমসেকম আট বার দেশে যাওয়া হইয়াছে।
৪০২
প্রতিবারে পাঁচশ করিয়া খরচ করিয়া আসিলেও আট বারে চার হাজার চলিয়া গিয়াছে। বাকি থাকিল মাত্র হাজার টাকা। এই টাকার চার-পাঁচ মাসের বেশি চলিতে পারে না। তার উপর এই টাকা হইতে উকালতির প্রস্তুতির জন্য কিছু প্রাথমিক ব্যয় করিতে হইবে। গাউন, বই-পুস্তক ও ফার্নিচারের একটা বড় খরচ আছে না, হাজার টাকা মূলধন লইয়া এত বড় রিস্ক নেওয়া যায় না। অথচ বিবি সাব ত কোনও যুক্তি মানিতেছেন না।
অথচ তাঁকে শক্ত কথা বলিতেও পারি না। বিয়ার চার বছর পরেই পনের বছরের বালিকার উপর সংসার চালাইবার ভার দিয়াছিলাম। এটা চরম নিষ্ঠুরতা হইয়াছিল, দরদি অনেক বন্ধুই আমাকে তা বলিয়াছিলেন। কিন্তু যার উপর নিষ্ঠুরতা করিলাম, তিনি কিছু বলেন নাই। কোনও দিন প্রতিবাদ করেন নাই। বরঞ্চ তিনি আমার মনে এই ধারণা সৃষ্টি ও বদ্ধমূল করিয়াছেন যে আমি যা রােযগার করি তাতে স্বচ্ছন্দে আমার সংসার চলিয়া যায়। আমার নিজের এবং ছেলেদের অথবা স্ত্রীর নিজের পােশাকপাতি, লেখাপড়ার খরচা, সিনেমা-বায়স্কোপের ব্যয়, বাড়িভাড়া, ইনশিওরেন্সের প্রিমিয়াম, দেশের জমি-জিরাতের ট্যাক্স-খাযনা, দেনার কিস্তি, অসুখ ও বিসুখে চিকিৎসা খরচা কোনটাই আদায়ের সময় তিনি বলেন, নাই : টাকা নাই। যখন যেটার প্রয়ােজন হইয়াছে, ঠিকমত ও সময়মত তা করিয়া গিয়াছেন। ঈদ-পরবাদিতে শুধু ছেলেদের নয়, আমাদের উভয়ের জন্য কাপড়-চোপড় কিনিয়াও বাড়িতে আমার মা, বহিন, ভাই-ভাবি-ভাতিজাদের জন্যও কাপড়-চোপড় কিনিতেন। এক একবার বাড়ি যাইবার সময় তিনি সকলের জন্যই কিছু-না কিছু নিয়া নিতেন। আমার পরামর্শ বা অনুমতির অপেক্ষা রাখিতেন না। নিজের বাপের বাড়ির কারাে জন্য কিছু কিনার কথা না ভাবিয়া, না বলিয়া, আমার বাপের বাড়ির লােকজনের কথা তিনি চিন্তা করেন দেখিয়া আমি মনে-মনে খুশিই হইতাম । দেশের বাড়িতে গেলে গরীব আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীকে কিছুকিছু সাহায্যও করিতেন। তাঁর এই সব কাজ অনেক সময় আমার কাছে দানখয়রাতের বিলাসিতা বলিয়া মনে হইত কিন্তু ভাল-মন্দ কিছুই বলিতাম না। এসব ব্যাপারে তাঁর স্বাধীনতা তিনি যেন ধরিয়াই লইতেন।
কিন্তু আজকার ব্যাপার তা নয়। এ ব্যাপারে স্ত্রীর উপর নির্ভর করা বুদ্ধিমানের কাজ হইবে না। অথচ দৃঢ়তা দেখাইবার সহজ পদ্ধতি খুঁজিয়া পাইতেছি না। বিষম ভাবনায় পড়িলাম। কিছুক্ষণ পরে কামরায় ঢুকিয়া আমাকে সেই অবস্থার চিন্তায় মগ্ন দেখিয়া তিনি কাছে আসিয়া বসিলেন। হাত ধরিয়া বলিলেন : কী অত-শত ভাবিতেছ? আমার প্রস্তাবে তুমি রাজি আছ ত?
৪০৩
দৃঢ়তা দেখাইবার এই উপযুক্ত সময়। আমি রাজি না বলিলেই বােধহয় সব সমস্যার সমাধান হইয়া যাইত। কিন্তু তা বলিতে পারিলাম না। তার বদলে বলিলাম : সংসার চালাইবা তুমি। কষ্ট হইবে তােমার। তুমি কষ্ট করিতে রাজি থাকিলে আমার রাজি-গররাজিতে কী আসে যায়?
তিনি দুই হাতে আমার ডান হাতটা চাপিয়া ধরিলেন। দরদ দিয়া বলিলেন; না না তুমি অমন কথা বলিও না। বলাে তুমি মনের খুশিতে রাজি হইয়াছ।
এ ভারি মজার কথা! একগুয়েমি করিয়া নিজের জিদ বহাল রাখিবেন। অথচ শুধু সে জিদ মানিয়া নিলেই চলিবে না, খুশিও হইতে হইবে। খুশিনাখুশি মনের ব্যাপার। কারাে ফরমায়েশ মত খুশি হওয়া যায় না। তবু যখন সহধর্মিণী-জীবনসঙ্গিনী খুশি হইতে বলিতেছেন, তখন অগত্যা বলিলাম : হাঁ, খুশিতেই রাজি হইলাম।
বলিয়া হাসিলাম। চেষ্টা করিয়া হাসিতে হইল না। স্বতই হাসি আসিল। নিজের ঐ উপায়হীনতা সত্যই হাসির ব্যাপারই ছিল। স্ত্রী তাতেই সন্তুষ্ট হইলেন।

৭. বিবিই জিতিলেন
সন্ধ্যার সময় তিনি আমাকে আমার সােদর-প্রতিম বন্ধু খান বাহাদুর সিরাজুল ইসলামের বাসায় পার্ক সার্কাস নিয়া গেলেন। খান বাহাদুর সাহেব এই সময় বাংলা সরকারের অফিসিয়েটিং জুডিশিয়াল সেক্রেটারি। আমার স্ত্রীর সাথে তার পাতা-ভাই-বহিন সম্পর্ক। ভাই-বহিনে গােপনে আলাপ হইল। তারপর খান বাহাদুর সাহেব আমাকে যা বলিলেন, আমার স্ত্রীর কথার সঙ্গে সবই মিলিয়া গেল। তার দৃঢ়মত এই যে আমার ময়মনসিংহ ফিরা চলিবে না। কলিকাতা আলীপুরে প্র্যাকটিস শুরু করিতে হইবে। তিনি আমার ভার নিলেন। আমাকে কোনও চিন্তা করিতে হইবে না। চিন্তা সত্যই করিতে হইল না। ভার তিনি সত্যই নিয়াছিলেন। এইভাবে আমার কলিকাতা থাকা হইয়া গেল। অল্প দিনেই ভাল রােযগার হইতে লাগিল। সম্পাদকতা করিয়া যে টাকা পাইতাম, তার চেয়ে অনেক বেশি টাকার মুখ দেখিতে লাগিলাম। স্ত্রী হাসি-মুখে সংসার চালাইতে লাগিলেন। আমি প্রায় রােজই একবার মনে করিতাম এই বুঝি তিনি বলিলেন : “কেমন আমার কথা ঠিক হইল? তােমার কথামত ময়মনসিংহ চলিয়া গেলে কত বড় ভুল হইত। বহু দিন এই কথা শুনিবার জন্য অপেক্ষা করিলাম। জবাবটাও ঠিক করিয়া রাখিয়াছিলাম। বলিতাম : সত্যই। এর জন্য
৪০৪
অসংখ্য প্রশংসা তােমারই প্রাপ্য। কিন্তু অনেক দিন চলিয়া গেল। তিনি ঐ ধরনের কোনও কথাই বলিলেন না। তৈরি জবাবটা দিয়া স্ত্রীকে খুশি করিবার। কোনও মওকা কাজেই পাইলাম না। অগত্যা আমি নিজেই একদিন বলিলাম : ‘এ সবই তােমার বদৌলতে। তােমার উপদেশ না মানিলে মস্তবড় ভুল করিতাম। তিনি আমার প্রশংসাটা গায় না মাখিয়া বলিলেন : “ওসব কথা রাখ। প্রশংসা তােমারও নয়, আমারও নয়। সব প্রশংসা আল্লার। আল্লা এখানেই আমাদের রেযেক রাখিয়াছেন। তুমি তা বদলাইতে কিরূপে? এই কলিকাতায় থাকা-না থাকার উপর আমার ভবিষ্যৎ জীবনের অনেক ঘটনা নির্ভরশীল ছিল। ময়মনসিংহে চলিয়া আসিলে এর চেয়েও আর্থিক ভাল হইত কি মন্দ হইত, সেটা অবশ্য বুঝিবার বা বলিবার উপায় নাই। কিন্তু কলিকাতায় থাকার দরুন যা-যা ঘটিয়াছিল, কলিকাতায় না থাকিলে তা না ঘটিবার সম্ভাবনাই বেশি ছিল। কলিকাতার রাজনৈতিক ও সাহিত্যিক জীবনের সাথে ঘনিষ্ঠতা, রেনেসাঁ সােসাইটির প্রেসিডেন্ট হওয়া, মুসলিম লীগে যােগ দেওয়া, গণ-পরিষদের মেম্বর হওয়া, সাধারণ নির্বাচনে প্রাদেশিক লীগের নমিনেশন। পাওয়া, প্রাদেশিক মুসলিম লীগের প্রচার সম্পাদক হওয়া, ইত্তেহাদ-এর সম্পাদক হওয়া ইত্যাদি ঘটনাবলিকে যদি আমার রাজনৈতিক জীবনের উল্লেখযােগ্য ঘটনা ধরা হয়, তবে এটাও ধরিতে হইবে যে কলিকাতায় উপস্থিত না থাকিলে এর অনেকগুলিই না ঘটিতে পারিত। আমার কলিকাতার থাকার জন্য একমাত্র আমার স্ত্রীই দায়ী। সুতরাং নির্ভয়ে বলা চলে আমার জীবনের এইসব ঘটনার জন্য আমার স্ত্রীই দায়ী।
ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা আমাকে মুখের উপর স্ত্রৈণ বলিতেন। কথাটা হয় ত সত্য। কারণ আমার জীবনের সব ক্ষেত্রেই তার প্রভাব অল্প-বিস্তর ছিল। উপরের ঘটনাবলিতে তাঁর দায়িত্ব স্পষ্টই বুঝা যায়, তবে তার প্রভাব ওতে তত সুস্পষ্ট নয়। কিন্তু এর পর যা ঘটিল তাতে তার সুস্পষ্ট প্রভাব দেখা যাইবে ।

৮. বিবির প্রভাবের ব্যাপকতা
১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের এক বছর আগে হইতেই নির্বাচনের তােড়জোড় আরম্ভ হইয়াছিল। সে তােড়জোড়ের আমি অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা। আওয়ামী লীগের কাউন্সিল মিটিং হইল ময়মনসিংহে। আমি অভ্যর্থনা সমিতির চেয়ারম্যান। আমার বাসায় নেতাদের যাতায়াত ও সমাগম। সবটাতেই আমি আছি। কিন্তু বরাবরের মত আমি আগেই ঘােষণা করিয়া
৪০৫
রাখিয়াছি, আমি নিজে নির্বাচনে দাঁড়াইব না। হক সাহেব ভাসানী সাহেব ও শহীদ সাহেব সকলেই আমার এই সংকল্পের কথা জানিতেন। তাঁরা আমার দাঁড়াইবার পক্ষে অনেক যুক্তি-তর্ক দিয়াছেন। অনেক আদেশ-নির্দেশ দিয়াছেন। আমি রাজি হই নাই। মওলানা ভাসানী ও হক সাহেব আমার স্ত্রীর সঙ্গে কি আলাপ-আলােচনা করিলেন আল্লাই জানেন। এরপর তিনিও আমাকে ক্যানভাস করিতে লাগিলেন। আমি মনে করিয়াছিলাম শুধু হক সাহেব ও ভাসানী সাহেবের মত মুরুব্বিদ্বয়ের অনুরােধেই বিবিসাহেব আমাকে এই কথা বলিতেছেন। আমাকে অনুরােধ করিয়াই তিনি তার কর্তব্য শেষ করিবেন।
কিন্তু ও খােদা! আমার ‘না’ বরাবরের ন্যায় মানিলেন না। বরঞ্চ তিনি অন্য পথ ধরিলেন। বলিলেন : বেশ। তবে তােমার সংকল্পই ঠিক থাক। তুমি তবে কোনও প্রকার রাজনীতিই করিতে পারিবা না।
তর্ক বাধিয়া গেল। তিনি বলিলেন : হয় আমাকে পুরাপুরি রাজনীতি করিতে হইবে অর্থাৎ আইনসভায় যাইতে হইবে। নয় ত একদম ছাড়িতে হইবে । মাঝামাঝি রাজনীতি তিনি আমাকে করিতে দিবেন না। তর্ক করিতে-করিতে তিনি উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিলেন। আবেগ-ভরা ওজস্বিনী ভাষায় তিনি বলিলেন : পঁচিশ বছর ধরিয়া রাত জাগিয়া তােমার কর্মী বন্ধুদেরে ভাত খাওয়াইয়াছি। কোনও কথা বলি নাই। কোনও আপত্তি করি নাই। জীবন-ভরা পরের জন্য খাটিয়া শরীর খারাপ করিয়াছ, পরের জন্য ভােট ভিক্ষা করিয়া আত্মমর্যাদা নষ্ট করিয়াছ, ভােটারদের কাছে ওয়াদা করিয়াছ তােমার নিজ মুখেই কিন্তু সে ওয়াদা পূরণের দায়িত্ব দিয়াছ অপরের কাঁধে। এটা আমি আর হইতে দিব না। হয় তুমি নিজে প্রার্থী হইবা, নয় ত আজই আওয়ামী লীগের সভাপতিত্বে রিযাইন দিবা । এই দুইটার একটা তােমাকে করিতেই হইবে। আজই করিতে হইবে।
এর ফলে সকলেই জানেন। মওলানা ভাসানী ও হক সাহেব আমার মত পরিবর্তনে মােটেই বিস্মিত হন নাই। তারা বলিয়াছিলেন, এটা যে হইবে তারা তা জানিতেন। জানিতেন হয়ত ঠিকই কিন্তু তারা বােধ হয় এটা জানিতেন না। যে আমার স্ত্রী অমন বেঁকিয়া না বসিলে আমি কিছুতেই মত বদলাইতাম না। কারণ এটা কেউ বিশ্বাস করুক আর না করুক, কথাটা সত্য যে মেম্বরগিরি বা মন্ত্রিতে আমার কোনও লােভ ছিল না। এ মনােভাব আমার কংগ্রেস হইতেই শিক্ষা। আমার চিন্তা-ধারার উপর এটা মহাত্মা গান্ধীর প্রভাব। আমি ভয়ানক রাজনৈতিক চিন্তক ছিলাম। দেশের সমস্ত সমস্যা আমার মাথায় কিলবিল করিত ও করে। সে সব সমস্যা সমাধানেরও চিন্তা আমি করিতাম ও করিয়া থাকি। ঐসব সমস্যার সমাধান করিয়া দেশবাসীর কল্যাণ করিয়া যশ ও সম্মান
৪০৬
অর্জনের বাসনাও আমার খুবই তীব্র। অথচ বিপ্লবে আমি বিশ্বাস করি না। আমার মতে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচনের মাধ্যমে ঐসব সংস্কার করিতে হইবে। তা করিতে গেলে আইনসভার মেম্বাররাই ঐ সব করিবেন। শুধু মেম্বর হইলেই চলে না। মন্ত্রীও হইতে হয়। এসব ব্যাপারে আমার কোনও দ্বিমত বা দ্বিধা-সন্দেহ ছিল না। কিন্তু এসব করিতে হইলে আমাকেই মেম্বর-মন্ত্রী হইতেই হইবে, এটা আমি বিশ্বাস করি না। কংগ্রেসে মহাত্মাজী ছাড়াও অনেকে ছিলেন এবং আছেন যারা মেম্বর-মন্ত্রী না হইয়াও দেশের সেবা। করিতেছেন এবং দেশবাসীর শ্রদ্ধা-সম্মান যশ ও প্রভাবের অধিকারী হইয়াছেন। তাঁদের যশ-মর্যাদা মন্ত্রীদের চেয়ে কম নয়। এঁরাই আমার আদর্শ। কাজেই মেম্বর-মন্ত্রী না হওয়াটাকে আমি কোনও ত্যাগ মনে করিতাম না। কিন্তু আমার স্ত্রী এবং অনেক ভক্ত-অনুরক্ত সহকর্মী মনে করিতেন, আমি দলের সাফল্যের জন্যই এইভাবে আত্মত্যাগ করিতেছি। মেম্বর হইলেই আমি মন্ত্রীও হইব এটা আমার সহকর্মীরা ও আমার স্ত্রী বিশ্বাস করিতেন। আমি নিজেও করিতাম। আমি মন্ত্রী হইবার যােগ্য। দলের মধ্যে আমার চেয়ে যােগ্য লােক খুব বেশি নাই, এ আত্মবিশ্বাসও আমার ছিল এবং আছে। হয়ত আমার স্ত্রী এই চিন্তার দ্বারা প্রভাবিত হইয়াছিলেন। মন্ত্রী হওয়ার আশা ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা কোনও দোষের ব্যাপার নয়। তেমনি কোনও নারীর পক্ষে উকিলের বিবি হইতে মন্ত্রীর বেগম হইবার উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকাও দোষের নয়। যদি আমার স্ত্রীর মনে অমন উচ্চাকাঙ্ক্ষা হইয়া থাকে, তবে সেজন্য আমি তাকে দোষ দেই না। কিন্তু তেমনি কথা তিনি আমাকে বলেন নাই। বরঞ্চ আমার মেম্বর-মন্ত্রী না হওয়ার অভিপ্রায়কে তিনি দায়িত্ব এড়াইবার মনােভাব বলিয়া নিন্দা করিয়াছিলেন। তিনি বলিয়াছিলেন : তুমি দায়িত্ব লইতে ভয় পাও। পরের কাঁধে বন্দুক রাখিয়া শিকার করিতে চাও। নিজে বন্দুক কাঁধে লইতে চাও না।
এটা ভীরুতা-কাপুরুষতার অভিযােগ। এ অভিযােগ এর আগে কেউ আমার বিরুদ্ধে করেন নাই। আমিও নিজেকে কাপুরুষ মনে করিতাম না। বরঞ্চ আমি একরূপ বেপরওয়া রেকলেস ছিলাম। কাজেই দায়িত্ব এড়াইয়া চলিবার অভিযােগ, ভীরুতার কটাক্ষ, আমাকে খেপাইয়া দিয়াছিল। তাই বােধ হয় এবার অতি সহজে ত্রিশ বৎসরের সংকল্প একদিনে বিসর্জন দিতে পারিয়াছিলাম। কাজেই দেখা যাইতেছে আমার মেম্বর-মন্ত্রী হওয়ার গােড়ায় রহিয়াছে আমার স্ত্রীর প্রভাব। দেশের রাজনৈতিক কর্মীদের চরম উচ্চাকাঙ্ক্ষা যা, আমার বেলা তা পূর্ণ হইয়াছে। আমি প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের মেম্বর, প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, এমনকি পাকিস্তানের অস্থায়ী
৪০৭
প্রধানমন্ত্রীও হইয়াছি। এইদিক হইতে আমার স্ত্রীর গর্ব করিবার অধিকার আছে। এ সবের প্রশংসা একমাত্র তাঁরই প্রাপ্য। এই একই কারণে দুঃখও তার সবচেয়ে বেশি। কারণ ১৯৫৩ সালে জোর-যবরদস্তি না করিলে পাকিস্তানের অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী হইতাম না। এটা যেমন সত্য, তেমনি দুর্নীতির অভিযােগের আসামিও হইতাম না, এটাও সত্য। বেচারীর এই দুঃখ রাখিবার স্থান নাই। আমাকে গ্রেফতার করিয়া জেলে নেওয়ার সময় তিনি বলিয়াছিলেন : “তােমাকে আমিই জেলে পাঠাইলাম। জীবনে একথা আমি ভুলিতে পারিব না। আমি তাকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করিয়াছি এই বলিয়া : ‘তুমি আমাকে মন্ত্রী হইতেই বলিয়াছিলা; ভুল বা অন্যায় করিতে ত বল নাই।

৯. আমার স্বাস্থ্যের দিকে অতন্দ্র দৃষ্টি
আমার শরীর-স্বাস্থ্য, রােগ-চিকিৎসা সম্বন্ধে তিনি কতটা অধিকার খাটাইতেন, তার প্রমাণ পাইয়াছিলাম করাচিতে মন্ত্রী থাকাকালে। একবার আমার পায়ের চিকিৎসা করিতে গিয়া ডাক্তাররা ঠিক করিলেন আমার বা উরাতে সাফেনাস নামক রগ একটি কাটিয়া ফেলিতে হইবে। হাসপাতালে মন্ত্রীর উপযােগী ব্যবস্থাদি করিয়া ডাক্তাররা আমাকে নিতে আসেন। আমার স্ত্রী ডাক্তারদেরে জেরা করিয়া কী ধরনের অপারেশন হইবে, তা জানিয়া নেন এবং তাতে আপত্তি করেন। আমাকে তিনি বুঝাইতে চেষ্টা করেন যে ঔষধে সকল প্রকারের চেষ্টা শেষ না করিয়া অপারেশনে আমার রাজি হওয়া উচিৎ নয়। আমি জবাব দিলাম এ ব্যাপারে ডাক্তারদের মতকে চূড়ান্ত বলিয়া মানা উচিৎ। উত্তরে তিনি বলিলেন : পূর্ব-পাকিস্তানের প্রধান-প্রধান ডাক্তারদেরে না দেখাইয়া করাচির ডাক্তারদের মতকে তিনি চূড়ান্ত বলিয়া মানিয়া নিতে রাজি নন। আমি বিবি সাহেবের এই অযৌক্তিক জিদে বড়ই বেকায়দায় পড়িয়া যাই। যাঁরা করাচিতে আমার চিকিৎসা করিতেছেন তারা সকলেই নামকরা বড় ডাক্তার। কেউ ফিজিশিয়ান, কেউ সার্জন। তাঁদের অভিমতের নির্ভুলতার সন্দেহ করিবার কোনও কারণ নাই। তিনি আমার কথার জবাবে বলিলেন : তাদের নির্ভুল মত দুদিন পরেও নির্ভুলই থাকিবে। ইতিমধ্যে দুই-একদিনের জন্য ঢাকা গিয়া ওখানকার ডাক্তারদের কনসাল্ট করিয়া আসিতে দোষ কী? আজ শিরাটা না কাটিলেও দুদিন পরে কাটা যাইবে । কিন্তু একবার কাটিয়া ফেলিলে পুনর্বহাল করা যাইবে না। ডাক্তাররা যথেষ্ট শ্রদ্ধা-বিনয়ের ভাব দেখাইয়া দৃঢ়তার সঙ্গে জানাইলেন যে মন্ত্রী-হিসাবে আমার স্বাস্থ্যের জিম্মাদার তারা। বেগম সাহেবের তাতে হস্তক্ষেপ করিবার
৪০৮
কোনও অধিকার নাই। অধিকারের প্রশ্ন তােলায় বিবি সাহেব আগুন হইয়া গেলেন। ডাক্তারদেরে বলিলেন : মন্ত্রী হওয়ার দরুন যদি স্বামীর চিকিৎসার উপর আমার কোনও হাত না থাকে, এই মন্ত্রিত্বই যদি আপনাদেরে এই একক অধিকার দিয়া থাকে, তবে আমি তাকে এই মুহূর্তে মন্ত্রিত্বে পদত্যাগ করাইব। তবু আজ অপারেশনের জন্য আমার স্বামীকে আপনাদের হাতে ছাড়িয়া দিব না।
আমার স্ত্রী অগ্নিমূর্তি ও এই দৃঢ়তা দেখিয়া ডাক্তাররা প্রথমে স্তম্ভিত হইলেন। তাঁর অজ্ঞতায় কৌতুক বােধ করিলেন। ফলে নরম হইলেন। ভাবিলেন বােধ হয় অজ্ঞ মেয়েলােকের সঙ্গে তর্ক করা নিষ্ফল। ডাক্তাররা। নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করিয়া অপারেশনের দিন পিছাইয়া দিলেন এবং মুখে খাইবার ঔষধ দিয়া বিদায় হইলেন। ডাক্তাররা বিদায় হইলে বিবি সাহেব প্রাইভেট সেক্রেটারিকে দিয়া তৎক্ষণাৎ সেই-রাত্রের প্লেনেই ঢাকা আসিবার দু’খানা টিকিট করিয়া ফেলিলেন। এর ফলে পরদিন সকালে সাতটার সময় আমি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের একজন রােগী। বিবি সাহেবের কথাই ঠিক। ঢাকা ও মির্যাপুরের সব ডাক্তাররাই একমত হইলেন যে, বিবি সাহেব অপারেশন বাধা দিয়া আমাকে বাঁচাইয়াছেন। ঐ অপারেশন মস্ত বড় ভুল হইত। জীবনের নামে বাঁ-পা হারাইতাম।
শুধু এইবার নয়। আরেকবার করাচির বড়-বড় সার্জন-ফিজিশিয়ানরা। একমত হইয়া আমার গল-ব্লাডার অপারেশন করিতে চাহিয়াছিলেন। এ বারও বিবি সাহেব বাধা দেন এবং আবার এক্স-রে করাইয়া ঢাকার ডাক্তারদের দেখাইয়া প্রমাণ করেন যে, আমার গল-ব্লাডারে কোনও স্টোন হয় নাই।
এই সব ঘটনা হইতে এটাই বুঝা যাইবে যে, আমার স্ত্রী নিজেকেই সকল ব্যাপারে আমার গার্ডিয়ান নিযুক্ত করিয়াছেন এবং আমি তা সানন্দে মানিয়া লইয়াছি। সানন্দে মানিয়া লইয়াছি এই জন্য যে স্ত্রীর এই অভিভাবকত্ব কখনাে আমার কাছে প্রভুত্ব বলিয়া ঠেকে নাই। বরঞ্চ কথায় ও কাজে আমার সুখ-সুবিধার জন্য শারীরিক পরিশ্রমে তিনি প্রমাণ করিতেন, আজও করেন, তিনি আমার দাসী মাত্র। কাজেই দাম্পত্য জীবনে আমি পরম সুখী এ কথা শুধু আমার একার কথা নয় আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধবরাও তা বলিয়া থাকেন।

১০. সুখী দাম্পত্য জীবন
আমার অনেক বন্ধু-বান্ধবের ধারণা এবং সে ধারণা তাঁরা মুখে প্রকাশও করিয়া থাকেন যে, দাম্পত্য জীবনে এই নিরঙ্কুশ সুখই আমার প্রতিভা
৪০৯
বিকাশে বিঘ্ন উৎপাদন করিয়াছে। তাঁদের দু-চারজন খুব কঠোর ভাষায় কিন্তু আন্তরিকতার সঙ্গে বলিয়াছেন : ‘তুমি বউ-এর আঁচলে বাধা গৃহপালিত পশু “ডােমিসটিকেটেড এনিম্যাল” মাত্র। আর্ট-সাহিত্যে মৌলিক কিছু দিবার দিন তােমার ফুরাইয়াছে। শুধু আমাকে একা নয় আরাে অনেককেই একথা তারা বলিয়াছেন। সারা দুনিয়ার বহু দৃষ্টান্ত দিয়া এঁরা দেখাইয়া থাকেন যে, চিরস্মরণীয় মনীষীরা কেউই দাম্পত্য জীবনে সুখী ছিলেন না। মনীষী বলিতে তারা নিশ্চয়ই কবি-সাহিত্যিক ও দর্শনী-বিজ্ঞানীদেরেই বুঝাইয়া থাকেন। কারণ দাম্পত্য জীবনে পরম সুখী বহু লােক রাষ্ট্রনেতা হিসাবে চরম সাফল্য লাভ করিয়াছেন। অসুখী স্বামী ইব্রাহিম লিংকনের মােকাবিলা আমরা অনেক রু্যভেল্ট, চার্চিল, গান্ধীর নাম করিতে পারি। তবে কবি-সাহিত্যিকদের বেলা বন্ধুদের কথায় জোর আছে বলিয়া আমার মনে হয়। অনুভূতির তীব্রতা ছাড়া উৎকৃষ্ট কাব্য-সাহিত্য সৃষ্টি হইতে পারে না। মনের দিক হইতে সুখী লােকের অনুভূতি তীব্র হওয়ার অসুবিধা আছে। পাথরে পাথর ঘষিলে যেমন আগুন ক্ষরিত হয়, তেমনি বেদনার আঘাতেই মন হইতে তীব্র অনুভূতি বিচ্ছুরিত হয়। সুখের অপর নাম সন্তোষ । দাম্পত্য-সুখের অপর নাম গৃহ-প্রীতি বা ঘরমুখিতা। এই সন্তোষ ও ঘরমুখিতা মানুষের কল্পনা, উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও বেপরােয়া সাহস ভুতা করিয়া দেয়। এমন লােক মৌলিক শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টির শক্তি হারাইয়া ফেলে। ঘরে বা পরিবারে যার মন বাঁধা পড়িল, তাঁর চিন্তার পরিধিও স্বভাবতই ছােট হইয়া গেল। ঐ সংকীর্ণ মন ও সীমাবদ্ধ দৃষ্টি দিয়া কেউ বড়-কিছু সৃষ্টি করিতে পারে না।
এ সব কথাই ঠিক হইতে পারে। হইতে পারে কেন, বােধ হয় সত্যই ঠিক। কিন্তু যে কথাটা আমার জীবনকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করিয়াছে, তা এই যে সামাজিক জীব হিসাবে মানুষের জীবনের যেটা সবচেয়ে সুন্দর দিক সেটা মানুষের সভ্যতা। সভ্যতার প্রাথমিক ইউনিট পরিবার। পরিবারের ইউনিট দম্পতি। সুতরাং দাম্পত্য জীবনই সভ্যতার প্রাথমিক ইউনিট। ইউনিটের সঙ্গে ইউনিটির, ব্যষ্টির সঙ্গে সমষ্টির যেমন শত্রুতার সম্পর্ক থাকিতে পারে না, পরিবারের সঙ্গে তেমনি জাতির ও মানবতার শত্রুতা থাকিতে পারে না। যে বিরােধ দৃশ্যত দেখা যায়, সেটা আমাদের ভ্রান্ত নীতিরই কুফল। অন্যের সুখই আমার অসুখের হেতু, অন্য কথায় আমাকে সুখী হইতে হইলে অপরকে অসুখী করিতে হইবে, এই মনােভাবই আমাদের সমস্ত সমস্যার মূল কারণ।
৪১০
দাম্পত্য জীবন লইয়া আমরা স্বামী-স্ত্রীতে অনেক আলােচনা ও তর্কবিতর্ক করিয়াছি। সাধারণ জ্ঞানের বই-পুস্তক ছাড়া যৌনবিজ্ঞানের বইও আমি অনেক পড়িয়াছি। আমার স্ত্রীও কম পড়েন নাই। তাতে আমরা উভয়েই জ্ঞান লাভ করিয়াছি নিশ্চয়ই। কিন্তু জীবন-পুস্তক-পাঠলব্ধ জ্ঞান বই-পুস্তক পাঠ-লব্ধ জ্ঞানের চেয়ে কোনও অংশেই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমাদের চতুর্থ পুত্র মনজুর আনাম ও পঞ্চম পুত্র মহফুজ আনামের আজ্ঞা যে ছয়-সাত বছর, তা এই জ্ঞানেরই সুফল। বিদ্যা ও বয়সের শ্রেষ্ঠত্বের জোরে আমি তাঁকে। শিখাইয়াছি অনেক। কিন্তু বয়সে ছােট ও বিদ্যায় কম হইয়াও তিনিও আমাকে অনেক শিখাইয়াছেন। সে গর্ব তিনি তাঁর লেখা ও কথায় যাহির করিতে ছাড়েন নাই। তিনি বহুবার বলিয়াছেন : “আমার স্বামী আমাকে গড়িয়াছেন। নিশ্চয়ই, কিন্তু আমিও তাকে গড়িয়াছি।’ কথাটা সত্য। দাম্পত্য জীবন সম্বন্ধে স্পষ্টতই তার একটা নিজস্ব মতবাদ আছে। তিনি এ সম্পর্কে আধুনিক স্ত্রী ও আধুনিক স্বামী নামে দুইখানি জনপ্রিয় বই লিখিয়াছেন। উচ্চ-শিক্ষিত ডিগ্রিধারী বান্ধবীদের সাথে তুমুল বাদ-বিতণ্ডা করিয়া অবশ্য তাঁর মতবাদ গড়িয়াছে। আমার বা তাঁর বন্ধু-বান্ধব যারাই তাঁকে চিনেন, তাঁরা সবাই জানেন, তিনি একটা অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারিণী। আমিসহ পরিবারের এবং আত্মীয়স্বজনের সবাই আমরা সেই ব্যক্তিত্ব মানিয়া চলি।
কিন্তু মতবাদের দিক দিয়া আমিও কম একরােখা নই। তবু মতবাদ লইয়া আমাদের মধ্যে কদাচ বিরােধ হয় নাই। বন্ধু-বান্ধবরা বলেন, আমরাও জানি যে, আমরা সুখী দম্পতি। এ সুখের বয়স প্রায় অর্ধশতাব্দী। আমাদের এ সুখের গূঢ় কথা এই যে, মতবাদের দিক দিয়া আমরা আন্তরিকভাবেই টলারেন্ট । আর সব বিষয়ে আমরা সম্পূর্ণরূপে পরস্পরের উপর নির্ভরশীল। তিনি রবারের মত নমনীয়। পােশাক-পাতি ও সাজ-সজ্জা সম্পর্কে তিনি বলেন যে আমার মতই তাঁর মত। তাঁর মত-মতে স্ত্রীর সাজ-সজ্জা ত স্বামীর জন্যই। কাজেই আমি যা বলি, তিনি তাই করেন। আমি যে পােশাক পছন্দ করি, তাই তিনি পরেন । প্রসিদ্ধ পীর-আলেমের পর্দানশীন মেয়ে হইয়াও তিনি বােরকা ছাড়িয়া ‘বেপর্দা হইতে পারিয়াছিলেন এই কারণে। তিনি আমার সকল বন্ধু-বান্ধবের সাথে মিশিলেন, বব কাটিয়া ‘মেম সাব’ হইলেন। হবিবুল্লা বাহারের কলমে আজাদ-এর পৃষ্ঠা তিনি তৎকালে ‘ববকাটা ভাবি’ রূপে মশহুর হইয়াছিলেন।
রাজনীতিক মতবাদে আমি তাঁকে প্রভাবিত করিয়াছি সত্য, কিন্তু তিনি আমাকে করিয়াছেন অনেক বেশি। ত্রিশ দশকে আমি তাঁকে কংগ্রেসি
৪১১
রাজনীতিতে দীক্ষা দিয়াছিলাম। জিলা স্তরে তিনি মহিলা কংগ্রেসের আফিসবিয়ারার এবং প্রাদেশিক স্তরে সক্রিয় মেম্বর হইয়াছিলেন। কিন্তু দশ বছর পরে চল্লিশের দশকে তিনিই আমাকে পাকিস্তানি মন্ত্রে দীক্ষা দিয়াছিলেন। কৃষক ও নবযুগ-এর সম্পাদনকালে আমি যখন ঘােরতর ‘সাম্প্রদায়িকতা-বিরােধী, তিনিই তখন অতি সাবধানে ধীরে-ধীরে মুসলিম রাজনীতি’র দিকে আমার নজর ফিরান। আমার তিন ছেলে মনসুর আনাম, মহজুব আনাম ও মতলুব আনাম তখন ৮/১০/১২ বছরের কলিকাতা মাদ্রাসার নিম্ন শ্রেণীর ছাত্র। এদেরই মুসলিম লীগের ন্যাশনাল গার্ডের মিছিলে শামিল দেখিয়া একদিন ধমক দিলাম। জানিতে পারিলাম, তাদের আম্মার অনুমতি নিয়াই তারা এটা করিতেছে। আস্তে আস্তে বুঝিলাম আমার গােটা পরিবারই ‘পাকিস্তানি’ অগত্যা আমিও হইলাম। এই কারণেই বলিয়াছি, রাজনীতিতে আমার স্ত্রীই আমাকে অনেক বেশি প্রভাবিত করিয়াছেন। আমি যে তাঁকে কংগ্রেসি করিয়াছিলাম সেটা ছিল স্বল্পমেয়াদি। আর তিনি যে আমাকে পাকিস্তানি, বানাইয়াছিলেন, সেটা হইয়াছে দীর্ঘমেয়াদি। বস্তুত সারা জীবন স্থায়ী। আমার রাজনৈতিক জীবনে যদি কিছু সাফল্য ঘটিয়া থাকে, তার সবটুকু কৃতিত্বই, অতএব, আমার স্ত্রীরই প্রাপ্য।
কিন্তু এক ব্যাপারে আমি তাকে মােটেই প্রভাবিত করিতে পারি নাই। সেখানেই আবশ্যক ছিল সহিষ্ণুতা। সেটা ছিল ধর্মানুষ্ঠানের ব্যাপার। আমিও ধর্মবিশ্বাসী ছিলাম ও আছি। কিন্তু তিনি বরাবর আনুষ্ঠানিক ধার্মিক। এই আনুষ্ঠানিকতার ব্যাপারেই তিনি ছিলেন এবং আছেন সম্পূর্ণ স্বাধীন। যে মুদ্দতে তিনি আমার সহচর, পােশাক-পরিচ্ছদে, চালে-চলনে ‘অতি-আধুনিক হইয়াছিলেন, তখনও তিনি নামাজ-রােযা ছাড়েন নাই। আমার কথায়ও না, আধুনিকতার খাতিরেও না। কিছু বলিলে দৃঢ়তার সাথে জবাব দিতেন : দাস ফার, এন্ড নাে ফার্দার। ওটাই তােমার এলাকার সীমানা। এর পরের এলাকা আমার বিবেক ও আমার আল্লার ।
এই অধ্যায়ের শেষ কথা হিসাবে আমার তরুণ বন্ধুদের একটিমাত্র উপদেশই দিতে পারি : স্ত্রীকে বিশ্বাস কর এবং সেটা শুরু কর প্রথম দিন হইতেই।
৪১২
অধ্যায় বাইশ
উকালতি জীবন

১. শুরুতে নৈরাশ্য
১৯২৯ সালের নভেম্বর মাসে উকালতির সনদ লই ময়মনসিংহ জজকোর্টে প্র্যাকটিস করিবার জন্য। কিন্তু কলিকাতার সাংবাদিক জীবন গুটাইয়া আসিতে-আসিতে ১৯৩০ সালের জানুয়ারি হইয়া যায়। পঁচাশি টাকা মাহিয়ানার সাংবাদিকতা ছাড়িয়া উকালতি ধরিতে সাধ্যমত সাবধানতা অবলম্বন করিয়াছিলাম। বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজন যারা উকালতি করিতেছিলেন, চিঠি-পত্র লিখিয়া আগে হইতেই তাদের মতামত লইয়াছিলাম। প্রায় সকলেই জানাইয়াছিলেন যে আমার পক্ষে গােড়া হইতেই মােটামুটি দুই হইতে তিনশ টাকা মাসে রােযগার করা মােটেই কঠিন হইবে না।
তিনশ টাকা? তবে আর চিন্তাটা কী? স্নেহময় মৌলবী মুজিবর রহমান সাহেবকে যামিন দিয়া বাটারওয়ার্থ কোং হইতে দুই হাজার টাকার আইন বই লইয়া ময়মনসিংহে পৌছিলাম। আটাশ টাকা মাসের এক নূতন দালান ভাড়া করিলাম। উকিলের বাসার উপযােগী নয়া ফার্নিচার কিনিলাম। সাইনবাের্ড লটকাইলাম। নয়া বই-বােঝাই নয়া আলমারি-টেবিল চেয়ারে চেম্বার সাজাইয়া বসিলাম। আস দেখি এইবার কত মওক্কেল আসিতে পার।
কিন্তু মওক্কেল আসিল না। এক মাস-দুই মাস-তিন মাস গেল । শেষে চার মাসও যায়। নূতন উকিলকে কোর্ট গার্ডিয়ান করা হয়। এই গার্ডিয়ান গিরির ফিস বাবত প্রথম মাসে সাড়ে চার টাকা, দ্বিতীয় মাসে ন’টাকা, তৃতীয় মাসে ফের সাড়ে চার, চতুর্থ মাসে একদম শূন্য। বাড়ি ভাড়া বকেয়া পড়িয়াছে চার
৪১৩
মাসে সােওয়াশ । বাটারওয়ার্থের কিস্তি খেলাফ চার মাসে দুইশ। চাচা উকিল, তাঁর বাসায় খাই। তাই উপাস থাকি নাই।
ঘাবড়াইয়া গেলাম। স্ত্রী-পুত্র লইয়া নূতন দালানে ধুম-ধামে থাকিবার যে রঙ্গিন স্বপ্ন দেখিতেছিলাম, প্রবল ধাক্কায় সে স্বপ্ন ভাঙ্গিয়া গেল; চোখে অন্ধকার। দেখিতেছিলাম। কিন্তু মুখে তা প্রকাশ করিলাম না। বাইরে ভড়ক ঠিক রাখিলাম।
এমন সময় দি মুসলমা-এর শেয়ার বিক্রয় সফলে মৌ. মুজিবর রহমান সাহেব ময়মনসিংহে আসিলেন। তিনি আমার দুরবস্থার কথা জানিতে পারিয়া আমাকে তাঁর কাছে ফিরাইয়া নিতে চাইলেন। আমি রাজি না হওয়ায় তিনি নিজে খোজ-তালাশ করিয়া আট টাকা ভাড়ার ছােট বাসায় রাখিয়া গেলেন। আর নগদ চারশ টাকা দিয়া গেলেন। বাটারওয়ার্থের নিকট আরাে সময় নিবেন, আশ্বাস দিয়া গেলেন। মৌলবী সাহেবকে বিদায় দিয়া স্টেশন হইতে সােজা বাসায় আসিলাম। কৃতজ্ঞতায় অঝােরে চোখের পানি ফেলিলাম।
এরপর আস্তে-আস্তে দু-একজন করিয়া মওক্কেল আসিতে লাগিল। তারা বড় গরীব। যা দিত চোখ বুঝিয়া তাই লইতাম। বন্ধু পরামর্শ দিলেন, অভিজ্ঞ মুহরি না রাখিলে কেস পাওয়া যাইবে না। তা ত বুঝি। কিন্তু মুহরি রাখি কেমনে? ছােট বাসা। অন্যলােক রাখিবার জায়গা নাই। স্টোভে নিজ হাতে পাক করিয়া খাই। মুহরিকে খাওয়াইব কেমনে?
জ্ঞানী-অভিজ্ঞ পুরান উকিলরা বলিলেন : যদি ঝর-ঝরা কাঁচা টাকা চাও ফৌজদারি প্র্যাকটিস কর। আর যদি মরিবার দিন পর্যন্ত রােযগার করিতে চাও, তবে দেওয়ানি প্র্যাকটিস কর। আমার যা অবস্থা, তাতে আমি আগে ঝর-ঝরা কাঁচা টাকার সন্ধানে ফৌজদারি কোর্টেই গেলাম। কিন্তু টাকা ধরা দিল না। বুঝিলাম, আয়ের বেশির ভাগ টাকা টাউটকে না দিলে সেখানে কেস। পাওয়া যাইবে না। অনেক হিতৈষী বন্ধু যুক্তি দিলেন : একদম না পাওয়ার অপেক্ষা অর্ধেক পাওয়া ভাল। যুক্তি অকাট্য। কিন্তু মনকে প্রবােধ দিতে পারিলাম না।
দেওয়ানিতেই মনােযােগ দিলাম। দেওয়ানি প্র্যাকটিসে যারা হাত পাকাইয়াছেন, তাঁরা হুঁশিয়ার করিলেন : কমসেকম পাঁচ বৎসর পেটে-ভাতে থাকিতে হইবে।
তাই রাজি। পেটে-ভাতেই থাকিলাম।
বরাবরের মত স্টোভে আন্ডাভাজি ও চাউল সিদ্ধ করিতেছি, এমন সময় খান সাহেব সাহেব আলী ‘উকিল সাব’ ‘উকিল সাব’ চিৎকার করিতে করিতে
৪১৪
আশি-বৎসরের এই বৃদ্ধের এই কথার আন্তরিকতা তাঁর চোখে-মুখে ফুটিয়া উঠিল। আমি বলিলাম : আপনার কথা আমি বিশ্বাস করি; কিন্তু এই বাড়িতে ওদেরে আনি কেমন করিয়া?
উত্তরে খান সাহেব যা বলিলেন তাতে বুঝিলাম তাঁর আজিকার এ আগমন। আকস্মিক নয়। তিনি আমার সপরিবারে থাকিবার বাড়ি ঠিক করিয়াই আসিয়াছেন। সামনের বাড়িটা দুই-একদিনের মধ্যে খালি হইতেছে। ও-বাড়ি তিনি আমার জন্য ঠিক করিয়া বাড়িওয়ালার সঙ্গে চূড়ান্ত কথা ঠিক করিয়া আসিয়াছেন। পরের রবিবারে যেন বউমাকে লইয়া আসি। ঐ বাড়ি যেদিন খালি হইবে, সেইদিনই যেন আমি উক্ত বাড়িতে প্রবেশ করিয়া বিছানা-পত্র, আসবাব-পাতি ঠিক-ঠাক করিয়া রাখি। বাড়িওয়ালার সাথে আমার কথা বলিবার দরকার নাই। আমার মঙ্গল চিন্তায় এই অনাত্মীয় বৃদ্ধের নিঃস্বার্থ আগ্রহ ও তৎপরতা দেখিয়া কৃতজ্ঞতায় আমার মন ভরিয়া উঠিল। আমি এই নূতন ব্যবস্থার আর্থিক দিকটার কথা ভাবিয়া শুধু বলিলাম : কিন্তু ও-বাড়ির ভাড়া যে অনেক বেশি।
তিনি হাসিয়া জবাব দিলেন : বউমা ও ছেলেদের খােরাকিটা যিনি পাঠাইতে পারিবেন, তিনি তাদের থাকার বাড়িটার ভাড়াও পাঠাইতে পারিবেন।

৩. নূতন অভিজ্ঞতা
আমি তার পরামর্শ-মত কাজ করিলাম। দিনে-দিনে বুঝিলাম, খান। সাহেবের কথা একেবারে মিথ্যা নয়। রােযগার বাড়িতে লাগিল। কায়ক্লেশে নয় বেশ স্বচ্ছন্দে ও সুখেই দিন যাইতে লাগিল। মওক্কেল বেশ বাড়িল। অবশ্য মওক্কেল যত বাড়িল, মেহমান বাড়িল তার চেয়ে অনেক বেশি। মওক্কেল যা আসিলেন, তাদের অধিকাংশেই আত্মীয় অথবা চিনাজানা ‘দেশের লােক। লজ্জায় তাদের কাছে ফিস চাইতে পারিতাম না। নিতান্ত বাধ্য হইয়া চোখ-কান বুজিয়া যখন চাহিতাম তখন অসামান্য সরলতার। সাথে তারা জবাব দিতেন : ‘বাবাজি, টাকাই যদি দিতে পারিব, তবে আর আপনার কাছে আসিব কেন?’ কথাটার তাৎপর্য না বুঝিয়াই হয়ত এমন কথা তারা বলিতেন। কিন্তু অর্থ যাই হােক, আমি ফিস পাইতাম না। আর ফিস তাঁরা আমাকে দেন বা না দেন আত্মীয়তা হইতে তাঁরা আমাকে বঞ্চিত করিতেন না। অন্য উকিলকে ফিস দিয়া তারা রাত্রে আমার মেহমান হইতে
৪১৬
বিন্দুমাত্র লজ্জা পাইতেন না। শহরে থাকিবেন অথচ আমার মত নিকট আত্মীয়ের বাসায় না উঠিয়া অন্যত্র উঠিলে আমিই বা কী মনে করিব, আর লােকেই বা কী বলিবে? এইভাবে মওক্কেলের চেয়ে মেহমান বেশি হওয়ায়ও খােদার ফযলে একরকমে চলিয়া যাইত। এইখানেই খান সাহেবের কথার সত্যতা আরাে বেশি করিয়া ঠিক প্রমাণিত হইল। খান সাহেব মাঝে-মাঝেই আমার খোঁজখবর করিতে আসিতেন। আমার বৈঠকখানা ভর্তি লােক দেখিয়া পরিতৃপ্তির হাসি-হাসিয়া বিদায় হইতেন। বৈঠকখানার লােকের শতকরা নব্বই জন যে মওক্কেল নয়, বাকি দশের অর্ধেক যে বিনা-পয়সার মওক্কেল তা-ও তিনি জানিতেন। কারণ কোর্টে সে কথা বলিতেন এবং সাহস দিতেন। বলিতেন, আগে ভিড় হউক। এই ভিড় হইতেই মওক্কেল বাহির হইবে।
আমার বিদ্যা-বুদ্ধি ও বাগ্মিতার প্রতি বাপজীর আস্থা ছিল অসীম। কাজেই উকিল হওয়ামাত্র আমার চারপাশে মওক্কেল মৌমাছির মত ভেনভেন করিয়া ঘুরিতে শুরু করিবে, এই ছিল তাঁর বিশ্বাস। কিন্তু বউমার নিকট ও লােকমুখে আমার অবস্থার কথা শুনিয়া তিনিও ঘাবড়াইয়া উঠিলেন। তাঁর মত নিরীহ সরল মানুষও বাড়ি বসিয়া থাকিতে পারিলেন না। আমাকে কেস দিবার জন্য তিনি আত্মীয়-বন্ধুর বাড়ি-বাড়ি ক্যানভাস করিয়া বেড়াইতে লাগিলেন। এই আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে একজনের কথা আমি ভুলিতে পারি নাই। তখন তার উপর রাগ করিয়াছিলাম। এখন ব্যাপার বুঝিতে পারিয়াছি বলিয়া সে রাগ আর নাই।
এই আত্মীয়টি একজন মৌলবী সাহেব। তিনি অনেক জমি-জমা-ওয়ালা অবস্থাশালী বলিয়া তার নিজেরও অনেক মামলা-মােকদ্দমা ছিল। তার চেয়ে বেশি তিনি আশ-পাশের মামলাবাজ লােকদের মামলার তদবিরাদি করিতেন। ফলে সপ্তাহে ছয় দিনই তিনি কোর্টে হাজির থাকিতেন। বাপজী এঁকেই আমার মুরুব্বি ধরিলেন। আমাকে কেস দিবার জন্য তাঁকে জোর করিয়া পাকড়াইলেন। মৌলবী সাহেব কেস ত দিলেনই না, কোরআন হাদিস আওড়াইয়া বাপজীকে বুঝাইয়া দিলেন যে, উকালতি পেশা মুসলমানের নয়; ওটা পেশাকারের ব্যবসার মতই হারাম। আমার মত একটা ভাল ছেলেকে ঐ হারাম ব্যবসায়ে দিয়া আমার বাপ গােনাহ করিয়াছেন। মৌলবী সাহেব নিজে ঐ পাপ কাজের সহায়তা করেন কেন, বাপজীর এই কৌতূহলের উপরে তিনি বাপজানকে এই জ্ঞানের নূর দান করেন : মুসলমানের জন্য নাপাক দুনিয়ায় দুনিয়াবি কাজের জন্য মামলা-মােকদ্দমার মত গােনার কাজ করিতেই
৪১৭
যখন হয়, তখন সেটা মালাউন-কাফের-হিন্দুদের দিয়া করাই ভাল। বাপজীর মত ধার্মিক আত্মীয়ের প্রিয় পুত্রকে দিয়া তিনি এই পাপ করাইতে পারেন না।
মৌলবী সাহেবের কথিত উদ্দেশ্যে না হইলেও অন্য কারণে তকালে অধিকাংশ অবস্থাশালী মুসলমান হিন্দু উকিলদেরই কেস দিতেন। তৎকালে এই ধারণা খুব প্রবল ছিল যে, হিন্দুরাই ভাল উকিল; মুসলমানরা ভাল উকিল নয়। ধারণাটা নিতান্ত মিথ্যা ছিল না। মুসলমান উকিলদের অধিকাংশই ফৌজদারি কেস নিতেন। কয়েক দিন হাত-মুখ পাকাইয়াই তারা এসিস্ট্যান্ট পাবলিক প্রসিকিউটর হইবার আশায় অফিসারদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ আরম্ভ করিতেন। এর ফলে আরেকটা ধারণা মক্কেলদের মধ্যে হইয়াছিল যে মুসলমান উকিলরা দেওয়ানি মােকদ্দমা বুঝেন না। এই ধারণার বিরুদ্ধে লড়াই করিয়াই আমাকে উকালতি, তা-ও দেওয়ানি উকালতি চালাইয়া যাইতে হইল। কোনও মতে বাসা খরচ যখন চলিয়া যাইতেছে তখন শনৈঃ শনৈঃ অগ্রসর হইতেও আমার কোনও আপত্তি ছিল না।

৪. ‘অনুকিলী’-সততা
এই সময়ে উকিল হিসাবে আমি দুইটি কাজ করিলাম, যার ফলে উকিলরা যেমন আমার উপর খাফা হইলেন, মওক্কেল সাধারণ বিশেষত মুসলমান মওক্কেলরা আমার উপর তেমনি সন্তুষ্ট হইলেন।
প্রথমটি উকিলের বৈঠকখানায় মওক্কেলদের বসিবার ব্যবস্থা। তক্কালে ময়মনসিংহ শহরে প্রায় দুই-আড়াইশ উকিল। তার মধ্যে মুসলমানের সংখ্যা মাত্র জন ত্রিশেক। বাকি সকলেই হিন্দু। তাদের মধ্যে দুই-তিনজন ব্যারিস্টার ছিলেন। হিন্দু উকিলদের চেম্বারে সাধারণ মুসলমান মওক্কেলরা চেয়ারে বসিতে পারিতেন না। তাঁদের জন্য ছিল টুল। প্রত্যেক হিন্দু উকিলের। বৈঠকখানায় এককোণে মুসলমান মওক্কেলদের জন্য একটি পানি-ছাড়া ডাবা (নারিকেলী হুক্কা), কতকটা ভুষি তামাক এবং কিছু টিক্কা থাকিত। মওক্কেলরা নিজ হাতে তামাক সাজিয়া খাইতেন। নিতান্ত শিক্ষিত ভদ্রবেশী ছাড়া আর সব মুসলমান মওক্কেলকেই উকিলরা তুমি’ বলিতেন। ময়মনসিংহ হিন্দুজমিদার-প্রধান জিলা। এখানে জমিদার ও তাদের কর্মচারী-আমলা সবাই মুসলমান প্রজাদেরে ছােট-বড়-ধনী-নির্ধন-নির্বিশেষে তুমি’ বলিয়া থাকেন। উকিলরা তাঁদেরই আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব। কাজেই জমিদার কাছারির এই
৪১৮
আদব-কায়দা খুব স্বাভাবিকভাবেই উকিলের শেরেস্তায় ঢুকিয়াছে। এই জন্য হিন্দু উকিলের শেরেস্তায় মুসলমানদের অমর্যাদার, এই অবমাননার, এই নীচুতার, এই অছুৎ-অছুৎ ভাবটা বিশেষ কারাে চোখে দৃষ্টিকটু লাগিত না। আমার কাছেও না।
কিন্তু আমি উকালতি করিতে আসিয়া দেখিলাম যে, শুধু হিন্দু উকিলদের নয়, মুসলমান উকিলদের বাসাতেও এই ব্যবস্থা। মুসলমান উকিলদের অধিকাংশেই আমারই মত কৃষক-সম্প্রদায়ের লােক। তাঁদের আত্মীয়স্বজন যারা মামলা করিতে আসেন, তারাও অধিকাংশ শিক্ষাদীক্ষায় পােশাকেপরিচ্ছদে নিতান্ত সাধারণ লােক। মুসলমান উকিলের বাসাতে আসিয়াও তাঁরা বরাবরের অভ্যাস-মত টুলেই বসিতেন, চেয়ারে বসিতেন না।
হুঁক্কার অবস্থাও প্রায় তাই। এই ব্যবস্থা আমার মনে পীড়া দিল। দুইএকজন ঘনিষ্ঠ মুসলিম বন্ধুর কাছে কথাটা তুলিলাম। তাদের এই ব্যবহারের প্রতিবাদ করিলাম। তারা আমার ভাবালুতার নিন্দা করিলেন। ব্যবসা করিতে গেলে ওসব সেন্টিমেন্টালগিরি চলিবে না। মামলায় মুসলমান মক্কেলদেরে চেয়ারে বসিতে দিলে তারা মাথায় উঠিবে। হিন্দু উকিলরা আমাদের বৈঠকখানায় আসিবেন না। হিন্দু-মুসলিম উকিলদের মধ্যে পরস্পরের বৈঠকখানায় আড্ডা মারার যে একটা ভ্রাতৃত্ব গড়িয়া উঠিয়াছে, এটা নষ্ট হইবে। এতে মুসলমান উকিলদেরই ক্ষতি হইবে। বন্ধুরা নিজেদের অভিজ্ঞতা হইতেই এসব কথা বলিলেন। দুই-তিনজন গােড়ার দিকে নাকি আমার মতই চিন্তা করিতেন এবং কাজও এইরূপ শুরু করিয়াছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজেদের স্বার্থেই ঐ ভাবালুতা ত্যাগ করিয়াছেন।
বন্ধুদের কথা আমার পছন্দ হইল না তাই তাঁদের অভিজ্ঞতার খুঁটি-নাটি জানিতে চাহিলাম। কে কবে কোন মুসলিম মওক্কেলকে চেয়ারে বসিতে দেখিয়াছিলেন, কোন হিন্দু বন্ধু তার প্রতিবাদ করিয়াছিলেন, ইত্যাদি জানিবার চেষ্টা করিলাম। বুঝিলাম, এঁরা কেউ কিছুই করেন নাই। কোনও হিন্দু বন্ধুও প্রতিবাদ করেন নাই। কাজেই অমন কোনও ঘটনাই ঘটে নাই। ঘটিয়া থাকিলেও এঁরা দেখেন নাই । অনুমানেই এঁরা এই চিত্র আঁকিয়া লইয়াছিলেন। যা হইতে পারে, হওয়া খুব সম্ভব, তাই হইয়াছে বলিয়া ইহারা চালাইয়া দিয়াছেন।
কাজেই এই ব্যবস্থা আমি মানিলাম না। আমার বৈঠকখানায় চেয়ারের সংখ্যা বাড়াইলাম। যে কোনও মওক্কেল আসিলেই আমি হাতের ইশারায় চেয়ারে বসিতে বলিতাম।
৪১৯
অনেক মওক্কেল আনন্দে আসন গ্রহণ করিতেন। কিন্তু অধিকাংশেই আমার কথা অগ্রাহ্য করিয়া টুলেই বসিতেন। আমি তাঁদেরে চেষ্টা করিয়া আনিয়া চেয়ারে বসাইতাম। তাঁরা জড়-সড় হইয়া চেয়ারের কিনারায় বসিতেন। স্পষ্টই দেখিতাম তারা চেয়ারে বসিয়া অস্বস্তি বােধ করিতেছেন। তখন মামলার আলােচনা ফেলিয়া বসার ব্যবস্থা মান-সম্মান এবং মওক্কেলের অধিকার ইত্যাদি সম্বন্ধে বক্তৃতা শুরু করিতাম । উকিল-মােখতারদের সমস্ত বাড়ি-ঘর, দালান-কোঠা, টেবিল-চেয়ার ও খাট-পালং-এর প্রতিটি ইট-কাঠ মওক্কেলদের টাকায় হইয়াছে, এদিকে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করিতাম। মওক্কেলরা উকিলদের অন্নদাতা মনিব, উকিলরা মক্কেলদের দিন চুক্তির কামলা, এই সব কথা বলিতাম। কে কোথায় কবে শুনিয়াছেন যে মনিবকে চাকর তুই-তুংকার করে? কে কোথায় দেখিয়াছেন যে চাকর চেয়ারে বসিয়া থাকে আর মনিব তার সামনে চেয়ারে না বসিয়া টুলে বসিয়া থাকে? দস্তুরমত কৃষক-প্রজার পাবলিক মিটিং-এর বক্তৃতা।
আমার বক্তৃতায় ক্রিয়া শুরু হইল। আমার চেম্বারে লুঙ্গি-পরা, খালি গা, গামছা-কাঁধে মওক্কেলদেরে চেয়ারে বসিয়া থাকিতে রাস্তার লােকেরা দেখিতে পাইল। নিতান্ত অল্প-বয়স্ক ছেলেদেরে ছাড়া আর সকল শ্রেণীর মক্কেলদেরে আমি আপনি সম্বােধন করিতে লাগিলাম । এমনকি, দেশের বাড়িতে, রাস্তাঘাটে ও হাটে-বাজারে, যাদেরে আমি তুমি’, বলিয়া নাম ধরিয়া ডাকিতাম, কোর্টে-কাছারিতে-এজলাসে-কাঠগড়াতে, বার লাইব্রেরিতে তাদেরই ‘আপনি’ ‘অমুক সাহেব’ বলিয়া ডাকিতে লাগিলাম। মাতবর শ্রেণীর মওক্কেলরা আমার বৈঠকখানায় বসিয়া আমার ফরসি হুঁক্কা আর গড়গড়ায় তামাক খাইতে লাগিলেন। আমি নিজে হুক্কা টানিবার পর নিজ হাতে টেবিলের উপর দিয়া গড়গড়ার নল মওক্কেলের দিকে বাড়াইয়া বলিতাম : হুঁক্কা মরজী করেন।
কথাটা বনের আগুনের মতই শহর-সুদ্ধা ছড়াইয়া পড়িল। আমার নিকট প্রতিবেশী উকিল বন্ধু ছিলেন একজন জমিদার। তার সাথে আমার খুবই ঘনিষ্ঠতা ছিল। তিনি সাহিত্যামােদী ছিলেন। তা ছাড়া তিনি আমার সাথে ক্রসওয়ার্ড ও দাবা খেলিতেন। আমার বৈঠকখানায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠান তিনিই প্রতিবাদ করিলেন সকলের আগে। আমার মক্কেলদের মধ্যে তারা নিজের প্রজার সংখ্যাও কম ছিল না। যদিও তিনি বরাবর শহরে থাকিতেন বলিয়া প্রজাদের অনেকেই তাকে চিনিত না, এবং তিনি নিজেও কোনও প্রজাকেই চিনিতেন না, তবু প্রজা ত? তাদের সাথে তিনি একত্রে চেয়ারে বসেন কী
৪২০
করিয়া? কাজেই তিনি আমার বাসায় আসা বন্ধ করিলেন। ঐ সব কাজের জন্য এবং দাবা খেলিতে অতঃপর তিনি তাঁর বৈঠকখানায় আমাকে ডাকিয়া নিতেন।
যা হােক আমার বাসায় এই সুবিধার কথা শুনিয়া মওক্কেল সাধারণের অধিকার বােধ ও আত্মমর্যাদা জ্ঞান বাড়িল। তারা প্রায় সব উকিলের বাসায় অমন ব্যবহার পাইবার আশা করিতে লাগিলেন। অনেকেই কাজে-কর্মে তাদের দাবি প্রতিষ্ঠা করিতে লাগিলেন। উকিলদের অনেকেই আমার নিন্দা করিলেন। আনুষ্ঠানিকভাবে না হইলেও কথাটাও বার লাইব্রেরিতে উঠিল । এই সময় বার লাইব্রেরিতে কনসালটেশানের জন্য অর্থাৎ মওক্কেলদেরে লইয়া কথাবার্তা বলিবার জন্য কোনও নির্দিষ্ট কামরা ছিল না। আমার প্রবর্তিত নয়া অধিকার খাটাইতে গিয়া অনেক মওক্কেল বার লাইব্রেরিতে উকিলদের জন্য নির্দিষ্ট চেয়ার খালি পাইলেই বসিয়া পড়িতে লাগিলেন। আমার প্রবর্তিত নয়া ব্যবস্থারই এটা কুফল বলিয়া সকলে আমার ভুল চোখে আঙুল দিয়া দেখাইতে লাগিলেন। কিন্তু আমি তাতেও পরাজয় স্বীকার না করায় অবশেষে মওক্কেলদের আক্রমণ হইতে উকিলদের চেয়ার রক্ষার উদ্দেশ্যে কনসালটেশনের জন্য অর্থাৎ মওক্কেলদের জন্য একটি কামরা আলাদা বলিয়া নির্দিষ্ট করিয়া দেওয়া হইল।
দ্বিতীয়টি এই : তকালে কোর্ট ফি আইন অনুসারে পঞ্চাশ টাকার বেশি মূল্যের মামলার দরখাস্তে লাগিত বার আনার কোর্ট ফি; এর কম মূল্যের মামলার দরখাস্তে লাগিত দুই আনার কোর্ট ফি । এই দরখাস্ত বাদী-বিবাদী উভয় পক্ষেই লাগে। অধিকাংশ মামলার বিশেষত বকেয়া খাযনা মামলার দাবি প্রায়ই পঞ্চাশের কম থাকিত। আমি নয়া উকিল হিসাবে দেখিলাম যে পঞ্চাশ টাকার উপর-নিচ-নির্বিশেষে সমস্ত মামলার দরখাস্ত কোর্ট ফি খরচা বার আনা আদায় করা হইতেছে। আমি অনেক পুরাতন মামলাবাজ লােকের সঙ্গে আলাপ করিয়া দেখিলাম : দুই আনা কোর্ট ফির কমেও দরখাস্ত হইতে পারে, এ কথা তারা জানেন না। এমন অদ্ভুত কথা তারা কোনওদিন শুনেনও নাই। আমি দুই-একজন প্রবীণ উকিলকে এ কথা জিজ্ঞাসা করিলাম; তারা বলিলেন : ওটা উকিলদের ‘ট্রেড-সিক্রেট’। মক্কেলদেরে ও-কথা জানাইতে নাই। আমি আমার মুহরিকে এ কথা বলিলাম। তিনিও অপর উকিলদের কথা সমর্থন করিলেন। সকলেই বলিলেন : বেশির ভাগ মওক্কেলই বড় পাজি। তাঁরা উকিল-মুহরির ন্যায্য পাওনা দিতে চান না। তাঁদের নিকট হইতে কোর্ট ফি, পেশকার, শেরেস্তাদার, দাখিলি-রেজিস্ট্রারি ইত্যাদির বাজে দোহাই দিয়া।
৪২১
টাকা আদায় করিতে হয়। আমি তাঁদের যুক্তি গ্রহণ করিলাম না। চিনাপরিচিত মওক্কেলদেরে এই ‘ট্রেড সিক্রেট’ বলিয়া দিলাম। তকালে কোর্ট ফি আইনের সংক্ষিপ্তসার বাংলায় দু-চার আনা দামের পুস্তিকাকারে কলিকাতায় পাওয়া যাইত। আমি অনেক মামলাবাজ লােককে দিয়া ঐ পুস্তিকার এক-এক কপি কিনাইলাম। ইহাতে উকিল-মুহরিদের অনেকেই আমার উপর ভয়ানক খাফা হইলেন। কিন্তু মক্কেলদের নিকট আমি খুব জনপ্রিয় হইয়া উঠিলাম । আমার পসার বাড়িয়া গেল।

৫. ফিস আদায়
কিন্তু ক্রমে বুঝিতে পারিলাম যে, আমাদের দেশের মফস্বলের মক্কেলরা। বাস্তবিকই উকিলের ন্যায্য ফিস দিতে কৃপণতা করেন। এঁরাই আবার হাকিম, পেশকার, দারােগা, শেরেস্তাদার বাবত মুক্তহস্তে টাকা খরচ করেন। আমার নিজের বেলাতে এমন অনেক ঘটনা ঘটিয়াছে। মওক্কেল আমার ফিস বাবত দুটা টাকা দিলেন না। পকেট ঝাড়িয়া দেখাইলেন, বাড়ি ফিরিবার ট্রেন ভাড়া বাবত মাত্র চারি আনা পয়সা আছে। আজ দিতে পারিবেন না। দুই-এক দিনের মধ্যেই আমার ফিস লইয়া আসিতেছেন। আমার নিজের নিষ্ফলতা দেখিয়া আমার মুহরি আমাকে গােপনে বলিলেন : ‘আপনি যদি ফিস আদায়ের ক্ষমতা আমাকে দেন এবং পরে কিছু না বলেন, তবে আমি চেষ্টা করিয়া দেখিতে পারি। আমি অনুমতি দিয়া বার লাইব্রেরিতে বসিয়া আড্ডা মারিতে লাগিলাম। আধ ঘণ্টার মধ্যে ফিরিয়া আসিয়া মুহরি সাহেব আমাকে পাঁচটা টাকা দিয়া বলিলেন : “আজকার দুই টাকা, আগের পাওনা তিন টাকা। আমি বিস্ময় ও কৃতজ্ঞতার সাথে বলিলাম : ‘এটা কিরূপে সম্ভব হইল?’ মুহরি সাহেব বলিলেন : সে কথা জিজ্ঞাসা করিবেন না।’
জিজ্ঞাসা করিলামও না। অতঃপর আমার ফিস আদায়ের ভার মুহরি সাহেবের উপরই ছাড়িয়া দিলাম। আস্তে-আস্তে আমার ফিসসহ মামলা খরচের টাকা-পয়সা আদায় আমি একদম ছাড়িয়া দিলাম। মওক্কেলরা উপযাজক হইয়া আমার হাতে দিতে চাহিলেও আমি নিতাম না। বলিতাম : মুহরি সাবের হাতে দেন। অনেক বড়-বড় মওক্কেল এতে চটিতেন। এটাকে অপমান মনে করিতেন। কিন্তু আমি বুঝাইতাম : হিসাবের সুবিধার জন্য খাতায় তারিখ-মত টাকা-পয়সা জমা করিবার সুবিধার জন্যই এটা দরকার।
৪২২
কারণ পয়সা-কড়ির ব্যাপারে আমি একেবারে ছেলেমানুষ। তখন তারা নিরস্ত হইতেন। ফলে আমার উকালতি জীবনের শেষ পর্যন্ত মক্কেলদের সঙ্গে টাকা-পয়সার ব্যাপারে আমার সােজাসুজি সম্পর্ক ছিল না। মুহরিই আমার পক্ষ হইতে সকল টাকা-কড়ি আদায় করিতেন।
কিন্তু এই ব্যবস্থার একটা খারাপ দিকও ছিল । উকিল নিজ হাতে টাকা নিতে না পারেন, কিন্তু তাঁর ফিস কত, মুহরির পাওনা কত, কোর্ট ফি-আদি বাবত খরচ কত, এসব কথা মক্কেলের জানা উচিৎ। তা না করিয়া মওক্কেলকে অন্ধকারে রাখিয়া মুহরির উপর টাকা-পয়সা আদায়ের ভার দিলে টাকা-পয়সা আদায়ের যে সুবিধা হয়, সে কথা আগে বলিলাম। কিন্তু এর দোষের দিকটাও আমাদের দেখা উচিৎ। সাধারণ মওক্কেলরা উকিল-মুহরির ন্যায্য পাওনা দিতে চায় না বলিয়াই মুহরিরা পেশকার-শেরেস্তাদারের নামে টাকা আদায় করিতে বাধ্য হয়, এই হইল সাধারণ মত। কিন্তু কথাটা পুরাপুরি ঠিক নয়। শুধু মক্কেলদেরে একতরফাভারে দোষ দেওয়া চলে না। উকিল-মুহরিরাও এতে সমানভাবে দোষী। মওক্কেলরা উকিল-মুহরির নামে টাকা না দিয়া পেশকার-শেরেস্তাদারের নামে টাকা দেন, এতে এটাই প্রমাণিত হয় যে, মওক্কেলরা তাঁদের কেসের ব্যাপারে উকিলের চেয়ে পেশকার-শেরেস্তাদারকেই বেশি গুরুত্ব দিয়া থাকেন। ভাবটা এই : পেশকার-শেরেস্তাদার পক্ষে থাকিলে উকিল না হইলেও চলে। অজ্ঞ সাধারণ মওক্কেলের মনে এ ধারণা সৃষ্টি করিয়াছে কে? উকিল-মুহরিরাই। একদিনে এই ধারণার সৃষ্টি হয় নাই। আস্তে আস্তে অনেক দিনে এই ধারণার জন্ম হইয়াছে। উকিল-মুহরিরাই নিজেদের কাজে-কর্মে ও কথাবার্তায় এই ধারণার জন্ম দিয়াছেন। আয় ও মর্যাদা উভয় দিক হইতেই এতে আইনব্যবসায়ীর লােকসান হইয়াছে।

৬. টাউট প্রথা
এই ভ্রান্ত ধারণা হইতে যে আরেকটা কুপ্রথা আইন ব্যবসায়ে ঢুকিয়াছে তার নাম টাউট প্রথা। অবস্থা এমন দাড়িইয়াছে, টাউট না ধরিয়া আইন ব্যবসা, বিশেষত ফৌজদারি আইন ব্যবসা করা একরূপ অসম্ভব হইয়া উঠিয়াছে। গােড়াতে এই প্রথার পক্ষেও একটা নৈতিক ও আইন-সম্মত যুক্তি দেওয়া হইত, তাঁদেরে টাউট না বলিয়া এক শ্রেণীর প্রাইমারি-লিগ্যাল এডভাইয়ার’ বলা যাইতে পারে। সুদূর পাড়াগাঁয়ের অজ্ঞ মামলা-ওয়ালাদের পথ-ঘাট
৪২৩
চিনাইয়া ঠক-রাহাজান-পকেটমারের হাত হইতে বাঁচাইয়া নির্ভরযােগ্য উকিল-মােখতারের শেরেস্তায় পৌছাইয়া দেওয়াও এডমিনিস্ট্রেশন-অবজাসটিসের একটা অঙ্গ। সুতরাং উকিল-মােখতারের মত তাদেরও একটা ফিস পাওয়া উচিৎ। এ ফিসটা ন্যায়ত মওক্কেলরই দেওয়া উচিৎ। কিন্তু নানা কারণে ওঁরা মক্কেলের কাছে তা সােজাসুজি চাইতে পারেন না। কাজেই উকিল-মােখতাররাই ঐ পাওনাটা আদায় করিয়া দেন। তাহা আদায় করিতে গিয়া কেউ নিজের ফিসটাই প্রয়ােজন-মাফিক বাড়াইয়া আদায় করেন, কেউ পেশকার-শেরেস্তাদার এবং কোর্ট-এর নামে আদায় করিয়া থাকেন। কোর্ট শব্দ দ্বারা তারা অবশ্য মিন করেন কোর্ট ইন্সপেক্টর বা কোর্ট সাব-ইন্সপেক্টর । কিন্তু ঐ সংক্ষিপ্ত শব্দ ব্যবহারের মধ্যে উচ্চারণ-সুবিধা ছাড়াও আরেকটা উদ্দেশ্য লুক্কাইত থাকে। কোর্ট অর্থে যে কেউ-কেউ হাকিম-ম্যাজিস্ট্রেট বুঝেন তাতে টাকা আদায় সহজও হয়। অথচ হাকিমের নামে ঘুষ আদায়ের রিস্কও থাকে না। এইভাবে গােড়াতে টাউট প্রথার সৃষ্টি হইয়াছিল। কিন্তু কালক্রমে আজ এ প্রথা আফিস-আদালতের করাপশন প্রথার মতই অকটোপাসের শক্তি অর্জন করিয়াছে।
আমি যখন উকালতিতে ঢুকি, তখন অনেক হিতৈষী মুরুব্বি প্রবীণ উকিল আমাকে এই প্রথার উপকারিতা বুঝাইবার চেষ্টা করিয়াছেন। এঁদের বিরুদ্ধতার বিপদ সম্বন্ধেও আমাকে সজাগ করিয়াছেন। এক মুরুব্বি প্রবীণ উকিল নিজের সময়ের অভাবহেতু একটি দায়রা মামলা আমার কাছে পাঠাইয়াছিলেন। মামলায় জিতিয়াছিলাম। কাজেই মুরুব্বির প্রশংসা পাইয়াছিলাম। কিন্তু এক কারণে তিরস্কৃতও হইয়াছিলাম। তদবিরকারককে আদায়ী ফিসের অংশ না দেওয়ায় তিনি উক্ত প্রবীণ উকিলের কাছে নালিশ করেন। মুরুব্বি আমার ঐ কাজকে ‘প্রফেশন্যাল মিসকন্ডাক্ট’ বলিয়াছেন। আরেকজন সিনিয়র ফৌজদারি উকিলের এই সুনাম ছিল যে তিনি আদায়ী ফিসের শতকরা পঁচাত্তর টাকা টাউটকে দিয়া থাকেন। আমি এ সম্বন্ধে তাঁকে জিজ্ঞাসা করিলে তিনি টাউট প্রথার উপকারিতা সম্বন্ধে ওজস্বিনী ভাষায় বক্তৃতা করিলেন। তাঁর মধ্যে মুদ্দা কথা ছিল দুইটা : (১) তুমি এক দিনে একটা কেস করিয়া পাইবে দশ টাকা; আর আমি একদিন দশটা কেস করিয়া পাইব দশদশং একশ। টাউটদের পঁচাত্তর বাদ দিয়াও আমার থাকিবে নেট পঁচিশ। (২) টাউট ছাড়া কেস করিয়া হারিলে মওক্কেলের গাল খাইতে হয় উকিলের; আর টাউটদের মাধ্যমে কেস করিয়া হারিলে উকিলের গাল খাইতে হয় না, সে গাল খায় হাকিম। টাউট একশ একটা যুক্তি প্রমাণ দিয়া
৪২৪
মওক্কেলকে চোখে আঙুল দিয়া বুঝাইয়া দিবেন এই উকিলের মত সুন্দর করিয়া কেস কেউ করিতে পারিত না। কিন্তু অপর পক্ষ হাকিমকে মােটা ঘুষ দিয়া মামলা জিতিয়াছে।
উভয় প্রবীণ মুরুব্বির কথার কঠোর সত্যতা পরে বুঝিয়াছিলাম। কিন্তু তাঁদের উপদেশ মানিয়া চলিতে মনকে কিছুতেই রাজি করিতে পারি নাই।

৭. ‘নােবল প্রফেশন’
উকালতি ব্যবসাকে আমি উঁচু দরের মহান বৃত্তি ‘নােবল প্রফেশন’ মনে করিতাম। এখনও করি। আমাদের দেশের বড়-বড় উকিল-ব্যারিস্টারের মতামত এবং বই-পুস্তক পড়িয়াই আমার এই বিশ্বাস হইয়াছে। অবশ্য এর বিরুদ্ধ কথাও শুনিয়াছি পরম শ্রদ্ধেয় আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় একদা প্রকাশ্য সভায় বলিয়াছিলেন : ‘উকিল ও বেশ্যা একই শ্রেণীর ব্যবসায়ী; একদল সতীত্ব বিক্রয় করিয়া খায়, অপর দল সততা বিক্রয় করিয়া খায়। আচার্য রায় ছাড়াও আরাে অনেক বিজ্ঞানী ও শিক্ষক উকিলদেরে লইয়ার’ না বলিয়া ‘লায়ার’ বলিয়াছেন।
তলাইয়া বিচার করিলে শেষ পর্যন্ত দেখা যাইবে যে, উভয় মতের মধ্যেই সত্য আছে। এডমিনিস্ট্রেশন-অব-জাসটিস’কে যদি মহৎ কাজ বলিতে হয়, কোর্ট-আদালত, হাকিম-হুকামাকে যদি সভ্যতার অলংকার বলিতে হয়, মানুষের জান-মালের নিরাপত্তা ও মৌলিক অধিকার রক্ষাকে যদি মহান দায়িত্ব ও কর্তব্য বলিতে হয়, তবে উকিল সম্প্রদায়কে অমন উচ্চ মর্যাদার আসন না দিয়া উপায় নাই। উকিলরা যে এই এডমিনিস্ট্রেশন-অব-জাসটিসের অপরিহার্য অঙ্গ, সেটা যুক্তি ও দৃষ্টান্ত দিয়া বুঝাইবার দরকার নাই।
বলা যাইতে পারে উকালতি মানুষের মন ও চরিত্রকে ‘এনৃনােবল করে না। মানুষের হৃদয়কে উদার, চিন্তাকে উন্নত ও দৃষ্টিকে প্রসারিত করে না। কারণ আসলে উকিলরা নিজেদের মক্কেলকে জিতাইতেই চান, সুবিচার চান না। মামলা জিতিবার জন্য তাঁরা মওক্কেল ও সাক্ষীকে মিথ্যা কথা শিখান। ধর্মের নামে হলফ করিয়া মানুষ যে আদালতের কাঠগড়ায় ডাহা। মিথ্যা কথা বলিয়া আসে, তা কেবল এই বিদ্বান-বুদ্ধিমান উকিলদের পরামর্শেই।
অভিযােগ মিথ্যা নয়। একটু পরেই নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার নজির দিতেছি। কিন্তু তার আগে একটু ভূমিকা করিয়া লইতে চাই।
৪২৫
আমাদের মনে রাখিতে হইবে কোনও ব্যবসা বা রােযগারের পথই মানুষকে পুরাপুরি এনােবল করে না। সব রােযগারের পথেই কিছু না কিছু দোষ-ত্রুটি আছেই। সব ব্যবসাতেই মানুষ নিজের স্বার্থের দিকটা সকলের আগে দেখিয়া থাকে। দৃশ্যত সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যবসা যে মসজিদের এমামতি, মন্দিরের পৌরাহিত্য, গির্জার ক্লার্জিম্যানগিরি, তবলিগ বা মিশনারিগিরি, এমনকি মাস্টার-প্রফেসারগিরি, এ সব ব্যবসাও স্বতই মানুষের আত্মাকে উন্নত করে না। অন্যান্য ব্যবসার কথা ত উঠেই না। সব ব্যবসা ও রােযগারের ব্যাপারেই ভাল-মন্দ দুই দিক আছে। একজন চরিত্রহীন পাষণ্ড লােককে সৎপথে আনিয়া একজন মুবাল্লেগ বা মিশনারি, একটা বখাটে বাউণ্ডেল ছেলেকে পরীক্ষা পাশ করাইয়া একজন শিক্ষক যে আনন্দ পাইবেন, একজন কঠিন-পীড়াগ্রস্ত মৃতপ্রায় রােগীকে আরােগ্য করিয়া একজন ডাক্তার যে আনন্দ পাইবেন, একজন নিরপরাধ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড হইতে খালাস করিয়া একজন উকিলও ঠিক তেমনি আনন্দ পাইবেন। কাজেই মিশনারি শিক্ষক, ডাক্তার ও উকিলরা সমান মর্যাদার অধিকারী। পক্ষান্তরে বেহেশতের টিকিট বিক্রয় করিয়া মুবাল্লেগ-মিশনারি, পরীক্ষার প্রশ্ন অগ্রিম বিক্রয় করিয়া শিক্ষক, কায়দায় পাইয়া রােগীর নিকট হইতে গলা-কাটা ভিজিট আদায় করিয়া ডাক্তার যে পাপ করিয়া থাকেন, উকিলদের এই শ্রেণীর পাপও ওঁদের পাপের সমান, কিছুমাত্র বেশি নয়।

৮. মিথ্যাই সত্য
উকিলরা নিজেরা মিছা কথা কন, মওক্কেল ও সাক্ষীদেরও মিছা কথা কওয়ান। আগে তাঁদের নিজেদের মিথ্যা ভাষণেরই বিচার করা যাউক। উকিল যদি মওক্কেলের ক্ষতি না করেন; মওক্কেলের ভালর জন্য যদি দুচারটা মিছা কথা বলান এবং বলেন, তবে সেটা দোষের হইবে কেন? এমনকি খােদ মওক্কেলকেও যদি ফাকি দেন, তবে সব-সময় তা দোষের হইবে না। ধরুন একটি লােক বাড়িতে শরিকদের সঙ্গে ঝগড়া করিয়া হলফ করিয়া আসিয়াছেন, পরদিনই তিনি বাঁটোয়ারা মামলা দায়ের করিবেন। সমস্ত টাকা-পয়সা ও প্রয়ােজনীয় দলিলপত্র আপনাকে বুঝাইয়া দিয়া তিনি পরদিনই মামলা দায়ের করিতে বলিলেন। আপনি তার সহিত তর্ক করিলেন না। তাঁর কথামত কাজ করিতে রাজি হইয়াই মামলা গ্রহণ করিলেন । আপনি যদি বলিতেন অত তাড়াতাড়ি করিবার মত সময় আপনার নাই,
৪২৬
কিম্বা যদি বলিতেন অত তাড়াতাড়ি করিলে আরজিতে ভুল-ভ্রান্তি থাকিয়া। যাইতে পারে, যদি তাকে বুঝাইবার চেষ্টা করিতেন যে, মামলাতে তামাদির কোনও প্রশ্ন নাই, তাড়াহুড়ার কোনও দরকারও নাই, ধীরে-সুস্থে মামলা দায়ের করিলেই চলিবে, তবে তিনি আর আপনার মক্কেল থাকিতেন না। কারণ তিনি ক্রুদ্ধ মানুষ। তিনি পরদিনই মামলা দায়ের করিতেই আসিয়াছেন। পরেও মামলা দায়ের করা যাইতে পারে—এই যুক্তি শুনিতে তিনি আসেন নাই। সেই যুক্তি তার আগে হইতেই জানা আছে। কাজেই আপনি অভিজ্ঞ বুদ্ধিমান লােকের মতই বিনা-তর্কে মামলা গ্রহণ করিলেন । তাঁর কথামতই মামলা দায়ের হইবে বলিয়া তাকে বিদায় দিলেন। কিন্তু বাড়ি ফিরিয়াও ভদ্রলােকের শান্তি নাই। একদিন পরেই তিনি আপনার কাছে আসিয়া খোঁজ করিলেন, মামলা দায়ের হইয়াছে কিনা? আপনি তার কাগজপত্র পড়িয়াছেন। আরজিও মুসাবিদা করিয়াছেন। ফারায়েযটা আবার রিভাইয করিতে হইবে। আর একদিনে মুসাবিদাটা ঠিক হইয়া যাইবে। আপনি সাধ্যমত তাড়াতাড়ি করিয়াছেন। গত দুই রাত্র একটু বেশি রাত্র পর্যন্ত জাগিয়াছেন। কাজেই আপনার মুহরি এবং আপনি নিজেও মওক্কেলকে বলিয়া দিলেন তার মামলা দায়ের হইয়া গিয়াছে। মিথ্যা কথা। কিন্তু এ মিথ্যা কথা আপনি মওক্কেলের অনিষ্ট করিবার জন্য বলেন নাই; এ মিথ্যার ফলে মওক্কেলের কোনও ক্ষতিও হইবে না। বরঞ্চ মওক্কেলের মনটা প্রফুল্ল এবং তার এলাকায় তাঁর মস্তক উন্নত রাখিবার উদ্দেশ্যেই এই মিথ্যা কথা বলিয়াছেন। এই মিথ্যার ফলে মওক্কেলের ভালই হইবে, কারণ আপনি তাড়াহুড়া না করিয়া ধীরে-সুস্থে আরজি মুসাবিদা করায় তাতে ভুল-ভ্রান্তি থাকিবে না।
এটা ত গেল উকিলদের নিজের মিছা কথা কওয়ার আবশ্যকতার নজির। মওক্কেলদেরে দিয়াও যে মিছা কথা বলান কত দরকার, কিভাবে দরকার, তাও আমাদের বিচার করিয়া দেখা দরকার । সরলভাবে স্বীকার করা দরকার যে, মওক্কেলকে ও সাক্ষীগণকে দিয়া মিছা কথা না বলাইয়া মামলা জিতা যায় না। কিন্তু সেগুলি আসলে মিছা কথা নয়, সত্য কথাই একটু গােছাইয়াসাজাইয়া বলা। মাটি, কাঠ ও পাথর দিয়া শিল্পী যেমন সুন্দর মূর্তি গড়েন, একই ঘটনাকে তেমনি বিভিন্ন রূপে ও আকারে সাজাইয়া হাকিমের সামনে। উপস্থিত করিতে হয়; তবেই হাকিমরা বিচার করিতে পারেন। শিল্পীর নৈপুণ্যে অনেক সময় নকল জিনিসও আসল বলিয়া ভুল হয় । হাকিমরাও তাই কোনও কোনও ক্ষেত্রে ভুল বিচার করেন । কিন্তু ঐরূপ না সাজাইয়া শুধু
৪২৭
সত্যের ও তথ্যের ঢেলা হাকিমের নাক বরাবর ছুড়িয়া মারিলে হাকিমরা ভুল করিতেন আরাে বেশি। এইজন্য আইনও সে ব্যবস্থা করিয়াছে। পুলিশের কাছে যবানবন্দিকে আইন সাক্ষ্য বলিয়া স্বীকার করে না। অপরাধের স্বীকারােক্তি প্রত্যাহার করিবার অধিকার আসামিকে দেওয়া হইয়াছে। এইজন্য দেওয়ানি মামলার বাদী-বিবাদীর আরজি-জবাব উকিলরা মুসাবিদা করিয়া কোর্টে দাখিল করেন; পক্ষগণকে সােজাসুজি আদালতের সামনে দাঁড়াইয়া নিজের কথা বলিবার জন্য পাঠাইয়া দেন না। অর্থাৎ হাকিমের কাছে মক্কেলদের কথা উকিল বলেন আগে, মক্কেল নিজে বলেন তার পরে। কাজেই মওক্কেলের কথা উকিল মানিয়া চলেন না, মক্কেলই উকিলের কথামত চলেন। এ বিষয়ে একটি মজার ঘটনা উল্লেখ না করিয়া পারিতেছি না।

৯. সত্যের জন্যে মিথ্যার ভূমিকা
একদিন এক বুড়াে হাজী সাহেব মামলা লাগাইতে আসেন। একজন তাঁর নিকট হইতে প্রায় দেড় হাজার টাকা দামের ধান-সরিষা নিয়াছে। তলবতাগাদায় দেনা শােধ করে নাই। আমি হাজী সাহেবের সঙ্গে খানিক আলাপ করিয়া মুহরির হাওলা করিয়া অন্য কাজে ব্যস্ত হইলাম। কোর্ট ফি, উকিলের ফিস, মুহরির তহুরি ইত্যাদি সব খরচাদি আদায় করিয়া মুহরি খানিক পরে হাজী সাহেবকে আমার সামনে উপস্থিত করেন। আমি এক খণ্ড সাদা কাগজ টানিয়া লইয়া আরজির পয়েন্টস লিখিয়া লইতে লাগিলাম। হাজী সাহেব বলিয়া যাইতে লাগিলেন। বাদী-বিবাদীর নাম, তাদের পিতার নাম, গ্রাম, থানা, ধান-সরিষার পরিমাণ ও দাম লিখিলাম। কিন্তু ঋণ নিবার সময়-তারিখ লিখিতে গিয়া কলম ছাড়িয়া সােজা হইয়া বসিলাম এবং হাজী সাহেবের নিকট চাহিলাম। বলিলাম : হাজী সাহেব, সন-তারিখ ঠিকমত বলিতেছেন ত? কোনও ভুল করেন নাই ত?
হাজী সাহেব মাথা নাড়িয়া জোরের সঙ্গেই বলিলেন : আমার ভুল হইবার উপায় নাই। সব আমার মুখস্থ। কত তাগাদা করিয়াছি। শালার বেটা কি আমারে কম ঘুরাইয়াছে।
আমি বিষন্ন মুখে বলিলাম : বড়ই আফসােসের কথা হাজী সাহেব; আপনার মামলা চলিবে না; দাবি আপনার তামাদি হইয়া গিয়াছে।
হাজী সাহেব আসমান হইতে পড়িলেন। বলিলেন : তামাদি হইয়াছে?
৪২৮
কেন হইয়াছে? কেন মামলা চলিবে না? হক টাকার আবার তামাদি? আমি হাজী সাহেবকে বুঝাইলাম, আইনের বিধান। তিন বছরের একদিন বেশি হইলেই দাবি পচিয়া গেল। পাওনা যতই হক হােক, আর মামলা চলে না। হাজী সাহেব চঞ্চল হইয়া উঠিলেন। এখন তবে উপায় কী? আমি বলিলাম, উপায় একটা আছে। আপনার দাবি মাত্র তিন মাসের জন্য তামাদি হইয়া গিয়াছে। আপনি যদি ধান-সরিষার নেওয়ার তারিখ তিন মাস পিছাইয়া বলেন অর্থাৎ যদি পৌষের বদলে ফাল্গুন মাস বলেন, তবেই আপনার তামাদি রক্ষা হয়।
হাজী সাহেব কানে হাত দিয়া তাওবা-আসতাগফারুল্লাহ পড়িলেন। কী! মিথ্যা কথা বলিব? দেড় হাজার টাকার জন্য? মাফ করিবেন উকিল সাহেব। আমি আল্লার ঘর যিয়ারত করিয়া আসিয়াছি। দেড় হাজার ত দূরের কথা, দেড় লাখের জন্যও মিছা কথা বলিতে পারিব না।
হাজী সাহেবের ইমানদারিতে যেমন খুশি হইলাম, তার হক টাকাটা মারা যাইতেছে দেখিয়া তেমনি দুঃখিতও হইলাম। বােধহয় আমার মনের অগােচরে কেসটা হারাইবার আশঙ্কাও কাজ করিতেছিল। তাই হাজী সাহেবকে বুঝাইবার চেষ্ট করিলাম : এটা আসলে মিথ্যা নয়, সত্যের খাতিরে কথা একটু ঘুরাইয়া বলা মাত্র। ঐ লােকটা যে হাজী সাহেবের ধান-সরিষা নিয়াছে, এটা সত্য কথা। সে যে টাকা দেয় নাই, এটাও সত্য কথা । হাজী সাহেব যে লােকটার কাছে দেড় হাজার টাকা পাইবেন, এটাও সত্য কথা । এই হক টাকা ঐ নিমকহারাম লােকটা শােধ করিতেছে না। কাজেই নিরীহ হাজী সাহেবকে কোর্ট করিতে হইতেছে। আল্লার আইনে হক টাকার তামাদি নাই। অথচ গবর্নমেন্ট একটা আইন করিয়াছেন যে পাওনা সত্যই হক হােক, তিন বছর পর হইয়া গেলেই সেটা নাহক হইয়া যায় । আইনটা যে আল্লার নয়, গবর্নমেন্টের, গবর্নমেন্ট যে খৃষ্টান, হাজী সাহেবকে তা-ও বলিলাম। সুতরাং ঐ আইনের সাথে মিল রাখিবার জন্য যদি হাজী সাহেব লেন-দেনের মাসটা সনও নয় তারিখও নয়—একটু নড়চড় করেন, তবে কোনও গােনাহ হইবে না। কারণ সত্য প্রতিষ্ঠার জন্যই তিনি এটা করিতেছেন। ফতােয়াটা আরাে মযবুত করিবার জন্য বলিলাম : হক পাওনা শােধ করা আল্লার আইন, আর তিন বছরে তামাদিটা খৃষ্টানদের আইন। খৃষ্টানের আইন আল্লার আইনের উপরে যাইতে পারে না।
কিন্তু প্রায় ঘণ্টাখানেকের এই ওজস্বিনী বক্তৃতায়ও কোনাে কাজ হইল । হাজী সাহেব এর পরেও বলিলেন : না উকিল সাহেব, বুড়াে বয়সে এই
৪২৯
কয়টা টাকার জন্য মিছা কথা বলিয়া ঈমান নষ্ট করিব না। মামলা আর করিব না, যদি হক্কে থাকে টাকা পাইব, না থাকিলে পাইব না।’
বলিয়া হাজী সাহেব উঠিলেন। আমি মুহরি সাহেবকে বলিলাম : হাজী সাহেবের টাকা ফেরত দাও।
মুহরি সাহেব একতাড়া নােট আনিয়া এমন জোরে টেবিলের উপর রাখিলেন যাতে আমার মনে হইল ঐ নােটের তাড়া দিয়া তিনি আমার মাথায় বাড়ি মারিলেন ।
হাজী সাহেব চলিয়া গেলে আমাকে নিরালা পাইয়া মুহরি সাহেব রাগকম্পিত কণ্ঠে বলিলেন : এই রকমে উকালতি চলিবে না, সার। দেখলেনও ত একটা সামান্য কথায় কতগুলি টাকা হারাইলাম?
মুহরি সাহেব আমার একদিনের ফিস বত্রিশ টাকা ও নিজের তহুরি বাবত পাঁচ টাকা আদায় করিয়াছিলেন। এ ছাড়া দাখিলি, শেরেস্তা, পেশকার, আমলা, নম্বর ইত্যাদি বাবতও আরাে দশ টাকা আদায় করিয়াছিলেন। তার উপর আরজির কোর্ট ফি দেড় হাজার টাকা দাবির উপর যা আদায় করিয়াছিলেন তাতেও লাভ থাকিত। পরের টাকা হাতাইয়াও আরাম আছে। কথায় বলে : পরের হলদি বাটিলেও হাতে রং লাগে। কাজেই মুহরি সাহেবের রাগের কারণ বুঝিলাম। ঠাণ্ডা হাসি হাসিয়া বলিলাম : কি দোষ করিলাম?
মুহরি : তামাদির কথা বলিতে গেলেন কেন?
আমি বিরক্ত-মাখা চোখে চাহিয়া বলিলাম : বলাে কী? দাবি তামাদি হইয়া গিয়াছে, মক্কেলকে তা বলিব না? মিথ্যা করিয়া বলা উচিৎ ছিল সব ঠিক আছে?
মুহরি গম্ভীর সুরে বলিলেন : মিথ্যা বলিবেন কেন? কিছু না বলিলেই হইত। আরজি লিখিবার সময় আমরা ঠিক ফালগুন মাসের লেন-দেন লিখিয়া দিতাম। হাজী সাহেবকে পরে বুঝাইলেই তিনি তা মানিয়া নিতেন।
আমি যখন দৃঢ়স্বরে জানাইলাম যে, মুহরি সাহেবের সহিত আমি একমত নই, তখন তিনি বলিলেন, অন্য যে কোনও উকিল তার মত-মতেই কাজ করিতেন। করিবেনও তাই। হাজী সাহেব অন্য উকিলের হাতে পড়িবেন। মামলা দায়েরও হইবে। মাঝখান হইতে আমার ফিসটা মারা গেল। মামলাটা খুবই কনটেস্টেড হইবে। আরাে অনেক ফিস পাওয়া যাইত। আমাদের টাকাও গেল। বদনামও হইল । অন্য উকিল হাজী সাহেবকে বুঝাইবেন, তাঁর মামলা মােটেই তামাদি হয় নাই। যে উকিল তামাদির কথা বলিয়াছে, সে
৪৩০
কিছু আইন জানে না। হাজী সাহেব সে কথা বিশ্বাস করিবেন। নাহক আমাদের ফিসটা মারা গেল।
আমি মুহরি সাহেবকে সান্ত্বনা দিলাম, ঐ টাকা আমাদের হক্কে ছিল না বলিয়াই পাইলাম না। যদি ওটা কিসমতে থাকে, তবে ঘুরিয়া-ফিরিয়া তা আসিবেই।
মুহরি সাহেব বিনয়ের নিচে রাগ গােপন করিয়া বলিলেন : টাকা পকেটে পাইয়াও যদি আমরা ফেলিয়া দেই, তবে তা আবার আমাদের পকেটে ফিরিয়া আসিবে টাকার এমন হাত-পা নাই।
মুহরি সাহেব নামাজি মানুষ। খুব সকালে উঠিয়া তিনি কালামুল্লাহ তেলাওত করিতেন। আমি রাগ করিয়া বলিলাম : তুমি নামাজি মানুষ। তাই আল্লার উপর তাওয়াক্কুল না রাখিলেও বােধ হয় তােমার চলে। কিন্তু আমার যে তাওয়াক্কুল ছাড়া চলে না। তুমি দেখিয়া লইও কিসমতে থাকিলে এই মামলা আবার আসিবেই।
সপ্তাহ না যাইতেই হাজী সাহেব আসিয়া হাজির। সেদিন তিনি তার বড় ছেলেকে সঙ্গে আনিয়াছেন। ছেলেও প্রৌঢ়। হাজী সাহেব যা বলিলেন তার মর্ম এই : তিনি সকলের সঙ্গে বুদ্ধি-পরামর্শ করিয়া দেখিয়াছেন। আমার কথাই ঠিক। হক পাওয়ার জন্য আইনের বিধান মানিতে গিয়া কথা একটু ঘুরাইয়াফিরাইয়া বলা যাইতে পারে। অতএব তিনি মামলা করিবেন। ইতিমধ্যে দুইএকজন উকিল এবং অনেক মুহরি এই মােকদ্দমা হাত করিবার জন্য হাজী সাহেবের বাড়ি পর্যন্ত গিয়াছেন। আমার চেয়ে কম ফিসে ও কম খরচে মামলা জিতাইয়া দিবেন বলিয়াছেন। কিন্তু হাজী সাহেব তাঁদের কাছে মামলা দেন নাই। আমারই কাছে আসিয়াছেন। উপসংহারে তিনি বলিলেন : আমার ছেলেরা ও বিবি সাব বলিলেন, মামলা যদি করিতেই হয়, তবে প্রথমে যে উকিলের কাছে গিয়াছেন, তার কাছে যান। আমার নিজেরও ইচ্ছাও তাই। কিন্তু বিবি সাহেব আমার কথায় বিশ্বাস না করিয়া বড় ছেলেকে সঙ্গে পাঠাইয়াছেন।
আমি হাজী সাহেবের কথা শুনিতে-শুনিতে মাঝে-মাঝে মুহরি সাহেবের দিকে তাকাইতেছিলাম। তিনি একবার আমার চোখে-চোখে চাহিয়াই মাথা হেঁট করিলেন।
হাজী সাহেব কোমর-পঁাচা থলি খুলিতে-খুলিতে বলিলেন : আইনের যখন বিধান, তখন হক টাকার জন্য লেনদেনের সময়টা বদলাইতে রাজি আছি তবে তিন-তিনটা মাসের অতবড় মিছা কথাটা না বলিয়া মাস খানেকের কথা বলিলে হয় না?
৪৩১
আমি হাসিয়া বলিলাম : তিন মাসেও যে মিছা হইবে, এক মাসেও সেই মিছাই হইবে।
অবিশ্বাসের মাথা নাড়াইয়া হাজী সাহেব বলিলেন : উকিল সাহেব, আমি উম্মী মানুষ, কিন্তু একেবারে নাদান নই। তিন মাসের মিছা আর এক মাসের মিছার গােনা সমান হইতেই পারে না। এক টাকার চুরি আর একশ টাকার চুরির গােনাও সমান হইতে পারে না।
আমি হাজী সাহেবের সঙ্গে তর্ক বাড়াইলাম না। বলিলাম : আপনার কথাই বােধ হয় ঠিক। কিন্তু তিন মাসের কমে আপনার মামলার তামাদি রক্ষা হয় না। এখন কী করিবেন?
হাজী সাহেব দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া অর্ধ সমর্থনের সুরে বলিলেন : দেন তবে আল্লার নামে মামলা দায়ের করিয়া। তিনি মাসই পিছাইয়া দেন। কী করি? হক টাকার জন্য মিছা কথা বলিতে হইবে। আয় খােদা তুমি সাক্ষী থাকিও।
যথাসময়ে মামলার শুনানির দিনে হাজী সাহেব নিজে সাক্ষী দিতে আসিলেন এবং সঙ্গে আরাে দুইজন হাজী সাক্ষী ও একজন ইউনিয়ন মেম্বর সাক্ষী হইয়া আসিলেন। সকলে সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়াইয়া ধৰ্মত হলফ করিয়া ফাল্গুন মাসের লেন-দেনের কথা, জুম্মার মসজিদে তলব-তাগাদার কথা এবং বিবাদীর দাবি স্বীকার করার কথা বেদেরেগ বলিয়া গেলেন। বিবাদীর উকিলের জেরার মুখে অগ্রহায়ণ মাসে লেনদেনের কথা খুব জোরের সঙ্গে অস্বীকার করিয়া গেলেন। হাজী সাহেবের মামলা পুরাপুরি ডিক্রি হইল। এবং আপিল পর্যন্ত সে ডিক্রি বহাল রহিল।
১০. আলীপুরে উকিল হিসাবে আমি খুব বড় কেউকেটা ছিলাম না। সাংবাদিকতা ও রাজনীতি করার দরুনই হােক আর আমার অযােগ্যতার দরুনই হােক কথাটা সত্য। কাজেই উকিল হিসাবে আইন-ঘটিত ব্যাপারে কোনও চাঞ্চল্যকর ঘটনা আমার বলিবার নাই। তবু আলীপুর জজকোর্টের অভিজ্ঞতা কিছুটা না বলিলে আমার উকিল জীবনের কাহিনী অপূর্ণ থাকিয়া যাইবে।
আলীপুরের কথা বলিবার আগে বলিতে হয় যিনি আমাকে আলীপুরে নিলেন, তাঁর কথা। ইনি খান বাহাদুর মােহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম। এঁর
৪৩২
সঙ্গে আগের পরিচয় থাকিলেও ঘনিষ্ঠতা হয় তিনি যখন ময়মনসিংহের মুনসেফ। ঘটনার সময় তিনি বাংলা সরকারের এসিস্ট্যান্ট জুডিশিয়াল সেক্রেটারি । সেক্রেটারি না থাকায় তিনিই তখন অফিশিয়েটিং জুডিশিয়াল সেক্রেটারি । নিতান্ত অকস্মাৎ নবযুগ-এর চাকুরি যাওয়ায় আমি যখন কী করি, কী করি করিতেছিলাম, তখন সেই বন্ধু ফেরেশতার মত আমার জীবনে উদয় হইলেন। নিজের আইনের বই-পুস্তক দিলেন। বাপের পরিত্যক্ত গাউনটা আমার কাঁধে তুলিয়া দিয়া বলিলেন : উপযুক্ত উত্তরাধিকারীর কাঁধে উঠিল এটা।’ তাঁর বাবা অবসরপ্রাপ্ত জিলা ও সেশন জজ মৌ. আবদুল খালেক। শুধু বই-পুস্তক ও গাউনই দিলেন না। তিনি আমাকে নিয়া আলীপুরের সমস্ত জজ-মুনসেফ ও কলিকাতা স্মল ক্যু কোর্টের জজদের সঙ্গে পরিচিত করিয়া দিলেন।
এর ফল হাতে-হাতে পাইলাম। উকালতির শুরুতে হাকিমদের সহায়তা, সুনজরের পৃষ্ঠপােষকতা যে কত মূল্যবান, সে কথা বুঝাইয়া বলা অনাবশ্যক। মামলা পরিচালনার সময় জেরা-যবানবন্দির সময় যদি হাকিম বলেন, ‘চমকার’, ‘বেশ করিতেছেন’, ‘ওয়েল ডান ফর এ বিগিনার’, তবে নূতন উকিলের শুধু আত্মবিশ্বাস ও সাহসই বাড়ে না, জনপ্রিয়তা ও পসারও সঙ্গেসঙ্গে বাড়িয়া যায়। পক্ষান্তরে ঐ সময় হাকিম যদি বলেন, তৈয়ার হইয়া আসেন নাই’, ‘আইন-কানুন কিছু জানেন না’, ‘মওক্কেলের সর্বনাশ করিতেছেন’ তবে সে নূতন উকিলের প্র্যাকটিসের বারটা বাজিয়া যায় । সিনিয়রদের জন্য অবশ্য হাকিমের ভাব-গতিকে বেশি কিছু আসে যায় না; কিন্তু নবাগতের জন্য এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বন্ধুবর সিরাজুল ইসলাম এইভাবে আমাকে প্র্যাকটিসের পাকা সড়কে তুলিয়া দিয়াছিলেন। আমি সারাজীবনেও তার এ দেনা শােধ করিতে পারিব না।
আলীপুরের মর্যাদার অভিজ্ঞতাও তেমনি আমার মনে থাকিবে। প্রথমত, উকিল-মুহরির সম্পর্ক। আলীপুরের মুহরিদিগকে আমি সলিসিটর উপাধি দিয়াছিলাম। কার্যত হাইকোর্টের সলিসিটর যা আলীপুরের মুহরিও তাই। অন্যান্য স্থানে মুহরিকে জিজ্ঞাসা করা হয় : ‘আপনি কোন উকিলের শেরেস্তায় কাজ করেন? আর আলীপুরের উকিলদেরে জিজ্ঞাসা করা হয় : ‘আপনি কোন মুহরির শেরেস্তায় কাজ করেন? বস্তুত ‘শেরেস্তা’ মুহরিদেরই। উকিলদের প্রায় কারুরই শেরেস্তা নাই। সেখানে মওক্কেল আসে মুহরিদের কাছে। তাঁরাই কেস নেন; কাগজ-পত্র, দলিল-দস্তাবেজ বুঝিয়া লন । টাকাপয়সা লন। উকিলের ফি আদায় করেন তারাই। কেসের শ্রেণী ও গুরুত্ব
৪৩৩
হিসাবে উকিল নিযুক্ত করেন তাঁরাই। উকিলকে ফিসও দেন তাঁরাই। এ কাজের জন্য তাঁদের প্রত্যেকের নিকট বিস্তারিত ও বড় নােট বই আছে। সে নােট বইয়ে বর্ণানুক্রমিক সূচিপত্রও আছে। এসব কাজ করিতে গেলে যে আইন জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও বিদ্যা-বুদ্ধির দরকার, আলীপুরের মুহরিদের অধিকাংশের মধ্যেই তা আছে অন্তত আমার আমলে ছিল। আমার মুহরির নাম ছিল মােহাম্মদ আমজাদ আলী মিয়া। অর্থাৎ আমি তাঁরই শেরেস্তার উকিল ছিলাম। লেখক সাহিত্যিক হিসাবে আমার নাম জানিতেন বলিয়াই গােড়াতে তিনি দয়া করিয়া আমাকে তার শেরেস্তার জুনিয়র উকিলের তালিকাযুক্ত করিয়াছিলেন। কিন্তু অল্পদিনেই তিনি আমাকে সিনিয়র লিটিতে নেন এবং আরাে কিছুদিন পরে তিনি আমাকে তাঁর শেরেস্তার প্রধান করেন। তাঁর কাছে আমি উকালতির অনেক পঁাচ-মােচড় ও মামলার প্রধান ইঞ্জিনিয়ারের কাজকর্ম অনেককিছু শিখিয়াছি। ভদ্রলােক ত মুহরি নন, পাশ-না-করা সনদহীন একজন উকিল।
মােকদ্দমার তদারককারীদের সকলেই যে টাউট নয়, এ অভিজ্ঞতাও হয় আমার আলীপুরেই। সেখানেই আমি প্রথম জানিতে পারি শিক্ষিত অবস্থাশালী ও অবসর-প্রচুর দুই-একজন গ্রাম্য মাতব্বরের এটা শখ, এটা তাদের অবসর বিনােদনের একটা স্পাের্টস। আলীপুরে কয়েক মাস কাটিবার পর আমজাদ মিয়া এক ভদ্রলােককে আমার সঙ্গে পরিচয় করাইয়া দেন। বলেন : ভদ্রলােক। আমার বই-পুস্তক বিশেষত আয়নার একজন সমঝদার। আমার একজন ভক্ত। ভদ্রলােকের নাম সিদ্ধেশ্বর প্রামাণিক। পাড়াগাঁয়ের একজন হিন্দু ভদ্রলােক আমার লেখার ভক্ত শুনিয়া খুশি হইলাম। আমি যতদিন আলীপুরে ছিলাম, এই ভদ্রলােক ততদিনই মাসে গড়ে দুই-তিনটা বড়-বড় কেস আমাকে দিতেন। প্রথম দিন যখন কেস আমাকে দেন, সেদিন তাঁকে আমি বড় রকমের টাউট মনে করিয়াছিলাম। আমার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা এবং মােকদ্দমার ইনস্ট্রাকশনে তার উৎসাহপূর্ণ অংশগ্রহণ হইতেই আমার এই ধারণা হইয়াছিল। ভদ্রলােক চলিয়া গেলে আমজাদ মিয়ার নিকট আমার মনােভাব ব্যক্ত করিলে তিনি জিভ কাটিয়া বলেন : উনি তেমন লােক নন। রােদ বৃষ্টি-ঝড়-তুফান তিনি অগ্রাহ্য করিয়া ভদ্রলােক অমন নিঃস্বার্থভাবে মাসে দুই-তিন বা তার চেয়েও বেশি বার আমার কাছে পরের কেস নিয়া আসেন দেখিয়া নিজের খাইয়া বনের মহিষ তাড়াইবার তাঁর শখে আমি সত্যই আশ্চর্য হইয়াছিলাম। তার প্রতি আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা জন্মিয়াছিল। কিন্তু এর পরে আরাে বিস্মিত হইয়াছিলাম, যখন জানিতে পারিলাম তিনি হিন্দু নন,
৪৩৪
মুসলমান। ঘটনাচক্রেই এটা জানিতে পারিলাম। আমার সামনে একটা কাগজে নিজের নাম দস্তখত করিতে গিয়া পিতার নাম লিখিলেন আইনুদ্দীন প্রামাণিক। সিদ্ধেশ্বর প্রামাণিকের পিতার নাম আইনুদ্দীন প্রামাণিক? বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলিলাম; ভদ্রলােক আর্য সমাজীর পাল্লায় পড়িয়া শুদ্ধি হইয়াছেন নাকি?
ভদ্রলােক আমার বিস্ময় বুঝিতে পারিয়া সব বলিলেন। তার আসল নাম সিদ্দিকুর রহমান প্রামাণিক। শৈশবে বাবা মারা যান। হিন্দু-প্রধান এলাকা । প্রতিবেশীরা তাঁকে ‘সিদ্ধেশ্বর’ বলিয়া ডাকিত। হিন্দু বাড়িতে হাইস্কুল। সব শিক্ষক হিন্দু। কাজেই স্কুলের রেজিস্ট্রারিতেও তাঁর নাম উঠিল সিদ্ধেশ্বর প্রামাণিক। সেটেলমেন্ট-পর্চায়, সাবরেজিস্টারি আফিসে, জমিদারের শেরেস্তায় এবং ইউনিয়ন বাের্ডের খাতায় তিনি এখন সিদ্ধেশ্বর প্রামাণিক। নাম-সংশােধন করা কঠিন ও ব্যয়সাধ্য ব্যাপার ।
নিজের গ্রামের কথা মনে পড়িল। সেখানে দুইজন প্রতাপশালী সম্মানী হিন্দু মাতব্বর ছিলেন। একজন ইনছান দাস (ঈশ্বান চন্দ্র দাস), অপরজন ওমর সরকার (উমাচরণ সরকার)। এঁরা নিজ মুখেই ইনছাস দাস’ ও ‘ওমর সরকার’ বলিতেন। কারণ আসল নাম বলিলে রাতের অন্ধকারে কেউ চিনিতও না; হয়ত তাঁদের প্রাপ্য সম্মানও দিত না। কিন্তু তাঁদেরও নাম খাতাপত্রে ঠিক ছিল সিদ্দিকুর রহমান সাহেবের মত এমন ‘ঢাকী-শুদ্ধা বিসর্জন তাঁদের দিতে হয় নাই।
কলিকাতা হইতে ফিরিয়া আসিয়া ১৯৫০ হইতে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত ময়মনসিংহেই উকালতি করিলাম । আমার আগেকার মুহরি আখতারুদ্দীন খাঁ। আমার সাহচর্যে পেটি-ফগিং ঘৃণা করিতে শিখিয়াছিলেন। কাজেই আমি ময়মনসিংহ ছাড়ার পরে তিনিও মুহরিগিরি ছাড়িয়া বাড়িতে অবসর জীবন যাপন করিতেছিলেন। কারণ তাঁর অবস্থা ভাল। আমি পুনরায় উকালতি শুরু করায় তিনি আসিয়া আমার মুহরিগিরি নিলেন।
কিন্তু বার বছর আগে ময়মনসিংহ ছাড়িবার সময় আমি যা ছিলাম তা আর নাই। এখন বয়স হইয়াছে, স্টাইল বাড়িয়াছে, আমিরি শিখিয়াছি; পরিবার বড় হইয়াছে, সুতরাং খরচও বাড়িয়াছে। তাই আয়ও অনুপাতে বাড়া দরকার। শুধু দেওয়ানিতে তাড়াতাড়ি অত টাকা আসিবে না। কাজেই ফৌজদারিতে যাওয়া দরকার । আখতার মিয়ার সঙ্গে গভীর পরামর্শ করিলাম। ফৌজদারির প্রতি তাঁরও ঘৃণা ছিল খুব বেশি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ফৌজদারিতে যাওয়া ঠিক হইল। নিম্ন আদালতে বেল-টেলের ব্যাপারে দুই-একদিন গেলামও।
৪৩৫
অমনি টাউট মহলে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হইল। তাদের পক্ষে এক দল প্রতিনিধি বেশি রাতে আমার সঙ্গে দেখা করিলেন। তাঁরা নিতান্ত ভদ্রভাবে মিষ্টি ভাষায় যা বলিলেন, তার সারমর্ম এই : আমি ফৌজদারি লাইনে আসায় তারা আনন্দিত। কিন্তু তাঁদের সহানুভূতি ছাড়া আমার পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়। ইতিপূর্বে আমি উদ্যোগী হইয়া তাদের অনেককে জিলা জজ ও জিলা ম্যাজিস্ট্রেটকে দিয়া টাউটনােটিফাই করাইয়াছিলাম, সে কথা তারা মনে রাখিবেন না। পুরাপুরিই আমাকে সাহায্য করিবেন। তাদের সহায়তা নিলে আমি কেস করিয়া দম ফেলিতে পারিব না। টাকা রাখিবার স্থান পাইব না । তারা এখন এসােসিয়েশন ফার্ম করিয়াছেন। ইচ্ছা করিলে তারা একজনকে আসমানেও তুলিতে পারেন, পাতালেও নামাইতে পারেন। তাদের সাথে সম্পর্ক ঠিক রাখিলে মামলায় খুব বেশি খাটিবার দরকার নাই। সব মামলা জিতিবারও দরকার নাই। হারি আর জিতি মওক্কেল আমার হাতছাড়া হইবে না । কারণ জিতিলেও জিৎ হারিলেও জিৎ। যদি মামলায় জিতি, তবে আমার সেটা কৃতিত্ব। তখন আমার তারিফে তাঁরা দেশের আকাশ-পাতাল মুখরিত করিবেন। আর যদি হারি, তবে দোষ হইবে হাকিমের জুরির। হাকিম ও জুরিরা অপর পক্ষের মােটা টাকা খাইয়া আমার জিতা মামলাটার বিরুদ্ধে রায় দিয়াছেন। আপিলে ও হাইকোর্টে সব ঠিক হইয়া যাইবে। স্থানীয় আপিল হইলে আবার ফিস পাইব। আর হাইকোর্ট হইলে নিজের লােককে কেস দিয়া সেখানেও অংশ পাইব। এত সুবিধা। আর যদি তাদের সঙ্গে সম্পর্ক না রাখি, তবে মামলা হারিলে হার, জিতিলেও হার। যদি জিতি তবে তাঁরা প্রচার করিবেন, অমন সহজ মামলায় উকিলের দরকারই ছিল না। যে কোনও জুনিয়র অথবা একজন মােখতার দিয়া ওর দশভাগের একভাগ খরচে মামলা হইয়া যাইত। সরল মওক্কেল পাইয়া আমি অমন গলাকাটা ফিস নিয়াছি। আর যদি হারি, তবে ওরা বলিয়া বেড়াইবে এটা। হারিবার মামলাই নয়। আমি ভুল জেরা করিয়া বাদী পক্ষের কেস প্রমাণ করিয়া দিয়াছি। মানুষ বুঝিয়া কারাে কাছে তারা বলিবেন, কবি-সাহিত্যিক মানুষ রাতদিন বই লিখিয়া কাটান, আইনের বই পড়ার সময় কই? সব আইন ভুলিয়া গিয়াছেন। আর কারাে কাছে বলিবেন, অপর পক্ষের কাছে টাকা খাইয়া মক্কেলের এই সর্বনাশ করিয়াছেন। শুধু এই মওক্কেল না, আরাে অনেকেরই এইরূপ সর্বনাশ করিয়াছেন। আমাকে কেস দেওয়া মানেই ফাঁসির দড়ি নিজ গলায় দেওয়া ও জেলের দরজা নিজ হাতে খুলিয়া দেওয়া।
৪৩৬
বার বছর আগে হইলে এঁদেরে যুদ্ধে আহ্বান করিয়া গলাধাক্কা দিয়া বাহির করিয়া দিতাম। কিন্তু এবার দিলাম না। কারণ স্পষ্টই দেখিলাম, এঁদের কথায় অতিশয়ােক্তি থাকিলেও মােটামুটি সত্য। কাজেই তাঁদেরে চা-পান খাওয়াইয়া এবং চিন্তা করিয়া দেখিবার ওয়াদা করিয়া বিদায় করিলাম।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত এঁদের নিকট মাথা নত করিলাম না। অন্য উপায় অবলম্বন করিলাম। মােখতারদের সঙ্গেই অর্থনৈতিক সম্বন্ধ স্থাপন করিলাম। ফিসের অংশ যখন দিতেই হইবে, তখন মােখতারদেরেই দিব, টাউটকে দিব না। মােখতাররা আমাদের সহব্যবসায়ী। তারাও সনদধারী। তারাও উকিলদের মতই আদালতের অফিসার। কিন্তু ব্যাপারটাকে সুষ্ঠু ও বিবেক সংগত করিবার জন্য মােখতারের অংশটার নাম দিলাম ‘জুনিয়র ফিস। আমার ফিস আদায়ের ক্ষমতাও ছাড়িয়া দিলাম তাদেরই হাতে। অতঃপর ফৌজদারি প্র্যাকটিসেও আমার অসুবিধা থাকিল না।
বলা হয়, উকালতি রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। কথাটা সত্য শুধু আইন সভার মেম্বর হওয়া পর্যন্ত। মন্ত্রী হইলেন ত উকালতি গেল। মন্ত্রিত্ব যাওয়ার পর এক্স-মিনিস্টার হিসাবেও সুবিধা হয়; কিন্তু সেটা শুধু ক্রিমিন্যাল প্র্যাকটিসে। দেওয়ানি প্র্যাকটিসে একবার কনটিনিউটি ভাঙ্গিলে আর সহজে জোড়া লাগে না। আমারও লাগে নাই ।
৪৩৭

অধ্যায় তেইশ
বিষয়ী জীবন

১. বংশগত দুর্বলতা
যাকে বলা হয় বাস্তব বিষয় বুদ্ধি’, ‘কাণ্ডজ্ঞান’ ‘কমনসেন্স’, সেটার কিছু-কিছু অভাব বােধ হয় পাইয়াছিলাম বাপ-দাদার কাছ হইতেই। ছেলে-বেলা শুনিতাম, আমার বাপ-দাদাকে প্রায় সকলেই সরল-সিধা-মানুষ’ বলিত । আহম্মক বলিত না বােধ হয় সম্মান করিয়া। মাঠ হইতে কামলারা একদিন উত্তেজিত হইয়া আসিয়া দাদাজীর কাছে নালিশ করিল, ফলানারা অমুক ক্ষেতের বাতর কাটিয়া আমাদের প্রায় এক হাত জমি তাদের ক্ষেতভুক্ত করিয়াছে। দাদাজী ক্ষেত দেখিতে গেলেন। ভিড় করিয়া বহু হিতৈষী প্রতিবেশী সঙ্গে গেল। সকলেই দাদাজীকে উস্কানি দিতে লাগিল : এমন বাড়াবাড়ি কিছুতেই সহ্য করা যায় না। আজ বেটাদেরে আক্কেল দিতেই হইবে। কিন্তু দাদাজী উল্টা আক্কেল দিলেন নিজের কামলাদেরে কোথায়। একহাত জমি কাটিয়া লইয়াছে? আমাদের ক্ষেত উঁচা অপর পক্ষেরটা নিচা। আমাদের আইলটাই কালক্রমে ধসিয়া-ধসিয়া ওদের ক্ষেতে পড়িয়াছে। কোদালে ক্ষেতের কানি সাফ করিবার সময় ঐটুকুই মাত্র কাটিয়াছে। প্রতিবেশীদের মধ্যে যারা একটা বড় রকমের দাঙ্গা-হাঙ্গামা দেখিবার আশা করিতেছিল, তারা নিরাশ হইয়া বাড়ি ফিরিল। ফরাযীরা আসলে ভীরুকাপুরুষ।
আরেকটা ঘটনা বাপজীর আমলের। বাড়ি হইতে দূরে এক ক্ষেতের মধ্যে বড় একটা আমগাছ ছিল। খুব আম ধরিত। একবার চাকর আসিয়া নালিশ করিল পাড়ার পুলা-পানে সব কাঁচা আম পাড়িয়া ফেলিতেছে। উপস্থিত
৪৩৮
সকলেই আশা করিল ব্যাপার একটা কিছু ঘটিবেই। ঘটিলও। বাপজী চাকরকে ধমক দিলেন : কাঁচা আম পুলা-পানে খাইব না ত বুড়ারা খাইব? যা তুই দেখ গিয়া পুলাপান যাতে আম পাড়িতে গিয়া নালিয়া ক্ষেত পাড়াইয়া না ভাঙ্গে।
পরে সকলেই মন্তব্য করিয়াছিল, এমন দিনে-দুপুরে অত্যাচার অবিচারেরও যদি প্রতিকার না করে, তবে ফরাযীরা গ্রামে থাকিতেই পারিবে । বাপ-দাদার এই দুর্বলতাকে আমি নিজেও ছেলে-বেলা পছন্দ করিতাম। পরে পছন্দ করিয়াছিলাম। বয়স হইলে বুঝিয়াছিলাম আমার বাপ-দাদার কথাই ঠিক। কী হইত ঐ তুচ্ছ ব্যাপার লইয়া মানুষের সাথে ঝগড়া করিয়া? বরঞ্চ উল্টা ক্ষতিই হইতে পারিত। সত্যই তাই। এক-আধ-ইঞ্চি জমির দখল লইয়া দু-চারটা আম-কাঁঠাল লইয়া কত মামলা মােকদ্দমা দেখিয়াছি। উকিল হইয়া আরাে বেশি দেখিয়াছি। হাজার-হাজার টাকা খরচ হইতে দেখিয়াছি। দশ-বিশজন খুন-জখম হইতে দেখিয়াছি। দু-দশজনের জেল-জরিমানা হইতে দেখিয়াছি। গােড়াতে একপক্ষ সবুর করিলে এ সব হইত না।

২. উস্তাদের শিক্ষা
হক-নাহক জ্ঞানও পাইয়াছিলাম বাপ-দাদার নিকট হইতেই। আই-এ পড়ার সময় নিতান্ত অভাবের দিনেও রাস্তায় বাইশ টাকা পড়িয়া পাইয়া টাকাটা হজম করিতে পারিলাম না ত ঐ কারণেই। ও-টাকা যে আমার নয় পরের, এটা বুদ্ধি-বিবেচনা, চিন্তা-ভাবনা করিয়া বুঝি নাই। এমনি স্বভাবতই আপনা হইতেই উৎপ্রেরণা বশেই বুঝিয়াছিলাম।
বাপ-দাদার-দেওয়া এই মতিগতি আরাে জোরদার হয় মৌলবী মুজিবর রহমানের সংশ্রবে আসিয়া। তিনি তখন দি মুসলমান দৈনিক করিবার আশায় টাকার জন্য বর্মা-বাংলা দৌড়াদৌড়ি করিতেছেন। তবু যথেষ্ট টাকা উঠিতেছে না। তেমনি একদিনে তৎকালীন মন্ত্রী নবাব মােশাররফ হােসেন মৌ. সাহেবের নিকট প্রস্তাব দেন, যদি দি মুসলমান নবাব সাহেবের মন্ত্রিত্ব সমর্থন করেন, তবে তিনি দি মুসলমান-এ পঞ্চাশ হাজার টাকার শেয়ার কিনিবেন। এই মুহূর্তে পঁচিশ হাজার। সমর্থনে একটা এডিটরিয়েল লেখার পরই বাকি পঁচিশ হাজার। প্রস্তাবটা তিনি সােজাসুজি মৌলবী সাহেবের কাছে করেন নাই। তিনি মৌলবী সাহেবকে ভাল করিয়াই জানিতেন। প্রস্তাব করেন দি মুসলমান-এর ম্যানেজার মৌলবী সাহেবের কনিষ্ঠ চাচাত ভাই
৪৩৯
মি. রফিকুর রহমান সাহেবের কাছে। রফিকুর রহমান সাহেব এমএ। দুচারটা ভাল-বেতনের চাকুরি ইচ্ছা করিলেই তিনি পাইতে পারিতেন। কিন্তু মৌ. সাহেবের অনুপ্রেরণায় তিনিও আমাদের সমান অল্প বেতনে দি মুসলমান-এর ম্যানেজারি করিতেছিলেন। সততা-সাধুতায় তিনিও প্রায় মৌলবী সাহেবের অনুসারী। তবু বিষয়-জ্ঞানে তিনি আমাদের মতই বাস্তব জ্ঞানী ও হিসাবি লােক। কিন্তু মৌলবী সাহেবের কাছে নবাব সাহেবের প্রস্তাব লইয়া তিনি নিজে যাইতে সাহস পাইলেন না। নবাব সাহেব নিজের এই প্রস্তাবের সৎ ব্যাখ্যা দিয়া মৌ. সাহেবের সামনে উপস্থিত করিবার মত সুন্দর যুক্তি-তর্কও দিয়াছিলেন। নবাব সাহেব কস্মিনকালেও এটাকে ঘুষ রূপে দিতেছেন না। তিনি সত্যি-সত্যি মুসলমানদের একটা ইংরাজি দৈনিকের অভাব তীব্রভাবে অনুভব করিতেছেন। মৌলবী সাহেবই এ কাজের একমাত্র উপযুক্ত ব্যক্তি। দি মুসলমান-এর তিনি একজন পুরা সমর্থক। সেই হিসাবেই তিনি দৈনিক মুসলমান তহবিলে যৎকিঞ্চিৎ সাহায্য করিতেছেন। তবে কিনা একটু…ইত্যাদি। রফিক সাহেব আমাকে সব কথা বলিলেন এবং আমাকেই এ কাজের দায়িত্ব দিলেন। আমাকে মৌলবী সাহেব অতিশয় স্নেহ করিতেন বলিয়া যা-তা বলিবার সাহসও আমার ছিল । আমি যথাসম্ভব গােছাইয়া নবাব সাহেবের যুক্তিগুলি পুরাপুরি বরঞ্চ রং লাগাইয়া মৌলবী সাহেবের কাছে বলিলাম। একদিন দুইদিন নয়, বেশ কয়েক দিন তাকে বুঝাইবার চেষ্টা করিলাম। তিনি অনড়-অটল। আমার সব যুক্তির জবাবে তিনি বলিলেন ও সব যুক্তিই তার জানা। সব জানিয়াশুনিয়াও নিরুপায়ের নীরব থাকা সম্পর্কে কলিকাতায় সর্বজন পরিচিত একটা প্রবাদ চালু আছে : “নিমতলার ঘাটও চিনি, কাশী মিত্তিরের ঘাটও চিনি। কিন্তু কথা বলতে পারি না। আমি যে মরে আছি।” মৌলবী সাহেব হাসিয়া এই প্রবাদটি আমাকে শুনাইলেন। এর পরেও আমি পরাজয় মানিলাম না। এই অভাবের দিনে এমন হাতে-পাওয়া পঞ্চাশ হাজার টাকা। লােকসান হইয়া যাইতেছে এর উত্তরে তিনি বলিলেন : “দেখ আবুল মনসুর, এক-একজনের এক-একটা নেশা থাকে। মদ-মেয়ের নেশাতেই কত ধনী ও বিদ্বান লােক কত ধন-দৌলত নষ্ট করিতেছে। হাজার সদুপদেশ দিয়াও তাদেরে ফিরান যায় না। ধর এ অবাস্তব সাধুতা আমার একটা নেশা। এ নেশা ছাড়াইবার চেষ্টা করিয়া তােমরা সফল হইবে না। এরপর পরাজয় স্বীকার করিতেই হইল।
৪৪০
৩. সাধু থাকা কঠিন না
এমন দৃষ্টান্ত নিশ্চয়ই আমার জীবন প্রভাবিত করিয়াছিল। টাকা পয়সার প্রতি আমার খুব বেশি আগ্রহ ছিল না। তার মানে প্রয়ােজন-মাফিক টাকা পাইলেই আমার হইয়া যাইত। উঠন্ত বয়সের অবিবাহিত স্বাধীন কলিকাতাপ্রবাসী যুবকদের অনেকের যেসব দোষ ছিল, আমার সে সব দোষের একটাও ছিল না; এই কারণেই কলিকাতায় পঞ্চাশ-ষাট টাকার সাংবাদিকতা করিয়াও সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন-যাপন করিতে পারিয়াছিলাম। পাঁচ-ছয় টাকা মেসের খােরাকি, এক টাকা সিটরেন্ট দিয়া থাকিতে পারিলে কতই বা টাকার দরকার? পােশাক-পরিচ্ছদ? এক টাকা আঠার আনার একটা খদ্দরের ধুতি কিনিয়া একটা তহবন্দ ও একটা পাঞ্জাবি বানাইতাম। কাটি-কুটিতে একটা গান্ধী টুপি হইয়া যাইত। সিলাই লাগিত পাঞ্জাবিতে ছয় আনা, তহবন্দ ও টুপিতে এক কানা করিয়া দুই আনা। এমনি করিয়া দুই খানা ধুতিতে সােওয়া দুই টাকা ও সিলাইয়ে এক টাকা খরচ করিলে বছরের পােশাক হইয়া যাইত। ধুপা-লনট্রি খরচ ছিল না। পাঁচ আনায় দু’সের এক নম্বর নূতন ঢাকাইয়া সাবান কিনিতাম। সপ্তাহে দুইবার নিজ হাতে কাপড় ধুইতাম। তাতেই পনের দিন যাইত। শীতবস্ত্র হিসাবে বউ-বাজার চোরাবাজার হইতে তিন-চার টাকায় একটা সেকেন্ড হ্যান্ড গরম কোট কিনিয়া আমি পাঁচ বছর চালাইতাম। উড়নার জন্য খদ্দরের একটা মােটা ‘শাল’ কিনিতাম আড়াই-তিন টাকায়। সেটাও চার-পাঁচ বছর নিতাম। যাতায়াত খরচা বেশি ছিল না। পারতপক্ষে ট্রামে উঠিতাম না, হাঁটিয়াই আফিস করিতাম । উঠিতে হইলেও সেকেন্ড ক্লাসে উঠিতাম। ভাড়া ছিল তিন পয়সা। ‘অপব্যয়ের মধ্যে ছিল দুইটা একটা সিনেমা দেখা। রােজ সিনেমা দেখিতাম। মাঝে-মাঝে দিনে দুইবারও দেখিতাম। কোনও কোনও দিন তিনবারও দেখিতাম। কিন্তু টিকিট কিনিতাম সর্বনিম্ন ক্লাসের। চৌরঙ্গী অঞ্চল হইলে চার আনা। উত্তর কলিকাতা হইলে তিন আনা। এতেই মাসে পনের টাকা যাইত। আরেকটা বাতিক ছিল পুরাতন বই কিনা। কলেজ স্কোয়ারের বড়-ছােট পুরাতন পুস্তকের দোকান, তথাকার ফুটপাথ ও ধর্মতলা-ফ্রিস্কুল স্ট্রিটের ফুটপাথের দোকানের সবগুলিতে আমি ছিলাম একটা পরিচিত উৎপাত। দু-চার ঘণ্টায় দোকানের সব-পুস্তক ঘাঁটিয়া কিনিতাম দু’চার আনার একখানা বই। কিন্তু কিনিতাম। সেজন্য কোনও দোকানদারই আমার সাথে অভদ্রতা করিত না। ইচ্ছামত বই ঘাঁটিতে দিত। কারণ তারা জানিত,
৪৪১
শেষে একখানা আমি কিনিবই। ফলে পয়সা যাইত আমার সারাদিনে হয়ত ছয় আনা-আট আনা। কিন্তু সময় যাইত আমার চার-পাঁচ ঘণ্টা। বন্ধুরা বলিত আমি সময়ের অপচয় করিতেছি। কিন্তু আমি জানিতাম তাদের ধারণা ভুল। কারণ এই সব পুরাতন পুস্তকের দোকান ছিল আমার ফ্রি রিডিং রুম।
আমি ইচ্ছা করিয়া সঞ্চয় কখনও করি নাই। কিন্তু সঞ্চয় আমার অমনি হইয়া গিয়াছে। অত অল্প আয়ের সব টাকা আমি খরচ করিয়া সারিতে পারিতাম না। কারণ সব জিনিসই আমার কাছে অসাধারণ টিকসই হইত। কাপড়-চোপড় ছিড়িতেই চাইত না। ১৯১৩ সালে সতের টাকায় একটা সাইমা লন্ডন হাতঘড়ি ও আড়াই টাকায় একটা ব্ল্যাকবার্ড ফাউন্টেন পেন কিনিয়াছিলাম। ১৯২৭ সালেও দুইটাই চালু ছিল। এই সালে জানালার ফাঁক দিয়া চোর আমার কোটটা চুরি করে। সেই কোটের পকেটে আমার হাতঘড়ি ও ফাউন্টেন পেন ছিল। চুরি না হইলে ওরা কতদিন চলিত আমিও বলিতে পারি না। ১৯১১ সালে আমি একটি ছাতা কিনিয়াছিলাম। ১৯২৬ সালে সেটা কোনও এক দোকানে ফেলিয়া আসি। আর পাই নাই।

৪. নবাব সাহেবের উপদেশ
বুদ্ধি ও বিশ্বাসের সংঘাত সম্পর্কে অতি মূল্যবান কথা বলিয়াছিলেন নবাব মােশাররফ হােসেন সাহেব। তিনি তখন মন্ত্রী। তাঁর এক কাজের সমালােচনা করিতে গিয়া দি মুসলমান-এর সম্পাদকীয়তে নবাব সাহেবের কাজকে নির্বুদ্ধিতা (ফুলিশনেস) বলিয়াছিলাম। এতে নবাব সাহেব রাগিয়া আমাদের অফিসে আসিয়া আমার কৈফিয়ত তলব করিলেন। বলিলেন : তুমিও বিএল, আমিও বি-এল। তুমি মাসে পঁচাশি টাকা রােযগার কর । আমার বার্ষিক ইনকাম চার লাখ । তুমি আমাকে “ফুল” বলিয়া গাল দাও কোন মুখে?’ নবাব সাহেব আমাকে খুব স্নেহ করিতেন। সুতরাং শক্ত কথা বলার অধিকার তাঁর ছিল। আমিও তাকে শক্ত বলিতে পারিতাম। বলিলাম : চার লাখ টাকা আয়ের শ্বশুরের মেয়ে বিয়া করিলে আমারও ঐ ইনকাম হইত। শ্বশুরের খুঁটা দেওয়ায় নবাব সাহেব চটিলেন না। বরঞ্চ হাসিয়া বলিলেন : তেমন শ্বশুরের মেয়ে বিয়া বুদ্ধিমানরাই করিতে পারে, নির্বোধরা পারে না। তর্কে-তর্কে নবাব সাব বলিলেন : “যে নিজেকে সবার চেয়ে বুদ্ধিমান মনে করে, তার মত নির্বোধ আর নাই। তােমাকে লােকে অত ঘন-ঘন ঠকায় কেন? যেহেতু তুমি নিজেকে মস্তবড় বুদ্ধিমান মনে কর। তােমাকে কেউ ঠকাইতে পারিবে না এই
৪৪২
বিশ্বাসেই তুমি সবাইকে বিশ্বাস কর। ঐ বিশ্বাসের সুযােগ নিয়াই সবাই তােমাকে ঠকায়। আমি স্পষ্টই দেখিতেছি, তুমি জীবন-ভর ঠকিবে। জীবনে কোনও দিন সফল হইতে পারিবে না। যদি জীবনে সফল হইতে চাও, তবে আমার কথা শােন। জীবন ‘রং-এন্ডে’ নয়, রাইট-এন্ডে’ শুরু কর। অর্থাৎ সকলকে বিশ্বাস করিয়া নয়, অবিশ্বাস করিয়া শুরু কর। যারা কাজে-কর্মে তােমার বিশ্বাস অর্জন করিবে তাদেরই শুধু বিশ্বাস কর। অন্য সবাইকে অবিশ্বাস কর । দেখিবে কেউ তােমাকে ঠকাইবে না। অবশেষে সবাই তােমার বিশ্বাসী হইবে। আর তা না করিয়া তুমি যদি ঐ ‘রং-এন্ডে’ আরম্ভ করিতেই থাক, তবে সবাই তােমাকে ঠকাইবে। অবশেষে তােমার কারাে উপর বিশ্বাস থাকিবে না। চারদিকে কেবল অবিশ্বাসী-বিশ্বাসঘাতক দেখিবে। শেষ জীবন তােমার বড় দুঃখে কাটিবে। আমি তােমাকে বদ-দোওয়া করিতেছি না। শুধু হুশিয়ার করিয়া দিতেছি মাত্র।’
চল্লিশ বছর আগের কথা। মাঝে-মাঝেই মনে হইয়াছে, নবাব সাহেবের কথাই বােধহয় ঠিক। কিন্তু মৌলবী মুজিবর রহমানের মূর্তি নবাব সাহেবের মূর্তিকে পিছনে ঠেলিয়া দিয়াছে। আমি এই সান্ত্বনা দিয়াছি মনকে : পরকে ঠকাইতে পারার আনন্দের চেয়ে নিজে ঠকিতে পারার আনন্দে মজা অনেক বেশি। একবার এক হােস্টেল মেটের হাতে পাঁচ টাকা ঠকিয়া যে সম্পদ অর্জন করিয়াছিলাম, প্রতিশােধ নিতে গিয়া তাকে দশ টাকা ঠকাইবার আগুনে সে সম্পদ পােড়াইয়া ছারখার করিয়াছি। তারপরেও আগুন নিবে নাই। জীবনসায়াহ্নে আজো আমি বিশ্বাস করি : অবিশ্বাস করিয়া ঠকার চেয়ে বিশ্বাস করিয়া ঠকা ভাল।
অর্থনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা আমার যৌবন হইতেই সীমাবদ্ধ ছিল। মনে করি, আজো তাই আছে। মনে আছে, ছাত্র-জীবনে একবার ত্রিপুরা স্টেট লটারির টিকিট কিনিয়াছিলাম। তৎকালে ওর প্রথম পুরস্কার ছিল এক লাখ। টিকিট কিনিয়া আমার ঘুম নষ্ট হইল। যদি ফার্স্ট প্রাইয পাই, তবে ঐ লাখ টাকা দিয়া। আমি করিব কী? আমি যৌবনের সােনালি স্বপ্নের অনেক চিত্র মনে-মনে আঁকিলাম। কিন্তু লাখ টাকা খরচের কোনও উপায় বাহির করিতে পারিলাম না । রূপান্তরে সে মনােভাব আমার আজো আছে। প্রয়ােজনের অতিরিক্ত টাকাকে আমি সত্যই ভয় পাই। পাকিস্তান সরকারের শিল্প-বাণিজ্য মন্ত্রী হওয়ায় আমার চার কোটি টাকার বদনাম হইয়াছে। এ নিয়া কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুসহ ডন-এর এডিটার আলতাফ হােসেনের সাথে আমার রম্য আলাপ হইতেছিল। বন্ধু বলেন : “শিল্প-বাণিজ্য মন্ত্রিত্ব একটা সাংঘাতিক ক্ষমতার
৪৪৩
পদ। এই দুইটা গদিতে একই ব্যক্তি বসিলে তার কাছে চার কোটি কেন, তার চেয়ে বেশি টাকার অফার আসিতে পারে। তুমি কি বলিতে চাও তােমার কাছে কোনও অফার আসে নাই?’ আমি সত্য কথা সরলভাবে স্বীকার করিলাম : নিশ্চয় আসিয়াছে, পরােক্ষভাবে।
বন্ধু বলেন : ‘ঘুষের অফার ইনডিরেকটলিই আসে। সােজা আসে না। তুমি কি এতই একটা ফেরেশতা যে ঐ সব লােভ তুমি সম্বরণ করিয়াছ শুধু। সাধুতার খাতিরে? আমি সরলভাবে বলিলাম : সাধুতার খাতিরে নয়, অফারের বিশালতার ভয়ে।
৫. অর্থম-অনর্থম মানুষের আর্থিক প্রয়ােজন সম্পর্কে আমার মনের কথা বাহির হইয়া পড়িয়াছিল একদা আকস্মিকভাবে। আলাপ হইতেছিল এক জজ সাহেবের সাথে। তখন আমি ময়মনসিংহে উকালতি করি (অনুমান ১৯৩৫-১৯৩৬ সাল)। শ্রীযুক্ত নগেন্দ্রনাথ বসু প্রবীণ সাব-জজ। খুব কড়া ও যশস্বী বিচারক। আইনের পােকা। আমার মত জুনিয়র উকিল ত দূরের কথা তার কোর্টে দাড়াইতে অনেক সিনিয়র উকিলেরও হাঁটু কাপিত। আমার বাসায় যাইতে এই জজ সাহেবের বাসার সামনে দিয়াই যাইতে হইত। কোর্ট-ফেরতা প্রায়ই এক সঙ্গে যাইতাম। উকিল হিসাবে জুনিয়র হইলেও কংগ্রেস ও কৃষক প্রজা পার্টির নেতা হিসাবে আমি গণ্যমান্য লােক ছিলাম। নগেন বাবু রাজনীতির ‘রা’ও জানিতেন না বটে, কিন্তু অন্য সব ব্যাপারে সদালাপী ছিলেন। বাসায় ফিরিতে এই সবই আলােচনা হইত।
বাসায় ফিরিবার পথে প্রায় প্রতিদিনই তিনি নিজে বাজার করিতেন। বাজার মানে দুই আনা-দশ পয়সার গুড়া মাছ, কয়েক আনার তরি-তরকারি। কলাপাতা বা কচু পাতার ঠোঙ্গায় মাছ বাম হাতে এবং তরি-তরকারি ডান হাতে লইয়া নূতন বাজার হইতে বাহির হইতে নগেনবাবুকে প্রায়ই দেখা যাইত।
একদিন আমি তাকে বলিলাম : এত টাকা মাহিয়ানা পান, খাওয়ায় এত কৃপণতা করেন কেন?
দুঃখিত হইয়া নগেনবাবু বলিলেন : অত টাকা মাহিয়ানা দেখিলেন কই?
আমি যখন স্মরণ করাইয়া দিলাম, তার মাহিয়ানা সাড়ে তেরশ টাকা, তখন তিনি বলিলেন : ঐ শুনিতেই শুধু তেরশ।
৪88
অতঃপর তিনি ইনকাম ট্যাক্স, ইনশিওরেন্স, প্রভিডেন্ট ফান্ড, সেভিং ব্যাংক ইত্যাদির সঠিক অঙ্ক উল্লেখ করিয়া দেখাইলেন যে, শেষ পর্যন্ত তাঁর হাতে আসে মাত্র আড়াইশ টাকা। আমি জবাবে বলিলাম যে, এক ইনকাম ট্যাক্স ছাড়া আর সব খরচই তাঁর ইচ্ছাধীন। তাঁর অত-অত টাকা জমা করার কোনও আবশ্যকতা নাই। তিনি তখন সঞ্চয়ের আবশ্যকতা বুঝাইলেন। অসুখ-বিসুখ, আপদ-বিপদ কতটাই ত আছে।
আমি তখন মৌলিক কথায় চলিয়া গেলাম। বলিলাম : তাহা হইলে নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হইল যে, আপনার মাসিক প্রয়ােজন মাত্র আড়াইশ টাকা। এর বেশি যে টাকা আপনি বেতন পান, সেটা বাহুল্য।
সেটা কৃষক-প্রজা আন্দোলনের যুগ। জমিদারি উচ্ছেদ, মন্ত্রী-বেতন। হাজার টাকা, শাসন-ব্যয় হ্রাস, সরকারি কর্মচারীদের বেতন কমান, তৎকালে প্রাত্যহিক স্লোগান। রাস্তা-ঘাটের আলাপের এবং খবরের কাগজের আলােচনার বিষয়। নগেনবাবু আমার কথার বাস্তব অর্থ করিলেন। ব্যগ্রতার। সঙ্গে বলিলেন : “আপনারা কি সত্য-সত্যই অফিসারদের বেতন কমাইতে চান? বিচার বিভাগের লােকেরও?
আমি যখন বলিলাম “নিশ্চয়ই’, তখন তিনি আন্তরিক ব্যাকুলতার সঙ্গে মুনসেফ-জজদের রাতদিন গাধার খাটুনির তুলনায় বেতনের স্বল্পতা, দেড়শ টাকায় মুনসেফি শুরু করিয়া তেরশতে পৌছাতক প্রায় কুড়ি বছরের দুঃখকষ্ট, অভাব-অনটনের কথা বিস্তারিত বলিলেন। তিনি অন্তত মুনসেফ-সাবজজদের বেতন না কমাইবার জন্য আমাকে সনির্বন্ধ অনুরােধ করিলেন। এটা তিনি এমনভাবে করিলেন, আমিই যেন কমানের কর্তা এবং আজই যেন সে অর্ডার দিতেছি।
আমিও সরলভাবে আমাদের প্রােগ্রামের যৌক্তিকতা তাঁকে বুঝাইবার চেষ্টা করিলাম। আমাদের ন্যাশনাল ইনকাম, পার-ক্যাপিটা ইনকাম, সে ইনকামের সাথে সরকারি কর্মচারীদের আনুপাতিক পার্থক্য, মাথাভারী শাসনব্যয়ের জন্যই আমাদের দেশের স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতে প্রয়ােজনীয় অর্থের অভাব ইত্যাদি উচ্চ পলিটিক্যাল-ইকনমিকসের উপর পাণ্ডিত্যপূর্ণ বক্তৃতা করিলাম। উপসংহারে বলিলাম : ব্যাংক ব্যালেন্স, ইনশিওরেন্স, প্রভিডেন্ট ফান্ড, জুয়েলারি, গহনা-পত্র, অনাবশ্যক সম্পত্তি, বাড়ি-ঘর, সাজ-সরঞ্জাম যার যত আছে সব সরকারে বাযেয়াফত করাই আমাদের প্রােগ্রাম।
আলাপে-আলাপে নগেনবাবুর বাসার সামনে আসিয়া পড়ায় আদাব দিয়া বিদায় হইলাম। কিন্তু বাসায় ফিরিয়া কাপড়-চোপড় ছাড়িতে-না-ছাড়িতেই
৪৪৫
নগেনবাবু আমার বৈঠকখানায় ঢুকিয়া ‘উকিল সাব’ ‘উকিল সাব’ বলিয়া ডাকাডাকি শুরু করিলেন। রাজা-মহারাজা, লাট-মন্ত্রী হইলেও এ সময়ে নাশতা-চা না খাইয়া বাহির হইতাম না। কিন্তু এ যে হাকিম। ঐ অবস্থায়ই বাহির হইয়া আসিলাম। নগেনবাবু সােজাসুজি বলিলেন : ‘এ ব্যাপারে একটা হেস্তনেস্ত না করিলে আজ আমার আহার-নিদ্রা হইবে না। তাই একটা ফয়সালা করিতে আসিলাম।
ক্ষুধায় আমার মেজাজ গরম হইয়াছিল নিশ্চয়ই। কিন্তু পরম দক্ষতার সহিত তা গােপন করিয়া হাসি মুখে বলিলাম : আপনারা প্রয়ােজনের অতিরিক্ত যে টাকা পান, তা আপনারা জমা করেন ভবিষ্যৎ অসুখ-বিসুখ ও আপদ-বিপদে খরচ করিবার জন্য, এই ত? কিন্তু আপনারা কি জানেন না যে, ঐ সঞ্চয়ের দ্বারাই আপনারা নিজেদের অসুখ-বিসুখ ও আপদ-বিপদ ডাকিয়া আনেন?
নগেনবাবু : সেটা কেমন? আমি : আপনি ভগবানে বিশ্বাস করেন?
নগেনবাবু দাঁতে জিভ কাটিয়া বলেন : কন কি মনসুর সাব? আমি ভগবান মানি না?
বলিয়া তিনি জোড়হাত কপালে ঠেকাইলেন। আমি বলিলাম : আপনি চিত্রগুপ্তের নাম শুনিয়াছেন?
নগেনবাবু যেন অপমানিত হইলেন। বলিলেন : আমি হিন্দু, চিত্রগুপ্তের নাম শুনি নাই আমি?
আমি : বেশ। তা হইলে এই চিত্রগুপ্তের কাজটা কি তাও আপনি জানেন। চিত্রগুপ্ত ভগবানের ফাইন্যান্স মিনিস্টার, চ্যান্সেলার-অব-দি-এক্সচেকার, প্রজেক্ট ডাইরেক্টর, একাউন্টেট-জেনারেল ও অডিটর-জেনারেল। তিনি চতুর্দশ, যমের অন্যতম শ্রেষ্ঠ যম। মানেন আপনি?
নগেনবাবু জীবন ফাটাইয়াছেন মােকদ্দমার ফাইল ও আইনের পুস্তক পড়ায় । অত কথা তিনি জানেন না। তবু আমার মত আইনজ্ঞের কাছে সে কথা স্বীকারও করিতে পারেন না। তাই শুধু সম্মতিসূচক মাথা ঝুঁকাইলেন।

৬. চিত্রগুপ্তের বাজেট
আমি বলিতে লাগিলাম : মানুষের জীবন-মৃত্যু, অসুখ-বিসুখ, সুখ-সম্পদ ও আপদ-বিপদের মালিক এই চিত্রগুপ্ত। ভগবান এই চিত্রগুপ্তকে কনসাল্ট
৪৪৬
করিয়াই এ সব বিলি-বণ্টন করিয়া থাকেন। আমাদের গবর্নমেন্ট যেমন বছরের গােড়াতে ফাইনান্স মিনিস্টারের মারফত বাজেট রচনা ও ঘােষণা করিয়া থাকেন, ভগবানও তেমনি প্রতি বছর শিবরাত্রিতে চিত্রগুপ্তের মারফত এটা করিয়া থাকেন। মুসলমানদের আল্লাহ এ বাজেট করেন শবে-বরাতে। অসুখ-বিসুখ ও আপদ-বিপদের কথাটাই ধরা যাউক। শিবরাত্রে ভগবান সভাসদ লইয়া বাজেট করিতে বসেন। চিত্রগুপ্ত বসেন তাঁর খাতা-পত্র লইয়া। ভগবান চিত্রগুপ্তকে ডাকিয়া বলেন : দেখ ত অমুক মহারাজের অসুখ-বিসুখের তহবিলে কত টাকা আছে। চিত্রগুপ্ত খাতা দেখিয়া বলিলেন : এক লাখ । ভগবান বলিলেন : দেও তারে একটা ক্যানসার । ভগবান বলেন : দেখ ত অমুক রাজা-বাহাদুরের ঐ তহবিলে কত আছে? চিত্রগুপ্ত বলেন : পঞ্চাশ হাজার। ভগবান বলেন : দেও তারে একটা করােনারি থ্রম্বসিস। এরপর দেখ ত অমুক রায় বাহাদুরের ঐ তহবিলে কত আছে? চিত্রগুপ্ত বলিলেন : বিশ হাজার । ভগবান বলেন : দেও তারে একটা টিবি । তারপর দেখ ত সাব-জজ নগেনবাবুর ঐ তহবিলে কত আছে? চিত্রগুপ্ত খাতার পাতা উল্টাইয়া বলেন : দশ হাজার। ভগবান বলেন : দেও তারে একটা ডায়েবেটিস। তারপর দেখ ত সরকারি উকিল সতীশ দত্তের ঐ তহবিলে কত আছে? চিত্রগুপ্ত বলিলেন : মাত্র পাঁচ হাজার সার। ভগবান বলিলেন : দেও তারে একটা টায়ফয়েড। তারপর দেখ ত উকিল উপেন দের ঐ তহবিলে কত আছে? চিত্রগুপ্ত দুই-তিনবার পাতা উল্টাইয়া আঙুলে গনিয়া বলেন : মাত্র পাঁচ শ টাকা মহারাজ। ভগবান ঘাড় ও মাথা চুলকাইয়া অবশেষে বলেন : কি আর দিবে ওকে? দেও একটা সর্দি-জ্বর । তারপর দেখ ত অশ্বিনী মােখতারের ঐ তহবিলে কত আছে? চিত্রগুপ্ত অত বড় খাতাটার এক মলাট হইতে অপর মলাট পর্যন্ত দুই-তিনবার উল্টাইয়া অবশেষে বলিলেন : এক পয়সাও নাই, ভগবান। ভগবান তখন সকলের দিকে চাহিয়া মুচকি হাসিয়া বলেন : দেও, ও-হতভাগাকে ছাড়িয়াই দেও।
আমি গােড়াতে ক্ষুধার মেজাজে রাগ করিয়া নগেনবাবুকে উত্ত্যক্ত করিবার জন্যই বােধহয় কথাগুলি শুরু করিয়াছিলাম। কিন্তু অল্পক্ষণেই অনুপ্রেরণার উচ্চস্তরে উঠিয়া গেলাম। ক্ষিধা বেশি লাগিলে আমার বক্তৃতা ভাল জমে। সেদিনও বােধ হয় তাই হইয়াছিল। দেখিলাম নগেনবাবু হাঁ করিয়া আমার কথাগুলি গিলিতেছেন।
আমার কথা শেষ হইলে তিনি গম্ভীর মুখে বলিলেন : আপনি যে সব কথা বলিলেন, তা সত্যি-সত্যি শাস্ত্রের কথা নাও হইতে পারে কিন্তু কথাগুলি সত্য।
৪৪৭
নিজের জীবনেই আমি তার ফল পাইয়াছি। আপনার কথা শুনিবার পর আজ তা বুঝিলাম। আপদ-বিপদ অসুখের নামে যত বেশি জমাইয়াছি, সত্য-সত্যই আপদ-অসুখ তত বাড়িয়াছে। তার এক ছেলে যে মারা গিয়াছে, তার এক মেয়ে যে বিধবা হইয়াছে, তার সঙ্গে নিজের ঐ সময়ের সঞ্চয়ের কার্য-কারণ সম্পর্কে দেখাইলেন।
নগেনবাবু চলিয়া গেলে নিজের কথাগুলিই অনেকক্ষণ পর্যালােচনা করিলাম। চা-নাশতা করিতে করিতে ঐ লইয়া স্ত্রীর সাথে রসিকতা করিবার চেষ্টাও করিলাম। বাধ-বাধ ঠেকিল। বুঝিলাম, রসিকতা করিতে গিয়া অন্তরের কথাই বলিয়াছি। এই কারণেই বােধহয় জীবনে টাকা সঞ্চয় করিলাম না। ব্যাংকের একাউন্ট খুলিলাম না। যেমন আয় তেমনি ব্যয়। এই জন্যই আমি সঞ্চয়কে আহাম্মকি মনে করিয়া থাকি। নিজে না খাইয়া টাকা জমাইয়া যারা বাড়ি-ঘর, ধন-সম্পদ করে, তাদেরে বিদ্রুপ করিয়া আমি অনেক রচনা লিখিয়াছি। কলিকাতা চিত্তরঞ্জন এ্যাভিনিউ-এর সুরম্য প্রাসাদগুলিতে বাস করেন ভােগ-বিলাসী ভাড়াটিয়ারা। আর বাড়িওয়ালা বাস করেন বড় বাজারের তুলাপট্টির কবুতরের খােপে। মাসে লাখ-লাখ টাকা তারা রােযগার করেন, জমা করেন। কিন্তু কাগজের চেক, সােনার মােহর বা রুপার টাকা নয়। ব্যাংকে যা জমা হয় তাও সােনা-রুপা নয়, শুধু ফিগার : লাখের পর কোটি, কোটির পর পরার্ধ্ব। মিলিয়নের পরে বিলিয়ন, তারপর ট্রিলিয়ন। এমনিভাবে কোটিপতি তুলাপট্টির কবুতরের খােপেই মারা যান। পুত্র যদি বাপের মত সাধু-সজ্জন হয়, তবে সে কোটিকে করে পরার্ধ্ব। পরে বাপের মতই মারা যায়। আর সে যদি বুদ্ধিমান হয় তবে মদে-মেয়েলােকে ও রেসে সব উড়াইয়া দেউলিয়া হয়। এইই সঞ্চয়ের পরিণাম। এই সঞ্চয়েরই যারা প্রাণপাত করে, তারা আমাকে নির্বোধ বলিতে পারে, কিন্তু আমিও তাদেরে বুদ্ধিমান বলি না।
সব মতবাদের নৈতিক ও অর্থনৈতিক দুইটা দিকই আছে। ধনতান্ত্রিক সমাজে এই সঞ্চয়কে ক্যাপিটেল কর্মেশন বলে। আমি বলি এটা হাের্ডিং। সব দ্রব্য হাের্ডিং-এর মত এটাও আমার মতে পাপ।
কিন্তু বাড়ি করা সম্পর্কে আমার মতামত আরাে অদ্ভুত। ওটা নিছক অর্থনীতিক। ওর কোনও নৈতিক দিক নাই। আমি নিজে বাড়ি না করিয়া ভাড়াটিয়া বাড়িতে থাকার পক্ষপাতী। হিতৈষীরা আমাকে নিজের বাড়ি তৈরি করিতে বহু হিতােপদেশ দান করিয়াছেন। কিন্তু আমাকে রাজি করিতে পারেন নাই।
৪৪৮
৭. নিজের বাড়ি
নিজস্ব বাড়ি তৈয়ার করিতে আমার কোনও নৈতিক আপত্তি ছিল না। আপত্তিটা ছিল নিছক বিষয়-বুদ্ধির হিসাব-নিকাশের কথা। আমার যুক্তিটা ছিল এইরূপ : আমি বর্তমানে পঞ্চাশ টাকা ভাড়া দিয়া সে বাড়িতে আছি তা তৈয়ার করিতে কম-সে-কম পঁচিশ হাজার টাকা লাগিয়াছে। এই রকম সুবিধার নিজস্ব বাড়ি তৈয়ার করিতে বর্তমানে আরাে বেশি টাকা লাগিবে। তেমন আর্থিক ক্ষমতা আমার নাই। যদি থাকিতও, তবু আমি ঐ টাকা খরচ করিয়া নিজস্ব বাড়ি করিতাম না। কারণ তার অর্থ এই হইত যে, মাসে-মাসে বাড়ি ভাড়া না দিয়া আমি পঞ্চাশ বছরের ভাড়া অগ্রিম দিয়া একটি বাড়ি ভাড়া করিলাম। তাতেও রক্ষা নাই। কোয়ার্টারে-কোয়ার্টারে মিউনিসিপ্যাল ট্যাক্স, বছর-বছর জমির খাযনা, বছর-বছর হােয়াইট ওয়াশ, কিছুদিন পরে-পরে তাতেও এ সব খরচা আমাকে করিয়া যাইতেই হইত। ভাড়াটিয়া বাড়িতে এসব খরচা আমার নাই। পক্ষান্তরে পঁচিশ হাজার টাকা না থাকা সত্ত্বেও যদি আমাকে নিজের বাড়িতে থাকার গৌরবলাভ করিতে হয়, তবে অল্প টাকা খরচ করিয়া শহরতলিতে ছােট বাড়ি করিয়া থাকিতে হয়। শুধু নিজ বাড়িতে থাকিবার নিছক মানসিক ও কল্পিত অহংকারের খাতিরে আমাকে সুখস্বাচ্ছন্দ্য, যাতায়াতের সুবিধা, শহরের অভ্যন্তরের সুন্দর বাড়ি ছাড়িয়া অসুবিধাজনক বেকায়দায় অসুন্দর বাড়িতে থাকিবার কষ্ট সহ্য করিতে হয়। বন্ধুরা বলিতেন : ‘তবু ত নিজের বাড়ি। আমি বলিতাম : ভাড়াটিয়া বাড়িইবা আমার নিজের বাড়ি নয় কেন? আমি ত ভাড়াটিয়া বাড়িকেই নিজের বাড়ি মনে করি। ফুলের বাগান করি শাক-সবজির গাছ লাগাই। এমনকি ফলের গাছ লাগাই। ছােটখাটো মেরামত নিজে করাই। কই, কখনও ত মনে হয় না পরের বাড়িতে আছি!’ বন্ধুরা বলিতেন : মাসে-মাসে ভাড়া দাও যখন, তখন কি তােমার মনে পড়ে না পরের বাড়িতে আছ? ভাড়া না দিলেই ত বাড়িওয়ালা তােমাকে উঠাইয়া দিবে। আমি বলিতাম : বছরবছর নিজের বাড়ির ট্যাক্স ও জমির খাযনা দিতে হইবে। ঐ খাযনা-ট্যাক্স না দিলেও ত জমিদার বা সরকার বাড়ি নিলাম করিয়া আমাকে উঠাইয়া দিবেন। পক্ষান্তরে রীতিমত ভাড়া দিলে কোনও বাড়িওয়ালাই আমাকে উঠাইতে পারিবেন না। আমি পুরুষানুক্রমে এই বাড়িতে থাকিতে পারিব। আমার ‘পুরুষানুক্রমে’ কথায় বন্ধুরা বলিতেন : নিজের জন্য না হউক ছেলে-পিলের জন্য তাদের মাথা উঁজিবার আশ্রয়স্থল হিসাবে একটা বাড়ি নিশ্চয়ই থাকা।
৪৪৯
উচিৎ। তুমি চোখ বুজিলে ছেলে-পিলেরা দাঁড়াইবে কোথায়? আমি হাসিয়া বলিতাম : ‘আমার নিজের জন্য তা হইলে তােমাদের আর ভাবিবার নাই। ছেলেদের কথা? আমার ছেলেরা, সব বাপের ছেলেরাই, মাত্র তিন রকমের হইতে পারে। হয় তারা আমার মত হইবে, নয় আমার চেয়ে ভাল হইবে, অথবা আমার চেয়ে খারাপ হইবে। এই তিন অবস্থার কোনও অবস্থাতেই আমার-তৈরি বাড়ি তাদের কাজে লাগিবে না। প্রথমত, তারা যদি আমার মত হয়, তবে তারাও আমারই মত ভাড়াটিয়া বাড়িতে আমারই মত সুখেস্বাচ্ছন্দ্যে থাকিতে পারিবে। সুতরাং তাদের জন্য আমার বাড়ি করার দরকার নেই। দ্বিতীয়ত, তারা যদি আমার চেয়ে ভাল ও বড় হয়, তবে তারা কেউ ঢাকায়, কেউ করাচিতে, কেউ বিদেশে থাকিবে। ময়মনসিংহের মত ছােট শহরে থাকিয়া তারা সুখ পাইবে না। সুতরাং তাদের জন্য আগে হইতে বাড়ি করিয়া রাখা বেকার। তৃতীয়ত, আমার ছেলেরা যদি আমার চেয়ে খারাপ হয়, তবে মূর্খ হইতে পারে, চরিত্রহীন হইতে পারে, নির্বোধ হইতে পারে, চোর-গাঁজা-খাের হইতে পারে। তা হইলে তারা কেউ আমার তৈরি বাড়িতে থাকিবে না। ভাই-এ ভাই-এ মারামারি করিয়া, ভাগাভাগি করিয়া, বিক্রয়। করিয়া অথবা বন্ধক দিয়া অন্যত্র নিম্নমানের বাড়িতে থাকিবে। সুতরাং এদের জন্যও আমার বাড়ি করার দরকার নাই। নিজস্ব বাড়ির এই শােচনীয় ভষ্যিৎ দেখাইয়া আমি উপসংহার করিতাম : ‘যে টাকায় বাড়ি করিব, সেই টাকা খরচ করিয়া ছেলেদেরে পড়া-শােনা করাইব, দুধ-ঘি খাওয়াইয়া স্বাস্থ্যবান করিব। আত্মমর্যাদাবান, ভদ্র ও চরিত্রবান করিব। তা যদি করিতে পারি, তবে ভষ্যিতে তাদের মাথা পুঁজিবার ঠাইয়ের জন্য এখন হইতে আমাকে চিন্তা করিতে হইবে না।

৮. নিজের বাড়ি বনাম ভাড়াটিয়া বাড়ি
বলা বাহুল্য এর একটাও নীতিবাক্য নয়, নিছক বিষয়-বুদ্ধির কথা। আমি প্রেরণা-বশে বা নিজের বুদ্ধি-বিবেচনায় এই সত্য আবিষ্কার করিয়াছিলাম তা নয়। আমার পরম শ্রদ্ধেয় তিনজন চিন্তাবিদের কথা ও কাজ হইতে এই প্রেরণা আমি লাভ করিয়াছিলাম। এই তিন মনীষী হইতেছেন, মওলানা আবুল। কালাম আজাদ, মি. অতুলচন্দ্র গুপ্ত এবং ডা. নরেশ চন্দ্র সেন। পরবর্তী দুই মনীষী সাহিত্য সেবায় এবং কৃষক-প্রজা আন্দোলনে আমাকে প্রচুর প্রেরণা দিয়াছেন। উকালতি করিয়া এঁরা বিপুল টাকা রােযগার করিতেন। বহু টাকা
৪৫০
ভাড়া দিয়ে সুন্দর-সুন্দর প্রাসাদতুল্য বাড়িতে পরম বিলাস-ব্যসনে থাকিতেন। কিন্তু নিজের বাড়ি তৈরি করিবার কল্পনাও তাঁরা করিতেন না। মওলানা সাহেবেরও টাকা-পয়সার অভাব ছিল না। তিনি অনেক টাকার ভাড়ার বাড়িতে থাকিতেন। বিপুল পুস্তকরাজির বিশাল লাইব্রেরি ছিল তার। মাসে-মাসে তিনি হাজার-হাজার টাকার বই কিনিতেন। নিত্য-নূতন ট্যাক্সিতে চড়িতেন। নিজে মােটর কিনিতেন না। বিশ্ববিখ্যাত চিন্তা-নায়ক বার্ট্রান্ড রাসেলেরও এই মত। তাঁর পুস্তক পড়িয়াই সর্বপ্রথম জ্ঞান লাভ করি যে, ইউরােপ মার্কিন মুলুকের বহু কোটিপতির নিজস্ব কোনও বাড়ি-ঘর নাই। তারা পুরুষানুক্রমে হােটেলে ও জাহাজে বাস করিয়া আসিতেছেন। লর্ড রাসেল লিখিয়াছেন, নিজস্ব বাড়ি ও ভাড়াটিয়া বাড়ির মধ্যে সাধারণ লােকেরা যে পার্থক্য করিয়া থাকে, সেটার ভিত্তি শুধু পযেসরী ইনটিংক্ট। ওটা অবৈজ্ঞানিক সংস্কার মাত্র। অতঃপর এই মতবাদ আমার ঈমানের অঙ্গ হইয়া উঠে। বই-পড়া এই মতবাদ ছাড়াও আমার স্বতঃপ্রণােদিত একটা অভ্যাস ছিল। ভাড়াটিয়া বাড়িইে আমি সত্য-সত্যই নিজের মনে করিতাম। ছােটখাটো অল্প-ব্যয়সাধ্য মেরামত আমি নিজেই করিতাম, বাড়িওয়ালার করার অপেক্ষায় বসিয়া থাকিতাম না। জানিতে পারিয়া বাড়িওয়ালা খরচাটা দিলে নিতাম, না দিলে চাহিতাম না। ধরুন, ঝড়ে আমার বাড়ির একটা জানালার পাল্লার কবৃজা খুলিয়া পড়িয়াছে; কিম্বা পানির কলটা খারাপ হইয়া গিয়াছে। আমি বহুবার দেখিয়াছি ঐরূপ ঘটনায় আমার প্রতিবেশী বাড়িওয়ালাকে মেরামতের জন্য মুখে, টেলিফোনে তাগাদা করিতেছেন। শেষ পর্যন্ত ভাড়া বন্ধ করিবার ও উকিলের নােটিস দিবার ভয় দেখাইতেছেন। ইতিমধ্যে ভাঙ্গা জানালা দিয়া বৃষ্টির পানি আসিয়া তার বিছানা ভিজিতেছে, খােলা-কলে পানি পড়িয়া ছাদের উপরস্থ টাংকির পানি শেষ হইয়া গিয়াছে। বাথরুমের পানির অভাবে রান্না ও গােসলের ভয়ানক অসুবিধা হইতেছে। ভিস্তিওয়ালাকে দিয়া রাস্তার কল হইতে পানি আনাইয়া তিনি কাজ চালাইতেছেন। বাড়িতে ভিজা বিছানা-বালিস রােজ রােদে দিতেছেন। তবু ঐ সামান্য মেরামতের কাজটুকু নিজে করিতেছেন না। পক্ষান্তরে এইরূপ ঘটনায় আমি তৎক্ষণাৎ একটা প্লাম্বারকে চার আনা ও একটি সূতার মিস্ত্রিকে আট আনা দিয়া ঐ কল ও জানালার পাল্লা মেরামত করাইয়া ফেলিয়াছি এবং দিব্যি আরামে জানালা ও পানির কল ব্যবহার করিয়াছি।
আমার এই মনােভাব কোনও নৈতিক আদর্শের মনােভাব নয়, নিতান্ত বিষয়-বুদ্ধি ও কাণ্ডজ্ঞানের কথা। কাজেই এটা বুঝা সহজ হওয়া উচিৎ
৪৫১
সকলের পক্ষেই। তাই প্রতিবেশী বন্ধুকে এটা বুঝাইবার চেষ্টা করিতাম। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখিতাম, মানুষের মালিকানাবােধ, বার্ট্রান্ড রাসেল যাকে পযেসরী ইনসটিংক্ট বলিয়াছেন তা অতিশয় প্রবল। ভাড়া দিয়া যে বাড়িতে থাকেন, সে বাড়ি যে তার নয় অপরের, এই বােধ সব ভাড়াটিয়ার মনে অতিশয় তীব্র। পরের বাড়িতে তিনি নিজের এক পয়সাও খরচ করিবেন কেন? এ বুদ্ধি তাদের টন-টনা। কিন্তু আমার মত তারা বার আনা পয়সা ব্যয় না করিয়া যে বৃষ্টিতে ভিজিলেন, রান্না-গােসলের কষ্ট ভােগ করিলেন, সে কষ্ট ও দুর্ভোগের দাম যে বার আনার চেয়ে অনেক বেশি, সে কথাটা তাঁদের আক্কেলে ধরা দেয় না। এই নিজস্ব মালিকানা-বােধের অভাবে এবং পরস্ববােধের প্রভাবে তারা ভাড়াটিয়া বাড়িতে ফলের গাছ। লাগান, ফুলের বাগান করা, টব বসানাে বা অন্য প্রকারে সাজানকে পরের বাড়িতে অর্থের অপব্যয় মনে করেন। বাগানের ফুলের খােশবু যে তিনিই ভােগ করিবেন; বাড়িওয়ালা করিবেন না, বাড়ির সাজসজ্জা যে তাঁরই নিজের ও তাঁর পরিবারের মনে আনন্দ দান করিবে, বাড়িওয়ালার মনে করিবে না, এটাও বুঝিতে চান না। এই পরস্ববােধের জন্যই এই শ্রেণীর ভাড়াটিয়ারা বাড়ির এখানে-সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলিয়া থাকেন, দাহাতুড়ি দিয়া মেঝের সিমেন্ট ও দেয়ালের আস্তর বিনষ্ট করিয়া থাকেন, ছেলে-মেয়েরা কয়লা ও পেনসিল দিয়া দেওয়ালে ‘চিত্র আঁকিয়া থাকে, চাকর-চাকরানিরা দেওয়ালে হাঁড়ি-পাতিলের কালি মাখিয়া রাখে। পরের বাড়ির এই ধরনের অনিষ্ট করিয়া তাঁরা যেন একটা আনন্দ পান। অথচ এই কদর্যতা, অপরিচ্ছন্নতা ও সৌন্দর্যহীনতা বাড়িওয়ালা ভােগ করেন না। করিতে হয় ভাড়াটিয়ার নিজেরই। এটাই হইয়া থাকে ঐ পযেসরী ইনটিংক্ট হইতে। অথচ এ মালিকানাবােধ যে কত ভ্রান্ত, পণ্ডিত রাসেল তা সুন্দররূপে বুঝাইয়া দিয়াছেন। একটু ধীরচিত্তে বিবেচনা করিলেই বুঝা যাইবে শেষ পর্যন্ত আমি যেখানে যখন আছি, তখনকার জন্য সেই স্থানটিই আমার বাসস্থান। আমার সুখ-সুবিধা ও আনন্দের জন্য যা করা দরকার তাই আমাকে করিতে হইবে। এমনকি পথিকও রাস্তার ধারে গাছতলায় বিশ্রাম করিতে বসিলে বসার জায়গাটি ঝাড়িয়া-পুছিয়া পরিচ্ছন্ন করিয়া লয়। জায়গাটি নিজের নয় পরের, সে কথা তার মনেও পড়ে না। আমার বিশ্বাস। এই মামুলি কাণ্ডজ্ঞান থাকিলে মানুষ নিজের বাড়ি ও ভাড়াটিয়া বাড়ির মধ্যে পার্থক্য করিতে পারে না। ভাড়াটিয়া বাড়ির জন্য যেমন ভাড়া দিতে হয় নিজের বাড়ির জন্যও তেমনি খাযনা-ট্যাক্স দিতে হয়। ওটা না দিলে যেমন
৪৫২
বাড়ি থাকে না, এটা না দিলেও তেমনি থাকে না। কাজেই নিজের বাড়িতে বাস করার স্বপ্নে সারা জীবন কষ্ট করার চেয়ে পরের-তৈরি ভাড়াটিয়া বাড়িতে যারা জীবন কাটায়, তারাই বুদ্ধিমান। আহাম্মকেরা ভােজের আয়ােজন করে, বুদ্ধিমানেরা তা খায়, ইংরাজি এই প্রবাদটি বাড়ির ব্যাপারেও সত্য।

৯. জ্ঞান ও বুদ্ধি
শুধু বাড়ি করার ব্যাপারে নয়, সব ব্যাপারেই বন্ধুরা আমাকে বুদ্ধিমান-জ্ঞানী বলিতেন। আমিও মনে-মনে তৃপ্তি, এমনকি গর্ব বােধ করিতাম। এই বুড়া বয়সে বার্ধক্যের জ্ঞান আমার কিছুটা থাকিলেও বিষয়-বুদ্ধি নাই। জ্ঞান ও বুদ্ধি’ দুইটা গুণকে এক করিয়া ভাবাতেই এই বিভ্রান্তি ঘটিয়াছে। আসলে দুইটা এক নয়। জ্ঞানটা জানায় সীমাবদ্ধ। বুদ্ধিটা করায় প্রসারিত। বিষয়ী জীবনের জন্য থিওরেটিক্যাল জ্ঞান যথেষ্ট নয়। প্র্যাকটিক্যাল বুদ্ধিও দরকার। এমনকি বিষয়ী জীবনের সাফল্যের জন্য জ্ঞান অত্যাবশ্যক নয়, শুধু বুদ্ধি থাকিলেই চলে। বুদ্ধিমানেরা ‘জ্ঞানীর’ জ্ঞান ধার করিয়া শুধু বুদ্ধির জোরে জীবনে সাফল্য লাভ করিয়াছেন, সমাজের সকল স্তরে এর ভূরি-ভূরি দৃষ্টান্ত রহিয়াছে। সাংবাদিক হিসাবে কলিকাতা জীবনে আমি যখন মেসে থাকি, তখন আমার রুমমেট ও আমি এক বেকার বন্ধুকে আমাদের রুমে বিনাভাড়ায় থাকিতে দিয়াছিলাম। বেকার বন্ধুর তখতপােশ ও বিছানা-পত্র কিনিবার সাধ্য ছিল না। সারাদিন কাজের তালাশে ঘুরিতেন। রাত্রে মেঝের মাদুরে শুইয়া থাকিতেন। আমরা তাঁকে স্বাধীন ব্যবসার উপদেশ ও ব্যবসায় চালাইবার জ্ঞান দান করি। দরকারি কাগজ-পত্র মুসাবিদা করিয়া দেই। আমরা কলিকাতা থাকিতেই ঐ বন্ধুর দু’তলা বাড়ির ভাড়াটিয়া ছিলাম। থিওরেটিক্যাল জ্ঞান ও প্র্যাকটিক্যাল বুদ্ধির পার্থক্য এইখানে। আসলে প্র্যাকটিক্যাল না হইলে জ্ঞানও পূর্ণ হয় না।
আমি যে মােটেই প্র্যাকটিক্যাল নই, এ কথা বলিলেও নিজের উপর অবিচার করা হইবে। সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য আরাম-আয়েশ ও আর্থিক সচ্ছলতায় আমি মােটেই উদাসীন ছিলাম না। কিন্তু সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও বিলাসিতা, আর্থিক সচ্ছলতা ও ধনী হওয়া, এক জিনিস নয়, এ বিষয়েও সচেতন ছিলাম। আমি সন্ন্যাস, ফকিরি, কৃপণতা, কৃচ্ছ-সাধনা ও অপরিচ্ছন্নতার বিরােধী। সুস্থ দেহ ও সৎ মন যা খাইতে, পরিতে এবং যেভাবে থাকিতে চাহিবে,
৪৫৩
সেভাবেই খাওয়া-পরা-থাকার আমি পক্ষপাতী। সুস্থ মনের কোনও স্ট্যান্ডার্ড নাই, এ কথা আমি মানি না। যে মন নিজের ও অপরের প্রয়ােজনের সীমাসরহদ্দ চিনে, সেটাই সুস্থ মন। কড়ার ফকির হাজার টাকার মালিক হইলে সে লক্ষ টাকা চাহিবে, লক্ষ পাইলে কোটি চাহিবে, মিলিয়ন পাইলে বিলিয়ন চাহিবে এটা সাধারণ ব্যাপার হইলেও সুস্থ মনের পরিচায়ক নয়। সুস্থ মন। জানে, খাওয়া-পরার মতই মানুষের সব ভােগের একটা সীমা আছে। টাকা-পয়সার প্রয়ােজনেরও সীমা আছে। এ সীমা লঙ্ঘনের ফলেই অর্থে অনর্থ ঘটিয়া থাকে।
তবে এই সীমার যেমন ম্যাক্সিমাম আছে, তার একটা মিনিমামও আছে। এই মিনিমাম চিনিতে হইলে জ্ঞান ও বুদ্ধির সমন্বয় দরকার। নিজস্ব বাড়ি করার ব্যাপারে আমার থিওরির জ্ঞানে বুদ্ধির বেড়া দেন আমার স্ত্রী। তারই প্রাধান্যে আমি আজ শহরে বাড়ির মালিক হইয়াছি। নিজের বাড়িতে পুতনাতি লইয়া সপরিবারে পরম সুখে বাস করিতেছি। বার্ট্রান্ড রাসেলের আদর্শ আমার নিজস্ব বাড়ি নির্মাণ ঠেকাইতে পারে নাই। এটা ঘটিয়াছে বুদ্ধির জোরে। সে বুদ্ধিটাও আমার নয়, আমার স্ত্রীর। ১৯৫৭ সালে তৎকালীন সিএন্ডবি মিনিস্টার আমার পরম বন্ধু কফিলুদ্দিন চৌধুরীর সাথে একরূপ ষড়যন্ত্র করিয়াই আমার স্ত্রী আমার অজ্ঞাতে ও অনুপস্থিতিতে ধানমন্ডিতে জমি বন্দোবস্ত নেন। পরে হাউস বিল্ডিং হইতে টাকা নিয়া বাড়ি। করা হয় তাঁরই উদ্যোগে ও আমার সক্রিয় সহযােগিতায়। ততদিনে আমার আদর্শের জোর ও আমার ব্যক্তিগত প্রভাব কমিয়া গিয়াছে। স্ত্রীরও জোর বাড়িয়াছে। ছেলেরা বড় হইয়াছে। আমি তখন বড় পরিবারের অনেকের একজন মাত্র। ক্যাবিনেট সিস্টেমে আমি তখন নাম্বার ওয়ান এমাংস্টইকুয়ালস মাত্র। তাছাড়া ততদিনে আমার এই বােধােদয় হইয়া গিয়াছে যে, সুফি-দরবেশ ও বিজ্ঞানী দর্শনীর জন্য যাই হউক, বিষয়ীর জন্য জ্ঞানবিজ্ঞানের সাথে একটু কাণ্ডজ্ঞান থাকা ভাল।

১০. আহাম্মকের পাহারাদার তকদির
বিষয়ী জীবনের টাকা-পয়সার ব্যাপারে আমি খানিকটা বুদ্ধিহীন ছিলাম ঠিকই কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই তকদির আমার পাহারাদারি করিয়াছে। অসাবধানতায় যা হারাইয়াছি, বরাত তা ফিরাইয়া দিয়াছে। হারানাে বস্তু ফেরত পাওয়া সৌভাগ্যের লক্ষণ—এমন একটা প্রবাদ আমাদের দেশে চালু আছে। আমার
৪৫৪
জীবনে এমন অনেকবার ঘটিয়াছে। কাজেই আমাকেও ভাগ্যবান বলা যাইতে পারে। সাধারণ অবস্থা ছােট-খাটো বস্তু হারাইয়া ফিরিয়া পাওয়া খুব উল্লেখযােগ্য কিছু নয়। কিন্তু তৎকালে পঞ্চাশ লক্ষ বাসেন্দার ভিড়ের শহর কলিকাতায় ট্রামে-বাসে হাজার টাকা-ভরা মানিব্যাগ পকেটমার যাওয়ার পরও তা ফিরিয়া পাওয়া সত্যই একটা অসাধারণ ব্যাপার। এটাও বরাতে ঘটিয়াছিল। ব্যাপারটা ঘটে এই ভাবে :
ইত্তেহাদএর সম্পাদকরূপে প্রথম মাসের বেতন পাইয়াছি হাজার টাকা। এত টাকা একসঙ্গে বেতন পাই নাই কোনও দিন এর আগে। প্রথম সুযােগেই বাসায় ফিরিলাম। বিবির হাতে টাকাটা দিলাম। তিনি নােটগুলি খানিক হাতাইয়া সেগুলি আমার হাতে দিলেন। বলিলেন : উকালতির টাকাতেই কিছুদিন চলিয়া যাইবে। বেতনের টাকা দিয়া একটা ব্যাংক একাউন্ট খােলাে।
ব্যাংক একাউন্ট একটা খােলাই ছিল। কৃষক-এর সম্পাদকতাকালে অধ্যাপক হুমায়ুন কবির কংগ্রেস নেতা মি. ধীরেন মুখার্জির সদ্যপ্রতিষ্ঠিত হুগলি ব্যাংকে আমাকে দিয়া একটা সেভিং একাউন্ট খুলান। ঐ খুলা তকই। বহুদিন পরে ঐ একাউন্টের কথা মনে পড়িল। বিবির হুকুম-মত পরদিন সকালে আফিসে কিছুক্ষণ কাজ করার পরই ব্যাংকে রওয়ানা হইলাম।
কলিকাতা তখন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-বিধ্বস্ত। ট্রাম বন্ধ। বাসও আংশিক বন্ধ। শুধু বিশেষ বিশেষ রুটে কিছু বাস চলে। কলুটোলা ও পার্ক সার্কাসের মধ্যে মুসলিম প্রধান-এলাকায় যােগাযােগ রক্ষার জন্য যে সার্ভিসটি চালু ছিল, তা বরাবরের লােয়ার সার্কুলার রুটে না গিয়া ইলিয়ট রােড, রয়েড স্ট্রিট, ওয়েলেসলি, ধর্মতলা, বেন্টিক স্ট্রিট, লােয়ার চীৎপুর দিয়া যাকারিয়া স্ট্রিটে নাখােদা মসজিদ পর্যন্ত যাইত। হুগলি ব্যাংক ধর্মতলা স্ট্রিটে। কাজেই আমি পার্ক-সার্কাস হইতে এই বাস ধরিলাম। ধর্মতলায় হুগলি ব্যাংকের কাছাকাছি গিয়া বাস হইতে নামিলাম। দুতলাস্থ ব্যাংকে গেলাম। কাউন্টারে টাকা দিতে গিয়া দেখিলাম পকেটে মানিব্যাগ নাই। ধরিয়া নিলাম বাসেই পকেট-মার গিয়াছে। বুঝিলাম, ওটা ফেরৎ পাওয়ার চেষ্টা পাগলামি। কিন্তু কিসের তাড়নায় পাগলামিটাই করিলাম। দুতলা হইতে ছুটিয়া রাস্তায় নামিলাম। দেখিলাম, অদূরেই বাসটি তখনও দাঁড়াইয়া আছে। দু-চারজন বাসযাত্রী উঠিতেছে। আমি সেদিকে ছুটিতেই বাসটি স্টার্ট দিল। আমি চিকার করিতে-করিতে বাসের পিছনে ধাওয়া করিলাম। ধরিলাম। বাসে
৪৫৫
উঠিলাম। দরজায় দাঁড়ানাে কন্ডাকটরকে হাঁপাইতে-হাঁপাইতে ব্যাপারটা বলিলাম। সে আমার এ পাগলামিতে একটু হাসিল। কিন্তু তার মনে দয়া হইল। সে চিল্লাইয়া বলিল : এ বাসে একজনের পকেট-মার গিয়াছে। যারা নামিবেন, তাদেরে আমরা সার্চ করিব। কন্ডাকটরের সহকারী ছিল দুইজন। তারাও এমনি ঘােষণা করিল। পথে অনেক স্টপেজে বাস থামিল । অনেক যাত্রী উঠিল। কিন্তু দু-একজন ছাড়া কেউ নামিল না। যারা নামিল, তারা নিজেরাই নিজ-নিজ পকেট-টকেট দেখাইয়া গেল। তাদেরই খালি করা সিটের একটিতে আমাকে বসাইল। শেষ পর্যন্ত বাসটি নাখােদা মসজিদের সামনে অস্থায়ী টার্মিনালে থামিল। যাত্রীরা নামিতে লাগিল। কন্ডাকটরদের নামমাত্র তল্লাশি করিতে হইল। কারণ সবাই স্বেচ্ছায় পকেট-টকেট দেখাইতেছিল। আমার বুকের ধড়ফড়ানি দ্রুত বাড়িয়া অবশেষে প্রায় শেষ। আর আশা নাই। পাথরের মত বসিয়া আছি। সবাই নামিয়া গেল। আমার মানিব্যাগ উদ্ধার হইল না। কন্ডাকটররা আমাকে সমবেদনা জানাইতে আসিয়া দেখিল আমার পাশেই একজন যাত্রী বসা। তাঁদের সন্দেহ হইল। তাকে ধাক্কাইয়া তুলিল। দেখা গেল, তার পাছার নিচেই আমার মানিব্যাগ। ব্যাগটা আমাকে দিল। কাঁপা হাতে খুলিয়া দেখিলাম সব ঠিক আছে। আমি শােকরানার মােনাজাত করিলাম। কন্ডাকটররা লােকটাকে বেদম মারপিট করিতে লাগিল। আমি তাকে ছাড়িয়া দিতে কাকুতি-মিনতি করিলাম। ততক্ষণে বাস ঘেরিয়া বিপুল জনতা। অনেকে আমার সমর্থন করিল। লােকটাকে ছাড়িয়া দেওয়া হইল। কন্ডাকটররা ও জনতার অনেকে সব শুনিয়া আমাকে কংগ্রেচুলেট করিলেন। আনন্দ পুলকে আমার চোখে পানি দেখা দিল। আমি শুধু মেহেরবান আল্লাহকে দেখিলাম না। কন্ডাকটররাও আমার নজরে ফেরেশতা মনে হইল। আমাকে হেফাযত করিতে আল্লাই ওঁদেরে পাঠাইয়াছেন। আমি তাঁদেরে বখশিশ ত নয় নজরানা দিতে চাহিলাম। নিদান পক্ষে চা-নাশতা খাওয়াইতে চাহিলাম : তারা কিছু গ্রহণ করিল না। বরঞ্চ একজন বিশ্বস্ত ট্যাক্সিওয়ালা ডাকিয়া আমাকে বাসায় পৌছাইবার ব্যবস্থা করিল। বাসায় পৌছাইবার পর ট্যাক্সিওয়ালাও মিটারে উঠা ভাড়া ছাড়া একপয়সা অতিরিক্ত নিল না আমার সাধাসাধি সত্ত্বেও। ট্যাক্সিটা ফিরিয়া গেল। আমি রাস্তার মােড় না ফেরা পর্যন্ত সেদিকে চাহিয়া রহিলাম। মনে হইল আল্লাহর পাঠানাে ফেরেশতাদের মধ্যে ঐ ট্যাক্সি ড্রাইভারটিও একজন।
৪৫৬
১১. ‘অজাতশত্রু’
জ্ঞান কাণ্ডজ্ঞানের কথা বলিতে গিয়া আমার আরেকটা কথা মনে পড়িয়া গেল। কথাটা মামুলি। তরুণদেরও জানা কথা। জ্ঞানীর পক্ষে অহংকারী। হওয়া অস্বাভাবিক নয়। আত্মসম্মান, গর্ব, অহংকার, সেলফ-রেসপেক্ট, প্রাইড। ও ভ্যানিটির পার্থক্য এত সূক্ষ্ম যে বিভ্রান্তি ঘটার সম্ভাবনাই বেশি। খারাপ অর্থে দম্ভ, অহংকার ও তুকাব্বরির দুইটা রূপ : এক, নিজেকে বড় মনে করা। দুই, অপরকে ছােট মনে করা। দুইটাই খারাপ। জ্ঞানীর জন্য ও বিষয়ীর জন্য প্রথমটার মধ্যে অপর’ অনুপস্থিত অপরকে ছােট মনে না করিয়াও, তার মানে, আর কারাে কথা মােটেই চিন্তা না করিয়াও নিজেকে ‘বড়’ মনে করা সম্ভব। স্কুল দৃষ্টিতে মনে হইবে, এটা মন্দের ভাল। কারণ এ মনােভাবেরও দুইটা মুখ আছে। একটা সুন্দর, অপরটা অসুন্দর । অহংকারের এই রূপে মানুষ নিজেকে অজাত শত্রু মনে করে। আমি এত বড়, এত ভাল, এত গুণবান যে আমাকে সবাই শ্রদ্ধেয় মনে করে। আমি সমাজের একটা সম্পদ। কাজেই আমার কোনও শত্রু নাই। আমি অজাতশত্রু। এটাও যে নিরর্থক দম্ভ তা আমি বুঝিয়াছিলাম অধিক বয়সে। বিনয়ী, শিষ্টাচারী ও আদব-কায়দা-দুরস্ত হওয়ার শিক্ষা পাইয়াছিলাম শৈশব। হইতেই। মুরুব্বি, গুরুজন, শিক্ষক-অধ্যাপকরা সবাই এসব গুণের জন্য আমার তারিফ করিতেন। ভাল’ বলিতে-বলিতে মানুষ সত্য-সত্যই ভাল হইয়া যায়, এটা অংশত সত্য হইলেও পূর্ণ সত্যটা এই যে যাকে ভাল’ বলা। যায় সে নিজেকে ভাল মনে করিয়া বসে বিশ্বাস করে। আমিও বিশ্বাস করিলাম। সঙ্গে-সঙ্গে আমি ঐ তারিফের পুরামাত্রায় যােগ্য হইবার চেষ্টাও করিতে লাগিলাম। সর্বদা হুঁশিয়ার থাকিলাম, লােকমুখের ঐ তারিফের কোনও ব্যাঘাত না ঘটে। লােকে নিন্দা করিতে পারে, ভদ্রতার খেলাফ হইতে পারে, এমন কোনও কাজই করিতাম না।
আচার-ব্যবহারের এই বাহ্যিক রূপ নিশ্চয়ই অন্তরেও সংক্রমিত হইয়াছিল। বাহিরে কারাে অনিষ্ট ত করিতামই না, অন্তরেও অনিষ্টের চিন্তা করিতাম না। বাহিরে যাকে যত শ্রদ্ধা-ভক্তি দেখাইতাম, অন্তরেও তাঁকে। ততখানি ভাবিবার চেষ্টা করিতাম। এইভাবে আমার মনে এই ধারণা ও বিশ্বাস জন্মিল যে আমি যখন কারাে ক্ষতি বা অনিষ্ট করি নাই, তখন অপরেও আমার ক্ষতি বা অনিষ্ট করিবে না। আমি যখন কারাে অনিষ্ট চিন্তা করি না, তখন অপরেও আমার অনিষ্ট চিন্তা করে না। এ সবেরই যােগফলে আমার
৪৫৭
বিশ্বাস হইল আমি ‘অজাতশত্রু’। এ বিশ্বাস আমার এতই দৃঢ় ছিল যে আমি পাড়াগাঁয়ে অন্ধকার রাতেও একা-একা পথ চলিতে ভয় পাইতাম না। লােকেরা বা বন্ধু-বান্ধব ভয় দেখাইলে বলিতাম : ‘আমার কোনও শত্রু নাই। ভয় কিসের?
এই মনােভাবটায় যে আসলে সাহসের চেয়ে অহংকারই ছিল বেশি, সেটা আমাকে বুঝাইয়াছিলেন সুভাষবাবু। তিনিই সর্বপ্রথম আমার এই অহংকারে প্রচণ্ড আঘাত হানিয়াছিলেন। সেটা ছিল ১৯৩৮ সালের শেষ দিক। তিনি তখন কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট। দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট হওয়ার ইচ্ছা। এলগিন রােডের বাসায় পারিষদবর্গের সঙ্গে আলােচনা। পারিষদদের মধ্যে আমিও একজন। তর্কে তর্কে কথার পিঠের কথায় আমি বড়াই করিয়াছিলাম : ‘আমার কোনও শত্রু নাই। তাঁর সুন্দর মুখখানিতে মৃদু হাসি ফুটাইয়া সুভাষবাবু বলিয়াছিলেন : আপনার ধারণা ভুল। বােবারই শত্রু নাই। আপনি বােবা নন।
সুভাষবাবুর কথায় তখন বেজার হইয়াছিলাম, পরে বুঝিয়াছিলাম, তাঁর কথাই সত্য। কিন্তু বুঝিতে বেশ সময় লাগিয়াছিল। তখন আরাে বুঝিয়াছিলাম যে কথাটা সুপ্রাচীন বলিয়াই আমরা উহার সংকীর্ণ অর্থই করিয়া থাকি। আসলে ও-বােবার অর্থ শুধু ‘বােবা’ নয়। কালাও’। অজাতশত্রু হইতে গেলে শুধু বােবা হইলেই চলে না, কালাও হইতে হয়।

১২. সততা ও তুকাব্বরি
সৎ-সাধু হওয়ার দরুন গর্ববােধ করা, টন-টনা আত্মসম্মানবােধ থাকা দোষের। নয়। সততা-সাধুতার ওটা পুরস্কার। কিন্তু সে সততা-সাধুতার গর্ব যদি দম্ভঅহংকারে প্রসারিত হয়, সে অহংকার যদি অপরকে ঘৃণা-অবজ্ঞা করিতে শিখায়, তবে সেটা হয় তখন আযাযিলের তুকাব্বরি। এই তুকাব্বরি মহৎ মানুষকে নীচ করে, বড় মনকে ক্ষুদ্র করে। ফলে সৎ-সাধু লােকেরা নিতান্ত স্পর্শকতার হইয়া পড়েন। সমালােচনাকে তারা নিন্দা মনে করেন । হিতােপদেশ-দাতাদের তারা অশিষ্ট ধরিয়া লন। এটা নিজের দিক। অপরদিকে পরের উপর তাঁরা অবিবেচক, অসহিষ্ণু, নিষ্ঠুর ও হৃদয়হীন হইয়া পড়েন। মহাপুরুষদের এই মহাকাব্য, ‘পাপকেই ঘৃণা করিও, পাপীকে ঘৃণা করিও না, বেমালুম ভুলিয়া যান তাঁরা। নিজের সততা-সাধুতার অন্ধঅহংকারে তারা গুনাহে-সগিরা ও গুনাহে-কবিরার পার্থক্য ভুলিয়া যান। লঘুগুরুর জ্ঞান হারাইয়া ফেলেন।
৪৫৮
আমার জীবনেই এটা ঘটিয়াছিল। প্রয়ােজনবােধের সীমাজ্ঞান হইতেই হক-নাহকের নীতিবােধের জন্ম। ছেলেবেলা হইতেই আমি জমিদারমহাজনদের প্রয়ােজনাতিরিক্ত অর্থ-লালসার মতই ঘুষ রেশওয়াতেরও প্রচণ্ড নিন্দুক হইয়া উঠিয়াছিলাম। জমিদারদের মাথট-আবওয়াব, মহাজনদের চক্রবৃদ্ধি সুদের মতই মােল্লা-মৌলবীদের দান-খয়রাত, পীর-ফকিরদের নজরানাকেও অন্যায় যুলুম ও নাজায়েয উশুল বলিতাম। পরবর্তীকালে উকিল হইয়া কোর্টে-আদালতে আসিয়া কেরানি-পেশকার ও পিয়নচাপরাশিদের উপরি বখশিশকেও ঘুষ আখ্যা দিতাম। ধুচিয়া গাল পাড়িতাম। শুধু মুখে গাল দিতাম না। অন্তরেও ঘৃণা করিতাম। মাত্র বিশ টাকা মাহিয়ানায় পিয়ন-চাপরাশির, আর মাত্র চল্লিশ টাকা বেতনে কেরানিপেশকারের চলে না। কিছু উপরি পাওনা ওদের দরকার। এসব যুক্তি আমি মানিতাম না। অবস্থা ভেদের মাত্রাজ্ঞান আমার ছিল না। পান হইতে চুন খসিলেই আমি ক্ষেপিতাম। মামলা-মােকদ্দমার টাউটদের আমি দু’চক্ষে দেখিতে পারিতাম না। তাদেরে আমি আমার বৈঠকখানায় ঢুকিতে দিতাম না। লােক্যাল বাের্ড, ডিসট্রিক্ট বাের্ডের চেয়ারম্যান-মেম্বরদের তৎকালে বদনাম ছিল। লােক-মুখে তাদের দুর্নীতির কাহিনী শুনিয়াই তাঁদের নিন্দা শুরু করিলাম। শহরে টাউন হল প্রাঙ্গণে এবং মফস্বলে মাঠে-ময়দানে সভা করিয়া তাঁদের নিন্দায় প্রস্তাব গ্রহণ করিতে লাগিলাম। আমার এই অভিযানে কারাে কোনও ক্ষতি বা আর্থিক লােকসান হইয়াছিল বলিয়া শুনি নাই।
কিন্তু অন্তত একজনের বস্তুত একটা পরিবারের সত্য-সত্যই এতে বিপুল ক্ষতি হইয়াছিল। আমার জীবনে এটা একটা অনুশােচনার স্মৃতি। সেটা ১৯৩২-৩৩ সালের ঘটনা। লাহাের হাইকোর্টের জনৈক বিচারপতি মি. রবার্ট ইয়ং এই সময়ে কোর্টে দুর্নীতি দমনের উদ্দেশ্যে একটি এন্টি-কোরাপশান’ সংঘ গঠন করেন এবং সারা ভারতের হাইকোর্টে ও তাদের অধীনস্থ আদালতসমূহে তার শাখা স্থাপনের প্রস্তাব দেন। তদনুসারে ময়মনসিংহেও একটি শাখা স্থাপিত হয়। মি. হেন্ডারসন (পরে কলিকাতা হাইকোর্টের জজ) এই সময়ে ময়মনসিংহের জিলা জজ। তাঁরই উদ্যোগে হাকিম-উকিলদের যুক্ত সভায় একটি কমিটি গঠিত হয়। অন্যতম মুনসেফ মি. মােহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম (পরে জুডিশিয়াল সেক্রেটারি ও খান বাহাদুর) এই কমিটির সভাপতি ও আমি সেক্রেটারি নির্বাচিত হই। ঐ কমিটির রিপাের্টে একজন কেরানি প্রথমে সাসপেন্ড ও পরে ডিসমিস হন। সাসপেন্ড থাকাকালে তিনি ছেলেমেয়েসহ সপরিবারে আমার বাসায় আসেন। তিনি নিজে আমাকে এবং
৪৫৯
তার স্ত্রী আমার স্ত্রীকে অনেক অনুরােধ-উপরােধ ও কাকুতি-মিনতি করেন। নিজেদের ও ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যতের দোহাই দেন মর্মস্পর্শী ভাষায়। তিনি এও জানাইলেন যে, তাঁর উপরওয়ালারা তাকে আশ্বাস দিয়াছেন যে আমার একটা ভাল রিপাের্ট পাইলেই জজ সাহেব তার চাকরি বহাল রাখিবেন। এর পরেও আমার মন গলিল না।
পরবর্তীকালে এই নীতিবাগিশতাই আমার অনুশােচনার কারণ হইয়াছে। কিন্তু চরম শাস্তি আমার তখনও পাওয়া হয় নাই। ১৯৪৭ সালে আমার এই অহংকারের গালে প্রচণ্ড চপেটাঘাত করেন শেরেবাংলা হক সাহেব। তাঁর সাথে তর্কে-তর্কে কথার পিঠে কথার বড়াই করিয়াছিলাম : কই, আমার নিন্দা ত কেউ করে না। হক সাহেব হাে হাে করিয়া হাসিয়া বলিয়াছিলেন : ‘শেওড়া গাছে কেউ ঢিল মারে না। আম গাছেই মারে।
এরও দশ বছর পরে আমার দর্প চূর্ণ হইয়াছিল। নিজেই দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হইয়াছিলাম। সত্য-সত্যই গায় ঢিল পড়িয়াছিল। তখন দশ বছর আগে কওয়া হক সাহেবের কথা হইতে আম গাছের তসল্লি পাইবার চেষ্টা করিয়াছিলাম কিন্তু যতবার সে চেষ্টা করিয়াছি ততবার সে তসল্লি ঠেলিয়া পঁচিশ বছর আগের ময়মনসিংহ কোর্টের সেই কেরানি ও তাঁর অসহায় ছেলেদের মুখ আমার দিকে চাহিয়া শেখ সাদীর বয়েত আওড়াইয়াছে : ‘তাকাব্বর আজাজিলেরা খাবে কর্দ।
খােদাকে ধন্যবাদ। আমার তুকাব্বরি আমাকে খােয়ার করে নাই। হুঁশিয়ার করিয়াছে মাত্র।
৪৬০

শেষ কথা

আমার এ আত্মজীবনীর ‘শেষ কথা আমার জীবনের মুদ্দা কথা। সে কথাটা এই যে, আমি জীবনে সুখী হইয়াছি। আর দশজনের মত জীবনে আমি সুখ চাহিয়াছিলাম। সুখ আমি পাইয়াছি। এ সুখ মনের শান্তি। আত্মার তৃপ্তি । অন্তরের সন্তোষ। চাওয়া-পাওয়া লইয়াই মানবজীবন। আমি যা চাহিয়াছি, তাই পাইয়াছি। জীবনের কাছে আমার আর কোনও পাওনা নাই। কোনও দেনাও নাই। দুনিয়ার বিরুদ্ধে আমার কোনও অভিযােগ নাই। সমাজের বিরুদ্ধে আমার কোনও অসন্তোষ নাই। মানুষের বিরুদ্ধে আমার কোনও অভিমান নাই। আশি বছর বয়সে আমার মন তৃপ্ত। আমার দেহ শান্ত। আমার অযােগ্যতা, অসম্পূর্ণতা, আমার অনধিকার ও অসংখ্য ভুল-ত্রুটি সত্ত্বেও এই সুখ, তৃপ্তি ও মর্যাদা আমাকে দেওয়া হইয়াছে বলিয়া আমার বন্ধু-বান্ধব, আমার আত্মীয়-স্বজন, আমার প্রতিবেশী, আমার সহকর্মী, আমার নেতা-মুরুব্বি, আমার সমাজ, আমার দেশ, সর্বোপরি আমার আল্লার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। এ কথা বলিবার জন্যই আমার এই আত্মজীবনী লেখা।
কিন্তু এটা আমার ব্যক্তিগত জীবন। এই ব্যক্তিগত জীবনেই আমি সুখ, শান্তি, তৃপ্তি, সন্তোষ ইত্যাদি মানবিক সম্পদের অধিকারী হইয়াছি। এমনকি ব্যক্তিগত জীবনের যেটুকু বাহিরে প্রসারিত সেখানেও আমি সাফল্য, সুখ, শান্তি ও তৃপ্তি ভােগ করিয়াছি। যশ ও পদ-মর্যাদাও লাভ করিয়াছি। শিক্ষা ও জ্ঞান লাভ করিতে চাহিয়াছি, উচ্চশিক্ষা পাইয়াছি। জ্ঞানলাভের জন্য অসংখ্য বই-পুস্তক পড়িবার সুযােগ পাইয়াছি। রােযগারের তালাশে উকালতিতে গিয়াছিলাম, সফল উকিল হইয়াছি।
৪৬১
সাংবাদিক হইতে গিয়াছিলাম, তিন-তিনটা দৈনিকের সম্পাদক হইয়াছি। সাহিত্যিক হইতে চাহিয়াছিলাম, বই-পুস্তক লিখিয়া অর্থ, যশ, প্রশংসা, এওয়ার্ড ও স্বর্ণপদক পাইয়াছি। রাজনীতি করিতে চাহিয়াছিলাম, মেম্বরমন্ত্রী হইতে, এমনকি প্রধানমন্ত্রিত্ব করিতে পারিয়াছি। কাজেই বলা যায়, ভিতর ও বাহির সর্বত্র আমি ব্যক্তিগত জীবনে সাফল্য, সুখ ও সন্তোষ লাভ করিতে পারিয়াছি। নিজের বুদ্ধিতে যেখানে কুলায় নাই, তকদির সেখানে সহায়তা করিয়াছে।

২.
কিন্তু প্রশ্ন থাকিয়া যায়, দেশ ও সমাজের তাতে কী লাভ হইয়াছে? জনগণের জন্য কোন ভাল কাজটা সমাধা করিতে পারিয়াছি? স্পষ্টতই পারি নাই। কাজেই বলা চলে আমার ব্যক্তিগত জীবনে আমার স্বপ্ন-সাধ পূর্ণ হইলেও দেশ-সমাজের ক্ষেত্রে আমার স্বপ্ন-সাধ সফল হয় নাই। দেশ, সমাজ ও জনগণ সম্বন্ধে আমার উচ্চ আদর্শ ও রঙ্গিন স্বপ্ন ছিল। তার একটাও সম্যক সফল হয় নাই। জনগণের দারিদ্র্য, অশিক্ষা, তাদের উপর শােষণ-নির্যাতন, যুলুম-নিপীড়ন, অত্যাচার-অবিচারের প্রতিকারের স্বপ্ন দেখিয়াছি। যুদ্ধবিগ্রহ, সাম্রাজ্যবাদী শােষণ-শাসনের অবসান চাহিয়াছি। দেশের সকল প্রকার আন্দোলনের শরিক হইয়াছি। সাধ্যমত ত্যাগ স্বীকার করিয়াছি। জেল-যুলুম-দুর্নাম সহিয়াছি। মনে হইয়াছে, সবটাতেই সফল হইয়াছি। আসলে তা হয় নাই। নিচের তলার জনগণের দারিদ্র্য-নিরক্ষরতা, শােষণনির্যাতন আগের মতই আছে। উপরের তলার কতিপয় আগের মতই বিলাসের প্রাচুর্যে গড়াগড়ি দিতেছে, আমার ছেলেবেলা এদের, মানে শােষক-শােষিতের ও নিপীড়ক-নিপীড়িতের, যারে যেখানে যে অবস্থায় দেখিয়াছি, আজও ঠিক সেখানেই দেখিতেছি। এ সবই আমার সামাজিক, অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের স্বপ্নের অসাফল্য। রাজনীতিতেও তাই। স্বাধীন ভারত, স্বাধীন পাকিস্তান, স্বাধীন বাংলাদেশ কোনওটাই আমার স্বপ্নকল্পনামত হয় নাই। দেশের মাটি স্বাধীন হইয়াছে, কিন্তু মাটির মালিকরা। স্বাধীন হয় নাই। ফলে আমার রাজনৈতিক স্বপ্নও পুরাপুরি সফল হয় নাই। এক কথায় আমার পাবলিক লাইফ, সামাজিক-রাষ্ট্রীয় জীবন, অতৃপ্তঅসুখী।
৪৬২
৩.
এ কথার তাৎপর্য এই যে আমি প্রাইভেট লাইফে, ব্যক্তিজীবনে তপ্ত, সন্তুষ্ট ও সুখী; আর পাবলিক লাইফে সমাজ-জীবনে অতৃপ্ত, অসন্তুষ্ট ও অসুখী। এটা কি করিয়া সত্য হইল, সম্ভব হইল? সত্য ও সম্ভব হইয়াছে বলিয়া এটাই আমার জীবনের বৈশিষ্ট্য। দম্ভ-অহংকার না করিয়াও আমি বলিতে পারি, এটাই আমার জীবনের শিক্ষা। আজকার তরুণরা অন্তত এইটুকুর জন্য আমার জীবন হইতে শিক্ষা গ্রহণ করিতে পারেন।

৪.
শিক্ষণীয় বিষয়টা এই: মানুষ সামাজিক জীব হইলেও তার একটা ব্যক্তিত্ব আছে। ঐ ব্যক্তিত্বে সে একা ও স্বাধীন। এই বইয়ের ভূমিকাতেও আমি ইশারায় এই কথাটাই বলিয়াছি। তার এই ব্যক্তিগত ব্যাপারে তার কর্তব্য, দায়িত্ব, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বিষাদ, আপদ-সম্পদ সম্পূর্ণ তার একার।
কিন্তু এই ব্যক্তিজীবনের বাইরে সে সমষ্টির অংশ। সেখানে সে একাও নয়, স্বাধীনও নয়। তথায় সে একার ইচ্ছায় একা কিছু করিতে পারে না। সেখানকার ভাল-মন্দ, সফলতা-নিষ্ফলতা, আপদ-সম্পদ, সুখ-দুঃখ, আনন্দবিষাদ তার একার নয়, সমষ্টির। সেখানকার দায়িত্ব-কর্তব্যও কাজেই তার। একার নয়। ব্যক্তিগত জীবনের সুখ-দুঃখের নিন্দা-প্রশংসাটা তার নিজের একার। কিন্তু সমাজ-জীবনের ভাল-মন্দের নিন্দা-প্রশংসার অধিকারী সে একা নয়। সুফল-কুফলও সে একা ভােগ করে না।
মানুষের প্রাইভেট ও পাবলিক এই যে দুইটা জীবন সে দুইটা আলাদাভাবে যাপন করিবার কায়দা যারা জানিতে পারিয়াছে, তারাই এক জীবনে। অতৃপ্ত থাকিয়াও অপর জীবনে তৃপ্ত হইতে পারিয়াছে। খােদাকে অসংখ্য ধন্যবাদ, আমি এদের মধ্যে একজন।

৫.
প্রাইভেট লাইফে আমি সবুরী। পাবলিক লাইফে আমি গণতন্ত্রী। উভয় জীবনেই উচ্চাশা ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর দশজনের মতই আমার ছিল। কিন্তু তার যতটুকু আমার পূর্ণ হইয়াছে, তাতেই আমি তৃপ্ত। আমার পাওয়ার
৪৬৩
যতটুকু আমি পাইয়াছি, তাতেই আমি সন্তুষ্ট। আমার প্রাপ্যের পরিমাণ, আমার যােগ্যতার পরিমাপ ও আমার অধিকারের সীমানা উপরের কোনও অদৃশ্য শক্তির অসীম জ্ঞান যে-যেখানে নির্ধারণ করিয়াছেন, সেটাই নিশ্চয় ঠিক। এই উপলব্ধি হইতে আমার বেশি সময় লাগে নাই এটা বােধহয় আমার সহজাত। আমার বাপ-মা ও দাদা-দাদিকে আমি এমনি সবুরী পাইয়াছিলাম। আমাদের এটা নাই, ওটা হইল না, এ ধরনের কথা তাঁদের মুখে শুনি নাই। যৌবনে স্ত্রীর মুখে এবং বার্ধক্যে ছেলেদের মুখেও ঐ ধরনের কথা শুনি নাই। আমার ব্যক্তিগত তৃপ্তি ও সন্তুষ্টিই যেন আমার সংসারের আবহাওয়া।
কিন্তু পাবলিক লাইফে ব্যক্তিগত সবুরে চলে নাই। গণতান্ত্রিক উপলব্ধির দরকার হইয়াছে। সে জীবনেও আমার ব্যক্তিগত মর্যাদা প্রাপ্যাধিকই পাইয়াছি। কিন্তু পাবলিকের জন্য কী পাইয়াছি? দেশ, জাতি ও কৃষকশ্রমিকদের মুক্তির জন্য যে সব কথা বলিয়াছি ও লিখিয়াছি, ওয়াদা করিয়া মেম্বর-মন্ত্রী হইয়াছি, সেগুলি ত আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার নয়। ও-সবে ত আপােস করিবার, অল্পে তুষ্ট হইবার কোনও অধিকার আমার ছিল না। তবু তৃপ্ত হইলাম এই উপলব্ধিতে যে ও-সব প্রচারেই আমার অধিকার প্রয়ােগে নয়। এটাই গণতন্ত্র । আমার নির্দেশিত পথটা যতই ঠিক হউক, জোর করিয়া তা প্রয়ােগ করা যাইবে না। করিলে সেটা হইবে ডিক্টেটরশিপ। ডিক্টেটররা পরিণামে জনগণের কল্যাণ করেন না। ক্ষমতার লােভেই তারা ক্ষমতা খাটান। জনতার জিন্দাবাদ-ধ্বনির লােভ বড় লােভ।
ব্যক্তিজীবনে ধন-লােভের তৃপ্তি নাই। রাষ্ট্র-জীবনে ক্ষমতা-লােভেরও তৃপ্তি নাই। ডিক্টেটররা ক্ষমতা ছাড়িতে এবং রাষ্ট্র-নেতারা রিটায়ার করিতে পারেন না, এই কারণে। সব জীবনের এটাই চরম শিক্ষা।

Previous