You dont have javascript enabled! Please enable it! Draft - সংগ্রামের নোটবুক

This is a temporary post for collecting data. Not for posting and not for publishing. Saved only as readable for the editors. Not clickable and not downloadable.

৬৯ –এর শহিদ সার্জেন্ট জহুরুল হক ও মুক্তিযুদ্ধ
নাজনীন হক মিমি

প্রাককথন
নদী বিধৌত বাংলার উর্বর মাটি, সবুজ সুফলা শস্য ক্ষেত, সােনালি আঁশ, মৌসুমী বায়ুর প্রবাহ আর বর্ষায় বৃষ্টিস্নাত গ্রাম, বাউল সংগীতের মূর্ঘনায় এই মাটির মানুষ, বেলে মাটির মতাে ছিল নরম, আপন ভুবনে স্বনির্ভর এক জাতিসত্ত্বা। কার্ল মার্ক্সের সমাজতান্ত্রিক বিশ্লেষণে প্রাচ্য ভূমি ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ, গ্রামগুলি নিজস্ব চাহিদা পূরণে স্বাবলম্বী। মানুষ তার মুক্তির আনন্দ খুঁজে পেতাে হাজার বছরের সংস্কৃতি চর্চায়-ধর্মের প্রভাব থাকলেও, তা নিয়ে ছিল না কোনাে দ্বন্দ্ব । এই উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসন আমলে বৈদেশিক রাজনৈতিক প্রভাব এবং কূটনৈতিক চক্রান্তের ফলে সুদূরপ্রসারী প্রভাব সৃষ্টি করেছিল মানুষের মনস্তত্ত্বে এবং সামাজিক অর্থনৈতিক কাঠামােতে- তারই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে বিভক্ত হয়ে ভারত এবং পাকিস্তান দুইটি রাষ্ট্রে পরিণত হয় আর পাকিস্তানের দুইটি অঞ্চল পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তান। ভৌগােলিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক কাঠামাের মাঝে ছিল বিস্তর ব্যবধান। দুইটি অঞ্চলের মধ্যে ভৌগলিক দূরত্ব এবং ভাষা ও সংস্কৃতির ব্যাপক পার্থক্যের ফলশ্রুতিতে প্রথম থেকেই সৃষ্টি হলাে সামাজিক ও রাজনৈতিক মতদ্বন্দ্বের । পাকিস্তানিদের শােষণমূলক আচরণ ক্রমাগত বাঙালিদের নিরীহ সত্ত্বার উপর আঘাত হানা শুরু করেছিলাে। পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী ক্রমাগত বাংলার ভূমিতে উৎপাদিত সােনালি ফসলের মুনাফা পশ্চিম পাকিস্তানে স্থানান্তরিত করার প্রক্রিয়ায় মত্ত হয়ে উঠেছিল, উপর্যুপরি পাকিস্তানি শাসকচক্র অন্যায়ভাবে বাংলার মানুষের মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চায়। তখনই বাংলার মানুষ রুখে দাঁড়ায়, শুরু হয় “রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন”। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ক্রমান্বয়ে শুরু হয় বাংলার জনগণের ন্যায্য দাবি আদায়ের আন্দোলন। ১৯৪৭-১৯৭১ কাল পর্বে প্রতিবাদের এক দীর্ঘ ইতিহাস সৃষ্টি হয়-যা বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের রক্তাক্ত ইতিহাস। উনসত্তর বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে এক গৌরবােজ্জ্বল অধ্যায় । ১৯৬৯ বাঙালির জাতির অনন্য এক রেনেসাঁ মুহূর্ত। বাঙালির দীর্ঘ সংগ্রাম ও প্রতিবাদের উত্তাল আন্দোলন সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়ায় সৃষ্টি হয় ‘গণ-অভ্যুত্থান’ । ক্রমাগতভাবে বঞ্চনার ফলে আপামর মানুষের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ আগে থেকেই ফুসে উঠছিল, ১৯৬৮ সালে পাকিস্তানিদের দায়েরকৃত মামলা ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্যরা’র ফলে সমগ্র জাতি বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। পরবর্তী সময়ে এই মামলার শুনানি শুরু হওয়ার পর, আইনজীবীদের কৌশলগত কারণে এবং প্রচার মাধ্যমের সাংবাদিকদের লেখনী ও ধারা ভাষ্যের প্রতিক্রিয়ায় মামলাটির নাম একটি প্রচলিত নামে রূপান্তরিত হয়- ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’। মামলাটির গূঢ় সত্য অনুসন্ধানের লক্ষ্যে একটি সুদৃঢ় পরিকল্পনা থেকে ইতিপূর্বে ২০১৫ সালে আমি আরেকটি বই সম্পাদনার কাজ করেছি, বইটির নাম- ‘আগরতলা মামলার অনুচ্চারিত ইতিহাস ও শহিদ সার্জেন্ট জহুরুল হক’ । ২০১১ সালের শেষের দিকে কাজটি শুরু করি।

আগরতলা মামলাটি একটি সত্য মামলা । শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলার মানুষ যখন আন্দোলনে সােচ্চার সেই সময়ে একই ঐক্যসূত্রে পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে বাঙালি সেনা, নৌ এবং বিমানবাহিনীর অফিসার-সৈন্যরা দেশ স্বাধীন করার প্রত্যয়ে এক গভীর পরিকল্পনায় নিয়ােজিত হয়। উল্লেখিত বইটিতে সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে আগরতলা মামলার অভিযুক্ত এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের অভিজ্ঞতালব্ধ বহু তথ্য বর্ণিত হয়েছে ।
সেই বইটি করার সময় মূল লক্ষ্য ছিল, সার্জেন্ট জহুরুল হকের বীরত্বগাথা বিস্তারিতভাবে লিপিবদ্ধ করার কিন্তু সেসময় বাকি অভিযুক্তরা বয়সের ভারে ধীরে ধীরে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছিলেন, তাই নিজ পরিবারের স্মৃতি নিয়ে পরবর্তী সময়ে আরাে একটি নতুন বই করার সংকল্প নিয়েছিলাম । জহুরুল হকের মৃত্যুর দীর্ঘ ৫০ বছর পার হয়ে গেছে, দেশ হাঁটি হাঁটি পা পা করে ৫০ বছরে পদার্পণের দিকে যাচ্ছে। এই মাহেন্দ্রক্ষণে মনে হয়েছে ১৯৬৯-এর কালজয়ী ইতিহাসের কিছু অংশ এবং ১৫ই ফেব্রুয়ারি সার্জেন্ট জহুরুল হকের হত্যাকাণ্ডের সময়ে পরিবারের কথাগুলাে পাঠকের জন্য নিবেদন করা প্রয়ােজন।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীনতার স্থপতি ও রাজনীতির কবির সেই অমর মহাকাব্য‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম স্বাধীনতা ঘােষণার পর, একটি পরিবার কিভাবে মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল।
পরবর্তী সময়ে সেই মহান মানুষটিকে হারিয়ে কিভাবে স্বাধীন দেশে স্বাধীনতাহীন আর ঘনঘাের অন্ধকার সময়ে আমাদের পরিবার দিন যাপন করেছিল, সেসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনা নিয়ে বর্তমান বইটির নির্মাণ, হয়তাে হাজার পরিবারের কথার সাথে একই রকম কষ্টের গল্প হয়ে ফুটে উঠবে । বইটি বিনির্মাণের ক্ষেত্রে অনেকের উৎসাহ আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে, লে. কর্নেল (অব.) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির বীর প্রতীক, প্রফেসর মাইনুল হক, আশফাক আমিন, সাদিকুর রহমান পরাগ, পিয়াস মজিদ তাদের সকলের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। শহিদ অধ্যাপক মােফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর ১৯৬৯-এর অপ্রকাশিত ডায়েরির লেখা থেকে উদ্ধৃতি প্রকাশের অনুমতি দিয়েছেন তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র তানভীর হায়দার চৌধুরী (শােভন) তার প্রতি এবং জানিম্যান বুক্স-এর প্রকাশনা বিভাগের আকরামুজ্জামান খান ও আক্তার হােসেনসহ সকলের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই। জানিম্যান বুক্‌স-এর সিইও তারিক সুজাত গুরুত্বের সঙ্গে বইটি সম্পাদনা ও প্রকাশনার উদ্যোগ নেওয়ায় জহুরুল হকের পরিবারের সকলে আনন্দিত।
আমার জননী, মা মাসুদা হক’ দেশ বিভাগের পর ১৯৫২ সালে পশ্চিমবঙ্গের মাটি ছেড়ে, নিজ ঘর ছেড়ে এই দেশে আসেন। এক সময় তিনিও সম্পূর্ণ অনিশ্চয়তার ভিতরে মুক্তিযুদ্ধের একটি পরিবারের যুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন । আর তিনিই সমস্ত স্মৃতি আমাদের মাঝে জাগিয়ে রেখেছিলেন। অনেক ছােট ছােট বেদনাবিধুর ঘটনা। একটি দেশের জন্মলগ্নের সময় থেকে ৫০ বছর পর্যন্ত বেড়েওঠার সময়ের উল্লেখযােগ্য ঘটনাসমূহ নতুন প্রজন্মের মাঝে পৌছে দেওয়া একটি বৃহৎ কাজ। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম- প্রকৃত দেশপ্রেম ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার নিয়ে বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে সর্বাধিক ভূমিকা রাখেন ‘মা’ । ধরণী যেমন মাতৃভূমি, তেমনি আমার ‘মা’ এই পঞ্চাশ বছরের ইতিহাসের যাবতীয় প্রাপ্তি, আনন্দ-বেদনার স্মৃতি আমাকে দিয়ে, আমাদের সকলকে ছেড়ে চলে গেছেন না ফেরার দেশে- এই বইটি প্রকাশের মাত্র কয়েকদিন আগে। জহুরের যে স্মৃতিচিহ্নগুলাে তিনি আঁকড়ে রেখেছিলেন আমৃত্যু- তার ভার যেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে পৌছে দিতে পারি।
নাজনীন হক মিমি

নিবেদন
সেই এক আশ্চর্য সময় ছিল বটে! ১৮-তে মাত্র পা দিয়েছি । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সেই সময় এল উনসত্তর, সেটি শেষ হতে না হতে একাত্তর । আসলে ১৯৬৯-৭১ একটি একক হিসেবেই বিবেচনা করা ভালাে। ইতিহাসের প্রশ্নে মাঝে মাঝে আসেঅমুক বিষয়ের তাৎক্ষণিক কারণ উল্লেখ করাে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের তাৎক্ষণিক কারণ লিখতে গেলে সেই সময়টাই হবে তাৎক্ষণিক কারণ। তা যা বলছিলাম, এক আশ্চর্য সময়! বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস বন্ধ হয় নি বটে, বা হলেও কবে থেকে মনে নেই। শুধু মনে আছে প্রায় সারাটা সময় রাস্তায়ই কাটিয়েছি। আমি থাকতাম এলিফ্যান্ট রােডের পাশে সায়েন্স ল্যাবরেটরির গলিতে, আমার চাচা বােরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের বাসায়। মাঝে মাঝে তার সঙ্গে দেখা হলে বলতেন, মামুন, সাবধানে, সবখানে তােমার যেতে হবে না। অভিভাবক হিসেবে তাঁর ভয়। কিছু হলে! আমি সুকান্তর কবিতা আবৃত্তি করে বলতাম,
‘আঠারাে বছর বয়স কী দুঃসহ
স্পর্ধায় নেয় মাথা তােলবার ঝুঁকি,
আঠারাে বছর বয়সেই অহরহ
বিরাট দুঃসাহসেরা দেয় যে উকি।
শুনে তিনি স্মিত হাসতেন। হয়তাে, মনে পড়তাে তাঁর ১৯৫২-এর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের কথা যার সঙ্গে তিনি ছিলেন যুক্ত । ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনের সঙ্গেও তাঁর যােগাযােগ ছিল, যদিও তিনি ছিলেন তখন সরকারি চাকুরে। আরেকদিনের কথা মনে আছে । নীলক্ষেতে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক মিছিলে যাচ্ছি। আমার বড় খালা যাচ্ছেন রিকশা করে। আমাকে দেখে ভয়ার্ত স্বরে ডাকা শুরু করলেন। সব অভিভাবকের ভয়। যদি কিছু হয়! কিন্তু, কোনাে অভিভাবককে সে সময়ের তরুণরা মেনেছে কিনা সন্দেহ। মানলে, ক্লাস এইটের ছাত্র মতিউর চিরকুটে মাকে বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে মিছিলে যেয়ে শহিদ হতাে না। উনসত্তরের স্মৃতিগুলি মনে হানা দিল নাজনীন হক মিমির ‘৬৯-এর শহিদ সার্জেন্ট জহুরুল হক ও মুক্তিযুদ্ধ বইটি পড়ে । মিমিও সময়টাকে একটি একক হিসেবে বিবেচনা করেছেন। সচরাচর কবির স্ত্রী লেখক হয় না। বর্তমানে যে ক’জন পাঠযােগ্য কবিতা লিখছেন তার মধ্যে তারিক সুজাত একজন। তার স্ত্রী নাজনীন। পেশায় অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জাবিদ যেটাকে ইংরেজিতে বলে ইনটেরিয়র ডিজাইনার । নাজনীন ছবি আঁকলে অবাক হতাম না। কিন্তু তিনি লিখছেন। এবং বর্তমান বইটিই তাঁর প্রথম বই নয় । এর আগে অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জার ওপর বা তার কাজের ওপর ঢাউস একটি ইংরেজি

বই বেরিয়েছে। আগরতলা মামলা নিয়েও বড়সড় একটি বই সম্পাদনা করেছেন। ইংরেজি কাগজে ভ্রমণ বৃত্তান্ত ও নানা সব নিবন্ধ লেখেন। এবং সে সব টুকটাক লেখালেখি ছেড়ে লিখেছেন- ১৯৬৯, শহিদ সার্জেন্ট জহুরুল হক ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে । তারিক-মিমি আমার স্নেহভাজন দেখে বলছি না, মিমি স্বাদু গদ্যে চমৎকার একটি গ্রন্থ। উপহার দিয়েছেন।
প্রথমে এর ফর্ম নিয়ে বলি । এটি কি আত্মস্মৃতি? এটি কি সার্জেন্ট জহুরুল হকের কাহিনি নিয়ে শ্রদ্ধার্ঘ্য? নাকি এটি সামাজিক ইতিহাসের দলিল ? এক কথায় উত্তর- সবকিছু।
১৯৬৯-৭১-এ মিমি শিশু, কিশােরীও নয়। তাঁর বাবা স্টেট ব্যাংকের কর্মকর্তা, থাকেন বনানীতে। তার পরের ভাই এ্যাডভােকেট আমিনুল হক, যিনি একসময় ছিলেন আমাদের অ্যাটর্নি জেনারেল । তাঁর ছােট ভাই জহুরুল হক যিনি পাকিস্তানি এয়ার ফোর্সে চাকরি করেন। সবাই আলাদা আলাদা থাকলেও যেন একটি যৌথ সংসার। মিমি তার চাচা আমিনুল ও জহুরুলের প্রিয় ভ্রাতুস্পুত্রী।
দুই চাচার প্রতি তার অগাধ ভালােবাসা ও শ্রদ্ধা। শিশুর স্মৃতিতে যা ছিল তা বিস্তৃত করেছেন। এলিফ্যান্ট রােডে তখনকার কাম্পালা হােটেলের গলিতে একটি দোতলা বাড়ির দেয়ালে লেখা “চিত্রা’ শব্দটি চোখে পড়ত । তখন জানতাম না এটি আমিনুল হকের বাড়ি । আমিনুল হক তখনও খুব পরিচিত নন। মিমি সে বাড়িতে আসেন। তার চাচা-চাচি, দাদী-তাদের স্মৃতি তিনি বর্ণনা করছেন। ‘৬৯ কেমন?-বড়রা যা বলছেন। তা তাঁর স্মৃতিতে কিছু আছে। কিছু নেই।
মিমি বড় হচ্ছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন পড়েন তখন তিনি জানেন ‘৬৯-এর এক নায়ক তার চাচা সার্জেন্ট জহুরুল হক। তখন তিনি আরাে জানতে চান আগরতলা মামলা ও তার চাচার ভূমিকা নিয়ে। তিনি তরুণী, বিয়ে করেন, সন্তানের মা হন পেশায় সাফল্য আসে কিন্তু সব সময় মনে পড়ে তার চাচাদের কথা। তিনি আগরতলা মামলার বেঁচে থাকা আসামিদের খোজ নেন। তাদের সাক্ষাৎকার নেন। তখনও বেঁচে থাকা বাবা ও চাচা আমিনুলের কাছে জানতে চান। শিশুকালের স্মৃতি তখন উজ্জ্বল হয়, সম্প্রসারিত হয় স্মৃতি।
শহিদ জহুরুলের ক্যান্টনমেন্টে বন্দি অবস্থা, তাঁর সঙ্গে তাঁর ভাইদের কথােপকথন, ডাক্তারের ভূমিকা- এঁদের জবানীতে তুলে ধরেছেন সে সময়কার চালচিত্র। খুঁটিনাটিসহ নানা বিবরণ যা একেবারে নতুন তথ্য। শহিদ জহুরুলের লাশ নিয়ে আসা হয়েছে। ‘চিত্রায়। সেদিনটির কথা আমার মনে আছে। সকালে জেনেছি বা পড়েছি সার্জেন্ট জহুরুল হক শহিদ হয়েছেন। ক্রোধ জন্মেছে বুকে । সায়েন্স ল্যাবরেটরির গলি থেকে বেরিয়ে আরেকটি গলি দিয়ে কাম্পালার গলিতে এসেছি। বাইরে মিছিল । চিত্রায় ঢুকলাম । প্রাঙ্গণের একদিকে সার্জেন্ট জহুরুলের দেহ, কাফনে ঢাকা । প্রাঙ্গণে ইতস্তত কিছু মানুষ । মওলানা ভাসানী এলেন, দাঁড়িয়ে থাকলাম খাটিয়ার পাশে। এই চিত্রটি আমার স্মৃতিতে এখনও উজ্জ্বল। তারপরের ঘটনা সবার জানা। সে সব ঘটনারও জীবন্ত বর্ণনা দিয়েছেন মিমি।

তারপর মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয়। একজন শিশুর মনে যে সব চিত্র গেঁথে থাকে সেগুলির বর্ণনা। যেমন নায়ক রাজ্জাককে নিয়ে ঘটনা। আসলে আমরা মনে করি শিশু তরুণ হলে সব স্মৃতি মুছে যায়, যায় না। আমার পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত আমি ঢাকার স্বামীবাগ ছিলাম । আমার মনে এখনও সে সব স্মৃতি উজ্জ্বল, বন্যা, দাঙ্গা আর চৌ এন লাইয়ের ঢাকা সফরে কমিউনিস্টদের উত্তেজনা। মিমি তার বাবা-মা, চাচাদের চরিত্র চিত্রণ করেছেন ছােট ছােট ঘটনা দিয়ে। অনেকটা কুশলী শিল্পীর ড্রইংয়ের মতাে। বিভিন্ন আঁচড় ও তার মধ্যে উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। একেকটি চরিত্র। কাহিনি এগিয়ে যাচ্ছে দ্রুত, যেন কোনাে উপহারের একটির পর একটি পরত খুলছে। আগরতলা মামলার কুশীলবদের আমরা কতােটা মনে রেখেছি? খুব একটা না । স্বাধীনতা পুরস্কারও তাঁদের সবার জোটে নি, এমনকী ১৯৬৯-এর নায়কদেরও। অথচ, এমন অনেকে স্বাধীনতা পদক পেয়েছেন যাদের অবদানের কথা অনুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে খুঁজতে হয় । ইতিহাস এত সহজে আমরা ভুলে যাই! আপনাদের মনে আছে কিনা, গুলিস্তানের উল্টোদিকে একটি পার্ক ছিল, ১৯৬৯ সালে যার নামকরণ করা হয়েছিল মতিউর শিশু পার্ক’। সাংবাদিক-লেখক ফয়েজ আহমদ এই নামকরণ করেছিলেন । সেই পার্ক এখন কোথায়? মিমি একধরনের তাড়না নিয়ে বইটি লিখেছেন। এটি তার বাবা-চাচাদের স্মৃতি কাহিনী। শুধু নয়, এটি ইতিহাস সংরক্ষণের প্রচেষ্টা। আবেগ আছে অবশ্যি, কিন্তু পাঠক এ বই পড়ে যে হারানাে স্মৃতি খুঁজে পাবেন তা বলা বাহুল্য। মিমির বইটি পড়ে এককথায় বলব, আমি মুগ্ধ । একজন লেখিকার প্রথম মৌলিক বাংলা বই, কিন্তু কী স্বাদু গদ্য! কী বলার ভঙ্গি! এই যে আমি শুরু করলাম, তারপর শেষ করে উঠেই, এই ‘নিবেদন’টুকু লিখলাম । এটি বইয়ের ভূমিকা নয়। সেটি লিখবেন প্রাজ্ঞজন এ লেখা একজন সাধারণ পাঠকের, যিনি নতুন লেখকের প্রথম বই পড়তে অনাগ্রহী, কিন্তু, বাধ্য হয়ে একটি পাতা পড়ছেন । তারপর নিজেও জানেন না, পাতার পর পাতা তিনি পড়ে যাচ্ছেন।
মুনতাসীর মামুন
ঢাকা। ১৪২৬, ২০২০
৪৯ মুক্তিসন, মুজিববর্ষ

‘৬৯-এর ১৫ই ফেব্রুয়ারি ভােরবেলা
ফজরের আযান শােনা যাচ্ছে। ‘৬৯-এর ফেব্রুয়ারি মাসের ১৫ তারিখ । তেমন করে আলাে ফোটেনি, চারদিকে হালকা আলাের কমলা রঙের আভা ছড়াচ্ছে। পাখিরা জেগে ওঠে আরাে আগে তাদের কিচিরমিচির ডাক ভেসে আসছে । জহুরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ফজলুল হকের পেটে ব্যথা হচ্ছে। তার ওয়াশরুমে যাওয়া প্রয়ােজন। জহুরকে সে ডাকল, জহুর আগে থেকেই জেগে ছিল। গত রাতে তার ভালাে ঘুম হয়নি। কেমন আচ্ছন্নের মতাে রাতটা কেটে গেছে । চাপা একটা ক্রোধ তার বুকের মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে । অনেক দিন ধরে তারা এই থার্ড পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ব্যারাকে বন্দি অবস্থায় আছে । জহুর আর ফজলুল হক অনেক দিনের বন্ধু । পাকিস্তানের করাচির কোরাঙ্গি ক্রিকে পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে একসঙ্গে কাজ করেছেন। সেই সময় থেকে তাদের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব। ভাবনা-চিন্তা ও পথচলায় এই দুই বন্ধু ছিল একই মতাদর্শের মানুষ ।
ফজলুল হক বললেন- ওয়াশরুমে যাওয়া দরকার। কিন্তু পাকিস্তানি সৈন্যদের গতিবিধি দেখে কেমন যেন অস্বাভাবিক লাগছে ।
জহুর বললেন- চলাে আমিও তােমার সঙ্গে যাব । রুমে ছিলেন স্টুয়ার্ড মুজিব, উনিও উঠে দাঁড়ালেন। চলাে, আমরা একসঙ্গে যাই। গত রাতের ঘটনাটায় ওরা ক্ষেপে আছে, তবুও আমাদের হয়তাে কিছু করবে না। জহুরের মনে ভেসে উঠল গত রাতের পাকিস্তানি সেনাদের দুর্ব্যবহার । ক্যান্টনমেন্টে বন্দি অবস্থায় যে সকল রাজবন্দি ছিল, তাদের জন্য পাকিস্তানিরা মানসম্পন্ন খাওয়াদাওয়া দিত না । বাঙালিরা ভাত খেতে পছন্দ করে জেনেও তারা অভিযুক্তদের নিম্নমানের মােটা চালের ভাত দিত, এমনকি সেই ভাতের সঙ্গে কাঁকর মেশানাে থাকত । অভিযুক্তরা প্রায়ই সম্পূর্ণ ভাত খেতে পারতেন না। থার্ড পাঞ্জাব রেজিমেন্টে যে ব্যারাকে আগরতলা মামলার অভিযুক্তরা বন্দি অবস্থায় ছিলেন, সেটি ষাট দশকে নির্মিত একটি একতলা দালান, কোথাও কোথাও টিনের ছাদ, তার পাশেই ছিল কাঁটাতারের বেড়া। সেখানে মাঝে মাঝেই কিছু গরিব ছােট ছােট অভুক্ত শিশু সামান্য খাবারের আশায় আসত । মূলত তারা অভিযুক্তদের অবশিষ্ট খাবারগুলাে সংগ্রহ করতে আসত। গত রাতে জহুর চুপচাপ বসে ছিলেন। অন্য অভিযুক্তরা তাদের অবশিষ্ট খাবার অসহায় শিশুদের মাঝে বিতরণ
১৯
করে দিচ্ছিলেন। এভাবে প্রায়ই অভিযুক্তরা তাদের খাবার থেকে একটা অংশ কাঁটাতারের বেড়ার অপর প্রান্তে অপেক্ষারত ছােট বাচ্চাদের দিয়ে দিতেন। পাকিস্তানি সেনারা প্রায় প্রতিদিনই এই ছােট বাচ্চাদের গালাগাল আর মারধর করে তাড়িয়ে দিত। গত রাতেও অভিযুক্তরা একইভাবে খাবার বিলিয়ে দিচ্ছিলেন।
পাকিস্তানি সৈনিক মঞ্জুর শাহ আবারাে গালাগাল শুরু করে। একপর্যায়ে অভিযুক্তরা প্রতিবাদ করে বলেন- আমরা তাে আমাদের খাবার থেকে খাবার বাঁচিয়ে ওদের দিচ্ছি! মঞ্জুর শাহ ক্ষিপ্ত হয়ে বাচ্চাদের লাথি মারা শুরু করে। জহুর চুপচাপ বসে পুরাে ঘটনাটা দেখছিলেন। মঞ্জুর শাহর দুর্ব্যবহার দেখতে দেখতে হঠাৎ তার বুকের ভেতর এক তীব্র প্রতিবাদের ঝড় উঠল। জহুর মুহূর্তের মধ্যে উঠে দাঁড়ান এবং অতর্কিতে মঞ্জুর শাহর ওপর ঝাঁপ দিয়ে তার রাইফেলটা কেড়ে নেন । মঞ্জুর শাহ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। জহুর বলে ওঠে- তােমরা কী ভেবেছাে? তােমাদের এই দুর্ব্যবহার দেখে দেখে আমরা অসহ্য হয়ে পড়েছি, তােমাদের হাতে অস্ত্র আছে তাই এত ক্ষমতা দেখাচ্ছাে । চাইলে আমরা খালি হাতে এই ক্যান্টনমেন্ট দখল করতে পারি। এই কথা বলার পর, জহুর সবলে রাইফেলটি মঞ্জুর শাহর দিকে ছুড়ে দেন। মঞ্জুর শাহর চেহারা দেখে অন্য অভিযুক্তরা বুঝতে পারেন- অস্ত্রধারী এই উদ্ধত পাকিস্তানি সেনাটি তার যােগ্য অপমানটি পেয়েছে। মঞ্জুর শাহ হতবাক হয়ে পড়ল, সে ভাবতেও পারেনি, একজন নিরস্ত্র বাঙালি অভিযুক্ত এইভাবে প্রতিবাদ করতে পারে! আবার এইভাবে রাইফেলটা ছুড়ে দিতে পারে! জহুর দীর্ঘদিন পাকিস্তানের কোরাঙ্গি ক্রিকে অস্ত্র প্রশিক্ষক ছিলেন। অভিজ্ঞ অস্ত্র প্রশিক্ষক হিসেবে তাঁর যথেষ্ট সুনাম ছিল। কিন্তু তার মাঝে এই শিক্ষাও ছিল যে, তিনি জানতেন শত্রুর সঙ্গে সামনা-সামনি অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধে নামতে হয় । কারাগারের কক্ষগুলাে বাইরে থেকে তালা লাগানাে থাকত। ভেতর থেকে নাড়া দিয়ে শব্দ করায় সেন্ট্রি এসে জিজ্ঞেস করে, “তােম লােক কেয়্যা চ্যাতা? তারা ওয়াশরুমে যাওয়ার কথা বললেন । সেন্ট্রি বলল, একটু অপেক্ষা করতে হবে ওপর থেকে পারমিশন আনতে হবে । তারপর নিয়ে যাওয়া যাবে। কিছুক্ষণ পর সেন্ট্রি এসে গেট খুলে কড়া গলায় তিনজনকে লাইন করে দাঁড়াতে বলল। কারাগারের কক্ষগুলাের সামনে ছিল প্রশস্ত বারান্দা। সেখান থেকে হেঁটে গিয়ে শেষ মাথায় ছিল ওয়াশরুম। ভােরের আভা সবে মাত্র ছড়িয়ে যাচ্ছে- জহুর সবার আগে হাঁটছে, মাঝখানে ফজলুল হক, শেষে স্টুয়ার্ড মুজিব । ওয়াশরুমের কাছাকাছি পৌছে হঠাৎ তারা দাঁড়িয়ে পড়লেন। তাঁরা এক অশনিসংকেত বুঝতে পারলেন ।দ্রুত বুটের শব্দে কেউ এগিয়ে আসছে। জহুর
২০
বিন্দুমাত্র বিচলিত হলেন না। তিনি যেমন ছিলেন, তেমনি সােজা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। গত রাতের সেই উদ্ধত পাকিস্তানি সৈনিক মঞ্জুর শাহ রাইফেল তাক করে তাদের সামনে এসে দাঁড়াল। চোখে-মুখে রক্তের পিপাসা, আক্রোশের ছাপ। উর্দুতে গালি দিয়ে বলল- কাল তাের সাহস দেখেছি, কিন্তু আজ আমি তােদের মেরে ফেলব। জহুর একটুও বিচলিত হলেন না। সরাসরি তাকিয়ে রইলেন তার দিকে। মঞ্জুর শাহ মুহূর্তের মধ্যে গুলি চালাল, গুলি এসে সােজাসুজি জহুরের পেটে লাগল । আচমকা গুলির আঘাতে দীর্ঘদেহি মানুষটি মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। আরও একটি গুলির শব্দ, জহুর সাহসী যােদ্ধা- তার শরীর সবল ও শক্তিশালী, কিন্তু আচমকা গুলির আঘাতে গভীর আচ্ছন্নতার। ভেতরেই সে দেখতে পেল তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ফজলুল হকের দেহটিও মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে। জহুর বুঝতে পারল না স্টুয়ার্ড মুজিবের কী হয়েছে । সেও নিশ্ৰুপ শুয়ে আছে। জহুর ধীরে ধীরে ফজলুল হককে ডাকল- বলল, ফজলু শক্ত হও, গত রাতের সেই বর্বর পাকসেনারা আমাদেরকে মেরে ফেলতে চাচ্ছে, আমাদেরকে উঠতে হবে, বাঁচতে হবে। ওদের বর্বরতা যে কতখানি নির্মম হতে পারে, তারই দৃশ্য এইবার ফুটে ওঠল । পাকসেনারা ছুটে এসে হাসতে হাসতে বলল- দ্যাখাে, ইয়ে আদমি আভি তাক জিন্দা হ্যায়। রাইফেল খাড়া করে- জহুরের গুলিবিদ্ধ পেটের ওপর উঠে দাঁড়াল । রাইফেলের মাথার বেয়নেট দিয়ে সরাসরি পেটের মধ্যে আঘাত শুরু করল । বেয়নেটের আঘাতে জহুরের পেটের সমস্ত তন্ত্রী ছিড়ে যাচ্ছে। তবুও বর্বর পাকিস্তানি সৈন্যটি ক্ষান্ত হচ্ছে না। তাকে জুতা দিয়ে মাড়িয়ে যাচ্ছে। বুটের আঘাতে জহুরের কলার বােন ভেঙে গেল । জহুর বুঝে উঠতে পারছে না একজন নিরস্ত্র মানুষকে একজন অস্ত্রধারী মানুষ কীভাবে এই রকম নৃশংস আক্রমণ করতে পারে । আজন্ম এই শিক্ষা সে পেয়েছে একজন প্রকৃত যােদ্ধা নিরস্ত্র মানুষকে আক্রমণ করতে পারে না। এই রকম অবস্থায়ও সে খেয়াল করল ফজলুল হককেও ওরা বুট দিয়ে লাথি মারছে। এরা সৈনিক না, এরা একই দেশের মানুষ না, এদের সঙ্গে আমি একই সঙ্গে পাকিস্তানে কাজ করেছি, তবুও এরা আমাদের ভাই না, এরা রক্তপিপাসু, পিশাচ! পাকিস্তানি বর্বর মঞ্জুর শাহর বেয়নেটের আঘাতে জহুরুল ধীরে ধীরে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। গুলির শব্দে আচমকা ঘুম ভেঙে গেছে থার্ড পাঞ্জাব রেজিমেন্টের কারাগার কক্ষে বন্দি বাকি অভিযুক্তদের । সকলেই উদ্বিগ্ন হয়ে বুঝতে চেষ্টা করছে, কোথায় গুলি চলছে । কারাগার কক্ষে নিচের দিকে জানালা ছিল না। তাই সরাসরি তারা দেখতে পারছিল না। দেয়ালের ওপরের দিকে লােহার গ্রিল ও কাচের শার্সি ছিল । অভিযুক্তরা চেয়ার টেনে এনে তার ওপর দাড়িয়ে ওপরের জানালা দিয়ে কষ্ট করে দেখার চেষ্টা করে যাচ্ছে। অভিযুক্তরা অচিরেই বুঝতে পারল তাদের কোনাে ঘনিষ্ঠ সহযােদ্ধার ওপর বর্বর পাকসেনারা গুলি চালিয়েছে। অথচ তারা কিছুই করতে পারছে না। বাইরে থেকে সবগুলাে কক্ষ তালাবদ্ধ। বাইরে পাকিস্তানি সেনারা জোরেশােরে টহল দিচ্ছে। কিন্তু বাঙালিরা থেমে থাকতে পারছিল না। তারা ঘরের ভেতর থেকে মৃত্যু ভয় উপেক্ষা করে, চিৎকার করে প্রতিবাদ শুরু করে দিল । তাদের প্রতিবাদে চিৎকারে সমস্ত পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠল ।
২১
জহুরের কখন জ্ঞান হারিয়েছিল আবার কখন জ্ঞান এলাে, সে কিছুই ঠিকমতাে মনে করতে পারছে না। হঠাৎ সে বুঝতে পারল- একটা অ্যাম্বুলেন্সে তাকে আর ফজলুল হককে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
জহুর বন্ধকে জিজ্ঞেস করল- তােমার কেমন লাগছে? সাহস রাখাে, আমরা বেঁচে যাব ।
ফজলুল হক জহুরকে বলল- তােমার জখম অনেক বেশি, তােমার কেমন লাগছে । আমাদের ওরা কোথায় নিয়ে যাচ্ছে! কী করবে বুঝতে পারছি না!
ডা. কর্নেল এম. এ. আলী
ঘড়িতে ভাের সাড়ে ছয়টা, ডা. কর্নেল এম. এ. আলী প্রতিদিনের মতাে খুব ভােরে উঠেছেন, গােসল সেরেছেন । সকালের নাস্তা তখনও করেননি। স্ত্রী মারিয়ম নাস্তা তৈরি করছেন। হঠাৎ ঝন ঝন শব্দে টেলিফোন বেজে উঠল। সিএমএইচ থেকে ফোন- খুব জরুরি অবস্থা! এখনই তাকে হাসপাতালে যেতে হবে। সকালের নাস্তা খাওয়ার সময় হলাে না। তিনি দ্রুত হাসপাতালে পৌঁছলেন। সেই ষাটের দশকের শুরুতে, পাকিস্তান থেকে এসে ঢাকার সিএমএইচে সার্জন হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছিলেন। বিলাতে ছিলেন অনেক দিন, ডাক্তারি পড়েছেন। আর সেখানেই পরিচয় ‘মারিয়ম’-এর সঙ্গে। পরে মারিয়মকে বিয়ে করেছেন । আজও এই ব্রিটিশ নারী, বাঙালি রমণীর মতাে ঘর-সংসারের দায়িত্ব নিয়ে আছেন আমাদের বাংলাদেশে।
২২
কর্নেল আলী সিএমএইচ হাসপাতালে পৌছেই বুঝতে পারলেন, পরিস্থিতি খুব ভয়াবহ। সহকারী ‘খাওসা’ দ্রুত এসে তাকে জানাল, দুইজন মানুষকে পাকিস্তানি সৈন্যরা নির্মমভাবে আহত করে হাসপাতালে নিয়ে এসেছে । রক্তে ভেসে যাচ্ছে- কোনােভাবে রক্ত থামানাে যাচ্ছে না, এরা ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বন্দি অবস্থায় ছিল। আগরতলা মামলায় অভিযুক্ত। কর্নেল আলী খাওসাকে রােগীদের কাছে থাকার নির্দেশ দিয়ে দ্রুত পাকিস্তানি অফিসারদের কাছে ছুটে যান। পাকিস্তানি অফিসারদের মধ্যে তখন তুমুল বাগ্‌বিতণ্ডা চলছে। কেউ কেউ বলছেন- এদের পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হােক। কেউ কেউ বলছেন- আধমরা লােক দুটোকে এখানেই চিকিৎসা করানাে হােক। তা না হলে বাইরে আন্দোলন তীব্র হবে। আবার কেউ কেউ হাসতে হাসতে বলে ওঠল- এগুলােকে ফেলে রাখাে। এমনিতেই আধমরা, আর কিছুক্ষণ পর মরে যাবে, ল্যাটা চুকবে । মেজর নাসের ডা. আলীকে নির্দেশ দিলেন আহত রােগীদের চিকিৎসার জন্য । ডা. আলী আহতদের কাছে গিয়ে এক অভূতপূর্ব ঘটনার সম্মুখীন হলেন। রক্তে ভেসে যাচ্ছে দু’জনের শরীর । অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে ধমনিতে রক্তের সঞ্চালন অত্যন্ত ক্ষীণ হয়ে আসছে। সমস্ত চেহারা রক্তশূন্যতায় বিবর্ণ, চোখের উজ্জ্বলতা লীন, শরীরের শেষ রক্তবিন্দু নিয়ে মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করছেন। ডা. আলী প্রথমে জহুরের কাছে গেলেন। জহুর তাঁকে ক্ষীণকণ্ঠে বললেন- “আমার বন্ধুর অবস্থা খারাপ, আপনি তাকে আগে দেখেন। ডা. কর্নেল আলী অবাক হয়ে, অপর পাশে শুয়ে থাকা ফজলুল হকের কাছে গেলেন। ফজলুল হক ডা. আলীকে বললেন- “আমার চেয়ে জহুরের আঘাত অনেক বেশি, ওকে ওরা রাইফেলের বেয়নেট দিয়ে অনেক আঘাত করেছে, আপনি ওকে আগে দেখেন। ৯৮ বছর বয়সে ডা. কর্নেল আলী আমাকে বলেছিলেন- আজ আমি মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়ে আছি। সে সময় ওদের দুই বন্ধুর মধ্যে যে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালােবাসা লক্ষ করেছি। আমি কোনাে দিন তা ভুলতে পারিনি। আমি হত-বিহ্বল হয়ে পাকিস্তানি সেনা অফিসারদের কাছে আবার ছুটে গেলাম চিকিৎসার সুব্যবস্থার জন্য।
আমি তখন পাকিস্তানি সৈন্যদের অনুরােধ করে বললাম, এ রকম রােগীর অপারেশনে দেরি করা যাবে না। ঢাকা মেডিকেল কলেজে অনেক ভালাে ভালাে সার্জন আছে। এক-দু’জন সার্জন নিয়ে আসুন, দু’জনকে দ্রুত অপারেশন করাতে হবে । আমার পক্ষে একা দু’জনকে একসঙ্গে অপারেশন করা সম্ভব না। এ ছাড়া আনুষঙ্গিক প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থার জন্য অনুরােধ করি ।
২৩
আরাে অনুরােধ করলাম, জহুরের রক্তের গ্রুপ ‘ও-নেগেটিভ’- এ ধরনের রক্ত পাওয়া দুষ্কর। জহুরের রক্তের জন্য প্রয়ােজনে পত্রিকা, গণমাধ্যমে উন্মুক্ত বিজ্ঞাপন দেওয়া প্রয়ােজন, নতুবা অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে রােগী বিপজ্জনক অবস্থায় চলে যেতে পারে। তৎকালীন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কোনােমতেই বাইরে থেকে চিকিৎসক, সার্জন ও কোনাে রকম সাহায্য নিতে রাজি হলেন না। তারা মূলত এবিষয়টি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের বাইরে যাতে অভিযুক্তদের ওপর গুলি হওয়ার খবরটা প্রকাশ না পায় সে জন্য গােপনীয়তার আশ্রয় নিয়েছিল। তারা অনেকটা হুকুমের মতাে ডা. আলীকে বললেন- আমাদের এক কথা, আপনি যা পারেন তা-ই করেন। এমনকি তারা জহুরের জন্য রক্ত সংগ্রহের আহ্বান জানিয়ে বিজ্ঞাপনও দিলেন না। এদিকে বিহ্বল এক বাঙালি তরুণী নার্স খাওসা মাটিতে পড়ে থাকা গুলিবিদ্ধ দু’জনকে কোনােমতে দুটি বেডে শুইয়েছেন। সে একা বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছে। এই হাসপাতালের সে চিফ মেট্রন । শ্যাম বর্ণের ২২ বছরের মেয়েটি মাথায় কোঁকড়া কোঁকড়া চুল, মিষ্টি চেহারা, তার অমায়িক স্বতঃস্ফূর্ত ব্যবহারের জন্য ডা. আলী ও তার স্ত্রীর অনেক স্নেহের একজন। হাসপাতালে তার দিনের বেশির ভাগ সময় কেটে যায়। অনেক জটিল রােগী দেখেছেন, তাদের কেউ ভালাে হয়েছে, কেউ বা ইহলােক ছেড়ে চলে গেছে। কিন্তু সেদিনের মতাে পরিস্থিতিতে কোনাে দিন পড়তে হয়নি। ইতােমধ্যে সে খবরের কাগজে পড়েছে আগরতলা মামলার কথা, ক্যান্টনমেন্টে শেখ মুজিবুর রহমানসহ আরও অনেককে বন্দি করে রাখা হয়েছে। ওখান থেকেই দুজনকে পাকিস্তানিরা গুরুতর জখম করে নিয়ে এসেছে। সে বিচলিত হয়ে পড়ল, কীভাবে এদের বাঁচাবে, দুজনের শরীর থেকে এত রক্ত বের হচ্ছে, স্টোর থেকে অনেক তুলা এনে চাপ দিয়ে ক্ষত স্থানগুলাে চেপে ধরার চেষ্টা করছে, তবুও রক্তে ভিজে যাচ্ছে। এরপর দৌড়ে গিয়ে দু-তিনটি চাদর নিয়ে এসে চাদর দিয়ে তাদেরকে জড়িয়ে ধরে, রক্তের ধারা থামানাের জন্য। তবুও রক্তক্ষরণ হয়েই যাচ্ছে। এদিকে পাকিস্তানিদের সঙ্গে বাগবিতণ্ডার পর ডা. আলী ক্লান্ত মন নিয়ে আবার রােগীদের কাছে ফেরত এলেন। ডা. আলী এসে খাওসাকে বললেন- অপারেশন করতে হবে, রােগীদের অপারেশনের ব্যবস্থা নাও। ডা. আলী আবার রােগীদের পরীক্ষা করলেন। ফজলুল হকের ক্ষত বুকে । গুলি তার বুকে লেগেছে। গুলি বুকের পাঁজরের হাড় বিদীর্ণ করে শরীরের ভেতর প্রবেশ করেছে। তার অবস্থা অপেক্ষাকৃত আশঙ্কামুক্ত। কিন্তু জহুরের অবস্থা অত্যন্ত সংকটাপন্ন । তার পেটে গুলি লেগেছে। একই সঙ্গে বেয়নেটের নির্মম আঘাতে সমস্ত নাড়িভুড়ি ছিড়ে গেছে। বিশেষ করে অগ্ন্যাশয় খণ্ডিত হয়ে গেছে। অগ্ন্যাশয় খণ্ডিত হয়ে পড়ায়, অগ্ন্যাশয় থেকে নিঃসৃত জায়লরিক অ্যাসিড পেটের সকল তন্ত্রিকে জখম করে ফেলেছে। এই ঘটনার অনেক বছর পরে, আমি যখন ‘আগরতলা মামলার অনুচ্চারিত ইতিহাস ও শহিদ সার্জেন্ট জহুরুল হক’ বইটির তথ্য সংগ্রহের জন্য কর্নেল আলীর সঙ্গে কথা বলি,
২৪
তখন তিনি আমাকে বলেছিলেন- জীবনে আমাকে এত কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমি ভাবতে পারিনি। আমি বুঝতে পারছিলাম না কীভাবে এই রােগীদের বাঁচাবাে।
পাকিস্তানিরা কোনাে রকম সাহায্য-সহযােগিতা করছে না, দেশে এত সার্জন থাকতেও অপারেশন করার জন্য কাউকে সহায়ক হিসেবে দিচ্ছে না। সেই সময় আমার স্ত্রী মারিয়ম আমাকে ফোন করে সাহস জুগিয়েছিল । সে হাসপাতালে চলে আসে এবং পাকিস্তানিদের সঙ্গে কথা বলে, তবুও তারা অনুমতি দেয়নি বাইরে থেকে আরাে সার্জন বা সহযােগী ডাক্তার দিতে। সেই সময় আমার স্ত্রী আমাকে আবারও সাহস দেয় এবং রােগীদের দ্রুত অপারেশন শুরু করতে বলে। এরপর আমাকে আরও একটি চরম সিদ্ধান্ত নিতে হয়। কাকে আগে অপারেশন করবাে? তিনি বললেন- আমার মনে হলাে ফজলুল হককে বাঁচানাের সম্ভাবনা আছে, তাকে আগে অপারেশন করি। পরে জহুরুল হককে অপারেশন করবাে। কেননা তার অবস্থা অত্যন্ত জটিল, ক্ষত সর্বত্র তাকে বাঁচানাে কঠিন হবে। যদি একজনকেও বাঁচানাে সম্ভব হয়, সেই চেষ্টা করতে হবে । এদিকে খাওসা দুইজনের দিকে সমানভাবে নজর ও সেবা দিয়ে যাচ্ছে, রক্তস্নাত রােগীদের মুখ, হাত, পা মুছিয়ে অপারেশনের প্রস্তুতি শুরু করেছে। সে রােগীদের নাম জানে না, কোথায় তাদের দেশের বাড়ি? কেন তাদের গুলি করা হয়েছে? কিছুই জানে না। শুধু জানে শেখ মুজিব ও আরাে কিছু লােককে ক্যান্টনমেন্টে আটক করে রাখা হয়েছে। সেখান থেকে এদের আনা হয়েছে। মুজিব ভাইয়ের জন্য তার মন খুব অস্থির। জহুরুল হকের কাছে গিয়ে প্রশ্ন করল, আপনি কি শেখ মুজিবুর রহমান? মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়েও জহুর মৃদু হেসে বলেছিল, না, আমি জহুরুল হক। দীর্ঘদেহি, ঘন গোঁফ ছিল জহুরের । কিছুটা সাদৃশ্য ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দৈহিক গড়নে। খাওসার বিশ্বাস হয় না, সে বুঝতে পারে না এরা কারা? তবুও সে বুঝতে পারে এরা অকুতােভয় যােদ্ধা! জহুর পানি খাওয়ার জন্য খাওসার কাছে বারবার অনুরােধ করে। তাঁর খুবই পানির পিপাসা পেয়েছিল । খাওসার মায়া হয়, কিন্তু অপারেশনের রােগীকে পানি দেওয়া যায় না, তুলাতে পানি ভিজিয়ে জহুরের ঠোটের কাছে ধরেন, দুই ফোঁটা পানি দেওয়ার জন্য। মুহূর্তের মধ্যে জহুর তার হাতটা শক্তভাবে চেপে ধরেন। তিনি আরাে পানি খেতে চান। মৃত্যু পথযাত্রী এক যােদ্ধার এই সংবেদনশীল মুহর্তটি খাওসা কোনাে দিন ভােলেননি। জীবনের গতিতে, নানা পথ পাড়ি দিয়ে ৭০ বছর বয়সে দাঁড়িয়েও আজও তার মনে সেই বিশেষ মুহূর্তটি অমলিন হয়ে আছে।
২৫
জহুররা তিন ভাই
জহুররা ছিলেন তিন ভাই । সে সবার ছােট। বড় ভাই মাহবুবুল হক পাকিস্তান স্টেট ব্যাংকে কর্মরত। মেজো ভাই তরুণ আইনজীবী আমিনুল হক।
পূর্ব পাকিস্তান রেডিওতে দুপুর ২টার খবরে ঘােষণা দেওয়া হলাে- ‘ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে আটকাবস্থায় আগরতলা মামলার অভিযুক্ত সার্জেন্ট জহুরুল হক ও ফজলুল হককে (পালিয়ে যাওয়ার সময়) গুলি করা হয়েছে।’ প্রচারমাধ্যম জনগণের উদ্দেশে কত বড় ভূমিকা রাখে, তা বােধ করি আজকের পৃথিবীতে সর্বজনস্বীকৃত। কিন্তু প্রচারমাধ্যমে মিথ্যাচার, অসত্য সংবাদ মানুষের মনে যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে, সেইরূপ মিথ্যা ও অসত্য সংবাদ পরিবেশনের জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নির্ধারিত হওয়া প্রয়ােজন। নতুবা ইতিহাস জরাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। নিজেদের অন্যায় আড়াল করার জন্য পাকিস্তানিদের নির্দেশে পূর্ব পাকিস্তানে রেডিও থেকে প্রচারকৃত ১৯৬৯ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা সম্পর্কিত সংবাদটি ছিল চরম মিথ্যাচার! জহুরুল হক আর ফজলুল হকের মতাে কালজয়ী দেশপ্রেমী বীরযােদ্ধা কোনােদিন পালানাের জন্য জন্মগ্রহণ করেনি। জহুর মৃত্যুকে বিন্দুমাত্র ভয় করতেন না। জহুরের বড় ভাই পরিবারের সকলের প্রিয় বড় দাদা জানতেন, কোনােভাবেই তার ছােট ভাই জহুর কারাগার থেকে পালাতে পারে না। ব্যাংকে কর্মরত অবস্থায় সংবাদটি পাওয়ামাত্র তিনি নিশ্ৰুপ হয়ে পড়েন। প্রকৃত অর্থেই তিনি ধীরস্থির ঠান্ডা স্বভাবের মানুষ ছিলেন। সংবাদটি পেয়ে একেবারে চুপ হয়ে গেলেন। তার মনে হলাে, তাকে এখনই ক্যান্টনমেন্টে যেতে হবে। ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে পাকিস্তানি ঊর্ধ্বতন অফিসারদের কাছ থেকে জহুরের অবস্থা সম্পর্কে জানতে হবে । তিনি একটুও কালক্ষেপণ না করে তার উর্ধ্বতন অফিসারকে পরিস্থিতি জানিয়ে তৎকালীন স্টেট ব্যাংক থেকে বের হয়ে পড়লেন। আশপাশে অনেক বাঙালি সহকর্মী ছিলেন, সকলেই সমবেদনা জানালেন । কিন্তু তাঁর সঙ্গে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে যাওয়ার জন্য কেউ-ই আগ্রহ প্রকাশ করেনি। মাহবুবল হক জানেন দেশের পরিস্থিতি ভালাে নয়, কেউ সাহস করে আসতে না চাইলে জোর করা যায় না । তিনি একা হেঁটে হেঁটে মতিঝিলের রাস্তায় একটা বেবিট্যাক্সি খুঁজতে চেষ্টা করছেন। বেবিট্যাক্সিতে ওঠার সময় হঠাৎ পেছন থেকে একজন জোরে ডেকে বললেন- হক সাহেব, হক সাহেব একটু দাড়ান! আমি আপনার সঙ্গে যাব, মাহবুবুল হক ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখেন, পা খোড়াতে খোড়াতে এগিয়ে আসছেন ‘আক্তার হাসমি’- তারই সহকর্মী, যিনি একজন অবাঙালি, বিহারি । তিনি কাছে এসে বললেন- আপনার ভাইকে পাকিস্তানিরা ক্যান্টনমেন্টে গুলি করেছে আর আপনি একা যাচ্ছেন ক্যান্টনমেন্টে? আমি আপনার সঙ্গে যাব। বেবিট্যাক্সি নিয়ে হক সাহেব দ্রুত এলিফ্যান্ট রােডে ছােট ভাই আইনজীবী আমিনুল হকের বাসায় যান। সেখানে গিয়ে শুনতে পান ইতােমধ্যে আমিনুল হক ক্যান্টনমেন্টে
২৬
চলে গেছেন। মাহবুবুল হক দ্রুত বেবিট্যাক্সি নিয়ে ক্যান্টনমেন্টে আগরতলা মামলার দায়িত্বে নিয়ােজিত মেজর নাসেরের অফিস রুমের সামনে পৌছেন, জহুরের সঠিক অবস্থা জানার জন্য তিনি দ্রুত পাকিস্তানি অফিসারের রুমে প্রবেশ করতে চান। সেই সময় একটি অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছিল । যা আজ পর্যন্ত ইতিহাসে কোথাও লিখিত হয়নি। মাহবুবল হককে সেন্ট্রি বাধা দিয়ে বলল- তােমার ভাই আমিনুল হক ভেতরে ঢুকে হইচই করছে। তুমি এখানে অপেক্ষা করাে। মাহবুবল হক দরজার বাইরে থেকে শুনতে পাচ্ছেন, আমিনুল হক উত্তেজিত হয়ে উচ্চস্বরে প্রতিবাদ করছেন। তিনি তখন প্রায় জোর করে মেজর নাসেরের ঘরে ঢুকে দেখেন, আমিনুল হক মেজর নাসেরের শার্টের কলার চেপে ধরে প্রশ্ন করছে, কীভাবে তােমরা আমার ভাইকে হত্যা করেছাে? অভিযুক্তদের সুরক্ষার দায়িত্ব তােমাদের। আবার মিথ্যা প্রচার করছাে?” মেজর নাসের ঘাবড়ে গেলেন! তার ইশারাতে পাকিস্তানি সেনারা ঘরে প্রবেশ করতে শুরু করে।
মাহবুবল হক মুহূর্তের মধ্যে বুঝতে পারলেন, পরিস্থিতি খুব ভয়ঙ্কর। মাহবুবুল হক ও আক্তার হাসমি বহু কষ্টে আমিনুল হককে বুঝিয়ে শান্ত করলেন । মাহবুবল হক দ্রুত ভাবলেন, এক ভাইকে হারাচ্ছি, সে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে, আরেক ভাইকেও পাকিস্তানিরা মেরে ফেলবে- সে কারণে তিনি জোর করে আমিনুল হককে বুঝিয়ে শান্ত করলেন। পাকিস্তানি অফিসাররা এত বর্বর ছিল যে, তারা শুধু জানালাে, তােমার ভাইয়ের চিকিৎসা হচ্ছে। কিন্তু তারা জহুরের দুই ভাইকে সিএমএইচে যাওয়ার কোনাে অনুমতি দিলেন না। এমনকি জহুরকে একবার দেখার সুযােগও দিলেন না। মাহবুবল হক ও আমিনুল হক। সেখান থেকে এলিফ্যান্ট রােডের বাসায় ফিরে এসে দুই ভাই মিলে আলােচনায় বসেন। আমিনুল হক তার চেম্বারের আইনের বইপুস্তক দ্রুত বের করে একটি বিধান পর্যালােচনা করলেন। ইতােমধ্যে তাদের আরও এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু আব্দুল কুদ্স (প্রাক্তন বাণিজ্য সচিব) এসে পৌছান। আমিনুল হক, তার ভাই ও বন্ধুকে বললেন- পাকিস্তানের সংবিধান অনুযায়ী এবং জেলকোডের বিধান অনুসারে সকল রাজবন্দিদের সুরক্ষার সম্পূর্ণ দায়িত্ব গণপ্রজাতন্ত্রী পাকিস্তান সরকারের । তাই ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট জেলে বন্দি অবস্থায় জহুরুল হক ও ফজলুল হকের উপর গুলি চালানাে সংবিধানের পরিপন্থি একটি গুরুতর অপরাধ। পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে ভােরবেলায় নিরস্ত্র রাজবন্দিদের উপর গুলি বর্ষণ করে। এর প্রতিবাদে তাৎক্ষণিকভাবে আমিনুল হক, মাহবুবুল হক ও তাদের বন্ধুকে নিয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের দায়িত্বে নিয়ােজিত প্রতিরক্ষা সচিব রাও ফরমান আলীর উদ্দেশে একটি শক্ত ও প্রতিবাদী ভাষায় টেলিগ্রাম তৈরি করেন। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তানিদের দায়িত্বহীন ও বর্বরােচিত আক্রমণে সার্জেন্ট জহুরুল হক ও সার্জেন্ট ফজলুল হকের ওপর গুলিবর্ষণের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদই ছিল এই টেলিগ্রামের মূল বক্তব্য। মাহবুবল হক তার বন্ধু আব্দুল কুদ্সকে সঙ্গে নিয়ে দ্রুত জিপিওতে যান এবং তৎকালীন পাকিস্তানের সামরিক সচিব রাও ফরমান আলীর কাছে আর্জেন্ট টেলিগ্রাম পাঠান।
২৭
ডা, কর্নেল এম আলী সিএমএইচ-এ অপারেশন থিয়েটারে অপারেশন শুরু করলেন। প্রথমে তিনি সার্জেন্ট ফজলুল হকের অপারেশন শুরু করেন। ফজলুল হকের বুকের পাঁজরের দুটি হাড় তাকে কেটে ফেলে দিতে হলাে। পাকিস্তানিদের গুলিতে ফজলুল হকের বুকের পাঁজরের দুটি হাড় সম্পূর্ণভাবে ভেঙে যাওয়ায় তিনি বাধ্য হয়ে তার বুক থেকে হাড় দুটি কেটে ফেলে দিয়ে তাকে বাঁচানাের চেষ্টা করেন। এরপর তিনি সার্জেন্ট জহুরুল হকের অপারেশন শুরু করেন। কিন্তু অপারেশন চলাকালীন অবস্থায় তিনি বুঝতে পারেন রােগীর অবস্থা অত্যন্ত সঙ্কটাপন্ন। রাইফেলের বেয়নেটের আঘাতে অগ্ন্যাশয় যেভাবে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে তা কোনাে চিকিৎসকের পক্ষেই সুরক্ষা করা সম্ভব নয় ।
ডা. কর্নেল আলী অপারেশন শেষ করে বিকালে বিষন্ন মনে বাড়ি ফিরলেন। ভারাক্রান্ত মন, কোনােমতেই মেনে নিতে পারছেন না এই রকম দুইজন বীর যােদ্ধার জন্য এত স্বল্প ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসার ঘটনাটি। মন বলছে- একজন হয়তাে বা বাঁচবে, যদিও আশঙ্কাজনক, আরেকজনের বাঁচার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। সেই সুদুর সিলেট শহর থেকে আসা ডা. আলীর পিতামহ ব্রিটিশদের সঙ্গে যুদ্ধ। করেছিলেন । ডা. আলী কয়েক মাইল পথ হেঁটে হাই স্কুলে গেছেন। ছাত্রজীবনে ক্লাসে প্রথম হয়েছিলেন বহুবার । জীবনে দৃঢ়চিত্তে সকল কিছুর সঙ্গে লড়াই করে জিতেছেন। ইংরেজ ডাক্তারদের সঙ্গে বিলাতে কাজ করেছেন। পাশ্চাত্যের মােহ ছেড়ে নিজ দেশে ফিরে এসেছেন বাঙালিদের সুচিকিৎসা প্রদানের জন্য। অথচ আজ তিনি পাকিস্তানিদের নিষ্ঠুরতা ও হীনম্মন্যতার জন্য দেশপ্রেমী দুই বীরযােদ্ধার যথাযােগ্য চিকিৎসার ব্যবস্থা নিতে পারলেন না। ওরা এমন করে জহুরকে আঘাত করেছে- তাকে বাঁচানাে চিকিৎসাবিদ্যার বাইরে চলে গেছে। সন্ধ্যার বিষন্ন আলােয় দুঃখ-ভারাক্রান্ত মন নিয়ে চা খেতে বসলেন ডা. আলী । এমন সময়। টেলিফোন বেজে উঠল । সিএমএইচ থেকে জানানাে হলাে, সার্জেন্ট জহুরুল হক মারা গেছেন।
‘৬৯-এর উত্তাল ঢাকা শহর
যেন আকাশটা ঘন কালাে মেঘে হঠাৎ মেঘলা হয়ে পড়ল; মৃত্যুর গন্ধে- চিল উড়ছে আকাশে, মৌমাছিরা গুঞ্জন করে ধীরে ধীরে বাংলার মানুষের কাছে পৌছে দিল এই সংবাদ- একজন বাঙালি বীরযােদ্ধাকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বন্দি অবস্থায় গুলিবিদ্ধ করেছে- ‘৬৯-এর জাগ্রত বাঙালি শহরবাসী জাগাে, তােমরা জাগাে … ১৯৬৯ সালের উত্তাল দিনগুলি ছিল আন্দোলন-সংগ্রামের । ন্যায্য দাবি আদায়ে সােচ্চার, মিছিলে মিছিলে প্রকম্পিত শহর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের প্রতিবাদের শহর। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে শহরের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রী, শিল্পী, লেখক- সকলেই প্রতিবাদে মুখর। ২০শে জানুয়ারি জমায়েত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী ১৪৪ ধারা ভেঙে বিরাট মিছিল বের করে। কিন্তু ছাত্রদের বিশাল মিছিলে পাকিস্তানি প্রভুদের নির্দেশে পুলিশ গুলিবর্ষণ করে। ফলে স্বতন্ত্র ছাত্র ইউনিয়নের নেতা আসাদউজ্জামান (আসাদ)
২৮
গুলিবিদ্ধ হয়ে শহিদ হন । ২১শে জানুয়ারি ঢাকা শহরে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয় । এই দিন পুলিশের বদলে ই.পি.আর বাহিনীর হাতে শহরের কর্তৃত্ব ছেড়ে দেয়া হয় । শহিদ আসাদের জানাজায় পল্টন ময়দানে লক্ষাধিক লােকের সমাগম হয়। ছাত্রনেতা আসাদকে হত্যার পর প্রতিদিন পাকিস্তানিরা ছাত্রদের মিছিল ছত্রভঙ্গ করার জন্য টিয়ার গ্যাস, লাঠিচার্জ করতাে আর প্রায়ই রাতে কারফিউ দিত। প্রতিবাদী বাঙালি ছাত্র-ছাত্রীরা পাকিস্তানিদের গুলির আঘাত উপেক্ষা করে, মৃত্যু ভয় তুচ্ছ করে প্রতিবাদে সােচ্চার হয়ে উঠেছিল। মতিঝিলের নবকুমার ইনস্টিটিউটের ছাত্র মতিউর- মাকে শেষ বিদায়ের চিঠি লিখে, শার্টের পকেটে সেই চিঠি নিয়ে মিছিলে এসেছিল- মা আমি মিছিলে যাচ্ছি, যদি কোনাে দিন ফিরে না আসি, তাহলে মনে রেখাে তােমার মতিউর, বাংলা মায়ের জন্য এবং প্রিয় নেতা শেখ মুজিবের জন্য জীবন দিয়ে গেলাে।
ইতি,
মতিউর রহমান।
দশম শ্রেণি
নবকুমার ইনস্টিটিউট
পিতা : আজহার আলী মল্লিক
ন্যাশনাল ব্যাংক কলােনি মতিঝিল,
ঢাকা ।
পাকিস্তানিদের নির্মম বুলেটে ২৪শে জানুয়ারি ১৯৬৯ সালে প্রতিবাদী নিস্পাপ কিশাের মতিউর প্রাণ হারায়। ছাত্রসমাজ নির্ভয়ে মতিউরের লাশ নিয়ে ঢাকার রাজপথে মিছিল বের করে ।
২৯
ছাত্রনেতা আসাদ ও মতিউরের মৃত্যুতে পূর্ব পাকিস্তানের সকল বাঙালির হৃদয়ে দারুণ ভাবাবেগের সৃষ্টি হয়। আসাদের রক্তমাখা শার্ট নিয়ে ছাত্ররা নির্ভয়ে রাজপথে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে মিছিল করে। বাঙালি হৃদয় শােকে বিহ্বল হয়ে পড়ে।
আজও দেশব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের মানুষ- আসাদ, মতিউর ও ‘৬৯-এর অগ্নিঝরা প্রতিটি দিনের আত্মত্যাগী ছাত্রসমাজের সাহসী ভূমিকাকে রক্তের অক্ষরে লেখা অম্লান ইতিহাস হিসেবে গণ্য করে থাকে। সেদিন তাই কবির হৃদয়ও কম্পিত হয়ে উঠেছিল, কবি শামসুর রাহমানের ‘আসাদের শার্ট’ কবিতাটি আজও বাঙালির প্রাণে শক্তি সঞ্চারিত করে ।
‘গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর মতাে কিংবা সূর্যাস্তের
জ্বলন্ত মেঘের মতাে আসাদের শার্ট
উড়ছে হাওয়ায় নীলিমায়।
বােন তার ভায়ের অম্লান শার্টে দিয়েছে লাগিয়ে
নক্ষত্রের মতাে কিছু বােতাম কখনাে
হৃদয়ের সােনালী তন্তুর সূক্ষ্মতায়
বর্ষীয়সী জননী সে-শার্ট।
উঠোনের রৌদ্রে দিয়েছেন মেলে কতদিন স্নেহের বিন্যাসে।
– শামসুর রাহমান
২৪শে জানুয়ারি ১৯৬৯ সারা পূর্ব বাংলায় বিশেষত ঢাকায় ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থানের সৃষ্টি হয়। ছাত্র-ছাত্রী, লক্ষ লক্ষ শ্রমিক, সর্বশ্রেণির মেহনতি জনতা, মধ্যবিত্ত, পেশাজীবী, অফিস কর্মচারী, দোকানকর্মী, ব্যবসায়ী সকল পেশার জনগণ দৃঢ় মনােবল নিয়ে রাজপথে নেমে আসে। ইতােমধ্যে, বাঙালির প্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা আন্দোলনের দাবি রূপান্তরিত হয়েছিল সমগ্র জাতির এক দফার দাবিতে। এমন উত্তাল পরিস্থিতিতে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা জনগণের মধ্যে আরাে তীব্রতর বিপ্লবের আগুন সঞ্চারিত করে। আগরতলা মামলার অভিযুক্তদের মুক্তির দাবিতে ছাত্রসমাজ সােচ্চার আন্দোলন শুরু করে। ‘৬৯ বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসের এক রক্তঝরা সময়। উত্তাল তরঙ্গের মতাে জনতার মাঝে সংবাদটি ছড়িয়ে পড়ল- ‘ক্যান্টনমেন্টের কারাগারে বন্দি অবস্থায় সার্জেন্ট জহুরুল হক ও ফজলুল হককে গুলি করা হয়েছে- এর প্রতিবাদে ঢাকা শহরে সর্বস্তরের মানুষ রাজপথে নেমে পড়ে। ফেব্রুয়ারি মাস, শীতের আবহাওয়া। সন্ধ্যার মধ্যে এলিফ্যান্ট রােডের ‘চিত্রা বাড়ি আত্মীয়-স্বজনে ভরে উঠতে শুরু করে। সমস্ত পরিবার উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় যখন বিপর্যস্ত সেই সময় ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে খবর আসে ‘জহুর ইহলােক ছেড়ে চলে গেছেন। বাঙালির ‘৬৯-এর প্রবল প্রতিবাদের শহরে, এলিফ্যান্ট রােডের চিত্রা বাড়িতে আমিনুল হকের ক্রন্দনের শব্দে সন্ধ্যার বাতাস আরও ভারি ও ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে।
৩০
বড় দাদা মাহবুবুল হক গভীর শােকে পাথরের মতাে চুপচাপ বসেছিলেন। সহােদর ছােট দুই ভাইকে তিনি নিজের কাছে রেখে অতি যত্নে বড় করেছেন। বাবা কাজী মজিবুল হক তখনও বেঁচে আছেন । সমস্ত পরিবেশ বেদনা বিধুর হয়ে ওঠে। মাহবুবল হক বুঝতে পারলেন, এর পরের অধ্যায়টি হবে পাকিস্তানিদের সঙ্গে যুদ্ধ । তিনি ভাবলেন, কীভাবে বনানী থেকে মঞ্জু, মিমি ও ওদের মাকে এলিফ্যান্ট রােডে নিয়ে আসা যায় । এমন সময় চাচাতাে ভাই মােশাররফ হােসেন তার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে কাছে এসে বললেন- বড় দাদা চলেন বনানীর বাসা থেকে বড় ভাবি, মঞ্জু ও মিমিকে এখানে নিয়ে আসি । যে কোনাে সময় পাকিস্তানিরা বাঙালিদের প্রতিবাদে ভয় পেয়ে আবার কারফিউ জারি করে দেবে, তার আগেই মঞ্জু, মিমি ও ভাবিকে এই বাসায় নিয়ে আসি। বাবা ও মােশাররফ চাচা একটি নীল টয়ােটা গাড়ি নিয়ে আমাদেরকে নেওয়ার জন্য বনানী বাড়িতে আসেন। বাড়িতে ভয়ার্ত কোনাে ঘটনা ঘটলে তা শিশুদের মনে ব্যাপক প্রভাব সৃষ্টি করে, অনেক সময় তারা খুব কাঁদে, কখনাে কখনাে কাঁদে না, কিন্তু অনেক সময় চুপ করে থাকে, ভয় পেয়ে যায়, আবার অনেক সময় সেখান থেকে শিশুরা সরে পড়তে চায় । আমার এখনও মনে আছে, জহুরের মৃত্যুর খবর পেয়ে স্টেট ব্যাংক কোয়ার্টারে আমাদের বাসার ওপরতলা, নিচতলাসহ অন্যান্য বাসা থেকে প্রতিবেশীরা নেমে এসে মায়ের সঙ্গে কথা বলছিল । বাবার বন্ধু ইসমাইল হােসেন ও তার স্ত্রী মাহিয়া ইসমাইল মায়ের পাশে এসে বসেছিলেন। মা খুব বিচলিত হয়ে পড়ে- ভাইজান কোথায় কী করছিলেন এখন মনে নেই, শুধু মনে আছে এত লােক দেখে আমি হঠাৎ খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম । ভয় পেয়ে ঘরের এক কোণে লুকিয়ে ছিলাম । তার পরের ঘটনা কিছু মনে নেই । মা পরে বলেছেন- সেই রাতেই আমরা এলিফ্যান্ট রােডের বাসায় চলে গিয়েছিলাম ।
ক্যান্টনমেন্ট থেকে জহুরুল হকের লাশ দেওয়া হবে কি হবে না, তা নিয়ে পাকিস্তান আর্মির অফিসারদের সঙ্গে পরিবারের লােকদের বাগ্‌বিতণ্ডা শুরু হলাে। ক্রমাগত টেলিফোনে আমিনুল হক, মেজর নাসের ও পাকিস্তানি অন্যান্য অফিসারের সঙ্গে কথাবার্তা চলতে থাকে । দেশের অন্যান্য আইনজীবী ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে তিনি যােগাযােগ স্থাপন শুরু করেন, পরিবারের ক্রমাগত চাপে পাকিস্তানিরা মরদেহ প্রদানের বিষয়ে আলাপ-আলােচনা শুরু করে। এদিকে ঢাকার উত্তাল জনস্রোত- ক্যান্টনমেন্টের দিকে অগ্রসর হওয়ার প্রস্তুতি শুরু করেছে । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় অসংখ্য ছাত্র-জনতা কারফিউ উপেক্ষা করে রাস্তায় নেমে স্লোগান দিতে থাকে। জহুরের রক্ত বৃথা যেতে দেব না। ঢাকার বাইরে জেলায় জেলায় প্রতিবাদী জনতা মিছিলে মুখর হয়ে ওঠে। জহুর পরিবারের আত্মীয়-স্বজন এলিফ্যান্ট রােডে চিত্রা বাড়িতে একত্রিত হয়েছে । জহুরের মেজো চাচা অর্থনীতিবিদ ড. মজহারুল হক, ফুপা আব্দুর রশিদ (বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর) ও তাঁর পরিবার, চাচাতাে ভাই মােশারফ হােসেন, বন্ধু
৩১
আব্দুল কুদ্স ও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন এবং রাজনীতিবিদরা সহমর্মিতা জানানাের জন্য এসেছিলেন। এক পর্যায়ে প্রায় মধ্যরাতে তােয়ালে জড়ানাে নিস্তব্ধ-নিথর জহুরের মৃতদেহটি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি গাড়িতে এলিফ্যান্ট রােডের চিত্রা বাড়িতে নিয়ে আসা হলাে।
১৬ই ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ সাল
জহুরের পরিবারের সদস্যদের বিদ্রি রাত্রির পর একসময় ভােরের আলাে ফুটে ওঠল। ১৬ই ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ সাল। জহুরের অমলিন দীপ্ত চেহারা- বরফের চাঁইয়ের ওপরে সাদা কাপড়ে মােড়ানাে মৃতদেহটি শায়িত। বেয়নেটের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত পেট থেকে রক্তক্ষরণ তখনাে থামেনি। পাকিস্তানি সৈন্যরা একটা তােয়ালে দিয়ে পেটটি পেঁচিয়ে দিয়েছিল । এলিফ্যান্ট রােডের চিত্রা বাড়ির পেছনে খেলাঘরের মাঠে কফিনটি রাখা হয়েছিল।
শহিদ সার্জেন্ট জহুরের লাশ দেখার জন্য সেদিন হাজার হাজার মানুষের ঢল নেমেছিল। জহুরের কৌসুলি আইনজীবী বদরুল হায়দার চৌধুরী (পরবর্তী সময়ে বিচারপতি) এলিফ্যান্ট রােডে চিত্রা বাড়িতে আসেন। মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান
৩২
ভাসানী এসেছিলেন। এই ঢাকা শহরে সেদিন মানুষের ঢল নেমেছিল। উন্মুক্ত হয়ে পড়েছিল প্রতিটি ঘরের দরজা। মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ইকবাল হলের নাম পরিবর্তন করে জহুরুল হক হল নামকরণ করে। হাজার হাজার মানুষের আগমনে, মিছিলে মিছিলে ভরে উঠেছিল এলিফ্যান্ট রােড। এ কথা সবার মুখে মুখে প্লেন মসজিদের সন্নিকটে চিত্রা বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে জহুরের লাশ, সেখানে যেতে হবে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শােকাহত ছাত্র-ছাত্রীসহ জনগণ কালাে রঙের ব্যানার নিয়ে একের পর এক মিছিলে মিছিলে চিত্রা বাড়ির পাশের রাস্তাটি দিয়ে খেলাঘরের মাঠে শায়িত জহুরুলকে দেখতে আসছে । মা কোথায় আমার মনে নেই, ভাইজান পাশে, এখনাে মনে পড়ে না আমি কার কোলে ছিলাম । শুধু অবাক-বিহ্বল চোখে ছাদের ওপর থেকে কোনাে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের কোলে বসে দেখেছিলাম হাজার হাজার মানুষের ঢল । দোতলা ছাদের ওপর থেকে দেখেছিলাম বাবা, চাচা, দাদা দাড়িয়ে আছে ছােট চাচার মৃতদেহের কাছে । ১৬ই ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯- জহুরের পরিবারের সদস্যরা কালাে কাপড়ে আচ্ছাদিত কফিনে জহুরের লাশ নিয়ে আজিমপুর কবরস্থানে দাফনের জন্য যাত্রা শুরু করে । জহুরের পরিবারের সঙ্গে একাত্ম হয়ে অসংখ্য ছাত্র-জনতা- জহুরের লাশ নিয়ে কবরস্থান অভিমুখে অগ্রসর হতে থাকে- জনস্রোত একপর্যায়ে মিছিলে পরিণত হয়। সেদিনের মিছিলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের নেত্রী আমেনা বেগম।
৩৩
শুধু সেদিনের যাত্রা নিয়ে একটি কাহিনি হয়
শুধু সেদিনের যাত্রা নিয়ে একটি কাহিনি হয়- অত কথা লিখবাে না, তবে পরিবারের কিছু ছােট ছােট ঘটনার উল্লেখ করবাে। বিচারপতির বাসা থেকে ফুল চুরি করেছিল ছােট ছােট স্কুল-ছাত্ররা জহুরের কবরে দেওয়ার জন্য। উভ্রান্ত পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠীর নির্দেশে পুলিশ ছাত্রদের ওপর গুলি চালায়। জহুরের লাশসহ মিছিল নিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশের গুলি চালানাের খবর কোনাে একজন আত্মীয় চিত্রা বাসায় এসে জানায়। মা ও চাচিমা-বাবা চাচাদের জন্য উৎকণ্ঠায় পাগলের মতাে হয়ে যান। আমার এখনাে ঝাপসা ঝাপসা মনে পড়ে- মায়ের মাথায় ঘন ও কোঁকড়ানাে লম্বা লম্বা চুল ছিল। মা মাথা নিচু করে আছে, সমস্ত চুল এলােমেলাে, শােকে অবিরাম কাঁদছিল । চাচিমাও মায়ের পাশে বসে কাঁদছিল, আর আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে মা ও চাচিমাকে দেখছিলাম।
তৎকালীন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী আমেনা বেগমের নেতৃত্বে সার্জেন্ট জহুরুল হকের লাশ
নিয়ে রাজপথে মিছিল। ১৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৯।
সারা ঢাকা শহর প্রতিবাদে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। এই মিছিল আজিমপুর গােরস্থানের দিকে অগ্রসর হতে থাকলে বিক্ষুব্ধ জনতা মন্ত্রীদের বাড়িতে আগুন দিতে আরম্ভ করে । মন্ত্রীদের বাড়িতে প্রহরারত পুলিশ গুলিবর্ষণ করলে একজনের মৃত্যু হয়। ফলে বিক্ষোভ আরও বৃদ্ধি পায়। এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যে আগুন আব্দুল গনি রােড থেকে আরম্ভ করে মন্ত্রী হাসান আসকারীর পরীবাগস্থ বাড়ি পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষুব্ধ জনতা কনভেনশন মুসলিম লীগের নির্মীয়মাণ অফিস ও রেসকোর্স পুড়িয়ে দেয় ও সরকারি গেস্ট হাউস আক্রমণ করে। এই গেস্ট হাউসে আগরতলা মামলার প্রধান বিচারপতি
৩৪
থাকতেন। তিনি পালিয়ে আত্মরক্ষা করেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার পাকিস্তানি বিচারপতি এস. এ. কাদের স্লিপিং স্যুট পরে, খালি পায়ে ঢাকা এয়ারপাের্টে গিয়ে বাঙালিদের ভয়ে চটজলদি পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যায়। জহুরের বড় ভাই, মেজো ভাই পরিবারের অন্য সদস্যরা, আরও অসংখ্য জনতা, ছাত্ররা জহুরের লাশ নিয়ে আজিমপুর নতুন কবরস্থানে পৌছেন। কবরস্থানটি সেই সময় নতুন নির্মিত হয়েছিল । জহুরের ভাইয়েরা জহুরের জন্য ১ নম্বর কবরের স্থানটি নির্ধারণ করেছিলেন। জহুরের নিষ্প্রাণ দেহটি কবরে নামানাের সময় বড় ভাই মাহবুবল হক অনুভব করলেন, কেউ তাঁর পকেট থেকে মানিব্যাগ নিয়ে যাচ্ছে, মাত্র ১২১ টাকা সঙ্গে ছিল । সেই বিধ্বস্ত সময়ে টাকাটার প্রয়ােজন ছিল। কিন্তু ভাইকে শেষ সজ্জায় শায়িত করতে হবে, চোরকে হাতেনাতে ধরার সময় এখন নেই। জহুরকে দাফন করে নিঃস্ব দুই ভাই এলিফ্যান্ট রােডে ফিরে আসেন। সেখানে পরিবারের লােকেরা উদ্বিগ্ন হয়ে অপেক্ষা করছিল।
প্রতিবাদের শহর ঢাকা
বিকেলের দিকে মাহবুবুল হকের ফুফাতাে ভাই ফারুক বললেন- বড় দাদা আপনাদের আমি বনানী পৌছে দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছি। এখনও মনে পড়ে আমার স্মৃতিপটে এক অদ্ভুত দৃশ্য- ফারুক চাচা গাড়ি নিয়ে যাত্রা শুরু করে। আমাদের প্রতিবেশী ইসমাইল চাচা (মােঃ ইসমাইল হােসেন), বাবার এই সংকটপূর্ণ সময়ে আমাদের সঙ্গে সব সময় ছিলেন। ফারুক চাচার (মাহবুবুর রশিদ) গাড়িটি বিস্কুট রঙের ভক্সওয়াগান, তিনি নিজেই গাড়ি চালাচ্ছিলেন, ইসমাইল চাচা সামনে বসে আছেন। বাবা, মা, ভাইজান পেছনে বসে আছে। আমি এত ছােট গাড়ির মাঝখানের টুলবক্সের ওপর বসেছি। গাড়ি কিছুদূর এগােনাের পর ইসমাইল চাচা চিৎকার করে উঠলেন- গাড়ি ঘােরাও, সামনে আগুন, আমি অবাক হয়ে আগুন দেখলাম। রাস্তার মধ্যে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে, গাড়ি ঘুরিয়ে আবার কিছুদূর যাওয়ার পর দেখা গেল- সেদিকে আরও বেশি আগুন জ্বলছে, গােলাগুলির আওয়াজ হচ্ছে। জহুরের মৃতদেহটি দাফনের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজ প্রতিবাদে সােচ্চার হয়ে ওঠে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে কোনাে প্রকার গ্রাহ্য না করে তাঁরা শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে উত্তাল মিছিল নিয়ে পরিভ্রমণ করে, সেই সঙ্গে বিক্ষুব্ধ জনতা এক হয়ে পাকিস্তানিদের বিভিন্ন অফিস-আদালতে আগুন জ্বালিয়ে দেয় । জনতার মাঝ থেকে হঠাৎ দৌড়ে দু-তিনজন ছেলে গাড়ির কাছে এসে পরিচয় জানতে চাইল বাবার কাছে। বাবা জহুরুল হকের বড় ভাই জানতে পেরে তারা দ্রুত রাস্তা খালি করে দিল। ফারুক চাচা এলিফ্যান্ট রােডের দিকে গাড়ি ঘুরিয়ে নিল- আমরা আবার এলিফ্যান্ট রােডে ফিরে এলাম । সেই রাতে আমাদের আর বনানীর বাড়িতে ফেরা হলাে না। ১৯৬৯ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি শহিদ দিবস ঢাকাসহ সারাদেশে ব্যাপকভাবে উদযাপিত হয় । বিপুলসংখ্যক জনগণের সমাবেশ ঘটে । সভা, মিছিল, অনুষ্ঠান, শহিদ মিনারে শপথ গ্রহণ প্রভৃতি এই দিবসের বিশেষ কর্মসূচি ছিল । সর্বত্র হরতালও পালিত হয়। পাকিস্তান সরকার ২১শে ফেব্রুয়ারিকে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে বাঙালির দাবিকে মেনে নিতে
৩৫
বাধ্য হয়। ৬৯-এর ২১শে ফেব্রুয়ারি পল্টন ময়দানে সর্ববৃহৎ জনসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। প্রায় তিন থেকে চার লাখ মানুষ সমাবেশে উপস্থিত হয়েছিল। ছাত্র-জনতার বিক্ষোভের মুখে ক্ষমতাশালী পাকিস্তানি স্বৈরশাসকরা বাধ্য হয় আগরতলা মামলা তুলে নিতে। ২২শে ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৪ জন অভিযুক্ত ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে মুক্তি লাভ করেন। শুধু ফেরত আসেননি সার্জেন্ট জহুরুল হক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী, সর্বস্তরের জনতা ২৩শে ফেব্রুয়ারি বিশাল সমাবেশে বর্তমান সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে শেখ মুজিবুর রহমানকে সংবর্ধনা জানায়। তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানের জনসমাবেশ কানায় কানায় পূর্ণ, জনসমুদ্রের ঢেউ থেকে মুহুর্মুহু করতালি শােনা যাচ্ছে। তকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তরুণ ছাত্রনেতা সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ডাকসুর ভিপি তােফায়েল আহমেদ উদাত্ত কণ্ঠে বক্তৃতা শুরু করেন। তিনি তাঁর প্রাণের সমস্ত আবেগ দিয়ে, তার প্রাণপ্রিয় নেতাকে ‘তুমি’ বলে সম্বােধন করে বলেন- “প্রিয় নেতা কারাগারে অন্ধকার ফাঁসির কাষ্ঠে তুমি বাংলার মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছে। কারাগারে অন্ধকারে বসে বাঙালি জাতির ছবি তুমি বুকে অঙ্কন করেছে। আমরা বাঙালি জাতি তােমার কাছে ঋণী, কিছুটা হলেও হালকা করতে চাই। ১০ লক্ষ লােক ২০ লক্ষ হাত তুলেছিল। যে নেতা যৌবনে কাটিয়েছে কারাগারে, যে নেতা ফাঁসির কাষ্ঠে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করছেন। সে নেতাকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দিলাম। ইতিহাসের পাতায় ‘৬৯-এর এই দেশপ্রেমী ছাত্রনেতা, ছাত্র-ছাত্রীদের ভূমিকা ও ত্যাগ অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। কিন্তু জাতীয় ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা আজও প্রকৃত মর্যাদায় গ্রন্থিত হয়নি। অনেক উল্লেখযােগ্য ঘটনাই হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের স্মৃতি থেকে। ‘৬৯-এর এই দিনগুলােতে কত যে সজীব প্রাণের আত্মাহুতি ঘটেছে, তা নিয়ে আমাদের। ইতিহাস এখনও দৈন্য- প্রতিটি প্রাণের বলিদান নিয়ে হয়নি উল্লেখযােগ্য রচনা, স্মৃতিস্বারক । ‘৬৯ আমার স্মৃতিতে জহুরের রক্তেরঞ্জিত লেলিহান শিখা। ‘৬৯-এর উত্তাল দিনগুলাে যারা দেখেনি, তাদের জন্য বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের কালজয়ী অধ্যায়টি। অনুধাবন করা কঠিন। সেই অগ্নিঝরা দিনগুলাে অনুভব করার জন্য শহীদ বুদ্ধিজীবী মােফাজ্জল হায়দার চৌধুরী’র ১৯৬৯ সালের অপ্রকাশিত ডায়েরি থেকে কয়েকটি দিনের লেখা উদ্ধৃত করছি । যিনি সম্পর্কে শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হকের চাচা-
১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ ইং/২ ফাল্গুন ১৩৭৫ বাংলা, শুক্রবার আজ আবার হরতাল । Democratic Action com. ও ছাত্রদের যুক্ত উদ্যোগে। পূর্ণ হরতাল হলাে । দুপুরে পল্টনে জনসভা। আমি একবার বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলাম । ছাত্ররা কেউ নেই। আর কোথাও বেরুলাম না। আজ রুনুকে Cantonment-এ মিলিটারি গুলি করল (শনিবার ভােরে)
১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ ইং/৩ ফাল্গুন ১৩৭৫ বাংলা, শনিবার। আজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস হলাে। বিকেলে বসে ২১শে ফেব্রুয়ারির জন্য প্রবন্ধ খানিকটা লিখলাম । সন্ধ্যায় হনুফা বেগম (মিসেস জহিরুল ইসলাম)-কে ও বউকে নিয়ে মিনুদের বাড়ি গেলাম কনে
৩৬
দেখতে । হনুফার ভাইয়ের সঙ্গে মিনুর বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছে। রাত ১:১০টায় দুলাভাই রশীদ সাহেব ফোন করে জানালেন রুনু (Sgt. Zahurul Haque) Cantonment-এ মারা গেছে।
১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ ইং/৪ ফাল্গুন ১৩৭৫ বাংলা, রবিবার আজ ভাের হতেই চা না খেয়ে মনুদের বাসায় গেলাম। সেখানে রুনুর লাশ আনা হয়েছে। দেখলাম। পরে এসে আম্মাকে নিয়ে গেলাম। দুপুর ৩টায় রুনুর নামাজে জানাজা হলাে স্টেডিয়ামে। গেলাম। তারপর ছাত্ররা লাশ নিয়ে গেল দাফন করতে। পথে গােলমাল-গুলি আবার ছাত্র হত্যা। আগুন লাগানাের ঘটনা। সন্ধ্যা ৭টা থেকে আবার Curfew.
১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ ইং/৫ ফাল্গুন ১৩৭৫ বাংলা, সােমবার আজ সকাল ৭টা থেকে ৯টা বাদ দিয়ে সারাদিন Curfew চললাে। সারাদিন ঘরে আটক থাকলাম । লােকের মধ্যে দারুণ উত্তেজনা। ইত্তেফাকের শহীদ সংখ্যার জন্য বাংলা ভাষার শক্তি’ শীর্ষক প্রবন্ধ লিখছি।
১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ ইং/৬ ফাল্গুন ১৩৭৫ বাংলা, মঙ্গলবার শহরে আজও ৭টা থেকে ৯টা বাদ দিয়ে সারাদিন রাত Curfew বাড়িতে আটক । আমি ঘরে বসে ইত্তেফাক ও পরে পাকিস্তান অবজার্ভার-এর জন্য প্রবন্ধ তৈরি করলাম। ও হৈ চৈ এর শব্দ শােনা গেল। আজ রাত রাজশাহীতে গুলি ও ওখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শামসুজ্জোহার মৃত্যুর খবর এলাে। তাতে শহরে প্রবল উত্তেজনা।
১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ ইং/৭ ফাল্গুন ১৩৭৫ বাংলা, বুধবার আজ আমাদের পাড়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সবাই আমরা সমবেত হয়ে গায়েবানা জানাজা পড়লাম ড. শামসুজ্জোহার মৃত্যুতে। পরে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট করার প্রস্তাব পাশ হলােএকটি সভা করে । আজ ১১টা থেকে ৩টা Curfew বিরতি । বিরতির খবর লােকে ঠিক মতাে জানত না বলে অনেকে আগে বেরিয়ে মিলিটারির গুলিতে মারা গেল ।
২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ ইং/৮ ফাল্গুন ১৩৭৫ বাংলা, বৃহস্পতিবার আজ সকাল ৭টা থেকে Curfew বিরতি। আমি বাঙলা আমার মা’ নামে লেখাটা শেষ করে ১০টায় বেরুলাম । ব্যাংকে গিয়ে ২০০ টাকা তুলে নিলাম। তারপর রেডিওটা নিয়ে শান্তিনগর Green Bow-তে গেলাম । ঠিক করে নিলাম । হঠাৎ গুজব রটাল যে ১২টায় Curfew আর অসংখ্য লােক আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে ছুটতে লাগলাে। সন্ধ্যায় আবার রটল যে শেখ মুজিব ছাড়া পেয়েছেন অসংখ্য লােক রাস্তায় বেরুল।
২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ ইং/৯ ফাল্গুন ১৩৭৫ বাংলা, শুক্রবার গতকাল ৫টা থেকে Curfew মাফ। আজ শহীদ দিবস। অসংখ্য লােক খালি পায়ে প্রভাতফেরীতে যােগ দিয়ে আজিমপুর গােরস্থানে ফুল দিতে গেল। আমি ৮:৩০টায় শহীদ মিনার গেলাম। সেখান থেকে ৯টায় বাঙলা একাডেমী গেলাম । আজ সেখানে দারুণ কাণ্ড ঘটে গেল । একাডেমীর ডিরেক্টর কাজী দীন মুহম্মদকে জনতা রবীন্দ্র বিরােধিতা করে যারা, বাঙলা ভাষার শত্রু তারা বলতে বলতে সভা থেকে বার করে দিল। আমি বক্তৃতা করলাম ।
৩৭
২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ ইং/১০ ফাল্গুন ১৩৭৫ বাংলা, শনিবার গতকাল সন্ধ্যায় আয়ুব খান বেতারে ঘােষণা করলেন যে তিনি আগামী নির্বাচনে দাঁড়াবেন না । আজ বেলা ১০টায় ক্লাব ঘরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এক সভায় আগামী ৪ তারিখ পর্যন্ত ধর্মঘট চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হলাে। দুপুরে একবার ও বিকেলে ২ বার অনশন ধর্মঘটকারী ছাত্রদের দেখতে ও অনশন ভাঙাতে গেলাম। আজ শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য রাজনৈতিক আসামী (ষড়যন্ত্র মামলার) সবাই মুক্তি পেলেন । শহরে দারুন উত্তেজনা ও প্রচণ্ড বিজয় উল্লাস।
২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ ইং/১১ ফারুন ১৩৭৫ বাংলা, রবিবার আজ সকাল ৮:৩০টায় বেরিয়ে প্রথমে শেখ মুজিবুর রহমান সাহেবের সঙ্গে দেখা করলাম। পরে আহমদ ফজলুর রহমান C.S.P ও শামসুর রহমান C.S.P এর সঙ্গে দেখা করলাম। এরাও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অভিযুক্ত ছিলেন। পরে যে একজন ফিরে আসেনি (Sgt. Zahurul Huq) সেই রুনুর ভাই মনুদের বাসায় গেলাম । বিকেল ২টায় রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমানের সংবর্ধনা। আমি পরে বেরিয়ে জনসমাগম দেখলাম ।
২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ ইং/১৬ ফাল্গুন ১৩৭৫ বাংলা, শুক্রবার আজ সকালে বাড়িতেই থাকলাম। সৈয়দ আলী আহসান সাহেব এলেন। তাঁর কবিতার কথা ও অন্যান্য বিবেচনা বইটির একটি সংখ্যা আমাকে দিলেন। ইউনুস বউসহ এলাে। বনানীতে সার্জেন্ট জহুরুল হকের জন্য কোরান শরীফ খতম অনুষ্ঠানে গেলাম । ওকে সামরিক প্রহরাধীনে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। সন্ধ্যায় বাসায় এসে দেখি । বউয়ের শরীর খুব খারাপ। পেট ব্যথা বেড়ে গেছে। রাত্রে ডাক্তার ও পরে ডাক্তার (Professor) আনসারীকে ডাকা হলাে। বাচ্চু বুবুরা ও বড় মামারা দেখতে এলেন। পরে ডাক্তার নিয়ে এলেন। ডাক্তার আনসারী Terromycin ইনজেকশন দিতে উপদেশ দিলেন।
৩৮
রক্তভেজা তােয়ালে
১৯৯৬ সাল, এলিফ্যান্ট রােডের চিত্রা বাড়ি থেকে বের হয়ে আমি একটা বেবি ট্যাক্সিতে বসেছি। খিলগাঁও আবাসিক এলাকায় যাবাে বাবার কাছে। বাবা অপেক্ষা করছেন। আমার কোলের ওপর একটা রক্তমাখা শুকনাে তােয়ালে । তার মধ্যে রয়েছে ছােট চাচার কিছু জিনিস । সেই রক্তমাখা তােয়ালেটি ছােট চাচার মৃতদেহের সঙ্গে জড়ানাে অবস্থায় এসেছিল । আমিনুল হক চাচার বাসায় একটি ফলস সিলিংয়ের ওপর ট্রাঙ্কের ভেতরে অনেক কিছুর সঙ্গে তােয়ালেটি ছিল । ১৯৯৫ সালের ১৩ই জুলাই, চাচা (অ্যাটর্নি জেনারেল আমিনুল হক) তার প্রিয় কর্মক্ষেত্র সুপ্রিমকোর্টে কর্মরত অবস্থায় হৃদ্‌যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। তার পর থেকেই ধীরে ধীরে চাচিমা কেমন এক বিষন্নতার জগতে প্রবেশ করতে শুরু করেন, আমি ছােট চাচার স্মৃতিবিজড়িত জিনিসপত্র খুঁজছি শুনে আমাকে ডেকেছিলেন। বলেন, ওখানে কিছু জিনিস আছে, তুই খুঁজে দেখ । ঘরটা আবছা অন্ধকার ছিল । আমি একটি ট্রাঙ্ক খুলে ধীরে ধীরে অনেক কিছু খুঁজে পেলাম । রঙের কৌটা, তুলি, কাঠের তৈরি শিল্পকর্ম। কাঠ মসৃণ করার ফাইলার, চিরুনি, পাকিস্তান এয়ার ফোর্সের সােয়েটার, লং কোট- একটার পর একটা জিনিস বের করতে করতে হঠাৎ সেই রক্তভেজা তােয়ালেটি পেলাম। ছােট চাচার মৃত্যুর পর পশ্চিম পাকিস্তান থেকে দুইটি ট্রাঙ্ক আসে। মেজো চাচা আমিনুল হক সেগুলাে সযত্নে রক্ষা করেছিলেন । আমার মায়ের কাছেও তাঁর স্মৃতি বিজড়িত অনেক জিনিস এখনাে আছে। আজও সেগুলাে সেভাবেই আছে। প্রতিবছর ১৫ই ফেব্রুয়ারি এলেই আমিনুল হক চাচা ছােট ভাই জহুরের জিনিসপত্রগুলাে বের করতেন। ছােটবেলা থেকেই অনেকবার দেখেছি। জহুর ছিলেন খুবই শৌখিন স্বভাবের। ছবি আঁকতেন, কাঠের ভাস্কর্য বানাতেন, ‘৬৫ সালের ভারত ও পাকিস্তানের যুদ্ধে বিধ্বস্ত বিমানের ধ্বংসাবশেষ দিয়ে ছােট ছােট প্লেন বানাতেন।
৪৩
আমি সেই তােয়ালেটি দিয়ে রঙের কৌটা আর তুলিগুলাে জড়িয়ে সযত্নে রেখেছি, সঙ্গে নিয়েছি পাকিস্তান এয়ার ফোর্সের সােয়েটার আর লং কোট। জহুরের জিনিসগুলাে প্রথমে বাবার কাছে নিয়ে যাচ্ছি- ৫, সেগুন বাগিচাস্থ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে দেওয়ার জন্য। তারিকের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু জাদুঘরের ট্রাস্টি ও প্রথম মেম্বার সেক্রেটারি মুক্তিযােদ্ধা আব্দু চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর থেকে প্রায়ই ফোন করতেন। প্রসঙ্গত জহুরুল হকের কথা শােনার পর থেকেই তিনি অনুরােধ করেন জহুরুল হকের স্মৃতিসংবলিত কিছু জিনিসপত্র জাদুঘরে দেওয়ার জন্য, আর সেই কারণে ছােট চাচা শহিদ সার্জেন্ট জহুরুল হকের ব্যবহৃত জিনিসপত্রগুলাে নিয়ে প্রায় ছাব্বিশ বছর পরে আমি যাচ্ছি- এগুলাে আমাদের পরিবারের অমূল্য সম্পদ। দুপুরবেলা, বেশ রৌদ্রকরােজ্জ্বল দিন ছিল, চারদিকে কোলাহল, ঢাকা শহর ব্যস্ত নগরীতে পরিণত হয়েছে। মাঝে মাঝে জ্যামে থেমে থাকছে বেবিট্যাক্সি । চারপাশের ব্যস্ততার ভেতর শক্ত হাতে আমি ধরে আছি একজন বীর যােদ্ধার মৃত্যুর ছাব্বিশ বছর পরে তার ছবি আঁকার রং-তুলি, আর রক্তভেজা তােয়ালে । আমার সমস্ত মন ভারাক্রান্ত, মনের মাঝে ভেসে ওঠে ‘৬৯-এর রােজার ঈদ-পরবর্তী একটি দিনের কথা- জহুরুলকে দেখার জন্য বাবা, মা, মেজো চাচা, চাচিমা, ভাইজান ও আমি গিয়েছিলাম ঢাকা ক্যান্টনমেন্টেযেখানে আগরতলা মামলায় অভিযুক্তদের বন্দি করে রাখা হয়েছে।
মা ও চাচিমা অনেক খাওয়াদাওয়া রান্না করে সঙ্গে নিয়েছিলেন, অন্য অভিযুক্তরাও যাতে খেতে পারেন । এবার আমি মায়ের কাছে এই সব কথা শুনেছি- যা মুখস্তের মতাে স্মৃতির পাতায় রয়েছে। তেমন কিছু আর মনে পড়ে না, কিন্তু দু-একটি দৃশ্য ঝাপসা ঝাপসা ভেসে ওঠে।
৪৪
ছােট চাচা জহুরুল অসাধারণ কবিতা আবৃত্তি করতেন। মা বলেছিল, সেই দিন তিনি কাজী নজরুলের কারার ঐ লৌহ কপাট’ আবৃত্তি করেছিলেন। ঈদের জন্য আমরা যে আসবাে তিনি তা আগে থেকেই জানতেন। কীভাবে যেন চকোলেট সংগ্রহ করেছিলেন ।
আমি চকোলেট খেতে খেতে সারা মুখ-হাত ভরিয়ে ফেলি, জহুরুল তা দেখতে পেয়ে আমাকে কোলে করে ঘরের বাইরে বারান্দায় রাখা বালতির কাছে গিয়ে বসেন। অভিযুক্তদের ব্যবহারের জন্য টিনের বালতিতে পানি রাখা থাকত। ছােট চাচা আমাকে কোলে নিয়ে সযত্নে মুখটি ধুইয়ে দিয়েছিলেন। এমন সময় একজন পাকিস্তানি এমপি এসে দাঁড়ান। বােধকরি ক্ষণিকের জন্য তার হৃদয়ে পরিবারের কথা মনে পড়ে যায়। এমপি। জহুরকে প্রশ্ন করেন, কে এই বাচ্চাটি? যাকে তুমি এত যত্ন করে মুখ ধুইয়ে দিচ্ছাে? আমাকে কোলে নিয়ে জহুর উঠে দাঁড়ান । তিনি আমাকে শক্ত করে ধরে বলেছিলেন, আমার খুব প্রিয় বাচ্চা। বড় ভাইয়ের মেয়ে। পাকিস্তানি এমপিটির কী ভাবাবেগ সৃষ্টি হয়েছিল আমি জানি না, তিনি তাঁর মাথা থেকে টুপিটি খুলে তাঁর পদবির সবুজ পালকটি খুলে আমার মাথায় পরিয়ে দেন। ছােট চাচা সেই যে আমাকে সজোরে স্নেহের আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরেছিলেন, তার থেকে আমি কোনাে দিন মুক্ত হতে চাই না। হঠাৎ খেয়াল করলাম, বেবিট্যাক্সি খিলগাঁও এসে পৌঁছেছে।
৪৫
বাবা জানতেন আমি আসবাে, দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন। আমি বুঝলাম তার উদ্বেগ, আমি ছােট চাচার জিনিস নিয়ে আসছি। বাবা সিড়ি দিয়ে নেমে হেঁটে এসে কাছে দাঁড়ালেন। আমি তােয়ালে জড়ানাে জিনিসপত্রগুলাে তার হাতে দিলাম । বাবা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠলেন। প্রায় ২৬ বছর পরে আবার ভাইয়ের জিনিস হাতে নিয়ে তার মতাে স্থির মানুষ, ভেতরের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে কেঁদে উঠলেন। স্বাধীনতাযুদ্ধে যাদের ভাই, বােন মারা গেছেন তারা জানেন এই কষ্ট কত বেদনার।
৪৭
১৯৬৮ সালের একটি সন্ধ্যা
তারিখটা আমার মনে নাই। বাবা, মেজো চাচা কেউ আজ আর বেঁচে নাই, মাও মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন । তারিখটা জেনে নেব সে কথা বলার মতাে আর কাউকে পাচ্ছি না। শুধু মনে হচ্ছে ১৯৬৮ সালের একটি সন্ধ্যার কথা । ঐ সন্ধ্যায় আমরা এলিফ্যান্ট রােডে আমিনুল হক চাচার বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলাম। এলিফ্যান্ট রােডে প্লেনওয়ালা মসজিদের একটু সামনে চিত্রা বাড়িটি এখনও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি খুব ছােট ছিলাম । মা-বাবার কাছে অনেক শুনেছি, দুইজন লােক এসে ছােট গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আমাদের ডেকেছিল, পরে জেনেছি চাচা তাদের চেম্বারে নিয়ে বসান, বাবাও সেখানে ছিলেন। লােক দুটি ছিলেন পাকিস্তানি, ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে তাদের পােস্টিং হয়েছে। তারা দুজনেই জহুরের পূর্বপরিচিত। ছােট চাচা জহুর তাদের হাতে ছােট একটা চিঠি পাঠিয়েছেন । চিঠিতে লিখেছেন- তাকে পাকিস্তান থেকে বন্দি করে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে আসা হয়েছে। তাঁর জন্য কোনাে প্রকার চিন্তা না করতে। সম্ভব হলে একটি মশারি দিতে। লােক দুটি জানালেন, সেখানে খুব মশা। জহুরের জন্য একটি মশারি নিয়ে তারা দ্রুত চলে যাবেন। অনুরােধ করলেন, তারা যে এখানে এসেছেন এই বিষয়টি গােপন রাখার জন্য।
জহুরের প্রতি বন্ধুত্বস্বরূপ এই খবরটি তারা পরিবারের কাছে পৌছে দিল । লােক দুইজন চলে যাওয়ার পর বাবা, চাচা কান্নায় ভেঙে পড়লেন। মা আর চাচিমা বিচলিত হয়ে পড়লেন। বাবা বুঝতে পারলেন, কেন তার পাঠানাে চিঠি ফেরত এসেছে। ১৯৬৮ সালের ২৫শে মার্চে সার্জেন্ট জহুর (ডাক নাম রুনু) মেজো দাদার কাছে চিঠি লেখেন-
এই চিঠিতে রুনু মেজো দাদাকে তার জন্য একটি চাকরি খোঁজার অনুরােধ করেছিলেন। সেই চিঠির সূত্র ধরে মাহবুবল হক ছােট ভাই রুনুর কাছে একটি রেজিস্টার্ড চিঠি পাঠান। কিন্তু সেই চিঠিটা ফেরত আসে এবং সেই থেকে বড় দুই ভাই ও পরিবারের সঙ্গে রুনু অর্থাৎ জহুরের যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ছােট ভাইয়ের কোনাে খোঁজই তারা কয়েক মাস ধরে পাচ্ছিলেন না। সেদিন সন্ধ্যায় তাঁর গ্রেফতার হওয়ার কথা শুনে পুরা পরিবার।
৫১
হতাশায় ভেঙে পড়ে। এখন তারা কী করবে? আমিনুল হক তরুণ আইনজীবী হিসেবে ইতােমধ্যে সিনিয়রদের কাছে প্রিয় পাত্র হয়ে উঠেছেন। তিনি পাগলের মতাে বিভিন্ন জায়গায় দৌড়াদৌড়ি শুরু করেন। কীভাবে অফিশিয়াল খবর নেওয়া যায়, কীভাবে ক্যান্টনমেন্টে যাওয়া যায় ।
৫২
ছােট ভাই জহুরের সন্ধানে ভাইয়েরা
আমরা তখন বনানীতে থাকতাম, সেই সময় বনানী ছিল সবুজ গাছপালাসমৃদ্ধ প্রকৃত বনানীর মতােই, চারদিকে অসংখ্য গাছপালা- প্রাকৃতিক সবুজে ঘেরা একটি এলাকাখুব কম বাড়িঘর, স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানে যারা চাকরি করতেন তারা স্টেট ব্যাংক কোয়ার্টারে থাকতেন। কোনাে বাউন্ডারি দেয়াল ছিল না, ৫/৪ নং বাড়িটির সামনে বড় মাঠ- একটি বড় শিমুলগাছ। আর তার সামনে আজকের বনানীর প্রধান সড়ক কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউ ।
মা প্রতিদিন রাতে ৫/৪ নং বাড়ির দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাবার জন্য অপেক্ষা করতেন, মাঝে মাঝে একটি-দুটি বাস আসে- এই বুঝি বাবা আসবেন। কখনও দূর থেকে দেখা যেত দীর্ঘদেহী বাবা হেঁটে আসছেন, প্রতিদিন ব্যাংকের কাজ সেরে বাবা এলিফ্যান্ট রােডে যেতেন, দুই ভাই মিলে আলােচনা করতেন কীভাবে ছােট ভাই রুনুকে খুঁজে বের করা যায়। কীভাবে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে মামলা করা যায়।
১৯৫৬ সালে আমিনুল হক ও সার্জেন্ট জহুরুল হক একই সঙ্গে পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে যােগদান করার জন্য পরীক্ষা দিয়েছিলেন। মেজো ভাই আমিনুল হক কমিশন র্যাংকে চান্স পান এবং জিডি পাইলট হিসেবে প্রশিক্ষণ শুরু করেন, ছােট ভাই জহুর নন-কমিশনড র্যাঙ্কে চান্স পান।
বাবা অর্থাৎ তাদের বড় দাদা জহুরকে অনুরােধ করেছিলেন আবার পরীক্ষা দিয়ে কমিশন র্যাংকে যােগদানের জন্য। সেই সময় দাদা কাজী মুজিবুল হক বেশির ভাগ সময় হাতিয়া, সন্দ্বীপ থাকতেন। তিনি ছিলেন- ফুড ইন্সপেক্টর- অত্যন্ত সৎ হিসেবে তাঁর সুনাম ছিল।
জহুর স্পষ্ট ভাষায় বড় দাদাকে জানান, তিনি বড় দাদার ওপর আর ভার দিতে চান না। তিনি স্বাবলম্বী হতে চান, আর সেই কারণেই নন-কমিশনড রাঙ্কে যােগদান করে পাকিস্তানে চলে যান এবং বড় দাদাকে বলেন- তুমি আমার জন্য চিন্তা কোরাে না, তােমার ওপর পরিবারের অনেক দায়িত্ব রয়েছে । তুমি মাকে দেখাে।
তিনি আরাে বলেন- পরবর্তী সময়ে আমি বিমানবাহিনীর অভ্যন্তরীণ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কমিশন র্যাঙ্কে চলে যাব । তুমি আমার জন্য এত চিন্তা কোরাে না। তখনও আমার বাবার বিয়ে হয়নি, অনেক পরে মা-বাবার কাছে শুনেছি, ১৯৫৮ সালে একটি ভয়াবহ খবর বাড়িতে আসে আর সেই থেকেই আমাদের বাড়িতে যুদ্ধের শুরু। একজন দক্ষ আইনজীবী হিসেবে আমিনুল হককে দেশব্যাপী অনেক মানুষ চিনতেন, তারা অনেকেই জানেন না, পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে তার নামে কোর্ট মার্শাল হয়েছিল, বিমানবাহিনীতে জিডি পাইলট ট্রেনিং শেষে আমিনুল হককে ‘বন্ড সই’ দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে পাকিস্তানিদের সঙ্গে তার ঝগড়া-বিবাদ শুরু হয়ে যায়। একসময় তিনি পাকিস্তানিদের ঔদ্ধত্যপূর্ণ ব্যবহারে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন এবং কোনােমতেই নতি স্বীকার করতে রাজি হন। নাই, তখন তার বিরুদ্ধে কোর্ট মার্শাল হয়ে যায় ।
পাকিস্তান বিমানবাহিনীর সঙ্গে ঝগড়ার মূল কারণ হলাে বিমানবাহিনীর ট্রেনিং শেষে কাজে যােগদানের ফর্মে যে বাক্যটি লেখা ছিল তা হলাে I will serve Pak. A.E. at
৫৬
the peril of my life, but Aminul Huq had cut the word “Peril” one then signed, it was the real cause of quarrel.
১৯৫৮ সালে বাবা করাচি গিয়ে মেজো চাচা আমিনুল হককে বিমানবাহিনীর চাকরি থেকে ইস্তফা দেয়ার পর ফিরত নিয়ে আসেন।
১৯৬০ সালের ২৭শে মে বাবা-মায়ের বিয়ে হয়, মায়ের সঙ্গে মেজো চাচা আমিনুল হকের অত্যন্ত মধুর সম্পর্ক ছিল। তখন আমিনুল হক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ থেকে পাস করে বার-এট-ল শেষ করেছেন ।
১৯৬৯-এর কোনাে এক সন্ধ্যায় আমার বাবা আবার বুঝতে পারলেন যে, তাঁর ছােট ভাই রুনু (জহুর) পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে নিশ্চয়ই ন্যায্য কোনাে বিষয়ে প্রতিবাদ করেছে, যে কারণে পাকিস্তানিরা তাকে গ্রেফতার করেছে। আর সে কারণেই জহুরকে লেখা তার রেজিস্ট্রি করা চিঠিটা ফিরত এসেছে।
বাবা মাহবুবল হক ছােট ভাইয়ের চিন্তায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। আমিনুল হক ক্রমাগত বিভিন্ন জায়গা থেকে তথ্য সংগ্রহ করে জানতে পারলেন পাকিস্তানিরা একটি কঠিন মামলা দায়ের করবে বাঙালিদের বিরুদ্ধে। রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্যরা ইংরেজিতে ‘State vs. Sheikh Mujibur Rahman and others.’
উল্লিখিত নামটি আমি অনেক পরে জেনেছি, দীর্ঘদিন সমস্ত দেশবাসীর মতাে আমিও জানতাম, ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’। ছােটবেলা থেকে বাবা-চাচার কাছ থেকে শুনেছিলাম, জহুরুল হক (ছােট চাচা) দেশ স্বাধীন করার জন্য একটা আন্দোলনে যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন ।
স্বৈরাচারী আইয়ুব খানকে উৎখাত করার জন্য আন্দোলন করেছিলেন । কিন্তু তখন এত ছােট ছিলাম যে এসব কিছু বুঝতে পারতাম না । ভাইজান সামান্য একটু বড় ছিল- কিছু কিছু বুঝতে পারত, কিন্তু আমি খুব ডানপিটে ছিলাম, সারাদিন খেলাধুলায় মেতে থাকতাম। মায়ের বয়সও কম ছিল, এইসব আলােচনা বেশি করতে চাইতেন না, শুধু বলতেন- এত যুদ্ধ, এত রক্ত দেখেছি আর দেখতে চাই না।
৫৭
১৯৭০ সাল : বাঙালির নির্বাচন
১৯৭০ সাল আমার স্মৃতি থেকে বিস্মৃত- সত্যি বলতে কী, আমার তেমন কিছু মনে নাই। ছােট ছােট দুই-একটি ঘটনা স্মৃতির পাতায় রয়েছে। অনেক পরে জেনেছিলান বাঙালির বিজয়ের বছর। ১৯৭০-এ ঐতিহাসিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে পূর্ব বাংলার ১৬২টি আসনের মধ্যে ১৬০টি এবং মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত ৭টি আসনে- অর্থাৎ মােট ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে জয়লাভের মাধ্যমে বাংলার জনগণের নিরঙ্কুশ ম্যান্ডেট লাভ করে, যা পাকিস্তানিরা কোনােমতে মানতে পারেনি। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে একত্রিত হয়ে বাঙালি জাতি পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ব্যালটের মাধ্যমে তাদের রায় জানিয়েছিল।

নির্বাচনের আগে ছাত্ররা প্রায়সময় মিছিল বের করত, প্রতিবাদে মুখর হয়ে তারা মাঝে মাঝে মশাল মিছিল করত । একদিন সন্ধ্যার সময় হঠাৎ ভাইজান বারান্দা থেকে দৌড়ে ঘরের ভেতরে এসে আমাদের বলল, বনানীর বড় রাস্তার শেষ মাথা থেকে একটা মশাল মিছিল আসছে। আমরা তখন বনানী স্টেট ব্যাংকের কোয়ার্টারে থাকতাম- সামনে কোনাে বাউন্ডারি দেয়াল ছিল না। বাসার সামনে বড় একটা মাঠ ছিল, একটা শিমুলগাছ,
৬১
আরাে কিছু গাছপালা ছিল। রাস্তায় খুব কম খাম্বার ল্যাম্পপােস্ট ছিল। আমরা সবাই দৌড়ে বারান্দায় আসলাম, এখনাে মনে আছে মশাল মিছিলটি স্লোগান দিতে দিতে রাস্তার মাঝখানে এসে থামল । মিছিলের কোনাে একজন ছাত্রনেতা সার্জেন্ট জহুরুল হকের কথা জানতেন। তিনি দেখালেন- এখানে জহুরুল হকের বড় ভাই মাহবুবল হক থাকেন। মিছিলটি স্লোগান দিতে দিতে ধীরে ধীরে আমাদের বাসার নিচে দাঁড়াল। বাবা নিচে নেমে ছাত্রনেতাদের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বললেন। এরপর মিছিলটি স্লোগান দিতে দিতে পথ চলা শুরু করল । এখনাে মনে পড়ে, উত্তাল সত্তরের বাঙালি তরুণ ছাত্রদের মশাল মিছিলের প্রজ্বলিত আগুনের আভা- যা আমার স্মৃতিপটে চিরজাগরূক হয়ে আছে। ১৯৭০ সাল ছিল ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের বছর। প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। বাংলার উপকূলীয় সমস্ত অঞ্চল ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়। লক্ষ লক্ষ মানুষ হারায় তাদের ঘরবাড়ি, কৃষিক্ষেত, গবাদি পশু আর আপনজন । আমার এখনও ঝাপসা-ঝাপসা মনে আছে, ঘূর্ণিঝড়ের প্রবল বাতাসে বনানী বাসার জানালাগুলাে থরথর করে কাঁপছে। মা আমাকে আর ভাইজানকে নিয়ে বিছানায় বসেছিল, সেই সঙ্গে ছিল আমাদের প্রিয় দুই দিনের ছােট বােন মােনামী হক (রেশমী)। ১০ই নভেম্বর ১৯৭০ রেশমী মানিকের জন্ম হয়। ১২ই নভেম্বর আসে প্রবল ঘূর্ণিঝড় । প্রবল বাতাসের কম্পন শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পরে বাবা স্টেট ব্যাংকের অফিস থেকে বনানীর বাসায় ফিরে আসেন, ঝাবিক্ষুব্ধ সেদিনও তিনি দায়িত্বের সঙ্গে ব্যাংকের নির্ধারিত কাজ করেছিলেন। প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে সমগ্র বাংলার উপকূলবর্তী অঞ্চল তছনছ হয়ে যায়, তথাপি অকুতােভয় বাঙালি ভয় না পেয়ে একে অপরের পাশে দেশপ্রেম আর ভ্রাতৃত্ববােধ নিয়ে এগিয়ে আসে। ১৯৭০-এর ঘূর্ণিঝড় একদিকে যেমন বিক্ষুব্ধ প্রকৃতির রূপ, তেমনি বাঙালি জাতি মর্মে মর্মে বুঝতে পারে তাদের হৃদয়ের ভেতরেও জ্বলছে আরাে প্রবল একটি ঝড়। বাঙালি জাতি অনুভব করে স্বাধীনতার আগমন বার্তা।
৬২
মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১- রক্তঝরা মার্চ
৭ই মার্চ ১৯৭১ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর বাঙালি জাতি মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে যায় । লক্ষ লক্ষ জনতার সামনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলিষ্ঠ কণ্ঠে স্বাধীনতার ঘােষণা দেন- ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
পাকিস্তানিরা ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ মধ্যরাতে ঘুমন্ত শহর ঢাকায় অপারেশন সার্চলাইট শুরু করে। পৃথিবীর ইতিহাসে জঘন্যতম গণহত্যা সংঘটিত হয় । এখনাে মনে আছে, বাবা-মা আমাদের ডেকে ঘুম থেকে উঠিয়েছিলেন, আমি বারবার ঘুমে ঢলে পড়ছিলাম । ভাইজান বলছে- যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে । বাবা বিছানা থেকে গদিটা টেনে মাটিতে নামিয়েছিল, আমরা তার ওপর জড়ােসড়াে হয়ে বসেছিলাম। ক্রমাগত কামানের শব্দ, গুড়ম-গুড়ুম শব্দ, অবিরাম গােলাগুলির শব্দ হচ্ছিল। বনানী তখনও খুব কম বসতিপূর্ণ খালি এলাকা ছিল। বাড়িঘর তেমন কিছু ছিল।
৬৫
না।বনানীতে স্টেট ব্যাংক কোয়ার্টারের সামনে বিস্তীর্ণ জায়গাজুড়ে ছিল সবুজ গাছপালা, সবুজ মাঠ । অসংখ্য তালগাছ, আমগাছ ও কাঁঠালগাছ, এ ছাড়া নানা জাতীয় গাছপালার সমারােহ। এমনকি নানা প্রকার ছােট ছােট জীবজন্তুও ছিল। সন্ধ্যা হওয়ার পর শিয়াল, নেড়ি কুকুর, বেজি, সজারু ও সাপ-খােপের ভয়ে মানুষ রাস্তায় কম চলাচল করত। সন্ধ্যার পর তক্ষ (সাপ) ঘরে ঢুকে যেত। গাড়ির সংখ্যাও ছিল খুব কম। আমাদের বনানীর বাসা থেকে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যেত। সে সময় বনানী বাসার তিনতলার ছাদে উঠলে মহাখালী পর্যন্ত দেখা যেত। ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানিদের কামানের গােলার আগুনের আভায় সমস্ত আকাশটা লালচে হয়ে যায় । ভােরের দিকে কালাে ধোয়া কুণ্ডলি পাকিয়ে আকাশের ওপরের দিকে উঠছিল। বাবা-মা বুঝতে পারছিলেন, সমস্ত ঢাকা শহরের ওপর পাকিস্তানিরা নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। খুব সকালে ওপরতলা থেকে মাে. ইসমাইল হােসেন চাচা বাবার কাছে আসেন।
দেশের ভয়াবহ পরিস্থিতি দেখে বলেন- হক সাহেব, পাকিস্তানিরা বাঙালিদের ওপর গণহত্যা শুরু করেছে। এখন দেশের অবস্থা খুব দ্রুত খারাপ হয়ে যাবে, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। এমন অবস্থায় কী করা যায়, এখানে থাকা নিরাপদ হবে না। ইতােমধ্যে আরাে ঘণ্টাখানেক আগে ব্যাংক কলােনির কিছু পরিবার পায়ে হেঁটে বাড়া দিয়ে নৌকা করে গ্রামের দিকে চলে গেছে। আপনি কী চিন্তা করছেন, মঞ্জুর মা ও বাচ্চাদের নিয়ে কী করবেন? বাবা বললেন- রেশমী খুব ছােট, তা ছাড়া মিমিদের অসুস্থ বড়মা আছেন । অর্থাৎ বাবার দাদি তখন আমাদের সঙ্গে ছিলেন। ওনার অনেক বয়স। তাই বাবা বললেন- এমন অবস্থায় বাসা ছেড়ে কোথাও যাওয়া যাবে না।
৬৬
২৬ ও ২৭শে মার্চের কথা আমার মনে নাই। শুধু মনে আছে, সবাই ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে দরজা-জানালা বন্ধ করে ঘরের মধ্যে ছিল। কিন্তু এর দুই দিন পরে একটি ভয়ংকর ঘটনা। ঘটে বনানীতে, ঘটনাটি এখনও স্মৃতির পাতায় জ্বলজ্বল করছে। হঠাৎ মা বলল, সামনের বড় রাস্তায় কিছু একটা হচ্ছে। সেই সময় মা সামনের বারান্দায় যাওয়ার দরজা একদম বন্ধ করে দিয়েছিল। বারান্দার দরজাটা হুরকা দিয়ে বাবা বন্ধ করে রাখত । আমরা একটু পর্দা সরিয়ে দেখলাম, একজন পাকিস্তানি সৈন্য আমাদের বাসার সামনের বড় রাস্তায়, অর্থাৎ বনানীর রাস্তার মাঝখানে গাড়ি থামাচ্ছে। সেই সময় বনানীর রাস্তায় বর্তমানের তুলনায় গাড়ির সংখ্যা ছিল খুবই কম, তার ওপর যুদ্ধকালীন অবস্থা। কিন্তু ইতােমধ্যে দু-চারটি গাড়ি আসায় পাকিস্তানি আর্মিটি গাড়িগুলাে থামিয়ে আরােহীদের গাড়ি থেকে নামাচ্ছে, বাবা জানালা দিয়ে ঘটনাটি দেখে উত্তেজিত হয়ে পড়েন। বারান্দার দরজা খুলে নিচু হয়ে বারান্দায় বসেন। আমি আর ভাইজানও তার সঙ্গে বারান্দায় নিচু হয়ে বসি, বারান্দার রেলিংটা ছিল সিমেন্টের । কিন্তু কোথাও কোথাও ফাঁকা ছিল তা দিয়ে বাইরে দেখা যায় । এখনাে মনে আছে, বারান্দার জালি দিয়ে আমরা দেখছি। পাকিস্তানি সৈন্যটির বেপরােয়া আচরণ, সে গাড়ি থেকে বাঙালি আরােহীদের নামিয়ে সবাইকে হাত উঁচু করে দাঁড় করিয়েছে। প্রত্যেকের পকেট থেকে টাকা-পয়সা ও হাতের ঘড়ি নিয়ে গাড়ির সামনে জমা করছে । রাইফেলের বাট দিয়ে বাঙালিদের মারধর করছে । বেশ কয়েকজন বাঙালিকে সে মাটিতে নীলডাউন করাল। এমন সময় একটি গাড়ি দৃশ্যমান হয়, সৈন্যটি সেই গাড়িটিকেও বাঁশি বাজিয়ে থামাল। গাড়িতে ছিল দুইজন বিদেশি নাগরিক, সে সময় বনানী সংলগ্ন গুলশানে বেশ কিছুসংখ্যক বিদেশি নাগরিক বসবাস করত। সৈন্যটি তাদের সঙ্গে অত্যন্ত দুর্ব্যবহার করে, তাদেরও গাড়ি থেকে নামিয়ে হাত উঁচু করে দাঁড় করাল। তারা কিছু বলার চেষ্টা করলেন, ক্ষিপ্ত সৈন্যটি রাইফেলের বাট দিয়ে তাদের সজোরে আঘাত করল। ভাইজান আমাকে ফিসফিস করে বললেন, পাকিস্তানি সৈন্যটির কাছে রাইফেল আর ম্যাগজিনভর্তি গুলি ছিল । সমস্ত পরিবেশ ক্রমে ভয়ার্ত হয়ে ওঠল। এদিকে কোয়ার্টারের মধ্যে লােকজন অস্থির হয়ে পড়ল, ঘরের ভেতরে তারা প্রত্যেকে পরিবার-পরিজন নিয়ে আতঙ্কিত। পরিবারের লােকজন রেখে কেউ নিচে নামতে সাহস করল না। পাকিস্তানি সৈন্যটির হাতে রাইফেল ছিল, সে যে-কোনাে মুহূর্তে গুলি করা শুরু করতে পারে । এছাড়া তার হাতে ওয়াকিটকিও ছিল, সে চাইলে তার দলের আরাে সৈন্য ডাকতে পারে । কিন্তু বাঙালিরা থেমে থাকার মতাে নয়- আর ধৈর্য রাখতে পারছে না। এরই মধ্যে দু-তিনজন তরুণ বাবা-মায়ের কথা উপেক্ষা করে বাসা থেকে নেমে ধীরে ধীরে কোয়ার্টারের সামনে গাছপালার কোনায় কোনায় অবস্থান নিল। বনানী সড়কের মাঝখানে একজন পাকিস্তানি সৈন্য পথচারী আর গাড়ির আরােহীদের ওপর অত্যাচার করছে খবরটি ব্যাংক কোয়ার্টারের পেছনে অবস্থিত কাস্টমস কোয়ার্টারে পৌছে গেল। নবারুণ ক্লাবের দু-তিনজন সাহসী তরুণ বড় রাস্তা ঘেঁষে গাছপালার আড়ালে অবস্থান। নিল। পাকিস্তানি সৈন্যটি একাই অস্ত্র হাতে বড় রাস্তাসহ সমস্ত এলাকায় ভয়ার্ত অবস্থার সৃষ্টি করল ।
৬৭
রাস্তায় যেসব বাঙালিকে পাকিস্তানি সৈন্যটি নীলডাউন করিয়েছিল, তাদের কিছুক্ষণ পরপর হাতের বেল্ট ও রাইফেলের বাঁট দিয়ে মারধর করতে থাকে। এমনকি বুট দিয়ে লাথিও মারে। তরুণ বাঙালি ছেলেরা খালি হাতে ছিল, তাই তারা কী করবে বুঝতে পারছিল না, তবুও তারা ইট-পাটকেল সংগ্রহ করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছিল, কীভাবে পাকিস্তানি সৈন্যটিকে আক্রমণ করা যায়। বনানী ব্যাংক কোয়ার্টার থেকে সবাই উত্তেজনার সঙ্গে ঘটনাটি দেখছেন। এমন সময় ঘটনার মােড় ঘুরে দাঁড়াল, হঠাৎ আমরা দেখতে পেলাম কাকলীর মােড় থেকে একটি গাড়ি দ্রুত এগিয়ে আসছে। হালকা নীল রঙের টয়ােটা গাড়িটি সকলের পরিচিত । সেই সময় বনানী-গুলশানের সবাই গাড়িটি চিনত। নায়করাজ রাজ্জাকের গাড়ি। বাঙালির হৃদয়ের নায়ক রাজ্জাক গাড়ি চালিয়ে ঘটনার কাছাকাছি পৌঁছেন। তিনি বুঝতে পারেন, এখানে পরিস্থিতি খারাপ, কিছু একটা সংঘটিত হচ্ছে। পাকিস্তানি সৈন্যটি তাকে চিনত না। বাঁশি বাজিয়ে তাকে সতর্ক করে গাড়ি থামাতে বলে । সেই সময় বনানী-গুলশানে খুব অল্প কিছু ব্যক্তিগত বাড়ি-ঘর ছিল। রাজ্জাকের বাড়িটি ছিল গুলশান ২ নম্বর পানির ট্যাঙ্কির পেছন দিকে । তিনি সম্ভবত FDC থেকে বাড়ি ফিরছিলেন। রাজ্জাক ছিলেন দেশপ্রেমিক বাঙালি, মুহূর্তের মধ্যে তিনি বুঝতে পারলেন এখানে পাকিস্তানি সৈন্যটি একাই ত্রাসের রাজত্ব চালাচ্ছে, রাস্তায় চলাচলরত বাঙালি আরােহীদের ওপর অমানবিক অত্যাচার করছে। রাগান্বিত সৈন্যটি আবার তীব্র জোরে রাজ্জাকের উদ্দেশে বাঁশি বাজিয়ে ইশারায় গাড়ি থেকে নামতে বলে। সে রাজ্জাকের গাড়ি থেকে ১২-১৩ গজ দূরে ছিল ।
৬৮
ইতােমধ্যে প্রায় ৫০ গজজুড়ে তার অত্যাচারের স্থানটি তৈরি হয়েছে। হঠাৎ সে বুঝতে পারে বনানীর অপর দিক থেকে আরও একটি গাড়ি এসে রাস্তা clear করার জন্য হর্ন দিচ্ছে। ক্ষিপ্ত সৈন্যটি বাঁশি বাজিয়ে নির্দেশ দেয় সেই গাড়িটিকেও থামার জন্য। গাড়িটিতে দুইজন বিদেশি আরােহী ছিল। পাকিস্তানি সৈন্যটি ভেবেছিল দুর্বল বাঙালির ওপর গত দুই দিন থেকে তারা কামানের আঘাত হেনেছে। ইতােমধ্যে অসংখ্য বাঙালির প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। এখন যারা বেঁচে আছে, তারা কোনাে টু শব্দটি করতে পারবে না। অকুতােভয় বাঙালিদের পাকিস্তানিরা চিনতে ভুল করেছিল। নায়করাজ রাজ্জাক গাছের আড়ালে লুকানাে বাঙালি তরুণদের ইশারা দেখতে পেলেন, সেই সঙ্গে তিনি রাস্তায় নির্যাতিত বাঙালিদের চেহারা দেখে মুহূর্তের মধ্যে বিদেশিদের হাত নেড়ে ইশারা করে এক অভাবনীয় ঘটনার সৃষ্টি করেন। তিনি মুহূর্তের মধ্যে অত্যন্ত ক্ষিপ্র গতিতে গাড়ি চালিয়ে সজোরে পাকিস্তানি সৈন্যটিকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দ্রুত গাড়ি চালিয়ে চলে যান। তার গাড়ির আঘাতে পাকিস্তানিটির হাত থেকে রাইফেলটি ছিটকে পড়ে এবং সেও মাটিতে পড়ে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যে সে আবার উঠে দাঁড়ানাের চেষ্টা করে। অপর পাশ থেকে আগত বিদেশি দু’জন দ্রুততার সঙ্গে গাড়ি চালিয়ে আবার তাকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দেয় । বিদেশিরা গাড়ি থেকে অন্য বিদেশিদের ইশারা করে দ্রুততার সঙ্গে চলে যায়। এভাবে দু-দুবার গাড়ির প্রচণ্ড আঘাতে পাকিস্তানি সৈন্যটি মাটিতে মুখ। থুবড়ে পড়ে যায়, মুহূর্তের মধ্যে নির্যাতিত বাঙালিরাও তাকে সম্মিলিতভাবে আক্রমণ করার জন্য উঠে দাঁড়ায়। উদ্ধত সেনাটি তখনও রাইফেল সংগ্রহের চেষ্টা করে যাচ্ছে। এমন সময় রাস্তায় বসে থাকা একজন বাঙালি তরুণ দ্রুততার সঙ্গে একটি পাথর তার দিকে ছুড়ে মারে, নতুবা। উদ্ধত সৈন্যটি তার রাইফেলটি ব্যবহার শুরু করে দিত। সে সময় একজন বাঙালি তরুণ তার অস্ত্রটি দ্রুত সরিয়ে ফেলে, তারপর নির্যাতিত বাঙালিরা যে যার মতাে করে হাতের কাছে পড়ে থাকা ইট-পাটকেল নিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যটিকে আক্রমণ শুরু করে। সকল গাড়ির আরােহীরা আবার গাড়িতে উঠে দ্রুত প্রস্থান করে। বাঙালি তরুণরা দেখতে পায় পাকিস্তানি সৈন্যটি আর নড়াচড়া করছে না। তখন তারাও সেখান থেকে সরে পড়ে। তারা জানত শহরে পাকিস্তানি সৈন্য টহল দিচ্ছে, যে কোনাে সময় খবর পেয়ে তারাও চলে আসবে। রাস্তার পাশের গলিতে ছােট ছােট দু-একটি মুদি দোকান ছিল । ঝপঝপ করে দোকানিরা ঝাপ ফেলে চলে যায়। ব্যাংক কোয়ার্টারের সকল বাসার বাসিন্দারা, দরজা-জানালা ভেতর থেকে বন্ধ করে অন্ধকার ঘরের মধ্যে আশ্রয় নিল । ধীরে ধীরে দুপুরের প্রখর রৌদ্র কমতে শুরু করে, বনানী একেবারে নিশ্ৰুপ, নিঃশব্দ ভয়ার্ত জনপদে পরিণত হয়। ঘটনাটি দুপুরের দিকে সংঘটিত হয়েছিল, ঘণ্টা দেড়েক পরে পাকিস্তানি আর্মির দুইটি জিপ গাড়ি বনানী সড়কের মাঝখানে এসে দাঁড়ায়। কয়েকজন সৈনিক জিপ গাড়ি থেকে নেমে রাস্তায় পড়ে থাকা পাকিস্তানি সৈন্যটির দেহটি উঠিয়ে নিয়ে চলে যায়। ইতােমধ্যে সন্ধ্যার অন্ধকার নামতে
৬৯
শুরু করেছে, কেউ বাসা থেকে বের হওয়ার সাহস করছে না। এমনকি ব্যাংক কোয়ার্টারের কোনাে বাসায় সেদিন লাইট জ্বলেনি, সকলে অন্ধকারে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে বসে ছিল। সন্ধ্যার পর কারফিউ শুরু হলাে। বনানীর রাস্তায় মাঝে মাঝে পাকিস্তানিদের জিপ গাড়ি এলােমেলাে পেট্রোল ট্যুর দিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে তারা গাড়ি থামিয়ে ব্যাংক কোয়ার্টারের দিকে টর্চলাইট ফেলে বােঝার চেষ্টা করছে, এখানে বাঙালি মানুষজন আছেকি না।
পরের দিন খুব ভােরবেলা, সকালের আলাে ফোটার আগে প্রতিবেশীরা আমাদের বাসায় আসেন, বাবার সঙ্গে কথা বলেন। তারা বলেন- সময় থাকতে বাসা বদলানাে দরকার । পরিস্থিতি খুব খারাপ। ব্যাংক কোয়ার্টারের এই বাসাগুলাে রাস্তার একেবারে সামনে, যে। কোনাে সময় পাকিস্তানিরা এইসব বাসায় হামলা করবে। আর তখন যদি জানতে পারে, এখানে সার্জেন্ট জহুরুল হকের বড় ভাই থাকেন, তবে আপনাকে আপনার পরিবারসহ সেই সঙ্গে আমাদের সবাইকে মেরে ফেলবে। নবারুণ ক্লাবের কিছু ছেলে এসে বাবাকে বললেন- চাচা পরিস্থিতি খুবই খারাপ। বনানী এখনও শহর থেকে দূরে- তাই তারা এই জায়গাটায় এখনাে হামলা করেনি। কিন্তু গতকালের ঘটনার পর তারা রাতে টহল দিয়েছে। পাকিস্তানিরা যদি জানতে পারে, জহুর চাচার বড় ভাই এখানে আছে, তাহলে বনানীতে বড়সড় আক্রমণ চালাবে। বাবা সকলের কথা চুপচাপ শুনলেন। মা আমাদের নিয়ে চিন্তায় অবিরত কাঁদছিলেন। মা বললেন- জহুরের ছবিটা ড্রয়িংরুমের দেয়াল থেকে নামিয়ে রাখতে । ওকে সবাই চেনে। জহুরের ছবিটা দেখলে তােমাকে মেরে ফেলবে। বাবা কঠিন স্বরে বললেন- কোনাে অবস্থাতেই আমি আমার ছােট ভাই জহুরের ছবি দেয়াল থেকে নামাব না। আজো আমাদের বাড়িতে জহুরের সেই ছবি দেয়ালে টানানাে আছে।
সমস্ত পরিস্থিতির কারণে এবং প্রতিবেশীদের কথায় বাবা রাজি হলেন বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার জন্য, কিন্তু জহুরের ছবি ও জিনিসপত্র কিছু সরালেন না। সেগুলাে যেমনভাবে সাজানাে ছিল তেমনি রইল । শুধু বাড়িটিতে ভারী কয়েকটি তালা দিয়েছিলেন। আমরা কয়েকজন প্রতিবেশীসহ ব্যাংক কোয়ার্টারের পেছনের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে গুলশান-২-এর দিকে গিয়েছিলাম। বাবা একটি রিকশা ঠিক করতে পেরেছিলেন বড়ামা আর আরেকজন অসুস্থ প্রতিবেশীর জন্য। বাবা রিকশার পেছনে হাঁটছিলেন, হাতে জিনিসপত্রের একটি পোঁটলা। মায়ের কোলে ছােট্ট রেশমী আর ব্যাগের ভেতরে কিছু মূল্যবান জিনিসপত্র । ভাইজানের হাতে কাপড়-চোপড়ের একটা পোঁটলা। আর আমার হাতে মা দিয়েছিল ছােট একটা পাতিল, যার মধ্যে ছিল রেশমীর জন্য দুধ । আমি হাঁটছি। বাবা-মা’র সঙ্গে, খুব ভয়ে-ভয়ে, মাঝে মাঝে পাতিল থেকে ছলকে দুধ পড়ে যাচ্ছে । মা বলছেন, পাতিলটা শক্ত করে ধর, দুধ পাওয়া যাবে না, রেশমী কী খাবে । ভাইজান বলছে, তাড়াতাড়ি হাঁটো …
৭০
সবাই অনেক দ্রুত হাঁটছে- শরণার্থীদের মতাে আমাদের যাত্রাটি অত দীর্ঘ যাত্রা ছিল না, তবুও সারাজীবন মনে থাকবে মৃত্যুর ছায়ার নিচে ওই পথ চলার কথা । বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তারা কীভাবে যেন যােগাযােগ করেছিল উর্ধ্বতন বাঙালি অফিসারদের সঙ্গে। একজন বাঙালি অফিসার ব্যাংক কর্মকর্তাদের পরিবার নিয়ে থাকার জন্য গুলশান-২-এর স্টেট ব্যাংকের বাড়িটি খুলে দিয়ে সকলকে সাময়িকভাবে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। গুলশান-২-এর স্টেট ব্যাংকের গভর্নরের বাড়িটি তখন খালি পড়ে ছিল। বাগানসহ দোতলা একটি বাড়ি । ব্যাংক কলােনি থেকে বেশ কয়েকটি পরিবার এসে বাড়িটিতে আশ্রয় নেয়। এত লােক থাকার মতাে খাট-পালং ছিল না। আমার এখনাে মনে আছে, সবাই মাটিতে চাদর বিছিয়ে ঘুমিয়েছিল। প্রতিবেশীদের আমার মতাে ছােট কয়েকজন বাচ্চা ছিল, আমরা সেই পরিবেশের মধ্যেই খেলাধুলা শুরু করি। মায়ের কাছে গেলে মন খারাপ হয়ে যেত। মা বলতেন, নিচে নামবে না, চারদিকে পাকিস্তানি সৈন্যরা ঘুরছে। আমার খুব ভয় লাগছে তােমার বাবাকে নিয়ে আর তােমাদের নিয়ে। বড়ামাকে খেয়াল করবে । বড়রা সারাক্ষণ নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে যুদ্ধের কথা আলােচনা করত । খণ্ড খণ্ড যুদ্ধের তথ্য আসত, সে নিয়ে কথা বলত। ভাইজান মাঝে-মাঝে আমার কাছে এসে যুদ্ধের কথা বলত। আমার কিন্তু কারাে কাছে গিয়ে নিজের বিদ্যা জাহির করার মতাে লােক ছিল না। তাই বড়ামার কাছে যেয়ে আমি যুদ্ধের গল্প করতাম। তিনি আমাকে আদর করে মিনি ডাকতেন। ওনাকে বললাম, পাকিস্তানিরা কামান এনেছে, এই জন্য গুড়ম গুড়ম শব্দ হচ্ছে। অনেক বাঙালিকে মেরে ফেলেছে। বডডামার তখন অনেক বয়স, উনি কোনােমতে হাঁটেন, কোনােমতে খান। কানে শােনেন না, চোখেও তেমন দেখেন না। তিনি বললেন, মিনি, তুমি যে কী কও? নদীতে দাউ ডাকছে, তাই গুম গুম আওয়াজ। ১৯৫২ সাল, মেঘনা তখনও খরস্রোতা। আমার প্রপিতামহের বসতবাড়ি ছিল নােয়াখালীর মেঘনার তীরে, খরস্রোতা মেঘনার ভাঙনে বসত-বাড়িটি নদীর অতল গহ্বরে ডুবে যায়। বড্ডমা বাংলার গাছগাছালির শ্যামল ছায়ার ভেতর মেঘনা নদীর পাড়ে বড় হয়েছেন। তিনি দেখেছেন, বাংলার শ্যামলিমা, নদীসংলগ্ন গ্রাম । তিনি বুঝতে পারলেন না, কোথা থেকে আসবে কামান? পাকিস্তানিরা কেন বাঙালিদের মারছে? তিনি জানেন না তাঁর স্নেহের ছােট নাতি জহুরকে ইতােমধ্যে পাকিস্তানিরা গুলি করে হত্যা করেছে। মেজো নাতি আমিনুল হক (মনু) যুদ্ধে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। বড় নাতি মাফু (মাহবুবুল হক) পরিবারের নিরাপত্তা নিয়ে উভ্রান্ত হয়ে পড়েছে। তিনি আমাকে বললেন- নামাজের পাটি দাও, আমাকে অজু করাইয়া দাও। নামাজের পাটিতে বসে তিনি বললেন- মিনি ভয় পেয়াে না, নদী এমন কইরা দাউ ডাকে।
৭১
স্টেট ব্যাংকের গভর্নরের বাসায় বেশিদিন থাকা হলাে না। অল্প কয়েকটা দিন পার হওয়ার পরই গুঞ্জন উঠল পাকিস্তানি আর্মিরা খবর পেয়েছে, এখানে বেশ কিছু বাঙালি পরিবার এসে আশ্রয় নিয়েছে। বাবা চিন্তিত হয়ে মাকে এসে জানাল, সবাই বলছেএখানে যে কোনাে সময় আক্রমণ হতে পারে। তাই সবাই ভাবছে, এখান থেকে আবার। অন্য কোথাও চলে যাবে। মা বিমর্ষ হয়ে পড়ছেন, রেশমী তখন অনেক ছােট। এ ছাড়া বডডামা আছেন। মা বাবাকে বললেন- উনি যা বলবেন তাই করবেন । মা বারবার বললেন- একবার ধানমণ্ডিতে তাঁর বড় বােনের সঙ্গে ফোন করে যােগাযােগ করতে। ইতােমধ্যে পাকিস্তানি সৈন্যরা পুরাে ঢাকা শহরে তাদের হত্যাযজ্ঞের তাণ্ডবলীলায় মেতে উঠেছে, শহরের অসংখ্য বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে, লুট করে, লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছে। অসংখ্য মানুষকে ধরে নিয়ে গিয়ে তাদের আস্তানায় বন্দি করছে। মানুষ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে প্রাণের মায়ায় পরিবারের চিন্তায় ঘর-বাড়ির মায়া ত্যাগ করে শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছে অজানার উদ্দেশে। বাবা খেয়াল করলেন, প্রতিবেশীরা ধীরে ধীরে একত্রে থাকার সিদ্ধান্ত ত্যাগ করছেন। কারাে কারাে দেশের বাড়ি ঢাকার অদূরে ছিল, তারা এরই মধ্যে কিছুটা পায়ে হেঁটে, কিছু পথ রিকশায় আবার পায়ে হেঁটে, কখনাে নৌপথে গ্রামের বাড়ির দিকে যাত্রা শুরু করেছে। বাবা গভীর চিন্তায় পড়লেন- বড্ডমার পক্ষে হাঁটা সম্ভব না, আমি ও ভাইজান ছােট, রেশমী চার মাসের বাচ্চা শিশু। মা অসুস্থ, এই অবস্থায় কোথাও যাওয়া সম্ভব না। তিনি ঠিক করলেন- আবার নিজ বাড়ি স্টেট ব্যাংক কোয়ার্টার বনানীতে চলে যাবেন। এই সময় একজন প্রতিবেশী বাবার কাছে এগিয়ে আসলেন, তিনি একান্ত আগ্রহ নিয়ে বললেন- হক সাহেব, আপনার ওপর পাকিস্তানিদের নজর আছে। তাই আপনাকে
৭২
অনুরােধ করব, আপনার বাসায় আপনি থাকবেন না। আপনার বাসাটি বড় রাস্তার একদম সামনে। পাকিস্তানিরা মাঝে মাঝেই ব্যাংক কোয়ার্টারের ভেতরে ঢুকে ভাঙচুর করছে। কোথাও লােকজন আছে কি না দেখছে। বাবা বললেন আমার নিজের ফ্ল্যাটে চলে যাওয়া উচিত, এ ছাড়া আর কী-ই বা করার আছে । আমার পক্ষে ঢাকা ছেড়ে যাওয়া সম্ভব না। বাবার একজন সহকর্মী বললেন- হক সাহেব আপনি যদি কিছু মনে না করেন, আমার বাসা ৮ নম্বর বিল্ডিংয়ের তিনতলার একটি ফ্ল্যাটের চাবি আমার কাছে আছে। আপনি সেখানে দু-তিন দিন থাকতে পারেন। পরে আবার ঠিক করবেন, কী করবেন । যুদ্ধের সময় এভাবে কত মানুষ যে কত মানুষের কাছে এসেছে। নিঃস্বার্থভাবে উপকার করেছেন, তাঁদের কথা লিখতে বসলে বুকের ভেতর কষ্ট মােচড় দিয়ে ওঠে। আজ বাবা নেই। বাবার প্রতিবেশীর নামটিও স্মরণ করতে পারছি না, আজ এত দিন পর সেদিনের ঘটনাগুলাে লিখতে বসে তার জন্য গর্ব হচ্ছে। নামটি মনে না করতে পারায় নিজের ব্যর্থতার কথা স্বীকার না করে পারছি না। ৮/৫নং স্টেট ব্যাংক কোয়ার্টারে আমরা কীভাবে এসেছিলাম মনে নেই। পরে মায়ের কাছে শুনেছি, গুলশান-২-এ স্টেট ব্যাংকের গভর্নর হাউস থেকে রিকশায় ব্যাংক কলােনির পেছনের রাস্তা দিয়ে স্টেট ব্যাংক কোয়ার্টারের ৮নং বিল্ডিংয়ের বাসায় এসেছিলাম। আমাদের প্রতিবেশী দোতলার ফ্ল্যাটে একা ছিলেন। তিনি ছিলেন খুবই সাহসী। তিনি তিনতলার পশ্চিম দিকের একটি ফ্ল্যাট চাবি দিয়ে খুলে আমাদের সেই বাসায় থাকতে বললেন। বাবা-মাকে সতর্ক করলেন, কোনাে অবস্থায়ই লাইট জ্বালাবেন না। এ ছাড়া তিনি কিছু কেরােসিন তেল, আর খাবারদাবার দিলেন। ব্যাংক কোয়ার্টারের ফ্ল্যাটগুলাের দুটি করে দরজা ছিল। উনি বাবাকে বুদ্ধি দিলেন- একটি দরজায় তালা থাকবে। যেই দরজাটা প্রধান, সেটি তালাবদ্ধ থাকলে মনে হবে বাড়িতে কেউ নেই। আরেকটি দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করতে হবে, বাবা-মা শুধু ওনার গলার আওয়াজ ছাড়া যেন দরজা না খােলে । সেদিন দুপুরে আমরা এসে সেই বাসায় আশ্রয় নিলাম। সেই দিন সন্ধ্যায় বাবার বন্ধু এসে বললেন- হক সাহেব, সামনের দিকের বিল্ডিংয়ে পাকিস্তানিরা ভাঙচুর করছে। ঘরের ভেতর লাইট নিভিয়ে চুপচাপ বসে থাকেন। আমি বাইরে থেকে তালা দিয়ে নিজের বাসায় যাচ্ছি। কোনাে খবর পেলে আবার জানাব। উনি দ্রুত দোতলায় ৮/৩ ফ্ল্যাটে নিজের বাসায় চলে যান। সন্ধ্যার পর আকাশের আলাে যেমন নিভে যায়, তেমনি মানুষের মনের আলাে নিভে গিয়েছিল। সমস্ত পরিবেশ ভয়ার্ত হয়ে ওঠল । দিনের বেলায় অন্ধকার, রাতের বেলায় ঘুটঘুটে অন্ধকারে বসে মানুষ মৃত্যু-ভয়ে বিচলিত । এখনাে ঝাপসা মনে পড়ে, মা একটি হারিকেনে মৃদু আলাে জ্বেলে রেখেছিল, ছােট্ট রেশমী কেঁদে উঠতে পারে, এই ভয়ে তাকে বুকের ভেতর চেপে ধরে রেখেছিল। আমি আর ভাইজান ভয়ে ভয়ে গুটিসুটি হয়ে বাবা-মা’র পাশে বসেছিলাম।
৭৩
ভয়ার্ত মুহূর্তগুলাে সারাজীবন মনের মধ্যে গভীর দাগ সৃষ্টি করে, মনের মধ্যে কাটা দাগের যে ছায়া থাকে, তা ভুলেও ভােলা যায় না। পরের দিন কারফিউ ভাঙার পর বাবা বনানী থেকে শহরে গেলেন, ব্যাংকেও গিয়েছিলেন। এরপর কয়েকজন আত্মীয়কে ফোন করলেন, কোথাও আশ্রয় পাওয়ার জন্য। পরবর্তী সময়ে সারাজীবন বাবা বলতেন- আমি চিরকাল মনে রাখবাে, তােমাদের বড় খালার কথা, বড় বুর কাছে ঋণী থাকবাে। ২৫শে মার্চের ভয়াল পরিস্থিতির পর, নিজের অনেক মানুষ আশ্রয় দিতে রাজি হয় নাই।
আবার যার কাছে কোনাে আশ্রয় চাওয়া যায় না। তিনি সােজাসুজি বলছেন- নির্দ্বিধায় আমাদের বাসায় চলে আসাে, পুরাে পরিবার নিয়ে আসাে। আমরা সবাই কষ্ট করে থাকবাে, তবুও আমার কাছে থাকো । আমরা যা খাবাে, সবাই মিলে ভাগ করে খাবাে।
মতিঝিলে স্টেট ব্যাংকে গিয়ে মাহবুবল হক দেখলেন, সমস্ত পরিবেশ থমথমে। পাকিস্তানি প্রহরারত সৈনিকরা বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান নিয়েছে। স্টেট ব্যাংকের ভেতর ব্যাংক কর্মচারীদের আইডি কার্ড দেখে ঢােকাচ্ছে। খুব কমসংখ্যক অফিসার উপস্থিত, বেশির ভাগ বিভাগে অল্প কিছু লােক। একজন বাঙালি অফিসার এসে ভয়ে ভয়ে বললেন- পাকিস্তানিরা বেতন বন্ধ করে দেবে, যেসব বাঙালি অফিসার উপস্থিত থাকবে না। বাবা বুঝলেন, এমন পরিস্থিতিতে কাজ করা খুব দুরূহ, তবে তিনি ব্যাংকের ক্যাশ ডিপার্টমেন্টে আছেন। এখানে লােকজন কাজ না করলে বাঙালি অফিসাররা কোনােভাবে বেতন পাবে না। ঊর্ধ্বতন অফিসারের কাছ থেকে সেই দিনের মতাে ছুটি নিয়ে মতিঝিলের রাস্তায় বের হয়ে এলেন । আজকের শাপলা চত্বরের কাছে একটা বেবিট্যাক্সি খুঁজতে শুরু করলেন, মগবাজারে দিলু রােডের গলিতে ফুপুর বাসায় যাওয়ার জন্য । মতিঝিলের সমস্ত রাস্তা ফাঁকা। মাঝে মাঝে দু-একটি বেবি ট্যাক্সি শাঁ শাঁ করে চলে যাচ্ছে। ভেতরে যাত্রী, বােঝা যাচ্ছে বাঙালি আরােহী নিয়ে দ্রুত এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলে যাচ্ছে। পাকিস্তানি আর্মির জিপ মাঝে মাঝে টহল দিয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি গাড়িভর্তি অস্ত্র হাতে সৈন্যরা। মাহবুবল হক বুঝতে পারলেন, খুব দ্রুত তাকে একটা বাহন পেতে হবে । হঠাৎ একটা রিকশাওয়ালা কাছে এসে বললেন- কোথায় যাবেন স্যার? আমি তাড়াতাড়ি নিয়ে যেতে পারবাে। মাহবুবল হক বুঝতে পারলেন, যাত্রী না পেলে ওর কী করে চলবে? তিনি দ্রুত রিকশায় উঠে মগবাজার যেতে বললেন । রিকশাওয়ালা মুহূর্তের মধ্যে রিকশা শাঁ শাঁ করে অত্যন্ত দ্রুত চালাতে শুরু করল। মাহবুবল হক রিকশায় বসে রিকশার পর্দা সরিয়ে পেছনের দিকে তাকালেন। সেই ‘৬৮-৬৯ সাল থেকে এ রকম ভয়ার্ত পরিস্থিতিতে, মাঝে মাঝেই খেয়াল করতেন, পেছন থেকে তাকে পাকিস্তানি ইন্টেলিজেন্সের সাদা কাপড় পরিহিত লােকেরা অনুসরণ করত । আর সেই অভ্যাস থেকে তিনি খেয়াল করলেন তাকে কেউ ফলাে করছে কি না।
৭৪
১৯৫০ সালে নােয়াখালীর সােনাপুর থেকে এসেছিলেন জগন্নাথ কলেজে পড়ার জন্য। আর সেই সময় ফুপা আব্দুর রশীদ তার চাকরি ঠিক করেছিলেন স্টেট ব্যাংকে। ফুপুর ফরাশগঞ্জের বাসায় তিনি থাকতেন। সদরঘাটের স্টেট ব্যাংকের একদিকে ছিল। লক্ষ্মীবাজার, আরেক দিকে বাহাদুর শাহ পার্ক। ফুপুর বাসায় যেতে যেতে মাহবুবুল হকের মনে আবার ভেসে উঠল, ছােট ভাই ফারুক আর ছােট বােন রানুর কথা। ফরাশগঞ্জ থেকে সদরঘাটের ব্যাংকে যাওয়ার আগে প্রতিদিন মাহবুবল হক ছােট ভাই ফারুককে সেন্ট গ্রেগরি আর ছােট বােন রানুকে সেন্ট ফ্রান্সিস স্কুলে নামিয়ে দিয়ে যেতেন।

সদরঘাট, লক্ষ্মীবাজারের সেই চিত্র আজ আর নেই। সে সময় জায়গাগুলােতে দোকানপাট, বাড়ি-ঘর এবং খুব কম লােকজন ছিল। সবাই তাকে চিনত । অনেক সময় কেউ কেউ মজা করে বলত, লম্বা লােকটা দুই হাতে দুই ভাই-বােনকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে, উনি এত লম্বা যে তাঁর পায়ের ধাপের সঙ্গে মিল রাখতে গিয়ে ছােট ভাই বােন দুটি দৌড়ে দৌড়ে যায় ।
৭৫
সবার কথা ভাবতে ভাবতে মগবাজারে ফুপুর বাসায় পৌছলেন। সবার খোজ নিয়ে। জানলেন- ফুপু এবং ফুপা খুবই চিন্তিত এমন পরিস্থিতিতে কীভাবে চলবেন। ফুপুর বাসা থেকে বের হয়ে বাবা মগবাজারে আরেকটি বাসায় যান। সেখানে বাবার কিছু নিকটতম আত্মীয় থাকতেন। পাইওনিয়ার প্রিন্টিং প্রেসের প্রতিষ্ঠাতা আব্দুল মােহাইমেন ভাই তার গাড়িটি দিতে রাজি হলেন; কিন্তু ড্রাইভার ছিল না । এমন অবস্থায় তার ছােট ভাই বললেন- মাফু আমার একজন বিহারি ড্রাইভার আছে, সে খুব সাহসী আর যেহেতু বিহারি তাকে তুমি নিয়ে যাও। ড্রাইভারটি ভালাে মানুষ, সে তােমাদের দ্রুত বনানী থেকে ধানমণ্ডিতে পৌঁছতে পারবে। তারপর বাবা সেই ভক্সওয়াগন গাড়িটি নিয়ে বনানীতে আসেন। মা সামনের বিল্ডিংয়ের নিজের ফ্ল্যাট থেকে কিছু জিনিস নিতে চেয়েছিলেন । বাবা বললেন- শহরের পরিস্থিতি খুব খারাপ, কোনােমতে একটা গাড়ির ব্যবস্থা করে আব্দুল মােহাইমেন ভাইয়ের কাছ থেকে এনেছি। এই পরিস্থিতিতেও ভালাে যে ড্রাইভার সাহেব রাজি হয়েছে বনানী থেকে আমাদের নিয়ে ধানমণ্ডিতে যাওয়ার জন্য, কোনােভাবেই দেরি করা যাবে না। যে কোনাে সময় কারফিউ শুরু হয়ে যাবে । ভক্সওয়াগন গাড়িতে করে দ্রুত আমরা রওনা হলাম । বাবা ড্রাইভারকে বললেন- বনানীর প্রধান সড়ক দিয়ে না যেতে, কারণ পরিস্থিতি খুবই খারাপ। তাই ছােট ছােট গলিপথে মহাখালী হয়ে অবশেষে ধানমণ্ডিতে পৌছেন ।
আমি গাড়ির জানালা দিয়ে তাকিয়ে ছিলাম । প্রখর রৌদ্রে শহরটা খাঁ খাঁ করছিল । বনানীর প্রধান রাস্তার পাশের মাঠে নিঃসঙ্গ তালগাছগুলাে দাঁড়িয়েছিল। প্রতিদিন বিকেলে আমরা
৭৬
এখানে খেলতাম, সেদিন কোনাে বাচ্চা ছিল না। এমনকি মাঝে মাঝে গরু চড়ানাের জন্য যেসব রাখালেরা আসত, তারাও কেউ আসেনি । কেমন নিস্তব্ধ ভয়ার্ত শহর! বিচ্ছিন্নভাবে কিছু লােক চলাচল করছে। মা শুধু দোয়া পড়ছিলেন, মায়ের কাছে পথটা শেষ হচ্ছিল না। আর আজ শুধু মনে হয়, কোনাে দিন মায়ের সঙ্গে এ রকম ভয়ার্ত পথ অতিক্রম করিনি । ধানমণ্ডির ৩ নম্বর রােডে ১৭ নম্বর বাড়িটি বড় খালু ডা. আমিন আহমেদের ছিল । বেশ বড় বাড়ি, নারিকেলগাছ ঘেরা, সবুজে সুশােভিত ধানমণ্ডি এলাকার প্রথম দিককার আবাসিক বাড়ির একটি। যুদ্ধের দিনগুলাের প্রতিদিনের কথা মনে করা সম্ভব না, আবার কিছু কিছু কথা মন থেকে কোনাে দিন মুছে যাবে না। কিছু দুঃখজনক ঘটনা হৃদয়ের মধ্যে চিরদিনের জন্য বাসা বেঁধে আছে। ধানমণ্ডির বাসায় আমরা পৌছানাের একদিন আগে কি একদিন পরে ছােট মামা, মামি ও রিংকুরা এসে পৌঁছে। ছােট মামা জহিরউদ্দীন আহমেদ ও মামি রাসেদা আহমেদ নিজ বাসা মােহাম্মদপুর থেকে সর্বস্বান্ত হয়ে বড় খালার কাছে আসেন। ছােট মামারা মােহাম্মদপুরে থাকতেন । ২৫শে মার্চের ভয়াল রাত্রির পর ঢাকার মােহাম্মদপুর ও মিরপুর এলাকায় শুরু হয়েছিল আরেক ধরনের হত্যাযজ্ঞ । ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগের পর বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয় অসংখ্য বিহারি । এরা অনেকেই ছিল পাকিস্তানের সমর্থক। উর্দু ভাষায় কথা বলত। পাকিস্তানিদের নৃশংস হামলার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর মােহাম্মদপুর ও মিরপুরের অনেক বিহারি রাতের অন্ধকারে বেরিয়ে আসে বাঙালিদের ওপর আক্রমণ করার জন্য। তাদের মধ্যে অনেকে রামদা, কিরিচ নিয়ে এগিয়ে এসে নৃশংসভাবে বাঙালিদের হত্যা করেছিল । কিছু বাঙালি প্রাণ নিয়ে কোনােমতে বেঁচে এসেছিল। মামিরাও মৃত্যুর মুখ থেকে কোনােমতে পালিয়ে আসে, ঘর-বাড়ি লুট হয়ে যায়। মানুষের জীবন যখন মৃত্যুর মুখােমুখি তখন প্রিয় মানুষ ছাড়া আর কোনাে জিনিসের মূল্য থাকে না। মামিরা তাঁদের চোখের সামনে প্রিয় ছােট বােনের স্বামীকে হারিয়েছিল । কোনােমতে হাসনাত মামা (ডা, কাজী করিম) দ্রুতগতিতে গাড়ি চালিয়ে পরিবারের বাকিদের নিয়ে মােহাম্মদপুর থেকে বের হতে পেরেছিলেন। সারাজীবন আভা খালা স্বামীর স্মৃতি নিয়ে চলেছেন। খালুর (মিজানুর রহমান) চেহারা মনে নেই, কিন্তু তাঁর প্রতি বিহারিদের এই নৃশংস আচরণ আজ পর্যন্ত ভুলতে পারি নাই। বড় খালু আমিন উদ্দীন আহমেদ সবাইকে অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে নিজের বাড়িতে রাখলেন।
৭৭
আমিনুল হকের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন সেক্টরে ভাগ হয়ে সেক্টর কমান্ডারদের তত্ত্বাবধানে মুক্তিযােদ্ধারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবেন- এ রকম আলােচনা মার্চের শুরু থেকেই এসব নিয়ে গােপন বৈঠকও শুরু হয়ে যায়। আমিনুল হকের চিত্রা বাড়িতে ক্রমাগত আইনজীবী, রাজনীতিবিদদের বৈঠক ও আলােচনা চলত । কত যে রাজনীতিবিদ দিনের পর দিন চিত্রা বাড়ির একতলায় পশ্চিম দিকের চেম্বারে মামলা নিয়ে, রাজনীতি নিয়ে সময় পার করেছেন, তাদের অনেকেই আজো বেঁচে আছেন, আমিনুল হককে নিশ্চয়ই মনে রেখেছেন তারা। ২৫শে মার্চের কয়েক দিন আগে থেকে শহরের অবস্থা ক্রমাগত খারাপ হতে থাকে। বাবা-চাচাদের কোনাে আপন বােন ছিল না। কিন্তু চাচাতাে বােনদের নিজের বােনের মতাে ভালােবাসতেন। চাচা রেহানা ফুপুর চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়ায়, চাচিমা নিজে গিয়ে রােকেয়া হল থেকে রেহানা ফুপুকে নিয়ে আসেন। ২৫শে মার্চ রাত্রিতে ও তার পরবর্তী সময়ে, পাকিস্তানিরা নির্বিচারে মানুষ হত্যা করে ক্ষান্ত হয়নি। শহরের ঘর-বাড়ি লুট করে ও পুড়িয়ে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করেছিল। বাঙালি নারীরাও রেহাই পায়নি। পাকিস্তানি সৈন্যদের করাল গ্রাসের ছােবলে অসংখ্য বাঙালি নারী সম্ভ্রম হারায়। এর কয়েক দিন পর আমিনুল হক বাড়ি ছেড়ে চলে যান, ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয়ে আগরতলা পাড়ি দেন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য। চাচিমা তখন নিজের বাসা ছেড়ে চিত্রা বাড়ির পেছনের অংশে তার বাবার বাসায় থাকতেন।
৭৮
বড্ডমা’র নােয়াখালী যাত্রা
বাবা বরাবর আত্মনির্ভরশীল একজন একাকী মানুষ ছিলেন। কখনাে তিনি কারাে সাহায্য-সহযােগিতা নিতে পছন্দ করতেন না। বড় খালু ও খালার আন্তরিক ব্যবহারে তিনি তাদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু তার কাছে এমন কোনাে অর্থ ছিল না, যা দিয়ে পরিবারের খরচের জন্য কোনােরূপ সহায়তা করবেন। ইতােমধ্যে তিনি ব্যাংক থেকে টাকা ধার করেছেন আগরতলা মামলার খরচ চালানাের জন্য। তাই গভীর দুশ্চিন্তায় পড়লেন, কীভাবে মাসের খরচ চালাবেন। ‘৬৯-এর পর তার সামান্য সঞ্চয় প্রায় শেষ । কীভাবে অন্যের বাসায় সম্পূর্ণ খালি হাতে থাকবেন। বড় বু’র বাসায় থাকার জন্য কোনাে রকম ভাড়া তাকে দিতে হবে না, সেটা তিনি জানতেন। কিন্তু নিজের পরিবারের অন্যান্য খরচ চালানাের জন্য তাে ন্যূনতম অর্থের প্রয়ােজন । সব ব্যাপারে বড় বু’র ওপর তাে আর নির্ভর করা যায় না । অনেক চিন্তার পর তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, আবার স্টেট ব্যাংকে যাওয়া শুরু করবেন। এ ছাড়া তাঁর মনে হলাে এই ব্যাংক- তার এবং বাঙালি সহকর্মীদের নিজের হাতে গড়া। সেই সদরঘাট থেকে মতিঝিলে স্টেট ব্যাংকে আসার অসংখ্য স্মৃতি রয়েছে। বাঙালিরাই গড়ে তুলেছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সব বড় বড় প্রতিষ্ঠান। এই স্থাপনাগুলাের প্রতিটি ইটের গায়ে লেগে আছে বাঙালির স্বেদবিন্দু ও ত্যাগের ইতিহাস। ধীরে ধীরে বাবা ব্যাংকে যাতায়াত শুরু করলেন । থমথমে সারা শহর, মাঝে মাঝে বাস চলে। বাস ও রিকশায় করে যাতায়াত শুরু করলেন। আমিনুল হক চাচার বাসায় গিয়ে জানলেন, চাচা ইতােমধ্যে মুক্তিযুদ্ধে চলে গেছেন । কমলাপুর রেলস্টেশনে গিয়ে খবর নিলেন দক্ষিণ অঞ্চলের ট্রেন চলাচলের অবস্থা।
৭৯
কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে হাঁটতে হাঁটতে মাহবুবুল হক আবার মতিঝিলে স্টেট ব্যাংকে গেলেন। ব্যাংকে যাওয়ার পথে কয়েক জায়গায় মিনিটখানেক থেমেছেন, সমস্ত শহর গত কয়েক দিনে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। পাকিস্তানিদের আগ্রাসনে শহরের বিভিন্ন জায়গায় বাড়ি-ঘর পুড়ে গেছে। জায়গায় জায়গায় কামান আর ভারী অস্ত্রের গুলির আঘাতে ভবনগুলাের দেয়ালের বিভিন্ন অংশে বড় বড় গর্ত তৈরি হয়েছে। রেলস্টেশনের বিভিন্ন স্থানে যাত্রীরা মাটিতে চাদর বিছিয়ে অসহায় চেহারা নিয়ে বসে আছে। দোকানপাট বেশির ভাগ বন্ধ, কিছু মুদি দোকানদার অর্ধেক ঝপ খুলে দোকান চালাচ্ছে। মানুষ দ্রুত পায়ে দোকান থেকে কিছু প্রয়ােজনীয় দ্রব্য কিনে চলে যাচ্ছে। রাস্তার মােড়ে ধ্বংসলীলার সঙ্গে আবর্জনার স্তুপ হয়ে শহরটা যেন মৃত্যুপুরীর রূপ নিয়েছে। মৃত মানুষের গন্ধে আশপাশের বাতাস ভারি হয়ে আছে, শকুন উড়ে বেড়াচ্ছে আকাশে। মাহবুবল হক বুঝতে পারলেন, এখানে থাকা কঠিন হবে। তবুও কোনাে উপায় নেই। এলিফ্যান্ট রােডে ফোন করে দেখলেন ছােট ভাই মনুর (আমিনুল হকের) কোনাে খবর এসেছে কি না। বড় দাদার ফোন পেয়ে আমিনুল হকের স্ত্রী ফরিদা আক্তার (লুলু) খুশি হলেন । কিন্তু তার পরেই শান্ত হয়ে বললেন- আখাউড়া থেকে ফোন করেছিল, আগরতলায় যাবে বলেছে। কিন্তু এর বেশি আর কোনাে কথা ফোনে বলতে চায়নি। মাহবুবুল হক বিষন্ন মন নিয়ে ব্যাংক থেকে বের হলেন । চারিদিকে ভয়ার্ত পরিবেশ। মৃত্যুর গন্ধে সারা শহর বিষন্ন হয়ে পড়ছে। মানুষ শুধু প্রাণ নিয়ে রুদ্ধশ্বাসে ছুটছে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় একটি নিরাপদ আশ্রয়ের খােজে। মাহবুবুল হক (মাফু) দ্রুত একটা রিকশা নিয়ে মগবাজার দিলু রােডের দিকে রওনা হলেন, পথে পথে পাকিস্তানি আর্মির জিপ গাড়ি দেখতে পেলেন। রিকশাচালক প্রাণের তাগিদে শহরে বেরিয়েছেন- একটুখানি উপার্জন না হলে আজকের দিনের খাওয়াটা জোগাড় হবে না। ধীরে ধীরে বলে উঠলেন- আপনাকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার পর ভাতের চাল কিনে বাড়ি যাব ।
মাহবুবুল হক বুঝলেন, শহরটাতে পাকিস্তানিরা শুধু মানুষের স্বাধীনতা খর্ব করেনি- কাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে বাঙালিদেরকে ভাতে মারবে । ধীরে ধীরে রিকশা মগবাজার দিলু রােডে ফুপুর বাসায় পৌছল । মাহবুবল হক অনেক দিন তাঁর প্রিয় বাচ্চু ফুপুর কাছে থেকেছেন। মাফুকে দেখে তিনি খুশি হয়ে ওঠেন। নিজের পাশে বসান। খুব মন খারাপ করে বলেন- এই বিপদের সময় তােকে, বৌ-কে, বাচ্চাদের আমার কাছে। রাখতে পারলাম না, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। তবে বৌ-এর বড় বােন- অর্থাৎ বড় খালার। কথা ওঠায় তার প্রশংসা করলেন। আরও বললেন- আমার ছেলেমেয়েরা সবাই এখন বড় হয়ে গেছে, ঘরে এত জায়গা নেই। হক সাহেব ধীরে ধীরে বললেন- ফুপু অসুবিধা নাই । মিমির খালা ও খালু সবাই আন্তরিকভাবে আমাদের রেখেছেন। আপনি তাে জানেন আমি কারাে সাহায্য নিতে পছন্দ করি না। কিন্তু এই মুহুর্তে আমি অশেষ কৃতজ্ঞ । তবে সেই বাসায়ও অনেক লােক। মিমি-মঞ্জুর ছােট মামা সর্বস্বান্ত হয়ে মােহাম্মদপুর থেকে এসেছে। এ অবস্থায় আমি ওনার বাড়িতে দাদুকে রাখতে পারছি না। তা ছাড়া ওনার বয়স হয়েছে, প্রতিনিয়ত সেবা-যত্ন প্রয়ােজন।
৮০
বাবার দাদু- অর্থাৎ বাচ্চুনির মা। বাচ্চু ফুপু এই বিষয়টি গভীর মনােযােগ দিয়ে শুনলেন। তিনি ধীরে ধীরে বললেন- বৌয়ের বড় বােন তােদের রেখেছে, এর ওপর মায়ের দায়িত্ব ওনাকে দেওয়া উচিত হচ্ছে না। কাল-পরশু অবস্থা একটু ভালাে দেখে তুই মাকে আমার কাছে দিয়ে যা। তারপর আমি দেখবাে। মাফু (মাহবুবল হক) ধীরে ধীরে ফুপুকে জিজ্ঞেস করলেন, দাদু কি আপনার কাছে। থাকবেন? নাকি নােয়াখালীতে ছােট চাচার কাছে পাঠাবেন? উনি নােয়াখালীতে যেতে চান। আজ কমলাপুর রেলস্টেশনে গিয়েছিলাম, পরিস্থিতি খারাপ, তবে দক্ষিণাঞ্চলের ট্রেন চলাচল করছে। বাচ্চু ফুপু বললেন- আগে ওনাকে ধানমণ্ডি থেকে আমার এখানে নিয়ে আয়, তারপর একজন বিশ্বস্ত লােকের সঙ্গে নােয়াখালী পাঠাবাে । এর কয়েক দিন পর বড়ামা বাবার সঙ্গে ধানমণ্ডির বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিলেন। মা সব কিছু গুছিয়ে দিলেন। বড়রা সবাই তার দোয়া নিলেন। বাবা বরাবরের মতাে খুব নীরব ছিলেন। আমি এক কোনায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখছিলাম । কষ্ট বুঝার, কষ্ট প্রকাশ করার মতাে ভাষা ছিল না বডডামার । ইশারা করে ডাকলেন, কাছে গেলাম আমার মাথায় হাত রাখলেন মাকে বললেন- ‘হেতিরে তুমি হলুদ পােশাক পরাইয়াে না, জ্বল জ্বল করে, নজর লাগবে। এর কয়েক দিন পর বড্ডমা ঢাকা ছেড়ে নােয়াখালীর সােনাপুরের শফিক দাদার বাড়িতে চলে যান। দেশ স্বাধীন হওয়ার অল্প কিছুদিন পরে, তিনি ইহলােক ত্যাগ করেন। আমি আর কোনােদিন বডডামাকে দেখতে পাই নাই।
৮১
মুক্তিযুদ্ধ
মুক্তিযুদ্ধ ক্রমে ক্রমে সারা দেশে বিস্তৃত হতে থাকে। দেশের প্রায় সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। ফলে সারা দেশের স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যায়। বাঙালি জাতির কাছে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ এক অপরাজেয় শক্তি । তিনি হাজার বছরের শৃঙ্খল থেকে বাঙালিকে উদ্বুদ্ধ করতে পেরেছিলেন তাঁর নিরলস দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের মহিমায়। আন্দোলন-সংগ্রাম ও কারারুদ্ধ জীবনের প্রতিটি প্রহর পাকিস্তানবিরােধী আন্দোলনের পুরােটা সময় জুড়ে তার উচ্চারিত শব্দগুলাে ছিল বাঙালি জাতির ন্যায্য অধিকার-আদায়ের স্বপক্ষে ঘুম ভাঙানিয়া অগ্নিমন্ত্র। বঙ্গবন্ধুর ডাকে মন্ত্রমুগ্ধের মতাে বাংলার কৃষক, ছাত্র, জনতা কোনােরূপ প্রশিক্ষণ ছাড়াই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে । অসংখ্য ছাত্র মুক্তিযুদ্ধে যােগদান করে, এমনকি অনেক সাহসী কিশাের সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। বিভিন্ন স্থানে গেরিলা মুক্তিযােদ্ধারা সংগঠিত হয়ে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের আগরতলা-কলকাতাসহ গােটা সীমান্তবর্তী অঞ্চলে অসংখ্য মানুষ শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেয়। ত্রিপুরার মানুষ হৃদয় উন্মুক্ত করে বাংলাদেশের মানুষকে আশ্রয়, খাদ্য, বস্ত্র, ওষুধ দিয়ে সাহায্য করেছিল। শুধু শরণার্থী নয়, বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ, কবি, লেখক, শিল্পীসহ অসংখ্য মানুষ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে আশ্রয় নেয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও বাঙালিদের পক্ষে অতি দ্রুত বিশ্ব জনমত গড়ে ওঠে।
৮২
২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে শুরু হয় অপারেশন সার্চলাইট। বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হন। দেশকে স্বাধীন করার স্বপ্ন নিয়ে সীমান্ত পাড়ি দেন তাজউদ্দীন আহমদ। ১৭ এপ্রিল শপথ নেয় মুজিবনগর সরকার । মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার একটি আমবাগানকে বাছাই করা হয় প্রবাসী সরকারের শপথ অনুষ্ঠানের জন্য। এই স্থানটির বিষয় গােপন রাখা হয় নিরাপত্তার স্বার্থে । ২১৩ বছর আগে ১৭৫৭ সালে পলাশীর এক আমবাগানে স্বাধীনতা হারানাের পর বাংলার স্বাধীনতার নতুন অভ্যুদয় হয় আরেক আমবাগান এই বৈদ্যনাথতলায়। শুরু হয় স্বাধীন বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা অস্থায়ী সরকার, মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় প্রতিষ্ঠিত হয় মুজিবনগর সরকার ।
৮৫
এমন পরিস্থিতিতে আমরা ঢাকায় বড় খালার বাসায় যুদ্ধের ভয়াবহতার মধ্যে সময় অতিক্রম করছিলাম। যুদ্ধের ভয়ংকর তথ্যগুলাে আমার মধ্যে বা রিংকুর মধ্যে খুব বেশি প্রভাব ফেলতে পারেনি। আমি আর রিংকু (রেসউদ্দীন আহমেদ) সারাদিন খেলা করতাম । রিংকু আমার ছােট মামার একমাত্র ছেলে আমার থেকে দুই বছরের ছােট, কিন্তু আমাদের মধ্যে খুব ভাব ছিল। মজার ব্যাপার হলাে, বড় খালাতাে ভাই-বােনরা নানা বিষয় নিয়ে আমাদের মধ্যে ঝগড়া লাগিয়ে দিত। আমি আর রিংকু ভীষণ মারপিট করতাম।
এসবের মধ্যে একটি বিষয় সব সময় চোখে পড়ত। সন্ধ্যার পর সবাই একসঙ্গে বড় ঘরটাতে বসত। বড়রা দুই একজন চেয়ারে। বেশির ভাগ সময় সবাই মাটিতে বসতবাবা ছােট একটা রেডিও নিয়ে বসতেন। আর ছােট মামা বলতেন- ‘মাফু ভাই তাড়াতাড়ি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ধরেন’- বড় খালা তখন দুশ্চিন্তায় পড়ে যেতেন। মা, মামিকে নিয়ে বাড়ির সব জানালা-দরজা বন্ধ করে দিতেন। দোতলা বাড়িটিতে অনেকগুলাে ঘর ছিল, বড় খালা প্রায় সব ঘরের আলাে নিভিয়ে দিতেন। বাইরে পাকিস্তানি আর্মি জিপ নিয়ে টহল দিয়ে যেত মাঝে মাঝেই। এমন পরিস্থিতিতে খালা সবার নিরাপত্তার কথা ভেবে কোনাে রকম উত্তেজনা সহ্য করতে পারতেন না। তাঁর কিছু করার ছিল না, তার নিজের জোয়ান তিনটি ছেলে এবং একটি মেয়ে। এ ছাড়া ছােট বােন, ভাই সবাইকে নিয়ে এত বড় সংসারের সকলের দায়িত্ব তার। তিনি অত্যন্ত সাবধানতার সঙ্গে রেডিও চালাতে বলতেন। বাবা আর ছােট মামা ধীরে ধীরে রেডিও ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংবাদ ধরতেন। মাঝে মাঝে আশা-জাগানিয়া তথ্য পেয়ে সবাই উৎফুল্ল হয়ে উঠতেন। মুক্তিযােদ্ধাদের বীরত্বের কাহিনি শুনে সবাই উৎসাহিত হতেন। মাঝে মাঝে সবার সঙ্গে আমি আর রিংকুও এসে বসতাম, বুঝতে চাইতাম মুক্তিযােদ্ধাদের ঘটনা। এমন সময় ধানমণ্ডির বাসায় একটা মজার ঘটনা ঘটে যায়। সেটি আজ পর্যন্ত ভুলতে পারিনি। হঠাৎ আমি আর রিংকু খেয়াল করলাম বড় খালা খুব রেগে গেছেন। বড় খালাতাে ভাই বীরু খালাকে কী যেন বােঝানাের চেষ্টা করছেন।
পরে ভাইজান এসে আমার আর রিংকুর সঙ্গে যােগ দিল। লুপু ভাই এসে আমাদের সঙ্গে এক হলাে- ও বলল, বুঝতে পারছি না, বাসার মধ্যে একটা কিছু ঘটেছে- তােরা অপেক্ষা কর আমি জেনে আসি।’ একটু পরে লুপু ভাই এসে আমাদের জানালাে, একজন মুক্তিযােদ্ধাকে বীরু ভাই নিয়ে এসেছেন বাড়িতে। ওনার অনেক দিনের বন্ধু- মুক্তিযােদ্ধাকে তিনি নিচের তলায় স্টোররুমে রেখেছেন। আজকের রাতে তার কোথাও থাকার জায়গা নেই। সে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে সরে যাচ্ছে। পাকিস্তানিদের চোখের আড়াল হওয়ার জন্য। এমন অবস্থায় বীরু ভাই তাঁকে এক রাতের জন্য নিজেদের বাড়িতে গােপনে রাখার আশ্বাস দিয়েছে। বড় খালা কিছুতেই রাজি হচ্ছেন না, কেননা পাকিস্তানিরা টের পেলে বাড়ির সবাইকে মেরে ফেলবে। বাড়ির সকলের সঙ্গে আলােচনা করলেন বড় খালা- প্রতিটি মানুষ
৮৬
মুক্তিযােদ্ধাকে আশ্রয় দেওয়ার পক্ষ নিল । কেউ ভাবতে পারেনি একজন মুক্তিযােদ্ধার বিরুদ্ধে কিছু চিন্তা করার কথা। কিন্তু বড় খালার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল, তবু তিনি নিচের তলার বড় ঘরটি খুলে দিলেন। খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন। কিন্তু বাড়ির সবাইকে সাবধান করে দিতেও ভুললেন না। ওখানে কেউ যেন না যায়, গােপন রাখতে হবে পুরাে ঘটনাটি’মুক্তিযােদ্ধা এবং বাড়ির সবার নিরাপত্তার জন্য। আমাদের মধ্যে একটা মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হলাে, আমি আর রিংকু চিন্তায় পড়লাম। মুক্তিযােদ্ধা দেখতে কেমন হয়? সে কি মানুষের মতাে, তাদের কি আমাদের মতাে আচরণ? নাকি বিশেষ কোনাে চেহারা আছে। প্রচণ্ড উত্তেজনায় আমরা অস্থির হয়ে পড়লাম। লুপু ভাই, ভাইজানের থেকে বড়। তিনি এসে খবর দিলেন, নিচের তলার ঘরে মৃদু আলাের মধ্যে মুক্তিযােদ্ধাটি আছে। বয়সে সে বীরু ভাইয়ের মতাে, দেখতে ভালাে- খুব ভদ্র, তবে ঘর ছেড়ে মুক্তিযুদ্ধে যােগ দিয়েছে, তার মানে খুব সাহসী ব্যক্তি। ভাইজান ধীরে ধীরে গর্বের সঙ্গে বলল- ছােট চাচা জহুর খুব সাহসী ছিলেন, আমার মেজো চাচাও মুক্তিযুদ্ধে চলে গেছেন। আমরা চারজন ঠিক করলাম মুক্তিযােদ্ধাটিকে দেখতে হবে, কিন্তু কীভাবে? তিনি আছেন নিচের তলার বড় ঘরে, বড় খালা কড়া নির্দেশ দিয়েছেন কেউ নিচে নামতে পারবে না। লুপু ভাই বলল- একটা বুদ্ধি আছে, দোতলা আর একতলার মাঝে যে সিড়ি, তার মাঝখানে একটি জালি করা জানালা আছে। সেখান থেকে একতলার ড্রয়িংরুমটা দেখা যায়। আমরা ঠিক করলাম, একটু পরে যখন সব লাইট নিভে যাবে, সবাই ঘুমাতে যাবে, তখন ধীরে ধীরে সিড়ি দিয়ে নেমে জালি জানালাটার কাছে গিয়ে মুক্তিযােদ্ধাকে দেখবাে। এখনাে আমার স্পষ্ট মনে আছে উত্তেজনায় আমরা চারজন অস্থির । কিছুক্ষণ পর ধীরে ধীরে আমরা সিঁড়ির জানালার কাছে গেলাম । এবার একটা ভিন্ন পরিবেশ সৃষ্টি হলাে। কে আগে মুক্তিযােদ্ধাকে দেখবে? আমাদের মধ্যে একটা ঠান্ডা যুদ্ধ শুরু হলাে, অবশেষে ঠিক হলাে লুপু ভাই বড় তাই সে আগে দেখবে । ভাইজান বলল- আমার চাচাও মুক্তিযােদ্ধা আমি জানি ওরা কেমন সাহসী মানুষ হয়। আমি আর রিংকু ধাক্কাধাক্কি করে একসঙ্গে নিচের দিকে উঁকি দিলাম । অবিশ্বাস্য দৃশ্য, মৃদু টেবিল ল্যাম্পের আলােয় দেখলাম একজন সুদর্শন যুবক কালাে রঙের ট্রাউজার আর একটা সাদা শার্ট পরে আছেন। কাঠের সােফায় আধ শােয়া হয়ে শুয়ে আছেন, সােফার কুশন মাথায় দিয়ে ঘুমাতে চেষ্টা করছেন, মনে হচ্ছে তার ঘুম হচ্ছে না। আমাকে আর রিংকুকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে লুপু ভাই আর ভাইজান আবার নিচের দিকে তাকাল । তারপর লুপু ভাই বলল- ওনাকে একটা ভালাে বালিশ দিতে হবে, তবেই ভালােমতাে ঘুমাতে পারবে। লুপু ভাই বলল- যা, দোতলার বড় ঘর থেকে একটা বালিশ চুরি করে আন।
৮৭
দোতলার ঘরটিতে চাদর বিছিয়ে অনেক আত্মীয়-স্বজন লাইন করে ঘুমাতেন । ইতােমধ্যে প্রায় সবাই শুয়ে পড়েছেন, লাইট নিভে ডিম লাইট জ্বলছে । রিংকু আর ভাইজান দ্রুত একটা বালিশ চুরি করে নিয়ে এলাে। লুপু ভাই বালিশটা নিয়ে দ্রুত নিচের ঘরে গেল, আমরা ওপর থেকে জালি জানালা দিয়ে দেখছি। লুপু ভাই তেমন কথা না বলে মুক্তিযােদ্ধার হাতে বালিশটা দিয়ে ঘুমাতে বললেন । এখনাে মনে পড়ে, মুক্তিযােদ্ধা বালিশ পেয়ে আন্তরিক হাসি হাসলেন । পরের দিন দুপুরের দিকে শুনেছিলাম, বীরু ভাইয়ের সঙ্গে খুব ভােরে নাস্তা খেয়ে মুক্তিযােদ্ধা বের হয়ে গেছেন। বীরু ভাই তাকে কিছুটা পথ এগিয়ে দিয়েছিলেন। মুক্তিযােদ্ধাটি তার জন্য অপেক্ষারত সঙ্গীদের সঙ্গে আরেকটি অপারেশনের জায়গায় চলে গেছেন। কিছুদিন পর জানতে পেয়েছিলাম, মুক্তিযােদ্ধাটি একজন বিশিষ্ট ব্যক্তির সন্তান। তিনি হচ্ছেন শহিদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর বড় ছেলে- ভাষণ। অনেক বছর পার হয়ে গেছে, অনেক বার আমি মনে মনে তাকে খুঁজেছি। কিন্তু হয়তাে তেমনভাবে খুঁজলে— তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হতে পারতাে। কিন্তু বারবার মনে হয়েছে, ঐ যে সিঁড়ির জালির জানালা দিয়ে ৭ বছর বয়সে যে মুক্তিযােদ্ধাকে দেখেছিলাম, সেই হচ্ছে আমার বাংলাদেশের নাম না-জানা অসংখ্য মুক্তিযােদ্ধার প্রতীক। মুক্তিযুদ্ধের সময়টাতে, তাঁদের মতাে বীর মানুষদের জীবন ঘরবিহীন, খাওয়াদাওয়া অনিশ্চিত, প্রিয়জনের বিচ্ছেদ, মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে ক্রমাগত এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় পৌছে ফের যাত্রা করেছেন দেশমাতৃকার মুক্তির পথে- ক্লান্তিহীন তাদের সেই যাত্রাপথ । খালি হাতে, স্বল্প-ভারী অস্ত্র নিয়ে বাঙালি তরুণ, যুবক ছেলেরা ক্রমাগত পাকিস্তানিদের ঘাঁটিতে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রায় প্রতিদিন ঝরে যাচ্ছে অসংখ্য বাঙালি তরুণের প্রাণ। গ্রামগুলােও আর শান্ত রইল না, পাকিস্তানিদের আক্রমণে অসংখ্য গ্রাম লেলিহান আগুনে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হলাে। আর সেই সঙ্গে পাকিস্তানি নেকড়েদের খাঁচায় তুলে দিল বাঙালি রাজাকাররা অসহায় বাঙালি কিশােরী-তরুণীদের। প্রতিদিন অসংখ্য নারীর লাঞ্ছিত হওয়ার করুণ কাহিনি প্রকাশিত হতে থাকল । প্রাণের মায়া ত্যাগ করে শিল্পীরা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে মুক্তিযােদ্ধাদের উজ্জীবিত করার জন্য নানা রকম পরিবেশনা- গান, কৌতুক-নকশা ইত্যাদি শুরু করলেন । আজো বাঙালি জাতির কাছে এই সব গান প্রাণে উদ্দীপনা সৃষ্টি করে। প্রতিদিন বাবা আর ছােট মামা টুটু (জহিরউদ্দীন আহমেদ) স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শুনতেন। সকালবেলায় ছােট মামা টুটু ধীরে ধীরে (মুক্তির মন্দির সােপানােতলে কত প্রাণ হলাে বলিদান, লেখা আছে অশ্রু জলে…) গানটি গাইতেন। এ ছাড়া আরও কয়েকটি গান (পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে রক্ত লাল রক্ত লাল, জোয়ার এসেছে জন-সমুদ্রে রক্ত লাল রক্ত লাল…) মামা হেঁটে হেঁটে বা কখনাে ডাইনিং টেবিলে বসে গাইতেন। এই সময় বড় বােন জেনি বুবু (ফরিদা আহমেদ) এসে মামার সঙ্গে আস্তে আস্তে গলা মেলাতেন। বড় খালা, মা, মামী অনান্যরা নীরবে মামার কণ্ঠে স্বাধীনতা সংগ্রামের গানগুলাে শুনে। অনুপ্রাণিত হতেন।
৮৮
জেনি বুবু আমাদের সবচেয়ে বড় বােন, ও খুব সুন্দর আর তেমনি তার আন্তরিক ব্যবহার। পরিবারের সবাইকে তিনি পরম যত্নের সঙ্গে দেখে রাখতেন। আমার ছােট বােন রেশমী-মানিক সেই যুদ্ধদিনে ওরই কোলে বড় হয়েছে । জেনি’বু সবসময় আমার ছােট চাচা সার্জেন্ট জহুরুল হক-এর প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন আর দেশের মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য চিন্তিত থাকতেন। প্রতিদিন পাকিস্তানিরা কোনাে-না-কোনাে গ্রামে বা শহরে নৃশংস আক্রমণ চালাচ্ছে। কিন্তু অকুতােভয় বাঙালিরা সেই গ্রামেরই আরেক পাশে রাস্তার ধারে কোনাে ছােট চায়ের দোকানে, কয়েকজন একত্রিত হয়ে ছােট একটি রেডিও চালিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত মুক্তিবাহিনীর বিজয়ের কথা শুনছে। ১৯৭১-এর মাঝামাঝি সময়ে হানাদার পাকিস্তানিরা ঢাকা শহরের বিভিন্ন বাসায় গিয়ে মাঝে মাঝে সার্চ করা শুরু করল। পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের ইচ্ছামতাে আচরণ করত। কখনাে নির্দ্বিধায় সেই বাসার বর্ষীয়ান কোনাে মানুষকে হত্যা করত, বাড়ির সবার সামনে জোয়ান ছেলেদের ধরে নিয়ে পাড়ার রাস্তার মােড়ে লাইন করে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে চলে যেত। কখনাে বর্বর সৈন্যরা বাঙালি তরুণী মেয়েদের হাসতে হাসতে বাবা-মায়ের সামনে থেকে তুলে নিয়ে যেত । এই দেশ, এই বাংলার স্বাধীনতা, এই সবুজ পতাকার বৃত্তাকার লাল- সিক্ত হয়েছে অসংখ্য শহিদের রক্তে আর নির্যাতিতা নারীর আত্মত্যাগের করুণ কাহিনিতে ।
৮৯
ধানমণ্ডির ৩ নম্বর সড়কে পাশাপাশি অনেকগুলাে বাড়ি ছিল ডাক্তারদের । ডা. লস্কর, ডা. আমিন উদ্দীন আহমেদ, ডা. এম আর খান, এ ছাড়া আরাে কয়েকজন বিশিষ্ট ডাক্তার এখানে থাকতেন।
৯০
আমাদের বাড়িটি ছিল মাঝখানে, ডা. আমিন উদ্দীন আহমেদ- বড় খালুর জন্মস্থান। বাংলাদেশে ছিল না। ওনার প্রপিতামহেরা ভারতের জলপাইগুড়িতে থাকতেন, অত্যন্ত অভিজাত পরিবারের মানুষ ছিলেন। দেশবিভাগের পর ওনার পরিবার জলপাইগুড়ি থেকে রংপুর অঞ্চলে এসে বসতি স্থাপন করেন। কালক্রমে বিশাল সম্পত্তির অধিকারী হয়েছিলেন। বড় খালু রেলওয়ের চিফ মেডিক্যাল অফিসার ছিলেন। আরও একটি ভিন্ন। বিষয় ছিল, তিনি অত্যন্ত বড় ধরনের শিকারি ছিলেন। সে কারণে ওনাদের বাসায় দুই আলমারি-ভর্তি লাইসেন্স করা অস্ত্র ছিল । আমি আজ পর্যন্ত এত অস্ত্র কারও বাসায় দেখি নাই, অস্ত্রগুলাে সাধারণত শিকারের কাজে ব্যবহার হতাে। তবে বড় খালা ও খালু সব অস্ত্রের সঠিক লাইসেন্স মেনটেইন করতেন।
৯১
পাকিস্তানিরা ঢাকা দখলের পর, থানা থেকে সকল বাড়ির তথ্য অত্যন্ত নিপুণভাবে সংগ্রহ করে । পরিস্থিতি বিপজ্জনক দেখে বড় খালা সকল অস্ত্র রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বড় খালু তার পূর্বপুরুষ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত শখের একটি অস্ত্র ও পাকিস্তানিদের কাছে জমা দিতে চান নাই। এই কারণে পাকিস্তানিরা মাঝে মাঝেই ধানমণ্ডির বাসায় এসে হানা দিত । বড় খালা ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে সবাইকে নিচতলার গােপন রুমে ঢােকাতেন। কিন্তু নিজে অসীম সাহসের সঙ্গে বড় খালুর সঙ্গে থেকে পাকিস্তানি মেজর, কর্নেলদের সঙ্গে ইংরেজি ও উর্দুতে কথা বলতেন। আমরা ছােটরা ভয়ে অস্থির হয়ে পড়তাম । তবে বড় খালার সাহস দেখে সবাই তাকে বাহবা না দিয়ে পারত না। বড় খালা হামিদা বেগম (চিনা) কলকাতা থেকে দেশবিভাগের আগেই ঢাকায় চলে এসেছিল। কলকাতায় দেশবিভাগকে কেন্দ্র করে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা শুরু হয়। বড় চাচা জহিরউদ্দীন আহমেদের সঙ্গে বড় খালা ঢাকা চলে আসেন। হামিদার জন্ম কলকাতায়, তিনি লরেটোতে পড়তেন। বড় খালা সেই সময় কলকাতায় সাইকেল চালিয়ে ভবানীপুর থেকে লরেটো স্কুলে যেতেন। এই অসীম সাহসী মহিলা পরিবারের সবাইকে ছাতির মতাে ছায়া দিয়ে পুরা নয় মাস ঘিরে রেখেছিলেন। কী অদ্ভুত এক ব্যক্তিত্ব ছিল তা না দেখলে বােঝানাে যায় না। এমনকি তার ব্যক্তিত্বের সামনে পাকিস্তানি অনেক জাদরেল মেজর, কর্নেল অফিসার মাথা নিচু করে চলে গেছেন। হঠাৎ ধানমণ্ডির বাসার সবাই অস্থির হয়ে নিচের দিকে দৌড়াদৌড়ি শুরু করল, চিটাগং থেকে গাড়ি চালিয়ে খালু, খালা, ঝুমকি ও পিংকু এসেছে। সবাই এসে তাদের ঘিরে ধরল । বড় খালা সবাইকে এক তলার নিচের বড় বসার ঘরটিতে তাড়াতাড়ি নিয়ে বসতে বললেন, সেই সঙ্গে বাহিরের দরজাগুলাে বন্ধ করে দিলেন। আমি আর রিংকু বড়দের ফাঁক দিয়ে কোনােমতে বসার ঘরে ঢুকে একপাশে দাঁড়ালাম। বড় খালু আমিনউদ্দিন আহমেদ মাঝখানে বসলেন, চিটাগংয়ের খালু (মুক্তিযােদ্ধা এনায়েত মওলা) তার পাশে বসলেন। সেদিন আমি, রিংকু আর ভাইজান শুধু ঝুমকি আর পিংকুকে দেখছিলাম। ওরা আমাদের আপন খালাতাে ভাই-বােন, আমাদেরই সমান বয়সী । পিংকু ভীষণ কালাে হয়ে রােগা হয়ে গেছে । আর ঝুমকি খালার (আতিমা মওলা লীনা) কোলে ঘুমিয়ে পড়ছে। লীনা খালা বলল- ওর প্যারা টাইফয়েড হয়েছিল, খুব শরীর খারাপ । চট্টগ্রামের বাড়ি কাকলী ছেড়ে চৌধুরীহাটের বাঁশখালীতে আমরা পালিয়ে গিয়েছিলাম। সেখানে বেশ কয়েক দিন ছিলাম, তখনই ঝুমকির ভীষণ জ্বর আসে। এরপর থেকে ওর শরীর খারাপ হয়ে যায়। মওলা খালু সবাইকে বলছিল, তাঁর বাড়ির সহকারীদের পাকিস্তানিরা কীভাবে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। হাবিব শহিদুল্লা আর আলিকে কাকলীর বাড়ি থেকে পাকিস্তানিরা ধরে নিয়ে নিজাম রােডের মােড়ে নিয়ে যায়, সেখানে পাকিস্তানিরা আরও অনেককে ধরে নিয়ে এসেছিল । এরপরে পাকিস্তানিরা ২২ জনকে লাইন করিয়ে নৃশংসভাবে গুলি চালিয়ে হত্যা করে। আলির গায়ে ৫টি গুলি লেগেছিল কিন্তু পাকিস্তানিরা চলে যাওয়ার পরে সে
৯২
কোনােমতে মাটির সঙ্গে বুক ঘেঁষটে ঘেঁষটে পশুশালা রােডের কাছে পৌছায়। একজন রিকশাওয়ালা তাকে কোনােমতে হাসপাতালে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায় । দ্বৈবক্রমে ঐ ২২ জনের মধ্যে আলি একমাত্র বেঁচে যায়। পরবর্তী সময়ে তার কাছ থেকে আমরা সেইদিনের ঘটনা জানতে পারি । পাকিস্তানিরা আমার উপর ক্ষিপ্ত হয়ে কাকলী বাড়ির সার্চ করতে এসে সবকিছু লুটপাট করে, তছনছ করে ওদের ধরে নিয়ে গিয়েছিল ।
এনায়েত খালুর বর্ণনা শুনতে শুনতে মা, মামি, মামা, বড় খালা ও বড় ভাই বােনেরা সবাই কাঁদছিল, আমি আর রিংকু বিহ্বল হয়ে সবকিছু দেখছিলাম । আরাে অনেক পরে ঝুমকি আমাকে দেখিয়েছিল, যেখানে হাবিবদাদের পাকিস্তানিরা হত্যা করেছিল সেই জায়গাটি, বর্তমানে সেখানে সেন্ট্রাল প্লাজা নির্মিত হয়েছে। এনায়েত মওলা (খালু) বলছিলেন- তিনি কীভাবে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়লেন। মার্চ মাসের শুরুতে চট্টগ্রামের তরুণ ছেলেরা বিভিন্ন বাসা থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করছিল । এরকম সময় অনেকেই জানতেন এনায়েত মওলার কাছে বেশ কিছু অস্ত্র আছে। কেননা তিনি পূর্ব পাকিস্তানের বেস্ট শু্যটার হিসেবে যথেষ্ট খ্যাতি লাভ করেছিলেন । তাই তরুণেরা তার কাছেও অস্ত্র সংগ্রহের জন্য এগিয়ে আসে। সেই সময় এনায়েত মওলা তরুণদের প্রশ্ন করেন, অস্ত্র সংগ্রহের সঙ্গে সঙ্গে অস্ত্র প্রশিক্ষণেরও প্রয়ােজন আছে। সেই সময় স্বতঃস্ফূর্ত তরুণেরা তার কাছে দাবি জানায় তাদেরকে অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য। এরপরে এনায়েত মওলার বাড়ি কাকলীতে অসংখ্য তরুণের আগমন শুরু হয়। প্রতিদিন সকাল বিকাল অস্ত্র প্রশিক্ষণের মহড়া শুরু হয় । খালু বলছিলেন। তিনি এমনকি অনেক তরুণকে চিনতেন না কিন্তু সবাই তাকে খালু বলে ডাকতাে। এরপরে কিছু তরুণী ও মহিলারাও অস্ত্র প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য এগিয়ে আসে। সেই সময় খালা মহিলাদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজ শুরু করে। এর কিছু দিন পরে পাকিস্তানি ইন্টেলিজেন্স বিভাগের লােকদের নজরে পড়ে যায় এনায়েত মওলার কাকলী বাড়িটি ও লাল রঙের টয়ােটা গাড়িটি।
আরাে অনেক পরে তারিক ও আমার কাছ থেকে সাহিত্য প্রকাশ-এর বিশিষ্ট প্রকাশকলেখক মফিদুল হক, এনায়েত মওলার মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী শুনে তার সঙ্গে দেখা করতে আগ্রহী হন এবং পরবর্তী সময়ে মফিদুল হক অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে এনায়েত মওলার লিখিত মুক্তিযুদ্ধের ভিন্ন ছবি- চট্টগ্রামের কাকলী’ বইটিসহ বেশ কয়েকটি বই প্রকাশ করেন। চট্টগ্রাম শহরে মক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অমূল্য দলিল হিসেবে এই বইটি বিবেচিত হওয়া চট্টগ্রাম শহরে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অমূল্য দ উচিৎ। এনায়েত মওলা অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার বর্ণনা করেছেন, সেটি হচ্ছে- কর্ণফুলী নদী ও পতেঙ্গা বন্দরে কীভাবে বাঙালি নির্ভীক তরুণ ছেলেরা প্রাণের মায়া ত্যাগ করে পাকিস্তানি জাহাজ অকেজো করার কাজে নিয়ােজিত হয়েছিল। এই সব তরুণদের একমাত্র অস্ত্র ছিল মাইন। রাতের অন্ধকারে ডুবসাঁতার কেটে পাকিস্তানি জাহাজের কাছে পৌছে জাহাজের নিচের দিকে মাইনগুলাে লাগিয়ে দিত। মাইন লাগানাের কাজ শেষ করে আবার সাঁতার কেটে ওপারে চলে যেত । মাইনগুলাের
৯৩
বিস্ফোরণ শুরু হতাে একটা নির্দিষ্ট সময়ের পরে। নদীতে স্রোত থাকলে এই কাজটি করা খুব দুঃসাধ্য ছিল। সেজন্য জোয়ারের আর ভাটার শুরুতে যখন পানিতে স্রোতের টান থাকে না সেই সময়টাকে বেছে নেওয়া হতাে। এইভাবে একাধিক পাকিস্তানি জাহাজ ডুবির পর বন্দরে ও নদীতে পাকিস্তানিরা অতিরিক্ত প্রহরী মােতায়েন করে। পাকিস্তানিরা ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে পরে, তারা কচুরিপানা নড়তে দেখলেও গুলি করা শুরু করতাে। কিন্তু কোনােভাবেই বাঙালি নির্ভীক তরুণদের প্রতিহত করতে পারে নাই । চট্টগ্রামে বাঙালি তরুণদের ক্রমাগত আক্রমণে জাহাজ ডুবির ফলে পাকিস্তানিদের মনােবল ভেঙে পড়ে। এনায়েত মওলা তাঁর বইতে মুক্তিযুদ্ধের সময়ের অনেক উল্লেখযােগ্য ঘটনা বর্ণনা করেছেন। একাত্তরে চাটগাঁর খালা-খালু, ঝুমকি-পিংকুসহ বেশ কয়েকদিন ধানমণ্ডিতে বড় খালার বাসায় থেকে আবার চট্টগ্রামে ফিরে যান। যাওয়ার সময় বড় খালা হামিদা আহমেদ, এনায়েত মওলাকে বার বার অনুরােধ করেছিলেন তার বােন লীনা ও ঝুমকি-পিংকুকে ঢাকার ধানমণ্ডিতে তার বাসায় রেখে যাওয়ার জন্য। কিন্তু লীনা খালা খালুকে ছাড়া থাকতে চান নাই। অনেক কিছুর ভেতর দিয়ে বড় খালা সবার দায়িত্ব নিয়ে ধানমণ্ডির বাসায় স্নেহের সঙ্গে দুই হাতে সবাইকে একত্রিত করে রেখেছিলেন। এত কিছুর ভিতর বড় খালা হামিদা বেগম সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তায় থাকতাে ছােট বােনের স্বামী মাহবুবল হক (মাফুকে) নিয়ে । কেননা তিনি সার্জেন্ট জহুরুল হকের বড় ভাই । মাফুর মেজো ভাই আইনজীবী আমিনুল হক ইতােমধ্যে মুক্তিযুদ্ধে চলে গেছেন। চারদিকে মানুষজন বলাবলি করছে, পাকিস্তানিরা বাংলাদেশের মানুষদের গত কয়েক মাস গণহত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি। তারা নতুন করে লিস্ট করছে, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, ডাক্তার, শিল্পী- অর্থাৎ সমাজের জ্ঞানীগুণী লােকজনের নামের তালিকা করছে। বর্বর পাকিস্তানিরা আবারাে তাদের হত্যা করার পরিকল্পনা করছে। এরই মধ্যে বাবা, মাহবুবুল হক এই বিপর্যয়ে অর্থনৈতিক সংকটের জন্য প্রাণের মায়া ত্যাগ করে এবং আরাে বাঙালি ব্যাংক কর্মকর্তাদের সহায়তার জন্য প্রতিদিন মতিঝিলে স্টেট ব্যাংকে যেতেন। তিনি হিসাব কাজে নিয়ােজিত না থাকলে বহু বাঙালি অফিসার বেতন পেতেন না। বাবার মনে হতাে এই ব্যাংক, এই অর্থ-সম্পদ সকলই বাংলার মানুষের। কোনােভাবেই পাকিস্তানিদের হাতে সম্পূর্ণভাবে ছেড়ে দেয়া যায় না। তিনি সততার সঙ্গে সেই কঠিন সময়ে নিজ দায়িত্ব পালন করেছেন। একদিন হঠাৎ একটা ফোন পেয়ে বড় খালা থমকে গেলেন। বাড়ির সবাই চিন্তিত হয়ে পড়ল। বাবার বাচ্চু ফুপুর মেজো ছেলে আজাদকে (আজিজুর রশীদ) এয়ারপাের্টে পৌছানাের জন্য মাহবুবুল হক পুরাতন এয়ারপাের্টে গিয়েছিলেন। বাবার কাছে তার বাচ্চু ফুপু সম্মানীয় ব্যক্তি ছিলেন। তিনি অনুরােধ করেন আজাদ লন্ডনে সিএ পড়তে যাবে, ওর সঙ্গে এয়ারপাের্টে যাওয়ার কোনাে লােক পাচ্ছি না। এমন অবস্থায়, তুই কি আজাদকে এয়ারপাের্টে সি-অফ করতে যেতে পারবি? আজাদ বাবার ছােট ভাই। বাবা তাকে অনেক আদর করতেন। বাবা বললেন- অসুবিধা নাই ফুপু, আমি ওকে এয়ারপাের্টে পৌঁছে দিয়ে আসবাে।
৯৪
সময়টা ছিল ‘৭১-এর নভেম্বর মাস। বাবা ছােট ভাই আজাদকে মগবাজারের বাসা থেকে নিয়ে পুরাতন এয়ারপাের্টে গেলেন । ছােট ভাই ইমিগ্রেশন পার হয়ে যাওয়ার পর, ধীরে ধীরে তিনি বের হয়ে একটি যানবাহন খুঁজতে থাকেন আর সেই সময় পাকিস্তানি ইন্টেলিজেন্সের লােকেরা তাকে ফলাে করা শুরু করে। পুরাতন এয়ারপাের্টের রাস্তায় হঠাৎ মাহবুবল হক দেখেন একটি বাস আসছে, তিনি দ্রুত তাতে উঠে পড়েন।
পাকিস্তানি গােয়েন্দা বিভাগের লােকেরা মগবাজারে রশীদ সাহেবের (অর্থাৎ বাচ্চু ফুপুর) বাড়িতে গিয়ে খোঁজ নেয়। তারা জানতে চায়- মাহবুবল হক কোথায়? সে সার্জেন্ট জহুরুল হকের বড় ভাই, আমরা তাকে খুঁজতে এসেছি।’ বাচ্চু দাদি খুব শান্তভাবে তাদের বলেন- সে অনেক দিন আগেই এখান থেকে চলে গেছেন। এর পরেই বাবার ফুপাতাে বােন রানু ফুপু (খােদেজা রশীদ) বড় খালাকে ফোন করে সাবধান করেন। ইঙ্গিত ভাষায় তিনি তার বড় দাদাকে সরে যেতে বলেন। এরই মধ্যে বাবা ধানমণ্ডির বাসায় পৌছেন। বাসার সবাই থমথমে চেহারায় বসে আছে । মা নীরবে কাঁদছেন, বড় খালা বাবাকে সব কিছু বুঝিয়ে বললেন । খালু বললেন- মাফু তােমাকে কয়েকটা দিন কোথাও আত্মগােপন করতে হবে । বাবা তার স্বভাবসুলভ আচরণে সব কিছু শান্তভাবে শুনলেন এবং বুঝতে পারলেন- এই মুহূর্তে তাকে খুঁজতে এখানে যদি পাকিস্তানিরা আসে তবে বাড়িসুদ্ধ ২৫/৩০ জনকে মুহূর্তের মধ্যে তারা নৃশংসভাবে হত্যা করবে। বাবা বুঝতে পারলেন, তার জন্য বাড়ির সবাই বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়বে। বাবা কিছুক্ষণ চুপ থেকে ধীরে ধীরে মাকে বললেন- খুব অল্প কয়েকটা কাপড় গুছিয়ে দেওয়ার জন্য, তিনি দ্রুত এখান থেকে চলে যাবেন। মা, বড় খালা, মামি, ভাই-বােনেরা সবার কাছে তিনি প্রিয় ব্যক্তি, সবাই নীরবে কাঁদতে থাকলেন। আমি কিন্তু সেদিন কাঁদি নাই । চুপচাপ স্থির হয়ে পাথরের মতাে দাঁড়িয়ে
৯৫
দেখছি। বাবা একটা ছােট ব্যাগ নিয়ে ধীরে ধীরে ধানমণ্ডির বাসার পেছনের রাস্তা দিয়ে বের হয়ে চলে গেলেন। বাবা কোথায় চলে গেলেন আমি জানি না। কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করিনি, শুধু দেখেছি মা খুব কাঁদছে । ভাইজানও কাঁদছে। ছােট মামি কাদছে । বড় খালা স্থির হয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন। আমি বুঝতে পারছিলাম না, আমি কেন কাঁদছি না । শুধু মনে হয়েছিল পাকিস্তানিরা যেন বাবাকে না ধরতে পারে । মা বারবার বলছিলেন, ‘দোয়া করাে।
বেশ কয়েক দিন পর বাবা ফিরে এলেন। সেদিন ধানমণ্ডি থেকে বের হয়ে মাহবুবল হক বেশ কিছুটা পথ হাঁটতে হাঁটতে আজিমপুর হয়ে লালবাগ কেল্লা পার হয়ে খাজে দেওয়ান চলে গিয়েছিলেন । খাজে দেওয়ান ছিল মাহবুবুল হকের নানার বাড়ি । তিনি চার-পাঁচ দিন তাঁর ছােট মামা আর বড় মামার বাসায় মিলেমিশে থেকেছিলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধ শুধুমাত্র রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কাহিনি নয় । লক্ষ লক্ষ দেশপ্রেমী সাধারণ মানুষের আত্মত্যাগ আর প্রতিনিয়ত কষ্টের ফসল এই স্বাধীনতা। বাংলার আনাচে-কানাচে প্রায় প্রতিটি ঘরের মানুষ কোনাে না কোনােভাবে এই মুক্তিসংগ্রামের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছিল । চরম দুঃখজনক হলেও একথা সত্য- এই বাঙালিদের ভেতর থেকেই রাজাকার, আলবদর এবং মীরজাফরদের সৃষ্টি হয়েছিল। পাকিস্তানিদের তৈরি বাঙালি আলবদরগােষ্ঠী বাঙালি মুক্তিযােদ্ধাদের ঘাটির সন্ধান ও নিরীহ বাঙালিদের বর্বর ঘাতকদের হাতে তুলে দিত। পাকিস্তানিদের টর্চার সেলগুলােতেও বাঙালি নামধারী আলবদরদের বিশেষ ভূমিকা ছিল।
৯৬
বাবা-মা আর আমি মাঝে মাঝেই রিকশায় করে ধানমণ্ডি থেকে এলিফ্যান্ট রােডে চাচিমার বাসায় যেতাম । প্লেনওয়ালা মসজিদের পাশেই ছিল চিত্রাবাড়ি । মা গিয়ে চাচিমার পাশে বসতেন। আমি অঞ্জনের সঙ্গে খেলা শুরু করে দিতাম। বাবা চুপচাপ একটা চেয়ারে বসে থাকতেন। ভারত থেকে চাচার (আমিনুল হকের) কোনাে খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। চাচিমা স্থির হয়ে বসে থাকতেন, তেমন কোনাে কথা বলতেন না। মাঝে মাঝে উঠে গিয়ে আমার জন্য নিজের হাতে বানানাে বিস্কুট প্লেটে করে নিয়ে আসতেন, বাবা-মাকে চা-নাস্তা দিতেন। এমনি একটি থমথমে পরিবেশ বাবা দুশ্চিন্তায় আরও নিশ্ৰুপ হয়ে পড়লেন।
এর কিছুদিন পর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে সারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রতিনিয়ত মুক্তিবাহিনীর বিজয়ের খবর আসতে শুরু করে। ভারতীয় সৈন্যরা অর্থাৎ মিত্রবাহিনী হিসেবে বাংলাদেশে প্রবেশ করে মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গে একত্রে পাকিস্তানিদের আক্রমণ করতে শুরু করে। ভারতীয়দের ঐকান্তিক সহযােগিতায় যুদ্ধটি দ্রুত পরিণতির। দিকে এগিয়ে যায়। ডিসেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের দিকে বাবা খবর পেলেন তার সাব চাচাকে (মােফাজ্জল হায়দার চৌধুরীকে) রাজাকাররা তাঁর বাসভবন থেকে ধরে নিয়ে গেছে। ইতােমধ্যে বিমান হামলা শুরু হয়েছে। বাঙালি কয়েকজন তরুণ বৈমানিক ভারতীয়দের সাহায্যে পাকিস্তানি ঘাঁটিতে হামলা শুরু করে। সন্ধ্যার পর বিমান আক্রমণ শুরু হতাে। বড় খালাতাে ভাইয়েরা সবাই মিলে, বাড়ির পেছনের বাগানে কোদাল চালিয়ে দ্রুত ট্রেঞ্চ বানানাের কাজ শুরু করল । জেড শেইপের একটি ট্রেঞ্চ তৈরি হলাে। পাশের বাসায় ডা. লস্করের আত্মীয়-স্বজনরাও তাঁদের বাগানে একটি ট্রেঞ্চ তৈরি করল । ডা. লস্করের স্ত্রীর নাম ছিল হামিদা, বড় খালার নামও ছিল হামিদা- তাই তাঁরা একে অপরকে মিতা ডাকতেন। বিমানযুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছু আগে থেকেই বড় খালা বাড়ির সামনের দরজাটি বন্ধ করে রাখতেন। দুই প্রতিবেশীর মধ্যে গভীর সম্পর্ক ছিল । ডা. লস্করের ছােট মেয়ে মিতু আর বড় খালার ছােট ছেলে লুপু ভাই সমবয়সী হওয়ায় তাদের মধ্যে খুবই বন্ধুত্ব ছিল। এমনকি পরবর্তী সময়ে লুপু ভাইয়ের সঙ্গে মিতু বু’র বিয়ে হয়। ডা, লস্করের ভায়রাভাই ছিলেন নাট্যকার সু-লেখক আনিস চৌধুরী ওনার স্ত্রী রিজিয়া খালার সঙ্গে বড় খালা, মা, ছােট মামা- সবার সম্পর্ক ছিল গভীর বন্ধুত্বের । রিজিয়া খালার মেয়ে লুভা, মিতুবু, লুপু ভাই, মঞ্জু (ভাইজান), রিংকু আর আমি অনেক খেলাধুলা করতাম । বিমানযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বড় খালা দুই বাড়ির মাঝখানের দেয়ালের ওপর কাঁটাতারের বেড়াটি কিছু অংশ কেটে দেন এবং দুই পাশে দুটি বাঁশের সিঁড়ি বসানাে হয়। যাতে এক বাসা থেকে আরেক বাসায় অনায়াসে যাতায়াত করা যায়। এখনাে মনে আছে, লুভার (শিল্পী-স্থপতি লুভা নাহিদ চৌধুরী) জন্মদিন ছিল- ও সেদিন একটা সাদা রঙের ফ্রক পরেছিল। আর বাঁশের সিঁড়ি টপকিয়ে কাঁটাতারের ফুটো দিয়ে আমরা এক বাসা থেকে আরেক বাসায় যাতায়াত করতাম।
৯৭
যুদ্ধের সময় বিমান আক্রমণের আগে সাইরেন বাজলে সবাই দৌড়ে গিয়ে ট্রেঞ্চের ভেতরে গিয়ে বসত। ট্রেঞ্চের ভেতর বড় খালা পলিথিন জোগাড় করে বিছালেনবাচ্চাদের কষ্ট হবে ভেবে। এ ছাড়া ডিসেম্বর মাসে কিছু কথা-কম্বল নিয়ে রেখেছিলেন।
আমার এখনাে মনে আছে, ট্রেঞ্চে বসে আমি, রিংকু আর ভাইজান অনেক দোয়া পড়ছি, মা ছােট্ট রেশমীকে বুকের ভেতর জড়িয়ে বসে থাকতেন। মামা, মামি- সবাই ভয়ে ভয়ে দোয়া পড়ত । ওপর দিয়ে বিকট শব্দে প্লেন দ্রুত চলে যাচ্ছে, মাঝে মাঝে মেশিনগানের আওয়াজ, আর বােমা পড়ার শব্দ শুনতাম। ট্রেঞ্চের ওপর গাছপালা কেটে জঙ্গল করে রাখা হয়েছিল, যাতে মনে হয় এটি সবুজে আবৃত স্থান, ভেতরে ঢােকার জন্য কয়েক ধাপের একটা সিঁড়ি ছিল। বিমান আক্রমণ শুরু হওয়ার দু-তিন দিন পর বাবা হঠাৎ মাকে বললেন- বিমান হামলার সময় তিনি আর ট্রেঞ্চে যাবেন না, বাড়িতেই থাকবেন, মা তাকে অনেক বােঝালেন যে, বাড়ির ওপর হামলা হতে পারে কিংবা কোনাে শেল জানালা দিয়ে এসে আঘাত করতে পারে । অনেক বাড়িতে মানুষ এভাবে বােমায়, শেলের আঘাতে মারা যাচ্ছে । বাবা বললেন- আমার এক ভাই দেশ স্বাধীন করার জন্য মারা গেছে, আর এক ভাই মুক্তিযুদ্ধে চলে গেছে, আমি তােমাদের জন্য, পরিবারের জন্য একসঙ্গে আছি; কিন্তু আমি মৃত্যু ভয়ে মাটির গর্তে ডুকবাে না । মৃত্যু এলে এখানেই মারা যাবাে, তবে তুমি বাচ্চাদের নিয়ে নিরাপত্তার প্রয়ােজনে বুবুর সঙ্গে ট্রেঞ্চে যাবে । এ সময় হঠাৎ একদিন লুপু ভাই আমাদের বলল- ভারত থেকে যুদ্ধবিমান এসে পাকিস্তানি ঘাঁটির ওপর আক্রমণ শুরু করেছে, বড় খালাতাে ভাই-বােনরা সিঁড়ির জানালা দিয়ে ডকফাইট দেখার চেষ্টা করছে। আমরা সবাই একসঙ্গে দৌড় দিলাম দেখার জন্য, আমি আর রিংকু ধাক্কাধাক্কি করে বড়দের পাশে দাঁড়ালাম। ঝাপসা মনে পড়ে দর আকাশে একটি দুটি প্লেন দেখেছিলাম । ৯ মাসের যুদ্ধে সারা বাংলাদেশের সবুজ মাটি রক্তরঞ্জিত হয়ে ওঠে। কত যে মানুষ গৃহহীন হয়েছিল, তার হিসাব এখনও করা সম্ভব হয়নি। ৩০ লক্ষ শহিদ, ৩ লক্ষ মা-বােনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে প্রিয় মাতৃভূমি মুক্ত হলাে- ১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৭১। হঠাৎ শুনলাম দেশ স্বাধীন, বাবা নীরবে ভাইদের জন্য কাঁদছিল, ছােট মামিও কাঁদছিল, ভাই-বােনরা সবাই উত্তেজিত হয়ে পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের কথা আলােচনা করছিল। সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে পাকিস্তানি জেনারেল নিয়াজি আত্মসমর্পণ করবে। সেখানে হাজার হাজার মানুষের ভিড় হচ্ছে, অনেকেই যাচ্ছে পাকিস্তানিদের পরাজয় দেখতে। বড় খালা কড়া নির্দেশ দিলেন বাড়ি থেকে কেউ বেরােতে পারবে না, কেননা এ রকম পরিস্থিতিতে উত্তেজনায় অনেক রকম দুর্ঘটনা ঘটছে। কিন্তু বড় খালুকে বললেন তিনি। গাড়ি নিয়ে আত্মসমর্পণ দেখার জন্য রেসকোর্স ময়দানে (সােহরাওয়ার্দী উদ্যান) যাবেন। এমনকি বড় খালু, বাবা, ছােট মামা বা ভাই-বােনদের কাউকে নেবেন না। শুধু বড় ছেলে বীরু গাড়ি চালাবে, তিনি আমাকে, ভাইজান (মঞ্জু) আর রিংকুকে নিয়ে ঘুরে আসবেন।
৯৮
শুধু মনে আছে, গাড়ি করে আমরা ধানমণ্ডি থেকে বের হয়ে কিছুদূর যাওয়ার পর অসংখ্য মানুষের ঢল দেখেছিলাম, রেসকোর্স ময়দানের কাছাকাছি যাওয়ার পর, বড় ভাই বীরু বললেন- এখানে হাজার হাজার মানুষ, মা এত সহজ হবে না আত্মসমর্পণের স্থানের কাছাকাছি পৌছানাে।
বড় খালা আমার আর রিংকুর হাত ধরে গাড়ি থেকে নেমে একটু দাঁড়ালেন, সবকিছু স্পষ্ট মনে নাই, তবে এইটুকু মনে আছে সেখানে অসংখ্য মানুষ উল্লাসের সঙ্গে দ্রুত হেঁটে, কেউ বা দৌড়ে যাচ্ছিল। বড় খালা আমাদের নিয়ে আবার নিরাপদে বাড়িতে ফেরত আসলেন। সবাই উৎসুক হয়ে প্রশ্ন করলেন। তিনি কি কিছু দেখতে পেরেছেন? বড় খালা বললেন- আমি জানতাম অনেক মানুষের ভিড় থাকবে, পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান দেখা যাবে না। আমি শুধু দেখতে গিয়েছিলাম বাঙালির বিজয়ের উল্লাস, নয় মাস এত কষ্টভােগের পর মানুষের চোখে মুক্তির আনন্দাশ্রু।
৯৯
১৯৭৫ সাল- অন্ধকার সময়
১৯৮২ সালে সবে কলেজ শেষ করেছি, সেই সময় ধীরে ধীরে আমার মনের ভেতর আবার ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার’ গূঢ় রহস্য জানার আগ্রহ তৈরি হলাে। কিন্তু সেসময়ে আমাদের পরিবারে আরেকটি যুদ্ধের দমকা হাওয়া আবার সব তছনছ করে দিল, অনেকের মনে হতে পারে, বিশেষত আজকের প্রজন্মের অনেকের মনে হতে পারেস্বাধীন দেশে কিসের যুদ্ধ? ১৯৮২ সালে দেশ দ্বিতীয়বারের মতাে সামরিক শাসকের হাতে চলে যায়। ১৯৮২ সালের সামরিক শাসনের কথা উল্লেখ করার আগে প্রথমবারের সামরিক শাসনের অন্ধকার সময়ের কথা আগে উল্লেখ করা প্রয়ােজন । তখনাে আমি ছােট ছিলাম । শাহীন স্কুলে পড়ার সময়, সামাজিক ইতিহাসের বইতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিষয়ে একটি অধ্যায় ছিল। কিন্তু ‘৭৫ সালে সামরিক শাসকের আবির্ভাবের পর ইতিহাসের বইতে আগরতলা মামলার অধ্যায়টি অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত হয়ে যায়। তবুও সার্জেন্ট জহুরুল হকের আত্মত্যাগের কথাটি উল্লেখ ছিল । তখনাে আমার মনে আগরতলা মামলা সম্পর্কে নানা রকম প্রশ্ন সৃষ্টি হতাে। প্রথমবারের সামরিক শাসকের আবির্ভাবের ফলে সদ্যস্বাধীনতাপ্রাপ্ত আমাদের দেশের মহিমায় যে কুৎসিত কালিমার ইতিহাস রচনা হয়েছিল, তা বর্ণনাতীত । কিছু বর্বর মনুষ্যত্বহীন মানুষ নামধারী প্রাণী তারা জন্মসূত্রে বাঙালি, তবুও তারা মানুষ না- তারা বাঙালি জাতির পরিচয় হত্যা করেছিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের কাকডাকা ভােরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু এবং তার পরিবারের ১৮ জন সদস্যকে নির্মমভাবে হত্যা করার মধ্য দিয়ে সমস্ত জাতি অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত হয়। সেই বীর বাঙালি জাতি যারা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন, তারা চুপ করে ছিল কেন? সে প্রশ্নের উত্তর আজও পাইনি। মর্মান্তিক সেই হত্যাকাণ্ডের সংবাদ শুনে কি দেশবাসী হকচকিত হয়ে পড়ে? আমার মনে আছে, আমি আর ভাইজান কয়েকজন বাচ্চাসহ ভােরের একটা বাসে করে বনানী থেকে শাহীন স্কুলে যাই। স্কুলে পৌছে দেখি গেট বন্ধ । প্রিন্সিপাল মামুনুর রশীদ স্যার দাঁড়িয়ে ছিলেন স্কুলের গেটের সামনে ।। তিনি আমাদের বললেন- বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিজনকে হত্যা করা হয়েছে, তােমরা তাড়াতাড়ি বাসায় চলে যাও।
১০৩

________________________________________
স্কুল বন্ধ থাকায় আমরা ভয় পেয়ে দেরি না করে দ্রুত বাসায় যাওয়ার চিন্তা করি। তারপর ভাইজান একটা রিকশা ঠিক করল। আমার তখনও রাজনীতি ও দেশ বােঝার মতাে বয়স হয়নি। শুধু মনে হয়েছিল, ছােটবেলায় আমি একবার বঙ্গবন্ধুকে দেখেছিলাম। সেই অবিস্মরণীয় মুহূর্তটির কথা আমি পরে বলব । কিন্তু তখন আমার আরাে মনে হয়েছিল যে আমি তাে শেখ কামালকে দেখেছিলাম। তিনি শাহীন স্কুলে পড়তেন। মামুন স্যার শাহীন স্কুলে ব্রতচারী শিক্ষার বিশাল ব্যবস্থা করেছিলেন। তখন ভারতসহ অন্যান্য দেশ থেকে এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ছাত্রছাত্রীরা এসে শাহীন স্কুলে ব্রতচারীর প্রশিক্ষণ নিয়েছিল। সেই সময় একদিন স্কুলের অনুষ্ঠানে আমি শেখ কামালকে দেখেছিলাম। শাহীন স্কুলে সেইসময়ে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযােগিতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে শেখ কামালের একটি বড় ভূমিকা থাকতাে। শেখ কামালকে আমি আরও একদিন খুব কাছ থেকে দেখেছিলাম, স্বাধীনতার পর উনি আমাদের বনানী বাড়িতে এসেছিলেন। আমাদের ড্রয়িংরুমে সার্জেন্ট জহুরুল হকের ছবিটি দেখার জন্য আর বাবার সঙ্গে দেখা করার জন্য এসেছিলেন। এখনও মনে পড়ে, আমি ভাইজানের পাশে দাঁড়িয়ে আছি।
১০৪
বাবা ওনাকে ছােট চাচার ছবি দেখাচ্ছেন আর কথা বলছেন- আমি শেখ কামালকে দেখছিলাম, শেখ কামাল সুদর্শন ছিলেন। বঙ্গবন্ধুসহ তার পরিবারের সদস্যদের হত্যার খবর ইতােমধ্যে ছড়িয়ে পড়ায় মা খুব উদ্বিগ্ন হয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। আমরা বাড়িতে পৌছলে মা বললেন- কয়েক দিন স্কুলে যাওয়ার দরকার নেই। বাবা বললেন- পরিস্থিতি খারাপ, বাঙালি নামধারী কিছুসংখ্যক উদ্ধত, উচ্ছখল মানুষের কুকর্মের ফলে আমরা আবার স্বাধীনতা হারালাম । আমার সেই সময়ের প্রতিটি দিনের কথা মনে নেই, যাদের আছে তারা নিশ্চয়ই লিখবেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যার অল্প কয়েক দিন পরে হঠাৎ একদিন দেখি বাবা-মা খুব অস্থির । বাবার মুখ কালাে হয়ে গেছে গভীর চিন্তায়, তিনি বারবার টেলিফোন করতে গার্ডরুমের দিকে যাচ্ছেন। মা-বাবা বারবার কিছু কথা আস্তে আস্তে বলছে। আমি ভাইজানকে জিজ্ঞেস করে জানলাম কী হয়েছে- এলিফ্যান্ট রােডের চিত্রা বাড়ি থেকে চাচিমা ফোন করে জানিয়েছেন চাচা বিকাল বেলা বেরিয়েছেন, তখন অনেক রাত, এখনও বাসায় ফেরেননি, চাচার সঙ্গে ছিলেন ফজলুল হক চাচা। চাচিমা ফজলুল হক চাচার বাসায় ফোন করে জেনেছেন, উনিও ফেরেন নাই। বাবা, মা, চাচিমা বুঝতে পারছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর চাচার এই নিখোঁজ হওয়াটা স্বাভাবিক না। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট ঘাতক বাহিনীর হাতে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবার নিহত হওয়ার পর আমিনুল হক অস্থির হয়ে পড়েন; তিনি বুঝতে পারছিলেন না তারা কোন দেশে আছেন- স্বাধীন বাংলাদেশে না পাকিস্তানে? ফ্লাইট সার্জেন্ট ফজলুল হকও বিভ্রান্ত হয়ে আমিনুল হককে ফোন করেন, আমিনুল হক তাঁকে চিত্রা বাড়ি চলে আসতে বলেন। এরপর তারা দুই বন্ধু একটি ট্যাক্সি নিয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে লে. কর্নেল শওকত আলীর বাসায় যান। সেই আগরতলার মামলার সময় থেকেই তাদের গভীর বন্ধুত্ব ছিল, দেশের এই ক্রান্তিকালে কী অবস্থা তৈরি হবে? কী করণীয়? এই নিয়ে আলােচনা করার জন্য একসঙ্গে বসেছিলেন। দুশ্চিন্তা আর ভারাক্রান্ত মন নিয়ে সন্ধ্যার পর তারা দুজন লে. কর্নেল শওকতের বাসা থেকে বের হন। তারা দু’জন ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের জাহাঙ্গীর গেটের কাছে হাঁটতে হাঁটতে এসে একটি বেবি ট্যাক্সি খুঁজছিলেন, তখন হঠাৎ করে দু-তিনজন সাদা পােশাকধারী লােক এসে তাদের পথ রােধ করে দাঁড়ায় । আমিনুল হক ও ফজলুল হককে আর্মির গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে যায় । সেই ঘাতক নেকড়েদের গুহা- শাহবাগের নিকট বাংলাদেশ বেতার কেন্দ্রে। কোনাে রকম আলােচনা ছাড়াই তারা আমাদের দুই চাচার ওপর অমানুষিক নির্যাতন শুরু করে। সারা দিন পার হয়ে যাওয়ায় চাচিমা উদ্বিগ্ন হয়ে কর্নেল শওকত চাচাকে ফোন করেন । খুব সংক্ষেপে যদি লিখি, স্বাধীন দেশে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যাকাণ্ডের পর এই দেশ অনিশ্চয়তার এক কালাে ছায়ার নিচে নিমজ্জিত হয়েছিল, সেটি চাচিমা বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি তার উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা রােধ করতে পারছিলেন না । চাচার খোজে তিনি বাবাকে ও বিভিন্ন জায়গায় ফোন করা শুরু করেন। ব্রিগেডিয়ার শাফায়েত
১০৫
জামিল ছিলেন চাচিমার বড় বােনের ছেলে, একপর্যায়ে চাচিমা দোদুল ভাইকে (ব্রি. শাফায়েত জামিলকে) ফোন করেন। কর্নেল শওকত আলী কয়েকটি জায়গায় ফোন করে বুঝতে পারলেন যে, তাঁর বাসা থেকে বের হওয়ার পর আমিনুল হক এবং ফ্লাইট সার্জেন্ট ফজলুল হককে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে রেডিও অফিসে। সেখানে বঙ্গবন্ধুর ঘাতকরা তাদের ঘাঁটি তৈরি করেছিল । কর্নেল শওকত সেখানে ফোন করে আমিনুল হক এবং ফজলুল হকের কোনাে প্রকার ক্ষতি না করার জন্য সতর্ক করেন। এদিকে দোদুল ভাই- মেজর ডালিম এবং অন্যদের সঙ্গে যােগাযােগ শুরু করেন এবং দ্রুত তাদের ছেড়ে দেওয়ার জন্য কঠিন চাপ সৃষ্টি করেন। ভােরের দিকে আমিনুল হককে আর্মির একটি গাড়ি এসে এলিফ্যান্ট রােডের বাসায় নামিয়ে দিয়ে যায়। আমরা আজো ভাবতে পারি না আমিনুল হকের মতাে একজন বিচক্ষণ প্রাজ্ঞ মানুষকে তারা কীভাবে শারীরিক অত্যাচার করেছিল । আজ মনে হয়, বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের পক্ষে তাে তা-ই স্বাভাবিক। কিন্তু আরও আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটেছিল। তার পরের দিন আবার ঘাতক দলের কিছু সেনা সদস্য অতর্কিত এলিফ্যান্ট রােডের চিত্রা বাড়িতে রেইড দেয়ার মতাে প্রবেশ করে । আজ আশ্চর্য হয়ে ভাবি, অতবড় আইনজীবীর বাড়িতে কোনাে রকম ওয়ারেন্ট ছাড়া তারা প্রবেশ করেছিল কোন অধিকারে? ১৯৭৫-এর ১৫ই আগস্টের পর দেশ আবারও এক ঘন অন্ধকারে নেকড়ের ছােবলের তলায় চলে যায়। সেদিন হঠাৎ করে যারা রেইড করতে এসেছিল তাদের ব্যবহার ছিল হামলাকারীদের মতাে, বাড়ির সমস্ত জিনিসপত্র তছনছ করে তারা খুঁজতে থাকে। কী তারা খুঁজছিল তারাই জানে, আলমারি, বইয়ের আলমারি থেকে সব জিনিসপত্র মাটিতে ছুড়ে ফেলে দিতে থাকে । চাচা, চাচিমাসহ বাড়ির অন্যরা সবাই বিহ্বল হয়ে পড়ে। সেই সময় দাদি, আমিনুল হকের ছােট খালা মিসেস রহমত আরাও তার বাসায় ছিলেন, একপর্যায়ে উনি সামনে এসে প্রশ্ন করেন। আপনারা কী খুঁজছেন? উদ্ধত সেই গােষ্ঠীর মাঝে কোনােরূপ আচরণগত সুশিক্ষা ছিল না, কীভাবে একজন বর্ষীয়ান মহিলার সঙ্গে কথা বলতে হয়, কথার উত্তর না দিয়ে তারা সজোরে দাদিকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়, দাদি (মিসেস রহমত আরা) মাটিতে পড়ে যায় । হকচকিত চাচিমা আমার ভাই অঞ্জনকে নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন। কয়েক ঘণ্টা তাণ্ডবলীলা চালিয়ে তারা পুনরায় আসবে বলে বেরিয়ে পড়ে। পরের দিন খুব ভােরে মিসেস রহমত আরার ঘুম ভেঙে যায়। সারা রাত ঘুম হয়নি। গতকালের তাণ্ডবলীলায় বাড়িতে কেউ শান্তি মতাে ঘুমাতে পারেনি। তিনি খুব দ্রুত বাইরে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে গেলেন, মনু (আমিনুল হক) ও লুলুর সঙ্গে কথা বলে কর্নেল শওকত আলীর স্ত্রী মাজেদা শওকতকে ফোন করলেন এবং তাঁকে নিউ মার্কেটের বেবি আইসক্রিমের দোকানে আসতে বললেন। তিনি এলিফ্যান্ট রােডে এসে দ্রুত একটা রিকশা নিলেন নিউ মার্কেটে যাওয়ার জন্য । রিকশায় বসে মিসেস রহমত আরা একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলেন, গত কয়েক দিনের পরিস্থিতিতে তার মনে হচ্ছিল, এই স্বাধীন দেশে তিনি ঘর থেকে বের হতে পারছেন না। কীভাবে এই দেশের মানুষ বঙ্গবন্ধুকে ও তাঁর পরিবারকে হত্যা করতে পারে?
১০৬
তাঁর চোখের ওপর ভেসে ওঠল, বড় বােনের ছােট ছেলে (ভাগিনা) জহুরের কথা। ১৯৬৬ সালে তারা যখন রাওয়ালপিন্ডিতে বদলি হয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে যান তখন জহুর (রুনু) প্রায়ই অফিস থেকে ছুটি নিয়ে তাদের বাসায় আসতেন। তাঁর ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে জহুরের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। সাব্বিরের জন্মদিনে ও অন্যান্য অনুষ্ঠানে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে তাদের বাসায় চলে আসতেন।
সে সময় রুনু তাঁকে বলেছিল- পাকিস্তানে বাঙালি অফিসার এবং সৈনিক পর্যায়ের অনেক কর্মচারী পাকিস্তানিদের দুর্ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়ে একটি গােপন সংগঠন তৈরি করেছে এবং দেশ স্বাধীন করার জন্য পরিকল্পনা চলছে। রুনুর (জহুরুল হক) এই ধরনের পরিকল্পনার কথা শুনে তিনি আঁতকে উঠেছিলেন, ওকে বলেছিলেন, তুমি খুব সাবধানে থেকো । মন বলেছিল- রুনু অনেক বড় বিপদে জড়িয়ে
১০৭
এসব কথা ভাবতে ভাবতে মিসেস রহমত আরা নিউ মার্কেটে এসে পৌঁছেন। রিকশাভাড়া। মিটিয়ে বেবি আইসক্রিমের দোকানে যান। সেখানে মাজেদা তাঁর জন্য অপেক্ষা করছেন। রহমত আরা মাজেদা কোনার দিকে একটি টেবিলে বসেন। এরপর রহমত আরা মাজেদার কাছ থেকে জানতে চান, সেদিন আমিনুল হক আর ফজলুল হকের সঙ্গে আর কেউ তাদের বাসায় গিয়েছিল কি না? এ ছাড়া আরাে জানতে চান, সেখানে আর কেউ উপস্থিত ছিল কি না? মাজেদা শওকত অত্যন্ত ব্যথিত হয়ে বললেন- না, আমাদের বাসায় শুধু আমিনুল হক ও ফজলুল হক এসেছিলেন। আপনি তাে জানেন বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সারা শহরের পরিস্থিতি অত্যন্ত খারাপ, কেউ বাসা থেকে তেমন বের হচ্ছে না। সবাই নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে বাসায় বা খুব প্রয়ােজনীয় জায়গায় যাওয়া ছাড়া মানুষের গতিবিধি খুব কম। আজকেও আমি আসার সময় রাস্তায় খুব কম লােকজন দেখেছি। কিন্তু আমিনুল হক ভাইয়ের বিপদ শুনে এবং আপনি আমাকে ডেকেছেন- এমন অবস্থায় বাসায় বসে থাকতে পারিনি।
রহমত আরা বললেন- তােমাকে অনেক ধন্যবাদ। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার প্রতিবাদে শহরে কোনাে লােকজনকে আমি দেখি নাই, এমনকি মানুষ নিজের জান বাঁচানাের কথা ভেবে কোথাও যাচ্ছে না।
মাজেদা শওকত বললেন- আমিও ভাইদের দেখে একটু অবাকই হয়েছিলাম । কিন্তু জানতাম আমিনুল হক জহুরুল হকের বড় ভাই, তার অনেক সাহস। এ ছাড়া ফজলুল হকের সাহস তাে অতুলনীয়। আমিনুল হক বঙ্গবন্ধুর প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল ও ভাবাবেগে। পূর্ণ ছিলেন। তিনি মূলত কর্নেল শওকতের সঙ্গে এমন পরিস্থিতিতে কী করা যায়, বঙ্গবন্ধুকে কারা হত্যা করল? কেন হত্যা করল, এসব নিয়ে আলাপ করতে আমাদের বাসায় এসেছিলেন। রহমত আরা জানান, বারবার বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরা আমিনুল হকের বাসায় এসে হামলা করছে, এমন অবস্থায় আমরা খুবই মানসিক বিপর্যয়ের মধ্যে আছি। রহমত আরা আরাে কিছুক্ষণ মাজেদার সঙ্গে আলাপ করে তাঁকে বললেন- তুমি তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে যাও, পরিস্থিতি অত্যন্ত খারাপ। মাজেদাকে বিদায় দিয়ে তিনি ধীরে ধীরে বেবি আইসক্রিমের দোকান থেকে বের হয়ে ভাবলেন, মনুর বাসার জন্য কিছু খাওয়াদাওয়া, কেনাকাটা করা প্রয়ােজন। গত কয়েক দিনের তাণ্ডবলীলার কারণে লুলু তেমনভাবে বাজার করতে পারেনি। লুলুর শরীরটা খারাপ, এমতাবস্থায় কিছু ফলমূল নিয়ে গেলে সবাই খেতে পারবে, সে কারণে তিনি ফলের দোকানের দিকে ধীরে ধীরে অগ্রসর হলেন । দূর থেকে ফলের দোকানের দিকে তাকিয়ে তার মনে পড়ে গেল পশ্চিম পাকিস্তানের ফলের বাজারের কথা। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই তিনি এবং তাঁর পরিবার অনেক কিছু থেকে নির্মমভাবে বঞ্চিত হয়েছিলেন। পরিবার-পরিজনসহ তিনি তখনও পাকিস্তানে। পাকিস্তানে যেসব বাঙালি পরিবার আটকে পড়েছিল, বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও তাদের আর কোনাে সুন্দর জীবন ছিল না। স্বাধীনতার পরপরই পাকিস্তানিরা ঘােষণা দিল- সব বাঙালির চাকরি শেষ এবং
১১০
বাঙালিদের ক্যাম্পে চলে যেতে হবে। বাচ্চারা স্কুল থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসে, এমনকি বাড়ির ফার্নিচারগুলাে ধীরে ধীরে বিক্রি করা শুরু করে দিই। তখন ভালাে খাওয়ার ব্যবস্থা বাচ্চাদের জন্য করতে পারতাম না। ফ্রিজ ছিল না, সাব্বিরের বন্ধু একদিন এসে বরফ দিয়ে গেল। এ রকম সময় আমরা ঠিক করলাম, ক্যাম্পে যাওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব না। আমরা পাকিস্তান থেকে পালিয়ে ঢাকায় চলে যাব। কিন্তু কীভাবে যাব, হঠাৎ করে খবর পেলাম কিছু বাঙালি তরুণ ছেলে স্মাগলারদের সাহায্য নিয়ে পাকিস্তান থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। তখন আমার স্বামী জাতীয় অধ্যাপক ড. আতােয়ার হােসেন প্ল্যানিং সেক্রেটারি ছিলেন, তিনিও সিদ্ধান্ত নিলেন, পরিবার নিয়ে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে চলে যাব। ওনার সঙ্গে পাকিস্তানি একজন ধনী ব্যক্তি আকবর আদিলের সঙ্গে ভালাে সম্পর্ক ছিল। তিনি আকবর আদিলকে গিয়ে বলেন- আমরা কীভাবে এখান থেকে পালিয়ে যেতে পারি। আকবর আদিল বললেন- ইতােমধ্যে অনেক পরিবার ক্যাম্পে চলে গেছে, তােমরাও ক্যাম্পে চলে যাও। পাকিস্তান থেকে পালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি খুবই কঠিন, এখন পর্যন্ত কোনাে পরিবার পালিয়ে যেতে পারেনি। শুধুমাত্র তরুণ-যুবক শক্তিশালী বাঙালি পুরুষরাই পালিয়ে যাচ্ছে স্মাগলারদের সঙ্গে। তবুও আমার স্বামী আতােয়ার হােসেন তাঁকে অনুরােধ করেন, আপনি আমাদের জন্য কোনাে ব্যবস্থা করতে পারবেন কি না? এই সময় আকবর আদিল সাহেব বললেন- আমি তােমার পরিবারকে সাহায্য করবাে। এবং এর কয়েক দিন পরে তিনি জানালেন, তিনি সবচেয়ে বিশ্বাসযােগ্য স্মাগলার গ্রুপের সঙ্গে যােগাযােগ করেছেন। তাদের বেশ কিছু পরিমাণ অর্থ দিলে তােমাদের পার করে দেবে। বাড়ির যা কিছু ছিল সব কিছু বিক্রি করে দিয়ে সব টাকা আমি তার হাতে তুলে দিই। এর পরেই রাওয়ালপিন্ডি থেকে আমরা যাত্রা শুরু করি, যাত্রার দিন স্মাগলাররা আমাদের জন্য দুটি বােরকা নিয়ে আসে, কথা ছিল তাঁরা দুটি নতুন বােরকা নিয়ে আসবে আমার জন্য এবং আমার মেয়ের জন্য; কিন্তু যখন বােরকা নিয়ে এলাে তখন দেখলাম বােরকা অনেকটাই ছেড়া । তিন স্যুটকেস কাপড় দিয়েছিলাম, তারা বলেছিল- তােমরা কাবুলে পৌছানাের পরে এই স্যুটকেসগুলাে তােমাদের হাতে দেব । যাত্রার শুরুতেই বলল- গেট লাগিয়ে দাও, বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দাও এবং তালার চাবিটা এমনভাবে ফেলে দাও যেন ভেতর থেকে তালা দেখে বাইরের লােকের মনে হয় এরা ভেতরেই আছে। আমার বড় ছেলে ইকবাল ভেতরে রইল, আমরা তালা দিয়ে ভেতরে চাবিটা ফেলে দিই। দেয়াল টপকে ইকবাল বাইরে চলে এলাে এবং দ্রুত আমরা একটি গাড়িতে উঠে পড়ি। সামনে ছিল আমার স্বামী এবং পেছনে আমরা। স্মাগলাররা অত্যন্ত দ্রুত ইসলামাবাদ থেকে গাড়ি চালিয়ে পেশােয়ারের দিকে রওনা দেয়। আমরা প্রচণ্ড টেনশন নিয়ে যাত্রা শুরু করলাম।
১১১
স্মাগলাররা আমাদের বলেছিল- আটক চেক পয়েন্টে পাকিস্তানি সৈন্যরা কড়া পাহারা বসিয়েছে, যাতে কোনাে বাঙালি পালিয়ে যেতে না পারে। বাঙালি তরুণ যুবকরা বাসে করে মাঝে মাঝে মানুষের ভিড়ের মধ্যে মিশে থেকে এই পথ দিয়ে পালাচ্ছে। প্রাইভেট কারে এই প্রথম তারা একটি পরিবারকে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা বুঝলাম, পাকিস্তানি স্মাগলার দুজনও আমাদের জন্য ভয়ে ভয়ে আছে, আটকের কাছে পৌঁছতেই দূর থেকে দেখতে পেলাম, চেকপােস্টের কাছে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সৈন্য গাড়ি থামিয়ে চেক করছে। ভয়ে আমাদের বুক কেঁপে ওঠল, হঠাৎ একটা বাস হর্ন দিতে দিতে আমাদের ওভারটেক করার চেষ্টা করছে। ড্রাইভার গাড়ির গতি কিছুটা কমিয়ে বাসটাকে সুযােগ করে দিয়ে আবার দ্রুতগতিতে বাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আটক চেকপোেস্ট পার হয়ে গেল। স্মাগলার লােকটি বলল- তােমরা এখন নিরাপদ, এর পরেও আরাে অনেক কঠিন পথ আছে, তবে এই চেকপােস্টটি ছিল সবচেয়ে কঠিন। প্রায় ৭/৮ ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে পেশােয়ারের পাহাড়ি এলাকায় একটি গ্রামে এসে স্মাগলাররা আমাদের বলল- দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে পড়াে। আরেকটি স্মাগলার গ্রুপ তােমাদের নিয়ে যাবে।
আমরা গ্রামের একটা ছােট বাড়িতে গেলাম, সেখানে আরাে অনেক লােক অপেক্ষারত ছিল পাকিস্তান সীমান্ত অতিক্রম করার জন্য। কিছুক্ষণ পর স্মাগলাররা ছােট ছােট ৫/৬টি খচ্চর নিয়ে এসে আমাদের বলল- “এখন তােমরা সবাই খচ্চরের পিঠে ওঠো, এ কথায় রহমত আরা ভীষণ অবাক হয়েছিলেন।
তার ধারণা ছিল, ঘােড়ায় চড়ে আফগান সীমান্তে যেতে হবে, অথচ এখন দেখছি খচ্চরের পিঠে করে আফগান সীমান্তে যেতে হচ্ছে। সারারাত ধরে খচ্চরের পিঠে চড়ে উঁচু নিচু দুর্গম পাহাড়ি এলাকা, অন্ধকার পথ, মাঝে মাঝে জলাভূমি, খাইবারপাসের পথটি অতিক্রম করতে হচ্ছিল। মাঝে মাঝে পাকিস্তানি উপজাতীয় সন্ত্রাসীগােষ্ঠী পথ রােধ করছে । স্মাগলাররা তাদের সঙ্গে সমঝােতা করে আমাদের নিয়ে যাচ্ছে ।
১১২
এভাবে তারা জালালাবাদ গ্রামে পৌছে, সেখান থেকে ট্রাকে করে আফগানিস্তানের কাবুল শহরে পৌছে । স্মৃতির পাতা থেকে সরে এসে রহমত আরা ঢাকা নিউ মার্কেটে ফলমূলের দোকান থেকে বেশ কিছু ফল কিনে একটি রিকশায় উঠলেন এলিফ্যান্ট রােডের বাসায় যাওয়ার জন্য। রিকশায় বসে তার মন খুব খারাপ হয়ে গেল । কত কষ্ট করে তিনি ও তাঁর পরিবার পাকিস্তান থেকে নিজের দেশে ঢাকায় এসেছেন। ঢাকার প্রতিটি আত্মীয়-স্বজনের কাছে থাকবেন, দেশের জন্য কাজ করবেন, এমন ভাবনা তার মনজুড়ে ছিল। অথচ আজ বাঙালিরা পথভ্রষ্ট। নিজের দেশের প্রাণপ্রিয় নেতাকে হত্যা করেছে, অন্যান্য বাঙালির ওপর অত্যাচার শুরু করেছে। তার মনে ভেসে ওঠে আফগানিস্তানের কাবুলে তাদের কষ্টের দিনগুলির কথা । হাতে টাকা খুব কম ছিল, ছেলে-মেয়েরা রাস্তার পাশে বসে কালাে চা দিয়ে আফগান রুটি খেত। পাকিস্তানি স্মাগলাররা কাপড়ের স্যুটকেসগুলাে আর ফেরত দেয় নাই। রহমত আরার স্বামী জাতীয় অধ্যাপক আতােয়ার হােসেন পূর্বেই এক স্যুটকেস কাপড়। একজন ব্রিটিশ কূটনীতিকের কাছে দিয়েছিলেন- যিনি কিছুদিন আগেই কাবুলের উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন। হঠাৎ তাঁর সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়ায় কিছু কাপড়ের ব্যবস্থা হয়ে যায়, নতুবা আমরা বিপদে পড়তাম । কাবুল থেকে প্লেনে করে দিল্লি, সেখান থেকে ট্রেনের থার্ডক্লাসে করে কলকাতায়- পরিশেষে কলকাতা থেকে প্লেনে করে ঢাকায় আসি। মহান আল্লাহ সহায় ছিলেন, আর আতােয়ার হােসেনের আন্তর্জাতিক যােগাযােগ থাকায় আমরাই প্রথম পরিবার- যারা এই দুর্গম পথ অতিক্রম করে পাকিস্তান থেকে ঢাকায় আসি । স্মৃতির ভাবনা থেকে রহমত আরা অনেক কষ্ট নিয়ে এলিফ্যান্ট রােডে চিত্রা বাড়িতে পৌছেন।
১১৩
পরের দিন, বঙ্গবন্ধুর ঘাতকরা আবার আমিনুল হকের বাসায় আসে, পুনরায় বেশ কিছুক্ষণ আবার বিভিন্ন কক্ষের ভেতরে ঘােরাঘুরি করে চলে যায় । ফজলুল হকের স্ত্রী চাচিমাকে ফোন করে জানায় তাদের বাড়িতেও ঘাতকদলের সৈন্যরা এসে রেইড করে গেছে। চাচিমা বিচলিত হয়ে দোদুল ভাইকে (ব্রিগেডিয়ার শাফায়েত জামিল) আরাে একবার ফোন করে সবকিছু জানান। দোদুল ভাই চাচিমার বাসায় দ্রুত আসেন এবং সব কিছু দেখে তিনি অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। ব্রিগেডিয়ার শাফায়েত জামিল আবার মেজর ডালিম এবং তাঁর সহচরদের সতর্ক করেন আমিনুল হক- অর্থাৎ খালুর কাছ থেকে দূরে থাকার জন্য। তিনি চাচিমাকেও সতর্ক করেন, পরিস্থিতি খুব খারাপ, এদের পক্ষে সবকিছু করা সম্ভব, তাই চাচাকে সাবধানে থাকতে হবে। সেই রাতে চাচা এলিফ্যান্ট রােডের চিত্রা বাড়ির পেছনে চাচিমার অন্য একজন নিকটাত্মীয়ের বাসায় চলে যান। আর ঠিক তার পর দিন আবার চিত্রা বাড়িতে সেই দলের লােকজন চাচাকে খুঁজতে আসে। চাচিমা আবারও অস্থির হয়ে বাবাকে ফোন করেন, সেই সময় আমরা বনানীতে বাংলাদেশ ব্যাংক কোয়ার্টারে থাকতাম। হঠাৎ মা বলল- চাচার বাসায় যেতে হবে । আমার এখনও মনে আছে, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর পুরাে ঢাকা শহর নিস্তব্ধ, যুদ্ধের সময় মানুষ যেমন ভীত হয়ে শহরের রাস্তা ছেড়ে, শহরের ঘর-বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল । শহরটা ভূতের শহরে পরিণত হয়েছিল, ‘৭৫ সালেও আমি ছােট ছিলাম, তবু আমার মনে হয়েছিল, নিস্তব্ধ শহর, কেমন ভয়ার্ত ভাব! বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম- দেশে কি আবারাে যুদ্ধ হবে? বাবা বলেছিলেন- বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলেছে, পরিস্থিতি খুবই খারাপের দিকে যাচ্ছে, তােমার চাচাকে ওরা ধরে নিয়ে গেছে। আমি আর কোনাে কথা বললাম না, বুঝলাম বাবা-মা খুবই দুশ্চিন্তায় আছেন, চুপচাপ বাবার কোলে রিকশায় বসে রইলাম। এলিফ্যান্ট রােডের বাসায় পৌঁছার পর দেখলাম, ঘরের মাঝখানে চাচা চুপচাপ বসে আছেন। গত দুই দিনের তাণ্ডবলীলার কথা চাচিমা আর দাদি- বাবাকে সব জানালাে। গত দুই দিনের প্রভাব সর্বত্র, সমস্ত জিনিসপত্র এলােমেলাে, অনেক কিছু মাটিতে বিচ্ছিন্নভাবে পড়ে আছে । চাচার ওপর শারীরিক অত্যাচারের কথা শুনে বাবা-মা জানতে চান, ওরা কী করেছে? এখনও স্পষ্ট মনে পড়ে আমি দাঁড়িয়ে দেখছি, চাচিমা আমিনুল হক চাচার সাদা শার্টটা পিঠের দিক থেকে উঁচু করে ধরেন, আমি চমকে উঠি, চাচার সাদা পিঠে পিশাচদের বেল্ট আর রডের আঘাতে রক্ত জমে কালাে কালাে দাগ হয়ে আছে ।
১১৪
চাচা-বাবা ও ছােট চাচার থেকে ফর্সা, সমস্ত শরীরে কালাে দাগ হয়ে গেছে। আমিনুল হক জহুরুল হকের মেজো ভাই, একজন বীর মুক্তিযােদ্ধা, আগরতলা মামলা থেকে গােলাম আযমের নাগরিকত্ব খারিজ মামলা এবং আরাে অসংখ্য মামলার একনিষ্ঠ আইনজীবী। অথচ স্বাধীন দেশে তাকে পেতে হয়েছিল চরম কষ্ট। বঙ্গবন্ধুর প্রতি অশেষ শ্রদ্ধাবােধ এবং আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠার জন্য, দেশের জন্য কাজ করে গেছেন মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত ।
বাবা-মা চাচিমাকে বললেন- চাচাকে বনানীর বাসায় নিয়ে যাবেন। এখনও মনে পড়ে সেই যাত্রার কথা, চাচিমা গলির মধ্যে দুটি রিকশা ডেকে আনতে পাঠালেন, বাবা-মা একটা রিকশায় বসলেন, আরেকটা রিকশায় আমি আর চাচা। একটা খদ্দরের খয়েরি রঙের চাদর দিয়ে চাচিমা আমাকে আর চাচাকে জড়িয়ে দিলেন। রিকশায় ওঠার আগে মা আর চাচিমা আমাকে বুঝিয়ে বললেন- হঠাৎ যদি কোনাে আর্মির লােক রিকশা থামায়, তাহলে আমি যেন বলি, আমার জ্বর, বাবা ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাচ্ছে। এখনও মনে পড়ে, রিকশা মহাখালীর কাছাকাছি এসেছে, বালির বস্তা দিয়ে বঙ্গবন্ধু। হত্যাকারীদের সমর্থক সৈন্যরা বেরিকেড বসিয়েছে। আমি নিজের অজান্তে চাচার হাতটা চেপে ধরেছিলাম । ছােট চাচাকে হারিয়েছি, মেজো চাচাকে হারানাে যায় না। চাচা প্রায় ৭-৮ দিন বনানীর বাসায় ছিলেন। মায়ের সঙ্গে কথা বলতেন, দেশের কী হবে? তাই নিয়ে অনেক দুশ্চিন্তায় থাকতেন। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের জন্য বাবা, চাচা ও মা। বিমর্ষ থাকতেন। স্বাধীন দেশ- তবুও আমরা হারালাম স্বাধীনতা, জাতির পিতা ও বাঙালির গৌরবােজ্জ্বল ইতিহাস। যাঁদের বাড়িতে প্রতিনিয়ত খণ্ড খণ্ড যুদ্ধ হয়েছে, তাঁরা সেই যুদ্ধের ইতিহাস লিখতে পেরেছেন কি? কত কিছুই তাে আজও অজানার গহ্বরে রয়ে গেছে!
১১৫
ইতিহাসের সন্ধানে
১৯৮৩-৮৪ সালের দিনগুলাে ছিল রৌদ্রোজ্জ্বল সােনালি দিন । আসলে মানুষের যৌবনের সময়গুলাে বরাবরই হয় উদ্দাম-উচ্ছল । জীবনস্রোতও নদীর মতাে সদা চঞ্চল । আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। সারা দিন বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াতাম। সেই দিনগুলােকে আজও মনে হয় জীবনের সবচেয়ে আনন্দপূর্ণ সময় । সব কিছু বাদ দিয়ে শুধু একজন শহিদ মুক্তিযােদ্ধার জন্য তথ্য সংগ্রহ করা, সেই সময়গুলােতে সম্ভব ছিল নাএটিই ছিল বড় সত্য । মাঝে মাঝে মনে হতাে, জহুরের (ছােট চাচা) জন্য মনের মধ্যে কোথাও যেন একটা গভীর টান আছে সেই শৈশব থেকেই। অনেকবার বাবা-মায়ের কাছে আগরতলা মামলার কথা জানতে চেয়েছি, বাবার কাছে, মায়ের কাছে খণ্ড খণ্ডভাবে অনেক তথ্য শুনেছি । কিছুটা মুখস্থের মতােই ছিল ছােট চাচা জহুরুল হক দেশমাতৃকার স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র অভ্যুত্থানের পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত ছিল । কিন্তু মামলাটি সম্পর্কে সম্পূর্ণ তথ্য সঠিকভাবে জানতে পারিনি। ১৯৮৩-৮৪ সালের দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমার মনে হলাে, যতটুকু পারি তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির ইতিহাস বিভাগ থেকে কয়েকটা বই খুঁজে বের করলাম । আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা সম্পর্কে জানার জন্য পাবলিক লাইব্রেরিতে গেলাম। সেখানেও বইপত্রে একই কথা ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। বইগুলােতে এই মামলা সম্পর্কে মূল কথা ছিল পাকিস্তানিরা বাঙালিদের ফাঁসানাের জন্য একটি সশস্ত্র অভ্যুত্থানের পরিকল্পনার নাম দিয়ে একটি মামলা দায়ের করেছে। বঙ্গবন্ধুসহ ৩৫ জন এই মামলায় অভিযুক্ত। যারা পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করার জন্য একটি সশস্ত্র অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করেছিল, ফলে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা দিয়ে পাকিস্তানিরা বাঙালিদের ওপর নির্মম অত্যাচার শুরু করেছিল- উল্লিখিত বইপত্রে আরাে লেখা হয়েছে, এই মামলাটি ছিল বাঙালির বিরুদ্ধে চরম ষড়যন্ত্রমূলক একটি মিথ্যা মামলা ।। বস্তুতপক্ষে সে সময় বাঙালিরা দেশ স্বাধীন করার জন্য কোনাে ষড়যন্ত্রমূলক কাজে লিপ্ত ছিল না। বাঙালিদের বিভিন্ন দাবি- প্রধানত ছয় দফার দাবির প্রচণ্ড চাপ নিতে না পেরে পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুসহ বেশ কয়েকজন বাঙালি অফিসারকে অভিযুক্ত করে একটি মিথ্যা মামলা দায়ের করে। পরস্পরবিরােধী তথ্যের কারণে আমি বিভ্রান্তিতে পড়ে যাই, ছােট চাচার আত্মত্যাগের প্রকৃত সত্য জানার ঐকান্তিক ইচ্ছা সর্বক্ষণ মনের মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে ।
১১৯
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমাদের বাসার পরিবেশ ছিল অন্যরকম। ভাইজান তখন মেডিক্যাল কলেজে পড়ে। মঞ্জু (ডা. মাইনুল হক) অত্যন্ত পড়ুয়া ছিল। যেখানেই ভালাে বই পেত বা নতুন লেখক ও বই সম্পর্কে জানতে পেত, চেষ্টা করত সেই বইটি সংগ্রহ। করে বাসায় নিয়ে আসতে। মাও খুব বই পড়তেন। সে সময়ই আমার হাতে একটি বই আসে সাম্স্ রাশীদের ‘উপল উপকূলে’ । বইটি পড়ে আমার ভেতরে এক অদ্ভুত ভালােলাগার অনুভূতি সৃষ্টি হয়, একই সঙ্গে কষ্টেরও অনুভূতি অনুভব করি। বইটি আশির দশকে আলােচিত উপন্যাস হয়েছিল কি না আমি বলতে পারব না। কিন্তু বইটিতে লেখক ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগ, ভারত ও পাকিস্তান এবং পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের এক অসাধারণ সামাজিক চিত্র তুলে ধরেছেন। ব্যক্তিজীবনে লেখিকার নৌবাহিনীর সঙ্গে সংযােগ ছিল, তার স্বামী তকালীন পাকিস্তানের নৌবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। বইটিতে মূলত প্রেম-ভালােবাসা ও বিরহের যেমন এক অনবদ্য সামাজিক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, তেমনি তৎকালীন সময়ে সামরিক জীবন ও পাকিস্তানের ঊর্ধ্বতন অফিসারদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সূক্ষ্ম বর্ণনাও আছে। পাকিস্তানের নৌবাহিনী, সেনাবাহিনীর বিভিন্ন পেশাগত জটিলতার প্রভাব কীভাবে সামাজিক জীবনে পড়েছিল তার এক অপরূপ বর্ণনা উপন্যাসের ভেতর ফুটে উঠেছিল। কীভাবে সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীর বাঙালি অফিসাররা যােগ্যতা থাকা সত্ত্বেও প্রমােশন, ট্রেনিং, পােস্টিং ও বিভিন্ন সুবিধা থেকে ক্রমাগত বঞ্চিত, অবহেলিত হয়েছে তার চিত্র পরিস্ফুটিত হয়েছে। লেখিকা সামস্ রাশীদের ‘উপল উপকূলে এবং পরবর্তী উপন্যাস ‘সিন্ধু বারুয়া’, দুটি উপন্যাসের কিছু অংশ উল্লেখ করছিঃ
উপল উপকূলে -১
মিত্র বল্লেন- এবারে ‘ডালহৌসী’তে বাংলাদেশ থেকে যেসব নতুন রিক্রুট এসেছে তাদের মধ্যে একজন এসেছে, যে এম.এ পাশ- মানে ফিলসফিতে থার্ড ক্লাস পেয়ে পাশ করেছে । স্টুয়ার্ড হিসেবে নাম লিখিয়েছে সে । আসলে জানে না স্টুয়ার্ডের কাজ কি। মাইনে বেশি দেখে ভর্তি হয়ে এসেছে। এখানে এসে সব কিছু দেখে শুনে সে কিছুতেই কাজে জয়েন করতে চাইছে না। এরাও নাছােড়বান্দা! একবার সার্ভিসের খাতায় নাম লেখালে তাে আর ছাড়াছাড়ি নেই! এরা তাকে তিন দিন সময় দিয়েছিল মন ঠিক করতে । কাল তিন দিন হয়ে যাবার পর ক্যাপ্টেন তাকে আমার কাছে পাঠালেন। কারণ তাকে কিছুতেই ইউনিফর্ম পরতে রাজি করানাে যাচ্ছিল না। আজ তাকে বলা হয়েছিল- ইউনিফর্ম পরে কাজে জয়েন
করলে জেলে পাঠানাে হবে। শেষকালে ইউনিফর্ম পরে সে এল আমার অফিসে। আমাকে দেখে সে কী কান্না! বলে আমাকে বাঁচান । আমি ব্রাহ্মণের ছেলে, স্টুয়ার্ডের কাজে অন্যের এঁটো বাসন ধুতে হবে আমাকে। এ আমি পারব না। রেশাদের জ্বরতপ্ত মস্তিষ্কে অনুরণিত হতে লাগল- অনেক যুদ্ধ করেছি, আর পারি না। অনেক যুদ্ধ করেছি … যুদ্ধ, সব জায়গায় যুদ্ধ। ভেতরে বাইরে কোথাও বাকী নেই । এই যুদ্ধই ত’ তাকে অসুস্থ দেহমন নিয়ে গৃহহারা করে ফেলে রেখেছে একা ঘরে। তার মন ও বিবেক, আকাক্ষা ও অভাববােধ তাকে কি নিরন্তর একটা অন্তর্দ্বন্দ্বের বশবর্তী করে রাখেনি? কে বলে ভারত প্রত্যক্ষ যুদ্ধে লিপ্ত হয়নি! বম্বে ডকে দুটি বিরাট বারুদ ভরা জাহাজ কেন এসেছিল? কেন
১২০
সেদিনের প্রলয়ঙ্করী বিস্ফোরণে এত লােকের প্রাণহানি হ’ল- এত লােক অঙ্গহীন হয়েও বেঁচে রইল যুদ্ধের স্বাক্ষর বহন করে? বিশ্বের এত লােকের রক্ত শােষণ করেছে যে যুদ্ধতার হাত থেকে বম্বেরও রেহাই নেই! বম্বেকেও ত’ রক্ত দিতে হবে- বুকের রক্ত নিংড়ে দিতে হবে সেই অশুভ দানবের পায়ে! যুদ্ধের সময় এখন প্রাণের দামই নেই। তবে নৈতিকতার কী দাম! রক্তের সঙ্গে নীতিও কি বিসর্জন দিতে হয় না? রেশাদের নৈতিক অধঃপতনের শুরু হয়েছে সেইদিন- যেদিন কাম্বালা হিলের সাগর শিলায় বসে, দ্বিতীয় বিস্ফোরণের শব্দে রুথ ঘােষ তার বুকের আশ্রয়ে ধরা দিয়েছিল। সে দিন থেকে রুথ ঘােষ রেশাদের জীবনে দ্বিতীয় নারী।
উপল উপকূলে – ২
জিন্নাহ সাহেবের বিরাট কালাে গাড়ীখানা আস্তে আস্তে ড্রাইভ করে চলে গেল । আজহার সাহেবের ছেলে সায়ফুল গাড়ীর বনেটে দাঁড়িয়ে ছিল, জিন্নাহ সাহেবকে দেখবার জন্য। খুব হাত নাড়তে লাগল সে। জিন্নাহ সাহেব জনগণকে হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানাতে লাগলেন। সায়ফুল খুশি হয়ে বলতে লাগল- জিন্নাহ সাহেব আমাকে হাত দেখিয়েছেন। জিন্নাহ সাহেবের সঙ্গে বৃটিশ সরকারের প্রতিনিধি এবং কংগ্রেস নেতাদের যত বেশী বৈঠক এবং আলােচনা চলতে থাকল- দিল্লীর জনসাধাণের মধ্যে উত্তেজনাও সেই পরিমাণে বেড়ে যেতে লাগল । দিল্লী বাস দিন দিন ভয়াবহ হয়ে উঠতে লাগল । পাশের সর্দার বাহাদুরের বাড়ীতে নিত্য নূতন লােকের আনাগােনা আরও বেড়ে গেল। তাদের হাসি তামাসা হৈ হুল্লোড়ও যেন দিন দিন বেড়েই চল্ল। সেদিন দুপুরবেলা মিকির ঘরে গিয়ে রাস্না মিকিকে ঘুম পাড়াচ্ছিল। খাটে ঘুমন্ত মিকিকে শুইয়ে দিতেই তার কানে এল, কারা যেন চিৎকার করে বলছে- কতল হাে গিয়া- কতল হাে গিয়া…। রাস্না কান পেতে রইল- কিন্তু বহু লােকের চিল্কারে স্পষ্ট করে আর কিছু শােনা গেল না। তাড়াতাড়ি মিকিকে কোলে তুলে নিয়ে সে নিজের ঘরে চলে গেল। করাচী নতুন দেশ- আকাশটা কী ভীষণ নীল- রােদটা কড়া । সেপ্টেম্বর মাস- বম্বেতে এখন ভরা মনসুন রােজ বৃষ্টি হচ্ছে সেখানে! কিন্তু এখানে অসম্ভব রকম উজ্জ্বল নীল আকাশে শুধু ছেড়া ছেড়া সাদা মেঘ। কালাে মেঘ ঘনিয়ে আসে না কখনও। দিল্লীর মত ধুলাের ঝড় উঠেছিল কয়েক দিন- কিন্তু কী আশ্চর্য্য, বর্ষাকালে বৃষ্টি হবে না একদিনও! বম্বের আকাশ থেকে থেকে কাঁদে, কী মিষ্টি, কী করুণ যে লাগে সে দৃশ্য! কিন্তু হােক করাচি শুষ্ক- তাতে কিছু এসে যায় না। রাজশাহী, যেখানে ভাই ভাবি রতু আছে- সেখানে ত’ বম্বের মত বর্ষা নামে- সেটাও ত’ রাস্নার দেশ। সেটাও ত’ পাকিস্তান! মনে একটা শান্তির পরশ পায় সে! সেদিন চাঁদ এসে বল্ল- আঃ, করাচিতে এসে বাঁচলাম! বম্বের পাঁচ মাস জোড়া প্যাচপ্যাচানি বৃষ্টি অসহ্য ছিল, বাইরে বেরােনাে যেত না। করাচিতে কি আরাম- ঠিক যে লাহােরের মত- বৃষ্টি নেই। চাঁদের কথা শুনতে শুনতে রাস্না রাজশাহীর কথা ভাবতে থাকে ।
১২১
সিন্ধু বারােয়া
বৃটিশ নেভীর একজন কমান্ডার এসে সকলের কথা শুনছিলেন। তিনি বললেনপাকিস্তানে কিছু স্বার্থান্বেষী লােক দেশের মানুষকে প্রভিন্সিয়ালিজমের দীক্ষা দিচ্ছেনতারাই লিয়াকত হত্যার চেষ্টায় লিপ্ত এতে কোনাে সন্দেহ নেই। এটা এখনই কনট্রোল করা দরকার। রাস্না সকলের কথা শুনতে লাগল। বৃটিশ কমান্ডার ঠিক কথাই বলেছেন। কিন্তু প্রভিন্সিয়ালিজমের বিষাক্ত মানসিকতা কনট্রোল করবে কে? যাদের হাতে শক্তি, যারা রাষ্ট্র চালনার কর্ণধার তারা যদি সংযত না হয়- শক্তির জোরে তারা সরকার দখলের চেষ্টা করে তখন কনট্রোলের আর কোনাে প্রশ্নই ওঠে না। রাস্তার বিশ্বাস হয় না লিয়াকত হত্যার ষড়যন্ত্র সত্য হতে পারে। কোনাে মূর্খ লিয়াকত আলীর মত নিঃস্বার্থ বিচক্ষণ নেতাকে হত্যা করতে চাইবে? পাকিস্তানের অনেক যন্ত্রণা অনেক সমস্যা আছে। আছে দুর্বলতা। ভারতের সঙ্গে যেসব চুক্তি হয়েছে- তা ত’ লিয়াকতের সঙ্গেই হয়েছে। সেই লিয়াকতকে হত্যা করে যারা পাকিস্তানকে হীনবল করতে চায় তারা আসলে কী চায়! এরা বৃক্ষের যে শাখার আশ্রয়ে বসে আছে- সেই শাখারই মূল ছেদন করছে। কী আশ্চর্য! জীবনে অনেক বই পড়েছি, এখনাে তার বই দুটি আমার মনে গেঁথে আছে। ১৯৮২-১৯৮৪ সালে যখন আমি লাইব্রেরিতে লাইব্রেরিতে আগরতলা মামলার তথ্য খুঁজছিলাম ইতিহাসের বইতে- অথচ ইতিহাসের বই থেকে সঠিক কিছু পাচ্ছিলাম না- সেই সময় আমাকে এই বই দুটি ইতিহাস অন্বেষণে বেশি অনুপ্রাণিত করে।.
১২২
সার্জেন্ট জহুরুল হকের বন্ধুদের সন্ধানে
ফ্লাইট সার্জেন্ট ফজলুল হক
ইতিহাসের কোনাে বই থেকে আগরতলা মামলা সম্পর্কে সঠিক তথ্য না পেয়ে আমার মন খারাপ হয়ে যায়। হঠাৎ একদিন সার্জেন্ট ফজলুল হক চাচাকে ফোন করে বললাম- আমি কিছু জানতে চাই, ওনার বাসায় আসতে চাই । উনি সাদরে আমন্ত্রণ জানালেন। ১৯৮৩-৮৪ সালে প্রায়ই আমি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রিকশা করে শান্তিনগরে ফজলুল হক চাচার বাসায় যেতাম। কখনও আমার সঙ্গে সহপাঠী-বন্ধু পপি, কখনও নাসরিন থাকত। কিন্তু বিষয়টা মাকে জানাইনি। মা ভীষণ কড়া ছিলেন, মা চাইতেন আমরা শুধু ভালােভাবে লেখাপড়া করি, রাজনৈতিক কোনাে বিষয়ে না জড়াই। ফজলুল হক ছিলেন প্রাণবন্ত এক কৃষ্ণকায় মানুষ, চোখ জোড়া ছিল অসাধারণ উজ্জ্বল আর মুখে ছিল সবসময় হাসি। রিকশা করে পপির সঙ্গে যখন ওনার বাসার দিকে যাচ্ছিলাম, তখন পপিকে আমি বলেছিলাম- তার বুকে একটা ক্ষত আছে- যা স্বাধীনতার ইতিহাসের প্রথম ক্ষত । ১৯৬৯ সালে হসপিটাল থেকে ছাড়া পেয়ে উনি আমাদের বাসায় এসেছিলেন। বাবা-মা দেখতে চেয়েছিলেন তার বুকের কোন জায়গায় পাকিস্তানিরা গুলি করেছিল? অপারেশনের পর কী অবস্থা হয়েছিল? চাচার পাঁজরের দু’টি হাড় ছিল না, বহু কষ্টে কর্নেল আলী তাকে বাঁচিয়েছিলেন ।
১২৫
ফজলুল হক আগরতলা মামলার ১১ নম্বর অভিযুক্ত ছিলেন। তিনি আমাকে জানালেন, পাকিস্তানে বাঙালি অফিসার, সৈন্যরা পাকিস্তানিদের দ্বারা বরাবর শােষিত ছিল। তাদের বর্বর ব্যবহারে তারা অস্থির হয়ে পড়েন। প্রতিনিয়ত বাঙালিদের পাকিস্তানিরা হেয়প্রতিপন্ন করত। ১৯৬০ সালের পর থেকে এই অবস্থা আরও বৃদ্ধি পায়। ১৯৬১-৬২ সালের দিকে বাঙালি অফিসাররা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এই বিষয়টি নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলােচনা শুরু করে। ১৯৬১-৬৪ এই সময় পরিসরে, সমমনা বাঙালি অফিসার ও সৈন্যরা একত্রিত হওয়া শুরু করেন। ভেতরে ভেতরে একটি শক্তিশালী সংগঠন তৈরি করার প্রক্রিয়া আরম্ভ হয়ে যায় । পাকিস্তানিদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে বাঙালিরা সিদ্ধান্ত নেয় একটি সংগঠন গড়ে তােলার। একই সঙ্গে গােপন মিটিং শুরু হয়। এই সময় জহুরুল হক তাঁকে জানান, ইতােমধ্যে তারা পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়েছে এবং পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন করার পরিকল্পনা চলছে। আরও একটি বিষয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই সংগঠন শুধু বিমানবাহিনীতে সীমাবদ্ধ নয়, সামরিক এবং নৌবাহিনীতেও বিস্তৃত। তৎকালীন পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর নৌবাহিনীতে ছিলেন মেধাবী বাঙালি অফিসার কমান্ডার মােয়াজ্জম হােসেন, তিনি এই আন্দোলনে নেতৃত্বের ভূমিকা নেন। তিনি অত্যন্ত মেধাবী অফিসার ছিলেন। তিনি নৌবাহিনীর বিভিন্ন বাঙালি অফিসার এবং সেইসঙ্গে সৈনিক পর্যায়ে যারা ছিলেন তাদের একত্রিত করা শুরু করেন। নূর মােহাম্মদ, আব্দুর রউফ, কামালউদ্দীন এবং সুলতানউদ্দীনসহ আরও অনেকেই গােপনে এই আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েন। ফজলুল হক চাচা আমাকে আরও বলেন- সামরিক বাহিনীর ভেতর থেকে বাঙালি সামরিক অফিসার এবং সৈনিকরা সংগঠিত হওয়া শুরু করে। করাচির কোরাঙ্গি ক্রিক বিমানবাহিনীর ঘাঁটিতে অন্য বাঙালি অফিসাররাও ইতােমধ্যে তাদের দলে যােগদান করে। তারা অত্যন্ত সাবধানতা ও গােপনীয়তার সঙ্গে বাঙালি অফিসারদের বাসায় মিটিং শুরু করে । মেজর জলিলের বাসায় তারা অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। ফজলুল হক চাচা আমার সঙ্গে কথা বলতে পছন্দ করতেন। একটি ছােট ডায়েরিতে আমি তথ্যগুলাে লিখতাম। মাঝে মাঝে চাচি এসে নাস্তা খাওয়াতেন । আমাদের কথােপকথনের মাঝে চাচি এসে বলতেন- এসব কথা থাক, তােমার মা কেমন আছেন? তােমার পড়ালেখা কেমন চলছে? এসব পুরােনাে কথা বাদ দাও। তােমার চাচার কাছ থেকে শুনে কী করবে? তখন আমি খুব জোর দিয়ে বললাম- আমি এইসব কথা জানতে চাই, আগরতলা মামলা সম্পর্কে বুঝতে চাই । তখন ফজলুল হক চাচা হেসে উঠে বললেন- তােমার চাচিকে আমি অনেক কষ্ট দিয়েছি, আমাকে সে অনেক কষ্টে বাঁচিয়েছে। এর পরেও আরাে অনেক যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে, তাই এইসব আলােচনা করতে চায় না। আমি জানতাম, চাচি ‘খাওসা’ আগরতলা মামলার একজন গুরুত্বপূর্ণ নারী চরিত্র । তিনি ছিলেন সেই ভয়ংকর দিনগুলােতে কালের সাক্ষী।
১২৬
আমার আগ্রহ আরাে বেড়ে যায়, কয়েকবার ফজলুল হক চাচার শান্তিনগরের বাসায় গিয়েছি এবং ধীরে ধীরে অনেক কিছু জেনেছিলাম। ফজলুল হক চাচা জীবদ্দশায় প্রতিবছর শ্রদ্ধা ও ভালােবাসার সঙ্গে পালন করেছেন তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু জহুরুল হকের মৃত্যুদিবস ১৫ ফেব্রুয়ারি । পাকিস্তানিদের দ্বারা সংঘটিত ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ সালের নির্মম ঘটনাটি ছিল তাঁর শরীর এবং মনের মধ্যে এক চিরস্থায়ী দুঃখ-ভারাক্রান্ত কষ্টের স্মৃতি। জহুর এবং তাঁর ওপর পাকিস্তানিদের গুলি চালানাে, নির্মম বেয়নেটের আঘাত এবং পরবর্তী সময়ে অ্যাম্বুলেন্সে জহুরের সঙ্গে তার কথােপকথন, এইসব কথা আমরা তাঁর কাছ থেকে শুনেছিলাম। পরে বাবা-মায়ের কাছেও অনেকবার শুনেছি, যা আজও আমার কানে বাজে এবং মনের মধ্যে মুখস্থের মতাে রয়েছে। জহুরের নির্মম হত্যার পর, ১৯৬৯ সালের রক্তঝরা ফেব্রুয়ারি গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয়, সর্বস্তরের মানুষ প্রতিবাদ মিছিলে-আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। প্রতিদিন পাকিস্তানিরা কারফিউ দিত- ছাত্রদের উত্তাল মিছিল- প্রতিবাদ বন্ধ করার জন্য। কিন্তু ‘৬৯-এর সাহসী বাঙালি তরুণ ছাত্রসমাজকে রােধ করা কোনােমতেই সম্ভব ছিল না। ঢাকার বাইরে জেলায় জেলায় জহুরুল হকের হত্যার প্রতিবাদে মিছিল, মিটিং ও সমাবেশ শুরু হয় । ১৭ই ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ড. জোহাকে পাকিস্তানি বাহিনী নির্মমভাবে হত্যা করে।
১২৭সমস্ত বাংলাদেশের মানুষ ক্রোধে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সােচ্চার আন্দোলন শুরু করে। বঙ্গবন্ধুকে তখনও দেশবাসী শেখ মুজিব, মুজিব ভাই বলত । ছাত্ররা ক্রমাগত স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত করে রেখেছিল বাংলার প্রতিটি জনপদ- ‘জেলের তালা ভাঙবাে শেখ মুজিবকে আনবাে। ঢাকা শহর যখন পাকিস্তানি সৈন্যদের ক্ষিপ্ত রােষের মুখে- টিয়ার গ্যাসের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন, তখন ক্যান্টনমেন্টের সিএমএইচ-এর একটি কক্ষে ফজলুল হকের নিভু নিভু প্রাণ ধিক ধিক করে কোনােমতে নিঃশ্বাস নিচ্ছে । জ্ঞান ফিরেই তিনি জানতে চান, প্রিয় বন্ধু জহুরুল হকের কথা। জহুরের মৃত্যুসংবাদ শুনে তার ক্লান্ত শরীর আর বিধ্বস্ত মন আরাে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে। ডা. কর্নেল আলী আরও সচেতন হয়ে ওঠেন, কীভাবে ফজলুল হককে বাঁচাবেন । তিনি এই দায়িত্ব তাঁর অত্যন্ত প্রিয়ভাজন নার্স ‘খাওসার’ ওপর দেন, খাওসাকে তিনি আরাে বলেন- কাউকে বিশ্বাস করা যায় না, যে কোনােভাবে পাকিস্তানিরা একে হত্যা করবে । হয়তাে বা খাওয়ার সঙ্গে বিষ মিশিয়ে দিয়ে মেরে ফেলবে। তুমি কাউকে বিশ্বাস করবে না, নিজের হাতে ফজলুল হকের খাওয়াদাওয়া, ওষুধপত্র ও সব রকম পরিচর্যার ভার নাও। খাওসার ভূমিকা হয়ে ওঠল কন্যা-জায়া-জননীর প্রতিভূ এক অসাধারণ সেবিকারূপে । প্রতিদিন সে নিজের হাতে ফজলুল হকের খাওয়া, ওষুধ এবং অন্যান্য চিকিৎসাপদ্ধতিগুলাে পর্যবেক্ষণ শুরু করল। ফজলুল হকের ক্ষতটি ছিল মারাত্মক । অপারেশনের সময় তার বুকের পাঁজরের দুটি হাড় ফেলে দিতে হয়, তার ড্রেসিংয়ের প্রয়ােজন হতাে। কর্নেল আলী প্রতিদিনই তাঁকে পর্যবেক্ষণ করতেন। সেই সঙ্গে খাওসার দায়িত্ব আরও বেড়ে যেত লাগল । আর শুধুই কি দায়িত্ব দিয়ে মানুষ মানুষকে বাঁচাতে পারে। খাওসা অনেক সময় ভয় পেত পাকিস্তানি পাহারারত মিলিশিয়া সৈন্যদের গতিবিধি দেখে, নিজের অজান্তে তার মনের ভেতর এক অজানা শঙ্কা সৃষ্টি হওয়া শুরু হয় তার মনে হয় এরা ফজলুল হককে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলতে পারে। আর এই ভাবনা থেকে সে একটি অভূতপূর্ব কাজ শুরু করে। প্রতিদিন সে ফজলুল হকের খাওয়া আগে নিজে খেয়ে দেখত, এইভাবে খাওয়া পরীক্ষা করে রােগীকে খাওয়ানাে শুরু করে। প্রায় তিন মাস লেগেছিল ফজলুল হকের
১২৮
সুস্থ হতে, আর খাওসা নিজেও বুঝতে পারেনি কখন এই বীর যােদ্ধার প্রতি গভীর প্রেম তার হৃদয়ে বাসা বেঁধেছে আর তা থেকে কখনাে তাঁর আর মুক্তি পাওয়া সম্ভব না। একইভাবে বীরযােদ্ধা ফজলুল হকের হৃদয়েও এই মমতাময়ী নারীর জন্য গভীর প্রেমের সৃষ্টি হয় । ফজলুল হক ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে গঠিত ৯ নম্বর দায়িত্ব পালন করেন। ঢাকার শান্তিনগরে তার বাসার পরিবেশ ছিল অন্যরকম। খুব সাধারণ আসবাবপত্র, বড় একটি কী দুটি শােবার ঘর আর একটি বসার ঘর । সর্বত্রই অতি সাধারণ জীবনযাত্রার প্রতিচ্ছবি। ফজলুল হক স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হন এবং ১৯৭০ সালে নিজ এলাকা বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ-কোতােয়ালি থেকে এমপিএ নির্বাচিত হন। ১৯৭৩ সালে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
১২৯
বসার ঘরের সঙ্গে পশ্চিম দিকে একটা বারান্দা ছিল, আমরা সেখানেই বসতাম । চাচা মাঝে মাঝেই উঠে যেতেন বসার ঘরের দিকে, সেখানে তাঁর নির্বাচনী এলাকা থেকে অনেক লােক আসত ।
চাচি বড় বােলের ভেতর মুড়ি মাখিয়ে সবাইকে দিতেন, আর সকল অতিথিকে চা। খাওয়াতেন। আমি একদিন বললাম- যুদ্ধের সময় থেকে এমন করে সবার জন্য করে যাচ্ছেন! উনি হেসে উঠে বললেন- না, আমি তাে অনেকদিন ছিলাম না। আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম- কোথায় গিয়েছিলেন? চাচি বললেন- যুদ্ধের পর সংসার চলত না, তােমার চাচা রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকত, আমি সংসার চালানাের জন্য নার্সের চাকরি নিয়ে সৌদি আরবে চলে যাই। মেয়ে তখন ছােট ছিল, ওকে আমার শাশুড়ির কাছে রেখে যাই । আজও সমাজের অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি প্রশ্ন করে- আগরতলা মামলার সত্যতা নিয়ে, অভিযুক্তদের দেশপ্রেম আর আত্মত্যাগ নিয়ে, তখন লজ্জা হয় আমার! আমরা এমন ব্যর্থ ও অকৃতজ্ঞ জাতি, আমাদের উচিত ছিল স্বাধীনতাসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি দিনের দিনলিপি লিখা । কিন্তু তা না করে প্রশ্ন করি! চাচির (খাওসা) কাছ থেকে অনেক পরে ‘আগরতলা’ বইটি করার সময় আরও অনেক তথ্য নিয়েছিলাম। আগরতলা মামলার অনুচ্চারিত ইতিহাস ও শহিদ সার্জেন্ট জহুরুল হক বই থেকে উদ্ধৃত করছি :
“মিসেস ফজলুল হক : হ্যা, অনেক লােক ছিল। নির্বাচনের জন্য এসেছিল। বঙ্গবন্ধু যে বঙ্গবন্ধু তার তুলনা হয় না। বঙ্গবন্ধু অনেক লম্বা ছিলেন। তাে উনি বের হয়ে দেখলেন, এত লােকের মাঝে একজন মহিলা। তখন বঙ্গবন্ধু সবাইকে সরিয়ে দিয়ে আমাকে ভিতরে ডাকলেন। তুমি কে? আমি ফজলুল হকের স্ত্রী। আরে তুমি ফজলুল হকের স্ত্রী। এত রাতে কেন, কী করাে, আমি বললাম, আপনার এখানে এসেছি। বঙ্গবন্ধু বললেন, তুই ভিতরে আসলি না কেন, দেখা করলি না কেন? তখন আমি যদি বলি আমাকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। তাহলে কেমন পরিস্থিতি হবে, তাই আমি মিথ্যা বলে দাঁড়িয়ে ছিলাম । আমার লােকজন আছে, এরা কী করে এখানে আসবে। তারপর আমি ফজলুল হকের লেখা চিঠিটা দিলাম বঙ্গবন্ধুর হাতে । বঙ্গবন্ধু চিঠিটা দেখে হাসলেন। কামালের কাছে দিলেন। বঙ্গবন্ধুর ছেলে কামাল। বঙ্গবন্ধু একটু ভিতরে গেলেন, পাঁচ হাজার টাকা গুনতে যতটুকু সময় লাগে। একটু পরে বঙ্গবন্ধু আসলেন। এখানে অনেক লােক ছিল। বঙ্গবন্ধু এমনভাবে চাদরের নিচ দিয়ে আমার হাতে দিলেন কেউ টের পেলাে না। আমাকে বললেন, ‘তুই এসেছিস কীভাবে? আমি বললাম, ‘আমি গাড়িতে এসেছি। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘কোথায় থাকিস? আমি বললাম, ‘আমি বকশিবাজারে থাকি। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘যাবি কীভাবে?’ আমি বললাম, ‘গাড়িতে যাবাে। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘ফজলুল হকের আবার গাড়ি আছে! ওর গাড়ি থাকতে পারে না। ফজলুল যে উদার মনের মানুষ, ওর গাড়ি থাকবে
১৩০
কীভাবে। পরে বঙ্গবন্ধু বললেন, “এই ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে আসাে। ফজলুল হকের স্ত্রীকে বাড়িতে রেখে আসাে। মানে, বঙ্গবন্ধু দাঁড়িয়ে থাকবেন, আমাকে রেখে আসবে ড্রাইভার। তারপর বঙ্গবন্ধু যাবেন, এই হলেন বঙ্গবন্ধু। আমি অসুস্থ, আমাকে একা ছাড়বেন না। বঙ্গবন্ধু গাড়িতে করে আমাকে বাড়িতে রেখেই আসবেন।”
বঙ্গবন্ধু ছিলেন সেই মহান মানুষ, যার চোখে শুধু ফজলুল হকই প্রিয় ছিলেন না, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী, রাতের বেলা কীভাবে বাড়ি ফিরে যাবে! তাই নিয়ে তাঁর উদ্বেগ হয়েছিল । এমনকি সেদিন তিনি জোর করে নিজের গাড়িটি ফজলুল হকের স্ত্রীকে দিতে চেয়েছিলেন, বাসায় যাওয়ার জন্য । বাংলাদেশে আজ মুক্তিযুদ্ধের ওপর অনেক চিত্রনির্মাতা ছবি করছেন, সাহিত্যিকগণ উপন্যাস লিখছেন- কেউ কী ভাববেন, ফজলুল হকের মতাে বীরযােদ্ধার জীবন নিয়ে কী অসাধারণ উপন্যাস বা চলচ্চিত্র সৃষ্টি হতে পারে? তাঁর জীবন কাহিনিই তাে জীবন্ত এক চলচ্চিত্র। হঠাৎ মা একদিন জেনে গেলেন, ফ্লাইট সার্জেন্ট ফজলুল হক চাচার বাসায় আমি প্রায়ই যাচ্ছি। তিনি খুবই রেগে গেলেন, তখন সময়টা ছিল ভিন্ন। দেশ আবারাে সামরিক শাসকের নিয়ন্ত্রণে পাকিস্তানি নয়, বাঙালি সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদের সময়কাল।
মেজো চাচা আমিনুল হক চাচার উপর জেনারেল এরশাদ অত্যন্ত ক্ষিপ্ত, কেননা চাচা আইনের প্রতিষ্ঠা নিয়ে বরাবরই ছিল স্পষ্টবাদী মানুষ ও প্রতিবাদী আইনজীবী।
মা ফজলুল হক চাচাকে সরাসরি নিষেধ করলেন আমাকে উৎসাহ না দিতে । মায়ের ভয় ছিল- এই রকম উৎসাহ থেকে আমার রাজনীতির দিকে যাওয়ার আগ্রহ সৃষ্টি হতে পারে । ফজলুল হক চাচা কতবার যে এসেছেন বনানীর বাসায় আমার সঙ্গে দেখা করতে। তার সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরিহিত সেই রূপ, আর উজ্জ্বল, জুলজুলে চোখ দুটি আজও মনে পড়ে। মায়ের কথা শুনেছি, তখন নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছি আগরতলা মামলার তথ্য সংগ্রহের কাজ থেকে। আরাে পরিণত হয়ে কাজ করার সংকল্প করেছিলাম। মাকে দোষ দিতে পারি না, তিনি তার সন্তানদের সুযােগ্য, সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য ছাতিমের মতাে ছায়া হয়ে ছিলেন আমার সঙ্গে আজও আছেন।
১৩১
ফজলুল হক চাচার কাছেই আমি আহাদ ভাইয়ের বাবা ফ্লাইট সার্জেন্ট মফিজুল্লাহর গ্রামের বাড়ির ঠিকানা পাই। ১৯৮৩ সালে আমি তাকে একটি চিঠি লিখি, সেই চিঠির উত্তরে তিনি আমাকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। সেই চিঠির কিছু অংশ উল্লেখ করছি :
সার্জেন্ট জহুরুল হকের সঙ্গে ১৯৬০ সালে পাকিস্তানের কোয়েটা বিমানবন্দরে আমার প্রথম পরিচয় । বিমান প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে তিনি ছিলেন একজন বিশেষ প্রশিক্ষক ইস্ট্রাক্টর। সমস্ত বাঙালিদের মধ্যে একমাত্র তিনি ঐ পদ পাওয়ার গৌরব অর্জন করেছিলেন। তাঁর সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর থেকেই বুঝতে পারলাম নির্যাতিত বাঙালিদের ওপর সংখ্যাগুরু পাঞ্জাবি পশুদের অত্যাচারে তার মন আগ্নেয়গিরি থেকে বেশি পুঞ্জীভূত হয়ে আছে। মনে হয়েছিল যে-কোনাে মুহূর্তে তা ফেটে পড়বে। পাঞ্জাবি পশুরা রীতিমতাে তাকে ভয় করতাে এবং সেই জন্যই অনেক সময় বহু বাঙালি ছেলে নির্যাতন থেকে রেহাই পেয়েছে। সার্জেন্ট জহুরুল হকের এমন মানসিক অবস্থা উপলব্ধি করেও আমি ১৯৬২ সাল পর্যন্ত তাঁকে জানতে দিই নাই যে, সামরিক বাহিনীর লােকদের নিয়ে আমি বাংলার মুক্তিফ্রন্ট গঠন করেছি। শুধু মাঝে মাঝে বাঙালি নির্যাতনের কাহিনী শুনিয়ে তাঁকে খোচা দিতাম। ১৯৬৩ সালে জহুর ভাই এবং আমি করাচির কোরাঙ্গি ক্রিক বিমান ঘাঁটিতে বদলি হয়ে আসি। তার পর থেকে জহুর ভাইয়ের সঙ্গে অনেক কথা আদান-প্রদান করতে সক্ষম হয়েছি। আজও আমার মনে পড়ে, ১৯৬৪ সালে কোনাে-এক সময় আমি বলেছিলাম, জহুর ভাই, বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য বাঙালি সামরিক বাহিনীর লােকদের নিয়ে একটা সশস্ত্র বিপ্লব করা কি সম্ভব হবে না। সশস্ত্র শক্তি ছাড়া কোনাে রাজনৈতিক দল কোনাে দেশের মুক্তি আনতে পারে না। এ পলিটিক্যাল পার্টি ইজ নট এ পার্টি হুইজ নট ব্যাকড বাই স্ট্রং আর্মড ফোর্স’। আমার কথাগুলি শুনে আমাকে লক্ষ্য করে জহুর ভাইয়ের চোখে-মুখে
১৩২
কিছুক্ষণের জন্য আগুনের রশ্মি বয়ে গেলাে। কিন্তু পরক্ষণেই তা আবার অন্তর্হিত হয়ে আস্তে আস্তে বললেন, মফিজ ভাই, হয়তাে তা সম্ভব কিন্তু ভরসা পাইনি। সমগ্র বাংলার মাটি মীরজাফরে ভরা। বাংলার স্বাধীনতার জন্য আমি আমার সমস্ত বুকের রক্ত ঢেলে দিতে পারি। কিন্তু সে স্বাধীনতা যদি আবার মীরজাফরদের হাতে খেলনা হয়ে যায় সেটাই হবে সবচেয়ে যাতনাদায়ক।
এই চিঠি থেকে আরও কিছু অংশ সংযােজিত করছি-
সেই দিন থেকে জহুর ভাই বাংলা মুক্তিফ্রন্টের একজন বিশেষ সদস্য হলেন । জীবন বাজি রেখেও বহু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ব্যক্তিগতভাবে পাকিস্তানের বহু সেনানিবাসে ঘুরে ঘুরে বাঙালি সৈনিকদের সংগঠিত করেছেন। যত্রতত্র উল্কার মতাে ছুটেছেন। যার দ্বারা এক বছরের সংগঠন আমরা মাত্র তিন মাসে সমাপ্ত করেছি। এই কাজের জন্য জহুর ভাই বেশ সুনাম অর্জন করলেন এবং সর্বত্র অভিনন্দিত হলেন। এভাবে তাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হয় গেরিলা আক্রমণে বাঙালিদের সুদক্ষ করে তােলার। তিনি তা অতি অল্প সময়ের মধ্যে সুসম্পন্ন করে ফেলেন। তারপর একই সঙ্গে আমরা ধরা পড়ি, আইয়ুবশাহীর সৈন্যদের হাতে এবং নিক্ষিপ্ত হই ঢাকা সামরিক কারাগারে । কিন্তু অসহ্য নির্যাতনের মধ্যেও আমরা আমাদের সাহস ও মনােবল হারাইনি।
ফ্লাইট সার্জেন্ট মফিজুল্লাহর চিঠিটির শেষ অংশটি উল্লেখ করছি। তিনি লিখেছেন :
প্রতিটি বছরে ফিরে আসে সেই দিন, সেই ক্ষণ, সেই মুহূর্ত। ১৯৬৯-এর ১৫ ফেব্রুয়ারি ভাের ছয়টায় সবার মুখে-মুখে ধ্বনিত হয়ে যায়, যার নাম শহিদ সার্জেন্ট জহুরুল হক দিবস। এই দিনটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতােই চিরদিন অম্লান অক্ষয় হয়ে থাকবে সমস্ত বাঙালির অন্তরে । সেদিনের রক্তঝরা মুহূর্তটি বারবার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। শয়তানের মাত্র কয়েকটি উত্তপ্ত বুলেট এসে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়েছিল জহুর ভাইয়ের চির-উন্নত বুকের পাঁজরগুলাে। মুহুর্তে মনে হয়েছিল, বাংলার মাঠ-ঘাট, আকাশ-বাতাস, সবুজ-প্রান্তর যেন রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছিল। বাংলার প্রকৃত স্মরণরূপে যেন বাংলা মা সেদিন হাতে মেহেদি পরে গ্রাম্যবধূর মতােই দু-চোখের কোলে ভরা আদরে উচ্ছল তরঙ্গের মতাে একরাশ উনূল অশ্রু নিয়ে দৃশ্যের সামনে দাঁড়িয়েছিল । সেদিনের ভােরের মেঘমুক্ত লাল পূর্বাকাশ, বাংলার পদ্মা, মেঘনা, যমুনা লালের কাছে বুঝি ম্লান হয়ে গিয়েছিল। জহুর ভাইয়ের বিদেহী আত্মা আজ যেখানেই বিচরণ করুক না কেন, সে ধন্য। কেননা তার রক্ত আমাদের পথের দিশা দিয়েছে। তাঁকে আমরা কোনাে দিন ভুলতে পারবাে না। তিনি ছিলেন আমাদের পথপ্রদর্শক আর আমরা পথযাত্রী। হঠাৎ একদিন ফ্লাইট সার্জেন্ট মফিজুল্লাহ আমাদের বনানীর বাড়িতে আসেন। আজো মনে পড়ে, তিনি হরিদ্রাভ বর্ণের একটি পাঞ্জাবি পরেছিলেন। হাতে ছিল কালাে ছাতি, পান খেতেন। তিনি আমার চিঠি পেয়ে নােয়াখালী থেকে
১৩৩
ঢাকা আসবেন, আমি কল্পনাও করতে পারি নাই। আগরতলা মামলার ৭নং অভিযুক্ত, একজন সাহসী মুক্তিযােদ্ধা। অনেক পরে ফ্লাইট সার্জেন্ট মফিজুল্লাহর ছােট ছেলে আহাদ ভাইয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক হয় সহােদর ভাইয়ের মতাে।
১৩৪
অ্যাটর্নি জেনারেল আমিনুল হক
মা ও আমিনুল হক চাচা যখন জানতে পারলেন আমি জহুরুল হক এবং আগরতলা মামলার তথ্য খুঁজছি, তখন আমাকে চাচা একদিন কাছে ডেকে পাশে বসিয়ে বললেনরুনুর (জহুর) সম্পর্কে তাের জানার অনেক আগ্রহ, আমার নানা ধরনের কাজের ব্যস্ততা থাকে, তারপরও তােকে সবকিছু জানাবাে। আজ শুধু একটুখানি বলে রাখি, কথাটি তুই মনে রাখবি- রুনুর (জহুরুল হক) বিরুদ্ধে পাকিস্তানিরা একটি সামরিক এলিগেশন কখনাে প্রমাণ করতে পারে নাই।
আমি জানতে চাই- এলিগেশনটি কী ছিল? চাচা আমাকে বলতে শুরু করেন, জহুরুল হক আগরতলা মামলা অর্থাৎ দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে দুইটি কাজের সঙ্গে জড়িত ছিল। একটি ছিল অস্ত্র প্রশিক্ষণ আর একটি ছিল সংগঠনের পরিধি বৃদ্ধির জন্য গােপনে সদস্য রিক্রুটমেন্টের কাজ। জহুর বাঙালি অফিসারদের স্বাধীনতাসংগ্রামে অংশগ্রহণের জন্য তাদের সংগঠনে যােগদানের জন্য অনুপ্রাণিত করতেন, আর সে জন্য রুনু (জহুর) মারি যান এবং একজন বাঙালি অফিসারকে তাদের দলে যােগদানের জন্য অনুরােধ করেন। পরবর্তী সময়ে সেই অফিসার পাকিস্তানিদের পক্ষে মামলার সাক্ষ্য দিয়েছিল, কিন্তু আদালতে পাকিস্তানিরা তা প্রমাণ করতে সক্ষম হয় নাই।
১৩৭
ছােট চাচা জহুরুলের স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকার কথা জানতে পেরে আমি উদ্বেলিত হয়ে পড়ি। আমার মন ছুটে যায় আরও দূরে- আমার জানার আকাঙ্ক্ষা আরাে অনেক গুণ বেড়ে যায়। বাবার সঙ্গে প্রতিবছর ১৫ই ফেব্রুয়ারি কবরস্থানে যেতাম। সেখানে কর্নেল শওকত আলী, সার্জেন্ট জলিল, আব্দুস সামাদ, মাহবুবউদ্দিন, ব্রিগেডিয়ার খুরশিদ- আরাে অনেকের সঙ্গে দেখা হতাে। বাবার কাছ থেকে আগরতলা মামলা সম্পর্কে আরাে তথ্য জানার জন্য মাঝে মাঝেই গল্প করতে বসতাম । কিন্তু আশির দশকে দেশে সামরিক শাসনের প্রভাবে আমাদের বাড়িতে পুনরায় ঝড় এসে আছড়ে পড়লাে, জেনারেল এরশাদ ক্ষমতায় থাকাকালীন নানা রকম রাজনৈতিক আন্দোলন চলছিল, সে সময় আমিনুল হক বহু হেভিস কর্পাস মামলা শুরু করেন। যখনই কোনাে রাজনৈতিক নেতা বন্দি হয়ে কারারুদ্ধ হতেন, তিনি তাদের জন্য পারিশ্রমিক ছাড়াই মামলা করেছেন, আজও হয়তাে অনেক প্রবীণ রাজনৈতিক নেতা তাঁর এই অবদান শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবেন। ১৯৮৪ সালে আমার বড় ভাই মঞ্জুর (ডা. মাইনুল হক) বিয়ে ঠিক হয়, সেই সময়ে আমিনুল হকের ওপর এরশাদ সরকারের হুমকি ক্রমাগত বাড়তে থাকে । হুমকির কারণে তিনি প্রায়ই বাড়িতে থাকতে পারতেন না। খুবই মজার ব্যাপার- দেশ যখন বাঙালিদের, তখন কী করে শত্রু চেনা যাবে? সবাই বাঙালি, পােশাকের ধরন আর চেহারাও এক । ডিজিএফআইয়ের লােকজন চাচাকে কোনাে রাজনৈতিক মামলা পরিচালনার কাজে বাধা দেওয়ার জন্য অ্যারেস্ট করতে পারেন, এরকম আশংকাজনক অবস্থায় পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আব্দুল কুদুস চাচার (বাবা ও চাচার ঘনিষ্ঠ বন্ধু) নিকটাত্মীয় পুলিশের এডিশনাল আইজি কাজী গােলাম রহমান চাচাকে ফোন করে আগেই জানিয়ে দিতেন। তিনি বলেদিতেন- আমিনুল হক, আজ রাতে আপনাকে অ্যারেস্ট করতে পারে! সম্ভব হলে বাসা থেকে অন্য কোথাও চলে যান। চাচা রাতের বেলা বাড়িতে না থেকে চিত্রা বাড়ির পেছনে চাচিমার আত্মীয়দের বাসায় বিভিন্ন সময় থেকেছেন। স্বাধীন দেশেও আমিনুল হক সততার সঙ্গে আইন পেশার জন্য নিজ বাড়িতে বহু রাত শান্তিতে থাকতে পারেন নাই। ভাইজানের বিয়ের দিন সন্ধ্যায় বিয়ের আসরে আসতে পারেননি, কিন্তু তাঁর দায়িত্ববােধ এত ছিল যে, সকালবেলা নিজে গাড়ি চালিয়ে আমাদের নিয়ে ভাইজানের কাবিনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছিলেন। এমনসব সংকটের ভেতর দিয়ে পরিবারের মানুষগুলাের সময় কেটেছে যা আজ ভাবলে মনে হয়, কোনাে ঘটনা বাদ দেয়া যায় না, লিখতে বসলে অনেক কিছুই ভাবনার করিডােরে এলােমেলােভাবে মনে আসে। স্মৃতি হাতড়ে গুছিয়ে লেখাটা কঠিন থেকে কঠিনতর, আর সে কারণেই অনেক দুর্লভ মূল্যবান ঘটনা বিস্মৃতির অতল গহ্বরে চলে যায়। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে অনেক পরিবারের রয়েছে অনেক বেদনাদায়ক স্মৃতি, তাদের অনেকেই কষ্টের কথাগুলাে লিখতে পারেননি। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতেই হবে- হঠাৎ বুঝতে পারলাম ১৯৯২ সাল দ্বারপ্রান্তে। অনেকগুলাে সময় পার হয়ে গেছে, ছাত্রজীবন থেকে স্বাবলম্বী নারী সত্তা আর সেই সঙ্গে জীবন হয়েছে দ্বৈত সত্তায় আবদ্ধ। নতুন ঘর নতুন জীবন। ১৯৯২ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি
১৩৮
আজিমপুর থেকে এলিফ্যান্ট রােডে চাচার বাসায় মাঝে মাঝে চলে যেতাম, চাচা আমাকে এত আদর করতেন যেন আমাকে দেখলেই খুশি হয়ে উঠতেন । সুপ্রিমকোর্টের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ করতেন। ইতােমধ্যে ‘৯০-এর গণ-আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল, সামরিক শাসনের অবসান হয়েছে। আমিনুল হক চাচা প্রতিনিয়ত নানা ধরনের মামলা সাহসের সঙ্গে পরিচালনা করছেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল আমিনুল হকের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা নিয়ে নানা রকম কার্যক্রম প্রতিনিয়ত তিনি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করেছেন ।
আমি এ রকম একটা সময়ই আবার প্রশ্ন করি- চাচা, ছােট চাচার আগরতলা মামলায় অংশগ্রহণের বিষয়টি পুরােপুরি বলাে। চাচা বললেন- ছােট চাচার বুকভরা সাহসের কথা। জহুর করাচিতে অ্যারেস্ট হয় । ১৯৬৮ সালে ঢাকায় চলে আসার আগে করাচির। একটি দোকানে কিছু কেনাকাটার জন্য যায়। সেই সময় পাকিস্তান ইন্টেলিজেন্সের লােকেরা এসে তাকে অ্যারেস্ট করে থানায় নিয়ে যায়। থানায় পাকিস্তানি ওসি। সরাসরি তাকে জানায় যে, তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার এলিগ্যাশন আছে । রাষ্ট্রদ্রোহিতা অর্থাৎ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সে জড়িত। জহুরকে বলা হয় তার স্বপক্ষে সে কিছু লিখতে পারে ।
১৪১
জহুর লিখেছিল- ‘আমি সুস্থ মস্তিষ্কে লিখছি, আমি আমার জন্মভূমি পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করার জন্য সশস্ত্র অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত এবং আমি আমার দেশকে স্বাধীন করতে চাই। পাকিস্তানি ওসি সঙ্গে সঙ্গে জহুরকে জানান, তােমার ফাঁসি হয়ে যাবে । জহুর বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে বলেছিলেন- ‘দেশের জন্য আমি সব করতে পারবাে। পরবর্তী সময়ে মামলাটি একটি বিপরীত রূপ ধারণ করে, মামলাটির জন্মলগ্নে প্রথম নাম হয়েছিল, লে. কমান্ডার মােয়াজ্জম হােসেন এবং অন্যান্যরা। পাকিস্তানি জেনারেলরা বুঝতে পেরেছিলেন মামলাটি আরাে মজবুত করার জন্য বাঙালিদের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে সম্পৃক্ত করা প্রয়ােজন। শেখ মুজিবুর রহমান ২২ মাস কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি আছেন, তথাপি তাঁকে সংযুক্ত করে রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব এবং অন্যান্যরা’- পাকিস্তানিরা মামলাটির নতুন নামকরণ করে। আইনজীবীদের পরামর্শে আসামিপক্ষ সকল অভিযুক্তকে নির্দোষ দাবি করেন। মামলার শুরুতে আমিনুল হক বিহ্বল হয়ে পড়েন। মামলার প্রয়ােজনে তিনি বহু জায়গায় ছুটে যান। তিনি ১৯৯২ সালে আলমারি থেকে তার এই বিষয়ে পত্রিকায় প্রকাশিত একটি লেখা বের করে বললেন- ‘এটা যত্ন করে রাখিস। চাচার বাসা থেকে বের হয়ে আজিমপুরের বাসায় ফিরে গেলাম। সন্ধ্যা হয়ে গেছে । সন্ধ্যার আলােতে আজিমপুরের বাসায় আমার ঘরে বসে টেবিল-ল্যাম্পের আলােতে চাচার লেখাটি পড়ে আমি অত্যন্ত ব্যথিত হয়ে পড়লাম।
১৪২
পরবর্তী সময়ে ‘আগরতলা মামলার অনুচ্চারিত ইতিহাস ও শহিদ সার্জেন্ট জহুরুল হক বইটি প্রকাশ করার সময় আমিনুক হক চাচা আর আমাদের মাঝে ছিলেন না। তাই বইটিতে চাচার সেই লেখাটি সংযােজিত করেছি। পুনরাবৃত্তি হওয়া সত্ত্বেও আজ আবার মনে হচ্ছে আমিনুল হকের লেখাটি থেকে কিছু অংশ সংযােজন করা যায়। কেননা কিছু কিছু যন্ত্রণাদায়ক ঘটনা স্মৃতির দর্পণে বারবার ভেসে ওঠে। তাই লেখাটির অংশবিশেষ উল্লেখ করছি :
… আমার দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধু জুলমত আলী খান ও এ. কে, আলম হাসপাতালে এলেন। তাদের উপস্থিতি আমাকে শক্তি জোগালাে। আমরা খুব তাড়াতাড়ি একটি আলােচনা সেরে নিলাম। পরে একত্রে সবাই আমরা তল্কালীন জিওসি পাকিস্তানি অফিসার মেজর জেনারেল মােজাফফরের বাসায় গেলাম। আমরা জোর করেই মেজর জেনারেল মােজাফফরকে সাক্ষাৎ দিতে বাধ্য করলাম । প্রথমে তিনি রেডিওর খবর নিয়েই বেশ প্রগলভ হয়ে উঠলেন এবং আমিও সমানভাবে রেডিওর খবরের সত্যাসত্য নিয়ে প্রশ্ন তুললাম। কারণ কোনাে অভিযুক্তই এই বিচারের শেষ পর্যায়ে পালানাের চেষ্টা করবে না। জেনারেল মােটামুটি হতবুদ্ধিই হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু জুলমত আলী খান আমাকে তাঁর একজন সহকর্মী ও গুলিবিদ্ধ অভিযুক্তদের একজনের ভাই হিসেবে পরিচয় করিয়ে তাকে শান্ত করেন। জেনারেল মােজাফফর যেন বিস্ময়ের ঘুরপাকে পড়লেন। অবিলম্বে তিনি তাঁর কণ্ঠস্বর পরিবর্তন করলেন এবং আমাকে অত্যন্ত নরম কণ্ঠে বললেন, তাদের জীবন বাঁচানাের জন্য সব রকম পদক্ষেপ নেয়া হবে। তাঁর জওয়ানরা স্বেচ্ছায় রক্ত দেবে, তাদের জীবনের জন্য প্রার্থন করা হবে। এ পর্যায়ে আমি তাকে নিতান্ত অভদ্রভাবেই বললাম, তাদের মারা যাওয়ার ক্ষেত্রে তিনি তাদের লাশ হস্তান্তরে রাজি আছেন কি না। তিনি বললেন, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কেউ-ই এমন মন্তব্য করতে পারে না। কিন্তু আমি এ রকম নিশ্চয়তা পাওয়ার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলাম। পরে তিনি ভদ্রভাবে বললেন, ঈশ্বর নিশ্চয়ই তােমার আশা পূরণ করবেন। এরপর আমি আমার ভাইকে ব্যক্তিগতভাবে দেখতে চাইলাম। কিন্তু তিনি তার অক্ষমতা প্রকাশ করলেন। আমরা জেনারেল মােজাফফরের বাসা থেকে চলে এলাম। তারপর আমার বাসায় অপেক্ষা করতে থাকলাম। ১০টার দিকে অভিযুক্তদের রক্ষক মেজর নাসির আমাকে টেলিফোনে জানান যে, আমার ভাই সাড়ে নয়টার দিকে মারা গেছেন।
তখন আমি জুলমত আলী খানের বাসায় গেলাম। কে, জেড, আলম, শওকত হােসেন, আমার চাচাতাে ভাই মােশাররফ হােসেন, ডা. মুনির ও শ্যালক জাকিউদ্দিন আহমদকে সঙ্গে নিয়ে সিএমএইচ-এ এলাম। সেখানে গিয়ে আমি ব্রিগেডিয়ার রাও ফরমান আলীসহ অন্যান্য অফিসারকে পেলাম । সেখানেই আমার ছােট ভাইয়ের পােস্টমর্টেমের ব্যাপারে তীব্র বাক্যবিনিময় হলাে রাও ফরমান আলীর সঙ্গে। আমি তার নগ্ন মৃতদেহটি দেখলাম । দেখলাম তার মুখে বুটের আঘাত, পেটে গুলি করার পর বেয়নেটের উপর্যুপরি আঘাতের চিহ্ন। রাও ফরমান আলী বললেন, তিনি পােস্টমর্টেমের জন্য
১৪৩
মতামত দিতে প্রস্তুত নন। কিন্তু আমি একটি সার্জিক্যাল রিপাের্ট বা সে গুলির আঘাতে মারা গেছে এ রকম সার্টিফিকেটের জন্য জোর দিচ্ছিলাম। এটিই আমাকে সন্তুষ্ট করেছে। আমার মনােভাবের কোনাে পরিবর্তন না দেখে রাও ফরমান আলী জিজ্ঞাসা করলেন, সে কি আপনার সত্যিকার ভাই? আমি যতােটুকু পারি ততােটুকু কঠিনভাবেই জবাব দিলাম, হ্যা, সে আমার সত্যি সত্যিই ভাই।…
আরও কিছু বিশেষ অংশ সংযােজিত করছি :
.. ট্রাইব্যুনাল থেকে ফিরে আসার পর আমি দুপুরে ঘুমাচ্ছিলাম । ঘুমের ভিতরেই আমি পূর্বাশঙ্কা করেছিলাম যে, স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল সন্ধ্যায় তার অধিবেশন অনুষ্ঠান করবে। আমি জেগে উঠি এবং আমার স্ত্রীকে বলি যে আমার ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে যাওয়া উচিত। আমি আমার চাচাতাে ভাই মােশাররফ হােসেন ও শ্যালক জাকিউদ্দিন আহমদকে নিয়ে ক্যান্টনমেন্টে যাই। সেখানে গিয়ে বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করি, স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল অধিবেশনে বসেছে। আমি দেখলাম টি এইচ খান হাওয়াই শার্ট ও পাজামা পরে উপস্থিত হয়েছেন। দেখলাম একদল আইনজীবী শেখ মুজিবুর রহমানকে জামিনে মুক্ত করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন যাতে তিনি গােলটেবিল বৈঠকে অংশ নিতে পারেন। আমি দেখলাম সাধারণ মানুষ পিঁপড়ের মতাে ক্যান্টনমেন্টের দিকে আসতে শুরু করেছে। আমি আরও জানলাম, প্রতিরক্ষামন্ত্রী ভাইস অ্যাডমিরাল এম আর খান ঐদিন ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে অবস্থান করেছেন। আরও জানলাম, তিনি সঙ্গে করে দুটি বিকল্প প্রস্তাবও নিয়ে এসেছেন। ১. শেখ মুজিবকে প্যারােলে মুক্তি দিয়ে বৈঠকে যােগ দেয়ার অনুমতি দেয়া; ২. একটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে মামলাটি প্রত্যাহার করে নেয়া। প্যারােলের ব্যাপারটির আমি প্রচণ্ডভাবে বিরােধিতা করলাম। আমি তাদের বললাম, যদি সরকার তাকে জামিনে মুক্তি দেয়ার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন থাকে তবে তাদের সেটি করতে দিন। এ পর্যায়ে সিনিয়র আইনজীবীরা আমাকে সাগ্রহে সঙ্গে নিয়ে সিগন্যাল রেজিমেন্টের মেসে যেখানে শেখ মুজিবকে রাখা হয়েছে, সেখানে নিয়ে গেলেন। আমি শেখ মুজিবকে অনুরােধ করলাম, কেন অনির্দিষ্ট শর্তে তার প্যারােলে যাওয়া উচিত হবে না। আমার এই ধারণা আরও জোরদার হলাে যখন বেগম মুজিবও বললেন তার প্যারােলে যাওয়া উচিত হবে না। আমি দেখলাম তাজউদ্দীন তাঁর পাশে বসে আছেন। এ পর্যায়ে শেখ মুজিব প্যারােলে যেতে অস্বীকৃতি জানালেন। আমি এয়ারপাের্টে চলে এলাম। দেখলাম মওদুদ আহমদ, শহিদুল হকসহ বেশ কয়েকজন সাংবাদিক শেখ মুজিবের প্যারােলে গােলটেবিল বৈঠকে অংশ নেয়ার বিষয়টির সংবাদ কভার করার জন্য সেখানে বসে আছেন। তাঁকে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিমানও তৈরি। কিন্তু প্যারােলে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলাে। সেদিন সমস্ত ঢাকা শহরের অধিবাসী রাস্তায় নেমে এলাে। পুরাে রাজপথ শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে উত্তাল ।
১৪৪
ছাত্ররা মশাল মিছিল বের করার জন্য মনস্থির করেছে । আমিও মিছিল ভেঙে দেয়ার জন্য তৈরি। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে জিওসি মেজর জেনারেল মােজাফফর স্পেশাল ট্রাইব্যুনালের আইনজীবী ও রাজনৈতিক নেতাদের পীড়াপীড়ি করছেন, অনুগ্রহ করে আমাদের হাজার হাজার ছাত্র হত্যার দায় থেকে রক্ষা করুন। তিনি এও বলেছেন যে কারফিউ তুলে নেয়া হয়েছে। বাস্তবে ২০ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে পুরাে ঢাকা শহরই মশাল মিছিলে যােগ দেয়। ২১ ফেব্রুয়ারিও ঢাকার জনগণ রাস্তায় ছিল। ২২ ফেব্রুয়ারি সাড়ে এগারােটার দিকে আমি জানলাম, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সকল অভিযুক্তকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। ২২ ফেব্রুয়ারি রাত আনুমানিক ৯টায় শেখ মুজিব, তাজউদ্দীন ও আবদুল মােমেনকে সঙ্গে নিয়ে আমার এলিফ্যান্ট রােডের বাসায় আসেন। আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, সবাইকে নিয়ে ফিরেছি । জহুরকে আনতে পারলাম না। আমি আনন্দ-দুঃখ মিশ্রিত কণ্ঠে বললাম, আপনি আমাদের বড়াে ভাই, আপনি ফিরে এসেছেন তাতেই আমাদের সমস্ত বেদনা লাঘব হয়েছে ।
আমার স্ত্রী বললেন, আপনি আজ এসেছেন, আবার যদি আসেন তাহলে বুঝবাে আপনি আমাদের ভােলেননি। এ কথার পর তিনি বিদায় নিলেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি সংবাদপত্রগুলাে আমার ভাইয়ের ছবিসহ খবর ছাপালাে আর ফিরল না’ শিরােনামে।
সূত্র : দৈনিক জনকণ্ঠ, ১৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯২।
চাচার সঙ্গে পল্টনের কাছে প্রেস ক্লাবে গিয়েছিলাম ২২শে ফেব্রুয়ারি ১৯৯৩ সালে আগরতলা মামলা মুক্ত দিবস অনুষ্ঠানে। সেইখানে চাচা আমাকে কর্নেল আলীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন এবং ডা. আলীর অসাধারণ বক্তৃতা শুনেছিলাম । ১৯৯৪ সালের ২৭ মে আমার ছেলের জন্ম হয়। চাচিমা সারাদিন আমার ও বাচ্চার সঙ্গে ছিলেন । দুদিন পর ভােরবেলায় বাসায় যাওয়ার জন্য হাসপাতালের গেটে গাড়িতে ওঠার সময় হঠাৎ দেখি চাচা এসে হাজির, আমি অবাক হয়ে বললাম, তুমি কোর্টে যাওনি? চাচা আমার কোল থেকে আমার বাচ্চাকে কোলে নিয়ে বললেন, কোর্টে যাওয়ার আগে তােদের দেখতে ইচ্ছা হলাে। সদ্য মা হওয়ার আনন্দে দুপুরে ঘুম আসেনি, তবুও ক্লান্ত চোখে হঠাৎ হালকা ঘুমের মধ্যে আমাকে ডেকে তুলে বাসায় থাকা একটি মেয়ে বললাে, একজন মেহমান এসেছেন, গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি তাড়াতাড়ি গিয়ে দেখি আমিনুল হক চাচা এক প্যাকেট মিষ্টি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি বললাম, তুমি কোর্ট থেকে বাসায় যাওনি? চাচার চোখে-মুখে এক অস্বাভাবিক ভাবাবেগ ছিল। বললেন- তােকে আর বাচ্চাকে আবার দেখতে এসেছি। সােজা কোর্ট থেকে এসেছি, আমার হাতে একটা মিষ্টির প্যাকেট দিয়ে বললেন- তাের শ্বশুর আছেন? আরাে বললেন- বড় দাদা উত্তরা থেকে আসবেন, তাই আমি আবার আসলাম।
১৪৫
ইতােমধ্যে আমার শ্বশুর ভাষাসংগ্রামী তােফাজ্জল হােসেন (আব্দু) ১৯৫৩ সালে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ঐতিহাসিক ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ সংকলনে সংকলিত রক্ত শপথে আমরা আজিকে তােমারে স্মরণ করি/একুশে ফেব্রুয়ারী রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলনের অন্যতম গানের স্রষ্টা। আমি চিরদিন আব্ব বলেই ডাকতে অভ্যস্ত ছিলাম। তিনি চাচাকে দেখে খুব খুশি হয়েছিলেন। তিনি সরাসরি তাঁর শােবার ঘরে চাচাকে নিয়ে গেলেন। এরপর দুজনে কত বিষয় নিয়ে যে আলাপ করেছেন, পুরাে আলােচনার একটা বড় অংশ দেশ আর বঙ্গবন্ধু । সেই সঙ্গে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা নিয়ে, চাচার নানা রকম কার্যক্রম নিয়ে আলােচনা চলল। দিব্য তখন খুব ছােট। চাচার বাড়িতে আবার হামলা হলাে। আমরা সবাই খুব অস্থির হয়ে পড়লাম। তখন তিনি অ্যাটর্নি জেনারেল, গােলাম আযমের নাগরিকত্ব খারিজ মামলা সুপ্রিমকোর্টে তিনি উত্থাপন করেছিলেন। জেনারেল এরশাদের বিরুদ্ধেও তিনি মামলা লড়েছিলেন। আমিনুল হককে নিয়ে এই দেশে আইন বিভাগ কয়েকটি স্মরণসভা করেছে, তাঁদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। আইন ও শালিসী কেন্দ্রও তাকে স্মরণ করেছে। তবুও বােধকরি তাঁকে নিয়ে আরও অনেক কাজ বাকি আছে। ছােট বাচ্চা নিয়ে হিমশিম অবস্থায় এক বছর পার হয়ে গেল। একদিন দিব্যকে নিয়ে চাচার বাসায় গেছি, বিকেলের দিকে চাচিমা আশপাশে কোথাও ছিলেন, ঠিক বাসায় ছিলেন না। চাচার বাসার ডাইনিং টেবিলের ওপর আম-কলা রাখা ছিল, আমাকে আর বাচ্চাকে খেতে বললেন। বড় দাদা, তাঁর ভাবির কথা জিজ্ঞেস করলেন- অর্থাৎ বাবা-মায়ের কথা। চন্দন কোথায়? আমি জিজ্ঞেস করলে চাচা খুব খুশি হয়ে উঠে বললেন, চন্দন আর তিন বছর পর আইন পাস করে যাবে, কোর্টে প্র্যাকটিস করতে পারবে। এর মধ্যে দিব্যকে আম খাওয়ানাে শেষ করেছি, তারপর আমি পানি খাওয়াতে চেষ্টা করছি । হঠাৎ আমার হাতটা ধরে চাচা বলল- বাচ্চাকে ফল খাওয়ানাের পর পানি খাওয়ানাের দরকার নেই। আমের ভেতর পানি আছে। এখন মনে হয়, কেউ কেউ ভাবতেন; অনেক ব্যস্ত আইনজীবী, তার মধ্যে বােধ করি বাৎসল্য-স্নেহ-মমতা কম ছিল, কী যে ভালােবাসা ছিল আমি তা হৃদয়ের গভীরে অনুভব করি।
১৪৬
এর কিছুদিন পরে হঠাৎ একদিন সকালবেলা অঞ্জনের ফোন পেয়ে আমি চিৎকার করে উঠেছিলাম। আমিনুল হক, আমার মেজো চাচা সুপ্রিম কোর্টের চেয়ারে বসে হার্ট অ্যাটাক করে মারা গেছেন। আমিনুল হক সম্পর্কে ৫০০ পৃষ্ঠার একটি বইও যথেষ্ট কি? আমার মনে হয়, না। আমি দুই পৃষ্ঠায় কী লিখব? এই কথাগুলাে শুধুই সার্জেন্ট জহুরুল হকের মেজো ভাই হিসেবে উল্লেখ করেছি। শুধু এইটুকু বলতে পারি যে, আমিনুল হকের মৃত্যুতে আমাদের পরিবারে যে শােক নেমে। এসেছিল তা অবর্ণনীয়। বাবা, তাঁদের বড় দাদা মাহবুবুল হক স্তব্ধ হয়ে পড়েছিলেন। জীবন দিয়ে এই দুই ভাইকে তিনি মানুষ করেছিলেন, আমি গর্বের সঙ্গে বলতে পারিআমিনুল হক, মাহবুবুল হকদের কোনাে টাকা ছিল না। মানুষ কতখানি সৎ হতে পারে তা আমি বাবা আর চাচাদের মধ্যে দেখেছি। বহু কষ্টে নিরন্তর সংগ্রামের মাঝে সজীবনের অনুসারী এই তিন ভাই আমৃত্যু একসঙ্গে ছিলেন, আজও তারা আজিমপুর কবরস্থানে একই কবরে শায়িত। আমি তাদের মাঝে যে ঐক্য, যে নির্ভীক সাহসিকতা দেখেছি- যা আজ পর্যন্ত আর কোথাও দেখি নাই- তা যেন সততার চিহ্নিত প্রতীকের মতাে। বাবার মাঝে সততামেজো চাচার আইনের প্রতি নিষ্ঠা- ছােট চাচার দেশের প্রতি জীবন দিয়ে আত্মত্যাগের মহিমা আমার জীবনে ধ্রুবতারার মতাে সত্য।
১৪৭একটা চেয়ারে বসে চাচিমা ধীরে ধীরে অর্থোপেডিক্সের প্যাশেন্ট হয়ে গেলেন। হাড়ের মাঝে গভীর সমস্যা দেখা দিল। হাড় ক্ষয় হতে হতে ধীরে ধীরে তিনি নিঃশেষিত হতে শুরু করলেন। একসময় আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন, ২০০৭ সালে জুন মাসের ৬ তারিখে । চাচিমা ফরিদা আক্তার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। নানাভাই ফজলুল হক ছিলেন আইনজীবী, এলিফ্যান্ট রােডের চিত্রা বাড়িটি ছিল ওনার। অনেকেই ভুল করেন, মনে করেন চিত্রা বাড়িটি আমিনুল হকের ছিল । এই বাড়িটিতে উনি থাকতেন, বাড়ির মালিক ছিলেন ওনার শ্বশুর। আমিনুল হক এই ঢাকা শহরে আইনের পবিত্র প্রাসাদ তৈরি করেছিলেন, কিন্তু ইট-পাথরের কোনাে বাড়ি তৈরি করেননি।
খেলাঘরের সামনে একটি উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ ছিল, আর সেখানেই জহুরুল হকের মৃতদেহটি বাংলার মানুষকে দেখানাের জন্য রাখা হয়েছিল । ইতিহাসের পাতায় জহুরুল হকের শায়িত যে ছবিটি আমরা দেখি, সেই স্থানটি খেলাঘরের মাঠ।
১৪৯
বাবা-মা
চাচিমাকে হারিয়ে ফেলার আগে আরও বড় ধাক্কা খেয়েছিলাম বাবা আমাদের ছেড়ে চলে যাওয়ায় । আমার মনে হতাে বাবা কখনও যেতে পারেন না । ১৯৯৯, ২০০০ সাল থেকে ধীরে ধীরে বাবা অসুস্থ হয়ে পড়লেন, কিন্তু এ রকম দৃঢ়চিত্তের মানুষ আমি কোনাে দিন দেখি নাই । ব্রিটিশবিরােধী আন্দোলনের সময়টা ছিল ওনার যৌবনের দীপ্ত অধ্যায়। সেই সময়ের মানুষগুলাের ভেতরে গভীর দেশপ্রেম, সততা আর নিষ্ঠার এক অভাবনীয় মিশ্রণ ঘটে, যা আজকের দিনের মতাে নয়।
১৫৩
বাবা কতটা শক্ত মনের মানুষ ছিলেন তা প্রকাশ করা কঠিন। তিনি আদর্শের সঙ্গে কখনও আপস করেননি। গম্ভীর, স্বল্পভাষী ও দীর্ঘকায় এক মানুষ। সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি ছিল, তার যে কোনাে কষ্ট আছে, জীবন গড়ে তােলার জন্য অথবা পরিবারের কারাে জন্য নিজের জীবনের সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন বিসর্জন দিয়েছেন, কারাে উপকার করছেন- এ রকম বিষয়ে কোনাে দিন বাবাকে কিছু বলতে শুনি নাই। মানুষ যে এমন নিশ্ৰুপ-নীরবে পরিবার এবং প্রিয়জনের জন্য কিছু করতে পারে, তা আমি ভাবতেও পারি না। এত যে নিঃস্বার্থ জীবনের মূল্যবােধ তার মধ্যে ছিল- যা স্মরণ করলে আমার হৃদয়ে একটা কথা কেবলই মনে হয়, এ রকম মানুষ সমাজে কেন এত কম জন্মায়। জীবনে হয়তাে তিনি প্রাচুর্য পাননি, কিন্তু ভাইবােন, বন্ধুদের কাছ থেকে পেয়েছিলেন অপরিসীম শ্রদ্ধা আর সন্তানের কাছ থেকে তার নেওয়ার কিছু ছিল না, তবুও বােধ হয় তিনি পেয়েছিলেন অপরিসীম ভালােবাসা। বাবার কাছ থেকে আমি একটা মূল্যবান সম্পদ নিতে পেরেছি, সেই মূল্যবান সম্পদটি আমি বহুদিন যত্ন করে রেখেছি। সেটি হচ্ছে, বাবার সঙ্গে আমার কথােপকথনের সংলাপগুলাে একটি ছােট নােট বইয়ে লিখে রেখেছিলাম। বাবা আমাকে জহুরুল হক সম্পর্কে- ছােট চাচা কীভাবে আগরতলা মামলার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন সে বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা করেছিলেন। সংসার আর ইন্টেরিয়র ডিজাইনের কাজ নিয়ে ক্রমে ব্যস্ত হয়ে যাচ্ছিল জীবন । ১৯৯৪-৯৫ সালে ঢাকা শহরে এই নতুন পেশায় কাজ করা ছিল অনেকটা চ্যালেঞ্জিং। ঢাকা শহরের মানুষ ইন্টেরিয়র যে একটি পেশা হতে পারে সে বিষয়ে অভ্যস্ত ছিল না। তবুও ধীরে ধীরে সময় এগিয়ে যাচ্ছিল। দিব্যকে সার্বক্ষণিক দেখাশােনা করে বাকি কিছু করা ছিল সবচেয়ে কঠিন কাজ। তারপরও কোনাে রকম কাজ না করে, বাড়ির জীবনে অভ্যস্ত হওয়ার কথা কখনও ভাবতে পারি নাই। কর্মজীবন আর মাতৃত্বের সঠিক দায়িত্ব পালন করা- আজকের পৃথিবীর উন্নত দেশের অনেক মেয়ের কাছে হয়তাে সহজ। কিন্তু তখনও আমাদের দেশে মেয়েদের জন্য মাতৃত্বের দায়িত্ব এবং পেশাগত জীবন একসঙ্গে পরিচালনা করা ছিল খুব কঠিন। অথচ আমাদের সংস্কৃতি, সমাজের ঐতিহ্যের পরিপ্রেক্ষিতে এটি কিন্তু আরও সহজ হওয়া উচিত। কেননা বাঙালির ঐতিহ্য যৌথ পরিবার। দিব্য ছােট থাকতে আমার সুবিধার কথাটা বলবাে- আমি অনেক ভাগ্যবান ছিলাম, আমার বাবা-মা যেমন দিব্যকে দেখে রাখতেন, তেমনি আমার শ্বশুর-শাশুড়ি দিব্যকে অনেক দেখে রেখেছেন। দিব্যকে নিয়ে দিনগুলাে ভালােই যাচ্ছিল। কিন্তু মাঝে মাঝেই আমার মনে হতাে, বাবা ও চাচাদের গৌরবােজ্জ্বল সময়ের কথাগুলাে সংগৃহীত হওয়া প্রয়ােজন। ছােট চাচার বিষয়ে বাবার কাছ থেকে অনেক তথ্য জানার জন্য একবার আমি শুধু দিব্যকে নিয়ে দুই দিনের জন্য খিলগাঁওয়ে বাবার বাসায় গিয়েছিলাম । আমার সব সময় সেই কথাগুলাে মনে পড়ত, মেজো চাচা আমিনুল হক যে আমাকে বলেছিলেন, ছােট চাচা আগরতলা মামলার অর্থাৎ স্বাধীনতাসংগ্রামের রিক্রুটমেন্টের কাজে লিপ্ত ছিলেন। অর্থাৎ
১৫৪
তার কাজ ছিল সংগঠনের সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধি করা। বাঙালি অফিসার এবং সৈন্যদের বােঝানাে যে, দেশ স্বাধীন করার জন্য একটি সংগঠন তারা তৈরি করেছেন, সেখানে যােগ দিতে হবে এবং সেই সঙ্গে বিষয়টি অত্যন্ত গােপন রাখতে হবে। বাবা আস্তে আস্তে বলতে শুরু করলেন- ছােট চাচা জহুরুল তাঁদের তিন ভাইয়ের মধ্যে ছােট, নােয়াখালীর সােনাপুর গ্রাম সুধারাম থানায় তাদের বাড়ি ছিল, তাদের মূল বাড়ি ছিল ফেনীর সােনাগাজী অঞ্চলে। ফেনীতে মূলত দুটি থানা আছে সােনাগাজী ও ফুলগাজী। বাবার কাছে শুনেছি, সােনাগাজী ও ফুলগাজী ছিলেন দুই ভাই। তারা এসেছিলেন মধ্য এশিয়া থেকে। জহুরুলের মেজো ভাই আমিনুল হক, বড় ভাই এ. এস. এম. মাহবুবুল হক। তাদের বাবার নাম ছিল কাজী মজিবুল হক। তাঁরা ছিলেন চার ভাই । কাজী মজিবুল হক বড়, মেজো ভাই ড. মাজহারুল হক (অর্থনীতিবিদ), সেজো ভাই সাংস্কৃতিক সংগঠক কাজী মাহফুজুল হক (মান্দু মিয়া) ও ছােট ভাই কাজী শফিকুল হক । তাদের একমাত্র বােন ছিলেন মাহবুবা রশিদ (বাচ্চু)। দাদা কাজী মজিবুল হকের পিতা কাজী সেরাজুল হক ফেনী অঞ্চল থেকে অনারারি ডিস্ট্রিক ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে সােনাপুরে আসেন। সােনাপুরের বাড়ির পূর্বে তাদের বাড়ি ছিল ফেনীর সােনাগাজী উপজেলার মেঘনা নদীর পাড়ে আহমেদপুর অঞ্চলে। খরস্রোতা মেঘনার ভাঙনে আহমেদপুরের বাড়ি মেঘনার অতল গহ্বরে বিলীন হয়ে যায়। তারপর কাজী সেরাজুল হক গ্রামের বাড়ি ছেড়ে, নিজের পরিবার নিয়ে সােনাপুরে চলে আসেন। পরিবারের অনেকগুলাে শাখা ফেনীতে রয়ে যায় । জহুরুল হক ১৯৩৬ সালের ৯ই ফেব্রুয়ারি সােনাপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্মের খবর পেয়ে দাদা কাজী সেরাজুল হকের ভাই বেলায়েত হােসেন ফেনী থেকে একটি গরু উপহার পাঠান। নবজাতক শিশুর জন্ম উপলক্ষে একটি মেজবান অনুষ্ঠান হয়েছিল। জহুরুল হকের দাদা কাজী সেরাজুল হক এক অসাধারণ মানুষ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন নােয়াখালীর সােনাপুরে। তিনি কলকাতার ইসলামিয়া কলেজ থেকে আরবিতে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে এসেছিলেন, তিনি বরিশাল বি.এম. কলেজের ইসলামি শিক্ষা বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। সদাশয় ব্যক্তি হিসেবে তিনি সর্বজনের কাছে সম্মানীয় ছিলেন। হিন্দু, মুসলমান সব ধর্মের মানুষের প্রতি ছিল তার সমান ভালােবাসা। বাবা বললেন- দাদা মাঝে মাঝে হিন্দুদের বিবাহ পর্যন্ত সম্পন্ন করতে সাহায্য করতেন। তাঁর সােনাপুরের বাড়িতে অনেক লােকের যাতায়াত ছিল । নাতি জহুরের জন্মের পর মেজবান অনুষ্ঠানে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। হঠাৎ বাড়ির লােক তাকে গিয়ে জানায়, একজন দরবেশ এসেছেন। কাজী সেরাজুল হক দেখতে পেলেন একজন দরবেশ উঠানে দাঁড়িয়ে আছেন, তিনি তাকে সাদরে অভ্যর্থনা জানিয়ে নাতির জন্মের কথা বলেন। দরবেশ সাহেবকে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে আপ্যায়ন করেন। খাওয়াদাওয়ার পর দরবেশ সাহেব আপন মনে বলে ওঠেন- “এই বাচ্চা বড় হলে একদিন খুব বিখ্যাত হবে, তাঁর মৃত্যুর পরও তাকে মানুষ বহুদিন মনে রাখবে।
১৫৫
বাবা এই কথাগুলাে আমাকে, ভাইজানকে, মাকে অনেক আগেই বলেছেন। সেদিন আবারও বললেন। ছােট থেকেই জহুর ছিল চঞ্চল, খেলাধুলায়ও খুব ভালাে, খুব ভালাে সাঁতার কাটত। খুব একরােখা ছিল। নিজের মতাে লেখাপড়া করত। সােনাপুর ব্রাদার্স স্কুলে পড়ত। ছােটবেলায় একবার বাড়ির কোনাে এক গুরুজনের কাছে বকা খেয়ে রাগ করে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। এবং একা পায়ে হেঁটে, সাঁতার কেটে, নৌকায় করে ভৈরব পার হয়ে ঢাকায় চলে যায়।
১৯৫৪ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন আর ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে যােগ দেন। বাবার কথা শুনতে শুনতে আমার নিজের চোখে ভেসে ওঠে, মুড়ির টিনের মতাে একটা বাসে করে ছােটবেলায় নােয়াখালীর বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম ।
বাবা জানান, পাকিস্তান থেকে চাচা মাঝে মাঝেই ঢাকায় আসতেন। আমার মায়ের বিয়ের পর চাচা যখনই ঢাকায় আসতেন, তখন অনেক কিছু মায়ের জন্য নিয়ে আসতেন । খুব ভালাে ছবি আঁকতেন তিনি। কাঠের জিনিসপত্র বানিয়ে নিয়ে আসতেন, ছােট চাচার সেইসব জিনিস এখনও রয়েছে আমাদের বাড়িতে। মা, মাসুদা হক পশ্চিমবঙ্গ থেকে ঢাকায় এসেছিলেন ১২ বছর বয়সে ১৯৫২ সালে । যুদ্ধটা। তার জীবনে শুরু হয়েছিল অত্যন্ত কৈশাের থেকে। নানাভাই খড়গপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে পাস করা ইঞ্জিনিয়ার রেইসউদ্দীন আহমেদ এবং তার বাবা জহিরউদ্দীন আহমেদ কলকাতায় সুপ্রতিষ্ঠিত জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। ১৯৪৭-এর দেশবিভাগের পর সবকিছু তছনছ হয়ে যায় । কত মানুষ এখান থেকে তাদের সমস্ত ভিটা-বাড়ি, জমিজমা ছেড়ে চলে যায় শূন্য হাতে, আর তেমনি শূন্য হাতে
১৫৬
অনেকেই ভারত থেকে বাংলাদেশে চলে আসে। ঘরছাড়া মানুষের দুর্বিষহ জীবনের ইতিহাস ছিল অবর্ণনীয় । আজও তারা ঘর খুঁজতে এপার থেকে ওপারে, ওপার থেকে এপারে আসে, যায় । মা খুব শৌখিন মানুষ। মা তেমন লম্বা নয়, ছােটখাটো মানুষ । ছােট চাচা মাকে বলতেন তােমার সঙ্গে কথা বলতে গেলে আমার ঘাড় নিচু করে কথা বলতে হয় । মাকে ‘তুমি’ সম্বােধন করে কথা বলতেন। আমাদের বাড়িতে তুমি’ বলার এক আড়ষ্টতাহীন বাচনভঙ্গির প্রচলন ছিল। আমি ও ভাইজান- বাবা, মা, চাচা, চাচি-মা, ছােট চাচা সবাইকে তুমি বলতাম। আমাদের মধ্যে ‘তুমি’ শব্দটা খুব প্রিয় ছিল।
১৫৭
বাবা আরাে বললেন- রুনু কোহাট থেকে ঢাকায় আসার পরে, বেশির ভাগ সময় নােয়াখালীর সােনাপুর বাড়িতে যেত। রুনু কখনাে বােনদের কথা ভুলে যেত না। আমাদের কোনাে আপন বােন ছিল না, কিন্তু চাচাতাে বােনেরাই আপন বােনের মতাে ছিল । সােনাপুরের বাড়িটাতে একটা যৌথ পরিবারের জীবনযাপন ছিল । রুনু সবসময় বােনদের জন্য ছােট-বড় কিছু না কিছু উপহার নিয়ে আসত। সে সময় রুবি পর্যন্ত সাত-আটজন বােন ছিল। রুনুর সবচেয়ে বড় গুণ সে সবসময় খেলাধুলায় মেতে থাকত, সবাইকে মাতিয়ে রাখত, বােনদের নিয়ে নানা রকম খেলার আয়ােজন করত । ফারুককে সামনের বড় দিঘিতে সাঁতার শেখানাের চেষ্টা করত। ঢাকায় এলে বেশির ভাগ সময় তােমার মায়ের কাছে বনানীর বাসায় থাকতে পছন্দ করতাে। বনানীর বাসায় অনেক গাছ ছিল । ড্রয়িংরুমের জানালায় কোনাে পর্দা ছিল না। জানালার সামনে দুই সারি গাছ ছিল। সেগুলাে অনেক পরেও সেইভাবে ছিল । জহুর যখনই ঢাকায় আসত তখনই একটা শটস্ পরে ওর ভাবির সব গাছের টব রং করে দিত । বনানী সেই সময় ছিল কোলাহলহীন অপরূপ একটি নতুন আবাসিক এলাকা, খুব কম বাড়িঘর, চারদিকে অসংখ্য গাছপালা। আজকের বনানীতে অনেক আধুনিকতা এসেছে, নতুন নতুন অসংখ্য বাড়িঘর তৈরি হয়েছে, বিশাল বিশাল উঁচু ভবন নির্মিত হয়েছে । অনেক নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। তখন কিন্তু বনানীতে খুব বেশি আধুনিক ব্যক্তিগত বাড়িঘর ছিল না। এমন কি কোনাে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ছিল না, তবে একটা জিনিস ছিল- সবুজের সমারােহ। এমনকি স্বাধীনতার পরেও এখানে বাড়িঘরগুলাের চারপাশে খালি জায়গা রাখার নিয়ম ছিল । প্রতিটি বাড়িতে অনেক গাছপালা ছিল। আজকের বনানী অনেক রুক্ষ, আমরা আধুনিকতার নামে উঁচু ভবনের চাপে প্রকৃতিকে বিনষ্ট করে ফেলেছি। এখনাে বাংলাদেশ ব্যাংক কোয়ার্টারের ভেতরে অনেক গাছপালা আছে । জহুর খুব ভালাে ছবি তুলতে পারত । ঢাকায় এলে বনানী এলাকায় আমাদের নিয়ে ছবি তুলতে যেত । ছােট চাচা আমাদের নিয়ে ব্যাংক কলােনির আশেপাশে, কলােনির একটু দূরে গুলশান লেক- যেটিকে মানুষ আগে বনানী, গুলশান খাল বলত সেখানেও ছবি তুলতে যেতেন। মা আমাদের অনেকবার একটি ঘটনা বলেছেন- শেষবার চাচা যখন ঢাকায় আসেন, আমাদের নিয়ে ছবি তুলতে গিয়েছিলেন। ছবি তােলা শেষ করে বাসায় এসে হাসতে থাকেন। মা জহুরকে ডেকে জিজ্ঞেস করেন- রুনু (জহুর) ভাই তুমি হাসছাে কেন? কী হয়েছে? মা জিজ্ঞেস করায় জহুর হেসে বললেন- আজকে ছবি তােলার সময় অনেক মজা। হয়েছে। আমাদের মঞ্জু অনেক শান্ত চুপচাপ। মিমি কিন্তু অন্যরকম, ওর মতাে না । নিচে কয়েকটা সুন্দর মােরগ-মুরগি ছিল, মঞ্জু বললাে- মুরগিগুলাে সব আমাদের। মা মুরগি পছন্দ করেন, এগুলাে সব মায়ের পােষা মােরগ-মুরগি । আমি বললাম- তােমার কাছে ডাকো মােরগটাকে ও খুব সুন্দর । ওকেসহ তােমার ছবি তুলি । মঞ্জু কোনােভাবেই মােরগ ধরতে রাজি হচ্ছিল না, কিন্তু হঠাৎ মিমি দ্রুততার সঙ্গে খপ করে বড় মােরগটা ধরে ফেলে কোলে নিল । মঞ্জু মিমির থেকে একটু সরে দাঁড়াল, আমি সঙ্গে সঙ্গে ছবি তুলি।
১৬০
জহুর নানা কিছুর আয়ােজন করত । সবচেয়ে বড় মজার জিনিস হচ্ছে- তিনি কাগজ দিয়ে সুন্দর সুন্দর টুপি বানাতে পারতেন । টুপিটা ছিল লম্বা ও উঁচু লাল রঙের । টুপির পেছনে ছিল লম্বা ঝালর । আমার জন্মদিনের জন্য লাল রঙের টুপিটা তিনি বানিয়ে এনেছিলেন । এরকম টুপি তিনি পরিবারের ছােট বাচ্চাদের জন্য বানাতেন। জহুর করাচিতে থাকার সময় বাবা-চাচাদের ছােট খালা মিসেস রহমত আরা আর খালু ড. আতােয়ার হােসেন ঢাকা থেকে বদলি হয়ে রাওয়ালপিন্ডিতে যান। জহুরের ছােট খালু প্ল্যানিং সেক্রেটারি হন এবং খালা রাওয়ালপিন্ডি মহিলা কলেজে জয়েন করেন, সেই সময় জহুরের খালাতাে ভাই সাব্বিরের এক জন্মদিন উপলক্ষে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে খালার কাছে যান। আর খালাতাে ভাইয়ের জন্মদিনের উপহারস্বরূপ লাল রঙের ঝালরসহ টুপি বানিয়ে দিয়েছিলেন।
আমার জন্যও লাল রঙের পেছনে ঝালরওয়ালা একটি টুপি তিনি বানিয়েছিলেন, সেই টুপিটা অনেক দিন মা যত্ন করে আলমারিতে রেখে দিয়েছিলেন। আমি অনেক বড় হওয়ার পরও আলমারি খুলে টুপিটা দেখতাম।
১৬১
আমার জন্মদিনটি খুব সুন্দর করে প্রতিবেশী বাচ্চাদের নিয়ে মা, বাবা, ছােট চাচা পালন করেছিলেন। সেইবার একটা মজার ঘটনা ঘটেছিল। মায়ের কাছে ছােটবেলা থেকে অনেকবার শুনেছি- চাচার (আমিনুল হক) একটা ভেসপা (মােটর সাইকেল) ছিল, ছােট চাচা আসায়, আমিনুল হক চাচা মােটর সাইকেলটি বাসায় রেখে গিয়েছিলেন। বললেন, জহুর যদি কোথাও যেতে চায় তবে ভেসপাটা চালাতে পারবে।
চাচা আমার জন্মদিনের উপহার কেনার জন্য আমাকে নিয়ে গুলশান ২ নম্বর ডি.ই.টি মার্কেটে যান । মায়ের কাছে অনেকবার শুনেছি- চাচা জানতেন আমার পুতুল পছন্দ, তাই আমাকে সুন্দর সুন্দর বিভিন্ন ধরনের পুতুল দেখিয়ে জিজ্ঞেস করছিলেন, আমি কোনাে পুতুলটা কিনতে চাই? কিন্তু সেদিন আমার কোনাে পুতুল পছন্দ হয় নাই। হঠাৎ শােকেসের ভেতরে আমি একটা সবুজ রঙের ব্যাঙ দেখতে পাই । আমি বারবার ব্যাঙটা আঙুল দিয়ে চাচাকে দেখাচ্ছিলাম। দোকানদার আমার আগ্রহ দেখে ব্যাঙটা বের করে কাচের শাে-কেসের কাউন্টারের ওপর চাবি দিয়ে ছেড়ে দেয়। ব্যাঙটা ধীরে ধীরে চলতে শুরু করে। আমি আশ্চর্য হয়ে তা দেখতে থাকি । চাচা আমাকে তখন ব্যাঙটা কিনে দেন।
বাসায় এসে মাকে বললেন- তােমার মেয়েকে এত কিছু দেখালাম, সে কোনাে কিছু নিতে রাজি হলাে না, এমনকি কোনাে পুতুলও নিল না। শুধু মাথা নাড়ে আর আঙুল দিয়ে ব্যাঙটা দেখায়, ধরাে এই ব্যাঙ-এর বাক্স, এটাই তােমার মেয়ের পছন্দ। ব্যাঙটা এখনও আমার কাছে আছে। জহুর চাচার দেয়া জন্মদিনের সেই মূল্যবান উপহারটি সারাজীবন ধরে আঁকড়ে রেখেছি।
১৬৪
আমার ঝাপসা-ঝাপসা মনে পড়ে ছােট চাচার বনানীর বাড়িতে নানারকম সম্পৃক্ততার কথা। আসলে ছােটবেলার কথাগুলাে স্মৃতির পাতায় সযত্নে থাকার মধ্যে দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ । ঘটনার মধ্যমণি ব্যক্তিটি যদি কোনাে স্মরণীয় ব্যক্তি হয়- যাকে নিয়ে কোনাে অভাবনীয় ঘটনা ঘটে যায়, তার সঙ্গে জড়ানাে ঘটনাগুলাে ভুলতে পারা যায় না, তা সে যতই ছােট হােক। আরেকটি বিষয় হচ্ছে- ঘটনার মধ্যমণি ব্যক্তিটি যদি পরিবারের সবার প্রাণপ্রিয় ব্যক্তি হয় তবে তাকে অপরিণত সময়ে হারানাের ফলে পরিবারের বড়রা যখন বারবার সেই ছােট ছােট মধুর স্মৃতিগুলাে আলােচনা করে, তখন ছােটদের স্মৃতির মধ্যে তা উজ্জ্বল অনাবিল হয়ে থাকে। আমাদের পরিবারের বাবা-মা, আমিনুল হক চাচা, এমনকি আমাদের ভাইবােনদের মধ্যে জহুর এক প্রিয় ব্যক্তিত্ব। মায়ের কাছে এতবার এসব ঘটনা শুনেছি, যা আজও আমার মনের মধ্যে জ্বল জ্বল করে জ্বলছে । একজন স্বাধীনতাকামী মানুষের পরিবারে কী কী ঘটনা ঘটেছিল, তা হয়তাে কোনাে জাদুঘরের স্বাধীনতার ইতিহাসের গ্যালারিতে বুলেট ক্যাপশন’ হবে না। বাঙালি জাতির সামাজিক ইতিহাস পর্যালােচনায় অথবা বিশ্লেষণে, সাহিত্য রচনায়, বাঙালি পরিবারের মনস্তাত্ত্বিক আলােচনায় একেকটি পরিবারের এই ছােট ছােট ভালােবাসাপূর্ণ ঘটনাগুলাে হয়তাে কোনাে একদিন সামাজিক ইতিহাসকে প্রাণিত করবে। এরপর বাবার কাছে জানতে চাইলাম- আগরতলা মামলায় জহুর কীভাবে জড়িয়ে পড়লেন? বাবা বললেন- জহুর শেষ চিঠিতে আমাকে লিখেছিল, দাদা আমার জন্য একটা চাকরি বা কাজ দেখাে। আমি দেশে চলে আসব । এই চিঠিটা পেয়ে আমার মন কেমন যেন অস্থির হয়ে পড়েছিল, কেননা জহুর সেনাবাহিনীর কার্যক্রম পছন্দ করত, অথচ সে চাকরি ছেড়ে দেশে চলে আসতে চাচ্ছে। বাবা আরও বললেন- রুনুর (জহুর) চিঠিটা পেয়ে আমি খুব চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম । আমি দ্রুত তার চিঠির উত্তর দিলাম । কিন্তু কয়েক দিন পর চিঠিটা ফেরত এলাে। অর্থাৎ সে আমার চিঠি পাওয়ার আগেই স্টেশন লিভ করেছিল। কিন্তু সে বিষয়েও আমি অনিশ্চিত হয়ে পড়লাম। জহুর চাচা ও বাবার চিঠির কথা আমি আগেই উল্লেখ করেছি। কীভাবে ১৯৬৮-র সন্ধ্যায় বাবা ও চাচা এলিফ্যান্ট রােডের চিত্রা বাসায় জহুরের অ্যারেস্টের খবরটি পেয়েছিলেন । বাবা কথা বলতে বলতে চুপ হয়ে যান। কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে যান । আমি বুঝতে পারলাম, ভাই হারানাের যন্ত্রণা কখনােই তার ভিতর থেকে লাঘব হয়নি। ইতােমধ্যে বাবা তার মেজো ভাই আমিনুল হককে হারিয়েছেন। ভাইজান বিদেশে চলে গেছে। আমিও এখন আর তার কাছে থাকি না। বয়সের ভারের কোনাে ক্লান্তি তার মধ্যে ছিল না। কিন্তু প্রিয় মানুষগুলাে হারানাের যন্ত্রণায় তিনি আরও নিশ্ৰুপ হয়ে পড়েছিলেন। বাবা শেষের দিকে ক্রমাগত একা হয়ে পড়ছিলেন। আমি সেদিন মনে মনে খুব শক্ত হয়েছিলাম, কেননা ছােট চাচার (জহুর) আগরতলা মামলার বিষয়টা আমাকে জানতেই হবে । তবুও আমার ভয় হলাে বাবা যদি কোনােরকম
১৬৫
ভাবাবেগ থেকে অসুস্থ হয়ে পড়েন, তাই আমি কিছুক্ষণ চুপ করেছিলাম, এমন যখন ভাবছিলাম, তখন বাবাই আমাকে আবার ডাকলেন এবং বলা শুরু করলেন। তুমি যখন জানতে চাও, আজকে তােমাকে যতটা সম্ভব বলে যাব। আমার শরীরটা ভালাে নয়, কখন কী হয়ে যায় জানি না। তুমি শুনে রাখাে এবং লিখে নাও। বাবাকে, জহুরুল হকের বড় ভাই এস. এম. মাহবুবুল হককে আমার এবার সত্যি মনে হলাে ভীষণ একা!
বাবার সঙ্গে প্রতিবছর ১৫ই ফেব্রুয়ারি আজিমপুর কবরস্থানে গিয়েছি। জহুরুল হকের স্মরণে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে একসঙ্গে বাসে বা রিকশায় গিয়েছি। আমার বিয়ে হওয়ার পর থেকে অনেক সময় তিনি একা গেছেন, হয়তাে অনুষ্ঠানে গিয়ে আমার সঙ্গে দেখা হয়েছে, কিন্তু সত্যি তিনি একা, তিনি বড় কিন্তু ছােট দুই ভাই আর নেই। এই অনুভূতি আমার ভেতরে আসার সঙ্গে সঙ্গে, আরও একটি বিপরীত অনুভূতি জেগে উঠল। মনে হলাে গত কয়েক বছরে পরিবারে নানা সমস্যা আর দুর্যোগের সময় তিনি দায়িত্বের সঙ্গে পরিবারের সকলের সঙ্গে থেকেছেন এবং আজকে আমাকে চাচাদের ঐতিহাসিক ঘটনার কথাগুলাে বলার জন্যই বােধ হয় এখনও আমাদের সঙ্গে আছেন ।
বাবা ধীরে ধীরে বলতে শুরু করলেন-
জহুরুল হক অ্যারেস্ট হওয়ার পর মাহবুবল হক প্রায়ই তার সঙ্গে দেখা করতে যেতেন। মেজো ভাই আমিনুল হকও প্রায় প্রতিদিনই দেখা করতে যেতেন। কীভাবে মামলাটি এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, তাই নিয়ে তাদের মধ্যে একটা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছিল । এমন সময় জহুরুল হক খুব চুপচাপ হয়ে যান, একদিন বড় দাদাকে বললেন- তার জন্য কিছু বাংলা বই নিয়ে আসতে। বন্দি অবস্থায় কিছুই করার নাই, বাংলা কবিতা পড়তে পছন্দ করতেন আর গল্পের বই। তার দু-এক দিন পর জহুরুল হকের হঠাৎ লক্ষ্য করলেন বড় দাদা জেল গেটের কাছে। দাঁড়িয়ে আছেন, আর প্রহরারত পাকিস্তানি সেন্ট্রি তার সঙ্গে ভীষণ জোরে জোরে কথা বলছে এবং এক পর্যায়ে তার হাত থেকে বইগুলাে কেড়ে নিয়ে মাটিতে ফেলে দেয়। জহুর বুঝতে পারলেন, বড় দাদা তার জন্য বই নিয়ে এসেছেন আর সে জন্য তার সঙ্গে বর্বর পাকিস্তানি সেন্ট্রিগুলাে খারাপ ব্যবহার করছে। জহুর সহ্য করতে না পেরে ছুটে গেটের কাছে যান। সেন্ট্রিকে জহুর সজোরে ধাক্কা দিয়ে প্রশ্ন করেন, কেন তুমি আমার ভাইয়ের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করছাে? পাকিস্তানি সৈন্যটি তখন ঔদ্ধত্যের সঙ্গে বলে উঠল- বাংলা বই ভেতরে নেয়া নিষেধ। কেন তােমার ভাই বই এনেছে? জহুরুল হক সেসব কথা গ্রাহ্য না করে বইগুলাে মাটি থেকে উঠিয়ে নিলেন এবং পাকিস্তানি সৈন্যটির দিকে রাগতভাবে তাকিয়ে স্পষ্টভাবে প্রতিবাদ করে উর্দুতে বললেন- এই জন্য আমরা তােমাদের সঙ্গে থাকতে পারবাে না। তােমরা আমাদের
১৬৬
ভাষাকে গুরুত্ব দাও না। মায়ের ভাষার বই পড়তে পারবাে না, এটা হতে পারে না। এই বলে তিনি কোনােরকম ভ্রুক্ষেপ না করে বড় দাদাকে বললেন- দাদা চলাে আমার সঙ্গে ভেতরে চলাে।
বাবা আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবার বলতে শুরু করলেন-
আরেক দিনের কথা আমার খুব মনে পড়ে, এ ঘটনাটি শুরুর দিকের ছিল । আমি সকালের দিকে জহুরের সঙ্গে দেখা করতে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে গিয়েছিলাম। থার্ড পাঞ্জাব রেজিমেন্টে যেখানে অভিযুক্তদের রাখা হয়েছিল সেখানে গিয়ে আমি প্রশ্ন করলামজহুরুল কোথায়, কোন কক্ষে আছে? একজন সেন্ট্রি ইশারা করে দেখালাে জহুরকে দূরের একটা ঘরে রাখা হয়েছে। আমি ঘরটার কাছাকাছি পৌছে দেখলাম, জহুর ওয়াশরুম থেকে গােসল শেষ করে রুমটির দিকে আসছে। আমাকে দেখে জহুর থামল, বলল- বড় দাদা, আসাে । আমাকে কয়েক দিনের জন্য পাকিস্তানিরা এই ঘরটাতে রেখেছে। জহুরের বড় দাদা প্রশ্ন করলেন- অন্য অভিযুক্তরা কি এখানে আছে? জহুর বললেন- না, ওরা জানিয়েছে আমাকে কয়েক দিন এখানে একা থাকতে হবে । দিনের বেলা ঘরের দরজাটা খােলা থাকে; কিন্তু এই পাশে অন্য অভিযুক্তরা আসতে পারে না। সন্ধ্যার পর দরজার বাইরে থেকে তালা বন্ধ করে দেয়। কিন্তু সব সময় পাকিস্তানি অস্ত্রধারী সৈন্যরা ঘােরাফেরা করছে। খিলগাঁওয়ের বসার ঘরে সােফায় বসে- বাবা আমাকে কথাগুলাে বলছেন- কিন্তু আমার মনে হলাে বাবা ওখানে নেই, বাবা ১৯৬৮ সালের সেই সময়টাতে চলে গেছেন। আমি সমস্ত কোলাহল উপেক্ষা করে বাবার অনুভূতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে প্রশ্ন করলামকেন ছােট চাচাকে আলাদা করে কয়েক দিন রেখেছিল? পাকিস্তানিদের কী উদ্দেশ্য ছিল?
বাবা বললেন- আমি আস্তে আস্তে জহুরের সঙ্গে সেই কক্ষের ভেতরে যাই। খুব সাধারণও নয়, একেবারে দৈন্য অবস্থা ছিল সেই ঘরটির। এক পাশে শােবার জন্য একটিমাত্র চৌকি ছিল সেখানে আমরা দুই ভাই পাশাপাশি বসি। জহুরকে প্রশ্ন করি- তােমাকে এখানে একা রাখার কারণ কী? জহুর বলল- দাদা সম্ভবত আমাকে ওরা একা রেখে নির্জনতার ভেতর দিয়ে এক প্রকার শাস্তি দিতে চাচ্ছে, এ ছাড়া আমাকে ওরা মনে হয় কিছুটা সমঝে চলে। আমি বুঝতে পারলাম, জহুরকে পাকিস্তানিরা ভয় পেত । আর দশটা বাঙালির মতাে ওর গড়ন ছিল না। সে ছিল দীর্ঘকায় ৬’-২”, এক সবলদেহি বাঙালি। অস্ত্র প্রশিক্ষক, অস্ত্র চালনায় অত্যন্ত পারদর্শী, একরােখা, তার বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের জন্যও সে বারবার পাকিস্তানি সৈন্যদের দুর্ব্যবহারের প্রতিবাদ করেছে। আর এই কারণে পাকিস্তানিরা তাকে কিছুদিন সম্পূর্ণ একা নির্জন একটি কক্ষে রেখেছিল। কারাে সঙ্গে কথা বলার সুযােগ ছিল না তার। পাকিস্তানিরা তাকে সর্বদাই অবজারভেশনে রাখত । আমি বুঝতে পারলাম, বিষয়টা সুবিধাজনক নয়।
১৬৭
অনেক দিন পর আমাকে এই কথাগুলাে বলার সময় মনে হলাে, বাবা তখনও আতঙ্কগ্রস্ত ছিলেন, জহুরকে কি বাঁচানাে সম্ভব হবে? এত বছর পরেও বাবার চেহারায় সেই দিনগুলােতে ভাইয়ের জন্য চিন্তার, কষ্টের ভাবাবেগ দেখতে পেলাম। বাবা সারাজীবনই তার দুই ভাইয়ের জন্য এক গভীর মমতাবােধ, ভালােবাসা পােষণ করতেন। আর তার সঙ্গে দুই ভাইকে হারানাের কষ্ট নিজের মধ্যে সঙ্গোপনে রেখেছিলেন। বাবাকে কিছুটা সময় দিয়ে আবার প্রশ্ন করলাম, সেদিন জহুরের সঙ্গে তার কী ধরনের কথা হয়েছিল?
১৬৮
বাবা বললেন- সেদিনটা আমি খুব চিন্তিত ছিলাম রুনুকে নিয়ে। কীভাবে ওকে এই মামলা থেকে বাঁচানাে যায়? মনু (আমিনুল হক) প্রতিদিন সিনিয়র আইনজীবীদের সঙ্গে আলাপ-আলােচনা করছেন। এমনকি আওয়ামী লীগের উধ্বর্তন কয়েকজন নেতার সঙ্গে কষ্ট করে দেখা করে আলাপ-আলােচনা করছেন- কীভাবে এ ধরনের কঠিন মামলা সকল অভিযুক্তের পক্ষ থেকে একত্রে পরিচালনা করা যায়? সিনিয়র আইনজীবীদের বক্তব্য ছিল- মামলাটি অত্যন্ত পাকাপােক্তভাবে, শক্ত ভিত্তিতে, সুনির্দিষ্ট সাক্ষী সংগ্রহের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানিরা দাঁড় করিয়েছে। সামরিকবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী এবং সরকারি কর্মকর্তারা চাকরিরত অবস্থায় সরকার উৎখাতের পরিকল্পনা করেছে- এটি অত্যন্ত জোরালাে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা। এই আগরতলা মামলার থেকে কোনাে অভিযুক্তের মুক্ত হওয়া কোনােভাবেই সম্ভব না। তাই এ রকম কঠিন পরিস্থিতিতে সকল অভিযুক্তকে তাদের বিরুদ্ধে আনীত গােপন ষড়যন্ত্রের অভিযােগ সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করতে হবে । যদিও তৎকালীন সামরিক, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী এবং উর্ধ্বতন সরকারি বাঙালি কর্মকর্তারা একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজ মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টা নিয়েছিল। বাবা (মাহবুবল হক) জানতেন, তিনি নিজে এবং তার দুই ভাই যে কোনাে অবস্থায়ই মিথ্যাচারের বিপক্ষে। তারা তিন ভাই সকল অবস্থায়ই সত্য কথা বলতেন। আর এ কারণেই জহুর পাকিস্তানে বন্দি হওয়ার পরে থানার ওসির কাছে জবানবন্দিতেও লিখেছিলেন- সুস্থ মস্তিষ্কে নিজ মাতৃভূমির অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করার জন্য সশস্ত্র অভ্যুত্থানের বিপ্লবের সঙ্গে জড়িত। বাবা আরাে বললেন- আমি জহুরের ঘরে বসে চারদিকে খেয়াল করলাম, ঘরের খুব কাছে কোনাে পাকিস্তানি প্রহরী আছে কি না। তারপর আস্তে আস্তে জহুরের আরাে কাছে গিয়ে বসলাম ।
জহুরকে প্রশ্ন করলাম- মনু বলেছিল পাকিস্তানিরা তােমার বিরুদ্ধে যে অভিযােগ এনেছে, সেটি হচ্ছে তুমি করাচির কোরাঙ্গি ক্রিক থেকে মারি গিয়েছিলে একজন বাঙালি অফিসারকে কনভিন্স করার জন্য, পরবর্তী সময়ে সেই বাঙালি অফিসার তােমাদের সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়। অর্থাৎ দেশ স্বাধীন করার জন্য তােমরা যে বিপ্লবী কার্যক্রম শুরু করেছে তার সঙ্গে সংযুক্ত হতে তাকে অনুরােধ করেছিল। কিন্তু সে বাঙালি অফিসারটি তােমাদের এ ধরনের বৈপ্লবিক সংগঠনের সঙ্গে সংযুক্ত হতে অস্বীকার করে । এমতাবস্থায় তুমি তাকে হুমকি দাও যে, সে যেন এ বিষয় নিয়ে কোনাে রকম তথ্য কোথাও প্রকাশ না করে। পাকিস্তানি ইন্টেলিজেন্সের লােকেরা আগরতলা মামলার তথ্য প্রদান করেছে, সেখানে উল্লেখ করেছে যে, তুমি সেই দিন মারিতে গিয়েছিলে । এমনকি সেই বাঙালি অফিসারটিকে পাকিস্তানিরা ধরে নিয়ে যায় এবং শারীরিক নির্যাতনের মাধ্যমে চাপ সৃষ্টি করায় বাঙালি অফিসারটিও সাক্ষ্য দিয়েছে যে, তুমি সেই দিন মারিতে তার বাসায় কিছু সময়ের জন্য গিয়েছিলে ।
১৬৯
আইনজীবীরা পরীক্ষা করে দেখেছেন যে, চাকরির উপস্থিতির খাতায় তােমার স্বাক্ষর আছে অর্থাৎ তুমি সেইদিন করাচির কোরাঙ্গি ক্রিকে ছিলে, করাচি থেকে মারির দূরত্ব অনেক। একই দিনে দুই শহরে থাকা সম্ভব নয়। ফলে তােমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযােগটি প্রমাণ করা কঠিন হচ্ছে। বাবা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন- এ নিয়ে আমার মনের মধ্যে এক রহস্য সৃষ্টি হয়েছিল, আমার মনে হচ্ছিল এর ভেতরে একটা গূঢ় রহস্য আছে। তাই জহুরের কাছে আস্তে আস্তে প্রশ্ন করলাম, কীভাবে এই ঘটনা সম্ভব, ওরা কি মিথ্যা বলছে? জহুর খুব স্বাভাবিক ছিল। আমার কথায় সে হেসে ওঠল ।
হাসতে হাসতে বলল- দাদা, ঘটনাটা সম্পূর্ণই সত্য। আমাদের একটা বড় সংগঠন ছিল। সকলের অন্তরে পাকিস্তানিদের অত্যাচারে, বৈষম্যমূলক আচরণে বিক্ষুব্ধ হয়ে দেশ স্বাধীন করার ব্রত ছিল। সকল ক্যান্টনমেন্টের বাঙালি অফিসাররা আক্রমণ চালিয়ে বিদ্রোহ করে দেশ স্বাধীন করার পরিকল্পনা ছিল । আইয়ুব খান পূর্ব পাকিস্তানের চট্টগ্রামে যাওয়ার কথা ছিল আর সেই সময়ে এই অভ্যুত্থানটি সংঘটিত হবে- এরকম একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছিল। জহুর আরাে বলল- দাদা, তুমি আর মেজোদা এইসব কথা তাে জানােই । জহুর আমাকে যখন এসব কথা বলছিল তখন ওর চোখেমুখে এক কঠিন শপথের প্রতিফলন দেখেছিলাম, ওর ভেতর কোনােরকম ভয়ভীতি ছিল না। ধীরে ধীরে আরাে বললসংগঠনের সব সদস্য পাকিস্তান বিমানবাহিনী ছাড়া নৌবাহিনী এবং সামরিক বাহিনীতে ছিল প্রায় প্রতিটি ক্যান্টনমেন্টে সংগঠন ও কর্মী ছিল । প্রত্যেকের দায়িত্ব ছিল ভিন্ন ভিন্ন। এবং ছিল ছদ্মনাম, সংগঠনের কর্মীরা তাদের ঊর্ধ্বতন কর্মীর সঙ্গে যােগাযােগ করতেন। জহুর আমাকে আরাে একটি বিষয় জানায়, তাতে আমি চমকে উঠি যে তারা অস্ত্র প্রশিক্ষণ শুরু করেছিল, আমি তাকে আবার জিজ্ঞেস করি তার মারি যাওয়ার বিষয়টি।
জহুর বলল- দাদা তুমি তাে জানাে আমি খুব ভালাে উর্দু বলতে পারতাম । এমনকি ইংরেজিতে কোনাে অসুবিধা ছিল না। আমি সেদিন সত্যি সত্যি মারিতে গিয়েছিলাম। আমি জানতাম, কখন ক্যান্টনমেন্ট থেকে এয়ার কার্গো হেলিকপ্টার কোথায় যাবে, আসলে সংগঠনের কাজের জন্য আমরা চোখ-কান খােলা রাখতাম। আমার সঙ্গে পাকিস্তানি পাইলটদের ভালাে সম্পর্ক ছিল। আমি জানতাম, আজকে মারিতে যাওয়ার একটা ফ্লাইট আছে। আমি সকালে এসে অফিস রেজিস্টার খাতায় সই করে অফিসের কিছু কাজ শেষ করে ফেললাম।
১৭০
তারপর ফ্লাইটের যাত্রার ঠিক আগ মুহূর্তে আমি ওখানে পৌঁছে পাইলটকে প্রশ্ন করলামতুমি কোথাও যাচ্ছাে, হাসতে হাসতে ওকে বলতাম, আমাকে নিয়ে যাবে, আমি ঐ শহরটা দেখতে চাই। আমাকে কোনাে সময় কোনাে পাইলট হতাশ করেনি। এমনকি সকল যাত্রীর নামের লিস্ট হয়ে গেছে, আমি বেশির ভাগ সময় পাইলটদের পাশে কো-পাইলট চেয়ারে বসে মারি চলে গিয়েছি। শুধু মারি না, এইভাবে কোহাট, বেলুচিস্তান আরাে কয়েকটা জায়গা সকালে গিয়েছি আবার সন্ধ্যার মধ্যে ফেরত এসেছি। আর ঐ দিনের মধ্যেই আমি দ্রুত বাঙালি অফিসারদের সঙ্গে যােগাযােগ করে আসতাম। এভাবেই আমি মারি গিয়েছিলাম । কিন্তু সেই বাঙালি অফিসার আমাদের সঙ্গে কাজ করতে রাজি হন নাই। আমি সেদিনও সকালে অফিসে যাই, রেজিস্টার খাতায় সই করেছিলাম, কিছুক্ষণ অফিসের কাজও করেছিলাম। আর মারি যাওয়ার ফ্লাইটটি চালু হওয়ার শেষ মুহূর্তে প্লেনের কাছে যাই। পাইলটকে সম্ভাষণ জানাই, তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে আমাকে ফ্লাইটে ওঠার আমন্ত্রণ জানান। আমি সঙ্গে সঙ্গে প্লেনে উঠে পড়ি। সেইদিন ফ্লাইট চালু হওয়ার শেষ মুহূর্তে আমি ফ্লাইটে উঠেছিলাম, ফ্লাইটের লগবুকেও আমার নাম ছিল না। আবার একই ফ্লাইটে আমি করাচি ফেরত আসি । আর সেই কারণেই আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযােগটি প্রমাণ করতে পারেনি। এমনকি ফ্লাইট সার্জেন্ট ফজলুল হক এবং আব্দুল জলিলের বাসায় যেতাম অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য। এ ছাড়া আমাদের মধ্য থেকে একজন একটি গ্রেনেড সংগ্রহ করে নিয়ে আসে, গ্রেনেড কিভাবে ছুড়তে হবে এ বিষয়ে বাঙালিদের প্রশিক্ষণ দিতাম। সেদিনগুলাে ছুটির দিন থাকায় তারা আমার বিরুদ্ধে কোনাে প্রমাণ তৈরি করতে পারে নাই।
১৭১
জহুর আমাকে আরও একটি কথা বলল- এই সংগঠনের সঙ্গে সামরিক বাহিনীর বাঙালি অফিসার ছাড়াও পাকিস্তানে অবস্থানরত বেসামরিক কিছু বাঙালি সংযুক্ত ছিল, যারা তাদের সঙ্গে এখন ক্যান্টনমেন্টে বন্দি আছে। ও আমাকে মাহবুবউদ্দিনের কথা বলল- তিনি আগরতলা মামলার ৩০নং অভিযুক্ত ছিলেন। তিনি ব্রিটিশ-অ্যামিরিকান টোব্যাকো কোম্পানিতে কাজ করতেন। পাকিস্তানে বাঙালিদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি আসতেন, এইভাবে তিনিও এই সংগঠনের সঙ্গে জড়িত হয়েছিলেন। দেশ স্বাধীন করার একই মন্ত্রে দীক্ষিত হয়েছিলেন।
একপর্যায়ে হঠাৎ রুনু হেসে উল্টো আমাকে প্রশ্ন করল, দাদা আমি কিন্তু অ্যারেস্ট হওয়ার পর সব কিছু স্বীকার করেছি। আমি লিখিত Statement-এ লিখেছি- দেশ স্বাধীন করার জন্য আমি সশস্ত্র আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত। আমি চুপ হয়ে গেলাম, মনে হলাে এটা খুব বিপজ্জনক পরিস্থিতি। ও এখনাে কঠিন স্বরে এই বন্দি অবস্থায় পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে। আমি ধীরে ধীরে বললামএখন এসব কথা আর বােলাে না। ওরা জানলে তােমাকে ফাঁসি দিয়ে দেবে। রুনু আমার কথায় এতটুকু বিচলিত হলাে না। বড় দাদা, আমার যদি ফাসির অর্ডার হয়ে যায় তবুও আমি বলব, আমি দেশের স্বাধীনতার কাজের সঙ্গে সংযুক্ত । আমার আর কথা বাড়ানাের ইচ্ছা ছিল না। সেদিনটা সেখানেই কথা থামিয়ে বিদায় নিলাম। অনেক বছর আগের কথাগুলাে বাবা আমাকে ধীরে ধীরে বলতে বলতে কেমন যেন বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়ে যাচ্ছিলেন। এত কষ্টকর স্মৃতি হাতড়ানাে খুব বেদনাদায়ক, যদিও এখনও বাবার সব কিছু মুখস্তের মতাে মনে আছে। আমি ভাবলাম, কিছুক্ষণ চুপ থাকি । কিছুক্ষণ পর বাবা নিজের থেকে আমাকে আবার বলতে শুরু করলেন। সেদিন ক্যান্টনমেন্ট থেকে ফিরে আমি মনুর (আমিনুল হক) বাসায় যাই। আমরা দুই ভাই বুঝতে পারছিলাম রুনু (জহুরুল হক) মানসিকভাবে অন্য এক স্তরে চলে গেছে। দেশের স্বাধীনতার জন্য অনেকেই নিবেদিতভাবে কাজ করেছেন। কিন্তু নিজের জীবন দেওয়ার জন্য সে সম্পূর্ণ প্রস্তুত। তার মধ্যে ক্ষণিকের ভাবাবেগ নয়- এক দৃঢ় সংকল্প আমরা অনুভব করেছিলাম ।
১৭২
এদিকে আইনজীবীরা সম্মিলিতভাবে বারবার বৈঠক শুরু করলেন। রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্যরা’- মামলার নাম হলাে। প্রথমে বঙ্গবন্ধুর জন্য আলাদা আইনজীবীর কথা ভাবা হয়েছিল, কিন্তু বঙ্গবন্ধু তাতে একেবারে রাজি হলেন না। তিনি সম্মিলিত একটি আইনজীবীদের দল গঠন করে মামলা পরিচালনা করতে কঠিন নির্দেশ দেন। তার এই নির্দেশনা অনুযায়ী অ্যাডভােকেট সালামকে প্রধান করে প্রায় ১২/১৪ জন আইনজীবীর একটি দল মামলাটি শুরু করেন।
মামলার শুনানির দিনগুলােতে আমি আর তােমার মেজো চাচা (আমিনুল হক) ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে যেতাম, সিগন্যালের কাছে একটা একতলা ভবনে শুনানির কাজ চলত। অনেক দিন শুনানি চলেছিল প্রত্যেক অভিযুক্তের বিরুদ্ধে দেশ স্বাধীন করার নানা রকম অভিযােগ ছিল। বিভিন্ন জায়গায় মিটিং করার, বিভিন্ন সন্দেহজনক কাজের অভিযােগ আনা হয়েছিল। পাকিস্তানের গােয়েন্দা বিভাগের লােকেরা বাঙালি অফিসারদের গতিবিধি পরখ করত। আর এইভাবে তারা বিভিন্ন অভিযােগ তুলে ধরার মাধ্যমে মামলাটি কঠিন থেকে কঠিনতর দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। পাকিস্তানিদের মূল লক্ষ্য ছিল দুটি- প্রথমটি হচ্ছে বঙ্গবন্ধুসহ বাঙালি প্রতিবাদী অফিসারদের সশস্ত্র অভ্যুত্থান ঘটানাের পরিকল্পনার বিষয়টি প্রমাণ করে এদের হত্যা করা এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে বাঙালি জাতিকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনা। সর্বোপরি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আন্দোলনকে নিশ্চিহ্ন করা ।
১৭৩
প্রতিবাদী বাঙালি জাতিকে কোনােভাবে প্রতিহত না করতে পারায় বাঙালির প্রাণপ্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে দোষী সাব্যস্ত করে ফাঁসিকাষ্ঠে উপনীত করা এবং তাঁর সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানকে নিজেদের কজায় রাখা। বাবা সারাজীবন খুব কম কথা বলতেন, যে কোনাে ঘটনা খুব সংক্ষেপে বলে শেষ করতেন- এটি তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল। কিন্তু সেদিন অনেক কথা বলেছিলেন। তিনি আবার বলতে শুরু করলেন- বঙ্গবন্ধুকে সেই সময় কেউ বঙ্গবন্ধু বলতেন না, সবাই তাকে শেখ মুজিবুর রহমান, মুজিব ভাই আবার কেউ কেউ তাঁকে শেখ সাহেব বলতেন। আমি বাবাকে প্রশ্ন করলাম- ছােট চাচা জহুর কি ওনাকে চিনতেন? বাবা বললেন- না, জহুর শেখ মুজিবুর রহমানের পূর্বপরিচিত ছিল না। মুজিবুর রহমান তাকে চিনতেন না, মামলা শুরু হওয়ার পর জহুর তাঁকে দেখেছিলেন। তা ছাড়া মামলার সকল অভিযুক্ত এক জায়গায় বন্দি ছিল না। জহুরসহ আরও অনেককে রাখা হয়েছিল 3rd Panjab রেজিমেন্টের কাছে, সেখান থেকে কিছুটা দূরে শেখ মুজিবুর রহমানকে রাখা হয়েছিল । অন্যান্য অভিযুক্তকে আরেকটি জায়গায় রাখা হয়েছিল। মামলা শুরু হওয়ার পর সবার সঙ্গে সবার দেখা হতাে। আমি আসবাে দেখে মা সেদিন অনেক রান্নাবান্না করেছিলেন, হঠাৎ রান্নাঘর থেকে মা এসে বললেন- আমার একটা কথা মনে হচ্ছে। সে কথাটি হলাে মিমি তুমি এখন বড় হয়েছে, এখন সব কিছু লিখে রাখাে । তােমার ছােট চাচা আমাকে একটা কথা বলত, ও বেলুচিস্তানে যেত মাঝে মাঝে, পশতু ভাষা ভালাে বলতে পারত। বেলুচিস্তানের গ্রামের এবং শহরের মানুষগুলাে অনেক বঞ্চিত ছিল। তারাও করাচি বা ইসলামাবাদের রাজনৈতিক নেতাদের ওপর বৈষম্যমূলক আচরণের জন্য খুব ক্ষিপ্ত ছিল। বাবা চুপচাপ মায়ের কথা শুনছিলেন, মাকে কোনাে সময় কথা বলতে বাধা দিতেন না। বাবা বললেন- হ্যা এই বিষয়টিও খুব গুরুত্বপূর্ণ। বেলুচের জনগণের অসন্তোষের কথা আমাকে রুনু বলত।
১৭৪
বাবাকে আবার জিজ্ঞেস করলাম- শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে মামলাটি জড়িয়ে পাকিস্তানিরা মামলাটিকে কি শক্ত করতে চেয়েছিল, নাকি সত্যি উনি জড়িত ছিলেন? বাবা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন, বললেন- আমি যা জানি তােমাকে তাই বলবাে, এই বিষয়টি নিয়ে অনেকের মাঝে দ্বিধাদ্বন্দ্ব আছে, অনেকেই বলেন তিনি জড়িত ছিলেন না। আবার কেউ কেউ বলেন তিনি এই আন্দোলন সম্পর্কে জানতেন। এই বিষয়টি নিয়ে আমাদের পরিবারের সেই মুহূর্তে কোনাে রকম চিন্তা বা পর্যালােচনা করার মতাে অবস্থা ছিল না। আমরা দুই ভাই শুধু এক চিন্তায় ছিলাম কীভাবে ছােট ভাইকে এই মামলা থেকে উদ্ধার করবাে। বাবা একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলেন- মামলাটির শুনানির শুরুতে পাকিস্তানিরা প্রচুর তথ্য এবং সাক্ষী জড়াে করেছিল। প্রত্যেক অভিযুক্ত কোথায় ও কখন গিয়েছে, কার সঙ্গে দেখা করেছে- বিশদ তথ্য তারা জোগাড় করে এবং দীর্ঘ শুনানি পর্ব শুরু হয়। আমার এখনাে স্পষ্ট মনে পড়ে, আমি অনেক ভােরে বাসা থেকে বের হয়ে ক্যান্টনমেন্টে পৌছে যাই। মাহবুবল হক দাঁড়িয়ে আছেন ১৯শে জুন ১৯৬৮ সাল, ক্যান্টনমেন্টের আগরতলা মামলার কোর্টে শুনানির জন্য ধীরে ধীরে আরও কিছু লােক এসে জড়াে হলেন । তারা কেউ কেউ অভিযুক্তদের আত্মীয়স্বজন। প্রথমে এসেই চোখে পড়েছিল, শ্যাম বর্ণের সুদর্শন একটি ছেলের দিকে, ছেলেটি চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল । কথা বলে জানলাম, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বড় ছেলে শেখ কামাল। তিনিও এসেছেন বাবার শুনানির জন্য। পরবর্তী সময়ে আমাদের সঙ্গে শেখ কামালের অনেকবার দেখা হয়েছে আগরতলা মামলা শুনানির কক্ষে। শেখ কামালের ব্যবহার ছিল খুবই নম্র, আমাকে সে কয়েকবার বাসা পর্যন্ত গাড়ি চালিয়ে পৌছে দিয়েছিলেন।
১৭৫
কোনাে রকম আন্দোলনের বা সশস্ত্র অভ্যুত্থানের কথা সম্পূর্ণ অস্বীকার করতে হবে। অভিযুক্তরা অঙ্গীকার করে স্বীকারােক্তি প্রদান করার সময় মামলাটিতে আনীত অভিযােগ সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করবেন। প্রায় সকল অভিযুক্তই তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযােগ অস্বীকার করলেন। সাংবাদিকরা এই পর্যায়ে মামলাটিকে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হিসেবে পত্রপত্রিকায় আখ্যায়িত করে প্রচার শুরু করেন, সমস্ত বাঙালি জাতি অভিযুক্তদের পক্ষে বিক্ষোভ শুরু করে। কিন্তু আমাদের পরিবারের আমরা দুই ভাই তখন ভীষণ চিন্তায় পড়ি রুনুকে নিয়ে। কারণ সে কখনও মিথ্যা কথায় অভ্যস্ত ছিল না। আসলে মিথ্যার সঙ্গে আপস করা সহজ ছিল না রুনু কিংবা আমাদের কারও। বাবা চুপ হয়ে গেলেন কয়েক মিনিটের জন্য। আমি বুঝতে পারলাম তার অনুভূতি, বাবাকে আমি কোনাে দিন মিথ্যা কথা বলতে দেখি নাই। কোনাে অবস্থায় তিনি তার সত্যবাদিতা ভঙ্গ করতেন না। আর সেই জন্য ভাইয়ের সত্যবাদিতার বিষয়ে তার অনুভূতিটি অনুভব করতে পারলাম। বাবা আবার বলতে শুরু করলেন, রুনুকে আমি আর মনু অনেক বুঝালাম।ঢাকা শহরের পরিবেশ অত্যন্ত উত্তাল, জনগণ আগরতলা মামলায় অভিযুক্তদের মুক্তির দাবিতে ক্রমাগত আন্দোলন করছে। কৌশলগত কারণে আইনজীবীরা সকল আসামিকে স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টার অভিযােগ সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করতে বলছেন। ইতােমধ্যে অভিযুক্তরা অনেকেই আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযােগ সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করা শুরু করেছেন। এ ছাড়া মামলার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ “Narrative” বা তাত্ত্বিক বিষয় ছিল যে, পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি দিয়ে আবার সঙ্গে সঙ্গে এই মামলায় জড়িত করে মামলাটি একটি কঠিন শক্তিশালী রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলায় রূপান্তরিত করে। সকল অভিযুক্তকে ফাঁসি দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। আর এই মামলার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতিকে পরাস্ত করার জন্য পাকিস্তানিরা গভীর ষড়যন্ত্রমূলক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। বঙ্গবন্ধুকে জড়িত করার ফলে প্রতিবাদী বাঙালিরা আরও তীব্রতর আন্দোলন শুরু করেছে। সর্বস্তরের মানুষ প্রতিদিন রাস্তায় নেমে এসেছে। বাঙালি আইনজীবীরা এই মামলার গুরুত্ব উপলব্ধি করে লন্ডন থেকে টমাস উইলিয়াম’-কে ঢাকায় নিয়ে আসেন এই মামলার পক্ষে কৌসুলি হিসাবে কাজ করার জন্য। আমিনুল হক সেই সময় তরুণ আইনজীবী, আইনজীবী বদরুল হায়দার চৌধুরীকে বাবা ও চাচা- ছােট চাচার পক্ষে কৌসুলি হিসেবে কাজ করার জন্য অনুরােধ করেন। বাবা ও চাচা আইনজীবীদের পরামর্শ অনুযায়ী ঢাকার সার্বিক পরিস্থিতির বিষয়ে ছােট চাচাকে জানান। অর্থাৎ কাঠগড়ায় জেরার সময় তাকে, তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযােগটি অস্বীকার করতে হবে। অর্থাৎ তিনি সশস্ত্র আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। বাবা বললেন- জহুর খুব স্বল্পভাষী মানুষ ছিল । সব শুনে সে একেবারে চুপ হয়ে গেল । আমার মনে হলাে বাবা আমাকে কথাগুলাে বলছেন কিন্তু তিনি আমার সামনে বসে নাই, বাবা ১৯৬৯-এর দিনগুলােতে চলে গেছেন।
১৭৬
আমিনুল হক, তােমার মেজো চাচা আইনজীবীর মতাে বললাে- সকল অভিযুক্তরা এখন অস্বীকার করছেন। কাঠগড়ায় তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযােগগুলাে সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করছেন। কৌসুলিরা বিষয়টি এমনভাবে উপস্থাপন করছেন যাতে মনে হয় এরূপ কোনাে আন্দোলনে বাঙালিরা জড়িত ছিল না। পাকিস্তানিরা একটি মিথ্য মামলা সৃষ্টি করেছে আর এই উত্তাল আন্দোলনের মুখে পাকিস্তানিরা মামলাটিতে হেরে যাবে। জহুর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ধীরে ধীরে অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে শুরু করলমামলাটি সত্য, এই আন্দোলনও সত্য, দেশ স্বাধীন করার জন্য আমরা মৃত্যুর জন্যও প্রস্তুত । পাকিস্তানিদের সঙ্গে আমি অনেক বছর থেকেছি বরং নিজের দেশে কম ছিলাম; কিন্তু ওদের মতাে বর্বরদের সঙ্গে আমরা কোনােভাবে থাকতে পারবাে না। সশস্ত্র আন্দোলন অনিবার্য হবে, সম্ভব হলে তা খালি হাতেই শুরু করতে হবে। বড়দাদা তােমাদেরকে ২৫শে মার্চ ১৯৬৮ সালে শেষ চিঠি লিখেছিলাম। তখনই মনে হয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানিদের সঙ্গে থাকা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। সেইসময়ই আমি করাচি ছেড়ে ঢাকায় চলে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, কিন্তু মৌরিপুর থেকে অ্যারেস্ট হয়ে যাই। অনেক পরে আগরতলা মামলা নিয়ে কাজ করবার সময় আমার মনে হয়েছে- কী আশ্চর্য দ্বৈববাণী! ১৯৬৮ সালের ২৫শে মার্চের ৩ বছর পর ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ গভীর রাত্রিতে পাকিস্তানিরা বাঙালিদের উপর নির্মম গণহত্যা, ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যা সংঘটিত করেছিল। বাবা বলেন- আমি বুঝতে পারলাম জহুর সম্পূর্ণভাবে এক অন্য জগতে অবস্থান করছে, বাস্তবতার সঙ্গে মিথ্যাচার করে নিজেকে বাঁচানাের কোনাে পথ সে পছন্দ করছে না। আমিনুল হক জহুরকে আবার বুঝাল কেন তােমার বিরুদ্ধে পাকিস্তানিদের আনীত অভিযােগটি ওরা কোর্টে প্রমাণ করতে পারছে না। ওরা যেদিন বলছে তুমি মারি গিয়েছিলে, সেদিন করাচির রেজিস্টার খাতায় তােমাকে উপস্থিত দেখা যাচ্ছে। তােমাকে কোর্টে কিছু বলতে বললে বলতে হবে না। সব কিছু তােমার পক্ষে কৌসুলি বলবেন, তুমি শুধু চুপ থাকবে। জহুর চুপ করে থাকল । আমরা ক্লান্ত মনে দুই ভাই বাড়ি ফিরে এলাম। আমি বুঝতে পারলাম জহুর পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড প্রতিবাদ করতে চাচ্ছে, অথচ আমাদের চাপে তাকে নিশ্ৰুপ হয়ে থাকতে হচ্ছে। এরপর কোর্টে জহুরের শুনানির আগে আরেকবার আমি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে ওকে দেখতে গিয়েছিলাম । জহুর সেদিন খুব চুপচাপ ছিল । মামলা নিয়ে তেমন কোনাে কথা বলেনি শুধু বাড়ির সবার কথা জিজ্ঞেস করেছিল। আমরা কীভাবে মামলার খরচ চালাচ্ছি সেটাও জানতে চায় । আমি তেমন কিছু বলিনি। তবুও সে বুঝতে পারে, ব্যাংক থেকে টাকা ধার করে মামলা চালাচ্ছি। আমি কোনাে রকম কষ্টের কথা বলিনি। জহুর হঠাৎ মৃদু কণ্ঠে আমাকে প্রশ্ন করল, বড় দাদা পাকিস্তান থেকে দুইটা ট্রাঙ্ক আসার কথা, আমার এক বন্ধুকে অনুরােধ করেছিলাম, তােমাদের ঠিকানা দিয়েছিলাম । ট্রাঙ্ক দুইটা কি এসেছে? মাহবুবল হক বললেন- না এখনাে আসেনি। তুমি জিনিসপত্র নিয়ে চিন্তা কোরাে না। জহুর ধীরে ধীরে বলল- না তেমন কিছু না, আমার কিছু শখের রং-তুলি ছিল, আর কিছু কাপড়চোপড়, সেগুলাের জন্য বলছি না, মিমির জন্য একটা লাল কোট কিনেছিলাম, ওটা ওকে দিয়াে।
১৭৭
আমি বুঝতে পারলাম, বাবা ছােট চাচাকে কীভাবে আশ্বাস দিয়েছিলেন। আমি বাবাকে জীবনে কোনাে দিন কষ্টের কথা বলতে শুনি নাই। তিনি বরাবর সমস্ত কষ্ট নিজের ভেতরে রাখতেন। তার ব্যক্তিত্বের অসাধারণ এই দিকটা আজকের দিনে বিরল- যা ভাবাই যায় না । আমাদের সময় আমরা পরিবারে কারও জন্য কিছু করলে সেটা বারবার বলিআত্মত্যাগের বিষয়টা প্রায় ভুলে গেছি। অথচ তাদের সময়টা ছিল ভিন্ন। তাঁরা ভাইয়ের জন্য ভাই জীবন দিতে পারত । জহুর আমাকে শুধু বলল- আমার জন্য তােমাদের কষ্ট হচ্ছে। আমাকে বলতে বলতে বাবা অত্যন্ত ভাবাবেগপূর্ণ হয়ে উঠলেন। গত কয়েক বছর বাবার শরীর খুব খারাপ হয়ে গেছে। আজও ঢাকা শহরে বাবাকে যারা চিনতেন এমন লােক বেঁচে আছেন। তাঁরা জানেন, বাবা অসাধারণ একজন সৎ, ভালাে মানুষ ছিলেন। তিনি ছিলেন কষ্টের কঠিন আগুনে পােড়া একজন প্রকৃত মানুষ। আমাকে তার প্রাণপ্রিয় ছােট ভাইদের কথা বলতে বলতে হঠাৎ দেখি নীরবে তার চোখ থেকে পানি ঝরছে। স্মৃতিবিজড়িত আরাে কিছু ঘটনা বললেন- জহুর নিশ্ৰুপ হয়ে পড়েছিল, কোর্টে শুনানির দিন আমাদের পরামর্শমতাে কোনাে কথা বলেনি। তার পক্ষে কৌসুলি সমস্ত বক্তব্য রেখে নির্দোষ সাব্যস্ত করার প্রয়াস নিলেন।
এর কয়েক দিন পর রায় হওয়ার কথা। সমস্ত ঢাকা শহর উত্তপ্ত। প্রচণ্ড দুশ্চিন্তায় থাকতাম। প্রতিদিন খবর আসত ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তানি সিপাহিরা অভিযুক্তদের সঙ্গে বিভিন্ন অজুহাতে বর্বর আচরণ করছে। আমরা তবুও আশায় ছিলাম, রায় বাঙালিদের পক্ষে হবে অভিযুক্তরা মুক্তি পাবে । রুনু বাড়িতে আসবে। বাবা চুপ হয়ে গেলেন। এর পরের ঘটনা আমরা জানি, ১৪ই ফেব্রুয়ারি রাতে জহুরের অবিনাশী প্রতিবাদ। আমি চুপ করে থাকলাম, আর কোনাে প্রশ্ন করতে ইচ্ছা হলাে না। বাবা ধীরে ধীরে কেঁদে যাচ্ছেন, মা চুপচাপ আমাদের পেছনে এসে দাঁড়ালেন। সারাজীবন বাবার পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমার ছেলে দিব্য তখনও ছােট, খেলা থামিয়ে অবাক হয়ে নানাভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইল ।
১৭৮
জীবন বহমান
জীবনের গতি বহমান। আমার জীবনও বহতা নদীর মতাে এগিয়ে যাচ্ছে, ছােট্ট দিব্য হাঁটি হাঁটি পা পা করে স্কুল যাওয়া শুরু করল, প্রতিনিয়ত ওর প্রতিটি পদক্ষেপ আমাকে আনন্দ থেকে এক গভীর ভালােবাসায় নিমজ্জিত করে রাখত। প্রতিনিয়ত নতুন এক খেলার সঙ্গে আমি পরিচিত হতাম । দিব্যর বেড়ে ওঠা আমার কাছে স্বপ্নের মতাে ছিলহয়তাে সব মায়ের কাছেই তাঁর সন্তানের শৈশবের আনন্দঘন মুহর্তগুলাে সমস্ত বেদনাকে উপেক্ষা করে আনন্দময় হয়ে ওঠে। দিব্যর বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান, আইন পড়ার অভিজ্ঞতার পাশাপাশি আরেকটি বিষয় নিয়ে পড়ার কোর্স শুরু করলাম, ইন্টেরিয়র ডিজাইনিং। কাজটি আকর্ষণীয়, তেমনি পরিশ্রমেরও। তখন ঢাকায় এ বিষয়ে প্রথম প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষা শুরু হয়েছিল । নতুন এক অভিজ্ঞতার জগতে প্রবেশ করলাম। প্রতিদিন নতুন কিছু জানার চেষ্টা । অনেক কিছু না পারার অভিজ্ঞতা, তবুও ব্যর্থ হতে চাইনি। পরিশ্রম আর অনেক কিছু না জানার ভেতর দিয়ে ধীরে ধীরে শিক্ষা-প্রচেষ্টার মধ্যে সময় চলে যাচ্ছিল । বাবা-মায়ের বয়স বেড়ে যাওয়ায় তাঁদের শরীর মাঝে মাঝেই খারাপ থাকত, জীবনের এই গতিপথে পরিবারের আরাে কিছু প্রিয় মানুষকে হারাই। নানা রকম বিপর্যয়, নানা রকম অর্জনের মধ্য দিয়ে দিন চলে যাচ্ছিল। জহুরুল হকের কথা কখনও আমার পক্ষে সম্পূর্ণভাবে ভােলা সম্ভব হয় নাই । আবার জীবনের গতিতে আর সব কিছু বাদ দিয়ে নিষ্ঠা নিয়ে তার জন্য কিছুই করতে পারছিলাম না। প্রায়ই চলার পথে অনেক কাজের ভিড়ে মনে হতাে জহুরুল হকের জন্য কিছু একটা করা প্রয়ােজন। শুধু মনে হতাে, এ কাজে কারও সাহায্য নেওয়া যাবে না। বাবার সঙ্গে ফেব্রুয়ারি মাসে একদিন রাশিয়ান কালচারাল সেন্টারে গিয়েছিলাম । জহুরুল হকের ওপর একটা স্মরণসভার আয়ােজন করা হয়েছিল- মূলত সার্জেন্ট আব্দুল জলিল সব রকম দায়-দায়িত্ব নিয়ে স্মরণসভা করতেন। ওনার প্রতি জহুরুল হকের পরিবারের পক্ষ থেকে গভীর কৃতজ্ঞতা জানাই।
১৮১
সেদিনের অনুষ্ঠানে কয়েকজন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ছিলেন, দর্শক সারিতে লােকসংখ্যা ছিল খুব কম । আমি বাবার পাশে বসে ছিলাম চুপচাপ । বাবা নীরবে রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের উচ্ছ্বসিত বক্তৃতা শুনতে শুনতে বললেন- অনেক কিছু সঠিক নয়- সেদিন সেই ঐতিহাসিক ১৬ই ফেব্রুয়ারি ‘৬৯-এর মিছিলে অনেকেই আসেন নাই, অথচ বলেন মিছিল করেছিলেন! এরপর জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)-এর জিকু সাহেব বক্তৃতা দিতে শুরু করলেনএকপর্যায়ে উত্তেজিত হয়ে বললেন- সার্জেন্ট জহুরুল হকের স্মরণসভায় কেন এত কম লােক? আমাকে আগে জানানাে হলে আমি লােক দিয়ে ভর্তি করে দিতাম। আমি আর বাবা অনুষ্ঠান শেষে আস্তে আস্তে ধানমণ্ডির লেকের পাড় দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। বাবা আমার হাত ধরে চুপচাপ হাঁটছিলেন। হঠাৎ আমার মনের ভেতরে একটা চিন্তার আবির্ভাব হলাে, বাবাকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বললাম- জহুরুল হককে নিয়ে আমি কিছু করতে চাই, তবে তা কোনােমতেই স্মরণসভা হবে না। বাবা মৃদু হেসে বললেনতােমার চিন্তাটা আমাকে বলাে- আমরা সবাই মিলে করবাে। আমি বাবাকে ধীরে ধীরে আমার ভাবনাটা বলতে শুরু করলামআমি তােমার আর মায়ের কাছ থেকে শুনেছি, ছােট চাচা (জহুর) খুব সাহসী আর হাসিখুশি মানুষ ছিলেন। তাঁর মধ্যে কোনাে দুঃখবােধ প্রকাশ পেত না। তােমার কাছ থেকে শুনেছি, তিনি কবিতা পড়তে পছন্দ করতেন, ছবি আঁকতেন, ভাস্কর্যের প্রতিও তাঁর গভীর অনুরাগ ছিল, আগরতলা মামলায় বন্দি থাকাকালীন তার ভেতরে কোনাে মৃত্যুভয় বা মৃত্যুচিন্তা ছিল না। আর সেই জন্য আমরা তার জন্য আর কোনাে শােকসভা করবাে না।
বাবা মৃদু হেসে বললেন- তাহলে তুমি কী করতে চাও?
আমি বললাম- আমার চিন্তাটি হচ্ছে, তাকে নিয়ে ছবি আঁকার অনুষ্ঠান করা যেতে পারে । ফেব্রুয়ারি মাসে সার্জেন্ট জহুরুল হক দিবস পালন করা যেতে পারে। সেই দিবসে অনেক শিশু-কিশাের একটা জায়গায় এসে ছবি আঁকতে পারে এবং উপস্থিত সবাইকে মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে বলা যেতে পারে। বাবা শুনে বললেন- তােমার চিন্তাটা সুন্দর, আমি থাকবাে। তুমি তারিকের সঙ্গে প্রথমে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করাে। সেই রাতে তারিককে বললাম- মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সঙ্গে এ রকম একটা আয়ােজন করা সম্ভব হবে কি?
এর কিছুদিন পরেই তারিক আমাকে জানাল, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি আক্কু চৌধুরী বিষয়টা আগ্রহের সঙ্গে নিয়েছেন। অন্য ট্রাস্টিরাও সবাই সম্মতি জানিয়েছেন। আমরা জহুর দিবস শুরু করবাে খুব শীঘ্রই। এ রকম সময়ই আরেক দিন তারিক এসে আমাকে বলল- জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক, বিশিষ্ট লেখক, লােক-গবেষক শামসুজ্জামান খানের সঙ্গে ওর খুব ভালাে সম্পর্ক। উনি জহুরুল হকের কথা শােনার পর জহুরের বিখ্যাত আত্মপ্রতিকৃতিটি আমরা জাতীয় জাদুঘরের সংগ্রহের জন্য প্রদান করবাে কি না জানতে চেয়েছেন?
১৮২
আমি দ্রুত বাবার সঙ্গে কথা বললাম, বাবা বললেন- ছবিটা দিতে চাই, আরও কিছু জিনিসও দিতে পারবাে। জহুর সাঁতারে খুব ভালাে ছিল। পাকিস্তানে একাধিকবার বিমানবাহিনীতে সাঁতার প্রতিযােগিতায় প্রথম হয়েছে, সে রকম একটি কাপ দেব, এ ছাড়া জহুরের ব্যবহৃত পাকিস্তান এয়ারফোর্সের লং কোট এবং ওর নিজ হাতে তৈরি কাঠের শিল্পকর্ম দিবাে। বাবা আরও বললেন- আমার শরীর খারাপ হয়ে যাচ্ছে, জহুরের ছবি ও হাতের কাজের জিনিস জাদুঘরে থাকলে অনেক মানুষ দেখতে পারবে । আমি জহুরের পরিবারের পক্ষ থেকে অধ্যাপক শামসুজ্জামান খানকে আবারও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। তিনি খুব সুন্দর একটি অনুষ্ঠানের আয়ােজন করেছিলেন। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, কবি-ভাষাসংগ্রামী তােফাজ্জল হােসেন এবং বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান, ড. মুহাম্মদ সামাদ (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাে-ভিসি) পরিবারের পক্ষ থেকে বাবার হাত থেকে জহুরের স্ব-অংকিত বিখ্যাত ছবিটি গ্রহণ করেন। সেদিন বিকেলের চমৎকার পরিবেশে পরিবারের অনেকেই একত্রিত হয়েছিল শাহবাগস্থ বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের একতলার কনফারেন্স রুমে । পরিবারের সদস্য ছাড়াও ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধব জাদুঘরের আমন্ত্রিত বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতিতে একজন বীর যােদ্ধার মৃত্যুর বহু বছর পর নতুন প্রজন্মের জন্য আমরা জহুরের জিনিসপত্র হস্তান্তর করি।
১৮৩
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে জহুর দিবস
আগরতলা মামলা একটি সত্য মামলা। ইতােমধ্যে তারিক আবার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্যতম ট্রাস্টি কবি-স্থপতি রবিউল হুসাইনের সঙ্গে সার্জেন্ট জহুরুল হক দিবসের বিষয়টি নিয়ে আলােচনা করেছে। হঠাৎ একদিন একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবি-স্থপতি রবিউল হুসাইন ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হলাে, উনি আমাকে দেখে অত্যন্ত খুশি হয়ে আমার কাছে এসে বললেন- তারিকের কাছে সার্জেন্ট জহুরুল হকের ওপর তােমার আইডিয়াটা শুনলাম । তােমার চিন্তাটা চমৎকার । তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা নিয়ে শুরু করে ফেলাে। তিনি আরও বললেন- আকু চৌধুরী খুবই Active person । ওর কাছে গিয়ে বসে আলােচনা শুরু করাে (সার্জেন্ট জহুরুল হক দিবস নিয়ে) – মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ও জহুরুলের পরিবার যৌথ উদ্যোগে প্রতিবছর এই অনুষ্ঠান আয়ােজন করবে। ফেব্রুয়ারি মাস, সকালে শীতের হালকা আমেজ- ৫, সেগুনবাগিচায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রাঙ্গণ ভরে ওঠে শিশু-কিশােরদের কলকাকলিতে । ছােট ছােট শিশুরা রং পেন্সিল ও তুলি নিয়ে নিজের মনের মতাে করে ছবি আঁকছে। কিশাের বয়সীরা মুক্তিযুদ্ধের ওপর ছবি আঁকছে। জাদুঘরের কর্মীদের কাছে দিনটি হয়ে উঠল উৎসবের । রফিক ভাই, আমেনা, রনেকা, কামাল ভাই, চন্দ্র দা সকলে মেতে উঠলেন ছােট ছােট শিশু-কিশােরদের ছবি আঁকা, কবিতা, গান, নাচের মাঝে, জহুরের পরিবারের সদস্যরাও শিশুদের এই অনাবিল সুন্দর আয়ােজনে কখনও জাদুঘরের কর্মীদের মাঝে হাত মিলিয়ে সহায়তা করে, জাদুঘরের ট্রাস্টি আক্কু চৌধুরী, মফিদুল হক, জিয়াউদ্দীন তারিক আলী, ড. সারােয়ার আলী, আসাদুজ্জামান নূর প্রায় প্রতিবছরই অনুষ্ঠানটি প্রাণবন্ত করার জন্য উপস্থিত থেকেছেন। অনেকেই ভাবতে পারেন- এই তাে সেদিনের কথা, কিন্তু কীভাবে দিন চলে যায় আমাদের অজান্তেই । হিসাবের খাতায় দেখি প্রায় উনিশ বছর যাবত নিয়মিত অনুষ্ঠান সম্পন্ন হচ্ছে। শিল্পী রফিকুন নবীর প্রতি আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা। তিনি প্রায় প্রতিবছরই অনুষ্ঠানে এসে শিশুদের মনে আনন্দের সঞ্চার করেছেন । জহুরুল এবং তাঁর সহযােদ্ধাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা দেখেছি। সেই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে তার একান্ত আবেগ প্রকাশ করেছেন। আগরতলা মামলার অন্য অভিযুক্তদের কাছেও অনুষ্ঠানটি প্রিয় হয়ে ওঠে। বাবার সঙ্গে
১৮৭
প্রতিবছর ১৫ই ফেব্রুয়ারি আজিমপুর কবরস্থানে সার্জেন্ট জহুরুল হকের কবরে যখন যেতাম তখন থেকেই অভিযুক্ত আব্দুস সামাদ, মাহবুবউদ্দিন, লে. কর্নেল শামসুল আলম, ব্রিগেডিয়ার খুরশীদ এবং লে. কর্নেল শওকত আলী, মাজেদা শওকত এবং মিসেস কর্নেল হুদার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা হয়। প্রায় প্রতিটি বছর তাঁরা এসেছেন। জলিল চাচা, শওকত চাচা ও চাচি আমার ডাকে প্রতিটি বছর জহুর দিবসে উপস্থিত হয়েছেন। ওনাদের মাঝে আমি একটি জিনিস খেয়াল করেছি- বন্ধুর জন্য, সহযােদ্ধার জন্য কোনাে দিন নিজের ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যাহত হবে এ রকম অসুবিধার কথা উল্লেখ করেননি। সমস্ত সমস্যা উপেক্ষা করে উপস্থিত থাকেন সকল অনুষ্ঠানে। অভিযুক্তদের পরিবারের সদস্যরাও আহাদ ভাই, আনজাল, সুমন, রেহানা, মিলি ও মাহিম সকলেই আমার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন। প্রতিবছর আগরতলা মামলার অভিযুক্তরা মঞ্চে উঠে ছােট ছােট শিশুদের উৎসাহ ও উদ্দীপনা দিয়েছেন, দেশের প্রতি বীর মুক্তিযােদ্ধাদের আত্মত্যাগের কথা সহজ ভাষায় বলেছেন। অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী প্রতিটি শিশুকে দীর্ঘ সময় ধরে দাঁড়িয়ে থেকে পুরস্কার ও সার্টিফিকেট বিতরণ করেছেন আগরতলা মামলার অভিযুক্তরা, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টিরা, শিশু সাহিত্যিকরা। আর অনুষ্ঠানটিতে যারা সহায়তা করেছেন, তাদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য শিল্পীদের কথা না। বললেই নয় । মনিরুল ইসলাম, মুক্তিযােদ্ধা শিল্পী আবুল বারক আলভি, মান্নান ভাই, আফজাল হােসেন, রােকেয়া সুলতানা, হাসান ভাই, শিশির ভট্টাচার্য, নেসার হােসেন, মনিরুজ্জামান, অশােক কর্মকার প্রমুখ। শিশুসাহিত্যিকদের মধ্যে অনেকবার উপস্থিত থেকেছেন আখতার হুসেন, ফরিদুর রেজা সাগর, আমীরুল ইসলাম প্রমুখ । রফিক ভাই প্রতিবছর সমস্ত অনুষ্ঠানটিকে এক সুতায় বেঁধে প্রাণবন্ত করে তােলেন। সকলের একান্ত সম্পৃক্ততার মধ্যে প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাসের একটি সকাল শহিদ সার্জেন্ট জহুরের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের মধ্য দিয়ে হয়ে ওঠে শিল্পের সুষমাভরা অনাবিল এক মুহূর্ত। ২০০১-২০০৫ সালে বাবা প্রতিবছর অনুষ্ঠানে আসেন। প্রথমে তিনি জাদুঘরের ট্রাস্টিদের সঙ্গে কিছুক্ষণ আলাপ করার পর জাদুঘরের উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে শিশু-কিশােরদের পাশে চেয়ার নিয়ে বসে থাকতেন। আগরতলা মামলার অভিযুক্তদের সঙ্গে গল্প করতেন, মাঝে মাঝে অনেকে এসেছেন তাদের ছেলেমেয়েকে নিয়ে বাবা আগরতলা মামলায় অভিযুক্তদের প্রতিটি পরিবারের সঙ্গে কথা বলতেন, সবার খোঁজ নিতেন। ধীরে ধীরে আমি সবার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে যাই। আমরা একে অপরের আপনজন হয়ে উঠি। তখন আরেকটি চিন্তা মাথায় আসে, জহুরের ওপর একটি স্মারক গ্রন্থ প্রকাশ করার জন্য সবাইকে অনুরােধ করি- জহুরের ওপর একটি লেখা দেওয়ার জন্য।
প্রথম দিকের অনুষ্ঠানে বারবার ঘােষণা দিতাম লেখা দেওয়ার জন্য। কিন্তু একটি বিষয় অচিরেই অনুধাবন করলাম, আগরতলা মামলার অভিযুক্তরা নানা সমস্যায় জর্জরিত । ‘৬৯-এর পর তাঁরা বাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত হন। পরবর্তী সময়ে আগরতলা মামলার অভিযুক্তরা প্রায় সকলেই সম্মুখসমরে ‘৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে যােগদান করেছিলেন । কেউ তেমনভাবে তাদের ব্যক্তিগত জীবন গােছাতে পারেননি। অনেকেই এ বিষয়ে পত্র-পত্রিকায় লিখেছেন, ইতােমধ্যে অভিযুক্তরা অনেকেই তাদের জীবনের অভিজ্ঞতা
১৮৮
নিয়ে বই রচনা করেছেন । কর্নেল শওকত আলীর ‘সত্য মামলা আগরতলা’ বইটি একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর বঙ্গবন্ধুকে হারিয়ে তারা আরও অভিভাবকহীন হয়ে পড়েন। ১৯৭৫ সালে দেশের সর্বত্র বিপরীতমুখী রাজনীতি, অনৈতিকতার ভয়াবহ পরিস্থিতিতে, তারা আরও একা ও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন।
ক্রমে ক্রমে সময়ের স্রোতে বয়সের ভারে ২০০৪ সালে তারা ক্লান্ত, অসুস্থ, বিপর্যস্ত । এমন অবস্থায় আন্তরিকতা থাকা সত্ত্বেও তারা আমাকে কেউ লেখা দিতে পারছিলেন না। আমার জীবনের গতিধারাও থেমে থাকছে না। আমিও পেশাগত জীবনের নানা চাপে ক্রমাগত ছুটে যাচ্ছি । বাবা বলতেন ওনার কাছ থেকে তুমি তথ্য সংগ্রহ করেছাে? এমন একটি সময়ের মধ্যেই আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ, প্রিয় বন্ধু বাবা ২০০৬ সালে আমাদের। ছেড়ে চলে গেলেন। বাবা চলে যাওয়ার পর কয়েকটি বছর আমার শুধু মনে হতাে আমার অনেক দায়িত্ব; চাচিমা চলে যাওয়ার পর আমার আরও মনে হতাে সবাইকে দেখে রাখতে হবে। নানা রকম সংবাদ আর অজানাকে জানার ভেতর দিয়ে সময় পার হচ্ছে।
১৮৯
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংবর্ধনা
জানুয়ারি মাস, ২০১০ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে খোঁজ নিলেন ড. আবু মােহাম্মদ দেলােয়ার হােসেন, সেই সময়ে তিনি জহুরুল হক হলের সিনিয়র হাউস টিউটর ছিলেন। প্রতিবছর ১৫ই ফেব্রুয়ারি জহুরুল হক হল থেকে খুব ভােরবেলায় প্রভােস্টসহ শিক্ষক, ছাত্র ও কর্মচারীরা মৌন মিছিল করে আজিমপুর কবরস্থানে আসে ফুল দিতে । জহুরুল হক হলের ফুলের রিংটি বেশির ভাগ সময় অত্যন্ত সুন্দর হয়। ছাত্ররা তাদের হলের বাগানের ফুল দিয়ে রিংটি তৈরি করে। সেই বছর ড. আবু মাে. দেলােয়ার হােসেন আমার সঙ্গে যােগাযােগ করলেন- ওনারা যে সময় ফুল দিতে আসেন সেই সময় আমরাও যেন উপস্থিত থাকি। আমি ফ্লাইট সার্জেন্ট আবদুল জলিল চাচা ও অন্যান্যের সঙ্গে যােগাযােগ করলাম । অভিযুক্তরা এবং মুক্তিযুদ্ধ সংহতি পরিষদ থেকে অনেকেই আসেন, তাঁরাও সবাই একের পর এক ফুল দিলেন। এর কয়েক দিন পর জহুরুল হক হল থেকে আবার যােগাযােগ করলেন ড. আবু মাে. দেলােয়ার হােসেন, জহুরুল হক হল জীবিত অভিযুক্তদের সম্মাননা দিতে চায়, আর আমি যেন অভিযুক্তদের পক্ষ থেকে এই কাজটিতে হল কর্তৃপক্ষকে সহায়তা করি। আলােচনার শুরুতে আমি বললাম- আপনারা শুধু জীবিত অভিযুক্তদের নয়, সকল অভিযুক্তকে সম্মাননা দিতে পারেন। ওনারা কেউ অর্থ-বিত্ত চায় না। সম্মাননাটি প্রকৃত অর্থেই সম্মানজনক হওয়াই বাঞ্ছনীয়। সেক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুসহ ৩৫ জন অভিযুক্তকে সম্মাননা প্রদান করলে সকলেই সম্মানিত হবে । আগরতলা মামলার অন্তর্নিহিত নির্যাস- স্বদেশকে পাকিস্তানিদের করালগ্রাস থেকে মুক্ত করার আন্দোলনটিকে সম্মানিত করা হবে। বিষয়টি আর জহুরুল হক হলে সীমাবদ্ধ থাকলাে না, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবন মিলনায়তনে প্রথমবারের মতাে দেশের সর্বোচ্চ বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি অসাধারণ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে তল্কালীন ভিসি আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ ও জহুরুল হক হলের প্রভােস্টসহ শিক্ষকবৃন্দ আগরতলা মামলার সকল অভিযুক্তকে সম্মানিত করলেন।
১৯৪
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট হলে আগরতলা মামলায় অভিযুক্ত এবং তাঁদের পরিবারের অধিকাংশ সদস্য উপস্থিত হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন প্রজন্মের ছাত্র-ছাত্রীদের উপস্থিতিতে একটি স্মরণীয় অনুষ্ঠানের আয়ােজন করেছিল সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জহুরুল হক হল কর্তৃপক্ষ। সকলের জন্য এ রকম একটি অনুষ্ঠান করার কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে পেরে অনেক আনন্দিত হয়েছিলাম। পথ চলতে চলতে বুঝতে পারলাম, কখন যেন ছােট চাচা জহুরের বন্ধুরা আমার নিজের বন্ধু হয়ে পড়েছে। আরেকটি বিষয় উল্লেখযােগ্য ২০১১ সালে জহুরুল হক হলের প্রভােস্টের প্রস্তাবে ঢাকা। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জহুরুল হক হলের নামের সঙ্গে সংযুক্ত করেন শহিদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল’। এই নামকরণ অনুষ্ঠানটিতেও জহুরুল হক হল কর্তৃপক্ষ জহুরুল হকের পরিবারের সদস্য ও অন্যান্য ছাত্র-শিক্ষকদের নিয়ে একটি আনন্দঘন অনুষ্ঠানের আয়ােজন করেছিল । একই সঙ্গে জহুরুল হক হলের মূল প্রবেশদ্বারে জহুরুল হকের ছবিসহ সংক্ষিপ্ত জীবনীর ফলকটি স্থাপন করা হয়। যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরের এই বীর যােদ্ধার আত্মদানের ইতিহাস জানার জন্য একটি উল্লেখযােগ্য কাজ। জীবনের দিনগুলাে আপন গতিতে চলে যাচ্ছিল, আর সেই সঙ্গে মনে হলাে, এইবার যে করেই হােক, আগরতলা মামলা সম্পর্কে অভিযুক্তদের নিকট থেকে তথ্য সংগ্রহ করে নিতে হবে ।
অনেক আগে যে পরিকল্পনাটি ছিল- জহুরের জন্য একটি স্মারকগ্রন্থ করব, সেই চিন্তাটা ভিন্ন ধারায় নিলাম। মনে হলাে, অভিযুক্তদের মধ্যে যে অল্প কয়েকজন বেঁচে আছেনতাঁদের নিয়েই কাজ শুরু করা যেতে পারে ।
১৯৫
‘আগরতলা মামলার অনুচ্চারিত ইতিহাস ও শহিদ সার্জেন্ট জহুরুল হক – বইটির বিনির্মাণ বিষয়ে কিছু কথা
আগরতলা মামলার অভিযুক্তদের সঙ্গে প্রায়ই দেখা হচ্ছে, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যাচ্ছি, তারিককে সব কিছু বলতাম । তখন হঠাৎ একদিন তারিক আমাকে বলল- স্মারকগ্রন্থের কী করছ? ওনাদের সঙ্গে যখন তােমার নিয়মিত দেখা হচ্ছে, সবার কাছ থেকে জহুরুল হকের ওপর লেখা চেয়ে নিয়ে একটা বই করা যেতে পারে। আমার মন খারাপ হয়ে গেল। বললাম, সবাইকে বলেছি অনেকবার কিন্তু প্রত্যেকের অনেক বয়স হয়ে যাচ্ছে, শারীরিকভাবে সুস্থ থাকেন না। তার উপর সবার নানা রকম সমস্যা- কারও পারিবারিক, কারও অর্থনৈতিক, কারও বা রাজনৈতিক । কেউ কেউ ঢাকার বাইরে থাকেন।
তারিক চুপ করে শুনল, এর কয়েক দিন পরে তারিক আমাকে একটা অসাধারণ ব্যবস্থার কথা জানাল। তারিক অফিস থেকে এসে অত্যন্ত উৎফুল্লতার সঙ্গে বলল- আমাদের অফিসে যে স্টুডিওটি তৈরি হওয়ার কথা ছিল, তা ইতােমধ্যে সম্পন্ন হয়ে গেছে। এই স্টুডিওটির Sound System অত্যন্ত ভালাে। এখানে উন্নতমানের রেকর্ডিং করা সম্ভব হবে। তারিক আরাে বলল- ছােট চাচার বন্ধুদের, আগরতলা মামলার সহযােদ্ধাদের সবার সঙ্গে কথা বলাে, ওনারা কি রাজি হবে এখানে এসে রেকর্ডিং করতে? আমি অত্যন্ত খুশি হলাম, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আরও একটি কথা মনে হলাে, আমি কীভাবে এই কাজটি করব । ওনাদের বয়স হয়েছে, গাড়ি থাকে না, কী করে আসবেন? তা ছাড়া আমার মনের মধ্যেও তাে শক্তি নেই। যখনই জহুরুল হকের নির্মম হত্যাকাণ্ডের কথা মনে পড়ে হৃদয় ছিড়ে আমার দুই চোখ থেকে পানি গড়িয়ে আসে। একসময় বহুদিনের কাঙ্ক্ষিত কাজটি শুরু করি।
এমন সময় একদিন ড. আবু মাে. দেলােয়ার ভাইকে বিষয়টি জানাই। উনি অত্যন্ত উৎসাহিত হয়ে বললেন- আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারি, একসঙ্গে অভিযুক্তদের ইন্টারভিউ করার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করলেন। শুরু হলাে দীর্ঘ ইন্টারভিউ পর্ব- আমি প্রথমে সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেললাম, মনে হলাে মাত্র ১১ জন অভিযুক্ত বেঁচে আছেন। ইতােমধ্যে অনেকেই ইহলােক ছেড়ে চলে গেছেন- এ রকম
১৯৯
একটি স্টুডিও হয়তাে সব সময়ের জন্য পাওয়া সহজ হবে না। স্টুডিওটি সার্জেন্ট জহুরুল হকের বিষয়ে সার্বক্ষণিক আবদ্ধ থাকলে জহুরুল হকের সঙ্গে পরলােকে যখন আমার দেখা হবে তিনি খুবই রাগ করবেন। তিনি তাে নিজের কথা কোনাে দিন ভাবেননি! আমার মনে আগরতলা মামলা, না কি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা- এই নিয়ে দোলাচল আর জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা অভিযুক্তরা তাদেরকে কীভাবে আপ্যায়ন করবাে? তাদের জন্য আমি কী করতে পারি? মনে হলাে আমার ক্ষমতা ছােট- আমার পক্ষে কিছুই করা সম্ভব না, তবে একটা কাজ করতে পারি, তাদের কাছ থেকে অনেক তথ্য সংগ্রহ করতে পারি। একজন বীর যােদ্ধার সম্পূর্ণ জীবন কথা হয়তাে নেওয়া সম্ভব না , তবে অনেকেটা তথ্য তাে নিতে পারি।
প্রথমেই সার্জেন্ট জলিল চাচাকে ফোন করলাম, উনি অত্যন্ত উৎসাহিত হয়ে বললেনউনি নিজেই চলে আসবেন, আমাদের হাতিরপুল সংলগ্ন সােনারগাঁও রােডের অফিসে এবং সঙ্গে সামাদ চাচাকে নিয়ে আসবেন। দীর্ঘ ইন্টারভিউ শুরু হলাে, সারাদিন ধরে চলল কথােপকথন- মাঝে মাঝে চা খাওয়া, তারপর বিরতি দিয়ে দিয়ে রেকর্ডিং।
রেকর্ডিং শেষে খাওয়াদাওয়া । আমাদের অফিসে তরুণ প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা অনেকেই আগরতলা মামলায় অভিযুক্তদের আন্দোলনটি সম্পর্কে জানতেন না। ফলে তারা কৌতূহল নিয়ে মাঝে মাঝেই এ বিষয়ে জানতে চাইত। রেকর্ডিং শেষ করার পর জলিল চাচা কনফারেন্স রুমে বসে আমাকে ও দেলােয়ার ভাইকে বিভিন্ন অভিযুক্তের ফোন নম্বর দিলেন, তাদের সঙ্গে যাতে আমি যােগাযােগ করি সেই পরামর্শ দেন। কয়েক সপ্তাহ পর পর একেকটি রেকর্ডিং শুরু হতাে প্রায় দিনভর চলত। একটি বিষয় ধীরে ধীরে আমি বুঝতে পারলাম, চাচার বন্ধুরা কখন যেন আমার বন্ধু হয়ে গেলেন। কিন্তু কয়েকটি ঘটনা না বললেই নয়, ইন্টারভিউয়ের কাজ অনেক দিন পর পর হয়েছে বা সময়ের ফাঁকে অন্য কাজের ব্যস্ততায় আটকে যেত। দৈনন্দিন জীবনের সব কাজ, সব অনুষ্ঠানের ভেতরে আর দশটা সাধারণ মানুষের মতাে জীবন চলে যাচ্ছিল। কখনও আমি সব কাজ বাদ দিয়ে জহুর আর আগরতলা মামলা সম্পর্কে তথ্য নিতে পারি নাই । দেখতে দেখতে ৪৫ বছর পার হয়ে গেছে। আমাকেও পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তােলার চেষ্টায় নিয়ত পথ চলতে হয়েছে । আর এর ভেতর দিয়ে এক অসাধারণ আন্দোলনের তথ্য সংগ্রহের কাজে নিয়ােজিত হতে পেরেছি। কোহিনুর চাচি যেদিন ইন্টারভিউ দিতে এলেন, যেদিনটার কথা না লিখলেই নয়- কী অসাধারণ সুন্দরী এবং ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ। আমাদের অফিসের করিডোেরটি যেন আলােকিত হয়ে গেল ওনার আগমনে, শান্তশিষ্ট মানুষ, হালকা ছাপা সাদা শাড়ি পরেছেন। মাথায় হালকা করে ওড়না জড়ানাে। কোনাে রকম জড়তা ছাড়া জীবনের কঠিন পথ পাড়ি দেওয়ার তেজোদীপ্ত কাহিনি বলে গেলেন। আমি শুধু অবাক হইনি- স্তম্ভিত হয়ে পড়েছিলাম। কীভাবে এই দেশের এক বীর যােদ্ধা- ‘আগরতলা মামলা’-র অভিযুক্তকে ২৬শে মার্চ ভােরবেলায় পাকিস্তানিরা নির্মমভাবে হত্যা করেছিল, হত্যা করার পূর্বে পাকিস্তানিরা তাকে বন্দুক তাক করে হুকুম দিয়েছিল পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বলার জন্য। তবু লে. কমান্ডার মােয়াজ্জেম হােসেন নতি স্বীকার করেননি।
২০০
আর সেদিন প্রায় ৪৩ বছর পর আমাদের এই কাহিনি বলে যাচ্ছেন, মাঝে মাঝে কথা বলতে পারছেন না, কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। চোখ থেকে নীরবে পানি ঝরছে, আমি আর দেলােয়ার ভাইও নীরবে কেঁদেছি। উনি নিজেকে সামলে নিয়ে আবার কথা বলছেন। আগরতলা মামলার অনুচ্চারিত ইতিহাস বইটি থেকে স্বাধীনতার পর তাঁর ছােট ছেলের চিকিৎসা সম্পর্কে কিছু অংশ উদ্ধৃত না করে পারছি না :
মিসেস কোহিনূর : হঁ্যা, এই অসুস্থ বাচ্চা নিয়ে। কোলের মধ্যে নিয়ে ঢাকায় এলাম। এর পর থেকেই ট্রিটমেন্ট শুরু হলাে। ড. গার্ড ছিলেন সােহরাওয়ার্দীতে। তিনি পরীক্ষা করে দেখলেন যে, আর্থারাইটিস। পরবর্তীকালে সে অনেক বছর বিছানায় পড়ে ছিল।
নাজনীন : স্বাধীনতার পরে কোনাে সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পেরেছিলেন?
মিসেস কোহিনুর : না, কোনাে ব্যবস্থা হয়নি। তার যখন বারাে বছর বয়স, তখন অ্যালেনচেনি বলে এক নিউজিল্যান্ডবাসী ডাক্তার এখানে এসেছিলেন।
নাজনীন : ইউসেফ-এর সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন?
মিসেস কোহিনূর : হা, ইউসেফ-এর ফাউন্ডার ডাইরেক্টর। উনি আমার ছেলেটাকে নিয়ে ট্রিটমেন্ট করান। উনি ওকে নিজের ছেলের মতাে মানুষ করেন । উনি এখানে ছিলেন, কিন্তু আমার ছেলেকে বাইরে রেখেই লেখাপড়া সব করিয়েছেন।
নাজনীন : উনি যখন আপনার সন্তানকে সহযােগিতা করলেন, এটা একেবারেই কি তার উদ্যোগ ছিল, না সরকারি কোনাে ইচ্ছা ছিল না।
মিসেস কোহিনূর : না, সরকারি কোনাে উদ্যোগ ছিল না।
নাজনীন : ওনার ব্যক্তিগত উদ্যোগেই?
মিসেস কোহিনূর : হ্যা, এটা ছিল সমাজকলাণে- আমি একটা চাকরি পেয়েছিলাম। সে সুবাদে অ্যালেনচেনি আমার ছেলেটিকে চিকিৎসা করেন। তিনি যে সমস্ত বাচ্চা নিয়ে যেতেন বিদেশে তারা লুলা, বােবা, ওয়ার বেবিট্রিটমেন্টের জন্য নিয়ে যেতেন বিদেশে। সমাজকল্যাণের অনুমােদন লাগত । সমাজকল্যাণের যিনি ডাইরেক্টর ছিলেন, আমার বড় ভাইয়ের বন্ধু ছিলেন তিনি। আমাকে খুব ভালােবাসতেন। তাে চেনিকে তখন বলেছিলেন, আমার হাজবেন্ডের কথা। বলেছিলেন যে, এরকম তার একটা বাচ্চা আছে। তার যদি কোনাে হেল্প করে একটা ব্যবস্থা করাে- তাহলে আমি তােমাকে আরও ফ্যাসিলিটি দেওয়ার চেষ্টা করবাে।
নাজনীন : অ্যালেনচেনি সমাজকর্মী ছিলেন?
মিসেস কোহিনূর : হঁ্যা, সমাজকর্মী ছিলেন। তাঁর দুর্ভাগ্য। তাঁর একটাই ছেলে ছিল। তিনি টিচার ছিলেন নিউজিল্যান্ডেই। তার ওয়াইফও টিচার ছিলেন। তাে একদিন তার ছেলেটাকে নিয়ে চুল কাটাতে যাচ্ছিলেন হাইওয়ে
২০১
দিয়ে। তেলের ড্রাম গড়িয়ে পড়ে অন দ্য স্পট, তার ওয়াইফ মারা যান এবং তাঁর ছেলেটা নয়-দশ বছরে। ছেলে হসপিটালে মারা যায়। একটু পাগলের মতাে হয়ে তিনি চাকরি-টাকরি ছেড়ে ইন্ডিয়ায় চলে আসেন।
নাজনীন : ভারতবর্ষ এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশে কাজ করেছেন আমরা জানি। উনি তাে বড় একজন সমাজকর্মী ছিলেন। আমাদের বাংলাদেশে অনেক শিশুকে নিয়ে কাজ করেছেন । যে-সব শিশু শারীরিকভাবে বিকলাঙ্গ ছিল, অনেক ওয়ার বেবি, তাদের নিয়ে কাজ করেছেন। অনেক শিশুকেই তিনি নেদারল্যান্ড এবং অনেক দেশে নিয়ে যান চিকাৎসার জন্য। এখন বাংলাদেশে অনেক ইউসেফ-এর স্কুল হয়ে গেছে এবং অনেক ভালাে ভালাে ছেলেমেয়ে বেরিয়েছে। লেখাপড়া করেছে। বিশেষ করে ছেলেরা হাতের কাজ শেখে, ড্রাইভিংয়ে বেশ ভালাে করছে ।
নাজনীন : আমরা আবার সেই অধ্যায়ে চলে যাই । উনি আপনার ছেলের ভার নিলেন?
মিসেস কোহিনূর : আমার ছেলের ভার নিলেন। আমার ছেলেকে নিয়ে যান বাইরে।
নাজনীন : কোথায় নিয়ে গিয়েছিলেন?
মিসেস কোহিনূর : প্রথমে নিয়ে গেলেন ডেনমার্কে । ডেনমার্ক সরকার বলে যে, এ বাচ্চা তাে আমাদের লিস্টের না। ডেনমার্কে তাদের ওখানে রেখে, উনি নিজের খরচে ওকে লন্ডন নিয়ে যান। সেখানে উনি ওকে দেখান। আমার ছেলের হাঁড়ই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেছে, আর্টিফিশিয়াল থাই লাগাতে হবে। সব কিছু উনি করেছেন। ওকে যে নিয়ে গেছেন, কিছু জানাতেন না। আমার ডিরেক্টরকে জানাতেন, উনি আমাকে বলতেন যে, তুমি কোনাে চিন্তা কোরাে না । ঠিক আছে সব। ফিরে এলাে বােধ হয়, দুমাস বা দেড় মাস পরে ।
নাজনীন : এটা কত সালে হবে?
মিসেস কোহিনূর : সম্ভবত ১৯৭৪ সালের দিকে হবে।
নাজনীন : ১৯৭৪ সালে ওকে চিকিৎসা করে ফেরত নিয়ে এলেন?
মিসেস কোহিনূর : এখানে নিয়ে এলেন। আমার ছেলের তখন ১২ বছর বয়স । ওর বাবা থাকতেই ওরা দুজনে ল্যাবরেটরি স্কুলের ছাত্র ছিল, ক্লাস সেভেনে পড়ত । তাে ওর সমস্যা বলে ও ক্র্যাচে ভর করে হাঁটত । এতে স্কুলের অন্য ছেলেরা ওকে ল্যাংড়া বলে টর্চার করত । ও এতে খুব মন খারাপ করত । এটা দেখে অ্যালেনচেনি ওকে আদর করে বললেন, তােমার এ দেশটাই ভালাে না। তােমাদের লােকজন ভালাে না। তােমাকে আমি নিয়ে যাবাে। আমার কাছে না বলে তিনি লন্ডনে নিয়ে গেলেন। আমার ছেলে ওখানে পড়াশােনা করে ‘ও’ লেভেল শেষ করেছে।
নাজনীন : উনি কি দত্তক নিতে চেয়েছিলেন? এ বিষয়টা যদি একটু বিস্তারিত বলেন?
২০২
মিসেস কোহিনূর : আমার ছেলেটাকে দত্তক নিতে চেয়েছিলেন। আমার ছেলেও বলেছিল যে, সে তার কাছে বাবার আদর পেয়েছিল।
নাজনীন : সে তার বাবার অনুপস্থিতি একেবারে অনুভব করেনি?
মিসেস কোহিনূর : হঁ্যা, যেহেতু তার কোনাে পরিবার ছিল না, কেউ ছিল না । আমার ছেলে যদি বলত আকাশের চাদ চাই, তিনি চেষ্টা করতেন আকাশের চাঁদ ধরে আনবার। সবকিছু আমার ছেলের জন্য তার কাছে মাফ ছিল । আমার ছেলেকে দত্তক নিতে চাইলে, কাগজপত্র নিয়ে এসে বললেন, আমার ছেলেও বললাে, আম্মা দাও না, ইয়ে করে। বললাম- বাবা, তুমি এটা আমাকে বােলাে না, দত্তক দিলে তার নামটা তােমার নামের সঙ্গে যাবে। ওদের দেশে নিয়ম যা । তােমার নামের পাশে তার নাম থাকবে, এটা বাবা আমি পারব না। আর সবচেয়ে বড় কথা, আমি তােমার বাবার কাছে অপরাধী হয়ে যাব। তােমার বাবার আত্মা বলবে দেখাে, আমি নাই আমার ছেলেটাকেও দিয়ে দিয়েছে কাউকে।
নাজনীন : আপনার তখন মনে হয়েছিল যে, তার বাবা বীরযােদ্ধা লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মােয়াজ্জেম হােসেনের নাম আপনার সন্তানের সাথে সংযুক্ত থাকুক।
মিসেস কোহিনূর : হঁ্যা। এটাই মনে হয়ছিল যে, আমার ছেলেটা তাে হারিয়ে যাবে আমার কাছে থেকে। তারপরে আমার ছেলেও আমাকে আর ফেস করেনি, আর অ্যালেনচেনিও আমাকে কিছু বলেনি। কিন্তু ছেলে তার কাছেই থেকেছে।
নাজনীন : এত বছর পরে হলেও অ্যালেনচেনির প্রতি আমরা কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। একজন বীর মুক্তিযােদ্ধার সন্তানকে তিনি কীভাবে দেখেছিলেন এবং কতখানি স্নেহ দিয়েছিলেন, সে জন্য আসলে কতজ্ঞতা পুরাে জাতির জন্য একটা ব্যাপার যে, আমরা তার কাছে কতখানি কৃতজ্ঞ। এরপরে আমরা একটু ঐ অধ্যায়ে চলে যাই।
তারপরে লন্ডনে উনি চলে গেলেন। কোহিনূর চাচি এখন অসুস্থ অবস্থায় আছেন, তবুও তাকে বারবার মনে পড়ছে, আমরা ব্যর্থ- কিছুই করা হয়নি লে. কমান্ডার মােয়াজ্জেম হােসেনের পরিবারের জন্য। ফ্লাইট সার্জেন্ট জলিল চাচা আমাকে ধীরে ধীরে বললেন- আমি তােমার কথা ওনাকে বলেছি, তুমি জহুরুল হকের ভাতিজি, এ রকম একটা কাজ করতে চাচ্ছাে, তাই উনি এসেছেন, নতুবা কোথাও যান না, কাউকে এসব কথা আর বলতে চান না। কয়েকজন অভিযুক্তের Oral History নেওয়ার পর অনুভব করলাম যে, ডা. কর্নেল এম আলীর ইন্টারভিউটি নেওয়া প্রয়ােজন, কেননা ডা. এম আলী অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়ছেন, মাঝে মাঝে হাসপাতালে থাকছেন। কর্নেল শওকত আলী চাচা আমাকে বললেন- মিমি তুমি ওনার সাক্ষাৎকার আগে নিয়াে।
আমি আগেই জানতাম ওনার শরীরের যে অবস্থা, ওনার পক্ষে বাসা থেকে বের হওয়া। সম্ভব নয়।
২০৩
আমি ফোন করার সঙ্গে সঙ্গে ডা. আলী অত্যন্ত উৎফুল্ল হয়ে আমাকে বাসায় যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন। সেদিন আমি আর রােমান বিকেলের একটু আগে ওনার বাসায় পৌছাই। উত্তরা ১ নম্বর সেক্টরে ছিমছাম একটি বাসা। বসার ঘরে বসে অপেক্ষা করছিলাম, দেয়ালে কয়েকটি পারিবারিক ছবি আর ওনার স্ত্রী মরিয়মের ছবি টাঙানাে। অনেকদিন পর ব্রিটিশ নারী মরিয়মের ছবি দেখে আমার মনের মধ্যে অন্যরকম ভালাে লাগার অনুভূতি হলাে। ডা. আলী চাচা বসার ঘরে ঢুকে আমাকে বললেন- তুমি আমার কাছে এসে বসাে। আমি আর রােমান গিয়েছিলাম । রােমান রেকর্ডিংয়ের কাজে দক্ষ, আগরতলা মামলার বইটির সাক্ষাৎকারগুলাের রেকর্ডিং রােমান করেছিল। আলী চাচা ওর রেকর্ড প্লেয়ারটি দেখে সহকারী কাউকে ডাকলেন, বললেন- একটা ছােট টেবিল দিতে ডিজিটাল রেকর্ডার রাখার জন্য। কিছুদিন আগে চিকিৎসা শেষে হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরে এসেছেন। কিন্তু তার পরেও তাঁর মধ্যে এক অদ্ভুত আগ্রহ দেখলাম । বললেন, আগরতলা মামলা নিয়ে অনেক জায়গায় কিছু বক্তব্য দিয়েছি ।
কিন্তু এই প্রথম আমার কথা কেউ রেকর্ড করতে চেয়েছে, এখন আমার অনেক বয়স হয়ে। গেছে। আমি কোনাে দিন সার্জেন্ট জহুরুল হক আর ফজলুল হককে ভুলতে পারি নাই । এরপর দীর্ঘ কথােপকথন শুরু হয়- যার সবটাই আগরতলা মামলার বইটিতে আছে । কিন্তু সাক্ষাৎকারের বাইরের একটা কথা লিখছি, প্রথম দিন সাক্ষাৎকারের পরের দিন হঠাৎ দেখি, ওনার নম্বর থেকে ফোন আসছে । আমি দ্রুত ফোনটা ধরলাম, উনি খুব আস্তে আস্তে কিন্তু স্পষ্ট করে আমাকে বললেন- মিমি আমি তােমাকে কিছু কথা বলতে পারিনি, তুমি চলে যাওয়ার পর রাতের বেলায় আমার কথাগুলাে মনে পড়েছে । আমি তােমাকে কথাগুলাে বলতে চাই, আমি বললাম- চাচা কোনাে অসুবিধা নেই, আমি না হয় আরাে একদিন আসবাে। উনি খুব ধীরে কিন্তু দৃঢ় কণ্ঠে বললেন- না, তুমি দেরি কোরাে না। আমার শরীরের অবস্থা ভালাে না। তুমি তাড়াতাড়ি এসাে, আজ অথবা কালকের মধ্যে এসাে। রেকর্ড প্লেয়ার কি আনা সম্ভব হবে? আমি বললাম, জি চাচা, আমি আজকে। বিকেলে রেকর্ড প্লেয়ার নিয়ে আসব। আলী চাচা আর আমার টেলিফোনের কথােপকথনটি এখনও আমার কানে বাজে। সেইদিন আবার কর্নেল আলী আমাকে জহুরুল হক সম্পর্কে আরাে অনেক কথা বলেছিলেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথাটি উল্লেখ করছি । কর্নেল আলী বললেন মিমি একটি কথা তােমাকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে আমি জানাচ্ছি, চিকিৎসক হিসেবে কোনাে গুলির আঘাতপ্রাপ্ত রােগীকে আমরা যখন পরীক্ষা করি, তখন বুঝতে চেষ্টা করি গুলিটা শরীরের কোন দিক থেকে ঢুকেছে এবং শরীরের কোন দিক দিয়ে বের হয়েছে। সাধারণত গুলি মানুষের শরীরে যেখান দিয়ে প্রবেশ করে, সেই স্থানটিতে অল্প ছিদ্র হয় আর গুলি যেখান দিয়ে বের হয়ে যায় সেস্থানটি বড় ক্ষত হয়ে বীভৎস আকার ধারণ করে। জহুরের পেটের সম্মুখ ভাগ থেকে গুলিটা ঢুকেছিল তাই পেটের সামনের ছিদ্রটি ছােট ছিল, কিন্তু গুলিটি পিঠের দিক দিয়ে বের হয়ে যায় তাই সেখানে বড় ধরনের গর্তের সৃষ্টি হয়েছিল, আর একারণেই অগ্নাশয় সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত
২০৪
হয়েছিল। তােমরা মনে রেখাে, আমি চিকিৎসক হিসেবে বুঝতে পেরেছিলাম জহুরকে পাকিস্তানিরা সরাসরি গুলি করেছিল। এর কিছুদিন পরেই আলী চাচা পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন । আমার শুধু মনে হয়েছে- এত অসুস্থ অবস্থার ভেতরও ওনার স্মৃতিশক্তি ছিল কী অসাধারণ, আর এক গভীর মমতাবােধ ছিল তার দুই বীর রােগীর প্রতি। নৌবাহিনীর নুর মােহাম্মদের সাক্ষাঙ্কার কীভাবে নেব বুঝতে পারছিলাম না, উনি থাকেন বরিশালে, ওনারও বয়স হয়েছে । সার্জেন্ট জলিল চাচা আমাকে বললেন- তুমি চিন্তা কোরাে না, আমি ওনাকে বলছি- উনি সুযােগমতাে ঢাকায় আসবেন। নূর মােহাম্মদ হচ্ছে একমাত্র অভিযুক্ত, যিনি বঙ্গবন্ধুকে করাচির লাখাম হাউস থেকে নিয়ে এসেছিলেন, বাঙালিদের মিটিংয়ে । সময় চলে যাচ্ছে। নানা কাজের ব্যস্ততার মধ্যে। সময়ের কাঁটা ঘুরতে ঘুরতে আবার এলাে ফেব্রুয়ারি মাস । ১৫ই ফেব্রুয়ারি ভােরবেলায় কবরস্থানে যাওয়ার প্রস্তুতি- খুব ভােরবেলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জহুরুল হক হল থেকে ছাত্ররা ফুল দিয়ে গেছে জহুরের কবরে। প্রায় প্রতিবছর হলের মালি বাগানের ফুল দিয়ে গােলাকৃতি রিংটি তৈরি করে। জলিল চাচা আমার কাছ থেকে সময় জেনে নেন আমরা কখন যাবাে। একই সময় ওনারাও উপস্থিত থাকেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত আমি কোনাে দিন জলিল চাচার আগে কবরস্থানে পৌঁছতে পারি নাই। জলিল চাচা আমাকে বললেন- মিমি, কানাডা থেকে মাহফুজুল বারী এসেছেন, উনিও অভিযুক্ত, আমার সঙ্গে কবরস্থানে দেখা হলাে, বারী চাচা অত্যন্ত প্রাণবন্ত মানুষ, লম্বা-চওড়া, বয়সের ভারে একটু নাজুক, তবুও বললেন- তুমি একটা কাজ শুরু করেছে, আমাদের অর্থাৎ অভিযুক্তদের বক্তব্য নিচ্ছাে । কী করবে- এইসব কেউ পড়ে না, কোনাে সময় আমাদের বিষয়ে কেউ গুরুত্ব সহকারে কিছু করল না। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর দেশ ছেড়ে চলে গেছি, অনেক দূরে থাকি তবুও দেশের টানে ফিরে আসি, এত লম্বা প্লেন জার্নি করলে শরীর খারাপ হয়ে যায়, তবু দেশে না এসে থাকতে পারি না। আমি বললাম, চাচা আমাকে সময় দিতে হবে । বারী চাচা বললেন- বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার অনেক সময় কেটেছে, আমি তােমাকে বলবাে, তবে কাল-পরশুর মধ্যে নােয়াখালী যাবাে, সেখান থেকে ঘুরে এসে সময় দিবাে। মাহফুজুল বারী চাচা শুধু সাক্ষাক্তারের জন্য আমাকে সময় দেননি। পরবর্তী সময়ে লিপিবদ্ধ করার কাজ এবং প্রুফ চেকিংয়ের সময়, তিনি জলিল চাচাকে নিয়ে আমাদের অফিসে এসেছেন। আমাকে সাহায্য করেছেন, কথােপকথনের কিছু অস্পষ্ট শব্দ ঠিক করার জন্য। এরপর কানাডা থেকে আমাকে ফোন করেছেন, দিব্যর নম্বর নিয়ে দিব্যর সঙ্গে কথা বলেছেন, দিব্য আমাকে বলেছে- মা, উনি নানা ভাইয়ের বন্ধু, কিন্তু আমার সঙ্গেও কথা বললেন খুব ফ্রেন্ডলি । মাত্র কয়েক বছর আগে হাসিখুশি মানুষটি নিজের দেশে এসেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন।
২০৫
বরিশাল থেকে সাদা শার্ট আর সাদা প্যান্ট পরিহিত নূর মােহাম্মদ চাচা যেদিন হাতিরপুল। অফিসে এলেন, আমার মনে হলাে, উনি বােধ হয় এখনও নৌবাহিনীতে কর্মরত আছেন। এখনও ওনার শক্তিশালী কণ্ঠস্বর শুনে মনে হয় না ৮০ বছর পার হয়ে গেছে, তার কাছেই বঙ্গবন্ধুর কথা শুনেছি। আরও একটি বিষয় তিনি বলেছেন- ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় তাঁর কারসাজের যুদ্ধের বর্ণনা শুনেছি। এখনও বরিশাল থেকে ঢাকায় এসে আগরতলা মামলার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যােগ দেন এবং বক্তৃতা করেন। কর্নেল শওকত চাচা ও চাচির সাক্ষাৎকার একই দিনে করেছিলাম। চাচা সেই সময় জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার । আমি ভেবেছিলাম, উনি কীভাবে সময় দেবেন- যথেষ্ট ব্যস্ততা আছে। কর্নেল শওকত আমার বাবা, চাচা, ছােট চাচার সহােদরপ্রতিম, গত পঞ্চাশ বছরে আমরা কোনাে দিন ভাবিনি তিনি আমাদের পরিবারের বাইরের কেউ । ভেবেছি তিনি ও তাঁর পরিবার আমাদেরও পরিবার । সব রকম কাজ উপেক্ষা করে চাচা ও চাচি হাসিমুখে হাতিরপুল অফিসে চলে এলেন। নিরাপত্তার জন্য বেশ কিছু পুলিশ সদস্য তাঁদের সঙ্গে এসেছেন। ছয়-ছয়বার শরিয়তপুরের নড়িয়ার সংসদ সদস্য- জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার অথচ তিনি এসেছেন স্বাধীনতা-সংগ্রামে তাঁর সহযােদ্ধার কথা স্মরণ করতে। শওকত চাচা ও চাচি আগরতলা মামলার সকল অভিযুক্তের সুখে-দুঃখে সবসময় পাশে থেকেছেন। আরেকটি বিষয় না বললেই নয়, যারা ওনাদের চেনেন তারাও আমার সঙ্গে একমত হবেন । আমি আজ পর্যন্ত চাচা-চাচিকে আলাদা দেখি নাই। অনেক স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেই অমিল থাকে, কিন্তু মাজেদা শওকতের মতাে স্বামীর জন্য এ রকম নিবেদিতপ্রাণ কম দেখেছি। চাচাও তেমনি সব সময় সব কাজে চাচিকে তাঁর আদর্শ সহধর্মিণী হিসেবেই ভেবেছেন। সেই ষাটের দশক থেকে পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর, এমনকি দ্বিতীয়বার সামরিক শাসনের সময় জেনারেল এরশাদ যখন তাকে বন্দি করলেন তখনও চাচিকে দেখেছি, শওকত চাচার জন্য অর্থাৎ তার স্বামীর বিচারের বিভিন্ন বিষয়ে আমিনুল হক চাচার বাসার চেম্বারে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করছেন। আমাদের অফিসে বইটির কাজের জন্য প্রথম সাক্ষাঙ্কারটি ছিল চাচার, অনেক কিছু বলেছিলেন- বইটিতে বিস্তারিত সংকলিত আছে। কিন্তু কিছু কথা আছে, যেগুলাে লেখা যায় না- অনুচ্চারিত সেই কথামালা অন্তরে অন্তরে গুমরে মরে। সাক্ষাৎকারের শেষের দিকে ডেপুটি স্পিকার কর্নেল শওকত ‘৬৯ … ‘৭৫ … ‘৮২ সালের দুঃখজনক দিনগুলাের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে ভাবাবেগে আপ্লুত হয়ে যান- যা লেখা যায় না । ওনার চোখ দিয়ে অবিশ্রান্ত ধারায় অশ্রু ঝরছিল। এর পরে ছিল চাচির সাক্ষাৎকার । আমি ওনার গুরুত্বপূর্ণ সময় বাঁচানাের জন্য বললামচাচা আপনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন, এখন একটু চা খান ।। ইতােমধ্যে চাচি (মাজেদা শওকত) সাক্ষাৎকার দেওয়ার জন্য উঠে দাঁড়িয়েছেন। শওকত চাচা বললেন- না, আগে তােমার চাচিসহ আমরা একসঙ্গে চা খাব । তারপরে তােমরা ওর সাক্ষাঙ্কার নিয়াে।
২০৬
আমি বললাম- আপনার সময় হবে তাে? শওকত চাচা বললেন- জহুরুল হকের জন্য কোনােদিন সময়ের অভাব হয়নি, হবেও না। যত রাতই হােক, তােমাদের সঙ্গে কথা বলবাে। এরপর সবাই একসঙ্গে চা খেলাম, একটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কর্নেল শওকতকে যারা চেনেন তারা জানেন, ওনার স্ত্রী মাজেদা শওকত কীভাবে সারা জীবন ওনার সকল কাজের। সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন। আমি খুব কম নারীকে দেখেছি এভাবে স্বামীর রাজনৈতিক জীবনের কঠিন পথে একসঙ্গে পা মিলিয়ে চলতে। খুব ভােরবেলা ঘুম থেকে ওঠা প্রায় দুঃসাধ্য কাজ এখন আমার জন্য, ছােটবেলা মা ঘুম থেকে উঠিয়ে স্কুল, কলেজে পাঠিয়েছিলেন কীভাবে সেটা এখন বুঝতে পারি না। মা যে কত কষ্ট করে আমাদেরকে শাহীন স্কুল, হলিক্রস কলেজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন, কখনও তার সময়ের হিসাবে ভুল হতাে না। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আমাদেরকে তৈরি করে রওনা করিয়ে দিতেন।
তারই ধারাবাহিকতায় অনেক পরেও নিজের জীবনের কাজগুলােতে, তাঁর মতাে সময়ের প্রতি নিষ্ঠা না রাখতে পারলেও, যেন কোথাও একটা সময়ের তাগিদ অনুভব করি। ঘুম থেকে চটজলদি উঠে তৈরি হচ্ছি, হাতিরপুলে জানিম্যান অফিসে পৌঁছতে হবে । এমন সময় সার্জেন্ট আব্দুল জলিল চাচা ফোন করলেন মিমি তুমি তাড়াতাড়ি অফিসে যাও। কমান্ডার আব্দুর রউফ তােমার অফিসের দিকে রওনা হয়েছেন। জলিল চাচার কাছে আমার কৃতজ্ঞতার সীমা নেই, উনি আগরতলা মামলার বইটি করার সময় প্রায় প্রতিটি সাক্ষাৎকারের বিষয়ে আমাকে সর্বাত্মক সাহায্য করেছেন। আমি দ্রুত অফিসে পৌছে ড. আবু মাে. দেলােয়ার ভাইকে খবর দিলাম, উনিও চলে এলেন । রউফ চাচাকে দেখে সেদিন আমার মন খারাপ হয়ে গেলে, দীর্ঘদেহি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী মানুষটি তখনও সবল দৃঢ়চিত্তের, কিন্তু শরীর খারাপ হয়ে যাওয়ার স্পষ্ট লক্ষণ দেখতে পেলাম । আমাকে বললেন- মিমি, বেশিক্ষণ থাকতে পারবাে না। আমার খাওয়ার অনেক বাধা-নিষেধ আছে। আমি বললাম- চাচা আমি জানি, আমি সে রকম কিছু হালকা খাবারের ব্যবস্থা রেখেছি। আশা করি, আপনার অসুবিধা হবে না। দেলােয়ার ভাই সাক্ষাৎকারের প্রথম পর্বটি শুরু করলেন, চল্লিশ বছর আগের স্মৃতি রক্ষা করা সােজা কথা নয় । কিন্তু আশ্চর্য যে, কমান্ডার আব্দুর রউফ ধীরে ধীরে তার যৌবনের সময়গুলােতে পৌছে গেলেন। পশ্চিম পাকিস্তানিদের অত্যাচারের হাত থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য তাদের যে সাহসী পরিকল্পনা ও দেশ স্বাধীন করার সচেষ্ট প্রচেষ্টা- তার সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা দিতে শুরু করলেন। আগরতলা মামলার অনুচ্চারিত ইতিহাস বইটিতে তার সাক্ষাৎকারটি বিস্তৃতভাবে আছে, পুনরাবৃত্তি করার প্রয়ােজন মনে করছি না। তবে একটি বিষয় না বলে পারছি না। কমান্ডার আব্দুর রউফের একাগ্রতা। স্মৃতিচারণা করতে করতে কখন যে দুপুর পার হয়ে গেছে- আমি কথা থামাতে পারছি না। মনে মনে ভাবছি ওনার খাওয়ার কথা, ওষুধের সময় হয়ে গেছে ।
২০৭
একবার তার বাসা থেকে ফোন এলাে, উনি বিরক্ত হয়ে ফোনটি সাইলেন্ট মােডে দিয়ে আমাকে বললেন- ‘৬৪ থেকে ‘৬৮ সাল- এই সময়গুলােতে আমরা যেভাবে দেশ স্বাধীন করার জন্য দৃঢ় পরিকল্পনা করেছিলাম, তারই ধারাবাহিকতায় পরিপূর্ণ স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধ করতে পেরেছিলাম । বর্বর পাকিস্তানিদের হাত থেকে দেশ স্বাধীন করা অত সহজ ছিল না। বঙ্গবন্ধু বছরের পর বছর, বাঙালির ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য দিনের পর দিন রাজপথে, দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত পায়ে হেঁটে, কারাগারের অন্তরীণ থেকেও মুক্তি ও স্বাধীনতার আন্দোলন পরিচালনা করেছেন। আর সেই সময় আমরা পাকিস্তানে দুর্গম ক্যান্টনমেন্টে বসে পাকিস্তানিদের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে দেশ স্বাধীন করার দৃঢ় পরিকল্পনা শুরু করি। কমান্ডার আব্দুর রউফ বিস্তৃতভাবে সব কিছু বলতে শুরু করলেন, আমি দুইবার খাওয়ার জন্য তাগিদ দিলাম । উনি বললেন- তারিক ও তােমরা এখানে এত সুন্দর রেকর্ড করে সব কিছু সংগ্রহ করছাে- আমি অত্যন্ত আনন্দিত, আমাকে অনেক কিছু বলতে হবে । এখন খাওয়াদাওয়া করবাে না । মনে হলাে মানুষটি পঞ্চাশ বছর আগে চলে গেছেন। তিনি যৌবনের দীপ্তিময় সময়ে আছেন, এই দেশ এই মাতৃভূমি স্বাধীন করার সংকল্পের পরিকল্পনার আঙিনায় দৃপ্ত পায়ে এগিয়ে চলেছেন। কিন্তু দুঃখ পেয়েছিলাম, রউফ চাচা এই বইটি প্রকাশনার সময় আমাদের পাশে ছিলেন না। প্রকাশনা অনুষ্ঠানের দুই দিন আগে তিনি আমাদেরকে ছেড়ে চলে যান। কর্নেল শামসুল আলম চাচাকে আজও কাছে পাই। যখনই ডাকি তখনই উনি সব কাজ ফেলে চলে আসেন। মানুষের মধ্যে অনেক গুণ থাকে, যা অন্যদের অনুপ্রাণিত করে, কর্নেল শামসুল আলমের বিনীত কথােপকথন এবং সদাস্মিত হাস্যোজ্জ্বল চেহারা আমাকে উদ্দীপ্ত করেছে বারবার। কর্নেল শামসুল আলম হচ্ছেন একজন অসাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ। এক অর্থে তিনি ভাগ্যবানও, কেননা তিনি আগরতলা মামলার অভিযুক্তদের মধ্যে একমাত্র ব্যক্তি যিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একই কক্ষে বন্দি ছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে এসে পাকিস্তানিরা যেখানে বন্দি করে রেখেছিল- সেটি বর্তমানে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর । বঙ্গবন্ধুকে বন্দি করে আনার কিছুদিন পর কর্নেল শামসুল আলমকে একই কক্ষে বন্দি করা হয়। শামসুল আলমের সাক্ষাৎকার থেকে জানতে পারি, বঙ্গবন্ধু তাঁকে কীভাবে আপন করে নিয়েছিলেন । বঙ্গবন্ধু তাঁর নিজের কাপড় রাখার ট্রাঙ্ক থেকে তাঁর জন্য লুঙ্গি বের করে নিতে বলেছিলেন। শামসুল আলম কোনাে দিন জেলে থাকেননি, সেটি বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরে তাঁকে হাসিমুখে জেলে থাকার নানা রকম অসুবিধার বিষয়গুলাে বুঝিয়ে দিলেন । শামসুল আলম আর্মির ডাক্তার- কিন্তু গান গাইতেন খুব সুন্দর, এখনও তাঁর গানের গলা সুন্দর । আগরতলা মামলার শুনানি শুরু হয় ১৯ জুন, ১৯৬৮। পাকিস্তানিরা একটা বাসে করে সকল অভিযুক্তকে শুনানির স্থানে নিয়ে যেত ।। বঙ্গবন্ধু বাসে উঠেই সবাইকে উদ্দীপ্ত করে তুলতেন- তােরা এইভাবে মন খারাপ করে থাকবি না, গান ধর! আমরা গান গেয়ে গেয়ে কোর্টে যাব । আর তখনই শামসুল আলম গান ধরতেন
২০৮
“ধন ধান্য পুষ্প ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা,
তাহার মাঝে আছে দেশ এক সকল দেশের সেরা,
ও যে স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা।
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি,
সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি ।
সে যে আমার জন্মভূমি, সে যে আমার জন্মভূমি।”
বঙ্গবন্ধু গলা মেলাতেন- সবাইকে গান গাইতে বলতেন। তিনি তার মনের শক্তি দিয়ে সবাইকে এক সুতায় বেঁধে নিয়েছিলেন। বাসে বেশির ভাগ সময় আব্দুস সামাদ তাঁর পাশে বসতেন, তিনি বঙ্গবন্ধুর কাছাকাছি বয়সের ছিলেন। এ রকমই একটি যাত্রার কথা সার্জেন্ট আব্দুল জলিল আমাকে পরে বলেছেন। ঘটনাটি খুবই ছােট কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আগরতলা মামলা চলাকালীন আব্দুল জলিলের বাড়ি থেকে আত্মীয়রা দেখা করতে এসেছিলেন তাঁর সঙ্গে। সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন, নারকেলের সন্দেশ। আব্দুল জলিল বঙ্গবন্ধুর পাশে বসতে চেয়েছিলেন, আব্দুস সামাদ তাঁকে জায়গা করে দেন। আব্দুল জলিল বঙ্গবন্ধুর পাশে বসলেন এবং ধীরে ধীরে বললেন- বাড়ি থেকে লােকজন এসেছিল দেখা করতে। তাঁরা সন্দেশ নিয়ে এসেছিল । আপনার জন্য দুইটা সন্দেশ রেখেছি, আপনি খেলে খুশি হবাে। বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত খুশি হয়ে আব্দুল জলিলকে ধন্যবাদ দিয়ে বললেন- আমি খুব খুশি হয়েছি, যে আমার কথা মনে রেখে তুমি সন্দেশ নিয়ে এসেছাে, কিন্তু সবাইকে কি সন্দেশ দিয়েছাে? আব্দুল জলিল অত্যন্ত লজ্জা পেয়ে বলেছিলেন- সন্দেশ তাে বেশি ছিল না তাই সবাইকে দিতে পারি নাই।
বঙ্গবন্ধু হেসে বললেন- এই সন্দেশগুলাে ভাগ করাে, যদি একজন একটি চালের সমান পায় তবুও আমরা সবাই একসঙ্গে ভাগ করে খাবাে। বঙ্গবন্ধু এইভাবে আগরতলা মামলার প্রতিটি অভিযুক্তকে নিজের অন্তরের ভালােবাসা দিয়ে একসঙ্গে কোর্টে শুনানির সময় নিয়ে যেতেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ সন্তান শেখ হাসিনার বিবাহ সম্পন্ন হয় আগরতলা মামলা চলাকালীন সময়ে । বঙ্গবন্ধু তখনও ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বন্দি। বাড়ি থেকে বিয়ে উপলক্ষে বেশ কিছু মিষ্টি আসে, বঙ্গবন্ধু আব্দুল জলিলকে দায়িত্ব দেন সবার মাঝে মিষ্টি বিতরণ করার জন্য। আব্দুল জলিল মিষ্টি বিলি করতে গিয়ে কিছুটা বিব্রত অবস্থায় পড়েন, কেননা অভিযুক্তরা অনেকেই অনেক দিন দেশি মিষ্টির স্বাদ থেকে বঞ্চিত ছিল। ফলে কেউ কেউ ২/৩টি মিষ্টি নিয়ে খেয়ে ফেললেন। ফলে কেউ কেউ ভাগে মিষ্টি পাননি।
মিষ্টি বিতরণ শেষে আব্দুল জলিলকে বঙ্গবন্ধু প্রশ্ন করেন- সবাইকে মিষ্টি দিয়েছাে? কেউ বাদ যায়নি তাে? আব্দুল জলিল বললেন- তিনি কয়েকজনকে মিষ্টি দিতে পারেননি। মিষ্টি দেখে উৎফুল্ল হয়ে কেউ কেউ বেশি খেয়েছেন।
২০৯
বঙ্গবন্ধু হাসি দিয়ে বললেন- তুমি চিন্তা কোরাে না, আমি আবার খবর পাঠাবাে মিষ্টি পাঠানাের জন্য, তবে এইবার মিষ্টি এলে যারা পায়নি তাদের আগে দিয়াে। আব্দুল জলিল আমাকে আরও বললেন- বঙ্গবন্ধু তার পরের দিন আবার মিষ্টি আনিয়েছিলেন। খুব ছােট ছােট ঘটনার ভেতর দিয়ে বােঝা যায়, উনি এক পাহাড় সমান উচ্চতার মানুষ ছিলেন, হৃদয় ছিল সমুদ্রের মতাে বিপুল। কর্নেল শওকতের সাক্ষাৎকার থেকে সরাসরি উদ্ধৃতি করি, তবে দেখতে পাবাে বঙ্গবন্ধুর প্রতিবাদের প্রখরতা কতখানি তীব্র- কোর্টে শুনানি চলছে, অভিযুক্তরা তাদের ওপর অমানবিক নির্মম অত্যাচারের বর্ণনা দিচ্ছিল- আগরতলা মামলা বইটি থেকে সংকলিত : “শেখ মুজিবুর ১-নং অভিযুক্ত, তিনি বসেছিলেন অভিযুক্তদের জন্য সংরক্ষিত স্থানের প্রথম সারির ১ নম্বর চেয়ারে । তাঁর খুব সন্নিকটে পাকিস্তানি বিচারকবৃন্দ। চারিদিকে প্রহারত পাকিস্তানি সৈনিকরা টহল দিচ্ছে। স্টুয়ার্ড মুজিব যখন বক্তব্য দিচ্ছিলেন, তখন ওঁর মতাে ৩৪২ ধারায় এতাে হৃদয়বিদারক লোমহর্ষক বর্ণনা আর কেউ দেয়নি। যখন ও বক্তব্য দিচ্ছে, আমরা সবাই শুনছি। বঙ্গবন্ধু ১ নম্বর আসামি। হঠাৎ বঙ্গবন্ধু দাঁড়িয়ে। গেলেন, কাছেই মঞ্জুর কাদের। উনি এই মামলার প্রধান কৌঁসুলি। বঙ্গবন্ধু দাঁড়িয়ে বললেন, ‘মি. মঞ্জুর কাদের আর ইউ লেসেনিং স্টুয়ার্ড মুজিব যা বলছে তুমি তা শুনছাে । আই শ্যাল টেক রিভেঞ্জ। আমি এর প্রতিশােধ নিবাে’। সবাই চেয়ে আছে বঙ্গবন্ধুর দিকে। বিচারক বলছেন, মি. মুজিবুর রহমান, মি. শেখ মুজিবুর রহমান প্লিজ সিট ডাউন! কে কার কথা শােনে। বঙ্গবন্ধু ১ নম্বর আসামি হয়েও মঞ্জুর কাদেরকে ধমকালেন। কত বড় দেশপ্রেমিক, এত বড় সাহস তার, সেটা বলতে পেরেছেন আর কেউ পারেননি।” শেখ মুজিবুর রহমানের বজ্রকণ্ঠের প্রতিবাদে সমস্ত কোর্টরুম কেঁপে উঠল, পাকিস্তানি বিচারকবৃন্দ হতবাক হয়ে পড়লেন ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে। ইতিহাসের সাক্ষী হিসাবে বিজয়কেতন জাদুঘরে আগরতলা মামলার শুনানি কক্ষটি একইভাবে রয়েছে। ‘আগরতলা মামলার অনুচ্চারিত ইতিহাস’ বইটিতে ধারাবাহিকভাবে সাক্ষাঙ্কারসমূহ নিতে পারি নাই। এখানে আমার ব্যর্থতা রয়েছে, দেশের অন্যান্য খ্যাতিমান লেখকের মতাে আমি একনাগাড়ে বইটির কাজ সম্পন্ন করতে পারি নাই। পেশাগত কারণ ও জীবনের তাগিদে মাঝে মাঝেই সাক্ষাৎকারে বিরতি পড়ে যেত। কিন্তু তার পরেও যখনই ড. মাে. আবু দেলােয়ার হােসেনকে ডেকেছি, জলিল চাচাকে বলেছি, অভিযুক্তদের কাছে সাক্ষাৎকার চেয়েছি- সবাই সহায়তা করেছেন। এমনকি দেশের বরেণ্য সাংবাদিক আবেদ খান, আইনজীবী ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, লেখক শাহরিয়ার কবির এবং রাজনীতিবিদ তােফায়েল আহমেদের কাছে সময় চেয়েছি সাক্ষাৎকারের জন্য, সবাই আমাকে অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে সহযােগিতা করেছেন। কখনও কেউ তাদের ব্যক্তিগত অসুবিধার কথা আমাকে বলেননি। বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনে ছয় দফা- ইতিহাসের একটি উজ্জ্বল অধ্যায়, যার বিচ্ছুরিত আলােয় সমস্ত বাঙালি জাতি, নিজেদের আর্থ-সামাজিক অধিকার সম্পর্কে সচেতন ও সােচ্চার হয়ে উঠেছিল। এরপর বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন পর্বে ‘৬৮, ‘৬৯-এর আগরতলা মামলা হচ্ছে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, ইতিহাসের আরেকটি
২১০
উজ্জ্বল নক্ষত্র। মুক্তিকামী বাঙালি সেনা সদস্যদের মুক্তিসংগ্রামের আন্দোলনের নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত। আর এই অধ্যায়টি বাঙালি জাতির অবিস্মরণীয় গণ-অভ্যুত্থানের রূপরেখা নির্মাণ করেছিল। একটি বিষয় খুবই দুঃখজনক, এখনও এই ২০২০ সালে অনেক পাঠ্যপুস্তকে ইতিহাস ও সামাজিক ইতিহাসের বইতে কোনাে কোনাে লেখক লিপিবদ্ধ করেছেন- বাঙালি জাতির ছয় দফা আন্দোলনের প্রখরতায় বিপর্যস্ত হয়ে পাকিস্তানিরা বাঙালিদের ওপর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাটি দায়ের করেছিল। আগরতলা মামলায় অভিযুক্ত এবং দেশের প্রবীণ রাজনীতিবিদের মধ্যে একটি বিষয় গভীরভাবে গ্রন্থিত- তারা সবাই ষাটের দশকে বাঙালির প্রতিবাদের সময়টাকে নিজেদের স্মৃতিতে ছবির মতাে অমিয় অক্ষরে ধারণ করে রেখেছেন। আর সেই কারণে যতবার সাক্ষাৎকারের জন্য আয়ােজন করতাম বা কখনও তাদের বাসায় যেতাম, তখনই একটা স্মৃতি রােমন্থনের মতাে আড্ডা শুরু হয়ে যেত। কর্নেল শওকতের বাসায় আমরা অভিযুক্ত পরিবারের অনেকেই বহুবার গিয়েছি। সেখানে প্রায়ই নানা বিষয় নিয়ে কথা হতাে। আগরতলা মামলা পাঠ্যপুস্তকে সংযুক্ত করার বিষয়টি নিয়ে, ‘আগরতলা মামলার সংহতি পরিষদ’ অনেক প্রচেষ্টা করেছে। বাঙালি জাতির জাতিসত্তা, মানবিক ও অর্থনৈতিক অধিকারের বহুমাত্রিক বিষয়ে সােচ্চার ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তারই ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়, নিরলস একাগ্রতায়, প্রাজ্ঞ বিশ্লেষণে এবং উচ্চারিত অমােঘ বাণীতে হাজার বছরের বাঙালি জেগে উঠেছিল এক অভূতপূর্ব শক্তির মহিমায়। বঙ্গবন্ধুর ডাকে বাংলার সমস্ত প্রান্তর থেকে নির্ভীক ও নির্ভয় বাঙালি পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সমস্ত শক্তি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে, ত্রিশ লক্ষ বাঙালির আত্মত্যাগ ও তিন লক্ষ মা-বােনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, হাজার বছরের প্রতীক্ষারত বাঙালির হাতে মুক্তি ও স্বাধীনতার মুক্ত স্বদেশ এনে দেন। আগরতলা মামলা বইটির শেষপর্যায়ে লে. কমান্ডার মােয়াজ্জেম হােসেনের ছবি সংগ্রহের জন্য তার স্ত্রী কোহিনূর হােসেন (মদিনা) চাচির বাসায় যাই। দিনটি বিশেষ উল্লেখযােগ্য ছিল, ১৬ই ডিসেম্বর বিকাল ৩টা ৩০ মিনিটের সময় ধানমণ্ডিতে তার বাসভবনের ঘরে ঢােকার পর একজন মহিলা বললেন- আপনি একটু বসুন, খালাম্মা নামাজ পড়ছেন। বসার ঘরে লে. কমান্ডার মােয়াজ্জেম হােসেনের ছবির দিকে তাকিয়ে আমার মনটা অন্যরকম হয়ে গেল । আজ বিজয় দিবস, চারদিকে মানুষের আনন্দের ঢল। আবার মনে পড়ে গেল- এই বীরযােদ্ধা মানুষটিকে পাকিস্তানিরা ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ কালরাত্রির শেষ লগ্নে, ২৬শে মার্চ ভােরবেলায় নির্মমভাবে হত্যা করে, তাদের জিপ গাড়ির সঙ্গে দড়ি দিয়ে বেঁধে নিয়ে গিয়েছিল। মৃতদেহের প্রতিও পাকিস্তানিরা মনুষ্যত্বহীন আচরণ করেছিল। আর মােয়াজ্জেম হােসেনের তরুণী স্ত্রী তিনটি সন্তান নিয়ে দোতলার জানালা দিয়ে এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড দেখে স্তব্ধ হয়ে যান। কিছু কিছু ঘটনা কখনও ভুলা যায় না, আমি যতবার লে. কমান্ডার মােয়াজ্জেম হােসেনের ছবি দেখি, তখনি মনে পড়ে যায় সেই নির্মম হত্যাকাণ্ডের কথা।
২১১
বাংলাদেশের মানুষ আর নতুন প্রজন্মের অনেকেই এখনও জানে না মুক্তিযুদ্ধের সময়কালীন বহু পরিবারের মর্মান্তিক ঘটনা। মর্মান্তিক ঘটনাগুলাে স্মৃতির পাতার অতলে স্তিমিত হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ আমার চিন্তার মাঝে ছেদ পড়ল- কোহিনুর চাচি এসে বললেন- মিমি তুমি বসে আছাে, আমি নামাজ পড়ছিলাম। আমি বললাম- না, কোনাে অসুবিধা হয়নি। আপনার কাছ থেকে লে. কমান্ডার মােয়াজ্জেম হােসেনের আর আপনাদের ছবিটা নিতে এসেছিলাম। তিনি হাত বাড়িয়ে বললেন- এই ছবিটি নাও। এটাই শেষ ছবি তােমার চাচার সঙ্গে, যত্ন। করে রেখাে । দাড়াও তােমার জন্য একটু চায়ের ব্যবস্থা করি। চায়ের কথা বলে তিনি এসে আবার বসলেন। আমার মনে হলাে, তিনি এখনও ভীষণ সুন্দর- বললাম সে কথা। তারপর নানা রকম আলাপ হলাে, শেষ কথাগুলাে না উল্লেখ করে পারছি না। আমি জিজ্ঞেস করলাম- দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আপনার যােগাযােগ ছিল? এতক্ষণ তিনি অত্যন্ত স্বতঃস্ফূর্তভাবে কথা বলছিলেন, বঙ্গবন্ধুর কথায় তিনি আরও ভাবাবেগে আপ্লুত হয়ে ওঠলেন। বললেন- উনি অনেকবার আমার খোঁজ নিয়েছেন। মাঝে মাঝেই ফোন করে খোঁজ নিতেন। একদিন তাে আমি খুবই লজ্জা পেয়েছিলাম। সেদিন সকাল থেকে বারবার কারেন্ট চলে যাচ্ছিল ঠিক আমাদের এই এলাকাটিতে, তখনও ধানমণ্ডিতে থাকতাম। আমরা বারবার বিদ্যুৎ বিভাগকে খবর দিয়েও লাভ হচ্ছিল না। সে সময় হঠাৎ তিনি আমাকে ফোন করেন। সরাসরি ফোন করেছিলেন, পিএস বা ফোন অপারেটরকে ফোন সংযােজন করতে বলেন নাই। সরাসরি ফোন করে বললেন- মদিনা তুমি কেমন আছাে? বাচ্চারা কেমন আছে? কোহিনুর হােসেন (মদিনা) চাচি আমাকে বললেন- আমার খুব মেজাজ খারাপ ছিল । কারেন্টের জন্য বাচ্চাদের নিয়ে নানা রকম বিপদের মধ্যে ছিলাম। মাথা ঠিক ছিল না তাই সােজাসুজি বলে ফেললাম, মুজিব ভাই কী করবাে? আপনাদের লােকেরা কিছু ঠিকমতাে ব্যবস্থা করতে পারছে না। সারাদিন কারেন্ট নাই। এর মধ্যে বাচ্চারা অসুস্থ, আমি একনাগাড়ে নানা অভিযােগ বলে যাচ্ছি। হঠাৎ মনে হলাে, একি করছি! অপর প্রান্তে মুজিব ভাই, বঙ্গবন্ধু, দেশের প্রধান ব্যক্তি। আমি খুব লজ্জা পেলাম, আমি হঠাৎ থেমে গেলাম । বঙ্গবন্ধু তখন কী যে মায়া নিয়ে আমাকে বলেছিলেন, মদিনা আমি জানি তােমাদের কষ্ট হচ্ছে। অনেক কিছুই এখনও সঠিক ব্যবস্থায় আসেনি। আমাকে একটু সময় দাও। কোহিনুর হােসেন (মদিনা) চাচি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন, অনেক বছর পার হয়ে গেছে। মনে হলাে, এই তাে সেদিনের কথা এখনও আমার কানে বাজে, বঙ্গবন্ধুর কথাগুলাে। কী আন্তরিকভাবে কথাগুলাে বলেছিলেন। কোনােরকম রাগ করেননি। তাঁর ভেতরে এক গভীর মমতাবােধ আর ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিবােধ ছিল।
কোহিনূর হােসেন চাচির বাসা থেকে বের হয়ে আস্তে আস্তে ধানমণ্ডির রাস্তায় হাঁটছি। কেমন একটা আচ্ছন্নতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। শহরের ছেলেমেয়েরা লাল-সবুজ পােশাক
২১২
পরে রিকশায় করে যাচ্ছে। চারদিকে বিজয় দিবসের আবহাওয়া বাঙালির চেতনার রঙ লাল-সবুজে আবৃত। এখান থেকে অল্প কিছুদূরে বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর বাড়ি। যা আজ জাতির হৃদয় নিংড়ানাে স্মৃতিবিজড়িত এক জাদুঘর । আমার মনে ভেসে ওঠল, ২২শে ফেব্রুয়ারি ‘৬৯ সালে আগরতলা মামলার মুক্তি দিবসের কথা। আগরতলা মামলা থেকে মুক্তি লাভ করে বঙ্গবন্ধু আমার মেজো চাচা অ্যাটর্নি জেনারেল আমিনুল হকের বাসায় এসেছিলেন । দুঃখ-ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে আমিনুল হককে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, একজনকে ফিরিয়ে আনতে পারলাম না! জহুর আমাদের সঙ্গে জীবন নিয়ে মুক্তি লাভ করতে পারলাে না। জহুর জীবন দিয়ে, প্রাণ দিয়ে, দেশের জন্য চলে গেলেন। আমিনুল হকের ক্রন্দন ও আবেগাপ্লুত অবস্থা দেখে তিনি আরও মর্মাহত হন। বলেছিলেন- “আমি আবার আসব।’ চাচিমা ফরিদা আক্তার বলেছিলেন- আপনি আরেকবার কষ্ট করে আসবেন। ‘৭৩ সালে মেজো চাচা আমিনুল হক এবং চাচিমা ফরিদা আক্তার তাদের এলিফ্যান্ট রােডের চিত্রা বাড়ির সামনের বাগানের মাঠে প্রথমবার আগরতলা মামলার ২২শে ফেব্রুয়ারি মুক্তি দিবসের অনুষ্ঠান করেছিলেন ।। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার কথা রেখেছিলেন। আমিনুল হকের আমন্ত্রণে তিনি সেদিনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে সবাইকে আবারাে নিজের অন্তরের কাছে টেনে নিয়েছিলেন। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির পিতাবিশ্ব মানচিত্রে এক অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। আর আমার তাকে একবারই দেখার সুযােগ হয়েছিল। এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। ১৯৭২ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু আজিমপুর কবরস্থানে খুব ভােরবেলা আসেন। আমি, ভাইজান, বাবা, চাচা সার্জেন্ট জহুরুল হকের কবরের একপাশে দাড়িয়েছিলাম। অনেক লােকজনের সমাগম হয়েছিল। একপর্যায়ে সাদা পােশাক পরিহিত সৈন্যরা বিউগল বাজানাে শুরু করল । বন্দুক উঁচু করে বিমানবাহিনীর সৈন্যরা শ্রদ্ধা নিবেদন করল । ভাইজান (মঞ্জু) ধীরে ধীরে আমার কানের কাছে এসে বলল- গান স্যালুট শুরু হচ্ছে । বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সবার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি তখনও ছােট, হঠাৎ আমার মনে হলাে আমি কিছু দেখতে পারছি না। সবার পা দেখছি, বাবা, চাচাদের পায়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি, আর কিছু দেখতে পারছি না। চাচার হাত ধরে বললামকিছু দেখতে পারছি না। চাচা (আমিনুল হক) মুহূর্তের মধ্যে এক টানে আমাকে তুলে নিয়ে তার কাঁধের ওপর বসালেন। আর আঙুল উঁচু করে বললেন ‘ঐ দ্যাখ- বঙ্গবন্ধু’। আমি অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছি, সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা, কালাে কোট পরিহিত বঙ্গবন্ধু। সার্জেন্ট জহুরুল হকের কবরের সামনে দাঁড়িয়ে সম্মান জানাচ্ছেন । চাচা আমার হাত ধরে মৃদু টান দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন- কী দেখছিস? আমি ধীরে ধীরে বললাম- ‘অনেক বড় মানুষ। অনেক বছর পার হয়ে গেছে, প্রায় ৪৬ বছর- এখনও মনে হয় তিনি অনেক বড় মানুষ ।
২১৩