হোটেল আগ্রাবাদ অপারেশন (চট্টগ্রাম)
হোটেল আগ্রাবাদ অপারেশন (চট্টগ্রাম) পরিচালিত হয় ২৩শে অক্টোবর (২রা রমযান)। এ-মাসেই পাকিস্তান সরকার বিশ্বব্যাপী প্রচার করে যে, পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি স্বাভাবিক এবং সবকিছু তাদের নিয়ন্ত্রণে। তাদের এই দাবি বিশেষত জাতিসংঘের কাছে প্রমাণ করার জন্য তারা জোর চেষ্টা চালায়। তাদের চেষ্টার ফল হিসেবে জাতিসংঘের একটি প্রতিনিধি দল পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসে। তাঁরা চট্টগ্রামে গিয়ে হোটেল আগ্রাবাদে অবস্থান নেন। কিন্তু পাকিস্তান সরকারের এই প্রচারণা যে মিথ্যা তা প্রমাণ করার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তাঁরা জাতিসংঘ প্রতিনিধি দলের অবস্থানস্থল আগ্রাবাদ হোটেলের পার্শ্ববর্তী বিদ্যুৎ ট্রান্সফরমার উড়িয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এ অপারেশনের পরিকল্পনা করেন ডা. মাহফুজুর রহমান এবং এতে অংশ নেন ডা. জাফর উল্লাহ, বোরহান উদ্দিন (চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্রলীগ নেতা), ডা. সাইফুদ্দিন, ফয়েজুর রহমান, গরীব উল্লাহ, মো. শফি মুন্সী প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধা।
অপারেশনের জন্য প্রয়োজনীয় বিস্ফোরক ও অস্ত্র সংগ্রহ করা হয় এবং সেগুলো বিভিন্নভাবে পৌঁছে যায় মোগলটুলীর কবির তোরণ মাতব্বর বাড়ির মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন আশ্রয়ে। অপারেশন টিমের সকল মুক্তিযোদ্ধা ক্ষীণস্বরে ‘জয়বাংলা’ বলে মাটি ছুঁয়ে শপথ নিয়ে অপারেশনের দিন সন্ধ্যার পর বেরিয়ে পড়েন। তাঁরা ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখেন ট্রান্সফরমারের নিরাপত্তায় নিয়োজিত একজন পাকসেনা ও একজন অবাঙালি রাজাকার নিজেদের অস্ত্র দূরে রেখে গভীর গল্পে মগ্ন। কিছু বোঝার অগেই তাদের বুকে রিভলবার ঠেকিয়ে দুজনকে গাছের সঙ্গে বেঁধে রেখে মুক্তিযোদ্ধা ফয়েজুর রহমান ও গরীব উল্লাহ ট্রান্সফরমারে পর্যাপ্ত পরিমাণে বিস্ফোরক স্থাপন করেন। তারপর তাঁরা নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার পর প্রচণ্ড শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। সঙ্গে-সঙ্গে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায় এবং আগ্রাবাদ হোটেলসহ সমগ্র এলাকা অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়। হোটেলে অবস্থানকারী দেশী-বিদেশী অতিথিরা প্রাণভয়ে পালাতে শুরু করেন।
হোটেল আগ্রাবাদে এই অপারেশন নানা কারণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এর ফলে পাকিস্তান সরকারের মিথ্যা অহঙ্কার চূর্ণ হয়ে যায়। পূর্ব পাকিস্তানে স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে বলে তারা যে প্রচারণা চালিয়েছিল, তা মিথ্যা প্রমাণিত হয়। জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক দল মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে নতুন ধারণা নিয়ে ফিরে যায়। পাকিস্তান সরকারের মিথ্যাচার সম্বন্ধে তাঁরা সুস্পষ্ট ধারণা পান। অপারেশনের পরদিন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র এবং বিবিসি- থেকে এ সম্পর্কিত খবর প্রচারিত হয়। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের চরমপত্র- অনুষ্ঠান থেকে এ অপারেশনের খবর বিশেষভাবে প্রচারিত হয়। [সাখাওয়াত হোসেন মজনু]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড