You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে হোসেনপুর উপজেলা (কিশোরগঞ্জ) - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে হোসেনপুর উপজেলা (কিশোরগঞ্জ)

হোসেনপুর উপজেলা (কিশোরগঞ্জ) ১৯৬৬ সালের ৬- দফা আন্দোলনে হোসেনপুরের মানুষ সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়। মূলত থানা আওয়ামী লীগএর স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সার্বক্ষণিক জনসংযোগের মধ্য দিয়েই এ উপজেলায় পাকিস্তান-বিরোধী আন্দোলন চাঙ্গা হয়ে ওঠে। উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফজলুল হক (দীপেশ্বর) এবং সাধারণ সম্পাদক ফজলুল হক (ধনকুড়া) সে-সময় আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। অধিকন্তু মরজত আলী মাস্টার এবং সিরাজ মিয়া (পরবর্তীতে ভাইস চেয়ারম্যান)-এর ভূমিকা গণআন্দোলনকে বেগবান করে। বিশিষ্ট সমাজসেবক মিছবাহ উদ্দিন আবুল মিয়া এবং মহিউদ্দিন আহমেদ ওরফে দুলু মিয়া (ধুলজুরি) সংগঠক হিসবে আন্দোলনে ভূমিকা রাখেন। এছাড়াও ৬-দফা আন্দোলনে আব্দুল মালেক চৌধুরী (উত্তর গোবিন্দপুর), বীরেন্দ্র সরকার বীরু (ধুলজুরি) ও মো. তমিজ উদ্দিন (দ্বীপেশ্বর) সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। সে-সময় হোসেনপুরকেন্দ্রিক ছাত্র-আন্দোলনে যারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন, তারা হলেন— শাহ্ মো. মনসুরুল হক (অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব, বাসুরচর), কামরুজ্জামান কমরু (চরজামাইল), জহিরুল ইসলাম নূরু (নারায়ণডহর), সোহরাব উদ্দিন মোড়ল (পিতলগঞ্জ), নজরুল ইসলাম মজনু (শহীদ মুক্তিযোদ্ধা, পুমদি), এমদাদুল হক (ধনকুড়া), আব্দুল কুদ্দুছ হীরা (জামাইল), ইমরুল হুদা (কুড়িমারা) প্রমুখ। ১৯৬৮-৬৯-এর গণআন্দোলনে ছাত্রনেতা বেলায়েত হোসেন (নান্দাইল), আতাউল করিম জেমস (দীপেশ্বর) ও আবু হানিফ কুদ্দুছ (চৌধার) বিশিষ্ট ভূমিকা রাখেন।
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু ইয়াহিয়া সরকার বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ষড়যন্ত্রের পথ বেছে নেয়। এর প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে হোসেনপুরের সর্বস্তরের মানুষ তাতে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ-এর পর এ উপজেলার স্বাধীনতাকামী মানুষ সংগঠিত হতে থাকে। হোসেনপুর-পাকুন্দিয়ার এ কে এম শামসুল হক গোলাপ মিয়া এমপিএ স্থানীয় কাচারি প্রাঙ্গণে বিশাল সভা করে সবাইকে দিকনির্দেশনা দেন এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণের আহ্বান জানান।
হোসেনপুর থানায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন মরজত আলী মাস্টার, মো. নূরুল হক, মো. ফজলুল হক, মো. তমিজ উদ্দিন (দ্বীপেশ্বর), মহিউদ্দিন দুলু মিয়া, ডা. মোহাম্মদ আলী, বীরেন্দ্র সরকার বীরু প্রমুখ। তাঁরা স্থানীয় ছাত্র-যুবকদের সংগঠিত করেন এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য তাদের হালুয়াঘাট, দুর্গাপুর ও কলমাকান্দা সীমান্ত দিয়ে ভারতের মেঘালয় রাজ্যে স্থাপিত বিভিন্ন ট্রেনিং ক্যাম্পে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। কাউকে- কাউকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সীমান্ত দিয়ে ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলায় পাঠানো হয়। প্রশিক্ষণার্থী তরুণদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন মো. নূরুল ইসলাম (কুড়িমারা) এবং শ্যামল চন্দ্র সরকার (ভরুয়া)। এ উপজেলার বেশিরভাগ তরুণ মেঘালয় রাজ্যের তুরা ট্রেনিং ক্যাম্পে সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে কর্নেল আবু তাহেরের নেতৃত্বাধীন ১১ নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন।
হোসেনপুর উপজেলার যুদ্ধকালীন কমান্ডার ছিলেন আব্দুল হান্নান মোল্লা (বিন্নতি, মোল্লাবাড়ি, কিশোরগঞ্জ), হারুন-অর-রশীদ(খাগডহর, ময়মনসিংহ) এবং শুকুর মাহমুদ (পুমদি)।
২৫শে মার্চ গভীর রাতে পাকবাহিনী ঢাকায় গণহত্যা শুরু করলে আওয়ামী লীগ নেতা মিছবাহ উদ্দিন আবুল মিয়ার নেতৃত্বে বিক্ষুব্ধ পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য কাওনা সেতুর নিকটবর্তী রাস্তা কেটে ফেলে। এ সময় বিক্ষুব্ধ জনতা রামদা, লাঠি, বর্শা ইত্যাদি দেশীয় অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে তোলে৷ তৎকালীন সার্কেল অফিসারও প্রতিরোধে যোগ দেন।
২০শে এপ্রিল পাকবাহিনী কিশোরগঞ্জ থেকে ২টি সামরিক জিপে চড়ে হোসেনপুরে অনুপ্রবেশ করে। এখানে তাদের কোনো স্থায়ী ক্যাম্প ছিল না। কুলেশ্বরী বাড়িতে তারা একটি অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করে। জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে পাকবাহিনীর তত্ত্বাবধানে সিও অফিস কার্যালয়ে একটি রাজাকার ক্যাম্প স্থাপিত হয়।
হোসেনপুর উপজেলায় স্বাধীনতাবিরোধী দল হিসেবে তৎপর ছিল মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী ও পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি (পিডিপি)। মুসলিম লীগ নেতা আছর আলী মৃধাকে সভাপতি করে শান্তি কমিটি গঠিত হয়। কমিটির অন্য সদস্যরা হলো- আব্দুল জব্বার চেয়ারম্যান (ধূলিহর), ইব্রাহিম খাঁ ওরফে আশু খাঁ (আড়াইবাড়িয়া), দৌলত খাঁ (আড়াইবাড়িয়া), শাহনেওয়াজ মাস্টার (গোবিন্দপুর) ও মুখলেছুর রহমান চেয়ারম্যান (গোবিন্দপুর)। পরবর্তী সময়ে এদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। রাজাকারদের মধ্যে সবচেয়ে নিষ্ঠুর ছিল কমান্ডার আলী হোসেন (চরবিশ্বনাথপুর) এবং মিছির আলী (ঢেকিয়া)। এরা হোসেনপুরে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। এদের ইন্ধনেই ১৭ই আগস্ট হনুমানতলায় নারকীয় হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। এখানে একরাতে একসঙ্গে ১৫০ জন মানুষকে হত্যা করা হয়, যা হনুমানতলা গণহত্যা নামে পরিচিত। হোসেনপুর থানা শান্তি কমিটির সভাপতি আছর আলী মৃধা এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। তার সহযোগিতায় পাকবাহিনী অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজ, নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড চালায়।
নারায়ণডহর যুদ্ধএর পর পাকসেনারা ধুলজুরি গ্রামের “মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রাজ্জাকসহ ১০ জন গ্রামবাসীকে ধরে নিয়ে চৌরাস্তা-সংলগ্ন নদীর পারে গুলি করে হত্যা করে। চরপুমদি বাজারে অবস্থিত ক্যাম্পের রাজাকাররা আশপাশের বাড়িঘর থেকে গরু, খাসী, মুরগি ইত্যাদি জোর করে নিয়ে আসত। তারা বিভিন্ন বাড়ি থেকে যুবতী মেয়েদের ধরে এনে তাদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালাত।
এ উপজেলায় পাকহানাদার বাহিনীর কোনো নির্যাতনকেন্দ্র ছিল না। যাদের ধরা হতো তাদের সরাসরি কিশোরগঞ্জের নির্যাতনকেন্দ্রে পাঠিয়ে দেয়া হতো।
নারায়ণডহর এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুললে উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয়। কৌশলগত কারণে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটেন। নারায়ণডহর যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা রুস্তম আলী (পিতা ইয়াছিন, ধুলজুরি) শহীদ হন এবং মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মান্নান (ধুলজুরি) ও আব্দুর রাজ্জাক (ধুলজুরি) পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে শহীদ হন। নারায়ণডহর যুদ্ধের পর পাকবাহিনী ঢেঁকিয়ার দিকে অগ্রসর হলে সেখানে মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ফলে উভয় পক্ষের মধ্যে সেখানে যুদ্ধ হয়। ঢেঁকিয়ার যুদ্ধ ২৬শে নভেম্বর সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধে হাবিবুর রহমান মুক্ত (ধুলিহর) ও গিয়াসউদ্দিন (হারেঞ্জা) শহীদ হন।
মুক্তিযোদ্ধারা চরপুমদি বাজারে অবস্থিত রাজাকার ক্যাম্পে ১৭ই নভেম্বর অপারেশন চালান। এ অপারেশনে নেতৃত্ব দেন কিশোরগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুল হান্নান মোল্লা। মুক্তিযোদ্ধাদের অতর্কিত আক্রমণে ১০ জনের অধিক রাজাকার নিহত হয় এবং ক্যাম্পটির পতন ঘটে। এটি চরপুমদি বাজার রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন হিসেবে পরিচিত। মুক্তিযোদ্ধারা থানা শান্তি কমিটির সভাপতি আছর আলী মৃধার বাড়িতে আক্রমণ করলে রাজাকারদের সঙ্গে তাদের যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। অন্যদিকে আছর আলী মৃধাসহ বেশ কয়েকজন রাজাকার নিহত হয়। এটি আছর আলী মৃধার বাড়ি অপারেশন নামে পরিচিত। ২৯শে নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা হোসেনপুর সিও অফিস রাজাকার ক্যাম্প চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে গুলিবর্ষণ শুরু করেন। রাজাকাররাও পাল্টা গুলিবর্ষণ করে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে টিকতে না পেরে তারা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। হোসেনপুর সিও অফিস রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন-এ শতাধিক রাজাকার নিহত হয়। এ অপারেশনের মধ্য দিয়ে হোসেনপুর উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হলেন- নূরুল ইসলাম খান পাঠান, বীর প্রতীক (পিতা আবদুস সাত্তার খান পাঠান, গড়মাছুয়া)।
হোসেনপুরের শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- আবু হেনা শামসুদ্দোহা (পিতা মোহাম্মদ আলী, পুমদি), আব্দুল বারী (পিতা মো. আশেক আলী, জগদল), আব্দুল মালেক (পিতা রহমত আলী, গনমানপুরুরা), মো. গিয়াস উদ্দিন (পিতা জনাব আলী, হারেঞ্জা), হাবিবুর রহমান মুক্ত (পিতা ফাহিম উদ্দিন, ধুলিহর), ফিরোজ আহম্মদ (পিতা সুলতান আহমদ, দ্বীপেশ্বর), আমিনুল হক (পিতা মিয়া হোসেন, ধনকুড়া), নূরুল ইসলাম (পিতা ওবায়দুল্লাহ, নান্দানিয়া), রেণু মিয়া (পিতা আব্দুল মালেক, চরপুমদি), নজরুল আলি ওরফে মজনু (পিতা কিসমত উদ্দিন তালুকদার, পুমদি), সোহরাব উদ্দিন (পিতা ছফির উদ্দিন, বীরপাইকসা), সুরুজ আলী (পিতা সিরাজ হোসেন, বীরপাইকসা), আব্দুর রহিম (পিতা খোদনেওয়াজ, সাহেদল), ছফির উদ্দিন (পিতা ছলিম ভূঞা ওরফে মইষা ভূঞা, চরজামাইল), মো. নূর হোসেন (পিতা ছলিম ভূঞা, চরজামাইল), আব্দুর রাজ্জাক (পিতা আব্দুল সোবহান, ধুলজুরি), আব্দুল মান্নান (ধুলজুরি) ও রুস্তম আলী (পিতা ইয়াসিন, ধুলজুরি)। এছাড়া কিশোরগঞ্জ সদরের মুক্তিযোদ্ধা খায়রুল জাহান ও মো. সেলিম হোসেনপুরের প্যারাভাঙ্গা যুদ্ধে শহীদ হন।
হোসেনপুর ডিগ্রি কলেজ-সংলগ্ন স্থানে নির্মাণ করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ। পুমদিতে স্থাপন করা হয়েছে শহীদ আবু হেনা শামসুদ্দোহা সড়ক (নান্দানিয়া থেকে লাখুহাট) ও শহীদ আবু হেনা শামসুদ্দোহা স্মৃতি গ্রন্থ কুটির। স্বাধীনতার পরপরই পুমদি বাজারের নামকরণ করা হয়েছে জয়বাংলা বাজার। শহীদ হাবিবুর রহমান মুক্তুর নামে হোসেনপুর- দেওয়ানগঞ্জ সড়কে পারিবারিকভাবে নির্মিত হয়েছে শহীদ হাবিবুর রহমান মুক্ত গেইট। এছাড়া ১৯৮৩-২০০০ সাল পর্যন্ত শহীদ মুক্ত থিয়েটার নামক একটি নাট্য সংগঠন ক্রিয়াশীল ছিল। ১৯৯৫ সালে কুড়িমারা গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা হাই স্কুল নামে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এছাড়া মুক্তিযোদ্ধা সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী, মুক্তিযোদ্ধা ক্রীড়া চক্র এবং ‘আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান’ নামক সংগঠন গড়ে তোলা হয়েছে। [শাহ্ মো. আফতাব উদ্দীন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড