মুক্তিযুদ্ধে হিজলা উপজেলা (বরিশাল)
হিজলা উপজেলা (বরিশাল) ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ভাষণের পর সারা দেশের মতো হিজলার মানুষও একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখতে থাকে। এ লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে তারা অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে। এরই ধরাবাহিকতায় জেলা আওয়ামী লীগ নেতাদের নির্দেশে একটি সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন যথাক্রমে কাজী মো. শাহজাহান ও সৈয়দ কামাল উদ্দিন এবং সদস্য ছিলেন শাহে আলম দেওয়ান, আবুল হোসেন কাজী প্রমুখ। কমিটি পরবর্তী কার্যক্রমের জন্য বঙ্গবন্ধুর চূড়ান্ত ঘোষণার অপেক্ষায় থাকে।
২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর সংগ্রাম কমিটির নেতৃত্বে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি। এ উপলক্ষে বদরটুনী হাইস্কুল মাঠ, মেমানিয়া হাইস্কুল মাঠ, সংহতি হাইস্কুল মাঠ, হিজলা পি এন হাইস্কুল মাঠ এবং কাউনিয়া হাইস্কুল মাঠে এলাকার তরুণদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। বাঁশের লাঠি ও থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল দিয়ে প্রশিক্ষণ চলে। প্রশিক্ষক ছিলেন আনসার ভিডিপি কমান্ডার আবদুর রহিম পালোয়ান। পরে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য আওয়ামী লীগ নেতা হোসেন রাঢ়ীর নেতৃত্বে কিছুসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধাকে ভারতে এবং কিছু সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধাকে দেশের অন্যান্য ক্যাম্পে পাঠানো হয়। সৈয়দ কামাল উদ্দিনের নেতৃত্বে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা থানা থেকে কিছু অস্ত্র সংগ্রহ করেন। পরবর্তীতে উপর্যুক্ত নেতৃবৃন্দ হিজলায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন।
৯নং সেক্টরাধীন হিজলা উপজেলার যুদ্ধকালীন সাবসেক্টর কমান্ডার ছিলেন কুদ্দুস মোল্লা এবং ফিল্ড কমান্ডার মো. আবদুর রশীদ সিকদার (আনসার বাহিনীর কোম্পানি কমান্ডার)। এঁদের সহযোগী ছিলেন আকবর মোল্লা, সিরাজুল ইসলাম, মো. হানিফ রাড়ী, আবদুল খালেক সিকদার, মমিন আলী বেপারী, হাবিবুর রহমান আকন প্রমুখ।
হিজলা উপজেলায় পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো প্রতিরোধযুদ্ধ হয়নি। তবে পাকবাহিনী যাতে হিজলায় প্রবেশ না করে সেজন্য মুক্তিযোদ্ধারা কিছু কৌশলে অবলম্বন করেছিলেন। পাকবাহিনী গানবোট নিয়ে নদীতে মহড়া দেয়ার সময় মাঝে-মধ্যে তীরে এসে জমিতে কর্মরত কৃষকদের কাছে মুক্তিবাহিনী সম্পর্কে জানতে চাইত। তখন কৃষকবেশী মুক্তিযোদ্ধারা এ এলাকায় মুক্তিযোদ্ধা নেই বলে জানিয়ে দিতেন।
মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে পাকবাহিনী হিজলায় এক ঝটিকা আক্রমণ চালায়। তবে এখানে তাদের কোনো ক্যাম্প ছিল না। হিজলা থানায় রাজাকারদের ক্যাম্প ছিল এবং পাকবাহিনী মাঝে-মধ্যে এখানে এসে রাজাকার ও পুলিশের মাধ্যমে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করত।
পাকবাহিনীকে সহায়তার জন্য স্থানীয় স্বাধীনতাবিরোধী সৈয়দ মকবুল আলম মানিক মিয়ার নেতৃত্বে আব্দুল সামাদ মাস্টার এবং এ কে ফজলুল হক চৌধুরী মুসলিম লীগ- ও জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মীদের নিয়ে শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠন করে। পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) নেতা মাওলানা নূরুজ্জামান খানের বাড়ি ছিল হিজলার মেমানিয়া ইউনিয়নে। তার দুজন ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিল জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ-এর কেন্দ্রীয় নেতা মাস্টার মো. ইব্রাহিম ও মাস্টার মো. মহিউদ্দিন (রাজাকার বাহিনীর সদস্য)। এদের নির্দেশে ১নং হরিনাথপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কাজী আলতাফ হোসেন, ৩নং গুয়াবাড়িয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হাসান মাহমুদ সিকদার, ৪নং বড় জালিয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা মাওলানা সৈয়দ নূরুল হক (বর্তমানে বরিশাল দক্ষিণ জেলা জামায়াতে ইসলামীর আমীর), গোবিন্দপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও হোগলটুলী মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা আবুল হাসেম (বর্তমানে জামায়াতে ইসলামীর নেতা) এবং ফজলু মৌলভীর নেতৃত্বে আলবদর বাহিনী গঠনের চেষ্টা চালানো হয়। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধে সে তৎপরতা নস্যাৎ হয়ে যায়। পাকবাহিনীর অপারেশনে সহযোগিতা করার জন্য রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা মুক্তিযোদ্ধা, তাঁদের পরিবার এবং মুক্তিযুদ্ধের সমর্থকদের তথ্য সংগ্রহ করে পাকবাহিনী ও হিজলা থানা পুলিশকে দিত। মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে হিজলা থানার পুলিশ মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করলেও পরে পাকবাহিনী ও রাজাকারদের কথামতোই কাজ করত।
মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে পাকবাহিনী রাজাকার ও পুলিশের সহযোগিতায় গুয়াবাড়িয়া ইউনিয়নের কালিকাপুর গ্রামের হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় হানা দিয়ে নারকীয় তাণ্ডব চালায়। তারা প্রায় অর্ধশত বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজ করে। আবদুর রহিম পালোয়ানকে ধরে থানার রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে যায় এবং তাঁকে রাজাকারদের প্রশিক্ষক হওয়ার জন্য চাপ দেয়। স্থানীয় তিনজন বাসিন্দা কাজী শাহজাহান, আব্দুল মান্নান সিকদার ও সেকেন্দার আলী মাস্টার পার্শ্ববর্তী থানা মুলাদীতে বাজার করতে গেলে রাজাকাররা আব্দুল মান্নান সিকদারকে ধরে নিয়ে যায়। তাঁর আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।
হিজলায় পাকবাহিনীর পৃথক কোনো নির্যাতনকেন্দ্র বা বন্দিশিবির ছিল না। থানার রাজাকার ক্যাম্পই ছিল তাদের অত্যাচার-নির্যাতনের কেন্দ্র। এখান থেকে রাজাকাররা প্রায়ই মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়ি গিয়ে তাঁদের পরিবার-পরিজনদের এই বলে শাসাত যে, তাঁদের ছেলেরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিলে তাঁদের মেরে ফেলা হবে, এ-দেশ কখনো স্বাধীন হবে না, পাকিস্তানই থাকবে।
হিজলায় বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা কুদ্দুস মোল্লার নামে একটি স্থানীয় মুক্তিবাহিনী ছিল – কুদ্দুস মোল্লা বাহিনী। স্থানীয়ভাবে এ বাহিনী মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
হিজলা উপজেলায় পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের একটিই যুদ্ধ হয় – হিজলা থানাযুদ্ধ। ১৩ই অক্টোবর ফিল্ড কমান্ডার আবদুর রশীদ সিকদারের নেতৃত্বে সংঘটিত এ-যুদ্ধে থানার পুলিশ ও রাজাকাররা আত্মসমর্পণ করে, আবদুল হালিম নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং বেশ কয়েকজন পুলিশ ও রাজাকার আহত হয়। এদিনই কার্যত হিজলা উপজেলা হানাদারমুক্ত হলেও মুক্তদিবস পালন করা হয় ৪ঠা ডিসেম্বর।
হিজলা উপজেলার একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। তিনি হচ্ছেন হরিনাথপুর ইউনিয়নের গঙ্গাপুর গ্রামের আবদুল হক মুন্সী। এছাড়া মুলাদী উপজেলার বাটামারা ইউনিয়নের আবদুল হালিম হিজলা থানাযুদ্ধে শহীদ হন। হিজলায় শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি রক্ষার্থে উপজেলা সদরে মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া হিজলা সদরে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিসহ ‘চিরঞ্জীব বঙ্গবন্ধু’ নামে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। [বাপপী মজুমদার]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড