হুশোরখালী যুদ্ধ (মহেশপুর, ঝিনাইদহ)
হুশোরখালী যুদ্ধ (মহেশপুর, ঝিনাইদহ) সংঘটিত হয় দুবার। প্রথমবার আগস্ট মাসের শেষদিকে এবং দ্বিতীয়বার ১৯-২১শে অক্টোবর। এতে বেশকিছু পাকসেনা নিহত হয়। অপরপক্ষে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ এবং ৩ জন আহত হন। ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর উপজেলা ও চুয়াড়াঙ্গা জেলার জীবননগর উপজেলার অংশবিশেষ নিয়ে দত্তনগর কৃষি খামার গঠিত। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে যশোর সেনানিবাসের পাকিস্তানি সৈন্যরা এ খামারে অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করে। ক্যাম্পের কমান্ডার ছিল মেজর আব্বাস। তার চাহিদামতো নারী ও মাংস সরবরাহ করতে হতো। এতে এলাকার মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। আগস্ট মাসের শেষদিকে ভারত থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা এসে পাকিস্তানি বাহিনীকে আক্রমণ করার জন্য হুশোরখালী গ্রামে ক্যাম্প স্থাপন করেন। রাজাকারদের মাধ্যমে এ খবর পেয়ে পাকিস্তানি বাহিনী মেজর আব্বাসের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প আক্রমণ করে। কিন্তু অবস্থানগত সুবিধা ও অসীম সাহসিকতার কারণে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করেন। এ-সময় দস্তগীর নামে একজন পাকসেসনা নিহত ও কয়েকজন রাজাকার- বন্দি হয়। এতে পাকসেনারা চরমভাবে ক্ষুব্ধ হয় এবং এর প্রতিশোধ নিতে তৎপর হয়ে ওঠে।
১৭ই অক্টোবর পান্তাপাড়া ক্যাম্পের সেকশন কমান্ডার মাহতাব উদ্দিন ও এফ আর চৌধুরীর নেতৃত্বে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা জানতে পারেন যে, পাকসেনা ও রাজাকাররা হুশোরখালীর মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ করবে। এ খবর পেয়ে তাঁরা কমান্ডার মাহতাব উদ্দিনের নেতৃত্বে হুশোরখালী খালের বিপরীতে অবস্থান নেন। ঐদিন বেলা ২টার দিকে দত্তনগর ক্যাম্প থেকে এক প্লাটুন পাকিস্তানি সেনা হুশোরখালী খালের অপর পাড়ে এলে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের অবস্থান লক্ষ করে গুলি করেন। পাকসেনারও পাল্টা গুলি চালায়। উভয় পক্ষে প্রায় ৪ ঘণ্টা গুলি বিনিময় হয়। কিন্তু সংখ্যায় অল্প হওয়ায় পাকসেনারা সন্ধ্যার পূর্বে তাদের দত্তনগর ক্যাম্পে ফিরে যায়। এর একদিন পর ১৯শে অক্টোবর সকাল ১১টার দিকে পাকবাহিনী পুনরায় মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর আক্রমণ করার জন্য ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হুশোরখালী খালের দিকে অগ্রসর হয়। মুক্তিযোদ্ধারা পূর্বেই এ খবর পেয়ে খালের বিপরীত পাড়ের দিকে অগ্রসর হন। তাঁরা তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে একদিকে মুজিব বাহিনী, অন্যদিকে মাহতাব বাহিনী এবং অপরদিকে ফয়জুর বাহিনী অবস্থান নেয়।
যুদ্ধ করতে হলে পাকবাহিনীকে খাল পার হতে হবে। তাই পূর্বেই মুক্তিযোদ্ধারা খালের ওপর নির্মিত সাঁকোর গোড়ায় এন্টি পারসোনাল মাইন ও দুটি বুবি ট্র্যাপ পুঁতে রাখেন। হানাদাররা সাঁকোর কাছে পৌঁছলে মাইন বিস্ফোরিত হয়। এতে অনেক পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। বেঁচে যাওয়া পাকসেনারা পিছু হটে পজিশন নিয়ে তুমুল গুলিবর্ষণ শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা জবাব দেন। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে তাঁরা নিকটবর্তী গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে আশ্রয় নেন।
পরের দিন ২০শে অক্টোবর সকাল ৮টার দিকে পাকিস্তানি সৈন্যরা পুনরায় সেখানে এসে প্রচণ্ড গুলি করতে শুরু করে। এ-সময় কমান্ডার মাহতাব এলএমজি এবং অন্য মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের অস্ত্রের মাধ্যমে পাল্টা গুলি করতে থাকেন। পূর্বের রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের স্থানে পেতে রাখা কয়েকটি ট্র্যাপে পড়ে বেশকিছু পাকিস্তানি সৈনিক প্রাণ হারায়। ফলে প্রতিশোধ গ্রহণকল্পে পাকিস্তানি বাহিনী ঐদিন মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি বৃষ্টির মতো গুলি করতে থাকে। এদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের গোলাবারুদ প্রায় ফুরিয়ে আসে। এদিন রাতে স্থানীয় বিএলএফ বাহিনী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যুক্ত হয়।
তৃতীয় দিন ২১শে অক্টোবর ভোরে পাকিস্তানি বাহিনী পুনরায় মুক্তিযোদ্ধাদের লক্ষ করে গুলি করতে শুরু করে। সকাল ১১টার দিকে মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুল্লাহর কোমরে গুলি লাগে। তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন। শত্রুদের আক্রমণের তীব্রতা ক্রমশ বাড়তে থাকে। বিকেল ৩টার দিকে পাকসেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের বলয়ে ঢুকে পড়লে মুক্তিযোদ্ধারা হাবিবুল্লাহকে ধানক্ষেতে রেখে পিছু হটেন। এ-সময় মুক্তিযোদ্ধা সানোয়ার পাকসেনাদের হাতে ধরা পড়েন। পাকসেনারা তাঁকে নির্মম নির্যাতনের পর হত্যা করে।
মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে থাকলে পাকবাহিনী দুদিক থেকে মাহতাব গ্রুপকে ঘিরে ফেলে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা কৌশলে সরে পড়তে সক্ষম হন এবং সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে ভুল বুঝাবুঝির কারণে সেমসাইড যুদ্ধে ৯৫ জন পাকসেনা নিহত হয়। এ-যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা এবং মাহতাব আহত হন। [অশোক বিশ্বাস]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড