You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.27 | হেঁয়াকো যুদ্ধ (ফটিকছড়ি, চট্টগ্রাম) - সংগ্রামের নোটবুক

হেঁয়াকো যুদ্ধ (ফটিকছড়ি, চট্টগ্রাম)

হেঁয়াকো যুদ্ধ (ফটিকছড়ি, চট্টগ্রাম) হেঁয়াকো ছিল মুক্তিযুদ্ধের সময় ১ নম্বর সেক্টরের মনুঘাট সাব-সেক্টরের অন্তর্গত একটি গুরুত্বপূর্ণ রণাঙ্গন। ১৯৭১ সালে এ রনাঙ্গণে পাকিস্তানি সৈন্যদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি বড় যুদ্ধ সংঘটিত হয়- একটি ২৭শে থেকে ৩০শে এপ্রিল এবং অন্যটি ২৭শে জুলাই।
হেঁয়াকো চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি উপজেলার অন্তর্গত একটি পাহাড়ী বাজার। এটি ফটিকছড়ি উপজেলা সদর থেকে ২০ কিলোমিটার উত্তরে এবং রামগড় থেকে ১৮ কিলোমিটার দক্ষিণে দুর্গম পাহাড়ী এলাকা। ভৌগোলিক ও সামরিক দিক থেকে এ স্থানটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ২০শে এপ্রিল পাকিস্তানি সৈন্যদের সঙ্গে ক্যাপ্টেন অলি আহমদের নেতৃত্বে প্রতিরোধযুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর (৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্টে) হাত থেকে মিরসরাইয়ের পতনের পর শত্রু সৈন্যরা মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর সকল দিক থেকে চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। প্রাথমিক প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে এপ্রিল মাসেই চট্টগ্রাম অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধারা (৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, অন্যান্য-আধা সামরিক বাহিনী ও এক সপ্তাহ সামরিক ট্রেনিংপ্রাপ্ত ছাত্র-জনতা ) মেজর জিয়ার নির্দেশে ভারতীয় সীমান্তবর্তী রামগড়ে অবস্থান নেন। এর ফলে রামগড় হয়ে ওঠে চট্টগ্রাম অঞ্চলের মুক্তিবাহিনীর অস্থায়ী সদর দপ্তর। শত্রুর হাত থেকে রামগড় মুক্ত রাখতে এবং সামরিক দিক থেকে হেঁয়াকোর অবস্থান ধরে রাখা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শত্রুর আক্রমণ থেকে রামগড় রক্ষা করার জন্যই মূলত করেরহাট-রামগড়ের মাঝামাঝি হেঁয়াকোতে মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করেন। অল্পদিনের মধ্যেই এ অবস্থানে ক্যাপ্টেন অলির নেতৃত্বে তুলাতুলি সেতুর নিকট অবস্থান নেয়া একটি দল ও ২ বেঙ্গল রেজিমেন্টের লেফটেন্যান্ট এজাজের নেতৃত্বে একটি কোম্পানি এসে সমবেত হয়। ২৫শে এপ্রিলের মধ্যে হেঁয়াকোতে ২য় ও ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্টসহ মুক্তিবাহিনীর ৪০০ সদস্য একত্রিত হয়ে এক শক্তিশালী প্রতিরক্ষা অবস্থান গড়ে তোলেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ভারতীয় সমর্থন, সামরিক সাহায্য ও কূটনৈতিক সহযোগিতার জন্য হেঁয়াকো হয়ে ভারতের অভ্যন্তরে যাতায়াত করা হতো। এছাড়াও মুক্তিবাহিনী এখানে একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রও পরিচালনা করত। এ স্থান দিয়েই ট্রাকে করে মুক্তিযোদ্ধারা পার্শবর্তী ভারত থেকে অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ পেত। তাই স্বল্প দিনের মধ্যেই হেঁয়াকো একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরোধ কেন্দ্রে পরিণত হয়। রামগড়ের অবস্থানকে রক্ষা করার জন্য মুক্তিবাহিনী হেঁয়াকোতে একটি প্রতিরোধব্যূহ রচনা করে।
২৫শে এপ্রিল পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে ক্যাপ্টেন অলির দখলে থাকা মুক্তিবাহিনীর করেরহাট অবস্থানের পতন ঘটে। এরপর শত্রুসৈন্যরা মুক্তিবাহিনীর রামগড় অবস্থান দখলের জন্য নাজির হাট-হেঁয়াকো-রামগড়, মীরসরাই-হেঁয়াকো-রামগড় এবং করের হাট, হেঁয়াকো রামগড় এই তিনটি এক্সিস ধরে রামগড়ের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। রামগড় দখল করা ছাড়াও তাদের উদ্দেশ্য ছিল করেরহাট-রামগড় সড়কের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো নিজেদের জন্য উন্মুক্ত ও নিরাপদ রাখা।
শত্রুসৈন্যরা যে-কোন সময় মুক্তিবাহিনীর হেঁয়াকো অবস্থান আক্রমণ করতে পারে এটা অনুমান করে পূর্ব থেকেই মুক্তিযোদ্ধারা প্রস্তুত ছিলেন। ২৭শে এপ্রিল পাকিস্তানি শত্রু বাহিনী ১০০ গজ দূরত্বের মধ্যে আসতেই মুক্তিযোদ্ধারা একযোগে তাদের ওপর আক্রমণ করেন। হঠাৎ প্রচণ্ড গোলাবর্ষণের ফলে শত্রুসৈন্যরা আতঙ্কগ্রস্থ ও ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। তবে অল্প সময়ের মধ্যে তারা পুনরায় সংগঠিত হয়ে দুই দিক থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর একযোগে প্রতিআক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধারাও অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে শত্রুসেনাদের আক্রমণ প্রতিহত করতে থাকেন। এতে অনেক পাকিস্তানি সৈন্য হতাহত হয়, তবে আস্তে আস্তে যুদ্ধের তীব্রতা বাড়তে থাকে। প্রায় দুই ঘন্টাব্যাপী প্রচণ্ড যুদ্ধে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাও হতাহত হন।
ইতিমধ্যেই পাকিস্তানি সৈন্যদের একটি দল নারায়ণহাট- হেঁয়াকো-রামগড় সড়ক ধরে অগ্রসর হয়ে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের দক্ষিণ দিকের খোলা মাঠ পেড়িয়ে তাদের নিজস্ব সৈন্যদের সঙ্গে যোগ দিয়ে শক্তি বৃদ্ধি করে। ২৯শে এপ্রিল ভোর বেলা শত্রুসৈন্যরা মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের ওপর মর্টারের সাহায্যে আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধারাও আক্রমণ প্রতিহত করে চলেন। ৩০শে এপ্রিল পাকিস্তানি সৈন্যরা পুনরায় মুক্তিযোদ্ধাদের হেঁয়াকো অবস্থানের ওপর আক্রমণ করে। এতে উভয় পক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। এ দিন পাকিস্তানি সৈন্যরা একটি নতুন রণকৌশল অবলম্বন করে। তারা প্রায় ২০০ স্থানীয় বাঙালিদেরকে মর্টার ও কামান ফায়ারের অগ্রভাগে মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে অগ্রসর হতে থাকে। তিনদিক থেকে তারা হেঁয়াকোর মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানকে ঘিরে ফেলে। মর্টার, কামান ও মেশিনগানের আক্রমণে হেঁয়াকো ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। শত্রুসেনাদের আক্রমণের ভয়াবহতায় মুক্তিযোদ্ধারা প্রাণপণে যুদ্ধ করেও হেঁয়াকো রক্ষা করতে ব্যর্থ হন। ৩০শে এপ্রিল বিকেলে পাকিস্তানি সৈন্যরা হেঁয়াকো দখল করে নেয়। মুক্তিযোদ্ধারা রণকৌশল পরিবর্তন করে চিকনছড়ার দিকে পিছিয়ে যান। প্রতিরোধযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের হটিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা হেঁয়াকোতে একটি শক্ত ঘাঁটি গড়ে তোলে।
হেঁয়াকো পতনের পর মুক্তিযোদ্ধাদের রামগড়ের প্রতিরক্ষা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। চট্টগ্রাম অঞ্চলের হাজার-হাজার শরণার্থী চট্টগ্রাম-ফটিকছড়ি-নারায়ণহাট-হেঁয়াকো-রামগড় এ পথ ধরে সীমান্ত পাড় হয়ে ভারতে যাতায়াত করত। হেঁয়াকো পতনের সঙ্গে-সঙ্গে ভারতে যাওয়ার এ গুরুত্বপূর্ণ পথটি বন্ধ হয়ে যায়। ভৌগোলিক ও সামরিক গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে জুলাই মাসে মুক্তিযোদ্ধারা হেঁয়াকোতে পাকিস্তানি অবস্থানের ওপরে আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। ২৭শে জুলাই লেফটেন্যান্ট এ ওয়াই এম মাহফুজুর রহমান, বীর বিক্রমএর নেতৃত্বে এক প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা হেঁয়াকোতে পাকিস্তানি সৈন্যদের ঘাঁটি অতর্কিত আক্রমণ করেন। হেঁয়াকো দুর্গম পাহাড়ি এলাকা এবং এটি ছিল পাকিস্তান সরকারের সহযোগী মিজো অধ্যুষিত। পাকিস্তানি সৈন্যরা সংখ্যায় ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের চেয়ে প্রায় তিনগুন বেশী। শত্রু সৈন্যরা কল্পনাও করতে পারেনি যে, হেঁয়াকোয় তাদের অবস্থানের ওপর এ ধরণের আক্রমণ হতে পারে। প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে ওঠে পাকিস্তানি সৈন্যরাও পাল্টা আক্রমণ করে। প্রায় ২০ মিনিট ধরে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে ৪ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়। এ ছাড়াও মুক্তিযোদ্ধাদের ছোড়া মর্টার শেলের আঘাতে তাদের বেশ কয়েকটি গাড়ি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। যুদ্ধ চলাকালীন এক পর্যায়ে পাকিস্তানি সৈন্য এবং তাদের পক্ষ নেয়া মিজোরা মুক্তিযোদ্ধাদের চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলে। লেফটেন্যান্ট মাহফুজের সাহসিকতা, তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত ও বুদ্ধিমত্তার ফলে মুক্তিযোদ্ধারা চরম বিপর্যয়ের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করেন। কোনো প্রকার ক্ষয়-ক্ষতি ছাড়াই মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদে তাঁদের ঘাঁটিতে ফিরে যেতে সক্ষম হন। [সাজাহান মিয়া]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড