হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরা বাহিনী (খাগড়াছড়ি সদর)
হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরা বাহিনী (খাগড়াছড়ি সদর) একটি স্থানীয় মুক্তিবাহিনী। মুক্তিযুদ্ধে এ বাহিনীর অবদান অনেক। বর্তমান পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষদের মধ্যে একটি অংশ মুক্তিযুদ্ধকালে বাঙালিদের সঙ্গে মিলে পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন কর্মকৌশল নির্ধারণ, অপারেশন পরিচালনা ও যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। অনেকে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেন। তাঁদের মধ্যে হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরা, মানিকছড়ির মং রাজা মং প্রু সেইন, রণবিক্রম কিশোর ত্রিপুরা, সুবোধ বিকাশ ত্রিপুরা, মনীষ দেওয়ান, চারু বিকাশ চাকমাসহ আরো অনেকের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মং রাজা মং প্রু সেইন ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। তিনি রণাঙ্গনে একাধিক যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্ব জনমত গঠনেও তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য একই সঙ্গে যাঁর নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়, তিনি হলেন হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরা।
মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি সর্বপ্রথম খাগড়াছড়িতে ১৬ জন যুবককে সংগঠিত করে একটি মুক্তিযোদ্ধা দল গঠনে উদ্যোগী হন। ৫ই মে ১নং সেক্টরের অধীনে পার্বত্য চট্টগ্রামের যুবকদের নিয়ে তাঁর নেতৃত্বে ২৫ সদস্যবিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা দল গঠন করা হয়। এটি পরবর্তীকালে একটি পূর্ণাঙ্গ কোম্পানি হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে এবং এ কোম্পানির কমান্ডার নিযুক্ত হন হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরা। এ কোম্পানির অধীনে গ্রুপ নং ৯১, ৯২, ৯৩, ৯৪ এবং ৯৫ সংযুক্ত করা হয়। উক্ত গ্রুপগুলোর ট্রেনিং হয়েছিল ভারতের অম্পিনগর এবং ১নং সেক্টর হেডকোয়ার্টার্স হরিণা এলাকায়। আগস্ট মাসের প্রথম দিকে ১নং সেক্টরের অধীনে হরিণা থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরবর্তী এলাকা ভারতের বৈষ্ণবপুরে সাব-সেক্টর স্থাপন করা হয়। সেখানে অবস্থানরত গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় গেরিলা আক্রমণ পরিচালনা করা হতো।
মুক্তিযুদ্ধকালে পার্বত্য জেলার খাগড়াছড়ি ছিল অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট। কারণ, এটি ছিল ভারতে প্রবেশের দ্বার। মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই চট্টগ্রাম থেকে রাঙ্গামাটি এবং সেখান থেকে নৌপথে মহালছড়ি হয়ে খাগড়াছড়ি প্রবেশ করেন। এ সময় মহালছড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য একটি লঙ্গরখানা ও সাংগঠনিক ক্যাম্প খোলা হয়৷ লঙ্গরখানার দায়িত্বে ছিলেন মহালছড়ির বীর মুক্তিযোদ্ধা মোবারক মাস্টার। ১লা এপ্রিল পার্বত্য চট্টগ্রামের কাপ্তাই ও চন্দ্রঘোনায় অস্ত্রের সরঞ্জাম ও গোলাবারুদ আসে। এপ্রিলের প্রথম দিক থেকে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ ও গেরিলা যুদ্ধ।
কমান্ডার হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরার গ্রুপটি পার্বত্য অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধাদের চলাচলের সুবিধার্থে এবং গেরিলা যুদ্ধের জন্য খাগড়াছড়ির নাকাপা, কুমারপাড়া (কুমারী), পাগলাপাড়া, মানিকছড়ি, ডাইনছড়ি, যোগ্যাছলা ও গাড়িটানা এলাকার গহীন অরণ্যে মুক্তিবাহিনীর গোপন ক্যাম্প বা আশ্রয়স্থল স্থাপন করে সেসব ক্যাম্পে ঐ এলাকার হেডম্যান ও কার্বারীসহ সকল স্তরের মানুষ খাদ্যশস্য সরবরাহ করত এবং পাকিস্তানি বাহিনীর গতিবিধি ও তাদের অবস্থান সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহ করত। ১৩ই আগস্ট বৈষ্ণবপুর বর্ডার দিয়ে বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি গ্রুপ রামগড়ে অবস্থানরত পাকিস্তানি ক্যাম্প আক্রমণ করে। এ অপারেশনে হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরার গ্রুপও অংশ নেয়। সেপ্টেম্বর মাসে মানিকছড়ি, ৭ই অক্টোবর যোগ্যাছলাতে এ গ্রুপ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে লিপ্ত হয়। তাঁরা নভেম্বর মাসে মানিকছড়িতে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি আক্রমণকে সফলতার সঙ্গে মোকাবেলা করেন। ৯ই ডিসেম্বর হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরার গ্রুপসহ মুক্তিযুদ্ধকালে ভারতের হাফলং-এ বিএসএফ-এর ট্রেনিংপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল গ্রুপ কমান্ডার নাজিম উদ্দিনের নেতৃত্বে কাউখালী উপজেলার অন্তর্গত বেতবুনিয়া ও বালুখালীতে গেরিলা অপারেশন পরিচালনা করে। এ-যুদ্ধে গ্রুপ কমান্ডার নাজিম উদ্দিন এবং মোহাম্মদ জাফর শহীদ হন। মুক্তিযোদ্ধা দল গঠন করার পর সুলতান আহমেদ, মোয়াজ্জেম হোসেন মাস্টার ও হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরার নেতৃত্বে আরো অনেক ত্রিপুরা ও মারমা মুক্তিযোদ্ধা রামগড়ের সেম্পুপাড়ায় ১০ই অক্টোবর পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এ-যুদ্ধে ১২ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত এবং ১৫-২০ জন আহত হয়। এছাড়াও পার্বত্য এলাকায় হাজার হাজার পরিবারের আশ্রয়স্থল ঠিক করতে, পথ দেখাতে, আশ্রয়স্থল পাহারা দিতে হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরার গ্রুপ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাঁর নেতৃত্বাধীন গ্রুপের কয়েকটি অপারেশনের মধ্যে মহামনি অপারেশন, ডাইনছড়ি অপারেশন, যোগ্যাছলা অপারেশন, পাতাছড়া অপারেশন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
রামগড়ের মহামুনি এলাকায় ঘাঁটি স্থাপন করেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সীমানা থেকে অনতিদূরে এ এলাকার অবস্থান বিধায় স্থানটি মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানি বাহিনী উভয়ের জন্য ছিল গুরুত্বপূর্ণ। অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে কমান্ডার হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরা তাঁর বাহিনীর সুদক্ষ যোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে ক্যাপ্টেন মাহফুজের নেতৃত্বে রামগড় মহামুনির দারোগাপাড়ায় অপারেশন পরিচালনা করেন। এ অপারেশনে পাকিস্তানি বাহিনীর একজন কর্নেলসহ ১৭ জন পাকসেনা নিহত ও অনেকে আহত হয়। এ দলে ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা রণবিক্রম ত্রিপুরা, চিত্তরঞ্জন কারবারী, মনীষ দেওয়ান, গৌরাঙ্গ মোহন দেওয়ান, সব্যসাচী মহাজন, সুবোধ বিকাশ ত্রিপুরা, নীল মোহন ত্রিপুরা, রনজিত দেব ত্রিপুরা, ভুবন ত্রিপুরা, ক্লাচান বর্মন, গমচন্দ্র ত্রিপুরা, বিজয় ত্রিপুরা, সুরেন্দ্র ত্রিপুরা, ব্রজেন্দ্র ত্রিপুরা প্রমুখ।
১০ই সেপ্টেম্বর কমান্ডার হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরার নেতৃত্বে মানিকছড়ির ডাইনছড়িতে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা আক্রমণ পরিচালিত হয়। ডাইনছড়ির গহীন অরণ্যে স্থাপিত মুক্তিযোদ্ধাদের গেলিরা ক্যাম্পে প্রায় ৮০ জন মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান করেছিলেন। সঙ্গে ছিলেন আলী আশরাফ ও অন্যান্যরা। এ-যুদ্ধে ১ জন ক্যাপ্টেনসহ ১২ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। সেখান থেকে নিরাপদে ক্যাম্পে ফিরে যান মুক্তিযোদ্ধারা। বিপর্যস্ত পাকিস্তানি সেনারা মারমা পাড়ায় অনেক বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয় এবং নারীদের নির্যাতন করে। ডাইনছড়ি অপারেশনে সফলতার পর মুক্তিযোদ্ধারা একের পর এক অভিযান চালিয়ে যেতে থাকেন। কমান্ডার হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরার ৯১নং গ্রুপ ৭ই অক্টোবর মানিকছড়ির যোগ্যাছলা এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন পরিচালনা করেন। এ গেরিলা দলে ছিলেন ৬০ জন মুক্তিযোদ্ধা। অপারেশনে মুক্তিযোদ্ধারা ৯ জন পাকিস্তানি সেনাকে হত্যা করেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় খাগড়াছড়ির পাতাছড়া ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। এ এলাকা পাকবাহিনীর দখলমুক্ত করার জন্য কমান্ডার হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরা বাহিনী, অং শোয়ে অং (জুলু বাবু) বাহিনী ও আলী আশরাফ বাহিনীর ৯০-৯৫ জন মুক্তিসেনা যৌথভাবে পরিকল্পনা করেন। সময়-সুযোগ বুঝে তিনটি দল একত্রিত হয়ে পাতাছড়া এলাকায় অপারেশন পরিচালনা করে। এতে পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিসেনাদের আক্রমণে টিকতে না পেরে মানিকছড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায়। এছাড়াও কমান্ডার হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরার নেতৃত্বে কালাপানি অপারেশন, দেওয়ান বাজার অপারেশন, রামশিরা অপারেশন সফলভাবে পরিচালিত হয়। ৮ই ডিসেম্বর রামগড় শত্রুমুক্ত হয়। পর্যায়ক্রমে তবলছড়ি, পানছড়ি ও ভাইবোনছড়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয় অর্জিত হয়। ১৫ই ডিসেম্বর খাগড়াছড়ি শত্রুমুক্ত হয়। ১৬ই ডিসেম্বর দীঘিনালায় মিজোরা হঠাৎ বিদ্রোহ করলে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ বাঁধে। মুক্তিসেনাদের হাতে এখানাকার যুদ্ধে প্রায় ৩০০ মিজো ও রাজাকার নিহত হয়। দীঘিনালা যুদ্ধে শত্রুবাহিনীকে পরাজিত করে মুক্তিযোদ্ধারা বিজয়ীর বেশে খাগড়াছড়ি ফিরে আসেন এবং খাগড়াছড়ি পুরোপুরি শত্রুমুক্ত ঘোষণা করা হয়। খাগড়াছড়িতে প্রথম পতাকা উত্তোলন করেন সুবোধ বিকাশ ত্রিপুরা।
মহান মুক্তিযুদ্ধে খাগড়াছড়ির ত্রিপুরা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। এজন্য ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীকে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের ব্যাপক রোষানলে পড়তে হয়। পাকহানাদাররা তাদের স্থানীয় দোসরদের নিয়ে ত্রিপুরা লোকালয়ে অনুপ্রবেশ করে তাদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালায় ও বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। বিশেষ করে খাগড়াছড়ি জেলার সদর থলিপাড়া, রামগড়, মানিকছড়ি, মহালছড়ি, পাতাছড়া, যোগ্যাছলা, হেয়াঁকো, মাটিরাঙ্গা, তৈলাইফাং, তবলছড়ি, তাইংন্দং অঞ্চল, পানছড়ির মদন কারবারী পাড়া, পূজগাং, লৌগাং, কালানাল প্রভৃতি ত্রিপুরা গ্রামে তারা অনুপ্রবেশ করে সম্পদ লুট, নির্যাতন, হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। এ সময় কমপক্ষে ১২ জন ত্রিপুরা যুবক পাকিস্তানি সেনাদের হাতে নিহত হয় এবং ৮ জনের অধিক নারী নির্যাতনের শিকার হন। মুক্তিযুদ্ধকালে ২০ হাজারের অধিক ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের অত্যাচারের শিকার হয়ে ভারতে শরণার্থী হতে বাধ্য হয়। [জগন্নাথ বড়ুয়া]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড