হালাবট রেলপথ অপারেশন (কুড়িগ্রাম সদর)
হালাবট রেলপথ অপারেশন (কুড়িগ্রাম সদর) পরিচালিত হয় ২০শে নভেম্বর। এতে বহু পাকসেনা নিহত হয়। অপরপক্ষে মুক্তিযোদ্ধাসহ বেশ কয়েকজন সাধারণ মানুষ শহীদ হন।
মানকার চর সাব-সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা কুড়িগ্রাম সদরের হালাবট এলাকায় অপারেশন পরিচালনা করেন। হালাবটের পূর্বদিকে সামান্য দূরে কুড়িগ্রাম-চিলমারী রেলসড়ক। রেলসড়কের আধামাইল দক্ষিণে অর্জুনের ডারা রেলব্রিজ। এই রেলপথেই পাকসেনারা তাদের রসদ নিয়ে নিয়মিত যোগাযোগ রাখত চিলমারী ও উলিপুরের সঙ্গে। সেখান থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে পাকসেনারা ১১নং সেক্টরের রৌমারী মুক্তাঞ্চলে মাঝে-মাঝে গুলি ছুড়ত। সে-কারণে ১১নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে এ ব্রিজটি ধ্বংস করা জরুরি ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা সে লক্ষ্যে একাধিকবার অভিযান পরিচালনা করেন। সর্বশেষ খায়রুল আলম কোম্পানির প্লাটুন কমান্ডার তাহমীদুর রহমান চাঁদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা ২০শে নভেম্বর রেললাইনে এন্টিট্যাংক মাইন পুঁতে পাশেই গোপনে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। ঐ সময় পাকিস্তানি সৈন্যরা গেরিলা আক্রমণের কারণে কৌশল হিসেবে ট্রেনের ইঞ্জিনের অগ্রভাগে বালুভর্তি কয়েকটি ওয়াগন সেট করে ট্রেন পরিচালনা করত। সকাল ৯টায় এরূপ একটি ট্রেন এগিয়ে এলে মুক্তিযোদ্ধারা ট্রেনের বালু ভর্তি ওয়াগন পার হওয়ার পর ডেটোনেটরের সাহায্যে বিস্ফোরণ ঘটালে পাকসেনা ভর্তি ট্রেনের বগি দুমড়ে-মুচড়ে যায়। ফলে পাকিস্তানিদের রসদসহ বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়। হালাবটের ঐ গেরিলা আক্রমণে পাকবাহিনীর ১৯ জন সৈন্য নিহত হয়। এ ঘটনার পর পাকবাহিনীর তৎপরতা ব্যাপক বৃদ্ধি পায়। তাহমীদুর রহমান চাঁদের কোম্পানি ১১নং সেক্টরে ফিরে যাওয়ার পর আব্দুল হাই কোম্পানি মোগলবাসা, বুড়াবুড়ি প্রভৃতি এলাকা থেকে পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ২৭শে নভেম্বর হাই কোম্পানির একটি ইউনিট কর্তৃক হালাবট এলাকায় রেললাইনে পুঁতে রাখা মাইন বিস্ফোরিত হলে পাকবাহিনীর রসদবাহী ট্রেন লাইনচ্যুত হয়। এরপর হালাবট এলাকার ডাকুয়া পাড়ায় পাকবাহিনী ঘরেঘরে তল্লাশি চালায়। তল্লাশিকালে আব্দুল হাই কোম্পানির সঙ্গে পাকবাহিনীর সম্মুখ যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে বিপুল সংখ্যক পাকসেনা নিহত হয়। এতে মোগলবাসার চেয়ারম্যান ইব্রাহিমের পুত্র মুক্তিযোদ্ধা নুর ইসলাম নুরু এবং ডাকুয়া পাড়ার অনির উদ্দিনসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা গুলির বাক্সসহ হানাদাদের হাতে ধরা পড়েন। পাকসেনারা তাদের বেয়নেট চার্জ ও গুলি করে হত্যা করে। আব্দুল আজিজ (পিতা বাচ্চু সরকার), নাদারু ও তার পুত্র হুজুর আলী দুলু, ইউসুফ আলী, জোনাব আলী (পিতা রহিম উদ্দিন), ওসমান, ছমির উদ্দিন (পিতা মংলু মামুদ) ও অপর একজন শহীদ হন এবং শিশুসহ কয়েকজন আহত হয়। বিপুল সংখ্যক পাকসেনা নিহত হওয়ার ক্ষোভে পাকসেনারা ৩রা ডিসেম্বর মোগলবাসা আক্রমণ করে শতশত ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয় এবং মুক্তিযোদ্ধাসহ ১৭ জন মানুষকে হত্যা করে। হালাবট অপারেশন মোগলবাসায় পাকিস্তানিদের তাণ্ডব সৃষ্টির কারণ হলেও ঐ অপারেশন মুক্তিযোদ্ধাদের দারুণভাবে উজ্জীবিত করে। [এস এম আব্রাহাম লিংকন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড