You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ২রা সেপ্টেম্বর, রোববার, ১৬ই ভাদ্র, ১৩৮০

জোট-নিরপেক্ষ গোষ্ঠীর সদস্যপদ দানের সুপারিশ প্রসঙ্গে

আগামী পাঁচই সেপ্টেম্বর আলজিয়ার্সে জোটনিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলন শুরু হচ্ছে। জোট নিরপেক্ষ দেশগুলির এটি চতুর্থ সম্মেলন। সম্মেলনের প্রস্তুতি পরিষদ এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার ৬ টি দেশকে জোট নিরপেক্ষ জাতিগোষ্ঠীর সদস্যপদ দানের প্রস্তাব করেছে। এই ছ’টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। এবারের চতুর্থ জোট নিরপেক্ষ সম্মেলন নানা কারণে উল্লেখযোগ্য। এবারের আলজিয়ার্স সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বয়ং উপস্থিত থাকবেন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতি হিসেবে জোট নিরপেক্ষতা ইতিমধ্যেই বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তাছাড়া, জোট নিরপেক্ষতা বাংলাদেশের একটি সাংবিধানিক নীতিও বটে। বাংলাদেশে এখনও জোট নিরপেক্ষ রাষ্ট্র বর্গের সদস্য পদ লাভ করেনি, সদস্যপদ দানের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে মাত্র। তবে বাংলাদেশ যে জোট নিরপেক্ষ রাষ্ট্র বর্গের সদস্যপদ লাভের সমর্থ হবে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। ইতিমধ্যে উপমহাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে বাংলাদেশের জোট নিরপেক্ষ ভূমিকা প্রমাণও অনেক পাওয়া যাবে। বাংলাদেশ যে জোট নিরপেক্ষতা নীতিকে বলিষ্ঠভাবে বাস্তবায়নের জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ তা বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিই প্রমাণ করে। আসন্ন আলজিয়ার্স সম্মেলনে বাংলাদেশকে যে জোট-নিরপেক্ষ রাষ্ট্রপতি এর সদস্য হিসেবে ঘোষণা করা হবে, তাতে আমরা সন্দেহ পোষণ করি না। বাংলাদেশের সদস্যপদ দানের জন্য প্রস্তুতি পরিষদের সুপারিশ করেছে, তাতে আমরা আনন্দিত হয়েছি। এবং এর ধারণা আমাদের বদ্ধমূল হয়েছে যে, বাংলাদেশের জোট নিরপেক্ষ নীতি আজ আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অঙ্গনে স্বীকৃতি পেয়েছে। বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ যে একটি বাস্তব সত্য, তা দিনে দিনে প্রমাণিত হচ্ছে। আসন্ন আলজিয়ার্স সম্মেলনে জোট-নিরপেক্ষ রাষ্ট্রবর্গের সদস্য ভুক্তি, বাংলাদেশের বাস্তবতা এবং পররাষ্ট্র নীতির একটি উজ্জ্বল স্বীকৃতি হিসেবেই চিহ্নিত হবে। বিশ্বের নিরপেক্ষ নীতির প্রতীক হিসেবে যেসব রাষ্ট্রনায়ক অন্যতম প্রধান ছিলেন, তাদের মধ্যে নেহেরু, নাসের, নক্রুমা ও সোয়েকার্ণো উল্লেখযোগ্য। জীবিতদের মধ্যে জোট নিরপেক্ষতার প্রতীক হিসাবে মার্শাল টিটো অন্যতম। এবারের আলজিয়ার্স সম্মেলনে প্রথমবারের মতো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যোগদান করছেন। জোট নিরপেক্ষ ভূমিকা অগ্রসেন হিসেবে এবার থেকে বঙ্গবন্ধুর নামটিও সংযোজিত হবে। সেইসঙ্গে বাংলাদেশের জোট নিরপেক্ষ নীতির জয়জয়কার ঘোষিত হবে বলেই আমাদের বিশ্বাস।

বস্ত্র সংকটঃ সমাধান বিলম্বিত হচ্ছে

এমনিতেই সারাদেশে বস্ত্র শংকর তার উপর নির্মীয়মান চারটি বস্ত্র নির্মাণ কাজ বন্ধ। কাজ চললে এই আগস্টেই দুটো আর আগামী অক্টোবরে আরো দুটো মিল উৎপাদনে যেত। কাপড় তৈরি হতো দেশি মিলে; পর্যাপ্ত না হলেও অন্তত এই চরম সঙ্কটের মুখে জনসাধারণের হাতে দু’চার টুকরো কাপড় পৌঁছাতো। কিন্তু সে সম্ভাবনার দ্বার রুদ্ধ হয়েছে, কবে নাগাদ এই মিলগুলোর অসমাপ্ত নির্মাণকাজ পুনরায় শুরু হবে তা কর্তৃপক্ষ নামক ঈশ্বরই বলতে পারেন।
আসলে শুধু বস্ত্র সংকট নয়, যে অভাব-অভিযোগ আর সমস্যাগুলো আজ নানা কারণে সংকটের রূপ নিয়েছে তার কোনোটিই সমাধানের জন্য দৃঢ়স্থির পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। চলছে, চলবে -এমনি করেই একদিন সংকট সমস্যার জটগুলো খুলতে থাকবে; যা পাওয়া যাবে জনসাধারণের হাতের কাছে যতটুকু মিলবে তা দিয়েই মোটামুটি চালিয়ে নেওয়া হবে। কোন উদ্যোগ নেই, কোন লক্ষ্য নেই -শুধুই চলা। এটা সমাজের যেমন একটা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মানসিকতা তেমনি একটা রক্তক্ষয়ী সংগ্রামোত্তর সরকারেরও চিন্তা-চেতনা। এভাবে চলতে থাকলে সব সমাধানই ঢিমে তালে এগুবে, বস্ত্র সংকটের সমাধান তো বটেই।
বস্ত্র শিল্প কর্পোরেশনের সূত্রে জানা গেছে, স্পিন্ডল মওজুত থাকা সত্ত্বেও শুধু মিলের নির্মাণকাজ বন্ধ থাকার জন্য তা বসানো যাচ্ছে না। মিলের নির্মাণকাজ বন্ধ রয়েছে কারণ বিল্ডিং নির্মাণ সরঞ্জামাদির অভাব। বস্ত্র শিল্প কর্পোরেশনই জানিয়েছেন যে, বিল্ডিং নির্মাণ সরঞ্জামাদি সরবরাহের জন্য সরকারি কর্তৃপক্ষকে বলা হয়েছিল। কিন্তু তারা গা করেননি। আজ পর্যন্ত জানা যায় নি কত দিন নাগাদ তারা কর্পোরেশনের তাগাদার দিকে নজর দেওয়ার ফুসরত পাবেন।
কাপড়ের কল এমনিতেই নেই বললেই চলে। স্বাধীনতার আগে বাঙ্গালীদের গায়ের কাপড় আসতো পাকিস্তান থেকে। স্বাধীনতার পর বাধ্য হয়েই ভারতসহ বিদেশ থেকে আমাদের কাপড় আনতে হচ্ছে। এটা সাময়িক ব্যবস্থাঃ সরকার তাই বলেছেন, আমরাও মেনে নিয়েছি। বলা হয়েছে যত শীঘ্র সম্ভব আমরা কাপড়ে স্বয়স্তরতা অর্জন করব। যতদিন না সুতো চাষ হচ্ছে প্রয়োজনীয় পরিমাণ ততদিন সুতোর জন্যই শুধু বিদেশের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে আমাদের। এর মধ্যে তাঁত এবং বস্ত্র শিল্প গড়ে তোলা হবে দেশের চাহিদার দিকে নজর রেখে। কিন্তু শুরুতেই যে কর্ম তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে তাতে খুব একটা আশাবাদী হবার কোন কারণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। তাঁতের সত্যিকার হিসেব পেতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। তারপর তার সম্প্রসারণঃ বস্ত্রমিল নির্মাণের শুরুতেই গড়িমসি। এসবের অবসান না হলে, একটা আন্দোলন হিসেবে বস্ত্র সংকট সমাধানের ব্যাপারটা গ্রহণ না করলে স্বনির্ভরতা অর্জনের আশা ফিকে হয়ে আসবে, আরে বহুদিন পরনির্ভরতা চলতে থাকবে।

খনিজ সম্পদ আহরণ

গত শুক্রবার বাংলাদেশ ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। বাংলাদেশের সমুদ্র সৈকত থেকে খনিজ সম্পদ আহরণের জন্য কক্সবাজারে একটি পাইলট প্রকল্প স্থাপনের নিমিত্তে এই চুক্তিটি স্বাক্ষর হয়। উল্লিখিত চুক্তি অনুযায়ী প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশকে এক লাখ পঁয়তাল্লিশ হাজার অস্ট্রেলিয়া ডলার মূল্যের সরঞ্জামসহ বিশেষজ্ঞ দিয়ে এবং সংশ্লিষ্ট কর্মীদের প্রশিক্ষণ দান করে সাহায্য করবে। অপরদিকে বাংলাদেশ এ প্রকল্প বাস্তবায়নের স্থান নির্ধারণ, প্রকল্পের প্রস্তুতি নকশা তৈরি, নির্মাণকাজ এবং প্রকল্পের স্থাপন ও চালু করা বাবদ যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করবে।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য যে, বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশন বিগত ১৯৬১ সালের এক ভূতাত্ত্বিক জরিপ চালিয়ে কক্সবাজার ও অদূরবর্তী দ্বীপ গুলোর সমুদ্র সৈকতের বালিরাশিতে প্রচুর পরিমাণে খনিজ সম্পদ রুটাইল, ইলমেনাইট, জিরকন, ম্যাগনেটাইট ও মোনাজাইট ইত্যাদি রয়েছে বলে লক্ষ্য করেন। অস্ট্রেলিয়া সরকারও গত বছর এই খনিজ সম্পদ আহরণের সম্ভবতা সম্পর্কে জরিপ চালিয়ে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে এ সম্পর্কে একটি রিপোর্ট বাংলাদেশ সরকারের কাছে পেশ করেছেন এবং সেই রিপোর্টে সম্পদ আহরণের জন্য ষাট থেকে সত্তর মাইল এলাকাজুড়ে একটি পাইলট প্রকল্প স্থাপনের সুপারিশ করেন। আরো উল্লেখ্য যে, সমুদ্র সৈকতের বালিরাশিতে ম্যাগনেটাইট নামক যে খনিজ সম্পদ রয়েছে তা ধাতব লোহা উৎপাদন ও কয়লা পরিশোধন প্রকল্পে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে কাজে আসবে। অন্যান্য খনিজ সম্পদের মধ্যে ইলমেনাইট, রুটাইল, জিরকন প্রভৃতিকে দ্রব্যাদি তৈরীর কাজে লাগানো যাবে। এছাড়া মোনাজাইট থেকে যে থোরিয়াম পাওয়া যাবে তা আণবিক চুল্লি জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হ’তে পারে বলে বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন। বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান সাহেবের দেয়া তথ্য অনুসারে সেখানকার তিন বর্গমাইল এলাকায় তিন লাখ টন খনিজ পেয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এবং তা থেকে বাংলাদেশে ষাট লাখ ডলার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারবে। কবিরা বলেছেন, এদেশ সোনার দেশ, এদেশের মাটি সোনা ফলায়, এদেশ সোনার বাংলাদেশ। এদেশের প্রকৃতির অপরূপ রূপ মাধুর্য এবং এদেশের সোনালী আঁশ ও সোনা রঙ ফসলের সম্ভারকে দেখেই হয়তো কবিরা কল্পনার রং তুলি দিয়ে অনুভবের প্রচ্ছায়ায় এদেশকে সোনার দেশ বলে উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু তাই বলে তাদের উক্তি মিথ্যা হয়নি। বিজ্ঞানীরা তাদের নিষ্ঠুর বাস্তবতা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকেও নিরীক্ষা করে দেখেছেন সত্যিই এদেশের মাটিতে সোনা ফলে। কেননা এদেশের জলে-স্থলে সর্বত্র রয়েছে অনেক অনেক সম্পদ। কিন্তু সেই সম্পদ এতদিন আবিষ্কৃত হয়নি, আবিষ্কারের কোন প্রচেষ্টা চালানো হয়নি এবং এ কারণেই হয়তো স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে হানাদাররা এদেশের মানুষকে চায়নি, চেয়েছিল শুধু এদেশের মাটিকে।
বঙ্গবন্ধুর সরকার বিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের মধ্যে হাজারো সমস্যা থাকা সত্ত্বেও বাংলার মাটিতে ছড়িয়ে থাকা সম্পদ আহরণের জন্য বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করেছেন। আর এই প্রকল্প গুলো বাস্তবায়নে বন্ধু দেশগুলোও তাদের বন্ধুত্বের হাত প্রসারিত করে এগিয়ে আসছেন। আমাদের বিশ্বাস, বঙ্গবন্ধুর সরকারের গৃহীত এ ধরনের বাস্তবমুখী প্রকল্পগুলোর যথাযথভাবে সঠিক সময়ের মধ্যে বাস্তবায়িত হয় এদেশকে সোনার দেশে পরিণত করবে। এবং আমাদের সেটাই আন্তরিক প্রত্যাশা।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!