বীর বিক্রম হেমায়েত উদ্দিন
হেমায়েত উদ্দিন, বীর বিক্রম (১৯৪১-২০১৬) বীর মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৪১ সালের ৩রা ডিসেম্বর গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া উপজেলার টুপারিয়া গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মুন্সি আবদুল করিম এবং মাতার নাম সকিনা বেগম। ৮ম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত অবস্থায় ১৯৫৯ সালে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। তারপর চাকরিরত অবস্থায় ইন্টারমিডিয়েট পাস করে বারো বছরের মধ্যে তিনি জু4নিয়র অফিসার পদ লাভ করেন (ওয়ারেন্ট অফিসার)। এ সময় তিনি পাকিস্তানের এবোটাবাদস্থ আর্মি স্কুল অব মিউজিক-এ প্রশিক্ষকের দায়িত্বে ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ-এর পর ৯ই মার্চ ছুটি নিয়ে তিনি দেশে আসেন এবং ১৪ই মার্চ জয়দেবপুর সেনানীবাসের ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগদান করেন।
২৮শে মার্চ জয়দেবপুর সেনানীবাসে বিদ্রোহ করে হেমায়েত উদ্দিন বেশ কয়েকজন পাকসেনাকে হত্যা করেন। এরপর স্থানীয় শ্রমিক নেতা এম এ মোতালিবের সহায়তায় অস্ত্রাগার দখল করেন। অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে কাপাসিয়ার মাত্রা হাইস্কুল মাঠে বিভিন্ন জেলার লোকজন সমন্বয়ে তিনদিনের একটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প করেন। প্রত্যেককে কিছু অস্ত্র দিয়ে স্ব-স্ব এলাকায় চলে যাওয়ার জন্য বলেন। এ-সময় শাহআলম, ইব্রাহিম খান প্রমুখকে নিয়ে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করেন। কাপাসিয়া, বরমী, কাওরাইদ রেলব্রিজ, কালিয়াকৈর প্রভৃতি এলাকায় স্বল্পকালীন ক্যাম্প স্থাপন করে পাকবাহিনীকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখেন। এ-সময় সেমসাইডের কারণে তাঁর দলের ডিএসপি আবদুস সবুর শহীদ হন। কালিয়াকৈরে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে একটি যুদ্ধ হয় এবং তাতে ৪ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ল্যান্স নায়েক আলম, আইয়ুব, ওয়াজেদ ও ইব্রাহিম খানসহ বারোজনকে সঙ্গে নিয়ে ১৬ই এপ্রিল তিনি ফরিদপুর পৌঁছান। সেখানে কে এম ওবায়দুর রহমান এমএনএ, ইমাম উদ্দিন আহমেদ এমপিএ, আওয়ামী লীগ নেতা ফিরোজ মাস্টার প্রমুখের সহায়তায় তিনি ডাকবাংলোয় ক্যাম্প স্থাপন করেন। পাকসেনারা ২০শে এপ্রিল গোয়ালন্দ দখল করলে তিনি ২১শে এপ্রিল ফরিদপুর পুলিশ লাইনস দখল করে এর অস্ত্র ও গোলাবারুদ স্থানীয় ছাত্র-জনতার মধ্যে বণ্টন করে দেন। অসহযোগিতা করায় জেলা প্রশাসক আ ন ম ইউসুফ এবং পুলিশ সুপার নূরুল মোমেনকে গ্রেফতার করে মাদারীপুর পাঠিয়ে দেন। হেমায়েত উদ্দিন ২৮শে এপ্রিল ইব্রাহিম খান ও মোজাহিদসহ কোটালীপাড়ায় নিজ বাড়িতে পৌঁছান। ৯ই মে তিনি নিজে পাকসেনা ক্যাপ্টেন সেজে মাত্র দুজন সহকারী ইব্রাহিম খান ও সোলেমানকে সঙ্গে নিয়ে কোটালীপাড়া থানা দখল করেন। থানা দখলের ফলে প্রচুর অস্ত্র তাঁর হস্তগত হয়। স্থানীয় আওয়ামী লীগ সভাপতি চিত্তরঞ্জন গাইন এবং আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের সহায়তায় ছুটিতে আসা সেনাসদস্যদের নিয়ে কোটালীপাড়ায় ক্যাম্প স্থাপন করেন। এ-সময় তিনি ‘মেজর’ উপাধি গ্রহণ করেন এবং তাঁর নেতৃত্বে হেমায়েত বাহিনী-র আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। নবম সেক্টরের একটি বিশাল এলাকা জুড়ে ছিল এ বাহিনীর কর্মকাণ্ড।
যুদ্ধকালীন সময়ে হেমায়েত উদ্দিন অনেকগুলো সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেন, যার মধ্যে ১৪ই জুলাই সংঘটিত রামশীলের যুদ্ধ – বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁর তৎপরতায় ৩রা ডিসেম্বর কোটালীপাড়া ও টুঙ্গিপাড়া এবং ৬ই ডিসেম্বর গোপালগঞ্জ মহকুমা হানাদারমুক্ত হয়।
মহান মুক্তিযুদ্ধে সাহসিকতাপূর্ণ অবদানের জন্য হেমায়েত উদ্দিনকে ‘বীর বিক্রম’ খেতাবে ভূষিত করা হয়। তাঁর নামে ঢাকার মিরপুর ১ নম্বর গোলচক্কর থেকে চিড়িয়াখানা পর্যন্ত রাস্তা এবং কোটলীপাড়ার একটি ব্রিজের নামকরণ করা হয়েছে। এছাড়া কোটালীপাড়ায় নির্মিত হয়েছে হেমায়েত বাহিনী স্মৃতি জাদুঘর। তের সন্তানের জনক হেমায়েত উদ্দিন, বীর বিক্রম ২২শে অক্টোবর ২০১৬ মৃত্যুবরণ করেন। [হারুন-অর-রশিদ]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড