You dont have javascript enabled! Please enable it! স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা অন্যতম বৃহৎ মুক্তিবাহিনী 'হেমায়েত বাহিনী' (কোটালীপাড়া, গোপালগঞ্জ) - সংগ্রামের নোটবুক

স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা অন্যতম বৃহৎ মুক্তিবাহিনী ‘হেমায়েত বাহিনী’ (কোটালীপাড়া, গোপালগঞ্জ)

হেমায়েত বাহিনী (কোটালীপাড়া, গোপালগঞ্জ) মুক্তিযুদ্ধকালে স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা অন্যতম বৃহৎ মুক্তিবাহিনী। মুক্তিযোদ্ধা হেমায়েত উদ্দিন, বীর বিক্রম সেনাবাহিনীর কতিপয়সৈনিক এবং স্থানীয় ছাত্র-যুবকদের নিয়ে এ বাহিনী গঠন করেন। ১৫ই মে গৌরনদীর বাট্টা হাইস্কুল মাঠে আসমত আলী খান এমপিএ, হরনাত বাইন এমপিএ এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দসহ হাজারো জনতার উপস্থিতিতে এ বাহিনীর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। এ-সময় হেমায়েত উদ্দিন নিজে ‘মেজর’ উপাধি গ্রহণ করেন। নিম্ন অঞ্চল হিসেবে পরিচিত কোটালীপাড়ার জহরের কান্দি হাইস্কুল মাঠে প্রথম এ বাহিনীর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট জবেদ আলী এবং ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের সদস্য আবদুল খালেক এ ক্যাম্পের দায়িত্ব পালন করেন। এ ক্যাম্পে প্রায় সাড়ে তিন হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। স্থানীয় নারিকেলবাড়ি মিশনে নারীদের জন্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খোলা হয়। ডা. লালমোহন বৈদ্য এবং আশালতা বৈদ্য এ ক্যাম্পের দায়িত্ব পালন করেন। প্রথমে এখানে ৬৫ জন নারীকে প্রশিক্ষণ দানের ব্যবস্থা করা হয়। পরবর্তীতে প্রায় তিন শতাধিক নারী এখানে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ৪২টি গ্রুপে বিভক্ত হেমায়েত বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে সমস্ত কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতেন। নবম সেক্টরের অধীন কোটালীপাড়া, টুঙ্গিপাড়া, গোপালগঞ্জ, কাশিয়ানী, মোকসেদপুর, ভাঙ্গা, শিবচর, মাদারীপুর, গোসাইরহাট, রাজৈর, কালকিনি, গৌরনদী, আগৈলঝাড়া, উজিরপুর, স্বরূপকাঠী, নাজিরপুর, মোল্লারহাট, কালিয়া প্রভৃতি এলাকায় হেমায়েত বাহিনীর তৎপরতা ছিল।
হেমায়েত উদ্দিন ছাড়াও তাঁর বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন মকবুল হোসেন দাড়িয়া (গ্রুপ কমান্ডার), শেখ আবদুল খালেক (ট্রেনিং কমান্ডার), আবদুল জলিল দাড়িয়া (সহকারী কমান্ডার), শাজাহান শিকদার (সহকারী গ্রুপ কমান্ডার), কামাল আহমেদ (সহকারী কমান্ডার), ফরমান আলী শেখ (সহকারী কমান্ডার), মো. ময়ুর আলী শেখ (সহকারী কমান্ডার), মোরশেদ আল তালুদার (সহকারী কমান্ডার), মো. খোকন সরদার (সহকারী কমান্ডার), আইয়ুব আলী শিকদার (সহকারী কমান্ডার), মেজর সেলিম, ইব্রাহিম খান, সৈয়দ মনিরুল ইসলাম সেন্টু, ছলেমান, আবদুল হাকিম বিশ্বাস, মন্মথ সিকদার, কমলেশ চন্দ্র বৈদজ্ঞ, আতিয়ার রহমান মোল্লা, হায়েত মিয়া, বাহার তালুকদার, কাজী আশরাফুজ্জামান প্রমুখ। এঁদের অনেকেই ভারত থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিলেন।
প্রায় ১০০০ সদস্য নিয়ে গঠিত হেমায়েত বাহিনীর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো এর নারী বাহিনী গঠন। এ বাহিনীতে প্রশিক্ষিত তিন শতাধিক নারী মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন— আশালতা বৈদ্য (পিতা হরিপদ বৈদ্য, লাটেংগা, কোটালীপাড়া), তাহমিনা খানম (কুশালা, কোটালীপাড়া), মনা রাণী ব্যানার্জী (পয়সার হাট, আগৈলঝাড়া), মোমেলা খাতুন (সোনারগেতি, কোটালীপাড়া), পুষ্প রাণী হালদার (পিতা রমেশ চন্দ্র হালদার, আগরকান্দা, কোটালীপাড়া), মঞ্জু রাণী হালদার (রাজিহার, গৌরনদী), কানন বালা বণিক ধর্মান্তরিত নাম নাজমা বেগম (পিতা জগবন্ধু, ভাজনন্দি, মোকসেদপুর), অঞ্জলি চৌধুরী (পিতা অধর চৌধুরী, খাগবাড়ি, কোটালীপাড়া) প্রমুখ। এসকল নারী কোটালীপাড়ার নারিকেলবাড়ি মিশনে সংক্ষিপ্ত নার্সিং প্রশিক্ষণ শেষে জহরের কান্দি হাইস্কুল কেন্দ্রে নিয়মিত অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিতেন।
হেমায়েত বাহিনী অনেকগুলো সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেয়। সেগুলো হলো— কোটালীপাড়া থানা আক্রমণ- (৯ই মে, ৪ঠা জুন, ১৪ই জুন, ৩০শে জুন, ৩রা ডিসেম্বর), গোপালগঞ্জ যুদ্ধ (১১ই মে), পয়সার হাট যুদ্ধ (২১শে মে), চান্দেরহাট যুদ্ধ (২৯শে মে), মাটিভাঙ্গা যুদ্ধ (৮ই জুন), বাঁশবাড়িয়ার যুদ্ধ (২৪শে জুন), রামশীলের যুদ্ধ (১৪ই জুলাই), কুরপালা যুদ্ধ (৬ই সেপ্টেম্বর), চৌধুরী হাটখোলা যুদ্ধ (১৩ই সেপ্টেম্বর), টিহটি মিয়ার হাট যুদ্ধ (১৮ই সেপ্টেম্বর), শিকির বাজার যুদ্ধ (৪ঠা অক্টোবর), জলির পাড় যুদ্ধ এবং ভাটিয়াপাড়া ওয়ারলেস সেন্টার যুদ্ধ (৬ই নভেম্বর)। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ১৪ই জুলাই সংঘটিত রামশীলের যুদ্ধ। এ-যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা হাবিলদার মকবুল শহীদ হন এবং ১৫৮ জন পাকসেনা ও রাজাকার নিহত হয়। হেমায়েত বাহিনীর তৎপরতায় ৩রা ডিসেম্বর কোটালীপাড়া ও টুঙ্গীপাড়া থানা এবং ৬ই ডিসেম্বর গোপালগঞ্জ মহকুমা হানাদারমুক্ত হয়।
হেমায়েত বাহিনী সম্পূর্ণ সামরিক কায়দায় পরিচালিত হতো। প্রত্যেক গ্রুপের সঙ্গে প্রশাসনিক ইউনিট, বিচার ব্যবস্থা, গোয়েন্দা ইউনিট, রেকি পার্টি, খাদ্য সরবরাহ টিম, চিকিৎসা সেবা টিম এবং নৌকা বাহিনী ছিল। পানিকবলিত অঞ্চল হওয়ায় নৌকা ছিল হেমায়েত বাহিনীর যোদ্ধাদের চলাচলের প্রধান মাধ্যম। তাঁদের নৌবহরে ৩৫০টি নৌকা ছিল। নৌকার মাঝি এবং গরিব মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়মিত বেতন দেয়া হতো।
মহান মুক্তিযুদ্ধে সাহসিকতাপূর্ণ অবদানের জন্য হেমায়েত বাহিনীর প্রধান হেমায়েত উদ্দিনকে ‘বীর বিক্রম’ খেতাবে ভূষিত করা হয়। [হারুন-অর-রশিদ]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড