বীর প্রতীক হোসেন আলী তালুকদার
হোসেন আলী তালুকদার, বীর প্রতীক (জন্ম ১৯৪০) সুবেদার ও বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৪০ সালের ১লা জুলাই সিরাজগঞ্জ জেলার কামারখন্দ উপজেলার জামতৈল ইউনিয়নের চরদশসিকা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম সাবের হোসেন তালুকদার এবং মাতার নাম সাকেরা খাতুন। ৪ ভাই ও ৪ বোনের মধ্যে হোসেন আলী তালুকদার সবার বড়। তিনি জামতৈল ধোপাকান্দি হাইস্কুলে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেন।
হোসেন আলী তালুকদার ১৯৫৮ সালের ১৮ই অক্টোবর পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। ১৯৭১ সালে তিনি ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধীনে যশোর সেনানিবাসে কর্মরত ছিলেন। ৩০শে মার্চ যশোর সেনানিবাসে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দ্বারা আক্রান্ত হলে তিনি ক্যাপ্টেন হাফিজ উদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে বিদ্রোহ করে চৌগাছায় চলে যান। অতঃপর তিনি যশোরের বেনাপোল, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া প্রভৃতি স্থানে সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এরপর ভারতে গিয়ে তিনি ‘জেড’ ফোর্সের প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টে অন্তর্ভুক্ত হন। এ রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার মেজর জিয়াউদ্দিনের নেতৃত্বে কোম্পানি কমান্ডার ক্যাপ্টেন হাফিজ উদ্দিন আহমেদের অধীনে জামালপুর জেলার ধানুয়া-কামালপুর, হবিগঞ্জ, কানাইঘাট, শ্রীমঙ্গল, সিলেটের এম সি কলেজসহ বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। সিলেটের এম সি কলেজে স্থাপিত পাকবাহিনীর ঘাঁটি আক্রমণ ছিল তাঁর যুদ্ধকালীন সময়ে সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনা। এম সি কলেজে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী একটি শক্তিশালী ঘাঁটি স্থাপন করে। ১৪ই ডিসেম্বর কোম্পানি কমান্ডারের নির্দেশে হোসেন আলী তালুকদার তাঁর সহযোদ্ধাদের নিয়ে এটি আক্রমণ করার জন্য অগ্রসর হন এবং তাঁরা পাকবাহিনীর ঘাঁটি থেকে মাত্র পাঁচশ গজ দূরত্বে অবস্থান নিয়ে টিলার ওপর বাঙ্কার খনন করতে থাকেন। হঠাৎ সেখানে পাকবাহিনীর আর্টিলারি গানবাহী একটি গাড়ি ও দুটি জিপ ভর্তি পাকিস্তানি সৈন্য চলে এলে মুক্তিযোদ্ধারা সঙ্গে-সঙ্গে তাদের ওপর গোলাবর্ষণ শুরু করেন এতে মুহূর্তেই পাকবাহিনীর কামানবাহী গাড়ি ও জিপে আগুন ধরে যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের এ অতর্কিত আক্রমণে পাকিস্তানি সৈন্যরা দিশেহারা হয়ে দৌড়াদৌড়ি শুরু করে। ঠিক সেই মুহূর্তে হোসেন আলী তালুকদার ও তাঁর সহযোদ্ধারা পাকবাহিনীর ওপর মেশিনগান ও অন্যান্য অস্ত্র থেকে গোলাবর্ষণ করতে থাকেন। এতে ২০-২৫ জন পাকসেনা হতাহত হয়। পরে পাকবাহিনী আরো শক্তি সঞ্চয় করে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। মুক্তিযোদ্ধারাও তুমুল বেগে পাল্টা আক্রমণ চালান। এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র আক্রমণে টিকতে না পেরে পাকবাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে সিলেট শহরে তাদের মূল ঘাঁটির দিকে পালিয়ে যায়। এ-যুদ্ধে শতাধিক পাকসেনা নিহত ও ২৫-৩০ জন আহত হয়। অপরদিকে ২০ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ এবং ২২-২৩ জন আহত হন।
মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদান রাখায় বাংলাদেশ সরকার হোসেন আলী তালুকদারকে ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করে। তিনি ১৯৮১ সালে সেনাবাহিনীর চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তাঁর স্ত্রীর নাম মোছা. সুফিয়া বেগম। এ দম্পতি ২ কন্যা ও ২ পুত্র সন্তানের জনক-জননী। [শফিউদ্দিন তালুকদার]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড