You dont have javascript enabled! Please enable it!

হারবার জেটি বধ্যভূমি (মংলা, বাগেরহাট)

হারবার জেটি বধ্যভূমি (মংলা, বাগেরহাট) বাগেরহাট জেলার মংলা উপজেলার অন্তর্গত মংলা বন্দরের নৌবাহিনী গেটের নিকটবর্তী সিগনাল টাওয়ার এলাকায় পশুর নদীর পূর্বতীরে অবস্থিত ছিল। বর্তমানে এটি অস্তিত্বহীন। এখানকার একজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি ছিলেন ইসমাঈল সাহেব।
তাঁর কয়েকটি মিলস ছিল। এ-কারণে এটি ‘ইসমাঈলের জেটি’ নামেও পরিচিত ছিল। যুদ্ধের সময় এখানেই থাকত হারবার মাস্টার আয়ুব আলী রাজাকার-, তার ছেলে ও সহযোগীরা। এদের সহায়তায় পাকসেনারা অনেক লোককে এ জেটিতে হত্যা করে নদীতে ফেলে দেয়। যারা পাকবাহিনীর গণহত্যার শিকার হন, তাদের অধিকাংশ ছিলেন চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী এলাকার বন্দর শ্রমিক। তারা আওয়ামী লীগএর শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তাদের অনেকেরই পরিচয় পাওয়া যায়নি। স্বাধীনতার পরে এখানে একটি পুকুর খনন কালে বেশ কয়েকটি মাথার খুলি পাওয়া যায়, যা নিকটস্থ কবরস্থানে মাটিচাপা দেয়া হয়। তৎকালীন শ্রমিক নেতা চট্টগ্রামের সৈয়দ আলী সরদার এবং শরণখোলার বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা আলী কেরানীকে এ বধ্যভূমিতে হত্যা করা হয়। অন্য একজন হলেন বৈদ্যমারী গ্রামের মোহাম্মদ আব্দুল কুদ্দুস। তিনি বৈদ্যমারী ক্যাম্পে ট্রেনিংপ্রাপ্ত একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। ১৬ই অক্টোবর মুজিব বাহিনী র বৈদ্যমারী ক্যাম্পের কমান্ডার শেখ আব্দুল জলিল তাঁকে একটি চিঠি দিয়ে তা কালেখার বেড়ে অবস্থিত কমান্ডার আফজালের নিকট পৌছে দিতে বলেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি বৈদ্যমারী থেকে নৌকায় করে আসার পথে মিঠেখালী এলাকায় পাবাহিনী ও রাজাকারদের দালালদের হাতে ধরা পড়েন বিপদ বুঝে তিনি নৌকাসহ ধানক্ষেতে লুকিয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে দালালরা তাঁর অবস্থান বুঝতে পেরে নিকটে চলে আসে। তিনি সঙ্গে-সঙ্গে আব্দুল জলিলের চিঠিখানা মুখে গিলে ফেলেন এবং কাছে থাকা গ্রেনেডটি নৌকা থেকে পানিতে ফেলে দেন। দালালরা তা দেখে ফেলে এবং তাঁকে ধরে সেখান ক্যাম্পে নিয়ে যায়। এরপর রাজাকাররা তাঁকে রামপাল ক্যাম্প থেকে মংলাগামী গানবোটে পাকবাহিনীর হাতে তুলে দেয়। মংলায় এনে আরো দশজনের সঙ্গে তাঁর ওপর নির্মম নির্যাতন চালানো হয়। তাঁদের মধ্যে কালেখার বেড়ের দুজন, কৈলাশগঞ্জের দুজন এবং তেঁতুলবাড়িয়ার একজন ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রও ছিল। আব্দুল কুদ্দুসকে সেদিন গানবোটের ওপর রোদের মধ্যে চিত করে শুইয়ে রেখে অত্যন্ত অমানবিকভাবে দুজনকে হত্যা করার দৃশ্য প্রত্যক্ষ করানো হয়।
৩০শে অক্টোবর রাতে আরো ৮জনসহ আব্দুল কুদ্দুসকে হারবার জেটিতে নিয়ে যাওয়া হয়। পরনের লুঙ্গি খুলে তা দিয়ে সকলের চোখ বেঁধে কাঠের পুলের ওপর (বর্তমান কংক্রিটের পুল) সারি করে বসিয়ে গুলি করা হয়। পরের দিন সকালে আব্দুল কুদ্দুস নিজেকে আবিষ্কার করেন কাইনমারীর দক্ষিণচরে জনৈক হাসেম মিয়ার বাড়িতে। হাসেম মিয়ার স্ত্রীর সেবাযত্নে তিনি জ্ঞান ফিরে পান। একটি গুলি তাঁর গলার পাশ দিয়ে বের হয়ে গিয়েছিল। স্বাধীনতার পূর্ব পর্যন্ত খুলনা নিউজপ্রিন্টের এক ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে এবং স্বাধীনতার পরে ঢাকার পি জি হাসপাতালে তাঁর চিকিৎসা হয়।
মোহাম্মদ আব্দুল কুদ্দুসের মতে, মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে হারবার জেটি বধ্যভূমিতে কয়েক হাজার লোককে হত্যা করা হয়। বর্তমানে বধ্যভূমিটির চিহ্ন আর নেই। নদীর গতি পরিবর্তনের কারণে ঐ এলাকা ভরাট হয়ে যাওয়ায় সেখানে এখন জনবসতি গড়ে উঠেছে। স্থানীয় লোকদের ধারণা, জেটির আশপাশে খনন করা হলে এখনো অনেক শহীদের কঙ্কাল উদ্ধার হবে। [মনোজ কান্তি বিশ্বাস]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!