You dont have javascript enabled! Please enable it! বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান - সংগ্রামের নোটবুক

বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান

হামিদুর রহমান, বীরশ্রেষ্ঠ (১৯৫৩-১৯৭১) সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় খেতাব প্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি হবিগঞ্জ জেলার কমলগঞ্জ থানার অন্তর্গত ধলই সীমান্ত ঘাঁটি দখলের যুদ্ধে শত্রুর গুলিতে শহীদ হন। ১৯৫৩ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর উপজেলার খর্দ্দ খালিশপুর গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আক্কাস আলী ও মাতা কায়েছুন্নেছা। তাঁদের পরিবারের আদি নিবাস ছিল পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার চাপড়ার ডুমুরিয়া গ্রামে। ভারত বিভাগের পর তাঁর পিতা এদেশে চলে আসেন।
আর্থিক অভাব-অনটনের মধ্যে হামিদুরের শৈশব কাটে। পিতা কাঠমিস্ত্রীর কাজ করে কোনো প্রকারে সংসার চালাতেন। ছোটবেলায় কখনো-কখনো হামিদুর পিতার কাজে সাহায্য করতেন। স্থানীয় প্রাইমারি স্কুলে তাঁকে ভর্তি করে দেয়া হলে পঞ্চম শ্রেণির পর আর লেখাপড়া করা সম্ভব হয়নি।
১৯৭০ সালে তিনি মুজাহিদ বাহিনীতে যোগ দেন। এরপর ১৯৭১ সালের শুরুতে তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। প্রশিক্ষণের জন্য তাঁকে চট্টগ্রাম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সেন্টার (ইবিআরসি)-এ পাঠানো হয়। ২৫শে মার্চ রাতে সেখানে তিনিসহ ২৫০০ প্রশিক্ষণার্থী নতুন বাঙালি সৈনিক ছিল। সেন্টারের দায়িত্বে ছিলেন লে. কর্নেল এম আর চৌধুরী নামে এক বাঙালি অফিসার। হঠাৎ মধ্যরাতে বালুচ রেজিমেন্টের পাকিস্তানি সেনারা যুদ্ধসাজে সজ্জিত হয়ে ভারী অস্ত্র নিয়ে প্রশিক্ষণার্থীদের ব্যারাকের দিকে এগিয়ে যায়। এরপর শুরু হয় নির্বিচারে বাঙালি সৈনিক হত্যা। তাঁদের অনেকে ছিলেন ঘুমন্ত অবস্থায়। পার্শ্ববর্তী ফ্যামিলি কোয়ার্টারের সদস্যদেরও কেউ হায়েনাদের হাতে মৃত্যু থেকে রক্ষা পায়নি। তারা প্রথমেই লে. কর্নেল এম আর চৌধুরীকে গুলি করে হত্যা করে। এমনি এক ভয়াবহ অবস্থায় কয়েকজন প্রশিক্ষণার্থীসহ হামিদুর রহমান পাশের জঙ্গল দ্বারা পরিবেষ্টিত পাহাড়ের উঁচুতে আশ্রয় নিয়ে রাত্রি কাটান। সেখান থেকে সারারাত ধরে হানাদারদের কর্তৃক সংঘটিত হত্যার বীভৎসতা দেখেন। ভোর হলে পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথ ধরে হেঁটে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে এসে পৌঁছান। সেখান থেকে শুরু হয় নিজ গ্রামের উদ্দেশ্যে পথচলা- বাংলাদেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। অধিকাংশ পথ পায়ে হেঁটেছেন। অতঃপর দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে নিজ বাড়িতে এসে পৌঁছান। চোখে তাঁর প্রতিশোধের আগুন।
মা-বাবাকে বুঝিয়ে তাঁদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য কয়েক দিনের মধ্যে যশোরের চৌগাছা এসে ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিদ্রোহী সেনাদের সঙ্গে যোগ দেন। তাঁদের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন ক্যাপ্টেন হাফিজ উদ্দিন আহমেদ। হামিদুর রহমান সুবেদার মেজর মজিদ মিয়ার বাহিনীতে নাম লেখান? কম বয়স এবং কয়েক সপ্তাহের সামরিক ট্রেনিংপ্রাপ্ত হওয়ায় প্রথমে হামিদুরকে যুদ্ধক্ষেত্রে না পাঠিয়ে সৈনিকদের রান্নার কাজে তাঁকে নিয়োজিত করা হয়। কিন্তু হামিদুরের মন কিছুতেই এ কাজে সায় দিচ্ছিল না। তিনি চাচ্ছিলেন শত্রুর বিরুদ্ধে অস্ত্রহাতে যুদ্ধ করতে। অবশেষে অপর এক সেনা কর্মকর্তার সুপারিশে তাঁর মনের ইচ্ছা পূরণ হয়। অচিরেই একজন সাহসী যোদ্ধা হিসেবে তিনি পরিচিতি লাভ করেন। সুবেদার মেজর মজিদ মিয়ার নেতৃত্বে পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে অনুষ্ঠিত লেচুতলার যুদ্ধে হামিদুর রহমান যথেষ্ট সাহস ও যোগ্যতার পরিচয় দেন। এটিই ছিল তাঁর প্রথম কোনো সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ।
শত্রুর ভারী অস্ত্র ও বিমান হামলার মুখে ১ম ইস্ট বেঙ্গলের বিদ্রোহী সৈনিকদের বেশিদিন বাংলাদেশের অভ্যন্তরে টিকে থাকা সম্ভব ছিল না। তাছাড়া ফোর্স পুনর্গঠন আবশ্যক হয়ে পড়ে। তাঁরা ভারতে চলে যান। ফোর্স গঠন-পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় যুদ্ধের শেষের দিকে ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়কত্ব মেজর জিয়াউদ্দিন-এর ওপর ন্যস্ত করা হয়। হামিদুর রহমান এ রেজিমেন্টে সেনাসদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। এর পূর্বে মেজর জিয়াউর রহমান, বীর উত্তমকে অধিনায়ক করে ‘জেড’ ফোর্স গঠন করা হলে, তিনি এর অধীনে কয়েক সপ্তাহের জন্য অধিকতর সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
পুনর্গঠিত ১ম ইস্ট বঙ্গল রেজিমেন্টের ‘সি’ কোম্পানির অধিনায়ক ছিলেন লে. কাইয়ুম। হামিদুর রহমান-কে তিনি যুদ্ধের মাঠে তাঁর ‘রানার’ হিসেবে নিযুক্ত করেন। ২১শে সেপ্টেম্বর সীমান্তবর্তী রৌমারী কোদালকাঠীর বিখ্যাত যুদ্ধে হামিদুর রহমান অসীম সাহস ও বীরত্বের পরিচয় দেন। এক পর্যায়ে গুলি ছুড়তে ছুড়তে একাই শত্রুর বিরুদ্ধে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। প্রচণ্ড যুদ্ধশেষে শত্রুর ঘাঁটি মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে।
হেডকোয়ার্টার্সের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অক্টোবর মাসে মৌলভী বাজার জেলার শ্রীমঙ্গল থানাধীন সীমান্তবর্তী ধলই বিওপি শত্রুর হাত থেকে দখলের পরিকল্পনা নেয়া হয়। পাহাড় আর চা-বাগানে ঘেরা এটি। সিলেটের একাধিক অঞ্চলে প্রবেশদ্বার ছিল এটি। তাই মুক্তিবাহিনী ও পাকসেনা উভয়ের জন্য এর কৌশলগত গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। হানাদার বাহিনী এখানে ৩ কোম্পানি ফ্রন্টিয়ার সৈন্য ও ১ কোম্পানি মুজাহিদ মোতায়েন এবং অসংখ্য ট্রেঞ্চ-বাঙ্কার, মেশিনগান পোস্ট নির্মাণ করে একটি দুর্ভেদ্য প্রতিরক্ষাব্যূহ তৈরি করে। ২৮শে অক্টোবর ইস্ট বেঙ্গলের যোদ্ধারা সম্মিলিতভাবে ধলই বিওপি- র ওপর আক্রমণ পরিচালনা করেন। কিন্তু শত্রুপক্ষের দুটি মেশিনগান পোস্ট থেকে বৃষ্টির মতো গোলা বর্ষিত হচ্ছিল। এ দুটি ধ্বংস না করা পর্যন্ত তাঁদের পক্ষে সম্মুখে অগ্রসর হওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। অধিনায়ক লে. কাইয়ুম তাঁর রানার হামিদুর রহমানকে এ কঠিন দায়িত্ব পালন করতে পারবে কি-না জিজ্ঞেস করতেই হামিদুর সঙ্গে-সঙ্গে সম্মতি জ্ঞাপন করেন। এরপর তিনি দুটি গ্রেনেড হাতে নিয়ে ক্রলিং করে নালা বেয়ে লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন। নিকটে পৌঁছে প্রথম গ্রেনেড নিক্ষেপ করে একটি মেশিনগান পোস্ট ধ্বংস করেন। দ্বিতীয় পোস্ট থেকে বিরামহীন গুলি বর্ষিত হচ্ছিল। হামিদুর দ্বিতীয় গ্রেনেডটি চার্জ করে সেটিও নিস্তব্ধ করে দেন। ঠিক একই সময় শত্রুর মেশিনগানের গুলি তাঁর বুক ও কপাল ভেদ করে বেরিয়ে যায়। শহীদ হন বীর যোদ্ধা হামিদুর রহমান। তাঁর সাহসী ভূমিকার কারণে ধলই শত্রুঘাঁটি মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে। সহযোদ্ধারা তাঁর লাশ ভারতের মেঘালয় রাজ্যের আম্বাসা শহরে নিয়ে সেখান থেকে ২ মাইলের মতো দূরবর্তী জঙ্গলবেষ্টিত পাহাড়ের এক কবরস্থানে বীরের মর্যাদায় সমাহিত করেন। স্বাধীনতার ৩৬ বছর পর ২০০৭ সালে সেখান থেকে তাঁর দেহাবশেষ দেশে এনে ১১ই ডিসেম্বর মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।
মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মোৎসর্গ ও বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তাঁকে সরকার কর্তৃক সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। এছাড়া তাঁর জন্মস্থান খোর্দ – খালিশপুরের নাম রাখা হয় হামিদনগর। একই গ্রামে তাঁর নামে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, লাইব্রেরি ও স্মৃতিজাদুঘর এবং একটি কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ঝিনাইদহ সদরে রয়েছে একটি স্টেডিয়াম। [হারুন-অর-রশিদ]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড