মুক্তিযুদ্ধে হাতিয়া উপজেলা (নোয়াখালী)
হাতিয়া উপজেলা (নোয়াখালী) ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলে পাকিস্তানের সামরিক শাসক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। সারা দেশের মানুষ প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে। হাতিয়াবাসীর ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলনএর ডাক দিলে এখানকার ছাত্র-জনতা প্রায় প্রতিদিনই মিটিং-মিছিল ও বিক্ষোভ অব্যাহত রাখে। আওয়ামী লীগ ও ন্যাপ (মোজাফ্ফর)-এর নেতৃত্বে আন্দোলন-সংগ্রাম চলতে থাকে। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ-এর পর হাতিয়ার মানুষ মুক্তিযুদ্ধের দিকনির্দেশনা পেয়ে যায়। ‘জাগো জাগো বাঙালি জাগো’, ‘বাঁশের লাঠি হাতে ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ‘ইয়াহিয়ার ঘোষণা মানিনা, মানবো না’, ‘ছাত্র-শিক্ষক-জনতা, গড়ে তোল একতা’, ‘কৃষক-শ্রমিক-জনতা, গড়ে তোল একতা’ ইত্যাদি স্লোগানে সমগ্র হাতিয়া উত্তাল হয়ে ওঠে। ২৮শে মার্চ এডভোকেট দেলোয়ার হোসেন এমএনএ-কে সভাপতি এবং মাস্টার আমির হোসেন বিকম-কে সম্পাদক করে ১৭ সদস্যের থানা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। উপজেলা সদরে ছাত্র-যুবকদের সমন্বয়ে বাঁশের লাঠি ও কাঠের তৈরি ডামি রাইফেল দিয়ে প্রশিক্ষণ শুরু হয়। প্রশিক্ষণ প্রদান করেন থানা আনসার এডজুট্যান্ট এম এ মান্নান ও ডেপুটি এডজুট্যান্ট মোছলেহ উদ্দিন। সুখচর ইউনিয়নের কেন্দ্রস্থলে ইউনিয়ন ভূমি অফিসের সম্মুখে কেফায়েত উল্যার উদ্যোগে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খোলা হয় এবং ছাত্র-যুবকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। প্রশিক্ষণ প্রদান করেন অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য মাহফুজুর রহমান। ডা. আবু তাহের (মুরাদ মিয়া)-কে সভাপতি, কামাল উদ্দিন বিকম-কে সম্পাদক এবং কেফায়েত উল্যাহ-কে সাংগঠনিক সম্পাদক করে ইউনিয়ন সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। ছাত্রলীগ- নেতা ফুয়াদ পাশা কচি সমগ্র উপজেলার তরুণদের ইউনিয়ন সংগ্রাম কমিটির সঙ্গে সমন্বয় সাধন করেন।
এডভোকেট দেলোয়ার হোসেন, এডভোকেট কামাল উদ্দিন, মাস্টার আমির হোসেন, মাওলানা নাসির, অলি উল্যাহ ডাক্তার (বুড়িরচর), অধ্যাপক মো. ওয়ালী উল্যাহ, মোয়াজ্জম হোসেন ভূঞা, জিয়াউল হক তালুক মিয়া, মৌ. শফি উল্যাহ, মৌ. আলতাফ হোসেন নিজাম, মৌ. মোজাম্মেল হোসেন প্রমুখ এ উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। ছাত্র-জনতা বিভিন্ন অফিস- আদালত হতে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে পুড়িয়ে ফেলে। ২৩শে মার্চ এখানে বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা তৈরি করে তা নিয়ে মিছিল-মিটিং শুরু হয়।
সুখচর ইউনিয়নের সাহেবানী বাজারে এবং ওছখালী হাইস্কুল মাঠে বাঁশের লাঠি ও কাঠের ডামি বন্দুক দিয়ে ছাত্র-যুবকদের প্রশিক্ষণ চালু হয়। স্থানীয় আনসার এবং অবসরপ্রাপ্ত সেনা- সদস্যরা এ প্রশিক্ষণ পরিচালনা করেন। পরবর্তীতে ভারত হতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা দেশে মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা, সামছুদ্দিন শোভা, ফয়েজুর রহমান, শাখাওয়াত হোসেন ও বজলুর রহমানভ ভূঁঞা স্থানীয়ভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ করেন। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সাংগঠনিক ও আর্থিক সহযোগিতা এবং রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ দেন। হাতিয়া থানার ওসি আবদুল লতিফ পরোক্ষভাবে এসব প্রশিক্ষণে সহযোগিতা করেন। সাহেবানী বাজারে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন ডা. আবু তাহের মুরাদ মিয়া (সভাপতি, সুখচর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ), কামাল উদ্দিন বিকম (সম্পাদক, সুখচর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ) ও মো. কেফায়েত উল্যাহ (ছাত্রলীগ নেতা ও সংগ্রাম কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক)। পরবর্তীতে ফুয়াদ পাশা কচি এবং মাস্টার আমীর হোসেনের তত্ত্বাবধানে হাতিয়া থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে পাঠানো হয়। ছাত্রলীগ থেকে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্বে সার্বিকভাবে নেতৃত্ব দেন ফুয়াদ পাশা কচি, রফিকুল আলম, শামছুদ্দিন শোভা, শাখাওয়াত হোসেন, কাজী আওরঙ্গজেব, নুরুল ইসলাম (আফাজিয়া), বিনয় ভূষণ দাস (বাবুলাল), আবু তাহের প্রমুখ। হাতিয়ার মুক্তিযোদ্ধারা ভারতের জাফলং, দেরাদুন ও বেলগড় গিয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে দেশে ফিরে আসেন এবং বিভিন্ন স্থানে পাকবাহিনী ও রাজাকারদের সঙ্গে যুদ্ধ করেন।
যুদ্ধকালীন হাতিয়া-রামগতির আঞ্চলিক কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন মোশারেফ হোসেন (পিতা মুন্সী ফরহাদ আলী, চর আলেকজান্ডার)। আঞ্চলিক কমান্ডার ছিলেন শাহ আবদুল মাজেদ (পিতা মাওলানা শাহ ছায়েদুল হক, আলেকজান্ডার, রামগতি)। থানা কমান্ডার ছিলেন অধ্যাপক মো. ওয়ালী উল্যাহ (পিতা তহছিল আহাম্মদ), ডেপুটি কমান্ডার ছিলেন রফিকুল আলম (পিতা ফছিয়ল আলম, চানন্দী), রাজনৈতিক প্রধান ছিলেন মাস্টার আমীর হোসেন বিকম (বিএলএফ, হরণী), রাজনৈতিক উপ-প্রধান ছিলেন মৌ. আলতাফ হোসেন নিজাম (সুখচর)।
পাকবাহিনী যে-কোনো সময় হাতিয়ায় আসতে পারে এমন আশঙ্কা থেকে হাতিয়া সদর থেকে স্টিমার ঘাট পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে ছাত্র-যুবকদের নেতৃত্বে কাঠের গুঁড়ি ফেলে এবং রাস্তা কেটে প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়৷
পাকবাহিনী হাতিয়ার নদী দিয়ে একাধিকবার ঢাকা-চট্টগ্রাম আসা যাওয়া করলেও হাতিয়াতে অনুপ্রবেশ করে ১১ই মে। তারা জাহাজ থেকে নেমে ব্রিটিশ আমলে নির্মিত হাতিয়া দেওয়ানী আদালত ভবনে ক্যাম্প স্থাপন করে। তিন শতাধিক সেনা সদস্য এই ভবন থেকে হাতিয়ার বিভিন্ন স্থানে অপারেশন চালায়।
হাতিয়ায় স্বাধীনতাবিরোধী দল হিসেবে মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, পিডিপি – এবং ইসলামী ছাত্র সংঘ- তৎপর ছিল। পাকবাহিনী হাতিয়ায় ক্যাম্প স্থাপনের পর এখানে শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। মাওলানা আবদুল হাই (আফাজিয়া) ও মাওলানা মাহমুদুর রহমান (আফাজিয়া) যথাক্রমে শান্তি কমিটির সভাপতি ও সেক্রেটারি ছিল। মাওলানা মোজাক্কেরুল বারি (জামায়াতে ইসলামীর নেতা), আমিরুল ইসলাম কালাম ও মাওলানা আবদুল হাই (মুসলিম লীগ নেতা) শান্তি কমিটির সদস্য হিসেবে তৎপর ছিল। রাজাকার বাহিনী থানায় ক্যাম্প স্থাপন করে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। তবে এখানে আওয়ামী লীগের শক্তিশালী সংগঠন থাকায় রাজাকার বাহিনী তেমন কোনো তৎপরতা চালাতে পারেনি। দুর্ধর্ষ কয়েকজন রাজাকার মাইজদী গিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী তৎপরতা চালায়। তাদের মধ্যে মৌলভী মীর মুজাম্মেল (চরকিং, পরবর্তীতে আজহারুল উলূম মাদ্রাসার শিক্ষক) এবং বগা বজলু (চানন্দী) অন্যতম। এ উপজেলায় মোট ১২০ জন রাজাকার ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা হাতিয়া থানা আক্রমণ করলে তারা সবাই আত্মসমর্পণ করে এবং স্বাধীনতার বিরোধিতা না করার শপথ গ্রহণ করে মুক্তি পায়৷
পাকবাহিনী ১২ই মে আফাজিয়া বাজারে এসে কোরআন শরীফ পাঠরত অবস্থায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ সমর্থক হাজী গোলাম রহমান সওদাগরকে (পিতা হামিদ আলী, ফজরন মাঝি, চরকিং) লাঠি দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে। তারা একই বাজারে ৮ জন মানুষকে লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে। এটি আফাজিয়া বাজার গণহত্যা – নামে পরিচিত। এরপর খাসের বাজারে এসে পল্লী চিকিৎসক শশী কুমার দাসকে (পিতা রাম দয়াল দাস) হত্যা করে। ওছখালীতে এসে তরণী কর্মকার (পিতা অন্নদা কর্মকার, ওছখালী) এবং অপর একজনকে হত্যা করে। তারা জেলা সদর মাইজদীতে এসে মো. এহছানকে (পিতা মোজাম্মেল হক, চরঈশ্বর, হাতিয়া) হত্যা করে। মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার পথে তারা ফণীন্দ্র কুমার দাস (পিতা যোগেন্দ্র কুমার দাস) এবং পবিত্র কুমার দাসকে (পিতা নন্দকুমার দাস, চরলটিয়া, চরঈশ্বর) হত্যা করে।
পাকসেনারা নদীতীরের গ্রামগুলোতে বহু নারীর ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। ১২ই মে তারা ওছখালীতে একটি বিয়ে বাড়িতে নারীনির্যাতন করে। একই দিন তারা চরঈশ্বর ইউনিয়নের রাজের হাওলার হিন্দু অধ্যুষিত দাস পাড়ায় গণধর্ষণ চালায়। পাকবাহিনী হাতিয়া সদরে এডভোকেট দেলোয়ার হোসেন, জিয়াউল হক তালুক মিয়া ও আলী আজ্জম মিয়ার বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। নলচিরা ইউপি অফিস এবং চরঈশ্বর ইউনিয়নের রাজের হাওলা দাস পাড়ার অসংখ্য ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। ১১ই মে তারা হাতিয়া সদরের দোকানপাট এবং ১২ই মে ওছখালী বাজার ও চরঈশ্বরের দাসপাড়ায় ব্যাপক লুটপাট চালায়।
এ উপজেলায় পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো যুদ্ধ হয়নি। তবে রাজাকারদের সঙ্গে একটি যুদ্ধ হয়, যা হাতিয়া থানা যুদ্ধ নামে পরিচিত। ১৪ই আগস্ট মুক্তিযোদ্ধারা থানা আক্রমণ করেন। এতে ১২০ জন রাজাকার ও পুলিশ আত্মসমর্পণ করে এবং বিপুল পরিমাণ অস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়।
হাতিয়ার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- মোস্তফা আলী দুলাল (পিতা নুরুল ইসলাম, চানন্দী), আলী আহাম্মদ ভূঞা (পিতা মুখলেছুর রহমান ভূঞা, বুড়িরচর; বিডিআর সদস্য), আলতাফ উদ্দিন (পিতা মাস্টার জবিয়ল হোসেন, হরণী; সেনা-সদস্য), নায়েক মিরাজ উদ্দিন (পিতা হারিছ আহাং, হরণী), জামাল উদ্দিন মোল্লা (পিতা বদিউর রহমান মোল্লা, হরণী), অলি উদ্দিন (পিতা জবিয়ল হোসেন, হরণী), মিরাজ উদ্দিন (পিতা আমিনুল ইসলাম, আফাজিয়া) ও আবদুস সাত্তার (পিতা কাদিয়ান আলম, বাংলা বাজার)।
শহীদ আলী আহাম্মদ স্মরণে এলাকাবাসীর উদ্যোগে বুড়িরচরে শহীদ আলী আহাম্মদ মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। উপজেলা সদরে আদালত প্রাঙ্গণে শহীদ মোস্তফা আলী দুলাল স্মরণে স্মৃতিফলক এবং পারিবারিক উদ্যোগে ওছখালীতে মোস্তফা আলী স্মৃতি পাঠাগার স্থাপিত হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা ফুয়াদ পাশা কচির নামে পৌরসভায় একটি এবং মুক্তিযুদ্ধের থানা কমান্ডার অধ্যাপক ওয়ালী উল্যাহর নামে বুড়িরচর ইউনিয়নে অপর একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। [মো. কেফায়েত উল্যাহ]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড