হাতিয়ানদহ গণহত্যা (সিংড়া, নাটোর)
হাতিয়ানদহ গণহত্যা (সিংড়া, নাটোর) সংঘটিত হয় ৮ই মে। এখানে বহু লোককে হত্যা করে ইন্দারার মধ্যে ফেলে দেয়া হয়। ১৭ জনকে হাতিয়ানদহে গণকবর দেয়া হয়। কলম হত্যাযজ্ঞ শেষ করে (৮ই মে) হানাদার বাহিনী নাটোরের দিকে ফিরছিল। নাটোর থেকে মাত্র ৭ মাইল দূরে কলম যাওয়ার পথেই হাতিয়ানদহ গ্রাম। এটি ৬নং হাতিয়ানদহ ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডে অবস্থিত। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ট্রাকে করে অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে হাতিয়ানদহ গ্রামের ওপর দিয়ে কলম গ্রামে যাওয়ার পথে কিছুক্ষণ থেমে কলম চলে যায়। কিন্তু বিকেল ৩.৩০-৪টার দিকে পাকিস্তানি বাহিনীর ট্রাক নাটোরে না গিয়ে হাতিয়ানদহ গ্রামে ঢুকে পড়ে। হাতিয়ানদহ মীর পরিবারের সদস্য দালাল ময়েন উদ্দিন মীর পাকিস্তানিদের ছোট্ট ব্রিজের কাছ থেকে হাতিয়ান্দহ গ্রামে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। তাদের বলা হয়, এ গ্রামে ‘মালাউন’ [হিন্দু] এবং মুক্তিবাহিনী- লুকিয়ে আছে। এছাড়া বিভিন্ন স্থান থেকে অনেকে এখানে আশ্রয় নিয়ে আছে। ঘাতক হানাদার বাহিনী গ্রামে ঢুকেছে দেখে অনেকে সড়ে পড়ার উপায় না থাকায় তারা গ্রামের উল্টো দিকে একটি জঙ্গলে আশ্রয় নেয়। সেখানে পাকিস্তানি হানাদাররা মেশিনগান দিয়ে গুলি করতে থাকে। তখন জঙ্গলে অবস্থানকারী মানুষজন দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পালাতে গিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরা পড়ে। তাদের মধ্যে ২০-২২ জনকে বাছাই করে লাইনে দাঁড় করানো হয়। হিন্দু ও মুসলিমদের দুটি পৃথক লাইনে দাঁড় করানো হয়। এরপর উভয় লাইনের ওপর শুরু হয় গুলি। একই পরিবারের বলরাম চন্দ্র ও হরিদাস তৎক্ষণাৎ মারা যায়। শশীভূষণ নামে একজন গুলি লেগে কাতরাচ্ছিল। ভোলানাথ কর্মকারের ছেলে বিজয় কর্মকারকে বাঁচাতে গুলি করবার সময় সে জাপটে ধরে। গুলিতে ভোলানাথ মারা যায়। ঈশ্বরদীর নরেশ কুণ্ডু ইন্দু শেখরের বাসায় থাকত। তাদের উভয়কেই গুলি করে হত্যা করে।
রতিকান্ত সাহা নামে এক ব্যক্তি বাড়িতে ছিলেন। জানালা দিয়ে দেখতে পান একটি মেয়েকে পাকিস্তানি বাহিনী ধরে নিয়ে যাচ্ছে। তিনি বসে থাকতে পারেননি। তাই তাকে বাঁচাতে এগিয়ে গেলে হানাদাররা লাঠি দিয়ে পিটিয়ে রোডে তাকে হত্যা করে। রথীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য নামে এক ব্যক্তির শরীরে গুলি লাগে। তাকে তার বাড়ি মঠগ্রামে নিয়ে গেলে সেখানে তিনি মারা যান। মেয়ের বাড়ি বেড়াতে এসে মেশিনগানের গুলিতে প্রাণ হারান চন্দ্র প্রামাণিক। শশী প্রামাণিক নামক এক রাজমিস্ত্রি পাকিস্তানি বাহিনী চলে গিয়েছে ভেবে বাজারের দিকে যাচ্ছিল। পথে দীঘল গ্রাম রোডে তাকে গুলি করে হত্যা করে। এভাবে বগুড়াপাড়া গ্রামে ১৭-১৮ জন শহীদ হন। লাইনে থাকা কয়েকজন বেঁচে যান। আবার কেউকেউ জঙ্গলে গুলি চলাকালে আহত হন। বিনয়কৃষ্ণ, নরেন্দ্রনাথ, সতীশ চন্দ্র, বিষ্ণুপদসহ ১৩ জনের মতো আহত হন। দীঘল গ্রাম রোডেও বহু মানুষ মারা যান। পাকিস্তানিরা অনেক ব্যক্তির লাশ গ্রামের মধ্যে বিনয় কুণ্ডুর বাড়ির উত্তর পাশের পাকা ইন্দারার মধ্যে ফেলে দেয়। ফলে তাদের অনেকের পরিচয় জানা যায়নি। তাদের অনেকে বিভিন্ন স্থান থেকে এসে এখানে আশ্রয় নিয়েছিল। হাতিয়ানদহে বিকেল থেকে মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বহু মানুষকে হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে ঘাতক পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসররা। এছাড়াও হাতিয়ানদহের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্তভাবে বহু মানুষকে তারা হত্যা করে।
যারা সেদিন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যার শিকার হন, তারা হলেন— শশধর প্রামাণিক (পিতা বন্য প্রামাণিক), হরিদাস রায় (পিতা সুবেন্দু নাথ রায়; বগুড়াপাড়া গ্রামে হানাদারদের গুলিতে নিহত), বলরাম চন্দ্র কুণ্ডু ও তার সহোদর হরিদাস (পিতা মহেশ চন্দ্র কুণ্ডু; বলরামের পুত্র বিনয়কৃষ্ণও লাইনে দাঁড়ানো অবস্থায় গুলিতে আহত হয়ে অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে থাকে), ইন্দুশেখর চক্রবর্তী (পিতা সুধাংশু শেখর চক্রবর্তী), শশী ভূষণ মিস্ত্রী (পিতা ষষ্ঠিচরণ মিস্ত্রী), ভোলানাথ কর্মকার (পিতা যদুনাথ কর্মকার; ছেলে বিজয়কে বাঁচাতে গিয়ে গুলিতে নিহত), গোকুল চন্দ্র প্রামাণিক (পিতা নিতাই চন্দ্ৰ প্রামাণিক; কৃষিকাজ), নরেশ কুণ্ডু (পিতা নরেন্দ্র নাথ কুণ্ড, আদিনিবাস ঈশ্বরদী), মাদার দাস (পিতা বৈদ্যনাথ দাস, ডাব ব্যবসায়ী; প্রথমে গুলি ও লাঠিপেটা করে পরে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারা হয়), পাঁচু বাদ্যকর (পিতা সুবল বাদ্যকর, সাঁঐল), শশধর প্রামাণিক (পিতা ধন্য প্রামাণিক), বিশ্বনাথ দাস (পিতা বিপদ দাস, কৃষক), সুনীল চন্দ্র, রতিকান্ত সাহা (পিতা মদনমোহন সাহা, একটি যুবতী মেয়েকে বাঁচাবার চেষ্টাকালে পাকসেনা কর্তৃক নিহত), রথীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য (পিতা চন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য; গুলিবিদ্ধ হয়ে পরে মারা যায়; মৃতদেহ গণকবরে মাটিচাপা দেয়া হয়) ও সুরেশ সাহা (নাটোর; হাতিয়ানদহে আত্মগোপন অবস্থায় পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে নিহত)। এদের সবাইকে সিংড়ার হাতিয়ানদহ গণকবরে সমাহিত করা হয়। এখানে ১৭ জন শহীদের নামসহ একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। [সুমা কর্মকার]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড