You dont have javascript enabled! Please enable it!

হাতীবান্ধা অপারেশন (হাতীবান্ধা, লালমনিরহাট)

হাতীবান্ধা অপারেশন (হাতীবান্ধা, লালমনিরহাট) পরিচালিত হয় কয়েকবার। তার মধ্যে ২৭শে সেপ্টেম্বর ও ২০-২১শে নভেম্বরের আক্রমণ ছিল বেশ তীব্র ও রক্তক্ষয়ী। এতে উভয় পক্ষে হতাহতের ঘটনা ঘটে।
পাকিস্তানি বাহিনী ট্রেনযোগে ৮ই এপ্রিল হাতীবান্ধায় অনুপ্রবেশ করে। শহরে ঢুকে তারা এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, হত্যা ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটায়। সিঙ্গিমারী, হাটখোলা, টংভাঙ্গা, বড়খাতা, গড্ডিমারী, পারুলিয়াসহ বিভিন্ন স্থানে তারা হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে।
বর্তমান হাতীবান্ধা উপজেলা পরিষদ কার্যালয়, হাটখোলা ভিম মাস্টারের বাড়ি, ফকিরের ডাঙ্গা, কেদার পুল, ভোটমারী, সিন্ধুর্না, ভবানীপুর, গড্ডিমারী, সিঙ্গিমারী, পারুলিয়া, বড়খাতাসহ বিভিন্ন স্থানে তারা ক্যাম্প ও বাংকার স্থাপন করে।
পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থান নির্মূল করার জন্য ৬ নম্বর সেক্টরের পাটগ্রাম সাব-সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা হাতীবান্ধায় একাধিক অপারেশন চালান। ২৭শে সেপ্টেম্বর প্রথম দুপক্ষের মধ্যে সম্মুখ যুদ্ধ হয়। মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাপ্টেন মতিউর রহমানের নেতৃত্বে গড্ডিমারী ও নাওতাড়ার পশ্চিম, তিস্তা নদীর পশ্চিম ও সিঙ্গিমারী বিওপি-তে অবস্থান নেন। অন্যদিকে পাকিস্তানি সেনারা হাতীবান্ধা কলেজ, সিও (ডেভ) কার্যালয় ও তিস্তা নদীর পূর্বদিকে পজিশন নেয়। সিঙ্গিমারী বিওপি-তে ছিলেন কোম্পানি কমান্ডার ফজলুর রহমান। তাঁর পশ্চিমে সুবেদার মেজর ফজলুর রহমান, তাঁর পশ্চিমে মেজবাহউদ্দিন, তাঁর পাশে সুবেদার মেজর আব্দুল মালেক এবং তাঁর পশ্চিমে সুবেদার মেজর গোলাম মোস্তফার বাহিনীর অবস্থান ছিল। ২৭শে সেপ্টেম্বর ভোররাতে দুপক্ষের মধ্যে গুলি বিনিময় শুরু হয় এবং বিকেল পর্যন্ত তা চলে। সন্ধ্যায় মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদ অবস্থানের দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু এ-সময় পাকিস্তানি সেনারা ক্ষিপ্ৰ গতিতে হামলা চালিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ফেলে দেয়। মুক্তিযোদ্ধারা পাল্টা আক্রমণ করলে দুপক্ষের মধ্যে রাতভর যুদ্ধ চলে। যুদ্ধক্ষেত্রে সুবেদার মেজর ফজলুর রহমান আহত হয়ে পরে শহীদ হন।
হাতীবান্ধায় মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি বড় অপারেশন হয় ২০ ও ২১শে নভেম্বর। ২০শে নভেম্বর সকাল ৮টায় মুক্তিযোদ্ধাদের ৪টি কোম্পানি দুদিক থেকে হাতীবান্ধায় আকস্মিক আক্রমণ করে। এরকম আক্রমণের জন্য পাকিস্তানি সেনারা প্রস্তুত ছিল না। এ-সময় পাকিস্তানি সেনাদের কোম্পানি বদল হচ্ছিল। পুরনো কোম্পানির স্থলে নতুন কোম্পানি আসামাত্র মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ করেন। আক্রমণে পাকিস্তানিদের নতুন কোম্পানি কমান্ডার নিহত হয়। অন্য সৈনিকরা পালিয়ে নিকটবর্তী একটি গ্রামে ডিফেন্স নেয়। গ্রামটিতে আগে থেকে পাকিস্তানি সেনাদের আর্টিলারি পজিশন ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ করলে দুপক্ষের মধ্যে তীব্র যুদ্ধ হয়। পাকবাহিনী আর্টিলারি, কামান, থ্রি ইঞ্চি মর্টার, হেভি মেশিনগান, রকেট লাঞ্চার, এলএমজি ইত্যাদি ভারী অস্ত্র ব্যবহার করে। অপরদিকে প্রায় ৩ শতাধিক মুক্তিযোদ্ধার পেছনে আর্টিলারি বাহিনীর সাপোর্ট ছিল। মুক্তিযোদ্ধারাও থ্রি ইঞ্চি মর্টার, এলএমজি, এসএলআর-সহ ভারী অস্ত্র ব্যবহার করেন। এখানে রাঙ্গু মিয়া ও লুৎফর রহমান নামের ২ জন মুক্তিযোদ্ধা আর্টিলারির গোলায় শহীদ হন। এভাবে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে হাতীবান্ধায় কয়েক দফা অপারেশন হলেও তাদের শক্ত অবস্থান ধ্বংস করতে মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক সময় লাগে। তবে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানিদের তীব্র প্রতিরোধ সত্ত্বেও এগিয়ে যেতে থাকে। ৪ঠা ডিসেম্বর পর্যন্ত হাতীবান্ধার বিভিন্ন স্থানে হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। ৫ই ডিসেম্বর হাতীবান্ধা উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়। হাতীবান্ধা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সম্মুখ চত্বরে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মৃতিফলক রয়েছে। [আজহারুল আজাদ জুয়েল]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!