You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে হাতীবান্ধা উপজেলা (লালমনিরহাট)

হাতীবান্ধা উপজেলা (লালমনিরহাট) একটি পুরনো থানা। ১৯১৪ সালে এ থানা গঠিত হয় এবং ১৯৮৩ সালে এটি উপজেলায় রূপান্তরিত হয়। লালমনিরহাট শহর থেকে হাতীবান্ধা সদরের দূরত্ব ৫২ কিলোমিটার। হাতীবান্ধা একটি সীমান্তবর্তী এলাকা। এর উত্তরে পাটগ্রাম উপজেলা ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, দক্ষিণে কালীগঞ্জ উপজেলা, পূর্বে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং পশ্চিমে নীলফামারী জেলার ডিমলা ও জলঢাকা উপজেলা।
হাতীবান্ধা একটি রাজনীতি-সচেতন এলাকা। পাকিস্তানি আমলে বাঙালিদের স্বাধিকার আন্দোলনের প্রভাব এ দূরবর্তী থানায়ও পড়ে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের মার্চে যে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়, তাতে হাতীবান্ধার মানুষ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ এর পর এখানে সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। থানা আওয়ামী লীগএর সভাপতি জব্বার আলী মিয়াকে সভাপতি এবং প্রকৌশলী নজরুল ইসলামকে সাধারণ সম্পাদক করে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। ৮ই মার্চ হাতীবান্ধায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত হয়।
হাতীবান্ধার মুক্তিযোদ্ধারা স্থানীয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ৩০শে মার্চ শিতুল কুচিতে এবং ৩রা এপ্রিল শিতাই-এ হাতীবান্ধার মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। এখানে প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর এ এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ-কেউ ভারতের কুচবিহারের শীতলকুচি, দার্জিলিং-এর মূর্তি ক্যাম্প ও অন্যান্য স্থান থেকে প্রশিক্ষণ নেন। হাতীবান্ধা উপজেলা বুড়িমারী সাব-সেক্টরের আওতাধীন ছিল। এ সাব-সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান। স্থানীয় কমান্ডারদের মধ্যে ছিলেন মো. নজরুল ইসলাম, আ. রাজ্জাক বুলু, মোজাফ্ফর হোসেন, নজরুল ইসলাম (কোম্পানি কমান্ডার) প্রমুখ।
কোনো স্থানীয় প্রতিরোধ মোকাবেলা না করেই পাকবাহিনী ২৮শে মার্চ হাতীবান্ধা উপজেলায় প্রবেশ করে। তারা ২৯শে মার্চ হাটখোলা তহশিল অফিসে তাদের প্রধান ক্যাম্প স্থাপন করে। এছাড়া উপজেলার অন্য কয়েকটি স্থানে রাজাকারদের অস্থায়ী ক্যাম্প ছিল।
হাতীবান্ধা উপজেলায় পাকবাহিনীর সহযোগী হিসেবে যারা কুখ্যাত ছিল, তারা হলো- ডা. করিম (জল্লাদ প্রধান), খেরু মিয়া ওরফে আজিজার রহমান (শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান), ডা. আমির (জল্লাদ), রফিকুল ইসলাম (ভিএম, শান্তি কমিটির সহকারী), ঘুটু মিয়া, তোফাজ্জল হোসেন, মশোর মাহমুদ পণ্ডিত, সাবির উদ্দিন মাস্টার, আমজাদ চেয়ারম্যান ও এহসান উদ্দিন। এছাড়া রাজাকার বাহিনীর প্রধান ছিল মোকলেছার রহমান। অন্য রাজাকারদের মধ্যে নেহাল উদ্দিন, নেজাব উদ্দিন, তছির উদ্দিন বৈরাগী, তছির উদ্দিন, তোফাজ্জল হোসেন, সিরাজ উদ্দিন, আ. লতিফ, নবি উদ্দিন, ইউসুফ আলী-১, ইউসুফ আলী-২, মোশারফ হোসেন, মোজ্জাফর হোসেন (মোনা) প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা উপজেলার বিভিন্ন স্থানে সাধারণ মানুষের ওপর নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড চালায়। ৮ই এপ্রিল পাকবাহিনী বেশ কয়েকজন নিরীহ মানুষকে বড়খাতা বাসস্ট্যান্ডের পাশে হত্যা করে। হাতীবান্ধায় অনেক নারীনির্যাতনের ঘটনা ঘটে। এতে নেতৃত্ব দেয় রফিকুল ইসলাম (ভিএম)। উপজেলার অনেক গ্রামে অগ্নিসংযোগ করা হয়। সর্বাধিক অগ্নিসংযোগ করা হয় বাড়াইপাড়া, গেন্দুকুড়ি, পূর্ব সারডুবি ও পশ্চিম সারডুবি গ্রামে। পাকবাহিনী ও তাদের সহযোগীরা হাতীবান্ধা হাটখোলা তহশিল অফিসকে নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির হিসেবে ব্যবহার করে।
হাতীবান্ধা উপজেলায় দুটি গণকবর রয়েছে। একটি হাটখোলা তহশিল অফিসের কাছে গণকবর এবং অন্যটি বড়খাতা বাসস্ট্যান্ড গণকবর।
হাতীবান্ধায় পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের একাধিক সম্মুখ যুদ্ধ হয়। সেসব যুদ্ধের মধ্যে ১২ই আগস্ট বড়খাতা ব্রিজ অপারেশন এবং ২৭শে সেপ্টেম্বর ও ২০-২১শে নভেম্বর সংঘটিত হাতীবান্ধা অপারেশন- উল্লেখযোগ্য। বড়খাতা ব্রিজ অপারেশনে ১৫ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং হাতীবান্ধা অপারেশনে উভয় পক্ষে হতাহতের ঘটনা ঘটে। ৬ই ডিসেম্বর হাতীবান্ধা উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
হাতীবান্ধা উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- মকবুল হোসেন (পিতা মেছের উদ্দিন, পূর্ব সিন্দুর্না), আইনুল হক (পিতা তৈয়ব আলী, চড় সিন্দুর্না), আবুল হোসেন (পিতা আলম খা, বুড়া সারডুবি), আবেদ আলী (পিতা নুর মোহাম্মদ, পূর্ব ফকিরপাড়া), মফিজ উদ্দিন (পিতা ছাদুরা শেখ, দক্ষিণ গড্ডিমারী), আক্কেল আলী (পিতা হোসেন আলী, দক্ষিণ পারুলিয়া), মোজাফ্ফর আলী (পিতা শাহা
আলম, উত্তর ডাউয়াবাড়ী), আবেদ আলী (পিতা আ. হামিদ, মধ্য গড্ডিমারী), বোচারাম দাস (পিতা বাচ্চারাম দাস, গাওচুলকা), ভরত চন্দ্র বর্মণ (পিতা শরৎ চন্দ্র বর্মণ, ধওলাই), প্রভাত চন্দ্ৰ বৰ্মণ (পিতা সুরেন্দ্রনাথ নওদাবাস), ধনঞ্জন সিংহ (পিতা বসন্ত সিংহ, নওদাবাস) এবং মজিবর রহমান (পিতা ময়েজ উদ্দিন, ঠেংঝাড়া)।
মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি রক্ষায় হাতীবান্ধায় একটি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের নামে একটি বাজার প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। এ বাজার হাতীবান্ধা শহীদ মুক্তিযোদ্ধা বাজার নামে পরিচিত। হাতীবান্ধার গড্ডিমারী ইউনিয়নে বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাতার হোসেন কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। উপজেলার বড়খাতা নামক স্থানে লালমনিরহাট-পাটগ্রাম সড়কের পাশে একটি স্মৃতিসৌধ রয়েছে। এতে আফজাল হোসেন (তিস্তা, লালমনিরহাট), আ. খালেক (আনোয়ারা, কুমিল্লা) এবং আ. কুদ্দুস (আনোয়ারা, কুমিল্লা)– এ ৩ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম রয়েছে। [মিজানুর রহমান]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!