You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে হাজীগঞ্জ উপজেলা (চাঁদপুর)

হাজীগঞ্জ উপজেলা (চাঁদপুর) ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর সারাদেশের ন্যায় চাঁদপুর জেলায় মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হলেও হাজীগঞ্জে তা শুরু হয় তার পূর্বে ফেব্রুয়ারি মাস থেকে। ভাসানী ন্যাপের নেতা বি এম কলিম উল্যা ভূঁইয়া হাজীগঞ্জ থানা থেকে ৬টি রাইফেল ও কিছু বুলেট সংগ্রহ করে প্রাক্তন কিছু সৈনিকদের সমন্বয়ে মুক্তিবাহিনী গড়ে তুলতে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালান। এতে স্থানীয় মুক্তিকামী জনতা সর্বাত্মক সহযোগিতা করে। ১৪ই ফেব্রুয়ারি হাজীগঞ্জ থেকে নির্বাচিত এমপিএ ডা. আবদুস সাত্তারের হাজীগঞ্জ বাজারস্থ চেম্বার (কারিগরি ঘর)-এর দোতলায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের উপস্থিতিতে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় আলোচনা শেষে সবাই একমত হন যে, সশস্ত্র সংগ্রাম ছাড়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হবে না। সেই লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের আগাম প্রস্তুতিস্বরূপ সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে হাজীগঞ্জ বাজারে অবস্থিত হাজীগঞ্জ কলেজ হোস্টেলে আগ্নেয়াস্ত্র পরিচালনার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। আওয়ামী লীগ ও কমিউনিস্ট পার্টির কিছু সদস্য এবং আগ্রহী কিছু যুবক এ প্রশিক্ষণ নেন। প্রথমে ব্যক্তি মালিকানাধীন বন্দুক এবং থানা থেকে সংগৃহীত ৬টি রাইফেল দ্বারা প্রশিক্ষণ পরিচালনা করা হয়। এরপর মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে থানা থেকে আরো অস্ত্র সংগ্রহ করে পুরোদমে প্রশিক্ষণ চালানো হয়।
৮ই এপ্রিল ডাকবাংলোর নিকটস্থ কলি মিয়ার ঘরে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ডা. আবদুস সাত্তার এমপিএ, আবদুর রব (স্বাধীনতা পরবর্তী এমপি, পরলোকগত), ড. হাবিবুর রহমান ওরফে ড. আবু ইউসুফ (মালিগাঁও, পরবর্তীতে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান) ও তাঁর ভাই সাঈদুর রহমান, বি এম কলিম উল্যা ভূঁইয়া ও আলী আহমদ দিগচাইলের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য একটি সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয় এবং প্রাক্তন সেনা সদস্যদের মুক্তিবাহিনীতে রিক্রুট করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এ সভার ২-৩ দিন পর উচ্চঙ্গা মুন্সি বাড়ি নিবাসী বশির মুন্সীর হাজীগঞ্জ বাজারস্থ বাসভবনে আরেকটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সভায় একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠিত হয় এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক পরিকল্পনা গৃহীত হয়। উপদেষ্টা পরিষদে ছিলেন ডা. আবদুস সাত্তার এমপিএ, আবদুর রব, এম কলিম উল্যা ভূঁইয়া, আলী আহমদ দিগচাইল, তাফাজ্জল হায়দার নসু চৌধুরী, আলী আজ্জম মজুমদার প্রমুখ। হাজীগঞ্জ থানার সার্কেল অফিসার (উন্নয়ন) আ. মতিন ছিলেন উপদেষ্টা পরিষদের সেক্রেটারি।
পাকসেনারা হাজীগঞ্জ বাজারে প্রবেশ করার পূর্বে সংগ্রাম কমিটি হাজীগঞ্জ কলেজের হোস্টেলে ক্যাম্প করে কিছু আনসার সদস্য ও আগ্রহী যুবকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। এ ক্যাম্প থেকে চাঁদপুর ও অন্যান্য স্থানে পাকসেনাদের অবস্থান সম্বন্ধে তথ্য সংগ্রহ করতে সোর্স প্রেরণ করা হতো। পাকসেনারা হাজীগঞ্জে প্রবেশ করার পর সংগ্রাম কমিটির সদস্যরা উক্ত ক্যাম্প ত্যাগ করে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান। এ পরিস্থিতিতে আবদুর রব, বি এম কলিম উল্যা ভূঁইয়া ও আলী আহমদ দিগচাইলসহ অন্যরা বিক্ষিপ্তভাবে সাংগঠনিক কাজ চালান। এ সময় চাঁদপুর ও ফরিদগঞ্জ থেকে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক ও সংগঠকবৃন্দ ডাকাতিয়া নদীর দক্ষিণ পাড়ে একত্রিত হতে থাকেন।
হাজীগঞ্জ সদর ইউনিয়নের অলিপুর গ্রামের বাসিন্দা সেনাবাহিনীর হাবিলদার টিজে (তমঘায়ে জরুরত) খেতাবপ্রাপ্ত জহিরুল হক পাঠান ১৯৭১ সালে কুমিল্লা সেনানিবাসে সেনা সদস্য হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তাঁকে লাহোর বদলি করায় তিনি সেখানে যেতে অসম্মতি জানিয়ে ফেব্রুয়ারি মাসে সপরিবারে ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে আসেন।
যুদ্ধ আঁচ করতে পেরে তিনি আর চাকরিতে ফিরে যাননি। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ শোনার পর তিনি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আর্মি, ইপিআর, পুলিশ, আনসার, নেভি ও এয়ারফোর্সের অবসরপ্রাপ্ত ও ছুটিতে আসা সদস্যদের সংগঠিত করে অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিতে থাকেন। এক পর্যায়ে ডা. আবদুস সাত্তার ও নসু চৌধুরী অস্ত্র সংগ্রহ করে দেয়ার পর তিনি প্রশিক্ষণ কার্যক্রম জোরদার করেন। তাঁর নিজ গ্রামে ও হাজীগঞ্জ বাজারের সন্নিকটে পরিচালিত এ প্রশিক্ষণে ৬০ জন মুক্তিযোদ্ধা অংশ নেন।
মে মাসের শেষদিকে হাজীগঞ্জের পার্শ্ববর্তী ফরিদগঞ্জ উপজেলার সুবিদপুর (পূর্ব) ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ডা. আবদুস সাত্তার এমপিএ-এর সভাপতিত্বে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সভায় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য হাজীগঞ্জ থানা সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয় (শাহরাস্তি উপজেলা তখন হাজীগঞ্জ থানার অন্তর্ভুক্ত ছিল)। সংগ্রাম কমিটির সভাপতি ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা আলী আহমদ (দিগচাইল) এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন বর্তমান শাহরাস্তি উপজেলার সূচীপাড়া (দক্ষিণ) ইউনিয়নের নরিংপুর গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল মান্নান বিএসসি। এ কমিটির সদস্য ছিলেন শাহরাস্তির সূচীপাড়া গ্রামের ছালেহ আহমেদ, মেহের গ্রামের ইদ্রিস মোল্লা, হাজীগঞ্জের রামচন্দ্রপুর গ্রামের আবুল খায়ের প্রমুখ। থানা সংগ্রাম কমিটি ১৯টি ইউনিয়নের প্রতিটি গ্রামে সংগ্রাম কমিটি গঠন করে। এসব কমিটির দায়িত্ব ছিল রাজাকার ও পাকিস্তানপন্থীদের তালিকা তৈরি, তহবিল গঠন ও বিচার-আচার করা। গ্রাম সংগ্রাম কমিটির মাধ্যমে সাধারণ মানুষ থেকে সংগৃহীত তহবিলের ২৫% রেখে ৭৫% দেয়া হতো ইউনিয়ন কমিটিকে। ইউনিয়ন কমিটি বিভিন্ন গ্রাম কমিটি থেকে প্রাপ্ত সমুদয় অর্থ বা তহবিলের ১৫% রেখে ৮৫% দিত থানা কমিটিকে। হাজীগঞ্জের সাধারণ মানুষ মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বাত্মকভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করে। মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতায় এলাকার চোর-ডাকাত নির্মূল হয়ে গিয়েছিল বলে ডাকাতিয়া নদীর দক্ষিণ পাড়ের জনগণ রাতে শান্তিতে ও নির্ভয়ে ঘুমাতে পারত। যারা সংগ্রাম কমিটিকে নগদ অর্থ দিতে পারেনি তারা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নারিকেল, সুপারি, খাসি, মোরগ-মুরগি, চাল-ডাল, এমনকি পিঁয়াজ-রসুন, হলুদ-মরিচ দিয়েও সহযোগিতা করেছে।
হাজীগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে ১০ কিলোমিটারের মতো উত্তর-পশ্চিমে রাজারগাঁও ইউনিয়নের নাসিরকোট হাইস্কুলে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের সবরকম তৎপরতাই এখানে চলত। যেমন, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণেচ্ছু যুবকদের তালিকা প্রণয়ন, সামরিক কায়দায় প্রাথমিক ট্রেনিং, গোপন পথে আগরতলা ও অন্যান্য ক্যাম্পে প্রেরণ, গুপ্তচর বৃত্তির জন্য অপ্রাপ্ত বয়স্ক বুদ্ধিদীপ্ত ছেলেদের নির্বাচন ও তথ্য সংগ্রহের জন্য প্রেরণ এবং বিভিন্ন যুদ্ধে শহীদদের আনয়ন, সমাধিস্থকরণ ও আহতদের সেবা- শুশ্রূষাকরণ। এ ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন ডা. শামছুল আলম। নাসিরকোটে হাজীগঞ্জ থানা সংগ্রাম কমিটির আওতায় একটি আঞ্চলিক কমিটি গঠন করা হয়। এর সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন কালচোঁ উত্তর ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান রাজাপুর গ্রামের শরীফ উল্লা পাটোয়ারী ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন নাসিরকোটের ডা. শামছুল আলম। নাসিরকোট ছিল মুক্তাঞ্চল। মুক্তিযুদ্ধের নয়মাস পাকসেনারা এ গ্রামে প্রবেশ করতে পারেনি।
উপদেষ্টা পরিষদ এবং সংগ্রাম কমিটির সদস্যরাই হাজীগঞ্জ উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের ২নং সেক্টরের আওতায় ‘মধুমতি অঞ্চল’ হিসেবে চাঁদপুর মহকুমার মুক্তিফৌজ (এমএফ) কমান্ডার সুবেদার জহিরুল হক পাঠানের দায়িত্বপ্রাপ্ত এলাকার একটি অংশ ছিল হাজীগঞ্জ থানা। কাজের সুবিধার্থে তাঁর অধীনে ছিলেন ৫ জন সহ-অধিনায়ক। তাঁদেরই একজন রামগঞ্জের বাসিন্দা নায়েক সুবেদার আলী আকবর পাটোয়ারীর দায়িত্বাধীন অন্য দুটি এলাকার সঙ্গে ছিল হাজীগঞ্জ থানা।
হাজীগঞ্জে মুক্তিবাহিনীর (এফএফ) কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ৩ নং কালচোঁ উত্তর ইউনিয়নের ফিরোজপুর গ্রামের বাসিন্দা মো. মুজিবুর রহমান মজুমদার (বর্তমানে হাজীগঞ্জ উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার)। তাঁর সঙ্গে সহকারী কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন রাজারগাঁও ইউনিয়নের রাজারগাঁও গ্রামের আবুল কালাম আজাদ পাটওয়ারী (অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক, বর্তমানে ঢাকায় বসবাসরত ও সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম-এর যুগ্ম সম্পাদক)। মুক্তিবাহিনীর (এফএফ) একাধিক প্লাটুন গঠন করা হয়। এর মধ্যে হাজীগঞ্জ থানায় নেতৃত্ব দেন আবুল খায়ের ওরফে উল্কা খায়ের, ফরহাদ হোসেন রতন ও আবুল কালাম আজাদ পাটওয়ারী। হাজীগঞ্জ থানার বিএলএফ কমান্ডার ছিলেন হাতেম আলী (মকিমাবাদ, উপজেলা সদর) এবং সহকারী কমান্ডার ছিলেন ফয়েজ আহমেদ মুন্সী (উচ্চঙ্গা, হাজীগঞ্জ সদর ইউনিয়ন) ও খোরশেদ আলম বাচ্চু (হাটিলা)।
হাজীগঞ্জ উপজেলায় পাঠান বাহিনী নামে একটি স্থানীয় মুক্তিবাহিনী ছিল। এর প্রধান ছিলেন জহিরুল হক পাঠান তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন। শুরুতে এ বাহিনীর যোদ্ধা-সংখ্যা ছিল ২০০ জন। ধীরে-ধীরে বেড়ে তা ৮৯৭ জনে পৌঁছায়। যুদ্ধের শেষের দিকে এ সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পেয়েছিল। পাঠান বাহিনীর যোদ্ধারা বহু যুদ্ধে অংশ নিয়ে সাফল্য অর্জন করেন।
৭ই এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদারদের পদাতিক বাহিনী অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রসহ চাঁদপুর শহরতলীর গভর্নমেন্ট টেকনিক্যাল হাইস্কুলে অবস্থান নেয়। এ খবর জানতে পেরে হাজীগঞ্জের মানুষ তাদের অনুপ্রবেশ রোধের উদ্যোগ নেয়। বি এম কলিম উল্যা ভূঁইয়ার নেতৃত্বে এবং হাজীগঞ্জ থানা সংগ্রাম কমিটি ও আওয়ামী লীগ নেতাদের উদ্যোগে অসংখ্য মুক্তিকামী জনতা শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তারা এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে হাজীগঞ্জ বাজারের পশ্চিমে মিঠানিয়া পুলের পূর্বে (বর্তমান মান্নান কোল্ড স্টোরেজের সামনে) চাঁদপুর-কুমিল্লা সড়কের কয়েকশ ফুট রাস্তা কেটে পার্শ্ববর্তী জমির সমান্তরাল করে ফেলে। এতে চাঁদপুর থেকে হাজীগঞ্জ অভিমুখী পাকবাহিনীর গাড়িসমূহ বাধাগ্রস্ত হয়। এ প্রতিরোধ ভাঙ্গতে তারা বেপরোয়া হয়ে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ শুরু করে। এতে নিকটবর্তী মকিমাবাদ গ্রামের বাসিন্দা আবদুল মতিন মজুমদার শহীদ এবং অনেক মানুষ আহত হন। পাকসেনারা কাটা রাস্তায় নেট বিছিয়ে অবশেষে মোটর গাড়ির বহর নিয়ে হাজীগঞ্জ বাজারে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়।
এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে পাকবাহিনী হাজীগঞ্জ থানা সদরে অনুপ্রবেশ করে এবং আলীগঞ্জের হামিদিয়া জুট মিলে স্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করে। এরপর তারা হাজীগঞ্জ বাজারের পূর্ব পার্শ্বস্থ বোয়ালঝুরি খালের ব্রিজ থেকে কয়েকশ গজ দূরবর্তী জুনাব আলী ময়দান সংলগ্ন দোতলা ভবনে রাজাকার বাহিনীর ক্যাম্প স্থাপন করে।
মে মাসে পাকবাহিনীর তত্ত্বাবধানে হাজীগঞ্জের পাকিস্তানপন্থীদের নিয়ে শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়। আনোয়ার হোসেনকে (পিতা খান সাহেব জনাব আলী, টোরাগড়) আহ্বায়ক করে থানা শান্তি কমিটি গঠিত হয়। চাঁদপুর মহকুমা রাজাকার কমান্ডার লোকমান হোসেন বাচ্চুর (টোরাগড়) নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। কেরামত আলী (টোরাগড়, কাজীরগাঁও), মুজিবুর রহমান (মকিমাবাদ), আলী আহম্মদ গাঁজা প্রমুখ রাজাকার বাহিনীর সংগঠক হিসেবে মুখ্য ভূমিকা পালন করে।
আনোয়ার হোসেনের সভাপতিত্বে ৩০শে জুলাই পাকিস্তানপন্থীদের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। জুনাব আলী ময়দানের দোতলা ভবনে আয়োজিত উক্ত সভায় বক্তব্য রাখে আজিজুর রহমান, মাজেদুল হক, দলিলুর রহমান প্রমুখ (এরা ছিল বৃহত্তর কুমিল্লার কুখ্যাত দালাল)। সভায় দেশের পরিস্থিতির জন্য ভারতকে দায়ী করা হয়। হাজীগঞ্জের কুখ্যাত রাজাকার ছিল বলাখাল গ্রামের মো. আলী আকবর বকাউল ও আবু আহমেদ এবং দোফল্লার আনা মিয়া (হাজীগঞ্জ মুক্ত হবার পর এরা গণপিটুনিতে প্রাণ হারায়)। অন্যান্য রাজাকার যারা মুক্তিযুদ্ধের পর আত্মগোপন করে এবং পরবর্তীতে ১৯৭২ সালের দালাল আইনে হাজীগঞ্জ থানায় গ্রেফতার হয়, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো— মো. সামছুল হক পোদ্দার (উল্লাশ্বর), আবদুর রশিদ (বড়কুল), মমিনুল হক (অলিপুর), চাঁন মিয়া (ব্রাহ্মণগাঁও), আবদুস সাত্তার (দোফল্লা), জমির উদ্দিন (দোফল্লা), সুলতান আহম্মদ (দোফল্লা) ও আবুল খায়ের (বড়কুল)। পাকবাহিনীর আরো দুজন দোসর ছিল এ বি এম খালেক মজুমদার (ধড্ডা) ও মো. নুরুজ্জামান (প্রতাপপুর)। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। এছাড়া ১৩ জনের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের দায়ে চাঁদপুর ফৌজদারী আদালতে মামলা হয় এবং তাদের মধ্যে একজন হলো হাজীগঞ্জের মো. সফিক উল্লাহ পাটোয়ারী (খাটরা)। রাজাকার কমান্ডার লোকমান হোসেন বাচ্চু ৮ই ডিসেম্বর হাজীগঞ্জ মুক্ত হবার দিন পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সঙ্গে প্রথমে ঢাকা এবং পরে রংপুরে চলে যায়। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে রংপুরে তিন বছর আত্মগোপন শেষে ১৯৭৪ সালের ১৫ই জুন নিজ গ্রাম টোরাগড় ফিরে এলে বিক্ষুব্ধ লোকজন তাকে ধরে পুলিশে সোপর্দ করে। এরপর তাকে প্রকৌশলী নূরুদ্দীন হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে জেলে প্রেরণ করা হয়। দীর্ঘ ছয় বছর কারাভোগের পর পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ১৯৭৯ সালের মার্চ মাসে সে মুক্তি পায়।
লোকমান হোসেন বাচ্চুর নেতৃত্বে চাঁদপুর মহকুমার ৬০০ জনের মতো লোক নিয়ে রাজাকার বাহিনী গড়ে তোলা হয়। সে শতাধিক সাধারণ মানুষকে হত্যা করে। তার দ্বারা শতাধিক হিন্দু-মুসলিম নারী নির্যাতিত হয়। এসব কাজে তার সহযোগী ছিল রাজাকার উজির আলী ও মন্তা। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে কুখ্যাত এ বাচ্চু রাজাকার সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিল। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে সে প্রথমে মুক্তিবাহিনীতে ঢুকে পড়ে। কিন্তু তার অনৈতিক কার্যকলাপ ও লুটপাটের প্রবণতা দেখে মুক্তিযোদ্ধারা তাকে হাত-পা-চোখ বেঁধে ডাকাতিয়া নদীতে ফেলে দেয়। স্থানীয় কিছু লোকের কৃপায় সে নদী থেকে উঠে মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পায়। এরপর সে কুমিল্লা সেনানিবাসে তার সাবেক কর্মস্থলে ফিরে যায়। জুন মাসে সে হাজীগঞ্জে ফিরে এলে চাঁদপুর মহকুমা শান্তি কমিটির সুপারিশে পাকহানাদাররা তাকে মহকুমা রাজাকার কমান্ডার হিসেবে নিয়োগ দেয়। এরপর বাচ্চু দুটি গণহত্যায় নেতৃত্ব দেয়। একটি কচুয়া ও হাজীগঞ্জ উপজেলার সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থিত বড় রঘুনাথপুর বাজারে এবং আরেকটি চাঁদপুর সদর উপজেলার ছোট সুন্দর গ্রামে।
রঘুনাথ বাজারে বাচ্চুর নেতৃত্বে গণহত্যা চালানোর প্রাক্কালে প্রতিরোধকারী মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মতিন গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হবার পর তাঁর মৃতদেহ নিয়ে পৈশাচিক বর্বরতা চালানো হয়। প্রথমে তাঁকে নৌকার পেছনে বেঁধে সাত মাইল পথ টেনে নিয়ে আসে। পরে হাজীগঞ্জ বাজারে জীপের পেছনে বেঁধে দুই মাইল রাস্তা অতিক্রম করে আব্দুল মতিনের লাশ টেনে- হিঁচড়ে ক্ষত-বিক্ষত করে জুনাব আলী ময়দান সংলগ্ন দোতলা ভবনের রাজাকার সদর দপ্তরের সামনে বাঁশের খুঁটিতে ২ দিন ধরে টাঙ্গিয়ে রেখে সাধারণ মানুষকে দেখতে বাধ্য করে। এরপর বাচ্চু রাজাকার নারকীয় উল্লাসে আব্দুল মতিনের লাশের বুকের উপরে পা রেখে স্টেনগান তাক করে ছবি তোলে এবং ঐ ছবি হাজীগঞ্জের সর্বত্র টানিয়ে রেখে ও বিতরণ করে নিজের দুর্ধর্ষ-ভয়ঙ্কর রূপ তুলে ধরে জনমনে ভীতির সঞ্চার করে।
হাজীগঞ্জে পাকহানাদার ও তাদের দোসর রাজাকার বাহিনী কর্তৃক বেশ কয়েকটি গণহত্যা সংঘটিত হয়। সেগুলো হলো- বড়কুল গণহত্যা, কাশিমপুর গণহত্যা, রঘুনাথপুর গণহত্যা ও লাওকরা গণহত্যা।
২৬শে এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ৬নং বড়কুল (পূর্ব) ইউনিয়নের বড়কুল গ্রামে আকস্মিক অভিযান চালিয়ে গুলিবর্ষণ করে এবং বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে। এতে ২৬ জন গ্রামবাসী নিহত হয়। ৪ঠা মে হাজীগঞ্জের নিভৃত পল্লি ১০নং গন্ধর্বপুর (দক্ষিণ) ইউনিয়নের কাশিমপুরে পাকহানাদাররা ২৩ জন মানুষকে হত্যা করে। দোফল্লা গ্রামের বাসিন্দা, কুখ্যাত রাজাকার আনা মিয়া এ গণহত্যার প্রধান সহযোগী ছিল। পাকবাহিনী হত্যা, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে এ গ্রামে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। ৮ই সেপ্টেম্বর বুধবার মতলব, হাজীগঞ্জ ও কচুয়া উপজেলার সীমানায় বোয়ালঝুরি খালের পাড়ে অবস্থিত রঘুনাথপুর বাজারে সাপ্তাহিক হাটবারের দিন গণহত্যা চালায় লোকমান হোসেন বাচ্চুর নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনী। এতে তিন উপজেলার অর্ধশত সাধারণ মানুষ প্রাণ হারান। ২৩শে অক্টোবর ৮নং হাটিলা (পূর্ব) ইউনিয়নের লাওকরার (লাকমারা) গ্রামে হানাদাররা হামলা চালিয়ে বহু লোককে হত্যা করে।
পাকবাহিনীর হামিদিয়া জুট মিলস-এর ক্যাম্প এবং রাজাকার বাহিনীর জুনাব আলী ময়দান সংলগ্ন দোতলা ভবনের ক্যাম্প ছিল তাদের নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির। লোকমান হোসেন বাচ্চুর নেতৃত্বে রাজাকাররা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের নেতৃস্থানীয় লোকজন, সাধারণ মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধার পিতা, ভাইসহ – ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনকে তাদের ক্যাম্পে ধরে নিয়ে আসত। ধনাঢ্যদের কাছ থেকে নগদ অর্থ নিয়ে কাউকে ছেড়ে দিত, আবার কখনো অর্থ আদায় করেও ছেড়ে না দিয়ে হামিদিয়া জুট মিলস-এর বন্দিশালায় পাঠিয়ে দিত। সেখানে তাদের হাত-পা বেঁধে নির্যাতন শেষে গুলি করে বা বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করা হতো। জুনাব আলী ময়দানের দোতলা ভবন ও হামিদিয়া জুট মিলস-এর ক্যাম্পে প্রতিদিনই পাকসেনা ও তাদের দোসর রাজাকার কর্তৃক নারী ধর্ষণসহ সাধারণ মানুষকে নির্যাতন ও হত্যার ঘটনা ঘটত।
আগস্ট মাসে জুনাব আলী ময়দানের দোতলা ভবন রাজাকারদের প্রধান নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবিরে পরিণত হয়। এখানে নির্যাতন শেষে নারী, মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজনকে হামিদিয়া জুট মিলস এলাকায় হত্যা করে পার্শ্ববর্তী ডাকাতিয়া নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হতো। এছাড়া নির্যাতনের পর লোকজনকে হাত-পা ও মুখ বেঁধে বস্তাবন্দি করে রাতের আঁধারে হাজীগঞ্জ বাজারের পশ্চিমে মিঠানিয়া খালে ফেলে দেয়া হতো। মুক্তিযুদ্ধ শেষে ডিসেম্বর- জানুয়ারিতে এই খাল থেকে সংগৃহীত মানব কঙ্কাল মিঠানিয়া পূর্ব-দক্ষিণ দিকের জমিতে স্তূপ করে রাখা হয়। পাকবাহিনী হাজীগঞ্জ উপজেলার হামিদিয়া জুট মিলস এলাকায় বহু মানুষকে ধরে এনে হত্যা করে নদীতে ভাসিয়ে দিত। ঐ স্থানটি হামিদিয়া জুট মিলস বধ্যভূমি নামে পরিচিত। হাজীগঞ্জ উপজেলায় পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। সেগুলো হলো— রামচন্দ্রপুর খেয়াঘাট যুদ্ধ, বলাখাল হরিসাহার বাড়ি যুদ্ধ, – লাওকরা যুদ্ধ, ফকিরহাট যুদ্ধ, বলাখাল যুদ্ধ, ফুলছোঁয়া যুদ্ধ, মুকুন্দসার যুদ্ধ ও হাজীগঞ্জ রেল ব্রিজ অপারেশন। ১৭ই মে মুক্তিফৌজ (এমএফ)-এর চাঁদপুর মহকুমা কমান্ডার সুবেদার জহিরুল হক পাঠানের নেতৃত্বে হাজীগঞ্জ পৌরসভার প্রসিদ্ধ এলাকা বলাখালের পার্শ্ববর্তী রামচন্দ্রপুর খেয়াঘাটে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর তুমুল যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে পাঠানের সহযোগী ছিলেন বি এম কলিম উল্যা ভূঁইয়া, নায়েক সুবেদার নূর আহমেদ গাজী, সুবেদার আলী আকবর পাটোয়ারী প্রমুখ। দুঘণ্টাব্যাপী এ-যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা হাবিলদার লোকমান আহত হন এবং ৫ জন স্থানীয় ব্যক্তি প্রাণ হারান। মুক্তিযোদ্ধাদের সাঁড়াশি আক্রমণে বেসামাল হয়ে পাকসেনারা নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এতে বেশ কয়েকজন পাকসেনা ও রাজাকার নিহত হয়।
২৭শে আগস্ট বলাখাল হরিসাহার বাড়িতে লুটপাট চালাতে আসে পাকবাহিনী ও রাজাকাররা। খবর পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের আক্রমণ করে। দুঘণ্টাব্যাপী এ-যুদ্ধে ৫ জন স্থানীয় লোক শহীদ হন; ১০ জনের অধিক পাকসেনা ও রাজাকার নিহত হয় এবং ১৫ জন রাজাকার বন্দি হয়। এ-যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন সুবেদার জহিরুল হক পাঠান। তাঁর সহযোগী ছিলেন বি এম কলিম উল্লাহ ভূঁইয়া, হাবিলদার রশিদ, নায়েক গোলাম মাওলা, নায়েক সিদ্দিক প্রমুখ।
সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে হাটিলা পূর্ব ইউনিয়নের লাওকরা গ্রামে পাকবাহিনী ও রাজাকারদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর তুমুল যুদ্ধ হয়। এতে ১০ জন পাকসেনা ও রাজাকার নিহত হয়। অপরপক্ষে বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে সংঘটিত হয় ফকিরহাটের যুদ্ধ। তৎকালীন রাজাগাঁও ইউনিয়নের অন্তর্গত ফকিরহাটে (বর্তমান বাকিলা) রাজাকারদের সঙ্গে সংঘটিত এ-যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে নেতৃত্ব দেন কমান্ডার মো. মুজিবুর রহমান মজুমদার। এ-যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা ছিদ্দিকুর রহমান আহত হন।
আগস্ট নভেম্বর মাসে বলাখাল যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এতে কয়েকজন রাজাকার ধরা পড়ে এবং বাকি রাজাকার ও পাকসেনারা পালিয়ে যায়। তাদের কিছু অস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়।
১০ই ডিসেম্বর ফুলছোঁয়া যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এতে পাকসেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। একই দিন দ্বাদশ গ্রাম ইউনিয়নের মুকুন্দসারে পলায়নরত পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তক্ষয়ী সম্মুখ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ-যুদ্ধে ২ জন পাকসেনা নিহত হয়। অপরপক্ষে ৪ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
অক্টোবর মাসে বি এম কলিম উল্যা ভূঁইয়ার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা হাজীগঞ্জ রেল ব্রিজে পাহারারত রাজাকারদের ওপর আক্রমণ করেন। এ অপারেশনে ২৫ জন রাজাকার হাতিয়ার ও গোলাবারুদসহ মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট আত্মসমর্পণ করে। তারা অনেক তথ্য দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করে।
ভারতের মাউন্টেন ব্রিগেড এবং ইস্টার্ন সেক্টরের মুক্তিবাহিনীর সমন্বয়ে যৌথ বাহিনী কুমিল্লা-চাঁদপুর সড়ক দিয়ে ৬ই ডিসেম্বর চাঁদপুর যাওয়ার পথে হাজীগঞ্জে পাকসেনাদের তীব্র প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। ৩৬ ঘণ্টা তীব্র লড়াইয়ের পর ৮ই ডিসেম্বর হাজীগঞ্জ হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- মো. আনোয়ার হোসেন, বীর উত্তম (পিতা মো. আবদুল হক, আলীগঞ্জ) ও আব্দুল হাকিম, বীর প্রতীক (পিতা ফজলুর রহমান, মোহাম্মদপুর)।
হাজীগঞ্জ উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- মো. আনোয়ার হোসেন, বীর উত্তম (যশোর সেনানিবাসে পাকিস্তানি সৈন্যদের গুলিতে শহীদ), আলী আজ্জম (পিতা আবদুর রহমান মুন্সী, মকিমাবাদ), মো. আবু তাহের মিয়া (পিতা আব্দুল কাদের, সুবিদপুর, হাজীগঞ্জ সদর), মো. এমদাদুল হক (পিতা মো. ফজলুল হক মাস্টার, সেন্দ্রা, হাজীগঞ্জ সদর), জয়নাল আবেদীন (পিতা আবদুল মজিদ মিয়া, রাধাসার, রাজারগাঁও), মো. আব্দুর রশিদ (পিতা মনোহর আলী, কীর্তনখোলা), মো. জয়নাল আবেদীন (পিতা সেকান্দর আলী, লোধপাড়া, হাজীগঞ্জ সদর), মো. জহিরুল হক (সমেশপুর), মো. আবদুল মান্নান (পিতা মো. ইয়াকুব আলী, সোনাইমুড়ি, বড়কুল পূর্ব), জাহাঙ্গীর আলম (পিতা মো. ছেরাজল হক বেপারী, পূর্ব রাজারগাঁও), ইদ্রিস তপাদার (আনসার সদস্য, পিতা আলহাজ্ব বশির উদ্দিন তপাদার, মোহাম্মদপুর, গন্ধর্বপুর), আব্দুল মান্নান মিয়াজি (পিতা করিম উদ্দিন মিয়াজি, মকিমাবাদ, হাজীগঞ্জ পৌর এলাকা)। এঁরা হাজীগঞ্জ উপজেলা ও চাঁদপুর জেলা এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত যুদ্ধে শহীদ হন। এঁদের মধ্যে আলী আজ্জমকে তাঁর গ্রামের বাড়ি মকিমাবাদে এবং বাকিদের অনেককে নাসিরকোটে সমাধিস্থ করা হয়।
হাজীগঞ্জের শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্মরণে ১৯৭৩ সালের ২৫শে মার্চ নাসিরকোট শহীদ স্মৃতি কলেজ নামে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৮০ সালে সরকারি অর্থায়নে নাসিরকোটে ৯ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সমাধির ওপর স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। এসব শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- মো. এমদাদুল হক, মো. জহিরুল হক, মো. জাহাঙ্গীর আলম, মো. আবদুর রশিদ, মো. জয়নাল আবেদীন (লোধপাড়া), মো. আবু তাহের মিয়া (রাধাসার), মো. জয়নাল আবেদিন (রাধাসার), মো. আবদুল মতিন (পিতা হাজী আব্দুল গফুর, রাজাপুর, শাহরাস্তি) ও মো. ইলিয়াছ হুছাইন (পিতা সৈয়দ আব্দুর রাজ্জাক, আলীপুর, শাহরাস্তি)। এছাড়া নাসিরকোট শহীদ সমাধি ও স্মৃতি পাঠাগার সংরক্ষণ পরিষদ গঠন করা হয়। এ পরিষদসহ কলেজ কর্তৃপক্ষ প্রতিবছর স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসে নাসিরকোটে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে। হাজীগঞ্জ বাজারে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আলী আজ্জমের নামে সাবেক স্টেশন রোডের নামকরণ করা হয়েছে। ওয়ারুক রেলস্টেশন থেকে লাওকরা পর্যন্ত সড়কের নামকরণ করা হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা সড়ক।
এ উপজেলার মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক তাফাজ্জল হায়দার ওরফে নসু চৌধুরী। তাঁর স্ত্রী ডা. সৈয়দ বদরুন নাহার চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস স্বামীর সঙ্গে রণাঙ্গনে থেকে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অবদান রাখার স্বীকৃতিস্বরূপ স্বাধীনতা পদক লাভ করেন। তিনি ২০০৭ সালের ২৪শে জানুয়ারি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। [কাজী শাহাদাত]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!