হাড়িখোলা ব্রিজ বধ্যভূমি (চান্দিনা, কুমিল্লা)
হাড়িখোলা ব্রিজ বধ্যভূমি (চান্দিনা, কুমিল্লা) কুমিল্লা জেলার চান্দিনা উপজেলায় অবস্থিত। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চান্দিনা বাস স্টেশন থেকে দুই কিলোমিটার পশ্চিমে হাড়িখোলা স্থানটি অবস্থিত। মুক্তিযুদ্ধকালে এখানে খালের ওপর একটি ব্রিজ ছিল। সাধারণ মানুষজন ব্রিজের নিচ দিয়ে নৌকায় খাল পার হবার সময় রাজাকার- আলবদর- ও পাকবাহিনীর সদস্যরা তাদের গ্রেফতার করত এবং খালের পাড়ে নিয়ে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করত। বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষজন ধরে এনে একইভাবে হত্যা করত। কখনো- কখনো মুক্তিযোদ্ধারাও তাদের হত্যার শিকার হতেন। মে মাস থেকে এখানে এ হত্যাকাণ্ড শুরু হয়।
হাড়িখোলা ব্রিজের নিচ দিয়ে চান্দিনা, দেবিদ্বার ও আশ-পাশের মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ নিরীহ জনগণ যাতায়াত করত। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রথম থেকে হাড়িখোলা ব্রিজের নিচে পাকবাহিনীর তত্ত্বাবধানে রাজাকাররা পাহারা বসায়। পাহারার সময় সন্দেহভাজনদের ধরে তারা হত্যা করত। এখানে অক্টোবর-নভেম্বর মাস পর্যন্ত হত্যাকাণ্ড চলে। মোট কতজনকে ব্রিজের নিচে হত্যা করা হয়েছে তার সঠিক সংখ্যা উদ্ধার করা কখনো সম্ভব হবে না। মুক্তিযোদ্ধা ও হাড়িখোলা গ্রামের বাসিন্দাদের সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায় যে, এখানে কয়েকশ নিরীহ নর-নারী ও মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করা হয়। তবে ব্রিজের নিচে যাদের হত্যা করা হয়নি এমন অনেকের লাশও এই খালে পাওয়া যায়। সে-সময় খালে প্রচুর কচুরিপানা ছিল। বিভিন্ন স্থানে হানাদার বাহিনীর হত্যার শিকার অনেকের লাশ কচুরিপানার নিচে ভেসে আসে। এর মধ্যে কাঠের পুল সাহাপাড়া (পুলঘাটা) বধ্যভূমিতে গণহত্যার শিকার চান্দিনা উপজেলার ছায়কোট গ্রামের সোনা মিয়া মেম্বার (পিতা জাহা বক্স)-এর লাশ হাড়িখোলা ব্রিজের নিচে ভেসে ওঠে। চান্দিনা বাজারের লবণ ব্যবসায়ী দেবিদ্বার উপজেলার নবিয়াবাদ গ্রামের সুরেন্দ্র নাথকে হত্যা করা হয় কাঠের পুল সাহাপাড়া (পুলঘাটা) বধ্যভূমিতে। তার লাশও হাড়িখোলা ব্রিজের নিচে পাওয়া যায়। এভাবে কিছু-কিছু লাশ শনাক্ত করা সম্ভব হয়।
হাড়িখোলা ব্রিজের পাশে বর্তমান উষা জুট মিলের সামনে বসত দুধের বাজার। প্রতিদিন পাকবাহিনীর সদস্যরা এ বাজারে এসে দুধ বিক্রেতাদের সকলকে চেক করত এবং লুঙ্গি খুলতে বলত। আলফু (হাড়িখোলা, চান্দিনা) ছিল ঐ বাজারের একজন দুধ ব্যবসায়ী। একদিন আলফু মিয়া বিরক্ত হয়ে পাকবাহিনীর সদস্যদের বলার আগেই লুঙ্গি খুলে দাঁড়িয়ে ছিল। নির্দেশনার আগে এমন আচরণ করায় তারা রেগে যায় এবং আলফু মিয়াকে প্রকাশ্যে বাজারে গুলি করে হত্যা করে। পরে তার লাশ খালে ফেলে দেয়।
যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে হাড়িখোলা ব্রিজের নিচ দিয়ে একটি বড় নৌকা বোঝাই শরণার্থী দল পার হচ্ছিল। পাকবাহিনীর সদস্যরা তাদের ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে। তাদের অনেকের লাশ খালে ভাসতে দেখা যায়।
মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন ছাত্র ভারতে প্রশিক্ষণ নিতে হাড়িখোলা ব্রিজ পার হচ্ছিল। ২০শে অক্টোবর হানাদার বাহিনী তাদের গুলি করে হত্যা করে। [মো. তামিদুর রহমান দিদার]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড