হলুদিয়া রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন (ফটিকছড়ি, চট্টগ্রাম)
হলুদিয়া রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন (ফটিকছড়ি, চট্টগ্রাম) পরিচালিত হয় ১০ই ডিসেম্বর মীর্জা আবু মনসুর ও লে. শওকতের নেতৃত্বে। এতে ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও ৪ জন গুলিবিদ্ধ হন। অপরপক্ষে ৩ জন পাকসেনা নিহত হয়। অপারেশনের পূর্বরাতে হলুদিয়া ক্যাম্পে পাকসেনারা আশ্রয় নিয়েছিল। এ খবর মুক্তিযোদ্ধাদের জানা ছিল না। তাই তাঁরা তেমন প্রস্তুতি না নিয়েই ক্যাম্প আক্রমণ করেন। এর ফলে ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। তাঁরা হলেন— পংকজ বড়ুয়া (পিতা সুরেন্দ্রলাল বড়ুয়া, পিঙ্গলা, রাউজান), শামসুল আলম (পিতা বদিউল আলম, নোয়াখালী) এবং আবদুল মান্নান (পিতা এস এম আবদুল জলিল, উত্তর সত্তা)। পাকসেনারা এঁদের লাশ তাদের দখলে নিয়ে নেয়। এরপর এদিন দুপুরের দিকে পাকসেনারা পার্শ্ববর্তী হলুদিয়া গ্রামে ঢুকে অত্যাচার ও অগ্নিসংযোগসহ ১২ জনকে গুলি করে হত্যা করে।
পাকবাহিনী কর্তৃক অগ্নিসংযোগ ও গণহত্যার খবর শুনে মুহূর্তের মধ্যে কচুপাড়া ক্যাম্পের মুক্তিযোদ্ধারা এবং ফটিকছড়ি এলাকার মুক্তিযোদ্ধা আবু বকর সিদ্দিকী ও শেখ আবু আহমদ গ্রুপের সদস্যরা ঘটনাস্থলে চলে আসেন এবং একটি বাড়ির পুকুরপাড়ে পজিশন নেন। আবু বকর, সালমান ও শেখ আবু আহমদ ছিলেন কমান্ডার। কিছুক্ষণের মধ্যে মিলিশিয়া ও রাজাকার বাহিনী ঐ বাড়ির দিকে আসতে থাকে। কিন্তু কমান্ডারদের নির্দেশ ছাড়াই বাবুল নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা গুলিবর্ষণ শুরু করেন। এরপর কমান্ডারসহ উপস্থিত ২২ জন মুক্তিযোদ্ধা একযোগে গুলি ছোড়া শুরু করেন। হানাদাররা ভয়ে পালিয়ে যায়। তাদের পেছনে-পেছনে ধাওয়া করে মুক্তিযোদ্ধারা কানখাইয়া খালে গিয়ে অবস্থান নেন। মুক্তিযোদ্ধাদের দুগ্রুপই খালের এক পাড়ে তাদের অবস্থান দৃঢ় করে। মিলিশিয়া ও রাজাকাররা খালের অপর পাড়ে অবস্থান নেয়। বকর গ্রুপের ২ জন মুক্তিযোদ্ধা নির্দেশ না মেনে খাল পার হয়ে ওপারে যান এবং গুলিবিদ্ধ হন। ইতোমধ্যে নুরুল গনি গ্রুপ ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছায়। ভরত বড়ুয়ার গ্রুপসহ অন্য একটি গ্রুপ সিলোনিয়া খালের অবস্থানে ছিল। গোলাগুলির শব্দ শুনে তাঁরা সেখানেই পজিশন নেন। কিছুক্ষণের মধ্যে লে. শওকতও গুলির শব্দ শুনে এগিয়ে আসেন। কানখাইয়া খাল ও সিলোনিয়া খাল বরাবর ৩ মাইল এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরোধব্যূহ রচনা করেন। এরপর কমান্ডারের নির্দেশ উপেক্ষা করে ভরত গ্রুপ প্রতিরোধব্যূহকে ছাড়িয়ে আরো সামনে এগোবার লক্ষে সত্তাখাল পার হয়ে শত্রুর ওপর আক্রমণ রচনা করে। এখানে ভরত গ্রুপের ২ জন মুক্তিযোদ্ধা গুলিবিদ্ধ হন। মুক্তিযোদ্ধারা নিজ-নিজ অবস্থানে থেকে অনবরত গুলি ও শত্রুর অবস্থানের ওপর দুই ইঞ্চি মর্টারের সাহায্যে গোলাবর্ষণ করতে থাকেন। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে মিলিশিয়া ও রাজাকাররা এলাকা ছেড়ে চলে যায়।
হলুদিয়া রাজাকার ক্যাম্প অপারেশনে ৩ জন পাকসেনা নিহত হয়। পাকিস্তানি সেনারা নিহত তাদের ৩ জনসহ মুক্তিযোদ্ধাদের ৩টি লাশ নিয়ে রাউজান চলে যায় এবং তিন মুক্তিযোদ্ধার লাশ রাউজান কলেজের পশ্চিম পাশে সিকদার বাড়ির পার্শ্ববর্তী শিব দাশের বাড়ির গর্তে ফেলে দেয়। কয়েকদিন পর দেশ হানাদারমুক্ত হলে পংকজ বড়ুয়া ও আবদুল মান্নানের লাশ উদ্ধার করে তাঁদের স্বজনরা নিজ-নিজ বাড়িতে নিয়ে যথাযোগ্য মর্যাদায় সমাহিত করে। শামসুল আলমের লাশ রাউজান কলেজ সংলগ্ন পাক্কাইন্যা পুকুরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণায় যথাযোগ্য মর্যাদায় সমাহিত করা হয়। [জামাল উদ্দিন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড