বীর প্রতীক হাজারীলাল তরফদার
হাজারীলাল তরফদার, বীর প্রতীক (জন্ম ১৯৪২) বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৪২ সালের ১৫ই মে যশোর জেলার অন্তর্গত চৌগাছা উপজেলার রানীয়ালী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম রসিকলাল তরফদার, মাতা শৈলবালা তরফদার।
অষ্টম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়ার পর নানা কারণে আর হাজারীলাল তরফদারের পড়ালেখার সুযোগ হয়নি। বাড়িতে নানা সাংসারিক কাজে জড়িয়ে পড়েন। কৃষি কাজের পাশাপাশি তিনি রাজনীতি সচেতন একজন যুবক ছিলেন। তিনি ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ও ৭০-এর নির্বাচন প্রত্যক্ষ করেন৷ ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যা শুরু হলে স্বপ্রণোদিত হয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। প্রতিরোধযুদ্ধে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
৩০শে মার্চ রাতে যশোর সেনানিবাসের পাকসেনারা রানীয়ালী গ্রামে অতর্কিতে আক্রমণ চালিয়ে মানুষের বাড়িঘর ধ্বংস, নারীনির্যাতন, নির্বিচারে হত্যা ও লুটপাটের দ্বারা সমগ্র এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। এ নৃশংস বর্বরতা সহ্য করতে না পেরে হাজারীলাল তরফদার পাকসেনাদের দোসর ২ জন দালালকে হত্যা করে ভারতের বনগাঁ চলে যান এবং বনগাঁ টালীখোলা মুক্তিবাহিনী ক্যাম্পে যোগ দেন। সেখান থেকে তাঁকে বিহারের চাকুলিয়া মুক্তিবাহিনী প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে প্রেরণ করা হয়। চাকুলিয়া প্রশিক্ষণ ক্যাম্প থেকে তিনি ২৮ দিনের অস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। প্রশিক্ষণ শেষে ৮নং সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ মঞ্জুরের নেতৃত্বে পাকসেনাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। হাজারীলাল তরফদার ক্যাপ্টেন খন্দকার নাজমুল হকের নেতৃত্বে বয়রা সাব-সেক্টরে অনেক দুঃসাহসিক অভিযানে অংশগ্রহণ করেন। তন্মধ্যে দোসতিনা পাকিস্তানি টহলদলের বিরুদ্ধে অভিযান, পাকবাহিনীর গোরপাড়া ক্যাম্প অভিযান, শিমুলিয়া ঘাঁটিতে আক্রমণ রাজাকারসহ ১৫০ জন পাকসেনাকে হত্যা উল্লেখযোগ্য। সেপ্টেম্বর মাসের প্রথমার্ধে হাজারীলাল তরফদারসহ একদল মুক্তিযোদ্ধা ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী গ্রাম দোসতিনায় এম্বুশ করে পাকিস্তানি টহলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এক পর্যায়ে ব্যাপক গোলাগুলি শুরু হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে হতচকিত পাকবাহিনী পিছু হটলেও পুনরায় শক্তি সঞ্চয় করে পাল্টা আক্রমণ শুরু করে। তখন পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড যুদ্ধ শুরু হয়। হাজারীলাল সেদিনের যুদ্ধে অসীম সাহসিকতার পরিচয় দেন। যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর টহলদলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ৬ জন পাকসেনা নিহত ও ২ জন আহত হয়। বাকি সৈন্যরা স্থান ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।
হাজারীলাল তরফদারের অসীম সাহসিকতা ও যুদ্ধ পরিচালনায় নৈপুণ্যের স্বাক্ষর ছিল পাকহানাদার বাহিনীর গোরপাড়া ক্যাম্প অভিযান। তিনি আক্রমণ চালিয়ে ঐ ক্যাম্পে অবস্থানরত সকল পাকসেনাকে হত্যা, তাদের অস্ত্র, গোলাবারুদ ও রসদ এবং পরিত্যক্ত মৃতদেহ ১৫টি গরুর গাড়ি যোগে সাব-সেক্টর হেডকোয়ার্টার্সে কমান্ডারের নিকট জমা দেন।
হাজারীলাল তরফদার অনেক সম্মুখ ও গেরিলা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তন্মধ্যে চৌগাছা, নাভারন, ছুটিপুর, গোয়ালহাটি, গদখালি, কাগজপুর ও বেনাপোলের যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য। তিনি বয়রা সাব-সেক্টরে দুর্ধর্ষ ও সাহসী যোদ্ধা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।
মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে গুরুত্বপুর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক হাজারীলাল তরফদারকে ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করা হয়। তাঁর ২ পুত্র ও ৩ কন্যা সন্তান রয়েছে। তাঁর স্ত্রীর নাম সুমিত্রা রাণী তরফদার। [মো. ওসমান গনী]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড