You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে হরিরামপুর উপজেলা (মানিকগঞ্জ)

হরিরামপুর উপজেলা (মানিকগঞ্জ) মানিকগঞ্জ জেলার সর্বদক্ষিণে পদ্মানদীর প্রায় ত্রিশ কিলোমিটার তীর ঘেঁষে অবস্থিত। আয়তনে বিশাল এ উপজেলা ১৩টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত। এটি একটি প্রত্যন্ত জনপদ হলেও শিক্ষা, রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে সচেতনতার কারণে এ উপজেলার বিশেষ ঐতিহ্য রয়েছে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে এ অঞ্চলের মানুষের গৌরবময় ভূমিকা ছিল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর
ভাষা-আন্দোলন ও যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনকে ঘিরে এ অঞ্চলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের এক শক্তিশালী ভিত্তি গড়ে ওঠে। হরিরামপুর বামপন্থী আন্দোলনের অন্যতম সূতিকাগার নামেও খ্যাত।
১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে হরিরামপুরের ছাত্র-জনতা নিভৃত পল্লি-প্রান্তরকে মিছিল-স্লোগানে প্রকম্পিত করে তোলে। ছাত্রনেতা মো. ইয়াকুব আলী, মো. আওলাদ হোসেন, খন্দকার লিয়াকত হোসেন, দেওয়ান সফিকুল ইসলাম প্রমুখ আন্দোলনের অগ্রভাগে থেকে সমগ্র দক্ষিণ মানিকগঞ্জে আইয়ুব-বিরোধী আন্দোলনকে বেগবান করেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ অভূতপূর্ব বিজয় অর্জন করে। কিন্তু পাক সামরিক জান্তা নানা অজুহাতে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া বিলম্বিত করতে থাকে। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের তাৎপর্য বুকে ধারণ করে বাংলার কৃষক-শ্রমিক ও ছাত্র-জনতা অমিততেজে জ্বলে ওঠে। প্রতিটি বাঙালির মনে ধ্বনিত হতে থাকে বঙ্গবন্ধুর ইতিহাস সৃষ্টিকারী অমর বাণী, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ ২৫শে মার্চ রাতের অন্ধকারে পাকিস্তানের বর্বর সেনাবাহিনী এদেশের নিরীহ মানুষের ওপর পৈশাচিক আক্রমণ চালায়। ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এ খবর শুনে হরিরামপুরের সংগ্রামী জনতা এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ স্বতঃস্ফূর্তভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকা সদরের দক্ষিণ, মুন্সীগঞ্জ, মানিকগঞ্জ ও কুমিল্লার মতলব থানাসহ ২২টি থানা কমান্ডের হেডকোয়ার্টার্স ছিল হরিরামপুরে। ফলে হরিরামপুরের মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও মুক্তিযোদ্ধাদের কর্মকাণ্ড এই ২২টি থানায়ই বিস্তৃত ছিল। মানিকগঞ্জ মহুকুমা সদর থেকে দূরত্ব ও যাতায়াত ব্যবস্থার প্রতিকূলতার কারণে হরিরামপুর ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ এর পর থেকেই এ এলাকার ছাত্র ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সামরিক প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে চিন্তা করতে থাকেন। মার্চের শেষদিকে ক্যাপ্টেন আবদুল হালিম চৌধুরী ২০-২৫টি রাইফেল নিয়ে হরিরামপুর আসেন। গুলিবিহীন এসব রাইফেল দিয়েই মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শুরু হয়। হরিরামপুরে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক আব্দুল মতিন চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা মো. ইয়াকুব আলী, আওলাদ হোসেন, খন্দকার লিয়াকত হোসেন (ছাত্রলীগ নেতা) প্রমুখ বিভিন্ন স্থানে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। এ সময় ছুটিতে থাকা ও অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক এবং ইপিআর বাহিনীর সদস্যবৃন্দ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ প্রদানে অবদান রাখেন। এসব সৈনিকের মধ্যে ছিলেন আবদুস সালাম, আব্দুল হাকিম, আবদুল আহাদ, ফিরোজ আহমেদ, ইরফান আলী মৃধা, মোহাম্মদ আলী শিকদার, হারুনুর রশিদ, চান মিয়া, কাদের ভূঁইয়া, গোলাম মহিউদ্দিন, মো. কফিল উদ্দিন দেওয়ান প্রমুখ।
হরিরামপুরে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুল হালিম চৌধুরী (মানিকগঞ্জ), আব্দুল মতিন চৌধুরী (আজিমনগর), অধ্যক্ষ আব্দুর রউফ খান (মালুচী), এডভোকেট মীর হাবিবুর রহমান (আজিমনগর), থানা আওয়ামী লীগ সভাপতি ডা. চিত্তরঞ্জন দত্ত ওরফে ভোলা বাবু (লেছড়াগঞ্জ), ন্যাপ নেতা আবদুল খালেক মৃধা (বলড়া), মো. আওলাদ হোসেন (বয়ড়া), মীর মোশারফ হোসেন মুতাহার (সুতালড়ি), আবদুল কাদের খান (বলড়া), মো. ইয়াকুব আলী (বয়ড়া), আব্দুর রশিদ খান মাস্টার (সুতালড়ি), আয়নাল হোসেন ফকির (বয়ড়া), সুবল চন্দ্র হালদার (সুতালড়ি), নরেশ চৌধুরী (সুতালড়ি), গোলাম মহিউদ্দিন (রামকৃষ্ণপুর), আহাম্মদ চেয়ারম্যান (সুতালড়ি) প্রমুখ।
হরিরামপুরে মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুল হালিম চৌধুরী (এরিয়া কমান্ডার, মানিকগঞ্জ), আব্দুল মতিন চৌধুরী (২২ থানা কমান্ডের ডেপুটি কমান্ডার, সার্বিক, সুতালড়ি), অধ্যক্ষ আবদুর রউফ খান (২২ থানা কমান্ডের ডেপুটি কমান্ডার, অপারেশন, মালুচী, শিবালয়), মো. আওলাদ হোসন (২২ থানা কমান্ডের অতিরিক্ত ডেপুটি কমান্ডার, বয়ড়া), মীর মোশারফ হোসেন মুতাহার (২ নং সাব-এরিয়া কমান্ডার, সুতালড়ি), আবদুল হাকিম (কোম্পানি কমান্ডার, চার্লি কোম্পানি, চালা), গোলাম মহিউদ্দিন (কোম্পানি কমান্ডার, আলফা কোম্পানি, রামকৃষ্ণপুর) এবং আবুল বাশার (কোম্পানি কমান্ডার, বিটা কোম্পানি, শিকারীপাড়া)।
ঢাকায় ২৫শে মার্চ সংঘটিত নারকীয় ঘটনার পরের দিন ২৬শে মার্চ আব্দুল মতিন চৌধুরীর নেতৃত্বে আজিমনগর বাজার থেকে ছাত্র-জনতার এক বিশাল মিছিল হরিরামপুর অভিমুখে রওনা হয়। দীর্ঘ পাঁচ মাইল অতিক্রমকারী এ মিছিলে হাজার-হাজার কৃষক-শ্রমিক ও সাধারণ মানুষ যোগ দেয়। মিছিলকারীদের হাতে ছিল বাঁশের লাঠি, রামদা, কাতরা ইত্যাদি দেশীয় অস্ত্র। মিছিলটি হরিরামপুরের বিভিন্ন জায়গা প্রদক্ষিণ করে।
ঢাকার পশ্চিমাঞ্চলে হরিরামপুর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল হওয়ায় কৌশলগত কারণে এখান থেকে মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে কোনো প্রতিরোধযুদ্ধের পরিকল্পনা করেননি। তবে পাকবাহিনীকে সন্ত্রস্ত রাখার জন্য মাঝে-মাঝে রাতে দু-এক রাউন্ড গুলি ছোড়া হতো। এতে পাকবাহিনী ভীতির মধ্যে দিন কাটাত।
পাকবাহিনী এপ্রিলের শেষদিকে হরিরামপুর থানা সদরে প্রবেশ করে, কিন্তু কোনো স্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন না করেই তারা চলে যায়। মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে হরিনা গ্রামে অবস্থিত থানা সদরের নবনির্মিত ভবনসমূহে তারা ক্যাম্প স্থাপন করে।
হরিরামপুরে মুসলিম লীগ নেতাদের ছত্রছায়ায় শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। শান্তি কমিটির প্রধান ছিল আব্দুল ওয়াহাব মোল্লা (লেছড়াগঞ্জ) ও আব্দুর রব মোল্লা (লেছড়াগঞ্জ; লেছড়াগঞ্জ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান)। সদস্য ছিল এডভোকেট বজলু মিয়া (লেছড়াগঞ্জ), রমজান মুন্সি (লেছড়াগঞ্জ ইউনিয়নের প্রাক্তন চেয়ারম্যান), নয়ান মোল্লা ওরফে নয়ান ঢুলি (জালসা), মোতালেব মুন্সি (বয়ড়া,), শেখ মোহাম্মদ সুলতান (বয়ড়া), আবদুর রাজ্জাক (বয়ড়া), আবদুস সালাম (বয়ড়া), মো. জাফর (বয়ড়া), মো. তাইজদ্দিন (বয়ড়া), মো. আলাউদ্দিন (বয়ড়া) এবং ওমর আলী (বয়ড়া)। এরা নানাভাবে পাকবাহিনীকে সহায়তা করে। এছাড়া অর্থের লোভে অনেকে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেয় এবং পাকবাহিনীকে সহায়তা করে।
পাকবাহিনী ও রাজাকাররা হরিনা গ্রামে অবস্থিত ক্যাম্প থেকে আশপাশের গ্রামগুলোতে নানা ধরনের অত্যাচার চালাত। তারা হরিনা, রামকৃষ্ণপুর ও বয়ড়া গ্রাম থেকে জোর করে সাধারণ মানুষের বিভিন্ন ধরনের সম্পদ নিয়ে যেত। পাকবাহিনী পাঠানকান্দি গ্রামের কয়েকটি বাড়ি এবং বয়ড়া গ্রামের সেনাসদস্য (অব.) ডা. আবদুল আলীমের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে।
শান্তি কমিটির সহায়তায় পাকসেনারা ঝিটকার গোপীনাথপুর গ্রামের পবিত্র নাগের পরিবারের পাঁচজনকে হরিনা ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যায় এবং পবিত্র নাগের পিতা প্রফুল্ল নাগ ও তাঁর তিন ছেলেকে নির্মমভাবে হত্যা করে। কলতার এক হিন্দু পরিবারের একজন গর্ভবর্তী নারীকে ধর্ষণের পর পাকবাহিনী হত্যা করে। এছাড়া ঝিটকার সাহা পরিবারের দুই মেয়েকে তারা ধরে নিয়ে ধর্ষণ করে।
হরিনাস্থ ক্যাম্প ছিল পাকবাহিনী ও রাজাকারদের প্রধান নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির। এখানে তারা সাধারণ মানুষদের ধরে এনে নির্যাতন চালাত।
হরিরামপুর উপজেলায় পাকবাহিনী ও রাজাকারদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদরে চারটি সম্মুখ যুদ্ধ হয়। সেগুলো হলো- সুতালড়ি কাজীবাড়ি যুদ্ধ, বালিরটেক যুদ্ধ, আজিমনগর যুদ্ধ ও হরিরামপুর থানা যুদ্ধ। সুতালড়ি কাজীবাড়ি যুদ্ধ সংঘটিত হয় ২২শে জুন। এদিন ক্যাপ্টেন আবদুল হালিম চৌধুরীর ভারত গমন উপলক্ষে মুক্তিযোদ্ধারা মওলার কান্দা ক্যাম্পে একত্রিত হচ্ছিলেন। তখন পাশের খাল দিয়ে লঞ্চযোগে পাকবাহিনী গ্রামে ঢোকার চেষ্টা করলে সুতালড়ি গ্রামের কাজীবাড়ির পাশে মুক্তিবাহিনীর পাহারারত সদস্যরা অতর্কিতে তাদের আক্রমণ করেন। এতে দুজন পাকসেনা নিহত এবং শান্তি কমিটির সদস্য নয়ান মোল্লা ও ৫-৬ জন পাকসেনা আহত হয়। আকস্মিক এ আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পাকসেনারা পিছু হটে। এ-যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সালাম (বয়ড়া ইউনিয়ন), আবদুল আহাদ (ঐ), শুকুর মিয়া (আজিমনগর ইউনিয়ন), আবুল বাশার (হারুকান্দি ইউনিয়ন), আবদুল ওহাব (সুতালড়ি ইউনিয়ন), সামসুদ্দিন আহমদ (ঐ), মোক্তার আলী (ঘিওর থানা), জিন্নত আলী (জাবরা, ঐ), বরকত আলী (ঐ) এবং কালাম (পুটাইল ইউনিয়ন, মানিকগঞ্জ থানা) অংশগ্রহণ করেন। এ-যুদ্ধে সাফল্য অর্জনে মোক্তার আলী ও কালাম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
বালিরটেক যুদ্ধ সংঘটিত হয় ১৭ই ও ২৭শে জুলাই দুবার। বালিরটেকে পাকবাহিনীর একটি ক্যাম্প ছিল। তবে এ ক্যাম্পে সাধারণত রাজাকাররা থাকত এবং ক্যাম্পের নিকটস্থ খাদ্যগুদাম পাহারা দিত। ১৭ই জুলাই সন্ধ্যার পর হরিরামপুরের মুক্তিবাহিনীর জন্য খাদ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে আওলাদ হোসেনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা খাদ্যগুদাম আক্রমণ করেন। হঠাৎ আক্রমণে দিশেহারা হয়ে গুদাম পাহারারত রাজাকাররা অস্ত্রশস্ত্র ফেলে পালিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা বেশকিছু রাইফেল, গুলি এবং বিপুল পরিমাণ চাল ও গম নিজেদের দখলে নেন। এ-যুদ্ধে আবদুর রাজ্জাক, লিয়াকত আলী, সামসুদ্দিন আহমদ, আবদুস সালাম, আবদুস সামাদ বিশ্বাসসহ আরো অনেক মুক্তিযোদ্ধা অংশগ্রহণ করেন। ২৭শে জুলাই গভীর রাতে মুক্তিযোদ্ধারা উত্তর ও দক্ষিণ দিক থেকে ক্যাম্পে অবস্থানরত পাকসেনা ও রাজাকারদের আক্রমণ করেন। শত্রুপক্ষ প্রতি-আক্রমণ করলে ভোর পর্যন্ত যুদ্ধ চলে। ভোরে পাকবাহিনী আত্মসমর্পণের ইঙ্গিত দিলে মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাম্পের ভেতরে প্রবেশ করেন। পাকসেনারা তখন কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে ধরে ফেলে। ঘটনাস্থলে আবুল কাসেম নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং নওশের আলী মোল্লা (হরিনা) ও হাবিবুর রহমান (সুতালড়ি) পাকসেনাদের হাতে বন্দি হন। পরে নওশেরকে পাকসেনারা হত্যা করে এবং হাবিবুর রহমান কৌশলে পালিয়ে আসেন।
আজিমনগর যুদ্ধ সংঘটিত হয় ১লা আগস্ট আব্দুল মতিন চৌধুরী এবং অধ্যক্ষ আব্দুর রউফ খানের নেতৃত্বে। এদিন সকালে পাকসেনারা আজিমনগর গ্রাম ঘেরাও করে গুলি করতে থাকে। গুলিতে সমগ্র এলাকা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে মুক্তিযোদ্ধারা পাল্টা আক্রমণ করেন। কিন্তু অবস্থা প্রতিকূল বুঝে এক পর্যায়ে তাঁরা পিছু হটেন। এরপর পাকসেনারা ৪-৫ জন গ্রামবাসীকে হত্যা করে এবং কয়েকটি বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। হরিরামপুর থানা যুদ্ধ সংঘটিত হয় ২২শে আগস্ট। এ-যুদ্ধে ৪১ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং বেশ কয়েকজন আত্মসমর্পণ করে। যুদ্ধের সাফল্যে উত্তেজিত হয়ে ওয়ারলেস ঘরটি জ্বালিয়ে দিতে গিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহফুজুর রহমান (পিপুলিয়া) আগুনে পুড়ে আহত হন এবং কয়েকদিন পর তাঁর মৃত্যু হয়। এ-যুদ্ধের মধ্য দিয়ে হরিরামপুরে পাকবাহিনীর দখলদারিত্বের অবসান ঘটলেও ১৩ই অক্টোবর পর্যন্ত তারা মাঝে-মধ্যে নৌকা বা গানবোটে এ এলাকায় আসা-যাওয়া করেছে। ১৩ই অক্টোবরের পরে আর তারা হরিরামপুরে প্রবেশ করেনি। তাই ১৩ই অক্টোবর হরিরামপুরে হানাদারমুক্ত দিবস হিসেবে পালিত হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হলেন- মাহফুজুর রহমান খান, বীর প্রতীক (পিতা জিয়ারুল হক খান, পিপুলিয়া)। হরিরামপুরের শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- মাহফুজুর রহমান খান, বীর প্রতীক (হরিরামপুর সিও অফিস পাকবাহিনী ক্যাম্প অপারেশনে শহীদ), মিরাজ উদ্দিন আহম্মেদ (রামকৃষ্ণপুর), মাহফুজুর রহমান (২২শে আগস্ট হরিরামপুর থানা যুদ্ধের পর অগ্নিদগ্ধ হন এবং তার কয়েকদিন পর মৃত্যুবরণ করেন), নওশের আলী মোল্লা (লেছড়াগঞ্জ), মোকছেদ আলী (চালা), আবুল কাসেম (সুতালড়ি) এবং মোজাফর হোসেন (সুতালড়ি)।
ঝিটকা-হরিরামপুর রোডে হরিরামপুর মোড় থেকে পোদ্দারবাড়ি পর্যন্ত রাস্তাটির নামকরণ করা হয় বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন আবদুল হালিম চৌধুরীর নামে। এছাড়া শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মিরাজ উদ্দিন আহম্মেদ ও শহীদ তপনের নামে মানিকগঞ্জ স্টেডিয়ামের নাম রাখা হয় ‘শহীদ মিরাজ- তপন স্টেডিয়াম’। [আবুল ইসলাম শিকদার]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!