হরিহর নদীতীর হত্যাকাণ্ড (মনিরামপুর, যশোর)
হরিহর নদীতীর হত্যাকাণ্ড (মনিরামপুর, যশোর) সংঘটিত হয় ২২শে অক্টোবর রাতে। যশোর জেলার পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল)-এর স্থানীয় বাহিনীর ৫ জন মুক্তযোদ্ধা এ হত্যাকাণ্ডের শিকার হন।
আগস্ট মাসে কমিউনিস্ট পার্টির পুলুম ঘাঁটির পতন ঘটলে পার্টির কর্মীরা ডুমুরিয়া এলাকায় আশ্রয় নেন। এরপর যশোরের মণিরামপুর এবং খুলনার ডুমুরিয়া অঞ্চলে পার্টির কার্যক্রম জোরদার করা হয়। পাকবাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকাররা এ অঞ্চলেও তাঁদের ওপর আক্রমণ চালাতে থাকে। অব্যাহত আক্রমণের মুখে ডুমুরিয়া এলাকা ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন পার্টির বাহিনীর সদস্য মুক্তিযোদ্ধা আসাদুজ্জামান আসাদ (৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের সময় ছাত্রদের ১১ দফা আন্দোলনের সময় গঠিত স্থানীয় সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ও যশোর এম এম কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি), মাশুকুর রহমান তোজো (পিতা হাবিবুর রহমান, ষষ্টিতলা; ইস্টার্ন ফেডারেল কোম্পানির স্পেশাল অফিসার ও পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী), সিরাজুল ইসলাম শান্তি (যশোর জেলা কৃষক সমিতির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক), আহসানউদ্দিন খান মানিক (ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপের যশোর জেলা শাখার সভাপতি) ও ফজলুর রহমান ফজলু (সেনাবাহিনীর সদস্য)। ১৫ থেকে ২০শে সেপ্টেম্বরের মধ্যে তাঁরা এলাকা ত্যাগ করেন এবং মণিরামপুরের ইসলামকাঠি গ্রামে অবস্থান নেন। এরপর তাঁরা যশোর অঞ্চলে আসার জন্য পরিস্থিতি বুঝতে আব্দুল মতিন নামে পার্টির এক কর্মীকে সেখানে পাঠান। আব্দুল মতিন সবুজ সংকেত দিলে ২২শে অক্টোবর রাতে তাঁরা মণিরামপুরের রত্নেশ্বরপুর গ্রামের শামসুজ্জামানের বাড়িতে আশ্রয় নেন। এ গ্রামের রাজাকার রায়হান তা জেনে যায় এবং মণিরামপুর রাজাকার ক্যাম্পে এ খবর পৌঁছে দেয়। রাতেই রাজাকার কমান্ডার ইসাহাক, আব্দুল আজিজ, মেহের আলী (মেহের জল্লাদ) ও আব্দুল মজিদসহ ৪০ জনের মতো রাজাকার ঐ বাড়ি ঘিরে ফেলে এবং তাঁদের ধরে চোখ বেঁধে চিনাটোলা বাজারের পূর্ব পাশে নিয়ে যায়। সেখানে তাঁদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালায়। তাঁদের শরীর বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে তাতে লবণ লাগিয়ে দেয়। এভাবে সন্ধ্যা পর্যন্ত নির্যাতন চলে। তারপর রাত ৮টার দিকে চোখবাঁধা অবস্থায় আসাদুজ্জামান আসাদ, মাশুকুর রহমান তোজো, সিরাজুল ইসলাম শান্তি, আহসানউদ্দিন খান মানিক ও ফজলুর রহমান ফজলুকে নেয়া হয় সৈয়দ মাহমুদপুর গ্রাম সংলগ্ন হরিহর নদীর তীরবর্তী স্থানে। সেখানে প্রথমে গুলি করে তারপর বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে তাঁদের হত্যা করা হয়। এভাবে শহীদ হন এ ৫ বীর মুক্তিযোদ্ধা। পরদিন সকালে শ্যামাপদ দেবনাথ নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি একই গ্রামের অমূল্য দেবনাথের (চানমনি কবিরাজ) কাছ থেকে দুই আনা দিয়ে জমি কিনে নিজহাতে তাঁদের কবরস্থ করেন।
মনিরামপুরের চিনেটোলা বাজারের পাশে হরিহর নদীর তীরবর্তী ৫ বীর শহীদ মুক্তিসেনাকে সমাহিত করা হয়। [আমিনুর রহমান মামুন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড