মুক্তিযুদ্ধে হরিণাকুণ্ডু উপজেলা (ঝিনাইদহ)
হরিণাকুণ্ডু উপজেলা (ঝিনাইদহ) স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রাণপুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। তিনি সকলের প্রতি আহ্বান জানান, ‘প্রত্যেক ঘরে-ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তা-ই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে’। তাঁর এ আহ্বানে সমগ্র বাংলাদেশের মতো হরিণাকুণ্ডু উপজেলার মানুষও স্বাধীনতার চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে ওঠে।
এ উপজেলার সংগ্রামী জনতা মার্চের প্রথম থেকেই মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। জেলা আওয়ামী লীগ নেতা এ বি এম গোলাম মজিদ, আব্দুল হাই, গোলাম মোস্তফা এবং মোশারফ হোসেন (মশা ভাই)-এর নির্দেশে নজরুল ইসলাম (বৈঠাপাড়া), জোয়াদ আলী মল্লিক (পার্বতীপুর), শফিউদ্দিন বিশ্বাস (পোলতাডাঙ্গা), ওয়াহেদ আলী (আহাদনগর), নিজাম উদ্দীন (বোয়ালিয়া), খগেন্দ্ৰ মজুমদার (রিশখালি), নিমাই মণ্ডল (ফলসী), কোরবান আলী মেম্বর (পারফলসী), আফসার আলী মেম্বর (পারফলসী), সুশীল বাবু (মাঠ আন্দুলিয়া), খলিল বিশ্বাস (ভায়না), শফিউর রহমান (বলরামপুর), আলতাফ চেয়ারম্যান (হরিশপুর) প্রমুখ স্থানীয় নেতার নেতৃত্বে গঠিত হয় সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ। এ পরিষদের নির্দেশে প্রতিটি গ্রামেও সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। সংগ্রাম পরিষদের তত্ত্বাবধানে স্থানীয় ছাত্র-জনতা লাঠি, ঢাল-সড়কি ইত্যাদি দেশীয় অস্ত্র নিয়ে পাকবাহিনীর মোকাবেলা করার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। যুদ্ধ শুরু হলে তারা খাদ্য ও তথ্য সরবরাহের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করে।
এক পর্যায়ে তারা বুঝতে পারে যে, আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পাকবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করতে হলে নিজেদেরও প্রশিক্ষণ থাকা প্রয়োজন। তাই উপজেলার মুক্তিযোদ্ধারা প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে চলে যান। তাঁরা প্রথমে পশ্চিমবঙ্গের করিমপুর ইউনিয়নের জমসেরপুর ক্যাম্পে ভর্তি হন। সেখানে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য তাঁরা বিহারের সিংভূম জেলার চাকুলিয়া আর্মি ক্যাম্পে যান। সেখানে মাসাধিক কাল প্রশিক্ষণ নিয়ে বিভিন্ন প্রকার অস্ত্র চালনায় পারদর্শিতা অর্জন করেন এবং আব্দুর রহমান আবদারের নেতৃত্বে পঞ্চান্ন জনের একটি প্রশিক্ষিত মুক্তিবাহিনী বাংলাদেশে প্রবেশ করে।
হরিণাকুণ্ডু উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে যাঁরা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন, তাঁরা হলেন- আব্দুর রহমান আবদার (শ্রীপুর), আব্দুল ওয়াহেদ জোয়ার্দার (শিতলী), রেজাউল ইসলাম গেন্দা (পায়রাডাঙ্গা), মো. সাহেব আলী (ঝিনাইদহ), মো. মোহসীন আলী (ঝিনাইদহ), মো. সদর উদ্দিন (ঝিনাইদহ), মো. আতিয়ার রহমান, মসিউর রহমান, নূরউদ্দিন, আব্দুল গণি (ভেড়াখালি), রজব আলী (হিঙ্গেরপাড়া), তৈয়ব আলী, আব্দুর রহমান (বলরামপুর), আবুল হোসেন (শিতলী), তোফাজ্জেল হোসেন (ভলকী), মোশারফ হোসেন মশা ভাই (ভায়না), আশরাফুল আবেদিন আশা (ভায়না), এশারত বিশ্বাস (পারফলসী), আইনুদ্দিন বিশ্বাস (পারফলসী), জোয়াদ মল্লিক (বুড়ো মল্লিক) (পার্বতীপুর), নজরুল ইসলাম (ইসলাম মিয়া) (বৈঠাপাড়া) মশিউর রহমান জোয়ার্দার (শিতলী), আফজাল হোসেন (গাড়াবাড়িয়া), শফিউদ্দিন বিশ্বাস (পোলতাডাঙ্গা), ওয়াহেদ আলী (আহাদনগর) প্রমুখ।
২৫শে মার্চ যশোর সেনানিবাস থেকে পাকবাহিনী ঝিনাইদহ হয়ে কুষ্টিয়া শহরে গিয়ে ধ্বংসলীলা চালায় এবং মানুষের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। তারা যাতে আর যশোরে ফিরে আসতে না পারে এবং ফেরার পথে ঝিনাইদহে ধ্বংসলীলা চালাতে না পারে সেজন্য মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের নির্দেশে কুমার নদের ওপর অবস্থিত গাড়াগঞ্জ ব্রিজের দক্ষিণ প্রান্তে পাকা রাস্তা কেটে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। ৩১শে মার্চ কুষ্টিয়া থেকে ফেরার সময় পাকবাহিনীর দুটি গাড়ি ঐ খাদে পড়ে যায়। সঙ্গে-সঙ্গে ওঁৎ পেতে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা তাদের আক্রমণ করেন। এতে মেজর শোয়েবসহ কয়েকজন পাকসেনা ঘটনাস্থলেই নিহত হয়। বাকি পাকসেনারা পালিয়ে যাওয়ার সময় দুজন দিগ্ভ্রান্ত হয়ে হরিণাকুণ্ডু উপজেলার চরপাড়া গ্রামে ঢুকে পড়ে। এ খবর শুনে অসংখ্য গ্রামবাসী দেশীয় অস্ত্র নিয়ে তাদের ধাওয়া করে। সেদিনকার এ-যুদ্ধ হরিণাকুণ্ডু প্রতিরোধযুদ্ধ বা গাড়াগঞ্জ ব্রিজযুদ্ধ নামে পরিচিত।
মে মাসের প্রথমদিকে পাকবাহিনী হরিণাকুণ্ডু উপজেলায় প্রবেশ করে। তবে এখানে তাদের কোনো স্থায়ী ক্যাম্প ছিল না; বাকচুয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়, সাতব্রিজ ওয়াপদা, হরিণাকুণ্ডু উপজেলা মিলনায়তন ও হরিণাকুণ্ডু থানায় অস্থায়ী ক্যাম্প ছিল।
হরিণাকুণ্ডু উপজেলায় স্বাধীনতাবিরোধীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- গোলাম দরবেশ, মুকুল মিয়া (বেলতলা), ফকির মাহমুদ (ভেড়াখালি), ডা. নজরুল ইসলাম, মাস্টার মওলা বক্স (আদর্শ আন্দুলিয়া), আতিয়ার রহমান (পার্বতীপুর), আনিচ ডাক্তার (জোড়াদহ) প্রমুখ। এদের নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনী ও শান্তি কমিটি গঠিত হয়। এই দুই বাহিনীর সহায়তায় পাকবাহিনী খুন, ধর্ষণ, গুম, লুট-তরাজ, অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি নৃশংস কর্মকাণ্ড চালায়। তারা ভায়না গ্রামে প্রবেশ করে মুক্তিযোদ্ধা মোশারফ হোসেন (মশা ভাই)-এর বাড়িতে হামলা করে এবং পেট্রোল দিয়ে বাড়িটি পুড়িয়ে দেয়। তাঁর বড়ভাই মহিউদ্দীন পুটেকে ধরে নিয়ে যায়। তাঁর আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। পাকবাহিনী ও রাজাকাররা বিশেষ করে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর বেশি অত্যাচার করে। তারা টাকের পোতা গ্রামের রাখাল চন্দ্র ও রমেশ চন্দ্রকে গুলি হত্যা করে হত্যা করে এবং জোড়াদহ ও পারফলসী গ্রামের তিনজন সংখ্যালঘু নারীকে ধর্ষণ করে।
বর্তমান বাকচুয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়, সাতব্রিজ ওয়াপদা, হরিণাকুণ্ডু উপজেলা মিলনায়তন, জোড়াদহ মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং হরিণাকুণ্ডু থানায় ছিল পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির। বিভিন্ন এলাকা থেকে নিরীহ লোকদের ধরে এনে এখানে নির্যাতন করা হতো এবং লুটকরা মালামাল ভাগ-বাটোয়ারা করা হতো। পাকসেনারা এখান থেকে বন্দিদের ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ ক্যাম্প ও চুয়াডাঙ্গা ক্যাম্পে নিয়ে যেত।
হরিণাকুণ্ডু উপজেলায় রজব বাহিনী, তৈয়ব বাহিনী ও -মুঙলা বাহিনী নামে তিনটি স্থানীয় মুক্তিবাহিনী ছিল। এ তিন বাহিনীর সদস্যরা রাজাকার ও পাকবাহিনীর আস্তানায় গেরিলা পদ্ধতিতে হামলা চালাতেন।
যুদ্ধের সময় হরিণাকুণ্ডু উপজেলা ছিল ৮ নম্বর সেক্টরের অধীন। মেজর এম আবু উসমান চৌধুরী এপ্রিল থেকে ১৮ই আগস্ট পর্যন্ত এবং মেজর মোহাম্মদ আবুল মঞ্জুর ১৮ই আগস্ট থেকে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত এখানে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। এ উপজেলায় পাকবাহিনী ও রাজাকারদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের একাধিক যুদ্ধ হয়। উল্লেখযোগ্য যুদ্ধগুলো হলো— হরিশপুর যুদ্ধ, পায়রাডাঙ্গা যুদ্ধ, ভবানীপুর যুদ্ধ এবং হরিণাকুণ্ডু থানাযুদ্ধ। ১২ই মে সংঘটিত হরিশপুর গ্রামের যুদ্ধে দুজন সাধারণ লোক নিহত হয় এবং বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে পরে শহীদ হন। এ ঘটনা হরিশপুর ট্রাজেডি- নামেও পরিচিত। ১৬ই নভেম্বর কাপাশহাটিয়া ইউনিয়নের অন্তর্গত পায়রাডাঙ্গা গ্রামে দুজন পাকসেনা ও ২০-২৫ জন রাজাকারের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের ৩ ঘণ্টা ব্যাপী যুদ্ধ হয়। এতে চারজন রাজাকার নিহত হয়। ২রা ডিসেম্বর ভোরে ৩নং তাহেরহুদা ইউনিয়নের অন্তর্গত ভবানীপুর গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা ও পাকসেনাদের মধ্যে প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়। এতে পাকবাহিনীর এক অফিসারসহ ৪১জন সেনা নিহত হয় এবং ঝিনাইদহ সদরের সদরউদ্দীন ও তাজউদ্দীন নামে দুজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। ৫ই ডিসেম্বর রাত আনুমানিক ১১টায় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুর রহমানের নেতৃত্বে ৫৫ জন মুক্তিযোদ্ধা হরিণাকুণ্ডু থানা আক্রমণ করেন। পাকবাহিনী ও রাজাকাররাও পাল্টা গোলাবর্ষণ করে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে না পেরে রাত আনুমানিক ২টার দিকে তারা পালিয়ে যায় এবং মুক্তিযোদ্ধারা থানা দখল করেন। ৬ই ডিসেম্বর সকাল ১০টায় থানার সামনে কমান্ডার আব্দুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। এভাবেই হানাদারমুক্ত হয় হরিণাকুণ্ডু উপজেলা।
উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- কাওসার আলী (পিতা জমির উদ্দীন বিশ্বাস, চরআড়ুয়াকান্দি; ৩১শে মার্চ হরিণাকুণ্ডু প্রতিরোধযুদ্ধে শহীদ), নবীছ উদ্দীন (পিতা খোরসেদ মণ্ডল, ফতেপুর), ইজাল উদ্দীন বিশ্বাস (পিতা আবাদান আলি বিশ্বাস, শ্রীপুর), মোহাম্মদ আলী মালিথা (পিতা নাজের আলী মালিথা, রঘুনাথপুর), তোয়াজ উদ্দীন মণ্ডল (পিতা মঙ্গল মণ্ডল, ভাদড়া), এলাহী বক্স (পিতা আতর আলী, বড়ভাদড়া), দোস্তর আলী, (পিতা করিম মণ্ডল, কন্যাদহ), কাদের আলী (পিতা গফুর শাহ, জোড়াদহ), রেজাউল ইসলাম (পিতা গোলাম মহিউদ্দীন, ভায়না) এবং আমোদ আলী (পিতা শুকুর মণ্ডল, জোড়াদহ)।
হরিণাকুণ্ডু উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। সেগুলো হলো ভায়না শহীদ মোশারফ দলিল উদ্দীন মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কুল্লাগাছা শহীদ সদরউদ্দীন প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং মুক্তিযোদ্ধা মসিউর রহমান সড়ক। এছাড়া উপজেলা ক্রীড়া সংস্থার মাঠের দক্ষিণ প্রান্তে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের একটি নামফলক রয়েছে। [জামাল উদ্দিন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড