You dont have javascript enabled! Please enable it!

হরিপুর যুদ্ধ (শ্যামনগর, সাতক্ষীরা)

হরিপুর যুদ্ধ (শ্যামনগর, সাতক্ষীরা) সংঘটিত হয় এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা এবং মুসলিম লীগ নেতা গোলাম সারোয়ার ও তার পরিজনদের মধ্যে। সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলায় সংঘটিত এ-যুদ্ধে সারোয়ার ও তার এক পুত্র মওলানা আবদুল্লাহ নিহত হয়। ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষণার পর সারা দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। বেসামরিক লোকজনের কেউ-কেউ নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাচ্ছিল কেউ-কেউ আবার সহায়-সম্বল ছেড়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে ভারতে পাড়ি জমাচ্ছিল। এ সুযোগে প্রথম দিকে স্থানীয় স্বাধীনতাবিরোধীরা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। নূরনগর অঞ্চলের প্রভাবশালী মুসলিম লীগ নেতা গোলাম সারোয়ার ছিল পাকিস্তানের অন্ধ সমর্থক। তার পিতা জসীম ডাক্তার ছিল নূরনগর ইউনিয়নের প্রথম প্রেসিডেন্ট। পারিবারিক এ ঐতিহ্যের কারণে সারোয়ার ও তার পরিবারের লোকজন মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। তাদের কাছে ছিল লাইসেন্সপ্রাপ্ত আগ্নেয়াস্ত্র।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বিত্তবান হিন্দু পরিবারের তালিকা প্রস্তুত করে সারোয়ার ও তার দুই পুত্র মওলানা আবদুল্লাহ ও হাফেজ শহীদুল্লাহ তাদের বাহিনী নিয়ে নির্বিচারে লুট-তরাজ শুরু করে। প্রথমে তারা রাতের বেলা এ কাজ করত, পরে প্রকাশ্য দিবালোকে করতে থাকে। সারোয়ার বাহিনী শুধু বাড়ির জিনিস-পত্র, গোলার ধান ও গোয়ালের গরুই লুট করেনি, মহিলাদের পরিধানের কাপড় পর্যন্ত খুলে নিয়ে গেছে। এর প্রতিবাদে প্রতিবেশী যারাই এগিয়ে এসেছিল, তাদের প্রত্যেককেই সারোয়ার বাহিনীর নির্মম নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছিল। এ ঘটনার একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী এখনো জীবিত আছেন, যারা আজো সেদিনের নিষ্ঠুরতার চিহ্ন বহন করছেন। লুটের পর সারোয়ারের লোকেরা বৈদ্যনাথ মিস্ত্রীর বাড়িতে আগুন দেয় এবং পুকুরে বিষ ঢেলে সমস্ত মাছ মেরে ফেলে। তারা দুই গোলা ধান লুট করে প্রকাশ্যে গরুর গাড়িতে করে নিয়ে যায়। লুটকরা ধানের যতটা নিজের বাড়িতে রাখা যায় ততটা রেখে, গোলাম সারোয়ার অবশিষ্টাংশ নূরনগর ইউনিয়ন কাউন্সিলের ফুড অফিস দখল করে সেখানে গুদামজাত করে রাখে। রাতে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের ভয়ে পিতা-পুত্ররা নিজেদের বাড়ির প্রকাণ্ড একটি তেঁতুল গাছে টং বেঁধে পর্যাপ্ত অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ পাহারা দিত।
গোলাম সারোয়ার ও তার পুত্রদের এসব অপকর্ম বন্ধ করার উদ্দেশ্যে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা একটি অপারেশনের পরিকল্পনা করেন। সে-লক্ষ্যে এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহে ২৭ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল অপারেশনে অংশ নেন। তাঁরা সারোয়ারের বাড়ির চারপাশ ঘিরে ফেলেন। তখন গোলাম সারোয়ার ও তার পুত্ররা তেঁতুল গাছের ওপর থেকে আক্রমণ চালায়। তারা মুহুর্মুহু গোলাবর্ষণ করতে থাকে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা কৌশলী হয়ে থেমে-থেমে গুলি করতে থাকেন। প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা গুলি বিনিময়ের পর সারোয়ারের গোলা-গুলি শেষ হয়ে যায়। তখন মুক্তিযোদ্ধারা হ্যান্ড মাইকে তাদের নেমে এসে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানান। অগত্যা তারা গাছ থেকে নেমে আসে। মুক্তিযোদ্ধারা কাপড় দিয়ে তাদের চোখ বাঁধার সময় সারোয়ার স্থানীয় একজন মুক্তিযোদ্ধাকে চিনে ফেলে এবং তাঁর নাম ধরে অশ্লীল ভাষায় গালাগালি করতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধারা চেয়েছিলেন সারোয়ার ও তার পুত্রদের ধরে শ্যামনগর ক্যাম্পে নিয়ে যাবেন। কিন্তু গালিগালাজ করার কারণে তাঁরা তাদের ওখানেই হত্যা করার সিদ্ধন্ত নেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তেঁতুল গাছের নিচে পুকুরপাড়ে তাদের দাঁড় করিয়ে গুলি করা হয়। এতে সারোয়ার ও আবদুল্লাহ নিহত হয় এবং হাঁটুতে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় শহীদুল্লাহ পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ে পালিয়ে যায়। [মিজানুর রহমান]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!