You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে হবিগঞ্জ সদর উপজেলা

বর্তমান হবিগঞ্জ জেলা মুক্তিযুদ্ধকালে ছিল মহকুমা। ৮টি থানা নিয়ে গঠিত এ মহকুমা পরবর্তীকালে জেলা এবং এর অন্তর্গত থানাসমূহ উপজেলায় উন্নীত হয়। ১০টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভা নিয়ে হবিগঞ্জ সদর উপজেলা গঠিত হলেও পরবর্তীতে শায়েস্তাগঞ্জ ইউনিয়নের অংশবিশেষ নিয়ে শায়েস্তাগঞ্জ পৌরসভা ও নুরপুর ইউনিয়নকে দ্বিখণ্ডিত করে নুরপুর ও ব্রাহ্মণডোরা ইউনিয়ন গঠিত হয়। তখন থেকে এ উপজেলার ইউনিয়ন সংখ্যা হয় ১১টি এবং পৌরসভা ২টি। ২০১৮ সালে শায়েস্তাগঞ্জ, নুরপুর ও ব্রাহ্মণডোরা ইউনিয়ন এবং শায়েস্তাগঞ্জ পৌরসভা নিয়ে শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলা গঠিত হয়।
হবিগঞ্জ থানা মহকুমা সদরে অবস্থিত হওয়ায় মুক্তিযুদ্ধপূর্ব ও মুক্তিযুদ্ধকালীন মহকুমার সকল আন্দোলন ও তৎপরতা হবিগঞ্জ সদর থানাকে কেন্দ্র করেই পরিচালিত হয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগএর নিরঙ্কুশ বিজয়ের মধ্য দিয়ে বাঙালিদের মনে পাকিস্তানি শাসন-শোষণ ও নিয়ন্ত্ৰণ থেকে মুক্তির যে আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি হয়, তার ঢেউ মফস্বল শহর শায়েস্তাগঞ্জেও লাগে।
১৯৭১ সালের ১লা মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান কর্তৃক আসন্ন জাতীয় পরিষদের অধিবেশন মুলতবি ও ঢাকার পূর্বানী হোটেলে বঙ্গবন্ধুর সাংবাদিক সম্মেলনের খবর রাত ৭:৩০টার বিবিসি সংবাদে হবিগঞ্জ জেলা সদরে ছড়িয়ে পড়লে সমগ্র শহর বিক্ষোভ মিছিলে উত্তাল হয়ে ওঠে। একটি স্বতঃস্ফূর্ত মিছিল হবিগঞ্জ পুরাতন হাসপাতাল এলাকা থেকে বের হয়ে বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে। এর নেতৃত্বে ছিলেন মহকুমা ছাত্রলীগ সভাপতি মোহাম্মদ শাহজাহান, সাধারণ সম্পাদক মহিবুর রহমান খান প্রমুখ।
৫ই মার্চ হবিগঞ্জের বিডি হলে আহুত সভায় মহকুমা ছাত্রলীগের সভাপতি মোহাম্মদ শাহজাহানকে আহ্বায়ক এবং সাধারণ সম্পাদক মহিবুর রহমান খানকে সদস্য-সচিব করে ১১ সদস্যবিশিষ্ট স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ- “গঠন করা হয়। মার্চ হবিগঞ্জে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন ও ইশতেহার পাঠের কর্মসূচি গ্রহণ করেন। সেদিন হবিগঞ্জ শহরে ছাত্রলীগের অফিস প্রাঙ্গণে প্রথমবারের মতো স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন মোহাম্মদ শাহজাহান। একই সঙ্গে পতাকাকে অভিবাদন জানান হবিগঞ্জ জয়বাংলা বাহিনীর প্রধান সিরাজ উদ্দিন ও তাঁর দল। বাবলু পালচৌধুরী (প্রয়াত), সুবীর নন্দী (বিশিষ্ট সঙ্গীত শিল্পী, সম্প্রতি প্রয়াত), গোলাম মোস্তফা রফিক, মো. সুরুজ আলী, উজ্জ্বল ভট্টাচার্য, সিদ্ধার্থ বিশ্বাস প্রমুখ রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি পতাকা উত্তোলনের সময় জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে পরিবেশন করেন এবং একই সঙ্গে ইশতেহার পাঠ করেন ছাত্রলীগ নেতা সুরুজ আলী। ২৩শে মার্চ ‘পাকিস্তান দিবস’-এর পরিবর্তে ‘বাংলাদেশ দিবস’ পালিত হয়। ছাত্রনেতা আব্দুল মতিনের নেতৃত্বে শহরের প্রত্যেকটি সরকারি অফিস, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও বাসাবাড়িতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বাংলাদেশের মানচিত্র-খচিত পতাকা উত্তোলিত হয়। এ ব্যাপারে হবিগঞ্জ সদর থানায় পুলিশের পক্ষ থেকে বাধা আসে। থানা থেকে দুজন পুলিশ এসে পতাকা উত্তোলনে বাধা দেয়। কিন্তু আন্দোলনকারীদের চাপে সে-বাধা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। আন্দোলনকারীদের পক্ষে ‘পাগলা হাবিব’ (প্রকৃত নাম সৈয়দ হাবিবুর রহমান) নামে ছাত্রলীগের এক দুঃসাহসী কর্মী থানার স্ট্যান্ড থেকে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে ছিঁড়ে ফেলে সেখানে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা বেঁধে দেন। সঙ্গে-সঙ্গে হাজারো জনতার উল্লাস ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের দুঃসাহস দেখে থানার পুলিশ বাংলাদেশের নতুন পতাকার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য একযোগে অভিবাদন জানায়।
২রা মার্চ থেকে ২৫শে মার্চ পর্যন্ত চলা অসহযোগ আন্দোলন-এ আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত এমএনএ ও এমপিএ-দের তত্ত্বাবধানে হবিগঞ্জে মূলত ছাত্ররাই মুখ্য ভূমিকা পালন করে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অন্যান্য ছাত্র সংগঠনগুলোও এ আন্দোলনে যথার্থ ভূমিকা রাখে। ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া গ্রুপ) নেতা শহীদ উদ্দিন চৌধুরী, জসিম উদ্দিন নীলু প্রমুখের নেতৃত্বে বৃন্দাবন কলেজে কাঠের তৈরি রাইফেল দিয়ে সামরিক প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয়৷ কমান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরী এমএনএ-এর পৃষ্ঠপোষকতায় ছাত্রলীগ সভাপতি মোহাম্মদ শাহজাহানের নেতৃত্বে বি কে জি সি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ‘বিক্ষুব্ধ বাংলার মুক্তিবাহিনী’ নাম দিয়ে একটি গ্রুপের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ চলে।
হবিগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রস্তুতি সভা অনুষ্ঠিত হয় মহকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি এডভোকেট মোস্তফা আলী এমএনএ-এর সভাপতিত্বে শহরের শায়েস্তানগরস্থ তাঁর বাসভবনে। এরপর মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করতে হবিগঞ্জ মহকুমা পর্যায়ে একটি সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়, যা ছিল এরূপ: আহ্বায়ক- এডভোকেট মোস্তফা আলী এমএনএ (আওয়ামী লীগ), সদস্য-সচিব- ডাক্তার সামছুল হোসেন ওরফে উমদা মিয়া (আওয়ামী লীগ), সদস্য- লতিফুর রহমান চৌধুরী ওরফে মানিক চৌধুরী এমএনএ (আওয়ামী লীগ), কর্নেল (অব.) এম এ রব এমএনএ (আওয়ামী লীগ), এনামুল হক মোস্তফা শহীদ এমপিএ (আওয়ামী লীগ), মৌলানা আছাদ আলী এমপিএ (আওয়ামী লীগ), গোপাল কৃষ্ণ মহারত্ন এমপিএ (আওয়ামী লীগ), ডা. আবুল হাসেম এমপিএ (আওয়ামী লীগ), আজিজুর রহমান চৌধুরী এমপিএ (স্বতন্ত্র), চৌধুরী আব্দুল হাই এডভোকেট (মোজাফ্ফর ন্যাপ), এডভোকেট সৈয়দ আফরোজ বখ্ত (মোজাফ্ফর ন্যাপ), এডভোকেট আফছর আহম্মেদ (ভাসানী ন্যাপ), এডভোকেট জনাব আলী (ভাসানী ন্যাপ), কৃপেন্দ্র বর্মণ (কমিউনিস্ট পার্টি) এবং কোষাধ্যক্ষ- আ র ইয়াকুত চৌধুরী (আওয়ামী লীগ)। এছাড়া সদর থানার জন্য একটি সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। সেটি ছিল নিম্নরূপ: আহ্বায়ক- ডা. দিদার আলী, সেক্রেটারি- আ. রহিম চৌধুরী, সদস্য- ডা. সালেহ আহমেদ (পরে শায়েস্তাগঞ্জে শহীদ), মো. ইউনুছ চৌধুরী, নিম্বর আলী তালুকদার, আ. রেজ্জাক রাজা মিয়া প্রমুখ।
২৫শে মার্চ রাতে ঢাকা শহরে পাকবাহিনীর বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের খবর শোনার পর ২৬শে মার্চ সকালে হবিগঞ্জ শহরের মানুষের মধ্যে চরম ক্ষোভ লক্ষ করা যায়। এ নৃশংস হত্যাকাণ্ড পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে তাদের ভীষণ বিক্ষুব্ধ করে তোলে। এ ক্ষোভ, উত্তেজনা ও উৎকণ্ঠার মধ্যে আওয়ামী লীগ নেতা এ কে এম লতিফুর রহমান ওরফে মানিক চৌধুরী এমএনএ-র নিকট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান -এর পক্ষ থেকে পাঠানো টেলিগ্রাম আসে। একইভাবে এ টেলিগ্রামটি হবিগঞ্জ মহকুমা আওয়ামী লীগ সভাপতি এডভোকেট মোস্তফা আলী এমএনএ এবং ডা. আবুল হাসেম এমপিএ-র নিকটও আসে। বঙ্গবন্ধুর এ টেলিগ্রাম জনগণকে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণে প্রচণ্ডভাবে উদ্বুদ্ধ করে। এরই অংশ হিসেবে ছাত্রলীগের কর্মীরা হবিগঞ্জ শহরসহ মহকুমার বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের নিকট থেকে লাইসেন্সকৃত বন্দুক সংগ্রহ করতে থাকে।
২৭শে মার্চ হবিগঞ্জ এসডিও অফিস প্রাঙ্গণে হাজারো মুক্তিপাগল ছাত্র-জনতা একত্রিত হয়। তাদের কারো-কারো হাতে বন্দুক ও লাঠিসোঁটা ছিল। সেখানে উপস্থিত কর্নেল এম এ রব, এডভোকেট মোস্তফা আলী এবং এনামুল হক মোস্তফা শহীদের নিকট জনতা দাবি তোলে ট্রেজারি থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য। জনতার দাবির মুখে সংগ্রাম পরিষদ অফিসে কর্নেল এম এ রব, এডভোকেট মোস্তফা আলী, এনামুল হক মোস্তফা শহীদ ও ভাসানী ন্যাপ নেতা সংগ্রাম পরিষদ সদস্য আফসার আহম্মদ এক সভায় মিলিত হন। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এসডিও আকবর আলী খান (স্বাধীনতা পরবর্তী কালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা)-এর সঙ্গে যোগাযোগ করে ট্রেজারি থেকে অস্ত্র সংগ্রহের দায়িত্ব দেয়া হয় আফসার আহম্মদকে। তিনি অস্ত্র সরবরাহের দাবি জানালে এসডিও প্রথমে অসম্মতি জানান। এমতাবস্থায় বিক্ষুব্ধ জনতা চরমভাবে উত্তেজিত হয়ে ওঠে। এ খবর শুনে মানিক চৌধুরী শায়েস্তাগঞ্জ থেকে দ্রুত হবিগঞ্জ এসে মহকুমা হাকিম কার্যালয় প্রাঙ্গণে অবস্থানরত উত্তেজিত জনতাকে অস্ত্র পাওয়ার ব্যাপারে আশ্বস্ত করেন। এরপর তিনি এসডিও অফিসে যান এবং এসডিওকে ট্রেজারির চাবি দেয়ার নির্দেশ দেন। এসডিও তখন চাবি দিতে সম্মত হন এবং মানিক চৌধুরী নিজে রেজিস্টারে স্বাক্ষর করে ৫২০টি রাইফেল ও ১৭,৭৩৮ রাউন্ড গুলি গ্রহণ করেন। আনসার প্রশিক্ষক ইউনুস চৌধুরীর নেতৃত্বে আনসারদের মধ্যে অস্ত্রগুলো বণ্টন করা হয়। তৎকালীন এমএলআর/৯ মামলাটির নথি থেকে জানা যায় যে, এসডিও আকবর আলী খানকে হবিগঞ্জ ট্রেজারি খুলে দিতে বাধ্য করা এবং সেখানে রক্ষিত অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুট করার অভিযোগে সংশ্লিষ্ট নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে সামরিক আদালতে একটি মামলা হয়। এ ঘটনার পর হবিগঞ্জ শহরের বিডি হল প্রাঙ্গণে আনসার-মুজাহিদ ও ছাত্র-যুবকদের এক সশস্ত্র সমাবেশে উপস্থিত হন কর্নেল এম এ রব, মেজর চিত্ত রঞ্জন দত্ত, বীর উত্তম এবং মানিক চৌধুরী। বিক্ষুব্ধ জনতার উদ্দেশে বক্তব্য রাখেন কর্নেল (অব.) এম এ রব এমএনএ ও মানিক চৌধুরী এমএনএ। বক্তৃতায় পাকবাহিনীর মোকাবেলায় সবাইকে প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানালে জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে শত্রুর মোকাবেলা করতে দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করে। মুক্তিযুদ্ধের সময় উপর্যুক্ত নেতৃবৃন্দ হবিগঞ্জ সদর উপজেলায় সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন।
মার্চের ২৯ তারিখ কর্নেল এম এ রব কর্তৃক মেজর সি আর দত্তকে আনুষ্ঠানিকভাবে সমবেত যোদ্ধাদের কমান্ড (সেনা অধিনায়কত্ব) প্রদান করার পর মেজর সি আর দত্ত সকল যোদ্ধাদের তিনটি কোম্পানিতে ভাগ করেন, যথা- আনসার, আর্মি ও মুজাহিদ। আনসার কোম্পানি পরিচালনার জন্য ইউনুছ চৌধুরী, আর্মি কোম্পানি পরিচালনার জন্য সুবেদার সামছুল হুদা এবং মুজাহিদ কোম্পানি পরিচালনার জন্য কমান্ডার আব্দুস শহীদকে দায়িত্ব দেয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধকালে তাঁরা সে দায়িত্ব পালন করেন।
২৫শে মার্চ রাতে ঢাকায় সংঘটিত পাকবাহিনীর বর্বর হত্যাকাণ্ডের খবর পরদিন সকালেই সর্বত্র প্রচারিত হয়ে যায়। হবিগঞ্জের সর্বস্তরের মানুষ তাদের করণীয় জানার জন্য সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দের কাছে ছুটে যান। নেতৃবৃন্দ সকলকেই সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দেন। সকলেই যার-যার অবস্থান থেকে প্রতিরোধের প্রস্তুতি নিতে থাকে। যাদের বৈধ অস্ত্র ছিল তারা তাদের অস্ত্র নিয়ে, অন্যরা লাঠিসোঁটা, বল্লম, রামদা, তীর-ধনুক ইত্যাদি নিয়ে দলবদ্ধভাবে রাস্তায় নেমে পড়েন। শত্রুরা কখন কোন দিক থেকে আসবে তার জন্য অপেক্ষায় থাকেন। কমান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরীর নেতৃত্বে হবিগঞ্জ ট্রেজারি থেকে সংগৃহীত অস্ত্র নিয়ে হবিগঞ্জের মুক্তিপাগল মানুষ সিলেটের প্রথম প্রতিরোধযুদ্ধের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে এবং শেরপুর ও সাদিপুরে তারা শত্রুর বিরুদ্ধে প্রথম সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেয় পাকবাহিনী ২৯শে এপ্রিল হবিগঞ্জ সদর উপজেলায় প্রবেশ করে এবং সার্কিট হাউজে ক্যাম্প স্থাপন করে।
সৈয়দ কামরুল আহসান (রাজনগর, হবিগঞ্জ সদর থানা)- কে আহ্বায়ক ও আব্দুল বারী মোক্তার (শরীফাবাদ, নিযামপুর ইউনিয়ন, হবিগঞ্জ সদর থানা; আহ্বায়ক, সদর থানা শান্তি কমিটি; স্বাধীনতার পর গ্রেপ্তার ও ৭৫-পরবর্তী জিয়া সরকার কর্তৃক মুক্ত)-কে সেক্রেটারি করে হবিগঞ্জ মহকুমা শান্তি কমিটি গঠিত হয়। এর নেতৃস্থানীয় অন্যান্যের মধ্যে ছিল এডভোকেট আব্দুল্লাহ। শান্তি কমিটি গঠিত হওয়ার পর রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। আ. শহীদ ও আ. মোহিত (স্বাধীনতার পর বিচারে ৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত)-এর নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনী লুটতরাজ, ধর্ষণ, হত্যাসহ সর্বপ্রকার অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে সরাসরি অংশগ্রহণ করে। হবিগঞ্জ সদর উপজেলায় স্বাধীনতাবিরোধী দল হিসেবে মুসলিম লীগ- খুবই সক্রিয় ছিল।
হবিগঞ্জ সদর উপজেলায় শীর্ষস্থানীয় স্বাধীনতাবিরোধীরা হলো— সৈয়দ কামরুল আহসান, আব্দুল বারী মোক্তার, সৈয়দ মহিবুল হাসান (সেক্রেটারি, হবিগঞ্জ সদর শান্তি কমিটি), আফজাল চৌধুরী (হবিগঞ্জ বৃন্দাবন কলেজের অধ্যাপক ও পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক), এডভোকেট আব্দুল্লাহ (শায়েস্তানগর, হবিগঞ্জ), আবুল ফজল মোক্তার (সদস্য, শান্তি কমিটি) ও আশরাফ আলী মোক্তার (সদস্য, শান্তি কমিটি)।
দেশের অন্যান্য স্থানের মতো হবিগঞ্জ সদর উপজেলায়ও পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা সাধারণ মানুষসহ আওয়ামী লীগ ও হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নির্মম নির্যাতন চালায়। ২৯শে এপ্রিল পাকবাহিনী হবিগঞ্জ সদরে প্রবেশ করে প্রথমেই আওয়ামী লীগ নেতা কমান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরী এমএনএ-এর বাসায় অগ্নিসংযোগ করে। মহকুমা আওয়ামী লীগ সভাপতি এডভোকেট মোস্তফা আলী এমএনএ-এর বাসাসহ অন্যান্য আওয়ামী লীগ নেতাদের বাসায় লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। ডা. আবুল হাসেম এমপিএ-র বাসভবন ভেঙ্গে ফেলে। হিন্দুদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালামাল ও টাকা-পয়সা লুটপাট করে। এমনকি বসতঘরের আসবাবপত্র পর্যন্ত লুট করে নিয়ে যায়। হবিগঞ্জ শহরের দৃষ্টিনন্দন বাড়ি ‘উমেশ ভবন’ পাকবাহিনীর দোসর বানিয়াচংয়ের দেওয়ান আলী রাজা দখল করে নেয়। লস্করপুর খোয়াই ব্রিজ সংলগ্ন মাঠে আওয়ামী লীগ নেতা ও জনপ্রিয় চিকিৎসক ডা. সালেহ আহম্মেদসহ তিনজনকে হত্যা করা হয়। লস্করপুর রেলওয়ে ব্রিজ সংলগ্ন স্থানে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করে নদীতে ফেলে দেয়া হয়। হবিগঞ্জে স্থাপিত পাকবাহিনীর ক্যাম্প নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির হিসেবে ব্যবহৃত হতো। সেখানে আওয়ামী লীগ সমর্থক ও হিন্দুদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালাত।
হবিগঞ্জ সদর উপজেলায় একটি বড় ধরনের যুদ্ধ হয়, যা হবিগঞ্জ থানা ও বিদ্যুৎ ভবন যুদ্ধ নামে পরিচিত। ৬ই ডিসেম্বরের এ-যুদ্ধে পাকসেনা ও রাজাকাররা পালিয়ে যায় এবং তাদের ৭টি রাইফেল মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়। এদিনই হবিগঞ্জ সদর উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
হবিগঞ্জ সদর উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- মহফিল হোসেন ওরফে কলার বাপ (পিতা মনছুর আলী, পূর্ব বাগুনিপাড়), রঙ্গু মিয়া (পিতা মারফত আলী, রিচি গ্রাম, হবিগঞ্জ শহরতলী; আনসার ট্রেনিংপ্রাপ্ত; তেলিয়াপাড়া যুদ্ধে শহীদ), সৈয়দ আ. হাই (পিতা সৈয়দ ওবায়দুল হক, পৈল), মো. ফজর আলী (পিতা মনফর আলী, শরীফপুর), আবু মিয়া (তেঘরিয়া), সুবেদার ফিরোজ খান (পাইকপাড়া), মো. মকবুল আলী (জগৎপুর), আবুল ফারুক চৌধুরী (জগৎপুর), আব্দুল আলী (জগৎপুর), আব্দুস শুকুর (লেঞ্জাপাড়া), সাহেব আলী (তেতৈয়া), মো. তোতা মিয়া (ইনাতাবাদ), নূরুল ইসলাম (শায়েস্তানগর) এবং আব্দুল হেকিম (বড় বহুলা)। হবিগঞ্জ সদর উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। মুক্তিবাহিনীর চিফ অব স্টাফ ও পূর্বাঞ্চলের বেসামরিক প্রশাসক কর্নেল (অব.) এম এ রব, বীর উত্তমএর নামে হবিগঞ্জ শহরের মধ্যস্থলে একটি গ্রন্থাগার ও একটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এছাড়া তাঁর নামে শহরের কামড়াপুর নামক স্থানে খোয়াই নদীর ওপর নির্মিত একটি ব্রিজের নামকরণ করা হয়েছে। উমেদনগর গ্রামে তাঁর কবরের ওপর একটি স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে। হবিগঞ্জ উপজেলা সদরে নামসহ শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিস্তম্ভ এবং পৌরপার্কে ‘দুর্জয় ভাস্কর্য’ নির্মিত হয়েছে। শায়েস্তাগঞ্জ মহাসড়কের নসরতপুর থেকে হবিগঞ্জ কামড়াপুর পর্যন্ত সড়কটি বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরীর নামে নামকরণ করা হয়েছে। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা রঙ্গু মিয়ার নামে হবিগঞ্জের শহরতলী রিচি গ্রামের প্রবেশমুখে একটি তোরণ রয়েছে। হবিগঞ্জ-লাখাই সড়কে পুরাতন রেল স্টেশন সংলগ্ন চত্বরটি মুক্তিযোদ্ধা এম এ মুত্তালিবের নামে নামকরণ করা হয়েছে। [হুমায়ুন কবির সৈকত]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!