You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.05.07 | হরিণখোলা গণহত্যা (তালা, সাতক্ষীরা) - সংগ্রামের নোটবুক

হরিণখোলা গণহত্যা (তালা, সাতক্ষীরা)

হরিণখোলা গণহত্যা (তালা, সাতক্ষীরা) সংঘটিত হয় ৭ই মে। পাকিস্তানি বাহিনীর এ নৃশংস গণহত্যায় ৬০-৭০ জন মানুষ শহীদ হন।
হরিণখোলা সাতক্ষীরা জেলার তালা উপজেলার নগরঘাটা ইউনিয়নের একটি দ্বীপগ্রাম। ছোট এ গ্রামটির চারদিকে সবুজ ধানক্ষেত, বর্ষার সময় চারদিকে থাকে পানি। গ্রামটিকে তখন দেখতে একটি দ্বীপের মতো মনে হয়। এখানকার অধিবাসীরা সকলে ক্ষত্রিয় ও নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ভুক্ত। জীবিকা হিসেবে তাদের অধিকাংশ প্রান্তিক চাষী ও মৎস্যজীবী। ৬ই মে সকাল ১০টার দিকে নগরঘাটা ইউনিয়নের চেয়্যারম্যান শান্তি কমিটির নেতা আবদুল বারী হরিণখোলা গ্রামে এসে গ্রামবাসীদের নির্ভয়ে গ্রামে থাকার জন্য বলে। পাকিস্তানি সৈন্যরা গ্রামে এলে তারা যেন দৌড়াদৌড়ি না করে খুব শান্তভাবে অবস্থান করে সেকথাও বলে। ২৫শে মার্চ হানাদার বাহিনীর গণহত্যা শুরুর পর থেকে খুলনার দাকোপ, বটিয়াঘাটা, পাইকগাছা প্রভৃতি এলাকা থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন ভারতে যাওয়ার জন্য রওনা হয়। পথিমধ্যে শরণার্থীদের অনেকেই হরিণখোলা গ্রামে আশ্রয় নেয়।
৭ই মে গ্রামবাসীদের অনেকেসহ শরণার্থীরা ভারতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। অনেকে তাদের বিভিন্ন জিনিস- পত্র বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নেয়। ঐদিন দুপুরের পর গ্রামের বাইরের কিছু ব্যবসায়ী এসব জিনিস ক্রয় করার জন্য হরিণখোলায় আসে। শাল্যে গ্রামের কুখ্যাত রাজাকার- গুলজার ওরফে গুলবাহারের দেখানো পথে বেলা ৩টার দিকে গ্রামের পশ্চিম পাশ দিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা কয়েকটি জিপ গাড়িতে হরিণখোলা গ্রামে প্রবেশ করে। হঠাৎ হানাদার বাহিনীর আগমনে গ্রামবাসীরা ভীত হয়ে দিগববিদিক দৌড়াতে শুরু করে। তারা এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে থাকে। তারা মণ্ডল পাড়ায় প্রবেশ করে সৃষ্টিধর মণ্ডলের চোখে গুলি করে। এ-সময় সৃষ্টিধর মণ্ডলের ১২ বছরের মেয়ে বাউনি বাবাকে জড়িয়ে ধরে। হানাদাররা বাউনিকে নৃশংসভাবে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। গ্রামবাসী এবং আশ্রিত শরণার্থীদের অনেকে পালিয়ে হরিণখোলার দক্ষিণ পাশে খালের ঢালে আশ্রয় নেয়। অন্যরা গ্রামের বিভিন্ন স্থানে লুকানোর চেষ্টা করে। হানাদার বাহিনী গ্রামে লুকিয়ে থাকা গ্রামবাসী ও শরণার্থীদের খুঁজে বের করে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে অত্যন্ত নির্মমভাবে হত্যা করে। হাজরা নামক একজন গ্রামবাসী ধানের গোলায় আশ্রয় নিলে হানাদাররা ধানের গোলায় আগুন ধরিয়ে দেয়। গোলার মধ্যে হাজরা দগ্ধ হয়ে মারা যান। লুণ্ঠন শেষে তারা গ্রামের ঘড়বাড়ি, গোয়াল ঘর ও ধানের গোলায় অগ্নিসংযোগ করে। এরপর তারা গোয়ালপোতা গ্রামের দিকে অগ্রসর হয়। বাইরে থেকে আগত কিছু লোক এ লুটতরাজে অংশ নেয়৷
পাকিস্তানি বাহিনীর এ গণহত্যায় ৬০-৭০ জন মানুষ শহীদ হন। দূর-দূরান্তের হওয়ায় তাদের সকলের নাম-পরিচয় জানা যায়নি। যাদের নাম জানা গেছে, তারা হলেন— রঘুনাথ মণ্ডল (পিতা হীরালাল মণ্ডল), হাজারি মণ্ডল, যজ্ঞেশ্বর মণ্ডল (২৫) (পিতা বসন্ত মণ্ডল), সুবল মণ্ডল (পিতা বসন্ত মণ্ডল), চতুর সরকার, বন্দীরাম ঢালী (৭০), সৃষ্টিধর মণ্ডল (৪০) (পিতা ক্ষীরধর মণ্ডল), বাউনী মণ্ডল (১২) (পিতা সৃষ্টিধর মণ্ডল), বনমালী মণ্ডল (২৫) (পিতা সনাতন মণ্ডল), পাচু মণ্ডল (৬৫) (পিতা রতিকান্ত মণ্ডল), সনাতন ঢালী (পিতা রূপচাঁদ ঢালী), বাল্যক চাঁদ ঢালী (পিতা সনাতন ঢালী), নিতাই পদ মণ্ডল, রঘুনাথ ঢালী (৩০) ও সুবল মণ্ডল (২৭)। এ গণহত্যায় বিধান ঢালী আহত হয়ে বেঁচে যান। [মাসুদুর রহমান]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড