শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা স্বপন চৌধুরী
স্বপন চৌধুরী (১৯৪৯-১৯৭১) শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৪৯ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার উত্তর ঢেমশা গ্রামে জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা হরিরঞ্জন চৌধুরী ও মাতা হিরন্ময়ী চৌধুরী। তিন ভাইয়ের মধ্যে স্বপন চৌধুরী ছিলেন দ্বিতীয়। ছেলেবেলা থেকেই তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ও সাহসী। দেশমাতৃকার প্রতি অগাধ ভালোবাসার কারণে তিনি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন।
১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র (কালুরঘাট, চট্টগ্রাম) থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। যুদ্ধের শুরুতে ২৬শে মার্চ ও ২৭শে মার্চ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর ও আনসার বাহিনীর পাশাপাশি চট্টগ্রামের বেশকিছু অকুতোভয় ছাত্রনেতা নিজেদের সংগঠিত করেন এবং অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তাঁদের মধ্যে স্বপন চৌধুরী উল্লেখযোগ্য। তাঁর কাকা দীপক চৌধুরী, অধ্যাপক দিলীপ চৌধুরী, দীপেশ চৌধুরী ও দীপেন চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ছিলেন এবং যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
স্বপন চৌধুরী ছাত্রলীগ-এর রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এইচএসসি পাসের পর তিনি আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমান বুয়েট, ঢাকা) মেকানিক্যাল বিষয়ে ব্যাচেলর ডিগ্রি কোর্সে ভর্তি হন। এরপর থেকে তিনি প্রবীণ ও নবীন রাজনীতিবিদদের সংস্পর্শে আসেন। তখনকার ছাত্র-রাজনীতির অন্যতম সংগঠক সিরাজুল আলম খানের সংস্পর্শে এসে তিনি তাঁর রাজনৈতিক দর্শনে অনুপ্রাণিত হন এবং স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠনের জন্য নিজেকে নিয়োজিত করেন। সে-সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু। তাই স্বপন চৌধুরী হাইকমান্ডের নির্দেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগে স্নাতক (সম্মান) শ্রেণিতে ভর্তি হন। যেসব নেতৃত্বের সংস্পর্শে থেকে তিনি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাতেন, তাঁদের মধ্যে শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান, তোফায়েল আহমেদ, আবদুর রাজ্জাক, আ স ম আবদুর রব ও শাহজাহান সিরাজের নাম উল্লেখযোগ্য। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর রাজনৈতিক আদর্শের অন্যতম অনুসারী এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম সংগঠক চট্টগ্রামের এম এ আজিজ স্বপন চৌধুরীর রাজনৈতিক জীবনে প্রভাব ফেলেন।
স্বপন চৌধুরী ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদক হিসেবে ১৯৭০ সালের ১২ই আগস্ট সংগঠনের বর্ধিত সভায় সর্বপ্রথম ‘স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ’-এর প্রস্তাব উত্থাপন করেন। সে-সময় তিনি পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন জেলায় এর পক্ষে সমর্থন সংগ্রহে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ছাত্রসমাজের ১১ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭০-এর জাতীয় নির্বাচনে তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষিত হওয়ার পর স্বপন চৌধুরী চট্টগ্রামে প্রতিরোধ সংগ্রামে নেতৃত্ব দেন এবং চট্টগ্রামের রাইফেল ক্লাবের অস্ত্র লুট করে সেগুলো স্বাধীনতাকামী যুবক ও ছাত্রদের মধ্যে বিলি করেন। পাকহানাদার বাহিনীর নিকট চট্টগ্রামের পতন ঘটলে স্বপন চৌধুরী সহযোগীদের নিয়ে ভারতে চলে যান এবং সেখান থেকে ফিরে ১নং সেক্টরের কমান্ডার সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রফিকুল ইসলাম, বীর উত্তমএর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এছাড়া তিনি বিভিন্ন শরণার্থী শিবির-এ গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে আগ্রহী ছাত্র-যুবকদের রিক্রুটমেন্টের দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তিনি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী- ও মুজিবনগর সরকার-এর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ-এর উপস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সারির নেতৃবর্গের নীতি-নির্ধারণী বৈঠকে বক্তব্য রাখেন। উচ্চতর সামরিক প্রশিক্ষণ শেষে তিনি বিএলএফ চট্টগ্রাম দক্ষিণ অঞ্চল ও কক্সবাজারসহ সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামের কমান্ডার নিযুক্ত হন এবং অত্যন্ত সফলভাবে গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে যান।
স্বপন চৌধুরী তাঁর গ্রুপ নিয়ে অক্টোবরে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবেশ করেন এবং বিভিন্ন গেরিলা যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। তিনি রাঙ্গুনিয়া, রাউজান, চন্দ্রঘোনা ও কাউখালীতে বেশ কয়েকটি সফল অপারেশন পরিচালনা করেন। তিনি তাঁর গ্রুপ নিয়ে ২৭শে নভেম্বর রাঙ্গুনিয়ার রাণীরহাটের অদূরে রাঙ্গামাটির কাউখালীর কলমপতি নামক স্থানে ক্যাম্প স্থাপন করে অবস্থান নেন। এ সংবাদ পেয়ে পাকিস্তানি সেনারা রাঙ্গামাটি থেকে এসে ক্যাম্প ঘেরাও করে ঘুমন্ত অবস্থায় স্বপন চৌধুরী, নুরন্নবী, সুব্রত সাহা, শংকর সাহা ও শচীন দেওয়ানজীকে বন্দি করে রাঙ্গামাটি নিয়ে যায়। হানাদার বাহিনী তাঁদের রাঙ্গামাটি সদর দপ্তরে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন চালানোর পর ৩রা ডিসেম্বর নৃশংসভাবে হত্যা করে। দেশ স্বাধীনের পর শেখ ফজলুল হক মণির নির্দেশে রাঙ্গামাটির কাউখালীতে স্বপন চৌধুরী, নুরন্নবী, সুব্রত সাহা, শংকর সাহা ও শচীন দেওয়ানজীর হানাদারদের হাতে ধরা পড়ার বিষয়টি তদন্ত করতে চট্টগ্রাম জেলা কমান্ডের অধীনে গোয়েন্দা কাজে নিয়োজিত মুক্তিযোদ্ধা ইঞ্জিনিয়ার ইব্রাহিম হোসেন সেখানে আসেন। তিনি এলাকার মুক্তিযোদ্ধা ও গাইডদের থেকে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করেন। কিন্তু এ সম্পর্কে বিস্তারিত তেমন কিছু জানা সম্ভব হয়নি।
মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের কারণে পাকহানাদার বাহিনী স্বপন চৌধুরীর পরিবারের সদস্যদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালায় এবং তাঁদের গ্রামের বাড়িঘর ধ্বংস করে দেয়। পরবর্তীতে একই কারণে তাঁদের পরিবারের চকরিয়া থানার খুটাখালী ইউনিয়নের বইলতলী মৌজার প্রায় ২০০০ একর জমি স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের যোগসাজশে স্বাধীনতাবিরোধী কিছু লোক জবরদখল করে নেয়, যা আজো পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। বঙ্গবন্ধু চট্টগ্রাম শহরের নাসিরাবাদ এলাকায় তাঁদের নামে একটি বাড়ি বরাদ্দ দেন (১৩-বি/২ নং নতুন নং- ৩৬/৩)। সেই থেকে শহীদ পরিবার এখানে বসবাস করলেও বাড়িটি এখনো তাঁদের নিকট স্থায়ীভাবে হস্তান্তর করা হয়নি। স্বপন চৌধুরীর স্মৃতি রক্ষার্থে ১৯৭২ সালে তাঁর গ্রামে শহীদ স্বপন চৌধুরী স্মৃতি সংসদ প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং এ সংসদের উদ্যোগে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়। [জগন্নাথ বড়ুয়া]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড