You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে স্বরূপকাঠি উপজেলা (পিরোজপুর)

স্বরূপকাঠি উপজেলা (পিরোজপুর) একটি রাজনীতি- সচেতন এলাকা হিসেবে পরিচিত। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনসহ বাঙালির সকল স্বাধিকার আন্দোলনে স্বরূপকাঠি ছিল অগ্রগণ্য। ‘হক সাহেব’ নামে সাধারণ মানুষের কাছে অতি পরিচিত শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক বানারীপাড়ার চাখারের বাসিন্দা হওয়ায় স্বরূপকাঠিতেও তাঁর ব্যাপক জনপ্রিয়তা ছিল। ৫৪-র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে তিনি এখানকার আসন থেকে আইন সভার সদস্য হয়ে প্রথমে পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী (১৯৫৪) ও পরে গভর্নর (১৯৫৬-১৯৫৮) হন। তাঁর ছেড়ে দেয়া আসনে অনুষ্ঠিত উপ-নির্বাচনে আওয়ামী লীগএর প্রার্থী জয়নুল আবেদীন মোক্তারের পক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কয়েকদিন ধরে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশগ্রহণ করায় স্বরূপকাঠির রাজনীতিতে এর দীর্ঘ মেয়াদি প্রভাব পড়ে। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে স্বরূপকাঠি উপজেলায় আওয়ামী লীগ মনোননীত হক সাহেবের পুত্র এ কে ফায়জুল হক এমএনএ এবং ডা. শাহ মোজাহার উদ্দিন এমপিএ নির্বাচিত হন। নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিয়ে মেজরটি পার্টির নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তা ষড়যন্ত্রের আশ্রয় গ্রহণ করে। দুদিন পরে অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ১লা মার্চ স্থগিত ঘোষণা করা হয়। ২রা মার্চ থেকে ২৫শে মার্চ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর ডাকা অসহযোগ আন্দোলনএর সঙ্গে স্বরূপকাঠির মানুষ একাত্ম হয়ে বিক্ষোভে সোচ্চার হয়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ-এর পর এখানকার মানুষ আওয়ামী লীগের এমপিএ ডা. মোজাহার উদ্দিন, ন্যাপ নেতা জহুরুল হক লাল মিয়া, আওয়ামী লীগের আব্দুল লতিফ (লীগ লতিফ), জগদীশ চন্দ্ৰ আইচ, আইয়ুব আলী মাস্টার, শামসুল আরেফিন, নুরুল ইসলাম মুন্সী, কাজী ফজলুল হক, ছাত্রনেতা জাহাঙ্গীর বাহাদুর (পিতা নূর মোহাম্মদ মিয়া, সোহাগদল), ছাত্রনেতা নূর মোহাম্মদ প্রমুখের নেতৃত্বে সংগঠিত হওয়া শুরু করে। এ- সময় এডভোকেট সিরাজুল ইসলাম, কাজী শামসুল হক, কাজী মতিউর রহমান, মন্টু হাওলাদার, আব্দুল মান্নান, শামসুল আরেফিন প্রমুখের নেতৃত্বে স্বরূপকাঠি বাজার সংগ্রাম কমিটি এবং ১২ই মার্চ মাহমুদকাঠি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। এছাড়া হরিবর বিশ্বাসের নেতৃত্বে কুড়িয়ানা সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়।
কুড়িয়ানা মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে ১৫ই মার্চ থেকে ১৫ দিন প্রশিক্ষণ চলে। এ-সময় ক্যাপ্টেন মাহফুজ আলম বেগ, ক্যাপ্টেন বুলু, সচীন কর্মকার, তোফাজ্জল হোসেন, পরিমল ঘোষ, নাঈম প্রমুখ ব্যক্তিরা স্টেনগান, রাইফেল, গ্রেনেড, এসএলআর নিয়ে কুড়িয়ানায় আসেন। প্রশিক্ষণ ক্যাম্প পরিদর্শন শেষে তাঁরা অস্ত্রগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে হস্তান্তর করেন। অস্ত্র নিয়ে তাঁরা চলে যান পেয়ারা বাগানে। এ-সময় কচুয়াকাঠিতে প্রায় শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান করছিলেন। এখান থেকেই তারা নরেরকাঠি, বাউকাঠি, ইন্দুকাঠি, মাদ্রা (ঝালকাঠি)-তে পাকসেনাদের প্রতিরোধ করেন।
১৫ই মার্চ মাহমুদকাঠি গ্রামে আজাহার আলী, আনসার কমান্ডার মোফাজ্জেল হোসেন ও আবুল কালাম শতাধিক ছাত্র-যুবককে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। কমান্ডার জাহাঙ্গীর বাহাদুরের ভাই আলমগীর বাহাদুর (পিতা নূর মোহাম্মদ মিয়া, সোহাগদল) পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট ছিলেন। মার্চের উত্তাল দিনে ছুটি নিয়ে তিনি নিজ এলাকায় চলে আসেন। তিনি শুরু থেকে প্রশিক্ষণ কার্যক্রমসহ মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। স্বরূপকাঠি কলেজ মাঠে এ বি এম জহুরুল হক লাল মিয়া, আলমগীর বাহাদুর ও জাহাঙ্গীর বাহাদুরের উদ্যোগে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু হয়।
কমিউনিস্ট পার্টি-র ছত্রছায়ায় করিমুন্নেছা স্কুলে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প গঠন করে গেরিলা প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলতে থাকে। পাকসেনারা পিরোজপুর প্রবেশ করলে মুক্তিযোদ্ধারা এ ক্যাম্পটি গুটিয়ে নিতে বাধ্য হন। পরবর্তীতে ৪টি অংশে বিভক্ত হয়ে কাউখালি, নাজিরপুর, ভাণ্ডারিয়া ও স্বরূপকাঠির জলাবাড়িতে ক্যাম্প স্থাপন করা হয়।
স্বরূপকাঠি উপজেলায় ৪ঠা এপ্রিল থেকে সিরাজ সিকদার পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টির নামে কার্যক্রম শুরু করেন। প্রাথমিক অবস্থায় ১৭ জনের একটি বাহিনী এ দলে নাম লেখান। তাঁদের মধ্যে ছিলেন আলতাফ হোসেন কালু, আ. সোবাহান, ইসরাফিল কানু, হারেজ মিয়া প্রমুখ। তাঁরা সন্ধ্যা নদীর পশ্চিম পাড়কে ১নং জোন হিসেবে চিহ্নিত করে কৌরিখাড়া বিসিক শিল্প নগরীতে একটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপন করেন। এ-সময় সুটিয়াকাঠি, সোহাগদল ও পার্শ্ববর্তী গ্রামে অভিযান চালিয়ে লাইসেন্সকৃত ১৭টি একনলা ও দোনলা বন্দুক নিজেদের দায়িত্বে নিয়ে নেন। আটঘর-কুড়িয়ানার পেয়ারা বাগান ছিল পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টির মূল ঘাঁটি। অনেক নারী এ দলের সদস্য হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
তাঁদের মধ্যে ছিলেন শোভা রাণী মণ্ডল, সন্ধ্যা রাণী মণ্ডল, শিখা রাণী মণ্ডল, শোভা রাণী হালদার, মনিকা রায়, কনিকা রায়, প্রভা, বীথিকা, লালবিবি, অঞ্জলি, মঞ্জু, সুভাষিণী, রেবা, নিভা, বকুল, বীথিকা, আলমতাজ বেগম ছবি, রেহানা বেগম প্রমুখ। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধকালে বলদিয়া উচ্চ বিদ্যালয়, বলদিয়ার জিলবাড়ি ও পঞ্চবেকীতে মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাম্প স্থাপন করেন।
প্রাথমিক অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধারা সংগঠিত হয়ে স্থানীয় পর্যায়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। কিন্তু এ প্রশিক্ষণ হানাদার বাহিনীর সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকার মতো পর্যাপ্ত না হওয়ায় এবং এলাকায় রাজাকার-আলবদর বাহিনীর ক্যাম্প গড়ে ওঠায় পর্যায়ক্রমে অনেক মুক্তিযোদ্ধা উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য ভারত গমন করেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন ডা. শাহ মোজাহার উদ্দিন এমপিএ, ন্যাপ নেতা সাবেক ব্রিটিশ সেনাহিনীর সদস্য জহুরুল হক লাল মিয়া, নলিনী দাস, মুকুল সেন, নিরোদ নাগ প্রমুখ। ভারতে প্রশিক্ষণের জন্য চব্বিশ পরগনা জেলার অশোক নগর, বনগাঁ ও টাকিতে ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। অশোকনগর পৌরসভার চেয়ারম্যান ও এমএলএ ডা. সাধন ঘোষের তত্ত্বাবধানে সিপিআই প্রাদেশিক কমিটির দপ্তর সম্পাদক সমর সেনের অশোকনগরের বাড়িতে ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। এ ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন পিরোজপুর, বাগেরহাট ও বরিশাল অঞ্চলের ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়ন-এর কর্মীরা। ক্যাম্প পরিচালনায় নলিনী দাস, সহকারী পরিচালক হিসেবে জহুরুল হক লাল মিয়া (স্বরূপকাঠি), কমান্ডিং অফিসার এস এম এ সবুর (বাগেরহাট) এবং খাদ্য বিভাগে কমরেড আয়ুব আলী (স্বরূপকাঠি) দায়িত্ব পালন করেন। ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া) গ্রুপের উদ্যোগে মুজিব বাহিনী-র আদলে একটি গেরিলা বাহিনী গঠিত হয়।
জাহাঙ্গীর বাহাদুর ১৪ই আগস্ট ইন্দুরহাট বন্দরে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ মাইকে বাজিয়ে প্রচার করেন। জাহাঙ্গীর বাহাদুরের নেতৃত্বে তাঁর বাহিনী বলদিয়া ইউনিয়নের বিন্না স্কুলে সদর দপ্তর স্থাপন করে। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন শাহজাহান ওমর এখানে এসে অবস্থান করেন।
১৭ই এপ্রিল মুজিবনগর সরকার শপথ গ্রহণের পর সুসংগঠিতভাবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। জুলাই মাসে বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। পিরোজপুর জেলা ৯ম সেক্টরের আওতাধীন ছিল। এ সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন মেজর এম এ জলিল। তাঁর অধীনে বৃহত্তর বরিশাল অঞ্চল নিয়ে গঠিত সাব-সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন শাহজাহান ওমর। পরবর্তীতে এই সাব-সেক্টরের অধীনে স্বরূপকাঠি উপজেলায় জাহাঙ্গীর বাহাদুর কমান্ডার নিযুক্ত হন। আলমগীর বাহাদুর, নূর মোহাম্মদ হাওলাদার (মুজিব বাহিনী), হরিবর বিশ্বাস (কুড়িয়ানা), সৈয়দ কবির প্রমুখও কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া ডা. মোজাহার উদ্দিন এমপিএ, চিত্তরঞ্জন সূতার, ন্যাপ নেতা জহুরুল হক লাল মিয়া, আওয়ামী লীগের আব্দুল লতিফ (লীগ লতিফ), জগদীশ চন্দ্র আইচ, আইয়ুব আলী মাস্টার, এ শামসুল আরেফিন, নুরুল ইসলাম মুন্সী, কাজী ফজলুল হক প্রমুখ মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে সিরাজ সিকদারের নেতৃতে স্বরূপকাঠির পেয়ারা বাগানে একটি গ্রুপ সক্রিয় ছিল। এর প্রধান সিরাজ সিকদার (১৯৪৪-১৯৭৫) (পিতা আবদুর রাজ্জাক সিকদার, ভেদরগঞ্জ, শরীয়তপুর) ১৯৬৭ সালে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করে ১৯৬৮ সালে পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। একই সময়ে তিনি ঢাকায় ‘মাও রিসার্স সেন্টার’ নামে একটি রাজনীতি চর্চা কেন্দ্র গড়ে তোলেন, যার মূল লক্ষ্য ছিল জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের মাধ্যমে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটানো। পরবর্তী ধাপ ছিল শ্রেণিশত্রু খতমের মাধ্যমে সর্বহারার রাজত্ব কায়েম করা। ২৫শে মার্চ পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা শুরুর পর তিনি তাঁর বাহিনী নিয়ে স্বরূপকাঠি উপজেলার আটঘর-কুড়িয়ানার পেয়ারা বাগানে অবস্থান নেন। যুদ্ধ চলাকালে ৩রা জুন গঠন করেন পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি। স্থানীয় অনেক নারী-পুরুষ এ বাহিনীতে যোগ দেন এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। বরিশাল অঞ্চলে সুইসাইডাল বাহিনী নামে একটি গ্রুপ ছিল। এর কমান্ডার ছিলেন সিরাজ সিকদারের বাহিনীর রেজায়ে সাত্তার ফারুক (পিতা আ. সাত্তার, হাসপাতাল রোড, বরিশাল)। আটঘর-কুড়িয়ানায় পাকবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে তিনি অসীম সাহসিকতা ও নৈপুণ্যের পরিচয় দেন। এলাকার অনেক শিক্ষার্থী ভারতে ট্রেনিং নিয়ে এ বাহিনীতে যোগ দেন। ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় পিরোজপুরে গড়ে ওঠা স্থানীয় বাহিনীসমূহের অন্যতম ছিল জাহাঙ্গীর বাহাদুর বাহিনী। গেরিলা যুদ্ধের পশ্চাৎভূমি হিসেবে জাহাঙ্গীর বাহাদুর স্বরূপকাঠি, নাজিরপুর ও বানারীপাড়ার বিরাট বিল এলাকা বেছে নেন। এ এলাকায় সংঘটিত প্রতিটি যুদ্ধে এ বাহিনী বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সহোদর আলমগীর বাহাদুর এবং এ পরিবারের বেশ কয়েকজন সদস্য মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন। জাহাঙ্গীর বাহাদুর নিরাপত্তার জন্য ‘আসাদ’ এবং এ বাহিনীর কমান্ডার মঞ্জুরুল ইসলাম ‘বদি’ ছদ্মনাম ব্যবহার করতেন। ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর জাহাঙ্গীর বাহাদুর ও মুজিব বাহিনীর প্রধান নূর মোহাম্মদ হাওলাদারের নেতৃত্বে স্থানীয় ছাত্র-যুবকরা স্বরূপকাঠি, নাজিরপুর ও বানারীপাড়ার বিভিন্ন এলাকায় এবং কুড়িয়ানা সংগ্রাম কমিটির সাধারণ সম্পাদক হরিবর বিশ্বাস ও পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টির নেতা সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে আটঘর-কুড়িয়ানার পেয়ারা বাগানে স্থানীয় ছাত্র-যুবকরা পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।
৩রা মে পাকসেনারা হুলারহাট বন্দরে গানবোট থেকে নেমে সড়ক পথে পিরোজপুর শহরে অনুপ্রবেশ করে। পিরোজপুর শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান সৈয়দ আফজাল ও আশরাফ আলী চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে স্বাধীনতাবিরোধীরা কমান্ডার কর্নেল আতিক ও ক্যাপ্টেন এজাজসহ পাকবাহিনীকে অভ্যর্থনা জানায়। ১১ই মে তারা পিরোজপুর থেকে স্বরূপকাঠি উপজেলায় অনুপ্রবেশ করে। শর্ষিনার পীর মাওলানা আবু জাফর মোহাম্মদ সালেহ এবং সেখানকার মাদ্রাসার ছাত্রসহ রাজাকার, আলবদররা স্বরূপকাঠি লঞ্চঘাটে তাদের সংবর্ধনা জানায়। পরবর্তী সময়ে পাকহানাদাররা কুড়িয়ানা স্কুলে ক্যাম্প স্থাপন করে। তবে তা মাত্র ১২ দিন স্থায়ী ছিল। ২০শে মে পাকসেনারা স্বরূপকাঠির শশীদ হাটে ক্যাম্প স্থাপন করে। এ ক্যাম্প মাত্র ১০ দিন স্থায়ী ছিল।
পাকবাহিনীকে সহায়তা করার জন্য হাজী আব্দুর রহমানের নেতৃত্বে স্বরূপকাঠিতে থানা শান্তি কমিটি গঠিত হয়। শর্ষিনার পীর মাওলানা আবু জাফর মোহাম্মদ সালেহ পাকিস্তানি পক্ষ নেয়, যা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। তার আস্তানায় গড়ে ওঠে রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর দুর্গ। মাদ্রাসার ছাত্রদের নিয়ে গঠন করা হয় রাজাকার ও আলবদর বাহিনী। তাদের অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এখান থেকেই তারা পাকবাহিনীকে সহায়তা করত। তারা গ্রামেগঞ্জে হামলা চালিয়ে হত্যা, ধ্বংস, অগ্নিসংযোগ, লুটপাটে মেতে উঠে।
উপজেলায় পাকবাহিনীর সহযোগী ব্যক্তিরা হলো- মাওলানা আবু জাফর মোহাম্মদ সালেহ (পিতা মাওলানা শাহ্ সূফী নেছার উদ্দীন আহমেদ, শর্ষিনা; মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য ১৯৭১ সালের ৩১শে ডিসেম্বর আটক); মোহাম্মদ সালেহ-কে ১৯৮০ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান কর্তৃক শিক্ষায় স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদান), আলী আকবর শিকদার (মাগুরা; মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য ১৯৭১ সালের ৯ই ডিসেম্বর আটক), সুলতান আহমেদ (আটঘর; মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য ১৯৭১ সালের ১০ই ডিসেম্বর আটক), আব্দুল জব্বার আকন (চেয়ারম্যান, দৈহারী ইউনিয়ন; সারেংকাঠি; মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ১৯৭১ সালের ৩১শে ডিসেম্বর নিহত), আ. করিম (নান্দুহার, স্বরূপকাঠি; মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য ১৯৭১ সালের ১৩ই ডিসেম্বর আটক), আব্দুল কাদের মাওলানা (কাটা দৈহারী; মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য ১৯৭১ সালের ২৭শে ডিসেম্বর আটক), আ. কাদের (নান্দুহার; মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য ১৯৭১ সালের ১৩ই ডিসেম্বর আটক), আলী হোসেন হাওলাদার (ভরতকাঠি; মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য ১৯৭১ সালের ১৯শে ডিসেম্বর আটক), আ. হালিম শেখ (ভরতকাঠি; মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য ১৯৭১ সালের ১৯শে ডিসেম্বর আটক), মুজিবুর রেহমান (গুয়ারেখা; মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য ১৯৭১ সালের ১৯শে ডিসেম্বর আটক), লতিফ হাওলাদার (ভরতকাঠি; মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য ১৯৭১ সালের ১৯শে ডিসেম্বর আটক), লোকমান (ভরতকাঠি; মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য ১৯৭১ সালের ১৯শে ডিসেম্বর আটক), সিরাজুল ইসলাম ফকির (ভরতকাঠি; মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য ১৯৭১ সালের ১৯শে ডিসেম্বর আটক), মালেক হাওলাদার (ভরতকাঠি; রাজাকার বাহিনীর সদস্য থাকার কারণে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর আটক), আ. রাজ্জাক ফকির (ভরতকাঠি; মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর আটক), শের শাহ (সোহাগদল; মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত), খলিলুর রহমান খলিলুর রহমান শেখ (গুয়ারেখা, মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর আটক), সামছুল হক হাওলাদার (আটঘর; মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য ১৯৭১ সালের ১০ই ডিসেম্বর আটক), মোকছেদ মুন্সী (চাঁদকাঠি), মোশারফ হোসেন শেখ (চাঁদকাঠি), হাতেম আকন (সারেংকাঠি; মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত), কাছেম (করফা, সারেংকাঠি; মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত), মাওলানা আলী আজিম (শর্ষিনা মাদ্রাসার ছাত্র), আ. করিম ফকির (ভরতকাঠি), মো. শাসুল হক (জগন্নাথকাঠি), আমজাদ হোসেন ফকির (ভরতকাঠি), তোতা তালুকদার (ভরতকাঠি), মাওলানা বজলুল হক (শর্ষিনা রাজাকার ক্যাম্পের সহযোগী; পটুয়াখালী), আব্দুল খালেক (উত্তর-পশ্চিম সোহাগদল), আব্দুস সালাম (সোহাগদল), মোহাম্মদ আবুবকর (সোহাগদল), চিত্ত মণ্ডল (আটঘর-কুড়িয়ানা), আনছার আলী আকন ওরফে মন্টু চেয়ারম্যান (সুটিয়াকাঠি), সামছুল হক মাওলানা (সুটিয়াকাঠি), মোজাম্মেল হক কালা মিয়া (দক্ষিণ কৌরিখাড়া), মাস্টার আব্দুল খালেক (চেয়ারম্যান, দৈহারী ইউনিয়ন), মতিউর রহমান সিকদার (মাগুরা), আব্দুল খালেক তালুকদার (কাটা দৈহারী), আ. জলিল (কাটা দৈহারী), আ. লতিফ (কাটা দৈহারী), মাওলানা আ. রব (শর্ষিনা মাদ্রাসার ছাত্র, শর্ষিনা), মো. ইয়াকুব আলী (শর্ষিনা), আ. আজিজ (শর্ষিনা), মাওলানা সোলায়মান (শর্ষিনা মাদ্রাসার ছাত্র; সোনাখালী, পটুয়াখালী), মাওলানা আ. রহমান (শর্ষিনা মাদ্রাসার ছাত্র), মাওলানা আবু জাফর (শর্ষিনা মাদ্রাসার ছাত্র; পটুয়াখালী), মাওলানা রফিকুল্লাহ (শর্ষিনা রাজাকার ক্যাম্পের কমান্ডার; পটুয়াখালী), আছমত আলী হাজি ওরফে লুডু হাজি (পূর্ব সোহাগদল), মাওলানা মোহেবুল্লাহ (শর্ষিনা), মোখলেছ মুন্সী (গুয়ারেখা), আজাহার তালুকদার (নান্দুহার), আফসার দফাদার (নান্দুহার), শুক্কুর আলী চৌকিদার (নান্দুহার), মো. শাহ আলম (নান্দুহার), আব্দুল হাসেম (নান্দুহার), মাওলানা আব্দুল আজিজ (শর্ষিনা রাজাকার ক্যাম্পের প্রশিক্ষক; মির্জাগঞ্জ, পটুয়াখালী), জয়নাল আবেদিন (বিন্না), মাওলানা তোহা (শর্ষিনা রাজাকার ক্যাম্পের সহকারী; মোড়েলগঞ্জ, বাগেরহাট), শাহ সের আলী (সোহাগদল), রুস্তম আলী (সঙ্গীতকাঠি), আব্দুল কুদ্দুস মিয়া (সঙ্গীতকাঠি), মাওলানা আবু জাফর মিয়া (সঙ্গীতকাঠি), কাদের মিয়া (সঙ্গীতকাঠি), ফজলু মল্লিক (আটঘর), এহছাক আলী (আটঘর), মোক্তার আলী (আটঘর), আ. লতিফ হাওলাদার (আটঘর), আব্দুল আউয়াল (কামারকাঠি), আব্দুল আউয়াল (কামারকাঠি), ডাক্তার আব্দুস সাত্তার (ইদিলকাঠি), আব্দুল জব্বার (ইদিলকাঠি), সোবাহান মেম্বর (অলঙ্কারকাঠি), আবুল হাসেম (শর্ষিনা রাজাকার ক্যাম্পের সহকারী), খবির উদ্দীন তালুকদার (সাগরকান্দা), মকছেদ আলী ফরাজি (সাগরকান্দা), আব্দুল গফুর (আরামকাঠি), আবুল হাসেম আকন (আরামকাঠি), আ. রব (মাদ্রা, ঝালকাঠী), আব্দুল আজিজ (মাদ্রা, ঝালকাঠী), আব্দুল আজিজ (মাদ্রা ঝালকাঠী), আব্দুল গণি (মাদ্রা, ঝালকাঠী), মো. ফজলুল হক (মাদ্রা, ঝালকাঠী), আনসার আলী (মাদ্রা, ঝালকাঠী), আব্দুল হাকিম (মাদ্রা, ঝালকাঠী), আজাহার আলী (মাদ্রা, ঝালকাঠী), মোজাহার আলী বেপারী (মাদ্রা, ঝালকাঠী), মো. রুস্তুম আলী (মাহমুদকাঠি), আক্তার মিয়া (মাহমুদকাঠি), আব্দুল মালেক মিয়া (মাহমুদকাঠি), জলিল মিয়া (মাহমুদকাঠি), সোবাহান মিয়া (মাহমুদকাঠি), মো. মোজাহার মোল্লা (মাহমুদকাঠি), আ. হালিম মিয়া ওরফে হালিম চেয়ারম্যান (মাহমুদকাঠি), আজাহার আলী (মাহমুদকাঠি), মুজাহার আলী (মাহমুদকাঠি), আনোয়ার হোসেন (মাহমুদকাঠি), মো. সিদ্দিকুর রহমান (কামারকাঠি), আব্দুর রহমান মাওলানা (কামারকাঠি), মো. আবুল বাশার (জগন্নাথকাঠি), মোসলেম আলী ডাকুয়া (জগন্নাথকাঠি), আব্দুর রহমান (জগন্নাথকাঠি), মো. বাদশা (জগন্নাথকাঠি), আউয়াল (জগন্নাথকাঠি), আবুল হাসেম (জগন্নাথকাঠি), চৌকিদার মো. করম আলী (দৈহারী) প্রমুখ।
স্বরূপকাঠির আটঘর-কুড়িয়ানার অধিকাংশ এলাকা জুড়ে পেয়ারা বাগান। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর দিকে বিভিন্ন এলাকায় পাকসেনা ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের তৎপরতা বেড়ে গেলে সাধারণ মানুষ প্রাণ বাঁচাতে ঘরবাড়ি ছেড়ে পেয়ারা বাগানে আশ্রয় নেয়। মুক্তিযোদ্ধারাও নিরাপদ স্থান হিসেবে এখানে শক্ত ঘাঁটি স্থাপন করেন। আটঘর-কুড়িয়ানার পেয়ারা বাগান পরিণত হয় এক উদ্বাস্তু শিবিরে। এ খবর পৌঁছে যায় পাকসেনাদের কাছে। শর্ষিনা পীরের বাড়ি তখন হানাদার বাহিনী, রাজাকার ও আলশামস-এর আখড়া। তারা মাদ্রাসার ছাত্রদের নিয়ে একযোগে পেয়ারা বাগানে নিধন চালায়। তারা ধন-সম্পত্তি লুণ্ঠনসহ নারীনির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে। পেয়ারা বাগানের পথঘাট না চেনায় দূর-দূরান্ত থেকে আগত মানুষজনই বেশি হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়।
পাকসেনারা তাদের কুড়িয়ানা স্কুল ক্যাম্পে নিরপরাধ মানুষজন ধরে নিয়ে আসত। মাঠে খেলার রিং-এর সঙ্গে হাত-পা বেঁধে তাদের ঝুলিয়ে রাখত। তারা ২-৩ জনকে এক সঙ্গে বেঁধে গুলি করে হত্যা করত। একদিন তারা কাশীনাথ হালদার ও তার ছেলে ১০ম শ্রেণির ছাত্র নির্মল হালদারকে ধরে নিয়ে আসে। নির্মলকে গুলি করার জন্য দাঁড় করালে নির্মল ‘বাবা’ বলে ডাক দেয়। কাশীনাথ দৌড়ে এসে ছেলেকে জড়িয়ে ধরলে মুহূর্তেই বাবা ও ছেলেকে পাকবাহিনী বুলেট বিদ্ধ করে।
পাকসেনারা কুড়িয়ানা স্কুলে অগ্নিসংযোগ করে। স্কুলের দপ্তরি শশীভূষণ মজুমদার (সকলের প্রিয় ঠাকুর ভাই) এর প্রতিবাদ করলে পাকসেনারা তাকে ধরে নিকটস্থ খালপাড়ে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। এ খালপাড়ে তারা অসংখ্য মানুষকে হত্যা করে। ২৬শে মে-র পরে মুক্তিযোদ্ধারা আটঘর-কুড়িয়ানার পেয়রা বাগান ছেড়ে চলে গেলে হানাদার বাহিনী চারদিক থেকে পেয়ারা বাগান আক্রমণ করে। এরপর থেকে বিরতিহীনভাবে চলে অগ্নিসংযোগ, হত্যা ও ধর্ষণ। তারা মুক্তিযোদ্ধা সুধীর বড়ালকে দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দেয়। মাদ্রা গ্রামের এক ব্যক্তি নিজের নাম সুধীর পরিচয় দিলে হানাদাররা তাকে গুলি করে। পাশের গ্রামের মকসুদুর রহমানের ছেলে মানিক পেয়ারা বাগানে আশ্রয় নেয়। হানাদাররা মানিকসহ ২৯ জনকে গুলি করে হত্যা করে।
হানাদাররা কিশোরদের গাছে উঠে ডাব (নারিকেল) পেড়ে দেয়ার জন্য বলত। গাছে উঠলে উল্লাসে গুলি করে তাদের হত্যা করত। তারা গৌরাঙ্গ মিস্ত্রীর ২ বছর ও ৩ মাস বয়সী দুই কন্যাকে মা-বাবার কোল থেকে ছিনিয়ে নিয়ে পুকুরের পানিতে ফেলে হত্যা করে। রমেশ চন্দ্র রায়ের স্ত্রী গুলিবিদ্ধ হয়ে বেঁচে যান। এ-সময় তারা আটঘর-কুড়িয়ানার অসংখ্য ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। মুক্তিযুদ্ধকালে স্বরূপকাঠিতে তারা অনেকগুলো গণহত্যা চালায়। সেগুলো হলো- অলংকারকাঠি গণহত্যা, গুয়ারেখা গণহত্যা, গণকপাড়া গণহত্যা, দৈহারী গণহত্যা করফা গণহত্যা ছৈলাবুনিয়া-বাঁশতলা-থালিয়া গণহত্যা, জলাবাড়ি গণহত্যা, বরছাকাঠি গণহত্যা, গাবতলা গণহত্যা, জিলবাড়ি গণহত্যা ইত্যাদি।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ১১ই মে স্বরূপকাঠি উপজেলায় অনুপ্রবেশ করে। স্বরূপকাঠি লঞ্চঘাটে শর্ষিনার পীর ও মাদ্রাসার ছাত্রসহ রাজাকার-আলবদরদের সংম্বর্ধনা গ্রহণ করে তারা হিন্দু অধ্যুষিত অলংকারকাঠি গ্রাম আক্রমণ করে এবং গণহত্যা চালায়। অলংকারকাঠি গণহত্যায় ১৬ জন নিরীহ মানুষ শহীদ হন। গণহত্যার পর এলাকাবাসী ৬ জনকে গণকবরে সমাহিত করে।
২৪শে মে দুপুর বেলা রাজাকার কাদের মাওলানা, আমজাদ ফকির প্রমুখের দেখানো পথে হানাদার বাহিনী গুয়ারেখা গ্রাম আক্রমণ করে। তারা হিরন্ময় মৃধার বাড়ি, বেপারী বাড়ি এবং রায় বাড়িতে গণহত্যা চালায়। গণহত্যার পাশাপাশি তারা অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজে মেতে ওঠে। গুয়ারেখা গণহত্যায় ১৮ জন গ্রামবাসী শহীদ হন। গণহত্যার পর স্থানীয়রা ২টি গণকবরে তাদের সমাহিত করে।
২৪শে মে দুপুরবেলা পাকিস্তানি সৈন্যরা একটি গানবোটে করে গণকপাড়া স্কুলের কাছে আসে। স্থানীয় দোসরদের সহায়তায় তারা গ্রামের ১৮ জনকে ধরে দড়ি দিয়ে বেঁধে সতীশ শেখর রায়ের বাড়ির দক্ষিণ পাশে জড়ো করে। এরপর গুলি করে তাঁদের হত্যা করে। গুলিবিদ্ধ হয়ে বেঁচে যান বিনোদ মণ্ডল। একই সময় তারা বাঁশতলায় ষষ্ঠী চরণ হালদার ও তাঁর পুত্র ধীরেন্দ্রনাথ হালদারকে নিজ বাড়িতে হত্যা করে। গণহত্যার পর কয়েকজনের লাশ নিকটস্থ নিজ- নিজ বাড়িতে নিয়ে মাটি দেয়া হলেও স্থানীয়রা শহীদ ৮ জনকে একটি গণকবরে সমাহিত করে।
২৪শে মে স্থানীয় রাজাকার বাহিনীর কমান্ডার মাওলানা আব্দুল কাদের, আব্দুল খালেক তালুকদার ও দৈহারী সারেংকাঠি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আ. জব্বার আকনের সহযোগিতায় পাকবাহিনী দৈহারী গ্রামে নৃশংস গণহত্যা চালায়। এতে ১২ জন সাধারণ মানুষ প্রাণ হারায়। এ-সময় হানাদাররা বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, নারীনির্যাতন ও লুটতরাজে মেতে ওঠে। তারা দৈহারী বাজার লুণ্ঠন করে দোকানপাট পুড়িয়ে দেয়।
২৪শে মে দৈহারী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আ. জব্বারের সহযোগিতায় পাকসেনারা করফা গ্রামে আক্রমণ করে হিন্দু এলাকায় গণহত্যা চালায়। এ-সময় তারা গ্রামের অনেক বাড়িঘরে ব্যাপক হারে লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগ করে। করফা গণহত্যায় ১৬ জন গ্রামবাসী শহীদ হন।
২৪শে মে হানাদার বাহিনী স্থানীয় দোসরদের সহায়তায় উপজেলার ছৈলাবুনিয়া, বাঁশতলা ও থালিয়া গ্রামে গণহত্যা চালায়। এ-সময় তারা বাড়িঘরে লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করে। ছৈলাবুনিয়া-বাঁশতলা-থালিয়া গণহত্যায় ২৬ জন মানুষ শহীদ হন
হানাদার বাহিনী স্থানীয় রাজাকার ফয়জুদ্দিন এবং শর্ষিনার রাজাকারদের সহায়তায় ২১শে মে থেকে ৩রা জুন পর্যন্ত জলাবাড়ি এলাকায় গণহত্যা চালায়। জলাবাড়ি গণহত্যায় কয়েকশত মানুষ শহীদ হন। গণহত্যার পাশপাশি মাদ্রা পল্লীমঙ্গল মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং আশপাশের অনেকগুলো বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে।
স্বরূপকাঠি উপজেলা সদরের সন্ধ্যা নদীর পশ্চিম পাড়ে সোহাগদল ইউনিয়নের বরছাকাঠি কাছারিউলায় ১০ই নভেম্বর পাকসেনা ও তাদের দোসররা নৃশংস গণহত্যা চালায়। তারা বিভিন্ন এলাকা থেকে ১৮ জন নিরপরাধ মানুষকে ধরে এনে ২ জন করে রশি দিয়ে বেঁধে কাছারিউলার একটি পুকুরপাড়ে দাঁড় করিয়ে গুলি করে পুকুরে ফেলে দেয়। তাদের মধ্যে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় কাঞ্চন মিয়া (পিতা আলিম উদ্দিন, দক্ষিণ কৌরিখাড়া, সুটিয়াকাঠি) ও মো. লাল মিয়া (পিতা আব্দুল কাদের) বেঁচে যান। এদিন মোট ২১ জন মানুষ শহীদ হন।
পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা ১০ই নভেম্বর স্বরূপকাঠির ইন্দুরহাট-মিয়ারহাট বন্দরে অগ্নিসংযোগ করে হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে। তারা স্বরূপকাঠি কলেজের দিঘির দক্ষিণ পাড়ে বেতগাছের ঝোপ (যা গাবতলা নামে পরিচিত)-এ হানাদাররা বিভিন্ন এলাকা থেকে ধরে আনা মানুষের ওপর গণহত্যা চালায়। গাবতলা গণহত্যায় ১৮ জন মানুষ শহীদ হন।
বেলুয়া নদীর পূর্বপাড়ে স্বরূপকাঠির বলদিয়া ইউনিয়নের জিলবাড়ি গ্রাম। নদীর তীরে একটি সিড স্টোরে মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাম্প স্থাপন করেন। ১০ই নভেম্বর পাকসেনারা জিলবাড়িতে গানবোট থামিয়ে মর্টারশেলের গুলিতে সিড স্টোরে আঘাত হানে। এতে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পটি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়ে যায়। গানবোট থেকে নেমে তারা জিলবাড়ি গ্রামে ব্যাপকভাবে গণহত্যা চালায়। ফজিলা রহমান মহিলা কলেজের সহকারী অধ্যাপক মো. শহীদুল ইসলাম বাহাদুর জিলবাড়ি গণহত্যার একজন প্রত্যক্ষদর্শী। গণহত্যায় আ. খালেক শহীদ হন, তাঁর সহোদর আ. রহমান গুলবিদ্ধ হয়ে বেঁচে যান। জিলবাড়ি গণহত্যায় ১৮ জন মানুষ শহীদ হন। সোহাগদল ইউনিয়নের শেখপাড়ার ৬ জন মুক্তিযোদ্ধা যথা— মো. জাফর আলী (৩৫) (পিতা মো. বাহর আলী; নারকেল ব্যবসায়ী), এস এম শাহ্ আলম (২০) (পিতা ডা. আব্দুল আজিজ; বরিশাল পলিটেকনিক্যাল কলেজের ছাত্র), আউব আলী (১৮) (পিতা আ. সোবাহান; শ্রমিক), আ. হাই (১৭) (পিতা মো. শফিজ উদ্দিন; স্বরূপকাঠি কলেজের ছাত্র), মোকছেদ আলী মোল্লা (১৬) (পিতা হাতেম আলী মোল্লা; সোহাগদল হাই স্কুলের ছাত্র) এবং মো. সোহারব হোসেন (১৮) (পিতা মো. নেছার উদ্দীন; জুট মিল শ্রমিক, খুলনা) নভেম্বর মাসের প্রথমদিকে উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য ভারতের উদ্দেশে বাড়ি ত্যাগ করেন। তাঁরা ১৭ই নভেম্বর বাগেরহাট জেলার মোড়লগঞ্জ উপজেলার নিশানবাড়ি ইউনিয়নের গুলিশাখালি গ্রামের ঘোপের খালের মোহনায় একটি নৌকায় অবস্থান করছিলেন। রাত ৩টার দিকে স্থানীয় রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা নৌকার ২ জন মাঝিসহ ৬ জন মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করে লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেয়। বাগেরহাটের মোড়লগঞ্জ থানার সানকিডাঙ্গা গ্রামের সুন্দর আলী খানের ছেলে লিয়াকত আলী খান এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী।
উপজেলায় হানাদার বাহিনী গণহত্যা, লুণ্ঠন এবং অগ্নিসংযোগের পাশাপাশি নারীদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। লোকলজ্জায় অনেকেই তা প্রকাশ করেননি। কেউ- কেউ আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।
এসএসসি শিক্ষার্থী কনক প্রভা (১৮) (থালিয়া, গণকপাড়া) পাকবাহিনীর ভয়ে গ্রামের অন্যদের মতো পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বাঁশতলার বৈরাগীর ভিটায় আশ্রয় নেয়৷ রাজাকারদের সহায়তায় হানাদাররা সেখানে গিয়ে ঘটনাস্থলে হত্যাযজ্ঞ এবং নারীনির্যাতন চালায়। রাজাকাররা কনক প্রভাকে ধরে নিয়ে আসে। পাকসেনারা কনক প্রভাকে গানবোটে ওঠানোর চেষ্টা করলে বৃদ্ধা মানোদা সুন্দরী তাকে জড়িয়ে ধরে। বৃদ্ধা ছাড়তে না চাইলে পাকসেনারা তাকে গুলি করে। রক্তে রঞ্জিত হয় কনক প্রভা ও মানোদা সুন্দরীর দেহ। ২০শে মে শশীদ হাটে ক্যাম্প স্থাপনের পর এলাকায় পাকসেনারা ব্যাপক হারে নারীনির্যাতন করে। তারা রাতের বেলা গ্রামে প্রবেশ করে নারীদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। তারা নারীদের ধরে ক্যাম্পে নিয়ে যেত এবং পালাক্রমে পাকিস্তানি পশুরা তাদের ধর্ষণ করত। তারা ১১ বছরের একটি মেয়ে এবং ৮ মাসের গর্ভবতী এক গৃহবধূকে ধরে নিয়ে তাদের ওপর পাশবিক অত্যাচার চালায়। অত্যাচারে গৃহবধূ পেটের সন্তানসহ মারা যান। হাসান হাফিজুর রহমান (সম্পাদিত) বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র ৮ম খণ্ডের ২৫৩ পৃষ্ঠায় শশীদ গ্রামের বাসিন্দা এবং বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ ও নির্যাতনের প্রত্যক্ষদর্শী যতীন্দ্রনাথ মণ্ডলের মর্মস্পর্শী বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে। তিনি জানান, ‘একমাত্র স্বরূপকাঠি থানাতেই ১ হাজারের বেশী মেয়েকে পাক বাহিনী ধর্ষণ করেছে।’
মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে একদিন রাজাকারদের সহায়তায় পাকসেনারা জুলুঘাট গ্রাম আক্রমণ করে এবং নারীদের ওপর নির্যাতন চালায়। জুলুঘাট গ্রামে নারীনির্যাতনের একজন প্রত্যক্ষদর্শী ঊষা রাণী মল্লিক। তার বাড়ির পাশের বাড়িতে প্রবেশ করে পাকবাহিনীর ৪ জন সৈন্য দুজন মেয়েকে ধরে তাদের কোলের ছোট ছেলেকে আছাড় মেরে বাইরে ফেলে দিয়ে ভেতরে নিয়ে ধর্ষণ করে। তারা ঐদিন গ্রাম থেকে আরো কয়েকজন মেয়েকে ধরে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়। তারা দৈহারী ইউনিয়নের অঞ্জলি রাণীকে হাত-পা বেঁধে জীবন্ত পুড়িয়ে মারে।
উপজেলায় শর্ষিনার পীর মাওলানা আবু জাফর মোহাম্মদ সালেহ অনেক হিন্দুকে ধর্মান্তরিত করার উদ্যোগ নেয়। পীরের তাণ্ডবে অলংকারকাঠির ডাক্তার বাড়ির হিন্দুরা সর্বপ্রথম ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। তারা তাদের নাম পরিবর্তন করে ইসলামি নাম রাখে, পুরুষরা মাথায় টুপি পড়ত এবং নামাজের সময় নামাজ পড়ত। বিবাহিত নারীরা সিঁদুর মুছে ফেলে এবং হাতের শাখা ভেঙ্গে ফেলে।
৭ই মে কীর্তিনাশা খাল হয়ে পাকসেনারা স্বরূপকাঠি ও ঝালকাঠির পেয়ারা বাগানে প্রবেশ করে। পাকসেনা ও দোসররা সারাদিন বাড়িঘরে লুটপাট চালায় এবং অগ্নিসংযোগ করে। ১০ই মে তারা শশীদ হাট আক্রমণ করে। মতিলাল দেবনাথ ও হীরালাল দেবনাথের কাপড়ের দোকান লুট করে স্পিড বোটে ভর্তি করে কাপড় নিয়ে যায়। তারা এ-সময় মতিলাল দেবনাথের কাছ থেকে ১২,০০০ টাকা ছিনিয়ে নেয় এবং তাকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে-খুঁচিয়ে পরে গুলি করে হত্যা করে। এদিন শশীদ গ্রামের অধিকাংশ বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। ৩০শে মে পল্লীমঙ্গল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ক্যাম্প স্থাপনের পর পাকবাহিনী রাজাকারদের সহায়তায় এলাকায় হত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন ও ধর্ষণে মেতে ওঠে। তারা বিদ্যালয়ের আসবাবপত্র ভেঙ্গে রান্না করত। এক সময় বিদ্যালয়টিও আগুনে পুড়িয়ে দেয়। ১০ই নভেম্বর হানাদার বাহিনী আওয়ামী লীগের পিরোজপুর মহকুমা সভাপতি জয়নাল আবেদীনের সোহাগদলের বাড়িতে লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করে। এদিন তারা উপজেলার বৃহত্তর ইন্দুরহাট-মিয়ারহাট বাজারে লুণ্ঠন শেষে সবগুলো দোকানপাটে আগুন লাগিয়ে দেয়। এ সময় তারা বরছাকাঠি এবং ইন্দুরহাট-মিয়ারহাট বাজারের পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোর অসংখ্য বাড়িঘরে লুণ্ঠন এবং অগ্নিসংযোগ করে।
১০ই মে স্বরূপকাঠির শশীদ হাটে পাকবাহিনী ও রাজাকাররা জিতেন নামে একজনকে নারকেল গাছের সঙ্গে শক্ত করে বাঁধে। তারপর তার পায়ের কাছে খড়কুটা দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। সারা শরীরে আগুন ধরে গেলে তার আর্তনাদে বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। এরপর হানাদার পাকবাহিনী গুলি করে তার মাথার অর্ধেক অংশ উড়িয়ে দেয়।
কমান্ডার জাহাঙ্গীর বাহাদুরের ভাই আলমগীর বাহাদুর (পিতা নূর মোহাম্মদ মিয়া) পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট ছিলেন। মার্চের উত্তাল দিনে ছুটি নিয়ে তিনি নিজ এলাকায় চলে আসেন। মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে তিনি প্রশিক্ষণ কার্যক্রমসহ মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। রাজাকারদের সহযোগিতায় থানার দারোগা ১২ই মে আলমগীর বাহাদুরকে গ্রেপ্তার করে পাকসেনাদের পিরোজপুর ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয়। হানাদাররা ১৩ই মে বলেশ্বর পুরাতন খেয়াঘাটে তাঁকে গুলি করে হত্যা করে। তাঁর ছোট ভাই জহিরুল ইসলাম ২৭শে মার্চ শহীদ হন। এছাড়াও তাঁদের পরিবারের অপর এক সদস্য ইপিআর সদস্য আব্দুল খালেক মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি এবং মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক কাজী সামসুল হক প্রতিজ্ঞা করেন ‘দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত তিনি পায়ে জুতা পরবেন না।’ তাঁর এ প্রতীজ্ঞার কথা শর্ষিনার পীরের কাছে পৌঁছে যায়। ১০ই জুন তাঁকে পাকসেনাদের কাছে ধরিয়ে দেয়া হয়। পাকসেনারা তাঁকে নির্যাতন করে ৩০শে জুন হুলারহাট লঞ্চঘাটে গুলি করে হত্যা করে।
কমান্ডার সৈয়দ কবিরের সহযোদ্ধা জাকির হোসেন (গোবর্ধন, নাজিরপুর) ও বাদশাহ তালুকদার (বাঁশবাড়িয়া, কোটালিপাড়া, গোপালগঞ্জ)-কে রাজাকারদের সহায়তায় পাকিস্তানি পুলিশ ইন্দুরহাট বন্দর থেকে আটক করে ঝালকাঠি পাকসেনাদের ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয়। পাকসেনারা দুদিন ক্যাম্পে আটক রেখে নির্যাতন করে। ২৬শে জুলাই আরো ৫ জনের সঙ্গে তাঁদের গুলি করে হত্যা করা হয়। স্বরূপকাঠি উপজেলায় পাকবাহিনী ও রাজাকার বাহিনীর ক্যাম্পগুলো ছিল তাদের নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির। এর মধ্যে কুড়িয়ানা, শর্ষিনা, শশীদ হাট ও মৈশানী ক্যাম্প উল্লেখযোগ্য।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী স্বরূপকাঠি উপজেলায় ব্যাপক হত্যাকাণ্ড চালায়। এখানে একাধিক বধ্যভূমি রয়েছে। এর মধ্যে কুড়িয়ানা বধ্যভূমি ও শর্ষিনা বধ্যভূমি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়া উপজেলার একাধিক স্থানে গণকবর রয়েছে। এর মধ্যে বরছাকাঠি গণকবর উল্লেখযোগ্য। মুক্তিযুদ্ধে কুড়িয়ানা হানাদার বাহিনীর অন্যতম বধ্যভূমি হিসেবে পরিচিত। ১৬ই ডিসেম্বর বিজয়ের পর কুড়িয়ানা স্কুলের পেছনের ডোবা থেকে অন্তত ২৫০টি মাথার খুলিসহ কঙ্কাল উদ্ধার করা হয়। কুড়িয়ানা বধ্যভূমিতে কোনো স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করা হয়নি।
শর্ষিনার পীরের বাড়ি ছিল হানাদার বাহিনীর অপর একটি বধ্যভূমি। পীর মাওলানা আবু জাফর মোহাম্মদ সালেহর নেতৃত্বে রাজাকার ও আলবদর বাহিনী মুক্তিযোদ্ধা এবং স্বাধীনতার পক্ষের মানুষদের ধরে এনে শর্ষিনা বধ্যভূমিতে হত্যা করত। ২৬শে নভেম্বর শর্ষিনা যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা কাজী মতিয়ার রহমান ওরফে মতি কাজী তাদের হাতে ধরা পড়েন। তাঁকে হত্যার পর তাঁর মৃতদেহের ওপর শতাধিক গুলি করা হয়। তাঁর মৃতদেহ পীরের বাড়ির পোস্ট অফিসের খালে ফেলে দেয়া হয়। পীরের বাড়িতে যাদের ধরে এনে হত্যা করা হয় মতি কাজীর মতো তাদের লাশও এখানে ফেলে রাখা হয়। এ বধ্যভূমিতে শতাধিক মানুষকে হত্যা করা হয়। পূর্ব জলাবাড়ি (ইদিলকাঠি বাজার) ছিল পাকবাহিনীর অপর একটি বধ্যভূমি। ২১শে মে থেকে ১৪ দিন তারা এ বধ্যভূমিতে হত্যাযজ্ঞ চালায়। বিভিন্ন স্থান থেকে ধরে এনে এ বধ্যভূমিতে শতাধিক মানুষকে হত্যা করা হয়।
স্বরূপকাঠি থানার সন্ধ্যা নদীর পশ্চিম পাড়ে সোহাগদল ইউনিয়নের বরছাকাঠি একটি বড় গণহত্যা। ১০ই নভেম্বর পাকসেনা ও তাদের দোসররা ১৮ জন নিরপরাধ মানুষকে ধরে এনে পুকুরপাড়ে দাঁড় করে গুলি করে হত্যা করে। তাদের মধ্যে ৭ জনকে বরছাকাঠি গণকবরে দাফন করা হয়। এ গণহত্যায় শহীদ আ. কাদের ও তাঁর ভাই আ. রহমানকে সুটিয়াকাঠিতে একই কবরে দাফন করা হয়।
গণকপাড়ায় ২৪শে মে গণহত্যায় শহীদ ৮ জনের একটি গণকবর রয়েছে। এছাড়া অলংকারকাঠি ও গুয়ারেখা গ্রাম গণহত্যায় শহীদদেরও এখানে গণকবর রয়েছে। স্বরূপকাঠি উপজেলায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের বেশ কতগুলো যুদ্ধ হয়। সেগুলোর মধ্যে আটঘর-কুড়িয়ানা পেয়ারা বাগান যুদ্ধ ও শর্ষিনা যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য। এছাড়া ইন্দুরহাট-তারাবুনিয়া-বালিহারিতেও যুদ্ধ হয়।
২৫শে এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বরিশাল শহর দখল করে নিলে ২৭শে এপ্রিল ক্যাপ্টেন মাহফুজ আলম বেগ, এ এম জি কবীর ভুলু ৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে আটঘর- কুড়িয়ানার পেয়ারা বাগানে চলে যান। ১১ই মে ক্যাম্প স্থাপন করার পর রাজাকার এবং পাকবাহিনী পেয়ারা বাগানে অভিযান চালায়। এ-সময় হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি খণ্ড যুদ্ধ হয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি সফল অপারেশন পরিচালনা করতে সমর্থ হন। এখানকার যুদ্ধে ক্যাপ্টেন মাহফুজ আলম বেগ, এ এম জি কবীর ভুলু, সিরাজ সিকদার ও হরিবর বিশ্বাস নেতৃত্ব দেন।
১০ই নভেম্বর ইন্দুরহাট, তারাবুনিয়া, বালিহারিতে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। পাকবাহিনীর ভারী অস্ত্রের আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটেন। এ-যুদ্ধে নির্মল ও আলী হোসেন শহীদ হন।
২২শে নভেম্বর রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর দুর্গ বলে খ্যাত শর্ষিনা পীরের বাড়িতে হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে জাহাঙ্গীর বাহাদুর, কাজী মতিয়ার রহমান ওরফে মতি কাজী ও হায়দার, নূর মোহাম্মদ এবং বেনুলাল দাসগুপ্তের নেতৃত্বে অত্র অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধারা যোগ দেন। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত এ-যুদ্ধের এক পর্যায়ে কাজী মতিয়ার রহমান রাজাকার-আলবদরদের হাতে ধরা পড়েন। তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করে পীরের বাড়ির খালে ফেলে দেয়া হয়। মো. আনসার উদ্দিন (কাউখালী) নামে অপর একজন মুক্তিযোদ্ধা এ-যুদ্ধে শহীদ হন।
১৬ই ডিসেম্বর দেশ শত্রুমুক্ত হলেও স্বরূপকাঠিতে তখনো রাজাকার-আলবদর বাহিনীর শক্ত ঘাঁটি ছিল। শর্ষিনা পীরের বাড়ির রাজাকার দুর্গের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধারা লড়াই করে যাচ্ছিলেন। অবশেষে বিজয়ের ২দিন পর শর্ষিনার রাজাকার- আলবদর বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। ১৮ই ডিসেম্বর স্বরূপকাঠি হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হলেন- কাজী আব্দুস সাত্তার, বীর প্রতীক (পিতা কাজী আব্দুর রউফ, সুটিয়াকাঠি)। স্বরূপকাঠি উপজেসীverহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- সুভাষ চন্দ্র হালদার (পিতা ষড়ানন হালদার, আদাকুল), মো. আবু জাফর মন্টু (পিতা আ. গণি মিয়া, মাগুড়া), মো. আলী হোসেন (পিতা জিন্নাত আলি, কৌরিখাড়া), নির্মল চন্দ্র হালদার (পিতা মহেন্দ্র নাথ হালদার, জলাবাড়ি), আলমগীর বাহাদুর (পিতা নূর মোহাম্মদ মিয়া, সোহাগদল), আবুল কালাম আজাদ (পিতা মৌলভী আ. হামিদ আকন, মাহামুদকাঠি) এবং কাজী শামসুল হক (পিতা কাজী মোতাহার উদ্দিন, আকলম)।
মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে স্বরূপকাঠি উপজেলার বরছাকাঠি কাছারিউলা গণহত্যার স্থানটিকে বধ্যভূমি হিসেবে চিহ্নিত করে ২০০৬ সালে গণপূর্ত অধিদপ্তর স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করে। সোহাগদলের মো. জাফর আলী, এস এম শাহ আলম, আউব আলী, আ. হাই, মোকছেদ আলী মোল্লা, মো. সোহারব হোসেন এই ৬ জন শহীদের স্মৃতি রক্ষার্থে ২০১২ সালে সোহাগদলের শেখপাড়া বাজারে ‘শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিস্তম্ভ’ নির্মাণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের সাবেক যুগ্মসচিব মো. আবুল কালামের উদ্যোগে পূর্ব সোহাগদলের গরাইবাড়িতে চার শহীদের স্মরণে নির্মাণ করা হয়েছে শহীদ মো. মোতাহার আলী মেমোরিয়াল গেইট। এডভোকেট সিরাজুল ইসলাম ও অধ্যক্ষ শাহ্ আলমের নেতৃত্বে ১৯৮৬ সালে শহীদদের স্মরণে প্রতিষ্ঠিত হয় শহীদ স্মৃতি ডিগ্রি কলেজ। বাংলদেশ সরকারের সাবেক সচিব এম শামসুল হক ১৯৮৪ সালে প্রতিষ্ঠা করেন পশ্চিম সোহাগদল শহীদ স্মৃতি মাধ্যমিক বিদ্যালয়। ১৯৯৫ সালে তাঁরই নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় পশ্চিম সোহাগদল শহীদ স্মৃতি বি এম কলেজ। ১৯৭৩ সালে শহীদদের স্বরণে দৈহারীতে প্রতিষ্ঠিত হয় শহীদ স্মৃতি মাধ্যমিক বিদ্যালয়। অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক এস এম জাহাঙ্গীর ২০১১ সালে দক্ষিণ-পূর্ব সোহাগদলে প্রতিষ্ঠা করেন মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতি শিক্ষালয়। ১৯৭৮ সালে দক্ষিণ-পূর্ব সোহাগদলে প্রতিষ্ঠা লাভ করে মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতি সংসদ ও পাঠাগার। সোহাগদলের চাঁদকাঠি সড়কে হাওলাদার বাড়ি ব্রিজ সংলগ্ন স্থানের নামকরণ করা হয় জয়বাংলা চত্বর। স্বরূপকাঠি পৌরভবন সংলগ্ন বাসস্ট্যান্ড-ফেরিঘাট রোডের নামকরণ করা হয় মুক্তিযোদ্ধা স্মরণি। [হাবিবুল্লাহ রাসেল] তথ্যসূত্র: হাসান হাফিজুর রহমান (সম্পাদিত), স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : ৮ম খণ্ড, তথ্য মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, ১৯৮৪

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!