স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল
স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল জুন মাসে গঠিত হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গঠন এবং অর্জিত অর্থ মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় ব্যয় করা।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল প্রকৃতপক্ষেই একটি জনযুদ্ধ। এ যুদ্ধে সকল পর্যায়ের মানুষ অংশগ্রহণ করে। খেলোয়ার বা ক্রীড়াবিদরাও কোনো অংশে পিছিয়ে ছিলেন না। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী দ্বারা তাঁরাও নানাভাবে বৈষম্য বা লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধকালে কোনো-কোনো ক্রীড়াবিদ বা ক্রীড়া সংগঠককে পাকহানাদারদের হাতে জীবন দিতে হয়েছে। অনেকে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ভরতে যান এবং সেখানে ট্রেনিং গ্রহণ করেন। কেউ মুক্তিযোদ্ধাদের অভ্যর্থনা ক্যাম্পের ইন-চার্জ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের এক পর্যায়ে বাংলাদেশ সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম-এর উদ্যোগ ও প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ ক্রীড়া সমিতি গঠিত হয়। জাতীয় পরিষদ সদস্য শামসুল হক এর সভাপতি, লুৎফর রহমান সাধারণ সম্পাদক ও মোহাম্মদ মোহসীন কোষাধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। এর পরপর এ সমিতির তত্ত্বাবধানে জুন মাসে সাবেক ক্রিকেটার তানভীর মাজহারুল ইসলাম তান্নাকে ম্যানেজার, খ্যাতিমান রেফারি ননী বসাক-কে কোচ এবং ৩১ জন খেলোয়াড় নিয়ে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল গঠন করা হয়। খেলোয়াড়রা হলেন- মো. জাকারিয়া পিন্টু, প্রতাপ শংকর হাজরা, মেজর জেনারেল (অব.) খোন্দকার মো. নুরুন্নবী, আইনুল হক, শাহজাহান আলম, আলী ইমাম, শেখ মনসুর আলী লালু, মো. কায়কোবাদ, সুভাষ সাহা, অমলেশ সেন, শেখ আশরাফ আলী, এনায়েতুর রহমান খান, সাইদুর রহমান প্যাটেল, বিমল কর, শেখ তসলিম উদ্দিন, অনিরুদ্ধ, আবদুল মমিন জোয়ারদার, ফজলে সাদাইন খোকন, কাজী সালাউদ্দিন (তুর্য হাজরা), কে এম নওশেরুজ্জামান, আমিনুল ইসলাম সুরুজ, আবদুল হাকিম, নীহার কান্তি দাশ, লুৎফর রহমান, গোবিন্দ কুণ্ডু, সঞ্জিত কুমার দে, মজিবুর রহমান, আবদুস সাত্তার, মো. মনিরুজ্জামান পেয়ারা, মাহমুদুর রশিদ ও দেওয়ান মো. সিরাজউদ্দিন (শিরু)। জাকারিয়া পিন্টু ছিলেন দলের অধিনায়ক এবং প্রতাপ শংকর হাজরা ছিলেন সহ- অধিনায়ক। এ ফুটবল টিম গঠনে এক সময়ের কৃতী ফুটবল খেলোয়াড় ও কোচ আলী ইমাম মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল গঠনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গঠন এবং অর্জিত অর্থ মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় ব্যয় করা। ২৪শে জুলাই নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগর মাঠে নদীয়া জেলা একাদশের সঙ্গে প্রথম প্রীতি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে বাংলাদেশ দলের মাঠে প্রবেশ ও তা ওড়ানো এবং ভারত ও বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন শেষে খেলা শুরু হয়। বাংলাদেশ টিমের খেলোয়াড়দের ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে ওঠার সঙ্গে-সঙ্গে সৃষ্টি হয় এক আবেগঘন পরিবেশ, যা মাঠ ছাড়িয়ে গ্যালারির উৎসুক বিপুল সংখ্যক দর্শক, আশ্রয়ার্থী বাঙালি ও উপস্থিত মুক্তিযোদ্ধাদের হৃদয়কে গভীরভাবে স্পর্শ করে। অবশ্য এজন্য স্থানীয় জেলা প্রশাসক দীপক কান্তি রায়-কে এক ধরনের মাসুল দিতে হয়, কেননা তখন পর্যন্ত ভারত বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। যাহোক, খেলাটি ছিল স্বাধীন বাঙলাদেশ ফুটবল দল গঠিত হওয়ার পর প্রথম ম্যাচ। তাও বিদেশের মাটিতে। চরম প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এ খেলায় উভয় দল ২-২ গোলে ড্র করে। বাংলাদেশ দল যখনই গোল করেছে তখনই চতুর্দিকের গ্যালারি থেকে দর্শকদের মুহুর্মুহু ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে সারা মাঠ ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়েছে। এভাবে স্বাধীন বাংলা ফুটবল টিম ভারতের নদীয়া, কলকাতা, নরেন্দ্রপুর, বিহার, বেনারস, আগরতলা ও মুম্বাইতে মোট ১৬টি ম্যাচ খেলে। এর মধ্যে ৯টিতে বিজয়, ৪টিতে হার আর ৩টিতে ড্র করে। প্রীতি ম্যাচ খেলে স্বাধীন বাংলা ফুটবল টিম প্রায় ৫ লক্ষ ভারতীয় রূপী পায় এবং সমুদয় অর্থ বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিযুদ্ধ ফান্ডে জমা দেয়। উল্লেখ্য, উপমহাদেশের কিংবদন্তিতুল্য অভিনেতা দিলীপ কুমার বাংলাদেশ ফুটবল টিমকে এককালীন ২০ হাজার ভারতীয় রূপী দান করেছিলেন। আরো অনেকে এরূপ দান করেছিলেন।
অস্ত্র হাতে না হলেও ফুটবল পায়ে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে অনন্য ভূমিকা পালন করে। কেউ খেলা ছেড়ে অস্ত্র হাতে যুদ্ধের মাঠে ফিরে যান এবং শত্রুর বিরুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধ করেন, যেমন মেজর জেনারেল (অব.) খোন্দকার মো. নূরন্নবী। এমনকি মাঠের ফুটবল খেলাও ঝুঁকিহীন ছিল না। যুদ্ধের সময় ফুটবল দলের অধিনায়ক জাকারিয়া পিন্টুর পিতা কাপ্টেন (অব.) ডা. নাজিব উদ্দিন আহমদ (অবসরকালীন চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিত)-কে পাকহানাদাররা পুত্রের কারণে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। ঘটনাক্রমে তিনি প্রাণে বেঁচে যান। খেলোয়াড় কাজী সালাউদ্দিন একই কারণে নিজ নামের পরিবর্তে ‘তুর্য হাজরা’ ছদ্মনাম ধারণ করে ফুটবল টিমে খেলেছেন।
স্বাধীনতা-উত্তর সরকার স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সদস্যদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে নাম গেজেটভুক্ত করে। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দলের অধিনায়ক জাকারিয়া পিন্টুকে সরকার কর্তৃক ১৯৯৫ সালে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’-এ ভূষিত করা হয়। ফুটবল টিমের সকল সদস্য রাষ্ট্রীয় সম্মানী পাচ্ছেন। [হারুন-অর-রশিদ]
তথ্যসূত্র: মো. জাকারিয়া পিন্টু, ফুটবল যখন মুক্তিযুদ্ধের হাতিয়ার, ঢাকা, গৌরব প্রকাশন ২০১৮
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড