You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধের সময়কার রেডিও স্টেশন 'স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র' - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধের সময়কার রেডিও স্টেশন ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়কার একটি রেডিও স্টেশন। মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে এটি অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত। মুক্তিযুদ্ধে এর বিশাল ও উদ্দীপনীয় ভূমিকার কারণে এটিকে যুদ্ধের দ্বিতীয় ফ্রন্ট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এটি আবির্ভূত হয়েছিল ঐক্যবদ্ধ মুক্তিযুদ্ধের প্রাণকেন্দ্র স্বরূপ। এর ভূমিকা সশস্ত্র ফ্রন্টের চেয়ে কোনো অংশে কমতো নয়ই, বরং বহুলাংশে তা ছিল অধিকতর শক্তিশালী ও কার্যকর। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে এ বেতার কেন্দ্রের যাত্রা শুরু। মুক্তিযুদ্ধের অপরিহার্য অঙ্গ হিসেবে এটিকেও যুদ্ধের ন্যায় নানা পর্যায় বা পর্ব অতিক্রম করে নিজ অবস্থান সংহত করতে হয়েছে। এসব পর্যায় বা পর্বকে প্রধানত তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়, যথা- চট্টগ্রামের কালুরঘাট বা সূচনা পর্ব, ত্রিপুরার আগরতলা বা অর্ন্তবর্তীকালীন পর্ব এবং কলকাতার বালিগঞ্জ বা স্থিতি পর্ব।

কালুরঘাট বা সূচনা পর্ব (২৬-৩০শে মার্চ): স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র
৭১-এর মার্চ মাসে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চ তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে সমগ্র জনগণের পাশাপাশি রেডিও- টেলিভিশনে কর্মরত বাঙালি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উদ্দেশে শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে কোনোরূপ সহযোগিতা না করার সুস্পষ্ট নির্দেশনা দান করেন। গঠিত হয় বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ। ২৫শে মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইট নামে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বাঙালিদের ওপর সশস্ত্র আক্রমণ ও গণহত্যা পরিচালনা এবং তাদের হাতে বন্দি হওয়ার পূর্বে ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর স্বাধীনতা ঘোষণাকে কেন্দ্র করে শুরু হয় বাঙালির নয় মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। এমনি একটি ক্ষণের জন্য বাঙালিরা মানসিকভাবে পূর্ব থেকে প্রস্তুত ছিল। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা ওয়ারলেসের মাধ্যমে সঙ্গে-সঙ্গে দেশের সর্বত্র জেলা ও মহকুমা শহরে পৌঁছে যায়। তাই দেশের সর্বত্র শুরু হয় হানাদারদের বিরুদ্ধে বাঙালি ইপিআর ও সেনাসদস্য, পুলিশ, আনসার এবং মুক্তিকামী জনতার প্রতিরোধযুদ্ধ। এদিকে দেশের অনেক স্থানের মতো চট্টগ্রামে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার ইংরেজি বার্তাটি বাংলায় অনুবাদ করে হ্যান্ডবিল আকারে বিতরণ করা হয়। এমনি এক পরিস্থিতিতে একইদিন (২৬শে মার্চ) দুপুর বেলা হঠাৎ চট্টগ্রাম বেতারের কালুরঘাট ট্রান্সমিটার থেকে একটি তেজোদীপ্তকণ্ঠে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার সংবাদ প্রচার ও সেটি পাঠ করা হয়। যাঁর কণ্ঠ থেকে সে-সময় ঐ ঘোষণা এসেছিল, তিনি হলেন চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগএর তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নান (বর্তমানে প্রয়াত)। মাত্র ৫ মিনিটকাল বেতারের ঐ কার্যক্রম স্থায়ী ছিল। এরপর সন্ধ্যায় একই স্থান থেকে বিপ্লবী কণ্ঠে ঘোষণা এলো- ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে বলছি’। এর ঘোষক ছিলেন চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি কলেজের তৎকালীন ভাইস-প্রিন্সিপাল অধ্যাপক আবুল কাশেম সন্দ্বীপ। তিনিও ঐদিন একাধিকবার বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা এ বেতার থেকে পাঠ করেন। এরপর ২৭শে মার্চ বেতারের সান্ধ্য অধিবেশনে চট্টগ্রামের মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক তথা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের আহ্বানে মেজর জিয়াউর রহমান, বীর উত্তম বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার আলোকে অন্যদের সহযোগিতা নিয়ে ইংরেজি ভাষায় একটি ঘোষণাপত্র প্রস্তুত করে ‘আমাদের মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমান-এর পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণা করছি’ মর্মে তা পাঠ করেন। তাতে তিনি আরো উল্লেখ করেন যে, ‘শেখ মুজিবুর রহমান-এর নেতৃত্বে আইন ও সংবিধানসম্মতভাবে একটি বৈধ সরকার ইতোমধ্যে গঠিত হয়েছে।’ জিয়ার স্বকণ্ঠে পাঠ করা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পরবর্তী কয়েকদিনও একাধিকবার এ বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়। মেজর জিয়াউর রহমানকে দিয়ে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের এরূপ ঘোষণাপত্র পাঠ করানোর পেছনে মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল, সারাদেশে হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নিয়োজিত বাঙালি সশস্ত্র যোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধকরণ। মেজর জিয়ার স্বাধীনতার এ ঘোষণাপাঠ দেশের সর্বত্র শ্রুত না হলেও তা বিভিন্ন স্থানের প্রতিরোধযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করে।
এভাবে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের প্রথম আত্মপ্রকাশ। এটিকে সংগঠিত করতে চট্টগ্রাম বেতারের তৎকালীন লেখক-শিল্পী বেলাল মোহাম্মদ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন আরো ৯ জন, যাঁরা হলেন- আবুল কাশেম সন্দ্বীপ, সৈয়দ আবদুস শাকের (চট্টগ্রাম বেতারের তৎকালীন প্রকৌশলী), আব্দুল্লাহ আল-ফারুখ (অনুষ্ঠান প্রযোজক), মুস্তফা আনোয়ার (অনুষ্ঠান প্রযোজক), রাশেদুল হোসেন (টেকনিক্যাল এসিস্ট্যান্ট), আমিনুর রহমান (টেকনিক্যাল এসিস্ট্যান্ট), শারফুজ্জামান (টেকনিক্যাল অপারেটর), রেজাউল করিম চৌধুরী (টেকনিক্যাল অপারেটর) ও কাজী হাবিবউদ্দিন আহমদ। এছাড়াও আরো যাঁরা সহযোগিতা করেন, তাঁদের মধ্যে অধ্যাপক মমতাজউদ্দীন আহমেদ, আবদুল কাহ্হার (সহকারী আঞ্চলিক পরিচালক, চট্টগ্রাম বেতার), ডা. মন্জুলা আনোয়ার, ডা. সৈয়দ আনোয়ার আলী, ইঞ্জিনিয়ার আশিকুল ইসলাম, দিলীপ চন্দ্র দাস, কাজী হোসনে আরা, কবি আবদুস সালাম প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
বেতার কেন্দ্রটি স্বল্পকালীন সময়ের জন্য স্থায়ী হয়েছিল। ৩০শে মার্চ পাকিস্তানি বিমান বাহিনী এর ওপর বোমা বর্ষণ করে। তখনো অত্র এলাকাটি প্রতিরোধযোদ্ধাদের দখলে ছিল। ২৬শে মার্চ থেকে শুরু করে ৩০শে মার্চ পর্যন্ত এ ৫ দিন এখান থেকে মোট ১৪টি অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়। এর মধ্যে ছিল সংবাদ বুলেটিন, প্রতিরোধযোদ্ধা ও জনগণের উদ্দেশে নির্দেশনাবলি, বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ থেকে উদ্ধৃতি, গণসংগীত ইত্যাদি। অধিবেশনের সূচনা ও সমাপ্তি হতো ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ সংগীত দিয়ে। উল্লেখ্য, তৃতীয় দিনে বেতার কেন্দ্রের নাম থেকে ‘বিপ্লবী’ শব্দটি বাদ দিয়ে শুধু ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ নামে অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়। বেতার কেন্দ্রের ৫ দিনের স্থায়ীত্বকালে এটিকে সক্রিয় রাখার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, পেশাজীবী, বাঙালি সৈনিক ও ইপিআর-এর সদস্য এবং স্থানীয় জনগণ বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেন।
পাকিস্তানি বিমান হামলায় বেতার কেন্দ্রটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে ইপিআর সদস্যদের প্রহরায় বেলাল মোহাম্মদের নেতৃত্বে সংশ্লিষ্ট কতিপয় শিল্পী ও সংগঠক ১ কিলোওয়াটের একটি শর্টওয়েভ ট্রান্সমিটার ট্রাকে করে পটিয়া হয়ে ভারতের সীমান্তবর্তী মুক্ত অঞ্চল রামগড়ে নিয়ে যান। পরে এটিকে ত্রিপুরার বাগাফায় নিয়ে যাওয়া হয়।
আগরতলা বা অর্ন্তবর্তীকালীন পর্ব (৩রা এপ্রিল-২৪শে মে) ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে ৫২ দিনের প্রচারকালটি ছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের দ্বিতীয় পর্যায়। এটিকে অর্ন্তবর্তীকালীন পর্ব হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। এ অধ্যায়ে এর আয়োজনে বৃহত্তর পার্বত্য অঞ্চলের জেলা প্রশাসক ও মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকারের কেবিনেট সচিব এইচ টি ইমাম বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই তিনি বাংলাদেশের প্রতি তাঁর আনুগত্য ঘোষণা করে হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করার লক্ষ্যে এপ্রিলের শুরুতে তিনি বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকা রামগড় থেকে ত্রিপুরা রাজ্যে গিয়ে সেখানে কিছুদিনের জন্য অবস্থান করেন। ভারতীয় বিএসএফ-এর কাছ থেকে ২০০ ওয়াটের একটি শর্টওয়েভ ট্রান্সমিটার পাওয়া যায়। সীমান্তবর্তী ভারতীয় অংশের সাবরুম এলাকার নিকটবর্তী বিএসএফ ৯২-এর বাগাফা হেডকোয়ার্টার্সে একটি বাঁশের ঘরে রক্ষিত ঐ ক্ষুদ্র ট্রান্সমিটারটি দিয়ে ৩রা এপ্রিল থেকে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ নামে নতুন করে প্রচারকার্য শুরু হয়। অমর সিং নামে একজন শিখ ছিলেন ট্রান্সমিটারের অপারেটর। কালুরঘাট স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রধান সংগঠক বেলাল মোহাম্মদ ও তাঁর টিমের সদস্যগণ অনুষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। এ পর্যায়ে আরো যাঁদের সহযোগিতা পাওয়া যায় তাঁদের মধ্যে অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ এমএনএ, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ, মোস্তফা মনোয়ার, আমিনুল হক বাদশা, ড. হাবিবুর রহমান প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। এক পর্যায়ে বেতারের প্রচারকার্য বাগাফা থেকে ত্রিপুরার আগরতলা সংলগ্ন বিএসএফ ৯১-এর হেডকোয়ার্টার্স শালবনে স্থানান্তরিত করা হয়। সার্কিট হাউজের একটি কক্ষ স্টুডিও হিসেবে ব্যবহৃত হয়। পূর্বের ২০০ ওয়াটের স্থলে এখানে ৪০০ ওয়াটের একটি ট্রান্সমিটার পাওয়া যায়। তবে প্রতিদিন অনুষ্ঠান পরিচালনা সম্ভব হতো না, মাঝে-মাঝে বিরতি দিয়ে তা চলত। অনুষ্ঠানসূচির মধ্যে ছিল- বাংলা ও ইংরেজি সংবাদ, সংবাদ বুলেটিন, কথিকা, পত্রিকার সম্পাদকীয় মন্তব্য নিয়ে বিশ্বজনমত, উদ্দীপক সংগীত, দেশাত্মবোধক গান, আবৃত্তি ইত্যাদি। জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ পরিবেশনের মাধ্যমে অধিবেশনের সূচনা ও সমাপ্তি হতো। এ বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম- ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ-এর ভাষণ প্রচারিত হয়।

কলকাতার বালিগঞ্জ বা স্থিতি পর্ব (২৫শে মে-২রা জানুয়ারি ১৯৭২)
বাংলাদেশ সরকার-এর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে কলকাতার বালিগঞ্জের একটি দ্বিতল বাড়িতে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা সহকারে ২৫শে মে থেকে নতুন আঙ্গিকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের যাত্রা শুরু হয়। ২রা জানুয়ারি ১৯৭২ পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে তা অব্যাহত থাকে। ভারত সরকারের নিকট থেকে এজন্য একটি ৫০ কিলোওয়াট মিডিয়াম ওয়েভ ট্রান্সমিটার পাওয়া গিয়েছিল। এটিকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের তৃতীয় বা স্থিতি পর্ব হিসেবে অভিহিত করা যায়। তৃতীয় পর্বের শুভ সূচনার দিনটি ছিল বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন। সরকারের তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয় পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন আনোয়ারুল হক খান (সচিব), কামরুল হাসান (পরিচালক, ডিজাইন), এম আর আখতার মুকুল (পরিচালক, তথ্য), আবদুল জব্বার খান (পরিচালক, চলচ্চিত্র), সিরাজুল ইসলাম (চিত্র প্রযোজক) ও অজিত কুমার (প্রধান হিসাবরক্ষক)। টাঙ্গাইল থেকে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল মান্নান এমএনএ-এর ওপর বেতার কেন্দ্রের পরিচালনার ভার অর্পিত হয়। তিনি সরকারের মুখপাত্র জয় বাংলা পত্রিকারও প্রকাশক ছিলেন। বেতার কেন্দ্রের পরোক্ষ উপদেষ্টা হিসেবে জিল্লুর রহমান এমএনএ, অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ এমএনএ ও তাহেরউদ্দিন ঠাকুর এমএনএ দায়িত্ব পালন করেন। বেলাল মোহাম্মদের নেতৃত্বাধীন চট্টগ্রামের কালুরঘাট ও আগরতলা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ১০ জনের টিম, ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে শহীদুল ইসলাম ও আশফাকুর রহমান খানের নেতৃত্বে এক দল সিনিয়র অফিসার, রাজশাহী বেতার কেন্দ্র থেকে শামসুল হুদা চৌধুরীর নেতৃত্বে অপর একটি দল এবং খুলনা বেতার কেন্দ্র থেকে মমিনুল হক চৌধুরী এসে এখানে যোগ দেন। তাঁদের সঙ্গে ছিল সংগ্রামী গান, গণসংগীত ও অন্যান্য বিষয়ে প্রচুর মূল্যবান টেপ।
প্রতিদিন সকাল ও সন্ধ্যা দুটি অধিবেশন অনুষ্ঠিত হতো। অনুষ্ঠানসূচির মধ্যে ছিল পবিত্র ধর্মগ্রন্থসমূহ থেকে পাঠ, বাংলা ও ইংরেজি খবর, সংবাদ পর্যালোচনা, বজ্রকণ্ঠ, চরমপত্র, রণাঙ্গনের খবর, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিশেষ অনুষ্ঠান অগ্নিশিখা, রণাঙ্গনের চিঠি, ব্যঙ্গ নাটিকা জল্লাদের দরবার, বিশেষ সাহিত্যানুষ্ঠান রক্ত স্বাক্ষর, বিশ্বজনমত, কথিকা, আবৃত্তি, সংগীত, ইত্যাদি।
ব্যবস্থাপক, কর্মকর্তা, অনুষ্ঠান প্রযোজক, পরিচালক, সংগঠক, সঞ্চালক, স্ক্রিপ্ট লেখক, পাঠক, ঘোষক, সংবাদ দাতা, সংবাদ পাঠক, সুরকার, সংগীত শিল্পী, নাট্যশিল্পী, চিত্রশিল্পী, নৃত্যশিল্পী, কবি-সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, প্রকৌশলী, কলাকুশলী, যন্ত্রী প্রমুখকে নিয়ে এ পর্যায়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র একটি পূর্ণ অবয়বে গড়ে ওঠে। এঁদের মধ্যে শতাধিক ছিলেন সরকার কর্তৃক স্থায়ীভাবে নিয়োগকৃত। অভ্যন্তরীণভাবে বিভিন্ন বিভাগে ভাগ করে এক-এক বিভাগ ও অনুষ্ঠানের দায়িত্ব নির্দিষ্ট জনের ওপর ন্যস্ত করা হয়, যেমন কামরুল হাসান (পরিচালক, ডিজাইন), এম আর আখতার মুকুল (পরিচালক, তথ্য), আব্দুল জব্বার খান (পরিচালক, চলচ্চিত্র), সামসুল হুদা চৌধুরী (সংগঠক, প্রশাসন), কামাল লোহানী (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, সংবাদ), আলমগীর কবির (সংগঠক, ইংরেজি সংবাদ), আলী জাকের (প্রযোজক, ইংরেজি সংবাদ), আবুল কাশেম সন্দ্বীপ (সম্পাদক, বাংলা সংবাদ), সৈয়দ হাসান ইমাম (সংগঠক, নাটক), জাহিদ সিদ্দিকী (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, উর্দু অনুষ্ঠান), বেলাল মোহাম্মদ (কর্মকর্তা, অনুষ্ঠানসূচি), সমর দাস (পরিচালক, সংগীতানুষ্ঠান), অজিত রায় (প্ৰযোজক, সংগীত), আশফাকুর রহমান খান (সমন্বয়কারী, সংগীতানুষ্ঠান), মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ (প্রযোজক, নাটক ও সাহিত্য), আশরাফুল আলম (পরিচালক, অগ্নিশিখা ও রক্ত স্বাক্ষর), আমিনুল হক বাদশা (সংগঠক) ও সৈয়দ আবদুস শাকের (প্রধান প্রকৌশলী)। লেখক-কবি-সাহিত্যিক-সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ড. মাযহারুল ইসলাম, ড. আনিসুজ্জামান, ড. সৈয়দ আলী আহসান, ড. এ আর মল্লিক, ড. গোলাম মুরশিদ, ড. অনুপম সেন, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, জহির রায়হান, সিকান্দার আবু জাফর, শওকত ওসমান, বুলবন ওসমান, তোয়াব খান, গাজীউল হক, বেগম মুশতারী শফী, নির্মলেন্দু গুণ, আসাদ চৌধুরী, মহাদেব সাহা, বিপ্রদাস বড়ুয়া প্রমুখ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নেন। নাট্যশিল্পীদের মধ্যে ছিলেন সৈয়দ হাসান ইমাম, মামনুর রশীদ, সুভাষ দত্ত, আজমল হুদা মিঠু, রাজু আহমেদ প্রমুখ। বহু সংগীত শিল্পী, সুরকার ও গীতিকারের পরিবেশনায় বেতারের অনুষ্ঠান হয়ে ওঠে খুবই প্রাণবন্ত ও উদ্দীপনাময়। সংগীত শিল্পীদের মধ্যে সমর দাস, আবদুল জব্বার, অনুপ ভট্টাচার্য, রফিকুল আলম, স্বপ্না রায়, আপেল মাহমুদ, রথীন্দ্রনাথ রায়, অজিত রায়, সুবল দত্ত, কল্যাণী ঘোষ, ডা. অরূপ রতন চৌধুরী, কাদেরী কিবরিয়া, মলয় কুমার গাঙ্গুলী, নমিতা ঘোষ, মান্না হক, তপন মাহমুদ, ফকির আলমগীর, শেফালী ঘোষ, তিমির নন্দী, শাহিন মাহমুদ, সর্দার আলাউদ্দিন আহমেদ প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠানসমূহের মধ্যে বজ্রকণ্ঠ, চরমপত্র, জল্লাদের দরবার, কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী গান, দেশাত্মবোধক গান ইত্যাদি ছিল খুবই আকর্ষণীয় ও জনপ্রিয়। বজ্রকণ্ঠ ছিল বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণভিত্তিক অনুষ্ঠান, যা রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ভীষণ উদ্দীপনাময় ছিল। এম আর আখতার মুকুল ছিলেন চরমপত্রের রচয়িতা ও পরিবেশক। ঢাকাইয়াসহ বিভিন্ন অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষায় অদ্ভুত কণ্ঠস্বর ও বাচন-ভঙ্গিতে তাঁর রণাঙ্গনের খবর পরিবেশন ছিল খুবই জনপ্রিয় ও উপভোগ্য। ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ ও মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন ছিল এ অনুষ্ঠানের সর্বশেষ পরিবেশনা। কল্যাণ মিত্র রচিত ইয়াহিয়া সামরিক জান্তার চরিত্র উন্মোচন করে ‘জল্লাদের দরবার’ নামে ব্যঙ্গাত্মক নাটিকা ছিল বেতারের আর একটি আকর্ষণীয় অনুষ্ঠান।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংবাদ পাঠকদের মধ্যে ছিলেন- নুরুল ইসলাম সরকার (বাংলা), বাবুল আখতার (বাংলা), সালেহ আহমেদ ছদ্ম নামে হাসান ইমাম (বাংলা), আশরাফুল আলম (বাংলা), শহীদুল ইসলাম (বাংলা), পারভীন হোসেন (ইংরেজি), ফিরোজ ইফতেখার (ইংরেজি), জেরিন আহমেদ ছদ্ম নামে নাসরীন আহমেদ শিলু (ইংরেজি) প্রমুখ।
পবিত্র ধর্মগ্রন্থসমূহ থেকে যাঁরা পাঠ করতেন, তাঁরা হলেন- মওলানা নুরুল ইসলাম জেহাদী, মওলানা খাইরুল ইসলাম যশোরী, মওলানা ওবাইদুল্লাহ জালালাবাদী, বিনয় কুমার মণ্ডল, জ্ঞানেন্দ্র নাথ বিশ্বাস, রণধীর বড়ুয়া ও ডেভিড প্রণব দাস।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে পরিবেশিত জনপ্রিয় সংগীতের মধ্যে আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি, জয় বাংলা বাংলার জয়, কারার ঐ লৌহ কপাট, দুর্গম গিরি কান্তার মরু, মোরা ঝঞ্ঝার মতো উদ্দাম, জনতার সংগ্রাম চলবেই, বিচারপতি তোমার বিচার, সোনা সোনা সোনা, সালাম সালাম হাজার সালাম, আমি শুনেছি শুনেছি আমার মায়ের কান্না, নোঙর তোলো তোলো, শোনো একটি মুজিবরের থেকে, একটি ফুলকে বাঁচব বলে, আমার নেতা শেখ মুজিব, অনেক রক্ত দিয়েছি আমরা, সোনায় মোড়ানো বাংলা মোদের, রক্তেই যদি ফোটে জীবনের ফুল, তীরহারা এই ঢেউ-এর সাগর, ছোটদের বড়দের সকলের, এক সাগর রক্তের বিনিময়ে, সাড়ে সাত কোটি মানুষের আর একটি নাম, পূর্বদিগন্তে সূর্য উঠেছে, জগৎবাসী বাংলাদেশকে যাও দেখিয়া, আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে অংশগ্রহণ না করলেও বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিকরা নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা, ভারতে আশ্রয় নেয়া ১ কোটি শরণার্থী ও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী দ্বারা অবরুদ্ধ বাংলাদেশের মানুষকে মুক্তিযুদ্ধকালে ভীষণভাবে উজ্জীবিত করে রাখেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অবদান চির ভাস্মর হয়ে থাকবে। [হারুন-অর-রশিদ]
তথ্যসূত্র: এইচ টি ইমাম, বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১, বাংলা একাডেমি ২০১২; বেলাল মোহাম্মদ, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, অনুপম প্রকাশনী ২০১৫; অধ্যাপক ডা. অরূপ রতন চৌধুরী, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, আগামী প্রকাশনী ২০১৮; এ এস এম সামছুল আরেফিন, মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তির অবস্থান, সময় প্রকাশন ২০১২; শামসুল হুদা চৌধুরী, একাত্তরের রণাঙ্গন, আহমদ পাবলিশিং হাউস ২০০৯

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড