You dont have javascript enabled! Please enable it!

সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাস প্রতিরোধকালে গণহত্যা (চট্টগ্রাম মহানগর)

সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাস প্রতিরোধকালে গণহত্যা (চট্টগ্রাম মহানগর) সংঘটিত হয় ২৪শে মার্চ এতে পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে ২৩ জন প্রতিরোধকারী নিহত এবং অনেকে আহত হন।
মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়ে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে ‘সোয়াত’ নামক পাকিস্তান শিপিং কর্পোরেশনের একটি বাণিজ্যিক জাহাজ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বহির্নোঙ্গরে অবস্থান নেয়। অস্ত্রগুলো বাঙালিদের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য নিয়ে আসা হয়। ১৯শে মার্চ জাহাজটি ১৭ নম্বর জেটিতে ভেড়ে। বন্দরে কর্মরত বাঙালি অফিসার ক্যাপ্টেন এস এল রহমান, ডা. আনোয়ার হোসেন, ডা. শহীদুল্লাহ প্রমুখ সোয়াতের অস্ত্রের কথা চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দকে জানান। আওয়ামী লীগ নেতারা তা প্রচার করলে সারা চট্টগ্রামে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। বন্দরের ডক শ্রমিক নেতাদের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে শ্রমিকরা অস্ত্র খালাসে অস্বীকৃতি জানায় এবং সভা-সমাবেশ করতে থাকে। ২৪শে মার্চ বিকেলে চট্টগ্রাম শহরের নিউমুরিং কলোনির মাঠে একটি সমাবেশ ডাকা হয়। কলোনির বাসিন্দারা ব্যাপক আগ্রহ নিয়ে এ সমাবেশ সফল করতে উৎসাহ যোগায় এবং সমাবেশে যোগ দিয়ে এটিকে একটি বিশাল প্রতিবাদী জনসভায় রূপান্তরিত করে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা বাদশা আলমের সভাপতিত্বে বিকেল ৪টায় সমাবেশ শুরু হয়। সমাবেশে এম এ হান্নান (চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক), এম এ মান্নান, এম এ মজিদ প্রমুখ বক্তৃতা করেন। এম এ হান্নান তাঁর বক্তৃতায় বলেন, “নিউমুরিং কলোনির পূর্বপাশে কর্ণফুলী নদীর ১৭ নং জেটিতে নোঙ্গর করা হয়েছে সোয়াত জাহাজ। এ জাহাজে করে বাঙালিদের হত্যা করার জন্য অস্ত্র আনা হয়েছে। আমরা সেই অস্ত্র নামাতে দেবো না। আমরা সোয়াত জাহাজ অবরোধ করব।’ ঠিক সেই মুহূর্তে চিটাগাং স্টিল মিলস থেকে কয়েক হাজার লোকের একটি মিছিল আসে। মিছিলে প্রত্যেকের হাতে ছিল লোহার রড। সমবেত জনতা বড় মিছিল নিয়ে তিন নম্বর জেটি গেইটের দিকে রওনা হয়। তাদের লক্ষ্য ছিল বারিক মিয়া স্কুলের পাশে নেভি ফ্লিট ক্লাবে গিয়ে অস্ত্র খালাসের প্রতিবাদ করা। নিউমুরিং কলোনি থেকে মিছিলটি যখন ডবলমুরিং-এর দিকে এগিয়ে যায়, তখন প্যারেড গ্রাউন্ড থেকেও আরেকটি মিছিল বন্দরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। সেদিন বিকেলে প্যারেড গ্রাউন্ড ময়দানে বিশিষ্ট নাট্যকার মমতাজ উদ্দিন আহমদের ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম’ নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছিল। বিশাল মাঠভর্তি দর্শক যখন নাটকটি দেখছিল, তখন তাদের কাছে খবর আসে যে, ডক বন্দরের শ্রমিকরা সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাস প্রতিরোধ করতে নেভি নিউক্লাব ঘেরাও করার জন্য মিছিল সহ এগিয়ে আসছে। মুহূর্তে প্যারেড গ্রাউন্ড মাঠের জনতা নাটক দেখা বন্ধ করে বন্দর অভিমুখে রওনা হয়। একই সময় পোর্ট কলোনির ১২ নম্বর রোডে এক সমাবেশ চলছিল। সোয়াত জাহাজ অবরোধের খবর বিদ্যুৎ বেগে ঐ সমাবেশেও পৌঁছে যায়। খবর পাওয়া মাত্র উত্তেজিত জনতা মিছিল নিয়ে ৩ নম্বর জেটির দিকে রওনা হয়। এসব মিছিলের নেতৃত্বে ছিলেন স্টিল মিলের শ্রমিক নেতা আবুল বশর, ম্যানেজার জাহেদ, পোর্ট ট্রাস্টের শ্রমিক নেতা নবী মিস্ত্রী, শ্রমিক নেতা আহসানউল্লাহ চৌধুরী, আবুল কালাম, মান্নান সিকদার, নজরুল ইসলাম, মতিউর রহমান, শেখ মানিক, ওমর ফারুক, শাহ আলম, আবু সালেহ এমএনএ, মোশারফ হোসেন এমপিএ, এম এ মজিদ, মো. ইসহাক প্রমুখ। ১ নম্বর জেটি থেকে নিউমুরিং নেভাল বেইজ পর্যন্ত সামরিক তৎপরতা নেভি নিউক্লাব থেকে পরিচালিত হতো। মিছিলটি ৩ নং জেটি গেইটের কাছে পৌঁছতেই নেভি ফ্লিট ক্লাবে টহলরত সৈনিকরা জনতার ওপর গুলি চালায়। এতে ঘটনাস্থলেই ২৩ জন নিহত এবং অনেকে আহত হন। জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে যে যেদিকে পারে সরে গিয়ে আত্মরক্ষা করে। রাত ১টা পর্যন্ত সেদিন ৩ নম্বর জেটি এলাকার বাইরে রাস্তায় গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়।
পরের দিন পত্রিকায় এ খবর ছাপা হয়। বঙ্গবন্ধু ঢাকায় তাঁর বাসভবনের সামনে জনতার উদ্দেশে ভাষণ দিতে গিয়ে এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানান। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ- সংবাদপত্রে প্রদত্ত বিবৃতিতে এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগ এবং সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন এবং আহতদের খোঁজ-খবর নিতে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে ছুটে যান। [জামাল উদ্দিন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!