সোহাগপুর গণহত্যা (নালিতাবাড়ী, শেরপুর)
সোহাগপুর গণহত্যা (নালিতাবাড়ী, শেরপুর) সংঘটিত হয় ২৫শে জুলাই। শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ী উপজেলার কাকরকান্দি ইউনিয়নের সোহাগপুর গ্রামে সংঘটিত এ গণহত্যায় ১৮৭ জন নিরীহ মানুষ প্রাণ হারান। এ গণহত্যা বাংলাদেশে পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের পরিচালিত হত্যাযজ্ঞের এক মর্মস্পর্শী দৃষ্টান্ত। গণহত্যার পর পাকসেনা ও তাদের দোসররা নিহতদের স্ত্রীদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। সেদিন একটি পাড়ার সমস্ত পুরুষ মানুষকে হত্যা করা হয়। এরপর থেকে গোটা গ্রামের নাম হয় সোহাগপুর বিধবাপল্লী। সেদিন ১৩ জন নারী পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন। যুদ্ধাপরাধী জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কামারুজ্জামানের উদ্যোগে পাকহানাদার বাহিনীর একটি দল এ নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ চালায়। ৬ ঘণ্টা ধরে তাদের দ্বারা এ নির্মম হত্যাকাণ্ড ও পাশবিকতা চলে।
নালিতাবাড়ী শহর থেকে সোহাগপুর গ্রামের দূরত্ব ৮ কিলোমিটার। সোহাগপুর গ্রামের উত্তর-পূর্ব প্রান্ত দিয়ে প্রবহমান বুড়ি ভোগাই নদী। দক্ষিণে গ্রামটিকে লতার মতো জড়িয়ে আরেকটি নদী সুতিয়া। সোহগপুরের পশ্চিমে আরো দুটি গ্রাম বেণুপাড়া ও রসাইতলা। পাকহানাদার বাহিনীর কাছে এদেশীয় দোসররা তথ্য দিয়েছিল যে, সোহাগপুর গ্রামে কৃষকের ছদ্মবেশে শতশত মুক্তিযোদ্ধা আত্মগোপন করে আছে। এসব মুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য ২৫শে জুলাই সকালে পাকবাহিনী এ গ্রামে হানা দেয়। যুদ্ধাপরাধী কামারুজ্জামানের উদ্যোগ ও পরামর্শে পাকসেনাদের ১৫০ জনের একটি দল রাজাকার-আলবদরদের সহায়তায় সোহাগপুর গ্রামের প্রফুল্লের দিঘি থেকে সাধুর আশ্রম পর্যন্ত বেণুপাড়া ও আতিয়াপাড়া এলাকা ব্যারিকেড দিয়ে ঘিরে ফেলে। এরপর তারা নারকীয় হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। পাকসেনাদের এলোপাতাড়ি গুলিতে সারা গ্রামে ১৮৭ জন পুরুষ প্রাণ হারান। সম্ভ্রম হারান ১৩ জন নারী। তাদের ৬ ঘণ্টার নারকীয় তাণ্ডবে বিধবা হন শতাধিক নারী। সেদিন স্বামী-সম্ভ্রম হারানো বিধবা বীরাঙ্গনাদের আত্মত্যাগের সাক্ষী সোহাগপুর বিধবাপল্লী।
হামলার প্রথম শিকার হন রমেন রিসিল, চটপাথাং ও মিরিশ গ্রাব্রিল নামে ৩ জন আদিবাসী গারো। রমেন রিসিল তার দুই শিশু কন্যা সন্ধ্যা দিত্ত ও কুমুদিনি দিত্তকে নিয়ে ঘরে বসেছিলেন। চটপাথাং ও মিরিশ বাড়ির সামনে কাজ করছিলেন। এমন সময় রাজাকার- নাজিমুদ্দিন রমেন, চটপাথাং ও মিরিশকে ঘর থেকে ডেকে আনে। তারপর ৩ জনকে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। ১১ বছরের সিরাজ আলী তার চাচা হাসেন আলীর সঙ্গে মাঠে গিয়েছিল। হাসেন আলী, দিনমজুর আব্দুল লতিফ, সফর উদ্দিন, জহুরুল হক, শহর আলী, আনসার আলী মাঠে ধান রোপণ করছিলেন। সিরাজ আলী বসে ছিলেন ক্ষেতের আইলে। হঠাৎ গুলির শব্দে চমকে ওঠেন সবাই। সারিবদ্ধভাবে হানাদার সেনা ও তাদের সহযোগীদের এগিয়ে আসতে দেখে ভয়ে দৌড়ে পালাতে গেলে কিশোর সিরাজ আলীসহ সবাইকে গুলি করে হত্যা করা হয়। মাঠে কাজ করছিলেন হযরত আলী, উমেদ আলী, দুই সহোদর কাসেম আলী ও আছত আলী, মহেজ, ময়েন, রহম, সিরাজ, ইমান আলী, জহুর আলী, সফর উদ্দিন, রিয়াজ উদ্দিন, আহমেদ আলী, হোসেন আলী, কাসেম আলী, সাহেব আলী, বাবর আলী, হযরত আলী, বাবা সিরাজ আলী, খের আলী, আবুল হোসেন, মোসলেম আদ, হিদুইল্লা, নবে, নেওয়াজ আলী, জসিম উদ্দিনসহ আরো অনেকে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই পাকসেনারা গুলি করে তাদের বুক ঝাঁঝরা করে দেয়। নিহতদের রক্তে লাল হয়ে যায় সবুজ ধানক্ষেত। পাঁচটি গুলি লাগার পরও মুমুর্ষু অবস্থায় পড়ে ছিলেন রহম আলী, তার ছেলে সিরাজুল ও অন্য একজন। তাদের গোঙানি থামছে না দেখে একজন হানাদার সৈন্য ধারালো বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে তাদের হত্যা করে। গুলির বিরামহীন শব্দে সবাই যখন সন্ত্রস্ত, তখন মো. তনা সেক বাড়ির সবাইকে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে গরুগুলোকে বাঁচানোর জন্য বাঁধনমুক্ত করে দেন। কিন্তু সবাইকে বিপদমুক্ত করতে পারলেও নিজে ধরা পড়েন পাকসেনাদের হাতে। তাকে বাড়ির উঠানে গুলি করে হত্যা করা হয়। এরপর হত্যা করা হয় একই বাড়ির নেকবর আলী, নুরু ও কাঞ্চা মিয়াকে। ভীত-সন্ত্রস্ত সমশের আলী ও তার ছেলে হযরত আলী মাঠ থেকে দৌড়ে এসে ঘরে আশ্রয় নিয়েছিলেন। হায়েনার দল ঘরে ঢুকে তাদের বের করে আনতে চাইলে স্ত্রী লাগজান বেওয়া পাকহানাদারদের পায়ে লুটিয়ে পড়ে স্বামী ও সন্তানের প্রাণ ভিক্ষা চান। কিন্তু রুক্তখেকোদের হৃদয় টলেনি। গৃহিণী লাগজান বেওয়াকে লাথি দিয়ে সরিয়ে স্বামী সমশের আলীকে বের করে আনে হায়েনার দল। স্ত্রীর সামনেই গুলি করে ঝাঁঝরা করে দেয় তাঁর শরীর। একইভাবে হত্যা করা হয় ছেলে হযরত আলীকে। ফজর আলী, মালেক ফকির, তোফাজ্জল হোসেনকে হত্যা করার পর হানাদার বাহিনী রহিম উদ্দিন ও জসিম উদ্দিনের বাড়িতে হামলা চালায়। শিশুপুত্র সাইফুলকে বুকে জড়িয়ে ধরে বাঁচার আকুতি জানিয়েছিলেন জসিম উদ্দিন। কিন্তু সাইফুলকে কোল থেকে ছিনিয়ে নিয়ে শূন্যে ছুড়ে ফেলে দিয়ে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। একই সঙ্গে বেয়নট চার্জ করে হত্যা করা হয় সাবু শেখকে। মৃত্যুর আগে পানি-পানি বলে চিৎকার করেছিলেন সবাই। কিন্তু তাদের মুখে এক ফোটা পানি দিতে পারেনি কেউ।
গ্রামের আলেক নেসার বাড়িতে এক সঙ্গে ১১ জনকে হত্যা করা হয়। আলেক নেসার ঘরে আশ্রয় নিয়েছিলেন ভাই কিতাব আলী, সহর উদ্দিন ইব্রাহীম, পালিত ছেলে মমিন, সতীনের ছেলে মোহাম্মদ, নিজের ছেলে মন্নাছ, ভগ্নিপতি ইমান আলী। আলেক নেসা একটি কোরান শরিফ বুকে জড়িয়ে ধরে সবাইকে নিরাপত্তা দেয়ার চেষ্টা করেন। পাকসেনাদের গুলির শব্দে তার বুক থেকে খসে পড়ে কোরান শরিফ। ঘরের ভেতর আশ্রিত সবাই পালানোর সময় হানাদারদের গুলিতে প্রাণ হারান। কবজ উদ্দিন (পিতা ময়েজ উদ্দিন মোল্লা) গুলির শব্দ শুনে ঘর থেকে বের হলে হানাদার সেনারা তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে।
প্রতিবেশীদের নির্মম মৃত্যু দেখে বাবর আলী এক পাকসেনাকে একটা দা দিয়ে কোপ দেয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু তার আগেই বাবর আলীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ৬ ঘণ্টাব্যাপী এরূপ হত্যাযজ্ঞ ও নারীদের ওপর পাশবিক নির্যাতনের এক পর্যায়ে মসজিদ থেকে বের হয়ে হানাদার বাহিনীকে হত্যাকাণ্ড বন্ধের অনুরোধ জানাতে সামনে এগিয়ে যান মসজিদের ইমাম আলী হোসেন ও ধর্মপ্রাণ জহির উদ্দিন। কিন্তু কিছুটা অগ্রসর হতেই এক রাজাকারের গুলিতে তাঁরা সঙ্গে-সঙ্গে প্রাণ হারান।
-হানাদার সৈন্যরা চলে যাওয়ার পর কোনোরকমে গর্ত করে শাড়ি, মশারি, চাদর, কলাপাতা পেচিয়ে কিছু লাশ মাটিচাপা দেয়া হয়। অনেক লাশ দাফন করা সম্ভব হয়নি। সেসব লাশ শেয়াল-কুকুরের খাবারে পরিণত হয়। বরুয়াজানী গ্রামের শহীদ মোফাজ্জল স্মৃতি সংঘ কর্তৃক সংগৃহীত তথ্য থেকে সোহাগপুর গণহত্যার শিকার ৮১ জনের নাম জানা যায়। তারা হলেন- মিরিস গ্রাব্রিল, চটপাথাং, রমেন, কিতাব আলী, মো. ইব্রাহিম, মুসলেম, রেজত আলী, শহর আলী, নেওয়াজ আলী, নবাব আলী, কায়েম আলী, হযরত আলী, ইমান আলী, সিরাজ আলী, ময়েন উদ্দিন, ছফির উদ্দিন, কিতাব আলী, মোহাম্মদ আলী, আব্দুল মন্নাফ, মমিন মিয়া, কভু উদ্দিন, ইমাম আলী মুন্সী, মোস্তাজ আলী, শহীদ মিয়া, আবুল বাশার, সফর উদ্দিন, আব্দুর রহমান, হুরমুজ আলী, নীলু, কছিম উদ্দন, ফজর আলী, আব্দুল খালেক, আব্দুল বারেক, রহম আলী, চাতু মিয়া, জসিম উদ্দিন, রহিম উদ্দিন, সিরাজ আলী, সাহেব আলী, ইব্রাহীম খলিল, খেজর আলী, আইয়ুব আলী, মালেক ফকির, হযরত আলী, সমশের আলী, আবুল হোসেন, তনা সেক, ফজল তালুকদার, হাতেম আলী, নেকবর আলী, বাবর আলী, হোসেন আলী, সাহেব আলী, হাছেন আলী, আব্দুল লতিফ, আনসার আলী, জহুর উদ্দিন, একাব্বর আলী, জাহের আলী, ইছব আলী, ইমরদি, আলী হোসেন, হাবেজ উদ্দিন, জমির উদ্দিন, আব্দুল কুদ্দুছ, মেহের আলী, হালিম উদ্দিন, সুবর্ধন সাধু, কাঞ্চা দেওয়ান, নুর মোহাম্মদ, মানিক মিয়া, শহর আলী, ছফর উদ্দিন, আশরাফ আলী, মফিজ উদ্দিন, শের মামুদ, শামছুল হক, রহমত আলী, আলীম উদ্দিন, নজরুল ইসলাম ও জহর আলী। বাকিরা বহিরাগত ছিলেন বলে তাদের নাম সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি।
সেদিনের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ভয়াল স্মৃতি নিয়ে এখনো বেঁচে আছেন ৩০ জন শহীদ জায়া ও ১৩ জন বীরাঙ্গনা। সেনাবাহিনীর উদ্যোগে সোহাগপুরে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ ও কয়েকটি গণকবর পাকা করা হয়েছে। স্মৃতিফলকে ৬৭ জনের নাম রয়েছে। অধিকাংশ গণকবরের স্থান অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। স্বাধীনতার ৪৩ বছর পর এখানকার বীরাঙ্গনারা মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পান। এ গণহত্যা এবং যুদ্ধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে বিচার শেষে ২১শে এপ্রিল ২০১৫ সালে কুখ্যাত আলবদর- কামারুজ্জামানের ফাঁসিতে মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর হয়। তবে সোহাগপুরের শহীদদের স্মৃতি এখনো যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা হয়নি। [এম এ হাকাম হীরা ও কোহিনূর রুমা]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড