সৈয়দপুর যুদ্ধ (সিরাজদিখান, মুন্সীগঞ্জ)
সৈয়দপুর যুদ্ধ (সিরাজদিখান, মুন্সীগঞ্জ) সংঘটিত হয় ২৫ ও ২৬শে নভেম্বর। এটি সৈয়দপুর যুদ্ধ নামে পরিচিতি লাভ করলেও তা হয়েছিল মূলত গোয়ালখালী, ফুলহার ও ডাকপাড়া (ডাকেরহাটি) গ্রাম জুড়ে। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে সৈয়দপুর যুদ্ধ সিরাজদিখান থানায় সংঘটিত হলেও এটি ছিল নবাবগঞ্জ, শ্রীনগর, লৌহজং ও মুন্সীগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বিত যুদ্ধ। এটি মুন্সীগঞ্জ মহকুমার সর্বশেষ যুদ্ধ। এ-যুদ্ধের পর পুরো সিরাজদিখান থানা মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে আসে। এ-যুদ্ধে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। অপরদিকে পাকবাহিনীর ৯ জন সৈন্য নিহত হয়।
সৈয়দপুরের উত্তর-পশ্চিম কোণে ধলেশ্বরী ও ইছামতি নদীর মোহনা। এখান থেকে ধলেশ্বরীর একটি প্রবাহ পূর্বদিকে ঢাকা- ফতুল্লা ও মুন্সীগঞ্জের দিকে এবং অপর একটি প্রবাহ উত্তরে সিঙ্গাইর ও মানিকগঞ্জের দিকে গেছে। এ মোহনা থেকে ইছামতি নদীর একটি প্রবাহ নবাবগঞ্জ থানা এবং অপর একটি প্রবাহ শ্রীনগর থানার দিকে প্রবাহিত হয়েছে। মোহনার পশ্চিম পাড়ে নবাবগঞ্জ থানার দৌলতপুর, পশ্চিম-দক্ষিণ পাড়ে সিরাজদিখান থানার সৈয়দপুর, গোয়ালখালী, ফুলহার ও ডাকপাড়া গ্রাম এবং উত্তর পাড়ে কেরানীগঞ্জ থানার লাখিরচর। ২৪শে নভেম্বর পাকবাহিনী ৩০০ সৈন্যসহ তাদের নবাবগঞ্জের ঘাঁটি ছেড়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। এর আগে কয়েকটি যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর কাছে তাদের শোচনীয় পরাজয় ঘটে, অনেক সেনা নিহত হয় এবং প্রচুর গোলাবারুদ হাতছাড়া হয়। ঢাকার পথে তারা আগলা বাজার, টিকরপুর, বেনুখালী, খারশুর ও মরিচা গ্রামে মুক্তিবাহিনীর প্রবল বাধার সম্মুখীন হয়। বেনুখালীর পর থেকে সিরাজদিখান-শ্রীনগর-নবাবগঞ্জ থানার আঞ্চলিক কমান্ডার নাসির উদ্দিন খান ও তাঁর বাহিনীর দ্বারা আক্রান্ত হয়ে পাকবাহিনী ধলেশ্বরী নদী পার হতে না পেরে গোয়ালখালীতে অবস্থান নিতে বাধ্য হয়। নাসির উদ্দিন খানও তাঁর বাহিনী নিয়ে ফুলহার গ্রামে পাকবাহিনীর মুখোমুখি অবস্থান নেন। নদী পার হতে পারলে পাকসেনারা কেরানীগঞ্জ থানার ওপর দিয়ে ঢাকা পৌঁছতে পারত। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা আগে নদী পারাপারের সকল নৌকা সরিয়ে দিলে তারা নদী পার হতে পারেনি। পরদিন গোয়ালখালীর পাশের ডাকপাড়া (ডাকেরহাটি) গ্রামে গিয়েও পাকবাহিনী নদী পার হতে পারেনি। তারা ২৫ ও ২৬শে নভেম্বর এসব গ্রামে আটকা পড়ে। অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধারা গ্রামগুলো চারদিক থেকে ঘেরাও করে রাখেন।
এ অবস্থায় ঢাকার জিঞ্জিরা থেকে পাকবাহিনীর এক প্লাটুন সৈন্য গোয়ালখালীতে অবরুদ্ধ সৈন্যদের উদ্ধারের জন্য সৈয়দপুরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। তেঘরিয়া গ্রামের ও বিক্রমপুর আওয়ামী লীগএর বিশিষ্ট নেতা শামসুজ্জোহা খান চিঠির মাধ্যমে এ সংবাদ সিরাজদিখান থানার মুক্তিযোদ্ধাদের জানিয়ে দেন। ফলে সিরাজদিখান থানার মুক্তিযোদ্ধারা দলে-দলে সৈয়দপুরে গিয়ে অবস্থান গ্রহণ করেন। পরনে লুঙ্গি, মাথায় গামছা এবং কাঁধে স্টেনগান নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা সারিবদ্ধভাবে ইছামতির পশ্চিম তীর ধরে এগিয়ে যান। সিরাজদিখান থানা যুদ্ধএর পর উদ্ধারকৃত বিপুল অস্ত্র নিয়ে ২০শে নভেম্বর ছাত্রনেতা জামাল চৌধুরীও তাঁর দলবল নিয়ে ফুলহারে কমান্ডার নাসির উদ্দিন খানের বাহিনীর সঙ্গে মিলিত হন। এ-যুদ্ধে সিরাজদিখানের আলী আহাম্মদ বাচ্চু, মুহাম্মদ জহুরুল আলম বিমল, আ. লতিফ, মো. শাহজাহান মিয়া, হাবিলদার নাজিম উদ্দিন, আ. মতিন হাওলাদার, আ. শহীদ কমান্ডার, এম এ আউয়াল, হারুন- অর-রশিদ মোল্লাসহ নেতৃস্থানীয় সকল মুক্তিযোদ্ধা অংশ নেন। ২৫শে নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা গোয়ালখালীতে অবস্থান নেয়া পাকসেনাদের আক্রমণ করলে উভয় পক্ষের মধ্যে তীব্র যুদ্ধ শুরু হয়। দুদিন ব্যাপক গুলি বিনিময় হয়। পাকবাহিনীর ট্রেঞ্চ গ্রেনেড মেরে উড়িয়ে দেয়ার জন্য বীর মুক্তিযোদ্ধা ওমর ফারুক তাদের খুব কাছে চলে গেলে হঠাৎ একটি গুলিতে ঘটনাস্থলে তিনি শহীদ হন। তিনি পাড়াগ্রাম মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প থেকে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাঁকে পাড়াগ্রামেই সমাহিত করা হয়। ২৬শে নভেম্বর রাতে পাকসেনারা নৌকায় নদী পার হয়ে জিঞ্জিরার দিকে পালিয়ে যায়। এভাবে সৈয়দপুর যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে। এ-যুদ্ধে পাকবাহিনীর ৯ জন সৈন্য নিহত হয়। [মো. শাহজাহান মিয়া]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড