You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.06.19 | সৈয়দাবাদ যুদ্ধ (কসবা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া) - সংগ্রামের নোটবুক

সৈয়দাবাদ যুদ্ধ (কসবা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া)

সৈয়দাবাদ যুদ্ধ (কসবা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া) সংঘটিত হয় ১৯শে জুন। এতে বহু পাকসেনা হতাহত এবং তাদের কয়েকটি গাড়ি ধ্বংস হয়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা থানার সৈয়দাবাদ এলাকায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া-কুমিল্লা সড়কে পাকিস্তানি গোলন্দাজ বাহিনীর শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল। সালদা নদী, নয়নপুর, টি আলীর বাড়ি, লতুয়ামোড়া প্রভৃতি স্থানে অবস্থানকারী পাকসেনাদের সাহায্যকারী দল হিসেবে তারা এখান থেকে কামানের গোলা নিক্ষেপ করত। এ কারণে পাকিস্তানি সেনাদের উপর্যুক্ত অবস্থানসমূহে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ অনেক সময় সফল হতো না। দেড় শতাধিক পাকিস্তানি সেনা এই কামানগুলোর ব্যবহার ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল। তাদের এই অবস্থানটি ধ্বংস করে দেয়ার লক্ষ্যে সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ, বীর উত্তমএর নির্দেশে লে. হুমায়ুন কবির মুক্তিবাহিনীর একটি দল নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া- কুমিল্লা সড়কের দিকে অগ্রসর হন। এ দলে ছিলেন মাত্র ৪০ জন মুক্তিযোদ্ধা। ১৬ই জুন সমস্ত রাত পথ চলার পর পরদিন ভোর ৫টার মধ্যে তাঁরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া-কুমিল্লা সড়কের পশ্চিমে সৈয়দাবাদ থেকে চার মাইল উত্তরে গোপন ঘাঁটি স্থাপন করেন। ১৭ই জুন সমস্ত দিন এবং রাত লে. হুমায়ুন কবির কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে অত্যন্ত গোপনে পাকিস্তানি সেনাদের সৈয়দাবাদ অবস্থানটি সম্পূর্ণরূপে অনুসন্ধান এবং পর্যবেক্ষণ করেন। এ অবস্থানটিতে পাহারার কী কী ব্যবস্থা আছে, কারা পাহারাদার এবং কী কী অস্ত্রের সাহায্যে পাহারা দেয়, এখানে পৌঁছার গোপন পথ কী, কামানগুলো রাতে কোথায় রাখে, কোন সময়ে পাকিস্তানি সেনারা বেশির ভাগ সজাগ থাকে এবং তাদের বাংকারগুলোর অবস্থান কোথায়
প্রভৃতি খবরাখবর সংগ্রহ করে ভোর হবার পূর্বেই তিনি গোপন ঘাঁটিতে ফিরে যান। ১৮ই জুন সারাদিন তিনি তাঁর দলটিকে পাকিস্তানি অবস্থান সম্পর্কে বিস্তারিত জানান। তাদের ওপর আক্রমণের পরিকল্পনা এবং কার্যাবলি সম্পর্কে প্রত্যেককে বুঝিয়ে দেন। সমস্ত দিন ধরে দলটি আক্রমণের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে এবং পরদিন ১৯শে জুন ভোর ৪টায় পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানের ওপর অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। পাকিস্তানি সেনারা তখন তাঁবুর মধ্যে ঘুমিয়ে ছিল। এরূপ আক্রমণের জন্য তারা মোটেই প্রস্তুত ছিল না। মুক্তিবাহিনীর অতর্কিত আক্রমণে পাকিস্তানি ঘাঁটিতে ভীষণ বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। এ আক্রমণে ঘুমন্ত অবস্থায়ই বহু শত্রুসেনা হতাহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা কয়েকটি গাড়িতে গ্রেনেড ছুড়ে আগুন ধরিয়ে দেন। দীর্ঘ সময় ধরে আক্রমণ অব্যাহত থাকে। পাকিস্তান সেনারা এত বেশি ভীত হয়ে পড়ে যে, তারা তাদের হেডকোয়ার্টার্সে জঙ্গি বিমানের জন্য আবেদন জানায়। যুদ্ধ বেশ কিছুক্ষণ ধরে চলতে থাকে। মুক্তিবাহিনী একের পর এক কামান, গাড়ি, বাংকার ইত্যাদি মানুষ সহজেই বুঝতে পারে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুতি গ্রহণের বিকল্প নেই।
স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুতিস্বরূপ মোহাম্মদ হানিফ এমএনএ- কে উপদেষ্টা এবং শামছুল হুদা চৌধুরীকে আহ্বায়ক করে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। পরিষদের অন্য সদস্যরা হলেন- মাস্টার রফিক উল্লাহ মিয়া এমপিএ, শামছুল হক মিয়া (ছোট মিয়া), ইউনুছ মিয়া চেয়ারম্যান, আবদুর রহমান হেডমাস্টার, ভূপেন্দ্র কিশোর মজুমদার, আবদুল খালেক ভূঞা, আবদুল গফুর মাস্টার, গোলাম ছারওয়ার পাটোয়ারী, গোলাম মোস্তফা ভূঞা, আবদুল মুকিত, আবুল খায়ের পাটোয়ারী বকুল, মমিনুল ইসলাম বাকের, মো. ইউনুছ প্রমুখ। সোনাইমুড়ী বাজারের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত ডাকবাংলোতে (ব্রিটিশ আমলে প্রতিষ্ঠিত) সংগ্রাম পরিষদের কন্ট্রোল রুম স্থাপন করা হয় এখান থেকে মাইজদী জেলা হেডকোয়ার্টার্সের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয়। সংগ্রাম কমিটির সদস্যগণ নিজ-নিজ এলাকায় ছাত্র-যুবক, শ্রমিক ও সাধারণ জনগণকে সংগঠিত করে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকেন।
২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অতর্কিত হামলার সংবাদ এ উপজেলায় পৌঁছার পরপরই শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণ। কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে হানাদার বাহিনী যাতে সহজে সোনাইমুড়ীতে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য সোনাইমুড়ী স্কুল মাঠ, পুরনো ডাকবাংলো মাঠ, খাদ্য গুদাম মাঠ, আমিশাপাড়া স্কুল মাঠ, বজরা হাইস্কুল মাঠ ও কাশিপুর হাই স্কুল মাঠসহ বিভিন্ন স্থানে ডামি বন্ধুক ও লাঠি দিয়ে ছাত্র-যুবক, কৃষক ও সাধারণ জনতাকে প্রশিক্ষণ প্রদান শুরু হয়। ছাত্র-যুবকদের সংগঠিত করে প্রশিক্ষণ গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে আবদুল সাত্তার ভূঞা (মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতা-পরবর্তী সরকারের সচিব, বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত), মিয়া মোস্তাক আহম্মেদ (ছাত্রনেতা ও স্বাধীনতা-পরবর্তী সরকারের সচিব, বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত), মোস্তাফিজুর রহমান লুতু (এডভোকেট) প্রমুখ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে ছুটিতে আসা সুবেদার লুৎফর রহমানসহ অবসরপ্রাপ্ত সেনা, নৌ, বিমান, ইপিআর ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যগণ প্রাথমিক প্রশিক্ষণ প্রদানে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এ উপজেলায় প্রবেশ করার পূর্বেই প্রাথমিক প্রশিক্ষণ সম্পন্ন হয়। ইতোমধ্যে কয়েকশত ছাত্র-যুবক উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে যায়।
২৯শে এপ্রিল আবিরপাড়ার আবুল খায়ের ভূঞা, আমিন উল্যা, সুলতান আহম্মেদ, ছাত্রনেতা আ ও ম সফিউল্যা ও কারী করিম উল্যাহ আবিরপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় এলাকায় সেনাবাহিনীর সদস্য, পুলিশ, আনসার ও মুক্তিযোদ্ধাদের হাজির হওয়ার আহ্বান জানান। সেখানে সুবেদার লুৎফর রহমান উপস্থিত ছিলেন। সকল বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে থেকে ৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধাকে বাছাই করা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন- সুবেদার লুৎফর রহমান, সুবেদার ওয়ালী উল্যা, সুবেদার সামছুল হক, সুবেদার এছহাক, হাবিলদার মন্তাজ, হাবিলদার রুহুল আমিন, হাবিলদার জামাল প্রমুখ। হাবিলদার জামালকে গ্রুপ কমান্ডার নিয়োগ করা হয়। এ-সময় লক্ষ্মীপুর এলাকার এমএনএ খালেদ মোহাম্মদ আলী ভারত থেকে এসে কারী করিম উল্যাহর বাড়িতে (ভবানী জীবনপুর) অবস্থান নেন এবং বেগমগঞ্জ, লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালী, সদর মহকুমায় মুক্তিবাহিনীকে সংগঠিত করার ওপর জোর দেন। ইতোমধ্যে বেগমগঞ্জের দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন বাহিনীর বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা কারী করিম উল্যাহর বাড়িতে অবস্থান নেন।
মে মাসের শুরুতে সোনাইমুড়ী থেকে প্রথম ব্যাচে ভারতের হরিণা ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নেন গোলাম মোস্তফা ভূঞা (বজরা, ১৯৭০ সালে বেগমগঞ্জ থানা ছাত্রলীগ-এর আহ্বায়ক এবং জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচন পরিচালনা কমিটির বেগমগঞ্জ থানার আহ্বায়ক), আহমেদ সুলতান (বজরা), আব্দুল হালিম (ছাচুয়া), মোজাম্মেল হোসেন বাচ্চু (কেশারপাড়), আব্দুল ওয়াছেক মিন্টু (রামগতি), নুরুল ইসলাম (হাতিয়া) প্রমুখ। এঁদের দায়িত্ব ছিল যুদ্ধকালীন অবস্থায় তথ্য সংগ্রহ ও সরবরাহ করা, ছাত্র-যুবকদের সংগঠিত করে প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে নিয়ে যাওয়া, প্রশিক্ষণ শেষে দেশের অভ্যন্তরে নিয়ে আসা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের থাকা-খাওয়া ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। এসব দায়িত্ব পালনকালে গোলাম মোস্তফা ভূঞা বহুবার সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে যান।
২রা মে আবীরপাড়ায় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ বৈঠকে মুক্তিযোদ্ধাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য খালেদ মোহাম্মদ আলী এমএনএ-কে সভাপতি এবং আবুল খায়ের ভূঞাকে সম্পাদক করে ৩১ সদস্যবিশিষ্ট সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। রুহুল আমিন (খিলপাড়া), গাজী আমিন উল্যাহ (চৌমুহনী), আলী আহম্মদ চৌধুরী, কারী করিম উল্যাহ, আবদুর রব চেয়ারম্যান (জিরতলী) প্রমুখ এ কমিটির সদস্য ছিলেন। গাজী আমিন উল্যাহ-সহ কয়েকজনকে ভারতের আগরতলায় যোগাযোগ করে অস্ত্র সংগ্রহ ও সরবরাহের দায়িত্ব দেয়া হয়। এছাড়াও এতদঞ্চলে ভারত থেকে অস্ত্র সংগ্রহ এবং সরবরাহের কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন গোলাম সারওয়ার (রাজীবপুর), আহম্মেদ সুলতান (বজরা), ফুয়াদ পাশা কচি (হাতিয়া), গোলাম মোস্তফা ভূঞা (সোনাইমুড়ী), আবদুল ওয়াসেক মিন্টু (চৌমুহনী, পৈতৃক নিবাস রামগতি), নুরুল ইসলাম প্রমুখ। ৩রা মে কারী করিম উল্যাহর বাড়িতে পুনরায় একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ বৈঠকে সুবেদার লুৎফর রহমান, খালেদ মোহাম্মদ আলী এমএনএ, আকতারুজ্জামান, শাহজাহান কামাল, অমল নাগ, আলী আহম্মদ চৌধুরী, শ্রমিক নেতা শফিকুর রহমান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। এ-সময় আলী আহম্মদ চৌধুরী গোপন খবর পেয়ে নোয়াখালী খালের দক্ষিণে চরে মাটির নীচে পুঁতে রাখা ৫১টি রাইফেল উদ্ধারের ব্যবস্থা করেন। সুবেদার আবদুল হাইয়ের নেতৃত্বে মোজাফ্ফর আহম্মদ হেডমাস্টারসহ মুক্তিযোদ্ধারা রাইফেলগুলো উদ্ধার করেন এবং সেগুলো শামছুল কবিরের দায়িত্বে দেয়া হয়। ইতোমধ্যে ভারত থেকে পর্যাপ্ত অস্ত্রশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে পৌছে। এতে তাঁদের মনোবল বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়।
২৮শে আগস্ট মো. ইউনুছ মাস্টার (পিতা নুর মিয়া বেপারী, ফোরকরা)-সহ ৬২ জনের একটি দল কানকির হাট হয়ে কুমিল্লার চিওরা কাজীবাড়ি দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে। ভারতে গিয়ে প্রথমে তাঁরা রাজনগর ইয়ুথ ক্যাম্পে ওঠেন। সেখানে তাঁদের সহযোগিতা করেন ইয়ুথ ক্যাম্পের প্রধান ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক মোহাম্মদ হানিফ এমএনএ। ইয়ুথ ক্যাম্পে কিছুদিন অবস্থানের পর তাঁদের মেলাঘর ট্রেনিং ক্যাম্পে নেয়া হয়। সেখানে তারা ৪৫ দিনের অস্ত্র প্রশিক্ষণ নেন। কমান্ডার ছিলেন নায়েক সুবেদার নজির আহম্মদ। ২নং সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশারফ, বীর উত্তম এবং সাব-সেক্টর কমান্ডার লে. কর্নেল জাফর ইমাম, বীর বিক্রম এ প্রশিক্ষণ তদারক করেন। এখানে ইউনুছ মাস্টারকে ১৯নং প্লাটুন কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়। প্রশিক্ষণ শেষে তাঁর নেতৃত্বে ১৪ জনের একটি দল ১৪ই অক্টোবর ফেনীর বিলোনিয়া সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। তাঁদের এফএফ দলে সংযুক্ত করা হয়। পরে নোয়াখালীর বিএলএফ প্রধান ইউনুছ মাস্টারকে বিএলএফ-এর সঙ্গে যুক্ত করেন। বাংলাদেশে প্রবেশ করার পর প্রথমে তিনি ফেনী অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে হানাদার বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করেন।
এরপর তাঁকে বৃহত্তর বেগমগঞ্জ অঞ্চলে সুবেদার লুৎফর রহমান ও রুহুল আমিন ভূঞার সঙ্গে যুক্ত করা হয়। এ অঞ্চলে এসে তিনি কাজীর হাট, জমিদার হাট, কিতিন্নার হাট, সোনাইমুড়ী ও বিপুলাসারে পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ৭ই ডিসেম্বর সোনাইমুড়ী যুদ্ধে তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন। তাঁর সঙ্গী মোহাম্মদ আলী ও ইসমাইল শহীদ হন।
সোনাইমুড়ী উপজেলার যুদ্ধকালীন কমান্ডাররা হলেন- মোস্তাফিজুর রহমান (বিএলএফ), সুবেদার লুৎফর রহমান (এফএফ), সুবেদার বাদশা মিয়া (এফএফ), নায়েক সুবেদার এছহাক (এফএফ), নায়েক সুবেদার জামাল (এফএফ), আহম্মদ সুলতান খান (বিএলএফ), গোলাম মোস্তফা ভূঞা (বিএলএফ), মোস্তাফিজুর রহমান লুতু (বিএলএফ), আবদুস সাত্তার ভূঞা (বিএলএফ) এবং মুহাম্মদ উল্যা মিঞা (বিএলএফ)।
সুবেদার লুৎফর রহমান ও তাঁর দল ফেনী থেকে কিছু বিস্ফোরক দ্রব্য এবং অবাঙালিদের কাছ থেকে বেশকিছু অস্ত্র উদ্ধার করে সোনাইমুড়ী-লাকসাম রোডে অবস্থান নিয়ে কিছুদিন এ এলাকা মুক্ত রাখতে সক্ষম হয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সহজে যাতে সোনাইমুড়ীতে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য সুবেদার লুৎফর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা সোনাইমুড়ী থেকে লালমাই পর্যন্ত রেল ও সড়ক পথে বিপুলাসার, নাথের পেটুয়া, খিলা, দৌলতগঞ্জ, লাকসাম ও বাঘমারাতে বাংকার করে পজিশন নেন। এছাড়াও স্থানীয় জনতা সোনাইমুড়ীর উত্তরে শাহাবজাদা ও রথিজোরা পুল এবং দক্ষিণে বগাদিয়াপুল ভেঙ্গে ফেলে, যাতে সেনাবাহিনীর কনভয় এদিকে অগ্রসর হতে না পারে। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ থেকে ছাত্র, শ্রমিক ও সাধারণ জনতা ভারতে প্রবেশ করতে থাকেন এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ শেষে জুনের শেষ ও জুলাইয়ের প্রথমার্ধ থেকে দেশে ফিরতে শুরু করেন। তখন থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে। এর আগে এতদঞ্চলে সুবেদার লুৎফর রহমানের নেতৃত্বে অবসরপ্রাপ্ত এবং ছুটিতে থাকা সশস্ত্র বাহিনীর অল্প সংখ্যক সদস্য নিয়ে গঠিত একটি মুক্তিযোদ্ধার দল পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং বিভিন্ন অপারেশন পরিচালনা করে।
পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে বের হয়ে বেশ কয়েকবার বাধাগ্রস্ত হয়ে ২২শে এপ্রিল বৃহস্পতিবার সকাল ১১টায় বিশাল বহর নিয়ে সোনাইমুড়ী উপজেলায় অনুপ্রবেশ করে এবং সোনাইমুড়ী ডাকবাংলোতে ক্যাম্প স্থাপন করে।
মে মাসের শেষের দিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এ দেশীয় দোসররা স্বাধীনতাবিরোধী তৎপরতা শুরু করে। সোনাইমুড়ীতে পাকবাহিনীর শীর্ষস্থানীয় দোসর ছিল কনভেনশন মুসলিম লীগ-এর মহকুমা প্রেসিডেন্ট বারাহিনগর গ্রামের ছেরাজুল ইসলাম টিকে (তকমায়ে খেদমত, পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত)। শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীর সদস্য ছিল- ডা. মফিজুল ইসলাম (কাঠালি), ডা. আব্দুর রশিদ (সাহারপাড়), আলী আকবর ভূঁইয়া (পোরকরা), মাওলানা আমানত উল্যাহ ভূঁইয়া (রথী), জিল্লুর রহমান (কাঠালি), মাওলানা জালাল আহম্মেদ ওরফে জালাল মৌলবী (বরলা), আবদুর রশিদ (কৈয়া), মাওলানা আবদুল বাকী (মকিল্যা), তোফায়েল আহমেদ (শিমুলিয়া), আলী হোসেন (শিমুলিয়া), মাওলানা তোফায়েল আহমেদ (বগাদিয়া), ডা. আব্দুল মন্নান (কৌশলারবাগ), ডা. অলি উল্যা (মাইজদী কোর্ট), ফয়েজ আহমেদ (শিমুলিয়া), আব্দুল কাইউম (শিমুলিয়া), ডা. আব্দুস সাত্তার (কাবিলপুর), ইয়াকুব আলী মাস্টার (রামপুর), আব্দুল খালেক (ইংলিশ খালেক নামে পরিচিত, সোনাইমুড়ী), মোবারক উল্যাহ (শিমুলিয়া), শফিক উল্যাহ (কৌশলারবাগ), আব্দুল মন্নান (কৌশলারবাগ), মকবুল আহমদ পাটোয়ারী (রশিদপুর), এহছাক মিয়া মেম্বার (পূর্বচাঁদপুর), মোকলেছুর রহমান (শিলমূদ), নুরুজ্জামান মিয়া (বদরপুর), আকতারুজ্জামান বেচু মিয়া (সাকিরপুর), সুলতান আহমেদ বাসু মিয়া (শিলমূদ), মাস্টার আব্দুস সোবহান (শিলমূদ), কালা মিয়া ওরফে নব্যার বাপ (বজরা) প্রমুখ।
পাকহানাদার বাহিনী মুক্তিযুদ্ধের সময় জয়াগে অবস্থিত ঐতিহাসিক গান্ধী আশ্রম (১৯৪৬ সালের ৭ই নভেম্বর হিন্দু- মুসলিম দাঙ্গা নিরসনে শান্তি মিশন নিয়ে মহাত্মা গান্ধী এখানে আসেন) লুণ্ঠন করে এবং আশ্রমের সেবক দেবেন্দ্র নারায়ণ সরকার, মদন মোহন চট্টোপাধ্যায় এবং জীবন কৃষ্ণ সাহাকে গুলি করে হত্যা করে। ২২শে এপ্রিল তারা সোনাইমুড়ী বাজারে অগ্নিসংযোগ করে এবং পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে রামপুর, আলোকপাড়া, বগাদিয়া, বাংলা বাজার (রুবীর হাট), আমিশাপাড়া, বজরা, নান্দিয়া পাড়া ও ভাট্টা গ্রামে অগ্নিসংযোগ এবং লুণ্ঠন করে। ২৬শে মে সোমবার দুপুর ১২টার দিকে পাকবাহিনী সোনাইমুড়ীর কিছুটা উত্তরে নাওতোলা, বিজয়নগর, কেশারপাড়, আলোকপাড়া, সোনাইমুড়ী ও ভাট্টা -গ্রামে হামলা করে ব্যাপক অগ্নিসংযোগ, নারীনির্যাতন ও গণহত্যা চালায়। এ-সময় তারা ১২৬ জন গ্রামবাসীকে হত্যা করে, যা সোনাইমুড়ী গণহত্যা নামে পরিচিত।
সোনাইমুড়ী হাইস্কুল ক্যাম্প, বিওসি খলিল কোম্পানি বিল্ডিং ক্যাম্প (বর্তমানে অগ্রণী ব্যাংক ভবন), পুরাতন ডাকবাংলো, রেলওয়ে স্টেশনের স্টাফ কোয়ার্টার এবং বজরা হাসপাতাল ক্যাম্প ছিল পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির।
উপজেলার রথি জোরা, শাহেবজাদা পুল এবং কাটালীতে (বারী পুকুর পাড়, বর্তমানে কলাবাগান) বধ্যভূমি ও গণকবর রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে সোনাইমুড়ী ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। কারণ এখানকার বগাদিয়ার পুলের নিচ দিয়ে নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ভোলা, বরিশাল, কুমিল্লা ও চাঁদপুরের মুক্তিযোদ্ধারা কুমিল্লার গুনবতী সীমান্ত দিয়ে ভারতে যাওয়া- আসা এবং অস্ত্রশস্ত্র আনা-নেয়া কররতন। এ-কারণে এ এলাকা নিরাপদ রাখার জন্য মুক্তিবাহিনী সর্বদা সতর্ক থাকত এবং প্রায়ই পাকবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হতো। এ উপজেলায় হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর ছোট-বড় অনেগুলো যুদ্ধ হয়েছে। ২৫শে এপ্রিল বগাদিয়ার পুল সংলগ্ন এলাকায় সুবেদার লুৎফর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীকে আক্রমণ করলে যুদ্ধ শুরু হয়। এ-যুদ্ধে ৬ জন পাকসেনা নিহত হয়। অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধা সুবেদার ওয়ালী উল্যা আহত হন। ভারী অস্ত্র না থাকায় মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্য হন। এটি বগাদিয়া যুদ্ধ নামে পরিচিত। ৯ই মে সুবেদার লুৎফর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা পুনরায় বগাদিয়ায় এম্বুশ করেন। পাকসেনারা রেঞ্জের কাছাকাছি আসামাত্র মুক্তিযোদ্ধাদের এলএমজি গর্জে ওঠে। শুরু হয় উভয় পক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড গোলাগুলি। ৫ ঘণ্টা স্থায়ী এ-যুদ্ধে বেশ কয়েকজন পাকসেনা হতাহত হয়। তাদের গাড়িগুলো বিকল হয়ে রাস্তার পাশে খালের মধ্যে পড়ে যায় এবং তারা পালিয়ে যায়। ১৯শে মে মুক্তিযোদ্ধারা তৃতীয়বার বগাদিয়ায় পাকসেনাদের ওপর আক্রমণ করেন। উভয় পক্ষের মধ্যে ৮ ঘণ্টাব্যাপী তুমুল যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে পাকবাহিনীর ১৩ জন সৈন্য নিহত এবং বহু সৈন্য গুরুতর আহত হয়। ২৮শে এপ্রিল সুবেদার লুৎফর রহমান সিপাহি শাহজাহানকে সঙ্গে নিয়ে সোনাইমুড়ীতে রেকি করে আসেন এবং ২৯শে এপ্রিল নায়েক সফি তাঁর সেকশন নিয়ে সোনাইমুড়ী রেল স্টেশনের আউটার সিগনালের নিকট এম্বুশ করেন। আধাঘণ্টা পর শত্রুবাহিনীর তিনটি সামরিক যান কাছাকাছি এলে মুক্তিযোদ্ধারা গুলিবর্ষণ শুরু করেন। শত্রুসেনারাও পাল্টা জবাব দেয়। তিন ঘণ্টার মতো উভয় পক্ষের মধ্যে গুলি বিনিময় হয়। গুলি শেষ হয়ে যাওয়ায় এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটেন। এটি সোনাইমুড়ী রেলস্টেশন যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত। এ-যুদ্ধে পাকবাহিনীর একটি গাড়ি বিকল হয়ে যায় এবং একজন পাকসেনা গুরুতর আহত হয়। এতে ২ জন মানুষ নিহত হন।
মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করতে নোয়াখালীর সঙ্গে রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার উদ্দেশ্যে সাহেবজাদা পুল ভেঙ্গে ফেলেন। পাকবাহিনী পুনরায় তা মেরামত করে নোয়াখালীর সঙ্গে রেল যোগাযোগ স্থাপন করলে সুবেদার লুৎফর রহমান সুবেদার শামছুল হক ও নায়েক আবুল হোসেনকে নিয়ে পুনরায় সেটি ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে গেলে বহু অস্ত্রধারী রাজাকার ও মিলিশিয়াকে সেখানে পাহারারত দেখতে পান। সুবেদার লুৎফর রহমান ফন্দিকার পুলটির কিছু দূরে গুলিবর্ষণ করে রাজাকার ও মিলিশিয়া বাহিনীর দৃষ্টি সেদিকে সরিয়ে নেন। এদিকে নায়েক আবুল হোসেন গোপনে পুলের নিচে ৩৫ পাউন্ড পি-কে বিস্ফোরক বিছিয়ে ফায়ার করতে-করতে পেছনে সরে আসেন। পাঁচ মিনিটের মধ্যে প্রকট আওয়াজে সাহেবজাদা রেলওয়ে পুলটি ভেঙ্গে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায় এবং আবার নোয়াখালীর সঙ্গে রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
২৬শে মে সোনাইমুড়ীর কিছুটা উত্তরে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর এক সম্মুখ যুদ্ধ হয়। এতে পাকবাহিনীর একজন মেজর, একজন ক্যাপ্টেন ও ৪ জন সৈন্য নিহত হয়। এ-যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে নেতৃত্ব দেন সুবেদার লুৎফর রহমান। তাঁর সহযোদ্ধা ছিলেন সুবেদার ওয়ালী উল্যা ও সুবেদার শামসুল হক। এটি সোনাইমুড়ী যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত। ২৪শে জুলাই পাকহানাদার বাহিনী আমিশাপাড়ায় অভিযান চালালে সেখানে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধারা তাদের প্রতিরোধ করেন। এ-যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন সুবেদার ওয়ালী উল্যা। ৭ ঘণ্টার মতো উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয়। এক পর্যায়ে শত্রুবাহিনী তাদের বহু সৈন্যের ক্ষতবিক্ষত লাশ ফেলে পলায়ন করে। এ-যুদ্ধে পাকবাহিনীর ১৮ জন সৈন্য নিহত হয় এবং তাদের ফেলে যাওয়া ১৯টি চাইনিজ রাইফেল মুক্তিবাহিনী উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। এটি আমিশাপাড়া প্রতিরোধযুদ্ধ নামে পরিচিত।
নদনার নিকট স্তূপীকৃত ইট দিয়ে পাকসেনারা বিভিন্ন রাস্তা মেরামত করত। সুবেদার শামছুল হককে সেখানে পাঠানো হলে তিনি কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ইটখোলার নিকট আত্মগোপন করে থাকেন। কিছুক্ষণ পর পাকবাহিনীর কয়েকজন সৈন্য ইট নেয়ার জন্য কিছু লোক নিয়ে সেখানে আসে। সুবেদার শামছুল হক ভাবলেন এরা ইটখোলায় এলে হয়ত তাঁদের দেখে ফেলবে। তাঁদের হাতেও তেমন কোনো অস্ত্র ছিল না, ছিল মাত্র ২টি হ্যান্ড গ্রেনেড ও রিভলভার। তিনি হ্যান্ড গ্রেনেড ব্যবহার করতে মনস্থ করলেন। হানাদাররা কিছু দূরে থাকতেই ছুড়লেন গ্রেনেড। সঙ্গে-সঙ্গে ২ জন পাকসেনা নিহত ও ৩ জন আহত হয়, বাকিরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে গুলি করতে-করতে পেছনের দিকে সরে যায়। এরপর পাকসেনারা আর কোনো দিন সেখান থেকে ইট নিতে আসেনি।
৪ঠা সেপ্টেম্বর আক্রমণ করা হয় চাটখিলের গান্ধী আশ্রম। এতে ৩ জন সেবক শহীদ হন। এটি গান্ধী আশ্রম হত্যাকাণ্ড নামে পরিচিত।
২৩শে সেপ্টেম্বর পাকবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যতম ঘাঁটি নান্দিয়াপাড়ায় অতর্কিতে আক্রমণ করে। উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয়। এটি নান্দিয়াপাড়া যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত। এ-যুদ্ধে ৪-৫ জন পাকসেনা হতাহত হয় এবং তারা পিছু হটে। এতে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে নেতৃত্ব দেন সুবেদার লুৎফর রহমান এবং সুবেদার শামছুল হক। ১১ই অক্টোবর পাকসেনারা পুনরায় নান্দিয়াপাড়ায় আক্রমণ করলে সুবেদার লুৎফর রহমানের নেতৃত্বে নুর মোহাম্মদ, হাবিলদার আউয়াল ও হাবিলদার সিরাজের প্লাটুনের মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে পাকবাহিনীর বহু সৈন্য হতাহত হয় এবং তারা পিছু হটে সোনাইমুড়ীতে ফিরে যায়। সুবেদার লুৎফর রহমান এরপর সোনাইমুড়ীতে পাকবাহিনীর ঘাঁটিতে আক্রমণ করেন। নায়েক সুবেদার ইসহাকের ২ ইঞ্চি মর্টারের গোলার আঘাতে হাবিব ব্যাংকের ওপর (বর্তমান অগ্রণী ব্যাংক) বসানো শত্রুদের হেভি মেশিনগানটি ভেঙ্গে খান-খান হয়ে যায়। সেখান থেকে ঝাঁপ দিয়ে একজন শত্রুসৈন্য প্রাণ হারায় এবং অপর দুজন পরিখার মধ্যে আশ্রয় নিতে গিয়ে সাপের কামড়ে মারা যায়। এটি সোনাইমুড়ী ক্যাম্প যুদ্ধ নামে পরিচিত। এ-যুদ্ধে পাকহানাদার বাহিনীর ১৮ জন সৈন্য নিহত এবং ৬৩ জনের মতো আহত হয়।
২৪শে অক্টোবর মুক্তিবাহিনী বগাদিয়া গ্রামের নিকট চৌমুহনী-লাকসাম সড়কে মাইন পুঁতে রেখে রাস্তার কিছু দূরে এম্বুশ করে। কিছুক্ষণ পর পাকবাহিনীর মাছ বোঝাই একটি লরি লাকসামের দিকে দ্রুত অগ্রসর হতে থাকে। লরিটি মাইনের ওপর আসামাত্র বিকট শব্দে মাইনটি বিস্ফোরিত হয় এবং লরিটি উল্টে গেলে অনেকগুলো মাছ মাটিতে পড়ে যায়। এ- সময় সোনাইমুড়ী ক্যাম্প থেকে রাজাকাররা তাদের সাহায্যে এগিয়ে এলে এম্বুশরত মুক্তিবাহিনীর ফায়ারে ৩ জন রাজাকার নিহত হয়। একই তারিখে নায়েক সুবেদার ওয়ালী উল্যার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা লক্ষ্মীপুর ও রায়পুর রোডে অভিযান চালিয়ে ১০০ জনের মতো রাজাকারকে হতাহত করেন। ২৯শে অক্টোবর পাকহানাদার বাহিনীর বেলুচ রেজিমেন্টের ৪টি কোম্পানি লাকসাম থেকে দূরপাল্লার কামান ও রকেটের সাহায্যে ফায়ার করতে-করতে সোনাইমুড়ী হয়ে চাটখিল রোডের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এ খবর সুবেদার লুৎফর রহমানের নিকট পৌছলে তিনি রামগঞ্জ থেকে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের একত্রিত করেন এবং শত্রুদের ওপর পাল্টা আক্রমণ শুরু করেন। উভয় পক্ষের মধ্যে ৭-৮ ঘণ্টা যুদ্ধ চলে। এটি সোনাইমুড়ী-চাটখিল রোড যুদ্ধ নামে পরিচিত। এ-যুদ্ধে শত্রুপক্ষের ৭০-৮০ জনের মতো সৈন্য হতাহত হয় এবং তারা পিছু হটে। ৭ই ডিসেম্বর সোনাইমুড়ী উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- শহীদ মোহাম্মদ রুহুল আমিন, বীরশ্রেষ্ঠ (পিতা মৌলভী আজহার পাটোয়ারী, বাগপাচড়া, বর্তমানে রুহুল আমিন নগর), শহীদ নায়েক মোজাফ্ফর হোসেন, বীর বিক্রম (পিতা ওলি মিয়া, পশ্চিম চাঁদপুর), মো. আব্দুল গণি, বীর প্রতীক (পিতা আহম্মদ উল্লা বেপারী, মির্জানগর), হাবিলদার মো. ইব্রাহীম, বীর প্রতীক (পিতা হায়দার আলী মিজি, পাপুয়া), হাবিলদার ওয়াজি উল্ল্যাহ, বীর প্রতীক (পিতা নূর আলী মুহুরী, সোনাইমুড়ী) এবং শহীদ নায়েক মো. লোকমান, বীর প্রতীক (পিতা মো. ইসমাইল, ওয়াসেকপুর)।
সোনাইমুড়ী উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন— মোহাম্মদ রুহুল আমিন, বীরশ্রেষ্ঠ (১০ই ডিসেম্বর খুলনায় শহীদ), নায়েক মোজাফ্ফর হোসেন, বীর বিক্রম (১৩ই ডিসেম্বর চাঁপাইনবাবগঞ্জের হরিপুর যুদ্ধে শহীদ), এবং নায়েক মো. লোকমান, বীর প্রতীক (৪ঠা জুন ফেনীতে শহীদ), আবদুল লতিফ (পিতা হাজী ওমর আলী, ভাবিয়াপাড়া), ইমান আলী (পিতা মুসা মিয়া ভূঞা, কৌশল্যারবাগ), আবদুল হামিদ (পিতা মোহাম্মদ উল্যাহ, শিবপুর), মো. নুরুল ইসলাম (পিতা বাদশা মিয়া, মীর্জানগর), মোখলেছুর রহমান (পিতা খলিলুর রহমান, ঘাসের খিল), শাহ আলম (পিতা ইদ্রিস আলী, কৃষ্ণপুর; গুনবতী রেলস্টেশনের দক্ষিণ পার্শ্বে শত্রুপক্ষের গুলিতে শহীদ), আবদুর রহমান (পিতা ছেরাজল হক, ঘোষকামতা; গুনবতী রেলস্টেশনের দক্ষিণ পার্শ্বে শত্রুপক্ষের গুলিতে শহীদ), আজিজ উল্লাহ (পিতা বসির উদ্দিন মিজি, এনায়েতপুর), মোহাম্মদ আলী, ইসমাইল, আব্দুল হামিদ (সুরহলি দেওটি; ৭ই ডিসেম্বর সোনাইমুড়ী হাইস্কুল মাঠের উত্তর পার্শ্বে শত্রুপক্ষের গুলিতে শহীদ), মানিক লাল ভৌমিক (বগাদিয়া; ৭ই ডিসেম্বর বজরা দিঘীরজানে শত্রুপক্ষের গুলিতে শহীদ)।
দেওটি ইউনিয়নের বাগপাঁচরায় (বর্তমানে রুহুল আমিন নগর) বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ মো. রুহুল আমিনের নামে জাদুঘর ও পাঠাগার এবং নান্দিয়াপাড়ায় বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ মো. রুহুল আমিন ডিগ্রি কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। জয়াগ ইউনিয়নের আনন্দপুর গ্রামে সুবেদার লুৎফর রহমানের নামে একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। বগাদিয়ায় (বোগদাদ) মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ এবং কাঠালি (কলাবাগান) বধ্যভূমিতে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়েছে। [গোলাম মোস্তফা ভূঁঞা]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড