You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.29 | সোনাইমুড়ী রেলস্টেশন যুদ্ধ (সোনাইমুড়ী, নোয়াখালী) - সংগ্রামের নোটবুক

সোনাইমুড়ী রেলস্টেশন যুদ্ধ (সোনাইমুড়ী, নোয়াখালী)

সোনাইমুড়ী রেলস্টেশন যুদ্ধ (সোনাইমুড়ী, নোয়াখালী) সংঘটিত হয় ২৯শে এপ্রিল। এতে ১ জন পাকসেনা আহত হয়। অপরদিকে ২ জন সাধারণ মানুষ শহীদ হন।
সুবেদার লুৎফর রহমান ২৮শে এপ্রিল সিপাহি শাহজাহানকে সঙ্গে নিয়ে সোনাইমুড়ী রেলস্টেশন রেকি করেন এবং ২৯শে এপ্রিল নায়েক সফিকে নিয়ে রেলস্টেশনের আউটার সিগনালের নিকট এম্বুশ করেন। আধঘণ্টা অপেক্ষা করার পর শত্রুবাহিনীর তিনটি সামরিক যান এম্বুশের ২০০ গজের মধ্যে এসে পড়ে। শুরু হয় ফায়ারিং। প্রথম ফায়ারেই শত্রুবাহিনীর সম্মুখের একটি গাড়ি অকেজো হয়ে যায়। সঙ্গে-সঙ্গে শত্রুরাও পজিশন নিয়ে পাল্টা ফায়ার শুরু করে। প্রায় তিন ঘণ্টা গোলাগুলি চলে। কিন্তু অ্যামুনেশন শেষ হয়ে যাওয়ায় সুবেদার লুৎফর রহমান সকল মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে সরে পড়েন। শত্রুরা তাদের গুরুতর আহত একজন সৈনিককে নিয়ে চৌমুহনী টেকনিক্যাল স্কুল ক্যাম্পে চলে যায়। পাকিস্তানি বাহিনীর গুলিতে একজন কিশোর ও একজন বৃদ্ধ শহীদ হন।
এই পরিস্থিতির মধ্যেও সুবেদার লুৎফর রহমান চারদিকে রেকি করে একাধিক এম্বুশের স্থান নির্ণয় করেন। কিন্তু পর্যাপ্ত অ্যামুনেশনের অভাবে নিয়মিতভাবে অভিযান পরিচালনা করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। যেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে হানাদার বাহিনীর সংঘর্ষ হতো, সেখানেই তারা বিপুল শক্তি নিয়ে এসে নিরীহ জনসাধারণের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিত।
অস্ত্র সংগ্রহের নিমিত্তে মুক্তিযোদ্ধারা এলাকায় কিছুদিন নীরব থাকায় হানাদার বাহিনী হামলা বৃদ্ধি করে। মুক্তিবাহিনী যাতে পাকিস্তানি বাহিনীকে মোকাবেলা করতে না পারে, এজন্য পাকিস্তানি সেনারা তাদের এ দেশীয় দালালদের সহযোগিতায় বিভিন্ন বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, মালামাল লুট ও বাঙালি নিধনে মেতে ওঠে। সুবেদার লুৎফর রহমান সুবেদার ওয়ালীউল্ল্যাহ এবং সুবেদার সামছুল হকের কমান্ডকে দুটি গ্রুপে ভাগ করেন। একটি গ্রুপ চৌমুহনী-লক্ষ্মীপুর রোডে এবং অপর গ্রুপ চৌমুহনী-লাকসাম রোডে মোতায়েন করেন। গাজী আমিনউল্যাহ ও সুবেদার লুৎফর রহমান ভারতে অস্ত্র সংগ্রহের জন্য যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। আবিরপাড়ার আবুল খায়ের ভূঞা, আমিনউল্যা, সুলতান আহম্মেদ, ছাত্রনেতা আ ও ম সফিউল্যা ও কারী করিমউল্যাহ ২৯শে এপ্রিল আবিরপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় এলাকায় স্থানীয়ভাবে অবস্থানরত সকল বাঙালি সেনা, পুলিশ, আনসার ও মুক্তিযোদ্ধাকে হাজির হওয়ার অনুরোধ করেন। আবিরপাড়ার বৈঠকে সুবেদার লুৎফর রহমানও উপস্থিত ছিলেন। সকল বাহিনীর সদস্যদের মধ্য থেকে ৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধাকে বাছাই করা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন- সুবেদার লুৎফর রহমান, সুবেদার ওয়ালীউল্যা, সুবেদার সামছুল হক, সুবেদার এছহাক, হাবিলদার মন্তাজ, হাবিলদার রুহুল আমিন, হাবিলদার জামাল প্রমুখ। হাবিলদার জামালকে গ্রুপ কমান্ডার হিসেবে নিয়োগ প্রদান করা হয়। এ-সময় লক্ষ্মীপুরের খালেদ মোহাম্মদ আলী এমএনএ ভারত থেকে এসে জীবনপুরের ক্বারী করিমউল্যাহর বাড়িতে অবস্থান নেন। তিনি বেগমগঞ্জ, লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালী সদর মহকুমার মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করার ওপর জোর দেন। এর মধ্যে বেগমগঞ্জের দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন বাহিনীর বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ক্বারী করিমউল্যাহর বাড়িতে অবস্থান নেন।
২রা মে আবিরপাড়ায় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকে মুক্তিযোদ্ধাদের থাকা, খাওয়া : ও বাসস্থানের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য একটি শক্তিশালী সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। খালেদ মোহাম্মদ আলী এমএনএ-কে সভাপতি এবং আবুল খায়ের ভূঞাকে সম্পাদক করা হয়। রুহুল আমিন (যুদ্ধে শহীদ), গাজী আমিনউল্যাহ, আলী আহম্মদ চৌধুরী, কারী করিমউল্যাহ, আবদুর রব চেয়ারম্যানসহ ৩১ জনকে সদস্য করে সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। ঐ সভায় গাজী আমিনউল্যাহসহ কয়েকজনকে ভারতের আগরতলায় যোগাযোগ করে অস্ত্র সংগ্রহ ও সরবরাহের দায়িত্ব দেয়া হয়। এছাড়া এতদঅঞ্চলে ভারত থেকে অস্ত্র সংগ্রহ এবং সরবরাহের কাজে আরো যাঁরা জড়িত ছিলেন, তাঁরা হলেন- গোলাম সারওয়ার (রাজীবপুর), আহম্মেদ সুলতান (বজরা), ফুয়াদ পাশা কচি (হাতিয়া), গোলাম মোস্তফা ভূঞা (সোনাইমুড়ী), আবদুল ওয়াসেক মিন্টু (চৌমুহনী), নুরুল ইসলাম প্রমুখ। এ-সকল মুক্তিযোদ্ধা জীবন বাজি রেখে অস্ত্র সংগ্রহের কঠিন দায়িত্ব পালন করেন।
ক্বারী করিমউল্যাহর বাড়িতে ৩রা মে পুনরায় একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ বৈঠকে খালেদ মোহাম্মদ আলী এমএনএ, সুবেদার লুৎফর রহমান, এডভোকেট আকতারুজ্জামান, শাহজাহান কামাল, অমল নাগ, আলী আহম্মদ চৌধুরী, শ্রমিকনেতা শফিকুর রহমানসহ আরো অনেকে উপস্থিত ছিলেন। এ-সময় সুবেদার আবদুল হাইয়ের নেতৃত্বে হেড মাস্টার মুজাফফর আহম্মদ, আলী আহম্মদ চৌধুরী প্রমুখ গোপন সূত্রে খবর পেয়ে নোয়াখালী খালের দক্ষিণ চরে মাটির নীচে পুঁতে রাখা ৫১টি রাইফেল উদ্ধার করেন। উদ্ধারকৃত রাইফেলগুলো শামছুল কবির চৌধুরীর দায়িত্বে রাখা হয়। এর মধ্যে ভারত থেকে পর্যাপ্ত অস্ত্রশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে এসে পৌছে। এতে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। [মো. ফখরুল ইসলাম]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড