মুক্তিযুদ্ধে সোনাগাজী উপজেলা (ফেনী)
সোনাগাজী উপজেলা (ফেনী) ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। নোয়াখালী জেলায়ও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। এখানকার জনগণও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের বিজয়ী করে। সোনাগাজীবাসী তাদের সঙ্গে ছিল।
১৯৭১ সালের ৩রা মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন। এ অধিবেশনে দলীয় কৌশল ও কার্যক্রম নির্ধারণের জন্য বঙ্গবন্ধু ১লা মার্চ ঢাকার হোটেল পূর্বাণীতে সংসদীয় দলের সভা আহ্বান করেন। এতে যোগদানের জন্য ফেনী থেকে নির্বাচিত খাজা আহমেদ এমএনএ সহ নেতৃবৃন্দ ঢাকায় আসেন। সারা দেশের ন্যায় সোনাগাজীবাসীও গভীর আগ্রহের সঙ্গে প্রতীক্ষা করে ৩রা মার্চ জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে কী সিদ্ধান্ত হয় তা জানার জন্য। কিন্তু হঠাৎ ১লা মার্চ দুপুর ১টায় রেডিও পাকিস্তানের এক ঘোষণায় বলা হয় যে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেছেন। এ সংবাদের পরপরই সমগ্র বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষের ন্যায় সোনাগাজীর সর্বস্তরের মানুষও প্রচণ্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। বিক্ষুব্ধ জনতা গ্রাম থেকে শুরু করে থানা হেডকোয়ার্টার্সের প্রধান-প্রধান সড়কে মিছিল বের করে তীব্র প্রতিবাদ ও ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকে। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ-এর শীর্ষ নেতারা এতে নেতৃত্ব দেন। উল্লেখ্য যে, ফেনী ছিল তখন নোয়াখালী জেলার একটি মহকুমা। জেলা হেডকোয়ার্টার্স ছিল মাইজদীতে। আন্দোলনের সকল নির্দেশনা কেন্দ্র থেকে মাইজদীতে এবং মাইজদী থেকে ফেনী হয়ে সোনাগাজীতে আসত।
২রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক বটতলায় অনুষ্ঠিত হয় স্মরণকালের বৃহত্তম ছাত্র-গণজমায়েত। সেই জমায়েতে সবুজ জমিনের মধ্যে লালবৃত্তের মাঝখানে বাংলাদেশের সোনালি রঙের মানচিত্রখচিত জাতীয় পতাকা প্রদর্শন করা হয়। সেটি করেন তখনকার ডাকসু-র ভিপি (বর্তমানে জাসদ সভাপতি) আ স ম আবদুর রবসহ অন্যান্যরা। ঢাকার এই সংবাদ সোনাগাজী থানায় পৌঁছলে ছাত্র-জনতার মধ্যে স্বাধীনতার নব চেতনা ও প্রেরণার সৃষ্টি হয়। সিদ্ধান্ত হয় বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আন্দোলন পরিচালনা করার।
৩রা মার্চ বঙ্গবন্ধুর ডাকে সারাদেশের মতো সোনাগাজীতেও সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। এদিন ঢাকার পল্টনে অনুষ্ঠিত ছাত্র-জনসভায় বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ-এর পক্ষে শাজাহান সিরাজ স্বাধীনতার ইস্তেহার পাঠ করেন। এ সভা থেকেই ময়দান (বর্তমান সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান)-এ ৭ই মার্চ রেসকোর্স বঙ্গবন্ধুর জনসভার ঘোষণা দেয়া হয়। কেন্দ্ৰীয় কর্মসূচি অনুযায়ী সোনাগাজীতেও থানা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। সংগ্রাম পরিষদের সদস্যরা ছিলেন আ ক ম ইসহাক, আবদুস ছালাম মিয়া, সুবেদার আবু আহম্মেদ আওরঙ্গজেব, খাজা আহম্মদ (নবাবপুর), আনোয়ার আহম্মেদ প্রমুখ।
৭ই মার্চ সমগ্র বাংলাদেশের মুক্তিপাগল মানুষের মতো সোনাগাজীর সাধারণ মানুষও ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ভাষণ রেডিওতে শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল। তারা জানতে চাচ্ছিল বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে কী নির্দেশনা দেন। কিন্তু পূর্ব ঘোষণা থাকা সত্ত্বেও ৭ তারিখ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচারিত হয়নি। কিন্তু জাতির আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্রের বাঙালি কর্মচারীদের সহযোগিতায় পরদিন ৮ই মার্চ সকালে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ রেডিওতে প্রচারিত হয়। বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ভাষণ থেকে সোনাগাজীবাসী স্বাধীনতার দিকনির্দেশনা পায়। বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ ছিল মূলত স্বাধীনতার ঘোষণা এবং মুক্তিযুদ্ধের সাহসী প্রেরণা। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীও বুঝতে পেরেছিল মুজিব তাঁর ভাষণে প্রকারান্তরে স্বাধীনতারই ডাক দিয়েছেন। তাই ১৫ই মার্চ ইয়াহিয়া খান আলোচনার জন্য ঢাকা আসেন। ১৬ই মার্চ থেকে শুরু হয় আলোচনার নামে প্রহসন। একদিকে চলছে আলোচনার নামে প্রহসন, অন্যদিকে চলছিল সামরিক আক্রমণের প্রস্তুতি। প্রতিদিন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আকাশপথে বিমানে ও সমুদ্রপথে স্টিমারে করে ঢাকা ও চট্টগ্রামে সৈন্য ও গোলাবারুদ আনা হচ্ছিল। ২৩শে মার্চ পাকিস্তান দিবস। এ দিবসে সমগ্র বাংলাদেশের মতো সোনাগাজী থানার সকল বাড়িঘর, অফিস-আদালত ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ওড়ানো হয় পাকিস্তানি পতাকার পরিবর্তে বাংলাদেশের পতাকা।
১৯৭১ সালে সোনাগাজী থেকে মহকুমা হেডকোয়ার্টার্স ফেনী ও জেলা হেডকোয়ার্টার্স মাইজদীর সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত ছিল না। ইপিআর-এর বিওপি ওয়ারলেস ছাড়া খবরাখবর আদান-প্রদানের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। বিবিসি, আকাশবাণী ও ভয়েস অব আমেরিকা ছিল তখন খবর সংগ্রহের প্রধান মাধ্যম। ট্রেন ও বাস চলাচলে বিঘ্ন থাকায় পত্র-পত্রিকাও নিয়মিত পাওয়া যেত না। খবর প্রকাশে সেন্সর থাকায় পত্রিকায়ও সঠিক তথ্য থাকত না।
এদিকে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক সাতই মার্চের ভাষণ-এর নির্দেশনা মোতাবেক চলছিল যুদ্ধের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ। প্রায় প্রতিদিনই হাটে-মাঠে-বাজারে মিছিল বের হতো। মিছিলের স্লোগান ছিল ‘জয় বাংলা’, ‘তোমার আমার ঠিকানা – পদ্মা মেঘনা যমুনা”, “আমার নেতা তোমার নেতা শেখ মুজিব শেখ মুজিব’। এসব স্লোগান থেকে বোঝা যাচ্ছিল ছাত্র- জনতা স্বাধীনতার প্রশ্নে কতটা অটল। এভাবে আসে ২৫শে মার্চের কালরাত। ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে লেলিয়ে দিয়ে রাতের অন্ধকারে ঢাকা ত্যাগ করে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যায়। তারা সেই রাতেই অপারেশন সার্চলাইট-এর নামে ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পিলখানা ইপিআর হেডকোয়ার্টার্স, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, পুরান ঢাকার শাঁখারি বাজার এবং ঢাকার বাইরে অন্যত্র বর্বরোচিত গণহত্যা চালায়।
২৫শে মার্চ রাত ১২টার পরে হানাদার বাহিনী ধানমন্ডির ৩২নং বাড়ি থেকে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায়। তার আগে অর্থাৎ ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান – বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং যুদ্ধ চালিয়ে যাবার জন্য দেশবাসীকে আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা বার্তা ইপিআর ওয়ারলেসের মাধ্যমে সমগ্র বাংলাদেশে প্রেরণ করা হয়। নোয়াখালীতে উক্ত বার্তা গ্রহণ করেন জেলা প্রশাসক মঞ্জুরুল করিম। তিনি তা ২৬ তারিখ সকালে নোয়াখালী সার্কিট হাউসে সর্বদলীয় সভা ডেকে সকলকে অবহিত করেন। সেই সভায় বৃহত্তর নোয়াখালীর সংগ্রাম কমিটির সভাপতি আবদুল মালেক উকিল এমএনএ-সহ গণ্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। পরবর্তীতে ঐ বার্তা ফেনী মহকুমাসহ সকল থানায় পৌঁছে দেয়া হয়।
২৬শে মার্চ থেকে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলেও বৃহত্তর নোয়াখালীর ফেনী মহকুমায় হানাদার বাহিনী প্রবেশ করে ২৩শে এপ্রিল। এই এক মাস অত্র অঞ্চলে সোনাগাজী থানা সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে সোনাগাজী ডাকবাংলো মাঠ, থানা হাইস্কুল মাঠ, মোহাম্মদ সাবের হাইস্কুল মাঠ এবং প্রফুল্ল বাবুর বাসার সামনের মাঠে সামরিক প্রশিক্ষণ চলে। প্রশিক্ষণে চর গণেশের হাবিলদার শামছু, চর চান্দিয়া ইউনিয়নের প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টের মুনির আহম্মদ, হাবিলদার মফিজুর রহমান, অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ মোস্তাফিজুর রহমান, মতিগঞ্জের আবুল হাসেম, নায়েক রুহুল আমিন ও ক্যাপ্টেন সাহাব উদ্দিন (মতিগঞ্জ) স্থানীয় ছাত্র-যুবকদের রাইফেল ট্রেনিং প্রদান করেন। সোনাগাজী থানার ওসি আবদুল গফুর থানা থেকে প্রশিক্ষণের জন্য রাইফেল সরবরাহ করেন।
সোনাগাজী থানার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সর্বদা খাজা আহমেদ এমএনএ ও ছাত্রলীগের মহকুমা নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। পরিস্থিতি যখন ক্রমশ সংকটময় হয়ে উঠছিল তখন ছাত্র-যুবক, শ্রমিক ও সাধারণ ছাত্র-জনতা উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য বিলোনিয়া সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করতে শুরু করেন। খাজা আহমেদ এমএনএ এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
সোনাগাজীর সন্তান মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন (পিতা হাফেজ মোহাম্মদ এছহাক, চর গণেশ) দেশমাতৃকার টানে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তিনি এপ্রিল মাসের শেষদিকে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য বিলোনিয়া হয়ে ভারতে প্রবেশ করেন। সেখানে কিছুদিন ট্রানজিট ক্যাম্পে থাকার পর ভিপি জয়নাল আবেদীনের রিক্রুটমেন্টে এবং ডাকসু ভিপি আ স ম আবদুর রবের উদ্যোগে অন্যান্য সহকর্মীসহ আসামের হাফলং ক্যান্টনমেন্টে ৫০ দিনের উচ্চতর প্রশিক্ষণ নেন। অতঃপর শ্রীনগর ও ছাগলনাইয়ার ভেতর দিয়ে সোনাগাজীতে প্রবেশ করেন। দেশে এসে তিনি সোনাগাজী থানার উপ-অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সোনাগাজী থানার মুজিব বাহিনী-রও উপ-অধিনায়ক ছিলেন (বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিল সোনাগাজী থানার কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন)।
মুক্তিযুদ্ধের সময় এ এলাকা ছিল ২নং সেক্টরের অধীন। সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর খালেদ মোশারফ। আর এ এলাকার মুজিব বাহিনীর (বিএলএফ) কমান্ডার ছিলেন নাসির উদ্দিন এবং ডেপুটি কমান্ডার ছিলেন মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ২৩শে এপ্রিল ফেনীতে প্রবেশ করে এবং পরবর্তীতে সোনাগাজী থানায় প্রবেশ করে মতিগঞ্জ সিও অফিস, সোনাগাজী থানা, বক্তার মুন্সীর হাট, দৌলতপুর ওলেমা বাজার, কুঠির হাটের কাজার হাট, ভোর বাজার ও মঙ্গলকান্দিতে ক্যাম্প স্থাপন করে। সোনাগাজী হাসপাতাল, ওয়াপদা ডাকবাংলো ও বক্রমপুর স্কুলে রাজাকার-দের ঘাঁটি ছিল।
স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে থেকেই সোনাগাজী ছিল মূলত জামায়াতে ইসলামী ও মুসলিম লীগ প্রভাবিত এলাকা। এ উপজেলায় রয়েছে বহু মাদ্রাসা। এ সকল মাদ্রাসায় মুক্তিযুদ্ধবিরোধীরা প্রভাব খাটিয়ে বহু ছাত্র-শিক্ষককে হানাদার বাহিনীকে সহযোগিতা দান এবং রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিতে উদ্বুদ্ধ করে। সোনাগাজী থানার শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিল সোনাগাজী হাইস্কুলের প্রাক্তন সহকারী শিক্ষক এ বি এম শামছুদ্দিন। কুখ্যাত রাজাকার ছিল চর চান্দিয়া ইউনিয়নের মোহাম্মদ শাহজাহান, আনার আহম্মদ কেরানী, আমিরাবাদের শামছুল হুদা, আবদুর রব চেয়ারম্যান প্রমুখ।
মুক্তিযুদ্ধকালে পাকবাহিনী ও রাজাকাররা এ উপজেলার বহু স্থানে হত্যা, গণহত্যা, লুটতরাজ, নির্যাতন ও অগ্নিসংযোগ করে। তার মধ্যে চর সোনাপুর ৩নং সুইস গেটের গণহত্যা ও নির্যাতন ছিল ভয়াবহ। এ এলাকার আবদুল মান্নান ভোলা মিয়ার বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধারা থাকতেন। তাঁদের আস্তানার খবর হানাদাররা তাদের দোসরদের মাধ্যমে জেনে যায়। আগস্ট মাসের শেষ দিকে হানাদার ও রাজাকার বাহিনী এসে সুইস গেটের আশ-পাশের বাড়িঘরে আগুন দেয় এবং লোকজন প্রাণভয়ে পালাতে থাকলে তাদের গুলি করে হত্যা করে। চর সোনাপুর গণহত্যায় সেদিন প্রায় অর্ধশত গ্রামবাসী শহীদ হন।
এ উপজেলায় আরেকটি গণহত্যা সংঘটিত হয় সেনেরখিলে, যা সেনেরখিল গণহত্যা নামে পরিচিত। সেনেরখিল বঙ্গোপসাগরের কুলঘেঁষা একটি প্রত্যন্ত অঞ্চল। দীর্ঘদিন এটি মুক্তাঞ্চল ছিল। তাই এলাকাটি ছিল, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের অন্যতম স্থান। এখানে বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা সেলিম আলদীন (পরবর্তীতে খ্যাতিমান নাট্যকার ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক)-এর নেতৃত্বে এক বিশাল মুক্তিবাহিনীর দল গড়ে উঠেছিল। হিন্দু অধ্যুষিত এলাকাবাসীকে হানাদার ও রাজাকারদের হামলা থেকে নিরাপদ রাখার জন্য এখানে রাতদিন সশস্ত্র প্রহরা চলত। জুনের শেষদিকে এক গভীর রাতে হানাদার বাহিনী আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রসহ রাজাকারদের নিয়ে সেনেরখিলের নতুন বাজারে এসে গোটা বাজারে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। মুহূর্তের মধ্যে সব লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা আত্মরক্ষার জন্য দক্ষিণে সরে গিয়ে চর চান্দিনায় আশ্রয় নেন। হানাদারদের ভয়ে ভাঙ্গা কবরে পালিয়ে থাকা নারীদের টেনে এনে রাস্তার পাশে ধর্ষণ করা হয়। এদিন এখানে ১৬৪ জন গ্রামবাসীকে হত্যা করা হয়। সেদিনের গণহত্যা থেকে বেঁচে গেলেও দুর্বিষহ ক্ষত ও যন্ত্রণা নিয়ে এখনো বেঁচে আছেন ডা. বজলুল হক, এ বি এন বাহার উদ্দিন, নাজিম উদ্দিন প্রমুখ।
পাকবাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকারদের প্রতিটি ক্যাম্পই ছিল নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির। তার মধ্যে মতিগঞ্জ সিও অফিস ও মতিগঞ্জ থানা ছিল বর্বরোচিত নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির।
সোনাগাজী উপজেলায় পাকসেনা ও রাজাকারদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি যুদ্ধ হয়। ১৪ই আগস্ট মোহাম্মদ মোশারফ হোসেনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা বগাদিয়া মাদ্রাসায় স্থাপিত রাজাকার ক্যাম্পে আক্রমণ চালিয়ে তাদের সেখান থেকে বিতাড়িত করেন। ১৬ই আগস্ট মোহাম্মদ মোশারফ হোসেনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা সাতবাড়ীয়ায় ফেনী-সোনাগাজী সড়কে এন্টিট্যাংকের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে প্রায় অর্ধশত পাকসেনাকে হত্যা করেন। সেপ্টেম্বর মাসের ১৫ তারিখ পরিচালিত হয় মতিগঞ্জ সিও অফিস অপারেশন। এতে বেশ কয়েকজন রাজাকার হতাহত হয়। অপরদিকে পাকসেনা ও রাজাকারদের অত্যাধুনিক অস্ত্রের সামনে টিকতে না পেরে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্য হন। এ অপারেশনে গাজীপুরের অধিবাসী মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম ও নুরুল করিম শহীদ হন। তাঁদের গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হয়। ১৫ই অক্টোবর মোহাম্মদ মোশারফ হোসেনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা সোনাগাজী থানায় অপারেশন চালিয়ে পাকসেনা ও রাজাকারদের পরাস্ত করেন এবং ৩ দিন পর্যন্ত থানা নিজেদের দখলে রাখতে সক্ষম হন। এতে ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। তাঁরা হলেন- খায়রুল আলম, আবদুস সোবহান (১) ও আবদুস সোবহান (২)। ৫ই ডিসেম্বর সোনাগাজী উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- ক্যাপ্টেন মো. রুহুল আমিন, বীর প্রতীক (পিতা আবদুল জাব্বার, মঙ্গলকান্দি) ও আহছান উল্লাহ, বীর প্রতীক (পিতা মো. আমিন উল্লাহ, আহমদপুর)।
উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- খায়রুল আলম (পিতা শামছুল হক, সুজাপুর), আবদুস সোবহান (পিতা হাজী আবদুর রব, তুলাতলি), আবদুস সোবহান, আবুল বাসার (পিতা জালাল আহম্মদ, রঘুনাথপুর), আবু বকর সিদ্দিক (পিতা হাজী দুলাল মিয়া, দজরিয়া), ওবায়দুল হক (পিতা আবদুল হাকিম, মজুপুর) এবং সফিউল্যা মানু (পিতা ভুলু মিয়া)। এছাড়া গাজীপুরের দুজন মুক্তিযোদ্ধা এ উপজেলায় যুদ্ধ করতে এসে শহীদ হন। তাঁরা হলেন- নুরুল ইসলাম (পিতা আলী আহম্মদ, হাজীপুর) ও নুরুল করিমI উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের স্মারক হিসেবে সোনাগাজী থানা সদরে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিস্তম্ভ এবং নবাবপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে। এছাড়া বীর মুক্তিযোদ্ধা সেলিম আলদীনের নামে সেনেরখিলে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সেলিম আলদীন কমপ্লেক্স ও পাঠাগার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। [মো. ফখরুল ইসলাম]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড